ফিদার সামনে চায়ের কাপ। চোখ চায়ের কাপে। মন অন্য কোথাও। ওর কপালে গভীর চিন্তার রেখা। সে-চিন্তার কি নীতু মেহতা আর নাম-না-জানা ইনফরমার জায়গা করে নিয়েছে? ভাবল সুদেশ। একটা থামের আড়ালে একটা টেবিলে বসেছে সুদেশ। গোপনে লক্ষ রাখছে ফিদা জয়সওয়ালের ওপর।
চায়ের কাপে টোকা মারছিল সুদেশ। তখনই সে দেখতে পেল জগদীশ আম্বাস্তাকে।
নেশা করা চোখ নিয়ে কালো জলহস্তীমার্কা জগদীশ আম্বাস্তা রেস্তোরাঁয় ঢুকেছেন। তার বেজির মতো চঞ্চল চোখ পিছলে যাচ্ছে প্রতিটি লোকের মুখে। পুলিশ বিভাগের চরম কুখ্যাত অফিসার জগদীশ আম্বাস্তা। রাহুল দস্তিদারের দলে ঢোকার কয়েকদিন পরেই জগদীশকে চিনিয়ে দিয়েছিল রাহুলদা। গোয়েন্দা-পুলিশের দলে সবচেয়ে নৃশংস স্যাডিস্ট এই জগদীশ। বিপ্লব সফল হলে তাঁর জন্য বিশেষ পুরস্কার তাকে তুলে রেখেছে রাহুলদা। নীতু মেহতার করুণ ধ্বংসের মুলে জগদীশ আছেন বলেই সকলের ধারণা।
জগদীশ সাদা পোশাকে আছেন। গিয়ে বসলেন ফিদার মুখোমুখি। ফিদার শরীর হাই ভোল্টেজ শকে শিউরে উঠল–সেকেন্ডের ভগ্নাংশের জন্য। কিন্তু সুদেশের সেটা নজর এড়াল না।
ফিদা চিনতে পেরেছে জগদীশকে।
জগদীশ পকেট থেকে একটা ছোট বোতল বের করলেন। সকলের চোখের সামনেই ভেতরের তরলটুকু গলায় ঢাললেন। জগদীশকে সকলেই চেনে। কয়েক জোড়া ভয়ার্ত চোখ ছিটকে এল কুচকুচে কালো লোকটার দিকে। ফিদা চটপট ওর চা শেষ করল। তখনই জগদীশ কী যেন বললেন ওকে। তারপর বোতলটা পকেটে রেখে একটা চুরুট বের করলেন। ফিদা একটা দেশলাই এগিয়ে দিল তার দিকে। গোটাকয়েক কাঠি নষ্ট করে চুরুট ধরালেন জগদীশ। তিনি ফিদাকে আরও কী যেন বললেন। কাধ কঁকিয়ে ফিদা তাকাল দরজার দিকে। জানোয়ারের মতো হাসলেন জগদীশ, খামচে ধরলেন ফিদার কাঁধ। ফিদা কাষ্ঠ হাসি হেসে উঠে দাঁড়াল। হেসে কী যেন বললেন জগদীশ। ফিদা বিল মিটিয়ে বেরিয়ে এল দোকান থেকে।
সুদেশও উঠে দাঁড়িয়ে অনুসরণ করল ফিদাকে।
ফিদা চটপট পা চালাল রাতের পথ ধরে।
নিজের আস্তানার কাছে পৌঁছে ওর চলার শব্দ আয়েশি হল। বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল ফিদা। সুদেশ অপেক্ষা করতে লাগল রাস্তায়। রাস্তার অল্প আলোয় নিজেকে লুকিয়ে রাখতে সুদেশের তেমন কষ্ট হল না। তারপর আলো জ্বলে উঠল ফিদার ঘরে।
তোমার নজরদারির প্রশংসা করতে হয়, সুদেশ।
বিদ্যুৎ ঝিলিকের মতো ঘুরে দাঁড়াল সুদেশ। ওর গলা চিরে বেরিয়ে এল এক চাপা চিৎকার– ওর অনিচ্ছা সত্ত্বেও। নিঃশব্দে পিছনে এসে দাঁড়ানো আগন্তুকের ওপর যখন চিতাসুলভ ক্ষিপ্রতায় ও ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছে, তখনই ও চিনতে পারল মানুষটাকে।
রাহুল দস্তিদার।
অল্প আলোয় ওর চশমার কাচ চকচক করছে।
রাহুলদা! তুমি এখানে কী করছ? ফিশফিশ করে বলল সুদেশ।
তোমাকেও তো একই প্রশ্ন করতে পারি।
আমি ফিদাকে ফলো করছিলাম।
আর আমি তোমাকে।
অবাক-দৃষ্টিতে রাহুল দস্তিদারের দিকে চেয়ে রইল সুদেশ। রাহুল নিঃশব্দে হাসল।
সন্ধেবেলা তোমাকে ডাকতে গিয়েছিলাম, রাহুল বলল, কিন্তু তুমি বাড়িতে ছিলে না। পাশের ঘরের এক ভদ্রমহিলা বললেন, তুমি বোধহয় কসমোপলিটান হোটেলে গেছ তোমার দেশের কোন লোকের সঙ্গে দেখা করতে। তারপর পথে তোমার দেখা পেয়ে ফলো করতে শুরু করলাম। পরে বুঝলাম, তুমি ফিদাকে ফলো করছ। সুতরাং, কোনও জানান না দিয়ে দেখতে লাগলাম কী হয়।
তুমি সবই দেখেছ তাহলে? সুদেশ জানতে চাইল, ফিদা আর জগদীশকে দেখেছ?
হ্যাঁ, দেখেছি।
তাহলে তো সবই বুঝতে পারছ।
কী বুঝতে পেরেছি?
যে ফিদাই সেই ইনফরমার!
ফিদার ঘরের জানলার আলোর দিকে রাহুল দস্তিদারের চোখ স্থির। ঠোঁটের ওপর দাঁতের সেই পুরোনো খেলা।
আজ রাতে যা দেখেছ তার জোরেই বলছ যে, ফিদা ইনফরমার?
জগদীশ আম্বাস্তা ওর সঙ্গে কথা বলেছে। সে ফিদাকে চেনে, কিন্তু ওকে অ্যারেস্ট করছে না। কেন?
আমার তো মনে হয়েছে, জগদীশ আম্বাস্তা ফিদার কাছে দেশলাই চাইছিল।
সেই দেশলাইয়ের সঙ্গে কি কোনও সাংকেতিক খবর হাতবদল হতে পারে না? চুরুট ধরাতে জগদীশের অনেক বেশি সময় লেগেছে। কোনও খবর হাতবদল করতে তার বেশি সময় লাগে না।
ফিদার ঘরের আলো নিভে গেল।
কাঁধ ঝাঁকিয়ে পকেটে হাত ঢোকাল রাহুল দস্তিদার।
তোমার কয়েকটা কথা ভাববার মতো সুদেশ। কিন্তু তা বলে ফিদা যে নির্দোষও হতে পারে সে কথা ভুলে যেয়ো না। সেই ইনফরমার অন্য কেউও হতে পারে।
রতনলাল?–অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করল সুদেশ। তারপর আরও অস্পষ্ট স্বরে যোগ করল, পুতুল?
রাহুল পকেট থেকে হাত বের করে হাওয়ায় দোলাল।
সেইজন্যেই আজ তোমার কাছে গিয়েছিলাম। ক্ষমা চাইতে। এই নয় যে, পুতুলকে আমি সন্দেহ থেকে পুরোপুরি বাদ দিয়েছি। সেটা সম্ভব নয়। কারণ, অনেকগুলো লাইফের ব্যাপার। কিন্তু তোমার সঙ্গে আমি বন্ধুত্ব রাখতে চাই, সুদেশ। আজ সন্ধেয় তুমি রাগ করে চলে গিয়েছিলে। এখন ঝগড়া করার সময় নয়। আমাদের এখন একজোট হয়ে থাকতে হবে। জগদীশ আম্বাস্তা আর গোয়েন্দা পুলিশকে দূরে রাখতে গেলে এটাই একমাত্র পথ। শুনেছি, জগদীশ টরচার করতে এক্সপার্ট। আমি চাই না, সে তার টরচারের পরীক্ষা-নিরীক্ষা আমাদের ওপর চালাক।
চারপাশে তাকাল রাহুল। অন্ধকার নির্জন রাস্তা। ঘুমিয়ে পড়া বাড়ি-ঘর। ফিদার অন্ধকার জানলা।