- বইয়ের নামঃ প্রফুল্ল রায়ের গল্প
- লেখকের নামঃ প্রফুল্ল রায়
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
আগুন
চিঠিখানা এসেছে সকালের ডাকে। নীল খামের চিঠি। পাওয়ামাত্রই সেটা খুলতে পারেননি সুনীতি। তখন সে অবকাশ ছিল না।
স্বামী পাবলিক প্রসিকিউটর; সাড়ে দশটায় তাকে কোর্টে হাজিরা দিতে হয়। বড় ছেলে বিমল লক্ষৌয়ে একটা ব্যাঙ্কের বিরাট অফিসার; নটার লোকাল ট্রেনটা ধরতে না পারলে লেট হওয়া অবধারিত। ছোট ছেলে কমল আর একমাত্র মেয়ে সুরভি কলেজে পড়ে; তাদের ক্লাসও এগারোটার মধ্যেই।
এদিকে কপালগুণে যে রাঁধুনিটা জুটেছে তার নড়তে চড়তেই প্রহর কাবার। অতএব সবার সঙ্গে তাল দিয়ে ফিরতে ফিরতে সকালের দিকটা চোখে আর কিছু দেখতে পান না সুনীতি। অবশ্য বড় ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। বউমাটি হয়েছে মনের মতো; সব সময় তাঁর পায়ে পায়ে ঘুরে ঝক্কিগুলো ভাগাভাগি করে নেয়।
যাই হোক অফিসযাত্রী, কলেজযাত্রী আর এজলাসযাত্রীদের যার যার গন্তব্যে পাঠিয়ে দিয়ে খাওয়ার পালা চুকিয়ে যখন খামখানা হাতে নিয়ে বসলেন তখন দক্ষিণায়ণের সূর্য পশ্চিম আকাশের ঢাল বেয়ে অনেকখানি নেমে গেছে। সময়টা অঘ্রাণের মাঝামাঝি; এর মধ্যেই উত্তর প্রদেশের শীত বেশ সমারোহ করেই নামতে শুরু করেছে। রোদটা স্তিমিত, নিষ্প্রভ, অনুজ্জ্বল। বাতাসেও বেশ টান ধরেছে।
খামটা হাতে দিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলেন সুনীতি। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই তার নামে চিঠি আসে। দাদারা লেখেন, দিদিরা লেখেন, বাবা-মা লেখেন। তাঁদের হাতের লেখার সঙ্গে তিনি পরিচিত। কিন্তু এই খামটার ওপর যে নাম-ঠিকানা রয়েছে সে হস্তাক্ষর তার সম্পূর্ণ অচেনা। কিছুটা বিস্ময়ের বশে, কিছুটা বা কৌতূহলে নীল আবরণ ছিঁড়ে চিঠিটা বার করে পড়তে লাগলেন সুনীতি।
প্রিয়ংবদে না সুহাসিনী, কী নামে সম্বোধন করব, বুঝে উঠতে পারছি না। এখনও তোমার কথা শুনলে হৃদয় ময়ুরের মতো পেখম মেলে কিনা অথবা হাসলে সুধা ঝরে কিনা, কিছুই জানা নেই। অতএব সম্বোধনের বালাইটুকু বাদ দিলাম।
খবর পেয়েছি চুটিয়ে সংসার করছ। তোমার স্বামী কাড়ি কাড়ি টাকা রোজগার করেন; বড় ছেলেটিও কৃতী হয়েছে। অন্য ছেলেমেয়েরাও বেশ ভালো; বড়বউমাটিও চমৎকার। অতএব আশা করি সুখ আর টাকার টনিকে ফুলে ফুলে একটি মৈনাক পর্বত হয়ে উঠেছ। অবশ্য এটা আমার নিছক অনুমান।
একদিন দেখেছিলাম হরিণীর মতো তোমার চোখ। মেঘের মতো চুল, চম্পাকলির মতো আঙুল, নবীন বর্ষার সজীব লতাটির মতো শরীর। সেই যে তোমাদের কবি কী যেন ছাই বলেছেন, মধ্যে ক্ষীণা, নিম্নে বিশালাঃ, নগ্রোধপরিমণ্ডলা, তা-ই ছিলে তুমি। আমার দেখা তুমি আর আমার অনুমান করা তুমি, এই দুয়ের ভেতর মিল আছে কিনা বড় জানতে ইচ্ছে করছে।
একদিন তো ছিলে সুললিতে রসবতী; প্রাণটি ছিল সরোবরের মতো টলটলে। সে সরোবর মজে হেজে বুজে গেছে কিনা কে বলবে! বুধবার পাঁচটা নাগাত এলাহাবাদ থেকে লক্ষৌ যাবার পথে আমার ট্রেনটা তোমাদের স্টেশনে মিনিট দশেকের জন্য দাঁড়াবে।
যমনাপুলিনে কৃষ্ণকানাইয়ার বাঁশি শুনে শ্রীরাধিকে যেমন লোকলজ্জা ভুলে বেরিয়ে আসত, একদিন আমার ডাকে তুমিও তেমনি আসতে পারতে। আমার সেই সুখের দিন আজ আর আছে কিনা, জানি না। যাই হোক, ইতিতে নামটা দিলাম না। চিনতে পারলে স্টেশনে এসো।
চিঠিখানা পড়ে ভ্রুকুঞ্চিত করলেন সুনীতি; যারপরনাই বিরক্ত হয়েছেন তিনি। তার চিঠি এলে সবাই খুলে পড়ে। ভাগ্যিস আগেভাগে কেউ খোলেনি; খুললে কারো দিকে মুখ তুলে তাকানো যেত না।
ইতির পর নাম নেই, তবু পলকেই চেনা গেল। এমন চিঠি একটি মানুষই নিক্ষেপ করতে পারেন। তিনি সোমনাথ। তার মতো মাত্রাজ্ঞানহীন বাঁচাল-চুড়ামণি জগতে আর দ্বিতীয়টি আছে কিনা সন্দেহ।
সোমনাথের ওপর বিরক্ত হয়েও হঠাৎ উজান টানে জীবনের পিছন দিকে ফিরলেন সুনীতি এবং মুহূর্তে স্মৃতির ভেতর বিভোর হয়ে গেলেন।
এক-আধটা দিন নয়, প্রায় তিরিশ বছর হয়ে গেল। মনে পড়ছে, তখন তাঁর বিয়ে হয়নি। কলকাতায় বাপের বাড়ি। সেখানেই থাকতেন।
বড়দির বিয়ে হয়েছিল হাওড়ায়, মেজদির বর্ধমানে, কিন্তু সেজদির বিয়ে হয়েছিল সুদূর পাঞ্জাবে। চাকরির খাতিরে সেজ জামাইবাবুরা ওখানকার প্রবাসী। বড়দি-মেজদির সঙ্গে প্রায়ই দেখা হত কিন্তু সেজদির পক্ষে পাঞ্জাব থেকে যখন তখন আসা সহজ নয়। বিয়ের পর বার দুই এসে আসাটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তারপর বছর তিনেক চিঠিপত্র ছাড়া আর যোগাযোগ ছিল না।
মনে পড়ছে সেবার বাবার খুব অসুখ। সেজদিকে টেলিগ্রাম করা হয়েছিল। সেজ জামাইবাবু আসতে পারেননি। এক দেওরকে সঙ্গে করে সেজদি চলে এসেছিলেন। সেজদির সেই দেওরটিই সোমনাথ।
সেজদিরা এসে পৌঁছবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাবা সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। যাই হোক, এতদিন পর সেজদি আসায় বাড়িতে উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছিল। তবে উৎসবের ঘটাটা তার দেওরটিকে নিয়েই বেশি হয়েছিল।
সেজদির দেওরটি অর্থাৎ সোমনাথ অসাধারণ কৃতী ছাত্র। সে-সময় ইউনিভার্সিটিতে অঙ্কের দুরূহ একটা বিষয় নিয়ে কী গবেষণা করছিলেন। দেখতেও চমৎকার। তীক্ষ্ণ নাক, মেদহীন দীর্ঘ শরীর, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, উজ্জ্বল কপাল, স্বণাভ গাত্রবর্ণ-সব মিলিয়ে আশ্চর্য সুপুরুষ। এটুকুই তাঁর পরিচয় নয়। ভালো বাঁশি বাজাতে পারতেন, আবৃত্তি করতে পারতেন সুন্দর। তাছাড়া ছিলেন অত্যন্ত হাসিখুশি, রগুড়ে, আমোদপ্রিয় এবং বোধহয় কিঞ্চিৎ ফাজিলও। এসেই সবাইকে মাতিয়ে দিয়েছিলেন সোমনাথ।
মনে পড়ে সবার মতো তার সঙ্গেও সোমনাথের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সেজদি। তখন তার কত আর বয়স? খুব বেশি হলে অষ্টাদশীই হবেন। চোখ বড় বড় করে সোমনাথ বলেছিলেন, বোনটি তত তোমার খাসা দেখছি বউদি।
প্রথম পরিচয়ের দিন এভাবে কেউ বলতে পারে, ভাবা যায়নি। মুখ লাল হয়ে উঠেছিল সুনীতির। লজ্জায় জড়সড় হয়ে চোখ নামিয়ে নিয়েছিলেন।
সেজদি ঠোঁট টিপে হেসেছিলেন, তোমার যেন খুব মনে ধরেছে–
ধরেছে বলে ধরেছে। ওই যে কী বলে, মুনিগণ ধ্যান ভাঙি দেয় পদে তপস্যার ফল–সেই রকম দেখতে।
সুনীতি আর বসে থাকতে পারেননি; ছুটে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
সেবার মাসখানেকের মতো থেকে গিয়েছিলেন সেজদি। অগত্যা সোমনাথকেও থাকতে হয়েছিল। চলে যেতে অবশ্য চেয়েছিলেন, বাবা-মা একরকম জোর করেই ধরে রেখেছিলেন।
দিন কয়েক সবাইকে নিয়ে মাতামাতির পর সোমনাথের সমস্ত মনোযোগ এসে পড়েছিল তার ওপর। সর্বক্ষণ তাকে প্রায় ঝালাপালা করে রাখতেন সোমনাথ। এমন একেকটা কথা বলতেন, রসিকতা করতেন যে লজ্জায় সুনীতির মাথা কাটা যেত।
এমনিতেই তার বাপের বাড়ির সংসারটা ছিল অত্যন্ত রক্ষণশীল; মেয়েদের চলাফেরার ব্যাপারে চারদিকে অনেক গন্ডি কাটা ছিল। কিন্তু সোমনাথ আসার পর কড়াকাড়ি বেশ আলগা হয়ে গিয়েছিল। অন্তত সুনীতির পক্ষে।
সোমনাথের আগ্রহে সবাই মিলে একদিন বোটানিক্যাল গার্ডেনে যাওয়া হয়েছিল পিকনিক করতে। তাছাড়া প্রায়ই কলকাতার একটা করে দর্শনীয় জায়গায় বেড়াতে যেতে হত। অবশ্য রোজ সবার পক্ষে যাওয়া সম্ভব হত না। তবে সেজদি আর সুনীতি সোমনাথের সঙ্গে বেরুতেনই।
সব চাইতে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার, একদিন সোমনাথ একলা তাকে সিনেমায় নিয়ে গিয়েছিলেন। আরেকদিন নিয়ে গিয়েছিলেন গঙ্গার ধারে। এর আগে দাদা বউদি বা মায়ের সঙ্গে ছাড়া বাড়ির বাইরে একটি পা-ও বাড়াননি। সোমনাথের সঙ্গে বেরুতে গিয়ে লজ্জায়, কুণ্ঠায় আর খুশিতে হৃৎপিণ্ডে এস্রাজে ছড় টানার মতো কিছু একটা হচ্ছিল যা ঠিক মুখের কথায় বোঝানো যায় না। একটা ব্যাপার লক্ষ করেছিলেন সুনীতি; সোমনাথের সঙ্গে বেরুতে কেউ আপত্তি তো করেনইনি, বরং সবাই যেন খুশিই।
ঘরে-বারান্দায় খিলানে-অলিন্দে–বাড়ির সর্বত্র একটা গুঞ্জন শুরু হয়েছিল। গুঞ্জনটা যে তাকে আর সোমনাথকে ঘিরে, একটু কান পাতলেই তা টের পাওয়া যেত। একটি রমণীয় পরিণামের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন সবাই।
মনে আছে সে-সময় কারো দিকে তিনি তাকাতে পারতেন না। শুধু মনে হত ঘুমঘোরে সুখের এক সরোবরে রাজহংসীটির মতো ভেসে বেড়াচ্ছেন।
শুধু বাইরে বেরুনোই নয়, সেজদি আরেক বিপদে ফেলেছিলেন। তার দেবরটি নাকি ভীষণ খেয়ালি, আত্মভোলা গোছের। তার খাওয়া-দাওয়া-স্নান ঠিক মতো হচ্ছে কিনা তা সুনীতিকেই দেখতে হবে। অতএব বাবুর ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই চায়ের পেয়ালাটি নিয়ে শিয়রে দাঁড়াতে হত। স্নানের জন্য সকাল দশটা থেকেই তাগাদা দিতে হত। সময়টা ছিল কার্তিক মাস। ছাদে বসে হিমের মধ্যে রাতের দুটো প্রহরই হয়তো বাঁশি বাজিয়ে গেলেন সোমনাথ, তাড়া দিয়ে তাকে শুতে পাঠাতে হত।
দেখতে দেখতে একটা মাস কেটে গিয়েছিল। একটা মাস বা দীর্ঘ তিরিশটা দিন নয়; মনে হয়েছিল একটা মাত্র নিমেষ। ভোরের বাতাসে বয়ে আসা এক ঝলক সৌরভের মতো দিনগুলো কখন কীভাবে ফুরিয়ে গেছে তা যেন টের পাওয়া যায়নি। যাই হোক, সেজদিরা আর থাকতে পারলেন না। তাদের পাঞ্জাবে ফিরে যেতে হল।
মনে আছে, যাবার আগের দিন ছাদের নিভৃত কোণে দাঁড়িয়ে সামনাথ বলেছিলেন, কাল চলে যাচ্ছি; তবে হৃদয়খানা কলকাতাতেই রেখে গেলাম।
খুব খারাপ লাগছিল সুনীতির; ভয়ানক কান্না পাচ্ছিল। মাত্র কয়েকটা দিনের মধ্যেই সোমনাথ তাঁর প্রাণে গভীর রেখায় কীসের একটা ছাপ ফেলে দিয়েছেন। কঁপা শিথিল সুরে সুনীতি জিগ্যেস করেছিলেন, আবার কবে দেখা হবে?
মাঝখানে বাবা-মা একবার আসবেন। তারপর একেবারে টোপর মাথায় দিয়ে আমার আবির্ভাব হবে। তখন দেখা হবে।
সুনীতি আর কিছু বলতে পারেননি। শুধু মনে হয়েছিল হৃৎপিণ্ড উচ্ছলিত হয়ে কোথায় যেন ঢেউ উঠেছে।
সোমনাথেরা চলে যাবার পর পাঞ্জাব আর কলকাতায় দুপক্ষের অভিভাবকদের মধ্যে বিয়ের ব্যাপারে চিঠি যাওয়া-আসা করেছে। সুনীতি আশায় আশায় থেকেছেন। কিন্তু মাস ছয়েক পর হঠাৎ খবর এসেছিল দুর্লভ একটা স্কলারশিপ পেয়ে সোমনাথ লন্ডন চলে গেছেন। গবেষণার জন্য সেখানে তাঁকে বছর কয়েক থাকতে হবে। শুনে সুনীতি নিভৃতে বসে নীরবে শুধু কেঁদেছেন।
সোমনাথ কবে ফিরবেন তার স্থিরতা নেই। সুতরাং বাবা-মা নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকতে পারেননি। অন্য ছেলের সন্ধান করে তার বিয়ে দিয়েছেন। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে উত্তর প্রদেশের এই শহরে চলে এসেছেন সুনীতি। তারপর লম্বা তিরিশটা বছর কেটে গেছে। এখন তিনি পরিপূর্ণ সংসারের মাঝখানে রাজেন্দ্রাণী হয়ে আছেন। সুখ-সৌভাগ্য-বাড়ি-গাড়ি-পরিতৃপ্তি, কোনও কিছুর অভাব নেই। জীবন তার দুহাত ভরে অজস্র দিয়েছে।
সবাই বলে তিনি গম্ভীর, অসাধারণ ব্যক্তিত্বময়ী। সোমনাথের সঙ্গে জড়ানো সেই একটা মাস নিতান্তই ছেলেমানুষি; অতএব অনাবশ্যক। এই তিরিশ বছরে একবারও সে-কথা তিনি স্মরণ করেননি; সেদিনের স্মৃতিকে প্রশ্রয় দেবার মতো কোনও কারণও খুঁজে পাননি সুনীতি।
কাছেই থানা। সেখানকার পেটা ঘড়িতে তিনটে বাজল। স্মৃতিভারে বিভোর সুনীতি চমকে উঠে পড়লেন। আজই তো বুধবার। উঠে ঘরের দিকে যেতে যেতে স্থির করলেন, স্টেশনে যাবেন। সোমনাথকে বুঝিয়ে দিয়ে আসবেন, এ জাতীয় চিঠি তিনি পছন্দ করেন না। বাচালতা-চপলতার জন্য তাকে যথেষ্ট তিরস্কার করবেন।
.
একমাত্র গাড়িখানা নিয়ে স্বামী কোর্টে গেছেন। অতএব টাঙা ডেকে স্টেশনে এলেন সুনীতি। সঙ্গে সঙ্গে ট্রেনটা এসে পড়ল। উন্মুখ হয়ে এদিক সেদিক তাকাতেই ডাকটা কানে এল, সুনীতি, সুনীতি
চোখ ফেরাতেই সুনীতি দেখতে পেলেন প্রথম শ্রেণির একটি কামরা থেকে মুখ বাড়িয়ে হাতছানি দিচ্ছেন সোমনাথ। তিরিশ বছর আগের মতোই আছেন তিনি, তেমনই উজ্জ্বল সুদীপ্ত চেহারা। শুধু কিছু চুল সাদা হয়েছে। একরকম ছুটেই গাড়িতে উঠে সোমনাথের মুখোমুখি গিয়ে বসলেন সুনীতি।
হাসি হাসি চোখে তাকালেন সোমনাথ, আমার চিঠি তা হলে পেয়েছিলে?
সুনীতি গম্ভীর হতে চেষ্টা করলেন, না পেলে আর এলাম কী করে।
তা বটে। বলে একটু চুপ করে থেকে সোমনাথ আবার শুরু করলেন, অনেক দিন পর দেখা হল। তা তুমি কিন্তু সেদিনের মতোই সুন্দরী রসের আগরী হয়েই আছ।
কথাটা মিথ্যে নয়। তিনটি ছেলেমেয়ের জননী সুনীতি; বয়সও শতাব্দীর অর্ধেক, কিন্তু দেহে সামান্য একটু ভার পড়া আর কটি চুলের রঙ বদলে যাওয়া ছাড়া প্রায় অষ্টাদশীর মতোই আছেন। রাগ করতে গিয়েও চপল হলেন তিন। তরল গলায় বললেন, ফাজলামি হচ্ছে! আমি না হয় রসের আগরী কিন্তু তুমি? তুমি যে নটবরটি হয়ে আছ!
খুব জব্দ করলে যা হোক।
এরপর এলোমেলো অনেক কথা হল। তার মধ্য থেকে সুনীতি যেটুকু জানতে পারলেন, তা এইরকম। সোমনাথ ইদানীং দিল্লিতে সরকারি কলেজের প্রিন্সিপ্যাল, বিয়ে করেননি। ভৃত্যতন্ত্রের হাতে নিজের সমস্ত দায়িত্ব সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্ত আছেন।
সব কথা সুনীতি জানতেন না। তার বিয়ের পর থেকে, সেজদির সঙ্গে নিয়মিত চিঠি লেখালেখি হচ্ছে। ইচ্ছা করলে অনায়াসেই এ খবর জানতে পারতেন। কিন্তু সঙ্গত কারণেই ইচ্ছা হয়নি। সেজদিও সোমনাথ সম্বন্ধে একেবারে নীরব থেকেছেন।
সুনীতি বললেন, তা চিরকুমার ব্রত নিলে যে হঠাৎ?
তোমার জন্যে। পদপল্লবে তো আর জায়গা দিলে না।
সুনীতি বিব্রত বোধ করলেন। প্রসঙ্গ বদলের জন্য তাড়াতাড়ি বললেন, যা আত্মভোলা লোক তুমি; কোনওদিকে হুঁশ নেই। দুপুরবেলা খেয়েছিলে তো?
ওই দেখো, একদম ভুলে গেছি। সোমনাথ হাসলেন।
সুনীতি তাড়াতাড়ি প্ল্যাটফর্ম থেকে মিষ্টি আর ফল কিনে সযত্নে সাজিয়ে দিয়ে বললেন, খাও।
খেতে খেতে সোমনাথ সুনীতির সংসার সম্পর্কে প্রশ্ন করে করে কিছু খবর সংগ্রহ করলেন। তারপর হঠাৎ আড়াই যুগ আগে ফিরে গিয়ে বললেন, বউদির সঙ্গে কলকাতায় তোমাদের বাড়ি গিয়ে কটা দিন কি চমৎকারই না কাটিয়ে এসেছিলাম। মনে পড়ে, বোটানিক্যাল গার্ডেনে পিকনিকে গিয়েছিলাম?
সুনীতি চুপ; চোখ নামিয়ে আঙুলে শাড়ির আঁচল জড়াতে লাগলেন।
সোমনাথ আবার বললেন, মনে পড়ে তোমাকে নিয়ে জীবন-মরণ ছবিখানা দেখতে গিয়েছিলাম?
সোমনাথ বলতে লাগলেন, গঙ্গার ধারে দুজনে বেড়াতে বেড়াতে চাঁদ উঠেছিল; তুমি আস্তে আস্তে একখানা গান গেয়েছিল। সে-সব কথা নিশ্চয়ই তোমার মনে নেই?
খুব আছে, খুব আছে। কিন্তু মুখ ফুটে কী করে তা বলেন সুনীতি? হঠাৎ চোখ তুলে তিনি যেন আবিষ্কার করলেন, এই বিকেল পাঁচটাতেই কার্তিকের সন্ধ্যা ঘনতর হয়ে আসছে; হিমেল বাতাস সাঁই সাঁই বয়ে যাচ্ছে। দেখলেন, সামান্য একটা সুতির জামা পরে আছেন সোমনাথ। বললেন, তোমার গরম পোশাক কোথায়?
সোমনাথ একটা সুটকেস দেখিয়ে দিলেন। সেটা খুলে কোট বার করে সুনীতি বললেন, পরে ফেলো।
পরে পরব।
উঁহু, ভুলে যাবে। তারপর ঠান্ডা লেগে এক কাণ্ড বাধাবে।
সোমনাথ খেতে খেতেই কোট পরলেন। সুনীতি বোতাম আটকে দিলেন।
কিছুক্ষণ পরে সোমনাথ আবার বললেন, কী, আমার কথাগুলোর জবাব তত দিলে না–
সুনীতি কী বলতে যাচ্ছিলেন; সেই সময় বাইরে ট্রেন ছাড়ার প্রথম ঘণ্টি পড়ল। দশটা মিনিট কখন কেটে গেছে, কারো খেয়াল নেই। সোমনাথ চকিত হয়ে বললেন, নামো সুনীতি, ট্রেন ছেড়ে দেবে।
সুনীতি বললেন, আরে বাপু, নামছি।
একটু পরেই দ্বিতীয় ঘন্টি পড়ল। কাণ্ডজ্ঞানহীন সোমনাথ এবার এক কাণ্ডই করে বসলেন; হাত ধরে সুনীতিকে প্ল্যাটফর্মে নামিয়ে দিলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে বিপর্যয়টা ঘটে গেল। অভিমানিনী কিশোরীর মতো অবরুদ্ধ সুরে সুনীতি বললেন, চিরদিন আমাকে দূরেই সরিয়ে রাখতে চেয়েছ। সেদিন বিদেশে চলে গেলে। আজও
তার কথা শেষ হতে না হতেই গার্ডের হুইসিল শোনা গেল। ট্রেন ছেড়ে দিল। বিমূঢ় সোমনাথ জানালার বাইরে মুখ বাড়িয়ে বিভ্রান্তের মতো তাকিয়ে রইলেন।
একসময় সোমনাথকে নিয়ে ট্রেনটা ডিসট্যান্ট সিগনালের ওপারে অদৃশ্য হয়ে গেল। আর তখনই আত্মবিস্মৃতির ঘোরটা কেটে গেল সুনীতির। কী করতে এসেছিলেন সোমনাথের কাছে আর এ কী করে গেলেন? নিজের অগোচরে অভিসার করতেই কি বেরিয়েছিলেন সুনীতি? গ্লানিতে, আত্মধিক্কারে নিজের কাছেই অত্যন্ত ছোট হয়ে গেলেন তিনি।
কিন্তু সুনীতি কি জানতেন, সব আগুন নেভে না? ভস্মেই সব আগুনের পরিণাম লেখা নেই? সংসার-সুখ-স্বামী-সন্তান এবং তিরিশটা বছর দিয়ে যে স্ফুলিঙ্গকে তিনি আড়াল করে রেখেছিলেন, কে জানত একটুতেই প্রাণের অতল থেকে ঊর্ধ্বমুখ শিখার মতো তা বেরিয়ে আসবে।
আর একবার – প্রফুল্ল রায়
এই সতেরো তলা হাইরাইজ বিল্ডিংটার টপ ফ্লোরে সুশোভনের ফ্ল্যাট। এখানে যে কোনও জানালায় দাঁড়ালে বিশাল আকাশ চোখে পড়ে। কলকাতার মাথার ওপর যে এত বড় একটা আকাশ ছড়িয়ে আছে, এখানে না এলে টের পাওয়া যায় না।
বেশ কিছুক্ষণ আগেই সকাল হয়েছে। শীতের মায়াবী রোদে মেঘশূন্য আকাশটাকে অলৌকিক মনে হচ্ছে।
কটা শঙ্খচিল অনেক উঁচুতে, আকাশের নীলের কাছাকাছি, ডানা মেলে অলস ভঙ্গিতে হাওয়ার ভেসে বেড়াচ্ছে। সব মিলিয়ে কোনও জাপানি চিত্রকরের আঁকা একটি ছবি যেন।
বেডরুমে সিঙ্গল-বেড খাটে হেলান দিয়ে দুরনস্কর মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সুশোভন। হাতের কাছে একটা টি-পয় টেবিলে সাজানো রয়েছে আজকের মর্নিং এডিশরে বগুলো খবরের কাগজ, অ্যাশ-ট্রে, সিগারেটের প্যাকেট, এইটার আর এক কাপ চা।
কুক-কাম-বেয়ারা সতীশ ঘন্টাখানেক আগে খবরের কাগজ-কাগজ দিয়ে গেছে কিন্তু একটা কাগজেরও ভাজ খুলে এখন পর্যন্ত দেখেনি সুশোন। মেটালের অ্যাশ ট্রেটা ঝকঝকে পরিষ্কার, পোড়া সিগারেটের টুকরো বা ছাই কিছুই তাতে নেই। এমন কি, সতীশ যেভাবে চা দিয়ে গিয়েছিল ঠিক সেই ভাবেই পড়ে আছে। কাপে একটা চুমুকও দেয়নি সুশোভন। চা জুড়িয়ে জল হয়ে গেছে। ক’দিন ধরে এভাবেই তার সকালটা কাটছে।
অনেকটা সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার পর আস্তে আস্তে চোখ নামায় সুশোন। একটানা একভাবে বসে থাকার কারণে কোমরে খিচ ধরার মতো একটু ব্যথা ব্যথা লাগছে। অর্থাৎ ব্লড সার্কুলেশনটা ঠিকভাবে হচ্ছে না। রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করতে হাত-পা টান টান করে বাঁ দিকে সামান্য কাত হল সুশোভন। আর তখনই ওধারের বেডরুমে মণিকাকে দেখতে পেল। তার আর মণিকার শোবার ঘরের মাঝখানে যে দরজাটা রয়েছে সেটা আধাআধি খোলা। সুশোভন দেখল, মণিকা তারই মতো সিঙ্গল-বেড খাটে হেলান দিয়ে আকাশ দেখছে। তার পাশের টি-পয় টেবিলেও চা জুড়িয়ে ওপরে পড়ে গেছে।
মাসখানেক ধরে রোজ সকালে সুশোভন এবং মণিকার ঘরে এই একই দৃশ্য চোখে পড়ে।
সপ্তাহের অন্য ঘ দিন অবশ্য এভাবে সুশোভনকে বেশিক্ষণ বসে থাকতে হয়। কাটায় কাটায় সাড়ে নটায় অফিসের গাড়ি এসে যায়। তার আগেই শেভ করে, আন এবং ব্রেকফাস্ট চুকিয়ে রেডি হয়ে থাকতে হয়। লাঞ্চের সময় সে ফ্ল্যাটে ফেরে না। ওটা অফিসেই সেরে নেয়।
আজ রবিবার। সপ্তাহের কাজের দিনগুলো প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যে কেটে যায়। কিন্তু ছুটির দিন নিয়েই যত সমস্যা। সময় আর কাটতে চায় না তখন। রেল স্টেশনের
প্ল্যাটফর্মে অপরিচিত যাত্রীদের মতো পাশাপাশি ঘরে তারা চুপচাপ বসে থাকে।
অবশ্য এরকম অস্বাভাবিক গুমোট আবহাওয়া খুব বেশিদিন থাকবে না। এ সপ্তাহেই যে কোনও সময় এলাহাবাদ থেকে মণিকার দাদা অমলের আসার কথা আছে। সে তার বোনকে নিয়ে যেতে আসছে। মণিকা সেই যে চলে যাবে, তার আর ফেরার সম্ভাবনা নেই। সেটাই হবে সুশোভনের জীবন থেকে তার চিরবিদায়। তারপর আনুষ্ঠানিক ভাবে কোর্টে গিয়ে ডিভোর্সের জন্য দরখাস্ত করবে। ঝগড়াঝাঁটি, হই চই বা পরস্পরের দিকে কাদা ছোড়াছুড়ি নয়, শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়ে যাবে দু’জনের চার। বছরের ক্ষণস্থায়ী দাম্পত্য জীবন।
অথচ সুশোভন এবং মণিকা, দু’জনেই ভদ্র, শিক্ষিত। তাদের ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউণ্ডও চমৎকার। লুও তাদের মধ্যে বনিবনা বা অ্যাডজাস্টমেন্ট ঘটেনি। অমিলের কারণ বা বীজটি রয়েছে তাদের চরিত্রের মধ্যে।
মণিকা খুবই শান্ত, স্বল্পভাষী এবং ইনট্রোভার্ট ধরনের মেয়ে। সে কথা বললে দশ ফুট দূরের লোক শুনতে পায় না। জোরে টিভি বা রেডিও চালায় না সে। চলাফেরার সময় এত আস্তে পা ফেলে যে শব্দই হয় না। চা খায় আলতো চুমুকে— নিঃশব্দে।
বিয়ের পর এই চারটে বছর বাদ দিলে আজন্ম এলাহাবাদেই কেটেছে মণিকার। কলকাতার বাইরে বাইরে নানা প্রভিন্সের নানা জাতের মানুষের কসমোপলিটান পরিবেশে বড় হয়ে উঠলেও সে রীতিমত রক্ষণশীল ধরনের মেয়ে। তাদের বাড়ির আবহাওয়াতেও এই রক্ষণশীলতার ব্যাপারটা রয়েছে। তার মা বাবা বা ভাই-বোনের কেউ পুরনো ধাঁচের পারিবারিক কাঠামো ভেঙে বৈপ্লবিক কিছু ঘটাবার কথা ভাবতে পারে না। তার বাপের বাড়িতে মদ ঢোকে না। ড্রিংক করাটা সেখানে ট্যাবু। উনিশ শতকের সুখী যৌথ পরিবার যেভাবে চলত সেই চালেই তাদের বাড়ি চলছে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানো ছাড়া সেখানে বিশেষ কোনও পরিবর্তনের ছাপ পড়েনি।
সুশোভনদের ফ্যামিলি একেবারে উলটো। হই চই, পার্টি, ড্রিংক, ওয়েস্টার্ন পপ মিউজিক, কেরিয়ারের জন্য যতদূর দরকার নামা— এসব নিয়ে তারা মেতে আছে। জয়েন্ট ফ্যামিলিতে তাদের আস্থা নেই। ছেলেরা চাকরি-বাকরিতে ঢুকবার সঙ্গে সঙ্গে সুশোভনের বাবা তাদের আলাদা করে দিয়েছে। নিজের নিজের সংসার বুঝে নাও এবং সুখে থাকো। অন্যের দায় বা সাহায্য, কিছুই নেবার প্রয়োজন নেই। এতে সম্পর্ক ভাল থাকবে। মোটামুটি এটাই হল তাঁর জীবনদর্শন এবং ছেলেদের প্রতি অমূল্য উপদেশ।
এই ফ্যামিলির ছেলে হবার ফলে উত্তরাধিকার সূত্রে পারিবারিক ট্রাডিশানের সব কিছুই পেয়েছে সুশোভন। সে একটা নামকার অ্যাড কোম্পানির টপ একজিকিউটিভ। বড় বড় ফার্মের হয়ে তারা বিজ্ঞাপনের পরিকল্পনা তো করেই, তাছাড়া প্রচুর অ্যাড-ফিল্মও তুলতে হয়।
আজকাল অগুনতি অ্যাডভার্টাইজমেন্ট কোম্পানি গজিয়ে উঠেছে। কমপিটিশন প্রচণ্ড। বড় বড় ক্লায়েন্টদের হাতে রাখতে হলে প্রায়ই পার্টি দিতে হয়। শুধু হোটেল বা ‘বার’-এ নয়, বাড়িতে ডেকেও মাঝে মাঝে ড্রিংকের আসর বসাতে হয়। এমন কি বড় কোম্পানি ধরে রাখতে হলে অনেক সময় জায়গামতো টাকাপয়সাও দিতে হয়। কারও কারও যুবতী সুন্দরী মেয়ে সম্পর্কে দুর্বলতা রয়েছে। কাজেই দরকারমতো। তারও ব্যবস্থা করতে হয়। যে ছেলেমেয়েদের নিয়ে অ্যাড-ফিল্ম ভোলা হয়, তারা তো প্রায়ই সুশোভনদের ফ্ল্যাটে এসে হানা দেয়। যতক্ষণ তারা থাকে চড়া সুরের ওয়েস্টার্ন মিউজিকের সঙ্গে হুল্লোড় চলে।
জীবন সম্পর্কে ধ্যানধারণা, রুচি, কালচার, কোনও কিছুতেই সুশোভন আর মণিকার মধ্যে এতটুকু মিল নেই। তু তাদের বিয়েটা হয়ে গিয়েছিল। প্রেমের বিয়ে নয়। দুপক্ষেরই এক আত্মীয় যোগাযোগটা ঘটিয়ে দিয়েছিল।
বিয়ের পর কলকাতায় এসে দু-চারদিন কাটাতে না কাটাতেই চমকে উঠেছিল মণিকা। সুশোভনের বন্ধুবান্ধব বা বড় বড় কোম্পানির একজিকিউটিভ এবং তাদের স্ত্রীরা প্রায়ই আসত। সতীশ হুইস্কি-টুইস্কি বার করে দিত। যে মহিলারা আসত তারাও পাড় মাতাল। পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তারা রাম কি হুইস্কি খেত।
এমন দৃশ্য আগে আর কখনও দেখেনি মণিকা। সে শিউরে উঠত। অন্য একটা ঘরে ঢুকে দম বন্ধ করে সিঁটিয়ে বসে থাকত। সুশো এসে ডাকাডাকি করত, কী। হল? ওঁরা তোমার জন্যে ওয়েট করছে— এস। মণিকা জানাতো, মদের আসরে সে যাবে না। কাকুতি-মিনতি করেও ফল কিছুই হত না। সুশোভন বলত, ‘ওঁরা কী ভাবছেন বল তো?’ মণিকা বলত, ‘যা খুশি ভাবুক। বাড়িতে ‘বার’ না বসালেই কি হয় না?’ সুশোভন কৈফিয়তের ভঙ্গিতে বলত, কী করব বল। দিস ইজ আ পার্ট অফ মাই জব। আমার কেরিয়ার, আমার ফিউচারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। প্লিজ এস, ফর মাই সেক।
প্রথম প্রথম কিছুতেই মদের আসরে যেত না মণিকা। পরে অনিচ্ছাসত্ত্বেও খানিকটা অ্যাডজাস্ট করে নিয়েছিল। সুশোভনের বন্ধুবান্ধব এবং তাদের স্ত্রীরা এলে সে ওদের সামনে যেত ঠিকই, তবে হুইস্কির ছোঁয়া বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে চলত। অবশ্য সঙ্গ দেবার জন্য হাতে একটা সফট ড্রিঙ্কের গেলাস রাখত।
সুশোভনের বন্ধুরা বলত, একটু হুইস্কি টেস্ট করুন ম্যাডাম। পুরাকালে ঋষিটিষিরাও সোমরস পান করতেন। জিনিসটা খুব অস্পৃশ্য নয়।
মণিকা উত্তর দিত না।
বন্ধুরা আবার বলত, আফটার ডেথ যখন ওপারে যাবেন তখন ব্রহ্মা বিষ্ণুরা এক্সপ্লেনেশন চাইবে— মা জননী, ওয়ার্ল্ডে যে তোমাকে পাঠালাম, হুইস্কিটা টেস্ট করে এসেছ তো? তখন কী উত্তর দেবেন? মানব জীটা এভাবে নষ্ট হতে দেবেন না ম্যাডাম।
মণিকা আবারও চুপ।
বন্ধুদের স্ত্রীরা বলত, ‘তোমার মতো পিউরিটান মেয়ে লাইফে দেখিনি। ড্রিংক করলে ক্যারেক্টার নষ্ট হয় না।’
এসব কথারও উত্তর দেওয়া দরকার মনে করত না মণিকা। মনের দিক থেকে সায় না থাকলেও দাম্পত্য জীবনের খাতিরে দাঁতে দাঁত চেপে এসব মেনে নিতে হত তাকে। তবে কম বয়সের ছেলেমেয়েদের লেভেলে নেমে তাদের সঙ্গে সমান তালে সুশোভন যখন হুল্লোড় করত তখন অসহ্য লাগত।
ভেতরে ভেতরে বারুদ একটু একটু করে জমছিলই। কিন্তু বিস্ফোরণটা ঘটল দেড়-দুই বছর আগে। মণিকা যেদিন জানতে পারলে, কাজটাজ বাগাবার জন্য সুশোভন কাউকে ঘুষ দেয়, কাউকে কাউকে সঙ্গ দেবার জন্য সুন্দরী যুবতী যোগাড় করে তখন তার মাথায় আগুন ধরে গিয়েছিল। যা কখনও সে করে না, যা তার স্বভাবের বাইরে, ঠিক তাই করে বসেছিল। উত্তেজিত মুখে চিৎকার করে বলেছিল, তুমি ঘুষ দাও?
স্থির চোখে অনেকক্ষণ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থেকেছে সুশোভন। বলেছে, ‘ঘুষ না, গিফট।
‘একই বস্তু। আর ওই মেয়েদের ব্যাপারটা?’
‘নাথিং নাথিং’ টোকা দিয়ে গা থেকে পোকা ঝাড়ার মতো ভঙ্গি করে বলেছিল সুশোন।
দাঁতে দাঁত চেপে মণিকা বলেছিল, ‘নাথিং বলে উড়িয়ে দিলে চলবে না।’
কাঁধ ঝাঁকিয়ে, দুই হাত উলটে সুশোভন হালকা গলায় বলেছিল, ‘এ নিয়ে তোমায় মাথা ঘামাতে হবে না। খুব সিম্পল ব্যাপার। কেউ কেউ মেয়েদের কোম্পানি পছন্দ করে। এই একটু গল্প-টল্প করতে চায়। জাস্ট আ টেণ্ডার ফেমিনিন টাচ।’
সোজাসুজি সুশোভনের চোখের দিকে তাকিয়ে মণিকা চাপা অথচ কঠিন গলায় বলেছে, ‘এ তোমাকে ছাড়তে হবে।‘
হাসির একটা পলকা ভঙ্গি করে সুশো বলেছে, কী যে বল, তার কোনও মানে হয় না।
‘নিশ্চয়ই হয়। আমি চাই না আমার স্বামী কেরিয়ারের জন্য এত নিচে নামুক।‘
‘নিচে নামানামির কী আছে! দিস ইজ আ পার্ট অফ আওয়ার লাইফ।‘
‘এ ধ্বনের লাইফের দরকার নেই আমার। তোমার সম্পর্কে আমার শ্রদ্ধা নষ্ট হতে দিও না।‘
মণিকার কণ্ঠস্বরে এমন এক দৃঢ়তা ছিল যাতে সুশোভন চমকে উঠেছে। বলেছে, ‘একটা তুচ্ছ বাজে ব্যাপার দেখছি তোমার মাথায় ফিক্সেশানের মতো আটকে গেছে। আজকাল র্যাট রেসে টিকে থাকতে হলে, জীবনে ওপরে উঠতে হলে, মানুষকে অনেক কিছু করতে হয়।‘
‘খুব বেশি রাইজ আর অনেক টাকার দরকার কী? ভদ্রভাবে চলে গেলেই হল।‘
সুশোভন বোঝাতে চেষ্টা করেছে, তার বন্ধুবান্ধবরা টাকা পয়সার জন্য, প্রোমোশনের জন্য কত কী করে বেড়াচ্ছে। তাদের স্ত্রীরা এই নিয়ে মণিকার মতো খিটিমিটির তো করেই না, বরং রীতিমত উৎসাহই দেয়।
মণিকা বলেছে, তোমার দুর্ভাগ্য, আমি তোমার বন্ধুর স্ত্রীদের মতো উপযুক্ত সহধর্মিণী হতে পারিনি।
মাথার ভেতরটা এবার গরম হয়ে উঠেছে সুশোভনের। বলেছে, ‘দেখ, মস্তিষ্কে নাইনটিনথ সেঞ্চুরির কিছু ভ্যালুজ ঢুকিয়ে বসে আছ। ও আজকাল একেবারে অচল, টোটালি মিনিংলেস। তোমার বাপু কোনও সাধু-টাধু টাইপের লোককে বিয়ে করা উচিত ছিল। আমি তোমার লাইফে মিসফিট।’
হিতাহিত জ্ঞানশূন্যের মতো মণিকা তৎক্ষণাৎ বলেছে, ‘বোধহয়। এই বিয়েটা তোমার আমার কারও পক্ষেই হয়তো ভাল হয়নি।’
এরপর আর কিছু বলার ছিল না সুশোভনের। স্তব্ধ বিস্ময়ে বিমূঢ়ের মতো সে তাকিয়ে ছিল।
ক্রমশ যত দিন গেছে, দু’জনের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছিল। পারস্পরিক শ্রদ্ধা বিশ্বাস বা মমতা বলতে কিছুই প্রায় আর অবশিষ্ট ছিল না। রাত্তিরে এক ঘরে তারা থাকে না। তাদের বিছানা আলাদা হয়ে গেছে। কথাবার্তাও একরকম বন্ধ। সুশোভন ফ্ল্যাটে থাকলে পাশাপাশি দুই ঘরে তারা চুপচাপ বসে থাকে। ইদানীং বেশ কিছুদিন বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে ডাকে না সে। ওদের কারও কিছু দরকার হলে সতীশকে দিয়ে বলায়। সমস্ত ফ্ল্যাট জুড়ে এখন দম বন্ধ করা আবহাওয়া।
এভাবে মন এবং স্নায়ুর ওপর মারাত্মক চাপ নিয়ে জীবন কাটানো অসম্ভব। এর মধ্যে একদিন মণিকা সোজা তার ঘরে এসে বলেছে, ‘তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে।’
প্রায় দেড়মাস পর সুশোভনের ঘরে এসেছিল মণিকা। রীতিমত অবাকই হয়ে গিয়েছিল সুশোভন। বলেছিল, কী কথা?
‘আমরা যেখানে এসে পৌঁছেছি তাতে নিশ্চয়ই তোমার খুব অসুবিধে হচ্ছে।‘
‘আমার কথা থাক। অসুবিধাটা বোধহয় তোমারই বেশি। তা কী করতে চাও তুমি?’
‘এলাহাবাদ যেতে যাই। দাদাকে চিঠি লিখেছি। কয়েকদিনের ভেতরেই আমাকে নিতে আসবে।‘
কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল সুশোভন। তারপর বলেছিল, একেবারে নিয়ে যাবার জন্যে চিঠি লিখে ফেললে! একটু থেমে বলেছিল, ঠিক আছে।
তারপর থেকে শুধু অমলের জন্য অপেক্ষা করে থাকা। আজ কাল পরশু, যে কোনওদিন সে এসে পড়তে পারে। সুশোভনের বুঝতে অসুবিধা হয়নি, অমলের সঙ্গে সেই যে মণিকা চলে যাবে, আর কোনওদিনই ফিরবে না।
কতক্ষণ আধখোলা দরজার ফাঁক দিয়ে মণিকার দিকে তাকিয়েছিল, খেয়াল নেই। আচমকা কলিং বেল বেজে উঠল।
আজকাল তাদের ফ্ল্যাটে বিশেষ কেউ আসে না। বন্ধুবান্ধব, অফিসের কলিগ, অ্যাড-ফিল্মের মডেলরা—কেউ না। মণিকার সঙ্গে তার সম্পর্কটা কোন পর্যায়ে। পৌঁছেছে, মোটামুটি সবাই তারা জেনে গেছে। তাই পারতপক্ষে এধার মাড়ায় না। একটা অস্বস্তিকর আবহাওয়ার ভেতরে গিয়ে কী লাভ?
সুশোভন প্রথমটা ভেবেছিল, জমাদার বাথরুম সাফ করতে এসেছে। কিংবা যে ছেলেটা মিল্ক বুথ থেকে দুধ এনে দেয় সে-ও হতে পারে। যে-ই আসুক বিশেষ, কৌতূহল নেই সুশোভনের। ওরা এলে সতীশ দুধ নিয়ে ফ্রিজে রেখে দেবে বা বাথরুম পরিষ্কার করাবে। কাজকর্মে লোকটা দারুণ চৌখস।
একটু পরেই দরজা খোলার আওয়াজ কানে এল। পরক্ষণেই ফ্ল্যাট কাঁপানো চিৎকার, সুশোভন কোথায় রে?
গলার আওয়াজেই টের পাওয়া গেল পরিমল। আস্তে, গলার স্বর নিচু পর্দায় নামিয়ে কথা বলতে পারে না সে। কলেজে সুশোভনের সঙ্গে পড়ত। পরে এঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ডিগ্রি নিয়ে চাকরি যোগাড় করে ক’বছর আগে মিডল ইস্টে চলে গিয়েছিল। ওখানে তাদের কোম্পানি কী একটা প্ল্যান্ট বসাচ্ছে। সেখানে পরিমল টপ একজিকিউটিভ এঞ্জিনিয়ার।
ব্যস্তভাবে খাট থেকে নেমে বাইরে আসতেই সুশোভনের চোখে পড়ে, লিভিং কাম-ড্রইং রুমে পরিমল আর তার স্ত্রী সুজাতা দাঁড়িয়ে আছে। পরিমলের হাতে একটা মাঝারি সাইজের দামি সুটকেস। তাকে দেখেই সুটকেসটা নামিয়ে রেখে প্রায় দৌড়ে এসে দু’হাত জড়িয়ে ধরল, ‘কেমন আছিস রে শালা?’
সেই কলেজ লাইফ থেকেই পরিমলটা দারুণ হুল্লোড়বাজ আর আমুদে। তার মধ্যে কোনওরকম প্যাঁচ বা নোংরামি নেই। ওর স্বভাব অনেকটা দমকা বাতাসের মতো-ও এলেই মনে হয় ঘরের সব বন্ধ দরজা-জানলা খুলে গেল।
পরিমলকে দেখে মনটা খুশি হয়ে গেল সুশোভনের। বলল, এই চলে যাচ্ছে। তোরা কেমন আছিস বল।
‘আমরা কখনও খারাপ থাকি না। অলওয়েজ ইন আ জলি গুড মুড। আমাদের মতো স্বামী-স্ত্রী হোল ওয়ার্ল্ডে খুব বেশি খুঁজে পাবি না।‘ বলে ঘাড় ফিরিয়ে চোখের কোণ দিয়ে স্ত্রীকে দেখতে দেখতে পরিমল বলল, ‘না কি বল?’
সুজাতা হাসল, অর্থাৎ পরিমল এবং সুজাতা দাম্পত্য জীবনে খুবই সুখী। পারফেক্ট আণ্ডারস্ট্যাণ্ডিং বলতে যা বোঝায় তা তাদের রয়েছে। হঠাৎ নিজের আর মণিকার কথা মনে পড়তে অদ্ভুত বিষাদে বুকের ভেতরটা ভরে যেতে লাগল সুশোভনের।
বন্ধুকে ছেড়ে দিয়ে একটা সোফায় বসতে বসতে পরিমল বলল, অনেকদিন পর তোর সঙ্গে দেখা হল। কী ভাল যে লাগছে!
সুশোভন দাঁড়িয়েই ছিল। একটু ভেবে বলল, ‘হ্যাঁ, প্রায় বছর পাঁচেক পর তোকে দেখলাম। এখন যেন তুই মিডল-ইস্টে কোথায় পোস্টেড?’
‘কুয়েতে। আমাদের কোম্পানি ওখানে একটা বিরাট এয়ারপোর্ট তৈরি করছে।‘
সুশোভন জানত, যাদবপুর থেকে ডিগ্রি নিয়ে বেরুবার পর পরিমল বছর দুই তিন কলকাতার একটা ফার্মে কাজ করেছে। তারপর চলে যায় বম্বে অন্য একটা কোম্পানিতে। সেই কোম্পানি মিডল-ইস্ট আর আফ্রিকার নানা দেশে বিরাট বিরাট প্রোজেক্ট করেছে। ক’বছর ধরে পরিমল এই সব প্রোজেক্টের কাজে কখনও আবুধাবি, কখনও বাগদাদ, কখনও ত্রিপোলিতে রকির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাইরে দিনরাত তার এত ব্যস্ততা যে দেশে ফেরার সময়ই পায় না। আগে তবু দেড় দু’বছর পর পর। আসতে পারত। ক’বছর আগে একবার সুজাতাকে বিয়ে করতে এসেছিল। এবার তো এল পাঁচ বছর বাদে।
পরিমল বলল, এবার একমাসের ছুটি নিয়ে এসেছি। লাস্ট উইকে বম্বে পৌঁছেছি। হেড অফিসে দুটো জরুরি কনফারেন্স ছিল। সেসব সেরে পরশু মর্নিং ফ্লাইটে এসেছি কলকাতায়। তোকে সারপ্রাইজ দেব বলে ফোন-টোন না করেই চলে এলাম। কতকাল একসঙ্গে থাকি না। এবার তোর এখানে তিন-চার দিন থেকে যাব। সুটকেসটা দেখিয়ে বলল, এই দ্যাখ, একেবারে জামাকাপড় নিয়ে রেডি হয়ে এসেছি।
সুশোভন চমকে উঠল। পরিমল তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। সেই স্কুল কলেজে পড়ার সময় থেকে যতদিন পরিমল কলকাতায় ছিল, রোজ দু’জনের একবার করে
দেখা না হতে চলত না। কতদিন পরিমল তাদের বাড়ি এসে থেকে গেছে, সে-ও গিয়ে থাকত পরিমলদের বাড়ি। কোনওদিন যে তাদের ছাড়াছাড়ি হবে, এ যেন ভাবাই যেত না।
পরিমল তার কাছে ক’দিন থাকবে। সোনার সুতো দিয়ে বোনা যৌবনের সেই দিনগুলো নতুন করে ফিরে আসবে, এর চেয়ে আনন্দের ব্যাপার আর কী হতে পারে। কিন্তু কয়েক দিন না, কয়েকটা মিনিট থাকলেই তার আর মণিকার এখনকার সম্পর্কটা ওদের চোখে ধরা পড়ে যাবে। ভেতরে ভেতরে দারুণ গুটিয়ে গেল সুশোভন। ফ্যাকাসে একটু হেসে কোনওরকমের বলল, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।
সুজাতা ওধারের একটা সোফায় এর মধ্যে বসে পড়েছিল। সে এবার বলে উঠল, ‘আপনার মিসেস কোথায়? তার তো সাড়াশব্দ পাচ্ছি না। বাড়িতে নেই?’
সুজাতার দিকে তাকাল সুশোভন। গোলগাল আদুরে চেহারা। চোখে মুখে হাসির আভা মাখানো। সে যে সুখী, তৃপ্ত সেটা যেন তার সর্বাঙ্গে হালকা লাবণ্যের মতো মাখানো রয়েছে।
সুজাতাকে আগে খুব বেশি দেখেনি সুশোভন। পরিমলের বিয়েটা প্রেম-ফ্রেম করে বিয়ে নয়। পুরনো স্টাইলে বাড়ি থেকে মেয়ে দেখে বিয়ের ব্যবস্থা করা। হয়েছিল। মেয়ে দেখার সময় একবার সুজাতাকে দেখেছে সুশোভন। তারপর বিয়ে এবং বৌভাতের দিন। পরে খুব সম্ভব বারদুয়েক। সুজাতার সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ বেশি পাওয়া যায়নি। যাই হোক, হৃৎপিণ্ড পলকের জন্য থমকে যায় সুশোভনের। কাঁপা দুর্বল গলায় সে বলে, বাড়িতেই আছে।
ওধারের সোফা থেকে প্রায় চেঁচিয়েই ওঠে পরিমল, তুই আশ্চর্য ছেলে তো বৌকে কোথায় গায়েব করে রেখেছিস? ডাক, এক্ষুনি ডেকে আন।
অগত্যা প্রায় মাসখানেক-মাসদেড়েক বাদে মণিকার বেডরুমের দরজায় এসে দাঁড়াল সুশোভন। দূরমনস্কের মতো এখনও আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে মণিকা। পরিমলরা যে এসেছে, সে কি টের পায়নি?
কয়েক মুহূর্ত দ্বিধান্বিতের মতো তাকিয়ে থাকে সুশোভন। তারপর আস্তে করে ডাকল, মণিকা–
চমকে মুখ ফেরায় মণিকা। রীতিমত অবাকই হয়ে যায়। কতদিন পর সুশোভন তাকে ডাকল, মনে করতে পারল না। জিজ্ঞাসু চোখে সে তাকিয়ে থাকে।
সুশোভন এবার বলল, ‘পরিমলকে তো তুমি চেন।‘
মণিকা মাথা নাড়ল—চেনে। যদিও তার বিয়ের পর দু-একবার মাত্র পরিমলকে দেখেছে। অবশ্য সে যে সুশোভনের প্রাণের বন্ধু, এ খবর তার অজানা নয়।
সুশোভন বলল, ‘পরিমল ওর স্ত্রীকে নিয়ে এসেছে। ড্রইং রুমে বসে আছ। ওরা ক’দিন আমাদের এখানে থাকবে।‘
মণিকার চোখে মুখে চাঞ্চল্য ফুটে উঠল কিন্তু এবারও কিছু বলল না সে।
সুশোভন গলার ভেতর একটু শব্দ করল। তারপর ইতস্তত করে বলল, ‘আমার একটা অনুরোধ রাখবে?’
মণিকা আবছা গলায় বলল, ‘কী?
‘আমাদের মধ্যে যা-ই হয়ে থাক না, পরিমলরা যেন বুঝতে না পারে। ওরা যে কদিন থাকে একটু অ্যাডজাস্ট করে নিও। আই মীন–’ বলতে বলতে থেমে যায় সুশোভন। তার দু’চোখে অনুনয়ের ভঙ্গি ফুটে ওঠে। অর্থাৎ বাইরের লোকজনের সামনে পরস্পরের তিক্ত সম্পর্কটা যাতে বিস্ফোরণের মতো ফেটে না পড়ে সেই জন্যই সুশোভনের এই কাকুতি-মিনতি।
মণিকা এক পলক ভেবে নিল। আর কদিন বাদেই দাদা এলে সে তো এলাহাবাদ চলে যাচ্ছেই। তার আগে দু-চারটে দিন সুখী দম্পতির রোলে অভিনয় করলই না হয়। যে সম্পর্ক চিরকালের মতো শেষ হয়ে যাচ্ছে, যার আর জোড়া লাগার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই, খুশি মুখে পরিতৃপ্ত ভঙ্গিতে কয়েকটা দিনের জন্য তার জের টেনে চলতে হবে। এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের ডিভোর্স হয়নি, আইনের চোখে এখনও তারা স্বামী-স্ত্রী। এ সবই ঠিক, তবু মনে মনে তারা বিবাহ-বিচ্ছেদের জন্য প্রস্তুত হয়েই আছে। এই সময় আদর্শ স্বামী-স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করাটা একটা নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা বৈকি।
মণিকা বলল, ‘ঠিক আছে। তোমার সম্মান যাতে নষ্ট না হয়, যাতে কোনও রকম অস্বস্তিতে না পড় সেটা আমি দেখব।‘
মারাত্মক একটা টেনশান কেটে যায় সুশোভনের। দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে একটু হাসে সে। বলে, পরিমলরা ড্রইং রুমে বসে আছ। তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিল। বলে গভীর আগ্রহে মণিকার দিকে তাকাল।
সুশোভনের ইচ্ছেটা বুঝতে অসুবিধে হয় না মণিকার। খাট থেকে নামতে নামতে সে বলে, চল, আমি যাচ্ছি। একটু পরে সুশোভনের সঙ্গে ড্রইং রুমে এসে স্নিগ্ধ হেসে মণিকা পরিমলকে বলে, কতদিন পর আপনার সঙ্গে দেখা। কী ভাল যে লাগছে। আমাদের এখানে কিন্তু কদিন থেকে যেতে হবে। পরিমলরা যে এখানে থাকতেই এসেছে সে খবর সুশোভনের কাছে কিছুক্ষণ আগেই পেয়েছে মণিকা। তবু কথাটা যে বলল, সেটা নিতান্তই আন্তরিকতা বোঝাবার জন্য।
পরিমল বলল, ‘থ্যাংক ইউ। আমরা তো সেইরকম প্ল্যান করেই এসেছি। ক’টা দিন হই-হই কাটিয়ে দেওয়া যাবে।‘
মণিকা হেসে হেসে বলল, আপনারা দুই বন্ধু গল্প করুন। আমি এঁর সঙ্গে একটু কথাটথা বলি। আপনাদের বিয়ের সময় সেই একবার মোটে দেখেছিলাম। তারপর যে দু’বার কলকাতায় এসেছিলেন তখন আমি এলাহাবাদে, বাপের বাড়িতে। বলতে বলতে সুজাতার পাশে গিয়ে বসল মণিকা। বলল, ‘প্রথমেই বলে রাখছি, আমি কিন্তু আপনি-টাপনি করে বলতে পারব না।
সুজাতা হাসল।
‘তুমি করে বললে রাগ করবে না তো?’ মণিকা ফের বলে।
‘আরে না না, তুমি করেই তো বলবে।’ মণিকা যে এত দ্রুত আপন করে নেবে সুজাতা ভাবতে পারেনি। তাকে খুবই খুশি দেখাল।
বন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে চোখের কোণ দিয়ে মণিকাকে লক্ষ করতে লাগল সুশোভন। হেসে হেসে সুজাতার সঙ্গে গল্প করছে মণিকা। খুবই ইনট্রোভার্ট ধরনের মেয়ে সে। কোনওদিন তাকে এত উচ্ছ্বসিত হতে দেখেনি সুশোভন। যেভাবে অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে সুজাতার সঙ্গে সে কথা বলছে তাতে মনে হয় সুজাতা যেন তার কতকালের চেনা। মণিকার সঙ্গে তার সম্পর্কটা যে একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, এই মুহূর্তে তাকে দেখলে কে তা বুঝবে!
কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে সতীশকে দিয়ে প্রচুর কেক, প্যাস্ট্রি, সন্দেশ আর চা নিয়ে নিজের হাতে সাজিয়ে সবার সামনে ধরে দিল মণিকা। তারপর বাজার থেকে কী কী আনতে হবে, তার একটা লিস্ট করে তাকে পাঠিয়ে দিল। প্রায় দেড়মাস বাদে এভাবে তাকে বাজারে পাঠাল মণিকা। এই ক’সপ্তাহ সতীশ নিজের থেকেই যা ইচ্ছে কিনে এনেছে বা বেঁধেছে। কিভাবে কি হচ্ছে, সে সম্পর্ক একটা কথাও বলেনি মণিকা। এমন কি রান্নাঘরে উঁকি পর্যন্ত দেয়নি। গভীর উদাসীনতায় সংসার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে চুপচাপ নিজের ঘরে বসে থেকেছে। সতীশও সুশোভনের মতোই অবাক হয়ে গেছে। বিমূঢ়ের মতো মণিকাকে দেখতে দেখতে সে চলে গেল।
এদিকে আচমকা কিছু মনে পড়ে যেতে পরিমল স্ত্রীর দিকে ফিরে বলল, ওদের জন্যে কী সব এনেছ, সেগুলো বার করে দাও।
‘আরে তাই তো—’ ব্যক্তভাবে নিজেদের সুটকেসটা খুলে সুশোভনের জন্য দামি প্যান্টের পিস, টাই-পিন, টেপ-রেকর্ডার এবং মণিকার জন্য ফরেন কসমেটিকস, হাউস কোট ইত্যাদি ইত্যাদি কত রকমের জিনিস যে বার করে দিল সুজাতা!
সুশোভন বলল, ‘এত সব কী এনেছিস! তোদের কি মাথা-টাথা খারাপ!’
সুজাতা এবং পরিমল একসঙ্গে জানালো, এমন কিছুই তারা আনেনি। খুবই সামান্য জিনিস।
হাত পেতে হাউস কোট-টোট নিতে নিতে ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে যাচ্ছিল মণিকা। এসব তাকে নিতে হচ্ছে সুশোভনের স্ত্রী হিসেবে, যার সঙ্গে কিছুদিনের মধ্যেই তার সম্পর্ক চিরদিনের মতে ছিন্ন হয়ে যাবে। এই উপহারগুলিতে তার এতটুকু অধিকার নেই। এক ধরনের ক্লেশ এবং অস্বস্তি মণিকাকে খুবই কষ্ট দিতে থাকে। মনে মনে সে স্থির করে ফেলে, এলাহাবাদ যাবার সময় এর একটি জিনিসও নিয়ে যাবে না, সব এখানে রেখে যাবে।
মণিকা নিজের মনোভাবটা মুখে চোখে ফুটে উঠতে দেয় না। শুধু বলে, এর কোনও মানে হয়!
ওদের কথাবার্তার মধ্যেই একসময় বাজার করে ফিরে আসে সতীশ। কী কী রান্না হবে, ভাল করে তা বুঝিয়ে দেয় মণিকা। শুধু তা-ই নয়, মাঝে মাঝে গল্পের ফাঁকে ফাঁকে উঠে গিয়ে রান্না দেখিয়ে আসে, কখনও বা চা করে আনে।
অতিথিদের যে এত যত্ন করতে পারে, যে এমন নিপুণ সুগৃহিণী, কদিন পরেই তার সঙ্গে আর কোনও সম্পর্ক থাকবে না, ভাবতেই বুকের ভেতর অদৃশ্য কোনও শিরা ছিঁড়ে যায় সুশোভনের।
.
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার সময় অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটে যায়। টেবিলের এক দিকে পাশাপাশি বসেছে পরিমল এবং সুজাতা। তাদের মুখোমুখি মণিকা আর সুশোভন। মণিকা অবশ্য একসঙ্গে বসতে চায়নি। সবাইকে খাইয়ে, পরে খাবে বলে ভেবে রেখেছিল। কিন্তু সুজাতা রাজি হয়নি, একরকম জোরজার করে তাকেও সঙ্গে বসিয়ে দিয়েছে।
মণিকার ইঙ্গিতে এবং নির্দেশে সতীশ সবার প্লেটে খাবার দিয়ে যাচ্ছিল। একটা বড় মাছের মাথা সে যখন পরিমলের প্লেটে দিল তক্ষুনি পরিমল সেটা সুজাতার পাতে তুলে দিল। লজ্জায় এবং সুখে মুখটা আরক্ত দেখাচ্ছে সুজাতার।
ওদিকে সতীশ আর একটা মাছের মুড়ো সুশোভনের পাতে দিয়েছে। দ্রুত সুশোভন এবং মণিকা পরস্পরের দিকে একবার তাকায়। আগে হলে মুড়োটা কিছুতেই নিত না সুশোভন। মাছের মুড়ো মণিকার খুব পছন্দ। কিন্তু এখন তাদের যা সম্পর্ক তাতে হুট করে মুড়োটা তুলে দেওয়া যায় না। ভেতরে ভেতরে ভয়ানক
অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে লাগল সুশোভন।
এদিকে আচমকা চেঁচিয়ে উঠল পরিমল, ‘কি রে শালা, তুই তো টেরিফিক সেলফিশ দেখছি।‘
সুশোভন চমকে ওঠে, ‘কেন, কী করলাম?’
‘নিজে এত বড় মাছের মুড়োটা সাবড়ে দেবার তাল করছিস। আর তোর বউ মুখ চুন করে বসে আছে। বৌকে কী করে ভালোবাসতে হয় আমার একজাম্পল দেখেও শিখলি না। মুড়োটা মণিকার পাতে তুলে দে এক্ষুণি।‘
সুশোভন অস্পষ্ট গলায় কিছু একটা বলতে চেষ্টা করল, বোঝা গেল না। মণিকাই তাড়াতাড়ি বলে উঠল, মাছের মুড়ো-টুড়ো আমার ভাল লাগে না। ভীষণ কাটা।
এরপর যান্ত্রিক নিয়মে খেতে লাগল মণিকা আর সুশোভন। পরিমল অবশ্য প্রচুর কথা বলছিল। আর করছিল বিদেশবাসের সময়কার মজার মজার সব গল্প। একটু আধটু হাসছিল সুশোভন। মাঝে-মধ্যে হুঁ হাঁ করে যাচ্ছিল।
.
খাওয়া-দাওয়ার পর সুশোভন বলল, সতীশকে বিছানা করে দিতে বলি। তোরা একটু রেস্ট নে।
পরিমল জোরে জোরে মাথা ঝাঁকায়, দিবানিদ্রা দেবার জন্যে কুয়েত থেকে তোর এখানে এসেছি নাকি? কদিন এখন শুধু আড্ডা, বাংলা সিনেমা, তাস, বাংলা থিয়েটার, এটসেট্রা, এটসেট্রা।
দু’মিনিটের ভেতর কদিনের একটা প্রোগ্রামও ছকে ফেলে পরিমল। আজ এই দুপুরবেলায় তাসের আসর বসবে। বিকেলে চা-টা খেয়ে একটা বাংলা নাটক কি সিনেমা। রাত্রে ফিরে এসে আবার আচ্ছা, তারপর ডিনার, অবশেষে ঘুম। কাল সকাল থেকে আড্ডা-নাটক ইত্যাদি ব্যাপারগুলোর সঙ্গে ছেলেবেলার বন্ধুদের বাড়িতেও হানা দেবে। ক’টা দিন কলকাতাকে জমিয়ে মাতিয়ে পরিমলরা আবার কুয়েতে ফিরে যাবে। ঠিক হয়, কাল থেকে দিন চারেক সুশোভন ছুটি নেবে।
কাজেই ড্রইং রুমে আবার সবাই চলে আসে। হালকা মেজাজে নতুন করে গল্পটল্পর ফাঁকে একসময় সুশোভনকে ডেকে দক্ষিণ দিকের ব্যালকনিতে নিয়ে যায় মণিকা। বেশ অবাকই হয়েছিল সুশোভন। জিজ্ঞেস করে, কিছু বলবে?
হ্যাঁ। আস্তে মাথা হেলিয়ে দেয় মণিকা, তোমার বন্ধুরা আমাদের জন্যে এত জিনিস এনেছে। ওদেরও আমাদের দিক থেকে কিছু প্রেজেন্টেশন দেওয়া দরকার। নইলে খারাপ দেখাবে।
এই ব্যাপারটা আগে মাথায় আসেনি, অথচ আসা উচিত ছিল। সংসারের সব দিকে মণিকার চোখ কান খোলা। বরাবরই সুশোভন লক্ষ করেছে, তার কর্তব্যবোধের তুলনা হয় না। মণিকা সম্বন্ধে রীতিমত কৃতজ্ঞতাই বোধ করল সে। খুব আন্তরিকভাবে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, দেওয়া তো নিশ্চয়ই দরকার। ওদের জন্যে তোমার পছন্দমতো কিছু কিনে এনো।
তুমিই নিয়ে এস না।
দোকানের ভিড়ভাট্টায় আমার যেতে ইচ্ছে করে না। সাফোকেটিং মনে হয়। তুমিই একসময় চলে যেও।
ওরা যেরকম প্রোগ্রাম-ট্রোগ্রাম করেছে তাতে পরে যাবার সময় পাওয়া যাবে। গেলে এখনই যেতে হয়।
‘বেশ তো, গাড়িটা নিয়ে চলে যাও।‘
মণিকা নিজে ড্রাইভ করতে জানে। সুশোভন বলা সত্ত্বেও মণিকা কিন্তু গেল না, দাঁড়িয়েই রইল।
সুশোভন জিজ্ঞেস করল, আর কিছু বলবে? মুখ নামিয়ে দ্বিধান্বিতের মতো মণিকা বলে, ‘মানে—’ বলেই থেমে যায়।
হঠাৎ সুশোভনের মনে পড়ে, ডিডোর্স সম্পর্কে মোটামুটি একটা সিদ্ধান্ত নেবার পর থেকেই আলমারির চাবি নিজের কাছে আর রাখে না মণিকা, সতীশকে দিয়ে সুশোভনের কাছে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছে।
দ্রুত নিজের বেডরুমে গিয়ে বালিশের তলা থেকে চাবির গোছাটা এনে মণিকাকে দিতে দিতে সুশোভন বলে, আলমারি থেকে টাকা নিয়ে যাও—
কুণ্ঠিত মুখে মণিকা বলে, ‘কিন্তু—’
বিষণ্ণ হাসে সুশোভন, ‘স্বামী-স্ত্রীর নকল রোলে যখন অভিনয় করতে রাজিই হয়েছ তখন সামান্য খুঁতটা আর রাখছ কেন? ফিউচারে আমাদের যা-ই ঘটুক না, আমি কি তোমাকে কোনওদিন অবিশ্বাস করতে পারব?’ তার কণ্ঠস্বর অদ্ভুত এক কষ্টে বুজে আসে।
মণিকা উত্তর দেয় না। চাবি নিয়ে সোজা সুশোভনের ঘরে গিয়ে আলমারি খোলে। কতকাল বাদে সে এই ঘরে ঢুকল।
একটু পর টাকা নিয়ে একাই ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গেল মণিকা। যাবার আগে পরিমলদের বলল, একটা দরকারি কাজে সে বেরুচ্ছে। ঘন্টাখানেকের ভেতর ফিরে আসবে। ইচ্ছে হলে পরিমলরা একটু ঘুমিয়ে নিতে পারে।
পরিমল জানালো, দুপুরে ঘুমোবার অভ্যাস তার বা সুজাতার কারও নেই। মণিকা যতক্ষণ না ফিরছে তারা সুশোভনের সঙ্গে গল্প করে কাটিয়ে দেবে। সে ফিরে। এলে চারজনে জমিয়ে তাসের আসর বসাবে।
.
এক ঘন্টা না, প্রায় ঘন্টাদুয়েক বাদে সুজাতার জন্য দামি মাইশোর সিল্কের শাড়ি, নামকরা গায়কদের লং-প্লেয়িং রেকর্ড, কিছু ইন্ডিয়ান পারফিউম আর পরিমলের জন্য দামি প্যান্ট এবং শার্টের পীস ইত্যাদি নিয়ে ফিরে এল মণিকা।
পরিমল প্রায় চেঁচামেচিই জুড়ে দিল, এই জন্যে বেরুনো হয়েছিল! কোনও মানে হয়?
সুজাতা মজা করে বলল, ‘ওই যে আমরা কি একটু দিয়েছি, সঙ্গে সঙ্গে তার রিটার্ন দেওয়া হল।
মণিকা বলল, রিটার্ন আবার কী! সামান্য উপহার। এগুলো দেখলে আমাদের কথা মনে পড়বে।
পরিমল বলল, এগুলো না দিলেও মনে পড়বে।
‘জানি। তবু—’
এরপর এ নিয়ে আর কথা হয় না। পরিমল বলে, এবার তা হলে তাস নিয়ে বসা যাক।
মণিকা বলে, আমার আপত্তি নেই। পুরুষ ভার্সান মহিলা খেলা হোক। সুজাতা আর আমি একদিকে, আপনার ফ্রেণ্ড আর আপনি আরেক দিকে।
‘ও, নো নো—’ জোরে জোরে প্রবলবেগে মাথা নাড়ল পরিমল, ওটা হবে না। ওই ইভস ভার্সান আদমস-এর কারবারে আমি নেই। সুজাতা আমার লাইফ পার্টনার। সুখে-দুঃখে ভালয়-মন্দয়, চেস্ট বেঙ্গলিতে কী যেন বলে শ্মশানে রাজদ্বারে সব সময় ও আমার পার্টনারই থাকবে। এই তাস খেলাতেও ওকে আর কারও পার্টনার হতে দেব না বলে রগড়ের ভঙ্গিতে চোখ টিপল।
পরিমল এবং সুজাতার মধ্যে সম্পর্কটা কতটা গভীর, নতুন করে আরেক বার টের পাওয়া গেল। সুশোভন একধারে এতক্ষণ চুপচাপ সিগারেট হাতে বসে ছিল। কোনও এক যান্ত্রিক নিয়মেই যেন তার চোখ চলে যায় মণিকার দিকে। মণিকাও তার দিকে পলকহীন তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই দ্রুত মুখ ফিরিয়ে নেয় মণিকা। সুশোভন টের পায়, বুকের অতল থেকে ঢেউয়ের মতো কিছু একটা উঠে আসছে।
একসময় খেলা শুরু হয়। পরিমলের ইচ্ছে মতোই সুজাতা তার পার্টনার হয়েছে। অগত্যা সুশোভনের পার্টনার হয়েছে মণিকা।
সুজাতা ভুল তাস ফেললেই হই চই করে একটা কাণ্ড বাধিয়ে দিচ্ছে পরিমল, তুমিই আমাকে ডোবাবে।
মণিকা খুব ভাল তাস খেলতে জানে না। সে এনতার বাজে তাস ফেলে যাচ্ছে। আগেকার সম্পর্ক থাকলে পরিমলের মতোই সুশোভনও চেঁচামেচি করত। কিন্তু হারজিত্রে ব্যাপারে এখন তার মনোভাব একেবারেই নিস্পৃহ। প্রতি দানেই তারা পরিমলদের কাছে হেরে যাচ্ছে। কিন্তু কী আর করা যাবে। জয় পরাজয়, দুইই তার কাছে এখন সমান। নিঃশব্দে অন্যমনস্কর মতো সে খেলে যেতে লাগল।
প্রতি দানে জিতে জিতে দারুণ মেজাজে আছে পরিমল। সে বলল, কি রে, তোর বউ তোকে ফিনিশ করে দিলে!
চমকে মণিকার দিকে তাকায় সুশোভন। চমকানো ভাবটা তার একার নয়, মণিকারও। দ্রুত মণিকা তার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল।
এক পলক কিছু ভাবল সুশোভন। তারপর বলল, ‘আরে বাবা, খেলাটা খেলাই। এটা তো আর লাইফ অ্যান্ড ডেধের ব্যাপার নয়। তাসের খেলায় তোরা না হয় জিতলিই। এই তুচ্ছ জিনিস নিয়ে বউকে বকাবকি করতে যাওয়াটা মিনিংলেস।’ বলে চিন্তাটিস্তা না করেই হাতের তাসগুলো থেকে একটা বেছে টেবিলের ওপর ফেলল।
একটানা ঘন্টা দুয়েক খেলা চলল। তারপর সন্ধের আগে আগে পরিমল বলল, অনেকক্ষণ তাস হল। এবার চল, একটু বাইরে ঘুরে আসা যাক।
সুশোভন বলল, ফাইন। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকে থেকে কোমর ধরে গেছে।
দশ মিনিটের ভেতর চারজন টপ ফ্লোর থেকে নিচে নেমে সুশোভনের গাড়িতে করে বেরিয়ে পড়ল। ময়দানের চারপাশে চক্কর দিতে দিতে হঠাৎ পরিমল বলল, ‘অনেকদিন বাংলা নাটক দেখিনি। কলকাতায় এখন ভাল ড্রামা কী চলছে?
সুশোভন বলল, ঠিক বলতে পারব না। আমরাও অনেক দিন নাটক-টাটক দেখিনি। অ্যাকাডেমিতে গ্রুপ থিয়েটারগুলো রোজই নাটক করে। ওদের ড্রামায় একটা ফ্রেশ ব্যাপার থাকে। দেখবি নাকি?
পরিমল বেশ উৎসাহিত হয়ে উঠল। বলল, চল না, দেখাই যাক।’
আহামরিও না, আবার খুব খারাপও না, একটা নাটক দেখে ফ্ল্যাটে ফিরতে ফিরতে সাড়ে নটা বেজে গেল।
.
রাত্তিরে খাওয়ার পর আরও কিছুক্ষণ আড্ডা-টাজ্ঞা দিতে দিতে পরিমলের হাই উঠতে লাগল। সে বলল, ‘ঘুম পাচ্ছে রে। এবার শুতে হবে। আমি আবার রাতটা বেশি জাগতে পারি না।
শোওয়ার কথায় চমকে উঠল সুশোভন। কেননা তার এই ফ্ল্যাটে মোটে দুটো বেডরুম। পরিমলদের যদি একটা ঘর ছেড়ে দেওয়া হয়, অন্য ঘরটায় তাকে আর মণিকাকে থাকতে হবে। অনেকদিন মণিকা এবং সে এক ঘরে রাত কাটায় না।
একটু ভেবে সুশোভন বলল, এক্ষুনি শোবার ব্যবস্থা হচ্ছে। এক কাজ করা যাক—’
‘কী?’
‘তুই আর আমি এক ঘরে শোব। আমাদের বউরা অন্য ঘরে। সেই কলেজ লাইফে তুই আর আমি কতদিন এক বিছানায় রাত কাটিয়েছি। এতদিন পর যখন একটা চান্স—’
সুশোভনের কথা শেষ হতে না হতেই প্রবল বেগে দুই হাত এবং মাথা নাড়তে নাড়তে পরিমল বলল, ‘নো নো, নেভার। কলেজ লাইফে যা হয়েছে, হয়েছে। এখন আমাদের ম্যারেজ লাইফ। বউকে ছাড়া আমি ভাই ঘুমোতে পারব না। পরক্ষণেই গলার স্বরটা ঝপ করে অনেকখানি নামিয়ে বলল, তুই কী রে, বউকে ফেলে আমার মতো একটা দুম্বো পুরুষের সঙ্গে শুতে চাইছিস! তোদের মধ্যে কোনওরকম গোলমাল টোলমাল হয়েছে নাকি?’ বলে রগড়ের ভঙ্গিতে হাসতে লাগল।
নেহাত মজা করার জন্যই কথাটা বলেছে পরিমল, কিন্তু সুশোভন এবং মণিকার শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ চমকের মতো কিছু খেলে গেল। তাদের সম্পর্কটা কি বাইরের একজন মানুষের চোখে ধরা পড়ে গেছে? দ্রুত পরস্পরের দিকে একবার তাকিয়ে নিল তারা। তারপর সুশোভনই আবহাওয়াটাকে সহজ করে নেবার জন্য। হেসে বলল, ঠিক আছে বাবা, তুই তোর বউয়ের কাছেই শুবি। ম্যারেজ লাইফের হ্যাবিট তোকে নষ্ট করতে হবে না।
সতীশকে দিয়ে একটা ঘরে পরিমল এবং সুজাতার বিছানা করে দেওয়া হল। এবং নিতান্ত নিরুপায় হয়েই অন্য ঘরটায় গিয়ে ঢুকল সুশোভন আর মণিকা। দরজায় তারা খিল দেয়নি। পান্না দুটো ভেজিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রইল দু’জনে। তারপর মণিকা আস্তে আস্তে ডান দিকে জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল।
জানালার ফ্রেমের ভেতর দিয়ে যে আকাশ দেখা যায় সেখানে হাজার হাজার তারা জরির ফুলের মতো আটকে আছে। রুপোর থালার মতো গোল চাঁদ উঠেছে। অপার্থিব জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে কলকাতা।
শহর এখনও ঘুমোয়নি। নিচে অবিরত গাড়ি চলার শব্দ। অবশ্য হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের এই টপ ফ্লোরে বাতাসের ছাঁকনির ভেতর দিয়ে সেই আওয়াজ ক্ষীণ হয়ে উঠে আসছে।
সুশোভন খুবই অস্বস্তি বোধ করছিল। দ্বিধান্বিতের মতো খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর আস্তে করে বলল, ‘পরিমলটা ভীষণ ঝামেলায় ফেলে দিল।’
মুখ ফিরিয়ে এদিকে তাকায় মণিকা। সুশোভন কী বলতে চায়, সে বুঝেছে। ধীরে ধীরে চোখ নামিয়ে নিল সে।
সুশোভন এবার বলল, ‘আমি বরং এক কাজ করি।‘
আবার চোখ তুলে তাকায় মণিকা। তবে কিছু বলে না।
সুশোভন বলল, ‘আমি বাইরের ড্রইং রুমে গিয়ে শুই। তুমি এখানেই থাক। আধফোঁটা গলার মণিকা বলল, কিন্তু—’
‘কী?’
‘ড্রইং রুমে তো সতীশ শোয়। ওখানে—’
ইঙ্গিতটা বুঝতে অসুবিধে হয় না। কাজের লোকের গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বাড়ির কর্তা গিয়ে শোবে, দৃশ্যটা একেবারেই মনোরম নয়। তাছাড়া সতীশ ভাববেই বা কী!
সুশোভন বলল, ‘তা হলে?’
ঘরের চারপাশ একবার দেখে নেয় মণিকা। তারপর বলে, তুমি শুয়ে পড়। আমি ওই জানালাটার ধারে সোফায় বসে থাকি। একটা তো রাত।
‘আজকের রাতটা না হয় না ঘুমিয়ে কাটাবে। কিন্তু পরিমলরা তো কয়েক দিন থাকছে। বাকি রাতগুলো?’
মণিকা কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই হঠাৎ পাশের ঘর থেকে টুকরো টুকরো হাসি, জড়ানো গাঢ় গলার আবছা আবছা কথা, চুমুর শব্দ, খুনসুটির আওয়াজ ভেসে আসতে থাকে।
চমকে মণিকা সুশোভনের দিকে একবার তাকাল। পরক্ষণেই মুখ নামিয়ে নেয়। আর সুশোভনের সমস্ত অস্তিত্বের ভেতর দিয়ে তীব্র স্রোতের মতো অনেকক্ষণ, একটানা কী যেন বয়ে যেতে থাকে। নিজের অজান্তেই কখন যে সে মণিকার কাছে চলে এসেছে, জানে না। কোনও এক অভ্রান্ত নিয়মে তার হাত মণিকার কাঁধে উঠে। আসে। সঙ্গে সঙ্গে কী এক অলৌকিক বৈদ্যুতিক ক্রিয়া ঘটে যায়। হঠাৎ সুশোভন টের পায় মণিকার মুখ তার বুকের ওপর আটকে আছে এবং মণিকার শরীরটাও ক্রমশ তার শরীরের ভেতর মিশে যাচ্ছে।
অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে তারা। তারপর কাঁপা গম্ভীর গলায় সুশোভন। বলে, তোমার দাদা অমল এলে বলব, তুমি এলাহাবাদ যাবে না। আরেক বার আমরা চেষ্টা করে দেখি না। তুমি কী বল?
মণিকা উত্তর দেয় না। অনবরত তার মুখটা সুশোভনের বুকে ঘষতে থাকে।
একটু পর সুশোভন বুঝতে পারে, তার বুক চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে। মণিকার কান্না তার মধ্যেও বুঝিবা ছড়িয়ে পড়ে। ভাঙা ভাঙা, ঝাঁপসা গলায় বলে, ‘কেঁদো না, কেঁদো না।‘
আরণ্যক
আরণ্যক
ভাই টুপুদি,
মাসখানেক হল কানপুর থেকে আমরা ফরাসগাঁও এসেছি। জায়গাটা মধ্যপ্রদেশের সুদূর অভ্যন্তরে। এখানে দাঁড়িয়ে যে দিগন্তেই চোখ ফেরাই, শুধু পাহাড় আর পাহাড়। নীলাভ পাহাড়গুলো ঘর অরণ্যে রোমঞ্চিত হয়ে আছে। একটু ব্যাখ্যা করে বলি। রামায়ণে দণ্ডকারণ্যের কথা পড়েছিস তো। এ হল সেই জায়গা। সে-যুগে রামচন্দ্র এখনে বনবাসে এসেছিলেন। এ-যুগে পূর্ব বাংলার উদ্বাস্তুদের জন্য অরণ্য সংহার করে উপনিবেশ গড়ে উঠছে। খবরের কাগজের কল্যাণে এ খবর নিশ্চয়ই তোর অজানা নয়। সমস্ত এলাকাটা জুড়ে বিচিত্র এক জীবনযজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে যেন।
সে যাই হোক, আমাদের ফরাসগাঁও আসার কারণটা এবার বলি। তোর ভগ্নীপতিটিকে তো জানিস একটা আস্ত বেদে। দুটো দিন কোথাও যদি স্থির হয়ে থাকতে পারে! ছবছর বিয়ে হয়েছে। এর মধ্যে কত চাকরি যে ছাড়ল, কত চাকরি ধরল আর নতুন নতুন কত জায়গায় না ঘুরল! এই ভ্ৰমণবাগীশটিকে নিয়ে আর পারি না।
তুই তো জানিস, বিয়ের পরই আমরা বোম্বাই চলে গিয়েছিলাম। ও তখন সেখানে চাকরি করত। বোম্বাই থেকে দুমাস পরেই গেলাম ভাইজাগ, ভাইজাগ থেকে পাঞ্জাব, পাঞ্জাব থেকে মাদ্রাজ সারা ভূমণ্ডল পাড়ি দিয়ে শেষ পর্যন্ত কানপুরে এসে বছরখানেক ছিলাম। ভেবেছিলাম, এতদিনে বেদেটা বুঝি শান্ত হল। কিন্তু ও মা, বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ কানপুরের চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে দণ্ডকারণ্য প্রোজেক্টে কাজ জুটিয়ে ফেলল। অগত্যা ফরাসগাঁও না এসে উপায় কী!
জানিস ভাই, এখানে একেবারে আরব্য রজনীর ব্যাপার। এখনও বাড়িঘর তৈরি হয়নি। তাঁবুর ভেতর থাকার ব্যবস্থা। তোর ভগ্নীপতিটির পাল্লায় পড়ে বাংলাদেশের ভীরু মেয়ে আমি, পুরোদস্তুর আরব বেদুইন বনে গেছি।
যাই হোক, প্রথম প্রথম ভীষণ ভয় করত। তাঁবু ছেড়ে এক পা-ও বেরুতাম না। ইদানীং ভয়টা গেছে। ধীরে ধীরে, সত্যি বলছি ভাই, দণ্ডক-বনের প্রেমে পড়ে গেছি। আমাদের এই ফরাসগাঁও থেকে দক্ষিণে গেলে চিত্রকুট। সেখানে চমৎকার একটা ফল্স্ আছে। কিন্তু এই বাহ্য। এখান থেকে উত্তরে পাড়ি জমালে কেশকাল পাহাড়ের চুড়ো সেখানে কাঁচ দিয়ে ঘেরা একটা রেস্ট হাউস আছে। চার পাশে নিবিড় বন–মধ্যপ্রদেশের রিজার্ভ ফরেস্ট। যে কোনও একটা রাত্রি সেখানে গিয়ে থাকলে কাচের স্বচ্ছ দেওয়ালের ওপরে দেখা যাবে বাঘ ভালুক আর বাইসনেরা ইচ্ছামতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেখতে দেখতে রোমাঞ্চ হয়। ভয়ও লাগে। মনে হ্য, সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বহু শতাব্দী আগের এক হিংস্র আদিম জগতে ফিরে গেছি। ইতিমধ্যেই দুরাত আমরা সেখানে কাটিয়ে এসেছি। কেশকাল পাহাড়ের চুড়া আমার মনোহরণ করেছে।
ভাই টুপুদি, মনে পড়ে বিয়ের আগে মাঝে মাঝেই আমরা চিড়িয়াখানায় যেতাম। পিঞ্জরাবদ্ধ পশুগুলোকে দেখে তোর খারাপ লাগত। বলতিস ওদের মুক্ত প্রকৃতির মাঝখানে দেখতে ইচ্ছে করে। সংসার থেকে দিনকয়েকের ছুটি নিয়ে চলে আয় না। কেশকাল পাহাড়ের চুড়োয়, প্রকৃতির সেই স্বদেশে তোর ইচ্ছেপূরণ করে নিতে পারবি।
আমি জানি তোর ভগ্নীপতিটি এবং আমার ভগ্নীপতিটি–দুই ভায়রা একেবারে উল্টো স্বভাবের মানুষ। তোরটি বনের পাখি, সব সময় খালি উড়ু উড়ু। আমারটি খাঁচার পাখি। তা ভাই কয়েকটা দিনের জন্য খাঁচার পাখিটাকে দণ্ডকবনের অবাধ আকাশে এনে ছেড়ে দে।
দুবছর তোরও বিয়ে হয়েছে। এর মধ্যে কলকাতার ভিতর থেকে একটা দিনের জন্যেও বেরুসনি। অথচ ছেলেবেলা থেকেই বেড়াবার কত সাধ তোর। বিয়ের আগে এ নিয়ে কত গল্পই না করতিস। বোম্বাইতে থাকতে, পাঞ্জাবে থাকতে, কি কানপুরে থাকতে কতবার তোকে যেতে লিখেছি। তুই যাসনি। এবার কিন্তু কোনও অজুহাতই শুনব না। জামাইবাবু একান্ত না এলে ছেলেপুলেদের রেখে একাই চলে আসবি, নিশ্চই আসবি। কোনও অসুবিধে নেই। বোম্বাই মেলে রায়পুর স্টেশন থেকে আমরা তোকে নিয়ে আসতে পারব। যদি না আসিস জন্মের মতো আড়ি। ইতি–মঞ্জু।
বিকেলের ডাকে চিঠিটা এসেছে। একবার, দুবার, তিনবার, কতবার যে চিঠিখানা পড়ল শোভনা! তার আদরের নাম টুপু।
মঞ্জু তার আপন বোন নয়, ছোট কাকার মেয়ে। জেঠতুতো খুড়তুতো বোনদের মধ্যে মঞ্জুর জন্যেই শোভনার আকর্ষণটা সবচেয়ে বেশি। প্রায় আশৈশব। তার জন্যে মঞ্জুরও প্রাণের টান প্রবল। বোন বলল যথেষ্ট বলা হয় না; মঞ্জু ছিল তার সখী। বিয়ের আগে চলাফেরা ওঠা-বসা–সবই ছিল একসঙ্গে। স্কুল-কলেজে একই ক্লাসে পড়ত। তাছাড়া দুজনে প্রায় সমবয়সিও। শোভনা খুব বেশি হলে বছরখানেকের বড়।
কাকারা জেঠারা এবং শোভনারা নদীয়া জেলার এক মফস্বল শহরে একই বাড়িতে থাকত। একই বাড়িতে, তবে এক অন্নে আবদ্ধ ছিল না। বাড়িটা ছিল পূর্ব পুরুষের। শোভনার বাবা-কাকারা সেটা ভাগাভাগি করে নিয়েছিলেন। কাজেই বিয়ের আগে পর্যন্ত শোভনা আর মঞ্জু ছিল সর্বক্ষণ পরস্পরের সহচরী, সঙ্গিনী।
যাই হোক, বি.এ পড়তে পড়তেই দুজনের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল এবং তা-ও মাসখানেকের মধ্যেই। প্রথমে মঞ্জুর, পরে শোভনার। বিয়ের পর বোম্বাই চলে গিয়েছিল মঞ্জু। আর শোভনা এসেছিল কলকাতায়।
কলকাতা বললে ঠিক বোঝানো যায় না। এই শহরের পূর্ব মেরুতে এক জন্মান্ধ রুদ্ধশ্বাস গলির শেষ প্রান্তে জীর্ণ ধ্বংসপ্রায় একটা বাড়িতে তাকে এনে তুলেছিল শশাঙ্ক। সেখানে এজমালি একখানা উঠোন ঘিরে বৃত্তাকারে সারিবদ্ধ ঘর। সেই ঘরগুলির একটিতে শশাঙ্কর সংসার।
কলকাতার এই অংশের এই বাড়িটিতে শীত-গ্রীষ্ম কোনও ঋতুই স্পষ্ট করে বোঝা যায় না। সবসময় যেন ছায়া-ছায়া বিষণ্ণ বিকেল। সূর্য বিষুবরেখায় না গেলে এ বাড়িতে রোদ আসে না।
শোভনার বিয়ে হয়েছে ছবছর। ছবছর, অর্থাৎ একটা যুগের অর্ধেক। এর ভেতর বার দুই নদীয়ায় যাওয়া ছাড়া সময়ের এই বিরাট অংশটা আলো-বাতাস-বর্জিত রুদ্ধ গলিতেই কেটে গেল। এর মধ্যে সংসার বেড়েছে। দুটি ছেলে আর একটি মেয়ে হয়েছে।
চিঠিটা হাতের মুঠোতেই ছিল। হঠাৎ সমস্ত স্নায়ুতে কেমন এক অস্থিরতা অনুভব করল শোভনা। ছটা বছর পূর্ব কলকাতার এই বিবরে আবদ্ধ হয়ে আছে সে। অথচ-অথচ বিয়ের আগে আশ্চর্য যাযাবর একখানা মন ছিল তার। হিল্লি-দিল্লি, কাশী-কাঞ্চী—ভারতবর্ষের দুর দিগন্তগুলি দুর্বার আকর্ষণে তাকে টানতে থাকত। বিশেষ করে অরণ্যের প্রতি তার মোহ ছিল তীব্র। কিন্তু বেড়াতে নিয়ে যাবার মতো সঙ্গতি তার বাবার ছিল না। কাজেই মনসা-মথুরাং আর ভ্রমণকাহিনি পড়েই শব্দ মেটাতে হত। মনে মনে নিরুচ্চার একটা স্বপ্ন ছিল, তেমন কারো হাতে গিয়ে যদি পড়ে, বিয়ের পর সব সাধ মিটিয়ে নেবে। তেমন বিয়ে তো প্রায় স্থিরই হয়ে গিয়েছিল। সেটা হলে আজ মঞ্জুর বদলে সে-ই তো–কিন্তু–চিঠিটা হাতে নিয়ে আত্মবিস্মৃতের মতো কতক্ষণ বসে ছিল খেয়াল নেই। হঠাৎ ছোট ছেলেটা তক্তপোষের ওপর ঘুম ভেঙে কেঁদে উঠল। ঘোর কেটে গেল শোভনার। ইতিমধ্যে বিকেলটা কখন যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে। পূর্ব কলকাতার জন্মান্ধ গলির পটে সন্ধে নামতে শুরু করেছে।
.
সন্ধের পর শশাঙ্ক অফিস থেকে ফিরে এল। চা-খাবার খাওয়া হলে বিকেলের সেই চিঠিখানা তার হাতে দিল শোভনা।
শশাঙ্কর মুখটা চতুষ্কোণ, চোখ দুটি পিঙ্গল। দৃষ্টিতে কোনও ভাবের খেলাই খেলে না। তার দিকে তাকালে স্নায়ুতে ধাক্কা লাগে যেন। মনে হয় এই লোকটির অদৃশ্য গভীরে কোথায় যেন খানিকটা নিষ্ঠুরতা রয়েছে। যাই হোক নিরুৎসুক সুরে শশাঙ্ক বলল, কী ব্যাপার, কার চিঠি?
শোভনা বলল, পড়েই দেখো না।
পড়তে পড়তে শশাঙ্কের পিঙ্গল চোখে কীসের একটা ছায়া পড়ল যেন। কিন্তু তা মুহূর্তের জন্যই। দ্রুত পড়া শেষ করে এক সময় নিস্পৃহ ভাববর্জিত মুখে চিঠিটা শোভনার হাতে ফিরিয়ে দিল সে।
সাগ্রহে শোভনা বলল, পড়লে?
হুঁ। শশাঙ্কের গলা থেকে সংক্ষিপ্ত একটা শব্দ বেরিয়ে এল।
তা হলে মঞ্জুকে কী লিখব?
এত তাড়াহুড়োর কী আছে। বলতে বলতে শশাঙ্ক উঠল, যাই, আজকের বাজারটা সেরে রাখি। কাল একটু তাড়াতাড়ি বেরুতে হবে। সকালে সময় পাব না।
.
দণ্ডকারণ্য তার সমস্ত অস্তিত্বের মধ্যে তরঙ্গ তুলেছে। কাল শশাঙ্ক বলেছিল ব্যস্ততার কিছু নেই। কিন্তু পরের দিনই আবার সেই প্রশ্নটা তুলল শোভনা, কটা দিন ছুটি নিয়ে চলো না, মঞ্জুদের ওখানে বেড়িয়ে আসি?
ইয়ার এন্ডিং হয়ে আসছে। দুমাসের মধ্যে এখন অফিস থেকে ছুটি পাওয়া যাবে না।
বেশ তো, ইয়ার এন্ডিং-এর পরই না হয় যাওয়া যাবে?
দেখি।
দুটো মাস আশায় আশায় রইল শোভনা। ইতিমধ্যে আরো তিনখানা চিঠি এসেছে মঞ্জুর। এদিকে ইয়ার এন্ডিং-এর ঝামেলা চুকে গেছে শশাঙ্কের। অতএব নিষ্কণ্টক। শোভনা বলল, এবার ছুরি নাও।
প্রথমটা নিরুত্তর রইল শশাঙ্ক।
শোভনা বলতে লাগল, ছবছর ধরে ওরা চিঠি লিখছে-বোম্বাই-পাঞ্জাব ভাইজাগ–যেখানেই গেছে আমাদের যাবার জন্যে কত করে বলছে। কিন্তু কোথাও আমাদের যাওয়া হয়নি। ভেবে দেখো এবার না গেলে খুব খারাপ দেখাবে।
এবার মুখ খুলল শশাঙ্ক যাবে যাবে তোতা বলছ। কিন্তু খরচটার কথা ভেবেছ। হিসেব করে দেখ যাতায়াতের গাড়িভাড়া কত পড়ে। তাছাড়া ওখানে গেলে হাত টেনে চলা যাবে না। রীতিমতো খরচ করতে হবে। এবার যাওয়া বরং স্থগিত রাখো। পরে সুবিধামতো এক সময়
ছ বছর ধরে এই রকম এক-একটা অজুহাত খাড়া করে তার যাওয়া বন্ধ রেখেছে। শশাঙ্ক। প্রতিবারই শান্ত সহিষ্ণু মুখে সব মেনে নিয়েছে শোভনা। কিন্তু এবার যেন কী হয়ে গেল তার। ক্ষিপ্তের মতো বলে উঠল, কোথাও একটু বেরুতে পারি না। দম আমার বন্ধ হয়ে আসছে। ছবছর এ নরকে আমাকে আটকে রেখেছ। কিন্তু
কথা শেষ হল না তার। শশাঙ্কের ভাববর্জিত পিঙ্গল চোখ দুটা দপ করে উঠল। শোভনার মুখের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে সে দাঁতে দাঁত চাপল, নরক! আমি কিছুই লুকোইনি। তোমার বাবা এই নরক দেখেও তোমাকে আমার হাতে দিয়েছে। তাকে বললেই পারত একটা স্বর্গ ফুটিয়ে দিত।
শোভনা মরিয়ার মতো বলতে লাগল, তোমার কোনও কথা শুনতে চাই না। তুমি না যাও আমাকে রেহাই দাও। এখানে আমি আর পারছি না। এবার আমি মঞ্জুদের কাছে যাবই।
তা তো যাবেই। নইলে অনিমেষের সঙ্গে রাসলীলা চালাবে কেমন করে! ব্যঙ্গে ঠোঁট দুটো বেঁকে গেল শশাঙ্কের।
কী, কী বললে!
যা বলেছি তা তো শুনেছই।
মুখ সামলে কথা বলবে।
একমুহূর্ত থমকে রইল শশাঙ্ক। পরক্ষণেই গর্জে উঠল, কেন তোর ভয়ে! সত্যি কথাটা বলতেই গায়ে বুঝি ফোঁসকা পড়ল। মনে করেছিস আমি কিছুই জানি না। তোর সঙ্গেই তো বিয়ে হবার কথা ছিল অনিমেষের। বিয়ের আগে।
.
শুনতে শুনতে শশাভনার মনে হল, একেবারে অন্ধ আর বধির হয়ে গেছে। ব্যাপারটা নিতান্তই তুচ্ছ। মঞ্জুর স্বামী অনিমেষ ছিল নদীয়া জেলায় তাদের সেই মফস্বল শহরেরই ছেলে। শোভনাদের বাড়িতে খুবই যাতায়াত ছিল। প্রচুর হাসতে পারত সে। মজা করতে, গল্প জমাতে বিশারদ ছিল। গানের গলাখানি চমৎকার। ভালো ফুটবল খেলতে পারত। তার ওপর ছিল প্রিয়দর্শন, সুপুরুষ। মফস্বল শহরের ছোট্ট পরিধির মধ্যে থাকত, বাড়িতে যাওয়া-আসা ছিল। স্বাভাবিক নিয়মেই শোভনার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। মনেও রঙ লেগেছে। সেই রঙ গাঢ় হয়েছিল যখন তার সঙ্গে বিয়ের কথা উঠল। কথাটা অনেকদূর এগিয়েছিল। কিন্তু পাকাপাকি হবার পর্যায়ে এসে ভেঙে যায়। কেননা অনিমেষের বাবার দাবি পূরণ করা শোভনার বাবার পক্ষে অসাধ্য ছিল। এদিকে ছোটকাকা এমন একটি শিকার হাতছাড়া করলেন না। কন্ট্রাক্টরির দৌলতে তার প্রচুর টাকা। অতএব অনিমেষের সঙ্গে মঞ্জুর বিয়ে হয়ে গেল। আর শোভনার বাবা হন্যের মতো খুঁজে খুঁজে শশাঙ্ক নামে মার্চেন্ট অফিসের এক কেরানিকে আবিষ্কার করলেন। যাই হোক, বিয়ের পর চেতনে বা অবচেতনে প্রাক-বিবাহ সেই রঙের চিহ্নমাত্র ছিল না। নিজের দীন সংসার, ছেলেমেয়ে এবং শশাঙ্ককে নিয়েই পরিতৃপ্ত হতে চেয়েছিল শোভনা।
এদিকে শশাঙ্ক থামেনি। সামনে গজরাচ্ছে। কেন যে মঞ্জুদের ওখানে যাবার জন্য তোর প্রাণ আঁকুপাঁকু–সব জানি। কিন্তু তা হবে না। ছবছর যেতে দিইনি। কোনওদিন দেবও না। ভেবেছিস
শশাঙ্কর পিঙ্গল চোখ দুটি জ্বলছে। গলার কাছে শিরাগুলো দড়ির মতো পাকিয়ে পাকিয়ে উঠেছে। সন্দিগ্ধ চতুষ্কোণ মুখটা কী নিষ্ঠুরই না হয়ে উঠেছে। সব মিলিয়ে শশাঙ্ক যেন মানুষ না, একটা আদিম হিংস্র পশু।
শোভনার মনে হল, কোথাও যেতে হয় না। বিশ শতকের এই সভ্য সুসজ্জিত কলকাতাও মাঝে মাঝে অরণ্য হয়ে উঠতে পারে। সেই রাত্রেই মঞ্জুকে চিঠি লিখল শোভনা, মঞ্জু, বাঘ-ভালুক দেখার জন্যে আমাকে যেতে লিখেছিস। নতুন করে অতদূরে কী আর দেখতে যাব বল। দণ্ডকারণ্যের জন্য এতটুকু আকর্ষণ বোধ করছি না। এই কলকাতা শহরেই এক অরণ্যের মধ্যে বাস করছি ভাই।
গল্প নয় ১
প্রায় ষাট বছর হয়ে গেল, আমি তখন বম্বেতে। বম্বে সেই সময় মুম্বই হয়নি। থাকতাম জুহুতে। জুহু বিচের ভুবন জোড়া নাম।
আমার আস্তানা ছিল আদ্যিকালের একটা পার্শি কলোনিতে। টানা ব্যারাকের মতো লম্বা লম্বা কটা বিল্ডিং। সেগুলোর মাথায় সিমেন্ট দিয়ে সাঁটা টালির ছাদ। এই কলোনিরই দুটো কামরা ভাড়া নিয়ে থাকতাম।
জুহু তখন আজকের মতো এমন জমকালো ছিল না। এখন চারিদিকে সারি সারি হাই-রাইজের ছড়াছড়ি, কত যে পাঁচ-তারা সাত-তারা হোটেল। সেই সময় এলাকাটা ফাঁকা ফাঁকা। যেদিকেই তাকানো যাক অজস্র নারকেল গাছ। তবে গ্ল্যামার একটা ছিলই। হিন্দি ফিল্মি দুনিয়ার নায়ক-নায়িকাদের চোখ ধাঁধানো বাংলো ছিল বেশ কয়েকটা। একটা মাত্র পাঁচতারা হোটেল ছিল–সান অ্যান্ড স্যান্ড।
আমাদের পার্শি কলোনির পাশ দিয়েই চলে গেছে ঝা চকচকে জুহু-তারা রোড, রাস্তাটার গা ঘেঁষে নারকেল গাছের সারি। তারপরেই বিচ–সোনালি বালির সৈকত। দক্ষিণ দিক থেকে এসে উত্তরে বহুদূর চলে গেছে। বিচের পরেই আদিগন্ত আরব সাগর। আরব সাগর বে আব বেঙ্গলের মতো খামখেয়ালি, বদমেজাজি, খ্যাপাটে ধরনের নয়। বর্ষাকালটা বাদ দিলে সারাক্ষণ শান্ত।
বম্বে দেশের পশ্চিমপ্রান্তে। তাই কলকাতায় সূর্যোদয় যখন হয় পৌনে ছটা কি ছটায়, বম্বেতে সূর্য দর্শন দেন তার এক ঘন্টা পরে, ঘড়িতে সাতটা বাজিয়ে।
ভোর হতে না হতেই আমি বিচে চলে যাই। তখনও রোদের দেখা নেই, চারিদিক ঝাপসা ঝাপসা। আমি শুধু একাই নই, সমুদ্রের টাটকা বাতাস ফুসফুসে টানার জন্য কম করে শপাঁচেক নানা বয়সের মানুষ ততক্ষণে হাজির হয়ে গেছে। বেলা যত বাড়ে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে ভিড়। প্রাতভ্রমণকারীর দঙ্গল কখনও উত্তর থেকে দক্ষিণে, কখনও দক্ষিণ থেকে উত্তরে লম্বা লম্বা কদমে হাঁটতে শুরু করেছে। আমিও তো একই ঝুঁকের কই। একটা দলের সঙ্গে ভিড়ে যাই। তারপর হাত-পা ছুঁড়ে মার্চ করতে করতে জুহুর সোনালি সৈকত দাপিয়ে বেড়াই।
হাঁটাহাঁটি কিন্তু সবাই করে না। অনেকেই যোগাসনে বসে যায়। কেউ কেউ আবার মাথা নীচে রেখে পা দুটো সোজা ওপরে তুলে জ্যামিতির পিরপেন্ডিকুলারের মতো নট নড়নচনড়; ঘন্টাখানেক একদম স্থির হয়ে থাকে।
বিচের একধারে ঘোড়া আর উটওয়ালাদের ঘাঁটি। তাদের কাছ থেকে ঘোড়া কি উট ভাড়া দিয়ে অনেকে হই হই করে হর্স রাইড কি ক্যালে রাইডে বেরিয়ে পড়ে।
প্রাতভ্রমণকারীরা ছাড়া জুহু সৈকতে যাদের চোখে পড়ে তারা হল বারো- চোদ্দো বছরের কত যে বিচ-বয়। শীত-গ্রীষ্ম বারো মাস, দিন রাত তারা এখানেই থাকে। কারা তাদের বাপ-মা কেউ জানে না। প্রাতভ্রমণকারীদের ফরমাশ মতো এটা সেটা করে দিয়ে বকশিশটা ভালোই পায়। এটাই তাদের একমাত্র রোজগার।
বিচের আরেক দিকে সারি সারি স্টল। কোনওটা নিম্বুচায়ের (লেবু চা), কোনওটা আইসক্রিমের, কোনওটা ভেলপুরি, বাটাটা পুরির, কোনওটা ইডলি দোসার, কোনওটা নারিয়েল পানির।
দেখতে দেখতে রোদ উঠে যায়, বেলা চড়তে থাকে।
ঘণ্টা দেড়েক ঘাম ঝরিয়ে হাত-পা ছোঁড়া, ফুসফুসে তরতাজা সামুদ্রিক বাতাস টানা, তারপর স্বাস্থ্যান্বেষীরা বেশিরভাগই চলে যায় স্টলগুলোর দিকে। অন্য অনেকের সঙ্গে আমি যাই নিষু চায় অর্থাৎ লেবু-চায়ের স্টলে। বাকি সবাই অন্য স্টলগুলোতে। চার কুইন্ট্যাল ওজনের কয়েক জন সিন্ধি আর গুজরাতি মহিলাকে রোজই দেখি দৌড় ঝাপের পর আইসক্রিমের স্টলে ভিড় জমান। বিচে এক দেড় ঘণ্টা যে পরিমাণ মেদ ঝরান আইসক্রিম পার্লার থেকে তার পাঁচ-সাত গুণ ক্যালোরি সংগ্রহ করে বাড়ি ফেরেন।
প্রাতভ্রমণে এসে অনেকের সঙ্গেই আলাপ পরিচয় হয়েছে। বন্ধুত্বও আমাদের সেই দলটা চায়ের স্টলে এসে লেবু-চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কিছুক্ষণ আড্ডা-টাজ্ঞা দিয়ে যে যার আস্তানায় ফিরে যাই।
এইভাবেই চলছিল।
একদিন সমুদ্রসৈকতে হেঁটে এসে চায়ের স্টলে সবে আমরা জড়ো হয়েছি, পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছরের একটি লোক হই হই করতে করতে এসে হাজির, আ গিয়া রে, ম্যায় আ গিয়া
আমি না চিনলেও আমার সঙ্গীরা তাকে ভালোই চেনে। তারা শোরগোল বাধিয়ে দিল।–কোথায় ছিলে এতদিন?
লোকটা বলল, ইন্ডিয়াটা তো ভালো করে দেখা হয়নি। তাই একটু ঘুরে-টুরে এলাম– বলেই চায়ের স্টলওয়ালার দিকে তাকাল, সবাইকে চায় আউর বিস্কুট, কেক-টেক দাও! কারও কাছ থেকে পাইসা নেবে না। বিল আমি মেটাব।
স্টলের অল্পবয়সি কাজের ছেলেরা পুরু কাগজের কাপ প্লেটে চা, কেক বিস্কুট সাজিয়ে সবার হাতে হাতে দিতে লাগল।
একটা অচেনা লোক যাকে আগে কখনও দেখিনি, সে আমাকে চা-টা খাওয়াতে চাইছে, ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল। অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ তার নজর এসে পড়ল আমার দিকে, তোমার সঙ্গে আগে তো মোলাকাত হয়নি। মনে হচ্ছে নয়া আমদানি। কোত্থেকে এসেছ, কী নাম?
নাম ধাম জানিয়ে দিলাম।
লোকটা বলল, বংগালি। বহুৎ আচ্ছা। আমার নাম যোহন–যোহন ডিসুজা। পি হো-পি
নাম শুনেই বুঝলাম লোকটা গোয়ান ক্রিশ্চান। বম্বেতে এদের বলে পিদ্রু।
যোহন তাড়া দিতে লাগল, চায় লে লো; মুঝে আপকা দোস্ত সমঝো
আমার ভ্রমণসঙ্গীরাও তার সঙ্গে গলা মেলায়, নিয়ে নাও, নিয়ে নাও। না নিলে যোহন ছাড়বে না।
অগত্যা নিতেই হল।
ওদিকে বিচ-বয়রা অর্থাৎ যে ছেলেগুলো জুহুর সমুদ্র সৈকতে বারো মাস, দিন রাত পড়ে থাকে, যোহনকে দেখে চারিদিক থেকে উধ্বশ্বাসে দৌড়তে দৌড়তে এসে তাকে ছেকে ধরল, তারপর চেঁচামেচি জুড়ে দিল, চাচা, কতদিন তোমাকে দেখিনি, ভাবলাম আমাদের ছেড়ে তুমি চলেই গেছ। আর কখনও ফিরে আসবে না।
এর ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলোতে যোহন বলল, আরে উল্লুরা, তোদের ছেড়ে বরাবরের জন্যে চলে যাব, ভাবলি কী করে? এই তো চলে এসেছি। পকেট থেকে এক তাড়া নোট বের করে ছেলেগুলোকে দিল, এই নে, ভেলপুরি, বাটাটা পুরি, যা দিল চায়, খেয়ে নে। কিছুক্ষণ পর তোদর নিয়ে সেই জায়গাটায় যাব–
এতগুলো কড়কড়ে নোট পেয়ে ছেলেগুলো আহ্লাদে আটখানার জায়গায় আঠারো খানা। তারা লাফাতে লাফাতে খাবারের স্টলগুলোর দিকে চলে গেল।
যোহন আবার আমাদের সঙ্গে আড্ডায় জমে গেল। একজন বলল, তুমি ছিলে না। হাসি নেই, মাজাক নেই। মনে হত জুহু বিচের জানটাই চলে গেছে।
ভুরু নাচাতে নাচাতে যোহন বলল, এই তো জান ফিরে এসেছে।
আরও কিছুক্ষণ গল্প-টল্প করে বিচ-বয়গুলোকে ডেকে নিয়ে উত্তর দিকে চলে গেল যোহন।
.
এরপর রোজই সকালে বিচে আসতে লাগল যোহন। মজার মজার কথায় সবাইকে মাতিয়ে দিয়ে ঘণ্টাখানেক পর বিচ-বয়গুলোকে সঙ্গে করে উত্তর দিকে চলে যায়। সেখানে ওরা কী করে, প্রথম প্রথম বুঝতে পারিনি।
একদিন যোহন মস্ত এক ঝুড়ি আপেল নিয়ে এল। কম করে শদেড়েক তো হবেই। সবাইকে একটা একটা করে দিতে দিতে বলল, সাচ্চা কাশ্মীরি আপেল। বহুৎ বড়িয়া খাও খাও
আমিও একটা পেয়ে গেলাম। না নিয়ে উপায়ও নেই, যোহন কিছুতেই ছাড়বে না। কিন্তু মনে একটা ধন্দ থেকে গেল। এত আপেল সে কোথায় পেল? কিনে এনেছে কি? এক ঝুড়ি আপেলের দাম তো কম নয়। গাঁটের পয়সা খরচ করে লোককে খাওয়ানোর কারণ কী হতে পারে? মাথামুন্ডু কিছু বুঝতে পারছি না।
আরেকদিন সে নিয়ে এল এক পেটি নতুন টি-শার্ট। তাও কমসে কম শখানেক হবে। সেই একই কায়দায় একটা একটা করে সবাইকে বিলিয়ে দিল। আমাকে অবশ্য গছাতে পারেনি।
এইভাবেই মাঝে মাঝে দামি দামি নানা জিনিস এনে হাজির করে বিলিয়ে দিতে লাগল সে। জুহু বিচের নতুন বন্ধুদের জিগ্যেস করে জানা গেল, এমনটাই নাকি যোহন অনেকদিন ধরে করে আসছে।
অন্য একদিন সে একেবারে তাক লাগিয়ে দিল। একটা অ্যাটাচি কেস বোঝাই কড়কড়ে একশো টাকার অগুনতি বান্ডিল এনো অকাতরে সবাইকে দুটো চারটে করে দিল।
টি-শার্টের মতোই আমাকে টাকা নেওয়াতে পারেনি যোহন। যত তাকে দেখছি ততই অবাক হচ্ছি। লোকটার বাড়িতে কি টাকার গাছ গজিয়েছে? যখন ইচ্ছা হল পেড়ে এনে দেদার বিলিয়ে চলেছে।
অবাক যত হচ্ছিলাম, তার চেয়ে ঢের বেশি হচ্ছিল কৌতূহল। একদিন যোহনকে একা পেয়ে বললাম, তোমার সঙ্গে একটু কথা আছে।
হাঁ হাঁ, জরুর। বোল বোল
তুমি যে এত টাকা ওড়াচ্ছ, কোথায় এসব পাও? কী কর?
চোখ সরু করে নিজের বুকে আঙুল ঠেকিয়ে মিটিমিটি হাসতে হাসতে যোহন বলল, আমি ফুল-টাইম ফোর টোয়েন্টি
বলে কী লোকটা! আমি চমকে উঠি। বললাম, মানে
মানে আবার কী। এর টুপি ওর মাথায়, ওর টুপি এর মাথায় চাপিয়ে কাম হাসিল করে নিই।
সবকিছু গুলিয়ে যায়। আমি আকাশ পাতাল হাঁ করে তাকিয়ে থাকি।
মিটি মিটি মিচকে হাসিটি তার মুখে লেগেই আছে। বলল, বম্বেতে কত লোক আছে? এখানকার পপুলেশন কত?
আমার ভেতর তালগোল পাকিয়ে যায়। এই পিটা আমাকে সেনসাস ডিপার্টমেন্টের বড় কর্তা ভেবেছে নাকি? সেইসময় বম্বেতে এখনকার মতো জনবিস্ফোরণ ঘটেনি। আন্দাজে বললাম, ষাট লাখের মতো হবে।
বহুৎ আচ্ছা। এই ষাট লাখের ভেতর চাল্লিশ লাখ গাধা নেই?
মানে?
মানে আমার চেয়ে তাদের মগজের ধার কম। এই গাধূধেগুলোকে পথে বসিয়ে টাকা পয়সা আর মাল খালাস করি। সমঝা?
ব্যাপারটা এতক্ষণে বোধগম্য হল। বললাম, তুমি এত এত জিনিস আর টাকা নিয়ে এসে সবাইকে বিলিয়ে দাও। নিজের জন্যে কিছু রাখো না কেন?
দুহাতের আঙুলগুলো নাড়াতে নাড়াতে যোহন বলল, নো সেভিংস বিজনেস স্যার। আজ এক গাধধেকে টুপি পরিয়ে যা আমদানি হবে, আজই তা খতম করব। কাল নয়া গাধূধে পাকড়াব। এইভাবে চালিয়ে যাচ্ছি।
যোহনের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর একটা ব্যাপার লক্ষ করেছি মর্নিং ওয়াকের পর টি স্টলে এসে বেশ কিছুক্ষণ চুটিয়ে মজাদার কাণ্ড-টান্ড করে ভিড় হালকা হলে বিচের ছেলেদের নিয়ে উত্তর দিকে চলে যায়। আপেল, শার্ট বা অন্য কোনও জিনিস আনলেও তার কাঁধে থাকে একটা কাপড়ের ভারী ব্যাগ। সেটা কখনও সে সবার সামনে খোলে না। ব্যাগটা কোন জাদুগা ঝাপ্পি, কে জানে।
একদিন মর্নিং ওয়াকের পর আমার সঙ্গীরা প্রায় সবাই চলে গেছে। কারণ সমুদ্রসৈকতে পড়ে থাকলেই তো চলবে না। সবারই চাকরি-বাকরি বা ব্যাবসা- ট্যাবসা আছে। বিচ থেকে ফিরে কাজের জায়গায় তত তাদের দৌড়তে হবে।
আমিও জুহু থেকে কুড়ি-বাইশ মাইল দূরে ফোর্ট এরিয়ায় নামকরা একটা অ্যাড কোম্পানিতে ছোটখাটো কাজ করি। ফোর্ট এরিয়া হল কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ার বা বিবাদিবাগের মতো বিশাল অফিসপাড়া। সেদিন ঠিক করলাম অফিসে যাব না। বিচের ছেলেদের নিয়ে অনেকটা দূরে চলে গেছে। আমি তাদের পিছু নিলাম।
চায়ের স্টল, ভেলপুরি-টুরির স্টলুগলো থেকে প্রায় আধ মাইল দূরে সান অ্যান্ড স্যান্ড হোটেলের পেছন দিকটায় অজস্র নারকেল গাছের জটলা। চোখে পড়ল ছেলেগুলোকে নিয়ে যোহন তার ভেতর ঢুকে বসে পড়ল, নারকেল গাছগুলোর গা ঘেঁষে একটা পুরোনো জং ধরা টিনের চালের ঘর।
ছেলেরা ঘর থেকে বই-টই নিয়ে যোহনের সামনে বসল। যোহনের কাঁধে যে ভারী ব্যাগটা ছিল যেটা নামিয়ে রেখেছিল। ব্যাগ থেকে প্রচুর খাতা পেন্সিল বের করে ছেলেগুলোকে দিতে দিতে বলল, নে, এবার শুরু কর–
আমি খানিক দূরে একটা ডালপালাওয়ালা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে ওদের লক্ষ করছি।
খুব মগ্ন হয়ে পড়াচ্ছে যোহন। পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝে বলছে, বিচে যারা বেড়াতে আসে তাদের খিদমত করে দুচারটে টাকা বকশিস পেয়ে তামাম জিন্দেগি কি কেটে যাবে। বোম্বাইতে হাজারো নয়া কল-কারখানা বসছে। পেটের ভেতর থোড়েসে এডুকেশন ঘুষিয়ে নে। কোথাও না কোথাও নৌকরি জুটে যাবে। বুঝলি কিছু?
আমি অবাক। এই যোহন আমার পুরোপুরি অচেনা। সে কি ফেরেববাজ, প্রতারক, নাকি সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী, সমাজসেবী না দার্শনিক?
একসময় প্রায় সারা ভারতবর্ষ আমি ঘুরে বেড়িয়েছি কিন্তু যোহনের মতো পরমাশ্চর্য মানুষ আর একটিও দেখিনি।
গল্প নয় ২
শুরুতেই কবুল করি এটি বানানো গল্প নয়; আমার জীবনের আশ্চর্য একটি ঘটনা। ঘটনাটি ঠিক কেমন, কোথায় কীভাবে ঘটেছিল তা বলার আগে ছোটখাটো একটি ভূমিকা করে নেওয়া যাক। নইলে পড়তে পড়তে খাপছাড়া মনে হবে।
সাতান্ন কি আটান্ন বছর আগে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে আমি আন্দামানে যাই। যে জাহাজটিতে গিয়েছিলাম তার নাম এস এস মহারাজা। এস এস হল স্টিমশিপ। তখনকার দিনে বেশির ভাগ জাহাজই কয়লা জ্বালিয়ে বাষ্প তৈরি করে তার জোরে চালানো হত।
কিশোর ভারতী পত্রিকার কিশোর পাঠকরা জানে আন্দামান একটি মাত্র দ্বীপ নয়। আড়াই শোরও বেশি ছোটবড় দ্বীপ মিলিয়ে বিশাল এই আর্কিপেলাগো বা দ্বীপপুঞ্জ। অজস্র এই দ্বীপগুলির মধ্যে সবচেয়ে বড় হল তিনটি দ্বীপ–দক্ষিণ আন্দামান, মধ্য আন্দামান আর উত্তর আন্দামান। এগুলোর প্রতিটি চল্লিশ বেয়াল্লিশ মাইল লম্বা, প্রস্থ কম করে তিরিশ বত্রিশ মাইল। আন্দামানের সমস্ত দ্বীপ জুড়ে শুধু পাহাড় আর গভীর জঙ্গল। তবে পাহাড়গুলো খুব উঁচু নয়; বড় জোর সাড়ে তিন কি চার হাজার ফিট উঁচু।
এই পত্রিকার পাঠকরা আরও জানে উনিশশো সাতচল্লিশের পনেরোই অগস্ট ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়েছিল আর সেই একই তারিখে অখণ্ড ভারত টুকরো হয়ে আলাদা আলাদা দুটো দেশের সৃষ্টি হল–পাকিস্তান এবং বাকি অংশটার নাম ভারতই থেকে গেল। ভারতের পশ্চিম দিকে পাকিস্তানের একটা অংশ পড়ল; তার নাম পশ্চিম পাকিস্তান আর পুব দিকে পশ্চিমবঙ্গের সীমানা ঘেঁষে পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানে যার নাম বাংলাদেশ)। পূর্ব পাকিস্তানে সেই সময় এমনই ভয়ংকর দমবন্ধ-করা পরিস্থিতি যে বাঙালি হিন্দুদের পক্ষে সেখানে থাকা আর সম্ভব ছিল না। লক্ষ লক্ষ মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে সীমান্তের এপারে পশ্চিমবাংলায় চলে এল। তাদের একটা তকমা দেওয়া হল উদ্বাস্তু। নরম করে বলা হত শরণার্থী।
পশ্চিমবঙ্গ তো খুব বড় রাজ্য নয়। এখানে অসংখ্য উদ্বাস্তু কোথায় থাকবে? কী হবে তাদের ভবিষ্যৎ? তাই সরকারের উদ্যোগে আন্দামানে বনজঙ্গল নির্মূল করে উদ্বাস্তুদের চাষের জমি-টমি দিয়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হল।
এই যে আমি হুট করে আন্দামানে চলে গেলাম তার একটি উদ্দেশ্য হল উদ্বাস্তুদের সঙ্গে থেকে স্বচক্ষে পুনর্বাসনের কাজ দেখা।
কিশোর পাঠকরা নিশ্চয়ই এতক্ষণে অধৈর্য হয়ে উঠেছে। আশ্চর্য, ঘটনার লক্ষণই তো দেখা যাচ্ছে না। তাদের আরেকটু ধৈর্য ধরতে বলি। আন্দামানে যাওয়ার আমার আরও একটা উদ্দেশ্য ছিল।
সারা পৃথিবী দক্ষিণ আন্দামানের পোর্টব্লেয়ার শহরের কুখ্যাত সেলুলার জেলের কথা জানে। সেই ইংরেজ আমলে উনিশ শো পঁয়ত্রিশ সাল অবধি ব্রহ্মদেশ বা বার্মা (এখন মায়ানমার) ছিল অখণ্ড ভারতের একটি অংশ। বার্মা থেকে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ পর্যন্ত এই বিশাল দেশের ভয়ংকর খুনিদের কালাপানির সাজা দিয়ে সেলুলার জেলে নিয়ে যাওয়া হত। এদের প্রায় সবাই যাবজ্জীবন কারাদন্ডের আসামী। তখনকার আইনকানুন অনুযায়ী কালাপানিতে যাবজ্জীবন মানে আমৃত্যু আসামীদের আন্দামানেই কাটাতে হত। এই কয়েদিদের মধ্যে বাঙালি, বিহারি, ইউপিওয়ালা, শিখ, মারাঠি, পাঠান, জাঠ, তামিল, বর্মী, কারেন, এমনি সব রাজ্যের মানুষ ছিল।
অনেকেই জানেন না, সেলুলার জেলের মতো আরও একটা মস্ত জেনানা ফাটক ছিল পোর্টব্লেয়ারে। তার নাম সাউথ পয়েন্ট জেল। এই কয়েদখানা পুরোপুরি মেয়েদের জন্য। সেই আমলে বর্মা মুলুক থেকে সুদূর নর্থ ওয়েস্টার্ন প্রভিন্স পর্যন্ত নানা প্রদেশে এমন অনেক মহীয়সী মহিলা ছিল যারা দায়ের কোপে দু-তিনজনের ধড় থেকে মুন্ডু নামিয়ে দ্বীপান্তরী সাজা নিয়ে সাউথ পয়েন্ট জেলে এসে উঠত। পুরুষ কয়েদিদের মতো এই মেয়েদেরও দেশে ফিরে যাবার উপায় ছিল না।
ইংরেজ সরকার এক দিক থেকে বেশ সদাশয়ই ছিল বলা যায়। কোনও পুরুষ কয়েদি যদি আন্দামানে এসে দুবছর আর মেয়ে কয়েদি এক বছর শান্তশিষ্ট হয়ে থাকত, তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করা হত। জাতিগোত্র ঠিকুজি কুলুজি মিলিয়ে বিয়ে নয়। একজন বৌদ্ধধর্মাবলম্বী বর্মী বা কারেনের সঙ্গে বাঙালি হিন্দুর, জাঠের সঙ্গে তামিলের, পাঠানের সঙ্গে শিখের–এইভাবে বিয়ে হত। হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান বা বৌদ্ধ, কোনওরকম বাছবিচার ছিল না।
বিয়ের পর এই কয়েদিদের আর জেলখানায় থাকতে হত না। সরকার থেকে পোর্টব্লেয়ার এবং আশপাশের নানা দ্বীপে তাদের থাকার জন্য কাঠের ছোট ছোট অনেক বাড়ি আর নানা ধরনের কাজকর্মের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। এই সব বাড়ি এবং তার বাসিন্দাদের নিয়েই গড়ে উঠেছিল অগুনতি পেনাল কলোনি।
আমার দুনম্বর উদ্দেশ্য ছিল, এই পেনাল কলোনিগুলোতে দু-তিন মাস কাটিয়ে পুরোনো কয়েদিরা দেশের স্বাধীনতার পর কীভাবে দিন কাটাচ্ছে তা জানা।
ভূমিকা এখানেই শেষ। এবার ধীরে ধীরে সেই আশ্চর্য ঘটনার কথায় আসা যাক।
স্টিমশিপ মহারাজার কথা আগেই জানিয়েছি। দশ বারো হাজার টনের সেই জল্যানটিতে টানা তিন দিন তিন রাত কাটিয়ে চতুর্থ দিন সকালে পোর্টব্লেয়ারের চ্যাথাম জেটিতে গিয়ে নামলাম।
আমার বন্ধু বিশ্বজিৎ রাহা (নাম পরিবর্তিত) ছিলেন আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের ফার্স্ট ক্লাস ম্যাজিস্ট্রেট এবং আন্দামানের উদ্বাস্তু পুনর্বাসন বিভাগের একজন জাঁদরেল অফিসার। তখনও পর্যন্ত অবিবাহিত এই মানুষটির ধ্যানজ্ঞান ছিল বাঙালি উদ্বাস্তুদের জন্য চাযের জমি, বাড়িঘর এবং রোজগারের নিখুঁত বন্দোবস্ত করে বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জকে দ্বিতীয় বঙ্গভূমি গড়ে তোলা। এজন্য বেছে বেছে কয়েকটি টিম তৈরি করেছিলেন। এই অফিসারদের প্রচণ্ড উদ্যম, প্রচুর কর্মক্ষমতা। যেখানে যেখানে উদ্বাস্তু কলোনির কাজ চলছে সেই সব জায়গায় ঘুরে ঘুরে তাঁরা কাজকর্ম তদারক করতেন। এসব খবর আমি কলকাতায় বসেই শুনেছিলাম।
বিশ্বজিৎ একটা জিপ হকিয়ে আমাকে নিয়ে যাবার জন্য চ্যাথাম জেটিতে এসেছিলেন। সঙ্গে তাঁর আর্দালি।
জাহাজ থেকে নেমে আসতেই অন্য প্যাসেঞ্জারদের সঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলাম। বিশ্বজিৎ হাসিমুখে এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে বললেন, ওয়েলকাম টু আন্দামান আইল্যান্ডস। চলুন—
আমি হাসলাম।
জেটির বাইরে কার পার্কিং এরিয়া। বিশ্বজিৎ আমাকে নিয়ে একটা নীল অ্যামবাসাডরের ফ্রন্ট সিটে উঠলেন। আমার স্যুটকেস-টুটকেস নিয়ে ব্যাকসিটে উঠল তাঁর আর্দালি হরিপদ।
শো ফার ছিল না। বিশ্বজিৎ নিজে ড্রাইভ করে গাড়িটাকে চ্যাথাম পোর্টের বাইরে নিয়ে এলেন। তারপর সোজা এগিয়ে চললেন।
পোর্টব্লেয়ার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পাহাড়ি শহর। কাঠের বাড়িঘর বেশি। দালানকোঠা কম। ভিড়টিড় নেই বললেই হয়।
মাইল তিনেক দৌড়ের পর অ্যামবাসাডর সেলুলার জেলের কাছাকাছি সমুদ্রের ধারে একটা মস্ত কাঠের বাংলোর সামনে এসে থামল। বিশ্বজিৎ বললেন, এই আমার আস্তানা। নেমে আসুন।
বাংলোয় ঢুকে একটা সাজানো গোছানো ড্রইংরুমে আমাকে বসিয়ে বিশ্বজিৎ মুখোমুখি বসলেন। বেশ কয়েকজন কাজের লোককে দেখা গেল। তাদের একজনকে ডেকে বললেন, আমাদের চা-টা দে
শুধু চা-ই নয়, ঘরে তৈরি প্রচুর খাবার দাবারও এল। খেতে খেতে নানারকম কথাবার্তা চলল। বিশেষ করে কলকাতায় উদ্বাস্তুরা কী অবস্থায় আছে, পূর্ব পাকিস্তান থেকে আরও কত মানুষ আসতে পারে, ইত্যাদি ইত্যাদি। একসময় বিশ্বজিৎ বললেন, বে অফ বেঙ্গল খুবই বদমেজাজি সমুদ্র। আসার সময় নিশ্চয়ই রোলিং হয়েছে?
তা হয়েছে। আমি মাথা কাত করি।
হালকা সুরে বিশ্বজিৎ বললেন, তার মানে হাড়গোড় সব আলগা হয়ে গেছে, কী বলেন?
উত্তর না দিয়ে আমি একটু হাসি।
বিশ্বজিৎ বললেন, এক উইক ভালো করে রেস্ট নিয়ে গায়ের ব্যথা কমান। তারপর যে জন্যে আসা
তাঁকে শেষ করতে দিলাম না—-না না না, আজ আর কাল, এই দুটো দিন বিশ্রাম করলেই চাঙ্গা হয়ে যাব।
ঠিক আছে। আগে পেনাল কলোনিতে যাবেন, না উদ্বাস্তু কলোনিতে?
উদ্বাস্তু কলোনি।
একটু ভেবে বিশ্বজিৎ বললেন, দেখুন, এই দক্ষিণ আন্দামানে অনেক জায়গায় পুনর্বাসনের কাজ শেষ হয়ে এসেছে। জেফ্রি পয়েন্টে সবে শুরু হয়েছে। হাজারখানেক উদ্বাস্তুকে সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছি। কীভাবে কলোনি বসানোর কাজ হয়, শুরু থেকে দেখলে আপনার পরিষ্কার একটা আইডিয়া হয়ে যাবে। আমার মনে হয় যে কারণে আপনার আসা, প্রথমে ওখানে যাওয়াটাই ঠিক হবে।
জেফ্রি পয়েন্টটা কোথায়?
পোর্ট ব্লেয়ার থেকে পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ মাইল সাউথ-ওয়েস্টে। একেবারে বে অফ বেঙ্গলের ধারে। একদিকে সমুদ্র, আর তিন দিকে পাহাড় আর ডিপ ফরেস্ট। এই ফরেস্টে কারা থাকে জানেন?
কারা?
জারোয়াদের নাম শুনেছেন?
শুনেছি। ওরা তো ভীষণ হিংস্র নিগ্রোয়েড একটা টাইপ।
ঠিক শুনেছেন। সভ্য জগৎ থেকে কেউ ওদের ধারে-কাছে যাক, সেটা ওরা একেবারেই চায় না। এর মধ্যে তির-ধনুক দিয়ে দু-তিনবার উদ্বাস্তুদের ওপর হামলা করেছে। ভেবে দেখুন, যাবেন? রিস্ক কিন্তু আছে।
অ্যাডভেঞ্চারের নামে চিরকালই আমার শিরায় শিরায় রক্ত নেচে ওঠে! আন্দামানে আসার বছর দুই আগে আমি উত্তর-পূর্ব ভারতের নাগা হিলসে গিয়েছিলাম। সেখানে জীবনের ঝুঁকি কম ছিল না। চার পাঁচ বার অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরে এসেছি। বললাম, রিস্ক নিতে ভয় পাই না। লাইফে অনেকবার বিপদের মুখে পড়েও দিব্যি বেঁচে বর্তে আছি। এ নিয়ে ভাববেন না।
বিশ্বজিৎ রাহা খুব সম্ভব খুশিই হলেন।–ঠিক আছে। তবে ওখানে গিয়ে সাবধানে থাকবেন।
একটু চুপচাপ।
তারপর বিশ্বজিৎ বললেন, দু-দিন পর আমার সহকর্মী সুকুমার পাল জেফ্রি পয়েন্টে যাবেন। উনি উদ্বাস্তু পুনর্বাসন ডিপার্টমেন্টের একজন বড় অফিসার। চমৎকার মানুষ। পালবাবুকে আজই বলে রাখব। তিনি আপনাকে জেফ্রি পয়েন্টে নিয়ে যাবেন। ওখানে মাস দেড় দুই থাকলে আপনার ভালো রকম অভিজ্ঞতা হবে।
.
দিন দুই পর বিকেলবেলায় সুকুমার পাল চলে এলেন। আমি স্যুটকেস হোল্ড-অল গুছিয়ে তৈরি হয়ে ছিলাম। বিশ্বজিৎ রাহা আজ কোর্ট বা তাঁর পুনর্বাসন দপ্তরের অফিসে যাননি। আমি জেফ্রি পয়েন্টে যাব, তাই বাংলোতেই থেকে গেছেন। সুকুমার পালের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন।
সুকুমারের বয়স চল্লিশ একচল্লিশ। চোখেমুখে ভালোমানুষ ভালোমানুষ ভাব। চেহারাটা ভারী গোছের। সাজগোজের দিকে নজর নেই। পরনে ঢোলা ফুল প্যান্টের ওপর ফুল শার্ট, যেটার দুটো বোতাম নেই। পায়ে চামড়ার ফিতে বাঁধা চপ্পল।
জানা গেল, তাঁদের দেশ ছিল পূর্ব বাংলার ফরিদপুর জেলায়। দেশভাগের পর কলকাতায় এসে অন্য সব উদ্বাস্তুর মতো খুব কষ্টে কয়েকটা বছর কেটেছে। সুকুমারদের সংসারটা খুব ছোট নয়। বাবা, মা, সুকুমার এবং ছোট আরও তিন ভাইবোন।
দেশে থাকতে আই এটা পাশ করেছিলেন। তার জোরে এপারে এসে একটা ছোটখাটো কাজ জুটিয়ে নিয়েছিলেন। দিনের বেলা চাকরি, রাত্তিরে নাইট ক্লাস করে বি-এ পাশ করার পর পুনর্বাসন বিভাগের এই চাকরিটা পেয়ে আন্দামানে চলে এসেছেন। ফ্যামিলির বাকি সবাই কলকাতায় ভাড়া বাড়িতে থাকে। ভাইবোনেরা কলেজে পড়ছে। সংসারের সব দায় সুকুমারের। প্রাণবন্ত, হাসিখুশি, সরল মানুষটির সঙ্গে আলাপ করে খুব ভালো লাগল।
যাই হোক, জেফ্রি পয়েন্টে যাওয়ার সোজা কোনও রাস্তা নেই। বিশ্বজিৎ রাহা তাঁর গাড়িতে আমদের দুজনকে চ্যাথাম জেটিতে পৌঁছে দিলেন। সেখান থেকে লঞ্চে সমুদ্রের খাড়ি পেরিয়ে ওধারে বাম্বু ফ্ল্যাটের (?) জেটিতে চলে এলাম। জেটির বাইরে পুনর্বাসন বিভাগের একটা জিপ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। যে ড্রাইভার গাড়িটা নিয়ে এসেছে তার নাম লতিফ। সে কিন্তু আমাদের জেফ্রি পয়েন্টে পৌঁছে দেবে না। রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের একটা জরুরি কাজে যে লঞ্চটায় আমরা ব্যাম্বু ফ্ল্যাটে এসেছি সেটায় উঠে তাকে পোর্টব্লেয়ারে যেতে হবে। জিপটা চালিয়ে আমাকে নিয়ে জেফ্রি পয়েন্টে যাবেন সুকুমার পাল।
লতিফ গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। সে বাঙালি মুসলমান। কাঁচুমাচু মুখে সুকুমারকে বলল, স্যার, পোর্টব্লেয়ারে আমাদের হেড অফিসে আজ আমাকে যেতেই হবে। নইলে আমি আপনাদের জেফ্রি পয়েন্টে নিয়ে যেতাম। গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যেতে আপনার কষ্ট হবে।
সুকুমার বললেন, কীসের কষ্ট। আর দাঁড়িয়ে থেকো না। তিন-চার মিনিটের মধ্যে লঞ্চ চ্যাথামে চলে যাবে। যাও-যাও
লতিফ প্রায় দৌড়াতে দৌড়োতে জেটির দিকে চলে গেল।
সুকুমার পাল বললেন, উঠে পড়ুন
ফ্রন্ট সিটে আমরা পাশাপাশি বসলাম। সুকুমারের হাত স্টিয়ারিংয়ে। গাড়ি চলতে শুরু করল।
ব্যাম্বু ফ্ল্যাট জেটির প্রায় গা থেকেই পাহাড়ি রাস্তা। ক্রমশ সেটা চড়াইয়ের দিকে উঠে গেছে। দু-ধারে খাদ আর গভীর জঙ্গল। বিরাট বিরাট প্রাচীন সব গাছ যেমন আছে, তেমনি রয়েছে ঝোপছাড়, মাথা সমান উঁচু বুনো ঘাসের জঙ্গল।
রাস্তাটা কখনও পাহাড়ের গা বেয়ে ওপরে উঠছে, কখনও নীচে নামছে। আমাদের জিপটা একের পর এক চড়াই উতরাই ভেঙে পাহাড়ি পথে পাক খেতে খেতে এগিয়ে চলেছে।
বিকেলবেলায় আমরা বিশ্বজিৎ রাহার বাংলো থেকে বেরিয়েছিলাম। এখন সন্ধে নামতে শুরু করেছে। সূর্যটাকে আকাশের কোথাও আর দেখা যাচ্ছে না। যেদিকে যতদূর চোখ যায়, সব ঝাপসা ঝাপসা। কোথাও মানুষজন চোখে পড়ে না। সব নিঝুম। মাঝে মাঝে ঝিঁঝিদের কোরাস আর গাছের আড়াল থেকে অজানা বুনো পাখিদের ডাক ভেসে আসছে। মনে হয় আমাদের চেনাজানা এই পৃথিবীর বাইরে সৃষ্টিছাড়া জনমনুষ্যহীন এক গ্রহে এসে পড়েছি। কেমন যেন গা ছমছম করে।
আন্দামানে আসার পর লক্ষ করেছি, বছরের এই সময়টা সন্ধে নামার অল্প কিছুক্ষণ পরেই চারদিক গাঢ় অন্ধকারে ডুবে যায়।
ব্যাম্বু ফ্ল্যাটে জিপে ওঠার পর প্রথম দিকে কথা বলছিলেন সুকুমার পাল। হঠাৎ তিনি চুপ করে গেছেন।
সন্ধে নামার সঙ্গে সঙ্গে জিপের দুটো হেডলাইট জেলে দিয়েছিলেন সুকুমার। স্পিডও কমিয়ে দিয়েছেন। হেডলাইটের আলোয় উইন্ডস্ক্রিনের বাইরে চোখ রেখে তিনি গাড়ি চালাচ্ছেন।
আমরা এমন একটা জায়গায় চলে এসেছি যেখানে পাহাড় কাটা বেশ কটা রাস্তা নানা দিকে এঁকেবেঁকে চলে গেছে। অনেকটা গোলকধাঁধার মতো।
জিপের ভেতর একটা লম্বাটে বাল্ব জ্বলছিল। তার আলোয় লক্ষ করলাম সুকুমার পালের চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ ফুটে উঠেছে।
জিপের স্পিড দ্রুত কমে আসছে। একসময় অনেকটা স্বগতোক্তির মতো বললেন, ঠিক রাস্তায় যাচ্ছি তো?
বলে কী লোকটা? আমি তাঁর দিক থেকে চোখ সরাইনি। জিগ্যেস করলাম, ভুল রাস্তায় চলে এসেছেন নাকি?
খানিকটা সামলে নিতে চাইলেন সুকুমার।-না, না, ভুল হয়নি।
তাঁর কথাগুলো খুব জোরালো মনে হল না। যেন আমাকে ভরসা দেবার জন্যে বলা।
সুকুমার ফের বললেন, কতবার গাড়ি ড্রাইভ করে জেফ্রি পয়েন্টে গেছি। ভুল হবে কেন? আপনিই বলুন
তিনি ভুল পথে যাচ্ছেন, না ঠিক পথে, সেটা আমি বলব! মাত্র দুদিন আগে এই প্রথম আন্দামানে এসে পোর্টব্লেয়ারে কাটিয়ে দিয়েছি। বিশ্বজিৎ রাহা এ কার সঙ্গে আমাকে জেফ্রি পয়েন্টে পাঠিয়েছেন। অবাক হয়ে সুকুমার পালের দিকে তাকিয়ে থাকি।
আরও খানিকটা চলার পর সুকুমার বললেন, মনে হচ্ছে ডান দিকের রাস্তাটায় গেলে জেফ্রি পয়েন্টে যাওয়া যাবে না; বাঁ দিকের রাস্তাটাই ধরা যাক, কী বলেন?
একেবারে থ হয়ে যাই। এই দ্বীপে আমার মতো আনকোরা একজনকে সুকুমার পাল কি পথপ্রদর্শকের দায়িত্বটা দিলেন। উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে থাকি। এ ছাড়া আমার আর করারই বা কী আছে!
রাত আরও বাড়ছে, অন্ধকার আরও গাঢ় হয়েছে। আকাশে ফ্যাকাশে চাঁদ দেখা দিল, তার নির্জীব আলো দক্ষিণ আন্দামানের এই নিঝুম এলাকাটাকে কেমন যেন রহস্যময়, এবং ভীতিকর করে তুলেছে। চারপাশে আবছা আবছা পাহাড়গুলিকে দেখতে দেখতে মনে হয় প্রাগৈতিহাসিক বিশাল বিশাল আদিম সব প্রাণী যেন ওত পেতে আছে।
আমি মুখ বুজে বসেই আছি। গাইড হিসেবে আমাকে খুব সম্ভব পছন্দ হল না সুকুমার পালের। একটু বেপরোয়া হয়ে তিনি পাকদণ্ডি বেয়ে জিপটাকে পাহাড়ের মাথায় তুলছেন, তৎক্ষণাৎ নামিয়ে আনছেন। ডাইনে বাঁ-য়ে, এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে জিপটাকে দৌড় করালেন। এইভাবে অনেকটা সময় কেটে গেল। তা কম করে ঘণ্টা দেড় দুই।
একসময় রীতিমতো ক্লান্ত এবং হতাশই হয়ে পড়লেন সুকুমার পাল। বললেন, ব্যাপারটা কী হল বলুন তো? কখন জেফ্রি পয়েন্টে পৌঁছে যাবার কথা। আর আমরা কিনা, পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরপাক খেয়ে বেড়াচ্ছি।
আমারও খুব ক্লান্তি লাগছিল। বললাম, শেষ পর্যন্ত আজ রাত্তিরে জেফ্রি পয়েন্টে পৌঁছোতে পারব তো?
আমার কথায় খুব সম্ভব একটু খোঁচা ছিল। ঘাড় ফিরিয়ে স্থির দৃষ্টিতে আমাকে কয়েক সেকেন্ড লক্ষ করে সুকুমার পাল কণ্ঠস্বরে বেশ জোর দিয়ে বললেন, আলবত পারবেন। আমি আছি না?
বলতে যাচ্ছিলাম, আপনি তো কয়েক ঘণ্টা ধরেই আছেন। পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ মাইল যেতে চার পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগে নাকি? কিন্তু বলা হল না।
এখন গাড়িটা একটা পাহাড়ের মাথা থেকে অনেকটা নেমে এসেছে।
হঠাৎ সুকুমার বললেন, দেখুন তো বাঁ দিকে একটু আলো দেখা যাচ্ছে না? ওই যে তিনি আঙুল বাড়িয়ে দিলেন।
ওঁর আঙুল বরাবর বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকি। কিন্তু কোথায় আলো? সুকুমার পালের মতো দিব্যদৃষ্টি আমার নেই। বললাম, কই, কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না।
সুকুমার পাল মানুষটি ভদ্র, বিনয়ী, খুবই শান্তশিষ্ট। কিন্তু এখন বেশ চটে উঠলেন।রায়বাবু, কলকাতায় ফিরে গিয়ে চোখ দেখাবেন। ওখানে নিশ্চয়ই আলো আছে। তার মানে মানুষজনও রয়েছে। ওদের জিগ্যেস করলে জেফ্রি পয়েন্টের রাস্তা দেখিয়ে দেবে, কী বলেন?
তিনি আমার জবাবের অপেক্ষা না করে বেশ জোরেই জিপটা চালিয়ে দিলেন। কিন্তু আলোর চিহ্নমাত্র চোখে পড়ল না। হতাশা তখন সুকুমার পালের ওপর চেপে বসেছে। বললেন, এই আলো দেখলাম। এখন আর দেখছি না। তা হলে কি আমার চোখটাই গেছে?
এ প্রশ্নের জবাব হয় না। আমি মুখ বুজেই থাকি।
আরও কিছুক্ষণ এলোপাতাড়ি জিপটাকে ছোটানোর পর আচমকা একটা অঘটন ঘটে গেল। বোমা ফাটার মতো প্রচণ্ড আওয়াজ করে জিপের একটা চাকা ফেঁসে গেল। ফস ফস করে হাওয়া বেরিয়ে চাকাটা চুপসে গিয়ে খানিকটা এগিয়ে থেমে গেল। জিপটাও খানিকটা কাত হয়ে গেছে।
সুকুমার পাল হাহাকার করে উঠলেন।-সর্বনাশের মাথায় বাড়ি। রায়বাবু গাড়িতে এক্সটা চাকা নেই যে বানচাল চাকাটা পালটে দেব। সারারাত এই গাড়ির ভেতর বসে থাকতে হবে। কাল সকালে আলো ফুটলে রাস্তায় লোকজন দেখা গেলে একটা উপায় হতে পারে।
সুকুমার যা যা বললেন তার কোনওটাই সুখকর নয়। এই নিঝুম, জনমানবহীন পাহাড় জঙ্গলে ঘেরা দক্ষিণ আন্দামানে সমস্ত রাত বিকল জিপে বসে বসে জেগে কাটাতে হবে, ভাবতেই ভীষণ দমে যাই।
সুকুমার এবার বললেন, একটাই সমস্যা। মারাত্মক খিদে পেয়েছে। পেটের ভেতর একেবারে খাণ্ডবদাহন চলছে।
তাঁর কথায় খেয়াল হল, আমারও খিদেটা চনচনে হয়ে উঠেছে। বাকি রাতটা না জুটবে এক টুকরো রুটি বা একমুঠো ভাত। ব্যাপারটা খুব আনন্দদায়ক নয়। কিন্তু কী আর করা?
সুকুমার পাল থামেননি, দেখুন ভাই, গান্ধীজি মাঝে মাঝেই অনশনে বসতেন। দেশপ্রেমী যতীন দাস একটানা ছাপ্পান্ন না সাতান্ন দিন অনশন করেছিলেন। পট্টি রামালু ষাট না বাষট্টি দিন অনশন করে সেকালের মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিটা ভেঙে তেলুগুভাষীদের জন্যে আলাদা অন্ধ্রপ্রদেশটা আদায় করে ছেড়েছিলেন। আর আমরা একটা রাত উপোস দিয়ে থাকতে পারব না? খুব পারব! এরপর ফি মাসে দু-চারদিন উপোস করলে শরীরস্বাস্থ্যের পক্ষে সেটা কতটা উপকারী সে সম্বন্ধে লম্বা-চওড়া একটা ভাষণ দিলেন।
বানচাল জিপে বসে সময় কাটতে থাকে। ঘণ্টাখানেক পর সুকুমার পাল হঠাৎ বলে ওঠেন, নাহ, পেটের ভেতর খিদেটা জ্বালিয়ে মারলে দেখছি। মনে হচ্ছে নাড়িভুড়ি জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। আর তো পারি না। কিছু একটা না করলেই নয়।
এই লোকটাই না খানিকক্ষণ আগে উপবাসের উপকারিতা সম্পর্কে সাতকাহন কেঁদে বসেছিলেন? জিগ্যেস করলাম, এই নির্জন জায়গায় কী করতে চান?
সুকুমার পাল সামান্য ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, কী আবার করব? খাবার-দাবারের খোঁজ করতে হবে না?
কিছুক্ষণ আগে যা যা বলেছিলেন বেমালুম ভুলে গেছেন সুকুমার পাল। বললাম, এখানে। খাবার কোথায় পাবেন?
চেষ্টা করতে হবে। কথায় বলে না যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। গাড়ির ভেতর বসে বসে অনাহারে প্রাণত্যাগ করাটা কাজের কথা নয়। নামুন নামুন। দেখা যাক আশেপাশে কোনও বসতি পাওয়া যায় কিনা।
সুকুমার নেমে পড়লেন। অগত্যা আমাকেও নামতে হল। মেটে মেটে চাঁদের আলোয় আমাকে পাশে নিয়ে পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটা শুরু করলেন সুকুমার। বললাম, গাড়িটা রাস্তায় পড়ে রইল। আমার স্যুটকেস-ট্যুটকেস যে থেকে গেল। হঠাৎ কেউ এসে পড়লে তো সর্বস্ব খোয়া যাবে।
সুকুমার আমার দুশ্চিন্তা প্রায় তুড়ি মেরেই উড়িয়ে দিলেন।-আরে ভাই, আন্দামান আর যাই হোক, বম্বে দিল্লি কলকাতা নয়। এখানে দু-চারটে খুনখারাপি হতে পারে কিন্তু চুরিচামারির মতো ছ্যাচড়া কাজ কেউ করে না। চুরি-টুরিকে এখানকার লোক ঘেন্না করে। কেউ এসে পড়লেও জিপ বা আপনার জিনিসপত্রের দিকে ফিরেও তাকাবে না—
উঁচু নীচু রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হাঁটু আর গোড়ালি আলগা হয়ে যাবার উপক্রম। কোমর টনটন করছে। যে পথটা ধরে ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে হাঁটছি সেটা এক জায়গায় এসে দু ভাগে ভাগ হয়ে দুদিকে চলে গেছে। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। হাঁপাতে হাঁপাতে বলি, আর যে চলতে পারছি না।
সুকুমার বেশ দমে গেছেন। তিনিও দাঁড়িয়ে পড়েছেন। বললেন, আমারও তো একই হাল। শরীর যেন ভেঙে পড়ছে।
আমি কী বলতে যাচ্ছিলাম, আচমকা ডান ধারের রাস্তাটা থেকে এক পাল কুকুরের ডাক ভেসে এল।
মরা মরা জ্যোৎস্নায় সুকুমার পালের চোখ দুটো চকচক করে উঠল। বিপুল উৎসাহে বলে উঠলেন, আছে আছে আলো আছে। ভেঙে পড়ার কিছু হয়নি। এত হাঁটাহাঁটির রিওয়ার্ড এবার পাওয়া যাবে।
তাঁর কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। চড়াই উতরাই ভাঙতে ভাঙতে লোকটার মাথা কি খারাপ হয়ে গেল! হাঁ করে সুকুমার পালের মুখের দিকে কয়েক লহমা তাকিয়ে থেকে বললাম, কীসের আলো? কীসের রিওয়ার্ড?
সুকুমার পাল বললেন, কুকুরগুলোর ডাক শুনতে পাচ্ছেন না?
কুকুরের ডাকের মধ্যে কতটা আশা, কতটা রিওয়ার্ড জড়িয়ে আছে, বুঝতে পারছি না। ধন্দ-ধরা মানুষের মতো বললাম, তা তো পাচ্ছি। কিন্তু
আরে ভাই, একসঙ্গে এতগুলো কুকুর যখন চেঁচাচ্ছে তখন কাছাকাছি নিশ্চয়ই কোনও বসতি-টসতি আছে। রাস্তার ধার ঘেঁষে কটা মাঝারি হাইটের ডালপালাওয়ালা ঝাঁকড়া গাছ দাঁড়িয়ে আছে। সুকুমার দুটো ডাল ভেঙে নিয়ে একটা নিজের হাতে রাখলেন, অন্যটা আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন।
জিগ্যেস করলাম, এই ডাল দিয়ে কী হবে?
লাঠির কাজ করবে।
মানে?
যেখানে কুকুর ডাকছে আমরা সেদিকে যাব। ওরা তো এই মাঝরাতে আমাদের আদর করে অভ্যর্থনা জানাবে না। তখন লাঠির দরকার হবে। চলুন–
বিশ্বজিৎ রাহা মনে হয় এক বদ্ধ উম্মাদের হাতে আমাকে তুলে দিয়েছেন। কিন্তু এখন আর কিছুই করার নেই। সুকুমার পালের পাশাপাশি ডান দিকের রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম।
বেশিক্ষণ নয়, মিনিট দশেক হাঁটার পর এক দঙ্গল কুকুর তারস্বরে চেঁচাতে চেঁচাতে আমাদের দিকে তেড়ে এল। আমাকে বিশেষ কিছু করতে হল না। সুকুমার পাল বাই বাই করে হাতের ডালটা ঘোরাতে লাগলেন। আর আদুরে সুরে বলতে লাগলেন, হট-হট। কেন চেল্লাচিল্লি করছিস? আমরা ডাকু না খুনি? দেখছিস না ভদ্দরলোক।
কিছুক্ষণ এই রকম চলল। কুকুরগুলো কী ভাবল, কে জানে। তাদের মারমুখো তেরিয়া মেজাজ আর নেই। চিৎকারও থেমে গেছে; দূরে সরে গিয়ে তারা কুই কুঁই করতে থাকে।
সারা জীবনে কত জায়গায় ঘুরেছি। কিন্তু কুকুর বশ করার এমন কায়দা আর কারোর দেখিনি।
সুকুমার পাল বললেন, কুকুরগুলো বেয়াড়া, বেআদব নয়। মানুষের সঙ্গে থাকে তো। তাই আমার কথাগুলো বুঝতে পেরে সরে গেছে।
লোকটাকে যত দেখছি, তার কথা যত শুনছি ততই অবাক হচ্ছি।
সুকুমার পাল এবার সামনের দিকে একটু দূরে আঙুল বাড়িয়ে দিলেন।–ওই দেখুন!
সেই সন্ধের পর থেকে অল্প অল্প কুয়াশা পড়তে শুরু করেছিল। এখন তা বেশ গাঢ় হয়ে উঠেছে। কুয়াশা ভেদ করে যে চাঁদের আলো চুঁইয়ে চুঁইয়ে এসে পড়েছে সেটা রীতিমতো ঘোলাটে। সেই আলোতে কুড়ি বাইশটা কাঠের বাড়ির অস্পষ্ট কাঠামো চোখে পড়ল। সেগুলো কাছে-দূরে ছাড়া ছাড়া ভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
সুকুমার পাল বললেন, কপাল ভালো, তাই কুকুরগুলো ডেকে উঠেছিল। নইলে এত রাত্তিরে বসতিটার কথা জানতে পারতাম না।
কুকুরের হল্লা শুনে যিনি একটি লোকালয়ের হদিস পেতে পারেন তাঁকে আমি কিনা বদ্ধ পাগল ভেবেছিলাম। ভেতরে ভেতরে বিব্রত বোধ করলাম। ওইরকম ভাবাটা অন্যায় হয়ে গেছে।
সুকুমার বললেন, চলুন যাওয়া যাক। বাড়িগুলো দেখে মনে হচ্ছে ব্রিটিশ আমলে তৈরি।
বললাম, আলো-টালো তো কিছু দেখা যাচ্ছে না।
এই মাঝরাতে ঝাড়লণ্ঠন জ্বালিয়ে কেউ ঘুমোয় নাকি?
পায়ে পায়ে সুকুমার পালের সঙ্গে এগিয়ে যাই। খাবার-দাবারের আশা যে নেই সে ব্যাপারে আমি শতকরা একশো ভাগ নিশ্চিত। শরীর ভেঙে আসছে। বাকি রাতটুকুর জন্য যদি একটা আস্তানা জোটে তাই যথেষ্ট। জুটবে যে এমন ভরসা নেই।
প্রথম যে বাড়িটা পাওয়া গেল সেটার রাস্তার দিকে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লাম। কুকুরগুলো খুব সম্ভব এই এলাকার পাহারাদার। তারা পিছু পিছু এসে একটু দূ রে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের লক্ষ করতে লাগল। কিন্তু কোনও রকম চিৎকার জুড়ে দিল না। কুকুরের মনস্তত্ত্ব আমার জানা নেই। মনে হয়, আমাদের হাল দেখে তাদের কিঞ্চিৎ সহানুভূতি হয়ে থাকবে।
একটু ইতস্তত করে সকুমার পাল দরজার কড়া নাড়লেন। প্রথম দিকে আস্তে আস্তে। কিন্তু ভেতর থেকে কোনও সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না।
অগত্যা জোর লাগাতে হল। একটানা খটখটানি চলছেই।
আচমকা দরজার পাল্লা ভেদ করে তীব্র বাজখাঁই একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল।–কৌন রে কুত্তা? কৌন হো?
একসঙ্গে দশটা জগঝম্পর সঙ্গে দশটা ফাটা কাঁসর পেটালে যে শব্দ বেরোয়, অনেকটা সেইরকম।
আঠারোশো সাতান্নয় সিপাহি বিদ্রোহের পর মিরাট, কানপুর, লখনৌ ইত্যাদি শহর থেকে বিদ্রোহী সেনাদের ধরে ইংরেজরা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দিয়ে কালাপানি অর্থাৎ আন্দামানে পাঠায়। তারা হিন্দি আর উর্দু মেশানো যে ভাষাটি বলত সেটাকে বলা হয় হিন্দুস্থানী বুলি। স্বাধীনতার পর অনেকদিন পর্যন্ত সেই বুলিটি চালু ছিল।
বাড়ির ভেতর থেকে সেই কণ্ঠস্বরটি মুহুর্মুহু বেরিয়ে আসছে।আবে উল্লুকা পাঠঠে, খামোস কিউ? বাতা-বাতা
গলাটা কোনও পুরুষ না মহিলার বুঝতে পারছি না। তবে এর আগে এমন তীব্র বিকট কণ্ঠস্বর আর কখনও শুনিনি। ইহজন্মে আর শুনব কিনা, জানি না। আমার হৃৎকম্প শুরু হয়ে গিয়েছিল।
ওদিকে সুকুমার পাল দরজার কড়া দুটো ধরে রেখেছিলেন ঠিকই, তবে তাঁর হাত থর থর কাঁপছিল। মিয়োনো গলায় তাঁর ভাঙা ভাঙা ফরিদপুরি হিন্দিতে সুকুমার জবাব দিলেন, আমরা দু-লোক হ্যায়। তারপর তড়বড় করে যা বললেন তা এইরকম। তিনি এবং আমি পাহাড়ি রাস্তায় পথ হারিয়ে এদিকে চলে এসেছি। এত রাত্তিরে দরজা খটখটিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে তখলিফ দেওয়া হয়েছে, সেজন্য মাফি মাঙছেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।
থোড়েসে ঠহর যা
মিনিট তিনেক পর দরজা খুলে গেল। গলা শুনে আমার হৃৎকম্প শুরু হয়েছিল। তাকে দেখে আচমকা হৃৎপিণ্ডটা এক লাফে গলার কাছে উঠে এল। প্রায় দু-ফিটের মতো লম্বা এবং ইয়া চওড়া তাগড়াই একটি মেয়েমানুষ। হাতের পাঞ্জা দুটো যেন বাঘের থাবা। কাঁচা পাকা, উশকো খুশকো, রুক্ষ চুল ঝুঁটিবাধা। চোখের তারা দুটো কটা। পরনে ঘাঘরা আর ঢলঢলে ব্লাউজ। দুটোই কোঁচকানো মোচকানো। ঘুম থেকে উঠে এসেছে তাই পোশাকের হাল ওইরকম।
মেয়েমানুষটির হাতে একটা হ্যারিকেন। তার আলোয় দেখা গেল তার বাঁ-গালের ঠোঁট থেকে প্রায় কানের কাছাকাছি অবধি গালের আধাআধি অংশের মাংস নেই। ফলে ওই দিকটার দু-পাটির সব দাঁত বেরিয়ে পড়েছে।
মনে হল রামায়ণ কি মহাভারতের পাতা থেকে বেরিয়ে এসে কোনও অতিমানবী বা দানবী আমাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। আমার একটু আগে ছিলেন সুকুমার পাল। তাঁর গলা থেকে আঁক করে একটা আওয়াজ বেরুল। পরক্ষণে লাফ দিয়ে তিনি আমার পেছন দিকে চলে এলেন। আমার এমন বুকের পাটা নেই যে ওই দানবীর সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। লাফ দিয়ে আমিও সুকুমারের পেছনে চলে গেলাম। তিনি পাক খেয়ে আমার পেছনে চলে গেলেন। এইভাবে সামনে-পেছনে বারকয়েক লাফঝাঁপ চলল।
মেয়েমানুষটির বোধহয় মজা লাগছিল। কটা চোখ দুটো কৌতুকে চিকচিক করছে। এবার সে ভারী নরম গলায় বলল, ডারো মাত্ বেটা, অন্দর আও
যার গলার ভেতর থেকে এই কিছুক্ষণ আগে বিকট বাজখাই স্বর বেরিয়ে আসছিল তার গলা কয়েক মিনিটের মধ্যে এমন মোলায়েম হয়ে যাবে, কে ভাবতে পেরেছিল।
আমার কানের কাছে মুখ এনে সুকুমার পাল ফিসফিস করে জিগ্যেস করলেন, ভেতরে যাবেন নাকি। যা মূর্তি দেখছি আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয়ে যাবার জোগাড়। সারা শরীরে কাঁপুনি ধরে গেছে। চলুন, সরে পড়ি।
সুকুমার যা বললেন, আমারও সেই একই হাল। তবু কেন যেন মনে হল মেয়েমানুষটি আমাদের কোনও ক্ষতি করবে না। তা ছাড়া হাত-পায়ের জোড়গুলো ঢিলে হয়ে গেছে; অনেক চড়াই-উতরাই ভেঙেছি, তাই শিরদাঁড়া যন্ত্রণায় টনটন করছে। ফিরে যে যাব, শরীরে তেমন এক ফোঁটা এনার্জি আর নেই।
মেয়েমানুষটি হিন্দুস্থানীতে কথা বলছিল। কিশোর পাঠকদের পক্ষে বুঝতে অসুবিধা হবে। তাই দু-চারটে হিন্দি উর্দু রেখে বাকিটা বাংলাতেই লিখছি।
মেয়ে মানুষটি আমাদের লক্ষ করছিল। দুজনের মনোভাবটাও আন্দাজ করে নিয়েছিল। বলল, বেটারা, কী ফুসুর ফুসুর করছিস? বললাম তো ডর নেই। আ যা–আ যা–
আমি খানিকটা সাহস ফিরে পেয়েছিলাম। সামনের দিকে পা বাড়িয়ে দিলাম। সুকুমার পাল আর কী করবেন, তিনিও আমার পেছন পেছন আসতে লাগলেন। তাঁর আসার ভঙ্গিটা দেখে মনে হল যেন বধ্যভূমিতে চলেছেন।
বাড়ির ভেতর ঢোকার পর মেয়েমানুষটি আমাদের যে ঘরটায় নিয়ে এল সেটার মেঝে থেকে চাল অবধি সব কাঠের। দু-ধারের দেওয়াল ঘেঁষে কাঠের চওড়া দুটো মাচা; তার ওপর তোশক; তোশকের ওপর পরিপাটি করে চাদর পাতা। দুই মাচার মাঝখানে চারটে বেতের চেয়ারের মাঝখানে বেতেরই সেন্টার টেবিল।
সেই সময় দক্ষিণ আন্দামানে পোর্টব্লেয়ার ছাড়া অন্য কোথাও ইলেকট্রিসিটি আসেনি। কেরোসিন তেলের হ্যারিকেনই ভরসা। হ্যারিকেনটা সেন্টার টেবিলে নামিয়ে রেখে মেয়েমানুষটি বলল, বেটারা, তোদের দেখে মালুম হচ্ছে হাঁটতে হাঁটতে থকে গেছিস। বৈঠ বৈঠ, আগে থোড়েসে আরাম কর
নিঃশব্দে আমরা দুটো চেয়ারে বসে পড়ি। এতটাই ক্লান্ত যে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না।
হঠাৎ পাশের কোনও কামরা থেকে ঘুম-জড়ানো গমগমে একটা গলা ভেসে এল।-এ সুলতানা, ইতনি রাতে কাদের সঙ্গে বড়র বড়র করছিস?
মেয়েমানুষটির নাম জানা গেল-সুলতানা। শব্দটার মানে সম্রাজ্ঞী। পৃথিবীর কোনও দেশে এমন চেহারার সম্রাজ্ঞী আদৌ ছিল কিনা, এখনও আছে কিনা, আমার জানা নেই।
সুলতানা ঝঙ্কার দিয়ে উঠল, আরে জনাব, ভইসের মতো ভোস ভোস করে ঘুমাচ্ছ। ইতনা নিদ, ইতনা নিদ! বাইরের কামরায় এসে দেখ, কারা এসেছে।
একটু পরেই ভেতর দিকের একটি ঘর থেকে বিপুল আকারের একটি লোক চলে এল। সুলতানার চেয়ে আরও চার পাঁচ ইঞ্চি লম্বা। বুকের পাটা কম করে চুয়াল্লিশ পঁয়তাল্লিশ ইঞ্চি। হাত দুটো জানু অবধি নেমে এসেছে। ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল আর খোঁচা খোঁচা দাড়ির বেশির ভাগই সাদা। পরনে প্রচুর কুচি-দেওয়া ঢোলা ইজের, তার ওপর ফতুয়া ধরনের জামা। চোখ দুটো ঢুলু ঢুলু, আধবোজা। বোঝা যায়, ঘুমের ঘোর এখনও কাটেনি।
সুলতানা এইভাবে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিল। এ হল দিল্লিবালা ধরম সিং; হিন্দু। আর আমি হলাম পাঠান। তিশ সাল ধরম সিংয়ের ঘরবালী হয়ে সংসার করছি। –এরা রাস্তা ভুল করে ঘুরতে ঘুরতে এখানে চলে এসেছে।
আগেই জেনেছি আন্দামানে নানা রাজ্যের এবং নানা সম্প্রদায়ের মধ্যে বিয়ে হয়েছে। কিন্তু নিজের চোখে এমন একজোড়া স্বামী-স্ত্রী দেখলাম। কিছুটা অভব্যের মতো অবাক হয়ে দুজনকে দেখতে থাকি।
ধরম সিং আমাকে লক্ষ করছিল। তার ঘুমটা পুরোপুরি কেটে গেল। ডান ধারের দেওয়াল ঘেঁষে তোশক-পাতা যে কাঠের মাচাটা রয়েছে তার ওপর জম্পেশ করে বসে বলল, আরে ভেইয়া তাজ্জব বন গিয়া কিয়া? লেকিন তাজ্জবের কারণ নেই। আংরেজ সরকার এরকম হাজারো শাদি দিয়েছে। এই যেখানে এসেছ এটার নাম টুগাপুর। এখানে পঁচিশটা ফ্যামিলি আছে। হিন্দু-মুসলমানে ঘর করছে, খ্রিস্টান শিখে ঘর করছে, বঙ্গালি বর্মীর ঘর আছে। এ এক আজীব জাজিরা (দ্বীপ)। সমঝ লো, এখানে সব হয়।
দু-এক মিনিটের আলাপেই টের পেলাম ধরম সিং মানুষটা বেশ মজলিশি ধরনের। জমিয়ে গল্প করতে ভালোবাসে। সে বলতে লাগল, বত্তিশ সাল আগে আমি দায়ের কোপে তিন আদমির মুন্ডি নামিয়ে সেলুলার ফাটকে কালাপানি খাটতে আসি। ওই যে সুলতানাকে দেখছ, সে-ও দো মুন্ডি নামিয়ে জেনানা ফাটক সাউথ পয়িন্ট এসেছিল। চাকুর ঘা খেয়ে তার বদনের কী হাল হয়েছে দেখেছ তো; গালের একদিকের সব দাঁত বেরিয়ে পড়েছে। কালাপানি এসে আমরা কেউ ঝামেলা ঝঞ্ঝাট করিনি। তাই আংরেজ সরকার আমাদের সাথ আরও বহোৎ আদমির শাদি দিয়ে ফরিন ডিপাটে (ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে) নৌকরি দিয়ে টুগাপুরে পাঠাল। নৌকরির মিয়াদ খতম। আমরা দুজন এখন পুরা পাঁচ হাজার রুপাইয়া পেনশন পাই।
আমাদের ব্যাপারে ধরম সিংয়ের এতটুকু আগ্রহ নেই। সে নিজেদের সম্বন্ধে, পুরোনো দিনের আন্দামান সম্বন্ধে সাতকাহন ফাঁদতে যাচ্ছিল, হঠাৎ সুলতানার কী খেয়াল হতে ধরম সিংকে থামিয়ে দিয়ে আমাদের দিকে তাকাল।–বেটা, তোমরা তো পুটবিলাস (পোর্টব্লেয়ার) থেকে আসছ। কখন ওখান থেকে বেরিয়েছিলে?
সুকুমার পাল বললেন, বিকেলে
এখন তো আধি রাত। কুছু খানা টানা জুটেছে?
করুণ চোখে সুলতানার দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নামিয়ে আস্তে আস্তে নাড়তে লাগলেন সুকুমার।
ব্যস্তভাবে উঠে পড়ল সুলতানা। ধরম সিংকে বলল, বড়র বড়র না করে বেটাদের পানি এনে দাও। হাতমুখ ধুয়ে নিক। আমি আধা ঘণ্টার মধ্যে আসছি। সে বাইরের ঘর থেকে বেরিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেল।
.
আধ ঘণ্টাও কাটল না, তার আগেই সুলতানা দুটো বড় স্টেনলেসের থালায় গরম গরম ঘি-মাখানো চাপাটি, আলুর ডোকা, আমলকীর আচার আর এক লাস করে ঘন দুধ আমাদের সামনে সাজিয়ে দিয়ে কাছে বসে মায়ের মতো যত্ন করে খাওয়াতে লাগল। খা লে বেটা সামান্য আয়োজন। গনগনে খিদের মুখে মনে হল অমৃত।
আমাদের খাওয়া চলছে। নানা কথা বলছিল সুলতানা। হঠাৎ একসময় জিগ্যেস করল, তোদের গাড়ির চাকা তো ফেঁসে গেছে। কোথায় রয়েছে গাড়িটা?
ঠিক কোথায় আছে বলতে পারব না। কাল দিনের বেলা খুঁজে বের করতে হবে।
ধরম সিং কাছেই রয়েছে। জিগ্যেস করল, ফিকর মত কর। আমরাই ছুঁড়ে বের করে দেব। কী গাড়ি তোদের?
কখনও আমাদের তুমি বলছে ধরম সিং, কখনও তুই। সুকুমার পাল বললেন, জিপ–
ধরম সিং বলল, টুগাপুরের এই পেনিল কলুনিতে (পেনাল কলোনিতে) আমার এক দোস্ত আছে। মান্দ্রাজি খ্রিস্টান যোশেফ। বত্তিশ সাল আগে আমরা এক জাহাজে কল্পকাত্তা থেকে কালাপানি এসেছিলাম। সে আরও জানায়, যোশেফ খুব ভালো মোটর মেরামতি করতে পারে। তার কাছে হরেক কিসিমের মোটরের চাকা আছে। নসিব ভালো হলে জিপের চাকা তার কাছে পাওয়া যাবে। কাল সুবেহ তাকে ডেকে আনা হবে।
ধরম সিংয়ের কিছু খেয়াল হওয়ায় ব্যস্তভাবে জিগ্যেস করল, তোরা কোথায় যাবি সেটাই তো জানা হয়নি।
সুকুমার বললেন, জেফ্রি পয়েন্টে। এখান থেকে কতদূর?
নজদ্গি। খুব বেশি হলে ছ-সাত মিল। দরিয়ার কিনারে ওই জায়গাটায় জঙ্গল সাফ করে পাকিস্তানে বঙ্গালি রিফুজদের (রিফিউজিদের) কলুনি বসানো হচ্ছে না?
হ্যাঁ। আমরা সেই কলোনিতেই যাব।
খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে সুলতানা ঘরের দু-ধারের কাঠের মাচানে পরিপাটি করে বিছানা পেতে গায়ে দেবার জন্য পাতলা দুটো চাদর দিয়ে বলল, শো যা বেটারা। রাতে যদি কিছু জরুরত হয় তো আমাদের ডাকি। বলে চাবি ঘুরিয়ে হ্যারিকেনটা নিবু নিবু করে রেখে ধরম সিংকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেল।
.
আগের দিন আমাদের ওপর দিয়ে প্রচণ্ড ধকল গেছে। তাই পরেরদিন ঘুম ভাঙতে একটু দেরি হয়ে গেল।
আমাদের অনেক আগেই জেগে গিয়েছিল সুলতানা আর ধরম সিংহ। তারা খুব সম্ভব লক্ষ রাখছিল। আমরা বিছানা থেকে নামতেই ধরম সিং এসে বলল, চল, তোদের নানা ঘরে নিয়ে যাই।
বাড়ির ভেতর দিকে চানের ঘর বা বাথরুম। সেখানে কয়েক বালতি জল ধরা আছে। সুকুমার পাল আর আমি একে একে গিয়ে গিয়ে মুখ-টুখ ধুয়ে এলাম। যাওয়া-আসার পথে চোখে পড়ল রসুইঘরে অর্থাৎ কিচেনে ছাক ছোঁক আওয়াজ করে ভীষণ ব্যস্তভাবে কী সব করছে সুলতানা।
আমাদের জামাকাপড় সবই রয়েছে সেই জিপটায়। তাই বাথরুমে কাজ সেরে এসে বাসি পোশাকেই থাকতে হল।
ধরম সিং আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই রয়েছে। সুকুমার পাল তাকে বলল, এবার তো আমাদের যেতে হবে।
ধরম সিং বলল, যাবি যাবি। এখন বোস্। আমার ঘরবালী আসুক। তার হুকুম ছাড়া যাওয়া চলবে না।
কয়েক মিনিটের ভেতর চলে এল সুলতানা। তার হাতে দুটো থালায় মুলোর পরোটা, হিং-দেওয়া ঘন অড়র ডাল, নানারকম আনাজ দিয়ে একটা তরকারি আর এক লাস করে ঘোল। বুঝতে পারছি, এ-বাড়িতে চায়ের ব্যবস্থা নেই। বুঝতে পারলাম, ভোরবেলা উঠে আমাদের জন্যে এইসব খাবার তৈরি করেছে।
থালা দুটো আমাদের সামনে রেখে সুলতানা বলল, খা, বেটারা। বলে একটা চেয়ার টেনে কাছে বসল।
ধরম সিং সুলতানাকে বলল, তুই তোর বেটাদের খাওয়া। আমি যোশেফকে ডেকে আনি। সে চলে গেল।
মিনিট কুড়ি বাদে ধরম সিং একটা বেঁটে খাটো, কালো, মজবুত চেহারার লোককে সঙ্গে করে নিয়ে এল। নিশ্চয়ই তার বন্ধু যোশেফ। লোকটার কাঁধে একটা টায়ার আর হাতে চটের ব্যাগে কিছু জিনিসপত্র রয়েছে। খুব সম্ভব মোটর মেরামতির যন্ত্রপাতি। সে ধরম সিংয়েরই সমবয়সি হবে। তবে মাথার চুল খুব একটা পাকেনি।
ধরম সিং লোকটার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল।
আমাদের খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। সুলতানাকে বললাম, এবার যাই
ভারী গলায় যে বলল, ধরে তো রাখতে পারব না। ঠিক হ্যায়। চল, আমিও তোদের সঙ্গে গিয়ে গাড়িটা খুঁজি।
কাল মাঝরাতে সুলতানাদের বাড়িতে এসেছিলাম, এখন সকাল আটটা কি সাড়ে-আটটা। মাত্র কয়েক ঘণ্টায় এই পাঠান রমণীটি, যে বত্রিশ বছর আগে দায়ের কোপে দুটো লোকের ধড় থেকে মুন্ডু নামিয়ে কালাপানি এসেছিল যাবজ্জীবন সাজা খাটতে, সে আমাদের কত আপন করে নিয়েছে। আমার বুকের ভেতরটাও ভারী হয়ে উঠল।
.
একসময় আমরা বেরিয়ে পড়লাম। সুলতানা, ধরম সিং, যোশেফ, সুকুমার পাল এবং আমি।
ঘণ্টা দেড়েক খোঁজাখুঁজি চলল। শেষ পর্যন্ত তিনটে পাহাড় পেরিয়ে চার নম্বর পাহাড়ের একটা রাস্তার বাঁকে আমাদের বানচাল জিপটা পাওয়া গেল। সামান্য কাত হয়ে সেটা পড়ে রয়েছে। লক্ষ করলাম আমার স্যুটকেস হোল্ড-অল কাল রাতে যেমন রেখে গেছি তেমনই আছে। এই পথ দিয়ে যদি কেউ গিয়েও থাকে সেসব ছুঁয়েও দেখেনি।
যোশেফ কাজের লোক। আন্দাজ করে যে চাকাটা নিয়ে এসেছিল, সেটার মাপ জিপের অন্য চাকাগুলোর মতোই। আমাদের ফেঁসে যাওয়া চাকাটা খুলে দশ মিনিটের মধ্যে তার চাকাটা লাগিয়ে বলল, এবার তোমরা চলে যাও
সুকুমার পাল বললেন, কিন্তু আপনার চাকাটা ফেরত দেব কী করে?
কোঈ জরুরত নেই। আমি তো তোমাদের চাকাটা নিলাম।
ওটা তো ফেঁসে গেছে।
ও আমি মেরামত করে নেব। ফিকর মাত্ কর।
সুকুমারের মুখ দেখে মনে হল, যোশেফকে কিছু টাকা দেবার কথা ভাবছেন কিন্তু সে কথা বলতে তাঁর সাহস হল না।
হাতজোড় করে ওদের তিনজনকে, বিশেষ করে সুলতানাকে বললাম, যাচ্ছি–
সুলতানা বলল, বেটা, তোদের ভালো করে খাওয়াতে পারলাম না। আমাদের লেড়কা লেড়কি নেই। কভি কভি দো-চার রোজ এসে তোরা থাকলে আমাদের দিল খুশ হয়ে যাবে। আসবি তো?
আসব। আস্তে মাথা নাড়লাম। কিন্তু টুগাপুরে আর কখনও যাওয়া হয়নি।
গাড়িতে উঠে পড়েছিলাম। সুকুমার পাল স্টার্ট দিলেন। জিপ চলতে শুরু করল। তিনটি মানুষ পাহাড়ি পথের ধারে দাঁড়িয়ে রইল। আমি ঘাড় ফিরিয়ে শুধু সুলতানার দিকে তাকিয়ে থাকি। ওই পাঠান মহিলাটি সুন্দরী নয়, তাকে দেখলে আঁতকে ওঠার কথা। কিন্তু মায়ায় মমতায় স্নেহে সহানুভূতিতে পৃথিবীর সেরা সেরা সম্রাজ্ঞীরা তার পায়ের নখের যোগ্য নয়।
সুলতানার মতো জননীদের ভারতবর্ষের নানা জায়গায় আমি দেখেছি। বম্বের (এখনকার মুম্বই) চওল-এ, দণ্ডকারণ্যের কেশকাল পাহাড়ে, কোঙ্কন উপকূলের জেলেপাড়ায়, বিহারের অস্ফুটুলিতে ইত্যাদি ইত্যাদি। তাদের কথা পরে কখনও বলা যাবে।
জননী
দক্ষিণ কলকাতার নিরিবিলি এলাকায় এই দশতলা হাইরাইজ বাড়িটার নাম আকাশ দীপ। এর প্রতিটি ফ্লোরে তিনটি করে হাজার স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট, বেসমেন্টে গ্যারাজ। সব মিলিয়ে তিরিশটি ফ্ল্যাটের তিরিশ জন স্বত্বধিকারী কো-অপারেটিভ করে এই বাড়িটা বানিয়েছে।
জায়গাটা শুধু নিরিবিলিই নয়, বড় রাস্তা থেকে একটু দূরে থাকার কারণে গাড়ি টাড়ির উৎপাত কম। পরিবেশ দূষণ বলতে যা বোঝায় তা থেকে অঞ্চলটা অনেকখানি মুক্ত। চারপাশে আরো কটা হাইরাইজ থাকলেও এখনও এখানে প্রচুর গাছপালা আর পাখি চোখে পড়ে। অগুনতি মানুষের ভিড়ে, তুমুল হইচইতে এয়ার-হর্নের কানফাটানো আওয়াজে, পোড়া গ্যাসোলিনের ধোঁয়ায় যখন এই শহরের দম বন্ধ হয়ে আসছে তখন তারই এক ধারে এমন একটা ঘন সবুজে ঢাকা, শান্ত, নিঝাট পাড়া থাকতে পারে, তা যেন ভাবাই যায় না।
আকাশ দীপ-এর বাসিন্দাদের সবাই শিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত, কেউ অধ্যাপক, কেউ মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানির টপ একজিকিউটিভ, কেউ ডাক্তার, কেউ ব্যাঙ্ক ম্যানেজার, কেউ স্টেট বা সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের অফিসার ইত্যাদি।
এই বাড়িরই থার্ড ফ্লোরের একটি ফ্ল্যাটের কোণের দিকের একটি ঘরে জানালার ধার ঘেঁষে চুপচাপ বসে ছিল তাপসী। অত্যন্ত সুশ্রী চেহারা। বয়স সাতাশ-আটাশ। পোশাক বা সাজসজ্জার দিকে কোনওরকম নজর নেই তার। পরনের শাড়িটা আধময়লা, চুল উষ্কখুষ্ক, কপালে বাসি সিঁদুরের আবছা দাগ। সারা মুখ জুড়ে গাঢ় বিষণ্ণতা।
রাস্তার দিকে তাপসীর মুখ ফেরানো। এখন দুপুর। খানিকক্ষণ আগে ইলেকট্রনিক দেওয়াল ঘড়িতে সেতারের ঝঙ্কার তুলে বারোটা বেজেছে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই অবিনাশের ফেরার কথা, তার জন্যই অপেক্ষা করছে তাপসী। শুধু আজই না, সাতদিন ধরে এখানে, এই সময়টা, ঠিক এইভাবে বসে থাকছে সে। এ কদিন অবিনাশ যে খবর নিয়ে এসেছে তা খুবই হতাশাজনক। আজ এসে কী বলবে কে জানে।
তাপসী যেখানে বসে আছে সেখান থেকে পাশের ঘরের ব্যালকনির একটা অংশ চোখে পড়ে। ওখানে একটা বেতের সোফায় বসে আছেন মৃণালিনী। বয়স বাষট্টি-তেষট্টি। তার ফর্সা মুখের একাংশ, সাদা এবং কালোয় মেশানো চুল, খাড়া নাক, মেটালের চশমা ইত্যাদি মিলিয়ে যে প্রোফাইলটা দেখা যায় তাতে মনে হয় মহিলা খুবই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। তপসী জানে তার মতো মৃণালিনীও অবিনাশের জন্য অপেক্ষা করছেন। আসলে অবিনাশকে তিনিই কদিন ধরে একটা খবরের জন্য বরুণের অফিসে পাঠাচ্ছেন, যার সঙ্গে এই পরিবারের ভবিষ্যৎ এবং তাপসীর মরণবাঁচন জড়িয়ে আছে।
ঘড়িতে যখন একটা বাজল সেই সময় দেখা গেল সামনের রাস্তা দিয়ে অবিনাশ আকাশ দীপ-এর মেন গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েছে। তিন চার মিনিটের ভেতর সে লিফটে করে ওপরে উঠে আসবে।
তাপসী টের পেল তার হৃৎপিণ্ডে এলোপাথাড়ি ঢাক পেটানোর মতো আওয়াজ হচ্ছে। তারই মধ্যে লক্ষ করল, ওধারের ব্যালকনিতে মৃণালিনী নেই। নিশ্চয়ই অবিনাশকে দরজা খুলে দেবার জন্য উঠে গেছেন।
তাপসী একবার ভাবে, উঠে পড়বে কিন্তু পরক্ষণে টের পেল পা দুটো পেরেক ঠুকে কেউ যেন মেঝেতে আটকে দিয়েছে। একটা অজানা চাপা আশঙ্কা তাকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরতে থাকে। যদি আজও বরুণের খবর পাওয়া না গিয়ে থাকে?
আচ্ছন্নের মতো বসে থাকতে থাকতে একসময় দরজা খোলার শব্দ কানে তাপসীর। তারপরই মৃণালিনী ডাকেন, বউমা, এখানে এসো
কোনও রকমে নিজেকে টেনে তোলে তাপসী। তারপর এলোমেলো পা ফেলে দরজার দিকে এগিয়ে যায়।
এই ফ্ল্যাটে সবসুদ্ধ তিনটে বেড রুম। এ ছাড়া কিচেন, স্টোর, ডাইনিং-কাম ড্রইং রুম। সবগুলোই চমৎকার সাজানো গোছানো।
ড্রইং রুমে আসতে চোখ পড়ে মৃণালিনী একটা সোফায় বসে আছেন। অবিনাশ বসেনি, একটু দুরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
অবিনাশের বয়স চুয়াল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ। তামাটে রং চৌকো মুখ, মাথার মাঝখানে সিঁথি। পেটানো স্বাস্থ্য তার। চেহারায় বুদ্ধির ছাপ আছে। পরনে ধুতি এবং ভোরা-কাটা হাফ-হাতা পাঞ্জাবি। সে এ বাড়ির কাজের লোক।
খুব অল্প বয়সে মৃণালিনীর কাছে এসেছিল অবিনাশ। বাবা-মা, ভাই-বোন তিন কুলে কেউ নেই তার। বিয়ে করেনি। এঁদের কাছে থাকতে থাকতে সংসারের একজন হয়ে গেছে। জড়িয়ে গেছে মৃণালিনীদের সুখ দুঃখ আশা আর নৈরাশ্যের সঙ্গে। রক্তের সম্পর্ক না থাকলে সে মৃণালিনীদের সত্যিকারের হিতাকাঙ্খী।
মৃণালিনী তাপসীকে সোফা দেখিয়ে বলেন, বসো বউমা–
তাপসী বসে না, রুদ্ধশ্বাসে অবিনাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মৃণালিনী এবার অবিনাশের উদ্দেশে বলেন, কিছু জানা গেল।
মুখ নামিয়ে অবিনাশ ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে, না মা। আজও দাদাবাবু অফিসে আসেননি।
কবে আসবে, ওরা কিছু বললে?
না।
আশ্চর্য!
অবিনাশ চুপ করে থাকে।
মৃণালিনীর চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ ফুটে উঠতে থাকে। এমনিতে তিনি ধীর, স্থির, সহজে চঞ্চল বা বিচলিত হন না, কিন্তু সাত দিন আগে বরুণ সেই যে অফিসে গিয়েছিল তার পর থেকে তার কোনো খোঁজ নেই। রোজ অবিনাশকে তার অফিসে পাঠানো হচ্ছে কিন্তু অফিসের কেউ জানে না সে কোথায় গেছে। বরুণও বাড়িতে কিছু জানিয়ে যায়নি। এমনকী দূরে কোথাও গিয়ে থাকলে ফোন করে বা চিঠি লিখে খবরও দেয়নি। এই কদিনে একটু একটু করে উৎকণ্ঠা জমা হচ্ছিল মৃণালিনীর মনে। আজ সত্যিই তিনি ভেতরে ভেতরে অত্যন্ত অস্থির হয়ে উঠেছেন। কোথায় যেতে পারে ছেলেটা? তার কি কোনো বিপদ ঘটেছে?
মৃণালিনী হঠাৎ মনস্থির করে ফেলেন। অবিনাশকে দিয়ে হবে না। তিনি নিজেই আজ তাপসীকে সঙ্গে করে বরুণের অফিসে যাবেন। তার ধারণা অবিনাশকে হয়তো ওরা সঠিক খবর দিচ্ছে না।
মৃণালিনী বলেন, বৌমা, তুমি তাড়াতাড়ি স্নানটা সেরে নাও। দুপুরের যাওয়া সেরে আমার সঙ্গে রাজার অফিসে যাবে। বরুণের ডাক নাম রাজা।
তাপসী চকিত হয়ে ওঠে, আমি–আমি যাব!
হ্যাঁ।
কিন্তু অবিনাশদা তো রোজ গিয়ে ঘুরে আসছে। আপনার ছেলের সম্বন্ধে কোনো খবর থাকলে কি ওরা জানাত না?
কিছুক্ষণ চিন্তা করে মৃণালিনী বলেন, কোথায় যেন একটা মিষ্ট্রি রয়েছে। ঠিক বুঝতে পারছি না। একটু থেমে বলেন, মা আর স্ত্রী গেলে গুরুত্বটা ওদের কাছে অনেক বেড়ে যাবে।
তাপসী আর কোনো প্রশ্ন করে না, সোজা নিজের বেডরুমে গিয়ে স্নানের ঘরে ঢুকে যায়।
.
মৃণালিনীদের ছোট্ট পরিবার। একমাত্র ছেলে বরুণ, পুত্রবধু তাপসী আর তিনি নিজে–সব মিলিয়ে তিনজন। অবশ্য অবিনাশকে ধরলে চার।
মৃণালিনী পরমাশ্চর্য একটি মানুষ। প্রবল আত্মসম্মান বোধ তার, সেই সঙ্গে রয়েছে। শক্ত মেরুদণ্ড যা কখনও কোনও কারণেই তাকে নুয়ে পড়তে দেয় না। তার বিবাহিত জীবন অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। বিয়ের সাত বছরের মাথায় যখন তার বয়স মোটে বত্রিশ এবং বরুণের তিন সেই সময় স্বামীকে হারান।
মৃণালিনীর দাদারা ছুটে এসে তাকে নিজেদের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর বাবার বহুদিন আগেই মৃত্যু হয়েছে। ভাইরা মানুষ হিসেবে সহৃদয়, সহানুভূতিশীল। বোনকে তারা পরম মমতায় আগলে রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ছেলেকে নিয়ে অন্যের কাঁধে চিরকার বোঝা হয়ে থাকতে তার মন সায় দেয়নি।
মাত্র বছর তিনেকের মতো দাদাদের কাছে থেকেছেন মৃণালিনী। বিয়ের আগে বি.এ-টা পাশ করেছিলেন। অসাধারণ ছাত্রী তিনি, ইংরেজি অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড। বিয়ে হয়ে যাবার পর নানা কারণে পড়াশোনায় ছেদ পড়ে গিয়েছিল। স্বামীর মৃত্যুর পর শোকের প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠে সোজা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। এম.এতেও ভালো রেজাল্ট হল। এবারও ফার্স্ট ক্লাস। তিরিশ বছর আগে এখনকার মতো কলেজের চাকরি দুর্লভ ছিল না। ইউনিভার্সিটি থেকে বেরুবার সঙ্গে সঙ্গে নামকরা কলেজে লেকচারশিপ পেয়ে যায় মৃণালিনী। ছমাস পর আলাদা বাড়ি ভাড়া করে ছেলেকে নিয়ে সেখানে চলে গেলেন। দাদারা ভীষণ দুঃখ পেয়েছিলেন। তিনি তাদের বুঝিয়েছেন, আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে দাও। তোমরা তো কাছেই রইলে। তেমন বুঝলে আবার তোমাদের কাছে চলে আসব।
এরপর একদিকে কলেজ, আরেকদিকে ছেলেকে মানুষ করা–এর মধ্যেই জীবন কেটে যেতে লাগল। একজন অবিবাহিত, প্রায় সমবয়সি সহকর্মী, সমরেশ সান্যাল তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। মানুষটি ভদ্র সুপুরুষ, সহানুভূতিশীল। কিন্তু মৃত স্বামীর স্মৃতি তাঁর কাছে এমনই মূল্যবান যে দ্বিতীয়বার বিয়ের কথা ভাবতে পারেননি মৃণালিনী। সবিনয়ে সমরেশকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। সেজন্য কোনও রকম তিক্ততা হয়নি। পরে সমরেশ বিয়ে করেছেন। এখনও তাদের যোগাযোগ আছে। দুজনের সম্পর্ক পারস্পরিক প্রীতি ও শ্রদ্ধার।
বরুণ বড় হতে লাগল। ছাত্র হিসেবে সে খুবই মেধাবী। পঁচিশ বছর পূর্ণ হবার আগেই চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্সির সঙ্গে বিজনেস ম্যানেজমেন্টে চোখ ধাঁধানো রেজাল্ট করার পর একটা বিরাট ফার্মে তার চাকরি হয়ে যায় এবং চার-পাঁচ বছরের ভেতর প্রমোশন পেয়ে এখন সে কোম্পানির ফিনান্স ডিপার্টমেন্টের একজন টপ একজিকিউটিভ।
বরুণের সবাই চমৎকার কিন্তু চরিত্রে সংযম বলতে কিছু নেই। সুন্দরী মেয়েদের সম্পর্কে তার প্রচণ্ড দুর্বলতা। কলেজে ভর্তি হবার পর থেকেই এই নিয়ে বারবার নানা স্ক্যান্ডালে সে জড়িয়ে পড়েছে। ফলে টেনসানের শেষ নেই মৃণালিনীর। সবাই আড়ালে বলাবলি করে, অমন শুদ্ধ চরিত্রের মায়ের এ রকম দুশ্চরিত্র ছেলে হয় কী করে?
লম্পট ছেলেদের শোধরাবার জন্য সবাই যে মুষ্টিযোগ প্রয়োগ করে মৃণালিনীও তাই করলেন। প্রথমে অনেক বুঝিয়েছেন কিন্তু তাতে কাজ না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত তার বিয়ে দিলেন। নিজেই তাপসীকে পছন্দ করেছিলেন। বাপ-মা-মরা মেয়ে। নম্র, ভদ্র, বিনয়ী। ইতিহাসে অনার্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েট। দূর সম্পর্কের এক মামার বাড়িতে সে অল্প বয়স থেকে মানুষ হয়েছে। মামা এবং মামি মানুষ ভালো, খুবই সহৃদয়। নিজেদের ছেলেমেয়েদের থেকে কোনওদিন তাপসীকে আলাদা করে দেখেননি।
ছেলের স্বভাব কেমন, বিয়ের আগেই তাপসীকে জানিয়ে দিয়েছিলেন মৃণালিনী। কিছুই গোপন করেননি। তার দুহাত ধরে বলেছিলেন, আমি পারিনি। আমার বিশ্বাস তুমি পারবে। রাজাকে শোধরাবার দায়িত্ব তোমাকে দিলাম। স্ত্রী হিসেবে এটা তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
বিয়ের পর কিছু দিন স্বভাবটা পাল্টাতে শুরু করেছিল বরুণের। আগে অফিসের পর প্রায়ই বান্ধবী জুটিয়ে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াত। সেটা এবার বন্ধ হল। অফিস ছুটি হলে নিয়মিত বাড়ি আসতে লাগল বরুণ। স্ত্রীকে নিয়ে প্রায়ই নাইট শোয়ে সিনেমায়, নইলে কোথাও বেড়াতে যেত। আসলে নতুন একটা তরুণীকে নিবিড় করে পাওয়ার মধ্যে তীব্র মাদকটা থাকে।
কিন্তু দু-এক বছর কাটতে না কাটতেই নেশা কেটে যায় বরুণের। আবার তার সম্বন্ধে কিছু কিছু স্ক্যান্ডাল কানে আসতে থাকে তাপসী আর মৃণালিনীর। ছুটির পর বাড়িতে ফেরাটা তার অনিয়মিত হয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে এক-দুদিন ফেরেও না। অবশ্য রাতের দিকে ফোন করে জানিয়ে দেয়, এক বন্ধু তাদের বাড়ি ধরে নিয়ে এসেছে, ফেরা সম্ভব হবে না।
মৃণালিনী ছেলের হাড়ের ভেতর পর্যন্ত জানেন। তাঁর মুখ গম্ভীর হয়ে ওঠে। প্রচণ্ড উৎকণ্ঠা তাকে গ্রাস করতে থাকে। অবশ্য বাইরে থেকে তা দেখে বোঝার উপায় নেই।
তাপসীও এত দিনে স্বামীকে চিনে ফেলেছে। মৃণালিনীর কথামতো বরুণকে শোধরানোর অনেক চেষ্টা করেছে। প্রচুর কান্নাকাটি করেছে সে, প্যাসিভ রেজিস্ট্যান্স হিসেবে দিনের পর দিন উপোস দিয়ে থেকেছে কিন্তু তাকে ফেরানো যায় নি।
আগে মাঝে মাঝে দু-একদিন রাতে বাড়ি আসেনি বরুণ। এখন তো পুরো সাতদিন কাটতে চলল, তার খোঁজ নেই।
.
কোনও রকমে স্নান-খাওয়া চুকিয়ে মৃণালিনীর সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে তাপসী। বড় রাস্তা তাদের বাড়ি থেকে তিন মিনিটের পথ। সেখানে আসতেই একটা ফাঁকা ট্যাক্সি পাওয়া গেল।
বরুণের অফিস ক্যামাক স্ট্রিটে, একটা বোলতলা হাইরাইজের সেভেন্থ এইটথ নাইথ আর টেথ, মোট চারটে ফ্লোর জুড়ে। অফিস বিল্ডিংয়ের সামনে এসে ট্যাক্সি থেকে নেমে সারি সারি লিফট বক্সগুলোর দিকে চলে যায় দুজনে। সবগুলো লিফটের সামনেই লম্বা লাইন। যে লাইনটা অন্যগুলোর তুলনায় ছোট তার পেছনে দাঁড়িয়ে পড়ে তারা।
মিনিট দশেক বাদে লিফটে ঢোকার সুযোগ পাওয়া যায়। আগে একবারই মাত্র মৃণালিনী বরুণের অফিসে এসেছিলেন। তাপসী কখনও আসেনি। ঝিঁঝির ডাকের মতো একটানা আওয়াজ করে লিফট যত ওপরে উঠতে থাকে ততই বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডের উত্থানপতনের গতি বেড়ে যায়। অজানা এক শঙ্কা তাকে যেন চারদিক থেকে ঘিরে ধরে।
সেভনথ ফ্লোরে ঢুকলেই বরুণদের অফিস ম্যাগনাম ইন্টারন্যাশনাল-এর রিসেপসান। সেখানে দারুণ স্মার্ট চেহারার একটি তরুণী সারা গা থেকে উগ্র সেন্টের গন্ধ বিতরণ করছিল। তার বাদামি রঙের ফাঁপানো চুল, কঁধ পর্যন্ত ছাঁটা, ভুরু প্লাক-করা, ম্যানিকিওর করা নখে এবং ঠোঁটে চড়া রং।
মাপা যান্ত্রিক হেসে তরুণী ইংরেজিতে জিগ্যেস করে, আপনাদের জন্যে কী করতে পারি?
বোকা যাচ্ছিল মেয়েটি বাঙালি। বিশুদ্ধ বাংলায় মৃণালিনী বলেন, আমি ফিনান্স ডিপার্টমেন্টের একজিকিটিভ বরুণ মল্লিক সম্পর্কে কিছু জানতে চাই।
তিনি অফিসে আসেননি। এবার তরুণী বাংলাতেই উত্তর দেয়।
জানি। আমি তার মা। আর এ হল বরুণের স্ত্রী– তাপসীকে দেখাতে দেখাতে মৃণালিনী বলেন, সাতদিন ধরে তার খোঁজে লোক পাঠাচ্ছি। রোজ বাড়ি গিয়ে সে জানাচ্ছে বরুণ অফিসে আসেনি।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, রিসেপসনিস্ট বলে, একজন মিডল-এজেড লোক কদিন ধরে মিঃ মল্লিকের খোঁজে আসছে। আজও এসেছিল।
সাতদিন আগে সে অফিসে এসেছিল। তারপর আর বাড়ি ফেরেনি। কোথায় যেতে পারে বলে আপনাদের ধারণা? অফিস কি কোনও প্রয়োজনে তাকে কলকাতার বাইরে পাঠিয়েছে?
আমি বলতে পারব না।
কার পক্ষে বলা সম্ভব?
আপনি ফিনান্স ডিপার্টমেন্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট মিস্টার পাইয়ের সঙ্গে দেখা করে কথা বলুন।
ঠিক আছে। কীভাবে তার সঙ্গে দেখা করব?
একটু ওয়েট করুন। আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
ইন্টারকমে কথা বলে তরুণীটি মৃণালিনীদের জানায় নাইথ ফ্লোরে মিস্টার পাইয়ের চেম্বার। তিনি তার ঘরেই আছেন, মৃণালিনীদের জন্য অপেক্ষা করছেন।
মিস্টার পাইয়ের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। অত্যন্ত ভদ্র এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। বরুণের ব্যাপরে তাকে বেশ উৎকণ্ঠিতই দেখা গেল। বললেন, বরুণ আমাদের কোম্পানির অ্যাসেট। কেন যে সাতদিন ধরে আসছে না, বুঝতে পারছি না। আজকের দিনটা দেখে কাল আপনাদের বাড়িতে যোগাযোগ করতাম। একটু থেমে গলা নামিয়ে এবার বলেন, একটা ইনফরমেসন আপনাদের দিতে পারি যেটা বলতে বলতে চুপ করে যান।
টেবলের ওপর অনেকটা ঝুঁকে মৃণালিনী জিগ্যেস করেন, যেটা কী?
খুবই এমব্যারাসিং। হয়তো আমাদেরও ভুল হতে পারে। কো-ইন্সিডেন্স হওয়া আশ্চর্য নয়।
দয়া করে আপনি বলুন। আমরা কিছু মনে করব না।
দ্বিধান্বিতভাবে পাই বলেন, যেদিন থেকে বরুণ আসছে না, দেখা যাচ্ছে ঠিক সেদিন থেকেই আমাদের পার্সোনেল ডিপার্টমেন্টের একজন অফিসার সুনীতা কুলকার্ণি ছুটি নিয়েছে। তিনদিন আগে তার ছুটি ফুরিয়েছে কিন্তু এখনও জয়েন করেনি। কবে করবে তাও জানায়নি।
মৃণালিনী জিগ্যেস করেন, সুনীতা কুলকার্ণির বয়স কী রকম?
মিস্টার পাই একটু ভেবে বলেন, সাতাশ-আটাশ হবে।
দেখতে কেমন?
কোয়াইট অ্যাট্রাক্টিভ।
মুখ শক্ত হয়ে উঠেছিল মৃণালিনীর। যা তার স্বভাববিরুদ্ধ এবার তাই করে বসেন। উত্তেজনায় চিৎকার করে বলেন, আমি সিওর, ওরা দুজন একসঙ্গেই গেছে।
মিস্টার পাই হতচকিত। বলেন, এ কী বলছেন মিসেস মল্লিক।
মৃণালিনী আগের স্বরেই বলেন, ঠিকই বলছি পাইসাহেব। নিজের ছেলেকে আমি চিনি। মেয়েদের ব্যাপারে তার সুনাম নেই। আপনার অনেকটা সময় নষ্ট করলাম। আচ্ছা চলি, নমস্কার। চলো তাপসী বলতে বলতে উঠে পড়েন।
আচ্ছন্নের মতো বসে ছিল তাপসী। সুনীতা আর বরুণ। সাত দিন ধরে অফিসে আসছে না, এটা জানার সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতর থেকে অসহ্য কান্না উঠে এসে গলার কাছে যেন ডেলা পাকিয়ে যাচ্ছিল। ধীরে ধীরে সে উঠে দাঁড়ায়।
বাড়ি ফিরে ড্রইং রুমে বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন মৃণালিনী। একটু দুরে একটা বেতের মোড়ায় তাপসীও শ্বাসরুদ্ধের মতো বসে ছিল। সে লক্ষ করে মৃণালিনীর মুখ লাল হয়ে উঠেছে। মনে হয় শরীরের সব রক্ত সেখানে গিয়ে জমা হয়েছে। তার ভেতরে যে মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো কিছু চলছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
একসময় উঠে দাঁড়ান মৃণালিনী। অস্থির পা ফেলে ফেলে ঘরময় ঘুরে বেড়ান। যেন কোনও কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। আধঘণ্টা এভাবে কাটার পর হঠাৎ যেন মনস্থির করে ফেলেন। তাপসীর কাছে এগিয়ে এসে বলেন, বউমা, তোমার কাছে আমার অপরাধের শেষ নেই। বিয়ের আগে তোমার দিকটা চিন্তা করিনি, নিজের স্বার্থই শুধু দেখেছি। এমন লম্পটের সঙ্গে তোমার সঙ্গে তোমার বিয়ে দেওয়া ঠিক হয়নি। স্বগতোক্তির মতো বলেন, ফুলের মতো একটা মেয়ের জীবন একেবারে নষ্ট করে দিলাম। পরক্ষণে তার ওপর কী একটা যেন ভর করে। ক্রুদ্ধ, হিংস্র ভঙ্গিতে বলেন, আমি ওকে ছাড়ব না। অনেক সহ্য করেছি, আর নয়। বউমা, তোমার বিরাট ভবিষ্যৎ পড়ে রয়েছে। সেজন্যে আমাকে কিছু করতেই হবে। আমি যা ডিসিসান নেব, সেটা তোমাকে মানতে হবে।
পাঁচ বছর বিয়ে হয়েছে তাপসীর, কিন্তু মৃণালিনীর এমন ভয়ঙ্কর চেহারা এই প্রথম দেখল। বিহুলের মতো আস্তে মাথা নাড়ে সে।
মৃণালিনী বলেন, সবার আগে দরকার ওদের খুঁজে বার করা। আরে আমার পিসতুতো ভাই সুরজিৎই তো রয়েছে লালবাজারে। মস্ত অফিসার। ওকে একটা ফোন করে জানাই
তাপসী ঝাপসা গলায় বলে, মা, ব্যাপারটা জানাজানি হলে
তাকে থামিয়ে দিয়ে মৃণালিনী বলেন, অনেকদিন চাপা দিয়ে রেখেছি। বহু আগেই স্টেপ নেওয়া উচিত ছিল। মাতৃস্নেহ আমাকে অন্ধ করে রেখেছিল। কিন্তু আর নয়
ড্রইংরুমের একধারে ঘোট টেবলের ওপর টেলিফোনটা থাকে। সেটা তুলে নিয়ে ডায়াল করে লালবাজারে সুরজিৎকে ধরে ফেলেন মৃণালিনী, বাপি, আমি সোনাদি বলছি। তার ডাকনাম সোনা।
ওধার থেকে সুরজিৎ কী বললেন, শোনা গেল না।
মৃণালিনী এবার বরুণ এবং সুনীতা সম্পর্কে সব জানিয়ে বললেন, সাতদিনের ভেতর ওদের খবর চাই। তারপর কথোপকথনটা এইভাবে চলল। কেলেঙ্কারি? তার আর কী বাকি আছে?…হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি কোনও কথা শুনব না!…ওকে একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার।…
সুরজিতের গলা শোনা না গেলেও তিনি কী বলছেন আন্দাজ করতে পারছিল তাপসী।
মিনিট দশেক কথা বলে ফোন নামিয়ে রাখেন মৃণালিনী। তারপর তাপসীর দিকে তাকান, বলেন, কোথায় লুকিয়ে থাকবে? পুলিশ না পারে এমন কাজ নেই, ঠিক খুঁজে বার করবে। তারপর আমি দেখব ও কত বড় বদমাস হয়ে উঠছে।
.
পরদিন বিকেলে মিস্টার পাইয়ের ফোন এল। ব্যাপারটা এত অপ্রত্যাশিত যে খুবই অবাক হয়ে গেলেন মৃণালিনী। জিগ্যেস করলেন, কোনও জরুরি খবর আছে পাইসাহেব?
মিস্টার পাই বললেন, হ্যাঁ ম্যাডাম। আপনি আপনার ছেলের সম্পর্কে ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন। তাই ইনফরমেশনটা দেওয়া দরকার মনে করলাম।
মৃণালিনী উন্মুখ হয়ে রইলেন, কিছু বললেন না।
মিস্টার পাই এবার যা বলেন তা এই রকম। বরুণ এবং সুনীতা তাদের অফিসে আর আসবে না, তারা রেজিগনেশান লেটার পাঠিয়ে দিয়েছে।
মৃণালিনী এতটা ভাবতে পারেননি। একটু চুপ করে থেকে বলেন, ওদের রেজিগনেশান অ্যাকসেপ্টেড হয়েছে?
হয়ে যাবে।
আমি যত দূর জানি আমার ছেলে যে পোস্টে কাজ করত তাতে রেজিগনেশান দিলেই অ্যাকসেপ্টেড হয় না। তার আগে মিনিমান তিন মাসের নোটিশ দিতে হয়।
তা হয়, কিন্তু যে কাজ করবে না ঠিক করেছে তাকে ধরে রাখা তো সম্ভব নয়। আজ হোক কাল হোক ছেড়ে দিতেই হবে। আমরা কোনও রকম তিক্তকা করতে চাই না।
মৃণালিনী বলেন, অফিসের যা নিয়ম তা তো মেনে চলতে হবে। মিস্টার পাই, ওকে সহজে ছাড়বেন না। যা খুশি তাই করবে সেটা কোনও ভাবেই মেনে নেওয়া ঠিক নয়। এতে আপনাদের অফিসে ইনডিসিপ্লিন বেড়ে যাবে।
মিস্টার পাই রীতিমতো অবাক হয়ে যান। মা হয়েও ছেলের বিরুদ্ধে বলছেন মৃণালিনী। এটা তাঁর কাছে অভাবনীয়। বললেন, কী করতে বলেন আপনি?
মৃণালিনী তীক্ষ্ণ স্বরে এবার বলেন, অফিসিয়াল প্রোসিডিওর যা, স্ট্রিক্টলি তা ফলো করা উচিত। বরুণকে অফিসে ডেকে পাঠান, তিন মাস ওকে আটকে রাখবেন। যেদিন অফিসে আসবে আমাকে জানাবেন। বরুণের হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না। অফিসে এলে তাকে ধরবেন, মৃণালিনী সেরকম ইচ্ছা।
মিস্টার পাই বলেন, কিন্তু সেটা বোধহয় সম্ভব হবে না।
কেন?
রেজিগনেশান লেটারের সঙ্গে অ্যাড্রেস দেয়নি বরুণ। ওর সঙ্গে যোগাযোগ করব কী করো?
হঠাৎ খুব হতাশা বোধ করেন মৃণালিনী। বলেন, আচ্ছা, ঠিক আছে। বলে ফোনটা নামিয়ে রাখেন।
.
এরপর চারটে দিন দারুণ অনিশ্চয়তার ভেতর কেটে যায়। সুনীতা আর বরুণ যখন একই দিনে রেজিগনেশান লেটার পাঠিয়েছে তখন এটা পুরোপুরি নিশ্চিত ওরা একসঙ্গেই আছে। কিন্তু কোথায়? কলকাতায়, না বাইরে চলে গেছে? কলকাতায় থাকলে তবু একটু আশা আছে, কিন্তু বাইরে গেলে ধরা ছোঁয়া যাবে কিনা কে জানে।
সারাক্ষণ বুকের ভেতর একটা তীব্র চাপা কষ্ট অনড় হয়ে থাকে তাপসীর। সারা রাত ঘুমোত পারে না। শুধু তাকেই না, বরুণের এই জঘন্য নোংরা আচরণ মৃণালিনীকে আমূল নাড়া দিয়ে গেছে। তাঁর মতো শান্ত গম্ভীর ধৈর্যশীল মানুষ আজকাল সারাক্ষণ ক্ষিপ্ত এবং উত্তেজিত হয়ে থাকেন। দিনে সাত-আটবার লালবাজারে সুরজিৎকে ফোন করেন। কেন এতদিনেও একটা সুশৃঙ্খল পুলিশবাহিনী বরুণ আর তাপসীকে খুঁজে বার করতে পারছে না সেজন্য যথেষ্ট বকাবকিও করেন। সুরজিৎ বোঝান, এক কোটি মানুষের এত বড় মেট্রোপলিসে দুই যুবক যুবতীর হদিশ পাওয়া খুব সহজ ব্যাপারে নয়। পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে কত দিন লুকিয়ে থাকবে? তবে কলকাতায় বাইরে চলে গেলে সমস্যাটা জটিল হয়ে উঠবে। তখন বিশাল দেশের নব্বই কোটি মানুষের ভেতর দুজনকে খুঁজতে হবে। কাজটা অত্যন্ত দুরূহ। তবে আজ হোক কাল হোক ধরা ওরা পড়বেই। ও ব্যাপারে সুরজিৎ শতকরা একশোভাগেরও বেশি নিশ্চিত।
সুরজিৎ যে পুলিশের কর্মক্ষমতা সম্পর্কে বাড়িয়ে কিছু বলেনি সেটা পাঁচদিনের দিন বোঝা গেল। দুপুরবেলা সবে তাপসীদের খাওয়া শেষ হয়েছে সেই সময় লালবাজার থেকে ফোন এল।
ফোনটা তাপসীই ধরেছিল। ওধারে সুরজিতের গলা শোনা যায়, কে, বউমা?
তাপসী বলে, হ্যাঁ, মামা
সোনাদিকে একটু ডাকো তো
মৃণালিনী খাওয়ার পর তার ঘরের ব্যালকনিতে চুপচাপ বসে ছিলেন। তাপসী গিয়ে তাকে ডেকে নিয়ে এল।
মৃণালিনী ফোন তুলে জিগ্যেস করেন, কী ব্যাপার রে বাপি?
সুরজিৎ বলেন, তোমাকে একটা সুখবর দিচ্ছি সোনাদি। রাজা আর ওই মেয়েটা কোথায় আছে জানতে পেরেছি।
মৃণালিনী ফোনের ভেতর প্রায় মুখটা ঢুকিয়ে রুদ্ধশ্বাসে বলেন, কোথায়?
লেকটাউনের একটা হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের ফ্ল্যাটে। এখন বলো ক্যালকাটা পুলিশ একেবারেই অপদার্থ নয় বলে শব্দ করে একটু হাসেন সুরজিৎ।
তার কথায় এবং হাসিতে সূক্ষ্ম খোঁচা ছিল। সেটা লক্ষ করেন না মৃণালিনী। বলেন, ঠিকানাটা দে
ঠিকানা জানাতে জানাতে সুরজিৎ বলেন, ওদের ওপর একজন প্লেন ড্রেসের পুলিশকে নজর রাখতে বলেছি যাতে অন্য কোথাও পালিয়ে যেতে না পারে। এখন কী করব?
তোর কিছু করতে হবে না। যা করার আমিও করছি।
তুমি কি ওখানে যাবে?
নিশ্চয়ই।
কিন্তু
কী?
বেশ শঙ্কিতভাবেই সুরজিৎ বলেন, তোমার না যাওয়াই ভালো। আমি বরং বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়িতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করি। তুমি গেলে হইচই চেঁচামেচি হবে। লোকজন মজা দেখার জন্যে ভিড় করবে। স্ক্যান্ডালের চুড়ান্ত হবে।
মৃণালিনী বললেন, স্ক্যান্ডালের বাকি কিছু আছে! এখন কিছু লোক জানে, দুদিন পর না হয় সবাই জানবে। সেই কলেজে ঢোকার পর থেকে জ্বালিয়ে আসছে। এবার যা হবার হোক। যে কোনও ইভেনচুয়ালিটির জন্যে আমি তৈরি। সুরজিৎকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে লাইন কেটে দিতে দিতে তাপসীকে বলেন, বউমা, জামাকাপড় পালটে নাও। আমিও শাড়িটা বদলে নিচ্ছি।
ভয়ে ভয়ে তাপসী জিগ্যেস করে, আপনি কি এখনই লেকটাউনে যাবেন।
হ্যাঁ। একা আমি না, তোমাকেও যেতে হবে।
কিন্তু
মৃণালিনী তীক্ষ্ণ চোখে তাপসীকে লক্ষ করতে করতে বলেন, লড়াইটটা আমার একার না, তোমারও। যাও–
আধঘণ্টার ভেতর দুজন বেরিয়ে পড়েন।
.
সুরজিৎ লেকটাউনের যে হাইরাইজের ঠিকানা দিয়েছেন তার নাম অপ্সরা। সেটা খুঁজে বার করতে অসুবিধা হল না।
ট্যাক্সি থেকে নেমে লিফটে করে মৃণালিনীর সঙ্গে সিক্সথ ফ্লোরে উঠতে উঠতে তাপসীর বারবার কেন যেন মনে হচ্ছিল যে যুদ্ধে তারা নেমেছে তাতে হার অনিবার্য। অথৈ নৈরাশ্যে ক্রমশ ডুবে যাচ্ছিল সে।
সিক্সথ ফোরে এসে সাত নম্বর ফ্ল্যাটে কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে দেয় বরুণ। মৃণালিনীদের দেখে ভয়ে তার মুখ রক্তশূন্য হয়ে যায়। কোনওরকমে সে বলতে পারে, তুমি-তোমরা! এ বাড়ির ঠিকানা কোথায় পেলে!
মুখ শক্ত হয়ে উঠেছিল মৃণালিনীর। কঠোর গলায় বলেন, তা নিয়ে না ভাবলেও চলবে। এক্ষুনি বাড়ি চলো–
এর মধ্যে নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে বরুণ। বলে, না। এখন আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব না।
কেন?
বরুণ উত্তর দেয় না।
মৃণালিনী কী বলতে যাচ্ছিলেন, এই সময় ভেতর থেকে একটি তরুণী বেরিয়ে আসে। গায়ের রং পাকা গমের মতো। চোখ ধাঁধিয়ে দেবার মতো তার চেহারা। মেয়েটার চিবুকের খাঁজে, ভেজা ভেজা রক্তাভ ঠোঁটে, ঢুলঢুলু চোখে, ডান গালে মটরদানার মতো একটি তিলে, নিটোল মসৃণ গ্রীবায় এমন এক উগ্র মাদকতা মাখানো রয়েছে যে তার দিকে তাকালে যে কোনও পুরুষের মন অশ্লীল হয়ে ওঠে।
তরুণীটি যে সুনীতা তা না বলে দিলেও চলে। একটু আগে লিফটে করে ওপরে আসতে আসতে তাপসী যা ভেবেছিল সে সম্পর্কে আর সংশয় থাকে না। এ যুদ্ধে জেতা অসম্ভব।
এদিকে প্রখর চোখে কয়েক পলক তরুণীটির দিকে তাকিয়ে থাকেন মৃণালিনী। তারপর বলেন, তুমি সুনীতা?
মেয়েটি আস্তে মাথা নাড়ে।
মৃণালিনী বলেন, তুমি কি জানো, আমার ছেলে বরুণ বিবাহিত?
সুনীতা বলে জানি।
তাপসীকে দেখিয়ে মৃণালিনী বলেন, এ হল তার স্ত্রী
সুনীতা একবার তাপসীকে দেখ মুখটা ফিরিয়ে নেয়।
মৃণালিনী বলেন, সব জেনেশুনে একটা সংসার নষ্ট করে দিচ্ছ কেন?
সুনীতা উত্তর দেয় না।
প্রচণ্ড রাগে শরীরের সব রক্ত হঠাৎ মাথায় উঠে আসে মৃণালিনীর। গলার শিরা ছিঁড়ে তিনি চেঁচিয়ে ওঠেন, শেমলেস ডার্টি বিচ—
তাঁকে থামিয়ে দিয়ে জ্বলন্ত চোখে তাকায় সুনীতা। ছুরির মতো ধারালো গলায় বলে, স্টপ। এই ফ্ল্যাটটা আমি ভাড়া নিয়েছি। আমাকে আর একবার গালাগাল দিলে আপনাকে বার করে দেব। আপনাদের পারিবারিক ব্যাপারে যা বলার বরুণকে বলবেন। সে নাবালক শিশু নয়, তাকে আমি ফুসলে নিয়ে আসিনি। বলে অত্যন্ত উদ্ধত ভঙ্গিতে যে ঘরটা থেকে বেরিয়ে এসেছিল, আবার সেখানে ঢুকে যায়।
মৃণালিনীর মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। বরুণকে বলেন, এক সেকেন্ডও আমি এই নরকে থাকছি না। প্যাসেজে চলো। সেটা নিশ্চয়ই ওই বজ্জাত মেয়েটা ভাড়া নেয়নি। বাইরে এসে বলেন, তোমার জন্যে একটা নোংরা বেশ্যা আমাকে অপমান করল।
বরুণ মুখ নামিয়ে শুধু বলে, তুমি এখানে এসেছ কেন?
স্থির দৃষ্টিতে ছেলেকে দেখতে দেখতে মৃণালিনী বলেন, খুব অন্যায় করে ফেলেছি। শেষ বারের মতো জিগ্যেস করছি, তুমি কি বাড়ি ফিরবে।
তোমাকে তো তখনই বললাম—
তার মানে ফিরবে না। কিন্তু বউমার কী হবে।
আমি কিছু জানি না। বিয়েটা তুমিই জোর করে দিয়েছিলে।
তোমার একেবারেই মত ছিল না, এই তো? তা হলে এক-দেড় বছর তার সঙ্গে ঘর করলে কী করে?
বরুণ বলে, সেটা তোমার মুখ চেয়ে।
মৃণালিনী বলেন, ও, আচ্ছা! তোমার মতো ইতর, লম্পটের সঙ্গে কথা বলতেও ঘেন্না হচ্ছে। এখন থেকে তাপসীর বা আমার সঙ্গে তোমার কোনও সম্পর্ক থাকবে না। চলো তাপসী।
দুজনে লিফটে করে নীচে নেমে আসনে। ট্যাক্সি ধরে বাড়ির দিকে ফিরতে ফিরতে তাপসীর কাঁধে একটা হাত রেখে নরম গলায় মৃণালিনী বলেন, ভেঙে পড়ো না মা। ওই রকম একটা লম্পটের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলে জীবন নষ্ট হয়ে যায় না। তোমার সামনে বিরাট ভবিষ্যৎ। তোমার জীবন আমি নতুন করে গড়ে দেব।
তাপসী কাঁদছিল। পরম মমতায় তার চোখ মুছিয়ে দেন মৃণালিনী।
দিন দশেক পর একজন পরিচিত লইয়ারকে ডেকে এনে তাপসীকে দিয়ে বরুণের বিরুদ্ধে ডিভোর্সের মামলা শুরু করিয়ে দেন মৃণালিনী। কারণ দুশ্চরিত্র স্বামীর লাম্পট্য। তারপর তাকে বি.টি, পড়বার জন্য কলেজে ভর্তি করে দেন।
আরো দুবছন বাদে পর পর দুটো ঘটনা ঘটে যায়। বি.টি. করার পর একটা নাম করা স্কুলে চাকরি পায় তাপসী। তার মধ্যেই বরুণের সঙ্গে তার বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল।
দ্বিতীয় ঘটনাটি মারাত্মক। হঠাৎ একদিন রাত্রে মাঝারি ধরনের হার্ট অ্যাটাক হয়ে যায় মৃণালিনীর। চারদিন ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে এবং আরো পনেরো দিন নাসিং হোমের কেবিনে থাকার পর বাড়ি ফিরে আসেন ঠিকই কিন্তু খাওয়া-দাওয়া, চলা-ফেরা–সবই ধরা বাঁধা। ডাক্তারের নির্দেশে সারাদিনই ফ্ল্যাটে আটকে থাকতে হয়, বাইরে বেরুবার উপায় নেই। স্কুলে ছুটি নিয়ে সারাক্ষণ তাঁকে আগলে আগলে রাখে তাপসী। রোজ একজন ডাক্তার এসে তাকে দেখে যান।
একদিন মৃণালিনী বললেন, তোমার সঙ্গে আমার একটা দরকারি কথা আছে মা।
আগে তাপসীকে বউমা বলতেন তিনি, কোর্ট থেকে পাকাপাকি বিবাহবিচ্ছেদের পর শুধু তাপসী বলেন কিংবা মা।
উৎসুক চোখে তাকায় তাপসী।
মৃণালিনী বলেন, আমার বয়স পঁয়ষট্টি পেরিয়েছে। কদিন আর বাঁচব! তার ওপর একটা স্ট্রোক হয়ে গেল। ডাক্তাররা বাড়ির ভেতর আটকে দিয়েছে। জীবন অনেকখানি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
তাপসী সন্ত্রন্ত ভঙ্গিতে বলে, এসব বলবেন না মা। আপনি এখনও অনেকদিন বাঁচবেন। আমি ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলেছেন তাদের কথামতো চললে কোনও ভয় নেই।
মৃণালিনী হাসেন, বলেন, ডাক্তাররা যাই বলুন, মৃত্যুর ওপর মানুষের হাত নেই। বিশেষ করে আমার যা বয়স তাতে সময় ফুরিয়ে আসছে। তার আগে তোমার ব্যাপারে আমার কিছু করণীয় আছে।
তাপসী বলে, আমার জন্যে যা করেছেন, আমার মা-বাবা বেঁচে থাকলে তা করতে পারত কিনা সন্দেহ। আপনার জন্যে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছি।
মৃণালিনী বলেন, আমাদের যা সোসাইটি তাতে একটি কম বয়সের মেয়ের পক্ষে তা যথেষ্ট নয়। রাজার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে তোমার কয়েকটা বছর আমি নষ্ট করে দিয়েছি। এবার তার ক্ষতিপূরণ করব।
মৃণালিনী ঠিক কী বলতে চান বুঝতে না পেরে তাকিয়ে থাকে তাপসী।
মৃণালিনী বলেন, আমি একটি ছেলেকে জানি, সে আমার এক ছাত্রীর দাদা। হি ইজ আ ব্রিলিয়ান্ট বয়। আমেরিকা থেকে ডক্টরেট করে এসেছে। এখানকার একটা ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। ভেরি অনেস্ট, চরিত্রবান। এখনও বিয়ে করেনি। নাম রজত। এই ছেলেটির সঙ্গে তোমার বিয়ে দেব। আমার বিশ্বাস, এবার তুমি সুখী হবে।
তাপসী হকচকিয়ে যায়। দুহাতে মুখ ঢেকে জোরে জোরে প্রবল বেগে মাথা নাড়তে নাড়তে বলে, না, না, এ হতে পারে না। আমি আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাব না।
কোথাও যেতে হবে না আপাতত। রজতের সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে। রেজিস্ট্রিটা হয়ে থাক। তারপর দেখা যাবে।
তাপসী কিছুতেই রাজি হয় না। সমানে কাঁদতে থাকে। তাকে কাছে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে মৃণালিনী অনেকক্ষণ বোঝন, আমার কিছু হলে কে দেখবে তোমাকে? মেয়েরা যতই স্বাবলম্বী হোক, তাদের একজন রক্ষাকর্তা দরকার।
একসময় কান্না থামে তাপসীর। মাথা নীচু করে ঝাপসা গলায় জিগ্যেস করে, আপনি তো বিয়ের কথা বলছেন। আমার সব কথা কি ওরা জানে?
জানে। আমি কিছুই লুকোইনি।
তাপসী আর কোনও প্রশ্ন করে না।
.
আরো মাস তিনেক বাদে ম্যারেজ রেজিস্ট্রারকে বাড়িতে ডাকিয়ে রজতের সঙ্গে তাপসীর বিয়ে দেন মৃণালিনী। এখনকার মতো রেজিস্ট্রি হয়ে রইল। পরে আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধবদের নেমন্তন্ন করে বড় হল-এ অনুষ্ঠান করা হবে।
বিয়ের মাসখানেক পর সজ্ঞানে, সুস্থ মস্তিষ্কে উইল করে ফেলেন মৃণালিনী। তার মৃত্যু হলে এই ফ্ল্যাট এবং তার জমানো সমস্ত অর্থ পাবে তাপসী।
অনেক বাধা দিতে চেষ্টা করেছিল তাপসী। মৃণালিনী শোনেননি।
এই মানুষটিকে বরুণের সঙ্গে বিয়ের পর খানিকটা চিনতে পেরেছিল তাপসী। তারপর বিবাহবিচ্ছেদ, রজতের সঙ্গে দ্বিতীয়বার বিবাহ এবং উইলের মধ্য দিয়ে সেই চেনাটা যেন সম্পূর্ণ হয়। জীবনে মৃণালিনীর মতো মানুষ আছে আর কখনও দেখেনি তাপসী।
পদ্মার ইলিস
ইলসা। খড়্গের মতো ধারালো জলতরঙ্গ। ঘোলা জলের ঢেউ খল-খল করে বাজে আচক্রবাল বিস্তারে। গম্ভীর রাত্রে আচমকা মনে হয় জিনলোকের সুপ্তিশয্যা থেকে কোটি কোটি প্রেতাত্মা জেগে উঠে মাতলা হাসি হাসতে হাসতে পারের জেলে কৃষাণের জীবন্ত জনপদগুলোকে অপমৃত্যুর ভয় দেখাচ্ছে। ধমনির ওপর এক ঝলক রক্ত চলকে ওঠে আতঙ্কে।
সেই ইলসা। ঢেউয়ের মুকুটে চড়িয়ে একমাল্লাই ই-ডিঙিগুলোকে বেপরোয়া উল্লাসে ছুঁয়ে দেয় মেঘের সামিয়ানা-টাঙানো আকাশে, তার পরেই মোচার ভোলার মতো টেনে নিয়ে আসে নিজের খরধারায়।
ইলসা-ডিঙিটার সামনের গলুই-এ বসে তিরিশ হাত জলের অতল গর্ভে কাসেম ছড়িয়ে দিয়েছে জালটা। হাতের সতর্ক মুঠোতে দড়ির খোট ধরা রয়েছে। তিরিশ হাত জলের অতলান্তে একটি অনিবার্য সংকেত; দড়িটায় স্পর্শ করেছে ইত্সার রুপালি ফসল। আর সঙ্গে সঙ্গেই মসৃণ নিয়মে দড়িটাকে টেনে দেবে কাসেম। জালের মুখ বন্ধ হয়ে যাবে ইসার গভীর পাতালে। তিরিশ হাত জলের অতলে, স্বাধীন বিচরণের সাম্রাজ্য থেকে বন্দি হয়ে কাসেমের ডিঙিতে উঠে আকাশ-প্রণাম করবে চাঁদের মতো রূপালি ইলিস। জালের খোট-ধরা মুঠোতে সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলোকে কেন্দ্রিত করে বসে আছে কাসেম।
টিপটিপ করে ইলসেগুঁড়ি ঝরে খই-এর মতো ফুটে উঠছে নদীতে। আকাশের পটভূমিতে অপরাজিতার মতো স্তবকে স্তবকে মেঘ জমেছে। শেষ ক্ষেপটা নৌকার ওপর তুলে ডোবার নীচে প্রসন্ন চোখে তাকাল কাসেম। নাঃ, বিশ কুড়ির মতো ইলিস পড়েছে আজ। পাইকারের নৌকায় তুলে দিলে তিরিশ-চল্লিশটা টাকা আজ মিলবেই। জালটা গুটিয়ে পাটাতনের নীচে রেখে দিল কাসেম। আজ আর মাছ ধরবে না। তার পর গু-গুন্ করে একটি আবিষ্ট নেশার গান ধরল পুলকিত গলায়–
ওগো, আমার আহ্লাদের স্বামী,
শ্বশুর বাড়ি যাইতে চাই কো নাইয়র দিবা নি?
এই ধর গো তুমি আমার চাবির ছোরানি।
তুমি আমার ট্যাকাপয়সা সিকি দোয়ানি।
ওগো, আমার আহ্লাদের স্বামী।
গানের রেশটা উজানি ঢেউ ছুঁয়ে ছুঁয়ে ছড়িয়ে পড়ল দুরতর ক্রান্তিরেখার দিকে।
সঙ্গে সঙ্গেই কাছের ইলসা-ডিঙিটা থেকে একটা উদ্দাম রসিকতা ভেসে এল; কে রে কাসমা না কি? একটা বউর লেইগ্যা মনটা বুঝি ফাকুর ফুকুর করে?
নিভন্ত গলায় কাসেম বলল; আমি কি সোয়ামীর গান গাই না কি? আমি গাই বউর বুকের পোড়ানির গান।
হ, হ, আমরা বেবাকই বুঝি। তুই যা শয়তান! বউর নাম কইর্যা তুই নিজের বুকের পোড়ানি কমাইস।
গানের সুর থামিয়ে দিয়ে চুপচাপ বসে রইল কাসেম। দূরের নৌকা থেকে আবারও সেই উদ্দাম গলাটা ভেসে এল; কি রে ঘরে যাবি না? আইজ কোন গঞ্জের পাইকাররে মাছ দিবি?
ইনামগঞ্জের।
ক্যান অতখানি গাঙ পাড়ি দেওনের কোন কাম? যে মেঘ জমছে, ডরে বুকের লৌ (রক্ত) পানি হইয়া যায়। এই মামুদপুরে মাছ বেইচ্যা ঘরে গিয়া কাথা মুড়ি দিয়া ঘুম লাগা। গাঙ্গের গতিক আইজ ভালো না কিন্তুক।
অন্তরঙ্গ গলায় সতর্ক করে দিল পাশের নৌকার ইঙ্গ-মাঝি।
না, না, ইনামগঞ্জ থিকা বউঠাইনের লেইগ্যা একখান থান কাপর নিতে লাগব। মামুদপুরে থান পাওয়া যায় না। সেই লেইগ্যা যাওন।
ওঃ, সেই হিন্দু বিধবা মাগিটা! মাথাটা বুঝি চাবাইয়া খাইছে তোর! পেতনিটারে খেদাইয়া একটা বউ ঘরে আন।
পয়গম্বরের গলায় হাবশি উচ্চারণের মতো উদাত্ত ভঙ্গিতে একটা পবিত্র পরামর্শ ভেসে এল।
অমুন কথা মুখে আনাও গুণাহ। কাসেমের গলায় নির্বাপিত প্রত্যুত্তর।
তবে গোরে যা হারামজাদা জিন। ভাগীদার মইরা গেছে, তার বউরে তা বইল্যা পুষতে হইব–এই কথা কোন কোরানে লিখা আছে? তুই কি তার লগে নিকাহ বসবি?
ছিঃ ছিঃ, কি যে কও ফরিদ চাচা!
একটা তীক্ষ্ণ অপরাধ বোধে ব্রহ্মতালুর মধ্যে রঙ বিঘূর্ণিত হতে লাগল কাসেমের।
ততক্ষণে পাশের নৌকাটা দূরতর ব্যবধান রচনা করতে করতে বিন্দুর মতো মিলিয়ে গিয়েছে মামুদপুরের দিকে।
সামনের গলুইটা থেকে পেছনের গলুইর দিকে একবার তাকাল কাসেম। আর সঙ্গে সঙ্গেই ইন্সর ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া একটা দমকা বাতাসের মতো বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটা হু-হুঁ করে উঠল। তিন মাস আগেও ওই গলুইতে হালের বৈঠাটা শক্ত মুঠোয় চেপে ধরে বসত জলধর। তার এই ইলসা মাছ ধরার ভাগীদার সে। আজ সেখানে কাটাল কাঠের বৈঠাটাই আড়কাঠের সঙ্গে বেঁধে ডিঙির দিকনির্দেশ নির্ভুল রাখে কাসেন; আর সামনের গলুইতে বসে ইলসা-জাল বায়।
হালের গলুইতে এসে বলল কাসেম। বৈঠাটা আড়কাঠ থেকে খুলে নিয়ে আকাশের দিকে নজরটা একবার ছড়িয়ে দিল। নলখড়ি স্কুলের মতো মেঘের স্তবক থেকে সন্ধ্যার ঘন ছায়াভাস নেমে এসেছে, বেলা শেষের সূৰ্য্যের ওপর অন্ধকার গুণ্ঠনের যবনিক টেনে দিয়েছে। কেউ। ঢেউ-এর নাগরদোলায় দোল খেতে খেতে ছল-ছল করে ইমামগঞ্জের দিকে এগিয়ে চলেছে কাসেমের একমাল্লাই জেলে-ডিঙিটা।
আচমকা ইলসার অবারিত বাতাসের অশ্রান্ত আকুলতায় জীবনের পাণ্ডুলিপিটা এলোমেলো হয়ে দুবছর আগের একটা অধ্যায় চোখের সামনে স্থির হয়ে দাঁড়াল। পদ্মাপারের মানুষ কাসেম। যাযাবর কোষ ডিঙিটায় ভাসতে ভাসতে কেমন করে যে ইসার পারে জলঘরের চৌচালা ঘরখানায় নোঙর ফেলেছিল–তা একটা অবাস্তব স্বপ্নের মতো অসত্য মনে হয়। এখানে এসেই তার বেবাজিয়া জীবনে প্রথম যতিচিহ্ন, প্রথম জন্মান্তর। তার পর জলধর আর জলধরের বউয়ের মায়ামধুর স্নেহ তার অস্থির পদচারণায় প্রথম বিশ্রান্তির কাছি পরাল। একসঙ্গে তারা খঙ্গাধার ইলসায় বের হত রুপালি ফসলের তল্লাশে। সেই জলধর-সাত দিনের জ্বরে চোখ দুটো পাকা ধানের রঙের মতো হলদে হতে হতে একদিন বিছানার মধ্যে নিথর হয়ে গেল; শরীরের সমস্ত উত্তাপ সরে গিয়ে একটা অর্থময় শীতলতা নেমে এল। সবচেয়ে বড় সত্যটা একটা ভয়ঙ্কর আতঙ্কের মতো জলধরের বউয়ের মর্মবিদারী চিৎকারের মধ্যে পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল। জলধরের ওপর মৃত্যুর নিম্মম একটা সমাপ্তি-রেখা টেনে দিয়েছে।
তার কয়েকদিন পর কাসেম বলেছিল ও তোমার কোনও কুটুম-বাটুম আছে বউ-ঠাইন; সেখানে যাইবা?
কোনও কালে আমার কেউ নাই ঠাকুরপো। আমি আর যামু কই? আমারে দুইটা লবণ-ভাত তুমি দিতে পারবা না? সোয়ামীর ভিটা ছাইড়্যা যামু আর কোন আখায়?
জলধরের বউয়ের বিবর্ণ চোখের তারায় সেদিন ছিল একটা অসহায় প্রার্থনা। অমুন কথা কইও না বউ-ঠাইন! আমার গুণাহ লাগে। আমি ভাবতে আছি, আমি মুসলমান, তুমি হিন্দু। মাইনষে কইব কি?
মাইনষের কওনেরে আমি ডরাই না, ঠাকুরপো তোমারে আমি আমার ছোট ভাই-এর লাঘান দেখি।
সেই থেকে জলধরের বউ আর কাসেম পাসাপাশি দুখানা চৌচালা ঘরের প্রতিমুগ্ধ আয়তনে ছড়িয়ে দিয়েছে নিজেদের।
ইতিমধ্যে নৌকাটা ইনামগঞ্জের বন্দরে এসে পড়েছে। দূর থেকে ইসা-মাঝিদের ডিঙিতে লাল লাল ইমলি পাখির মালার মতো রাশি রাশি আলোর লেখা দেখা যাচ্ছে।
.
ইলিস মাছ পাইকারের গাছি নৌকায় তুলে, বউঠাইনের জন্য একখানা থান কাপড় আর তিনপাসারী পানকাইজ ধান কিনে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত্রির পরমায়ু ত্রিযামা পেরিয়ে গেল। চারদিকের আকন্দ-বৈচির ঘুমন্ত অরণ্যবেষ্টনে জোনাকির দীপান্বিতা, আটকিরা-ঝোঁপের অন্তরাল থেকে ব্যাঙ আর ঝিঁঝিদের জলসার অকৃত্রিম ঐক্যতান ভেসে আসছে।
বৃষ্টিস্নিগ্ধ উঠান থেকে কাসেম ডাকল, বউঠাইন, বউঠাইনসঙ্গে সঙ্গেই কাঁচা বাঁশের ঝাঁপ খুলে বাইরে বেরিয়ে এল জলধরের বউ; হাতের কুপির আলো থেকে কনকপদ্মের মতো শিখা বিকীর্ণ হয়েছে তার নিঘুম আঁখিতারায়।
কাসেম বলল, এখনও ঘুমাও নাই বউঠাইন?
না, ঘরের পুরুষ মানুষ রইল বাইরে। আমি মাগি খাইয়া খাইয়া শরীলে (শরীরে) রস কইর্যা বুঝি ঘুমামু? অমুন আহ্বাদের মুখে ছালি পড়ুক। আস, আস খাইবার আস। এত দেরি করলা ক্যান?
ইনামগঞ্জে গেছিলাম। তোমার কাপড় নাই–এই ধরো। এইট্যা কিনতে গেছিলাম। আর এই ট্যাকাগুলা রাখো। আইজ বিস্তর মাছ পড়ছিল জালে। কোমরের গোপন গ্রন্থি থেকে অনেকগুলো কঁচা টাকা আর খানাখানা জলধরের বউয়ের হাতে ঢেলে দিল কাসেম।
তোমারে সেই কথা কইল কে? আমার কাপড় আছে আস্তা দুখান। এমুন কাম আর কইরো না।
বিব্রত গাম্ভীর্যের আবরণ নেমে এল জলধরের বউয়ের মুখের ওপর।
তোমার যে কত আস্তা কাপড় আছে, তা আমার জানা আছে। শিলাই কইর্যা পুরান কাপড়খান পরতে আছ আইজ এক মাস। আমার চৌখ আছে বউঠাইন! আমি অন্ধ না! আমি যা খুশি করুম। অভিমানের নিবিড় রেশ আসন্ন বর্ষণের প্রতীক্ষায় থম থম করতে লাগল কাসেমের গলায়।
এবারে ফিক করে হেসে ফেলল জলধরের বউ; আইচ্ছা, খুব কত্তা-পুরুষ হইছ একেবারে! এইবার থিকা যা খুশি কইর্যো। আমি কিছু কইতে যামু না। এখন খাইতে আস, রাইত পোহাইয়া আইল যে!
হ তাই করুম। তুমি কোনও কথা কইতে পারবা না। আমি না আইন্যা যদি জলধরদাদায় আইজ আইন্যা দিত! একদিন তুমি আমারে ছোট ভাই কইছিলা–মনে নাই? আমার মা-বাপের কথা মনে নাই! আছিলাম এক বেবাজিয়া (বেদে) বহরের মাঝি। তোমার কাছে মার সোহাগ পাইছি পরথম। অমুন কথা আর কইব না।
কান্নার মতো একটা ঘনকম্পিত অনুভূতি তখনও আঠার মতো জড়িয়ে রয়েছে কাসেমের গলায়।
এই মুহূর্তে সেই কান্নাটা সংক্রামিত হয়ে গেল জলধরের বউয়ের গলায়।
আর কইও না ঠাকুরপো! তুমি আমার মার প্যাটের ভাই এক দিকে, আর এক দিকে প্যাটের পোলা। তোমারে এটটু ঠাট্টা করছিলাম। তা-ও বোঝো না!
মাটির সানকিতে রাঙা বোরো চালের ভাত আর ইলিস মাছের সর্ষে-পাতরি সাজিয়ে কাসেমের সুমুখে এগিয়ে দিল জলধরের বউ। দু-এক গ্রাস ভাত মুখে দেবার পরেই জলধরের বউ বলল; একটা কথা কমু ঠাকুরপো?
কও। কদম্বরেণুর মতো গোঁফদাড়িতে আকীর্ণ মুখখানা তুলে ধরল কাসেম।
আমার কথা রাখলে তবে কই কথাটা।
তোমার কথা রাখুম না, এই একটা কথা হইল!
দুর্বিণীত অভিমানে ভাতের সানকি থেকে হাতখানা কোলের ওপর গুটিয়ে আনল কাসেম।
আমি রহিম খোন্দকারের মাইয়াটারে দেখেছি, বড় সোন্দর দেখতে। তোমার পাশে খাসা মানাইব। তোমার হইয়া আমি কথা দিয়া দিছি। পাঁচ কুড়ি টাকা বউ-পণ লাগব।
রুদ্ধশ্বাস আগ্রহে সামনে এগিয়ে এল জলধরের বউ।
না, না বউঠাইন! এখন সাদির ল্যাঠা থাউক। আর অত ট্যাকা দিমু কোথা থিকা বউ-পণের লেইগ্যা?
কাসেমের উদার আকাশের মতো দৃষ্টিতে বিস্ময়ের হালকা হালকা মেঘসঞ্চার।
ট্যাকার লেইগ্যা তোমার ভাবতে হইব না। আমি মুন্সীবাড়ি ভারা ভাইন্যা (ধান ভেনে) টাকার জোগাড় রাখছি। তুমি মত দিলেই হয়। বেরাজি হইও না। আমি একটা টুকটুকা বইন চাই। একলগে কাম করুম, একলগে হাসুম, একলগে গলা জড়াইয়া কান্দুম। জলধরের বউয়ের গলায় আকুলিত প্রার্থনা চকিত হয়ে উঠল।
বউ! তেইশ বছরের রোমাঞ্চিত কেলীতরঙ্গের মধ্য দিয়ে একটা অনাস্বাদিত শিহরণ বয়ে গেল কাসেমের। একটা বেনামি পুলকের অনুভূতিতে ধমনির ওপর রক্তে ঝলক লাগল আচমকা। ইসার নির্ধারিত পটভূমিতে আজ প্রথম সন্ধ্যায় বউর মোহকামনার স্বপ্ন এঁকে দিয়েছিল পাশের নৌকার মাঝি।
নিবিড় গলার নিশ্চুপ স্বরে কাসেম বলল, কোন একা পেতনির বাচ্চারে ধইরা আনবা–তোমার যত কথা বউঠাইন
আচমকা কোথা দিয়ে কী ঘটে গেল। নিরুৎসাহ গলায় জলধরের বউ বলল, না, না, সাদি তোমারে করতেই হইব। তোমারে-আমারে লইয়্যা পাঁচ জনে মন্দ কয়।
কী কইল্যা!
দূরের আকাশ থেকে দুজনের ব্যবধানের ভূমিতে একটা বজ্র এসে বিদীর্ণ হল যেন।
বাকি রাত্রিটুকু সন্নিহিত ঘরের মাচায় বিছানো জীর্ণ শয্যার ওপর বিনিদ্র চোখের প্রহর গুনে চলল কাসেম আর জলধরের বউ।
মাঝরাত থেকে ঝমঝম নূপুর বাজিয়ে বৃষ্টির উর্বশী-নাচ শুরু হয়েছে। ঘরের চালের ফাঁক দিয়ে বর্ষণ-প্লাবিত অন্ধকার আকাশ দেখা যায় এক টুকরো। দরের মাতলা ইলসার গজ্জিত ফোসানি ভেসে আসে। দুজনেই দুজনের নিধুম থাকার পরিষ্কার সংকেত পাচ্ছে।
আচমকা জলধরে বউ বলল, ঠাকুরপো!
কী? একটা গম্ভীর উত্তর ভেসে এল বেড়ার ও-পাশ থেকে। দরজাটা খুইল্যা কাথাখান নাও। বড় জবর কাল (শীত) পড়েছে। শ্যাষে আবার অসুখ-বিসুখ করতে পারে।
ঝাঁপ খুলে কথা হাতে বাইরে বেরিয়ে এল জলধরের বউ। পাশের ঘরের ঝপ খোলার শব্দ ভেসে আসে।
তিমির পিঠের মতো কালো আকাশের ওপর সপাং করে বিদ্যুতের চাবুক চমকাল একবার।
হো হো করে বৃষ্টি-তুফানের আবহ বাজনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হেসে উঠল কাসেম। আমরা গাঙের পোকা বউঠাইন। এট্ট কালে (শীতে) অসুখ ব্যারাম হইব আমাগো!
তার হাসিটা ইলসার দমকা বাতাসে মুছে গেল সহসা। খানিকটা সময়ের বিরতি-চিহ্ন। দুজনের মাঝখানে খানিকটা অন্ধকার অর্থহীন নীরবতায় স্থির হয়ে রয়েছে।
ফিসফিস গলায় জলধরের বউ বলল, সারা রাইত বিছানায় উসপাস্ করছ। ঘুমাও নাই এক দণ্ড-ক্যান ঠাকুরপো?
আশ্চর্য সংযত গলায় কাসেমের, তুমিও তো ঘুমাও নাই বউঠাইন, কি ভাবতে আছিলা? দাদার কথা?
সহসা কাসেমের সমস্ত শরীরে বর্ষাস্পন্দিত মেঘনার একটা চকিত দোলন লাগল। নীচু হয়ে জলধরের বউর পা দুখানার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সে; বউঠাইন, সত্য কথা কও। তুমি আমারে সন্দ করো? তবে আমি আইজই যামু গিয়া;
দুখানা হাতের স্নিগ্ধ বেষ্টনে কাসেমকে পায়ের আশ্রয় থেকে টেনে তুলল জলধরের বউ, ছিঃ, অমুন কথা আমার মনেও আসে নাই কোনও দিন, তুমি আমার ছোট ভাই। তবে মাইনষে কয়–তুমি সাদিটা কইর্যা ফেলাও। আমি বউ পণের ট্যাকা দিমু।
ও, এইর লেইগ্যা বুঝি আমারে না জানাইয়া মুন্সীবাড়ি ভারা ভাইন্যা (ধান ভেনে) টাকা কামাইছ? বেশ, তোমার কথা আমি রাখুম। তবে আমার মাথার কিরা আর কখনও দান ভানতে যাইবা না। আমি মরলে পরে যাইও। গাঢ় গলায় পিষ্ট কান্না ছড়িয়ে বলল কাসেম।
অন্ধকারের পটভূমিতে একটা দ্রোণফুলের মতো জলধরের বউয়ের হাসিটা ফিক করে ফুটে উঠল; হইচে, হইচে। এইবার ঘরে গিয়া শোও। এই নাও কাথাখান-মুড়ি দিয়া শুইও।
আর মস্করা কইরো না। কাথা দেওনের নাম কইর্যা নিজের জিদখান বজায় রাখলা। তুমি যা চতুর–এখন আর শুমু না। এইবার নদীতে যাই। আইজ বিস্তর মাছ পড়ব; মনে লয়।
দিকরাত্তিরে কাঁথা দেবার ভূমিকার নেপথ্যালোকে যে অর্থটি আত্মগোপন করে ছিল, তা পরিষ্কার ধরে ফেলেছিল কাসেম।
.
বউ-এর নাম ফুলমন। জলধরের বউ নিজের বেসর, বনফুল আর পৈছা সাজিয়ে দিল তার সারা দেহে। নাচের বিঘূর্ণিত ছন্দে যখন তখন ঘুরপাক খায় সে ঝম ঝম মল বাজিয়ে।
কবুতরের বুকের মতো নরম ঠোঁট দুটিতে পানের রক্তরাগ। সেই পানরাঙানো ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে মধুর ঝরাবার যে প্রত্যাশা ছিল জলধরের বউর, তার বদলে ফিনকি দিয়ে কালনাগিনীর বিষ বেরিয়ে এল এখানে আসার ষোলটা প্রহর পেরিয়ে যাবার পরই।
পাইকারের নৌকায় মাছ দিয়ে দশটা কাঁচা টাকা মিলেছিল; সেই টাকাটা জলধরের বউর হাতে যেই মাত্র অনেক দিনের মসৃণ অভ্যাসে গুঁজে দিল কাসেম; ঠিক তখনই চোখের মণিদুটো ভুরু-ধনু পার করে আসমানে তুলে ভুজঙ্গপ্রয়াত ছন্দে ঝঙ্কার দিয়ে উঠল; আগো আমার বাজান! কোন নিঃবইংশ্যার লগে আমার সাদি দিছিলা গো বাজান! ড্যাকরা হিন্দু বিধবা মাগির লগে মববৎ করে গো বাজান
বয়রা বাঁশের মাচায় একটা শরাহত ভাল্লুকের মতো গড়াতে লাগল ফুলমন।
কাসেম আর জলধরের বউ বদগ্ধ দৃষ্টিতে পরস্পরের দিকে নিস্পলক তাকিয়ে রইল।
এক সময় রুদ্ধবাক গলায় বলল জলধরের বউ, এইবার থিকা বউর হাতেই ট্যাকা দিও ঠাকুরপো। সত্য কথাই তো আমি রাঢ়ি মাগি, অলক্ষী। বউ মানুষ–ঘরের লক্ষ্মী। তার হাতেই দিও ঠাকুরপো।
শান্তিনিবিড় পৃথিবীর যে আকাশটাকে রামধনুর স্বপ্নমায়ার রঙে রঙে প্লাবিত করে দেবার কোমল বাসনা ছিল তাদের; সেই আকাশে প্রথম কালবৈশাখীর সঞ্চারে একটা অনিবার্য অশুভের সংকেত সূচিত হচ্ছে। সে কালবৈশাখী ফুলমন।
জলধরের বউ ঘরের ভেতর এসে কাঁচা বাঁশের ঝপ টেনে দিল; আর কাসেম ইলসার দিকে আবার ক্লান্তমন্থর শরীরটাকে বয়ে বয়ে নিয়ে গেল। বড় বিস্বাদ, বড় অপ্রত্যাশিত ঠেকছে আজকের এই সকালটা। প্রসন্ন রোদের সোনা আচমকা মেঘের ছায়াপাতে যেন বিবর্ণ হয়ে গিয়েছে।
বর্ষার বীতবর্ষণ আকাশের মতো থমথম করে কয়েকটা দিন পেরিয়ে গেল। সন্ধ্যার সময় তিন চাঙাড়ি ইলিস মাছ এনে উঠানে নামাল কাসেম, তারপর ডাক দেয়, অ বউঠাইন, অ বউ-তোমরা সব বাইরে আস।
ত্রস্ত পদক্ষেপে বাইরে বেরিয়ে এল জলধরের বউ। ফুলমন সস্তা দামের আয়নার সামনে সমস্ত মুখখানা অমানবিক ভঙ্গিতে দুলিয়ে দুলিয়ে সূৰ্মার সতর্ক রেখা আঁকছিল চোখের কোলে। কাসেমের ডাকটা কানের গুহাপথে প্রবেশ করবার সঙ্গে সঙ্গে কুৎসিত গলায় চিৎকার করে উঠল : ক্যা, হইচে কী ড্যাকরার? পিরীতের নাগরীই তো রইছে। তার কানে কইলেই হইব। ফুলমনের উন্মনা ভূঁইচাপার মতো অকলঙ্ক মুখখানার মধ্যে এমন একখানা ক্ষুর-শাণিত জিভের অস্তিত্ব কোথায় ছিল, সাদির আগে কাসেম কী জলধরের বউ কেউ তা আবিষ্কার করতে পারেনি। কাসেম বলল : বউঠাই, এইগুলান দিয়া লবণ-ইলিশ কইর্যা কইলকাতায় চালান দিলে ভালো কারবার হইব; পয়সাও আসব ভালোই। তুমি আর বউ মাছ কাইট্যা লবণ মাখাইয়া রাখো। নিথর গলায় জলধরের বউ বলল বউ পোলাপান মানুষ; আমিই একলা কাইট্যা লবণ দিয়ে মাইখ্যা রাখুম! তুমি হাতমুখ ধুইয়্যা ভাত খাইবা আস ঠাকুরপো!
একটু সময় নীরবতার যতিচিহ্নের মতো কেটে গেল। তারপর কাসেম প্রখর অভিযোগের গলায় বলল কী বউই আইন্যা দিছিলা বউঠাইন! আমি তখন কত বার না করলাম–এইবার ঠেলা সামলাও।
চুপ করো, বউ আবার শুনতে পাইব। পোলাপান মানুষ–ওরে এট্ট সোহাগ-আহাদ কইরো।
রাত্রিবেলা শুয়ে শুয়ে ফুলমনকে নিবিড় আলিঙ্গনের বেষ্টনে জড়িয়ে বুকের কাছে টেনে নিয়ে এল কাসেম। অতিকায় একটা কালো মাছের মতো প্রচণ্ড ঝটকায় বিছানার আর এক প্রান্তে সরে গেল ফুলমন। সামনের ইসা থেকে সারেঙ্গীর সুরের মতো ঢেউ-এর বাজনা ভেসে আসছে সোঁ সোঁ করে, হিজল-সুপারীর পাতায় পাতায় বাতাসের অশ্রান্ত মৰ্ম্মর। কাসেম আকুলিত গলায় বলল : অমুন করে না বউ, বউঠানাই আমাগো কত ভালোবাসে। বেবাজিয়া নৌকার মাঝি আছিলাম আমি। পদ্মার ওই দূর দ্যাশ থিকা ইসায় আইলাম। জলধর দাদায় আশ্রয় দিল–বউঠাইন মায়ের লাঘান বুকে নিল। অমুন কথা বউঠাইনরে কইস না।
বুকে নিল! সোহাক কইর্যা নাগরেরে বুকে নিল। ওঃ, সেইর লেইগ্যা বুঝি টাকা আইন্যা ওর হাতে দিস ড্যাকরা। ওর হাতে মধু আছে, ওর হাতে ভাতে মধু আছে। যা, যা ওর ঘরে যা–দ্যাখ গিয়া তোর গায়ের গোন্ধ না পাইলে আবার সারা রাইত ঘুম আসব না।
খিক খিক করে সারা দেহ-মন্থন-করা জিনলোকের হাসি হেসে উঠল ফুলমন।
বিস্রস্ত গলায় কাসেম বলল, চুপ চুপ! বউঠাইনে আবার শুনতে পাইব।
শুনতে পাইব, তো আমার কী? শোননের লেইগ্যই তো কই।
এইবার চুপ না করলে কবুতরের লাঘান গলাটা ছিড়া ফেলমু-হারামজাদি কাছিমের ছাও শুওর।
কাসেমের গলাটা একটা ভয়ানক ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিল।
চুপ করুম কার ডর! নিঃবইংশ্যা, ড্যাকরা, আল্লার অরুচি-ওগো বাজান! তোমার মনে এই আছিল! টাকার লেইগ্যা এই ছিনালের বাচ্চার লগে দিছিলা আমার সাদি গো বাজান!
বিনিয়ে বিনিয়ে আনুনাসিক গলায় সুর-লয়ে কান্নার ঢেউ ছড়াতে লাগল ফুলমন।
অনেকটা সময় দাঁতের ওপর দাঁত চাপিয়ে নির্মম সংযমে নিজের উত্তেজনাটাকে বাঁধ দিয়ে রাখল কাসেম; তারপর এক সময় ফুলমনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। অনেক দিনের অসহ্য আর বন্দী ক্রোধটা কিল-চড় আর অবিশ্রাম লাথির মধ্যে মুক্তি পেয়ে আছড়ে পড়তে লাগল ফুলমনের সারা দেহে।
ফুলমনের কথাগুলো শুনতে শুনতে পাশের ঘরে বিধ্বস্ত অনুভূতি নিয়ে নিশ্চুপ পড়ে ছিল জলধরের বউ। এবার সে দানা-পাওয়া গলায় চিৎকার করে উঠল; কী করো কী করো ঠাকুরপো! মাইয়া মানুষের গায়ে হাত তুলতে সরম লাগে না?
ঝাঁপ খুলে বাইরে বেরিয়ে এসে উঠানে দাঁড়াল কাসেম; কী বিজাত বউ যে আইন্যা দিছ বউঠাইন! সব তোমার দোষ, সব তোমার দোষ। এক মুহূর্তও আর ঘরে থাকতে ইচ্ছা হয় না। কাছিমের ছাওটা ঘরের মধ্যে যেন বিষ মাখাইয়া দিছে।
বিশৃঙ্খল পদসঞ্চারে ইলসার দিকে চলে গেল কাসেম।
মাছের চাঙাড়িগুলো উঠানের এক কিনারায় পড়ে রয়েছে; একটা উগ্র আঁশটে গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে বাতাসে।
খানিকটা সময় স্তব্ধ থেকে কুপি জ্বালিয়ে বঁটি নিয়ে বসল জলধরের বউ। সন্ধ্যারাত্রিরে কুমারবাড়ি থেকে অনেকগুলো নতুন হাঁড়ি এনে দিয়েছিল কাসেম। মাছ কেটে কেটে হাঁড়ি ভৰ্ত্তি করে নুন জারিয়ে রাখতে লাগল জলধরের বউ।
পোহাতি রাতে কাসেম ফিরে এল আবার। ব্যস্ত গলায় বলল; বউঠাইন, তোমারে কইতে ভুইল্যা গেছি। লবণ-মাছের চালান পাঠাইতে হইব আইজ সকালেই। শয়তানের ছাওটা গণ্ডগোল কইরা দিছে।
তোমার ব্যস্ত না হইলেও চলব। তোমার মাছ কাইট্যা আমি গুছাইয়া রাখছি। এই লইয়্যা যাও ঠাকুরপো।
লঘু-মৃদু হাসল জলধরের বউ।
অসীম কৃতজ্ঞতায় চোখ দুটো জলোচ্ছাসে ঝাপসা হয়ে গেল কাসেমের।
.
সকাল বেলা বয়রা বাঁশের মাচার ওপর থেকে উঠে বাইরে বেরিয়ে এল ফুলমন। সমস্ত মুখখানায় রক্তের ছোপ ছোপ স্বাক্ষর। কাসেমের হাত-পা ফুলমনের দেহের ওপর প্রলয় নাচ নেচেছে কাল রাত্রে।
ইতিমধ্যে গাঙের ঘাট থেকে গোটা কয়েক ডুব দিয়ে বিনিদ্র রাত্রির সমস্ত ক্লেদ ধুয়ে এসেছে জলধরের বউ; ফুলমনের মুখের ওপর আহত দৃষ্টিটা পড়তেই আর্তনাদ করে উঠল, ঠাকুরপোর রাগ উঠলে আর কাণ্ডজ্ঞেয়ান থাকে না। আয়, আয় বউ, আম তোরে গান্দার পাতা বাইট্যা দেই, মুখে লাগা।
একটা আলাদ গোক্ষুরের ল্যাজে যেন খোঁচা লেগেছে বল্লমের; সাঁ করে ফণা তুলে দাঁড়াল ফুলমন; হারামজাদি, কালামুখী বেউশ্যের আবার পীরিত উলাইয়া উঠছে। আমার লগে কথা কইবি না। তুই যেইখানে থাকবি, আমি সেইখানে নাই।
এই কী সব্বইশ্যা কথা কইস বউ!
গলাটা বিস্ময়ের কান্নায় রুদ্ধবা হয়ে রইল জলধরের বউয়ের।
সত্য কথা! তুই নামবি এই বাড়ি থিকা, না হয় আমিই এখন বাজানের বাড়িতে যামু গিয়া।
আমি গেলে গিয়া তুই খুশি হইস বউ? তোগো কাজিয়া বিবাদ যাইব গিয়া?
চোখের আকাশে যে বর্ষণ এতক্ষণ স্তব্ধ হয়েছিল, এবারে তা ঝরে ঝরে সমস্ত মুখখানা ভাসিয়ে দিল জলধরের বউয়ের!
নিচ্চয়; আমার সোয়ামীর কাঁচা মুড়াটা চিবাইছিস এতদিন, এইবার আমারে এট্ট চিবাইতে দে লো নটীর ছাও।
ফুলমনের গলায় আলাদ গোক্ষুরের ফণাটা ঘন ঘন আন্দোলিত হতে লাগল।
বেশ আমি যাইতে আছি গিয়া। আমার কে আছে–আমারে কে কী কইব? তুই ঘরের বউ, তুই সোয়ামীর ঘর থিকা নাইম্যা গেলে নিন্দা হইব, মাইনষে মোন্দ কইব।
হ হ, তাই যা তুই। মাগি রাঢ়ি বেউশ্যে।
এক সময় সামনের মুলিবাঁশ-ঝোপের ছায়ামেদুর যে পথটা কুমারীর অকলঙ্ক সাঁথির মতো নিরাভরণ রেখায় এঁকে বেঁকে মুন্সী-বাড়ির দিকে চলে গিয়েছে, সেই পথটার বাঁকের অদৃশ্য হয়ে গেল জলধরের বউ।
ঘরের ভেতর এসে ঝাঁপটা প্রচণ্ড শব্দে বন্ধ করে দিল ফুলমন। আর সঙ্গে সঙ্গে কাঁচা বাঁশের জানালার ওপর ভেসে উঠল দুটো কামনামুগ্ধ চোখ।
উচ্ছ্বসিত গলায় ফুলমন বলল; তুই আইছিস্ রুস্তম। কয়টা দিন হারামজাদা জিনের লগে শুইয়্যা আমার ঘুম হয় নাই। বাজানটা যা চশমখোর, ট্যাকার লেইগ্যা সাদি দিল এই বখিলটার লগে।
তোরে কয় দিন দেখি না। তুই একা খবরও দিস না। মাইয়া লোক যখন যেই মরদের গন্ধ পায়, তখন তার কথাই কয়।
অমুন কথা কইস না রুস্তুইম্যা। আমি তেমুন মাগি না। কিন্তু কী রকম, ওই বিধবা মাগিটা অষ্টপহর তাকে তাকে থাকে। শ্যাষে তোর আমার ব্যাপার জাইন্যা ওই মরদার কাছে কইলে, আমার পিঠের বাক্লা তুইল্যা ফেলাইত।
তা হইলে উপায়?
একটা অথৈ আশঙ্কার সমুদ্রে যেন নিরুপায় হয়ে হাবুডুবু খেতে লাগল রুস্তম। ডর নাই, মাগিরে কাইজা কইরা খেদাইছি। এইবার ঘর বান্ধনের ব্যবস্থা করো; আমি আর থাকুম না, এইখানে একদিনও।
ফিক করে আশ্বাসের হাসির প্রশ্রয় ছড়াল ফুলমন।
বেশ, ট্যাকা দে তিন কুড়ি।
নে। ভাঙা কাঠের বাক্স থেকে টাকা বের করে রুস্তমের হাতে ঢেলে দিল ফুলমন; এইবার যা। আবার আসিস রাইতে।
ঘরে তোর কাছে শুইতে দিবি তো?
ইলিশ মাছের রূপালি আঁশের মতো চকচক করতে লাগল রুস্তমের কদর্য চোখ দুটো।
যা ভাগ এখন, আসিস তো রাইতে। মরদটা না থাকলে
ফুলমনের সমস্ত দেহটাকে আর একবার দৃষ্টিভোজ করে চলে গেল রুস্তম।
সূর্যের আকাশ থেকে রাশি রাশি সোনালি রোদের বন্যা এসে পড়েছে ইসা-পারের মাটিতে। সাদা সাদা রেণু ছিটানো মানকচুর অরণ্যে সোতা খালটা পান্নার কণার মতো ঝিলমিল করছে।
আনন্দিত পদক্ষেপে বৃষ্টিকোমল মাটিতে এসে পুলকিত গলায় ডাকল কাসেম, বউঠাইন, অ বউঠাইন
পাকের ঘরে আজ সর্বপ্রথম আবির্ভাব হয়েছে ফুলমনের; ডালের উগ্র সম্বরা দিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল সে। প্রসন্ন হাসির অভ্যর্থনা জানিয়ে বলল; আস ঘরে আস–
দৃষ্টিটা বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে এনে অস্থির গলায় কাসেম বলল; বউঠাইন কই? আইজ তার লবণ-ইলিসে এক কুড়ি পাঁচ ট্যাকা লাভ হইচে। কই গেল বউঠাইন? তার লেইগ্যা আর তোমার লেইগ্যা কাপড় আনছি নয়া।
কই দেখি কাপড়? ব্যগ্র কৌতূহলে উঠানের পরিসরে নেমে এল ফুলমন।
বউঠাইন কই? কাসেমের গলায় কঠিনতম জিজ্ঞাসা।
রাঢ়ি মাগিরে খেদাইয়া দিছি। নির্লিপ্ত জবাব ভেসে এল ফুলমনের।
খেদাইয়া দিছ! কাসেমের সমস্ত ভঙ্গিমার ঘনীভূত আর্তনাদটা গলা বিদীর্ণ করে বেরিয়ে এল।
খেদাইয়া দিছি। হিঁদু মাগির লগে কোন পীরিত?
তবে আইজ যে লবণ-ইলিশের বায়না লইয়া আইলাম একশো রাইঙ (হাঁড়ি); সেই সব বানাইয়া দিব কে? তুই তো বাদশাজাদি; সূৰ্মা পরতে কাইট্যা যায় বেলা তিন পহর!
তার আমি জানি কী? ওগো বাজান-নিঃবইংশ্যা আমারে দিয়া বলদের লাঘান খাটানের লেইগ্যা সাদি করেছে গো বাজান! তুমি আমারে এই ড্যাকরার লগে দিছিলা সাদি গো বাজান। ফুলমন কাঁসর-পেটানো গলায় বিনাতে শুরু করল।
সামনের সূৰ্য্যদীপিত পটভূমিটা যেন অন্ধকারের অতলতায় নিঃশেষে তলিয়ে যাচ্ছে। চোখ দুটো দুটো হাতের ঢাকনায় আবৃত করে উঠানের ওপর বসে পড়ল কাসেম; খেদাইয়া দিলা–খেদাইয়া দিলা বউঠাইরে
.
একটু পরেই গাব-মাদারের রোদ-ঝলমল ছায়ার জাফরি-কাটা পথটা ধরে মুন্সীদের চেঁকি-ঘরটার কাছে এসে দাঁড়াল কাসেম। চেঁকি-ঘরটার সন্নিহিত একখানা ভাঙা একচালা। অনেক দিনের ঝড়-বর্ষণের শরাঘাতে হেলে রয়েছে এক দিকে; মাটির দেওয়া ঝরে গিয়ে বাঁশের খুঁটির কঙ্কাল আত্মপ্রকাশ করেছে।
ইতিমধ্যে মেঝেটা পরিচ্ছন্ন করে নিকিয়ে নিয়েছে জলধরের বউ। ভাঙা ইটের টুকরো দিয়ে উনুন রচনা করেছে।
কাসেম কান্নাপ্লাবিত গলায় বলল, ঘরে লও বউঠাইন। এইখানে আসছ; মানুষে আমারে মন্দ কইব।
না, ঠাকুরপো! আমি তোমার উপুর গোসা হইয়া আসি নাই। তোমরা সুখে-শান্তিতে ঘর-গৃহস্থী কর; আমি দূর থিকা দেখি।
জলধরের বউয়ের গলায় তীব্র অভিমানের উত্তাপটুকু স্পষ্ট হয়ে ফুটে বেরিয়ে এল।
তুমি যাইবা না তবে? আমি তোমার পর বইল্যা খেদাইয়া দিলা!
নাঃ, আমি গেলেই আবার তোমার সংসারে আগুন লাগব। বউ আমারে চায় না। তুমি ঘরে যাও ঠাকুরপো!
বউরে আমি খেদাইয়া দেই। তবু তুমি লও।
তুমি কেমুনতর সোয়ামী, চন্দ্রসূয্য সাক্ষী কইর্যা যারে সাদি কইর্যা আনলা-তারে খেদাইতে চাও? যাও, বেলা নাইম্যা গেছে। খাইতে যাও। জলধরের বউর গলাটা তীক্ষ্ণ ধমকে উচ্চকিত হয়ে উঠল।
বেশ, কিন্তুক আইজ আবার লবণ-ইলিসের বায়না দিছে। ফুলবিবি তো সুম্মা আর গন্ধ তেল ছাড়া কিছুই ধরে না। আমার কেউ নাই এই দুনিয়ায়–থাকলে কি আর অমুন কইর্যা ফেলাইয়া আইতে পারত? কাসেম ছোরা-কাটা লুঙ্গির প্রান্তে অশ্রুকম্পিত চোখ মুছতে মুছতে সেই বনছায়ার গোরোচনা-আঁকা পথটা দিয়ে ছুটতে ছুটতে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ঠাকুরপো!
ডান হাতটা সামনের দিকে প্রসারিত করে চিৎকার করে উঠতে চাইল জলধরের বউ। কিন্তু ভারী পাথরের মতো কান্নার অবরোধ সরিয়ে স্বরটা অত্মপ্রকাশ করতে পারল না।
.
সারাদিন আর উনুনের চিতা জ্বালেনি জলধরের বউ। মুন্সীদের ধান ভেনে একচালা ঘরখানায় এসে নতুন আখাটাকে ভেঙে ফেলল। তার পর উৎসুক-ব্যাকুল চোখ দুটো সতর্কভাবে পথের ওপর স্থির রেখে একটা অতি পরিচিত পদধ্বনি শুনবার জন্য চৌকাঠের ওপর বসে রইল। কিন্তু না, কৃষ্ণা চতুর্দশীর চাঁদটা পার হয়ে এসেছে। ত্রিযামা-পথিক শিয়ালের গলায় অনেকগুলো প্রহর ঘোষিত হয়ে গেল। তার আচ্ছন্নতা ছত্রখান করে মাঝে মঝে ঝরাপাতার ওপর দিয়ে ভাম-খটাসের শোভাযাত্রা চলে গেল। ধড়মড় করে উঠে বসেছে জলধরের বউ।
ততক্ষণে আসন্ন প্রভাতের আবছায়া আলোর ছোপ পড়েছে পুবালি দিয়ে। হাতের পাতা দিয়ে চোখ দুটো ঘষে ঘষে উঠে দাঁড়ালো জলধরের বউ।
কাসেম হয়তো তার তন্দ্রার অবসরেই মখমল-মৃদু পদক্ষেপে এ পথ দিয়ে চলে গিয়েছে; সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলো মথিত করে অশ্রুধারা নেমে আসতে চাইল জলধরের বউয়ের।
ইতিমধ্যে কখন যে মুন্সীবাড়ির ছোট কর্তা পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন খেয়াল ছিল না। পাশ ফিরতেই নজরে পড়ল ছোট কত্তার চোখজোড়া তার বিস্ত থানের বাতায়ন দিয়ে শরীরের অনাবৃত চামড়ার ওপর সড়কির আঘাতের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এস্তে কাপড়খানা গুছিয়ে নিয়ে ভীতি-চকিত গলায় জলধরের বউ বলল; আপনে এইখানে ছোট কত্তা?
এই তোমার এট্ট খবর-বাত্তা নিতে আইলাম। এই একচালা ঘরখানে থাকতে ডর লাগে না তো রাইতে?
না। ডরের কী আছে, আমার কী-ই বা আছে?
ছোট কর্তা বৈষ্ণব। সমস্ত শরীরে শ্রীকৃষ্ণের চন্দন-পদচিহ্ন; পাতলা নিমার নীচে তুলসীর মালার আধ্যাত্মিক ঘোষণা; চোখে প্রসন্ন গোপিনীদৃষ্টি। হাতের জপের মালায় উত্তেজনার ঝড়।
আপাততঃ তিনি কৃষ্ণভাবে ভাবিত; না, কইলেই হইল? তোমার যে কী আছে; কী আর নাই, তা কি তুমি জানো সুন্দরী! কত সাপ-খোপ, বদমানুষ আছে। তাগো হাত থিকা বাঁচাইতে হইব না কৃষ্ণের জীবেরে। রায়, নারায়ণ। তোমার কিছু ডর নাই। এই জায়গাটা বেশ নিরালা রাত্রে আইস্যা তোমার লগে কৃষ্ণকথা কওয়া যাইব। নারায়ণ, নারায়ণ রহস্যময় হেসে সামনের হেউলি ঝোপটার আড়াল দিয়ে মিশিয়ে গেলেন ছোট কত্তা, অনেক দূর থেকে তার অমৃতনিঝর কণ্ঠ ভেসে এল কয়েক কলি গানের সঙ্গে–
কৃষ্ণের যতেকে লীলা,
সর্বোত্তম নবলীলা,
নববধু তাহার স্বরূপ…
কানের ওপর একটা শঙ্খচূড় সাপের ছোবল পড়ল যেন। শিউরে উঠল জলধরের বউ।
.
সারারাত ক্ষ্যাপা নদীতে ইস্লা জাল বেয়ে অপরিসীম ক্লান্তির অবসাদে শরীরটা যেন ভেঙে ছত্রখান হয়ে গিয়েছে কাসেমের।
বাড়ির উঠানের ওপর আসতে আসতে মাথার ওপর সূর্যটা তির্যকভাবে লম্বিত হয়ে ঝুলতে লাগল; পায়ের নীচের ছায়াটা হ্রস্বতম হয়ে এসেছে। উঠানের ওপর পা দিয়েই শরীরের সমস্ত রক্ত ফেনিয়ে ব্রহ্মতালুতে গিয়ে আবর্তিত হতে লাগল কাসেমের।
নিরাবৃত বারান্দার ওপর রুস্তমের অন্তরঙ্গ আলিঙ্গনে ধরা রয়েছে ফুলমন। কী সে করতে পারে? হাতরে ধারালো ছেদা-খানা দুজনের গলার ওপ বসিয়ে একেবার সহমরণে পাঠিয়ে দেওয়া ছাড়া পুরুষের মতো বীৰ্য্যবান কাজ আর কী আছে? অথবা নিজের ঘাড়েই চাপিয়ে দেবে নাকি দা-টা? সমস্ত চিন্তা ইন্দ্রিয়কোষগুলো থেকে এক মুহূর্ত বিলুপ্ত হয়ে গেল কাসেমের।
আর বারান্দার ওপর থেকে রুস্তম আর ফুলমন একসঙ্গেই ভূত-দর্শনের পুলকিত শিহরণ অনুভব করল।
কয়েকটা নিষ্ক্রিয় মুহূর্ত রুদ্ধশ্বাস হয়ে রইল তিন জোড়া বজ্রপ্রহত চোখের নিস্পলক আয়নায়।
তারপর পুরুষের পলায়নের স্বাভাবিক প্রেরণায় রুস্তম ফুলমনকে বারান্দার ওপর আছড়ে ফেলে একটা জ্যা-মুক্ত তীরের মতো সাঁ করে বাইরে অরণ্যের বোরখায় মিলিয়ে গেল।
গন্ধসাবান-মাখা ফুরফুরে দেহটা থেকে ধূলোর কণাগুলো ঝেড়ে উঠে বসেছে ফুলমন।
কাসেমের গলাটা ডোরাকাটা বাঘের মতো গর্জন করে উঠল এই প্রথম। ও কে? ও আসে ক্যান?
প্রথমে রক্তধারার মধ্যে ভয়ের একটা আকস্মিক ছায়াপাত ঘটেছিল। এতক্ষণে নিজেদের সামলে নিয়েছিল ফুলমন; ও আসে ক্যান্ ওরে জিগাইও শরীরে তেল থাকলে! তুমি যাও ক্যান ওই রাঢ়ি মাগির বিছানায়?
সাবধান সুমুন্দির ঝি, তোরে আইজ কোতল করুম।
কাসেম হাতের ছো-খানা ছুঁড়ে মারার আগেই তৎপরতার সঙ্গে ঘরে ঢুকে ঝাঁপটা চক্ষের পলকে টেনে দিল ফুলমন। আর সেই কঁপের ওপর দা-খানা এসে আছড়ে পড়ল।
উঠান থেকে আবারও গর্জন করে উঠল কাসেম; তোরে আমি শ্যাষ করুম আইজ; তবে আমি শেখের ছাও। ওই কাছিমের বাচ্চাটারে আইন্যা একলগে তোগো দুইটারে ইসা মাছের লাঘান কুচি কুচি করুম।
ঘরের ভেতর থেকে আনুনাসিক ব্যঙ্গের অপমান ভেসে এল; তোর লাঘান কত ড্যাকরা দেখলাম রে নিঃবইংশ্যা! আমারে কাটব, আয় আগে তোর মাথা লামাইয়া দিই। রুস্তইম্যা তো আসবই, একশ ফির আসব। পারলে তুই তারে বান্ধিস, তবে বুঝুন এক বাপের বেটা তুই!
আহত পৌরুষের দাবদাহে চোখের মণি দুটো ফেটে যেন ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসবে, মনে হল কাসেমের।
অনুপায় আক্রোশে উঠানের দিকে একবার তাকাল সে। কয়েকদিন আগে এক কিনারায় লবণ-ইলিস করার জন্য কয়েক কুড়ি মাছ এনে রেখেছিল কাসেম। নগণ্য অবজ্ঞায় সেগুলো তেমনি পড়ে পড়ে পচছে; একটা উগ্র দুর্গন্ধ বাতাসের মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে গিয়েছে। দেখতে দেখতে কয়েক বিন্দু অশ্রু চোখের কোল বেয়ে লবণাক্ত আস্বাদের সঙ্গে ঠোঁটের ওপর এসে পড়ল কাসেমের। আর সঙ্গে সঙ্গেই চেতনার বিধ্বস্ত কোষে কোষে একখানা মুখ টলমল করে ভেসে উঠল। জলধরের বউ। বউঠাইন!
পেশিগুলো কেমন যেন অবসন্ন হয়ে আসছে। শিথিল পদসঞ্চারে বাইরে বেরিয়ে গেল কাসেম।
.
আবার তিন খণ্ড ইট তুলে এনে উনুন পেতে এক পাতিল ভাত ফুটিয়ে নিয়েছে জলধরের বউ।
এখন সন্ধ্যা। আম আর গাবপাতার প্রচ্ছটপটে রাত্রির শিলালিপি; মাঝে মাঝে জোনাকির সবুজ প্রদীপ জ্বলছে মিট মিট করে। টিনের কুপিটা থেকে ধোঁয়ামাখা লাল শিখাটা ছড়িয়ে পড়েছে অষ্টবক্র ঘরখানার আয়তনে।
মনের মধ্য দিয়ে ডুব-সাঁতারের মতো একটা অতঙ্ক পিছলে পিছলে গেল। একটু পরেই আবির্ভাব হবে ছোট কর্তার। এই ভাঙা ঘরের পাল্লাবিহীন আয়তনে অকলঙ্ক চরিত্রের নিরাপত্তা কোথায়? সে কি ফিরে যাবে কাসেমের কাছেই? কিন্তু ফুলমনের জিভ থেকেও গরল ঝরে যে!
আচমকা আত্মমগ্ন ভাবনাটা ছত্রখান হয়ে গেল। শুকনো ঝরা-পাতার ওপর পদধ্বনি। প্রথমে চমকে উঠেছিল জলধরের বউ। ছোট কর্তা নয় তো! নাঃ, টলতে টলতে মাতালের মতো মেঝের ওপর এসে আছড়ে পড়ল কাসেম। সারাদিন পেটের মধ্যে ক্ষুধার বাসুকি ফণা ঝাঁপটিয়েছে; চেতনার পর্দায় ফুলমন আর রুস্তমের বেআইনি আলিঙ্গনের যুগল-মূর্তি বিষের জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছে।
দুহাত ধরে কাসেমের নির্জীব দেহটা তুলে বসাল জলধরের বউ; ব্যস্ত গলায় বলল : কী হইচে ভাই, অসুখ ব্যারাম না তো!
না, বউঠাইন!
সারা দিনে খাইছ? কাজিয়া করছ বউর লগে?
জলধরের বউয়ের গলায় অবিরাম প্রশ্নের বিশৃঙ্খলা।
কী বউ যে দিছিলা বউঠাইন! ক্যান তুমি আমার লগে এই শত্রুতা করলা? ক্যান? আমি তোমার কাছে কী দোষ করছিলাম? সেই জবাব নিতে আইছি। দ্যাও জবাব দাও।
কাসেমের দুচোখ বেয়ে প্লাবন নেমে এল।
তোমার জবাব দ্যাওনের আগে আমার জবাব দ্যাও তো আগে। সারাদিনে প্যাটে দানা পড়ছে একটা? সত্য কইবা ঠাকুরপো!
গলার ওপর দিয়ে ইলসার একটা ঢেউ ছল ছল করে বয়ে গেল জলধরের বউ-র। আর মাথাটা গোঁজ করে নিরুত্তর বসে রইল কাসেম। তবে আগে ভাত খাইয়া লও।
হাত দুটো অঞ্জলির মধ্যে মুঠো করে একখানা মাটির সানকির সামনে কাসেমকে বসিয়ে দিল জলধরের বউ। তারপর পাতিল থেকে রাঙা আউশের মোটা মোটা ভাতগুলো ছড়িয়ে দিতে লাগল পাতের ওপর।
বিকেলের দিকে বৃষ্টি হয়েছিল; এখন আমের পাতা থেকে টুপ টুপ করে জলের বিন্দু ঝরছে।
এক গ্রাস সবে মাত্র মুখ তুলেছে কাসেম; আর সঙ্গে সঙ্গেই ঘটে গেল ঘটনাটা।
ঘরের পৈঠার কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন ছোট কর্তা। তাঁর চোখ দুটো তুলসী-বনের বাঘের মতো জ্বলছে ধক ধক করে। ঝকঝকে ছুরির ফলার মতো দাঁতগুলো বিকাশ করে চতুষ্পদের ভঙ্গিতে খিঁচিয়ে উঠল ছোট কর্তা, তাই কই নাগরখান কে? শ্যাষে শেখের হাতে ইজ্জৎ দ্যাও হিন্দুর বউ হইয়া! এই সব পাপ কাম এইখানে এই কৃষ্ণের রাজত্বে চলবে না। কলি কাল পড়েছে বইল্যা যা খুশি করবা মনে ভাইবো না।
কি কন আপনে? কাসেম আমার ছোট ভাই।
জলধরের বউয়ের গলায় ব্যাকুল আবেদন।
ছোট ভাই রাইতে আইস্যা বিছানায় থাকে বুঝি! দিনে খবর লয় না! আচমকা চিৎকার করে উঠলেন ছোট কর্তা। হরি, যুগেশ হরেন, সব লাঠি লইয়া আস-গেরামে পাপ রাখুম না। নারায়ণ, নারায়ণ-চক্ষের নিমেষে আটকিরার জঙ্গল দলিত করে লাঠি বল্লম নিয়ে শিকারের উত্তেজনায় ছুটে এল যোগেশরা।
ছোট কর্তা বৈষ্ণবীয় নির্দেশ দান করলেন, কিছু মনে কইরো না জলধরের বউ, সব কৃষ্ণের ইচ্ছা, যুগেশ
মুহূর্তে দুখানা লাঠি শূন্যে আন্দোলিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল কাসেমের ওপর। চড়াৎ করে খুলিটা ফেটে খানিকটা রক্ত চলকে এসে পড়ল সাদা সাদা ভাতের ওপর।
ও বাজান!
কপালের ওপর হাতখানা চাপা দিয়ে সাকিটার ওপর আছড়ে পড়ল কাসেম।
হায় ভগবান! তোমার মনে এই আছিল–সারাদিনের না-খাওয়া মানুষ জলধরের বউয়ের বুকফাটা আর্তনাদটা কুণ্ডলিত হয়ে আকাশের দিকে উঠে গেল। মুচ্ছিত হয়ে মেঝের ওপর লুটিয়ে পড়ল জলধরের বউ।
কৃষ্ণের ইচ্ছায় এইমাত্র যে কর্মটি হল সেই রক্তাক্ত বীরকীর্তির দিকে তাকিয়ে একবার প্রসন্ন গলায় নাম-কীর্তন করলেন ছোট কর্তা। নারায়ণ, নারায়ণ–
এত আনন্দের মধ্যেও একা অমসৃণ ভাবনা ময়না কাটার মতো চেতনায় খচখচ করতে লাগল। যবনের সঙ্গে কী করে পীরিত হল মাগিটার? সবই তার ইচ্ছা। মনে মনে ছোট কর্তা একবার জপ করে নিলেন; কৃষ্ণ পদে রাখ রে মন, সব জনমের ধন।
দিগ্বিজয় সমাপ্ত করে বাহিনী নিয়ে একটু পরেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন ছোট কর্তা।
.
চেতনা একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি কাসেমের, কপাল ফেটে ভিরমি লেগেছিল। ছোট কর্তারা বীর কর্ম সমাপ্ত করে চলে যাবার পরই উঠে বসল কাসেম। পাশে মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে রয়েছে জলধরের বউ। কাসেম ডাকল, বউঠাইন, বউঠাইন
কিন্তু জলধরের বউর দেহটা স্থির নিস্পন্দ। কুপির লালাভ আলোতে চোখের মণি দুটো নিথর হয়ে রয়েছে। এক পাশে ভাতের হাঁড়িটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে রয়েছে–চার দিকে রাশি রাশি ভাত ইতস্ততঃ ছড়ানো।
একটা নতুন পাতিল থেকে জল নিয়ে জলধরে বউর মুখে ঝাঁপটা দিতে লাগল কাসেম।
এক সময় বিস্ফারিত চোখের মণি দুটো নড়ে উঠল জলধরের বউর; গলার ধু ধু স্পন্দনে জীবনের মৃদু লক্ষণ, ঠাকুরপো।
তোমার মনে এই আছিল বউঠাইন, তোমার মনে এই আছিল–
জলধরের বউর শিয়র থেকে উঠে আম-সুপারীর গহন অরণ্যপথ ধরে ছুটতে শুরু করল কাসেম।
ঠাকুরপো-ঠাকুরপো–আমি কিছুই জানতাম না এইর
একটা করুণ আর্তনাদ যেন কাসেমের পদধ্বনি অনুসরণ করতে করতে একটা অপুর্ব মিনতির রেশ নিয়ে গড়িয়ে আসতে লাগল পেছন দিক থেকে।
সারাটা রাত ইলসার পার দিয়ে শ্মশান-কবর ডিঙিয়ে গতচেতন মাতালের মতো ঘুরপাক খেয়ে বেড়াল কাসেম। রাশি রাশি রক্ত মালতীর মতো আলো জ্বালিয়ে ইলিস-ডিঙিগুলো রুপালি ফসলের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছে। কিন্তু আজ আর ইসার জলতরঙ্গ তাকে হাতছানি দিল না। একটা নির্জন বিবরে জীবনের ক্ষতক্লেদ লেহন করবার জন্য নিরিবিলি অবসর খুঁজেছে সে; কিন্তু শরীরের সমস্ত রক্ত মাথার মধ্যে জমা হয়ে বিঘূর্ণিত হচ্ছে। আর সেই রক্তকেন্দ্র থেকে উল্কাপিণ্ডের মতো ছিটকে ছিটকে পড়ছে কতকগুলো মুখ-ফুলমন, বউঠাইন, মুন্সীদের ছোটকর্তা-দিবা-রাত্তিরে কাঁটালতা, ঝোপ-জঙ্গল আছাড় খেতে খেতে অবসন্ন চরণসঞ্চারে বাড়ির উঠানে পা দিল কাসেম; তার পর মৃত গলায় ডাকল, বউ, অ বউ-দুয়ার খোল।
দরজার পাল্লা খোলা রয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটা কেমন যেন চমকে উঠল কাসেমের।
একটা বিরাট লাফে উঠান থেকে ঘরের মধ্যে এসে পড়ল কাসেম। মাচার ওপর জীর্ণ বিছানায় কেউ নেই।
চেতনার মধ্যে একটা বিদ্যুতের চমক বয়ে গেল যেন। এস্তে ভাঙা কাঠের বাক্সটার কাছে চলে এল কাসেম। ডালাটা খুলবার সঙ্গে সঙ্গেই মুখের সমস্ত রক্ত সরে বিবর্ণ হয়ে গেল। কয়েক কুড়ি টাকা এনে রেখেছিল কাসেম, তার মধ্যে একটি অচল কড়িও অবশিষ্ট নেই।
সেখান থেকে একটা অগ্নিমুখী হাউইর মতো সরে এল পশ্চিমের বাঁশের খুঁটিটার দিকে। ফুকর করে করে কয়েক কুড়ি কাঁচা টাকা রেখেছিল, বাঁশ খুঁটিটা দুখণ্ড হয়ে পড়ে রয়েছে।
ফুলমনের সঙ্গে সেই অপরিচিত লোকটার অশোভন আলিঙ্গনের অর্থটা এতক্ষণে স্বচ্ছ আয়নায় মতো পরিস্কার হয়ে এসেছে কাসেমের কাছে। ফুলমন পালিয়ে গিয়েছে। ঘরের অভিশপ্ত পরিবেষ্টন থেকে বাইরের বারান্দায় এসে বসল কাসেম। শরীরের জোড়গুলো যেন শিথিল হয়ে আসছে। দুটো হাতের আবরণে মুখটা ঢেকে একটা বজ্ৰপ্ৰহত মানুষের মতো বসে রইল কাসেম। উঠান থেকে কয়েক দিন আগে এনে রাখা পচা ইলিশ মাছের তীক্ষ্ণ দুর্গন্ধটা বাতাসে বাতাসে বিষ ছড়াতে লাগল।
এক সময় পুবের ক্রান্তিরেখায় সূর্য সঞ্চারিত হল। রোদের একটা সোনালি রেখা এসে স্থির হয়ে জ্বলছে কাসেমের কপালের রক্তচিহ্নে।
আরক্ত চোখ দুটো তুলে চারিদিকে একবার তাকাল কাসেম। পচা মাছের দুর্গন্ধ, উঠানের আবর্জনা, কাকের মুখে মুখে চলে-আসা মাছের কাটা আর থমথম নির্জনতায় আগামী গোরস্থানের ভয়াবহ ইঙ্গিত!
বিক্ষত স্নায়ুগুলোর মধ্যে কালকের রাত্রিটাকে একবার ধরবার চেষ্টা করল কাসেম। একটা আতঙ্কময় দুঃস্বপ্নের মতো সেটা বারবার ছিটকে ছিটকে যাচ্ছে চেতনা থেকে।
উঠানের ওপর এসে দাঁড়াল মুন্সীদের ছোকরা গোমস্তা গোকুল, কাসেম ভাই, তোমার বউঠাইনে একবার যাইতে কইছে–
যাও, যাও। আমার বউঠাইন আবার কে? হিন্দু কখনও মুসলমানের আপন হয়? যাও, যাও
হাঁটু দুটোর অবরোধে মুখখানা আবার গোপন করল কাসেম। একটা বন্দী কান্নার আবেগ ঢেউ-এর মতো কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল সমস্ত দেহের ওপর।
গোকুল বলল, বেশ না আস, না আসবা। বউঠাইনে দুইটা ট্যাকা চাইছে। নৌকার ভাড়া লাগব। কেরায়া ভাড়া কইরা দিছি; পদ্মার পারে তার কোন মাসিবাড়ি যাইব না কী?
চকিত হয়ে উঠে দাঁড়াল কাসেম, কোনও চুলায় তার কোনও কুটুম আছে বইল্যা তো জানি না। কই সে?
খালের ঘাটে কেরায়া নৌকায় রইছে।
চিৎকার করে উঠল কাসেম। আমারে আগে কও নাই ক্যান, কেরায়া করণের আগে আমারে একবার খবর দিতে পারো নাই? দ্যাখতাম, কেমুন যাইতে পারে আমারে ফেলাইয়া। চলো, চলো। ইসার কাইতানের মতো হু-হুঁ করে খালের ঘাটে ছুটে এল কাসেম। কেরায়া নৌকার ছই-এর গুণ্ঠন থেকে জলধরের বউয়ের সাদা থানে আঁচল দেখা যায়।
নৌকার গলুইটা চেপে ধরল কাসেম। বিউঠাইন–গলা থেকে ভারী কান্না বেরুল তার।
না, ঠাকুরপো। আমার লেইগ্যা তোমার কষ্টের শ্যাষ নাই। বদনামের শ্যাষ নাই। কাইল আমার লেইগ্যাই মাইর খাইলা। আমারে দুইটা ট্যাকা দ্যাও। আমি যাই গিয়া।
জলধরের বউয়ের গলাটাও ঘনমন্থর।
তুমি আমারে ফেলাইয়া যাইতে পারবা?
বউ রইছে। তারে লইয়া সুখে ঘর করো ঠাকুরপো! রাজা হইও। একাট উত্তরঙ্গ কান্নার উৎক্ষেপকে দমন করে নিল জলধরের বউ।
জানো বউঠাইন, ওই কাছিমের ছাওটা কাইল একজনের লগে ট্যাকাপয়সা বেবাক লইয়্যা ভাগছে। এইর পরেও তুমি আমারে ছাইড়া যাইবা? অশ্রুঝরা চোখের করুণার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কাসেম।
ঘরের বউ পরপুরুষের লগে ভাগছে! ছই-এর অন্তরাল থেকে একটা চমকিত কণ্ঠ ভেসে এল।
হ, ভালোই হইছে। আপদটা ভাগছে। না হইলে কী তোমারে পাইতাম ফিরা? ঘরে মাছ পচতে আছে। একেবারে গোরস্থানের মতো হইয়া গেছে সব। আস, ঘরে চলো। এখন তুমি না থাকলে, আমি মইরাই যামু। বর্ষার ইসার মতো দুচোখ বেয়ে বন্যা নামল কাসেমের।
এতক্ষণ রোধ করে রাখবার পরে জলধরের বউয়ের কান্নাও সমস্ত বাঁধ ভাসিয়ে হু-হুঁ করে নেমে এল ছই-এর ভেতর।
মাঝি ব্যস্ত গলায় বলল, বেলা হইয়া গেল দুফার, এখন নৌকা না ছাড়লে, রাইত ভোর হইয়া যাইব পদ্মার পারে যাইতে।
রোদন আর পুলক-জড়ানো অপূর্ব অনুভূতির গলায় কাসেম বলল, তোমার আর রাইত ভোর করতে লাগব না মাঝি! বউঠাইনের যাওয়া হইব না। আমারে ফেলাইয়া কি বউঠাইন যাইতে পারি?
মানুষ
ঠিক দুপুরবেলা শেরমুণ্ডি পাহাড়ের কাছাকাছি আসতেই হুড়মুড় করে বৃষ্টিটা নেমে গেল।
সেই ভোরে—আকাশ তখন ঝাপসা, রোদ ওঠেনি, বাঁশের লাঠির ডগায় রঙ-বেরঙের তালি মারা ঝুলিটা বেঁধে এবং ঝুলিসুদ্ধ লাঠিটা কাঁধে ফেলে বেরিয়ে পড়েছিল ভরোসালালা সে আসছে রাজপুত ঠাকুর রঘুনাথ সিং-এর তালুক হেকমপুর থেকে, আপাতত যাবে শেরমুণ্ডি পাহাড়ের ওপারে টাউন ভকিলগঞ্জে.
ভোরে ভরোসালাল যখন হেকমপুর থেকে বেরোয় তখন আকাশের চেহারা দেখে টের পাওয়া যায়নি দুপুরের মধ্যেই চারদিক ভেঙেচুরে এভাবে বৃষ্টি নেমে যাবে। খুব নিরীহ চেহারার দু-চার টুকরো ভবঘুরে মেঘ মাথার ওপর বাতাসের ধাক্কায় ধাক্কায় এদিক-সেদিক ভেসে বেড়াচ্ছিল। তারপর বেলা একটু বাড়লে চাঁদির থালার মতো সূর্যটা আকাশের গড়ানে গা বেয়ে উঠে এসেছিল। গলানো রূপোর মতো ঝকঝকে রোদে মাঠ-ঘাট-বন-জঙ্গল ভেসে যাচ্ছিল তখন কিন্তু এই রোদ আর কতক্ষণ! বেলা আরেকটু চড়বার সঙ্গে সঙ্গে এক ছুঁতে বাতি নিভে যাবার মতো আচমকা চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছিল মকাইয়ের খেত, যবের খেত, আখের খেত, নানারকম ঝোপঝাড় আর হতচ্ছাড়া চেহারার দু-একটা গ্রাম পেরিয়ে আসতে আসতে ভরোসালালের অজান্তে কখন যে ভারী ভারী চাংড়া চাংড়া জলবাহী মেঘে আকাশ ছেয়ে গিয়েছিল, টের পাওয়া যায়নি ভরোসালাল চমকে উঠেছিল মেঘের ডাকে, সেই সঙ্গে তার চোখে পড়েছিল আকাশটা আড়াআড়ি চিরে বিদ্যুৎ ছুটে যাচ্ছে।
মাথার ওপরে মেঘ আর বিদ্যুৎচমক নিয়ে জোরে জোরে পা চালিয়ে দিয়েছিল ভরোসালালা আজ যেমন করেই হোক, তাকে শেরমুণ্ডি পাহাড়ের ওপারে ভকিলগঞ্জে পৌঁছতেই হবে।
হাঁটতে হাঁটতে ঘাড় ফিরিয়ে বার বার পেছন দিকটা দেখে নিচ্ছিল ভরোসালালা হঠাৎ একসময় অনেক, অনেক দূরে আকাশ যেখানে পিঠ বাঁকিয়ে দিগন্তে নেমেছে সেখানটায় বৃষ্টি নেমে গিয়েছিল। জল নামতে দেখে দৌড়তেই শুরু করেছিল ভরোসালাল কিন্তু বৃষ্টিটা নাছোড়বান্দা হয়ে তার পিছু নিয়েছে। শেষ পর্যন্ত শেরমুণ্ডি পাহাড়ের তলায় এসে তাকে ধরেই ফেলেছে।
বেশ কোমর বেঁধেই নেমেছে বৃষ্টিটা। তার সঙ্গে হাত মিলিয়েছে উল্টোপাল্টা ঝড়ো হাওয়া। এই ঝড়বৃষ্টি ঘাড়ে নিয়ে সামনের খাড়া পাহাড়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ভরোসালাল এদিক-সেদিক তাকাতে লাগল। এই মুহূর্তে মাথা বাঁচাবার জন্য কোথাও একটু দাঁড়ানো দরকার। হঠাৎ সে। দেখতে পেল, খানিকটা দূরে একটা ঝাঁকড়া-মাথা পিপুল গাছের তলায় দশ-বারোটা দেহাতী লোক দাঁড়িয়ে আছে, তাদের মধ্যে একটা মেয়েও রয়েছে।
বোঝা যাচ্ছে, বৃষ্টির জন্যই ওরা ওখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। গাছতলায় মাথা গুঁজে জলের ছাঁট থেকে নিজেদের যতটা বাঁচানো যায়। ভরোসালাল দৌড়ে সেখানে চলে গেল।
ভরোসালালের বয়স পঞ্চাশ-বাহান্না শরীরের কাঠামো দারুণ মজবুত চওড়া ছড়ানো কাঁধ তার, এবড়ো-খেবড়ো পাথরের মতো প্রকাণ্ড বুক, হাতদুটো জানু ছাড়িয়ে কয়েক আঙুল নেমে গেছে। গায়ের চামড়া পোড়া ঝামার মতো, সাত জন্মে সেখানে তেল পড়ে না। ফলে বারোমাস খসখসে কর্কশ গা থেকে খই উড়তে থাকে। চৌকো মুখে খামচা খামচা দাড়ি তার, থ্যাবড়া থুতনি। চেহারা যেমনই হোক, চোখদুটো কিন্তু আশ্চর্য মায়াবী যেমনি সরল তেমনি নিষ্পাপ।
ভরোসালালের পরনে হাঁটু পর্যন্ত খাটো টেনি আর ফতুয়ার মতো লাল কামিজ। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে তার ঘাড়ের অনেকখানি মাংস শুকিয়ে ডেলা পাকিয়ে প্রায় ঝুলে আছে। বাঘের থাবা খেয়ে ঘাড়টার অবস্থা এই রকম
ভরোসালাল একজন ‘বীটার’। এ অঞ্চলে যাকে জঙ্গল-হাঁকোয়া বলে সে তা-ই। তার কাজ হল বনে-জঙ্গলে টিন পিটিয়ে আর চেঁচিয়ে তাড়া করে করে বাঘ ভাল্লুক কিংবা অন্য জন্তু-জানোয়ারকে শিকারীদের বন্দুকের মুখে নিয়ে যাওয়া। বছর তিনেক আগে রক্সেলে এক শিকারীর জন্য টিন পেটাতে গিয়ে বাঘের থাবায় ঘাড়ের মাংস ওইভাবে ঝুলে গেছে। ‘বীটারের কাজ ছাড়া আরো একটা কাজ করে থাকে ভরোসালাল। চারিদিকে যত ছোটখাটো শহর আছে, সেসব জায়গায় মিউনিসিপ্যালিটিগুলো মাঝে মাঝে রাস্তার বেওয়ারিশ খ্যাপা কুকুর ধরে মেরে ফেলে। এই কুকুর ধরা আর মারার কাজটিও করে থাকে সে।
বীটারের কাজ কিংবা কুকুর মারার দায়িত্ব কেউ তাকে ডেকে দেয় না। ভরোসালাল নিজে থেকেই খোঁজ-খবর নিয়ে শিকারীদের বাড়ি বাড়ি কিংবা মিউনিসিপ্যালিটিগুলোর দরজায় দরজায় হানা দেয়। এটাই তার জীবিকা। খুবই নিষ্ঠুর হয়তো, কিন্তু স্রেফ পেটের জন্য এসব করতে হয় তাকে।
এদিকে বৃষ্টির জোর আরো বেড়েছে। আকাশের যা অবস্থা তাতে জল কখন ধরবে তার ঠিক ঠিকানা নেই। ঝাঁকড়া-মাথা পিপুল গাছের তলায় দেহাতী মানুষগুলোর সঙ্গে গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়েও কি রেহাই আছে! ডালপালা আর পাতার ফাঁক দিয়ে ঝরঝর জল পড়ে গা-মাথা ভিজিয়ে দিচ্ছে। তবে খোলা জায়গায় দাঁড়ালে চোখের পলকে চান হয়ে যাবে। সেই তুলনায় এখানে ভেজাটা কম হচ্ছে, এই আর কি।
অন্যমনস্কর মতো তাকিয়ে তাকিয়ে বৃষ্টির ভাবগতিক দেখছিল ভরোসালাল। হঠাৎ পাশের লোকটা বলে উঠল, ‘বহোত ভারী বারিষ (বৃষ্টি)!
ভরোসালাল ঘাড় ফেরাল। দেখল—লোকটা মধ্যবয়সী, মাথায় পাগড়ী, ভাঙাচোরা চেহারা। সে বলল, ‘হাঁ–’।
লোকটা এবার বলল, মালুম হচ্ছে এ বারিষ জলদি রুখবে না। ‘ তার ভাষা হিন্দি এবং বাংলায় মেশানো। খুব সম্ভব বিহার-বাংলার সীমান্তে কোন অঞ্চলে তার বাড়ি।
ভরোসালাল বলল, ‘হাঁ–’।
মধ্যবয়সী লোকটা এবার তার সঙ্গীদের দেখিয়ে বলল, ‘দুফারে হামলোককো টেউন ভকিলগঞ্জে যাবার বাত ছিল। লেকিন কী করে যাই?
বোঝা যাচ্ছে, এরাও শেরমুণ্ডি পাহাড় পেরিয়ে ওপারে যাবে। ভরোসালাল কৌতূহলহীন চোখে লোকটার সঙ্গীগুলোকে একবার দেখে নিল। তারা অবশ্য এই লোকটার মতো মাঝবয়সী না, দামড়া মোষের মতো তারা একেকটা তাগড়া জোয়ান। তাদের দেখতে দেখতে সেই মেয়েটার দিকে নজর পড়ে গেল ভরোসালালেরা দলটার মধ্যে সে একা—একমাত্র মেয়ে।
জীবন বা মানুষ সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা খুবই কম ভরোসালালেরা জোয়ান বয়সের শুরু থেকে বনের হিংস্র জন্তু-জানোয়ার আর খ্যাপা কুকুরের পেছনে ছুটে ছুটে এতগুলো বছর কেটে গেছে। তার। তবু সে বুঝতে পারল মেয়েটা গর্ভিণী। দু-চার দিনের মধ্যে তার বাচ্চাটাচ্চা হবে।
পাশের লোকটা প্রচণ্ড বক বক করতে পারে। এবার সে যা বলল সংক্ষেপে এইরকম বৃষ্টিতে ভিজে পাহাড়ী রাস্তার হাল খুবই বুরা (খারাপ হয়ে গেছে। এখন সেখানে উঠতে যাওয়া বোকামি,
পা পিছলে পড়ে গেলে আর দেখতে হবে না—নির্ঘাত খতম হয়ে যেতে হবে মেয়েটির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে ভরোসালাল বলল, হাঁ—’।
লোকটা এবার বলল, ‘লেকিন দুফারের ভেতর ভকিলগঞ্জে হাজির হতে না পারলে কামটা ছুটে যেতে পারে?’ তাকে খুবই চিন্তিত দেখাল।
‘কিসের কাম?’
‘ভকিলগঞ্জে নদীর কিনারে বাঁধ বানানো হবে। আমরা মাটি কাটার কামে যাচ্ছি। দেরি হয়ে গেলে গরমিন অফসর (গভর্নমেন্ট অফিসার) যদি ভাগিয়ে দ্যায়—’।
‘রামজী কিরপা করলে ভাগাবে না।’ বলতে বলতে আবার মেয়েটির দিকে তাকাল ভরোসালাল। পৃথিবীর কোন কিছু সম্বন্ধেই বিশেষ কৌতূহল নেই তারা নিজের পেটের জন্য বনে-জঙ্গলে বা লোকালয়ে সর্বক্ষণ তাকে এত ব্যস্ত থাকতে হয় যে অন্য দিকে চোখ তুলে তাকাবার সময় পর্যন্ত পায় না যদিও বা পায়, খুবই আগ্রহশূন্যভাবে এই পৃথিবী আর পৃথিবীর মানুষকে দেখে থাকে। তবু আবছাভাবে ভরোসালাল ভাবল, ওই মেয়েটির পেটে অন্তত ন-দশ মাসের বাচ্চা রয়েছে। এ অবস্থায় সে-ও কি মাটি কাটতে চলেছে? জেনানাদের এ সময়টা কোনো ভারী কাজ করা ঠিক না ভাবল বটে, তবে কিছু বলল না।
সেই লোকটা ঘাড়ের পাশ থেকে বলে উঠল, রামজী কি কিরপা করবে?
ভরোসালাল এবার আর উত্তর দিল না। অন্যমনস্কের মতো মুখ ফিরিয়ে মেঘের ভারে নেমে আসা ঝাপসা আকাশ দেখতে লাগল।
কিন্তু উত্তর না দিলে কী হবে, পাশের লোকটা ঘ্যানঘেনে বৃষ্টির মতো সমানে বকে যাচ্ছে।
কতক্ষণ পিপুল গাছটার তলায় দাঁড়িয়েছিল, খেয়াল নেই ভরোসালালের। হঠাৎ একসময় বৃষ্টির তোড় কমে এল, সেই সঙ্গে ঝড়ের দাপটও। তবে আকাশ ভারী হয়ে আছে। যে কোনো মুহূর্তে প্রবল বেগে আবার শুরু হয়ে যেতে পারে।
সেই লোকটা কানের পাশ থেকে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, ‘বারিষ ধরে এসেছে। এই মওকায় পাহাড় পেরুতে হবে।’ বলেই সঙ্গীদের উদ্দেশে জোরে জোরে হাঁকল, ‘অ্যাই ছোকরারা—চল চল, জোরসে পা চালা’—সবাইকে তাড়িয়ে নিয়ে সে পাহাড়ের দিকে চলল।
দলটা আগে আগে চলেছে। তাদের পেছনে রয়েছে সেই মেয়েটা ভরোসালাল এই সুযোগটা ছাড়ল না। মেয়েটার পেছন পেছন সে-ও হাঁটতে লাগল। বৃষ্টির জোর নতুন করে বাড়বার আগেই সে-ও শেরমুণ্ডি পাহাড় পেরিয়ে যেতে চায়।
দিন কয়েক আগে ঠাকুর রঘুনাথ শিং শিকারে যাবে—এই খবরটা পেয়ে হেকমপুর তালুকে ছুটে গিয়েছিল ভরোসালাল। পুরো চারটে দিন রঘুনাথ সিংয়ের সঙ্গে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে টিন পিটিয়ে মোট দশটা টাকা আর তিন কিলো মাইললা মজুরি হিসেবে পেয়েছে। সেই টাকাটা তার কোমরে গোঁজা রয়েছে, আর মাইলোগুলো তার চিত্রবিচিত্র ঝুলিটায়।
হেকমপুরে থাকতে থাকতেই সে খবর পেয়েছিল, পূর্ণিয়া টাউনে দু-চার দিনের মধ্যে খ্যাপা কুকুর মারা হবে। তাই রঘুনাথ সিংয়ের শিকার শেষ হতে না হতেই সে বেরিয়ে পড়েছে। শেরমুণ্ডি পাহাড় ডিঙিয়ে ওপারে টাউন ভকিলগঞ্জে আজকের রাতটা কাটাবে ভরোসালাল। তারপর কাল সকালে উঠে চলে যাবে সগরিগলি ঘাটে, সেখানে নদী পেরিয়ে পূর্ণিয়া টাউনের দিকে হাঁটা শুরু করবে।
যাই হোক, এই শেরমুণ্ডি পাহাড়টা ভয়ানক রকমের খাড়া তার সারা গায়ে ঘন অরণ্যা শাল আর মহুয়ার গাছই এখানে বেশি করে চোখে পড়ে। অবশ্য আমলকী, দেবদারু, কেঁদ আর ট্যারাবাঁকা চেহারার অগুনতি সিসম গাছও চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। এছাড়া আছে নানা ধরনের ঝোপঝাড়, সাবুই ঘাস এবং আগাছার জঙ্গল।
জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা পায়ে চলার রাস্তা উঠে গেছে। সেই রাস্তা এই মুহূর্তে অত্যন্ত বিপজ্জনক। কেননা যদিও এটা একটা পাহাড়, তবু হাজার হাজার বছরের ঝড়বৃষ্টিতে পাথর ক্ষয়ে ক্ষয়ে এর গায়ের ওপর চামড়ার মতো মাটির একটা স্তর জমেছে। বৃষ্টিতে সেই মাটি গলা মাংসর মতো থকথকে হয়ে আছে।
খুব সাবধানে পা ফেলে ফেলে ওরা পাহাড় বাইছিলা বৃষ্টির জোর কমে এলেও অল্প অল্প পড়েই যাচ্ছে। হাওয়ার দাপটও আগের মতো নেই। দু-ধারের ঝোপ-ঝাড় থেকে ঝিঝিদের একটানা চিৎকার উঠে আসছিলা গাছের মাথায় সরু-মোটা, নানা বিচিত্র সুরে পাখিরা একটানা ডেকে যাচ্ছে। কোথায় যেন সাপেদের পেট টেনে টেনে চলার শব্দ হচ্ছে।
সেই মধ্যবয়সী লোকটা মাঝে মাঝেই তার সঙ্গীদের উদ্দেশে হেঁকে উঠছিল, ‘জলদি পা চালা। হো রামজী, দুফার পার হয়ে গেল!
চারিদিকের নানারকম শব্দ বা মধ্যবয়সী লোকটার হাঁকাহাঁকি শুনেও যেনে শুনতে পাচ্ছিল না ভরোসালাল। দূরমনস্কর মতো খাড়াই পাহাড় ভাঙছিল সো নেহাত বৃষ্টিটা হঠাৎ এসে গেছে। নইলে তাড়াহুড়ো করে ওপারে যাবার খুব একটা দরকার তার নেই। কারণ আজকের দিনটা তার বিশ্রামা টাউন ভকিলগঞ্জে একবার পৌঁছতে পারলে ধীরে সুস্থে হাত-পা ছড়িয়ে দিনের বাকি অংশটা সে কাটিয়ে দেবে। তারপর কাল থেকে আবার নতুন কাজের ধান্দা শুরু হবে। কিন্তু কালকের কথা কাল।
খানিকক্ষণ পাহাড় বাওয়ার পর হঠাৎ কাতর গোঙানির মতো একটা আওয়াজ কানে আসতে চমকে উঠল ভরোসালাল। সামনের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল সেই গর্ভিণী মেয়েটা পাহাড়ে ওঠার ক্লান্তিতে ভয়ানক হাঁপাচ্ছে। তার মুখটা খুলে অনেকখানি হাঁ হয়ে গেছে। তার ফাঁক দিয়ে থেকে থেকে গোঙানিটা বেরিয়ে আসছিল হাঁপানির দাপটে মেয়েটার বুক তোলপাড় হয়ে যাচ্ছিল। চোখের তারা দুটো মরা মাছের চোখের মতো, মনে হচ্ছিল সে-দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসবে।
প্রায় টলছিল মেয়েটা তার মধ্যেই হাতখানেক গভীর থকথকে কাদার ভেতর এলোপাথাড়ি পা ফেলতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু পারছিল না। সে হয়তো ঘাড়-মুখ গুঁজে হুড়মুড় করে পড়েই যেত, তার আগেই পেছন থেকে হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলল ভরোসালাল। বলল, ‘কেয়া, তুমহারা তবিয়ত আচ্ছা নেহী?
খুব নির্জীব গলায় মেয়েটা উত্তর দিল, নেহী—’। ভরোসালাল কি বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ তার চোখে পড়ল সেই মাঝবয়সী লোকটা দামড়া মোষের মতো জোয়ান ছোকরাগুলোকে নিয়ে ঝোপ-ঝাড় ঠেলে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। সে এবার অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়ল, ‘আরে তোমার সাথবালারা (সঙ্গীরা) বহোত দূর চলে গেল যে!’
মেয়েটা বলল, ‘আমি ওদের সাথে আসি নি।’
ভয়নক চমকে ওঠে ভরোসালাল, ‘মতলব (মানে)?’
‘আমি অকেলিই এসেছি।’
‘হো রামজী, শরীরের এই হাল নিয়ে তুমি অকেলিই বেরিয়ে পড়েছ!’
‘কী করব?’
‘কেন, তোমার মরদ কোথায়?’
মেয়েটা ভরোসালালের প্রকাণ্ড চওড়া বুকের ওপর শরীরের ভার রেখে খানিকটা সামলে নিয়েছিল। এবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সে বলল, ‘সে আসতে পারল না’
ভরোসালাল জিজ্ঞেস করল, ‘কেন?’
‘মহাজনের খেতিবাড়িতে সে বেগার দিতে গেছে।‘
‘বেগার?
‘হাঁ—’ মেয়েটা এবার যা বলে, সংক্ষেপে এইরকম চার সাল আগে তাদের দেহাতের মহাজন বিষুণ আহীরের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়েছিল তার মরদা টাকাটা আর শোধ করা যায়নি কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা লোকটার, তার সিন্দুক সোনাচাঁদি আর জহরতের পাহাড় আর জমিজমা খেতিবাড়ির তো লেখাজোখা নেই। তাদের দেহাতে যেখানে যে জমিতে পা দেওয়া যাক না, সেটাই বিষুণ আহীরের। এত জমি, এত টাকা-পয়সা থাকলে কী হবে, লোকটা আস্ত কসাই। এই মেয়েটার মরদের সামান্য ক’টা টাকা উসুল করার জন্য বিষুণ তাকে বছরের পর বছর বেগার খাটিয়ে চলেছে। বছরে দু মাস মেয়েটার মরদকে বিষুণ আহীরের খেতিবাড়িতে বেগার দিতে হয়। সুদে আসলে বিষুণের টাকাটা ফুলেফেঁপে এমনই হয়ে দাঁড়িয়েছে যাতে দশ বছর বেগার দিলেও নাকি ওটা শোধ হবে না। এইরকম যখন অবস্থা তখন মেয়েটির মরদ তার সঙ্গে আসে কী করে?
সব শুনে ভরোসালাল এবার জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার ঘরে মরদ ছাড়া আর কোঈ নেহী?’
‘নেহী?’
‘হো রামজী’ বলে একটু চুপ করে ভরোসালাল। পরক্ষণে আবার শুরু করে, ‘এবার তুমি চলতে পারবে?
মেয়েটা বলল, ‘পারব।’
‘বোত হোঁশিয়ার হয়ে পা ফেলে চল—‘
খুব সাবধানে চটচটে আঠালো কাদার ভেতর পা টেনে টেনে দু’জন এগুতে থাকে। সেই মধ্যবয়সী লোকটা তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে শাল এবং সিসম গাছটাছের ভেতর উধাও হয়ে গেছে। এখন আর তাদের দেখা যাচ্ছে না। ইচ্ছা করলে লম্বা লম্বা পা ফেলে ভরোসালাল পাহাড়ের খাড়াই বেয়ে অনেক উঁচুতে উঠে যেতে পারে। কিন্তু মেয়েটাকে এ অবস্থায় ফেলে তার পক্ষে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না।
জঙ্গলের জন্তু-জানোয়ার, খ্যাপা কুকুর আর নিজের পেট ছাড়া পৃথিবীর কোনো ব্যাপারেই ভরোসালালের আগ্রহ নেই। তবু মেয়েটার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে তার অল্পস্বল্প কৌতূহল হতে লাগল। সে বলল, তোমার গাঁও কোথায়?
মেয়েটি বলল, ‘পাঁচ মিল (মাইল) পশ্চিমে, নাম ঝুমরিতালিয়া—।’
‘গাঁও থেকেই এখন আসছ?’
‘হাঁ—’।
‘পাহাড়ের ওপারে কোথায় যাবে?’
‘টেউন ভকিলগঞ্জে—’
‘কোনো রিস্তার (আত্মীয়) বাড়ি?’
‘নেহী।’
‘তব?’
একটু চুপ করে থেকে মেয়েটা বলল, ‘আমি অসপাতাল (হাসপাতাল) যাচ্ছি।’
‘অসপাতাল কেন?’ বলেই ভরোসালালের মনে পড়ল মেয়েটা গর্ভিণী নিশ্চয়ই বাচ্চাটাচ্চা হবার ব্যাপারে হাসপাতালে চলেছে। সঙ্গে সঙ্গে সে আবার বলে উঠল, ‘সমঝ গিয়া, রামজীকা কিরপা—’
মেয়েটা মুখ নিচু করে হাঁটতে লাগল।
কিছুক্ষণ দু’জনই চুপচাপ।
এই শেরমুণ্ডি পাহাড়ের গায়ে নির্দিষ্ট কোনো রাস্তা নেই। ঝোপঝাড় এবং জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ফাঁকা জায়গা দেখে দেখে চড়াই বেয়ে ওপরে উঠতে হচ্ছে।
একসময় মেয়েটি জড়ানো গলায় হঠাৎ ডেকে ওঠে, ‘এ আদমী—’।
ভরোসালাল ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়, কিছু বলবে?
‘হাঁ একগো বাত—।’
‘বল—।’
তক্ষুনি কিছু বলল না মেয়েটা। খানিকক্ষণ বাদে প্রায় মরীয়া হয়েই সে শুরু করল, ‘আমি অকেলি আওরত, তবিয়তের হালও খুব খারাপ। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পাহাড় বাইতে ডর লাগছে। তুমি আমাকে অকেলি ফেলে রেখে চলে যেও না।’
ভরোসালাল ভালো করে মেয়েটাকে লক্ষ্য করলা তার দুর্বল রক্তহীন শরীর, গর্তে বসে-যাওয়া চোখের কোলে গাঢ় কালি, পেরেকের মাথার মতো ঠেলে-ওঠা কণ্ঠার হাড়, মাংস-ঝরে-যাওয়া। লম্বাটে রোগা মুখ, শির-বার-করা সিকড়ে সিকড়ে হাত, ন-দশ মাসের বাচ্চাওলা স্ফীত পেট, বোতামহীন জামার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা টসটসে স্তন, স্তনের বোঁটার চারপাশে ভুসো কালির ছোপ, ইত্যাদি দেখতে দেখতে কেমন যেন মমতা বোধ করতে লাগল সে বলল, ‘আরে না-না, তোমাকে একলা ফেলে আমি যাচ্ছি না। টেউন ভকিলগঞ্জে আমিও যাচ্ছি। আমার সঙ্গে সঙ্গে তুমি সেই পর্যন্ত যেতে পারবে’।
মেয়েটির মুখচোখ দেখে মনে হল, একটা শক্তসমর্থ সবল পুরুষের ভরসা পেয়ে সে অনেকটা নিশ্চিন্ত হতে পেরেছে।
পাঁক ঠেলে ঠেলে দু’জনে চলেছে তো চলেছেই। আরো খানিকক্ষণ যাবার পর হঠাৎ ভরোসালাল লক্ষ্য করল, মেয়েটার পা ঠিকমতো পড়ছে না, আবার সে টলতে শুরু করেছে। জোরে জোরে শ্বাস পড়ছে তারা এবারও তাকে ধরে ফেলল ভরোসালাল। জিজ্ঞেস করল, ‘কী হল?’
মেয়েটা কাঁপা দুর্বল গলায় বলল, ‘মাথা ঘুরছে।’
হাঁটতে তখলিফ হচ্ছে?’
‘হাঁ।’
‘থোড়েসে জিরিয়ে নাও—’।
ওখানেই একটা পাথর দেখে বসে পড়ে মেয়েটা। কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে উঠতে উঠতে বলে, ‘চল—’কিন্তু পা ফেলতে গিয়ে আবার টলতে শুরু করে।
ভরোসালাল চিন্তিত ভাবে বলল, ‘মালুম হচ্ছে তুমি হেঁটে যেতে পারবে না। পা ফেলতে গেলেই টলছ, মাথায় চক্কর লাগছে। এক কাম করা যাক—’।
মেয়েটি নির্জীব গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কী? ‘তোমাকে আমি ধরে ধরে নিয়ে যাই। তোমার যা হাল, অকেলি চলতে গেলে পড়ে গিয়ে বিপদ হয়ে যাবে।’
মেয়েটি আস্তে মাথা হেলায়। অর্থাৎ ভরোসালাল ধরে নিয়ে গেলে তার আপত্তি নেই। তা হলে সে বেঁচেই যায়।
ভরসালাল মেয়েটিকে ধরে ফেলল। এক হাতে তার কাঁধ বেড় দিয়ে আস্তে আস্তে আবার ওপরে উঠতে লাগল। খানিকটা যাবার পর সে টের পেল মেয়েটার হাঁটার শক্তি ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে। আর যত ফুরিয়ে আসছে ততই তার শরীরের সব ভার ভরোসালালের হাতের ওপর এসে পড়ছে। কাদাভর্তি পিছল পথে বাচ্চাসমেত একটি গর্ভিণী মেয়ের গোটা দেহের ওজন একটা হাতের ওপর নিয়ে এগুনো সম্ভব না। ভরোসালাল মেয়েটাকে প্রায় সাপটে বুকের ভিতর নিয়ে এল। সেই অবস্থাতেই তাকে নিজের সঙ্গে লেপটে নিয়ে পাহাড় ভাঙতে লাগল আর সমানে বিড় বিড় করতে লাগল, ‘হো রামজী—তেরে কিরপা, তেরে কিরপা—’
এতক্ষণ বৃষ্টির জোর ছিল না, তবে মিহি চিনির দানার মতো সেটা ঝরেই যাচ্ছিল। হঠাৎ আবার তোড়ে নেমে এল বৃষ্টিটা হাওয়া পড়ে গিয়েছিল সেটাও বৃষ্টির মতোই আচমকা উন্মাদ হয়ে পাহাড়ী জঙ্গলের ভেতর দিয়ে সাঁই সাঁই ঘোড়া ছোটাতে শুরু করে দিল।
এদিকে মেয়েটির দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি শেষ হয়ে গেছে। তার কোমরের তলার দিকটা শরীর থেকে আলগা হয়ে যেন ঝুলে পড়ছে। ভরোসালাল দিশেহারা হয়ে পড়ল। গর্ভিণী মেয়েটাকে সে কথা দিয়েছে, শেরমুণ্ডি পাহাড় পার করে দেবো কিন্তু এখন, এই অবস্থায় কিভাবে যে তার এবং তার পেটের বাচ্চাটাকে রক্ষা করবে—ভেবে পাচ্ছে না।
কয়েকটা মুহূর্ত। তারপরেই মনে মনে ভরোসালাল সব স্থির করে ফেলল।
মেয়েটার শরীরের যা হাল তাতে তাকে আর হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না। তা ছাড়া সেই পিপুল গাছটার মতো ঝাঁকড়া-মাথা এমন কোনো গাছ নেই যার তলায় গিয়ে কিছুক্ষণ মাথা গোঁজা যেতে পারে। আর বৃষ্টিটা এবার যেভাবে শুরু হয়েছে তাতে আদৌ থামবে কিনা, কিংবা থামলে কখন থামবে তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনিশ্চিতভাবে ভেজার চাইতে এগুবার চেষ্টা করাই ভালো।
ভরোসালাল করল কি, যেখানে কাদা কম এমন একটা জায়গা দেখে মেয়েটাকে শুইয়ে দিল। তারপর বাঁ কাঁধে লাঠির ডগায়-বাঁধা সেই চিত্রবিচিত্র ঝুলিটা নামিয়ে তার ভেতর থেকে দুটো ধুতি বার করে দ্রুত একটা বড় ঝোলা বানিয়ে ফেলল। মেয়েটাকে সেই ঝোলার ভেতর বসিয়ে, তার পাশে মাইলোগুলো রেখে নিজের পিঠে ঝুলিয়ে নিল। তারপর কাদার ভেতর বুড়ো আঙুল গেঁথে গেঁথে খুব সাবধানে পাহাড়ের গা বাইতে লাগল। দায়িত্ব যখন নিয়েছে তখন মেয়েটাকে নিরাপদে পাহাড় পার করে দিতেই হবে।
আকাশ থেকে লক্ষকোটি বৃষ্টির রেখা বল্লমের ফলার মতো ছুটে আসছিল। ঝড়ে চারপাশের অর্জুন-শাল-আমলকী আর সিসম গাছগুলো একেক বার মাটিতে নুয়ে পড়ছে, পরক্ষণেই সটান খাড়া হয়ে যায়। ঝোপঝাড় উল্টোপাল্টা খ্যাপা বাতাসে ছিঁড়ে-খুঁড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছিল। আকাশের গায়ে বড় বড় ফাটল ধরিয়ে বিদ্যুৎ চমকে যাচ্ছে। ঝড়বৃষ্টির সর্বনাশা চেহারা দেখতে দেখতে ভরোসালাল সমানে বলে যেতে লাগল, ‘হো রামজী তেরে কিরপা, হো রামজী তেরে কিরপা—’ বলতে বলতে থকথকে আঠালো কাদায় পায়ের আঙুলগুলোকে গজালের মতো গেঁথে গেঁথে সে ওপরে উঠতে লাগল।
পিঠে একটা ভরা গর্ভিণী মেয়ের বাচ্চাসুষ্ঠু দেহের সমস্ত ভার চাপানো। যদিও ভরোসালাল হাট্টাকাট্টা দুর্দান্ত শক্তিশালী মরদ, তবু তার শিরদাঁড়া যেন ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে, শ্বাস আটকে আসছে। তুমুল বৃষ্টি অনবরত চোখমুখে এমন ঝাপটা দিয়ে যাচ্ছে যাতে সামনের কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না ভরোসালাল। তাছাড়া দারুণ ঝড়ো হাওয়া তাকে ঠেলে দশ হাত একদিকে নিয়ে যাচ্ছে, পর মুহূর্তেই ধাক্কা মারতে মারতে পনেরো হাত অন্য দিকে সরিয়ে নিচ্ছে। জলে আর হাওয়ায় তার চোখ অন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। তারই মধ্যে এই প্রচণ্ড দুর্যোগের বিরুদ্ধে শরীরটাকে। ঢালের মতো খাড়া রেখে ভরোসালাল নিশানা ঠিক করে এগিয়ে যেতে লাগল আর কাতর সুরে একটানা বলে যেতে লাগল, ‘হো রামজী তেরে কিরপা, তেরে কিরপা—’
কতক্ষণ পর খেয়াল নেই, শেরমুণ্ডি পাহাড়ের মাথা ডিঙিয়ে যখন সে ওপারে গিয়ে নামল তখন বৃষ্টির দাপট থেমে এসেছে। ঝড়টাও আর নেই। আকাশের গায়ে মেঘ ক্রমশ পাতলা হয়ে যাচ্ছে। পিঠ থেকে মেয়েটাকে নামিয়ে ভরোসালাল দু’হাঁটুতে মুখ গুঁজে অনেকক্ষণ হাঁপাল, তার শরীরের সব শক্তি তখন প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। ভরোসালালের মনে হচ্ছিল শরীরের একটা হাড়ও আর আস্ত নেই, সমস্ত ভেঙেচুরে গেছে। শিরাটিরাগুলো ছিঁড়ে যাচ্ছে। ঘাড়ের তলা থেকে অসহ্য একটা। যন্ত্রণা শিরদাঁড়া বেয়ে কোমরে, কোমর থেকে পা পর্যন্ত চমক দিয়ে দিয়ে ছুটে যাচ্ছিল।
অনেকক্ষণ বাদে খানিকটা ধাতস্থ হবার পর হঠাৎ সেই মেয়েটার কথা মনে পড়ে গেল ভরোসালালেরা ধড়মড় করে মুখ তুলতেই দেখতে পেল তারা সারা গা, শাড়ি-জামা—সব ভিজে সপসপে হয়ে আছে। শরীরের চামড়া আর আঙুলের ডগাগুলো সিটিয়ে সাদা হয়ে গেছে। দেখতে দেখতে যেই তার মুখের দিকে চোখ পড়ল অমনি চমকে উঠল ভরোসালালা মেয়েটার মুখ অসহ্য যন্ত্রণায় কুঁচকে যাচ্ছে, ঠোঁটদুটো নীলবর্ণা দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণাটা চাপতে চেষ্টা করছে সো ভরোসালাল ভয় পেয়ে গেল। তাড়াতাড়ি মেয়েটার কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হল?
নিজের পেটের কাছটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গোঙানির মতো শব্দ করল মেয়েটা, এখানে বহোত দর্দা জলদি আমাকে অসপাতাল নিয়ে চল—’
পাহাড়ের তলা থেকে টাউন ভকিলগঞ্জ ঝাড়া পাঁচটি মাইল তফাতো সেখানে পৌঁছতে না পারলে হাসপাতালে যাওয়া যাবে না। ভরোসালাল শুধলো, ‘তুমি কি হেঁটে যেতে পারবে?
‘নেহী। আমার কোমর পেট ছিঁড়ে যাচ্ছে।‘
ভরোসালাল সেটাই আন্দাজ করেছিল। এ অবস্থায় উঠে দাঁড়িয়ে একটা পা ফেলাও মেয়েটার পক্ষে সম্ভব না। এদিকে ভরোসালালের শরীরে এমন শক্তি আর অবশিষ্ট নেই যাতে তাকে পিঠে ঝুলিয়ে আরো পাঁচ মাইল যেতে পারে। মেয়েটাকে পাহাড় পার করাতেই তার জিভ বেরিয়ে গেছে।
অবশ্য এই শেরমুণ্ডি পাহাড়ের তলায় ছোটখাটো একটা বাজার আছে। নামেই বাজার। একটা চাল-ডাল-নিমক-মরিচের দোকান, একটা পান-বিড়ি-খৈনিপাতার, তৃতীয় দোকানটা হল চায়েরা ব্যস, এই হল বাজারের নমুনা। তার গা ঘেঁষে একটা আঁকাবাঁকা কাঁচা রাস্তা, জনারের খেত, গেঁহুর খেত, যবের খেত আর এলোমেলোভাবে ছড়ানো নানা দেহাতের মধ্য দিয়ে টাউন ভকিলগঞ্জের দিকে চলে গেছে। ওই বাজারটার কাছে গেলে শহরে যাবার বয়েল গাড়ি পাওয়া যায়। তক্ষুনি তার খেয়াল হল, গাড়ি ভাড়া করলে কম করে পাঁচটি টাকা লাগবে। ঠাকুর রঘুনাথ সিংয়ের দেওয়া দশটি টাকা তার ট্যাঁকে গোঁজা আছে। এ-ই তার শেষ সঞ্চয়। ওই টাকা থেকে খরচ করা ঠিক হবে কিনা, ভাবতে লাগল ভরোসালাল। আর তখনই তার কানে অস্পষ্ট গোঙানির মতো আওয়াজটা এসে ধাক্কা দিল। ঘাড় ফেরাতেই সে দেখল, পেটের মাংস এক হাতে খামচে ধরে থেকে থেকে কাতর শব্দ করে উঠছে মেয়েটা।
আর কিছু ভাবার সময় পেল না ভরোসালাল। কেউ যেন আচমকা টান মেরে তাকে দাঁড় করিয়ে দিল। এক দৌড় বাজারের কাছ থেকে একটা বয়েল গাড়ি নিয়ে এল সে। তারপর পাঁজাকোলা করে মেয়েটাকে ছইয়ের তলায় নিয়ে শুইয়ে দিল। গাড়িওলাকে বলল, ‘জলদি টেউন চল ভেইয়া, বহোত জলদি—’।
গাড়িওলা ‘উর-র-র—’ বলে একটা শব্দ করে দুটো গোরুরই ল্যাজ মুচড়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে গোরু দুটো কাঁচা রাস্তা দিয়ে উধ্বশ্বাসে দৌড় লাগাল।
এদিকে আকাশটা দ্রুত পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। মেঘের গায়ে অল্প অল্প ফাটল ধরিয়ে মরা মরা নির্জীব রোদ বেরিয়ে আসতে চাইছিল। রোদের চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল, বেলা ফুরিয়ে এসেছে, একটু পরেই সন্ধে নেমে যাবে।
গাড়িতে উঠবার পর থেকে ভরোসালাল কোন দিকে আর তাকায়নি, মেয়েটাকেই শুধু লক্ষ্য করে যাচ্ছে। মেয়েটা কাত হয়ে বুকের কাছে হাত-পা গুটিয়ে অনবরত গুঙিয়ে যাচ্ছিল আর চোয়াল শক্ত করে শ্বাস আটকে যন্ত্রণা চাপবার চেষ্টা করছিল। ভরোসালাল ঝুঁকে খুব নরম গলায় শুধলো, এ জেনানা, খুব কষ্ট হচ্ছে?
মেয়েটা শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে মাথা নাড়ল শুধু, কিছু বলল না।
ভরোসালাল যে কী করবে, কী করলে মেয়েটার কষ্ট একটু কমতে পারে ভেবে পেল না সে শুধু শ্বাসরুদ্ধের মতো বিড়বিড় করতে লাগল, ‘হো রামজী তেরে কিরপা, হো পবনসূত তেরে কিরপা—।
মেয়েটা এবার বলল, ‘আমার বহোত ডর লাগছে।’
পরম মমতায় তার একটা হাত ধরে ভরোসালাল বলল, ‘ডর কী?’
মেয়েটার যন্ত্রণা যেন পাঁচগুণ বেড়ে গেল হঠাৎ। শরীরটা ধনুকের মতো বেঁকে যেতে লাগল তার, কপাল-গলা কণ্ঠ সব ঘামে ভিজে যাচ্ছে। গায়ের লোমগুলো হঠাৎ শীত লাগার মতো খাড়া হয়ে উঠেছে। চোখের তারা আস্তে আস্তে স্থির হয়ে যাচ্ছে।
ভরোসালাল অস্থির হয়ে উঠল। এই মেয়েটা পনেরো মাইল রাস্তা পেরিয়ে, মাঝখানে বিশাল পাহাড় ডিঙিয়ে মানুষের জন্ম দিতে চলেছে। মানুষ সম্বন্ধে প্রায় অনভিজ্ঞ ভরোসালাল জানে না কিভাবে তার শুশ্রষা করবো ভীতভাবে সে বলল, ‘এ জেনানা, তোমাদের এ সময় কী করতে হয়?’
কোমরের কাছটা ধরে মেয়েটা অত্যন্ত দুর্বল স্বরে বলল, ‘এখানে একটু সেঁক দিয়ে দাও—’।
এই বয়েল গাড়ির ভেতর কোথায় আগুন, কোথায় বা কী? কিন্তু যেভাবেই হোক সেঁকটা দিতেই হবে। উদভ্রান্তের মতো এদিক-সেদিক তাকাতে তাকাতে ভরোসালালের চোখে পড়ল গাড়ির ছইয়ের নিচে এক ধারে একটা হেরিকেন ঝুলছে। সঙ্গে সঙ্গে সে ঘাড় ফিরিয়ে গাড়িওয়ালাকে বলল, ‘ভেইয়া, তোমার হেরিকেনে তেল আছে?
গাড়িওলা বলল, ‘আছে, কেন?’
‘ওটা একটু জ্বালব। এই জেনানাকে সেঁক দিতে হবে।’
‘জ্বালতে পারো, তবে তেলের জন্য চার আনা দিতে হবে।’
‘দেব।’
‘তব ঠিক আছে।’
‘তোমার কাছে আগ আছে?’
‘আছে।‘ ‘গাড়িওলা কোমরের খাঁজ থেকে একটা দেশলাই বার করে ছুঁড়ে দিল।
ভরোসালাল হেরিকেন ধরিয়ে নিলা তারপর নিজের একটা কাপড়ের খানিকটা অংশ চার ভাঁজ করে হেরিকেনটার মাথায় বসিয়ে গরম করতে লাগল। সেটা বেশ তেতে উঠলে, আস্তে আস্তে মেয়েটার কোমরে সেঁক দিতে লাগল। অনেকক্ষণ সেঁক দেবার পর গোঙাতে গোঙাতে এক সময় মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়ল।
সন্ধের অনেক পর বয়েল গাড়িটা টাউন ভকিলগঞ্জের সরকারী হাসপাতালে পৌঁছে গেল।
কিন্তু এত রাতে ডাক্তার সাহেবকে পাওয়া গেল না। তিন তাঁর কোয়ার্টারে চলে গেছেন।
যারা ছিল তারা বলল, ‘আজ তো হবে না, কাল নিয়ে এসো।’
ভরোসালালের মাথায় তখন পাহাড় ভেঙে পড়ার অবস্থা। মেয়েটাকে নিয়ে এই রাত্তিরে কোথায় রাখবে সে? সবার কাছে সে কাকুতি-মিনতি করতে লাগল, ‘কিরপা করে জেনানাকে ভর্তি করে নিন।’
হাসপাতালের লোকেরা জানাল, ডাক্তারসাব অর্ডার না দিলে কাউকে ভর্তি করা যাবে না। তখন মরীয়া হয়ে ডাক্তারসাবের কোয়ার্টারের ঠিকানা নিয়ে খুঁজে বার করল ভরোসালাল। তারপর তাঁর হাতে পায়ে ধরে, কিভাবে কত কষ্ট করে গর্ভিণী মেয়েটাকে পাহাড় পার করিয়ে এত দূরে নিয়ে এসেছে তার যাবতীয় বিবরণ দিয়ে বলল, ‘এখন আপনার কিরপা ডাগদরসাব।’
সব শুনে ডাক্তারসাব হাসপাতালে এসে মেয়েটিকে ভর্তি করে নিলেন।
এবারে ভরোসালালের দায়িত্ব শেষ। গাড়িওলাকে ভাড়া বাবদ পাঁচ টাকা আর তেলের দরুন চার আনা দিয়ে, আজ রাতের মতো একটা আস্তানার খোঁজে বেরিয়ে পড়ল ভরোসালালা
পৃথিবীতে কেউ নেই তার। কাজেই পিছুটানও নেই। সে একেবারে ঝাড়া হাত-পা লোক। যখন যেখানে যায় সেখানে নিজের হাতে খানকতক রুটি সেঁকে নেয়। তারপর কারো বাড়ির দাওয়ায় কিংবা মাঠে-ঘাটে গাছতলায় শুয়ে পড়ে।
আজ আর কিছুই ভাল লাগছিল না ভরোসালালের আটা কিনে এনে ছানো, উনুন বানাও, কাঠকুটো জোগাড় করো—এত সব ঝঞ্চাট একটা দিনের জন্যে সে বাদ দিতে চায় ভরোসালাল করল কি, একটা দোকানে গিয়ে তেঁতুলের আচার আর নুন-লঙ্কা দিয়ে একদলা ছোলার ছাতু খেয়ে এসে এক বাড়ির খোলা বারান্দায় শুয়ে রইলা। কাল সকালে সে সগরিগলি ঘাটে যাবে। সেখান থেকে টাউন পূর্ণিয়া।
পরের দিন সকালে উঠে সগরিগলি ঘাটে যাবার সময় হঠাৎ ভরোসালালের মনে হল, মেয়েটার একটা খবর নিয়ে গেলে হয়। অন্যমনস্কর মতো হাঁটতে হাঁটতে এক সময় সে হাসপাতালেই এসে পড়ল এবং খবর নিয়ে জানল, এখনও মেয়েটার ছেলেপুলে কিছু হয়নি তবে যে-কোন মুহূর্তে হয়ে যেতে পারে। আর জানল মেয়েটা ভয়ানক কষ্ট পাচ্ছে।
শেষ খবরটা পেয়ে মন খারাপ হয়ে যায় ভরোসালালেরা পৃথিবীর সব ব্যাপারেই সে উদাসীন তবু কাল পিঠে চাপিয়ে যাকে পাহাড় পার করিয়েছে, যার জন্য নিজের সঞ্চয় থেকে নগদ সোয়া পাঁচ টাকা খরচও করে ফেলেছে, গরম সেঁক দিয়ে যার সেবা করেছে, তার খুব কষ্ট হচ্ছে জেনে আজ আর সগরিগলি যেতে মন করছে না। সে ঠিক করে ফেলল, ভালোয় ভালোয় মেয়েটার বাচ্চাটাচ্চা হয়ে গেলে সে পূর্ণিয়া টাউনে যাবে। গিয়ে হয়তো দেখবে মিউনিসিপ্যালিটির লোকেরা খ্যাপা কুকুর মারার জন্য অন্য লোক লাগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু কি আর করা যাবে? ‘হো রামজী, হো পবনসূত—’
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এদিক-সেদিক খানিক ঘুরে বেড়াল ভরোসালাল। তারপর রুটি বানিয়ে খেয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকল। ঘুম থেকে উঠে বিকেলে আবার সে এল হাসপাতালে। কিন্তু কোন খবর নেই। রাতটা কাটিয়ে পরের দিন সকাল আর বিকেলে দু’বার এল ভরোসালালা খবর। নেই।
দু’ দিন কাটবার পর উদ্বেগে তার দম যখন বন্ধ হয়ে আসছে সেই সময় ডাক্তারসাব হাসতে হাসতে বললেন, ‘বহুত বড়িয়া খবর—।
ভরোসালাল বলল, ‘হো গিয়া ডাগদরসাব?’
‘হো গিয়া।’
‘রামজীকা কিরপা, পবনসুতকা কিরপা—’ভরোসালালের চোখে আলো ঝিলিক দিয়ে গেল।
‘তোমার জেনানার লেড়কা হয়েছে। বহুত গোরা লেড়কা—’।
চমক লাগল ভরোসালালেরা ডাগদরসাব নিশ্চয়ই মেয়েটাকে তার আওরত ধরে নিয়েছে। ভুল শুধরে দেবার জন্য তাড়াতাড়ি সে বলে উঠল, ‘ও আমার আওরত না ডগদরসাব!’
‘তব?’ ডাক্তারসাব ভুরু কুঁচকে তাকালেন। ভরোসালাল বলল, ‘রাস্তায় আস্তে আস্তে জান-পয়চান (আলাপ-পরিচয় হয়েছিল। আচ্ছা চলি ডাগদরসাব, রাম রাম।’ এবার পরম নিশ্চিন্তে সগরিগলি ঘাট পেরিয়ে পূর্ণিয়া যেতে পারবে।
রসুল মাঝির গল্প
মাঝিঘাটা থেকে মেঘনাকে খুবসুরৎ দেখায়। আসমানে ছেঁড়া ছেঁড়া নীলচে রঙের মেঘ, নীচে উদ্দাম মেঘনা, রাশি রাশি ঢেউ আর হু-হুঁ বাতাস। মাঝিঘাটার ওপাশে লঞ্চঘাটা। চিলগুলো পাক খেয়ে খেয়ে জলের ওপর ছোঁ দিয়ে পড়ছে। ভেঁ দিয়ে একটা লঞ্চ ছেড়ে দিল। বড় বড় কয়েকটা ঢেউ এসে মাঝিঘাটাকে দুলিয়ে গেল।
এক-মাল্লাই নৌকোর গলুইতে বসে ছিল রসুল মাঝি। শেষবেলার রোদ, চিল, ঢেউ আর মেঘ দেখছিল। দেখতে ভালো লাগছিল।
এমন সময় সওয়ারি এল।
ও মাঝি, চরলখিন্দর কেরায়া যাবা নাকি?
চমক ভাঙল। রসুল মাঝি ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। পরের মাটিতে এক মিঞা সাহেব এসে দাঁড়িয়েছে। মাথায় লাল ফেজ, রেশমি লুঙ্গি, পায়ে বাহারি নাগরা। সমস্ত শরীরে শৌখিন চেকনাই। পিছনে বোরখা-ঢাকা একটি মূর্তি। খুব সম্ভব মিঞা সাহেবের বিবি। এক পাশে স্তু পাকার মালপত্র।
রসুল মাঝি বলল, যামু না ক্যান মিয়া ছাহাব? যাওনের জন্যই তো বইস্যা রইছি। চরলখিন্দর পাঁচ টাকা কেরায়া লাগব।
মিঞ্চা সাহেব দরাদরি করল না। বোরখা-ঢাকা বিবিকে নিয়ে নৌকোয় উঠতে উঠতে বলল, পাঁচ টাকাই সই। মালপত্তর উঠাও মাঝি।
মনে মনে আপসোস করল রসুল মাঝি। কেরায়া আর একটু চড়িয়ে বললেই হত। এখন আর উপায় নেই।
একটু পরেই নৌকা ছেড়ে দিল। মাঝনদীতে এসে বাদাম খাটাল রসুল মাঝি। হু-হু বাতাস সাঁই সাঁই বাজছে। বাদামটা ফুলে রয়েছে। হালের বৈঠাটা কঠিন মুঠোয় চেপে গলুইতে কাত হয়ে বসল রসুল।
জল-কাটার একটানা শব্দ হচ্ছে। শেষবেলার রোদ নিবু নিবু হয়ে আসছে। আকাশটা আবছা দেখাচ্ছে। একটা ধোঁয়া রঙের পর্দা সমস্ত আসমান আর নদীটাকে যেন একটু একটু করে ঘিরে ধরছে।
ছইয়ের মধ্য থেকে মিঞা সাহেব বলল, চরসোহাগীতে একবার নৌকা ভিড়াইও মাঝি। রান্নাবান্না করতে হইব।
আইচ্ছা-রসুল মাঝি সংক্ষিপ্ত জবাব দিল।
কাল এক পহর বেলায় চরলখিন্দরে যাইতে পারুম না মাঝি?
মনে হত হয়।
এর পর কাটা কাটা দু-একটা কথা হল। কেরায়া নৌকার এই গলুইতে হালের বৈঠাটা চেপে একটানা ঢেউ আর বাতাসের শব্দ শুনতে শুনতে মনটা কেমন যেন উদাস উদাস লাগে রসুল মাঝির। তখন মেজাজটা আলাপ জমাবার মতো খোশবন থাকে না। আসমান-জমিন একাকার করে মনের ওপর কত ভাবনার যে ছায়া পড়ে, তার ইয়ত্তা নেই। রসুল মাঝির দিক থেকে তেমন উৎসাহ না পেয়ে অগত্যা মিঞা সাহেবকে থামতেই হল।
আজকাল ইলিশ মাছের মরশুম। ঘোট ঘোট জেলে-ডিঙিতে মেঘনা ছেয়ে গিয়েছে। দূরে কাছে যতদূর নজর চলে শুধু একের পর এক ইলশা-ডিঙি। মেঘনায় এই ইলশা-ডিঙি দেখলে রসুল মাঝির বুকের মধ্যেটা যেন হু-হুঁ করে ওঠে। অতীত জীবনটাকে মনে পড়ে। আর সেই সঙ্গে এক দুর্বোধ্য যন্ত্রণায় দেহমন বিকল হয়ে যায়।
জাল বাইতে বাইতে একটা ডিঙি পাশে এসে পড়েছিল। অভ্যাসবশে রসুল মাঝি জিগ্যেস করল, কেমুন মাছ পড়তে আছে মাঝি?
জবর।
ডিঙির খোলে ইলিশ মাছের স্তূপ জমেছে। রপালি আঁশগুলি শেষবেলার রোদে চকচক করে। চোখের মণিগুলো নীলার মতো জ্বলে। কানসার ফাঁকে তাজা রক্ত জমে রয়েছে। বড় একটা নিশ্বাস ফেলল রসুল মাঝি।
ঢেউয়ের মাথায় দুলতে দুলতে ইলশা-ডিঙিটা ফারাকে সরে গেল।
সামনেই একটা বিরাট ঘূর্ণি। কালো জল সোঁ-সোঁ শব্দে পাক খাচ্ছে। অসাবধান হলে আর উপায় থাকবে না। ঘূর্ণিতে পড়লে একটা মোচার খোলার মতো সোঁ করে একমাল্লাই নৌকোটাকে কোন অতলে টেনে নেবে। মেঘনা নদীর পাকা মাঝি রসুল। সুকৌশলে ঘূর্ণির পাশ ঘেঁষে নৌকা চালাচ্ছিল। আচমকা কানে এল
ছইয়ের মধ্যে বিবিজান মিঞা সাহেবকে ধমকাচ্ছে এই নৌকায় উঠলেন ক্যান মিঞা? কোরায়া-ঘাটায় কি আর মাঝি ছিল না?
মিঞা সাহেব বিব্রত হল। ফিসফিস গলায় বিবিজানকে সামলাতে লাগল : চুপ চুপ বিবি। মাঝি শুনতে পাই। মাঝনদীতে মাঝিরে ক্ষ্যাপাইলে উপায় থাকব না। জান পরাণ যখন তার হাতে। বাঁচাইলে সে, মারলেও সে।
তার আমি কী জানি! পারে নাইম্যা নৌকা বদল করেন।-বিবিজান আবার ঝামটা দিল? এই নৌকায় যামু না।
ভুরু কুঁচকে, বাঁ চোখটা ছোট করে রসুল মাঝি তাকাল। ভাবল, মেঘনা নদীর সঙ্গে তার কতকালের মহব্বত। কোথায় কোন ঘূর্ণি রয়েছে, কোথায় কয় বাঁও জল, কোথায় চোরাঘুর্ণির ফাঁদ পাতা রয়েছে, সব–সবকিছু তার জানা। ইচ্ছে করলেই বিবিজানের চোখের পলক পড়বার আগেই তার বদখত মেজাজটাকে ঠান্ডা করে দিতে পারে রসুল। ছোট্ট এক-মাল্লাই নৌকোটাকে ডুবিয়ে দিতে কতক্ষণই বা লাগে। মেঘনা নদীর মাঝি। সওয়ারি ডুবিয়ে দাঁতে নৌকোর রশি চেপে একটা কুটোর মতো ভাসতে ভাসতে এক সময় পারে উঠতে সে পারবেই।
ব্যঙ্গভরা গলায় রসুল মাঝি বলল, বিবিজান যেন আমার নৌকাটার উপুর জবর গোঁসা হইছেন। নৌকাটা কি কসুর করল?
ধড়ফড় করতে করতে ছইয়ের মুখে চলে এল মিঞা সাহেব : কিছু না, কিছু না মাঝি। বিবি ছেলেমানুষ। কী কইতে কী কয়, ঠিক নাই। তুমি ইদিকে কান দিও না। যেমুন বাইতে আছ, তেমুন বাও।
বিবি ছেলেমানুষ! মিঞা সাহেবের দিকে এতটুকু লক্ষ নেই রসুল মাঝির। তার চোখ দুটো ছইয়ের মধ্যে বিবিজানকে তল্লাশ করতে লাগল।
মিঞা সাহেব সমানে তোয়াজ করতে লাগল : তুমি কিছু মনে কইরো না মাঝি। হে-হে, বিবির আমার মাথার ঠিক নাই।
রসুল মাঝি জবাব দিল না।
ছইয়ের মধ্যে ঢুকে বোরখা খুলে ফেলেছে বিবিজান। ডুরে শাড়ির ঘোমটার ফাঁকে একরাশ ঘন চুল, দুটি সুর্মা-আঁকা ঘনপক্ষ্ম চোখ, নাকে সোনার বেশর আর একটি শ্যামলা রঙের মিষ্টি মুখ দেখা যায়। সে মুখ সরস লাবণ্যে ঢলঢল করছে। আড়চোখে চেয়ে রয়েছে বিবিজান। দেখতে দেখতে ভয়ানক চমকে উঠল রসুল মাঝি। কণ্ঠার ফাঁকে অসহ্য যন্ত্রণা। বুকের মধ্যে একটা শক্ত থাবায় কেউ যেন বাতাস চেপে চেপে ধরছে। তালুটা শুকিয়ে আঠার মতো চটচট করছে।
হালের বৈঠাটা হাতের মুঠি থেকে আলগা হয়ে গিয়েছে। খসে পড়বার আগেই চেপে ধরল রসুল মাঝি। নৌকাটা একটা গোত খেয়ে উজানের দিকে ঘুরে গেল।
মিঞা সাহেব চিৎকার করে উঠল, কী হইল মাঝি। হায় খোদা, এই মাঝগাঙে কি সব্বনাশ হইল!
আস্তে গলায় রসুল মাঝি ধমক দিল, চুপ করেন মিঞা ছাহাব। রসুল মাঝির হাতে বৈঠা থাকতে নৌকা ডুবব না।
ঘন ঘন বৈঠার পাড় দিয়ে উজানের দিক থেকে নৌকাটাকে ভাটির মুখে ঘুরিয়ে দিল রসুল মাঝি তার পর হালের বৈঠাটি চেপে আবার ডোরায় এসে বসল।
ডুরে শাড়ির ঘোমটার ফাঁকে একরাশ ঘন চুল, দুটি সুর্মা-আঁকা চোখ, সোনার বেশর, শ্যামলা রঙের মিষ্টি মুখে সরস লাবণ্য-অনেকদিন আগের আজিমা নামে এক সোহাগ-বউ মনের নিবিড়ে ঘন হয়ে এল। রসুল মাঝি ভাবে, কতকাল আগে আয়ু থেকে, জীবন থেকে সেই মধুর দিনগুলি খসে পড়েছে। কতকাল আগে তারা সত্য ছিল।
সে সব দিনে ইলিশ মাছের মরশুমে পদ্মা আর মেঘনায় পাঁচ মাস ইলশা-জাল বাইত রসুল মাঝি। চার মাস চাটগাঁয়, কক্সবাজারে কি নোয়াখালির গঞ্জে-বন্দরে নোনা ইলিশের কারবার করত। মেটে হাঁড়িতে কাটা ইলিশ নুনে জারিয়ে ঢাকা, কলকাতা কি আরও দূর দূর দেশে চালান দিত। সে সব দিনে রেশমি লুঙ্গি, ডোরাকাটা পিরহান আর বাহারি জুতো পরত রসুল মাঝি। কানে আতর দিত। মাথায় ফুলের তেল দিয়ে পরিপাটি করে টেরি বাগাত। গা থেকে ভুরভুরে গন্ধ বেরুত। ফুরফুরে জীবন। গলায় সিল্কের রুমাল বেঁধে দামি সিগারেট ফুকত। ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে কায়দা করে ধোঁয়া ছাড়ত। কথায় কথায় মেজবান করত। খুশির খেয়ালে মুঠো মুঠো টাকা উড়িয়ে দিত।
ফেচুপুর গ্রামের কুমারি মেয়েরা বলাবলি করত, দিল বটে একখান! যেমুন ট্যাকা কামায়, তেমুন উড়ায়। অনেকের ঘরেই তো ট্যাকা আছে, কিন্তুক এমুন মন নাই সারা গেরামে।
একা মানুষ, পরাণভরা শখ আর শখ, খেয়াল আর খেয়াল।
কেউ বলে, রসুল মিয়ার চেহারাখানও জবর সোন্দর।
মোট কথা, ফেচুপুর গ্রামের কুমারী চোখগুলিকে মুগ্ধ করেছিল রসুল, কুমারী মনগুলিকে মজিয়ে দিয়েছিল। পাঁচ মাস ইলশা-জাল বাইত, চার মাস চাটগাঁ কি নোয়াখালিতে ব্যাপার করত আর বাকি তিনটে মাস একটা শৌখিন তৃষ্ণার মূর্তি হয়ে শিস দিয়ে দিয়ে ফেচুপুর গ্রামের আনাচে-কানাচে, মাঠে-ঘাটে, ব্যাপারী আর মাঝি-বাড়ির উঠানে দাওয়ায় ঘুরে ঘুরে বেড়াত রসুল।
সব বাড়িতেই রসুলের জন্য কপাট খোলা, দিল দরাজ। সদর-অন্দর একাকার। খাতির-আদরে এতটুকু খুঁত নেই। মীর বাড়িতে দুপুরে মেজবান থাকলে, মৃধা-বাড়ি রাত্তিরে দাওয়াত দেয়। ব্যাপারীরা কোর্মা খাওয়ালে মাঝিরা মোরগ-মুসল্লম ফরমাস করে আনায় গঞ্জ থেকে। শহর-বন্দরের গল্প করতে করতে যখনই রসুল চোখ তোলে তখনই ছিটে বেড়ার জানলার পাশ থেকে চট করে একটা মুখ সরে যায়! সে মুখে শ্যামল আশনাই, সুর্মা-আঁকা চোখ, কানে বনফুল, হাতের পাতায় মেহেদী মাখা, সুডৌল হাতে আয়নাচুড়ি। সব বাড়িতেই জানলার পাশে এক ছবি দেখতে দেখতে চোখ সয়ে গিয়েছে। বলা যায়, অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। ওতে আর সাতাশ বছরের কঁচা প্রাণটা আজকাল এতটুকু চঞ্চল হয় না। জানলার পাশে খুবসুরৎ তরুণীর ছবি আপ্যায়নের একটা অঙ্গ হিসাবেই মেনে নিয়েছে রসুল। দূরের আকাশ, নদী, জারুল কি হিজল বনের মতো ওগুলোর আবেদন নিছক নিসর্গশোভা ছাড়া তার কাছে আর কিছু নয়।
খাওয়া-দাওয়ার পর বাটার সুগন্ধি মসলা এগিয়ে দিতে দিতে মৃধারা বলে, ব্যাপারীরা বলে, মাঝিরা বলে, সবাই বলে ও রসুল মিঞা, এইবার একটা সাদি করেন। সাদির সময় কিন্তুক আপনের হইছে।
রসুল জবাব দেয় না। মিটিমিটি হাসে। ব্যাপারীরা, মৃধারা, মাঝিরা ভাবে, শহরে-বন্দরে ঘুরে ঘুরে রসুল মিয়ার হালচাল, আদবকায়দাই বদলে গিয়েছে।
আবার শোনা যায়ঃ যদি মত করেন, তা হইলে আমার ছোট মাইয়াটা আছে। নাম রোশেনা। হে-হে, বুঝলেন কি না।
এবারও কোনও কথা বলে না রসুল। তবু সেই মিটিমিটি হাসিটাকে রহস্যময় করে তোলে। তারপর সুগন্ধি মসলা চিবুতে চিবুতে রাস্তায় গিয়ে নামে।
তিন বছর ধরে ফেচুপুর গ্রামে আছে রসুল। এর আগের চব্বিশ বছরের জীবনের ইতিহাস কেউ জানে না। সে সম্বন্ধে কেউ ভাবেও না। রসুল মিঞা, তার নোনা-ইলিশের ফলাও কারবার, শৌখিন রুচি আর হাল হকিকত ছাড়া আর কিছু তারা জানতেও চায় না।
তিনটে বছর এ-বাড়ি সে-বাড়ি মেজবান খেয়ে আর দাওয়াত দিয়ে দিয়েই কাটিয়ে দিল রসুল। ফেচুপুর গ্রামের জীবনে এই দাওয়াত আর মেজবানের পালা একটা অভ্যস্ত রীতির মতোই দাঁড়িয়ে গেল। এ ব্যাপারে আর চমক রইল না।
কিন্তু চমকের সবটাই বাকি ছিল। রাতারাতি নিকারীপাড়ায় মোল্লা-মুচ্ছল্লি ডাকিয়ে যেবার আজিমাকে সাদি করে আনল রসুল, সেবার সমস্ত ফেচুপুর গ্রামটা বেয়াড়া ধরনের এক বিস্ময়ে ঘায়েল হয়ে পড়েছিল। নিকারীদের ঘরে পচা চাচের দেওয়াল, ফুটি-ফাটা খাপরার চালে রোদবৃষ্টি বাগ মানে না। নিকারীদের ঘরে মাটির সানকি আর পিতলের গোটা দুই গ্লাস ছাড়া আর কোনও আসবাব নেই। সেই বাড়ির মেয়েকে সাদি করার মতো এত বড় একটা আহামুকি যে রসুল মিঞার মতো একটা শৌখিন খুশির মুর্তি করে বসতে পারে, তা কেউ ভাবতেই পারেনি। সারা ফেচুপুর, গ্রামটা কুৎসায় নিন্দায় সরগরম হয়ে উঠল। মৃধারা, ব্যাপারীরা, মাঝিরা একযোগে কাদা ছিটোতে লাগল। রসুল মিঞার মতো শয়তান, ইবলিশ আর কুচরিত্র মানুষ এত বড় আসমানের নীচে, এতবড় দুনিয়াটায় না কি আর একটিও নেই।
কিন্তু যাকে নিয়ে এত কুৎসা রটানো, এত নিন্দা ছড়ানো, সে একেবারেই নির্বিকার। কোনদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ নেই।
সাদি করে নদীর কিনার ঘেঁষে ঘর তুলল রসুল। উপরে ঢেউটিনের চাল, দুপাশে ময়ুরমুখ আঁকা, ফরিদপুরের কারিগর কাঠের দেওয়ালে বাটালি দিয়ে কেটে কেটে ফুলপাতা বার করল।
ব্যবসা আরও বড় হয়েছে রসুলের। চাটগাঁ, কক্সবাজার কি নোয়াখালির গঞ্জ-বন্দর ছাড়িয়ে আকিয়াব-আরাকানে ছড়িয়ে পড়েছে।
নাকে বেশর, কানে বনফুল, চোখে সুর্মা, হাতে মেহেদী, একরাশ চুল আর শ্যামলা রঙের ঢলল মুখ আজিমা ছুটে বেড়ায়। ইলিশ মাছ কাটে, নতুন মেটে হাঁড়িতে নুন দিয়ে সেই মাছ জারায়। হাঁড়ির মুখে সরা দিয়ে গুনতি করে। কিছুদিন মক্তবে পড়েছিল, তার দৌলতে কাগজে-কলমে হিসাব রাখে আজিমা। লোকজন খাটে। ঠিক ঠিক হিসাব করে তাদের মজুরি দেয়।
রসুল বলে, বুঝলি সোহাগ-বউ, তোর বরাতে আমার বরাত খুলল। এই ব্যবসা যে এত বড় হইছে, সব তোর জন্যে। তোরে যেদিন সাদি করছি, সেদিন থিকাই আমার কপাল খুলছে। আগে-আগে আমার মাছ নোয়াখালি-চাটগাঁর গঞ্জে যাইত। আইজকাল আকিয়াব, আরাকান, এমুন কী রেঙ্গুনেও চাহিদা হইছে।একটু ছেদ, আবার তোর হাতে জাদু আছে সোহাগ-বউ। আর সকলের মাছ পাঁচ-ছমাসেই পচে গলে, কিন্তু আমার মাছ এক বছরেও যেমুনকে তেমুনই থাকে। লবণের লগে মাছে আর কি দিস রে বউ?
আজিমা হাসে, বলে, তোমার মাছে আমার মনের ঝাঁঝ মিশাই। সেই ঝাঁঝে মাছ পচন-গলন লাগে না। বুঝলা মিঞা। আর কথা না। এইবার খাইবা আসো।
আগে বল, কী মিশাইয়া দিস? না কইলে খামু না।
কপট রোষে ফুঁসে ওঠে আজিমা এই দিকদারি আর ভালো লাগে না মিঞা। আগে খাইবা চলো।
তুই তা হলে বলবি না বউ?–কঠিন গলায় রসুল বলে।
হালকা তামাসায় সব-কিছু উড়িয়ে দিতে চায় আজিমা : কী আবার কমু! হাতের গুণ মিঞা, হাতের গুণ। এমুন হাতের গুণ যে পচন-গলন তো দূরের কথা, কাটা মাছ জোড়া দিয়া জলে ছাড়লে তাজা হইব।
বেশ, না বললি।–গুম মেরে বসে থাকে রসুল।
রাত্রে আজিমার পাশে শুয়ে শুয়ে রসুল ভাবে, মৃধাপাড়া, ব্যাপারীপাড়া, মাঝিপাড়ার তিন বছরের দাওয়াতকে অগ্রাহ্য করে নিকারীদের মেয়ে বিয়ে করেছে; সে কি নিছকই একটা খেয়াল মাত্র! নিতান্ত উদারতার বশেই কি মাঝি-ব্যাপারীদের গরানকাঠের পঁচিশ বন্দের ঘর, ভারী ভারী মকরমুখী পালঙ্ক, কঁসার বাসন, দোফসলা জমির লোভ ছেড়ে নিকারীদের পচা ধসা বাড়ি, অভাব, হতাশা, দারিদ্রের টানে সে ছুটে গিয়েছিল?
কাত হয়ে একবার দেখল রসুল। আজিমা ঘুমুচ্ছে। নিশ্বাসের তালে তালে সুডৌল বুকটা উঠছে, নামছে। রসুল ভাবল, দুবেলা বাপজানের বাড়িতে ঠিকমতো খেতে না পেয়েও আজিমা যে কোথা থেকে এমন অফুরন্ত যৌবন জোটাল, সেটাই এক বিস্ময়ের ব্যাপার। এ ভাবনাটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। আগের ভাবনাটা মনের মধ্যে আরও স্পষ্ট হল। রক্ত-মাংস, হাত-পা, ইন্দ্রিয়গ্রাম, যৌবন, স্বাস্থ্য, রূপ নিয়ে যে কোনও একটি খুবসুরৎ মেয়েই তো সাদির পর তার পাশে এসে দাঁড়াতে পারত! দুনিয়ার এত মেয়ে থাকতে আজিমার জন্যেই বা কেন তার পক্ষপাত! রসুল ভাবে, তিনটি বছর ফেচুপুর গ্রামের মাঠে ঘাটে, আনাচে কানাচে ঘুরে ঘুরে একটা খবর সে যোগাড় করেছিল। নিকারীপাড়ার মেয়েরা নোনা ইলিশের সঙ্গে এমন কিছু মেশায়, যাতে পচন-গলন লাগে না। নিকারীদের ব্যবসার মগজ নেই। তাই ব্যবসার এমন মন্ত্রগুপ্তি জানা সত্ত্বেও সারা বছর তাদের পাড়ায় হতাশা, দারিদ্র আর মড়ক চক্কর মেরে বেড়ায়। নিকারীদের একটি মেয়েকে সাদি করে এনে যদি মাছের পচা-গলা রোধ করার অমোঘ কায়দাটা শিখে নেওয়া যায়, তা হলে রসুল দোজখ-বেহস্ত-ঘেরা দুনিয়ার মাঝখানে তার নোনা ইলিশের কারবার ছড়িয়ে ফেলতে পারবে। পদ্মা কি মেঘনার তিরিশ-চল্লিশ হাত জলতল থেকে একান্তে অবলীলায় ইলিশ মাছ তুলে আনে রসুল। কিন্তু নিকারীদের মেয়ে বোধহয় মেঘনা-পদ্মার ইলিশের চেয়েও গভীরচারী। সহজে আজিমা ধরা দেয় না। ব্যাবসার গোপন খবরটা জানায় না। আচ্ছা রসুলও পাকা ইলশা-মাঝি, সে-ও দেবে নেবে নিকারীদের মেয়ের দৌড় কত? দেখবে, কবে সে তার জালে ধরা দেয়?
দিন কতক পর কমলাঘাটের বন্দর থেকে রূপার মল আর পৈছা নিয়ে এল রসুল, বলল, এগুলি পর দেখি সোহাগ-বউ। তোরে জবর মানাইব।
দেখি, দেখি–নিমেষে কোমারে পৈছা, পায়ে মল পরে ফেলল আজিমা। নাকে বেশর, কানে বনফুল, হাতের পাতায় মেহেদী, দুটি ঘনপক্ষ্ম চোখ, আজিমাকে বুকের কাছে টেনে গাঢ় গলায় রসুল বলল, তুই কি সোন্দর বউ? আসমান-দুনিয়ায় তোর মতো খুবসুরৎ মাইয়া আর আমি দেখি নাই।
মিছা, মিছা। তুমি আমার মন রাখা কথা কও।
না, না। খোদার কসম। এই তোর গা ছুঁইয়া কই।–একটু থেমে রসুল বেজার গলায় বলল, আমি তোরে এত পিরীত করি, মব্বৎ করি আর তুই আমারে ইটুও পিরীত করিস না। বরাতটাই আমার মন্দ। সাদি করা বউর কাছ থিকা মহব্বৎ মিলে না।
আমি তোমারে পিরীত করি না!–ঝটকা মেরে দূরে সরে যায় আজিমা। ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ে। রোষে, ক্ষোভে শ্যামলা রঙের মুখখানা লাল দেখায়। চোখের কোণে নোনা জল টলটল করেঃ কেমনে বুঝলা আমি তোমারে পিরীত করি না?
বুঝি বুঝি! আমি সবই বুঝি। এক বছর সাদি হইছে, তবু বিশ্বাস কইর্যা একটা কথা আমারে কইতে পারলি না! ভার-ভার মুখ করে রসুল বলে।
কী কথা!
নোনা ইলিশের লগে কী মিশাইল?
একটুক্ষণ চুপ। তারপর আজিমা বলল, সে কথা কইতে বাপজান বারণ কইরা দিছে। আমি গরিব নিকারীর মাইয়্যা। জানো তো, নোনা ইলিশের ব্যবসার গুণ আছে আমাগো হাতে। আর ওই গুণেই আমাগো সাদি হয়। এই গুণ সকলে জাইন্যা ফেললে নিকারী মাইয়্যার আর সাদি হইব না। এমুন বিশ্বাসঘাতী কাম আমি করুম না।
আমি তোর সোয়ামী। আমারে কইলে কেউ জানব না। কারুরে জানামু না। না যদি কইস, তা হইলে একদিকে যামু গিয়া। ঠিকই যামু, খোদার কসম। বাপজানের বারণ আর এই বাড়িঘর লইয়্যা তুই থাকিস মনের সুখে।নির্বিকার ভঙ্গিতে খোদার নামে কসম খেয়ে বসে রসুল, মুখে চোখে একরোখা ভাব ফুটে বেরোয়।
ছুটে এসে রসুলের বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আজিমা : না না, তুমি যাইও না। কমু, নিচ্চয় কমু। শোনো, নোনা ইলিশের লগে কচুরিফুলের রস, আদা আর পেঁয়াজের রস, বিটলবণ মিশাইলে পচন-গলন লাগে না। কইলাম, তোমার উপুর বিশ্বাস রাখলাম। বিশ্বাস রাখা এইবার তোমার ধর্ম।
মাসখানেকের মধ্যে পাঁচশোমণী নৌকা ভরে নোনা ইলিশের চালান নিয়ে আকিয়াব রওনা হল রসুল। দুমাস পরে আকিয়াব থেকে ফিরে সে একেবারে আলাদা মানুষ। ঘরে বসে মদ খায়। চোখ টকটকে লাল। মাথা টলমল করে। পরনে রেশমি লুঙ্গি, ডোরাকাটা পিরহান, কানে আতর, গলায় সিল্কের রুমাল, সরু শিস দিয়ে দিয়ে মৃধাপাড়া, মাঝিপাড়া, ব্যাপারীপাড়ায় শৌখিন খুশির মূর্তি সেজে আবার ঘুরে বেড়াতে লাগল রসুল। নতুন করে দাওয়াত আর মেজবানের পালা শুরু হল। ব্যাপারীদের মেয়ে রোশেনাবানুর উপর নজর পড়েছে রসুলের।
সব–সব খবর কানে আসে আজিমার। নোনা ইলিশের কারবারে লোকজন খাটে। তারাই ঠিক ঠিক খবর যোগায়। প্রথম প্রথম কয়েকদিন আজিমা বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদল।
রসুল ধমকে ওঠে, চুপ কর মাগি। মড়াকান্না কান্দে, কোন নাগর মরছে তোর? চুপ না মারলে গলা টিপে ধরুন।
রসুলের হাল হকিকত দেখে আর দিল-জ্বালানো বোলচাল শুনে কয়েকটা দিন স্তব্ধ হয়ে রইল নিকারীদের মেয়ে আজিমা। তারপর নিজের হক অধিকারের কথাটা স্মরণ করে কঠিন গলায় বলল, বড় যে কুচরিত্তির ইইছ! মদ খাও, ঘরে বউ থাকতে ব্যাপারীপাড়ায় যাও রোশেনাবানুর কাছে! সব খবরই আমার কানে আসে। কিন্তুক মতলবখান কী তোমার?
লাল চোখ তুলে টেনে টেনে হাসে রসুল : সব খবরই তোর কানে আসে। তুই জানিস তোর থিকা রোশেনাবাবু অনেক খুবসুরৎ?
কী কইতে চাও তুমি?–চমকে তাকাল আজিমা।
শোন তা হইলে। সিধা কথাটা সিধা কইর্যাই কই। রোশেনাবানুরে আমি নিকাহ করুম।
রোশেনাবানুরে নিকাহ করবা! ফিসফিস গলায় বলল আজিমা। বুকটা ধুক ধুক করল। সমস্ত হৃৎপিণ্ডটা মোচড় দিয়ে উঠল। অসহ্য যন্ত্রণায় দেহ মন ইন্দ্রিয় শিরা স্নায়ুগুলো যেন ছিঁড়ে ছিঁড়ে পড়ছে। রক্ত মেদ হাড়ের বস্তুময় দেহে যেন প্রাণের চিহ্ন নেই আজিমার।
হ।
তা হইলে বাপজানের কাছে আমারে পাঠাইয়া দাও।
একেবারে জন্মের মতোই পাঠাইয়া দিমু। শোন, তোরে তালাক দিমু।
দিন কয়েক পর মুছল্লির যোগসাজসে আর আইনের কারসাজিতে বাইন তালাক দিয়ে দিল রসুল। কালো বোরখায় সারা গা ঢেকে বাপজানের সঙ্গে নিকারীপাড়ায় চলে গেল আজিমা।
মাঝখানে একটা দিন। তারপরেই রোশেনাবানুর বাপ বড় ব্যাপারী এসে বলল, এইবার তা হলে দিন দেখি রসুল মিয়া!
দ্যাখেন! মাস তিনেকের মধ্যে একটা চালান নিয়া আরাকান যামু, সেখান থিকা ফিরা রোজা পাইল্যা নিকাহ করুম-খুসবু তামাকের ডিবে এগিয়ে দিতে দিতে রসুল বলল।
.
আরাকানের বিরাট চালানটা একেবারে বরবাদ হয়ে গেল রসুলের। জোয়ার ভাটা আর উজানি বাতাসের মর্জি এবং মেজাজ খোশ থাকলে আরাকান পৌঁছতে মাস দেড়েক লাগে। কিন্তু পৌঁছবার আগেই মাছে পচন ধরল। সমস্ত বর্ষার যত ইলিশ সে ধরেছে, তা বাদে কর্জ করে আরও অজস্র কিনেছে। সে সব ইলিশ কেটে মেটে হাঁড়ি ভর্তি করে পাঁচশোমনি নৌকো নিয়ে আরাকানের পথে পাড়ি জমিয়েছে রসুল।
আজিমার কাছ থেকে নোনা ইলিশের পচন রোধ করার মন্ত্রগুপ্তি জেনে নিয়েছিল। কিন্তু কতটা পরিমাণ বিটলবণ, কচুরিফুলের রস, আদার রস মেশাতে হবে, সে হিসাবটা শিখে রাখা হয়নি। মনে মনে আপসোসের অন্ত রইল না রসুলের। হাঁড়ি-বোঝাই পচা ইলিশ গাঙের জলে ফেলে ফেচুপুরে ফিরে আসতে হল।
গঞ্জের মহাজনের কাছে প্রচুর ধার। আরাকানের এত বড় চালানটা নষ্ট হল। দিনরাত গুম মেরে বসে থাকে রসুল। কাজকর্মে ফুর্তি নেই। মাসখানেকের মধ্যে চোখ কোটরে ঢুকল, হনু দুটো ফুঁড়ে বেরুল। মুখের টান টান সতেজ চামড়ায় ভাঁজ পড়ল।
প্রথম প্রথম দু-চারদিন বড় ব্যাপারী আসত। বলত, রসুল মিঞা, এইবার সাদিটা চুকাইয়্যা ফেলুন। বেফয়দা দেরি কইর্যা লাভ নাই।
রসুল জবাব দিত না, শুধু মাথা নাড়ত। তাতে হানা বোঝার উপায় থাকত না। উদাস চোখে সামনের মজা খাল আর বাজপোড়া ন্যাড়া তালগাছটার মাথায় একটা চিলের দিকে তাকিয়ে বসে থাকত।
খোঁজখবর নিয়ে রসুলের হাল হকিকত জেনে গেল বড় ব্যাপারী। বাজারে প্রচুর দেনা। আরাকানের চালান বরবাদ। বড় ব্যাপারীর আসা বন্ধ হল।
গ্রামের এক প্রান্তে নিরালা নির্জন পঁচিশ বন্দের ঘরখানায় আরও দিনকতক কাটিয়ে এক নিবুনিবু রোদের বিকেলে নিকারীপাড়ার দিকে পা বাড়িয়ে দিল রসুল। আজিমাকে তালাক দেওয়ার পর এই বাড়ি কি নিরানন্দ, কি শ্রীহীন হয়ে গিয়েছে। তাকে ফিরিয়ে আনতেই হবে। যেমন করেই হোক। আজিমার মুল্যে সে রোশেনাবানুকে চেয়েছিল। কিন্তু কিসমাতের মর্জি বোধ হয় অন্যরকম। রসুলের মনে হল, নিকারীদের মেয়ের মেহেরবানি না পেলে আরাকানের বিরাট চালানটার মতো তার জীবনটা বরবাদ হয়ে যাবে।
নিকারীপাড়ায় যাবার পথে বিশাল রবিশস্যের মাঠ। আলপথে কাসিমালি নিকারীর সঙ্গে দেখা হল। কাসিমালি আজিমার চাচাজান।
ভাঙা ভীরু গলায় রসুল বলল, চাচা, আজিমারে তালাক দিয়া গুনাহ করছি। কসুর মাপ করেন। আজিমারে আবার দেন আমারে। ওরে না পাইলে, এই জনম নষ্ট হইয়া যাইব আমার।
কাসিমালি নিকারীর গলায় বিদ্রূপ ফুটল, মস্করা করেন না কি রসুল মিঞা! বড় ব্যাপারীর মাইয়া রোশেনাবানুর লগে আপনের নিকাহ হইব। সারা গেরামের মানুষ সেই খবর জানে। গরিব মানুষেরে নিয়া খেলা করনের মর্জি এখনও যায় নাই!
না না, চাচা। কোনও মন্দ মতলব নাই আমার আর্তনাদ করে উঠল রসুল। নিবুনিবু রোদের বিকেলটা চমকে উঠল।
রসুলের মুখ চোখ দেখে আর আর্তনাদ শুনে কিছু একটা আন্দাজ করল কাসিমালি নিকারী। সহজ স্বাভাবিক, একটু বা সহানুভূতির সুরেই বলল, কিন্তু কই রসুল মিঞা, দিন তিনেক হইল আজিমার যে আবার নিকাহ হইছে। ফরিদপুরে সোয়ামীর ঘর করতে গেছে আজিমা।–ক্ষিপ্র অস্বাভাবিক দ্রুত পা ফেলে কাসিমালি চলে গেল।
কিছুক্ষণ আচ্ছন্নের মতো দাঁড়িয়ে রইল রসুল। এই দেহে প্রাণ আর যেন বাজছে না। মন চেতনা ভাবনা সব অথর্ব হয়ে গিয়েছে। সারা দেহের হাড় মাংস রক্ত তালগোল পাকিয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে। একটু পরে এই ভাবটা কেটে গেলে রসুলের মনে হল, অসহ্য ভয়ানক এক যন্ত্রণা দেহটাকে মনটাকে জড়িয়ে পেঁচিয়ে দুমড়ে মুচড়ে চুরমার করে দিচ্ছে। এলোমেলো পায়ে টলতে টলতে বাড়ি ফিরে এল রসুল।
পরের দিনই বাড়ি বেচে মহাজনের দেনা শোধ করে ফেচুপুর ছেড়ে চলে গিয়েছিল রসুল। সেই থেকে আর ইলশা-জাল বায় না, নোনা ইলিশের চালান নিয়ে নোয়াখালি কি কক্সবাজারের দিকে পাড়ি জমায় না। নিকারীদের মেয়ে আজিমার সঙ্গে সঙ্গে নোনা ইলিশের ব্যবসার পালা চুকে গিয়েছে। ঘুচে গিয়েছে। ইলিশ মাছের উপর কেমন একটা বিতৃষ্ণা ধরে গিয়েছিল রসুলের। ইলিশ মাছ সে খায় না, ছোঁয় না। দেনা শোধ করে এক-মাল্লাই নৌকা কিনেছিল। সেটা নিয়ে গঞ্জে বন্দরে, চর-চরান্তরে কেরায়া বায়। সওয়ারি পারাপার করে। পদ্মা-মেঘনা ইলশা কালাবদরের ঢেউ কেটে কেটে তার একমাল্লাই ছুটে চলে।
.
তাজ্জবের ব্যাপার। এত বছর পর, বলা যায়, নতুন এক জন্মান্তরে সেই আজিমা যে মিঞা সাহেবের বিবিজান হয়ে তার নৌকার সওয়ারি হবে, এ কথা কি কোনওদিন আন্দাজ করতে পেরেছিল রসুল মাঝি! আজিমার নিকাহর কথা শোনার পর যেমনটি হয়েছিল, ঠিক তেমনি এক দুঃসহ যন্ত্রণা বুকের মধ্যে তালগোল পাকিয়ে শ্বাসনালীর কাছে ফুলে ফুলে উঠছে।
নিবু নিবু রোদ মুছে গেল। আকাশ নদী জল ঢেউ–সব এখন আবছা, সব অস্পষ্ট। শুধু হাহাশ্বাসের মতো পালে একটানা বাতাস বাজছে।
আজিমা, না-রসুল মাঝি দেখল, মিঞা সাহেবের বিবিজান এখন তেরছা হয়ে ঘুরে বসেছে। শ্যামলা রঙের টলটল মুখ, একরাশ চুল, নাকের বেশর দেখা যাচ্ছে না।
উৎসুক গলায় রসুল মাঝি বলল, মিঞা সাহেবের ঘর কোথায়? কী কাজকাম করেন?
মিঞা সাহেব কিছু বলার আগেই বিবিজান শাণিত কষ্ট গলায় চেঁচিয়ে উঠল, মাঝির আবার অত খবরের দরকার কী?
বড় একটা নিশ্বাস ফেলে রসুল মাঝি বলল, দরকার আর কী বিবিজান? দরকার না থাকলেই কি জানাটা দোষ?
ছটফট করতে করতে ছইয়ের মুখে এল মিঞা সাহেব। তুমি কিছু মনে করো না মাঝি। বউটা আমার ছেলেমানুষ, মাথার ঠিক নাই।–একটু ছেদ, আবার : ফরিদপুরে আমার দেফসলা জমি আছে দুই শো কানি, সুপারি আর পাটের ব্যাপার আছে। খোদার ফজলে দিনকাল ভালোই চলে।
ভালো, ভালো।-ঘন ঘন মাথা নেড়ে রসুল মাঝি বলল, বিবিজান যে আপনের কাছে সুখে আছে, তাই জাইন্যা সুখ। ভালো, ভালো। জবর খোশ খবর।
ঘন রোমশ ভুরু দুটো একটু কুঁচকে গেল। তার পরেই হো হো শব্দে হেসে উঠল মিঞা সাহেব? আমি সুখ দেওনের কে? সবই খোদার মার্জি।
একটুক্ষণ চুপচাপ।
মিঞা সাহেব আবার বলল, গোঁসা হইলা না তো মাঝি?
না।–হালের বৈঠাটা শক্ত মুঠোয় চেপে নিরাসক্ত গলায় জবাব দিল মাঝি রসুল।
অন্ধকার একটু একটু করে ঘন হল। আকাশে একখানা গোল চাঁদ আর তারা দেখা দিল। জলো দুধের মতো ফিকে জ্যোৎস্না আকাশ-নদী মুড়ে রেখেছে।
কাছে দূরে, আরও দূরে ইলশা-ডিঙি ঘুরে বেড়ায়। এখন ইলিশের মরশুম। রাশি রাশি জোনাকির মতো ইলশা-ডিঙির আলোগুলো নদীময় ছুটাছুটি করে।
মনটা কেমন জানি উদাস উদাস লাগে রসুল মাঝির। পালের বাতাসের শব্দ, ঢেউয়ের একটানা শব্দ, মেঘনার রাশি রাশি ইলশা-ডিঙি আর ছইয়ের মধ্যে আজিমা-না না, মিঞা সাহেবের বিবিজান–সব মিলিয়ে এক দুর্বোধ্য অথচ ভয়ানক যন্ত্রণা সমস্ত মনকে অসাড় করে রাখে। জীবন তত তার বরবাদই হয়ে গিয়েছে। রসুল মাঝি ভাবল, নৌকা ডুবিয়ে আজিমার সাধের আর সুখের জীবনটাকে সে দুনিয়া থেকে মুছে দেবে। আবার ভাবল, পাটাতনের নীচে বড় একটা কোঁচ রয়েছে। সেটা দিয়ে মিঞা সাহেবকে কুপিয়ে মেঘনার খরধারায় ভাসিয়ে আজিমাকে নিয়ে সন্দীপ কি হাতিয়ায় পাড়ি জমাবে। অজানা অচিন জায়গায় নতুন করে জীবন শুরু করবে। ভাবল, কিন্তু হালের বৈঠাটা শক্ত মুঠোয় চেপে বসে থাকা ছাড়া আর কিছুই করল না রসুল মাঝি। পারল না।
মাঝখানে জেলেদের কাছ থেকে গোটা দুই ইলিশ মাছ কিনে নিল মিঞা সাহেব।
রাত্রি আরও ঘন হল। চাঁদের আবছা আলো ঢেউয়ের মাথায় মাথায় দোল খায়। ইলশা-ডিঙির আলোগুলো জ্বলে নেবে, নেবে জ্বলে।
লখাইর চর, ভাতারখাকির চর, নাককাটির চর পেরিয়ে চরসোহাগীর চরে নৌকা ভিড়াল রসুল মাঝি। এখন মাথার উপর চাঁদটা উঠে এসেছে।
মিঞা সাহেব আর বিবিজান চরের মাটিতে নামল।
মিঞা সাহেব বলে, চুলা আছে মাঝি?
নিঃশব্দে পাটাতনের তলা থেকে উনুন বের করে দিল রসুল। কাঠকুটো জ্বালিয়ে ভাত চাপিয়ে দিল বিবিজান। পাশে বসে রান্নাবান্নার যোগান দিতে দিতে অবিরাম বকর বকর করে মিঞা সাহেব। আর নৌকার গলুইতে আচ্ছন্নের মতো বসে থাকে রসুল মাঝি। দুর্বোধ্য ভীষণ যন্ত্রণাটা হাড়ে মজ্জায় শিরায় শিরায় পাক দিতে থাকে।
উনুনের গনগনে আগুনে বিবিজানের শ্যামলা মুখখানা লাল দেখায়। নাকের বেশরটা ঝিকমিক করে। এক গোছা এলোমলো চুল সারা গালে মাখামাখি হয়ে রয়েছে। দেখতে দেখতে ইন্দ্রিয়গুলি বিকল হয়ে যায়।
কত কি ভাবে রসুল মাঝি! ফেচুপুর গ্রামের কথা, নিকারীদের মেয়ে আজিমার কথা, বড় ব্যাপারী আর রোশেনাবানুর কথা, আরাকানের বড় চালানটার কথা, আসমান-জমিন একাকার করে নানা কথা ভাবে। সে ভাবনার তল-কুল-বাঁও মেলে না।
অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল রসুল মাঝি। এক দৃষ্টে বিবিজানের দিকে তাকিয়ে রইল। আরও খানিকটা পর মিঞা সাহেব ডাকতে এলঃ মাঝি খাইবা আস।
মিঞা সাহেবের পিছু পিছু সম্মোহিতের মতো উঠে এল রসুল মাঝি। দেহ-মনের উপর নিজের কোনও মজিই ক্রিয়া করছে না। এখন এমন অবস্থা, কেউ তাকে চালনা করলেই তবে সে চলতে পারে।
খেতে বসে ককিয়ে উঠল রসুল মাঝি? আমি যে ইলিশ মাছ খাই না।
হালকা গলায় মিঞা সাহেব বলল, খাও, খাও মাঝি। পয়লা বর্ষার মাছ। জবর স্বোয়াদ। জবর তেল।
কোনও কথা না বলে উঠে দাঁড়াল রসুল মাঝি। আর সহসাই ঘটে গেল ঘটনাটা। কেউ কিছু করবার বা বলবার আগেই। দুটি নধর নরম হাত দিয়ে রসুল মাঝির একটা হাত চেপে ধরল আজিমা। গাঢ়, থামা-থামা, ভেজা গলায় বলল, খাও মাঝি, আমি রান্না করছি। আমি কইতে আছি।
নিরালা নির্জনচর। হু-হুঁ বাতাস। মেঘনার একটানা ঢেউয়ের শব্দ। ফিকে ফিকে আবছা জোছনা। ভাত খেতে খেতে রসুল মাঝির মনে হল, তার চোখ থেকে জল ঝরে ঝরে ইলিশের স্বাদকে বড় নোনা করে তুলেছে।
দুচার গরাস ভাত খেয়ে মুখ তুলল রসুল মাঝি। চোখাচোখি হল। এক রাশ চুল, নাকে সোনার বেশর, কানে বনফুল, শ্যামলা রঙের একটি ঢলঢলে মুখ। দুটি ঘনপক্ষ্ম কালো চোখ তার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রয়েছে। অস্পষ্ট চাঁদের আলোতে রসুলের মনে হল, সে চোখ দুটিতে জল চিকচিক করছে।
লাবণির জীবনযাপন
লাবণি মজুমদার একটা নামকরা বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল সাতরং-এর ডেপুটি নিউজ এডিটর। সপ্তাহের ছটা দিন তার প্রচণ্ড কাজের চাপ থাকে। বুধবার শুধু ছুটি। চাপমুক্ত হয়ে এই দিনটা সে নিজের মতো করে হালকা মেজাজে কাটিয়ে দেয়।
আজ বুধবার। অন্য দিন সকালে সাতটা সাড়ে সাতটায় সে উঠে পড়ে। সাড়ে দশটায় তার আফিসের গাড়ি চলে আসে। তার মধ্যে স্নান-টান করে, ব্রেকফাস্ট সেরে তৈরি হয়ে নেব লাবণি।
আজ কোনওরকম তাড়াহুড়ো নেই। লাবণির ঘুম ভাঙল নটায়। তারপর সোজা বাথরুমে। মিনিট পনেরো বাদে, বেরিয়ে এসে বাসি নাইটি পালটে একটি ঢোলা হাউসকোট টাইপের গায়ে চাপিয়ে, হাতে মোবাইল নিয়ে দোতলার প্রশস্ত বারান্দায় একটি গদি-আঁটা চেয়ারে আয়েশ করে বসল লাবণি। পাশেই ছোট, নিচু একটা টেবিল। সেটার ওপর আজকের মর্নিং এডিশনের পাঁচটা খবরের কাগজ গুছিয়ে রাখা আছে। হাতের মোবাইলটা সেগুলোর পাশে রাখল সে।
এই দোতলা বাড়িটা তার বাবা দেবনাথ মজুমদার কুড়ি-বাইশ বছর আগে তৈরি করেছিলেন। বছর বারো আগে, মা মারা গেছেন। তিন বছর হল, বাবারও মৃত্যু হয়েছে। বাড়িটা এখন শুধু সে আর একমাত্র বিকলাঙ্গ ছোটভাই কমল, যার ডাকনাম সোমু। জন্মের পর থেকেই সে শয্যাশায়ী। লাবণির বয়স বত্রিশ-তেত্রিশ। কিন্তু এখনও যথেষ্ট সুন্দরী।
বাড়িতে কাজের লোক তিনজন। জবা, মুকুন্দ আর মালতী। জবা দুবেলা রান্না করে। ঘর ধোয়ামোছা, বাসনমাজা, কাপড় কাঁচা, বাজার করা, এমন ভারী ভারী কাজের দায়িত্ব মুকুন্দর। মালতী আয়া, সে সামুকে দেখাশোনা করে। তিনজনই খুব বিশ্বাসী।
জবা চা দিয়ে গেল। আলতো চুমুক দিতে দিতে টেবিল থেকে একটা কাগজ তুলে নিয়ে হেডলাইনগুলো দেখতে লাগল লাবণি।
হঠাৎ মোবাইলে বেজে উঠল। ছুটির দিন বলে রেহাই নেই। গন্ডা গন্ডা ফোন আসে। বেশিরভাগই অফিসের কলিগদের। যেহেতু লাবণি নিউজ ডিপার্টমেন্টের উঁচু পোস্টে আছে, রাজনৈতিক দলের তো বটেই, বিনোদন এবং অন্যান্য ক্ষেত্রের লোকজনও তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে।
লাবণি মোবাইলের দিকে তাকাল। অচেনা একটা নাম্বার ফুটে উঠেছে। কে হতে পারে? ফোনটা তুলে নিয়ে হ্যালো বলতেই ভাঙা ভাঙা একটা গলা ভেসে এল–আমি কি লাবণি মজুমদারের সঙ্গে কথা বলছি? বয়স্ক কোনও মহিলার দুর্বল কণ্ঠস্বর।
আমিই লাবণি। আপনি কে বলছেন?
কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর শোনা গেল, আমি সরোজিনী। চিনতে পারছ মা? বলার ভঙ্গিতে কুণ্ঠা, দ্বিধা, হয়তো একটু আকুলতাও মেশানো।
নামটা শোনার পরও কিছুই পরিষ্কার হল না। কে সরোজিনী? লাবণি বলল, না, মানে, আপনাকে ঠিক
আমি সরোজিনী মল্লিক। লেক টাউনের
এবার মাথার ভেতরটা তোলপাড় হয়ে গেল লাবণির। অনেক আগেই মনে পড়া উচিত ছিল। কিন্তু যাদের জীবন থেকে চিরকালের মতো খারিজ করে দিয়েছে তাদের কেউ যে ফোন করতে পারে, ভাবা যায়নি। তা ছাড়া সরোজিনীর গলার স্বরটা আগের মতো নেই। মুখটা কঠিন হয়ে উঠল লাবণির। কঠিন গলায় বলল, হঠাৎ এতদিন পর আমাকে ফোন?
তুমি ছাড়া ফোন করার মতো আমার আর কেউ নেই লাবণি। কয়েকদিন ধরেই ভাবছিলাম, ফোনটা করব, কিন্তু সাহস হচ্ছিল না।
লাবণির মাথায় লেক টাউনের সেই বাড়িটার লোকজন সম্বন্ধে একসময় প্রবল ক্ষোভ, বিতৃষ্ণা এবং ক্রোধ জমা হয়ে ছিল। ধীরে ধীরে তার ঝাঁঝ কমেও এসেছিল। লেক টাউনের সেই মানুষগুলোর চেহারা ক্রমশ ঝাপসা হয়ে এসেছে। কিন্তু হঠাৎ সরোজিনীর ফোনটা আসার পর পুরোনো ক্ষোভ, রাগ স্মৃতির অতল স্তর ভেদ করে বেরিয়ে এসে যেন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিল। গলার স্বর উঁচুতে তুলে লাবণি বলল, অনেকদিন আগেই তো আপনাদের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক চুকেবুকে গেছে। তা হলে আবার ফোন কেন? নতুন করে যোগাযোগ করার কী প্রয়োজন?
জানি, তুমি আমাদের বাড়িতে এসে শান্তিতে থাকতে পারোনি। চূড়ান্ত অপমানিত হয়েছ। তোমার ক্ষোভ, রাগ, এসব থাকা খুবই স্বাভাবিক। তবু একটা বিশেষ দরকারে ফোন করতে হল।
অরিজিৎ মল্লিক লাবণির প্রাক্তন স্বামী। লেক টাউনের বাড়িতে সে তাকে কম নির্যাতন করেনি। এই সরোজিনী মল্লিকও ছেলের সঙ্গে সমান তাল মিলিয়ে যেতেন। কিন্তু লাবণি অসভ্য, ইতর নয়। উম্মা যেটুকু প্রকাশ করার করেছে। নিজেকে এবার কিছুটা সামলে নিয়ে জিগ্যেস করল, আপনি আমার ফোন নম্বর পেলেন কীভাবে?
সরোজিনী বললেন, তোমাদের চ্যানেলে একজনকে দিয়ে ফোন করে জেনে নিয়েছি।
ও। তা দরকারের কথা যে বলছিলেন, সেটা কী?
তোমার সঙ্গে দেখা হলে বলব।
কী চান আপনি? ফের তিক্ত হয়ে উঠল লাবণিআমি লেক টাউনে গিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করব? একটা কথা স্পষ্ট শুনে রাখুন, যে বাড়ি থেকে একবার বেরিয়ে এসেছি সেখানে এ জন্মে আর কখনও যাব না।
না, না– সরোজিনী উতলা হয়ে উঠলেন। লেক টাউনে আমি আর থাকি না।
রীতিমতো অবাকই হল লাবণি। তা হলে কোথায় থাকেন?
বছরখানেক হল বোড়ালের কাছে একটা বৃদ্ধাশ্রমে।
লাবণি চমকে উঠল-বৃদ্ধাশ্রম! মানে ওল্ড এজ হোম?
সরোজিনী মোটামুটি শিক্ষিতা। সেই আমলের ম্যাট্রিকুলেট। বললেন, হ্যাঁ।
লেক টাউন থেকে ওল্ড এজ হোম! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
তুমি ভীষণ ব্যস্ত মানুষ। বলতে সাহস হয় না, তবু বলছি। পরশুর মধ্যে তুমি কি দয়া করে একবার হোমে আসতে পারবে? এলে সামনাসামনি বসে সব বলব। হোম থেকে আমাকে আল্টিমেটাম দেওয়া হয়েছে, পরশু পর্যন্ত ওখানে থাকতে পারব। তারপর এলে আমার সঙ্গে আর দেখা হবে না। বলে, একটু থেমে সরোজিনী ফের শুরু করলেন, তুমি যদি না আসো, একটা মারাত্মক অপরাধবোধ নিয়ে বাকি জীবনটা আমাকে রাস্তায় রাস্তায় কাটিয়ে দিতে হবে। তার শেষ কথাগুলো কাতর মিনতির মতো শোনাল।
যাবে কি যাবে না, ঠিক রতে পারছে না লাবণি। একদিন এই মহিলার কী না ছিল। লেক টাউনে তার স্বামীর মস্ত তেতলা বাড়ি, ব্যাঙ্কে লক্ষ লক্ষ টাকা, ছেলে অরিজিৎ মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির উঁচু পোস্টে। সেই তিনিই নাকি শেষ বয়সে বৃদ্ধাশ্রমে? তার সঙ্গে সরোজিনী যত দুর্ব্যবহারই করে থাকুন, এখন যেন একটু করুণাই হচ্ছে। সেই সঙ্গে কৌতূহলও। লাবণি মনস্থির করে ফেলে।–আচ্ছা যাব।
কবে মা?
আজই। আমাদের বাঁশদ্রোণীর বাড়ি থেকে বোড়াল খুব দুরে নয়। ঠিকানাটা দিন। ঘণ্টাখানেক ঘণ্টাদেড়েকের ভেতর পৌঁছে যাব।
সরোজিনী শুধু ঠিকানাই নয়, কীভাবে সেখানে যেতে হবে, সব বুঝিয়ে দিলেন।
ফোন অফ করে লাবণি জবাকে তাড়া দিল। জবাদি, আমাকে তাড়াতাড়ি দুটো টোস্ট আর ডিমের অমলেট করে দাও। সেই সঙ্গে আরেক কাপ চা। আমাকে এক্ষুনি বেরুতে হবে।
জবা কিচেনে খুটখাট, ঠুং ঠাং করে রান্নার তোড়জোড় করছিল। বলল, দিচ্ছি।
খাওয়া শেষ করে হাউসকোট ছেড়ে, শাড়ি-টাড়ি পরে, কিছু টাকা ব্যাগে পুরে বেরিয়ে পড়ল লাবণি। তাদের বাড়িটা প্রায় বড় রাস্তার ওপরে। সেখানে আসতেই একটা ফাঁকা ট্যাক্সি পাওয়া গেল। কোথায় যেতে হবে, ট্যাক্সিওয়ালাকে জানাতেই গাড়িটা গড়িয়ার দিকে দৌড় শুরু করল।
কয়েক বছরের মধ্যে শহরের এই এলাকাটা আগাগোড়া বদলে গেছে। রাস্তার দুধারে আদ্যিকালের যেসব বাড়ি, ডোবা, পানাপুকুর, ঝোপঝাড় ছিল তার চিহ্নমাত্র নেই। লাইন দিয়ে এখন চোখধাঁধানো হাইরাইজ, আঁ-চকচকে কত যে শো-রুম, ব্যাঙ্ক, নানা ধরনের অফিস ইত্যাদি ইত্যাদি। মানুষজন বেড়ে গেছে বহুগুণ; তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রাইভেট কার, অটো, বাস, মিনি। পাশের টালির নালার ওপর দিয়ে অবিরল ছুটে চলেছে মেট্রো রেল।
জানলার বাইরে অন্যমনস্কর মতো তাকিয়ে আছে লাবণি। রাস্তায় গাড়ি-টাড়ি, লোকজনের ভিড়, কিছুই যেন দেখতে পাচ্ছিল না। কী এক উজান টানে সে ন-দশ বছর আগের দিনগুলোতে ফিরে যাচ্ছিল।
.
বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে তখন তারা তিনজন। বাবা দেবনাথ মজুমদার, ছোট ভাই সোমু আর সে। যে তিনটি কাজের লোক এখন রয়েছে, তখনও তারাই ছিল। এর কিছুদিন আগে মায়ের মৃত্যু হয়েছে।
দেবনাথ রাজ্য সরকারের একটা ডিপার্টমেন্টের ছোটখাটো অফিসার। রিটায়ারমেন্টের তখনও দুতিন বছর বাকি।
লাবণি ছাত্রী হিসেবে যথেষ্ট ভালো মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক তিন-চারটে লেটার নিয়ে ফাস্ট ডিভিশন, একটা নামকরা কলেজ থেকে ইংরেজি অনার্স নিয়ে হাই সেকেন্ড ক্লাস। রেজাল্টগুলো উড়িয়ে দেবার মতো নয়।
দেবনাথের ইচ্ছা ছিল মেয়ে ইংরেজিতে এম.এ.-টা করে বি.এড-টাও করে নিক। তারপর স্কুল সার্ভিস কমিশনে বসুক। তুড়ি মেরে পাশ করে স্কুলের চাকরি পেয়ে যাবে। স্কুল টিচারদের মাইনে টাইনে খুবই ভালো। তা ছাড়া পার্মানেন্ট সার্ভিস। ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত। রিটায়ারমেন্টের পর পেনশন।
কিন্তু, তখন কি তারও আগে থেকে মিডিয়ার রমরমা শুরু হয়েছে। একদিকে নতুন নতুন কাগজ বেরুচ্ছে, অন্যদিকে টেলিভিশনে কিছুদিন পর পরই নতুন চ্যানেল খোলা হচ্ছে।
ইংরেজিতে অনার্স থাকলেও, বাংলাতেও লাবণির যথেষ্ট দখল। দুটো ভাষাতেই চমৎকার। কলেজে পড়তে পড়তেই সে স্বপ্ন দেখত সাংবাদিক হবে। দেবনাথ তা জানতেন। মেয়েকে বোঝাতেন কয়েকটা চ্যানেল আর চার-পাঁচটা বিখ্যাত কাগজ ছাড়া বাকিগুলো টিকে থাকবে কিনা সন্দেহ। লাবণি ভালো করে ভেবে দেখুক, কী করবে।
মিডিয়ার দুরন্ত মোহ, তাছাড়া লাবণির আত্মবিশ্বাসটা প্রচণ্ড। সে নিশ্চিত ছিল, প্রিন্ট মিডিয়া বা ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে সুযোগ পাবেই। খ্যাতি, প্রতিষ্ঠা, অর্থ সবই হবে। স্কুল মাস্টারির ভ্যাদভেদে, একঘেয়ে জীবন তার আদৌ পছন্দ নয়। সে সোজা মাস-কমিউনিকেশনে কোর্স করতে ভর্তি হয়ে গেল। শুধু সে-ই নয়, তার কলেজের অনেক বন্ধু একই স্বপ্ন দেখত। যেমন রাঘব, নন্দিনী, গোপা, রণেন, সুব্রত এবং আরও কয়েকজন। তারই সঙ্গে ওরাও ভর্তি হল। এদের মধ্যে লাবণির সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু হল রাঘব। ভারি সরল, অকপট, তার মধ্যে কোনওরকম নোংরামি নেই। মাথায় কোনও মতলব বা স্বার্থ নিয়ে সে কারও সঙ্গে মেশে না। বন্ধুদের কেউ, বিশেষ করে লাবণি ভালো কিছু করলে সেটা যেন তার নিজেরই সাফল্য।
হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করার পর রাঘব আর সে আলাদা আলাদা স্কুল থেকে এসে কলেজে ভর্তি হয়েছিল। তখনই আলাপ-পরিচয়, কয়েদিনের মধ্যে বন্ধুত্ব। বন্ধুত্বটা দিনে দিনে আরও গাঢ় হয়েছে।
রাঘবদের বাড়ি টালিগঞ্জের চণ্ডীতলায়। সেখান থেকে বাঁশদ্রোণী আর কতদূর? অটোয় উঠলে মিনিট পনেরো কুড়ির মধ্যে পৌঁছনো যায়। রাঘব ছুটির দিনে প্রায়ই লাবণিদের বাড়ি চলে আসত। তার স্বভাবে এমন একটা আপন করা ব্যাপার আছে যে দেবনাথও তাকে খুব পছন্দ করতেন। রাঘব এলে খুশি হতেন।
মাস-কমিউনিকেশন সেশন শেষ হলে চ্যানেলে চ্যানেলে আর খবরের কাগজের অফিসগুলোতে হানা দেওয়া শুরু হল। মিডিয়ার বাড়বাড়ন্ত হলেও চাকরি জোটানো সম্ভব হচ্ছিল না। একমাত্র রণেনই নর্থ বেঙ্গলের একটা ছোট চ্যানেলে চাকরি পেল। বাকি সবাই কাজের চেষ্টায় ঘুরছে। নানা কাগজে টুকটাক এটা সেটা লিখে কিছু পয়সা পাচ্ছে।
রাঘব এসে একদিন খবর দিল একটা নামকরা বাংলা কাগজে আর একটা সর্বভারতীয় ইংরেজি ডেইলিতে চাকরি নয়, তবে ওদের ফরমাশমতো লিখলে আর সেই লেখা ওদের পছন্দ হলে ছাপবে। অবশ্য তারা নিজেরাও যদি চমকপ্রদ বিষয় খুঁজে নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে দেয়, ছাপা হবে। এর জন্য বেশ ভালো অঙ্কের টাকাও পাওয়া যাবে।
রাঘব লাবণিকে সঙ্গে করে দুটি কাগজের দুই বার্তা-সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করল। তারা কয়েকটা বিষয় জানিয়ে দিয়ে লেখা তৈরি করে আনতে বললেন।
মনে আছে লেখাগুলো খুব খেটেখুটে, সময় নিয়ে যত্ন করে, লিখে জমা দিয়ে এসেছিল লাবণিরা। তারপর একটা সপ্তাহ ভয়ে ভয়ে কাটিয়েছে। লেখা ভালো না লাগলে নিশ্চয়ই নিউজ এডিটররা ছাপাবেন না। দুই কাগজের দরজা তাদের কাছে বন্ধ হয়ে যাবে।
সাতদিন পর দেখা গেল বাংলা ইংরেজি দুটো কাগজেই তাদের লেখা বেরিয়েছে। টেনশন থেকে পুরোপুরি মুক্ত। লাবণিরা দুই কাগজের অফিসে ছুটল। দুই বার্তা-সম্পাদক তাদের লেখার স্টাইল, ভাষা, প্রকাশভঙ্গির তারিফ করলেন–গুড।
সেই শুরু। তারপর বছরখানেক এভাবেই চলল। লাবণি আর রাঘবের লেখা সম্পর্কে বাংলা দৈনিকটির বার্তা-সম্পাদক অমলেশ সান্যালের ভালো ধারণা তো ছিলই, ওদের তিনি খুব পছন্দও করতেন। একদিন তিনি একটা সুখবর দিলেন। বছর দেড়েকের মধ্যে নিউজ ডিপার্টমেন্টের পাঁচজন সিনিয়র সাংবাদিক অবসর নিতে চলেছেন। তাঁদের শূন্যস্থানগুলি পূ রণ করার জন্য নতুন লোক নেওয়া হবে। তিনি কাগজের কর্তৃপক্ষকে লাবণি আর রাঘবের নাম সুপারিশ করলেন। ওদের চাকরি নিশ্চয়ই হয়ে যাবে।
কিন্তু কাগজের চাকরিটা করা হল না লাবণির। মিডিয়া ছিল তার পাখির চোখ। হঠাৎ এমন কিছু ঘটনা ঘটল যাতে আসল নিশানাটা বহুদূরে প্রায় মিলিয়ে গেল। জীবনটা তোলপাড় হতে হতে তাকে টেনে নিয়ে গেল অন্য এক দিকে, যার জন্য সে আদৌ প্রস্তুত ছিল না।
মাস কম-এ তাদের ব্যাচের নন্দিনীর দিদি মালিনীর সে বছর বিয়ে ঠিক হয়েছে। নন্দিনী বন্ধুদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে নেমন্তন্ন তত করলই, সেই সঙ্গে শাসিয়েও দিল, যে তার দিদির বিয়েতে যাবে না, ইহজীবনে সে তার মুখদর্শন করবে না।
হাজরা রোডে নন্দিনীদের বিরাট চারতলা বাড়ি। সামনের দিকে অনেকটা ফাঁকা জায়গা জুড়ে সামিয়ানা খাটানো হয়েছে। সেখানে নিমন্ত্রিতদের বসার ব্যবস্থা। মস্ত ছাদটা ঘিরে বিশাল প্যান্ডেল।
লাবণিরা ঠিক করেছিল, কয়েকটা গাড়ি ভাড়া করে বন্ধুরা একসঙ্গে বিয়ে বাড়িতে আসবে সন্ধের পর পর তারা এসেও গেল। নন্দিনীদের বাড়িটা অজস্র ফুল আর নানা রংয়ের আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে। আকুল করা সুরে সানাই বেজেই চলেছে।
গিফট বক্স আর প্যাকেট-ট্যাকেট নিয়ে লাবণিরা গাড়িগুলো থেকে নেমে বাড়ির ভেতরে সামিয়ানার কাছাকাছি চলে এসেছে, ছুটতে ছুটতে নন্দিনী এসে হাজির। হাসতে হাসতে বলল, তোরা এসেছিস! কী ভালো যে লাগছে! আয় আয়–
কলবল করতে করতে সবাই এগিয়ে চলল। নন্দিনী তাদের তেতলায় মস্ত এটা হলঘরে নিয়ে এল। এখানেও গেস্টদের বসার জন্য চমৎকার বন্দোবস্ত। বলল, বোস্ বোস্। কী দিতে বলব? কফি, কাবাব-টাবাব, না সরবত?
কেউ বলল না। বলল, ওসব পরে হবে। আগে দিদির কাছে নিয়ে চল–
তেতলারই একটা বিশাল ঘরের পুরো মেঝেটা দামি কার্পেট দিয়ে মোড়া। মাঝখানে ফুলের ঝালর দিয়ে সাজানো চাদোয়ার তলায় যে বসে আছে, সে যে মালিনী, দেখামাত্রই বোঝা যায়। পরনে মেরুন রংয়ের মহার্ঘ বেনারসি। তার গলা, কান, হাত, আঙুলের গয়নাগুলো থেকে হীরের ঝলক ঠিকরে ঠিকরে বেরুচ্ছে। তাকে ঘিরে ডজন ডজন কিশোর, তরুণী এবং কয়েকজন বয়স্ক মহিলা অবিরত কলর কর করে চলেছে। কোনও মজার কথায় একসঙ্গে সবাই গলা মিলিয়ে হেসে উঠছে। বিয়ের কনেকে ঘিরে যেমন হয় আর কী।
ঘরের চারপাশে ফ্লাওয়ারভাসের রজনীগন্ধা, গোলাপের তোড়া। ফুলে আর মেয়েদের পোশাক থেকে উঠে আসা পারফিউমের গন্ধে সারা ঘর ম-ম করছে।
মেয়েদের ভিড় সরিয়ে নন্দিনী সবান্ধবে মালিনীর কাছে চলে এল–দিদি, এরা আমার বন্ধু। একসঙ্গে মাসকম করেছি।
মিষ্টি হেসে মালিনী বলল, তোমরা এসেছ, খুব আনন্দ হচ্ছে। কিন্তু আজ এমন একটা দিন যে জমিয়ে গল্প করব তার উপায় নেই।
সুধেন্দু বেশ হাসিখুশি, আমুদে ধরনের ছেলে। বলল, না, না, আজ আপনার এমন সময় নেই যে গল্প করবেন। দ্বিরাগমনে যখন আসবেন, নন্দিনী যদি আমাদের ইনভাইট করে জামাইবাবু আর আপনার সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা দেব।
মালিনী ছোটবোনের দিকে তাকাল। এই ছুটকি, ওদের সেদিন কিন্তু আসতে বলবি।
নন্দিনীর ডাকনাম যে ছুটকি, সেই প্রথম জানল তার বন্ধুরা। ঠোঁট টিপে তার দিকে তাকিয়ে সবাই হাসতে লাগল।
এমন একটা বিদঘুটে ডাকনাম বন্ধুরা জেনে ফেলায় অস্বস্তি হচ্ছিল নন্দিনীর। কোনওরকমে একটু হাসল সে।
দিদি, হ্যাপি হ্যাপি হ্যাপি ম্যারেড লাইফ হই হই করে এই ধরনের শুভেচ্ছা জানিয়ে গিফটগুলো দিয়ে সুধেন্দু, গোপা, লাবণিরা হলঘরে ফিরে এল। সঙ্গে নন্দিনীও।
এদিকে হলঘর প্রায় ভরে গেছে। কয়েকটা বেয়ারা ট্রেতে কফি, চা, শরবত, কাবাব, চিকেন পাকোড়া, কাজু, পেস্তা ইত্যাদি নিয়ে ভিড়ের মধ্যে চক্কর দিচ্ছে। গেস্টরা যে যার ইচ্ছামতো কফি-টফি তুলে নিচ্ছে। লাবণিরাও নিল। খেতে খেতে লঘু মেজাজে গল্প চলছে।
গোপা নন্দিনীকে বলল, তুই এখানে বসে আড্ডা মারছিস কেন? দিদির বিয়ে, কাজ কর গিয়ে
তোদের অ্যাটেন্ড করাই আমার কাজ। অন্য কাজের জন্যে ডজন ডজন লোক আছে।
ঠিক আছে, মনপ্রাণ দিয়ে অ্যাটেন্ড কর।
আ যখন তুমুল হয়ে উঠেছে তখন কেউ ডেকে উঠল, ছুটকি—
দেখা গেল দোতলা থেকে প্রৌঢ়ত্বের শেষ সীমায় পৌঁছে যাওয়া একজন সুশ্রী মহিলা এবং একটি যুবক, বয়স তিরিশের নীচেই হবে, উঠে এল। যুবকটির পরনে ধাক্কাপাড় ধুতি, তসরের পাঞ্জাবি, হাতে বিদেশি রিস্টওয়াচ, পাঞ্জাবির বোতামগুলোতে হীরে বসানো। এমন সুন্দর মানুষ কচ্চিৎ কখনও চোখে পড়ে।
গোপা, সুধেন্দু, মঞ্জুশ্রীরা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল।
এদিকে নন্দিনী প্রায় লাফিয়ে উঠেছে।–পিসি, অপুদা, তোমাদের তো সন্ধের আগে আসার কথা। এত দেরি করলে কেন?
মহিলা আর যুবকটির সঙ্গে নন্দিনীর কী সম্পর্ক, মোটামুটি বোঝা গেল।
অপু বলল, কী করে আসব? বেরিয়েছি পাঁচটায়। রাস্তায় যা জ্যাম ভাবতে পারবি না। ভিআইপি রোডে গাড়ি এত বেড়েছে যে নড়াচড়া করাই মুশকিল।
এদিকে বাবা আর মা মিনিমাম পঁচিশবার তোদের কথা জিগ্যেস করেছে।
মহিলা বললে, দাদা-বউদি কোথায় রে?
নন্দিনী বলল, দোতলায়। যেখানে বর আর বরযাত্রীরা এসে বসবে সেই জায়গাটা ঠিকমতো সাজানো হয়েছে কিনা, সার্ভে করতে গেছে।
মহিলা তার ছেলেকে বললেন, চল অপু, দাদা-বউদির কাছে যাই।
অপু বলল, তুমি যাও। আমি পরে আসছি।
মহিলা চলে গেলেন। অপু রাঘব, সুধেন্দু, গোপালের দেখিয়ে বলল, এদের তো চিনতে পারলাম না।
নন্দিনী বলল, এরা আমার বন্ধু। একসঙ্গে আমরা জার্নালিজম মাস কমিউনিকশন পড়তাম।
আরে বাবা, একসঙ্গে আমি এত জার্নালিস্ট আগে আর কখনও দেখিনি।
সুধেন্দু বলল, পাশ করেছি, কিন্তু এখনও কেউ জার্নালিস্ট হইনি। হবার চেষ্টা করছি।
লক্ষ্য করেছি এখানে বেশ আড্ডা চলছে। আমিও খুব আড্ডাবাজ। বসতে পারি?
সুদর্শন, ঝকঝকে, মিশুকে যুবকটিকে সবার ভালো লেগে গিয়েছিল। তারা হই হই করে উঠল–নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই
অপু বসে পড়ল। নন্দিনী বলল, অপুদা, আগে তোমাদের পরিচয়টা করিয়ে দিই
অপু বলল, দরকার নেই। ওটা আমি নিজেই করে নিচ্ছি। বলে সুধেন্দু, গোপা-টোপাদের দিকে তাকাল। –আমার ডাকনাম অপু। ভালো নাম অরিজিৎ মল্লিক। লেক টাউনে আমাদের ছোট একটা বাড়ি আছে, সেখানে আমার মা সরোজিনী মল্লিক আর আমি থাকি। একটা ছোট চাকরি করি। ব্যস–
নন্দিনী দুহাত নাড়তে নাড়তে চেঁচামেচি করতে লাগল। তোরা বিশ্বাস করিস না। লেক টাউনে অপুদাদের বিশাল তেতলা বাড়ি। ও আমেদাবাদের আইআইএম থেকে এমবিএকরেছে। ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট। একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির খুব বড় পোস্টে আছে।
এনাফ, এনাফ। এবার চুপ কর। নন্দিনীকে থামিয়ে দিয়ে একে একে সুধেন্দুদের নাম-টাম জেনে নিতে নিতে সবার শেষে লাবণির দিকে তাকাল।
লাবণি লক্ষ্য করেছে এতক্ষণ অন্য বন্ধুদের সঙ্গে অরিজিৎ কথা বলছিল ঠিকই, তবে বারবার তার চোখ এসে পড়ছিল তারই দিকে। সেই সময়ে লাবণি ছিল খুবই সুন্দরী, সপ্রতিভ। সে নিজেও কি অরিজিৎকে দেখছিল না?
অরিজিৎ হাসল, এবার আপনার কথা শুনি।
আমি লাবণি। আমাদের খুব সাধারণ মিড ক্লাস ফ্যামিলি। গলা উঁচু করে বলার মতো তেমন কিছুই নেই।
অরিজিৎ কয়েক লহমা তাকিয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে চোখ সরিয়ে নিল।
তারপর আজ্ঞা দারুণ জমে উঠল। কতরকম টপিক-পলিটিকস, ক্রিকেট, ফুটবল, সিনেমা, স্টেজ, আন-এমপ্লয়মেন্ট ইত্যাদি ইত্যাদি।
বিজনেস ম্যানেজমেন্টের তুখোড় ছাত্র অরিজিৎ দেশের তো বটেই, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কত বিষয়েই যে জানে! বলার ভঙ্গিটাও চমৎকার। মুগ্ধ হয়ে শোনার মতো।
আচ্ছা যখন জমজমাট, সেইসময় কে এসে খবর দিল, ছুটকি, বর, বরযাত্রীরা কখন এসে গেছে। এখনি বিয়ে শুরু হবে। শিগগিরি বন্ধুদের নিয়ে আয়। বিয়ে দেখবি না!
বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে দোতলায়; ফুল-টুল দিয়ে সাজিয়ে একটা সামিয়ানার ভেতর। আড্ডায় সবাই এতটা মেতে ছিল যে কখন মালিনীকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কেউ খেয়াল করেনি। নন্দিনী প্রায় লাফিয়ে উঠে বন্ধুদের সঙ্গে অরিজিৎকে তাড়া দিতে দিতে দোতলায় নামিয়ে নিয়ে এল।
মুহুর্মুহু উলুধ্বনি, শাঁখের আওয়াজ আর পুরোহিতদের মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে বিয়ের কাজ চলছে। সামিয়ানার চারপাশ নানা বয়সের মেয়েদের ভিড়ে ঠাসা। চলছে তাদের কলকলানি, হাসাহাসি। পুরুষরা একটু দূরে থোকায় থোকায় দাঁড়িয়ে নানা রঙ্গকৌতুকে হেসে হেসে উঠছে।
নন্দিনীর মা-বাবা এখানেই ছিলেন। নন্দিনী তাদের সঙ্গে বন্ধুদের পরিচয় করিয়ে দিল। সবাই প্রণাম করতে যাচ্ছিল, নন্দিনীর বাবা হাত তুলে তাদের থামিয়ে দিয়ে হেসে হেসে বললেন, এতজনের প্রণাম নিতে গেলে রাত ভোর হয়ে যাবে। প্রণামগুলো ভোলা রইল, পরে একদিন হবে। ছুটকি, বিয়ে শেষ হতে মাঝরাত পেরিয়ে যাবে। তোর বন্ধুদের আগেই খাইয়ে দিস। ওদের তো বাড়ি ফিরতে হবে। লাবণিদের বললেন, এটা তোমাদের দিদির বিয়ে। আনন্দ করে খেয়ো। যার যেটা ইচ্ছে, চেয়ে নেবে কিন্তু
কিছুক্ষণ বিয়ের অনুষ্ঠান দেখার পর নন্দিনী বন্ধুদের নিয়ে ছাদে চলে এল। অরিজিৎও সঙ্গে এসেছে। বলল, আলাপ-পরিচয় হল। সবাই একসঙ্গে বসে গল্প করতে করতে খাওয়া যাবে। তাই এসে পড়লাম। আপত্তি নেই তো?
সবাই হই হই করে উঠল। একেবারেই না। আপনার কোম্পানি পাওয়া-ইটস আ প্লেজার।
লাবণি কিছু বলল না। নিঃশব্দে লক্ষ করতে লাগল।
ছাদের মস্ত প্যান্ডেলের বেশির ভাগটা জুড়ে টেবিল চেয়ার পেতে খাওয়ানোর ব্যবস্থা।
অন্য নিমন্ত্রিতদের মধ্যে অনেকেই এসে গেছে। প্যান্ডেলের এক ধারে মুখোমুখি লম্বা দুটো রো ফাঁকা রয়েছে। নন্দিনী বন্ধুদের সেখানে নিয়ে বসাল।
একটা রোয়ের শেষ দিকে বসেছে লাবণি। তার পর তিন চারটে খালি চেয়ার। আচমকা অরিজিৎ লাবণির ঠিক পাশের চেয়ারটায় এসে বসল।
অরিজিৎ কি লক্ষ রাখছিল তার পাশের চেয়ারটা কেউ দখল করেনি, তাই চটপট এসে বসে পড়ল। ওর মাথায় কি কোনও মতলব ঘুরছে? মনটা কেমন ঘোলাটে হয়ে গেল। সেই সঙ্গে একটু অস্বস্তিও হচ্ছে। আবার অল্প অল্প ভালোও লাগছে। কেন লাগছে লাবণি বলতে পারবে না।
গলা অনেকটা নামিয়ে অরিজিৎ বলল, তেতলার হলঘরে, আমরা সবাই যখন হইচই করে আড্ডা দিচ্ছিলাম, আপনি কিন্তু দুচারটের বেশি কথা বলেননি।
এটাও আপনার নজরে পড়েছে?
পড়বে না? মেয়েটা তত বেশি কথা বলে। আপনি একেবারে চুপচাপ।
আমার শুনতে বেশি ভালো লাগে।
ইউ আর ভেরি স্পেশ্যাল।
আপনার সঙ্গে যখন পরিচয় হল, তখনই কিন্তু জানিয়ে দিয়েছিলাম, আমি মিডল ক্লাস ফ্যামিলির সামান্য একটি মেয়ে।
কে সামান্য, কে অসামান্য, মুখ দেখে খানিকটা বুঝতে পারি।
ও বাবা, আপনার এই গুণটাও আছে।
অরিজিৎ হাসল।
কেটারারের উর্দিপরা বেয়ারারা খাবার এনে প্লেটে প্লেটে দিয়ে যেতে লাগল। দুই রোয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে নন্দিনী অনবরত বলতে লাগল, একে ফ্রাই দাও, ওর পাত খালি, পোলাও আর কোর্মা নিয়ে এসো ইত্যাদি।
হই হই করে খাওয়া দাওয়া চলছে। খেতে খেতে অরিজিৎ অন্য সবার সঙ্গে গলা মেলাচ্ছে, আবার কণ্ঠস্বর নামিয়ে লাবণির সঙ্গে দু-একটা কথা বলছে।
খাওয়া শেষ হলে সবাই নীচে নেমে এল। তখনও বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হয়নি। নন্দিনীর মা-বাবার সঙ্গে দেখা করে লাবণিরা সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে বাইরের রাস্তায় চলে এল। যে সাতটা গাড়ি ভাড়া করে তারা এসেছিল সেগুলো লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এগুলোই তাদের সবাইকে বাড়ি পৌঁছে দেবে।
নন্দিনী বন্ধুদের রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসেছিল। সঙ্গে অরিজিৎ এসেছে। সবাই যখন একে একে গাড়িতে উঠছে, সেই ফাঁকে অরিজিৎ লাবণিকে বলল, আবার কবে দেখা হবে?
লাবণি স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। এইরকম কোনও অনুষ্ঠানে আপনাকে আর আমাকে যদি ইনভাইট করা হয় দেখা হলেও হতে পারে। তবে তার সম্ভাবনা অ্যাট অল আছে বলে মনে হয় না। বলেই গাড়িতে উঠে গেল।
.
বাড়ি ফিরে শুতে শুতে বারোটা বেজে গেল। কিন্তু ঘুম আসছে না। বারবার অরিজিতের মুখটা মনে পড়ছে। এত সুপুরুষ, ম্যানেজমেন্টে চোখ-ধাঁধানো রেজাল্ট, দুর্দান্ত কেরিয়ার, পয়সাওয়ালা বাড়ির একমাত্র ছেলে। সবে তো সেদিনই আলাপ হয়েছে। দু-চারটের বেশি কথা হয়নি। তার সম্বন্ধে অরিজিতের এত আগ্রহ কেন? উটকো চিন্তাটা মাথা থেকে জোর করে বের করে দিতে সময় লাগল লাবণির। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল।
পরদিন ঘুম ভাঙল বেশ বেলায়। মুখ-টুখ ধুয়ে চা খেয়ে লেখার টেবিলে গিয়ে বসল লাবণি। বাংলা কাগজের অমলেশদা আর ইংরেজি ডেইলির নিউজ এডিটর বিজয়দা অর্থাৎ বিজয় পালিত তাদর দুই কাগজের জন্য দুটো টপিক দিয়েছেন। লেখা দুটো চার কি পাঁচদিনের ভেতর দিতে হবে।
আগে থেকেই ঠিক করা আছে, বাংলা কাগজের লেখাটা প্রথমে শেষ করে ইংরেজি কাগজেরটায় হাত দেবে।
কাগজ-কলম-টলম টেবিলের ড্রয়ার থেকে বের করে মনে মনে লেখাটা শুরু থেকে শেষ অবধি মোটামুটি সাজিয়ে নিয়ে শুরু করতে যাবে, দেবনাথ দরজার বাইরে থেকে বললেন, বেরুচ্ছি রে। পৌনে দশটা বাজে। আজ অফিসে নির্ঘাত লেট। কাল রাত্তিরে তুই তখন বিয়েবাড়িতে, সোমুটার জ্বর এসেছিল। মালতী আছে, তবু তুই দু-একবার গিয়ে ছেলেটাকে দেখে আসিস।
আসব, আসব। তুমি ভেবো না।
দেবনাথ চলে গেলেন।
তারপর মাত্র দশ-বারো লাইন লিখেছে লাবণি, হঠাৎ রাঘবের ফোন-কাল নন্দিনীদের বাড়ি থেকে এত রাত্তিরে ফেরা হয়েছে। এখনও বিছানায় চিতপাত হয়ে পড়ে আছিস নাকি!
লাবণি বলল, না রে না, উঠে পড়েছি।
অমলেশদা খুব ভালো মানুষ, সিমপ্যাথেটিক, কিন্তু সময়মতো লেখা না দিলে ফায়ার হয়ে যান। তোর আর আমার লেখা পরশুদিন দিতে হবে। মনে থাকে যেন।
রাঘবের মতো বন্ধু হয় না। লাবণি বলল, সেই লেখাটা নিয়েই তো বলছি।
গুড ছাড়ছি।
আরও কয়েক লাইন লেখার পর আবার ফোন। এবার নন্দিনী। রীতিমতো অবাকই হল লাবণি। কী রে, বিয়েবাড়িতে এত ব্যস্ততা, তার মধ্যে হঠাৎ ফোন করলি? এনিথিং আর্জেন্ট?
নন্দিনী বলল, কাল খেতে বসে ফিসফিস করে কী বলছিল রে অপুদা?
তুই লক্ষ করেছিস?
আমি একা কেন, আরও কেউ কেউ দেখেছে।
অরিজিৎ যা যা বলেছে, সব জানিয়ে দিল লাবণি।
নন্দিনী বলল, তোকে একটা ব্যাপার জানানো দরকার। অপুদার মা আমার আপন পিসি নয়। আমাদের সঙ্গে লতায় পাতায় সম্পর্ক। তবে ঘনিষ্ঠতা আছে। আমাদের বাড়ির সব ফাংশনে ওরা আসে, ওদের বাড়ির ফাংশনে আমরা যাই। অপুদার সব ভালো, তবে সুন্দরী মেয়ে দেখলে কাত হয়ে পড়ে। এটা ওর ডিজিজ। বলেই লাইনটা কেটে দিল।
কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে লাবণি। তারপর ফের লিখতে লাগল। কাল রাত্তিরেই তো অরিজিতের চিন্তাটা খারিজ করে দিয়েছে। এ নিয়ে আর ভাবাভাবির প্রয়োজন নেই।
.
মালিনীর বিয়ের পর দশ-বারোটা দিন কেটে গেছে। দুপুরবেলা ড্রইংরুমে ডিভানে কাত হয়ে একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাচ্ছিল লাবণি, ল্যান্ড লাইনের ফোনটা বেজে উঠল। অন্যমনস্কর মতো সেটা তুলে হ্যালো বলতেই ওধার থেকে চেনা কণ্ঠস্বর ভেসে এল। সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন। চমকে উঠে বসল সে-আপনি। আমার ফোন নাম্বার পেলেন কী করে?
ওটা পাওয়া কি খুব কঠিন।
কতটা সহজ?
আপনি যে কাগজ দুটোয় লেখেন, সেই দুটোতেই আমার জানাশোনা কেউ কেউ কাজ করে। লেখার সঙ্গে ফোন নাম্বার, অ্যাড্রেস দিয়েছেন। এটাই নাকি নিয়ম। বুঝতেই পারছেন তাদের কারও কাছ থেকে দুটোই জেনে নিয়েছি। সে যাক আমার ইচ্ছে আপনার সঙ্গে একদিন দেখা হোক। যদি বলেন, ভালো কোনও রেস্তোরাঁয় টেবল বুক করি।
মুখটা কঠিন হয়ে উঠল লাবণির।অরিজিত্ত্বাবু, অনেক মিডল ক্লাস ফ্যামিলির ভ্যালুজ নষ্ট হয়ে গেছে; তারা বদলে গেছে। আমরা কিন্তু পুরোনো ভ্যালুগুলো ধরেই আছি। বার-কাম-রেস্তোরাঁয় কোনওদিনই যেতে পারব না।
না না, যে রেস্তোরাঁর কথা বলছি, সেখানে বার নেই।
না থাক। আমি যাকে একবার মাত্র দেখেছি, তার সঙ্গে রেস্তোরাঁয় যাব? ভাবলেন কী করে?
এক্সট্রিমলি সরি। ভুল হয়ে গেছে। ক্ষমা করবেন। তা হলে আপনি যেখানে কমফর্ট ফিল করবেন সেখানেই আমাদের দেখা হবে।
.
মনে আছে, এক বৃহস্পতিবার ফোন করেছিল অরিজিৎ। তার ঠিক দুদিন বাদে রবিবার বিকেলে সে তাদের বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে এসে হাজির। বিতৃষ্ণায়, রাগে, গা রি-রি করে উঠেছে লাবণির। ভেবেছিল ঘাড় ধরে বের করে দেয়। কিন্তু পারা যায়নি। বাবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে হয়েছে। চা-মিষ্টি খেতে খেতে সে বাবার সঙ্গে ফুরফুরে মেজাজে গল্প করেছে। সোমুর ঘরে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে হেসে হেসে কথা বলেছে। যাবার সময় বাবার কানে যাতে না যায়, তাই গলা নামিয়ে বলে গিয়েছিল, বলেছিলাম দেখা করব, করলাম তো—
অরিজিৎকে, দেবনাথের খুব ভালো লেগেছে। সে চলে যাবার পর তিনি বললেন, ছেলেটা চমৎকার। কী সুন্দর ব্যবহার।
সেই শুরু। তারপর ছুটির দিনে তো বটেই, সপ্তাহের অন্য দিনেও সন্ধের পর আসতে লাগল অরিজিৎ। দেবনাথের সঙ্গেই গল্প করত বেশি।
প্রথম প্রথম তাকে দেখলে মুখচোখ শক্ত হয়ে উঠত লাবণির। কোন উদ্দেশ্য মাথায় পুরে সে লেক টাউন থেকে বাঁশদ্ৰোণীতে আসত তাই নিয়ে যথেষ্ট ধন্দ ছিল তার। কবে থেকে সংশয়, অস্বস্তি, বিরক্তি কেটে যাচ্ছিল খেয়াল নেই।
দেবনাথকে জানিয়ে দু-চারদিন লাবণিকে নিয়ে বেড়াতেও বেরিয়েছে অরিজিৎ। লাবণি খুব একটা আপত্তি করেনি। মনে হচ্ছিল অরিজিৎকে বিশ্বাস করা যায়। বাইরে বেরুলে কোনও দিনই বড় হোটেলে বা রেস্তোরাঁয় তাকে নিয়ে যায়নি। রাস্তার ধারে খুব সাধারণ চায়ের দোকানে ঢুকে চা টোস্ট কি অন্য কিছু খেত।
ততদিনে তারা একজন আরেকজনকে তুমি করে বলতে শুরু করেছে। চা-টা খেতে খেতে মজা করে লাবণি বলল, তোমরা তো সোসাইটির উঁচু স্তরের মানুষ। হঠাৎ মিডল ক্লাসের লেভেলে নেমে আসতে চাইছ যে
অরিজিৎ হাসত, উত্তর দিত না।
এদিকে আগের মতো আর লেখালেখিতে লাবণির তেমন মন নেই। লেখার জন্য তথ্য জোগাড় করতে কত জায়গায় ছুটত, ন্যাশনাল লাইব্রেরি ছাড়াও কলকাতার অন্য অনেক পুরোনো গ্রন্থাগারে গিয়েও বই ঘাঁটাঘাঁটি করত। অরিজিৎ তাদের বাড়িতে সেই যে প্রথম এসেছিল তার কিছুদিন পর থেকে লেখার উৎসাহ বা উদ্যম যেন কমে আসছিল। কাগজের অফিসগুলোতেও আগের মতো ততটা যেত না।
রাঘব ফোনে, কখনও কখনও লাবণিদের বাড়িতে এসে রাগারাগি করত।–দ্যাখ, আমাদের চাকরির সুযোগ এসে গেছে। অমলেশদার কথামতো লেখালেখিটা যদি সিরিয়াসলি না করিস তোর ওপর তার ইমপ্রেশনটা কী হবে? ওদিকে বিজয়দাও আমি গেলে তোর কথা জিগ্যেস করেন। সুযোগ কিন্তু বার বার আসে না।
রাঘব যে তার এত প্রিয় বন্ধু, এত হিতাকাঙ্ক্ষী, অরিজিৎ যে তাদের বাড়ি আসে, এ খবরটা তখনও তাকে দেয়নি লাবণি। রাঘবের তাড়ায় মাঝে মাঝে কাগজের অফিস দুটোতে যেত সে; অমলেশ বা বিজয়ের ফরমাশ মতো দু-একটা লেখা লিখে দিত।
এইভাবেই চলছিল। হঠাৎ একদিন রাত্তিরে খাওয়া দাওয়ার পর দেবনাথ তার ঘরে এলেন। একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন, তোর সঙ্গে দরকারি কথা আছে খুকু
লাবণি উৎসুক চোখে তাকিয়েছে। কী কথা বাবা?
অরিজিৎকে তো বেশ কিছুদিন ধরে দেখছি। বেশ ভদ্র, ভালো ছেলে। উচ্চশিক্ষিত, লাইফে এস্টাব্লিশড। অরিজিৎ আমার কাছে একটা প্রোপোজাল দিয়েছে।
কীসের পোপোজাল?
ও তোকে বিয়ে করতে চায়।
কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর লাবণি বলল, একটা কথা ভেবে দেখেছ বাবা?
কী?
তোমার বয়স হয়েছে। রিটায়ারমেন্টের আর দু-তিন বছর বাকি। মানুষ তো অমর নয়। আমি খারাপের দিকটা ভাবছি। ধরো আমার বিয়েটা হল আর হঠাৎ তোমার কিছু হয়ে গেল, সসামুর তখন কী হবে, কে তাকে দেখবে?
অরিজিতের সঙ্গে সে সব কথাও আমার হয়েছে। আমার কিছু হলে সে সোমুর দায়িত্ব নেবে।
বাবার সঙ্গে অরিজিতের এত সব কথা হয়েছে, আগে জানতে পারেনি লাবণি। সে চুপ করে থাকে। আগের মতো সংশয়, কাঠিন্য না থাকলেও অরিজিৎ সম্পর্কে বরাবর একটা দ্বিধা থেকে গেছে তার। সে তাদের বাড়ি আসে, তার সঙ্গে বন্ধুত্বও হয়েছে। এই পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু বিয়ে? বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সুন্দরী মেয়ের কি খুবই অভাব? অরিজিৎ আঙুল তুলে একটু ইশারা করলে লাবণির চেয়ে অনেক বেশি রূপসি, অনেক বেশি বিদুষী, অভিজাত পরিবারের মেয়েদের বাবারা তাদের লেক টাউনের বাড়ির সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে যেত। লাবণির মতো সাদামাটা, মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি মেয়ের মধ্যে কী পেয়েছে অরিজিৎ? এই ধন্দটা কিছুতেই পুরোপুরি কাটছে না।
দেবনাথ বললেন, কী রে, কিছু বলছিস না যে!
আমাকে কদিন ভাবতে দাও।
শেষ পর্যন্ত বিয়েটা হয়েই গেল। বিয়ের অনুষ্ঠানটা লাবণি আর অরিজিতের বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনরা হইহই করে মাতিয়ে দিল। শুধু দুজন বাদ! রাঘব আর নন্দিনী। রাঘব বলেছে, আর কদিন ওয়েট করলে চাকরিটা হয়ে যেত। চাকরি হলে পায়ের তলায় শক্ত জমি পাওয়া যায়। সেটা একটা বড় শক্তি। নন্দিনী বলেছে, অপুদাকে বিয়ে করলি। দেখা যাক সে হয়তো কোনও ইঙ্গিত দিয়ে চেয়েছিল, লাবণি শুনেও শোনেনি।
.
বিয়ের পর অরিজিতদের লেক টাউনের বিশাল বাড়িতে চলে এল লাবণি। প্রথম দিকে সরোজিনী ভালোই ব্যবহার করতেন, হেসে হেসে কথা বলতেন। মুখ কাঁচুমাচু করে অরিজিৎ একদিন বলেছে, দেখো, আমার যে টাইপের কাজ তাতে প্রায়ই পার্টিতে যেতে হয়। অনেককে সঙ্গ দিতে ড্রিংকও করতে হয়। দ্যাটস আ পার্ট অফ মাই জব। তুমি তো আবার পিউরিটান। রাগ করবে না তো?
লাবণি বলেছে, বাইরে যা খুশি করতে পারো। বাড়িতে এসে মাতলামি না করলেই হল। আরেকটা কথা। আমার বন্ধু রাঘবকে চেনো তো?
চিনি। তোমাদের সঙ্গেই তো মাস-কম করেছে। হঠাৎ তার কথা উঠছে কেন?
ওর মতো ছেলে হয় না। আমরা একসঙ্গে লেখালেখি শুরু করেছিলাম। আমার ধারণা, ও এখানে চলে আসতে পারে। ও চায় আমি লেখাটা যেন না ছাড়ি। সেজন্য তাড়া দিতে আসবে।
আসুক না। নো প্রবলেম
লেক টাউনে এসে যেন স্বপ্নের উড়ানে উঠে পড়েছিল লাবণি। জীবনটা মসৃণভাবেই কেটে যাচ্ছিল।
সত্যিই রাঘব কোনও কোনও দিন চলে আসত। বাংলা দৈনিকে তার চাকরি হয়ে গেছে। বলত, অমলেশদা তোর জন্যে একটা পোস্ট খালি রেখেছে। তুই গেলেই চাকরিটা হয়ে যাবে।
লাবণি বলত, চাকরি আমি করব না।
তাহলে লেখালেখিই কর। এত ভালো লিখিস। ওটা ছাড়িস না।
তাড়া দিয়ে দিয়ে চিৎ কখনও লাবণির কাছ থেকে দু-একটা লেখা আদায় করত রাঘব।
এর মধ্যে প্রায়ই উড়ো চিঠি আর অচেনা কারও ফোন আসত–যাকে বিয়ে করেছেন সেই লোকটা বদ, দুশ্চরিত্র। অনেক মেয়ের ক্ষতি করেছে। সাবধান
লাবণি পাত্তা দিত না। অরিজিতের কথাবার্তায় আচরণে এমন কিছুই পাওয়া যায়নি যা আপত্তিকর।
এইভাবেই চলছিল। হঠাৎ অরিজিৎ যেন বদলে যেতে লাগল। কোনও কোনও দিন তার ফিরতে মাঝরাত পেরিয়ে যায়। দু-একদিন ফেরেই না, জিগ্যেস করলে যা জবাব দেয় সেগুলো বিশ্বাসযোগ্য নয়। এ নিয়ে বেশি বললে খেপে যায়। লাবণি টের পায়, লেক টাউনে আসার পর দিনগুলো যেভাবে কাটছিল তেমনটা আর নেই। সবসময় দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ। সরোজিনীকে বললে তিনি ঝাঁঝিয়ে ওঠেন–আমাকে এসব বোলো না। কেন আমার ছেলের নামে বদনাম করছ?
লাবণি হতবাক হয়ে যায়।
একদিন অরিজিতের অফিসের একটি জুনিয়র একজিকিউটিভ, নাম তরুণ সেন, লাবণিকে ফোন করল–ম্যাডাম অফিসের বাইরে একটা প্রাইভেট বুথ থেকে ফোন করছি। আপনাকে একটা খবর দিতে চাই, আমার নামটা জানাজানি হলে ভীষণ বিপদে পড়ব।
তরুণকে ভালোই চেনে লাবণি। অফিসের কাজে অরিজিতের কাছে লেক টাউনের বাড়িতে অনেকবার এসেছে। খুবই ভদ্র, বিনয়ী। লাবণি বলল, কেউ জানবে না, আপনি বলুন। খুব টেনশন চলছিল। সে কোনও দুঃসংবাদের জন্য আপেক্ষা করতে লাগল।
তরুণ যা জানাল তা এইরকম। তাদের অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টের একজন জুনিয়র অফিসার, নাম কল্পনা মীরচন্দানির সঙ্গে অরিজিৎ জড়িয়ে পড়েছে। দু-একদিনের মধ্যে সপ্তাহখানেকের জন্য তারা মুম্বই যাবে। এই নিয়ে অফিসে সবাই ছি-ছি করছে। আগেও এরকম অন্য মেয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন স্যার। আপনাকে সাবধান করে দিলাম।
ফোনটা অফ করে বাকি দিনটা উদ্ভ্রান্তের মতো কাটিয়ে দিল লাবণি। রাত্তিরে অরিজিৎ ফিলে এলে খাওয়া-দাওয়ার পর তাকে জিগ্যেস করল, কল্পনা মীরচন্দানি কে?
অরিজিৎ চমকে উঠল। তারপর ঠান্ডা গলায় বলল, দ্যাটস নান অফ ইওর বিজনেস। এ নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।
হবে। কারণ আমি তোমার স্ত্রী।
স্ত্রী! একটা থার্ড ক্লাস মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির মেয়েকে করুণা করে বিয়ে করেছিলাম। আর কোনও কথা বলবে না।
একটা মানুষের রাতারাতি এমন পরিবর্তন ঘটতে পারে, ভাবাই যায় না। লাবণি বলল, আমি কি তোমার করুণা চাইতে এসেছিলাম?
স্টপ ইট।
এরপর শুরু হল অশান্তি, তিক্ততা, চিৎকার-চেঁচামেচি, নোংরা নোংরা গালাগাল, লাবণির ওপর তীব্র মানসিক নির্যাতন। আশ্চর্য, ছেলের সঙ্গে তার মা সরোজিনী মল্লিকও গলা মেলালেন।
জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। একদিন লাবণি বলল, এই নরককুণ্ডে আমার আর এক মুহূর্তও থাকতে ইচ্ছে করে না।
অরিজিৎ খেপে ওঠেনি। শান্ত গলায় বলল, ভেরি গুড় ডিসিশন। চলল, কালই আমরা কোর্টে গিয়ে সেপারেশনের জন্যে একসঙ্গে অ্যাপিল করি। ব্যাপারটা পিসফুলি মিটে যাবে।
অত সহজে তোমাকে ডিভোর্স দেব না।
কী চাও—টাকা? বলো, কত দিতে হবে।
টাকা দিয়ে তুমি ডিভোর্স কিনতে পারবে না। তোমাকে আমি একটা শিক্ষা দিতে চাই।
লেক টাউন থেকে বাঁশদ্ৰোণীতে বাবার কাছে চলে এল লাবণি।
মানুষ যে কত নীচের স্তরে নামতে পারে অরিজিতরা এবার দেখিয়ে দিল। ওরা ডিভোর্সের মামলা করল। বিবাহ-বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে লাবণির ব্যাভিচারের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। রাঘব যে লেক টাউনে লাবণিকে লেখাটেখার জন্য তাড়া দিতে যেত সেটা ওরা কাজে লাগিয়েছে।
সরোজিনী মল্লিক আদালতে দাঁড়িয়ে হলফ করে বলেছেন, অরিজিৎ যখন বাড়িতে থাকত, দুপুরের দিকে প্রায়ই রাঘব আসত। অতবড় বাড়িতে তিনি তখন তার ঘরে ঘুমোচ্ছেন। কোনও কোনও দিন ঘুম না এলে এধারে-ওধারে হয়তো ঘুরছেন, হঠাৎ রাঘবের সঙ্গে লাবণিকে জঘন্য আপত্তিকর অবস্থায় দেখতে পেতেন। বকাবকি করেও ছেলের বউকে তিনি শোধরাতে পারেননি। অগত্যা ছেলেকে জানাতে হয়েছে, ইত্যাদি।
স্তম্ভিত হয়ে গেছে লাবণি। একজন ভদ্র বংশের বয়স্ক মহিলা শপথ নিয়ে কোর্টে মিথ্যা বলতে পারেন, ভাবা যায় না।
এই মামলা নিয়ে চারিদিকে এত কুৎসা রটেছিল যে কারও মুখের দিকে তাকানো যেত না। আদালতে যখন লাবণিকে তলব করা হত, তার মনে হত আগুনের বলয়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।
শেষ পর্যন্ত ডিভোর্সটা হয়ে গেল।
তারপর অনেকদিন লাবণি বাড়ি থেকে বেরুত না। মুহ্যমানের মতো নিজের ঘরে বসে বা শুয়ে থাকত। খেতে চাইত না, ঘুমোত না। যে অভিযোগে বিবাহ-বিচ্ছেদটা হয়েছে সেটা তাকে এমন আঘাত দিয়েছে যে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কেনই বা অরিজিৎ তাকে বিয়েটা করল, আবার কেনই বা দুটো বছর পেরুতে না পেরুতে অন্য একটা মেয়ের জন্য রাঘবের মতো সরল ভালোমানুষকে তার সঙ্গে জড়িয়ে নোংরা খেলাটা খেলল সেই রহস্যের তলকূল পাওয়া যাচ্ছিল না। তার সঙ্গে বিয়েটা যে হয়েছিল তা কি অরিজিতের ক্ষণিকের মোহে?
সেই দুঃসময়ে পাশে থেকেছেন বাবা আর রাঘব। রাঘবের গায়ে তার জন্য তো কম পাক লাগেনি; তবু সে সময় পেলেই বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে চলে আসত। দুজনে তাকে বোঝাত, এত ভেঙে পড়লে চলবে না। আবার উঠে দাঁড়াতে হবে।
সময় এক আশ্চর্য জাদুকর। সব দাহ ধীরে ধীরে জুড়িয়ে দেয়। বুকের সেই দগদগে ক্ষতটা একদিন শুকিয়েও গেল।
সাতরং চ্যানেলের অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ রয়েছে রাঘবের। সে-ই তাদের ধরাধরি করে ওদের নিউজ ডিপার্টমেন্টে লাবণির চাকরির ব্যবস্থা করে। কয়েক বছর পর সে এখন সেখানকার ডেপুটি নিউজ এডিটর। দেবনাথ মারা গেছেন। বাড়িতে এখন সে আর সোমু এবং তিনটি কাজের লোক।
.
কতক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে ছিল খেয়াল নেই। হঠাৎ ট্যাক্সিটা বেশ ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল। সেইসঙ্গে চালকের কণ্ঠস্বর কানে এল–দিদি, আমরা পৌঁছে গেছি। স্মৃতির অতল স্তর থেকে উঠে এল লাবণি। চোখে পড়ল সামনেই একটা বড় গেট, তার মাথায় আধখানা বৃত্তের আকারের সাইনবোর্ডে বড় বড় হরফে লেখা ও সেবা নিকেতন। গেটের পর সবুজ ঘাসের একটা লন পেরুলে হলুদ রংয়ের মস্ত চারতলা বিল্ডিং।
ট্যাক্সি থেকে নেমে ভাড়া-টাড়া মিটিয়ে গেটের দিকে এগিয়ে গেল লাবণি। একটা উঁচু টুলের ওপর দারোয়ান বসে ছিল। তাকে কিছু জিগ্যেস করতে যাবে, বাঁ-দিক থেকে একজন বৃদ্ধা এগিয়ে এলেন-এসো মা। তোমার জন্যে আমি এখানে অপেক্ষা করছিলাম।
চমকে উঠল লাবণি। একসময় কী স্বাস্থ্য ছিল সরোজিনীর; এখন আর চেনাই যায় না। গাল বসে গেছে, পুরু লেন্সের চশমার ওধারে চোখ দুটো কোটরে ঢোকানো, কণ্ঠার হাড়, শীর্ণ হাতের শিরাগুলো বড় বেশি প্রকট। সারা শরীর জুড়ে ভাঙচুরের চিহ্ন। যে সরোজিনী মল্লিককে সে লেক টাউনে দেখে এসেছিল ইনি যেন তাঁর ধ্বংসস্তূপ।
সবুজ লনটা পেরিয়ে দুজনে মেইন বিল্ডিংয়ে ঢুকল। তারপর বাঁদিকের প্রশস্ত করিডর দিয়ে কয়েক পা এগিয়ে ডান পাশে একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন সরোজিনী। দরজায় পর্দা ঝুলছে। সেটার একপাশে কাঠের ফলকে ইংরেজিতে লেখা : অফিস। অন্য দিকে কাঠের ফলক। তাতে লেখা : ইন্দুমতী ব্যানার্জি, সুপারিনটেন্ডেন্ট।
পর্দাটা একধারে ঠেলে দেয় সরোজিনী। ভেতরে একটা গদি-আঁটা মস্ত চেয়ারে বসে আছেন বিপুল আকারের একজন মধ্যবয়সিনী। বোঝা গেল ইনিই ইন্দুমতী। তাঁর সামনে বড় টেবিল; টেবিলের এধারে কয়েকজন মহিলা বসে আছেন। ঘরের দেওয়ালগুলো জুড়ে ঢাউস ঢাউস স্টিলের আলমারি।
ইন্দুমতী সরোজিনীকে দেখতে পেয়েছিলেন। জিগ্যেস করলেন, কিছু দরকার আছে?
সরোজিনী বললেন, আমার একজন গেস্ট এসেছে। মেয়ের মতো। তাকে আমার ঘরে নিয়ে যাচ্ছি।
ঠিক আছে।
বোঝা গেল, সুপারিনটেন্ডেন্টের অনুমতি ছাড়া এখানকার আবাসিকরা বাইরের কাউকে নিজের ঘরে নিয়ে যেতে পারে না।
কাছেই সিঁড়ি। সরোজিনী লাবণিকে সঙ্গে করে দোতলায় একটি ঘরে চলে এলেন। একজনের পক্ষে ঘরটা বেশ ভালোই। একধারে সিঙ্গল-বেড খাট, ছোটখাটো একটা আলমারি, এক দেওয়ালে টিভি আটকানো, ব্র্যাকেটে কিছু শাড়ি, নাইটি-টাইটি। তাছাড়া দু-তিনটে চেয়ার, একটা মাঝারি টেবিল, ইত্যাদি।
লাবণিকে একটা চেয়ারে বসিয়ে নিজে বিছানায় বসলেন সরোজিনী।
লাবণি বলল, আমি কিন্তু বেশিক্ষণ বসতে পারব না।
সরোজিনী বললেন, জানি তুমি খুব ব্যস্ত মানুষ। আধঘণ্টার বেশি আটকে রাখব না।
লাবণি নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে লাগল।
সরোজিনী বললেন, তোমার সঙ্গে আমি অনেক দুব্যবহার করেছি। বিশ্বাস করি তুমি সৎ, নিষ্কলঙ্ক চরিত্রের মেয়ে। তোমার বন্ধু রাঘবও তাই। তবু আদালতে হলফ করে মিথ্যে বলেছি। গ্লানি আর অপরাধবোধে কতদিন যে ঘুমোতে পারিনি! তোমাদের দুজনের কাছে। আমি হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
লাবণি উত্তর দিল না।
সরোজিনী থামেননি–কেন আমাকে এই পাপটা করতে হয়েছিল, কেন জানো? গর্ভে আমি একটা অমানুষ, জন্তুকে ধারণ করেছিলাম। তার চাপে, তার ভয়ে আমাকে এটা করতে হয়েছিল। কত মেয়ের যে ও ক্ষতি করেছে- তার গলা প্রায় বুজে এল।
অনুশোচনায় জর্জরিত বৃদ্ধাকে দেখতে দেখতে যে নিস্পৃহতা আর কাঠিন্য নিয়ে লাবণি এখানে এসেছিল সেসব ততটা তীব্র আর রইল না। নরম গলায় বলল, শান্ত হন, যা হবার তা তো হয়েই গেছে।
তুমি আমাকে ক্ষমা করলে কিনা–সরোজিনী ব্যাকুল হয়ে উঠলেন।
যা চুকেবুকে গেছে তা নিয়ে আমি আর ভাবি না। আপনি এ নিয়ে আর কষ্ট পাবেন না।
অনেকক্ষণ নীরবতা।
তারপর লাবণি বলল, একটা কথা জিগ্যেস করব?
করো, করো
লেক টাউনে এত বড় বাড়ি থাকতে আপনি কেন এই ওল্ড-এজ হোমে?
তুমি কিছু শোনোনি?
কী শুনব?
তোমার বন্ধু ছুটকি, মানে নন্দিনী তোমাকে কিছু বলেনি? ওর সঙ্গে অনেকদিন আমার যোগাযোগ নেই।
আমি যার গর্ভধারিণী সে-ই আমাকে এখানে পাঠিয়েছে। এরপর সরোজিনী যা বলে গেলেন তা মোটামুটি এইরকম। লাবণি চলে আসার পর কল্পনা মীরচন্দানি নামে একটা সিন্ধি মেয়েকে অরিজিৎ বাড়িতে এনে তোলে। কিছুদিন শান্তশিষ্টই ছিল ওরা। তারপর দিনের পর দিন পীড়ন চালিয়ে লেক টাউনের বাড়ি, ব্যাঙ্কের টাকা, লকার-টাকার সব নিজের নামে লিখিয়ে নেয়। তারপর বাড়িটাড়ি বিক্রি করে সরোজিনীকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আমেরিকায় চলে যায়। যাবার সময় বলেছিল, আমেরিকার জল-হাওয়া সরোজিনীর সহ্য হবে না, সেখানকার পরিবেশ অন্যরকম, তিনি এই বয়সে মানিয়ে নিতে পারবেন না। সেবা নিকেতন খুব ভালো ওল্ড-এজ হোম। চিকিৎসা থেকে শুরু করে খাওয়া-দাওয়া, সমস্ত কিছুর ব্যবস্থা চমৎকার। যত্ন, সেবা, কোনও কিছুর ত্রুটি হবে না। মোটামুটি একটা হিসেব করে তার নাকি জীবনের জন্য যথেষ্ট টাকা এই হোমে জমা রাখা আছে। তাছাড়া বছরে এক-দুবার অরিজিতরা তো আসবেই।
বলতে বলতে বৃদ্ধার চোখেমুখে রাগ, ঘৃণা, বিতৃষ্ণা, উত্তেজনা, নৈরাশ্য, কতরকমের অভিব্যক্তি যে ফুটে উঠতে লাগল–ওরা আমাকে ঠকিয়েছে। জানো, কয়েকদিন আগে আমাকে হোম থেকে জানানো হয়েছে, যে টাকা অপুরা জমা দিয়ে গেছে তাতে আর মাত্র দুটো দিন চলবে। ওরা আমাকে সর্বস্বান্ত করে চলে গেছে। হাঁপাতে হাঁপাতে তিনি দুহাতে মুখ ঢাকলেন। তার পিঠটা ফুলে ফুলে উঠতে লাগল।
বেশ কিছুক্ষণ পর মুখ থেকে হাত সরালেন সরোজিনী।
লাবণি বলল, পরশু তো আপনাকে হোম ছাড়তে হবে। তখন কী করবেন, কোথায় যাবেন, কিছু ঠিক করেছেন?
না। তবে রাস্তা আছে, গাছতলা আছে, লোকের বাড়ির রোয়াক আছে। রাতটা কোনও একটা জায়গায় কেটে যাবে। কিন্তু খিদের জ্বালাও তো থাকবে। কারও কাছে কোনওদিন হাত পাততে হয়নি। জানি না কী করব।
অনেকক্ষণ কী ভেবে লাবণি বলল, উঠুন। আমার সঙ্গে যাবেন।
কোথায়?
আমাদের বাড়িতে। সেখানেই থাকবেন। পরশু আপনাকে সঙ্গে করে এখানে একবার আসতে হবে। আপনার কী জিনিসপত্র আছে চিনিয়ে দেবেন। সেসব নিয়ে আমরা ফিরে যাব।
বিহ্বলের মতো তাকিয়ে থাকেন সরোজিনী।
সত্যের মুখোমুখি
দোতলার প্রশস্ত বারান্দায় একটা ইজিচেয়ারে শরীরটা পেছন দিকে অনেকখানি হেলিয়ে দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছিলেন অধ্যাপক অনির্বাণ সান্যাল। তিনি পড়ান ইংরেজি, গল্প-উপন্যাস লেখেন বাংলায়। অধ্যাপক হিসেবে তার যথেষ্ট সুনাম, লেখক হিসেবে তাঁর খ্যাতি আরও বেশি।
কলকাতা থেকে দেড়শো কিলোমিটার দূরের এই শান্ত, নিরিবিলি শহরে কলকাতার মর্নিং এডিশনের কাগজগুলো ট্রেনে নটার আগে পৌঁছায় না। তাই ছুটির দিন ছাড়া সকালের দিকে কাগজ পড়ার সময় পান না অনির্বাণ। তখন কলেজে যাবার তাড়া থাকে। আজ রবিবার। তাই কাগজ খুলে আয়েশ করে বসতে পেরেছেন।
মাস তিনেক হল অনির্বাণ এই শহরের একটা সরকারি কলেজে বদলি হয়ে এসেছেন। যেখানে তিনি বসে আছেন, দোতলার সেই আস্ত ফ্লোরটা ভাড়া নিয়ে একাই থাকেন। একতলার ভাড়াটেরা হল একজোড়া কপোত-কপোতী। স্বামী এবং স্ত্রী। বয়স বেশি নয়, তিরিশের নীচে। দুজনেই ব্যাঙ্ক এমপ্লয়ি, তবে আলাদা আলাদা ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চে। ওদেরও ট্রান্সফারের চাকরি। বাড়িওয়ালা থাকেন শহরের অন্য এলাকায়।
নীচের তলায় ভাড়াটেরা এখন নেই। ছুটি নিয়ে কোথায় যেন বেড়াতে গেছে। মাসখানেক আগে ফিরবে না। তাই বাড়িটা একেবারে নিঝুম।
অনির্বাণের বয়স চুয়াল্লিশ পয়তাল্লিশ। রং ময়লা হলেও মোটামুটি সুপুরুষ। কোনও অদৃশ্য মেক আপ ম্যান এলোমেলো ব্রাশ চালিয়ে তার মাথায় সাদা সাদা কিছু ছোপ ধরিয়ে দিয়েছে।
বারান্দার কোনাকুনি ডান দিকে কিচেন। সেখান থেকে ঠুং ঠাং আওয়াজ আসছে। খুব সম্ভব নিতাইয়ের মা রান্না চাপিয়েছে।
হঠাৎ সদর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। খবরের কাগজে ডুবে ছিলেন অনির্বাণ। চমকে উঠে হাতের কাগজ নামিয়ে রেখে সামনের দিকে তাকালেন। নিতাইয়ের মা ছাড়াও অন্য একটি কাজের লোক আছে তার, শিবু। সে সারা মাসের চাল ডাল তেল মশলা-টশলা কেনার জন্য বাজারের একটা মুদিখানায় গেছে। তার তত এত তাড়াতাড়ি ফেরার কথা নয়। নীচের তলার ভাড়াটেদের কাছে ছুটির দিনে অনেকে আসেন কিন্তু তারা তো এখন নেই। তাই কারও আসার সম্ভবনা খুবই কম। অনির্বাণ নিজে আদৌ মিশুকে নন। কলেজের সহকর্মীরা আছেন ঠিকই, তবে তাঁদের সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠতা হয়নি যে, না জানিয়ে হুট করে এসে হাজির হবেন। অনির্বাণ কারওকে আসতেও বলেন না। তা হলে?
কড়া নাড়াটা চলছেই। গলার স্বর একটু উঁচুতে তুলে অনির্বাণ বললেন, নিতাইয়ের মা, দেখো তো কারা এল
রান্নাঘর থেকে যে বেরিয়ে এল তার বয়স ষাটের কাছাকাছি। পরনে নীল-পাড় সাদা শাড়ি। পিঠটা সামান্য বেঁকে গেলেও এই বয়সে বেশ চটপটে, কাজকর্মে দড়। দৌড়ে তরতর সিঁড়ি দিয়ে সে নেমে গেল।
অনির্বাণ সামনের দিকে তাকিয়ে আছেন। নীচে অনেকটা জায়গা জুড়ে সিমেন্টে বাঁধানো উঠোন। তারপর সদর দরজা। শিবু বেরিয়ে যাবার পর নিতাইয়ের মা খিল লাগিয়ে দিয়েছিল। এখন সেটা খুলতেই দুটি সালোয়ার-কমিজ পরা মেয়েকে দেখা গেল। বয়স কত হবে? খুব বেশি হলে আঠারো কি উনিশ। সদ্য তরুণীই বলা যায়।
অনির্বাণ রীতিমতো অবাক। তিনি ইজিচেয়ার থেকে উঠে বারান্দার রেলিংয়ের কাছে এসে দাঁড়ালেন। নিতাইয়ের মা তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ঘুরে আঙুল বাড়িয়ে তাকে দেখিয়ে দিল।
মেয়ে দুটি এবার অনির্বাণকে দেখতে পেয়েছে। তাদের একজন বলল, স্যার, আমরা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। ভেতরে আসব?
একটু বিরক্ত হলেন অনির্বাণ। ভেবেছিলেন খবরের কাগজ দেখা হলে লেখার টেবিলে গিয়ে বসবেন। একটা নামকরা মাসিক পত্রিকার সম্পাদক অনবরত তাড়া দিচ্ছেন, দিন পনেরোর মধ্যে নভেলেট লিখে দিতে হবে।
নাঃ, এবেলাটা মাটিই হবে। একবার ভাবলেন এখন আমি ব্যস্ত আছি বলে ওদের চলে যেতে বলবেন। আবার একটু কৌতূহলও হচ্ছিল। দোনোমনো করে শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললেন, আচ্ছা এসো।
মেয়ে দুটি উঠোন পেরিয়ে ওপরে উঠে এল। দোতলার বারান্দার দেওয়াল ঘেঁষে তিন চারটি বেতের মোড়া রয়েছে। ওখান থেকে দুটো নিয়ে এসে এখানে বোসো বলে ইজিচেয়ারটায় বসলেন অনির্বাণ। মেয়ে দুটি তাঁকে প্রণাম করে মোড়া টেনে এনে সামনা সামনি, তবে একটু দূরে ধীরে ধীরে বসে পড়ল।
অনির্বাণ লক্ষ করছিলেন। একটি মেয়ে খুবই সুশ্রী, টকটকে রং। অন্যটির গায়ের রং চাপা হলেও দেখতে ভালোই। বললেন, তোমরা কারা? চিনতে পারলাম না তো।
সুশ্রী মেয়েটি বেশ সপ্রতিভ। বলল, আমার নাম সর্বাণী আর ও আমার বন্ধু, ওর নাম মল্লিকা। আমরা এই শহরেই থাকি।
অনির্বাণদের কলেজটা কো-এড। হাজারখানেকের মতো ছাত্ৰ-ছাত্ৰী। মাত্র তিন মাস তিনি এখানে এসেছেন। সব স্টুডেন্ট তো নয়ই, তার সাবজেক্টের ছেলেমেয়েদের মুখও তার স্পষ্ট মনে থাকে না। জিগ্যেস করলেন, তোমরা কি আমার কলেজে পড়ো?
সর্বাণী বলল, না স্যার। এখানে একটা গার্লস কলেজ আছে। আমরা সেই কলেজের স্টুডেন্ট। আমার পলিটিক্যাল সায়েন্সে অনার্স, মল্লিকার সোশিয়লজিতে। দুজনেই ফার্স্ট ইয়ার।
অনির্বাণের কোনও ব্যাপারেই তেমন আগ্রহ নেই। নির্বিকার ধরনের মানুষ। কম কথা বলেন। যেটুকু বা বলেন, অন্যমনস্কর মতো।
আচমকা দুই সদ্য তরুণী এসে পড়ায় তিনি খুশি হননি ঠিকই, তবে বিরক্তি প্রকাশ করাটা অশোভন। জিগ্যেস করলেন, তোমরা যে এলে, কোনও দরকার আছে কি?
সর্বাণী উজ্জ্বল চোখে তাকাল। আপনার লেখা গল্প-উপন্যাস আমাদের খুব ভালো লাগে। আপনি বেগমপুর গভর্নমেন্ট কলেজে আসার পর থেকে ভীষণ দেখা করতে ইচ্ছে করছিল। শুনেছি আপনি খুব গম্ভীর। তাই ভয় ভয় করছিল। শেষ পর্যন্ত সাহস করে চলে এলাম।
সুদূর এই মফস্সল শহরে তার লেখার দুজন অনুরাগিণী পাওয়া যাবে, ভাবা যায়নি। ছুটির দিনে হঠাৎ এসে লেখালেখি পণ্ড করায় মনে যে বিরক্তি জমা হয়েছিল, তার ঝঝ কমে এল। অনির্বাণ বললেন, শুনতে পাই, আজকালকার ছেলেমেয়েরা বাংলা-টাংলা পড়ে না। বেঙ্গলি লিটারেচারের নামে তাদের জ্বর আসে।
স্যার, কলকাতার ব্যাপারটা বলতে পারব না। আমাদের এই মফসসল শহরে কলেজ কি স্কুল লাইব্রেরিগুলো ছাড়াও তিনটে বিরাট বিরাট পাবলিক লাইব্রেরি আছে। তার প্রত্যেকটায় পনেরো-ষোলো হাজার করে বই। বয়স্ক মানুষেরা তো বটেই, আমাদের বয়সি কি আমাদের চেয়ে ছোট অনেকেই সেগুলোর মেম্বার। সুধাকর বাগচি, নীরেন্দ্র ঘোষ আর আপনার লেখার কত যে ভক্ত এখানে রয়েছে, ভাবতে পারবেন না স্যার।
কলকাতায় থাকলে নানা হতাশাজনক কথা কানে আসে। বাঙালি বাংলা বই পড়ছে না, বাংলা বই বিক্রি হচ্ছে না, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু সর্বাণীর কথাগুলো শুনতে শুনতে বেশ ভালোই লাগল। অনির্বাণ একটু হাসলেন।
সর্বাণী থামেনি। সে বলতে লাগল, আমাদের এই বেগমপুরের চল্লিশ-পঞ্চাশ কিলোমিটারের মধ্যে আরও তিন-চারটে ছোট শহর আছে। সেই শহরগুলোতেও বড় বড় অনেক লাইব্রেরি রয়েছে। প্রত্যেকটা টাউনের নাইনটি পারসেন্ট মানুষ বাংলা বই পড়ে।
কোনও ব্যাপারেই যিনি উৎসুক নন, এবার তার চোখেমুখে আগ্রহ ফুটে ওঠে, তাই?
হ্যাঁ স্যার।
তা হলে তো দেখা যাচ্ছে, কলকাতা নয়, মফসল শহর আর গ্রাম-ট্রামগুলো বাংলা সাহিত্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে। বলতে বলতে অনির্বাণ সর্বাণীর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন। আগেই চোখে পড়েছিল মেয়ে দুটির মধ্যে সর্বাণী খুবই সুন্দরী, অন্য মেয়েটি অর্থাৎ মল্লিকা তেমনটা নয়। সে চুপচাপ, লাজুক ধরনের। এখন পর্যন্ত একটি কথাও বলেনি। আর সর্বাণী অবিরল কথা বলে চলেছে।
অনির্বাণের যা স্বভাব, কাছে বসে থাকলেও অন্যমনস্কর মতো তাকে দেখেন। কিন্তু এবার তার ব্যতিক্রম ঘটল। সর্বাণীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন যেন চেনা চেনা লাগল। কার একটা হালকা আদল যেন তার চেহারায় বসানো? কার? ঠিক মনে পড়ছে না। হুবহু না হলেও এই ধরনের মুখ আগে কোথাও দেখেছেন।
যেভাবে তিনি তাকিয়ে আছেন সেটা অশোভন। ধীরে ধীরে চোখ সরিয়ে নিলেন অনির্বাণ।
কিছুক্ষণ গল্প-টল্প করে সর্বাণী বলল, স্যার, আপনার অনেকটা সময় নষ্ট করলাম। এবার আমরা যাই।
ব্যস্ত হয়ে পড়লেন অনির্বাণ, না না, আরেকটু বোসো গলার স্বর উঁচুতে তুলে ডাকলেন, নিতাইয়ের মা, দেখ তো মিষ্টি-টিষ্টি আছে কিনা, থাকলে দুজনের মতো নিয়ে এসো, তারপর চা করে দিয়ো। আমিও খাব।
সর্বাণী হাত নেড়ে অস্বস্তির সুরে বলতে লাগল, আনতে বারণ করুন স্যার।
অনির্বাণ বললেন, প্রথম দিন এলে। একটু কিছু না খেলে আমার খারাপ লাগবে।
চা মিষ্টি-টিষ্টি এসে গেল। খাওয়া শেষ হলে সর্বাণী বলল, এবার যাই স্যার। আবার কিন্তু আসব।
এসো।
মেয়ে দুটি চলে যাবার পরও ইজিচেয়ারে বসেই রইলেন অনির্বাণ। এবেলা আর লেখা-টেখা হবে না, আগেই বোঝা গেছে। সেই চিন্তাটা মাথায় ফিরে এল। বেগমপুর শহরে এই তার প্রথম আসা। সর্বাণীকেও প্রথম দেখলেন। তার মুখের সঙ্গে কার মুখের আবছা মিল?
বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে একরকম চেহারার দুজন মানুষ দেখা যে যায়নি, তা তো নয়। তাদের রক্তের সম্পর্ক নেই। একজন হয়তো জন্মেছে বিহারে, অন্যজন রাজস্থানে। সর্বাণীর চিন্তাটা খারিজ করে দিতে চাইলেন অনির্বাণ কিন্তু মেয়েটা যেন তাঁর মাথায় চেপে বসে আছে।
চুয়াল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছরের জীবনে কম মানুষ তো দেখেননি অনির্বাণ। তাদের অনেককেই ভুলে গেছেন। কেউ কেউ একেবারে ঝাপসা হয়ে গেছে। স্মৃতি খুঁড়ে খুড়ে যাদের তুলে আনা গেল তাদের কারও সঙ্গেই সর্বাণীর মিল নেই। কী যে অস্বস্তি! মনটা কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে রইল।
.
সেই যে সর্বাণী আর মল্লিকা এসেছিল তারপর বেশ কয়েকটা দিন পেরিয়ে গেল। এর মধ্যে অনির্বাণ সামান্য লেখালেখি করেছেন, কলেজে গিয়ে ক্লাস নিয়েছেন। মনের অশান্ত ভাবটা অনেকখানি কেটে গেলেও পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি। নীচের তলায় ভাড়াটেরা ফিরে এসেছে। তাদের সঙ্গে দেখা হলে কেমন আছেন স্যার, আপনারা ভালো তো সম্পর্কটা এর বেশি এগোয়নি। অনির্বাণ যতদিন বেগমপুরে আছেন, এমনটি চলছে।
তিন সপ্তাহ পর এক রবিবার আবার এল সর্বাণী! সে একাই এসেছে। সঙ্গে তার বন্ধুটি নেই। হাসি মুখে বলল, আগেই আসতাম। মাঝখানে কটা দিন জ্বরে ভুগলাম। তাই।
বুকের ভেতর যে অস্বস্তিটা কমে এসেছিল সেটা ফের বেড়ে গেল। অনির্বাণ চাপা স্বভাবের মানুষ। ভেতরে যা চলে তা বাইরে বেরিয়ে আসতে দেন না। সর্বাণীকে বসতে বলে জিগ্যেস করলেন, এখন কেমন আছ?
ভালো স্যার। কদিন বাড়িতে আটকে ছিলাম। জ্বরটা ছাড়ছিল না। এক উইক হল রেগুলার ক্লাস করছি। আপনি ভালো আছেন তো?
ওই চলে যাচ্ছে।
এলোমেলো কিছু কথা হল। তারপর সর্বাণী বলল, আপনার অসমাপ্ত উপন্যাসের শেষটা ট্র্যাজিক হল কেন? বিকাশ আর শিপ্রাকে মিলিয়ে দিলে কিন্তু অনেক ভালো লাগত।
তাই বুঝি? অনির্বাণ একটু হাসলেন। কোনও উত্তর দিলেন না।
আপনার সমান্তরাল, পটভূমি, ধূসর পৃথিবী উপন্যাসগুলোতেও নায়ক নায়িকার মিলন ঘটাননি। আপনার লেখায় দুঃখ, কষ্ট-টষ্ট বড্ড বেশি।
অনির্বাণ বললেন, মানুষের জীবনে দুঃখ কষ্ট নেই?
তা আছে তাই বলে এত? একটু কম কম করে এসব দিয়ে পাঠক যাতে আনন্দ পায় এবার থেকে সেই রকম লিখুন না।
অস্বস্তি থাকলেও মজা লাগছিল অনির্বাণের। লঘু সুরে বললেন, তোমার কথাগুলো ভেবে দেখতে হবে।
আরও কিছুক্ষণ কাটিয়ে সর্বাণী চলে গেল।
আবার এল পরের রবিবার। এবারও একা। স্যার কেমন আছেন, তুমি ভালো আছ তো-ইত্যাদির পর সর্বাণী বলল, একটা কথা ভাবলে আমার খুব অবাক লাগে।
উৎসুক দৃষ্টিতে সর্বাণীর দিকে তাকালেন অনির্বাণ। কোনও প্রশ্ন করলেন না।
সর্বাণী বলতে লাগল, আপনি কতগুলো গল্প উপন্যাস লিখেছেন?
তুমি তো আমার একজন দুর্দান্ত পাঠিকা। তুমিই বলো না
চোখ কুঁচকে একটু ভাবল সর্বাণী। তারপর বলল, একত্রিশটা উপন্যাস। গল্প অনেক; কতগুলো বলতে পারব না।
উপন্যাসের নাম্বারটা ঠিক বলেছ। গল্প কত লিখেছি, আমারই মনে নেই। দেড়শো তো হবেই।
আচ্ছা
আবার কী?
এত সব যে লিখেছেন, আরও লিখছেন; আইডিয়া, গল্পের প্লট পান কীভাবে?
মেয়েটির অনন্ত কৌতূহল। অনির্বাণ বললেন, চারপাশের মানুষজনকে দেখে।
যেমনটা দেখেন অবিকল তাই লেখেন?
শুধু অভিজ্ঞতার ওপর লেখা হয় না। তার সঙ্গে কল্পনা মেশাতে হয়। তবেই কিছু সৃষ্টি হয়।
খুব ডিফিকাল্ট ব্যাপার।
সর্বাণীর মুখচোখের ভাবভঙ্গি দেখে হাসিই পাচ্ছিল অনির্বাণের। তিনি অবশ্য কিছু বললেন না।
সর্বাণী বলল, আপনার অতল জল উপন্যাসটা নিয়ে আমার কিছু জানার আছে।
কী জানতে চাও, বলে ফেলো।
আজ নয়, বইটা আরেকবার পড়ে নিই। তারপর বলল।
ঠিক আছে।
ফি রবিবার সর্বাণীর আসাটা নিয়মে দাঁড়িয়ে গেল। যে অনির্বাণ নির্বিকার, সমস্ত ব্যাপারেই যাঁর চরম উদাসীনতা সেই তিনিই রবিবার সকাল থেকেই আশ্চর্য এই মেয়েটির জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন।
একদিন এসে সর্বাণী বলল, স্যার, রাগ না করলে একটা কথা জিগ্যেস করতাম।
কেন রাগ করব? বলো না
আমি তো দু-আড়াই মাস ধরে আসছি। দুজন কাজের লোক বাদ দিলে আপনাকে ছাড়া অন্য কারওকে তো দেখি না।
আমি এখানে একাই থাকি।
অন্য সবাই?
অন্য সবাই বলতে আমার মা, ছোট এক ভাই আর ভাইয়ের স্ত্রী। তারা সব শ্যামবাজারে আমাদের পৈতৃক বাড়িতে থাকে।
কিন্তু ম্যাডাম?
পলকহীন কয়েক সেকেন্ড সর্বাণীর দিকে তাকিয়ে রইলেন অনির্বাণ। তারপর নীরস গলায় বললেন, তুমি কার সম্বন্ধে জানতে চাইছ, বুঝেছি। কিন্তু তেমন কেউ আমার লাইফে নেই।
সর্বাণী চুপ করে রইল।
আরও মাস দেড়-দুই এভাবেই কেটে গেল। দু-একটা রবিবার বাদ দিলে বাকি সব ছুটির দিনই সে এসেছে। যখনই আসে, তাকে বাইরের বারান্দায় বসিয়ে গল্প করেন অনির্বাণ।
এক রবিবার এসে সর্বাণী নানা কথার ফাঁকে বলল, স্যার, আপনি কোথায় বসে লেখেন দেখতে ইচ্ছে করছে।
দেখবার মতো কিছু নেই। অনির্বাণ হাসলেন–তবু যখন তোমার ইচ্ছে, এসো।
দোতলায় তিনটে বড় বড় ঘর একটা হল অনির্বাণের স্টাডি। এখানে মস্ত একটা টেবিলের ওপর কম্পিউটার, পাঁচ-ছটা ডিকশনারি, টেলিফোন, আট-দশটা পেন, আঠার টিউব ইত্যাদি। দুধারের দেওয়াল জোড়া র্যাকে গাদাগাদি করে রাখা অজস্র ইংরেজি এবং বাংলা বই। একপাশে ডিভান এবং দুটো সোফাতেও ভঁই করা বই এবং ম্যাগাজিন। সব ছত্রখান হয়ে রয়েছে।
অনির্বাণ বললেন, এটাই আমার লেখা আর পড়ার ঘর। বুঝতেই পারছ আমি কেমন মানুষ। অগোছালো, ছন্নছাড়া। বেডরুমটা দেখলে বোধ হয় ভিরমি খাবে। চলো, সেটাও দেখাই।
লেখার ঘরের চাইতেও বেডরুমের হাল অনেক বেশি করুণ। ময়লা জামা প্যান্ট, বিছানার চাদর, যেদিকে তাকানো যায়, সব লন্ডভন্ড। যেন সারা ঘর জুড়ে ঝড় বয়ে গেছে। সর্বাণী বলল, লেখকরা সব ব্যাপারেই খুব উদাসীন হয় দেখছি। আমি ঘর দুটো গুছিয়ে-টুছিয়ে দেব?
না না, সে কী কথা ভীষণ বিব্রত হয়ে পড়েন অনির্বাণ। এসব তোমাকে ঘাঁটাঘাঁটি করতে হবে না।
কিন্তু সর্বাণী শুনল না। রবিবার এসে গল্প-টল্প তো করেই, ফাঁকে ফাঁকে ঘর দুটো গোছগাছও করে দেয়। পড়ার ঘর আর বেডরুমের চেহারাই পালটে গেল। এক রবিবার সর্বাণী এসে দেখল, সেদিনই সকালে বাথরুমে পড়ে গিয়ে হাতে চোট পেয়েছেন অনির্বাণ। শিবু ছুটি নিয়ে তাদের গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছিল। নীচের ভাড়াটেদের যে ডেকে আনা হবে তারও উপায় নেই। তারা ভোরবেলা বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে কোথায় যেন পিকনিকে গেছে।
সারা বাড়িতে নিতাইয়ের মা ছাড়া আর কেউ নেই। সে কাপড় গরম করে সেঁক-টেক দিয়েছে ঠিকই কিন্তু তাতে যন্ত্রণা খুব একটা কমেনি। বিছানায় শুয়ে শুয়ে অনির্বাণ উঃ আঃ করছেন। এই সময় সর্বাণী এল। সব শুনে তক্ষুনি বেরিয়ে গিয়ে ডাক্তার ডেকে এনে প্লাস্টারের ব্যবস্থা করল। এই রকম নানা ব্যাপারে ক্রমশ সর্বাণীর ওপর নির্ভর করতে শুরু করেছেন অনির্বাণ, হয়তো নিজের অজান্তেই। কোনও কারণে সে আসতে পারলে মন খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু কার সঙ্গে সর্বাণীর চেহারার মিল সেই ধন্দটা এখনও কাটেনি।
এক ছুটির দিনে চা খেতে খেতে অনির্বাণ বললেন, আমার কথা তো সবই শুনেছ। তোমার সম্বন্ধে আমি কিন্তু বিশেষ কিছুই জানি না।
সর্বাণী হাসল–আমাদের কথা বলার মতো নয়। বাড়িতে শুধু আমি আর আমার মা।
বাবা?
নেই।
মানে?
তিনি ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। সাত-আট বছর আগে এখানকার নদীর ওপর বাঁধ তৈরি হচ্ছিল। বাবা ইন্সপেকশনে গিয়েছিলেন। আচমকা ওপর থেকে লোহার একটা বিম এসে পড়ে তার ওপর। স্পষ্ট ডেড। আমাদের বাড়ি কলকাতায়। বাবার মৃত্যুর পরে আমরা সেখানে যাইনি। তার কোম্পানিই আমাদের জন্যে এই শহরে একটা বাড়ি করে দিয়েছে। প্রত্যেক মাসে পঁচিশ হাজার টাকা করে দেয়। একটা প্রাণের বদলে আমরা কমপেনসেশন পাচ্ছি।
ভেরি স্যাড- অনির্বাণের সারা মুখ বিষাদে ভরে গেল।
অনেকক্ষণ নীরবতা।
তারপর একেবারে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল সর্বাণী।–স্যার, এক-দেড় মাস আগে বলেছিলাম আপনার অতল জল উপন্যাসটা সম্পর্কে আমার কিছু প্রশ্ন আছে। আরও বলেছিলাম, বইটা আরেকবার পড়ে নেব। তারপর আপনার সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলব। এর মধ্যে পড়া হয়েও গেছে।
ভুলেই গিয়েছিলেন অনির্বাণ। মনে পড়ে গেল। বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, বলেছিলে। তা হঠাৎ অতল জলকে টেনে নিয়ে এলে!
তিনি বেশ অবাকই হয়েছেন।
বাড়ির সমস্ত কিছুই তো জানিয়ে দিয়েছি। এবার অতল জল নিয়ে আমার কৌতূহলটা মিটিয়ে নিই। না বলবেন না স্যার।
ঠিক আছে।
উপন্যাসের তিনটে প্রধান ক্যারেক্টার। শান্তনু, সুদীপ্তা আর বিক্রম। শান্তনু শান্ত, ভদ্র, নিস্পৃহ ধরনের মানুষ। উচ্চ শিক্ষিত। পড়াশোনা নিয়ে থাকতে পছন্দ করে। ভালো চাকরি করে, তবে তা বদলির চাকরি। তিন-চার বছর পর পর তাকে নানা জায়গায় পাঠানো হয়। শান্তনুর স্ত্রী সুদীপ্তা সুন্দরী। এমন রূপ যে তার দিকে তাকালে চোখ ঝলসে যায়। ঘরের কোণে ভ্যাদভেদে গৃহলক্ষ্মী হয়ে পড়ে থাকতে তার দমবন্ধ হয়ে আসে। সে চায় ঘরের দেওয়াল ভেঙে উড়ে বেড়াতে। তার এটা চাই, সেটা চাই, চাহিদার শেষ নেই। তা ছাড়া এখানে নিয়ে যাও, সেখানে নিয়ে যাও। উপন্যাসের তিন নম্বর লিডিং ক্যারেক্টার হল বিক্রম। সে শান্তনুর বন্ধু; একটা মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানির টপ একজিকিউটিভ। আজ ইউরোপে যাচ্ছে, কাল আমেরিকায়। বিক্রম প্রবল শক্তিমান পুরুষ। যা সে চায় তা ছিনিয়ে নেয়। ক্লাব, পার্টি, মদ এবং বান্ধবীদের তো তার কাম্য ছিল। একদিন বিক্রমের সঙ্গে সে স্বামী সংসার ফেলে চলে গেল। বলে সোজাসুজি অনির্বাণের দিকে তাকাল–আপনার উপন্যাসে এরকমই রয়েছে। আপনি বলেছিলেন, চারপাশের চেনা জানা মানুষ এবং ঘটনা নিয়ে গল্প-উপন্যাস লেখেন। শান্তনু, সুদীপ্তা আর বিক্রম নিশ্চয়ই বাস্তব চরিত্র।
অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন অনির্বাণ তারপর চাপা গলায় বললেন, হ্যাঁ, মানে
অনির্বাণের কথা যেন শুনতেই পেল না সর্বাণী। বলতে লাগল, আপনার কাছে আগেই শুনেছি বাস্তব চরিত্রের নামটাম বদলে তার সঙ্গে কল্পনা মিশিয়ে গল্প-উপন্যাস লেখেন। অন্য গল্প-টল্প কাদের নিয়ে লিখেছেন বলতে পারব না। তবে অতল জল-এর তিনটে ক্যারেক্টারের আসল নাম-টাম আমি জানি। তারা শান্তনু, সুদীপ্তা আর বিক্রম নন।
সামনের দিকে অনেকখানি ঝুঁকে, জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে গলার স্বরটা ঝপ করে নামিয়ে দিয়ে বলল, তারা হলেন, অনির্বাণ, দীপিকা আর প্রতাপ।
শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ খেলে গেল অনির্বাণের। তার গলা চিরে দুটি শব্দ বেরিয়ে এল–তুমি কে?
আমার মায়ের নাম দীপিকা, আপনার অতল জল-এ যিনি সুদীপ্তা আর বাবা হলেন প্রতাপ উপন্যাসে যিনি বিক্রম।
এতদিনে সেই ধন্দটা কেটে গেল অনির্বাণের। সর্বাণীর মুখে কার আদলটি আবছাভাবে বসানো, সেটা স্পষ্ট হয়ে গেল।
সারা শরীর উথাল পাথাল হয়ে যাচ্ছে। বিহুলের মতো তাকিয়ে রইলেন অনির্বাণ। মাথার ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে।
সর্বাণী উঠে পড়েছিল। বলল, স্যার, আজ আমার একটু তাড়া আছে। যাচ্ছি। সে চলে গেল।
অনেকটা সময় স্তব্ধ হয়ে বসে থাকার পর অনির্বাণের অস্থির অস্থির ভাবটা কমে এল।
সর্বাণী কেন তাঁর কাছে প্রায় প্রতিটি ছুটির দিনে এসেছে? সে যে তার ভক্ত পাঠিকা সেটা বোঝাতে; নাকি অন্য কোনও উদ্দেশ্য ছিল? সে যে আসে দীপিকা কি তা জানে? জেনে শুনেও কি যে পুরুষটির সঙ্গে সম্পর্কের গিট ছিঁড়ে একদিন প্রতাপের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল, তার কাছে নিজের মেয়েকে বারবার পাঠিয়েছে? সর্বাণী তার মা-বাবার সঙ্গে তার সম্পর্কটা জানল কী করে? নানা প্রশ্ন চারদিক থেকে ধেয়ে আসতে লাগল।
না না, এসব ভেবে নিজেকে ভারাক্রান্ত করার মানে হয় না। অনির্বাণ একটা সিদ্ধান্ত নিলেন।
পরদিন কলেজে গিয়ে লম্বা ছুটি পেয়ে প্রিন্সিপালকে দরখাস্ত দিয়ে সোজা একটা এজেন্সির অফিসে চলে এলেন। এরা নানা লটবহর এক শহর থেকে আরেক শহরে নিয়ে যায়। দুদিন বাদে একটা ট্রাক এসে বইপত্র, ব্যাগ স্যুটকেস-টুটকেস গুছিয়ে নিয়ে কলকাতায় চলে গেল। সেখানে অনির্বাণদের বাড়িতে সেসব পৌঁছে দেবে।
ফার্নিচারগুলো ভাড়া করা। আরও তিনদিনের মধ্যে বাড়ি ভাড়া, আসবাবের ভাড়া, শিবু এবং নিতাইয়ের মায়ের মাইনে চুকিয়ে দিয়ে ট্রেনে উঠলেন অনির্বাণ। জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবলেন, কলকাতায় গিয়ে কটা দিন নিজেদের বাড়িতে চুপচাপ শুয়ে থাকবেন। তারপর সটান চলে যাবেন হায়ার এডুকেশন ডিপার্টমেন্টের অফিসে। এই অফিসের অনেক সিনিয়র আধিকারিক তাকে পছন্দ করেন। তাদের অনুরোধ করলে অন্য কোনও শহরে ট্রান্সফার হয়ে যাবেন। বেগমপুরে ফিরে গেলে রবিবার রবিবার সর্বাণী যেমন আসে হয়তো তেমনই আসবে। তার সঙ্গে কোনও একদিন দীপিকাও চলে আসতে পারে। না এলেও রাস্তায় কখনও দেখা হয়ে যেতে পারে। বহু বছর আগে দীপিকা প্রতাপের সঙ্গে পালিয়ে যাবার পর ভেঙে-চুরে খান খান হয়ে গিয়েছিলেন অনির্বাণ। সময়ের হাতে বোধ হয় আশ্চর্য কোনও ম্যাজিক থাকে। ধীরে ধীরে সব ক্ষত শুকিয়ে গেছে, নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। লেখালেখি, কলেজের পড়ানো ছাড়া অন্য কোনও দিকে আর তাকাবেন না। বাকি দিনগুলো এভাবেই কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু দীপিকা? না। জীবনটাকে নতুন করে জটিল করে তোলার লেশমাত্র ইচ্ছা নেই অনির্বাণের।
ইলেকট্রিক ট্রেন দুরন্ত গতিতে বেগমপুরের সীমানা ছাড়িয়ে কলকাতার দিকে দৌড় শুরু করল।