‘আহা, ফাঁসী!’ মৈত্র শিউরে উঠলেন। ‘হাইকোর্ট কনফার্ম করল?’
‘শোন তারপর কী হলো! আসামী কাঁদল না, কাটল না। নীরবে দণ্ড গ্রহণ করল। শুধু একবার সামনের দিকে হাতজোড় করে তাকাল। এর পরে আরম্ভ হলো বিচারকের বিচার। তিনি বাংলোয় ফিরে গিয়ে অন্য কাজে মন লাগাতে পারলেন না। তাঁর আহারে রুচি নেই। তিনি দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠেন, আর ঘুমোতে পারেন না। তাঁর নিজের শান্তির জন্যে তিনি দিনকয়েক পরে জেলখানা পরিদর্শনের ছলে গোপালের সঙ্গে কথা বলতে যান বলেন, গোপাল, তোমার জন্য আমি আন্তরিক দুঃখিতা কিন্তু কী করব বল, আমারও তো ধর্মভয় আছে। গোপাল বলে, ধর্মাবতার, কেয়ামতের দিন খোদাতালা আমার বিচার করবেন। সাক্ষীদেরও, জুরি সাহেবানেরও, ধর্মাবতারেরও। নিয়োগী ভড়কে গিয়ে বলেন, তুমি আপীল কর। গোপাল বলে, নিজের বাপ যাকে মেরে রেখেছে, সে কি আপীলে বাঁচবে, ধর্মাবতার! আর মরতেই আমি চাই। যে মেয়ে আমার সৎমা হয়েছে, তার সঙ্গে কি নিকে বসা যায়! খালাস হলেও আমি মুখ দেখাতে পারতুম না, ধর্মাবতার। লোকে বিশ্বাস করত যে সৎমাকে নিকা করবার জন্যে আমিই আমার বাপজানকে মেরেছি।’
মৈত্র কণ্ঠক্ষেপ করলেন, ‘এরই নাম ঈডিপাস কমপ্লেক্স!’
সুর বলতে লাগলেন, ‘ছেলেটির কথাবার্তায় এমন একটা সত্যের ঝঙ্কার ছিল যে নিয়োগীর মনে হলো, আর সকলে অভিনয় করে গেছে, শুধু গোপাল তা করেনি। তিনি স্থানকাল ভুলে তাকে মিনতি করে বললেন, গোপাল, তুমি একবার শুধু বল আসলে কী হয়েছিল। গোপাল বলল, খোদায় মালুম। আমি তো সেখানে যাইনি। রুমালটা সোনাভান আমাকে দিয়েছিল নিকার আগে, আমি সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আসি নিকার পরে। তাতে রক্ত কী করে এলো খোদা জানেন! এরপরে গোপাল চুপ করে নিয়োগীও আর তাকে খোঁচান না। কিন্তু সেই যে তাঁর মাথায় পোকা ঢুকল সে পোকা সেইখানেই থেকে গেল। তিনি সরকারকে চিঠি লিখলেন যে তিনি ছুটি নিতে চান। ছুটির পর আর যেন তাঁকে জজ না করা হয়। করলে তাঁর নার্ভাস ব্রেকডাউন করা হবে।’
মৈত্র বললেন, ‘তার মত লোকের জজ না হওয়াই ভালো যে যা বলে, তাই তিনি বিশ্বাস। করবেন! আরে, ফাঁসীর কয়েদী তো অমন কথা বলবেই।’
‘ফাঁসীর কয়েদী,’ সুর বললেন, ‘আপীল করে না কোথাও শুনেছ এ কথা?’
‘তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে বল–গোপাল আপীল করেনি?’ মৈত্র পাল্টা শুধালেন।
‘না, বন্ধু। গোপাল আপীল করেনি। এটা এমন একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার যে কেবল নিয়োগী কেন, অনেকের মনেই ধোঁকা লেগেছিল পাবলিক প্রেসিকিউটারও পরে স্তম্ভিত হয়েছিলেন। কিন্তু শোন, তারপরে কী হলো। নিয়োগী ছুটি পেলেন, কিন্তু ছুটির পরে তাঁকে সেই জেলারই কলেক্টর পদে অফিসিয়েট করতে বলা হলো তিনি তার সুযোগ নিয়ে টুর ফেললেন বদলগাছি থানায়। পাহাড়পুরের স্তূপ পরিদর্শন করবেন। সরেজমিনে গিয়ে হারুনল রশিদের মতো। ছদ্মবেশে অনুসন্ধান করতে লাগলেন। দফাদার চৌকিদারদের মুখেই শুনলেন যে, হালিম মির্ধা এক ঢিলে দুই পাখী মেরেছে। বাপকে আর বেটাকে, সোনাভান আর তার সম্পত্তির লোভ কাজিয়া একটা অনেক দিন থেকে চলছিল। নিকার আগে সোনাভানের জমিজমা তারই হেফাজতে ছিল। তার বিবি না থাকলে সোনাভান তার সঙ্গেই নিকা বসত তার মুখের গ্রাস কেড়ে নিল ইংরেজ মোল্লা। তলে তলে ফন্দী আঁটছিল। একদিন অন্ধকার রাত্রে বাপজান’ বলে ঘরে ঢুকে ইংরেজকে নিকাশ করলা ঘুমের ঘোরে ইংরেজ চেঁচিয়ে উঠল, ‘গোপাল, তুই! সোনাভান ছিল না। সাক্ষীরা আসবার আগে হালিম অন্তর্ধান!’
মৈত্র ব্যঙ্গ করে বললেন, ‘গাঁজা, গাঁজা! বদলগাছিতে তো গাঁজার চাষ হয় শুনেছি, নিয়োগীকে গাঁজা খাইয়ে দিয়েছে। তারপর?’
‘হালিম অনেকদিন নিরুদ্দেশ ছিল। গোপালের সাজা হওয়ার পর সে আবার গ্রামে ফিরে এসেছে। কিন্তু গ্রামের লোক তাকে সন্দেহের চোখে দেখছে। সে খুব সাবধানে চলাফেরা করছে। গোপালের ফাঁসী হয়ে গেলে পরে সোনাভানকে নিকা করবে। নিয়োগী সাহেব যখন সদরে ফিরলেন, তখন তাঁর ১০২ ডিগ্রী জ্বর। সেই জ্বর নিয়েই তিনি নতুন জজের বাড়ি গিয়ে দেখা করলেনা বললেন, এখনো সময় আছে, ছেলেটার যাতে ফাঁসী না হয় তার জন্যে আসুন আমরা চেষ্টা করি। নতুন জজ ম্যাকগ্রেগর কি রাজী হন? বললেন, কেসটা আমি করিনি। আমার কোনো লোকাস স্টান্ডই নেই। আর আপনিও এখন জজ নন। আপনি ফাংটাস অফিসিওা কাগজপত্র হাইকোর্টে চলে গেছে। প্রাণদণ্ড তাঁরা হয়তো কনফার্ম করবেন না। তাহলেও তো ছেলেটা মরছে না। তা শুনে নিয়োগী বললেন, যদি কনফার্ম করে, তখন যে খুব দেরি হয়ে গিয়ে থাকবে। ম্যাকগ্রেগর বললেন, তখন গভর্ণরের কাছে করুণা ভিক্ষা করলে তিনি তার বয়স বিবেচনা করে প্রাণদণ্ড মকুব করবেনা এর নজির আছে। নিয়োগী বললেন, যে মানুষ আপীল করল না, সে কি মার্সি পিটিশন দেবে? তাহলে তো স্বীকার করে নেওয়া হয় যে সেই তার বাপকে খুন করেছে! ম্যাকগ্রেগর বললেন, স্বীকার তাকে করতেই হবে—যদি প্রাণে বাঁচতে চায়। চৌদ্দ বছর দেখতে দেখতে কেটে যাবে জীবন নতুন করে আরম্ভ করার পক্ষে তেত্রিশ বছর এমন কিছু বেশী বয়স নয়। চাষীর ছেলে—অন্য কোনো গ্রামে গিয়ে বাস করলে কেই বা তাকে সমাজে ঠেলবে!’
‘হ্যাঁ, ম্যাকগ্রেগরই জজ হবার যোগ্যা’মৈত্র তারিফ করে বললেন, ‘তারপর?’