ব্যাঙ্কে গিয়ে একটা চেক লিখলাম। একটা ভালো ক্যামেরার কথা মনে রেখে টাকার অঙ্কের জায়গায় লিখলাম বারোশো টাকা। তারপর চেক আর পাশবই জমা দিয়ে টোকেন নিলাম। গিয়ে দাঁড়ালাম ক্যাশ কাউন্টারের সামনে। পরপর টোকেনের ডাক আসতে লাগল–আমারটা ছাড়া।
প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর রীতিমতো অধৈর্য হয়ে ক্যাশে বসে থাকা কর্মচারীটিকে প্রশ্ন করলাম, আমার টোকেনটা এসেছে কি না। উত্তরে যথারীতি নেগেটিভ জবাব পেলাম। সেইসঙ্গে সে কাউন্টারের মুখটা ছেড়ে দাঁড়াতে অনুরোধ করল।
অপমানটা হজম করে প্রথম কেরানিটির কাছে গেলাম, যে আমার পাশবই আর চেক নিয়ে টোকেন দিয়েছিল।
তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই একটা চাপা গালাগালের শেষ টুকরো আমার কানে এল। লোকটা সপ্রশ্ন চোখে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর তাকাল আমার পাশবইটার দিকে। দু চার পাতা উলটে তারপর বলল, মশায় কি ইয়ার্কি-প্রিয়?
তার মানে? আমার স্বর উঁচু পরদায় উঠল।
সে পাশবইটা আমার হাতে ধরিয়ে দিল, চেকটা ছিঁড়ে ফেলে দিল।
সরে দাঁড়ান, পেছনে আরও লোক রয়েছে। লোকটার নুন মাখানো গলা আমার শরীরে কেটে বসল।
মনে হয় আমি চেঁচিয়েই উঠেছিলাম। নইলে সব লোক ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাবে কেন?
কী হয়েছে বলবেন তো!
দেখলাম, সামনের টেবিল ছেড়ে আর-একজন কর্মচারী আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। চারপাশে ভিড় জমছে।
দ্বিতীয় কর্মচারীটি প্রথমজনের চেয়ে বয়স্ক। সেই কারণেই হয়তো তার গলাও একটু নরম, সহানুভূতি মাখানো।
কী হয়েছে, ভাই, গোলমাল কীসের?
এই ভদ্রলোকটিকে একটু ভদ্রতা শিখতে বলবেন? আমার অপমানিত শরীর কাঁপছে। স্বর কাঁপছে : ইনি আমার চেকটা ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছেন, পাশবই ফেরত দিয়ে দিচ্ছেন–এসবের মানে কী?
কই, দেখি আপনার পাশবইটা। বলে হাত বাড়িয়ে পাশবইটা সে নিল। তারপরই অবাক হয়ে চোখ তুলে তাকাল। একটু হেসে স্পষ্ট গলায় বলল, আপনার পাশবইয়ে একটা কালির দাগ পর্যন্ত নেই ধবধবে সাদা।
ছিনিয়ে নিলাম পাশবইটা। পাগলের মতো পাতা হাতড়ে গেলাম। বুকের ভেতর বুলডোজার চলছে।
পাশবইটাতে ব্যবহারের কোনও চিহ্নমাত্র নেই। কিন্তু…
কিন্তু কী করে এমন হল– আমি প্রায় ডুকরে উঠলাম।
যদি বলেন তা হলে অ্যাকাউন্ট নাম্বারটা আমরা চেক করে দেখতে পারি। সে বলল, আপনি বরং ভেতরে আসুন।
কিন্তু পাশবইয়ে কোনও নম্বরই নেই। সেটা দেখতে আমার ভুল হয়নি। আমার দু-চোখ। ফেটে জল বেরিয়ে এল।
না…তার আর দরকার নেই– আচ্ছন্ন পায়ে ব্যাঙ্কের দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম।
এই যে ভাই, একমিনিট–শুনুন। লোকটির গলা পেছন থেকে ভেসে এল।
আমি ছুটতে শুরু করলাম।
দুদ্দাড় করে সিঁড়ি ভেঙে নেমে এলাম রাস্তায়।
ঘরে পৌঁছে হাঁপাতে লাগলাম। দেখলাম, রীণা নেই। হয়তো পাশের ফ্ল্যাটে গেছে। রীণার ফিরে আসার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
এখনও আমি অপেক্ষা করছি, আর দেখছি পাশবইটা। দেখছি লাইন টানা খালি জায়গাটা, যেখানে আমি নিজের নাম সই করেছিলাম। ছক কাটা শূন্য ঘরগুলো–যেখানে জমা দেওয়া টাকার অঙ্ক স্পষ্ট অক্ষরে লেখা ছিল। আমাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে রীণার বাবা-মা রীণাকে ঘড়ি কেনার জন্যে চারশো টাকা উপহার দিয়েছিলেন। অফিসের মাইনে থেকে বাঁচিয়ে জমানো দেড়হাজার টাকা। পাঁচশো টাকা। সাতশো টাকা।
সব খালি।
সবকিছুই ক্রমশ খালি হয়ে যাচ্ছে। প্রথমে নাম, তারপর…।
ভাবছি, এখন পর্যন্ত এই–এর পর কী হবে?
পরে।
এখন বুঝতে পারছি।
রীণা এখনও বাড়ি ফেরেনি।
প্রতিবেশীদের কয়েকজনের ফোন-নাম্বার লেখা ছিল। সেখানে ফোন করে জানলাম, রীণা সেখানে নেই।
তখন ওর দু-একজন বন্ধুর বাড়িতে ফোন করলাম। ওদের জিগ্যেস করলাম রীণা ওখানে গেছে কি না। ওরা বলল, আমি হয়তো ভুল নাম্বারে ফোন করেছি, কারণ, রীণা নামে কাউকে ওরা চেনে না। অথচ আমার নাম বলতেই ওরা চিনতে পারল!
হতবাক হয়ে রিসিভার নামিয়ে রাখলাম।
তারপর একের-পর-এক ফোন করে চললাম। আমার মাসতুতো ভাইকে, দিদিকে, রীণার মা-কে, দাদাকে–কোনও উত্তর নেই। শুধু এনগেজড টোন। আমি জানি ১৯৯ নম্বরে ফোন করলে কী জবাব পাব–আগেও পেয়েছি। ওরাও তা হলে কৃতান্ত, নয়না, সুধাকর, রোজিকে অনুসরণ করেছে?
রবিবার।
জানি না এখন কী করব। সারাদিন জানলার ধারে বসে রাস্তার লোক চলাচল দেখেছি। দেখেছি এই আশায়, যদি চেনা কেউ আমার চোখে পড়ে। পড়েনি। প্রতিটি পথচারীই আমার অচেনা– যেমন ছিল গত রাতে টিভির পরদায় দেখা প্রতিটি শিল্পী, অভিনেতা। এমনটা আগে কখনও হয়নি।
এখন বাড়ি ছেড়ে বেরোতে আমার ভয় করছে। থাকার মধ্যে শুধু এটাই আছে। আর আছে আমাদের ফার্নিচার, জামাকাপড়।
শুধু আমার জামাকাপড়। রীণার পোশাকের আলমারি একেবারে কঁকা। আজ ভোরে ঘুম ভাঙতেই আলমারিটা খুলে দেখেছি। আমার ভয়টাই সত্যি হয়েছে।
সত্যি, পুরো ব্যাপারটা যেন ম্যাজিক। প্রত্যেকটা জিনিস কোনওরকম জানান না দিয়েই উধাও হয়ে যাচ্ছে। যেন…।
হাসি পেল। আমার নিশ্চয়ই মাথা…।
ফার্নিচারের দোকানে একবার ফোন করলাম। রোববার বিকেলে ওদের খোলা থাকে। আমার আর রীণার নাম বললাম। বললাম, দিনকয়েক আগে আমরা একটা কয়ারের গদি-ওয়ালা খাট কিনেছি।
ওরা একটু পরেই জানাল, না, ওই নামে কাউকে ওরা কোনও খাট-টাট বিক্রি করেনি।