হরিদাসী একনজরে মুখের পানে চায়–এই সেই লোক, যাকে সে বহুবৎসর কাল দাদাবাবু বলবার পর সম্প্রতি বাবু বলতে শুরু করেছিল। তারপর ফোকলা গালের গর্তে টোল ফেলে কেমন-কেমন হাসে। হেসে বলে, বেশ! তাই বলব। মেমসায়েবের কাছে। ঘনশ্যামবাবু এয়েছেন। হলো তো?
ঘনশ্যাম সোমেশের ইস্কুলের বন্ধু। রোজ সন্ধেবেলায়, রাতে খাবার আগে পর্যন্ত দাবা খেলাটা তাদের কলেজ যুগ থেকেই নেশা। এক পাড়ায় বাড়ি হওয়ার দরুণ এই নেশাটি বিয়ের পরেও ভাঙেনি।
ফরাসি সুগন্ধ বিলিয়ে, আঁচল এলিয়ে, চুল ফুলিয়ে সোমেশ হাস্য বদনে ঘরে ঢুকতেই ঘনশ্যাম চমকে উঠলেন। তারপরেই মুখ ভেংচে চেঁচিয়ে ওঠেন, এ্যাঃ। ছিছিছি ই-কী করিচিস রে ব্যাটা সোমা? অ্যাত্তে করে তোকে বারণ কলুম–বল্লম, এটা অ্যামেরিকা বিলেত নয়, ওসব কীর্তি করতে যাসনি, সব্বোনাশ হবে–শুনলিনি? সেই, যা জেদ ধরবি, তাই?
কেন রে ঘনা? বেশ ভালো দেখাচ্ছে না? একটু দমে গিয়ে প্রশ্ন করেন সোমেশ। চোখে অনিশ্চয়তা।
তোমার মাথা। ঠিক বাঁদরের মতন দেখাচ্ছে। মাথা নিচু করে বোর্ড থেকে ঘুটিগুলো বাক্সে তুলে ফেলতে থাকেন ঘনশ্যাম।
ঘুঁটি তুলে ফেলছিস যে? খেলবি না?
কী খেলব?
ন্যাকামো রাখ!
বলি ন্যাকামোটা কে কচ্চে? রোজ রোজ এসে তোমার সঙ্গে দাবা খেলি, আর পাড়ার লোকে নিন্দে করুক। না রে সোমা, কম্মোটি আমি আর পারব না। গিন্নি অ্যালাউ করবে না। ছেলেপুলে বড় হচ্ছে, তারাই বা কী ভাববে। আমার দ্বারা লীলাখেলা হবে না ভাই।
ঘনা! কাতর আর্তনাদ বেরোয় সোমেশের গলা চিরে। এ তুই কী বলছিস ভাই ঘনা? তুই কি পাগল হলি? এ যে আমাদের বিশ বছরের নেশা রে! কে আবার কী বলবে এতে?
ওসব কথা থাক। দ্য পাস্ট ইজ পাস্ট। তুমি বরং এখন থেকে আমার বউয়ের সঙ্গে সাপলুডো খেলতে যেও রোজ দুপুরবেলায় আমি কিছু বলব না। ঘনশ্যামের গলা অভিমানে বুজে এল, শালা। বিশ্বাসঘাতক। ইস্টুপিড কোথাকার। এত করে বারণ করলুম।
সোমেশের চোখের জল আর বাঁধ মানে না। চোখে আঁচল তুলে দেন তিনি। আর ছিঃ ছিঃ বলতে বলতে বেরিয়ে যান ঘনশ্যামবাবু। প্রায় দৌড়ে পালালেন।
ঠিক এমনই সময়ে নীচে উঁক ভঁক করে হর্ন বেজে ওঠে। ছেলেমেয়েরা এসে গেছে বলতে বলতে ছুটে এলেন ইন্দ্রাণী। ডুরে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে, সর্বাঙ্গে অপরূপ ঢেউ খেলিয়ে সোৎসাহে উঠে দাঁড়ালেন সোমেশ, সদ্য হারানো বন্ধুর দুঃখু ভুলে। হাতে জ্বলন্ত সিগার, গায়ে কমলাডুরের আঁচল। মাস্কারা-ঘন চোখে অপত্য স্নেহের অমৃতধারা। সারপ্রাইজ।–ছেলেমেয়েরা জানে না বাবা ফিরে এসেছেন।
বাবা।
বাবা।
বাবা। দুড়দাড় দৌড়াতে দৌড়তে সিঁড়ি থেকেই চেঁচাতে চেঁচাতে, উল্লাসে নাচতে নাচতে ঘরে ঢুকল বান্টি-মিন্টু-সন্টু। গেটের কাছ বাবার প্রিয় চুরুটের গন্ধটি পেয়েই তাদের মন নেচে উঠেছে। খবর পৌঁছে গেছে প্রাণে। বাবার গন্ধ। বাবা এসে গেছেন। ঘরে ঢুকেই স্ট্যাচু। বজ্রাহত। নিশ্চুপ।
নিবাত নিষ্কম্প তিনটি স্তব্ধতা। তারপরেই পাঁচ বছরের সন্টুটা কেঁদে ফেললে, বাবা কই? ডুরে শাড়ির আঁচল সামলাতে সামলাতে সন্টুকে কোলে তুলতে যান সোমেশ। তার আগেই সে ছুটে গিয়ে ইন্দ্রাণীর হাঁটুতে মুখ গুঁজেছে। ছোট ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে আঙুল দিয়ে মা দেখান ওই গ্লামারাস তরুণীটির দিকে
এই তো বাবা।
ন্না ন্না ও বাবা না। সন্টু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতেই থাকে। ছোট্ট শরীরটা গুটিয়ে আরো ছোট দেখায়। বান্টি এখন ক্লাস এইটে, সদ্য গোঁফের রেখার ছায়া পড়েছে ঠোঁটের ওপরে। মিন্টুরাণী পড়ছেন ক্লাস সিক্সে, একটা হালকা প্রজাপতির মতন দেখতে।
গেটে বাবার সিগারের পরিচিত গন্ধটি তাদের তিন মাস ধরে হারানো বাবার পুনরাগমনের খবর দিয়েছিল, কিন্তু এ কে এসে বসে আছে বাবার ইজিচেয়ারে। বাবা কই? এ যে ছোটপিসি। আবার ঠিক ছোটপিসিও নয়। অন্য কেউ। এ কে?
নেলপলিশচিত্রিত দশ আঙুল বাড়িয়ে মিষ্টি আদুরে গলায় সোমেশ ডাকলেন, ছি, সন্টু কাঁদে না বাবা। এসো, কোলে এসো–এই দেখ, দেখ না, তোমাদের জন্যে কী সুন্দর ক্যাডবেরি এনেছি–
সন্টু নড়ল না। বান্টিও নড়ল না। মিন্টুই শুধু পায়ে পায়ে একটু এগোল। সোমেশ ডাকলেন, কই রে আয়? এই দ্যাখ আরেকটা কী মজার সারপ্রাইজ আছে তোমাদের জন্যে–পাশের ভ্যনিটি ব্যাগটা হাতে নেন সোমেশ। সন্টু নড়ল না।
যাও, কাছে যাও- ইন্দ্রাণী এবার সন্টু-বান্টি দুই অবাধ্য পুত্রের পিঠে দুই ঠেলা মেরে বললেন, ছিঃ! ও কী হচ্ছে কি? অসভ্যতা?
অমন করতে নেই, সন্ট-বান্টু, বাবা ডাকলে যেতে হয়। ছেলেমেয়েদের পেছু পেছু, ঘনশ্যামবাবুও আবার কখন ওপরে উঠে এসেছিলেন। এবার টের পাওয়া গেল। ঘনশ্যামবাবু বললেন, যা, বাবা ডাকছে, অমন কোরো না। কাছে যাও। বাবা বলে কথা–ধুতিই পরুক আর শাড়িই পরুক। বাবা, বাবাই। যাও, কাছে যাও–
বাবা বাবাই মানে? নেপথ্যে হরিদাসীর গলা পাওয়া গেল। বাবা ডাকছে মানে? এখন কি আর বাবা বলে ডাকলে চলবে নাকি? এখন বলতে হবে মা। কী বলে ডাকবে তোমাকে তোমার ছেলেমেয়েরা, বাবু? এই য্যাঃ, কী যেন বলে, মেমসায়েব? তোমার ছেলেমেয়েরা তোমায় বাবার বদলে কী নাম ধরে ডাকবে? মেমসায়েব, না মা? ঘরের বাইরে থেকে বোমা ফেলতে লাগল হরিদাসী। সোমেশের মনে পড়ল জন মরিস যখন জ্যান মরিস হলেন, তারও তখন বড় বড় সন্তান ছিল। জ্যানের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী-পরিবারের ভাবভালোবাসা তো এতটুকুও নষ্ট হয়নি। কী যোগাযোগে, কী উষ্ণতায়, কোথাও কিছু কম পড়েনি। কিন্তু জ্যানের ছেলেমেয়েরা এখন তাকে কী বলে ডাকে? জ্যান বলে? না ড্যাডি বলে? আত্মজীবনীতে কি সেটার উল্লেখ ছিল না? ভাবতে ভাবতে সোমেশের নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে বেরুল। নাকটি তিনি থুপে থুপে মুছে দিলেন। তবুও মনে পড়ল না।