তাই বুঝি?–চশমার কাচের আড়ালে রাহুল দস্তিদারের চোখজোড়া ঝিকিয়ে উঠল। সুদেশ হুদার সেটা নজর এড়াল না। সুদেশ, তুমি আইন-পালানো দাগি হতে পারো। এখানকার গোয়েন্দা পুলিশ এইরকম দাগিদেরই ইনফরমার হিসেবে পছন্দ করে।
আমি? দাগি?সুদেশের বিস্ময়ে ওরা দুজনেই হেসে উঠল।
রাহুল হাত বাড়িয়ে মৃদু চাপড় মারল সুদেশের হাতে।
আমার কথাগুলো মনে রেখো, সুদেশ। আমরা কেউই সন্দেহের বাইরে নই। এমনকী আমিও।
চেয়ারে হেলান দিয়ে রাহুলের চোখে চোখ রাখল সুদেশ।
তুমি?
মাথা নাড়ল রাহুল।–কেন নয়? সেটাই তো হবে সত্যিকারের চালাকি। যে-লোকটা সব সন্দেহের বাইরে–আমি–সে-ই হল গিয়ে আসল লোক। অ্যাটাকের দিনটার কথা আমিই প্রথম জানব। আমাদের দলের হাই লেভেল লিডারদের আমিই খানিকটা হয়তো চিনি।
রাহুলদা।–সুদেশ বলল।–এসব কথা শুনতে আমার ভালো লাগছে না। আমি জানি, এই বিপ্লবের জন্য তোমার দরদ কতখানি। তুমি কখনও বিট্রে করতে পারবে না। যদি আমাদের মধ্যে ইনফরমার কেউ থেকেই থাকে, তবে সে হয় রতনলাল, নয় ফিদা।
আমার কথা তুমি ভুলে যাচ্ছ, সুদেশ। আমি বলছি, আমাদের কেউই সন্দেহের বাইরে নয়। এখনও একজন বাকি আছে যার নাম আমরা এখনও তুলিনি।
সুদেশ হুদার দু-চোখে আতঙ্ক।
অসম্ভব, রাহুলদা! পুতুল হতে পারে না।
সেও তো আমাদের একজন।–মাথা নেড়ে বলল রাহুল।
তুমি ঠাট্টা করছ।
রাহুল দস্তিদারের ঠোঁটের রেখা হিংস্র হল। বলল, নীতু মেহতার সঙ্গে কেউ ঠাট্টা করেনি।
সুদেশ হিংস্র স্বরে জবাব দিল, পুতুলকে নিয়েও ঠাট্টা চলে না।
তুমি ওকে ভালোবাসো, তাই না সুদেশ?–শান্ত গলায় বলল রাহুল, বড়ই দুঃখের কথা যে, ভালোবাসা অন্ধ হয়।
সুদেশ চোখ নামিয়ে তাকাল চায়ের কাপের দিকে। চা এখন ঠান্ডা। সুতরাং, সুদেশের জিভে বিস্বাদ ঠেকবে। ওর চোখের সামনে পুতুলের মুখ। মনে-মনে ওর ঠোঁটের স্পর্শ, শরীরের উষ্ণতা, আর একইসঙ্গে ওকে কাছে পাওয়ার ইচ্ছে…সব মিলিয়ে এক বিষণ্ণতা ঘিরে ফ্যালে সুদেশ হুদাকে। এই রাজনীতির মধ্যে পুতুলের আসার কী দরকারটা ছিল?
সুদেশের রাগ হল। হিংসা, প্রতিহিংসা, রাজনীতি, বিপ্লব–এসব পুরুষদের কাজ। পুতুল তো ওর পড়াশোনা নিয়ে থাকতে পারত, পারত না?
হঠাৎই সুদেশের মনে পড়ল, পুতুল যদি রাহুলদার দলে না থাকত তা হলে সুদেশ এখানে এসে কোনওদিনই ওর দেখা পেত না। গড়ে উঠত না ওদের এই অদ্ভুত ভালোবাসা।
হ্যাঁ, ভালোবাসি। রাহুলের দিকে চোখ রেখে সুদেশ বলল, ওকে আমি ভীষণ ভালোবাসি, রাহুলদা। সেইজন্যেই বলছি, ওকে সন্দেহ কোরো না। অন্য কাউকে সন্দেহ করো, আমাকে করো, কিন্তু ওকে না। আমাদের বন্ধুত্বকে বন্ধুত্বের মধ্যেই ধরে রাখো, রাহুলদা।
রাহুল দস্তিদারের চোখে বিষণ্ণ দৃষ্টি।
তোমার জন্যে দুঃখ হয়, সুদেশ। তোমরা ইরানিরা বড় অদ্ভুত। আমরা অন্যরকম–অন্তত আমি। কোনও মেয়ে আমার নজর কাড়ে না। এই বিপ্লবই আমার মা, বোন, বউ-সব। বলতে পারো এই বিপ্লবের সঙ্গেই আমার বিয়ে হয়েছে। সেই কারণেই পুতুল বক্সীকেও আমি সন্দেহের চোখে দেখি। সে পুরুষ কি মেয়ে তা দেখি না। আমি দেখি, সে আমাদেরই একজন, অতএব সন্দেহের বাইরে নয়।
আর কোনও কথা আমি শুনতে চাই না।–উঠে দাঁড়াল সুদেশ।
রাহুল দস্তিদার চারপাশে তাকাল। দোকানে ইতিমধ্যে আরও কয়েকজন খদ্দের ঢুকেছে।
হ্যাঁ, সেই ভালো। আমাদের কথাবার্তা ক্রমশই উঁচু পরদায় উঠছে।
চশমার কাচ ভেদ করে সুদেশের দিকে তাকাল সে। আবার আমাদের দেখা হবে… শিগগিরই…দলের ডেরায়।
কোনও কথা না বলে বেরিয়ে গেল সুদেশ হুদা।
.
সুদেশ হুদা বাড়ি ফিরতেই খবর পেল, একজন ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তারা ইরানের লোক।
আপনার দেশ থেকে এসেছেন। প্রতিবেশী মহিলা বললেন সুদেশকে। তাঁর চোখেমুখে কৌতূহলের ছাপ৷ যাতে ভুলে না যাই সেজন্যে তাদের নাম-ধাম লিখে রেখেছি–এই যে।
এক টুকরো কাগজ সুদেশের হাতে তুলে দিলেন তিনি। মিস্টার অ্যান্ড মিসেস গাজি। কসমোপলিটান হোটেল। রুম নাম্বার চারশো পাঁচ।
কাগজটা হাতের মুঠোয় দলা পাকিয়ে ফেলল সুদেশ।
কী হল, ঠিকানাটা আপনার লাগবে না?–মহিলাটি প্রশ্ন করলেন।
না। মনে থাকবে।
ওঁদের তাহলে আপনার ভালোমতো মনে আছে? ওঁরা বলছিলেন, আপনাদের ফ্যামিলির সঙ্গে নাকি ওঁদের জানাশোনা আছে। এ দেশে বেড়াতে এসে তাই ভাবছিলেন আপনার সঙ্গে একটু দেখা করে যাবেন। সত্যি, দুর-দেশে চেনা লোক পাওয়া মানে…।
হাতে স্বর্গ পাওয়া।–সুদেশের গলায় প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গের সুর।
আপনি ঠিক দেখা করবেন কিন্তু। ওঁরা অনেক করে বলে গেছেন।
কাল দেখা করব। এখন পড়াশোনা আছে। খবরটা দেওয়ার জন্যে থ্যাঙ্কস।
আলোচনায় দাঁড়ি টেনে নিজের ঘরে ঢুকে পড়ল সুদেশ।
ফিদা জয়সওয়াল
সেই রাত্রেই ফিদাকে অনুসরণ করল সুদেশ।
ফিদা ওকে দেখতে পায়নি। রাস্তায় অনেক লোকের ভিড়। সুতরাং, নিজেকে গোপন রেখে অনুসরণে কোনও অসুবিধেই হয়নি।
ফিদার চালচলন এখন খেয়ালি, উদ্দেশ্যহীন। একটা দোকান থেকে একটা কোকাকোলা কিনে গলায় ঢালতে শুরু করল সে। তারপর একটা ম্যাগাজিন-স্টলে দাঁড়িয়ে দু-একটা ম্যাগাজিনের পাতা উলটে দেখল। একটা সিনেমা হলের সামনে কিছুটা সময় কাটিয়ে একটা ছোট রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়ল ফিদা।