একটা ঠান্ডা স্রোত আমার পাকস্থলী থেকে উঠে এল গলা পর্যন্ত। আমি জানি, কী হবে অপারেটারের উত্তর। এবং তাই হল।
মেয়েটা নরম গলায় জানাল, ওরকম কোনও ফোন নাম্বার নেই।
রিসিভারটা আমার হাত থেকে খসে পড়ল মেঝেতে।
শব্দ পেয়ে রান্নাঘর থেকে ছুটে এল রীণা। অপারেটর তখনও হ্যালো, হ্যালো বলছে।
তাড়াতাড়ি রিসিভারটা তুলে জায়গামতো রাখলাম।
কী হয়েছে? রীণা জানতে চাইল।
আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। জবাব দিলাম, কিছু না, রিসিভারটা হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল।
রীণা কয়েক সেকেন্ড অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে রান্নাঘরে ফিরে গেল।
বিছানায় বসতেই বুঝলাম, আমার হাত-পা ঠকঠক করে কাঁপছে।
কৃতান্ত আর সুধাকরের কথা রীণাকে বলতে আমার ভয় করছে।
ভয় করছে, কারণ যদি ও হঠাৎ বলে বসে, সাতজন্মে ওদের নাম ও কখনও শোনেনি!
শুক্রবার।
প্রসাধনী পত্রিকা সম্পর্কে আজ একটু খোঁজখবর করলাম। জানলাম, ওনামে কোনও পত্রিকা নেই– কোনওদিন ছিল না। তা সত্ত্বেও একরোখা মন নিয়ে নয়নার অফিসে গেলাম। বেরোনোর সময় রীণা বারবারই জিগ্যেস করছিল কোথায় যাচ্ছি। কিন্তু আমি কোনও জবাব না দিয়ে বেরিয়ে পড়েছি। আজ এ-রহস্যের সরাসরি হেস্তনেস্ত আমাকে করতেই হবে।
অফিসবাড়িটার একতলায় একরাশ কাঠের নেমপ্লেট লাগানো আগের দিনও প্রসাধনী নামটা সেখানে ছিল কিন্তু আজ আর দেখতে পেলাম না। নেমপ্লেটের জায়গাটা ফাঁকা।
ব্যাপারটা একেবারে আনএক্সপেক্টেড।
বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা-ফাঁকা ঠেকল, মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল।
ওই অবস্থাতেই সিঁড়ি ভেঙে উঠতে শুরু করলাম। মনে হল যেন হাওয়ায় গা ভাসিয়ে উড়ে চলেছি।
চারতলায় এসে দাঁড়ালাম। চারপাশের ঘর-দরজা সবই আমার চেনা। এখনও স্রেফ চোখ বুজে আমি বলতে পারি নয়নার অফিস কোন ঘরটায়, কোন ঘরে ও বসে বসত।
কিন্তু দেখলাম, সেখানে একটা ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি রয়েছে।
এখানে একটা ম্যাগাজিনের অফিস ছিল না? রিসেপশনিস্টের কাছে প্রশ্ন রাখলাম।
ঠিক বলতে পারছি না–অন্তত আমার তো মনে পড়ছে না। ইতস্তত করে মেয়েটি বলল। তারপর নিষ্ঠুরভাবে যোগ করল, অবশ্য আমি মাত্র বছর তিনেক এখানে জয়েন করেছি।
বাড়ি ফিরে এলাম। রীণাকে বললাম, শরীর ভালো নেই, আজ আর কোথাও বেরোব না। ও বলল, ভালোই হবে। দুজনে মিলে দিনটা বাড়িতেই কাটিয়ে দেওয়া যাবে। একটু একা থাকার ইচ্ছেয় শোওয়ার ঘরে চলে গেলাম। নতুন চোখে তাকিয়ে রইলাম নতুন কেনা কয়ারের গদিওয়ালা খাটের দিকে।
রীণা ঘরে এসে ঢুকল। যুদ্ধং দেহি দৃষ্টি নিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল।
আচ্ছা, তোমার কী হয়েছে বলো তো? ও জিগ্যেস করল, আমার কি একটুও জানার রাইট নেই?
কিছু হলে তো জানবে! ছোট্ট জবাব দিলাম।
আর মিথ্যে কথা নাই-বা বললে, ও বলল, আমি জানি, কিছু একটা হয়েছে।
ভাবলাম, ওকে সব খুলে বলি। কিন্তু এগোতে গিয়েও কী এক অজানা কারণে থেমে গেলাম। বললাম, আমাকে…আমাকে একটা চিঠি লিখতে হবে।
কাকে?
ভেতরে-ভেতরে বিরক্ত হলেও নিজেকে সামলে নিয়ে শান্ত গলায় বললাম, সমীরকে লিখব।
তা হলে তোমার সমীর-কে আমার শুভেচ্ছা জানিয়ো। আর চাকরির ব্যাপারটা নিয়ে পারলে পজিটিভ কিছু বোলো– ওর গলা ঠান্ডা। অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে।
উত্তরে কিছু একটা হয়তো বলতাম, কিন্তু তার আগেই ও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
জেদ নিয়ে বসলাম। কাঁপা হাতে চিঠিটা লিখতে শুরু করলাম। মনে হল, সমীরকে সবকিছু খুলে বলা দরকার। কারণ, পরপর ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো গোপন করার চরম সীমা ছাড়িয়ে ক্রমশ বিপজ্জনক এলাকায় চলে যাচ্ছে। ফোনে এসব কথা বলা সম্ভব নয়। সামনাসামনি বলতে আরও লজ্জা। তাই চিঠিই একমাত্র পথ।
লিখলাম, কৃতান্ত সম্পূর্ণ উধাও হয়ে গেছে। জানতে চাইলাম কৃতান্তকে ওর মনে আছে কি না।
ক্রমশ আমার কাঁপা হাত স্থির হয়ে এল। সারা শরীরে এতটুকু কাঁপুনি নেই, নেই একবিন্দু ভয়–কিংবা উত্তেজনা। আমি যেন একটা রোবট।
মানুষ যখন মরিয়া হয়ে ওঠে তখন বোধহয় এরকমটাই হয়।
শনিবার।
আমি ছুটি নিয়ে বাড়িতে বসে আছি।
এই অদ্ভুত সিচুয়েশানের জ্বলন্ত প্রমাণ দাখিল করতে কী করা যায় সেটাই মনে-মনে ভাবছিলাম। হঠাৎই মনে হল, ক্যামেরার হেল্প নিলে কেমন হয়? রীণা তো এখনও আছে আমার কাছেই আছে। রয়েছে আমার বেশ কয়েকজন আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব। যদি আমি তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে আমাদের ফটো তুলি এবং সবাইকে এক কপি করে দিয়ে দিই তা হলে সেই হারিয়ে যাওয়া র ঘটনা ঘটার পর তারা আমার কথার সলিড প্রুফ পাবে। বুঝতে পারবে, আমি মিথ্যে বলছি না।
সুধাকর অদৃশ্য হয়েছে, হয়েছে কৃতান্ত। রোজি আর নয়নার খবর তো এখন একশো বছরের পুরোনো। এখনও যদি আমি কাউকে এই অদ্ভুত ব্যাপারটা জানাতে না পারি তা হলে এই পৃথিবী আমাকে ক্ষমা করবে না।
উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ালাম। বাড়িতে ক্যামেরা নেই। একটা ছিল, সেটা ছোটভাই সাউথ ইন্ডিয়া বেড়াতে যাওয়ার সময় নিয়ে গেছে–এখনও ফেরেনি। ফিরবে কি না জানি না। কিন্তু এই মুহূর্তে একটা ক্যামেরা আর এক রোল ফিল্ম আমার চাই।
সামান্য কিছু মুখে দিয়ে শোওয়ার ঘরে গেলাম। তোশকের নীচ থেকে বের করে নিলাম ব্যাংকের চেকবই আর পাশবইটা। তারপর রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। এবার সোজা ব্যাঙ্ক। টাকা তুলতে হবে।