.
আধ ঘণ্টাও কাটল না, তার আগেই সুলতানা দুটো বড় স্টেনলেসের থালায় গরম গরম ঘি-মাখানো চাপাটি, আলুর ডোকা, আমলকীর আচার আর এক লাস করে ঘন দুধ আমাদের সামনে সাজিয়ে দিয়ে কাছে বসে মায়ের মতো যত্ন করে খাওয়াতে লাগল। খা লে বেটা সামান্য আয়োজন। গনগনে খিদের মুখে মনে হল অমৃত।
আমাদের খাওয়া চলছে। নানা কথা বলছিল সুলতানা। হঠাৎ একসময় জিগ্যেস করল, তোদের গাড়ির চাকা তো ফেঁসে গেছে। কোথায় রয়েছে গাড়িটা?
ঠিক কোথায় আছে বলতে পারব না। কাল দিনের বেলা খুঁজে বের করতে হবে।
ধরম সিং কাছেই রয়েছে। জিগ্যেস করল, ফিকর মত কর। আমরাই ছুঁড়ে বের করে দেব। কী গাড়ি তোদের?
কখনও আমাদের তুমি বলছে ধরম সিং, কখনও তুই। সুকুমার পাল বললেন, জিপ–
ধরম সিং বলল, টুগাপুরের এই পেনিল কলুনিতে (পেনাল কলোনিতে) আমার এক দোস্ত আছে। মান্দ্রাজি খ্রিস্টান যোশেফ। বত্তিশ সাল আগে আমরা এক জাহাজে কল্পকাত্তা থেকে কালাপানি এসেছিলাম। সে আরও জানায়, যোশেফ খুব ভালো মোটর মেরামতি করতে পারে। তার কাছে হরেক কিসিমের মোটরের চাকা আছে। নসিব ভালো হলে জিপের চাকা তার কাছে পাওয়া যাবে। কাল সুবেহ তাকে ডেকে আনা হবে।
ধরম সিংয়ের কিছু খেয়াল হওয়ায় ব্যস্তভাবে জিগ্যেস করল, তোরা কোথায় যাবি সেটাই তো জানা হয়নি।
সুকুমার বললেন, জেফ্রি পয়েন্টে। এখান থেকে কতদূর?
নজদ্গি। খুব বেশি হলে ছ-সাত মিল। দরিয়ার কিনারে ওই জায়গাটায় জঙ্গল সাফ করে পাকিস্তানে বঙ্গালি রিফুজদের (রিফিউজিদের) কলুনি বসানো হচ্ছে না?
হ্যাঁ। আমরা সেই কলোনিতেই যাব।
খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে সুলতানা ঘরের দু-ধারের কাঠের মাচানে পরিপাটি করে বিছানা পেতে গায়ে দেবার জন্য পাতলা দুটো চাদর দিয়ে বলল, শো যা বেটারা। রাতে যদি কিছু জরুরত হয় তো আমাদের ডাকি। বলে চাবি ঘুরিয়ে হ্যারিকেনটা নিবু নিবু করে রেখে ধরম সিংকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেল।
.
আগের দিন আমাদের ওপর দিয়ে প্রচণ্ড ধকল গেছে। তাই পরেরদিন ঘুম ভাঙতে একটু দেরি হয়ে গেল।
আমাদের অনেক আগেই জেগে গিয়েছিল সুলতানা আর ধরম সিংহ। তারা খুব সম্ভব লক্ষ রাখছিল। আমরা বিছানা থেকে নামতেই ধরম সিং এসে বলল, চল, তোদের নানা ঘরে নিয়ে যাই।
বাড়ির ভেতর দিকে চানের ঘর বা বাথরুম। সেখানে কয়েক বালতি জল ধরা আছে। সুকুমার পাল আর আমি একে একে গিয়ে গিয়ে মুখ-টুখ ধুয়ে এলাম। যাওয়া-আসার পথে চোখে পড়ল রসুইঘরে অর্থাৎ কিচেনে ছাক ছোঁক আওয়াজ করে ভীষণ ব্যস্তভাবে কী সব করছে সুলতানা।
আমাদের জামাকাপড় সবই রয়েছে সেই জিপটায়। তাই বাথরুমে কাজ সেরে এসে বাসি পোশাকেই থাকতে হল।
ধরম সিং আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই রয়েছে। সুকুমার পাল তাকে বলল, এবার তো আমাদের যেতে হবে।
ধরম সিং বলল, যাবি যাবি। এখন বোস্। আমার ঘরবালী আসুক। তার হুকুম ছাড়া যাওয়া চলবে না।
কয়েক মিনিটের ভেতর চলে এল সুলতানা। তার হাতে দুটো থালায় মুলোর পরোটা, হিং-দেওয়া ঘন অড়র ডাল, নানারকম আনাজ দিয়ে একটা তরকারি আর এক লাস করে ঘোল। বুঝতে পারছি, এ-বাড়িতে চায়ের ব্যবস্থা নেই। বুঝতে পারলাম, ভোরবেলা উঠে আমাদের জন্যে এইসব খাবার তৈরি করেছে।
থালা দুটো আমাদের সামনে রেখে সুলতানা বলল, খা, বেটারা। বলে একটা চেয়ার টেনে কাছে বসল।
ধরম সিং সুলতানাকে বলল, তুই তোর বেটাদের খাওয়া। আমি যোশেফকে ডেকে আনি। সে চলে গেল।
মিনিট কুড়ি বাদে ধরম সিং একটা বেঁটে খাটো, কালো, মজবুত চেহারার লোককে সঙ্গে করে নিয়ে এল। নিশ্চয়ই তার বন্ধু যোশেফ। লোকটার কাঁধে একটা টায়ার আর হাতে চটের ব্যাগে কিছু জিনিসপত্র রয়েছে। খুব সম্ভব মোটর মেরামতির যন্ত্রপাতি। সে ধরম সিংয়েরই সমবয়সি হবে। তবে মাথার চুল খুব একটা পাকেনি।
ধরম সিং লোকটার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল।
আমাদের খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। সুলতানাকে বললাম, এবার যাই
ভারী গলায় যে বলল, ধরে তো রাখতে পারব না। ঠিক হ্যায়। চল, আমিও তোদের সঙ্গে গিয়ে গাড়িটা খুঁজি।
কাল মাঝরাতে সুলতানাদের বাড়িতে এসেছিলাম, এখন সকাল আটটা কি সাড়ে-আটটা। মাত্র কয়েক ঘণ্টায় এই পাঠান রমণীটি, যে বত্রিশ বছর আগে দায়ের কোপে দুটো লোকের ধড় থেকে মুন্ডু নামিয়ে কালাপানি এসেছিল যাবজ্জীবন সাজা খাটতে, সে আমাদের কত আপন করে নিয়েছে। আমার বুকের ভেতরটাও ভারী হয়ে উঠল।
.
একসময় আমরা বেরিয়ে পড়লাম। সুলতানা, ধরম সিং, যোশেফ, সুকুমার পাল এবং আমি।
ঘণ্টা দেড়েক খোঁজাখুঁজি চলল। শেষ পর্যন্ত তিনটে পাহাড় পেরিয়ে চার নম্বর পাহাড়ের একটা রাস্তার বাঁকে আমাদের বানচাল জিপটা পাওয়া গেল। সামান্য কাত হয়ে সেটা পড়ে রয়েছে। লক্ষ করলাম আমার স্যুটকেস হোল্ড-অল কাল রাতে যেমন রেখে গেছি তেমনই আছে। এই পথ দিয়ে যদি কেউ গিয়েও থাকে সেসব ছুঁয়েও দেখেনি।
যোশেফ কাজের লোক। আন্দাজ করে যে চাকাটা নিয়ে এসেছিল, সেটার মাপ জিপের অন্য চাকাগুলোর মতোই। আমাদের ফেঁসে যাওয়া চাকাটা খুলে দশ মিনিটের মধ্যে তার চাকাটা লাগিয়ে বলল, এবার তোমরা চলে যাও
সুকুমার পাল বললেন, কিন্তু আপনার চাকাটা ফেরত দেব কী করে?
কোঈ জরুরত নেই। আমি তো তোমাদের চাকাটা নিলাম।