তাই সুধাকরের ঠিকানা আর ফোন-নাম্বার লেখা ডায়েরির পাতাটা খুললাম।
ফোন-নাম্বার তো দূরের কথা, সুধাকরের নাম-ঠিকানাও ডায়েরির পৃষ্ঠা থেকে উধাও হয়ে গেছে।
আমি কি পাগল হয়ে গেলাম? আমি শিয়ের যে, নাম-ঠিকানাটা এখানেই লেখা ছিল। একটা রেস্তোরাঁয় বসে যেদিন ওর ঠিকানা আর ফোন-নাম্বার ডায়েরিতে টুকেছি সেদিনটা এখনও আমার স্পষ্ট মনে আছে। পেনের মুখটা ফাটা ছিল বলে কয়েক ফোঁটা কালিও পাতাটায় পড়ে গিয়েছিল– আমার ভালো করে মনে আছে।
আর এখন? পাতাটা নিষ্কলঙ্ক, সাদা!
ওর নাম আমার মনে আছে, মনে আছে ওর চেহারা, ওর কথা বলার ভঙ্গি, আমাদের কলেজ-জীবনের কীর্তিকলাপ, অফ পিরিয়ডে আমাদের আড্ডার রমেটিরিয়াল–সব মনে আছে।
একবার গরমের ছুটিতে একটা চিঠিও সুধাকর আমাকে দিয়েছিল। ঘটনাচক্রে কৃতান্ত তখন ছিল আমার বাড়িতে আমার সঙ্গে গল্প করছিল। চিঠিটা রসিকতা করে গালা দিয়ে সিলমোহর করে দিয়েছিল সুধাকর। সিলমোহরে ছিল ওর নাম-লেখা আংটির উলটো ছাপ। আর চিঠির ওপরে লালকালি দিয়ে লেখা ছিল একান্ত গোপনীয়। ফচকেপনার একেবারে চূড়ান্ত।
সেই চিঠিটা খুলে দেখি তো!
আশ্চর্য! যে-ড্রয়ারে চিঠিটা বরাবর থাকত সেখান থেকে হঠাৎই যেন উধাও হয়ে গেছে।
এ ছাড়া কলেজ ক্যাম্পাসে ফ্রেশার্স ওয়েলকাম-এ তোলা আমাদের দুজনের ফটোও আমার কাছে ছিল। ছবিটা আমার অ্যালবামে সযত্নে সাঁটা ছিল–এখনও আছে। তাই ঝটপট আলমারি খুলে অ্যালবামটা বের করলাম। পাতা উলটেপালটে সেই ফটোটার পাতায় পৌঁছে গেলাম।
কিন্তু…হে ভগবান! সে-ছবিতে সুধাকরের চিহ্নমাত্র নেই। আমার ডানহাত, যেটা ওর কাঁধে রাখা ছিল, সেটা এখন শূন্যে ঝুলছে। সুধাকর যেখানে ছিল, সেখানে এখন দেখা যাচ্ছে পেছনের কলেজ-বাড়ির পোরশান।
আরও খোঁজখবর করতে আমার ভয় করছে। আমি কলেজে চিঠি লিখে অথবা দেখা করে সুধাকরের কথা জিগ্যেস করতে পারি, প্রশ্ন করতে পারি সুধাকর নন্দী নামে কেউ ওই কলেজে কখনও পড়েছে কি না।
কিন্তু সেটুকু করতেও আমি কেন জানি না ভীষণ ভয় পাচ্ছি।
বৃহস্পতিবার। বিকেল।
আজ মিশন রো-তে সমীরের পত্রিকা অফিসে গিয়েছিলাম। ওর সঙ্গে দেখা করেছি। আমাকে দেখে ও ভীষণ অবাক হল। জানতে চাইল, ওর পত্রিকা অফিসে আমার পদধুলি পড়ার কারণ।
তুই আমার অফার করা চাকরিটা নিতে এসেছিস, এ-কথা বলিস না–বিশ্বাস করব না। ও ঠাট্টা করে বলল।
আমি জিগ্যেস করলাম, সমীর, কখনও নয়না নামে কোনও মেয়ের কথা আমার মুখে শুনেছিস?
নয়না? উঁহু, মনে তো পড়ছে না।
প্লিজ, সমীর একটু মনে করে দেখ! আমি ওর নামটা অন্তত একবার হলেও তোকে বলেছি। মনে আছে, যেদিন আমি, তুই, আর কৃতান্ত অলিম্পিয়া-তে গিয়েছিলাম? সেইদিনই বোধহয় ওর কথা তোকে বলেছি।
বলেছিস? আমার কিন্তু একদম মনে পড়ছে না বিশ্বাস কর। ও বলল, কেন, কী হয়েছে মেয়েটার?
ওকে আমি খুঁজে পাচ্ছি না। আর কৃতান্ত হারামজাদা সরাসরি মেয়েটার কথা ডিনাই করে বলছে, সাতজন্মে ও নাকি ওর নাম শোনেনি।
সমীর হতভম্ভ হয়ে পড়ায় কথাগুলো স্পষ্ট করে আবার রিপিট করলাম।
তখন ও বলল, কী ব্যাপার রে? তুই বিয়ে করা মরদ অন্য মেয়ের এত খোঁজ নিচ্ছিস।
না রে, অন্য কিছু নয়, স্রেফ বন্ধু। ওকে বাধা দিয়ে বললাম, আমার কলেজের এক বন্ধুর সোর্সে ওর সঙ্গে আমার পরিচয়। উলটোপালটা কিছু ভাবিস না।
ঠিক আছে, ঠিক আছে, ওসব বাদ দে। এখন বল, আমাকে কী করতে হবে।
আমি ওদের খুঁজে পাচ্ছি না–মানে, নয়নার সঙ্গে ওর এক বন্ধুও ছিল। ওরা একেবারে উধাও হয়ে গেছে। এমনকী ওরা যে-কোনওদিন এই পৃথিবীতে ছিল, তাও আমি এস্টাবলিশ করতে পারছি না।
সমীর কাধ ঝাঁকালঃ হ্যাঁ, তাতে কী হয়েছে? তারপর জানতে চাইল ব্যাপারটা রীণা জানে কি না।
আমি প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলাম।
কাগজে খোঁজ চেয়ে অ্যাড দিবি নাকি? সমীর আবার খোঁচাল আমাকে? নাকি পুলিশে যাবি?
এরপর আর কিছু বলার নেই।
একটু পরে ওর অফিস ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। ও বড় বেশি ইন্টারেস্ট দেখাচ্ছিল। এর ফলে কী হবে বেশ বুঝতে পারছি। সমীর ওর বউকে বলবে। ওর বউ বলবে রীণাকে–এবং অ্যাটম বোম।
বাড়ি ফেরার পথে একটু অদ্ভুতভাবেই মনে হল, আমি নিজেও একটা অস্থায়ী জিনিস।
বিছানায় গা এলিয়ে দিতে গিয়ে সেই অদ্ভুত চিন্তার ভয়ংকর অর্থটা আমাকে গ্রাস করল। আর সেইসঙ্গে মনে হল, আমি যেন হাওয়ায় গা ভাসিয়ে দিয়েছি।
ইলেকট্রিক শক খেয়ে উঠে বসলাম। আমি কি পাগল হতে চলেছি? নইলে সঙ্গে-সঙ্গেই বা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ব কেন? রাস্তায় চলা এক প্রৌঢ়কে ইচ্ছে করে শুধু-শুধুই বা ধাক্কা মারব কেন? আমি বোধহয় জানতে চাইছিলাম, লোকটা আমাকে দেখতে পাচ্ছে কি না, আমার অস্তিত্বকে টের পাচ্ছে কি না। লোকটার দাঁতখিচুনি এবং গালাগালিতে আশ্বস্ত হলাম। ইচ্ছে হল, তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাই।
সত্যি লোকটার ব্যবহারে আমি কৃতজ্ঞ।
বৃহস্পতিবার। রাত।
সুধাকর নন্দীর কথা ওর মনে আছে কি না সে কথা জানতে কৃতান্তকে আবার ফোন করলাম। বাড়ি থেকেই। উত্তরে ফোন এনগেজড পেলাম। বারবার রিং করে ওই একই পি-পিঁ শব্দ! অগত্যা টেলিফোন কোম্পানির ১৯৯ ডায়াল করলাম। অপারেটার ফোন ধরতেই কৃতান্তর ফোন নাম্বারটা বললাম। কয়েক সেকেন্ড নীরবতা।