‘কিন্তু ক্রমেই আমার প্রতীতি হতে থাকে যে আমি আমার মনের স্বাস্থ্য হারিয়ে ফেলছি। রাতদিন যাদের নিয়ে আমার কারবার তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ—তারা খুন কিংবা ডাকাতি কিংবা নারীধর্ষণ করেছে। সমাজের সবচেয়ে পঙ্কিল স্তরের জীব তারা তাদের মামলা হাতে নিয়েছে যারা তারাও হাতে পায়ে সারা গায়ে পাঁক মেখেছে। এক এক সময় মুখের সঙ্গে মুখ মিলিয়ে দেখেছি। কোনটা ক্রিমিনালের আর কোনটা পুলিসের তা নিয়ে ধাঁধায় পড়েছি। জেলখানায় গিয়ে দেখেছি জেল ওয়ার্ডদের মুখও জেল কয়েদীর মতো। উকিলের মুখ দেখেও ধোঁকা লেগেছে। পোশাক ভিন্ন। মুখ অভিন্ন। ক্রাইম যাকেই ছোঁয় তাকেই ক্রিমিনালের চেহারা দেয়। এই সর্বব্যাপী পাঁকের মধ্যে আমি কেমন করে পাঁকাল মাছ হব? আমার নিজের চেহারা দেখি আয়নায়—ভয় পেয়ে যাই।
‘একদিন বোর্ড অফ রেভিনিউর মেম্বার ও’নীল এলেন আমার স্টেশনে। এককালে আমার ওপরওয়ালা ছিলেন। আবার দেখা হলো কথায় কথায় বললেন, ‘সুর, জজিং তোমার ভালো লাগে? আমার ধারণা ছিল, তোমার অভিরুচি শাসনো উত্তর দিলুম, আপনার অনুমান ঠিক, কিন্তু ফিরে যেতেও আমি চাইনো ও’নীল চলে গেলেন কিন্তু কথাটা আমার মন থেকে গেল না। শাসনবিভাগ থেকে সরে আসার পরও আমি তার সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল থাকতে কম চেষ্টা করিনি ধাতটা আমার একজিকিউটিভ। কিন্তু চার বছরে একটা ছেদ পড়ে গেছল। ফিরে গেলে আমি জোড় মেলাতে পারতুম না। রাজনৈতিক মনোমালিন্য তো চরমে উঠেছিল। কেবল ইংরেজে বাঙালীতে নয়, হিন্দুতে মুসলমানে ‘তবু ক্রিমিনালদের সঙ্গে ক্রিমিনাল বনে যাবার চেয়ে ওই অশান্তির মধ্যে ফিরে যাওয়াও ভালো চীফ সেক্রেটারীকে চিঠি লিখলুম একদিন আমাকে কি চিরকাল জজিং করতে হবে? আমার রুচির বিরুদ্ধে? তিনিও আমার পুরোনো অতিথি সহানুভূতির সঙ্গে উত্তর দিলেন, তোমার সম্বন্ধে কাগজপত্র আনিয়ে দেখলুম। আগে থেকেই ঠিক হয়ে রয়েছে যে তোমার স্থান জুডিসিয়ালো। তোমার নিজের পছন্দ হোক আর নাই হোক, এই হচ্ছে তোমার বরাদ্দ। ভালো জজেরও তো দরকার। আশা করি তুমি এটা স্বীকার করবে যে, ব্যক্তিগত অভিরুচির চেয়ে পাবলিক ইন্টারেস্ট বড়। তোমার সাফল্য কামনা করি।
‘মনটাকে মানাতে আমার কতকাল যে লেগে গেল। কেমন করে যে পারলুম! একবার ভেবে দেখ, মড়ার মাথার খুলি পর্যন্ত কোনো কোনো কেসে আলামৎ হয়। শুক্র আর শোণিত মাখা কাপড় জামা তো আকসারা আমাকে পর্যবেক্ষণ করতে হয় সেসব নাড়াচাড়া করে পুলিসের লোক। ডাক্তার এসে বলে যান মৃতদেহের অঙ্গে কী কী জখম ছিল। ব্যবচ্ছেদের পর কোন কোন অর্গানে কী কী লক্ষণ দেখা গেল। কী কী বস্তু পাওয়া গেল। আমাকেই স্বহস্তে লিপিবদ্ধ করতে হয়। বীভৎস সব খুঁটিনাটি তার চেয়েও বীভৎস বলাৎকারের মামলায় স্ত্রী অঙ্গের রিপোের্ট। ডাক্তারের মুখে তবু সহ্য হয় নারীর মুখে পাশবিক অত্যাচারের আদ্যোপান্ত বিবরণ! উকিলরা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বার করে ৩৭৬ ধারার অত্যাবশ্যক উপাদান আছে কিনা অন্তর্ভেদ ঘটেছে কিনা। আমার ইচ্ছা করে উকিলদের ধরে চাবকাতে। সতী মেয়েকেও তারা প্রতিপন্ন করতে চায় অসতী। যেন অসতী হলে তার অনিচ্ছা থাকতে মানা। যেন তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যে কোন পশু ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। এর পিছনে ক্রিয়া করছে আমাদের বৈষম্যময় সামাজিক মূল্যবোেধ একবার যে অভাগিনীর পদলন হয়েছে, যে-কোনো দিন যে-কেউ তার উপর আক্রমণ করলেও সেটা হবে সম্মতিসূচক পুরুষ কিন্তু হাজার পদলন সত্বেও আইনের দ্বারা সুরক্ষিত।
‘এখন ওই সব হতভাগিনী মেয়েদের এই বৈষম্যময় সমাজে আমি ভিন্ন আর কে রক্ষক আছে? এই বাইশ লক্ষ লোকের মাঝে? শুধু ওদের নয়, যারা একবার চুরি করে দাগী হয়েছে কেউ কি তাদের বিশ্বাস করে স্বাভাবিক কাজকর্ম দেয়? অগত্যা আবার চুরি করতে হয় তাদের দ্বিতীয়বার চুরি করলেই ডবল সাজা। অনেক সময় দেখা যায়, দ্বিতীয় অপরাধটা প্রথম অপরাধের তুলনায় লঘু। তবু আমাদের হাকিমরা চোখ বুজে প্রথম দণ্ডটাকে দ্বিগুণিত করে দেনা আপীলে আমি দণ্ড হ্রাস করি। বলি, লোকটার পাওনা যদি হয় ছ মাস, হাকিম তার পূর্ব অপরাধের কথা স্মরণ করে এক বছর দিতে পারেন কিন্তু পূর্ব অপরাধের জন্যে সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থায় ভিন্ন হাকিমের হাতে সে হয়তো পেয়েছিল দশ মাস, সেটাকে কলের মত নির্বিচারে দ্বিগুণিত করে বিশমাস করলে বর্তমান অপরাধের সঙ্গে সামঞ্জস্য হয় না। হাকিমেরা করবেন কী! কোর্ট সাবইন্সপেক্টর তাঁদের তাই বুঝিয়েছেন। আমি যখনই সুযোগ পাই, সাজা কমিয়ে দিই আর পুলিসের অভিশাপ কুড়োই। একটা প্রতিষ্ঠানও খাড়া করি, কয়েদীদের জেল থেকে বেরিয়ে আসার পর স্বাভাবিক কাজকর্ম জোটানোর আশায়। দেখি কেউ ওদের কাজ দেবে না দিলে পুলিস পিছনে লাগবে। তাছাড়া দাগী চোরকে বিশ্বাস কী! কোন দিন আবার চুরি করে পালাবে! তখন পুলিসে খবর দিলে পুলিস বলবে, কেমন? সাবধান করেছিলুম কিনা? সাহস করে আমিই মালী রাখি কোন দিন আমাকে বোকা বানাবে! পুলিস সাহেব বলবেন, রাইটলি সার্ভড! আরে কুকুরের ল্যাজ কখনো সিধে হয়!
‘সমাজে ভালো জজেরও দরকার আছে। কিন্তু এই বিশ্বাসই যথেষ্ট নয়। চাই আরো একটা বিশ্বাস। সেটা না থাকলে আমার মতো লোকের পক্ষে বেঁচে থাকাই এক যন্ত্রণা। জগতে যা কিছু কুৎসিত, যা কিছু মিথ্যা, যা কিছু কু তাই নিয়ে আমার কারবার। জগৎ সম্বন্ধে আমার ধারণা কি তা হলে এই যে, জগতে সুন্দর নেই, সত্য নেই, সৎ নেই? আমার এই নরকবাস থেকে অনুমান