এতটা সুস্পষ্ট কথা আর কী হতে পারে। পরিষ্কারভাবেই দেখা যাচ্ছে, ভূভারতের আদিতম নীতিশাস্ত্রটি হল ‘দণ্ডনীতি’ এবং যুধিষ্ঠিরকে পিতামহ ভীষ্মদেব আরও বলেছিলেন, “দণ্ডপ্রভাবেই জনসমাজে নীতি ও ধর্মের প্রচার হইয়াছে”। তার মানে, ‘দণ্ডনীতি’-ই যে কতৃত্বতন্ত্রের আদিতম নীতিশাস্ত্র শুধু তাই-ই নয়, এ জিনিস জনসমাজে প্রচলিত নীতিবোধের জনকও বটে। এবং এই নীতিবোধের প্রধান দুই উপায় হচ্ছে ‘নিগ্রহ’ ও ‘অনুগ্রহ’। এই হল সেই ‘নিমিত্ত’, যে নিমিত্তে “সকল লোকে … রাজার প্রসাদলাভের আকাঙ্ক্ষা করে”। নইলে যে মার খেতে হবে, নিগৃহীত হতে হবে। তার চেয়ে অনুগ্রহ-তাড়নাই বাস্তববাচিত।
দণ্ডনীতি কী বস্তু, সমাজ-সংসারে এর কাজ কী তাও যুধিষ্ঠিরকে সবিস্তারে বুঝিয়ে বলেছিলেন অর্জুন– “দণ্ড প্ৰজাদিগকে শাসন ও রক্ষণাবেক্ষণ করিয়া থাকে। সকলে নিদ্রায় অভিভূত হইলেও দণ্ড একাকী জাগরিত থাকে। পণ্ডিতেরা দণ্ডকে প্রধান ধর্ম বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন”।
এসব কথা আজকের সংসদীয় গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের অত্যাধুনিক প্রবক্তাদের মুখে শোনাও যা, ‘সভ্যতার উষালগ্নের দণ্ড বা আইন প্রয়োগকারী সত্তা অর্জুনের মুখে শোনাও তা-ই। কেননা আইনের শাসন তথা দণ্ডনীতি প্রতিষ্ঠার নামই সভ্যতা’ এবং সত্যিকারের ‘সভ্যতার’ নামে এই জিনিসই চলছে গত পাঁচ হাজার বছরের ‘কতৃর্তৃতান্ত্রিক সভ্যতা’ জুড়ে। এই দণ্ডনির্ভর সভ্যতায় দণ্ডই ‘প্রধান ধর্ম’ বটে, তবে তা ‘মনুষ্যধর্ম’ নয়। শাস্ত্রধর্ম তথা ‘রাজধর্ম এবং সেই কারণেই বিপরীত দিক থেকে ‘প্রজা’-র ধর্মও বটে। অন্য কথায় এ বস্তুই আজকের ‘সভ্যযুগের রাষ্ট্রের ধর্ম। আইনের ধর্মই তো দণ্ড। শাসনের ধর্মই তো দণ্ড। এই আইনের শাসনকে কখনও সত্যিকারের মনুষ্যধর্মের নামে চালানো যায় না। একে চালাতে হয় শাস্ত্রধর্মের নামে। এবং পুনরাবৃত্তি করতেই হবে, আদিতম শাস্ত্রধর্মের নামই দণ্ডশাস্ত্র বা দণ্ডধর্ম বা কর্তৃত্বনীতি বা কর্তৃত্বধর্ম। এই জিনিসটিকেই কর্তৃত্বতন্ত্র মানুষের ধর্ম এবং প্রকৃতির ধর্ম বলে চালাতে চায়।
যুধিষ্ঠিরকে অর্জুন বলছেন, “ভয়ের রাজত্বই হচ্ছে দণ্ডনীতির প্রাণ” এবং “দণ্ডপ্রভাবে ধন ও ধান্য রক্ষিত হয়। … অনেকানেক পাপপরায়ণ পামরেরা রাজদণ্ডভয়ে, অনেকে যমদণ্ডভয়ে, অনেকে পরলোকভয়ে এবং অনেকে লোকভয়ে পাপানুষ্ঠান করিতে পারে না। অনেকে কেবল দণ্ডভয়েই পরস্পর পরস্পরকে ভক্ষণ করে না। ফলত সংসারে প্রায় সমুদয় কাৰ্য্যই দণ্ডভয়ে নির্বাহ হইতেছে। … ব্রহ্মচারী, গৃহস্থ, বানপ্রস্থ ও ভিক্ষুক ইহারা দণ্ডের ভয়ে স্ব স্ব পথে অবস্থান করিতেছেন। ভীত না হইলে কেহই যজ্ঞানুষ্ঠান, দান ও নিয়ম প্রতিপালন করিতে ইচ্ছা করে না।” তৎকালীন প্রধান সেনাপতি অর্জুনের বক্তব্য খুবই পরিষ্কার। দণ্ডনীতি মানেই হচ্ছে দমননীতি এবং শাসন-ত্রাসনের নীতি : “দমন ও শাসন করে বলিয়াই উহা দণ্ড নামে নির্দিষ্ট হইয়াছে”। আর কার জন্য কোন্ দণ্ড সমুচিত তার মোক্ষম বিধানও প্রস্তুত— “দণ্ড সংসার রক্ষা না করিলে সমুদয়ই গাঢ় অন্ধকারে নিমগ্ন হইত। দণ্ড দুর্দান্তদিগকে দমন ও দুর্বিনীত ব্যক্তিদিগকে শাসন করিয়া থাকে। দমন ও শাসন করে বলিয়াই উহা দণ্ড নামে নির্দিষ্ট হইয়াছে। ব্রাহ্মণের তিরস্কার, ক্ষত্রিয়ের বেতন প্রদান না করা, বৈশ্যের রাজসমীপে দ্রব্যজাত সমর্পণ এবং শূদ্রের সর্বস্বাপহরণই সমুচিত দণ্ড।”
কী সুনির্দিষ্ট, কী তীব্ৰসূচিমুখ এই দণ্ডনীতি সেই প্রাচীনকাল থেকেই। আর শাসনের প্রশ্নে সে কাউকেই ছাড়ে না। শাসনযন্ত্রের হাতে তথা শাসকের হাতে, রাষ্ট্রযন্ত্রের ম্যানেজারদের হাতে ব্রাহ্মণ থেকে শূদ্র পর্যন্ত কারও কোনো নিস্তার নেই? পার্থক্য আছে বৈকি। ব্রাহ্মণের জন্য তিরস্কার’-ই যথেষ্ট। আর শূদ্রকে শায়েস্তা করার জন্য চাই তার সর্বস্ব অপহরণ করা। (সেলিম রেজা নিউটন)।
প্রাক-ঐতিহাসিককালে মানুষের আত্মরক্ষার প্রধান উপকরণ ছিল দণ্ড। এক্কেবারে প্রথমদিকে ছিল শক্ত কাঠের লাঠি, পরবর্তী সময়ে হাড় বা ধাতুর তৈরি দণ্ড বা অস্ত্র। লগুড়, গাছের গুঁড়ি, বীণার ছড়, যষ্টি, নৌকার দাঁড় লাঙলের ঈষ, হাত বা ভুজ– সবই দণ্ড। সুস্থিত সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাজদণ্ড হল আইন ও বিচারের প্রতীক। জগতের সকলকে এ দমন করে, শাসন বা সংযত করে –তাই এর নাম দণ্ড। তাই শাসক হলেন দণ্ডধারী বা দণ্ডধর বা দণ্ডপাণি। মনু বলেছেন –লঘু পাপে লঘু দণ্ড, গুরু পাপে গুরু দণ্ড। দণ্ড বিধান এবং দণ্ড প্রণয়ন রাষ্ট্রনায়কের অন্যতম কর্তব্য।
মনুসংহিতার সপ্তম অধ্যায়ের ১৮ নম্বর শ্লোকে মনু বলছেন –”দণ্ড শাস্তি প্রজাঃ সর্বা এবাভিরক্ষতি।/দণ্ড সুপ্তেম্ভ জাগর্তি দণ্ডং ধর্মং বিদূর্বধাঃ।” অর্থাৎ দণ্ডই প্রজাদের শাসন করে, দণ্ডই তাদের রক্ষা করে, রক্ষক পুরুষেরা নিদ্রিত থাকলে দণ্ডই জেগে থাকে। পণ্ডিতগণ দণ্ডকেই ধর্ম বলে জানেন। অপরদিকে দণ্ড না-থাকলে কী হত সে বিষয়েও মনু বলেছেন –“যদি ন প্রণয়েদ্রাজা দণ্ডং দণ্ডেম্বততিঃ।/শূলে মৎসানিবাপক্ষ্য দূর্বলান বলবত্তরা।” (মনুসংহিতা– সপ্তম অধায়– শ্লোক ২০) অর্থাৎ রাজা যদি অনলসভাবে দণ্ডনীয় ব্যক্তির দণ্ডবিধান না করতেন, তবে শূলে মৎস্যের ন্যায় বলবান ব্যক্তিরা দুর্বল ব্যক্তিগণকে উৎপীড়ন করত। আরও যা যা ঘটত সেগুলিও মনুসংহিতার সপ্তম অধ্যায়ের ২১ নম্বর শ্লোকে উল্লেখ আছে– “অদ্যাৎ কাকঃ পুরোশং শ্বাবলিহাদ্ধবিস্তথা।/স্বামঞ্চ ন স্যাৎ কস্মিংশ্চিৎ প্রবর্তেধরোত্তরম্।” অর্থাৎ দণ্ড না-হলে কাক যজ্ঞীয় পিঠা ভক্ষণ করত, কুকুর যজ্ঞীয় হবি লেহন করত এবং কারও কোনো বিষয়ে অধিকার থাকত না। এক ওলট-পালট অবস্থার সৃষ্টি হত। মনু মনে করেন, “সর্বো দণ্ডজিততা লোকো দুর্লভভা হি শুচিনরঃ।/দণ্ডস্য হি ভয়াৎ সর্বং জগদ্ভোগায় কল্পতে।” (মনুসংহিতা– সপ্তম অধ্যায়– শ্লোক ২২) অর্থাৎ দণ্ডের দ্বারাই সকল মানুষ নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে, কারণ স্বভাবশুচি লোক দুর্লভ। দণ্ডেরই ভয়ে সমগ্র জগৎ ভোগে সমর্থ হয়।