রাত হয়েছে। আজ কারফিউ হতে পারে শুনেছি। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে পুলিশের হাতে ধরা দেওয়ার কোনও মানে হয় না। চললাম, সুদেশ। মনে রাগ রেখো না।
না। রাখব না।
সুদেশের দৃষ্টির সামনে রাস্তার বাঁকে অদৃশ্য হল রাহুল দস্তিদার। ফিদার জানলার দিকে আর একবার তাকিয়ে রওনা হল সুদেশ। আজকের পরিশ্রমের ফল কী হবে সে জানে না।
তোমার জন্যে, পুতুল।–আপনমনে ভাবল সুদেশ।–যা করছি সব তোমার জন্যে। তোমাকে বাঁচানোর জন্যে।
জগদীশ আম্বাস্তা
পরের দিনটা সুদেশের পড়াশোনা, লাইব্রেরি নিয়েই কেটে গেল। বাড়ি ফিরতে সিঁড়িতে দেখা হল প্রতিবেশী সেই ভদ্রমহিলার সঙ্গে। তার চোখে-মুখে একটা বিস্রস্ত ছাপ।
মিস্টার হুদা! তাঁর গলার স্বরে ছেলে-কে তিরস্কারের ইঙ্গিত।–ওঁরা আবার এসেছিলেন– মিস্টার অ্যান্ড মিসেস গাজি। আপনি কাল ওঁদের সঙ্গে দেখা করেননি বলে খুব দুঃখ করছিলেন।
সময় পাইনি।বলল সুদেশ, দেখা করার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু পড়াশোনা নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম যে, যেতেই পারিনি।
ওঁরা কালকের প্লেনে দেশে ফিরে যাচ্ছেন। কী লজ্জার কথা বলুন তো! একবার দেখা করতে পারলেন না? ওঁরা এত আশা করে এসেছেন।
আজ রাতে দেখা করব। কোনও ভুল হবে না। আচ্ছা–ধন্যবাদ।
তাঁকে পাশ কাটিয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল সুদেশ।
ঘরে ঢুকে বইপত্র নিয়ে আবার পড়াশোনায় বসল। কিন্তু মনে চিন্তার ঘূর্ণিঝড়, কালো ঘূর্ণিঝড়।
অন্ধকার ঘন হতেই পড়াশোনায় মনোযোগ ফিকে হয়ে এল সুদেশের।
ফিদা। ফিদা জয়সওয়াল।
*
সুতরাং, সংবিৎ যখন ফিরল, তখন গতকালের মতোই ফিদাকে অনুসরণ করে চলেছে সুদেশ।
একই রাস্তা ধরে পথ চলার অভ্যেস ফিদার। ওকে খুঁজে নিতে বেশি অসুবিধে হয়নি সুদেশের। এবং আজকের অনুসরণ গত সন্ধের অ্যাকশান রিপ্লে বলা যায়। অবশেষে সেই একই রেস্তোরাঁয় গিয়ে ঢুকল ফিদা। সুদেশও ঢুকল।
জগদীশ আম্বাস্তা টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। টলোমলো পায়ে এগিয়ে গেলেন ফিদার কাছে। একটা চেয়ার নিয়ে বসলেন। ফিদা এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়েছিল–সেটা এসে পৌঁছলে জগদীশ ওকে কী যেন বললেন। সুদেশ শত চেষ্টা করেও কথাগুলো শুনতে পেল না।
হঠাৎই এক হিংস্র গর্জন করে লাফিয়ে উঠলেন জগদীশ। বাঁ-হাতের মুঠোয় খামচে ধরলেন ফিদার চুল। পিছন দিকে লাথি মেরে ফেলে দিলেন নিজের চেয়ার। এবং ডানহাতে গরম চায়ের কাপ তুলে নিয়ে ছুঁড়ে দিলেন ফিদার মুখে।
একটা জান্তব চিৎকার বেরিয়ে এল ফিদার গলা চিরে। রেস্তোরাঁর সব লোক ত্রাসে বিস্ময়ে ওদের দিকে তাকিয়ে। জগদীশের লাথি-ঘুসি এখন অবাধে ছিটকে পড়ছে ফিদার শরীরে।
শালা, বিপ্লব। গর্জে উঠলেন জগদীশ আম্বাস্তা। নীতুকে দেখে শিক্ষা হয়নি? চল সালা! তোকে বিপ্লব দেখাচ্ছি।
তার পরেই শুরু হল জগদীশের অশ্রাব্য খিস্তি।
অন্যান্য খদ্দেরের মতো সুদেশও উঠে দাঁড়িয়েছে। ওর হাত চলে গেছে পকেটে। রিভলভারের খোঁজে। পিছন থেকে কে যেন ওর হাত চেপে ধরল।
এক ঝটকায় ফিরে তাকাল সুদেশ।
রাহুলদা। রাহুল দস্তিদার।
কেটে পড়ো এখান থেকে।–চাপা গলায় বলল রাহুল। তারপর কোলাহল আর ভিড়ের মাঝে মিলিয়ে গেল।
সুদেশ জানে, আগামীকালই হয়তো বড় রাস্তায় পড়ে থাকবে ফিদা জয়সওয়ালের বডি।
প্রথম নীতু মেহতা। দ্বিতীয় ফিদা। তিন নম্বর কে?
আশপাশে তাকিয়ে রাহুলকে একবার খুঁজল সুদেশ। পেল না।
পুতুল এখন কোথায়? ভাবতে-ভাবতে বাড়ির দিকে পা চালাল ও।
পুতুল বক্সী
মাথা নীচু করে গভীর চিন্তা নিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে চলেছিল সুদেশ, হঠাৎই আলোর ঝলক চোখে পড়তেই মুখ তুলল। একটা গাড়ি এগিয়ে আসছে ওর মুখোমুখি। তীব্র হেডলাইটের আলো ঝাপটা মারছে সুদেশের চোখ-মুখে। কুঁকড়ে গেল সে। তৈরি হল বিদ্যুৎবেগে দৌড়োনোর জন্য। তখনই ভেসে এল পুতুলের মিষ্টি গলা।
সুদেশদা!
গাড়িটা দেখে সুদেশ অবাক হল। ও দেখল, ভেতরে ড্রাইভার ছাড়া পুতুল একা।
গাড়িটা পেলে কোত্থেকে?
সে জেনে কী হবে? সময়ে-সময়ে দরকার হলে পাওয়া যায়। রাহুলই জোগাড় করে দিয়েছে। এখন এসো।
পিছনের সিটে পুতুলের পাশে গিয়ে বসল সুদেশ। চোখের ইশারায় প্রশ্ন করল ড্রাইভার যুবকটিকে দেখিয়ে।
দলের ছেলে।–ওর কানের কাছে মুখ এনে বলল পুতুল।
গাড়ি চলতে শুরু করল। জনবহুল চঞ্চল এলাকা এড়িয়ে শান্ত নির্জন পথ ধরে এগিয়ে চলল ওরা। সুদেশের মনে অনেক প্রশ্ন, অনেক জিজ্ঞাসা। কিন্তু কোথায় শুরু করবে ও বুঝতে পারছে না। অবশেষে ফিদার কথাই ও বলল।
পুতুল, ফিদা ধরা পড়েছে।
জানি। জগদীশ আম্বাস্তা ধরেছে।–পুতুল বক্সীর চোখ সামনের অন্ধকার পথে স্থির।
কে বলল? রাহুলদা?
হ্যাঁ। আমাদের খতমের লিস্টে এর পরের নাম জগদীশ আম্বাস্তার। শান্ত স্বরে পুতুল বলল, রাহুলদা তোমাকে সকালে খুব খুঁজেছে, সুদেশদা।
আমি লাইব্রেরিতে ছিলাম।
আমরাও তাই ভেবেছি–যখন অন্য কোথাও তোমাকে পাইনি। বাড়িতে তো একটা খবর রেখে যেতে পারো।
কী করে জানব রাহুলদা ডাকবে। আমাকে বলেছিল, এখন কয়েকদিন আমরা একজোট হব না।
তোমার পাশের ঘরের এক ভদ্রমহিলা রাহুলকে বলেছে তুমি নাকি আজকাল বাড়িতে প্রায় থাকোই না। শুধু স্নান করতে আর খেতে যাও।
এ কটাদিন খুব পড়াশোনায় চাপ যাচ্ছে। আমাদের মিটিং-এর জন্য পড়াশোনায় খুব পিছিয়ে পড়েছি। পরীক্ষায় পাশ না করতে পারলে আমার স্কলারশিপ নষ্ট হয়ে যাবে।–চোখ ফিরিয়ে পাশে বসা পুতুলের দিকে তাকাল সুদেশ।ভয় নেই, আমি পালিয়ে যাচ্ছি না।