তারপর কী করতে বলেছে? সুকান্তর বুকের ভেতরে একটা চাপা ঢিপঢিপ শব্দ শুরু হয়ে গিয়েছিল।
বলেছে শাড়ি-জামাকাপড় খুলতে। তুমি যা খুশি করো না কেন বাধা না দিতে।
যা খুশি বলতে?
সে আমি জানি না। মা বলেছে, আমায় কিছু করতে হবে না, যা করার তুমিই করবে।
তোমার মা তোমাকে সবকিছু শিখিয়ে দেয়?
হ্যাঁ।
আর কী শিখিয়ে দিয়েছে?
বলেছে সবসময় তোমার কাছে কাছে থাকতে। তুমি ছাড়া আর কেউ টাকাপয়সা-গয়না চাইলে না দিতে।
সুকান্তর ভেতরে একটা ভাঙচুর চলছিল। ও মিনুর কাঁধ ধরে ওকে নিজের দিকে ফেরাল। জিগ্যেস করল, আজ কী বার?
মিনু সরাসরি ওর চোখে তাকিয়ে হেসে বলল, তিন বার।
আজ কত তারিখ?
মিনু কোনও উত্তর দিল না।
বলো, আজ কত তারিখ?
মিনু গোঁজ হয়ে বলল, জানি না। মা বলেছে কম কথা বলতে। নইলে সবাই ধরে ফেলবে।
সুকান্ত দেওয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ওদিকে দেখে বলো। কাল ৩১শে জানুয়ারি ছিল। তাহলে আজ কত তারিখ?
৩২শে জানুয়ারি। একত্রিশের পর বত্রিশ। মিনু সিরিয়াস মুখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইল।
সুকান্ত আর পারল না।
মিনুকে ছেড়ে দিয়ে মুখ ঢাকল দু-হাতে।
ভগবান! কেন আমার এ সর্বনাশ করলে।
এরপর রাত চারটে পর্যন্ত মিনুকে অনেক প্রশ্ন করেছে সুকান্ত। আর মিনুর অদ্ভুত-অদ্ভুত সব উত্তর শুনেছে।
প্রশ্ন-উত্তরের পালা চলছিল আর সুকান্ত ভেতরে-ভেতরে আরও ভেঙেচুরে যাচ্ছিল। একটা পাগল করা অনুভবের মধ্যে ডুবে যেতে-যেতে সুকান্ত বুঝতে পারছিল ভেসে ওঠার কোনও আশা নেই।
একসময় সুকান্ত জিগ্যেস করেছিল, কবে থেকে তোমার এরকম মাথা খারাপ?
উত্তরে সরল মুখে সুন্দরী মেয়েটা বলেছে, ক্লাস সেভেন থেকে। তবে মা বলেছে, ডাক্তার দেখালে ঠিক হয়ে যাবে।
তোমার কি মনে হয় তুমি সেরে উঠেছ?
মিনু হেসে বলল, এইবার তো সেরে উঠব। মা বলেছে, আর যেটুকু ইয়ে আছে সেটা বিয়ের পর ঠিক হয়ে যাবে।
কীভাবে ঠিক হবে? সুকান্ত প্রশ্নটা করেছে কোনও কৌতূহল থেকে নয়। শুধু এটা দেখার জন্য যে, শেখানো তোতাপাখির বুলি মেয়েটা কতক্ষণ আওড়াতে পারে।
মা বলেছে, তুমি আদর করলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
শেষের কথাটা মিনু ঘুম-জড়ানো গলায় হাই তুলে বলল। তারপর হঠাৎই কাত হয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়, ঘুমিয়ে পড়ল।
আবছা অন্ধকার ঘরে পাথরের মতো বসে রইল সুকান্ত। আর কোনওরকম অনুভূতি ওর ভেতরে কাজ করছিল না।
একসময় চন্দ্রিমার কাছ থেকে খানিকটা দূরে শরীর এলিয়ে দিয়েছিল ও। হাতের উলটো পিঠ মাথায় রেখে এলোমেলো অনেক কথাই ভাবতে চেষ্টা করছিল।
ছোটমামা কি চন্দ্রিমাদের পাড়ায় ভালো করে খোঁজখবর নেননি? সুকান্তও তো বিয়ের আগে ওকে দেখেছে, কথা বলেছে, ওর গান শুনেছে কই কিছু তো বুঝতে পারেনি। সেই অবশ-করে দেওয়া গান এখনও সুকান্তর কানে লেগে আছে। কী প্রাণ ঢেলেই না গান করেছিল মেয়েটা! তখন ওকে সরস্বতী মনে হচ্ছিল। তা ছাড়া…।
পাখির ডাক কানে যেতেই সুকান্ত বুঝতে পেরেছে ভোর হয়েছে। ও উঠে এসেছে বারান্দায়। গতকাল রাতের কথাটা ও প্রাণপণে ভুলতে চাইছিল। চন্দ্রিমা অজান্তে ঠিকই বলেছে। গতকাল ছিল ৩২ জানুয়ারি। এমন তারিখ যা ক্যালেন্ডারে নেই। ওই দিনটা সুকান্ত নিজের জীবনের ক্যালেন্ডার থেকে মুছে ফেলতে চায়। কিন্তু সত্যি সত্যিই কি মুছে ফেলা যাবে?
এরপর অসম্ভব সময় শুরু হল।
সুকান্ত প্রথমে কথাটা জানাল ছোটমামাকে। ছোটমামার কাছ থেকে মা শোনামাত্রই বাড়িতে কান্নার রোল শুরু হয়ে গেল। তারই সঙ্গে কানাকানি, গুঞ্জন, ফিশফাশ।
সুকান্ত সারাটা দিন গুম হয়ে বসে রইল। সুধা ছলছলে চোখ নিয়ে মায়ের কাছে-কাছে থাকতে চেষ্টা করল। বাড়িতে হাজির আত্মীয়স্বজন নানান মন্ত্রণা আর পরামর্শ দিতে শুরু করল। কিন্তু এ অবস্থায় চন্দ্রিমাকে নিয়ে ঠিক কী যে করা উচিত সেটাই কেউ ঠিকমতো বলতে পারছিল না।
চন্দ্রিমা নিতান্ত উদাসীন হয়ে এঘর-ওঘর ঘুরে বেড়াতে লাগল। ও সুকান্তর কাছ ঘেঁষে থাকতে চেয়েছিল, কিন্তু সুকান্ত বিরক্তি দেখানোয় স্বামী-আজ্ঞা শিরোধার্য করে সরে গেছে।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই খবরটা বাড়ি থেকে ছড়িয়ে গেল পাড়ায়। নেমন্তন্ন খেয়ে ফিরে যাওয়া প্রতিবেশীরা রীতিমতো অবাক হল। কেউ কেউ সহানুভূতি দেখাল, কেউ বা সুকান্তর ছোটমামাকে পাত্রী দেখার ব্যাপারে অনভিজ্ঞ বলে দোষারোপ করল।
অনেক রাতে সুকান্তর সঙ্গে কয়েক প্ৰস্ত আলোচনার পর গুরুজনেরা সিদ্ধান্ত নিলেন, চন্দ্রিমাকে ওর বাপের বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে আসা হবে। সুকান্তকে সঙ্গে করে তারা চার-পাঁচজন এই অপ্রিয় দায়িত্ব পালন করতে যাবেন।
ছোটমামা এর মধ্যেই পাড়ার উকিলের সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে পরামর্শ করেছেন। তিনি বলেছেন, মেয়েটি যে অ্যাবনরম্যাল, তার প্রমাণ চাই। তা না হলে ডিভোর্স পাওয়ার অসুবিধে হতে পারে।
এইসব সমস্যা মাথায় করে পরদিন দুপুরে সুকান্তরা গেল চন্দ্রিমাদের বাড়িতে।
চন্দ্রিমাকে দেখেই ওর মা মুখে আঁচল গুঁজে কেঁদে ফেললেন।
সুকান্তর একটু-একটু খারাপ লাগছিল। কিন্তু কিছু করার নেই। ওর নিজের ওপর দিয়েও তো ঝড় কম যায়নি!
চন্দ্রিমার মা-কে ওরা প্রায় ঘিরে ধরল। প্রশ্নে-প্রশ্নে ভদ্রমহিলাকে একেবারে নাস্তানাবুদ করে তুলল।