- বইয়ের নামঃ চক্রী
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
০১. সাগর-সৈকত হোটেল
ঠিক সমুদ্রের উপকূল ঘেষে ‘সাগর-সৈকত’ হোটেলটি। বলতে গেলে ছোটখাটো শহরটি যেন গড়ে উঠেছে সাগরেরই কূল ঘেষে। শহরটিতে নানা শ্রেণীর স্বাস্থ্যান্বেষীদের ভিড় ও আনাগোনা যেন লেগেই আছে। এবং একমাত্র বর্ষাকাল ব্যতীত বৎসরের বাকি সময়টা নানা জাতীয় নানা শ্রেণীর যাত্রীদের আনাগোনা চলে। মাঝে মাঝে হোটেলে স্থান পাওয়াই দুষ্কর হয়ে ওঠে। সাগর-সৈকত হোটেলটির মালিক একজন সিন্ধী। সময়টা মাঘের শেষ এবং শীত এখনো যেন বেশ আঁকড়েই বসে আছে এখানে। কিরীটীর ধারণা, শীতকালে কোনো সমুদ্র-সৈকতই নাকি রৌদ্রসেবনের প্রকৃষ্ট স্থান এবং এমন কোন স্থানে আসতে হলে নাকি মনের মত একজন সঙ্গী বা সাথী অপরিহার্য, অতএব আমাকেও সে এখানে টেনে নিয়ে এসেছে সঙ্গে করে, আমার কোন যুক্তিতেই সে কান দিতে চায়নি।
আমি অনেক করে ওকে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলাম, রৌদ্রসেবনের আমার আদৌ প্রয়োজন নেই, যেহেতু আমার জন্মগত দৈহিক কৃষ্ণবর্ণের উপরে আর এক পোঁচ কৃষ্ণ রঙ সূৰ্যদেবতার নিকট হতে আমি গ্রহণে একান্তই অনিচ্ছুক, কিন্তু আমার যুক্তি সে মেনে নিতে রাজী হয়নি, বলেছে, গায়ের রঙটাই বড় কথা নয় সুব্রত। আমাদের মাথার মধ্যে যে স্নায়ুকোষের গ্রে সেলগুলো আছে, সূর্যরশ্মির মধ্যস্থিত বেগুনী-পারের আলোর প্রভাবে সেগুলো আরো সজীব ও সক্রিয় হয়ে ওঠে। তা ছাড়া সমুদ্রের মত মনের খোরাকও কেউ দিতে পারে না। তুই দেখবি, কী আশ্চর্যরকম সক্রিয় করে তোলে রৌদ্রসেবন তোর মনকে ও চিন্তাশক্তিকে!
কিন্তু রৌদ্রসেবন তো এখানে বসেও চলতে পারে?
উহুঁ। এখানে হলে চলবে না। রৌদ্রসেবনেরও অনুপান আছে—সমুদ্রসৈকত। কিরীটী মাথা নেড়ে জবাব দেয়।
কিরীটীর যুক্তিকে হয়তো, তর্কের ঝঞ্চা তুলে কিছুক্ষণ ক্ষতবিক্ষত করতে পারতাম কিন্তু তাতেও তাকে নিরস্ত্র করা যেত না; কারণ রৌদ্রসেবন ও সমুচ-সৈকত একটা অছিলা মাত্র। মোট কথা মনে মনে কোন একটি নির্দিষ্ট জায়গা সে স্থির করেছে এবং কিছুদিনের জন্য সে সেখানে গিয়ে নিরবচ্ছিন্ন খানিকটা নিষ্ক্রিয় আরাম উপভোগ করতে চায় এবং সাথী হতে হবে আমায়। তাই বৃথা আর যুক্তিতর্কের জাল না বুনে একান্তভাবেই ওর হাতে আত্মসমর্পণ করে দিনপাঁচেক হল আমরা এই জায়গাটিতে এসে সাগর-সৈকত হোটেলে অধিষ্ঠিত হয়েছি এবং হোটেলের সামনে খোলা জায়গাটিতে বসে রীতিমত রৌদ্রসেবনও চলেছে আমাদের।
সাগর-সৈকত হোটেলটি থেকে সমুদ্র হাত-কুড়ি-পচিশের বেশী দূরে হবে না। হোটেলের বারান্দা হতে সমুদ্র একেবারে স্পষ্ট দেখা যায়—ঐ দিগন্তে আকাশ ও সমুদ্র যেন প্রীতির আনন্দে কোলাকুলি করছে। একটানা সমুদ্রের নোনা বাতাসে ভেসে আসছে যেন অবিশ্রাম নিষ্ঠুর চাপা হাসির একটা উল্লাস। সফেন তরঙ্গগুলি যেন আদি-অন্তহীন সমুদ্রের ঝকঝকে করাল দন্তপাতি। পৃথিবীর তিন ভাগ জল, একভাগ স্থল। বলতে গেলে পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ মাটি, যেটুকু সমুদ্রের বলয়গ্রাসের বেষ্টনীতে বন্দী হয়ে আছে সেটুকুও যেন গ্রাস করবার জন্য দুরন্ত নিষ্ঠুর ঐ জলধির চেষ্টার অন্ত নেই। ব্যাকুল নির্মম লক্ষ লক্ষ বাহু প্রসারিত করে মুহুর্মুহুঃ সে মাটির বুকে দুরন্ত উল্লাসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ক্ষুরধার তৃষিত লোল জিহবা দিয়ে লেহন করে নিষ্ঠুর কলহাসিতে যেন পরক্ষণেই আবার ভেঙে শতধায় গড়িয়ে ভূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে।
বেলা প্রায় সাড়ে আটটা হবে। সূর্যের তাপ এখনো প্রখর হয়নি। হোটেলের সামনেই বালুবেলার উপরে নিত্যকারের মত আমি ও কিরীটী দুটো ক্যামবিসের ফোলডিং চেয়ার পেতে কিরীটীরই নির্দেশমত শোলার হ্যাট চাপিয়ে গেঞ্জি গায়ে পায়জামা পরিধান করে যথানিয়মে রৌদ্রসেবন করছি। রৌদ্রসেবনের ফলাফল যাই হোক, শীতের সকালে সমুদ্রোপকূলে বসে রৌদ্রের তাপটুকু বেশ উপভোগই করছিলাম।
অল্প দূরেই সমুদ্র-সৈকত এবং শীতকাল হলেও নানাজাতীয় যুবা-বৃদ্ধ-পুরুষ-রমণী ও কিশোর-কিশোরী স্নানার্থী ও দর্শকদের ভিড়ে সমুদ্র-সৈকতটি আলোড়িত হচ্ছে এবং মধ্যে মধ্যে তাদের উল্লাসের সুস্পষ্ট গুঞ্জনও কানে আসছে সাগর-বাতাসে ভেসে।
হোটেলের সামনে যে জায়গাটিতে আমরা বসে আছি তাকে ছোটখাটো একটা উদ্যান বলা চলে। নানাজাতীয় পাতাবাহারের গাছ ও মরসুমী ফলের বিচিত্র রঙিন সমারোহ স্থানটিকে সত্যিই মনোরম করে রেখেছে। হোটেল থেকে যে পায়ে-চলা-পথটা বরাবর সাগর-সৈকতে গিয়ে মিশেছে, তার দু পাশে ঝাউয়ের বীথি। সাগর-বাতাসে ঝাউ গাছের পাতায় একটা করুণ কান্না যেন নিরন্তর দীর্ঘশ্বাসের মত ছড়িয়ে যাচ্ছে।
অল্পক্ষণ আগে কিরীটী তার মাথা থেকে শোলার টুপিটা খুলে একটা মোটা লাঠির মাথায় বসিয়ে পাশেই বালুর মধ্যে লাঠিটা পুতে দিয়ে আড় হয়ে আরামকেদারটার ওপরে বাম হাঁটুর উপরে ডান পা-টা তুলে দিয়ে মৃদু মৃদু নাচাচ্ছিল সামনের সাগর-সৈকতের দিকে তাকিয়ে। হাতের মুঠোয় ধরা একটা ইংরাজী উপন্যাস। হঠাৎ আমাকে সম্বোধন করে বললে, সু, ঐ সাদা ফ্লানেলের লংস ও গায়ে কালো গ্রেট কোট একটা চাপিয়ে যুবকটি এই দিকেই আসছে, স্রেফ ওর চলা দেখে এই মুহূর্তে ওর মনের চিন্তাধারার একটা study করে বলতে পারিস কিছু?
হাতের মধ্যে ধরা বাংলা বইটা বাজিয়ে কিরীটীর কথায় সামনের দিকে তাকালাম, শ্লথ মন্থর পায়ে যুবকটি এইদিকেই আসছে। একেবারে পথের ধারের ঝাউবীথি ঘেষে আসছে যুবক। মুখের রঙ শ্যামবর্ণই। মাথার একরাশ ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, বাতাসে চুলগুলো এলোমেলো হয়ে উড়ছে। চুলের সঙ্গে তেলের বা চিরুনির যে সংস্পর্শ বড় একটা নেই বোঝা যায় বিস্রস্ত রুক্ষ চুলগুলো দেখে। যুবকের দুটি হাতই পরিহিত গ্রেট কোটের দু পাশের পকেটে প্রবিষ্ট। মুখটা নিচু করে হাঁটার দরুন ভাল করে দেখা যাচ্ছে না। মনে হয় কোন কারণে যুবক যেন একটু চিন্তিতই।
ভদ্রলোকটি বোধ হয় কিছু ভাবছেন!
ভাবছেন? কী ভাবছেন? কিরীটী প্রশ্ন করে, হিত না অহিত?
চলতে চলতে ঐ সময় যুবকটি একবার সামনের দিকে দৃষ্টি তুলে তাকাল।
তা কী করে বলি, থটরীডিং তো জানা নেই!
থট রীড করতে তো বলিনি তোকে, বলেছি ভদ্রলোকের গেইট, অর্থাৎ চলাটা দেখে বলতে,—অর্থাৎ পা থেকে মাথা।
কিরীটীর মুখের কথাটা শেষ হল না, হঠাৎ কেমন একটা অস্পষ্ট শব্দ কানে এল। সেই সঙ্গে-সঙ্গেই প্রায় উপবিষ্ট কিরীটীর পাশেই লাঠির মাথায় বসানো তার শোলার টুপিটা ছিটকে গিয়ে মাটিতে পড়ল ও অস্ফুট একটা কাতর শব্দও কানে এল।
ঘটনার আকস্মিকতায় দুজনেই চমকে উঠেছিলাম। জায়গাটায় হাওয়া ছিল কিন্তু হাওয়ার বেগ এত ছিল না, যাতে করে সহসা অমন করে লাঠির মাথায় বসানো কিরীটীর টুপিটা উড়ে গিয়ে মাটিতে পড়তে পারে।
সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি, মাত্র হাত ৮।১০ ব্যবধানে একটু পূর্বে যে যুবকটিকে কেন্দ্র করে আমাদের কথাবার্তা চলছিল, সে বাঁ হাতে তার নিজের ডান কাঁধটা চেপে মাটির উপরেই বসে পড়েছে। আমি তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠে এগিয়ে গেলাম যুবকটির দিকে। তার সামনে গিয়ে পৌঁছবার আগেই যুবক উঠে দাঁড়িয়েছে, চোখে-মুখে তার সুস্পষ্ট একটা যন্ত্রণার চিহ্ন। যুবকের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি প্রশ্ন করলাম, পড়ে গিয়ে হঠাৎ কাঁধে লাগল বুঝি? পড়ে গেলেন কি করে?
আমার প্রশ্নে যুবকটি মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল। মৃদুকণ্ঠে বললে, ঠিক বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ কাঁধে যেন একটা ধাক্কা লাগতে পড়ে গেলাম আচমকা। না, তেমন কিছু লাগেনি।
হঠাৎ ধাক্কা লাগল মানে? বিস্মিত আমি প্রশ্ন করলাম।
কিরীটী ইতিমধ্যে তার টুপিটা মাটি হতে কুড়িয়ে আমাদের কাছে এসে কখন দাঁড়িয়েছে টের পাইনি। সহসা অতি নিকটে তার কণ্ঠস্বর শুনে যুগপৎ আমরা দুজনেই ফিরে তাকালাম।
মনে হচ্ছে একটা বুলেট সুব্রত!
বুলেট! সবিস্ময়ে কথাটা উচ্চারণ করে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে ঘুরে তাকালাম।
কিরীটী কিন্তু তখনও গভীর মনোযোগ সহকারে তার হস্তধৃত টুপিটা ঘুরিয়ে দেখছে এবং দেখতে দেখতেই মৃদু কণ্ঠে বললে, হ্যাঁ নিশ্চয়ই it was a bullet and that blessed bullet pierced through and through my poor hat!
এবং কথাটা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় হস্তধৃত টুপিটা আমার চোখের সামনে তুলে ধরে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে, বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি আমার কথাটা? Well see—এই দেখ!
তাকিয়ে দেখলাম কিরীটীর কথা মিথ্যা নয়, সত্যি। টুপিটার দুই দিকে দুটি গোলাকার ছিদ্র।
কিন্তু সর্বাগ্রে আপনাকে একবার দেখা দরকার। বলতে বলতে কিরীটী আমাদের সম্মুখে দণ্ডায়মান যুবকটির দিকে অগ্রসর হয়। বুঝতে অবশ্য পারছি আঘাতটা নিশ্চয়ই তেমন মারাত্মক হয়নি, তা হলেও আপনার কাঁধের ক্ষতস্থানটা একটিবার পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন। জামাটা খুলেন তো!
না না—বিশেষ কিছু হয়নি, যুবকটি কাঁধের উপর থেকে ততক্ষণে হাতটা সরিয়ে নিয়েছেন। স্মিতভাবে বললেন, ব্যস্ত হবেন না।
আপনি বলছেন কি—মানে—
আমার নাম শতদল বোস। না, ব্যস্ত হবার কিছু নেই। মৃদু হাস্যতরল কণ্ঠে জবাবটা দিলেন মিঃ বোস। এবং সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় গায়ের গরম ওভারকোটটা খুলে ফেলে দিলেন। কোটের নিচে সাদা টুইলের শার্ট ছিল। দেখা গেল মিঃ বোসের কথাই সত্য। গুলিটা তাঁর কাঁধ ছুঁয়ে গেলেও কোটের নীচে শার্ট পর্যন্তও পৌঁছয়নি। বোধ হয় সামান্য কাঁধের উপর দিয়ে ছুঁয়ে গেছে, যার ধাক্কাতেই বেমক্কা তিনি টলে পড়ে গেছেন।
যাক গে—না লেগে থাকলেই ভাল! But it was a bullet-এযাত্রা খুব বেঁচে গেছেন যা হোক। কিরীটী স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলে।
মিঃ বোস আবার কথা বলেন, কিন্তু কিছুই আমি বুঝতে পারছি না তো! আপনি বলছেন একটা বুলেট, কিন্তু কই, কোন ফায়ারিং-এর শব্দও শুনলাম না! তা ছাড়া এখানে আমাকে গুলিই বা করবে কে? এবং কেন
কে আর করবে! করেছেন অবশ্য তিনিই যিনি হয়তো এ পৃথিবীতে আপনার বেঁচে থাকাটা বাঞ্ছনীয় মনে করছেন না। তা ছাড়া ফায়ারিং-এর শব্দ বলছেন? সমুদ্রের হাওয়া ও সী-বীচের স্নানার্থীদের একটানা হৈ-হল্লার মধ্যে ফায়ারিং-এর শব্দটা না শুনতে পাওয়াটাও বিশেষ কিছু আশ্চর্য নয়। তা ছাড়া পিস্তলে সাইলেন্সারও তো লাগানো থাকতে পারে। তাতেও আপনি ফায়ারিংএর শব্দ শুনতে পাবেন না। কিন্তু কেউ না কেউ যে একটা গুলি ছুড়েছে সে বিষয়েও সন্দেহ নেই। বলতে বলতে হঠাৎ কথাটার মোড় ঘুরিয়ে কিরীটী অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়, আপনিও আমাদের মতো স্বাস্থ্যান্বেষী নাকি মিঃ বোস? না এইখানেই থাকেন?
আজ্ঞে দুটোর একটাও নয়। মাসখানেক হল বিশেষ একটা কাজে এখানে এসে আছি। ঐ দেখছেন যে দক্ষিণ দিকে পাহাড়ের ওপর বাড়িটা—ঐ বাড়িতেই আমি থাকি।
শতদলবাবুর কথা অনুসরণ করে দক্ষিণদিকে আমরা তাকালাম। সমুদ্রের কোল ঘেষে একটা ছোট পাহাড়, তারই উপরে যেন ঐতিহাসিক দুর্গের মতো বাড়িটা দূর থেকে মনে হয়। দুর্গের মতো পাহাড়ের উপরের ঐ বাড়িটার প্রতি এখানে এসে পৌঁছবার পরদিনই প্রত্যুষে কিরীটী আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। দূর হতে মনে হয় একখানা ছবি। পাহাড়টা লোকালয় হতে আধ মাইলটাক দূর তো হবেই।
কিরীটী শতদলবাবুর কথায় দূর পাহাড়ের মাথায় দুর্গের মতো বাড়িটার দিকে তখনও তাকিয়ে ছিল অন্যমনে। একসময় ঐ দিক হতে দৃষ্টি ফিরিয়ে শতদলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, অদ্ভুত জায়গায় বাড়িটা তৈরী করা হয়েছে। বাড়িটা যিনি তৈরী করেছিলেন তাঁর সম্পর্কে দুটো কথা কেউ না বললেও, স্বতঃই মনে হয়—
কী বলুন তো? সকৌতুকে শতদল প্রশ্ন করে।
প্রথমতঃ, যিনিই বাড়িটা তৈরী করে থাকুন, বিশেষ খেয়ালী-প্রকৃতির ছিলেন তিনি। দ্বিতীয়তঃ, তাঁর অর্থের অভাব ছিল না—
আশ্চর্য! সত্যি তাই। বাড়িটা আমার দাদামশাইয়ের। এককালে পূর্ববঙ্গে ওঁদের সবিস্তীর্ণ জমিদারী ছিল। যার আয় ছিল শুনেছি প্রায় বাৎসরিক লক্ষাধিক টাকা। আর দাদামশাই লোকটিও ছিলেন নিজে একজন নামকরা চিত্র ও মৃৎশিল্পী। শিল্পী রণধীর চৌধুরীর নাম শুনেছেন নিশ্চয়!
নিশ্চয়ই। শুনেছি বৈকি। অত বড় শিল্পপ্রতিভা নিয়ে আমাদের দেশে খুব কম লোকই জন্মেছেন। আপনি তাঁরই দৌহিত্র?
হ্যাঁ। তাঁর একমাত্র মেয়ের একমাত্র পুত্র। তাঁর বিরাট সম্পত্তির শেষ ও একমাত্র অবশিষ্ট তাঁর ঐ নিরালা নামক পাহাড়ের ওপরে বাড়িখানার ওয়ারিশন। মৃদু হাস্যতরল কণ্ঠে শতদল বললে।
একজন শিল্পীর জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। মূল্যের দিকে যাচাই করতে গেলে হয়তো আপনাকে হতাশই হতে হবে। কিন্তু সাগরের উপকূলে ঐ পাহাড়ের উপর নগরের কোলাহল হতে দূরে অমন একখানা বাড়ির মধ্যে যে মহামূল্যবান সৌন্দর্য-সৃষ্টির ইঙ্গিত ওর প্রতিটি গাঁথুনির মধ্যে ওতোপ্রোত হয়ে জড়িত আছে, তার মূল্য নিছক স্রেফ কাঞ্চনমুল্যে তো ধার্য করা যায় না শতদলবাবু। বিশেষ মূল্যেই যে ওর বিশেষত্ব।
শতদলবাবু কিরীটীকে বাধা দিয়ে কী বলতে উদ্যত হতে কিরীটী বলে ওঠে, না না শতদলবাবু এ সংসারে সব কিছুকেই নিছক টাকার নিক্তিতে ওজন করবেন না। এ শিল্পীর প্রতিভা আপনিও হয়তো আমার দাদার মতই শিল্প-পাগল, তাই ওই নির্জন সমুদ্রের উপকূলে জনমানবের বসতি ছাড়িয়ে পাহাড়ের উপর বাড়িখানা দূর থেকে দেখেই অত্যাশ্চর্য সৌন্দর্যের আভাস পাচ্ছেন। এবং বাড়িটার মধ্যে প্রবেশ করলে হয়তো আরও কিছু দেখতে পাবেন। কারণ বাড়ি-ভর্তি সব নর-নারীর স্ট্যাচু এবং অয়েল ও ওয়াটারকলার পেন্টিং, এ ছাড়া আর কিছু নেই। কিন্তু আমি অত্যন্ত বস্তুতান্ত্রিক লোক, অতি সাধারণ ছাপোষা মধ্যবিত্ত মানুষ, আমার কাছে ওর কী-ই বা মূল্য বলুন! শতদল হাসতে হাসতে বলে।
মানুষের মন এমনিই বিচিত্র বটে মিঃ বোসু কিন্তু মন আপনার যতই বস্তুতান্ত্রিক হোক, আপাততঃ ক্ষমা করবেন, একটা কথা আপনাকে আমি কিন্তু না বলে পারছি না—আপনার প্রাণটি নেবার জন্য কেউ-না-কেউ অত্যন্ত উদগ্রীব হয়ে উঠেছেন।
এবারই হাসালেন মশাই। আমার মত একজন অতি সাধারণ লোকের প্রাণের এমন কি মূল্য আছে বলুন তো যে সেটি নেবার জন্য কেউ উদগ্রীব হয়ে উঠবে! না আছে আমার অগাধ সম্পত্তি, না আছে এ দুনিয়ায় আমার কোন শত্রু।
হতে পারে, তবে আমার কথায় যদি বিশ্বাস করেন তাহলে জানবেন it was a pure and simple attempt on your life!
সত্যি নাকি? আমার কৌতূহলটা মাপ করবেন, আপনার নামটি জানতে পারি কি?
কিরীটী রায়। মৃদুকণ্ঠে কিরীটী জবাব দেয়।
নমস্কার। আপনিই কি বিখ্যাত সেই রহস্যভেদী কিরীটী রায়?
বিখ্যাত কিনা জানি না, তবে আমিই কিরীটী রায়। মৃদু হেসে কিরীটী জবাব দেয়।
আর উনি?
সুব্রত।
কী সৌভাগ্য, আপনার মত লোকের এখানে পদার্পণ হয়েছে অথচ জানতেও পারিনি! তা আসুন না আজ আমার বাড়িতে। রাত্রির আহারূপর্বটা গরীবের ঘরেই সারবেন।
বিলক্ষণ, সে একদিন হবেখন। তবে আজ নয়, কাল সকালের দিকে যাব, আপনার ঐ বাড়িটা দেখতে। কিরীটী জবাব দেয়।
আসবেন, নিশ্চয় আসবেন কিন্তু। শতদলবাবু অনুরোধ জানান দরদ দিয়ে।
যাব। কিন্তু আমার কথাটা মনে থাক যেন।
কি বলুন তো? শতদল সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল আবার।
একটু সাবধানে থাকবেন। আপনার আততায়ীটীর নিশানা একবার ব্যর্থ হলেও, বার বার ব্যর্থ নাও হতে পারে।
সত্যিই কি আপনার তাই সন্দেহ নাকি কিরীটীবাবু, আমার জীবনের উপরেই কেউ attempt নিয়েছিল!
কোন ভুল নেই তাতে। আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, একটু ভেবে বলুন তো—আজকের এই দুর্ঘটনার আগে আপনার অন্য কোন accident দুদশদিনের মধ্যে হয়েছে কিনা?
Accident!
হ্যাঁ, মানে কোনপ্রকার দুর্ঘটনা?
কই, এমন বিশেষ কোন ঘটনা তো আমার মনে পড়ছে না যাকে প্রাণহানিকর দুর্ঘটনার পর্যায়ে ফেলা যেতে পারে।
ভেবে দেখুন
না মশাই। তবে, কিন্তু তাকে দুর্ঘটনাই বা বলি কি করে এবং সেগুলো যে আমার জীবনের ওপরেই attempt নেওয়া হয়েছে তাই বা
কী ঘটেছিল বলুন তো?
এমন বিশেষ কিছুই নয়। এই তো পরশু রাত্রে যে ঘরে শুই—আমার ঠিক শিয়রের ধারে মাথার উপরে দেওয়ালের গায়ে মস্ত বড় একটা অয়েলপেন্টিং টাঙানো ছিল, হঠাৎ মাঝরাত্রে সেটা ছিড়ে আমার মাথার কাছেই পড়ে—অবশ্য অল্পের জন্যই আঘাত পাইনি
হুঁ। আর কোন ঘটনা ঘটেছে?
গতকাল সন্ধ্যার সময় পাহাড়ের গায়ের ঢালু পথ বেয়ে নিচে নেমে আসছি, হঠাৎ একটা বড় পাথরের চাঁই গড়াতে গড়াতে আর একটু হলে হয়তো আমার ঘাড়েই পড়ত এবং ঐ পাথরটা এসে গায়ে পড়লে একেবারে যে পিষে ফেলত তাতে কোন সন্দেহ নেই, তবে দুটো ব্যাপারই তো pure and simple accident! আমার জীবনের ওপরে attempt বলি কী করে! আপনি না বললে হয়তো মনেও পড়ত না, ভুলেই গিয়েছিলাম।
ভুলে যে যাননি তার প্রমাণ আপনার ঘটনা দুটির narration এবং আগের দুটি যেমন আপনার জীবনের উপরে attempt হয়েছিল, আজও ঠিক তেমনি চেষ্টা হয়েছিল। তিন-তিনবার নিষ্ফল হয়েছে যখন, চতুর্থবারের প্রচেষ্টা হয়তো খুব শীঘ্রই হবে। সাবধান হবেন।
কিরীটীর চরিত্রের সঙ্গে আমি যতখানি পরিচিত অনেকেই তা নয় এবং বিশেষ করে সে যখন কোন সাবধান বাণী উচ্চারণ করে, তার গুরুত্ব যে কতখানি সেও আমার চাইতে বেশী কেউ জানে না। কিন্তু শতদলবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল, তিনি যেন কিরীটীর কথায় কোন গুরুত্বই আরোপ করতে পারছেন না। সামান্য দু-চারটে কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে বুঝেছিলাম, শতদলবাবু মানুষটি বেশ দিলখোলা ও সরল প্রকৃতির। সংসারের কূটনীতি যেন তাঁকে কোনরুপে স্পর্শই করতে পারে না।
শতদল হাসতে হাসতেই এবার প্রত্যুত্তর দিলেন, আপনি যখন অত করে বলছেন মিঃ রায়, চেষ্টা করব সাবধান হতে।
হ্যাঁ, করবেন। এবং শুধু বাইরেই নয়, বাড়ির মধ্যেও সাবধানে থাকবেন।
বাড়ির মধ্যেও সাবধানে থাকব? কী বলতে চাইছেন আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না!
এই ধরুন, যে ঘরে আপনি রাত্রে শয়ন করেন সে ঘরটা ভাল করে দেখেশুনে শোবেন।
কেন বলুন তো, রাত্রেও কেউ আমার শয়নঘরে চড়াও হয়ে আমার প্রাণহানি করবার চেষ্টা করবে নাকি?
ঘরের বাইরে ও ভিতরে যখন চেষ্টা হয়েছে, সেটা কিছু অসম্ভব নয়।
সহসা এমন সময় কুড়ি-বাইশ বৎসরের অপরূপ সুন্দরী একটি তরুণী হোটেলের সিঁড়ি দিয়ে নেমে সোজা একেবারে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে শতদলবাবুকই সম্বোধন করে বললে, বাবাঃ, এতক্ষণে তোমার আসবার সময় হল? দোতলার বারান্দা থেকে তোমাকে দেখতে পেয়ে ছুটে আসছি। স্টেশনে আসনি কেন?
তরুণীর কণ্ঠস্বরে আকৃষ্ট হয়ে আমরা তিনজনেই আগন্তুক তরুণীর মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম।
এই তো, সবে সকালেই আজ তোমার চিঠি পেয়েছি রাণু—তুমি কবে এসে পৌচেছ?
কাল সকালের গাড়িতে, রাণু জবাব দেয়, কিন্তু সত্যি তুমি আজই আমার চিঠি পেয়েছ?
হ্যাঁ। কৌতুকোজ্জল দৃষ্টিতে তাকায় শতদল রাণুর মুখের দিকে। বিশ্বাস করি না। অভিমান-ক্ষরিত কণ্ঠে রাণু, জবাব দেয়।
সে হবেখন। এসো আগে এদের সঙ্গে তোমার আলাপটা করিয়ে দিই রাণু। আশ্চর্য ভাবেই এদের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল এইমাত্র। একে চেনো? বিখ্যাত রহস্যভেদী কিরীটী রায় আর ইনি সুব্রত রায়।
শতদলের কথায় রাণু, আমাদের দিকে তাকাল। কিন্তু আমাদের পরিচয় পেয়ে যে সে বিশেষ কিছু আনন্দিত হয়েছে তেমন কোন কিছু তার মুখের চেহারায় বোঝা গেল না।
তথাপি সে হাত তুলে বোধ হয় একান্ত সৌজন্যের খাতিরেই আমাদের নমস্কার জানাল।
সহসা এমন সময়ে কিরীটী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, চল, সুব্রত, সমুদ্রের ধারে একটু বেড়িয়ে আসা যাক।
বলে কাউকে কোনরুপ আর কোন কথার অবকাশ মাত্রও না দিয়ে সমুদ্রসৈকতের দিকে এগিয়ে চলল। অগত্যা কতকটা যেন বাধ্য হয়েই তাকে আমি অনুসরণ করলাম।
কিরীটীর হঠাৎ এভাবে চলে আসাটা কেমন যেন আকস্মিক ও বিসদৃশ বলেই আমার কাছে মনে হল।
কিন্তু কিরীটী বেশী দূর অগ্রসর না হয়েই সামনেই জলের একেবারে কোল ঘেষে বালুর উপরেই একটা জায়গায় হঠাৎ বসে পড়ল। আমিও পাশে বসলাম।
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। কারো মুখে কোন কথা নেই। বুঝলাম, কোন একটা বিশেষ চিন্তা আপাততঃ কিরীটীর মাথার মধ্যে ফেনিয়ে চলেছে।
জিজ্ঞাসা করলাম, কি ভাবছিস কিরীটী?
কিরীটী আনমনে সমুদ্রের দিকেই তাকিয়ে ছিল। সেই দিকেই তাকিয়ে সে বলল, পর পর দুটি আবির্ভাব। বুলেট ও নারী সুন্দরী তরুণী!
কিরীটীর কণ্ঠস্বরে এমন একটা কিছু ছিল যাতে তার মুখের দিকে না তাকিয়ে আমি পারলাম না।
০২. আবার সমুদ্রের দিকে
কিরীটী কিছুক্ষণ আবার সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে।
হঠাৎ আবার কতকটা যেন খাপছাড়া ভাবেই কিরীটী বলে উঠল, এমন সুন্দর পৃথিবী অথচ মানুষগুলোর কি বিচিত্র স্বভাব! শান্তির মধ্যে নিশ্চয় তার মধ্যে যেন ওরা কিছুতেই দিন কাটাতে চায় না!
মৃদু হেসে বললাম, কেন, তোর আবার শান্তির অভাব ঘটল কিসে?
এখনো বলছিস অভাব হল কিসে? এর পরও শান্তিতে থাকতে পারব বলে মনে করিস? দুর্ঘটনাটা ঘটবার সঙ্গে সঙ্গে স্থির করেছিলাম ওদিকে চোখ দেব না কিন্তু শতদল আর রাণু, নাঃ, কিছুতেই যোগে মিলছে না। কিন্তু তারও আগে সর্বাগ্রে আমাকে একটিবার ঐ নির্জন সাগরকূলে পাহাড়ের উপরে নিরালা নামক বাড়িখানি দেখতে হচ্ছে—
তোর কি তাহলে ধারণা যে, ঐ বাড়িটার সঙ্গেই কোন রহস্য জড়িয়ে আছে কিরীটী?
নিশ্চয়ই, নচেৎ এমন অকস্মাৎ বুলেটের আবির্ভাব ঘটবে কেন?
কিন্তু একটা কথা তোকে না বলে পারছি না। বুলেটটা যেন বুঝলাম, কিন্তু রিভলবারের—
কথাটা আমায় কিরীটী শেষ করতে না দিয়েই বলে ওঠে, আওয়াজটা শুনতে পাসনি, এই তো? কিন্তু বললাম তো
কিন্তু–
রিভলবারের সঙ্গে সাইলেন্সার ফিট করা ছিল। কিন্তু গুলিটা এল কোন দিক থেকে?
পূর্ব দিক অর্থাৎ সাগরের দিক থেকেই এসেছে বলে আমার মনে হয়।
ঐসময় সেই দিকে অত লোকজন ছিল!
সেটা তো আরো চমৎকার কেমোফ্লাজ-শতদলবাবুর দিক থেকে সামান্য একটুক্ষণের জন্য আমি অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম সুব্রত, তোর সঙ্গে কথা বলতে বলতে এবং ঠিক সেই মুহূর্তটিতে ব্যাপারটা ঘটে গেল, নচেৎ আমার দৃষ্টিকে সে এড়াতে পারত না।
সহসা একটা আনন্দ-মিশ্রিত হাসির শব্দে চমকে ফিরে তাকালাম। মাত্র হাত-আট-দশ দূরে সমুদ্রের ধার দিয়ে শতদল ও রাণু, পাশাপাশি হেঁটে চলেছে।
এবং রাণু ও শতদল দুজনেই খুব হাসছে।
চমৎকার মানিয়েছে কিন্তু ওদের দুজনকে কিরীটী! চেয়ে দেখ, a nice pair!
আমি ওদের সম্পর্কে বিশেষ করে বলা সত্ত্বেও কিরীটী ফিরে তাকাল না, কেবল মৃদুকণ্ঠে বললে, নির্জন সাগরকূলে পাহাড়ে উপরে এক দুর্গ গড়ে তুলেছিল এক আপনভোলা শিল্পী। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত সেই দুর্গের মধ্যে শিল্পী বসে বসে কখনো আঁকত ছবি, কখনো গড়ত মূর্তি, কিতু তার চাইতে বড় কথা—আমাদের দেশে যে একটা প্রবাদ আছে, মরা হাতির দামও লাখ টাকা—যদি সেই দিক দিয়ে ভাবা যায়, তাহলে কী দাঁড়ায় বল?
কিন্তু উত্তরাধিকারী শতদলবাবুই তো একটু আগে বলে গেলেন, অবশিষ্ট এখন মাত্র ঐ গৃহখানিই। সম্পত্তির আর কিছু অবশিষ্ট নেই–
তারই দাম লাখ টাকা। চল, ওঠা যাক। হোটেলে গিয়ে আপাততঃ তো এক কাপ গরম চা সেবন করা যাক। বলতে বলতে কিরীটী উঠে দাঁড়াল এবং হোটেলের দিকে চলতে শুরু করল। আমি তাকে অনুসরণ করলাম।
সমস্তটা দ্বিপ্রহর কিরীটী হোটেলের সামনের বারান্দায় একটা ইজিচেয়ারের উপরে হেলান দিয়ে একটা মোটামত বাংলা উপন্যাস নিয়েই কাটিয়ে দিল।
সকালের ব্যাপারে তাকে বিশেষভাবে যে একটু উত্তেজিত বলে মনে হয়েছিল, সে উত্তেজনার যেন এখন অবশিষ্টমাত্রও নেই। তার হাবভাব দেখে মনে হয় ব্যাপারটা যেন সে ইতিমধ্যেই একেবারে ভুলেই গিয়েছে। মনের মধ্যে তার কোন চিহ্নমাত্রও নেই।
বাইরে শীতের রৌদ্র ইতিমধ্যেই ঝিমিয়ে এসেছে। নিভন্ত দিনের আলোয় সমুদ্রও যেন রূপ বদলিয়েছে। বিষণ্ণ ক্লান্তিতে সমুদ্রের নীল রঙ কালো রূপ ক্রমে ক্রমে নিচ্ছে যেন। এ বেলা আর স্নানার্থীদের কোন ভিড় নেই। তবু বায়ুসেবনকারীদের চলাচল শুরু হয়েছে।
হোটেলের ভৃত্য শিবদাস চায়ের ট্রেতে করে চা ও কিছু কেক বিস্কুট রুটি জ্যাম সামনের টেবিলের ওপরে এনে নামিয়ে রাখল।
কিরীটী একমনে পড়ছে দেখে আমিই উঠে চায়ের কাপে চা ঢেলে কাপটা এগিয়ে দিতে দিতে বললাম, চা!
কিরীটী হাতের বইটা মুড়ে কোলের উপর নামিয়ে রেখে চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিল। উষ্ণ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললে, তোর সঙ্গে টর্চ আছে না সুব্রত?
আছে।
কেডস জুতো আছে?
না, তবে আমার ক্রেপ-সোলের জুতো— ওতেই হবে। কোথাও বের হবি নাকি?
হ্যাঁ, নিরালা দর্শনে যাব।
আধ ঘণ্টার মধ্যেই প্রস্তুত হয়ে দুজনে নিরালার দিকে অগ্রসর হলাম। সূর্যাস্তের পূর্বে ওখানে আমাদের পৌঁছতে হবে। কিরীটী বলল।
তা আর পারা যাবে না কেন?
ক্ৰমে লোকালয় ছেড়ে সমুদ্রের কোল ঘেষে অপ্রশস্ত একটা পায়ে-চলা পথ ধরে আমরা দুজনে এগিয়ে চললাম। সমুদ্র যেন আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। টের পাচ্ছি সমুদ্রের পাড় যেন ক্রমে সমুদ্র থেকে উঁচু হয়ে চলেছে। সমুদ্রের গর্জমান ঢেউগুলো পাড়ের গায়ে এসে ধাক্কা দিয়ে ভেঙে আবার পিছিয়ে যাচ্ছে। এ জায়গাটায় সমুদ্রের পাড়টা বড় বড় পাথর দিয়ে বাঁধানো। মধ্যে মধ্যে বড় বড় এক-একটা ঢেউ বাঁধানো পাড়ের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে জলকণার ফুলঝুরি ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। বিকেল থেকেই হাওয়াটাও যেন বেড়েছে।
ক্ৰমে খাড়াই পথ ধরে আমরা উপরের দিকে উঠছি। চমৎকার বাঁধানো পথ। সূর্য ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে অনেকটা নেমে এসেছে পশ্চিম দিগবলয়ে।
তিন-চারশো ফুটের বেশী পাহাড়টা উঁচু হবে না।
ক্রমে যত উপরের দিকে উঠছি, ডান দিকে সমুদ্র আরো স্পষ্ট ও অবারিত হয়ে ওঠে। ভারি চমৎকার দৃশ্যটি।
এমন জায়গায় শিল্পী না হলে কেউ এত খরচ করে বাড়ি করে!
কিরীটীর কথায় সায় না দিয়ে আমি পারলাম না, যা বলেছিস। লোকটা সত্যিই শিল্প-পাগল ছিল।
আরো কিছুর উপরের দিকে উঠতেই একটা লোহার গেট দেখতে পেলাম। এবং গেটের সামনে দাঁড়াতেই বাড়িটার সামনের দিকটা সুস্পষ্ট হয়ে চোখের উপর ভেসে উঠল।
মুঘল যুগের স্থাপত্যশিল্পের পরিপূর্ণ একটি নিদর্শন যেন বাড়িখানি। দ্বিতল বাড়িটা, চারদিকে চারুটি গোলাকার গম্বুজ। গম্বুজের গায়ে বোধ হয় নানা রঙের পেটেন্ট স্টোন বসানো, অস্তমান সূর্যের শেষ রশ্মি সেই পাথরগুলোর ওপরে প্রতিফলিত হয়ে যেন মরকতমণির মতো জ্বলছে।
বাড়িটার সামনেই একটা নানাজাতীয় ফুল-ফলের বাগান। গেট বন্ধ ছিল, এক পাশের থামে শ্বেতপাথরের প্লেটে সোনালী অক্ষরে বাংলায় লেখা নিরালা।
গেট ঠেলে দুজনে ভিতরের কম্পাউণ্ডে প্রবেশ করলাম। হাত-চারেক চওড়া লাল সুরকি ঢালা পথ বরাবর বাড়ির সদর দরজার সামনে গিয়ে শেষ হয়েছে। এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে দুজনে সামনের দিকে এগিয়ে চললাম।
দোতলার ও একতলার সব জানালাগুলোেই দেখছি ভিতর থেকে বন্ধ।
মাঝামাঝি রাস্তা এগিয়েছি, হঠাৎ একটা কর্কশ কণ্ঠস্বরে চমকে পাশের দিকে তাকালাম। একঝাড় গোলাপগাছের সামনে হাতে একটা খুরপি নিয়ে একজন প্রৌঢ় দাঁড়িয়ে।
কাকে চান?
দেখলাম লোকটা বেশ রীতিমত ঢ্যাঙা। এবং একটু কুঁজো হয়েই যেন দাঁড়িয়ে আছে। পরিধানে একটা ধুতি ও গায়ে একটা গরম গেঞ্জি। গেঞ্জির হাতা দুটো গোটানো এবং দুই হাতেই কাদামাটি লেগে আছে। বুঝলাম প্রৌঢ় বাগানের গোলাপ গাছগুলোর সংস্কার করছিল।
প্রৌঢ়ের মাথার চুলগুলো সবই প্রায় পেকে সাদা হয়ে গিয়েছে। কপালের উপর বলিরেখাগুলো বয়সের ইঙ্গিত দিলেও দেহের মধ্যে যেন একটা বলিষ্ঠ কর্মপটুতা দেহের সমগ্র পেশীতে পেশীতে সুস্পষ্ট ও সজাগ হয়ে আছে। দেখলেই বোঝা যায়, এককালে ভদ্রলোক শরীরে যথেষ্ট শক্তি তো ধরতেনই, এখনও অবশিষ্ট যা আছে তাও নেহাত কম নয়।
দেহের ও মুখের রঙ অনেকটা তামাটে। রৌদ্র-জলে পোড়-খাওয়া দেহ। হাতের আঙুলগুলো কী মোটা মোটা ও লম্বা!
ভদ্রলোকের প্রশ্নে এবার কিরীটী জবাব দিল, শতদলবাবু আছেন?
শতদল! সে তো এমন সময় কখনো বাড়িতে থাকে না। গোটাচারেকের সময় বের হয়ে যায়।
ফেরেন কখন?
তা রাত্রে ক্লাব থেকে ফিরতে রাত এগারোটা সাড়ে-এগারোটা হয়।
এখানকার ক্লাব বলতে সাগর-সৈকত হোটেলেরই নিচের একটা ঘরে নাচগান তাস দাবাখেলা ও ড্রিঙ্কের ব্যবস্থা আছে, সেটাই এখানকার ক্লাব। এখানকার স্থানীয় ভদ্রলোকেরা সেইখানেই প্রতিদিন সন্ধ্যায় এসে মিলিত হন। এবং রাত দশটা পর্যন্ত আনন্দ চলে সেখানে।
আমি যতদূর জানতাম, শতদলবাবু এখানে একাই থাকেন! কিরীটী প্রৌঢ়কে আবার প্রশ্ন করে।
শতদল তো মাত্র মাসখানেক হল এসেছে। আমি আমার স্ত্রী ও আমার মেয়েকে নিয়ে এক বছরের উপরে এখানে আছি। তা ছাড়া চাকর অবিনাশ, মালী রঘুনাথ আছে।
ওঃ, তা আপনি শতদলবাবুর—
রণধীর আমার সম্পর্কে শ্যালক হত।
ওঃ, রণধীরবাবুর আপনি তাহলে ভগ্নীপতি হন?
হ্যাঁ।
চমৎকার জায়গায় বাড়িটি কিন্তু–, কতকটা যেন তোষামোদের কণ্ঠেই কথাটা উচ্চারণ করে কিরীটী।
আর মশাই চমৎকার জায়গা! নেহাত আটকা পড়ে গিয়েছি, নইলে এমন জায়গায় মানুষ থাকে? আধ মাইলের মধ্যে জন-মনিষ্যি পর্যন্ত একটা নেই। রাতবিরেতে ডাকাত পড়লে চেঁচিয়েও কারো সাড়া পাবার উপায় নেই।
কিরীটী হাসতে হাসতে জবাব দেয়, বাইরে থেকে যেভাবে বাড়িটা তৈরী দেখছি তাতে ডাকাত পড়লেও বিশেষ তেমন কিছু একটা সুবিধা করতে পারবে বলে তো মনে হয় না।
এমন সময় সুমিষ্ট মেয়েলী গলায় আহান শোনা গেল, বাবা গো বাবা! এত করে তোমাকে ডাকছি, তা কি শুনতে পাও না? ওদিকে চা যে জড়িয়ে জল হয়ে গেল!
চেয়ে দেখি একটি উনিশ-কুড়ি বৎসরের শ্যামবর্ণ একহারা চেহারার মেয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে।
মেয়েটির পরিধানে চমৎকার একটি নীলাম্বরী শাড়ি, কলকাতার কলেজের মেয়েদের মত স্টাইল করে পরা, গায়ে সাদা ব্লাউজ।
মেয়েটি ততক্ষণে একেবারে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
কখন আবার তুই ডাকলি আমায় সীতা! মেয়েটির বাপ জবাব দেন।
রোগা একহারা চেহারা হলে কী হয় এবং গায়ের রঙ শ্যাম হলেও অপরূপ একটা লাবণ্য যেন মেয়েটির সর্বদেহে। সর্বাপেক্ষা মেয়েটির মুখখানির যেন তুলনা হয় না—চোখে-মুখে একটা তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ছাপ রয়েছে।
মেয়েটির দেহের সর্বাপেক্ষা বড় সম্পদ তার পর্যাপ্ত কুঞ্চিত কেশ। বর্মীদের ধরনে মাথার উপরে প্যাগোডার আকারে বাঁধা। হাতে একগাছি করে কাঁচের চুড়ি।
এইটিই আমার মেয়ে সীতা। হ্যাঁ, ভাল কথা—আপনাদের নাম তো জানা হল না! আমার নাম হরবিলাস ঘোষ। হরবিলাস নিজের পরিচয় দিলেন।
পরিচয়টা দিলাম এবারে আমিই, আমার নাম সুব্রত রায়, আর ইনি হচ্ছেন কিরীটী রায়।
আবার একদফা নমস্কার প্রতি-নমস্কারের আদান-প্রদান হল।
আসুন না কিরীটীবাবু, শতদলের কাছে এসেছেন, সে যখন বাড়িতে নেই আমার আতিথেয়তাটুকু না হয় গ্রহণ করুন, এক কাপ করে চা—আপত্তি আছে নাকি কিছু? কথাগুলো বলে হরবিলাস একবার কিরীটী ও একবার আমার মুখের দিকে তাকালেন।
আমি একটু ইতস্তত করছিলাম, কিন্তু কিরীটী দ্বিধামাত্র না করে বললে, সানন্দে। বিশেষ করে চা যখন। কিন্তু সীতা দেবী, আপনার আপত্তি নেই তো? কথাটা শেষ করল কিরীটী সীতার মুখের দিকেই তাকিয়ে।
আপত্তি! বা রে, আপত্তি হবে কেন? আসুন না—
হ্যাঁ, চলুন। এই পাণ্ডব-বর্জিত বাড়িতে লোকের মুখ দেখবারও তো উপায় নেই। তাছাড়া আমার স্ত্রীও আপনাদের সঙ্গে আলাপ করে সুখী হবেন। রোগী মানুষ, কোথাও তো বের হতে পারেন না।
রোগী! কিরীটী সবিস্ময়ে প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ, আজ দু বছর ধরে নিম্ন-অঙ্গের পক্ষাঘাতে ভুগছেন। তাঁর জনেই তো এখানে আসা আমার শ্যালকের অনুরোধে।
ইতিমধ্যে সন্ধ্যার অন্ধকার প্রকৃতির বুকে ঘন হয়ে এসেছে। দূরে সন্ধ্যার অষ্পষ্ট আলোয় মনে হয়, সমুদ্রের জলে কে যেন একরাশ কালো কালি ঢেলে দিয়েছে, কেবল মধ্যে মধ্যে ঢেউয়ের চূড়ায় শুভ্র ফেনাগুলো কোন ক্ষধিত করাল দানবের হিংস্র দন্তপাতির মত ঝিকিয়ে উঠছে আর তার সঙ্গে সঙ্গে চাপা ক্রদ্ধ গর্জন একটানা ছেদহীন।
প্রকাণ্ড দরজা পার হয়ে আমরা সকলে বাড়ির মধ্যে এসে প্রবেশ করলাম।
সামনেই একটা বারান্দা এবং বারান্দা অতিক্রম করে একটা সুসজ্জিত হলঘর, সেটা পার হয়ে মাঝারি গোছের একটা আলোকিত কক্ষমধ্যে এসে আমরা প্রবেশ করলাম।
ঘরে সিলিং থেকে একটা বাতি ঝুলছে। সেই আলোয় প্রথমেই নজরে পড়ে ঘরের ঠিক মধ্যিখানে একটা টেবিলের পাশে একটা ইনভ্যালিড চেয়ারের উপর বসে একজন স্থূলাঙ্গী মধ্যবয়সী মহিলা উল ও কাঁটার সাহায্যে কী যেন একটা বুনে চলেছেন অত্যন্ত ক্ষিপ্র হস্তে।
ভদ্রমহিলা আমাদের পদশব্দে মুখ তুলে আমাদের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন, কিন্তু হাত দুটি যেন মেশিনের মতই অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতিতে বয়নকার্য চালিয়ে যেতে লাগল।
সিলিং থেকে ঝুলন্ত আলোর স্বল্প রশ্মি যা সেই উপবিষ্ট ভদ্রমহিলার মুখের উপরে এসে পড়েছিল তাতেই তাঁর মুখখানা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। পাথরের মত ভাবলেশহীন এমন মুখ ইতিপূর্বে খুব কমই যেন চোখে পড়েছে। আর তাঁর দুটি চক্ষুর স্থির দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছিল যেন আমাদের অন্তস্তল পর্যন্ত ভেদ করে চলে যাচ্ছে। আমাদের চোখে-মুখে এসে যেন বিধছে। মুখের একটি রেখারও এতটুকু পরিবর্তন দেখা গেল না।
আড়চোখে একবার কিরীটীর দিকে না তাকিয়ে পারলাম না, কিন্তু কিরীটীর চোখে-মুখে কোন কিছুরই সন্ধান পেলাম না।
হিরণ দেখ, এরা আজ আমাদের গৃহে সান্ধ্য-অতিথি। সুব্রতবাবু, কিরীটীবাবু—এই আমার স্ত্রী হিরন্ময়ী—হরবিলাস শেষের কথাগুলো আমাদের উভয়ের দিকে ফিরে তাকিয়ে শেষ করলেন।
আসুন। বসুন। কী সৌভাগ্য আমাদের! হিরন্ময়ী আমাদের নিষ্প্রাণ কণ্ঠে যেন আহ্বান জানালেন। আমরা উভয়ে পাশাপাশি দুটো চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম।
আশ্চর্য একটা জিনিস লক্ষ্য করছিলাম, ঘরের সব কটি জানলাই বন্ধ। একটা চাপা গুমোট ভাব যেন সমস্ত ঘরটার মধ্যে থমথম করছে। বুকটা কেমন চেপে ধরছে।
সামনে টেবিলটার ওপরে সূক্ষ্ম সূচের এমব্রয়ডারি করা একটি টেবিলক্লথ বিছানো, তার উপরে সজ্জিত চায়ের সাজসরঞ্জাম। ঘরের মধ্যে আসবাবপত্র সামান্য যা আছে তাও এক পরিপাটিভাবে যেখানকার যেটি ঠিক হওয়া উচিত রুচিসম্মতভাবে সাজানো। তথাপি মনে হচ্ছিল, সব কিছুর মধ্যে একটা সযত্ন সুচারু পরিচ্ছন্নতা থাকলেও কিসের যেন একটা অভাব আছে। সবই আছে অথচ কী যেন নেই! কোথায় যেন ছন্দপতন হয়েছে।
সত্যিই সৌভাগ্য আমাদের কিরীটীবাবু, আপনাকে আজ আমার ঘরে অতিথি পেয়ে। হিরন্ময়ী দেবী কিরীটীকে লক্ষ্য করেই কথাটা উচ্চারণ করলেন, আপনাকে ইতিপূর্বে আমার দেখবার সৌভাগ্য না হলেও আপনার নাম আমি শুনেছি।
কিরীটীর ওষ্ঠপ্রান্তে মৃদু একটা হাসির আভাস যেন বঙ্কিম রেখায় জেগে উঠেই মিলিয়ে যায়।
তা ছাড়া, হিরন্ময়ী দেবী আবার বলতে শুরু করেন, আজ দেড় বৎসরের মধ্যে এমন জায়গায় পড়ে আছি যে কারও সঙ্গে বড় একটা দেখাই হয় না, তাই কেউ এলে মনে হয় যেন বন্ধ এই ঘরটার মধ্যে একটা খোলা হাওয়ার ঝুলক বয়ে গেল। উঃ, এই ঘরটি এবং পাশের ছোট একটা ঘর—এরই এই সঙ্কীর্ণতার মধ্যে এই দীর্ঘ দেড় বছরের রাত্রি দিন দুপুরগুলো কীভাবে যে কাটাচ্ছি তা আমি জানি। একটা ক্লান্ত অবসন্নতা যেন হিরন্ময়ীর কণ্ঠস্বরে মূর্ত হয়ে ওঠে। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস যেন তাঁর বুকখানা কাঁপিয়ে বের হয়ে আসে।
হরবিলাস কন্যাকে তাড়া দিলেন, কই রে সীতা, এদের চা দে!
সীতা ইতিমধ্যে চায়ের কাপগুলো সাজিয়ে দুধ দিয়ে চা ঢালতে শুরু করেছিল। আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনাদের কে কয় চামচ করে চিনি নেন চায়ে?
আমি বললাম, আমাকে ছোট চামচের এক চামচ দেবেন, আর ওকে দেড় চামচ দেবেন।
সীতা আমাদের দিকে চা ও প্লেটে কিছু কেক এগিয়ে দিল।
চা-টা নিতে নিতে বললাম, ও প্লেটটা সরিয়ে রাখুন সীতা দেবী-বিকেলে হোটেল থেকে বের হবার পূর্বেই একপেট খেয়ে এসেছি।
তা হোক, তা হোক, একটু খেয়ে দেখুন বাজারের জিনিস নয়, আমার স্ত্রীরই নিজের হাতের তৈরী। হরবিলাস বলে উঠলেন।
কিন্তু পেটে যে একেবারে জায়গা নেই হরবিলাসবাবু! কিরীটী হাসতে হাসতে বলে।
আরে মশাই, এক পীস কেক আর খেতে পারবেন না? বললে হয়তো বলবেন লোকটা তার নিজের স্ত্রীর প্রশংসা করছে, কিন্তু তা নয়, ঊনত্রিশ বছর ঘর করছি তো, অমন রান্না মশাই কোথাও খেলাম না! আসবেন একদিন, এখানে দুপুরে আহার করবেন।
না, উনি রোগী মানুষ—কিরীটী প্রতিবাদ জানায়।
তাতেও কি উনি নিশ্চিন্ত থাকেন! ঐ invalid চেয়ারে বসে বসেই রোজ দুবেলা রান্নার যাবতীয় সব করেন।
সত্যি আশ্চর্য তো! আমি বলি, কষ্ট হয় না আপনার?
বরং এমনি করে সারাটা দিন চেয়ারের উপর নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকাটাই আমার দুঃসহ লাগে। তাই যত পারি নিজেকে engaged রেখে দেহের এই অভিশাপটা ভুলে থাকবার চেষ্টা করি। তাছাড়া দেখুন, এমন জায়গায় পড়ে আছি, একটা লোকজনের মুখে পর্যন্ত দেখবার উপায় নেই। তাই তো ওকে বলি, যে ভাই এত আদর করে এখানে নিয়ে এল আমায়, সেই যখন চলে গেল আর কেন, চল অন্য কোথাও চলে যাই। দেহটা অকর্মণ্য হয়ে গিয়েছে বলে বেশী দিন এক জায়গায় থাকতেও ভাল লাগে না।
ঘরের মধ্যে অত্যন্ত গরম বোধ হচ্ছিল। শীতকাল হলেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দেয়। কিরীটীরও বোধ হয় গরম লাগছিল ঘরের মধ্যে। সে-ই বলে উঠল, ঘরটার মধ্যে বেশ গরম মনে হচ্ছে যেন।
ওঃ, সত্যিই তো, আমারই ভুল হয়ে গিয়েছে। সীতা, দাও তো মা দক্ষিণের জানালাটা খুলে। এ বাড়িতে এত বেশী হাওয়া যে বিরক্ত ধরে যায়, তাই বেশীর ভাগ সময় জানালাগুলো এঁটে রাখি—
না, থাক না, তেমন কিছু বিশেষ অসুবিধা হচ্ছে না। কিরীটী প্রতিবাদ জানাবার চেষ্টা করে। সীতা কিন্তু ততক্ষণে মায়ের আদেশে এগিয়ে গিয়ে ঘরের একটা জানালা খুলে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে বাইরের সমুদ্রবক্ষ থেকে একঝুলক ঠাণ্ডা হাওয়া ঘরের মধ্যে হু-হু করে বয়ে এল সমুদ্রের নোনা স্বাদ নিয়ে। সেই সঙ্গে এল অদূরাগত সমুদ্রের শব্দকল্লোল। বাইরের দূরন্ত খ্যাপা সমুদ্রের স্পর্শ যেন সমস্ত ঘরটার মধ্যেকার পীড়িত বন্ধ আবহাওয়াটাকে মুহূর্তে এসে একটা মুক্তির স্নিগ্ধ পরশ দিয়ে গেল।
দেখলাম জানালাটা খুলে সীতা আর ফিরে এল না, খোলা জানালার গরাদ ধরেই দাঁড়িয়ে রইল ঘরের দিকে পিছন ফিরে। বাইরের রহস্যময় সমুদ্রের মত সীতার দেহটাও যেন একটা রহস্যে পরিণত হয়েছে।
এখানে বুঝি বেড়াতে এসেছেন মিঃ রায়? হিরন্ময়ী আবার প্রশ্ন করলেন কিরীটীকেই লক্ষ্য করে।
হ্যাঁ। সী-সাইডটা এখানকার ভারী চমৎকার!
শতদলের সঙ্গে আপনার আগেই বুঝি আলাপ ছিল?
না। আজই সকালে সবে আলাপ হয়েছে।
ওঃ, সবে আজই আলাপ হয়েছে?
হ্যাঁ।
আপনারা আসবেন সে কি জানত না? আবার প্রশ্ন করলেন হিরন্ময়ী দেবী!
না। ভেবেছিলাম একটা surprise visit দেব।
সহসা এমন সময় বাইরের অন্ধকার ভেদ করে সমুদ্রের একটানা গর্জনকে ছাপিয়ে ক্রুদ্ধ একটা জন্তুর চিৎকার কানে ভেসে এল। বাইরের অন্ধকার যেন সহসা একটা আর্তনাদ করে উঠলো। চমকে হিরন্ময়ী দেবীর মুখের দিকে তাকাতেই দ্বিতীয়বার আবার সেই ক্রুদ্ধ গর্জন শোনা গেল, এবারে বুঝলাম কোনো বড় জাতীয় বিলেতী কুকুরের ডাক সেটা।
হঠাৎ সীতা ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুতপদে কক্ষ হতে বের হয়ে গেল।
কুকুরটার গম্ভীর ডাকটা বাইরের অন্ধকারকে যেন ফালি ফালি করে দিচ্ছে।
০৩. হিরন্ময়ী দেবীই প্রথমে কথা বললেন
হিরন্ময়ী দেবীই প্রথমে কথা বললেন, সীতার কুকুর টাইগারটা অমন করে চেঁচাচ্ছে কেন?
কিরীটী ততক্ষণে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। হরবিলাসবাবুর দিকে তাকিয়ে বললে, আজ এবার তাহলে আমরা উঠি মিঃ ঘোষ!
উঠবেন? এখনি উঠবেন? হিরন্ময়ী দেবী প্রশ্ন করলেন।
হ্যাঁ, রাত হয়ে গেল। আবার কাল-পরশু আসব। শতদলবাবুকে তাহলে বলবেন আমরা এসেছিলাম।
বলব, দেখা হলে বলব। হরবিলাস জবাব দিলেন।
কেন, আপনাদের সঙ্গে কি দেখা-সাক্ষাৎ হয় না? এক বাড়িতেই তো—
এক বাড়ি হলে কি হয়? বাইরের মহলের সঙ্গে ভিতরের মহলের কোন যোগাযোগ নেই, সম্পূর্ণ পৃথক। আমরা থাকি বাইরের মহলে, তাই বড় একটা দেখা-সাক্ষাৎ হয় না। জবাব দিলেন হিরন্ময়ী দেবী।
হরবিলাসই আমাদের দোরগোড়া পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলেন। এবং কিরীটীই তাঁকে অনুরোধ জানাল আর বেশী দূর না আসবার জন্যে।
আপনাকে আর গেট পর্যন্ত কষ্ট করে আসতে হবে না, মিঃ ঘোষ। এবারে আমরা নিজেরাই যেতে পারব।
না না, তাতে কি, চলুন না গেট পর্যন্ত।
না, আপনি যান।
হরবিলাস ফিরে গেলেন। পাশাপাশি আমরা দুজনে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চললাম।
গেটের কাছাকাছি প্রায় এসেছি, হঠাৎ একটা চাপা ক্রুদ্ধ গর-র শব্দ শুনে দুজনেই থমকে দাঁড়াই।
শব্দটা লক্ষ্য করে সামনের অন্ধকারে গেটের ঠিক পাশেই চামেলী-ঝাড়টার দিকে তাকিয়ে চোখের দৃষ্টি আমার পাথরের মতই স্থির হয়ে গেল। অন্ধকারে দুটো আগুনের ভাঁটা যেন ক্রুদ্ধ জিঘাংসায় ধকধক জ্বলছে। অশরীরী কোন প্রেত যেন হিংস্রলোলুপ হয়ে আমাদের পথরোধ করে দাঁড়িয়েছে।
গোঁ-গর-র একটা চাপা ক্রুদ্ধ গর্জন।
আঃ Tiger, stop! Stop! চাপা মেয়েলী কণ্ঠের একটা নির্দেশ শোনা গেল।
সীতার গলা।
অন্ধকারে চামেলী-ঝোপটার নিচু থেকে ছায়ার মত নিঃশব্দে সামনের দিকে এগিয়ে এল সীতা এবং তার পাশে এগিয়ে এল প্রকাণ্ড একটা কালো আলসেসিয়ান কুকুর তো নয় যেন একটা বাঘ!
কিন্তু আশ্চর্য, কুকুরটা তার মনিবের নির্দেশে তখন একেবারে চুপ করে গিয়েছে—শান্ত, স্থির!
চলে যাচ্ছেন বুঝি? সীতা আবার প্রশ্ন করল।
হ্যাঁ। আপনার ঐ টাইগারের ডাকই বুঝি একটু আগে শোনা গিয়েছিল! প্রশ্ন করল কিরীটী।
হ্যাঁ। অচেনা কারো সাড়া পেলে টাইগারটা যেন একেবারে ক্ষেপে ওঠে। বোধ হয় কোনমতে আপনাদের সাড়া পেয়েছিল। হাসতে হাসতে জবাব দেয়।
কিন্তু একটু দেরিতে পেয়েছিল বোধ হয় মিস ঘোষ! প্রত্যুত্তরে হাসতে হাসতে কিরীটী জবাব দেয়।
কিরীটীর ইঙ্গিতটা সীতা বুঝতে পারল কিনা বোঝা গেল না, কারণ জবাবে সে বললে, আর কখনো আপনাদের দেখলে ও গোলমাল করবে না। টাইগার, চিনে রাখ, এরা আমাদের বন্ধু। ভাল লোক।
কুকুরুটি আপনার কী খায় মিস ঘোষ? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
মাংস আর রুটি। জবাব দেয় সীতা।
আচ্ছা চলি, মিস ঘোষ, নমস্কার। কিরীটী হাত তুলে নমস্কার জানিয়ে এগিয়ে গেল।
চলুন, নিচু পর্যন্ত আপনাদের এগিয়ে দিয়ে আসি কিরীটীবাবু। এ পাহাড়টার উপর বেজায় সাপের উৎপাত।
তাই নাকি? কিরীটী চলতে চলতেই বলে।
হ্যাঁ। সব একেবারে ভয়ঙ্কর বিষধর গোখরো।
সাপকে বুঝি আপনার ভয় করে না? কিরীটী প্রশ্ন করে।
না, সঙ্গে টাইগার থাকলে এ জগতে কিছুকেই আমি ভয় করি না।
মিস ঘোষ, তার আর প্রয়োজন হবে না। আপনি ফিরে যান। আয় সুব্রত। কিরীটী বেশ দ্রুতপদেই গেট অতিক্রম করে পাহাড়ের গা দিয়ে ঢালু পথ বেয়ে এগিয়ে চলল। আমি কতকটা একপ্রকার বাধ্য হয়েই অতঃপর কিরীটীকে অনুসরণ করি।
এগিয়ে চলেছি অন্ধকার পথ ধরে আবার হোটেলের দিকে।
শীতের কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি হলেও কালো আকাশটা তারায় তারায় যেন ঝকঝক করছে। বাঁয়ে কালো কালির মত গর্জন-উদ্বেলিত সমুদ্র।
মাঝামাঝি পথ আসতেই দূরে হোটেলের আলোগুলো অন্ধকার আকাশপটে ক্ৰমে ফুটে উঠতে লাগল। কিরীটী নিঃশব্দে পথ অতিক্রম করছিল, এতক্ষণ একটি কথাও বলেনি। কিন্তু কিরীটীর নিস্তব্ধতা আমাকে যেন কেমন পীড়ন করছিল। আমিই কথা বললাম, হিরন্ময়ী দেবীকে কেমন লাগল, কিরীটী?
কেন, ভদ্রমহিলা বেশ ভালই তো!
হরবিলাসের উপরে একটা অসাধারণ হোল্ড রয়েছে বলে যেন মনে হল!
স্বাভাবিক। ধনীর কন্যা বিবাহ করলে স্বামীকে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই স্ত্রীর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয় ও মধ্যে মধ্যে স্ত্রীর আজ্ঞাবহুও হতে হয়। বিশেষ করে আবার এক্ষেত্রে শ্রীমতী হিরন্ময়ী দেবীর মত প্রখর বুদ্ধিমতী নারীর কাছে হরবিলাসের একটা inferiority complx থাকাটাই তো স্বাভাবিক।
কিন্তু তা তুই ভাবছিস না, অন্য কিছু ভাবছিস! আমি আবার কিরীটীর চিন্তান্বিত মনটাকে একটা খোঁচা দিয়ে আমার প্রতি সজাগ করে তোলবার চেষ্টা করি।
এবং কিরীটীর পরবর্তী জবাব শুনে বুঝলাম প্রচেষ্টা আমার একেবারে নিষ্ফল হয় নি। কিরীটী মৃদু হাস্যসহকারে জবাব দিল, শতদলবাবু যে আজ সকালবেলাতে বললেন এই বাড়ির একমাত্র উত্তরাধিকারী এখন তিনিই, তা তো কই মনে হচ্ছে না। তিনি নাতি এবং হিরন্ময়ী দেবী বোন। সেদিক দিয়ে শ্রীমতী সীতাও তো মালিকের নাতনী। আরো আছে কিনা তাই বা কে জানে!
এতক্ষণে বুঝতে পারি কিরীটীর বর্তমান চিন্তাধারাটা ঠিক কোন পথ ধরে চলেছে। সকালবেলাকার আকস্মিক দুর্ঘটনা থেকে শতদলের রহস্যটাই তার সমস্ত চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এবং এও বুঝতে পারলাম, শতদলরহস্য মীমাংসিত না হওয়া পর্যন্ত এখান থেকে কিরীটী নড়বে না। সঙ্গে সঙ্গে আমারও নড়া চলবে না। অতএব অনির্দিষ্ট কালের জন্য এখন এখানেই অবস্থানও হবে অবধারিত।
বস্তুতঃ শতদলের রহস্যটা যে আমার মনকেও বেশ কিছুটা চঞ্চল করে তোলেনি তা নয়। কিন্তু কোন কিছুরই যেন হদিস পাচ্ছিলাম না। সকাল হতে কতকগুলো ছিন্ন ছিন্ন ঘটনা ও কয়েকটি বিভিন্ন চরিত্রের নর-নারী যার সংস্পর্শে আমরা এসেছি, কোন কিছুর মধ্যেই যেন একটা পূর্ণ যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সহসা একটা প্রশ্ন আমার মনের অন্ধকারে বিদ্যুৎ-চমকের মতই যেন ঝিলিক হেনে গেল, কিন্তু কিরীটীকে সে প্রশ্নটা করবার পূর্বেই সে আমাকে বললে, রাত আটটা বাজে প্রায়, একটু পা চালিয়ে চল সুব্রত, হোটেলের ক্লাব-ঘরে বহু জনসমাগম হয়, দেখা যাক আজ তাদের মধ্যে কারো সঙ্গে একটু-আধটু আলাপ-পরিচয় করা যায় কিনা। এতদিন এখানে এসেছি, হোটেলে আছি, অথচ কারো সঙ্গে আলাপ হল না! এ অন্যায়। চল।
হোটেলে এসে যখন পৌঁছলাম রাত তখন প্রায় সাড়ে আটটা।
কিরীটী ও আমি সোজা একেবারে হোটেলের নিচের তলায় যে হলঘরটি স্থানীয় ক্লাব-ঘর বলে এখানে পরিচিত, সেই ঘরে এসে প্রবেশ করলাম।
প্রশস্ত হলঘরটি তখন হোটেলের ও স্থানীয় অধিবাসী নরনারীতে গমগম করছে। বলতে গেলে হোটেলে আসবার পর এই সর্বপ্রথম ঐ ঘরে আমাদের পদার্পণ।
হলঘরের একধারে কাউন্টার। সেখানে উর্দি-পরা হোটেলের ওয়েটার নানাজাতীয় কড়া ও নরম পানীয়ের বোতলগুলো সাজিয়ে তৃষিতজনদের পানীয় পরিবেশন করছে। মধ্যে মধ্যে ছোট-বড় সব চৌকো ও গোলাকর টেবিল ও চেয়ার পাতা। সেই চেয়ারগুলো অধিকার করে নানাবয়সী নরনারীর ভিড় জমেছে। উচ্চ ও চাপা হাসির গুঞ্জন ও তর্কাতর্কির শব্দে সমগ্র হলঘরটি মুখরিত। চারদিকেই সর্বত্র একটা আনন্দঘন উচ্ছাসের সাড়া। কেউ গল্প করছে, কেউ তাস খেলছে, কেউ দাবা, কেউ টেবিল-টেনিসু আবার কেউ কেউ বা পানীয়ের ক্লাসে নিয়ে বসে আছে ও মধ্যে মধ্যে এক-আধ সিপ ড্রিংক করে স্বপ্নালু দৃষ্টিতে আশেপাশে চেয়ে দেখছে।
ঘরের এক কোণে একটা গোলাকার খালি টেবিলের পাশে খানতিনেক খালি চেয়ার পড়েছিল। কিরীটী আমাকে আকর্ষণ করে সেই দিকে নিয়ে গেল। এবং নিজে একটা চেয়ারে বসে আমাকে বললে, বোস।
পকেট থেকে চামড়ার সিগারের কেসটা বের করে একটা সিগার কেস থেকে নিয়ে অগ্নিসংযোগ করতে করতে বললে, যস্মিন দেশে যদাচারঃ-কী খাবি বল?
চেয়ে দেখি ইতিমধ্যে আমাদের চেয়ারে বসতে দেখে একসময় একজন উর্দিপরিহিত ওয়েটার আমাদের সামনে জার্মান-সিলভারের একটা ট্রে নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে।
একঠো ছোটা বিয়ার অ্যান্ড জিন—তুই কী খাবি বল সুব্রত?
আমি—মানে ওসব আমার চলবে না ভাই।
এক যাত্রায় পৃথক ফল নেই, you must keep company! আর দেখো, এ সাবকে লিয়ে একঠো ছোটো জিন অ্যাণ্ড লাইম লাও!
ওয়েটার সেলাম জানিয়ে কাউন্টারের দিকে চলে গেল।
কিন্তু ভাই, ওসব খেয়ে যদি মাতাল হই? ভয়ে ভয়ে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম।
একটা ছোট জিন অ্যাণ্ড লাইম খেয়েই মাতাল হবি? Rubbish!
অভ্যাস নেই যে ভাই।
আমার যেন কতকালের অভ্যাস আছে! থাম।
একটু পরে ওয়েটার ট্রেতে করে দুটো পেগ গ্লাস এনে টেবিলের উপরে নামিয়ে রাখল, আউর কুছ সাব?
হ্যাঁ, দোনোমে থোড়া করকে পানি মিলা দো।
ওয়েটার একটু একটু করে দুটো পেগ গ্লাসে জল ঢেলে দিয়ে চলে গেল।
সন্তর্পণের সঙ্গে একটু একটু করে সিপ করছি আর অনুভব করবার চেষ্টা করছি নেশা ধরল কিনা। হঠাৎ এমন সময় খোলা দরজার দিকে নজর পড়তেই চমকে উঠলাম, শ্রীমতী রাণু ও শতদল হাসতে হাসতে প্রবেশ করল ঘরের মধ্যে।
এবং তারা আমাদের দুটো টেবিলের পরের টেবিলে এসে বসল। ওরা আমাদের দুজনকে লক্ষ্য করেনি।
বোয়—বোয়? শতদলের কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
বয় এসে ওদের সামনে দাঁড়াল।
একঠো হুইস্কি সোডা, আউর একঠো অরেঞ্জ স্কোয়াসু শতদল অর্ডার দিল।
কিরীটীর দিকে তাকালাম। সে দেখি অন্যদিকে তাকিয়ে একমনে সিগার টেনে যাচ্ছে, শতদল বা রাণুর দিকে তার দৃষ্টি নেই।
কিন্তু তোমার মা, simply I cant stand her রাণু! তিনি যে আমাকে খুব বেশী পছন্দ করেন তা বলে মনে হয় না, শতদল রাণুকে বলছে কানে এল।
ওটা তোমার ভুল ধারণা দল
না, ভুল ধারণা নয়। কুমারেশের প্রতিই তাঁর একটু– কথাটা শতদল শেষ করে না।
Dont be silly, দল! রাণু জবাব দেয়।
একটু বোধ হয় অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। কাউন্টারের পাশে কনসার্ট বাজানো শুরু হয়েছিল। বেহালা, পিয়ানো ও ফ্লুট—মাত্র তিনটি যন্ত্রের সহযোগে চমৎকার ঐকতান বাদ্য। সুরটা একটা পরিচিত বাংলা গানের। কনসার্ট-বিরতি কয়েক মিনিটের জন্য হতেই আবার শতদলের কণ্ঠ শোনা গেল, কুমারেশের আজ পর্যন্ত কোনো সংবাদুই আর পাওয়া যায়নি?
না। রাণু জবাব দেয়।
কিন্তু এবারও কুমারেশের অলিম্পিকে যোগ দেবার কথা। সারা ভারতবর্ষ থেকে তো ওই একা সাঁতারে সিলেকটেড হয়েছে।
এতক্ষণে বুঝতে পারি কুমারেশ মানে বিখ্যাত সাঁতারু কুমারেশ সরকারের কথা হচ্ছে। নামটা তাই প্রথম থেকেই কেমন যেন চেনা-চেনা মনে হচ্ছিল।
এখানে আসবার দিন পনেরো আগে সংবাদপত্রে একটা সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল, বিখ্যাত সাঁতারু কুমারেশ সরকার তার কলকাতার বাসভবন থেকে হঠাৎ কাউকে কিছু না জানিয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছে। সংসারে তার আপনার বলতে একমাত্র বৃদ্ধ বাপ অধ্যাপক ডঃ শ্যামাচরাণু সরকার। বছর পাঁচেক হল ডঃ সরকার চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। কুমারেশ সরকার শুধু একজন বিখ্যাত সাঁতারুই নয়, কণ্ঠসংগীতেও আধুনিক গায়কদের মধ্যে সে অন্যতম। গায়কদের মধ্যেও কুমারেশ রেডিও গ্রামোফোন জগতে একচ্ছত্র সম্রাট। সেইজন্যই কুমারেশ সরকারের নিরুদ্দেশের সংবাদ যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল এবং এ-ও জানি, এখন পর্যন্ত সেই নিরদিষ্ট কুমারেশের কোন সংবাদুই পাওয়া যায়নি। ব্যাপারটা সত্যিই যেমন রহস্যপূর্ণ তেমনি চাঞ্চল্যকর।
আবার রাণুর গলা শোনা গেল, সত্যিই শতদল তুমি জান না কুমারেশ কোথায় গিয়েছে?
সকালবেলাতেই তো বলেছি জানি না।
কিন্তু আমি কি ভেবেছিলাম, জান?
কি
তুমিই তার সবচাইতে প্রিয় বন্ধু, অন্ততঃ তুমি বোধ হয় জান সে কোথায়!
শুধু তোমার কেন, সকলেরই তাই ধারণা। অথচ এরা কেউ বিশ্বাস করে না যে, তার সংবাদ জানা সত্ত্বেও গোপন করে রাখার কী আমার স্বার্থ থাকতে পারে! জগতে কুমারেশের চাইতে প্রিয় বন্ধু আর আমার নেই। সেই স্কুলের জীবন থেকে আমাদের বন্ধুত্ব, তার প্রতিটি কাজে চিরদিন আমিই সর্বাগ্রে তাকে উৎসাহ দিয়েছি, তার জীবনের প্রতিটি success-এ আমিই তাকে এগিয়ে দিয়েছি। সে শুধু আমার বন্ধুই নয়, সহোদরের চাইতেও অধিক।
জানি। মৃদুকণ্ঠে রাণু কেবল জবাব দেয়।
আবার বাজনা শুরু হয়, এবারে কিন্তু আর ঐকতান নয়, কেবল বেহালাবাদক বেহালা বাজাতে শুরু করে। চমৎকার বাজনার হাত লোকটির। আমার মনটা বাজনার প্রতি আবার আকৃষ্ট হয়ে পড়ে।
হঠাৎ কিরীটী চেয়ার থেকে উঠে পড়ল। চেয়ে দেখি, রাণু আর শতদলও চেয়ার ছেড়ে উঠে খোলা দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিরীটী দূর থেকে ওদেরই অনুসরণ করে, আমিও কিরীটীর পিছনে চললাম।
মাথাটা একটু হালকা হালকা বোধ হয়। বুঝলাম জিন ও লাইমের কার্য শুরু হয়েছে আমার মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলোতে।
শতদলবাবু? কিরীটীর ডাকে চমকে শতদল ফিরে তাকাল, কে? ও মিঃ রায়, our detective! Hallow! মনে আছে স্যার, আপনার সেই সাবধান বাণী। আর বলতে হবে না।
ব্যাপার কি শতদল? বিস্মিতা রাণু প্রশ্ন করে শতদলের মুখের দিকে তাকিয়ে।
মিঃ রায়ের ধারণা, আমার জীবনের উপরে কেউ না কেউ attempt নিচ্ছে, উনি আমাকে তাই আজ সকালে সাবধান করে দিয়েছেন, মৃদু হাস্যসহকারে বলে শতদল।
তোমার life-এর ওপরে attempt! বিস্মিত সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে আবার তাকাল রাণু শতদলের মুখের দিকে।
কিন্তু আমি অন্য কথা বলবার জন্য আপনাকে ডেকেছিলাম শতদলবাবু কিরীটী বললে।
কী বলুন তো?
আপনার বাড়িতে আজ সন্ধ্যায় গিয়েছিলাম। হরবিলাসবাবু, তাঁর স্ত্রী ও মেয়ের সঙ্গে আলাপ হল।
Really! তিনটে পাগল—তিন শ্রেণীর। কেমন লাগল পাগলগুলোকে? হাসতে হাসতে শতদল বলে।
কিন্তু আপনার নিরালা দেখা হল না, তাই ভাবছি কাল সকালের দিকে যাব।
নিশ্চয় নিশ্চয়। আসবেন। তুমিও এস না রাণু। রাণুর দিকে ফিরে তাকিয়ে শতদল বলে।
কোথায়, তোমার ওখানে?
হ্যাঁ। সকালে চা-পর্বটা আমার ওখানেই না হয় হবে সকলের, কী বলেন মিঃ রায়!
বেশ তো। তাহলে রাণু দেবী যাবেন নাকি!
কখন যাবেন? রাণু প্রশ্ন করে।
একটু সকাল-সকালই না হয় বের হওয়া যাবে। কিরীটী জবাব দেয়।
হঠাৎ একটা ভারিক্কী মেয়েলী কণ্ঠে সামনের দিকে তাকালাম। এই যে রাণু, কোথায় ছিলি এতক্ষণ? সেই কখন বের হয়েছিস–
একটি বিধবার বেশ পরিহিতা মধ্যবয়সী মহিলা। পরিধানে বিধবার বেশ থাকলেও ঐশ্বর্য ও আভিজাত্যের চিহ্ন যেন তাঁর চোখ-মুখ হাব-ভাব, এমন কি দাঁড়াবার ভঙ্গীটকু থেকে পর্যন্ত ফুটে বের হচ্ছে। পরিপাটি চুল আঁচড়ানো। হাতে একগাছি করে সোনার চুড়ি। চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা।
কোথায় ছিলি এতক্ষণ? আবার মহিলা প্রশ্ন করলেন।
এই—মানে, বলতে বলতে এদিক-ওদিক তাকায় রাণু।
চেয়ে দেখি, আমাদের ধারে-কাছে কোথাও শতদলের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। কখন একসময় ইতিমধ্যেই নিঃশব্দে অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতিতে সে গা-ঢাকা দিয়েছে।
০৪. ভদ্রমহিলা রাণুর দিকে তাকিয়ে
এরা কে রাণু? ভদ্রমহিলা রাণুর দিকে তাকিয়ে আমাদের ইঙ্গিত করে প্রশ্ন করলেন।
রাণু যেন শতদলের আকস্মিক অন্তর্ধানে কতকটা আরাম অনুভব করে এবং একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলে, আমার মা। ইনি মিঃ কিরীটী রায়, ইনি মিঃ সুব্রত রায়। মিঃ কিরীটী রায়ের নাম তুমি নিশ্চয়ই শুনে থাকবে মামি– বিখ্যাত রহস্যভেদী।
নমস্কার, মিঃ রায়—আমার স্বামীর নাম নিশ্চয়ই আপনি শুনে থাকবেন–স্যার আর. এন. মিত্র–
কোন স্যার আর, এন.? বিখ্যাত মার্চেন্ট, গত বৎসর সুইজারল্যান্ডে যিনি অপারেশন হতে গিয়ে মারা যান?
হ্যাঁ। পৃথিবীবিখ্যাত সার্জেনদের দিয়ে অপারেশন করানো হল এখান থেকে ফ্লাই করে গিয়ে…কিন্তু oh dear! He could not be saved– লেডি মিত্র হাতের দামী সুগন্ধযুক্ত রেশমী রুমালটা চোখের উপরে একবার বুলিয়ে নিলেন এবং মনে হল গলার স্বরটা যেন একটু অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছে।
হ্যাঁ, সংবাদপত্রে ঘটনাটা পড়েছিলাম। কিরীটী মৃদুকণ্ঠে জবাব দেয়।
শ্ৰীমতী রাণু তাহলে ক্রোড়পতি স্যার আর. এন.-এর সমস্ত সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারিণী এবং শ্রীমান শতদল তাহলে বেশ উঁচু ডালের দিকে হস্ত প্রসারিত করছে!
আসুন না, আমাদের ঘরে চলুন না। আপনারাও তো এই হোটেলে এসেই উঠেছেন? লেডি মিত্র তাঁর ঘরে আমন্ত্রণ জানালেন।
হ্যাঁ। আজ থাক মিসেস মিত্র, রাত হয়েছে। কিরীটী মৃদু প্রতিবাদ জানায়।
রাত আর এমন বেশী কি হয়েছে? লেডি মিত্র তাঁর সুডোল মণিবন্ধ চোখের সামনে তুলে ধরে দামী রিস্টওয়াচটার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই তো সবে রাত পৌনে দশটা। আসুন আসুন, তিন-চার দিন হল এই হোটেলটায় এসে উঠেছি, তা একটা লোক পেলাম না যার সঙ্গে দু-দণ্ড আলাপ করা যেতে পারে। ও হোটেলটায় জায়গা পেলাম না, তাই কতকটা বাধ্য হয়েই এসে এই হোটেলটায় উঠতে হল। এত ভাল ভাল সী-সাইড থাকতে কেন যে রাণুর এই হতচ্ছাড়া নাস্টি জায়গাটাতে আসবার জন্যেই এত জেদ চাপল! আসুন মিঃ রায়, মিঃ সুব্রত, আপনিও আসুন।
তরল পানীয়ের প্রভাবে পেটের মধ্যে তখন আমার ক্ষুধার প্রচণ্ড আলোড়ন চলেছে। বাধা দিতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু কিরীটীকে মিসেস মিত্রকে অনুসরণ করতে দেখে একপ্রকার বাধ্য হয়েই আমাকেও ওঁদের পশ্চাতে অনুসরণ করতে হল।
হোটেলের দোতলায় কোণের একটু বড় ঘর নিয়ে মাতা ও পুত্রী আছেন। এবং সঙ্গে এসেছে ওঁদের একজন বয়, একজন আয়া ও একজন দাই। এও দেখলাম ঘরে প্রবেশ করে যে, হোটেলের আসবাবপত্রের উপরেই ওঁরা একবারে নির্ভর করেননি, কিছু কিছু শয্যাদ্রব্য ও অন্যান্য আবশ্যকীয় জিনিসপত্র যা হয়তা তাঁরা সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছিলেন, তারই সাহায্যে নিজেদের বাসের কক্ষটি যথাসাধ্য রুচিসম্মতভাবে সাজিয়েগুছিয়ে নিয়েছেন। ধনের প্রাচুর্য ও আভিজাত্যের চিহ্ন সর্বত্রই ঘরের মধ্যে পরিস্ফুট।
ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে লেডি মিত্র বললেন, আসুন। May I offer you a drink Mr. Roy? লেডি মিত্র কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন।
No, thanks! Just now we had one!
What about you Mr. Subrata Roy? এবারে আমার প্রতি প্রশ্ন বর্ষিত হল।
No, thanks!
বেশ, ড্রিঙ্ক না চান, চা-কোকো-কফি অর ওভালটিন?
বুঝলাম লেডি মিত্র নাছোড়বান্দা। অতিথিদের অন্ততঃ কিছু না পান করিয়ে সুস্থির হতে পারছেন না।
বেশ, তাহলে চা আনতে বলুন। কিরীটী জবাব দেয়।
বয়, চা লাও। বয়কে চায়ের আদেশ দিয়ে সোফাটার উপরে নিজে একটু ভাল করে গুছিয়ে বসে লেডি মিত্র আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, বসে বসে আলাপ করবার সময় কোন একটা ডিঙ্ক সঙ্গে না থাকলে আমি চিরদিনই যেন কেমন bored feel করি। আমার বহুদিনকার habit। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, রাণু, দাঁড়িয়ে আছ কেন, বোসো!
রাণু এতক্ষণ একপাশে দাঁড়িয়েই ছিল, মায়ের আদেশ পেয়ে আমাদেরই পাশের খালি চেয়ারটার ওপরে উপবেশন করল।
আমার only child এই, মিঃ রায়। লরেটো থেকে এবার সিনিয়ার কেমব্রীজ পাস করেছে। Oh dear, রণেনের ইচ্ছে ছিল রাণু বিলেত যায়, ওকে তার ব্যারিস্টারি পড়াবার কী ইচ্ছেই ছিল! But where is he now? সব আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে দেখুন না—how cruel! আবার কণ্ঠস্বর তাঁর অশ্রুতে গদগদ হয়ে উঠেছিল, কিন্তু কিরীটী কথার মোড়টা পালটে দিল।
সে বললে, আপনারা তাহলে কিছুদিন এখানেই থাকবেন, লেডি মিত্র?
হ্যাঁ, যতদিন না ওর আবার ইচ্ছে হয় ফিরে যাবার! বড্ড জেদী আর একগুঁয়ে মেয়ে আমার।
কিরীটী হাসতে হাসতে বলে, কিন্তু সামান্য ওঁর সঙ্গে আমার যা আলাপ হয়েছে, তাতে মনে হয় she is really charming!
আপনিই বলুন তো মিঃ রায়, জায়গাটি really চমৎকার নয়? মামির ধারণা, এমন বিশ্রী জায়গা নাকি আর ভূ-ভারতে নেই! রাণুই এবারে জবাব দেয়।
বয় সুদৃশ্য চায়ের ট্রের ওপরে চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে এসে সামনের টেবিলের উপরে নামিয়ে রাখল।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কিরীটী বললে, আপনি বোধ হয় হোটেলের বাইরে যাননি লেডি মিত্র, গেলে দেখতেন বাইরের দৃশ্য এখানকার সত্যিই চমৎকার!
আমার আবার পায়ে হেঁটে বেড়াতে এমন বিশ্রী লাগে! লেডি মিত্র জবাব দিলেন।
তা অবশ্য ঠিক, পায় হেঁটে বেড়ানোও আপনার অভ্যাস নেই, ভালো তো লাগবেই না আপনার। কিরীটী লেডি মিত্রের কথায় সায় দিয়েই কতকটা যেন বলে ওঠে।
এমন চমৎকার সী-সাইডে কেউ আবার গাড়িতে চেপে বেড়ায় নাকি, মামির যেমন উদ্ভট সব, রাণু প্রতিবাদ জানায়।
শুনছেন মিঃ রায় আমার মেয়েটির কথা?
তা তো সত্যি, অভ্যাস না থাকলেও, কিরীটী আবার বলে।
অভ্যাস! অভ্যাস আবার কী? দুদিন হেঁটে বেড়ালেই অভ্যাস হয়ে যায়। মেয়ে বলে উঠে।
না মিস মিত্র, তারও একটা বয়স আছে। কিরীটী মৃদু হাস্যসহকারে বলে।
সে রাত্রে আমাদের আহার শেষ করতে করতে প্রায় রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গেল।
দুজনে এসে হোটেলের বারান্দায় দুটো চেয়ার টেনে নিয়ে পাশাপাশি বসলাম। হোটেলটি ইতিমধ্যেই যেন নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। ঘরে ঘরে যে যার শয্যা নিয়েছে রাত্রের মত। বোধ হয় কেবল আমরা দুজনেই জেগে এখনও।
বালুবেলার উপর অদূরে গর্জমান সমুদ্রের ঢেউগুলো ভেঙে ভেঙে পড়ছে কলচ্ছাসে। ভাঙা ঢেউইয়ের চূর্ণগুলোতে মধ্যে মধ্যে ফসফরাসের সোনালী চমকি ঝিলমিল করে ওঠে। দিবারাত্র একটানা ঢেউ ভেঙে-গড়েই চলেছে যেন
সমুদ্রের খেলা। ওর চোখে কি ঘুম নেই!
আমিই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করলাম, ব্যাপার কী বল তো কিরীটী, লেডি মিত্রকে হঠাৎ অত তোষামোদ করতে শুরু করলি কেন?
ভদ্রমহিলাকে যখন একটু তোষামোদপ্রিয়ই দেখলাম, আগে থাকতেই খানিকটা তোষামোদ করে ভবিষ্যতের জন্য হাতের মধ্যে রেখে দিলাম, প্রয়োজন হলে কাজে লাগানো যাবে।
তোর মতলবটা কি সত্যি করে বলবি? সত্যিই কি তুই সকালবেলাকার কী একটা accident হয়ে গিয়েছে, সেটার ভূতকে এখনো কাঁধে করে বেড়াচ্ছিস?
হ্যাঁ রে, কতকটা সেই সিন্দবাদ নাবিকের অবস্থা। কিন্তু আমার কথা যদি বিশ্বাস করিস তাহলে বলতে পারি, সকালবেলাকার ব্যাপারটা যোগসূত্রহীন সামান্য একটা এলোমেলো দুর্ঘটনাই নয়। পর পর কতকগুলো দুর্ঘটনা, যেগুলো একসূত্রে গাঁথলে শেষ পর্যন্ত হয়তো গিয়ে দাঁড়াবে একটা মার্ডার বা নিষ্ঠুর হত্যায়!
You mean
হ্যাঁ I mean শীঘ্রই যদি আমার পূর্বে দূরদৃষ্টির ক্ষমতা না নিঃশেষ হয়ে গিয়ে থাকে, অমি নিশ্চয় করে বলতে পারি, I can hear the footsteps! হ্যাঁ সুব্রত, আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি নিষ্ঠুর মত্যু নিঃশব্দে ফেলে এগিয়ে আসছে অবশ্যম্ভাবী অবধারিত। কিরীটীর কণ্ঠস্বরে উত্তেজনার সুস্পষ্ট আভাস। কিরীটী তখনও তার বক্তব্য শেষ করেনি, কিন্তু আমার চোখে যখন ব্যাপারটা পড়েছে, আমি চেষ্টা করব to my last to stop it! প্রতিরোধ করতে আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব।
তোর কি স্থির বিশ্বাস তাহলে something is going to happen? কোনো একটা কিছু শীঘ্রই ঘটবে?
হ্যাঁ, যদি আমার ক্যালকুলেশন ভুল না হয়, চব্বিশ থেকে আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যেই আবার একটা চেষ্টা হবে। বার বার চারবার।
কিরীটীর অনুমান যে কতখানি নির্ভুল, পরের দিন সকালেই সেটা জানা গেল।
খুব ভোরে উঠেই আমি, কিরীটী ও রাণু নিরালার উদ্দেশে রওনা হয়েছিলাম।
ভোরের আলো তখনও স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। সমুদ্রের বুকে একটা আলোছায়ার পর্দা যেন থির থির করে কাঁপছে। শীতের সকাল হলেও কোথাও কুয়াশার লেশমাত্র ছিল না। আকাশের প্রান্তে শুকতারাটা নিভে যায়নি তখনও।
নিরালার লৌহফটকের সামনে এসে আমরা যখন পৌঁছলাম, পূর্ব দিগন্ত যেখানে জলকে আলিঙ্গনের মধ্যে টেনে নিয়েছে, সেখানটা সূৰ্য-সারথির রথচক্রের ঘর্ষণে ঘর্ষণে ও সপ্ত অশ্বের খুরের আঘাতে যেন রক্তবর্ণ হয়ে উঠেছে।
গতকাল সন্ধ্যার মত লৌহফটক খোলাই ছিল, ফটক ঠেলে তিনজনে আমরা কম্পাউণ্ডের ভিতরে প্রবেশ করলাম।
একটু অগ্রসর হতেই হরবিলাসের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। কালো রঙের একটা ওভারকোট গায়ে, হাত দুটো পকেটের মধ্যে প্রবিষ্ট করে হাঁটতে হাঁটতে হরবিলাস গেটের দিকেই এগিয়ে আসছিলেন।
এই যে মিঃ ঘোষ, সুপ্রভাত! কিরীটীই প্রথমে সুপ্রভাত জানাল।
হরবিলাসও আমাদের শুভ প্রভাত জানালেন প্রত্যুত্তরে, সুপ্রভাত। খুব সকালেই এসেছেন দেখছি! যান, শতদল বোধ হয় বসেই আছে। সারাটা রাত বেচারা শোবার ঘরে খিল তুলে বসে আছে, পাশে একটা লোডেড রিভলভার নিয়ে।
ব্যাপার কী? কোন দুর্ঘটনা? উদ্বিগ্ন কণ্ঠে কিরীটী প্রশ্ন করে।
কী জানি মশাই, রাত দুটো-আড়াইটের সময় হঠাৎ পর পর দুটো বন্দুকের গুলির শব্দে চমকে উঠে—
বন্দুকের গুলির শব্দ! প্রশ্নটা এবারে করলাম আমি।
হ্যাঁ। চট করে রাত্রে ঘুম আসে না, তাই অনেক রাত পর্যন্ত জেগে জেগে বই পড়ি। কালও রাত্রে বসে বসে নিজের ঘরে একটা বই পড়ছিলাম, হঠাৎ বন্দুকের গুলির আওয়াজ, তারই কিছুক্ষণ পরে শতদল ও অবিনাশের চেঁচামেচি শুনে অন্দরের দিকে ছুটে যাই। শতদলের ঘরে গিয়ে দেখি, বেচারী অত্যত নার্ভাস হয়ে পড়েছে। ঘুম আসছিল না বলে জেগে টেবিলের আলোয় বসে কী একটা বই পড়ছিল, এমন সময় হঠাৎ বন্দুকের গুলির আওয়াজ ও সঙ্গে সঙ্গে টেবিলল্যাম্পের চিমনিটা ভেঙে চুরমার হয়ে ঘর আঁধার হয়ে যায়। ও কিছু বোঝবার আগেই অন্ধকারেই আবার একটা গুলি এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে। কী ভয়ানক ব্যাপার বলুন তো মিঃ রায়! ও বলে, কেউ ওকে হত্যা করার চেষ্টা করছে। কিন্তু হঠাৎ কে আবার শতদলকে হত্যা করবার চেষ্টা করবে বলুন তো? আমি তো মাথামুন্ডু কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। ও নিজেও এমন ঘাবড়ে গিয়েছে যে, বাকি রাতটকু বোধ হয় শোয়ওনি। চলুন, আপনি এসেছেন ভালই হল, ওকে একটু সাহস দিয়ে যান।
হরবিলাস গতরাত্রের ব্যাপারটায় যে বেশ একটু উত্তেজিতই হয়ে উঠেছেন, ওঁর কথাবার্তাতেই সেটা বোঝা গেল এবং ব্যাপারটার মধ্যে যথেষ্ট উত্তেজনার খোরাক থাকা সত্ত্বেও কিরীটীকে কিন্তু একান্ত নির্বিকার বলেই মনে হতে লাগল। অস্বাভাবিক বা অত্যাশ্চর্য কিছুই তেমন ঘটেনি, শান্ত ও নির্বিকার কণ্ঠেই সে এবারে হরবিলাসবাবু কে প্রশ্ন করল, তা এত সকালে আপনি কোথায় যাচ্ছিলেন?
সত্যি কথা বলতে কি মিঃ রায়, আমি আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম। গতরাত্রে আপনারা চলে যাবার পর আমার স্ত্রীর মুখে আপনাদের অনেক কীর্তিকাহিনীই শুনেছি, তাতে করে আমার মনে হল এ ব্যাপারে আপনিই যোগ্য ব্যক্তি বেচারীকে একটা পরামর্শ দেবার।
কেন, শতদলবাবু কি বলেননি আজ সকালে আমাদের তিনি চায়ের নেমন্তন্ন করেছেন, আমরা আসব? কিরীটী দ্বিতীয় প্রশ্ন করল।
কই, না তো! সবিস্ময়ে জবাব দিলেন হরবিলাস।
ও, আচ্ছা চলুন দেখি।
হরবিলাসবাবুকে অনুসরণ করে আমরা তিনজন অগ্রসর হলাম। সংবাদটা শোনা অবধিই লক্ষ্য করছিলাম, রাণুর মুখের পরিবর্তন। রাণু যেন সত্যিই বিস্মিত ও হতচকিত হয়ে গিয়েছে। রাণু, আমার ও কিরীটীর মধ্যবর্তিনী হয়ে পথ চলছিল, সহসা একসময় চাপা কণ্ঠে কিরীটীকে সে প্রশ্ন করল, আপনি শতদলকে সাবধান করে দিয়েছেন, কালই সকালে আমাকে বলছিল! আপনার নাকি ধারণা, ওকে মারবার জন্য কেউ attempt নিচ্ছে! শতদল তো বিশ্বাস করেইনি, সত্যি কথা বলতে কি মিঃ রায়, আমিও করিনি। কিন্তু এ-সব কী শুনছি—how horrible!
বিশ্বাস করেননি ভুলই করেছেন, এবারে বোধ হয় বিশ্বাস করবেন! কিরীটী মৃদুকণ্ঠে জবাব দেয়।
অন্দর ও বহির্মহলের মধ্যে যোগাযোগের দ্বারটা, সেটা অন্দর থেকে বন্ধই ছিল। বাইরের দরজায় একটা দড়ি ঝুলছিল, হরবিলাসবাবু, সেটা ধরে বার-দুই টান দিতেই অন্দর থেকে একটা অস্পষ্ট ঘণ্টাধনি শোনা গেল এবং অল্পক্ষণ পরেই দরজাটা খুলে গেল। দরজাটা খুলতেই চোখে পড়ল খোলা দ্বারপথে দাঁড়িয়ে একজন বৃদ্ধগোছের লোক। লোকটার বয়স পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে তো নিশ্চয়ই। রোগা ও বেটেমত চেহারা। দেহের সমস্ত মাংসপেশীগুলো যেন একেবারে শণের দড়ির মত পাকিয়ে গিয়েছে। মাথার চুলগুলো কাঁচায়-পাকায় মেশানো। লোকটার পরিধানে একটা ধোপদুরস্ত ধুতি ও হাতকাটা গরম বেনিয়ান। বেনিয়ানের উপরে একটা চাদর জড়ানো।
অবিনাশ, শতদল কোথায়? প্রশ্ন করলেন হরবিলাসই।
বাবু তাঁর ঘরেই আছেন। এখনো দরজা খোলেননি। বাবুর কাছেই যাচ্ছিলাম, আপনাদের ঘণ্টা শুনে
এদের বাবুর ঘরে নিয়ে যাও।
আসুন—আজ্ঞে, অবিনাশ আমাদের আহ্বান জানাল।
একটা দীর্ঘ টানা বারান্দা পার হয়ে আমরা অবিনাশকে অনুসরণ করে প্রশস্ত শ্বেতপাথরের সিঁড়ি বেয়ে উপরে গিয়ে উঠলাম সকলে। উপরের তলাতেও ঠিক নিচের মতোই অনুরূপ একটি টানা বারান্দা। বারান্দার দু-পাশের দেওয়ালে সব বড় বড় ফ্রেমে বাঁধানো নানাপ্রকারের চিত্র টাঙানো। মধ্যে মধ্যে স্ট্যাণ্ডের উপরেও রক্ষিত জয়পুরী টবে পামট্রি। বাড়িটা যে কোন এক শিল্পীর, বুঝতে সেটা আদৌ কষ্ট হয় না। বারান্দার শেষপ্রান্তে যে বন্ধ ঘরটার সামনে এসে আমরা দাঁড়ালাম, তারই ঠিক দরজার দুপাশে দুটো বহুদাকারের স্ট্যাচু একটি স্ট্যাচু হচ্ছে অপূর্ব একটি অর্ধউলঙ্গ নারীর এবং দ্বিতীয় স্ট্যাচুটি হচ্ছে একটি পুরুষের।
এই ঘরে আছেন বাবু। অবিনাশ বললে আঙুল তুলে ঘরটা ইঙ্গিতে দেখিয়ে দিয়ে।
কিরীটী দরজার গায়ে নক করল টকটক করে এগিয়ে গিয়ে, মিঃ বোস! শতদলবাবু!
ভিতর হতে আহ্বান এল, কে?
আমি কিরীটী, শতদলবাবু দরজা খুলেন—
একটু পরেই দরজা খুলে গেল। সামনেই দাঁড়িয়ে শতদল। চমকে উঠলাম শতদলের মুখের দিকে তাকিয়ে। মাত্র এক রাত্রের মধ্যে এ কী চেহারা হয়েছে তার? সমস্ত মুখে শুধু যে রাত্রি-জাগরণের ক্লান্তি তাই নয়, একটা নিরতিশয় ভয় ও উৎকণ্ঠা যেন মুখের রেখায়-রেখায় সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
এই যে মিঃ রায়, again there was an attempt last night! আবার কাল রাত্রে কেউ, somebody, আমাকে গুলি করে হত্যা করবার চেষ্টা করেছিল। এখন স্পষ্টই বুঝতে পারছি মিঃ রায়, you were right! আপনার কথাই ঠিক–সত্যিই someone is after me! কেউ আমার পিছনে লেগেছে। কিন্তু কে এবং কেন? উত্তেজনায় শতদলের কণ্ঠস্বর যেন একেবারে ভেঙে পড়ে।
Dont be nervous! চলুন শতদলবাবু ঘরের মধ্যে চলুন। হরবিলাসবাবুর মুখেই এইমাত্র গতরাত্রের সমস্ত ব্যাপার শুনেছি, কিরীটী যেন একপ্রকার শতদলকে ঠেলেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।
আমরাও পিছনে পিছনে তার ঘরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করলাম।
দেখবেন, সাবধান, কাঁচের টুকরো এখনো ঘরময় ছড়িয়ে আছে! সাবধান করে দিলেন আমাদের শতদলবাবু।
০৫. শতদলবাবুর কথায় তাকিয়ে দেখলাম
শতদলবাবুর কথায় তাকিয়ে দেখলাম, সত্যিই ঘরময় ছোট-বড় কাঁচের টুকরো ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। কিরীটী সাবধানে পা ফেলে এগুতে এগুতে বললে, ইসু কাঁচের টুকরোগুলো এখনো এইভাবে ঘরময় ছড়িয়ে রেখে দিয়েছেন! কাউকে বলুন ঘরটা তাড়াতাড়ি পরিষ্কার করে দিতে!
হ্যাঁ, এক্ষুনি পরিষ্কার করাচ্ছি। বলে শতদল ভৃত্য অবিনাশকে ডেকে ঘরটা পরিষ্কার করে দিতে আদেশ দিল।
ঘরটা বেশ বড় আকারের হবে। ঘরের মেঝেটা লাল সিমেন্টের তৈরী এবং পুরাতন হলেও এখনো ঝকঝক করে এমন চমৎকার পালিশ। একধারে মস্ত বড় একটা পালঙ্ক এবং তারই একপাশে একটা লোহার সিন্দুক, কাঠের একটা চৌকির ওপরে বসানো। ঘরের অন্য কোণে একটা জানলার একেবারে বরাবর একটা লিখবার টেবিল; ঐ টেবিলটি এখন বিশেষ ব্যবহৃত হয় বলে মনে হয় না, কারণ টেবিলের উপরে নানা কাগজপত্র ও বই এলোমেলো ভাবে ছড়ানো রয়েছে। সেই টেবিলটা থেকে হাতচারেক দূরে অনেকটা ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় ছোট একটি রাইটিং টেবিল, তারই উপরে টেবিল ল্যাম্প বোধ হয় বসানো ছিল এবং জানালাপথে নিক্ষিপ্ত গুলির আঘাতে ল্যাম্পটি মেঝেতে ছিটকে পড়ে চিমনিটা ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে।
অবিনাশই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে একটা ঝাড়নের সাহায্যে কাঁচের টুকরোগুলো তুলে, তখনও মেঝের উপরে উলটে-পড়ে-থাকা ল্যাম্পটা তুলে রাখতে যাচ্ছে, কিরীটী এগিয়ে গিয়ে অবিনাশের হাত থেকে একদিকে খানিকটা টোলখেয়ে-যাওয়া ল্যাম্পটা হাতে নিলে চেয়ে, দেখি অবিনাশ, ল্যাম্পটা?
অবিনাশ ল্যাম্পটা কিরীটীর হাতে এগিয়ে দিয়ে ঘর হতে চলে গেল। বারকয়েক ল্যাম্পটাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে কিরীটী এগিয়ে গিয়ে ল্যাম্পটা সামনের টেবিলের উপর বসিয়ে রাখল। এবং হঠাৎ শতদলের একেবারে মুখোমখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল, গুলিটা কোন দিক দিয়ে এসে ঢুকেছিল শতদলবাবু?
সামনের ঐ বাগানের দিককার জানালাটাই রাত্রে খোলা ছিল। ঐ জানালাপথেই গুলিটা এসেছিল।
শতদলবাবু হাত তুলে ঘরের অনেকটা মধ্যস্থলে রক্ষিত রাইটিং-টেবিলটার ঠিক মুখোমুখি যে জানালাটা তখনও বন্ধ ছিল, সেইটার দিকে হাত তুলে দেখাল।
কিরীটী আর দ্বিতীয় প্রশ্ন উচ্চারণ না করে নিজেই এগিয়ে গিয়ে ছিটকিনিটা তুলে হাত দিয়ে ঠেলে জানালার বন্ধ কবাট খুলে দিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে কী যেন গভীর মনোযোগের সঙ্গে দেখতে লাগল।
কৌতুহলভরে আমি ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
এ বাড়ির পশ্চাতের অংশ সেটা। দেখলেই বুঝতে কষ্ট হয় না, দীর্ঘদিন জমিটা অসংস্কৃত অবস্থায় পতিত হয়ে আছে। বড় বড় ঘাস ও আগাছায় জায়গাটা জঙ্গলে পরিণত হয়েছে বললেও অত্যুক্তি হয় না। মধ্যে মধ্যে শেয়াকুলের ঝোপ ও ঝাউগাছ। শেষপ্রান্তে জমির সীমানা দেড়-মানুষ-সমান উঁচু, প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। প্রাচীরের ওদিক দিয়ে জমি ঢালু হয়ে নেমে গিয়েছে, সমুদ্র বেশ কিছুটা দূরে সেখান থেকে। ঐসব ঝোপ ও আগাছার মধ্যে আত্মগোপন করে থেকে আততায়ীর পক্ষে এই ঘরের মধ্যে অবস্থিত কাউকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়াটা এমন কিছু কষ্টসাধ্য ব্যাপার নয়, কারণ নিচের ঐ জমিতে দাঁড়িয়ে ঘরের এই জানালাটা খোলা থাকলে ঘরের ভিতরের অনেকটা অংশই চোখে পড়া সম্ভব মনে হল।
আততায়ী ঐখান থেকেই বোধ হয় শতদলবাবুকে রাত্রে আলোর সামনে বসে থাকতে দেখে গুলি ছুড়েছিল। কথাটা কিরীটীকে সম্বোধন করেই নিম্নস্বরে বললাম আমি।
কিরীটী বোধ হয় নিজের আত্মচিন্তায় অন্যমনস্ক ছিল, আমার প্রশ্নে চমকে ফিরে তাকাল, কী বলছিলি সুব্রত?
বলছিলাম, ঐখান থেকে অনায়াসেই গুলি ছোঁড়া যেতে পারে।
তা পারে। মৃদুকণ্ঠে কিরীটী জবাব দিল। কিরীটীর কণ্ঠস্বরে যেন কোন আগ্রহের সুরই নেই।
রাণু এতক্ষণ একটি কথাও বলেনি আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘরে প্রবেশ করা অবধি, এবারে সে শতদলকে বলছে শুনতে পেলাম, তুমি কিন্তু সত্যিসত্যিই কাল খুব বেঁচে গেছ শতদল!
হ্যাঁ, তাই তো দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি রাণু, এখনো যেন এর মাথামুন্ডু, কিছুই আমি বুঝে উঠতে পারছি না! আমাকে কারো হত্যা করে কী লাভ থাকতে পারে। তা ছাড়া তুমি তো জান, এ জগতে কারো সঙ্গেই আমার কোন শত্রুতা নেই।
কিন্তু ব্যাপারটা যে রকম দাঁড়াচ্ছে–
রাণুর কথায় প্রতিবাদ জানিয়ে শতদল বলে, সে যাই হোক, ব্যাপারটা ক্ৰমে এমন দাঁড়াচ্ছে যে, এর একটা হেস্তনেস্ত না করে চুপ করে বসে থাকাটাও হয়তো আর উচিত হবে না। আপনি কি বলেন মিঃ রায়?
হ্যাঁ, তা বইকি। We must see to its end! কিরীটী ফিরে দাঁড়িয়ে জবাব দিল।
তাহলে এখন আমার কী করা উচিত? আপনার পরামর্শ কী?
সেইটাই এতক্ষণ আমি ভাবছিলাম, শতদলবাবু। দুটো কাজ সর্বাগ্রে আপনাকে করতে হবে। কিরীটী শতদলের দিকে তাকিয়ে বলে।
কী, বলুন?
প্রথমত সমস্ত ব্যাপারটা এখানকার স্থানীয় থানা-ইনচার্জকে জানাতে হবে। কারণ তাঁদের বাদ দিয়ে আমরা এসব ব্যাপারে এক পাও এগুতে পারব না, তাছাড়া সেটা একেবারেই আইনসঙ্গতও হবে না।
হ্যাঁ, গতরাত থেকে আমিও ঐ কথাটাই ভাবছিলাম। মৃদুভাবে শতদল বলে।
শুধু, ভাবা নয় মিঃ বোসু আপনার উচিত ছিল ইতিমধ্যে থানা-ইনচার্জকে সমস্ত ব্যাপার বলে তাঁর পরামর্শ নেওয়া। যাক আর দেরি করবেন না, এখুনি কোন একজনকে থানায় পাঠিয়ে দিন এবং লিখে পাঠান তিনি যেন এখনি একবার অনুগ্রহ করে এখানে আসেন, লিখবেন বিশেষ জরুরী।
এখনি দেব? হ্যাঁ, আর এক মুহূর্তও দেরি করা উচিত হবে না।
কিরীটীর নির্দেশমত তখুনি শতদল একটা কাগজে স্থানীয় থানা অফিসারকে সংক্ষেপে ব্যাপারটা লিখে এবং কিরীটীর নামটাম ঐ সঙ্গে যোগ করে মালী রঘুকে দিয়ে পাঠিয়ে দিল।
থানা অফিসার আসুন, ততক্ষণ আমরা চা-পান-পর্বটা শেষ করে নিই, কি বলেন শতদলবাবু!
নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। আমি এখনি আসছি, শতদল বোধ হয় সকলের চায়ের ব্যবস্থা করতেই ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
রাণু দেবী সমুদ্রের দিককার খোলা জানালাটার ধারে গিয়ে চুপচাপ বাইরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
আমি কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ওঁরা দুজনেই যে নার্ভাস হয়ে গিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে!
কিরীটী পকেট থেকে সিগার-কেসটা বের করে একটা সিগার কেস থেকে টেনে নিয়ে সেটাতে অগ্নিসংযোগের চেষ্টায় ছিল, আমার কথার কোন জবাব দিল না। বুঝতে পারলাম তার নিঃশব্দতার কারণ। কোনো একটা বিষয়ে যখনই সে গভীরভাবে চিন্তা করে, সেই চিন্তার মধ্যেই সে বরাবর এমনভাবে অন্যমনা হয়ে যায় যে বাইরের পারিপার্শ্বিকের থেকে সে যেন অনেক দূরে চলে যায়।
আমি আর একবার কতকটা অনন্যোপায় হয়েই ঘরটার চারদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। ঘরটার দিকে তিনটে তিনটে করে ছটা জানালা। দক্ষিণের দিকে সমুদ্র, উত্তরের দিকে একটু পূর্বে দেখা সেই খোলা জমিটা— প্রাচীর দিয়ে ঘেরা বাড়িটার পশ্চাতের অংশ। ঘরের দেওয়ালে বড় বড় সব অয়েল-পেনটিং এবং সবগুলোই নারী ও পুরুষের প্রতিকৃতি। বোধ হয় শিল্পী রণধীর চৌধুরীর পূর্বপুরুষদের প্রতিকৃতি। প্রত্যেকটি প্রতিকৃতি যেন একেবারে সজীব, প্রাণবন্ত। কী অদ্ভুত শিল্পচাতুর্য!
শতদল এসে প্রবেশ করল অবিনাশকে সঙ্গে নিয়ে, অবিনাশের হাতে চায়ের ট্রে।
চা পরিবেশন করল রাণু দেবী কিরীটীরই অনুরোধে। চা-পান করতে করতেই একসময় কিরীটী তার অর্ধসমাপ্ত কথার জের টেনেই যেন বলতে লাগল, যে কথাটা আপনাকে বলতে বলতে থেমে গিয়েছিলাম, আমার কিন্তু মনে হয়, এর পর আর আপনার এইভাবে একা একা এ বাড়িতে থাকা উচিত হবে না। এবং যুক্তিসঙ্গতও হবে না মিঃ বোস।
রাণু যেন কিরীটীর কথাটা কতকটা লুফে নিল। সে বলে ওঠে, আমিও সেই কথাটাই বলব বলব ভাবছিলাম তোমাকে শতদল। কিরীটীবাবু, ঠিকই বুলেছেন। এ বাড়িতে আর তোমার এভাবে risk নিয়ে একা একা থাকা উচিত নয়।
তোমার যেমন কথা রাণু! একা একা আবার আমি এ বাড়িতে আছি কোথায়? ভিতরের মহলে অবিনাশ আছে, দিন দুই হল অবিনাশের এক ভাইপো এসেছে, রমেশ। তাকেও এ বাড়ির কাজে আমি নিযুক্ত করেছি, তাছাড়া দাদুর একমাত্র বোন হিরন্ময়ী দিদি ও হরবিলাস দাদা এবং তাঁদের মেয়ে সীতা আছে। এতগুলো লোক বাড়িতে আছে। প্রতিবাদ জানায় শতদল।
তা হোক শতদলবাবু হরবিলাসবাবু ও তাঁর স্ত্রী-কন্যা তাঁরা সকলেই থাকেন বাইরের মহলে। ভিতরে এত বড় মহলটায় বলতে গেলে আপনি তো একাই থাকেন। অবিনাশের বয়স হয়েছে, সেও হয়তো থাকে ভিতরের দিকে, কিন্তু এ অবস্থায় রাত্রে যদি আচমকা একটা বিপদ-আপদ ঘটে তো সময়মত কারো সাহায্যও তো আপনি পাবেন না! তা ছাড়া আমি এমন একজন লোককে সর্বদা আপনার কাছে কাছে রাখতে চাই, যিনি সর্বতোভাবে আপনাকে সাহায্য তো করতেই পারবেন এবং সর্বদা আপনার প্রতি দৃষ্টিও রাখতে পারবেন। কিরীটী জবাব দেয়।
কিন্তু এমন কোন একজন সহচর আমি এখন পাই বা কোথায় মিঃ রায়? শতদল যেন একটু চিন্তিতই হয়ে ওঠে।
এমন কোন আত্মীয় কেউ কি আপনার নেই, যিনি অন্ততঃ কিছুদিন এসে আপনার কাছে থাকতে পারেন?
কিছুদিন মানে! সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায় শতদল কিরীটীর মুখের দিকে।
এই ধরুন, দিন ১৫।২০! দেখুন না ভেবে কেউ আছেন কিনা? কিরীটী আবার শতদলের মুখের দিকে তাকায় কথাটা বলে।
না, এমন কাউকেই মনে পড়ছে না। তবে আমার দাদার বোন ঐ হিরন্ময়ী দেবী, ওঁদেরই না হয় আমি অনুরোধ জানাতে পারি ভিতরের মহলে এসে থাকতে-শতদল বলে।
আমার মনে হয়, সেইটাই সব চাইতে ভাল ব্যবস্থা হবে। আমিই কথাটা বলি।
হরবিলাসবাবু ও তাঁর স্ত্রীকে অনুরোধ জানাতে তাঁরা শেষ পর্যন্ত স্বীকৃত হলেন অন্দরমহলে এসে থাকতে এবং মনে হল হরবিলাস যেন প্রস্তাবটা আনন্দের সঙ্গেই গ্রহণ করলেন। কিন্তু কেন যেন আমার মনে হল কিরীটীর এ প্রস্তাবে হরবিলাসবাবু, সম্মত হওয়ায় শতদল খুব বেশী সন্তুষ্ট হতে পারেনি। হরবিলাসবাবুকে প্রস্তাবটা জানাবার জন্য আমরাই সকলে নিচে বাইরের মহলে গিয়েছিলাম। হরবিলাস-পরিবারের স্থান পরিবর্তনের ব্যবস্থাটা যাতে ঐদিনই সম্ভব হয়, কিরীটী শতদলকে সেই অনুরোধ জানাল।
শতদল বললে, রঘু ফিরে আসুক, সে এলেই অবিনাশ ও রঘু সব ব্যবস্থা করে দেবেখন।
ঠিক এই সময় রঘু এসে ঘরে প্রবেশ করল এবং বললে, দারোগাবাবু এসেছেন নিজেই। বাইরে অপেক্ষা করছেন।
চলুন শতদলবাবু উপরে আপনার ঘরে যাওয়া যাক। রঘু, দারোগাবাবুকে উপরের ঘরে নিয়ে এস। রঘুর দিকে তাকিয়ে কিরীটী নির্দেশ দিল।
শতদলবাবুকে নিয়ে আমরা অন্দরমহলে তাঁর ঘরের দিকে অগ্রসর হলাম, রঘু বাইরে চলে গেল দারোগাবাবুকে ডাকতে।
স্থানীয় থানা-ইনচার্জ রসময় ঘোষাল, বয়স তেত্রিশের বেশী হবে না।
ভদ্রলোকের বোধ হয় নিয়মিত ব্যায়াম করা অভ্যাসু বেশ বলিষ্ঠ পেশীবহুল চেহারা। লোকটি কথাবার্তায় অত্যন্ত অমায়িক। আমি কিরীটীর পরিচয় দিতে তিনি সোল্লাসে এগিয়ে এসে কিরীটীর সঙ্গে করমর্দন করলেন, কী সৌভাগ্য, আপনিই মিঃ কিরীটী রায়?
ভদ্রলোকের অমায়িক ব্যবহারে আমিও যেন মনে মনে অনেক স্বস্তি পাই। অন্ততঃ এর পর প্রতি পদে যার সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে হবে, তাঁর মধ্যে কোন পলিসী অহমিকা বা গাম্ভীর্য নেই। সত্যিই ভদ্রলোক।
কিরীটীই শতদলবাবুর সঙ্গে ঘোষাল সাহেবের পরিচয়টা ঘটিয়ে দিল, ইনিই শতদলবাবু এই বাড়ির মালিক; ইনিই আপনাকে চিঠি দিয়ে পাঠিয়েছিলেন মিঃ ঘোষাল।
বলতে লজ্জা নেই মিঃ রায়, আমি কিন্তু ওঁর চিঠিতে আপনি এখানে উপস্থিত জেনেই, থানার সমস্ত কাজ ফেলে তাড়াতাড়ি এখানে ছুটে এসেছি। কী আশ্চর্য দেখুন, আপনি এখানে এসেছেন জানতেও পারিনি।
মিঃ ঘোষালের কথা শুনে শতদল একবার ঘোষালের দিকে তাকালেন।
কিরীটীর দিকে চেয়ে দেখি, কিরীটী কিন্তু মৃদু মৃদু হাসছে। ব্যাপারটার মধ্যে যে হাসির কি কারণ থাকতে পারে সেদিন ঐ মুহূর্তে বুঝিনি, পরে যখন রহস্যটা উপলব্ধি করেছিলাম—থাক, সে কথা, বহুবার বহু ক্ষেত্রে দেখেছি, কিরীটীর অত্যাশ্চর্য অনুসন্ধানী দৃষ্টি রহস্য উদঘাটনের ব্যাপারে সর্বদা এমন ভাবে সজাগ থাকে যে, ভাবতেও বিস্ময়ে যেন অভিভূত হয়ে যেতে হয়। শুধুমাত্র তাই নয়, বহুক্ষেত্রে তুচ্ছাদপি তুচ্ছ ঘটনা, অনেক সময় যার কোন তাৎপর্যই হয়তো আমরা খুঁজে পাই না,—কিরীটী প্রবলভাবে সেইটার প্রতি ঝুঁকে পড়ে। এবং বারংবার সেইটা নিয়েই নাড়াচাড়া করতে থাকে নিজের মনের গভীর তলদেশে। কিরীটীকে ঐ সম্পর্কে পরে প্রশ্নও করেছি। জবাবে সে বলেছে, প্রত্যেক মানুষেরই বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ আছে সুব্রত এবং তার বিচার-পদ্ধতিটাও মানুষ-বিশেষে বিভিন্ন। সামান্য একটা তুচ্ছ ঘটনা, যা হয়তো অনেকেরই চিন্তায় রেখাপাতও করে না, অনেক সময় সেই তুচ্ছর মধ্যেই আমি রহস্যেরই ইঙ্গিত পাই।
কিরীটীর কথায় আবার আমার সম্বিৎ ফিরে এল, তাহলে আপনাকে আগাগোড়া ব্যাপারটা খুলেই বলি, মিঃ ঘোষাল। যদিও ব্যাপারটার মধ্যে কাল পর্যন্তও শতদলবাবু কোন গুরুত্বই আরোপ করেন নি এবং গতরাত্রি থেকে কতকটা বাধ্য হয়েই মত পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছেন, সেটা হচ্ছে ভদ্রলোক বর্তমানে সত্যিই বিপন্ন হয়ে পড়েছেন। আমরা সোজা করে বললে বলা উচিত, শতদলবাবুর প্রাণ কয়েক দিন থেকে বিপন্ন হয়ে উঠেছে।
বিপন্ন হয়ে উঠেছে, কী রকম? প্রশ্ন করে ঘোষাল মশাই কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।
Somebody is after his life!
বলেন কী? সত্যি?
হ্যাঁ, চার-চারটে attempt, অর্থাৎ অত্যন্ত সাধুপ্রচেষ্টা ওঁর জীবনের ওপরে হয়ে গিয়েছে!
চার-চারবার attempt হয়েছে?
হ্যাঁ। প্রথমবার, ঐ যে দেখছেন খাটের পাশে মাটিতে নামানো বড় অয়েল পেনটিংটা, ঐটাই বোধ হয় ওঁর অজ্ঞাতে কোন এক সময় এমন কায়দা করে ফিট করে রাখা হয়েছিল, যাতে করে রাত্রে ঘুমের ঘোরে কোন এক সময় সহসা ছবিটা মাথার উপরে ছিড়ে পড়ে ওঁর মাথাটা থেতলে দিয়ে ওঁর মত্যু ঘটায়। যদিও ব্যাপারটা গতকালই মাত্র ওঁর মুখে শোনা, আজ ঘরে ঢুকে একসময় ইতিপূর্বে ঐ ছবিটার প্রতি নজর দিয়েই আমি দেখেছি এবং আপনিও ইচ্ছা করলে এগিয়ে গিয়ে দেখে আসতে পারেন, ছবিটা টাঙানো ছিল একটা মোটা তার দিয়ে এবং সে তারটাকে এমন ভাবে সামান্য একটু অংশ বাকি রেখে কাটা হয়েছে যে ছবির ভারে বাকি তারের অংশটুকু ছিড়ে পড়া একসময় এমন কিছুই বিচিত্র নয়।
কিরীটীর কথা শুনে আমরা সকলেই খাটের পাশে নামিয়ে রাখা ছবিটির দিকে তাকালাম এবং বুঝলাম কিরীটীর কথাটা মিথ্যা নয়। গতকাল সকালে হোটেলের সামনে সী-বীচে শতদলবাবু ছবি সম্পর্কে কিরীটীকে কী বলেছিলেন ভুলেই গিয়েছিলাম। আজ আবার হঠাৎ কিরীটীর কথায় মনে পড়ে গেল।
এগিয়ে গেলাম সকলে কিরীটীর সঙ্গে-সঙ্গেই ছবিটার দিকে।
যে তারের সাহায্যে ছবিটা দেওয়ালে পেরেকের সঙ্গে পাকাপোক্তভাবে টাঙানো ছিল, দেখলাম পরীক্ষা করে, সত্যি সত্যিই সে তারটা কোন কিছুর সাহায্যে এমন ভাবে কাটা যে বাকি যে অংশটুকু কাটা ছিল না সেটা ছবির ভারেই ছিড়ে গিয়েছে। কিরীটী কথাটা ভোলেনি এবং আজ ঘরে প্রবেশ করে অন্যান্য কথাবার্তার মধ্যেও ছবিটাকে লক্ষ্য করেছে এবং বেশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতেই সবটকু লক্ষ্য করেছে ইতিমধ্যেই। কিরীটী আবার বলতে লাগল, তারপর দ্বিতীয়বার attempt হয় এই বাড়ির বাইরে। এখানে আসবার সময়ই লক্ষ্য করে থাকবেন হয়তো মিঃ ঘোষাল, বাড়ির গেট থেকে যে রাস্তাটা বরাবর সামনের দিকে চলে গিয়েছে, বাড়িটা পাহাড়ের উপর অবস্থিত বলে রাস্তাটা ক্ৰমে ঢালু হয়ে নিচে গিয়েছে, সেই ঢালু রাস্তা দিয়ে একসময় শতদলবাবু যখন অন্যমনস্ক হয়ে নিচে নেমে যাচ্ছেন, পিছন থেকে কেউ একটা বড় পাথরের চাঁই গড়িয়ে দিয়ে ওঁকে পিষে মেরে ফেলবার চেষ্টা করেছিল।
ঘোষাল শতদলের মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন।
হ্যাঁ। মৃদু কণ্ঠে শতদল বললে, প্রথমটায় আমি বিশ্বাস করিনি। ব্যাপারটা, ভেবেছিলাম হয়তো সাধারণ ভাবেই হঠাৎ পাথরের চাঁইটা নিচের দিকে গড়িয়ে গিয়েছিল, কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, কিরীটীবাবুর কথাই ঠিক, that was also an attempt on my life!
তারপর তৃতীয় প্রচেষ্টা গতকাল সকালে সমুদ্রসৈকত হোটেলের সামনে সী বীচে কিরীটী আবার বলে।
বলেন কি মিঃ রায়? হ্যাঁ, and that was a bullet! কিন্তু আততায়ী লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। ফলে
উনি তো বেঁচে যানই, আমার পৈতৃক প্রাণটাও—মানে প্রাণ ঠিক নয়, মাথাটাও বেঁচে যায়।
সত্যি? বিস্ময়ে যেন একেবারে হাঁ হয়ে গিয়েছেন ঘোষাল কিরীটীর কথায়।
হ্যাঁ, আমার মাথার টুপিটা ফুটো করে এ-ফোঁড় ওফোঁড় হয়ে বুলেটটা বের হয়ে যায়। এবং সেই ব্যাপারের পরই আকস্মিকভাবে ওঁর সঙ্গে আমাদের চেনা-পরিচয়। আমি আর সুব্রত তখন ঠিক ঐ সময় সী-বীচে বসে রৌদ্রসেবন করছিলাম।
কই, এ কথা তো তুমি কাল আমাকে বলনি শতদল! এতক্ষণে প্রশ্ন করল রাণু শতদলকে।
কী বলব তোমাকে, গতকাল ব্যাপারটা আমি কি বিশ্বাস করেছিলাম! শতদল বিষণ্ণ ভাবে জবাব দেয়।
কিন্তু দিনের আলোয় অমন জায়গায় কাউকে গুলি করে হত্যা করবার প্রচেষ্টা, এ যে তাজ্জব ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে মিঃ রায়! আপনি না হয়ে অন্য কারো মুখে ব্যাপারটা শুনলে তো আমি বিশ্বাসই করতাম না, হেসেই উড়িয়ে দিতাম। ঘোষাল বললেন।
ব্যাপারটা অবশ্য কতকটা সেই রকমই বটে, মিঃ ঘোষাল। তবে অনেক সময় দেখা গিয়েছে, সত্যিকারের তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন ক্রিমিন্যাল দু-একটা ঐ প্রকারের দুঃসাহসের কাজ করে থাকে। যাই হোক, এর পর আমি কতকটা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই শতদলবাবুকে fourth attempt সম্পর্কে বিশেষভাবে সতর্ক করে দিই!
দিয়েছিলেন ওঁকে সতর্ক করে?
হ্যাঁ। And the fourth attempt was rather too early! ভাবতেই পারিনি, এত দ্রুত আবার আততায়ী ওঁর জীবনের উপরে attempt নেবে! এবারেও গুলি এবং এই ঘরের মধ্যে।
এই ঘরের মধ্যে?
হ্যাঁ। পিছনের বাগান থেকে কেউ ওঁকে গতরাত্রে টেবিলের সামনে আলোয় বসে লেখাপড়া করতে দেখে নিশ্চিন্ত মনে বন্দুক চালায়। এবং সৌভাগ্যবশতঃ এবারের নিক্ষিপ্ত মত্যুবাণটিও লক্ষ্যভেদ করতে সক্ষম হয়নি আততায়ীর। আলোর চিমনিটার উপর দিয়ে গিয়েছে। এরপর আপনাকে সংবাদ না দিয়ে থাকাটা এবং সব কিছু আপনার গোচরীভূত না করাটা বিবেচনার কাজ হবে না বুঝেই আপনাকে সংবাদ পাঠানো হয়েছে। Now you are in the spot, এবারে আপনি এর একটা বিহিত করুন, কারণ আইন আপনাদেরই হাতে। আমরা সম্পূর্ণ তৃতীয় ব্যক্তি, বুদ্ধি বা মৌখিক সাহস দিতে পারি ওঁকে, কিন্তু সত্যিকারের সাহস বলতে যা বোঝায় একমাত্র তা উনি আপনাদের কাছেই আশা করতে পারেন ও পেতে পারেন। কিরীটী চুপ করল।
ঘোষালের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সমস্ত ঘটনা শোনবার পর তাঁর অবস্থা কতকটা ন যযৌ ন তস্থৌ।
ভদ্রলোক বিমুঢ় ও বিহ্বল হয়ে পড়েছেন। অসহায়ের মতই ঘোষাল কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।
কিন্তু এ ব্যাপারে আমি যে ঠিক কি ভাবে ওঁকে সাহায্য করতে পারি, সেটা তো বুঝে উঠতে পারছি না মিঃ রায়। অবশ্য যদি উনি ভালো বোঝেন তো জন-দুই পাহারাওয়ালা এ বাড়িতে চব্বিশ ঘণ্টার জন্য মোতায়েন করতে পারি!
কিন্তু তাতে করে বিশেষ কোন ফল হবে বলে কি আপনার মনে হয়, মিঃ ঘোষাল? কিরীটী ঘোষালের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে।
তবে কি ভাবে আমি সাহায্য করতে পারি বলুন! I would be always at your service! ঘোষাল বললেন।
তার চাইতে যদি কোন plain dress-এর গোয়েন্দাকে সর্বদা শতদলবাবুকে পাহারা দেবার জন্য নিযুক্ত করা যায়, কথাটা আমি বললাম।
না, না মিঃ ঘোষাল, ও-সব কিছুর প্রয়োজন নেই। তার চাইতে যা বলছিলেন, রাত্রে জন-দুই যদি পাহারাওয়ালা আমার এ বাড়িটা পাহারা দেবার জন্য পাঠাতে পারেন, আমি নিশ্চিত হতে পারি। শতদলবাবু আমার কথার প্রতিবাদ জানান।
কিরীটী নিঃশব্দে চোখ বুজে আপন মনে চেয়ারটার উপর বসে পা নাচাচ্ছিল, শতদলবাবুর প্রতিবাদে একটিবার মাত্র বোজা চোখ দুটি খুলে শতদলের মুখের দিকে তাকিয়েই আবার পূর্ববৎ পা নাচাতে লাগল।
শতদলবাবুর প্রস্তাবে কতকটা যেন নিশ্চিত হয়েছেন বলে ঘোষালকে মনে হল। তিনি কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তাহলে সেই ব্যবস্থাই করি, মিঃ রায়?
কিরীটী সহসা উঠে দাঁড়ায়, হ্যাঁ, আপাততঃ তাই করুন। আচ্ছা শতদলবাবু আমরাও তাহলে উঠি। আপনি তাহলে হরবিলাসবাবুদের অন্দরমহলে আনার ব্যবস্থা করুন আজই।
হ্যাঁ, তাই করব। তবে আপনার সাহায্যও কিন্তু আমি চাই, মিঃ রায়!
কিরীটী হাসল, তা অবশ্যই পাবেন বইকি। তা ছাড়া ব্যাপারটায় আমি নিজেও কম interested নই। চল সুব্রত,—কিরীটী দরজার দিকে অগ্রসর হয়। ঘোষালও আমাদের অনুসরণ করলেন।
সিঁড়ির শেষ ধাপে অবিনাশের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।
কিরীটী হঠাৎ থেমে দাঁড়াল, অবিনাশ?
আজ্ঞে বাবু!
অনেকদিন এ বাড়িতে আছ, না?
হ্যাঁ, বাবু, মশাইয়ের কাছেই আমি তো পনের বছর চাকরি করেছি
হঠাৎ কিরীটী শতদলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, আচ্ছা শতদলবাবু কতদিন আগে আপনার ঘরের সেই ছবিটা ছিড়ে পড়েছিল বলুন তো?
তা দিনচারেক আগে হবে। শতদলবাবু জবাব দেন।
ব্যাপারটা তুমি জান অবিনাশ? কিরীটী ঘরে দাঁড়িয়ে এবারে অবিনাশকে প্রশ্ন করে, শতদলবাবুর ঘরের ছবি ছিড়ে পড়ে গিয়েছিল!
হ্যাঁ বাবু, দেখেছি। তাজ্জব ব্যাপার! অমন মোটা তারটা যে কী করে ছিড়ল—
ছেড়েনি তো–কেউ কেটে রেখেছিল তারটাকে! কিরীটী জবাব দেয়।
বলেন কি বাবু! বিস্মিত অবিনাশ কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।
হ্যাঁ। তুমি আর রঘু ছাড়া তো বাড়ির মধ্যে কেউ ঢোকে না? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
আজ্ঞে না। তবে দিনকতক হল আমার ভাইপো এসেছে, বাবু তাকে চাকরিতে বহাল করেছেন দয়া করে।
ও! বাবুর রান্নাবান্না করে কে?
হিন্দুস্থানী ঠাকুর আছে একটা, বাবুর সঙ্গেই তো এসেছে। অবিনাশ জবাব দেয়।
কই, আপনি তো সেকথা বলেননি শতদলবাবু? কিরীটী প্রশ্ন করে শতদলের মুখের দিকে তাকায়।
মনে ছিল না। হ্যাঁ, ভুখনা আছে, আমার সঙ্গেই এসেছে, লোকটা বোবা আর কালা।
বোবা আর কালা! এমন রত্নটি কোথায় পেলে শতদল? প্রশ্নকারী রাণু দেবী।
লোকটা অনেকদিন থেকেই আমার কাছে আছে। জাতে ছত্রী। রান্না করে চমৎকার। শতদল জবাব দেয়।
কই ডাকুন তো, দেখি লোকটাকে! আমিই বলি।
অবিনাশ, ভুখনাকে ডেকে নিয়ে এস তো! শতদল অবিনাশের দিকে তাকিয়ে আদেশ করে।
অবিনাশ ভুখনাকে ডাকতে চলে গেল। আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম সকলে।
০৬. দ্রষ্টব্য বটে ভুখনা
ভুখনাকে ডেকে নিয়ে এল অবিনাশ।
দ্রষ্টব্য বটে ভুখনা। যেমনি লম্বা তেমনি ঢ্যাঙা। দৈর্ঘ্যে প্রায় ছয় ফুট ছয় ইঞ্চির কাছাকাছি হবে। দেহের অতিরিক্ত দৈর্ঘ্যের জন্যই বোধ হয় লোকটা একটু কোলকুজো হয়ে হাঁটে। বড় বড় ভাসা ভাসা দুটো চোখের তারায় কেমন একপ্রকার বোবা নির্বোধ দৃষ্টি। ছড়ানো চৌকো চোয়াল। মাথার চুলগুলো ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া, অন্ধকারে আচমকা লোকটাকে দেখলে আঁতকে ওঠাও কিছু অসম্ভব নয়।
লোকটা তো বলছিলেন বোবা আর কালা, তা ওকে দিয়ে কাজ চালান কেমন করে শতদলবাবু? প্রশ্ন করল কিরীটী।
অনেকদিন আমার কাছে থেকে থেকে এখন আমার মুখ নাড়া দেখলেই ও বুঝতে পারে কী আমি বলতে চাই। তাই কাজকর্মের কোন অসুবিধা হয় না। তা ছাড়া একমাত্র রান্না করানো ছাড়া ওকে দিয়ে তো আর অন্য কোন কাজই করানো হয় না। শতদল জবাব দেয়।
এখানে আসবার পূর্বে তো আপনি কলকাতাতেই ছিলেন—তাই না শতদলবাবু?
হ্যাঁ, কলকাতার একটা বেসরকারী কলেজের আমি ইংরেজীর অধ্যাপক।
কিরীটী আবার অবিনাশের দিকে ফিরে তাকিয়ে তাকেই প্রশ্ন করল, ভুখনা একেবারেই শুনতে পায় না অবিনাশ, না?
তাই তো মনে হয় বাবু, একেবারে বেহদ্দ কালা!
এমন সময় সহসা গতরাত্রের সীতার সেই ভয়ঙ্কর আলসেসিয়ান কুকুরটার ডাক শুনতে পেলাম।
ঘেউ ঘেউ করে টাইগার ডাকছে।
আমরা সকলেই কুকুরের ডাকে চমকে বোধ হয় ক্ষণেকের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, হঠাৎ কিরীটীর দিকে তাকিয়ে দেখি, নিপলক দৃষ্টিতে সে ভুখনার দিকেই তাকিয়ে আছে।
ভুখনার চোখে কিন্তু সেই বোবা নির্বোধ দৃষ্টি। নিষ্প্রাণ, স্থির।
চলুন মিঃ ঘোষাল! কিরীটীই আবার সর্বাগ্রে দরজার দিকে এগিয়ে গেল!
আমরাও সকলে তাকে অনুসরণ করলাম।
শতদল গেট পর্যন্ত আমাদের পৌঁছে দিয়ে বিদায় নিয়ে ফিরে গিয়েছে।
নিঃশব্দে সর্বাগ্রে কিরীটী ও মিঃ ঘোষাল পাশাপাশি এবং আমি ও রাণু দেবী পাশাপাশি পাহাড়ের ঢালুপথটা দিয়ে এগিয়ে চলেছি হোটেলের দিকেই।
সকালের শীতের রৌদ্রে নীল সমুদ্র যেন চূর্ণ ঢেউয়ের মাথায় মাথায় গুচ্ছ গুচ্ছ জুঁই ফুল ছড়িয়ে আপন মনে খেলে চলেছে। আমার মনের মধ্যে তখন নিরালা ও তার অধিবাসীদের কথাই ঘোরাফেরা করছে।
শতদলবাবুর জীবন বিপন্ন সন্দেহ নেই, কিন্তু কেন? কোন গোপন রহস্য। কি ঐ নিরালার মধ্যে লুকিয়ে আছে? কিংবা কোন গুপ্তধন? শতদলই শিল্পী রণধীর চৌধুরীর যাবতীয় সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হল কি করে? আইনের দিক থেকে সীতা বা তার মা হিরাণ্ময়ী দেবীর কি কোন স্বত্বই নেই মত শিল্পীর সম্পত্তিতে? এবং শতদল সীতা ও হিরণ্ময়ী দেবী ব্যতীত আর কোন উত্তরাধিকারীই কি নেই? আর শতদলবাবুই বা বলেন কি করে তিনিই তাঁর মত দাদুর যাবতীয় সম্পত্তির একমেবাদ্বিতীয়ম উত্তরাধিকারী? কোন উইল বা ঐ জাতীয় কোন লেখাপড়া আছে কি? মৃত শিল্পী রণধীর চৌধুরীর কি কোন আইন-উপদেষ্টা সলিসিটার বা অ্যাটিনী ছিল না? না আছে? বৎসরাধিককাল হরবিলাসু তাঁর স্ত্রী হিরাণ্ময়ী ও তাঁদের কন্যা সীতা ঐ নিরালাতে আছেন এবং রণধীর চৌধুরীর জীবিতকালে তাঁরই আমন্ত্রণে রুগ্ন হিরণ্ময়ী ওখানে আসেন তাঁরা বাইরের মহলে থাকেন কেন? ব্যবস্থাটা কি রণধীর চৌধুরীরই? তাই যদি হয়, তাহলে নিজের রুগ্না ভগিনীর প্রতি এ ব্যবহার কেন? কোন কারণবশতঃই কি তিনি রণধীর চৌধুরী তাঁর রগ্ন বোনকে বাইরের মহলেই এনে স্থান দিয়েছিলেন? ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে, তথাপি হিরাণ্ময়ী দেবীরা এখনো এখান হতে অন্যত্র যাননি কেন? হরবিলাসদের কী ভাবেই বা সংসারযাত্রা নির্বাহ হয়? পূর্বেই বা কী করতেন, এখনই বা কী করেন! পেনশন পান, না কোন জমিদারী বা সঞ্চিত অর্থ আছে! তাই যদি থাকে, তাহলে এভাবে হতাদরে বহির্মহলে পড়ে থাকবারই বা কী কারণ থাকতে পারে! বাড়ির প্রত্যেকটি প্রাণীই যেন আমার মনের মধ্যে আনাগোনা করে ফিরতে থাকে। একান্তভাবে পত্নীর শরণাপন্ন ও মুখাপেক্ষী হরবিলাসু তাঁর স্ত্রী—পক্ষাঘাতগ্রস্ত চলচ্ছক্তিহীন প্রৌঢ়া স্ত্রী হিরণ্ময়ী; তাঁর চক্ষুর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। তাঁদের একমাত্র তরুণী কন্যা সীতা যেন একটি নির্বাক দ্রষ্টা। সদা-সঙ্গী তার ভীষণাকৃতি আলসেসিয়ান কুকুর-টাইগার। বৃদ্ধ পুরাতন ভৃত্য অবিনাশ। পুরাতন মালী রঘু। শতদলের বোবা ও কালা ছত্রী অনুচর ভুখনা। সহজ সরল অধ্যাপক মানুষ শতদল ক্রোড়পতির একমাত্র কন্যা অনন্যাসুন্দরী তরুণী রাণু দেবীর অনুরক্ত।
নিঃশব্দেই আমরা সকলে দীর্ঘ পথটা অতিক্রম করে হোটেলের সামনে এসে দাঁড়ালাম। ঘোষাল কিরীটীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তাহলে এবারে আমাকে বিদায় দিন মিঃ রায়!
তা কি হয়, এক কাপ চা অন্তত না খেয়ে—আসুন? রাণু দেবী, আপনি? কিরীটী রাণুর মুখের দিকে তাকাল।
আমাকে ক্ষমা করতে হবে মিঃ রায় কয়েকটা জরুরী চিঠি সকালেই আমাকে শেষ করতে হব। তা ছাড়া অনেকক্ষণ বের হয়েছি, মা হয়তো ব্যস্ত হয়ে আছেন।
রাণু বিদায় নিয়ে উপরে চলে গেল।
আমরা তিনজনে হোটেলের বারান্দায় এসে বসলাম তিনটে চেয়ার টেনে নিয়ে। আমার মাথার মধ্যে তখনও পূর্বের চিন্তাগুলোই নিঃশব্দে পাক খেয়ে খেয়ে ফিরছে। সম্মুখের রৌদ্রালোকিত সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে বসে রইলাম আমি।
কিরীটী ও ঘোষাল নিম্নস্বরে কী সব আলাপ করতে লাগল।
মধ্যে মধ্যে কেবল তাদের দু-একটা কথার অস্পষ্ট টুকরো শ্রুতিপথে আমার ভেসে আসছিল। বুঝলাম সম্পূর্ণ অন্য সাধারণ কথাবার্তা। নিরালা সম্পর্কে বা শতদল-ঘটিত কোন আলোচনাই নয়।
দিন দুই এর পর যেন কতকটা নির্বিবাদেই কেটে গেল। দুটো দিন কিরীটীও বিশেষ হোটেল থেকে কোথাও একটা বের হয়নি। বেশীর ভাগ সময়ই বারান্দায় ডেকচেয়ারে শুয়ে নিঃশব্দে একটার পর একটা সিগার ধংস করেছে। মনে হয়েছে, সে যেন চারিদিক হতে হঠাৎ নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে বিশেষ কোন একটা চিতায় সমাধিস্থ হয়ে পড়েছে। তৃতীয় দিন হঠাৎ বিকালের দিকে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললে, চল সুব্রত, সমুদ্রের ধার দিয়ে একটু ঘুরে আসা যাক।
দুজনে নিঃশব্দে সমুদ্রের বালুবেলার উপর দিয়ে পাহাড়টার দিকে হেঁটে চলেছি, হঠাৎ দূরে মনে হল যেন কে একটি তরুণী আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। অস্তমুখী ম্লান সূর্যালোকে দূর হতে সীতাকে দেখে আমার চিনতে কষ্ট হলেও কিরীটীর কিন্তু চিনতে কষ্ট হয়নি।
সে বলে ওঠে, আশ্চর্য! সীতা দেবী একাকী আসছেন? সঙ্গে তাঁর সেই চিরানুগত সাথী দুরন্ত ব্যাঘ্র-সদৃশ ভয়ঙ্কর আলসেসিয়ান কুকুর টাইগারকে কই দেখছি না যে!
সত্যি সীতাই আসছে।
কাছাকাছি আসতে কিরীটীই প্রথমে হাত তুলে সম্ভাষণ নমস্কার জানাল, শুভ সন্ধ্যা। এই যে সীতা দেবী, একা যে, আপনার অনুগত সাথীটি কই? তাকে দেখছি না যে?
নমস্কার। সীতাও হাত তুলে প্রতিনমস্কার জানিয়ে বললে, আমার অনুগত সাথী?
হ্যাঁ, আপনার সেই টাইগার?
সহসা লক্ষ্য করলাম কিরীটীর প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গেই সীতার চোখের তারা দুটি যেন কেমন বিষণ্ণ হয়ে উঠল, কাল রাত্রে হঠাৎ গুলি লেগে বেচারার একটা পা জখম হয়েছে, মিঃ রায়। কাতর কন্ঠেই সীতা বললে।
বলেন কী, টাইগার গুলিতে জখম হয়েছে! হাসতে হাসতে কিরীটী শেষের কথা কয়টি উচ্চারণ করে, তারপর সহসা সীতার মুখের দিকে তাকিয়েই বলে, কিন্তু ব্যাপার কি বলুন তো? এ যে বাঘের ঘরে ঘোঘের ব্যাপার!
সত্যিই আশ্চর্য ব্যাপার, মিঃ রায়! আমি আপনার সঙ্গেই হোটেলে দেখা করতে যাচ্ছিলাম।
আমার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন?
হ্যাঁ। আপনি তো জানেন, সেদিনই আমাদের অন্দরমহলে থাকবার জন্য শতদল-ভাগ্নে অনুরোধ জানান। আপনারা চলে আসবার পর কতকটা যেন নিজে উৎসাহ দেখিয়েই একপ্রকার আমাদের অন্দরমহলের দক্ষিণ দিককার যে দুটো ঘর খালি পড়ে ছিল, তাতে নিয়ে গিয়ে আমাদের থাকবার ব্যবস্থা করে দেন। একটা দিন ও একটা রাত ভালোই লাগছিল। কিন্তু, কথাগুলো বলে সীতা যেন একটু দম নেয়।
কিরীটী ও আমি দুজনই উদগ্রীব হয়ে সীতার কথা শুনছি।
সীতা আবার বলতে শুরু করে কাল রাত তখন বোধ হয় গোটা দুই হবে। অন্যান্য দিনের মতই টাইগার আমার ঘরের বাইরে শুয়ে ছিল। হঠাৎ তার ক্রুদ্ধ একটা চাপা গোঁ-গোঁ শব্দে আমার ঘুমটা ভেঙে গেল। মনে হল কোন কারণে টাইগার যেন হঠাৎ ভীষণ খাপ্পা হয়ে উঠেছে। তারপরই পর পর দুটো গুলির শব্দ!
গুলির শব্দ?
হ্যাঁ। প্রথমটায় তো সত্যি কথা বলতে কি মিঃ রায়, ভয়ে আতঙ্কে আমি একেবারে কাঠ হয়েই গিয়েছিলাম ঘটনার আকস্মিকতায়। কিন্তু চিরদিনই ভয় বস্তুটা আমার একটু কম। নিজেকে সামলে নিতে তাই আমার খুব বেশী সময় লাগেনি। তাড়াতাড়ি বিছানা হতে উঠে দরজাটা খুলে একেবারে বাইরে চলে এলাম। মাঝরাতে কাল বোধ হয় চাঁদ উঠেছিল। ম্লান চাঁদের আলো বারান্দার উপরে এসে পড়েছে। দেখলাম টাইগার তখনও আমার ঘরের দরজার অল্প দূরে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে গোঁ গোঁ করে গজরাচ্ছে যন্ত্রণায়। ইতিমধ্যে পাশের ঘরে মা-বাবার এবং উপরের তলায় শতদল-ভাগ্নেরও ঘুম ভেঙে গিয়েছিল, তারাও যে যার ঘর থেকে টাইগারের গর্জন শুনে বের হয়ে এসেছে। শতদলভাগ্নের ডাকাডাকিতে অবিনাশও ঘুম ভেঙে উঠে এল। আমি টাইগারকে ডাকতেই সে খোঁড়াতে খোঁড়াতে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। ভালো করে তাকিয়ে দেখি, তার ডান পা-টা বেশ গুরতর ভাবেই জখম হয়েছে। রক্ত ঝরছে তখনও। বারান্দাতেও রক্ত। আর—আর বারান্দায় দেখলাম, অনেকগুলো কেডস জুতোর সোলের ছাপ। ছাপগুলো জুতোর সোলে বোধ হয় ভিজে কাদা লেগেছিল তারই। এবং জুতোর ছাপ লক্ষ্য করে দেখলাম, বরাবর বারান্দার দক্ষিণ প্রান্তের শেষ পর্যন্ত যেখানে প্রাচীর শুরু হয়েছে এবং প্রাচীরের গায়ে যে দরজাটা সেই পর্যন্ত চলে গেছে। দরজাটা কিন্তু বন্ধ। দরজাটা বাইরের থেকে শিকল তুলে বন্ধ করে দিয়েছে। এদিককার খিল খোলা। দরজাটা ভিতর থেকেই খিল এঁটে বন্ধ করা ছিল।
সীতা চুপ করল। কিরীটী আগাগোড়া সীতার বর্ণিত কাহিনী গভীর মনোযোগ সহকারে শুনছিল। এতক্ষণে কথা বলল, আচ্ছা সীতা দেবী, ইতিপূর্বে আর কখনো ঐ বাড়িতে থাকাকালীন সময়ের মধ্যে আপনার টাইগারের উপর কোন প্রকার attempt হয়েছিল কি?
এখন মনে হচ্ছে, দিন দশেক আগে একবার বোধ হয় টাইগারের উপর কোন attempt হয়েছিল।
কী রকম?
সে-রাত্রেও ঠিক অমনি কালকের রাতের মতই টাইগারের চাপা গর্জন শুনে ঘর থেকে আমি বের হয়ে আসি কিন্তু কিছুই দেখতে পাই না।
কোন firing-এর শব্দ শুনেছিলেন সে-রাত্রে?
না।
হুঁ। কিরীটী মুহূর্ত কাল কি যেন ভাবে, পরে প্রশ্ন করে, শতদলবাবু কোথায়? এখন বাড়িতে আছেন নাকি?
তিনি ঘণ্টাখানেক আগেই বের হয়ে এসেছেন; জানি না ঠিক কোথায় গিয়েছেন।
আচ্ছা সীতা দেবী, জুতোর সেই ছাপগুলো বারান্দায় এখনো আছে কি? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
বোধ হয় আছে। কারণ সকালেই তো থানা-অফিসার মিঃ ঘোষালকে সংবাদ দেওয়া হয়েছিল।
মিঃ ঘোষাল গিয়েছিলেন ওখানে?
হ্যাঁ। তিনি দুপুরেই এসেছিলেন। বললেন, আপনার সঙ্গে তিনি দেখা করবেন। বুঝতে পারছি তিনি দেখা করেন নি।
সন্ধ্যার ঘূসর অস্পষ্টতা ক্রমে যেন চারিদিকে চাপ বেধে উঠছে। একটু একটু করে চারিদিককার পটচ্ছায়া লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যাকাশে দেখা দিতে শুরু করেছে একটি-দুটি করে তারা। অল্পদূরে ডানদিকে সমুদ্র সন্ধ্যার তরল অন্ধকারে একটানা গর্জনে জানাচ্ছে তার অস্তিত্ব।
ক্ষণকালের জন্য কিরীটী বোধ হয় কী চিন্তা করে সহসা ঘুরে দাঁড়িয়ে সীতা দেবীর দিকে তাকিয়ে বলে, সীতা দেবী, আপনার বাবা মিস্টার ঘোষ এখন বাড়িতেই তো আছেন, না?
হ্যাঁ। বাড়ি থেকে বড় একটা তিনি তো কোথাও বের হন না। মৃদুকণ্ঠে জবাব দেয় সীতা।
চলুন। একবার না হয় আপনাদের ওখান থেকেই ঘুরে আসা যাক। শতদলবাবু এর মধ্যে ফিরে এলে তাঁর সঙ্গেও হয়তো দেখা হয়ে যেতে পারে, কী বলেন?
চলুন। হতেও পারে। কতকটা সোৎসাহেই সীতা যেন কিরীটীর প্রস্তাবটা অনুমোদন করে।
কিরীটী ও সীতা পাশাপাশি এগিয়ে চলে, আমি ওদের অনুসরণ করতে লাগলাম।
মাথার উপরে শীতের কুয়াশাহীন প্রথম রাতের কালো আকাশে তারাগুলো বেশ উজ্জল মনে হয় এখন। সমুদ্রের ভাঙা ঢেউয়ের শীর্ষে শীর্ষে ফসফরাসের সোনালী ঝিলিক চিকচিক করে ওঠে। কালো জলে আলোর চুমকি ওগুলো যেন।
সহসা কিরীটীই আবার পাশাপাশি চলতে চলতে সীতাকে প্রশ্ন করে, আপনি আমার ওখানে যাচ্ছিলেন কেন মিস ঘোষ?
ভাবছিলাম আপনার সঙ্গে একটা পরামর্শ করব—
পরামর্শ! কিসের বলুন তো?
এখানে, মানে ঐ বাড়িতে থাকাটা আর ভালো হবে কি না তাই ভাবছি
কেন?
ভাবছিলাম মার বর্তমান অবস্থা ভেবেই। এমনিতে মার নার্ভ খুব স্ট্রং, কিন্তু গতরাত্রের ব্যাপার দেখেশুনে মা যেন বেশ একটু নার্ভাসই হয়ে পড়েছেন বলে মনে হয়। জানেন তো, একে প্যারালেটিক রোগী—ডাক্তারের অ্যাডভাইস আছে যেন ওঁর পক্ষে কোন সময়েই কোনপ্রকার মানসিক উত্তেজনার কারণ না ঘটে। মাকে সর্বদাই তাই আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করি যাতে ওঁর মানসিক শান্তি অটুট থাকে। কিন্তু গত কয়েক দিন ধরে ঐ বাড়িতে যা সব ঘটেছে সুস্থমস্তিষ্ক ব্যক্তির পক্ষেই উত্তেজনার কারণ হচ্ছে, তা মা তো রোগী
কথাটা অবশ্য ভাববার, মিস ঘোষ! কিন্তু আপনার বাবা কী বলেন? কিরীটী প্রশ্ন করে।
বাবা! এসব ব্যাপারে অত্যন্ত indifferent। জ্ঞান হওয়া অবধি দেখে আসছি তো, কোন ব্যাপারেই তিনি বড় একটা থাকতে চান না। নির্লিপ্ত। অসুস্থ হলেও মা-ই সব কিছু দেখাশোনা করেন। তাঁর পরামর্শমতই সব চলে। কিন্তু এক্ষেত্রে যে মাকে নিয়েই কথাটা।
সীতার কথার এবারে আর কিরীটী কোন জবাব দেয় না। নিঃশব্দে কেবল পথ অতিক্রম করতে থাকে।
সীতাই আবার কথা শুরু করে, মার আপনার উপরে একটা অসাধারণ শ্রদ্ধা আছে মিঃ রায়। আমার তো মনে হয়, এ অবস্থায় আমাদের আর ও বাড়িতে বেশী দিন থাকা উচিত হবে না। যে যাই বলুক, definitely some foul play is going over there! তা ছাড়া স্বাস্থ্যের জন্যই মার ঐ বাড়িতে থাকা স্বাস্থ্যের দিক দিয়েও মার বর্তমানে বিশেষ যে কোন progress হচ্ছে বলেও আমার মনে হয় না।
কিন্তু কোন প্রকার foul play-ই যে বর্তমানে ঐ বাড়িতে চলেছে তাই বা আপনার ধারণা হল কেন মিস ঘোষ?
নইলে গত কয়েক দিন ধরে যে সব ব্যাপার ঘটছে, এ-সবের আর কি explanation হতে পারে, আপনিই বলুন! একটা হানাবাড়ি
ভূত-প্রেতে আপনার বিশ্বাস আছে নাকি সীতা দেবী?
না, না—ঠিক সেভাবে কথাটা আমি অবশ্যই বলিনি, মিঃ রায়। বলছিলাম, যা ও বাড়িতে ঘটছে, যুক্তি-তর্ক দিয়েও যে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছি না!
আমার কি মনে হয় জানেন সীতা দেবী?
কী?
এখনি ও-বাড়ি ছেড়ে হয়তো আপনার মা অন্যত্র কোথাও যেতে রাজী হবেন না।
বিস্ময়-ভরা দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাল সীতা, এ কথা বলছেন কেন?
সীতার প্রশ্নের জবাবটা কিরীটী বোধ হয় একটু ঘুরিয়েই দিল, আপনার মামা স্বর্গীয় রণধীর চৌধুরীর সম্পত্তিতে আপনাদের কি কোন অংশই নেই, মিস ঘোষ?
তা তো জানি না!
রণধীর চৌধুরী গত হয়েছেন কতদিন?
মাস দুই হল।
তাঁর কোন উইল বা ঐজাতীয় কোন নির্দেশনামা নেই?
বলতে পারি না।
আপনার মার মুখেও কিছু শোনেননি?
কিরীটীর শেষ প্রশ্নে সীতা কেমন যেন একটু ইতস্তত করতে থাকে। কিরীটীর তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসাতে সেটুকু এড়ায় না। কিরীটী সঙ্গে সঙ্গেই আবার প্রশ্ন করে, সাধারণ ভাবে বিচার করে দেখতে গেলে আপনার মারও তাঁর ভাইয়ের সম্পত্তিতে কিছু দাবী থাকাটা তো বিচিত্র নয়। তবে অবশ্য যদি তিনি তাঁর যাবতীয় সম্পত্তি উইল করে তাঁর একমাত্র মেয়ের ছেলে-নাতিকেই দিয়ে গিয়ে থাকেন তো আলাদা কথা। আপনার মার সঙ্গে শতদলবাবুকেও ও-সম্পর্কে কোন দিন বলতে শোনেননি?
শতদল-ভাগ্নে এখানে আসবার কয়েক দিন পরে মার সঙ্গে তাঁর ঐ ধরনের কি সব কথাবার্তা হচ্ছিল, আমি বিশেষ কান দিইনি। মৃদুকণ্ঠে সীতা জবাব দেয়।
ইতিমধ্যে আমরা প্রায় নিরালার গেটের কাছাকাছি এসে পড়েছিলাম। অন্ধকারে কালো আকাশপটের নীচে নিরালা যেন কেমন একটা ভয়াবহ ছায়ার মতই মনে হয়। যেন কোন প্রাগৈতিহাসিক যুগের বিরাটকায় রক্তলোলুপ জানোয়ার ঘাপটি মেরে বসে আছে। নিজের অজ্ঞাতেই গা-টা অকারণেই কেমন যেন ছমছম করে ওঠে।
গেটটা খোলাই ছিল। সর্বাগ্রে সীতা, পশ্চাতে কিরীটী, তারও পশ্চাতে আমি ভিতরে প্রবেশ করলাম।
অস্পষ্ট তারকার আলোয় চারিদিককার গাছপালা কেমন ধোঁয়াটে, অস্পষ্ট। হঠাৎ তিনজনেই আমরা থমকে দাঁড়ালাম।
দোতলার একটা জানালা খুলে গেল আর সেই জানালাপথে একটা শক্তিশালী টর্চের অনুসন্ধানী আলো নীচের অন্ধকারে এসে উর্ধ্বদিকে উৎক্ষিপ্ত হল। শূন্য আকাশপথে অন্ধকারে আলোর রেখাটা কয়েক মুহূর্তে ঘরে-ফিরে দপ করে একসময় নিবে গেল। আলোটা দেখা যাবার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় কিরীটী দ্রুত বলিষ্ঠ হাতে আকর্ষণ করে আমাকে ও সীতাকে নিয়ে একটা মোটা ঝাউগাছের আড়ালেই আত্মগোপন করেছিল। আলোটা নিভে যাওয়া সত্ত্বেও আমরা তিনজনেই গাছের আড়ালেই দাঁড়িয়েছিলাম আত্মগোপন করে রুদ্ধ নিঃশ্বাসে। কিরীটীর দুহাত দিয়ে তখনও আমাদের দুজনের হাত ধরা। তিনজনেই নির্নিমেষে আমরা উপরের খোলা জানালাটার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে। খোলা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে অস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি একটা মানুষের ছায়া।
ছায়াটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চিত্রার্পিতের মত।
সহসা চাপা গলায় কিরীটী প্রশ্ন করে, কোন ঘরের জানালা ওটা বলতে পারেন মিস ঘোষ?
মনে হচ্ছে শতদল-ভাগ্নের ঘরের জানালা! চাপা উত্তেজিত কণ্ঠেই জবাব দেয় সীতা।
আমারও তাই ধারণা। কতকটা যেন স্বগতোক্তিই করে কিরীটী।
একটু পরেই জানালাটা বন্ধ হয়ে গেল।
আরো কিছুক্ষণ পরে আমরা গাছের আড়াল হতে বের হয়ে সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। দরজাটা ভিতর হতে বন্ধই ছিল। কিরীটী দরজা খোলার সংকেত-ঘণ্টার দড়ির প্রান্তটা ধরে টেনে দরজাটা খোলবার জন্য দড়ির সঙ্গে সংযুক্ত ভিতরের ঘণ্টাটা বাজাতে যাবে, হঠাৎ দরজাটা খুলে গেল। খোলা দরজার সামনে হ্যারিকেন হাতে দাঁড়িয়ে অবিনাশ।
অবিনাশই কথা বললে, বুড়োবাবু তো ঠিকই বলেছেন, আপনারা এসেছেন, দরজাটা খুলে দিতে!
বুড়োবাবু তিনি জানলেন কী করে যে আমরা এসেছি? প্রশ্ন করল কিরীটীই।
তা তো জানি না। তিনি দরজাটা এসে খুলে দিতে বললেন, তাই তো খুলতে এলাম। মৃদু হাসির সঙ্গে কথাটা বললে অবিনাশ।
০৭. দ্বিতীয় প্রশ্ন করল কিরীটী
শতদলবাবু বাড়িতে ফিরে এসেছেন, অবিনাশ? দ্বিতীয় প্রশ্ন করল কিরীটী অবিনাশের দিকে তাকিয়ে।
আজ্ঞে, কই না! দাদাবাবু তো এখনও ফেরেননি বাবু। মৃদুকণ্ঠে অবিনাশ জবাব দিল।
কখন ফিরবেন কিছু বলে গিয়েছেন? কিরীটী অবিনাশকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করে।
আজ্ঞে না। তা তো কিছুই বলে যাননি।
কোথায় গিয়েছেন তুমি জান?
না।
অতঃপর কিরীটী আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বললে, চল সু ভিতরে গিয়ে বসা যাক। এখনি হয়তো শতদলবাবু এসে পড়বেন—চলুন সীতা দেবী।
সকলে আমরা অন্দরের দিকে অগ্রসর হলাম। অন্ধকার বারান্দাটা। আগে আগে হ্যারিকেন বাতিটা হাতে ঝুলিয়ে চলেছে অবিনাশ, পশ্চাতে অমিরা তিনজন। বেশী দূর অগ্রসর হইনি, একটা খসখস শব্দ শুনে সামনে দিকে তাকাতেই অস্বচ্ছ আলোকিত বারান্দাপথে নজর পড়ল ইনভ্যালিড চেয়ারটার উপরে উপবিষ্ট পক্ষাঘাতে চলচ্ছক্তিহীন হিরণ্ময়ী দেবী দুই হাতে মন্থর গতিতে উপবিষ্ট চেয়ারটার দুই পাশের চাকা দুটো দুপাশের হ্যান্ডেলের সাহায্যে ঘোরাতে ঘোরাতে ঐদিকেই এগিয়ে আসছেন।
সকলের আগে ছিল হ্যারিকেন হাতে অবিনাশ, তাকেই প্রশ্ন করলেন উদ্বেগাকুল কণ্ঠে হিরণ্ময়ী দেবী, অবিনাশ, সীতা এল?
অবিনাশ জবাব দেবার আগেই সীতা জবাব দেয়, এই যে মা, এসেছি আমি–বলতে বলতে সামনের দিকে সে এগিয়ে যায়।
অন্ধকারে পশ্চাতে বোধ হয় আমাকে ও কিরীটীকে দেখতে পাননি প্রথমটায় হিরণ্ময়ী দেবী। তাঁর রুক্ষ বিরক্তিপূর্ণ কণ্ঠস্বর শোনা গেল, এত রাত করে কোথায় ছিলে শুনি? কিন্তু পরক্ষণেই কিরীটীকে সীতার পশ্চাতে দণ্ডায়মান দেখে হিরণ্ময়ী দেবীর কণ্ঠের ক্ষণপূর্বের সমস্ত বিরক্তি যেন নিমেষে অন্তর্হিত হয়ে গেল এবং এবারে আর কন্যাকে নয়, কিরীটীকেই সম্বোধন করে প্রশান্ত স্নিগ্ধ কণ্ঠে বললেন, এ কি। কিরীটীবাবু নাকি? আসুন, আসুন। কোথায় দেখা হল আপনার সঙ্গে ওর?
তুমি ওঁদের ভিতরে নিয়ে এস মা। আমি চায়ের জল চাপাচ্ছি। কথাগুলো বলে সীতা সহসা অন্ধকারে বেশ যেন দ্রুত পদবিক্ষেপেই অদৃশ্য হয়ে গেল।
তীক্ষ্ণ একটা দৃষ্টি কন্যার গমনপথের দিকে মুহূর্তের জন্য নিক্ষেপ করে হিরণ্ময়ী দেবী আমাদের দিকে আবার ফিরে তাকালেন। ইনভ্যালিড চেয়ারটার হ্যাণ্ডেলের উপরে রক্ষিত দুই হাতের মুষ্টি দুটো মনে হল যেন মুহূর্তের জন্য কঠিন হয়ে আবার শ্লথ হয়ে গেল। এবং এবারে শান্তকণ্ঠে কিরীটীকেই লক্ষ্য করে বললেন, চলুন মিঃ রায়। শতদলের কাছেই বোধ হয় এসেছেন! সে বোধ হয় তো বাড়িতে নেই, ক্ষণপূর্বেই বিরক্তির লেশমাত্রও কণ্ঠস্বরে নেই।
সকলে আবার ভিতরের দিকে অগ্রসর হলাম। অবিনাশ আগে আগে আলো দেখিয়ে চলল। সকলের আগে হিরণ্ময়ী দেবীর চলমান ইনভ্যালিড চেয়ারটার পাশাপাশি হেঁটে চলেছে কিরীটী। পশ্চাতে আমি।
আপনাদের এদিকেই আসছিলাম। পথেই আপনার মেয়ের সঙ্গে দেখা হতে তাঁরই মুখে শুনলাম শতদলবাবু বাড়িতে নেই। কিরীটী এতক্ষণে কথা বললে।
গতরাত্রের ব্যাপার বোধ হয় তাহলে সীতার মুখেই সব শুনেছেন মিঃ রায়?
হ্যাঁ, শুনলাম। মৃদুস্বরে জবাব দেয় কিরীটী।
এর পর আর এ-বাড়িতে বাস করা খুব বিবেচনার কাজ হবে না—আপনি কি বলেন কিরীটীবাবু?
খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছেন নিশ্চয়ই?
কি বলছেন আপনি মিঃ রায়! এই সেদিন রাত্রে শতদলের ঘরে কে বন্দুক ছুঁড়ল এবং শতদলের মুখেই কালকের রাত্রের ঘটনার পর আজ সকালে শুনলাম ইতিপূর্বেও নাকি তার উপরে আক্রমণ হয়েছিল—
সে তো তাঁর জীবনের ওপরে attempt হয়েছিল! জবাব দিলাম আমি।
কিন্তু কাল রাত্রের ঘটনাটা? সীতার কুকুরটাকে গুলি করেছে! এক বাড়িতে যখন আছি, ওর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ঘাড়েও বা বিপদ আসতে কতক্ষণ? আমিও ওঁকে আজ স্পষ্টই বলে দিয়েছি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ-বাড়ি ছেড়ে আমরা চলে যাব। সুখের চাইতে স্বোয়াস্তি ভালো—কি বলেন মিঃ রায়!
তা তো বটেই। কিরীটী জবাব দেয় মৃদুকণ্ঠে।
আমরা সকলে এসে হরবিলাসবাবুর ঘরেই ঢুকলাম। ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতেই নজরে পড়ল হিরণ্ময়ী দেবীর পূর্বেকার ঘরের মত এ ঘরখানির মধ্যেও রুচিসম্মত পরিচ্ছন্নতা। দুদিনের মধ্যেই ঘরখানি তিনি সুন্দরভাবে সাজিয়ে নিয়েছেন, তবে এ ঘরেও লক্ষ্য করলাম জানালাগুলো প্রায় সবই ভিতর হতে বন্ধ। একটা বদ্ধ বায়ু যেন থমথম করছে।
বসুন, মিঃ রায়। বসুন সুব্রতবাবু।
হিরণ্ময়ী দেবীর আহ্বানে আমরা দুজনে দুখানা খালি চেয়ার টেনে নিয়ে উপবেশন করলম।
ঘরের সিলিং থেকে একটা প্রকাণ্ড গোলাকৃতি সাদা ড়ুমের মধ্যে চারটে মোমবাতি জ্বলছে। এবং তাতেই ঘরটা বেশ পরিষ্কার ভাবেই যেন আলোকিত হয়ে উঠেছে।
ঘরে প্রবেশ করতেই দেওয়ালে টাঙানো কয়েকখানা চিত্র দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে। তার মধ্যে গোটা দুই ল্যান্ডস্কেপ এবং বাকি দুটো অল্পবয়সী দুই নারীর অয়েল-পেন্টিং।
দুটি নারী-প্রতিকৃতি একটু নজর দিয়ে দেখলেই মনে হবে দুটি যেন যমজ বোন। মুখের চেহারাও হুবহু, বলতে গেলে প্রায় একই, এমন কি তাকাবার ভঙ্গিটা পর্যন্ত যেন এক। কিরীটীকে কথাটা বলব ভেবে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি একদৃষ্টে ঐ ছবি দুখোনার দিকেই তাকিয়ে আছে। ছবি দুটো তাহলে কিরীটীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়ায়নি!
ট্রেতে করে টি-পট ও অন্যান্য চায়ের সরঞ্জাম হাতে এমন সময় সীতা এসে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করল।
ঘরের মধ্যস্থিত টেবিলের ওপরে চায়ের সরঞ্জাম রেখে সীতা কাপে কাপে চা ঢালতে লাগল।
সহসা কিরীটী হিরণ্ময়ী দেবীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ঐ দেওয়ালের অয়েলপেনন্টিং দুটো কার মিসেস ঘোষ?
কিরীটীর প্রশ্নে যেন চমকে তাকালেন হিরণ্ময়ী দেবী দেওয়ালের গায়ে টাঙানো ছবি দুটোর দিকে।
দেখলে মনে হয় যেন একই জনের দুটি প্রতিকৃতি! কিরীটী আবার মন্তব্য করে।
জানি না ও কার ছবি! মৃদুকণ্ঠে হিরণ্ময়ী দেবী জবাব দিলেন। শতদলবাবুর মা তো আপনার ভাইঝি, তাই না?
কিরীটীর এবারকার প্রশ্নে কিরীটীর মুখের দিকে দৃষ্টিপাত না করেই ইতিমধ্যে অর্ধসমাপ্ত যে উলের বুননটা কোলের মধ্যে ছিল সেটা তুলে নিয়ে অত্যন্ত ক্ষিপ্রহস্তে বুনতে বুনতে মৃদুকণ্ঠে জবাব দিলেন হিরণ্ময়ী দেবী, হ্যাঁ।
তাঁকে, মানে শতদলবাবুর মাকে আপনি দেখেননি?
খুব ছোট যখন তার তিন বছর বয়স হবে সেই সময় তাকে দেখি, তার পর আর দেখিনি। তার বিবাহের সময়ও আসতে পারিনি—পরে আর দেখাসাক্ষাৎই হয়নি। শতদলের যখন বছর তিনেক বয়স তখনি তো সে মারা যায়। কথাগুলো যেন একটানা সুরে কতকটা বলে গেলেন হিরণ্ময়ী দেবী।
আপনার ভায়েরও ঐ একটিমাত্র মেয়েই ছিলেন, তাই না?
না, দাদার দুই মেয়ে ছিল। বনলতা আর সোমলতা। সোমলতা বনলতার ৪৫ বছরের ছোট, তাকে আমি কোনদিনও দেখিনি
তিনি, মানে বনলতা দেবী চৌধুরী মশায়ের ছোট মেয়ে বেঁচে আছেন কি?
না। সহসা হিরণ্ময়ী দেবীর কণ্ঠস্বরটা যেন রুক্ষ শোনাল। হিরণ্ময়ী দেবীর আকস্মিক কর্কশ কণ্ঠে আমি চমকে ওঁর দিকে না তাকিয়ে পারলাম না।
পূর্বের মতই হিরন্ময়ী দেবীর দৃষ্টি তাঁর হাতের বুননের উপরে নিবদ্ধ এবং তিনি ক্ষিপ্রহস্তে বুননকার্যে রত।
কিরীটীর মুখের দিকে তাকালাম কিন্তু কিছু বোঝা গেল না। সে-মুখে রাগ দ্বেষ বা বিরক্তি কোন কিছুর চিহ্ন পর্যন্ত নেই। শান্ত ও নির্বিকার। চায়ের কাপটা শেষ হয়ে গিয়েছিল, নিঃশেষিত চায়ের কাপটা সামনের টেবিলের ওপরে নামিয়ে রাখতেই সীতা এগিয়ে এসে কিরীটীকে প্রশ্ন করল, আর চা দেব মিঃ রায়?
চা? না থাক, ধন্যবাদ।
বাইরের দালানে জুতোর মসমস শব্দ শোনা গেল।
ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেই বোধ হয় ঘরের বাইরে সেই জুতোর শব্দ শুনতে পেয়েছিল। সীতা নিম্নকণ্ঠে বললে, শতদল-ভাগ্নে এল বোধ হয়—
সীতা কথাগুলো বলবার আগেই কিরীটী চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজার দিকে অগ্রসর হয়েছিল এবং খোলা দরজাপথে অদৃশ্য হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই তার কণ্ঠস্বর শোনা গেল, এই যে শতদলবাবু কোথায় গিয়েছিলেন?
কে! কিরীটীবাবু নাকি? আপনি এখানে, আর আমি যে আপনার খোঁজেই হোটেলে গিয়েছিলাম!
কথা বলতে বলতে দুজনে ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করে।
সীতা, চা সব শেষ, না এক কাপ মিলতে পারে? ঘরে প্রবেশ করেই শতদল সীতাকে লক্ষ্য করে কথাটা বলে।
না, আছে বৈকি, দিচ্ছি, বসো। সীতা জবাব দেয়।
হঠাৎ ঐসময় আমার দৃষ্টিটা হিরন্ময়ী দেবীর উপরে গিয়ে পড়তেই দেখি ইতিমধ্যে তাঁর ক্ষিপ্র বুননরত হস্ত দুটি কখন থেমে গিয়েছে এবং তিনি বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে একবার শতদল ও একবার সীতার মুখের দিকে তাকাচ্ছেন, কিন্তু সীতা বা শতদল কারো সেদিকে দৃষ্টি নেই।
সীতা একটা কাপে ততক্ষণে চা ঢালতে শুরু করেছে।
কিরীটীর মুখের দিকে তাকালাম। পুরাতন একটা সংবাদপত্র টেবিলের উপর পড়েছিল, ইতিমধ্যে কখন একসময় টেবিলের উপর থেকে সংবাদপত্রটা টেনে নিয়ে সে গভীর মনোযোগ সহকারে কী যেন পড়ছে। ঘরের মধ্যে যে আমরা আরও চারটি প্রাণী উপস্থিত আছি, ঐ মুহূর্তে সে সম্পর্কে যেন সম্পূর্ণ অচেতন।
চিনি ও দুধ মিশিয়ে চায়ের কাপটা সীতা শতদলের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললে, এই যে
সবেমাত্র শতদল সীতার প্রসারিত করা হতে চায়ের কাপটি হাতে তুলে নিয়েছে, আচমকা কিরীটী কণ্ঠস্বরে আমি যেন চমকে উঠলাম, আপনি একটু বেশী চিনি খান চায়ে, না মিঃ বোস?
চায়ের কাপটা আর ওষ্ঠের নিকটে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হল না, শতদল বিস্মিত প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকাল কিরীটীর মুখের দিকে এবং বললে, চিনি বেশী খাই চায়ে!
হ্যাঁ, দেখলাম যে সীতা দেবী তিন চামচ চিনি দিলেন চায়ে।
হাতে-ধরা সংবাদপত্রটা ভাঁজ করতে করতে হাস্যোদ্দীপ্ত কণ্ঠে প্রত্যুত্তর দেয় কিরীটী, নিশ্চয় সীতা দেবীর ওটা deliberate mistake নয়, কী বলেন সীতা দেবী?
শতদলের মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। কেমন একটা অসহায় অপ্রস্তুত ভাব শতদলের চোখে-মুখে। কিন্তু সীতার মুখে ঠিক যেন একটা বিপরীত ভাবের সুস্পষ্ট আভাস। সমস্ত মুখখানা যে তার লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠেছে, ঐ মুহূর্তটিতে ঘরের স্বল্পলোকেও সেটা দৃষ্টিতে এড়ায় না।
অবশ্য চিনি কেউ কেউ চায়ে একটু বেশীই খান এবং আস্বাদনের ব্যাপারটাও যখন বিভিন্ন ব্যক্তির বিভিন্ন, এ বিষয় নিয়ে কোন কথাই চলে না, কি বলেন সীতা দেবী? কথাটা বলে নিজে সঙ্গে সঙ্গে হেসে ঘরের ঐ মূহর্তের আবহাওয়াটাকে যেন কিরীটী লঘু করে দেবার চেষ্টা করল।
হিরন্ময়ী দেবীর দিকে তাকিয়ে দেখি, অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতিতে তাঁর বুননকার্য চলেছে।
শতদল নিজেকে ততক্ষণে সামলে নিয়েছে এবং ব্যাপারটাও যেন আগাগোড়াই একটা কৌতুক ছাড়া কিছু নয়, এইভাবে চায়ের কাপে একটা দীর্ঘ আরামসূচক চুমুক দিয়ে বললে, সত্যিই কি সীতা তুমি আমার চায়ে তিন চামচ চিনি দিয়েছ নাকি?
কেন? এখনো বুঝতে পারেননি নাকি সেটা? হাসতে হাসতে কিরীটী বলে।
হ্যাঁ, সত্যি বড্ড বেশী মিষ্টি হয়ে গেছে চা-টা সীতা, আর একটু লিকার এর মধ্যে ঢেলে দাও
বলতে বলতে শতদল চায়ের কাপটা সীতার দিকে এগিয়ে দিল।
সীতাও টি-পট থেকে আরও খানিকটা লিকার ঢেলে মিল্ক-পট থেকে একটু দুধ ঢেলে চা-টা চামচ দিয়ে নেড়ে দিল।
শুনলাম কাল রাত্রে নাকি আবার এ-বাড়িতে একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে, শতদলবাবু! কিরীটী আচমকা প্রশ্নটা করে যেন প্রসঙ্গান্তরে চলে গেল।
হ্যাঁ, সেই জন্যই তো আপনার ওখানে গিয়েছিলাম। এও শুনেছেন বোধ হয়, এবারে সীতার কুকুরটার উপর দিয়েই ফাঁড়াটা আমার গেছে।
শুনলাম। মৃদুকণ্ঠে কিরীটী জবাব দিল, সীতা দেবীর মুখে অবিশ্যি ব্যাপারটা শুনেছি, তাহলেও আপনার মুখ থেকে ব্যাপারটা আর একবার শুনতে চাই, শতদলবাবু।
এবারেও ঘটনাটা অবিশ্যি extremely mysterious রাত তখন প্রায় গোটা বারো কি সাড়ে বারো হবে, সে রাত্রের ঐ ব্যাপারের পর থেকে সত্যি কথা বলতে কি মিঃ রায়, আমি যেন একটু নার্ভাসই হয়ে পড়েছি, রাত্রে ঠিক যেন আর sound sleep হয় না, বিছানায় শুয়েছিলাম বটে তবে ঠিক ঘুমোইনি, একটা তন্দ্রামত ভাব—হঠাৎ সীতার কুকুরের ঘন ঘন ডাকে চমকে উঠে পড়লাম। জামাটা গায়ে চাপিয়ে জুতোটা পায়ে গলিয়ে দরজা খুলে সিঁড়িতে পৌঁছবার আগেই দুড়ুম দুড়ুম দুটো গুলির আওয়াজ পেয়ে থমকে দাঁড়ালাম আর ঠিক সেই সঙ্গে সঙ্গেই যেন বিশ্রী করুণভাবে আর্তনাদ করে উঠলো সীতার কুকুরটা।
আপনি নিচে নেমে এলেন, না? প্রশ্নটা এবার শতদলকে করলাম।
হ্যাঁ, দু-চার মিনিটের জন্য বোধ হয় কেমন একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলাম, তার পরই তাড়াতাড়ি নিচে নেমে আসি। জবাব দেয় শতদল।
আপনি তখন কোথায় ছিলেন? আচমকা কিরীটী প্রশ্ন করে সীতার মুখের দিকে তাকিয়ে।
আমি? আমিও তখন টাইগারের চেচানি শুনে ঘরের বাইরে বের হয়ে এসেছি। জবাব দিল সীতা।
আর আপনি মিসেস ঘোষ?
আমি? হিরন্ময়ী দেবী হাতের বুনন থামিয়ে তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে।
হ্যাঁ, আপনি!
আমি আর আমার স্বামী দুজনেই প্রায় একসঙ্গে বের হয়ে আসি ঘর থেকে। কতকটা যেন ইতস্তত করেই কথাটা বললেন হিরন্ময়ী দেবী।
হুঁ। হরবিলাসবাবুকে দেখছি না, তিনি কোথায়?
আমাকে খুঁজছিলেন বুঝি, মিঃ রায়? কথাটা কেমন একটা ব্যঙ্গের সুরে উচ্চারণ করতে করতে ঠিক কিরীটীর প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গেই কতটা যেন মাটি ফুঁড়ে বের হয়ে আসবার মতই ঐ মুহূর্তে হরবিলাস ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়ালেন।
তাঁর আকস্মিক আবির্ভাব ও প্রশ্নের জবাবে মনে হল, কিরীটীর মুহূর্ত আগেকার প্রশ্নটির জন্যই বুঝি এতক্ষণ হরবিলাস ঠিক ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন।
গায়ে কালো রঙের সেই গরম গলাবন্ধ ঝুল-কোট, গলায় ও মাথায় একটা উলেন কম্ফর্টার জড়ানো, মুখ-ভর্তি কাঁচা-পাকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি—মনে হয় পাঁচ-ছদিন বুঝি ক্ষৌরকর্ম করেননি। হাতে একটা মোটা লাঠি।
ঘরের মধ্যে আমরা সকলেই নির্বাক। কেবল কিরীটী যেন অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে হরবিলাসের দিকে তাকিয়ে। আচমকা যেন ঘরের সমস্ত আবহাওয়াটা থমথমে হয়ে উঠেছে।
অতঃপর ঘরের মধ্যে উপস্থিত নির্বাক সকলের মুখের দিকে নিঃশব্দে বারেকের জন্য নিজের দৃষ্টিটা বুলিয়ে নিয়ে শতদলের মুখের দিকে তাকিয়ে একটু যেন কর্কশ কণ্ঠেই তাকে সম্বোধন করে হঠাৎ হরবিলাস বলে উঠলেন, তোমার ঐ অবিনাশকে সাবধান করে দিও, শতদলবাবু!
কেন, অবিনাশ আবার তোমার কী করল শুনি? প্রশ্নটা করলে হিরন্ময়ী দেবী তাঁর স্বামীকে। এবং চেয়ে দেখি পূর্ববৎ তিনি আবার তাঁর বুননকার্যে মনোনিবেশ করেছেন।
ক্ষিপ্রগতিতে হাত দুটো বুনন করে চলেছে।
কি করল মানে? হরবিলাসের কণ্ঠস্বরে বেশ একটা সস্পষ্ট বিরক্তি his every movements is suspicious! তোমার দাদার এ বাড়ি তো নয়, যেন একটা কবরখানা, আর ঐ বেটা কখন আচমকা কোন পথে যে এসে সামনে হঠাৎ হাজির হয়! রোজ সন্ধ্যার পরে একা একা এ বাড়ির পিছনে ঐ ভাঙা গোল-ঘরটায় অন্ধকারে ও কি করে বল তো? দেখ শতদলবাবু I am definite he is after something! নিশ্চয় ওর
হরবিলাসের মুখের কথাটা শেষ হল না, হঠাৎ একটা ভারী কোন বস্তু পতনের দুম করে একটা শব্দ ও সেই সঙ্গে রাত্রির স্তব্দতাকে দীৰ্ণবিদীর্ণ করে একটা কাচ ভাঙার ঝনঝন শব্দ যেন খানখান হয়ে চারিদিক সচকিত করে তুলল।
০৮. একটা ভারী বস্তু পতনের শব্দ
অতর্কিত সেই কোন একটা ভারী বস্তু পতনের ও ঠিক সেই সঙ্গে সঙ্গে কাচ ভাঙার ঝনঝন শব্দটা ঘরের মধ্যে আমাদের সকলকেই সচকিত করে দিয়ে গেল। কথা বললে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে প্রথমে আমাদের মধ্যে কিরীটীই, কাঁচের কোন জিনিস ভাঙার শব্দ!
তাই তো, শব্দটা উপরের তলা থেকেই এল বলে মনে হল! যাই দেখে আসি কি ভাঙল শতদল ঘর হতে বের হয়ে যেতেই কিরীটীও তাকে অনুসরণ করে আর আমি করি কিরীটীকে। দোতলায় ওঠবার সিঁড়ির দেওয়ালের গায়ে যে ওয়াল-ল্যাম্পটা টিমটিম করে জ্বলছে, তাতে করে সিঁড়িপথের অন্ধকার দূরীভূত হওয়া তো দূরের কথা, দুপাশের দেওয়ালের চাপে পড়ে আরো যেন ঘন হওয়ায় এবং তার মধ্যে আলোর স্বল্পতায় যেন একটা কেমন ছমছমে ভাবের সৃষ্টি করেছে।
সর্বাগ্রে শতদলবাবু তার পশ্চাতে কিরীটী ও সবার শেষে আমি সিঁড়িপথ অতিক্রম করে উপরের বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই একটা সাদা কাপড়ে ঢাকা। ছায়ামূর্তি যেন সোঁ করে আমাদের চোখের সামনে দিয়েই বারান্দার শেষপ্রাতের দরজাপথে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ব্যাপারটা এত চকিতে, যেন মনে হল, একটা স্বপ্নের মতই ছায়ামূর্তিটি অন্ধকারে বারান্দার ওদিকে মিলিয়ে গেল।
কিরীটী কিন্তু মুহূর্তের জন্যও সময় নষ্ট করেনি, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে যেন একপ্রকার দৌড়েই বারান্দার শেষপ্রান্তে যেদিকে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়েছে ক্ষণপূর্বে সেই ছায়ামূর্তি, সেই দিকে এগিয়ে গেল।
আমিও কতকটা যেন যন্ত্রচালিতের মতোই কিরীটীকে অনুসরণ করলাম।
দরজাটা পার হলেই একটা অপরিসর ছাদের মতো, তিনদিকে তার এক বুক-সমান প্রায় প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। কিরীটী দেখি সেই প্রাচীরের উপর দিয়ে ঝুঁকে অন্ধকারে নিচে তাকিয়ে আছে। আমি ওর পাশে এসে দাঁড়ালাম।
নিচে অন্ধকারে বাগানের মধ্যে গাছপালাগুলো নিঃশব্দে ছায়ার মত গা ঘেষাঘেষি করে দাঁড়িয়ে আছে। দোতলার ছাদ থেকে নিচের বাগানে চট করে কারো পক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়া সম্ভবপর না হলেও, প্রাণের দায়ে যে কেউ ঝাপিয়ে পড়বে না এমন কোন কথা নেই। এবং বেকায়দায় নিচে পড়লে গুরতর জখম বা আহত হওয়াও এমন কিছু আশ্চর্য নয়।
ছায়ামূর্তিটা এই ছাদের দিকেই যখন এসেছে এবং স্পষ্ট আমরা যখন সকলেই চোখে দেখেছি এবং এই ছাদ থেকে অন্য কোথাও যাওয়া যখন সম্ভবপর নয়, তখন একমাত্র নিচের ঐ বাগানে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মগোপন করা ছাড়া ছায়ামূর্তিটা আর অন্য কোথায় যেতে পারে?
সু তোর সঙ্গে টর্চ আছে? কিরীটী হঠাৎ প্রশ্ন করে।
না তো! জবাব দিই।
হঠাৎ এমন সময় আমাদের ঠিক পশ্চাতেই শতদলবাবুর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, আমার ঘরে টর্চ আছে মিঃ রায়, এনে দেব?
না, প্রয়োজন নেই। চলুন দেখা যাক কিসের শব্দ হয়েছিল! বলতে বলতে কিরীটীই আবার বারান্দার দিকে পা বাড়াল।
সকলে ভিতরে এসে প্রথমে বারান্দা অতিক্রম করে। শতদলবাবুর শয়নঘরের ঠিক পাশের ঘরটির দরজা হাঁ করে খোলা দেখে প্রথমে শতদলবাবুই থেমে বললে, এ কি! ঘরের দরজাটা খোলা কেন?
দরজাটা বন্ধ ছিল সেদিনও দেখেছি, যতদূরে আমার মনে পড়ছে তালাবন্ধই ছিল, না শতদলবাবু? কথাটা বললে কিরীটী।
হ্যাঁ। দাদার স্টুডিও-ঘর। এটা সর্বদা বন্ধই থাকে, আমি এখানে আসা পর্যন্ত,-মৃদুকণ্ঠে শতদল জবাব দেয়, আশ্চর্য! এ দরজায় একটা হবস-এর ভারী তালা লাগানো ছিল—তালাটাই বা কোথায় গেল? পরক্ষণেই ঘরে দাঁড়িয়ে সিঁড়ির দিকে অল্প একটু এগিয়ে শতদল উচ্চকণ্ঠে ডাকল, অবিনাশ? অবিনাশ?
অমনি অবিনাশকে একটা আলো নিয়ে আসতে বলুন তো! কিরীটী কথাটা বললে।
কিন্তু অবিনাশের কোন সাড়া পাওয়া গেল না।
শতদল সিঁড়ির দু-চারটে ধাপ এগিয়ে গিয়ে আবার উচ্চকণ্ঠে হাঁক দিল, অবিনাশ? ভুখনা?
এবারেও অবিনাশের বা ভুখনার কারোরই কোন সাড়া পাওয়া গেল না নিচের তলা হতে।
উপরে একটা বাতি নিয়ে আয় ভুখনা! তথাপি শতদল চেচিয়ে বললে।
কিছুক্ষণ পরেই সিঁড়িতে ক্ষীণ পদশব্দ পাওয়া গেল এবং দেখা গেল শতদলবাবুর সেই বিচিত্র চেহারার রাঁধুনী বামন একটা হারিকেন হাতে উপরে উঠে আসছে।
হ্যারিকেন বাতিটা হাতে নিতে নিতে শতদল ভুখনার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে, অবিনাশ কোথায়?
নিঃশব্দে ভুখনা মাথাটা একবার দোলাল মাত্র, সে জানে না। যা, দেখ অবিনাশ কোথায় আছে, তাকে একবার ডেকে দে। ভুখনা চলে গেল।
সর্বাগ্রে হ্যারিকেন হাতে শতদল এবং পশ্চাতে আমি ও কিরীটী ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকলাম।
হ্যারিকেনের বাতিটার অনুজ্জ্বল আলোয় অকস্মাৎ যেন ঘরের মধ্যে চারিদিক হতে অনেকগুলো চোখের দৃষ্টি একসঙ্গে আমাদের উপর এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
একসঙ্গে অনেকগুলো চোখের দৃষ্টি আমাদের চারিদিকে হঠাৎ সজীব হয়ে জিজ্ঞাসায় প্রখর হয়ে উঠেছে, কে তোমরা? কি চাও?
ঘরের দেওয়ালে বিরাট সব প্রমাণ-সাইজের কলার ও অয়েলপেন্টিং, নানা আকারের পাথর, প্লাস্টার ও ব্রোঞ্জের প্রতিমূর্তি। মনে হয় একটু আগেও বুঝি ওদের প্রাণ ছিল, হঠাৎ কেউ মন্ত্রোচ্চারণে ওদের বোবা করে দিয়ে গিয়েছে। অনুজ্জ্বল আলোর অপর্যাপ্ত আভা চারিদিককার ছবি ও মূর্তিগুলোর উপরে প্রতিফলিত হয়ে যেন সৃষ্টি করেছে কি এক ঘনীভূত রহস্যের!
কিরীটী শতদলবাবুর হাত হতে হ্যারিকেনটা নিয়ে উঁচু করে চারিদিকে ঘুরিয়ে একবার দেখতেই, সকলেরই আমাদের যুগপৎ দৃষ্টি গিয়ে পড়ল ঘরের পূর্বে কোণে মেঝেতে একটা ভারী কারুকার্যখচিত চওড়া বোঞ্জের ফ্রেমে বাঁধানো ছবি মেঝেতে পড়ে আছে এবং তার চারপাশে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য কাঁচের টুকরো। বোঝা গেল ক্ষণপূর্বে আমরা ঐ ভারী ছবিটারই পড়ে গিয়ে ভাঙ্গার শব্দে নীচে থেকে সচকিত হয়ে উঠেছিলাম। কিরীটী নিঃশব্দে বাতিটা হাতে নিয়ে সর্বাগ্রে সেই দিকে গেল।
ছবিটা উবুড় হয়ে পড়ে আছে।
একটা মোটা তার দিয়ে দেওয়ালের গায়ে বড় একটা পেরেকের সাহায্যে ছবিটা দেওয়ালে টাঙানো ছিল। দেখা গেল ছবির সঙ্গে তারটাও অক্ষতই আছে, দেওয়ালের গায়ে পেরেকটাও ঠিক আছে। তবে ছবিটা এইভাবে মাটিতে খসে পড়ল কী করে?
কিরীটী হ্যারিকেনটা মেঝেতে একপাশে নামিয়ে রেখে নীচু হয়ে মাটি হতে ছবিটা তুলে সোজা করে দাঁড় করাল।
চোগা-চাপকান পরিহিত মাথায় পাগড়ি-আঁটা বিরাট এক পুরুষের প্রতিকৃতি অয়েলকলারে অঙ্কিত। প্রশস্ত ললাট, উন্নত খড়্গের মত নাসিকা, দীর্ঘ আয়ত চক্ষু এবং সেই চক্ষুর দৃষ্টি যেন মনে হয় সজীব এবং অন্তর্ভেদী।
ছবিখানা দুহাতের সাহায্যে একবার মাটি থেকে উঁচু করে কিরীটী বোধ। হয় ছবিটার ওজনটা পরীক্ষা করে আবার নামিয়ে রাখল, বেশ ভারী ছবিখানা! ওজনে অন্ততঃ পনের-ষোল সের হবে!
মৃদু আত্মগত ভাবেই যেন কথাগুলো কতকটা উচ্চারণ করল কিরীটী। তার পরই শতদলের দিকে ফিরে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, চেনেন শতদলবাবু এ ছবিটা কার?
না। এখানে আসবার পর একদিন মাত্র এ ঘরে ঢুকেছিলাম। এর আগে দু-একবার যা এখানে এসেছি, এই স্টুডিও-ঘরে কখনো প্রবেশ করিনি। দাদু কখনো কাউকে এ ঘরে ঢুকতে দিতেন না।
কেন? প্রশ্নটা করলাম এবারে আমিই।
তিনি ঠিক কারো এই স্টুডিও-ঘরে প্রবেশ করাটা পছন্দ করতেন না। বরাবরই লক্ষ্য করেছি, এই স্টুডিও-ঘরে প্রবেশ সম্পর্কে তাঁর যেন একটা sentiment ছিল। দিবারাত্র এই ঘরের মধ্যেই প্রায় রং-তুলি, ইজেল অথবা ছেনী-বাটালী নিয়ে মগ্ন হয়ে থাকতেন। দীর্ঘকাল ধরে একবেলাই আহার করতেন শুনেছি রাত্রে। এও শুনেছি অনেক রাত্রে নাকি তিনি খাওয়ার কথা পর্যন্ত ভুলে যেতেন, এই ঘরের মধ্যে তাঁর রাত কেটে যেত
শিল্পীর সাধনা-ক্ষেত্রই বটে। শিল্পী রণধীর চৌধুরী যেন এখনো এই মূর্তি ও ছবিগুলোর মধ্যেই বেঁচে আছেন। নিভৃত এই কক্ষখানির মধ্যে তিনি আপনাকে যে একান্তভাবে সমর্পণ করেছিলেন এবং যে সমর্পণের ভিতর দিয়ে এই বিস্ময় তিল তিল করে গড়ে উঠেছে তারই সাক্ষ্য যেন কক্ষের চতুর্দিকে।
এই ঘরের চাবিটা?
সেটা তো আমি যে ঘরে থাকি সেই ঘরের আলমারির ড্রয়ারের মধ্যে থাকত একটা রিংয়ে অন্যান্য চাবির সঙ্গে।
দেখুন তো সে রিংয়ে চাবিটা আছে কিনা? কিরীটী শতদলকে অনুরোধ জানায়।
দেখছি, শতদলবাবু ঘর হতে বের হয়ে যাবার আগেই আবার কিরীটী বললে, শতদলবাবু just a minute, ঐ সঙ্গে kindly একটা টর্চও নিয়ে আসবেন।
শতদল ঘর হতে অতঃপর নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল। ঘরের মধ্যে এখন আমরা দুজনই—কিরীটী ও আমি। হ্যারিকেন-বাতির স্বল্প আলোয় কিরীটীর মুখের দিকে তাকালাম।
মুখের রেখায় রেখায় কোন কিছু একটা চিন্তার সুস্পষ্ট আভাস। তার ইতিপূর্বের ধীর মৃদু সংযত কণ্ঠস্বর ও নিস্ক্রিয়তা থেকেই বুঝেছিলাম, ঐ মুহূর্তে গভীর ভাবেই কোন একটা চিন্তা কিরীটীর মাথার মধ্যে পাক খেয়ে চলেছে। এবং ঐ সময়ে সে নিজ হতে স্বেচ্ছায় মুখ না খুললে কারো সাধ্য নেই তাকে কথা বলায়। বুঝতে পারছিলাম ছবিটা অমনি আকস্মিক ভাবে মাটিতে পড়ে গিয়ে ভাঙার ব্যাপারটা সে খুব সহজভাবে নেয়নি। শতদলের ক্ষণপূর্বের জবানিতে জানা গিয়েছে ঘরটা বন্ধ ছিল এবং এ ঘরের চাবিটাও তারই ঘরে ছিল। অথচ দেখা যাচ্ছে ঘরের দরজায় কোন তালা নেই-দরজা খোলা এবং ঘরের মধ্যে ঐ ছবিটা ভগ্ন কাঁচের টুকরোর মধ্যে পড়ে আছে। আরো ভাঙার শব্দটা কিছুক্ষণ পূর্বে আমরা নিচের তলা থেকেই শুনেছি। ছবিটা আপনা হতেই পড়ে গিয়ে যে ভাঙেনি তারও প্রমাণ পাচ্ছি।
সব কিছু পরিস্থিতি বিবেচনা করলে এ কথাটা স্বতঃই মনে হচ্ছে, কেউ নিশ্চয়ই এ ঘরে এসেছিল। এবং ছবিটা পাড়তে গিয়ে বা নামাতে গিয়ে দেওয়াল থেকে আচমকা অসাবধানতাবশতঃ তার হাত থেকে হয়তো মাটিতে পড়ে গিয়ে কাচটা ভেঙেছে। খুব সম্ভব সেই কারণেই হয়তো তাকে আচমকা ঘটনাবিপর্যয়ে স্থানত্যাগ করতে হয়েছে।
এক্ষেত্রে তাহলে বক্তব্য হচ্ছে, কেউ না কেউ কিছুক্ষণ আগে এ ছবিটার জন্য এ-ঘরে এসেছিল। যেই আসুক! কিন্তু কেন?
এ ছবিটার প্রয়োজন নিশ্চয় ছিল তার। কিন্তু কেন? কী প্রয়োজন ছিল তার?
ওজনে অত ভারী এবং আকারে অত বড় ছবিটা চট করে কোথায়ও নিয়ে যাওয়া বা লুকোনোও তো সহজ নয়। কিন্তু এমনও তো হতে পারে, তার ছবিটা সরাবার বা কোথাও নিয়ে যাওয়ার ঠিক প্রয়োজন ছিল না, কেবল হয়তো ছবিটা দেওয়াল হতে নামিয়ে দেখতেই চেয়েছিল সে। কিন্তু ছবিটা দেখবারই যদি প্রয়োজন ছিল তার, দেওয়ালে টাঙানো অবস্থাতেও তো দেখতে পারত? দেওয়াল হতে নামাবার কী প্রয়োজন ছিল?
বাইরে এমন সময় জুতোর শব্দ পাওয়া গেল। বুঝলাম শতদলবাবু চাবির রিং ও টর্চ নিয়ে এই ঘরেই আসছে।
অনুমান মিথ্যা নয়। শতদলবাবুই ঘরে এসে প্রবেশ করলেন এবং নিঃশব্দে চাবির রিংটা ও পাঁচ-সেলের একটা হান্টিং টর্চ কিরীটীর দিকে এগিয়ে দিলেন।
ডান হাতে চাবির রিংটা ধরে বাম হাতে টর্চটা নিল কিরীটী।
এই রিংয়ের মধ্যেই এই ঘরের তালার চাবিটা ছিল? কিরীটী শতদলকে প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ। দেখুন তো সে চাবিটা আছে কি না? সু বাতিটা একটু তুলে ধর। কিরীটীর নির্দেশমতো বাতিটা আমি তুলে ধরলাম।
চাবির গোছাটা কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখে শতদল মৃদুকণ্ঠে বললে, এই তো, চাবিটা রিংয়ের মধ্যেই আছে দেখছি।
একটা বড় আকারের চাবি গোছার ভিতর থেকে আলাদা করে কিরীটীর। সামনে ধরল শতদল।
চাবির রিংটা আপনার ঘরে যে আলমারির ড্রয়ারে ছিল বলছিলেন, সেটা কি চাবি দেওয়াই থাকত শতদলবাবু?
হ্যাঁ। চাবি দিয়ে ড্রয়ার খুলেই তো রিংটা নিয়ে এলাম।
ড্রয়ারের চাবিটা কোথায় ছিল?
আমার পকেটেই ছিল। সর্বদা পকেটেই রাখি।
আপনার ঘরটা কি সাধারণতঃ যখন আপনি থাকেন না, তালা দেওয়া থাকে
না।
কিরীটী অতঃপর টর্চের আলো ফেলে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে কী যেন দেখল, এরং ফিরে এসে বললে, তালাটা নেই দেখছি। ভাল কথা, আজ কখন আপনি বাইরে বের হয়েছিলেন? কতক্ষণই বা বাইরে ছিলেন শতদলবাবু?
প্রায় গোটা-চারেকের সময় বাইরে গিয়েছি–
যাওয়ার সময়ও এই ঘরের দরজার সামনে দিয়েই আপনি গিয়েছিলেন, তখন লক্ষ্য করেছিলেন কি, এই ঘরের দরজার তালাটা ছিল কিনা?
না, লক্ষ্য করিনি।
কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?
থানায় গিয়েছিলাম দারোগাবাবুকে গতরাত্রের ব্যাপারটা জানাতে।
দারোগাবাবুর সঙ্গে দেখা হল?
হয়েছে।
হোটেলে কখন গিয়েছিলেন?
থানায় ঘণ্টাখানেক ছিলাম, বোধ করি সাড়ে ছটা নাগাদ হোটেলে পৌঁছাই। সেখানে আপনাদের না পেয়ে বরাবর এখানে ফিরে আসি।
হুঁ। আচ্ছা একটা কথা বলতে পারেন, শতদলবাবু হিরন্ময়ী দেবীরা এখন নিচের মহলে যে ঘরটায় আছেন সেই ঘরের দেওয়ালে পাশাপাশি যে দুটি মহিলার ছবি টাঙানো আছে তাঁরা কারা?
আমি লক্ষ্য করে দেখিনি তো! বিস্মিত দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে শতদল জবাব দেয়।
দেখেননি? কাল একবার দিনের বেলা ছবি দুটো ভাল করে দেখে আমাকে বলবেন তো, চিনতে পারেন কিনা ছবি দুটো কার? কতকটা যেন নির্দেশের সুরেই কথাগুলো বললে কিরীটী।
কিরীটী প্রস্তাবে শতদল যেন একটু ইতস্ততঃ করে বলে, উনি মানে আপনার ঐ হিরন্ময়ী দেবী, আমাকে ঠিক যেন পছন্দ করেন বলে আমার মনে হয় না মিঃ রায়। কাজেই তাঁর ঘরে যাওয়া–
অবিশ্যি যদি কিছু মনে না করেন—আপনার ওরকম মনে হওয়ার কোন কারণ আছে কি?
থাকলেও অন্ততঃ আমি জানি না মিঃ রায়, কারণ এবারে এখানে আসবার পূর্ব পর্যন্ত ওঁদের সঙ্গে আমার কোন চেনা-পরিচয়ই ছিল না।
হরবিলাসবাবু, হিরন্ময়ী দেবী ও ওঁদের মেয়ে ঐ সীতা—এদের কারও সঙ্গেই পূর্বে আপনার আদৌ কোন পরিচয় ছিল না আপনি বলতে চান শতদলবাবু?
প্রশ্নটার মধ্যে যেন কোন গুরুত্ব নেই, কথার পিঠে কথাপ্রসঙ্গে এসে গিয়েছে এমনি ভাবেই অত্যন্ত শান্ত ও নির্লিপ্ত কণ্ঠে কথাগুলো বলতে বলতে ইতিমধ্যে হাতের টর্চটা জেলে তার আলোয় কিরীটী ঘরের চতুর্দিকে দেওয়ালে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল। শতদল মুহূর্ত কাল চুপ করে থেকে মৃদু সংযত কণ্ঠে জবাব দিল, না।
আচমকা কিরীটী ঘুরে দাঁড়াল শতদলের মুখোমুখি হয়ে এবং তার স্বাভাবিক অনুসন্ধানী চাপা অথচ স্পষ্ট কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ছিল না?
না।
মুহূর্তের জন্য কিরীটীর কণ্ঠে যে অনুসন্ধিৎসা জেগে উঠেছিল তার পরবতী প্রশ্নে যেন তার আর লেশমাত্রও অবশিষ্ট রইল না, আপনার সঙ্গে ওঁদের পূর্ব-পরিচয় যদি কিছু না-ই থেকে থাকে, তাহলে হঠাৎই বা হিরন্ময়ী দেবী আপনাকে অপছন্দ করতে যাবেন কেন?
তাহলে কথাটা আপনাকে খুলেই বলি মিঃ রায়, যদিচ কারণটা আমার কাছে একান্তই হাস্যাপদ বলে মনে হয়। হিরন্ময়ী দেবী দাদুর মত্যুর পর আমার এভাবে এখানে আসাটাই যেন পছন্দ করেননি। আমি না এলে দাদুর সমস্ত সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারিণী তো তিনিই হতেন, যদিচ দাদুর সম্পত্তির মধ্যে তো এই বাড়িখানা ও একগাদা ছবি ও মূর্তি। আমার কাছে তো এর কোন মূল্যই নেই আর দাবিও করব না। একা মানুষ, বিয়ে-থাও করিনি, হ্যাঁ। মাইনে পাই প্রফেসারি করে তা প্রয়োজনের অতিরিক্ত। এ কথা এখানে আসবার পরই ওদের আমি বলেছিলাম, কিন্তু
কিন্তু কী
কিন্তু উনি জবাব দিলেন, যতটুকু তাঁর প্রাপ্য তার এক কড়াক্ৰান্তিও উনি বেশী চান না এই সম্পত্তির!
হুঁ। মনে কিছু করবেন না শতদলবাবু একটা কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল এবং না বলেও পারছি না—
নিশ্চয়ই, বলুন না?
প্রথমে যেদিন সৈকতে আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়, মনে আছে নিশ্চয়ই আপনার, আপনি কথায় কথায় বলেছিলেন, যতদূর আমার মনে পড়ে যে শিল্পী রণধীর চৌধুরীর বিরাট সম্পত্তির শেষ ও একমাত্র অবশিষ্ট তাঁর এই নিরালার ওয়ারিশ আপনি। তাই নয় কি?
কিরীটীর অমন সোজা ও স্পষ্ট অভিযোগে শতদল প্রথমটায় কেমন যেন একটু বিহ্বল হয়েই পড়ে, কিন্তু মুহূর্তে সে বিহ্বলতাটুকু কাটিয়ে হাস্যতরল কণ্ঠে বলে ওঠে, হ্যাঁ বলেছিলামই তো এবং এখনও তাই বলব, কিন্তু ওঁরা সে কথা মানতে চান না।
মানতে চান না কেন? রণধীরবাবুর কোন উইল নেই?
উইল-সেটাকে উইলই বলা চলে, মানে দাদুর লেখা একখানি চিঠি আমার কাছে আছে যেটা অনায়াসে আইনের চোখে উইলের সমপর্যায়ে পড়ে।
ওঃ, তবে সেটা ঠিক উইল নয়?
না। ঠিক উইলের খসড়ায় ফেলে রেজেস্ট্রী করবার বা কোন আইনজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করবারও হয়তো তিনি সময় পাননি, কারণ সেটাকে চিঠিই বলুন বা উইলই বলুন, তাঁর মত্যুর মাত্র দিনসাতেক আগে লেখা–
সেই উইলে কী আছে?
চলুন না আমার ঘরে—ঐ ঘরের দেওয়াল-সিন্দুকেই উইলটা আছে—
যাবখন, তবু বলুন না আপনি কী লেখা আছে সেই চিঠিতে?
বিশেষ কিছুই না, লেখা আছে এই নিরালা ও এ-বাড়ির যাবতীয় সব কিছু আমাকে তিনি দিয়ে যাচ্ছেন তাঁর মৃত্যুর পরে।
বাইরের দালানে এমন সময় অস্পষ্ট পদশব্দ পাওয়া গেল। এবং ঘরের মধ্যস্থিত একমাত্র হ্যারিকেন বাতিটা, হঠাৎ মনে হল, কেমন যেন তার আলোর শিখাটা নিস্তেজ হয়ে আসছে।
আলোটার দিকে দৃষ্টি আমারই প্রথম পড়ল, আলোটায় তেল নেই বলে যেন মনে হচ্ছে শতদলবাবু!
আমার কথায় আকৃষ্ট হয়ে কিরীটী ও শতদল দুজনেই আলোটার দিকে তাকাল।
আলোটা নিস্তেজ হয়ে এসেছে।
পদশব্দটা ঠিক দরজার গোড়ায় এসে থেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শেষবারের মত বার-দুই দপ দপ করে আলোর শিখাটা কেঁপে নিবে গেল হঠাৎ।
অত্যন্ত আকস্মিক ভাবেই যেন আলোর শিখাটা নিবে গেল।
অন্ধকার। নিচ্ছিদ্র অন্ধকার হতে যেন আমাদের সমস্ত দৃষ্টিকে গ্রাস করল।
অন্ধকারে কিরীটীর গলা শোনা গেল, কে? কে ওখানে?
কথার সঙ্গে সঙ্গেই কিরীটীর হস্তধৃত পাঁচ-সেলের হানটিং টর্চের সতীব্র অনুসন্ধানী আলোর রশ্নিটা উন্মুক্ত দ্বারপথে গিয়ে পড়ল।
কে?
চিনতে কষ্ট হল না টর্চের আলোয়। দরজার ঠিক ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে এ-বাড়ির পুরাতন ভৃত্য অবিনাশ।
আজ্ঞে আমি অবিনাশ! অবিনাশ জবাব দিল, আমায় ডাকছিলেন দাদাবাবু?
হ্যাঁ। কোথায় থাক তোমরা? আলোগুলোতে তেল থাকে কি না থাকে সেদিকেও তোমাদের এতটুকুও নজর নেই, কী কর যে সব সারাদিন বসে বাড়িতে? ঝাঁজালো বিরক্তি-পূর্ণ কণ্ঠে বলে উঠলেন শতদলবাবু।
কেন? আজ দুপুরেও সব বাতিতে তেল ভরে দিয়েছি!
তেল ভরেছ তো বাতি নিবে যায় কি করে? যাও, আর একটা বাতি নিয়ে এস শিগগির করে।
যাই। অবিনাশ নিঃশব্দে চলে গেল।
কিরীটী হস্তধৃত টর্চের আলো ফেলে ঘরের মেঝেটা আবার দেখতে লাগল। যে জায়গায় দেওয়াল থেকে ছবিটা মেঝেতে পড়েছিল তার চারিদিকে কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে রয়েছে ইতস্তত।
দেওয়ালের গায়ে যেখানে ছবিটা টাঙানো ছিল কিরীটী সেখানে আলো ফেলল, তারপর আবার ঘরের চারিদিকে অনুসন্ধানী আলো ফেলে মৃদুকঠে বললে, কতকটা যেন আত্মগত ভাবেই, আশ্চর্য! টুলটা দেখছি না–গেল কোথায়?
কী বললেন মিঃ রায়? প্রশ্নটা করলেন শতদলবাবুই।
একটা টুল–
টুল! বিস্মিত কণ্ঠে কথাটা উচ্চারণ করে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন শতদল।
হ্যাঁ, টুল বা ঐ জাতীয় একটা কিছু– হ্যাঁ ভাল কথা, আপনার কাছে মজবুত তালা আছে শতদলবাবু?
তালা! তা আছে বোধ হয়—
নিয়ে আসুন। ঘরটা তালা দিয়ে রাখতে হবে।
শতদলবাবু ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।
কিরীটী হাতের আলোটা ততক্ষণে ভূপতিত ছবিটির উপরে ফেলেছে এবং আমাকে এবারে লক্ষ্য করে বললে, ছবির ফ্রেমটা কিসের তৈরী বলে মনে হয় সু?
ছবি—মানে ঐ ছবির ফ্রেমটা?
হ্যাঁ। চেয়ে দেখ ছবির ফ্রেমটা একটু যেন peculiar! ব্রোঞ্জ-জাতীয় কোন মেটালের তৈরী। এবং যেমন মজবুত তেমনি ভারি। ওয়াটার-কলার একটা ছবি ও তার কাঁচের ওজন এত বেশী হতে পারে না। ছবিটার যা-কিছু ওজন ওই ফ্রেমটার জন্যই। কথাগুলো বলে সহসা যেন অতঃপর কতকটা স্বগতোক্তির মতই আস্তে আস্তে বললে, কিন্তু কেন?
কী বললি! প্রশ্নটা করলাম আমিই কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে।
ভাবছি ছবির ফ্রেমটার কথাই। বিনা প্রয়োজনে এ জগতে কিছুই তৈরী হয় না, সু। ছবির ফ্রেমটাও নিশ্চয়ই ঐভাবে তৈরী করবার আর্টিস্টের কোন একটা উদ্দেশ্য ছিল।
হয়তো ছবিটাকে মজবুত ও টেকসই করবার জন্যই।
There you are! You are cent per cent right, সু।
বাইরে এমন সময় পদশব্দ শোনা গেল।
অবিনাশ একটা আলো হাতে ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল।
হঠাৎ কিরীটী অবিনাশের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, পায়ে তোমার বুঝি চোট লেগেছে অবিনাশ?
কিরীটীর আচমকা প্রশ্নে অবিনাশ যেন একটু চমকে থতমত খেয়ে বলে, আজ্ঞে?
কেমন একটু খুঁড়িয়ে হাঁটছ দেখছি কিনা। পায়ে চোট লেগেছে নাকি? বেশ মোলায়েম কণ্ঠে কিরীটী আবার শুধোয়।
আজ্ঞে ঠিক খুঁড়িয়ে নয়, তবে জন্ম হতেই বাঁ পা-টা একটু খাটো কিনা, তাই একটু টেনে চলতে হয় চিরদিনই।
শতদলবাবু এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন। হাতে তাঁর একটা ভারী পিতলের বড় তালা ও একটা চাবি।
এই নিন তালা কিরীটীবাবু! তালা ও চাবিটা এগিয়ে দিল শতদল কিরীটীর দিকে।
হ্যাঁ, দিন। কিরীটী তালা ও চাবি শতদলবাবুর হাত থেকে নিল, চাবি কি এই একটাই, না duplicate key আছে?
আছে।
সেটা কোথায়?
ও-ঘরে চাবির রিঙে আছে। এনে দেব কি?
না, থাক। চলুন বাইরে যাওয়া যাক।
সকলে আমরা বাইরে এলাম। কিরীটী নিজ হাতে দরজায় তালাচাবি দিয়ে চাবিটা নিজের জামার পকেটে রেখে দিল, এটা আমার কাছেই রইল শতদলবাবু। ডুপ্লিকেট চাবিটাও আমাকে দেবেন।
বেশ তো।
তারপর হঠাৎ যেন কথাটা মনে পড়েছে এইভাবে আলো হাতে দণ্ডায়মান অবিনাশের দিকে ফিরে তাকিয়ে কিরীটী তাকেই প্রশ্নটা করলে, ভাল কথা অবিনাশ, আজ এই কিছুক্ষণ আগে সন্ধ্যার দিকে তুমি যখন আমাদের সদর দরজা খুলে দিতে গিয়েছিলে, বলেছিলে না, বড়বাবু মানে হরবিলাসবাবু, তোমাকে আমাদের আসবার কথাটা জানতে পেরেই সদর দরজাটা খুলতে পাঠিয়েছিলেন
অ্যাজ্ঞে! মৃদুকন্ঠে অবিনাশ জবাব দিল।
আমরা যখন এ-বাড়ির সদরে এসে বাইরে থেকে ঘণ্টার দড়ি নাড়া দিই, তুমি আর তোমার বড়বাবু, কোথায় ছিলে?
আমি রান্নাঘরের দিকে ছিলাম—
আর বড়বাবু?
বড়বাবু রান্নাঘরের সামনে অন্ধকার বারান্দায় পায়চারি করছিলেন।
হুঁ। ভুখনা কোথায় ছিল?
সে তো রান্নাঘরেই ছিল। পূর্ববৎ মৃদুকণ্ঠে অবিনাশ জবাব দেয়, রান্না করছিল বোধ হয়।
হুঁ। আচ্ছা তুমি যেতে পার। আলোটা এইখানেই রেখে যাও।
অবিনাশ কিরীটীর নির্দেশমত হাতের হ্যারিকেনটা বারান্দায় নামিয়ে রেখে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল।
একদৃষ্টে কিরীটী অবিনাশের গমনপথের দিকে তাকিয়ে ছিল।
এবার আমিও স্পষ্ট লক্ষ্য করলাম, সত্যিই অবিনাশ যেন তার বাঁ পা-টা একটু টেনেটেনেই চলছে। যতক্ষণ অবিনাশকে দেখা গেল, কিরীটী একদৃষ্টে সেই দিকে তাকিয়ে রইল। ক্ৰমে অবিনাশ সিঁড়ি-পথে নেমে নিচের দিকে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যাবার পর কিরীটী শতদলের দিকে ফিরে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে, একটা ব্যাপার কখনো লক্ষ্য করেছেন শতদলবাবু—আপনাদের ঐ পুরনো চাকর অবিনাশের চলাটা একটু defective! মানে চলবার সময় বাঁ পা-টা একটু টেনে টেনে চলে?
কই, না? কখনো লক্ষ্য করিনি তো? শতদল জবাব দেয়।
লক্ষ্য করেননি? আশ্চর্য!
না, সত্যি লক্ষ্য করিনি। তবে সাধারণতঃ ও একটু আস্তেই যেন চলাফেরা করে বলে মনে হয়। শতদল বললে।
চলুন আপনার ঘরে যাওয়া যাক। কিরীটী যেন তার নিজের দিক হতেই উত্থিত ক্ষণপূর্বের প্রশ্নটা অতঃপর এড়িয়ে গিয়ে শতদলবাবুর শয়নকক্ষের দিকে সবাগ্রে পা বাড়াল।
সকলে এসে আমরা কিরীটীর পিছু পিছু শতদলবাবুর ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলাম। এক কোণে একটা উঁচু, টুলের ওপরে সাদা ডোম-ঢাকা আলো জ্বলছে। সমস্ত ঘরটা কিন্তু তবু সমানভাবে আলেকিত হয়নি। ঘর। আকারে বড় হওয়ার দরুনই বোধ হয় একটিমাত্র আলোয় সমস্ত ঘরটিকে তেমনভাবে আলোকিত করতে পারেনি। ঘরের একটিমাত্র জানালা ছাড়া বাকি সব কয়টি জানালাই বন্ধ। এবং একটিমাত্র ঐ খোলা জানালাপথে হু হু করে সমুদ্রের হাওয়া ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করছিল।
কিরীটী ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে সর্বাগ্রে ঐ খোলা জানালাটার দিকে এগিয়ে গেল। আমিও কিরীটীকে অনুসরণ করে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
দূরে সম্মুখে দৃষ্টির সামনে যেন একটা দিগন্তপ্রসারী কৃষ্ণ চাদর আর কানে ভেসে আসে একটানা একটা চাপা গর্জন অন্ধকার ভেদ করে। কিরীটীর হাতে তখন শতদলবাবুর দেওয়া পাঁচ সেলের হান্টিং টর্চটা। তারই আলো সম্মুখের দিকে ফেলল কিরীটী।
আলোর রশ্মিটা বহু দূর পর্যন্ত গেল—একেবারে এ-বাড়ির গেট পর্যন্ত।
হাতের আলোটা বার কয়েক কিরীটী নীচে চারিদিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল, তারপর আলোটা নিবিয়ে ঘুরে দাঁড়াল এবং শতদলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, আপনি তো বলছিলেন শতদলবাবু এ ঘরটা আপনার অনুপস্থিতিতে তালা দেওয়াই থাকে, তাই না?
হ্যাঁ।
আজও তালা দেওয়াই তো ছিল?
না, বোধ হয় তালা দেওয়া ছিল না।
ছিল না?
না, এসেও দেখলাম একটু আগে টর্চটা নিতে এসে-ঘরের দরজাটা কেবল ভেজানোই আছে, তালা লাগানো নেই। কিন্তু আমার যতদূর মনে পড়ে, বিকালে বেরবার আগে যেন তালা দিয়েই গিয়েছিলাম। কী জানি, বোধ হয় তালা দিতে ভুলে গিয়েছি!
চাবিটা কোথায় ছিল?
আমার পকেটেই ছিল।
আপনার এ-ঘরের তালার কোন duplicate চাবি তো নেই? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে শতদলকে।
আছে, সেও ঐ চাবির রিঙের মধ্যেই।
দেখুন তো, রিঙের মধ্যে চাবিটা আছে কিনা? হ্যাঁ, ঐ সঙ্গে রিং থেকে স্টুডিয়োর ঘরের তালার duplicate চাবিটাও আমাকে খুলে দিন।
কিরীটীর নির্দেশে শতদলবাবু ঘরের কোণে রক্ষিত একটা কাঠের ভারী চেস্ট ড্রয়ারের টানা খুলে তার ভিতর হতে অনেকগুলো চাবির গোছাসমেত একটা রিং বের করলেন। চাবির রিং থেকে প্রথমেই শতদল স্টুডিও-ঘরের তালার ড়ুপলিকেট চাবিটা খুলে কিরীটীকে দিলেন; তারপর এ-ঘরের তালার ডুপ্লিকেট চাবিটা রিঙের চাবির মধ্যে খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু রিঙের সমস্ত চাবিগুলো তন্ন তন্ন করে খুঁজেও প্রয়োজনীয় ডুপ্লিকেট চাবিটা খুঁজে পাওয়া গেল না।
কী হল, চাবিটা নেই? আমি প্রশ্ন করলাম।
আশ্চর্য, সত্যিই চাবিটা তো নেই দেখছি! বুঝতে পারছি না সুব্রতবাবু-পরশু তো যতদূর মনে পড়ছে দেখেছিলাম যেন রিঙের মধ্যে সে চাবিটা ছিল!
যাক, ও নিয়ে আর মিথ্যে ব্যস্ত হবেন না শতদলবাবু। আমি পূর্বেই অনুমান করেছিলাম চাবিটা পাওয়া যাবে না। কথাটা বললে কিরীটীই।
অনুমান করেছিলেন। বিস্মিত সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকান শতদল কিরীটীর মুখের দিকে।
হ্যাঁ। কিরীটীর কণ্ঠ হতে ছোট্ট সংক্ষিপ্ত জবাবটি উচ্চারিত হল।
আমি আপনার কথা তো ঠিক বুঝতে পারলাম না মিঃ রায়।
আপনিই হয়তো দু-চার দিনের মধ্যেই আমার কথার তাৎপর্যটা বুঝতে পারবেন, আমাকে আর কষ্ট করে বলতে হবে না শতদলবাবু। কিন্তু সেকথা থাক, আপনি যে একটু আগে কী একটা চিঠির কথা বলছিলেন, চিঠিটা একটিবার দেখতে পারি কি?
নিশ্চয়ই। শতদলবাবু এগিয়ে গিয়ে ঘরের একটা দেওয়াল-আলমারি খুলে তার ড্রয়ার থেকে একটা সাদা বড় আকারের রঙ ও তুলির সাহায্যে চিত্র-বিচিত্র খাম বের করে এনে কিরীটীর হাতে দিলেন।
কিরীটী শতদলবাবুর হাত হতে খামটা নিয়ে আলোর সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখতে লাগল। আমিও পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
খামটার উপরে রঙের বাহার যেন চিত্র-বিচিত্র হয়ে উঠেছে। মানুষের মুখ হতে শুরু করে পশু-পাখি, ফল-ফল, লতা-পাতা কী যে নেই তার ঠিকানা নেই!
অনেকক্ষণ ধরে তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণের সঙ্গে কিরীটী খামের উপরে আঁকা চিত্রগুলি দেখতে লাগল। খামের মুখটা খোলাই ছিল, অতঃপর তার ভিতর হতে একটা ভাঁজ-করা কাগজ টেনে বার করল।
আলোর সামনে ভাঁজ খুলে কাগজটা মেলে ধরল।
একটা চিঠিঃ চিঠির শীর্ষে ব্র্যাকেটের মধ্যে দুই লেখা।
০৯. শেষ নির্দেশ
আমার আত্মীয়দের প্রতি—ইহাই আমার শেষ নির্দেশ (৩)
সজ্ঞানে লিখিয়া যাইতেছি, রণধীর চৌধুরী আমি (০)
আমার যাবতীয় সম্পত্তি ও এই ‘নিরালা’ গৃহখানি আমার (৩)
দৌহিত্র শ্রীমান শতদল বোসকে আমার মত্যুর পর (৫)
বর্তাইবে। কেবলমাত্র সে যেন স্মরাণ রাখে যে আমার স্টুডিওতে (৪)
যে সব আত্মীয়ের ছবিগুলো, যেমন পিতামহ প্রপিতামহের (৬)
সেইগুলো ও অন্যান্য যে সকল পেন্টিং ও ছবি (৩)
এবং ঐ সঙ্গে ঐ কক্ষ-মধ্যস্থিত সমস্ত মূর্তিগলোরও স্বত্ব (২)
বাকি সব বর্তাইবে আমার দৌহিত্র শতদলকুমারে (৩)
শুধু ঐ নয়, আমার শিল্পী-জীবনের নিন্দা ও যশের (২)
উত্তরাধিকারীও একমাত্র সে-ই হইবে (৩)
ইতি–
রণধীর চৌধুরীঃ ৩০৩৫৪৬৩২৩২৩ :
১৮ই ভাদ্র ১৩৫৩
অবাক বিস্ময়েই চিঠিটা বার-দুই আগাগোড়া পড়বার পরও চিঠিটার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। লেখা ছাড়াও চিঠিটার মধ্যে দুপাশে দুখানি মুখের রেখাচিত্র বা স্কেচ আঁকা।
কিরীটীর দিকে আড়চোখে তাকালাম। কিরীটীর সমস্ত চেতনা যেন চিঠিটার মধ্যেই তন্ময় হয়ে গিয়েছে। স্থির নিস্পন্দ ভাবে চিঠিটা আলোর সামনে প্রসারিত করে হাতের মধ্যে ধরে সে দাঁড়িয়ে আছে।
সহসা শতদলবাবুর কণ্ঠস্বরে কিরীটীর তন্ময়তা ভঙ্গ হল।
দেখলেন তো চিঠিটা পড়ে মিঃ রায়? আমি আপনাকে ঠিক বলেছিলাম কিনা যে, আমিই দাদুর যাবতীয় সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী এবং তাঁর সম্পত্তি বলতে এই নিরালা গৃহটা আর স্টুডিওর মধ্যে একটু আগে যে ছবি ও মূর্তিগুলো দেখে এলেন ঐগুলোই!
হ্যাঁ, অন্ততঃ চিঠিটায় মোটামুটি ভাবে সেই নির্দেশই রয়েছে দেখলাম। অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে যেন কিরীটী শতদলের কথার জবাব দিল।
ঘরের মধ্যে দেরাজের উপর মাঝারি আকারের একটা টাইমস-পীস ছিল, হঠাৎ সেটা রিং-রিং করে বেজে উঠতেই চমকে টাইম-পীসটার দিকে তাকালাম, রাত্রি প্রায় পৌনে নটা।
শতদলও অ্যালার্মের শব্দে চমকে উঠেছিল, এগিয়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি অ্যালার্মের বোতামটা টিপে অ্যালার্ম বন্ধ করে দিলেন। কিরীটী রণধীর চৌধুরীর লেখা চিঠিটা ভাঁজ করে পুনরায় খামের মধ্যে ভরে রাখতে রাখতে বললে, যদি কিছু মনে না করেন শতদলবাবু এই চিঠিটাও আজকের রাতের মত নিয়ে যেতে চাই আমি। কাল আবার ফিরিয়ে দেব।
বেশ তো, নিয়ে যান না। শান্তকণ্ঠে প্রত্যুত্তর দেন শতদল।
ধন্যবাদ। আজকের মত তাহলে আমরা বিদায় নেব শতদলবাবু। কাল সকালে একবার পারেন তো হোটেলে আসবেন। আপনার সঙ্গে কিছু আলোচনা করবার আছে।
যাব। শতদল আমাদের সদর দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলেন।
অন্ধকারে দুজনে পাশাপাশি আমি ও কিরীটী সাগরের ধার দিয়ে হোটেলের দিকে ফিরে চলেছি। অকস্মাৎ যেন কিরীটী অসম্ভব রকম গম্ভীর হয়ে গিয়েছে।
কোন একটা চিন্তা যে তার মাথার মধ্যে পাক খেয়ে ফিরছে বুঝতে কষ্ট হয় না। এবং যে চিন্তাই হোক, বিষয়বস্তুটা যে তাকে বেশ বিচলিত করে তুলেছে বুঝতে পারছিলাম। আমিও অনেক কিছুই ভাবছিলাম।
মাত্র কয়েক ঘণ্টা সময়ের মধ্যে এই সন্ধ্যায় যে সব ঘটনা পর পর ঘটে গেল, কোনটার সঙ্গে কোনটারই কোন যোগসূত্র একটা খুঁজে না পেলেও একটা ব্যাপার যেটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল সেটা হচ্ছে শতদলের সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে একটা রহস্য যেন ক্রমেই ঘনীভূত হয়ে উঠছে। একটা আশু অমঙ্গলের ছায়া যেন ক্রমে ক্রমে চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কোন একটা অভাবনীয় দুর্ঘটনা যেন পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে। এবং অবশ্যম্ভাবী সে ঘটনাকে প্রতিরোধ করবার ক্ষমতা আমাদের কারোরই হবে না।
হোটেলের সামনে সী-বীচে কয়েকদিন আগেকার সকালের একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে রহস্য ঘনীভূত হয়ে উঠেছে, এই কয়দিন ধরে যে ব্যাপারটাকে অন্ততঃ আমি আদপেই কোন গুরুত্ব দিইনি, অথচ প্রথম হতেই যেটা কিরীটীকে বিচলিত করেছে সেটাই যেন এখন ক্রমশ স্পষ্ট আকার নিয়ে সত্যিই জটিল হয়ে উঠছে।
কিরীটীই একসময় নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে কথা বলে উঠল, তোকে একটা কাজ করতে হবে সু!
কী?
লুকিয়ে সীতার ও তার মায়ের গতিবিধির উপর নজর রাখতে হবে।
কেমন করে সেটা সম্ভব হবে? ওরা থাকে বাড়ির মধ্যে
যতদূর আমার মনে হয়, খুব বেশীদিন নজর রাখতে হবে না। দু-চারদিন নিরালার আশেপাশে সমুদ্রের ধারে ও নিরালার পিছনের বাগানে ঘোরাফেরা করতে পারলেই কিছু-না-কিছু তুই জানতে পারবি। তবে হ্যাঁ, তোকে জেলের ছদ্মবেশ ধরতে হবে।
বেশ, কাল সকাল থেকেই তাহলে শুরু করি!
না, আজ রাত থেকেই।
আজ রাত থেকেই?
হ্যাঁ।
হোটেলে পৌঁছে দেখি, আমাদের ঘরের সামনে বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন থানা-অফিসার রসময় ঘোষাল।
কিরীটীই প্রথম ঘোষালকে সংবর্ধনা জানাল, ঘোষাল সাহেব যে, কতক্ষণ?
তা প্রায় আধ ঘণ্টাটাক তো হবেই। এসে শুনলাম আপনারা বেড়াতে বেরিয়েছেন, এখনো ফেরেননি। এত রাত হল যে?
হ্যাঁ, একটু রাত হয়ে গেল। নিরালায় গিয়েছিলাম। কিরীটী বসতে বসতে বললে, উঠছেন কেন, বসুন!
আমি কিরীটীর পাশেই উপবেশন করলাম।
এতক্ষণ নিরালায় ছিলেন? শতদলবাবুর সঙ্গে দেখা হয়েছে? পুনরায় বসতে বসতে ঘোষাল বললে।
হয়েছে।
সব শুনেছেন তো?
পরশু রাত্রের ব্যাপারটা তো? কিরীটী শুধোয়।
হ্যাঁ। মশাই, আমিও সত্যিই তাজ্জব বনে গিয়েছি!
ভাল কথা মিঃ ঘোষাল, আপনার যে দুজন plain dress পুলিসের ও-বাড়িটা সর্বদা পাহারা দেবার কথা ছিল, পরশু রাত্রে তারা ছিল না?
ছিল।
তাদের রিপোর্ট কি?
সেরাত্রে ঐ সময় অশোক সাহা বলে আমার যে লোকটি পাহারায় ছিল, সেও নাকি গুলির আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল। ঐসময় সে নিরালার পিছনের বাগানেই ছিল।
অন্য কিছু সন্দেহজনক তার নজরে পড়েনি?
না।
পরে অশোক কি ঐ রাত্রে শতদলবাবুর সঙ্গে দেখা করেছিল?
করেছিল।
হুঁ। নিরালার একতলার বারান্দার শেষপ্রান্তে কতকগুলো কেডস জুতোর সোলের ছাপ পাওয়া গিয়েছিল, জানেন?
জানি। এবং তার ফটোও তুলে নেওয়া হয়েছে। আজ সকালেই আপনার সঙ্গে দেখা করতে আমি আসতাম, কিন্তু স্থানীয় একটা আসন্ন উৎসবের ব্যাপারে ব্যস্ত থাকায়
উৎসব! কিসের?
সামনেই ২রা মাঘ; ঐ রাত্রে প্রতি বৎসর এখানে একটা মেলা বসে সমুদ্রের ধারে। এখানকার লোকেরা বলে মাঘী মেলা। এবং রাত্রে একটা বিরাট বাজির প্রতিযোগিতা হয়।
বাজির প্রতিযোগিতা!
হ্যাঁ, বহু জায়গা হতে এখানে লোকেরা বাজির প্রতিযোগিতায় এসে যোগ দেয়, রাত নটা থেকে প্রায় বারোটা সাড়ে বারোটা পর্যন্ত বাজি পোড়ানো হয়। এই জায়গায় নিরালার উচ্চতা সব চাইতে বেশী বলে অনেকেই ঐ বাড়িতে গিয়ে ছাদে উঠে বাজি পোড়ানো দেখে। রণধীর চৌধুরীর আমল থেকেই নাকি ঐ নিয়ম চলে আসছে। বছরের মধ্যে ঐ রাতটির জন্য তিনি সকলের জন্য বাড়ির দরজা খুলে দিতেন। এখন তো বাড়ির মালিক শতদলবাবু তাই তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম আমি জনসাধারণের দিক হতে, তাঁর কোন আপত্তি আছে কিনা জানবার জন্য
তা কী বললেন শতদলবাবু?
বললেন, নিশ্চয়ই তাঁর কোন আপত্তি নেই। চিরদিন যা চলে এসেছে তাঁর দাদুর আমল থেকে, এখনও সেই নিয়ম চালু থাকবে। সকলেই স্বচ্ছন্দে তাঁর ওখানে গিয়ে বাজি পোড়ানো দেখতে পারেন। সব ব্যবস্থাই তিনি করে রাখবেন। After all he is a nice man! চমৎকার লোক। ঘোষাল বিশেষণ যোগ দিয়ে তাঁর বক্তব্য শেষ করেন।
আর দিন-পাঁচেক বাদেই তাহলে সেই মেলা? প্রশ্নটা করলাম আমি।
হ্যাঁ। কাল-পরশু থেকেই সব দোকান-পসারীরা এসে ভিড় জমাবে দেখবেন। আশেপাশে অনেক জায়গা হতেই সব লোকজন আসে। কিন্তু আসলে আপনার কাছে আমার আসবার উদ্দেশ্য ছিল মিঃ রায়-শতদলবাবুর ব্যাপারটা আমাকে বিশেষ ভাবিত করে তুলেছে। এ বিষয়ে আমি আপনার পরামর্শ ও সাহায্য দুই-ই চাই। শতদলবাবু নিজেও যেন অত্যন্ত নার্ভাস হয়ে পড়েছেন।
তা তো হবারই কথা। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি আমার পক্ষেও কোন মতামত দেওয়া তো সম্ভব নয় মিঃ ঘোষাল! তবে আজ সন্ধ্যা থেকেই একটা কথা আমার মনে হচ্ছে মিঃ ঘোষাল যে, শিল্পী রণধীর চৌধুরীর সম্পত্তি কেবল ঐ নিরালা প্রাসাদখানিই নয়—there is something more! Something more!
কী আপনি বলতে চান মিঃ রায়?
আমি নিজেও এখন অন্ধকারেই মিঃ ঘোষাল। কয়েকটা ছিন্ন সুত্র কেবল হাতে এসেছে, ভাসা-ভাসা অস্পষ্ট। হয়তো দু-একদিনের মধ্যেই এমন কোন ঘটনা ঘটবে যার সাহায্যে আমরা কোন একটা সিদ্ধান্তের পথে এগিয়ে যেতে পারব। Matter will take a shape!
কিরীটীর নির্দেশমত ঐ রাত্রেই সাধারণ একজন জেলের ছদ্মবেশে আমাকে হোটেল থেকে বের হতে হল।
রাত্রি তখন বোধ করি এগারটা হবে।
সাগরের কিনার দিয়ে হনহন করে চলেছি নিরালার দিকে। চাঁদ উঠতে এখনো ঘণ্টাখানেক দেরি।
সঙ্গে আমার একটা দড়ির মই, একটা টর্চ ও লোডেড পিস্তল।
নিরালার গেটের কাছাকাছি এসে থমকে দাঁড়ালাম। গেট হতে আমার দুরত্ব তখন প্রায় হাত-কুড়ি হবে।
তারার অল্প আলোয় দেখলাম, পাশাপাশি দুটি ছায়া-মূর্তি গেট খুলে বাইরে বের হয়ে এল।
চট করে রাস্তার ধারে পাথরের আড়ালে আত্মগোপন করলাম।
ছায়া-মূর্তি দুটো এগিয়ে আসছে। কে? কারা ওরা? অন্ধকারেই তাকিয়ে রইলাম।
১০. এগিয়ে আসছে ছায়া-মূর্তি দুটো
এই দিকে এগিয়ে আসছে ছায়া-মূর্তি দুটো। কাছে—আরো কাছে। ততক্ষণে তাদের অস্পষ্ট কথাবার্তার দু-একটা টুকরো টুকরো শব্দও কানে আসছে।
চমকে উঠলাম এবার, চিনতে পেরেছি ওদের। শতদল ও সীতা। দূরের একটানা সমূদ্রগর্জনকে ছাপিয়েও ওদের মৃদু কথার শব্দতরঙ্গ আমার কানে এসে প্রবেশ করছিল। অন্ধকারে স্পষ্ট না দেখতে পেলেও কণ্ঠস্বরে ওদের চিনেছি। সীতা বলছিল, তুমি জান না শতদল মায়ের দৃষ্টি কী অসম্ভব প্রখর। আমার মনে হয়, ঘুমের মধ্যেও তাঁর দুচোখের দৃষ্টি আমার সমস্ত গতিবিধির ওপরে রেখেছেন। তিনি যদি ঘুর্ণাক্ষরেও জানতে পারেন এত রাত্রে তোমার সঙ্গে আমি বাড়ির বাইরে এসেছি।
সেই জন্যই আরও ‘নিরালা’র বাইরে এলাম। তোমার মার শকুনির মত দৃষ্টি। সত্যি বলছি, আমার গা শিরশির করে। শতদল জবাব দেয়, তাই তো চিঠি লিখে তোমায় এত রাত্রে এই বাইরে ডেকে এনে তোমার সঙ্গে দেখা করবার ব্যবস্থা আমাকে করতে হয়েছে!
কিন্তু আমি যে তোমার চিঠি পেয়ে এত রাত্রে বাইরে আসব ভাবলে কী করে? যদি না আসতাম?
আমি জানতাম তুমি আসবেই, সেই জন্যই চিঠি দিয়েছিলাম। যাক, এই পাথরটার উপরেই এস বসা যাক।
পথের ধারে একটা বড় পাথরের উপর দুজন পাশাপাশি বসল আমার দিকে পিছন ফিরে। এ একপক্ষে ভালই হল। আমি যে পাথরটার আড়ালে আত্মগোপন করে ছিলাম সেই পাথরটা থেকে হাত-তিনেক দুরেই বড় পাথরটার উপরে দুজনে পাশাপাশি বসেছে।
মাথাটা একটু উঁচু করে দেখলাম, পিছন ফিরে সীতা বসে আছে, সাগরবাতাসে তার শাড়ির আঁচলটা ও খোলা চুলের রাশ উড়ছে। সীতার একেবারে গা ঘেষে বসে আছে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে শতদল।
শতদলের কথায় সীতা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর একসময় বলে, সব কিছুর পরেও তুমি কি আশা করেছিলে শতদল যে আমি আসব তোমার চিঠি পেয়ে?
তুমি আমাকে আগাগোড়াই ভুল বুঝেছ সীতা!
সব জায়গায় ভুল করলেও একটা জায়গায় মেয়েমানুষ বড় একটা ভুল করে না। সীতা জবাব দেয়।
মানুষ মাত্রেই ভুল করতে পারে সীতা, তা সে কি মেয়েই হোক বা পুরুষেই হোক। একতরফা তুমি বিচার করেছ।
একতরফা বিচার করেছি! সীতার কণ্ঠে যেন বিস্ময়ের সুর ধনিত হয়ে ওঠে।
নিশ্চয়ই। কেন যে তুমি হঠাৎ আমার ওপরে বিরাগ হয়ে উঠলে সেটা তুমি আমায় জানানো পর্যন্ত কর্তব্যবোধ করলে না!
জলের মতই যেখানে সব কিছু পরিষ্কার, সেখানে গলা উচিয়ে জানাতে যাওয়াটা কি বিড়ম্বনা নয়? কিন্তু কাসুন্দি ঘেটেই বা কি আর লাভ বল?
তাহলে সত্যি-সত্যিই তুমি আমাদের অতীত সম্পর্কটাকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে ধুয়ে-মুছে ফেলতে চাও সীতা?
সব দিক দিয়ে এক্ষেত্রে সেটাই তো বাঞ্ছনীয় শতদল। সেতারের একবার তার ছিড়ে গেলে আর কি ছেড়া তার জোড়া লাগালে পূর্বের সেই সুরে বের হয়! তবে কেন আর?
কোন কথাই তাহলে তুমি আর আমার শুনতে চাও না?
মনে মনে আমি সীতার কথা শুনে না হেসে পারি না। এমনই মেয়েদের মন বটে! সমস্ত সম্পর্ক শতদলের সঙ্গে ধুয়ে-মুছে গেছে বলেই বুঝি শতদলের একখানা চিঠি পেয়ে এই নিশুতি রাত্রেও বাড়ির বাইরে আসতে দ্বিধাবোধ করেনি?
শোন সীতা, কি কারণে তুমি হঠাৎ আমাকে আর বিশ্বাস করতে পারছ না। জানি না। তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় তো আজকের নয়—গত তিন বৎসর হতে—এই তিন বৎসরেও কি আমাকে তুমি বুঝতে পারনি?
এতদিন তোমাকে আমি বুঝতে পেরেছি বলেই আমার ধারণা ছিল কিন্তু এখন বুঝতে পারছি আমার সে জানাটাই ভুল! কিন্তু সে কথা থাক। কি জন্য এত রাত্রে এভাবে চিঠি লিখে তুমি আমাকে এখানে ডেকে এনেছ বল?
আমাকে যখন তুমি বিশ্বাস করতে পারছ না, তখন সে-কথা তোমার আর শুনেই বা লাভ কী বল? যাক সে কথা,—শতদলের কণ্ঠে সুস্পষ্ট অভিমানের সুর।
এরূপর কিছুক্ষণ দুজনেই স্তব্ধ হয়ে থাকে। কেউ কোন কথা বলে না। অখণ্ড রাত্রির স্তব্ধতা শুধু, অদূরবতী গর্জমান সাগরের কলকল্লোলে পীড়িত হতে থাকে।
এদের মান-অভিমানের পালাগান কতক্ষণ চলবে কে জানে! কিরীটীর উপরে সত্যিই রাগ ধরছিল। নিজে দিব্যি হোটেলের বিছানায় আরাম করে নাক ডাকাচ্ছে, আর আমাকে এই শীতের রাতে ঠেলে দিয়েছে! কী কুক্ষণেই যে ওর পাল্লায় পড়ে এই জায়গায় মরতে এসেছিলাম! ভেবেছিলাম কয়েকটা নিশ্চিত দিন আরামে কাটিয়ে দিয়ে যাওয়া যাবে সাগর-সিনারি দেখে, তা না, কী এক ঝামেলায়ই না পড়া গিয়েছে! কোথাকার কে এক পাগলা আর্টিস্ট, পাহাড়ের উপরে এক হানাবাড়ি, যত সব ভূতুড়ে কাণ্ডকারখানা, তার মধ্যে মিথ্যে মিথ্যে এমন করে জড়িয়ে পড়বার কি প্রয়োজন ছিল বাপ?
হঠাৎ আবার সীতার কথায় চমক ভাঙল।
তুমি আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছ শতদল!
প্রতারণা করেছি? এ-সব তুমি কি বলছ সীতা? শেষ পর্যন্ত তুমি এ কথা বললে যে তোমার সঙ্গে আমি প্রতারণা করেছি!
হ্যাঁ, প্রতারণা। নিশ্চয়ই প্রতারণা বৈকি। আজ বুঝতে পারছি, দিনের পর দিন তুমি আমার সঙ্গে প্রেমের খেলাই খেলে এসেছ। মনের মধ্যে একজনের চিন্তা অহোরাত্র করে বাইরে আর একজনের সঙ্গে তুমি খেলা করেছ। কিন্তু কী এর প্রয়োজন ছিল? আমি তো যেচে তোমার কাছে কোনদিন দাঁড়াইনি। তুমি, শেষের দিকে সীতার কণ্ঠস্বর কান্নায় যেন বুজে আসে। হায় রে! সেই চিরাচরিত ত্রিকোণ রহস্য। শতদল, সীতা ও রাণু। একটি পুরষ, দুটি নারী। সেই চির-পুরাতন চির-নতুন খেলা। সেই পঞ্চশরের একঘেয়ে রসিকতা।
ছি ছি! এতদিন এ কথা তুমি আমাকে বলনি কেন? রাণু-রাণুকে নিয়ে তুমি সন্দেহ করেছ? রাণু তো কুমারেশের বাগদত্তা। ওরা পরস্পর পরস্পরকে ভালবাসে। আর কুমারেশের সঙ্গে যে আমার কতখানি বন্ধুত্ব তাও নিশ্চয়ই তোমার অজানা নেই!
কুমারেশ? কোন কুমারেশ?
কুমারেশকে চেনো না? কুমারেশ সরকার! অধ্যাপক ডাঃ শ্যামাচরাণু সরকারের একমাত্র ছেলে। মস্ত বড় ধনী। কিন্তু তার চাইতেও তার বড় পরিচয় হচ্ছে এশিয়ার মধ্যে সবচাইতে বড় সাঁতারু। এবারে অলিম্পিকে যার সাঁতারে যোগ দেওয়ার কথা।
ওঃ, তোমার সেই গায়ক কুমারেশ?
হ্যাঁ, হ্যাঁ। সেই কুমারেশ ও রাণু, ওরা পরস্পর পরস্পরকে বহুদিন হতে ভালবাসে। আজ পাঁচ-ছ বছর ওদের আলাপ দুজনের সঙ্গে। ছি ছি! দেখ তো কী একটা মিথ্যা কল্পনায় অনর্থক ব্যস্ত করেছ?
আমি নিজে পুরুষ, শতদলও পুরুষ, তাই শতদলের শেষের কথাগুলো শুনে মনে হচ্ছিল শতদলের পরিস্থিতিতে আমি পড়লে আমিও হয়তো ঐরূপই অভিনয় করতাম। ঐ মুহূর্তে আমার মনে পড়ছিল, মাত্র কয়েক রাত্রি আগে হোটেলের বারে শতদল ও রাণুর কথোপকথন।
তাহলে মিথ্যে তুমি দেরি করছ কেন? মাকে এবারে সব বললেই তো হয়! সীতা অনুরোধ জানায় শতদলকে।
দাঁড়াও, আর কয়েকটা দিন যেতে দাও। অ্যাটর্নীকে আমি চিঠি দিয়েছি, এই বাড়িটা আমি বিক্রি করতে চাই। পেপারে বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়েছে।
পাহাড়ের উপরে এই পুরনো বাড়ি কে তোমার কিনবে?
কিনবে কী বলছ! জান, ইতিমধ্যেই দুজন খরিদ্দারের কাছ থেকে অফার পাওয়া গিয়েছে!
অফারই যদি পেয়েছ তো বিক্রি করে দিচ্ছ না কেন?
দাঁড়াও—ভাল দাম না পেলে ছাড়ব কেন?
এইরকম একটা বাড়ির জন্য তুমি ভাল দাম পাবে আশা কর?
নিশ্চয়ই। দাদুর হাতে আঁকা ছবিগুলোরই কি কম দাম! দাদুর মতই পাগল শিল্পী আছে যারা ঐ ছবির collections-এর জন্যই বাড়িটা হয়তো একটা fanatic দাম দিয়েও কিনবে।
কিন্তু কয়েক দিন ধরে যেভাবে তোমার উপর দিয়ে বিপদ যাচ্ছে
সেটাই তো চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে সীতা। ব্যাপারটার মাথা-মুন্ডু কিছুই আমি বুঝতে পারছি না। প্রথমটায় কিরীটীবাবুর কথা আমি তো হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিলাম, কিন্তু তার পরের ব্যাপারগুলো সত্যিই আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। এখন বেশ স্পষ্ট বুঝতে পারছি, কেউ আমার জীবন নিতে যেন বদ্ধপরিকর হয়ে উঠেছে। কিন্তু কেন? কারও তো আমি কোন ক্ষতি করিনি? আমার তো কোন শত্রু নেই?
বাবা কী বলেন জান?
কী?
এ ঐ মামার প্রেতাত্মা! এ-বাড়ির মায়া আজও তিনি কাটাতে পারেননি তাই–
পাগল! বলতে বলতে শতদল হঠাৎ সীতাকে দুহাতে আরও কাছে টেনে নেয়।
না—আমার সত্যি কিন্তু তাই মনে হয়—
দাদু আমাকে কত ভালবাসতেন তা জান! আর কেউ হলে না-হয় বিশ্বাস করা যেত। দাদু আমার কোন ক্ষতি করবেন এ আমি ভাবতেও পারি না। স্বেচ্ছায় তিনি সব আমার নামে লিখে দিয়ে গিয়েছেন
মা কিন্তু তা বিশ্বাস করেন না।
তা জানি, কিন্তু তাঁর চিঠি আছে—
মা বলেন, ও চিঠির কোন মূল্য নেই—
মূল্য আছে কি না আছে, সেটা কোর্টই স্থির করবে। সেজন্য আমি ভাবি না। তা ছাড়া আমি তো দিদিমাকে বলেছিই, বাড়ি বিক্রি হলে কিছু টাকা তাঁকে দেব—তাঁর কোন প্রাপ্য এ-বাড়ি থেকে নেই তা সত্ত্বেও। কিন্তু তা তিনি চান না। তিনি বলেন এ বাড়িতে তাঁর অর্ধেক অধিকার। তারপর একটু থেমে আবার বলে, বাড়ি বিক্রির টাকা থেকে কিছু যে তাঁকে দেব বলেছি সেও তোমার জন্য সীতা। দাদুর বোন বলে নয়—তোমার মা বলে।
এ তো খুব ভাল প্রস্তাব। মা বুঝি তাতে রাজী নন?
না। এক-একবার কি মনে হয় জান সীতা?
কী?
দিয়ে দিই বাড়িটা তাঁকে। কী হবে মিথ্যে আপনার জনের সঙ্গে ঐ একটা পুরনো বাড়ি নিয়ে গোলমাল করে? শেষ পর্যন্ত বাড়িটা তো আমাদেরই হবে—
কী রকম?
আরে তোমাকে বিয়ে করলে তো আর আমি পর থাকব না! আর তুমি ছাড়া ওঁদের বা আর কে আছে সংসারে? যাক গে চল, অনেক রাত হল-এবারে ওঠা যাক।
চল।
অতঃপর দুজনে উঠে দাঁড়াল। আমারই পাশ দিয়ে তারা দুজনে পাশাপাশি এগিয়ে গেল।
নিঃশব্দে আমি তাদের অনুসরণ করলাম।
একটা নতুন তথ্য আবিষ্কৃত হয়েছে। শতদল আর সীতার সম্পর্ক। কিন্তু সেই সঙ্গে আর একটা নতুন সংশয় মনের মধ্যে এসে উঁকি দিচ্ছে। বেশ কিছুটা দুরত্ব রেখে ওদের আমি পিছনে পিছনে চলেছি। দেখতে পেলাম, দূর হতে অন্ধকারে অস্পষ্ট, ওরা নিরালার গেট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল। আমি দাঁড়ালাম, ভাবছি এবারে কী করব, সহসা কার মৃদু করস্পর্শ পৃষ্ঠদেশে অনুভব করতেই চকিতে চমকে ফিরে তাকাতেই দেখি, সর্বাঙ্গে একটা কালো বস্ত্র জড়িয়ে ঠিক আমার পশ্চাতেই দাঁড়িয়ে মুখের ওপরে ঘোমটা তোলা, কেবলমাত্র মুখটা অন্ধকারে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে
কে?
চুপ! আস্তে-আমি।
চাপা সতর্ক কণ্ঠস্বরেও চিনতে কষ্ট হয় না। কিরীটী।
কিরীটী!
হ্যাঁ চল, ফেরা যাক।
কিন্তু
চল। ঘুমে আমার চোখ জড়িয়ে আসছে। বলে কিরীটী সত্যি-সত্যিই ঢালু পাহাড়ী পথ ধরে নিঃশব্দে নীচের দিকে নামতে লাগল। অগত্যা আমিও তার পিছু নিলাম।
দুজনে পাশাপাশি আবার হোটেলের দিকে হেঁটে চলেছি।
এদিকে কোথায় এসেছিলি?
নিরালার স্টুডিও-ঘরে কাজ ছিল। মৃদুকণ্ঠে কিরীটী জবাব দেয়। তারপর একটু থেমে পথ চলতে চলতেই বলে, কী এত মনোযোগ দিয়ে ওদের কথা শুনছিলি?
শুনছিলাম বলেই জানতে পেরেছি—
কি? ওদের আগে থাকতেই পরস্পরের সঙ্গে ভাব ছিল?
আশ্চর্য হই কিরীটীর কথায়। কিন্তু আমার কোনরূপ প্রশ্ন করবার আগেই কিরীটী বলে, সে-রহস্যও সন্ধ্যাবেলাতে জানা হয়ে গিয়েছে। Nothing new!
তুই জানতে পেরেছিলি?
নিশ্চয়ই। শতদলের চায়ের কাপে সীতার তিন চামচ চিনি দেওয়াটা অনিচ্ছাকৃত অন্যমনস্ক হয়ে ভুল নয়। শতদলের চায়ে তিন চামচ চিনি খাওয়ার অভ্যাসটার সঙ্গে সীতা পূর্ব হতেই সুপরিচিত। এবং তা থেকেই আমি বুঝেছিলাম ওদের—শতদল ও সীতার মধ্যে একটা জানাশোনা আছে এবং দুটি তরুণ-তরুণীর জানাশোনা মানেই রঙের ব্যাপার! একান্ত অবলীলাক্রমেই যেন কিরীটী কথাগুলো বলে গেল।
বিস্ময়ে একেবারে নির্বাক হয়ে গিয়েছিলাম আমি। কিরীটীর অতীব সক্ষম দৃষ্টিশক্তির সঙ্গে আমি একান্তভাবেই সুপরিচিত, কিন্তু তবু যেন নতুন করে আমার বিস্ময়ের অবধি থাকে না। কত সামান্য তুচ্ছ ঘটনার মধ্যে দিয়ে যে কিরীটী তার মীমাংসার সূত্ৰ খুঁজে বের করে, আবার নতুন করে যেন আমার উপলব্ধি হল।
হিরণ্ময়ী দেবী ওদের এই সম্পর্কের কথা জানেন বলে তোর মনে হয় কিরীটী?
না জানলেও তিনি সন্দেহ করেন।
কিন্তু শতদলের রাণুর সঙ্গে সম্পর্কটা?
রাণু ও শতদলের পরস্পর পরস্পরের প্রতি চিন্তাধারাটা আলাদা। বলতে বলতে হঠাৎ যেন কথার মোড়টা ঘুরিয়ে দিয়ে বললে, শতদল আর সীতার মানভাঙাভাঙি নিয়ে তুই ব্যস্ত ছিলি, ওদিকে নিরালায় গেলে অন্য কিছু তুই দেখতে পেতিস—more interesting! আসলে সেইজন্যই তোকে আমি এই রাত্রে ওইদিকে পাঠিয়েছিলাম।
কেন, সেখানে আবার কি হল? শতদলের হত্যাকারীর কোন সন্ধান পেলি নাকি? শেষের কথাটা যেন কতকটা ঠাট্টা করে আমি বলি।
চোখ থাকলে দেখতে পেতিস শতদলের হত্যাকারী দূরের লোক তো নয়ই, ধোঁয়াটেও নয়। কিন্তু তার চাইতেও যে ব্যাপারটা বর্তমানে আমাকে বিশেষ চিন্তিত করে তুলেছে
কী
বুড়ো শিল্পীর চিঠিটা। যেটা শতদলের কাছ হতে আমি আজ সন্ধ্যায় চেয়ে এনেছি। চিঠিটা শুধু যে বুড়োর শেষ উইল তাই নয়, নিরালা-রহস্যের আসল চাবিকাঠিই ওর মধ্যে আছে। ওই চিঠির মধ্যের প্রতিটি অক্ষরের আঁচড়ের মানে আছে। তাছাড়া শতদল মুখে যাই বলক, নিরালার কোন মূল্য নেই—একটা পুরনো বাড়ি ও কতগুলো ছবি, আসলে নিশ্চয়ই তা নয়। অন্যথায় হিরণ্ময়ী ও তার স্বামী হরবিলাসু শতদল ও বাড়ির পুরাতন ভৃত্য অবিনাশ এরা অমনি করে খুঁটি পেতে বসে থাকত না।
তোর তাহলে মনে হয় কোন গুপ্তধন ঐ বাড়ির মধ্যে কোথাও না কোথাও লুকোনো আছে?
গুপ্তধন আছে কিনা বলতে পারি না, তবে থাকলেও আশ্চর্য হব না। সেটাই বরং স্বাভাবিক।
শতদলের প্রাণের উপরে এই যে পর পর attemptগুলো হল, তাহলে তাঁরও কারণ তাই?
তাছাড়া আর কি!
শতদলের এখন কিন্তু বিশ্বাস হয়েছে যে সত্যি-সত্যিই তার প্রাণ নেবার চেষ্টায় কেউ না কেউ ঘুরছে।
হলেই ভাল। কতকটা উদাসীন ভাবেই যেন কিরীটী কথাটা বলে।
এতক্ষণে হঠাৎ যেন আমার মনে হয়, আমার সঙ্গে এতক্ষণ নানা ধরনের কথা বললেও তার মনের মধ্যে অন্য কোন চিন্তা ঘুরে বেড়াচ্ছে।
কী ভাবছিস বল তো? প্রশ্ন করি।
ভাবছিলাম একটা মজার কথা।
কী রে?
তোদের হিরণ্ময়ী দেবীও পঙ্গু নন, আর তোদের ভুখনাও কালা নয়।
বলিস কী!
হ্যাঁ। কিন্তু কথা হচ্ছে, কেন একজন পঙ্গুর অভিনয়—আর কেনই বা অন্যজন কালার অভিনয় করে যাচ্ছে? আর
আর আবার কী?
দুজনের একজনের ইতিমধ্যে মরবার কথা ছিল, কিন্তু এখনো মরছে না কেন?
বোকার মতই কিরীটীর মুখের দিকে তাকাই। ওর কথার মাথা-মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। তবু প্রশ্ন না করে পারি না, দুজন কারা?
কুব্জী মন্থরা বা প্রিয়সখী ললিতা! কিরীটী জবাব দেয়।
১১. হাঁটতে হাঁটতে হোটেলের প্রায় কাছাকাছি
ইতিমধ্যে আমরা হাঁটতে হাঁটতে হোটেলের প্রায় কাছাকাছি এসে পড়েছিলাম। হাতঘড়ির রেডিয়ম-ডায়েলের দিকে তাকিয়ে দেখি রাত প্রায় দেড়টা।
কুব্জী মন্থরা বা প্রিয়সখী ললিতা! কিরীটীর শেষোচ্চারিত কথাটারই জের টেনে কী যেন আমি বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু কিরীটী আমাকে বাধা দিয়ে নিরস্ত করলে, বড্ড ঘুম পেয়েছে রে। চোখ আর খুলে রাখতে পারছি না।
কথাটা উচ্চারণ করতে করতেই কিরীটী আমাদের নির্দিষ্ট ঘরের দিকে একেবারে এগিয়ে গেল সোজা। বুঝলাম এখন আর কোনরূপ আলোচনা করতে কিরীটীর ইচ্ছে নেই, তাই তার অকস্মাৎ মৌনভাব।
সত্যি-সত্যিই কিরীটী অতঃপর সোজা পায়ের জুতোটা খুলে শয্যার ওপরে চটপট চাদরটা গলা অবধি টেনে নিয়ে টান-টান হয়ে শুয়ে পড়ল।
অগত্যা নিরুপায় আমাকেও গিয়ে বাকি রাতটকুর জন্য শয্যা আশ্রয় নিতে হল। কিন্তু আমার চোখে আর তখন ঘুম নেই। বাকি রাতটুকু আমায় জেগেই কাটাতে হবে। শতদলের ব্যাপারটা ক্রমেই যেন বেশী অস্পষ্ট বলে মনে হচ্ছে। নিজে সেই সন্ধ্যা হতে মনে মনে সব কিছু বিশ্লেষণ করে একটা ব্যাপার বুঝতে পারছিলাম, নিরালার মূল্য একমাত্র সেই বাড়িটাই নয়, আর কিছু আছে এবং সেইখানেই এ রহস্যের মূল। শতদল ও সীতার কথাগুলো মনে পড়ছে। শতদল বাড়িটা বিক্রি করতে চায় এবং কয়েকজন খরিদ্দারও ইতিমধ্যে জুটেছে এবং আশাতীত মূল্য দিয়ে তারা বাড়িটা ক্রয় করতে চায়। কিন্তু কেন?
তা ছাড়া আরও একটা কথা। কিছুক্ষণ আগে হোটেলের পথে কিরীটী যা বলছিল, হিরণ্ময়ী দেবী নাকি পঙ্গু নন! কী উদ্দেশ্যে তিনি নিজেকে এভাবে পঙ্গু সাজিয়ে রেখেছেন? আর পঙ্গুই যদি তিনি নন—পঙ্গুর অভিনয়ই বা করে যাচ্ছেন কেন? আর কতদিন থেকেই বা এ অভিনয় করছেন? আর ভুখনাও নাকি কালা নয়! ভুখনা শতদলের নিজের চাকর। তার কথা নিশ্চয়ই শতদল জানে। শতদল কি জানে হিরণ্ময়ী দেবীর রহস্য? আশ্চর্য! এও তো বোঝা যায় না, একজন এমনি করে সুস্থ হয়েও দিনের পর দিন রাতের পর রাত পঙ্গুর অভিনয় করে যাচ্ছেন। আর ভুখনাই বা কেন কালা সেজে থাকে!
ইতিপূর্বে আরো কত জটিল রহস্যের মীমাংসা করেছি, কিন্তু এতখানি জটিলতার সম্মুখীন ইতিপূর্বে হয়েছি বলে মনে পড়ে না।
***
কিরীটীর অনুমান যে এত তাড়াতাড়ি সত্যে পরিণত হবে, এমন পৈশাচিক নিষ্ঠুরতায় সত্য রূপ নেবে, সত্যিই সেদিন সন্ধ্যাতে ভাবিনি। এবং সত্য কথা বলতে কি, শতদলের ব্যাপারটাকে প্রথম হতেই আমি খুব বেশী একটা গুরুত্ব দিইনি। কিন্তু কিরীটী বুঝেছিল, তাই বোধ হয় দু-চারবার অবশ্যম্ভাবী সেই সর্বনাশের ইঙ্গিত দিয়েছিল।
শুধু শতদলের ব্যাপারেই নয়, ইতিপূর্বে আমিও দুচারবার দেখেছি কিরীটীর অদ্ভুত বিশ্লেষণ-শক্তি—অন্ধকারের মধ্যে যেন ভবিষ্যতের পদসঞ্চার সে শুনতে পায়। পঞ্চ অনুভূতির বাইরে তার যে একটা বিচিত্র ষষ্ঠ অনুভূতি, যার সাহায্যে অনেক সময় অসাধ্য সাধন করেছে সে, ভাবতে গেলে যেন বিস্ময়ের অবধি থাকে না। কিরীটী বলে ওটা নাকি তার common sense, স্বাভাবিক বুদ্ধির বিচারশক্তি।
কিন্তু যাক, যে কথা বলছিলাম।
দিন দুই পরের কথা। মেলার উৎসবে ছোট শহরটিতে যেন প্রাণ-চাঞ্চল্যের একটা সাড়া পড়ে গিয়েছে।
রাত্রে বিস্তীর্ণ সমুদ্রের বালুবেলার ওপরে বাজির প্রতিযোগিতা হবে। অ্যামেচার ও পেশাদার বাজিকরদের ভিড়ে সৈকতের নিদিষ্ট স্থানটি গমগম করছে। রাত আটটা হতে বিভিন্ন দলের প্রতিযোগিতা শুরু হবে। নিরালার উন্মুক্ত গেট খুলে দেওয়া হয়েছে বিকাল হতেই। সর্বসাধারণের কাছে আজ অবারিত নিরালার লৌহ-ফটক। আমি, কিরীটী ও স্থানীয় থানা-ইনচার্জ গিয়ে দাঁড়িয়েছি। শতদল সকলকে অভ্যর্থনা করতেই ব্যস্ত। হোটেল হতে রাণু দেবীও এসেছে। আসেননি তার মা মিসেস মিত্র। হঠাৎ ঠাণ্ডা লেগে নাকি ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছেন তিনি। দুবেলাই স্থানীয় ডাক্তার চ্যাটার্জী যাতায়াত করছেন হোটেলে।
আজকের রাতের শীতটা বেশ আরামদায়ক। স্থানীয় দু-চারজন অফিসারের স্ত্রী ও কন্যারা এবং স্থানীয় ভদ্রলোকেরাও অনেকে স্ত্রী-কন্যাদের নিয়ে বাজি প্রতিযোগিতা দেখতে এসেছেন।
পরিষ্কার আকাশ। ঝকঝক করছে তারাগুলো।
হঠাৎ একটা মিষ্টি হাসির তরঙ্গোচ্ছাসে সামনের দিকে চেয়ে দেখি, সীতা রাণুর সামনে দাঁড়িয়ে উচ্ছসিতভাবে হাসছে।
সীতার এমন হাসিখুশি আনন্দ-রূপ এ কয়দিনের পরিচয়ের মধ্যে এক দিনের জন্যেও দেখিনি।
সীতাকে মানিয়েছেও আজ ভারি চমৎকার। সাদা চওড়া জরির পাড় বসানো কালো জর্জেট শাড়ি, গায়ে সিফনের সাদা ব্লাউজ, মাথার চুল বেণীর আকারে পৃষ্ঠদেশে লম্বমান।
রাত্রি ঠিক আটটার সময় বাজির প্রতিযোগিতা শুরু হল।
বিচিত্র সুন্দর দৃশ্য। কালো আশমানের বুকে লাল নীল সাদা হরেক রঙের আগুনের ফুলকিগুলো যেন আলোর ফুলঝুরি ছড়িয়ে চলেছে। হাউইগুলো সোনালী সর্পিল রেখায় কালো আকাশের এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত যেন এক-একটা অগ্নি-ইঙ্গিত এঁকে চলে যাচ্ছে। মিলিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে।
সকলেই আমরা যেন আনন্দে উচ্ছসিত হয়ে উঠেছি। হঠাৎ সেই কলগুঞ্জনের মধ্যে শতদলের কণ্ঠস্বর কানে এল।
শতদল সীতাকে বলছে, এই ঠাণ্ডার মধ্যে গরম জামা গায়ে দাওনি কেন সীতা?
ঠাণ্ডা আবার কোথায়!
হঠাৎ ঠাণ্ডা লাগতেই বা কতক্ষণ? যাও, নিচে গিয়ে একটা গরম জামা গায়ে দিয়ে এস।
কিছু হবে না।
না। আমার এই শালটাই না হয় গায়ে দাও।
না, না—তোমার ঠাণ্ডা লাগবে।
না। আমার গায়ে জামা আছে। নাও-
কতকটা জোর করেই যেন শতদল সীতার গায়ে ডীপ লাল রঙের কাশ্মীরী শালটা নিজের গা হতে খুলে জড়িয়ে দিল।
ঠিক ভিড়ের মধ্যে নয়, ছাদের একেবারে কিনার ঘেষে একধারে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কথা বলছিল সীতা ও শতদল। আমি ওদের থেকে হাততিনেক মাত্র দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম বলেই ওদের পরস্পরের কথাগুলো প্রায় স্পষ্টই শুনতে পেয়েছি। একটু পরেই দেখলাম শতদল ভিতরের দিকে চলে গেল।
ভিড় বাঁচিয়ে ছাদের অন্য দিকে দাঁড়িয়ে কিরীটী ও থানা-ইনচার্জ রসময় ঘোষাল নিম্নকণ্ঠে পরস্পরের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে আলাপ করছে।
বাজি পোড়ানোর ব্যাপারে কিরীটীর যে খুব বেশী মনোযোগ আছে বলে মনে হয় না। আজকের উৎসবে যোগ দিলেও সে যেন উৎসবকে বাঁচিয়ে চলেছে।
অতিথি—বিশেষ করে বিশিষ্ট অতিথিদের প্রতি যে শতদলবাবুর লক্ষ্য আছে বুঝলাম যখন কিছুক্ষণ বাদে ভৃত্য অবিনাশ ট্রেতে করে কেক, বিস্কিট ও ধূমায়িত চা পরিবেশন করে গেল আমাদের।
আরো আধ ঘণ্টাটাক পরে। কালো আকাশ-পটে তখন বিচিত্র বাজির অপূর্ব আলোর খেলা চলেছে।
প্রত্যেকেই আমরা তন্ময় হয়ে একেবারে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। ঐ মুহূর্তে ছাদের উপরে উপস্থিত সকলেরই মনোযোগ ও দৃষ্টি আকাশের দিকে কেন্দ্রীভূত।
হঠাৎ আমরা চমকে উঠলাম একটা মেয়েলী কণ্ঠের আর্ত তীক্ষ্ণ চিৎকারে।
ভয়ার্ত আকুল চিৎকার।
কী হল? ব্যাপার কী? সকলেই পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। সকলের চোখেই একটা প্রশ্ন যেন।
চিৎকারটা এসেছিল কোন দিক থেকে তাও ভালো করে প্রথমটায় বোঝা যায়নি। সকলেই আমরা যেন বিস্ময়ে চকিতে হতভম্ব বিমূঢ়।
ঠিক সেই সময় একটি সুবেশা তরুণী একপ্রকার চেঁচাতে চেঁচাতেই ছাদে এসে দাঁড়ালেন, খুন! খুন হয়েছে!
কথা বলতে বলতে তরুণীটি হাঁপাচ্ছিলেন। ভয়ে আতঙ্কে চোখের মণি দুটো যেন তাঁর ঠিকরে বের হয়ে আসছে।
মুহর্তে চারপাশ হতে সকলে এসে তরুণীটিকে ঘিরে ধরে।
খুন! কোথায় হয়েছে? কে খুন হল? যুগপৎ একসঙ্গে বহু কণ্ঠ হতে প্রশ্ন উত্থিত হল।
হঠাৎ এমন সময় কিরীটীর শান্ত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, একটু অনুগ্রহ করে আপনারা সরে দাঁড়ান তো। সরুন। পথ ছেড়ে দিন।
তাকিয়ে দেখি, কিরীটী ও তার পাশে থানা-ইনচার্জ রসময় ঘোষাল।
সরুন না! পথ ছাড়ুন না! শতদলের কণ্ঠস্বর।
শতদল মধ্যবর্তী তরুণীর কাছে এগিয়ে যাবার জন্য সকলকে পথ ছেড়ে দেবার মিনতি জানাচ্ছে।
বহু কষ্টে আমরা তরুণীর সম্মুখবর্তী হলাম।
শতদল প্রথমে প্রশ্ন করে, আপনি কে? কে খুন হয়েছে? কোথায়?
তরুণী তখনও হাঁপাচ্ছে। চোখে-মুখে ভয়ার্ত ব্যাকুলতা।
এবারে কিরীটী তরুণীর সামনে এগিয়ে যায়, কোথায় খুন হয়েছে বলুন তো?
নীচের বসবার ঘরে-
কিরীটী বলে, আসুন শতদলবাবু। আপনিও আসুন।
সকলে অতঃপর আমরা দোতলায় নেমে এলাম। অভ্যাগতদের বসবার জন্য দোতলার স্টুডিও-ঘরের পাশের ঘরটা খুলে কতকগুলো চেয়ার ও সোফা ঐদিনের জন্য সাজানো হয়েছিল।
ঐদিনকার উৎসবোপলক্ষে ঝাড়বাতিটাও সন্ধ্যা হতেই জেলে দেওয়া হয়েছিল। ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেছিলেন সর্বাগ্রে তরুণীটি এবং তাঁর ঠিক পশ্চাতে আমি ও কিরীটী।
ঘরের মধ্যে পা দিয়েই চমকে উঠেছিলাম। ঘরের ঠিক মাঝখানে মেঝের ওপর কাত হয়ে পড়ে আছে যে মৃতদেহটি তাকে দেখামাত্রই চিনতে আমার কষ্ট হয়নি।
সীতা!
শতদলের সেই রক্তবর্ণ কাশ্মীরী শালটায় তখনও তার দেহ আবৃত।
পশ্চাৎ হতে পৃষ্ঠদেশে গুলি করা হয়েছে। গায়ের শাল ও জামা ভিজিয়ে রক্তধারা ঘরের মেঝেতে—সেদিনই পরিষ্কার করা পরিচ্ছন্ন মসৃণ পাথরের মেঝেতে ছড়িয়ে জমাট বেধেছে।
মৃতদেহের চোখ দুটো বিস্ফারিত। যেন ভয় ও জিজ্ঞাসার চিহ্ন। হস্ত দুটি প্রসারিত।
স্তব্ধ বিস্ময় যেন আমার বাক্যরোধ করেছিল। মুখটা একপাশে কাত হয়ে আছে। শতদলও আমাদের পাশেই নিশ্চল পাষাণের মত দাঁড়িয়ে নির্বাক। তার সমগ্র মুখখানা জুড়ে একটা অসহায় আতঙ্ক যেন ফুটে উঠেছে। চোখে ভীত প্রশ্নভরা দৃষ্টি।
কিরীটীও স্তব্ধ হয়ে মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে। তার পাশে রসময় ঘোষাল। এবং রসময় ও কিরীটীর কাছ হতে বেশ কিছুটা ব্যবধান বাঁচিয়ে ভীত নর-নারীর দল চিত্রাপিতের মতই নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে গা-ঘেষাঘেষি করে। ঘরের মধ্যে পাথরের মতই জমাট একটা স্তব্ধতা যেন থমথম করছে।
বোধ হয় মিনিট চার-পাঁচ ঐভাবেই কেটে গেল।
কিরীটী এগিয়ে গেল সর্বপ্রথম মৃতদেহের খুব কাছে। ঝুঁকে নীচু হয়ে মৃতের অবশ শিথিল হাতটা তুলে আবার যেমনটি ছিল ঠিক সেইভাবে নামিয়ে রাখলে সন্তর্পণে আলগোছে।
স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে পৃষ্ঠদেশে গুলি করা হয়েছে।
সীতা! সীতা খুন হল! অস্ফুট ভাবে কথাগুলো শতদলের কণ্ঠ হতে উচ্চারিত হল। এবং সঙ্গে সঙ্গে দু হাতে মুখ ঢাকল শতদল।
বসুন শতদলবাবু বসুন। শতদলবাবুকে ধরে বসিয়ে দিলাম একটা চেয়ারের উপর, নার্ভ হারাবেন না।
আপনিই দেখেছিলেন? আপনার নামটা জিজ্ঞাসা করতে পারি কি? কিরীটী সেই তরুণীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে।
উনি মিস গূহ। এখানকার উকিল শরৎবাবুর মেয়ে। জবাব দিলেন পার্শ্বেই দণ্ডায়মান প্রৌঢ়বয়স্কা একটি ভদ্রমহিলা।
দেখুন! এবারে কিরীটী সমবেত সমস্ত নরনারীকে সম্বোধন করে বললে, আপনারা সকলে এইভাবে এই ঘরে ভিড় করলে তো চলবে না। অবশ্য আপনাদের সকলের সঙ্গেই আমাদের কথা বলার প্রয়োজন হবে—তবে একে একে, পৃথক পৃথক ভাবে। কী বলেন রসময়বাবু? কিরীটী তার বক্তব্য শেষ করলে শেষ মুহূর্তে থানা-ইনচার্জ রসময়বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে।
হ্যাঁ, আপনাদের আমার প্রয়োজন হবে।
থানা-ইনচার্জ রসময় ঘোষালকে সকলে চিনতেন না। কেউ কেউ যাঁরা চিনতেন, তাঁরাই বোধ হয় ইতিমধ্যে পাশাপাশি যাঁরা জানতেন না তাঁদের ফিসফিস করে জানিয়ে দিয়েছিলেন রসময় ঘোষালের সত্যিকারের পরিচয়টা। এবং কিরীটীকে রসময়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ দেখে তার সত্যিকারের পরিচয়টা না জেনেই বোধ হয় তাকেও ঐ পর্যায়ে ফেলে ওদের দুজনার সম্পর্কেই হঠাৎ যেন সকলে বেশ একটু চঞ্চল হয়ে ওঠে।
আকস্মিক মৃত্যুর ব্যাপারে প্রথমটায় সকলে হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু যে মুহূর্তে তারা বুঝতে পারলে এর মধ্যে থানা-পুলিশও উপস্থিত, সমস্ত ঘটনার চেহারাটাই যেন বদলে গেল। প্রথমটায় যে গুরুত্ব এতক্ষণ আকস্মিকতার মধ্যে ঠিক প্রকাশ পায়নি, থানা ও পুলিশের পরিচয়ের মধ্যে দিয়ে সেই গুরুত্ব যেন সহসা সুস্পষ্ট ও কঠিন হয়ে দেখা দিল। আকস্মিক বিমূঢ়তার মধ্যে ফুটে উঠল একটা ভয়-ব্যাকুল চাঞ্চল্য। সকলেই ভিতরে ভিতরে অবিলম্বে স্থানত্যাগের জন্য যেন চঞ্চল ও ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
যুগপৎ নিঃশব্দে উপস্থিত সকলেরই মুখের দিকে তাকিয়ে কিরীটী নিঃসংশয়ে ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পারে। মৃদু হেসে যেন সকলকেই সাহস দেয়, আপনাদের ব্যস্ত হবার বা ভয় পাবার কোন কারণ নেই। সামান্য দু-চারটে প্রশ্ন প্রয়োজনমত আপনাদের কাউকে কাউকে উনি রসময়বাবু ও আমি জিজ্ঞাসা করব মাত্র। তার পরই আপনারা যে যার গৃহে প্রত্যাবর্তন করবেন। কিছুক্ষণের জন্য বাইরের বারান্দায় আপনারা একটু অপেক্ষা করুন। আমরা বেশীক্ষণ সময় নেব না। কেবল মিস গুহ, আপনি ঘরে থাকুন।
দেখতে দেখতে ঘর খালি হয়ে গেল।
ঘরের মধ্যে এখন আমি, কিরীটী, থানা-ইনচার্জ রসময় ঘোষাল, শতদলবাবু ও মিস গুহ।
মিস গুহ, মনে হচ্ছে আপনিই বোধ হয় সর্বপ্রথম আমাদের মধ্যে ঐ মৃতদেহ দেখেছেন?
কিরীটীর প্রশ্নে মিস গুহ কিরীটীর মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে বোবাদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন, কোন জবাব দেন না। মৃতদেহ দেখার পর আকস্মিক ভাবে যে চাঞ্চল্য তরুণীর মনের মধ্যে জেগেছিল, তার কিছুমাত্র যেন এখন আর অবশিষ্ট নেই। একেবারে স্তব্ধ। বোবা হয়ে গিয়েছেন যেন তিনি।
আপনি নীচে এসেছিলেন কেন?
জলপিপাসা পেয়েছিল তাই এধারে এসেছিলাম। কিন্তু ঘরে ঢুকেই, মিস গুহ আবার মৃতদেহের দিকে দৃষ্টিপাত করে চুপ করে গেলেন।
কিরীটী বারেকের জন্য তার মণিবন্ধে বাঁধা হাতঘড়ির দিকে তাকাল। পরে মৃদু কণ্ঠে বললে, তা এখন ঠিক নটা বেজে দশ মিনিট। আপনি তাহলে পৌনে নটা নাগাদ এ ঘরে এসেছিলেন!
তাই হবে।
সে সময় এ ঘরে আর কেউ ছিল না?
না।
নামবার সময় বাইরের বারান্দায় বা সিঁড়িতেও আর কারো সঙ্গে আপনার দেখা হয়নি?
না।
আপনি জল খেতে নামবার আগে আগাগোড়া ছাদেই ছিলেন? একবারের জন্যও নীচে নামেননি?
না।
অতঃপর কিরীটী একে একে সকলকেই ডেকে তাদের গত এক ঘণ্টার গতিবিধি ও অবস্থান সম্পর্কে প্রশ্ন করতে লাগল।
নবম জনকে প্রশ্ন করা হল। মধ্যবয়েসী একজন ভদ্রমহিলা। তিনি জবাবে বললেন, রাত তখন আটটা আন্দাজ হবে, তিনি এ বাড়িতে আসেন। আসতে তাঁর একটু দেরিই হয়েছিল। এখানকার স্থানীয় স্কুলের তিনি একজন মিসট্রেস। নাম মালিনী সেন। মিস। অবিবাহিতা।
মিস সেন বললেন, সিঁড়ি দিয়ে সবে দোতলার বারান্দায় উঠেছি, হঠাৎ এখন মনে পড়ছে, দেখেছিলাম যেন—উনি ও আর একজন পুরুষ এই ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নিম্নকণ্ঠে পরস্পরের সঙ্গে কথা বলছিলেন। কিন্তু আমি তখন তাঁদের বিশেষ লক্ষ্য করিনি। সোজা উপরে ছাদে উঠে যাই।
মিস সেনের কথা মুহূর্তের জন্য লক্ষ্য করলাম শতদল যেন তাঁর দিকে মুখ তুলে তাকালেন।
সেই পুরুষটি দেখতে কেমন বা তার পরিধানে কী পোশাক ছিল আপনার মনে আছে কি মিস সেন? কিরীটীই প্রশ্ন করে।
ভাল করে ঠিক তো লক্ষ্য করিনি, তবে মনে আছে ভদ্রলোকের বয়স খুব বেশী হবে না। মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। লম্বা ও বেশ গাঁট্টাগোট্টা চেহারা! পরিধানে বোধ হয় ফুলপ্যাণ্ট ও একটা হাফশার্ট ছিল।
তাঁদের কোন কথাবার্তা আপনার কানে গিয়েছিল?
না। তাঁরা এত আস্তে কথাবার্তা বলছিলেন যে, তাঁদের কোন কথাই আমি শুনতে পাইনি। তাছাড়া ওঁদের দিকে আমি তত নজরও তো দিইনি।
সামান্য ঐ সংবাদটকু ছাড়া আর বিশেষ কোন প্রয়োজনীয় তথ্যের সন্ধানই আর কারো কাছ হতে প্রশ্ন করে পাওয়া গেল না।
হঠাৎ এমন সময় বাইরে হরবিলাসের উচ্চ কণ্ঠস্বর শোনা গেল, শতদল! শতদল!
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হরবিলাস এসে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করলেন এবং কক্ষে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই ভূপতিত একমাত্র কন্যার মৃতদেহটা জমাট রক্তের মধ্যে দেখে হঠাৎ যেন স্তব্ধ হয়ে পাষাণের মত নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। কারো মুখে একটি শব্দ পর্যন্ত নেই। নির্বাক কয়েকটি কঠিন মুহূর্ত।
তারপর হঠাৎ সেই স্তব্ধতা ভঙ্গ হল, সীতা! সীতাকে মেরে ফেলেছে! সীতা নেই! সীতা মারা গিয়েছে!
পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে মৃত কন্যার শিয়রের সামনে হাঁটু ভেঙে বসে পড়লেন হরবিলাস। নিঃশব্দে একখানি হাত মৃত কন্যার হিমশীতল মাথার ওপরে রেখে বার-দুই কেবল উচ্চারণ করলেন, সীতা! সীতা! সত্যিই তুই মরে গিয়েছিস মা!
সমস্ত কক্ষখানি যেন এক মর্মন্তুদ বেদনায় ঐ কথা কয়টির মধ্যে গুমরে গুমরে হাহাকার করে উঠল।
নিঃশব্দে হাতখানি মৃত কন্যার মাথার ওপরে বুলোচ্ছেন হরবিলাস। আমরা যেন স্তব্ধ বিমূঢ়। হঠাৎ হরবিলাস কিরীটীর মুখের দিকে তাকালে, কী হবে কিরীটীবাবু! হিরণএখনও কিছু জানে না। অবিনাশ আমাকে খবর দিতেই তাড়াতাড়ি আমি উপরে ছুটে এসেছি। হিরাণ রান্নাঘরে—সে এখনও কিছু জানে না। তারপর হঠাৎ থেমে গিয়ে কতকটা যেন আত্মগত ভাবেই বললেন, জানতাম। আমি জানতাম এ লোভের দণ্ড! লোভের দণ্ড! এত বড় মাশুল দেওয়া আমাদের বাকি ছিল বলেই হিরাণ এ বাড়ি ছেড়ে যেতে চায়নি। কিছুতেই তাকে মত করাতে পারিনি।
বলতে বলতে আচমকা হরবিলাস উঠে দাঁড়ালেন, না, না—এ আমি সহ্য করতে পারছি না। এ আমি সহ্য করতে পারছি না! সীতা! সীতা!
টলতে টলতে হরবিলাস কক্ষ হতে বের হয়ে গেলেন।
১২. একটা বেদনার ঝড়
একটা বেদনার ঝড় তুলে যেন প্রস্থানরত হরবিলাসের কতকটা আত্মোক্তির মত উচ্চারিত কথাগুলো তাঁর পিছনে পিছনে মিলিয়ে গেল চাপা হাহাকারের মতই।
এবং আমাদের বিমূঢ় ভাবটা কাটবার আগে আচমকা জ্ঞান হারিয়ে শতদলের শিথিল দেহটা চেয়ারের উপরেই ঢলে পড়ল। আমার আগেই কিরীটী ক্ষিপ্রগতিতে শতদলের দিকে এগিয়ে এসে উৎকণ্ঠিতভাবে বললো, শতদলবাবু হঠাৎ বোধ হয় জ্ঞান হারিয়েছেন সুব্রত। আয়, ধর। ওঁকে ঐ সোফাটায় শুইয়ে দিই—
আমি ও কিরীটী দুজনে ধরাধরি করে শতদলের জ্ঞানহীন দেহটা কোনমতে পাশের সোফাটায় শুইয়ে দিলাম। ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে তখন শতদলের। চোখ দুটো বোজা। মুখটা ফ্যাকাশে বিবর্ণ। ঘরের কোণে রক্ষিত কুজো থেকে একটা গ্লাসে করে জল নিয়ে শতদলের চোখেমুখে জলের ছিটে দিতে লাগলাম।
কয়েক মিনিট শুশ্রুষা করবার পরই শতদল চোখ মেলে তাকাল। লম্বা একটা নিঃশ্বাস টেনে নিল।
শুয়ে থাকুন শতদলবাবু। একটু বিশ্রাম নিন। আমিই বলি বাধা দিয়ে।
ইতিমধ্যে কিরীটী শতদলের শয়নকক্ষ হতে একটা সাদা চাদর এনে মৃতদেহটা ঢেকে দিয়েছিল। চোখের সামনেই রক্তাক্ত বীভৎস মৃতদেহটা যেন ক্রমেই অসহ্য হয়ে উঠছিল।
কিছুক্ষণ আগেও যাকে ছাতের ওপরে শতদলের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি, তারই নিষ্প্রাণ রক্তাক্ত দেহটা সামনে ঐ মেঝেতে পড়ে আছে।
সামান্য এই দু-ঘণ্টা সময়ের মধ্যে কখনই বা সে নিচে নেমে এল, আর কার হাতেই বা এমন নিষ্ঠুরভাবে নিহত হল? ঘুর্ণাবর্তের মতই প্রশ্নগুলো মনের মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে।
আর কখনই বা তাকে হত্যা করা হল? নিরীহ ঐ মেয়েটির পৈশাচিক হত্যার মূলে কী মোটিভ (উদ্দেশ্য) আছে? ছাতের উপর থেকে অলক্ষ্যে অলঙ্ঘ্য মত্যুই যেন ওকে টেনে নিয়ে এসেছিল নিচে। কিন্তু হত্যা করলে কে? কে? হত্যাকারী কে?
শরীরটার মধ্যে কেমন যেন অস্থির-অস্থির করছে! শতদল ক্ষীণকণ্ঠে বললে।
সুব্রত, শতদলবাবুকে ওঁর ঘরে বিছানায় নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দাও। কিরীটী আমাকে সম্বোধন করে বলে।
না, না, আমি একা থাকতে পারব না। অস্থির উদ্বেগাকুল কণ্ঠে বলে ওঠে শতদল এখানেই আমি থাকব। শতদলের সমস্ত মুখখানা যেন ভয়ে পাঁশটে হয়ে গিয়েছে, অভাবনীয় আকস্মিক আঘাতটা যেন খুবই লেগেছে।
তাহলে সোফাটার ওপরে ভাল করে শুয়ে পড়ুন। কিরীটী স্নিগ্ধকণ্ঠে বলে।
একজন ডাক্তারকে ডাকলে হত না? কথাটা আমিই বলি।
সুব্রত মন্দ কথা বলেনি। কোন জানা-শোনা ভাল ডাক্তার আছে আপনার মিঃ ঘোষাল? প্রশ্ন করে কিরীটী।
আছেন। ডাঃ আদিত্য চ্যাটার্জী। সব চাইতে তাঁরই এখানে ভাল প্র্যাকটিস। ছোটখাটো একটা নার্সিং হোম মতও তাঁর আছে।
তাঁকে একটা খবর দেওয়া যায় না?
বিপিন গেটের বাইরে plain dress-এ পাহারায় আছে, তাকেই আমি বলে আসছি। মিঃ ঘোষাল বলেন।
সুব্রত, মিঃ ঘোষালের সঙ্গে যা।
কিরীটীর মুখের দিকে তাকালাম। বুঝলাম একাকী শতদলের সঙ্গে ও কিছুক্ষণ থাকতে চায়। আমিও আর দ্বিধা না করে ঘোষালের দিকে তাকিয়ে বললাম, চলুন মিঃ ঘোষাল।
সিঁড়ির ঠিক শেষ ধাপের পাশে নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছিল অবিনাশ—এ বাড়ির পুরাতন ভৃত্য।
সিঁড়ির আলোর খানিকটা অবিনাশের মুখের একাংশে তির্যকভাবে এসে পড়েছে। আমাদের দেখে অবিনাশ তাড়াতাড়ি সরে গেল। মনে হল অবিনাশ আমাদের সান্নিধ্য থেকে যেন পালিয়ে গেল। অভ্যাগতের দল সকলেই চলে গিয়েছেন।
সমস্ত বাড়িটার মধ্যে একটা অদ্ভুত ভৌতিক স্তব্ধতা যেন থমথম করছে।
টানা বারান্দার মাঝামাঝি আসতেই থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। সামনে ঘরের খোলা দরজার সামনেই ইনভ্যালিড চেয়ারটার উপরে নিশ্চল পাথরের মত বসে আছেন হিরণ্ময়ী দেবী। বারান্দায় ঝুলন্ত বাতির আলো ওঁর ওপর এসে পড়েছে। সমস্ত মুখখানা ফ্যাকাশে বিবর্ণ। প্রাণের চিহ্ন পর্যন্ত যেন সে চোখে-মুখে নেই। হাত দুটি শ্লথভাবে কোলের ওপরে ন্যস্ত। তাঁর নিত্যসহচর উলের বল ও বুননটা কোলের ওপরে নেই।
আমাদের দুজনের পদশব্দেও কোনরূপ স্পন্দন জাগল না যেন হিরণ্ময়ী দেবীর মধ্যে। যেমন নিশ্চল পাষাণ-প্রতিমার মত স্তব্ধ-অনড় বসেছিলেন ইনভ্যালিড চেয়ারটার ওপর, ঠিক তেমনই বসে রইলেন। চোখের দৃষ্টি সামনের দিকে নিবদ্ধ।
আরো একটু এগিয়ে গেলাম ইনভ্যালিড চেয়ারে উপবিষ্ট হিরণ্ময়ী দেবীর কাছে।
এবারে নজরে পড়ল দুই চোখের কোল বেয়ে দুটি অশ্রুর ধারা। হিরণ্ময়ী দেবী কাঁদছিলেন। তাঁর চোখে জল।
আমি আর অগ্রসর হলাম না। দেওয়াল ঘেষে একটা থামের আড়ালে গিয়ে দাঁড়িয়ে কোন শব্দ না করে কেবল নিঃশব্দে চোখের ইঙ্গিতে ঘোষালকে এগিয়ে যেতে বললাম। ঘোষাল চলে গেলেন বারান্দার অন্য প্রান্তে দ্বারের দিকে।
হরবিলাস বোধ হয় এতক্ষণ ঘরের মধ্যেই ছিলেন, বের হয়ে এলেন। নিঃশব্দে এগিয়ে এসে হিরণ্ময়ীর পশ্চাতে দাঁড়িয়ে ডান হাতটা স্ত্রীর কন্ধের ওপরে রাখলেন। মৃদুকঠে ডাকলেন, হিরণ!
তথাপি নিশ্চল স্তব্ধ হিরণ্ময়ী। এতটুকু কম্পনও নেই। স্বামীর ডাক যেন তাঁর কানে পৌঁছয়নি।
ঘরে চল হিরণ! তথাপি হিরণ্ময়ীর দিক থেকে কোন সাড়া এল না। পূর্ববৎ নিশ্চল স্তব্ধ। হিরণ! আবার মৃদুকণ্ঠে ডাকলেন হরবিলাস।
স্বামী-স্ত্রীর এই শোকের মধ্যে নিজেকে কেমন যেন আমার বিব্রত মনে হতে লাগল। এমন সময় এখানে না থাকাই উচিত বোধ হয়। স্থানত্যাগ করাই কর্তব্য।
আচমকা এমন সময় হিরণ্ময়ীর পাথরের মত স্তব্ধ দেহটা ঈষৎ নড়ে উঠল। হিরণ্ময়ী স্বামীর দিকে চোখ তুলে তাকালেন। নিষ্প্রাণ অর্থহীন দৃষ্টি। স্বামী ডাকলেও যেন কিছু বুঝতে পারেননি তিনি।
ঘরে চল।
১৭৬
সীতাকে কি ওরা নিয়ে গিয়েছে? ক্ষীণকণ্ঠে প্রশ্ন করলেন হিরণ্ময়ী।
ঘরে চল হিরণ। স্নিগ্ধ কণ্ঠে হরবিলাস কেবল বললেন।
তুমি দেখেছ? সত্যিই সীতা মরে গিয়েছে? মনে নেই তোমার, ছোটবেলায় ওর ফিটের ব্যামো ছিল! ফিট হয়নি তো? সত্যিই হয়তো ও মরেনি, ফিট হয়ে আছে। Smelling Salt-এর শিশিটা নিয়ে যাও–
না, তুমি ঘরে চল।
না, ঘরে যাব না। এখান দিয়েই তো সীতাকে ওরা নিয়ে যাবে!
তা তো জানি না। ওসব কথা আর ভেবে কী হবে হিরণ? মনকে শক্ত করা ছাড়া তো আর উপায় নেই।
কিরীটীবাবু, কোথায়?
উপরেই আছেন।
তিনি কি বললেন? তিনিও ধরতে পারলেন না কে আমার সীতাকে খুন করল?
কথাগুলো বলতে বলতে হঠাৎ হিরণ্ময়ী দেবী চুপ করে রইলেন, তারপর আবার যেন আপন মনেই বলে উঠলেন, সে ঠিক ধরতে পারবে, আমার সীতাকে কে মেরেছে। সে ধরতে পারবে—পারবে।
ক্ষীণ পদশব্দ কানে এল।
চেয়ে দেখি ঘোষাল ফিরে আসছেন, আমিও আর বিলম্ব না করে পা টিপে টিপে সোজা দোতলার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। সত্যিই ঐ শোকের দৃশ্য যেন আর সহ্য করতে পারছিলাম না।
ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে দেখি, কিরীটী নিঃশব্দে ঘরের মধ্যে আপনমনে পায়চারি করছে। মুখে পাইপ। শতদলবাবু সোফার ওপরে যেমন অর্ধশয়ান অবস্থায় ছিল তেমনই আছে।
আমার পদশব্দে কিরীটী পায়চারি থামিয়ে আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ঘোষাল কই?
আসছেন।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘোষাল ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন।
ডাক্তারকে ডাকতে লোক পাঠিয়েছেন?
হ্যাঁ। বিপিনও সেই লোকটির কথা বললে মিঃ রায়।
কার কথা?
মিস সেন যে লোকটির কথা বলছিলেন! লোকটাকে বিপিন সদর দিয়ে বের হয়ে যেতে দেখেছে। রাত তখন পৌনে নটা হবে।
আসতে দেখেনি লোকটাকে? কিরীটী প্রশ্ন করে।
না। কেবল বের হয়ে যেতেই দেখেছে। তবে মিস সেন তার বেশভুষার যে description দিয়েছেন তার সঙ্গে মিল নেই।
কি রকম?
গায়ে একটা কালো রঙের গ্রেট কোট ছিল, আর মাথায় একটা কালো রঙের ফেল্ট ক্যাপ ছিল। ক্যাপটা ডানদিকে একটু টেনে নামানো ছিল। চেহারার বর্ণনায় মিল আছে। উঁচু, লম্বা বলিষ্ঠ গড়ন। এবং সদর দিয়ে বের হয়ে যাবার সময় সদরের আলোয় লোকটার মুখের একাংশ যা দেখতে পেয়েছিল, বললে মুখে নাকি খোঁচা খোঁচা দাড়ি ছিল, কিছুদিন যে লোকটা shave করেনি বোঝা যায়।
ঘোষালের কথা শেষ হতেই কানে এল একটা কুকুরের গরুগম্ভীর ডাক।
চমকে উঠেছিলাম প্রথমটায়, পরক্ষণেই মনে পড়ল সীতার কুকুরের ডাক। আজ সন্ধ্যায় এখানে লোকসমাগমের জন্য সীতার কুকুরটাকে নিচের তলার একটা ঘরে চেন দিয়ে বেধে রাখা হয়েছিল।
ঘেউ ঘেউ করে ডাকতে ডাকতে কুকুরটা একলাফে ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল এবং সোজা এসে সীতার ভূপতিত নিষ্প্রাণ হিমশীতল দেহটার সামনে দাঁড়িয়ে গেল।
সকলেই আমরা স্তব্ধ-বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি অ্যালসেসিয়ান প্রকাণ্ড কুকুরটার দিকে। স্থির দৃষ্টিতে সীতার মৃতদেহটার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কুকুরটা।
হঠাৎ কুকুরটা হাঁটু ভেঙে সীতার মৃতদেহের সামনে বসে পড়ল। তারপর মুখটা সীতার গায়ের উপর রেখে কুঁই কুঁই শব্দ করতে লাগল।
কুকুরটা কাঁদছে।
অত বড় একটা জানোয়ার যে অমন করে তার প্রভুর জন্য কাঁদতে পারে, অমন করে তার শোক প্রকাশ করতে পারে, দেখে সত্যিই যেন বিস্ময়ের অবধি ছিল না। নির্বাক আমরা সকলেই। একটা জানোয়ারের শোকপ্রকাশের মধ্যে দিয়ে সমস্ত ঘরের আবহাওয়াটাও যেন বিষণ্ণ হয়ে উঠেছে।
ঠিক এমনি সময় হাঁপাতে হাঁপাতে খালি গায়েই হরবিলাস ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন। হাতে তাঁর কুকুর বাঁধার মোটা শিকলটা।
কুকুরটা কিছুতেই তাঁর প্রভুর মৃতদেহের পাশ হতে নড়বে না। একপ্রকার জোর করেই গলার বকলসে শিকল এঁটে হরবিলাস কুকুরটাকে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন।
রাত প্রায় পৌনে বারোটায় ডাক্তার আদিত্য চ্যাটার্জী এলেন, বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি। দার্শনিকের মত এলোমেলো কাঁচা-পাকা চুল। মিঃ ঘোষালই ডাঃ চ্যাটার্জীর সঙ্গে আমাদের সকলের পরিচয়টা করিয়ে দিলেন এবং নিরালার দুর্ঘটনাটাও সংক্ষেপে তাঁর গোচরীভূত করলেন।
ডাঃ চ্যাটার্জী ওখানকার অনেক দিনের বাসিন্দা। শহরেই প্র্যাকটিস করেন এবং নিজের একটি ছোটখাটো নার্সিং হোমও আছে। মিঃ ঘোষালের মুখে সমস্ত কাহিনী শুনে তিনি একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। কেবল একবার মৃদুকণ্ঠে বললেন, How horrible!
আরও বললেন, এ গৃহ তাঁর পরিচিত, আগেও নাকি দু-একবার এসেছেন এখানে শিল্পী রণধীর চৌধুরীকে দেখতে। এবং সীতাকেও তিনি চিনতেন। এই বাড়িতেই আলাপ হয়েছিল রণধীর চৌধুরীর জীবিতকালে।
কিরীটীর অনুরোধে শতদলকে ডাঃ চ্যাটার্জী পরীক্ষা করলেন। বললেন, Simple nervous shock! একটু স্টিমিউলেন্ট ও কটা দিন বিশ্রাম পেলেই আবার চাঙ্গা হয়ে উঠবেন।
এমন সময় কিরীটী ডাঃ চ্যাটার্জীকে অনুরোধ জানাল, আমারও তাই মত ডাঃ চ্যাটার্জী। এবং আমার ইচ্ছে, শতদলবাবুর উপর দিয়ে উপর্যপুরি কয়েক দিন ধরে যে নার্ভাস স্ট্রেন গিয়েছে তাতেই তিনি আজকের দুর্ঘটনায় একেবারে ব্রেকডাউন করেছেন, এ অবস্থায় আমার মনে হয় যদিও আমি ডাক্তার নই—ওঁর কিছুদিন রেস্ট নেওয়া অবশ্যই কর্তব্য—complete bodily and mental rest এবং এখানে নয়—অন্য কোন জায়গায় স্থান-পরিবর্তন করা এখন বিশেষ প্রয়োজন। আপনি কী বলেন ডাঃ চ্যাটার্জী?
খুব ভাল হয় তাহলে! You are right!
আপনার নার্সিং হোমে সুবিধা হয় না?
আমার নার্সিং হোমে?
হ্যাঁ। আমার তো মনে হয়, ওঁর পক্ষে আপনার নার্সিং হোমই সব চাইতে ভাল জায়গা হবে। আপনার কেয়ারেও থাকবেন উনি এবং strict order থাকবে। কেউ যেন ওঁর সঙ্গে দেখা না করতে পারে।
বেশ তো। তা হতে পারে।
কোন সিঙ্গল রুম খালি আছে কি?
তা আছে।
তবে সেই ব্যবস্থাই ভাল। এখনি ওঁকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা তাহলে করুন।
বেশ তো, আমার টমটম এনেছি—আমার সঙ্গে উনি চলুন।
সেই মত ব্যবস্থাই হল। আমার ওপরেই কিরীটী ভার দিল ডাঃ চ্যাটার্জীর সঙ্গে শতদলবাবুকে নিয়ে গিয়ে একেবারে নার্সিং হোমে পৌঁছে দিয়ে আসার।
কিরীটী ও মিঃ ঘোষাল থেকে গেলেন মৃতদেহের একটা ব্যবস্থা করবার জন্য।
গতকাল থেকে শতদলবাবু ডাঃ চ্যাটার্জীর নার্সিং হোমেই আছেন। নার্সিং হোমে স্ট্রিক্ট অর্ডার দেওয়া আছে একমাত্র কিরীটী ও রসময়বাবু ছাড়া এবং তাঁদের বিনানুমুতিতে কোন ভিজিটার্সকেই কোন উপলক্ষে শতদলবাবুর সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হবে না।
সীতার আকস্মিক মৃত্যুর পর হতেই কিরীটীকে লক্ষ্য করেছিলাম হঠাৎ যেন সে বেজায় গম্ভীর হয়ে উঠেছে। কি একটা চিন্তা যেন তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।
আরো একদিন পরের ঘটনা। হঠাৎ নার্সিং হোম থেকে একজন লোক সংবাদ নিয়ে এল, সন্ধ্যার কিছু পরে ঘণ্টাখানেক আগে থেকে শতদলবাবু নাকি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এবং ডাঃ চ্যাটার্জী অবিলম্বে কিরীটীকে একবার নার্সিং হোমে যেতে বলেছেন। ডাক্তার তাঁর টমটম পাঠিয়ে দিয়েছেন।
আমি ও কিরীটী আর কালবিলম্ব না করে তখনি নার্সিং হোমে যাবার জন্য টমটমে উঠে বসলাম।
ছোট্ট শহর। হোটেল থেকে প্রায় মাইলখানেক দুরে স্টেশনের কাছে ডাঃ চ্যাটার্জীর নার্সিং হোম। প্রায় একবিঘে জমির ওপরে বাগান, এক-মানুষ সমান উঁচু প্রাচীরঘেরা সীমানার মধ্যে দোতলা একটি বাড়িনার্সিং হোম। বাইরে থেকে একমাত্র গেট ছাড়া নার্সিং হোমের মধ্যে প্রবেশ করা দুঃসাধ্য বললেও অত্যুক্তি হয় না।
সোজা আমরা টমটম থেকে নেমে দোতলার কোণের ঘরে যেখানে শতদলবাবু আছেন সেই ঘরে গিয়ে প্রবেশ করলাম।
শয্যার ওপরে শতদলবাবু শুয়ে। বুক পর্যন্ত চাদরে আবৃত। চোখ দুটি বোজা।
পাশে দাঁড়িয়ে ডাঃ চ্যাটার্জী শতদলকে একটা ইনজেকশন দিচ্ছেন। পাশেই দাঁড়িয়ে একজন নার্স।
ইনজেকশন দেওয়া শেষ হলে আমাদের মুখের দিকে তাকালেন ডাক্তার নাসের হাতে সিরিঞ্জটা দিয়ে, চলুন আমার ঘরে। ভয় বোধ হয় কেটে গিয়েছে।
ডাঃ চ্যাটার্জীর ঘরে এসে আমরা বসলাম।
কি ব্যাপার ডাঃ চ্যাটার্জী?
Morphia poisoning-কেউ বোধ হয় শতদলবাবুকে মরফিয়া খাইয়ে মারবার চেষ্টা করেছিল।
বলেন কি? কিরীটীই প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ। হঠাৎ নার্স এসে ঠিক সময়মত আমায় খবরটা না দিলে বোধ হয় রক্ষা করা যেত না life। অতঃপর একটু থেমে বললেন, এখন তো দেখছি সেদিন ওঁকে এখানে এনে ভালই করেছি।
কিন্তু কি করে সম্ভব হল? How it was done? প্রশ্ন করলাম আমি।
প্রথমটায় বুঝতে পারিনি। এখন বুঝতে পারছি দুপুরের দিকে কে একজন ভিজিটার্স দেখা করতে এসেছিল, কিন্তু দেখা করার অর্ডার না থাকায় নার্স দেখা করতে দেয়নি। ভদ্রলোক কিছু ফুল ও একটা কাগজের বাক্সে কিছু মিঠাই রেখে যান ওঁকে দেবার জন্য। সেই মিঠাই খেয়েই নাকি–
হুঁ। আচ্ছা ডাক্তার, আপনার সেই নার্স—যার হাতে সেই ভদ্রলোক ফল ও মিঠাই দিয়ে গিয়েছিল, এখানে তাকে একবার ডাকতে পারেন? তাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।
নিশ্চয়ই।
ডাক্তার বেল বাজালেন। বেয়ারা এসে ঘরে ঢুকল, ডঃ চ্যাটার্জী তাকে বললেন, নার্স সরলা মিত্রকে ডেকে দিতে। নিচের ওয়ার্ডে সরলা মিত্র তখন ডিউটিতে ছিল।
ভাল কথা ডাঃ চ্যাটার্জী, যে মিষ্টি খেয়ে শতদলবাবু অসুস্থ হয়ে পড়েন তার কিছু অংশ এখনো বাকি আছে নিশ্চয়ই! কিরীটী ডাক্তারকে শুধায়।
হ্যাঁ, বোধ হয় গোটা দুই সন্দেশ খেয়েছিলেন বাকিটা এখনো বাক্সেই আছে, রেখে দিয়েছি বাক্সটা সমেত, বলতে বলতে বসবার টেবিলের ডানদিককার ড্রয়ার চাবি দিয়ে খুলে ড্রয়ারটা টেনে কাগজের একটি ফ্যান্সি চৌকো বাক্স বের করে দিলেন ডাঃ চাটাজী।
ফ্যান্সি কাগজের চৌকো বাক্স। বাক্সের উপরে চমৎকার একটা ডিজাইন ও দোকানের নাম লেখা—বান্ধব সুইট হোম। কাগজের বাক্সের উপর লেখা নামটা পড়তে পড়তে কিরীটী বললে, এ তো দেখছি এখানকারই দোকান!
ডাক্তার জবাব দিলেন, হ্যাঁ, এখানকার বিখ্যাত মিষ্টান্নের দোকান। এদের কড়াপাকের সন্দেশ খুবই বিখ্যাত এবং খেতেও খুব ভাল।
বাক্সের ডালা খুলতেই দেখা গেল, গোটা-বারো সন্দেশ তখনও অবশিষ্ট আছে।
সরলা মিত্র এসে কক্ষে প্রবেশ করল, আমাকে ডেকেছিলেন ডাঃ চ্যাটার্জী?
কে, সরলা? এস। আমি ঠিক নয়, ইনি। একে তুমি চেন না, বিখ্যাত লোক—কিরীটী রায়।
নমস্কার। সরলা হাত তুলে নমস্কার জানায়।
চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়স হবে মিস মিত্রের। বেশ গোলগাল চেহারা এবং চোখে-মুখে বুদ্ধির দীপ্তি আছে।
নমস্কার। আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই মিস মিত্র। কিরীটী বললে।
বলুন!
৩নং কেবিনে অর্থাৎ শতদলবাবুর কাছে আজ যখন ভিজিটার্স আসেন, আপনি সে সময় নিচে ডিউটিতে ছিলেন শুনলাম!
হ্যাঁ।
সময়টা আপনার মনে আছে কি?
হ্যাঁ, সাড়ে তিনটে হবে।
যিনি এসেছিলেন তিনি দেখতে কেমন?
বাইশ-তেইশ বছরের একজন সুশ্রী সুবেশা মহিলা।
মহিলা!
হ্যাঁ। তিনি শতদলবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে বললাম পারমিশন নেই—তখন একথোকা গোলাপফুল ও একটি মিষ্টির বাক্স দিয়ে আমায় অনুরোধ জানান শতদলবাবুর ঘরে সেগুলো পেছে দিতে।
সঙ্গে তাঁর আর কেউ ছিল?
না।
তাঁকে দেখলে চিনতে পারবেন?
হয়তো চিনতে পারব, তবে চোখে কালো চশমা ছিল।
১৩. একজন সুশ্রী সুবেশা মহিলা
বাইশ-তেইশ বৎসর বয়সের একজন সুশ্রী সুবেশা মহিলা কিছু রক্তলাল গোলাপ ও এক বাক্স মিষ্টি-কড়াপাকের সন্দেশ-সঙ্গে নিয়ে শতদলবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন! চোখে তাঁর কালো লেন্সের চশমা ছিল অর্থাৎ সুস্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, মহিলা যেই হোন না কেন, তিনি তাঁর মুখখানির স্পষ্ট পরিচয়টা দিতে ইচ্ছুক নন। কিন্তু তার চাইতেও মারাত্মক ব্যাপার, তাঁর দেওয়া মিষ্টি খেয়েই শতদল অসুস্থ হয়ে পড়ল এবং সংবাদ পেয়ে তাড়াতাড়ি ডাঃ চ্যাটার্জী এসে পড়ায় কোনমতে শতদলকে সুস্থ করে তোলা হয়েছে। মরফিন পয়েজনিং কেস। শতদলকে মিষ্টির সঙ্গে মরফিন দিয়ে কৌশলে তাহলে হত্যা করারই চেষ্টা করা হয়েছিল। আবার শতদলের প্রাণহরণের প্রচেষ্টা এবং এবারে ডাঃ চ্যাটার্জী ঠিক সময়ে শতদলের অসুস্থতার সংবাদ না পেলে তাঁকে হয়তো বাঁচানোই যেত না! পরিকল্পনাটিও চমৎকারই বলতে হবে–মিষ্টির সঙ্গে বিষপ্রয়োগ! কিন্তু কে সেই ভদ্রমহিলা?
ভাল কথা মিস মিত্র, ভদ্রমহিলা তাঁর নাম বলেননি? আমিই প্রশ্ন করি।
না। নাম তো কিছু তিনি বলেননি, তবে একটা মুখ-আঁটা নীল খামে চিঠি দিয়েছিলেন ঐ সঙ্গে, শতদলবাবুর নাম উপরে লেখা। চিঠিটা দিয়ে বলেছিলেন, ঐ চিঠিটা দিলেই সব তিনি বুঝতে পারবেন। আমি সেই চিঠি, ফুল ও মিষ্টির বাক্সটা এনে উপরের ইনচার্জ নার্স মিসেস মহান্তির হাতে দিই।
ও, তাহলে মিসেস মহান্তিই তখন উপরে ডিউটিতে ছিলেন! কথাটা বলে কিরীটী মিস মিত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, মিসেস মহান্তি কি এখন এখানে উপস্থিত আছেন? তাঁকে একটিবার অনুগ্রহ করে যদি এই ঘরে ডেকে আনেন মিস মিত্র।
মণিকার এখন off-duty হলেও বোধ হয় নার্সিং হোমেই আছে। দেখছি যদি না বাইরে গিয়ে থাকে তো পাঠিয়ে দিচ্ছি!
মিস মিত্র ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
কিরীটী চেয়ারের ওপরে বসে অন্যমনস্ক ভাবে সম্মুখের টেবিলের উপর থেকে একটা কাঁচের কাগজ চাপা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। চোখের দৃষ্টি স্তিমিত। অন্যমনা।
বুঝতে পারলাম, কোন একটা বিশেষ চিন্তা ঐ মুহূর্তে তার মনের অবগহনে আলোড়ন তুলেছে। কোন একটা সূত্রকে ধরবার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। তাই তার দেহে ও মনে একটা শিথিল নিষ্ক্রিয়তা।
শতদলকে কেন্দ্র করে একটা দুর্বোধ্য রহস্য ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছিল— সীতার আকস্মিক রহস্যজনক মৃত্যু সেটাকে আরো জট পাকিয়ে তুলেছে।
ঘটনাগুলো যেন পরস্পরের সঙ্গে একান্তভাবেই বিচ্ছিন্ন। শতদলকে হত্যা প্রচেষ্টার সঙ্গে সীতাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করবার কী এমন কার্য-কারণ থাকতে পারে বুঝতে পারছি না। হত্যার মোটিভ কী? শতদলকে হত্যা করবার তবু, একটা কারণ থাকতে পারে, কিন্তু সীতা নিহত হল কেন? কী উদ্দেশ্য নিহিত আছে তার হত্যার সঙ্গে? তবে কি দুটো ব্যাপারের সঙ্গে কোন পারস্পরিক সম্পর্ক নেই? শতদলকে হত্যা-প্রচেষ্টা ও সীতাকে হত্যা করা—একের উদ্দেশ্যের সঙ্গে অন্যের উদ্দেশ্যের কোন সম্পর্কই নেই? ঘটনাচক্রে একটির সঙ্গে অন্যটি জড়িয়ে গিয়েছে মাত্র?
বাইরে পদশব্দ পাওয়া গেল। এবং সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় দরজার ভারী নীল রঙের পর্দাটা তুলে কক্ষে প্রবেশ করলেন ৩০/৩২ বৎসরের একটি নার্স।
ডক্টর চ্যাটার্জী, আপনি আমাকে ডেকেছিলেন?
মিসেস মহান্তি! হ্যাঁ, আসুন। পরিচয় করিয়ে দিই, ইমি মিঃ রায় উনিই আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চান। ডাঃ চ্যাটার্জীই মিসেস মহান্তিকে আহ্বান জানালেন।
মুখের দিকে চেয়ে কেবলমাত্র মুখাবয়ব থেকে মিসেস মহান্তির বয়স নিরুপণ করা কষ্ট। বেশ গোলগাল স্থূল চেহারা-চোখেমুখে একটা সরল নিরীহ বোকা বোকা ভাব।
মিসেস মহাতি ডাঃ চ্যাটার্জীর কথায় কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়েই বারেকের জন্য দৃষ্টি নামিয়ে নিলেন।
মিসেস মহান্তি, আপনি তো আজ উপরে ডিউটিতে ছিলেন?
মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানালেন মিসেস মহান্তি।
কেবিনে শতদলবাবু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে আপনি বোধ হয় ডক্টর চ্যাটার্জীকে সংবাদ পাঠান?
হ্যাঁ, সে সময় আমিই ঘরে ছিলাম। মৃদুকণ্ঠে জবাব এল।
কিরীটী হঠাৎ সোজা হয়ে বসল, আপনি সেই সময় শতদলবাবুর কেবিনের মধ্যেই উপস্থিত ছিলেন?
হ্যাঁ।
আগে থাকতেই আপনি কেবিনের মধ্যে ছিলেন, না ঠিক ঐ সময়টিতে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন?
ওঁর সঙ্গে বসে গল্প করছিলাম। সরলা আমাকে কিছু গোলাপ ফুল, একটা চিঠি ও একবাক্স মিষ্টি এনে দেয় শতদলবাবুকে দেবার জন্য। সেগুলো নিয়ে কেবিনে পৌঁছে দিতে গিয়েছিলাম, কিন্তু উনি আমাকে কথায় কথায় আটকে রেখেছিলেন।
আপনার সামনেই তাহলে শতদলবাবু মিষ্টি খান?
হ্যাঁ।
মিসেস মহান্তি, যদি কিছু মনে না করেন তো in details আজকের ঘটনাটা আমাকে খুলে বলুন!
জিনিসগুলো নিয়ে শতদলবাবুর কেবিনে ঢুকতেই তিনি প্রশ্ন করলেন, ওগুলো কী? আমি জিনিসগুলো তাঁর হাতে দিয়ে সব বললাম। তারপর বেরিয়ে আসতে যাব, শতদলবাবু আমাকে ডেকে বললেন, সিস্টার, ঐ ভাসে এই ফুলগুলো একটু সাজিয়ে দিন না, please! ভাসের ফুল যা ছিল সেগুলো তুলে নিয়ে গোলাপ ফুলগুলো সাজিয়ে দিচ্ছিলাম যখন, শতদলবাবু সে-সময় চিঠিটি পড়ছিলেন। তারপরই মিষ্টির বাক্সটা খুলে বললেন, How lovely! কড়াপাকের সন্দেশ! বলতে বলতেই গোটা-দুই সন্দেশ মুখে পুরে দিলেন। এবং আমাকে বললেন একগ্লাস জল দিতে। ঘরের কোণায় কুজোতে জল ছিল। গ্লাসে জল ভরে তাঁর সামনে নিয়ে দাঁড়াতেই দেখি, শতদলবাবুর সমস্ত চোখেমুখে যেন একটা আতঙ্ক। কোনমতে ঢোঁক গিলতে গিলতে বললেন, সিস্টার, শীগগির ডক্টর চ্যাটার্জীকে খবর দিন। আমি অত্যন্ত অসুস্থ বোধ করছি। Quick! যান। সঙ্গে সঙ্গে আমি প্রায় ছুটে গিয়ে ডক্টর চ্যাটার্জীকে ডেকে আনি।
সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে গভীর মনোযোগের সঙ্গে কিরীটী নিশ্চলভাবে বসে মিসেস মহান্তি বর্ণিত কাহিনী শুনছিল, হঠাৎ যেন তার নিশ্চল দেহটা একটা বিদ্যুৎস্পর্শে সজাগ প্রাণবন্ত হয়ে উঠল। কিরীটীর ক্ষণপূর্বের স্তিমিত চোখের তারা দুটো যেন আচমকা বিদ্যুৎ-শিখার মত জলে উঠল। ঝকঝক করে উঠলো ধারালো ছুরির ফলার মত। কিরীটীর ঐ দৃষ্টিকে আমি চিনি। সহসা উপবিষ্ট কিরীটী চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে শুরু করে। দু-চার মিনিট কেটে গেল একটা অখণ্ড নিস্তব্ধতার মধ্যে। ঘরের আমরা বাকি তিনজন নির্বাক হয়ে আছি। আমি আর ডক্টর চ্যাটার্জী উপবিষ্ট। মিসেস মহান্তি আমাদের সামনেই দণ্ডায়মান।
হঠাৎ আবার কিরীটীই ঘরের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করলে, ডক্টর, এবারে আমরা শতদলবাবুকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারি কি?
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। চলুন।
সকলে আমরা কেবিনে এসে প্রবেশ করলাম।
চক্ষু দুটি মুদ্রিত। শতদলবাবু শয্যার ওপরে শুয়েছিলেন। আমাদের পদশব্দে চোখ মেলে তাকালেন। ডাঃ চ্যাটার্জীই সর্বপ্রথমে এগিয়ে গিয়ে শতদলের পালসটা দেখলেন, এখন বেশ সুস্থ বোধ করছেন তো শতদলবাবু?
হ্যাঁ, ধন্যবাদ। অতঃপর কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, আপনি কখন এলেন মিঃ রায়?
এই তো কিছুক্ষণ হল।
ডক্টর চ্যাটার্জীর মুখে সব শুনেছেন বোধ হয়! There was another attempt! স্মিতকণ্ঠে শতদল বললে।
হ্যাঁ, শুনলাম। ভয় পাবেন না মিঃ বোস—this is last! কিরীটীর কণ্ঠস্বরে অদ্ভুত একটা দৃঢ়তা।
আর কারো কানে সেটুকু না ধরা পড়লেও আমার শ্রবণেন্দ্রিয়কে সেটা ফাঁকি দিতে পারে না।
সত্যি! ভাবতেই পারিনি সন্দেশের মধ্যে
শতদলকে বাধা দিয়ে কিরীটী বললে, কে আপনাকে ফুল ও মিষ্টি পাঠিয়েছিল শতদলবাবু?
সত্যি কথা বলতে কি, মিঃ রায়, এতক্ষণে শুয়ে শুয়ে সেইটাই ভাবছিলাম। আপনিও তাকে চেনেন– রাণু!
বজ্রের মতই যেন দু-অক্ষরের নামটি আমার কর্ণে ধ্বনিত হল, রাণু!
কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি সেও কম বিস্মিত হয়নি। এবং কণ্ঠস্বরেও তার সে বিস্ময়টুকু ধ্বনিত হয়ে উঠল, রাণু দেবী!
হ্যাঁ। এই দেখুন না চিঠি, বলে শয্যার আশেপাশে চিঠিটা খুজতে থাকে শতদল চিঠি চিঠিটা গেল কোথায়
মিসেস মহান্তি এমন সময় এগিয়ে এলেন এবং বালিশের তলা থেকে নীল খাম সমেত খোলা চিঠিখানা বের করে শতদলের হাতে তুলে দিলেন, এই যে!
কিরীটী চিঠিটা শতদলের হাত থেকে নিয়ে চোখের সামনে মেলে ধরল। আমিও আরো এগিয়ে গেলাম। নীল রঙের পর, লেটার-পেপারে রয়েল ব্লু কালিতে লেখা চিঠি।
মুক্তোর মতো ঝরঝরে পরিষ্কার হাতের গোটা অক্ষর। এবং হাতের লেখা দেখলে কোন পুরুষের নয়—মেয়ের বলেই মনে হয়। সংক্ষিপ্ত চিঠি।
শতদল,
একান্ত ইচ্ছা থাকলেও তোমার সঙ্গে দেখা করবার উপায় নেই। কড়া হকুম কিরীটী রায়ের।
নার্সিং হোমে প্রবেশ নিষেধ। তুমি রক্তগোলাপ ভালবাস, তাই কিছু রক্তগোলাপ ও তোমার বান্ধব
মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের প্রিয় কড়াপাকের সন্দেশ পাঠালাম। ভালবাসা নিও। ‘রাণু’।
চিঠিটি পড়ে ভাঁজ করতে করতে কিরীটী শতদলের দিকে তাকিয়ে বললে, চিঠিটা আমার কাছে থাক শতদলবাবু।
বেশ।
কিরীটী চিঠিটা জামার পকেটে রেখে দিল, চলুন ডাক্তার। ওঁকে আমাদের বিশ্রাম দেওয়াই প্রয়োজন। উনি বিশ্রাম করুন।
আমরা সকলে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম।
ডাক্তারের কাছে বিদায় নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎ কিরীটী ঘুরে দাঁড়িয়ে বললে, তুই এগো সুব্রত, আমি ডাক্তারকে একটা কথা বলে আসি!
কিরীটী আবার উপরে চলে গেল। মিনিট পনের বাদে কিরীটী ফিরে এল।
***
হোটেলে ফিরে এলাম। ডাক্তারের টমটমই আমাদের হোটেলে পৌঁছে দিয়ে গেল।
কিরীটীর পকেটে যে নীল লেটার-প্যাডের কাগজে লেখা চিঠিটা ছিল, আমার মনের মধ্যে সবটুকু সেটাই অধিকার করে ছিল। চিঠিটা সম্পর্কে কিরীটী আর কোন উচ্চবাচ্য করলেও আমি কিন্তু চিঠিটার কথা কোনমতেই ভুলতে পারছিলাম না। আশা করেছিলাম, হোটেলে ফিরেই কিরীটী রাণুকে ডেকে নিশ্চয়ই চিঠিটা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবে কিন্তু কিরীটী সেদিক দিয়েই গেল না। সোজা ঘরে ঢুকে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিল।
আমি বাইরের বারান্দায় একটা আরামকেদারার উপরে গা এলিয়ে দিলাম।
শীতের ঘনায়মান সন্ধ্যায় চারিদিক অস্পষ্ট। একটানা সমুদ্রগর্জন দূরের সন্ধ্যার অস্পষ্টতার মধ্য হতে কানে এসে প্রবেশ করছে। ইতিমধ্যেই হোটেলের ঘরে ঘরে আলো জ্বলে উঠেছে।
কতক্ষণ অন্ধকারে চেয়ারটার ওপরে বসেছিলাম মনে নেই, হঠাৎ রাণুর কণ্ঠস্বরে চমক ভাঙল।
কে, সুব্রতবাবু নাকি?
কে–ও মিস মিত্র!
অন্ধকারে চুপটি করে বসে আছেন যে?
না, এমনিই। বসুন।
রাণু পাশের চেয়ারটায় বসল।
উঃ, আজ অনেক ঘুরেছি। একা একা বেড়াতে যাব না বলে আপনাদের খুঁজতে এসেছিলাম। বেয়ারাটা বললে, বিকেলের দিকে টমটম করে আপনি আর মিঃ রায় শহরের দিকে গিয়েছেন। কোথায় গিয়েছিলেন? রাণু, জিজ্ঞাসা করে।
ডক্টর চ্যাটার্জীর নার্সিং হোমে।
শতদল কেমন আছে? বেচারা একটু সামলাতে পেরেছে কি?
হ্যাঁ। অদম্য কৌতূহলটাকে আর নিজের মধ্যে চেপে রাখতে পারলাম না। প্রশ্ন করলাম আপনি তো আজ ফুল আর মিষ্টি পাঠিয়েছিলেন রাণু দেবী শতদলবাবুকে!
হ্যাঁ, পেয়েছে?
শান্তকণ্ঠে উচ্চারিত রাণুর কথাটা যেন মুহর্তে একটা বৈদ্যুতিক তরঙ্গাঘাতে আমাকে একেবারে বিবশ করে দিল। কয়েক মুহূর্ত আমার যেন বাক্যস্ফূর্তি হল না। আমি বোবা হয়ে গিয়েছি। অন্ধকারেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম রাণুর মুখের দিকে, কিন্তু অন্ধকারে রাণুর মুখখানা অস্পষ্ট একটা ছায়ার মত মনে হয়।
আপনিই তাহলে শতদলবাবুকে আজ ফুল আর মিষ্টি পাঠিয়েছিলেন?
হ্যাঁ, কিন্তু কেন বলুন তো? উৎকণ্ঠা-মিশ্রিত কণ্ঠে রাণু, প্রশ্ন করে।
সেই সন্দেশ খেয়ে শতদলবাবু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন!
বলেন কি?
হ্যাঁ, ডক্টর চ্যাটার্জীর ধারণা সেই সন্দেশের মধ্যে মরফিন ছিল।
মরফিন! কী বলছেন যা-তা সুব্রতবাবু!
বললাম তো, ডাক্তারের তাই বিশ্বাস। সন্দেশ আপনি কি নিজে হাতে কিনেছিলেন?
না।
তবে?
সন্দেশ হোটেলের বেয়ারাকে দিয়ে কিনিয়ে আনিয়েছিলাম।
আর ফুলগুলো? অকস্মাৎ কিরীটীর কণ্ঠস্বর, শুনে আমি ও রাণু দুজনেই যুগপৎ পশ্চাতের অন্ধকারে ফিরে তাকালাম।
ইতিমধ্যে আমাদের সম্পূর্ণ অজ্ঞাতে কখন যে কিরীটী পশ্চাতের অন্ধকারে এসে দাঁড়িয়েছে নিঃশব্দে এবং আমাদের পরস্পরের কথোপকথন শুনেছে, তার বিন্দুমাত্র টের পাইনি। কয়েকটা মুহূর্ত আমরা দুজনেই চুপ করে থাকি। কিরীটী দ্বিতীয়বার আবার প্রশ্ন করে, আর গোলাপ ফুলগুলো?
ওগুলো শরৎবাবুর মেয়ে মিস কবিতা গুহ পাঠিয়েছিলেন।
মিস গুহ—মানে সে-রাত্রে নিরালায় যার সঙ্গে আলাপ হল? কিরীটীই প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ।
কবিতা গুহর সঙ্গে কি শতদলবাবুর পূর্ব-পরিচয় ছিল?
কবিতা আমার ক্লাস-ফ্রেণ্ড। শতদলের সঙ্গে কবিতার আমাদের বাড়িতেই আলাপ হয়।
হুঁ।
পরের দিন প্রত্যুষে আমি ও কিরীটী রাণুকে সঙ্গে নিকে কবিতা গুহর বাসায় গেলাম।
কবিতা ভিতরে ছিল। রাণুকে পাঠানো হল তাকে ডেকে আনবার জন্য। কিরীটী অবশ্য রাণুকে নিষেধ করে দিয়েছিল, পূর্বাহ্নে কবিতাকে কোন কথা না বলতে।
একটু পরেই রাণুর সঙ্গে কবিতা বাইরের ঘরে এল। শরৎ উকিল ঐ সময় বাসায় না থাকায় আমাদের কথাবার্তা বলবার বিশেষ সুবিধাই হল।
দু-চারটে মামুলী কথাবার্তার পর কিরীটী ফুলের প্রসঙ্গে এল।
আপনি কাল শতদলবাবুকে নার্সিং হোমে গোলাপফুল পাঠিয়েছিলেন কবিতা দেবী?
হ্যাঁ। হাসপাতাল থেকে শতদলবাবুর কাছ হতে কাল সকালে একজন লোক এসে বললে, শতদলবাবু কিছু ফুল পাঠাতে বলেছেন—আমাদের বাগানের গোলাপ। এ-ও সে বলেছিল, ফুলগুলো যেন আমি রাণুর হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিই। তাই–
আশ্চর্য! লোকটা কী রকম দেখতে বল তো কবিতা? কথাটা বললে রাণু।
এখানকার স্থানীয় লোক বলেই মনে হয়। বোধ হয় নার্সিং হোমেই কাজ করে। কবিতা জবাব দেয়, কালো ঢ্যাঙা লম্বা মত। একটু খুঁড়িয়ে চলে।
Exactly! সেই লোকটা কাল সকালে আমার সঙ্গে হোটেলে দেখা করে বলে, শতদলবাবু কিছু কড়াপাকের সন্দেশ তাঁকে পাঠাতে বলেছেন। কথাগুলো বললে রাণু।
এবারে কথা বললে কিরীটী, রাণু, ও কবিতা দুজনকেই সম্বোধন করে, তাহলে আপনারা দুজনেই সেই লোকটির মুখে সংবাদ পেয়েই ফুল আর মিষ্টি নার্সিং হোমে পাঠিয়েছিলেন?
হ্যাঁ। দুজনেই একসঙ্গে জবাব দেয়।
বলাই বাহুল্য, অতঃপর শরৎ উকিলের বাসা থেকে সোজা আমরা রাণুকে নিয়েই নার্সিং হোমে গেলাম। এবং ডাক্তার চ্যাটার্জীকে সব বলে কিরীটী ডাক্তারের কাছে জানতে চাইলে, কবিতা ও রাণু, বর্ণিত ঐ ধরনের বা চেহারার কোন লোক নার্সিং হোমে আছে কিনা!
ডাক্তার শুনে তো বিস্মিত, কই, ও-ধরনের চেহারার কোন লোকই তো আমার এখানে কাজ করে না! চারজন সুইপার, দুজন দারোয়ান ও দুজন কুক। তাদের ডাকা হল, কিন্তু রাণু, বললে, ওদের মধ্যে কেউ নয়।
কিরীটী আর আমি তখন শতদলের সঙ্গে দেখা করলাম।
তাকে প্রশ্ন করায় সে বিস্ময়ে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। বললে, সে কি! সন্দেশ কড়াপাকের আমি খেতে ভালবাসি সত্য এবং লাল গোলাপও আমার খুব প্রিয়, কিন্তু মনের অবস্থা কদিন ধরে আমার এমন চলছে যে, ওসব তুচ্ছ কথা ভাববারই অবকাশ পাইনি!
নার্সিং হোম হতে বিদায় নিয়ে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। সত্যি কথা বলতে গেলে, মনের মধ্যে কিছুটা হতাশা ও ঘনীভূত একটা বিস্ময় নিয়েই।
হোটেলে আমাদের প্রত্যাবর্তনের জন্য যে আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছে। তা বুঝতে পারিনি। হোটেলের বারান্দায় উঠতেই দেখি, থানার দারোগা রসময় ঘোষাল আমাদের জন্য অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করে বসে আছেন। আমাদের দেখেই রসময় বললেন, এই যে কিরীটীবাবু, কোথায় ছিলেন? কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি!
ব্যাপার কী? কিরীটী প্রশ্ন করে।
কাল রাত্রে যে নিরালায় চোর এসেছিল!
নিরালায় চোর এসেছিল?
হ্যাঁ, স্টুডিও-ঘরের তালা ভেঙে চোর ঢুকেছিল—
কিরীটী কথাটা শুনে যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত চমকে ওঠে, কী বললেন, স্টুডিও-ঘরে চোর ঢুকেছিল?
হ্যাঁ। কিছু চুরি গিয়েছে জানেন?
তা তো বলতে পরি না, তবে অবিনাশের হাত দিয়ে হরবিলাস ঘোষ চিঠি পাঠিয়েছেন। এই সেই চিঠি।
রসময় ঘোষাল একটা চিঠি কিরীটীর দিকে এগিয়ে দিলেন।
১৪. থানা-অফিসার রসময় ঘোষাল
কিরীটী হাত বাড়িয়ে থানা-অফিসার রসময় ঘোষালের প্রসারিত হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে চোখের সামনে মেলে ধরল।
আমিও কৌতুহল দমন করতে না পেরে পশ্চাৎ দিক হতে ঝুঁকে কিরীটীর হস্তধৃত খোলা চিঠিটায় দৃষ্টিপাত করলাম।
সংক্ষিপ্ত চিঠি। হরবিলাস ঘোষ লিখেছেন থানা-অফিসার রসময় ঘোষালকে সম্বোধন করে।
থানা ইনচাজ শ্রীরসময় ঘোষাল সমীপেষু,
সবিনয় নিবেদন, দারোগাবাবু, আপনাকে জানানো কর্তব্য বলিয়া জানাইতেছি—গতকাল
রাত্রে ‘নিরালা’য় চোর আসিয়াছিল এবং চোর কিছু চুরি করিয়া গিয়াছে কিনা বলিতে পারি না;
তবে দ্বিতলের স্টুডিও-ঘরের ও শতদলের ঘরের তালা দুটি ভগ্ন অবস্থায় দরজার কড়ার সঙ্গে
ঝুলিতেছে দেখিতে পাই এবং উভয় ঘরের দরজাই খোলা ছিল। শতদলের ঘর হইতে কোন
মূল্যবান কিছু চুরি গিয়াছে কিনা বলিতে পারি না। কারণ ইতিপূর্বে তার ঘরে আমি প্রবেশ করি
নাই এবং সে-ঘরে তাহার মূল্যবান কিছু ছিল কিনা বলিতে পারি না। যাহা হউক, এ ব্যাপারে
কোন কিছু করণীয় থাকিলে করিতে পারেন। আর একটা কথা—এই সপ্তাহের শেষেই আমি ও
আমার স্ত্রী এখান হইতে চলিয়া যাইতে চাই। নমস্কার।
ইতিঃ হরবিলাস ঘোষ
কিরীটী চিঠিটা একবার মাত্র পড়ে রসময় ঘোষালের হাতে প্রত্যর্পণ করল।
চিঠিটা হাতে নিয়ে রসময় কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, যাবেন নাকি একবার নিরালায়?
হ্যাঁ, যেতে হবে বৈকি। চলুন, এখুনি না হয় একবার ঘুরে আসা যাক!
এখুনি যাবেন?
হ্যাঁ-না, আর একটু দেরি করাই ভাল।
রাণুও এতক্ষণ আমাদের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে এবারে মন্থর পায়ে উপরের সিঁড়ির দিকে চলে গেল।
আমরা তো প্রস্তুত হয়েই ছিলাম সকলে নিরালায় যাবার জন্য। রাস্তায় নেমে সমুদ্রকিনারের পথ ধরে পাহাড়ের দিকে চলতে শুরু করলাম। রসময় ঘোষালের সঙ্গে যে লাল পাগড়ি এসেছিল সেও আমাদের অনুসরণ করে। শীতের রোদ আরামদায়ক হলেও এখনো বেশ কনকনে। কষ্টকর মনে হয়। বেলা প্রায় পৌনে এগারোটা হবে।
এখনো সমুদ্রে স্নানার্থীদের ভিড় কমেনি। বহু পুরুষ-নারী বালকবালিকা যুবক-যুবতী হৈ-চৈ করে সমুদ্রের জলে লাফালাফি ঝাঁপাঝাঁপি করছে। তাদের উল্লাস কানে আসে। নিঃশব্দে কিরীটী ও রসময় ঘোষাল পাশাপাশি হেঁটে চলেছে। ওদের পশ্চাতে আমি। নিরালায় স্টুডিও-ঘরে বা শতদলের ঘরে এমন কী ছিল যার জন্য কাল রাত্রে চোরের আবির্ভাব হল! শতদলের ঘরে তবু কিছু থাকতে পারে, কিন্তু স্টুডিও-ঘরে কেবল কতকগুলো ছবি আর স্ট্যাচু! খেয়ালী ধনী আর্টিস্টের বাড়ি—স্টুডিও-ঘরের মধ্যে কোন গুপ্ত কক্ষ বা আলমারি বা চোরা জায়গা ছিল না তো? ছিল না তো তার মধ্যে এমন কোন মূল্যবান বস্তু, যার জন্য চোরের উপদ্রব হয়েছিল গতরাত্রে? ইতিপূর্বেও রাত্রে নিরালায় যার আবির্ভাব ঘটেছিল একবার, সে শতদলের প্রাণহরণের চেষ্টা করেছিল এবং দ্বিতীয়বারের উদ্দেশ্যটা ঠিক পরিস্ফুট না হলেও সীতার কুকুরটাকে জখম করে গিয়েছিল!
হঠাৎ আবার সীতার কথা মনের মধ্যে ভেসে ওঠে।
সীতা!
মনে হয় সে বুঝি মরেনি। নিষ্ঠুরভাবে অদৃশ্য আততায়ীর হাতে পিস্তলের বুলেটে নিহত হয়নি। সে যেন এখনো মনে হয় নিরালাতেই আছে। এই যাচ্ছি—গেলেই দেখা হবে! শ্যামাঙ্গী অপরাজিতার মত ঢলঢলে মেয়েটি। স্মৃতির পাতাগুলো যেন জ্বলজ্বল করছে।
মরে গিয়েছে– চোখের সামনে তার রক্তাক্ত মৃতদেহটা অসাড় অসহায় অবস্থায় ঘরের মেঝের ওপরে কার্পেটে আমরা সকলেই পড়ে থাকতে দেখেছি। মৃতদেহের অবস্থায়—ভিতর থেকে রিভলভারের বুলেটও পাওয়া গিয়েছে, তবু মনে হচ্ছে মরেনি সে, এখনো বেঁচে আছে!
কেন এমন হয়?
কিন্তু কে অমন নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করলে মেয়েটিকে, আর কী উদ্দেশ্যেই বা হত্যা করলে? সীতার কুকুর টাইগার যে-রাত্রে জখম হয়, সে-রাত্রেও আততায়ী সীতাকে হত্যা করবার চেষ্টা করেছিল। আচমকা কুকুরটা সামনে পড়ায় শেষ পর্যন্ত তাকেই জখম করে পালিয়ে যায়। হঠাৎ রসময়ের কথা কানে এল, রসময় কিরীটীকে প্রশ্ন করছেন, সক্কালবেলাতেই কোথায় গিয়েছিলেন মিঃ রায়?
শরৎবাবু উকিলের বাসায় তাঁর মেয়ে কবিতা গুহর সঙ্গে দেখা করতে।
হঠাৎ?
নার্সিং হোমে ফুল-সন্দেশ তারই পরামর্শমত শতদলবাবুকে রাণু দেবী পাঠিয়েছিলেন!
তার মানে? বিস্মিত রসময় কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।
তার মানে ঐটাই সব ও শেষ নয়। ওটা তো প্রদীপের আলো। আলো জ্বালাবার ইতিহাস আরো পশ্চাতে। সে আর এক ভগ্নদূত-সংবাদ! কিরীটী মৃদু হাস্যসহকারে জবাব দেয়।
ভগ্নদূত-সংবাদটি আবার কী!
কে এক খোঁড়া দূত শতদলবাবুরে পরিচিত কবিতা দেবীকে এসে জানায়, শতদলবাবু নাকি অনুরোধ করে পাঠিয়েছেন তাঁকে যেন কিছু লাল গোলাপ নার্সিং হোমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যে কারণেই হোক, কবিতা দেবী নিজে ফুলটা না পাঠিয়ে ফুলগুলো রাণু দেবীকে পাঠিয়ে দিতে অনুরোধ জানায়। রাণু দেবী সেই ফুলই শুধু নয়—ঐ সঙ্গে মিষ্টি যোগ করে দেন, অর্থাৎ কিছু; কড়াপাকের সন্দেশ দিয়ে আসেন।
ঐ হোটেলের বেয়ারাদের মধ্যেই তাহলে কেউ একজন সন্দেশ কিনে এনে দিয়েছিল?
হ্যাঁ। কিন্তু ঘোষাল সাহেব, জল সেখানেও গভীর। অনুসন্ধানে জেনেছি রামকানাই নামে এক বেয়ারাই সন্দেশ কিনে এনে দিয়েছিল এবং রাণু দেবী স্বয়ং সন্দেশ ও ফুল নার্সিং হোমে পৌঁছে দিয়ে আসেন।
রাণু দেবীকে আপনি ঐ সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করেননি?
সুব্রতই গতরাত্রে করেছিল। দু-একটা আমিও করেছি, কিন্তু যে মৎস্যটি গভীর জলে থেকে ল্যাজের ঝাপটা মেরেছেন, সে তো রাণু দেবী নন! রাণু দেবীর বুদ্ধি ও চিন্তারও অগোচরে। কিন্তু তিনি যত গভীরেই থাকুন, তাঁর ল্যাজের আঁশ আমার চোখে পড়েছে।
বলেন কী! কাউকে সন্দেহ–
হ্যাঁ, অন্ধকারে আলো দেখতে পাওয়া গিয়েছে ঘোষাল সাহেব। কিন্তু মাত্র একটি জায়গায় সূত্র এসে একটা জট পাকিয়ে রয়েছে। সেই জটটি খুলতে পারলেই সব বোঝা যাবে।
কিরীটীর কথায় বিস্মিত আমিও কম হইনি। কিরীটী তাহলে সমাধানে প্রায় পৌঁছে গিয়েছে! নিরালা-রহস্য মীমাংসার চৌকাঠে এসে দাঁড়িয়েছে!
বলতে বলতে কিরীটী থেমে গিয়েছিল। যতটুকু কিরীটী এইমাত্র বললে, তার চাইতে একটি কথাও বেশী এখন আর সে বলবে না, এও আমার জানা। তাই সে ঐ পর্যন্ত বলে থেমে গেল, কিন্তু কিরীটীর চরিত্রের সঙ্গে রসময় ঘোষালের সম্যক পরিচয় নেই, তাই তিনি পুনরায় প্রশ্ন করলেন, লোকটি কে?
দু-একদিনের মধ্যেই জানতে পারবেন! গম্ভীর কণ্ঠে কিরীটীর সংক্ষিপ্ত জবাব শোনা গেল।
ইতিমধ্যে আমরা আমাদের গন্তব্য স্থান নিরালার গেটে পৌঁছে গিয়েছিলাম। সেই দিকেই কিরীটী রসময়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে, চলুন দেখা যাক নিরালা কী বলে!
দরজা বন্ধ ছিল।
বন্ধ দরজার একপাশে দরজা খোলবার জন্য ভিতরে সাংকেতিক ঘণ্টার সঙ্গে ঝুলন্ত সংযুক্ত দড়িটার প্রান্ত ধরে কিরীটী বার-দুই টান দিল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজা খুলে গেল। খোলা দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে হরবিলাস।
আসুন। হরবিলাস আমাদের আহ্বান জানালেন।
হরবিলাস এগিয়ে চললেন, পশ্চাতে রসময় ঘোষাল, আমি ও কিরীটী। সর্বশেষে সঙ্গের সেই কনস্টেবলটি।
সীতার মত্যুর প্রায় পাঁচদিন পরে নিরালায় এসে আমরা প্রবেশ করলাম। হঠাৎ নজরে পড়ল, হরবিলাস যেন ডান পা-টা একটু টেনে টেনে চলেছেন মন্থর ভাবে। এবং সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় কিরীটীর কণ্ঠস্বর শুনলাম।
ডান পায়ে আপনার কী হল হরবিলাসবাবু?
চলতে চলতেই হরবিলাস জবাব দিলেন, কয়েক দিন আগে বাগানে কাজ করবার সময় পায়ে একটা কাঁটা ফুটেছিল। সেটাই পেকে গিয়ে নচেৎ নিজেই আপনাদের কাছে যেতাম।
কাঁটা ফুটেছিল! কিরীটী পালটা প্রশ্ন করে।
কিরীটীর প্রশ্নের জবাবে হরবিলাস কী জবাব দিতেন জানি না, কিন্তু জবাব দেবার পূর্বেই কথা বললেন রসময় ঘোষাল।
কদিন বাড়ি থেকে তাহলে বের হননি বলুন!
না, মেয়েটা বুকটা একেবারে ভেঙে দিয়ে গিয়েছে। অশ্রুরুদ্ধ হয়ে এল হরবিলাসের কণ্ঠস্বর।
কিন্তু আপনি মিথ্যা কথা বলছেন হরবিলাসবাবু! কঠিন কণ্ঠে বললেন এবারে রসময় ঘোষাল কথাগুলো।
মিথ্যা কথা বলছি! প্রশ্নটা যেন পালটা উচ্চারণ করে ঘুরে দাঁড়ালেন হরবিলাস রসময়ের মুখের দিকে তাকিয়ে।
চোখ দুটো তাঁর অদ্ভুত একটা দীপ্তিতে ঝকঝক করছে কিসের এক প্রত্যাশায়।
আমরাও নির্বাক।
হ্যাঁ, মিথ্যা বলেছেন। বলতে বাধ্য হচ্ছি, কারণ পরশু সকালে বাজারে একটা ওষুধের দোকানের সামনে আপনাকে আমি দেখেছি। দোকান থেকে আপনি বের হয়ে আসছেন, হাতে আপনার একটা প্যাকেট ছিল।
ক্ষণপূর্বে যে বিস্ময় ও চাপা একটা ক্রোধ হরবিলাসের মুখখানার ওপরে থমথমে হয়ে উঠেছিল, মুহূর্তে যেন সেটা মেঘমুক্ত চাঁদের মত নির্মল হাস্যদীপ্তিতে ঝলমল করে উঠল। স্মিতকণ্ঠে হরবিলাস এবারে বললেন, ভুল দেখেছেন দারোগা সাহেব! আমি নয়—এই পাঁচদিন বাড়ি থেকে এক পা-ও আমি বের হইনি কোথাও!
স্পষ্ট দিনের আলোয় স্পষ্টই দেখেছি হরবিলাসবাবু! ভুল হতে পারে না।
পারে বৈকি। ভুল তো আমরা কত সময়েই করি। বিশেষ করে দেখার ভুল-দেখবার ভুল!
হরবিলাসের শান্ত নির্লিপ্ত কণ্ঠস্বর শুনে মনে হয়, যেন কোন একটি শিশুকে অসীম ধৈর্যের সঙ্গে কিছু বোঝাচ্ছেন। কিরীটীর দিকে একবার বক্রদৃষ্টিতে না তাকিয়ে পারলাম না। কিন্তু সে-মুখ যেন পাষাণে কুঁদে তোলা। কোথায়ও এতটুকুও উত্তেজনা বা দীপ্তিমাত্রও নেই। এতটকু আগ্রহের চিহ্ন পর্যন্তও যেন ওর মুখের ভাবে চোখের দৃষ্টিতে নেই।
দেখবার ভুল! আপনি বলছেন দেখবার ভুল? রসময় ঘোষালের স্পষ্ট কণ্ঠস্বরে যেন এবারে একটা পলিসী কাঠিন্য ফুটে ওঠে।
তা ছাড়া আর কী বলি বলুন! চারদিন পায়ের যন্ত্রণায় পায়ের পাতা ফেলতে পারি নি, নিজে বসে হট ফোমেন্টশন দিয়েছি—আজই সবেমাত্র একটু যা হাঁটা-চলা শুরু করেছি। আর আপনি কিনা দেখলেন আমায় বাজারে!
হরবিলাসবাবু, শাক দিয়ে মাছ ঢাকবার মিথ্যা চেষ্টা করছেন! পনের বছর এই পুলিশ লাইনে চাকরি করছি। অত সহজে আমাদের দৃষ্টিভ্রম হয় না। আপনি সাপ নিয়ে খেলা করছিলেন, আপনি নিশ্চয়ই জানেন, গতকাল হঠাৎ নার্সিং হোমে শতদলবাবু কড়াপাকের সন্দেশ খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন
মুহূর্তে যেন রসময় ঘোষালের কথাটা শুনে হরবিলাসের কৌতুকোভাসিত উজ্জল মুখখানা নিষ্প্রভ হয়ে গেল। হরবিলাসের মুখের চেহারার হঠাৎ পরিবর্তন আমার দৃষ্টিতেও এড়ায় না, কিন্তু হরবিলাস ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছেন। মৃদু উৎকণ্ঠামিশ্রিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, তাই নাকি? সন্দেশ খেয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ল কেন?
কারণ সে সন্দেশের মধ্যে বিষ ছিল!
বিষ! একটা আর্ত শব্দের মতই হরবিলাসের কণ্ঠ হতে কথাটা উচ্চারিত হল।
হ্যাঁ, বিষ। মরফিন।
হরবিলাস স্থির অচঞ্চল দৃষ্টিতে কয়েকটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন ঘোষালের মুখের দিকে।
রসময় ঘোষালের তীক্ষ্ণ অন্তর্ভেদী দৃষ্টিও হরবিলাসের দুটি চোখের প্রতি অপলক হয়ে আছে। চারজোড়া চোখের দৃষ্টি যেন পরস্পরকে লেহন করছে।
আপনি কী বলতে চান ঘোষাল সাহেব?
শতদলবাবুকে নার্সিং হোমে লাল গোলাপ ও কড়াপাকের সন্দেশ পাঠাতে হবে, আপনিই কবিতা দেবীকে অনুরোধটা জানিয়ে এসেছিলেন গত পরশু কোন এক সময়, তাই নয় কি?
একেবারে স্পষ্টাস্পষ্টি মুখের ওপরে অভিযোগ। একেবারে সম্মুখযুদ্ধে আহ্বান। আবার কয়েক সেকেন্ডের জন্য কঠিন স্তব্ধতা।
ওঃ, আপনি এতক্ষণ ধরে তাহলে এই কথাটাই আমাকে বলতে চাইছিলেন ঘোষাল সাহেব! হরবিলাসের শান্ত-গম্ভীর কণ্ঠস্বরে যেন একটা অস্পষ্ট ব্যঙ্গের হুল উদ্যত হয়ে ওঠে।
রসময় কোন জবাব দেন না। কেবল স্থিরদৃষ্টিতে ঘোষালের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
আপনার অনুমান তাহলে আমিই শতদলকে সন্দেশের মধ্যে বিষ দিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিলাম? হরবিলাসই দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করলেন।
হ্যাঁ। যতক্ষণ না বলছেন কেন আপনি গত পরশু সকালে বাজারে গিয়েছিলেন এবং ওষুধের দোকানে ঢুকেছিলেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আপনাকে আমি সন্দেহ করব।
কিন্তু শতদলকে মেরে আমার লাভ কী ঘোষাল সাহেব?
মারবার কথা তো এর মধ্যে উঠছে না হরবিলাসবাবু! এতক্ষণে কিরীটী কথা বলে, আপনার ঐ সময়ে সেদিন বাজারে উপস্থিতিটাই ওঁর মনে সন্দেহ আনছে কতকগুলো ব্যাপারে।
কিন্তু সেইটাই তো মিথ্যা!
মিথ্যা নয়। কিরীটীর কণ্ঠস্বরটা যেন বজ্রের মত ধ্বনিত হল, উনি ঠিকই বলেছেন।
তার মানে? মিনমিনে গলায় হরবিলাস কথাটা বললেন।
আপনার ডান হাতের আংটির প্রবাল পাথরটা কই? প্রবাল পাথর! বিস্ময়ে যেন স্তম্ভিত হরবিলাস।
হ্যাঁ, প্রবালটা! কোথায় সেটা? দেখুন তো হাতের আঙুলের আংটিটা আপনার!
তাই তো! পাথরটা? চোখের সামনে ডান হাতটা তুলে আংটিটার দিকে তাকালেন হরবিলাস।
সত্যি হরবিলাসের হাতের আঙুলের আংটিটার পাথরটা নেই!
লক্ষ্যও করেননি হরবিলাসবাবু; যে, আংটির পাথরটা আপনি ইতিমধ্যে হারিয়েছেন! যাক, এই নিন পাথরটা বলতে বলতে কিরীটী জামার পকেটে হাত চালিয়ে একটি বড় মটরের দানার মত প্রবাল পাথর বের করে হাতের পাতায় পাথরটা নিয়ে এগিয়ে ধরলে হরবিলাসের সামনে। দেখুন এটাই আপনার অজ্ঞাত হারানো প্রবাল। দেখুন ঠিক আংটিটায় বসে যাবে।
সত্যি হরবিলাসেরই আংটির পাথর সেটা।
সকলেই আমরা বিস্মিত ও নির্বাক। অকস্মাৎ অন্ধকার কক্ষের মধ্যে যেন রৌদ্রালোক এসে পড়েছে। কিরীটী আবার বলে, পাথরটা আজই সকালে শরৎবাবু উকিলের বাসার বৈঠকখানায় কুড়িয়ে পেয়েছি হরবিলাসবাবু। একটু আগে রসময়বাবু, যখন আপনাকে গত পরশু সকালে বাজারে দেখেছেন বলে জেরা করছিলেন, হঠাৎ আপনার হাতের আঙুলের আংটিটার প্রতি আমার নজর পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হয়, এই পাথরটাই ইতিপূর্বে আপনার আঙুলের আংটিতে বসানো আমি দেখেছি। একেবারে সাধারণ যোগ-দুয়ে দুয়ে চার। এখন আর নিশ্চয়ই অস্বীকার করবেন না হরবিলাসবাবু, যে আপনি এতক্ষণ যা বলছিলেন তা সত্য নয়!
হরবিলাস একেবারে নির্বাক। স্তব্ধ নিশ্চল। প্রাণহীন পাষাণমূর্তির মত দাঁড়িয়ে।
এবারে বলতে বাধা নেই নিশ্চয়ই হরবিলাসবাবু, কেন গত পরশু সকালে আপনি বাজারে গিয়েছিলেন আর কেনই বা কবিতা দেবীর বাড়িতে গিয়ে শতদলকে ফুল ও সন্দেশ পাঠাবার জন্য বলে এসেছিলেন! ঝাঁজিয়ে উঠলেন ব্যঙ্গে রসময় ঘোষাল।
কিন্তু নির্বাক হরবিলাস। টু শব্দটি বের হয় না মুখ দিয়ে।
কী, চুপ করে কেন? জবাব দিন?
আমার কিছুই বলবার নেই দারোগা সাহেব। আপনার যা খুশি করতে পারেন।
আমার প্রশ্নের আপনি জবাব দেবেন না?
না।
বেশ, তাহলে শতদলবাবুকে সন্দেশের মধ্যে বিষ মিশিয়ে হত্যা করবার প্রচেষ্টার জন্য আপনাকে আমি আরেস্ট করতে বাধ্য হচ্ছি। কান সিং!
বেশ, আপনার যেমন অভিরুচি। বললেন শান্তভাবে হরবিলাস। কান সিং এগিয়ে এল জুতোর মচমচ শব্দ তুলে। বাবুকে থানায় নিয়ে গিয়ে হাজতঘরে রাখ। রসময় বললেন।
দাঁড়ান!
নারীকণ্ঠ শুনে সকলেই আমরা একসঙ্গে ফিরে তাকালাম।
ইতিমধ্যে কখন একসময় নিঃশব্দে আমাদের পশ্চাতে হিরণ্ময়ী দেবী তাঁর ইনভ্যালিড চেয়ার চালিয়ে নিয়ে এসেছেন তা টেরও পাইনি।
আমার স্বামীকে আরেস্ট করবার আগে আমার কিছু বক্তব্য আছে কিরীটীবাবু! হিরণ্ময়ী দেবী শান্তকণ্ঠে বললেন।
১৫. হিরণ্ময়ী দেবীর কণ্ঠস্বর
হিরণ্ময়ী দেবীর কণ্ঠস্বরটা যেন মুহূর্তে একটা মোচড় দিয়ে আমাদের সকলের মনই তাঁর দিকে আকর্ষণ করল। তাঁর দু চোখের ব্যগ্র উৎকণ্ঠিত দৃষ্টি কিরীটীর দু চোখের ওপরে নিবদ্ধ। সমস্ত মুখে একটা গভীর উত্তেজনা যেন থমথম করছে। দুহাতের মুষ্টি যেন উপবিষ্ট ইনভ্যালিড চেয়ারটার হাতল দুটোর ওপরে লৌহ-কঠিন ভাবে চেপে বসে আছে।
কয়েকটা মুহূর্ত কারো কণ্ঠ হতে কোন শব্দ বের হল না। হরবিলাসকে কেন্দ্র করে ক্ষণপূর্বে যে সঙ্কটময় পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল, হিরণ্ময়ী দেবীর আকস্মিক আবির্ভাব ও নাটকীয় উক্তি সেটাকে যেন আরো রহস্যঘন করে তুলল। একমাত্র কিরীটী ছাড়া আমরা উপস্থিত সেখানে সকলেই হিরণ্ময় দেবীর মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করল কিরীটী। পকেট হতে সোনার সিগারেট কেসটা বের করে একটা সিগারেট দুই ওষ্ঠের বন্ধনীতে চেপে ধরে অগ্নিসংযোগ করবার জন্য ফস করে একটা দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালাল। এবং প্রজ্বলিত কাঠিটা ফুঁ দিয়ে নিবিয়ে ফেলে দিতে দিতে শান্ত কণ্ঠে বললে, আপনার কিছু বলবার থাকলে নিশ্চয় আমরা শুনব হিরণ্ময়ী দেবী। কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তো শোনা যাবে না। চলুন আপনার ঘরে চলুন!
আমরা সকলে অতঃপর কিরীটীর আহ্বানেই যেন কতকটা হিরণ্ময়ী দেবীর ঘরে গিয়ে ঢুকলাম।
সেই ঘর। ঠিক তেমনি ভাবে ঘরের সমস্ত জানালাগুলো বন্ধ। ঘরের দেওয়ালে সেই পাশাপাশি দুটি নারীর অয়েল-পেনটিং, দেখলে মনে হয় যেন একই জনের দুটি প্রতিকৃতি। যে ফটো দুটি সম্পর্কে কয়েকদিন পূর্বে কিরীটী হিরণ্ময়ী দেবীকে প্রশ্ন করায় তিনি বলেছিলেন, কার ছবি তিনি জানেন না। এ কথাও মনে পড়ল, তার উত্তরে কিরীটী পুনরায় প্রশ্ন করেছিল ওঁকে, শতদলবাবুর মা হিরণ্ময়ী দেবীর ভাইঝি কিনা? জবাবে হিরণ্ময়ী দেবী বলেছিলেন, হ্যাঁ।
বলুন হিরণ্ময়ী দেবী, আপনার কী বলবার আছে? কিরীটীই বলে হিরণ্ময়ী দেবীকে।
আপনার অনুমান ভুল। আমার স্বামী শতদলকে হত্যা করবার কোন চেষ্টাই করে নি।
কিন্তু আপনার স্বামী যে গত পরশু সকালে বাজারে গিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে কবিতা দেবীর বাড়িতে গিয়েছিলেন এ কথাও ঠিক, জবাবে বলে কিরীটী।
গত পরশু উনি বাজারে গিয়েছিলেন সত্যি, তবে
হঠাৎ এমন সময় বাধা দিলেন হরবিলাস। এতক্ষণ তিনি চুপ করেই ছিলেন। তিনি বলে উঠলেন, না হিরণ, চুপ কর। কোন কথাই তোমায় বলতে হবে না। মিঃ ঘোষাল, আপনি আমায় কোথায় নিয়ে যাবেন চলুন, আমি প্রস্তুত!
তুমি থাম, আমাকে বলতে দাও। কতকটা যেন ধমকের সুরেই হিরণয়ী তাঁর স্বামীকে থামিয়ে দিলেন।
কিন্তু আজ হরবিলাস যেন স্ত্রীর কর্তৃত্বে বাধা মানলেন না। জোর গলায় বলে উঠলেন, কেন-কেন মিথ্যে একটা কেলেঙ্কারি করছ হিরণ! যে গেছে সে তো ফিরবে না! চলুন না মিঃ ঘোষাল, কেন দেরি করছেন? চলুন না, কোথায় নিয়ে যাবেন আমায়!
না, না—আমাকে বলতে দাও। পাষাণের মত গুরুভার হয়ে আমার বুকের মধ্যে চেপে বসেছে। এ আর আমি সহ্য করতে পারছি না—আর আমি সহ্য করতে পারছি না, উত্তেজনার আবেগে হিরণ্ময়ী দেবীর কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এল।
হিরণ—হিরণ, চুপ করো—ভুলে যাও। ভুলে যাও ওসব কথা। মিনতিতে করুণ হয়ে ওঠে হরবিলাসের কণ্ঠস্বর।
শুনেন মিঃ রায়, সীতাকে আমি—হ্যাঁ, মা হয়ে আমিই তাকে হত্যা করেছি।
হিরণ—হিরণ! চিৎকার করে ওঠে হরবিলাস কী বলছ তুমি পাগলের মত?
হিরণ্ময়ী দেবীর কথায় ঘরের মধ্যে যেন বজ্রপাত হল। স্তম্ভিত বিস্ময়ে আমরা সকলেই নির্বাক।
হ্যাঁ, আমি। আমিই সীতাকে হত্যা করেছি। আর যে আক্রোশের বশে সীতাকে আমি হত্যা করেছি, সেই আক্রোশের বশেই শতদলকেও আমি হত্যা করতে চেয়েছিলাম। আমার স্বামী সম্পূর্ণ নির্দোষ। এ ব্যাপারে তাঁর কোন হাত নেই। অ্যারেস্ট যদি করতে হয় কাউকে, আমাকেই করুন। আমিই দোষী। সমস্ত দোষ আমারই। কান্নায় গলার স্বর বুজে এল হিরণ্ময়ী দেবীর।
না, না—মিঃ রায়, হিরণ নির্দোষ। দোষী আমিই। সীতাকে আমিই হত্যা করেছি। বাধা দিলেন হরবিলাস।
থাম তো তুমি, আমাকে বলতে দাও! চিরাচরিত হিরণ্ময়ী যেন আবার জেগে উঠলেন। সেই আধিপত্যলোভী নারী। নিজস্ব স্বকীয়তায়, নিজস্ব অহমিকায়। স্ত্রীর তর্জনে হরবিলাস একেবারে ঝিমিয়ে গেলেন। কয়েক মুহূর্ত আগেকার তাঁর কষ্টার্জিত পৌরষ যেন একটিমাত্র তর্জনে ভেঙে চুপসে গেল। তবু, শেষবারের মত বুঝি স্ত্রীকে নিরস্ত করবার চেষ্টায় ক্ষীণ মিনতিভরা কণ্ঠে বললেন, যা চুকেবুকে গিয়েছে, সেই অতীতকে দিনের আলোয় টেনে এনে কী লাভ আর হিরণ!
না, আমাদের যদি শাস্তি পেতেই হয়, সব কথাই বলে যাব। কারণ আমি জানি, এখানে এমন একজন আছেন যাঁর দৃষ্টির সামনে সত্যকে একটা আবরণ দিয়ে কেউ ঢেকে রাখতে পারবে না, বলতে বলতে হিরণ্ময়ী দেবী বারেকের জন্য কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।
আর কেউ ঘরের মধ্যে উপস্থিত হিরণ্ময়ী দেবীর শেষের কথাগুলোর তাৎপর্য সম্যক উপলব্ধি করতে না পারলেও আমি পারলাম।
কিরীটীবাবু, সব কথাই আমি বলব। কিন্তু বলবার আগে একমাত্র আপনি ও ইচ্ছা করলে সুব্রতবাবু, ব্যতীত আর সকলকে, এমন কি আমার স্বামীকেও অনুগ্রহ করে এ ঘর থেকে যেতে বলুন।
হিরণ্ময়ী দেবীর অনুরোধ কিরীটী চোখের ইঙ্গিতে বাকি সকলকে ঘর ছেড়ে যেতে বলল। এবং সকলে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন।
ঘরের মধ্যে রইলাম আমি, কিরীটী ও হিরণ্ময়ী দেবী।
ঘরের মধ্যে একটা অদ্ভুত স্তব্ধতা বিরাজ করছে, আর সেই স্তব্ধতার বুক চিরে অদূরে টেবিলের ওপর রক্ষিত টাইমপিসটা কেবল একটানা টিক-টিক শব্দ করে চলেছে।
হিরণ্ময়ী দেবীর অনুরোধে সকলে ঘর ছেড়ে চলে গেলেও কিন্তু কয়েকটা মুহূর্ত হিরণ্ময়ী কোন কথাই বলতে পারলেন না। মাথাটা বুকের কাছে ঝুঁকে পড়েছে। স্তব্ধ অনড় পাষাণ-প্রতিমার মত বসে আছেন হিরণ্ময়ী দেবী ইনভ্যালিড চেয়ারটার ওপরে।
সামনেই দুটি চেয়ারে আমি আর কিরীটী বসে। হিরণ্ময়ী একসময় মুখ তুলে কারো দিকে না তাকিয়েই বলতে শুরু করলেন। এবং বলবার সঙ্গে সঙ্গে কোলের উপর থেকে এতক্ষণ পরে উলের বুননটা তুলে নিয়ে দুই হাতে বুনে চললেন।
শিল্পী রণধীর চৌধুরী তাঁর পিতা লক্ষপতি শশাঙ্কশেখর চৌধুরীর একমাত্র পুত্রসন্তান ছিলেন। পূর্ববঙ্গে শুধু জমি-জমাই নয়, ব্যাঙ্কেও মজুত ছিল শশাঙ্ক চৌধুরীর লক্ষাধিক টাকা, তিন-চার পুরষ ধরে অর্জিত বিত্ত। শশাঙ্ক ছিলেন যেমনি হিসাবী তেমনি অর্থগৃধ্মু। আর তাঁর একমাত্র ছেলে রণধীর হল ঠিক উল্টো। যেমন খেয়ালী তেমনি দিলদরিয়া স্বভাবের। অল্প বয়সেই শশাঙ্ক চৌধুরীর স্ত্রী জগত্তারিণীর মৃত্যু হয়। লৌকিক ভাবে তিনি আর দ্বিতীয়বার বিবাহ না করলেও তাঁর এক বিধবা শালী জ্ঞানদা তাঁর গৃহে ছিল। তাকে তিনি এনেছিলেন অসুস্থ স্ত্রীর সেবা-শুশ্রষা করতে, কারণ মৃত্যুর আগে বৎসর-চারেক জগত্তারিণী নিদারুণ পক্ষাঘাত রোগে একপ্রকার শয্যাশায়িনী ছিলেন। সেই জ্ঞানদারই গর্ভে জন্ম হল হিরণ্ময়ীর। লোকে হিরণ্ময়ীকে জগত্তারিণীর সন্তান জানলেও আসলে তার জন্ম জ্ঞানদারই গর্ভে। রণধীর আর হিরণ্ময়ী মাত্র তিন বৎসরের ছোট-বড় ছিল এবং রণধীর বহুদিন পর্যন্ত জানতে পারেনি হিরণ্ময়ী তার মায়ের পেটের বোন নয়। জানতে পারে তার পিতার মৃত্যুর পাঁচ মাস আগে। কিন্তু সে-কথা পরে। শশাঙ্ক জীবিতকালেই হিরণ্ময়ীর খুব অল্প বয়সেই হরবিলাসের সঙ্গে বিবাহ দিয়ে যান। শশাঙ্কর মৃত্যুর সময় হিরণ্ময়ী কাছে ছিলেন না। তবে তাঁর মৃত্যুর মাস-দুই পূর্বে পিতার লিখিত এক চিঠিতে হিরণ্ময়ী জানতে পেরেছিলেন, শশাঙ্ক তাঁর যাবতীয় স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি সমান দুই ভাগে রণধীর ও হিরণ্ময়ীকে ভাগ করে দিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু পিতার মৃত্যুর পর হিরণ্ময়ী যখন পিতৃগৃহে এলেন এবং কথায় কথায় একদিন পিতার অর্ধেক সম্পত্তির দাবি তুললেন, রণধীর হা-হা করে হেসে উঠলেন।
সম্পত্তি! সম্পত্তি কিসের কী তুই বলছিস হিরু!
ঠিক বলছি। বাবার সম্পত্তিতে আমাদের দুজনের সমান অধিকারই আছে, কারণ
কারণটা বলেই ফেল তাহলে শুনি! কারণ তুমিও যেমন বাবার সন্তান, আমিও তেমনি তাঁর সন্তান।
সন্তান! হ্যাঁ, তা বটে। তবে অবৈধ সন্তান।
দাদা! তীক্ষ্ণ চিৎকার করে ওঠেন হিরণ্ময়ী দেবী।
হ্যাঁ। আইন বলে, জারজ সন্তানের পিতৃসম্পত্তির ওপরে কোন অধিকার বা দাবিই থাকতে পারে না।
দাদা!
হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। তোমার মা অর্থাৎ আমার বিধবা মাসী-বাবার সঙ্গে তাঁর যা-ই সম্পর্ক থাক, মত্যুর পূর্ব পর্যন্ত মন্ত্র বা আইনসিদ্ধভাবে বাবা তাঁকে স্ত্রীর মর্যাদা বা অধিকার দেননি এবং তিনি এখনো জীবিত। তাঁকে ডেকে শুধালেই সমস্ত কিছু জানতে পারবে।
রাগে, ঘৃণা লজ্জা ও অপমানে হিরণ্ময়ীর সর্বাঙ্গ তখন থরথর করে কাঁপছে। চেঁচামেচি বা ঝগড়া করবারও উপায় নেই। স্বামী হরবিলাস তখন নীচে। হরবিলাস যদি সব কথা শুনতে পায়, তার বিবাহিত-জীবন সেখানেই শেষ হয়ে যাবে।
কিন্তু তার আগে মা—হ্যাঁ, মাকে জিজ্ঞাসা করতে হবে। পাশের ঘরে গেলেন হিরণ্ময়ী। জ্ঞানদা দেবী পাশের ঘরেই ছিলেন। শুভ্র থান-পরিহিতা জ্ঞানদা দাঁড়িয়েছিলেন প্রস্তরমূর্তির মত ঘরের জানালার সামনে। মেয়ে এসে ডাকলে, মাসী! চিরদিন যে ডাকে অভ্যস্ত সেই মাসী ডাকেই ডাকল সে।
জ্ঞানদার কোন সাড়া পাওয়া গেল না। অবশ্য হিরণ্ময়ীর বুঝতে বাকি ছিল না, পাশের ঘর হতে তার ও রণধীরের ক্ষণপূর্বের কথাবার্তা সমস্তই তাঁর কানে এসেছ। সব কিছুই তিনি শুনেছেন।
মাসী!
এবারে জ্ঞানদা মেয়ের ডাকে ফিরে দাঁড়ালেন।
দুই চক্ষুর কোণ বেয়ে নিঃশব্দ ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। সেই পাষাণের মত স্তব্ধ মূর্তি। সেই নিঃশব্দ অশ্রুধারা মুহূর্তে যেন একটা চরম হাহাকারে হিরণ্ময়ীর বুকের মধ্যে এসে আছড়ে পড়ল।
হ্যাঁ হিরণ, সব—সব সত্যি। তুই এই অভাগিনীরই কলঙ্কের ফল। বলতে বলতে জ্ঞানদা দুই হাতে বোধ করি নিজের দুঃসহ লজ্জাটাকে ঢাকবার জন্যই মুখ ঢাকলেন।
হিরণ্ময়ী নির্বাক।
জ্ঞানদা এগিয়ে আসছিলেন দুই হাতে মেয়েকে বুকে নেবার জন্য, কিন্তু পাগলের মত ক্ষিপ্তকন্ঠে চিৎকার করে উঠলেন হিরণ্ময়ী, না, না—তুমি আমায় ছুঁয়ো না। তুমি আমার কেউ নও। আমি তোমার কেউ নই।…কলঙ্কিনি! রাক্ষসী! বলতে বলতে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে হড়মড় করে পা পিছলে গড়াতে গড়াতে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল হিরণ্ময়ী।
সেই পড়ে গিয়ে পিঠের শিরদাঁড়ায় প্রচণ্ড আঘাত লাগল। তিন মাস শয্যায় পড়ে রইলাম। সুস্থ হলাম, কিন্তু
কিন্তু জন্মের মত আপনার শিরদাঁড়ার হাড় নষ্ট হয়ে গিয়ে একটা কুঁজের মত হয়ে গেল! কথাটা বললে কিরীটী।
হ্যাঁ, কিন্তু আপনি জানলেন কী করে?
কারণ প্রথম দিন আপনার দুই পা ও কোমরের গঠন থেকেই বুঝেছিলাম, আপনি যে বলেছিলেন paralysis-এ আপনি ভুগছেন সেটা সত্যি নয়। কোমরে বা পায়ে আপনার কোন রোগ নেই। ইনভ্যালিড চেয়ারের আপনি ভেক নিয়েছেন অন্য কোন কারণে। এবং দ্বিতীয় দিনেই আমার দৃষ্টিতে আপনার পিঠের কুঁজটা ধরা পড়ে গিয়েছিল এবং বুঝেছিলাম ঐ কারণেই নিজের বিকল দেহটাকে ঢেকে রাখবার জন্য আপনি সর্বদা ইনভ্যালিড চেয়ারে বসে থাকেন।
ঠিক তাই। দীর্ঘদিন ধরে ইনভ্যালিড চেয়ার ব্যবহার করে করে এখন এটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু যা বলছিলাম—
হিরণ্ময়ী দেবী তাঁর অসমাপ্ত কাহিনী আবার শুরু করলেন–
হিরণ্ময়ী কিন্তু তবু পিতৃসম্পত্তির লোভ দমন করতে পারলেন না। রণধীরের কাছে বাপের লেখা চিঠিটার কথা উল্লেখ করলেন।
বাবার চিঠির দ্বারাই আমি প্রমাণ করব বাবার সম্পত্তির অর্ধেক আমার!
তা করতে পার, তবে ঐ সময় এ কথাও আমি কোর্টে প্রকাশ করব। তোমার সত্যকার পরিচয়। তার চাইতে আমি যা বলি তাই করো।
কি?
বিশ হাজার টাকা তোমাকে আমি নগদ দেব। আর আমার উইলে provision রেখে যাব, তোমার ও আমার সন্তান আমার সম্পত্তি সমান ভাগে পাবে।
কিন্তু তোমাকে বিশ্বাস কি! যদি তুমি তোমার কথা না রাখ?
লিখে দিচ্ছি—
বেশ, তাহলে রাজী আছি।
কিন্তু চিঠির মধ্যে এই শর্তও থাকবে, কোনক্রমে ঐ চিঠি যদি আমার মৃত্যুর পূর্বে প্রকাশ পায় তো ঐ condition নাকচ হয়ে যাবে। রাজী আছ তাতে?
রাজী।
সেই ভাবেই রণধীর একখানা চিঠি লিখে দিলেন।
নগদ কুড়ি হাজার টাকা ও চিঠি নিয়ে হিরণ্ময়ী ফিরে গেলেন স্বামীকে নিয়ে কলকাতায়। একেবারে রিক্তহস্তে ফিরে যাওয়ার চাইতে তবু কিছু পাওয়া গেল।
তার পর দীর্ঘ ষোল বৎসর দুজনে আর দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। তবে হিরণ্ময়ী শুনেছিলেন, রণধীর তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর তাঁর দুই যমজ কন্যা বনলতা ও সোমলতাকে নিয়ে নিরালায় এসে বসবাস করছেন।
কিরীটী আবার এইখানে বাধা দিল, ঐ ছবি দুটি তাহলে তাদেরই? হ্যাঁ, বনলতা আর সোমলতা দুই বোন। দাদারই হাতে আঁকা ছবি।
তবে যে আপনি সেদিনকার আমার প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, বনলতা আর সোমলতা একে অন্য হতে চার-পাঁচ বছরের ছোট-বড়? মিথ্যা বলেছিলেন বলুন?
হ্যাঁ।
১৬. দেওয়ালে টাঙানো অয়েল-পেন্টিং
আমি তাকিয়ে ছিলাম দেওয়ালে টাঙানো পাশাপাশি অয়েল-পেন্টিং দুটোর দিকে।
সোমলতা আর বনলতা শিল্পী রণধীর চৌধুরীর দুই মেয়ে। টুইন যমজ বোন। এবং ওদেরই একজনের ছেলে শতদল। কিন্তু শতদল কার ছেলে–বনলতার না সোমলতার! শশাঙ্ক চৌধুরীর ছেলে রণধীর চৌধুরী আর হিরণ্ময়ী দেবী।
হিরণ্ময়ী দেবীর মুখের দিকে তাকালাম। মনে হচ্ছে আরো যেন তাঁর কিছু বলার আছে, কিন্তু তিনি যেন বলতে পারছেন না। চোখের দৃষ্টি ঘুরিয়ে কিরীটীর দিকে তাকালাম। গভীর কোন চিন্তার মধ্যে ও ড়ুবে আছে। হস্তধৃত জলন্ত সিগারেটটা নিঃশব্দে পুড়ে যাচ্ছে, কিন্তু সেদিকে তার খেয়াল নেই। কোন একটা বিশেষ চিন্তাই তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। কিন্তু সেটা কী? হিরণ্ময়ী দেবী বর্ণিত কাহিনীর মধ্যে কী এমন সে পেল চিন্তার খোরাক? শতদল-রহস্য-কাহিনীর কোন সূত্র কি সে খুঁজে পেল? একটু আগে রাস্তায় আসতে আসতে কিরীটী বলেছিল, অন্ধকারে সে আলো দেখতে পেয়েছে। মাত্র একটি জায়গায় সুত্রে এসে জট পাকিয়ে রয়েছে। সেই জটটি খুলতে পারলেই সব বোঝা যাবে। হিরণ্ময়ী দেবী বর্ণিত কাহিনীর মধ্যে কি সেই সূত্রটিই ও খুঁজে পেল? আমি তো কই কিছুই এখনো ভেবে পাচ্ছি না! কেন শতদলবাবুর প্রাণের ওপরে এমনি বার বার প্রচেষ্টা হল? আর কেই বা তাঁকে বার বার হত্যা করবার চেষ্টা করছে?
আচমকা কিরীটীর কণ্ঠস্বরে চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল।
এইটুকুই কি আপনার বলবার ছিল হিরণ্ময়ী দেবী? আর কি কিছুই আপনার বলবার নেই? কিরীটীর দু’চক্ষুর শাণিত দৃষ্টি সম্মুখে উপবিষ্ট হিরণ্ময়ী দেবীর মুখের ওপরে স্থিরনিবদ্ধ।
অ্যাঁ! হিরণ্ময়ী যেন চমকে উঠলেন। আপনার কি বলবার আর কিছুই নেই?
না। ক্ষীণকণ্ঠে উচ্চারিত হল একটিমাত্র শব্দ।
আপনি তো কই এখনো বললেন না, আপনার স্বামী কবিতা দেবীর বাড়িতে কেন গিয়েছিলেন?
আমি যতদূর জানি আমার স্বামী এ দুদিন মোটে বাড়ি থেকে বেরই হননি।
হ্যাঁ, আপনার জানিত-ভাবে বের হননি এটা বিশ্বাস করি, কিন্তু তিনি যে গিয়েছিলেন এটাও ঠিক। কারণ দৈবক্রমে তাঁর হাতের আংটির পাথরটা সেখানে খসে পড়ে গিয়েই, সেখানে যে তিনি গিয়েছিলেন সেটা প্রমাণ করে দিয়েছে যে হিরণ্ময়ী দেবী! এক্ষেত্রে অস্বীকার করেও তো উপায় নেই। দৈবই যে প্রতিকূল!
কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন মিঃ রায়, আমার স্বামীর শতদলকে হত্যা করবার কোন কারণই নেই এবং তিনি তা করবার চেষ্টাও করেননি।
আমি বিশ্বাস করি হিরণ্ময়ী দেবী, হরবিলাসবাবু সে কাজ করেননি কিন্তু তিনি যে শরৎবাবুর বাসায় গিয়েছিলেন, যে কোন কারণেই হোক—সেটা আমার স্থিরবিশ্বাস। এবং অনুমান যদি আমার মিথ্যা না হয় তো হরবিলাসবাবু, আপনার জ্ঞাতসারেই সেখানে গিয়েছিলেন!
কিরীটীর স্পষ্টাস্পষ্টি অভিযোগেও হিরণ্ময়ী দেবী নিঃশব্দে বসে রইলেন। কোন সাড়া দিলেন না।
আমার কি বিশ্বাস জানেন হিরণ্ময়ী দেবী! কিরীটী আবার কথা বললে। হিরণ্ময়ী কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।
দূতরূপেই মিঃ ঘোষ কবিতা দেবীর ওখানে গিয়েছিলেন। এবং সে-কথা কবিতা দেবীর কাছ হতে বের করতে আমায় বিশেষ কষ্ট পেতে হবে না। কিন্তু আমি চাই আপনিই সব কথা আমাকে খুলে বলুন।
আমি কিছু জানি না। হিরণ্ময়ী দেবীর সমস্ত মুখখানা যেন পাথরের মত কঠিন মনে হয়।
তাহলে একান্ত দুঃখের সঙ্গেই আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, এর পর আপনার স্বামীকে গ্রেপ্তার করা ছাড়া আর আমাদের দ্বিতীয় পথ থাকবে না!
কিন্তু আপনি নিজের মুখেই তো একটু আগে বললেন যে, আমার স্বামী শতদলকে হত্যা করবার প্রচেষ্টার ব্যাপারে নিদোষ?
তা বলেছি। তবে তাঁকে ঘিরে যে সন্দেহ জমে উঠেছে, সেটা যতক্ষণ না পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে ততক্ষণ তাঁকে মুক্তি দেওয়াও তো সম্ভব নয়। আপনিই বলুন না! শুনুন হিরণ্ময়ী দেবী, আমি জানি এ সব কিছুর মূলে কে–
বিদ্যুৎ-চমকের মতই হিরণ্ময়ী কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন, আপনি —আপনি জানেন?
হ্যাঁ, জানি।
তবে—তবে আপনি তাকে ধরিয়ে দিচ্ছেন না কেন?
ব্যস্ত হবেন না। সময় হলে আপনা হতেই তাকে হাজতে গিয়ে ঢুকতে হবে।
কিন্তু
আপনার কাছে আমি যা জানতে চাইছি বলুন!
কি বলব?
বলুন কেন সেদিন আমাদের কাছে আপনি মিথ্যা কথা বলেছিলেন যে, স্বর্গত রণধীর চৌধুরীর দ্বিতীয় মেয়েটির কথা আপনি কিছু জানেন না? সোমলতা আর বনলতা—তাদের সমস্ত কথা এখনো আপনি বলেননি!
বনলতা আর সোমলতা দুজনেই মারা গেছে।
শতদলবাবু কার ছেলে?
সোমার।
আর বনলতার স্বামীই বা কে? আর তার সন্তান কটি?
বনলতার স্বামীর নাম ডঃ শ্যামাচরাণ সরকার।
হিরণ্ময়ী দেবী কথাটা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই কিরীটীর সমস্ত সত্তা যেন সহসা বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত সজাগ হয়ে ওঠে। উদগ্রীব ব্যাকুল কণ্ঠে প্রশ্ন করে, কী– কী বললেন?
ডঃ শ্যামাচরণ সরকার—বনলতার স্বামী।
কোন শ্যামাচরণ সরকার? অধ্যাপক ডঃ শ্যামাচরণ সরকার কি?
হ্যাঁ।
কিরীটীর চোখে-মুখে ক্ষণপূর্বে যে উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল, সেটা যেন আবার নিভে এল। সে দ্বিতীয় প্রশ্ন করলে, তাহলে—তাহলে হরবিলাসবাবু কবিতা দেবীর ওখানে গিয়েছিলেন কেন?
আপনাকে তো আমি বললাম, আমার স্বামী সেখানে যাননি! এবং কবিতার সঙ্গে তাঁর পরিচয়ও নেই।
তা হতে পারে না। Simply absurd! একেবারে অসম্ভব। নিশ্চয়ই হরবিলাসবাবু কবিতা দেবীর ওখানে গিয়েছিলেন। এবং তিনি শতদলবাবুকে নার্সিং হোমে ফুল ও মিষ্টি পাঠাতে বলেও এসেছিলেন, এ-ও সত্যি। কিন্তু এইটাই বোঝা যাচ্ছে না, কেন—কেন তিনি ও-কথা কবিতা দেবীকে বলতে গেলেন। তারপর একটু থেমে কতকটা আত্মগত ভাবেই বললে, আর আমার অনুমান যদি মিথ্যা হয় তাহলে–,কিরীটী শেষের কথাগুলো খুব ধীরে যেন উচ্চারণ করল এবং পরক্ষণেই হিরণ্ময়ী দেবীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে, আপনার স্বামীর হাতের আংটিটা কত দিন ওঁর হাতে আছে বলতে পারেন?
তা দশ-বারো বছর তো হবেই।
বলতে পারেন আপনার স্বামীর হাতের আংটিটার পাথরটা—যেটা তাঁর আংটিতেই আছে, শেষবারে কবে আপনার নজরে পড়েছিল?
সীতার মৃত্যুর আগের দিনও আংটির পাথরটা ঠিক ছিল—যেন দেখেছি বলেই মনে হয়।
তাহলে আর কি হবে! চল সুব্রত, ওঠা যাক। আমার দিকে তাকিয়ে কিরীটী বলল।
কিরীটীই প্রথমে কক্ষত্যাগের জন্য প্রস্তুত হয় এবং আমিও উঠে দাঁড়াই।
আমাদের কক্ষত্যাগ করতে উদ্যত দেখে ব্যাকুল কণ্ঠে হিরণ্ময়ী বলে ওঠেন, কিন্তু আমার স্বামী?
কিরীটী ঘুরে দাঁড়িয়ে শান্তকণ্ঠে বললে, আংটির পাথরের ব্যাপারটা যতক্ষণ না মীমাংসিত হচ্ছে, আপনার স্বামীকে হাজতে নজরবন্দী থাকতেই হবে হিরণ্ময়ী দেবী। আমি দুঃখিত।
বিনা দোষে আমার স্বামীকে হাজতবাস করতেই হবে?
দোষের কথা তো এখানে নয়, সন্দেহক্রমে—
অতঃপর হরবিলাসকে সঙ্গে নিয়েই আমরা নিরালা থেকে বের হয়ে এলাম। পথে বের হয়ে কিরীটীর নির্দেশক্রমে দুজন সেপাইয়ের হেপাজতে হরবিলাসকে থানায় পাঠিয়ে দিয়ে কিরীটী ঘোষাল সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললে, চলুন, আর একবার শরৎ উকিলের বাসাটা ঘুরে যাওয়া যাক!
এখুনি? বেলা অনেক হয়েছে, সন্ধ্যার দিকে গেলে হত না? প্রশ্নটা করলেন থানা-অফিসার রসময় ঘোষাল।
না, শুভস্য শীঘ্রম। কিরীটীর কণ্ঠস্বরে অদ্ভুত একটা দৃঢ়তা প্রকাশ পায়।
শহরের পথে চলতে চলতে আমি একটা কথা কিরীটীকে না স্মরণ করিয়ে দিয়ে পারলাম না, নিরালার উপরের ঘর—যার তালা ভাঙা ছিল, সে ঘর দেখা হল না!
কিরীটী মৃদুকণ্ঠে বললে, ব্যস্ততার কী আছে? দেখলেই হবে! বেলা তখন প্রায় একটা হবে।
মধ্যাহ্ন-সূর্য মাথার উপরে প্রচণ্ড তাপ বর্ষণ করছে। কিরীটীর দ্রুত পদবিক্ষেপ দেখে মনে হচ্ছিল, মনে মনে সে যেন বিশেষ কোন একটা মীমাংসায় উপনীত হতে চলেছে। বারবারই লক্ষ্য করেছি, কিরীটী যখন কোন একটা জটিল ব্যাপারে মীমাংসার কাছাকাছি আসে, তার চালচলন কথাবার্তা এমনি দ্রুত ও ক্ষিপ্র হয়ে ওঠে। তার অত্যন্ত ধীর-স্থির ভাব যেন সহসা অত্যন্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে।
ঠিক দ্বিপ্রহরে ঐদিন দ্বিতীয়বার আবার আমাদের তাঁর ওখানে আসতে দেখে কবিতা দেবী বেশ যেন কিছুটা বিস্মিতই হন।
শরৎবাবু বাসায় ছিলেন না, একটু আগে আদালতে বের হয়ে গিয়েছেন। কবিতা দেবী আমাদের বসতে বললেন।
আবার আপনাকে বিরক্ত করতে আসতে হল কবিতা দেবী! কিরীটীই কথা শুরু করে।
না, না—এর মধ্যে বিরক্তির আর কী আছে!
ঘোষাল সাহেব হরবিলাসবাবুকে শতদলবাবুর হত্যা-প্রচেষ্টার ব্যাপারে অ্যারেস্ট করেছেন কিছুক্ষণ আগে
সে কি! হরবিলাসবাবু–
হ্যাঁ, তবে তাঁর মুক্তির ব্যাপারটা নির্ভর করছে আপনার evidence-এর ওপরে।
আমার evidence-এর ওপরে?
হ্যাঁ।
কিন্তু আমি তো আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না মিঃ রায়!
হরবিলাসবাবু বলতে চান যে, তিনি আপনার কাছে গত পরশু এসে শতদলবাবুকে ফুল ও সন্দেশ পাঠাতে বলেননি, অথচ ঘোষাল সাহেবের ধারণা তিনিই এসেছিলেন! কিরীটী জবাব দিল।
কিন্তু আমি তো বলিনি যে হরবিলাসবাবু এসেছেন! একটা ঢোক গিলে কবিতা জবাব দেন।
তিনি যদি না-ই এসে থাকবেন, তাহলে তাঁর হাতের আংটির পাথরটা আজ সকালে আপনার এই ঘরে কুড়িয়ে পাওয়া গেল কি করে? কথাটা বললেন ঘোষাল।
আংটির পাথর কুড়িয়ে পাওয়া গিয়েছে এই ঘরে?
হ্যাঁ।
কে পেয়েছেন?
মিঃ রায়।
সত্যি! কথাটা বলে কবিতা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।
হ্যাঁ।
কই দেখি সে পাথরটা?
কিরীটী একান্ত নির্বিকার ভাবেই যেন জামার পকেট হতে হাত ঢুকিয়ে প্রবাল পাথরটা বের করে কবিতার চোখের সামনে ধরল।
আশ্চর্য! এই তো—এটা তো আমার আংটির পাথরটা! কাল কখন আংটি থেকে পড়ে গিয়েছে, খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
আপনার আংটির পাথর! কই, আপনার আংটিটা কই?
আংটি হতে পাথরটা পড়ে যাওয়ায় আজ সকালেই বাক্সে তুলে রেখেছি।
দয়া করে আংটিটা আনবেন কি?
নিশ্চয়ই। কিরীটীকে আর দ্বিতীয় প্রশ্নের সময় না দিয়ে কবিতা উঠে ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল। এবং কয়েক মিনিটের মধ্যেই পাথরহীন একটা আংটি নিয়ে এল।
এই দেখুন!
কিরীটী আংটিটা হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে আড়চোখে একবার কবিতার দিকে তাকিয়ে বললে, কিন্তু এ আংটিটা তো আপনার হাতের আঙুলে fit করবার কথা নয় কবিতা দেবী! এটা কার আংটি?
কেন, আমার?
উঁহু। কই পরুন তো!
এবারে কবিতা দেবী যেন একটু বিমূঢ় হয়ে পড়েন। একটু বিহ্বল। হতচকিত।—অবিশ্যি আংটিটা একটু আঙুলে আমার বড়ই হয়—
তাই তো বলছিলাম, সত্যি করে বলুন তো আংটিটা কার?
আমারই।
না, কেউ নিশ্চয়ই আপনাকে আংটিটা দিয়েছেন! তাই নয় কি কবিতা দেবী?
হ্যাঁ। নিম্নকণ্ঠে জবাব দিলেন কবিতা।
কে কে দিয়েছেন?
ক্ষমা করবেন কিরীটীবাবু, ব্যাপারটা আমার ব্যক্তিগত।
হুঁ।
অতঃপর কিরীটী কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকে।
পরশু কে আপনাকে এসে বলেছিল, শতদলবাবুকে ফুল ও সন্দেশ পাঠাতে নার্সিং হোমে?
তাকে চিনি না, দেখিনি কখনো।
দেখতে কেমন?
বয়েস পঞ্চাশের নীচে হবে বলে মনে হয় না। মুখে দাড়ি-গোঁফ ছিল। একটু খুঁড়িয়ে হাঁটছিল।
নাম কিছু বলেনি?
না, জিজ্ঞাসা করিনি।
কোথা হতে আসছে তা বলেনি?
হ্যাঁ, বলেছিল নার্সিং হোম থেকেই। সেখানেই নাকি কাজ করে।
আচ্ছা কবিতা দেবী, বিখ্যাত সুইমার কুমারেশ সরকারের নাম শুনেছেন?
কিরীটীর আচমকা বিষয়ান্তরে গিয়ে সম্পূর্ণ ঐ নতুন প্রশ্নে কবিতা প্রথমটা বোধ হয় একটু কেমন বিস্ময়ে বিহবল হয়ে পড়ে এবং ক্ষণকাল কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
তারপর কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়েই জবাব দেয়, নাম শুনেছি, কিন্তু সাক্ষাৎ আলাপ-পরিচয় নেই।
কিরীটী এরপর আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে বলে, আচ্ছা তাহলে চলি। নমস্কার।
হোটেলে প্রত্যাগমন করে আহারাদির পর কিরীটী ঘরের মধ্যে একটা আরামকেদারায় শুয়ে চোখ বুজল।
আমি একটা বাংলা বই নিয়ে শয্যায় আশ্রয় নিলাম। সারা সকাল হাঁটাহাঁটির ক্লান্তিতে কখন দু-চোখের পাতা বুজে এসেছিল টের পাইনি।
ঘুম ভাঙল একেবারে সন্ধ্যার দিকে। তাড়াতাড়ি শয্যার ওপরে উঠে বসতেই নজরে পড়ল কিরীটী নিঃশব্দ অস্থির পদে ঘরের মধ্যে পায়চারি করছে। এবং হাতে তার শতদলবাবুর নিকট হতে চেয়ে নিয়ে আসা রণধীরের চিত্রাঙ্কিত চিঠিটা।
চা খেয়েছিস? প্রশ্ন করলাম।
বাবাঃ, ঘুম ভাঙল তোর?
হ্যাঁ। খুব ঘুমিয়েছি নাকি?
না, মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টা! চল, চা খেয়ে একটু বেরনো যাক।
আগে শয্যা হতে উঠে সুইচ টিপে আলোটা জাললাম। তারপর বেরিয়ে গিয়ে বেয়ারাকে চায়ের অর্ডার দিয়ে ফিরে এসে দেখি, চেয়ারটার উপরে উপবেশন করে সেই চিত্রাঙ্কিত হিজিবিজি-মাকা চিঠিটা কিরীটী গভীর মনোযোগ সহকারে দেখছে।
ব্যাপার কি তোর বল, তো কিরীটী? চিঠিটার মর্মোদ্ধারের প্রতিজ্ঞা নিয়েছিস নাকি?
মর্মোদ্ধার হয়ে গিয়েছে এবং নিরালার রহস্যের উপরেও কাল প্রত্যুষেই যবনিকাপাত!
সত্যি?
হ্যাঁ।
চা-পান করে দুজনে হোটেল থেকে বের হলাম।
পথে নেমে কিরীটী বললে, চল, একবার ঘোষাল সাহেবের সঙ্গে দেখা করে আসি।
ঘোষাল সাহেব থানাতে ছিলেন না। কাছে-পিঠেই নাকি কোথায় এনকোয়ারিতে গিয়েছেন। এ, এস, আই, রামকিঙ্কর ওঝা ছিলেন। খসখস করে কাগজ ও পেন দিয়ে একটা চিঠি লিখে চিঠিটা খামের মধ্যে পরে সেটা ওঝার হাতে দিয়ে আমরা থানা হতে বের হয়ে এলাম। বুঝতে পারছি কিরীটীর বাইরের শান্ত ভাবটা মুখোশ মাত্র। ভিতরে তার যে ঝড় চলেছে সেটাকে সে চাপা দিতে পারছে না। এবং রহস্যের মীমাংসার শেষ ধাপে এসে পৌঁছেছে বলেই নিজেকে সে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে বাইরে ধীর ও শান্ত রাখার জন্য।
শামুকের মত নিজেকে ও এখন গুটিয়ে রেখেছে। হাজার খোঁচাখুচি করলেও এখন ও মুখ খুলবে না। এ যেন ওর রহস্যের মীমাংসার শেষ চৌকাঠের সামনে এসে নিঃশব্দে শক্তিসঞ্চয় করা। ঘণ্টাখানেক প্রায় সমুদ্রের কিনারে কাটিয়ে রাত সাড়ে আটটা নাগাদ হোটেলে ফিরে এলাম। এবং হোটেলে পৌঁছেই আমাকে কোন কথার অবকাশ মাত্র না দিয়ে কিরীটী দোতলার দিকে চলে গেল।
আমি দ্বিপ্রহরের অর্ধসমাপ্ত উপন্যাসটা নিয়ে চেয়ারে বসলাম।
উপন্যাসের কাহিনীর মধ্যে একেবারে ড়ুবে গিয়েছিলাম, হোটেলের ওয়েটারের ডাকে খেয়াল হল।
সার, আপনাদের খানা কি ঘরে দিয়ে যাব?
খানা! হ্যাঁ, নিয়ে এস।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত সাড়ে নটা। আশ্চর্য! এখনো কিরীটী ফিরল না? উঠে ডাকতে যাব, কিরীটী এসে ঘরে প্রবেশ করল।
এতক্ষণ কোথায় ছিলি?
সমুদ্রের ধারে রাণু দেবীর সঙ্গে গল্প করছিলাম।
এতক্ষণ ধরে কি এমন গল্প করছিলি?
গল্প নয়, শুনছিলাম। এক প্রেমের জটিল উপাখ্যান।
কার—রাণুর?
হ্যাঁ—তা নয় তো কি হিরণ্ময়ী দেবীর!
ওয়েটার ট্রেতে করে খানা সাজিয়ে ঘরে এসে প্রবেশ করল।
খানা খাবার পর কিরীটী চেয়ারে শুয়ে একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করল।
শয়নের যোগাড় করছি, কিরীটীর কথায় ফিরে তাকালাম, উঁহু, এখন নয়।
তার মানে?
এখন একবার বেরুতে হবে।
এত রাত্রে আবার কোথায় যাবি?
নিরালায়।
১৭. কালো অন্ধকার রাত
কালো অন্ধকার রাত।
সমুদ্রের কিনারা দিয়ে হেঁটে চলেছি দুজনে নিরালার দিকে।
ডাইনে অন্ধকারে গর্জমান সমুদ্র যেন কি এক মর্মভাঙা যাতনায় আছাড়িপিছাড়ি করছে।
নিরালার সামনে এসে যখন পৌঁছলাম হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত প্রায় সোয়া এগারটা।
কিরীটী কিন্তু নিরালার সম্মুখ দিক দিয়ে না প্রবেশ করে পশ্চাতের দিকে এগিয়ে চলল। প্রায় দেড়মানুষ সমান উঁচু প্রাচীর দড়ির মইয়ের সাহায্যে প্রথমে কিরীটী ও পশ্চাতে আমি টপকে নিরালার পশ্চাতে বাগানের মধ্যে প্রবেশ করলাম।
জমাট অন্ধকারে বিরাট প্রাসাদোপম অট্টালিকাটা একটা স্তূপের মত মনে হয়।
নিরালার মধ্যে প্রবেশ করতে চলেছে কিরীটী, কিন্তু কেন, সেটাই ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না! কী তার মতলব?
বাগানের চারিদিকে অযত্ন-বর্ধিত জঙ্গল। অন্য কিছুর না থাক, সাপের ভয়ও তো আছে!
প্রথম দিনের সেই সীতার সতর্কবাণী মনে পড়ে। নিরালায় ভয়ানক সাপের উপদ্রব।
শুধু কি তাই? সীতার কুকুর টাইগার! কে জানে সেই মত্যুসদৃশ অ্যালসেসিয়ান কুকুরটা ছাড়া আছে কিনা? সীতার মুখখানা যেন কিছুতেই ভুলতে পারি না। কেবলই ঘুরে-ফিরে মনে পড়ে সেই মুখখানা। সন্তর্পণে পা ফেলে ফেলে অন্ধকারে এগুচ্ছি কিরীটীর পিছু পিছু।
কী কুক্ষণেই যে সমুদ্রের ধারে হাওয়া বদলাতে এসেছিলাম ওর প্ররোচনায় পড়ে!
পৈতৃক প্রাণটা শেষ পর্যন্ত বেঘোরে না হারাতে হয়!
কোন প্রশ্ন যে করব ওকে তারও কি জো আছে? এখনি হয়তো খিঁচিয়ে উঠবে। নচেৎ বোবা হয়ে থাকবে। হঠাৎ একটা খসখস শব্দ কানে এল।
চকিতে কিরীটী আমাকে ঈষৎ আকর্ষণ করে একটা ঝোপের মধ্যে টেনে বসে পড়ল। আবছা আলো-অন্ধকারে শ্যেনদৃষ্টি মেলে সামনের দিকে তাকিয়ে আছি। কিছুক্ষণ পূর্বে আকাশে একফালি চাঁদ জেগেছে। ক্ষীণ অস্পষ্ট সেই চাঁদের আলো আশপাশের গাছপালার উপরে প্রতিফলিত হয়ে অদ্ভুত একটা আলো-ছায়ার সষ্টি করেছে।
খুব স্পষ্ট না হলেও দেখতে কষ্ট হয় না। ঢ্যাঙা-মত একটা ছায়া অন্ধকারে নিরালার পশ্চাতের বারান্দায় দেখা গেল। বারান্দা দিয়ে লোকটা পা টিপে টিপে এই দিকেই আসছে।
আরো একটু কাছে এলে দেখলাম, লোকটার দুই হাতে ধরা প্রকাণ্ড একটা কি বস্তু!
কিরীটীর দিকে তাকালাম। তার শ্বাস-প্রশ্বাসও যেন পড়ছে না। স্থির অপলক দৃষ্টিতে লোকটার দিকে তাকিয়ে আছে।
কে লোকটা? হাতে ওর ধরাই বা কী?
আরো একটু এগিয়ে আসতেই এবারে বুঝতে কষ্ট হল না, লোকটার হাতে ধরা বস্তুটি কী? প্রকাণ্ড একটা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। ছবির ফ্রেমে চাঁদের আলো প্রতিফলিত হয়ে চিকচিক করছে। এবং লোকটাকেও এবারে চিনতে কষ্ট হল না। এ বাড়ির সেই বোবা-কালা ভুখনা! কিন্তু কোথায় যাচ্ছে ভুখনা ছবিটা নিয়ে?
চাপা স্বরে আস্তে আস্তে কিরীটীকে সম্বোধন করে বললাম, ভুখনা!
হ্যাঁ, চুপ!
ভুখনা ছবিটা নিয়ে এগিয়ে আসতে লাগল বাগানের মধ্যেই। বাগানের দক্ষিণ কোণে একটা প্রশস্ত ঝাউগাছ, তার নীচে এসে দাঁড়াল ভুখনা এবং ছবিটা মাটিতে নামিয়ে রাখল।
চাঁদের অস্পষ্ট আলোয় পরিষ্কার না হলেও আমরা সবই দেখতে পাচ্ছি। হঠাৎ দেখলাম পাশের ঝোপ থেকে আর একটি ছায়ামূর্তি বের হয়ে এল। ছায়ামূর্তির সর্বাঙ্গ একটা কালো কাপড়ে ঢাকা। মুখে বাঁধা একটা কালো রুমাল, সর্বাঙ্গ কালো কাপড়ে আবৃত ছায়ামূর্তি ভুখনাকে চাপা স্বরে কী যেন বললে।
ওদের ব্যবধান আমাদের থেকে প্রায় হাত-আষ্টেক হওয়ায় বুঝতে পারলাম না কী কথা বললে!
কিন্তু ও কি? ভুখনা ও ছায়ামূর্তির ঠিক পশ্চাতে গুটি গুটি পা ফেলে তৃতীয় আর একজন এগিয়ে আসছে। এসব কী ব্যাপার!
অতি সতর্কতার সঙ্গে পিছন থেকে তৃতীয় আগন্তুক এগিয়ে আসলেও, কালো কাপড়ে আবৃত ছায়ামূর্তির অতি সতর্ক শ্রবণেন্দ্রিয়কে ফাঁকি দিতে পারেনি। মুহূর্তে চোখের পলকে কাপড়ে আবৃত ছায়ামূর্তি ঘুরে দাঁড়ায় ও আধো-আলো আধো-অন্ধকারে একটা অগ্নিঝলক ঝলসে ওঠে ও সেই সঙ্গে শোনা যায় পিস্তলের আওয়াজ—দুড়ুম! সেই সঙ্গে শোনা গেল একটা অস্ফুট আর্ত চিৎকার।
সমস্ত ব্যাপারটা এত দ্রুত এত আকস্মিক ভাবে ঘটে গেল যে, প্রথমটায় আমরা হতচকিত ও বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলাম কয়েক মুহূর্তের জন্যে।
কেমন করে যে কী ঘটে গেল যেন বুঝতেই পারলাম না।
খেয়াল হতেই দেখি, কিরীটী লাফিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। আমিও ক্ষিপ্রগতিতে তার পশ্চাদ্ধাবন করলাম।
কিন্তু অকুস্থানে পৌঁছে দেখি, ভুখনা বা সেই কালো কাপড়ে আবৃত ছায়ামূর্তির সেখানে চিহ্নমাত্রও নেই। কেবল কে একজন সুট-পরিহিত ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতটা চেপে হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে যন্ত্রণাকাতর শব্দ করছে।
উপবিষ্ট লোকটির ওপরে কিরীটীর হস্তধৃত টর্চের তীব্র একটা আলোর রশ্মি গিয়ে পড়ল ও সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী প্রশ্ন করে, কে? এ কি কুমারেশ সরকার!
কুমারেশ সরকার! আমিও বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালাম।
কে আপনি? যন্ত্রণাক্লিষ্ট কুমারেশ সরকার প্রশ্ন করেন কিরীটীকে।
আমি কিরীটী। কোথায় গুলি লাগল? দেখি! কিরীটী এগিয়ে গেল।
গুলি করবার আগেই চট করে হেলে পড়েছিলাম ডান দিকে। গুলিটা বাঁ হাতের পাতায় লেগেছে। একটুর জন্য শয়তানটাকে ধরতে পারলাম না, উঃ!
দেখি হাতটা? কিরীটী এগিয়ে গিয়ে কুমারেশ সরকারের গুলিবিদ্ধ আহত রক্তাক্ত বাঁ হাতটা টর্চের আলোয় পরীক্ষা করতে লাগল। পরীক্ষা করে বললে, না, গুলি pierce করে বেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু woundটার তো এখনি একটা ব্যবস্থা করা দরকার! বুলেট-উণ্ড—neglect করা যায় না। আমার রুমালটা অপরিষ্কার। সুব্রত, তোর কাছে পরিষ্কার রুমাল আছে।
কুমারেশ বললেন, দেখুন আমার শার্টের ভিতরের পকেটে কাচা রুমাল আছে, বের করুন!
কুমারেশের বুকপকেট হতে পরিষ্কার রুমালটা বের করে কিরীটী কুমারেশের আহত হাতটা বেধে দিল।
কিন্তু লোকগুলো যে পালিয়ে গেল! কুমারেশ বলেন।
পালাবে আর কোথায়? নিজের জালে নিজেই আটকে পড়েছে। অন্যের সঞ্চিত গুপ্তধনের প্রতি লোভ একবার জন্মালে সে লোভ সংবরণ করা বড় দুঃসাধ্য মিঃ সরকার! তাড়াতাড়িতে প্রাণভয়ে সেই বস্তুটিকেই তাঁদের এখানে ফেলে পালাতে হয়েছে যখন, এ জায়গা ছেড়ে তারা বর্তমানে খুব বেশী দূরে যাবে না। না জেনে আগুনে হাত দিলে হাত পোড়েই। সেটাই আগুনের ধর্ম। সে পোড়া হাত খুঁজে বের করতে আমাদের আর খুব বেশী বেগ পেতে হবে না। কিন্তু কালো কাপড়ে আবৃত মূর্তিটিকে অন্তত আপনার তো চেনা উচিত ছিল মিঃ সরকার, চিনতেই পারলেন না?
না। ভুখনাকে চিনেছিলাম, কিন্তু—
যাক, চলুন আপনার হাতের ক্ষতস্থানটির সর্বাগ্রে একটা ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। চলুন দেখি উপরের তলায় শতদলবাবুর ঘরে, যদি কোন ঔষধপত্র। থাকে! বলতে বলতে কিরীটী আমার দিকে চেয়ে তার বক্তব্য শেষ করল, ছবিটা একা নিয়ে যেতে পারবি না?
কেন পারব না! চল—
আগে আগে কিরীটী ও কুমারেশ সরকার ও পশ্চাতে আমি ছবিটা তুলে নিয়ে অগ্রসর হলাম। বারান্দা দিয়ে এগিয়ে যেতে হঠাৎ নজরে পড়ল হিরণ্ময়ী দেবীর ঘরের ভেজানো দ্বারপথের ঈষৎ ফাঁক দিয়ে মৃদু একটা আলোর ইশারা।
আশ্চর্য, হিরণ্ময়ী দেবীর ঘরে এখনো আলো জ্বলছে! বলতে বলতে সর্বাগ্রে কিরীটী ও পশ্চাতে আমরা দুজনে এগিয়ে গেলাম।
ভেজানো দরজার ঈষৎ ফাঁক দিয়ে বারেকের জন্য কিরীটী দৃষ্টিপাত করেই দরজাটা খুলে ফেলল। খোলা দ্বারপথে কক্ষের অভ্যন্তর আমাদের দৃষ্টিগোচর হল এবং থমকে দাঁড়ালাম। নিশ্চল পাষাণ-প্রতিমার মতই ইনভ্যালিড চেয়ারটার উপরে স্থির অচঞ্চল বসে আছেন হিরণ্ময়ী দেবী।
দৃষ্টি তাঁর মাটিতে নিবদ্ধ।
আর সামনেই পায়ের নীচে একরাশ পোড়া কাগজ।
সর্বপ্রথমে কিরীটী ও পশ্চাতে আমি ও কুমারেশ সরকার ছবিটা ঘরের বাইরে দেওয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে রেখে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলাম।
ঘরের বাতাসে একটা কাগজপোড়া কটু গন্ধ এবং তখনও পাতলা একটা ধোঁয়ার পর্দা ঘরের মধ্যে ভাসছে।
আমরা যে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলাম তা যেন হিরণ্ময়ী দেবী টেরই পেলেন না। নিজের মধ্যে এমন গভীর ভাবে নিমগ্ন যে তিনজনের আমাদের কক্ষের মধ্যে প্রবেশের ব্যাপারটা পর্যন্ত তাঁর সমাধিগ্রস্ত মৌনতাকে এতটুকু নাড়াও দিতে পারলে না।
আরো কাছে এগিয়ে গেলাম। তবু, আশ্চর্য, হিরণ্ময়ী দেবীর কোন সাড়া-শব্দ নেই! নিস্তব্ধ, নিশ্চুপ। হিরণ্ময়ী দেবী! মৃদুকণ্ঠে কিরীটী ডাকল।
না, তবু সাড়া নেই। হিরণ্ময়ী দেবী! শুনছেন? ঈষৎ উচ্চকণ্ঠেই এবারে কিরীটী ডাক দিল।
এবারে মুখ তুলে তাকালেন হিরণ্ময়ী দেবী।
ঘরের আলোয় হিরণ্ময়ী দেবীর মুখের দিকে তাকালাম। মড়ার মত ফ্যাকাশে রক্তহীন মুখ। আর দুই চোখের দৃষ্টিও যেন ঘষা কাঁচের মত নিশ্চল প্রাণহীন।
কিরীটী আবার ডাকল, হিরণ্ময়ী দেবী!
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন হিরণ্ময়ী দেবী। কোন সাড়া-শব্দই দেন না।
সর্বস্ব হারানোর এক মর্মান্তিক বেদনা যেন হিরণ্ময়ী দেবীর মুখখানিতে ছড়িয়ে পড়েছে।
সামনের ঐ ভস্মস্তূপের মত যেন তাঁরও সব কিছু আজ শেষ হয়ে গিয়েছে।
হঠাৎ কথা বলেন হিরণ্ময়ী দেবী, সব পুড়িয়ে ফেলেছি মিঃ রায়! সীতার শেষ স্মৃতিচিহ্নটুকুও পুড়িয়ে ফেলেছি! কিন্তু কই, তবু তো তাকে ভুলতে পারছি না। কিছুতেই তো মন থেকে তাকে মুছে ফেলতে পারছি না?
যে গিয়েছে তার কথা আর মিথ্যে ভেবে কী লাভ বলুন হিরণ্ময়ী দেবী! বাকি জীবনটা এমনি করেই তার স্মৃতি বার বার আপনার মনের মধ্যে এসে উদয় হবেই। ভেবেছেন কি তার চিঠিপত্রগলো পুড়িয়ে ফেললেই তার স্মৃতির হাত হতে আপনি রেহাই পাবেন! তা আপনি পাবেন না। বরং যে রহস্য এতকাল আপনার কাছে অজ্ঞাত ছিল, তার বাক্স ঘেটে তার চিঠিপত্রগুলো পড়ে
কিরীটীর কথা শেষ হল না, হিরণ্ময়ী দেবী চকিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, আপনি—আপনি সেসব কথা কেমন করে জানলেন মিঃ রায়!
আপনি না জানলেও আমি জানতাম হিরণ্ময়ী দেবী, আপনার মেয়ে সীতার মনটা কোথায় পড়ে আছে! আরও একটা কথা আপনি হয়তো জানেন না!
কী?
যে ভালবাসার মধ্যে সীতা নিজেকে অমনি নিঃস্ব করে বিকিয়ে দিয়েছিল সেই ভালবাসাই কালসাপ হয়ে তার বুকে মৃত্যু-ছোবল হেনেছে, অথচ বেচারী সে কথা তার শেষ মুহূর্তে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি!
কিরীটীবাবু? আর্ত চিৎকারের মতই ডাকটা শোনায় হিরণ্ময়ীর কণ্ঠে।
হ্যাঁ, হিরণ্ময়ী দেবী। একটা দিকই আপনার নজরে পড়েছে। মালাটাই আপনি দেখেছেন কিন্তু সেই মালার মধ্যেই যে ছিল দংষ্ট্রা কীট সেটা আপনার নজরে পড়েনি!
আমি—আমার যে সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে মিঃ রায়! এ সব আপনি কি বলছেন?
সময় আর তো নেই হিরণ্ময়ী দেবী। এখুনি একবার আমাকে নার্সিং হোমে যেতে হবে। কুমারেশবাবুর হাতে গুলি লেগেছে। একটা dressing-এর বিশেষ প্রয়োজন।
কুমারেশ!
হ্যাঁ। দেখুন একে চিনতে পারছেন কিনা?
এতক্ষণ কিরীটী কুমারেশ সরকারকে আড়াল করে দাঁড়িয়েই কথাবার্তা চালাচ্ছিল। এবারে সরে দাঁড়াল।
কে?
চিনতে পারছেন না? বনলতা দেবী ও অধ্যাপক ডঃ শ্যামাচরাণু সরকারের একমাত্র ছেলে কুমারেশ সরকার!
সে কি! তবে যে শুনেছিলাম—
কি শুনেছিলেন? তার কোন পাত্তাই পাওয়া যাচ্ছে না, তাই না?
হ্যাঁ।
তার জবাব অবিশ্যি উনিই সঠিক দিতে পারবেন। আচ্ছা এবারে আমরা চলি হিরণ্ময়ী দেবী।
আমরা দুজনে কিরীটীর পিছু পিছু দরজার দিকে অগ্রসর হতেই কিরীটী হঠাৎ আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে বললে, হ্যাঁ, একটা ছবি আপনার জিম্মায় রেখে যেতে চাই হিরণ্ময়ী দেবী। সুব্রত, ছবিটা ওঁর কাছেই রেখে যাও। আমার দিকে তাকিয়ে কিরীটী তার বক্তব্য শেষ করল।
ছবি, কিসের ছবি?
আমি ততক্ষণে ঘরের বাইরে গিয়ে ছবিটা এনে হিরণ্ময়ী দেবীর পায়ের সামনে দিলাম। ছবিটা দেখে হিরণ্ময়ী দেবী সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, এ কী! এ ছবিটা দাদার স্টুডিও-ঘরে ছিল না?
হ্যাঁ। আর যত বিভ্রাট এই ছবিটা নিয়েই। এইটা চুরি করবার মতলবেই গতরাত্রে এ বাড়িতে চোরের আবির্ভাব ঘটেছিল।
এই ছবিটা চুরি করতে? কী বলছেন আপনি মিঃ রায়?
হ্যাঁ, বললাম তো। নিরালা-রহস্যের মূলে এই ছবিটাই।
তবে—তবে আমার মেয়ে সীতাকে—
প্রাণ দিতে হল কেন, তাই না আপনার জিজ্ঞাসা হিরণ্ময়ী দেবী? একান্ত অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই আপনার মেয়ে হত্যাকারীর স্বার্থের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল, তাই তাকে প্রাণ দিতে হল। কিন্তু আমার আর দেরি করা তো চলবে না—ওদিকে সময় বয়ে যাচ্ছে।
একটা কথা মিঃ রায়
বলুন।
আমার স্বামী-
সে কথার জবাব তো আজ সকালেই দিয়ে দিয়েছি হিরণ্ময়ী দেবী!
আমরা সকলে অতঃপর নিরালা থেকে বের হয়ে এলাম।
হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, রাত দুটো বেজে গিয়েছে।
১৮. রাস্তায় পৌঁছে হনহন করে
রাস্তায় পৌঁছে হনহন করে হাঁটতে শুরু করে। আমি আর কুমারেশবাবু তাকে অনুসরণ করি।
কিরীটীর শেষের কথাগুলো সমস্ত সংশয়ের অবসান ঘটিয়েছে।
অথচ আশ্চর্য! বার বার ঐ কথাটাই মনে হচ্ছিল। এই দিকটা একবারও আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি কেন? আগাগোড়া ঘটনাটা একটিবারও ঐ দিক দিয়ে আমি বিশ্লেষণ করে দেখিনি কেন?
তাড়াতাড়ি একটু পা চালিয়ে আয় সুব্রত! কুমারেশবাবুর উণ্ডটা dress করাবার ব্যবস্থা করতে হবে।
কিরীটী চলতে চলতেই আমাকে একবার তাড়া দিল।
নার্সিং হোমে পৌঁছে দেখি, সেখানে আবার বেশ শোরগোল পড়ে গিয়েছে। ডাঃ চ্যাটার্জী নিজেই একজন ভৃত্যের সঙ্গে কী যেন কথা বলছিলেন।
আমাদের প্রবেশ করতে দেখে বলে উঠলেন, এই যে মিঃ রায়! আবার শতদলবাবুর life-এর ওপরে another attempt হয়েছে। ওকেই আপনার কাছে পাঠাচ্ছিলাম।
ডাঃ চ্যাটার্জীর কণ্ঠস্বরে একরাশ উৎকণ্ঠা ঝরে পড়ে। কিন্তু প্রত্যুত্তরে কিরীটীর কণ্ঠস্বরে কোনোরূপ উৎকণ্ঠাই প্রকাশ পেল
অত্যন্ত শান্ত ও নিরুৎসক কণ্ঠে প্রশ্ন করলে, আবার হয়েছিল বুঝি?
হ্যাঁ।
এবারেও poison, না বুলেট!
সেই পূর্বের মতই মরফিন হাইড্রোক্লোর
হুঁ। চলুন দেখা যাক।
এবারেও ঠিক সময়মত ব্যাপারটা জানতে পারায় কোনমতে ভদ্রলোককে বাঁচানো গিয়েছে। কিন্তু আর না মশাই। ও ঝঞ্চাট আর আমার নার্সিং হোমে রাখতে সাহস হচ্ছে না মিঃ রায়, আপনারা অন্য ব্যবস্থা করুন।
ভয় নেই ডক্টর চ্যাটার্জী, হত্যাকারীর এইটাই last show! খেলা তার ফুরিয়েছে, কিন্তু এবারেও কি কড়াপাকের সন্দেশ নাকি?
না, এবারে আরও serious
কি রকম?
হাসপাতালের দেওয়া দুধ পান করেই অসুস্থ হয়ে পড়েন।
হুঁ। তা দুধটা দিয়ে এসেছিল কে কেবিনে?
নার্সই। সে বললে, রাত দশটায় দুধ নিয়ে এসে শতদলবাবুর কেবিনে ঢুকে দেখে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে ঘরের আলো নিবিয়ে শতদলবাবু ঘুমোচ্ছেন তাই আর তাঁকে বিরক্ত না করে দুধটা মাথার ধারে মেডিসিন ক্যাবার্ডের ওপরে একটা কাঁচের প্লেট দিয়ে ঢেকে রেখে কেবিন থেকে বের হয়ে আসে।
তারপর? কিরীটী পূর্ববৎ নিরাসক্ত ভাবেই প্রশ্ন করে।
তারপর রাত যখন দেড়টা, নার্স বদলির সময় নতুন ডিউটি-নার্স মণিকা গুহ শতদলবাবুর কেবিনের সামনে দিয়ে যেতে যেতে একটা অস্পষ্ট গোঙানির শব্দ পেয়ে তাড়াতাড়ি কেবিনের মধ্যে প্রবেশ করে আলো জেলে দেখে, শতদল শয্যার উপরে গোঁ-গোঁ করছে। তাড়াতাড়ি আমাকে খবর দেয়, আমি ছুটে যাই—
এখন কেমন আছেন?
এখন একটু ভাল।
হুঁ। ভাল কথা ডাঃ চ্যাটার্জী, কুমারেশবাবুর হাতটা জখম হয়েছে, একটু দেখে ব্যবস্থা করে দিন
নিশ্চয়ই। কিন্তু
সব বলব আপনাকে। আগে হাতটা পরীক্ষা করে ব্যবস্থা করুন—আমরা ততক্ষণ শতদলবাবুর সঙ্গে একটিবার দেখা করে আসি। কথাগুলো বলতে বলতে আরো একটু ডাঃ চ্যাটার্জীর দিকে এগিয়ে গিয়ে নিম্নকণ্ঠে কিরীটী তাঁকে যেন কী নির্দেশ দিল, তারপর আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বললে, চল সুব্রত!
***
নির্জীবের মত শতদলবাবু তার নির্দিষ্ট কেবিনের মধ্যে শয্যায় শুয়ে ছিল। মাথার সামনে একজন নার্স একটা টুলের উপর বসে ছিল। আমাদের দুজনকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে উঠে দাঁড়াল।
কিরীটী চোখের ইঙ্গিতে নার্সকে কক্ষত্যাগ করতে বললে। নিঃশব্দে নার্স কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল।
কিরীটী অতঃপর শয্যার সামনে এগিয়ে গিয়ে ক্ষণকাল শয্যায় শায়িত নির্জীব শতদলের দিকে তাকিয়ে রইল।
তারপর এগিয়ে গিয়ে উদ্যানের দিকে খোলা জানলাটার সামনে নিঃশব্দে দাঁড়াল। এবং জানালাপথে ঝুঁকে কী যেন দেখতে লাগল বাইরে।
এমন সময় শতদলবাবু চোখ মেলে তাকাল এবং ক্ষীণকণ্ঠে ডাকল, নার্স!
আমি নার্সকে ডাকতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু কিরীটী চোখের ইঙ্গিতে আমাকে নিষেধ করে শয্যার কাছে এগিয়ে এল।
শতদলবাবু!
কে?
আমি কিরীটী, কেমন আছেন?
মিঃ রায় এসেছেন। আবার আমার life-এর ওপরে attempt নিয়েছিল!
তাই তো শুনলাম।
এবার দুধের সঙ্গে
হ্যাঁ, বড্ড কাঁচা কাজ করে ফেলেছে।
কাঁচা কাজ!
হ্যাঁ। আর সেই জন্যেই সে আমার চোখে ধরাও পড়ে গিয়েছে।
ধরা পড়েছে! শতদলবাবুর কণ্ঠে বিস্ময়।
হ্যাঁ, শতদলবাবু। জানেন একটা কথা, আপনি যে রণধীর চৌধুরীর চিঠিটা আমাকে দিয়েছিলেন—তার মর্মার্থ আমি উদ্ধার করতে পেরেছি।
চিঠি!
হ্যাঁ, মনে নেই আপনার? যে চিঠিটা আপনার কাছ থেকে আমি চেয়ে নিয়েছিলাম?
ও
আর সেই চিঠির মর্মোদ্ধারের সঙ্গে সঙ্গে হত্যাকারীও আমার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
হত্যাকারী?
হ্যাঁ সীতাকে যে হত্যা করেছে। চিঠিটা শিল্পীর একটা অদ্ভুত খেয়ালই বলতে হবে। আর আপনার কথাই ঠিক শতদলবাবু। ঐ চিঠিটাই রণধীর চৌধুরীর উইল!
আমি তো আপনাকে সেই দিনই বলেছিলাম, কিন্তু দিদিমা মানতে চাননি
ভুল করেছিলেন তিনি।
আমি আর নিজের কৌতুহলকে দমন করতে পারলাম না। প্রশ্ন করলাম কিরীটীকে, সত্যি তুই চিঠিটার মর্মোদ্ধার করতে পেরেছিস কিরীটী?
হ্যাঁ রে। চিঠিটার প্রত্যেকটি লাইলেন পাশে পাশে যে সাংকেতিক অঙ্ক বসানো আছে সেইটাই চিঠিটার মর্মোদ্ধারের সংকেত। এই দেখ পড়। বলতে বলতে চিঠিটা পকেট হতে বের করে কিরীটী আমার হাতে দিয়ে বললে, মোটামুটি চিঠিটায় বলেছে বটে, নিরালা বাড়ি ও তার যাবতীয় সব কিছু আমাদের শতদলবাবুই পাবেন—তবে তার মধ্যে আরো একটা নির্দেশ আছে, সেটা হচ্ছে ঐ সাংকেতিক অঙ্কগুলোর মধ্যে। অঙ্ক অনুসারে প্রত্যেক লাইনের সমানসংখ্যক কথাগুলো নিলে তার অর্থ এই দাঁড়ায়
নির্দেশঃ আমার মত্যুর পর স্টুডিওতে প্রপিতামহের ছবির স্বত্ব কুমারেশের হইবে।
কী বলছেন আপনি মিঃ রায়? শতদল বলে ওঠে।
হ্যাঁ শতদলবাবু। আমার কথা যে মিথ্যা নয় এই চিঠিই তার প্রমাণ দেবে এবং নিরালা ও তার মধ্যেকার যাবতীয় সম্পত্তি আপনি পেলেও, রণধীর চৌধুরীর প্রপিতামহের ছবিটা কুমারেশ সরকারই পাবেন।
কুমারেশ সরকার!
হ্যাঁ, কুমারেশ সরকার। তিনিও আজ এখানে উপস্থিত।
কুমারেশ! কুমারেশকে তাহলে খুঁজে পাওয়া গিয়েছে?
নিশ্চয়ই। ঐ যে—
ঠিক সেই সময় ডাঃ চ্যাটার্জীর সঙ্গে সঙ্গে কুমারেশ সরকার হাতে ব্যাণ্ডেজ বাঁধা অবস্থায় কেবিনের মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন।
কুমারেশবাবু, let us hear your story! আপনি কেমন করে হঠাৎ উধাও হয়ে গিয়েছিলেন, আর কোথায়ই বা এতদিন বন্দী হয়ে ছিলেন কেমন করে?
বিস্মিত কুমারেশ সরকার কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন, আপনি সে কথা কী করে জানলেন মিঃ রায়?
অনুমান। অনুমানের ওপর নির্ভর করেই জেনেছি মিঃ সরকার। এখন তো বুঝতে পারছেন, অনুমান আমার ভুল হয়নি! Now let us have the story! কিরীটী বললে।
আশ্চর্য মিঃ রায়, সত্যি আগাগোড়া ব্যাপারটা এখনো আমার কাছে একটা দুর্বোধ্যের মতই মনে হয়। মনে হয় সবটাই যেন প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত একটা দুঃস্বপ্ন। তবু, বলছি শুনুন। কুমারেশ সরকার তাঁর কাহিনী শুরু করলেন– আপনি হয়তো জানেন না মিঃ রায়, শিল্পী রণধীর চৌধুরীর আমি দৌহিত্র হলেও তাঁর সঙ্গে আমাদের কোনদিন কোন সম্পর্ক ছিল না। আমার মাকে তিনি ত্যাজ্য করেছিলেন। আমরাও অর্থাৎ আমার মা-বাবা বা আমি কোনদিন তাঁর সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখবারই চেষ্টা করিনি। সেই দাদুর কাছ হতে তাঁর মত্যুর মাসখানেক আগে একটা আবোল-তাবোল লেখা চিত্রবিচিত্র চিঠি পেলাম। আশ্চর্যই হয়েছিলাম। এবং চিঠিটার মাথামুন্ডু কিছু বুঝতে পারিনি বলে সে চিঠিটা ড্রয়ারের মধ্যেই অবহেলায় পড়ে ছিল, তারপর সাত-আট মাস পরে হঠাৎ হরবিলাস দাদুর একখানা চিঠি পেলাম—
হরবিলাসবাবুর চিঠি? কিরীটী প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ। চিঠিতে তিনি লেখেন, অবিলম্বে কোন বিশেষ অথচ গোপনীয় ব্যাপারের জন্য যেন চিঠি পাওয়া মাত্রই এখানে এসে তাঁর সঙ্গে নিরালায় সাক্ষাৎ করি। অন্যথায় আমার নাকি সমূহ ক্ষতি হবার সম্ভাবনা আছে। চিঠিতে এ-ও লেখা ছিল, যাবার আগে তাঁকে যেন আমি পত্র দিয়ে জানাই কবে যাচ্ছি।
হুঁ। তারপর?
চিঠি পেয়ে আমি এখানে আসব কিনা ভাবছি, এমন সময় রাণুর একখানা চিঠি পাই। সেও আমাকে দার্জিলিং থেকে লিখেছে দু-এক দিনের মধ্যেই তারা এখানে আসছে। তখন স্থির করলাম এখানে আসব। মনে মনে যে একটা কৌতূহল হয়নি তাও নয়। যা হোক, এখানে এসে পৌঁছলাম রাত্রের ট্রেনে এবং বলাই বাহুল্য, আগে হরবিলাস দাদকে চিঠিও দিলাম। কুমারেশ থামলেন।
থামলেন কেন? বলুন শেষ করনে। কিরীটী তাগিদ দেয়।
স্টেশনে নেমে বাইরে আসতেই একজন ঢ্যাঙামত লোক এগিয়ে এসে আমাকে প্রশ্ন করল, আমার নাম কুমারেশ সরকার কিনা এবং আমি কলকাতা হতেই আসছি কিনা। জবাবে আমি তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করতে সে বললে সে নিরালার হরবিলাসবাবুর লোক। আমাকে সে নিতে এসেছে। একটা ট্যাক্সি স্টেশনের বাইরে অপেক্ষা করছিল। তার মধ্যে তার কথামত উঠে বসতেই অন্ধকারে ট্যাক্সির মধ্যে থেকেই কে যেন মাথায় আমার অতর্কিতে আঘাত হানল। সঙ্গে সঙ্গে আমি জ্ঞান হারালাম। জ্ঞান ফিরে আসবার পর দেখি, ছোট্ট একটা ঘরে আমি বন্দী। পরে জেনেছিলাম সেটা নিরালার পিছনে জঙ্গলাকীর্ণ বাগানের মধ্যের আউটহাউস
একটা কথা মিঃ সরকার, আপনি চেঁচামেচি করে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবার চেষ্টা করেননি কেন বন্দী অবস্থায়?
সেও এক বিচিত্র ব্যাপার। ঢ্যাঙা লোকটা আমাকে শাসিয়েছিল, তারা নাকি চিঠি দিয়ে আমার রক্তচাপের রোগী বৃদ্ধ অধ্যাপক বাপকেও নাকি আমারই মত এখানে ধরে এনে অন্য একটা ঘরে আটকে রেখেছে। আমি যদি চেঁচামেচি করি বা গোলমাল করি তারা আমার বৃদ্ধ বাপকে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করে সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে দেবে। আর যদি চুপচাপ থাকি তো এক মাস বাদে ছেড়ে দেবে। বাবাকে যে আমি কতখানি ভালবাসি ঐ শয়তানরা জানত বোধ হয়। বাধ্য হয়েই তাই আমাকে কতকটা ঐ বন্দী জীবন মেনে নিতে হয়েছিল। একটিমাত্র জানালা ছিল ঘরের। সেই জানালাপথে সেই ঢ্যাঙা লোকটা প্রত্যহ এসে আমাকে খাবার দিয়ে যেত রাত্রে একবার করে। বন্ধী অবস্থায় আমার কেবলই ঘুম পেত।
Is it?
হ্যাঁ, কেবলই ঘুম পেত। উপযুক্ত আহার না পেয়ে এদিকে ক্রমেই দুর্বল হয়েও পড়ছিলাম।
আপনি টেরও পাননি মিঃ সরকার খাদ্যের সঙ্গে মরফিয়া দিয়ে আপনাকে ঘুম পাড়াত আর উপযুক্ত পরিমাণ আহার না দিয়ে ক্রমে আপনাকে দুর্বল করে ফেলছিল! কিরীটী বললে।
পরে বুঝতে পেরেছিলাম সব।
তারপর?
তারপর যে রাত্রে সীতা মারা যায়—সেই দিন বিকেলের দিকে ঐ উদ্যানের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে সে একসময় ঐ outhouse-এর কাছাকাছি গিয়ে হঠাৎ আমাকে দেখতে পায় এবং সীতাই আমাকে উদ্ধার করে ঐদিন সন্ধ্যার দিকে। এবং আমাকে সে অবিলম্বে এখান থেকে চলে যেতে বলে। কারণ, তার বাপ ব্যাপারটা জানতে পারলে নাকি আমাকে হত্যা করবে। আমিও তার নির্দেশমত চলে যাই, কিন্তু পথে গিয়ে মনে হয় শতদলকে সব ব্যাপারটা জানানো উচিত। সঙ্গে সঙ্গে নিরালায় ফিরে আসি। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে সামনেই সীতার দেখা পাই। সে তখন ছাদ থেকে নীচে নেমে আসছে। সীতা আমাকে দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি বসবার ঘরে টেনে নিয়ে যায়।
সে আমাকে বলে, এ কী! আবার আপনি এখানে এসেছেন কেন? একটা সর্বনাশ না করে আপনি ছাড়বেন না দেখছি! বাবা নীচে আছেন এখন, যদি তাঁর চোখে পড়ে যান?
শতদলের সঙ্গে একবার আমি দেখা করতে চাই। তুমি একবার যেমন করে হোক শতদলকে এই ঘরে ডেকে নিয়ে এস।
কিন্তু
না, তার সঙ্গে দেখা না করে আমি যাব না। আমি বললাম সীতাকে। কিন্তু কথা আমার শেষ হল না, ঠিক এমনি সময় দরজার ওপাশ থেকে একটা গুলির আওয়াজ এল ও সঙ্গে সঙ্গে একটা আর্ত চিৎকার করে সীতা মাটিতে পড়ে গেল। আমিও আকস্মিক সেই ব্যাপারে ভয়ে বিহবল হয়ে পড়েছিলাম। এবং ঐ মুহূর্তেই সেখান থেকে পালালাম। পালাই যখন তখন সিঁড়ি দিয়ে কে যেন একটি মহিলা ছাদ থেকে নেমে আসছিল। সে বোধ হয় আমাকে দেখে ফেলেছিল—
হ্যাঁ, শরৎ গুহর মেয়ে কবিতা গুহ। কিরীটী বললে, কিন্তু সে-রাত্রে ভয়ে আপনি যদি অমন করে হঠাৎ না পালিয়ে যেতেন তো আজ রাত্রে আপনাকে গুলি খেতে হত না। তবু, ভাগ্য বলতে হবে যে, গুলিটা আপনার হাতের উপর দিয়েই গিয়েছে। যাক, শেষ করুন আপনার কথা।
নিরালা থেকেও আমি পালালাম। কিন্তু এখান থেকে যেতে পারলাম না। কটা দিন আত্মগোপন করে বেড়িয়েছি আর ব্যাপারটা বুঝবার চেষ্টা করেছি—কী হল। হঠাৎ সীতাকে কে গুলি করে মারল? এমন সময় হরবিলাস দাদু অ্যারেস্ট হয়েছেন আজ সকালে শুনতে পেলাম। তখন ঠিক করলাম সীতার মা হিরণ্ময়ীদির সঙ্গে দেখা করব। এবং তাঁকে সব ব্যাপারটা খুলে বলব। কিন্তু সদর গেট দিয়ে নিরালা ঢুকতে সাহস হল না, সুদূরে পুলিস মোতায়েন দেখে। একটা বাঁশ যোগাড় করে পোলভল্টের সাহায্যে প্রাচীর টপকে নিরালার পিছনের বাগানে প্রবেশ করলাম। তারপর এগুচ্ছি–
এই সময় কিরীটী বাধা দিল, দেখলেন ভুখনা ও কালো কাপড়ে সর্বাঙ্গ আবৃত ছায়ামূর্তিকে বাগানের মধ্যে—তাই না?
হ্যাঁ, আমার ইচ্ছে ছিল লোকটাকে পিছন থেকে গিয়ে জাপটে ধরব, কিন্তু তার আগেই সে আমার উপস্থিতি টের পেয়ে।
গুলি করে! কিন্তু he missed the chance! এবং হত্যাকারী জানতে না যে তার আগেই বাগানে প্রবেশ করে একটা ঝোপের মধ্যে অনতিদূরে আমি আর সুব্রত আত্মগোপন করে আছি!
ঘোষাল-সাহেব এই সময় এসে ঘরে প্রবেশ করলেন। ব্যাপার কি কিরীটীবাবু! এত জরুরী তলব কেন? ঘোষাল প্রশ্ন করেন।
এই যে আসুন ঘোষাল সাহেব। আপনার নিরালা ও সীতা-হত্যা রহস্যের মীমাংসা হয়েছে। কিরীটী আহ্বান জানাল ঘোষালকে।
সত্যি!
হ্যাঁ।
কিন্তু ইনি—ইনি কে?
বিখ্যাত স্পোর্টসম্যান আমাদের কুমারেশ সরকার।
নমস্কার। তা উনি—
ঘটনাচক্রে উনিই তো যত অনর্থের মূল! কিরীটী জবাব দেয়।
কি বলছেন আপনি মিঃ রায়? প্রশ্নটা করল শতদল।
হ্যাঁ। বর্তমান রহস্যের উনিই নিউক্লিয়স! ওঁকে কেন্দ্র করেই সব কিছু ঘটেছে!
তার মানে?
তার মানেটা আপনার চাইতেও কারো বেশী জানবার কথা নয় শতদলবাবু। গম্ভীর কিরীটীর কণ্ঠস্বর।
আমি!
হ্যাঁ আপনি। চমৎকার খেলা খেলেছেন শতদলবাবু কিন্তু বড়ের চালে মারাত্মক ভুল করে ফেলেছেন—তাতেই কিন্তু মাত হয়ে গিয়েছেন!
আপনি—
শতদলবাবু আমি কিরীটী রায়।
মিঃ রায়! ঘোষাল সাহেব সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকান কিরীটীর মুখের দিকে।
হ্যাঁ মিঃ ঘোষাল, উনি– আমাদের শতদল বোসই এই নাটকের প্রধান চরিত্র। সকল রহস্যের মেঘনাদ। সীতা দেবীর হত্যাকারী।
ঘরের মধ্যে যেন বজ্রপাত হল।
১৯. নিরালাতেই আমরা সকলে উপস্থিত ছিলাম
নিরালাতেই আমরা সকলে উপস্থিত ছিলাম—আমি, হিরণ্ময়ী দেবী, হরবিলাস, কুমারেশ, রাণু, কবিতা গুহ ও ঘোষাল। এবং ঘোষাল সাহেবের অনুরোধেই কিরীটী নিরালা ও সীতার হত্যা-রহস্য সবিস্তারে বর্ণনা করল পরের দিন।
খেয়ালী শিল্পী রণধীর চৌধুরীর নিজের কন্যা বনলতা অধ্যাপক শ্যামাচরণ সরকারকে তাঁর অমতে ভালবেসে অসবর্ণ বিবাহ করায় ত্যাগ করলেও কন্যাকে তিনি কোন দিনই ভুলতে পারেননি এবং যদিও কন্যার জীবিতকালে কন্যা বনলতার কোন দিন মুখদর্শন করেননি, কন্যার মৃত্যুর পর ও নিজের মৃত্যুর পূর্বে বোধ হয় পিতার মনে অনুশোচনা এসেছিল। ফলে তাঁর সত্যিকারের যে সম্পদ ছিল, কতকগুলো বহু মূল্যবান জুয়েল, সেগুলো তাঁরই হাতে অঙ্কিত প্রপিতামহের অয়েল-পেন্টিংটার ফ্রেমের মধ্যে কৌশলে ভরে লুকিয়ে রেখেছিলেন। সেগুলো তাঁর মৃতা কন্যার একমাত্র পুত্র কুমারেশবাবুকেই দিয়ে যান উইল করে। অবশ্য শিল্পীর খেয়ালী মন তাঁর, তাই উইলটাকে একটা বিচিত্র চিঠির মত করে রেখে গিয়েছিলেন এবং তার একটি কপি নিরালার সিন্দুকে রেখে অন্য একটি কপি ডাকে কুমারেশের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এখানে অবশ্য একটা কথা উঠতে পারে, জুয়েলগুলো কুমারেশবাবুকেই যদি তাঁর দেবার ইচ্ছে ছিল—খোলাখুলিভাবেই তো একটা চিঠিতে সেকথা কুমারেশবাবুকে জানিয়ে যেতে পারতেন বা দিয়ে যেতে পারতেন। তবু, যে কেন তা না করে অমন একটা কৌতুক করে রেখে গিয়েছিলেন তা তিনিই জানতেন। তবে মনে হয়, এও তাঁর খেয়ালী মনের একটা বিচিত্র খেয়াল ভিন্ন কিছু নয়। যা হোক, রণধীর চৌধুরীর মৃত্যুর পর শতদলবাবু এখানে নিরালায় এসে ঐ চিঠির সরল মানে অনুযায়ীই সমস্ত সম্পত্তি নিজের হাতে নেন। চিঠিটার অপ্রকাশ্য সাংকেতিক অর্থটা তিনি প্রথমে ধরতে পারেননি। তারপর হিরণ্ময়ী দেবীর সঙ্গে যখন সম্পত্তির ব্যাপার নিয়ে কথা-কাটাকাটি হয়, তখন হয়তো হিরণ্ময়ী দেবীকে শতদল ঐ চিঠিটা দেখায়। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমতী হিরণ্ময়ী দেবী চিঠিটা পড়ে মনে মনে সন্দেহযুক্ত হয়ে ওঠেন। এবং খুব সম্ভবত ঐ চিঠিটার কথা ভাবতে ভাবতে কোন এক মুহূর্তে চিঠির সাংকেতিক রহস্যটা তাঁর কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। এবং তিনি কোন সময়ে হয়তো শতদলকে কিছু বলেন। এই গেল প্রথম পর্ব বা অধ্যায়। এবারে আসব আমি রহস্যের দ্বিতীয় অধ্যায়ে। শতদল যে মুহূর্তে জানতে পারলে চিঠির আসল রহস্য, মনে মনে তার প্ল্যান ঠিক করে নিল। হরবিলাসের নামে বেনাম চিঠি দিয়ে ভুখনার সাহায্যে প্রথমেই কুমারেশবাবুকে এনে নিরালার বাগানের মধ্যে secluded outhouse-এ বন্দী করে ধীরে ধীরে মরফিয়ায় addict করে তুলতে লাগল ও সেই সঙ্গে অপর্যাপ্ত আহার দিয়ে দুর্বল করে ফেলতে লাগল। তার ইচ্ছা ছিল হয়তো চট করে কুমারেশকে হত্যা না করে ধীরে ধীরে তাকে morphiaর নেশা ধরিয়ে cripple করে ফেলবে এবং পরে হয়তো প্রয়োজনমত সুযোগ বুঝে একেবারে শেষ করে ফেলতেও কষ্ট পেতে হবে না। দ্বিতীয় অধ্যায়ে এই তার প্রথম খেলা। দ্বিতীয় খেলা শুরু হল হরবিলাস ও হিরণ্ময়ী দেবীর উপরে সন্দেহ জাগিয়ে তুলতে তাঁদেরও নিজের পথ থেকে সরানো। ঘটনাচক্রে এই সময় আমি ও সুব্রত এখানে এলাম এবং এখানকার স্থানীয় সংবাদপত্রে আমার এখানে আগমনের সংবাদ পেয়ে আমাকেও এই ঘটনার মধ্যে টেনে এনে নিজেকে আরও safe করবার মতলব করলে। আমার সঙ্গে চাক্ষুষ পরিচয় না থাকলেও সংবাদপত্রের মারফৎ আমার চেহারা ও আমার পরিচয় শতদলের কাছে অজ্ঞাত ছিল না। এবং এখানে এসে যে হোটেলে উঠেছি সেও শতদলের পূর্বাহ্নেই জানা ছিল। একটা নাটকীয় কৌতুকের মধ্যে দিয়ে নিজে যেন আচমকা কোন অদৃশ্য আততায়ীর হাতে পিস্তলের গুলিতে আহত হয়েছে এই রকম pose নিয়ে শতদল আমার সামনে এসে আবির্ভূত হয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমাদের পরিচয় ঘটাল। প্রথমটায় frankly বলতে গেলে ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারিনি। পরে যখন তলিয়ে ভাবি, তখনই সর্বপ্রথম আমার মনে সন্দেহ জাগে। শতদলের life-এর উপরে তিন-চারবার attempt হয়েছে—একবার হোটেলের সামনে গুলি করে, একবার নিরালার পথে পাথর গড়াবার গল্প বলে, একবার শয়নঘরে ছবির তার কেটে, একবার নিজের ঘরে রিভলবার ছুড়ে আলোর চিমনি ভেঙ্গে—সে আমার কাছে প্রমাণ করতে চেয়েছে ব্যাপারটা। প্রতিবারই ব্যাপারগুলো আমি প্রথমে genuine ভেবেছি। কিন্তু তা সত্ত্বেও একটা ব্যাপার মনের মধ্যে আমার সর্বদাই খচখচ করে অদৃশ্য কাঁটার মত বিধেছে—why at all somebody should be after his life? কেন কেউ তাকে হত্যা করতে চাইবে? কী মোটিভ—কী উদ্দেশ্য, এবং ঐ সঙ্গে আরো একটা যুক্তি মনের মধ্যে এসে আমার উদয় হয়েছে—হত্যার attemptগুলোর মধ্যে কোথায় যেন একটু ফাঁক আছে। একটা বা দুটো attempt ব্যর্থ হতে পারে কিন্তু বার বার চার বার কেন attempt বিফল হবে? শেষবারের attempt-এর পর যে মুহূর্তে ঐ ধরনের অসামঞ্জস্যটা আমার মনকে আকর্ষণ করল, সেই মুহূর্ত হতেই মন আমার সজাগ হয়ে উঠেছে। কঠিন বিশ্লেষণে যুক্তি ও নিরঙ্কুশ বিচারে ঘটনাগুলোকে চিন্তা করতে শুরু করলাম এবং চিন্তা করতে গিয়ে একই জায়গায় এসে বারবার শুরু করলাম এবং চিন্তা করতে গিয়ে একই জায়গায় এসে বার বার থেমে যেতে হল আমাকে। ব্যাপারটা যুক্তিহীন। এলোমেলো। তারপরই তৃতীয় অধ্যায়ে আমি আসব : শতদল ও সীতার ব্যাপারে। সীতা ভালবেসেছিল সমস্ত প্রাণ দিয়ে শতদলকে কিন্তু শতদল চাইছিল রাণুকে। রাণু ভালবাসে আবার শতদলকে নয়, কুমারেশকে। অর্থ অনর্থ তো ছিলই সঙ্গে এসে যোগ দিল প্রেমের ব্যাপার। একটা জটিল পরিস্থিতির হল উদ্ভব। শতদল চায় রাণুকে, রাণু চায় কুমারেশকে, সীতা চায় শতদলকে। আবার শতদল চায় কুমারেশের ন্যায্য পাওনা থেকে তাকে বঞ্চিত করতে। কুমারেশই হল এক শতদলের পথের কাঁটা দুই দিক দিয়ে। একা রামে রক্ষা নেই তাতে সুগ্রীব দোসর! আকাঙ্ক্ষিতা নারী ও আকাঙ্খিত অর্থ। অতএব কুমারেশকে সরাতে পারলেই দুদিক পরিষ্কার শতদলের। কাজেই কুমারেশের ওপরেই পড়ল শতদলের যত আক্রোশ। শতদল আটঘাট বেধে আসরে অবতীর্ণ হল। শতদলের বুদ্ধির প্রশংসাই করতাম যদি না বড়ের চালে দুটো মারাত্মক ভুল করে নিজে মাত হয়ে না যেত। শেষ পর্যন্ত! এক নম্বর ভুল সে করলে, কুমারেশকে হত্যা না করে এনে বন্দী করে রেখে—কারণ তাতে করে সীতাকে হত্যা করতে হত না। সীতা কুমারেশের কথা জানতে পারার সঙ্গে সঙ্গেই তাই হতভাগিনীকে সরাতে হল ইহজগৎ হতে। আর সেইটেই হল শতদলের দ্বিতীয় মারাত্মক ভুল—অর্থাৎ সীতাকে হত্যা করা। এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার সমস্ত সন্দেহের মীমাংসা হয়ে গেল।
আমি বুঝলাম সকল রহস্যের মেঘনাদ কে! সীতাকে হত্যা করবার পূর্বমুহূর্তে নিজের লাল রঙের শালটা সীতার গায়ে দিয়ে ব্যাপারটা শতদল এমন করে সাজাতে চেয়েছিল, যাতে করে লোকের ধারণা হয় আসলে হত্যাকারী শতদলকেই হত্যা করতে চেয়েছিল কিন্তু আলোয়ানের ব্যাপারে ভুল করে সীতাকে হত্যা করে ফেলেছে! সীতার হত্যা একটা pure accident ভিন্ন কিছুই নয়! বলতে বলতে কিরীটী থামল।
হাতের পাইপটা কখন একসময় নিবে গিয়েছিল। সেটায় আবার অগ্নিসংযোগ করে কিরীটী তার অসমাপ্ত কাহিনী শুরু করলে।
এবারে আমি আসব চতুর্থ অধ্যায়ে। রাণু দেবীর সহাধ্যায়ী কবিতা দেবী, রাণুদের কলকাতার বাসাতেই শতদলের সঙ্গে কবিতা দেবীর পরিচয় হয়। এবং কবিতা দেবীর মনে সেই পরিচয়টা গাঢ় হয়ে উঠে ভালবাসায় পরিণত হয়। প্রথম victim সীতা ও দ্বিতীয় victim হলেন কবিতা দেবী।
কবিতা দেবীর দিকে তাকালাম। মাথাটা বুকের ওপর ঝুলে পড়েছে তাঁর।
কিরীটী বলে চলে, টের পেলাম আমি ব্যাপারটা একটি প্রবাল পাথর থেকে।
হিরণ্ময়ী দেবী এবার কথা বললেন, সেদিন আপনাকে আমি বলিনি মিঃ রায়, একই ধরনের প্রবাল পাথর দেওয়া দুটি আংটি ছিল বাবার! একটি দাদা নিয়েছিল, অন্যটি আমি নিয়েছিলাম। আমার আংটিটা আমার স্বামীকে ব্যবহার করতে দিয়েছিলাম—আর দ্বিতীয়টি রণধীর চৌধুরীর মৃত্যুর পর শতদলের হাতে যায়। পরে আমার মনে পড়ে, শতদলের হাতে প্রথম দিন আংটিটা দেখেছিলাম। এবং সেটাই বোধ হয় শতদল কবিতা দেবীকে দেয়। কেমন তাই না কবিতা দেবী?
কবিতা গুহ মৃদুভাবে ঘাড় নাড়লেন।
এবং সেই জন্যই পাথরটা কবিতা দেবীর বাইরের ঘরে কুড়িয়ে পাওয়ায় ও পরে কবিতা দেবীর আংটির পাথরটা হারানোর সংবাদে কবিতা দেবী যখন আংটিটা এনে আমাকে দেখালেন, চকিতে আমার সব কথা মনে পড়ে গেল। ও সেই সঙ্গে সঙ্গে কবিতা দেবী ও শতদলের relationটা চোখের উপরে আমার স্পষ্ট হয়ে উঠল। বুঝলাম কবিতা দেবীও শতদলের ফাঁদে পা দিয়ে মজেছেন। ডন জুয়ান শতদল! যাক, আবার পূর্বের কথায় ফিরে যাই। সীতাকে হত্যা করবার পরই আমি সাবধান হলাম। শতদলকে আর free রাখতে সাহস হল না। নার্সিং হোমে নিয়ে চোখে চোখে রাখলাম—so that he might not play any more dirty tricks। কিন্তু এবারে কবিতা দেবী হলেন তার সহায়। নার্সিং হোমের ব্যাপারগুলো সব কবিতা দেবীর সাহায্যেই ঘটে। কবিতা দেবীর বাড়িতে সন্দেশ ও ফুল নার্সিং হোমে পাঠাবার জন্য কেউ সংবাদ দেয়নি তাঁকে। A made-up story কবিতা দেবীর! শতদলের পরামর্শমতই কবিতা দেবী যা করবার করেছেন। এদিকে শতদল নার্সিং হোমে বন্দী থাকতে থাকতে অস্থির হয়ে উঠেছিল, কারণ কুমারেশ একবার যখন ছাড়া পেয়েছে সমস্ত planটাই তার বানচাল হয়ে যেতে পারে যে-কোন মুহূর্তে। সে ভয়ও ছিল, তাই ভুখনার সাহায্যে ফটোটা চুরি করে রাতারাতি এখান হতে সরে পড়বার মতলব ছিল! নার্সিং হোমের জানালাপথে ধুতি ঝুলিয়ে তার সাহায্যে নেমে গিয়ে নিরালায় যায়। নার্স দুধ নিয়ে যখন তার কেবিনে যায় শতদল আলো নিবিয়ে তখন ঘুমের ভান করেছে। এবং নার্স চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই কেবিন ত্যাগ করে। কিন্তু ধর্মের কল নড়ে উঠল বাতাসে ভাগ্যচক্রে সব গেল ভেস্তে, বাধ্য হয়েই তাকে তাই ছবিটা ফেলে কেবিনে ফিরে আসতে হল। এবং আবার করতে হল অভিনয়—তার উপরে আর-একবার attempt হয়েছে। কিন্তু তখন বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছে। রঙের খেলার আগেই ড্রপ পড়েছে!
ঘোষাল সাহেব প্রশ্ন করলেন, কিন্তু শতদলবাবুই যে সব কিছুর মূলে জানলেন কী করে মিঃ রায় সর্বপ্রথম?
বললাম তো। সীতা নিহত হবার পরই। তার আগে পর্যন্তও সন্দেহটা দৃঢ় হতে পারেনি। ভাসা-ভাসা অবস্থাতেই মনের মধ্যে ছিল। সে রাত্রে সর্বক্ষণই আমার দুজনের ওপরে নজর ছিল, একজন সীতা ও অন্যজন শতদল। সীতা ছাদ থেকে নেমে যাওয়ার পরই কিছুক্ষণ বাদে শতদলকে আমি নীচে যেতে দেখেছি এবং ঠিক তার পশ্চাতেই দেখেছিলাম নীচে যেতে কবিতা দেবীকে। কবিতা দেবীর চিৎকারেই আমাদের সকলের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়, সীতার হত্যার ব্যাপারটা কবিতা দেবী সবটা না জানলেও যে অনেক কিছুই জানেন, সেটা তাঁর মুখের দিকে তাকিয়েই সে রাত্রে বুঝেছিলাম। তখনি মনে হয় কবিতা দেবী কাউকে shield করছেন deliberately! কিন্তু কাকে? হঠাৎ চকিতে একটা কথা ঐ সঙ্গে মনে হয়, কবিতা দেবী শতদলকেই shield করছেন না তো! ভাবতে গিয়ে দেখলাম সেটাই সম্ভব। সেটাই স্বাভাবিক। আর তখন সন্দেহ রইল না। বুঝলাম এ খেলা শতদলেরই। ইতিমধ্যে রণধীরের চিঠির কথা একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম। তাই শতদলকে দোষী বুঝতে পেরেও, strong একটা motive খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কবিতা দেবীর বাড়ি থেকে ফিরবার পথে আংটির পাথর-রহস্যটা পরিষ্কার হয়ে যাওয়ায় ব্যাপারটা আর একবার গোড়া থেকে নতুন করে ভাবতে গিয়ে মনে পড়ল চিঠিটার কথা। হোটেলে ফিরেই চিঠিটা নিয়ে বসলাম। ঘণ্টা দুইয়ের মধ্যেই সব স্পষ্ট হয়ে গেল, দুয়ে দুয়ে চার অঙ্ক মিলে গেল। তখনি বুঝলাম, গত রাত্রে ছবিটা চুরি করবার চেষ্টা করে যখন হত্যাকারী সফল হয়নি, আর একবার সে সম্ভবত ঐ রাত্রেই attempt নেবে। সঙ্গে সঙ্গে নিরালায় গিয়ে হানা দিলাম এবং অনুমান যে আমার মিথ্যা হয়নি তার প্রমাণও পাওয়া গেল হাতে হাতে। কিরীটী তার কথা শেষ করল।
দিন-দুই বাদে ফিরবার পথে ট্রেনের কামরায় কিরীটী বলছিল, হিরণ্ময়ী দেবীর কথাই ঘুরে-ফিরে মনে পড়ছে সুব্রত। একমাত্র মেয়ে সীতার মৃত্যুটা সত্যিই বড় মর্মান্তিক হয়েছে তাঁর কাছে, ঘুণাক্ষরেও তিনি সন্দেহ করেননি কখনো যে সীতা শতদলকে ভালবাসে। এবং সেটাই যখন প্রকাশ পেল, তাঁর মুখের দিকে তখন যদি তুমি তাকাতে দেখতে কি সর্বস্ব হারানোর বেদনাই না তাঁর মুখের ওপরে ফুটে উঠেছিল। একেই বলে মর্মান্তিক বিয়োগান্ত ব্যাপার। যে সম্পত্তির লোভে তিনি নিরালা আঁকড়ে পড়েছিলেন সে সম্পত্তিও তাঁর হস্তগত হল না, ঐ সঙ্গে হারাতে হল মর্মান্তিক দুঃখ ও লজ্জার মধ্যে দিয়ে একমাত্র কন্যাকেও। শতদলও শুন্য হাতে চরম দণ্ডের জন্য অপেক্ষা করছে, হিরণ্ময়ীকেও ফিরে যেতে হল শূন্য হাতে। সীতাকে শূন্য হাতে বিদায় নিতে হল, কবিতা ফিরে গেল শুন্য হাতে। রণধীর চৌধুরীর এত সাধের নিরালা-তাও পড়ে রইল শূন্য, কুমারেশ বা রাণু, কোনদিনই হয়তো ওখানে পা দেবে না। হিরণ্ময়ী ও হরবিলাস তো দেবেনই না।
কথা শেষ করে কিরীটী পাইপটা মুখে তুলে নিল। ট্রেন ছুটে চলেছে কলকাতা অভিমুখে।