চিঠির বক্তব্য ছিল খুব সংক্ষিপ্ত। বরানগরের একটি মেয়েকে দেখে মায়ের খুব পছন্দ হয়েছে। মা ছোটমামাকে সঙ্গে করে মেয়ে দেখতে গিয়েছিলেন। মেয়ে বেশি দূর পড়াশোনা করতে পারেনি, তবে দেখতে খুব মিষ্টি, গানও জানে। ওদের ছোট পরিবার। মেয়ের ওপরে এক দাদা আছে। সদাগরি অফিসে চাকরি করে। বোনের বিয়ে দিয়ে তারপর সে বিয়ে করতে চায়। মেয়ের বাবা পি. ডব্লিউ. ডি-তে চাকরি করতেন–দু-বছর হল রিটায়ার করেছেন। ওদের একতলা ছোটবাড়ি–তবে নিজেদের বাড়ি। মেয়ে দেখে, পরিবার দেখে ছোটমামারও খুব পছন্দ হয়েছে। এখন সুকান্ত একবার এসে দেখে গেলেই কথাবার্তা এগোনো যেতে পারে।
সুকান্তর বাবা বহু বছর ধরেই বাতের ব্যথায় কাহিল। তাছাড়া অন্যান্য রোগের উপসর্গও কম নয়। বরাবরই তিনি সব ব্যাপারে সুকান্তর ছোটমামার ওপরে নির্ভর করেন। সুতরাং বিয়ের ব্যাপারে ছোটমামাই শেষ কথা।
ছোটমামা খুব খুঁতখুঁতে মানুষ। এর আগেও অন্তত জনা দশেক পাত্রী দেখা হয়েছে। তার মধ্যে তিনজনকে মায়ের মনে ধরেছিল। কিন্তু ছোটমামা নাকচ করে দিয়েছেন। মাকে বলেছেন, কী বলো, ছোড়দি! ভাগ্নে আমার হিরের টুকরো ছেলে। ওর জন্যে পণ-টন কিছু তো চাইছি না। শুধু রূপে লক্ষ্মী আর গুণে সরস্বতী ব্যস।
মাস তিনেক আগে দিল্লি থেকে শ্রীরামপুরের বাড়িতে এসেছিল সুকান্ত। তখন ছোটমামার এই নাকউঁচু সাধের কথা জেনে মনে-মনে বেশ একটু ভয়ই পেয়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ছোটমামার পছন্দসই মেয়ে পাওয়া যাবে তো!
যাই হোক, মাকে আড়ালে পেয়ে ভাববাচ্যে নিজের সাধটা জানিয়ে দিয়েছিল সুকান্ত। বলেছিল, ছোটমামার এতটা কড়াকড়ি না করলেই কি নয়!
সুকান্তর একটি মাত্র ছোটবোন সুধা। দাদার জন্য পাত্রী খোঁজার ব্যাপারে ওর উৎসাহও কম ছিল না। বন্ধুমহলে ও বেশ ঘটা করে জানিয়ে দিয়েছিল ওর দাদার জন্য মেয়ে দেখা চলছে। সেই কারণে আশপাশের এলাকা থেকেও খোঁজখবর কম আসছিল না।
দিল্লি ফিরে এসে সুকান্ত ফ্ল্যাটের খোঁজ শুরু করে দিয়েছিল। ওর পছন্দের এলাকা ছিল কালকাজী অথবা চিত্তরঞ্জন পার্ক। অফিসের সহকর্মীদের ব্যাপারটা ও জানিয়েছিল। কারণ ও দিল্লিতে আছে মাত্র দু-বছর। অফিসে যারা আরও পুরোনো তারা নিশ্চয়ই দিল্লির আস্তানার ব্যাপারে ওর চেয়ে বেশি অভিজ্ঞ।
সুতরাং ওদের ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট অফিস জুড়ে সে এক রীতিমতো হইচই। ডেপুটি ম্যানেজার সুকান্ত রায়চৌধুরী বিয়ে করতে চলেছে, ফ্ল্যাট খুঁজছে হন্যে হয়ে–একথা জেনে গেল সবাই। লাঞ্চ আওয়ারে ওকে ঘিরেই যত জটলা।
যেমন সিনিয়ার ম্যানেজার দেশমুখ একদিন সিগারেট খেতে-খেতে বললেন, রায়চৌধুরী, তোমার বিয়ের ব্যাপারটা আর কত মিটার এগোল জানতে পারি?
সুকান্ত লজ্জা পেয়ে বলেছে, মিটার নয়, স্যার, সেন্টিমিটার।
কাছাকাছি যারা হাজির ছিল তারা হেসে উঠেছে।
অফিস ক্যান্টিনের রামুদা আগেভাগেই বলে রেখেছেন, স্যার, আপনার বিয়ের পার্টিতে ক্যাটারিং-এর অর্ডারটা যেন আমি পাই। কালীমাতার দিব্যি কেটে বলছি, এক পয়সাও লাভ রাখব না। এমন আইটেম করব না, হোল লাইফ মনে রাখবেন।
সুকান্ত নরম গলায় বলেছে, এখনও সেরকম কিছু ঠিক হয়নি, রামুদা হলে বলব।
ওদের অফিসের সিনিয়ার ড্রাফ্টম্যান সঞ্জীব বোস একদিন লাঞ্চের পর পান চিবোতে চিবোতে বলেছেন, সুকান্তবাবু, শুনলাম আপনি নাকি খোঁয়াড়ে ঢুকছেন?
খোঁয়াড়! সুকান্ত বেশ অবাক হয়েছে।
হ্যাঁ, মানে–গোয়াল বললে খারাপ শোনায় তাই খোঁয়াড় বললাম! বোসদা পানের রসে রাঙানো ঠোঁট টিপে হেসে মন্তব্য করেছেন : ওই যেমন দালাল বললে শুনতে খারাপ লাগে, অথচ ব্রোকার বললে বেশ সাহেবি-সাহেবি ব্যাপার মনে হয়।
সুকান্ত কী জবাব দেবে বুঝতে পারছিল না।
তখন ওর পাশ থেকে রমেন সান্যাল বলে উঠেছে, কেন বোসদা, বিয়ে করা মানে কি গোয়ালে ঢোকা।
বোসদা চোখ ছোট-ছোট করে পাকা-চুল টাইপিস্ট রমেন সান্যালকে কিছুক্ষণ দেখলেন। তারপর বললেন, ব্যাপারটা আসলে তাই। এতদিন আমাদের সুকান্তবাবু ছাড়া ইয়ে ছিলেন, এখন থেকে বাঁধা পড়বেন। তবে এ-বাঁধনের মজা এমন যে, খোঁটাও দেখা যায় না, দড়িও দেখা যায় না। অথচ নাকে দড়ি দিয়ে শুধু ঘুরপাক। অবশ্য প্রথম-প্রথম ব্যাপারটা বেশ থ্রিলিং।
আবার হাসির রোল।
সুকান্তর অফিসের পরিবেশটা এত ভালো যে, সবাই যেন ওর আপনজন। আর সেই আপনজনদের তদারকিতে মায়ের চিঠি পাওয়ার মাসখানেকের মধ্যেই ওর সবকিছু গোছানো হয়ে গেল।
চিত্তরঞ্জন পার্কে নতুন ফ্ল্যাট, আধুনিক আসবাবপত্র দিয়ে সেটা সাজানো, সংসার করার জিনিসপত্র কেনা, এ-সবকিছুর সঙ্গে সঙ্গে টিভি-ফ্রিজ থেকে শুরু করে বালতি, কাপড় কাঁচার সাবান, এমনকী জামাকাপড় ছড়ানোর ক্লিপ পর্যন্ত কেনা হয়ে গেল।
তারপর শুধু যেন নতুন বউয়ের অপেক্ষা।
নতুন ফ্ল্যাটে থাকতে একা-একা লাগলেও সুকান্ত জানে এই নিঃসঙ্গতা আর বেশিদিন নয়। ওর কলেজ জীবনের বন্ধুদের অনেকেরই বিয়ে হয়ে গেছে। সেইজন্যেই কি ও কিছুটা অধৈর্য হয়ে উঠেছে?
বেশ কয়েকটা চিঠিপত্র চালাচালির পর দিল্লি থেকে শ্রীরামপুরে ফিরেছিল সুকান্ত। তারপর এক রবিবারের বিকেলে ছোটমামার সঙ্গে বরানগরে গিয়েছিল রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতীকে দেখতে।