এ তো একরকম। কিন্তু গতকাল যা ঘটল সেটা ক্লাসিক। দুপুরের দিবানিদ্রার পর উঠে ঠাকুমার বেজায় ফুর্তি। ব্যাপক চেঁচামেচি জুড়ে দিলেন। সারা মুখ উল্লাসে ঝলমল করছে, কণ্ঠস্বরে বিয়েবাড়ির ব্যস্ততা।
কই রে তপইন্যা, রঞ্জইন্যা, আমার চন্দনবুড়াটা, কই গেলি তরা সব? আয়, আয়, শীঘ্র আইস্যা আমারে তোল, আমারে তোল, আমারে পুড়াও সদানন্দ, ও তারাপদ, ও অমূল্যা, দৌড়িয়া আসো বাবারা, আমারে পুড়াও! আমরাই দৌড়ে যাই।
ও ঠাকুমা, হল কী তোমার! ও কী আকথা-কুকথা বলছ?
আহা, আমারে পুড়াইবি আর কখন? আমি ত মসি। রাইতেই মইরা গিসি, তরা কেউ বোঝ নাই। আর বিলম্ব না, জলদি জলদি পুড়া আমারে-রাইত হইলে তো মোশকিল, –দিনে দিনেই লইয়া চল্
ছিঃ ঠাকুমা, অমন বলে না, তুমি মরবে কেন! ষাট! তুমি মরনি।
হ, হ, আমি মরসি, আমি মরসি। আমার পোলাগুলা গেল কই? ডাইক্যা দে, পুড়াইতে ক আমারে।
আরে না, ঠাকুমা, মরনি তুমি! এই দ্যাখো, মরলে কি ব্যথা লাগে? বলেই সাবধানে ঠাকুমার পায়ে এক রামচিমটি।
উঃ হু হু হু..ঈ..শ কী পাজি! মরা মানুষেরে ব্যথা দেয়। মরসি, তবু জ্বালাস? তগো লজ্জাশরম নাই?
আহা, মরা মানুষকে কি ব্যথা দেওয়া যায়! তাহলে তো পোড়ালেও তুমি ব্যথা পাবে। পাবে না? তুমি বেঁচেই আছ ঠাকুমা। জিন্দা মানুষ তুমি।
তরা পোলাপাইন, তরা কিসু বোঝে না। আমি বাসি য্যান মরসি। আর তরা কও মরি নাই। ল ল আমারে পুড়াইতে ল।
না গো ঠাকুমা। সত্যি বলছি, তুমি মরনি। তুমি স্বপ্ন দেখেছ। স্বপ্ন। চিমটিতে ব্যথা পেলে, দেখলে না?
স্বপন ছিল ওইটা?
হ্যাঁ ঠাকুমা। স্বপ্ন।
মরি নাই?
না, না, মরবে কেন?
ঠিকঠাক কইতাসো তোমরা?
ঠিকঠাকই কইতাসি ঠাকুমা, মর নাই তুমি। বাইচ্যা আছে। জিন্দা আছ। শ্বাসপ্রশ্বাস পড়তাসে তোমার। স্বপ্নই দেখসিলা তুমি।
তৃপ্ত, উজ্জ্বল মুখখানি মুহূর্তের মধ্যে বিবর্ণ, নিষ্প্রভ, মলিন হয়ে গেল ঠাকুমার।
যাঃ, খোয়াবই দ্যাখতাসি ক্যাবল? এইবারেও মরণ হইল না তাইলে?
খুব দুঃখী মুখে ঠাকুমা চোখ বুজে জপের মালা নাড়াচাড়া শুরু করে দিলেন। আপন মনেই বললেন, মরি নাই? দু-র ছাই!
.
রঞ্জন চুপ করে গেল। স্তব্ধতা ভেঙে আমি বলি, ঘুগনিটা খা। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। তারপর? আজকে কী বলছেন ঠাকুমা? আজ কেমন মুড?
আজ? আজ যখন আমি বেরুচ্ছি আমাকে বললেন, রঞ্জইন্যা, তুমি কি নয়াপাড়ায় যাও? নয়াপাড়ার দাদুরে একবার দেইখ্যা আইস। ঘরদুয়ার সব বানের জলে ভাইস্যা গেসে, শিবমন্দিরের উচা চাতালে পইড়্যা আছে স্ত্রী-পুত্র লইয়া গরুছাগলের লগে। আমি বললাম, হ্যাঁ, দেখে আসব।
নয়াপাড়াটা কোথায়, রঞ্জন?
ঠাকুমার ভেসে যাওয়া বাপের বাড়ি। বিরাশি বছর আগেকার বন্যার খবর নিতে পাঠিয়েছেন আমাকে।
দেশ, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০০২
নেশাড়ু অ্যান্ড কোং
আমাদের উত্তেজনার শেষ নেই। এবারে দোল অন্যরকম হবে। এবারে দোলে সত্যি সত্যি ভাঙের শরবত তৈরি করা হবে বাড়িতে। সেই অনেক, অনেক বছর আগে একবার পুজোর সময়ে সত্যনারায়ণ পার্কে গিয়েছিলুম মারোয়াড়ি দোকানের বাদাম পেস্তা দেওয়া ভাঙের শরবত খেতে। আমার বড় মেয়ে পিকো, স্বাতী (গঙ্গোপাধ্যয়), দীপংকর চক্রবর্তী, রঞ্জন মিত্র আর আমি। পিকো তখন ইস্কুলে। বুদ্ধি করে নিজে গাড়ি চালাইনি, পাছে ভাং-টাং খেয়ে ফিরে আসতে না পারি? স্বাতী-সুনীলের পুরোনো ভোজপুরী ড্রাইভার মহেন্দ্রকে নেওয়া হল, তার প্রধান কারণ, সে-ই শুধু নিশ্চিত জানে কোন দোকানে মিলবে। দীপংকর দোকানিকে অন্তরালে নিয়ে গিয়ে বলে দিল, চার গেলাস ভাং সমেত রেগুলার, আর দুই গ্লাস ভাং ছাড়া বাদাম-পেস্তার শরবত, বাচ্চা আর ড্রাইভারের জন্য। কিন্তু কাউকেই কথাটা বলা চলবে না।
যথাকালে বড় বড় গ্লাস ভর্তি অপরূপ স্বর্গীয় স্বাদ-গন্ধের শরবত এল। মনে হল চুমুক দিয়ে গ্লাসভর্তি গলে যাওয়া গোলাপ-গন্ধী কুলফি মালাই খাচ্ছি বুঝি। আরে? কই কিছুই হচ্ছে না তো? একটু উন্নত মানের সঘন প্যারামাউন্টের শরবত। এতগুলো টাকা গোল্লায় গেল গো!
তারপরে বোঝা গেল বাড়ি গিয়ে। কেউ অদৃশ্য জলের মধ্যে পা দিয়ে ফেলার ভয়ে শাড়ি তুলে লক্ষ্য দিচ্ছি, কেউ নিজের পেটে ড্রাম বাজিয়ে মার্চ করছে, কেউ পুরুত হয়ে ওম শান্তিঃ ওম শান্তিঃ করছে। সে এক অপরূপ কাণ্ড। পিকোই কেবল বুক ফুলিয়ে দেখছ, আমার কিছু হয়নি বলে সব্বাইকে সামলাচ্ছে।
সেই যে আমাদের বাড়িতে বিজয়ার দিনে মা সিদ্ধির শরবত তৈরি করতেন, তার চেয়ে আর একটু ঘন। এটুকুই। সে শরবতও ছোটদের আর বড়দের দুরকম হত, বড়দেরটায় সিদ্ধি এক চিমটি বেশি, বাচ্চাদের সিদ্ধির পরিমাণ নামমাত্র।
কোনোদিন কারুর মধ্যে নেশার চিহ্ন দেখিনি। শুধু একবার কালীপুজোর সময়ে দীপংকর, আর রঞ্জন সিদ্ধি বেটে শরবত বানিয়েছিল। আমার মা-কে দেওয়া হচ্ছিল না, কিন্তু মা খোঁজ করলেন,–কই দেখি, কী বানিয়েছিস? শুধু তলানিটুকু বাকি ছিল। মাকে সেটাই দেওয়া হল। ভয়ে কাঁটা হয়ে। ওতেই নাকি চরম নেশা হয়। মায়ের কিন্তু কিছুই নেশা হয়নি তাতে। একমুখ হেসে বিজয়গর্বে বললেন,–এত কড়া কড়া ওষুধ খাই, আমাকে কোনো নেশা কাবু করতে পারবে না। ওষুধের বিষের জোর একদম সাপের বিষের মতন! হুঁ হুঁ বাবা!