- বইয়ের নামঃ নাস্তিকের ধর্মকথা
- লেখকের নামঃ অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃইতিহাস
নাস্তিকের ধর্মকথা – অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
.
উৎসর্গ
যাঁরা এ পৃথিবীকে সুস্থ রাখতে সর্বদা কাজ করে যাচ্ছেন
সূচিমুখ
কথামুখ
নাস্তিক্যবাদ
দেবতার তত্ত্বতালাশ
যুক্তিবাদীর ধর্মকথা
কথামুখ
নাস্তিক শব্দটি মানে যে ঈশ্বর ও ধর্মে অবিশ্বাস করে। আস্তিক মানে যে ঈশ্বর ও ধর্মে বিশ্বাস করে। বিষয়টি যদি এটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকত, তাহলে আমাকে এ গ্রন্থের অবতারণা করতে হত না।
কেবলং শাস্ত্রমাশ্ৰিত্য ন কর্তব্য বিনির্ণয়।
যুক্তিহীন বিচারেণ ধর্মহানিঃ প্ৰজায়তে।।
এটার আমার বচন নয়, শাস্ত্রীয় বচন। আমি নাস্তিক। শাস্ত্র আমার জীবন নিয়ন্ত্রণ করে না। অর্থাৎ আমি বস্তুত অশাস্ত্রীয় মানুষ। যুক্তিহীন ধর্মকথা মান্য করে পুণ্যলাভের বাসনা আমার নেই। বরং শাস্ত্রমতে যুক্তিহীন বিচারে ধর্মের ক্ষতিসাধন হয় বল আমি বিশ্বাস করি। এটাই আমার বিশ্বাস, আমার ধর্মানুভূতি। কল্পনাবিলাসে নাস্তিকরা অভ্যস্ত নয়।
পতঞ্জলি মতে ‘অস্তি’ বা ‘আছে’–এই ধারণার বশবর্তী হয়ে মানুষ আস্তিক এবং এর বিপরীত, ‘ন অস্তি’ বা ‘নেই’–এই ধারণার বশবর্তী হয়ে মানুষ ‘নাস্তিক’। ঈশ্বর ও ধর্ম বিষয়ে নাস্তিকদের চিন্তাচেতনা এবং আস্তিকদের চিন্তাচেতনা নিয়েই এই গ্রন্থের বিষয়। নাস্তিক্যবাদের ইতিহাস ও বিবর্তনই এই গ্রন্থের রসদ। প্রচলিত ধর্মগুলির ইতিহাসও আলাদা প্রবন্ধে আলোচনা হয়েছে। বস্তুত এই গ্রন্থে মোট তিনটি প্রবন্ধ আছে। প্রবন্ধ তিনটি হলেও নাস্তিকতাই মূল সুর। সুরের জয়, অ-সুরের পরাজয় আবশ্যক।
নাস্তিক্যবাদ ও নাস্তিকদের নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ধারণা পরিষ্কার নয়। নাস্তিকদের দর্শন ও লড়াই কখনোই আস্তিকদের বিরুদ্ধে নয়। নাস্তিকদের লড়াই বুজরুকদের বিরুদ্ধে, ভণ্ডদের বিরুদ্ধে, প্রতারকদের বিরুদ্ধে। যাঁরা আল্লাহ-ঈশ্বর-গডের নাম ভাঙিয়ে যাঁরা সাধারণ মানুষদের প্রতারণা করে, নাস্তিকদের লড়াই তাঁদের বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়–যাঁরা ধর্মের নামে দাঙ্গা বাধায়, রক্তবন্যা বইয়ে দেয়, যাঁরা ধর্মের নামে মানুষ হত্যা করে, লড়াই তাঁদের বিরুদ্ধে।
যতদিন এ পৃথিবীতে এই ভণ্ড-বুজরুকরা থাকবে, ততদিন নাস্তিকদের আন্দোলন চলবে। যাঁরা নিজ ধর্মকে বুক ঠুকে উৎকৃষ্ট বলে ঘনঘন চেল্লান, আর অন্য ধর্মকে নিকৃষ্ট বলে হেয় প্রতিপন্ন করে, নাস্তিকদের লড়াই তাঁদের বিরুদ্ধেও। কারোর ধর্মবিশ্বাসকে আঘাত করা নাস্তিকদের কাজ নয়। ঈশ্বর ও ধর্মকে যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করে।
যাবতীয় গুজব, অন্ধবিশ্বাস, প্রশ্নহীন আনুগত্য এবং সমস্ত রকমের পশ্চাৎপদতাকে সরিয়ে বিজ্ঞানমনস্ক সমাজের স্বপ্ন দেখে নাস্তিক্যবাদীরা। নাস্তিক্যবাদীরা ধর্মের নামে মানুষের বিভাজন ঘৃণা করে। নাস্তিকরা সমস্ত বিদ্বেষ-বিভাজনের বিরোধিতা করে।
এই গ্রন্থের মাধ্যমে সক্রেটিস, ব্রুনো, অভিজিৎ, তসলিমা, ভগৎ সিং, সলমন রুশদি, স্টিফেন হকিং, কালবর্গির পথ ধরে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার প্রয়াস। এই প্রয়াস যদি পাঠকদের কিছুমাত্র ঋদ্ধ করতে সক্ষম হয়, তাহলেই আমার পরিশ্রম সার্থক হবে।
অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
১. নাস্তিক্যবাদ
নাস্তিক্যবাদ (Atheism) একটি দর্শনের নাম, যাতে ঈশ্বর বা স্রষ্টার অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয় না এবং সম্পূর্ণ ভৌত এবং প্রাকৃতিক উপায়ে প্রকৃতির ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। আস্তিক্যবাদের বর্জনকেই নাস্তিক্যবাদ বলা যায়। নাস্তিক্যবাদ বিশ্বাস নয়, বরং অবিশ্বাস এবং যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। বিশ্বাসকে খণ্ডন নয়, বরং বিশ্বাসের অনুপস্থিতিই এখানে মুখ্য। ‘Atheism’ শব্দের অর্থ হল নাস্তিক্যবাদ বা নিরীশ্বরবাদ। ‘এইথিজম’ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে গ্রিক ‘এথোস’ শব্দটি থেকে। শব্দটি সেই সমস্ত মানুষকে নির্দেশ করে, যারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই বলে মনে করে এবং প্রচলিত ধর্মগুলোর প্রতি অন্ধবিশ্বাসকে যুক্তি দ্বারা ভ্রান্ত বলে প্রমাণ করে। মুক্তচিন্তা, সংশয়বাদী চিন্তাধারা এবং ধর্মসমূহের সমালোচনা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নাস্তিক্যবাদেরও প্রসার ঘটছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে সর্বপ্রথম কিছু মানুষ নিজেদের নাস্তিক বলে স্বীকৃতি দেয়।
বর্তমান বিশ্বের জনসংখ্যার ২.৩ শতাংশ মানুষ নিজেদের নাস্তিক বলে পরিচয় দিয়ে থাকে এবং ১১.৯ শতাংশ মানুষ কোনো ধর্মেই বিশ্বাস করে না। জাপানের ৬৪ শতাংশ থেকে ৬৫ শতাংশ মানুষ নাস্তিক অথবা ধর্মে অবিশ্বাসী। রাশিয়াতে এই সংখ্যা প্রায় ৪৮ শতাংশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৬ শতাংশ (ইতালি) থেকে শুরু করে ৮৫ শতাংশ (সুইডেন) পর্যন্ত। পশ্চিমের দেশগুলোতে নাস্তিকদের সাধারণভাবে ধর্মহীন পারলৌকিক বিষয়সমূহে অবিশ্বাসী হিসাবে গণ্য করা হয়। কিন্তু বৌদ্ধধর্মের মতো যেসব ধর্মে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হয় না, সেসব ধর্মালম্বীদেরকেও নাস্তিক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। কিছু নাস্তিক ব্যক্তিগতভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা, হিন্দুধর্মের দর্শন, যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ এবং প্রকৃতিবাদে বিশ্বাস করে। নাস্তিকরা কোনো বিশেষ মতাদর্শের অনুসারী নয় এবং তাঁরা সকলে বিশেষ কোনো আচার-অনুষ্ঠানও পালন করে না। অর্থাৎ ব্যক্তিগতভাবে যে কেউ, যে-কোনো মতাদর্শে সমর্থক হতে পারে, নাস্তিকদের মিল শুধুমাত্র এক জায়গাতেই, আর তা হল ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অবিশ্বাস করা।