সুদেশ হুদা
রাহুল আর সুদেশ পুতুলকে বাসে তুলে দিল। ফিদা আর রতনলাল নিজের নিজের ডেরায় চলে গেল। পুতুলের সঙ্গে একান্তে কথা বলতে ভীষণ ইচ্ছে করছিল সুদেশের। কিন্তু নীতুর ভয়াবহ পরিণতি যেন ওদের মাঝে পাঁচিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই শুধু নীরবে হাতে চাপ দিয়ে পুতুলকে বিদায় দিয়েছে।
বাস ছেড়ে দেওয়ার পর নিজেকে ভীষণ একা মনে হল সুদেশের। মন হয়ে উঠল বিষণ্ণ। কিন্তু পরমুহূর্তেই ওর মনে পড়ল, দলের কথা, বর্তমান পরিস্থিতির কথা, নিজেদের লক্ষ্যের কথা।
রাহুল দস্তিদার সুদেশের কাঁধে হাত রাখল : চলো, সুদেশ। চায়ে একটু গলা ভেজানো যাক। কথা আছে।
সামান্য হাঁটা-পথ পেরিয়ে একটা নির্জন চায়ের দোকান ওদের চোখে পড়ল। ভেতরে ঢুকে দু-কাপ চা নিয়ে বসল দুজনে। রাহুল চায়ের কাপে ছোট্ট চুমুক দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরল।
চায়ে চুমুক দিয়ে বেশি গরম বলে মনে হল সুদেশের। অথচ গরম চা ওর প্রিয়। তবে আজ কেন…!
রাহুল সুদেশের দিকে তাকিয়ে। চশমার পিছনে ওর চোখ অগ্নিময়। সুদেশ, আমাদের ভেতর একজন ইনফরমার আছে।
সরাসরি এই মন্তব্যে সুদেশ প্রচণ্ড চমকে উঠল, কিন্তু মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিল। রাহুলের সেটা নজরে পড়ল। সে হাসল হালকাভাবে।
তুমিও যে এ-কথা ভাবোনি, সে-কথা আমাকে বলো না, সুদেশ। এ ছাড়া নীতুর অ্যারেস্ট হওয়া বা মৃত্যুর কোনও সঠিক ব্যাখ্যা নেই–থাকতে পারে না।
কিন্তু কিন্তু, এ যে অসম্ভব!
উজ্জ্বল ময়াল-চোখ সামান্য তীক্ষ্ণ হল চশমার আড়ালে।–কেন? অসম্ভব কেন?
যদি ইনফরমার কেউ থেকেই থাকে, তা হলে সে শুধু নীতুর খবরই পুলিশকে জানাল কেন? সবাইকে কেন ধরিয়ে দিল না?
মাথা নাড়ল রাহুল, ঠোঁটের ওপর তীব্র হল ওর দাঁতের কামড়। ঠিকই বলেছ, সুদেশ। হয়তো সে নীতুর খবর পুলিশকে জানাতে বাধ্য হয়েছিল। হয়তো নীতু সেই ইনফরমারকে চিনে ফেলেছিল, তাই সে নিজেকে বাঁচাতে নীতুকে ধরিয়ে দেয়।
তা হলে নীতুকে ওরকম বীভৎসভাবে টরচার করা হল কেন?
রাহুল কাঁধ ঝাঁকাল, ওর ঠোঁট শক্ত হল।–এদেশের পুলিশরা স্যাডিস্ট। একটা কসাইয়ের কর্মচারীরা এর চেয়ে বেশি কী হবে?
রাহুল দেশনেতাকে কখনও নাম ধরে সম্বোধন করে না। বলে কসাই, অথবা বিশ্বাসঘাতক। দেশের রক্তচোষা।
সেই ইনফরমার আমাদের সম্পর্কে আর নতুন কী জানতে চায়? সুদেশ প্রশ্ন করল। আমরা কী, কে, তা তো সে ভালোভাবেই জানে!
সে জানতে চায় আমাদের বিস্ফোরণের দিনটা–কোন দিন আমরা আক্রমণ করব এই দুর্নীতিভরা শাসন ব্যবস্থাকে। এ ছাড়া রয়েছে আমাদের আসল নেতাদের নাম-ঠিকানা। তাঁদের পরিচয় আমিও ঠিকঠাক জানি না। তাঁদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ একজন মিলম্যানের মাধ্যমে।
সুদেশ সতর্কভাবে লক্ষ করছে রাহুল দস্তিদারকে।
আর কাউকে তোমার এ-সন্দেহের কথা বলেছ? বলেছ ইনফরমারের কথা?
ক্ষুরধার হাসি ফুটে উঠল রাহুলের ঠোঁটে, এবং মিলিয়ে গেল।
তোমাকেই প্রথম বললাম, সুদেশ।
কেন? আমাকে কেন?
আবার সেই হাসিঃ দলের মধ্যে তুমি একটু অন্যরকম, সুদেশ। তুমি আমাদের দেশের লোক নও। এখানে পড়তে এসেছ সুদূর মিক্স ইস্ট থেকে। আমাদের দলে তোমার যোগ দেওয়ার কারণ স্পষ্ট এবং জোরালো। আমাদের বিরুদ্ধে ইনফরমারগিরির জন্যে তুমি এত কষ্ট করে আমাদের দলে আসবে এ সম্ভবনা কম। তোমার প্রাণ দেশপ্রেমীর প্রাণ।
ধন্যবাদ রাহুলদা। সুদেশ হাসল।আমি তাহলে সন্দেহের বাইরে আছি?
আমরা কেউই সন্দেহের বাইরে নই, সুদেশ।
বিশেষ কাউকে তোমার সন্দেহ হয়?
তোমার হয়?
সুদেশ চোখ ছোট করে রাহুলের দিকে তাকাল ও আমাকে দিয়ে কী বলাতে চাও, রাহুলদা?
আবার হাসি।–যে-কোনও একজনের নাম করো। মনে রাখবে, আমরা কেউই সন্দেহের বাইরে নই। সুতরাং, একজনের নাম করো। যে-কোনও একজনের।
এর কোনও মানে হয়?সুদেশ হুদা বলল, তুমি তো জানো, ফিদাকে আমি পছন্দ করি না। ওর নাম বললাম, কারণ, ওকে আমার ভালো লাগে না। ও ইনফরমার কি না জানি না– তবে হতেও পারে।
ফিদা।–আস্তে-আস্তে উচ্চারণ করল রাহুল দস্তিদার। ঠোঁট কামড়ে ধরল দাঁতে। হতে পারে। ইনফরমার আছে কি না আছে জানার আগে থেকেই ফিদাকে আমার সন্দেহ হত। বড় বেশি নার্ভাস– ওকে দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকা যায় না। দেখেছ, নীতুর খবর শুনে কীরকম লুকিয়ে পড়ার কথা বলছিল? অন্য কারও নাম বলো।
সুদেশ ইতস্তত করতে লাগল।–রতনলাল? আমার মনে হয় ইনফরমারগিরির বুদ্ধি ওর নেই।
হয়তো সেটা ওর অভিনয় হতে পারে। কারণ, কখনও কখনও ওকে বেশ বুদ্ধি খেলাতে দেখেছি। চালাকিটা চমৎকার। ওপর-ওপর এক বোকাসোকা গোবেচারা ছাত্র। নেহাতই আমার শেখানোর ঠেলায় আর পরীক্ষার হলে টোকাটুকির জোরে পাস করে। কেই-বা ওকে সন্দেহ করবে? অন্য কারও নাম কোরো, সুদেশ।
আর কে আছে?
হালকা হাসির লক্ষ্য এবার সুদেশ। সবে তো শুরু করেছ, সুদেশ।
আমি..আমি। বলল সুদেশ, কিন্তু তুমিই তো বলেছ, আমি সন্দেহের বাইরে।
ভুল করছ, সুদেশ। আমি বলেছি, আমরা কেউই সন্দেহের বাইরে নই।
সুদেশ রাহুল দস্তিদারের দিকে তাকিয়ে হাসল ও রাহুলদা, আমি কি নিজের সাফাই নিজেই গাইব? তিন মাস আগে আমি মিডল ইস্ট থেকে এসেছি। আমার পাসপোর্ট, কাগজপত্র, সব হোস্টেলের ঘরে আছে। পুলিশ কি আমার মতো একজন বিদেশিকে তোমাদের দলে ইনফরমার হিসেবে ঢোকানোর ঝুঁকি নেবে?