মেয়েটির নাম চন্দ্রিমা। ডাকনাম মিনু।
কথাবার্তা বলার পর সুকান্তর মন হল, মেয়েটি ছোটমামার রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী না হলেও তার প্রায় কাছাকাছি।
মিনু লেখাপড়া খুব বেশি করেনি, তবে প্রাণ ঢেলে গান শিখেছে। সুকান্তর অনুরোধে খালি গলায় গেয়ে শোনাল, রূপে তোমায় ভোলাব না, ভালোবাসার ভোলাব।
সুকান্ত বিস্ময়-মুগ্ধ চোখে মিনুকে দেখছিল। গানের সুরটা অনেকক্ষণ ধরে লেগে ছিল ওর কানে। ও যেন অবশ হয়ে গিয়েছিল।
ওদের মুখোমুখি বসেছিল মিনু। সুকান্তর প্রশ্নের ছোট-ছোট উত্তর দিচ্ছিল আনত মুখে। মিনুর মা পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। একটু অপ্রস্তুত হেসে বললেন, ও বরাবরই কথা একটু কম বলে।
মিষ্টি মুখ ও হাসি-ঠাট্টা সেরে ফেরার পথে ছোটমামা সুকান্তকে জিগ্যেস করলেন, কী ভাগ্নে, দিন ঠিক করি?
সুকান্ত বলেছিল, করুন।
৩০ জানুয়ারি বিয়ের দিন ঠিক হল।
দিল্লির সব ব্যবস্থা পাকা করে ২২ জানুয়ারি কলকাতার ট্রেনে চড়ে বসল সুকান্ত। ওর কানে তখনও সঞ্জীব বোসের কড়া রসিকতাগুলো বাজছে।
ট্রেনের জানলা দিয়ে দূরের মাঠ-প্রান্তর দেখতে দেখতে সুকান্তর মনে হল, আর কিছুদিন পরই ও চন্দ্রিমাকে সঙ্গে নিয়ে কু-ঝিকঝিক করে ফিরবে। তারপর মধুচন্দ্রিমা।
খুশি-হুল্লোড় আর সানাইয়ের বাজনায় বিয়ে হয়ে গেল।
পরদিন নতুন বউ নিয়ে শ্রীরামপুর ফিরে এল সুকান্ত। সুধাকে ডেকে বলল, বাড়ির সকলের সঙ্গে তোর বউদির আলাপ করিয়ে দে।
সুধা মহা উৎসাহে ওর কাজে লেগে গেল। প্রথমে গোটা বাড়ি ঘুরিয়ে দেখাল মিনুকে। তারপর বাড়ির পিছনের বাগান।
খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ও মিনুকে নিজের বন্ধু করে নিল। তবে সুধা সারাক্ষণ বকবক করলেও মিনু খুব কম কথা বলছিল।
সন্ধেবেলা মায়ের কাছ থেকে নতুন একজোড়া দুল দিয়ে এল সুধা। এই দুলজোড়া গড়ানো হয়েছে নতুন বউয়ের জন্য।
কিন্তু সেই দুলজোড়া চন্দ্রিমাকে পরাতে যেতেই ও আচমকা ঝটকা মেরে মুখ ঘুরিয়ে নিল। শক্ত গলায় বলল, আমার কানের দুল খুলবে না।
সুধা একটু থতোমতো খেয়ে গেল প্রথমটা। তারপর সামলে নিয়ে বলল, তোমার বাড়ির দুলজোড়া খুলে তোমার কাছেই রেখে দাও। আর এই নতুন দুলজোড়া পরে নাও তোমার জন্যেই দাদা তৈরি করিয়েছে।
চন্দ্রিমা সুধার দিক থেকে মুখ ফিরিয়েই বসে রইল। আবার বলল, গয়না খুলব না। মা বারণ করে দিয়েছে।
সুধার ফরসা মুখ টকটকে লাল হয়ে গেল। ওর কান্না পেয়ে গিয়েছিল। কোনওরকমে কান্না চেপে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ও।
সুকান্ত তখন হেঁটে আসছিল এ ঘরের দিকে। সুধাকে ওরকমভাবে ছুটে বেরিয়ে যেতে দেখে ও অবাক হয়ে গেল।
ঘরে ঢুকে মিনুকে দেখে জিগ্যেস করল, কী হয়েছে? সুধা ওরকমভাবে চলে গেল কেন?
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মিনু বলে, কী জানি!
একটু পরে আবার বলল, আপনি আমার কাছে থাকুন। আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবেন না।
সুকান্ত হেসে মিনুর কাছে এগিয়ে এল। আশপাশে তাকিয়ে দেখল কেউ নেই। তখন ও চট করে মিনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, বোকা মেয়ে! আপনি নয়–তুমি।
মিনু বলল, ঠিক আছে। আপনি নয়, তুমি…তুমি।
সুকান্ত একটু হেসে ঘর ছেড়ে বেরোল সুধার খোঁজে। নিজের ছোটবোনটাকে ও কম ভালোবাসে না!
কিন্তু সুধা কিছুই ভাঙল না দাদার কাছে। একদিন দেখেই কাউকে বিচার করা ঠিক নয়। ও জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, সত্যি বলছি, কিছু হয়নি। তবে বউদি দেখছি তোকে ছেড়ে একদণ্ডও থাকতে চাইছে না।
শেষের কথাটা সুধা মজা করে বললেও সুকান্ত একটু অস্বস্তিতে পড়ল। কারণ সেই ফেরা থেকেই ও লক্ষ করেছে, চন্দ্রিমা প্রায় সবসময় ওর কাছে কাছে থাকছে। সুকান্তরও যে ইচ্ছেটা কম তা নয়। কিন্তু একটু ধৈর্যের পরীক্ষা তো দিতেই হবে।
সুকান্তর ধৈর্যের পরীক্ষা শেষ হল ফুলশয্যার রাতে।
ফুল দিয়ে সাজানো ঘরে ওরা দুজনে যখন একা হল তখন রাত সাড়ে বারোটা।
ঘরের জানলা-দরজা বন্ধ। শুধু পুবের বারান্দার দিকের দরজাটা খোলা। একটু পরেই সুকান্ত ওটা বন্ধ করে দেবে।
সুকান্ত মিনুর কাছাকাছি এসে বসল। নরম গলায় জিগ্যেস করল, ঠিকমত খেয়েছ তো?
মিনু মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে হাসল।
সুকান্ত এর মানে বুঝতে পারল না। অবাক হয়ে বলল, হাসির কী হল?
মিনু কোনও জবাব দিল না।
সুকান্ত এবার অন্য প্রসঙ্গে গেল।
আমাদের বাড়ি তোমার পছন্দ হয়েছে?
মিনু ঘাড় নাড়ল।
আমাকে?
মিনু আবার ঘাড় নাড়ল। শাড়ির ভাজ থেকে একটা চিঠি বের করে সুকান্তর হাতে দিল। তারপর মুখ নামিয়ে বসে রইল।
অবাক হয়ে চিঠিটা নিল সুকান্ত। খুলে পড়লঃ
বৃষ্টি ভালোবাসি,
আকাশ ভালোবাসি,
সংসার ভালোবাসি।
আর তোমাকে ভালোবাসি।
–চন্দ্রিমা।
মুক্তোর মতো সুন্দর হাতের লেখা। তার চেয়েও সুন্দর চন্দ্রিমার মুখ।
ওর দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে সুকান্ত বলল, চন্দ্রিমা, তোমার এই চার রকম ভালোবাসা দিয়ে আমাকে ঘিরে রাখবে তো?
চন্দ্রিমা মুখ নীচু করেই বলল, হ্যাঁ, রাখব। মা বারবার করে বলে দিয়েছে।
সুকান্ত একটা ধাক্কা গেল। একটা অদ্ভুত চিন্তা কালসর্পের মতো ওকে ঘিরে ধরছিল। ও উঠে গিয়ে বারান্দার দিকে দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে দিয়ে এল। তারপর ফিরে এল বিছানায়।
মিনুর একটা হাত চেপে ধরে চিঠিটা দেখিয়ে বলে, এ চিঠি কেন লিখেছ?
মা লিখিয়েছে। বলেছে ফুল দিয়ে সাজানো বিছানায় বসে তোমার হাতে দিতে।