কথায় কথায় গোরুরও আধার কার্ড হচ্ছে শুনেছি। জিগ্যেস করলুম কীভাবে হয়? ছেলেগুলি খুবই দুঃখিত। গোরুর খবর জানে না। কিন্তু তাদেরও আধার কার্ড হচ্ছে যে ইদানীং, সেটা জানে। যখন আমার নয়নতারা দুখানির অন্তরঙ্গ পর্যবেক্ষণ আর পুঙ্খানুপুঙ্খ। চিত্রগ্রহণ হচ্ছিল ছোটবেলায় দিল্লিকা কুতুব দেখো আগ্ৰাকা তাজমহল দেখো, হাওড়াকা ব্রিজ দেখোর মতন দেখতে চৌকো চৌকো গোদা কালো চশমা-ক্যামেরা পরিয়ে, সেই সময়টায় ওদের মধ্যে একটি তরুণ একান্ত মনোযোগে তার ফোন থেকে কী যেন খুঁজে খুঁজে সারা হচ্ছে। আমার কাজ ফুরোলে আমি জিগ্যেস করলুম, কী খুঁজছ ভাই?
একগাল হেসে একটা ছবি বের করে, বিজয়গর্বে ছেলেটি আমাকে দ্যাখাল, পেয়েছি! একটি গোরুর মুখের ছবি। তার একটা চোখের সামনে ছোট্ট আলো ফোকাস করা হচ্ছে, আমার মতোই, কিন্তু দুটোর বদলে কেবল একটি চৌকো কালো চশমা ক্যামেরা পরিয়েছে।
এক চোখ?
গোরুদের বেলায় একটা একটা করে চোখের ছবি তোলা হয় কিনা? দুই চোখ যে মুখের দুদিকে। আপনাদের একসঙ্গেই দুই চোখের ছবি হয় ম্যাডাম। এইটুকুই তফাত মাত্র গোরুর আর মানুষের বেলায়। বুইলেন।
মাত্র এইটুকুই? বুইলুম। গোরুর এবং আমার যে এটাই প্রধান ফারাক, এটা জেনে নিয়ে মনেপ্রাণে তৃপ্ত হয়ে আমি প্রশ্নে ক্ষান্ত দিলুম। এ জন্মের মতো আধার কার্ডের পালা শেষ।
যাক! দেড়মাস বাদে খবর আসবে। ততদিন নিশ্চিন্তি। থ্যাংক ইউ কে এম সি! কে এম সি জিন্দাবাদ।
.
না, আমি ভুল বলেছিলুম, পালা শেষ নয়, পুনশ্চ আছে।
আজকে একটা ফোন এল।
আমি কে এম সি থেকে বলছি। নবনীতা দেব সেন ম্যাডাম আছেন? আধার কার্ডের ব্যাপারে।
বুক ধসে গেল। এখনও মেটেনি? ভুল হয়েছিল কোথাও? আ-বা-আ-র শুরু হবে?
কী ব্যাপার, বলুন তো।
নমস্কার। আমি জগবন্ধু বলছি, কেএমসি থেকে। আপনি শিববাবুকে বলেছিলেন? আমাকে শিববাবু বলেছেন আপনার আধার কার্ডের ব্যাপারে। কোনও ভাবনা নেই ম্যাডাম, যে কোনও দিন বিকেল চারটে নাগাদ চলে আসুন, আমরা সব করে দেব, কবে আসবেন, বলুন?
অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু আমার আধার কার্ড হয়ে গেছে যে?
কী করে হল? আমাদের মেশিন তো–
মেশিন তো বাড়িতে এসেছিল, চার জন করিতকর্মা ছেলে এসেছিল, টালিগঞ্জ না কোথা থেকে, অনেক যন্ত্রপাতি নিয়ে। থ্যাংক ইউ।
হয়ে গেল! দুমিনিট স্তব্ধতা। অবশ্য আমাদের শিববাবু বলেছিলেন কয়েকদিন আগেই। কিন্তু তখন মেশিনটা চালু ছিল না বলে আর–
ঠিক আছে, থ্যাংক ইউ। হয়ে গেলেই তো হল।
দেড়মাস পরে বোঝা যাবে, হল কি হল না। আপাতত নিশ্চিন্ত।
.
দ্বিতীয় ভাগ
হ্যালো? কে এম সি? মিস্টার ঘোষাল আছেন? কিংবা শিবতোষ দত্ত?
ধরুন।
হ্যালো ঘোষাল বলছি।
মিস্টার ঘোষাল? আমি অমুক বলছিলুম। সেদিন কথা হল।
আ-বা-র? সেদিন হয়নি আধার কার্ড?
হ্যাঁ-হ্যাঁ। ছেলেগুলি খুব ভালো। এসেছিল। থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ।
ওয়েলকাম। দেড় মাস পরে পেয়ে যাবেন।
মিস্টার ঘোষাল? মানে, আচ্ছা, আরেকটা কথা ছিল যে? জলের ব্যবস্থাটা কে দ্যাখেন? সাত সপ্তাহ আমাদের একবেলা করে জল আসছে, তাও ট্যাংক ভরছে না…বেদম জলকষ্টে আছি…মেয়ে-জামাই-নাতি-নাতনি এসেছে। আমাদের বিরাশি বছরের বাড়ি কোনও দিন এমন হয়নি।
দেখুন ম্যাডাম, স্যরি, কিন্তু জলের ব্যাপারটা তো আমরা দেখি না, আপনাকে ওয়াটার সাপ্লাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে হবে–
অঃ। দয়া করে একটু যদি তাদের ফোন নম্বরটা…?
শারদীয়া বর্তমান ২০১৭
আরে, পেহলে হমে তো জীনে দো?
আমার বন্ধু সান্ত্বনা খুব বড় ডাক্তার, গাইনি। ভাগলপুরে গিয়ে দেখে এসেছি তার অসীম নামযশ, জনপ্রিয়তা। নাইবার-খাবার সময় পায় না সারাদিনে। নিজের বাড়ির একতলাতে তার চেম্বার আর মস্ত নার্সিংহোমও। সন্ধে সাতটাতেও তাকে দুপুরের ভাত খেতে দেখেছি। সারাদিনে ওপরে আসার সময় হয়নি তার। নিজের সন্তান নেই তাই তার জীবন। উৎসর্গ করেছে অপরের সন্তানকে সুস্থ, সতর্কভাবে এই পৃথিবীতে আনার কাজে। স্বামী মধুবাবু এক সফল ব্যবসায়ী, তিনি সত্যিই মধুময় স্বভাবের মানুষ। প্রকৃত জীবনসঙ্গী, সদাসর্বদা স্ত্রীর পাশে আছেন। স্ত্রী মধ্যাহ্নভোজে না এলে, সেদিন তিনিও পেটে কিল মেরে বিস্কুট খেয়ে সাতটা অবধি অপেক্ষা করেন স্ত্রীর সঙ্গে একত্রে খাবেন বলে। এমন দাম্পত্য ঈশ্বরের করুণা! দেখেও সুখ! এই বয়েসেও দুজন দুজনের প্রাণাধিক। দুয়েকদিনেই টের পেলুম ওদেশে ডাক্তারি করতে হলে শুধু ডাক্তারি জানলেই হবে না, আরো বেশি এলেম চাই। মেয়েদের ওপরে ওদেশে অশেষ অত্যাচার চলে, সেইসব যথাসাধ্য আগলে-সামলে মেয়েদের পাশে দাঁড়িয়ে সান্ত্বনার ডাক্তারি। পেশাদারি ডাক্তারি যতটা, স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা তারচেয়ে ঢের বেশি।
একদিনের কথা বলি, আমি বেরিয়ে যেতে যেতে দেখলুম একটি মেয়ে এসেছে কোলে শিশু নিয়ে, সে ডাক্তারের রুগিদের লাইনে দাঁড়াচ্ছে না, ভিড়ের একপাশে সরে আছে, আর বলছে সে সবার শেষে দেখাবে। আমি বুঝলুম না। কেউ যে কোনোদিন ইচ্ছে করে লাইনের শেষে দেখাব বলে, এমনটা তো দেখিনি। ফিরে এসে দেখি সান্ত্বনার চেম্বার শেষ, সেই মেয়েটি বাচ্চাকে নিয়ে হেসে হেসে সান্ত্বনার সঙ্গে ঊড়ে চা খাচ্ছে। সান্ত্বনা আলাপ করিয়ে দিল, পুরোনো পেশেন্ট বলে।