দুর দুর চশমার পাওয়ার খুব হাই, পুরু কাঁচ, সেটা আবার একটা কারণ হতে পারে? আর অঙ্কে ক্লাসের বেস্ট বয়, সেটাও কারণ হতে পারে না। কক্ষনও না!
কিন্তু আমার যে বেস্ট ফ্রেন্ড, জুনিয়ার, সে খুব চালাক, আর সব কিছু জানে-বোঝে দিদা। জুনিয়ার আমাকে বলেছে, গার্লস হেট ম্যাথস অ্যান্ড দোজ হু আর গুড অ্যাট ইট। ও বলেছে, তুই একটু খারাপ করে দ্যাখ না অঙ্কে? দেখবি এফেক্ট হবে। চশমার তো কিছু করা যাবে না। পরে বাবাকে বলে চোখে কনট্যাক্ট লেন্স পরে নিস।
অঙ্কে খারাপ করতে বলে দিল? আচ্ছা, ছেলে তো। ওর সঙ্গে আর মিশতে হবে। না। মনে-মনে টুসি এই কথাগুলো বললেও মুখে বেরিয়ে এল স্কুল শিক্ষিকা-দিদিমার আকুল জিজ্ঞাসা, অঙ্কে খারাপ করো বললেই হল? কেমন করে খারাপ করবি?
নো প্রবলেম। খারাপ করা সহজ তো, দিদু। ইচ্ছে করে দুটো অঙ্ক ছেড়ে দিলেই রেজাল্ট খারাপ হয়ে যাবে। মেঘদীপের মুখে হাসি ফুটেছে। লেটস সি? দিদু স্তম্ভিত।
এই অবস্থায় দাদু-দিদু চলে গেলেন ইউরোপে। ফিরে এসেই প্রশ্ন, হ্যাঁ রে, মেঘুর অঙ্কের টেস্ট হয়েছে?
হয়েছে।
অঙ্ক-টঙ্ক ছাড়েনি তো?
হ্যাঁ, ভদ্দরলোকের এক কথা। দুটো অঙ্ক ছেড়েছে।
সে কী রে বুলা। সাউথ পয়েন্টের দিদিমণিটির শ্বাস আটকে গেল।
মেঘুদাদা ইচ্ছে করে দু-দুটো জানা অঙ্ক ছেড়ে এল?
এল তো।
তাতে গার্লফ্রেন্ড হল?
হল তো।
আরও আশ্চর্য এবারে দিদিমণি।
সত্যি? অঙ্কে খারাপ করলে প্রেমিকা হয়? আমরা তো জানি ব্রিলিয়ান্ট ছেলেদের পছন্দ করে মেয়েরা। অন্তত আমাদের সময়ে তো তাই ছিল। কণ্ঠস্বর কঠোর হচ্ছে।
আমাদের সময়েও দেশে তাই-ই ছিল, মা। ইংল্যান্ডে হয়তো অন্যরকম?
গার্লফ্রেন্ড কি ওরই ক্লাসে পড়ে? নাম কী তার?
একসঙ্গেই পড়ে, বাবা ইংরেজ, মা পাঞ্জাবি। ওর নাম মিনি।
তুই দেখেছিস?
বেশ দেখতে, বাচ্চা প্রীতি জিন্টার মতো।
তো, গার্লফ্রেন্ড কী বলেন দাদুভাইকে?
বলেছেন তো এই ৫ নভেম্বর, গায় ফকস ডে-তে ময়দানে যেতে, সেখানে তিনি থাকবেন, দুজনে মিলে বাজি পোড়ানো দেখবেন।
সে তো পরশুদিন!
হ্যাঁ মা, পরশু সন্ধেবেলায় মেঘুকে নিয়ে যেতে হবে ওর প্রথম ডেট-এ।
বুলা মুখ টিপে হেসেই অস্থির। যেন খেলা-খেলা, পুতুলের বিয়ে দিচ্ছে।
কার সঙ্গে যাবে?
আমার সঙ্গে, আবার কার সঙ্গে? বাবার কি সময় আছে নাকি? ডাক্তার মানুষ।
দিদিমা একটু হতচকিত, মা নিজেই ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছে তার জীবনের প্রথম ডেট-এ? কোথায় মা-বাবাকে লুকিয়ে ছেলেমেয়েরা গোপনে ডেটিং করবে, নিত্যিনতুন মিথ্যে কথা তৈরি করতে প্রাণান্ত হবে, তা নয়, এখানে দেখি উল্টো? বুলারও কি মাথা খারাপ হল? যাকগে, যে-দেশের যে-নিয়ম তাতেই তো চলতে হবে!মেঘুর বান্ধবী যখন বলেছে তাকে মিট করবে ওই ময়দানে, বাপ-মা সেখানে সময়মতো না নিয়ে গেলে ছেলেরই মানসম্মান নষ্ট।
৫ তারিখে সেজেগুজে মায়েতে-ছেলেতে রওনা হল, মেঘদীপ খুব খুশি, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আয়নার সামনে দিয়ে যাতায়াত করছে। সুন্দর পোশাকে স্মার্টলি সেজেছে মায়ের উপদেশ মতো। নাচতে-নাচতে বেরুল সে। বুলার মুখে তেমন টেনশন দেখতে পেল না টুসি। বা-ই!–সি-ইউ! হেসে-হেসে গাড়ি স্টার্ট দিল। এদিকে দিদিমা তো দাদুর সঙ্গে পাশাপাশি বসে নিবিষ্ট চিত্তে ভুরু কুঁচকে টিভি-তে গায় ফকস ডে উদযাপনের উৎসব দেখছেন। ভিড়ের মধ্যে মেঘু বা তার গার্লফ্রেন্ডের চিহ্ন যদি দেখা যায়? বাচ্চা প্রীতি জিন্টার মতো কেউ?
রাত হতে বুলা ফিরল সপুত্রক। ফিরেই যে যার নিজের ঘরে চলে গেল, দাদু-দিদিমাকে কেউ দেখতে পেল বলে মনে হল না। দিদিমা চেঁচিয়ে ফেললেন, কী রে? হল তোদের ডেট করা?
মা, একদম ওই নিয়ে কথা নয়! পরে বলব সব। ফিসফিস গলায় বুলা বলল তার মা-কে।
পরে, মানে মেঘু ঘুমিয়ে পড়তেই, বুলা জানাল, তারা গিয়ে দ্যাখে সেখানে লোকে-লোকে লোকারণ্য। তার মধ্যে কোথায় মেঘদীপ, কোথায় বা তার গার্লফ্রেন্ড! নিজের হাতটাই খুঁজে পাওয়া যায় না। মিনিকে মোটে খুঁজেই পাওয়া যায়নি, সে বেচারিও তার মায়ের হাত ধরে ভিড়ের মাঝখানে কোথায় যে দাঁড়িয়েছিল কে জানে? ওরা বাজি পোড়ানো দেখে চলে এসেছে। মেঘুর খুব মনখারাপ, তার মায়ের মেজাজ খারাপ তার চেয়ে বেশি। রাতে শুয়ে দিদিমা দাদুকে বললেন,
সত্যি বলতে কী, আমি তো মেঘুর ডেটিং চাইনি এত অল্প বয়সে, কিন্তু আমারও মনটা এমন খারাপ-খারাপ করছে কেন?
তা করবে না? আহা, বাচ্চাটা একটা আশা করে বেরিয়েছিল? দাদুর সোজা উত্তর।
কয়েকদিন আর এ-বিষয়ে কিছু শোনা গেল না। তারপরে ছেলে বাড়ি এসে জানান। দিল, আবার সে অঙ্কে ১০০-তে ১০০পাচ্ছে। আর একটাও অঙ্ক ছেড়ে আসে না। অংকের টিচার ধরে ফেলেছেন যে, মেঘু ইচ্ছে করে উত্তর দেয় না। দারুণ বকুনি দিয়েছেন, আর ওরকম করা চলবে না, তাতে গার্লফ্রেন্ড হোক আর না-হোক।
পরের বছরে দাদু-দিদিমা গিয়ে দ্যাখেন নাতির ইশকুল বদল হয়েছে, সে এখন দারুণ এক নাক-উঁচু ইশকুলের ছাত্র। সেখানে অনেক নিয়ম-কানুনের কড়াকড়ি। একদিন নাতি ইশকুল থেকে ফিরে ব্যাগ নামাতে নামাতেই মা-কে বললে,
মা, আমাদের কাল ইশকুলের পরে ডিটেন করবে বলেছে। দেরি হবে, ভাবনা কোরো না।
কেন? কেন? কেন তোকে ডিটেন করবে। অমন বললেই হল?