তাই বলো! তুমিই সোমা। আর আমি ভাবছি- ইন্দ্রাণীর ভয়টা কেটে গেছে। বাঃ। বেশ তো? তেমন তো কিছু নয়। রাস্তায় হাততালি দিয়ে ঢোল বাজিয়ে নাচগান করে বেড়ায় যারা, তাদের মতন তো একটুও দেখাচ্ছে না সোমেশকে। ঠিক সোহিনীর মতো দেখাচ্ছে, যে ছোট ননদটিকে ইন্দ্রাণীর খুবই পছন্দ।
চিরদিনকার মেয়েলি সোমেশ এখন পরমাসুন্দরী হয়ে উঠেছেন। নীল নাইলনের ট্রান্সপ্যারেন্ট নাইটির তলায় সোমেশের ভাইট্যাল স্ট্যাটিসটিকস দেখে তিন ছেলেমেয়ের মা ইন্দ্রাণী রীতিমতো লজ্জা পেলেন। রূপসী বলেও ইন্দ্রাণীর খ্যাতি সুপ্রতিষ্ঠিত। কিন্তু তিনিও ঠিক এতটা রূপসী নন। ইশ, কী সরু কোমর। যেন মাছিটি। ইশ, কী ফিগার! অনায়াসে যে-কোনো বিউটি কটেস্টে নামতে পারবেন সোমেশ। বয়স কুড়ি বছর কমে গেছে। ইন্দ্রাণীর রীতিমতো ঈর্ষাই হয়। রাগী গলায় বলে ওঠেন, ছিলে কোথায় অ্যাদ্দিন, শুনি?
কেন টেলিগ্রামেই তো জানিয়েছি। ডক্টর চেঞ্জিংকর-এর নার্সিংহোমে। সেখানে কেবল অপারেশনই হয় না, আফটার-কেয়ার ক্লাসেসও হয়, বড় বড় বিউটিশিয়নরা এসে আমাকে চলতে, ফিরতে, বলতে, কইতে, সাজতে, গুজতে শিক্ষা দিয়েছেন। আমাকে কেমন লাগছে? ভালো না? মাত্র তিন মাসে?
ইন্দ্রাণী এ কথাটার উত্তর না দিয়ে বললেন, তারপর?
তারপর মানে?
কী করবে ভাবছ এবার? বোনের মতন উড়োজাহাজের গিন্নিপনা? নাকি তেল সাবানের বিজ্ঞাপন?
দুর দুর। ও বয়সে ওসব কি আর হয় গো? আমার লীভও তো শেষ। সোমবারই জয়েন করতে হবে।
তার মানে?
মানে তিন মাসের ছুটিতে গেছলুম। ছুটি ফুরিয়েছে, আবার অফিস যেতে হবে। পুনর্মুষিকো!
মানে, ওই চাকরিতেই–?
হ্যাঁ, ওই চাকরিতেই তো। চাকরি বদলানোর কোনো কারণ আছে কি? ইন্ডিয়ান কনস্টিটুশানে স্ত্রী-পুরুষের ইকোয়াল রাইট এসব ক্ষেত্রে।
ইন্দ্রা চমৎকৃত হল।
সত্যিই তো। মেয়েমানুষ যদি দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারে, তবে কোনো অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সির একজন সিনিয়র একজিকিউটিভ মেয়ে হয়ে গেলেই বা কার কী? বরং যা চেহারা খুলেছে সোমেশের তাতে একটা লিফটই উল্টে পাওনা হওয়া উচিত। পাবলিক রিলেশনস অফিসারের কাজে এফিসিয়েন্সি বাড়বে বই কমবে বলে তো মনে হচ্ছে না। মনে মনে ভরসা পেয়ে আদুরে গলায় ইন্দ্রাণী বলেন, হ্যাঁ গো, তোমাকে আমি কী বলে ডাকব তবে এবার থেকে?
কেন? যা বললে এক্ষুনি, তাই বলবে। অবিশ্যি সোমাও বলতে পারো। গালে টোল ফেলে হাসলেন সোমেশবাবু। ইন্দ্রাণীর অতি পরিচিত অতি প্রিয় সেই পুরোনো হাসি, শকিং পিংক লিপস্টিকের রেশমী চাদর মোড়া হয়ে কেমন যেন অচেনা দেখাল।
তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কিছুই বদলাবে না ইন্দু ভয় পেও না তুমি হাসলেন সোমা চৌধুরী, আসলে প্রবলেম অন্যত্র। প্রবলেম হবে লীগ্যালি সেকশুয়াল আইডেনটিটি চেঞ্জ করবার সব হ্যাপা পোয়ানো। চাকরিতে, পাসপোর্টে সর্বত্র নাম বদল, তারপর আগেকার সব সার্টিফিকেটগুলিতে কোর্ট এ্যাফিডেভিট করো–নতুন সিগনেচার করো-চল্লিশ বছরের আইডেনটিটি হঠাৎ বদল করা কি সহজ? উঃ, মা গো!
আমি কি এখন তবে মিসেস সোমা চৌধুরী ও মেয়েতে মেয়েতে বিয়ে কি এদেশে আইনসিদ্ধ হয়? ইন্দ্রাণীর প্রশ্নে সোমেশের হাসি শুকিয়ে গেল।
বোধহয় তুমি আমাকে ডিভোর্স করতে পারো এই গ্রাউন্ডে কিন্তু সেটা কমপালসরি কিনা সে খোঁজটা নেওয়া হয়নি। ইন্দু, আমাকে তুমি ছেড়ে যাবে না তো ভাই? সোমেশের মিঠে সরু গলায় আন্তরিক উদ্বেগ ছলছলাৎ করছে দেখে ইন্দ্রাণীর ধড়ে প্রাণ এল। যা প্রাণের টানটা আছে তাহলে। বান্টি-মিন্টু-সন্টু কই?–সোমেশ প্রশ্ন করেন।
ছেলেমেয়েগুলোকে মামাবাড়িতে নিয়ে গিয়েছে শনি-রবিবারের ছুটিতে। ইন্দ্রাণীর বৃদ্ধ বাবা-মাকে সান্ত্বনা দিতেই গেছে তারা, এমন বললেও খুব ভুল হবে না।
ট্রাঙ্ককল করতে হবে না, সোমবারই তারা এসে পড়বে। বোলপুর গেছে। মনের ভেতরে হালকা একটা বাতাস বয়ে গেল ইন্দ্রাণীর। যাক!
তোমার মা-বাবার শরীর ভালো তো? বাবার ছানি কাটার কি হল?
আঃ! আরেকবার আরাম পেলেন ইন্দ্রাণী। পারিবারিক দায়িত্ববোধটোধগুলোও সব ঠিকঠাক আছে।
কাটাবেন এবারে। তোমার জন্য ভেবে ভেবে দুটো ছানিই পেকে উঠেছে। অমন করে পালাতে হয়?
তা হলে তো উপকারই হয়েছে বলতে হবে? কনুই দিয়ে ইন্দ্রাণীকে একটা মেয়েলি ধাক্কা দিয়ে মুচকি হাসলেন সোমেশ।
সোমবার দিনে নতুন নামে অফিসে জয়েন করলেন জ সোমা চৌধুরী। মিস্ কিংবা মিসেস কিছুই লেখবার দরকার নেই, এই মস্ত সুবিধা হয়েছে আজকাল। সোমেশের পক্ষে আইডিয়াল বন্দোবস্ত। মিও নন, মিসেসও নন, আর মিস্টার তো ননই।
সোমবার অফিসে হই-হই পড়ে গেল। একমাত্র অফিসের অ্যাংলো ইন্ডিয়ান রিসেপশনিস্ট, যার সঙ্গে তার মিষ্টি মিষ্টি ভাব ছিল, সেই জেনিফারই কেবল অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল। আর সবাই ফ্ল্যাট। গোলাপি শিফনের আঁচল উড়িয়ে মজ এস চৌধুরী তার মার্ক ফোর অ্যাম্বাসাডার থেকে নামলেন, গায়ের মৃদুল ফরাসি সৌরভে, চোখের চটুল কটাক্ষে ভুরুতে-চুলেতে-আখিপল্লবে ভুবনমোহিনী হয়ে। গেটে বাহাদুর প্রথমে আটকে দিয়েছিল। পরে গাড়ির নম্বর দেখে ছেড়ে দিল। আলগোছে একটা সেলামও ঠুকে দিয়েছিল নেহাত অভ্যাসের বশে। সোমেশের অভ্যাস সেলামের উত্তরে কপালে ডান হাতটা আলতো করে ঠেকানো। অভ্যাসমতো সেটা করতেই বাহাদুরের চোয়াল ঝুলে পড়ল।