প্লিজ ইন্দু, দেখতে পাচ্ছ না, কীরকম বকচ্ছপ মূর্তি হচ্ছে তোমার স্বামীর। গেঞ্জি পরে লোকের সামনে বেরুতে পারি না, সাঁতারের ক্লাবে যাওয়া তো কবেই বন্ধ হয়েছে–একবার হ্যাঁ বল, লক্ষ্মীটি, বুঝতে পারছ না কী কষ্ট আমার?
হ্যাঁ, এইবারে বুঝতে পারছেন বটে ইন্দ্রাণী। তখন বোঝেননি। দুয়ে দুয়ে চার দিব্যি মিলে যাচ্ছে এতদিনে।
চিরকালই সোমেশের চেহারায় সেই মেয়েলি মিষ্টতাটা আছে, লালিমা পাল (পুং) গোছের একটা লাবণ্য, যাকে বলে লালিত্য। আবার স্বভাবেও ইদানীং কেমন-কেমন একটা বিতিকিচ্ছিরি ভাব দেখা দিয়েছিল, দিন দিন যেন পদিপিসি টাইপের স্বভাব হচ্ছে তোমার–গাল দিচ্ছিলেন স্বামীকে ইন্দ্রাণী। একেই তো উঁটাচচ্চড়ি খেতে ভয়ানক লোভ হয়েছিল, প্লেটের পাশে উঁটা চিবিয়ে পাহাড় করছিলেন, শরৎচন্দ্রের স্ত্রী চরিত্ররা যেমন করে থাকেন, যার জন্যে মাঝে মাঝে অফিসে দেরিও হয়ে যাচ্ছিল তার–আর তার চেয়েও ভয়ংকর কথা, বাড়িতে মেয়েরা এলেই আর রক্ষে নেই। অমনি সোমেশবাবু এসে হামলে পড়বেন, বাঃ, বাঃ, কী শাড়ি এটা, আঁ? মিসেস গুলাটি? দেখি! দেখি! অর্গানজা প্রিন্ট বুঝি? দারুণ তো?–কিম্বা, আরে? বালাজোড়া কবে গড়ালেন মিসেস রয়? আগে দেখিনি তো? দারুণ কাজটা করেছে কিন্তু! কভরি সোনায় হল? ইন্দ্রাণীর গা জ্বলে যেত স্বামীর এই মেয়েলিপনায়। গলার স্বরটি তো ঠিক মুখশ্রীর মতনই মধুমাখা, ইদানীং যেন আরো মিষ্টি হচ্ছিল, ফোনে মাঝে মাঝে ওঁকে ওঁদের রিসেপশনিস্ট জেনিফারের সঙ্গে গোলমাল করে ফেলেছেন ইন্দ্রাণী। এ ছাড়া ইদানীং যে কথায় কথায় চোখে জল এসে যাচ্ছিল সোমেশবাবুর, সে ব্যাপার তো বাড়িশুদ্ধ সকলেরই নজরে পড়ছে।
ভয়ংকর আপশোস হতে থাকে ইন্দ্রাণীর। ইন্দ্রাণী কিছুতেই রক্ত পরীক্ষা করানোর পাগলামিতে সায় দেননি। সোমেশ খেপে উঠেছিলেন নিজের রক্তের ক্রোমোজোম টেস্ট করাতে। প্রায়ই খবরের কাগজ পড়তে পড়তে মার্জিনে লিখে ফেলতেন X+Y Y+Y X+X! ইন্দ্রাণী বলতেন, তোমার নতুন করে কিসের এতো প্রমাণ দরকার? বান্টি-মিন্টু-সন্টু তো ঘুরে বেড়াচ্ছে জগৎ সমক্ষে, কিন্তু সোমেশের তাতে শান্তি ছিল না।
ওটা তো অতীত। আমি জানাতে চাই ভবিষ্যতের কথাটা–
তবে জ্যোতিষীর কাছে চলো।
জ্যোতিষ নয়, ডাক্তার। ইন্দু, ডাক্তার! আমাকে জানতেই হবে–বুঝতে পারছ না, এটা তো ইচ্ছাকৃত ঘটনা নয়, যা ঘটে যাচ্ছে, যা ঘটতে চলেছে–বি সায়েনটিফিক
ভেবে ভেবে ইন্দ্রাণীর বুক ফেটে যাচ্ছে। সত্যিই তো ওঁর এতে হাত ছিল না। ভগবানের মার। কেন যে তখন ইন্দ্রাণী রাজি হলেন না? কেন যে মত না দিয়ে গোঁয়ারের মতন জেদ ধরে রইলুম। এতবড় সর্বনাশটা আর হতো না তা হলে! এই দুনৌকোয় পা রেখে চলা সইতে না পেরে, হয় হিমালয়েই চলে গেছেন, নয়তো আত্মঘাতী হয়েছেন, সোমেশবাবু। হিমালয়ের সম্ভাবনাটা কম নয়, কেননা বুটজোড়া, ওভারকোট আর দস্তানাগুলোও পাওয়া যাচ্ছে না। চিন্তায় চিন্তায় আর কান্নায়-কান্নায়ই বোধহয় অসময়ে চোখে চালসে চশমা হয়ে গেল ইন্দ্রাণীর। তিন মাস হয়ে ঘুরতে চলল, সোমেশের খোঁজ নেই। ক্রমশ তিনি পাশের বাড়ির গাজর খেতের মাটিকাদামাখা বইগুলো তাক থেকে নামিয়ে আঁচল দিয়ে ঝেড়েমুছে পড়তে শুরু করলেন ক্রিস্টিন জর্গেনসেন্-এর আত্মজীবনী, ক্যান মরিসের আত্মকথা, ফ্যারা রুস্তমের বিবরণী–পড়তে পড়তে প্রায় স্থির করে ফেলেছেন, দাদার সঙ্গে পরামর্শ করে কাগজে বিজ্ঞাপন দেবেন,-সোমেশ কাম ব্যাক। ব্লাড টেস্টিং পারমিটেড; এমন সময়ে একটা টেলিগ্রাম এল–সোমেশ চৌধুরী এক্সপায়ার্ড থ্রি মান্থস্ এগো অ্যাট ডক্টর চেঞ্জিংকরস্ নার্সিংহোম–সোমা।
ইন্দ্রাণী ধড়াস করে আছাড় খেয়ে পড়লেন সোফার উপরে। তারপরে শুরু হল হাহাকার–সে কি আছাড়ি পিছাড়ি কান্না-হরিদাসী, গঙ্গাঠাকুর হার মেনে গেল; ডাক্তারবাবু এসে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে অজ্ঞান করে ফেললেন, তবে নিশ্চিন্তি। অজ্ঞান হবার আগে ইন্দ্রাণী কেবল বলতে পারলেন, ওই সোমাটা আবার কে?
জ্ঞান ফিরতে ইন্দ্রাণী চোখ মেলেই দেখলেন পাশের ঘাটে তার ফ্যাশনেবল ছোট ননদ শুয়ে শুয়ে ফেমিনা পড়ছে। সোহিনী এয়ার হোস্টেস, থাকে প্রধানত বম্বেতে। মাঝে মাঝে হুটহাট করে চলেও আসে কলকাতাতে, হিল্লিদিল্লি ঘুরতে ঘুরতে। ইন্দ্রাণী খুশি হয়ে বলেন, তুই এখানে? কবে এলি?
প্লাক করা ভুরুর ধনুক বেঁকিয়ে নীল রং করা চোখের পাতা কাঁপয়ে ভ্রমরকালো পল্লবের ছায়ায় তিরস্কার ঘনিয়ে এনে সুন্দরী ননদ বললে, ছিঃ ইন্দু, তুই বলে না! যাঃ!
আরেঃ! তুমি! ইন্দ্রাণী তো হাঁ।
অভিমানে মুচকি হেসে সোমেশ বলল ঠোঁট ফুলিয়ে, আ-হা! আমি না তো আবার কে? সে হাসিতে তার ঠোঁটের শকিং পিংক লিপস্টিক থিরথিরিয়ে কেঁপে উঠল। কেঁপে উঠল ইন্দ্রাণীর বুকও। এ কে? সরু ভুরুর মাঝখানে নীল টিপ, শ্যাম্পু করা বয়েজ-কাট চুল কপাল উড়ে পড়ছে, দুহাতের দশটা নোখে ম্যাচিং শকিং পিংক নেল পলিশ, সেই আঙুল দিয়ে খুব ডেলিকেটলি ফেমিনাটা ধরে আছেন সোমেশবাবু। পাশের বেডসাইড টেবিলে লম্বা গেলাশে কুয়াশা অরেঞ্জ স্কোয়াশ। কপালের উড়ো চুল আস্তে করে সরিয়ে সোমেশ বললেন, মেন দেখছ? আমার নাম এখন সোমা।