নতুন জমিদারদের সম্পর্কে হুতোম প্যাঁচার নক্সায় কালীপ্রসন্ন সিংহ লিখছেন, ক্ষুদ্র নবাব, ক্ষুদ্র নবাব দিব্যি দেখতে দুধে আলতার মতো রং, আলবার্ট ফ্যাশানে চুল ফেরানো, চীনের শূয়রের মতো শরীরটি ঘাড়ে-গদ্দানে, হাতে লাল রুমাল ও পিচের ইস্টিক, সিমলের ফিনফিনে ধুতি মালকোঁচা করে পরা, হঠাৎ দেখলে বোধ হয়, রাজারাজড়ার পৌত্তর; কিন্তু পরিচয়ে বেরোবে ‘হৃদে জোলার নাতি!’ কোনো কোনো বাবু আবার নিজস্বতার কারণেও প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন–“গোবিন্দরামের ছড়ি/উমিচাঁদের দাড়ি/নকু ধরের কড়ি/মধু সেনের বাড়ি”। হুতোম প্যাঁচার নকশায় কালীপ্রসন্ন সিংহ লিখেছেন–“সহরে ইংরাজী কেতার বাবুরা দুটি দল হয়েছেন; প্রথম দল উঁচুকে সাহেবের গোবরের গস্ত, দ্বিতীয় ‘ফিরিঙ্গীর জঘন্য প্রতিরূপ’; প্রথম দলের সকলি ইংরাজি কেতা, টেবিল-চেয়ারের মজলিস, পেয়ালা করা চা, চুরোট, জগে করা জল, ডিকান্টরে ব্রান্ডি ও কাঁচের গ্লাসে সোলার ঢাকনি, সালুমোড়া; হরকরা ইংলিশম্যান ও ফিনিক্স সামনে থাকে, পলিটিক্স ও ‘বেস্ট নিউজ অব দি ডে’ নিয়েই সর্বদা আন্দোলন। টেবিলে খান, কমড়ে হাগেন এবং কাগজে পোঁদ পৌঁছেন। এঁরা সহৃদয়তা, দয়া, পরোপকার, নম্রতা প্রভৃতি বিবিধ সগুণে ভূষিত, কেবল সর্বদাই রোগ, মদ খেয়ে জুজু, স্ত্রীর দাস, উৎসাহ, একতা, উন্নতির ইচ্ছা একেবারে হৃদয় হতে নির্বাসিত হয়েছে; এঁরাই ওল্ড ক্লাস।” হুতোম প্যাঁচার নকশায় কালীবাবু বাবুদের চরিত্র নিয়ে একটা ছড়া লিখলেন। আপনিও পড়ন–“আজব শহর কলকেতা।/রাঁড়ি বাড়ি জুড়ি গাড়ি মিছে কথার কি কেতা।/হেতা খুঁটে পোড়ে গোবর হাসে বলিহারি ঐক্যতা;/যত বক বিড়ালে ব্ৰহ্মজ্ঞানী, বদমাইসির ফাঁদ পাতা/পুঁটে তেলির আশা ছড়ি, শুড়ি সোনার বেনের কড়ি,/খ্যামটা খানকির খাসা বাড়ি, ভদ্রভাগ্যে গোলপাতাহদ্দ হেরি হিন্দুয়ানি, ভিতরে ভাঙ্গা ভড়ং খানি,/পথে হেগে চোখ রাঙ্গানি, লুকোচুরির ফেঁরগাঁতা।/গিলটি কাজে পালিস করা, রাঙ্গা টাকায় তামা ভরা,/হুতোম দাসে স্বরূপ ভাসে, তফাৎ থাকাই সার কথা।” শিবনাথ শাস্ত্রীর কলম সাক্ষ্য দিচ্ছে–“রাত্রিকালে বারাঙ্গণাদিগের গৃহে গৃহে গীতবাদ্য ও আমোদপ্রমোদ করিয়া কাল কাটাইত এবং খড়দহের ও ঘোষপাড়ায় মেলা এবং মাহেশের স্নানযাত্রা প্রভৃতির সময়ে কলিকাতা হইতে বারাঙ্গণাদিগকে সঙ্গে লইয়া দলে দলে নৌকাযোগে আমোদ করিতে যাইতেন।”
‘বাবু’ সম্পর্কে চমৎকার সব কথা লিখেছেন কালীপ্রসন্ন সিংহ—বাবু মাত্রেই ধনী, কিন্তু ধনী হলেই বাবু হয় না। রামদুলাল সরকারের টাকা ছিল, কিন্তু বাবু হননি। তিনি অতি দরিদ্র থেকে বাংলার শ্রেষ্ঠ ধনী হয়েছিলেন। খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন। রামদুলাল দু-বেলা নিরামিষ খেতেন। দুপুর বেলা ভাত দুধ আর দু-একটি। মিঠাই আর রাতে আটার রুটি। খুব সাধারণ পোশাক পরতেন। নিজের ছেলের বিয়েতে তিনি শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কয়েকদিনের জন্য একজন সিপাহীকে নিয়োগ করেন। সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত রামদুলাল সাধারণ বেশে বিবাহ সংক্রান্ত কাজ দেখাশুনা করতে গিয়ে কাজ শেষে পুনরায় গৃহে প্রবেশ করতে চাইলে সিপাহী রামদুলালকে চিনতে না পেরে পথরোধ করে। কারণ ধনী লোকদের জীবনযাপন এত সাধারণ হতে পারে সিপাহীটি ভাবতেই পারেনি। সাদাসিধা জীবনযাত্রায় অভ্যেস্ত মানুষ ‘বাবু’ হতে পারে না। বাবু হতে গেলে কুকুরের বিয়েতে লাখ টাকা খরচ করা, চার ঘোড়ার গাড়ি চড়ে ভেঁপু বাজিয়ে স্নান করতে যাওয়া, দু-একটি রাঁড় রাখা, রক্ষিতাদের দালানকোঠা করে দেওয়া, পায়রা ওড়ানো, বিদ্যাসুন্দরের আসর বসানো, শনিবারের রাতে বাই-বেশ্যা নিয়ে আসর বসানো ইত্যাদি করতে হয়। বহু বাবু পাল্লা দিয়ে লোক দেখানো এসব করতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছিলেন। মোট কথা—বাবু শুধু ভোগ করতে চান না, খ্যাতি চান, সকলের সঙ্গে টাকা। ওড়ানোর প্রতিযোগিতা করে সবার উপরে থাকতে চান। কলকাতার বিখ্যাত আট বাবু ছিলেন এর মধ্যে অগ্রগণ্য। কলকাতার আট বাবুর মধ্যে ছিলেন নীলমণি হালদার, রামতনু দত্ত, গোকুলচন্দ্র মিত্র, রাজা রাজকৃষ্ণ, কালীপ্রসন্ন সিংহের পূর্বপুরুষ ছাতু সিংহ, দর্পনারায়ণ ঠাকুর, রাজা সুখময় রায় এবং চোরাবাগান মিত্র বংশের এক বাবু—এঁরাই ছিলেন আট বাবু। পরবর্তীকালে নামডাক সম্পন্ন আরও বাবু এসেছিলেন, কিন্তু উপরে উল্লিখিত আটবাবুই হলেন কলকাতার প্রথম বাবু।
সিরাজদৌলার বিরুদ্ধে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের সাহায্য করার পুরস্কার হিসেবে নবকৃষ্ণ দেব পান প্রভূত ধনসম্পত্তি, জমি ও মহারাজা উপাধি। তার স্বল্পকালের মধ্যেই উত্তর কলকাতার শোভাবাজারে প্রাসাদোপম ভদ্রাসন ও দুর্গাপুজোর উপযোগী বিশাল ঠাকুর দালান তৈরি করে দুর্গাপুজো আরম্ভ করে মহারাজ কৃষ্ণদেব। প্রধানত ক্লাইভ ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের আপ্যায়নের জন্যই নবকৃষ্ণের এই দুর্গাপুজোর আয়োজন। ইংরেজদের খেতাবধারী মহারাজা নবকৃষ্ণ তাঁর এক বন্ধুকে লিখেছিলেন—“এবার পূজার সময় লর্ড ক্লাইভ আমার বাটিতে অনুগ্রহপূর্বক প্রতিমা দর্শন করিতে আসিবেন। তাঁহার সহিত কোম্পানির বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত থাকিবেন।” নবকৃষ্ণের বাড়িতে ইংরেজ সাহেবরা দুর্গাপুজো দেখতে আসবে বলে সকাল থেকে চিৎপুরে রাস্তায় লোক চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিল পুলিশ। এসব দুর্গাপুজোর অধিকাংশেরই মূল উদ্দেশ্য ছিল বিত্ত ও প্রাচুর্য। প্রদর্শন এবং পুজো উপলক্ষে আমোদপ্রমোদের আয়োজন করে ইংরেজ রাজপুরুষদের তোষণ। শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপুজো শুরু হওয়ার সময়ে অথবা পরবর্তীকালে আঠারো শতকে কলকাতায় এই ধরনের যে দুর্গাপুজোগুলো আরম্ভ হয়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—জোড়াসাঁকোর দাঁ বাড়ি ও দর্জিপাড়ার জয়রাম মিত্রের বাড়ি, দক্ষিণ কলকাতার চক্ৰবাড়িয়া সড়কের মিত্র বাড়ি, উত্তর কলকাতার বিডন স্ট্রিটের ছাতুবাবু-লাটুবাবুর বাড়ি, খিদিরপুরের ভূ-কৈলাশ রাজবাড়ি, মধ্য কলকাতার রানি রাসমণির বাড়ি। দুর্গাপুজো ছিল বাবুদের সবচেয়ে জমকালো উৎসব। সাহেবরাও এই উৎসবে যোগদান করার জন্য সবসময়ই আমন্ত্রিত হতেন এবং উৎসবের কর্তারাও নানারকম ফলমূল দিয়ে তাদের অভ্যর্থনা করতেন। উৎসবকালে প্রতি সন্ধ্যায় নাচগানের ব্যবস্থা করা হত। আমন্ত্রণ করা হত নামকরা সব বাঈজি-বেশ্যাদের। ধণিক শ্রেণি ছাড়াও এই প্রসাদ পেত সাহেবরাও। হঠাৎ কোনো বাইজী বা গণিকার প্রসিদ্ধি ছড়িয়ে পড়লে তাঁকে ‘বাঁধা মেয়েমানুষ’ হিসাবে রাখার জন্যে বাবুদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেত। এই গণিকাঁচর্চাই ছিল বাবু কালচারের অঙ্গ। কালীপ্রসন্নের লেখা থেকে জানা যায়, রাজরাজড়ারা রাতে নিজ বিবাহিত স্ত্রীর মুখ দেখতেন না। বাড়ির প্রধান আমলা, দারওয়ান, মুৎসুদ্দিরা যেমন হুজুরের বিষয়কর্ম দেখেন, তেমনই রাজরাজড়ার স্ত্রীদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়দায়িত্বও তাঁদের উপর বর্তাত। সুতরাং তাঁরাই-বা ছাড়বেন কেন! এই ভয়ে কোনো কোনো বুদ্ধিমান স্ত্রীকে বাড়ির ভিতর ঘরে পুরে বাইরে দিয়ে তালা-চাবি মেরে সারারাত নিশ্চিন্তে রাঁড় নিয়ে বা বাইজী-গণিকাদের সঙ্গে ফুর্তি করে সকালে বাড়ি ফিরতেন ‘বাবু’। ভাবছেন বাবুদের এত মদন-দহন! সেকালের মদন-দহন কেমন ছিল? কয়েকটি পংক্তি পড়ে নিন–“মদন-আগুন জ্বলছে দ্বিগুণ, কি গুণ কল্প ঐ বিদেশী,ইচ্ছা করে উহার করে প্রাণ সঁপে দিই হইগো দাসী।/দারুণ কটাক্ষ-বানে, অস্থির করেছে প্রাণে,/মনে না ধৈরজ মানে, মন হয়েছে তাই উদাসী।”