‘তারপর যা হবার তাই হলো। হাইকোর্ট দেখল, গোপাল আপীল করেনি, কেউ তার হয়ে একটি কথাও বলবার জন্যে দাঁড়ায়নি—প্রাণদণ্ড কনফার্ম করল। তা শুনে নিয়োগী আবার গোপালের সঙ্গে জেলখানায় গিয়ে কথা বললেন সে মার্সি পিটিশন দিতে নারাজ হলো। যে দোষ করেনি সে কেন করুণা ভিক্ষা করবে? তখন নিয়োগী একটা অভূতপূর্ব কাজ করলেন। জুডিসিয়াল সেক্রেটারীকে চিঠি লিখে সব কথা জানালেন। উত্তর এলো, আদালতের বাইরে ভূতপূর্ব জজ যদি কিছু শুনে থাকেন, তবে সেটার উপর কোনো অ্যাকশন নেওয়া যায় না। মার্সি পিটিশন না দিলে ধরে নেওয়া হবে যে দণ্ডিত ব্যক্তি অনুতপ্ত। সুতরাং করুণার অযোগ্য নিয়োগী হাল ছেড়ে দিলেন ফাঁসীর আগেই তাঁর অস্থায়ী কার্যকাল শেষ হয়ে যায়। তিনি অন্যত্র বদলি হন তারপর তিনি মদ ধরলেন, রেস ধরলেন। উপরন্তু গীতা ধরলেন। আশা করলেন, এইসব করলে তিনি বাঁচবেন।’
মৈত্র বিস্মিত হয়ে শুধালেন, ‘কেন? তিনি কি বাঁচলেন না?’
‘আহা, শোনই না সবটা!’ সুর বলতে লাগলেন, ‘আমার সঙ্গে যখন তাঁর প্রথম আলাপ তখন তিনি কমিশনার পদে অফিসিয়েট করছেন। না বাঁচলে কি কেউ এতদূর উন্নতি করতে পারে? আমি যখন তাঁকে বলি যে জজের কাজ আমার ভালো লাগে না, অথচ কলেক্টর পদ হচ্ছে দিল্লীকা লাড্ডু —যা খেয়ে আমি পসতাচ্ছি, তখন তিনিই আমাকে উপদেশ দেন, নিমিত্তমাত্রো ভব সব্যসাচী। কিন্তু তাঁর নিজের জবানীতে তাঁর জজিয়তীর গল্প শুনে আমার মনে ভয় ঢুকল যে আমিও হয়তো তাঁরই মতো কোন নিরপরাধীকে ফাঁসী দিয়ে আজীবন পসতাবা তাই ফাঁসীর মামলা আমার কোর্টে এলেই আমি গীতা খুলে বসি। কিন্তু তাতে কোনো শান্তি বা সান্তনা পাইনে। ঈশ্বর বলে কেউ আছেন কিনা তর্কের বিষয়। তাঁর হাতের অস্ত্র বলে নিজেকে ঘুম পাড়াতে। পারিনো জজকে সমস্তক্ষণ হুঁশিয়ার থাকতে হয়, পাছে কোনো নির্দোষের সাজা হয়। প্রাণদণ্ড দূরের কথা, কারাদণ্ডই বা কেন হবে? বিচারটা যতদিন চলে ততদিন আমার সোয়াস্তি নেই। যেন। বিচারটা আসামীর নয়, আমার নিজের! বিচার শেষ হলে আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। কিন্তু মনে একটা সংশয় থেকে যায়। কে জানে প্রকৃত সত্য কী? পাইলেট যা জিজ্ঞাসা করেছিলেন যীশুর বিচারের সময়। পাইলেটের মতো আমি অজ্ঞেয়বাদী কই, সাক্ষাৎ ভগবানের পুত্রকে দেখেও তিনি তো ভগবদবিশ্বাসী হননি! আসলে কী হয়েছিল তা আমার জানবার উপায় নেই। আমি অসহায়। তাই যদি না জানতে পেলুম তো কেবল দণ্ডমুণ্ডের নিমিত্ত হয়ে আমার কী লাভ?’
‘তোমার লাভ না হোক, সমাজের লাভ!’ মৈত্র সে বিষয়ে সুনিশ্চিত।’
‘হাঁ, একদিক থেকে সেটা ঠিক বিচারের একটা ঠাট বজায় না রাখলে লোকে আইনকে নিজেদের হাতে নেবে প্রত্যেকেই হবে এক একজন দণ্ডদাতা ও জল্লাদ। কিন্তু আমি চাই নিশ্চিতি। শতকরা একশ’ ভাগ নিশ্চিতি। যাকে সাজা দিলুম সে যে আরেকজন গোপাল নয় এই নিশ্চিতি অবশ্য গোপালের মতো আমি আর একজনকেও দেখিনি যে আপীল করবে না, মার্সি পিটিশন দেবে না, কেয়ামতের উপর বিচারের ভার ছেড়ে দিয়ে নিরুদ্বেগে মরবে। তোমাকে বলতে ভুলে গেছি যে জেলা থেকে বিদায় নেবার আগে নিয়োগী আরো একবার জেলখানায় গিয়ে গোপালের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। এবার তাকে কাতর কণ্ঠে বলেছিলেন, গোপাল, আমাকে তুমি ক্ষমা কর। আমিও সামান্য একজন ভ্রান্তিশীল মানুষ। ভুলচুক তো মানুষমাত্রেরই হয়।
গোপাল বলে, ধর্মাবতার, আপনার কী দোষ যে ক্ষমা করব? রাখে আল্লা মারে কে? মারে আল্লা রাখে কে? খোদা আপনাকে দোয়া করুন আপনি লাটসাহেব হোন!’
‘ছেলেটা সত্যি বড় ভালো বলতে হবে।’ স্বীকার করলেন মৈত্র।
‘কোয়াইট রাইটা’ সুর অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, ‘কিন্তু কী ট্র্যাজিক! কেন এ রকম হয়? মানুষ কী করতে এ জগতে আসে? কী করে? কেন শাস্তি পায়? সে শাস্তি কি ইহজন্মের কর্মফল?
পরজন্মের জের? না পরবর্তী জন্মের প্রস্তুতি? যারা পরজন্ম বা পরকাল মানে না, তাদের তুমি বুঝ দিচ্ছ কী বলে?’
০৩.
মৈত্র মৌন হয়ে বসে রইলেন। তখন সুর বললেন, ‘আজ খুব ভালো মিউজিক আছে হে! বি বি সি ধরব?’
মৈত্র হাত নেড়ে বললেন, ‘না, থাক।’ থমথমে পরিস্থিতি। কিছুক্ষণ পরে মৈত্র নীরবতা ভঙ্গ করলেন, বললেন, ‘সুর, তুমি এইবার একটা বিয়ে করা’
‘কেন বল দেখি? তোমাকে কেউ ঘটকালি করতে বলেছে?’
‘না হে, তোমার ভালোর জন্যেই বলছি। চুল পেকে শন হয়েছে বটে, কিন্তু শরীর শক্ত আছে। এ বয়সে কত লোক বিয়ে করছে–করে সুখী হচ্ছে।’।
‘হা হা! তোমাকে বলিনি, মিসেস নিয়োগী আমাকে কী বলেছিলেন?’
মৈত্র থতমত খেয়ে শুধালেন, ‘কী বলেছিলেন?’
‘বলেছিলেন, অভিলাষ, আমাকে দিদি বলে যখন ডেকেছ তখন সেই সুবাদে একটা কথা বলি —বিয়ে কোরো না, বৌটা বাঁচবে।’
‘অ্যাঁ, তাই নাকি?’
‘শুধু এই নয়, পরে একদিন তিনি সোজা আমার বাংলোয় এসে হাজিরা বললেন, অভিলাষ, তোমার কাছে লীগ্যাল অ্যাডভাইস চাইতে এসেছি। উকিলবাড়ি যেতে লজ্জা করে—তাছাড়া তুমি আমার ভাই, ভাইয়ের কাছে লজ্জা কিসের? তোমার আপন দিদিকে তুমি এ অবস্থায় যা করতে বলতে, আমাকেও তাই করতে বলবে আশা করি।’
‘কী ব্যাপার!’ মৈত্র চঞ্চল হয়ে উঠলেন।
‘গুরুতর। মিসেস নিয়োগী বললেন, অভিলাষ, ওঁর পরিবর্তনের জন্যে আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। এতদিনে বুঝতে পেরেছি, আমি ফেল। মদ আর রেস হলেও ক্ষমা করা যায়, কিন্তু নিজের দেশকে উনি ইংরেজের পায়ে বিকিয়ে দিচ্ছেন। ওঁর সরকারী নথিপত্র আমি লুকিয়ে লুকিয়ে পড়েছি। ওঁর প্রশ্রয় পেয়ে অধীনস্থরা অবাধে দমন-নীতি চালিয়ে যাচ্ছে। আমি বললে উনি রাগ করেন। আমি জানতে চাই, ডিভোর্সের এটা একটা গ্রাউন্ড হতে পারে কিনা?’