‘এবং ইসলামাইজেশনের।’ মৈত্রও বললেন ইংরেজীতে ‘কিন্তু সেই একমাত্র কারণ নয়, সুর। তুমি বিয়ে করনি। সিভিল সার্জনও চিরকুমার। তোমরাও যদি ওভাবে শত্রুতা কর, তাহলে ক্লাব উঠে যেতে কতক্ষণ? আমি তো মনে করি সমাজও উঠে যাবে।’
জজ হেসে বললেন, ‘হা হা! আমরা করছি শত্রুতা! চল হে চল। আমার ওখানে চল। খেতে খেতে গল্প করা যাবে। ডিনারে আজ তুমি আমার অতিথি হলে ধন্য হব।’
মার্কারকে ছুটি দিয়ে দুই বন্ধু মোটরে উঠে বসলেন।
০২.
খেতে খেতে বিস্তর আজেবাজে কথা হলো। তারপর কফির পেয়ালা হাতে করে দু’জনে গিয়ে বসলেন ফায়ারপ্লেসের ধারে। শীত পড়ছিল সেকথা ঠিক, কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা সুর সাহেবের বৈলাতিক অভ্যাস। আগুন পোহাতে পোহাতে তিনি রেডিওতে বি বি সি’র সঙ্গীত শুনতে ভালোবাসেন তাঁর পায়ের কাছে তাঁর প্রিয় কুকুর জলি।
‘আচ্ছা মৈত্র,’ সুর পূর্ব প্রসঙ্গে ফিরে গেলেন, ‘তুমি নিজে ফাঁসী দিতে পারো? মানে জজ হলে তুমি ফাঁসীর হুকুম দিতে পারবে?’
‘আলবৎ।’ মৈত্র সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, ‘আমি তো দিচ্ছিনে—দিচ্ছে আইন! দেশের সরকার যদি ক্যাপিটাল সেনটেন্স রহিত করে আমিও দেব না।’
‘কিন্তু সেই তিনিও, যিনি আমাকে নিমিত্তমাত্র হতে উপদেশ দিয়েছিলেন, তিনিও দেখলুম আমার প্রশ্ন শুনে পিছিয়ে গেলেন। বললেন, না আমি পারিনে। তারপর আমাকে এক কাহিনী শোনালেন তাঁর নিজের জীবনের কাহিনী।’ এই বলে জজ আবার অন্যমনস্ক হলেন তাঁর স্মৃতি ফিরে গেল জজিয়তীর প্রথম দিনগুলিতে
‘মামলাটা তো আমার কোর্টের নয়, খুঁটিনাটি আমার মনে নেই।’ তিনি একটু একটু করে স্মরণ করে বলতে থাকলেন থেমে থেমে, এখানে ওখানে শুধরে দিতে দিতে, নিজেই নিজের প্রতিবাদ করতে করতে। মোটামুটি দাঁড়াল এই রকম।
নিয়োগী সাহেব যখন রাজশাহী জেলার দায়রা জজ তখন তাঁর আদালতে এক খুনী মামলা আসে। ইংরেজ মোল্লা খুন হয়েছে। আসামী আর কেউ নয়, তার বেটা গোপাল মোল্লা। গোপালের বয়স আঠারো-উনিশ হবে। মা নেই। আদুরে দুলাল সে যা চায় তাই পায়। কখনো বাপের মুখে ‘না’ উত্তর পায়নি। মহা শৌখীন ছোকরা গোপাল। গ্রামে এক আলকাপ দল গড়েছে। এক রকম যাত্রার দল রাতদিন ওই নিয়ে থাকে। তার সুন্দর রূপ আর সুন্দর কণ্ঠ কত মেয়েকে যে আকর্ষণ করে! তাদের স্বামীরা শক্ত হয়, কিন্তু গোপাল ছেলেটা সৎ। কেউ তাকে দোষ দিতে পারে না।
এমন যে গোপাল সে একদিন বায়না ধরল নিকা করবো কাকে? না সোনাভানকে। অসমবয়সিনী রসবতী বিধবা। চারদিকে দুর্নাম। কিন্তু বহু সম্পত্তির মালিক। তাই তার প্রার্থীও অনেক প্রস্তাবটা শুনে ইংরেজ বলল, ‘না।’ গোপাল বিগড়ে গেল। ইংরেজ তখনো দিব্যি জোয়ান। তারও প্রচুর সম্পত্তি। ইউনিয়ন বোর্ডের মেম্বার গোপালকে বাঁচানোর জন্য গোপালের বাপ করে বসল সোনাভানকে নিকা। ভেবেছিল গোপাল তার কপালকে মেনে নিয়ে আর একটি লক্ষ্মী মেয়েকে বিয়ে করবো কিন্তু গোপাল বাপের সঙ্গে ঝগড়া করে ভিন্ন গাঁয়ে গিয়ে দেওয়ানা হলো। আলকাপের ভার নিল তার ইয়ার কাল্লু।
সুখেই ঘর করছিল ইংরেজ মোল্লা। আর একটি বেটাও হয়েছিল তার। একদিন অন্ধকার রাত্রে কে একজন তার ঘরে ঢুকে তাকে হেঁসো দিয়ে মেরে খুন করে। ইংরেজ চেঁচিয়ে ওঠে, গোপাল, তুই? চিৎকার শুনে পাড়ার লোক ছুটে আসে। দেখে ইংরেজ অজ্ঞান। একটু পরেই সে মারা যায়। গোপালকে তারা কেউ দেখেনি, কিন্তু তারাও শুনেছিল ইংরেজের চিৎকার, ‘গোপাল, তুই?’ সোনাভান সেসময় ছিল না। আলকাপ শুনতে গেছল। গোপালকে গ্রেফতার করা হয় পরের দিন আলকাপ দলের আখড়ায় সে বলে, আমি তো ও-বাড়ি চিরদিনের মতো ছেড়েছি, আমি কেন যাব? কিন্তু অবস্থা-ঘটিত প্রমাণ তার বিরুদ্ধে। একখানা রুমাল কুড়িয়ে পাওয়া গেল, সেখানা গোপালকে দিয়েছিল সোনাভান। তাতে রক্তের দাগ ছিল।
খুনী মামলায় জুরি সাধারণত ঝুঁকি নিতে চায় না একেবারে খালাস দিতে ইচ্ছে বোধ করলে ৩০২ ধারাকে দাঁড় করায় ৩০৪ ধারার ক’তে কিংবা খ’তো মামলায় জুরি ইচ্ছা করলে অপরাধের গুরুত্ব কমিয়ে আনতে পারত, কিন্তু ৩০২ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করলা পাবলিক প্রেসিকিউটার তাদের ভালো করে ভজিয়েছিলেন যে, বৌ মারা গেলে বৌ হয়, ছেলে মারা গেলে ছেলে হয়, কিন্তু বাপ মারা গেলে বাপ আর হয় না। পিতৃহত্যার মতো দুষ্কর্ম আর নেই। গোপাল যদি সৎমাকে পাবার আশায় এমন গর্হিত কাজ করে না থাকে, তবে আপনারা তাকে খালাস দিন, যদি আপনাদের মনে যুক্তি সঙ্গত সন্দেহ থাকে তবে সন্দেহে সুফল দিন। কিন্তু পাবলিক প্রেসিকিউটার নাটকীয় ভঙ্গীতে বলেছিলেন, ইংরেজ মোল্লাকে যে হত্যা করেছে সে যদি তার পুত্র গোপাল ভিন্ন আর কেউ না হয়ে থাকে, তাহলে তিনি চোখে জল এনে ফেলে জুরির সামনে চোখ মুছতে মুছতে বলেছিলেন, আপনাদের কর্তব্য অতি কঠোর। কোনো রকম কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দেবেন না। গোপাল গেলেও ইংরেজের বংশলোপ হবে না। আপনারা শিক্ষিত হিন্দু ও মুসলমান। বিজ্ঞের কাছে একটি শব্দই যথেষ্ট।
মৈত্র আর ধৈর্য ধরতে পারছিলেন না। বললেন, ‘তারপর বিচারক নিশ্চয় তার বয়স বিবেচনা করে তাঁকে ফাঁসী দিলেন না—দ্বীপান্তর দিলেন!’
‘না, বন্ধু। গোপাল আর গোপাল নয়। সে সাবালক হয়েছে। সাবালকের ছাড় নেইমাফ নেই। নিয়োগী জুরির সঙ্গে একমত হয়ে গোপালকে চরম দণ্ড দিলেন। ভালো উকীল দিলে হয়ত ছেলেটা বেঁচে যেত, কিন্তু আসামীর মামা গরীব লোক, সে সরে দাঁড়ায়। সরকারী ডিফেন্স প্যানেল থেকে যথারীতি একজন উকীল দেওয়া হয়। সরকারী খরচে। সামান্য ফী। ভালো উকীলরা কেউ সে প্যানেলে নাম দেন না। যাঁকে উকীল দেওয়া হয়েছিল তিনি পাবলিক প্রেসিকিউটারের সামনে দাঁড়াবার অযোগ্য। নিয়োগী কি করতে পারেন? ফাঁসীই দিলেন।’ সুর বললেন করুণ সুরে।