হায় রাম। চাউধ্রি সাব চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে। ততক্ষণে সোমেশ লিফটে।
বুড়ো লিফটম্যান ইব্রাহিম সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল কৌনসী ফ্লোর–, সোমেশ বললেন, ভালো আছ, ইব্রাহিম?
সড়াৎ করে শ্বাস টেনে ইব্রাহিম তার টুলের ওপর বসে পড়ল, তার হাত লিফটের বোতামে না গিয়ে পড়ল গিয়ে নিজের কপালে হিজিবিজিকাটা ছকে।
ইনশাল্লা। চাউধ্রি সাহাব। তৌবা। তৌবা।
এখন থেকে আর চৌধুরী সায়েব না, ম্যাডাম চৌধুরী বলবে, বুঝলে তো ইব্রাহিম? সোমেশ মিষ্টি হেসে বলেন–কই লিফ্ট চালাও?
লিফট থেকে নেমে নিজের ঘরে ঢুকলেন বিনা বাধায়। টুলে নিধিরাম ছিল না। একটু পরেই বেল বাজালেন মজু চৌধুরী। নিধিরাম পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকে সাহেবের সিটে এক অপরিচিতা সুন্দরীকে দেখে এতদূর অবাক, যে আপত্তি পর্যন্ত করার কথা মনে পড়ল না তার। অনেক ফাইল জমেছে তিন মাসে। ফাইলে চোখ রেখেই অভ্যাসমাফিক সোমেশ বলে, জল।
জগড়নাথ। নিধিরাম শব্দ করে ওঠে!
এ-কড়ও হলা? সাহাব-অর-স-র-ব-নাসও হই গলা রে হায়, হায়! হাহাকার করে ওঠে নিধিরাম। মুহূর্তের মধ্যে ঘরভর্তি দর্শক জড়ো হয়ে যায়। লাফিয়ে উঠে চৌহান বলল, গুড গ্রেশাস। হোয়াট লাক। চাউ৮ি সাবনে তো দিল্ ধড়কা দিয়া। একদম্ জিনৎ আ, সায়রা বানু-সোমেশ চাউধ্রি ইজ গন্, লং লিভ সোমা চাউধ্রি
ঘোষদা বলল, বড্ডই আপশোস হচ্ছে কেন যে তোর বউদিকে বিয়েটা করে ফেলেছিলুম।
চালু ছোকরা রণু ব্যানার্জী বললে, অ্যাবসলুটলি র্যাভিশিং এস কে। মে আই হ্যাভ আ ডেট উইথ ইউ দিস স্যাটারডে নাইট? লেটস গো ডান্সিং। শ্যাল উই?
গোলাপি স্লিভলেসে ভূমিকম্প তুলে সোমেশ বললেন, থ্যাংকু রণু! আইল থিংক অ্যাবাউট ইট।
কেবল তার বয়স্ক পি.এ.রাধাকৃষ্ণণ খুব গম্ভীর প্রকৃতির লোক। দক্ষিণের মানুষ তিনি, চট করে অবাক হন না বড় একটা। আগে সাদা সাহেবের কাছে কাজ করেছেন, তার বদলে এলেন কালো সাহেব। এমন পুং সাহেবের বদলে না হয় স্ত্রী সাহেব। রাধাকৃষ্ণণের তাতে কি? গম্ভীর মুখে খাতা-পেনসিল নিয়ে বসলেন এসে, চোখেমুখে কোনো বিস্ময় নেই।
ইয়েস স্যার? সরি, ইয়েস ম্যাডাম? শ্যাল উই বিগিন? ওদিকে অফিসময় ততক্ষণে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সকলেই উত্তেজিত, শশব্যস্ত, সোমেশ চৌধুরী ছাড়া কারুর মুখে কোনো কথা নেই।
হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে বাড়ি ফিরলেন সোমা চৌধুরী। ইন্দ্রাণীও আজ অপ্রস্তুত। প্রতিযোগিতার উচিত স্পিরিটে বিউটি পার্লারে গিয়ে মাথার চুলের ডগা থেকে নোখের আগা পর্যন্ত নতুন করিয়ে এনেছেন। একমাত্র প্রবেলম, কোমরটাকে কিছু করা যায়নি। ওখানে সোমেশের একচ্ছত্র জয়। দরজা খুলে এক রূপসী আরেক রূপসীকে রিসিভ করলেন। ঠিক সোহিনী এলে যেমন দোরগোড়াতেই ইন্দ্রাণীকে বউদি ভাই বলে জড়িয়ে ধরে, সোমেশ একেবারে তেমনি ঢঙে দরজাতেই ইন্দ্রাণীকে জড়িয়ে ধরে গালে গাল ঘষে, হ্যালো ডালিং বলে ঘরে পা দিলেন।
ছি! ছি। ও কী হচ্ছে? আপনার অজান্তেই বকে ফেলেছেন ইন্দ্রাণী। চোখ টিপে সোমা চৌধুরী বললেন, ওতে কিছু হবে না! তারপরেই ভুরু উঁচিয়ে ঠোঁট গোল করে কমপ্লিমেন্ট দেন, ই-ই—কী-ই দারুণ দেখাচ্ছে তোমাকে ইন্দু। চুলটা কোথায় করালে? ফেসিয়ালও করিয়েছ না? বেশ ভালো কাজ তো ওদের।
এসব কথায় কান না দিয়ে চায়ের কাপে চিনি গুলতে গুলতে ইন্দ্রাণী বললেন, তারপর? আপিসে সবাই তোমায় দেখে কী বললে?
হাত মুখ ধুয়ে, কাপড় বদলে, হাভানা সিগারটি ধরিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বসে গায়ে সুতি ডুরের আঁচলটি জড়িয়ে নিয়ে, চায়ের কাপ হাতে সোমেশ গল্প জুড়ে দেন–আপিসে আজ কত কী হলো। বাহাদুর, ইব্রাহিম, নিধিরাম, চৌহান, ঘোষদা, রাধাকৃষ্ণণ, রণু ব্যানার্জী–কেউ বাদ যায় না। কেবল জেনিফারের মুখ ভার করার কথাটা বলেন না। রণু ব্যানাজীর অফার শুনে চমকে ওঠেন ইন্দ্রাণী।
সে কি গো, যাবে নাকি তুমি নাচতে? আঁ? হায় রে পোড়াকপাল আমার শেষে কিনা–
দুর দুর। তুমিও যেমন। বলে সোমেশ প্রবল একটি কটাক্ষ হানেন, থ্যাংকু বলাটা কার্টসি, বুঝলে না?
এমন সময়ে হরিদাসী এসে বললে, বাবুর কাছে ঘনশ্যামবাবু এয়েচেন। গঙ্গাঠাকুর ও হরিদাসী যথাসাধ্য বাবুর সঙ্গে সোজাসুজি কথোপকথন এড়িয়ে চলেছে। তারা একটু বিব্রত বোধ করছে। বোঝাই যাচ্ছে, পাড়ার ভৃত্যকুলের কাছে তাদের মুখ দেখানোর উপায় নেই। বাড়ির কর্তা মেয়েমানুষ হয়ে গেছেন, এমন ধারা অনাচ্ছিষ্টি কাণ্ড কেউ কি বাপের জন্মেও শুনেছে? চোখে দেখা তো দূরস্থান। দুজনই খুব পুরোনো, ইন্দ্রাণীর শ্বশুর-শাশুড়ির টাইমের লোক। এই সংসারে অপরিহার্য দুজনেই। এই গঙ্গাঠাকুর, এই হরিদাসী, ইন্দ্রাণীর বিয়েতে গায়ে হলুদের তত্ত্ব নিয়ে তার বাপের বাড়ি গিয়েছিল।
আঃ! হরিদাসী, ফের! বলেছি না দুদিন ধরে বাবু বাবু করবি না? সোমেশবাবু খিঁচিয়ে ওঠেন। প্লাকড ভুরুতে জট পাকিয়ে যায়।
কী বলব তবে? মা? আর মাকে তবে কি বলব? আগেকার মতন, বউদিদি? ছানিপড়া চোখ হরিদাসী খুবই সরলভাবে তাকায়। ইন্দ্রাণীর শ্বশুর-শাশুড়ির মৃত্যুর পর থেকে সোমেশ-ইন্দ্রাণী বাবু-মা ডাকে প্রমোশন পেয়েছেন।
তা তো বটে? এক মিনিট ভুরু কুঁচকে সিগার কামড়ে চুপ করে থাকেন সোমেশ। তারপরেই মুখ থেকে চুরুট সরিয়ে বলেন, মাকে মা আর আমাকে মেমসাহেব বলবে। বাবু-টাবু বলবে না।