- বইয়ের নামঃ কিরীটীর আবির্ভাব
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- প্রকাশনাঃ মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
০০. ভূমিকা : কিরীটীর আবির্ভাব
প্রীতিভোজ উৎসব সুব্রতর বাড়িতে।–
আমহার্স্ট স্ট্রীটে প্রকান্ড বাড়ি কিনেছে সুব্রতরা। সেই বাড়িতেই গৃহপ্রবেশ উপলক্ষে এই প্রীতিভোজের উৎসব।
অনেক আমন্ত্ৰিতই এসেছেন, তাঁদের মধ্যে এসেছে বিশেষ একজন, কিরীটী রায়।
রহস্যভেদী কিরীটী রায়।
কিরীটী রায় প্রায় সাড়ে ছয় ফুট লম্বা, গৌরবর্ণ, বলিষ্ঠ চেহারা, মাথাভতি কোঁকড়ানো চুল, ব্যাকব্রাশ করা।
চোখে পর লেন্সের কালো সেললয়েডের ফ্রেমের চশমা। দাড়িগোঁফ নিঁখুতভাবে কামানো। মুখে হাসি যেন লেগেই আছে, সদানন্দ, আমুদে।
ওদের পাড়াতেই এক নবলব্ধ বন্ধুর গৃহে কিরীটীর সঙ্গে ওদের আলাপপরিচয় হয়।
প্রীতিভোজের পর বিদায়ের পূর্ব-মুহূর্তে কিরীটী বলে, এই কালো পাথরের ড্রাগনটি আমি চাই সুব্রতবাবু। অপূর্ব মূর্তিটির গঠন কৌশল। ঐটি আমি আমার মিউজিয়ামে রাখতে চাই।
বেশ তো, তা নিন না! সুব্রত বলে।
কিরীটী বলে, শুধু যে মূর্তিটিই তা নয়, ওর সঙ্গে যার নাম জড়িয়ে আছে, কেন জানি না, আপনাদের কাহিনী শুনে সেই নামটির প্রতিও আমার একটা দুর্বলতা জন্মে গেছে।
সুব্রত কিরীটীর কথায় হেসে ফেলে, জানেন না বোধ হয়, মা বলেন, ওটা নাকি একটা অমঙ্গলের চিহ্ন।
তবে তো ভালই হল। অমঙ্গলকে সাদরে আমার গৃহে বহন করে নিয়ে যাই আপনাদের ঘর থেকে। দেখা যাক কি অমঙ্গল আমার সঙ্গে ও নিয়ে আসে!
***
রাত্রি তার ঘন কালো পক্ষ বিস্তার করে দিয়েছে বিরাট এ কলকাতা মহানগরীর বুকে কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি।
জনহীন রাস্তা যেন ঘুমন্ত অজগরের মত গা এলিয়ে পড়ে আছে। সাড়া নেই শব্দ নেই।
কিরীটী একা একা পথ অতিক্রম করে চলেছে। পকেটের মধ্যে কালো পাথরের ড্রাগনটি।
আশ্চৰ্য, কিরীটীর যেন মনে হয়, নিঃশব্দে কে বুঝি আসছে কিরীটীর পিছু পিছু!
যে আসছে তার পায়ের শব্দ পাওয়া যায় না। কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যায়, সে আসছে।
এরকম নাকি ঘটে, শুনেছে কিরীটী অনেকের মুখেই এবং এও শুনেছে, চোখ ফেরালেও নাকি তাকে দেখা যায় না। কেউ ওদের দেখতেও পায় না! অথচ বিশ্ৰী অস্বস্তিকর একটা অনভূতি যেন সমগ্র চেতনাকে ওরা ঘিরে থাকে। কখনও নিঃশব্দে মরা চাঁদের আলোয় জনহীন প্রান্তরেও ওরা এমনি করে হেঁটে বেড়ায়, অনুসরণ করে। কখনও বা অন্ধকারে পিছনে পিছনে আসে। তা আসে আসুক। অনুসরণ করে করুক।
কিরীটী এগিয়ে চলে। অভিশাপকে বরণ করে নিয়ে চলেছে নিজের গৃহে। কালো ভ্রমরের মৃত্যু-পরোয়ানা!
***
কালো পাথরের ড্রাগনটির কথা সকলে একরকম ভুলেই গিয়েছিল। তা হল না বলেই আবার এ কাহিনীর শুরু।
কালো ভ্রমর আবার ফিরে এল। সেই তাদের মত বুঝি নিঃশব্দ পদসঞ্চারে রাত্রির রহস্য-ঘন অন্ধকারে। পৃথিবী যখন ঘামিয়ে পড়ে, নিঃসীম। অতলান্তি অন্ধকারে চারিদিক যখন হয়ে আসে নিঝুম, মাথার ওপরে শুধু তারায় ভরা আকাশ বোবা দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে থাকে, রাতের বাতাসের চুপিসাড়ে তখন যেন তাদের মতই আসে!
রহস্য দিয়ে ঘেরা কালো ভ্ৰমর। রহস্য-ঘন হয়েই ধরা দেয় যেন।
কতটকুই বা পরিচয় সনৎ-এর! সনৎ ভাবে : কতটকুই বা সে জানে কালো ভ্ৰমরের! মুখোশে ঢাকা ছিল। শুধু মুখোশের দুটি ছিদ্রপথে অন্তর্ভেদী দুটি চোখের দৃষ্টি।
কি সম্মোহন আছে ওই চোখের দৃষ্টিতে! একবার সে-চোখের দিকে যে, তাকিয়েছে, সে ভুলবে না। আর সে দৃষ্টি। ভুলতে পারে না।
চোখের তারা তো নয়, যেন দুটি জ্বলন্ত অঙ্গার খন্ড!
এখনও কত রাত্রে ঘামের ঘোরে দঃস্বপেনর মত সেই চোখের দৃষ্টি সনৎকে যেন বিচলিত বিবশ করে দেয়। কি এক অজানিত আশঙ্কায় সর্বাঙ্গ শিউরে শিউরে ওঠে তার।
ভুলতে পারে না রাজু।
দস্যু কালো ভ্ৰমর। শয়তান কালো ভ্ৰমর। কিন্তু সত্যিই কি তাই তার একমাত্র পরিচয়! সেই বলিষ্ঠ পেশল উন্নত গঠন! তেজোদৃপ্ত কন্ঠস্বর!
রাজু শুনেছিল—মস্ত বড় নাকি একটা দল আছে কালো ভ্রমরের। অথচ আশ্চর্য, দলের লোকের কেউ নাকি আজ পর্যন্ত জানে না, কালো ভ্রমরের আসল ও সত্যিকারের পরিচয়। কে সে, কি সে এবং কেমন দেখতে সে!
দলের লোকেরা শুধু এইটকুই জানে যে কঠোর তার অনুজ্ঞা। কঠোর তার নীতি। অপূর্ব তার সংযম। নির্লোভ। আজন্ম ব্রহ্মচারী। তবু সে শয়তান। তবু সে ডাকাত। তবু সে আতঙ্ক। তবু সে সমাজের বাইরে, সকলের ঘৃণা ও অভিশাপের পাত্র।
সুব্রত। সে ভাবে : একটা তেজোদীপ্ত অহঙ্কার। অদ্ভুত কৌশলী, ডাকাত, দস্যু! কালো পাথরের ড্রাগনটির কথা মনে হলেই মনে পড়ে সেই দুঃস্বপ্ন! রূকথার কাহিনীর মত সেই সম্পত্তি-প্রাপ্তি! তার পর সেই নীল পারাপার-হীন মহাজলধি! কি অপূর্ব বিরাট বিস্ময়! মগের দেশ! বেচারী অমরবাবু!
সত্যিই কি শয়তান কালো ভ্রমর তার ওপরে প্রতিশোধ নেবে?
আর ওদের সঙ্গে সঙ্গে ভাবে কিরীটী, রহস্যভেদী কিরীটী। রহস্য উদঘাটনের ওর আছে একটা তীব্র নেশা। আছে একটা তীব্র আকাঙক্ষা ও উত্তেজনা। কালো ভ্রমর সাধারণ ছিঁচকে চোর নয়। প্রখর বুদ্ধি ও অমিত শক্তির অধিকারী সে।
কালো ভ্ৰমর সম্পর্কে তাই বুঝি কিরীটী এক অদৃশ্য সঙ্কেত অনভব করে, কি এক গভীর রহস্য যেন ওকে আকষণ করে।
বিচিত্র এই জগৎ! আরও বিচিত্র এই জগতের মানুষ! কেন মানুষ এমনি করে অন্ধের মত ছুটে যায় সর্বনাশের পথে? অকারণে আপনাকে বিপদের মধ্যে ফেলে কেন নিজেকে করে ব্যস্ত? এও হয়তো একটা নেশা!
নেশা বৈকি। নেশা না হলে কি কেউ এমনি করে আপনাকে বিপদের মধ্যে টেনে নিয়ে যেতে পারে? সত্যি, বিচিত্র এই জগতের মানুষ! আরও বিচিত্র তার মতি-গতি।
০১. বাদল-সন্ধ্যার আগন্তুক
শীতের সকাল নয়, এবারে বাদলার রাত্রি।
টিপ টিপ করে বৃষ্টি ঝরছে বাইরে। মেঘ-মেদুর আকাশের গায়ে বিদ্যতের সোনালী আলোর চকিত ইশারা উঠছে থেকে থেকে লকলকিয়ে।
মেঘনিবিড় রাত্রির অন্ধকার সচীভেদ্য। রাত্রি সাড়ে সাতটা আটটার বেশী নয়।
সুব্রত, সনৎ ও রাজু পাশাপাশি তিনখানা চেয়ারের ওপরে বসে কি একটা বিষয় নিয়ে তাকে মেতে উঠেছে ঐ বাদলার সন্ধ্যারাত্রে।
রাজুর মা এসে ঘরে প্রবেশ করলেন। হাতে তাঁর ডিশে গরম গরম পাঁপর, বেগুনী ও মটরভাজা।
সুব্রত এক লাফে চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে আসে। দু হাতে মাকে জড়িয়ে ধরে আনন্দোৎফুল্ল কণ্ঠে বলে ওঠে, সত্যি মা, তোমাকে যে কি ভালবাসতে ইচ্ছা করছে, কেমন করে তুমি আমাদের মনের এই মুহূর্তের আসল কথাটি টের পেলে বল তো! এমন বাদলার রাতে তেলেভাজা! আমাদের এক বন্ধু কবি মণি দত্ত কবিগুরুর একটা কবিতার প্যারডি করেছিল একবার–
সমাজ সংসার মিছে সব
মিছে এ জীবনের কলরব,—
পাঁপর ভাজা দিয়ে মটর সাথে নিয়ে
জিহ্বা দিয়ে শুধু অনুভব…
সুব্রতর কবিতা শুনে মা হেসে ফেলেন। সঙ্গে সঙ্গে অন্য সকলেও।
রাজু হাসতে হাসতেই বলে, দাদাগো, বিশ্বকবিকে আর এভাবে স্মরণ করো না। তাঁর সর্বজনপ্রিয় বর্ষা কবিতাটির এই অদ্ভুত প্যারডি শুনে, আর যাই হোক, তিনি নিশ্চয়ই পরিতৃপ্ত হবেন না তা এখন তিনি যেখানেই থাকুন।
কিন্তু এগালো যে জুড়িয়ে গেল, বেশী রাত করিস নে! আজ মটরশুঁটির খিচুড়ি হচ্ছে। মা বলেন আবার মৃদু হেসে।
সত্যিThree cheers for মা! সুব্রত বলে ওঠে। মা খোলা দরজাপথে ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে যান।
সকলে আহার্যে মনোনিবেশ করে।
ঠিক এমন সময় বাইরের দরজায় কড়ানাড়ার শব্দ পাওয়া গেল, খুট খুট খুট।
রাজুই প্রথমে বলে, কে যেন কড়া নাড়ছে!
আবার কড়ানাড়ার শব্দ।
কে? সুব্রত উঠে দাঁড়ায় এবং দরজার দিকে এগিয়ে যায়।
সুব্রত দরজাটা খালে দিল। রাস্তার অদূরবর্তী গ্যাসের আলো বৃষ্টিভেজা পিচঢালা রাস্তার ওপরে পড়ে চিকচিক করছে।
মধ্যে মধ্যে এক-এক ঝলক জলকণাবাহী হওয়া গায়ে চোখে মুখে এসে ঝাপটা দেয়। সির সির করে ওঠে সর্বাঙ্গ।
দরজার ওপরেই গায়ে বিষতি, মাথায় বর্ষা-টুপি, হাতে ঝোলানো একটি গ্র্যাডস্টোন ব্যাগ এক অপরিচিত ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে।
এইটাই কি ১৮নং বাড়ি? মিঃ সুব্রত রায়?…আগন্তুক প্রশ্ন করেন।
আজ্ঞে হ্যাঁ। আমিই, তা আপনি…
আমাকে চিনতে পারছেন না, এই তো? তা সে হবেখন, আপাতত আমাকে এ বৃষ্টির মধ্যে না দাঁড় করিয়ে রেখে বাড়ির মধ্যে ঢুকতে দিলে—
বিলক্ষণ! আসুন আসুন।
সুব্রতর আহ্বানে আগন্তুক এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন। ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতেই রাজু ও সনৎ ভদ্রলোকের মাখের দিকে তাকাল বিস্মিত ভাবে।
ভদ্রলোক প্রথমেই গায়ের ভেজা বর্ষতিটা খালে এদিক-ওদিক দৃষ্টিপাত করে ঘরের দেওয়ালে আলনায় ঝুলিয়ে রাখলেন। তারপর সকলের দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে জানালেন নমস্কার।
আগন্তুকের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছিই বোধ হয় হবে, দেহের গড়ন দোহারা ও বলিষ্ঠ বলেই মনে হয়। ভদ্রলোক বেশ শৌখিন প্রকৃতির। মাথার চল কাঁচায় পাকায় মেশানো। ভ্রূযুগলের নীচে একজোড়া তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী চক্ষুতারকা। দাড়িগোঁফ নিঁখুতভাবে কামানো।
আমায় চিনতে পারছেন না আপনারা কেউই, তাই সর্বাগ্রে পরিচয়টাই দিই, আমার নাম বনমালী বসু। ডিব্রুগড় থেকে আসছি। কলকাতায় এসেছি আপনাদের কাছেই একটি বিশেষ জরুরী পরামশের জন্য। সুব্রত, রাজেন ও সনৎবাবু সকলের নিকটই আমার বক্তব্য আমি পেশ করব। কিন্তু তারও আগে যদি এক কাপ চা পেতাম! বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে শরীর যেন একেবারে অবশ হয়ে গেছে।
নিশ্চয়ই, এই সামান্য ব্যাপারের জন্য এত কুণ্ঠা বোধ করছেন কেন? বলে তখনই সুব্রত ভৃত্যকে ডেকে এক কাপ চা আনতে দিল।
কিছুক্ষণ পরে চা এলে, গরম চায়ের কাপে চমক দিতে দিতে ভদ্রলোক বললেন, শোনা যায় সত্যযুগে অতিথি-সৎকার করা গৃহস্থের একটা প্রধান ও অবশ্য-করণীয় ধর্ম ছিল আর আজকাল ভিখারী ও প্রার্থীকে বাড়ি হতে তাড়িয়ে দেওয়াটাই হয়েছে একটা রীতি!
রাজু প্রতিবাদের সরে বলল—হ্যাঁ, তার কারণও আছে। আজকাল সকলেই ফাঁকি দিয়ে স্বর্গ লাভ করতে চায়। পরের মাথায় যে যত সুন্দরভাবে হাত বুলাতে পারে তারই জয়জয়কার।
তা যা বলেছেন। বলতে বলতে ভদ্রলোক নিঃশেষিত চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখলেন।
বাইরে আবার জোরে বণ্টি নামল। সোঁ সোঁ করে হাওয়া বইতে শুরু করল।
আপনি কেন হঠাৎ এই ঝড়-বাদলের রাত্ৰে ডিব্রুগড় থেকে এত দূর আমাদের কাছে এলেন তা তো কই শোনা হল না বনমালীবাবু এখনও? সুব্রত প্রশ্ন করল।
হ্যাঁ, সে-কথাই এবারে বলব। বলতে বলতে ভদ্রলোক একটা নড়েচড়ে বসে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে আরম্ভ করলেনঃ তা হলে খালেই বলি কথাটা সুব্রতবাব, যে জন্যে এতদার ছুটে এসেছি তাই বলছি। একটা বিশেষ দভাবনায় পড়েছি মশাই।
সকলেই উদগ্রীব হয়ে বনমালী বসুর দিকে তাকাল।
বনমালী বলতে থাকেন, কেন আপনাদের কাছে আসতে হয়েছে জানেন? আমার কাকা অমর বসু ছিলেন রেঙ্গুনের বিখ্যাত কাঠ-ব্যবসায়ী মিঃ চৌধুরীর ফার্মের ম্যানেজার ও প্রাইভেট সেক্রেটারী।
ছিলেন মানে?—সকলে একসঙ্গে একই প্রশ্ন করলে।
হ্যাঁ ছিলেন, কিন্তু এখন আর নেই। কারণ গত ৩১শে তারিখে কোন অদৃশ্য আততায়ীর হাতে তিনি নিহত হয়েছেন।
নিহত হয়েছেন! অমরবাবু! এ আপনি কি বলছেন বনমালীবাবু? সুব্রত উৎকণ্ঠিত ভাবে বলে।
বলছি যা তার মধ্যে একবর্ণ ও মিথ্যা বা তৈরী নয়। কে বা কারা যে তাঁকে হত্যা করেছে তা অবিশ্যি এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি। দিন দশেক আগের এই তার আমি রেঙ্গুন থেকে পাই। এই দেখুন–বলতে বলতে ভদ্রলোক বকপকেট থেকে একটা ভাঁজকরা কাগজ বের করে সকলের চোখের সামনে আলোর নীচে মেলে ধরলেন।
কাগজের ভাঁজ খুলে ধরবার সময় ভদ্রলোকের হাতের জামাটা একটু সরে যেতেই খোলা হাতের উপর সনৎ-এর নজর পড়ল মুহূর্তের জন্য। বিস্ময়ে আতঙ্কে চমকে উঠল সে, কিন্তু আর সকলে তখন সেই কাগজের লেখা গুলো পড়তেই ব্যস্ত, সেদিকে কারও নজর গেল না। কাগজে যা লেখা ছিল, তার বাংলা তজমা করলে এই রকম দাঁড়ায়–
গত শুক্রবার মিঃ চৌধুরীর প্রাইভেট সেক্রেটারী মিঃ অমর বসুকে তাঁর শয়নঘরের মধ্যে মত অবস্থায় দেখিতে পাওয়া যায়। তীক্ষ্ণ ছুরি কিংবা ঐ জাতীয় কোন অস্ত্রের সাহায্যে তাঁর মাথাখানি এমনভাবে বিকৃত করা হইয়াছে যে মিঃ বসুকে একেবারে চেনাই যায় না। অবশ্য মৃতদেহ ময়না তদন্তের জন্য পাঠানো হইয়াছে। সি. আই. ডি. ইন্সপেক্টর মিঃ সলিল সেন তদন্তের ভার গ্রহণ করিয়াছেন। আপনি তার পাওয়া মাত্র এখানে আসিবেন।–ডি. আই. জি.।
পড়া শেষ হলে ভদ্রলোক বললেন, সেদিনকার স্থানীয় সংবাদপত্রে যে সংবাদ বেরিয়েছে তারও কাটিং যোগাড় করেছি। এই দেখুন কাটিংটায় লেখা রয়েছে–
স্বর্গীয় মিঃ চৌধুরীর প্রাইভেট সেক্রেটারী মিঃ অমর বসুর অভাবনীয় মৃত্যু।
আপনারা সকলেই জানেন, মাত্র মাসখানেক আগে মিঃ বসু মৃত মিঃ চৌধুরীর অন্যতম প্রধান সাক্ষীর কর্তব্য পালনের জন্য কিভাবে অক্লান্ত পরিশ্রম করিয়া বিখ্যাত দস্যু কালো ভ্ৰমরের মুখের গ্রাস ছিনাইয়া লইয়া উইল-সংক্রান্ত সমস্ত গোলমাল মিটাইয়া সব কিছুর নিষ্পত্তি করিয়াছিলেন। তাঁহার সেই প্রভুভক্তি ও কর্তব্য-পরায়ণতার কথা এখনও শহরবাসী কেহই আমরা ভুলিতে পারি নাই। গতকাল তাঁহার মৃতদেহ তাঁহার শয়নকক্ষের মধ্যে পাওয়া যায়। তীক্ষ্ণ ছোরা বা ঐ জাতীয় কোন অস্ত্রের সাহায্যে মুখচোখ এমনভাবে বিকৃত করা হইয়াছে যে তাঁহাকে আর শ্ৰীযক্ত অমর বসু বলিয়া চেনাই যায় না। আগের দিন প্রায় রাত ১২টা পর্যন্ত তিনি অফিস-সংক্রান্ত কাজ লইয়া ব্যস্ত ছিলেন। ১২টার পর তিনি শয়নগৃহে ঘুমাইতে যান এবং ঐ দেশীয় ভৃত্যও আলো নিভাইয়া দিয়া শুইতে যায়। পরদিন প্রত্যুষে ভৃত্য প্রভাতী চা লইয়া মনিবের শয়নকক্ষে প্রবেশ করিয়া মনিবের রক্তাক্ত মৃতদেহ শয্যার উপর পড়িয়া থাকিতে দেখিয়া তখনই ফোনে পুলিসে সংবাদ দেয়। ইন্সপেক্টর মিঃ সলিল সেন তদন্তের ভার লইয়াছেন। কে বা কাহারা যে এইভাবে তাঁহাকে হত্যা করিয়া গেল, আজ পর্যন্ত তাহা জানা যায় নাই। তবে আমাদের মনে হয় কালো ভ্ৰমর সম্পর্কে কর্তৃপক্ষ একটা মনোযোগী হইলে ক্ষতি কি!
শেষ পর্যন্ত সেই ড্রাগনের মৃতু-পরোয়ানাই সত্যি হল, একজন দুর্ধর্ষ ডাকাতের জেদই বজায় রইল!-সুব্রত বললে।
সনৎ কিন্তু একটিও কথা না বলে অন্যমনস্ক হয়ে কি যেন ভাবতে লাগল।
০২. গভীর নিশীথে
এত বড় একটা দুঃখের সংবাদ সকলের মনই যেন কেমন বিষণ্ণ করে দেয়। সেই উইল-সংক্রান্ত ঘটনাটা কি আজ পর্যন্ত কেউ ভুলতে পেরেছে? ভাবতেও গায়ে কাঁটা দেয়। সুব্রত ভাবছিলঃ অজানা বন্ধু কেমন করে ছায়ার মতই পাশে পাশে থেকে সেদিন তাদের সকলকে সকল বিপদের কবল হতে আড়াল করে রক্ষা করেছিল। এক কথায় বলতে গেলে মিঃ বসু না থাকলে ঐ বিপুল সম্পত্তিপ্রাপ্তি তাদের ভাগ্যে রম্ভা-প্রাপ্তিতেই পরিণত হত।
কতক্ষণ এভাবে নীরবে কেটে গেল। সব প্রথম সনৎই সেই নীরবতা ভঙ্গ করে। বনমালীবাবুর দিকে তাকিয়ে বললে, তা আপনি এখনও বার্মা যাত্রা করেন নি কেন বনমালীবাবু?
সনৎ-এর প্রশ্নটা শুনে বনমালী বসু যেন প্রথমটা একটা চমকে উঠলেন; কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, যাইনি তারও কারণ আছে। প্রথমতঃ সে বিদেশ-বিভুঁই মগের দেশ : কাউকে জানি না, চিনিও না কাউকে। দ্বিতীয়তঃ মশাই, সত্যি কথা বলতে কি, আমি একটা ভীত প্রকৃতির লোক। খবরের কাগজে আপনাদের কথা ও কাকার সঙ্গে আপনাদের আলাপ-পরিচয়ের কথা পড়েছিলাম এবং পরে কাকাও আমাকে আপনাদের সম্পর্কে চিঠি দিয়েছিলেন। ডি. আই. জি-র তার পাওয়ার পর প্রথমটা অনেক ভাবলাম এবং ভাবতে ভাবতে কেন জানি না, আপনাদের কথাই আমার মনে পড়ল। তার পর অনেক কম্পেট আপনাদের ঠিকানা যোগাড় করে এখানে আসছি। এখন যদি আপনাদের সহানভূতি ও সাহায্য পাই! এই পর্যন্ত বলে বনমালীবাবু থামলেন।
সনৎই আবার প্রশ্ন করে, আচ্ছা বনমালীবাবু, ঠিক কি ধরনের সাহায্য আপনি আমাদের কাছে। আশা করে এখানে এসেছেন বলেন তো? কারণ এক্ষেত্রে যে ঠিক কি ভাবে আপনাকে আমরা সাহায্য করতে পারি, সত্যি কথা বলতে কি, যেন ঠিক বঝে উঠতে পারছি না।
সাহায্য অবিশ্যি আপনারা আমাকে অনেক ভাবেই করতে পারেন, তবে যেজন্য আমি এতদূর আশায় ছুটে এসেছি, যদি আপনারা একটিবার দয়া করে আমার সঙ্গে রেঙ্গুনে যান, তা হলে আপনাদের সকলের সাহায্যে হয়তো ব্যাপারটার একটা ভাল করে অনুসন্ধান করে দেখতে পারতাম। তাছাড়া আত্মীয় বলতে আমার ঐ কাকাই যা একজন বেঁচেছিলেন। ভদ্রলোকের কন্ঠস্বর অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে যেন। একটা থেমে আবার বলতে শার করেন, অবিশ্যি বলাই বাহুল্য যে আপনাদের যাতায়াতের সর্ববিধ খরচ আনন্দের সঙ্গেই আমি বহন করব ৷
খরচের কথা বাদ দিন বনমালীবাবু। যেভাবে আমরা, বিশেষ করে আমি অমরবাবুর কাছে ঋণী, সামান্য অর্থের কথা সেখানে উঠতেই পারে না। কথাটা বলে সুব্রত।
তাছাড়া আমার কেন যেন মনে হচ্ছে মিঃ রায়, আমার খুড়ো মশাইয়ের এই নিষ্ঠুর হত্যার ব্যাপারে কোথাও যেন বেশ একটি গোলমাল আছে।
গোলমাল আছে মানে? সুব্রত প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ, গোলমাল। ভেবে দেখান, হত্যাই যখন তাঁকে করা হল, তখন অমন করে হত্যাকারী অস্ত্রের সাহায্যে মত ব্যক্তির মুখ বিকৃত করে গেল কেন? কি তার উদ্দেশ্য ছিল? তারপর সংবাদপত্রে ঐ যে দস্যু কালো ভ্রমরের কথা ইঙ্গিত করেছে, কারণ ভেবে দেখুন, আপনাদের উইলের ব্যাপার। আমার কাকা আপনাদের সাহায্য করায় ঐ কালো ভ্ৰমরের বিপক্ষে তাঁকে দাঁড়াতে হয়েছিল, সে ব্যাপারে কালো ভ্ৰমরের একটা আক্রোশ কাকার ওপর থাকাটাও অসম্ভব নয়—তাতে করে ঐ দস্যুকেই আবার সন্দেহ হয়। তাছাড়া আপনাদের উইলের ব্যাপার নিয়ে কালো ভ্ৰমরের দলের সঙ্গে বহ সংঘর্ষ হয়েছে বলে ও বিষয়েও আপনাদের খানিকটা সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতাও তো আছে। এই সব কারণেই আমি আপনাদের সাহায্যপ্রার্থী হয়ে এসেছি।
সনৎ বললে, কিন্তু এ হত্যার ব্যাপারে আদপেই কালো ভ্ৰমরের কোন হাত নাও তো থাকতে পারে। কালো ভ্ৰমরের ঘাড়েই বা দোষটা চাপাচ্ছেন কেন? হত্যার ব্যাপারে কালো ভ্রমর যে জড়িত আছে, এমন কোন নিদশন। কি পাওয়া গেছে? কিংবা সে কি কিছু রেখে গেছে? সবটাই তো সংবাদপত্রের অভিমত— সনৎ-এর কথায় বাধা দিয়ে সুব্রত ও রাজু বলে উঠল, সে তুমি যাই বল সনৎদা, আমরা একেবারে হলফ করে বলতে পারি-কালো ভ্রমর ছাড়া এ ব্যাপারে অন্য কারও হাত নেই। মনে পড়ে তোমার, সেই রেঙ্গুনের বাড়িতে একদিন সন্ধ্যাবেলা বাক্সে করে সেই চিঠি ও ড্রাগন পাঠাবার কথা? সে-সব কথা নিশ্চয়ই ভুলে যাওনি তুমি এত তাড়াতাড়ি?
না ভুলিনি এত তাড়াতাড়ি। কিন্তু সেই ব্যাপারের সঙ্গে এর এমন কি ঘনিষ্ঠ সম্প্ৰবন্ধ আছে সুব্রত, সেটাই ভাই যেন বঝে উঠতে পারছি নে!
কেন? সেই চিঠি ও ড্রাগন পাঠানোর পর অমরবাবুর এইরপ শোচনীয় মৃত্যু, এর পরও কি তোমার বোঝবার অসুবিধা হচ্ছে?
অসুবিধাটা ঠিক কালো ভ্ৰমরের এই ব্যাপারে জড়িত থাকার সম্ভাবনাটাই নয়, অন্য কিছু!
কি?
সময় হলে বলব, এখন না। সনৎ যেন ইচ্ছা করেই চাপ করে যায়।
আমি কিছু, বুঝতে পারছি না। সনৎদা, এই সোজা ব্যাপারটাকে তুমি ঘুরিয়েই বা দেখছ কেন?
আপনার বুঝি এ মৃত্যু-ব্যাপারে সন্দেহ হচ্ছে সনৎবাবু? সহসা বনমালীবাবু প্রশ্ন করলেন।
ভৃত্য এসে ঘরের মধ্যে ঐ সময় প্রবেশ করল; বললে, মা বললেন, খিচুড়ি তৈরী হয়ে গেছে। দেরি করলে ঠান্ডা হয়ে যাবে। আপনাদের কি খাওয়ার জায়গা করা হবে?
সনৎ জবাব দিল, হ্যাঁ, জায়গা করে দিতে বল গে…তা হলে বনমালীবাবু, আপনিও এই গরীবদের ঘরে দুটো খুদকুঁড়ো যা হয়— আশা করি আপত্তি নেই!…
বিলক্ষণ, একথা আবার জিজ্ঞাসা করতে হবে কেন? আপনারা না বললেও আমি সেধে খেতাম। আমার আবার হোটেলের খাওয়াও তেমন সহ্য হয় না।
আহারের স্থান হলে সকলে গিয়ে একত্রে খেতে বসল। এবং বেশ তৃপ্তি সহকারেই খাওয়া-দাওয়া শেষ হল।
বাইরে তখন মষিলধারায় বৃষ্টি নেমেছে। প্ৰমত্ত বায়ুর হাহাকারে দিগন্ত ঝঙ্কৃত ও কম্পিত হচ্ছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎঝলকে চোখ যেন ঝলসে যায়। সেই ঝড়বাদলের রাত্ৰে সুব্রতই যেচে বনমালীবাবুকে সেখানে থাকতে অনরোধ জানালে। তিনিও সম্মত হলেন। একতলার বৈঠকখানার পাশের ঘরে বনমালীবাবু্র শয়নের বন্দোবস্ত করে দেওয়া হল।
রাত যত বাড়তে থাকে, সেই সঙ্গে ঝড় ও জলের প্রকোপও যেন বৃদ্ধি পেতে থাকে।
বনমালীবাবুকে এইভাবে যেচে বাড়িতে স্থান দেওয়াটা গোড়া হতেই যেন সনৎ-এর মনঃপুত হয়নি। তার পরামর্শ না নিয়েই কেন যে সুব্রত বনমালীবাবুকে গৃহে স্থান দিল! সনৎ-এর চোখে ঘুম আসছিল না। তাই সে এক সময় ঘর থেকে বের হয়ে বাইরের টানা বারান্দায় রেলিংয়ে ভর দিয়ে নিশীথ রাতের তাণ্ডব-লীলা দেখছিল। বাইরের রুদ্র তাণ্ডব কি তার মনের মধ্যেও তাণ্ডব শুরু করেছে? পাশের ঘরেই সুব্রত ও রাজা অঘোরে নিদ্রা দিচ্ছে। আর তার পাশের ঘরে শুয়ে বনমালীবাবু।
এলোমেলো চিন্তা করতে করতে একসময় বুঝি সনৎ কেমন একটি অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল, সহসা কে যেন নিঃশব্দে সনৎ-এর কাঁধের উপর হাত রাখলে!
কে? চমকে উঠে সনৎ ফিরে তাকায়।
বারান্দায় সিলিংয়ে ঝোলানো ম্রিয়মাণ বৈদ্যুতিক আলোর খানিকটা তীর্যগতিতে এসে এদিকে পড়েছে।
আগন্তুক বললে, আমায় চিনতে পেরেছ, সনৎবাবু?
সনৎ যেন আগন্তুকের কথায় এতটকু ভয়ও পায়নি এমনি ভাবে ঠোঁটের কোণে মৃদু একটুকরো হাসি টেনে এনে বিদ্রুপাত্মক কণ্ঠে বললে, তোমার কি মনে হয় বন্ধু?
বন্ধু, বন্ধু! চমৎকার! কিন্তু তোমার নামে যে একটা পরোয়ানা আছে।
পরোয়ানা? কিসের পরোয়ানা তা শুনতে পাই না?
নিশ্চয়ই। কালো ভ্রমরের মৃত্যু-গুহায় হাজিরা দেওয়ার।
তাহলে বলব তুমি বা তোমার দলপতি এখনও সনৎ রায়কে ঠিক চিনতে পারনি!
চিনিনি তোমাকে? কে বললে? পাশ হতে চাপা কণ্ঠে অপর কেউ যেন বলে উঠল অকস্মাৎ ৷
অস্পষ্ট আলো-ছায়ায় বারান্দাটা যেন আশ এক ভৌতিক সম্ভাবনায় থম থম করে ওঠে সহসা।
আকাশ ভেঙে যেন আজ রাতে বৃষ্টি নেমেছে…ঝম…ঝম…ঝম…ঝম। সেই অবিশ্রাম একটানা শব্দেও পার্শ্ববর্তী আগন্তুকের কন্ঠস্বরটা শুনতে কষ্ট হয় না সনৎ-এর।
অতর্কিতে সেই কন্ঠস্বরের সঙ্গে সঙ্গে চমকে সনৎ ফিরে তাকায়। ইতিমধ্যে ঠিক তার পশ্চাতে কখন যে আরও চারজন এসে নিঃশব্দে উপস্থিত হয়েছে তা সে টেরও পায়নি। প্রথমটা সে অতকিতে এতগলো লোকের আবির্ভাবে বিস্মিত ও বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু নিমেষে নিজেকে সামলে নেয়।
একটা বেচাল বা অসতর্ক হলেই লোকগুলো যে তার ওপরে চোখের নিমেষে ঝাঁপিয়ে পড়বে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সনৎ ভেবেই পায় না, কি উপায়ে সে নিজেকে এই মুহূর্তে রক্ষা করতে পারে!
তোমাদের কি উদ্দেশ্য তা জানতে পারি কি?
কেন বন্ধু? এখনও কি তোমার সে কথা বঝতে কষ্ট হচ্ছে? নিশ্চয়ই এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাওনি যে, কালো ভ্রমরের প্রতিশ্রুতির টাকা বা কালো ভ্রমরের ন্যায্য পাওনা এখনও শোধ করনি তুমি?
কালো ভ্রমরের ন্যায্য পাওনা! হুঁ, তা পাওনাই বটে!
এত বড় বিপদের সম্পমখীন হয়েও সনৎ-এর কন্ঠস্বর অবিচলিত। বলে, বেশ, সে টাকা আমি কালই দিয়ে দেব।
অনেক দেরি করে ফেলেছ সনৎবাবু, সুদে-আসলে এখন সে টাকার অঙ্ক তোমার ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। কি ভাবে যে এখন তোমাকে সেটা শোধ করতে হবে, সে কথা কালো ভ্ৰমরই তোমায় যথাসময়ে বাতলে দেবে—। রূঢ় বিদ্রূপাত্মক কণ্ঠে লোকটি বলে।
লোকটার শেষ কথাগলি যেন মুখেই আটকে গেল। বিদ্যুৎগতিতে সনৎএর বজ্রমুষ্টি ভীমবেগে এসে লোকটার চোয়ালে আঘাত করল।
সনৎ দ্বিতীয়বার মুষ্টি উত্তোলনের আগেই দুজন তাকে পশ্চাৎ দিক থেকে চকিতে জাপটে ধরল।
আক্রান্ত হয়ে সনৎ নিজেকে মুক্ত করবার জন্য প্রথমেই সামনে যে ছিল তাকে পা দিয়ে লাথি বসাল।
ধরা শয়তানটাকে। শক্ত করে চেপে ধরা। কে যেন বলে।
সনৎ ইতিমধ্যে নিজেকে তাদের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছে এবং সঙ্গে সঙ্গে ক্ষিপ্রগতিতে সিংহ বিক্রমে সম্মখের লোকটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। মুহূর্তে সঙ্গে সঙ্গে পাশের লোক দুটিও সনৎকে দু পাশ হতে আক্রমণ করল।
অন্ধকার জলে-ভেজা বারান্দায় ওদের হুঁটোপুটি চলতে লাগল। এমন সময় কোথা থেকে ছায়ার মত আরও দুজন লোক এসে সেখানে হাজির হল। কাজেই সনৎকে শীঘ্রই বিপক্ষ দলের কাছে হার মানতে হল। এতগলো লোকের মিলিত আক্রমণে পরাজিত সনৎ-এর মুখটা ততক্ষণে আক্ৰমণকারীদের মধ্যে একজন ক্ষিপ্ৰহস্তে বেঁধে ফেলেছে, এবং দুজনে মিলে তাকে কাঁধে তুলে নিয়েছে। বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে ভিজতে ভিজতে সকলে সনৎকে বয়ে রাস্তায় এসে নামল।
ওদের বাড়ির অল্প দূরেই রাস্তার ওপর বৃষ্টির মধ্যে একখানা মোটরগাড়ি দাঁড়িয়েছিল। লোকগুলো তাড়াতাড়ি সনৎকে নিয়ে সেই গাড়ির মধ্যে তুলল।
পরমুহূর্তে গাড়িটা ছেড়ে দিল।
০৩. পরদিন সকালে
পরদিন সকালে যখন রাজুর ঘুম ভাঙল, সে দেখলে সুব্রত তখনও ঘুমোচ্ছে। সে তাড়াতাড়ি উঠে সুব্রতকে ডেকে বললে, এই সুব্রত, ওঠ ওঠ, বেলা অনেক হয়েছে।
রাজার ডাকে সবে সুব্রত চোখের পাতা রাগড়াতে রাগড়াতে শয্যার ওপরে উঠে বসেছে, ভূত্য এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে।—বড়দাদাবাব, উঠেছেন শিব? সুব্রতই প্রশ্ন করে।
তিনি তো তাঁর ঘরে নেই!
নেই? আর কালকের সেই বাবুটি?
না, তিনিও নেই।
সে আবার কি! এত সকালে গেল কোথায় তারা? বাইরে তখনও টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে, বর্ষাসিক্ত প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে রাজু বলে, এই বৃষ্টির মধ্যে কোথায় আবার গেল তারা?
মা এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন, হ্যাঁ রে, সনৎ কোথায় গেছে জানিস? তাকে দেখলাম না তার ঘরে?
না তো মা! রাজা জবাব দেয়।
চল তো রাজু, ওদের ঘর-ব্দটো একবার ঘরে দেখে আসি।
প্রথমেই রাজু ও সুব্রত এসে সনৎ-এর ঘরে প্রবেশ করল। নিভাঁজ শয্যা দেখে মনে হয় রাত্ৰে শয্যা স্পর্শ পর্যন্ত করা হয়নি।
হঠাৎ সামনের টী-পয়ের ওপর সুব্রতর নজর পড়ে, জলের গ্লাসটা চাপা দেওয়া একটা ভাঁজকরা হলুদবর্ণের তুলট কাগজ। সুব্রত এগিয়ে এসে কাজগটা তুলে চোখের সামনে মেলে ধরতেই বিস্ময়ে আতঙ্কে যেন স্তব্ধ হয়ে যায় ও।
সেই ভ্ৰমর-আঁকা চিঠি!
নমস্কার। চিহ্ন দেখেই চিনবো। সনৎকে নিয়ে চললাম। ভোরের জাহাজেই বর্মা যাব। ইচ্ছা হলে সেখানে সাক্ষাৎ করতে পার।
–কালো ভ্রমর
কিরে ওটা? রাজু এগিয়ে আসে।
সুব্রত চিঠিটা রাজুর হাতে তুলে দেয় নিঃশব্দে।
আবার সেই কালো ভ্ৰমর! মরিয়া না মরে রাম এ কেমন বৈরী! উঃ, কি বোকাটাই সকলকে বানিয়ে গেল! শয়তান! ডিব্রুগড় থেকে আসছি, অমরবাবুর ভাইপো! ধাপ্পাবাজ! সনৎদা কি তবে শয়তানটাকে চিনতে পেরেছিল?
গতরাত্রের আগাগোড়া ব্যাপারটার মধ্যে তার এতটকু উৎসাহও ছিল না। সে যেন এড়াতেই চাইছিল। বলে রাজু।
রাগে দুঃখে অননুশোচনায় সুব্রতর নিজেরই চুল চলে যেন নিজেরই টানতে ইচ্ছে করে।
উঃ, এত বড় আপসোস সে রাখবে কোথায়?
দেওয়ালে টাঙানো ওয়াল-ক্লকটার দিকে তাকিয়ে সুব্রত দেখল বেলা তখন আটটা বেজে পনেরো মিনিট। সাতটা তিরিশে জাহাজ ছেড়ে চলে গেছে। বাইরের দিকে তাকায়। বৃষ্টি থেমেছে, মেঘ-ভাঙা আকাশে সূর্যের আত্মপ্রকাশ, স্নিগ্ধ-সুন্দর।
এখন তাহলে কি করা যায় বল তো সু?
আর দেরি করা নয়। চল, এখনই গিয়ে আগে তো থানায় একটা ডাইরি করিয়ে আসি!
তাতে কি সংবিধা হবে?
তাহলে অন্তত বেতারে জাহাজের ক্যাপ্টেনকে একটা সংবাদ দেওয়া যেতে পারে, যদি আজকের জাহাজেই তারা গিয়ে থাকে!
তারপর?
তারপর সামনের শনিবারে জাহাজে সীট পাই ভাল, না হয়। পরের মঙ্গলবার আমাদের রেঙ্গুনের জাহাজ ধরতেই হবে, তা যে উপায়েই হোক। শুধু রেঙ্গুনে কেন, সনৎদার খোঁজে পৃথিবীর আর এক প্রান্তে যেতে হলেও যাব। আমি খাঁজে বের করবই, আর একবার সেই শয়তান-শিরোমণির সঙ্গে মুখোমুখি দাঁড়াব। সে আমার ধৈয্যের বাঁধ ভেঙে দিয়েছে, স্কাউন্ড্রেল!
মা এসে ঘরে প্রবেশ করলেন, তোদের চা জুড়িয়ে গেল। পরক্ষণেই ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে রে?
সুব্রত মার হাতে চিঠিটা তুলে দেয়। চিঠিটা পড়বার সঙ্গে সঙ্গে এক অস্ফুট কাতরোক্তি মার কন্ঠ হতে নির্গত হয়ে আসে, সর্বনাশ! কালো ভ্ৰমর!
সুব্রত দাঁতে দাঁত চেপে কঠিনস্বরে বললে, হ্যাঁ মা, আবার সেই কালো ভ্ৰমর! কিন্তু এবার সত্যিসত্যিই তার পাপের ভরা পূর্ণ হয়েছে।
কথাবার্তায় আর সময় নষ্ট না করে, কিছু, জলখাবার ও চা খেয়ে, রাজ্য ও সুব্রত তাড়াতাড়ি লালবাজারের দিকে ছুটল।
লালবাজারে গিয়ে সোজা তারা একেবারে ডেপুটি কমিশনারের সঙ্গে দেখা করে সব বললে।
ওদের সমস্ত কথা মনোযোগ সহকারে শুনে সাহেব আবশ্যকীয় সব কথা নোট করে নিলেন এবং বললেন, বাব, তোমাদের কথা শুনে আমি আশ্চর্য! এ একেবারে miracle (অত্যাশ্চর্য)! যা হোক, আমি এখনই জাহাজের ক্যাপ্টেনকে বেতারে সংবাদ প্রেরণের সব বন্দোবস্ত করছি।
সুব্রত লালবাজার থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে পোস্ট-অফিসে গিয়ে রেঙ্গুনে সি. আই. ডি. ইন্সপেক্টর সলিল সেনকে একটা তারা করে দিল—সনৎ সম্পর্কিত সকল ব্যাপার জানিয়ে।–
তারপরই দুজনে গেল জাহাজের বুকিং অফিসের দিকে। জাহাজ ছাড়বে শনিবার-পরশুর পরের দিন, এবং সেই জাহাজে দুখানা সীট রিজার্ভের সব বন্দোবস্ত করে যখন ওরা বাড়ির দিকে পা বাড়াল, তখন প্রখর রৌদ্রে সারা পৃথিবী যেন ঝলসে যাচ্ছে। কমচঞ্চল শহরের বকে অগণিত নরনারী ও বাসট্রামের আনাগোনার শব্দ।
ফিরতি-পথে ওরা যে রাস্তাটা দিয়ে আসছিল, তার দু পাশে চীনা পট্টি। সেই চীনা পট্টি দিয়ে চলতে চলতে একসময় রাজু চাপা, গলায় সুব্রতকে বললে, একটা লোক অনেকক্ষণ থেকে আমাদের পিছ নিয়েছে সুব্রত!
সুব্রত পিছনপানে না তাকিয়েই বললে, তাই নাকি?
অন্ততঃ আমার তো তাই মনে হয়।
লোকটা কি বাঙালী?
না, বর্মী বলে মনে হয়।
কি করে বুঝলে যে লোকটা আমাদের পিছ নিয়েছে?
রাজু প্রত্যুত্তরে একটু হাসলে মাত্র, তারপর বললে—তুই ভুলে যাচ্ছিস যে, একদিন এ দলে আমি বহু ঘোরাফেরা করেছি। শিকারী বিড়ালের গোঁফ দেখলেই আমাদের চিনতে কষ্ট হয় না।
আচ্ছা ওকে অনুসরণ করতে দে। দেখা যাক, লোকটার দৌড় কতদূর পর্যন্ত!
একটা কাজ করলে হয় না?
কি?
আয়, শ্যামবাজারের একটা ট্রামে এখন উঠি; খানিকটা ঘরে-ফিরে পরে বাড়ি যাওয়া যাবে।
মন্দ কি, বেশ তো!
চট করে তারা একটা শ্যামবাজার-গামী ট্রামে চেপে বসল।
***
আমহার্ট স্ট্রীটের যেখানটায় সুব্রতর বাড়ি, তার পিছনে একটা খালি মাঠ। তারই ওপাশে বহুদিনকার একটা চারতলা বাড়ি।
শোনা যায় এককালে নাকি বাড়িটা ছিল এক মস্ত ধনী ব্যবসায়ীর। ব্যবসায়ী মারা যাবার পর, তার ছেলে যখন সমস্ত অর্থের মালিক হয়ে বসল, তখন বিপুল অর্থ হাতে পেয়ে তার মনে হল (বেশীর ভাগ লোকের যা হয়), দুনিয়া তো তারই। এখনকার রাজাই তো সে। স্ফূর্তির স্রোতে গা ভাসিয়ে সে চোখ বাজে আকাশকুসম স্বপ্ন দেখতে শুরু করলে। আর হতভাগ্য পিতার বহু কষ্টার্জিত অৰ্থ রাশি দুদিনের জন্য তাকে নিয়ে পুতুল-খেলা খেললে, পরে তাকে হাত ধরে পথের ধুলোয় বসিয়ে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল।
সুখের দিনে একদিন যারা ছিল দিবারাত্র পাশাপাশি বন্ধুর মত, পরমাত্মীয়ের মত, সর্বনাশের নেশায় একদিন যারা ছিল তার মুখোশপরা একনিষ্ঠ বন্ধু, তারাই আজ অচেনার ভান করে অলক্ষ্যে বিদায় নিয়ে গেল। কেউ বা যাবার বেলায় দিয়ে গেল শুষ্ক সহানভূতির সোনালী হাসি।
যার মুখে একদিন সোনার বাটিতে জমাটবাঁধা দধি উঠিত, আজ তার মুখে ভাঙা কাঁসার বাটিতে জলটুকুও ওঠে না।
সৌভাগ্যের শৈলশৃঙ্গ হতে সে দুর্ভাগ্যের নরককুন্ডে নেমে এল। এতকাল সে শুধু হেসে-গেয়েই এসেছে, আজ তার দু চোখে জল উঠল ছলছলিয়ে।
তারপর অভাবের তাড়নায় অধীর হয়ে একদিন সে নিজের শয়নগৃহেরই কড়িকাঠের সঙ্গে পরনের কাপড় গলায় দিয়ে ফাঁস লাগিয়ে এ দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নিল। অভিমানে না দুঃখে কে জানে!
এদিকে একজন ধনী মারোয়াড়ী লোকটার জীবিতকালেই বাড়িখানা ক্রয় করে নিয়েছিল দেনার দায়ে, কিন্তু ঐ কেনা পর্যন্তই। কারণ বাড়িখানা সে কোন কাজে লাগাতে পারলে না। সমস্ত রাত্রি ধরে নাকি বুভুক্ষিত অশরীরীর দল সারা বাড়িময় হাহাকার করে বেড়াত। লোক এসে একদিনের বেশী দীদিন ও বাড়িতে টিকতে পারে না। সারারাত্রি ধরে কারা নাকি সব সময়ে কেঁদে কেঁদে ফেরে। অসহ্য তাদের সেই বকভঙা বিলাপ।
ক্ৰমে একদিন বাড়িটা জনহীন হয়ে ধীরে ধীরে শেষটায় পোড়ো বাড়ি বা ভূতের বাড়িতে পরিণত হল।
তারপর আজ প্রায় দশ বৎসর ধরে বাড়িটা পড়ে আছে। ভাড়াও কেউ নেয়নি, ক্ৰয় করতেও কেউ চায়নি।
সুব্রত গভীর রাত্রে ঘরে শুয়ে শুনত, রাতের বাতাসে নির্জন বাড়িটার খোলা আধভাঙা কপাটগলো বার বার শব্দ করে আছড়ে আছড়ে পড়ছে। কখনও বা দেখত জ্যোৎস্নারাত্রে চাঁদের নির্মল আলো বাড়িটার সারা গায়ে ছড়িয়ে পড়েছে দঃস্বপ্নের মত করুণ বিষণ্ণে।
সেদিন গভীর রাত্ৰে ঘাম ভাঙতেই সুব্রত চমকে উঠল—সেই মাঠের ওপারে পোড়ো বাড়ির জানালার খোলা কপাটের ফাঁক দিয়ে যেন একটা আলোর শিখা দেখা যাচ্ছে। পোড়ো বাড়িতে আলোর শিখা! আশ্চর্য কৌতূহলী চোখের পাতা দুটো রগড়ে নিল। তারপর আপন মনে বলল-না, ঐ তো মাঝে মাঝে হাওয়া পেয়ে আলোর শিখাটা কেঁপে কেঁপে উঠছে!
সুব্রত বিছানা থেকে উঠে খোলা জানালার কাছে এসে দাঁড়ায়। সহসা এমন নিশীথ রাত্রির জমাট স্তব্ধতা ভেদ করে জেগে উঠল একটা তীক্ষ্ণ বাঁশীর আওয়াজ। তারপর আর একটা, আরও একটা; পর পর তিনটে।
আকাশে মেটে-মেটে জ্যোৎস্না উঠেছে। স্বল্প আলো-আঁধারিতে পোড়ো বাড়িটা যেন একটা মাতৃ-বিভীষিকা জাগিয়ে তুলেছে! চারিদিক নিস্তব্ধ। কোথাও জনপ্রাণীর সাড়াশব্দ পর্যন্ত নেই। জীব-জগৎ সুপ্তির কোলে বিশ্রাম সুখ লাভ করছে। দিবাভাগের জনকোলাহল মুখরিত জগৎ যেন এখানকার এই স্তব্ধ ঘুমন্ত পৃথিবী থেকে দূরে—অনেক দূরে।
এমনি সময়ে হঠাৎ পোড়ো বাড়ির দোতলার দক্ষিণ দিককার একটা ঘরের একটা জানালার কপাট খালে গেল এবং সেই খোলা জানালার পথে একটা টর্চের সতীব্র আলোর রশ্মি মাঠের ওপর এসে পড়ল।
সুব্রতর দু চোখের দৃষ্টি এবারে তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। রহস্যঘন পোড়ো বাড়ির মধ্যে যেন হঠাৎ প্রাণ-স্পন্দন!
ইতিমধ্যে কখন একসময়ে রাজু এসে ওর পাশেই দাঁড়িয়েছে সুব্রত তা টেরও পায় নি। হঠাৎ কাঁধের ওপর মদ, স্পর্শ পেয়ে সে চমকে ফিরে তাকাল, কে? ও রাজু!
হ্যাঁ, কিন্তু কি আমন করে দেখছিলি বলা তো?
চেয়ে দেখ না। মাঠের ওদিকে ঐ ভাঙা বাড়িটা!…
আলোটা ততক্ষণে নিভে গেছে—নির্জন মাঠের মাঝে অসপালট চন্দ্রালোকে সহসা যেন একটা বিভীষিকার আবছা ছায়া নেমে এসেছে।
তাই তো! নির্জন পোড়ো বাড়িতে হঠাৎ কারা আবার এসে হাজির হলেন?—এতক্ষণে বললে রাজ্য।
হ্যাঁ, তোমার কথাই বোধ হয় ঠিক রাজু—
কি বলছিস?
শিকারী বিড়াল?
হ্যাঁ, তার গায়ের গন্ধ পেয়েছি। তারপর হঠাৎ চকিতে ঘরে দাঁড়িয়ে সুব্রত বললে, চল, একবার ওদিককার পথটা ঘরে দেখে আসা যাক।
এই রাত্রে?
ক্ষতি কি, চল না!
বেশ, চল। তাড়াতাড়ি গায়ে একটা শার্ট চাপিয়ে দেওয়াল-আলমারি থেকে সিলাককডোর মইটা ও একটা টিচ নিয়ে সৰ্ব্বত ও রাজ, রাস্তায় এসে নামল।
মাথার ওপর রাত্রির কালো আকাশ তারায় ভরা। অস্তমিত, চাঁদের আলো তখন আরো মালান হয়ে এসেছে। চারিদিকে থমথমে জমাট রাত্রি, যেন এক অতিকায় বাদাড়ের সবিশাল ডানার মত ছড়িয়ে রয়েছে। বড় রাস্তাটা অতিক্রম করে দুজনে এসে গলির মাথায় দাঁড়াল।
কিরীটী রায়কে মনে পড়ে? সুব্রত সহসা একসময় প্রশ্ন করে।
কোন কিরীটী রায়? ঐ সে আমাদের এখানে ফিরে আসার পর প্রীতিভোজের নিমন্ত্রণে যিনি এসেছিলেন? সাড়ে ছয় ফুট লম্বা গৌর বর্ণ, পাতলা চেহারা, মাথাভাতি কোঁকড়ানো চুল, চোখে পুর লেন্সের কালো সেলুলয়েডের ফ্রেমের চশমা!
ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। ঐ যে শখের ডিটেকটিভ, গোয়েন্দাগিরি করেন, টালিগঞ্জে না কোথায় থাকেন? যিনি ড্রাগনটা তোর কাছ হতে চেয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ, নির্জলা শখেরই গোয়েন্দাগিরি! কাকার প্রকান্ড কেমিকেল ল্যাবোরেটারী আছে। আর সে তাঁর একমাত্র ভাইপো।
ওর নামও তো খুব শুনি।
আমাদের পাশের বাড়ির শান্তিবাবুর বিশেষ বন্ধু উনি। তিনিই আমাদের কিরীটীবাবুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। আমরা শান্তিবাবুর সঙ্গে কিরীটীবাবুকেও নিমন্ত্রণ করেছিলাম। মনে নেই, কিরীটীবাবু আমাদের সব কাহিনী শুনে কি বলেছিলেন। আবার কোন আপদ-বিপদ ঘটলে তাঁকে যেন আগেই খবর দেওয়া হয়। ওঁর কথাটা আমার একেবারেই মনে ছিল না। কাল সকালে উঠেই একবার তাঁর ওখানে যেতে হবে, মনে করো।
ইতিমধ্যে ওরা চলতে চলতে দুজনে গলিটার মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়েছে। আর অল্প একটু এগোলেই পোড়ো বাড়িটার পেছনের দরজার কাছে এসে পড়বে। এমন সময় ক্রিং ক্রিং করে সাইকেলের ঘন্টি শোনা যায়। পরক্ষণেই দুজনের দৃষ্টি পড়ল আবছা আলো-আঁধারে কে একজন তীব্র বেগে সাইকেল চালিয়ে গলির ভিতর দিয়ে ঐদিকেই এগিয়ে আসছে। সাইকেলের সামনের আলোটা টিম টিম করে জলছে।
রাজু বা সুব্রত সাবধান হয়ে সরে যাবার আগেই সাইকেল-আরোহী হড়মড় করে এসে একেবারে অতর্কিতে রাজুর গায়ের ওপরই সাইকেল সমেত পড়ল।
সরি, আপনার লেগে গেল নাকি? দুঃখিত–
রাজুর পায়ে বেশ লেগেছিল। সে উষ্ণস্বরে বললে, ঐ ভাঙ্গা আলো লাগিয়ে বাইক চালানো! চলুন আপনাকে hand over করে দেব।
আহা, আপনার কোথাও লেগেছে নাকি? কিন্তু আপনিই বা এত রাত্রে এই চোরাগলির মধ্যে হাওয়া খেতে বেরিয়েছেন কেন?
কেন হাওয়া খেতে বের হয়েছি শুনতে চান? বলেই ক্রুদ্ধ রাজু লোকটার দিকে লাফিয়ে এসে সজোরে লোকটার নাকের ওপরে একটা লৌহ-মুষ্ট্যাঘাত করে।
লোকটা অতর্কিত ঐ প্রচণ্ড মুষ্ট্যাঘাতে প্রথমটা বেশ হকচকিয়েই গিয়েছিল, কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে ক্ষিপ্রগতিতে রাজকে আক্রমণ করল।
কেউ শক্তিতে কম যায় না।
দুজনে জড়াজড়ি করে ঐ সরু গলির মধ্যেই লুটিয়ে পড়ে। সুব্রত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল ব্যাপারটা কতদূর গড়ায়।
হঠাৎ এমন সময় তীব্র একটা অস্ফুট যন্ত্রণাকাতর শব্দ করে রাজু একপাশে ছিটকে পড়ল।
সুব্রতও কম বিস্মিত হয়নি। এক কথায় সে সত্যই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। ইতিমধ্যে আক্রমণকারী তড়িৎ বেগে উঠে পড়ে, সাইকেলে আরোহণ করে চালাতে শুরু করেছে।
রাজু যখন উঠে দাঁড়াল, সাইকেল-আরোহী তখন অদৃশ্য হয়ে গেছে। সুব্রত এগিয়ে এসে বলে, কি হল রাজু?–
০৪. কিরীটী রায়
রাজু যন্ত্রণায় কাতর ক্লিষ্ট স্বরে জবাব দিল, হাতের পাতায় কি যেন ফুটল সুব্রত।
সুব্রত পকেট থেকে টর্চটা বের করে বোতাম টিপল। কিন্তু আশ্চর্য, হাতের পাতায় কিছুই তো ফোটেনি। কিছু বিধেও নেই, এমন কি এক ফোঁটা রক্ত পর্যন্ত পড়েনি। হাতটা ভালো করে টর্চের আলোয় ঘুরিয়ে দেখা হল কোন চিহ্নই নেই। অথচ রাজার হাতের পাতা থেকে কনুই পর্যন্ত ঝিম ঝিম করছে অসহ্য যন্ত্রণায়। যেন অবশ হয়ে আসছে হাতটা।
কই, কিছু তো তোমার হাতে ফুটেছে বলে মনে হচ্ছে না! কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না। সুব্রত বলে।
কিন্তু মনে হল হাতে যেন কি একটা ফুটল, ফোটার সঙ্গে সঙ্গে মাথা পর্যন্ত ঝিম ঝিম করে উঠেছে, এখনও হাতটায় যেন কোন জোর পাচ্ছি না। বললে রাজু।
চল ফেরা যাক। সুব্রত আবার বলে।
কিন্তু ঐ বাড়িটা দেখবি না? যে জন্য এলাম!
না, কাল সকালের আলোয় ভাল করে একসময় এসে বাড়িটা না হয় খোঁজ করে দেখা যাবে। কিন্তু আমি ভাবছি ঐ সাইকেল-আরোহী লোকটা কে? কেনই বা এ পথে এসেছিল? লোকটা আচমকা এ পথে এসেছে বলে তো মনে হয় না। ও নিশ্চয়ই আমাদের ফলো করেই এসেছিল।
যা হোক দুজনে আপাতত বাড়ির দিকে অগ্রসর হল।
রাতের আকাশ ফিকে হয়ে আসছে। শেষ রাতের আঁধার তরল ও ম্লান হয়ে এসেছে। নিশিশেষের ঠাণ্ডা হাওয়া ঝিরঝির করে বয়ে যায়। রাজু আর সুব্রত বাড়ি ফিরে এসে নিজেদের ঘরে প্রবেশ করে শয্যায় আশ্রয় নিল এবং শীঘ্রই দুজনের চোখের পাতায় ঘুম জড়িয়ে আসে।
সুব্রতর যখন ঘুম ভাঙল, রাজু তখনও ঘুমিয়ে।
পূর্ব রাত্রের ব্যাপারটা সুব্রতর একে একে নতুন করে আবার মনে পড়ে। আজই একবার কিরীটীবাবুর ওখানে যেতে হবে। চাকরকে ডেকে চা আনতে বলে সুব্রত বাথরুমের দিকে পা বাড়াল।
বাথরুমে ঢুকে ঝর্ণা নলটা খুলে দিয়ে সুব্রত তার নীচে মাথা পেতে দাঁড়াল। ঝাঁঝরির অজস্র ছিদ্রপথে জলকণাগুলো ঝিরঝির করে সারা গায়ে ও মাথায় ছড়িয়ে পড়তে লাগল। সুব্ৰত সমস্ত শরীর দিয়ে স্নানটা উপভোগ করল। অনেকক্ষণ ধরে স্নান করার পর শরীরটা বেশ ঠাণ্ডা হল। পূর্বরাত্রের জাগরণ-ক্লান্তি যেন অনেক পরিমাণে কমে গেছে।
ভিজে তোয়ালেটা গায়ে জড়িয়ে সোজা রাজুর কক্ষে এসে সুব্রত দেখে রাজু হাতের মুঠো মেলে কি যেন একটা একাগ্র দৃষ্টিতে দেখছে।
সুব্রত বললে, কি দেখছ অত মনোযোগ দিয়ে?
রাজু, সে কথার কোন জবাব না দিয়ে নিঃশব্দে একটা কার্ড সুব্রতর দিকে তুলে ধরে।
কার্ডটার গায়ে কালি দিয়ে ছোট ছোট করে লেখা—
কালো ভ্রমরের হুল, এমনি মিষ্টি-মধুর। কেমন লাগল বন্ধু!
কোথায় পেলে এটা? সুব্রত শুধাল!
রাজু বলল, জামার পকেটে ছিল এটা।
কার্ডটা রাজুর হাত থেকে টান মেরে নিয়ে রাস্তায় ফেলে দিতে দিতে সুব্রত তাচ্ছিল্যভরে বললে, বড় আর দেরি নেই, হুলের খোঁচা হজম করবার দিন এগিয়ে এল। চল চল, একবার টালিগঞ্জে কিরীটীবাবুর ওখানে যাওয়া যাক। এর পর গেলে হয়তো আবার তাঁকে বাড়িতে নাও পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু আমি ভাবছি, ওরা জানলে কি করে যে অত রাত্রে আমরা গলিপথে যাব?
চর আছে সর্বত্র, যারা হয়তো সর্বদা আমাদের ওপর নজর রেখেছে—এ কি, তুই যে স্নান পর্যন্ত সেরে ফেলেছিস। রাজু বলে।
হ্যাঁ, শরীরটা বড় ক্লান্ত মনে হচ্ছিল।
তবে দাঁড়া, আমিও স্নানটা সেরে নিই চট করে।
***
টালিগঞ্জে সুন্দর একখানা দোতলা বাড়ি। সেই বাড়িখানিই কিরীটী রায়ের।
কিরীটী রায়
রহস্যভেদী।
দ্বিতল বাড়িখানি বাইরে থেকে দেখতে সত্যই চমৎকার, আধুনিক প্যাটার্নের নয়, পুরাতন স্টাইলে সবুজ রংয়ের বাড়িখানি।
বাড়ির সামনে ছোট একটা ফুলফল তরিতরকারির বাগিচা। ওপরে ও নীচে সবসমেত বাড়িতে চারখানি মাত্র ঘর। ওপরের একখানিতে কিরীটী শয়ন করে, একটিতে তার রিসার্চ ল্যাবরেটারী। নীচে একটায় লাইব্রেরী ও আর একটায় বৈঠকখানা : তিনজন মাত্র লোক নিয়ে সংসার-কিরীটী নিজে, একটা আধবয়সী নেপালী চাকর নাম তার জংলী ও পাঞ্জাবী শিখ ড্রাইভার হীরা সিং।
ভৃত্য জংলীর যখন মাত্র ন বছর বয়স, তখন একবার কাশিয়াং বেড়াতে গিয়ে কিরীটী তাকে নিয়ে আসে।
মা-বাপ হারা জংলী এক দূর সম্পকীয় আত্মীয়ের কাছে থাকত। সেবারে কিরীটী যখন কাশিয়াং বেড়াতে গেল, তখন সব সময়ে তার ছোটখাটো ফাইফরমাশ খাটবার জন্য একটা অল্প বয়সের চাকরের খোঁজ করতেই তার এক বন্ধু জংলীকে এনে দেয়।
দীর্ঘ পাঁচ মাস কার্শিয়াং-এ কাটিয়ে কিরীটী যেদিন ফিরে আসবে, জংলীকে মাহিনা দিতে গেলে সে হাত গুটিয়ে একপাশে সরে দাঁড়িয়ে মাথা নীচু করলে। তাকে ঐ অবস্থায় দাঁড়াতে দেখে কিরীটী সস্নেহে শুধায়, কি রে? কিছু বলবি জংলী?
জংলী কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। কিরীটী বলে, হ্যাঁ রে, কিছু বলবি?
জংলীর মনে এবার বুঝি আশা জাগে, তাই ধীরে ধীরে মুখটা তোলে। তার চোখের কোন দুটি তখন জলে উবুচুবু।
কি হয়েছে রে জংলী?
বাবুজী! আর কি আপনার চাকরের দরকার হবে না?
ও এই কথা!
এতক্ষণে সমস্ত ব্যাপারটা যেন কিরীটীর কাছে জলের মতই পরিষ্কার হয়ে যায়। হাসতে হাসতে বলে, তোর দেশ, তোর আত্মীয়স্বজন—এদের সবাইকে ছেড়ে তুই আমার কাছে কলকাতায় গিয়ে থাকতে পারবি?
চোখের কোলে অশ্রুমাখা হাসি নিয়ে খুশীর উচ্ছলতায় গদগদ হয়ে জংলী জবাব দেয়, কেন পারব না বাবু, খুব পারব। আর এখানে থেকে আমি কি করব। এখানে আমার কেই বা আছে। মা বাপ তো আমার কতদিন হল মারা গেছে। আমার তো কেউ নেই।…শেষের দিকটা বালকের কণ্ঠস্বর কেমন যেন জড়িয়ে যায়।
তাই কার্শিয়াং ছেড়ে আসবার সময় কিরীটী জংলীকে তার আত্মীয়দের কাছ হতে চেয়ে নিয়ে আসে। তারাও ঘাড়ের বোঝা নামল ভেবে বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
সে আজ দীর্ঘ সাত বছর আগের কথা। এখন জংলীর বয়স ষোল বৎসর। সে এখন বলিষ্ঠ যুবা; কিরীটীর সঙ্গে সঙ্গে সর্বদাই ছায়ার মত ঘোরে সে। অনেক সময় কিরীটীর সহকারী পর্যন্ত হয়। যেমনি বিশ্বাসী তেমনি প্রভুভক্ত।
পাহাড়ের দেশ থেকে কুড়িয়ে আনা অনাথ বালক, শ্নেহের মধুস্পর্শ পেয়ে আপনাকে নিঃস্ব করে বিলিয়ে দিয়েছে। মানুষ বুঝি অমনিই স্নেহের কাঙাল!
***
সেদিন সকালবেলায় একটা সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে কিরীটী সেদিনকার দৈনিকটার ওপর চোখ বুলোচ্ছিল। এমন সময় পত্রিকার দ্বিতীয় পাতায় বড় বড় হেডিংয়ে ছাপা সনৎ-এর উধাও হওয়ার সংবাদটা তার চোখে পড়ল।
কিরীটী কাগজের লেখাগুলোর উপর সাগ্রহে ঝুকে পড়েছে, ঠিক এমনি সময়ে সিঁড়িতে জুতোর শব্দ তার কানে এসে বাজল। জুতোর শব্দ আরোও এগিয়ে একেবারে দরজার গোড়ায় এলে কাগজ হতে মুখ না তুলেই হাসিমুখে সংবর্ধনার সুরে বললে, আসুন সুব্রতবাবু! আমি জানতাম আপনি আসবেন, তবে এত শীঘ্র বলতে বলতে কিরীটী হাঁক দিলে, জংলী, বাবুদের চা দিয়ে যা।
কিরীটী রায়ের কথা শুনে, সব্রত ও রাজু যেন হতবাক হয়ে গেছে। লোকটা কি সবজান্তা, তা না হলে না দেখেই জানতে পারে কি করে কে এল।
প্রথমটায় যে কি বলবে তা ওরা যেন ভেবেই পেলে না! বিস্ময়ের ভাবটা কাটবার আগেই কিরীটী কাগজের ওপর হতে চোখ সরিয়ে নিয়ে ওদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, নমস্কার সুব্রতবাবু, রাজেনবাবু, আরে দাঁড়িয়েই রইলেন যে! বসুন বসুন।
দুজনে এগিয়ে এসে দুখানা সোফা অধিকার করে বসল।
তারপর হঠাৎ এই সকালেই কি খবর বলুন শুনি? কিরীটী রায় সাগ্রহে শুধায়। সোফার ওপর বসতে বসতে সুব্রতই বলে, বলছি, কিন্তু তার আগে বলুন তো, কেমন করে আমাদের না দেখেই বুঝলেন যে আমরাই এসেছি। আপনি কি পায়ের শব্দেই লোক চিনতে পারেন নাকি?
কিরীটী মৃদু হেসে বললো, কতকটা হ্যাঁও বটে, আবার নাও বটে। এইমাত্র খবরের কাগজ খুলতেই চোখে পড়ল সনৎবাবুর গায়েব হওয়ার চাঞ্চল্যকর সংবাদ। আর আপনাদের সঙ্গে তো আমার কথাই ছিল, আবার কোন রকম গোলমাল হলে আপনারা দয়া করে আমাকে একটা খবর দেবেন। সহজ নিয়মে দুয়ে দুয়ে চার কষে ফেলতে দেরী হয়নি। এত সকালে জুতোর শব্দ পেয়ে প্রথমেই তাই আমার আপনাদের কথাই মনে পড়ল, আর সেই আন্দাজের ওপরে নির্ভর করে আপনাদের অভ্যর্থনা জানিয়েছি এবং আপনারাও যখন আমার অভ্যর্থনা শুনে চুপ করে রইলেন, তখন আমি স্থিরনিশ্চিত হলাম, আমার অনুমান মিথ্যা হয়নি।
চমৎকার তো।-রাজু বললে।
না, এর মধ্যে চমৎকারের বা আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। কতকটা সত্যি, কিছুটা মিথ্যে আর বাকিটা অনুমান—এই রীতির ওপরই দাঁড়িয়ে আছে আমাদের কার্যপদ্ধতি। বলতে পারেন কমনসেন্স-এর মারপ্যাঁচ মাত্র। একজন শয়তানকে তার দুষ্কর্মের সুত্র ধরে খুঁজে বের করা এমন বিশেষ কিছু একটা কঠিন বা আজব ব্যাপার নয়। দুষ্কর্মের এমন একটি নিখুত সূত্র সর্বদাই সে রেখে যায় যে, সে নিজেই আমাদের তার কাছে টেনে নিয়ে যায় সেই সূত্ৰপথে। এ সংসারে পাপ-পুণ্য পাশাপাশি আছে। পুণ্যের পরিষ্কার ও পাপের তিরস্কার—এইটাই নিয়ম। আজ পর্যন্ত পাপ করে কেউই রেহাই পায়নি। দৈহিক শান্তি বা দশ বছর জেল হওয়া অথবা দ্বীপান্তর যাওয়াটাই একজন পাপীর শাস্তিভোগের একমাত্র নিদর্শন নয়; ভগবানের মার এমন ভীষণ যে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরও তার কাছে একান্তই তুচ্ছ। বিবেকের তাড়নায় মানসিক যন্ত্রণায় চোখের জলের ভিতর দিয়ে তিল তিল করে যে পরিতাপের আত্মগ্লানি ঝরে পড়ে, তার দুঃসহ জালায় সমস্ত বুকখানাই যে পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। স্থূল চোখে আমরা অনেক কিছুই দেখতে পাই না বটে, কিন্তু তাই বলে তার অস্তিত্বটাই একেবারে অস্বীকার করে উড়িয়ে দেবার ক্ষমতাই বা আমাদের কোথায় বলুন? গায়ের জোরে সব কিছুকে অস্বীকার করতে চাইলেই কি মন আমাদের সব সময় প্রবোধ মানে সুব্রতবাবু?
হয়তো সব সময় মানে না।
হয়তো কেন, নিশ্চয়ই। আচ্ছা যাক সে-কথা; তারপর আগে সব ব্যাপারটা খুলে বলুন তো, শোনা যাক।
সুব্রত তখন ধীরে ধীরে এক এক করে সমস্ত ব্যাপারটাই খুলে বলল।
সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে কিরীটী কিছুক্ষণ পর্যন্ত চুপ করে বসে রইল, তারপর সোফা থেকে উঠে ঘরের মধ্যে কিছুক্ষণ পায়চারি করতে করতে বললে, হ্যাঁ, জাহাজে দুটো সীট তো রিজার্ভ করেছেন। আরও দুটো সীট রিজার্ভ করুন সুব্রতবাব। পরশু সকালে আমাদের জাহাজ ছাড়ছে তা হলে, কি বলেন? কিন্তু আমি ভাবছি, লোকটা আপনাদের চোখে বেশ স্বচ্ছন্দেই ধুলো দিয়ে গেল; আপনারা টেরও পেলেন না?
সুব্রত বললে, বনমালী বসু তো?
না, কালো ভ্রমর স্বয়ং।
হ্যাঁ, আমিও তাই বলছি, বনমালী বসুই স্বয়ং কালো ভ্রমর।
না, বনমালী বসু কালো ভ্রমর নয়।
সে নয়! তবে?
আপনাদের পোড়ো বাড়ির সামনে শিকারী বিড়ালই স্বয়ং কালো ভ্রমর।
কি করে এ কথা আপনি বুঝলেন?
পরে বলব, তবে বনমালী বসুও কালো ভ্রমরের দলের লোকই বটে এবং সে বিষয়েও কোন ভুল নেই। এতে করে এও প্রমাণিত হচ্ছে যে তারা আটঘাট বেধেই কাজে নেমেছে এবারে। অবশ্য বনমালী বসুর কথাবার্তাতেই আপনাদের বোঝা উচিত ছিল, অনেক কিছু অসঙ্গতি তাঁর কথার মধ্যে আছে, ভদ্রলোক ডিব্রুগড়ে বসেই সি, আই, ডি-র তার পেয়েছিলেন মাত্র দিন দশেক আগে, কিন্তু ঐ সময়ের মধ্যে ডিব্রুগড়ে বসে তার পেলেও, ঐদিনকার রেঙ্গুনের সংবাদপত্রের কাটিংটা পাওয়া নিশ্চয়ই সম্ভব ছিল না তাঁর পক্ষে! সন্দেহ তো ঐখানেই ঘনীভূত হয়ে ওঠে।
আশ্চর্য, এটা কিন্তু আমাদের আপদেই মনে হয়নি! বলে সুব্রত।
না হওয়াটাই স্বাভাবিক।
এরপর সুব্রত ও রাজু, কিরীটীর নিকট বিদায় নিয়ে রাস্তায় এসে নামল।
০৫. ১৮ নম্বরের হানাবাড়ি
দ্বিপ্রহরের প্রখর রৌদ্রে সমস্ত শহরটা ঝাঁঝাঁ করছে। প্রচণ্ড তাপে রাস্তার পিচ নরম হয়ে উঠেছে। একটা অস্বাভাবিক উষ্ণতা অনুভূত হয়। ট্রাম-বাসগুলো খড়খড়ি এটে যে যার গন্তব্যপথে ছুটছে। রিক্সাগুলো ঠং ঠং আওয়াজ করে দ্বিপ্রহরের রৌদ্রদগ্ধ নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করছে।
সুব্রত দরজা-জানালা এটে মেঝেয় একটা মাদুর পেতে তার উপর রেঙ্গুনের একটা ম্যাপ প্রসারিত করে ঝুঁকে পড়ে দেখছিল, এমন সময় বাইরে কড়ানাড়ার শব্দ পাওয়া গেল। রাজু পাশেই শুয়ে দিব্যি নাক ডাকছে। এত গ্রীষ্মেও তার ঘুমের কোন ব্যাঘাত হচ্ছে না।
সুব্রত চোখ ফিরিয়ে নিদ্রাভিভূত রাজুর দিকে একবার চাইল, তারপর উঠে দরজা খুলবার জন্য ঘর হতে বেরল।
তখনও সদর দুয়ারে কড়ানাড়ার শব্দ হচ্ছে খট-খট-খট। দরজা খুলতেই ও দেখলে সামনে দাঁড়িয়ে একজন এদেশীয় উৎকলবাসী।
কি চাই? সুব্রত লোকটার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে।
দণ্ডবৎ। রাজেনবানুর গলি কৌটি পড়িব বাবু? মতে নতুন কটক হইতে আইছন্তি। কলকাতার শহর এমতি সে মু কিমিতি জানিব? অঃ, গোট্টা শহর কত্ত ঘুরিল; ঘুরিতে ঘুরিতে এক বাবু বলি দিলা, গুটে রাজেনবাবুর গলি এক রাস্তা অছি বটে; আমহার স্ট্রীটের ধারে।
সুব্রত একদৃষ্টে শ্রীমান উৎকলবাসীর দিকে তাকিয়ে দেখছিল। লোকটা লম্বায় প্রায় সাড়ে ছয় ফুট। চোখ দুটো উজ্জল-ঝকঝক করছে অসাধারণ বুদ্ধির দীপ্তিতে, ছোট ছোট করে কদম-ছাঁট চল। জুলপিটাকে খুর দিয়ে কামিয়ে একেবারে রগ পর্যন্ত তোলা হয়েছে। একটা গোলাপী রংয়ের জাপানী সিল্কের জামা গায়ে, বহুদিনের ব্যবহারে তেলচিটচিটে হয়ে কেমনতর যেন হয়ে উঠেছে। পরনে একটা নতুন চওড়া লালপাড় কোরা ধুতি। গলায় একটা পাকানো চাদর গিট দেওয়া, কতকালের ময়লা যে তার ভাঁজে জমে উঠেছে, সঠিক নির্ণয় করাটা একান্তই দুষ্কর। মুখে একগাল পান; দুই কষের কোলে পানের রস ও সুপারির গুড়া আটকে রয়েছে। বগলে পুরাতন একখানি ছাতা ও বাঁ-হাতে বটুয়া।
তোর নাম কি? সুব্রত শুধাল।
শ্রীল শ্রী শ্রীমান জগরনাথ।
এই বাঁ-ধারের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে গেলেই ডান দিকে যে সরু গলি সেটাই রাজেনবাবুর গলি।
দণ্ডবৎ! বলে জগন্নাথ চলে গেল।
সুব্রত লক্ষ্য করলে লোকটা একটু খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে। লোকটাকে যতক্ষণ দেখা যায় সুব্রত বেশ ভাল করেই দেখল। তারপর যখন সে দৃষ্টির বাইরে চলে গেল, দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আস্তে আস্তে ওপারে চলে গেল।
মনে মনে কিন্তু জগন্নাথের কথাই ভাবছিল।
***
গত রাত্রের সরু গলিপথ ধরে সুব্রতর নির্দেশমত অবশেষে জগন্নাথ ১৮নং বাড়ির পিছন দিককার ভাঙা দরজাটার কাছে এসে দাঁড়াল। এইটাই সেই পোড়ো বাড়ি। দু-একবার শ্যেন দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে সে আস্তেআস্তে বাড়িটার মধ্যে ঢুকে পড়ল চট করে।
আগেই বলেছি বাড়িটা বহুদিনকার। দেওয়ালে দেওয়ালে চুনবালি ঝরার সমারোহ। ইটগুলো দেওয়ালের গায়ে গায়ে বিশ্রীভাবে বেরিয়ে পড়েছে। জানালার কপাটগুলো খিলানের গায়ে কোথাও অর্ধভগ্ন, কোথাও বা জর্জরিত হয়ে ঝুলছে—মাঝে মাঝে বাতাসের ধাক্কায় এদিক-ওদিক নড়ে ওঠে। জগন্নাথ সামনের একটা দরদালান পার হয়ে একতলার উঠোনের সামনে এসে দাঁড়াল।
উঠোনের সিমেন্ট চটে এবড়ো-খেবড়ো হয়ে গেছে, তার মাঝে মাঝে শ্যাওলা জাতীয় আগাছাগুলো গজিয়ে উঠেছে। উঠোনের ওধারে একই ধরনের গোটা পাঁচ-ছয় ঘর সারিবদ্ধ ভাবে আছে। কোনটির কপাট বন্ধ, কোনটির কপাট হা-হা করছে—একেবারেই খোলা। জগন্নাথ এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। বারান্দায় দক্ষিণের কোণ ঘেষে দোতলায় ওঠবার সিঁড়ি। সহসা দোতলার বারান্দায় কাদের পায়ের শব্দ শোনা গেল। শব্দটা ক্রমে জোরে শোনা যাচ্ছে।
কে যেন দম দম করে সিঁড়িপথেই নেমে আসছে।
জগন্নাথ চট করে সিঁড়ির পাশের একটা বড় থামের পেছনে সরে দাঁড়াল। কে যেন সিঁড়ি দিয়ে নামছে, তারই শব্দ। জগন্নাথ কান পেতে রইল। থামের আড়ালে থেকে সে দেখলে, আধবয়সী একজন বেটেমত লোক নেমে আসছে সিঁড়ি বেয়ে। লোকটার গায়ে একটা সাধারণ বার্মিজ কোট। মাথায় একটা ফেজ। লোকটির একটা পা কাঠের। বগলে তার একটা কাঠের ক্রাচ। সে সিঁড়ি বেয়ে নেমে কাঠের পায়ে ঠক ঠক শব্দ করতে করতে বারান্দা দিয়ে এগিয়ে চলল এবং ধীরে ধীরে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল।
আকাশে বোধ হয় মেঘ করেছে। মেঘের আড়ালে সর্য গেছে চেকে, তাই অবেলাতই নেমে এসেছে অন্ধকারের একটা ধসর ছায়া সর্বত্র। বাড়ির ভিতরটা হয়ে উঠেছে আরো অস্পষ্ট।
জগন্নাথ পা টিপে টিপে ওপরের সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায়। সিঁড়ির ধাপগুলো প্রশস্ত হলেও ভেঙ্গে ক্ষয়ে গিয়ে একেবারে ইট সব বের হয়ে পড়েছে। জগন্নাথ সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠল। সামনেই একটা প্রশস্ত টানা বারান্দা। এখানটাও আবছা মেঘে ঢাকা আলোয় অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মেঘলা আকাশে বোধ হয় বিদ্যুৎ চমকে গেল, মুহর্তের জন্য আবছা অন্ধকারের বুকে একটা হঠাৎ আলোর ঢেউ তুলে। জনহীন এই বাড়িটার সর্বাঙ্গে যেন একটা পুরু ধুলার আস্তরণ বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ধুলোবালির কেমন একটা তীব্র কটু গন্ধ নাসারন্ধ্রকে পীড়িত করে তোলে।
দোতলায় বারান্দার জমাট ধুলোর ওপরে ইতস্তত ছড়িয়ে আছে বহু পদচিহ্ন। পদচিহ্নগুলো অল্পদিনের বলেই মনে হয়। বর্তমানে যে এই জনহীন পোড়ো বাড়িতে অনেকের নিয়মিত আনাগোনা শুরু হয়েছে, সেটা বুঝতে কারুরই বিশেষ তেমন কষ্ট হবে না। জগন্নাথ তার তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে এদিক-ওদিক লক্ষ্য করে—একটু আগে কাঠের ক্রাচের সাহায্যে যে লোকটা নীচে নেমে গেল, কে ও? কি জন্যই বা এখানে এসেছিল?
লোকটা নিম্নশ্রেণীর—তার বেশভূষা চালচলন থেকেই বোঝা যায়।
বাইরে বোধ হয় টিপ টিপ করে বৃষ্টি নামল। একটা ঠাণ্ডা হাওয়া চোখে মুখে এসে ঝাপটা দেয়।
সহসা একটা অস্পষ্ট গোঙানির শব্দ জগন্নাথের কানে এসে প্রবেশ করে।
অতি সতর্ক জগন্নাথের শ্রবণেন্দ্রিয় মুহূর্তে সজাগ হয়ে ওঠে।
মৃদু গোঙানির শব্দ না? হ্যাঁ, ঐ তো অস্পষ্ট শোনা যাচ্ছে!
বৃষ্টিটা কি এবারে জোরেই নামল ঐ সময়!
আবছা আলোছায়ার মধ্যে সেই গোঙানির শব্দটা যেন আরও সুস্পষ্ট হয়ে হানাবাড়ির রন্ধ্রে রন্ধ্রে বুঝি অশরীরীর বুক-ভাঙা একটা দীর্ঘশ্বাসের মতই মনে হয়। সহসা এমন সময় পাশ থেকেই ফিসফিস করে একটা অস্পষ্ট চাপা, কণ্ঠস্বর জগন্নাথের কানে এল। চট করে সিঁড়ির কপাটের আড়ালে সরে এল সে এবং সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই শুনতে পেল কে যেন বলছেঃ না, কর্তার হকুম। আগামী শনিবারের পরের শনিবারের মধ্যে যেমন করেই হোক ও তিন বেটাকেই ওখানে হাজির করাতে হবে। শির জামিন দিয়ে এসেছি।
আরে বাবা, এ তো তোমার মগের মুলক নয় যে যা খুশি তাই করবে। এদিকে এক বেটা ফেউ জুটেছে কিরীটী রায়। বাছাধন শুনি নাকি আবার শখের টিকটিকি।
কিরীটী রায়? লোকটা কিন্তু খুব সুবিধের নয় বলেই শুনেছি। তা সে কথা থাক। দেখ একটা সন্দেহ আমার মনে জাগছে, কর্তাও যেন এখানে এসেছেন। তবে এ আমার অনুমান মাত্র।
অনুমান কেন? সত্যিও তো হতে পারে।
অসম্ভব কিছুই নেই। উনি যে কোথায় কি ভাবে যান তো বোঝাই দায়। উঃ, সেবার পাশাপাশি এক হোটেলে সারারাত কাটিয়েও টের পাইনি যে কর্তা আমার পাশেই আছেন। নিজেই যখন ধরা দিলেন, চমকে উঠলাম। সে কথা যাক, পরশুর জাহাজেই তো যাওয়া ঠিক?
এখন পর্যন্ত তো তাই ঠিক আছে, তবে শেষ পর্যন্ত কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, কে বলতে পারে বল?
এমন সময় আবার সেই করুণ গোঙানির শব্দটা শোনা গেল।
প্রথম ব্যক্তি বললে, নাঃ, বেটা জালালে দেখছি! আর ছাই বর্মা-মুলুকেই বা টেনে নিয়ে লাভ কি? এখানে শেষ করে দিলেই তো হয়, যত সব ঝামেলা! কণ্ঠে বেশ বিরক্তির ঝাঁজ।
জানিস তো, কর্তা খুনোখুনির ব্যাপারটা তেমন পছন্দ করেন না! জানিস তো!
কিন্তু পরে ঠেলা সামলাবে কে? আজ রাত্রি আটটায় আমাদের আড্ডায় যাবার কথা। সেখানে কাজের ফিরিস্তি সব ঠিক হবে। এখন চল, সেদিকেই যাওয়া যাক।
প্রথম ব্যক্তি জবাবে বললে, তুই এগিয়ে যা। সেই চীনাপট্টির-নং বাড়িটাতেই তো? আমি একটু পরে যাচ্ছি।
হ্যাঁ, হ্যাঁ।
কথা শেষ হতেই লোকটা এগিয়ে আসে। জগন্নাথ যেখানে দাঁড়িয়েছিল লোকটা সেদিকেই আসছে দেখে জগন্নাথ একেবারে দেয়াল ঘেষে নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়াল। পোড়ো বাড়িতে সাঁঝের আঁধারটা যেন থরে থরে চাপ বেধে উঠেছে তখন চারিদিকে।
বহুদিনকার বদ্ধ আবহাওয়ার বিশ্রী একটা ভ্যাপসা দুর্গন্ধ। জগন্নাথের যেন দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়।
জনহীন হানাবাড়ির কঠিন মৌনতা যেন সেই সন্ধ্যার আঁধারে এক অশরীরী বিভীষিকার মায়াজাল রচনা করেছে চারিদিকে। কাদের অশ্রুত চাপা শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ যেন আঁধারের গায়ে গায়ে বেধে উঠেছে। বাতাস নেই। এমন কি চতুঃসীমায় নেই একবিন্দু আলো। অভিশপ্ত পুরী…
লোকটা যে শেষ পঈযন্ত কোন পথে গেল জগন্নাথ বুঝতে পারলে না। আরও কিছুক্ষণ পরে জগন্নাথ যেদিক হতে কথার আওয়াজ আসছিল, নিঃশব্দে পা টিপে টিপে সেইদিকেই এগিয়ে চলল। খানিক দূর এগোতেই দেখা গেল, অদূরে একটা ঘরের ভেজানো কপাটের ফাঁক দিয়ে একটুখানি অস্ফুট আলোর আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সন্তর্পণে জগন্নাথ এগিয়ে গিয়ে কপাটের ফাঁকে চোখ দিয়ে দাঁড়াল। আশেপাশে কেউ নেই। কপাটের ফাঁক দিয়ে জগন্নাথ দেখতে পেল ছোট একখানি ঘর। ভিতরে একটা মোমবাতির সামনে কে একটা লোক যেন ঝুকে পড়ে মোমবাতির আলোয় কি একটা পড়ছে।
লোকটার চোখ-মুখের রেখায় রেখায় গভীর একাগ্রতা ফুটে উঠেছে।
জগন্নাথ ধীরে অতি ধীরে ডান হাতের একটা আঙুল দরজার ভেজানো। কপাটের গায়ে ছোঁয়ালে, তারপর ঈষং একটু চাপ দিতেই আপনিই কপাটটা একটু সরে গেল। কিন্তু লোকটার সেদিকে খেয়াল নেই; সে আপন মনে কাগজটার ওপর ঝুকে পড়ে সেটা পড়ছে তখন।
আরও একটু ঠেলা দিতেই দরজার কপাট দুটো বেশ খানিকটা ফাঁক হয়ে গেল। আরও একটু– ব্যস। এবার ধীরে অতি ধীরে নিঃশ্বাস বন্ধ করে জগন্নাথ বিড়ালের মতই যেন নিঃশব্দে সেই ফাঁক দিয়ে ঘরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করল। লোকটা তখনও একমনে সেই কাগজখানির ওপর ঝুকে পড়ে কি দেখছে। সে কিছুই টের পেল না। নিঃশব্দে পা টিপে অতি সন্তর্পণে জগন্নাথ এগোতে লাগল। যখন আর মাত্র হাতখানেকের ব্যবধান উভয়ের মধ্যে, সহসা জগন্নাথ ঝপ করে একলাফে লোকটার পিঠের ওপর পড়ে দু হাতে তাকে দঢ়ভাবে জাপটে ধরল।…
০৬. সাঙ্কেতিক লেখা
লোকটা এত গভীর মনোযোগের সঙ্গে কাগজখানি দেখছিল যে অতর্কিত ভাবে পশ্চাৎ দিক থেকে সহসা আক্রান্ত হওয়ায় প্রথমটা হকচকিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সে অতি অল্পক্ষণের জন্যই, পরক্ষণে সে শরীরের সমস্ত বলটুকু প্রয়োগ করে আক্রমণকারীর কবল থেকে আপনাকে মুক্ত করার জন্য সচেষ্ট হয়ে উঠল। কিন্তু আক্রমণকারীর সুকঠিন আলিঙ্গন তখন লৌহদানবের মতই লোকটাকে নিষ্পেষিত করছে।
সেই স্বল্প আলো-আঁধারে ঘরের ধূলিমলিন মেঝের ওপরেই আরম্ভ হল দুজনের তখন প্রবল হুটোপুটি। শক্তির দিক দিয়ে উভয়ের কেউ কম যায় না। ধস্তাধস্তিতে পায়ের ধাক্কায় মোমবাতিটা উল্টে নিভে গেল ও সঙ্গে সঙ্গে নিচ্ছিদ্র আঁধারে সমস্ত ঘরখানি জমাট বেধে উঠল। শীঘ্রই জগন্নাথের আসুরিক শক্তির কাছে লোকটাকে পরাভব স্বীকার করতে হল ও ক্রমে ক্রমে সে নিস্তেজ হয়ে আসতে লাগল। জোরে জোরে নিঃশ্বাসের শব্দ হতে লাগল। ধীরে অতি ধীরে লোকটা একসময় শেষ পর্যন্ত জগন্নাথের শক্তির কাছে সম্পূর্ণ পরাজিত হল।
ক্লান্ত অবসন্ন পরাভূত লোকটাকে মাটির ওপর ফেলে বুকের ওপরে চেপে বসে জগন্নাথ পকেট থেকে একটা সিল্ক কর্ড বের করে ক্ষিপ্রহস্তে লোকটার হাত-পা বেধে ফেলল।
গভীর শ্রান্তিতে জগন্নাথের সমগ্র শরীর তখন অবসন্ন ও ক্লান্ত। ঘামে জামাকাপড় সব ভিজে উঠেছে। সে হাত দিয়ে কপালের ঘামটা মুছে নিল। পকেট থেকে অতঃপর টর্চটা বের করে টিপতেই উজ্জল একটা আলোর ইশারায় ঘরের জমাট আঁধারের খানিকটা যেন জট পাকিয়ে সরে গেল।
এতক্ষণে টর্চের আলোয় লোকটাকে বেশ ভাল করে দেখা গেল। দোহারা। বলিষ্ঠ চেহারা। গায়ে একটা পাটকিলে-রংয়ের মের্জাই। মাথার চুলগুলো ছোট ছোট করে ছাঁটা। মুখটা গোল। নাকটা চ্যাপটা। চোখ দুটো ছোট ছোট। লোকটা পিট পিট করে জগন্নাথের দিকে তাকাচ্ছিল।
অদূরে একটা কাগজ পড়ে আছে। জগন্নাথ ঝুকে হাত বাড়িয়ে কাগজটাকে তুলে নিল, তারপর টর্চের আলোয় কাগজটাকে মেলে ধরল।
কাগজটা সাধারণ কাগজ নয়। নীল রংয়ের একটা অয়েল-পেপার। কাগজটার গায়ে একটা মানচিত্র আঁকা এবং তার নীচে কতকগুলো সাঙ্কেতিক চিহ্ন পর পর সাজানো রয়েছে। কাগজটার এক কোণে একটা ড্রাগনের মুর্তি–মুর্তিটি রক্তের মত টকটকে লাল কালিতে আঁকা।
ড্রাগনের মূর্তির নীচে ছোট ছোট অক্ষরে লাল কালি দিয়ে ইংরাজী-বাংলা মিশিয়ে কি একটা লেখা আছে। লেখাটা অনেকটা কবিতার মত করে সাজানো। যদিও কবিতাটার মাথামুণ্ডতে যেমন কোন কিছু মিল নেই, তেমনি সমস্তটা একেবারে দুর্বোধ্য।
মিয়াং–ভাঙা বুদ্ধদেবের মুর্তি। প্যাগোডার দক্ষিণে তার ডানদিকে চন্দন গাছ—মুর্তির গায়ে গোল চিহ্ন—ভ্রমর আঁকা।
—সেই গাছের
৯০ সোপা পিঠের পরে
দুই DK ০ ০ ০ হাত
পারা সস্তা আছে
চিহ্ন যত বাদ গেছে
তার BAMT ধরে
হাত ০ ০ ০ ০ যাও যদি মাত।
ড্রাগন দেখ বসে আছে
ধনাগারের চাবি কাছে
মুখে তার লোহার বালা
দুলছে তাতে চিকন শলা;
দুইয়ের পিঠে শুন্য নাও
ত্রিশ দিয়ে গুণ দাও,
শূন্য যদি যায় বাদ
সেই কবারে পূরবে সাধ ॥
জগন্নাথ বার দুই-তিন কাগজটা আগাগোড়া পড়ে ফেলল। কিন্তু মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারে না।
অথচ এটা বুঝতে তার কষ্ট হয় না যে জিনিসটা একটা সাঙ্কেতিক লিপি, একটা-না-একটা কিছু এর অর্থ আছেই।
আরও ভাল করে চিন্তা করলে হয়তো তখন অর্থ ধরা যেতে পারে।
কিন্তু এইভাবে এখানে আর দেরী করাও সমীচীন হবে না।
একটু আগে যে অস্ফুট কাতরোক্তি শোনা গিয়েছিল, সে ব্যাপারটার একটা খোঁজ নেওয়া একান্ত প্রয়োজন। এবং ক্ষণপূর্বে অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে যে কথাবার্তা ও শুনেছিল তা থেকে স্পষ্টই মনে হয়, এখান এই পোড়ো বাড়ির কোন কক্ষে নিশ্চয়ই কাউকে এরা ধরে নিয়ে এসে বন্দী করে রেখেছে।
জগন্নাথ ভূপতিত রজ্জুবদ্ধ লোকটার দিকে একবার তাকাল।
লোকটা যেন একেবারে নির্বিকার, যেন ভালমন্দ কিছুই জানে না, নেহাৎ একেবারে গোবেচারী গোছের।
জগন্নাথ তাড়াতাড়ি কাগজটা ভাঁজ করে জামার ভিতর দিককার পকেটে রেখে লোকটার সামনে এগিয়ে এল।
লোকটার মুখের ওপরে টর্চের আলো ফেলে কঠিন আদেশের স্বরে ভাঙা ভাঙা হিন্দুস্থানীতে প্রশ্ন করলে, এই, যে লোকটাকে তোরা এখানে ধরে এনে আটক করে রেখেছিস, সে কোন ঘরে শীঘ্র বল, না হলে গলা টিপেই তোকে এখানে শেষ করে রেখে যাব।
লোকটা যে জগন্নাথের কথার বিন্দুবিসর্গও বুঝতে পারেনি তা স্পষ্টই বোঝা গেল; সে ওর কথার কোন জবাবই দিল না, কেবল নিশ্চেষ্ট হয়ে পড়ে থেকে শুধু জগন্নাথের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে বোকার মতই তাকাতে লাগল।
এবারে লোকটাকে পা দিয়ে একটা ঠেলা দিয়ে জগন্নাথ বললে, এই, চুপ করে আছিস কেন? জবাব দে না বেটা!
ঐ সময় আবার সহসা পূর্বের সেই গোঙানির শব্দটা শোনা গেল। জগন্নাথ এবারে অত্যন্ত অসহিষ্ণু হয়ে বললে, এই, বল!
লোকটি তথাপি নীরব। সে আগের মতই বোকা-চাউনি নিয়ে চেয়ে আছে।
না, এর কাছ হতে জবাব পাওয়া যাবে না দেখছি। জগন্নাথ মনে মনে বললে। তারপর সে একটা রুমাল বের করে লোকটার মুখ চেপে বেধে দিল, যাতে করে লোকটা চিৎকার বা কোন শব্দ করলেও কেউ শুনতে না পায়।
থাক বেটা, যেমন কুকুর তার তেমনি মুগুর। বলতে বলতে জগন্নাথ ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে বাইরে থেকে ঘরের শিকলটা তুলে দিল।
অন্ধকার বেশ জমাট হয়ে উঠেছে। দেওয়ালের কোন ফাটলে বুঝি একটা ঝিঁঝি পোকা ঝিঁঝি করে একটানা বিশ্রী শব্দে ডেকে চলেছে তো চলেছেই।
০৭. খোঁড়া ভিক্ষুক
বাইরের অন্ধকার বারান্দায় এসে জগন্নাথ হাতের টর্চটা টিপতেই দেখলে, উপরেও নীচের তলার মতই বারান্দার গায়ে পর পর চার-পাঁচটি ঘর। উঃ, কি নিস্তব্ধ! সারা বাড়িটা মত্যুর মতই বিভীষিকাময় যেন। মনটা সত্যি কেমন যেন সিরসির করে ওঠে। আশঙ্কায় থমথম করে। বারান্দায় কতকালের ধুলো যে পড়তে পড়তে জমে উঠেছে তার ঠিক নেই।
জগন্নাথ টর্চ হাতে একে একে উপরের সব ঘরগুলোই পরীক্ষা করে দেখলে, কিন্তু কোন ঘরেই জনপ্রাণীর সাড়াশব্দ বা চিহ্ন পর্যন্ত নেই। যুগ যুগ ধরে যেন এখানে কেউ বাস করেনি। কারও পায়ের স্পর্শও যেন পড়েনি।
কই, কেউ তো এখানে নেই। তবে কার অস্ফুট কাতর শব্দ কানে আসছিল? কে অমন করুণ স্বরে গোঙাচ্ছিল? মনে মনে বলতে বলতে জগন্নাথ দোতলার সিঁড়ি বেয়ে একসময় ছাদে গিয়ে উঠল। ছাদও নির্জন জমাট আঁধারে থমথম করছে।
উপরে তারায় ভরা কালো আকাশ। সামনেই চোখে পড়ে সেই পোড়ো মাঠটা। সেটাও রাতের আঁধারে অস্পষ্ট আবছা হয়ে উঠেছে। ওদিকটার তালগাছটার পাতায় পাতায় নিশীথের হাওয়া কেমন একরকম সিপ, সিপ শব্দ তুলেছে।
ছাদে মাত্র চিলেকোঠা। সে ঘরের দুটো কপাটই খোলা, হাওয়ায় মাঝে মাঝে ঢপ ঢপ করে বন্ধ হচ্ছে আর খুলছে। আর কেউ নেই।
জগন্নাথ নীচে নেমে এল আবার। নীচের তলার ঘরগুলো আর একবার ভাল করে দেখল। কিন্তু বৃথা। সেখানেও কিছু পাওয়া গেল না। আর তো দেরি করা সঙ্গত নয়, যদি দলের কেউ আবার এসে পড়ে! অতঃপর জগন্নাথ বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এল।
গলিটা এর মধে বেশ নির্জন হয়ে উঠেছে। জগন্নাথ সন্ধানী দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে গলিপথ ধরে এগোতে লাগল।
গলিটা যেখানে এসে বড় রাস্তার সঙ্গে মিশেছে, সেখানে গ্যাস-পোস্টের নীচে মৃদু আলোয় একজন খোঁড়া ভিক্ষুক-শ্রেণীর লোক লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে করুণ স্বরে পথিকের করুণা ভিক্ষা করছে : বাবু গো, দয়া করে এই খোঁড়াকে একটি পয়সা দিয়ে যান। কত দিকে কত পয়সা আপনাদের যায়, মা জননী গো!
জগন্নাথ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ভিক্ষককে দেখতে লাগল। তার মনে সহসা জাগে, কে-কে এই ভিক্ষুক? কোথায় যেন ওকে দেখেছে। কোথায়?
জগন্নাথ চিন্তা করতে লাগল এবং চিন্তা করতে করতেই একসময় তার মনে হয়, লোকটাকে সে সেদিনই দেখেছে। ঐ পোড়ো বাড়িতে লোকটাকে দেখেছে সে। বগলে ক্রাচ ছিল লোকটার। জগন্নাথ এবার দৃষ্টি আরও প্রখর ও অনুসন্ধিৎসু করে ভিক্ষুকটাকে দূর থেকে দেখতে লাগল।
তারপর একসময় জগন্নাথ ধীরে ধীরে গাঢাকা দিয়ে ওপাশের ফুটপাত দিয়ে পা চালিয়ে এগিয়ে গেল। এবং সোজা, এসে সে সুব্রতদের বাড়ির দরজায় কড়া ধরে নাড়া দিলঃ খট-খট-খটা-খট।
কে? সুব্রতর গলা শোনা গেল ভিতর থেকে।
আমি। দরজাটা খুলেন।
দাঁড়ান, খুলছি।
দরজাটা খুলতেই জগন্নাথ-বেশী কিরীটী রায় হাসতে হাসতে মাথায় বসানো রবারের পরচুলাটা খুলতে খুলতে বললে, মতে জগন্নাথ সাহু। কত্ত ঘুরি ঘুরি কটক জিলা কো মতে কলকাতার–
কিরীটীর কথা শেষ হল না, সুব্রত হা হা করে হেসে বললে, উঃ, কি বিভীষণ লোক আপনি মশাই!
না মশাই, বিভীষণের মত আমি স্বজাতিদ্রোহী নই।
বিভীষণ স্বজাতিদ্রোহী? কি বলেন আপনি?
তা বৈকি। যে নিজের মায়ের পেটের ভাইয়ের মত্যুবাণ ও তার সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র জাতির স্বাধীনতা মানসম্ভ্রম অপরের হাতে তুলে দিতে পারে, তাকে শ্রীরামচন্দ্র যতই পূত আশীর্বাদ দিয়ে গরীয়ান করে তুলুন না কেন, তথাপি আমি বলব সে নীচ; সে কলঙ্ক—সে সমাজদ্রোহী-স্বজাতিদ্রোহী—বিশ্বাসঘাতক। উত্তেজনায় ও ভাবের দোলায় কিরীটীর কণ্ঠস্বর গাঢ় হয়ে এল; কিন্তু সে কথা থাক, তার চাইতেও বড় কাজ আমাদের সামনে। খোশগল্প করে আসর জমাবার মত অবকাশ আমাদের এখন এতটুকুও নেই।– বলতে বলতে ক্ষিপ্রহস্তে কিরীটী রায় গায়ের ছদ্মবেশগুলো খুলে ফেলতে লাগল।
ব্যাপার কি বলুন তো মিঃ রায়? কণ্ঠস্বরে সুব্রতর খানিকটা উদ্বেগ ও কৌতুহল প্রকাশ পায়।
তাড়াতাড়ি একটা চাদর আর একটা লাঠি আনতে পারেন?
কি হবে? কাউকে লাঠ্যৌষধির ব্যবস্থা করছেন নাকি?
রহস্যচ্ছলে জবাব দিল কিরীটীঃ
শৃণু শৃণু রে বর্বর!
দেরি যদি কর, বিপদ হবে বড়।
শীঘ্ৰ আন লাঠি ও চাদর।
সুব্রত হাসতে হাসতে লাঠি ও চাদর সংগ্রহ করতে উপরে চলে গেল এবং অল্পক্ষণের মধ্যেই একটা বাঁশের লাঠি ও সাদা চাদর এনে কিরীটীর হাতে দিল।
এবারে পকেট থেকে একটা টিকিওয়ালা পরচুলা বের করে কিরীটী মাথায় বেশ করে বসিয়ে নিল, তারপর চাদরটা গায়ে জড়িয়ে লাঠিটা হাতে নিয়ে দাঁড়াল সোজা হয়ে, সুব্রতর মুখের দিকে তাকিয়ে। কার সাধ্যি এখন তাকে একটু আগের কিরীটী রায় বলে চিনতে পারে! এখন সে অতি নিরীহগোছের একটি পুজারী ব্রাহ্মণ।
মৃদু হেসে ব্রাহ্মণোচিত গাম্ভীর্যপূর্ণ স্বরে কিরীটী রায় বলল, বৎস, তোমার কল্যাণ হোক। ক্ষণেক অপেক্ষা কর। তারপর কি মনে করে বললে, হ্যাঁ ভাল কথা, আপনাদের পা-গাড়ি আছে?
হ্যাঁ আছে, কেন বলুন তো?
আপনি বাইকটা নিয়ে, বড় রাস্তাটা যেখানে ট্রাম রাস্তার গায়ে গিয়ে মিশেছে সেখানে অপেক্ষা করবেন। আমি আধ ঘণ্টার মধ্যেই সেখানে যাব। বলতে বলতে কিরীটী রায় ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে পথে বেরিয়ে পড়ল।
রাস্তায় নেমে কিরীটী ধীরে ধীরে লাঠি হাতে গলির পথ দিয়ে এগোতে থাকে।
রাত্রি তখন সাতটার বেশী হবে না। মাঝে মাঝে দু-একটা মোটরগাড়ি রাস্তা দিয়ে হস, হস, শব্দে ছুটে যাচ্ছে। দু-একটা রিকশার মৃদু ঠুং-ঠাং আওয়াজ শোনা যায়। সামনেই একটা মস্তবড় ফটকওয়ালা বাড়িতে কোন উৎসব হচ্ছে বোধ হয়। রকমারী আলোতে আর লোকজনের গোলমালে বাড়িটা সরগরম। রাস্তার দুপাশে সারি সারি নানা রংয়ের ও নানা আকারের মোটরগাড়ি দাঁড়িয়ে।
কিরীটী এগিয়ে চলে।
খোঁড়া ভিক্ষুকটা তখনও চেচাচ্ছে বাবা গো! এই খোঁড়া ভিখারীকে একটি আধলা দাও বাবা। কত দিকে, কত ভাবে, কত পয়সা নষ্ট হয় বাবা গো। দয়া কর মাগো জননী।
কিরীটী একটা পয়সা হাতে নিয়ে ভিক্ষুকের দিকে এগিয়ে বলল, এই নে, পয়সা নে।
ভিক্ষুক বা হাতটা বাড়িয়ে দিল। আর একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিরীটী ভিক্ষুকটাকে দেখে নিয়ে পয়সাটা ভিক্ষুকের হাতে ফেলে দিল। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল সামনের দিকে।
ভিক্ষুক তখনও একই ভাবে চেচিয়ে চলেছে। হঠাৎ কিরীটী দেখলে আর একজন ভিক্ষুক যেন খোঁড়াতে খোঁড়াতে উলটো দিক থেকে ওদিকেই আসছে।
কিরীটী চলার গতিটা একটু শ্লথ করে দিল এবং আড়চোখে ভিক্ষুকটাকে লক্ষ্য করতে লাগল দূর থেকেই।
দ্বিতীয় ভিক্ষুকটা খোঁড়াতে খোঁড়াতে আগের ভিক্ষুকটার কাছাকাছি আসতেই দুজনে ফিস ফিস করে কি যেন বলাবলি করতে লাগল পরস্পরের মধ্যে।
কিরীটী আর অপেক্ষা না করে পা চালিয়ে চলল বড় রাস্তার মোড়ের দিকে এবারে।
মোড়ের পানের দোকানটার কাছে এক হাতে বাইক ধরে সুব্রত একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু অনভ্যাসের দরুনে মাঝে মাঝে কাশিতে তার দম আটকে আসতে চায়।
কিরীটী সুব্রতর কাছে এসে দাঁড়ায়। তারপর সুব্রতর হাত থেকে বাইকটা নিয়ে বাগিয়ে ধরতে ধরতে তাড়াতাড়ি বললে, ট্রামে চেপে লালবাজারের মোড়ে চলে যান সোজা। সামনেই যে রাস্তাটা বরাবর নয়া রাস্তায় মিশেছে, তার দুপাশে চীনাদের জুতোর দোকান আছে, ঐখানেই আমি যাচ্ছি। একটা ছুরি, সিল্ক কর্ড ও একটা টর্চ নিতে ভুলবেন না যেন।
কথাগুলো বলেই কিরীটী একলাফে বাইকে চেপে সজোরে প্যাডেল করে অদৃশ্য হয়ে গেল।
কিরীটীর নির্দেশমত তখনই সুব্রত ক্ষিপ্রপদে বাড়ির দিকে চলে গেল।
কিছুদূর এগিয়ে কিরীটী রাস্তার মোড়ে বাইক থেকে নেমে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। সহসা একসময় তার নজরে পড়ল দ্বিতীয় খোঁড়া ভিক্ষুকটা ঐদিকেই আসছে।
মহাপ্রভু নিশ্চয়ই এতক্ষণ যাত্রা করেছেন! কিরীটী বাইকে চেপে গলির দিকে চলল এবারে। কাছাকাছি আসতেই ক্রিং ক্রিং আওয়াজ পাওয়া গেল এবং পরক্ষণেই গলির মুখ দিয়ে একজন সাইকেল-আরোহী দ্রুত বেরিয়ে এল।
লোকটার পরনে ঢিলা পায়জামা, গায়ে ঢোলা কালো জামা, মাথায় কালো টুপি-কপাল পর্যন্ত টেনে দেওয়া হয়েছে; চোখে কালো কাঁচের গগলস।
গলিপথ হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে লোকটা ট্রাম রাস্তার দিকে সাইকেল চালাতে লাগল। কিরীটীও তার পিছু পিছ সাইকেল নিয়ে অনুসরণ করলে।
লোকটা সোজা আমহার্স্ট স্ট্রীট দিয়ে বৌবাজার স্ট্রীটে পড়ে বরাবর গিয়ে চিৎপুরে পড়ল।
দুপাশে যত সব ছবি আর আয়নার দোকান। কাঁচের গায়ে গায়ে উজ্জল বৈদ্যুতিক আলোর রশ্মিগুলি প্রতিফলিত হয়ে বিচিত্র রঙের রামধনু জাগিয়েছে।
রাত্রি কতই বা হবে! বড় জোর আটটা, তার বেশী নয়। কলকাতা শহরে সন্ধ্যা বললেই চলে। দোকানে লোকের ভিড়। পথে ট্রামে ঢং ঢং ঘণ্টার আওয়াজ আর রিকশাওয়ালাদের ঠং ঠুং শব্দ ও মোটরের হন।
লোকটা যে একজন পাকা সাইকেল-চালিয়ে, তা ওর গতি দেখেই বোঝা যায়। লোকটা অতি দ্রুত ভিড় বাঁচিয়ে লালবাজার ডাইনে ফেলে সোজা চীনাপট্টির মধ্যে ঢুকল।
রাস্তার দুপাশে সারি সারি চীনাদের জুতার দোকান। মোড়ের একটা লাইটপোস্টের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষমাণ সুব্রতকে দেখতে পেল কিরীটী।
সাইকেল চালিয়ে কিরীটী সুব্রতর পাশে এসে নামল।—যে লোকটিকে এতক্ষণে কিরীটী অনুসরণ করছিল, সে তখন খানিকটা দূরে সাইকেল থেকে নেমে সাইকেল হাতে করে এগোচ্ছিল।
এটা নিয়ে এখানে অপেক্ষা করুন। এই বলে কিরীটী বাইকটা সুব্রতর হাতে দিয়ে লোকটিকে অনুসরণ করল তাড়াতাড়ি। লোকটি বাইক নিয়েই সামনের অন্ধকার গলিটার মধ্যে গিয়ে পড়ল। কিরীটীও আঁধারে গা ঢাকা দিয়ে শিকারী বিড়ালের মত লোকটাকে অনুসরণ করল।
গলিটা বেশ প্রশস্ত। কিন্তু অন্ধকারে কিছুই ঠাওর করা যায় না। দুপাশে বাড়ির খাড়া দেওয়াল উঠে গেছে। হাত দশেক উচুতে একটা জানালার ফাঁক দিয়ে খানিকটা আলো এসে গলির অন্ধকারে ছিটকে পড়েছে যেন। অন্ধকার এত বেশী যে পাশের লোক পর্যন্ত নজরে আসে না। পচা মাছ ও চামড়ার বিশ্রী গন্ধে দম বন্ধ হবার যোগাড়।
কিরীটী অতি সন্তর্পণে দেওয়াল ঘেষে ঘেষে এগিয়ে চলল। আগের লোকটাকে তখন আর দেখা যাচ্ছে না। সম্মুখে পশ্চাতে ডাইনে বামে সব দিকেই অন্ধকার। অন্ধকার যেন স্তরে স্তরে জমাট বেধে উঠেছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। অন্ধকার গলির মধ্যে বুঝি বাতাসও আসতে ভয় পায়। কিরীটী বুঝল, আর এগিয়ে চলা বৃথা, তাই দাঁড়িয়ে রুদ্ধনিঃশ্বাসে কান পেতে রইল। হঠাৎ একসময়ে একটা আওয়াজ কানে এল খটখটখট। .
তারপরই খানিকক্ষণ চুপচাপ, আর কোন সাড়া-শব্দ নেই। আবার শব্দ হল-খট-খটখট।
এবার যেন কাছেই কোথায় একটা দরজা খোলার শব্দ হল। অন্ধকার গলিপথে একটা ম্লান আলোর শিখা দেখা গেল। তার পরেই ঈষদুন্মুক্ত একটা দরজাপথে একটা কুৎসিত চীনা বুড়ীর চেপ্টা মুখ দেখা গেল। হাতে তার কেরোসিনের বাতি। বাতিটা যেন আলোর চাইতে ধূমোদগিরণই বেশী করছে।
বুড়ী বাতিটি লোকটির মুখের উপর তুলে ধরল। অমনি লোকটা বাঁহাতের দুটো আঙুল কোণাকুনি করে দেখালে। সেই বিশ্রী বুড়ীটার কুৎসিত মুখে ততোধিক কুৎসিত এক টুকরো হাসি জেগে উঠল। বুড়ী রাস্তা ছেড়ে দাঁড়াল।
লোকটি বাড়ির মধ্যে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেল। মুহূতে কিরীটী নিজের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা স্থির করে নেয়, এবং ত্বরিৎপদে গলির ভিতর থেকে বের হয়ে গিয়ে সুব্রত যেখানে অপেক্ষা করছিল সেখানে এসে বললে, এখনই আপনি বাড়ি যান সুব্রতবাব এবং যত শীঘ্র পারেন রাজেনবাবুকে নিয়ে এখানে চলে আসবেন। ঐ যে দেখছেন, হংকং সু ফ্যাক্টরীর পাশ দিয়ে একটা গলি দেখা যাচ্ছে, ওরই আশে-পাশে কোথাও অন্যের সন্দেহ বাঁচিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করবেন। একেবারে শূন্য হাতে আসবেন না।
কি হাতিয়ার সঙ্গে আনি বলুন তো? সব্রত প্রশ্ন করে।
একটা ছুরি বা একটা অন্ততঃ লোহার রড হলেও চলবে। ব্রিটিশ রাজত্বে তো আর পিস্তল বা রিভলবার চট করে পাওয়া যাবে না। কাজে কাজেই আমাদের ভগবানপ্রদত্ত বুদ্ধিকেই কাজে লাগাতে হবে।
সুব্রত হেসে ফেলে।
হাসছেন সুব্রতবাবু! প্রায় পৌনে দুই শত বৎসরের পরাধীনতায় আমরা যে একেবারে পঙ্গু ও অথর্ব হয়ে আছি। কিন্তু থাক, সে-সব কথা, পরাধীন দেশের দুঃখের শেষ কোথায়! হ্যাঁ শুনুন, আপনি আর রাজেনবাবু এসে ঐ হংকং সু ফ্যাক্টরীর কাছে অপেক্ষা করবেন, পর পর দুটো বাঁশীর আওয়াজ পেলেই ঐ গলির মধ্যে ছুটে যাবেন। বাঁশীর আওয়াজ না পাওয়া পর্যন্ত কোথাও যাবেন না। আচ্ছা আমি চললাম।
কিরীটী কথাগুলো বলে দ্রুতপদে গলির মধ্যে অদশ্য হয়ে গেল অন্ধকারে।
সুব্রত আর ক্ষণমাত্র দেরি না করে, সামনেই একটা চলন্ত ট্যাক্সিকে হাতের ইশারায় থামিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে বসে বললে, আমহার্স্ট স্ট্রীট!
ট্যাক্সি নির্দিষ্ট পথে ছুটে চলল।
এদিকে গলির মধ্যে ঢুকে কিরীটী কিছুক্ষণ যেন কি ভাবলে, তারপর আঁধারে আন্দাজ করে ক্ষণপূর্বের দেখা সেই দরজাটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। মুহূত মাত্র চিন্তা করে টক-টক-টক করে দরজার গায়ে তিনটে টোকা দিল।
কিন্তু কোন সাড়া নেই। অল্পক্ষণ পরে আবার টোকা দিল—টক-টক-টক।
এবারে ক্যাঁচ করে একটা শব্দ হল এবং পরক্ষণেই দরজাটা খুলে গেল। আগের সেই চীনা বুড়ী বাতি হাতে বেরিয়ে এল।
কিরীটী আঙুল দিয়ে পূর্বের লোকটির মত ইশারা করতেই বুড়ী পথ ছেড়ে সরে দাঁড়াল। সে বাড়ীর পাশ দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল তখন।
সরু একটা অত্যন্ত স্বল্পপরিসর অন্ধকার গলিপথ বরাবর খানিকটা চলে গেছে। তার মধ্যে দিয়ে বাড়ী আলো নিয়ে এগিয়ে চলে আর কিরীটী পিছন পিছন চলে।
কিছুদূর অগ্রসর হতেই আচমকা কিরীটী হঠাৎ দুই হাত দিয়ে পিছন থেকে বুড়ীর মুখটি চেপে ধরল এবং ক্ষিপ্রহস্তে পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে বুড়ীর মুখে গুজে দিল; তারপর সিল্ক কর্ড দিয়ে বুড়ীকে বেধে ফেললে।
০৮. চীনা আড্ডায়
বুড়ীকে বাঁধতে কিরীটীর দুমিনিটও সময় লাগে না।
বুড়ীকে বেধে ফেলে কিরীটী উঠে সোজা হয়ে দাঁড়াল। জাপটে ধরবার সময় বুড়ীর হাতের বাতিটা ছিটকে পড়ে নিভে গিয়েছিল। কিরীটী পকেট থেকে দেশলাই বের করে একটা জালাল; তারপর সেই অন্ধকার গলিপথ দিয়ে খানিকটা অগ্রসর হতেই দেখা গেল, অদূরে একটা ঘরের দরজার পাশে টুলে বসে একটা চীনা যুবক, ঝিমুচ্ছে। দেওয়ালে একটা ওয়াল-ল্যাম্প পিটপিট করে জলছে। তারই প্লান আলো তন্দ্রাচ্ছন্ন চীনাটির মুখের উপর এসে পড়েছে। লোকটা কিছুই টের পায়নি তাহলে। সামনের ঘরের দরজাটা ভেজানো। ঘরের ভিতর থেকে মাঝে মাঝে অস্পষ্ট কথাবার্তার দু-একটা টুকরো আওয়াজ শোনা যায়। কিরীটী একেবারে দেওয়ালের গায়ে গা লাগিয়ে অতি সন্তর্পণে নিঃশব্দে এগিয়ে চলল। তারপর চীনা লোকটির কাছাকাছি এসে হঠাৎ পিছন দিক থেকে দুহাত দিয়ে খুব জোরে তার গলা জড়িয়ে ধরল।
আধো ঘুমন্ত অবস্থায় অতর্কিত আক্রান্ত হয়ে লোকটি যেমন চমকে উঠেছিল তেমনি হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল এবং সেই অবস্থাতেই লোকটাকে জাপটে ধরে মাটিতেই গড়িয়ে গড়িয়ে খানিকটা পিছন দিকে চলে এল কিরীটী।
অতর্কিত আক্রমণে চীনা লোকটা প্রথমটা বিশেষ হকচকিয়ে গিয়েছিল সত্যিই, কিন্তু একটু পরেই নিজেকে সে কিরীটীর বাহু বেষ্টন থেকে ছাড়াবার জন্যে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু কিরীটীর দৈহিক শক্তির কাছে পেরে ওঠে না। এবং পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়।
প্রথম থেকে কিরীটী লোকটা যাতে কোনরূপ শব্দ না করতে পারে, সেজন্য সতর্ক হয়ে লোকটার মুখে হাত চাপা দিয়েছিল, পরে একটা রুমাল ঠেলে ধরল মুখের মধ্যে। তারপর পকেট থেকে একটা সিল্ক কর্ড বের করে লোকটার হাত-পা বেধে ফেলল। তার পর ক্ষিপ্রগতিতে লোকটার জামা ও মাথার টুপি খুলে নিয়ে নিজে সেগুলো পরে নিল।
পরাজিত রজ্জুবদ্ধ লোকটা তার ছোট কুৎসিত চোখ দুটো মেলে অন্ধকারে হয়তো কিরীটীকে দেখবার চেষ্টা করছিল, কিন্তু সেদিকে কিরীটীর আদৌ লক্ষ্য ছিল না। মাথার কালো চীনা টুপিটা কপালের নীচে ভুরু পর্যন্ত কিরীটী টেনে দেয়। এই সমস্ত কাজ করতে কিরীটীর দশ-পনেরো মিনিটের বেশী সময় লাগেনি। আর দেরি না করে কিরীটী ঘরের ভেজানো দরজাটার দিকে এগিয়ে গেল। অতি ধীরে দু আঙুলে চাপ দিয়ে এবারে দরজাটায় একটু ঠেলা দিল। দুটো কপাট সরে গিয়ে সামান্য একটু ফাঁক হয়ে গেল। দেখা গেল, একটা ভাঙা টেবিলের পাশে তিনজন লোক গভীর মনোযোগ সহকারে বসে বসে কি সব কথাবার্তা বলছে। মুখের হাবভাবে মনে হয় যেন অত্যন্ত জরুরী কিছুর গোপন পরামর্শ চলেছে ঘরের লোকগুলোর মধ্যে।
দুজনের মুখ দেখা যায় না, তারা দরজার দিকে পিছন ফিরে বসেছে। যার মুখ দেখা যায়, সেরকম বীভৎস মুখ কিরীটী জীবনে দেখেছে কিনা সন্দেহ। হঠাৎ দেখলে মনে হয় বুঝি কোন শ্মশানচারী প্রেতলোকবাসী! প্রেতলোকের বিভীষিকায় মুখখানা বীভৎস! কি একটা ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন যেন ওর মুখের প্রতি রেখায় রেখায় ফুটে উঠেছে।
লোকটার ডান দিকটার কপাল ও গাল বোধ হয় কবে পুড়ে গিয়েছিল। সর্বগ্রাসী হুতাশন যেন তার নির্মম চিহ্ন রেখে গেছে ডান দিককার কপাল ও গালটাকে টেনে কুকড়ে বীভৎস করে দিয়ে। সেই সঙ্গে ডান দিককার চোখটাও যেন ঠেলে কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। সেই বীভৎস কুৎসিত মুখের ওপরে আলোর ম্লান শিখা পড়ে আরও ভয়াবহ মনে হয়।
লোকটার হাতে একটা তীক্ষ্ণ বাঁকানো ছুরি। সে সেটিকে দু আঙুলে দোলাতে দোলাতে কাকে যেন লক্ষ্য করে বললে, সনৎবাবু আবার ভেবে দেখ। এখনও সময় আছে।
সনৎবাবু নাম শুনেই কিরীটী চমকে উঠল।
লোকটি আবার বললে, হ্যাঁ, এখনও সময় আছে। আমাদের এইভাবে কলকাতায় আসতে বাধ্য করার জন্য খেসারত দশ হাজার না হোক—অন্ততঃ আমার দাবির দশ হাজার এবং কথার খেলাপের জন্য দশ হাজার টাকা—সর্বসমেত কুড়ি হাজার দিলেই মুক্তি পাবে।
আমি তো তোমাকে আগেও বলেছি, এখনও বলছি—টাকা তুমি পাবে না। তোমার যা খুশি আমাকে নিয়ে করতে পার।
সনৎবাবু তোমার দুঃসাহস দেখে সত্যিই অবাক হয়ে যাচ্ছি। নিশ্চিত মত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও কেমন করে যে তুমি নিশ্চিন্ত থাকার ভাব করছ তা তুমিই জান। একটু থেমে আবার বলল, সেবারে বড় ফাঁকিটা দিয়েছিলে। রেঙ্গুনে তোমার বাড়িতে সেই অপমান, শুধু তাই নয়, এত দুঃসাহস তোমার, আমার প্রেরিত মত্যুদূত ড্রাগনকে ঘৃণাভরে মাটিতে আছড়ে ফেলেছিলে। কিন্তু দেখছি তার চেয়ে ঢের বেশী দুঃসাহস ঐ টিকটিকি কিরীটী রায়ের। বলতে বলতে সহসা সে কথার মোড় ফিরিয়ে হাতের তীক্ষ্ণ ছুরিখানা একবার ঘুরিয়েই বোঁ করে চোখের নিমেষে দরজার দিকে লক্ষ্য করে ছুড়ে দিল। সোঁ করে ছুরির তীক্ষ্ণ অগ্রভাগটা এসে কপাটের গায়ে বিধে থর-থর করে কাঁপতে লাগল
ব্যাপারটা এত চকিতে ঘটে গেল যে, কিরীটী ক্ষণপূর্বে স্বপ্নেও তা ভেবে উঠতে পারেনি।
কত বড় খরসন্ধানী দৃষ্টি চারিদিকে সজাগ রেখে লোকটা সদাসতর্ক থাকে, সে কথা ভাবলেও বুঝি সত্যি শ্রদ্ধায় ও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয়। কিরীটী সঙ্গে সঙ্গে দরজার কাছ থেকে সরে পড়বার পূর্বেই–ক্ষুধিত নেকড়ের মত দুই হাত দিয়ে টেবিলের ওপর ভর দিয়ে, সামনে উপবিষ্ট লোক দুটোর ঘাড়ের ওপর দিয়েই, সেই কুৎসিত-দর্শন লোকটি দরজার গোড়ায় এসে পড়ল মুহূর্তে এবং এক ঝটকা মেরে দরজাটা খুলেই সে কিরীটীর কাঁধে একটা হাত দিয়ে চীনা ভাষায় কঠোর স্বরে বললে, কি শুনছিলি হতভাগা!
তারপর বিরাট এক ঝাঁকুনি দিয়ে ঘাড় ধরে তাকে সামনের টুলটির ওপর বসাতে যেতেই ঘরের আলোয় অদূরে দড়ি-বাঁধা সেই চীনা যুবকটার দিকে তার নজর পড়ল।
সঙ্গে সঙ্গে সে চমকে দু পা পিছিয়ে গেল।
আর দেরি করা সঙ্গত নয়, শুধু বোকামি– ভেবেই কিরীটী মুহূর্তে জোরে এক ধাক্কা মেরে লোকটাকে এক পাশে সরিয়ে দিয়ে চকিতে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে ভিতর থেকে খিল তুলে দিল।
অদূরে মেঝেয় হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে সনৎ। ওদিকে ঘরের মধ্যে উপবিষ্ট লোক দুটো কিরীটীর খিল বন্ধ করার শব্দে চমকে ফিরে তাকাল। ততক্ষণে কিরীটী দরজার গা থেকে সেই ছুরিটা এক টান মেরে তুলে নিয়ে সনৎ-এর কাছে গিয়ে পটাপট করে তার বাঁধন কাটতে শুরু করে দিয়েছে।
লোক দুটো সত্যিই বিস্ময়ে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেছে। কিন্তু সে মুহর্তের জন্য, পরক্ষণেই তারা দুজনেই একসঙ্গে ছুটে এল কিরীটীর দিকে। কিরীটী ফিরে দাঁড়িয়ে প্রথম লোকটির হাতে ছুরি দিয়ে ভীষণভাবে এক আঘাত করলে। লোকটা সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে পিছিয়ে গেল।
এদিকে দরজার গায়ে মুহুর্মুহু ধাক্কা পড়ছে। আর বাঁধন কেটে দিতেই বাকী বাঁধনগুলো পট-পট করে ছিড়ে ফেলে সনৎ এসে উঠে দাঁড়াল।
ইতিমধ্যে সেই লোক দুটো ছুটে এসে আবার ওদের আক্রমণ করল! কিরীটী আর সনৎ কায়দা করে লোক দুটোর কবল থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে ঘরের মধ্যে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করে বেড়াতে লাগল।
ওদিকে বাইরে থেকে তখন মুহুর্মুহু ধাক্কায় দরজাটা প্রায় ভেঙে পড়বার যোগাড়, আর লোক দুটো তখন ওদের ধরবার জন্য প্রায় মরীয়া হয়ে উঠেছে। তাদের চোখ-মুখে সে কি ব্যাকুল আগ্রহ!
কিরীটী স্পষ্টই বুঝতে পারছিল, এইভাবে বেশীক্ষণ আত্মরক্ষা করা মোটেই চলবে না। বাইরে থেকে দরজা ভেঙে ফেলবেই, তাছাড়া এদের দলে কজন আছে, তাই বা কে জানে! এখান থেকে বাঁশি হাজার জোরে বাজালেও বাইরে অপেক্ষমাণ সুব্রত বা রাজেনবাব, কেউই শুনতে পাবেন না।
সহসা এমন সময় মড়মড় করে প্রচণ্ড শব্দে দরজাটার খিলটা ভেঙে গেল এবং ভাঙা দরজাপথে অল্প আয়াসেই ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল একটু আগেই আক্রমণকারী কুৎসিত-দর্শন সেই লোকটা পুচ্ছ-মর্দিত ক্রুদ্ধ শার্দূলের প্রচণ্ড জিঘাংসায়।
কিরীটী স্থির হয়ে দাঁড়াল।
০৯. সংকট মুহূর্ত
কেবল কিরীটীই নয়।
ভীষণ-দর্শন লোকটা দরজার কপাট ভেঙে ঘরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের অন্য দুজনও একেবারে চুপ করে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল মুহূর্তের জন্য। যেন মন্ত্ৰপূত বারি ছিটিয়ে সকলকে মোহাচ্ছন্ন করা হয়েছে।
কয়েক সেকেণ্ড ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে কিরীটীর দিকে পলকহারা দৃষ্টিতে তাকিয়ে লোকটা আচমকা একটা বাজের মত তীক্ষ্ণ হাসি হেসে ওঠে। বীভৎস হাসিতে ঘরটা যেন ঝম ঝম করে ওঠে। সেই ভীষণ-দর্শন লোকটি হাসছে হা হা করে। হাসির ধমকে যেন ভেঙে গড়িয়ে পড়ছে। পরক্ষণেই সহসা ঝন ঝন করে কাঁচ ভাঙার শব্দ হল এবং সঙ্গে সঙ্গে জমাট অন্ধকারে সমস্ত ঘরটা ভরে গেল। কিরীটী পকেট হতে পিতলের ভারী সিগারকেসটা নিক্ষেপ করে ঘরের বাতি ভেঙে দিয়েছে বলেই কাঁচ-ভাঙার শব্দ উঠেছে।
আচমকা অন্ধকারে যেন মুহূর্তের জন্য সব নিস্তব্ধ হয়ে গেছে আবার। কিন্তু সেও অতি অল্পক্ষণের জন্যই।
ততক্ষণে অন্ধকারে ঘরের মধ্যে একটা বিশ্রী হুটোপুটি বেধে গিয়েছে। কিরীটী বাঁ হাত দিয়ে সনৎ-এর একটা হাত আগে থেকে ধরে রেখেছিল, এখন গোলমালের মধ্যে সনৎকে নিয়ে ঘর থেকে বেরোবার চেষ্টা করল এবং চাপা গলায় সনৎকে বললে, সনৎবাবু, চেষ্টা করুন পালাবার।
কিন্তু সহসা কে যেন এমন সময় পিছন থেকে তাকে দু হাতে জাপটে ধরল।
অন্ধকারেই কিরীটী একটা প্রবল ঝটকা দিয়ে আততায়ীর আক্রমণ থেকে আপনাকে মুক্ত করবার চেষ্টা করতেই বুঝতে পারে আততায়ীর দৈহিক শক্তি অপরিসীম। কাজেই সনৎ-এর হাতটা ছেড়ে দিয়ে দু হাতে সবলে আপনাকে মুক্ত করে নেবার জন্য সচেষ্ট হল।
দৈহিক শক্তির দিক দিয়ে কেউ কম যায় না। উভয়েই প্রাণপণে যুঝে চলেছে।
কিরীটী যত যুযুৎসর প্যাঁচ প্রয়োগ করে, আততায়ী ঠিক তার উল্টোটি দিয়ে আপনাকে অক্লেশে মুক্ত করে নেয়। ওদিকে ঘরের মধ্যে ক্রমে আরও গোলমাল বেড়ে উঠেছে। সহসা ঐ সময় অন্ধকারে একটা ক্ষীণ যন্ত্রণাকাতর চিৎকার শোনা গেল।
সেই চিৎকারের শব্দে সকলেই চমকে উঠল। সেই যন্ত্রণাকাতর শব্দে মুহর্তের জন্য কিরীটী ও তার আক্রমণকারীর শক্ত মুষ্টিও বোধ হয় শিথিল হয়ে গিয়েছিল।
কিরীটী ঐ সুযোগ হেলায় হারালে না। আততায়ীকে জোরে এক ধাক্কা দিয়ে সামনের দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়তেই, খোলা দরজাপথে বাইরের সরু গলিপথের মধ্যে এসে ছিটকে পড়ল। সেই চীনা যুবকটি তখনও তেমনি হাতপা বাঁধা অবস্থায় পড়েছিল সেইখানেই।
এক লাফ দিয়ে সেই লোকটিকে ডিঙিয়ে কিরীটী দরজার দিকে ছুটল। ছুটতে ছুটতে সদর দরজার কাছাকাছি এসে দেখতে পেল চেপ্টা-মুখ বুড়ীটা তখনও দরজার কাছে তেমনি ভাবে পড়ে আছে।
কিরীটী যেমন দরজার খিলটায় হাত দিতে যাবে, ঠিক সেই সময় দরজার বাইরে শুনতে পেল খট-খট-খট একটা শব্দ।
দরজা খোলবার সাংকেতিক শব্দ। খিল খুলতে উদ্যত হাতখানি যেন সহসা অর্ধপথেই থেমে যায়। কিরীটী অল্পক্ষণের জন্য রুদ্ধনিঃশ্বাসে স্থির অচঞ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার মনে হল—এক-একটি মুহূর্ত যেন এক একটি যুগ।
কি ব্যাকুল প্রতীক্ষা! প্রতি লোমকূপ—প্রতি রক্তকণা—দেহের ও মনের সমগ্র বোধশক্তি যেন এক অসীম প্রতীক্ষায় উন্মুখ হয়ে উঠেছে। এমন সময় অদূরে একই সঙ্গে অনেকগুলো দ্রুত পায়ের শব্দ শোনা গেল। শব্দ শুনে মনে হয়, কারা যেন শশব্যস্তে ঐদিকেই ছুটে আসছে।
কিরীটী চঞ্চল হয়ে ওঠে। আবার বাইরে থেকে শব্দ হল-খুটখুটখুট ঐ সময়।
ওদিকে পায়ের শব্দ তখন একেবারে কাছে এসে পড়েছে। আর অপেক্ষা করা বিপজ্জনক, সনৎও এল না। এক ঝটকায় খিলটা খুলেই সামনের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল কিরীটী।
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ঐ আড্ডারই বোধ হয় একজন লোক কপাটে সংকেতধ্বনি করছিল। দরজা খুলে কিরীটী আঁধারে আচমকা তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তেই লোকটা হড়মড় করে ধরাশায়ী হল। কিরীটীও মাটিতে পড়ে গিয়ে ছিল, কিন্তু তড়িৎবেগে উঠে দাঁড়িয়েই পশ্চাতের দিকে দৃষ্টিপাতমাত্র না করে গলিপথে বড় রাস্তার দিকে দৌড় দিল। ততক্ষণে আড়ার সকলে দরজার কাছে এসে জড়ো হয়েছে।
কিরীটী গলিটার প্রায় শেষাশেষি এসে পড়েছে, ঠিক এমন সময় একটা তীক্ষ্ণ ছুরির অগ্রভাগ এসে তার বাঁ হাতের মাংসপেশীর উপর বিধে গেল। বিষম যন্ত্রণায় অস্পষ্ট শব্দ করে দাঁড়িয়ে পড়ে মুহূর্তের জন্য কিরীটী।
কিন্তু এইভাবে অন্ধকার গলিপথে শত্রুর সীমানার মধ্যে আর বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকাও নিরাপদ নয় ভেবে কিরীটী অতি কষ্টে ডান হাত দিয়ে ছুরিটাকে টান দিয়ে খুলে, ডান হাতের পাতা দিয়ে ক্ষতস্থানটা সজোরে চেপে ধরে টলতে টলতে এগিয়ে চলল বড় রাস্তার দিকে।
সরত ও রাজ, নির্দিষ্ট জায়গায় অপেক্ষা করছিল বটে, কিন্তু কিরীটী তাদের খোঁজ করলে না। সম্ভবতঃ নিদারুণ পরিশ্রমে এবং বারংবার আক্রান্ত হয়ে সেসব কথা চিন্তা করবারও বুঝি তার দেহের বা মনের অবস্থা ছিল না।
বড় রাস্তার ওপরে এসেই প্রথমে সে রুমাল দিয়ে ক্ষতস্থানটা চেপে ধরল। প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে, মাথাটাও গুর পরিশ্রমে ঝিমঝিম করছে তখন।
১০. অনুসন্ধান
রাত্রি তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা।
বেন্টিঙ্ক স্ট্রীট প্রায় জনশূন্য হয়ে এসেছে। মাঝে মাঝে শুধ, দু-একটা মোটরগাড়ির হর্ন কিংবা রিকশার ঠং ঠং আওয়াজ পাওয়া যায়।
জনহীন শহরে যেন ক্ষীণ প্রাণস্পন্দন।
দোকানপাট প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। দু-একটা জুতোর দোকান তখন অবিশ্যি খোলা। কোন দোকানে খদ্দের নেই, কেবল দোকানে ক্যাশিয়ার খাতার ওপর ঝুকে পড়ে সারা দিনের বেচাকেনার জমাখরচ ঠিক করছে। এক দোকানের পাশে কয়েকটি চীনা জটলা পাকিয়ে নিজেদের মধ্যে তর্কবিতর্ক করছে।
একটা তেতলা বাড়ির নীচে বাঁধানো রোয়াকে কতকগুলো ভিখারী জড়ো হয়ে নিজেদের সুখ-দুঃখের কথা বলছে। তাদের কেউ কেউ আবার দেয়াল থেকে প্ল্যাকার্ড ছিড়ে নিয়ে শোবার ব্যবস্থা করছে।
কিরীটী সে-সব দিকে লক্ষ্য না করে এগিয়ে চলল। লালবাজার থানাটা ছাড়িয়ে একট, এগিয়ে এসেই কিরীটী কি ভেবে দাঁড়াল।
একখানা ট্যাক্সি সেদিকে আসছে। ট্যাক্সিটাকে হাত-ইশারায় দাঁড় করিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে বললে, টালিগঞ্জ–
ক্লান্ত অবসন্ন কিরীটী চলমান ট্যাক্সির নরম গদিতে গা এলিয়ে দেয়।
ঠাণ্ডা হাওয়া চোখে-মুখে এসে যেন শান্তির প্রলেপ বুলিয়ে দিয়ে যায়। ট্যাক্সি ছুটে চলেছে টালিগঞ্জের দিকে।
নিস্তব্ধ নিশীথ রাত্রি।
মাথার ওপরে সীমাহীন কালো আকাশ যেন সর্বাঙ্গে তারার রত্নখচিত ওড়না জড়িয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন।
চৌরঙ্গীর দীপমালা-শোভিত পিচঢালা রাস্তার ওপর দিয়ে গাড়ি বেগে ছুটে চলেছে। গাড়ির সীটে দেহভার এলিয়ে দিয়ে কিরীটী চোখ বুজে পড়ে থাকে।
বাড়িতে পৌঁছে কড়া নাড়তেই জংলী এসে দরজা খুলে দেয়। ট্যাক্সির ভাড়াটা দিয়ে দেয় জংলী।
ভাড়া মিটিয়ে ওপরে এসে জংলী দেখে কিরীটী একটা সোফয়ি হেলান দিয়ে চোখ বুজে পড়ে আছে। জংলী ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে কিরীটীর জামায় রক্ত দেখে সবিস্ময়ে বলে, ও কি বাবুজি, এমন করে জখম হল কি করে বাবুজি!
পিছন হতে অন্ধকারে ছুরি মেরেছে রে! তুই এক কাজ কর—ইলেকট্রিক স্টোভে খানিকটা জল গরম করে নিয়ে আয়। আর ঐ পাশের ঘরের সেলফে আইডিন আর তুলে আছে, নিয়ে আয়।
জখম খুব গুরতর হয়নি। ক্ষতস্থান বেশ ভাল করে চেপে বেধে দিয়ে জংলী কিরীটীকে হাত ধরে এনে শয্যায় শুইয়ে দিল। ফাস্ট এইড দেওয়া কিরীটীর নিকটেই জংলীর শিক্ষা।
পরের দিন সকালে যখন কিরীটীর ঘুম ভাঙল তখন ভোরের সোনালী রোদে সুনীল আকাশ যেন ঝকঝক করছে। খোলা জানালা দিয়ে খানিকটা প্রভাতী রোদ পায়ের ওপর এসে পড়েছে। বারান্দায় খাঁচায় পোষা ক্যানারী পাখিটা থেকে থেকে শিস দিচ্ছে। বাগানে বোধ হয় রজনীগন্ধা তার মধুর মিষ্টি গন্ধ বাতাসে ভাসিয়ে আনে।
কিরীটীর গা-হাত-পায়ে অল্প অল্প বেদনা আছে, মাথাটাও যেন একটু ভারী-ভারী মনে হয়। শয্যার উপর চোখ বুজে শুয়েই কিরীটী গতরাত্রের সমস্ত কথা আগাগোড়া একবার ভাববার চেষ্টা করে। গতরাত্রের দুঃসাহসিক অভিযানের ব্যাপারটা এখনও মনের উপর ছায়াবাজির মত ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে।
নিঃশব্দে জংলী এসে ঘরে প্রবেশ করে। বললে, বাবুজি! তবিয়ত আচ্ছি হ্যায় তো?
হ্যাঁ, বহুৎ তন দুরস্তি মালুম হোতা, এক কাপ চা নিয়ে আয় তো বাবা! শয্যা ত্যাগ করে কিরীটী বাথরুমে গিয়ে প্রবেশ করল।
মুখ হাত ধুয়ে মাথাটা বেশ করে জলে ভিজিয়ে, স্নানের ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে শিস দিতে দিতে কিরীটী বসবার ঘরে এসে ঢুকতেই সুব্রত ও রাজুকে সেখানে বসে থাকতে দেখল। অভ্যর্থনার পরে হাসতে হাসতে বলে ওঠে, সুপ্রভাত—সুপ্রভাত! কতক্ষণ এলেন?
অল্পক্ষণ। তারপর কেমন আছেন? শুনলাম কাল রাত্রে নাকি হাতে জখম হয়েছেন। প্রশ্ন করে সুব্রত।
হ্যাঁ, ও কিছু নয়। চলুন চা-পর্বটা শেষ করে একবার কালকের আড্ডাটায় হানা দিয়ে আসা যাক, যদি কিছুর সন্ধান মেলে।
তাতে কি কোন ফল হবে, আপনি মনে করেন? বলা যায় না, তাছাড়া যদি—
সুব্রত ও রাজু, কিরীটীর কথায় হো হো করে হেসে উঠল। সুব্রত বলল, —যদি কি? যদি একপাটি ছেড়া জুতো বা একটা ভাঙা ছুরির বাঁট নিদেনপক্ষে দেওয়ালের গায়ে একটা হাতের ছাপ পাওয়া যায়?
কিরীটী ওদের কথার ভঙ্গিতে মৃদু মৃদু হাসতে লাগল। বললে, হ্যাঁ, ডিটেকটিভরা নাকি ঐ সব সুত্র ধরেই অনেক সময় বড় বড় পাপানুষ্ঠানেরও কিনারা করে ফেলেন শুনতে পাওয়া যায়।
জংলী এসে চায়ের ট্রে হাতে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল। এবং সামনের পিয়ের ওপর ট্রে-টা নামিয়ে রাখল।
চা-পানের পর তিনজন রাস্তায় এসে নামল।
এর মধ্যেই বাইরে রৌদ্রের তাপ বেশ প্রখর হয়ে উঠেছে। একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে তিনজনে উঠে বসল।
একসময় কিরীটী বললে, আমরা তো কালই রওনা হচ্ছি! কি বলেন, সুব্রতবাবু?
হু। কিন্তু সনৎদার কোন একটা কিনারা তো হল না এখনও! বললে সুব্রত।
সনৎবাবু আপাততঃ কলকাতাতেই আছেন।
কিরীটীর কথায় রাজু ও সুব্রত চমকে উঠে বিস্ময়-ভরা কণ্ঠে শুধাল, সে কি!
হ্যাঁ। কাল রাত্রে সামান্য একটু ভুলের জন্য তাঁকে সেই শয়তানের আড্ডায় ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছি, কিন্তু একটা বিষয়ে নিশ্চিত আছি।
কি?
তাঁকে তারা প্রাণে মারবে না।
তাদের আপনি চেনেন না মিঃ রায়। এ সংসারে তাদের অসাধ্য কিছুই নেই। এমন কোন পাপ কাজ বা দুষ্কর্ম নেই যা ওদের বিবেকে বাধে। ওরা নেকড়ের চেয়েও হিংস্র, সাপের চেয়েও খল।
কিরীটী মৃদু মৃদু হাসতে লাগল। পরে গভীরভাবে বললে, কিন্তু এক্ষেত্রে মেরে ফেললে যে ওদের কাজ হাসিল হবে না সুব্রতবাবু। যে ফাঁদ ওরা পাততে চায় সে বড় বিষম ফাঁদ। কিন্তু ওদের হিসাবেই সামান্য একটু ভুল হয়ে গেছে এবং সেইটকু শুধরে নেওয়ার জন্য ওরা বোধ হয় সনৎবাবুকে নিয়েই কালকের জাহাজে আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই রেঙ্গুন রওনা হবে, এই পর্যন্ত বলে কিরীটী একে একে গতরাত্রের সমস্ত ঘটনাই আগাগোড়া খুলে ওদের বলে গেল।
সুব্রত কিরীটীর মুখে গতরাত্রের আনুপূর্বিক কাহিনী শুনে বললে, তা হলে দেখছি সত্যসত্যই আপনি ভাগ্যবান। প্রথম যাত্রাতেই মহাপ্রভুর সাক্ষাৎ মিলে গেল!
কিরীটী হাসতে হাসতে বললে, না, এবারেই প্রথম সাক্ষাৎ নয়। ইতিপূর্বে আরও একবার দর্শন মিলেছিল।
সে কি! দুজনেই একসঙ্গেই প্রশ্ন করল।
হ্যাঁ, খোঁড়া ভিক্ষুকই স্বয়ং মহাপ্রভু। বলে আবার কিরীটী খোঁড়া ভিক্ষুকের কাহিনীটাও ওদের বললে।
ট্যাক্সি ছুটে চলেছে চীনাপট্টির উদ্দেশে। রাজপথে অসংখ্য লোক। পিপীলিকার সারির মত যে যার গন্তব্যপথে চলেছে। অফিস টাইম। বাসট্রামগুলো যাত্রীতে যেন একেবারে ঠেসা।
কিরীটী বললে, একটা কথা ভাবছি, চীনাপট্টিতে হুট করে গিয়ে আগেই ওঠা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আটঘাট বেধে কাজে নামতে হবে।
কি করবেন তাহলে? সুব্রত প্রশ্ন করে।
আমরা প্রথমে লালবাজারে যাব, সেখানে চৌধুরী বলে একজন সি. আই. ডি, ইন্সপেকটারের সঙ্গে আমার যথেষ্ট আলাপ-পরিচয় আছে। তাকে সব কথা খুলে বলে লালপাগড়ির সাহায্য নিতে হবে।
লালপাগড়ি!
হ্যাঁ, জানেন না তো, চোর-ডাকাত-গুণ্ডা মহলে লালপাগড়ির মহিমা অপরিসীম।
লালবাজারের কাছাকাছি এসে ওরা ট্যাক্সিটা বিদায় করে দিল ভাড়া মিটিয়ে।
চৌধুরী অফিসেই ছিল। কিরীটী তাকে সংক্ষেপে সমস্ত ব্যাপারটা খুলে বলবার পর চৌধুরী সানন্দে কিরীটীকে সাহায্য করতে রাজী হয়ে গেল। এবং চৌধুরীর নির্দেশমত তখনই থানা থেকে দুজন কনস্টেবল কিরীটী তার সাহায্যের জন্য পেল।
থানা থেকে বের হয়ে কিরীটী সদলবলে যখন হংকং সু ফ্যাক্টরীর সামনে এসে হাজির হল, বেলা তখন প্রায় সাড়ে দশটা বাজে।
দোকানের ঠিক সামনে একজন প্রৌঢ়বয়সী চীনা একটা কাঠের টুলের ওপরে বসে একটা লম্বা পাইপ মুখে গুজে ঝিমোচ্ছিল। ওদের জুতোর শব্দে লোকটা হঠাৎ চমকে মুখ তুলে তাকাল এবং পরক্ষণেই সাদরে আহবান জানাল, জুতি সাব! আচ্ছা জুতি!
দোকানের ভিতরে একটি অল্পবয়সী চীনা যুবতী কাঁচি দিয়ে চামড়া কাটছিল আর মেসিনে বসে একজন আধ্যবয়সী চীনা যুবক কি যেন সেলাই করছিল।
কিরীটীদের সকলকে দোকানে প্রবেশ করতে দেখে ওরা দুজনেই মুখে তুলে একবার মাত্র চেয়ে আবার যে যার কাজে মন দিল। দোকানটি যে খুব বড়গোছের তা নয়।
নাতিপ্রশস্ত একখানা হলঘর। ওপরে প্ল্যাটফরমের মত কাঠের রেলিং দিয়ে ঘেরা। একপাশে পুরানো চামড়ার টুকরো স্তুপাকার করে রাখা হয়েছে। অন্য একপাশে দেখা যায় ওপরে ওঠবার জন্য একটা কাঠের সিঁড়ি। কিরীটী তার খরসন্ধানী দৃষ্টি বুলিয়ে চারিদিকে ভাল করে দেখতে লাগল।
কনস্টেবল দুজন কিরীটীর নির্দেশেই দোকানের ভিতর ঢোকেনি। তারা ওদিককার ফুটপাতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল।
কি জুতি চাই বাব?—প্রশ্ন করলে চীনা যুবকটি আধো আধো বাংলায়।
কিরীটী গম্ভীর হয়ে বলল, আমরা তোমাদের দোকানঘরটা একবার সার্চ করব বলে এসেছি।
কথাটা শোনামাত্র চীনা যুবকটি মেশিন ছেড়ে উঠে এল এবং বেশ পরিষ্কার ইংরাজীতে শুধাল, কেন, কি কারণে জানতে পারি কি?
কিরীটী দোকানের ভিতর চারিদিকে ইতস্তত দৃষ্টিপাত করতে করতে উদাস স্বরে জবাব দেয়, সরকারের হকুম।
চীনা যুবক রুক্ষ স্বরে জবাব দিল, তোমার ও হকুম আমি মানি না বাবু। এখনই তুমি আমার দোকান থেকে বেরিয়ে যাও, তা না হলে বিপদে পড়বে।
কিরীটী গভীরভাবে জবাব দেয়, বিপদে আমি পড়ব না, আমায় না দেখতে দিলে তুমিই বিপদে পড়বে সাহেব।
ইতিমধ্যে ওদের কথা-কাটাকাটির আওয়াজ পেয়ে পাশের একটা দরজা খুলে আরও দুজন হোমরাচোমরা গোছের চীনা বেরিয়ে এল। তারা বললে, কি হল বাবু?
কিরীটী ওদের দিকে একান্ত তাচ্ছিল্যভরে চেয়ে জবাব দিল, এই দোকানটা একবার আমরা ভাল করে দেখতে চাই।
কেন? রুক্ষ স্বরে একজন প্রশ্ন করে।
কিরীটী যেন ওদের ভ্রুক্ষেপমাত্রও না করে সুব্রতর দিকে তাকিয়ে বললে, চলুন সুব্রতবাবু, আমরা আমাদের কাজ করি।
কিরীটীর মুখের কথা শেষ হল না, চোখের পলকে ওদের একজন সুব্রতর সামনে এসে দাঁড়াল এবং মুহূর্তে সেই পরিষ্কার দিবালোকেই একখানা সুতীক্ষ্ণ বাঁকানো ছুরি ওদের গতিপথ রোধ করে।
১১. কালো ভ্রমরের হূল
চোখের পলক ফেলার আগেই কিরীটী চীনা লোকটির ছুরিসমেত হাতখানা ধরে এক হেচকা টানে নিজের দিকে টেনে নিয়ে কনুইটা চেপে ধরে লোকটার হাতটা মুচড়ে দিল।
একটা অস্ফুট চীৎকার করে চীনাটা ছরিখানা ফেলে দিল। আর ঠিক সেই মুহুর্তে কিরীটী বাম হাত দিয়ে ছোট্ট একটা বাঁশি বের করে তাতে সজোরে ফুঁ দিল।
বাঁশির আওয়াজ পেয়ে দ্রুতপদে অপেক্ষমান কনেস্টবল দুজন এসে দোকানে প্রবেশ করল। লালপাগড়ির শুভাগমন দেখে চীনাদের মুখের ভার যেন নিমেষে বদলে যায়। তারা একান্ত নিরীহ পোষা জীবটির মত একপাশে সরে দাঁড়াল মাথা নীচু করে সঙ্গে সঙ্গে।
কিরীটী একজন কনস্টেবলকে চোখের ইশারায় ডেকে নিয়ে, দরজাটা খুলে একটু আগে সেই চীনা লোক দুটো ঢুকেছিল সেই দরজার দিকে এগিয়ে গেল নির্ভীক পদক্ষেপে।
দরজা খুলে কিরীটী, সুব্রত ও একজন কনস্টেবল গিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল। সামনেই একটা মাঝারিগোছের ঘর। ঘরটা দিনের বেলাতেও বেশ অন্ধকার। উপরে ছোট ছোট দুটো স্কাইলাইট বসানো আছে বটে এবং ওদিকে আর একটা দরজাও আছে, কিন্তু সেটার কপাট ভেজানো থাকার জন্য ঘরটা অন্ধকার।
বাইরের আলো আসবার কোন পথ তো নেই-ই, কৃত্রিম আলোরও তেমন কোন বন্দোবস্ত নেই ঘরটার মধ্যে। স্কাইলাইটের ফাঁক দিয়ে সামান্য যে আলোটকু ঘরে আসে তাতেই সামান্য যেন এক মৃদু আলো-আঁধারির সৃষ্টি হয়েছে।
কিরীটী খরসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে চারিদিকে দেখতে লাগল। ঘরের এক কোণে স্তুপাকার করা একগাদা কাগজের তৈরী জুতোর বাক্স। আর এক কোণে একটা জুতো সেলাইয়ের কল। দেওয়ালে একটা ওয়াল-ল্যাম্প। ল্যাম্পটার চিমনির গায়ে একরাশ কালি জমেছে। কতকাল পরিষ্কার করা হয়নি কে জানে!
ওরা এগিয়ে এসে প্রথমেই ওদিককার দরজাটা খুলে ফেলল। সামনেই একফালি বারান্দা। সেখানে তবু যা হোক খানিকটা আলো এসে পড়েছে বাইরে।
বারান্দার সংলগ্ন পর পর দুখানা ঘর। প্রথম ঘরটা নেহাৎ ছোট নয়। সেখানে কতকগুলো চেয়ার-টেবিল ওলট-পালট হয়ে ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে। মনে হয় কারা বুঝি ঘরটার মধ্যে এসে হুটোপুটি করে গেছে। ঘরের মেঝেয় একটা টেবিল লাম্প উল্টে পড়ে আছে, খানিকটা জায়গায় কেরোসিন তেলের দাগ। ভাঙা চিমনির টুকরোগুলো ঘরময় ইতস্তত ছড়ানো। কিরীটী ভাল করে সব দেখতে দেখতে বুঝতে পারে, এই ঘরটিই গতরাত্রের সেই ঘটনাস্থল। এই ঘরেই গতরাত্রের খণ্ডপ্রলয় ঘটে গেছে। শূন্য ঘরখানি যেন প্রলয়কাণ্ডের মৌন সাক্ষী হয়ে রয়েছে এখনও।
ঘরের বাতাসটা যেন কেরোসিনের তেলের উগ্র গন্ধে ভরে আছে। নাক জালা করে। কিরীটী আরও একবার ভাল করে ঘরের চতুষ্পার্শ্বটা দেখে নিল। ভাঙা চেয়ার-টেবিলগুলো ছাড়া আর কিছুই নেই। কিরীটী অতঃপর ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে পাশের ঘরে এসে প্রবেশ করল।
এ ঘরটা অবশ্য আগের চাইতে অনেক ছোট এবং আগের ঘরটার চাইতে এ ঘরটা যেন আরো একটু বেশী অন্ধকার। মুক্ত দরজাপথে সামান্য যে আলো এসে ঘরে প্রবেশ করেছে, তাতে দেখা গেল একটা ভাঙা খাটিয়ার ওপরে আপাদমস্তক একটা মলিন দুর্গন্ধ চাদর মুড়ি দিয়ে কে একজন পড়ে আছে।
কিরীটীই এগিয়ে এসে চাদরটা টেনে তোলে।
একটা অস্ফুট কাতর শব্দ শোনা গেল। কিরীটী দেখলে একটা চীনা বুড়ী।
ভাল করে শায়িত বুড়ীটার মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই কিরীটী যেন চমকে ওঠে।
চিনতে এতটুকুও কষ্ট হয় না।
বুড়ীটার বোধ হয় সুখনিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটছিল, সে তার অসহিষ্ণু ক্রুদ্ধ দৃষ্টি মেলে পিটপিট করে কিরীটীর দিকে চেয়ে থাকে।
বুড়ীর জীবনে এ ধরনের উৎপাত হয়তো খুব কম দেখা দিয়েছে।
কিরীটী চমকে উঠেছিল বুড়ীটাকে চিনতে পেরেই। এই তো সেই চ্যাপ্টামুখ বুড়ী যাকে সে গতরাত্রে দড়ি দিয়ে বেধেছিল।
হঠাৎ বুড়ী কিচির-মিচির করে যেন কি বলতে বলতে উঠে বসল। কিরীটী ওর মুখের দিকে একবার চেয়ে সুব্রতকে বললে, চলুন সুব্রতবাবু দেখা যাক আর কোন ঘরটর আছে কিনা!
বারান্দাটা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে একটা টিনের বেড়া। বেড়ার গায়ে একটা দরজা; সেই দরজায় একটা দুর্গন্ধ পুরনো চটের পর্দা ঝুলছে।
কিরীটী এগিয়ে এসে হাত দিয়ে পর্দাটি তুলে ধরল। ঘরের ভিতর দেখা গেল তিনটি চীনা মেয়ে। তাদের একজন উনুনে হাঁড়ি চাপিয়ে কি যেন রাঁধছে, একজন একটা ছুরি দিয়ে তরকারি কেটে কেটে একটা ভাঙা সানকিতে রাখছে। অন্যজন একটা ভাঙা মোড়ার উপরে বসে একটা জামা সেলাই করছে। কিরীটীদের এমনি অতর্কিত ভাবে প্রবেশ করতে দেখে তিনজনেই বিস্মিত ও চমকিত হয়ে একই সময়ে যে যার হাতের কাজ ফেলে উঠে দাঁড়াল।
কিরীটী আফসোসের স্বরে বললে, না, কোন ফল হল না। চলুন। কিরীটীর কণ্ঠে রীতিমত একটা হতাশার সুর যেন ফুটে ওঠে।
সকলে আবার দোকান থেকে বেরিয়ে এল। রাস্তায় নেমে সুব্রত কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কিছুই পাওয়া গেল না, এখন কি করবেন ঠিক করলেন, মিঃ রায়
কনস্টেবল দুজনকে বিদায় দিয়ে কিরীটী অন্যমনস্ক ভাবে এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে বললে, কালকের জাহাজে আমাদের রওনা হতেই হবে সুব্রতবাবু। সেভাবেই আমরা যেন প্রস্তুত হই।..
সুব্রত কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে জবাব দিল, সেখানে যাওয়ার কি কোন প্রয়োজন আছে, মিঃ রায়? সনৎদাকে যখন ওরা এখানেই রেখেছে, তখন শুধু শুধু অত দূর দৌড়ে কি হবে?
সনৎবাবুকে অক্ষত দেহে ফিরে পেতে হলে আমাদের কালকের জাহাজে যেতেই হবে। কেননা একটু আগেই আপনাদের বলেছি, ওরা কালকের জাহাজেই রওনা হবে।
কিন্তু–
এর মধ্যে আর কোন কিন্তুই নেই সুব্রতবাবু। পাশার দান উল্টে গেছে, এ কথা খুবই সত্যি। কিন্তু আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বীর পাশার ঘুটি আবার নতুন করে সাজাবার মত বুদ্ধি বা ক্ষমতা বেশ আছে। এবং এবারে তার প্রথম ও প্রধান চেষ্টাই হবে, যাতে গতবারের মত ভুলের জের আর তাকে না টানতে হয়। সে যে একজন দস্তুরমত শয়তান সে বিষয়ে কোন মতদ্বৈধই নেই। সেই সঙ্গে এ কথাটাও যেন আমরা মুহূর্তের জন্য না ভুলি যে, বুদ্ধি তার অসম্ভব রকম তীক্ষ্ণ। কাজেই বুদ্ধির কৌশলে তাকে পরাস্ত করতে হলে ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের একান্তই প্রয়োজন। বলতে বলতে হঠাৎ চমকে উঠে উৎকণ্ঠামিশ্রিত কণ্ঠে কিরীটী বলে উঠল, সরে যান সরে যান!
কিন্তু সরে যাওয়ার আগেই সাইকেল-সমেত একজন আরোহী এসে হড়মড় করে একেবারে সুব্রতর ঘাড়ের ওপর পড়ল। এবং সঙ্গে সঙ্গে সুব্রত উঃ করে একটা অস্ফুট চিৎকার করে একদিকে ছিটকে পড়ল।
সকলে মিলে ভূপতিত সুব্রতকে সামলাবার আগেই সাইকেল-আরোহী সাইকেল ফেলে একছুটে সামনের একটা সরু গলিপথে অদৃশ্য হয়ে গেল।
কিরীটী এগিয়ে এসে সুব্রতকে তুলতে তুলতে স্নেহ ও উদ্বেগপূর্ণ স্বরে প্রশ্ন করল, লেগেছে কি? কোথায় লাগল?
সুব্রত ডান হাত দিয়ে বাম দিককার কোমরটা চেপে ধরে উঠতে উঠতে কাতর-স্বরে বললে, কোমরে একটু লেগেছে।
ততক্ষণে রাস্তায় কৌতুহলী পথিকদের মধ্যে অনেকেই সেখানে এসে জুটেছে। নানারকম প্রশ্ন ও মন্তব্যে স্থানটি বেশ মুখর হয়ে উঠেছে। ভিড় ও অবান্তর প্রশ্নোত্তর এড়াবার জন্য কিরীটী হাতের ইশারায় একখানা চলন্ত ট্যাক্সি ডাকল এবং সকলে ট্যাক্সিতে উঠে বসে বললে, আমহার্স্ট স্ট্রীট।
ট্যাক্সি ছুটে চলল।
কৌতূহলী হুজুগপ্রিয় পথিকেরা এমন একটা সরল ব্যাপার সহসা বিনা গোলমালে থেমে যেতে বেশ একটু মনঃক্ষুণ্ন হল এবং অগত্যা যে যার গন্তব্যপথে চলে গেল।
চলমান ট্যাক্সিতে বসে গভীরভাবে বললে কিরীটী, চারিদিকে চেয়ে পথ চলতে হয় সুব্রতবাবু!
সুব্রত সে কথায় কান দিল না। সে ততক্ষণে বাঁ হাত দিয়ে একটা মোটা পিনসমেত একখানি গোল কার্ড কাপড় থেকে টেনে বের করে হাতের পাতার উপর মেলে দেখছিল। এ সেই রকমের একখানি কার্ড, যেমনটি রাজু-র গায়ে পরশু রাতে বিধেছিল। তাতে খুব ছোট ছোট অক্ষরে কি যেন লেখা। কার্ডখানা চোখের কাছে নিয়ে সুব্রত পড়লে–
বন্ধু, কালো ভ্রমরের হুল শুধু হুলই নয়, এতে বিষের জ্বালাও আছে। সেই বিষ একবার শরীরে ঢুকলে আর নামে না। সাবধান!
১২. আবার যাত্রা শুরু
পিনটা কালো রংয়ের– দেখতে একটা মোটা বেলের কাঁটার মতই। তার এক দিক সূচের আগার মত তীক্ষ্ণ ও ধারালো, অন্য দিকটা ভোঁতা। পিনটা যেখানে বিধেছিল, সেখানে হাত বুলোতে বুলোতে সুব্রত কাতর স্বরে বললো, উঃ, এখনও জ্বালা করছে!
ট্যাক্সিটা তখনও হ্যারিসন রোড ধরে পুবদিকে ছুটে চলেছে। ট্যাক্সিচালক মুখ ফিরিয়ে শুধাল, আমহাস্ট স্ট্রীট মে কিধার বাবুসাব?
তুমি চল। আমি বলব খন। কিরীটী ড্রাইভারের দিকে চেয়ে বলল।
হ্যারিসন রোড ও আমহাস্ট স্ট্রীটের সংযোগস্থলে এসে কিরীটী ড্রাইভারকে বললে, গাড়ির মোড় ফিরিয়ে আমহার্স্ট স্ট্রীট ধরে এগিয়ে যেতে।
সুব্রতদের আমহার্স্ট স্ট্রীটের বাড়িতে পৌঁছে কিরীটী সেখানে খানিকক্ষণ বিশ্রাম করল। তারপর বিকেলের দিকে আবার আসবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাস্তায় গিয়ে নামল।
বেলা প্রায় তখন দেড়টা হবে। আবার যাত্রার উদ্যোগে সুব্রত একটা একটা করে আবশ্যকীয় জিনিসপত্র রাজুর দিকে এগিয়ে দিচ্ছে, আর রাজু সেগুলো একটা চামড়ার সুটকেসের মধ্যে সাজিয়ে-গুছিয়ে ভরে রাখছে।
একটা বড় তোয়ালে ভাঁজ করে সুটকেসের মধ্যে রাখতে রাখতে একসময় রাজু বললে, কিন্তু তোমরা যতই বল ভাই, মনের মধ্যে থেকে কিছুতেই যেন আমি সাড়া পাচ্ছি না সুব্রত। সনৎদা এখানে পড়ে রইল, আমরা চলেছি রেঙ্গুনের দিকে। এমনি ভাবে বৃথা অতদূর ছুটে গিয়ে যে কি লাভ হবে, তা মিঃ রায়ই জানেন।
সুব্রতও মন থেকে সায় পাচ্ছিল না। সে বললে, মিঃ রায়ের মত তো শুনলে।
শুনলাম তো, যা ভাল বোঝ কর। তিনি নিশ্চয়ই ভাল বুঝেই রেঙ্গনে চলেছেন।
এমন সময় মা এসে ঘরে ঢুকলেন, বললেন, হ্যাঁ রে, তা হলে সত্যিই কাল ভোরের জাহাজেই আবার তোরা সেই মগের মুল্লকে চললি?
এখন পর্যন্ত তো তাই ঠিক মা, তবে জাহাজে চাপবার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত বলা যায় না।
কিন্তু সনৎ-এর তো কোন খোঁজখবর মিলল না!
খোঁজ পাওয়া গেছে মা। সনৎদা প্রাণে বেচে আছে, এই পর্যত জেনে রাখ।
আহা, বেচে আছে তো? ঠিক খবর পেয়েছিস তো?
হ্যাঁ, মা। মিঃ রায় খবর এনেছেন।
আহা, ভগবান তার ভাল করন। বলতে বলতে মার চোখের কোণ দুটি অশ্রুসজল হয়ে উঠল। তিনি আবার বললেন, কোথায় তিনি তার দেখা পেলেন?
তা তো জানি নে মা, জিজ্ঞাসা করিনি সে কথা।
তা বাছাকে আমার নিয়ে এল না কেন?
সুব্রত মার কথায় মৃদু হেসে বলল, তারা ছেড়ে দেবে বলে তো আর কত কষ্ট করে চুরি করে নিয়ে যায়নি মা?
তা সে এইখানে পড়ে রইল, আর তোরা চললি রেঙ্গুনে?
ভয় নেই মা, এখানে থেকে তাকে উদ্ধার করা যাবে না, তাই আমরা রেঙ্গুন যাচ্ছি কাল।
হঠাৎ সকলে ঘরের মধ্যে অন্য একজনের কণ্ঠস্বর শুনে চমকে ফিরে তাকায়। দেখলে দরজার কপাটে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে কিরীটী রায়।
রাজু বললে, মিঃ রায়, কতক্ষণ এসেছেন?
কিরীটী ঘরের মধ্যে ঢুকে এগিয়ে আসতে আসতে বললে, আপনাদের সকলেরই মনে একটা সংশয় জেগেছে যে, সনৎবাবু এখানে পড়ে রইলেন, অথচ আমরা বর্মা চলেছি। আমার কথা যদি বিশ্বাস করতে না পারেন, তবে এইটকুই এখন শুধু জেনে রাখুন যে, সনৎবাবুকে যেমন করেই হোক ওরা কালকে রেঙ্গুনগামী জাহাজে তুলবেই। আমি আপনাদের আগেও বলেছি, এখনও বলছি কালো ভ্রমর যেমনি শয়তান তার চাইতেও ঢের বেশী তীক্ষ্ণধী। তার ওপর আরও একটা কথা হচ্ছে এই যে, সনৎবাবুকে ওরা প্রাণে মারবে না। তাই সনৎবাবু যেখানেই থাকুন না কেন, আমাদের দুর্ভাবনার আপাততঃ তেমন কিছু নেই। কালো ভ্রমর দুধর্ষ হলেও তার শত্রুর অভাব নেই, এমনি দুনিয়ার নিয়ম। এই দেখুন—বলতে বলতে কিরীটী জামার পকেট থেকে সেই সকালের ১৮নং বাড়িতে পাওয়া সাংকেতিক কাগজখানা বের করে সকলের চোখের সামনে ধরল।
সুব্রত ও রাজু উভয়েই একান্ত কৌতুহলে দেখি দেখি বলে কাগজটার ওপরে ঝুকে পড়ল।
কিরীটী আবার বলতে লাগল, সমস্ত জীবনভরে কালো ভ্রমর হয়তো প্রভূত অর্থ সংগ্রহ করেছে; কিন্তু তা থেকে তার ভোগে একটি পাইপয়সাও বোধ হয় লাগাতে পারেনি। আজ পর্যন্ত যতদিন সে বেচে আছে এবং ভবিষ্যতে আরও যতদিন সে বেচে থাকবে, সে শুধু সেই সংগৃহীত অর্থ যক্ষের মত আগলেই থাকবে। এ জীবনের অর্থপিপাসা মত্যুর পরও হয়তো তাকে এই পৃথিবীর মাটির বুকে টেনে আনবে। যে হাহাকার নিয়ে সে সারাজীবন কাটিয়ে গেল, সেই হাহাকারই থেকে যাবে তার বায়ভূত দেহে!
কিরীটীর কথাগুলো যেমনি দরদভরা তেমনি সতেজ। সকলেই বিস্ময়বিমুগ্ধ হয়ে কথাগুলো শুনছিল, উত্তরে কেউ একটি কথাও বলতে পারে না।
রাজু বললে, আমি কটা দিনই বা ওদের দলে ছিলাম, কিন্তু যে দলের সর্দার, তার দেখা মাত্র একবারের বেশী দুবার মেলেনি, তাও ছদ্মবেশে মুখোশের অন্তরালে অন্ধকার ঘরে। শুনেছি ওদের দলের কেউ নাকি আজ পর্যন্ত সর্দারকে স্বাভাবিক বেশে একদিনও দেখেনি। সে হরেক রকমের রুপ ধরে সকলের মাঝে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, পাশে থেকেই তার হকুম চালায় সকলের ওপরে, অথচ তাকে দেখলেও চেনা যায় না। একটা কথা ওদের মুখে আমি বরাবর শুনেছি, সর্দারকে নাকি রাত্রি ছাড়া দিনের আলোয় আজ পর্যন্ত কেউই দেখেনি এবং তাও ছদ্মবেশে। যে মুহতে দিনের আলো নিভে গিয়ে রাতের অন্ধকার চারিদিকে নেমে আসে, ঠিক সেই মুহূর্তে সর্দারও তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। আবার যেমনি পুব আকাশে ভোরের আলো প্রকাশ পায়, সর্দার যে কোন ফাঁকে কোথা দিয়ে আপনাকে লুকিয়ে ফেলে, শত চেষ্টা করেও আজ পর্যন্ত কেউ তা ধরতে পারেনি।
***
রাত্রি দশটা হবে।
আকাশ বেশ পরিষ্কার। কালো আকাশের কোলে—দূরে, অনেক দূরে মেঘপুরীর বাতায়নে যেন তারার প্রদীপ জালিয়েছে। তারই আলো সৃষ্টি করেছে পৃথিবী ও আকাশের মাঝে এক অপূর্ব আলো-ছায়াঘেরা পথ। ওপরে একখানা মাদুর পেতে মার পাশে বসে সুব্রত ও রাজু আসন্ন বিদেশযাত্রা সম্বন্ধে নানা গল্প করছে।
সনৎদার বাড়ির সেই সন্ধ্যার কথা মনে পড়ছে, রাজু? সেই ড্রাগন– কালো ভ্রমরের মৃত্যুদূত! একসময় বললে সুব্রত।
রাজু হাসতে হাসতে বললে, মনে নেই আবার? কিন্তু যাই বল, ড্রাগনের সত্যসত্যই ক্ষমতা আছে বলতে হবে। অন্য কোন ক্ষমতা না থাকলেও আকর্ষণী ক্ষমতা যে আছে—সে বিষয়ে একেবারে নিঃসন্দেহ!
হু, ক্ষমতা আছে বৈকি। কিন্তু একজনের কথা আমার বারবারই মনে হচ্ছে রাজু। সেবার আমাদের বিদেশযাত্রার সময় এমন একজন বন্ধু ছিলেন আমাদের পাশে পাশে সর্বদা, যাঁর সদাসতর্হ স্নেহদৃষ্টি সারাক্ষণ আমাদের নিরাপদে রেখেছিল। তিনি না থাকলে সেই মগের মুল্লক থেকে ফিরে এসে বাংলার মাটিতে পা দেওয়া হয়ত এ জীবনে আর আমাদের কারোরই ঘটে উঠত কিনা সন্দেহ। আবার সেই বিদেশের পথে চলেছি। সেবার যেমন অচেনা ছিল, এবারেও ঠিক তাই। সেদিনকার সেই পরম বন্ধুটি আজ আর আমাদের সঙ্গে নেই। এ পৃথিবী হতে তিনি চিরবিদায় নিয়ে গেছেন। আর সত্যি সত্যি কথা বলতে গেলে সেজন্য দায়ী তো আমরাই।…
শেষের দিকে সুব্রতর কণ্ঠস্বর যেন বুজে এল অশ্রুতে।
সত্যি, অমরবাবুর ঋণ আমরা আর এ জীবনে শোধ করার সুযোগ পেলাম না। রাজু বললে।
***
তখনও রাতের আকাশ থেকে ভাল করে আঁধারের ঘোর কেটে যায়নি। সবেমাত্র পুবদিক লালচে আভায় রঙিন হয়ে উঠতে শুরু করেছে।
সুব্রতর ঘুমটা ভেঙে গেল রাজুর ডাকে। রাজু ডাকছিল, এই সুব্রত, ওঠ ওঠ। কত রবি জলে রে, কে বা আঁখি মেলে রে! এরপর ব্যায়াম করবিই বা কখন, আর যাবিই বা কখন? জাহাজের সময় তো হয়ে এল।
সুব্রত চোখ রগড়াতে রগড়াতে উঠে বসল। পাশের ঘর থেকে স্টোভের গর্জন কানে আসে।
আসন্ন যাত্রার জন্য মা নিশ্চয়ই খাবার তৈরী করছেন।
সুব্রত তাড়াতাড়ি শয্যা ছেড়ে উঠে বাথরুমে গিয়ে মুখটা ধুয়ে ছাদে চলে গেল এবং খোলা বাতাসে বারবেলটা নিয়ে ব্যায়াম করতে শুরু করে দিল। তাড়াতাড়ি ব্যায়াম শেষ করে স্নানটাও সেরে নিল। স্নান শেষ করে জামাকাপড় পরে নীচের ঘরে এসে দেখে, ইতিমধ্যে কিরীটী ওদের বাড়িতে পৌঁছে গেছে।
কিরীটীবাবু এসে গেছেন দেখছি!
আগের দিন কথা হয়েছিল যে সকলে মিলে সুব্রতদের বাড়ি থেকে রওনা হবে।
কিরীটী বলে, হ্যাঁ, জাহাজের আর বেশী দেরি নেই, একটু তাড়াতাড়ি করুন।
অদূরে একটা মোড়া পেতে রাজ, বসেছিল। সে ইতিমধ্যেই প্রস্তুত হয়ে নিয়েছিল।
মা গরম গরম লুচি ভেজে একটা পাত্রে রাখছিলেন। সকলে মিলে সেগুলোর সৎকার করতে লেগে গেল।
মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সকলে এসে গাড়িতে চেপে জাহাজঘাটে এসে পৌঁছে দেখলে, জাহাজ ছাড়তে তখন আর বেশী দেরি নেই। জাহাজের ঘন ঘন হুইসেল চারিদিক প্রকম্পিত করে তুলছে। যাত্রী এবং তাদের আত্মীয়স্বজনে জাহাজঘাটে বেশ ভিড়।
একটা সেকেণ্ড ক্লাস কেবিন রিজার্ভ করা হয়েছিল। সুব্রত, কিরীটী, রাজু ও চাকর জংলী সিঁড়ি বেয়ে জাহাজে গিয়ে উঠল।
নির্দিষ্ট সময়েই জাহাজ ভোঁ দিতে দিতে জেটি ছেড়ে এগিয়ে চলল।
নবোদিত সূর্যের রঙিন আলোয় গঙ্গার ছোট ছোট ঢেউগুলি যেন গলিত রুপোর মতই ঝকঝক করে জলছে।
গঙ্গাবক্ষ থেকে বয়ে আসছে প্রথম ভোরের ঠাণ্ডা হাওয়া মৃদু মৃদু যেন স্নেহের স্নিগ্ধ করপ্রলেপ কারও।
নির্মেঘ নীলাকাশ সূর্যালোকে যেন ঝলমল করছে।
বর্ষার গঙ্গার গৈরিক জলরাশি ভেদ করে ধীরে মন্থরগতিতে জাহাজ এগিয়ে চলেছে। গঙ্গার দুপাশে সদ্য ঘুম ভাঙার সাড়া পড়ে গেছে। এদিকওদিকে বড় জাহাজ নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে আছে। ছোট স্টীমলঞ্চগুলো এদিকওদিক যাতায়াত করে। ছোট বড় নানা আকারের নৌকো অনেক দেখা যায়। মাঝে মাঝে শোনা যায় জাহাজের ইঞ্জিনঘরের ঘণ্টা।
রাতের রহস্যজনক অন্ধকার কেটে গিয়ে আবার নতুন দিনের যাত্রা হয় শুরু। দিনের শেষে ঘুমের দেশের পথের বাঁকে সাঁঝের আঁধার আবার বিদায় নেয় শেষদিনের আলোর কাছে। রাত্রি আবার ফিরে আসে তার রহস্য নিয়ে।
এই তো নিয়ম।
আকাশের প্রতি গ্রহতারাও এগিয়ে চলেছে অনন্ত যাত্রাপথে। মানুষও তেমনি দিনের পর দিন, রাত্রির পর রাত্রি তাদের নব নব যাত্রার পথে এগিয়ে চলেছে।
কালো ভ্রমর ওদের ডাক দিয়েছে।
সুব্রত ভাবে : কালো ভ্রমর!
কিরীটী ভাবে : কালো ভ্রমর!
রাজুও ভাবে : কালো ভ্রমর!
ডেকের উপর রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে কিরীটী, সুব্রত ও রাজু ক্রমবিলীয়মান কূলের দিকে চেয়ে।
কিরীটী বললে একসময়, মাটি আর জলের মধ্যে যেন একটা স্নেহের বাঁধন আছে সুব্রতবাবু। দেখুন কূলের মাটি যেন বুক পেতে দিয়েছে জলের স্পর্শটুকু পেতে।
জাহাজ কূল ছেড়ে অনেকখানি এগিয়ে চলে। ক্রমে বজবজ উলুবেড়িয়া পশ্চাতে পড়ে গেল।
হঠাৎ একসময় সুব্রত রাজুর দিকে ফিরে বললে, গেলবার নীতীশটা আমাদের সঙ্গে ছিল।
এবারেও নীতীশকে চিঠি দিয়ে নিয়ে এলে হত!
এখন তো সে হোস্টেলে থাকে না, রাধানগরে তার মামার ওখানে থাকে। ওদের রাধানগরের বাসার ঠিকানাও আমার জানা নেই। সুব্ৰত জবাব দেয়।
১৩. ডাঃ সান্যাল
পরের দিন।
সন্ধ্যা হতে তখন আর খুব বেশী দেরি নেই। সাগরের কালো জলে– সাঁঝের ধূসর ছায়া ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে। মেঘপুরীর বাতায়নে বাতায়নে সবেমাত্র দিগাঙ্গনারা দু-একটি করে তারার প্রদীপ জ্বালিয়ে গেল বুঝি।
বঙ্গোপসাগরের উত্তাল জলরাশির ওপর দিয়ে ঢেউয়ের তালে তালে নেচে চলেছে বিরাট অর্ণবপোত কত যাত্রী বুকে নিয়ে!
সাগরের বুক থেকে কেমন একটা যেন ঠাণ্ডা হাওয়া আসে, শীত-শীত করলেও তা বেশ আরামদায়ক।
ডেকে সেই বিকেল চারটে হতে এতক্ষণ পর্যন্ত অনেক যাত্রীই সাগরের সান্ধ্যশোভা উপভোগ করছিল। সবাই এখন কেবিনে চলে গেছে; শুধু যায়নি কিরীটী সুব্রত, রাজু ও একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক।
ভদ্রলোকের চেহারা যেমন প্রশান্ত, তেমনি ধীর ও গম্ভীর, দার্শনিকের মত এলোমেলো কাঁচা-পাকা চুল, চোখে একজোড়া সোনার ফ্রেমের চশমা। পরনে একটা ঢোলা জাপানী সিল্কের পায়জামা। গায়ে স্ট্রাইপ-দেওয়া কিমনো। সেলুন ডেকের উপর পাতা একটা বেতের চেয়ারে হেলান দিয়ে ভদ্রলোক এতক্ষণ গভীর মনোযোগ দিয়ে একটা কি মোটা ইংরাজী বই পড়ছিলেন। ডেকের ওপর সমবেত বহু লোকজনের নানা জাতীয় কণ্ঠস্বরে একটিবারের জন্যও তাঁর মনযোগ নষ্ট হয়নি।
সাঁঝের আঁধার গাঢ় হয়ে আসবার সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোক হাতের বইখানি মুড়ে সামনের অস্পষ্ট আলো-ছায়াঘেরা সাগরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন।
কিরীটী আপনমনে গুনগুন করে গাইছিল—
বনের ছায়ায়, জল ছল ছল সুরে
হৃদয় আমার, কানায় কানায় পুরে
ক্ষণে ক্ষণে ঐ গুরুগুরু তালে তালে
গগনে গগনে গভীর মৃদঙ্গ বাজে
আমার দিন ফুরাল!
সহসা কিরীটী চমকে উঠল। ঠিক পাশ থেকে কে যেন বললে, চমৎকার গলাটি তো আপনার! যেমন মিষ্টি, তেমনি দরদভরা। আহা, থামলেন কেন? শেষ করুন না গানটা?
কিরীটী মুখ ফিরিয়ে দেখে কথা বলছেন সেই প্রৌঢ় ভদ্রলোকটি, যিনি এতক্ষণ নিবিষ্ট মনে বই পড়ছিলেন।
আপত্তি যদি না থাকে, তাহলে শেষ করুন গানটা। ভদ্রলোক পুনরাবৃত্তি করলেন।
কিরীটী মৃদু হাসলেন, তারপর ধীরে ধীরে আবার শুরু করে–
কোন দূরের মানুষ এল আজ কাছে।
মনের আড়ালে নীরবে দাঁড়ায়ে আছে!
সত্যি, কিরীটীর গলাটি ভারী মিষ্টি!
কিরীটী তিন-চারবার সমগ্র গানটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গেয়ে থামল।
ভদ্রলোক বললেন, সত্যি বড় ভাল লাগল আপনার গান। বসেছিলাম ওখানটায়, হঠাৎ গানের সুর কানে যেতেই উঠে এসেছি।
কথা বলতে বলতে ভদ্রলোক যেন কেমন একটু অনিমনা হয়ে যান। তারপর আবার ধীরে ধীরে বলে চললেন, সংসারের কোলাহল, জীবনের নানা ত্রুটি বিচ্যুতি, প্রতিহিংসা, কর্তব্য-অকর্তব্য—সব যেন মুহূর্তে ভুলিয়ে দেয় এই গানের সুর। গানের সুরে আমি ভুলে যাই আমার নিজেকে।..কেউ বোঝে না, কেউ জানে না, কত দুঃখ আমার সমস্ত বুকখানায় জমাট বেধে আছে।
আমি কাঁদতে চাই; কিন্তু কই, কাঁদতে যে পারি না!…শেষের কথাগুলো যেন অনেকটা স্বগতোক্তির মতই শোনায় এবং শেষদিকে ভদ্রলোকের গলার আওয়াজও ক্রমে যেন ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয়ে জড়িয়ে যায়।
সহসা ভদ্রলোক আরও কি বলতে বলতে যেন চমকে উঠে থেমে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলেন। তারপর এক টুকরা মৃদু হাসিতে মুখখানি ভরিয়ে বললেন, কিছু মনে করবেন না যেন; আমার কেমন একটা স্বভাব যে কথা বলতে বলতে হঠাৎ এমনি অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি..আপনারাও বুঝি বর্মাতেই চলেছেন?
হ্যাঁ। সুব্রত ও কিরীটী একসঙ্গেই জবাব দিল।
বেড়াতে? না অন্য কোন কাজে? ভদ্রলোক ফিরে প্রশ্ন করলেন।
না, ঠিক বিশেষ কোন কাজেও নয়—আবার কাজেও বটে। আমাদের এক ছেলেবেলার বন্ধু ওখানে থাকে। অনেকদিন থেকে সে আমাদের তার ওখানে যাওয়ার জন্য লিখছিল, কিন্তু যাওয়া আর হয়ে ওঠে না। সময়ের অভাব। এখন পরীক্ষা হয়ে গেছে, সামনে লম্বা ছুটি। ভাবলাম বিদেশ বেড়াবার এই তো সুযোগ। তাই রওনা হয়ে পড়া গেল।
বেশ বেশ। পাশ্চাত্ত্য দেশের ছেলেমেয়েরা ছুটির সময় কখনও আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের মত দিনদুপুরে পড়ে পড়ে শুধু ঘুমিয়ে অথবা আড্ডা দিয়ে দিনগুলো কাটায় না—দেশে দেশে ঘুরে বেড়ায়।…মন ওদের বহুমুখী। দিবারাত্র অজানা ও অচেনার হাতছানি ওদের দেহ ও মনকে আকুল করে। নিত্য নতুনকে জানবার জন্য ওদের দেহ ও মনে ইচ্ছার অন্ত নেই। ঘরের চাইতে ওরা পথকেই ভালবাসে, তাই তো ওরা ঘরের বাধন ছিড়ে সাতসমুদ্র তেরো নদী ডিঙিয়ে দিকে দিকে ছোটে। কখনও আকাশপোতে চেপে সুদূরের পথে পাড়ি জমায়, কখনও বা সাঁতার কেটে দুরন্ত সাগর পার হয়, কিংবা সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গের উদ্দেশে অভিযান চালায়। ওরা এমনি দুরন্ত, এমনি দুর্বার, এমনি সদা-চঞ্চল। জীবন আর মরণ তো ওদের কাছে ছেলেখেলা। আর আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা দেখুন, সযতনে জীবনীশক্তিকে বাঁচিয়ে চলতে গিয়ে প্রতি মুহূর্তে জীবনকে ক্ষয় করে ফেলে। ছোটবেলার কথা আমার এখনও বেশ মনে পড়ে। স্কুলের ছুটি হলেই বাবা আমাকে নিয়ে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতেন। খুব ছোট বয়সেই মাকে হারাই, সংসারে আমরা দুটি ভাই-বোন, বাবাকেই শুধু জানতাম ও চিনতাম। বলতে বলতে ভদ্রলোক আবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন।
আপনিও রেঙ্গুনে চলেছেন বুঝি? সহসা কিরীটী প্রশ্ন করে।
রেঙ্গুনে আমি প্র্যাকটিস করি। আমার নাম সৌরেন্দ্র সান্যাল। সকলে আমায় ডাক্তার সান্যাল বলে ডাকেন। জন্ম হতেই আমি রেঙ্গুনে, বাবার মস্ত বড় ব্যবসা ছিল রেঙ্গুনে।
বাড়িতে আপনার আর কে কে আছেন?
কেউ না। আমি নিজে ও আমাদের এক পুরনো চাকর ভোলা। একটিমাত্র বোন ছিল, আমার চাইতে বয়সে প্রায় দশ বৎসরের বড়, তা তিনিও অনেকদিন হল আমার মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন। আর কোন বন্ধনেরই বালাই নেই—একা। ছোটবেলায় মা মরে যাবার পর দিদিই আমায় বুকে-পিঠে করে মানুষ করেছিলেন মায়ের মত করে।
আচ্ছা, রেঙ্গুন শহরটা আপনার কেমন লাগে ডাক্তার সান্যাল? প্রশ্ন করল কিরীটী।
জন্ম হতেই ওখানে আছি। দীর্ঘদিনের পরিচয় ঐ শহরের প্রতি ধুলিকণার সঙ্গে, কেমন যেন একটা মায়ার বাঁধন গড়ে উঠেছে।
বাংলাদেশে কি কোনও দিন আর ফিরবেন না?
ফিরব নিশ্চয়ই, অন্ততঃ মনে মনে সেই আশাই তো রাখি। চির শস্যশ্যামল, দোয়েল শ্যামার কলকাকলী-মুখরিত আমার বাংলাদেশ। ওরই শীতল মাটির বুকে যেন আমার শেষ শয্যা রচনা করতে পারি—এটাই আমার জীবনের শেষ সাধ। কিন্তু মৃত্যু তো কারও ইচ্ছার উপর নির্ভর করে না। যদি বর্মার মাটির কোলেই আমার জীবনের শেষের দিনটি ঘনিয়ে আসে, তবে কি আর করব বলুন?…কিন্তু দেখেছেন, নিজের কথাতে মশগুল হয়ে আছি। আপনাদের পরিচয়টি পর্যন্ত নেবার কথা মনে নেই।
কিরীটী মৃদু হেসে বলল, আমার নাম ধূর্জটি রায়, এর নাম সত্যব্রত সেন, আর ওর নাম জীবেন্দ্রপ্রসাদ রায়। আমরা সকলেই স্টুডেন্ট।
ইচ্ছা করেই কিরীটী নিজেদের নাম ও পরিচয়ের মধ্যে খানিকটা গোপনতার আশ্রয় নিল।
বেশ বেশ, আপনারা যখন বন্ধুর ডাকে চলেছেন, তখন ওখানে গিয়ে সেই বন্ধুর বাড়িতেই তো উঠবেন। যাবেন আমার ওখানে, ভুলবেন না তো? কমিশনার রোডেই আমার বাড়ি, তাছাড়া যাকে জিজ্ঞেস করবেন, সে-ই ডাঃ সান্যালের বাড়ি দেখিয়ে দেবে। ডাক্তার থামলেন।
নিশ্চয়ই যাব, বিশেষ করে যখন পরিচয় হয়ে গেল। কিরীটী জবাব দেয়।
রাত্রি বোধ করি আটটা হবে। কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি। বিশ্বচরাচরে কালো আঁধার ছড়িয়ে পড়েছে।
জাহাজের সার্চলাইট সমুদ্রের কালো জলে বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। মাঝে মাঝে সেই আলো সমুদ্রবক্ষে চারিদিকে ঘোরানো হচ্ছে।
কিছুক্ষণ আগে থেকেই কিরীটী লক্ষ্য করছিল, ডাক্তার সান্যাল কেমন যেন একটু চঞ্চল হয়ে উঠেছেন।
সুব্রত প্রশ্ন করলে, আপনার শরীরটা কি অসুস্থ ডাঃ সান্যাল?
ডাক্তার জবাব দিলেন, হ্যাঁ, না—মানে, বছরখানেক থেকে রাত্রির দিকে শরীরের মধ্যে কেমন যেন একটা অস্বস্তি অনুভব করি। মানে আমার মনে হয় যেন কারা আমার চারিপাশে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, আপন মনে কত কি বলে— আবার সময় সময় আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকে। তাদের গরম শ্বাস-প্রশ্বাসে আমার সমস্ত শরীর জ্বলতে থাকে। কত চেষ্টা করি তাদের ভুলতে, কিন্তু পারি না।…উঃ, আমি যাই—আমি যাই! বলতে বলতে ডাক্তার সান্যাল অনেকটা মাতালের মতই একরকম টলতে টলতে যেন ডেক থেকে কেবিনের দিকে চলে গেলেন দ্রুত চঞ্চল পদবিক্ষেপে।
সুব্রতরা আশ্চর্য হয়ে ডাক্তারের গমনপথের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।
১৪. সলিল সমাধি
গভীর রাত্রি।
সুব্রত আর রাজু অঘোরে ঘুমিয়ে।
অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই ঘুম এল না বলে কিরীটী শয্যা হতে উঠে বসল। স্লিপিং গাউনটা গায়ে চাপিয়ে কেবিনের দরজাটা খুলে সে বেরিয়ে এল এবং আস্তে আস্তে সেলুন ডেকের দিকে চলল।
ডেকের কাছাকাছি আসতেই হাওয়াইন গিটারের একটা মধুর বাজনার শব্দ কানে এল।
কিরীটী ক্ষণিকের জন্য থমকে দাঁড়াল।
ডেকের ওপর যে আলোটা রয়েছে সেটা খুব শক্তিশালী নয়। সেই ম্রিয়মাণ আলোয় ডেকের ওপর এক অপূর্ব আলো-ছায়ার সময় হয়েছে।
সেই আলো-ছায়া-ঘেরা ডেকের ওধার থেকেই বাজনার অপূর্ব আওয়াজটা ভেসে আসে।
কিরীটী পায়ে পায়ে ডেকের ওপর এসে দাঁড়াল।
নিশীথের নিঝুম আঁধারে সাগরবক্ষ থেকে অপূর্ব এক গুমগুম শব্দ ভেসে আসে।
মাথার ওপর তারায় ভরা আকাশের ছায়া সমুদ্রের বুকে ঢেউয়ের মাথায় কেঁপে কেঁপে ওঠে যেন।
বিচিত্র! অপূর্ব!
চারিদিকে ঘুমের ছোঁয়ায় সব বুঝি নিঝুম হয়ে গেছে। সেই অতল মৌনতার মাঝে গিটারে মধুর বাজনা স্বপ্নালোক থেকে যেন ভেসে আসছে বলেই মনে হয়। এ বুঝি কোন ব্যথিতের বুকছরা কান্না নিশীথ রাতের মৌনতার বুকে হাহাকার জাগিয়ে তুলছে।
রেলিংয়ের কোল ঘেষে যে চেয়ারখানা রয়েছে, কে যেন তার ওপর বসে আপন মনে গিটার বাজাচ্ছে।
কিরীটী পায়ে পায়ে চেয়ারের ঠিক পিছনটিতে এগিয়ে এসে দেখে—এ কি, এ যে ডাক্তার সান্যাল?
কিরীটী সবিস্ময়ে নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। শুনতে লাগল বাজনা।
অনেকক্ষণ বাজিয়ে বাজিয়ে ডাক্তার একসময় বাজনাটা কোলের ওপর নামিয়ে রাখলেন।
আর একটু পরে কিরীটী আস্তে আস্তে ডাকলে, ডাক্তার সান্যাল!
কে? বলে ডাক্তার ফিরে তাকালেন। ধূর্জটিবাবু! ঘুমোননি?
না। বলে কিরীটী একটু মৃদু হাসল, তারপর বললে, আপনিও তো দেখছি ঘুমোননি!
না। অন্ধকার আমার বড় ভাল লাগে। অন্ধকার রাতে একা একা চুপটি করে বসে থাকলে মনটা যেন কানায় কানায় ভরে ওঠে। যেন নিজেকে খুঁজে পাই।
আপনার বাজনার হাত বড় চমৎকার। কতক্ষণ থেকে যে আপনার বাজনা শুনছি!
ডাক্তার কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে মৃদু মৃদু হাসতে লাগলেন, কিছু, বললেন না।
ডাক্তারের কেবিনটা একেবারে জাহাজের ঐ ধারে। একসময় ডাক্তার বিদায় নিয়ে কেবিনের দিকে চলে গেলেন।
কিরীটী কিন্তু তার পরেও অনেকক্ষণ ডেকের ওপর ঘুরে ঘুরে বেড়াল। রাতের অন্ধকারে সমুদ্রের বুকে ঢেউগুলো ভেঙে ভেঙে গড়িয়ে পড়ছে। ঢেউয়ের বুকে সাদা সাদা ফেনা ফসফরাসের আলোয় যেন শুভ্র রজনীগন্ধার স্তবকের মতই মনে হয়। হাতের ঘড়ির দিকে চেয়ে কিরীটী দেখল রাত্রি তখন দেড়টা। আর বেশীক্ষণ জাগলে শরীর খারাপ হবে ভেবে কিরীটী কেবিনের দিকে পা বাড়াল।
কেবিনের দরজার কাছাকাছি আসতেই একটা অস্পষ্ট শিস শোনা গেল। কিরীটী থমকে দাঁড়াল।
আবার একটা শিস শোনা গেল। এবারের শিসটা আগের চাইতেও অনেক স্পষ্ট।
আবার একটা শিস!
পর পর তিনটে শিস শোনা গেল। কিরীটীর আর কেবিনে ঢোকা হল না। আন্দাজে ভর করে শিসের আওয়াজটা যেদিক হতে আসছে, প্রথমে সেইদিকেই সে এগিয়ে গেল। তারপর আবার যেন কি ভেবে ফিরে গিয়ে কেবিনে প্রবেশ করে সুটকেস থেকে টর্চটা নিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে এল।
দোতলার ডেকের সিঁড়িটা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে কতকগুলো প্যাকিং-করা কাঠের বাক্স স্তুপাকারে সাজানো রয়েছে। তারই ওধার থেকে কাদের যেন তর্কবিতর্কের চাপা স্বর শোনা গেল।
কিরীটী বিস্ময় ও কৌতুহলে প্যাকিং-করা বাক্সগুলোর আড়ালে এগোতে এগোতে কথাগুলো শুনতে পেল–
এখনও বল, সেই নোট-বইটা কি করেছিস? বক্তার কণ্ঠে কঠিন আদেশের সুর।
জানি না—আমি জানি না। কার যেন কাতরোক্তি শোনা গেল।
হ্যাঁ জানিস। আমার কালো ঢোলা জামাটার পকেটে ছিল। সেদিন রাতে সু ফ্যাক্টরীর মধ্যে জামাটা একটা লোহার গায়ে ঝুলিয়ে রেখে ঘুমিয়েছিলাম, সে কথা তো তুই ছাড়া আর কেউ জানত না।…ভোরবেলা উঠে পকেটে আর নোটবইটা পাইনি। পরের দিন নানা গোলমালে ছিলাম, সেজন্য ওদিকে নজর দিতে পারিনি। তুই ভেবেছিলি খুব আমার চোখে ধুলো দিলি, না?
অন্য পক্ষ বোধ হয় চুপ করে রইল, কোনো জবাব শোনা গেল না।
গর্দভ! তুই আমার চোখে ধুলো দিবি? সেই লোকটা যেন কাউকে আদেশ দিল—এই, বুকে হুল ফোটা!
পরমুহতেই একটা অস্পষ্ট যন্ত্রণাকাতর শব্দ নিশীথের অন্ধকারে জেগে উঠল।
উঃ, লোকটা কি পিশাচ!
উঃ! থাম, থাম, ফোটাসনি, বলছি বলছি।
বল।
লোকটা বোধ হয় গভীর যন্ত্রণায় হাঁপাতে থাকে।
***
কিরীটী বাক্সগুলোর গায়ে গায়ে পা দিয়ে উঠতে লাগল। ওপাশের একটা আলোর খানিকটা রশ্মি তির্যকভাবে এদিকে এসে পড়েছে। সেই মৃদু আলোয় কিরীটী দেখলে—সেখানে তিনজন লোক।
একজনের হাত-পা বেধে একপাশে ফেলে রেখে দেওয়া হয়েছে। আর দুজন এক পাশে দাঁড়িয়ে।
হাত-পা-বাঁধা লোকটা বললে, আমার কাছে নোট-বইটা আছে বটে, কিন্তু তার ভিতরে যে একটা ছক আঁকা কাগজ ছিল, সেটা নেই।
কি করেছিস সে কাগজটা?
লোকটা তখন ভয়ে ভয়ে—সেদিন কেমন করে তার হাত থেকে ১৮নং বাড়িতে সেই সাংকেতিক কাগজটা চুরি হয়ে গিয়েছিল, সে-সব কথা একে একে খুলে বললে।
কেন তুই আমার নোট-বুক চুরি করেছিলি?
তুমি কে—আজ ছ বছর তোমার পাশে আছি, তোমার সমস্ত আদেশ নীরবে বিনা বিচরে সবদা মাথা পেতে নিয়েছি, পালন করছি, তোমারই আদেশে কতদিন নিশ্চিত মৃত্যুর মধ্যে বিনা দ্বিধায় ঝাঁপ দিয়ে পড়েছি, কিন্তু যার জন্য দিবারাত্র এমনি করে জীবন-মত্যু নিয়ে ছিনিমিনি খেলে চলেছি সে যে কে— আজ পর্যন্ত হাজার চেষ্টাতেও তা জানতে পারিনি। তোমার ধন-সম্পত্তির ওপরে আমার এতটুকুও লোভ নেই, কেননা তুমি তো না চাইতেই যথেষ্ট দাও। আমি জানতে চাই—তুমি কে তুমি কে? লোকটা বলতে বলতে গভীর উত্তেজনায় হাঁপাতে লাগল।
যে দুজন দাঁড়িয়েছিল, তাদের একজন চাপা গলায় খিল খিল করে হেসে উঠল, তারপর সহসা গম্ভীর হয়ে বললে, আমি কে? অ্যাঁ! আমি কে?… তোর দুরাকাঙক্ষাই শেষ পর্যন্ত তোর মত্যুর কারণ হল। সেই সাংকেতিক ছক আঁকা কাগজটা কে নিয়েছে তাও আমি জানি, সেটা আমি উদ্ধার করবই।
হতভাগা কিরীটী রায় আজও বুঝতে পারেনি যে, হিংস্র কেউটে সাপ নিয়ে সে খেলতে শুরু করেছে!…তোর আগেও দলের আর দুজন আমায় জানবার চেষ্টা করেছিল, শেষ পর্যন্ত তাদের সে ইচ্ছা বুকে নিয়েই মত্যুকে বরণ করতে হয়েছে।
তারপর সহসা সে পাশে দাঁড়ানো লোকটার দিকে ফিরে কঠিন নির্মম আদেশের সুরে বললে, ফেলে দে হতভাগাটাকে এখনই স্ম্রদ্রের জলে! জলের অন্ধকারে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যখন ও তিল তিল করে মত্যুর মুখে এগিয়ে যাবে, হতভাগা তখন জানতে পারবে, কে আমি! কি আমার পরিচয়!
না না, আমায় এমনি করে জলের মধ্যে ড়ুবিয়ে মেরো না। এবারের মত আমায় ক্ষমা কর, প্রতিজ্ঞা করছি, এ জীবনে আর তোমার পরিচয় জানবার চেষ্টা করব না।
আবার সেই নিষ্ঠুর হাসি।
হিংস্র হাঙরে যখন তোর দেহ ধারালো দাঁতে টুকরো টুকরো করে ছিড়ে খাবে, তখন জানবি আমি কে!
ক্ষমা কর আমায়! ক্ষমা কর!
ফেলে দে! দে!
পাশে দণ্ডায়মান লোকটি বিনা বাক্যব্যয়ে নীচু হয়ে লোকটাকে অবলীলাক্ৰমে তুলে উঁচু করে তখনই রেলিং টপকে নীচের গজমান অতল পারাপারহীন সমুদ্রগর্ভে নিক্ষেপ করল।
একটা বুক-ভাঙা আকুল চিৎকার নিশীথ রাত্রির গভীর স্তব্ধতাকে মহতের জন্য যেন আলোড়িত করে তোলে। ঝপাং করে একটা শব্দ শোনা যায় মাত্র।
সমগ্র ব্যাপারটা এত চকিত ও এত অল্প সময়ের মধ্যে ঘটে গেল যে, কিরীটী বিস্ময়ে একেবারে হতবাক হয়ে গিয়েছিল। একটা টু শব্দ পর্যন্ত তার মুখে ফুটে বের হল না। স্থাণুর মতই কিরীটী প্যাকিং বাক্সটার ওপরে দাঁড়িয়ে রইল। পা দুটো যেন পাথরের মত ভারী ও অনড় হয়ে গেছে।
কেউ জানলে না, কেউ শুনলে না, রাত্রির নিস্তব্ধ অন্ধকারে একজনের জীবন্ত সলিল সমাধি হয়ে গেল। সাগরের কালো জলের তলে চিরনিদ্রায় সে অভিভূত হল। কিরীটীর যেন দম আটকে আসে।…
হতভাগা ভেবেছিল, আমার চোখে ধূলো দেবে। কিন্তু কি করব, এ ছাড়া উপায় ছিল না। বলতে বলতে লোকটার কণ্ঠস্বর কেমন যেন জড়িয়ে আসে। তারপর যেন কতকটা জোর করেই আপনাকে সামলে নিয়ে দ্বিতীয় লোকটির দিকে ফিরে বললে, ওই লোকটাকে বরাবর মৃত্যুগুহায় নিয়ে যাবে। জাহাজে আর তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে না। বলেই লোকটা ফিরে দাঁড়াল।
ফিরে দাঁড়াতেই সামনের একটা আলোর খানিকটা বাঁকা হয়ে এসে তার মুখের উপর পড়ল।
কিরীটী বিস্ময়ে আতঙ্কে চমকে উঠল। অন্ধকারে চলতে চলতে সামনে বিকটাকার ভূত দেখলেও বুঝি মানুষ এতটা চমকে ওঠে না।
১৫. নিশাচর ভূত
চিনতে কষ্ট হয় না কিরীটীর ঐ মুহূর্তের দেখাতেই। লোকটা আর কেউ নয়, সেই চীনা আড্ডায় দেখা ভীষণ-দর্শন লোকটিই এই পৈশাচিক অনুষ্ঠানের হোতা।
কিরীটী ভাবলে, তবে আমার হিসাব ভুল হয়নি। দলের নেতা ইনিই! স্বনামধন্য দস্যুরাজ কালো ভ্রমর! হ্যাঁ, লোকটার শক্তি আছে বটে। তাহলে দস্যুরাজ আমাদেরই সহযাত্রী!
প্যাকিং করা বাক্সগুলোর আড়ালে কিরীটী স্তম্ভিত ভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল তা নিজেই বুঝতে পারেনি। যখন খেয়াল হল তখন সে আস্তে আস্তে সেখান থেকে সরে এল।
রাতও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। চোখ দুটো জালা করছে। বেশ ঘুমও পেয়েছে।
কিরীটী ধীরে ধীরে এসে কেবিনে প্রবেশ করল এবং দরজাটা বন্ধ করে শয্যার ওপরে এসে গা এলিয়ে দিল। সাগরের দোলায় দোলায় অল্পক্ষণের মধ্যেই কিরীটী ঘুমিয়ে পড়ল একসময়।
পরের দিন যখন কিরীটীর ঘুম ভাঙল, বেলা তখন প্রায় সাড়ে আটটা হবে, প্রভাতী চা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।
সুব্রত ও রাজু তখন কেবিনে ছিল না—সম্ভবত ডেকে বেড়াতে গেছে।
একটু পরেই জংলী কেবিনে ঢুকে বলল, চা বোধ হয় ঠাণ্ডা হয়ে গেছে বাবুজি!
হ্যাঁ, তাই তো দেখছি। আমি একেবারে স্নানটা সেরে আসি। বলে কিরীটী তোয়ালে ও একটা ঢোলা পায়জামা নিয়ে স্নানঘরের দিকে পা বাড়াল।
স্নান সমাপ্ত করে আসতে আসতেই ব্রেকফাস্টের ঘণ্টা শোনা গেল। ব্রেকফাস্ট সেরে আবার ওরা সকলে যখন ডেকের ওপর এল, তখন একে একে অনেক যাত্রীই ডেকের ওপর এসে জড় হতে শুরু করেছে।
একটি বছর সাতেকের মেয়ে ডেকের ওপর স্কিপিং করছিল।
ডাঃ সান্যালও ডেকেই ছিলেন। সুব্রত ও রাজু ডাঃ সান্যালের দিকে এগিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে কিরীটী যখন ওদের দলে এসে মিশল, ডাঃ সান্যাল, সুব্রত ও রাজু তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল। কিরীটী ওদের একপাশে এসে দাঁড়াল।
সুপ্রভাত! কিরীটী জবাব দিল।
একবার তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে একটু মৃদু হেসে ডাক্তার বললেন, কাল বুঝি রাতটকু আপনার না ঘুমিয়েই কেটে গেছে, মিঃ রায়?
কিরীটী আনমনা ভাবে জবাব দিল, না, বেশ ঘুম হয়েছিল তো!
আর বিশেষ কোন কথাবার্তা হল না। সবাই একমনে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইল।
চারিদিকে কেবল জল। জল আর জল। নীল জলরাশি গভীর উচ্ছাসে ঢেউয়ের তালে তালে নেচে ফিরছে। ঢেউয়ে ঢেউয়ে যেন অস্ফুট সরে কি সব বলাবলি করছ।
সুনীল আকাশ রুপালী রোদের আভায় ঝিলমিল করছে।
***
সন্ধ্যায় ডাঃ সান্যালের কেবিনে সুব্রত, রাজু ও কিরীটী চা-পান করতে করতে ডাক্তারের সঙ্গে গল্প করছিল। কেবিনের মধ্যে স্টোভে চা তৈরী হয়েছে।
ডাক্তার বলছিলেন, বিশ্বাস জিনিসটা মানুষের মনের সহজ প্রবৃত্তি। যুক্তি দিয়ে তাকে খাড়া করা যায় না। এই দেখুন না, আমি সকলকেই বিশ্বাস করি, আবার কাউকেই বিশ্বাস করি না। এক-এক সময় আমাদের এক-একটা ব্যাপারে বিশ্বাস না করা ছাড়া আর উপায়ই থাকে না। মন না মানলেও আমরা তাকে মেনে নিতে বাধ্য হই। তেমনি প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই দুরকমের প্রবৃত্তি ঘুমিয়ে থাকে। অতি বড় শয়তান যে, তার বুকেও ভাল প্রবৃত্তি আছে। আবার সত্যসত্যই যে অতি নিরীহ ও একান্ত ধীরস্থির, তারও বুকে হয়তো শয়তানপ্রবৃত্তি ঘুমিয়ে থাকে। গাছের গোড়ায় জল ঢালতে ঢালতে যেমন সেটা ক্ৰমশঃ বড় হতে হতে শেষটায় শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে, আমাদের মনের ভিতরেও যে প্রবৃত্তিটা নিয়ে আমরা বেশী নাড়াচাড়া করি যেটাকে আমরা বেশী প্রশ্রয় দিই, সেইটাই শেষ পর্যন্ত আমাদের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। যে চোর, যে ডাকাত, তার অন্তরেও হয়তো একটা নিরীহ প্রবৃত্তি ঘুমিয়ে আছে।
কিরীটী হাসতে হাসতে বললে, কিতু দুষ্কর্ম করতে করতে দুজনের এমন একটা স্বভাব হয়ে দাঁড়ায় যে, কিছুতেই সে আর ভাল পথে চলতে চায় না। পেচা যেমন আলো পরিহার করে চলে, দুর্জনেরাও তেমনি ভাল যা কিছ, তা এড়িয়ে চলে।
আগের দিন সন্ধ্যার মত সেদিনও ডাঃ সান্যাল ক্রমশ যেন কেমন একটু চঞ্চল হয়ে উঠছিলেন। সেটা লক্ষ্য করে সুব্রত শুধাল, আপনার কি শরীর খারাপ হয়েছে, ডাঃ সান্যাল?
ডাক্তার কেমন একপ্রকার অন্যমনস্কের মত যেন জড়িয়ে জড়িয়ে বললেন, সন্ধ্যার দিকে মরফিয়া ইনজেকশন নেওয়া আমার একটা বদ অভ্যাস, আপনারা যদি কিছু মনে না করেন তবে… বলে ডাক্তার উঠে গিয়ে সুটকেস থেকে সিরিঞ্জ বের করে ইনজেকশন নেবার জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন।
সিরিঞ্জের মধ্যে ঔষধ ভরে ডান হাতটা বৈদ্যুতিক আলোর কাছে তুলে ধরে তিনি ঔষধটা শরীরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন।
সিরিঞ্জটা যথাস্থানে রেখে ডাক্তার যেন অনেকটা হৃষ্টচিত্তেই নিজের আসনে এসে উপবেশন করলেন।
ডাক্তারের সেই অস্থির-অস্থির ভাবটা ক্ৰমশঃ ঠিক হয়ে পূর্বের প্রফুল্লতা ধীরে ধীরে ফিরে আসতে লাগল।
এই দেখুন। বলতে বলতে ডাক্তার বাঁ হাতের আস্তিনটা গুটিয়ে সেটা আলোর নীচে সকলের চোখের সামনে প্রসারিত করে ধরলেন—হাতে অসংখ্য কালো কালো দাগ। একটু পরে তিনি আবার বলতে লাগলেন, দেখুন, মরফিয়া নিয়ে নিয়ে হাতটা একেবারে ভরে গেছে। কিন্তু কি করব বলুন, শরীরের মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করি সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই, আর সেই যন্ত্রণায় আমার সমগ্র শরীরটা যেন বিষের মত জ্বলতে থাকে। তাই মরফিয়া নিতে হয়।
সুব্রত প্রশ্ন করল, আচ্ছা এতে কি শরীরের কোন ক্ষতি হয় না, ডাঃ সান্যাল?
ডাক্তার হেসে বললেন, ক্ষতি হয় বৈকি। আমাদের মস্তিষ্কে যন্ত্রণাবোধের যে স্নায়ুকেন্দ্র আছে, সেখানকার স্নায়ুকোষে যন্ত্রণা-বোধ-বাহী স্নায়ু যন্ত্রণা বোধকে বহন করে নিয়ে যায় এবং তাতেই আমরা দেহের কোন না কোন স্থানে যন্ত্রণা হচ্ছে বুঝতে পারি। এ মরফিয়া সেই যন্ত্রণা-বোধ-বাহী স্নায়ুকে অবশ করে দেয়। তার ফলে যন্ত্রণা-বোধ-স্নায়ু দিয়ে যন্ত্রণাটা প্রবাহিত হয়ে মস্তিকে আর উপস্থিত হতে পারে না বলেই যন্ত্রণার উপশম হয়।
কিন্তু এইভাবে মরফিয়া নেওয়াটা কি একটা নেশা নয়?
ডাক্তার একটু হাসলেন, তারপর বললেন, নিশ্চয়ই নেশা বৈকি! নেশা…বদ অভ্যাস। বুঝতে কি আমি পারি না, পারি বুঝতে পারি সব, কেননা আমি একজন ডাক্তার। তবু নিজেকে সংযত করতে পারি না। কোন এক অদৃশ্য শক্তি যেন আমার সমস্ত দেহমনকে অন্ধকার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঐ সিরিঞ্জ ও মরফিয়ার দিকে ঠেলতে থাকে। আমি পারি না, কিছুতেই নিজেকে রোধ করে রাখতে পারি না।
ডাক্তারের মুখে একটা করুণ অসহায় ভাব ফুটে ওঠে।
রাত্রি বৃদ্ধি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিরীটীর দেহ ও মন কি জানি কেন সেই প্যাকিং-করা বাক্সগুলোর দিকে টেনে নিয়ে যেতে চায়। আকর্ষণটা কিছুতেই রোধ করতে পারে না কিরীটী, তাই গায়ে একটা ধুসর বর্ণের নিদ্রাবস্ত্র চাপিয়ে, মাথায় একটা নাইট-ক্যাপ এটে সেটাকে টেনে একেবারে কপালের নীচ পর্যন্ত নামিয়ে দিয়ে, কিরীটী কেবিন থেকে বেরিয়ে পড়ল। রেডিয়াম দেওয়া হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, রাত্রি তখন দেড়টা।
অতি সন্তর্পণে নীচে দোতলায় ডেকের দিকে চলল কিরীটী।
প্যাকিং-করা বাক্সগুলো যেখানে একটার ওপর একটা সাজানো আছে, তার আড়ালে এসে কিরীটী থমকে দাঁড়াল। আর ঠিক ঐ সময়ে কতকগুলো ফিস ফিস আওয়াজ তার কানে এল। মনে হল, দুজন লোক যেন নিম্নকণ্ঠে কথাবার্তা বলছে।
কেউ কিছু টের পেয়েছে?
না।
ঠিক জান?
হ্যাঁ।
এই ঔষধটা আজও আবার শেষরাত্রে লোকটার শরীরে ইনজেকশন করে দেবে। আর যেমন বলে রেখেছি ঠিক তেমনি ব্যবস্থা করবে। কোন গণ্ডগোল হবে না; ক্যাপ্টেনের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। সে বাধা দেবে না।
এর পরে আর কোন কথা শোনা গেল না। লোক দুটো তখন চলে গেছে বোধ হয়। মাঝে মাঝে শুধু সাগরের একটানা গর্জন আঁধারের বুকে ভেসে আসে।
তারপর সহসা একসময় একটা অস্পষ্ট গোঁ গোঁ শব্দ শুনে কিরীটী চমকে উঠল। ঐ পাশে সিঁড়ির নিচেটা যেখানে এসে শেষ হয়েছে, সেদিক থেকে আওয়াজটা আসছে বলে মনে হল। কিরীটী দ্রুতপদে এগিয়ে গেল।
সিঁড়ির নীচে সে জায়গাটায় তত আলো নেই। সিঁড়ির গায়ে যে বৈদ্যুতিক আলোটা জ্বলছে, তার ক্ষমতাও খুব বেশী নয়। সেই অস্পষ্ট আলোতে দেখা গেল সিঁড়ির নীচে একটা লোক পড়ে গোঁ গোঁ করছে।
কিরীটী লোকটার মুখের ওপর ঝুকে পড়ে দেখল, লোকটা কোন কারণে অজ্ঞান হয়ে গেছে। সে তাড়াতাড়ি সিঁড়ির ধারে যে কলিং বেল ছিল, সেটা টিপে দিলে।
দেখতে দেখতে জাহাজের উচ্চপদস্থ কর্মচারী হতে আরম্ভ করে খালাসীরা পর্যন্ত অনেকেই এসে হাজির হল।
সকলের মুখেই শঙ্কিত ভাব।
একজন খালাসী ক্যাপ্টেনের আদেশে লোকটির চোখ-মুখে জল দিতে শুর করলে। জাহাজের ডাক্তার খবর পেয়ে ছুটে এলেন এবং নাড়ি দেখে বললেন, ও কিছু নয়, কোন কারণে হয়তো অজ্ঞান হয়ে গেছে।
লোকটি অল্পক্ষণ পরেই জ্ঞান ফিরে পেয়ে উঠে বসল। চোখ-মুখে তার তখনও একটা ভয়াত ভাব। চারিদিক চকিত দৃষ্টিতে দেখে লোকটা অস্ফুট ঘরে কেবল বললে, ভূত ভূত!
জাহাজের মেট শুধায়, ভূত! কি বলছিস রে?
হ্যাঁ কর্তা, ভূত! আমি দেখেছি, স্বচক্ষে দেখেছি। এই দেখুন আমার গলা টিপে ধরেছিল। উঃ, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। বলে লোকটি আবার হাঁপাতে লাগল।
লোকটার কথা শুনেই সকলে যেন একটু ভয় পেয়ে গেছে। বুড়োগোছের একজন খালাসী এগিয়ে এসে বলল, আমিও কাল রাত্রে এমনি সময় ওই বাক্সগুলোর পিছনে কি একটা দেখেছিলাম। উঃ, কী ভীষণ মুখ তার! এই পর্যন্ত বলেই বুড়ো ভয়ে চোখ বুজল।
সমবেত সমস্ত লোকের মনেই কেমন একটা অস্পষ্ট আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। সকলেই একটা শঙ্কিত চাউনি নিয়ে একে অন্যের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। ক্যাপ্টেনের মুখটাও গম্ভীর হয়ে গেল।
রাত্রি আর বেশী নেই। একটি দুটি করে আকাশের তারাগুলো নিভতে শুরু করেছে।
১৬. আবার মগের মুল্লুকে
রেঙ্গুন শহর।
জাহাজ তখনও জেটিতে লাগেনি।
সুব্রত, কিরীটী, রাজু ও ডাঃ সান্যাল জাহাজের রেলিংয়ের কাছে দাঁড়িয়ে জেটির দিকে তাকিয়ে আছে।
লোকজন, কুলী, কর্মচারী প্রভৃতির সমাগমে স্থানটি একেবারে সরগরম।
প্রভাতী সূর্যের সোনালি আলো দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। জাহাজে বসে রেঙ্গুন নদীর পারে ভাসমান অবস্থায় শহরটিকে যেন একটি ছবির মতই দেখায়।
ডাক্তার বলছিলেন, কাল দুপুরে আমার ওখানে আপনাদের মধ্যাহ্নিক নিমন্ত্রণ রইল। এই নিন আমার কার্ড। বলতে বলতে ডাক্তার কোটের পকেট থেকে একটা ছোট কার্ড বের করে সুব্রতর হাতে দিলেন। তাতে লেখা আছে?
ডাঃ এস, সান্যাল
এম. বি. এম. সি. পি (লণ্ডন)
৩০, কমিশনার রোড, রেঙ্গন।
সুব্রত কার্ডটা পকেটে রেখে দিল।
জাহাজ ততক্ষণে জেটিতে লেগেছে। ক্ৰমে যাত্রী একে একে নামতে শুরু করে।
কিরীটীর পরামর্শমত ঠিক হয়েছিল সবশেষে ওরা নামবে। তাড়াতাড়ি কিছু নেই।
সুব্রত আনমনে রেলিংয়ে ভর দিয়ে যাত্রীদের অবতরণ দেখছিল।
একটা স্ট্রেচারে করে বোধ হয় একজন রোগীকে নামানো হচ্ছিল। দুটো খালাসী স্ট্রেচারটা ধরে নামাচ্ছিল। স্ট্রেচারে শায়িত ব্যক্তির কপাল পর্যন্ত কাপড়ে ঢাকা।
সহসা একজন যাত্রীর হাত লেগে লোকটার মুখের কাপড় সরে যেতেই সুব্রত চমকে উঠল, সেদিকে হাত বাড়িয়ে কি বলতে যেতেই তার মুখ দিয়ে একটা অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এল যেন, কে? কে?
কিরীটীর চোখেও সে দৃশ্য এড়ায়নি। কিন্তু ততক্ষণে আর একটা লোক, যে স্ট্রেচারের সঙ্গে সঙ্গে চলছিল, ক্ষিপ্রহাতে মুখের কাপড়টা আবার টেনে দিয়েছে স্ট্রেচারে শায়িত লোকটার।
সহসা সুব্রত অদৃশ্যে নিজের হাতের ওপরে একটা চাপ অনুভব করে পাশের দিকে তাকাতেই কিরীটীর সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায়। কিরীটীর চোখে অদৃশ্য কিসের যেন সঙ্কেত।
সুব্রত নিজেকে সামলে নেয় মুহূর্তে।
কিরীটীর মুখে কোন কিছু চিন্তার ছায়া পর্যন্ত যেন নেই, একান্ত নির্বিকার সে মুখ।
পাশেই দণ্ডায়মান ডাক্তারও সুব্রতর সেই অস্ফুট শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওদের দিকে চেয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন, কি হল মিঃ রায়?
কিরীটী ততক্ষণে নীচে নামবার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেছে। রাজু কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়নি, তাই সে হঠাৎ বলে ওঠে, সনৎদা!
সনৎদা? ডাক্তার প্রশ্ন করেন।
কিন্তু ততক্ষণে রাজু সুব্রতর চোখের দিকে দৃষ্টি পড়ায়, নিজেকে সামলে নিয়ে একটু মৃদু হেসে বললে, না কিছু না, আমাদের একজন চেনা লোককে যেন জেটিতে দেখলাম।
চেনা লোক! ডাক্তার বিস্মিত ভাবে তাকান।
হ্যাঁ। মানে, খবর পেয়েছিলাম, তিনি যেন, এই–
তিনি যেন কি? ক্ষমা করুন, যদি বিশেষ কোন গোপনীয় কিছু থাকে, তবে অবিশ্যি আমি শুনতে চাই না।
সুব্রত হেসে বললে, না, এমন বিশেষ কিছু গোপনীয় নয়, আচ্ছা বলবখন আপনাকে। চলুন এবারে নামা যাক।
জাহাজ-ঘাটের বাইরে কিরীটী একটা লাইটপোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে ব্যাকুল অনুসন্ধানী দৃষ্টি ফিরিয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল।
সুব্রত এসে পিছনে দাঁড়িয়ে ডাকল, মিঃ রায়!
দেরি হয়ে গেছে। পেলাম না সুব্রতবাবু।
পেলেন না?
না, চলুন।
ডাক্তারের প্রকাণ্ড কালো রংয়ের সুদৃশ্য হাম্বার গাড়িটা তার জন্য অপেক্ষা করছিল।
ডাক্তার সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে চেপে বসলেন। গাড়ি ছেড়ে দিল।
একটা গাড়িতে সমস্ত মালপত্র চাপিয়ে ওরা চালককে মিঃ চৌধুরীর বাড়ির ঠিকানা বলে দিয়ে গাড়িতে চেপে বসল।
চলমান গাড়ির মধ্যে বসে একসময় সুব্রত বলে, ডাক্তার সান্যাল চমৎকার লোক, কি বলেন মিঃ রায়?
কিরীটী চলন্ত গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে রাস্তার দুপাশের নানাজাতীয় অগণিত লোকজনের দিকে খরদৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে দেখছিল।
সুব্রতর কথায় চমকে উঠে বললে, অ্যাঁ! কিছু বলছিলেন সুব্রতবাবু?
কি ভাবছেন মিঃ রায়?
না, কিছু না।
একসময় গাড়ি ডাঃ চৌধুরীর বাড়ির সামনে এসে থামল। চৌধুরীর পুরনো চাকর দাশু দরজার গোড়াতে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল, কারণ তাকে আগেই তার করা হয়েছিল।
ওদের সকলকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে ব্যাকুল কণ্ঠে দাশু প্রশ্ন করে, আমার দাদাবাব-সনৎবাবু, আসেননি বাবু?
সুব্রত আমতা আমতা করে বললে, না দাশু সনৎবাবু আসেননি তো এ জাহাজে, পরের জাহাজে আসছেন।
খাওয়া-দাওয়ার পর কিরীটী একসময় বললে, আজকের দিনটা একেবারে পূর্ণ বিশ্রাম। পাদমেকং ন গচ্ছামি।
কথা শেষ করেই সে কলহাস্যে গান ধরল…
আজ আমাদের ছুটি রে ভাই,
আজ আমাদের ছুটি।
সুব্রত কিরীটীর হঠাৎ হাসিখুশীর কারণ বুঝতে পারল না, তবু হাসতে হাসতে বললে, ছুটি নয়, বরং এই তো সবে শুরু!
কিরীটী হাসতে হাসতে বললে, না। তারপরই আবার আগের মত গান গেয়ে চলল।
গান থামিয়ে কিরীটী আবার একসময় বললে, এখন একটা লম্বা ঘুম, তারপর জাগরণ। চা-পান ও জলখাবার ভক্ষণ, মোটরে চেপে রেঙ্গুন শহরটা ভ্রমণ, প্রত্যাগমন, স্নান-আহার, অতঃপর সারাটি রজনী ঘুম—এই হল আমার কর্মতালিকা অদ্য।
কিরীটী যেন দুবছরের শিশু। আনন্দে আর কলহাস্যে সে যেন মশগুল হয়ে উঠেছে।
সুব্রত হাসতে হাসতে বলে, ব্যাপার কি বলুন তো মিঃ রায়?
ব্যাপার কিস্তিমাত!
বলেন কি?—রাজু ও সুব্রত ব্যাকুল হয়ে উঠল।
কিরীটী ডান হাতের একটা আঙুল ওষ্ঠের উপর রেখে গভীর ভাবে মাথাটা দোলাতে দোলাতে বললে, চুপ করুন, চুপ করুন। সর্বদা মনে রাখবেন এটা কলকাতা শহর নয়, এটা কালো ভ্রমরের নিজের এলাকা। কিন্তু দেখলেন তো শেষ পর্যন্ত, আমার অনুমান মিথ্যা হয়নি! সনৎবাবুকে ওরা নিয়ে এল। যাক, তাঁর পক্ষে এ একপ্রকার ভালই হল, কি বলেন? বিনা খরচায় সাগরযাত্রাটা হয়ে গেল তাঁর।
কিন্তু তার উদ্ধারের কি করা যায়?
মা ভৈ …হবে হবে, সব হবে। জানেন তো সবুরে মেওয়া ফলে!
কিরীটী মৃদু মৃদু হাসতে থাকে।
১৭. কিরীটীর যুক্তি
সমস্ত দ্বিপ্রহর একটা টানা দিবানিদ্রা দিয়ে সকলেই যেন শরীরটা বেশ সুস্থ বোধ করে।
কয়েক দিন ধরে জাহাজে অবিশ্রাম ঢেউয়ের দোলায়, মনে হয় এখনও যেন দেহটা দুলছে।
বৈকালিক চা-পানের পর রাজু শহর দেখতে বের হয়েছিল, কিরীটী আর সুব্রত দোতলার ব্যালকনিতে পাশাপাশি দুখানা চেয়ার পেতে বসে গল্প করছিল।
সুব্রত বলছিল, যদিও আমি মুহূর্তের জন্য স্ট্রেচারে শায়িত সনৎদাকে দেখেছি, তবু–
কিরীটী বাধা দেয়, যদিও বলছেন কেন এখনও? আপনার মনে কি কোন সন্দেহ আছে সুব্রতবাবু? আপনি আমার কথা যদি বিশ্বাস করেন তা হলে জানবেন, সকালবেলার সেই স্ট্রেচারে শায়িত ব্যক্তি আর কেউ নন, আমাদের সনৎবাবুই।
কিন্তু কেন যে আপনি ভাবছেন কালো ভ্রমর সনৎদাকে প্রাণে মারবে না, এটা আমি ঠিক যেন এখনও বুঝে উঠতে পারছি না।
প্রাণে যে মারবেই না বা প্রাণে মারা একেবারেই অসম্ভব, সে কথা তো আমি বলিনি সুব্রতবাবু। আপনারা আমার কথার ঠিক অর্থ ধরতে পারেননি। আমি বলতে চেয়েছি, বর্তমানে তারা সনৎবাবুর প্রাণহানি করবে না, করতে পারে না।
কেন?
আচ্ছা আপনার প্রশ্নের জবাব দেবার আগে আপনাকে একটি প্রশ্ন করতে চাই সুব্রতবাবু!
বলুন?
আচ্ছা আপনার অমরবাবুর মত্যু সম্পর্কে কি ধারণা? আপনি কি মনে করেন সত্যিই কোন আততায়ীর হাতেই অমরবাবুর মৃত্যু ঘটেছে?
না।
কেন? কারণ তাই যদি হবে, তা হলে অন্ততঃ কালো ভ্রমর নিশ্চয়ই মৃতদেহের মুখটা ওভাবে বিকৃত করে রেখে যেত না।
তা হলে আপনি ধরেই নিচ্ছেন যে, এই হত্যা-ব্যাপারের সঙ্গে কালো ভ্রমর সুনিশ্চিত ভাবেই জড়িত আছে?
হ্যাঁ।
ঠিক তাই সুব্রতবাবু। সেইজন্যই সনৎবাবুকে বর্তমানে কালো ভ্রমর প্রাণে মারতে পারে না। কালো ভ্রমরের বিদ্বেষ শুধু সনৎবাবুর ওপরেই নয়, আপনার ওপরে অমরবাবুর ওপরেও। তবে সেই সঙ্গে আরও একটা কথা আমার মনে হচ্ছে, সনৎবাবুর ওপরে কালো ভ্রমরের রাগ বা বিদ্বেষ থাকাটা স্বাভাবিক এবং তার কারণও আমাদের চোখের সামনে আছে। কিন্তু আপনার ওপরে তার বিদ্বেষের কারণ যে কেবলমাত্র গতবারের লজ্জাকর পরাজয়ের ব্যাপারটাই, এটা মানতে যেন কিছুতেই আমার মন চায় না সুব্রতবাবু!
কেন? এ কথা বলছেন কেন কিরীটীবাবু?
তাই যদি বুঝতে পারতাম, তা হলে কালো ভ্রমরের এবারের অভিযানের অর্থটাও আমার নিকট পরিষ্কার হয়ে যেত। এই ঘটনা ঘটবার কিছুদিন আগে থেকেই কালো ভ্রমর সম্পর্কে আমি যথাসাধ্য খোঁজ নিয়েছি। একটা জিনিস আমি লক্ষ্য করেছি, কালো ভ্রমর আর যাই হোক ছিচকে চোর-ডাকাত নয়। কারণ বিশেষ করে তাহলে ধনিক সম্প্রদায়ের প্রতিই তার যত কিছু বিদ্বেষ, যত বিতৃষ্ণা থাকত না এবং বিশেষ বিশেষ কতকগুলি কুকীতি ছাড়া সাধারণ আরও পাঁচটা দুর্ধর্ষ ডাকাত বা চোরের মতই হাঙ্গামা, ডাকাতি ও খুনখারাপি করে করে বেড়াত।
কিরীটীর শেষের কথায় কান না দিয়েই সুব্রত বলে, কিন্তু একটা কথা এখনও আমি বুঝে উঠতে পারছি না কিরীটীবাবু, এই এত বড় রেঙ্গুন শহরে কোন পথে আপনি সনৎদার সন্ধান করবেন?
সুব্রতর কথায় কিরীটী মৃদু হেসে বলে, তার জন্যও চিন্তা নেই সুব্রত বাবু। কালো ভ্রমরকে আমাদের গৃহেই আসতে হবে।
এ আপনি কি বলছেন?
ঠিকই বলছি, এমন একটি বহুমূল্য সম্পদ হতে সে বঞ্চিত হয়েছে এবং বর্তমানে যা সম্পূর্ণ আমার অধিকারে, তারই আকর্ষণে সে আসবে। হ্যাঁ, কালো ভ্রমর আসবে। আসতে তাকে হবেই।
কিরীটীর কথাগুলো সুব্রতর নিকট যেন কেমন রহস্যপূর্ণ বলে মনে হয়। যেন পূর্ণ হেয়ালি।
আমি আপনার কথা কিছু বুঝতে পারলাম না কিরীটীবাবু।
ব্যস্ত হয়ে লাভ নেই সুব্রতবাবু। সময় এলেই সব বুঝতে পারবেন।
এমন সময় সিঁড়িতে জুতোর শব্দ পাওয়া গেল। কিরীটী যেন হঠাৎ উদগ্রীব হয়ে ওঠে, ঐ রাজেনবাবু আসছেন, আর তাঁর সঙ্গে বোধ হয় সলিলবাবুও আসছেন—যদি আমার অনুমান মিথ্যা না হয়ে থাকে।
সত্যিই কিরীটীর কথা শেষ না হতে হতেই প্রথমে রাজু এবং তার পশ্চাতে সলিলবাবু এসে ব্যালকনিতে প্রবেশ করলেন।
আসুন মিঃ সেন। কিরীটী আহ্বান জানায়, আপনাকে ডাকতে রাজেনবাবুকে পাঠিয়েছিলাম বটে, তবে ভাবিনি এখনই আপনি আসবেন।
জানেন তো বিদেশে স্বজাতি– সলিলবাবু হাসতে হাসতে চেয়ারে উপবেশন করলেন। তারপর প্রাথমিক পরিচয়-পর্ব শেষ করে সলিলবাবু বললেন, রাজেনবাবুর মুখেই সব শুনলাম মিঃ রায়।
এখন আপনি আমাদের সম্পূর্ণ ভরসা মিঃ সেন, কিরীটী বলে, আচ্ছা অমরবাবুর মত্যু সম্পর্কে আপনার মতামত কি জানতে পারি কি?
নৃশংস হত্যা সন্দেহ নেই। বরং এ যে সেই আগের ঘটনারই জের, তাও আমাদের ধারণা।
তারপর আবার একসময় কিরীটী কথায় কথায় সলিল সেনকে প্রশ্ন করে, আচ্ছা মিঃ সেন, অমরবাবু যে কক্ষে শয়ন করতেন, সেখান থেকে চিৎকার করলে বা কোন গোলমাল হলে, নীচের ভৃত্যদের ঘরে কি শোনা যায়?
না। আমি সেটা পরীক্ষা করে দেখেছি, শোনা যায় না।
ভৃত্য তাহলে কোন চিৎকার বা গোলমালই শুনতে পায়নি সে-রাত্রে?
না।
আচ্ছা লোকটা এদেশীয় কি?
হ্যাঁ।
লোকটা এখন কোথায়, নিশ্চয়ই হাজতে? ভাল কথা, করোনারের ভারডিকট কি?
কেউ বা কারও দ্বারা অমরবাবু নিঠুর ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছেন।
আচ্ছা আপনাদের ডি, আই, জি, লোকটা ইউরোপীয়ান নিশ্চয়ই?
অ্যাংলো-বার্মিজ।
আপনাদের ডিপার্টমেন্টে কালো ভ্রমরের একটা full details নিশ্চয়ই আছে?
আছে। সে
টা আমি একবার দেখতে পারি কি?
নিশ্চয়ই, কাল আমার ডিপার্টমেন্টে আসবেন, দেখাব। তাছাড়া আমাদের সুপারও আপনাদের সঙ্গে পরিচিত হতে ইচ্ছুক।
রাত্রি প্রায় নটার সময় ইন্সপেক্টার সলিল সেন ওদের নিকট হতে বিদায় নিলেন।
ভৃত্য ঐ সময় সংবাদ দিল আহার্য প্রস্তুত। আহারাদির পর সকলে এসে যে যার শয্যায় আশ্রয় নিল।
সুব্রত ভাবছিল কিরীটীর কথাগুলিই। কিরীটীর অদ্ভুত বিচার ও বিশ্লেষণ শক্তি সত্যই তাকে মুগ্ধ করেছে। কিন্তু তবু কিছুতেই সে যেন বুঝে উঠতে পারছিল না, কেন কিরীটীর ধারণা কালো ভ্রমর সনৎদাকে এখনই প্রাণে মারবে না!
কি জানি, সুব্রত আবার ঐ সঙ্গে ভাবে, সব কথা যে কিরীটীবাবু, খোলসা করে খুলে বলতে চান না!
উনি কি সুব্রতকে বিশ্বাস করেন না?
রাজুকে যে সলিলবাবুর সন্ধানে পাঠিয়েছেন, সে কথা পর্যন্ত উনি তার নিকট গোপন করে রেখেছিলেন, কিন্তু কেন?
আর কিরীটী ভাবছিল সম্পূর্ণ অন্য কথা। কালো ভ্রমর নিজে থেকে ধরা না দিলে কোনমতেই তাকে ধরা যাবে না।
সনৎ-এর উধাও হওয়ার দিন থেকে পর পর এই কদিনের ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করলে যেন তাই মনে হচ্ছে।
অবিবেচকের মত কোন কাজই কালো ভ্রমর করতে পারে না। প্রতিটি পদবিক্ষেপ সে হিসাব করে ফেলে।
এত বড় দলের যে দলপতি, অথচ কেউ আজ পর্যন্ত তার আসল পরিচয়টা পর্যন্ত জানে না এবং জানাতেও কালো ভ্রমর শুধু ইচ্ছুকই নয় তাই নয়, যাতে অন্য কেউ তার সত্যকারের পরিচয়টা না জানতে পারে, তার জন্য সে অত্যন্ত সচেষ্ট ও যত্নবান। কিন্তু কেন?
১৮. রাতের আঁধারে অনুসরণ
রাতের আঁধারে অনুসরণ
রাত্রি কত হবে কে জানে? সুব্রত আর কিরীটী পাশাপাশি এক শয্যায় শুয়ে। সুব্রত বোধ হয় অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছে। তার গভীর নিঃশ্বাসের শব্দ বেশ স্পষ্ট শোনা যায়।
ও-পাশের একটা খাটে ঘুমিয়ে আছে রাজু। সেও গভীর নিদ্রায় অচ্ছিন্ন।
গত দু রাত্রি কিরীটীর ভাল করে ঘুম হয়নি। কাজেই দু চোখের পাতা এবারে ঘুমে ভারী হয়ে আস্তে আস্তে বুজে আসে।
কিন্তু সহসা মাঝরাত্রে অত্যন্ত গরম বোধ হওয়ায় কিরীটীর ঘুম ভেঙে গেল।
রাত্রি কত হয়েছে ঠিক নেই। কিসের যেন একটা অস্পষ্ট আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। মনে হল যেন পাশের অন্ধকার ঘর থেকে শব্দটা আসছে!
কিরীটী উৎকর্ণ হয়ে ওঠে। পাশেই সুব্রত গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন, তার নিদ্রার কোন ব্যাঘাত হয়েছে বলে তো মনে হয় না।
হ্যাঁ, কার যেন সাবধানী পায়ের নিঃশব্দে চলাচলের অপষ্ট মদ, আওয়াজ। এত রাত্রে পাশের ঘরে কে?
খানিক পরে সে শব্দটা আর শোনা গেল না।
কিন্তু আবার! হ্যাঁ, ঐ তো আওয়াজটা আবার পাওয়া যাচ্ছে। কেউ নিশ্চয়ই নিঃশব্দে ঘরে হেটে বেড়াচ্ছে! না, দেখতে হল!
কিরীটী উঠে বসে। শয্যা ত্যাগ করে দু ঘরের মধ্যবর্তী যে দরজাটা আছে তার সামনে গিয়ে সে কান পেতে দাঁড়াল। তারপর দরজাটার গায়ে হাত দিয়ে ঠেলতে গিয়ে দেখল দরজাটা ওদিক হতে বন্ধ। আশ্চর্য, শোয়ার সময়ও তো দরজাটা খোলাই ছিল! তবে? কিরীটী আরও একটু জোরে দরজাটা ঠেলা দিল। কিন্তু দরজা খুলল না। কিরীটী বিস্মিত, বিমূঢ়।
সহসা মনে পড়ে ওদিককার বারান্দার দিকেও ঘরটার দুটো জানালা আছে। সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী এ ঘরের দরজা দিয়ে ওদিককার বারান্দায় গেল।
অন্ধকার বারান্দা।
নীচের বাগান থেকে ঝিঁঝি পোকার একঘেয়ে ঝিঁঝি শব্দ ভেসে আসে। রাতের হাওয়া নিঃশব্দে চোরের মতই আনাগোনা করে ফেরে। নাম-না-জানা একটা মিষ্টি ফলের গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়ায়।
কিরীটী পায়ে পায়ে নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে দেখে জানালাটি খোলা! দেওয়ালের গা ঘেষে চোরের মত চুপি চুপি এসে সে জানালাটার আড়ালে দাঁড়াল।
অন্ধকারে ঘরের মধ্যে একটা সরু আলোর রশ্মি এদিক-ওদিক ঘুরছে। চোখের দৃষ্টি যতটা সম্ভব প্রখর করে কিরীটী ঘরের ভিতরের সব কিছু দেখবার চেষ্টা করতে লাগল।
যেখানে ওদের সুটকেস ও বাক্সগুলো সাজানো আছে, সেখানে একটা ছায়ামূর্তি নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে টর্চের আলো ফেলে কি যেন দেখছে। লোকটা কে? কিই বা দেখছে?
কিরীটী উৎকণ্ঠিত হয়ে ওঠে।
খট করে একটা শব্দ হল—হ্যাঁ, বাক্সের ডালা খোলার শব্দ বটে! বাক্সের মধ্যে আঁতিপাঁতি করে লোকটা কি খুজছে অমন করে?
কিরীটী নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে সব ব্যাপার দেখতে লাগল।
ওপরের বাক্সটা নামিয়ে রেখে লোকটা আর একটা বাক্স খোলবার জন্য তার হাতের চাবির গোছার এক-একটা চাবি দিয়ে চেষ্টা করতে লাগল। আবার খট, করে একটা শব্দ হল—সঙ্গে সঙ্গে বাক্সের ডালাটাও খুলে গেল।
এবারে অল্পক্ষণ হাতড়াতে কি একটা কাগজ পেয়ে লোকটা টর্চের আলোয় সেটা মেলে ধরে দেখলে এবং সেটা পকেটে পরে টর্চ নিবিয়ে ওদিককার জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল, তারপর জানালা টপকে ওদিকে চলে গেল।
কিরীটীও সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে জানালা টপকে ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকল। জানালাটার কাছে ছুটে এসে সে দেখে জানালার গায়ে একটা দড়ির মই ঝলছে, আর লোকটা নিঃশব্দে সেই দড়ির মই বেয়ে নীচের বাগানে নেমে যাচ্ছে দ্রুত।
আর দেরি না করে কিরীটী একপ্রকার ছুটেই বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে বাগানের দিকে চলে যায়।
রাতের অন্ধকারে বাগানটি অস্পষ্ট। ভাল করে কিছু দেখাও যায় না বোঝাও যায় না।
বাগানের পিছন দিক দিয়ে একটা স্বল্পপরিসর রাস্তা ঘরে এসে এদিককার বড় রাস্তায় মিশেছে। যেতে হলে লোকটিকে বাগানের প্রাচীর টপকে ওই রাস্তা দিয়ে এই বড় রাস্তায় আসতেই হবে। কিরীটী মনে মনে এই চিন্তা করে দ্রুতপদে সদর দরজার দিকে চলল, তারপর দরজা খুলে রাস্তার ওপরে এসে দাঁড়াল।
সহসা তার নজরে পড়ে রাস্তার ঠিক ওপরেই ছোট একটা টু-সীটার মোটরগাড়ি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে।
একটু পরে কার পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। শব্দটা বাগানের পিছনের সরু রাস্তার দিক থেকেই যেন আসছে মনে হয়। শব্দটা ক্রমে স্পষ্ট হতে স্পষ্টতর মনে হয়।
কিরীটী দরজার কপাটের আড়ালে একটু সরে দাঁড়িয়ে দেখল, সরু রাস্তা দিয়ে একটা লোক বড় রাস্তার দিকে আসছে। লোকটার গায়ে একটা কালো রংয়ের কিমনো চাপানো, মাথায় একটা নাইট ক্যাপ। লোকটা আস্তে আস্তে মোটরটির কাছে এসে দরজা খুলে গাড়ির ভিতর গিয়ে বসল।
কিরীটী দ্রুতপদে এগিয়ে এসে গাড়ির পিছনে যে চাকার ক্যারিয়ারটা ছিল, সেটার ওপর চট করে উঠে বসে কোনমতে, তারপর গাড়ির হুড আটকাবার জন্য পিছনে যে দুটো লোহার হক ছিল, দু হাতে সে দুটোকে বেশ শক্ত করে চেপে ধরল।
গাড়ি ততক্ষণে স্টার্ট দিয়ে চলতে শুরু করেছে। গাড়ির বেগ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সামান্য একটা চাকার ওপর ঠিক হয়ে বসে থাকা সত্যি বড় কষ্টকর। গাড়ি রাত্রির অন্ধকারে রেঙ্গুন শহরের বিভিন্ন পথ ধরে ছুটে চলেছে।
সামান্য জায়গায় একই ভাবে বসে থেকে কিরীটীর হাত-পা সব টনটন করছে। অনেকক্ষণ পরে গাড়িটা এসে একটা বাগানের মধ্যে প্রবেশ করল। গাড়ির গতি ধীরে ধীরে কমে আসতেই কিরীটী লাফ দিয়ে গাড়ির পিছন থেকে নেমে পড়ল। গাড়িটা আরও একটু গিয়ে ছোট গাড়িবারান্দার নীচে দাঁড়াল।
কিরীটী অন্ধকারে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। খানিক পরেই গাড়িবারান্দার আলোটা জ্বলে উঠল। সেই আলোয় কিরীটী দেখতে পেল, মোটর থেকে সেই কিমনো পরিহিত লোকটি বেরিয়ে দেওয়ালের গায়ে একটি বোতাম টিপতেই সামনের একটি দরজা ফাঁক হয়ে রাস্তা করে দিল। লোকটি দরজা দিয়ে ভিতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় দরজাটা আবার বন্ধ হয়ে গেল। আলোটাও নিভে গেল।
কিরীটী উঠে গাড়িবারান্দায় এল, কিন্তু অন্ধকারে গাড়িবারান্দাটা ভাল করে দেখা যায় না। কোনমতে দেওয়াল ধরে ধরে আন্দাজে ভর করে কিরীটী সেই বোতামটি খুজতে লাগল, কিন্তু কিছুই ঠাওর করে উঠতে পারলে না। একটি দরজা যদিও বা হাতের কাছে পাওয়া গেল, কিন্তু হাত দিয়ে ভাল করে দেখতে গিয়ে কিরীটী বুঝল, একই রকমের দরজা পর পর আরও দুটো আছে। তার সব কিছু, যেন গুলিয়ে যায়। কোন দরজাটা দিয়ে এক মুহূর্ত আগে যে লোকটি অদৃশ্য হয়ে গেল তা সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না। কিরীটী ভাবল বড় ভুল হয়ে গেছে, আসবার সময় যদি টর্চটাও অন্তত নিয়ে আসতাম!
রাগে দুঃখে কিরীটীর নিজের হাত নিজেরই কামড়াতে ইচ্ছা করে। কিন্তু উপায় কি? কি এখন করা যেতে পারে? এতদূর এসে সে কি বিফল হয়ে ফিরে যাবে শেষটায়?
এমন সময় সামনেই কোথাও একটা ওয়াল-ক্লক ঢং ঢং ঢং ঢং করে রাত্রি। চারটে ঘোষণা করলে। কিরীটী চেয়ে দেখল পুবের আকাশে রাত্রিশেষের লালচে আভা জেগে উঠেছে। রাত্রি শেষ হয়ে আসছে। আর এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে থাকা সমীচীন নয়। কিরীটী নিঃশব্দে গেট পার হয়ে রাস্তায় চলে আসে।
১৯. ডাঃ সান্যালের গৃহে
রাস্তায় নেমে সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কিছুক্ষণ কিরীটী যেন কি ভাবে, তারপর আবার সে বাড়ির গেটের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করে, স্বল্প আলো-আঁধারে সে গাড়ির নম্বরটা দেখবার চেষ্টা করলে, কিন্তু আশ্চর্য হয়ে দেখল যে গাড়ির নাম্বার প্লেটই নেই—সেটা খুলে রাখা হয়েছে। গাড়িবারান্দায় যেখানে গাড়িটা দাঁড় করানো ছিল সেখানে কাঁকর বিছানো। কিরীটী একটা কাঁকর তুলে নিয়ে গাড়ির বডির উপর ঘষে ঘষে ইংরাজীতে লিখল K। তারপর আবার বের হয়ে রাস্তায় এসে নামল।
রাত্রি প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। চারিদিকে অল্প অল্প আলো ফুঁটে উঠেছে। সবেমাত্র দু-একজন করে লোক রাস্তায় হাঁটতে শুরু করেছে।
কিরীটী নিশ্চিন্ত মনে হাঁটতে শুরু করল। আনমনা হয়ে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে ভুলপথে এসে পড়েছে তা সে নিজেও টের পয়নি। যখন খেয়াল হল তখন বেশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। লোকজন গাড়িঘোড়া চলতে শর করেছে।
কিরীটী সামনেই একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে কিছু জলখাবার ও চা খেয়ে নিল। তারপর রাস্তায় এসে নামতেই হঠাৎ ওর কানে এসে বাজল, মিঃ রায়!
কিরীটী চমকে উঠে ফিরে দেখলে সামনেই দাঁড়িয়ে ডাঃ সান্যাল ও মিঃ সলিল সেন।
সুপ্রভাত! কোথায় চলেছেন? ডাক্তারই প্রথমে প্রশ্ন করলেন।
এই…মানে সকালবেলা বেড়াতে বেড়াতে…। কিরীটী আমতা আমতা করে জবাব দিল।
ডাক্তার মৃদু মৃদু হাসতে লাগলেন, তারপর বললেন, একেবারে রাত্রিবাস চাপিয়েই বেড়াতে বেরিয়েছেন দেখছি যে!
কিরীটী নিজের বেশভূষার দিকে সহসা এতক্ষণে তাকিয়ে লজ্জিত হল, একটু অপ্রস্তুতও হল। সত্যি, এ খেয়াল তো তার মোটেই হয়নি। তাড়াতাড়ি সে কথাটা ঢাকবার জন্য কিরীটী হাসতে হাসতে প্রশ্ন করলে, আপনিও মর্নিংওয়াকে বুঝি?
হ্যাঁ, না মানে, ভোরবেলা গেছলাম আমার এই বন্ধুর বাড়ি। এর পায়ে হেটে বেড়ানোর শখ। তাই বেড়াতে বেরিয়েছি। আমার এ বন্ধুটিকে বোধ হয় চিনতে পারছেন না! ইনি সি. আই. ডি ইনস্পেকটার মিঃ সলিল সেন।
বিলক্ষণ! আগেই এর সঙ্গে পরিচয় লাভের সৌভাগ্য হয়েছে, সুপ্রভাত মিঃ সেন। বলে কিরীটী হাত তুলে নমস্কার জানাল।
মিঃ সেনও প্রতি-নমস্কার দিলেন মৃদু হেসে।
ডাঃ সান্যাল সলিল সেনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ও তাই নাকি, বেশ বেশ।…কিন্তু মিঃ সেন, ধূর্জটিবাবুর আসল পরিচয়টুকু পেয়েছেন তো? ভদ্রলোক চমৎকার গান গাইতে পারেন। আসছেন তো আজ আমার ওখানে, শুনবেন এর গান…এবার জাহাজে ওঁর সঙ্গে আলাপ হল।
কিরীটী হাসতে হাসতে বললে, শুনবেন না মিঃ সেন ডাক্তার সান্যালের কথা, বিনয় করে বড্ড বেশী বাড়িয়ে বলছেন। বরং ওঁরই বাজনার সুর এখনও আমার দু কান ভরে আছে।
যা বলেছেন মিঃ রায়। সত্যি অতি অদ্ভুত ওঁর বাজনার হাত যেন সুধাবর্ষণ করে। মিঃ সেন বললেন।
মিঃ সেন, আপনি তো এদিকেই চলেছেন, চলুন আপনার সঙ্গে গল্প করতে করতে যাব। বলে যেন একপ্রকার জোর করেই কিরীটী মিঃ সেনকে সঙ্গে করে এগিয়ে যায়।
পথে যেতে যেতে কিরীটী সংক্ষেপে ডাঃ সান্যালের কাছে যে কেন পরিচয়টা তার গোপন করেছে সবই বলে।
***
দ্বিপ্রহরে ডাঃ সান্যালের গৃহে সকলেই এসে হাজির হয়েছে—কিরীটী, সুব্রত, রাজু ও মিঃ সলিল সেন।
কমিশনার রোডে ডাক্তার সান্যালের বাড়ি। মস্ত বড় দোতলা বাড়ি, বাড়ির পিছনে ফলের বাগান ও গ্যারেজ। দোতলায় একটি ল্যাবরেটরী। তার পাশেই লাইব্রেরি ঘর। দশ-বারোটা আলমারিতে ঠাসা ইংরাজী, বাংলা, ফ্রেঞ্চ, জার্মান ভাষার সব ডাক্তারীর বই। শয়নঘরে একটা ছোট ক্যাম্পখাটে সামান্য একটা কম্বল বিছানো। তার ওপরে একটা কাশ্মীরী চাদর পাতা। ঝালর-দেওয়া পরিষ্কার দুটি মাথার বালিশ। মাথার কাছে টী-পয়ের ওপরে একটা টেবিলল্যাম্প ও তার পাশে ধ্যানস্থ বুদ্ধের ছোট্ট একটি পিতল-মুর্তি।…
ঘরে তিনটি ফটো—একটি ডাক্তারের মার এবং অন্য দুটি তাঁর বাবার ও বোনের। ডাক্তার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ওদের সবাইকে সর বাড়ি-ঘর দেখালেন।
খেতে বসে নানা গল্প করতে করতে ডাঃ সান্যাল একসময়ে প্রশ্ন করলেন, মিঃ অমর বসুর মৃত্যুর কোন কিনারা হল মিঃ সেন?
না, এখনও তো কোন সন্ধান পাইনি।
ডাক্তার গম্ভীরভাবে বললেন, কিন্তু খবরের কাগজওয়ালারা তো খুব বলছিল যে, এর মধ্যে কালো ভ্রমরেরও নাকি হাত আছে!
কালো ভ্রমরের নাম শুনেই মিঃ সেন সহসা অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পড়লেন, চাপা কণ্ঠে বলতে লাগলেন, কালো ভ্রমর! উঃ, একটিবার যদি সেই শয়তানকে–সেই দুশমনকে হাতের কাছে পেতাম, তবে তার কাঁচা মাথাটাই চিবিয়ে খেতাম বোধ হয়।
মিঃ সেনের ভাব দেখে ডাক্তার সান্যাল হেসে বললেন, কালো ভ্রমরের ওপরে আপনার যে ভয়ানক রাগ দেখছি মিঃ সেন!
রাগ কি আর সাধে হয় ডাক্তার! সভ্য সমাজের মধ্যে সে একটা গলিত কুষ্ঠ। সর্বত্র এমন বিভীষিকা সে জাগিয়ে তুলেছে যে আঁতকে শিউরে উঠতে হয়।…শয়তান!
ডাক্তার এবারে যেন একটু গম্ভীর হলেন, বললেন, সত্যি সে বেটা বড় বাড়িয়ে তুলেছে। আর আশ্চর্য লোকটার ক্ষমতা! ভয়ডর বলে কি কিছু ওর শরীরে নেই আপনাদের ডিপার্টমেন্টটাই বা কেমন? সামান্য একটা ডাকাতের দলের আজ পর্যন্ত কিনারা করে উঠতে পারল না! দিনের পর দিন সে তার অত্যাচার চালিয়ে চলেছে!
পাপের ভরা তার পূর্ণ হয়েছে। এবার তার সকল কিছুর হিসাবনিকাশ হবে দেখুন না, বললে রাজু।
এ কথাই হতে পারে না। একটা ডাকাতের দলকে খুঁজে বের করা যায়! আপনাদেরও সে রকম চেষ্টা নেই মিঃ সেন। নইলে– বললেন ডাক্তার মৃদু মৃদু হাসতে হাসতে।
আহারাদির পর সলিল সেন বললেন, আমি এখন ঘণ্টা-দুয়েকের জন্য বিদায় নেব। আবার চারটে সাড়ে চারটার মধ্যে ফিরব, জরুরী একটা কাজ আছে।
মিঃ সেন উঠে পড়লেন।
কিরীটী বললে, আমারও একটু কাজ আছে, ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফিরব। সুব্রত, তোমরা এখানেই থেকো।
কিরীটীও মিঃ সেনের সঙ্গে উঠে গেল।
ছোট টু-সীটার গাড়িখানি মিঃ সেনের। একজন ভৃত্য গাড়ির মধ্যে বসেছিল। সে গিয়ে ভিতরের সীটে বসল, মিঃ সেন গিয়ে স্টিয়ারিংয়ে বসলেন।
মিঃ সেন কিরীটীর দিকে ফিরে গুডবাই বলে গাড়িতে স্টার্ট দিলেন। গাড়ি চলতে শুরু করল। এমন সময় গাড়ির বডির পিছনদিকটায় নজর পড়তেই কিরীটী চমকে উঠল। কারণ সে দেখলে গাড়ির গায়ে ঘষে ঘষে K অক্ষরটি তখনও স্পষ্ট রয়েছে।
বিস্ময়ের প্রথম ধাক্কাটা কাটবার আগেই গাড়িটা সাইলেন্সার পাইপ দিয়ে খানিকটা ধোঁয়া ছেড়ে স্থানটা ধূমায়িত ও পেট্রলের গন্ধে ভরিয়ে দিয়ে গেটের বাইরে চলে গেছে।
সহসা কিরীটীর চমক ভাঙল ডাক্তারের কণ্ঠস্বরে। ইতিমধ্যে কখন যে একসময় ডাঃ সান্যাল নীচে নেমে একেবারে ওর পাশটিতে দাঁড়িয়েছেন সে টেরই পায়নি। ডাক্তার বললেন, মিঃ রায়, আপনি যাবেন না বলছিলেন?
কিরীটী ততক্ষণে আপনাকে সামলে নিয়েছে, বললে, হ্যাঁ, এই যে যাই! বলে সে গিয়ে রাস্তায় নামল।
***
সন্ধ্যার তখন আর খুব বেশী দেরি নেই।
দিনের আলোর বিলীয়মনি রশ্মিগুলো আকাশের মেঘের গায়ে গায়ে ইন্দ্রধনু রচনা করছে।
ঘরের মাঝখানে একটা গোল টেবিলের চারপাশে হেলানো বেতের চেয়ারে বসে সুব্রত, কিরীটী, ডাক্তার সান্যাল, রাজু ও মিঃ সলিল সেন।
কিরীটী গাইছিল—
দিনের শেষে ঘুমের দেশে ঘোমটা-পরা ঐ ছায়া
ভুলাল রে ভুলাল মোর প্রাণ!
ওপারের ঐ সোনার কলে আঁধার মূলে কোন মায়া
গেয়ে গেল কাজ-ভাঙানো গান।…
কিরীটীর উদাত্ত কণ্ঠস্বর সান্ধ্য-প্রকৃতির গায়ে যেন মায়াজাল রচনা করে চলেছে। মুগ্ধ বিস্ময়ে সকলে শুনছে।
কিরীটী তখন গাইছে—
ফুলের বাহার নেইকো যাহার
ফসল যাহার ফলল না,
অশ্রু যাহার ফেলতে হাসি পায়।
দিনের আলো যার ফুরালো
সাঁঝের আলো জ্বললো না
সেই বসেছে ঘাটের কিনারায়–
ওরে আয়। আমায় নিয়ে যাবি কে রে
দিনের শেষে শেষ খেয়ায়—
ধীরে ধীরে কিরীটী গানটা শেষ করল।
ইতিমধ্যে ডাক্তারের ভৃত্য ভোলা এসে ঘরের বৈদ্যুতিক আলো জালিয়ে দিয়ে গেছে।
ওরা সবিস্ময়ে দেখল, ডাক্তারের দুচোখের কোলে দু ফোঁটা জল টলমল করছে।
ডাক্তার মৃদুস্বরে যেন কি বলছেন আত্মগতভাবে। তাঁর মনের মাঝে যেন বিষম ঝড় উঠেছে।
হঠাৎ একসময় ডাক্তার চেয়ার ছেড়ে উঠে অশান্ত অস্থির পদে ঘরের মধ্যে পায়চারি শুরু করেন।
২০. ডায়েরী কার?
ডাক্তার! ডাক্তার!
সহসা যেন সলিল সেনের ডাকে ডাক্তারের সম্বিৎ ফিরে এল।
তিনি বললেন, না, কিছু না। মাঝে মাঝে মনটা আমার কেন যে উতলা হয়ে ওঠে বুঝি না। একটু অপেক্ষা করুন আপনারা, এখনই আসছি। বলে দ্রুত পদবিক্ষেপে ডাক্তার ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।
বোঝা গেল ডাক্তার তাঁর ল্যাবরেটারী ঘরে গিয়ে ঢুকলেন, কারণ সে ঘরের দরজাটা দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল।
লোকটা এদিকে একেবারে চমৎকার। কিন্তু রাত্রি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কি যেন ওঁর ঘাড়ে চাপে—পাগলের মত যা-তা বকেন। অস্থির চঞ্চল হয়ে ওঠেন।…আশ্চর্য! মিঃ সেন বললেন।
রাজু বললে, মাথায় কোন গণ্ডগোল আছে বোধ হয়। অন্ততঃ আমার তো তাই মনে হয়।
কি জানি! এত বড় জ্ঞানী ডাক্তার এ শহরে আর দুজন নেই। কিন্তু লোকটা এমন খামখেয়ালী যে সন্ধ্যার পরে লক্ষ টাকা দিয়েও ডেকে পাওয়া। যায় না! সন্ধ্যা হয়েছে কি সদর দরজা একেবারে পরের দিন সকালের মত বন্ধ হয়ে গেল। মাঝে মাঝে শুধু গভীর রাতে গিটারের করুণ সুর-মুর্ছনা শোনা যায়। আমার মনে হয় মাথা খারাপ-টারাপ কিছু নয়, হয়তো জীবনে বড় রকমের কোন আঘাত পেয়ে থাকবেন, তারই জন্য এইরকম মানসিক অবস্থা হয়েছে।
রাত্রে কি সত্যি সত্যি ডাক্তার কোথাও বের হন না মিঃ সেন? কিরীটী শুধাল।
না। আমার সঙ্গে ওঁর আজ সাত বছরের আলাপ। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে একটি দিনের জন্যও শুনিনি যে রাত্রে বাড়ির বাইরে গেছেন। তবে একদিন জিজ্ঞাসা করায় উনি বলেছিলেন, রাত্রে উনি নিরিবিলিতে ল্যাবরেটারী ঘরে বসে নাকি ডাক্তার সম্বন্ধে রিসার্চ করেন।
হ্যাঁ, সত্যি রিসার্চ করি।
কথাটা শুনে সকলে চমকে ফিরে দেখল খোলা দরজার ওপরে দাঁড়িয়ে সহাস্যমুখে ডাক্তার সান্যাল।
ডাক্তার বলতে লাগলেন, আপনারা হয়ত জানেন টিউবারকল ব্যাসিলি বলে একরকম জীবাণু আছে, প্রতি বছর এই ভীষণ জীবাণুর প্রকোপে হাজার হাজার মানুষ মত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। শুধু সভ্য সমাজই নয়, সমগ্র মানবজাতির এত বড় শত্রু আর দ্বিতীয়টি নেই। আপনাদের ঐ কালো ভ্রমরের হাতে পড়লে তবুও অনেক সময় নিস্তার পাওয়া যায় শুনেছি, কিন্তু এই ভীষণ দুশমনের কবল থেকে রক্ষা পাওয়া সত্যই বড় দুরহ ব্যাপার। কালো ভ্রমর আসে রাতের আঁধারে লুকিয়ে চুপিচপি, কিন্তু এ শয়তান দিন-রাত্রি কিছু মানে না—এ তিল তিল করে মানুষের জীবন-শক্তি শুষে নেয়। আমি আজ দীর্ঘ এগারো বছর এই অদৃশ্য শত্রুর কবল থেকে রক্ষা পাবার পথ খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমার জীবনের সমস্ত শক্তি তিল তিল করে এর পায়ে ঢেলে দিতে প্রস্তুত আছি। দেখি এ আমার কাছে হার মানে কিনা!
ডাক্তারের স্বরে উত্তেজনা ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞার আভাস ঝরে পড়ল যেন। ভাবাতিশয্যে মাঝে মাঝে তাঁর সমস্ত দেহ যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে।
একটু থেমে ডাক্তার আবার বললেন, কিন্তু আর নয়, আজকের মত আপনাদের কাছ থেকে আমি বিদায় চাই।
সকলে উঠে পড়লেন।
ঘরের ওয়াল-ক্লকটা ঢং ঢং করে রাত্রি সাতটা ঘোষণা করলে।
পথে নেমে কিছুদুর এগিয়ে একসময় সলিল সেনের মুখের কাছে মুখ এনে ঈষৎ চাপা গলায় কিরীটী ডাক দিল, মিঃ সেন!
সলিল সেন ফিরে বললেন, অ্যাঁ, আমায় ডাকলেন?
হাাঁ মিয়াং এখান থেকে কত দূর হবে?
মিয়াং! বলে বিস্মিত দৃষ্টি তুলে মিঃ সেন কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।
হ্যাঁ, মিয়াং। কিরীটী জবাব দিল।
সে তো অনেক দূর হবে। টোয়ান্টে খাল ধরে কুড়ি মাইল উজানে গেলে পথে পড়ে মৌবিন, আরও এগলে ইয়ান্ডুন; তারপর পড়বে ডোনাবিয়ু—তারপর হেনজাদা শহর। হেনজাদার পরেই ইরাবতী নদী। যেখানে টোয়ান্টে খাল ইরাবতীর সঙ্গে মিশেছে সেইখানেই মিয়াং শহর।…কিন্তু হঠাৎ মিয়াং সম্বন্ধে প্রশ্ন কেন মিঃ রায়?
আপনি কালো ভ্রমরকে ধরতে চান?
কালো ভ্রমর! শুনেই একরাশ বিস্ময় যেন মিঃ সেনের কণ্ঠ দিয়ে ঝরে পড়ল। তিনি যেন বিস্ময়ে চমকে উঠলেন। প্রথম দু-চার মিনিট মিঃ সেনের কণ্ঠ দিয়ে কোন কথা বেরল না।
কিরীটী চাপা উত্তেজিত কণ্ঠে নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকাতে তাকাতে বললে, রাত্রি এখন সাতটা কুড়ি, হাতে আর মাত্র সাড়ে চার ঘণ্টা সময় আছে। যেমন করেই হোক আজ রাত্রি সাড়ে এগারোটার মধ্যে মিয়াং পৌঁছতে হবে আমাদের!
কিন্তু–, মিঃ সেন কি যেন বলতে গেলেন। কিন্তু কিরীটী তাঁকে একরকম বাধা দিয়েই থামিয়ে বললে, আজকের রাত যদি হারান, তবে এ জীবনে আর কালো ভ্রমরকে ধরতে পারবেন না। সে চিরদিনের মত মুঠোর বাইরে চলে যাবে। তাকে হাতেনাতে যদি ধরতে চান তো আজকের রাত পোহাতে দেবেন না!
আমি তো আপনার কথা কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না কিরীটীবাবু!
বুঝবেন, সময় হলেই সব বুঝতে পারবেন। আপনাদের দ্রুতগামী পুলিসলঞ্চ আছে না?
হ্যাঁ আছে।
এখন সেটা পাওয়া যাবে?
যাবে।
তবে চলুন, আর একটি মুহূর্তও দেরি নয়।
***
অন্ধকারে সার্চলাইট জ্বেলে পুলিস-লঞ্চখানা টোয়ান্টে খালের মধ্য দিয়ে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে।
লঞ্চে আরোহী আছে ছজন—সুব্রত, রাজু, কিরীটী, মিঃ সলিল সেন ও দুজন আর্মড বর্মী পুলিস।
কিরীটী একটা লেদার বাঁধানো ডায়েরী হাতে করে নাড়তে নাড়তে বললে, মিঃ সেন, আপনি হয়তো সমগ্র ব্যাপারটার আকস্মিকতায় আশ্চর্য হয়ে গেছেন! এই ডায়েরী পড়লেই ব্যাপারটা সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। শুনুন পড়ছি—
লঞ্চের কেবিনের আলোয় ডায়েরীখানা মেলে ধরে কিরীটী বললে, আমি অবিশ্যি ডায়েরীর সব কথা এখন আপনাদের পড়ে শোনাব না, কয়েকটা পাতা মাত্র পড়ব। শুনুন।
কিরীটী ছোট একখানা ডায়েরী খুলে পড়তে শুরু করল–
বাবা!—আমার স্নেহময় বাবা আর ইহজগতে নেই! বিলাত থেকে শেষ পরীক্ষা দিয়ে দেশে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এ সংবাদে আমার বুকখানা একেবারে ভেঙে গড়িয়ে দিলে।
তারপর বাবার ডায়েরী পড়ে বুঝতে পারলাম, বাবার অকালমৃত্যুর জন্য দায়ী তিনটি লোক। দুজনের নাম তাঁর ডায়েরীতেই পেলাম। তারা দুজনেই বর্মায় এখন বিপুল সম্পত্তির অধিকারী—একজন মিঃ চৌধুরী, আর একজন বিখ্যাত তামাক ব্যবসায়ী বিপিন দত্ত। তৃতীয়জনের নাম কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। বাবা, বিপিন দত্ত, মিঃ চৌধুরী ও আর একজন মিলে কাঠের ব্যবসা করেন। বিপিন দত্তের দুই ছেলে ও বৌ ছিল, মিঃ চৌধুরী অবিবাহিত। আমরা দুই ভাই-বোন ছাড়া বাবার আর কেউ ছিল না। বাবার ব্যবসায় উন্নতি হওয়ার আগেই মা মারা যান। বাবা ছিলেন যেমন সরল, তেমনি নিরীহপ্রকৃতির। এ জগতে কাউকেই তিনি অবিশ্বাস করতেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই বিশ্বাসই তাঁর কাল হল।
মা মারা যাবার পর থেকে বাবা কেমন যেন উদাস প্রকৃতির হয়ে গিয়েছিলেন। এ দুনিয়ার কোন কিছুর ওপরই তাঁর আর তেমন কোন আকর্ষণই যেন ছিল না। ব্যবসা সংক্রান্ত সকল কিছুই দত্ত ও চৌধুরী তাঁর ব্যবসার অন্য দুই অংশীদার দেখাশুনা করতেন। বাবার কাছে কোন কিছুর সম্বন্ধে মত নিতে গেলে বলতেন, ওর মধ্যে আর আমায় টেনো না তোমরা, যা ভাল বোঝ তাই করগে।
আমি ছিলাম তখন বিলেতে।
দত্ত আর চৌধুরী বাবার এই উদাসীন ভাব ও একান্ত নিরপেক্ষতার ও সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ভিতরে ভিতরে একটা প্রকাণ্ড ষড়যন্ত্র করলেন।
হঠাৎ একদিন শোনা গেল, ব্যবসার অবস্থা নাকি খুব খারাপ। বাবা শুনে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন। অডিটার এল, কমিটি বসল, শেষ পর্যন্ত সত্যিই দেখা গেল ব্যবসাতে প্রায় এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকার ওপর ডিফিসিট পড়েছে। যে ব্যবসার মূলধন মাত্র সাড়ে তিন লক্ষ টাকা, সে ব্যবসায় এত বড় ডিফিসিট দিয়ে আর চলা একেবারেই অসম্ভব। অতএব ব্যবসা লালবাতি জ্বালতে বাধ্য হল।
ভিতরে ভিতরে গভীর ষড়যন্ত্র করে দত্ত ও চৌধুরী নিজেদের কাজ গুছিয়ে নিয়ে বাবাকে একেবারে পথে বসাল।
সরল-প্রাণ বাবা আমার। তাদের বন্ধু বলে আপনার জন বলে বিশ্বাস করেছিলেন। তাই তারা তাঁকে বন্ধুত্বের ও বিশ্বাসের চরম পুরস্কার দিয়ে গেল। এ আঘাত ও অপমান বাবা সহ্য করতে পারলেন না–অসুখে পড়লেন এবং আমি ফিরে আসবার আগেই চিরনিদ্রায় অভিভূত হলেন। যাবার সময় তিনি আমার নামে একটা চিঠি রেখে যান।
সুরো বাবা আমার,
এ জীবনের শেষক্ষণে তোমায় দেখে যেতে পারলাম না, এ যে আমার কত বড় দুঃখ তা
একমাত্র ভগবানই জানেন। মনে মনে তোমার জন্য আমার শেষ আর্শীবাদ ভগবানের শ্রীচরণে
দিয়ে গেলাম। যাবার আগে তোমায় দেবার মত আর আমার বিশেষ কিছুই অবশিষ্ট নেই, তোমার
মার নামে জমানো হাজার পাঁচেক টাকা আর আমার জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে সঞ্চয় করা দুটি
কথা রেখে যাচ্ছি।
প্রথম কথা—এ দুনিয়ায় সরল বিশ্বাসের কোন দাম নেই।
দ্বিতীয় কথা—যে বিশ্বাসহন্তা, তার একমাত্র ব্যবস্থা কঠোর মত্যুদণ্ড।…
যারা তোমার বাবাকে এমনি করে পথে বসিয়ে গেল, তাদের তুমি ক্ষমা করো না।
চোখের জলের মধ্যে দিয়ে বাবার মৃত্যুর কথা স্মরণ করে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, যেমন করেই হোক, যারা বাবাকে আমার এমনি করে লাঞ্ছিত করেছে তাদের আমি উপযুক্ত দণ্ড দেব।
ভাল করে খোঁজ নিয়ে শুনলাম, দত্ত আর চৌধুরী এখন দুজনেই শহরের মধ্যে বিশেষ গণ্যমান্য লোক। একজন কাঠের ব্যবসা ফেদে লক্ষপতি, অন্যজন তামাকের ব্যবসায়ে প্রায় তাই।
এই পর্যন্ত পড়ে কিরীটী থামল। তারপর আবার পাতা ওল্টাতে লাগল।
তারপর শুনুন। বলে কিরীটী আবার পড়তে শুরু করে : দত্তর চরম শাস্তি মিলেছে, প্রাণে মারিনি। সমস্ত ব্যবসা তছনছ করে দিয়েছি। আজ লক্ষপতি তামাকের ব্যবসায়ী বিপিন দত্ত পথের ভিক্ষারী। পয়সার শোকে আজ সে পাগল, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়।
এক নম্বর হল। এবার চৌধুরী তোমার পালা।
চৌধুরীর ভাগ্নে সনৎকে লোক দিয়ে দলে ভিড়িয়েছি। ভাগ্নে বুড়োর খুব আদরের। উঃ, বুড়ো একেবারে জলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। দিনের পর দিন সনৎ অধঃপাতের পথে নেমে চলেছে। অর্থাৎ সে জানে না, এর মধ্যে আছে এক হতভাগ্যের প্রতিহিংসার চক্রান্ত। কিন্তু দিনকে-দিন এ কি হচ্ছে আমার? দুশ্চিন্তা সর্বদা যেন আমায় ভূতের মত পিছু পিছু তাড়া করে চলেছে। এ কি হল?…
ডায়েরীর আর এক জায়গায় লেখা আছে—
আরও কিছুদিন যাক। সনৎকে একেবারে পথের ধুলোয় টেনে এনে বসাই, তারপর বুড়ো চৌধুরীকে ধরব। ওকে শেষ করতে তো আমার এক মাসও লাগবে না। কিন্তু আর একজন কে? কি তার নাম, কে আমাকে বলে দেবে?
কিন্তু আমার এ কি হল? এ কি যন্ত্রণা? রাত্রি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার শয়তানটা যেন আমায় শত বাহু মেলে শয়তানির পথে টেনে নিয়ে চলে, কোনমতেই যেন আমি তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারি না।
আর এক জায়গায় লেখা–
ডাঃ চৌধুরী হঠাৎ মরে আমায় বড় ফাঁকিটাই দিয়ে গেল। আমার স্বপ্ন ধুলোয় মিশে গেল। কি করি? এখন কি করি?…কিন্তু এ কি! দুষ্কর্ম কি আমার জীবনের সাথী হয়ে দাঁড়াল নাকি? আমি কি পাগল হয়ে যাব?
ডায়েরীর আর এক পাতায় লেখা–
হ্যাঁ, সেই ঠিক হবে; যেমন করে হোক বুড়ো চৌধুরীর সমস্ত সম্পত্তি নষ্ট করে দিতে হবে। ওর ভাগ্নেদের পথে বসাতে হবে।
মিলেছে, সুযোগ মিলেছে। সনৎ লোক পাঠিয়েছিল আমার কাছে, উইলের অন্যতম উত্তরাধিকারীকে যদি কোনমতে প্রতিরোধ করতে পারি, তবে সে আমায় দশ হাজার টাকা দেবে।…
আরও এক পাতায় লেখা—
অমর বসু সব ভেস্তে দিল! শেষ পর্যন্ত কূলে এসে তরী ডোবাল, কিন্তু আমার যে সব গোলমাল হয়ে যায়! ভেবেছিলাম সনৎকে মুঠোর মধ্যে এনে ধীরে ধীরে তাকে পথের ভিখারী করে পিপড়ের মত পিষে মেরে ফেলে দেব একদিন। তা তো হল না। সব ভেস্তে গেল! এখন উপায়? মিলেছে—উপায় মিলেছে। আজ রাত্রেই সনৎকে শেষ করব।
উঃ, কী সর্বনাশ! সংবাদ পেলাম অমর বসুই নাকি বাবার ব্যবসায় ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি ছিল, চৌধুরীর সহকারী হিসাবে। দাঁড়াও বসু এবারে তোমার পালা।
তারপর অনেক পাতার পরে লেখা আছে–
দলের লোকেরা আমায় জানবার জন্য কী ব্যাকুল—কী ইচ্ছুক! অমর বসুর মৃত্যুর ঘটনা খুব চাঞ্চল্য জাগিয়েছে যাহোক!
কলকাতায় যেতে হবে।
সনৎ আর সুব্রত ওদের মধ্যে যে কোন একজনকেও যদি কোনমতে এখানে এনে ফেলতে পারি তবেই কিস্তিমাত। একজন ধরা পড়লেই ওরা সব কজনই ছুটে আসবে। ধরে সব কটাকে রেঙ্গুনেই আনতে হবে—আমার মুঠোর মধ্যে।
আর এক জায়গায় লেখা–
নাঃ, কিরীটী বড় বাড়িয়ে তুলেছে! কিন্তু ভদ্রলোকের দেখছি বুদ্ধি আছে। হ্যাঁ, বলতেই হবে বুদ্ধি আছে। ঠিক আঁচ করেছে তো!
বুদ্ধির লড়াই আমার বড় ভাল লাগে। দেখি না এক চাল খেলে!
আবার এক জায়গায় লেখা–
দেখছি ধনাগারের চার্টটা চুরি গেছে।…তা যাক, তাতে আমার কিছু এসে যায় না। ও তো আমি জানিই। ওটা আবার কিরীটীটাই হাত করেছে। ওটা চুরি করে আনতে হবে। রেঙ্গুনে গিয়ে চুরি করলেই হবে। ব্যস্ততার কিছু নেই।
ডায়েরীর শেষ পাতায় লেখা আছে–
টাকাকড়ি সঞ্চয় করে আমার আর কি হবে?…আমি আমার ধনাগারের সমস্ত অর্থ তাকে দিয়ে যাব—মরবার আগে যে আমার কাছে সবচাইতে বিশ্বাসী বলে মনে হবে। ও তো পাপের অর্থ, পাপের নেশায় অর্জন করা অর্থ। আমার চাই না।
ডায়েরীর সব শেষ পাতায় লেখা—
মত্যুগুহায় সনৎ ও অমরকে আটকে রেখেছি। কাল যাব মৃত্যুগুহায় রাত্রি বারোটায়। তপ্ত শলা দিয়ে অমরের চোখ কানা করব। আর সনৎকে চিরজীবনের জন্য আমার ধনাগারে বন্দী করে রেখে আসব। অর্থ-পিশাচ! দেখি আমার আজীবনের সঞ্চিত অর্থে ওর সাধ মেটে কিনা! যে সামান্য অর্থের জন্য ভাইকে মেরে ফেলতে পর্যন্ত কুণ্ঠিত নয়, তার প্রায়শ্চিত্ত হওয়া দরকার। তাছাড়া আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তারও শাস্তি হোক। থাকুক ও ওই রুদ্ধ ধনাগারে—যুগ যুগ ধরে অর্থের প্রাচুর্যের মধ্যে বন্দী হয়ে যখের মত।
এই পর্যন্ত পড়ে কিরীটী ডায়েরী বন্ধ করল এবং সকলের মুখের দিকে চেয়ে বলল, আজ সেই ভীষণ রাত্রি অর্থাৎ এগারোই, এবং আজ বারোটায় হবে সেই ভীষণ পাপানুষ্ঠান।
সকলে এতক্ষণ বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে কিরীটীর পড়া শুনছিল, এবার বলে উঠল, উঃ, কী ভয়ঙ্কর!
অন্ধকারে মোটর লঞ্চ ঝরঝর শব্দে জল কেটে চলেছে তখন।
কিরীটী ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল, তখন রাত্রি সাড়ে দশটা।…এখনও দেড় ঘণ্টা বাকি।
২১. শয়তানের কারখানা
মিয়াংয়ে এসে যখন লঞ্চ পৌছাল রাত্রি তখন প্রায় এগারোটা। কৃষ্ণাপঞ্চমীর চাঁদ আকাশের কোণে উঁকি দিচ্ছে।
ইরাবতীর উচ্ছসিত জলধারা অক্লান্ত কল্লোলে বয়ে যাচ্ছে।
স্বল্প চন্দ্রালোক নদীর বুকে ঢেউয়ের চড়ায় চড়ায় যেন কি এক মায়াস্বপ্নের সৃষ্টি করেছে। অদূরে অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় ইরাবতীর স্রোত-বিধৌত বিশাল গৌতম পর্বত প্যাগোডা মাথায় করে দাঁড়িয়ে আছে চন্দ্রকিরণ-স্নাত হয়ে।
সকলে লঞ্চ হতে নামল একে একে তীরে।
কিরীটী পকেট থেকে একটা ছোট কাগজ বের করল। তাতে আলো ফেলতে দেখা গেল তার ওপর সাঙ্কেতিক ভাবে কি কতকগুলো লেখা আছে।
কিরীটী সেই কাগজ দেখতে দেখতে বললে, ঐ দেখা যাচ্ছে গৌতম পর্বত। বোধ হয় প্যাগোডার দক্ষিণ কোণ দিয়ে এগিয়ে যেতে একটা চন্দনগাছ পাওয়া যাবে। চলুন, আর দেরি নয়, তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চলুন।
সকলে দ্রুতপদে এগিয়ে চলল।
কারও মুখে একটি কথা নেই; উৎকণ্ঠিত আগ্রহে রুদ্ধনিঃশ্বাসে এক রহস্যময় বিভীষিকার দ্বারোদঘাটন করতে সব এগিয়ে চলেছে যেন নিঃশব্দে।
এই সেই প্যাগোডা…চল দক্ষিণ কোণ ধরে। চলতে চলতে একসময় থেমে কিরীটী বললে।
সকলে আবার কিছুদূর এগিয়ে চলল। কিন্তু কোথায় ভাঙা বুদ্ধদেবের মতি!
সুব্রত ও রাজু বললে, মিঃ রায়, আমরা বোধ হয় ভুলপথে এসেছি।
কিরীটী জোরগলায় বললে, না, ঠিকই চলেছি। ঐ দেখন ভাঙা বুদ্ধদেবের মূর্তি দেখা যাচ্ছে সামনেই আমাদের।
সত্যই অদূরে ভাঙা একটা বুদ্ধদেবের মূর্তি দেখা গেল, একখণ্ড বড় পাথরের ওপর বসানো।
বুদ্ধমূর্তির ডানদিকে এগোতেই দেখা গেল সেই চন্দনগাছও। কিরীটী উল্লসিত কণ্ঠে বললে, সব ঠিক ঠিক মিলছে।
তারপর কাগজটা মেলে ধরে বলতে লাগল, এই লেখাগুলোর তলায় যেসব চিহ্ন আছে সেগুলো বাদ দিতে হবে, কেননা বলেছে—চিহ্ন যত বাদ গেছে। তাহলে দাঁড়াচ্ছে—দশ পা পরে দুই DK..অর্থাৎ দুই দিকে তিন শূন্য বা ৩০ হাত রাস্তা আছে। হ্যাঁ। এই তো দুদিকে দুটো রাস্তা গেছে দেখছি, একটা ডাইনে, একটা বাঁয়ে। এখন…এই দু রাস্তার BAMT অর্থাৎ বাঁয়ের রাস্তাটি ধরে, হাতী ০০০০ যাও। হাতী মানে গজ। চার শূন্য হল চল্লিশ, সব মিলে হল চল্লিশ গজ অথাৎ বাঁয়ের রাস্তাটি ধরে চল্লিশ গজ যেতে হবে। চল এগিয়ে। মন্ত্রমুগ্ধের মতই অন্য সকলে কিরীটীর পিছু পিছু এগিয়ে চলে। ত্রিশ হাত যাওয়ার পর দেখা গেল সত্যিই দুই দিকে দুটো রাস্তা চলে গেছে। বাঁয়ের রাস্তাটি ধরে চল্লিশ গজ এগোবার পর দেখা গেল একটা প্রকাণ্ড পাথরের ওপর এক ছোট লোহার ড্রাগন বসানো। তার মুখে একটা লোহার বালা পরানো। কিরীটী আবার কাগজ দেখে পড়তে লাগল–
ড্রাগন দেখ বসে আছে
ধনাগারের চাবি কাছে।
মুখে তার লোহার বালা
দুলছে তাতে চিকন শলা।
হ্যাঁ, এই তো ড্রাগনের মুখে লোহার বালা। দেখ দেখ, একটা লোহার শলাও আছে!
আনন্দে উত্তেজনায় কিরীটীর সর্বশরীর থরথর করে কাঁপছে তখন। সে পুনরায় চাপা স্বরে বলতে লাগল—
দুইয়ের পিঠে শূন্য নাও
ত্রিশ দিয়ে গুণ দাও,
অর্থাৎ তাহলে হল ২০x৩০=৬০০
শূন্য যদি যায় বাদ
সেই কবারে পুরবে সাধ।
উত্তেজনায় ও অধীর আবেগে কিরীটীর সমগ্র দেহখানি কেঁপে কেঁপে ওঠে; বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ করে।
ছবার ড্রাগনের মুখে দোলানো লোহার বালাটা ঘোরাতেই ড্রাগনটি যে পাথরের ওপর বসানো ছিল, সেই পাথরখানি ড্রাগন সমেত সর সর করে বাঁয়ে সরে গিয়ে দু হাত পরিমাণ একটা গর্ত প্রকাশ পেল।
পেয়েছি, পেয়েছি! ইউরেকা, ইউরেকা! কিরীটী চাপা কণ্ঠে বলে উঠল, সত্যি এ কি ভোজবাজি-না স্বপ্ন!
সকলেই যেন বিস্ময়ে একেবারে অভিভূত হয়ে পড়েছে।
সেই গর্তমুখে আলো ফেলতে দেখা গেল, ধাপে ধাপে সুন্দর সিঁড়ি নীচে নেমে গেছে। প্রথমে কিরীটী, তারপর মিঃ সেন, সুব্রত ও রাজু পর পর সিঁড়ির পথে পা বাড়াল। পুলিস দুজন বাইরে দাঁড়িয়ে রইল কিরীটীর নির্দেশের অপেক্ষায়।
গোটা পনেরো সিঁড়ি ডিঙিয়ে যাবার পরই সমতল ভূমি পায়ে ঠেকল। অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা সরু পথ। সেই অপরিসর পথে অতি কষ্টে দুজন লোক পাশাপাশি যেতে পারে।
কিরীটীকে মাথা নীচু করেই এগোতে হল। কিছুদূর এগোতেই অদূরে একটা আলোর ক্ষীণ রশ্মি অন্ধকারে মিটমিট করছে দেখা গেল।
এমন সময় মাটির নীচে অন্ধকার গুহার ভিতর থেকে একটা বাক-ভাঙা করুণ আর্তনাদ জেগে উঠল। সকলেই থমকে দাঁড়াল।
মনে হল এ বুঝি কোন অশরীরীর করুণ হাহাকার যুগ যুগ ধরে এই মাটির নীচে কেদে কেদে ফিরছে আজও!
অল্পক্ষণ বাদে আবার তারা এগিয়ে চলল। সকলে এসে একটা বিস্তৃত উঠোনের মত জায়গায় দাঁড়ায়। মাথার ওপরে ছাদের খিলান খুব বেশী উচু নয়।
সহসা অন্ধকারের মধ্যে ঝনঝন শব্দ শুনে সকলে ফিরে দাঁড়িয়ে দেখল, একটা ছোট্ট গোলাকার ছিদ্রপথ দিয়ে সর; একটা আলোর রশ্মি অন্ধকারে ছিটকে এসে পড়েছে।
কিরীটী এগিয়ে গিয়ে সেই ছিদ্রপথে চোখ রেখে চমকে ওঠে, এ কি স্বপ্ন না সত্যি! এ যে সেই গল্পের আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপকেও হার মানিয়ে দেয়! সহসা সহস্র আরব্য রজনীর বিস্ময়কর একখানা পাতা যেন এই পাতালপুরীর আঁধারকক্ষে সত্য হয়ে এসে ধরা দিয়েছে।
আলোতে দেখা গেল ছোট একখানি ঘর। সেই ঘরের ছাদের ওপর হতে শিকলের মাথায় একটা কাঁচের প্রদীপদান ঝুলছে। সেই প্রদীপের স্বল্পলোকে দেখা যায় ঘরের চারপাশে ছোট ছোট বেতের ঝাঁপিতে ভর্তি অসংখ্য চকচকে গিনি। কে একজন আগাগোড়া কালো পোশাক-পরা লোক নীচু হয়ে এক-একটা ঝাঁপির কাছে আসছে, আর দু হাত দিয়ে সেই ঝাঁপি হতে মুঠো করে গিনি তুলে নিয়ে পরক্ষণেই মুঠো আলগা করে ধরছে—অমনি সমধুর ঝনঝন শব্দ করে সেই সব গিনি কক্ষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ছে।
কিরীটী ছিদ্রপথ দিয়ে সকলকেই তা দেখাল। তারা সবিস্ময়ে দেখল এ যে সত্যই অতুল ঐশ্বর্য!
কিছুক্ষণ বাদে লোকটা পাশের একটা দরজা দিয়ে ঐ ঘর থেকে চলে গেল। অল্পক্ষণ পরেই আবার জেগে উঠল সেই বুকভাঙা চিৎকার।
কোথা হতে চিৎকার আসছে তা জানবার জন্য সকলে ফিরে দাঁড়াল। চিৎকারের শব্দটা ডানদিক হতে আসছে বলে মনে হচ্ছে না? হ্যাঁ, তাই।
সহসা সেই বেদনার্ত চিৎকারকে ড়ুবিয়ে দিয়ে বাজের মতই একটা তীক্ষ্ণ হাসির খলখল শব্দ যেন সেই গুহাগিরিতলে শব্দায়মান হয়ে উঠল– হাঃ হাঃ হাঃ!
দয়া কর! দয়া কর! কার করুণ আবেদন শোনা যায়।
দয়া! হাঃ হাঃ, মনে পড়ে অমর বসু, দিব্যেন্দু সান্যালের সেদিনকার সে হতমানের কথা? মানুষের বুকে ছুরি মেরে তাকে তোমরা শয়তান সাজিয়েছ! দয়া, মায়া, ভালবাসা কিছু সেখানে নেই, সেখানে পড়ে আছে শুধু জিঘাংসা আর প্রতিশোধ।…এবারে সনৎবাবু? এবার তোমাকে কে রক্ষা করবে বন্ধু? কালো ভ্রমরের প্রতিহিংসা—সে বড় ভীষণ জিনিস! চৌধুরীর ভাগ্নে তোমরা। চৌধুরী ফাঁকি দিলেও তোমরা যাবে কোথায়? লক্ষপতি নিরীহ সরল-বিশ্বাসী বাবাকে আমার একদিন তোমার মামাই রাজসিংহাসন থেকে পথের ধুলোয় নামিয়ে এনেছিল, এমনি ছিল তার অর্থপিপাসা! তুমিও অর্থপিশাচ! এমন কি একদিন তুমি তোমার ভাইয়ের বুকেও ছুরি বসাতে পশ্চাৎপদ হওনি। তারপর সকলে মিলে আমাকে সেদিন যে অপমান করেছ, সে অপমানের জ্বালায় এখনও আমার সর্বাঙ্গ জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। আমি সেই দুঃসহ পরাজয়ের গ্লানি কিছুতেই ভুলতে পারছি না।
আমি আমার এই সুদীর্ঘ এগারো বছরের পাপ-দস্যুজীবনে পাপানুষ্ঠানের দ্বারা প্রভূত অর্থ উপার্জন করেছি। ভেবেছিলাম আমার দলে সবচাইতে বিশ্বাসী দেখব যাকে তাকেই সব দিয়ে যাব, কিন্তু দেখলাম সত্যিকারের বিশ্বাসী মেলা এ দুনিয়ায় একান্তই দূরহ ব্যাপার। আমার কাজ শেষ হয়েছে। গত পিতার আমার প্রতিশোধ নেওয়া হয়তো হয়েছে।…এখন আমার এই পাপঐশ্বর্যের মধ্যে তোমাকে বন্দী করে রেখে যাব। তুমি তোমার বাকী জীবনের দিনগুলোর প্রতি মুহূর্তটিতে অর্থগৃধ্মুতার তীব্র অনুশোচনায় তিলে তিলে মৃত্যুর কবলে এগিয়ে যাবে। মত্যুর সেই করাল ভয়াবহ বিভীষিকার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তুমি দেখবে বন্ধু, যে অর্থের জন্য একদিন তুমি তোমার ভাইয়ের বুকে ছুরি বসাতে চেয়েছিলে, সে অর্থ তোমার কেউ নয়! এই পর্যন্ত বলেই লোকটা থামল।
তারপর আবার সে বলতে শুরু করলে, এই দেখছ তপ্ত শলা! এটা দিয়ে তোমার চক্ষু দুটি চিরজীবনের মত নষ্ট করে দিয়ে যাব। অন্ধ হয়ে তুমি তোমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত কর অমর বসু এই গিরিগুহায়।
দয়া কর। দয়া কর। তোমার পায়ে পড়ি।
দয়া! চুপ শয়তান!
অন্য কোন কথা শোনা গেল না। কেবল একটা হৃদয়দ্রাবী করুণ গোঙানি আঁধার-মধ্যে করুণ বিভীষিকায় জেগে উঠল যেন। এমন সময় কিরীটী সবলে সামনের দরজাটির ওপরে একটা লাথি মারল এবং সঙ্গে সঙ্গে রাজু আর সুব্রতও তার ইঙ্গিতে সজোরে ধাক্কা দিতে লাগল। তিনজনের মিলিত শক্তি প্রতিরোধ করবার মত ক্ষমতা সামান্য কাঠের দরজাটির ছিল না—দরজা ভেঙে গেল। হুড়মুড় করে সকলে ঘরের মধ্যে গিয়ে ছিটকে পড়ল।
শয়তান! কিরীটী গর্জন করে উঠল।
ছোট্ট ঘরখানির একপাশে হাতে-পায়ে শিকল দিয়ে বাঁধা অমর বসু। তাঁর চোখ দিয়ে দরদর ধারে তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে তখন। বেচারী যন্ত্রণায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন। অন্যদিকে একটা শিকলে বাঁধা সনৎ।
আর একজন মাত্র লোক ঘরে ছিল, একটু আগেকার সেই বক্তা। সে তখন ওদের দিকে ফিরে তাকিয়েছে। উঃ, কী কুৎসিত তার মুখ! এ বুঝি কোন মাটির নীচেকার কবরখানা থেকে এইমাত্র উঠে এসেছে। যুগযুগান্তরের বিভীষিকা যেন মূর্তিমান হয়ে সচল হয়েছে।
এখানেও এসেছ? তবে মর! বলে মুহূর্তে সেই ভীষণদর্শন লোকটা কোমর থেকে ছোরা বের করে কিরীটীর দিকে ছুড়ে মারল।
কিরীটী চকিতে সরে গেল, ছোরাটা এসে সলিল সেনের পাঁজরায় বিধে গেল।
শয়তান! সুব্রত গর্জে উঠল।
হাঃ হাঃ হাঃ করে হেসে ওঠে কালো ভ্রমর। জামার পকেট থেকে ছোট একটা অ্যাম্পলের মত জিনিস বের করে সেটা পট করে শরীরের চামড়ার মধ্যে বিধিয়ে দিল।
সুব্রত লাফিয়ে গিয়ে কালো ভ্রমরের একখানি হাত ততক্ষণে চেপে ধরেছে।
মূর্খ! পিপীলিকার ওড়বার সাধ! বলে অক্লেশে এক হেচকা টান দিয়ে সুব্রতর দৃঢ়মুষ্টির কবল থেকে আপনাকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললে, কাজ আমার শেষ! তারপর হঠাৎ যেন তীব্র যন্ত্রণায় সে আর্তনাদ করে উঠল, উঃ, জ্বলে গেল! তীব্র বিষ! বিষধর কালনাগিনীর উগ্র বিষ!…হ্যাঁ, প্রায়শ্চিত্ত—সারাজীবন যে সহস্র পাপ করেছি তার প্রায়শ্চিত্ত আমি নিজহাতে স্বেচ্ছায় করে গেলাম। তা নাহলে আমার অনুতপ্ত বায়ভূত আত্মা এই মাটির পৃথিবীর শত সহস্র পাপানুষ্ঠানের স্মৃতির দংশনে হাহাকার করে ফিরত।
কালো ভ্রমর আর কিছু বলতে পারল না—টলতে টলতে বসে পড়ল।
কণ্ঠস্বর তার ক্ষীণ হয়ে আসছে।
কম্পিত হস্তে সে নিজের মুখের মুখোসটা টেনে খোলবার চেষ্টা করতে লাগল।
কিরীটী তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে ক্ষিপ্রহস্তে কালো ভ্রমরের গায়ের জামাগুলো খুলে দেবার চেষ্টা করতে লাগল, কিন্তু সফল হল না, পাতলা রবারের মত জামাটা যেন গায়ে এটে বসে আছে এবং তার ভিতর থেকেও দেহসৌষ্ঠব যেন ফুটে বের হচ্ছে লোকটার। সত্যি, কি অদ্ভুত তার দেহের প্রতিটি মাংসপেশী! নিয়মিত ব্যায়ামে সুগোল ও সুষ্ঠু। কিন্তু কি আশ্চর্য, ভীষণ-দর্শন কুৎসিত অন্তরের সঙ্গে দেহের তো কোন সাদৃশ্যই নেই! সকলে বিস্মিত হয়ে তার দেহসৌষ্ঠব দেখতে লাগল।
অতি কষ্টে হাঁপাতে হাঁপাতে কালো ভ্রমর বলতে লাগল, এই বদ্ধ ঘরের বন্ধ হাওয়া ছেড়ে আমি বাইরে যাব।
তখন সকলে ধরাধরি করে তাকে বাইরে নিয়ে এল।
অমর বসু, সনৎ ও আহত সলিল সেনকেও একে একে বাইরের মুক্ত আকাশের তলায় নিয়ে আসা হল।
রাত্রি শেষ হয়ে আসছে। প্রভাতী পাখীর কল-কাকলীতে স্থানটি মুখরিত হয়ে উঠেছে। সকলে এসে কালো ভ্রমরের চারিপাশে ঘিরে দাঁড়াল।
অমরবাবুর জ্ঞান তখনও ফেরেনি।
আঃ, আলো-বাতাস! কিন্তু আমার মৃত্যুর পর আমার এ দেহটা নিয়ে আর টানাটানি করো না। ঐ ইরাবতীর শান্ত শীতল জলে ভাসিয়ে দিয়ে যেও। বলতে বলতে কালো ভ্রমর শ্লথ কম্পিত হস্তে নিজ মুখের মুখোশটা টেনে নিল।
তার মুখ দেখে সকলে বিস্ময়ে স্তম্ভিত হতবাক হয়ে পড়ল। তারা সকলে। ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে না তো!
সলিল সেন যন্ত্রণা ভুলে গিয়ে চিৎকার করে উঠল, ডাক্তার সান্যাল? এ কি!
হ্যাঁ, আমিই ডাক্তার সান্যাল! কালো ভ্রমর কোনমতে অস্পষ্ট ভাবে জড়িয়ে জড়িয়ে কথা কটা বললে।
তখন প্রভাতের রাঙা সূর্য মেঘের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিয়ে উঠছে।
২২. বেদনার অশ্রু
ধীরে ধীরে হতভাগ্যের প্রাণবায়ু বোধ করি বাতাসে মিলিয়ে গেল।
সকলের চোখের কোলেই অশ্রু। এত বড় শয়তান, তবু সকলের বুকেই যেন আজ দোলা দিয়ে গেছে।
অত বড় একটা পাপীর এমনি করুণ পরিসমাপ্তি! তীব্র বিষের ক্রিয়ায় সমস্ত দেহ একেবারে নীল হয়ে গেছে। কিরীটী অশ্রুসজল চোখে ডাক্তারের বা কালো ভ্রমরের মাথায় হাত রেখে বললে, ভগবান তোমার আত্মার মঙ্গল করবেন।
কথাগুলো বলতে বলতে কিরীটী যেই কালো ভ্রমরের মাথায় হাত বোলাতে যাবে, অমনি তার কাঁচাপাকা চুলের পরচুলাটাও কিরীটীর আঙুলের সঙ্গে খসে এল।
একমাথা ভতি সুন্দর ঢেউ-খেলানো কোঁকড়ানো কোঁকড়ানো চুল। এতক্ষণে যেন মাথার চুল থেকে দেহের প্রতি অণু-পরমাণু পর্যন্ত অপরপ সৌন্দর্যে বিকশিত হয়ে উঠল। এত সুশ্রী যে কেউ হতে পারে এ যেন ধারণারও অতীত। এমন সুন্দর দেহের অন্তরালে জঘন্য এক শয়তান লুকিয়ে ছিল! আজ শয়তান দেহ ছেড়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই দেহ আবার আপন সৌন্দর্য ফিরে পেল।
***
কিরীটী বলতে লাগল, ডাক্তার প্রথম পরশু রাত্রে আমাদের গৃহে গিয়েছিল এই নকল সাঙ্কেতিক লেখাটার আসল কাগজটা চুরি করতে। কিন্তু সে জানত না যে তার মতলব আমি জাহাজেই ধরে ফেলি। বলে সে একে একে জাহাজের দু-রাত্রির সমস্ত ঘটনা খুলে বললে।
তারপর একটু থেমে কিরীটী আবার বলতে লাগল, কিন্তু তখনও আমার সন্দেহটা ভাল করে দানা বেধে ওঠেনি। সেদিন রাত্রে যখন কাগজটা চুরি করে গাড়িতে করে পালায়, তখন তার গাড়ির পিছনে চেপে তার বাড়ি পর্যন্ত যাই। শুধু তাই নয় কাঁকর দিয়ে তার গাড়ির গায়ে K অক্ষরও লিখে রেখে আসি। কাল দুপুরে ডাক্তারের ওখানে নিমন্ত্রণ খেতে গিয়ে ওর শোবার ঘরে পিতলের মুর্তিটার পাশে ওর ডায়েরীটা পেয়ে তখনই সকলের চোখের আড়ালে সেটা লুকিয়ে ফেলি। তারপর মিঃ সেনকে নীচে বিদায় দিতে এসে তাঁর গাড়ির গায়ে K অক্ষরটা দেখে ভীষণ আশ্চর্য হয়ে গেলাম। যা হোক তখনই বেরিয়ে গিয়ে ডাক্তারের বাড়ির পিছনে গেলাম। চিনতে পারলাম, সেখানেই গতরাত্রে গাড়ির পিছনে করে এসেছিলাম। তখন আর কোন সন্দেহ রইল না। হ্যাঁ, ডাক্তার সান্যালই যে কালো ভ্রমর তাতে আর কোন সন্দেহই আমার রইল না। তারপর ডায়েরীটা খুলে পড়তে পড়তে একেবারে সকল সন্দেহের অবসান হল। কিন্তু একটা কথা তখনও বুঝতে পারিনি। মিঃ সেনের গাড়িতে K লেখা হল কেমন করে? সেটাও পরে একটু ভাবতেই পরিষ্কার হয়ে গেল, ভাবলাম হয়তো সে-রাত্রে মিঃ সেনের গাড়িটাই ডাক্তার নিয়ে এসেছিল।
এমন সময় মিঃ সলিল সেন বললেন, হ্যাঁ, ডাক্তার তাঁর গাড়িটা কারখানায় দেওয়া হয়েছে বলে বিকেলের জন্য আমার টু-সীটারটা চেয়ে নিয়েছিলেন।
কিরীটী অমনি সহাস্যে বলে উঠল, তবে তো সব কিছুই ঠিক ঠিক মিলে গেছে। আর একটা কথা, সনৎবাবুকে যে রেঙ্গুনে আনবে এ কথায় স্থিরনিশ্চিত কেমন করে হয়েছিলাম, আপনারা এখন হয়তো বুঝতে পেরে থাকবেন। কালো ভ্রমরের আগাগোড়াই ইচ্ছা ছিল সে সকলকে নিজের এলাকার মধ্যে টেনে নিয়ে আসে। সে ভেবেছিল দলের একজনকে যদি টেনে নিয়ে আসা যায়, তবে সকলেই তার উদ্ধারের জন্য বর্মা পর্যন্ত ছুটে আসবে। তার অনুমানের বিষয় সে ডায়েরীতেও লিখে রেখেছে। বলা বাহুল্য, তার অনুমান ভুল হয়নি। এবং এও জানতাম, ঐ সাঙ্কেতিক লেখাটা উদ্ধার করতে কালো ভ্রমর আমার গৃহে আসবেই এবং এসেছিলও।
তবে তার ব্যথার দিকটা, অর্থাৎ কি কারণে অমরবাবু ও সনৎবাবুর ওপর তার এতটা প্রতিহিংসার ভাব জেগে উঠেছে, সেটা আমরা তাঁর ডায়েরী পড়বার আগে পর্যন্ত টের পাইনি। এবং ঐখানেই ছিল আমার যত সন্দেহ।
এই পর্যন্ত বলে কিরীটী তার কথা শেষ করল। সব কথা শুনে তারা সবাই বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হয়ে গেল।
***
প্রভাতী সুর্যের সোনালী আলোয় ইরাবতী হেসে যেন গড়িয়ে পড়ছে।
সুব্রত, রাজু আর কিরীটী ডাক্তারের মৃতদেহ ধীরে ধীরে ইরাবতীর বুকে ভাসিয়ে দিল। ঢেউয়ের তালে তালে দেহটা ভেসে চলল।
সকলের চোখই অশ্রুভারে ঝলমল করে উঠল।
ইরাবতীর শান্তশীতল জলের তলে কালো ভ্রমর ঘুমিয়ে রইল। স্রোতবিধৌত গৌতম পর্বতোপরি প্যাগোডা ও পর্বতগাত্রে খোদিত অসংখ্য বুদ্ধদেবের মূর্তি সূর্যের আলোয় অতি সুন্দর দেখাচ্ছিল।
কালো ভ্রমরের কি সত্যিই মত্যু হল?
এ প্রশ্নের জবাব কে দেবে?
কে ও? কে?