যাক, তাহলে আর ভয়ের কিছু নেই, শুধু একটু তেঁতুল গোলা? কী লেবুর জল? নাঃ, কেশ টক ভালোবাসে না। কোনোটাই খাওয়ানো যাবে না। কী করা?
আহা, একটু দুধ খাওয়ালে হয় না?
কিন্তু কেন্টুশ কিছুতেই খেতে এল না। চলতে গলে পড়ে যেতে থাকল, আর সেখানেই শুয়ে ফুরফুর করে নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে থাকল। তার খিদেই পেল না।
থাকুক অমনি করে, আস্তে আস্তে ধাতস্থ হয়ে যাবে। বিষ তো নয়।
দুদিন ধরে ওর ঘোর কাটেনি, কুকুরছাড়া তো? পরিণত বয়স্ক কুকুর হয়তো আর একটু দ্রুত সেরে উঠত। আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠল কেশ, আমাদের চা খাবার সময়ে আবার বিস্কুট চাইতে লাগল হেংলু হয়ে। আঃ, আমাদের হৃৎপিণ্ডের গতি সহজ হল।
আর কোনোদিন কারুর প্যান্টের পকেট থেকে গন্ধে গন্ধে কিছু চুরি করে খায়নি কেশ। কেশের কেলোর কীর্তির সেখানেই ইতি হল।
এখন সে অতি সাবধানি ভদ্দরলোক। সাধ্যসাধনা করে কিছু না দিলে খায় না। বিস্কুট দিলেও তিন বার শুঁকে পরীক্ষা করে তারপরে ভেবেচিন্তে মুখে নেয়। একবার ভুল করে কেশও বড় হয়ে গেল?
শারদীয়া কলকাতা পুরশ্রী ১৪২৪
বাপ রে বাপ!
শুভ বুধবার দিনে, বিকেলবেলায়, অশ্লেষা নয়, মঘা নয়, ত্র্যহস্পর্শ নয়, সোমেশবাবু হঠাৎ উধাও হয়ে গেলেন। রহস্যঘন অন্তর্ধান। ইন্দ্রাণী খোঁজ করতে করতে প্রায় পাগল। জানা গেল অফিসে নাকি তিন মাসের ছুটি নিয়েছেন। মেডিক্যাল লিভ। অথচ ওঁকে কেউ অসুস্থ দেখেনি। বেশ ফুর্তিতে ছিলেন ছুটি নেবার সময়ে। বেরোনোর পথে স্টেনো মেয়ে জেনিফারের চুল টেনে দিয়ে গেছেন। অফিস থেকে বেরিয়ে প্রথমেই একটা মিঠে পান খেয়েছেন–তারপর কোনদিকে যে গেছেন সেটা আর কেউ বলতে পারছেন না। অফিসের গাড়ি নেননি। বাড়িতে একটা হেঁয়ালি চিঠি লিখে গেছেন–ইন্দ্রাণী আই হ্যাড নো চয়েস। এক্সকুজ মি–ক্যে সেরা সেরা–হোয়াট উইল বি উইল বি, দ্য ফিউচারস নট আওয়ার্স টু সী–আর ডায়েরিতে গোটা গোটা হরফে লিখে গেছেন–উৎকণ্ঠ আমার লাগি যদি কেহ প্রতীক্ষিয়া থাকে, সেই ধন্য করিবে আমারে। আর অফিসের ড্রয়ারে ঠিক জহরলাল নেহরুর মত করে প্যাডের পাতায় গোটা গোটা অক্ষরে লিখে রেখেছেন–The woods are lovely, dark and dup,/But I have promises to keep,/ And miles to go before I leap. শেষ শব্দটা ভুল লিখেছেন সেটা নিয়েও ইন্দ্রাণী অত্যন্ত চিন্তিত। ব্যাংকে ইনস্ট্রাকশন দিয়ে গেছেন। ড্রয়ারে জয়েন্ট একাউন্টের চেকবই পাশবই রেখে গেছেন। ছুটির মাইনে নেবার জন্যে তিনটি অথরিটি পত্র সই-করা। সঙ্গে আরেকটি খাম–ওপরে লেখা–ফর ক্যালকাটা পুলিশ–ভিতরে নোট–প্লিজ ডু নট লুক ফর মি। রাদার লুক আফটার মাই ফ্যামিলি। আইল বি ব্যাক ইন টাইম। পুলিশে ইন্দ্রাণীর দাদা কাজ করেন–তিনি গম্ভীর মুখে নোটটি নিয়ে পকেটে পুরেছেন। তারপর অফিসের ডিরেক্টর ঘোষদা, চৌহান আর রণু ব্যানার্জীর সঙ্গে ইন্দ্রাণীর দাদার একটা পরামর্শ সভা হয়েছে। মাস ঘুরতে চলল, পুলিশ কিছুই মীমাংসা করতে পারছে না। আপন বড় সম্বন্ধী থাকা সত্ত্বেও? ইন্দ্রাণী দাদাকে যাচ্ছেতাই করছেন। দাদা কেবলই বলেন, চেষ্টা তো করছি রে। খোঁজ তো করছি রে! এখন তোর কপাল আর আমার হাতযশ?
তা, দুটোর কোনোটাই বিশেষ কাজে দিচ্ছে না। দুমাস হয়ে গেছে।
ইন্দ্রাণী এখন কেবলই ভাবেন আর হা-হুঁতাশ করেন, আহা, তখন মতটা দিলেই হত। তবু ঘরেই থাকতো লোকটা। অত করে হাতে পায়ে ধরে বললেও, ইন্দ্রাণী কিছুতেই রাজি হতে পারেননি। ওঃ, কী বোকামিই হয়েছে। সোমেশ যাই বলুন, ইন্দ্রাণী কেবলই হাউমাউ করে কেঁদেছেন, আর বলেছেন, ওরে বাপ রে! সে কি হয়–মা-বাবা কী ভাববেন!–বান্টু, মিন্টু, সন্টুর কী হবে?–পাড়ার লোকে কী বলবে?-না, না, না, খব্বদার না! এ কী সব্বোনেশে কথা–জন্মেও শুনিনি–ছিঃ–
সোমেশ একের পর এক বই এনে রাত জেগে পড়েন আর একটা বই শেষ হলেই ইন্দ্রাণীকে পড়ানোর চেষ্টা করেন–পঁচিশ বছরের জগতে কতবারই তো এমনটি হয়েছে। এই ভারতবর্ষেই কি হয়নি? এই তো বম্বেতেই ফ্যারা রুস্তম আছে
একটা করে বই এনে সোমেশ ইন্দ্রাণীকে দেন, আর ইন্দ্রাণী টান মেরে সেই বইটি তক্ষুনি জানলা গলিয়ে ফেলে দেন। বই গিয়ে সোজা পড়ে পাশের বাড়ির সদ্য খোঁড়া গর্তের খেতে। সোমেশ ডাকেন,
বান্টু-মিন্টু-সন্টু।
যাই বাবা!
পাশের বাড়ির বাগানে একবার যাও তো।
এক্ষুনি নিয়ে আসছি বাবা!
সোমেশ কাদা ঝেড়েঝুড়ে বই আবার তাকে তোলেন। ইন্দ্রাণী কিছুতেই পড়তেন না।
না, না, না–ওসব কেলেঙ্কারি কাণ্ড আমি কিছুতেই হতে দেব না–মরে গেলেও না। না, না, না।
সোমেশবাবু কত বুঝিয়েছেন, তোমার বাবা-মা-র ভাবনার কী আছে? তাদের মেয়ে তো জলে পড়বে না? আমরা যেমন আছি তেমনই তো থাকব? আর পাড়ার লোকে যা খুশি বলুক, ক্ষতি নেই, দুদিন বাদে পরিবর্তন আসছে না। তাদের ছেলেমেয়ের জীবনে তো কোনও মৌলিক পরিবর্তন আসছে না। তাদের যত্নআত্তি দেখাশুনো শিক্ষাদীক্ষা সবই যেমনকে তেমনই থাকবে তো। ক্ষতি যদি জগতে কারুর হয় ইন্দু, সে কেবল তোমারই। তা আমার জন্য এইটুকু স্যাক্রিফাইস করতে পারবে না? সতী-সাবিত্রীর দেশের মেয়ে তুমি, স্ত্রীরা এখানে স্বামীর জন্যে কী না করেছে?
যে যাই করুক। এমনধারা অন্যায় আব্দার তো বাবা কস্মিনকালেও শুনিনি। না, ওতে মত দিতে পারব না–না, না! ইন্দ্রাণীর সেই এক জেদ।