ম্যাম, কতদূর হল? আমার মেজাজটা সেদিন সুস্থ ছিল না। ঠিক দুপুর বেলা শান্তিমতো লিখতে বসব তার উপায় নেই। একদিক থেকে আমাকে কে এম সি-র তাগাদা, আরেকদিকে কে এম সি-কে আমার তাগাদা। আধার কার্ডের আকুল তৃষ্ণায় খেপে গিয়ে বিকট কণ্ঠে বললুম, আপনারা আমাকে আমার আধার কার্ড দিচ্ছেন না মাসের পর মাস হয়ে গেল, তার বেলায় তাগাদা দিয়ে ফল হয় না, আর আমার লেখার বেলায় তাগাদা দিলেই ফল হবে বুঝি? যেমন ভাবে আধার কার্ডের প্রগতি হচ্ছে, সেইভাবেই আমার রচনাও এগোবে। বলেই ফোন বন্ধ করে দিই।
তারপরের দিন, কিঞ্চিৎ সসংকোচে, আমি কে এম সি থেকে বলছি। ম্যাম, রম্যরচনাটা কি…? মানে আমাদের তো ডেট এসে পড়ছে?
তাই নাকি? ডেট রাখেন আপনারা? ঠিক আছে, লিখে দিচ্ছি, তবে এই আধার কার্ড নিয়েই লিখব। যে কাণ্ডটা চলেছে! লেখাটা কতটা রম্য হবে সেটা আপনাদের ওপরেই নির্ভর করছে। দেব? বলুন, ছাপবেন তো?
তাই-ই দিন। কী করব ম্যাম, ইনভাইটেড আর্টিস্ট তো।
মিনিট পনেরো পরে আরেকটি ফোন।ম্যান, ইনি আপনার আধার কার্ডের ব্যবস্থা করে দেবেন। কোনও অসুবিধে হবে না। একটু কথা বলুন।
ভদ্রলোক গম্ভীর গলায় ফোন ধরেই বললেন, কোন ওয়ার্ড?
ওয়ার্ড? আমি তো হাসপাতালে নেই।
ভদ্রলোক অধৈর্য হয়ে বললেন, আহা মিউনিসিপ্যালিটির কত নম্বর ওয়ার্ড আপনাদের? কোথায় থাকেন?
বালিগঞ্জে, গড়িয়াহাটে, হিন্দুস্থান পার্কে!
বালিগঞ্জে আলাদা, গড়িয়াহাট আলাদা। ঠিক করে বলুন।
আমরা হিন্দুস্থান পার্কে থাকি। গড়িয়াহাটের কাছেই।
মিউনিসিপ্যালিটির নম্বর জানেন?
নম্বর? আমি তো ওসব–মানে, এখানে আগে ছিলেন দুর্গা, এখন আছেন তিস্তা, বুঝলেন কিছু?
ওয়ার্ডের নম্বর বলুন, কাউন্সিলরের নাম নয়।
ওয়ার্ডের নম্বর? আমি ঠিক জানি না–দাঁড়ান, কানাই? আমাদের পাড়ার ওয়ার্ডের নম্বর কত জানিস নাকি রে?
এইট্টি সিক্স, ছিয়াশি, দিদি।
এইট্টি সিক্স, ছিয়াশি। আমি পুনরাবৃত্তি করি। (বাঃ কানাই আমাকে কক্ষনও বসিয়ে দেয় না!)
ব্যস। ত্রিকোণ পার্কে চলে যাবেন, খুব কাছেই, আপনাদের পাড়ার ক্যাম্পে, যে কোনও দিন বিকেল চারটের মধ্যে, ওরাই করে দেবে সব, কোনও ভাবনা নেই।
আরে মশাই, না! ওই খানেই তো রেগুলার আমার সপরিবার যাওয়া আসা আর স্রোতে ভাসা চলেছে, ওটাই তো আমার টেম্পরারি ঠিকানা, বলতে পারেন! সবটা বলবার সুযোগ দিলেন না, খুব ব্যস্ত মানুষ, বাক্যের মাঝখানেই ফোন রেখে দিলেন।
.
দিন কয়েক বাদে, আবার ফোন এল।
বলুন?
নবনীতা দেব সেন ম্যাডাম বলছেন? আমি কলকাতা করপোরেশন থেকে বলছি। এবারে অন্য এক মহিলা কণ্ঠ।
কী প্রসঙ্গে ফোন? লেখা? না আধার কার্ড?
আধার কার্ড বিষয়ে সেদিন তো শিবতোষ দত্ত আপনাকে ফোন করেছিলেন, সব জানিয়ে দিয়েছেন। কার্ড হয়ে গিয়েছে তো?
কেউ কিছুই জানাননি।
কিছুই জানাননি? দাঁড়ান, এইখানে কথা বলুন তো।
কিছুই জানাননি। কেবল, যেখানে আমরা রোজ ধরনা দিচ্ছি সেইখানে যেতে বলেছেন।
এবার এক ভারিক্কি পুরুষ কণ্ঠ গম্ভীরভাবে ফোন ধরলেন।
নমস্কার ম্যাডাম। আমি ঘোষাল বলছি। আপনাকে উনি যেখানে যেতে বলছেন, সেটা কোথায়?
ত্রিকোণ পার্কে।
ঠিকই তো বলেছেন, ওখানেই তো আপনাদের পাড়ার ক্যাম্প।
.
আমি তো বলিনি ক্যাম্প কোথায় জানি না? আমি বলছি কার্ড কবে কখন হবে, সেটা জানিয়ে দিতে। আমার বয়েস আশির কাছাকাছি, পা চলে না, আমার পক্ষে গিয়ে লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার, বা গাড়িতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করার প্রশ্ন নেই এসব জানিয়ে একটা ফিক্সড টাইমে অ্যাপয়েন্টমেন্ট চেয়েছিলুম। সেটা কি খুব বেশি চাওয়া? এবারে আমাকে তো লিখতেই হয় সিনিয়র সিটিজেনদের অসম্ভব হ্যারাসমেন্টের বিষয়ে কলকাতা করপোরেশনের দায়িত্বহীনতা নিয়ে।
ইনি ধৈর্য ধরে সব শুনলেন। শুনে হালকা সুরে বললেন, বুঝেছি, ম্যাডাম। এই ব্যাপার? কোনও ভরসা নেই, আপনারা ব্যস্ত মানুষ, তায় এজেড, সত্যিই তো এতখানি সময় নষ্ট করা সম্ভব না, আমাদের লোক যাবে আপনার বাড়িতে, আধার কার্ডের যা কিছু লাগে, ঘরে বসেই করিয়ে নিয়ে আসবে। আমাদের এরকম ব্যবস্থা তো আছেই ম্যাডাম, অসুস্থ, বা অশক্ত নাগরিকদের জন্য। কোনও ভাবনা নেই আপনার। আপনাকে কোথাও যেতে হবে না, আমাদের লোক যাবে আপনার বাড়িতে, অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে নিয়ে, মেশিনপত্তর, আলোটালো সব নিয়ে যাবে। আপনি রিল্যাক্স করুন। আগে কেন জানাননি? তাহলে আগেই চলে যেত।
আগে জানাইনি? সেই ব্যবস্থাটা শুরু হওয়া ইস্তক জপ করে চলেছি। কানে তুলছে কেন?
আধঘণ্টার মধ্যেই আবার ফোন। এবারে তরুণ কণ্ঠ।
করপোরেশন থেকে বলছি। আমার নাম শ্যামল নন্দী। নবনীতা দেব সেন ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলব।
বলছি। বলুন।
আপনার ঠিকানাটা একটু বলবেন? আমরা আসছি।
মহানন্দে ঠিকানা বললুম। আজকেই?
হ্যাঁ ম্যাডাম, আজকেই।
কখন আসবেন?
এই তো, আমরা এখানে কাজ শেষ হলে সাড়ে চারটে নাগাদ চলে আসব। একটা প্যান কার্ড, কি ভোটার আইডি, কি পাসপোর্ট রেডি রাখবেন যেখানে আপনার ছবি আছে। আর আমাদের একটা ফর্ম ফিলআপ করতে হবে আপনাকে। ব্যস!
আর কিছু?
নাঃ, আর কিছু লাগে না।
.
বেল বাজল। শ্যামলের বাঁশি! এক, দুই, তিন, চার জন ছোকরা এল, বড়সড় ব্যাগ নিয়ে, গরমে পুড়তে পুড়তে। কানাই তাদের শরবত-এর ব্যবস্থা করে তদারকির ভার নিয়ে নিল। আমি নীচে গিয়ে দেখি টেবিলের ওপরে কমপিউটার, স্ক্যানার, অনেক তারের গোলা, আলো, প্রিন্টার, এই সব সাজানো। করপোরেশনের আধার কার্ডের অফিসের চেহারা দেওয়া হয়েছে আমাদের বৈঠকখানা ঘরটিকে। তারপরে চলল যাবতীয় অকহতব্য গোপন মধুর কর্ম, যথা, দশটি আঙুলের সযতনে স্পর্শন। অঙ্গুলিস্পর্শনের আর তদ্দারা তাদের ছাপ গ্রহণের কাণ্ডটি মোটেও সরল নয়, সব আঙুলের ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র। কোনওটা কাঁচের ওপরে দিব্যি চেপে বসে, কোনওটা বসবেই না! অজস্রবার ছবি তুলেও দশটা আঙুলের ছবি এল না এ-হাতে ও-হাতে মোট তিন জন গোঁ ধরে বাদ রইলেন। কে না জানে, হাতের দশটা আঙুল সমান হয় না।