আয়া ঘরে এসে ঢুকলো হন্তদন্ত হয়ে, জি মেমসাব–
বেবীকো লে যাও। দেখতা নেই—সা আভি আয়া, কেতনা পরেশান হুয়া—
সঞ্জীব বাধা দিলেন, না না, থাক।
No No, you look so tired darling! কাবি—যাও খেলগে যাও—
মাকে মেয়েরা যমের মতই ভয় করে, কাবেরী তাড়াতাড়ি বাপের কোল থেকে নেমে চলে গেল।
তারপর কেমন আছো?–করুণা প্রশ্ন করে।
ভাল—সব ready করে রেখেছে তো? পরশুই রওনা হবো আমরা।
এত তাড়া কেন? রহস্যপ্রিয় কণ্ঠে করুণা বলে।
কেন—তুমি আমার চিঠি পাওনি?
পেয়েছি গো পেয়েছি—
ঐদিন সন্ধ্যার মুখে সঞ্জীব তার কক্ষমধ্যে বসে কি একটা ইংরাজী বই পড়ছেন।
অপরূপ সাজসজ্জায় করুণা এসে স্বামীর সামনে দাঁড়াল।
ব্যাপার কি, হঠাৎ এত সেজেছো যে?
একটা পার্টি আছে মিঃ চাকলাদারের ওখানে—
পার্টি?
হাঁ-ফিরতে একটু রাত হবে।
আজ পার্টিতে না গেলেই নয় করুণা?
ওঃ ডিয়ার! কি বলছো তুমি? আমার জন্য সবাই হা-পিত্যেশ করে বসে থাকবে—
সত্যিই I am serious, রুণা। আজ পার্টিতে তোমার যাওয়া হবে না। ফোন করে দাও—
Dont be so jealous। আচ্ছা চলি–
রঙীন প্রজাপতির মতই যেন রূপের একটা ঢেউ তুলে করুণা স্বামীকে আর দ্বিতীয় বাক্য পর্যন্ত উচ্চারণ করার অবকাশ মাত্র না দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
একটু পরেই গাড়ির শব্দে জানা গেল করুণা চলে গেল।
স্তম্ভিত হয়ে সঞ্জীব ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে রইলেন।
অনেক রাত্রি। কৃষ্ণা কাবেরী ঘুমিয়েছে।
শয়নকক্ষে একাকী বসে বসে সঞ্জীব বহুদিন বাদে বেহালাটা বাজাচ্ছিলেন। অনেকক্ষণ ধীরে ধীরে বেহালা বাজিয়ে থামবার পর হঠাৎ ঘড়ির ঘণ্টাধ্বনিতে তাঁর চমক ভাঙল।
রাত্রি একটা। আশ্চর্য, এখনো করুণা ফিরল না! মুখে বিরক্তির ছায়া নেমে এলো সঞ্জীবের।
ঘরের মধ্যে পায়চারি সুরু করলেন সঞ্জীব আর বেহালাটা একপাশে রেখে ঘন ঘন দেওয়াল-ঘড়ির দিকে তাকাতে লাগলেন। এমন সময় নিচে গাড়ির শব্দ শোনা গেল। এগিয়ে এলেন সঞ্জীব জানালাটার ধারে।
নিচের গেটের সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে, আর তার স্ত্রী করুণা ও অরুণ পরস্পর পরস্পরের কাছ থেকে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে বিদায় সম্ভাষণ জানাচ্ছে।
মুহূর্তে দাবাগ্নির মতই সমস্ত অন্তর জ্বলে ওঠে সঞ্জীবের।
অপেক্ষা করতে লাগলেন ঘরের মধ্যেই দাঁড়িয়ে।
একটু পরেই সিঁড়িতে চঞ্চল পদশব্দ ও সেই সঙ্গে জড়িত কণ্ঠে গানের একটি কলি শোনা গেল,–
কাছে যবে ছিল তারে হলো না চাওয়া—
করুণা কমধ্যে এসে প্রবেশ করল। এবং সঙ্গে সঙ্গেই বজ্রকঠিন কণ্ঠ সঞ্জীবের শোনা গেল, করুণা!
করুণার তখন দাঁড়াবার মতও অবস্থা নয়, রীতিমত টলছে, চোখ দুটো নেশার ঘোরে বুজে আসছে, ঢুলু ঢুলু।
করুণা!
Oh dear! Please—not now! Im feeling so sleepy!
জড়িত, ক্লান্ত কণ্ঠে কথা কয়টি বলে করুণা যেমন শয়নকক্ষের দিকে পা বাড়াতে যাবে, তীক্ষ্ণ কণ্ঠ আবার শোনা গেল সঞ্জীবের, শোনা করুণা, দাঁড়াও। তোমার সঙ্গে আমার কয়েকটা কথা আছে—
করুণা আবার যাবার জন্য পা বাড়িয়ে জড়িত কণ্ঠে বলে ওঠে, Oh sweety, dont be so cruel! কাল-কাল সকালে সব-সব শুনবো–
করুণা! করুণা এবারে একটা চেয়ারে বসে পড়ে।
ছিঃ! এত দূর তোমার অধঃপতন হয়েছে! পরপুরুষকে নিয়ে শুধু যে ঢলাঢলি করছো তা নয়, ইতর মেয়েমানুষের মত মদও খেতে শুরু করেছ!
মদ! No No-শ্যাম্পেন—শেরী—that is not liquor!
Shut up! বাঘের মতই গর্জন করে ওঠেন সঞ্জীব, স্বৈরিণী!
হঠাৎ যেন করুণার নেশাটা টুটে গেল, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে উঠলো সে, সঞ্জীব, how dare you insult me!
Insult! অপমানের কোন জ্ঞান আজ আর তোমার আছে? ভদ্রঘরের বৌ, ভদ্রলোকের স্ত্রী-সন্তানের জননী হয়ে যে জঘন্য কুৎসিত জীবন তুমি যাপন করছে তোমার লজ্জা নেই কিন্তু আমার গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হচ্ছে।
সঞ্জীব! ভুলে যেও না আমি তোমার বিবাহিত স্ত্রী হলেও নিজস্ব আমার একটা মতামত, একটা স্বাধীনতা আছে—
এর নাম স্বাধীনতা! You shameless filthy woman!
সঞ্জীব!
তুমি না শিক্ষিতা? স্বামী বর্তমানে যে জঘন্য রুচিত পরিচয় তুমি আজ দীর্ঘ সাত বছর ধরে দিয়েছে—কি বলবো, তুমি আমার সন্তানের জননী, নইলে–
নইলে কি করতে? বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে?
তাড়িয়ে দিতাম? না। অত বড় বোকা সঞ্জীব চৌধুরী নয়। তোমাকে আজ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবো আর তুমি আমার পরিচয়ের শেষ চিহ্নটুকু বহন করে নিয়ে সর্বত্র কাদা ঘেঁটে বেড়াবে, নিজের সর্বাঙ্গে কালি মাখবে—সেই সঙ্গে আমার সর্বাঙ্গে কালি ছিটাবে!
একটু থেমে সঞ্জীব আবার বলেন, না করুণা, সে সুযোগ এ জীবনে আর তোমায় আমি দেবো না। আমার অফুরন্ত বুকভরা ভালবাসা, বিশ্বাস ও ধৈর্যের শেষ পাওনাগণ্ডাটুকুও পর্যন্ত তুমি মিটিয়ে দিয়েছে। অনেক দিয়েছো তুমি আমায় এই জীবনের সুদীর্ঘ সাত বছর ধরে হাঁ অনেক দিয়েছে।
করুণা এবারে বাধা দিয়ে উঠলো, থাক। তোমার লেকচার শোনবার মত আমার এখন ধৈর্য নেই, তুমি মনে করো না, তোমার এই ঘর ছাড়া এত বড় দুনিয়ায় আর জায়গা নেই—World is too big! এরপর আমারও এখানে থাকা সম্ভব নয়। এখুনি আমি চলে যাচ্ছি–
করুণা পাশের কক্ষে, যেখানে ছোট মেয়ে দুটি কৃষ্ণা কাবেরী ঘুমাচ্ছে সেই ঘরের দরজার দিকে অগ্রসর হতেই গম্ভীর বজ্রকঠিন কণ্ঠে সঞ্জীব বলে ওঠেন, ওদিকে কোথায় যাচ্ছ? দাঁড়াও!