অনুমানে কণ্ঠস্বরের দিকে এগিয়ে যায় সুদেশ হুদা। কিন্তু আলোয় বন্যা তার শরীরে অঙ্গাঙ্গী। পিছন থেকে কার গলা শোনা যায়,–আর-এক পা-ও এগোবে না। আমার হাতে পিস্তল আছে।
রতনলালের গলা সন্দেহ নেই।
ত্রাসে বরফ সুদেশ।
এ সব, কী রাহুলদা?–সে চিৎকার করে ওঠে, এ কী ধরনের ইয়ার্কি?
ইয়ার্কি নয়, ঠাট্টাও নয়, সুদেশ রাহুল দস্তিদারের কণ্ঠে হিংসা, উলঙ্গ হিংসা। মনে পড়ে? তিন মাস আগে এয়ারপোর্ট থেকে একজন ছাত্র ট্যাক্সি করে শহরে যাচ্ছিল। তার নাম সুদেশ হুদা। সুদূর ইরান থেকে এ-দেশে সে পড়াশোনা করতে এসেছিল। পথে জগদীশ আম্বাস্তার সিক্রেট-পুলিশ তাকে আটকায়। গাড়ি থেকে নামিয়ে ট্যাক্সি ছেড়ে দেয়। তারপর তারা সুদেশ হুদাকে খুন করে। পুঁতে ফ্যালে এই ঘাসজমিতে। কিন্তু অন্য এক সুদেশ হুদা ঠিকই শহরে এসে পৌঁছোয়। ইউনিভার্সিটিতে ভরতিও হয়। যদিও সে তুমি–নকল সুদেশ। জগদীশ আম্বাস্তার ডিপার্টমেন্টের লোক, গোয়েন্দা পুলিশের লোক। বুদ্ধির তোমার তুলনা নেই, সুদেশ। ওরা তোমাকে ভালোই ট্রেনিং দিয়েছিল…তারপর পাঠিয়েছিল আমার দলে। আমার কথা বুঝতে তোমার কষ্ট হচ্ছে না তো?
সুদেশের হৃৎপিণ্ড বুকের ভেতর দামামা। মস্তিষ্ক তীব্র চিৎকারে উন্মত্ত–পালাও, পালাও! কিন্তু সুদেশের পা অনড়, নিশ্চল। শ্যামাপোকার মতো আলোর বৃত্ত ওকে সম্মোহিত করে রাখে।
তুমি প্রোটেস্ট করবে না? সাফাইও গাইবে না? রাহুলদার গলায় ঠাট্টার সুর,সব্বাইকে ঠকালেও আমি ঠকিনি, সুদেশ। বিপ্লব আমার মা, বোন, বউ আমার রক্তে শুধু বিপ্লব আছে– আর কিছু নেই। ছাত্র সুদেশ হুদার মারা যাওয়ার খবরটা খবরের কাগজে বেরোয়নি–বের করা হয়নি। সুতরাং, তোমার কোনও অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। প্রথমটা হয়ওনি। নীতু মেহতা গেল। আমাকে ঠকানোর জন্যে তোমার পরিকল্পনায় সাহায্য করল জগদীশ আম্বাস্তা। ফিদার সঙ্গে মাখো মাখো ভাব দেখাল। তুমি আমাকে বোঝাবে, ফিদাই ইনফরমার। তোমার নির্দেশে ফিদা ধরা পড়ল। ছাড়াও পাবে। তখন তুমি আমাকে বোঝাবে, ফিদা জগদীশের লোক। তাই সে ফিদাকে ধরেও ছেড়ে দিয়েছে। কই, নীতুকে তো দেয়নি! আমিও তাই বুঝতাম। কিন্তু তোমার সর্বনাশ ডেকে আনল মিস্টার অ্যান্ড মিসেস গাজি।
এখন সুদেশ বুঝতে পারল অসহায়তা কাকে বলে। এই হতাশ অনুভূতিহীন মুহূর্তে বুঝতে পারল নীতুর শেষ অবস্থার কথা, জগদীশের হাতে ফিদার করুণ অবস্থার কথাও।
প্রথমে বুঝিনি তুমি তাদের এড়িয়ে চলছ কেন। নিজের দেশের লোক, প্রতিবেশী, পরিবারের বন্ধু–অথচ তাদের সঙ্গে দেখা করার বিন্দুমাত্রও ইচ্ছে তোমার নেই? এ তো ভালো কথা নয়! সুতরাং হোটেল কমোপলিটান-এ মিস্টার অ্যান্ড মিসেস গাজির সঙ্গে আমি দেখা করলাম। ওদের ঠিকানা তোমার প্রতিবেশী মহিলাই দিয়েছিলেন। যে সুদেশ হুদাকে তারা চিনতেন, সে বেঁটে এবং মোটা ছিল। তার গায়ের রংও পরিষ্কার। তুমি কে, সুদেশবাবু? নিজের লোকদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার মতো নোংরা মানসিকতা তোমার মনে কীভাবে জন্ম নিল? টাকার লোভে? পেটের দায়ে? তা হলে দ্যাখো, বড়লোক হয়ে ভরতি পেটে মরতে কেমন লাগে। রতনলাল!
আলো নিভে যায় মুহূর্তে। নিভেই থাকে। সময় দোদুল শূন্য। ক্রমশ গাঢ় হয় নৈঃশব্দ্যের পরদা। সুদেশ জানে, সামনে-পিছনে রাস্তা বন্ধ। এবং অন্ধকারে ওরা এগিয়ে আসছে, ধীরে-ধীরে এগিয়ে আসছে ওকে শাস্তি দিতে। ওর শরীরে আলোড়ন তুলতে।
ওর সঙ্গে এখন রিভলভার নেই। সুতরাং ওরা নির্ভয়ে আসতে পারবে। ওর রিভলভার সরিয়ে নেওয়ার জন্যেই পুতুল ওকে জড়িয়ে ধরেছিল। তখনই তুলে নিয়েছে সুদেশের আগ্নেয়াস্ত্র। এখন মনে পড়ছে, ওকে ছেড়ে দিয়ে পুতুলের কী কান্না! পুতুলের বিশ্বাসঘাতকতার যন্ত্রণার চেয়ে কী আর বেশি যন্ত্রণা ওরা দেবে? সুদেশ কাঁদবে না, ওর চোখে জল নেই। চোখের জল ফেলার অধিকারও ওর নেই। কারণ, সেও বিশ্বাসঘাতকতা করেছে? নীতুর সঙ্গে, ফিদার সঙ্গে নীতুর আগে আরও অনেকের সঙ্গে, দেশের অন্যান্য জায়গায়। সুতরাং, চোখের জল ফেলার কোনও কারণ নেই। বরং কারণ আছে নীরব থাকার এবং প্রতীক্ষার। ও অপেক্ষা করছে করবে। হে ভগবান! নিঃশব্দ চিৎকারে ভাবল সুদেশ, ওরা এত দেরি করছে কেন…?
অপারেশন দাঁড়কাক
কথায় বলে কাক কাকের মাংস খায় না।
আমিও এতদিন তাই-ই জানতাম। কিন্তু একটা ০.৪৫৭ লুগার অটোমেটিক নিয়ে মহিন রায়ের আবির্ভাবের পর থেকে ওপরের প্রবাদ-বাক্যটা এই অধম ভুলতে বসেছে। লোকটা এমন এলোপাতাড়িভাবে ডাইনে-বাঁয়ে খুন করে যাচ্ছে যে, না দেখলে বিশ্বাস হয় না। আমার ক্লায়েন্ট কমে যাওয়ায় আমি যত না আঘাত পেয়েছি, তার চেয়েও বেশি পেয়েছি ওই খুন শব্দটাকে মহিন রায় যাচ্ছেতাইভাবে অপমান করছে বলে।
অর্থাৎ মোদ্দা কথা, এতদিনের পর সতীশ দেবনাথ–অথবা শার্প দেবনাথ একজন উন্মাদ প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি হয়েছে।
আমি সাধারণত এইসব মোক্ষলাভ করানোর (খুন শব্দটাকে আমি আবার ঠিক পছন্দ করি না) ব্যাপারে শিল্পীসুলভ মন নিয়ে কাজ করি। ডিটেলের দিকে দিই অখণ্ড গভীর মনোযোগর জন্যে পুলিশ চিরকালই মুখোমুখি হয়েছে এক অদ্ভুত সমস্যার : সেটা হল, খুনের পদ্ধতি তারা কোনওদিনই খুঁজে পায়নি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বাজারে প্রফেশনাল কিলার হিসেবে আমার নামডাক বেড়েছে বই কমেনি।