‘আর বল কেন, মৈত্র!’ জজ বললেন পাংশুমুখে, ‘যেখানে একজনের প্রাণ নিয়ে টানাটানি সেখানে আরেকজন খেলা করবে কোন সুখে? খেলতে পারো তোমরা মাস্টাররা তোমরাই ভাগ্যবান।’
প্রিন্সিপাল প্রতিবাদ করলেন। বললেন, ‘মানুষকে ফাঁসী দিতে সকলেই পারে, কিন্তু মানুষের ছেলেকে মানুষ করে দিতে পারে ক’জন! অথচ মজুরী কিনা তাদেরই সবচেয়ে কম!’
‘ফাঁসী দিতে সকলেই পারে!’ জজ আশ্চর্য হলেন ‘বাইশ লাখ লোকের এই দুই জেলার মাত্র একজনকেই সে-ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আমি হলুম ওয়ান ইন টু মিলিয়ানস।’
মাথায় চুল চামরের মতো সাদা আর নরম। কিন্তু বয়স এমন কিছু হয়নি। সবে চল্লিশের কোঠায় পড়েছে। আঁটসাঁট মুখমণ্ডল। ঠোঁট জবাফুলের মতো রাঙা সিভিলিয়ান মানুষ পান খান। না। এ রঙ কৃত্রিম নয়। চেহারাও বাঙালীর পক্ষে অসাধারণ ফরসা। তিন চার বছর অন্তর অন্তর বিলেত ঘুরে আসা অভ্যাস। বিয়ে করেননি। জিজ্ঞাসা করলে জবাব দেন, ‘হাতে কিছু জমলে তো বিয়ে করার কথা ভাবব।’
ওদিকে প্রিন্সিপাল হচ্ছেন গ্রাস উইডোয়ার। তাঁর স্ত্রী থাকেন কলকাতায় ছেলেমেয়ে নিয়ে। ভদ্রলোক প্রেসিডেন্সী কলেজে দীর্ঘকাল থাকার পর এই প্রথম প্রিন্সিপাল পদ পেয়ে মফঃস্বলে বদলি হয়েছেন। যদি ভালো না লাগে তবে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাবেন নাই বা হল প্রমোশনা। আর যদি ভালো লাগে তা হলে সবাইকে নিয়ে আসবেনা একদা লন্ডনে পড়েছেন। সে সময় জজ ছিলেন তাঁর সমকালীন ছাত্র।
‘তোমার অত মাথাব্যথা কিসের?’ প্রিন্সিপাল বললেন জজের শুক্ল কেশের উপর কটাক্ষ করে, ‘সিদ্ধান্তটা তো তুমি করতে যাচ্ছ না হো করবে জুরি। জুরি যদি বলে আসামী ৩০২ ধারা অনুসারে অপরাধী আর তুমি যদি একমত হও তাহলে আইনে বলে দিয়েছে তুমি তাঁকে ফাঁসী দেবে। যদি না তুমি তার অপরাধ লাঘব করার মতো কোনো অবস্থা দেখতে পাও। সেক্ষেত্রে তুমি দ্বীপান্তরের আদেশ দেবে। এই পর্যন্ত তোমার স্বাধীনতা। যেখানে স্বাধীনতা নেই সেখানে দায়িত্ব নেই। যেখানে যতটুকু স্বাধীনতা সেখানে ততটুকু দায়িত্ব।’
মৈত্র কিছুদিন ব্যারিস্টারি করেছিলেন। পসার জমেনি। ধাতটা পণ্ডিতেরা ভালো ডিগ্রী ছিল। ভি পি আই’র সঙ্গে দেখা করতে না করতেই অমনি নিযুক্তি-পত্র এলো। সিদ্ধান্তটা তিনি সরকারী চাকরির বয়স পেরিয়ে যাবার আগেই নিয়েছিলেন। নইলে তাঁর মুখেও শোনা যেত—’আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু, হায় মাইকেলের মতো।
তর্ক করতে করতে তাঁরা টেবিল ছেড়ে কিন্তু কিউ হাতে করে অদূরে উঁচু বেঞ্চিতে গিয়ে বসলেন। মার্কার ধরে নিল যে তাঁরা একটু পরে নেমে এসে খেলা চালিয়ে যাবেন কাশতে কাশতে সে বাইরে গেল জজসাহেবের শোফারের সঙ্গে গল্প করতে।
‘হায়, বন্ধু!’ জজ বললেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ‘যদি অত সহজ হতো–কী করে আমি তোমাকে বোঝাব যে বিচারের পরিণামের জন্যে জুরির চেয়ে আমারই দায়িত্ব বেশী! তোমার কথায় মনে পড়ল আর একজনের কথা তিনি আমাকে উপদেশ দিয়েছিলেন, যাকে মারবার তাকে শ্রীভগবান স্বয়ং মেরে রেখেছেন হে অর্জুন, তুমি শুধু তাঁর হাতের অস্ত্র নিমিত্তমাত্রো ভব সব্যসাচী।’
‘ওই গীতার বচনই শেষ কথা। সমস্ত দায় ওই ব্যাটা ভগবানেরা তোমার আমার কিসের দায়! অত বেশী সিয়েরিয়াস হতে যাই কেন আমরা! প্রতিদিন এ জগতে লক্ষ লক্ষ মানুষ মরছে। একটা মানুষ বেশী মরলে কী আসে যায়!’ প্রিন্সিপাল উদাসীন ভাবে বললেন
‘মরবে মরুক। কিন্তু আমার হাত দিয়ে কেন মরবে? কপালের দোষে মরতে পারে। কিন্তু। বিচারের দোষে কেন মরবে? একজনও নির্দোষ ব্যক্তি যেন শাস্তি না পায়, এই আমাদের ধর্মাধিকরণের মূলনীতি। আমি সেই মূলনীতির সংরক্ষক। মাথাব্যথা আমার হবে না তো কার হবে? আমি এটাকে সিয়েরিয়াস ভাবে নিই।’ জজ নাছোড়বান্দা।
‘বেশ, তোমার ভাবনা তোমারা মাঝখান থেকে আমারই সন্ধ্যাটা মাটিা মার্কার! মার্কার ব্যাটা ভাগল কোথায়?’ প্রিন্সিপাল হাঁক দিলেন।
মার্কার পাগড়ি খুলে রেখে আরাম করছিল। পাগড়ি বাঁধতে বাঁধতে ছুটে এলো। তখন প্রিন্সিপাল বললেন, ‘পুছো।’
‘না, না—এবার তোমার পালা নয়, আমার পালা। মার্কার!’ জজ ইঙ্গিত করতেই মার্কার তাঁর আদেশ মান্য করল। প্রিন্সিপালের পাশে সেলাম ঠুকে দাঁড়াল।
মৈত্র বললেন, ‘নারঙ্গী!’
আর সুর চাইলেন ছোটা পেগ।
দু’জনে দু’জনকে ‘চীয়ারিও’ জানিয়ে পানীয় তুলে মুখে ছোঁয়ালেন। কিন্তু সেই উচ্চাসন থেকে নামবার নাম করলেন না। মার্কার বেচারা কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
হঠাৎ মার্কারের মুখের উপর নজর পড়ায় অন্তর্যামী জজ অনুমানে বুঝলেন তার মনের ভাষা। ডান হাত উঠিয়ে বললেন, ‘ব্যাস।’
সে তখন সাহেবদের হাত থেকে কিউ দুটি নিয়ে প্রাচীরে লগ্ন করল। আর টেবিলের উপর বলগুলোকে সাজিয়ে রাখল। আর টেবিলের উপরকার কড়া আলোর বাতির সুইচ টিপে নিবিয়ে দিল। তা সত্বেও সে বিদায় নিতে পারে না, যতক্ষণ সাহেবরা ক্লাবে থাকেন ও পানীয় ফরমাস করেন। ন’টা এখনও বাজেনি। তবু মনে হয় গভীর রাত নিঝুম শহর।
তার দশা দেখে জজ বলেন, ‘মৈত্র, এখন এ বেচারাকে আটকে রেখে আমাদের কী লাভ? ক্লাবে তো আজকাল কেউ আসতেই চান না টেনিসের পরে।’ ইংরেজীতে যোগ করলেন, ‘কিসের টানে আসবেন? মোহিনী শক্তি কোথায়? স্টেশনে উপস্থিত মহিলারা সকলেই পর্দা। ইন্ডিয়ানাইজেশনের পরিণাম।’