- বইয়ের নামঃ পূর্বপার্বতী
- লেখকের নামঃ প্রফুল্ল রায়
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. পাহাড়ী উপত্যকা
পূর্বপার্বতী – প্রফুল্ল রায়
PURBAPARBATI –A Bengali Novel By PRAFULLA Roy Published by Sudhangshu Sekhar Dey, Deys Publishing
প্রথম প্রকাশ : ভাদ্র ১৩৬৪, সেপ্টেম্বর ১৯৫৭, প্রথম দেজ সংস্করণ বৈশাখ ১৩৮৫, এপ্রিল ১৯৭৮ পঞ্চম রাজ সংস্করণ : মাঘ ১৪১৫, জানুয়ারি ২০০৯
.
অগ্রজপ্রতিম শ্ৰীসাগরময় ঘোষ পরম শ্রদ্ধাস্পদে
.
লেখকের কথা
আমি উপন্যাসে ভূমিকার পক্ষপাতী নই। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভূমিকা অপরিহার্য। পূর্বপার্বতী এরকম একটি ক্ষেত্র।
ভারত সীমান্তের নাগা উপজাতির জীবনযাত্রা ভিত্তি করে এই উপন্যাস রচিত হয়েছে।
নাগাদের মধ্যে গোষ্ঠী এবং বংশগত অসংখ্য ভাগ ও ভেদ রয়েছে। নানা ভাষা এবং উপভাষার প্রচলন আছে। সমাজব্যবস্থা, উৎসব এবং ধর্মাচরণের আনুষঙ্গিক রীতিও সর্বত্র এক নয়। তা সত্ত্বেও সামগ্রিকভাবে (স্বল্পসংখ্যক শিক্ষাপ্রাপ্ত ছাড়া) সকল শ্রেণীর নাগার মধ্যে আদিম বন্য চরিত্রের উপাদানগুলি মূলতঃ অভিন্ন। লালসা, প্রতিহিংসা, তীব্র রতিবোধ, হিংস্রতা প্রভৃতি প্রবণতাগুলির প্রকাশভঙ্গিতে তেমন কোনো তফাত নেই।
নাগাভূমি। সংখ্যাতীত পাহাড়মালা, দুর্গম অরণ্য, নদী-জলপ্রপাত ঝরনা-মালভূমি উপত্যকা দিয়ে ঘেরা সীমান্তের এই দেশটি সমতলের বাসিন্দাদের কাছে অপরিসীম বিস্ময়ের বিষয় হয়ে রয়েছে। শ্বাপদসঙ্কুল এই দেশটিতে মানুষের জীবনযাত্রা কিরকম, তাদের সমাজ কোন নীতিতে চলে, কৌলিক ও সামাজিক আচার-আচারণ কেমন–এ সব সম্পর্কে কৌতূহলের অন্ত নেই।
নাগা পাহাড়ের নিসর্গরূপ অপূর্ব। ভয়ঙ্কর এবং সুন্দরের এমন সার্থক স্বচ্ছন্দ মিশ্রণ ভারতের অন্য কোথাও আছে কিনা সন্দেহ।
নাগাদের জাতীয় জীবনের প্রাথমিক ইতিহাস বর্ণাঢ্য। যুথচারী মানুষগুলির গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে, বংশে বংশে সংঘাত, প্রতিহিংসা, নারী ও ভূমি আয়ত্ত করার উত্তেজনায় প্রতিটি মুহূর্ত রোমাঞ্চকর। এদের উৎপত্তি সম্বন্ধে প্রচুর রূপকথা ও উপকথা ছড়িয়ে আছে।
কিন্তু গত কয়েক দশকের ইতিহাস শুধু বর্ণময়ই নয়, বেগবানও। ইংরেজদের অভিযান, খ্রিস্টান মিশনারি, সমতলের বেনিয়া ও সরকারি এবং বেসরকারি কর্মচারীদের দৌলতে ভারতবর্ষের মুক্তি আন্দোলনের খবর আসা, দ্বিতীয় মহাসমর, স্বাধীনতা, ফিজোর অভ্যুত্থান–নাগা পাহাড়ে প্রতি মুহূর্তে উন্মাদনা, নিমেষে নিমেষে দৃশ্যপট পরিবর্তন।
সময়ের চতুর কারসাজি সত্ত্বেও নাগা-মনের মৌলিক বৃত্তিগুলি এখনও বিশেষ বিকৃত হয় নি।
পূর্বপার্বতী জাতিতত্ত্বের গবেষণা নয়; নাগাদের কাম-লালসা-হিংসা, ন্যায়-অন্যায় বোধ এবং জীবনের দ্রুত পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস।
নাগাদের অগণ্য গোষ্ঠীগুলির মধ্যে থেকে একটিকে বেছে নিয়ে তাদের অখণ্ড এবং সমগ্র জীবনবোধকে এই উপন্যাসে রূপ দেওয়া হয়েছে।
সুবৃহৎ আয়তন এবং সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার দিকে লক্ষ্য রেখে গ্রন্থটিকে দু’টি স্বয়ংসম্পূর্ণ পর্বে প্রকাশ করার ব্যবস্থা হয়েছে। বর্তমানে প্রথম পর্বটি প্রকাশিত হল।
শুধু পাদপ্রদীপের জলুসই নয়, নেপথ্যের আয়োজনটুকু পাঠকসমাজকে জানানো প্রয়োজন।
এই গ্রন্থ রচনার প্রথম প্রেরণা দিয়েছিলেন অগ্রজপ্রতিম শ্ৰীসাগরময় ঘোষ। নাগা পাহাড়ে পাঠানো থেকে শুরু করে উপন্যাসটির নামকরণ এবং প্রতিটি ছত্রে তাঁর স্নেহ ও আন্তরিকতার প্রীতিপ্রদ উত্তাপ অনুভব করি। তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক সম্পাদক লেখকের গণ্ডি পেরিয়ে ঘনিষ্ঠতা বিচারের বহু মাপকাঠি ডিঙিয়ে গিয়েছে। আমার সাহিত্যিক জীবনে তার অফুরন্ত উৎসাহের উৎস হয়ে থাকার কথাটি স্মরণ করে ঋণ পরিশোধের দুঃসাহস করব না।
এর পরেই যাঁর নাম করতে হয় তিনি শিলংয়ের শ্ৰীহেমন্তকুমার গুপ্ত। হেমন্তবাবু আমার অশেষ শ্রদ্ধাভাজন। এই একনিষ্ঠ সাংবাদিক ও নির্যাতিত দেশপ্রেমীর কাছে গ্রন্থটির জন্য অজস্র অমূল্য উপকরণ এবং পরামর্শ পেয়েছি। এ প্রসঙ্গে তার পরিবারের প্রতিটি ব্যক্তির সস্নেহ সহৃদয়তা ও শিলংয়ের কয়েকটি আশ্চর্য সুন্দর দিন তাদের মধ্যে কাটাবার কথা মনে রেখে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
আমার পরম শ্রদ্ধাস্পদ সুসাহিত্যিক শ্রীভবানী মুখোপাধ্যায় ও শ্রীনন্দগোপাল সেনগুপ্তের ঋণ এই সূত্রে স্বীকার করি।
লামডিংয়ের শ্রীপ্রাণবল্লভ তালুকদার ও তার পরিবার, ডিমাপুরের শ্রীমহাদেব কাকতি, কোহিমার শ্রীডেকা, শ্রীসেনগুপ্ত, মোককচঙের শ্রীমথুরপ্রসাদ সিংহ, মি.সেমা, মি,আও, মি.গ্ৰীয়ারসন এবং ইম্ফলের শ্ৰথম্বাল সিং, শ্ৰীগিরিধারী ফুকন, শ্রীগোস্বামী ও শ্রীসত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বিচার সহায়তার কথা উল্লেখযোগ্য।
সেই তিনটি পাহাড়ী সর্দার, যারা দিনের পর দিন, রাতের পর রাত আমাকে তাদের জীবনকথা, রূপকথা, উপকথা এবং অসংখ্য উপাদান যুগিয়ে পূর্বপার্বতী রচনা সম্ভব করেছে তাদের কাছে আমার ঋণ পর্বতপ্রমাণ। এই সঙ্গে সেই নাম-প্রকাশে অনুচ্ছিক দোভাষী বন্ধুটি এবং আবাল্যসুহৃদ শ্ৰীচিন্ময় ভট্টাচার্য ও শ্রীঅর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহায়তার কথা স্মরণ করি।
দেশ পত্রিকায় এই গ্রন্থ প্রকাশকালে যেসব সহৃদয় পাঠক-পাঠিকা চিঠি দিয়ে আমার উৎসাহ বর্ধন করেছিলেন, নানা কারণে স্বতন্ত্রভাবে তাদের উত্তর দেওয়া সম্ভব হয় নি। এই সুযোগে মার্জনা চেয়ে তাদের ধন্যবাদ জানাই।