ফোন করলাম টিভির দোকানে।
না, ও-নামে ওদের কাছ থেকে কেউ ইনস্টলমেন্টে টিভি কেনেনি।
রেফ্রিজারেটারের দোকানেরও সেই এক কথা। বলল, ইচ্ছে হলে আপনি নিজে এসে বিল বই দেখে যেতে পারেন।
ফোন নামিয়ে রেখে আবার জানলার কাছে এসে বসলাম।
ভাবলাম, খড়গপুরে আমার পিসি থাকে, তাকে একটা ফোন করি। কিন্তু ফোন নাম্বারটা কিছুতেই মনে পড়ছে না। আমার নাম-ঠিকানা ফোন নাম্বার লেখা ডায়েরির সব পাতাই সাদা। শুধু মলাটে আমার নামটা বড়-বড় হরফে জুলজুল করছে–অন্তত এখনও।
নাম। শুধু নামটাই এখন আমার শেষ সম্বল। এখন আমি কী করি?
সবকিছুই এত সহজ-সরল যে, আমার করার কিছু নেই। শুধু চুপচাপ বসে আমাকে এর শেষ দেখে যেতে হবে।
আজ আবার অ্যালবামটা নিয়ে বসেছি। দেখেছি সব ছবিই কেমন অদ্ভুতভাবে বদলে গেছে। কোনও ছবিতেই কোনও লোক নেই–শুধু আমি ছাড়া।
রীণার ছবি নেই, আত্মীয়স্বজন কারও ছবি নেই। যাঃ শালা!
আমার বিয়ের ছবিতে গলায় মালা, মাথায় টোপর পরে আমি একাই। একটা রজনীগন্ধার মালা আমার পাশে শূন্যে ঝুলছে।
বিয়ের সময় কৃতান্ত রীণাকে একটা সুন্দর টেবিল-ঘড়ি প্রেজেন্ট করেছিল। তখন সমীর ফটো তুলেছিল। এখন সেই ছবিতে কেউ নেই–শুধু শূন্যে ভেসে থাকা টেবিল-ঘড়িটা ছাড়া।
বুঝলাম, আমার ক্যামেরা কেনার আর কোনও দরকার নেই।
সোমবার। সকাল।
সমীরকে পাঠানো চিঠিটা Not Found ছাপ মারা।
পিওনের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছিলাম, পারিনি। আমি নেমে আসার আগেই নীচতলার ডাকবাক্সে চিঠি ফেলে সে চলে গেছে। জানলা থেকে তাকে দেখেই বুঝেছি, সে আমার সম্পূর্ণ অচেনা। আগে কোনওদিন লোকটাকে আমি দেখিনি।
বাড়ির কাছাকাছি স্টেশনারি দোকানটায় গিয়েছিলাম। দোকানদার আমাকে চিনতে পারল। কিন্তু তাকে রীণার কথা জিগ্যেস করতেই বলল, আর ঠাট্টা করবেন না। আপনি নিজেই কতদিন আমাকে বলেছেন, বিয়ে-ফিয়ে লেখকদের জন্যে নয়। ওই একটি ভুল জীবনে করছি না।
আর একটা মাত্র উপায় আমার হাতে রয়েছে। প্রচণ্ড ঝুঁকি থাকলেও কাজটা আমাকে করতেই হবে। বাড়ি ছেড়ে আমাকে একবার এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে যেতে হবে। সেখানে আমার, রীণার, দুজনেরই কার্ড করা ছিল। অনেকবার রিনিউ-ও করেছি। ওদের কাছে নিশ্চয়ই খাতাপত্র থাকবে, তাতে নিশ্চয়ই আমার সম্পর্কে বেশ কিছু ইনফরমেশান লেখা থাকবে। এই বিপন্ন মুহূর্তে ওরাই আমার একমাত্র ভরসা।
রোজনামচা লেখা এই ডায়েরিটাও সঙ্গে নিচ্ছি। এটা আমি হারাতে চাই না। এটা হারিয়ে গেলে, আমি যে পাগল নই সেটা আমাকে কে মনে করিয়ে দেবে? এই দুনিয়ায় এটাই হবে আমার একমাত্র সান্ত্বনা।
সোমবার।
বাড়িটা হাওয়া হয়ে গেছে। কাছাকাছি একটা রেস্তোরাঁয় বসে আছি।
এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ থেকে ফিরে এসে খানিকটা ফাঁকা জায়গা দেখতে পেলাম। কয়েকটা ছেলে সেখানে খেলা করছিল। ওদের ডেকে জিগ্যেস করলাম, এখানে যে বাড়িটা ছিল তার কী হল। ওরা বলল, ছোটবেলা থেকেই বরাবর এ-মাঠে ওরা খেলছে।
এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে জেনেছি, আমার বা রীণার সম্পর্কে ওরা কিছু জানে না। ওদের কাছে কোনও রেকর্ডও নেই–কোনওদিন ছিল না।
অর্থাৎ, আমি বর্তমানে আর কেউ নই। এখন যেটুকু আমার আছে তা হল এই শরীরটা– আর তার ওপরে জড়ানো পোশাক। আমার অফিসের আইডি কার্ড, ছবি, সব মানিব্যাগ থেকে উধাও হয়ে গেছে।
ঘড়িটাও হাতে আর নেই। সরাসরি কবজি থেকে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। মনে আছে, রীণা ওটা আমাকে প্রেজেন্ট করেছিল।
ঘড়ির উলটোদিকে খোদাই করে কয়েকটা কথা লেখা ছিল। আমার মনে আছে–এখনও।
তোমাকে– রীণা।
জটিল চিন্তার হাত থেকে মনকে রেহাই দিতে এক কাপ ক–।
৩২শে জানুয়ারির রাত
ভোর হতেই দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে সুকান্ত। চোখ জ্বালা করছে। মাথা অসম্ভব ভার। সামনে ভোরের আকাশ, নারকেল আর পেয়ারা গাছের সবুজ পাতা, কয়েকটা চঞ্চল পাখি। আর ওদের পিছনেই স্নিগ্ধ সূর্য। সদ্য উঠে পড়েছে দিগন্তের আড়াল ছেড়ে।
কিন্তু সুকান্তর মনে হচ্ছিল, এটা পুব নয়, পশ্চিম দিক। লাল সূর্যটা যেন নেমে যাচ্ছে নীচের দিকে। ধীরে-ধীরে ডুবে যাচ্ছে।
সুকান্তও ডুবে যাচ্ছিল লজ্জা আর গ্লানিতে।
গতকাল ছিল ফুলশয্যার রাত। যে-রাতের কথা কোনও পুরুষ কখনও ভোলে না। অথচ সুকান্ত সেই রাতটাকে প্রাণপণে ভুলতে চাইছিল। যেন গতকালের রাতটা ওর জীবনে কখনও আসেনি।
ভুলতে চাইছিল বলেই রাতটার কথা বেশি করে মনে পড়ছিল সুকান্তর। মনে পড়ছিল ওর নতুন বউ চন্দ্রিমার কথা। চন্দ্রিমা এখন ফুল দিয়ে সাজানো নতুন বিছানায় নিষ্পাপ সরল মুখে অসহায়ভাবে ঘুমিয়ে আছে।
রাতটার কথা ভাবতে-ভাবতেই সুকান্তর বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। শত চেষ্টাতেও নিজেকে ধরে রাখতে পারল না ও। কান্না পেয়ে গেল। হাতের ওপরে মাথা রেখে ও নীরবে কাঁদতে লাগল।
কিছুক্ষণ পর কে যেন আলতো করে ভালোবাসার হাত রাখল ওর মাথায়। হাতের স্পর্শে আশ্বাস খুঁজে পেল সুকান্ত, নির্ভরতা খুঁজে পেল। ও হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করল। আর সোজা সরল মেয়েটা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। যেন স্বামীর দুঃখকষ্ট ও আন্তরিকভাবে ভাগ করে নিতে চাইছে।
সুকান্ত ভেতরে-ভেতরে ভেসে যাচ্ছিল অকূলপাথারে। ভাসতে ভাসতে পিছিয়ে যাচ্ছিল সেই দিনটাতে যেদিন ওর দিল্লির অফিসের ঠিকানায় পৌঁছে গিয়েছিল মায়ের চিঠি।