করা শক্ত যে, স্বর্গ বলে কিছু থাকতে পারে বা ঈশ্বর বলে কেউ থাকতে পারেন। মানুষ আছে তা তো প্রত্যক্ষ সত্য। কিন্তু মানুষের চেহারা দেখে কি বিশ্বাস হয় যে, ভগবান তাকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর আপনার আদলে? তাঁর উপর পিতৃত্ব আরোপ করবার মতো কী এমন প্রমাণ আছে?
‘অল্পবয়স থেকেই আমি সৌন্দর্যদেবীর অন্বেষক। বিউটি আমার কাছে কথার কথা নয়। ওকে আমি প্রথম যৌবনে সর্বঘটে দেখতে চাইতুমা আভাসও পেতুম ওর আঁচলের। ওর অলকের। কিন্তু এই নরকপুরীতে কোথায় ওর হাতছানি? কোথায় ওর চাউনি? আমার জজিয়তীর জীবনে প্রায়ই হা-হুতাশ করেছি। হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিতে গেছি। দশ বছর পরে এই সম্প্রতি আমার অন্তর্দৃষ্টি খুলেছে। এত দিনে আমার প্রত্যয় হয়েছে। ও আছে।
‘ও আছে। ওর পথ গেছে এই ক্লেদের ভিতর দিয়ে। এই আঁস্তাকুড়ের উপর দিয়ে। এইসব মাজা-ভাঙা পুরুষদের, এইসব পড়ে-যাওয়া নারীর দ্বারা আচ্ছন্ন গিরিসঙ্কট দিয়ে ওর পথ হচ্ছে এই পথা এই পথে আমি ওর পথেরই পথিক হয়েছি। ওরই দর্শন পাব বলে। ও আমার আগে আগে চলেছে। উড়ে চলেছে মাটি না ছুঁয়ে ক্লেদ না ছুঁয়ে অন্তরীক্ষে ও যেন সূর্যকন্যা তপতী। আর আমি ওকে ধরবার জন্যে মাটিতে পা ফেলে জলকাদায় নেমে ডাঙায় পা তুলে উঠে চলেছি। ভূতলে। আমি যেন রাজা সংবরণ দৃষ্টি আমার ঊর্ধ্বমুখীন। ওর আর আমার উভয়েরই পথ এই ভীষণ কুৎসিত অশুভ অমাবস্যার ছায়াপথা।
‘ও যেন আমার চোখে ধুলো ছুঁড়ে মারে, যাতে আমি ওকে দেখতে না পাই, চিনতে না পারি। কিংবা ধুলো আপনি ওড়ে ওর গতিবেগের হাওয়ায় আমি অন্ধকার দেখি সেই অন্ধকারের নাম নিষ্ঠুর বাস্তব যে বাস্তব আমাকে নিত্য অভিভূত করে নিত্য নূতন অপরাধে এই তো সেদিন আমার কোর্টে এলো এক তরুণী জননী। নিজের হাতে নিজের শিশুর গলা টিপে মেরেছে। তার আগে এসেছিল এক বন্ধু বন্ধুকে ভুলিয়ে নিয়ে যায় এক পোড়োবাড়ীতে সেখানে তার নিদ্রিত অবস্থায় তাকে বলি দেয়। মুণ্ডুটা পুঁতে রাখে নদীর বালিতে এবার যে এসেছে তার কথা বলব
কেসটা সাব জুডিসা কিন্তু নিষ্ঠুর বাস্তবেরই অভিনব প্রকাশ স্তব্ধ হয়ে ভাবি এই তমসার অপর পারে কি ও আছে? ডাকলে কি ওর সাড়া পাব? চোখ মেলে আমি ওর দেখা পাইনো তবু চোখ আমার ওর উপরেই। এর উপরে নয়।
‘না। তোমার এই নিষ্ঠুর বাস্তব আমার দৃষ্টি হরণ করে না দৃষ্টিকে পীড়া দেয় যদিও আমার দৃষ্টি একে প্রতিনিয়ত অতিক্রম করে। আমার মন একে ছাড়িয়ে যায়। আমার পা একে মাড়িয়ে যায়। এর সম্বন্ধে আমার মোহ নেই। আমি একে ভালোবাসিনো। একে ভালো বলিনে। শুধু একে মেনে নিই। একদা আমার পণ ছিল বিনা পরীক্ষায় কিছুই মেনে নেব না। না ঈশ্বর, না পরকাল, না পুনর্জন্ম। এখনো গীতার মূল তত্ব মেনে নিতে পারিনি। কিন্তু অর্জুনের মতো আমিও সভয়ে। উচ্চারণ করি, দংষ্ট্রাকরালানি চ তে মুখানি দৃষ্টেব কালানলসন্নিভানি দিশো ন জানে না লভে চ শর্মা বাকীটুকু বাদ দিই।
‘নিষ্ঠুর বাস্তব, তোমাকে আমি মানি। কিন্তু তুমিই শেষ কথা না তোমাকে আমার চোখের উপর ছুঁড়ে মেরেছে যে, আমার দৃষ্টি তারই প্রতি নিবদ্ধ। সে করালদশনা নয়। তার মুখ কালানলসন্নিভ নয়। ‘সে’ বললে কেমন পর-পর ঠেকে। তাই ‘সে’ না বলে আমি বলি ‘ও’ ও আমার একান্তই আপনা আমি ওরা ওর সঙ্গে আমার নিত্য সম্পর্ক এমন দিন যায় না যেদিন আমি ওর উড়ে চলার ধ্বনি শুনতে না পাই। আদালতের চাপা কোলাহলকে ছাপিয়ে ওঠে ওর পলায়নধ্বনি। আমি এজলাস ছেড়ে উঠে যেতে পারিনো আমার আসনের সঙ্গে আমি গাঁথা আমার দুই কানই সাক্ষীর বা আসামীর দিকে পাবলিক প্রেসিকিউটার বা আসামীর উকিলের দিকে। তবু কেমন করে কানে এসে বাজে অন্তরালবর্তিনীর নূপুর-শিঞ্জন আছে, আছে। আরো একজন আছে। যে এদের সকলের প্রতিবাদরূপিণী। যে এদের কারো চেয়ে কম বাস্তব নয়, কম প্রমূর্ত নয়। যাকে ধরতে জানলে ধরা যায়। ছুঁতে জানলে ছোঁয়া যায়।
‘নিয়োগীর উনি তাঁকে নর্দমার পাঁক থেকে বাঁচাতে পারেননি। আমার ও আমাকে কর্দম থেকে। বাঁচিয়েছে। আমি যে বেঁচে আছি এটা ওরই কল্যাণে বিয়ের বৌ যা পারে না ও তা পারো কেন তাহলে আমি বিয়ের কথা ভাবতে চাইব! তোমরা এমন কী জিতেছ! আমি এমন কী হেরেছি! আমার শুভ্র কেশ আমার শ্বেত পতাকা নয়। আমি পরাজয় স্বীকার করিনি। নিষ্ঠুর বাস্তবের সঙ্গে আমার নিত্য সংঘর্ষ। তা সত্বেও আমি অপরাজিতা আপন ভুজবলে নয়। ওর রক্ষাকবচ ধারণ করে। পুরুষ চায় রণে অপরাজেয়। যে নারী তাকে অপরাজিত থাকতে সহায়তা করে সেই তার এষা। এ যদি পার্থিব নারী না হয় তাতে কী আসে যায়!
‘মৈত্র, তুমি হয়ত ভাবছ আমি কী হতভাগ্য! আমাকে চালতার অম্বল বেঁধে খাওয়াবার কেউ নেই। বাবুর্চিটা সুক্তো পর্যন্ত রাঁধতে জানে না। পাটনার লাটভবনে লর্ড সিনহার মতো আমি হাজার সাহেব সাজলেও আমার রসনাটি তো বাঙালীরা আমিও এককালে নিজেকে হতভাগ্য মনে করেছি। কিসে এ দশা থেকে পরিত্রাণ পাই তার উপায় অন্বেষণ করেছি। বিবাহের মধ্যে পরিত্রাণের কূলকিনারা পাইনি। মানুষ তো কেবল রুটি খেয়ে বাঁচে না। তেমনি পুরুষ তো কেবল বৌ পেয়ে বাঁচে না। তাকে তার জীবনের দুই দিক মেলাতে হয়। সুন্দরের সঙ্গে কুৎসিতের। শ্রেয়ের সঙ্গে প্রেয়েরা আমার জীবনে আমি কোনমতেই দুই দিক মেলাতে পারিনি। তাই ঐশ্বর্যের মধ্যেও জ্বলেছি। অবশেষে একপ্রকার পরিত্রাণের পন্থা পেয়েছি। এখন আমার সে জ্বালা নেই। আমি শান্তা আমার পরিত্রাণের পন্থা পলায়নে নয়, পলায়মানার পশ্চাদ্ধাবনে।’