মানদা ডাইনিং টেবিল পরিষ্কার করে শুতে চলে যায়, তারপর সে আর কিছু জানে না। দিদিমণির বন্ধুরা কত রাত্রে গিয়েছে, গীতা কখন শুতে গিয়েছে–
কোথায় তুমি শোও?
নিচের তলায় একটা ঘরে।
অতঃপর শম্ভুচরণের ডাক পড়ল। এই বাড়িতে সেই-ই সবচাইতে বেশিদিন ধরে কাজ করছে।
দাদাবাবু দিদিমণি যখন বলতে গেলে বাচ্চা, তখন থেকে।
সে শোয় উপরে একটা ঘরে।
দত্তরায় প্রশ্ন করে, তুমি কখন কাল রাত্রে শুতে যাও?
রাত বারোটা।
অত রাত হল কেন?
শুয়ে পড়েছিলাম, দিদিমণি ডেকে কফি দিতে বলল। কফি দিয়ে শুতে শুতে রাত বারোটা হয়ে যায়।
দিদিমণির বন্ধুরা কখন যায় জান? কত রাত হয়েছিল তখন?
ঠিক বলতে পারব না হুজুর, তবে কফি খাবার কিছু পরেই।
তখন তুমি কি করছিলে? শুয়ে পড়েছিলে কি আবার?
আজ্ঞে না। বসে একটা বিড়ি খাচ্ছিলাম। দিদিমণি ওদের বিদায় দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসে তার ঘরে গেল।
তারপর?
আজ্ঞে আমার মনে পড়ছে একটা কথা, দিদিমণি বোধ হয় উপরে এসে আবার নিচে গিয়েছিল।
কখন?
মনে হয় ঘণ্টাখানেক পরে।
কি করে বুঝলে?
সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসবার পায়ের শব্দ পেয়েছিলাম।
সে যে তোমার দিদিমণিই কি করে বুঝলে? অন্য কেউ তো হতে পারে?
তা হতে পারে। কিন্তু আর কে হবে? মাসীমা তো কখন শুয়ে পড়েছেন-মানদাও শুয়ে পড়েছিল। আমিও আমার ঘরে ছিলাম। তাই মনে হয় দিদিমণিই।
দত্তরায় অতঃপর আরও কয়েকটা মামুলী প্রশ্ন করে শম্ভুচরণকে নিষ্কৃতি দিলেন।
প্রতুল, সুভাষ ও কুণাল ঐ ঘরেই দাঁড়িয়ে ছিল। এবারে তাদের কয়েকটা প্রশ্ন করলেন।
একটা প্রশ্ন বিশেষ করে তিনজনকেই জিজ্ঞাসা করলেন, গীতার সঙ্গে তো তাদের অনেক দিনের পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা, সুইসাইড করবার মত কোন কারণ ছিল কিংবা ঘটেছিল কিনা গীতার?
তিনজনেই বলে, না।
প্রতুল বললে, গীতা সুইসাইড করতে পারে কথাটা যেন এখনও আমি বিশ্বাস করতে পারছি না মিঃ দত্তরায়। She was full of life and energy—তার কোন অভাব ছিল না বা কোন problem ছিল না, তবে কেন সে সুইসাইড করতে যাবে।
মিঃ দত্তরায় তখনকার মত মৃতদেহ মর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করে বিদায় নিলেন।
২. পরের দিন সকালেই জরুরী তার
০২.
পরের দিন সকালেই জরুরী তার পেয়ে গীতার দাদা শান্তনু প্লেনে কলকতায় ফিরে এল। গীতার আকস্মিক মৃত্যুসংবাদটা যেন তাকে কেবল মর্মাহতই নয়, যেন বিস্ময়ে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। আইলোশনের শিশিটা গীতারই চোখে দেবার জন্য ডাক্তার প্রেসক্রাইব করেছিল।
সবাই বলছে, গীতা সুইসাইড করেছে ঐ বিষাক্ত লোশন খেয়ে। কিন্তু কেন? কোন্ দুঃখে সে সুইসাইড করতে যাবে? বোনকে তো সে কোনদিন এতটুকু অনাদর করেনি, তার কোন কাজে কোনদিন বাধা দেয়নি, কখনও ভুলেও এতটুকু তিরস্কার করেনি তবে?
তাছাড়া গীতার মত বুদ্ধিমতী, বিবেচক, প্রাণচঞ্চল মেয়ে আত্মহত্যা করেছে কথাটা যেন ভাবাও যায় না।
নিজের ঘরের মধ্যে চুপচাপ বসেছিল শান্তনু। দত্তরায় এলেন।
শান্তুনবাবু, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আজ পাওয়া গিয়েছে, কিন্তু রিপোর্টটা সম্পূর্ণ অন্য রকম বলছে।
অন্য রকম!
হ্যাঁ, cause of death—বিষ নয়।
তবে? উৎকণ্ঠিত শান্তনু দত্তরায়ের মুখের দিকে তাকায়।
গীতা দেবী সুইসাইড করেননি। তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।
হত্যা! কি বলছেন আপনি?
তাই। গলা টিপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে।
হত্যা করা হয়েছে তাকে? কে–কে তাকে হত্যা করল?
আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব। মনে হচ্ছে বাড়ির কেউ। কারণ সে-সময় তো বাইরের কেউ ছিল না। আচ্ছা, আপনাদের ঐ চাকর শম্ভুচরণ–
না না, এ আপনি কি বলছেন! শম্ভু একপ্রকার গীতাকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছে।
তাহলেও পুরনো চাকরবাকরের অমন দুষ্কৃতির নজিরেরও অভাব নেই।
কিন্তু কেন—কেন সে গীতাকে হত্যা করবে?
সে কথা এই মুহূর্তে আমি বলতে পারব না আরও ইনভেসটিগেশন না করে। শম্ভুকে একবার আমি থানায় নিয়ে যেতে চাই। তাকে এরবার ডাকুন।
কিন্তু আশ্চর্য!
শম্ভুকে ডেকে সাড়া পাওয়া গেল না এবং খোঁজ করে জানা গেল, গত রাত থেকেই নাকি শম্ভু নেই।
কোথায় গেল শম্ভু?
মানদা বললে, তা তো জানি না।
আমাকে এ কথা এতক্ষণ জানাওনি কেন? শান্তনু প্রশ্ন করে।
ভেবেছিলাম আপনিই হয়ত তাকে কোন কাজে কোথাও পাঠিয়েছেন দাদাবাবু। মানদা বলে।
৩. শম্ভুচরণ যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে
০৩.
শম্ভুচরণ যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে। দুদিন ধরে সারা কলকাতা শহরে তোলপাড় করেও তার কোন সন্ধান করা গেল না। পুলিস হন্যে হয়ে যেন শম্ভুচরণকে সর্বত্র খুঁজে বেড়াচ্ছে। তার গ্রামের বাড়িতেও ধাওয়া করেছিল পুলিস, কিন্তু সেখানেও তার কোন সন্ধান পায়নি।
পুলিসের একপ্রকার ধারণাই হয়ে গিয়েছে, ওই শম্ভুচরণই দোষী। সে-ই গীতাকে হত্যা করছে।
শান্তনু কিন্তু এখন বলছে, শম্ভু গীতাকে হত্যা করতে পারে, কিছুতেই সে বিশ্বাস করতে পারে না। তবে শম্ভুচরণ গীতাকে না হত্যা করলেও, কেউ-না-কেউ হত্যা করেছে। তাকে ঠিকই কিন্তু সে কে? কে হত্যা করতে পারে গীতাকে? আর কেনই বা হত্যা করল? গীতার মৃত্যু হয়েছে, কথাটা যেন এখন কিছুতেই ভাবতে পারছে না শান্তনু।
হঠাৎ মনে পড়ে শান্তনুর একজনের কথা। প্রেসিডেন্সিতে একসঙ্গে বছর-দুই পড়েছিল। তারপর দুজন দুদিকে চলে যায়। তাহলেও মধ্যে মধ্যে দেখা হয়েছে।