চন্দ্রিমা মাকে আঁকড়ে বসেছিল বিছানায়। ওর বাবা করুণ মুখে ঘরের এক কোণে গদি ছেঁড়া একটা সোফায় চুপচাপ বসে রয়েছেন। চন্দ্রিমার দাদা বাড়িতে ছিল না।
তীব্র প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েও চন্দ্রিমার মা একটুও ভেঙে পড়লেন না। ভদ্রমহিলার স্থৈর্য, ব্যক্তিত্ব সুকান্তকে অবাক করছিল।
তিনি বারবার শুধু বলতে লাগলেন, চিকিৎসা করালে মিনু ঠিক হয়ে যাবে। ওর মাথায় এমন কিছু দোষ নেই।
কথাবার্তা ক্রমেই কথা কাটাকাটির চেহারা নিচ্ছিল। সুকান্ত নাটকের দর্শকের মতো সবকিছু দেখছিল, শুনছিল।
হঠাৎই কী ভেবে ও চন্দ্রিমার মায়ের কাছে এগিয়ে গেল, স্পষ্ট স্বরে বলল, মা, আমারই ভুল হয়েছে। আমি মিনুর ট্রিটমেন্ট করাব। যত যা-ই হোক, ও আমার স্ত্রী।
ছোটমামা স্তম্ভিত হয়ে সুকান্তর দিকে তাকিয়ে রইলেন। গুরুজনদের কে একজন যেন বললেন, সুকান্ত, তুমি এসব কী বলছ!
সুকান্ত কোনও কিছু ভ্রূক্ষেপ না করে চন্দ্রিমার মাকে বলল, আপনি মিনুর চিকিৎসার সব কাগজপত্র-প্রেসক্রিপশান আমাকে দিন। আমি দিল্লিতে নিয়ে গিয়ে বড়-বড় স্পেশালিস্ট দেখাব। দরকার হলে আমেরিকা নিয়ে যাব ওকে। আপনি কোনও চিন্তা করবেন না, ও সেরে উঠবেই।
ভদ্রমহিলা হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন। সুকান্তকে একেবারে জড়িয়ে ধরে মাথায় বারবার হাত বোলাতে লাগলেন। কান্না-জড়ানো গলায় বললেন, বাবা, তুমি মানুষ নও, দেবতা। তুমি মানুষ নও, দেবতা।
ভদ্রমহিলা ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। একটু পরেই দুটো মোটা ফাইল নিয়ে ফিরে এলেন। সুকান্তর হাতে ফাইল দুটো দিয়ে বললেন, এই নাও, বাবা। এতে ওর বারো বছরের সমস্ত ডাক্তারি কাগজপত্র আছে।
কথা শেষ করেই ভদ্রমহিলা সুকান্তর পায়ে লুটিয়ে পড়লেন। কাঁদতে লাগলেন অসহায়ের মতো।
সুকান্ত পা সরিয়ে নিয়ে মেডিক্যাল ফাইল দুটো এগিয়ে দিল ওর ছোটমামার দিকে। আবেগহীন গলায় বলল, এই দুটো নিয়ে গিয়ে আজই ল-ইয়ারের সঙ্গে কথা বলুন। এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর হয় না।
তারপর অপরিচিতের চোখে চন্দ্রিমার মা ও বাবার দিকে তাকিয়ে সুকান্ত বলল, আপনারা শয়তানি করে আমার লাইফটা শেষ করে দিয়েছেন। লোকের কাছে আমি মুখ দেখাতে পারছি না। যদি ভালোয় ভালোয় মেয়ের ডিভোর্স করিয়ে নেন, ভালো। নইলে কোর্টে দেখা হবে।
সুকান্তর ভেতরটা অদ্ভুত আক্রোশে টগবগ করে ফুটছিল। ওর মাথার শিরা দপদপ করছিল।
চন্দ্রিমার মা চিৎকার করে কেঁদে উঠে বললেন, বাবা, আমার মেয়েটার কী হবে?
ও এখানেই থাকবে।
ছোটমামা একটা বড় সুটকেস চন্দ্রিমার মায়ের হাতে দিয়ে বললেন, আপনার মেয়ের গয়নাগাঁটি শাড়ি-জামাকাপড়–আপনারা যা যা দিয়েছেন, সব এতে আছে। ভালো করে দেখে নিয়ে এই কাগজটায় সই করে দিন।
গোটা বাড়িটাকে বিধ্বস্ত শ্মশান করে দিয়ে সুকান্তরা ফিরে এল।
তারপর কদিন ধরে চলল উকিলের কাছে ছুটোছুটি।
ব্যাপারটাকে মোটামুটি একটা জায়গায় দাঁড় করিয়ে সুকান্ত ছন্নছাড়া মন নিয়ে চড়ে বসল দিল্লির ট্রেনে।
ট্রেন গাছপালা-মাঠঘাটের মাঝখান দিয়ে ছুটছিল। সুকান্তর মনে পড়ল চন্দ্রিমার কথা। সবকিছু যদি ঠিকঠাক হত তাহলে এখন ওর পাশে চন্দ্রিমার বসে থাকার কথা ছিল।
সুকান্তর মন খারাপ লাগছিল। আর একইসঙ্গে অস্বস্তি হচ্ছিল এই কথা ভেবে যে, কী করে ও অফিসের সহকর্মীদের মুখোমুখি হবে। কী করে রামুদাকে দেওয়া ক্যাটারিং-এর অর্ডার ক্যানসেল করবে। আর সাজানো ফ্ল্যাটটা নিয়েই বা ওর এখন কী করা উচিত।
ট্রেনের জানলা দিয়ে সুকান্ত গাছপালা দেখছিল আর এসব কথা ভাবছিল। চন্দ্রিমার মা ওকে বলেছিলেন, তুমি মানুষ নও, দেবতা। সুকান্ত কি সেই কথার মর্যাদা রাখতে পেরেছে? ও কি মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে ভদ্রমহিলার কাছ থেকে ডাক্তারি কাগজপত্রগুলো হাতিয়ে নেয়নি? কিন্তু ওঁরাও তো লুকিয়ে পাগল মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন সুকান্তর সঙ্গে!
মিনুকে ঘিরে সুকান্ত অনেক দূর পর্যন্ত স্বপ্ন দেখে ফেলেছিল। এখন ও স্বপ্নের রঙিন টুকরোগুলোকে মনে-মনে হাত নেড়ে উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করছিল। ওগুলো শিমুল তুলো হয়ে ভেসে যাচ্ছিল বাতাসে। আর ট্রেন ছুটে চলেছিল অক্লান্তভাবে।
.
রাতে ফ্ল্যাটে পৌঁছে মালপত্র এদিক-ওদিক রেখে সুকান্ত কিছু না-খেয়েই শুয়ে পড়েছিল বিছানায়। ডবল-বেড বিছানায় খালি অংশটা ওকে বারবার বিব্রত করছিল। অন্ধকারে প্রায় ঘণ্টাখানেক এপাশ-ওপাশ করার পর ও ঘুমিয়ে পড়ল।
রাতে স্বপ্নের ভেতরে মিনু ওকে গান শোনাল : রূপে তোমায় ভোলাব না, ভালোবাসায় ভোলাব..
কখনও ওর মনে হল, মিনু ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলছে! এ কী, তুমি কাঁদছ কেন?
সুকান্ত স্বপ্নের মধ্যেই কেঁদে ফেলল।
সকালে ঘুম থেকে উঠে ও এদিক-ওদিক ফেলে রাখা সুটকেসগুলো টেনে নিয়ে এল বিছানার কাছে। ওগুলো খুলে জিনিসপত্র গোছগাছ করতে শুরু করল।
খালি ফ্ল্যাটে ছোটখাটো প্রত্যেকটা শব্দ কেমন ফাপা শোনাচ্ছিল। সুকান্তর কিছু ভালো লাগছিল না।
হঠাৎই একটা ধুতির ভাঁজ থেকে একটা কাগজ খসে পড়ল বিছানার। কাগজটা তুলে নিয়ে দেখল সুকান্ত।
মিনুর সেই চিঠি
বৃষ্টি ভালোবাসি,
আকাশ ভালোবাসি,
সংসার ভালোবাসি,
আর তোমাকে ভালোবাসি।
–চন্দ্রিমা।
চিঠিটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল সুকান্ত। মিনু বলেছিল, এই চাররকম ভালোবাসা দিয়ে ওকে ঘিরে রাখবে। ঘরের চার দেওয়ালের দিকে তাকাল সুকান্ত। মিনুকে সঙ্গে নিয়ে এলে এই দেওয়ালগুলো ভালোবাসা হয়ে যেত।