কী কেলো রে? কী কেলো?
বাড়িতে উৎসব, সবাই জড়ো হয়েছেন। জড়ো হওয়া মানেই সবার আগে ঠাকুমার কাছে যাওয়া। তিন ছেলেই একত্রে উপস্থিত। জ্যাঠামশাই বেচারি তখনও স্বর্গের সিঁড়ির স্মৃতির দ্বারা তাড়িত–তাই তিনিই ঠাকুমাকে প্রণাম করে বললেন :
মা, আমারে চিনো?
চিনুম না ক্যান?
আমার নাম কী? কও দেহি।
ঠাকুমা হঠাৎ জিব কেটে সলজ্জ ঘোমটা টেনে দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। তারপর চোখের কোণ দিয়ে মিটিমিটির হেসে, ফিসফিস করে জ্যাঠামশাইকে প্রায় কানে কানে বললেন,
কমু কী কইরা? তোমার নাম যে আমারে লইতে নাই মনু? ভাসুরঠাকুরের নামে তোমার নাম দিসি কিনা! তুমি হইলা আমাগো বড় পোলা! সক্কলের আগে তুমি!
শুনে তো সকলেই স্তব্ধ।
তার ভাসুরের নামে নাম? মোটেই না। তার ভাসুরঠাকুর তো ঠাকুর্দার দাদা-বাবাদের জ্যোঠামশাই হন, তার নাম তো ক্ষেত্রপ্রসাদ। জ্যেঠুর নাম অমূল্য। কেসটা কী হল! ঠাকুমাই। বললেন, আইচ্ছা, নামের গোড়ার অক্ষর কইয়া দিতাসি–স-য়ে ফয়ে আস্ফ দিয়া নাম শুরু! বাস! অইসে! ঘরসুন্ধু মানুষ বজ্রাহত! ক্ষেত্ৰপ্ৰসাদে স-য়ে ফয়ে আস্ফ কই? সে তো কেবল স্ফটিকেই থাকা সম্ভব? এ পরিবারে তো ওই নামের কোনও পূর্বসূরী আছেন বলে এখনও শুনিনি।
এই স-য়ে ফ-য়ে-আস্ফ শুনে অবধি চেয়ারের পিঠ ধরে সেই যে দাঁড়িয়ে উঠেছিলেন, জ্যাঠা আর বসেননি।
এবারে জ্যাঠা একা নন–বাবা, কাকা সকলেই বিচলিত হয়ে ঠাকমাকে চেপে ধরলেন।
ঠিক কইর্যা কও দিনি মা? তোমার কয়ডা পোলা? তাদের নাম কী কী?
কাকু বললেন, মা, আমার পানে চাইয়া দ্যাখো। –কও তো আমি কে? আমার নাম কী? কাকুর চ্যালেঞ্জের সামনে পড়ে ঠাকুমাও মরিয়া। আর চালাকি চলছে না। এবার ঠাকুমা পুত্রের চোখে চোখে সোজাসুজি তাকালেন।
হঃ! তোমারে চিনি না? আমার পোলা, আমি চিনুম না। নাম শোনবা? ক্যান মনু, আপন আপন নামগুলো তগো মনে নাই? তবে শুইন্যা লও এই আমি কইয়া দিলাম।
তারপরেই হঠাৎ নামতা পড়বার মতো গড়গড় করে একঝাক নাম আবৃত্তি করে গেলেন
বনবিহারী-বিনোদবিহারী-বিমানবিহারী-পুলিনবিহারী-রাসবিহারী-তপন-স্বপন-চন্দন রঞ্জন-কাঞ্চন। লও। আমার সব কয়ডা পোলাপাইনের নাম। গইন্যা লও।
ঘরসুদ্ধ শ্রোতা নির্বাক।
ঠাকুমার তিন সন্তান। অমূল্য, তারাপদ, সদানন্দ। কেউ এই লিস্টে নেই। তাদের পুত্রেরা অবশ্য আছে। কিন্তু বাকি পাঁচজন বিহারীবাবুরা যে কারা, পরিবারের কেউই বলতে পারল না। ঠাকুমা নামগুলি পেলেন কোথায়? নাতিদের নাম না হয় বোঝা গেল,–ছেলেদের নাম বিস্মরণ, সেও না হয় কষ্টেসৃষ্টে বোধগম্য হল, কিন্তু ওই পাঁচটা উটকো নাম কাদের? ঠাকুমা যে ইষ্টমন্ত্রের মতো মুখস্থ আউড়ে গেলেন। বিরাট এক রহস্য সৃষ্টি করল ওই অচেনা নামাবলি। ওরা কারা?
.
রহস্যের মীমাংসা করলেন ঠাকুমারই ছোটভাই, আমাদের মামাদাদু। ঠাকুমার ওই একটিমাত্র ভাই। মামাদাদু বললেন, ওই পাঁচটিই তাদের পাঁচ দাদার নাম। মামাদাদুর জন্মের আগেই তারা গত হয়েছেন মা শীতলার কৃপায়, ঠাকুমার বয়স তখন চার বছর। এই কারণেই মামাদাদুর নাম হয়েছে শীতলাচরণ। ঠাকুমার বিয়ে হয়েছে ন বছরে। ঠাকুর্দাও দেখেননি এই সম্বন্ধীদের। কোথা থেকে যে তুলে এনেছেন ঠাকুমা শৈশবের বিস্মৃত নামগুলি, বসিয়ে দিয়েছেন নিজের সন্তানদের নামের সারিতে, তার অতিপ্রিয়জনদের তালিকায়। কিন্তু স-য়ে ফ-য়ে-আস্ফটার সমাধান মামাদাদুও জানেন না। ওটার কিনারা হল না।
.
এই ঘটনার উপসংহার বাকি আছে দিদি। এখানেই শেষ নয়। পরদিন সকালে উঠে ঠাকুমা মাকে ডেকে জিগ্যেস করলেন, বউমা, আমি কেডা? এ-হেন অস্তিত্ববাদী প্রশ্নে মা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে স্থাণুবৎ। কও দিনি? আমি কেডা?
প্রায় গোপন কথা বলাবলির মতো ফিসফিস করে মাকে জিগ্যেস করলেন ঠাকুমা, ষড়যন্ত্রের ভঙ্গিতে। অগত্যা তার বউমা বললেন, মা, আপনি আমার শাশুড়ি, এই বাড়ির কর্তামা, আনন্দমোহিনী।
ঠাকুমা মন দিয়ে শুনলেন। তারপর ভুরু কুঁচকে, সন্দিগ্ধ সুরে বললেন, আনন্দ মোহিনী? হেইডা আবার কেডা? বউমা? ওই নামখান কার?
মা-র প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা। তখন আমরা গেলাম অভয় দিতে। ওই লাইনেই নয়। ট্র্যাক বদল।
আরে! তুমি তো আমাদের ঠাকুমা, আমাদের চিনতে পারছ না?
আঃ হা। তাই ক। আমি তো রঞ্জন-চন্দনের ঠাকুমা। বাস বাস আর কইতে লাগব না। বুঝছি।
রঞ্জন থামল। এই গল্পের টীকা হয় না। আমি শুধু চায়ের কাপটা এগিয়ে দিই। রঞ্জন চা-টা শেষ করে আবার শুরু করল।
মেজদির নাতি হয়েছে। তাকে নিয়ে এসেছে ঠাকুমার কাছে। ঠাকুমা বসে আছেন বিছানায়, তার কোলে দেওয়া হল। ঠাকুমা তো পুতিকে কোলে করে খুব খুশি। অনেক আদর করছেন, ছড়া কাটছেন। ফরসা ধবধবে ছোট্ট বাচ্চাটা, মাসখানেক, মাস দেড়েকের হবে, তার পরনে কিছু নেই। কেবল কোমরে কালো ঘুনসিতে একটা তামার পয়সা বাঁধা। ঠাকুমা আদর করতে করতে জিগ্যেস করলেন, ভারি সোন্দর! এইডা কি হইসে? পোলা, না মাইয়া?
সবাই সমস্বরে বলে উঠেছি, কেন ঠাকুমা? ও তো তোমার কোলেই আছে; ছেলে না মেয়ে দ্যাখাই তো যাচ্ছে সেটা
ঠাকুমা কেমন লজ্জা পেয়ে গেলেন। আস্তে করে মাথা নেড়ে মৃদুস্বরে বললেন, অতশত আমার মনে নাই, তরাই কইয়া দে আমারে—
.
আমি এবারেও কী বলব, ভেবে পাই না, শেষে রঞ্জনই কথা বলে।