গীতা এম. এ. পাশ করে পার্টি করে বেড়ায় এবং এক বেসরকারী কলেজে অধ্যাপিকা।
মাসী অনেক চেষ্টা করেছে ভাই-বোনকে বিয়ে দেবার। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, শান্তনু বলে, বুঝি মাসী, বিয়ে একটা করা উচিত আর ইচ্ছেও ষোল আনা আছে, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে–
তোর আবার মুশকিলটা কি? বিয়ে করলেই তো হয়! মাসী বলে।
মুশকিল হচ্ছে গীতা।
গীতা!
হ্যাঁ। ও বিয়ে করলেই আমি নিশ্চিন্ত। ঝাড়া-হাত-পা একেবারে সটান গিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে পারি।
গীতা পাশেই ছিল, সে মুখ ভেংচে বলে ওঠে, ওঃ কী দরদ রে! গীতা না বিয়ে করলে উনি বিয়ে করতে পারছেন না! মনে করলেই তো হয় গীতার বিয়ে হয়ে গিয়েছে!
সেটা শান্তনুর ব্যাপারেও মনে করে নিলে হয়।
সত্যি দাদামণি, বিয়ে কর না একটা। একটা বেশ sweet বৌদি আসবে।
আর আমার বুঝি একজন ভগ্নীপতির শখ নেই!
ইতর! গীতা বলে ওঠে।
ক্রুয়েল! শান্তনু জবাব দেয়।
হিপক্রিট!
আনসিমপ্যাথেটিক!
কাওয়ার্ড!
আনসোস্যাল।
কথা-কাটাকাটি করতে করতে ভাই-বোন একসময় ক্ষান্তি দিয়েছিল।
গীতাই হাসতে হাসতে পরের দিন সবিস্তারে ব্যাপারটা বর্ণনা করেছিল ওদের তিন বন্ধুর কাছে।
সত্য দাদামণিটা ভারি ইন্টরেস্টিং!
ঐ সময় হঠাৎ প্রতুল বলেছিল, কিন্তু সত্যি গীতা, তোমার ব্যাপারটা কি বল তো?
কীসের ব্যাপার?
বিয়ে কি সত্যিই তুমি করবে না নাকি?
করব না কবে আবার বললাম।
তবে?
কি তবে?
করছ না কেন?
মনের মত স্বামী জুটবে! তবে তো। যার তার হাত ধরে তো কিছু আর বিয়ের পিড়িতে গিয়ে বসে পড়তে পারি না।
প্রতুল বলেছিল আবার, কেন, আমাদের পার্টিতেও এত ছেলে রয়েছে-মিত্রা, রেবা, রীতি ওরা তো পার্টির ছেলেদেরই বিয়ে করল।
করেছে বটে, তবে ভুল করেছে।
ভুল।
হ্যাঁ, কমরেডদের ভিতর থেকে বিয়ে করা উচিত হয়নি। কারণ পার্টি পলিটিকস ও সংসার-পলিটিকস্ সম্পূর্ণ দুটো আলাদা ব্যাপারকে এক জায়গায় এনে দাঁড় করানো ওদের বুদ্ধির কাজ হয়নি।
কুনাল ঐ সময় বলেছিল, কিন্তু কারও প্রতি কারও যদি ভালবাসা হয়ই
একটা কথা ভুলে যেয়ো না কুনাল, পার্টির কর্মী হলেও প্রত্যেকে মানুষ, মেসিন নয়। এবং কতকগুলো জায়গায় তাদের সংসারের আর দশজন মানুষের সঙ্গে কোন তফাৎ নেই।
ল্যান্সডাউন যখন পুরোপুরি ল্যান্সডাউন হয়নি, গীতাদের বাবা ডাঃ সুকান্ত চক্রবর্তী এসে জায়গা কিনে বাড়ি তৈরি করেছিলেন।
তারপর অবিশ্যি ক্রমে বহু ঘর-বাড়ি তৈরি হয়ে জমজমাট হয়ে ওঠে।
বাড়ির নাম নিরালা।
তিনতলা বাড়ির মধ্যে অনেকগুলো ঘর।
একতলার খান-দুই ঘর নিয়ে শান্তনুর চেম্বার এবং বাকি দুটো ঘরে গীতাদের পার্টির আড়া।
নন-রেজিস্টার্ড শাখা-অফিস।
দোতলার দুটো পাশাপাশি ঘরের একটাতে থাকে সৌদামিনী মাসী আর একটায় গীতা। বাকি সব খালিই পড়ে।
তিনতলায় শান্তনুর আড্ডা।
ব্যাপারটা অবিশ্যি দাসী মানদাই প্রথমে জানতে পারে। সাধারণত বেলা করে কখনও ওঠে না গীতা। কিন্তু বেলা সাতটা বেজে গেল, গীতা ওঠেনি দেখে মানদা ডেকে তুলতে গিয়েছিল দিদিমণিকে।
ঘরের দরজা খোলাই ছিল–মাত্র ভেজানো।
ভেজানো দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকেই মানদা কেমন যেন থমকে দাঁড়ায়। শয্যাটা এলোমেলো। আড়াআড়ি ভাবে গীতা শয্যার উপর শুয়ে। একটা হাত অসহায় ভাবে খাটের পাশ দিয়ে ঝুলছে, অন্য হাতটা ছড়ানো।
চোখ দুটো যেন ঠেলে বের হয়ে আসছে, মুখটা ঈষৎ হাঁ করা। ডানদিকের কষ বেয়ে ক্ষীণ একটি রক্তের ধারা।
তবু সামনে গিয়ে দাঁড়ায় মানদা এবং বুঝতে পারে গীতার দেহে প্রাণ নেই।
তাড়াতাড়ি বাইরে ছুটে আসে।
সোজা একেবারে একতলায়। শম্ভু ট্রেতে করে চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে উপরে যাচ্ছিল গীতার ঘরে।
শম্ভু! চিৎকার করে ওঠে মানদা।
কি হল? চমকে ফিরে তাকায় শম্ভু।
ওটা রাখ, শীগগিরি ওপরে চল!
কেন? কি হয়েছে?
দিদিমণি—
কি হয়েছে দিদিমণির?
মরে গেছে।
সে কি!
হ্যাঁ–চল শীগগির—
শম্ভু তাড়াতাড়ি ছুটে তখুনি উপরে যায়। গীতার ঘরে ঢুকে গীতার দিকে চেয়ে সেও বুঝেছিল গীতা আর বেঁচে নেই, তবু সে বাড়ির পারিবারিক প্রৌঢ় চিকিৎসক ডাঃ সান্যালকে ফোন করে দেয়।
ডাঃ সান্যাল এসে দেখেন, শয্যার উপর একপাশে একটা খালি পয়জন আইলোশনের শিশি পড়ে আছে।
ব্যাপারটা সুইসাইড ভেবে তিনিই তখন নিকটবর্তী থানায় পুলিশ অফিসারকে ফোনে সংবাদ দেন।
অল্পক্ষণের মধ্যে পুলিস এসে পড়ে।
শম্ভু ও মানদাকে নানারকম জেরা করে জানতে পারেন থানার ও. সি. মিঃ দত্তরায়, গতকাল অনেক রাত্রি পর্যন্ত গীতা তার পার্টির বন্ধু সুভাষ কুণাল ও প্রতুলকে নিয়ে আড্ডা দিয়েছে।
শম্ভু জানত গীতার ঐ তিনজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কথা।
তখন সে প্রতুলকে ফোন করে।
.
প্রতুল এসে পৌঁছল বেলা তখন সাড়ে নটা।
থানার ও. সি. দত্তরায় তখন গীতার শয়নঘরের পাশের ঘরে বসে মানদার জবানবন্দি নিচ্ছিলেন সৌদামিনীর জবানবন্দি শেষ করে।
সৌদামিনী বিশেষ কিছু বলতে পারেনি।
বয়স হয়েছে, তাছাড়া ইদানীং চোখে ছানি পড়ায় ভাল দেখতে পায় না। বাতও আছে। কদিন ধরে বাতের কষ্টটা বেড়েছে।
গতকাল তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়েছিল। গীতা ঐ সময় নিচের তলায় তার বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিচ্ছিল।
মানদা তার জবানবন্দিতে বললে, দিদিমণি ও তার বন্ধুরা রাত সাড়ে দশটা নাগাদ নিচের ডাইনিং হলে বসে একত্রে খাওয়া-দাওয়া করে। গীতা নিজে মার্কেট থেকে মাংস এনে রান্না করেছিল। খাওয়া-দাওয়ার পরে আবার ওরা বাইরের ঘরে গিয়ে বসে। বাইরে তখন বেশ বৃষ্টি পড়ছে।