(খুনি) তুমি রবে নীরবে (নভেলেট)
নীতু মেহতা
নীতু মেহতার মৃতদেহটা যখন রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলা হয় তখন সুদেশ সেখানে ছিল না। কিন্তু রতনলাল ছিল। সে কথা ওদের বলতে গিয়ে ঝিকিয়ে উঠেছিল রতনলালের কালো চোখ, ঝলসে উঠছিল হিংস্র দাঁতের সারি। রাহুল দস্তিদার চাপা স্বরে শাসিয়ে উঠল, রতন, রতন, আস্তে। লোকে শুনতে পাবে।
রাহুল দস্তিদার রাহুলদা–ওদের নেতা। সবাই ওর কথা শোনে। রতনলালও শুনল।
ওরা বসেছিল একটা রেস্তোরাঁয়। ওরা যখন আলোচনার জন্য জমায়েত হয়, তখন লোকজনের ভিড়ের মাঝেই আশ্রয় খুঁজে নেয়। লুকিয়ে কোনও গোপন জায়গায় সাক্ষাৎকারের চেয়ে চোখের সামনে থাকাটাই ভালো। তাতে গোয়েন্দা-পুলিশের নেকনজরটা কম পড়ে। কিন্তু সময়ে-সময়ে যে পোড়ো আস্তানায় দেখা করতে হয় না তা নয়।
রতনলালের স্বর আলতো হল। হল আরও হিংস্র। ও বলল, নীতুর কোনও আঙুলে নখ ছিল না। আঙুলগুলো ভেঙেচুরে চৌচির। আর–আর মাথায় একটা মস্ত গজাল ছুঁড়ে ছিল।
সুদেশ হুদা কেঁপে উঠল। এ সবই ওরা জানে, আগেই কানে এসেছে। কিন্তু তবুও ওদের চোখে-মুখে ফুটে ওঠে ত্রাসের উলঙ্গ ছায়া। নীতু মেহতা ওদেরই একজন ছিল। ওকে মেরে ফেলা হয়েছে, একইসঙ্গে সেই বীভৎস মৃতদেহ রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে দলের বাকি সবাইকে।
সামনে পড়ে আছে চায়ের কাপ, ওমলেট। খাওয়ার ইচ্ছে মিলিয়ে গিয়ে গা গুলিয়ে উঠছে। চারপাশের গুঞ্জন ওদের কানে আসে না। ওরা শুধু শুনতে পায় নিজেদের হৃৎপিণ্ডের শব্দ–টিক টিক-টিক। জীবনের ঘড়ি চলছে। এখনও।
সুদেশ নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। আড়চোখে তাকায় কাছে বসা পুতুল বক্সীর দিকে। ওর মুখের রং মিলিয়ে গেছে। সুদেশ অবাক হয়। মেয়েটা কেন তাদের দলে এল? আরও অবাক হয় এই ভেবে, রাহুল দস্তিদারের দলে এসে কীভাবে ও পুতুলের প্রেমে পড়ল!
রাহুল তখন নীচের ঠোঁট কামড়াচ্ছে। অর্থাৎ, ও এখন গভীর চিন্তায় ডুবে আছে। স্টিল ফ্রেমের চশমার আড়ালে ওর চোখে এক কুৎসিত দ্যুতি।
রাহুলের চেহারা রোগার দিকে। শরীরে এমন কিছু শক্তিও নেই। কিন্তু সে ইউনিভার্সিটির এক তুখোড় ছাত্র এবং সুদেশের ধারণা, যে-গঠনমূলক বিপ্লব বিস্ফোরণের পথে এগিয়ে চলেছে, তার পিছনে অনেকটাই কাজ করেছে রাহুল দস্তিদারের মাথা।
এ ভালো কথা নয়, বিড়বিড় করে বলল রাহুল, এ মোটেই ভালো কথা নয়। নীতু…।
মানে নীতু ওদের কাছে গান গেয়েছে?–প্রশ্ন করল ফিদা জয়সওয়াল, পুলিশ তাহলে আমাদের খবর জানতে পেরে গেছে?
নীতু গান গাওয়ার ছেলে নয়, কঠিন স্বরে ফিদার সন্দেহের উত্তর দিল রতনলাল, ওদের হাজার টরচারেও ও মুখ খুলবে না–আমি জানি।
মানুষের টলারেট করার একটা লিমিট আছে। ফিদা মন্তব্য করল।
না, নীতু কথা কইবার ছেলে নয়। রতনলাল আবার বলল, এ আমি জান বাজি রেখে বলতে পারি।
শুকনো স্বরে মুখ খুলল রাহুল দস্তিদার, সে-বাজি শুরু হয়ে গেছে, রতন। নীতু গেছে। এবার আমাদের পালা। বাজিতে তোমার জিত হোক তা-ই সবাই চায়।
ফিদা জয়সওয়ালের চোখে সন্ত্রস্ত দৃষ্টি। যেন গোয়েন্দা-পুলিশ এখনই ওকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে।
কী করে জানব নীতু সবাইকে ফাসায়নি?–ফিদার কণ্ঠস্বর উষ্ণ, আমাদের এখন লুকিয়ে থাকাটাই ঠিক হবে।
তার মানে, নীতুর সঙ্গে যে আমাদের কানেকশান ছিল সেটা গোয়েন্দা-পুলিশকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া।–চাপা অথচ শান্ত গলায় এ-মন্তব্য পুতুল বক্সীর। ওর মুখের রং ফিরে এসেছে। সুদেশ সেটা লক্ষ করল। তেজি জেনানা! ওর সহ্য শক্তি সম্পর্কে সুদেশের অনুমানে ভুল হয়েছিল!
রাহুল প্রশংসার চোখে পুতুলের দিকে তাকাল।
পুতুল ঠিক বলেছে, ফিদা। আমাদের এখন ভয় পেলে চলবে না। এখন মাথা ঠিক রাখতে হবে।–সে তাকাল সুদেশ হুদার দিকে। পুরু লেন্সের পিছনে রাহুল দস্তিদারের চোখ জ্বলছে? তুমি কী বলো, সুদেশ? একেবারে চুপচাপ যে?
সুদেশ কাঁধ ঝাঁকাল। বলল, পুলিশকে এখনই ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই।
ফিদা জয়সওয়াল তীব্র ব্যঙ্গে বলে উঠল, হ্যাঁ, নীতু যেমন ভেবেছিল!
সাপের চোখে ফিদার দিকে তাকাল সুদেশ। ওরা পরস্পরকে মোটেই পছন্দ করে না।
সুদেশ বলল, নীতু এখন সব আলোচনার বাইরে। সব সাহায্যের বাইরে। তবে আমার ধারণা, নীতু আমাদের কথা পুলিশকে বলেনি।
রাহুল তীক্ষ্ণ কৌতূহলে সুদেশকে খুঁটিয়ে দেখছিল–নীচের ঠোঁটে দাঁতের কামড়। তারপর বলল, তোমার এ ধারণার কারণ, সুদেশ?
এ তো একদম ক্লিয়ার। নীতু যদি সব ফাঁস করে দিত, তাহলে ওর ডেডবডি রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে পুলিশ আমাদের অ্যালার্ট করে দিত না। ওরা প্রথমে আমাদের অ্যারেস্ট করত।
রাহুল দস্তিদার আঙুলে টুসকির শব্দ করল? সারা সন্ধের এই একটা দামি কথা। নীতু আমাদের নাম বলেছে কি বলেনি তার উত্তর হল, আমরা এখনও জেলের বাইরে। নীতু আমাদের নাম বলে থাকলে এতক্ষণে নীতু মেহতার দাওয়াই আমাদের ওপর চালু হয়ে যেত। নীতুকে যে হেভি অত্যাচার করে খুন করা হয়েছে, সেটা আমাদের জানিয়ে পুলিশ বোকামি করত না। রাহুলের চোখ পিছলে গেল কাছাকাছি বসা এক যুবকের ওপর। সে খেতে-খেতে হঠাৎই চোখ তুলে তাকিয়েছিল ওদের দিকে।–ঢের হয়েছে। এবার উঠে পড়া যাক। নইলে সবাই আমাদের নজর করতে শুরু করবে। আবার আমাদের দেখা হবে। তবে, কোথায়, কখন, পরে জানিয়ে দেওয়া হবে…।