শেষ খবরটা পেয়ে মন খারাপ হয়ে যায় ভরোসালালেরা পৃথিবীর সব ব্যাপারেই সে উদাসীন তবু কাল পিঠে চাপিয়ে যাকে পাহাড় পার করিয়েছে, যার জন্য নিজের সঞ্চয় থেকে নগদ সোয়া পাঁচ টাকা খরচও করে ফেলেছে, গরম সেঁক দিয়ে যার সেবা করেছে, তার খুব কষ্ট হচ্ছে জেনে আজ আর সগরিগলি যেতে মন করছে না। সে ঠিক করে ফেলল, ভালোয় ভালোয় মেয়েটার বাচ্চাটাচ্চা হয়ে গেলে সে পূর্ণিয়া টাউনে যাবে। গিয়ে হয়তো দেখবে মিউনিসিপ্যালিটির লোকেরা খ্যাপা কুকুর মারার জন্য অন্য লোক লাগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু কি আর করা যাবে? ‘হো রামজী, হো পবনসূত—’
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এদিক-সেদিক খানিক ঘুরে বেড়াল ভরোসালাল। তারপর রুটি বানিয়ে খেয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকল। ঘুম থেকে উঠে বিকেলে আবার সে এল হাসপাতালে। কিন্তু কোন খবর নেই। রাতটা কাটিয়ে পরের দিন সকাল আর বিকেলে দু’বার এল ভরোসালালা খবর। নেই।
দু’ দিন কাটবার পর উদ্বেগে তার দম যখন বন্ধ হয়ে আসছে সেই সময় ডাক্তারসাব হাসতে হাসতে বললেন, ‘বহুত বড়িয়া খবর—।
ভরোসালাল বলল, ‘হো গিয়া ডাগদরসাব?’
‘হো গিয়া।’
‘রামজীকা কিরপা, পবনসুতকা কিরপা—’ভরোসালালের চোখে আলো ঝিলিক দিয়ে গেল।
‘তোমার জেনানার লেড়কা হয়েছে। বহুত গোরা লেড়কা—’।
চমক লাগল ভরোসালালেরা ডাগদরসাব নিশ্চয়ই মেয়েটাকে তার আওরত ধরে নিয়েছে। ভুল শুধরে দেবার জন্য তাড়াতাড়ি সে বলে উঠল, ‘ও আমার আওরত না ডগদরসাব!’
‘তব?’ ডাক্তারসাব ভুরু কুঁচকে তাকালেন। ভরোসালাল বলল, ‘রাস্তায় আস্তে আস্তে জান-পয়চান (আলাপ-পরিচয় হয়েছিল। আচ্ছা চলি ডাগদরসাব, রাম রাম।’ এবার পরম নিশ্চিন্তে সগরিগলি ঘাট পেরিয়ে পূর্ণিয়া যেতে পারবে।
রসুল মাঝির গল্প
মাঝিঘাটা থেকে মেঘনাকে খুবসুরৎ দেখায়। আসমানে ছেঁড়া ছেঁড়া নীলচে রঙের মেঘ, নীচে উদ্দাম মেঘনা, রাশি রাশি ঢেউ আর হু-হুঁ বাতাস। মাঝিঘাটার ওপাশে লঞ্চঘাটা। চিলগুলো পাক খেয়ে খেয়ে জলের ওপর ছোঁ দিয়ে পড়ছে। ভেঁ দিয়ে একটা লঞ্চ ছেড়ে দিল। বড় বড় কয়েকটা ঢেউ এসে মাঝিঘাটাকে দুলিয়ে গেল।
এক-মাল্লাই নৌকোর গলুইতে বসে ছিল রসুল মাঝি। শেষবেলার রোদ, চিল, ঢেউ আর মেঘ দেখছিল। দেখতে ভালো লাগছিল।
এমন সময় সওয়ারি এল।
ও মাঝি, চরলখিন্দর কেরায়া যাবা নাকি?
চমক ভাঙল। রসুল মাঝি ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। পরের মাটিতে এক মিঞা সাহেব এসে দাঁড়িয়েছে। মাথায় লাল ফেজ, রেশমি লুঙ্গি, পায়ে বাহারি নাগরা। সমস্ত শরীরে শৌখিন চেকনাই। পিছনে বোরখা-ঢাকা একটি মূর্তি। খুব সম্ভব মিঞা সাহেবের বিবি। এক পাশে স্তু পাকার মালপত্র।
রসুল মাঝি বলল, যামু না ক্যান মিয়া ছাহাব? যাওনের জন্যই তো বইস্যা রইছি। চরলখিন্দর পাঁচ টাকা কেরায়া লাগব।
মিঞ্চা সাহেব দরাদরি করল না। বোরখা-ঢাকা বিবিকে নিয়ে নৌকোয় উঠতে উঠতে বলল, পাঁচ টাকাই সই। মালপত্তর উঠাও মাঝি।
মনে মনে আপসোস করল রসুল মাঝি। কেরায়া আর একটু চড়িয়ে বললেই হত। এখন আর উপায় নেই।
একটু পরেই নৌকা ছেড়ে দিল। মাঝনদীতে এসে বাদাম খাটাল রসুল মাঝি। হু-হু বাতাস সাঁই সাঁই বাজছে। বাদামটা ফুলে রয়েছে। হালের বৈঠাটা কঠিন মুঠোয় চেপে গলুইতে কাত হয়ে বসল রসুল।
জল-কাটার একটানা শব্দ হচ্ছে। শেষবেলার রোদ নিবু নিবু হয়ে আসছে। আকাশটা আবছা দেখাচ্ছে। একটা ধোঁয়া রঙের পর্দা সমস্ত আসমান আর নদীটাকে যেন একটু একটু করে ঘিরে ধরছে।
ছইয়ের মধ্য থেকে মিঞা সাহেব বলল, চরসোহাগীতে একবার নৌকা ভিড়াইও মাঝি। রান্নাবান্না করতে হইব।
আইচ্ছা-রসুল মাঝি সংক্ষিপ্ত জবাব দিল।
কাল এক পহর বেলায় চরলখিন্দরে যাইতে পারুম না মাঝি?
মনে হত হয়।
এর পর কাটা কাটা দু-একটা কথা হল। কেরায়া নৌকার এই গলুইতে হালের বৈঠাটা চেপে একটানা ঢেউ আর বাতাসের শব্দ শুনতে শুনতে মনটা কেমন যেন উদাস উদাস লাগে রসুল মাঝির। তখন মেজাজটা আলাপ জমাবার মতো খোশবন থাকে না। আসমান-জমিন একাকার করে মনের ওপর কত ভাবনার যে ছায়া পড়ে, তার ইয়ত্তা নেই। রসুল মাঝির দিক থেকে তেমন উৎসাহ না পেয়ে অগত্যা মিঞা সাহেবকে থামতেই হল।
আজকাল ইলিশ মাছের মরশুম। ঘোট ঘোট জেলে-ডিঙিতে মেঘনা ছেয়ে গিয়েছে। দূরে কাছে যতদূর নজর চলে শুধু একের পর এক ইলশা-ডিঙি। মেঘনায় এই ইলশা-ডিঙি দেখলে রসুল মাঝির বুকের মধ্যেটা যেন হু-হুঁ করে ওঠে। অতীত জীবনটাকে মনে পড়ে। আর সেই সঙ্গে এক দুর্বোধ্য যন্ত্রণায় দেহমন বিকল হয়ে যায়।
জাল বাইতে বাইতে একটা ডিঙি পাশে এসে পড়েছিল। অভ্যাসবশে রসুল মাঝি জিগ্যেস করল, কেমুন মাছ পড়তে আছে মাঝি?
জবর।
ডিঙির খোলে ইলিশ মাছের স্তূপ জমেছে। রপালি আঁশগুলি শেষবেলার রোদে চকচক করে। চোখের মণিগুলো নীলার মতো জ্বলে। কানসার ফাঁকে তাজা রক্ত জমে রয়েছে। বড় একটা নিশ্বাস ফেলল রসুল মাঝি।
ঢেউয়ের মাথায় দুলতে দুলতে ইলশা-ডিঙিটা ফারাকে সরে গেল।
সামনেই একটা বিরাট ঘূর্ণি। কালো জল সোঁ-সোঁ শব্দে পাক খাচ্ছে। অসাবধান হলে আর উপায় থাকবে না। ঘূর্ণিতে পড়লে একটা মোচার খোলার মতো সোঁ করে একমাল্লাই নৌকোটাকে কোন অতলে টেনে নেবে। মেঘনা নদীর পাকা মাঝি রসুল। সুকৌশলে ঘূর্ণির পাশ ঘেঁষে নৌকা চালাচ্ছিল। আচমকা কানে এল