মৈত্র চমকে উঠলেন। বললেন, ‘না না, এ হতেই পারে না। এ অসম্ভব।’
‘আমিও তাঁকে সেই কথাই বোঝাই, বরং একটু ভয় দেখিয়ে দিই। স্বামীর সরকারী নথিপত্র লুকিয়ে লুকিয়ে পড়াও একটা গ্রাউন্ড হতে পারে।’ সুর মুচকি হাসলেনা
মৈত্রর মুখ শুকিয়ে গেল, ‘কা-কাজটা খু-খুবই খারাপ! কি-কিন্তু তা বলে ডি-ডিভোর্স হতে পারে নাকি? না, তুমি আমায় লেগ পুল করছ! তুমি জানো, আমি ডিভোর্সের শত্রু!’
সুর বললেন, ‘আমার উদ্দেশ্য ধরতে পারোনি, মৈত্র। আমি চাইনি যে আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন পরামর্শদাতার জীবন আরো দুরূহ হয়। ডিভোর্সের আমি লেশমাত্র প্রশ্রয় দিইনি। তোমার সমাজ আমার হাতে নিরাপদা’।
‘আমি হলে কী করতুম বলি। ‘ মৈত্র কথার সূত্র নিজের হাতে নিলেন, ‘আমি ভদ্রমহিলার মনোবিশ্লেষণ করতুম। কেন তিনি তাঁর স্বামীর উপর এতদূর বিরক্ত যে পরের কাছে যান বিবাহবিচ্ছেদের পরামর্শ চাইতে? এর মূলে কী আছে? দেশঘটিত পরস্পরবিরোধী চিন্তা, না অন্য। কিছু ঘটিত সন্দেহ?’
‘ঐ যাঃ, পণ্ডিতী আরম্ভ হলো!’ সুর হেসে উঠলেন, ‘একজন বিপন্ন হয়ে এসেছেন মুক্তির উপায় খুঁজতে, আমি বসে মনোবিশ্লেষণ করব পাণ্ডিতিক সত্য নির্ণয় করতে! আমি যদি তোমার মতো মনোবিশ্লেষণ করতে যেতুম, তাহলে হয়তো কত কী জট আবিষ্কার করতুম। ওই যেমন একটু আগে বলেছিলে ঈডিপাস কমপ্লেক্স, তেমনি তোমাদের ফর্দে আর কী কী কমপ্লেক্স আছে জানিনে। হয়তো জুপিটার কমপ্লেক্স।’
দু’জনেই হাসতে লাগলেন হাসি থামলে সুর বললেন, ‘তা ছাড়া সত্য বলতে আমি যা বুঝি তা অন্য জিনিস গোপালের হয়তো ঈডিপাস কমপ্লেক্স ছিল—যদি যে আদৌ খুন করে থাকে। কিন্তু আমি যদি তার বিচারক হতুম, আমি তোমার মতো মনোবিশ্লেষণ করতুম না। আমার সত্যনির্ণয়ের পদ্ধতি নয় ওটা আমার জিজ্ঞাস্য হচ্ছে, সিচুয়েশনটা কী? সিচুয়েশনের অবশ্যম্ভাবী পরিণতিটা কী? এক একটা সিচুয়েশন এমন যে তার পরিণতি ট্র্যাজিক না হয়ে পারে না। তার থেকে উদ্ধারের অপর কোনো পন্থা নেই। মানুষ অনেক সময় খুন করে ফাঁসী যায়, উদ্ধারের আর কোনো পন্থা খুঁজে না পেয়ে। সিচুয়েশনটা কী তা তো জজকে বিশ্বাস করে কেউ বলবে না, বলতে জানেও না। তাদের চোখে আমি কালান্তক যম। আসলে আমি মানুষের বন্ধু। যাকে ফাঁসী দিই তাকে মনে মনে বুকে জড়িয়ে ধরি। ওর চেয়ে ভয়ঙ্কর দণ্ড তো নেই, তবু ওই দণ্ড আমি প্রেমের সঙ্গে উচ্চারণ করি। আমার চোখে সব খুনীই গোপাল। কেয়ামতের দিন তার প্রকৃত বিচার হবে। এ যা হল তা সমাজের প্রয়োজনে—সমাজবিহিত পদ্ধতিতে।
মৈত্র আবেগে আপ্লুত হয়ে সুরের হাতে চাপ দিলেন। কিছুক্ষণ দু’জনে চুপচাপ। তারপর চটকা ভাঙল, মৈত্র শুধালেন, ‘শেষ পর্যন্ত হলোটা কী? ডিভোর্স না সেপারেশন?’
‘কোনটাই না।সুর একটু থেমে বললেন, ‘আরো বছরসাতেক তাঁরা এক সঙ্গেই কাটালেন। তার পরে’—সুরের সুর বিকৃত হয়ে এলো।
‘বল, বল বলেই ফ্যাল!’ মৈত্রর কৌতূহল উদগ্র।
‘ভদ্রলোক একদিন মাঝরাত্রে রাস্তার ধারে নর্দমায় পড়ে মারা যানা শুনেছি মদের নেশায়।’ বলতে বলতে কণ্ঠরোধ হলো সুরের।
‘আহা, মারা যান!’ মৈত্র অভিভূত হলেনা মনে হলো তন্দ্রায় অভিভূত।
বন্ধুকে এক ধাক্কা দিয়ে সুর বললেন, ‘তাহলে দেখতে পাচ্ছ, বিবাহ সর্বরোগহর নয়? নারীও পুরুষকে রক্ষা করতে পারে না—গীতাও না। আমি চিন্তা করে এর একটিমাত্র সমাধান পেয়েছি এ রকম বিপজ্জনক কাজ না করা। এর চেয়ে কয়লার খনিতে নানা কম বিপজ্জনক। কিন্তু আমি যদি কয়লার খাদে নামি, আমার হাত ধরতে কোনো ভদ্রলোকের মেয়ে রাজী হবেন না। অমন একটি হাতি পুষতে আমিই বা কেমন করে পারব! তোমার ভদ্রারা আমাকে খনিতে নামতে দেবেন না। কিন্তু তার চেয়েও যা বিপজ্জনক, সেই জজ কলেকটরের কাজে নামতে দিয়ে পরে মই কেড়ে নেবেনা জজ হয়ে আমি হয়তো দশটা অপরাধীর সঙ্গে একটা নিরপরাধীকেও জেলে পাঠাব বা ফাঁসীতে ঝোলাব। কলেকটর হয়ে আমি হয়তো দুরন্ত জনতার উপর গুলী চালানোর হুকুম দেব মরবে কয়েকটা পাজী লোকের সঙ্গে এক-আধটি নিরীহ ছেলে কি মেয়ে। অমনি আমার সহধর্মিণী বাম হবেন কী করে তাঁকে বোঝাব যে আমি মানুষটা খারাপ নই, আমার পেশাটাই খারাপ! পারলে আমি ইস্তফা দিয়ে সরে যেতুম। তার পরে যদি ফকিরের সঙ্গে ফকিরণী হয়ে গাছতলায় বাস করতে কেউ রাজী হতেন, তাহলে বিয়ে করা যেত।’
০৪.
মৈত্র তন্ময় হয়ে শুনছিলেন। ওদিকে ফায়ার প্লেসের আগুন নিবুনিবু করছিল। সুর তার উপর আরো কয়লা চাপিয়ে তাকে তেজী করে তুললেন। ও যেন তাঁর নিজের জীবনের প্রতীক।
‘এখন তোমার কথাই শোনা যাক। যদি তোমার কোনো কাজে লাগতে পারি।’ বললেন মৈত্র তাঁকে আবার স্থির হয়ে বসতে দেখে।
‘থ্যাঙ্ক ইউ, মাই ফ্রেন্ড। কিন্তু আমি ছাড়া আর কেউ আমাকে বাঁচাতে পারবে না। গীতার সব কথা না হোক, একটি বচন আমি মানি। উদ্ধরোত্মনাত্মানং নাত্মানমবসাদয়েৎ।’
এর পরে দু’জনেই অনেকক্ষণ নিস্তব্ধ। কখন এক সময় সুর আপন মনে বলতে আরম্ভ করলেন। তাঁর আত্মকাহিনী। মৈত্র শুনতে লাগলেন বিনা কণ্ঠক্ষেপে।
‘লন্ডনে যখন তোমার সঙ্গে পড়তুম তখন কি সংসারের খবর কিছু জানতুম! তখন আমার একমাত্র ধ্যান ছিল ভালো পাশ করে ভালো চাকরি নিয়ে দেশে ফিরতে হবে। বুড়ো বাপকে রেহাই দিতে হবে। আমার জন্যে কি তিনি শেষে ফতুর হবেন? তখন অত খতিয়ে দেখিনি কোন চাকরিতে মনের শান্তি, কোনটাতে অবসাদা আই সি এস হয়ে যেদিন বাবাকে পুত্রদায় থেকে অব্যাহতি দিই সেদিন এই ভেবে আমার আনন্দ হয়েছিল যে, এখন থেকে আমি স্বাধীন যথাকালে দেশে ফিরে চাকরিতে যোগ দিই। ভালোই লাগে একমাত্র কাঁটা রাজনৈতিক মনোমালিন্যা ওদের পলিসি আমি ক্যারি আউট করতে কুণ্ঠিত দেখে ওরাই আমাকে জজ করে। দেয়। আমি তার ফলে আরো স্বাধীন।