কুনাল চুপ করে থাকে।
কি, জবাব দিচ্ছেন না যে।
জানি না। তবে প্রতুল-ওকে আমি বিশ্বাস করি না, রাগলে ওর আসাধ্য কিছু নেই।
.
সর্বশেষ এল সুভাষ।
কিরীটীর সেই একই প্রশ্ন।
প্রথম প্রশ্নের জবাবে বলে, রাত ঠিক বারোটা পনেরো।
আপনার গাড়ি করেই তো সকলকে আপনি পৌঁছে দেন?
হ্যাঁ। রাত কটায় আপনি বাড়ি ফিরে যান?
তা একটা হবে।
কি রকম speed-এ আপনি গাড়ি চালান?
বেশ একটু speed-এ চালাই।
আচ্ছা সুভাষবাবু, আপনি কি জানতেন যে আপনার বন্ধু প্রতুলবাবুর সঙ্গে গীতা দেবীর বিয়ের ব্যাপারটা অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল।
জানব না কেন?
জানতেন। তারাই বুঝি আপনাকে জানিয়েছিল—গীতা ও প্রতুলবাবু?
হ্যাঁ-না they were coward; সোজা কথা স্পষ্ট করে যারা বলতে পারে না, বলবার courage রাখে না—তাদের আমি ঘৃণা করি। সুভাষের কণ্ঠস্বরে যেন একটা বিরক্তি, ঘৃণা ঝরে পড়ল। অথচ ব্যাপারটা নিয়ে লুকোচুরি করবার কিছুই ছিল না, আর জানালেও যে আমরা কেউ ভেঙে পড়তাম হতাশায় তা নয়।
আপনি কি করে কবে প্রথম জানতে পারলেন ব্যাপারটা? কিরীটী এবারে প্রশ্ন করে।
কি করে জানলাম সেটা বলব না, তবে মাসখানেক আগে জানতে পারি প্রথম।
আপনি যে জানতে পেরেছেন সেটা ওদের জানিয়েছিলেন?
না।
কেন? ওসব নোংরা ব্যাপার নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করাটা আমার রুচি ও শিক্ষায় বেধেছিল বলে।
নোংরা ব্যাপার।
তাছাড়া কি? যারা ভালবাসার নাম করে শেষ পর্যন্ত পরস্পরের দেহ নিয়ে টানাটানি করে তাদের সবটাই নোংরামি। যাদের রুচি আছে, শিক্ষা আছে-তাদের অতখানি বিকৃতি কখনও হয় না।
কিরীটী একটু চুপ করে থাকে। তারপর বলে, মনে হচ্ছে আপনি গীতাকে ভালবাসতেন—if I am not wrong!
ক্ষেপেছেন? ভালবাসতে যাব আমি ঐ মনোবৃত্তির একটা তুচ্ছ মেয়েছেলেকে? গীতা জানত না যে তাকে আমি কতখানি ঘৃণা করতাম, তার চরিত্রের ওই দুর্বলতা আর হ্যাংলামির জন্য!
তাহালেও বুঝতে পারছি, কখনও সে কথা গীতাকে আপনি জানতে দেননি নচেৎ সব কিছু জানবার পরও আপনি তার সঙ্গে মিশতেন না বা হেসে কথা বলতেন না।
বরং বলুন অতখানি নিচে কখনও আমি নামতে পারিনি!
আপনি বোধ হয় শুনেছন, গীতার মৃত্যুর কারণ বিষ নয়?
বিষ নয়!
না, কেউ তাকে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করছে সে-রাত্রে।
না, না,-তা কেন হবে—
তাই। ময়নাতদন্তেও তাই বলেছে। আচ্ছা কাউকে আপনি সন্দেহ করেন?
না।
অতঃপর সেদিনকার মত কিরীটী সকলকে বিদায় দিল।
.
দিন-দুই পরে।
সন্ধ্যারাত্রি তখন! কিরীটী হঠাৎ গিয়ে হাজির হয় সুভাষের গৃহে। সুভাষ তখন গৃহে। ছিল না।
সীতারাম বললে, দাদাবাবু তো বাড়িতে নেই!
কোথায় গিয়েছেন জান?
না।
কখন ফিরবেন, তা জান না?
না।
তোমার নাম কি?
আজ্ঞে সীতারাম।
কতদিন এ বাড়িতে আছ?
তা দশ-বারো বছর হবে।
তুমি শুনেছ বোধ হয় গীতা দিদিমণি মারা গিয়েছেন?
শুনেছি বৈকি বাবু। আহা, দিদিমণি বড় ভাল ছিল। হাসি ছাড়া কখনও দেখিনি।
এখানে আসত না?
হ্যাঁ, প্রায়ই আসত।
তোমার দাদাবাবুর সঙ্গে খুব ভাব ছিল, তাই না?
আজ্ঞে। আমি তো ভেবেছিলাম দাদাবাবু গীতা দিদিমণিকেই বিয়ে করবে।
আচ্ছা সেদিন রাত্রে কখন তোমার দাদাবাবু ফিরেছিল মনে আছে?
রাত তখন একটা হবে। না—ঠিক তা নয় বোধ হয়, রাত প্রায় দেড়টা হবে।
একবার বলছ রাত একটা, আবার বলছ রাত দেড়টা—
হ্যাঁ বাবু, ঘড়িটা আধ ঘণ্টা স্লো হয়ে গিয়েছিল, মনে পড়ছে আমার—
ঘড়িটা আধ ঘণ্টা স্লো হয় গিয়েছিল কি রকম?
হ্যাঁ, পরের দিন দেখি—দাদাবাবু গীতা দিদিমণির বাড়ি থেকে ফিরে এসে ঘড়িটা ঠিক করছে। আধ ঘণ্টা এগিয়ে দিলে দেখলাম।
কোন্ ঘড়িটা?
সীতারাম ঘড়িটা দেখিয়ে বলে, ঐ ঘড়িটা।
ওটা স্লো-ফাস্ট থাকে নাকি?
কখনও না। একেবারে ঠিক ঠিক টাইম দেয়। কখনও আগে-পিছে হতে গত দশ বছর দেখিনি।
আচ্ছা সীতারাম, আমি চলি।
কিন্তু আপনি কোথা থেকে আসছেন, কি নাম আপনার—বললেন না তো?
আমি আবার আসব। কথাটা বলে বের হয়ে এল কিরীটী।
সেখান থেকে বের হয়ে কিরীটী সোজা গেল নিরালায়।
শান্তনু গৃহেই ছিল।
শান্তনু!
বল?
তুমি সেদিন বলেছিলে না, তোমার মাসী গীতার পাশের ঘরেই শোন।
হ্যাঁ, কেন বল তো?
তাকে একটিবার ডাকবে? তার সঙ্গে আমার কয়েকটা কথা আছে।
শান্তনু তখনি গিয়ে সৌদামিনীকে ডেকে নিয়ে এল।
বসুন মাসীমা। কয়েকটা কথা আপনাকে আমি জিজ্ঞাসা করব।
কি বাবা?
রাত্রে আপনার ঘুম হয় কেমন?
ঘুম কি আর চোখে আছে—
সে-রাত্রে তো আবার বাতের ব্যথাটা আপনার বেড়েছিল, তাই না?
হ্যাঁ।
আচ্ছা, সাড়ে বারোটা পৌনে একটার সময় কোনরকম শব্দ বা চেঁচামেচি শুনেছিলেন পাশের ঘরে?
চেঁচমেচি নয়, তবে—
বলুন—থামলেন কেন?
দেখ বাবা—সেদিন আমি দারোগাবাবুকে বলিনি, তবে আমার বেশ স্পষ্ট মনে আছে। সে-রাত্রে গীতা যেন কার সঙ্গে কথা বলছিল—
আর কিছু শোনেননি?
না।
ঠিক আছে, আপনি যেতে পারেন।
মাসী চলে যাবার পর কিরীটী বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলে, ব্যাপারটা আমার কাছে। স্পষ্ট হয়েছে শান্তনু।
কি? কিছু জানতে পেরেছ?
হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি কে তোমার বোনকে হত্যা করেছে।
কে? শম্ভু?
না। ভাল কথা, শম্ভুকে পাওয়া গেছে, জান না?
না তো! কোথায়? কখন?
মেদিনীপুর এক গাঁয়ে তার আত্মীয়-বাড়িতে।
সে পালিয়েছিল কেন?
ভয়ে।
ভয়ে!
হ্যাঁ। কিন্তু একটা কথা তুমি কি জানতে, গীতা প্রতুলকে বিয়ে করবে বলে স্থির করেছিল?