তা মা ভালো আছ তো?
হ। আমি তো আছি ভালোই। তুমি কেমন আছ শুনি!
ভালোই আছি।
আইলা কী করিয়া?
ট্যাক্সিতে।
টেকশি চলাচল করে?
তা করে। খরচা আছে।
খরচা তো থাকবই। এই পার-ওই পার বইলা কথা!
জ্যাঠা এবারে সন্দেশের বাক্স এগিয়ে দ্যান,
মা, তোমার ল্যাইগ্যা সন্দেশ আনছি।
থাউক। ওইখানেই রাইখ্যা দাও। সন্দেশও নাকি বানায়? বা-ব্বাঃ!
কেন বানাবে না? বেশ ভালো সন্দেশ। অন্যরকম। একটু খেয়ে দ্যাখো।
–থাউক। খাইয়া কাম নাই। ভালো না হইয়া পারে! কইথিক্যা আনছ! সহজ কথা? এক্কেরে ওইপার থিক্যা!
ওই নামেই এপার-ওপার। সবই এক, মা।
ঠাকুমা একটুখন চুপ করে থাকেন।
তা, খাও কী?
মানে?
মানে ভাতটাত খাইতে পারো?
হ্যাঁ…ভাতটাত খেতে পারব না কেন?
রান্ধিয়া দ্যায় কে?
কেন, তোমার বউমা?
আ-হাঃ! এইডা তুমি কী কইলা অমূল্যা! বউ-মা-ও?
ঠাকুমা ডুকরে ওঠেন।
বউমাও? হায় হায় রে, আমারে এই খবরডাও কেও দেয় নাই? আমারে কেও কিসসুই কয় না, বউমার খবরখান আমারে দিলই না–, ঠাকুমা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে দেন। জ্যাঠা এবারে মৃদু লাঠিচার্জের মতো মৃদু ধমক লাগান।
কী আবার খবর দিব? শুধু শুধু কাইন্দো না তো মা। তার যদি খবর কিছু হইত, তোমারে দিতই।
ছেলের বকুনি খেয়েই ঠাকুমার কান্না বন্ধ। নাক-চোখ মুছে,–তা কও, বউমা আছে কই?
ঘরেই? যাইব ক্যানে?
তা ভালো, তা ভালো। লগে লগেই আছ দুইজনায়। সেই ভালো। রান্ধিয়া বাড়িয়া দিতাসে। হেইখানে যাইয়াও সেবাযত্ন পাইতাসো বউমার। শুইন্যাও শান্তি!
জ্যাঠামশাই দিশাহারা। কিছুতেই ঠাহর পাচ্ছেন না। ঠাকুমার আসল সমস্যাটি তাকে জানানো হয়নি। ছেলেকে দেখতে চান, মন কেমন করছে ছেলের জন্য–এটুকুই বলা হয়েছে তাকে। জ্যাঠামশাইয়েরও নয় নয় করেও তো বয়েস পঁচাত্তরের ওপরে। ওসব অলুক্ষুণে কথা তাঁকে খুলে বলা যায় না। জ্যাঠামশাইয়ের মনে মনে নানারকম হোঁচট লাগছে, কিন্তু একটা জিনিস তিনি গিলতে পারছেন না।
মা, কও দেহি তুমি আমারে প্রণাম করতে দিলা না ক্যান? ঠিক কইরা কও
জিভ কেটে মাথা নেড়ে ঠাকুমা বলছেন, ছি, ছি, পরনাম করতে হয় নাকি। ওইপার থিক্যা আইস্যা তুমিই তো সক্কলের পরনাম নিবা। তা ভালো, আইছ আমারে দেখনের লেইগ্যাই আইছ, সন্দেশ লইয়া আইছ। খুব ভালো, কিন্তু তাও এট্টা কথা বুঝি না। তুমি আইলা কীভাবে?
তুমিই পরনাম–নিবা-টা জ্যাঠামশাই বুঝতে না পারলেও আলোচনা চালিয়ে যান মুখখানা যারপরনাই বিভ্রান্ত দেখাতে থাকে যদিও।
কইতাসি ত, ট্যাকসি কইরা! কয়বার কমু? শোন নাই?
টেকশি ওইপারেও যায়?
যাইব না ক্যান? যাইতে তো মানা নাই?
না, মানে…আচ্ছা তুমি নীচে আইলা কীভাবে? হেইডা কও। নাকি, টেকশি এককেরে উপর অবধি চলিয়া যায়?
জ্যাঠা এবার উদভ্রান্ত।
এইডা তুমি কী কইলা মা? ট্যাকসি তিনতলার উপ্রে উঠে নাকি? আমিই সিঁড়ি দিয়া নাইমা আইসা বড় রাস্তা থিক্যা ট্যাকসি ধরি।
সিঁড়ি! সিঁড়ি দিয়া উপর-নীচ করো?
না তো কি? তিনতালা বাসায় কি লিফট বানায় নাকি!
অসুবিধা হয় না?
না অহন পর্যন্ত তো হয় নাই। তবে ফিউচারের কথা কওন যায় না।
তাহলে মনে হয় সিঁড়িডা কমপ্লিট করসিল রাবণে? আমি তো জানি, আধা-খাচরা। হইয়া পইরা আছে, কমপ্লিট হয় নাই–তাই জিগাইসি, নীচে আইলা কেমনে?
রা-ব-ণের সিঁড়ি! আমি কি স্বর্গে আছি মা?
এই কথাটায় মা ফোঁস করে উঠলেন।
স্বর্গ না তো কী? তুমি হইলা গিয়া তোমার বাবার বড় পোলা। তুমি স্বর্গে যাবা না তো কি নরকে যাবা! তুমিও কও অমূল্যা–
জ্যাঠার আর ধৈর্য থাকে না।
কিন্তু মা, হেইডা তো বহু পরের কথা, আগে তো মরি? অহন তো আমি বাইচ্যা আছি, স্বর্গে যামু, না নরকে যামু, এই প্রশ্নটা কেও করে নাই আমারে। তুমিই কইলা ক্যাবল।
কী কইল্যা? তুমি বাইচ্যা আছ? অমূল্যা তুমি বাইচ্যা আছ? তুমি জীবিত? তুমি স্বর্গে যাও নাই? ওঃ হো-হো…আমার অমূল্যা মরে নাই রে..। আমার অমূল্যা বাইচ্যা আছে রে…ওঃ হো হো…ঠাকুমার আনন্দাশ্রু অঝোরধারায় ঝরতে লাগল। এবং গলা ছেড়ে ওঃ হো-হো-কান্নাটা অবিকল মড়াকান্নার মতো শোনাতে লাগল। এর চাইতে সেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে–অমূল্যা আর নাই-কান্নাটাই ছিল ভালো।
জ্যাঠামশাই এতক্ষণে সবটা বুঝতে পারেন। ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরে জ্যাঠামশাই বললেন, মাগো, আসো, তাইলে প্রণামডা অহন কইরা লই?
লও, লও, কর না পরনাম তোমার যত ইচ্ছা। তখন কি জানি? আমি তো জানি তুমি ওইপার থিক্যা…তাই তো হড়বড় করিয়া শুদ্ধা কাপড়খানা পরিয়া আইলাম।
জ্যাঠামশাইয়ের চিবুক ছুঁয়ে চুমু খেয়ে ঠাকুমা মিষ্টি করে হাসেন। তারপরে হাত বাড়ালেন, কই দ্যাও তো দেহি সন্দেশডা যে আনছিলা? জিনিসখান কেমুন, দেখি খাইয়া–
.
আমি হাঁপ ছেড়ে বলি, যাক! সব ভালো যার শেষ ভালো!
কিন্তু শেষটা ভালো কিনা সেটাই তো সংশয়। সেদিন, ঘণ্টেশ্বরের পৈতের দিনে সিরিয়াস কেলো করেছেন। রঞ্জন গুছিয়ে বসেছে।
এতক্ষণে আমার চায়ের কথা মনে পড়ল। চা খাবি তো? রঞ্জন?
আর কী আছে, সঙ্গে কী দেবে?
আজকে হয়েছে মাংসের ঘুগনি।
গ্রেট! লাগাও চা। ঘন্টের পৈতের দিনে বাড়িতে অত লোক, তার মধ্যে ঠাকুমা, বাবা, জ্যাঠা, কাকামণি প্রত্যেকের প্রেস্টিজ পাংচার করে দিয়েছেন। ব্যাপক কেলো।
ঠাকুমার কেলোর কীর্তিগুলো শুনতে আমি সর্বদাই আগ্রহী।