.
ডাঃ সুকুমার গুপ্তের চেম্বার।
সকালের ডাকে আজ অনেকগুলো চিঠি এসেছে। ডাক্তার চিঠিগুলো একটার পর একটা খুলে পড়ছে। হঠাৎ একখানা চিঠি পড়তে পড়তে ডাক্তারের মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
ডাক্তার তাড়াতাড়ি পাশ থেকে ফোনটা তুলে নেয়, Please put me to south…. একটু পরে ওপাশ হতে কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, হ্যালো!
কে, কিরীটী নাকি?
কে, ডাক্তার? কি খবর ভাই?
সুখবর। তোর কৃষ্ণা কাবেরী দরখাস্ত করেছে—
সুখবর। দিয়ে দাও—জবাব দিয়ে দাও এখুনি। শুভস্য শীঘ্রম্।
কিন্তু—
কিন্তু আবার কি? না না—appointment দিয়ে দাও।
২. কাজ হয়ে গেল
কাজ হয়ে গেল। সুকুমারও মনে মনে যেন একটা নতুন উৎসাহ অনুভব করে। ব্যাপারটার মধ্যে সত্যিই একটা নতুনত্ব আছে। আছে একটা বৈচিত্র্য ও উত্তেজনা।
পৃথক পৃথক ভাবে sitting শুরু হলো। এক-একটা sittingয়ের জন্য ১০০ টাকা করে পারিশ্রমিকই দেওয়া হতে লাগল, যেমন কৃষ্ণা কাবেরী চেয়েছিল।
.
ডাঃ সুকুমার গুপ্তের চেম্বার।
রাত্রি আটটা হবে। প্রশস্ত একটি হলঘরের মধ্যে নানাজাতীয় বিচিত্র আসবাবপত্রে সুসজ্জিত। ঘরের মধ্যে জ্বলছে একটি ডোমে-ঢাকা নীলাভ আলো। কৃষ্ণার sitting।
একটি আরামকেদারার উপরে কৃষ্ণা অর্ধশায়িতভাবে বসে, পাশেই একটি স্ট্যাণ্ডের উপরে ভাসে রক্ষিত এক থোকা রক্তগোলাপ। ঘরের মধ্যে বায়ুস্তরে গোলাপের উগ্র একটি মিষ্টি গন্ধ ভেসে বেড়ায়। জানালার উপরে লাল রক্তবর্ণের সব ভারী পর্দা টাঙানো, বাইরের জনতার গোলমাল বা শব্দ ঘরে প্রবেশ করে না।
সুকুমার বলছিল–
আচ্ছা কৃষ্ণা দেবী, মনে করুন আপনাকে একটা particular situation বলবো এবং আপনাকে যদি সেই বিশেষ situationটিতে পড়তে হয় আপনি কি করতেন? চটপট জবাব দেবেন না—ভেবে বলুন। মনে করুন আপনি যেন কোন একটা অচেনা পথ ধরে এগিয়ে চলেছেন দিক ভুল করে। রাত্রির অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে, আশেপাশে সব নির্জন, জনপ্রাণীর চিহ্ন পর্যন্ত নেই।
সুকুমার গল্প বলে যায় কিন্তু তার স্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে সামনের বড় আর্শিটার উপরে—যার উপরে উপবিষ্ট কৃষ্ণার সম্পূর্ণ ছায়াটা প্রতিফলিত হয়েছে। কৃষ্ণার অজান্তে তার মুখের সমস্ত ভাব-বৈলক্ষণ্যই সুকুমারের দৃষ্টিতে ধরা দিচ্ছে।
সুকুমার বলতে থাকে—
আপনি চলেছেন—চলেছেন। হঠাৎ দেখলেন পথের মধ্যে একটা বিষধর সাপ ফণা তুলে দুলছে। এবং পথও সেখানে সংকীর্ণ। সাপটাকে এড়িয়ে পথ অতিক্রম করা দুঃসাধ্য। পিছনপানে ফিরে তাকালেন। একটি ছোট্ট শিশু টলতে টলতে এগিয়ে আসছে। এ অবস্থায় পড়লে আপনি কি করতেন?
কি আর করব—ছুটে পালাব! জবাব দেয় কৃষ্ণা।
আর সেই ছোট্ট শিশুটি! অসহায়—তাকে–
আপনি বাঁচলে বাপের নাম, আপনি কি করতেন? প্রাণ নিয়ে পালাতেন না?
কি জানি, হয়ত—হয়ত পালাতামই।
***
একই প্রশ্নের জবাবে দিন দুই পরে কাবেরী কিন্তু সাপের কথা শুনেই চিৎকার করে ওঠে অর্ধস্ফুটভাবে।
তারপর শিশুটির কথায় বলে, কি বিশ্রী নিষ্ঠুর গল্প আপনার ডাঃ গুপ্ত!
ডাঃ গুপ্ত হেসে ফেলে।
হাসলেন যে ডাঃ গুপ্ত? আমি কি মিথ্যা বলেছি?
ডাঃ গুপ্ত জবাব দেয় না।
.
আবার আর একদিন, ডাঃ গুপ্ত কৃষ্ণাকে প্রশ্ন করে, আচ্ছা কৃষ্ণা দেবী, প্রত্যেকেরই জীবন সম্পর্কে আমরা একটা কল্পনা বা আশা পোষণ করি মনে মনে, কেমন না?
কৃষ্ণা মৃদু কণ্ঠে জবাব দেয়, তা করি।
ডাঃ গুপ্ত বলে, বেশ। বলুন তো আপনি ভবিষ্যতের জীবন সম্পর্কে আপনি মনে মনে কি আশা পোষণ করেন? লজ্জা করবেন না কিন্তু, be frank & straightforward!
অনেক টাকাকড়ি থাকবে ব্যাঙ্কে, সচ্ছল জীবন, গাড়ি, বাড়ি, শিক্ষিত, রূপবান, স্বাস্থ্যবান স্বামী–
বলতে বলতে হঠাৎ মৃদু হেসে বলে, societyতে position না চায় কে বলুন ডাঃ গুপ্ত? স্বপ্ন আমরা সকলেই তো দেখি এবং শতকরা ৯৯টি ক্ষেত্রেই তা বাস্তবে পরিণত হয় না এই যা দুঃখ!
একটা নোটবুকে কৃষ্ণার মন্তব্যগুলো টুকে নিতে নিতে স্মিতভাবে সুকুমার বলে, অত pessimistic হচ্ছেন কেন? হয়ও তো!
কৃষ্ণা মৃদু হাসে।
পরের দিন ডাক্তারের একই প্রশ্নের জবাবে কাবেরী বলে, আকাঙ্ক্ষা বা কল্পনা বলতে আপনি কি ঠিক mean করছেন বলতে পারি না ডাঃ গুপ্ত। তবে এভাবে চাকরি করে জীবিকা উপার্জন করতে সত্যিই ভাল লাগে না। এর চাইতে–
বলুন-বলুন, dont be shy!
ছোটখাটো শান্ত সচ্ছল একটি পরিবার, সুখে দুঃখে দিন চলে যাবে, অশান্তি বা মনের গরমিল থাকবে না—তাছাড়া অভাব-অভিযোগ তো মানুষের কতকটা নিজেরই মনে সৃষ্টি করা ডাঃ গুপ্ত। শান্তি অর্থে ক্রয় করা যায় না, সেও মানুষের মনে।
ডাক্তার কাবেরীর মন্তব্যটা কৃষ্ণার মন্তব্যের পাশেই ঠিক টুকে নিতে নিতে বলে, যা বলেছেন। তবে মনকে সব সময় ঠিকভাবে যাচাই করতে গেলে দুঃখটা আমাদের বেশীর ভাগ মানসিকই বইকি।
***
দিনের পর দিন এই ধরনের আলাপ আলোচনা, দুটি সুন্দরী তরুণীর নিকটত্ব, একক সাহচর্য, তরুণ ডাক্তারের মনে রঙের ছোঁয়া লাগে বোধ হয়, অদৃশ্য মীনকেতুর ফুলশ্বর কখন বুঝি মনের একটি কোমল তারে মৃদু আঘাতে সুর জাগিয়ে যায়।
মনের আকাশে পঞ্চশরের ফুলবাণে কিসের স্পর্শ লাগে—ফুটে ওঠে কুসুমের কলি। মনের ঘরে অকারণে ভ্রমর যায় গুনগুনিয়ে। ভাল লাগে সুন্দর মুখখানি, ভাল লাগে কোন একটি কণ্ঠস্বর, চোখের চাউনি, একটি তনুর ভঙ্গিমা। মন পড়ে থাকে পায়ের সাড়ার সঙ্গীতে।