- বইয়ের নামঃ নাস্তিকের ধর্মকথা
- লেখকের নামঃ অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃইতিহাস
নাস্তিকের ধর্মকথা – অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
.
উৎসর্গ
যাঁরা এ পৃথিবীকে সুস্থ রাখতে সর্বদা কাজ করে যাচ্ছেন
সূচিমুখ
কথামুখ
নাস্তিক্যবাদ
দেবতার তত্ত্বতালাশ
যুক্তিবাদীর ধর্মকথা
কথামুখ
নাস্তিক শব্দটি মানে যে ঈশ্বর ও ধর্মে অবিশ্বাস করে। আস্তিক মানে যে ঈশ্বর ও ধর্মে বিশ্বাস করে। বিষয়টি যদি এটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকত, তাহলে আমাকে এ গ্রন্থের অবতারণা করতে হত না।
কেবলং শাস্ত্রমাশ্ৰিত্য ন কর্তব্য বিনির্ণয়।
যুক্তিহীন বিচারেণ ধর্মহানিঃ প্ৰজায়তে।।
এটার আমার বচন নয়, শাস্ত্রীয় বচন। আমি নাস্তিক। শাস্ত্র আমার জীবন নিয়ন্ত্রণ করে না। অর্থাৎ আমি বস্তুত অশাস্ত্রীয় মানুষ। যুক্তিহীন ধর্মকথা মান্য করে পুণ্যলাভের বাসনা আমার নেই। বরং শাস্ত্রমতে যুক্তিহীন বিচারে ধর্মের ক্ষতিসাধন হয় বল আমি বিশ্বাস করি। এটাই আমার বিশ্বাস, আমার ধর্মানুভূতি। কল্পনাবিলাসে নাস্তিকরা অভ্যস্ত নয়।
পতঞ্জলি মতে ‘অস্তি’ বা ‘আছে’–এই ধারণার বশবর্তী হয়ে মানুষ আস্তিক এবং এর বিপরীত, ‘ন অস্তি’ বা ‘নেই’–এই ধারণার বশবর্তী হয়ে মানুষ ‘নাস্তিক’। ঈশ্বর ও ধর্ম বিষয়ে নাস্তিকদের চিন্তাচেতনা এবং আস্তিকদের চিন্তাচেতনা নিয়েই এই গ্রন্থের বিষয়। নাস্তিক্যবাদের ইতিহাস ও বিবর্তনই এই গ্রন্থের রসদ। প্রচলিত ধর্মগুলির ইতিহাসও আলাদা প্রবন্ধে আলোচনা হয়েছে। বস্তুত এই গ্রন্থে মোট তিনটি প্রবন্ধ আছে। প্রবন্ধ তিনটি হলেও নাস্তিকতাই মূল সুর। সুরের জয়, অ-সুরের পরাজয় আবশ্যক।
নাস্তিক্যবাদ ও নাস্তিকদের নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ধারণা পরিষ্কার নয়। নাস্তিকদের দর্শন ও লড়াই কখনোই আস্তিকদের বিরুদ্ধে নয়। নাস্তিকদের লড়াই বুজরুকদের বিরুদ্ধে, ভণ্ডদের বিরুদ্ধে, প্রতারকদের বিরুদ্ধে। যাঁরা আল্লাহ-ঈশ্বর-গডের নাম ভাঙিয়ে যাঁরা সাধারণ মানুষদের প্রতারণা করে, নাস্তিকদের লড়াই তাঁদের বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়–যাঁরা ধর্মের নামে দাঙ্গা বাধায়, রক্তবন্যা বইয়ে দেয়, যাঁরা ধর্মের নামে মানুষ হত্যা করে, লড়াই তাঁদের বিরুদ্ধে।
যতদিন এ পৃথিবীতে এই ভণ্ড-বুজরুকরা থাকবে, ততদিন নাস্তিকদের আন্দোলন চলবে। যাঁরা নিজ ধর্মকে বুক ঠুকে উৎকৃষ্ট বলে ঘনঘন চেল্লান, আর অন্য ধর্মকে নিকৃষ্ট বলে হেয় প্রতিপন্ন করে, নাস্তিকদের লড়াই তাঁদের বিরুদ্ধেও। কারোর ধর্মবিশ্বাসকে আঘাত করা নাস্তিকদের কাজ নয়। ঈশ্বর ও ধর্মকে যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করে।
যাবতীয় গুজব, অন্ধবিশ্বাস, প্রশ্নহীন আনুগত্য এবং সমস্ত রকমের পশ্চাৎপদতাকে সরিয়ে বিজ্ঞানমনস্ক সমাজের স্বপ্ন দেখে নাস্তিক্যবাদীরা। নাস্তিক্যবাদীরা ধর্মের নামে মানুষের বিভাজন ঘৃণা করে। নাস্তিকরা সমস্ত বিদ্বেষ-বিভাজনের বিরোধিতা করে।
এই গ্রন্থের মাধ্যমে সক্রেটিস, ব্রুনো, অভিজিৎ, তসলিমা, ভগৎ সিং, সলমন রুশদি, স্টিফেন হকিং, কালবর্গির পথ ধরে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার প্রয়াস। এই প্রয়াস যদি পাঠকদের কিছুমাত্র ঋদ্ধ করতে সক্ষম হয়, তাহলেই আমার পরিশ্রম সার্থক হবে।
অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
১. নাস্তিক্যবাদ
নাস্তিক্যবাদ (Atheism) একটি দর্শনের নাম, যাতে ঈশ্বর বা স্রষ্টার অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয় না এবং সম্পূর্ণ ভৌত এবং প্রাকৃতিক উপায়ে প্রকৃতির ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। আস্তিক্যবাদের বর্জনকেই নাস্তিক্যবাদ বলা যায়। নাস্তিক্যবাদ বিশ্বাস নয়, বরং অবিশ্বাস এবং যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। বিশ্বাসকে খণ্ডন নয়, বরং বিশ্বাসের অনুপস্থিতিই এখানে মুখ্য। ‘Atheism’ শব্দের অর্থ হল নাস্তিক্যবাদ বা নিরীশ্বরবাদ। ‘এইথিজম’ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে গ্রিক ‘এথোস’ শব্দটি থেকে। শব্দটি সেই সমস্ত মানুষকে নির্দেশ করে, যারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই বলে মনে করে এবং প্রচলিত ধর্মগুলোর প্রতি অন্ধবিশ্বাসকে যুক্তি দ্বারা ভ্রান্ত বলে প্রমাণ করে। মুক্তচিন্তা, সংশয়বাদী চিন্তাধারা এবং ধর্মসমূহের সমালোচনা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নাস্তিক্যবাদেরও প্রসার ঘটছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে সর্বপ্রথম কিছু মানুষ নিজেদের নাস্তিক বলে স্বীকৃতি দেয়।
বর্তমান বিশ্বের জনসংখ্যার ২.৩ শতাংশ মানুষ নিজেদের নাস্তিক বলে পরিচয় দিয়ে থাকে এবং ১১.৯ শতাংশ মানুষ কোনো ধর্মেই বিশ্বাস করে না। জাপানের ৬৪ শতাংশ থেকে ৬৫ শতাংশ মানুষ নাস্তিক অথবা ধর্মে অবিশ্বাসী। রাশিয়াতে এই সংখ্যা প্রায় ৪৮ শতাংশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৬ শতাংশ (ইতালি) থেকে শুরু করে ৮৫ শতাংশ (সুইডেন) পর্যন্ত। পশ্চিমের দেশগুলোতে নাস্তিকদের সাধারণভাবে ধর্মহীন পারলৌকিক বিষয়সমূহে অবিশ্বাসী হিসাবে গণ্য করা হয়। কিন্তু বৌদ্ধধর্মের মতো যেসব ধর্মে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হয় না, সেসব ধর্মালম্বীদেরকেও নাস্তিক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। কিছু নাস্তিক ব্যক্তিগতভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা, হিন্দুধর্মের দর্শন, যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ এবং প্রকৃতিবাদে বিশ্বাস করে। নাস্তিকরা কোনো বিশেষ মতাদর্শের অনুসারী নয় এবং তাঁরা সকলে বিশেষ কোনো আচার-অনুষ্ঠানও পালন করে না। অর্থাৎ ব্যক্তিগতভাবে যে কেউ, যে-কোনো মতাদর্শে সমর্থক হতে পারে, নাস্তিকদের মিল শুধুমাত্র এক জায়গাতেই, আর তা হল ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অবিশ্বাস করা।
‘নাস্তিক’ শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থটি আমাদের জানা প্রয়োজন। ‘নাস্তিক’ শব্দটি ভাঙলে দাঁড়ায়, নাস্তিক + কন বা নাস্তি + ক। ‘নাস্তি’ শব্দের অর্থ হল নেই, অবিদ্যমান। ‘নাস্তি’ শব্দটি মূল সংস্কৃত থেকে বাংলায় এসে ‘ক’ বা ‘কন’ প্রত্যয় যোগে নাস্তিক হয়েছে, যা তৎসম শব্দ হিসাবে গৃহীত। ন আস্তিক = নাস্তিক, যা নঞ তৎপুরুষ সমাসে সিদ্ধ এবং আস্তিকের বিপরীত শব্দ। আরও সহজ করে বলা যায়, না + আস্তিক =নাস্তিক। খুবই পরিষ্কার যে, সংগত কারণেই আস্তিকের আগে ‘না’ প্রত্যয় যোগ করে নাস্তিক শব্দটি তৈরি করা হয়েছে। আস্তিকরা যে ঈশ্বর/আল্লাহ/খোদা ইত্যাদি পরমসত্ত্বায় বিশ্বাস করে এ তো সবারই জানা। কাজেই নাস্তিক হচ্ছে তাঁরাই, যাঁরা এই ধরনের বিশ্বাস হতে মুক্ত। তাই সংজ্ঞানুযায়ী নাস্তিকতা কোনো বিশ্বাস নয়, বরং বিশ্বাস থেকে মুক্তি বা ‘বিশ্বাসহীনতা’। ইংরেজিতে নাস্তিকতার প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘Atheist’। সেখানেও আমরা দেখছি “theist” শব্দটির আগে ‘a’ প্রিফিক্সটি জুড়ে দিয়ে Atheist শব্দটি তৈরি করা হয়েছে। নাস্তিকতা এবং মুক্তচিন্তার উপর বহুল প্রচারিত গবেষণাধর্মী একটি ওয়েব সাইটে শব্দটির যে সংজ্ঞা আছে–Atheism is characterized by an absence of belief in the existence of gods. This absence of belief generally comes about either through deliberate choice, or from an inherent inability to believe religious teachings which seem literally incredible. It is not a lack of belief born out of simple ignorance of religious teachings.
সহজেই অনুমেয় যে, “absence of belief” শব্দমালা চয়ন করা হয়েছে। ‘বিশ্বাসহীনতা’কে তুলে ধরতেই, উলটোটি বোঝাতে নয়। Gordon Stein তাঁর বিখ্যাত “An Anthology of Atheism and Rationalism’ বইয়ে নাস্তিকতার (Atheism) সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, “when we examine the components of the word ‘atheism, we can see this distinction more clearly. The word is made up of ‘a-’ and ‘-theism.’ Theism, we will all agree, is a belief in a God or gods. The prefix a-’ can mean ‘noť (or ‘no’) or ‘without’. If it means ‘not,’ then we have as an atheist someone who is not a theist (i.e., someone who does not have a belief in a God or gods). If it means ‘without, then an atheist is someone without theism, or without a belief in God”. (p. 3. Prometheus, 1980)।
আমরা যদি ‘atheist’ শব্দটির আরও গভীরে যাই তবে দেখব যে, এটি আসলে উদ্ভূত হয়েছে গ্রিক শব্দ ‘a’ এবং ‘theos’ থেকে। গ্রিক ভাষায় ‘theos’ বলতে বোঝায় ঈশ্বরকে, আর ‘a’ বলতে বোঝায় অবিশ্বাস বা বিশ্বাসহীনতাকে। সেজন্যই Michael Martin তাঁর “Atheism: A Philosophical Justification” বইয়ে বলেন, “According to its Greek roots, then, atheism is a negative view, characterized by the absence of belief in God.”
সৃষ্টিকর্তা বা একেশ্বরে অবিশ্বাসীদের নাস্তিক বলা হয়নি। সৃষ্টিকর্তা বা একেশ্বরের ধারণাই তো সৃষ্টি হয়নি। সর্বপ্রথম নাস্তিক’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছিল লোকায়তিকদের প্রতি। চার্বাক বা লোকায়ত দর্শনের অনুসারীদের লোকায়তিক বলা হয়। নির্দিষ্ট করে বললে–যাঁরা বেদের ক্রিয়া-কাণ্ড, যাগ-যজ্ঞাদিকে অনর্থক বলেছেন বেদকে প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসাবে স্বীকার করেননি এবং পরলোকে অবিশ্বাসী, এমন ভাবসম্পন্ন ব্যক্তিকে নাস্তিক বলা হয়েছে। সেই কারণেই নাস্তিক চার্বাকদের বেদবিশ্বাসীরা নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে বলে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন। বেদবিশ্বাসীদের মতে বৌদ্ধধর্মও নাস্তিক। কারণ বৌদ্ধরাও বেদবিরোধী। বেদবিশ্বাসীরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদেরও নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াস নিয়েছিল। ভারত থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করতে সক্ষম হলেও বৌদ্ধধর্ম ভারতের বাইরে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। অবশেষে বেদবিশ্বাসীরা পরাজিত হয়ে বিষ্ণুর দশমাবতারে এক অবতারে বুদ্ধদেবকে ঢুকিয়ে দিয়েছে।
সনাতন-ধর্মীয় মনুসংহিতা নাস্তিকের উপমায় বলছে –“সোহবমন্যেত তে মূলে হেতুশাস্ত্রাশয়াদ্বিজঃ। স সাধুভিহি, কাৰ্য্যো নাস্তিকো বেদনিন্দুকঃ”(২/১১)। অর্থাৎ “যে ব্যক্তি প্রতিকূল তর্ক দ্বারা মূলস্বরূপ শ্রুতি ও স্মৃতিশাস্ত্রকে অবমাননা করে, সাধু লোকেরা সেই বেদনিন্দক নাস্তিককে দ্বিজের কর্তব্য কর্ম অধ্যায়নাদি সকল অনুষ্ঠান হতে বহিস্কৃত করবেন।”
বিশিষ্ট বৈয়াকরণিক পাণিনির ব্যাখ্যা মতে যে ব্যক্তি পরলোকে কর্মফলে বিশ্বাস করে না, সেই নাস্তিক। অতএব প্রতীয়মান হয় যে, তৎকালে নিরীশ্বরবাদী নয়, বরং পরলোকে অবিশ্বাসী, বেদ অস্বীকারকারী এবং বেদ-নিন্দুককেই নাস্তিক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর এই দর্শনই নাস্তিকতা। নিরীশ্বরবাদীদেরকেই পাশ্চাত্যে ইংরেজিতে বলা হচ্ছে Atheist এবং এর দর্শনকে বলা হয়েছে Atheism. Jullian Baggini তাঁর “Atheism : A very sort introduction to the meaning of a atheist’s commitment to naturalism” প্রবন্ধে লিখেছে–“What most atheists do believe is that although there is only one kind of stuff, in the universe and it is physical, out of this stuff come minds, beauty, emotions, moral valued–in short the full gamut of phenomena that gives richness to human life.”
নাস্তিক এবং নাস্তিক্যবাদ–মুসলিমদের মধ্যে মৌলবাদীরা ধর্ম আর ঈশ্বরের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলে যে-কাউকেই ‘জঙ্গি নাস্তিক’ বলা হয়ে থাকে। ঘোষণা দেয়–“দেশকে নাস্তিকমুক্ত করতে হবে”, “নাস্তিকদের ফাঁসি দিতে হবে” বাংলাদেশের কেউ কেউ আবার বলেন “বাংলাদেশের নাস্তিকরা আসলে ছুপা হিঁদু”। সরব নাস্তিকদের জঙ্গি মুসলিম, জঙ্গি খ্রিস্টান, জঙ্গি হিন্দু বা অন্য যে কোনও ধর্মীয় জঙ্গিদের সঙ্গে এক পংক্তিতে ফেলার এই যুক্তিহীন ভিত্তিহীন প্রবণতা। নাস্তিকদের বিরুদ্ধে সব আস্তিক্যবাদীদেরই একইরকম খঙ্গহস্ত। নাস্তিকদের পৃথিবী থেকে একেবারে নির্মূল করতে পারলেই আস্তিকদের শান্তি ও স্বস্তি। নাস্তিকবাদীদের হত্যা করেই আস্তিকরা নিশ্চিন্তে সুখনিদ্রা দিতে চান। এ ব্যাপারে সব আস্তিকবাদীদের এক দর্শন। এ থেকেই বোঝা যায় আস্তিকরা কত দুর্বল। ঈশ্বরের প্রতিও ভরসা রাখার আত্মবিশ্বাস নেই। পদে পদে মুখোশ খুলে যাওয়ার ভয়। ভণ্ডামি ধরা পড়ার আতঙ্কে চড়াও হয় নাস্তিকদের উপর।
নাস্তিকরা আস্তিকদের ঘৃণার পাত্র, নিধনযযোগ্য। এই ঘৃণাটা সবচেয়ে বেশি প্রকট মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে। মৌলবাদী মুসলিমরা শুধু নাস্তিক মুসলিমদেরই ঘৃণা করে তা নয়, এঁরা অন্য সম্প্রদায়ের নাস্তিকদেরও ঘৃণা করে। আন্তর্জাতিক এক গবেষণা বলছে, বিশ্বের ৮৫টি দেশে ধর্মে অবিশ্বাসী বা নাস্তিকরা প্রচণ্ড বৈষম্য নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এর মধ্যে গত এক বছরে অন্তত সাতটি দেশে নাস্তিকদের বিরুদ্ধে চরম নির্যাতন হয়েছে। এই দেশগুলোর মধ্যে আছে ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব এবং মালয়েশিয়া। ধর্ম বা সৃষ্টিকর্তায় অবিশ্বাসীদের জন্য ৩০টি সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশের তালিকায় আছে বাংলাদেশের নাম। ‘International Humanist and Ethical Union’ নামে একটি সংস্থার উদ্যোগে পরিচালিত গবেষণা প্রতিবেদনে এমনই কথা বলা হয়েছে, যা ইউরোপীয় সংসদে পেশ করা হয়েছে।
নাস্তিকদের উপর হামলা নির্যাতনের প্রসঙ্গে পাকিস্তান, ভারত, সৌদি আরব, সুদান এবং মালয়েশিয়ার নাম একাধিকবার এসেছে। ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রকে অন্য ছাত্ররা পিটিয়ে হত্যা করেছে এমন সংবাদও প্রকাশ হয়েছে। মালদ্বীপের এক ব্লগার, যিনি ধর্ম নিরপেক্ষতার স্বপক্ষে নিয়ে লেখালেখি করতেন এবং মাঝে মধ্যে ধর্ম নিয়ে কটাক্ষ করতেন, তিনি নিজের ঘরে আততায়ী দ্বারা ছুরিকাঘাতে নিহত হন। সুদানে মোহামেদ আল দোসোগি নামে একজন মানবাধিকার কর্মী তাঁর জাতীয় পরিচয় পত্রে মুসলিম পরিচয় বদলে নাস্তিক হিসাবে পরিচিত হতে চাইলে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। IHEU তাঁদের গবেষণা রিপোর্টে উল্লেখ করেছে, ২০১৭ সালে বিশ্বের ৮৫টি দেশে এই ধরণের নির্যাতন চরমে পৌঁছেছে। তার মধ্যে সাতটি দেশে, যেমন–ভারত, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, মৌরতানিয়া, ভারত, পাকিস্তান, সুদান, সৌদি আরব। ধর্ম এসব দেশে অবিশ্বাসীদের ধরে ধরে বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে, কখনো-বা অতর্কিতে হত্যা করা হচ্ছে।
৩০টি সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম অবশ্যই আছে। এই তালিকায় আছে মিশর, কাতার, আফগানিস্তান, ইরান ও ইরাক। এর মধ্যে ১২টি দেশে ধর্মত্যাগীদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে। এই ৩০টি দেশে ‘নাস্তিক’ তকমা দিয়ে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক ঘটনা ঘটেছে। বিচার বহির্ভূত খুনও হয়েছে। এমনকি তথাকথিত ধর্ম অবমানকারীদের গুম করার ঘটনাও ঘটেছে। যেসব দেশে নাস্তিকরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে, সেগুলোর মধ্যে অধিকাংশই মুসলিম প্রধান দেশ। তবে কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রেও ধর্মে অবিশ্বাসী লোকজনের বিরুদ্ধে বৈষম্যের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ব্রিটেনের কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্ম বিষয়ক গবেষক ড লোয়া লি বলেছেন–“বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে ধর্মে অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা বা বৈষম্য সাধারণ ঘটনা।” যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের তথাকথিত বাইবেল-বেল্টে নাস্তিকদের বিরুদ্ধে অসহিষ্ণুতা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু কেন এত অসহিষ্ণুতা? পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বিশ্বজুড়ে ধর্ম বিশ্বাস যত তীব্র হচ্ছে, তেমনি বহু মানুষ নতুন করে নিজেদের অবিশ্বাসী হিসাবে পরিচিত করছে। ফলে দ্বন্দ্ব বাড়ছে। পিউ রিসার্চ সেন্টারের হিসাবে, ২০৬০ সালে গোটা বিশ্বে নাস্তিক এবং ধর্মে অবিশ্বাসীদের সংখ্যা বেড়ে ১২০ কোটিতে দাঁড়াবে। পাশাপাশি ধর্মে বিশ্বাসীদের সংখ্যাও বাড়বে।
বাংলাদেশে মৌলবাদীদের চিন্তাধারায় নাস্তিকরা যত খুশি অন্য ধর্মের সমালোচনা করতে পারে, কিন্তু ইসলামের সমালোচনা করা একদম চলবে না। তাই দেখা যায় বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যত নাস্তিক হত্যা হয়েছে, তার মধ্যে সকলেই ইসলাম বিরোধী সমালোচনা করার জন্যেই হত্যা হয়েছে। তা সে হিন্দুই হোক কিংবা মুসলিম। বাংলাদেশে কুখ্যাত প্রথম সারির বেশ কয়েকজন ইসলাম-বিদ্বেষী নাস্তিকের তালিকা তৈরি করা হয়েছে, যাঁরা বাংলাদেশে নাস্তিকতার জন্ম দিয়ে ইসলামের বিরোধিতা করে গেছে ও করছে। দেখা যাক, তালিকায় কারা কারা আছেন।
তালিকার প্রথমেই আছেন বাউল লালন শাহ। লালন শাহকে বলা হচ্ছে সুবিধাবাদী সেকুলার। কোনো ধর্ম পালন করতেন না। বলা হয় জীবনে যতবার গাঁজা টেনেছে ততবার ভাত খেয়েছে কি না সন্দেহ। দেশের সমস্ত নাস্তিক লালন বলতে অজ্ঞান। লালন এমন এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখত, যেখানে ধর্ম বলে কিছু থাকবে না। হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান এরকম কোন ধর্মীয় পরিচয় মানুষের থাকবে না। তালিকার দ্বিতীয় নামটি হল আরজ আলি মাতব্বর। আরজ আলি অতি সাধারণ ‘অশিক্ষিত’ এক কৃষক হয়েও সে বাংলাদেশের নাস্তিক সমাজের মধ্যমণি। নাস্তিক-বিদ্বেষীরা মনে করেন–ইসলামি জ্ঞানের স্বল্পতা থাকার দরুন না বুঝেই ইসলাম ধর্ম নিয়ে অনেক অভিযোগ উত্থাপন করেছিল। কোরান হাদিসের ভুল ধরতে গিয়ে সে কেবল তার নিজের সীমাবদ্ধতাকেই তুলে ধরতে পেরেছে। শুধুমাত্র ইসলাম বিরোধিতা করার কারণেই নাস্তিকরা তাঁকে নিজেদের ‘ধর্মগুরু’ বানিয়ে নিয়েছে। আহমেদ শরিফও নাস্তিক ছিলেন বলা হয়। আহমেদ শরিফের ইচ্ছা মেনেই মৃত্যুর পর তাঁর জানাজা এবং কবর কোনোটাই হয়নি। তাঁর একটা বিখ্যাত উক্তি–“পুরুষদের যদি সততা দরকার না হয়, তবে নারীদের সতীত্বের কেন দরকার? নারীরাও যেভাবে খুশি যৌনাঙ্গ বিলাতে পারবে।” হুমায়ুন আজাদও নাস্তিকতার দায়ে মৌলবাদীদের দ্বারা সশস্ত্র আক্রমণের শিকার হয়েছেন। হুমায়ুন আজাদ তাঁর লেখালেখির মধ্য দিয়ে সারাজীবন ধর্মের প্রতি বিষোদগার করে গেছেন। কবি শামসুর রহমানও নাস্তিকতার দায়ে অভিযুক্ত। শামসুর রহমানের একটি কুখ্যাত উক্তি–আজানের ধ্বনি বেশ্যার খদ্দের ডাকার ধ্বনির মতো মনে হয় নাউজুবিল্লাহ। এই একটা উক্তিই নাস্তিক-বিদ্বেষীদের কাছে প্রমাণ করে শামসুর রহমান ইসলাম বিদ্বেষী ছিল। তাঁকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল –“আপনি কি চান আপনার কবর হোক আপনার খালার কবরের পাশে?” শামসুর সপাটে জবাব দিয়েছিলেন –“আমি তো আমার কবর হোক এটাই চাই না।”
তসলিমা নাসরিনকে চেনে না এমন কেউ নেই বোধহয়। তসলিমা তাঁর লেখালেখির মধ্য দিয়ে লিঙ্গসমতা, মুক্তচিন্তা, নাস্তিক্যবাদ এবং ধর্মবিরোধী মতবাদ প্রচার করায় ইসলামপন্থীদের রোষানলে পড়েন। মৌলবাদীরা মনে করেন তসলিমা নিজেকে নাস্তিক বলে দাবি করলেও তাঁর যত ক্ষোভ, যত ঘৃণা সব কিছুই কেবল ইসলাম ধর্মের উপর। সনাতন ধর্ম কিংবা খ্রিস্ট ধর্ম অথবা ইহুদীদের নিয়ে তাঁর কোনো মাথাব্যথা তেমন চোখে পড়ে না। এইসব মৌলবাদীরা তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে ফতোয়া ঘোষণা করেন। তাঁদের কাছ থেকে হত্যার হুমকি পেতে থাকায় ১৯৯৪ সালে তসলিমা বাংলাদেশ ত্যাগ করেন এবং বিভিন্ন দেশে বাস করতে বাধ্য হন। বর্তমানে তিনি ভারতে আছেন। আব্দুল লতিফ সিদ্দিকি বাংলাদেশে বেশ পরিচিত এক নাম। তিনি মনে করেন ধর্ম তামাক ও মদের মতো একটি নেশা। মোল্লাদের কোনো কাজ নেই, তাই তাঁরা ঘন ঘন মসজিদ তৈরি করেছে। টাকা ইনকামের জন্য আব্দুল্লাহর পুত্র মোহাম্মদ হজ্জের প্রবর্তন করেছিল। সভা-সমাবেশের শুরুতে কোরান তেলাওয়াত বন্ধ করা দরকার। এইসব বক্তৃতার নাস্তিক-বিদ্বেষী ইসলামপন্থীরা তাঁর উপর ক্ষেপে আছে। নাস্তিকের তালিকায় উঠে এসেছে সাহিত্যিক জাফর ইকবালের নামও। বাংলাদেশের নাস্তিকতা প্রচারের মিশন দিয়ে আমেরিকার একটি বিশেষ সংস্থা তাকে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তরুণ সমাজকে নাস্তিক হিসাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। নিজে মুক্তিযুদ্ধ না করলেও জাফর এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিক্রি করে পেট চালায়। জাফরের দাবি সে পাকিস্তানের দোষর রাজাকারদের ঘৃণা করে, কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য ৭১ সালে পাকিস্তানকে সর্বপ্রকার সমর্থন ও সামরিক সাহায্য দেওয়া রাষ্ট্র আমেরিকার ব্যাপারে তার কোনো চুলকানিই নেই। জাফর নিজে আমেরিকায় চাকরি করত, এখন সে তাঁর ছেলে-মেয়েদেরকেও আমেরিকা পাঠিয়েছে পড়াশোনা করার জন্য।
সাহিত্যিক আনিসুল হক। ধর্মনিরপেক্ষ লেখক আনিসুল হক নাস্তিকপন্থী পত্রিকা প্রথম আলো’-র সহকারী সম্পাদক। ১৯৯১ সালে সে কোরানের একটি সুরাকে ব্যঙ্গ করে প্যারোডি সুরা রচনা করে, কয়েক বছর আগে তার ওই লেখা। পুনঃপ্রকাশিত হলে দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। আনিসুল হক এতে ভয় পেয়ে যান এবং নিঃশর্ত ক্ষমা চায়। এরপর তিনি আরও কৌশলী হয়ে যান, সরাসরি ইসলাম অবমাননা না করে এখন সে তার নাটক-সিনেমা ও পত্রিকা দ্বারা ইসলাম বিরোধী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। সুলতানা কামাল চক্রবর্তীও নাস্তিকদের তালিকায়। জন্মসূত্রে তিনি মুসলিম হলেও বিয়ে করেছেন শ্রী সুপ্রিয় চক্রবর্তী নামে এক হিন্দুকে। সংবিধান থেকে ‘বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ তুলে দেওয়ার জন্য বহু বছর ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছে তিনি। তাই তিনি কুখ্যাত সেকুলার হিসাবে চিহ্নিত হয়ে গেছেন। ইসলাম-বিদ্বেষী নাস্তিকদের প্রতি সে প্রকাশ্য সমর্থন দিয়ে থাকে। আসিফ মহিউদ্দিন নামক নাস্তিককে ইসলাম অবমাননার অভিযোগে যখন ডিবি পুলিশ গ্রেফতার করেছিল তখন সে আসিফকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেছিল। সারারাত থানায় অবস্থান করে নাস্তিক আসিফকে নৈতিক সমর্থন দিয়েছিল। কবির চৌধুরী চরমপন্থী নাস্তিক হিসাবে পরিচিত। কারণ তিনি একবার বলেছিলেন–“তোমরা আমার মরণের সময় মোহাম্মদের জ্বালাও-পোড়াও ওই কালেমা শোনাবে না, বরং রবীন্দ্রনাথের একটি সংগীত আমাকে শুনাবে।” সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’ রাখার ব্যাপারেও কবির চৌধুরী আপত্তি তুলেছিল। সৈয়দ শামসুল হককেও নাস্তিক বা ‘উগ্র সেকুলার’ বলা হয়। মুনতাসির মামুন নাস্তিক। তিনি সভা-সমাবেশে বলেন –“বিসমিল্লাহ বলা বা কোরান পড়ার দরকার নেই। সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’ থাকা আমাদের জন্য অপমানস্বরূপ। আমরা তো সংবিধানে আল্লাহর নাম অথবা বিসমিল্লাহ থাকবে সেজন্য দেশ স্বাধীন করিনি। ধর্ম যেমন ভণ্ডামি তেমনি মৌলবাদীদের সব ভণ্ডামি। বঙ্গভবনের দেয়ালে কোরান শরিফের আয়াত লেখা এটা একটা চরম ভণ্ডামি।” মুনতাসির বলেন–“এদেশে একজন মুসলমানও যত দিন। থাকবে ততদিন পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবেই চলবে।”
ব্লগার রাজীবকে (ওরফে থাবা বাবা) নাস্তিকতার দায়ে মুসলিম মৌলবাদী আততায়ী হত্যা করে। রাজীব নবি মোহাম্মদকে মহাউন্মাদ কিংবা মোহাম্মক (মহা+আহাম্মক) নামে উল্লেখ করত। হাদিসকে চটি গ্রন্থ এবং কোরানকে সে কৌতুকের বই বলত। বিভিন্ন সময়ে আল্লাহ নবির সাহাবীদেরকে নিয়ে চটি গল্প লিখে ‘ধর্মকারী’ নামে ব্লগে প্রকাশ করত। কোরানের বিভিন্ন আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে সেগুলোর ব্যাখ্যা দিয়ে ঠাট্টা ও হাসি-তামাশা করত। তাঁর এসব কার্যকলাপ তাঁকে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত ইসলাম-বিদ্বেষী নাস্তিকের মর্যাদা দিয়েছে। আসিফ মহিউদ্দিনকে ‘কুখ্যাত’ নাস্তিক বলা হয়। মৌলবাদীরা বলেন ইসলাম অবমাননার দিক দিয়ে থাবা বাবার পরেই তাঁর অবস্থান। মৌলবাদীরা মনে করেন, তাঁর ইসলাম-বিদ্বেষী কার্যকলাপে খুশি হয়ে জার্মান সরকার তাকে ওই দেশের ভিসা উপহার দিয়েছে। বর্তমানে সে জার্মানি থেকে ফেসবুক ও ব্লগে ইসলাম-বিদ্বেষী লেখালেখি করে থাকে। আসিফের দাবি আল্লাহ নিজেই নাস্তিক, অতএব নাস্তিক হওয়াটা দোষের কিছু নয়। আসিফ মহিউদ্দিন কোরানকে ‘আহাম্মোকোপিডিয়া’ বলে থাকে। তিনি কোরানের আয়াতকে বিকৃত করে “আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির নাস্তিকানির নাজিম” বলে এবং নবি হজরত মোহাম্মদের কল্পিত ছবি তাঁর ব্লগে প্রকাশ করে। ফরহাদ মজহার বাংলাদেশের আর-একজন প্রসিদ্ধ নাস্তিক। এখন তিনি আওয়ামি লিগ বিরোধী অবস্থানে আছেন। তিনি এখন আর আগের মতো নাস্তিকতা প্রচার করে বেড়ায় না, উল্টে ইসলামপন্থীদের পক্ষাবলম্বন করে কলাম লেখে, বিবৃতি দেয়। তবে একসময় তিনি ছিলেন একজন ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিক। নব্বইয়ের দশকে ‘এবাদতনামা’ নামে একটি ইসলাম-বিদ্বেষী কাব্যগ্রন্থ লিখে সে বেশ বিতর্কিত হয়েছিল। কয়েকটা লাইন উল্লেখ করছি–“বিবি খাদিজার নামে আমি এই পদ্যটি লিখি, বিসমিল্লাহ কহিব না, শুধু খাদিজার নাম নেব। নবিজির নাম? উঁহু, তাঁর নামও নেব না। মালিক শুধু খাদিজার নাম–দুনিয়ায় আমি সব নাম ভুলে যাব। তোমাকেও ভুলে যাব, ভুলে যাব নবিকে আমার।” তার আরেকটা কবিতা–“দুনিয়া রেজিস্ট্রি করো, তিলেক হিম্মত নাই আধা ছটাকের নাই তেজ সাত আসমানে প্রভু খোদাতালা হয়ে বসে আছ মুখে খালি কহ শুনি দুনিয়ার তুমিই মালিক অথচ মালিক অন্যে, অন্যে কহিতেছে তারা খোদা মালিক এ জমিনের–প্রত্যেকেই তোমার শরিক তোমার শরিক নাই এই কথা তবে কি বোগাস? এদের দলিল যদি মিথ্যা হয় যাও আদালতে উকিল ধরিয়া করো দুনিয়া রেজিস্ট্রি নিজ নামে।” শফিক রেহমানকে বাংলাদেশে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ নামক ‘বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রবর্তক বলা হয়। ১৯৯৩ সালে তিনি সর্বপ্রথম তাঁর পত্রিকা যায় যায় দিন’-এর মাধ্যমে এদেশে ‘ভালোবাসা দিবস’-এর প্রচলন ঘটায়। আর তাতেই তিনি মুসলিম মৌলবাদীদের কাছে চক্ষুশূল। কবি দাউদ হায়দারকেও নাস্তিক বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। বলা হয় বাংলাদেশে স্বাধীন হওয়ার পর মাথাচাড়া দিয়ে জেগে উঠা স্বঘোষিত নাস্তিকদের অন্যতম সে। তাঁর কবিতায় তিনি আলেমদের উদ্দেশ্য করে লিখেছে–”মাথায় টুপি, মুখে দাড়ি….. আননে কি রূপের বাহার……এক্ষনি পাবে ভরে দেব মুখ”। তিনি ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎসায় কালো বন্যায়’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। ওই কবিতাতে সে নবি মোহাম্মদ, জিশুখ্রিস্ট এবং গৌতম বুদ্ধ সম্পর্কিত অবমাননাকর উক্তি ছিল বলে সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছিল বলে মনে করা হয়। তখন বাংলাদেশে তৌহিদবাদী মানুষ এর বিরুদ্ধে প্রচণ্ড প্রতিবাদ শুরু করে। ঢাকার এক কলেজ শিক্ষক ঢাকার একটি আদালতে এই ঘটনায় দাউদ হায়দারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিলেন। তৎকালীন বঙ্গবন্ধুর সরকার কবি দাউদ হায়দারকে ১৯৭৩ সালে নিরাপত্তামূলক কাস্টডিতে নেওয়া হয়। ১৯৭৪ সালের ২০ মে সন্ধ্যায় তাঁকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং ২১ মে সকালে বাংলাদেশ বিমানের একটা রেগুলার ফ্লাইটে করে তাঁকে কলকাতায় পাঠানো হয়। তাঁর ভাষায়–“আমার কোনো উপায় ছিল না। মৌলবাদীরা আমাকে মেরেই ফেলত। মুজিব সরকারও আমার মৃত্যু কামনা করছিল।”
বাংলাদেশী মুসলিম মৌলবাদীরা নাস্তিকদের এতটাই ঘৃণা করে যে, তাঁদের হত্যা করাটাকে পবিত্র কাজ বলে মনে করেন। হেফাজতে ইসলামের আমির ও হাটহাজারি মাদ্রাসার শিক্ষা সচিব শায়খুল হাদিস আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী ঘোষণা দেন–“নাস্তিক-মুরতাদ ধ্বংস করতে প্রয়োজনে শহীদ হব। শরীরে এক ফোঁটা রক্ত থাকতে বাংলাদেশকে স্পেন হতে দেব না। বিশ্বের দুই শত কোটি মুসলমানের ভালোবাসার প্রতীক রাসুলের বিরুদ্ধে ফ্রান্স সরকার ব্যঙ্গ ও কটাক্ষ করে মুসলমানদের কলিজায় আগুন লাগিয়েছে। রাসুলের অপমানের মোকাবিলায় রক্তের বন্যা বইয়ে দেব। যারা ইসলামের শত্রু, রাসুলের দুশমন, নাস্তিক-মুরতাদদের কবর রচনার জন্য হেফাজতে ইসলামের অভ্যুদয়।” এ প্রসঙ্গে এটুকু বলা যায় বাবুনগরীরা চিৎকার করুক তথাকথিত নাস্তিকদের মনে রাখবে মানুষ, মনে রাখবে ইতিহাস–বাবুনগরীরা শূন্যে বিলীন হয়ে যাবে, দু চারটে প্রজন্মের পর তাঁর পরিবার-পরিজনও মনে রাখবে না। মুসলিম মৌলবাদীদের মধ্যে ধারণা নাস্তিক মানেই তাঁরা লুইচ্চা, চরিত্রহীন, পরকীয়ায় লিপ্ত, পতিতাপল্লিতে রাত কাটায়, সমকামী সহ সব বদ অভ্যাসের অধিকারী। কারণ নাস্তিকরা ঈশ্বর বিশ্বাস করে না, তাই পাপকাজে তাঁদের কোনো ভয়ডর থাকে না। অর্থাৎ মুসলিম মৌলবাদী তথা ইসলাম ধর্মানুসারীরা কখনোই লুইচ্চা, চরিত্রহীন, পরকীয়ায় আসক্ত, পতিতাগমন, সমকামী হতে পারে না–এটাই বোঝায়। বাস্তব কিন্তু সেই সাক্ষ্য দেয় না।
তাকেই নাস্তিক বলা হয়, যে-ব্যক্তি একেবারে কোনো ধরনের প্রমাণ না-থাকার কারণে ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষীয় দাবিতে অঅনাস্থা জ্ঞাপন করে। শুধু ঈশ্বরের বিরুদ্ধেই নয়, সমস্তরকম ভণ্ডামির বিরুদ্ধেই নাস্তিকরা অনাস্থা জ্ঞাপন করবে। এর বেশি কিছু নয়। বর্তমান যুগে জনসাধারণের মধ্যে ‘আস্তিক’ এবং ‘নাস্তিক সংজ্ঞা নিয়ে বেশ ভুল ধারণা আছে। এই ভুল ধারণার প্রতিফলন বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখতে পাই। মনুসংহিতার টীকাকার মেধাতিথি ‘নাস্তিক’ শব্দটির ব্যাখ্যা করেছেন “পরলোক বলে কিছু নেই, যাগ-দান-হোম এগুলিও কিছু নয়–এইরকম কথা যিনি বলেন এবং এই বিশ্বাসে যিনি চলেন তিনি নাস্তিক।”
এমতাবস্থায় অনেকে বলেন –দিন দিন যা দেখছি, সেদিন বেশি দূরে নয় যখন নাস্তিকতা একটি ধর্মে পরিণত হবে। আমি বলি–উঁহু, নাস্তিক্যবাদ কোনো ধর্মতত্ত্ব নয়। ধর্মতত্ত্ব ঈশ্বর ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। যেখানে ঈশ্বর নেই, সেখানে ধর্মতত্ত্বের ভিত্তি নেই। ধর্ম তাকেই বলি, যা ঈশ্বরবিশ্বাস ও ঈশ্বর প্রদত্ত অনুশাসনকে বোঝায়। নাস্তিক্যবাদে ঈশ্বর অনুপস্থিত। নাস্তিক্যবাদীরা ঈশ্বর ও ঈশ্বরের নামে অনুশাসনকে অস্বীকার ও বিরোধিতা করে। নাস্তিক্যবাদীরা মনে করেন মানুষকে সুপথে চালিত করতে রাষ্ট্রীয় অনুশাসনই যথেষ্ট। মানুষকে সুপথে চালিত করতে ঈশ্বরের কোনো প্রয়োজন নেই। যে সুপথে চালিত হবে না, তাঁর কাছে ঈশ্বরের অনুশাসন হোক বা রাষ্ট্রীয় অনুশাসন, তা কোনো কাজেই আসে না। বস্তুত প্রকৃত সৎ ব্যক্তির কোনো অনুশাসনেরই প্রয়োজন হয় না। নাস্তিক্যবাদে যেহেতু কোনো ঈশ্বরের জায়গা নেই, তাই কাল্পনিক ঈশ্বরের অনুশাসনের গ্রন্থও আসমান থেকে নাজিল হয় না। নাস্তিক্যবাদীরা মনে করেন তথাকথিত ঈশ্বর যদি সত্যিই সর্বশক্তিমান হন, তাহলে কোনো ধর্মগ্রন্থরেই প্রয়োজন হত না। সবাই তাঁর অঙ্গুলী হেলনে সুপথে চালিত হত। ধর্মবেত্তা দালালদের প্রয়োজন হত না। ঈশ্বর যদি চাইতেই তাহলে গোটা ঈশ্বর একটিই থাকতেন। তাহলে এত ঈশ্বরের এত পৃথক ধর্মগ্রন্থ এবং এত পৃথক ধর্মগোষ্ঠীর উপস্থিতি থাকত না। তাহলে মানুষ “আমার ধর্ম বড়, আমার ধর্ম বড়ো” বলে জাহির করত না, রক্তারক্তি করত না।
বস্তুত অনুশাসন গ্রন্থের প্রয়োজন হয় রাষ্ট্রের নামে রাষ্ট্রনায়কের। রাষ্ট্রনায়কের অনুশাসন প্রয়োজন হয় নিজের ও রাষ্ট্রের সুরক্ষার জন্য। জনগণকে শাসন ও শোষণের জন্য। ঈশ্বরের নাম জড়িয়ে যারা ধর্মীয় অনুশাসন রচনা করেছিলেন, তাঁরাও তৎকালীন সময়োপযোগী রাষ্ট্রনায়ক। অনুশাসনের উদ্দেশ্যও একই। শুরুটা ঈশ্বরের ভয় দেখিয়ে মানুষকে শাসকের ক্রীতদাসে পরিণত করা গেলেও, পরে ঐশ্বরীয় অনুশাসন ভোঁতা হতে শুরু করল। প্রয়োজন হয়ে পড়ল রাষ্ট্রীয় অনুশাসন। ঈশ্বরীয় অনুশাসন অদৃশ্য, রাষ্ট্রীয় অনুশাসন দৃশ্যমান। রাষ্ট্রীয় অনুশাসনকে কায়েমকে রাষ্ট্র প্রভূত শক্তি মোতায়েন করে। ঈশ্বরকে নয়, মানুষ ভয় করে রাষ্ট্রের লেলিয়ে দেওয়া পুলিশ ও সেনাকে। ধুরন্ধর মানুষরা বুঝেছিল ঈশ্বরে ভয় তেমন কোনো কাজে আসে না। প্রাচীন যুগে ধর্মীয় অনুশাসন প্রয়োগ করে রাষ্ট্র শাসিত হলেও আধুনিক বিশ্বে ধর্মীয় অনুশাসন অচল, রাষ্ট্র-নির্ধারিত অনুশাসনই শেষ কথা। নাস্তিক্যবাদীদের কাছে রাষ্ট্র নির্ধারিত অনুশাসনই যথেষ্ট।
শুধু ধর্মগ্রন্থই নয়, আসলে মানুষ সবকিছুই সৃষ্টি করতে পারে। সৃষ্টি যেমন করতে পারে, ধ্বংসও করতে পারে। ভগবান, ঈশ্বর, আল্লাহ সবই মনুষ্যসৃষ্ট। ভগবান, ঈশ্বর, আল্লাহ অস্তিত্বের গুজবটি মানুষই ছড়িয়ে দিয়েছে। ভগবান, ঈশ্বর, আল্লাহ যে নামেই ডাকা হোক এরা অতি নবীন। মানুষ প্রবীণ। মানুষের চেয়ে কোটি কোটি বছরের প্রবীণ ভাইরাস। ভাইরাস এখানে আলোচ্য বিষয় নয়। আলোচ্য বিষয় হল মানুষ আগে পৃথিবীতে এসেছে, তার অনেক পরে মানুষ ঈশ্বরকে সৃষ্টি করেছে। ঈশ্বরকে কেন সৃষ্টি করতে হয়েছে, সে বিষয়ে এই গ্রন্থের পরবর্তী প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
ঈশ্বর যদি এতই করিৎকর্মা, তাহলে পৃথিবীর প্রথম মানুষটির হাত দিয়েই ঐশীগ্রন্থটি পাঠিয়ে দিতেন এবং বলে দিতেন –“তোমাদের সৃষ্টি করে পৃথিবীতে পাঠাচ্ছি। কীভাবে তোমরা জীবনযাপন করবে তা এই গ্রন্থে বিস্তারিত লিখে দিয়েছি সহজ ভাষায়। সবাই অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলবে। এই নাও সেই ঐশী গ্রন্থ, যা তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছি।” না, তা হয়নি। হলে নবীন হোমোস্যাপিয়েন্সের হাতে প্রাচীন নিয়ান্ডার্থালদের পৃথিবী থেকে চিরতরে বিলীন হয়ে যেতে হত না। সেই সময়কার কথা –যখন মানুষের মুখে ভাষা ছিল না, অক্ষর ছিল না। তখন কেন ঐশীগ্রন্থগুলি মানুষের তুলে দেননি সেই তথাকথিত ঈশ্বর? কেন ঐশীগ্রন্থগুলি ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় রচিত হল? কেন সকলের জন্য একই ভাষায় একটি গ্রন্থ রচিত হল না? কেন সংস্কৃত, হিব্রু, আরবির মতো দুবোধ্য ভাষায় গ্রন্থগুলি লেখা হল? আস্তিকরা কি কখনো এইসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন? না, খোঁজার চেষ্টা করেন না। কারণ একদা আস্তিকরাই বিশ্বাস করতেন পৃথিবীর চারপাশে সূর্য ঘোরে। উত্তর খুঁজেছিল নাস্তিকরা। নাস্তিকরা যেদিন প্রথম বলেছিল –“ভুল, পৃথিবীর চারপাশে সূর্য ঘোরে না। সূর্যের চারপাশে পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ-গ্রহাণুরা নিরন্তর ঘুরে চলেছে।” সেইসব নাস্তিকদের উপর কম তো নির্যাতন করেনি আস্তিকরা। এমনকি হত্যা পর্যন্ত করেছে। আজও হত্যা করে চলেছে। অন্ধরা অন্ধকারে থাকতেই পছন্দ করে। আলোতে তাঁরা ঝলসে যায়। তাই ভয়ে ভীত হয়ে ব্রুনোদেরই ঝলসে দেয়। গ্যালিলিওদের কারাগারে নিক্ষেপ করে। সক্রেটিসদের হেমলক বিষ পান করতে বাধ্য করে।
জৈন দার্শনিক হরিভদ্র সুরীর ‘ষজ্ঞর্শনসমুচ্চয়’ গ্রন্থে ‘আস্তিকবাদিনা সূত্রের দেখা পাই। টীকাকার সোমতিলক সুরীর মতে পদটির অর্থ হল–“পরলোকগতিপুণ্য-পাপাস্তিক্যবাদিনা”। অর্থাৎ আস্তিকবাদী বলতে তাঁদেরকেই বোঝায় যাঁদের জন্মান্তরবাদ, পরলোক, পুণ্য, পাপ ইত্যাদিতে আস্থা আছে। অপরদিকে প্রাচীন ভারতের ‘আস্তিক নাস্তিক’-এর সংজ্ঞা ভিন্নরকম। পরলোকতত্ত্বে বিশ্বাসীদের ‘আস্তিক’ আর অবিশ্বাসীদের নাস্তিক বলা হত। পাণিনি রচিত ‘অষ্টাধ্যায়ী’-র নাম হয়তো কেউ কেউ জানবেন। এটি প্রাচীন ভারতীয় ব্যাকরণের একটি নির্ভুল গ্রন্থ হিসাবে সুবিদিত। পাণিনি ব্যাকরণ সূত্রে পাই : “অস্তিনাস্তিদিষ্টং মতিঃ” (৪/৪/৬০)। অর্থাৎ, পরলোক আছে ধারণায় প্রভাবিত ব্যক্তিকে ‘আস্তিক’ (দিষ্টং পরলোকো অস্তি) এবং “দিষ্টং পরলোকো নাস্তি”, অর্থাৎ পরলোক নেই ধারণায় প্রভাবিত ব্যক্তিকে ‘নাস্তিক’ বলা হয়েছে। (অস্তিগতিরস্য = আস্তিকঃ, পরলোকোহস্তি ইতি যস্য গতিরস্তি স আস্তিকঃ) পাণিনি সূত্রের ব্যাখ্যাকার ব্যাকরণবিদ মহর্ষি পতঞ্জলির ‘মহাভাষ্য’ গ্রন্থের মতানুসারে ‘অস্তি’ (আছে) ধারণার বশবর্তী ব্যক্তিগণ আস্তিক এবং ‘ন অস্তি’ (নেই) ধারণায় বশবর্তী ব্যক্তিগণ নাস্তিক পদের দ্বারা অভিধেয় (মহাভাষ্য ৪/৪/১)। আর-একটু খুলে লেখা যাক–বেদে বিশ্বাস এবং অবিশ্বাস দ্বারা নাস্তিক এবং আস্তিক বলা ছাড়াও আর কী কী কারণে নাস্তিক এবং আস্তিক বলা যায়? প্রতিটি ধর্মেই এই বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের উপরে নানা বিভাজন আছে। যেমন খ্রিস্টধর্মে মূল দুই ভাগে ভাগ হয়ে আছ। একটি ক্যাথলিক, অপরটি প্রোটেস্ট্যান্ট। প্রোটেস্ট্যান্টরা পুণ্যপিতার কর্তৃত্ব অস্বীকার করে। আমি চেষ্টা করব আমার মতো করে এ বিষয়ে বিশ্লেষণ করার। প্রথমেই নাস্তিকদের আর আস্তিকদের একটু বুঝে নিই।
নাস্তিকরা প্রধানত দুই প্রকার –(১) প্রকৃত নাস্তিক এবং (২) ছদ্মবেশী নাস্তিক। আমরা জানব এই প্রকৃত’ এবং ছদ্মবেশী ব্যাপারটা কী। কাদের বলব প্রকৃত, কাদের বলব ছদ্মবেশী?
(১) প্রকৃত নাস্তিক : সংকীর্ণ অর্থে–যিনি ধর্ম এবং ধর্মগ্রন্থের সমস্ত গলিখুঁজি বিষয়ে সম্যকভাবে ওয়াকিবহাল এবং যিনি কোনো ধর্মের ঈশ্বরকেই (তিনি ভগবান-আল্লাহ-গড যেই-ই হোন-না-কেন) বিশ্বাস করেন না, তিনিই প্রকৃত নাস্তিক। প্রকৃত নাস্তিক সে জ্ঞানী। তাঁর সব ধর্মে সম্যক জ্ঞান আবশ্যিক। তাঁদের এই ধর্মীয় জ্ঞানের সঙ্গে পৃথিবীর কোনো পুরোহিত-পণ্ডিত-মুমিন-ইমাম পাদরিদের জ্ঞানের তুলনা চলে না। এইসব পুরোহিত-পণ্ডিত-মুমিন-ইমাম পাদরিরা কেবল নিজধর্মেই জ্ঞানী হতে পারেন, আবার নাও হতে পারেন। কিন্তু অন্য ধর্মে আকাট মূর্খ। দু-চারজন ব্যতিক্রম থাকতেই পারেন। ব্যতিক্রমরা আলোচ্য নয়। পুরোহিত-পণ্ডিতদের ঘরে বেদ-মনুসংহিতা-উপনিষদ না-ই থাকতে পারে, পাদরি-পোপের ঘরে বাইবেল না-ই থাকতে পারে, মুমিন ইমামের ঘরে কোরান-হাদিস না-ই থাকতে পারে –কিন্তু প্রকৃত নাস্তিকের ঘরে বেদ, উপনিষদ, মনুসংহিতা, কোরান, হাদিস, বাইবেল সব থাকতে হবে এবং নিবিড় অধ্যয়ন করবে। কজন আস্তিকের ঘরে একটি ধর্মগ্রন্থ পাওয়া যাবে? কিন্তু প্রতিটি নাস্তিকের ঘরে ধর্মগ্রন্থ পাওয়া সম্ভব। একটি নয়, একাধিক ধর্মগ্রন্থ থাকা স্বাভাবিক।
ব্যাপক অর্থে –যিনি গুরুদেব তথা গুরুবাদ, জ্যোতিষ, রত্ন-পাথর, ভুত-প্রেত জিন, পরি-পশ্লীরাজ, জলপড়া-তেলপড়া, বাটিচালান-হাতচালান বিশ্বাস করে না এবং যিনি সহিষ্ণু, তিনিই প্রকৃত নাস্তিক। এঁরা কোনো ধর্মীয় বা শাস্ত্রীয় বিধি বিধান পালন করেন না। এঁরা নিজের এবং অন্যের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে অংশগ্রহণ করেন না। প্রকৃত নাস্তিকরা জন্মান্তরবাদ, আত্মা-পরমাত্মা, ইহলোক পরলোক, পাপ-পূণ্য, স্বর্গ-নরক বিশ্বাস করেন না। প্রকৃত নাস্তিকরা মরণোত্তর দেহদান করে থাকে। মরণোত্তর দেহদানের মাধ্যমেই তাঁরা মানবকল্যাণে নিয়োজিত হন। বস্তুত আস্তিকদের মরণোত্তর দেহদান করার প্রবণতা কম। কারণ তাঁরা মনে করেন দেহ দেহাংশ দান করলে পরজন্মে ওই দেহাংশটি ছাড়াই জন্মাতে হবে। অর্থাৎ চোখ দান করলে অন্ধ হয়ে জন্মাতে হবে। কারণ আস্তিকরা পরজন্মে বিশ্বাসী। কিন্তু অঙ্গ প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হলে তখন অঙ্গের জন্য হাত পেতে থাকে। একবারের জন্যেও মনে হয় না অঙ্গ কোথা আসবে? অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর, অনন্ত, হুমায়ুন আজাদ প্রমুখের মতো নাস্তিকরা চাপাতির কোপে নিহত হয়েছিলেন, তাঁরা কিন্তু মরণোত্তর দেহদান করেছিলেন। প্রকৃত নাস্তিকরা সমাজের শত্রু নয়, ধর্মেরও শত্রু নয়। এঁরা প্রশ্ন করতে শেখায়। উত্তর খুঁজে দেয়। (২) ছদ্মবেশী নাস্তিক : সংকীর্ণ অর্থে–যিনি আল্লাহকে বিশ্বাস করেন, কিন্তু ভগবানে বিশ্বাস নেই। অথবা ভগবান বিশ্বাস করেন, আল্লাহকে অস্বীকার করে–যিনি জ্যোতিষ বিশ্বাস করেন না, আবার রত্ন-পাথরে বিশ্বাস রাখে –যিনি ডাইনি বিশ্বাস করেন, আবার ভুত-প্রেতে বিশ্বাস রাখে না, তারাই ছদ্মবেশী নাস্তিক। ব্যাপক অর্থে–যাঁরা ধর্মের কিছু না জেনে, যিনি সমস্ত ধর্মাবলম্বীদের ধর্মগ্রন্থগুলি পাঠ করেনি, ঈশ্বরতত্ত্ব তলিয়ে দেখেনি, ভূগোল-বিজ্ঞান-ইতিহাসে সম্যক্ জ্ঞানলাভ না করে নেতিবাচক মন্তব্য করেন তিনিই ছদ্মবেশী নাস্তিক। না বুঝে যাঁরা হাসেন এরা তাঁদের দলে পড়েন। এঁরা আসলে ঈশ্বর নেই বলে তর্ক করলেও মন্দির-মসজিদ-গির্জার পাশ দিয়ে গেলেই নতমস্তকে প্রণাম সেরে নেন। এঁরা কিছু ধর্মীয় বা শাস্ত্রীয় বিধি-বিধান পালন করেন, কিছু পালন করেন না সুবিধা বুঝে। এঁরা ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে অংশগ্রহণ করেন এরা অন্য ধর্মানুসারীদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে এমন কথা বলে থাকেন। এরা মূলত সুবিধাবাদী, পরধর্মবিদ্বেষী।
আস্তিকরাও প্রধানত দুই প্রকার–(১) প্রকৃত আস্তিক এবং (২) ছদ্মবেশী আস্তিক।
(১) প্রকৃত আস্তিক : সংকীর্ণ অর্থে–যিনি সব ধর্মের ঈশ্বরকেই বিশ্বাস করেন, যিনি অন্য কোনো ধর্মের মানুষদের হেয় চোখে দেখে না, যিনি ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে পূজা-পাঠ করেন –তিনিই প্রকৃত আস্তিক।
ব্যাপক অর্থে –যিনি ধর্মের নামে রক্তপাত ঘটান না। যিনি গুরুদেব, জ্যোতিষ, ভূত-প্রেত-ডাইনি-জিন-রত্ন-পাথর-তন্ত্র-মন্ত্র-মানতে আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করেন, তারাই প্রকৃত আস্তিক।
(২) ছদ্মবেশী আস্তিক : সংকীর্ণ অর্থে–যিনি নিজ ধর্ম ব্যতীত অন্য সকল ধর্ম এবং ধর্মের মানুষদের ঘৃণা করেন, যিনি নিজ ধর্মকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে গলা ফাটান, অন্য ধর্মকে হেয় করেন তিনিই ছদ্মবেশী আস্তিক।
ব্যাপক অর্থে –যিনি গুরুদেব-জ্যোতিষ-ভূত-প্রেত-ডাইনি-জিন-রত্ন-পাথরগুলি কখনও বিশ্বাস, আবার কখনও বিশ্বাস করেন না। যেখানে যেমন সুবিধা সেখানে তেমন সুবিধামতো বিশ্বাস-অবিশ্বাস নির্ভর করে। এঁরা ধর্মেও আছে জিরাফেও আছে। এঁদের ধর্মের নামে রক্তপাত ঘটাতে হাত কাঁপে না। এঁরা হিন্দু ধর্মের নামে মুসলিম হত্যা করে, এরা ইসলাম ধর্মের নামে হিন্দু হত্যা করে, এঁরা খ্রিস্টধর্মের নামে ইহুদি হত্যা করে। এরা ঈশ্বর এবং ধর্মে অবিশ্বাসীদের হত্যা করে। এরা কবর থেকে মহিলাদের মৃতদেহ তুলে এনে ধর্ষণ করার নির্দেশ দেয়। কারণ এঁরা ছদ্মবেশী আস্তিক। সারা বিশ্বে এই ছদ্মবেশী আস্তিকদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। এঁরা সভ্যতার বোঝা, পৃথিবীর জঞ্জাল রূপে পরিগণিত হয়। এঁরা ধর্মকে নিজের সুবিধামত ব্যবহার করেন। এঁরা ধর্মের নামে ব্যাবসা ফাঁদেন। এরা অপরের ধর্ম তো দূরের কথা, স্বধর্ম এবং ধর্মগ্রন্থ বিষয়েও কিস্যু জানে না। বর্তমানে এইসব ছদ্মবেশী আস্তিকদের জন্যই মূলত সাধারণ মানুষদের মধ্যে ধর্মের প্রতি অনাস্থা বাড়ছে।
বস্তুত আমার মনে হয়, নাস্তিক হওয়াটা খুব কঠিন ব্যাপার। প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়। প্রভূত পড়াশোনা করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সমস্ত ধর্মগ্রন্থগুলি ঘেঁটে ফেলতে হয়। নৃতত্ত্ব, ভূগোল, প্রাচীন ইতিহাস, বিজ্ঞান নির্বিশেষে গ্রন্থগুলি অধ্যয়ন করে সম্যক জ্ঞান অর্জন করে যুক্তির তলোয়ার শাণিত করতে হবে। অসীম ধৈর্য এবং বিনয়ী হওয়া জরুরি। অপরদিকে আস্তিক হয়ে যাওয়াটা খুবই সহজ। শুধু বিশ্বাস করলেই হল। আর যদি কিছু বলতে চান তাহলে মন যা চায় গুছিয়ে বলে ফেলুন। আর একটু বেশি এবং গভীর কিছু বলতে চাইলে ধর্মযাজক, পুরোহিত, ধর্মধ্বজাধারীদের বলে দেওয়া বিবৃতি কপি-পেস্ট করে দিতে হবে। পরিশ্রম করে অনুসন্ধানের প্রয়োজন নেই, দায়ও নেই।
কোনো নাস্তিক যখন ধর্মকে আঘাত করে তখন গোটা সমাজ, গোটা রাষ্ট্র তাঁর বিরুদ্ধে খড়হস্ত হয়ে ওঠে; কিন্তু যখন কোনো ধর্মপ্রাণ কোনো নাস্তিককে আক্রমণ করে, তখন চুপ! বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলে ফেলেন–“নাস্তিকদের বরদাস্ত করা হবে না।” তাই নাস্তিকদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য ওদেশে বিশেষ আইনও প্রস্তুত করে রাখা আছে। তাই ওদেশে নাস্তিকদের হত্যা করলে খুনিরা গ্রেফতার হয় না, কোনো শাস্তি হয় না। আস্তিকগণ যথাযথ জবাব দিন। আস্তিকদের বিশ্বাসটা বিশ্বাস, নাস্তিকদের বিশ্বাসটা কি ফাউ? ভুলে যাবেন না এই পৃথিবীতে আস্তিক্যবাদের বয়স এবং নাস্তিক্যবাদের বয়স প্রায় সমান। নাস্তিক্যবাদ কোনো ফ্যাশন নয়। নাস্তিক্যবাদও শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে আছে। উড়ানোর চেষ্টা করবেন না। নাস্তিকরা আস্তিকদের মতো সশস্ত্র নয় বলে ভাববেন না নাস্তিক্যবাদ নিষ্ফলা। নাস্তিক্যবাদের রাষ্ট্রীয় মদত নেই বলে ভাববেন না নাস্তিক্যবাদ ভ্যানিশ হয়ে যাবে। মানুষের চাইতে বেশি মন্দির মসজিদ-গির্জ-বিহার গড়ে ফেলেছেন পৃথিবীর বুকে। তা সত্ত্বেও এত ভয় কীসের! ঈশ্বরে আস্থা নেই! সক্রেটিস, ব্রুনোদের হত্যা করে তো পরে
নিজেদের থুতু নিজেদেরই গিলতে হচ্ছে। আস্তিকদের বিশ্বাসে আঘাত করলে যদি অপরাধ হয়, তবে নাস্তিকদের বিশ্বাসে আঘাত করলেও একই অপরাধ হয়। মুদ্রার দু-পিঠের একপিঠকে অস্বীকার করলে মুদ্রা অচল হয়ে যায়! নাস্তিকরা মিথ্যা হলে, আস্তিকরাও মিথ্যা। কেবল আস্তিকরাই দিস্তাদিস্তা কাগজ খরচা করে বুকনি দিয়ে যাবেন, আর নাস্তিকরা মুখ বুজে হজম করবে? তাঁরা লিখবে না? তাঁরা তাঁদের মত প্রকাশ করবে না? কেন? আপনারা আপনাদের কথা বলছেন বলুন–ওটা আপনাদের মতাদর্শ। নাস্তিকরা বলবেন তাদের দর্শনের কথা–ওটা তাদের মতাদর্শ। সমস্যাটা কোথায়? সমস্যাটা হল আস্তিক্যবাদীরা নিজেরাই স্বঘোষিত সর্বজ্ঞানী বলে মনে করেন। আস্তিক্যবাদীরা অসহিষ্ণু, অন্যের মতবাদকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতেচায়–অগণতান্ত্রিক। এক ধর্মের আস্তিক অন্য ধর্মের আস্তিকদেরই বিনাশ করতে খঙ্গহস্ত হয়। আস্তিক্যবাদীদের গ্রন্থ বা কিতাবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ এবং ‘পরধর্মসহিষ্ণুতা’ বলে শব্দ নেই (এরা ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ‘পরধর্মসহিষ্ণুতা’-র তীব্র বিরোধী)। আছে শুধু বিদ্বেষ, দাঙ্গা এবং ধর্মান্তরের সুতীব্র বাসনা। নাস্তিক্যবাদীরা কখনো কোনোদিনই ধর্মান্তরিত হয় না। নাস্তিক্যবাদীরা অন্য ধর্মের কারোকে বিবাহ করলেও ধর্মত্যাগ করে না বা করায় না। আস্তিক্যবাদীরা সবসময় যে-কোনো কারণেই হোক স্বধর্ম ত্যাগ করেন। এরা ধর্মত্যাগের মধ্য দিয়ে নতুন ধর্মকে জাতে তুলে ফেলে-আসা ধর্মকে বেজাত করে, খাটো করে। ধার্মিক বা আস্তিকদের ঈশ্বরের নাম ভাঙিয়ে সবরকম অন্যায় কর্ম করে পার পাওয়া যায়, নাস্তিকরা আর যাই-ই করুক ঈশ্বরের নাম ভাঙিয়ে কোনো সুকর্ম বা কুকর্ম কোনোটাই করেন না। সুকর্ম বা কুকর্মের সব দায় নিজের কাঁধে নেন, ঈশ্বর বা আল্লাহর কাঁধে চাপান না।
সমগ্র পৃথিবীতে কোটি কোটি প্রজাতির কোটি কোটি প্রাণী বসবাস করেন। প্রতিটি প্রাণীকেই টিকে থাকার জন্য সুযোগের সদব্যবহার করে। এটাই দস্তুর, এটাই প্রাণের সর্বজনীন ধর্ম। যে পারে সে থাকে, যে পারে না সে বিলুপ্ত হয় চিরতরে। পৃথিবীর সব কাজই সব প্রাণীই সুযোগ বুঝে করে। এটা তার জন্মগত অধিকার। তাইসব প্রাণীই সুযোগবাদী।
নাস্তিক্যবাদী সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ কী বলছেন দেখি : “বিশ্বাস কাকে বলে? আমরা কি বলি আমরা পিঁপড়ায় বিশ্বাস করি, সাপে বিশ্বাস করি, জলে বিশ্বাস করি, বা বজ্রপাতে, বা পদ্মা নদীকে বিশ্বাস করি? এসব, এবং এমন বহু ব্যপারে বিশ্বাসের কথা ওঠে না, কেননা এগুলো বাস্তব সত্য বা প্রমাণিত। যা সত্য, যা প্রমাণিত, যা সম্পর্কে কোনও সন্দেহ নেই, তাতে বিশ্বাস করতে হয় না; কেউ আমরা বলি না যে আমি বিদ্যুতে বিশ্বাস করি, বা রোদে বিশ্বাস করি, বা গাড়িতে বিশ্বাস করি, কেননা সত্য বা প্রমাণ। প্রতি ব্যপারে বিশ্বাস করতে হয় না, বিশ্বাস করতে হয় অসত্য, অপ্রমাণিত, সন্দেহজনক বিষয়ে। অসত্য, অপ্রমাণিত, কল্পিত ব্যপারে আস্থা পোষণই হচ্ছে বিশ্বাস। বিশ্বাস ক’ ক্রিয়াটি নিশ্চয়তা বোঝায় না, বোঝায় সন্দেহ; আর এ-ক্রিয়ার অকর্তা পদে দু-রকম বিভক্তি হয় এবং বাক্যের অর্থ বিস্ময়করভাবে বদলে যায়। আমি বলতে পারি “আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি, কিন্তু ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি না”। এ-বাক্যে প্রথম ঈশ্বর অধিকরণ কারক, এতে বসেছে ‘এ’ বিভক্তি; আর দ্বিতীয় ঈশ্বর কর্মকারক, এতে বসেছে ‘কে’ বিভক্তি; এবং বাক্যটি বোঝাচ্ছে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করলেও আমি তার ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করি। বাঙলায় কিছুর অস্তিত্বে বিশ্বাস করার জন্য অধিকরণে সপ্তমী বিভক্তি হয়। বিশ্বাস নিশ্চয়তা বোঝায় না, সন্দেহই বেশি বোঝায়; তবে বিশ্বাসীদের স্বভাব ভাষার স্বভাবের বিপরীত; ভাষা যেখানে বোঝায় অনিশ্চয়তা, বিশ্বাসীরা সেখানে বোঝেন নিশ্চয়তা। মানুষের বিশ্বাসের শেষ নেই, কোটি কোটি বিশ্বাস পোষণ করে মানুষ। এমন মনে করার কোনও কারণ নেই যে এখন যেসব বিশ্বাস চলছে, সেগুলো চিরকাল ধরে চলছে; এখনকার বিশ্বাসগুলোর বয়স খুব বেশি নয়, এগুলোর আগে লাখ লাখ বিশ্বাসের উদ্ভব ও বিনাশ ঘটেছে; দেবতা বা ঈশ্বর বা বিধাতা বা কোনও বিশেষ স্রষ্টায় বিশ্বাস সেদিনের, চার-পাঁচ হাজার বছরের কথা; মানুষের বয়স তাদের বিভিন্ন দেবতা বা বিধাতাদের বয়সের থেকে অনেক বেশি।”
ধর্ম হল তাই-ই, যা ঈশ্বর নামক অনস্তিত্বকে সাক্ষীগোপাল করে নাগরিকদের শোষণ ও শাসনের অনুশাসনপত্র। আর ধর্মগ্রন্থগুলি হল প্রাচীনকালে শাসককর্তৃক রচিত অনুশাসনমালা, যা ‘ঈশ্বর’ নামক অদৃশ্য অস্তিত্বের ভয় দেখিয়ে প্রয়োগ করা হয়।
আজকাল আস্তিক্যবাদীদের মধ্যে বলা হচ্ছে নাস্তিকতাও নাকি একটি ধর্ম। নাস্তিক্যবাদ কোনোভাবেই ধর্ম নয়, যে কারণে কলকাতা বা ঢাকা কখনো দেশ নয়। নাস্তিক্যবাদ কোনো ধর্ম-ব্যবস্থার শর্ত পালন করে না, যেমনভাবে কলকাতা বা ঢাকা দেশের কোনো শর্ত পালন করে না। আস্তিক্যবাদীরা আসলে সব গুলিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর। যেনতেনপ্রকারেণ একই গোয়ালের গোরু বানাতে চায়, মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চায়। নাস্তিক্যবাদকে যাঁরা ধর্মের সঙ্গে তুলনা করে থাকে, তাঁদের বলি–(১) নাস্তিক্যবাদ যদি ধর্ম হয়, তবে–মদ্যপান না-করাও একটি নেশা, টেনিস-খেলাও একটি ক্রীড়া, বনের সিংহকেও মানুষ প্রজাতির বলতে হবে, স্ট্যাম্প বা মুদ্রা না-জমানোকে হবি বলতে হয়। (২) নাস্তিক্যবাদ ধর্ম হলে ‘অফ বাটনকে টিভি চ্যানেল বলতে হয়। (৩) নাস্তিক্যবাদ ধর্ম হলে আকাশকে বলতে হয় মেঘমালা।
বস্তুত ধার্মিকরা ধর্ম দ্বারা এতই প্রভাবিত যে, কোনোপ্রকার ধর্মবিশ্বাসহীনতাও যে একটা বোধ একটা দর্শন একজন মানুষ হতে পারে, তা কল্পনা করা তাদের বোধশক্তির বাইরে। যারা নাস্তিক্যবাদকে ধর্ম বলে দাবি করে, তাদের নাস্তিক্যবাদ সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই এটা নিঃসংশয়ে বলা যায়। নাস্তিক্যবাদ কোনো কাঠামোবদ্ধ বিষয় নয়। নাস্তিকবাদীরা বলেন স্রষ্টা, দেবতা বা অতিপ্রাকৃত কোনোকিছুতে অবিশ্বাসই নাস্তিক্যবাদ। নাস্তিক্যবাদ
আস্তিক্যবাদের মতো কিছু সুনির্দিষ্ট লিখিত নিয়ম ও নির্দেশের সমাবেশ নয়। একজন নাস্তিকের দর্শন যে আঙ্গিকেই হোক না-কেন, গুরুদেব-জ্যোতিষ-ভূত প্রেত-ডাইনি-জিন-রত্ন-পাথর-তন্ত্র-মন্ত্র-ঈশ্বরে অবিশ্বাস করলেই সে নাস্তিক্যবাদের আওতাভুক্ত। নাস্তিক্যবাদ একটি অলিখিত দর্শন–আস্তিক্যবাদের মতো প্রমাণ ছাড়া কিছু বিশ্বাস করতে বলে না। নাস্তিক্যবাদে যে-কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করা যায়, প্রমাণ চাওয়া যায়, প্রমাণ করতেই হয়। নাস্তিক্যবাদীরা যদি বলেন ভারতের উত্তর-পূর্ব জুড়ে হিমালয় পর্বতমালা অবস্থান করে আছে, তবে তা প্রমাণ করে দেখাতে সক্ষম। নাস্তিক্যবাদীরা কখনোই বলবেন না ভারত মহাসাগরের অনেক গভীরে যে জঙ্গল আছে সেই জঙ্গলে হাজার হাজার রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার বিচরণ করে। কারণ ওটা প্রমাণ করা যাবে না। অপরদিকে কোনো আস্তিক্যবাদীকে যদি একথা বলা যায়, তবে তা বিশ্বাস করে ফেলবে। কারণ আস্তিক্যবাদীদের যে বিশ্বাস ছাড়া কিছুই নেই–“বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু তর্কে বহুদূর”। নাস্তিক্যবাদীদের বিশ্বাস’ ছাড়া সবই আছে। নাস্তিক্যবাদীরা প্রশ্ন করে–উত্তর খোঁজে, খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে যায় নিরন্তর। আস্তিক্যবাদীদের কোনো প্রশ্ন নেই, তাই প্রশ্নের উত্তরও নেই। আস্তিক্যবাদী এবং নাস্তিক্যবাদীদের মধ্যে মূলগত পার্থক্য–একপক্ষ দৃষ্টিহীন, অপরপক্ষ চক্ষুষ্মন। দৃষ্টিহীনেরা অন্যের চোখে প্রত্যক্ষ করেন, কিংবা মনে মনে গড়ে নেয় অদৃশ্য পৃথিবী–এদের সঙ্গে প্রতারকেরা খুব সহজেই প্রতারণা করে। চক্ষুম্মানদের কাছে বনকুলকে আপেল বলে বেচা যায় না। আস্তিক্যবাদীরা ভিক্ষাবৃত্তি (পুণ্যলোভে ভিক্ষা দিয়ে এই বৃত্তিকে বাঁচিয়ে রেখেছে), বেশ্যাবৃত্তির মতো পেশার সাক্ষাৎ স্রষ্টা। আস্তিক্যবাদীরা বেশ্যাবাড়ির মাটি না-পেলে দুর্গাপুজো করতে পারবেন না। তাই বেশ্যাবৃত্তিও থাকতে হবে, দুর্গাপুজোও থাকবে।
যে সমস্ত আস্তিক্যবাদীরা নাস্তিক্যবাদীদের হেয় করেন, হত্যা করেন –তাঁরা ভুলে যাবেন না, পৃথিবী সৃষ্টির উষাকাল থেকেই আস্তিক্যবাদী শুধুমাত্র ধর্মের কারণেই লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষদের হত্যা করেছেন। ব্রুনো, সক্রেটিস, গ্যালিলিয়োর মতো অসাধারণ মানুষ থেকে থাবা বাবার মতো সাধারণ মানুষদেরও নির্মমভাবে হত্যা করে আস্তিক্যবাদীরা। তবে মানবজাতির ইতিহাসে মানুষ সবচেয়ে বড় ধর্মীয় হত্যার সাক্ষী হয়েছেন ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নামে পরিচিত। এই ৪ বছরে কত লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে তার সঠিক হিসাব কে রেখেছে! হাজার হাজার ইহুদি হত্যা এবং খেদানোর মধ্য দিয়েই এই যুদ্ধের সূত্রপাত। কারণ জার্মানিরাই প্রকৃত আর্য, বাকি সব ম্লেচ্ছ। আর্য তথা নাৎসি সংস্কৃতিই শ্রেষ্ঠ। অতএব বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ-জার্মান এবং ইহুদিদের দেশ থেকেই বিতাড়ন। সমগ্ৰজাতিকে Regimentation বা নাৎসি ছাঁচে ঢেলে ফেলা হয়। সঙ্গে তীব্র ইহুদি বিদ্বেষ প্রচারিত হয়। অসংখ্য শিশুদের ইহুদি-বিদ্বেষের দীক্ষা দেওয়া হয়। পথেঘাটে ইহুদিরা নির্যাতিত হন। বহু ইহুদি নির্যাতনের ফলে জার্মানি ছাড়তে বাধ্য হন। হিটলারের এক আদেশে ইহুদিরা জার্মানিতে অবাঞ্ছিত, ক্ষতিকারক, ঘৃণিত সম্প্রদায়ে পরিণত হয়। ঘোষণা করা হল–One people, one party, one fuehrer । শুধু মানুষ নয় –ধর্মীয় কারণে লক্ষ লক্ষ গোরু, পাঁঠা এবং অন্যান্য প্রাণীরাও হত্যার শিকার হয় বলি বা কোরবানির নামে। খাদ্য খাদকের সম্পর্কে নয়, বলি বা কোরবানি দেওয়া হয় মানুষের স্বর্গে ঠাঁই পাওয়ার লোভে। এক্ষেত্রে আমার কিছু বলার থাকত না, যদি গোরু বা পাঁঠা বা মহিষরাও স্বর্গে ঠাঁই পাওয়ার ইচ্ছায় মানুষদেরও ধরে ধরে বলি বা কোরবানি দিত। সবই একতরফা কেন হবে–ঈশ্বরের এ কেমন বিচার!
আস্তিক্যবাদ ও নাস্তিক্যবাদের তুলনামূলক ব্যবচ্ছেদ করলেই দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে সাদৃশ্য এবং বৈসাদৃশ্য। জোর করে মানতে হবে না। কোনো চাপাচাপির বিষয় নয়, এটা চোখের চশমা নামিয়ে সাদাকে সাদা কালোকে কালো দেখতে পারলে বিতর্কের কোনো অবকাশই নেই। যুক্তি ছাড়া ব্যাখ্যা ছাড়া সত্যের প্রত্যক্ষ হয় না। আসুন দেখা যাক, মতের মিল হয় কি না-–
(১) আস্তিকদের নির্দিষ্ট পুরোহিত, ইমাম, পাদরি, পোপ ইত্যাদি থাকে। অপরদিকে নাস্তিকদের তেমন কিছু নেই যে, যাঁদের বাণীবৃষ্টি তাদের জন্য ধ্রুব সত্য। যদি অন্যদের সঙ্গে নিজের ভাববিনিময় করলে তাকে প্রচারক বলা হয়, তবে প্রত্যেক নাস্তিককেই প্রচারক বলা যায়। তাই বলে নাস্তিকদের ধর্মপ্রচারকদের সঙ্গে তুলনা করলে মহাভুল হবে। ধর্মপ্রচারকরা সুনির্দিষ্ট একটি মত প্রচার করে, যেখানে নিজেদের মত ছাড়া বাকি সব মত ফালতু। অপরদিকে নাস্তিকরা কেবলমাত্র নিজের ভাবনা বা দর্শন অন্যদের সঙ্গে বিনিময় করে মাত্র–ধার্মিকদের মতো চাপিয়ে দেয় না, গা-জোয়ারি করে না।
(২) নির্দিষ্ট ধর্মে সকল ভৌগোলিক অঞ্চলের জন্য একই এবং সুনির্দিষ্ট সংস্কৃতি পালন করতে বলা হয়। কিন্তু নাস্তিক্যবাদ ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে গড়ে ওঠে এবং সে অঞ্চলের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করে।
(৩) নাস্তিকগণ যৌক্তিকচিন্তা ও বৈজ্ঞানিক তথ্য দ্বারা ধর্মের অযৌক্তিক বিষয়গুলি নিয়ে চিন্তা করতে সমর্থ্য, কিন্তু আস্তিকরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা প্রতিস্পর্ধা মনে করেন। চোখে আঙুল দিয়ে ভণ্ডামি ধরিয়ে দিলেও চোখ খোলে না।
(৪) আস্তিকদের নির্দিষ্ট উপাসনাস্থল ও প্রার্থনাবাণী, পবিত্র তীর্থস্থান ইত্যাদি থাকে, যা নাস্তিকদের কাছে অর্থহীন।
(৫) আস্তিকরা বিশ্বাস করে তাদের একমাত্র কাজ ইষ্টদেবতার উপাসনা করা, ভালোমন্দ-পাপপুণ্য-প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি সবই ঈশ্বরের পায়ে সঁপে দেয়। অপরদিকে নাস্তিক্যবাদীরা কোনোকিছুই ঈশ্বরের কাছে সঁপে দেন না। ধৈর্য না-হারিয়ে বুদ্ধি শানিয়ে নিজের বর্তমান-ভবিষ্যৎকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। নাস্তিকগণ ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে হাত-পা ধুয়ে ফেলতে পারে না, নিজের অক্ষমতাকে ঢাকতে ঈশ্বরকে সাক্ষী মানে না।
(৬) প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলিতে অন্ধবিশ্বাসের নানাবিধ বিষয় থাকে, যে-ব্যাপারগুলি সম্পর্কে প্রশ্ন করা অপরাধ, পাপ, তাই নিষিদ্ধ। অপরদিকে নাস্তিক্যবাদে বিশ্বাসের অন্ধত্বকে প্রশ্রয় দেয় না। (৭) আস্তিকগণ দেবতা, ভূত, জ্যোতিষ, তুকতাক, বশীকরণ, ওঝা-গুণিন, ডাইনি, ব্ল্যাক ম্যাজিক, মন্ত্রটন্ত্র ইত্যাদি অতিপ্রাকৃত বিষয় এবং ঘটনাবলিতে প্রশ্নহীনভাবে বিশ্বাস করেন। অপরদিকে নাস্তিকগণ এসব বিষয়গুলির বিরুদ্ধে অন্তহীন লড়াই করে যাচ্ছ।
(৮) আস্তিকরা কোনোরকম অস্বাভাবিক ঘটনার গন্ধ পেলে ঈশ্বরের কর্মকাণ্ড বলে বিশ্বাস করতে ভালোবাসেন। অপরদিকে নাস্তিকগণ খোঁজেন লৌকিক বা বাস্তব কারণ। কারণ নাস্তিকগণ মনে করেন পৃথিবী কেন পৃথিবীর বাইরে কোথাও অলৌকিক কাণ্ড ঘটে না, সবই লৌকিক। কারণ নাস্তিকগণ শুধু বিশ্বাসই করেন না, প্রমাণ করেন বাস্তবতা।
(৯) প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলিতে সৃষ্টিকর্তার জন্য নিত্যপালনীয় কিছু কাজ করে প্রচুর সময় ব্যয় করেন, যা নাস্তিকগণের কাছে যা শুধু সময়ের অপচয়।
(১০) আস্তিকদের বাধ্যতামূলকভাবে ধর্ম সম্পর্কিত কিছু অতিপ্রাকৃত ঘটনা বিশ্বাস করতে হয়। অপরদিকে নাস্তিকদের এমন কিছু বাধ্যবাধকতা নেই।
(১১) আস্তিকগণ ধর্মগ্রন্থগুলিকে অপৌরুষেয় বলেন, আসমানি কিতাব, ঈশ্বরপ্রদত্ত বলেন এবং অবশ্যই নির্ভুল বলে দাবি করেন যাঁর যাঁর ধর্মগ্রন্থ। নিজের ধর্ম এবং নিজের ধর্মগ্রন্থ মহান এবং সর্বশ্রেষ্ঠ। অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থগুলি বোগাস। নাস্তিকগণের কাছে কোনো ধর্ম এবং ধর্মগ্রন্থই ভ্যালু রাখে না।
(১২) আস্তিকরা তাদের কল্পিত সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য বিভিন্ন রীতি নীতি পালন করে। অপরদিকে নাস্তিকরা যেহেতু সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসের ধার ধারে না, তাই এহেন যোগাযোগের চেষ্টার প্রশ্নও নেই।
(১৩) আস্তিকগণ মন্দির-মসজিদ-গির্জা এবং অন্যান্য উপাসনাগৃহ ভেঙে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে অন্য ধর্মাবলম্বীদের চরমভাবে আহত করে, রক্তাক্ত করে। অপরদিকে নাস্তিকগণের এমন কোনো কর্মসূচি থাকেই না।
(১৪) আস্তিকগণ অন্য ধর্মাবলম্বীদের নৃশংসভাবে হত্যা করে ঈশ্বরের নামে অন্য ধর্মে বিশ্বাস রাখার অপরাধে। অপরদিকে নাস্তিকগণের এমন কোনো কর্মসূচিও থাকে না।
(১৫) আস্তিকগণ অন্য ধর্মাবলম্বীদের জোর করে, ভয় দেখিয়ে,সেবার মুখোশ লাগিয়ে ধর্মান্তরিত করে। অপরদিকে নাস্তিকগণের এমন কোনো কর্মসূচি থাকে না।
(১৬) আস্তিকগণ তাঁর অপছন্দের মানুষ বা শত্রু মনোভাবাপন্ন মানুষদের অমঙ্গল বা ক্ষতিসাধনের জন্য ভগবানের কাছে নানারকম মানত করে, ভাড়া বাঁধে, জোড়া পাঁঠা বলি দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। ঠাকুরের থানে মাথা ঠোকে, শাপ শাপান্ত করে। অপরদিকে নাস্তিকরা এমনধারা ভাবনা মাথাতেই আনতে পারে না।
(১৭) মৌলবাদী আস্তিকগণ সক্রেটিস, ব্রুনো, গ্যালিলিও, হুমায়ুন আজাদ, থাবা বাবা, সলমন রুশদি, তসলিমা নাসরিনদের মতো বিদগ্ধদের হত্যা করে কিংবা হত্যার করার জন্য ফতোয়া জারি করে। নাস্তিকদের এহেন “ঈশ্বর নির্দেশিত কর্ম”-এর ইতিহাস নেই।
নাস্তিকতা কোনো বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের নাম নয়, এটি একটি ‘স্কুল অব থট’। নাস্তিকতাবাদের মূল কাজ হচ্ছে আস্তিকতার নামে সারা পৃথিবীজুড়ে যে ভণ্ডামি চলে তার প্রতিবাদ করা। অতএব নাস্তিক্যবাদকে কোনোভাবেই ধর্ম বলা যায় না। ধর্ম সেটাই, যেখানে এক বা একাধিক ধর্মগ্রন্থ বর্তমানে। যদিও আস্তিক্যবাদীরা নাস্তিক্যবাদকেও ধর্ম বলার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে, তাই সেই পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় প্রকৃতপক্ষে আস্তিকদের অজ্ঞতা ও ধর্ম বিষয়ে ধারণার অভাবই নাস্তিক্যবাদকে ধর্ম হিসাবে দাবি করার কারণ। সংকট থেকেই এ ধারণা আস্তিকদের মাথার মধ্যে আসে। এটা নতুন নয়, হিন্দু আস্তিকগণ যখন দেখল প্রচুর হিন্দু দলে দলে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হচ্ছে, তখন হিন্দু ধর্মবেত্তারা বলতে শুরু করে দিল বৌদ্ধধর্মও যা হিন্দুধর্মও তাই। আর-এক ধাপ এগিয়ে এটাও বললেন যে, বিষ্ণুর নবম অবতারই তো বুদ্ধ। এদেশে ব্রিটিশশাসন শুরু না-হলে হয়তো হজরত মোহম্মদকেও বিষ্ণুর একাদশতম অবতার হিসাবে পেয়ে যেতাম। সেটা হলে কেমন হত ভাবলেই কেমন যেন রোমাঞ্চকর লাগে। আস্তিকগণ সব পারেন।
গোটা পৃথিবী জুড়ে সর্বমোট জনসংখ্যা ৭.২৮ (৭.২৮ billion people as of January 2015) কোটি। এই ৭.২৮ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী ২.২ কোটি (2.2 billion), ইসলাম ধর্মাবলম্বী ১.৮ কোটি (1.8 billion), ধর্মহীন মানুষ ১.১ কোটি (1.1 billion), হিন্দু বা সনাতন ধর্মাবলম্বী ১ কোটি (1 billion), বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ৩৭৬ মিলিয়ন ইত্যাদি। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে বিশ্বের সমগ্র জনসংখ্যার বিচারে খ্রিস্টান ৩১.৫ %, ইসলাম ২৩.২ %, হিন্দু ১৫ %, বৌদ্ধ ৭.১ %। বিশ্বের ২১০ কোটি লোক বলছে “খ্রিস্টান ধর্মই একমাত্র সত্য ধর্ম”। বিশ্বের ১৪০ কোটি লোক বলছে “ইসলামই একমাত্র সত্য ধর্ম”। বিশ্বের ৯০ কোটি লোক বলছে “হিন্দু বা সনাতন ধর্মই একমাত্র সত্য ধর্ম”। বিশ্বের ১১০ কোটি লোক বলছে “কোনো ধর্ম সত্য নয় (নাস্তিক)”। একাধিক ঈশ্বর, একাধিক ধর্ম এবং একাধিক মতবাদ। কেন, একাধিক কেন? এদের সবার দাবি একসঙ্গে সঠিক হতে পারে না, কারণ এগুলি পরস্পর-বিরোধী। যে-কোনো একটা দলের কথা সঠিক। অথবা কোনোটাই সঠিক নয়।
ভাববার বিষয় এই যে, খ্রিস্টানদের ঈশ্বর মোট জনসংখ্যার বাকি ৬৪.৫ % মানুষকে খ্রিস্টানে পরিণত করতে পারেনি, মুসলিমদের আল্লাহ মোট জনসংখ্যার বাকি ৭৬.৮ % মানুষকে মুসলিমে পরিণত করতে পারেনি, হিন্দুদের ভগবান মোট জনসংখ্যার বাকি ৮৫ % মানুষকে হিন্দুতে পরিণত করতে পারেনি, বৌদ্ধদের ভগবান বুদ্ধ মোট জনসংখ্যার বাকি ৯৩ % মানুষকে বৌদ্ধ করতে পারেনি। এছাড়া অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যেসব ধর্মগুলি আছে তাঁদের কথা তো ধরলামই না। আহা, ভগবানের ক্ষমতা নিয়ে তো প্রশ্ন উঠবেই। না ক্ষমতা আছে আল্লাহর, না ক্ষমতা আছে ভগবানের, না ক্ষমতা আছে ঈশ্বর বা গডের, না ক্ষমতা আছে অন্য কোনো দেবতার। সেই ভগবানই সর্বশক্তিমান এবং পরমকরুণাময় হবে যে ভগবান পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে এক ঈশ্বরে আস্থা এবং বিশ্বাস আনাতে পারবে। সত্যিই যদি ঈশ্বর বলে কিছু থাকত তাহলে পৃথিবী এত ধর্ম ভাগে বিভাজিত হয়ে থাকত না। “তুই বড়ো, না মুই বড়ো” ধর্মকে কেন্দ্র করে এত রক্তপাত আর হানাহানি থাকত না।
ইসলামধর্ম, হিন্দুধর্ম, খ্রিস্টানধর্ম, বৌদ্ধধর্ম ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানগুলি হল শাসক মানুষের তৈরি।এই ধর্ম-সংস্থাগুলির সঙ্গে ঈশ্বরের কোনো সম্পর্ক নেই। এগুলি এক-একটি গোষ্ঠীর এক-একটি দোকানমাত্র। ধর্ম-সংস্থাগুলির সঙ্গে ঈশ্বরকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে বলেই এত বিড়ম্বনা। শুধুমাত্র অন্য ধর্ম-সংস্থার আস্থাকারী বলেই আর-এক ধর্মের মানুষরা ধর্ষণ করে, খুন করে, উচ্ছেদ করে, বিতাড়িত করে দেশ থেকে। মর্মে অনুধাবন করার চেষ্টা করুন–ধর্ম-সংস্থাগুলি অনেকটা রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে তুলনীয়। ধর্ম-সংস্থাগুলি আসলেই এক-একটি রাজনৈতিক দল, শুধু নির্বাচনেই যা অংশগ্রহণ করে না। এই ভারতবর্ষের কথাই ধরুন-না এই মুহূর্তে ভারতে ১৭৬৬ টি রাজনৈতিক দল। এর মধ্যে ৬টি জাতীয় রাজনৈতিক দল। ৬টি জাতীয় রাজনৈতিক দলের মধ্যে মাত্র দুটি রাজনৈতিক দল (ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং ভারতীয় জনতা পার্টি) ভারতকে পালাক্রমে ডোমিনেট করে। অনুরূপ ভারতে গৌণ-অগৌণ মিলিয়ে অসংখ্য ধর্ম-সংস্থা আছে, তার মধ্যে দুটি ধর্মীয় সংস্থা ড্ডামিনেট করছে–একটি হিন্দু, অপরটি মুসলিম। ধর্ম রাজনৈতিক দলের মতো মতাদর্শের ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন। আসলে ভিন্নতা বলতে তেমন কিছু নয়, ভিন্নতার ছদ্মবেশে আলাদা নেতৃত্বে গোষ্ঠীর উত্থান। মৌলিক কিছু ভিন্ন তা ছাড়া সবই এক –সবই মুদ্রার ওপিঠ আর এ পিঠ। কী ধর্ম-সংস্থা, কী রাজনৈতিক দল–সবখানেই গোষ্ঠীতে-গোষ্ঠীতে দ্বন্দ্ব, কোন্দল। রূপ আলাদা, মোটো এক–কর্তৃত্ব, ক্ষমতায়ন। ধর্মে ঈশ্বরকে জড়িয়ে ভণ্ডামি, রাজনীতিতে আর্দশের কথা বলে ভণ্ডামি। কার্ল সেগান বলেন, “বিশ্বাসীকে যুক্তি-তথ্যের সাহায্যে কিছু বোঝানো সম্ভব নয়; কারণ তাদের বিশ্বাস প্রমাণভিত্তিক নয়, বিশ্বাস করার গভীর প্রয়োজনীয়তার ভেতরেই তাদের বিশ্বাসের ভিত্তি নিহিত।”
বিশ্বাস-নির্ভর ধর্মের প্রভাব গোটা বিশ্বজুড়ে। আমাদের রীতি-রেওয়াজ, আমাদের আইডেন্টিটি, বিয়ে-সাধী ইত্যাদি নানাবিধ সামাজিক উৎসব সবেতেই ধর্মের উপস্থিতি বহমান। ধর্ম একপ্রকার ভাইরাসের মতো। ভাইরাসকে টিকে থাকতে যেমন অসংখ্য ‘হোস্ট’-এর প্রয়োজন হয় বংশবৃদ্ধির জন্য, নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য, ধর্মেরও ঠিক তেমনই অসংখ্য ‘এজেন্ট’-এর প্রয়োজন হয়। সেইসব এজেন্টরা কেউ গুরু, কেউ পুরোহিত, কেউ ইমাম, কেউ মৌলবি, কেউ পাদরি, কেউ-বা পোপ হিসাবে পরিচিত। এঁরা ঈশ্বর ও ঈশ্বরপ্রদত্ত ধর্মের বান্দা বা সেবক। ভাইরাসকে বেঁচে থাকতে যেমন একটি জীবন্ত শরীরের প্রয়োজন হয়, ধর্মকে বেঁচে থাকতেও অন্ধ ভক্তের প্রয়োজন হয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় –“মানুষই দেবতা গড়ে তাহার কৃপার ‘পরে করে দেবমহিমা নির্ভর”।
বিশ্বাসের প্রভাবে বলীয়ান হয়ে মানুষ সেই প্রাচীনকাল থেকেই কুমারী হত্যা থেকে শুরু করে শিশু হত্যা করে কাল্পনিক ‘পরমকরুণাময়’-কে তুষ্ট করে গেছে, সতীদাহের নামে শত-সহস্র মহিলাকে জোর করে পুড়িয়ে মেরেছে, নাস্তিক ও বিধর্মীদের হত্যা করেছে, ধর্মের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ধর্মযুদ্ধ (Crusade) করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে। বিশ্বাসের ভাইরাস প্রচণ্ড সংক্রামক। জীবাণু ভাইরাসকে ওষুধ বা ভ্যকাসিন দিয়ে দমন করতে সক্ষম হলেও ধর্মের ভাইরাস দমন করা সম্ভব হয়। কারণ রাষ্ট্রই ধর্মীয় ভাইরাসের মদতদাতা। তাই ফারাবীর মতো মৃত্যুর হুমকিদাতার বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নিতে সাহস পায় না বাংলাদেশ রাষ্ট্র।
কিন্তু নাস্তিকদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র সর্বদাই খঙ্গহস্ত। নাস্তিকদের আদালতের তুলে এনে বিচার করা হয়, জেল হয়। নাস্তিকদের রচিত গ্রন্থ নিষিদ্ধ করা হয়, নাস্তিকদের বই যেসব প্রকাশক প্রকাশ করে, তাঁদের হত্যা করা হয়। নাস্তিকদের লেখা বই পুড়িয়ে, তাঁদের বইকে নিষিদ্ধ করে যুক্তিবাদী মুক্তচিন্তকদের প্রতিহত করার চেষ্টা নতুন কোনো প্রয়াস নয়। কথিত আছে, আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগারের বই ধ্বংস করতে গিয়ে ধর্মের ভাইরাস’ খলিফা
ওমর নাকি বলেছিলেন –“বইপত্রগুলো যদি কোরানের শিক্ষার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ না-হয়, তবে সেগুলো আমাদের দৃষ্টিতে নিতান্ত অপ্রয়োজনীয়। কাজেই ওগুলোর ধ্বংস অনিবার্য। আর বইগুলোতে যদি কোরানের শিক্ষার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কোনো কথাবার্তা আদৌ থেকেও থাকে, তবে তা হবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত। সেদিক থেকেও এই বইগুলো নষ্ট করে ফেলা সঠিক কাজ”। মুক্তচিন্তক হত্যা করা সম্ভব, আক্রমণ করা সম্ভব–কিন্তু মুক্তচিন্তকদের চিন্তাকে কোনদিন কোনোভাবেই বিনাশ করা যাবে না। মিখাইল বুলগাকভের ভাষায় –“পাণ্ডুলিপি পোড়ে না”।
কারোর কারোর মনে হয় যাঁরা ধর্মহীন যাঁরা ধর্ম মানে না তাঁরাই নাস্তিক। আর যাঁরা ধার্মিক বা ধর্ম মানে বলে জাহির করে, তাঁরাই আস্তিক। ধর্ম ব্যাপারটা কী? কোন ব্যাপারটাকে আমরা ধর্ম বলছি? কেধৰ্মমানে, কেই-বা ধর্ম মানে না! ধর্মহীন বলে কোনো প্রাণী এ পৃথিবীতে আছে নাকি? তাহলে? বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন। সব গুলিয়ে গেছে। আসুন সটিং করে দেখি। ধর্মের রূপ দুই ধরনের। (১) ঈশ্বরজড়িত ব্যবস্থাএবং (২) জৈবিকজড়িত ব্যবস্থা।
(১) ঈশ্বরজড়িতব্যবস্থা : ঈশ্বরজড়িত ব্যবস্থা হল ঈশ্বর নামক এক কাল্পনিক অস্তিত্বকে সামনে রেখে জীবনচর্যা। পূজার্চনা, যাগযজ্ঞ, আচার-সংস্কার, মন্দির মসজিদ-গির্জাদির মতো উপাসনাগৃহ নির্মাণ ইত্যাদি ব্যবস্থাই ঈশ্বরজড়িত ধর্মীয় ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় মানুষ নিজের ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থ ছাড়া বাকি ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থগুলিতে ব্রাত্য ভাবেন। এটাই আধ্যাত্ম ধর্ম বা Spritual Religion. (২) জৈবিকজড়িত ব্যবস্থা : জৈবিকজড়িত ব্যবস্থায় ঈশ্বরের কোনো স্থান নেই। এই নিয়মে পৃথিবীর বুকে যা যা অবস্থান করছে তার সবকিছুরই ধর্মআছে। সেদিক দিয়ে বিচার করলে ধর্মহীন কোনো বস্তু হয় না। “ধৃ’-ধাতুর উত্তরে মনিন প্রত্যয় করে ‘ধর্ম’ শব্দটি উৎপন্ন হয়েছে। যার অর্থ দাঁড়ায় যা আমাদের ধারণ করে। শুধু মানুষ নয় –গাছপালা, পোকামাকড়, জন্তুজানোয়ার সবাই পালন করে। হেমন্তকালে গাছের পাতা ঝরে, এটা গাছের ধর্ম। ক্ষুধার্ত বাঘ যখন হরিণের পিছু নেয় ওটা বাঘের ধর্ম, আত্মরক্ষার জন্য হরিণের পলায়ণ সেটা হরিণের ধর্ম। মানুষসহ সমস্ত প্রাণীরা যৌন-তাড়নায় একে-অপরের শরীরে শরীর সংযোজন করে, সেটা প্রাণীদেহের জৈবিক ধর্ম। খিদে পেলে খাদ্যগ্রহণ করি, খাদ্যগ্রহণ করাটা ধর্ম। আমাদের প্রত্যেকের নিজের নিজের পথ চলার দিশা আছে আদর্শ আছে ফিলোসফি আছে –সেটাই ধর্ম।
কোনো কিছুর সাধারণ ও বিশেষ বৈশিষ্ট্য তথা গুণাগুণকে তার ধর্ম বলা যায়। যেমন হাইড্রোজেন একটা গ্যাস, এটা বাতাস অপেক্ষা হালকা, এটা পোড়ালে জল উৎপন্ন হয় –এটা হল হাইড্রোজেনের ধর্ম। একইভাবে মানুষের ধর্ম হচ্ছে মানবধর্ম বা হিউম্যানিটি। একজন মানুষকে চেনা যাবে তার মানবধর্ম দিয়ে, যেমন করে হাইড্রোজেন বা লোহাকে চেনা যায় হাইড্রোজেন বা লোহার ধর্ম দিয়ে। তবে বাংলায় ‘মানুষ’ শব্দটাও ব্যাপক অর্থ বহন করে। তবে ‘ম্যান’ আর ‘হিউম্যান’ সমার্থক নয়। দুই হাত, দুই পা থাকা, সোজা হয়ে হাঁটতে পারাটাই কিন্তু মানবধর্ম নয়, বড়জোর সেটা হোমো স্যাপিয়েনসের বৈশিষ্ট বা ধর্ম হতে পারে। ম্যান যখন ম্যানুকাইন্ডের অন্তর্গত–তখনই সে হিউম্যান। এই মানবসমাজের অন্তর্গত মানুষের ধর্মই হল মানবধর্ম। মানবসমাজে ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের একটা ধারণা আছে। প্রচলিত ধর্মগুলো নিজ নিজ ব্যাখ্যা অনুযায়ী স্ব স্ব ধারণা গড়ে তুলে এবং বিভিন্ন ধর্মে এই ধারণার প্রচুর মিল ও অমিলও পাওয়া যায়, আছে প্রচুর কমন ফ্যাক্টর। প্রচলিত প্রধান ধর্মগুলোর ক্ষেত্রে এই ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের ধারণার মূলে আছে কোনো অপ্রত্যক্ষ এক বা একাধিক অস্তিত্বের নির্দেশ বা পবিত্র ও ঐশী দাবিকৃত তথাকথিত কোনো এক ধর্মগ্রন্থের দেখানো পথ বা পরলোকের ভয়/চিন্তা কিংবা কোনো এক বা একাধিক মহাপুরুষ-নবি-ঋষিগণের জ্ঞানগর্ভ আদেশ-উপদেশ। বেশ একটা স্ট্যাটিক ধারণা। দেশ-কাল-পাত্র-পরিস্থিতি সেখানে গৌণ, মানুষকে নিয়ে এই সমস্ত আদেশ-উপদেশ-নির্দেশ উত্থাপিত হলেও মানুষও যেন সেখানে গৌণ; মূল হচ্ছে অপ্রত্যক্ষ সেই একজন বা বহুজন, পবিত্র ও ঐশী দাবিকৃত সেই গ্রন্থ কিংবা এক বা একাধিক সেই পরমপূজ্য মহাপুরুষ। অপরদিকে আমার ধর্ম যখন বলছি মানবধর্ম, তখন বুঝব আমার কাছে সব কিছু বিচারের মানদণ্ড এই মানবজাতি–সমগ্র মানবসমাজ, যার দেশ-কাল-পাত্র ভেদে বৈচিত্র্য আছে এবং যা নিয়ত প্রবাহমান ও গতিশীল। সুতরাং আমার ক্ষেত্রে ভালো-মন্দের ধারণাটাও স্ট্যাটিক তো নয়ই, বরং প্রচণ্ড গতিশীল। বিশেষ কোনো গ্রন্থ বা কোনো কাল্পনিক সত্ত্বা, যা একান্তই মর্মর কাগজের তৈরি ও ব্যক্তিবিশেষের লিখিত কিংবা কোন্ সে-কালের এক বা একাধিক রক্তমাংসের মানুষের উপর যুগযুগ ধরে ও সর্বভূতে অর্থহীন এবং অন্ধ নির্ভরতার কোনো স্থান আর যেখানেই থাকুক না-কেন, মানব ধর্মে নেই। সমাজসংস্কারকরা ধর্মের অনুশাসন দিয়ে মোটেই আমাদের পথ সুগম বা মসৃণ করে যায়নি। পাঁচ হাজার বছর আগেও যাছিল, পাঁচ হাজার বছর পরেও তাই-ই আছে, আগামী পাঁচ হাজার বছর পরেও তাই-ই থাকবে। আর ভণ্ডরা ভণ্ডামি করে যাবে যুগযুগ ধরে। পূজা পার্বণ-জপ-তপ-আচার-অনুষ্ঠান-টিকি-দাড়ি-মন্দির-মসজিদ-গির্জা–এগুলি কোনোটাই প্রকৃত ধর্মের আওতায় পড়ে না–কর্মই ধর্ম। প্রেমই বিশ্ব প্রকৃতির ধর্ম। পরস্পরের প্রতি পরস্পরের কর্তব্য পালনের মধ্য দিয়ে সপ্রেম সহাবস্থানের নীতিতে দেওয়া-নেওয়া আদান-প্রদানেই ধর্ম আচরণ হয়। স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য, স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কর্তব্য, মা-বাবার প্রতি সন্তানের কর্তব্য, সন্তানের প্রতি মা-বাবার কর্তব্য, পাড়া-প্রতিবেশী-সমাজ-রাষ্ট্র প্রত্যেকের প্রতি প্রত্যেকের কর্তব্য পালনের মধ্য দিয়েই ধর্মের প্রকৃত সার্থকতা।
একবিংশ শতাব্দীতে কয়েকজন নাস্তিক গবেষক ও সাংবাদিকের প্রচেষ্টায় নাস্তিক্যবাদের একটি নতুন ধারা বেড়ে উঠেছে যাকে ‘নব-নাস্তিক্যবাদ’(New Atheism) নামে ডাকা হয়। ২০০৪ সালে Sam Harris রচিত The End of Faith : Religion, Terror, and the Future of Reason 2015 মাধ্যমে নব-নাস্তিক্যবাদের যাত্রা শুরু হয়েছে বলে মনে করেন আর-এক প্রখ্যাত নব্য-নাস্তিকভিক্টর স্টেংগার।প্রকৃতপক্ষে স্যাম হ্যারিসের বই প্রকাশের পর এই ধারায় আরও ছয়টি বই প্রকাশিত হয়, যার প্রায় সবগুলোই নিউইয়র্ক টাইমস বেস্ট সেলারে স্থান করেনিতে সমর্থ হয়। সব মিলিয়ে নীচের বইগুলোকেই নব্য-নাস্তিক্যবাদী সাহিত্যের প্রধান উদাহরণ হিসাবে আখ্যায়িত করা যায়–(১) The New Atheism (2009)–Victor J. Stenger, (*) The God Delusion (2006)–Richard Dawkins, () God is Not Great : How Religion Poisons Everything (2007) Christopher Hitchens, (8) The End of Faith : Religion, Terror, and the Future of Reason (2004)–Sam Harris, (@) Breaking the Spell : Religion as a Natural Phenomenon (2006)–Daniel C. Dennett, (y) Letter to a Christian Nation : A Challenge to the Faith of America (Rooy)–Sam Harris, (9) God : The Failed Hypothesis How Science Shows That God Does Not Exist (2004)–Victor J. Stenger
ভিক্টর স্টেংগার এই ব্যক্তিদেরকেই নব্য-নাস্তিক্যবাদের প্রধান লেখক হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। উল্লেখ্য, নব্য-নাস্তিকেরা ধর্মের সরাসরি বিরোধিতা করেন। তাঁরা ধর্মকে প্রমাণবিহীন বিশ্বাস বলে আখ্যায়িত করেন এবং এ ধরনের বিশ্বাসকে সমাজে যে ধরনের মর্যাদা দেওয়া হয় সেটার কঠোর বিরোধিতা করেন।
ধর্ম ও ধর্মীয় বিশ্বাসের এই সমালোচনার জন্য ‘New Atheist’ লেবেলে বিষয়বস্তু এবং তাঁদের বইগুলোর উপর সাংবাদিকতার ভাষ্য থেকে বেরিয়ে এসেছে। New Atheist মতাবলম্বীরা তাঁদের মতামতগুলিতে অস্বাভাবিকভাবে উচ্চস্তরের আত্মবিশ্বাস প্রদর্শন করে। সমালোচকরা লক্ষ করেছেন যে, এইসব লেখকরা নৈতিক চিন্তাধারার অনুভূতি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ওঠে এবং এমনকি বৈশ্বিক দৃশ্যের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রভাব সম্পর্কেও আতঙ্কিত হয়। New Atheist মতালম্বীরা কেন্দ্রীয় বিশ্বাস ভাগ করে যে-কোনো ধরনের অতিপ্রাকৃত বা ঐশ্বরিক বাস্তবতা নেই ঐতিহাসিক উপাদান তাঁদের সাধারণ দাবি হল, ধর্মীয় বিশ্বাস অযৌক্তিক। নৈতিক উপাদানটি একটি ধারণাকে ধারণ করে যে, একটি সার্বজনীন ও উদ্দেশ্য ধর্মনিরপেক্ষ নৈতিক মান আছে। Richard Dawkins বলেছেন, বিশ্বাস প্রমাণ ছাড়াও, এমনকি প্রমাণের বিরুদ্ধেও অন্ধ বিশ্বাস। তিনি দাবি করেন যে, বিশ্বাস একটি মন্দ কারণ। এটি যুক্তি ও প্রমাণের প্রয়োজন হয় না এবং বিতর্ক সহ্য করে না।
আস্তিকগণ মনে করেন, তাঁরাই শুধু সব সত্য জেনেছেন। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সেই অব্যাখ্যায়িত সত্য খোল-করতাল সহযোগে প্রকাশ করতে থাকেন ২৪ X ৭ X ৩৬৫ দিন। তাঁরাই একমাত্র মহাপণ্ডিত, সর্বজ্ঞ। তাহলে নাস্তিকরা কি ফেলনা? এলিতেলি? আসুন কিছু বিখ্যাত দার্শনিকদের তালিকা এখানে উল্লেখ করা যাক, যারা ইতিহাসের পাতায় নাস্তিক হিসাবে পরিচিত। মূলত ব্যাপক অর্থে নাস্তিক্যবাদ বলতে বোঝায়, উপাস্যদের অস্তিত্বের প্রতি বিশ্বাস প্রত্যাখ্যান করা। নেতিবাচক অর্থে, নাস্তিক্যবাদ হল, উপাস্যের কোনো অস্তিত্ব নেই–এই অর্থে বিশেষভাবে অবস্থান করা। সর্বাধিকভাবে, কেবল উপাস্যদের অস্তিত্বের প্রতি বিশ্বাসের অভাবের কারণে নাস্তিক্যবাদ গড়ে উঠে। এই তালিকা জীবিত এবং মৃত দার্শনিকদের, যারা দার্শনিক-চিন্তা দ্বারা ও উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম বা সামাজিক অবস্থার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক এবং যারা প্রকাশ্যে নাস্তিক হিসাবে নিজেদের প্রকাশ করেছেন। জন অ্যান্ডারসন (১৮৯৩-১৯৬২): স্কটিশ, জন্মসূত্রে অস্ট্রেলিয়ান দার্শনিক, গবেষণামূলক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা যেটা ‘সিডনি বাস্তববাদ’ হিসাবে পরিচিত। হেক্টর অভালস (জন্ম ১৯৫৮): মেক্সিকান-আমেরিকান, আইওয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মীয় শিক্ষা বিষয়ে অধ্যাপক এবং ধর্ম বিষয়ক বিভিন্ন বইয়ের লেখক। এ. জে, আয়ের (১৯১০-১৯৮৯): ব্রিটিশ দার্শনিক এবং “যৌক্তিক ইতিবাদ”-এর উকিল। যদিও টেকনিক্যালি তিনি বিদ্যমান ঈশ্বরের ধারণা অর্থহীন হিসাবে দেখেছিলেন। অ্যালান বাদিও (জন্ম ১৯৩৭): ফরাসি দার্শনিক। জুলিয়ান বেগ্নিনি (জন্ম ১৯৬৮): দর্শনের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্রিটিশ লেখক, “Theism: A Very Short Introduction,’-এর লেখক। মিখাইল বাকুনিন (১৮১৪-১৮৭৬): রাশিয়ান দার্শনিক, লেখক এবং নৈরাজ্যবাদী। ব্রুনো
বাউইর (১৮০৯-১৮৮২); জার্মান দার্শনিক, ধর্মতত্ত্ববিদ ও ইতিহাসবিদ, খ্রিস্টের পৌরাণিক তত্ত্বের প্রথম সূত্রটির প্রবক্তা। সিমোন দ্য বোভোয়ার (১৯০৮ ১৯৮৬); ফরাসি লেখক এবং বস্তুবাদী দার্শনিক। তিনি দর্শন, রাজনীতি ও সামাজিক বিষয়াবলির উপর রচনা, গ্রন্থ ও উপন্যাস এবং জীবনী ও আত্মজীবনী রচনা করেন। জেরেমি বেন্থাম (১৭৪৮-১৮৩২): ইংরেজি লেখক, আইনজীবী, দার্শনিক, এবং আইনগত ও সামাজিক সংস্কারক। তিনি তার উপযোগবাদের ওকালতির জন্য বেশি পরিচিত। সাইমন ব্ল্যাকবার্ন (জন্ম ১৯৪৪): ব্রিটিশ একাডেমিক নাস্তিক দার্শনিক, দর্শনকে জনপ্রিয় করার তাঁর প্রচেষ্টার জন্য পরিচিত। ইরন ব্রুক (জন্ম ১৯৬১): ইসরাইলের জন্মগ্রহণকারী ‘অ্যান রান্ড ইনস্টিটিউট’-এর সভাপতি ও নির্বাহী পরিচালক। রুড কার্নাপ (১৮৯১ ১৯৭০); জার্মান দার্শনিক, ১৯৩৫ সালের আগে তিনি ইউরোপে এবং তারপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্য সক্রিয় ছিলেন। তিনি ভিয়েনা চক্র’-এর একটি নেতৃস্থানীয় সদস্য এবং যৌক্তিক ইতিবাদ’-এর একজন বিশিষ্ট উকিল।
আবার দেখুন—
(১) প্রচলিত ঈশ্বর ধারণায় বিশ্বাস ছিল না বলে তৎকালীন গ্রিসের হর্তাকর্তারা সক্রেটিসকে নাস্তিক’ উপাধি দিয়েছিল এবং তাঁকে হেমলক বিষপান করে মৃত্যুকে বরণ করে নিতে বাধ্য করা হয়েছিল। অথচ তিনি প্রতিদিন প্রার্থনা করতেন “হেপ্রভু আমাকে জ্ঞান দাও”।
(২) জিয়োদানো ব্রুনো, ইনি একজন ধর্মযাজক ও ওকাল্টিস্ট (গূঢ় রহস্যাদিতে বিশ্বাসী ব্যক্তি) হয়েও ‘নাস্তিক’ তকমা পেয়েছেন। তিনি মতবাদ প্রচার করেছিলেন–“মহাবিশ্ব অসীম এবং এর কোনো কেন্দ্র নেই”। এর সঙ্গে প্রচলিত ধর্মের বিরোধিতার অপরাধে তাঁকে জ্যান্ত বেঁধে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।
(৩) জিশু তৎকালীন সময়ের প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাসকে ভেঙে দিয়ে খ্রিস্টধর্ম প্রচার শুরু করেছিল, তাকেও ‘নাস্তিক’ বলা হল। প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাসকে ভাঙার অপরাধে তাঁকে জ্যান্ত ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়।
(৪) নবি হজরত মোহাম্মদ যখন প্রচলিত ধর্মকে ভেঙে দিয়ে নতুন ধর্মের বাণী প্রচারে গেল, তখন তাঁকেও ‘নাস্তিক’ বলা হয়েছে। না, প্রচলিত ধর্মকে ভাঙার অপরাধে তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ করে বা জ্যান্ত বেঁধে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়নি। এটা অবশ্যই ব্যতিক্রম ঘটনা। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, এই নবিই আবার নাস্তিক বা মুরতাদদের হত্যা করার বিধান দিয়ে গেছেন।
(৫) গ্যালিলিও গ্যালিলাই যখন বললেন–সূর্য না, পৃথিবীই সূর্যের চারপাশে ঘুরছে। এই কথা শুনে তৎকালীন খ্রিস্টান পাদরিরা তাঁকে ‘নাস্তিক’ উপাধি দিলেন।
(৬) কাজী নজরুল ইসলাম যখন হিন্দুদের দেবদেবীদের নিয়ে গান-কবিতা লিখেছিলেন, তখনও তাঁকে নাস্তিক বলা হল। কিন্তু বাংলা ভাষায় সব থেকে বেশি ইসলামিক গজল তারই রচনা।
(৭) বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন বোরখা পড়ায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তাই তাঁকেও নাস্তিক বলা হত।
(৮) লালন সর্ব ধর্মের উপাসক ছিলেন বলে তাঁকেও নাস্তিক বলা হত। বাংলাদেশী মৌলবাদী মুসলিমরা তাঁকে ‘নাস্তিকদের গুরু’ বলে থাকে।
মাহিরাহি নামে একজন লেখক একটা লেখায় শুনিয়েছেন। লেখাটির শিরোনাম হল –“পৃথিবীর প্রথম নাস্তিক দেশটি কেমন ছিল?” মনোরঞ্জনের জন্য লেখাটি এখানে উল্লেখ করলাম : “ছোটোকালে শুনতাম ইউরোপের একমাত্র মুসলিম দেশ হল গিয়ে আলবেনিয়া। অথচ এটি ছিল পৃথিবীর প্রথম এবং একমাত্র নাস্তিক দেশ। পৃথিবীর প্রথম নাস্তিক দেশটির আয়ুষ্কাল ছিল ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে আনোয়ার হোজ্জা, আলবেনিয়াকে পৃথিবীর প্রথম নাস্তিক দেশ (এথেইস্ট স্টেট) সরকারিভাবে হিসাবে ঘোষণা দেন। সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সম্পদ দখল করে নেওয়া থেকে ধর্মীয় নেতাদের বিদেশি শক্তিগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিভিন্নভাবে তাঁদেরকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করা হয়। কাউকে পাঠানো হয় জেলে, কাউকে বাধ্য করা হয় কলকারখানায় কাজ করতে। এসব কিছুর পরও ধর্মীয় গোষ্ঠীকে দমনে ব্যর্থ হয়ে হোজ্জার পার্টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নাস্তিকীয় শিক্ষা প্রচারে মনোনিবশন করে। রমজানের মতো পবিত্র দিনগুলোতে তাঁরা হারাম খাদ্য পরিবেশন করা শুরু করে কারখানা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। খাবার গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে তাঁদেরকে লাঞ্ছিত করা হত। ১৯৬৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে আরও আক্রমণাত্মক পন্থা নেওয়া হয় নাস্তিকীয় শিক্ষা প্রচার করার জন্য। যদিও হোজ্জা বলেন যে, তিনি যে-কোনো সন্ত্রাসী পন্থা অবলম্বনের বিরোধী, তিনি চান বুঝিয়ে-শুনিয়ে ধর্মের বিরুদ্ধে যে-কোনো অ্যাকশন গ্রহণের শক্ত ভিত গঠন করা হোক। এক্ষেত্রে তরুণদেরকে বেছে নেওয়া হয়। ২,১৮৯টি মসজিদ এবং চার্চ বন্ধ করে দেওয়া হয়। নাস্তিকবাদ অফিসিয়াল পলিসিতে পরিণত হয়। ধর্মীয় নামের শহর, নগরগুলোকে নতুন নাম দেওয়া হয়, ব্যক্তির নামও বদলে ফেলা হয়। ১৯৮২ মানুষের নামের ডিকশনারি বের করা হয়। যার মধ্যে ৩,০০০ সেকুলার নাম ছিল। এঁরা ক্ষমতায় আসার সময় ৩০০ খ্রিস্ট ছিলেন, যাঁদের মধ্যে মাত্র ৩০ জন প্রাণে বাঁচতে পেরেছিলেন। সমস্ত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত এই নাস্তিক দেশটিতে যাঁরা জন্ম নিয়েছিল তাঁরা ধর্মের ব্যপারে কিছুই জানত না। তাই তাই তাঁরা ছিল হয় নাস্তিক, নয়তো অ্যাগোনস্টিক।”
আনোয়ার হোজ্জাকে চিত্রায়িত করা হয় এমন একজন জিনিয়স হিসাবে যিনি কিনা সংস্কৃতি, অর্থনীতি, সামরিক ইত্যাদি জীবনের প্রতিটি নৈতিক উপদেশ দান করে গেছেন। প্রত্যেকটা স্কুলের বইতে সে যে বিষয়ের উপরই হোক না কেন তাঁর উক্তি উদ্ধৃত করা হত। এক আলবেনিয়ান তাই আক্ষেপ করে বলেছিলেন ফিজিক্সের ক্লাসে মাধ্যাকর্ষ শক্তির সূত্রটির জন্য কৃতিত্বটা পেতেন। হোজ্জা, যা ছিল নিউটনের পাওনা। আলবেনিয়া সিক্রেট পুলিশ এজেন্সি কেজিবির (কেজিবির পুরো নাম রুশ ভাষায় ‘কমিটেট গোসুডরস্তভেনয় বেজোপাসনোস্তি’। অখণ্ড সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা।) মতো সব ধরনের দমনমূলক পন্থা অবলম্বন করত। আলবেনিয়ার প্রতি তিনজন নাগরিকের একজনকে হয়তো লেবার ক্যাম্পে কাটাতে হত কিংবা সম্মুখীন হতে হত আলবেনিয়া সিক্রেট পুলিশ অফিসারদের জেরার টেবিলে। ভিন্ন মতালম্বীদের দমনের জন্য সিস্টেমেটিক সব পন্থা অবলম্বন করা হত। চাকুরিচ্যুত করা, লেবার ক্যাম্পে আটকে রাখা এবং প্রায়শই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া। সরকারি কর্মকর্তাদের সরকারি সফর ছাড়া কাউকে বিদেশ যেতে দেওয়া হত না। পশ্চিমা নাচ নিষিদ্ধ ছিল, শিল্পকর্মকে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছিল সোসালিস্ট রিয়ালিজমের মধ্যে। ১৯৮১ সালে হোজ্জা অনেক পার্টির নেতা এবং সরকারি কর্মকর্তাকে শুলে চড়ান। প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শেহু এই সময় আত্মহত্যা করেন অন্তর্দলীয় কোন্দলের কারণে। এটি ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয় যে, তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। ১৯৮৫ সালে হোজ্জা যখন মারা যান আলবেনিয়া তখন সারা বিশ্বের কাছে একটি নিষিদ্ধ দেশ, যাঁরা বহির্বিশ্বের কাছে থেকে বিচ্ছিন্ন। তাঁর শাসনামলের প্রায় সবটুকু জুড়েই আলবেনিয়া ছিল ইউরোপের সবচাইতে গরিব দেশ। ১৯৯০ সালে হোজ্জার প্রতিষ্ঠিত একদলীয় শাসনের অবসান ঘটে। ১৯৯২ সালে পরাজিত হয় সোসালিস্ট পার্টি। আজ আলবেনিয়া হোজ্জা লিগ্যাসির সামান্য কিছুই অবশিষ্ট আছে। ধর্মীয় স্বাধীনতা জনগণকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আরও মজার ব্যপার আলবেনিয়া এখন ওআইসির সদস্য”। প্রকৃত ঘটনা যাচাই না-করেই এহেন ব্যতিক্রমী ঘটনাকে স্মরণ করে আস্তিক্যবাদীরা তৃপ্তি লাভ করেন।
অতএব আস্তিক্যবাদীরা মনে করেন–যাঁর যাঁর স্থানে অবস্থান করে শাস্ত্রীয় মতানুসারী, পারম্পরিক, জ্যোতিষী, দার্শনিক ও বিজ্ঞানীরা যাঁর যাঁর স্রষ্টাকে অবশ্যই বিশ্বাস করেন তাঁরা সবাই আস্তিক। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় যেহেতু সবাই যাঁর যাঁর স্রষ্টাকে বিশ্বাস ও মান্য করেন সেহেতু পৃথিবীতে ‘নাস্তিক’ বলে কেউ নেই। ফলে পৃথিবীতে নাস্তিক ও নাস্তিক্যবাদ বলে কিছুই নেই। আরও বলা যায়–মানুষ স্থূল দৃষ্টিতে একে অন্যকে নাস্তিক বলে অবুঝের মতো গালাগালি করলেও সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে সারা বিশ্বের কোথাও নাস্তিক বা নাস্তিক্যবাদের অস্তিত্ব বলে কিছুই নেই। কার্যত যাঁর যাঁর মনের মতো করে তাঁর তাঁর স্রষ্টার হাত, পা, চোখ, মুখ, কান, নাক, মন, জ্ঞান, রাগ, বিবেক ও বিচার সৃষ্টি করে তা অন্যকে বিনা বিচারে গ্রহণ করতে বা মেনে নিতে বলবেন তখন কেউ মেনে না নিলেই তাঁকে নাস্তিক বলবেন, এটা কখনই হতে পারে না। একটু ভালোভাবে লক্ষ করলেও দেখা যায় কারও স্রষ্টার হাত, পা, মুখ, বিবেক ও বিচার ইত্যাদি আছে, আবার কারও স্রষ্টার এসব নেই। তাহলে স্রষ্টা নির্মাণ একান্ত শৈল্পিক বিষয়। যাঁর যাঁর দলের রূপকার গুরু ও গোঁসাইরা ডাকার জন্য স্ব স্ব স্রষ্টা নির্মাণ করে তাঁকে মনের মাধুরিতে রূপদান করেছেন। সেটা হোক শাস্ত্রীয় স্রষ্টা বা বিজ্ঞানীদের স্রষ্টা। আস্তিক্যবাদীরা নাস্তিক্যবাদীদের নিয়ে আরও যা ভাবেন, তা হল–এটি রূপক সাহিত্যের বৈক্তিক সদস্য সারণির ‘অবিশ্বাসী পরিবারের অধীন একটি ‘রূপক পরিভাষা’ বিশেষ। তথাকথিত শাস্ত্রাদি-নির্ভর ও অন্ধবিশ্বাস-প্রসূত শাস্ত্রীয় নিরাকার উপাস্য কিংবা প্রতীতি মতবাদে অবিশ্বাসী এবং বস্তুবাদে বিশ্বাসীদেরকে অবিশ্বাসী বা নাস্তিক বলা হয়। সন্দেহ থেকেই অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়। অবিশ্বাসকারীকেই নাস্তিক বলা হয়। কাউকে অধিক বিশ্বাস করাও ভালো নয়, আবার কাউকে অধিক অবিশ্বাস করাও উচিত নয়। যাচাই-বাছাই বা প্রমাণ সাপেক্ষে সব কিছুই বিশ্বাস করা উত্তম।
তবে যে-কোনো বিচারকমণ্ডলীর দ্বারা কোনো বিষয় প্রমাণিত হলে তা বিশ্বাস করায় কোনো অসুবিধা নেই। যদিও বিশ্বাস ও বাস্তবতার মধ্যে অমিল পাওয়া যায়। কোনো ব্যক্তির মনে অবিশ্বাসের পরিমাণ অধিক হলে তাঁকে মাঝে মাঝে চরম ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। অবিশ্বাস থেকেই ঘরের তালা-চাবির আবিষ্কার হয়েছে বলে অনেকেই ধারণা করে থাকেন। আমাদের সমাজে সবসময় প্রায় পাঁচ প্রকার গল্পকাহিনি শুনতে পাওয়া যায়। যেমন –(১) দার্শনিক কাহিনি (২) বৈজ্ঞানিক কাহিনি (৩) রাজনৈতিক কাহিনি (৪) শাস্ত্রীয় কাহিনি ও (৫) পারম্পরিক কাহিনি। এদের মধ্যে কেবল শাস্ত্রীয় ও পারম্পরিক কাহিনির ক্ষেত্রে আমাদের আলোচ্য অবিশ্বাসী বা নাস্তিক পরিভাষাটি প্রযোজ্য। এছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাসী বা নাস্তিক পরিভাষাটি নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা দেখতে পাওয়া যায় না। শাস্ত্রীয় বিধিমালা অনুসারে শাস্ত্রীয় বিষয়বস্তু অস্বীকারকারীরা বিপথগামী এবং এটা অবিশ্বাসের ফলে অবশ্য-অবশ্যই তাঁরা নরকবাসী হবে।
নাস্তিক্যবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিন মনে করেন–“চোর, গুণ্ডা, বদমাশ, ধর্ষক, খুনি, সন্ত্রাসীও নাস্তিক হতে পারে, হয়। তোমাদের আর তাঁদের মধ্যে তবে পার্থক্যটা কী! নাস্তিক হওয়াটা খুব কঠিন কিছু নয়, মাথায় ঘিলু থাকলেই নাস্তিক হওয়া যায়। কিন্তু নাস্তিক হয়ে তুমি সমাজের কী উপকারটা করবে শুনি? তুমি যদি ভালো মানুষ না হও, সততা যদি তোমার আদর্শ না হয়, তুমি যদি নারীর সমানাধিকারে বিশ্বাস না করো, সমকামীদের এবং লিঙ্গান্তরিতদের অধিকারে বিশ্বাস না করো, মানুষের দারিদ্র, দুর্ভোগ ঘোচাতে না চাও, বর্ণবাদ, আধিপত্যবাদ, শ্রেণিবাদ, জাতপাতের প্রতিবাদ না করো, অসাম্য, বৈষম্য, অত্যাচার, নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়াও, তুমি যদি মুক্তচিন্তার পক্ষে, বিজ্ঞানমনস্কতার পক্ষে, সবার জন্য শিক্ষা আর স্বাস্থ্যের পক্ষে কথা না বলো, তুমি যদি আমরা যাঁদের সঙ্গে এই পৃথিবীটা শেয়ার করছি সেই প্রাণীদের প্রতি সহানুভূতিশীল না হও, তবে চোর বদমাশ খুনি সন্ত্রাসীর নাস্তিকতার সঙ্গে তোমার নাস্তিকতার মূলত কোনো পার্থক্য নেই।”
অপরদিকে বাংলাদেশের আর-এক যুক্তিবাদী ও নাস্তিক্যবাদী জুয়েল ইয়াসির বলছেন –“বাংলাদেশের নাস্তিকেরা নামে নাস্তিক। অনেক নাস্তিককে দেখা যায়, শুক্রবারে জুম্মার নামাজ পড়তে, রোজা রাখতে, ইদের নামাজ পড়তে; অন্য ধর্মগুলো বিষয়ে এরকমও হতে পারে। এই বিষয়ে বিশ্লেষণ করা যাক। বাংলাদেশের আস্তিক-ধার্মিকেরা অধিকাংশই ইসলাম ধর্মাবলম্বী। বাংলাদেশের আস্তিক-ধার্মিকেরা অত্যন্ত আবেগপ্রবণ, ধর্মপ্রবণ। তাই মুসলমান পরিবারগুলো ধর্মের প্রতি দুর্বল, অন্ধ। যখন মুসলমান পরিবারগুলোতে সন্তান জন্মানোর সাথে-সাথে আজান দিয়ে, পুরুষদের লিঙ্গের চামড়া কর্তন করে সন্তানের অজান্তে-অনিচ্ছায় ধর্মের ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এছাড়া সন্তানদের মুখে মা-বাবা ডাক শেখানোর পাশাপাশি, ঈশ্বরের ডাকটিও শেখানো হয়। যখন সন্তানদের ৫-৬ বছর বয়স হয়, তখন থেকে তাদেরকে ধর্ম মানানোর জন্য চাপ দেওয়া হয়, ধর্ম না মানলে, তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা হয়। ওই সন্তানেরা যতদিন পর্যন্ত কর্মজগতে না-ঢুকতে পারে, ততদিন পর্যন্ত পরিবার থেকে ধর্ম গিলানোর জন্য চাপ দেওয়া হয়। তাই দেখা যায়, যারা ধর্মীয় বেড়াজাল ভেঙে নাস্তিক হয়, তারা যতদিন পর্যন্ত কর্মজীবনে প্রবেশ না-করে, ততদিন পর্যন্ত অনেককে পরিবারের চাপে নিয়মিতভাবে অনিয়মিতভাবে অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ধর্ম গিলতে হয়। এতে তাদের আদর্শের কোনো ক্ষতি হয় না। বরঞ্চ ঈশ্বরের-ধর্মের দুর্বলতা বাস্তবে প্রমাণ হয়। তাই জোর করে ধর্ম গিলানোর মধ্যে কোনো সার্থকতা-সাফল্যতা নেই। পরে আসি উগ্র নাস্তিক বিষয়ে। আস্তিক-ধার্মিকেরা বলে থাকে, উগ্র নাস্তিক আর নাস্তিক এক না। কিন্তু উগ্র নাস্তিক বলে কিছুই নেই। কারণ উগ্র আস্তিকদের মতো উগ্র নাস্তিকেরা চাপাতি নিয়ে কাউকে হত্যা করতে যায় না, বোমা মারে না, খারাপ কাজ করে না। এগুলো করে আস্তিকেরাই। অনেক নাস্তিকদেরকেও দেখা যায়, আস্তিক-ধার্মিকদের সঙ্গে সমর্থন দিতে, একমত হতে। এরপরে আসি ধর্মবিদ্বেষী বিষয়ে। আস্তিক-ধার্মিকেরা, অনেক নাস্তিকেরাও মনে করে, ধর্মবিদ্বেষ অপরাধ অন্যায়। যারা ধর্মবিদ্বেষী, তাদের শাস্তি হওয়া উচিত। এটি একটু বিশ্লেষণ করা যাক।
মানুষের নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, পছন্দ-অপছন্দ, বিশ্বাস-অবিশ্বাস থাকতে পারে। কোনো কিছু পরে যদি কারোর বিদ্বেষ থাকে, সেটি দোষের কিছু নয়। মানুষের যেমন অমানুষের প্রতি বিদ্বেষ থাকে, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের যেমন জামায়াত-শিবির, রাজাকারের প্রতি বিদ্বেষ থাকে, অনেক মুসলমানের যেমন হিন্দুদের প্রতি বিদ্বেষ থাকে, অনেকের যেমন নেতা-নেত্রী-কর্মীদের উপর বিদ্বেষ । থাকে। কারণ সবার যে সবকিছু ভালো লাগবে, পছন্দ হবে; এমন কোনো কথা নেই। বিদ্বেষের জন্য কারোর শাস্তি চাওয়া মূর্খের কাজ, ব্যক্তি-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। সর্বশেষ আসি, ধর্মবিরোধী বিষয়ে। আস্তিকেরা-ধার্মিকেরাও মনে করে থাকে, নাস্তিক মানেই ধর্মবিরোধী। ধর্মবিরোধীদের শাস্তি চায় অনেকে। যেন ধর্মবিরোধী হওয়া তাদের কাছে অন্যায়। নাস্তিকেরা ধর্ম মানে না, তাই তারা ধর্মবিরোধী হতে পারে। কোনো কিছুর বিরোধী হওয়া অন্যায় নয়। যুক্তিযুক্ত হলে তো কোনো অন্যায়ের প্রশ্ন আসে না। অনেক আস্তিক-ধার্মিক-নাস্তিকেরা প্রায়ই বলে থাকে, নাস্তিক হলে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু ঈশ্বর-ধর্মের সমালোচনা-নিন্দা-ব্যঙ্গ করা দোষের। এই বিষয়েও একটু বিশ্লেষণ করা যাক। নাস্তিকেরা যেহেতু কুপ্রথা, ধর্মীয় কুসংস্কার, ধর্মীয় প্রথাবিরোধী, বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী; সেহেতু তারা যদি ঈশ্বর-ধর্মের ভুল বের করে, সমালোচনা করে; তবে এটি দোষের কিছু নেই। বরঞ্চ এটি সকলের ব্যক্তি-স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা। এটিতে হস্তক্ষেপ করাও অবশ্যই অপরাধ। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে ব্যঙ্গ যেমন করা যায়, তেমন ঈশ্বর-ধর্ম বিষয়েও ব্যঙ্গ করা যায়। ব্যঙ্গ করা কোনো অন্যায় না, কোনো অপরাধ না। ঠিক তেমনভাবে ঈশ্বর-ধর্মের নিন্দা করাও কোনো অপরাধ না। অনেক আস্তিক-ধার্মিক-নাস্তিকেরা বলে থাকে, ঈশ্বর-ধর্মের ভুল ধরার আগে, সমালোচনা করার আগে নাস্তিকদের উচিত নিজের পরিবারকে নাস্তিক বানানো। এটিও হাস্যকর কথা। নাস্তিকদের লক্ষ্য কাউকে নাস্তিক বানানো নয়। কুপ্রথার বিরুদ্ধে কথা বলা, ধর্মান্ধ-মৌলবাদ, বিজ্ঞান প্রচার করাই নাস্তিকদের লক্ষ্য।
বাংলাদেশের অনেক নাস্তিককেও দেখা যায়, মূর্খের মতো অযৌক্তিক কথা সমর্থন করতে। আবার অনেক নাস্তিকেরা কোনো যুক্তি না-দিয়ে, নিজের মন গড়া কথা বলে ঈশ্বর-ধর্ম নিয়ে। তাঁরা ঈশ্বরের প্রতি অবিশ্বাসী হলেও তারা প্রকৃত নাস্তিক নয়, তাদের চিন্তা-চেতনা, মানসিকতা নীচু মানের। তারা যে কোনো দাঙ্গা বাঁধতে পারে। কারণ বাংলাদেশের অধিকাংশ মুসলমানেরা ধর্মান্ধ। তাই তাঁরা যে-কোনো কিছুর ভুল বুঝে, দাঙ্গা তৈরি করতে পারে। এই ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মুসলমানেরা বাংলাদেশের অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্ম স্বাভাবিকভাবে দেখে না। বরঞ্চ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে অহেতুক ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে, তাঁদের ধর্ম-দেব-দেবী নিয়ে ঠাট্টা করে। বাংলাদেশের মুসলমানেরা ভাবে তাঁদেরই একমাত্র আদর্শ-অনুভূতি আছে। অন্যদের কোনো আদর্শ-অনুভূতি নেই। বেধর্মীদেরসহ নাস্তিকদের হত্যা করার চেষ্টা করে। হত্যা করে কখনো শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় না। যার-যার বিশ্বাস অবিশ্বাসকে গুরুত্ব দেওয়া নৈতিক দায়িত্ব। এই পৃথিবী সকলের। এখন না জেনে-বুঝে কথা বলা বেশিরভাগেরই অভ্যাস হয়ে গেছে। এই অভ্যাস যেভাবেই হোক পরিত্যাগ করতে হবে। এটিও সবাইকে মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর সবাই মানুষ না; পৃথিবীতে মানুষ, অমানুষ উভয়ই আছে। সবকিছুর ঊর্ধ্বে মানুষ পরিচয়। মানুষের মানুষ পরিচয়কে সব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে ভাবলেই পৃথিবী সুন্দর হবে। সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই!”
‘A Brief History of Time’-এর লেখক ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং আবারও বলেছেন, ঈশ্বর বলে কিছু নেই। নিজেকে নাস্তিক’ বলেও উল্লেখ করেছেন। হকিং বলেছেন, “যখন আমরা সেভাবে বিজ্ঞান বুঝতাম না, তখন এটা বিশ্বাস করাই স্বাভাবিক ছিল যে, পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন ঈশ্বর। কিন্তু (মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্যের বিষয়ে) বিজ্ঞান এখন জোরদার ব্যাখা দিতে সক্ষম।” হকিং বলেন, “ঈশ্বর থাকলে আমরা তার মনকে পড়ার চেষ্টা করতাম। তার মনকে পড়তে পারা মানে সবকিছু জেনে যাওয়া। আসলে কিন্তু ঈশ্বর বলে কিছু নেই। আর আমি একজন নাস্তিক।” স্প্যানিশ দৈনিক ‘এল মানো’-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন তাত্ত্বিক এই পদার্থবিজ্ঞানী। স্টারমাস ফেস্টিভালে অংশ নিতে হকিং স্পেনের ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে অবস্থান করেছেন। প্রসঙ্গত, ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয় ‘A Brief History of Time’। সেখানে “ঈশ্বরের মন’ নিয়ে কথা বলেন হকিং। ওই বইতে তিনি লেখেন, “ঈশ্বরের মনকে জানা উচিত’ বিজ্ঞানীদের। ঈশ্বর নেই’- এমন কথা কিন্তু হকিং আগেও বলেছেন, কয়েকবার। ২০১১ সালে ‘The Guardian’-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হকিং বলেছিলেন, “ঈশ্বর এক বানোয়াট গল্প। স্বর্গ বা পরলোকে আমি বিশ্বাস করি না।” এরও আগে ২০০৭ সালে বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হকিং বলেছিলেন, “বিজ্ঞানের নিয়মনীতিই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করে বলে আমি বিশ্বাস করি। হতে পারে ঈশ্বরই এ সব নিয়ম বেঁধে দিয়েছেন। কিন্তু নিয়মগুলো ভাঙার জন্য ঈশ্বর কখনও ঝামেলা পাকান না।”
নাস্তিক্যবাদ নিয়ে যখন আলোচনা হচ্ছে তখন কমিউনিস্টদের ধর্মচিন্তার বিষয়ে সামান্য আলোচনা হবে না? আচ্ছা, কমিউনিস্টরা কি ধর্মবিরোধী? নাস্তিক? কার্ল মার্কসের যে বিখ্যাত বাণী গণতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবীরা ব্যবহার করে, তা হল –“Religion is the opium of the masses” অর্থাৎ “ধর্ম হল জনগণের জন্য আফিম”। অতএব কমিউনিস্টরা নাস্তিক,ধর্মে বিশ্বাস করে না। মার্কসের তত্ত্ব হল–“ধর্ম হল নিপীড়িত জীবের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন জগতের হৃদয়, ঠিক যেমন সেটা হল আত্মবিহীন পরিবেশের আত্মা। ধর্ম হল জনগণের জন্য আফিম। মানুষের মায়াময় সুখ হিসাবে ধর্মকে লোপ করাটা হল মানুষের প্রকৃত সুখের দাবি করা। বিদ্যমান হালচাল সম্বন্ধে মোহ পরিত্যাগের দাবিটা হল যে–হালচালে মোহ আবশ্যক, সেটাকে পরিত্যাগের দাবি। তাই ধর্মের সমালোচনা হল ধর্ম যার জ্যোতিমণ্ডল সেই অশ্রু উপত্যকার সমালোচনার সূত্রপাত”।
মার্ক্স বলেছিলেন ধর্ম জনগণের জন্য আফিম। আর আমাদের মার্ক্সবাদীরা বলেন, “না না, মার্ক্স সরাসরি এমন কথা ধর্মের বিরুদ্ধে কোনো কথাই বলেননি। তিনি তো শুধু বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, এই পুঁজিবাদীরা ধর্মকে আফিমের মতো করে ব্যবহার করে; তাঁদের পুঁজিবাদী স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে”। আর সেইজন্যই বোধহয় কমিউনিস্টদের পুজো কমিটি বা বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিতে সেক্রেটারি/সভাপতি/উদ্যোক্তা হিসাবে দেখা পাওয়া যায়। অথবা পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন কমিউনিস্ট পরিবহনমন্ত্রী সুভাষচক্রবর্তীকে তারাপীঠের মন্দিরে বারবার পুজো দিতে দেখা যায়, কমরেড নাম্বুদ্রিপাদকে (ইল্লিকুল্লা মনাক্কেল শংকরণনাম্বুদ্রিপাদ) তাঁর পরিবারকে নিয়ে তিরুপতি মন্দিরে পুজো দিতে দেখা যায়। অতএব কমিউনিস্ট মানেই নাস্তিক্যবাদী নয়। কমিউনিস্ট হলেই নাস্তিক্যবাদী হওয়া যায় না। অপরদিকে নাস্তিক্যবাদী মানেই তিনি কমিউনিস্ট নয়। সাহিত্যিক ফিলিপ অ্যাডামসের মতে, “মার্ক্স ভুল ছিলেন। ধর্ম মানুষের মাদকাসক্তি নয়। মাদক মানুষকে তন্দ্রাচ্ছন্নতা, অসাড়তা আর বোধহীনতা দেয়। কিন্তু প্রায়শই ধর্ম এমন এক ভীতিকর উদ্দীপকের নাম, যা জাগ্রত করে মানুষের পশুত্বকে। শুধু মার্কসবাদীরাই ধর্মের বিরুদ্ধে লড়েনি। ধর্মের বিরুদ্ধে আলোচনা-সমালোচনা করলেই বলা হয় ‘কমিউনিস্ট’ বা ‘মাকু’ বা ‘সেকু’। যেন নাস্তিক মানেই কমিউনিস্ট। ধর্মের সঙ্গে সংগ্রামটা হল বুর্জোয়া বিপ্লবের অবশ্য কর্তব্য। ফ্রান্স এবং জার্মানির উভয় দেশেরই আছে ধর্মের বিরুদ্ধে বুর্জোয়া সংগ্রামের ঐতিহ্য। সেকুলারিজম, নাস্তিক্যবাদ ইত্যাদি ধারণা ও প্রত্যয়ের জন্য কমিউনিস্টরা আসলে চিরায়ত বুর্জোয়ার উদ্ভাবিত জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শনের কাছে বিপুলভাবে ঋণী। বুজোয়া সমাজ, রাষ্ট্র ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে কমিউনিস্ট ভাবাদর্শের ঘোর বিরোধ থাকা সত্ত্বেও মানবসভ্যতার বিকাশে বুর্জোয়াদের যা কিছু ইতিবাচক অবদান কমিউনিস্টরা তা শুধু অকুণ্ঠ স্বীকৃতিই দেয় না, আত্মস্থ করার ভিতর দিয়ে সেগুলোকে আরও বিকশিত করার কর্তব্য বোধ করে।
আধুনিক সচেতন শ্রমিক ঘৃণাভরে ধর্মীয় কুসংস্কারকে প্রত্যাখান করেছে। মৌলবি-পুরোহিত ও বুর্জোয়া ভণ্ডদের জন্য স্বর্গ ছেড়ে দিয়ে তাঁরা নিজেরা এই পৃথিবীতে উন্নততর জীবন জয়ে উদ্যোগী। ধর্মের কুহেলিকার বিরুদ্ধে সংগ্রামে শ্রমিকরা বিজ্ঞানকে টেনে আনছে এবং পৃথিবীতে উন্নত জীবনের জন্য সত্যিকার সংগ্রামে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের প্রত্যয় থেকে তাঁদের মুক্ত করছে। পরলোকে স্বর্গ সৃষ্টি সম্বন্ধে শোষিত শ্রেণির মতৈক্য অপেক্ষা পৃথিবীতে স্বর্গ সৃষ্টির জন্য নির্যাতিত শ্রেণির এই সত্যিকার বৈপ্লবিক সংগ্রামের ঐক্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ কমিউনিস্ট মানেই নাস্তিক্যবাদী নন, নাস্তিক্যবাদী মানেই কমিউনিস্ট নয়। মার্কসবাদ-লেলিনবাদ পাঠ এবং জীবনে প্রয়োগপূর্বক যে-কারোর পক্ষেই কমিউনিস্ট হওয়া সম্ভব, নাস্তিক্যবাদী হওয়া কোনোমতেই সম্ভব হয়। বামপন্থী অথবা ডানপন্থী –যে-কেউ নাস্তিক্যবাদী হতে পারেন, যদি তিনি যুক্তিভিত্তিক জ্ঞানলাভ করতে পারেন। নাস্তিক তিনিই, যিনি পার্থিব কোনো ভালো বা মন্দ কাজের দায় অদৃশ্য কারোর ঘাড়ে চাপিয়ে দেন না।
ধর্ম আর ধর্মবিশ্বাসীদের ব্যাপারে ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের বলেন, “পৃথিবীর প্রথম পুরোহিত বা মোল্লা ব্যক্তিটি হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম ধূর্ত বাটপাড়, যাঁর মোলাকাত হয়েছিল প্রথম বোকা-নির্বোধ ব্যক্তিটির সঙ্গে–বাটপাড় ব্যক্তিটি নির্বোধ ব্যক্তিকে বুঝিয়ে-পড়িয়ে নিজের অনুগত প্রথম ভক্ত বানিয়ে ফেলে। ক্রমে পুরোহিত তথা ধর্মযাজকেরা নতুন নতুন সুযোগ বুঝল –সৃষ্টি হল পুরোহিততন্ত্র বা মোগ্লাতন্ত্র–তাঁরা সহজ-সরল মানুষের অন্ধবিশ্বাসের সুযোগে সাধারণ মানুষ অপেক্ষা উৎকৃষ্টতা ও ডিভাইনিটি দাবি করল। মানুষ তাঁদের দাবি মেনে নিল, সঙ্গে সঙ্গে ধর্মযাজকেরা উৎপাদনশ্রম থেকে রেহাই পেল। পুরুষ মৌমাছি মধুমক্ষিকার মতো তাঁরা সাধারণের কষ্টার্জিত সম্পদ শুয়ে-বসে ভোগ করতে লাগল। মানুষের ধর্ম-বিশ্বাস, দুর্বলতা, বিশ্বাসপ্রবণতা, সরলতা ইত্যাদিকে হাতিয়ার করে নিজেদের স্বার্থের অনুকূলে যুগে যুগে অনাচার, রক্তপাত, ডাইনি শিকার, শোষণ, নিপীড়ন প্রভৃতির মহড়া চালিয়ে আসছে তথাকথিত ডিভাইনিটির দাবিদার ডিভাইন পুরোহিতেরা।”
অষ্টাদশ শতকের জ্ঞানবাদী আন্দোলনের এক তাত্ত্বিক নেতা ব্যারন ডি হোলবাচ The 126679, “We find in all the religions of the earth, ‘a God of armies’, ‘a jealous God’, ‘an avenging God’, ‘a destroying God’, ‘a God who is pleased with Carnage’… .” পণ্ডিত ডেনিস দিদেররা পোপ তৃতীয় ক্লেমেন্ট রাষ্ট্রের প্রবল বাধা অতিক্রম করে ষোলো খণ্ডে পৃথিবীর প্রথম বিশ্বকোষ বা এনসাইক্লোপিডিয়ার সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। দিদেরো মনে করতেন, “ধর্মের প্রতি যে-কোনো ধরনের সহানুভূতি প্রকৃতপক্ষে অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের সঙ্গে আপোষেরই নামান্তর।” জার্মান দার্শনিক ফ্রাহিদ্রিশ ভিলহেম নিটশে বলেন—”যাঁরই ধমনীতে ধর্মতাত্ত্বিকের রক্ত আছে তিনি একেবারে প্রথম থেকেই সবকিছুর প্রতি ভ্রান্ত ও অসৎ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন।… ধর্মতাত্ত্বিক যাকে সত্য বলে মনে করেন তা অবশ্যই মিথ্যা; এটিই সত্যতা নির্ণয়ের একটি মাপকাঠি।”
এলবার্ট হিউবা বলেন–”ধর্মতত্ত্ব হল কিছু লোকের একটি বিষয়ের ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রচেষ্টা, যে বিষয়টি তাঁরা বোঝেন না। সত্য কথা বলা ধর্মতাত্ত্বিকদের উদ্দেশ্য নয়, ধর্মানুসারীদের খুশি করাই তাঁদের উদ্দেশ্য।” ভারতীয় বস্তুবাদী পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে বলেন–“অজ্ঞানতার অপর নাম ঈশ্বর। আমরা আমাদের অজ্ঞানতাকে স্বীকার করতে লজ্জা পাই এবং তার জন্য বেশ ভারী গোছের একটা নামের আড়ালে আত্মগোপন করি। সেই ভারী গোছের আড়ালটির নামই ঈশ্বর। ঈশ্বর বিশ্বাসের আরও একটি কারণ হল বিভিন্ন বিষয়ে মানুষের অপারগতা ও অসহায়ত্ব। .অজ্ঞানতা আর অসহায়ত্ব ছাড়া আর কোনো কারণ যদি ঈশ্বর বিশ্বাসের পিছনে থেকে থাকে তা হল ধনী ও ধূর্ত লোকদের নিজ স্বার্থ রক্ষার প্রয়াস। সমাজে চলতে থাকা সহস্র অন্যায় অবিচারকে বৈধতা দেওয়ার জন্য তাঁরা ঈশ্বরের অজুহাতকে সামনে এনে রেখেছে। …ঈশ্বর বিশ্বাস এবং একটি সহজ সরল ছোটো শিশুর নিজস্ব বিশ্বাস, বস্তুত একই। পার্থক্য শুধু এইটুকুই ছোটো শিশুটির যুক্তি ভাঙার, উদাহরণ ইত্যাদির পরিমাণ খুবই সামান্য, আর বড়দের ওগুলো খানিকটা বিকশিত।” আলবেয়ার কাম তাঁর ‘The Rebel’ গ্রন্থে বলেন–”One must learn to live and to die and in order to be a man, to refuse to be a God.” অর্থাৎ একজনকে বাঁচা এবং মরার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে এবং মানুষের মতো বাঁচতে হলে ঈশ্বরকে অস্বীকার করতেই হবে।
ধর্মীয় অন্ধগোষ্ঠীর হাতে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি দগ্ধ হয়েছিল। তৎকালীন সময়ে এই লাইব্রেরি ছিল পৃথিবীর জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্রস্থল। আর ধর্মীয় অন্ধগোষ্ঠীর হাতে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিই পোড়ানো হয়নি, পোড়ানো হয়েছে। হাজার বছরের জ্ঞানভাণ্ডার। এক কল্পিত ঈশ্বরের স্বেচ্ছাচারিতায় ভূলুণ্ঠিত হয়েছে মানবসভ্যতার তিল তিল গড়ে তোলা অর্জিত জ্ঞান। কিন্তু মানুষ কখনো অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিজেকে ডুবিয়ে রাখেনি। মানবসভ্যতার উন্নয়নের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন মানুষ এই অজ্ঞানতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। ধর্ম নামক অন্ধকার শক্তি প্রতিনিয়ত মানুষকে পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছে। কল্পিত ঈশ্বর এবং চ্যালা-চামুণ্ডারা সবসময় চেষ্টা করছে মানবসভ্যতার ধ্বংসসাধনের জন্য।
আমি যদি নাস্তিক হয়ে থাকি সেই নাস্তিক্যবাদ প্রবল থেকে প্রবলতর হয়েছে প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার প্রতি ধর্মীয় প্রতিন্যাসের চেহারা দেখে। শিশুকাল থেকে পথেঘাটে দেখে আসছি ভিখারি, অর্ধাহারী অনাহারী মানুষ, কুষ্ঠরোগী, চড়া রং চড়ানো বেশ্যা। অনেককেই বলতে শুনেছি এসব নাকি পূর্বজন্মের পাপকর্মের ফল! কে, কার, কখন পূর্বজন্ম প্রত্যক্ষ করেছেন –এ পৃথিবীতে তেমন একজন মানুষ আজ অবধি জন্মেছেন? ইতিহাসে এসব সিদ্ধান্তের কোনো নথি নেই। মহামারি ও দুর্ভিক্ষের ঘটনা যখন জেনেছি, দেশে-দেশে যুদ্ধ ও ধর্মে-ধর্মে খুনোখুনি যখন দেখেছি, যখন পড়েছি নিগ্রোদের উপর শ্বেতকায় মার্কিনীদের অত্যাচারের ইতিহাস, যখন জার্মানিতে ইতিহাস হয়েছে ইহুদি নিধনের মর্মন্তুদ কাহিনি–তখন এই ঘটনাগুলোর সাফাই দিতে আস্তিক্যবাদীরা আমাদের বোঝাতে চেয়েছেন এসব কিছুই পরমকরুণাময়ের ইচ্ছা, তিনি যা কিছু করেন সবই মঙ্গলের জন্য –তাহলে বলব সব অত্যাচার, অবক্ষয়, যন্ত্রণার পিছনে সেই পরমকরুণাময়ই সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে আছেন? তা আমার পক্ষে মানা সম্ভব নয়। যখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট জাপানের লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ শিশুদের হত্যা করে নির্মমভাবে, তখন সেই পরমকরুণাময় কোথায় থাকেন? যখন ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেইন হাজারে হাজারে কুর্দৰ্জাতিদের কুকুর-বেড়ালের মতো হত্যা করে, তখন কোথায় থাকেন সর্বশক্তিমান সেই ঈশ্বর?
লেখক জর্জ ওয়াটসন তাঁর “Sons of the Morning” গ্রন্থে বলেছেন–“ধর্মবিশ্বাসের ফলে মানুষের আত্মশক্তির প্রকাশ ও বিকাশের পথে দুস্তর বাধার সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু অন্ধকার মুছে ফেলে সেই আলোর দিন আসছে নতুন কালের বার্তা নিয়ে যার মূল সুর হবে মানুষই ধর্ম, মানুষের ধর্ম ছাড়া আর কোনো ধর্ম নেই। এবং এই মানুষের ধর্ম হবে জিজ্ঞাসা ও অবিরাম বিজ্ঞানচেতনা”। এ পর্যন্ত ধর্ম অসহায় মানুষদের ধর্মান্ধ তা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেনি। এই কারণেই প্রয়োজন ধর্মান্ধ এই দেশে তথা সারাবিশ্বে ধর্মাশ্রয়ী সংস্কৃতির বিপরীতে নাস্তিকতার সংস্কৃতি। পৃথিবীতে এই মুহূর্তে ১০০ কোটির বেশি মানুষ নাস্তিক অথবা ধর্মহীন। তাঁরা সকলেই বুদ্ধিহীন নয়, তাঁরা অবশ্যই বুদ্ধিমান–জ্ঞানী। মানুষকে ভালোবাসা, মানুষের ভালোর জন্য কাজ করা, সততা-মূল্যবোধ ইত্যাদির মতো মানবিক চেতনাকে তাঁরা স্বাভাবিক নিয়মেই অনুসরণ করেন, কোনো ঈশ্বর, অবতার, গুরু অথবা কোনো অলৌকিক অতিপ্রাকৃত শক্তির ভয়ে নয়। ভয় যে থাকে না তা কিন্তু নয়, ভয় মনুষ্যত্ব হারানোর ভয়। এই ভয়টাই নিরীশ্বরবাদী অথবা তথাকথিত ধর্মহীন মানুষদের সাহস জোগায়। আত্মবিশ্বাসই নিরীশ্বরবাদী অথবা তথাকথিত ধর্মহীন মানুষদের একমাত্র শক্তি।
ইতিহাস আমাদের সাক্ষী দেয় হাজার হাজার কাল ও শতাব্দীর সোপান অতিক্রম করে বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে মানুষের ভয়, কৌতূহল এবং আপন অস্তিত্বকে জানার প্রয়োজনে–ঈশ্বরের প্রয়োজনে নয়। বৌদ্ধধর্ম ছাড়া পৃথিবীর সব ধর্মই তাঁদের অনুসারীদের নিঃশর্ত আনুগত্য এবং অন্ধবিশ্বাস দাবি করে। বৌদ্ধধর্ম তথাকথিত কোনো সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব স্বীকার করে না। স্বীকার করে না কোনো অবতার বা নবিতে। বুদ্ধ তাঁর অনুসারীদের বলেছেন, কারও কোনো কথা বিশ্বাস কোরো না, যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করে তা গ্রহণ করো, এমনকি আমি বললেও বিশ্বাস কোরো না। সেই ২৫০০ বছর আগে একজন মানুষের পক্ষে একথা বলা যে কী মহাবিপ্লবের কাণ্ড তা আজকে ঠিক উপলব্ধি করা যাবে না।
কোনো সৃষ্টিকর্তা বা দেব-দেবতারা নিজে বা নিজেরা স্বয়ং এসে তাঁদের অস্তিত্ব জানান দিয়ে কোনো ধর্মশিক্ষা দিয়ে যায়নি মানুষকে। মানুষই বরং তাঁদের চিন্তা-ভাবনা দ্বারা তাঁদেরকে কল্পনা করে ধর্ম ও ধর্মীয় কাহিনি আকার দিয়ে প্রচলন করেছে। ঈশ্বরবাদী ধর্মের আগমন ঘটে শাসক-মানুষের কল্পনাশক্তির বিকাশের পর। আদিযুগে মানুষের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে যত্রতত্র কিছু কিছু মানুষ সমীহ আদায় করে নেওয়ার জন্য নিজেকে ‘অবতার’ বলে জাহির করত। তিনি যে সত্যিই অবতার এবং তিনি ঈশ্বরপ্রেরিত তা জাহির করতে নানারকম ভেলকি-মায়াজাল-ইন্দ্রজাল-অলৌকিক কাণ্ডকারখানা করতেন। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও মানুষ ভেলকি-মায়াজাল-ইন্দ্রজাল-অলৌকিক কাণ্ডকারখানা দেখে যেভাবে বিস্ময়ে হা হয়ে থাকেন, হাজার হাজার আগে মানুষের হা তো আরও বিস্ময়াভূত ছিল, তাই না? লকলকে আগুন খাওয়াটা এখন অনেকেই জেনে গেছেন কীভাবে সম্ভব, কিন্তু প্রাচীনযুগে মানুষ জানতেন আগুন খাওয়াটা কোনো মানুষের কম্মো নয়–দেবতা বা দেবতাপ্রেরিত অবতারেরই কম্মো। এইভাবে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন দেবতা বা অবতারকে কেন্দ্র করে গোষ্ঠী বা লবি বা বিভিন্ন শাখাপ্রশাখা তৈরি হত। এই গোষ্ঠী বা লবির ধারণা বা বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়তই সংঘটিত হত যুদ্ধ-বিগ্রহ-হত্যা-হানাহানি। প্রাচীন ভারতে কিছু চতুর মানুষ নিজেকে সৃষ্টিকর্তার অবতার বলে দাবি করত। ভারতীয় হিন্দু (সনাতনধর্ম) অবতারের আবির্ভাব এখনও চলছে। প্রতি বছর কেউ-না-কেউ নিজেকে অবতার বলে দাবি করে বসে। এদেরই কোনো কোনো অবতারেরা নানা কেচ্ছা-কেলেঙ্কারীতে হাবুডুবু খেয়ে শ্রীঘরে আশ্রয় পেয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি ৭৫ বর্ষীয় বৃদ্ধ আশারাম বলে একজন অবতার নারীঘটিত কেচ্ছায় জড়িয়ে এখন শ্রীঘরে। তাঁর ১০কোটি শিষ্য, এই ১০ কোটি শিষ্য কি এরপর আশারামের শিষ্যত্ব ত্যাগ করেছেন? করেননি। উলটে শিষ্যদের কেউ কেউ আশারামকে রক্ষা করতে নগ্নভাবে মাঠে নেমে পড়েছেন।
ধর্ম যুক্তিবিজ্ঞান বা সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টি দিয়ে চলে না। ধর্মবিশ্বাসীরা কোনো যুক্তি মানেন না, যুক্তি মানা পছন্দ করেন না–যুক্তির কথায় ভয়ংকর ক্ষেপে যান। ভাবুন তো, ধর্ম এবং ঈশ্বরের যদি সকল জীবের স্রষ্টা হন তাহলে এত মতান্তর কেন? এত ভিন্নতা কেন? ঈশ্বর বা ধর্ম যদি এতই সর্বশক্তিমান হন তবে এক পৃথিবীতে এক ধর্মের এক ঈশ্বর সৃষ্টি করতে পারলেন না কেন? ধর্মে-ধর্মে এত হানাহানি কেন? ঈশ্বরে-ঈশ্বরে এত ভেদ-ভাও-বিভেদ কেন? আচার-বিচারে এত বৈসাদৃশ্য কেন? সে প্রশ্ন করেননি কেন আস্তিকবন্ধুরা? প্রশ্ন করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না আপনারা?
ইসলাম ধর্ম এক বাক্যেই সব ধর্মকেই নাকচ করে দেয়। কোরানে বলছে : “নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে একমাত্র মনোনীত ধর্ম ইসলাম (৩ : ১৯)”। অর্থাৎ বাকি সব ধর্ম ঈশ্বরের অমনোনীত ধর্ম বা সেগুলি কোনো ধর্মই নয়। ইসলাম মতে, মুসলমানরা মৃত্যুর পর বা পাপমোচনের পরে চিরদিনের জন্য বেহেস্তে যাবে এবং অবিশ্বাসীরা চিরদিনের জন্য দোজখে যাবে (২ : ৩৯)। অর্থাৎ মুসলিম ছাড়া বাকি সব অন্য ধর্মে অনুসারীদের সকলেরই মৃত্যুর পর ঠিকানা হবে দোজখ বা নরকে। অপরদিকে হিন্দু তথা সনাতনধর্মীরা দাবি করেন তাঁদের ধর্ম চিরায়ত ধর্ম। সেই আদিমকাল থেকে তাঁদের ধর্ম চলে আসছে, তাই তাঁদের ধর্ম খাঁটি এবং সর্বোত্তম। যদিও অন্য কোনো ধর্মাবলম্বীর এই ধর্মে স্বাভাবিক প্রবেশাধিকার নেই। তাই হিন্দুধর্মে উল্লেখ আছে, “স্বধর্মে নিধনং শ্রেয় পরধর্ম ভয়াবহোঃ”–অর্থাৎ, নিজের ধর্মে বিশ্বাসী থেকে মৃত্যুবরণ করলে পুরস্কার প্রাপ্তি, ভিন্ন ধর্মগ্রহণ করলে ভয়ংকর শাস্তি। বিধর্মীদের আছে রৌরব নামে নির্দিষ্ট নরক। অতএব অহিন্দু মাত্রই যবন, ম্লেচ্ছ ইত্যাদি। তা সত্ত্বেও সবচেয়ে বেশি ধর্মান্তরিত হয়েছে এই হিন্দুধর্ম থেকেই। হিন্দুধর্মের একটা বড়ো অংশই স্বধর্ম ত্যাগ করে হয় ইসলামধর্ম, হয় খ্রিস্টানধর্ম, নয়তো বৌদ্ধধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছেন। ইহুদিরা প্রচণ্ড ধর্মীয় জাতীয়বাদে বিশ্বাসী। তাঁরা নিজেদের ঈশ্বরের একমাত্র মনোনীত জাতি বলে মনে করেন, বাকি সবাই এ পৃথিবীতে অবাঞ্ছিত। খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে, সকল মানুষ আদি পাপের বোঝা নিয়ে এই ধরাধামে জন্মান। সকল মানুষই অনন্তকালের নরকভোগের উপযুক্ত, শুধু খাঁটি খ্রিস্টানরাই ব্যতিক্রম থাকবেন। আবার বৌদ্ধধর্মের মূলধারাটি নিরীশ্বরবাদী হওয়ায় অনেকে একে ধৰ্মই মনে করেন না–বৌদ্ধগণ মনে করেন, এটি একটি দর্শন।
ধর্মগুলোর মধ্যে একটি বড় সাদৃশ্য হল–সকল ধর্মই দাবি করে সেই-ই অভ্রান্ত, সত্য এবং সর্বোৎকৃষ্ট। স্বধর্ম ছাড়া বাকি সব ধর্ম মিথ্যা, ভ্রান্ত এবং খুবই নিকৃষ্ট। সব ধর্মই স্বধর্মাবলম্বীদের জন্য বরাদ্দ রেখেছেন অনন্ত স্বর্গ, অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য শুধুই নরক। এ কেমন কথা! সত্য তো এক এবং অখণ্ডই হবে–একই সময়ে একই সঙ্গে পরস্পরবিপরীত দুটি কথা সত্য হতে পারে না। অতএব “সকল ধর্মই মানবতার কথা বলে”–এরকম যাঁরা বলেন তাঁরা হয় মানবতা বোঝেন না, নয়তো ধর্ম বোঝেন না। ভুলে গেলে চলবে না, ধর্মগুলো সবটাই বিশ্বাস-নির্ভর। বিশ্বাস মানুষের একান্ত মনের ব্যাপার। অথচ ধর্মগুলো বিশ্বাস মানুষের উপর চাপিয়ে দিতে চায়। কিছু কিছু ধর্মবিশ্বাসীরা ধর্মশাস্ত্রের দাঁতভাঙা হিজিবিজি কথার মধ্যে গভীর তত্ত্বের খোঁজ পান। আবার কেউ কেউ দাবি করেন তাঁদের ধর্মগ্রন্থ সকল বিজ্ঞানের উৎস। কিন্তু কোনো কিছু আবিষ্কারের পরপরই তাঁরা তা ধর্মশাস্ত্রে খোঁজাখুঁজি শুরু করেন এবং অল্পকাল পরে তা পেয়েও যান এবং তারও কিছু পরে ধর্মশাস্ত্রের কিছু কথার ব্যাখ্যা এমনভাবে দিতে থাকেন যাতে মনে হয় এর আবিষ্কারক ওই ধর্মশাস্ত্রটিই। হাঃ হাঃ হাঃ। কিন্তু আবিষ্কার হওয়ার আগে কেন ওই বিষয়টি ওই ধর্মশাস্ত্রে পাওয়া যায়নি? বস্তুত যে-কোনো ধর্মবিশ্বাসীদের সিংহভাগই তাঁদের ধর্মগ্রন্থের মূল ভাষা জানেন না, অনুবাদের আশ্রয় নিতে হয়। মজার কথা হল, ধর্মবিশ্বাসীরা বুঝে অথবা না-বুঝে তাঁদের নিজ নিজ ভাষায় যতই ধর্মশাস্ত্র চর্চা করে থাকেন, ইচ্ছেমতো ব্যাখ্যা-অপব্যাখ্যা দিয়ে পক্ষ অবলম্বন করেন তাতে কোনো সমস্যা হয় না, কিন্তু যখনই কেউ ধর্মশাস্ত্র নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেন বা সন্দেহ প্রকাশ করেন ঠিক তখনই ধর্মবাদীরা “শাস্ত্র পাঠ করে ঠিকমতো বোঝা হয়নি” ওজর তোলেন।
অন্যের ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত করা খুবই অন্যায়। জ্ঞানত অথবা অজ্ঞানতা যেভাবেই হোক আঘাত করলেই ঘাড় থেকে মুণ্ডু নামিয়ে দেওয়া হবে। দেশের আইনও এই কারণে আঘাতকারীকে শাস্তি-টাস্তি দিয়ে থাকেন। “ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত”টি দেখতে কেমন? পাশের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম নাগরিকরা ইদের সময় গণহারে যে গোরু কোরবানি দেওয়া হয়, তা হিন্দুদের কাছে গোমাতা। এতে কি হিন্দুদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে না! ও-দেশে হিন্দুসমাজের কেউ এ ব্যাপারে মামলা করেছে বলে কোনোদিন শুনিনি। অপরদিকে এই ভারতের অনেক রাজ্যে গোরু জবাই নিষিদ্ধ। সেই রাজ্যের মুসলিমদের কি ধর্মানুভূতিতে আঘাত করা হয় না? মুসলিমরা কোনোদিন ওজর-আপত্তি তুলেছেন বলে তো শুনিনি। তাহলে ধর্মীয় আঘাত কি শুধুমাত্র একটা বিমূর্ত আবেগ। ছোঁয়া যায় না, কিন্তু কেমন যেন একটা শিরশিরানি হয়! সবটাই নির্ভর করে সংখ্যার উপর। কোন্ ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ তার উপর নির্ভর করে। বাংলাদেশে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, হিন্দুরা মিয়মান সংখ্যালঘু। তাই ওদেশে মুসলিমদের ধর্মানুভূতি বেশি। তাই দিনরাত সংখ্যালঘুদের হুমকি দিয়ে চলেছে ধর্মানুভূতিতে। হিন্দুরা মুখ বুজে সহ্য করে টিকে আছে। ভারতে হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, মুসলিমরা ক্রমবর্ধমান সংখ্যালঘু। তাই এদেশে সংখ্যাগুরুরা দিনরাত সংখ্যালঘুদের হুমকি দিয়ে চলেছে ধর্মানুভূতিতে। ধর্মানুভূতি কোথায় কারা তীব্র আকার ধারণ করবে, কোথায় কারা ‘বিড়াল তপস্বী’ হয়ে থাকবে, তা নির্ভর করে সংখ্যার উপরে।
মানবসমাজের শুরুতে তো ঈশ্বর ধারণা ছিল না, তারপর কেউ একজন প্রথমে ঈশ্বরের ধারণা নিয়ে আসে। এ ক্ষেত্রে burden of proof পড়ে ঈশ্বরের প্রবক্তার উপর। আইনের ভাষায় “the necessity of proof always lies with the person who lays charges.” সুতরাং, ঈশ্বর যে আছেন তা প্রমাণ করা আস্তিকদের দায়িত্ব, নাস্তিকদের ঈশ্বর নেই এটা প্রমাণ করার দরকার নেই। “না”-এর কোনো প্রমাণ হয় না, “হ্যাঁ” বললে প্রমাণ করতে হবে, হবেই। আপনার ঘরে সিন্দুকের ভিতর ময়ূর সিংহাসনটি আছে বললে ময়ূর সিংহাসনটি হাজির করে প্রমাণ করতে হবে যে ময়ূর সিংহাসনটি সিন্দুকের ভিতর আছে। কিন্তু কেউ যদি বলে সিন্দুকটির ভিতর কোনো ময়ূর সিংহাসন নেই, তাহলে “নেই” প্রমাণ হয় খালি সিন্দুক দেখিয়েই।
ঈশ্বর কেমন? এই প্রশ্নের উত্তর পৃথিবীতে যদি ৫ বিলিয়ন আস্তিক থাকে, তবে দেখা যাবে ঈশ্বরের ৫ বিলিয়ন সংজ্ঞা বাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে। আস্তিকগণ হাজার হাজারবছর পার করে দিলেও আজ পর্যন্ত ঈশ্বরের ব্যাখ্যায় একমতে আসতে পারল না। ঈশ্বর কী? ঈশ্বর কেমন?–কোনো প্রশ্নেরই যথাযথ উত্তর দিতে পারেন না। প্রশ্ন করলেই পালটা প্রশ্ন করে পৃথিবীতে দিনরাত হয় কে করেন? এক ফোঁটা বীর্য থেকে কীভাবে কে সন্তান সৃষ্টি করেন? সমুদ্রে জোয়ারভাটার পিছনে কার হাত? ইত্যাদি অবান্তর প্রশ্ন। এসব হেঁদো প্রশ্নের জবাব যুক্তিবাদী প্রবীর ঘোষ তাঁর “আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না” গ্রন্থে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আগ্রহীরা পড়ে দেখতে পারেন, পড়ে জেনে নিতে পারে, জেনে জ্ঞানী হতে পারেন।
ধর্ম হল সেই উন্মাদনা, যাকে যেন-তেন-প্রকারেণ উপস্থাপিত করতেই হয় যে সেই-ই শ্রেষ্ঠ, সেই-ই শেষ কথা। তাই বিভিন্ন মানুষের যদি ভিন্ন ভিন্ন ধর্মানুভূতি থেকে থাকে, ধর্মের ক্রিয়াকলাপ, আচার-ব্যবহার যদি আলাদা হয়ে থাকে, ধর্মের বাণী সম্পর্কে মতামত ভিন্ন হয়ে থাকে, তাহলে তাকে যেভাবেই হোক এক পথে নিয়ে আসতে হবে, এক মতে নিয়ে আসতে হবে–যে-কোনো মূল্যে। অবশ্য ধার্মিক লোকজনের কাছে সাধারণভাবে নিজের ধর্ম ছাড়া আর কোনো কিছুরই কোনো মূল্য নেই। নেই মানুষের মূল্য, নেই সভ্যতার মূল্য, নেই জীবনের মূল্য। আছে শুধু এক সর্বগ্রাসী এবং রক্তক্ষয়ী উন্মাদনা। চোখ-কান খোলা রাখলেই পরিষ্কার প্রত্যক্ষ করতে পারবেন–এই উন্মাদনার উৎপত্তি বেশ সুপরিকল্পিত। কারণ উন্মাদনা থিতিয়ে পড়লেই মানুষ তখন চিন্তা করতে চায়, আর চিন্তা করলেই তো ধর্মের অসারত্ব ধরা পড়ে যাবে। তাই যুগে যুগে ধর্মীয় নেতারা এই উন্মাদনাকে জিইয়ে রাখার আয়োজন করে এসেছে। ভবিষ্যতেও এর পুনরাবৃত্তি ঘটবে।
যুক্তিবাদী কৌশিক তাঁর “ধর্ম, একটি সামাজিক ব্যাধি” প্রবন্ধে এই উন্মাদনা বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে লিখেছেন, “সেটা কী ধরনের উন্মাদনা? সবচেয়ে বিষাক্ত, ক্ষতিকারক এবং ছোঁয়াচে ধরনের। যে উন্মাদনা কোনো যুক্তি মানে না, সাধারণ বুদ্ধি মানে না; যে উন্মাদনা নির্ভরশীল একটি অদৃশ্য, অলীক, অনুপস্থিত, কল্পনাপ্রসূত ব্যক্তি বা বস্তুবিশেষ বা এনটিটি-র উপরে; যে উন্মাদনার দৃঢ় ধারণা যে, সেই এনটিটি মানুষের কথা চিন্তা করে সমস্ত সৃষ্টির ইতিকথা লিখে গেছে কয়েকশ পাতার ধর্মপুস্তকের মধ্যে–এবং সেই অযাচিত ঐশী বাক্যসমূহ অক্ষরে অক্ষরে সত্য; যদিও তাদের উৎস বা প্রোভেনেন্স পরীক্ষা করতে গেলে অনেক রকম গণ্ডগোল ধরা পড়ে; যদিও অনেক সময়ই প্রত্যেকের নিজস্ব ধর্মপুস্তকটি অনুবাদের সংস্করণ অনুযায়ী বিভিন্ন রকম কথা বলে থাকে। এ হল সেই উন্মাদনা, যার বশবর্তী হয়ে একদল মানুষ নিশ্চিন্তে, নিশ্রুপে তাঁদের জীবনের সম্পূর্ণ দখল বা কন্ট্রোল তুলে দেয় এক বা একাধিক অন্য মানুষের হাতে, যাঁরা নিজেদের ধর্মগুরু বা আধ্যাত্মিক নেতা হিসাবে আখ্যা দিয়ে থাকে এবং সেইসব ধর্মীয় নেতার অঙ্গুলিহেলনে বা মুখের একটা কথায় তাঁরা মানবত্বকে শিকেয় তুলে যুক্তি-বুদ্ধি জলাঞ্জলি দিয়ে নেমে পড়ে ঘৃণ্য, জঘন্য, হীন, পাশবিক আচরণ করতে। আর সেইসব আচরণে যোগদান করাটা খুবই সহজ, কারণ ধর্মের ছায়া থাকতে কাউকে তো নিজের কোনো কাজের দায়িত্ব বা রেসপন্সিবিলিটি বহন করতে হয় না। ওই যে, আইনে একটা সুন্দর অজুহাত আছে–স্বল্প সাময়িক উন্মত্ততা, টেম্পোরারি ইনস্যানিটি; ধর্মের ক্ষেত্রে খুবই উপযোগী”।
ইতিহাস ঘেঁটে আস্তিকদের কতটুকু অবদান উদ্ধার করা যায় দেখা যাক। প্লেটোর প্রায় সমকালে ভেসেক্রিটাস ও এপিকুরাস, নাস্তিক্যবাদের সমর্থনে যুক্তিবিন্যাস করেছিলেন। খ্রিস্ট্রজন্মের ৫০০ বছর আগে পিথাগোরাস, এনাকু সিমেন্ডের মতো মনস্বীরা জানিয়েছিলেন, পৃথিবী সূর্যের একটি গ্রহ। সূর্যকে ঘিরে পৃথিবী ও অন্য গ্রহগুলি ঘুরছে। এই অপরাধে তাঁদের ভোগ করতে হয়েছিল অশেষ অত্যাচার, নির্যাতন। কারা করেছিল এই অত্যাচার? মৌলবাদী আস্তিকরা। এরপর তাঁদের মতকে ২০০০ বছর পরে গ্রন্থাগারে তুলে ধরলেন পোল্যান্ডের নিকোলাস কোপারনিকাস। তাঁরই উত্তরসূরি ইতালির জিয়োর্দানো ব্রুনো এবং গ্যালিলিও গ্যালিলি। ব্রুনোকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয় এবং গ্যালিলিওকে জীবনের শেষ আটটি বছর বন্দিশালায় কাটাতে হয়েছিল। কারা করেছিল এইসব কাণ্ড? মৌলবাদী আস্তিকরা। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস হেমলক বিষপান করিয়ে আত্মহত্যা করানো হয়েছিল। কারা করেছিল এইসব কাণ্ড? মৌলবাদী আস্তিকরা। আস্তিক মৌলবাদীরা কি ফিরিয়ে দিতে পারবেন। এইসব মহামানবদের জীবন? এখন বলুন আপনারা সক্রেটিস, ব্রুনো, গ্যালিলিওরা কি ভুল ছিল?
খ্রিস্টজন্মের প্রায় ৪০০ বছর আগে অ্যানাকসাগোরাস বলেছিলাম–চন্দ্রের নিজের কোনো আলো নেই। চন্দ্রগ্রহণের কারণও তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন। এহেন ‘অপরাধ’-এর জন্য তাঁকে দেশ থেকে বিতারিত করা হয়েছিল। যোড়শ শতকে সুইজারল্যান্ডে রসায়নবিদ্যার অধ্যাপক প্যারাসেলসাস ঘোষণা করেন মানুষের অসুস্থতার কারণ কোনো পাপের ফল বা অশুভ শক্তি নয়, রোগের জীবাণু। একথা শুনে ধর্মধ্বজীরা আস্তিকরা ক্ষুব্ধ হন এবং তাঁর প্রাণদণ্ড ঘোষণা করেন। তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে কোনোমতে প্রাণ রক্ষা করেন। সেদিন কি প্যারাসেলসাস ভুল তত্ত্ব ঘোষণা করেছিলেন?
এ তো গেল প্রাচীন যুগের কথা। এবার আসি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি-নির্ভর আধুনিক যুগের তথাকথিত শিক্ষিত ও সভ্য আস্তিকদের কথা। কিস্যু বদলায়নি। আজও বর্বর যুগ বহমান রেখেছেন তাঁরা। ধর্মকে সমালোচনা, ধর্মকে প্রশ্ন করা ও ধর্মে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলিকে ধরা মৌলবাদী আস্তিকরা আজও পছন্দ করেন না। সে পছন্দ না-ই করতে পারেন। তাই বলে বর্বরোচিত আচরণ। অপছন্দের মানুষদের সঙ্গে! বাংলাদেশের প্রখ্যাত লেখিকা ও চিকিৎসক তসলিমা নাসরিনকে ধর্মের বিরুদ্ধে কলম ধরার অপরাধে উগ্র আস্তিক্যবাদীরা তাঁর মুণ্ডচ্ছেদের ফতোয়া জারি করে দিল ১৯৯৪ সালে। তসলিমা দেশ ত্যাগ পালিয়ে বেঁচেছেন। আজ দীর্ঘ ২৭ বছর তিনি নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। ১৯৮৮ সালে “The Satanic Verses গ্রন্থটি লেখার অপরাধে লেখক সলমন রুশদির বিরুদ্ধে মৃত্যদণ্ডের ফতোয়া জারি করেন ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লা খোমেইনি। অভিযোগ ছিল ‘The Satanic Verses’ গ্রন্থটি আস্তিক মুসলিমদের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করছিল। বাংলাদেশের যুক্তিবাদী, নাস্তিক্যবাদী ও মুক্তমনা লেখক রাজীব হায়দার ওরফে থাবা বাবাকে হত্যা করেছিল উগ্র আস্তিক্যবাদীরা। অভিযোগ, তিনি তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে আস্তিক মুসলিমদের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করছিল। বাংলাদেশের যুক্তিবাদী মনোজ্ঞ লেখক ও ‘মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়কে ২০১৫ সালে হত্যা করে উগ্র আস্তিক্যবাদীরা। ২৬ জানুয়ারি রাত ৮ টা ৩০ মিনিট নাগাদ বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্টোদিকের সোহরাওয়ার্দি উদ্যান সংলগ্ন সড়কে আস্তিক্যবাদী আততায়ীদের চাপাতির এলোপাথাড়ি কোপে অভিজিৎ শরীর থেকে মুণ্ড বিচ্ছেদ করা হয়। সঙ্গী তাঁর স্ত্রী বন্যাকেও এলোপাথাড়ি কোপানো হয়। বন্যা মারাত্মভাবে জখম হন। ভারতে প্রখ্যাত কবি শ্রীজাতকে খুনের হুমকি ও অভিনেত্রী সায়নী ঘোষকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয় ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করার অভিযোগে। হুমকিদাতারা অবশ্যই উগ্র আস্তিক্যবাদী। সত্য প্রকাশ ও ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করার অভিযোগে এম এম কালবুর্গি, নরেন্দ্র দাভোলকর, গোবিন্দ পানসার, গৌরী লঙ্কেশ, রামচন্দ্র ছত্রপতিকে খুন হতে হয় উগ্র আস্তিক্যবাদীদের হাতে।
রামচন্দ্র ছত্রপতি সাংবাদিক ও সমাজকর্মী। তিনি ধর্ষক বাবা গুরমিত রাম রহিম সিংয়ের ঘটনা প্রথম সামনে আনেন তাঁর পত্রিকা ‘পুরা সচ’-এ। সেখানে দুই সাধ্বীর গোপন জবানবন্দি ছাপেন তিনি। যার ভিত্তিতে পরে সাজা পেয়েছে ধর্ষক রাম রহিম। তবে সেই ঘটনার এক মাসের মধ্যেই ২০০২ সালের ২১ নভেম্বর উগ্র আস্তিক্যবাদীদের গুলিতে খুন হন তিনি। নরেন্দ্র দাভোলকর পেশায় চিকিৎসক হলেও দুনিয়া তাঁকে চেনে বিশিষ্ট সমাজকর্মী হিসাবে। মহারাষ্ট্রের এই মানুষটি কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও ভৌতিক জাদুর বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে ২০১৩ সালের ২০ আগস্ট খুন হন উগ্র আস্তিক্যবাদীদের হাতে। পরের বছর সমাজসেবায় অনবদ্য অবদানের জন্য তাঁকে মরণোত্তর ‘পদ্মশ্রী সম্মান দেওয়া হয়। দাভোলকরের মৃত্যুর কয়েকদিনের মধ্যে কুসংস্কার ও কালাজাদু সম্পর্কিত অর্ডিন্যান্স পাস করে মহারাষ্ট্র সরকার। ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে নিহত হন সাহিত্য আকাঁদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত সমাজকর্মী এম এম কালবুর্গি। হাম্পি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য কালবুর্গি লিঙ্গায়েত সম্প্রদায়ের মানুষ। মূর্তিপুজো ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন। কর্ণাটকের ধারওয়াড়ে তাঁর বাড়িতে ঢুকে তাঁকে খুন করে উগ্র আস্তিক্যবাদীরা। বামপন্থী নেতা গোবিন্দ পানসারে ২০১৫ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি নিহত হন। তাঁদের বাড়িতে ঢুকে তাঁকে ও তাঁর স্ত্রীকে আক্রমণ করে উগ্র আস্তিক্যবাদীরা। ৫টি গুলি লেগেছিল গোবিন্দ পানসারের শরীরে। তিনি হাসপাতালে মারা যান। পানসার উগ্র হিন্দুত্ববাদের বিরোধিতায় সরব ছিলেন। নাথুরাম গডসের সমালোচনা করেছিলেন। কোলাপুরে টোল ট্যাক্সেরও বিরোধিতায় আন্দোলন শুরু করেছিলেন। এম এম কালবুর্গি, নরেন্দ্র দাভোলকর এবং গোবিন্দ পানসারেকে গুলি করে খুন করেছিল উগ্র আস্তিক্যবাদীরা। তিনজনের খুনের কিনারা হয়নি এখনও। একই অস্ত্রে খুন হলেন নির্ভীক সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ। মঙ্গলবার রাতে বাড়ির সামনে উগ্র আস্তিক্যবাদীরা তাঁকে গুলি করে খুন করেছে। ২০১৩ সালের আগস্ট থেকে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর। ৪ বছরের মধ্যে নির্ভীক চার জন মানুষ খুন হয়েছেন। ঘটনাস্থল আলাদা হলেও তাঁদের খুন করার ধরন একইরকম। সকলকেই গুলি করে খুন করা হয়েছে। উগ্র আস্তিক্যবাদীরা এসেছিল মোটরবাইকে চড়ে। ৪টি খুনের ঘটনার সাদৃশ্য ধরা পড়েছে কর্নাটকের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রামলিঙ্গ রেড্ডি এবং ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহর চোখে। ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে এম এম কালবুর্গিকে হত্যার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল ৭.৬৫ এম এম পিস্তল। একই আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে দাড়োলকর ও পানসারকেও খুন করা হয়। এইসব উগ্র আস্তিক্যবাদীদের ধর্ম-পরিচয় কী? কী যায় আসে এঁদের। ধর্ম-পরিচয়ে? এঁরা কেউ হিন্দু কেউ মুসলিম বটে, ধর্ম-পরিচয়ে। আসলে উগ্র আস্তিক্যবাদীরা ধর্ম-নির্বিশেষে একই মুদ্রার এপিঠ আর ও-পিঠ। মৌলবাদীর শিকড় এক জায়গাতেই মিশে আছে। এঁরা কেউ পৃথক নয়। এঁরা একে অপরকে কখনোই হত্যা করে না। এঁরা উভয়েই হত্যা করে যুক্তিবাদী নাস্তিকদের। এই একটি ভাবনায় উভয় গোষ্ঠী গলায় গলায় গলাগলি আর কোলাকুলি।
শুধু প্রতিবাদ নয়, এইসব আততায়ীদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে ধর্ম-নির্বিশেষে। ফিরিয়ে দিতে হবে প্রত্যাঘাত। গড়ে তুলতে হবে প্রতিরোধ আত্মরক্ষার অধিকারে। মৌলবাদে কোনো দেশ নেই, ধর্ম নেই, জাতি নেই। ওরা দুর্বল ভাবে, নিরস্ত্রের সুযোগ নিয়ে সশস্ত্র হামলাতে করে। আত্মরক্ষার সবরকমের প্রস্তুতি নিয়ে থাকুন। এইভাবে উগ্র আস্তিকদের বিরুদ্ধে নাস্তিকদের লড়াই জারি রাখতে হবে। উগ্র আস্তিকদের কাছে আমার একটাই বিনম্র আবেদন, নাস্তিকদের হত্যা করে নাস্তিক্যবাদকে হত্যা করতে পারবেন না নাস্তিক্যবাদ ছিল, আছে এবং থাকবে। পৃথিবীতে ১০০ কোটির বেশি নাস্তিককে হত্যা করতে করতে আপনারা হাঁফিয়ে উঠবেন, তবুও নাস্তিক্যবাদ থাকবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় “দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি/সত্য বলে, আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি?”
আস্তিক্যবাদীরা নিজেদের মত ও পথকে বিশ্বাসের প্রাধান্য দিয়ে রক্তপাতে পর্যন্ত দ্বিধাবোধ করেন। আস্তিকবন্ধুগণ রাগ করবেন না। ইতিহাস তো আমি সৃষ্টি করিনি। সেই ইতিহাসের সালতামামি যুক্তিবাদী অভিজিৎ রায়ের কলমে—
(১) প্রথম ক্রুসেড সংঘটিত হয়েছিল ১০৯৫ সালে। সে সময় Deus Vult (ঈশ্বরের ইচ্ছা) ধ্বনি দিয়ে হাজার হাজার মানুষকে জার্মানির রাইন ভ্যালিতে হত্যা করা হয় এবং বাস্তুচ্যুত করা হয়। জেরুজালেমের প্রায় প্রতিটি অধিবাসীকে হত্যা করা হয় শহর ‘পবিত্র’ করার নামে।
(২) দ্বিতীয় ক্রুসেড পরিচালনার সময় সেন্ট বার্নার্ড ফতোয়া দেন, “প্যাগানদের হত্যার মাধ্যমেই খ্রিস্টানদের গৌরব ফিরিয়ে আনা সম্ভব।”
(৩) প্রাচীন আরবে ‘জামালের যুদ্ধে প্রায় দশ হাজার মুসলিম নিহত হয়েছিল, তাঁদের আপন জ্ঞাতিভাই মুসলিমদের দ্বারাই। ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা হজরত মোহম্মদ নিজেও বনি কুরাইজার ৭০০ বন্দিকে একসঙ্গে হত্যা করেছিলেন বলে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে।
(৪) বাইবেল থেকে (O.T. ৩১ : ১৬-১৭) জানা যায়, মুসা প্রায় এক লক্ষ পুরুষ এবং আটষট্টি হাজার রমণীকে হত্যা করেছিলেন।
(৫) প্রাচীন মায়া সভ্যতায় নরবলি প্রথা প্রচলিত ছিল। অদৃশ্য ঈশ্বরকে তুষ্ট করতে গিয়ে হাজার হাজার মানুষের মাথা কেটে ফেলে, হৃৎপিণ্ড উপড়ে ফেলে, অন্ধকূপে ঠেলে ফেলে হত্যা করা হত। ১৪৪৭ সালে গ্রেট পিরামিড অব টেনোখটিটলান তৈরির সময় চারদিনে প্রায় ৮০,৪০০ বন্দিকে ঈশ্বরের কাছে উৎসর্গ করা হয়েছিল। শুধু মায়া সভ্যতাতেই নয়, সারা পৃথিবীতেই এ ধরনের উদাহরণ আছে। পেরুতে প্রি-ইনকা উপজাতিরা ‘হাউস অব দ্য মুন’ মন্দিরে শিশুদের হত্যা করত। তিব্বতে বন শামানেরা ধর্মীয় রীতির কারণে মানুষ হত্যা করত। বোর্নিওতে বাড়ির ইমারত বানানোর আগে প্রথম গাঁথুনিটা এক কুমারীর দেহ দিয়ে প্রবেশ করানো হত “ভূমিদেবতা’-কে তুষ্ট করার খাতিরে।
(৬) প্রাচীন ভারতে দ্রাবিড়রা গ্রামের ঈশ্বরের নামে মানুষ উৎসর্গ করত। কালিভক্তরা প্রতি শুক্রবারে শিশুবলি দিত।
(৭) তৃতীয় ক্রুসেড়ে রিচার্ডের আদেশে তিন হাজার বন্দিকে–যাদের অধিকাংশই ছিলেন নারী এবং শিশু–জবাই করে হত্যা করা হয়। দ্বিতীয় ক্রুসেডের সময় সেন্ট বার্নাড ফতোয়া দিয়েছিলেন–“প্যাগানদের হত্যার মাধ্যমেই খ্রিস্টানদের মাহাত্ম সূচিত হবে। আর জিশুখ্রিস্ট নিজেও এতে মহিমান্বিত হবেন।”
(৮) ইসমাইলি শিয়া মুসলিমদের একটি অংশ একসময় লুকিয়ে ছাপিয়ে বিধর্মী প্রতিপক্ষদের হত্যা করত। এগারো থেকে তেরো শতক পর্যন্ত আধুনিক ইরান, ইরাকএবং সিরিয়ায় বহু নেতা তাঁদের হাতে প্রাণ হারায়। শেষপর্যন্ত ইতিহাসের আর-এক দস্যুদল মোঙ্গলদের হাতে তাঁদের উচ্ছেদ ঘটে –কিন্তু তাঁদের বীভৎস কীর্তি আজও অম্লান।
(৯) কথিত আছে, এগারো শতকের শুরুর দিকে ইহুদিরা খ্রিস্টান শিশুদের ধরে নিয়ে যেত, তারপর উৎসর্গ করে তাদের রক্ত ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যবহার করত। এই রক্তের মহাকাব্য রচিত হয়েছে এমনি ধরনের শত সহস্র অমানবিক ঘটনার উপর ভিত্তি করে।
(১০) ১২০৯ সালে পোপ তৃতীয় ইনসেন্ট উত্তর ফ্রান্সের আলবিজেনসীয় খ্রিস্টানদের উপর আক্ষরিক অর্থেই ক্রুসেড চালিয়েছিলেন। শহর দখল করার পর যখন সৈন্যরা ঊর্ধ্বতনদের কাছ থেকে পরামর্শ চেয়েছিল কীভাবে বন্দিদের মধ্যে থেকে বিশ্বাসী এবং অধার্মিকদের মধ্যে পার্থক্য করা যাবে। পোপ তখন আদেশ দিয়েছিলেন–“সবাইকে হত্যা কর”। পোপের আদেশে প্রায় বিশ হাজার বন্দিকে চোখ বন্ধ করে ঘোড়ার পিছনে দড়ি দিয়ে বেঁধে ছ্যাঁচরাতে ছ্যাঁচরাতে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়।
(১১) মুসলিমদের পবিত্র যুদ্ধ ‘জিহাদ’ উত্তর আফ্রিকা থেকে শুরু করে স্পেন পর্যন্ত রক্তাক্ত করে তোলে। তারপর এই জিহাদের মড়ক প্রবেশ করে ভারতে–আর তারপর চলে যায় বলকান (ক্যাথলিক ক্রোয়েশিয়ান, অর্থডক্স সার্ব এবং মুসলিম বসনিয়ান এবং কসোভো) থেকে অস্ট্রিয়া পর্যন্ত।
(১২) বারো শতকের দিকে ইনকারা পেরুতে তাদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে, যে সাম্রাজ্যের পুরোধা ছিলেন একদল পুরোহিত। তাঁরা ঈশ্বর কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে ২০০ শিশুকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারে।
(১৩) ১২১৫ সালের দিকে চতুর্থ ল্যাটেরিয়ান কাউন্সিল ঘোষণা করে তাঁদের বিস্কুটগুলো (host wafer) নাকি অলৌকিকভাবে জিশুর দেহে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। এরপর একটি গুজব রটিয়ে দেওয়া হয় যে, ইহুদিরা নাকি সেসব পবিত্র বিস্কুট চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। এই গুজবের উপর ভিত্তি করে ১২৪৩ সালের দিকে অসংখ্য ইহুদিদের জার্মানিতে হত্যা করা হয়। একটি রিপোর্টে দেখা যায় ছয় মাসে ১৪৬ জন ইহুদিকে হত্যা করা হয়েছিল। এই পবিত্র হত্যাযজ্ঞ চলতে থাকে প্রায় ১৮ শতক পর্যন্ত।
(১৪) বারো শতকের দিকে সাড়া ইউরোপ জুড়ে আলবেজেনসীয় ধর্মদ্রোহীদের খুঁজে খুঁজে হত্যার রীতি চালু হয়। ধর্মদ্রোহীদের কখনো পুড়িয়ে, কখনো ধারালো অস্ত্র দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে কখনো-বা শিরোচ্ছেদ করে হত্যা করা হয়। পোপ চতুর্থ ইনোসেন্ট এই সমস্ত হত্যায় প্রত্যক্ষ ইন্ধন জুগিয়েছিলেন। কথিত আছে ধর্মবিচরণ সভার সংবীক্ষক (Inquisitor) রবার্ট লি বোর্জে এক সপ্তাহে ১৮৩ জন ধর্মদ্রোহীকে হত্যার জন্য পাঠিয়েছিলেন।
(১৫) বহু লোক সে সময় নিপীড়ন থেকে বাঁচতে ধর্মত্যাগ করেন, কিন্তু সে সমস্ত ধর্মত্যাগীদের পুরোনো ধর্মের অবমাননার অজুহাতে হত্যার আদেশ দেওয়া হয়। স্পেনে প্রায় ২০০০ ধর্মত্যাগীদের পুড়িয়ে মারা হয়। কেউ কেউ ধর্মত্যাগ না-করলেও ধর্মের অবমাননার অজুহাতে পোড়ানো হয়। জিওর্দানো ব্রুনোর মতো দার্শনিককে বাইবেল-বিরোধী কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্ব সমর্থন করার অপরাধে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয় সে সময়।
(১৬) ইতিহাস খ্যাত ‘ব্ল্যাক ডেথ’ যখন সাড়া ইউরোপে ১৩৪৮-১৩৪৯ এ ছড়িয়ে পড়েছিল, গুজব ছড়ানো হয়েছিল এই বলে যে, ইহুদিরা কুয়ার জল কিছু মিশিয়ে বিষাক্ত করে দেওয়ায় এমনটি ঘটছে। বহু ইহুদিকে এ সময় সন্দেহের বশে জবাই করে হত্যা করা হয়। জার্মানিতে পোড়ানো দেহগুলোকে স্তূপ করে মদের বড়ো বড়ো বাক্সে ভরে ফেলা হয় এবং রাইন নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। উত্তর জার্মানিতে ইহুদিদের ছোট্ট কুঠুরিতে গাদাগাদি করে রাখা হয় যেন তাঁরা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়, কখনো-বা তাঁদের পিঠে চাবুক কষা হয়। থারিঞ্জিয়ার যুবরাজ জনসমক্ষে ঘোষণা করেন যে, তিনি তাঁর ইহুদি ভৃত্যকে ঈশ্বরের নামে হত্যা করেছেন; অন্যদেরকেও তিনি একই কাজে উৎসাহিত করেন।
(১৭) তেরো শতকে এজটেক সভ্যতা যখন বিস্তার লাভ করেছিল, নরবলি প্রথার বীভৎসতার তখন স্বর্ণযুগ। প্রতি বছর প্রায় বিশ হাজার লোককে ঈশ্বরের নামে উৎসর্গ করা হত। তাঁদের সূর্যদেবের নাকি দৈনিক ‘পুষ্টির জন্য মানব রক্তের খুব দরকার পড়ত। বন্দিদের কখনো শিরোচ্ছেদ করা হত, এমনকি কোনো কোনো অনুষ্ঠানে তাঁদের দেহ টুকরো টুকরো করে ভক্ষণ করা হত। কখনো-বা পুড়িয়ে মারা হত, কিংবা উঁচু জায়গা থেকে ফেলে দেওয়া হত। বর্ণিত আছে, তাঁদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এক অক্ষতযোনি কুমারীকে দিয়ে ২৪ ঘণ্টা ধরে নাচানো হয়, তারপর তাঁর গায়ের চামড়া তুলে ফেলে ফেলে পুরোহিত তা পরিধান করেন, তারপর আরও ২৪ ঘণ্টা ধরে নাচতে থাকেন। রাজা আহুইতজোলের রাজাভিষেকে আশি হাজার বন্দিকে শিরোচ্ছেদ করে ঈশ্বরকে তুষ্ট করা হয়।
(১৮) ১৪০০ সালের দিকে ধর্মদ্রোহীদের থেকে চার্চের দৃষ্টি চলে যায় উইচক্রাফটের দিকে। চার্চের নির্দেশে হাজার হাজার রমণীকে ‘ডাইনি’ সাব্যস্ত করে পুড়িয়ে মারা শুরু হয়। এই ডাইনি পোড়ানোর রীতি এক ডজনেরও বেশি দেশে একেবারে গণ-হিস্টেরিয়ায় রূপ নেয়। সে সময় কতজনকে এরকম ডাইনি বানিয়ে পোড়ানো হয়েছে? সংখ্যাটা এক লক্ষ থেকে শুরু করে ২০ লক্ষ ছড়িয়ে যেতে পারে। ঠগ বাছতে গা উজাড়ের মতোই ডাইনি বাছতে গিয়ে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় করে দেওয়া হয়েছে। সতেরো শতকের প্রথমার্ধে অ্যালজাস (Alsace) নামের ফরাসি প্রদেশে ৫০০০ ডাইনিকে হত্যা করা হয়, ব্যাম্বার্গের ব্যাভারিয়ান নগরীতে ৯০০ জনকে পুড়িয়ে মারা হয়। ডাইনি পোড়ানোকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট ধর্মীয় উন্মত্ততা সে সময় অতীতের সমস্ত রেকর্ডকে ম্লান করে দেয়।
(১৯) সংখ্যালঘু প্রোটেস্টেন্ট হুগেনটস ১৫০০ সালের দিকে ফ্রান্সের ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের দ্বারা নির্মম নিপীড়নের শিকার হয়। ১৫৭২ সালে সেন্ট বার্থোলোমিও দিবসে ক্যাথেরিন দ্য মেদিসিস গোপনে তাঁদের ক্যাথলিক সৈন্য হুগেটসের বসতিতে প্রেরণ করে আক্ষরিক অর্থেই তাঁদের কচুকাটা করে। প্রায় ছয় সপ্তাহ ধরে এই হত্যাযজ্ঞ চলতে থাকে, আর এতে প্রাণ হারায় অন্তত ১০,০০০ হুগেনটস। হুগেনটসদের উপর সংখ্যাগুরু খ্রিস্টানদের আক্রোশ পরবর্তী দুই শতক ধরে অব্যাহত থাকে। ১৫৬৫ সালের দিকে একটি ঘটনার হুগেটসের একটি দল ফ্লোরিডা পালিয়ে যাওয়ার সময় স্প্যানিস বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে–তাঁদের এলাকার সবাইকে ধরে ধরে হত্যা করা হয়।
(২০) আবার ওদিকে পনেরো শতকে ভারতে কালিভক্ত কাঁপালিকের দল মা কালীকে তুষ্ট করতে গিয়ে অন্যদের শ্বাসরোধ আর জবাই করে হত্যা করত। এই কুৎসিত রীতির বলি হয়ে প্রাণ হারায় প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ। এখনও কিছু মন্দিরে বলি দেওয়ার রীতিচালু আছে–তবে আধুনিক রাষ্ট্রীয় আইন-কানুনের গ্যাড়াকলে পড়ে ব্রাহ্মণ-পুরোহিতরা আর আগের মতো মানুষকে বলি দিতে পারে না –সেই ঝাল ঝাড়া হয় নিরীহ পাঁঠার উপর দিয়ে। দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়েই আধুনিক যুগে এভাবে রক্তলোলুপ মা কালিকে তুষ্ট রাখা হয়।
(২১) ১৫৮৩ সালে ভিয়েনায় ১৬ বছরের একটা মেয়ের পেট ব্যথা শুরু হলে জিশুভক্তের দল তাঁর উপর আট সপ্তাহ ধরে এক্সরসিজম বা ওঝাগিরি শুরু করে। এই জিশুভক্ত পাদরির দল ঘোষণা করেন যে, তাঁরা মেয়েটির দেহ থেকে ১২,৬৫২ টা শয়তান তাড়াতে সক্ষম হয়েছেন। পাদরির দল ঘোষণা করে যে, মেয়েটির দাদি কাঁচের জারে মাছির অবয়বে শয়তান পুষতেন। সেই শয়তানের কারণেই মেয়েটার পেটে ব্যথা হত। দাদিকে ধরে নির্যাতন করতে করতে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয় যে দাদি আসলে ডাইনি, শয়তানের সাথে নিয়মিত ‘সেক্স’ করেন তিনি। অতঃপর দাদিকে ডাইনি হিসাবে সাব্যস্ত করে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। এটি তিন শতক ধরে ডাইনি পোড়ানোর নামে যে লক্ষ লক্ষ মহিলাকে পোড়ানো হয়েছিল, তার সামান্য একটি নমুনামাত্র।
(২২) এনাব্যাপ্টিস্টরা এক সময় ক্যাথলিক এবং প্রোটেস্টেন্ট অথোরিটিদের দ্বারা স্রেফ কচুকাটা হয়েছিলেন। জার্মানির মুন্সটারে এনাব্যাপ্টিস্টরা একসময় শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় আর নতুন জিয়ন’ প্রতিষ্ঠা করে ফেলে। ওদিকে আবার পাদরি মোল্লারা এনাব্যাপ্টিস্টদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তোলে এবং শহরের পতনের পর এনাব্যাপ্টিস্ট নেতাদের হত্যা করে চার্চের চূড়ায় লটকে রাখা হত।
(২৩) প্রোটেস্ট্যান্ট এবং ক্যাথলিকদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ১৬১৮ সালে শুরু হয়ে ত্রিশ বছর যাবৎ চলে। এ সময় পুরো মধ্য ইউরোপ পরিণত হয়েছিল বধ্যভূমিতে। জার্মানির জনসংখ্যা ১৮ মিলিয়ন থেকে ৪ মিলিয়নে নেমে আসে। আর-একটি হিসেব মতে, জনসংখ্যার প্রায় ত্রিশ ভাগ (এবং পুরুষদের পঞ্চাশ ভাগ) এ সময় নিহত হয়েছিল।
(২৪) ইসলামের জিহাদের নামে গত বারো শতক ধরে সাড়া পৃথিবীতে মিলিয়নের উপর মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। প্রথম বছরগুলোতে মুসলিম বাহিনী খুব দ্রুতগতিতে পূর্ব ভারত থেকে পশ্চিম মরোক্ক পর্যন্ত আগ্রাসন চালায়। শুধু বিধর্মীদের হত্যা করেনি, নিজেদের মধ্যেও কোন্দল করে নানা দল উপদল তৈরি করেছিল। কারিজিরা যুদ্ধ শুরু করেছিল সুন্নিদের বিরুদ্ধে। আজারিকিরা অন্য দল ‘পাপীদের’ মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। ১৮০৪ সালে উসমান দান ফোডিও, সুদানের পবিত্র সত্ত্বা, গোবির সুলতানের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ শুরু করে। ১৮৫০ সালে আর-এক সুদানীয় সুফি উমর-আল হজ্জ প্যাগান আফ্রিকান গোত্রের উপরে নৃশংস বর্বরতা চালায় –গণহত্যা এবং শিরোচ্ছেদ করে ৩০০ জন বন্দির উপর। ১৯৮০ সালে তৃতীয় সুদানীয় ‘হলি ম্যান মোহাম্মদ আহমেদ জিহাদ চালিয়ে ১০,০০০ মিশরীয় লোকজন হত্যা করে।
(২৫) ১৮০১ সালে রোমানিয়ার পাদরিরা ইহুদিদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে ১২৮ জন ইহুদিকে হত্যা করে।
(২৬) ভারতে ১৮১৫ থেকে ১৮২৮ সালের মধ্যে ৮১৩৫ নারীকে সতীদাহের নামে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় (প্রতি বছর হত্যা করা হয় গড়পরতা ৫০৭ থেকে ৫৬৭ জনকে)।
(২৭) ১৮৪৪ সালে পার্শিয়ায় বাহাই ধর্মপ্রচার শুরু হলে কট্টরপন্থি ইসলামিস্টরা এঁদের উপর চড়াও হয়। বাহাই ধর্মের প্রবর্তককে বন্দি এবং শেষপর্যন্ত হত্যা করা হয়। দুই বছরের মধ্যে সেখানকার মৌলবাদী সরকার ২০,০০০ বাহাইকে হত্যা করে। তেহেরানের রাস্তাঘাট আক্ষরিক অর্থেই রক্তের বন্যায় ভেসে যায়।
(২৮) বার্মায় ১৮৫০ সাল পর্যন্ত মানুষকে বলি দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। যখন রাজধানী মান্দালায় সরিয়ে নেওয়া হয়, তখন নগর রক্ষা করার জন্য ৫৬ জন ‘নিষ্কলুষ’ লোককে প্রাচীরের নীচে পুঁতে ফেলা হয়। রাজ জ্যোতিষীরা ফতোয়া দেয় যে নগর বাঁচাতে হলে আরও ৫০০ জন নারী, পুরুষ এবং শিশুকে বলি দিতে হবে। সেই ফতোয়া অনুযায়ী বলি দেওয়া শুরু হয় এবং ১০০ জনকে বলি দেওয়ার পর ব্রিটিশ সরকারের হস্তক্ষেপে সেই বলিপ্রথা রদ করা হয়।
(২৯) ১৮৫৭ সালে উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনামলে এনফিল্ড রাইফেলের কার্ট্রিজ, যেটাতে শুয়োর আর গরুর চর্বি লাগানো ছিল বলে গুজব রটানো হয়, তাকে কেন্দ্রকরে দাঙ্গা শুরু হয় এবং নির্বিচারে বহু লোককে হত্যা করা হয়।
(৩০) ১৯০০ সালে তুর্কি মুসলিমেরা খ্রিস্টান আর্মেনিয়ানদের উপর নির্বিচারে গণহত্যা চালায়।
(৩১) ১৯২০ সালে ক্রিস্টেরো যুদ্ধে ৯০ হাজার মেক্সিকান মৃত্যুবরণ করে।
(৩২) ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগকে কেন্দ্র করে দাঙ্গায় প্রায় ১ মিলিয়ন লোক মারা যায়। এমনকি ‘মহাত্মা’ গান্ধিও দাঙ্গা রোধ করতে সফল হননি এবং তাঁকেও অঘোরে হিন্দু ফ্যানাটিক নাথুরাম গডসের হাতে মৃত্যুবরণ করতে হয়।
(৩৩) ১৯৫০ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে খ্রিস্টান, এনিমিস্ট এবং মুসলিমদের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্বে ৫০০,০০০ লোক মারা যায়।
(৩৪) ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানিরা পুর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের উপর গণহত্যা চালায়, নয় মাসে তাঁরা প্রায় ৩ মিলিয়ন লোককে হত্যা করে, ধর্ষণ করে ২ লক্ষ নারীকে। যদিও এই যুদ্ধের পিছনে মদত ছিল রাজনৈতিক, তারপরেও ধর্মীয় ব্যাপারটিও উপেক্ষণীয় নয়। পশ্চিম পাকিস্তানিদের বরাবরই অভিযোগ ছিল যে, পূর্ব পাকিস্তানিরা ‘ভালো মুসলমান’ নয় এবং তাঁরা ভারতের দালাল।
(৩৫) ১৯৭৮ সালে গায়ানার জোন্স টাউনে রেভারেণ্ড জিম জোন্স সেখানে ভ্রমণরত কংগ্রেসম্যান এবং তিনজন সাংবাদিককে হত্যার পর ৯০০ জনকে। নিয়ে আত্মহত্যা করে, যা সারা পৃথিবীকে স্তম্ভিত করে দেয়।
(৩৬) ইসলামি আইন মোতাবেক চুরির শাস্তি হিসেবে হাত কেটে ফেলার রেওয়াজ প্রচলিত আছে। সুদানে ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৪ সালের মধ্যে প্রায় ৬৬ জনকে ধরে প্রকাশ্যে হাত কেটে ফেলা হয়। মডারেট মুসলিম নেতা মোহাম্মদ তাঁকে ফাঁসিতে লটকে মেরা ফেলা হয়। কারণ তিনি হাত কেটে ফেলার মতো বর্বরতার প্রতিবাদ করেছিলেন।
(৩৭) সৌদি আরবে ১৯৭৭ সালে কিশোরী প্রিন্সেস এবং তাঁর প্রেমিককে ‘ব্যাভিচারের অপরাধে হত্যা করা হয়। পাকিস্তানে ১৯৮৭ সালে এক কাঠুরিয়ার মেয়েকে ‘জেনা’ করার অপরাধে পাথর ছুঁড়ে হত্যার ফতোয়া দেয়া হয়। ১৯৮৪ সালে আরব আমিরাতে একটি বাড়ির গৃহভৃত্য এবং দাসীকে পাথর ছুঁড়ে হত্যার ফতোয়া দেওয়া হয়, অবৈধ মেলামেশার অপরাধে।
(৩৮) নাইজেরিয়ায় ১৯৮২ সালে মাল্লাম মারোয়ার ফ্যানাটিক অনুসারীরা প্রতিপক্ষের শতাধিক লোকজনকে ‘কাফের’ আখ্যা দিয়ে হত্যা করে, আর তাঁদের রক্তপান করে।
(৩৯) ১৯৮৩ সালে উত্তর আয়ারল্যান্ডে ক্যাথোলিক সন্ত্রাসীরা প্রোটেস্টেন্ট চার্চে ঢুকে গোলাগুলি করে প্রোটেস্টেন্ট অনুসারীদের হত্যা করে। দাঙ্গায় প্রায় ২৬০০ লোক মারা যায়।
(৪০) হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা ভারতে নিত্য-নৈমন্তিক ব্যাপার। ১৯৮৩ সালে আসামে এরকম একটি দাঙ্গায় ৩,০০০ জন মানুষ মারা যায়। ১৯৮৪ সালে এক হিন্দু নেতার ছবিতে কোনো এক মুসলিম জুতার মালা পরিয়ে দিলে এ নিয়ে পুনরায় দাঙ্গা শুরু হয়, সেই দাঙ্গায় ২১৬ জন মারা যায়, ৭৫৬ জন আহত হয়, আর ১৩,০০০ উদ্বাস্তু হয়। কারাবন্দি হয় ৪১০০ জন।
(৪১) লেবাননে ১৯৭৫ সালের পর থেকে সুইসাইড বোম্বিং সহ নানা সন্ত্রাসবাদী ঘটনায় ১৩০,০০০ জন লোক মারা গেছে।
(৪২) ইরানের মৌলবাদী শিয়া সরকার ঘোষণা করে যে সমস্ত বাহাই ধর্মান্তরিত না হবে, তাঁদের হত্যা করা হবে। ১৯৮০ সালের প্রথম দিকে প্রায় ২০০ জন ‘গোঁয়ার’ বাহাইকে হত্যা করা হয়, প্রায় ৪০,০০০ বাহাই দেশ ছেড়ে পালায়।
(৪৩) শ্রীলঙ্কা বিগত শতকের আশি আর নব্বইয়ের দশকে বৌদ্ধ সিংহলি আর হিন্দু তামিলদের লড়াইয়ে আক্ষরিক অর্থেই নরকে পরিণত হয়।
(৪৪) ১৯৮৩ সালে জেরুজালেমের ধর্মীয় নেতা মুফতি শেখ সাদ ই-দীন এল আলামিফতোয়া দেন এই বলে যে, কেউ যদি সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল আজাদকে হত্যা করতে পারে, তবে তাঁর বেহেস্ত নিশ্চিত।
(৪৫) ভারতে আশির দশকে শিখ জনগোষ্ঠী নিজেদের জন্য পাঞ্জাব এলাকায় আলাদা ধর্মীয় রাজ্য ‘খালিস্তান’ (Land of the Pure) তৈরির পায়তারা করে আর এর নেতৃত্ব দেয় শিখ চরমপন্থী নেতা জারনাইন ভিন্দ্রানওয়ালা, যিনি তাঁর অনুসারীদের শিখিয়েছিলেন যে, প্রতিপক্ষকে নরকে পাঠানো তাঁদের পবিত্র দায়িত্ব। চোরাগোপ্তাভাবে পুরো আশির দশক জুড়েই বহু হিন্দুকে হত্যা করা হয়।
(৪৬) ১৯৮৪ সালে শিখ দেহরক্ষীদের হাতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি নিহত হলে সাড়া ভারত জুড়ে শিখদের উপর বীভৎস তাণ্ডবলীলা চালানো হয়। তিনদিনের মধ্যে ৫০০০ শিখকে হত্যা করা হয়। শিখদের বাড়ি থেকে উঠিয়ে, বাস থেকে নামিয়ে, দোকান থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়, কখনো জীবন্ত পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
(৪৭) ১৯৮৯ সালে ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ নামের উপন্যাস লেখার দায়ে সালমান রুশদিকে ফতোয়া দেওয়া হয় ইরানের ধর্মগুরু আয়াতোল্লা খোমেইনির পক্ষ থেকে। বইটি না পড়েই মুসলিম বিশ্বে রাতারাতি শুরু হয় জ্বালাও পোড়াও তাণ্ডব। ইসলামকে অবমাননা করে লেখার দায়ে এর আগেও মনসুর আল হাল্লাজ, আলি দাস্তি, আজিজ নেসিন, উইলিয়াম নেগার্ড, নাগিব মাহফুজ, তসলিমা নাসরিন, ইউনুস শায়িখ, রবার্ট হুসেইন, হুমায়ুন আজাদ, আয়ান আরসি আলি সহ অনেকেই মৃত্যু পরোয়ানা পেয়েছেন। এদের মধ্যে অনেককেই মেরে ফেলা হয়েছে, কেউ-বা হয়েছেন পলাতক।
(৪৮) ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর রামজন্মভূমি মিথকে কেন্দ্র করে হিন্দু উগ্রপন্থীরা শত বছরের পুরোনো বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে। এর ফলশ্রুতিতে দাঙ্গায় ২০০০ মানুষ মারা যায়, এর প্রভাব পড়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও।
(৪৯) ১৯৯৭ সালে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় স্বর্গের দ্বার (Heaven’s Gate) নামে এক ‘ইউএফও ধর্মীয় সংগঠনের ৩৯ জন সদস্য একযোগে আত্মহত্যা করে, জীবনের পরবর্তী স্তরে যাওয়ার লক্ষ্যে।
(৫০) বাংলাদেশে ১৯৪১ সালে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল শতকরা ২৮ ভাগ। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের অব্যবহিত পরে তা শতকরা ২২ ভাগে এসে দাঁড়ায়। এরপর থেকেই সংখ্যালঘুদের উপর ক্রমাগত অত্যাচার এবং নিপীড়নের ধারাবাহিকতায় দেশটিতে ক্রমশ হিন্দুদের সংখ্যা কমতে থাকে। ১৯৬১ সালে ১৮.৫%, ১৯৭৪ সালে কমে দাঁড়ায় ১৩.৫%, ১৯৮১ সালে ১২.১%, এবং ১৯৯১ সালে ১০% এ এসে দাঁড়ায়। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে হিন্দুদের শতকরা হার কমে ৮ ভাগের নীচে নেমে এসেছে বলে অনুমিত হয়।
(৫১) ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার টুইন টাওয়ারের উপর আল কায়দা আত্মঘাতী বিমান হামলা চালায়, এই হামলায় টুইন টাওয়ার ধ্বসে পড়ে, মারা যায় ৩,০০০ আমেরিকান নাগরিক।
(৫২) ২০০২ সালে ভারতের গুজরাটে দাঙ্গায় ২০০০ মানুষ মারা যায়, উদ্বাস্তু হয় প্রায় ১৫০,০০০ মানুষ। নারী নির্যাতন প্রকট আকার ধারণ করে। বহু মুসলিম কিশোরী এবং নারীকে উপর্যুপরি ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়।
(৫৩) ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বাংলাদেশে বিএনপি-জামাত বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে বেছে বেছে হিন্দু বাড়িগুলোতে আক্রমণ চালানো হয়। পূর্ণিমা রানির মতো বহু কিশোরীকে ধর্ষণ করা হয়। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রথম ৯২ দিনের মধ্যে ২২৮টি ধর্ষণের ঘটনা, এবং পরবর্তী তিন মাসে প্রায় ১০০০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, যার মধ্যে শতকরা ৯৮ ভাগ ছিল হিন্দু কিংবা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অন্তর্গত।
(৫৪) বিএনপি-জামাত কোয়ালিয়েশন সরকারের সময় বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে জাগ্রত মুসলিম জনতার (জে এম. জে) উত্থান ঘটে। তাঁরা পুলিশের ছত্রছায়ায় বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। একটি ঘটনায় একজন গ্রামবাসীকে হত্যা করে গাছের সঙ্গে উলটো করে বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। সরকারের পক্ষ থেকে বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টি বলে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হয়।
(৫৫) ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের প্রথা ভাঙা লেখক হুমায়ুন আজাদের উপর হামলা চালায় মৌলবাদী জেএমবি। চাপাতি দিয়ে ক্ষত বিক্ষত করে ফেলা হয় তার দেহ, যা পরে তাঁকে প্রলম্বিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।
(৫৬) ২০০৪ সালের ২ নভেম্বর চিত্র পরিচালক থিও ভ্যান গগকে প্রকাশ্যে রাস্তায় গুলি এবং ছুরিকাহত করে হত্যা করে মুসলিম সন্ত্রাসী মোহাম্মদ বোয়েরি। সাবমিশন নামের দশ মিনিটের একটি ‘ইসলাম বিরোধী’ চলচিত্র বানানোর দায়ে তাঁকে নেদারল্যান্ডসের রাস্তায় প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। একই ছবির সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে নারীবাদী লেখিকা আয়ান হারসি আলিকেও মৃত্যুপরোয়ানা দেওয়া হয়।
(৫৭) বাংলাদেশে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সামান্য ‘মোহাম্মদ বিড়াল’ নিয়ে কৌতুকের জের হিসেবে ২১ বছর বয়সি কার্টুনিস্ট আরিফকে জেলে ঢোকানো হয়, বায়তুল মোকারমের খতিবের কাছে গিয়ে প্রথম আলোর সম্পাদকের ক্ষমা প্রার্থনার নাটক প্রদর্শিত হয়।
‘যুক্তিবাদ’ বাজারজাত কোনো ট্যাবলেট নয় এবং তা সেবনপূর্বক ‘যুক্তিবাদী’ হওয়া যাবে না। যুক্তিবিদ্যায় সমস্ত যুক্তিকে মূলত দু-ভাগে ভাগ করে নেওয়া যায়। ছাঁচে ঢালা বা ফর্মাল যুক্তি এবং ছাঁচহীন বা ইনফর্মাল যুক্তি। ছাঁচে ঢালা যুক্তি হল গণিতের মতো ব্যাপার। বেশি তত্ত্ব কথা না-বুঝেও বোধগম্য হয়। ছাঁচে ঢালা যুক্তির বৈধতা বা অবৈধতাও নির্ণয় করা যায় কয়েকটি সূত্র প্রয়োগ করে, ঠিক গণিতের মতোই। কিন্তু ছাঁচহীন বা ইনফর্মাল যুক্তি এরকম নয়। সাধারণ মানুষের কথায় প্রতিনিয়ত ব্যবহৃত হওয়া এই ধরনের যুক্তিকে গণিতের মতো একে ছাঁচে ঢালা যায় না। সহজে সূত্র প্রয়োগে উত্তর বেরোয় না।
যুক্তি নয়, আস্তিকবাদীগণ বিশ্বাসকেই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। তাই বলেন, “বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর”। মূলগতভাবে আস্তিকগণ ঈশ্বর ধর্ম প্রসঙ্গে মস্তিষ্ক-অলস মানুষ, তাঁরা এসব ব্যাপারে যুক্তিতর্ক করে বহুদূর যেতে পছন্দ করেন না। চোখ বন্ধ রেখে ইমাজিন করে নিতে ভালোবাসেন নিজের মতো করে। তারপর সেটাকেই ফ্রেমবন্দি করে ধ্রুবসত্য বলে প্রচার করবেন। কারণ যুক্তিতর্ক করে বহুদূর যেতে হলে মস্তিষ্ককে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতে হয় –প্রতিনিয়ত, প্রতিক্ষণ। তদুপরি আরও বলা যায়, বিশ্বাস কখনো একা একা পথ চলে না, বগলদাবা করে বয়ে নিয়ে বেড়ায় প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকেও। তাই বিশ্বাসের কথা বলতে গেলে পাশাপাশি অবধারিতভাবে ধর্মের কথাও এসে পড়ে। বিশ্বাস এবং ধর্ম অনেকসময়ই খুব পরিপূরক, অনেক সময় কেন–সবসময়ই। অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে সেখানে জাদুটোনা থেকে শুরু করে নরবলি, কুমারী হত্যা সহ হাজারো অপবিশ্বাসের সমাহার। সেদিক থেকে চিন্তা করলে নাস্তিকতা, যুক্তিবাদ, বিজ্ঞানমস্কতা, লিবারেলিজম প্রভৃতি উপাদানগুলি বিবর্তনীয় প্রেক্ষাপটে মানবসমাজের জন্য অত্যাবশ্যক সংযোজন।
গবেষণায় দেখা গেছে, অবিশ্বাসীরা স্মার্ট শুধু নয়, নৈতিক দিক দিয়েও অবিশ্বাসীরা বিশ্বাসীদের চেয়ে অনেক অগ্রগামী। সংখ্যালঘুদের প্রতি সহিষ্ণুতা এবং সংখ্যালঘুদের অধিকারের প্রতি সচেতনতাও বিশ্বাসীদের তুলনায় নাস্তিকদের মধ্যে অনেক বেশি। কারণ অবিশ্বাসীরা সাধারণত বৈজ্ঞানিক যুক্তি, মানবতা এবং বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে বিষয়গুলি বিবেচনা করেন, কোনো অন্ধবিশ্বাসের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে নয়। বিশ্বাস শুধু মানসিকভাবেই ব্যক্তিকে পঙ্গু এবং ভাইরাস আক্রান্ত করে ফেলে না, পাশাপাশি এর সার্বিক প্রভাব পড়ে একটি দেশের সামাজিক কাঠামোয়, রাষ্ট্রব্যবস্থায় এবং তদুপরি অর্থনীতিতেও। সাম্প্রতিক বহু গবেষণাতেই বেরিয়ে এসেছে যে দারিদ্রের সঙ্গে ধর্মবিশ্বাসের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে। যেসব দেশ যত দারিদ্রক্লিষ্ট, সেসব দেশেই ধর্ম নিয়ে বেশি নাচানাচি হয়, আর শাসকেরাও সেসব দেশে ধর্মকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে। সেজন্যই দারিদ্রক্লিষ্ট তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ধর্ম খুব বড়ো একটা নিয়মক হয়ে কাজ করে থাকে, সবসময়েই। কিংবা ব্যাপারটাকে যদি উলটো করেও দেখি তাহলে দেখব–ধর্মকে অতিরিক্ত প্রশ্রয় দেওয়া, কিংবা লম্ফঝম্ফ করা, কিংবা জাগতিক বিষয়-আশয়ের চেয়ে ধর্মকে মাত্রাতিরিক্ত বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কারণেই সে সমস্ত দেশগুলি প্রযুক্তি, জ্ঞানবিজ্ঞানে পশ্চাৎগামী এবং সর্বোপরি দরিদ্র।
বিশ্বাস একটা একান্ত ব্যক্তিগত আবেগ এবং অনুভূতির বিষয়। মানুষ বিশ্বাস তখনই করে, যখন ধারণাকে প্রমাণ করতে পারে না বা প্রমাণ করতে চায় না। মনে করেন আমি বললাম যে আমার কাছে কোনো টাকা নেই এবং আপনি চাইলে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। আপনি যদি পরীক্ষা করে দেখার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে পরীক্ষার পর এটা প্রমাণ হয়ে যাবে আমার কাছে টাকা আছে কি নেই, বিশ্বাসের আর কিছু নেই। আর যদি বিশ্বাস করেন, তার পিছনে যত কারণই থাক না-কেন ফাঁকির একটা সম্ভাবনা থেকেই যাবে। আজকাল শিক্ষিত মানুষগণ চোখের গঠন, নাকের গঠন মার্কা ভুয়া যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে ‘ঈশ্বর’ আছে। তাঁরা এটা বোঝেন না যে যখন তাঁরা বলে তাঁরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, এই বিশ্বাস শব্দটাই প্রমাণ করে যে তাঁদের কাছে কোনো প্রমাণ নেই এবং এই বিশ্বাসটা সত্যি না-হওয়ারও একটা সম্ভাবনা সবসময়ই আছে। এই ফাঁকির সম্ভাবনাটা গ্রহণ করার অক্ষমতাটার কারণেই বিশ্বাস হয়ে যায় অন্ধবিশ্বাস। এবং এই অন্ধবিশ্বাসই তাঁদের বানিয়ে দেয় ধর্মান্ধ।
বিশ্বাসের আর-একটা ব্যাপার হল আপনি বিশ্বাস না-করেও বলতে পারেন যে আপনি বিশ্বাস করেন। আপনি চাইলে একই সঙ্গে বিশ্বাস এবং অবিশ্বাস দুটোই করতে পারেন। যখন আমি বলেছি যে আমার কাছে কোনো টাকা নেই এবং আপনি চাইলে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন, আপনি হয়তো ভদ্রতা করে পরীক্ষা করলেন না। এই ক্ষেত্রে আপনি বিশ্বাস এবং অবিশ্বাস দুটোই একই সঙ্গে করতে পারেন। আপনার মস্তিষ্কের একটা অংশ বিশ্বাস করতে পারে আমার কাছে টাকা নেই, পাশাপাশি আপনারই মস্তিষ্কের আর-একটা অংশ বিশ্বাস করতে পারে যে আমার কাছে টাকা আছে, আমি শেয়ার করব না। এই ব্যপারটা স্বাভাবিক। যেটা স্বাভাবিক না সেটা হচ্ছে আপনি যখন পুরোপুরি বিশ্বাস না-করে বলেন বিশ্বাস করেন। এটা হচ্ছে নিজের সাথে প্রতারণা, ভণ্ডামির উৎস।
পৃথিবীতে প্রচলিত সমস্ত ধর্মগুলোর সত্যিই কি কোনো ভিত্তি আছে? যেখানে জন্মসূত্রে আমরা ধর্মগুলোকে পাই সেখানে ঈশ্বর মনোনীত ধর্ম পাওয়া সেফ ওই ঈশ্বর মনোনীত ধর্মের একজন পুরুষের সন্তান উৎপাদনের সঙ্গে যোগসূত্র। একজন হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ আর ইহুদি হওয়ার মধ্যে জন্মসূত্রই প্রধান। মহান ঈশ্বরের মনোনীত ধর্মের ডাকে সাড়া দেওয়ার অন্য কোনো উপায় নেই। ধর্মগ্রন্থের ধর্মবিধান মানুষ দ্বারাই সৃষ্ট। প্রাচীনকালে এই ধর্মগ্রন্থই ছিল অনুশাসনের জন্য একমাত্র সংবিধান। ধর্মগ্রন্থের উপর ভিত্তি করেই চলত দেশশাসন। এই ধর্মগ্রন্থগুলি অপৌরুষেয় তথা ঈশ্বরপ্রেরিত দূত দ্বারা প্রেরণ করা হয়েছে বলে যে গল্প শোনানো হয়, তা অমূলক নয়। সেসময়ের ধর্মীয় নেতা তথা শাসকগণ অনুশাসনের গ্রন্থগুলি রচনা করে অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন। না-হলে সমাজে সভ্যতার বিকাশ সম্ভব হত না। মানুষ চরম উদ্ধৃঙ্খল হয়ে পড়ত। এক অরাজকতার পরিস্থিতি বিরাজ করত সমগ্র পৃথিবীতে। চলত হানাহানি, খুনোখুনি। সভ্যতার বিকাশের ও বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এক সুসংগঠিত রাষ্ট্রের সৃষ্টি হল। রচিত হল শাসনতন্ত্রের সুদৃঢ় এবং আধুনিক সংবিধান। এই অনুশাসনে কোনো ধর্ম নেই, ঈশ্বর নেই। ঈশ্বরের আশীর্বাদ নেই, অভিসম্পাত নেই। অলৌকিক স্বর্গের সুখ, নরকের যন্ত্রণার কথা বলা হয়নি। বেদ, মনুসংহিতা, কোরান, হাদিস, বাইবেল, ত্রিপিটক–এসব গ্রন্থগুলির অনুশাসনগুলি আজ খুবই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। ধর্মের অনুশাসন এবং রাষ্ট্রের অনুশাসন দুটোই একসঙ্গে চলতে পারে না। ধর্মের বিধান নয়, রাষ্ট্রের পেনাল কোডই গ্রহণযোগ্য। ধর্মীয় অনুশাসন বর্বরোচিত, অমানবিক, বিভেদকামী, দুষ্পরিবর্তনীয়–যা আজকের দিনে সম্পূর্ণভাবে অচল। রাষ্ট্রের আইনব্যস্থা যখন যথেষ্ট সম্পূর্ণ, তখন সমাজে ধর্মীয় অনুশাসন অবাঞ্ছিতই!
ঈশ্বর যে কোনো ধর্ম পৃথিবীতে পাঠাননি সমগ্র পৃথিবীর জন্য এটা একটা প্রধান প্রমাণ। পৃথিবীতে যদি ঈশ্বর কোনো ধর্ম পাঠিয়ে না-ই থাকেন, তিনি যদি আদৌ আমাদের নিয়ে কোনো চিন্তাভাবনা না-ই করেন, তাহলে একজন ঈশ্বর আছেন এটা বিশ্বাস করেই-বা কী লাভ? তবে ঈশ্বর যে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে কোনো ভূমিকা রাখেন না। হাত নাড়লে খেতে পাবেন, না-নাড়লে ভুখা থাকতে হবে। এটা যত তাড়াতাড়ি মানুষ বুঝবে তত তাড়াতাড়ি মানুষের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে কথিত ঈশ্বর প্রেরিত ধর্মের প্রভাব থেকে দূরে থাকবে। রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্মের ব্যবহারের মারাত্মক দিকটি থেকে চিরমুক্তি পেতে পারে। এই আস্তিকতা যত তাড়াতাড়ি পৃথিবীতে প্রসার লাভ করবে আমাদের কাঙ্খিত শান্তির পৃথিবীর আশা ততই বাড়তে থাকবে। ঈশ্বর অনেক ব্যাপক বিতর্কের বিষয়। পৃথিবীতে এমন মানুষের সংখ্যা অনেক আছেন যাঁরা ঈশ্বর বিশ্বাস না করলেও প্রচলিত ধর্ম মানেন না। তাঁরা নিজেদের আস্তিক বলেই পরিচয় দেয়। এঁরা স্বর্গ-নরক-জাহান্নম-জন্নত নিয়ে মাথা ঘামায় না।
প্রচলিত ধর্ম যেহেতু মানেন না, তাই ধর্মাচরণ করে অন্য মানুষকে বিব্রত করেন না। ঈশ্বরের বিশ্বাস ও প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত হলেও মোটেইএক নয়। ঈশ্বর আছে কি নেই তার সঙ্গে ধর্ম সঠিক না বেঠিক বিতর্কের সংযোগ সামান্য। যদিও দুটিই মানুষ কর্তৃক সৃষ্ট, তা সত্ত্বেও বলব ধর্মকে নিয়ে বিতর্ক করা যেতে পারে, কিন্তু ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে তর্ক করা মানে ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে গাত্র ব্যথা করা। ঈশ্বর নিরাকার বিষয়, ধর্ম চর্চিত এবং রচিত বিষয়। ঈশ্বর ব্যক্তিগত স্বার্থের বিষয়, ধর্ম সমষ্টিগত স্বার্থের বিষয়। ধর্ম সমালোচক মানেই আমাদের সমাজে অবধারিতভাবে নাস্তিক কিংবা অন্য ধর্মের ছদ্মবেশী এজেন্ট। চুড়ান্তভাবে ঈশ্বর আছে কি নেই এসব চিন্তা করে পেট ভরবে না। ধর্মগ্রন্থগুলি তথাকথিত ঈশ্বরের সৃষ্টি, যে যতই বুক বাজিয়ে বলুক না-কেন, তা বাস্তব নয়। কারণ ধর্ম যদি ঈশ্বরের সৃষ্টিই হত এত বিভিন্নতা থাকত না। বিভিন্নতা থাকলেও অবিবেচক হতেন না।
ঈশ্বর যদি ধর্মগ্রন্থগুলি লিখতেন বা প্রেরণ করতেন, তবে হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান বৌদ্ধ ইত্যাদি হাজারো ধর্মমত তৈরি হত না। তাহলে বলতে হয় এ পৃথিবীতে যত ধর্মসংক্রান্ত বিড়ম্বনা হয়, সবকিছুর জন্য ঈশ্বরই দায়ী। ধর্মগ্রন্থগুলির বিধান যদি ঈশ্বরের নির্দেশ হয়, সেই ঈশ্বর মোটেই বিচক্ষণ নয়, বিবেচক নয়। গোরু যদি ভারতের দেবতা হয়, তবে তা এখানে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের ভক্ষ্যণীয় হত না। একই পৃথিবীতে একই জিনিস এক গোষ্ঠীর কাছে দেবতা, অন্য গোষ্ঠীর কাছে খাদ্য হত না। এক গোষ্ঠীর কাছে পাপ, অন্য গোষ্ঠীর কাছে সুন্নত হত না। আরবের জীবনযাত্রা গড়ে উঠেছে মরুভূমি এবং সেখানকার জলবায়ুর উপর। এই সত্য পৃথিবীর সমস্ত ভূখণ্ডের জন্যই। ভৌগোলিক কারণেই সেই অঞ্চলের মানুষদের পোশাক নির্দিষ্ট হয়। তাই আরবের নারী-পুরুষনির্বিশেষে মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা পোশাক পরতে হয়। সে নিয়ম অন্য কোনো দেশের মানুষদের জন্য প্রযোজ্য নয়। কোনো ধর্মগ্রন্থে যদি এই রকম নির্দেশ থাকে তাহলে বুঝতে হবে সেই ধর্মবেত্তাদের বিচক্ষণতার অভাব আছে। ভারতে মরু-জলবায়ুর কারণে রাজস্থানেও এরকম পোশাক পরার প্রচলন আছে। রাজস্থানের মানুষ যে ধরনের পোশাক পরিধান করেন সেই ধরনের পোশাক পশ্চিমবঙ্গের মানুষ পরিধান করতে পারে না। পোশাক ধর্মীয় কারণে নয়, ভৌগোলিক কারণেই নির্ধারিত
যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানুষের কাছে ঈশ্বরের বিশ্বাস মানসিক শান্তির জন্য দরকার হতে পারে, তাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সেই ব্যক্তিগত বিশ্বাসটা অন্যের ঘাড়ে ছলে-বলে-কৌশলে চাপিয়ে দেওয়াটা ঘোরতর অন্যায় কাজ। নাস্তিকগণ আপনার ঈশ্বর-ভাবনায় একমত হবেন কেন? আপনি যেভাবে ঈশ্বরকে নিয়ে ভাবেন নাস্তিকরা সেভাবে ভাবেন না। নাস্তিকরা মনে করেন ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি করেছেন বলেই ঈশ্বর মানুষের মতো দেখতে। গোরু, সাপ, ডাইনোমোরাসরা যদি ঈশ্বর সৃষ্টি করত তাহলে তাদের ঈশ্বর তাদের মতোই দেখতে হত। মানুষের ঈশ্বর মানুষ সহ দু-চারটি প্রাণী ছাড়া আর কোনো প্রাণীরই খবর জানেন না। অথচ জলে-স্থলে-অন্তরিক্ষে সব মিলিয়ে কোটি কোটি প্রাণীর অস্তিত্ব আছে। তাদের ব্যাপারে ঈশ্বর এবং ধর্মগ্রন্থ কিছুই উল্লেখ করেননি। সেটা নিশ্চয়ই নির্মাতাদের সংকীর্ণ জ্ঞানের কারণেই। কে যেন বলেছিলেন—’যে মানুষ সর্বপ্রথম ঈশ্বরের ধারণার জন্ম দিয়েছিল সে জগতের শ্রেষ্ট বাটপার’।
অনেকেই নাস্তিক এবং নাস্তিকতাকে দেশের ও সমাজের পক্ষে সর্বনাশা বলে মনে করেন। নিত্যনতুন অভিযোগ শোনা যায় নাস্তিকদের বিরুদ্ধে। বলেন অমুকে নাস্তিক ছিল সে এই ওই করেছে, সুতরাং নাস্তিকেরা খারাপ। কিন্তু আরও দশজন নাস্তিক যদি উপকার করে থাকেন তাহলেও সে নিয়ে কোনো বিশেষ উচ্চবাচ্য নেই। তা ছাড়া নাস্তিক হলেই যে তাঁকে ষড়রিপু (কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য) থেকে মুক্ত হতে হবে এমন দোহাই তো কেউ দেননি। নাস্তিকও দোষেগুণে মানুষ, সেটাই স্বাভাবিক। একজন আস্তিকের মতো নাস্তিকেরও কিছু মৌলিক অধিকার আছে এবং থাকবে। বেঁচে থাকার জন্য সবরকমের লড়াই আস্তিকের মতো নাস্তিকেরও থাকবে। নাস্তিক মানে তো এই নয় যে আপনি এক গালে চড় মারলে আর-এক গাল পেতে দেবে আর আর একটা চড় খাওয়ার জন্য। বরং যেটা স্বাভাবিক সেটাই হতে পারে–ইট খেয়ে পাটকেল ফেরত দিতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, নাস্তিকরা যাই-ই করুক তা ঈশ্বরের নামে বা ধর্মের নামে করেন না। তাঁরা যাই-ই করুন না-কেন সব দায় নিজের কাঁধেই নেবেন, ঈশ্বর বা ধর্মের কাঁধে চাপাবেন না। একটা ঘটনাবলি–
ঘটনাটি কলকাতার। কলকাতার নাদিয়াল থানা এলাকার বাগদি পাড়ায়। নাদিয়াল থানা এলাকার বাগদি পাড়া রিকশা স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত গলায় কথা বলছিল এক যুবক আর এক মহিলা। অন্য আর-এক মহিলা ওই দুজনকে প্রাণপণ কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। হঠাৎই যুবক পোশাকের মধ্যে থেকে একটা তলোয়ার বের করে মহিলার গলায় বসিয়ে দিল কোপ। ধড় থেকে আলাদা হয়ে মাথাটা ছিটকে পড়ল রাস্তায়। খোলা তলোয়ারের সামনে এগোবে কে? যুবক তখন চিৎকার করে বলছে, “এটা আমাদের পারিবারিক বিষয়। কেউ এগোলে গর্দান নামিয়ে দেব।” উঁত-রঙা সালোয়ার-কামিজ পরা ধড় রাস্তাতেই পড়ে রইল। ডান হাতে মুণ্ডটা ঝুলিয়ে নিয়ে হাঁটা শুরু করল সৌম্যদর্শন যুবকটি। বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পরিবারের সম্মানহানি করার দায়ে নিজের বোনকে এই ভাবে শাস্তি দিল দাদা। বোনের বয়স ২৪, নাম নিলোফার বেগম। দাদার নাম মেহতাব আলম (২৮)। মেহতাব বোনের মুণ্ড আর তলোয়ার হাতে নিয়ে পুলিশের কাছে ধরা দেয়। এই ঘটনায় স্থানীয় ধর্মবেত্তারা বললেন, “এটা কোনো অন্যায় কাজ নয়। এর মধ্যে কোনো অন্যায় দেখি না। আমাদের ধর্মে নাজায়েস সম্পর্কের কারণে পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে এমন কাজ করা যায়। এই কর্তব্য পালন করার জন্য মেহতাবের বেহেস্তে জায়গা হবে”। হ্যাঁ, এটাই তথাকথিত ধর্মের অন্ধকারময় দিক, যা অনেকে মেনে চলার পক্ষপাতী।
একইরকম আর-একটি ঘটনা। এটি পাকিস্তানে সংঘটিত হয়েছে। লাহোরে পারিবারিক সম্মান রক্ষার কথা বলে মা ও দুই বোনকে গলা কেটে হত্যা করেছে দুই যুবক। জানা গেছে, হাতে কোনো মজবুত প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও সৎ দুই বোন আমেনা আর মুক্কাদাসকে নিয়ে মারাত্মক সন্দেহে ভুগতেন কুড়ির কাছাকাছি বয়সের দুই ভাই। বোনেদের নানাভাবে সতর্ক করার পরও নাকি তাঁরা সংশোধন হননি। উপরন্তু মা সুঘরার প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়-আশ্রয় পেয়ে দিনদিন তাঁদের অবাধ্যতা বেড়েই চলেছিল। এর উপর ছিল মহল্লার তরুণদের টিকা টিপ্পনি। বন্ধুরাও কথায় কথায় দুই তরুণীকে নিয়ে হর-হামেশাই রসালো আলোচনায় মেতে উঠত। আর এসব দেখে-শুনে শরীরের রক্ত ফুটে উঠত ভাইদের। শেষপর্যন্ত যাবতীয় বিড়ম্বনার হাত থেকে রেহাই পেতে হত্যার মতো চরম সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। ভোররাতে ঘুমন্ত পঞ্চাশোর্ধ্ব মা এবং দুই যুবতী বোনের গলা ছুরির কোপ বসিয়ে দেয় ওই দুই যুবক। এ ঘটনাও কি ধর্মীয় নির্দেশ পালন করল যুবকটি?
তৃতীয় ঘটনাটি পড়ন। ঘটেছে মহারাষ্ট্রে। তান্ত্রিকের কথায় বিপুল ধন-সম্পদ ও সুখ আর সমৃদ্ধির জন্য নিজের মাকে বলি দিয়েছে দুই ভাই। মাকে হত্যার দায়ে ওই দুই ভাইকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তান্ত্রিক পলাতক রয়েছে। ভারতের মহারাষ্ট্রের নাসিকে এ ঘটনা ঘটেছে। থানে জেলার ডানডায়াল গ্রামের কাশীনাথ ডোরে এবং গোবিন্দ্র ডোরে এক মহিলা তান্ত্রিক বাচুবাই খড়কের কাছে যায়। তান্ত্রিক দুই ভাইকে ভগবানকে খুশি করার জন্য নিজের মাকে বলি দেওয়ার কথা বলে। কাশীনাথ ও গোবিন্দ্র তান্ত্রিকের কথায় প্রলুব্ধ হয়ে নিজের মা বুধিবাই ডোরেকে হত্যা করে। ঘটনাটি ঘটলে সম্প্রতি নিহত মা বুধিবাই ডোরের মেয়ে একটি সামাজিক সংস্থার কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ করে। মাকে হত্যাকারী দুই ভাই জানায়, তান্ত্রিকের কথামতো মাকে হত্যা করার পর সব ধরনের চেষ্টা করার পরও ধনী হতে পারিনি। তাঁরা জানায়, তান্ত্রিক বলেছিল আমাদের মা-বোন ডাইনি এবং তাঁদের জন্য আমাদের ধন-সম্পদ হচ্ছে না। নাস্তিকগণ এ ধরনের বিশ্বাস পোষণ করেন না। নাস্তিকগণ এ ধরনের ঘটনা সংঘটিত করবেন অবিশ্বাসের কারণেই। খুব অন্যায় হবে কী!
আস্তিকগণদের মধ্যে কেউ কেউ বলে থাকেন নাস্তিকদের কোনো জীবনদর্শন থাকে না। জীবনদর্শন? সেটা কেমন দেখতে? সেটা আস্তিক-নাস্তিক ভাবনার উপর নির্ভর করে নাকি? যে জীবনদর্শন মানুষ ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে আয়ত্ত করে, বা যে আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা ধার্মিকেরা অর্জন করে থাকে–নাস্তিকেরা তাঁকে নিশ্চয়ই অপছন্দ করে। তাই বলে নাস্তিকদের জীবনদর্শন নেই এটা বলা যায় না। ধর্মগ্রন্থ পড়লেই জীবনদর্শন লব্ধ হয় না। জীবনদর্শন উপলব্ধির বিষয়। জীবনদর্শন অর্জনের বিষয়। জীবনদর্শন বোধের বিষয়। জীবনদর্শন জীবনচর্চার বিষয়। বলা যায় নাস্তিকেরা প্রকৃতই জীবনদর্শন অর্জন করে থাকে। আস্তিকদের জীবনদর্শন মানেই তো পরকালের প্রস্তুতিমাত্র। জীবনদর্শনের মানে যদি এই হয় নিজেকে পরলোকে ভালো অবস্থানের বা স্বর্গলাভের জন্য প্রস্তুত করা, তাহলে সেই জীবদর্শনকে নাস্তিকরা জীবনদর্শন বলে না। বলে পরলোকদর্শন। তাই নয় কি? নাস্তিকেরা কোনো তত্ত্বের ব্যাখ্যার জন্য কাল্পনিক বা পূর্বপরিকল্পিত সর্বশক্তিমানের সাহায্য নেয় না। তাঁরা সেই তত্ত্বকে বাস্তবের মাটিতে রেখে পর্যবেক্ষণলব্ধ সূত্র থেকে ব্যাখ্যার চেষ্টা করে। যে ঈশ্বর জীবদ্দশায় মানুষকে দু-মুঠো অন্ন জোগানোর ক্ষমতা রাখে না, সেই ঈশ্বর মহাসুখ দেবে–এ ঢপলিং আস্তিকরা বিশ্বাস করলেও নাস্তিকরা বিশ্বাস করে না।
নাস্তিক্যবাদ কি একটা ফ্যাশনমাত্র? এমন কথা আস্তিকগণরা বলেন বইকি! আমি নই, জবাব দিয়েছেন নাস্তিক্যবাদী শুভজিৎ ভৌমিক। শুভজিৎ বলছেন, “মানুষের বিশ্বাস যদি হয় ফ্যাশন বিচারের মাপকাঠি, তাহলে ইসলাম একটা ফ্যাশন, হিন্দুধর্ম একটা ফ্যাশন এবং পৃথিবীর যাবতীয় বিশ্বাস হচ্ছে ফ্যাশন। সেই অনুযায়ী, আপনি যদি ধর্ম পালন করে ফ্যাশন দেখাতে পারেন, তাহলে আমি ধর্মপালন না করে ফ্যাশন দেখাতে পারব না কেন? না মানে, বলতে চাইছি এটা বাকি সবার চেয়ে আলাদা হওয়ার একটা চেষ্টা, তাই না? নির্দিষ্ট ধর্ম পালনই হচ্ছে আসলে মানুষের চেয়ে আলাদা হওয়ার চেষ্টা। আপনি একটি ধর্ম গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে ওই ধর্মটি বাদে পৃথিবীর বাকি ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা হয়ে গেলেন, তাই নয় কি? শুধু তাই নয়, এটা আপনাকে একেবারেই আলাদা করে দেবে। এক ধর্মের বিশ্বাসের সঙ্গে আর-এক ধর্মের বিশ্বাসে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এক ধর্ম অন্য ধর্মকে বাতিল করে দেয় এবং অন্য ধর্মাবলম্বীকে ভালো চোখে দেখে না। তাই আপনাকে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী থেকে শত হাত দূরে থাকতে হবে। তার মানে কী দাঁড়াচ্ছে? ধর্ম পালন হচ্ছে বাকি সবার চেয়ে আলাদা হওয়ার চেষ্টা।”
নাস্তিকতা মানুষকে অর্জন করতে হয়। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া নিজের পরম্পরা, বিশ্বাস, পরিবারের সংস্কার, প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে অস্বীকার করার মতো যুক্তি একজন মানুষকে প্রকৃতই শিক্ষিত করে তোলে। প্রকৃতই যাঁরা বিজ্ঞানের চর্চা করেন, নিজের পর্যবেক্ষণকে যাঁরা ব্যাখ্যা করতে পারেন তাঁরা কোনো কিছুকে অন্ধভাবে মেনে নিতে পারেন না। নাস্তিকরা আস্তিকদের মতো নিজের যুক্তিকে অন্যের উপর কখনোই চাপান না। নাস্তিকরা তর্ক করেন, যুক্তি দেন, বিশ্লেষণ করেন–আর আস্তিকরা জ্ঞান-যুক্তির অভাবে অন্ধভাবে নিজের বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে থাকেন। নাস্তিকরা তর্ক করেন, যুক্তির কথা বলেন, বিশ্লেষণ করেন; অপরদিকে আস্তিকরা নিজের মত ও বিশ্বাসের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় রক্তপাতেও দ্বিধা বোধ করেন না। ধার্মিকদের মতের সমর্থন দেওয়ার জন্য পৃথিবীতে মানুষের অভাব পড়ে না। ভবিষ্যতেও অভাব পড়বে না। ধার্মিকদের রাষ্ট্রসহ প্রচুর পৃষ্ঠপোষক থাকে। কোটি কোটি টাকার ডোনেশন আসেধার্মিকদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু নাস্তিকদের সেই সমর্থনটা কোথা থেকেও পাওয়া যায় না।
অবশ্য সমর্থনের দরকার পড়ে না। কেউ সমর্থন করবে না-জেনেই মানুষ নাস্তিক হয়। পরিবারের সমর্থন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই থাকে না, থাকে না বন্ধু-বান্ধবদের সমর্থনও। নাস্তিকদের লড়াইটা একাই করতে হয়। সর্বশক্তিমান আস্তিক বা ধার্মিকদের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে লড়াইকরাটা যে কী কঠিন তা একমাত্র নাস্তিকরাই বোঝেন, হাড়েহাড়ে! খ্রিস্টানদের স্বপ্ন যদি সমগ্র পৃথিবীর ৭০০ কোটি মানুষ খ্রিস্টান বানানো ন্যায্য হয়, মুসলিমদের স্বপ্ন যদি সমগ্র পৃথিবীর ৭০০ কোটি মানুষ মুসলিম বানানো ন্যায্য হয়, হিন্দুদের স্বপ্ন যদি সমগ্র পৃথিবীর ৭০০ কোটি মানুষ হিন্দু বানানো ন্যায্য হয়, বৌদ্ধদের স্বপ্ন যদি সমগ্র পৃথিবীর ৭০০ কোটি মানুষ বৌদ্ধ বানানো ন্যায্য হয়–তবে অবশ্যই নাস্তিক চিন্তাশীল মানুষরাও স্বপ্ন দেখবে সমগ্র পৃথিবীর ৭০০ কোটি মানুষকে নাস্তিক বানানোর এবং অবশ্যই সেটা ন্যায্য হয়। দেখছিলাম কতিপয় ধর্মান্ধ ব্যক্তি রাস্তায় ‘নাস্তিকদের ফাঁসি চাই’ লিখে দাবি জানাচ্ছে, নাস্তিকরাও বলুক ওইসব ধর্মান্ধ ‘আস্তিকদের ফাঁসি চাই’। কেনই-বা ফাঁসিতে ঝোলানো হবে নাস্তিকদের?
নাস্তিকতা কোনো অপরাধ হতে পারে না। নাস্তিক্যবাদীরা অপরাধী হলে আস্তিক্যবাদীরাও শতগুণ বেশি অপরাধী। কোনো আস্তিক কোনো ধর্মকে শ্রেষ্ঠ বলছে মানে বাকি সব ধর্মকে নিকৃষ্ট বলছেন –এই নিকৃষ্ট বলার অপরাধেই সেইসব আস্তিকদের ফাঁসি হওয়া উচিত। আস্তিকদের এই ধারণাই বিশ্বজুড়ে রক্তপাত ঘটায়। যাঁরা রক্তপাত ঘটান তাঁরা দীর্ঘজীবন লাভ করবেন, আর যাঁরা মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে আনার চেষ্টা করে চলেছে নিরন্তর, তাঁদের ধরে ধরে ফাঁসি দেবেন। বাঃ। মধুচক্রে উঁকি মারা মানা যে! আস্তিকগণ মনে রাখুন, নাস্তিকদের ঠিক ততটাই বাঁচার অধিকার আছে, যতটা অধিকার আপনাদের। তাঁদের ফাঁসি চাওয়ার কে তোমরা? তাঁদেরকে তাদের মতো বাঁচতে দাও। মানুষকে ভালবাসাই ধর্ম, এর বাইরে আর কিছু বলার নেই।
আশার কথা, নাস্তিকরা ক্রমশই বাড়ছে। জগতের সব মানুষ যখন অন্ধবিশ্বাসে এবং কুসংস্কার বিশ্বাসে মগ্ন ঠিক সেই সময়টিতে প্রচুর মানুষ প্রতিদিন নাস্তিক হচ্ছেন। পৃথিবীর বেশিরভাগ বিখ্যাত জ্ঞানী মানুষগুলোই যে নাস্তিক। তা সত্ত্বে আস্তিকগণ নাস্তিকগণদের হত্যা করে নাস্তিকশূন্য করতে চায়। সেটা সম্ভব হবে না। নাস্তিকগণ মনে করেন, চারপাশে যে লোকগুলো আস্তিক তাঁদের জন্য করুণা হওয়া উচিত। এঁরা প্রকৃতপক্ষে অন্ধ এবং বাস্তবতাবর্জিত মানুষ। কুসংস্কারাচ্ছন্ন এইসব অন্ধ এবং মিথ্যেকে বিশ্বাসকারীদের জন্য একজন নাস্তিকের করুণা ছাড়া আর কিছু দেখানোর নেই। তাঁরা তো বাস্তব জ্ঞান থেকে বঞ্চিত এবং সত্যের আলো থেকে বঞ্চিত মানুষ। এঁরা বাঁচে মিথ্যের মধ্যে, এরা মারা যায় মিথ্যেকে বিশ্বাস করেই। নাস্তিকগণ কুসংস্কারকে এবং মানুষের অন্ধবিশ্বাসকে তুচ্ছ জ্ঞান করে মানবতার জন্য লড়াই করছেন। নাস্তিকগণ মানবতার সেবক। অন্ধবিশ্বাস এবং কুসংস্কারের হাত থেকে মানবতাকে বাঁচাতেই নাস্তিকদের আন্দোলন। মানুষের ইতিহাসে নাস্তিকদের নাম একদিন সম্মানের সঙ্গেই উচ্চারিত হবে। কারণ নাস্তিকরাই সমাজ থেকে অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার এবং মিথ্যে বিশ্বাসকে সমাজ থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করে দেবে।
ঈশ্বরের নামে, ধর্মের নামে যাঁরা মধুচক্র চালাবে তাঁদের বিরুদ্ধে লড়াই জারি থাকবে। বৈষম্যমূলক ও শোষণমূলক সমাজে থাকে নানা ধরনের অসুস্থ নিষ্ঠুর উপসর্গ যা কোনো অনুভূতিশীল মানুষের মন বেদনার্ত করে তুলবে। এই বেদনাই ধর্মের বিরুদ্ধে কলম ধরতে আমাদের মধ্যে প্রেষণা সৃষ্টি করে। অভিজিতের সঙ্গেই থাকতে হবে। অভিজিতের পথই আমাদের পথ। এই পথ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করার লক্ষ্যে আমাদের সংগ্রাম। রিলে করে করে বাটনটা হাতে তুলে নিতে হবে আমাদের। যুদ্ধ শুরু।
শুধু মানুষ কেন, এই বিশ্বের প্রতিটি কণার ধর্ম আছে। সেই হিসাবে নাস্তিকেরও ধর্ম আছে। আমি নাস্তিক, কিন্তু আমিও ধার্মিক। ধর্ম মানে কয়েকটি ভুর্জপত্রে লিখন নয়, যা মেনে চললেই ধার্মিক হওয়া যায় আর না-মানলেই নরকের কীট! মানুষের ধর্ম মানুষের মানবিক গুণ, যা মানুষকে অন্য প্রাণীর থেকে আলাদা করে। আসলে নাস্তিক বলে আলাদা করে ব্যাখ্যা দেওয়ার মতো কিছু আছে বলে মনে হয় না। তবে নাস্তিক, নির্ধার্মিক, অজ্ঞেয়বাদী, সংশয়বাদী–এদের মধ্যে কোনো প্রথাগত বিভেদ নেই, যা আছে তা হল সব বুদ্ধিগত এবং অহিংসতা। এরা সকলেই একই গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে আমি নাস্তিক্যবাদী, নাকি আস্তিক্যবাদী? আমি একই সঙ্গে চরম নাস্তিক, চরম সংশয়বাদী, চরম অজ্ঞেয়বাদী, চরম নির্ধার্মিক।
এই প্রবন্ধটি শেষ করব কয়েকজন প্রখ্যাত ব্যক্তিদের হীরকখণ্ড দিয়ে –
(১) “The true atheist will stay silent. To give a theist someone to debate is to harbour his delusion further.”–Charles Darwin
(২) “Religion is the masterpiece of the art of animal training, for it trains people as to how they shall think.”–Arthur Schopenhauer
(৩) “All religions are equally sublime to the ignorant., useful to the politician, and ridiculous to the philosopher.”–Lucretius
(8) “Religion is an incarnation of the most childish superstitions.”–Albert Einstein
(৫) “With or with religion, good people will do good things and bad people will do bad things. But for good people to do bad things, that takes religion.”–Steven Weinberg
(৬) “All children are atheists, they have no idea of God.”–Baron d’Holbach
(৭) “If God exists, I hope he has a good excuse.”–Woody Allen
(৮) “God is conscience. He is even the atheism of the atheist.”–Mahatma Gandhi
(৯) “When the Missionaries arrived, the Africans had the Land and the Missionaries had the Bible. They taught us how to pray with our eyes closed. When we opened them, they had the land and we had the Bible.”–Jomo Kenyatta
(১০) “Is God willing to prevent evil, but not able? Then he is not omnipotent. Is he able, but not willing? Then he is malevolent. Is he both able and willing? Then whence come the evil? Is he neither able nor willing? Then why call him God?”