অল্প হাসল পুতুল।–জানি। তা ছাড়া পালিয়ে যাবেই বা কোথায়! আমাদের যতজনকে তুমি চেনো, তার চেয়েও অনেক বেশি লোক এ-শহরে ছড়িয়ে আছে, সুদেশদা।
রাহুলদা কি পুতুলকে ইনফরমারের কথা বলেছে? ভাবল সুদেশ। সে সন্দেহ করেছিল ফিদাকে। ফিদা জয়শওয়ালকে। কিন্তু তার পরিণতি কী অদ্ভুত! জগদীশের নৃশংস হাতে ধরা পড়ল ফিদা।
ফিদাকে যখন ধরা হয়, তখন আমি জগদীশকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলাম। আনমনাভাবে বলল সুদেশ, রাহুলদা বারণ করল। জানো পুতুল, আমি ফিদাকে পছন্দ করতাম না।
পছন্দ-অপছন্দ যার-যার নিজের কাছে। ফিদার কপাল খারাপ ছিল। তুমি কিছু একটা করতে গেলে ভালোর চেয়ে খারাপ হত।
পুতুল কি জানে, রাহুলদা পুতুলকে সন্দেহ করতে চেয়েছিল? সুদেশ পুতুলের পক্ষ নিয়ে বাধা দিয়েছে? হয়তো বলেনি। বললে পুতুল এত শান্ত, নিশ্চিন্ত, থাকতে পারত না। এই অনুভবের সঙ্গে-সঙ্গে এক নিঃসঙ্গ বিষণ্ণতা ঘিরে ফেলল সুদেশকে।
ও বাইরে তাকাল। শহর ছেড়ে ওদের গাড়ি শহরতলির খোলা পথ ধরেছে। দু-পাশে অন্ধকার প্রান্তর। আলো নজরে পড়ে না। শুধু নিজেদের গাড়ির হেডলাইট ছাড়া।
আমরা কোথায় যাচ্ছি? সুদেশ জানতে চাইল।
বেশি দূরে নয়।
ঠিক কতটা দূরে? সুদেশের স্বরে কিছুটা বিস্ময় আর কিছুটা অধৈর্যের সুর।
পৌঁছোলেই জানতে পারবে।
মিটিং আছে?
হ্যাঁ।
আগে কখনও শহরের বাইরে আমাদের মিটিং হয়নি।
মিটিংয়ের জায়গা তো আমি পছন্দ করি না, সুদেশদা। রাহুলদা করে। মুখ ফিরিয়ে সুদেশের দিকে তাকিয়ে হাসল পুতুল। সে-হাসিতে কিছুটা বিষণ্ণতা খুঁজে পেল সুদেশ।–আমাক তুমি বিশ্বাস করো না?
করি, পুতুল। সুদেশ হুদার কণ্ঠস্বর একাগ্র, একান্ত।
এই তো, এসে গেছি।বলার সঙ্গে-সঙ্গে গাড়ির গতি কমে এল।
রাস্তা নির্জন নির্জনতর। অন্ধকার। শুধু ওপরের আকাশে দিশেহারা নক্ষত্ররা চোখ পিটপিট করছে। এখানে, এই অদ্ভুত জায়গায় থামছে কেন গাড়ি? কই, অন্য কাউকে, রাহুলদাকে, তো চোখে পড়ছে না? সুদেশ অবাক হতে-না-হতেই গাড়ি একেবারে থেমে গেল।
এবার আমি চলে যাব।–বলল পুতুল।
চলে যাবে? সুদেশের স্বর বিপন্ন।
হ্যাঁ, রাহুলদার তা-ই নির্দেশ।
আকাশের ছেঁড়া মেঘের দিকে তাকিয়ে কী যেন খোঁজে সুদেশ। চারপাশ একেবারে চুপচাপ, শুধু গাড়ির ইঞ্জিনের চাপা গর্জন এক বিদ্রোহ।
কী ব্যাপার বলো তো, পুতুল?
জানি না।–ওর গলায় অস্বস্তির সুর। রাহুলদা আমাকে সব খুলে বলেনি। শুধু বলেছে আমি যেন এখানে না থাকি, আবার শহরেও ফিরে না যাই। গাড়ি নিয়ে আমাকে চলে যেতে হবে অন্য একটা জায়গায়। সে-জায়গার নাম আমি আর রাহুলদা ছাড়া কেউ জানে না, জানবে না। তোমাকে জানানো ঠিক নয়, তবুও বলছি…অ্যাকশন সম্ভবত আজ রাতেই শুরু হবে। ফিদা ধরা পড়ার পর রাহুলদা আর দেরি করতে চাইছে না।
আজ রাতে?সুদেশের স্বর যেন পাহাড়ি প্রতিধ্বনি। তাহলে আমাকে এখানে আনা হয়েছে কী করতে?
অস্ত্রশস্ত্র দেওয়ার জন্য। আক্রমণের সময় তোমাকে একটা গ্রুপ লিড করতে হবে। তোমার সঙ্গে রিভলভার আছে তো?
আছে।
ভালো। ওরা যখন আসবে, তোমাকে সিগন্যাল দেবে–আলো জ্বালিয়ে-নিভিয়ে।
আর সঙ্গে-সঙ্গেই দু-হাতে সুদেশকে জড়িয়ে ধরল পুতুল। ওর ঠোঁট থমকে গেল সুদেশের ঠোঁটে। উষ্ণতা। আচ্ছন্নতা। অবাধ্য হৃৎপিণ্ডের শব্দ। সুদেশের ঘ্রাণে ফোঁটা পদ্মের গন্ধ। এই মুহূর্ত চিরন্তন হয়ে থাক।–ও ভাবল।
তোমার গায়ে আঁচ লাগতে দেব না,–পুতুল বক্সীর নরম শরীরে সুদেশের কথা জড়িয়ে যায়।–ভয় কোরো না। তোমার কোনও ক্ষতি আমি হতে দেব না। বিশ্বাস করো।
পুতুল ফুঁপিয়ে কাঁদছে। নিজেকে সরিয়ে নিয়ে ও ফিশফিশ করে বলল, যাও–বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করো। ওরা এখুনি এসে পড়বে। আমি চললাম। গুড বাই, সুদেশ।
সুদেশ হুদা যেন শোলার পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তাকিয়ে থাকে গাড়ির অপস্রিয়মান লাল আলোর দিকে। দূরে, অন্ধকারে, কোথাও পাচা ডেকে ওঠে কর্কশ স্বরে। শরীরে শিহরন জাগে সুদেশের। এই মুহূর্তে পুতুল ওর সর্বাঙ্গে মিশে আছে। কিন্তু ও একা। সঙ্গী শুধু নৈঃশব্দ্য, আকাশের নক্ষত্র, আর অন্ধকার নির্জন প্রান্তর।
ইনফরমার
সত্যিকারের সময়ের অঙ্কে খুব বেশিক্ষণ ও অপেক্ষা করেনি, কিন্তু সুদেশের মনে হল এক শতাব্দী পার হয়ে গেছে। খোলা রাস্তায় ও পায়চারি করতে লাগল। কখনও রাস্তার কিনারায় দাঁড়িয়ে দেখতে চেষ্টা করল ঘাসে ছাওয়া অন্ধকার প্রান্তর, কখনও দেখল রাতের আকাশ। ওর মনে লক্ষ কথার ভিড়, লক্ষ ঘটনার ইশারা। পরিস্থিতি ওর বিচার-বুদ্ধির বাইরে চলে যাচ্ছে কেন?
প্রথমটা মনে হয়েছিল জোনাকির ছলনা। তারপর বোঝা গেল দূরাগত কোনও আলো দুটো চিতাবাঘের চোখ–দপদপ করে জ্বলছে-নিভছে। এগিয়ে আসছে সুদেশ হুদার দিকে।
স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ও লক্ষ করে যায়। অবশেষে আলোয় উচ্ছ্বাসী ঢেউ ছন্নছাড়াভাবে স্নান করিয়ে দেয় ওকে।
যাক, তুমি তাহলে সময় মতোই এসেছ, সুদেশ।
কণ্ঠস্বর আলোয় দিক থেকে আসেনি। এসেছে তার অনেকটা বাঁ-পাশ থেকে। তাই চমকে ঘুরে দাঁড়াল সুদেশ।
রাহুলদা! সুদেশ চিৎকার করে ওঠে, তুমি?
আমার প্রশ্নের উত্তর দাও, সুদেশ। এ-জায়গাটা তোমার মনে নেই? মনে থাকা উচিত। শত হোক, এখানেই তো তোমাকে কবর দেওয়া হয়েছিল।