.
ছোড়দার জন্মদিনে ছোড়দার বন্ধুরা আসবে ছটার সময়ে। জয় এসে যাবে পাঁচটায়। তাকে ফিরতে হবে তো সল্টলেকে? এই গড়িয়া থেকে? শীতকালে?
পৌনে পাঁচটা থেকে বাড়ির সবাই রেডি। ছেলেটা আশা করি পাঙ্কচুয়াল?
পাঁচটায় বেল বাজাল।
তিতলি দৌড়ে গেল, জয় এসেছে।
ছোড়দাও গেল গেট খুলতে, আফটার অল, অতিথি তো, বাড়ির ছেলেরা না গেলে হয়?
কিন্তু গেট খুলেই ছোড়দা অবাক। কই, জয় তো আসেনি? এ আবার কে? আরে, এ তো একটা ঝাকড়া চুলো জিন্স-টি শার্ট-পরা স্মার্ট মতন মিস্টি মতন মেয়ে এসেছে। জয় কই?
জয় আসেনি?
অবাক ছোড়দাকে আরও অবাক করে দিয়ে তিতলি ঝাঁপিয়ে পড়ল।
ছোড়দা, মীট জয়। দ্য গ্রেট জয়াবতী মুখার্জি। আমার ছোড়দা, যার কথা তোকে বলেছি।
হাসিমুখে জয় হাত বাড়িয়ে দিল ছোড়দার থমকে থাকা হাতের দিকে।
কৃত্তিবাস পুজো সংখ্যা ২০১৮
ঠাকুমার গল্প
রঞ্জন বিমর্ষ মুখে উস্কোখুস্কো চুলে দাড়ি চুলকোতে চুলকোতে এসে ঘরে ঢুকল।
নবনীতাদি, ঠাকুমার–
কী হয়েছে ঠাকুমার? হাতের কাজ ঠেলে দিয়ে খাড়া হয়ে বসি।
রঞ্জনের ঠাকুমাটি আমাদের বড় প্রিয়জন। নব্বই ছুঁয়েছেন–এই বয়েসে তো একটু ভয়-ভয় করেই।
শরীর খারাপ করেছে? কী হয়েছে ঠাকুমার?
শরীর না। মাথাটা।
সে আর নতুন কী! মাথা তো অনেকদিনই নিজের খেয়ালখুশিতে চলছে।
এ অন্য পরিচ্ছেদ–ভীমরতি এখন ভয়াল পরিণতির দিকে! শনৈঃ শনৈঃ- রঞ্জনটাকে নিয়ে বড় ঝামেলা। দুটো কথা বিশ্বাস করি, তো পরের তিনটে করি না। মুখচোখ দেখলে কিছুতেই টের পাওয়া যাবে না সত্যি বলছে না গুল মারছে। দুটোই তো অবিকল একরকমভাবে। পরিবেশিত হয়। সত্যিটাকে মনে হবে গুল, আর গুলটা সত্যি। বিশ্বাস করতেও ইচ্ছে হয় না, আবার বিশ্বাস না-করলেও ঠকে যেতে পারি!
ঠিক করে বল তো দেখি কী হয়েছে! ঠাকুমার আমার প্রিয় মানুষ হবার বহু কারণ রয়েছে। তার কয়েকটা বলতে পারি। ধরুন, আপনি বনের মধ্যে হঠাৎ, একা, রাত্রিবাস করতে বাধ্য হয়েছেন। আপনার ভয় করছে। তখন যদি ঠাকুমা থাকতেন আপনার কাছে। তিনি আপনার বালিশে তিনবার থাবড়া মেরে একটা মন্ত্র পড়ে দিতেন। মন্ত্রটা জরুরি। শিখে রাখুন! আমার তো যাযাবর স্বভাব, এখানে সেখানে হট্টমন্দিরে শয়ন করার সময়ে এই মন্ত্রটা খুবই কাজে লাগে।
বালিশে তিন থাবড়ার পর, বলুন :
কপ ফোল! কপ ফোল! কপ ফোল!
সাপ-চোরা-বাঘা তিনে নিষ্ফল! নিষ্ফল! নিষ্ফল!
যদ্দুর যায় কপ ফোলের এই রা-ও
সাপ-চোরা-বাঘা তিনে না বাড়াও পা-ও,
যদি বাড়াও পা-ও, দোহাই আমার ওস্তাদের মাথা খাও
মন আমার গুরুদেবের পায়!!
ওম্ গুরু দেবঃ শিবঃ/গুরুদেবঃ শিবঃ/গুরুদেবঃ শিবঃ, ওঁ..ম ম ম!
পরবর্তী স্টেপ, তিনবার, তিনদিকে ঘুরে ঘুরে ভক্তিভরে নমস্কার নিবেদন।
সেই মন্তর অবশ্যই শুনতে পাবে জগতের যত সাপ, চোর আর বাঘের দল। তিন গুষ্টির কেউই আর পা বাড়াবে না এদিকে–ওস্তাদের বাঁধন দেওয়া আছে না? এক্কেবারে নিশ্চিন্দি!–শুধু আরশোলা আর মাকড়সার জন্যে ঠাকুমার কোনও মন্তর আছে কিনা জেনে নিতে হবে। এইটেই বাকি।
ঠাকুমার কীর্তিকাহিনি কি অল্প? খুব বিশিষ্ট মহিলা। এই সেদিন নীল আর্মস্ট্রং যে চাদে বেড়াতে গিয়েছিল, সেটাই টিভিতে আবার করে দেখাচ্ছিল। নাতিরা গিয়ে ঠাকুমাকে বলল,
ঠাকুমা শুনেছ, কী হয়েছে? কী দেখলাম টিভিতে? চাঁদে মানুষ নেমেছে!
কী? তুমি কী কইলা মনু? চান্দের কথাডা কী কইলা?
চান্দে গিয়া মানুষ নামসে ঠাকুমা–চান্দ আর দূরে নাই–
নামসে কও ক্যান? ওঠসে কইতে হয়। মানুষ আকাশে নামে কী কইর্যা? চান্দে ত ওঠা লাগে। এইয়া কি পুষ্করিণী? তা, সেই মানুষ করসে কীডা, চান্দে যাইয়া?
ওই তো, হাঁটাচলা করছে, মানে ভেসে বেড়াচ্ছে আরকি, পা ডুবে ডুবে যাচ্ছে। তো, ভালো করে হাঁটা যায় না চাঁদের মাটিতে–।
আহা রে। পা-ও তো ডুইব্যা যাইবই। বর্ষাকাল না? এক্কেরে ভাইস্যা বেড়াইতাসে বেচারা? আহা হা। তা অহন না যাইয়া শুখা সিজনে যায় নাই ক্যান? অহন তো আকাশেও মাঘ বিদ্যুৎ-চান্দে যাওন কি সহজ ভ্রমণ? পথখান কি কম? দেইখ্যা মনে হয় কাছেই–চান্দ কিন্তু বহুদূর! কতদূর জানো? এক্কেরে হিমালয় পর্বত-টবর্ত পার হইয়া কৈলাস পর্বতের কাছে…বলেই হাত জোড় করে নমস্কার!
ঠাকুমার অভিনবত্ব বিভিন্নভাবে প্রকাশ পায়। সবাই মিলে গুলতানি করছে নাতিরা। ঠাকুমা গুটিগুটি উপস্থিত।
ও মনু তোমরা করো কী? সাড়ে তিনটার অ্যারোপ্লেলেন উইড়্যা গেল, অহন তরা চা খাইবি না? এইডা তো তগো চা খাওনের টাইম! খ্যাল করায়া দিতাসি। ঠাকুমা নিজে চা খান না।
বেলা সাড়ে তিনটের এরোপ্লেন! এরকমও হয় নাকি? আটটার মেল ট্রেন, দশটা পনেরোর প্যাসেঞ্জার, বড়জোর সাড়ে নটায় পাশের বাড়ির খুকুর স্কুলবাস–এসব হিসেব রাখতে পারে মানুষ। তাই বলে সাড়ে তিনটের এরোপ্লেন দেখে ঘরের কাজকর্মের টাইম শিডিউল বানানো! হ্যাঁ, সাড়ে তিনটের সময়ে আকাশ দিয়ে একটা জেট প্লেন যায় এবং ঠাকুমা তাই দিয়ে বিকেলটা শুরু করেন। লও লও সব তাস গুছাও এইবারে–চায়ের টাইম–সাড়ে তিনটার অ্যারোপ্পেলেন উইড়্যা গেসে গিয়া, সে-ই কখন…।
সেই ঠাকুমার কি ভীমরতি হয়? তবে হ্যাঁ, ওঁর মাঝে মাঝে খেয়াল চাপে। নানারকমের উদ্ভট খেয়াল। নাতিরাও তার মোকাবিলার জন্য সদাসর্বদা প্রস্তুত। ওই ঠাকুমারই নাতি তো তারা!