- বইয়ের নামঃ গণিকা-দর্শন
- লেখকের নামঃ অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
০. মুখবন্ধ (গণিকা-দর্শন)
গণিকা-দর্শন (প্রাপ্তমনস্কদের জন্য) – অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
.
উৎসর্গ : কবি অলোক বিশ্বাসকে
এক শীতের সকালে যে আমাকে ভাবিয়েছিল, চাইলে আমিও লিখতে পারি
.
সূচিপত্র
- মুখবন্ধ
- বেশ্যানাং পুরুষাধিগমে রতির্বৃত্তিশ্চ সৰ্গাৎ
- গণিকা এবং চৌষট্টি কলার সমম্বয়
- স্বর্গের বেশ্যা যাঁহারা = স্বৰ্গবেশ্যা
- গণিকাবৃত্তির এক করুণ রূপ বিষকন্যা
- বাৎস্যায়নের চোখে গণিকা
- প্রাচীন সাহিত্যে গণিকা
- দেবদাসীর অন্য নাম গণিকা
- প্রাক-আধুনিক ও আধুনিক সাহিত্যে গণিকা
- বাবুবিলাসীদের গণিকাযাপন
- ভারতের বাঈজি-সংস্কৃতি ও গণিকাবৃত্তি
- ব্রিটিশ-ভারতে গণিকাদের সামাজিক অবস্থা
- অন্য দেশ : প্রাচীন সভ্যতায় গণিকাবৃত্তি
- যাত্রা-থিয়েটার-চলচ্চিত্রে গণিকা
- স্বাধীনতা সংগ্রামে গণিকা
- গণিকাবৃত্তি নানা রূপে
- দেশে দেশে গণিকাবৃত্তি
- পুরুষ যৌনকর্মীর বাজার
- গণিকাবৃত্তির বিশ্ব-অর্থনীতি
- গণিকালয়ের নাম সোনাগাছি
- উত্তরণ : বেশ্যা থেকে যৌনকর্মী
- পুরুষরা কেন যৌনকর্মীদের সাহচর্য চায়
- বেশ্যাদ্বারের মাটি : গূঢ়তত্ত্ব
- যৌনকর্মীরা কি বাধ্য হয়েই যৌনপেশায়?
- গণিকাবৃত্তির অধিকারের লড়াই, নিশ্চয়তা, নিরাপত্তায় স্বেচ্ছাসেবী
- গণিকাগমন এবং গনোরিয়া, সিফিলিস ও এইডস
.
মুখবন্ধ (গণিকা-দর্শন)
যৌনপেশা সাধারণত দুটো ভাগে ভাগ করে নেওয়া যায়–(১) রেড লাইট এরিয়া এবং (২) নন-রেড লাইট এরিয়া। রেড লাইট এরিয়ায় মূলত বিক্রি হয়ে, পাচার ও প্রতারিত হয়ে আসা মেয়েরা বাধ্য হয়ে যৌনপেশায় যুক্ত থাকে। এঁরা সমাজের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন। নন-রেড লাইট এরিয়ার গণিকারা স্বেচ্ছায় যৌনপেশা বেছে নেয়। অতিরিক্ত রোজগারে আশায় এ পেশায় আসে। এঁরা কেউ স্বাধীন, কেউ-বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাজ করে। এঁরা সমাজের মূলস্রোতে বুক ফুলিয়েই থাকে। চাকরির মতো সকালে সেজেগুজে বেরয়, রাতে বাড়ি ফেরে।
গণিকাবৃত্তি বা বেশ্যাবৃত্তি বা যৌনপেশা আমাদের মনুষ্য সমাজে দুটি নজরে বা দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয়। সর্বাপেক্ষা প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গিটি হল নোংরামি, অনৈতিক এবং দণ্ডনীয়। অর্থাৎ গণিকাবৃত্তিকে দেখা হয় পাপকর্ম বা পাপাচার হিসাবে। অপর দৃষ্টিভঙ্গিটি হল সেফটি ভালব, মানুষের যৌন অবদমন থেকে মুক্তিদাত্রী। নারীদের গণিকাবৃত্তিকে সেফটি ভালব হিসাবে দেখার কারণ বিবাহের সীমার মধ্যে যেসব পুরুষের অধরা যৌনবাসনা পূরণ না-হয়, তাঁদের সেই কামনা চরিতার্থ করতেই সমাজে গণিকাবৃত্তির প্রয়োজন। গণিকারা যেন নীলকণ্ঠ, সমাজের পুরুষ-বিষ ধারণ করবে সে–এরকম একটা ট্যাবু।
অন্দরমহলে নারীর মূলত প্রধান দুটি ভূমিকা–একটি স্ত্রী, অন্যটি মাতা। দুটি সম্পর্কেই যত দ্বন্দ্ব! দুটি ভূমিকাই প্রজন্মের প্রজনন কর্মের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। প্রজনন প্রশ্নে অবশ্যই আসবে যৌনতা। যৌনতা বলতে গোদা বাংলায় অবশ্যই যৌনক্রিয়া বা ইন্টারকোর্স বোঝায়। যেহেতু নারীর যৌনতাকে কেবলমাত্র বিবাহের মাধ্যমেই বৈধতা দেওয়া হয়েছে, তাই বিবাহের মধ্যেই যৌনতাকে সংগঠিত করা হয়। বৈবাহিক জীবনে নারীর যৌনতা একটি গৃহস্থালী দায়িত্ব ও কর্তব্যে পর্যবসিত হয়ে যায়। স্বামীর যৌনক্ষুধা নিবারণ ও সন্তান উৎপাদনের জন্য উৎসর্গীকৃত নারী। স্বামী-স্ত্রীর এই সম্পর্কে যদি স্ত্রীর কামনা-বাসনা কিছুটাও পরিতৃপ্ত হয়, তা সত্ত্বেও বিবাহ নামক এই প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি হয়েছে সন্তান উৎপাদন ও স্বামীর যৌনক্ষুধা নিবারণ করতে। নারীর যৌনক্ষুধার তৃপ্তি মিটুক বা না-মিটুক বংশরক্ষার কারণে নারীকে অবশ্যই যৌনকর্ম করতে হবে। পুরুষকেও কেবলমাত্র স্ত্রীর সঙ্গেই যৌনকর্ম করতে হবে। তবে পুরুষ স্ত্রীসঙ্গ ছাড়া অন্য নারীর সঙ্গও পেতে পারে। বিশাল বাজার তাঁর জন্য খোলা আছে। চাইলেই বহুগামী মনকে বিকশিত করতে পারে। অথবা যৌন অবদমন থেকে মুক্তি পেতে পারে। কিন্তু আর্থ-সামাজিক কারণে তেমন সুযোগ হয়তো কম। সেই কম সুযোগটাকেও অনেক সাহসী নারী কাজে লাগিয়ে থাকে। স্বামী বা স্ত্রী ব্যতীত অন্য নারী বা পুরুষের সঙ্গে যৌনাচার করতে সাহস তো লাগেই। তাই নারী যৌনকর্মীদের সঙ্গে সঙ্গে পুরুষ যৌনকর্মীদের বাজারও আছে। দেহ বিক্রির বাজার না-নারী না-পুরুষদের জন্যেও আছে, যাদের আমরা সমকামী ও রূপান্তরকামী বলে থাকি।
গণিকাবৃত্তির যদি কেবলই নেতিবাচক প্রভাব থাকত, তবে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি সমাজে বা রাষ্ট্রে এই পেশা বিদ্যমান থাকত না হাজার হাজার বছর ধরে। কবেই নির্মূল হয়ে যেত। আসলে সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে এর বহু ইতিবাচক প্রভাব আছে। পেশাগত দিক থেকেও লাভজনক। ইকোসিস্টেমে যেমন পৃথিবীর কোনো প্রাণীকেই অপ্রয়োজনীয় ভাবতে পারি না, তেমনি কোনো পেশাকেই অপ্রয়োজনীয় ভাবার কোনো অর্থ নেই। কেউ যদি স্বেচ্ছায় কোনো পেশা বেছে নিয়ে নিজের মতো করে, তাতে তো কারোর আপত্তি থাকার কথা নয়। সারা দেশে বেকারত্বের সংখ্যা উত্তোরত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি সর্বত্র কর্মসংস্থানের হাহাকার। উচ্চমেধাদের জন্য কিছু ব্যবস্থা থাকলেও মধ্যমেধা আর নিন্মমেধাদের জন্য আর কোনো কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। চতুর্দিকে যে হারে অটোমেশন ঢুকে পড়েছে, ভবিষ্যতে মধ্যমেধা আর নিন্মমেধারা ভয়ানকভাবে সংকটে পড়বে। এখনই পরিলক্ষিত হচ্ছে এমএ পাশ পিএইচডি করা ছেলেমেয়েরা চতুর্থ শ্রেণি বা ডোমের পেশার মতো জায়গায় আবেদন করছে। যাঁরা বিশেষ কোনো কাজে দক্ষ নয়, তাঁরা নির্বিবাদে বেছে নিচ্ছে অন্য পেশা। তার মধ্যে যৌনপেশাও আছে–নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। কী বললেন? যৌনপেশা সম্মানজনক পেশা নয়? সমাজ যৌনকর্মীদের ঘৃণা করে? একদম ঠিক বলেছেন। যৌনপেশা ছাড়া গোটা পৃথিবী সহ আমাদের দেশেও অসংখ্য মানুষ নিজের পেশা লুকিয়ে জীবন অতিবাহিত করে। কী পুরুষ, কী নারী। কারণ সেই পেশা সমাজে সম্মানজনক নয়। সমাজের এক শ্রেণির মানুষ সেই পেশাকে ‘ছোটো কাজ’ বলে ঘৃণা করে। তাঁর প্রতি সম্বোধনই বদলে যায়। তবুও মানুষকে সেই পেশাকেই বেছে নিতে ভরা পেটে বেঁচে থাকার জন্য। পাথরপ্রতিমায় আমার এক পরিচিতের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সে রিকশা চালাচ্ছিল। আমার ক্লাসমেট ছিল। ও বনগাঁ থেকে প্রতিদিন সকালে স্যুটেড বুটেড হয়ে হাতে অফিস ব্যাগ নিয়ে ট্রেন ধরত। সবাই জানত সে কোনো অফিসে কাজ করে। পাথরপ্রতিমায় এসে নিজের পোশাক খুলে রিকশার সিটের নীচে ঢুকিয়ে রেখে সস্তার পোশাক পরে নিত। তারপর রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়ত। এরকম অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়।
‘International Encyclopedia of Social’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে–সমাজ গণিকাবৃত্তিকে ঘৃণার চোখে দেখলেও এর বিলুপ্তির জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করেনি। কারণ কতগুলো সামাজিক কাজ এটি করে থাকে। ফলে সমাজে ধর্ষণ প্রবণতাও হ্রাস পায়। বিবাহ ছাড়া যৌনক্ষুধার মতো মৌলিক ও জৈবিক চাহিদা পূরণের সুযোগ শুধু গণিকারাই দিয়ে থাকে। এভাবে যৌনকর্মীরা নিজের জীবনজীবিকার সঙ্গে সঙ্গে পরোক্ষ উপকারও করছে সমাজের। আসলে গণিকাবৃত্তি ছাড়াও অসংখ্য ‘নিকৃষ্ট’ পেশা আমাদের সমাজে টিকে আছে মানুষেরই স্বার্থের জন্যে। এইসব ইতিবাচক প্রভাব এবং সমাজের পরোক্ষ উপকারের জন্যই সমাজের ঘৃণিত প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও বিলুপ্ত করা হয়নি, হবেও না। তাই গণিকাবৃত্তির অনুমোদনে সরাসরি কোনো আইনের অস্তিত্ব না-থাকলে পরোক্ষভাবে গণিকাবৃত্তির অস্তিত্ব মেনে নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের মতো বেশ কিছু দেশে আবার ১৮ বছরের উপরের যুবতীদের এফিডেভিটের মাধ্যমে স্বেচ্ছায় গণিকাবৃত্তি গ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। থাইল্যান্ডের সরকার পর্যটন পরিকল্পনার আওতায় গণিকাবৃত্তিকে ‘জাতীয় শিল্প হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার পর এমন হয়েছে যে, সেই দেশের সব মেয়েকেই মনে করা হয় যৌনকর্মী। ফলে রাস্তায় দাঁড়ানো যে-কোনো মেয়ের কাছে গিয়ে পর্যটকরা বলা আরম্ভ করল, তাঁর সঙ্গে মেয়েটি শোবে কি না!
নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, আর্জেন্টিনা, আর্মেনিয়া, অস্ট্রিয়া, বেলিজ, লাটভিয়া, বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকার কিছু অংশ আছে, যেখানে গণিকাবৃত্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত নীতিগুলি আরও উদার। সেসব দেশে বেশ কয়েকটি বৈধ গণিকালয়ও আছে। তবে উত্তর কোরিয়া, সুদান, ইরান এবং সৌদি আরবের মতো দেশও আছে, যেখানে গণিকাবৃত্তি একটি গুরুতর অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হয় এবং যদি দোষী সাব্যস্ত হয়—শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তাই বলে সেখানে গণিকাবৃত্তি সেখানে বন্ধ আছে? গণিকাবৃত্তি বৈধকরণ সম্পর্কিত ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে কোনো মিল নেই। অবৈধ হওয়া সত্ত্বেও গৃহযুদ্ধের কারণে সামাজিক ভাঙন এবং দারিদ্র্যের কারণে আফ্রিকার কয়েকটি দেশে গণিকাবৃত্তি পরিচালিত হয়। গণিকাবৃত্তি ভারত, নেপাল, ভুটান এবং পাকিস্তানে অবৈধ, তবে এখনও বিভিন্ন ছদ্মবেশে চলছে। এশীয় দেশগুলির মধ্যে থাইল্যান্ডে যৌন পর্যটন বেশ জনপ্রিয়।
বিশ্বের বহু দেশেই গণিকাবৃত্তি বৈধ এবং সেখানে যৌনকর্মীরা নিয়মিত আয়করও দেন। হল্যান্ডে পর্যটকদের মূল আকর্ষণই এই ‘গণিকাপল্লি’, পুরোপুরি বৈধ। ইউরোপের এই দেশটির গণিকাপল্লি সত্যিকার অর্থেই বিশ্ববিখ্যাত। ওই ‘রেডলাইট জোন’ দেখতে প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজারো পর্যটক আসে আমস্টারডামে। নেদারল্যান্ডসের মতো ইউরোপের আর-এক দেশ বেলজিয়ামেও দেহ-ব্যাবসা সম্পূর্ণ বৈধ। জার্মানি এবং ফ্রান্সে বৈধ হলেও কঠোর, সেক্ষেত্রে যৌনকর্মীদের মানতে হয় কঠোর আইন। জার্মানির কিছু শহরে যৌনকর্মীরা রাস্তায় নেমে ক্লায়েন্টদের ডাকতে পারে না। ফ্রান্সেও ২০১৪ সালে এমন একটা আইন হয়েছে, যা মেনে যথেচ্ছ দেহ-ব্যাবসা করা খুব কঠিন। সুইডেন আর নরওয়েতেও নিয়ন্ত্রিত গণিকাবৃত্তি। ফ্রান্সের ২০১৪ সালের আইনটি প্রথম চালু হয়েছিল, সুইডেনে ১৯৯৯ সালে। এই কারণে আইনটি ‘সুইডিশ মডেল হিসাবে পরিচিত। এ আইনে যৌনকর্মীদের অধিকার রক্ষা করে দালালদের নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সুইজারল্যান্ড ও অস্ট্রিয়ায় যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা বাধ্যতামূলক। তবে এই দুটি দেশে ১৯ বছর বয়স না-হলে কেউ দেহ-ব্যাবসায় আসতে পারেন না। যৌনকর্মীদের যাতে কোনো যৌনরোগ না-হয় কিংবা তাঁদের মাধ্যমে ক্লায়েন্টদের মধ্যে যাতে এইডস, সিফিলিস বা অন্য কোনো যৌনরোগ ছড়াতে না-পারে, তা নিশ্চিত করতে যৌনকর্মীদের নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা করাতে হয়। অবশ্য শুধু সুইজারল্যান্ড ও অস্ট্রিয়াতে নয়, জার্মানিতেও ওই একই নিয়ম। গ্রিস ও তুরস্কেও গণিকাবৃত্তি নিয়ন্ত্রিত। গ্রিস এবং তুরস্কেও গণিকাবৃত্তি পুরোপুরি বৈধ। তবে দেহ-ব্যাবসার আইন। খুব কঠিন। জার্মানির মতো এই দুটি দেশেও যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্যবিমা করা বাধ্যতামূলক। এছাড়া যৌনকর্মীরা নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা করায় কি না, তা সবসময় তদারক করা হয়। স্বাস্থ্যকার্ডেই লেখা থাকে স্বাস্থ্যপরীক্ষার সব তথ্য। দক্ষিণ আমেরিকায় অধিকাংশ দেশেই যৌন-ব্যাবসা বৈধ। তবে কিছু দেশে মাফিয়া এবং মানব পাচার বড়ো সমস্যা হয়ে ওঠায় এই ব্যাবসার উপর কড়া নজর এবং তদারকি বেড়েছে। দেহ-ব্যাবসাকে মাফিয়া চক্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখতে ব্রাজিল এবং মেক্সিকোতে আছে কঠোর আইন। তারপরও দেশ দুটিতে মাফিয়া চক্রের আধিপত্য থেকে গেছে। প্রতিবেশী হয়েও নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার আলাদা নিয়ম, নিউজিল্যান্ডে যৌন ব্যাবসা একেবারেই বৈধ। তবে প্রতিবেশী দেশ অস্ট্রেলিয়ার অনেক রাজ্যে এই ব্যাবসা এখনও অবৈধ। ২০০৩ সালে আইন করে সব প্রাপ্তবয়স্কের জন্য যৌন-ব্যাবসাকে বৈধ করে দেয় নিউজিল্যান্ড।
আমার এই ‘গণিকা-দর্শন’ গ্রন্থে বিশ্বদর্শনের যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি। সমাজের সব শ্রেণির যৌনকর্মীদের নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করেছি। তুলে আনার চেষ্টা করেছি গোটা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণিকাবৃত্তির ইতিহাস ও বর্তমান বহমানতা। যৌনপেশা কারা করে? কেন করে? কারা যায় যৌনকর্মীর কাছে? কেন যায়? যৌনকর্ম কি বৈধ করা উচিত? কেন উচিত নয়? কেন অনুচিত? সমস্ত দূরহ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছি এই গ্রন্থে। বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে গণিকাবৃত্তির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে। যৌনকর্মীদের অন্দরমহলের কথা উঠে এসেছে। উঠে এসেছে তাঁদের জীবন-যৌবন-অর্থের কথাও। চমকে যাওয়ার মতো অনেক তথ্য উঠেছে, যা আগে কখনো কেউ বলেনি। এই গ্রন্থ কেবলমাত্র তথ্যের ঘনঘটা নয়, এটি একট ওয়ার্কশপ। মাঠে নেমে সংশ্লিষ্ট মানুষের সঙ্গে কথা বলে তুলে এনেছি মানুষের কথাই। যৌনপল্লিতে ঘুরে ঘুরে শুধু অন্ধকার খুঁজিনি, খুঁজেছি আলোর রশ্মিও। যৌনপল্লিগুলির বাইরেও আছে দেহ বিক্রেতাদের বৃহৎ বাজার। সেখানেও পৌঁছে গেছি ছলে-বলে-কৌশলে। সহজ কাজ ছিল না। পৌঁছে যেতে পেরেছি পুরুষ। যৌনকর্মীদের কাছেও। সর্বোপরি এটা বলে রাখা প্রয়োজন, এই গ্রন্থটি শুধুমাত্র প্রাপ্তমনস্কদের জন্য পাঠযোগ্য বলেছি। তার কারণ এই গ্রন্থে এমন অনেক বর্ণনা আছে এমন অনেক বিষয় আলোচিত হয়েছে, যা কখনোই অপ্রাপ্তমনস্কদের পাঠ্য নয়।
গণিকা বা পতিতা বা বেশ্যা অথবা যৌনকর্মী যাই-ই বলি না-কেন–সম্মান বা মর্যাদায় কোনো আকাশপাতাল প্রভেদ দেখি না। যৌনকর্মী’ বলার মধ্যে একটা ‘কর্মী’ স্বীকৃতি পায় বটে, আসলে পেশার পরিচয়ে সব শব্দই সমান। তবে আমি ‘গণিকাপরিচয় দিয়েই লেখা এগিয়ে নিয়ে গেছি। তবে কোথাও কোথাও অবশ্য ‘যৌনকর্মী’ সম্বোধনও করেছি প্রয়োজনে।
যৌনকর্মী বা গণিকাদের বিষয় করে ইংরেজি ভাষায় প্রচুর বইপত্র বাজারে আছে। কিন্তু গণিকাদের নিয়ে বাংলা ভাষায় লেখা বইপত্র অতি বিরল। থাকলেও তা পূর্ণাঙ্গ নয়। সেই তাগিদ থেকেই ‘গণিকা-দর্শন’ বাংলা ভাষায় লেখা এমনই একটি বই। পাঠকের প্রাপ্তিও অনেক বেশি হবে। এটা পাঠকরা এই আশা করতেই পারেন। সেই আশা পূরণের চেষ্টা করেছি, যতটা সম্ভব। জ্ঞানপিপাসু এবং কৌতূহলী পাঠকদের কথা মাথায় রেখে প্রচুর তথ্য সংযোজন করা হয়েছে। বিভিন্ন সংযোজনের মাধ্যমে গ্রন্থের বিষয়কে আপ টু ডেট করা হয়েছে। আশা করি এ গ্রন্থটি সর্বস্তরে আগ্রহ ও গুরুত্ব সহকারে পঠিত হবে।
পরিশেষে বলি, দীর্ঘ ১৪ বছরের গবেষণার ফল এই গ্রন্থটি। গ্রন্থ হয়ে ওঠার পিছনে যে অসংখ্য মানুষের সাহায্যের হাত আমার হাত ছুঁয়েছে, যাঁরা আমার সুপ্ত স্বপ্নকে সাকার করেছে নানাভাবে তাঁদের ঋণ কখনোই শোধ যাবে না। কৃতজ্ঞতা রইল অফুরাণ। বিভিন্ন স্তরের সেইসব যৌনকর্মীদের কাছেও আমি ঋণী, যাঁরা তাঁদের মূল্যবান সময় থেকে আমাকে সময় দিয়েছেন। তাঁদের জন্য কৃতজ্ঞতা অফুরাণ। শেষ পর্যন্ত পাঠক পরিতৃপ্ত ও সমৃদ্ধ হলে আমার পরিশ্রম সার্থক হবে। আমার এ লেখা পাঠকের চিন্তনে সামান্য আঁচড়ও যদি কাটতে পারে, তবেই আমি নিজেকে সার্থক বলে মনে করব।
০১. বেশ্যানাং পুরুষাধিগমে রতির্বৃত্তিশ্চ সৰ্গাৎ
‘পবিত্র’ গণিকাবৃত্তি প্রাচীন প্রাচ্য দেশে বেশি মাত্রায় হত। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ানরা ধর্মীয় যৌনতার প্রতিটি সুযোগই কাজে লাগাত। গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডটাস বলেন—ব্যাবলীয়ানদের সবচেয়ে খারাপ রীতি ছিল জীবনে একবার হলেও প্রত্যেক মহিলাকে বাধ্য করা হত আফ্রিদিতি মন্দিরে যেতে, যেখানে তাঁকে একজন অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে যৌনকর্মে লিপ্ত হতে হত। যেসব মহিলারা ধনী ও বংশমর্যাদায় গর্বিত ছিলেন, তাঁরা মিলিত হতে চাইতেন না। তাঁদের তখন দড়ি দিয়ে বেঁধে আনা হত মন্দিরে। প্রচুর অনুগামী লোক ভিড় করত তখন। এভাবে বিপুল সংখ্যক মহিলাদের আনা হত। যৌনকর্মে লিপ্ত হওয়ার আগে মহিলারা কখনোই বাড়িতে ফিরে যেতে পারতেন না। অপরিচিত কোনো লোককে অবশ্যই টাকা দিতে হত বন্দিনী মহিলার আঁচলে এবং তাঁকে আহবান করতে হত মাইলিত্তা দেবীর নামে। তাঁদের মন্দিরের বাইরে মিলিত হতে হত। টাকার পরিমাণ যাই হোক না-কেন, তা নিতে অস্বীকার করা পাপ মনে করা হত। এইভাবে সুন্দরী মহিলারা মর্যাদা খুঁইয়ে মুক্তি পেত অল্প দিনে। অসুন্দরীদের থাকতে হত দুই থেকে তিন বছর পর্যন্ত কোনো লোকের সঙ্গে যৌনমিলন হওয়া পর্যন্ত। খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৪ বছর আগে গ্রিসে জেনোফন নামের একজন অলিম্পিক বিজয়ী দেবীর মন্দিরে ১০০ জনের মতো তরুণীকে উপহার হিসেবে দান করে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ। করিন্থ নামক ওই শহরে দেবী আফ্রিদিতির মন্দির ছিল। রোমান যুগে ওই মন্দিরে প্রায় হাজারের উপর দেবদাসী ছিল।
“বেশ্যানাং পুরুষাধিগমে রতির্বৃত্তিশ্চ সৰ্গাৎ”–বেশ্যাগণের পুরুষগ্রহণ প্রবৃত্তি বা পুরুষকে প্রলুব্ধ করা এবং অর্থাৰ্জন সেই সৃষ্টিকাল থেকে চলে আসছে। এহেন ব্যাখ্যাই বাৎস্যায়ন তাঁর ‘কামসূত্র’ গ্রন্থের চতুর্থ অধিকরণে অবহিত করেছেন। বাৎস্যায়ন তাঁর গ্রন্থের চতুর্থ অধিকরণটি বৈশিক বা বেশ্যাদের জন্যই বেশ গুরুত্ব সহকারে বরাদ্দ রেখেছেন। প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে ‘বেশ্যা’ বিশেষণের বেশ কিছু সমতুল প্রতিশব্দ পাওয়া যায় পেশার ধরন হিসাবে। যেমন–পতিতা, বারাঙ্গনা, দেহপসারিণী, দেহপোজীবিনী, রূপোপজীবিনী, রক্ষিতা, খানকি, ছিনাল, বারবনিতা, উপপত্নী, জারিণী, সাধারণী, মহানগ্নী, পুংলী, পুংশ্চল, অতীত্বরী, বিজর্জরা, অসোঙ, অতিষ্কদ্বয়ী, গণিকা, গণেরুকা, নটী, হট্টবিলাসিনী এবং হাল আমলের ‘যৌনকর্মী। আমি যেহেতু আমার গ্রন্থের নাম ‘গণিকা দর্শন’ রেখেছি, তাই গোটা গ্রন্থে যথাসম্ভব ‘গণিকা’ প্রতিশব্দটিই ব্যবহার করব। তবে ইংরেজিতে যেমন Domimonde, Public Women, Hatairai, Aspasia, Phrynes ইত্যাদি শব্দের মতো আদিম ও প্রাগৈতিহাসিক বিশেষণ আছে, ঠিক তেমনি আধুনিক বিশেষণগুলি হল–Prostitute, Call Girl, Escort Girl, Pornstar ইত্যাদি।
মোদ্দা কথা, অর্থ বা পার্থিব সম্পদের বিনিময়ে যে নারীরা একাধিক পুরুষের সঙ্গে যৌনমিলন বা যৌনসুখ শরীর উলঙ্গ করে প্রদর্শনকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করেছে, তাঁকেই গণিকা (Prostitute) বলে। বলা হয়, এটি পৃথিবীর আদিম পেশা। বিশেষ এই পেশা মেয়েদের যে বিশেষণে বিশেষিত করা হয়েছে, সেগুলির সবই পেশার রকমফেরের উপর ভিত্তি করে। সবকটি বিশেষণের ব্যাখ্যা দিয়ে কলেবর বৃদ্ধি করব না। তবে আমাদের কাছে ‘বেশ্যা’ বিশেষণ বা পরিচয়টি বেশি পরিচিত। ভিন্টারনিৎসের মতে, ঋগবেদের প্রথম মণ্ডলের ১২৬ তম সূক্তের অন্তর্গত পঞ্চম ঋকে যে ‘বিশ্যা’ শব্দটি আছে, তা থেকেই ‘বেশ্যা’ শব্দটির উৎপত্তি। ঋকটি এরকম–“সুবন্ধবো যে বিশ্যা ইব ব্রা অনস্বন্তঃ শ্রব ঐযন্ত পূজা”। ভিন্টারনিৎস ঠিক না বেঠিক, সে ব্যাপারে এই ভারতের কোনো বেদবেত্তা আপত্তি করেছেন বলে শুনিনি।
‘বেশ্যা’ বা ‘গণিকা’ শব্দটির সঙ্গে ‘বৃত্তি’ শব্দটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এটাকে ব্যবসাও বলে, যেমন–দেহ-ব্যাবসা। যিনি অর্থ বা অন্য কোনো সম্পদের বিনিময়ে যৌনক্রিয়া করে, সে বিক্রেতা। আর সেই নারীর কাছে গিয়ে যৌনক্রিয়ার মাধ্যমে যৌনসুখ পেতে যে বা যাঁরা অর্থ বা সম্পদ প্রদান করে, সে ক্রেতা। যিনি অর্থ বা সম্পদের বিনিময়ে ক্রেতার সঙ্গে যৌনকর্মে লিপ্ত হন, সে যৌনসুখ পেল কি পেল না তাতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু যিনি অর্থ বা সম্পদ প্রদানের মাধ্যমে কোনো নারীর সঙ্গে যৌনক্রিয়া করতে আসেন, তাঁর যৌনসুখ অবশ্যই চাই। যৌনসুখ ছাড়া সে অর্থ প্রদান করবে না। ক্রেতাকে চরম যৌনসুখ দেওয়াটাই বিক্রেতার একমাত্র কর্তব্য। বিক্রেতারা চাইবে ক্রেতাদের নেশাগ্রস্ত কামগ্রস্ত করে তুলতে, যাতে ক্রেতারা বারবার বিক্রেতাদের কাছে আসে। কারণ শরীরই যে তাঁর পণ্য। ভালো মোড়কে সুস্বাদু করে পরিবেশন করতে হবে তাঁকে। শরীর বাজারে বিক্রেতার অধিকার অর্থ (Money), আর ক্রেতার অধিকার নারী-শরীর, যৌনসুখ।
গণিকাবৃত্তির শুরুটা ঠিক কবে থেকে? গণিকাবৃত্তির প্রসঙ্গ উঠলেই সবাই বলে ‘আদিম পেশা। “আদিম’ মানে কী? “আদিম জাতি’ বলতে আমরা সেই সময়ের মানুষের কথা বুঝি, যে সময় মানুষ পোশাকের ব্যবহার জানত না, উলঙ্গ থাকত। তাহলে গণিকাবৃত্তির শুরু কি সেইসময় থেকেই? গণিকাবৃত্তি ঠিক তখন থেকেই সৃষ্টি হয়েছে বলে আমি মনে করি না। সম্ভবত গণিকাবৃত্তি শুরু হয়েছে মানুষের পোশাকের ব্যাবহার শেখার অনেক পরে। নাগরিক সভ্যতায় বিনিময় প্রথার প্রচলন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শরীর বিক্রির প্রথা চালু হতে পারে। ক্রয়-বিক্রয় ব্যবস্থা চালু হলে শরীর বিক্রিও চালু হয়। নাগরিক জীবন শুরু হল বহির্দেশীয় মানুষদের আগমনের মধ্য দিয়ে। এই বহির্দেশীয়রাই ভূমিকন্যাদের যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করত। ক্রীতদাসী হিসাবে কিনে নিত বা দখল করত এবং যথেষ্ট ভোগ করত। সমাজের ধনশালী, বলশালী এবং তথাকথিত উচ্চস্তরের মানুষগুলো ভূমিকন্যা বা অনার্যদের সঙ্গে শারীরিকভাবে লিপ্ত হলেও স্বীকৃতি দেয়নি। অনার্য-কন্যাদের শারীরিকভাবে ভোগ করা যায়, কিন্তু গ্রহণ করা যায় না। প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে আমরা আর্য-অনার্যদের সংঘর্ষের কাহিনি পাই। মনুসংহিতায় এইভাবেই পেয়ে যাই হাজারো জারজ সন্তানের সংবাদ। ধর্ষণ করলে অনার্যদের শাস্তির বিধান ছিল, কিন্তু আর্যদের নয়। আর্যদের তুলনায় অনার্যরা সমরাস্ত্রের দিক দিয়ে দুর্বল ছিল। তাঁরা আর্যদের মতো তির-ধনুক, বর্শা, ছোঁড়া, কুঠার ব্যবহার করলেও শিরস্ত্রাণের ব্যবহার জানত না। তাই অনার্যদের বারবার পরাজয় ঘটত। সেই পরাজয়ের ফলে পুরুষ অনার্যদের হয় মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে, নচেৎ দাসত্ব বা বশ্যতা মেনে নিতে হয়েছে। আর অনার্য নারীরা দখলীকৃত ভোগের বস্তুতে পরিণত হয়েছে। প্রাচীন ও মধ্যযুগ জুড়ে অঞ্চলে অঞ্চলে যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই থাকত ভূমিদখলের জন্য। যুদ্ধে যুদ্ধে বিধ্বস্ত পুরুষরা ক্রীতদাসে পরিণত হত, আর নারীরা যৌনদাসীতে পরিণত হত। এঁদেরই একটা বড়ো অংশ যৌনজীবিকার পথ বেছে নিয়েছিল। সেইসব নারীরা বুঝে নিয়েছিল, নারী-শরীরের প্রতি পুরুষদের তীব্র লালসা। তাঁদের এই লালসা মোচন কেন মাগনায় হবে? সমাজেরই ধণিক শ্রেণি সেইসব নারীদের মূল্য নির্ধারণ করে দিল। তৈরি করা হল সেইসব নারীদের নির্দিষ্ট আস্তানা। সেই সময় গণিকাগমনের অধিকার ছিল শুধুমাত্র ধনীদেরই। সমাজে যখন রাজতান্ত্রিকতার উন্মেষ ঘটেছিল, তখন এইসব নারীদের শরীরী-ছলনায় শত্রু নিধন এবং গুপ্তচর বৃত্তির কাজে লাগানো হত। আজও এই ব্যবস্থা চালু আছে। স্বার্থসিদ্ধির জন্য নারীকে ‘ভেট’ দেওয়ার রীতি প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। আজকাল তো শুনছি নির্বাচনে প্রার্থী হিসাবে টিকিট পেতেও ‘মেয়েমানুষ’ ভেট দিতে হয়! একথা অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই বিশিষ্ট অতিথি, অমাত্য এবং অপরাপর উচ্চধনীবর্গদের আবদার মেটাতে নারী-শরীর উপঢৌকন দেওয়ার রীতি আজও অব্যাহত আছে। ব্রিটিশ যুগেও এই বৃত্তি রাষ্ট্রের আনুকূল্যে ও পৃষ্ঠপোষকতায় পুষ্ট হত। কলামিস্ট তসলিমা নাসরিন এই পেশা সম্বন্ধে এক লেখায় বলেছেন–“এটাকে পৃথিবীর প্রাচীনতম পেশা বলে লোককে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা হয় বটে, আসলে কিন্তু প্রাচীনতম পেশা নয়, এটা বরং মেয়েদের বিরুদ্ধে পৃথিবীর প্রাচীনতম নির্যাতন।”
প্রচলিত অর্থে বেশ্যা বা পতিতা বা গণিকা বলতে আমরা যেমনটাই বুঝি না-কেন, প্রাচীন ভারতে এইসব রমণীরা কিন্তু তেমনটা ছিলেন না। দেশের (দেশ বলতে সমগ্র ভারত বুঝবেন না। সে সময় দেশ বলতে সংশ্লিষ্ট রাজার শাসিত এক টুকরো ভূখণ্ড বা অঞ্চলকে বোঝাত।) রাজা স্বয়ং গণিকাদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বার্ষিক ১০০০ পণ বেতন দিয়ে রাজা তাঁর প্রাসাদে গণিকাদের নিয়োগ করতেন। গণিকাদের আয়ের একটা অংশ কর হিসাবে রাজাদের কোষাগারে সংগৃহীত হত। প্রাচীন ভারতে গণিকারা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হিসাবে গণ্য হত। তদুপরি গণিকাদের ঘরে যেমন জ্ঞানী-গুণীদের আলোচনা সভা বসত, আবার এমন জ্ঞানী-গুণীদের এবং শিক্ষাব্রতীদের গণিকালয় ছিল প্রধান আখড়া। প্রাচীনকালে গণিকালয়ে যাতায়াত খুব একটা গোপনীয় বা লজ্জাকর বিষয় ছিল না। সে যুগের নাগরিকরা বসন-ভূষণে সজ্জিত হয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে দিনে-দুপুরেই গণিকালয়ে যাতায়াত করতে পারতেন।
আগেই বলেছি, প্রাচীনকালে বহুভোগ্যা নারীদের নানাবিধ নামে উল্লেখ করা হত গণিকাবৃত্তির চরিত্রানুসারে। কেন সেটা কিছুটা আন্দাজ করা যেতেই পারে। যদিও মোটিভেশন একই, সকলেরই পেশা শরীর বিক্রি করা। এখনকার মত প্রাচীনকালেও গণিকা বলতে বোঝাত বহুভোগ্যা নারীকেই।গণ বা দলবদ্ধ হয়ে যে নারী যাপন করে, তিনিই গণিকা। অনুরূপ বেশ্যা বলতে বোঝায় যে নারী বেশ বা সাজসজ্জা দ্বারা পুরুষদের প্রলুব্ধ করে, তিনিই বেশ্যা। যে নারীদের পণের বাজি রেখে সম্ভোগ করা হত, সেই নারীরা পণ্যাঙ্গনা। যে নারীরা যুগপৎ মন্দিরের সেবাদাসী বা রাজা বা অমাত্য মর্যাদার রাজকর্মচারীদের ভোগ্যা হতেন, সেসব নারী বারস্ত্রী। পরিচারিকা বা ক্রীতদাসী বা রক্ষিতারা ভূজিয়া বলে পরিচিত। যে নারীর চরিত্রের পতন হয়েছে, তিনি পতিতা। অনুমান করা হয়, প্রধানত ব্রাহ্মসমাজের প্রচারের দৌলতেই ‘পতিতা’ শব্দটি বেশ্যার সুভাষণরূপে গ্রহণীয় হয়ে ওঠে। ১৮৯৪ সালে লেখা ‘বিচারক’ গল্পে রবীন্দ্রনাথও দেখছি ‘পতিতা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। সাহিত্যিক সমর সেন অবশ্য গণিকা শব্দটিই ব্যবহার করতেন। প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় তাঁর পত্রিকায় বারবার ‘বেশ্যা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। সাম্প্রতিককালে গণিকা বা বেশ্যা শব্দের বিকল্পে ‘যৌনকর্মী শব্দটিও শোনা যাচ্ছে। যৌনকর্মী শব্দটি যেন একটু বেশি নগ্ন হয়ে ধরা পড়েছে। যৌনকর্মী শব্দটি যেন তাঁদের জীবিকার ধরনকে আরও প্রকট করে তুলেছে। যোনিক্ষেত্রকেই প্রকট করে এই ‘যৌনকর্মী’ সম্ভাষণ। এই সম্ভাষণ তাঁরা স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছেন। কারণ তাঁদের শ্লোগান–“গতর খাঁটিয়ে খাই, শ্রমিকের অধিকার চাই”, “যৌনকর্মীর অধিকার, নারী-আন্দোলনের হাতিয়ার”, “মে দিবসের অঙ্গিকার, যৌনপেশার পূর্ণ অধিকার”।
০২. গণিকা এবং চৌষট্টি কলার সমন্বয়
বর্তমানে ধাত্রীবিদ্যা, উদ্যানবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা ইত্যাদি যেমন নানাপ্রকারের বিশেষ শিক্ষা আছে, ঠিক তেমনই সেকালে গণিকাবিদ্যাও ছিল এমনই এক শিক্ষণীয় বিষয় এবং সেই শিক্ষা এক্কেবারেই নিন্দনীয় ছিল না। এই বিষয়ে পৃথক বিদ্যালয়ও ছিল। রীতিমতো পরিচর্যা, প্রশিক্ষণ এবং অনুশীলন দ্বারা আগামীদিনের হবু গণিকাদের এইসব বিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ হতে হত। নৃত্য-গীত-বাদ্য ছাড়াও চিত্রকলা, জ্যোতিষশাস্ত্র, অভিনয়, রন্ধনবিদ্যা, ভাষাশিক্ষা, লিখন, মার্জিত ভাষায় কথা বলা, মালা গাঁথা ইত্যাদি এরকম ৬৪ কলায় পারদর্শী করে তোলা হত। ৬৪ কলায় সুশিক্ষিতা, রূপবতী গণিকারাই জনসমাজে বা রাজদরবারে বিশেষ মর্যাদাপ্রাপ্ত হতেন, সমাদর পেতেন।
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার সংজ্ঞা বলছে–গণিকাবৃত্তি হল স্বামী বা বন্ধুকে ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে নগদ অর্থ বা অন্য কিছুর বিনিময়ে বাছবিচারহীন ভাবে যৌনকর্মে লিপ্ত হওয়া। এই পণ্য-দুনিয়ায় নারী-মানুষকে পণ্য করার বা পণ্য হওয়ার নেটওয়ার্কগুলির জোয়ার ক্রমবর্ধমান। আজকাল প্রকাশ্যে বিজ্ঞাপন দিয়েই যৌনকর্মী নিয়োগ ও কাস্টমারদের আহ্বান করা হচ্ছে। জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে নিরাপত্তা সহ অন্যান্য সুবিধাগুলি। যৌন বাণিজ্যে এখন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের মুনাফা।
বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্রম’ গ্রন্থের ‘বৈশিকাখ্যং’ অধ্যায়ে বলা হয়েছে–“রুচি হইতে যে পুরুষগ্রহণপ্রবৃত্তি, তা স্বাভাবিক আর ‘অর্থাৰ্জনার্থ’ যে প্রবৃত্তি তা কৃত্রিম।” বাৎস্যায়ন উল্লিখিত ‘অর্থাৰ্জনার্থ’ এই কৃত্রিম প্রবৃত্তিই নিন্দাহ। এই গণিকাবৃত্তিই বর্তমান বিশ্বে পয়লা নম্বরের বাণিজ্য-উপজীব্য। এই পেশার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নেতা, মন্ত্রী, পুঁজিপতি, সমাজের বিভিন্ন স্তরের নারী ও পুরুষ। অনেক দেশের রাজকোশ উপচে পড়ে গণিকাবৃত্তির রাজস্বতে। কৌটিল্য বিভিন্ন কারণে যৌন-ব্যাবসাকে স্বাভাবিক বলেই ধরে নিয়েছিলেন। অবৈধ নারীসংসর্গ বোঝাতে তিনি ‘বাহবিহার’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু এই ‘বাহবিহার’-এর পক্ষে বা বিপক্ষে স্পষ্ট করে কিছুই তিনি বলেননি। বাৎস্যায়ন বলেছেন–গণিকা অথবা বিধবাদের সঙ্গে দেহসম্ভোগ সমর্থন করা হয় না, আবার নিষিদ্ধও নয়।
সমাজবিদ লেকির মতে, গণিকাবৃত্তি হল সমাজের মাত্রাতিরিক্ত যৌনকামনা বেরিয়ে যাওয়ার একটি সেফটি ভালভ। লেকি মনে করেন, নিজে মূর্তিমতী পাপীষ্ঠা হলেও পরিণামে পুণ্যের অধিকারিণী এই মেয়েরা। এরা না থাকলে সংখ্যাহীন সুখী পরিবারের প্রশ্নাতীত পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যেত।” তাহলে কি গণিকারা যুগের পর যুগ সমাজের বিষ-ক্লেদ কণ্ঠে ধারণ করে নীলকণ্ঠী হয়ে থেকে যাবে? উঁহু, গণিকারা লেকির সঙ্গে একমত নয়। গণিকারা মনে করে না, তাঁরা সমাজের সেফটি-ভালভ। তাঁরা মনে করেন গণিকা ছাড়াও এই সমাজে প্রচুর নারী-পুরুষ আছেন, যাঁরা গোপনে যৌন-বিনোদন দিয়ে থাকেন। গণিকারা মনে করে না, সেই কারণে তাঁরা পুণ্যের অধিকারিণী। গণিকারা মনে করে না, তাঁরা না-থাকলে সংখ্যাহীন সুখী পরিবারের প্রশ্নাতীত পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যেত। গণিকালয়ে গিয়ে প্রচুর গণিকাদের সঙ্গে কথা বলে আমার অন্তত সেটাই মনে হয়েছে।
নারীবাদী কলামিস্ট তসলিমা নাসরিন একটি ব্লগে লিখেছেন–ক্রীতদাস প্রথার সঙ্গে পতিতাপ্রথার মূলত কোনো পার্থক্য নেই। ক্রীতদাসরা যখন তুলো ক্ষেতে চাষের কাজ করত, দাসমালিকরা প্রায়ই সশরীরে উপস্থিত হয়ে কিছু ক্রীতদাসীকে যৌনকর্মের জন্য তুলে নিয়ে যেত। ত্বক যাঁদের একটু কম কালো, সাধারণত তাঁদেরকেই পছন্দ করত। বাজারে নিয়ে যৌন-ব্যাবসার জন্য ভাড়া খাটাত, নয়তো সরাসরি পতিতালয়েই নগদ টাকায় ক্রীতদাসীদের বিক্রি করে দিত। আঠারো-উনিশ শতকে যে প্রথাটিকে বলা হত ক্রীতদাস প্রথা, বিংশ একবিংশ শতকে সেই প্রথাকে বলা হচ্ছে পতিতাপ্রথা।” লেখিকা অনেক পুরোনো ধারণা নিয়ে লিখেছেন বোঝাই যাচ্ছে তাঁর বক্তব্য পড়ে। সময় বদলে গেছে অনেক। সব গণিকাই ক্রীতদাস নয়। এখন বহু সাধারণ মহিলারা স্বেচ্ছায় এই গণিকাবৃত্তিকে জীবিকা হিসাবে বেছে নিচ্ছেন আর পাঁচটা জীবিকার মতোই এবং স্বাধীনভাবেই জীবিকা করেন। বর্তমানে কোনো মেয়ে বা মহিলাকে জোর করে কোনো গণিকালয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া এত কাজ নয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব পরবর্তী কোনো অধ্যায়ে।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে গণিকা ও গণিকাবৃত্তি সংক্রান্ত ভারতবর্ষীয় এক চিত্র পাওয়া যায়। কী বলছে অর্থশাস্ত্র? অর্থশাস্ত্র বলছে দেহ-ব্যাবসা একটি প্রতিষ্ঠিত ব্যাবসা। পুরোপুরি ঘৃণিত বা গোপনীয় নয়। কৌটিল্যের সময় দেহ-ব্যাবসা শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত হয় বলে জানা যায়, যে শিল্পের নাম ছিল বৈশিক কলা। বিশেষজ্ঞরা এই শিল্পের চর্চা করতেন এবং শিক্ষা দিতেন। অর্থশাস্ত্রের ২৭ অধ্যায়ে গণিকাধ্যক্ষেরও উল্লেখ আছে।এখানে মৌর্য সাম্রাজ্যের সময়কার বহু পুরুষগামী বারাঙ্গনা নারীদের হাল-হকিকৎ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছে। বলা হয়েছে, গণিকাধ্যক্ষের কাজ ছিল রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে গণিকাদের সংগঠিত করা ও দেখভাল করা। গণিকাধ্যক্ষদের নিযুক্ত করতেন দেশের রাজা। গণিকাধ্যক্ষের আর-একটা প্রধান কাজ ছিল গণিকাদের আয় ও ব্যয়ের হিসাবপত্র রাখা। কোন্ গণিকার দিনে কত খরিদ্দার আসছে, খরিদ্দার-পিছু পারিশ্রমিক কত, উপরি পাওনা বা বকসিস কী ও কত, তার ব্যয়ই-বা কত ইত্যাদি সবকিছুই সে জাবেদা খাতায় নথিভুক্ত করত। অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে, কোনো গণিকা যদি তাঁর বৃত্তি ছেড়ে চলে যায়, অথবা কোনো কারণে মারা যায়, তাহলে তাঁর মেয়ে বা বোন তাঁর বৃত্তি গ্রহণ করবে। এই কারণেই তাঁর ত্যাজ্য সম্পত্তিরও সে মালিক হবে। অথবা সেই মৃতা কিংবা বৃত্তিত্যাজ্যা গণিকার মা তাঁর শূন্যস্থানে অন্য কোনো যোগ্য মেয়ে দ্বারা পূরণ করতে পারবে। যদি সেই মৃতা কিংবা বৃত্তিত্যাজ্যা গণিকার মেয়ে বা বোন বা মাতৃনিযুক্ত প্রতিগণিকা না-থাকে সেক্ষেত্রে তাঁর ত্যাজ্য ধন রাজকোশে জমা পড়বে।
কৌটিল্যের সময় গণিকাদের তিনভাগে ভাগ করা হত। যেমন–কনিষ্ঠ, মধ্যম ও উত্তম। কোন গুণাবলি বিবেচনা করে এই বিভাজন? বিভাজন হত কোন্ গণিকার কীরকম রূপ, কীরকম শারীরিক গঠন, কীরকম বয়স–সব মিলিয়ে তাঁর পুরুষকে আকর্ষণ ও মনোরঞ্জনের ক্ষমতা কতখানি, এসব দেখে তাঁকে উত্তম বা মধ্যম বা কনিষ্ঠ শ্রেণির গণিকার স্বীকৃতি দেওয়া হত। এই স্বীকৃতি বা সার্টিফিকেট দেওয়ার ক্ষমতা ছিল একমাত্র গণিকাধ্যক্ষের। গণিকার শ্রেণিভেদে বেতন তথা পারিশ্রমিকও ছিল ভিন্ন। যেমন–কনিষ্ঠ শ্রেণির গণিকার বেতন ছিল ১০০০ পণ, মধ্যম শ্রেণির গণিকার ২০০০ পণ এবং উত্তম শ্রেণির গণিকার বেতন ছিল। ৩০০০ পণ। সেসময় কোনো রাজকুলে নিযুক্ত গণিকারা যদি রাজসেবা থেকে কোনো কারণে মুক্তি চাইত, তাহলে সেই গণিকাদের রাজার কোষাগারে ২৪,০০০ পণ মুক্তিমূল্য দিতে হত। এমনকি গণিকাদের সন্তানদের দাসত্ব (গণিকার সন্তানদের ‘দাস’ হিসাবে গণ্য করা হত) থেকে মুক্তি পেতে ১২,০০০ পণ নিষ্ক্রয় দিতে হত। গণিকাদের কাছ থেকে শুধুই নিঙড়ে নিত যাঁরা ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন, তাঁদের বলি–নিঙড়ে যেমন নিত, তেমনি নিরাপত্তার দিকটিও কঠোরভাবে দেখা হত। যেমন–কোনো কামনারহিত গণিকাকে কোনো পুরুষ (খরিদ্দার) তাঁর ঘরে আবদ্ধ করে রাখে, অথবা কোনো গোপন স্থানে লুকিয়ে রাখে এবং তাঁর শরীরে ক্ষতের সৃষ্টি করে, দাঁত দিয়ে তাঁর বিশেষ বিশেষ স্থানে আঘাত করে তাঁর রূপ নষ্ট করে–তাহলে সেই পুরুষপুঙ্গবটিকে ২৪,০০০ পণ এবং প্রয়োজনে ৪৮,০০০ পণ পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। এখানেই শেষ নয়, যে গণিকা রাজার ছত্র, ভৃঙ্গার (জল ছিটানোর ছিদ্রযুক্ত পাত্রবিশেষ) বহনের কাজে নিযুক্ত হয়েছে, তাঁকে কোনোরকম মারধর করলে সংশ্লিষ্ট অভিযুক্ত পুরুষটিকে ৭২,০০০ পণ অর্থদণ্ড করা হত।
শুধু খরিদ্দার-পুরুষদের জন্যেই শাস্তি বা অর্থদণ্ডের ব্যবস্থা ছিল, তা কিন্তু নয়। শাস্তি বা অর্থদণ্ডের ব্যবস্থা ছিল গণিকাদেরও। যেমন–(১) রাজার আজ্ঞা বা আদেশ সত্ত্বেও যদি কোনো গণিকা কোনো বিশেষ পুরুষের সঙ্গে যৌনক্রিয়ায় আপত্তি জানায়, তাহলে সেই সংশ্লিষ্ট গণিকাকে ১০০০ বার চাবুক মারা হবে। কখনো-কখনো ৫০০০ পণ পর্যন্ত গুণগারি দেওয়ার রীতি ছিল। (২) যদি কোনো গণিকা কোনো পুরুষের কাছ থেকে যৌনক্রিয়া করার শর্তে অগ্রিম অর্থ নিয়ে দুর্ব্যবহার করে, তাহলে সংশ্লিষ্ট গণিকা অগ্রিম অর্থের দ্বিগুণ পুরুষটিকে ফেরত দিতে হত। (৩) যদি কোনো গণিকা কোনো পুরুষের কাছ থেকে যৌনক্রিয়া করবে এই শর্তে রাত্রিযাপনের কোনোরূপ আগাম অর্থ নিয়েও যৌনমিলন না করে, তাহলে উক্ত পুরুষ গণিকাটিকে যে পরিমাণ অর্থ প্রদান করেছিল তার আট গুণ অর্থ ফেরত দিতে হত। (৪) কোনো গণিকা যদি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে কোনো পুরুষকে হত্যা করে, তাহলে সেই মৃত পুরুষের জ্বলন্ত চিতায় খুনী গণিকাকেও পুড়িয়ে মারার বিধান ছিল।
০৩. স্বর্গের বেশ্যা যাঁহারা = স্বৰ্গবেশ্যা
ভারতের প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে–বিশেষ করে পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতে প্রচুর গণিকার উল্লেখ আছে। এইসব গণিকাদের মধ্যে বেশ কিছু গণিকা ‘স্বৰ্গবেশ্যা’ হিসাবেই পরিচিতা। সংস্কৃত শব্দ অপ্ (বাংলা অর্থ জল) থেকে এঁদের উৎপত্তি, তাই ‘অপ্সরা’ বলা হয়। ঋগবেদে অপ্সরা হলেন গন্ধর্বের স্ত্রী। অপ্সরা আবার দুই ধরনের–লৌকিক ও বৈদিক। অপ্সরাদের সৌন্দর্য ও যৌন আবেদনের কথা সবসময়ে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, অপ্সরারা মায়ারূপিনী, তাঁরা শরীর বা দেহ পরিবর্তন করতে পারত, অর্থাৎ চূড়ান্ত ছলনাময়ী ছিলেন। অথর্ব বেদে উল্লেখ আছে, এঁরা পাশা খেলতে খুব ভালোবাসত। পারদর্শিতার সঙ্গে খেলত। দেবাসুরের সমুদ্রমন্থনকালে এঁরা সমুদ্র থেকে উত্থিত হয়েছিলেন। কথিত আছে, দেবতা ও অসুরের সমুদ্রস্নানের সময় গণিকারা সমুদ্রের ভিতর থেকে অসংখ্য নারীর সঙ্গে উঠে আসেন। কিন্তু এইসব গণিকাদের কী দেবকুল কী অসুরকুল, কেউই গ্রহণ করতে রাজি হলেন না। তাহলে সমুদ্র থেকে উত্থিত এই নারীদের ভবিষ্যৎ কী? অতএব গ্রহণ করা না-গেলেও পণ্য করে নিতে কোনো বাধা নেই। প্রভাবশালী মানুষদের যৌন-বিনোদনের জন্য বিতরণ করা যেতেই পারে। একই সঙ্গে শরীরী ফাঁদ পেতে ধনী ও প্রভাবশালী পুরুষদের বিভ্রান্ত করাই হবে এঁদের কাজ।
অধিকাংশ স্বৰ্গবেশ্যার স্বামী ছিলেন গন্ধর্বরা। তবে অপ বা জল থেকে উৎপন্ন হননি, এমন কিছু অতুলনীয় নারীকেও স্বৰ্গবেশ্যা হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এঁদের মধ্যে স্বর্গের কিছু স্বাধীনা স্বৰ্গবেশ্যাও আছেন। এঁদেরকে সপ্তম মনু সৃষ্টি করেছিলেন বলে জানা যায়। এদের সংখ্যা প্রায় ৬০,০০০। এই ৬০,০০০ স্বৰ্গবেশ্যাদের অধিপতি ছিলেন কামদেবতা। এঁরা নৃত্যকলায় পারদর্শী ছিলেন। অধিকাংশ সময় গন্ধর্বদের সঙ্গে এঁরা ইন্দ্রের সভায় নর্তকী হিসাবে নৃত্য প্রদর্শন করতেন।
ভরত মুনির নাট্যশাস্ত্রের প্রথম অধ্যায় ৪৫-৫০ শ্লোকে পাওয়া যায়, ব্রহ্মা ভরতকে কৌশিকীনৃত্তির জন্য শিবের নৃত্য থেকে শৃঙ্গাররসের উপযোগী কোমল অঙ্গহার, আত্মা রস, ভাব ও ক্রিয়া নামক উপাদান দেন। এ সকল উপাদান নারী ছাড়া পুরুষ এককভাবে প্রয়োগ করতে পারে না। তাই ব্রহ্মা কিছু নিপুণ অপ্সরা তৈরি করলেন। এই অপ্সরা ছিলেন মঞ্জুকেশী, সুকেশী, মিশ্রকেশী, সুলোচনা, সৌদামিনী, দেবদত্তা, দেবসেনা, মনোরমা, সুদতী, সুন্দরী, বিদগ্ধা, সুমালা, সন্ততি, সুনন্দা, সুমুখী, মাগধী, অর্জুনী, সরলা, কেরলা, ধৃতি, নন্দা, সুপুষ্কলা ও কলভা। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনিগুলোতে যে সমস্ত স্বৰ্গবেশ্যা বা অপ্সরার নাম পাওয়া যায়, তাঁরা হলেন—অদ্রিকা, অরুণা, অর্জুনী, অলম্বুষা, অসিতা, উর্বশী, কলভা কেরলা, ঘৃতাচী, জানপদী, তিলোতমা, দেবদত্তা, দেবসেনা, ধৃতি, নন্দা, নাগদত্তা, পুঞ্জিকাস্থলা, বিদগ্ধা, বিদ্যুৎপর্ণা, বিশ্বাচী, পঞ্চচূড়া, পূর্বচিত্তি, মঞ্জুকেশী, মনোরমা, মাগধী, মিশ্রকেশী, মেনকা, রম্ভা, রুচিরা, সরলা, সুকেশী, সুদতী, সুনন্দা, সন্ততি, সুন্দরী, সুপুষ্কলা, সুবাহু, সুমধ্যা, সুমালা, সুমুখী, সুলোচনা, সোমা, সৌদামিনী, হেমা প্রমুখ। এঁদের মধ্যে মেনকা, উর্বশী, রম্ভা ও তিলোত্তমা হলেন অন্যতম। পুরাণে নানা রকম নারী আছে। স্বৰ্গবেশ্যা নারী, সতী নারী, ছলনাময়ী নারী, রহস্যময়ী নারী। পুরাণ থেকে নারী সরিয়ে দিলেই তা আর পুরাণ থাকে না।
খুব সুন্দরী মেয়েদের ‘অপ্সরা সুন্দরী’ বলার সময় কি কাদের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে সুন্দরীদের ভাবা হয়? সে যাই হোক, এইসব অপ্সরারা যে অতীব সুন্দরী ছিলেন, এটা মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। তাঁরা শুধু অতীব সুন্দরী ছিলেন, তা নয়। তাঁরা নৃত্য ও সংগীতেও পারদর্শিনী ছিলেন। ইন্দ্রের সভায় এঁদের গায়িকা ও নর্তকী হিসাবে পাই। এঁদের উপস্থিতিতে ইন্দ্রের সভা সর্বদাই ঝলমলে থাকত। স্বর্গের গণিকাদের অধিপতি ছিলেন স্বয়ং কামদেব। তাই কামদেব এইসব গণিকাদের যৌনপ্রতিমা করে গড়ে তুলেছিলেন। মোদ্দা কথা, গণিকা মানেই সাক্ষাৎ যৌনপ্রতিমা। যৌনক্রিয়ায় ইচ্ছাপূরণ দেবী যেন। তথাকথিত দেবতারা আসন্ন বিপদের ঘ্রাণ পেলেই সেই বিপদ থেকে মুক্তি পেতে পরমা সুন্দরী গণিকাদের লেলিয়ে দিত। এই লেলিয়ে দেওয়ার কাজটি করতেন স্বয়ং ইন্দ্র। দেবরাজ ইন্দ্র প্রায়ই এঁদের পাঠিয়ে দিত মুনি-ঋষিদের প্ররোচিত ও প্রলোভিত করে ধ্যানভঙ্গ করার জন্য। কারণ তাঁদের ধ্যান সমাপ্ত হলে তাঁরা যদি প্রবল পরাক্রান্ত হয়ে ওঁর ইন্দ্ৰত্ব (ইন্দ্রত্ব’ বিষয়টি আর কিছু নয়। ইন্দ্রত্ব একটি পদমাত্র। ইন্দ্রের পদ এবং ঐশ্বর্য ) দাবি করে বসে! গণিকারা ছলা আর কলায় তাঁদের বিভোর করে কাজ হাসিল করে নিত। এইসব গণিকারা মুনি-ঋষিদের ধ্যান ভাঙাতেন। কেন ধ্যান ভাঙাতেন? উদ্দেশ্য কী? কারণ বৈদিক যুগে কঠোর তপস্যার বলে কখনো-কখনো দেবতাদের চেয়েও বেশি ক্ষমতাধর উঠতেন মুনি-ঋষিরা। যাতে তাঁরা দেবতাদের চেয়ে ক্ষমতাধর হয়ে না-পড়েন, সেই কারণেই গণিকাদের নিয়োগ করা হত। এমনকি অসুরদের কবজা করতেও এঁদের নিয়োগ করা হত।
পাঠকগণ, আলোচনায় দেবতা প্রসঙ্গে বিভ্রান্ত হবেন না। হিন্দুসমাজের দেবতা কোনো অশরীরী, অলৌকিক কোনো বিষয় নয়। কিছু নিছক কাল্পনিক হলেও বেশিরভাগই শরীরী, রক্তমাংসের অস্তিত্ব। দেবতাদের জন্ম আছে, পূর্বাপর-সম্বন্ধ আছে। এক দেবতা থেকে আর-এক দেবতার জন্ম আছে। প্রায় সব বিষয়েই মানুষের সঙ্গে দেবতাদের মিল দেখা যায়। তাই হিন্দুধর্মের দেবতাদের মধ্যে মানুষেরই প্রতিরূপ পাওয়া যায়। সেই কারণে পুরাণের বর্ণিত দেবতারা মানুষের মতো দোষেগুণে (ষড়রিপু = কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য) গড়ে উঠেছে। আবার অনেক দেবতা সাধারণ মানুষ থেকেও জন্মেছেন। তাই আহার-বিহার, যানবাহন, বসন-ভূষণ প্রভৃতি ব্যাপারে অনেক দেবতা মানুষের কাছাকাছি। ইতিহাস থেকে আমরা দুই ধরনের দেবতাদের পাই–(১) আর্য দেবতা এবং (২) অনার্য দেবতা। বস্তুত পুরাণ থেকে আমরা প্রচুর দেবতার কাহিনি পাই। বিভিন্ন অলৌকিক কাণ্ডকারখানার মধ্য দিয়ে এই দেবদেবীদের প্রকাশ। এত দেবদেবতার প্রাবল্য একমাত্র সনাতন ধর্মেই দেখা মেলে। তবে গ্রিস ও রোমেও দেবদেবতাদের আধিক্য দেখা যায় যাঁদের দেখতে অবিকল মানুষের মতোই। সনাতনী দেবতারাও মানুষের রূপধারী। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষই দেবতায় উন্নীত হয়েছে সনাতন ধর্মে। আজও মানুষ দেবতায় উন্নীত হয়–ভগবান রজনীশ, ভগবান চন্দ্রস্বামী, ভগবান সাঁইবাবা, ভগবান আশারাম, ভগবান সারথীবাবা ইত্যাদি!!! ভগবান মনু রাজাদেরও দেবতা বা দেবতারূপী বলেছেন। বস্তুত প্রাচীন যুগে রাজা বা শাসকরাই ছিলেন স্বঘোষিত ভগবান। এঁরা পুজো পান। ভক্তদের কাছে অমিতাভ বচ্চনও দেবতা। কলকাতাতেই অমিতাভ বচ্চনের মূর্তি গড়ে মন্দির বানিয়ে পুজো দেওয়া হয়। আবার গুজরাটে গান্ধি হত্যাকারী নাথুরাম গডসেকেও মূর্তি গড়ে মন্দির বানিয়ে পুজো দেওয়া হয়। আসুন, কতিপয় স্বৰ্গবেশ্যাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই।
মেনকা : মহাঋষি বিশ্বামিত্রের ধ্যান ভাঙার জন্য গণিকা মেনকাকে নিয়োগ করা হয়েছিল। মেনকা নগ্ন হয়ে কামনামদির নৃত্য প্রদর্শন করে কামশৃঙ্গারে বিশ্বামিত্রকে বিচলিত করেছিল। তারই ফলস্বরূপ বিশ্বামিত্র গণিকা মেনকার সঙ্গে যৌনকর্মে লিপ্ত হতে বাধ্য হন এবং শকুন্তলার জন্ম দেন। যেহেতু এই ধরনের সম্পর্ক এবং সম্পর্কের ফলে জন্মানো সন্তান সমাজ স্বীকৃত নয়, সেহেতু সেই সদ্যজাত শিশুকে মালিনী নদীর তীরে নিক্ষেপ করে মেনকা পালিয়ে যায়। পালাবেই না-কেন, মেনকা তো মা হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় জন্ম দেননি। তিনি আজ্ঞাবাহক মাত্র। ঋষির ধ্যান ভাঙতে সফল হয়েছেন, সেইসঙ্গে তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্যও শেষ হয়েছে।
হিন্দুধর্ম মতে, ব্রাহ্মণগণ কঠোর তপস্যার ফলে দেবতা পদে উন্নীত হতে পারতেন। বিশ্বামিত্র তেমনই একজন ব্রাহ্মণ, দোর্দণ্ডপ্রতাপ। দেবরাজ ইন্দ্র তাঁকে যেমন সমীহ করতেন, তেমনি ঈর্ষাও করতেন। ভয়ও করতেন। ইন্দ্র সর্বদাই এক আতঙ্কে ভুগতেন, এই বোধহয় কেউ এসে তাঁর সিংহাসন ও পদ দখল করে নিল। ইন্দ্র আশঙ্কায় থাকতেন, ইন্দ্রের রাজ্যে বিশ্বামিত্র হানা দিতে পারেন। বিশ্বামিত্র তপস্যায় মগ্ন হলে ইন্দ্র বিশ্বামিত্রের ধ্যান ভাঙার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। হাতিয়ার করলেন গণিকা মেনকাকে। বিশ্বামিত্রের ধ্যানভঙ্গের জন্য মেনকাকে নির্দেশ দিলেন। অবাক হওয়ার কিছু নেই। সেই ট্র্যাডিশন আজও সমানভাবে চলছে। আজও বিভিন্ন কার্যসিদ্ধির উদ্দেশ্যে নেতা-মন্ত্রী-ধনী-পুঁজিপতিরা গণিকাদের রূপ-যৌবনকে কাজে লাগায়। এমনকি সেনানায়কদেরও কুপোকাৎ করে গোপন নথি সরিয়ে ফেলা হয়। গণিকা নিয়োগের মাধ্যমে কত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে যাচ্ছে, তার হিসাব কে রেখেছে! খেলোয়াড়দের মনোযোগ নষ্ট করার জন্য নারীকে নগ্ন করিয়ে মাঠের মাঝখান দিয়ে দৌড় করানোর রেকর্ড তো আছেই। খেলোয়াড়দের নারীমাংসের আবেশে ভুলিয়ে রাখার জন্য কত গণিকা যে হোটেল পর্যন্ত হানা দেয়!
কালিকাপুরাণে আমরা মেনকাকে দক্ষকন্যা সতীর সখী হিসাবে পাই। মহাভারতেও মেনকাকে পাই গন্ধর্বরাজ বিশ্বাবসুর স্ত্রী হিসাবে। বিশ্বাবসু ও মেনকার মিলনে এক কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। সেই কন্যাকে মহর্ষি স্থূলকেশের আশ্রমের পাশে বয়ে চলা এক নদীতীরে চলে যান। মহর্ষি সেই পতিত কন্যা দেখতে পেয়ে তাঁকে আশ্রমে এনে লালনপালন করতে থাকেন। নাম দেন প্রমদ্বরা। প্রমদ্বরা মহাভারতে উল্লিখিত বিখ্যাত রাজা রুরুর স্ত্রী।
উর্বশী : উর্বশী নাকি নারায়ণের উরু থেকে জন্ম নিয়েছেন। সে যেখান থেকেই জন্ম নিক, ইনি একজন স্বনামখ্যাত স্বর্গের পরমা সুন্দরী গণিকা। শতপথব্রাহ্মণে উর্বশী ও পুরূরবার প্রেমকাহিনি আছে। এই কাহিনি ঋগবেদেও কিছুটা পাওয়া যায়। সেই কাহিনি এখানে উল্লেখ করার প্রাসঙ্গিকতা নেই। পদ্মপুরাণে আছে, বিষ্ণু ধর্মপুত্র হয়ে পর্বতে তপস্যা করছিলেন। তাঁর এই তপস্যায় ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন। অতএব বিষ্ণুর তপস্যায় বিঘ্ন ঘটাতে হবে। ভাবনার বাস্তবায়ন করতে ইন্দ্র কয়েকজন গণিকার সঙ্গে বসন্ত ও কামদেবকে চক্রান্তে নিয়োগ করলেন। তাঁদের পাঠিয়ে দিলেন বিষ্ণুর ধ্যানভঙ্গ করতে। বলা হয়েছে, সেই দল তপস্যা ভঙ্গে ব্যর্থ হলে স্বয়ং কামদেব অন্যান্য গণিকাদের উরু থেকে উর্বশীকে সৃষ্টি করলেন এবং বিষ্ণুর ধ্যানভঙ্গ করতে পাঠিয়ে দিলেন। এর কার্যসিদ্ধি হল। কার্যসিদ্ধি করলেন গণিকা উর্বশী ধ্যান ভাঙলে বিষ্ণু উর্বশীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। উর্বশী রাজি হয়ে যান। উর্বশীর পতন হল পরে। না, বিষ্ণুর কারণে নয়। উর্বশীর পতন হল মিত্র ও বরুণের অভিশাপে (পড়ুন নির্দেশে)। বিষ্ণুর কিছু পরে মিত্র ও বরুণ উর্বশীকে কাছে পেতে চাইলেন। উর্বশী তা প্রত্যাখ্যান করেন। সেই অপরাধে উর্বশীকে মনুষ্যভোগ্যা করে মর্ত্যলোকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কারোকে প্রত্যাখ্যানের অধিকার গণিকার নেই। তাই এই চরমতম শাস্তি।
রম্ভা : রম্ভা হলেন স্বর্গগণিকাদের মধ্যে অন্যতম। রম্ভা নামের মানে কলাগাছের মতো পুষ্ট যে নারীর উরু। রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে উল্লেখ আছে, লঙ্কেশ্বর রাবণ পথে রম্ভাকে একা পেয়ে জোরপূর্বক যৌনসঙ্গম করেন। রম্ভা কুবেরের পুত্র নলকুবেরের কাছে অভিসারে যাওয়ার সময় রম্ভাকে দেখে কামদগ্ধ হয়ে পড়ে রাবণ। লঙ্কেশ্বর রাবণ সংযম হারিয়ে খোলা আকাশের নীচেই রম্ভাকে ধর্ষণ করেন। এরপর রম্ভা নলকুবেরের কাছে পৌঁছে সমস্ত ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করেন। সেই অপরাধে নলকুবের রাবণকে অভিসম্পাত করেন–রাবণ যদি কখনো নারীকে বলপ্রয়োগ করে ধর্ষণ করবে, তখনই তাঁর মাথা সাত খণ্ডে বিভক্ত হয়ে যাবে।
স্কন্ধপুরাণে উল্লেখ আছে, বিশ্বামিত্রের তপস্যায় ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে দেবরাজ ইন্দ্র গণিকা রম্ভাকে নিয়োগ করেন। কিন্তু ইন্দ্র এই অপারেশন চরমভাবে ব্যর্থ হন, সেইসঙ্গে বিশ্বামিত্রের ক্রোধে বিশ্বামিত্রের আশ্রমে রম্ভা ১০০০ বছরের জন্য শিলায় পরিণত হন। বিশ্বামিত্রের আশ্রমে যেসময় রম্ভার শিলারূপে অবস্থান করছিলেন, সেসময় অঙ্গকার নামে রাক্ষুসী নানারকম উপদ্রব করছিলেন। সেসময় ওই আশ্রমে তপস্যারত শ্বেমুনি বায়ব্য অস্ত্রে ওই শিলারূপী রম্ভাকে দু-টুকরো করে রাক্ষুসীকে লক্ষ করে নিক্ষেপ করেন। রাক্ষুসীর মৃত্যু হয়। রম্ভা আবার নিজরূপ ফিরে পান। স্কন্ধপুরাণের অন্য এক কাহিনি বলছে, ইন্দ্রের সভায় নৃত্য পরিবেশনের সময় রম্ভার তালভঙ্গ হয়। ইন্দ্র ক্ষুব্ধ হন এবং রম্ভাকে স্পন্দনহীন বিকলাঙ্গ করে সভা থেকে বহিষ্কার করে ভূতলে নিক্ষেপ করেন। গণিকার ভুল হতে নেই যে। পরে অবশ্য ব্ৰহ্মর্ষি নারদের পরামর্শে শিবকে সন্তষ্ট করে ইন্দ্রলোকে ফিরে আসতে সক্ষম হন।
অন্য এক পুরাণে উল্লেখ আছে, জাবালি মুনির তপস্যা ভঙ্গ করতে ইন্দ্র গণিকা রম্ভাকে নিয়োগ করেন। রম্ভা ইন্দ্রের ষড়যন্ত্র সফল করেন। রম্ভার রূপ-যৌবনে কামমোহিত হয়ে জাবালি মুনির সঙ্গে যৌনকর্মে লিপ্ত হন। এর ফলে মুনির ঔরসে রম্ভা এক কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। জাবালি এই কন্যার প্রতিপালন করেন। কন্যার নাম দেন ফলবতী। জাবালি মুনি বিশ্বামিত্রের মতোই অসংযমী হলেও বিশ্বামিত্রের মতো নিজ সন্তানকে প্রত্যাখ্যান করেননি। তবে বিশ্বামিত্রের সময়ে মেনকা যে কাজটি করেছেন, রম্ভাও সেই কাজ করেছেন। নিজ সন্তানকে ত্যাগ করে চলে যান। সেটাই স্বাভাবিক। তাঁরা গণিকাধর্ম পালন করেছেন, সন্তানের মা হতে নয়।
তিলোত্তমা : কালিকাপুরাণে আমরা গণিকা তিলোমাকে পাই। অপরূপা গণিকাদের মধ্যে অন্যতম। দৈত্যরাজ নিকুম্ভের দুই পুত্র সুন্দ ও উপসুন্দকে রূপের জালে ফাঁসানোর জন্য তিলোত্তমাকে নিয়োগ করা হয়েছিল। সুন্দ ও উপসুন্দ দুই ভাই ত্রিলোক বিজয়ের জন্য কঠোর তপস্যার মাধ্যমে ব্রহ্মার কাছে অমরত্ব প্রার্থনা করেন। কিন্তু ব্রহ্মা এঁদেরকে অমরত্ব দানে মোটেই রাজি নন। শেষপর্যন্ত অমরত্ব দিতেই হল, তবে তা কৌশল করেই। বলা হল, স্থাবর-জঙ্গমের কোনো প্রাণীই তাঁদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। এ পর্যন্ত এটা একপ্রকার অমরত্ব বলেই ভ্রম হতে পারে। মৃত্যুহীন জীবনযাপন করতে পারবে তা কি হয়? অর্থাৎ এরপর সংযোজন করা হল–তাঁদের মৃত্যু তখনই হবে, যখন দুই ভাই পরস্পর পরস্পরের হাতে হত্যা করবে। সুন্দ ও উপসুন্দ দুই ভাইয়ের মধ্যে এত ভাব-ভালোবাসা ছিল যে, এঁরা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি এক ভাইয়ের দ্বারা অন্য ভাইয়ের ন্যূনতম ক্ষতি হতে পারে। তাই অমরত্বের দাপটে স্বর্গলোকে দাপিয়ে বেড়াতে লাগল। ওঁরা স্বপ্নে কখনো ভাবতে না পারলেও বরদাতা ব্রহ্মা সেই ব্যবস্থা করে নিলেন, যাতে দুই ভাইয়ের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। টোপ হিসাবে ব্যবহার করা হল যৌন-আবেদনময়ী লাস্যময়ী নারীকে। এতটাই যৌন-আবেদনময়ী নারীকে ব্যবহার করা হল, তেমন নারী গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডেও দেখা গেল না। তাই স্বয়ং ব্রহ্মা স্পেশাল নারী সৃষ্টি করলেন, যিনি স্বর্গীয় সুন্দরী তিলোত্তমা। যাঁকে দেখে পাথর পর্যন্ত গলে যাবে, আর সুন্দ ও উপসুন্দ তো রক্তমাংসের! ত্রিভুবনের সমস্ত উত্তম বস্তু তিল তিল করে সংগ্রহ করে ব্রহ্মা এই তিলোত্তমাকে সৃষ্টি করলেন। সুন্দ ও উপসুন্দকে নিকেশ করতে নিয়োগ করা হল তিলোত্তমাকে। পরমা সুন্দরী তিলোত্তমা দুই ভাইয়ের সামনে সম্পূর্ণ নগ্ন উপস্থিত হয়ে নৃত্য শুরু করে দিলেন। তিলোতমার ভুবনমোহিনী রূপ আর কামোদ্দীপক দেহবল্লরীর ঝাঁকুনিতে দুই ভাই বিমূঢ় হয়ে পড়লেন। দুজনেই তিলোত্তমাকে কাছে পেতে চাইলেন। কিন্তু একজন নারীকে দুইজন কীভাবে পেতে পারে! তার উপর এইসব গণিকারা যত জনের সঙ্গেই যৌনমিলন করুক না-কেন, এঁরা পুনরায় কুমারীত্ব ফিরে পায়। এরা সসময়ই কুমারী। এ স্বাদের তো ভাগও করা সম্ভব নয়। অতএব যুদ্ধ, এক নারীকে পাওয়ার জন্য দুই ভাইয়ের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। যুদ্ধে দুই ভাইয়েরই মৃত্যু হল একে অপরের শাণিত অস্ত্রে। বোধহয়, স্বয়ং ঈশ্বর গণিকা সৃষ্টি করলেন কামুক পুরুষদের ধ্বংসের জন্য।
ঘৃতাচী : স্বর্গের আরও একজন গণিকার কথা না বললেই নয়। তিনি ঘৃতাচী। ইন্দ্রের হুকুমে ইনিও নিজের নগ্ন রূপ দেখিয়ে প্রচুর মুনি-ঋষিদের তপস্যাকর্মে জল ঢেলে দিয়েছেন। ঘৃতাচী এতটাই যৌন-আবেদনময়ী ছিলেন যে, তাঁকে দেখামাত্রই পুরুষদের বীর্যপাত হয়ে যেত। যেমন-তেমন পুরুষ নয় এমন মুনি-ঋষিদেরও একই হাল হত। ঘৃতাচীকে দেখে ভরদ্বাজ ঋষিরও বীর্যপাত হয়ে যায়। এই পতিত বীর্যেই দ্রোণের জন্ম হয়। ইনিই মহাভারতের দ্রোণাচার। অপরদিকে চ্যবন ও সুকন্যার পুত্র প্রমতির সঙ্গে ঘৃতাচী যৌনমিলন হয় এবং রুরুর জন্ম হয়।
একবার ব্যাসদেব সুমেরু পর্বত থেকে নিজ আশ্রমে ফিরে হোমের আয়োজন করছিলেন। সেসময় সেই হোম অনুষ্ঠানে গণিকা ঘৃতাচী এসে উপস্থিত হন। ঘৃতাচীকে দেখামাত্রই ব্যাসদেব কামাতুর হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় অনিবার্য ধর্ষণের আশঙ্কায় ঘৃতাচী পড়িমরি করে অকুস্থল থেকে পালিয়ে যান শুকপাখির রূপ ধরে। কিন্তু চরম কামোত্তেজনায় ব্যাসদেবের বীর্যপাত হয়ে যায়। সেই বীর্য অরণির (অরণি হল একপ্রকার কাঠ, যে কাঠের ঘর্ষণে আগুন জ্বলে) উপর ছিটকে গিয়ে পতিত হয়। ব্যাসদেব সেই অরণি মন্থন করতে শুরু করে দিলেন। মন্থনের ফলে এক শিশুপুত্রের জন্ম হয়। ঘৃতাচীকে স্মরণ করে সেই শিশুপুত্রের নাম রাখেন শুক। স্বর্গের সব গণিকাদের নিয়ে আলোচনা করাই যেত। কিন্তু তাতে কলেবর বৃদ্ধি হয়, লাভ কিছু হয় না। কয়েকজন গণিকার বিষয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করলাম স্বর্গের গণিকাদের বিষয়ে কিঞ্চিত আভাস দেওয়ার জন্য। আর-একটু সংযোজন করি। এইসব অনন্তযৌবনা গণিকারা দেবরাজ ইন্দ্রের নির্দেশে গুপ্তচরবৃত্তি ও গুপ্তহত্যার কাজে নিযুক্ত হতেন। রামায়ণেও প্রচুর গণিকার উল্লেখ আছে, যাঁরা গুপ্তচর বৃত্তির কাজে নিয়োজিত ছিল। রামচন্দ্রের অভিষেকের সময় প্রচুর গণিকা অংশগ্রহণ করেছিলেন। রামায়ণের যুগে বিশিষ্ট অভ্যাগতদের অভ্যর্থনায় রাজপরিবারের মানুষদের মৃগয়ায় গণিকাদের নিয়োগপ্রথার প্রচলন ছিল। গণিকা কর্তৃক ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির প্রলোভনের আখ্যান রামায়ণে সুখ্যাত হয়ে আছে।
মহাভারতের যুগে এমন জনা পাঁচেক মুনি-ঋষির নাম পড়ে পড়ছে, যাঁরা গণিকাদের শরীরী ছলনায় বশীভূত হয়ে কামার্ত হয়ে যৌন-সংসর্গ করেছিলেন। এঁরা হলেন–বিশ্বামিত্র, শরদ্বান, ভরদ্বাজ, ব্যাস, বশিষ্ঠ, পরাশর, দীর্ঘতমা প্রমুখ। মহাভারতের যুগে অপরাপর সম্মানজনক বৃত্তিগুলির মধ্যে গণিকাবৃত্তি ছিল অন্যতম। রাজদরবারে ও বিবিধ রাজকীয় অনুষ্ঠানে গণিকাদের উপস্থিতি ছিল অপরিহার্য। এঁরা মনোহর রত্ন, সোনা ও মণিমুক্তাখচিত অলংকারাদি ও মহামূল্য পোশাকে আচ্ছাদিত হয়ে রাজপথে অবাধে বিচরণ করতেন। যে-কোনো অনুষ্ঠানে ও শোভাযাত্রায় আয়োজন হলে পুরোভাগে বস্ত্রালংকার শোভিত সুন্দরী গণিকারা থাকতেন।
শুধু সুরলোকেই নয়, অন্যত্র গণিকাদের প্রয়োজনীয়তা ছিল যথেষ্ট, উপস্থিতিও ছিল লক্ষ্যণীয়। মহাভারতে তৃষ্টা নামক এক ঋষির কথা জানা যায়। ত্বষ্টার পুত্র ছিলেন ত্রিশিরা। ত্রিশিরা ছিলেন মদ্যপ ও নিষ্ঠাবান ধার্মিক। তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল স্বর্গলোক জয়। যেহেতু স্বর্গলোকের চৌকিদার স্বয়ং ইন্দ্র, সেইহেতু ইন্দ্রের ভয়ের কারণ হল ত্রিশিরা। উপায় খুঁজতে রূপবতী গণিকাদের শরণাপন্ন হলেন পুরন্দর ইন্দ্র। ত্রিশিরার তপস্যা ভঙ্গ করতে সুন্দরী গণিকাদের কাজে লাগালেন দেবরাজ। এখনকার মতো মহাভারতের যুগেও সমরসম্ভারের সঙ্গে সৈন্যশিবিরে সুন্দরী গণিকাদের স্থান দেওয়া হত। সেনাদের একঘেয়েমি নিবারণ ও যৌনক্ষুধা মেটানোর জন্য এঁদের মজুত রাখা হত। যুযুধান দুইপক্ষ পাণ্ডব ও কৌরব সেনাশিবিরে অসংখ্য সৈন্যদের বিনোদন ও মনোরঞ্জনের জন্য শত সহস্র গণিকা নিয়োগ করা হয়েছিল। পাণ্ডব সেনাশিবিরে যেসব ‘বেশস্ত্রী’ অর্থাৎ বেশ্যা বা গণিকা নিয়োগ করা হয়েছিল। তাঁদের সুযোগসুবিধা যা কিছু দেখভালের দায়িত্ব সবই ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের উপর ন্যস্ত ছিল। রামায়ণে রামচন্দ্রের জন্য যে স্বতন্ত্র সৈন্যবাহিনী গঠন করা হয়েছিল, সেই বাহিনীতে বিবিধ সমরসম্ভারেও অজস্র যৌবনবতী গণিকা নিয়োগ করা হয়েছিল।
শুধু হিন্দুধর্মেই নয়, আমরা ইসলাম ধর্মেও স্বৰ্গবেশ্যাদের কথা জানতে পারি, যাদের হুরপরি বলা হয়। বেহেশতকামীদের লোভ দেখাতেই এই স্বৰ্গবেশ্যাদের উপস্থাপনা। যাদের সঙ্গে বেহেশতবাসী পুরুষরা অনন্তকাল সেক্স করতে পারবে। মাসের পর মাস তাঁরা সেক্স করবে, কিন্তু সেই সেক্স কোনোদিন শেষ হবে না। তাঁরা ক্লান্ত হবে না, সেই বেশ্যারাও ক্লান্ত হবে না। কেমন হবে সেই গণিকারা? কেমন বর্ণনা দেওয়া হয়েছে সব বেশ্যাদের? স্বৰ্গবেশ্যাদের শারীরিক বর্ণনা যা পাওয়া যায়, তা হচ্ছে অনেকটা এরকম–
প্রত্যেক বেহেশতবাসীকে দেওয়া হবে ৭২টি অনিন্দ্য সুন্দরী হুরপরি তাঁদের ভোগের জন্য। বেহেশতবাসীরা যে কোনো বয়সেই মারা যাক না-কেন, তাঁরা যখন বেহেশতে প্রবেশ করবে তখন তাঁদের বয়স হবে ৩০ বছরের যুবকের মতো এবং তাঁদের বয়সের আর কোনো পরিবর্তন হবে না; আর প্রত্যেক বেহেশতবাসীকে ১০০টি শক্তিশালী পুরুষের সমান যৌনশক্তি দান করা হবে (তিরমিজি, অধ্যায় ২, পৃষ্ঠা ১৩৮)। হজরত আলি বর্ণনা করেছেন, নবি বলেছেন যে বেহেশতে একটি মস্ত বড় খোলা বাজার থাকবে, যেখানে কোনো কেনাবেচা হবে না। সেখানে শুধুই থাকবে অতিসুন্দরী উন্নবক্ষা হুরপরিরা, যাঁরা ফলের দোকানের মতো সেজেগুজে বসে থাকবে বেহেশতবাসীদেরকে আকর্ষণ করার জন্য। বেহেশতবাসীদের পছন্দ হলেই তৎক্ষণাৎ তাঁরা সেই হুরির সঙ্গে যৌনকর্ম শুরু করে দেবে ঠিক সেখানেই (সহি হাদিস, অধ্যায় ৪, পৃষ্ঠা ১৭২, নং ৩৪)। হুরপরিরা এত বেশি সুন্দরী ও রূপসী হবে যে, তাঁরা যদি আকাশের জানালা দিয়ে পৃথিবীর দিকে তাকায়, তাহলে সমস্ত দুনিয়া আলোকিত হবে এবং সুঘ্রাণে ভরে যাবে আকাশ ও পৃথিবীর মাঝখানের সব জায়গা। একজন হুরির মুখমণ্ডল হবে আয়নার চেয়েও মসৃণ বা পরিষ্কার, যাতে নিজ চেহারা দেখতে পাবে এবং হুরির পায়ের মজ্জা দেখা যাবে খালি চোখে (মিসকাত অধ্যায় ৩, পৃষ্ঠা ৮৩-৯৭)। একজন হুরি অনিন্দ্যসুন্দরী যুবতী, যাঁর শরীর হবে আয়নার মত স্বচ্ছ বা মসৃণ। তাঁর পায়ের হাড়ের ভেতরের মজ্জা দেখতে পাওয়া যাবে যেন মণি-মুক্তোর ভিতরে রেখার মতো। তাঁকে মনে হবে একটি সাদা গ্লাসে রাখা লাল মদের মতো। সে হবে সাদা রঙের দুধে আলতা মিশানো এবং তাঁর কখনো হায়েজ (মাসিক), মলমুত্র ত্যাগ, গর্ভবতী হওয়া ইত্যাদি কিছুই হবে না। হুরি হবে অল্পবয়স্কা, যাঁর স্তনযুগল হবে বড়ো বড়ো ও গোলাকার, যা কখনোই ঝুলে পড়বে না; সবসময় তীরের মতো তীক্ষ্ণ থাকবে। এসব হুরিরা থাকবেন এক অতি উজ্জ্বল এবং জৌলুসপূর্ণ জায়গায় (তিরমিজি, অধ্যায় ২, পৃষ্ঠা ৩৫ ৪০)।
আবু ওমামা বলেছেন যে, আল্লাহর রসুল বলেছেন—“আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বেহেশতে স্থান দেবেন এবং প্রতিটি বেহেশতবাসীকে বিবাহ দেবেন ৭২ জন অনিন্দ্যসুন্দরী রমণীয় সঙ্গে; যাঁদের মধ্যে দুইজন হবে চিরকুমারী আয়তলোচনা এবং বড়ো বড়ো চোখওয়ালা হুরি এবং বাকি ৭০ জন হবে উত্তরাধিকার, যা সে লাভ করবে জাহান্নমবাসীদের গনিমতের মাল থেকে। প্রত্যেকটি সুন্দরী রমণীর থাকবে খুব সুখদায়ক যৌনাঙ্গ এবং বেহেশতি পুরুষের যৌনাঙ্গ সর্বদাই শক্ত ও খাড়া হয়ে থাকবে, কখনো বাঁকা হবে না যৌনতার সময়। অর্থাৎ মূলত পুরুষাঙ্গটি সবসময়ই হুরপরিদের যোনির ভিতরে প্রবিষ্ট থাকবে পালাক্রমে একের পর এক প্রায় ৭০ বছর ধরে (হাদিস নং ৪৩৩৭ ইবনে মাজাহ, ভলিউম ৫, পৃষ্ঠা ৫৪৭)। আবু উমামা কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসুল বলেছেন–“আল্লাহ যাঁদের জান্নাতে প্রেরণ করবেন, তাঁদের প্রত্যেককে ৭২ জন হুরির সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হবে; যাঁর দুটি হুরি এবং বাকি সত্তরখানা হবে জাহান্নামবাসীদের সম্পত্তির। তাঁদের সকলের থাকবে কামুক যৌনাঙ্গ এবং তাঁর লিঙ্গ থাকবে অনন্তকাল উত্থিত [সুনান ইবনে মাজা, যুহদ (Book of Abstinence) ৩৯]। দারাজ ইবনে আবি হাতিম কর্তৃক উল্লেখিত, আবু সাইদ আল-খুদরির কাছ থেকে প্রাপ্ত, আবু আল-হায়থাম আবদুল্লাহ ইবনে ওহাব কর্তৃক বর্ণিত, যিনি শুনেছেন, নবি বলেছেন–“জান্নাতের সবচেয়ে ছোটো পুরস্কার হবে একটি প্রাকৃতিক ঘর, যেখানে আট হাজার ভৃত্য এবং ৭২ জন হুরি থাকবে, যার গম্বুজ থাকবে মুক্তো, পান্না ও চুনি দ্বারা সজ্জিত, এবং যা প্রশ্বস্ত হবে আল-জাবিয়াহ থেকে সানার মধ্যকার দুরত্বের সমান (আল-তিরমিজি, ভল্যুম ৪, চ্যাপ্টার ২১, নাম্বার ২৬৮৭)। একজন হুরির সঙ্গে প্রতিবার শয্যাগ্রহণকালে আমরা তাঁকে কুমারী হিসেবে পাব। তাছাড়া জান্নাতিদের লিঙ্গ কখনো নমনীয় হবে না। এই লিঙ্গোত্থান হবে অনন্তকালের জন্য; প্রতিবার তোমরা যে আনন্দ উপভোগ করবে, তা হবে পরম তৃপ্তিদায়ক যা এই দুনিয়ার কেউ পায়নি, এবং তোমরা যদি সেই পুলক দুনিয়াতে থেকে লাভ করতে তাহলে অজ্ঞান হয়ে যেতে। নির্বাচিত প্রতিটি মুসলিম বান্দা তাঁদের পৃথিবীর স্ত্রীদের ছাড়া আরও ৭০ খানা হুরির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হইবে, এবং তাঁদের সকলের থাকবে অত্যন্ত কামুক যোনি। (আল-ইতকান ফি উলুম আল-কুরান, পৃষ্ঠা ৩৫১)
০৪. গণিকাবৃত্তির এক করুণ রূপ বিষকন্যা
মহাভারতের যুগে ‘বিষকন্যা’ নামক এক শ্রেণির সুন্দরী গণিকাদের কথা জানা যায়। এঁরা খুনে গুপ্তচর বাহিনীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন। তাঁদের কাজ ছিল যৌনসম্ভোগকালে ওষ্ঠ-চুম্বনে অথবা দন্তদংশনে এরা হত্যার জন্য প্রেরিত ব্যক্তির শরীরে বিষ ঢেলে দিত। সেই ব্যক্তি জ্ঞান হারালে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করত এবং তাঁর পুরুষাঙ্গটিও কেটে ফেলা হত। মহাভারতের চতুর্দশ অধ্যায়ের বিষয়ই বিষকন্যা পাঠিয়ে গুপ্তহত্যা। শ্রীসুখময় ভট্টাচার্য তাঁর ‘মহাভারতের সমাজ’ গ্রন্থে লিখেছেন–“অনেক সময় শত্রুপক্ষ সুন্দর যুবতীকে উপঢৌকন স্বরূপ পাঠাইয়া থাকেন। পরিমিত মাত্রায় বিষ হজম করাইয়া সেই সকল কন্যাকে এমনভাবে তৈয়ারি করা হয় যে, তাহাদের স্পর্শমাত্রই অপর প্রাণী মৃত্যুমুখে পতিত হইয়া থাকে। সেই সকল কন্যাকে ‘বিষকন্যা’ বলে। গুপ্তচরের মুখে সমস্ত বার্তা অবগত হইয়া অতিশয় সাবধানে বাস করিবে। এই সকল প্রলোভন হইতে নিজেকে রক্ষা করিতে না পারিলে বিনাশ সুনিশ্চিত।”
শৈশবকাল থেকেই সুন্দরী কন্যাসন্তানদের শরীরে অল্প অল্প করে বিষ প্রয়োগ করে তাঁদের শরীরকে বিষ সহনীয় করে তোলা হত। এই প্রক্রিয়াকালে অনেক কন্যাসন্তান বিষের প্রভাবে মারাও যেত। যাঁরা সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যেত, তাঁদের শরীর জুড়ে বিষের প্রবাহ। এইসব মেয়েরা পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে উঠলে শত্রু কবজা করতে পাঠিয়ে দেওয়া হত। এঁরা শরীরী-ছলনায় কামুক পুরুষদের দখল নিত। যে পুরুষ যৌনকামকে জয় করতে পারত, তাঁকে কবজা করা জটিল হয়ে পড়ত।যে জয় করতে পারত না, তাঁর মৃত্যু অনিবার্য।
মোট কথা, ক্ষমতাবান শত্রুকে ধ্বংস করার জন্য বিষকন্যা পাঠানোর রেওয়াজ ছিলই। মৌযযুগেও এমন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল বলে জানা যায়। নন্দরাজার এক মন্ত্রী চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কাছে বিষকন্যা পাঠিয়েছিল। চাণক্যের কুট-বিচক্ষণতায় সেই বিষকন্যাকে পর্বতক নামে এক ব্যক্তির কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পর্বতক বিষকন্যায় শরীরী ছলনায় আত্মসমর্পণ করলে তাঁর মৃত্যু হয়। ভারতবর্ষে ‘বিষকন্যা’ গণিকাদের বাড়বাড়ন্ত হয়েছিল মৌর্য সাম্রাজ্যের সময়েই। বিশাখদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটকের প্রথম ও দ্বিতীয়াংশে বিষকন্যাদের উল্লেখ আছে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও বিষকন্যার হদিস পাওয়া যায়। কল্কিপুরাণে সুলোচনা (সুলোচনা ছিলেন গন্ধর্ব চিত্রগ্রীবের স্ত্রী) নামে এক বিষকন্যার কথা জানা যায়। এইসব বিষকন্যার নজরে কোনো পুরুষ পড়লেই পুরুষটি মারা যায়।
তৎকালীন রাজারাও বিষকন্যাদের নিয়োগ করতেন শক্রনিধনের স্বার্থে। এহেন বিষকন্যারা একদিকে যেমন বহুপুরুষগামী, অপরদিকে হত্যাকারী। জিশুর জন্মের ৩২৭ বছর আগে আটাশ বর্ষীয় এক শক্তিশালী গ্রিক রাজার কথা জানতে পাই। তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল পশ্চিম ইউরোপ থেকে পারস্য পর্যন্ত। এই রাজা পারস্যরাজ দরায়ুসকে পরাজিত করে পৌঁছোলেন ভারত ভূখণ্ডে এবং ভারত জয় করে নিলেন। পুষ্কলাবতীর রাজা অষ্টক, অশ্বক জাতির রাজারা একে একে তাঁর কাছে পরাজিত হলেন। তক্ষশীলার রাজাও আত্মসমর্পণ করলেন। অর্ধেক পৃথিবীর ‘রাজা’ তৃতীয় আলেকজান্ডারের শিবিরে বহুমূল্যের উপঢৌকন পাঠালেন ভারতীয় রাজ্যের রাজা সিকান্দার। সঙ্গে পাঠালেন পাঁচ অপরূপ সুন্দরী লাস্যময়ী নারী। সেই ক্ষীণকটির রূপবৈভবে মুগ্ধ হয়ে গেলেন গ্রিক শিবির। নারীর প্রতি যে আলেকজান্ডারের আসক্তি ছিল, সে কথা ততদিনে ভারতে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই আসক্তিকেই সুচারুভাবে কাজে লাগালেন ভারতীয় রাজা। আলেকজান্ডারও ঘুণাক্ষরে টের পেলেন না ভারতীয় রাজার কৌশল। লুব্ধ দৃষ্টিতে মোহিত হয়ে লাস্যময়ী নারীর দিকে এগোতে থাকলেন আলেকজান্ডার। ভারতীয় রাজা এই সুযোগের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। আত্মসমর্পণের বদলা নিতেই রাজা লাস্যময়ীদের পাঠিয়েছিলেন। গ্রিকশিবিরের আলেকজান্ডারের সঙ্গে ছিলেন অ্যারিস্টটল। আলেকজান্ডারের গুরু। লাস্যময়ীর নৃত্যে আলেকজান্ডার মোহিত হয়ে গেলেও অ্যারিস্টটল সতর্ক ছিলেন। তিনি আলেকজান্ডারকে সতর্ক করে বললেন–“আর এগিয়ো না বৎস। এই লাস্যময়ী বিষকন্যা”। আলেকজান্ডার বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না গুরুকে।গুরু অ্যারাস্টটলের দিকে অবিশ্বাসের চোখে তাকাতেই গুরু বললেন–“অপেক্ষা করো বেটা। আমি প্রমাণ দিচ্ছি”। অ্যারিস্টটল ঈশারায় দুজন দাসকে কাছে ডাকলেন এবং আদেশ দিয়ে বললেন–“ওই নারীর ওষ্ঠে চুম্বন করো”।
চুম্বন করবে কী! তাঁরা সেই লাস্যময়ী নারী শরীর স্পর্শ করামাত্রই দুজন দাসই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। এখানেই শেষ নয় পরীক্ষার। তিনি সেই নারীকে আলেকজান্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ঘোড়াকে স্পর্শ করতে বললেন। নারীর স্পর্শে নিমেষে তেজি ঘোড়া নিস্তেজ হয়ে গেল। এবার আলেকজান্ডারের মোহ ভাঙল এবং তলোয়ার দিয়ে দ্বিখণ্ডিত করে দিল এই গুপ্তঘাতিনী লাস্যময়ী নারীকে। তারপর বিষকন্যাকে পুড়িয়ে দেওয়া হল। এ কাহিনি পাওয়া যায় কবি গুইলাম ডি চেরভেরা রচিত ‘রোমানিয়া গ্রন্থ থেকে। এ কাহিনি ছড়িয়ে পড়েছিল ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি পর্যন্ত। এছাড়া আলেকজান্ডারের যেসব উপদেশ অ্যারিস্টটল দিয়েছিলেন, তার একটা সংকলন প্রকাশিত হয়। সংকলনটির নাম ‘সিক্রেটা সিক্রেটোরাম’। সিক্রেট সিক্রেটোরামে অ্যারিস্টটল ভারতের বিষকন্যাদের থেকে শত হস্তে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন আলেকজান্ডারকে। অ্যারিস্টটল এটাও মনে করিয়ে দিয়েছেন, অতীতে বহু রাজা খতম হয়েছেন এই বিষকন্যাদের সংসর্গে। ভারতের মতোই আকর্ষণীয় ভারতের বিষকন্যাদের কাহিনি। এই বিষকন্যারা গণিকা হিসাবে পরিচিত হলেও তাঁর সঙ্গে যৌনসংসর্গ করে উঠত পারত না শিকার। কারণ তাঁদের সামান্য স্পর্শেই শিকারের মৃত্যু অনিবার্য। সেই কারণেই বিনা যুদ্ধে শত্রুবিনাশে এই অপ্সরা-সুন্দরীদের ব্যবহার করত রাজা, মহারাজা, সম্রাটরা।
যে পদ্ধতিতে বিষকন্যাদের বিষসহনে অভ্যস্ত করা হত তার নাম মিথ্রিডেটিজম। গ্রিসের পন্টাসের রাজা ষষ্ঠ মিথ্রিডেটস নিজের শক্তিশালী শত্রুদের দমন করার জন্য প্রথম বিষকন্যাদের বিষময় করে তোলার পদ্ধতি ব্যবহার করেন। তিনি ভীত ছিলেন এই ভেবে যে, তাঁর মা তাঁকে বিষ দিয়ে হত্যা করবে। সেই ভয়ে তিনি জঙ্গলে পালিয়ে যান। সেখানে গিয়ে বনচরদের কাছ থেকে শিখে নেন কীভাবে অল্প পরিমাণ বিষাক্ত পদার্থ শরীরে প্রবেশ করিয়ে বিষক্রিয়া প্রতিরোধ করা যায়। বিষকন্যারা তাঁদের রূপের জালে রাজা বা রাজপুরুষ বা বণিকদের ফাঁসিয়ে গুপ্তহত্যার চেষ্টা করত প্রতিপক্ষ। শক্তিশালী শত্রু প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মানবঘাতক বিষকন্যাদের ব্যবহার করার সবথেকে বড়ো সুবিধা হল, তাঁদের বিষকন্যা হিসাবে চেনা অত সহজ ছিল না। ভোগলালসা নারীসঙ্গে ডুবে থাকা রাজারা খুব সহজেই গণিকা বিষকন্যাদের সৌন্দর্য ও লাস্যের ফাঁদে পড়ে মৃত্যুর দেশে পৌঁছে যেত নিমেষের মধ্যেই। বিষকন্যাদের যে চেন যেত না, তা কিন্তু নয়। অভিজ্ঞরা অবশ্যই চিনতে পারতেন।
প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত তিন চিকিৎসক হলেন–চরক, সুশ্রুত ও ভাগবত। এঁরা তাঁদের রচিত গ্রন্থে বিষকন্যাদের কথা লিখে গেছেন। সেখানে বলা হয়েছে বিষকন্যাদের চেনার সহজ উপায়–(১) অকারণ হাসি, (২) চুলে আঙুল চালানো, (৩) সন্দেহজনক আচরণ, (৪) অতিরিক্ত কথা বলা, (৫) মাটি আঁচড়ানো, (৬) ঘনঘন পিছন ফিরে দরজা দেখা, (৭) কোনো প্রশ্ন করলে নীরব থাকা ইত্যাদি।
বিষকন্যার বিষের সঙ্গে কীভাবে রক্ষা পেতে হবে, সেই উপায়ও বাতলে দিয়েছেন চিকিৎসক সুশ্রুত। কীভাবে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে সে কথাও বলে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন মেয়েদের অন্ন, দাঁত মাজার সামগ্রী, চুলের তেল, জামাকাপড়, স্নানের জল, চোখের পথ্য, অলংকার, প্রসাধনী দ্রব্য ইত্যাদিতে বিষক্রিয়ার সম্ভাবনা থাকে। প্রাচীন যুগে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশেই বিষকন্যাদের ব্যবহার ছিল। বোহেমিয়ার রাজা দ্বিতীয় ওয়েনচেসলাউসের মৃত্যু হয় বিষকন্যাদের সংসর্গেই। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে উত্তর ভারতের রাজনীতিতে বিষকন্যাদের দাপট ছিল ব্যাপক। অঙ্গ, কোশল, কাঞ্চী, অবন্তী সহ একাধিক রাজাদের পরাজিত করে মগধের উত্থান হয়েছিল এই বিষকন্যাদের সংসর্গে। মুদ্রারাক্ষস, অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে সেইসব রোমহর্ষক কাহিনি পাওয়া যায়। নন্দবংশের শাসনামলে বিষকন্যা কর্তৃক রাজা ও রাজপুরুষদের গুপ্তহত্যা প্রবলভাবে বেড়ে যায়। মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা একবার মরতে মরতে বেঁচে যান চাণক্যের তীক্ষ্ণ বুদ্ধিতে। মৌর্যসম্রাট চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে মগধসম্রাট ধননন্দের সঙ্গে বিরোধ ছিল। দাম্ভিক, প্ৰজাবিদ্বেষী রাজা ধননন্দের ভয়ে চন্দ্রগুপ্ত জঙ্গলে আত্মগোপন আছেন। প্রজ্ঞা ও চতুর কৌশলে চাণক্য আভাস পাচ্ছিলেন চারপাশে চন্দ্রগুপ্তকে হত্যার চক্রান্ত চলছে, তার মধ্যে বিষকন্যা কর্তৃক বিষের আক্রমণের সম্ভাবনাই ছিল প্রবল। তাই চন্দ্রগুপ্তের খাবারে তিনি গোপনে প্রতিদিন বিষ মিশিয়ে দিতেন। বিষের স্পর্শ থেকে বাঁচাতে চাণক্য এইভাবেই চন্দ্রগুপ্তের শরীরকে তৈরি করতে থাকলেন। যুদ্ধে ধননন্দের মৃত্যু হলেও ধননন্দের রাক্ষস নামক মন্ত্রী চন্দ্রগুপ্তের কাছে এক লাস্যময়ী বিষকন্যাকে পাঠিয়ে দিলেন। মৌর্যসম্রাটের ছায়াসঙ্গী চাণক্য সেই বিষকন্যাকে দ্রুত চিনে ফেললেন। তিনি সেই বিষকন্যাকে চন্দ্রগুপ্তের ত্রিসীমানায় ঢুকতে দিলেন না। বিষকন্যাকে পাঠিয়ে দিলেন পর্বতকের কাছে। পর্বতক ধননন্দের পুত্র। পর্তক চন্দ্রগুপ্তের প্রতিদ্বন্দ্বী। চন্দ্রগুপ্তের পথের কাঁটা হয়ে তিনিও গোপনে ষড়যন্ত্র রচনা করছিলেন। চন্দ্রগুপ্তকে পাঠানো বিষকন্যার ছোবলেই পর্বতকের মৃত্যু হয়।
তবে এমন শোনা যায় যে, বিষকন্যারা একবার কারোর মৃত্যুর কারণ হলে তাঁর শরীর থেকে বিষ শেষ হয়ে যেত। তাই একই সঙ্গে দুজনের মৃত্যু ঘটানো সম্ভব হত না, যতক্ষণ-না নতুন করে তাঁদেরকে বিষের জোগান দেওয়া হত। বিষ হজম করে বড় হতে থাকা মেয়েদের উপর চলত বিশেষ প্রশিক্ষণ। রাজ্যের বিশিষ্ট গণিকা, নর্তকীদের তত্ত্বাবধানে চলত এঁদের শিক্ষাদীক্ষা। শরীরের প্রতিটি অঙ্গের ব্যবহার কীভাবে সুচারুভাবে করতে হয়, তার শিক্ষা নিতে হত। শিখতে হত মোহময় বাক্যজাল বিস্তার। পুরুষকে আকর্ষণ করার সমস্ত ছলাকলাই শিখতে হত। এর সঙ্গে শিখতে হত ছদ্মবেশ ধারণ করা ও কামকলা। তাঁদের চলনে, বলনে, শরীরী কটাক্ষে ঝরে পড়তে হবে উত্তেজক যৌনতা। সেই যৌনতায় খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে তাবড় রাজা-মহারাজা বীরপুরুষরা।
এইসব বিষকন্যাদের মতো হত্যাকারিণীদের কি কোনো শাস্তির বিধান ছিল? না, এমন কোনো বিধান বা নির্দেশ ছিল না। তবে কোনো মেয়েকে বিষকন্যা বলে টের পেলে তাঁর শরীর তলোয়ার দিয়ে টুকরো টুকরো কেটে ফেলা হত। তারপর মাটিতে পুঁতে দেওয়া কিংবা আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হত। আমি আগেই উল্লেখ করেছি আলেকজান্ডারও তলোয়ার দিয়ে দ্বিখণ্ডিত করেছিল গুপ্তঘাতিনী লাস্যময়ী বিষকন্যাকে। তারপর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। কেটে দু-টুকরো করে দেওয়াই হোক বা মাটিতে পুঁতে ফেলাই হোক, আগুনে পুড়িয়ে দেওয়াই হোক–কী যায় আসে! এই অভাগাদের জীবন কি জীবন! মৃত্যুতেই এই অভাগা নারীদের মুক্তি। সেই শৈশবকাল থেকেই তাঁদের নিয়মিত বিষপান করতে হত রাজাদের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায়। নিজের শরীরে বিষ প্রতিরোধ করার সক্ষমতা এলে মানুষ মারার উপযুক্ত হয়ে উঠলে সেই মেয়েদের পাঠানো হত বিভিন্ন রাজার দরবারে। সব মেয়েই বিষ প্রতিরোধ করতে পারত না। অনেকেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তেন। হত অকালমৃত্যু। ভাগ্যক্রমে বেঁচে থাকলে কোনো রাজার বিশ্বাসভাজন হয়ে থাকতে হত শরীরে বিষের জ্বালা নিয়ে। সেই রাজা যখন মনে করত প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিপক্ষ রাজাকে হত্যা করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, তখন এইসব মেয়েদের পাঠিয়ে দেওয়া হত সংশ্লিষ্ট রাজার বিলাসভবনে।এঁদের প্রথম কাজ ছিল রাজার খাবারে বিষ মিশিয়ে খাওয়ানো। তবে রাজাকে সন্দেহমুক্ত করার জন্য নিজেকেও সেই বিষ মেশানো খাবার খেতে হত। এরপর রাজা সেই বিষ-খাবার খেয়ে মারা যেত, কিন্তু বিষকন্যাদের কিছু হত না। রাজাদের সাম্রাজ্যগ্রাসের কুটিল রাজনীতিতে বিষই হয়ে উঠেছিল বিষকন্যাদের জীবনের একমাত্র পরিচয়, যাকে ইচ্ছামতো ব্যবহার করত সেকালের ধুরন্ধর রাষ্ট্রনেতা, সমরবিদরা।
পৃথিবী জুড়ে আজও এঁরা আছে। কেবল পদ্ধতি পালটে গেছে। অন্য রূপে। অন্য ভাবে। যেমন ধরুন হাতের কাছে হানি ট্র্যাপ। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয় বিমানবাহিনীর এক অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল হানি ট্র্যাপের কাছে ঘায়েল হওয়ার। এরা সেইসব নারী, যাঁদের আন্তরিক আহ্বান, সহজ-সরল চোখদুটিকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা খুব কম পুরুষেরই আছে। এঁরা পুরুষদের প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে গোপন তথ্য বের করে আনে। ১৯১০ সালে বার্লিন থেকে প্যারিস সারা ইউরোপ জুড়ে দাপিয়ে বেড়াত মাতা হারি নামে এক গণিকা গুপ্তচর। পামেলা বোর্দেও ছিল এমনই এক গণিকা গুপ্তচর। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের চর ডামিনি ম্যাকনট নামে এক লাস্যময়ী নারীর ফাঁদে পা দেন বিমান বাহিনীর ওই অফিসার। তিনি নাকি বাহিনীর রণকৌশল পাচার করেছিলেন। সিআইএ, মোসাদ, র, হামাস, কেজিবি, আইএসআই সব গোয়েন্দা সংস্থার তূণে আছে এই গণিকা গুপ্তচর। ‘হানি ট্র্যাপ’ মানেই যে ‘মধুর ফাঁদ’। এই মধুর ফাঁদে শত শত রাঘব বোয়াল ধরা দেবেন এ আর নতুন কথা কী।
০৫. বাৎস্যায়নের চোখে গণিকা
প্রাচীন যুগে গণিকাদের বিবরণ দিতে চাইব, অথচ বাৎস্যায়নের কামসূত্রম’ উল্লেখ করব না, তাই হয় নাকি? কামসূত্রম আলোচনা করার আগে গ্রন্থের রচয়িতা বাৎস্যায়নকে না-জানলে আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। মল্লনাগ বাৎস্যায়ন ছিলেন বেদজ্ঞ ভারতীয় দার্শনিক। ধারণা করা হয় তিনি গুপ্তযুগে চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতাব্দী ভারতে বর্তমান ছিলেন। কামসূত্রম ও গৌতমের ন্যায়সূত্র গ্রন্থের টীকা ‘ন্যায়সূত্ৰভাষ্য’-এর রচয়িতা রূপে তাঁর নাম পাওয়া যায়। তবে সম্ভবত, বাৎস্যায়ন নামক কোনো একক ব্যক্তি এই দুই গ্রন্থ রচনা করেননি। তাঁর সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা যায় না। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল মল্লিনাগ বা মৃল্লান। বাৎস্যায়ন ছিল তার বংশনাম বা পদবি। নিজ গ্রন্থের শেষে তিনি যে আত্মপরিচয় দান করেছেন তা এরকম–“বাভ্রব্য ও অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থকারদের রচনা পড়িয়া তদনুসারে এবং তাঁহাদিগের দ্বারা প্রদত্ত অর্থবিধান পর্যালোচনা করিবার পর পবিত্র আদেশানুসারে জগতের কল্যাণার্থে বারাণসীর চতুষ্পঠীর ছাত্র ও দেবসেবক বাৎস্যায়ন কর্তৃক এই সন্দৰ্ভটি রচিত হইয়াছে। ইহা আমাদিগের কামনাবাসনা চরিতার্থ করিবার পুস্তক নহে। যে ব্যক্তি এই বিজ্ঞান সম্পর্কে সম্যক অবহিত, যিনি নিজ ধর্ম, অর্থ ও কাম রক্ষা করিয়া এবং লোকাঁচার মানিয়া চলেন, কেবল তিনিই তাঁর ইন্দ্রিয় জয়ে সক্ষম। সংক্ষেপে বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী ব্যক্তি ধর্ম ও অর্থের অধিকারী হইলে কামেরও অধিকারী হইবেন। তজ্জন্য তাঁহাকে তাঁহার কামনা বাসনার ক্রীতদাসত্ব করিতে হইবে না। তিনি যাহাই করিবেন তাহাতেই সাফল্য পাইবেন।”
বাৎস্যায়নের জীবন বা রচনার সঠিক সময়কাল নির্ধারণ করা অসম্ভব। সম্ভবত খ্রিস্টীয় প্রথম থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যবর্তী কোনো একসময়ে তিনি বিদ্যমান ছিলেন। তাঁর রচনায় আছে, কুন্তলরাজ সাতকর্ণী সাতবাহন কামান্ধ হয়ে কর্তারি নামক অস্ত্রের সাহায্যে নিজ পত্নী মাল্যবতাঁকে হত্যা করেন। এই ঘটনা উল্লেখ করে বাৎস্যায়ন সর্বসাধারণকে সতর্ক করে দেখিয়ে দেন যে কামান্ধ হয়ে নারীকে আঘাত করার মতো প্রাচীন প্রথা কতটা বিপজ্জনক হতে পারে। এই কুন্তলরাজ খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে বিদ্যমান ছিলেন। অর্থাৎ, বাৎস্যায়নের সময়কাল প্রথম শতাব্দীর পরে। আবার বরাহমিহির রচিত ‘বৃহৎসংহিতা’ গ্রন্থের অষ্টাদশ অধ্যায়টিও কামকলা সংক্রান্ত। এর বিষয়বস্তু মূলত বাৎস্যায়নের গ্রন্থ থেকে গৃহীত। বরাহমিহিরের সময়কাল খ্রিস্ট্রীয় ষষ্ঠ শতাব্দী। অর্থাৎ, বাৎস্যায়ন যেহেতু বরাহমিহিরের পূর্বে তাঁর গ্রন্থ রচনা করেন, সেইহেতু তিনি প্রথম থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে বিদ্যমান ছিলেন।
বাৎস্যায়ন ছিলেন কোনো ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের সন্তান। কেউ কেউ মনে করেন তাঁর বাল্যকাল কেটেছিল এক গণিকালয়ে, যেখানে তাঁর প্রিয় মাসি কাজ করতেন। এখান থেকেই তিনি কামকলা সংক্রান্ত প্রথম জ্ঞান লাভ করেছিলেন। বাৎস্যায়নের কামসূত্রম পাঠ করলে বোঝা যায়, ওইরূপ কামবিলাসসম্পন্ন পুরুষ ও নারীদের যুগে তাঁর আবির্ভাব হয়েছিল। কোথায় এবং কোন্ দেশে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন তাঁর ঐতিহাসিক বৃত্তান্ত বিশেষ পাওয়া যায় না। তবে মনে হয়, তিনি গুপ্ত সম্রাটদের সময়েই আবির্ভূত হয়েছিলেন। এই গুপ্ত সম্রাটদের সময়েই মহাকবি কালিদাস, জ্যোতির্বিদ বরাহ মিহির ইত্যাদি মনীষা সম্পন্ন ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাৎস্যায়নের সাহিত্যের মতো তাঁদের সাহিত্যে ও অনেক অধুনা সমাজ বিরুদ্ধ ও তথা কথিত বর্তমান ‘অশ্লীল’ আখ্যা বিশিষ্ট কবিতা ও লেখা দেখতে পাওয়া যায়। নাট্যলেখক শূদ্রক রাজা ও ওই সময়ে তাঁর ‘মৃচ্ছকটিক’ নামে সংস্কৃত নাটক লেখেন। তবে অনেকে বলেন বাৎস্যায়ন খ্রিস্টপূর্ব যুগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কেউ কেউ বলেন খ্রিস্টজন্মের পরবর্তী যুগে তিনি জন্মগ্রহণ করেন দাক্ষিণাত্য দেশে। এ বিষয়ে অনেক মতানৈক্য আছে। তবে আমরা একথা অনেকটা বিশ্বাস করি যে, মহর্ষি বাৎস্যায়ন গুপ্তরাজাদের সময়কালেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বহুদেশ বিদেশ ঘুরে যৌনক্রিয়ার বিভিন্ন প্রচলন দেখে জ্ঞান লাভ করে কামসূত্রম’ নামে গ্রন্থটি রচনা করেন।
পুরাণ মতে, মহাদেবের অনুচর নন্দী হর-পার্বতীর কথোপকথন শুনে রচনা করেন রতিশাস্ত্র। মহর্ষি উদ্দালকের পুত্র শ্বেতকেতু তা থেকে একটি সুন্দর গ্রন্থ রচনা করেন। তারপর বাভ্রব্য নামে উত্তর ভারতের একজন ঋষি তাঁকে সুন্দর ভাবে ১৫০ টি পরিচ্ছেদে ভাগ করে তা বিশ্লেষণ করেন। বাব্যের এই পুস্তক সারা বিশ্বের পণ্ডিত ও লেখক সমাজে বিশেষ প্রশংসা লাভ করে। গ্রন্থটির বিভিন্ন অধ্যায়কে আরও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে ভারতের ঋষিরা বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেন—(১) চারায়ণ লেখেন সাধারণ কাম বিচার’। (২) সুবর্ণাভ লেখেন ‘যৌন কাম বিচার”। (৩) ঘোটক মুখ লেখেন যুবতী নারীর বিচার’। (৪) গোমার্দীয় লেখেন “স্বামী-স্ত্রীর সম্বন্ধের বিচার’। (৫) গণিকা পুত্র লেখেন ‘পরস্ত্রী গমন বিচার’! (৬) দত্তক লেখেন ‘পতিতাদের কাম বিচার’। (৭) কুচুমার লেখেন ‘দেহ সৌন্দর্য ও যৌনিক বৃদ্ধির উপায় বিচার’। কিন্তু এইসব গ্রন্থ প্রত্যেকটি উৎকৃষ্ট হলেও পরস্পর বিচ্ছিন্ন ছিল বলে মানুষের মনকে তা আকর্ষণ করতে পারেনি। তাই ঋষি বাৎস্যায়ন এই শাস্ত্র একত্রিত করে তার “কামসূত্রম’ নামক গ্রন্থটি রচনা করলেন। এই গ্রন্থে তিনি বিভিন্ন ভাগে সব রকম কাম উদ্রেকের তত্ত্ব বিষয়ে সুন্দর ভাষায় ও স্পষ্ট করে আলোচনা করেছেন।
বাৎস্যায়নের মতে কামের পথে প্রকৃতই অগ্রসর হতে হলে নারী বা পুরুষ উভয়ের কতকগুলি কলাবিদ্যা শিক্ষা করা উচিত। মোট চৌষট্টি কলা বাৎস্যায়ন দেখিয়ে গেছেন। এইসব কলায় একজন মানুষ হয়তো শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারে না, তবে কয়েকটি কলায় সে ব্যুৎপত্তি লাভ করতে পারে। আর কলা ছাড়া জীবন ও কাম কিছুই। মধুময় হতে পারে না।
কোনো কোনো ভারতীয় দার্শনিক ‘পুরুষার্থ’ নামক জীবনের চার উদ্দেশ্যের কথা বলেছেন—(১) ধর্ম : ধার্মিক জীবন, (২) অর্থ : আর্থিক সমৃদ্ধি, (৩) কাম : নান্দনিক ও যৌন আনন্দ লাভ ও (৪) মোক্ষ : আধ্যাত্মিক মুক্তি। ধর্ম, অর্থ ও কাম দৈনন্দিন জীবনের লক্ষ্য। কিন্তু মোক্ষ জন্ম ও পুনর্জন্মের চক্র থেকে মুক্তিলাভ। কামসূত্রম গ্রন্থে লিখেছেন–“ধর্ম অর্থ অপেক্ষা শ্রেয়, অর্থ কাম অপেক্ষা শ্রেয়। কিন্তু অর্থই রাজার জীবনে প্রথম উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। কারণ কেবল ইহা হতেই প্রজাগণ জীবনধারণ করিবেন। পুনরপি, কাম বেশ্যাদিগের উপার্জনপথ এবং তাঁহারা অন্য দুই অপেক্ষা ইহাকেই বাছিয়া লয়। ইহা সাধারণ নিয়মের ব্যতয়।” এই গ্রন্থের একটি অংশের উপজীব্য বিষয় হল যৌনতা সংক্রান্ত ব্যাবহারিক উপদেশ। গ্রন্থটি মূলত গদ্যে লিখিত। তবে অনুষ্টুপ ছন্দে রচিত অনেক পদ্যাংশ এতে সন্নিবেশিত হয়েছে। ‘কাম’ শব্দের অর্থ ইন্দ্রিয়সুখ বা যৌন আনন্দ। অপরদিকে ‘সূত্র’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ সুতো বা যা একাধিক বস্তুকে সূত্রবদ্ধ রাখে। কামসূত্র’ শব্দটির অর্থ তাই পুস্তকের আকারে এই জাতীয় উপদেশমালার গ্রন্থনা। এতে রমণীদের জন্য প্রযোজ্য চৌষট্টি কলা বিবৃত হয়েছে।
মল্লনাগ বাৎস্যায়ন রচিত কামসূত্র গ্রন্থে ৭ ভাগে বিভক্ত ৩৬টি অধ্যায়ে মোট ১২৫০টি শ্লোক রয়েছে—১. সাধারণম্ (ভূমিকা) শাস্ত্রসংগ্রহ (গ্রন্থের উপাদান সংক্রান্ত অধ্যায়সমূহ), ত্রিবর্গপ্রতিপত্তি (জীবনের তিন লক্ষ্য), বিদ্যাসমুদ্দেশ (জ্ঞান লাভ), নাগরকবৃত্তম (সুনাগরিকের আচরণ), নায়কসহায়দূতীকর্মবিমর্শ (নায়কের সহায়তায় দৌত্যকর্ম সংক্রান্ত অধ্যায়) ২. কন্যাসযুক্তকম (পত্নীলাভ) বর্ণসম্বিধানম সম্বন্ধনিশ্চয় চ (বিবাহের ধরন), কন্যাবিস্ৰম্ভণম (পত্নীকে শান্ত করণ), বালায়াম উপক্ৰমা ইঙ্গিতাকারসূচনম চ (পত্নীলাভ), একপুরুষাভিয়োগা (একক ব্যবস্থাপন), বিবাহ দ্বারা সম্মিলন ৩. ভার্যাধিকারিকম (পত্নী সম্পর্কে) একচারিণীবৃত্তম প্রবাসচার্য চ (এক পত্নী সংক্রান্ত), প্রধানা পত্নী ও অন্যান্য পত্নী সংক্রান্ত ৪. বৈশিকম (গণিকা) সহায়গম্যাগম্যচিন্তা গমনকারণং গম্যোপাবর্তনম (প্রণয়ী নির্বাচন সংক্রান্ত উপদেশ), কান্তানুবৃত্তম (স্থায়ী প্রণয়িনীর অনুসন্ধান), অর্থাগমোপায়া বিরক্তলিঙ্গানি বিরক্তপ্রতিপত্তির নিষ্কাসনক্রম (অর্থোপার্জন), বিশীর্ণপ্রতিসন্ধানম (পুরাতন প্রণয়ীর সহিত পুনরায় বন্ধুত্বকরণ), লাভবিশেষা (লাভ বিশেষ), অর্থানর্থবন্ধসংশয়বিচারা বেশ্যাবিশেষশ্চ (লাভ ও ক্ষতি) ৫. পারদারিকম (অন্যান্য পত্নী সংক্রান্ত) স্ত্রীপুরুষশীলবষ্ঠাপনম ব্যবৰ্তনকারণাণি স্ত্রী সিদ্ধা পুরুষা অযত্নসাধ্য যোষিত (স্ত্রী ও পুরুষের আচরণ), পরিচয়কারণায় অভিযোগ (পরিচিত হওয়া), ভাবপরীক্ষা (ভাবপরীক্ষা করণ), দূতীকর্মাণি (দৌত্য), ঈশ্বরকামিতম (রাজসুখ), অন্তঃপুরিকং দাররক্ষিতকম (অন্দরমহল) ৬. সংপ্রয়োগিকম (যৌন মিলন) প্রমাণকালভবেভয়ো রত অবস্থাপনম (কামনা উদ্দীপ্তকরণ), আলিঙ্গনবিকারা (আলিঙ্গন), চুম্বনবিকল্পাস (চুম্বন), আদর, দশনচ্ছেদ্যবিহায়ো (দংশন), সম্বেশনপ্রকারাশ্চিতররতানি (স্ত্রীপুরুষের দৈহিক মিলন), প্রহণনপ্রয়োগাস তক্তাশ শীৎকৃতক্রম (শীৎকারাদি), পুরুষোপসৃপতানি পুরুষায়িতম (নারীর পুরুষোচিত আচরণ), ঔপরিষ্ঠকম (মৌখিক যৌনাচার), রত অরম্ভ অবসানিকম রত বিশেষ প্রণয়কলহশ্চ (কামকেলির বিবরণী) (১০ অধ্যায়) ৭. ঔপনিষদিকম (বশীকরণ) সুভগংকারণম বশীকরণম বৃষ্যাশ্চ যোগা (শারীরিক আকর্ষণের উন্নতি করণ), নষ্টরাগপ্রত্যানয়নম বৃদ্ধিবিধায়শ্চরিতাশ্চ যোগা (হ্রাসপ্রাপ্ত যৌনক্ষমতা পুনরায় বৃদ্ধিকরণ)
কামসূত্ৰমের ‘বৈশিক’ নামে একটি বিস্তৃত অধিকরণে প্রাচীনকালে ভারতীয় গণিকাদের জীবনযাত্রার একটি সুস্পষ্ট এবং সম্পূর্ণ বিবরণ পাওয়া যায়। এই বিবরণ থেকেই সাধারণের মনে গণিকাদের সম্পর্কে যে অবজ্ঞা, ঘৃণা এবং অশ্রদ্ধার বিরূপ ধারণা আছে বাৎস্যায়নের উল্লিখিত গণিকাদের জীবনযাত্রার বর্ণনা হৃদয়ঙ্গম করলেই সেই বদ্ধমূল ধারণার বদল হতে পারে।
বাৎস্যায়ন গণিকাদের পরিচয় দিতে গিয়ে কামসূত্ৰমের চতুর্থ অধিকরণের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম শ্লোকে বলেছেন–“বেশ্যানাং পুরুষাধিগমে রতির্বৃত্তিশ্চ সৰ্গাৎ”। অর্থাৎ “গণিকাদের পুরুষ-ধরা বিদ্যা এবং অর্থ উপার্জন সেই সৃষ্টির আদিকাল থেকে চলে আসছে”। দ্বিতীয় শ্লোকে বলেছেন–“রতিতঃ প্রবর্তনং স্বাভাবিকং কৃত্রিমমর্থার্থম্”। অর্থাৎ রুচি হল রতির প্রতিশব্দ। রুচি থেকে যে পুরুষ গ্রহণে প্রবৃত্তি সেটা স্বাভাবিক, আর তা থেকে গণিকাদের যে অর্থোপার্জন প্রবৃত্তি সেটা কৃত্রিম”। এবার গণিকাদের উদ্দেশে তৃতীয় শ্লোকটি পড়ুন–“তদপি স্বাভাবিকবপরেৎ কামপরাসু হি পুংসাং বিশ্বাসযোগাৎ”। অর্থাৎ “তুমি যে পুরুষের কাছে ছল করছ, সেটা যেন বুঝতে না পারে। এমন ভাব দেখাবে যে তুমি তাকে ভালোবাসো, তাঁর অনুরাগিণী–এরকম হলে পুরুষ তোমার হাতের মুঠোয় এসে যাবে”। ষষ্ঠ শ্লোকে বলা হয়েছে–“ন চানুপায়েনার্থান সাধয়েদায়তিসংরক্ষণার্থ”। অর্থাৎ, “পুরুষের কাছে অর্থ উপার্জন করবে, কিন্তু খুব কৌশলে”।
এই পরামর্শই বুঝিয়ে দেয় গণিকাবৃত্তির বৈধতা ছিল, নিন্দনীয় নয়। বাৎস্যায়ন পইপই করে বলে দিয়েছেন কোন্ ধরনের পুরুষ একজন গণিকার কাছে চরম কাম্য হওয়া আবশ্যক। অর্থাৎ সাদা বাংলায় গণিকারা কোন্ ধরনের পুরুষদের সঙ্গ দিলে মোটা টাকা মিলবে। তৎকালীন সময়ে গণিকারা প্রভাবশালী ও ধনীদেরই শয্যাসঙ্গিনী হতেন। এখনও এমন এক গণিকাশ্রেণি আছেন, যাঁরা কেবলমাত্র প্রভাবশালী ও ধনীদের বিলাসবহুল কক্ষে শয্যাসঙ্গিনী হন মোটা অর্থের বিনিময়ে। তবে তা খুব সংগোপনে।
যাই হোক, দেখা যাক বাৎস্যায়ন গণিকাদের কেমন শয্যাসঙ্গী পছন্দ করতে বলেছেন। যেমন–(১) ধনী তো হতেই হবে, সেইসঙ্গে পুরুষটিকে স্বাধীন হতে হবে। অর্থাৎ পিছুটান নেই এমন পুরুষ। (২) যে ব্যক্তি প্রজাদের কাছ থেকে শুল্কাদি আদায় করে। (৩) ধনীক শ্রেণির যৌন-বিকৃত বৃদ্ধ। (৪) সংঘর্ষবন, অর্থাৎ এক গণিকাকে নিয়ে দুজন ধনীর প্রতিদ্বন্দ্বীর কে কত টাকা দিয়ে তাঁকে নিতে পারে। (৫) সবসময় যাদের হাতে টাকা আসে। যেমন–সুদখোর, কুসীদজীবী ইত্যাদি (৬) যে পুরুষ দেখতে কালো কুৎসিত, অথচ নিজেকে সে রূপবান এবং রমণীরঞ্জন মনে করে।(৭) আত্মশ্লাঘার বড়াই করে এমন ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা আদায় করা খুব সহজ। (৮) ধনী, অথচ ধ্বজভঙ্গ বা নপুংসক পুরুষ বিবেচ্য। (৯) বাপ-মায়ের অনাদরের ছেলেকে আদরে ভরিয়ে দিলে প্রচুর অর্থ সমাগমের সম্ভাবনা। (১০) সঙ্গদোষে দুষ্ট বখে যাওয়া যুবক। ইত্যাদি।
কোন পুরুষের সঙ্গে গণিকারা যৌনমিলন করবে না, সে বিষয়েও পরামর্শ দিতে ভোলেননি বাৎস্যায়ন।যেমন–(১) যক্ষ্মারোগ (টিউবারকুলাইসিস) হয়েছে এমন পুরুষ। (২) কুষ্ঠরোগাক্রান্ত (লেপ্রসি) পুরুষ। (৩) যে ব্যক্তির বীর্যের সঙ্গে ক্রিমি জাতীয় একপ্রকার ক্ষুদ্র কীট (বোঝাই যাচ্ছে এখানে বিশেষ কোনো যৌনরোগের কথাই বলা হয়েছে) থাকে, যা নারীর যোনির ভিতর দিয়ে জরায়ুতে পৌঁছে নারীকে জরাগ্রস্ত করবে। (৪) কঠোর ও কর্কশভাষী। (৫) কঞ্জুষ বা কিপটে। (৬) নির্মূণ। (৭) গুরুজনের পরিত্যক্ত পুরুষ। (৮) চোর। (৯) বিশ্বাসঘাতক। (১০) যে পুরুষের মুখে দুর্গন্ধ। (১১) যে পুরুষ বশীকরণ জানে। (১২) বঞ্চক ইত্যাদি।
সব ঠিক থাকলে তবেই একজন গণিকা “বর্তমানং নিষ্পীড়িতার্থমুৎস্যজন্তী বিশীর্ণেন সহ সন্ধ্যাৎ”–একজন পুরুষের অর্থ নিঃশেষ করে ছিবড়ে করে তারপর আর-একজন অর্থবান পুরুষকে পাকড়াও করবে। (কামসূত্রম্ ৪/৩/১) বাৎস্যায়ন মনে করেন, একজন গণিকাকে বিভিন্ন রুচির যুবক এবং প্রৌঢ় ব্যক্তির সঙ্গ দিতে হবে। যদি ধনবান হয়, প্রয়োজনে বৃদ্ধের সঙ্গেও শুতে হবে অর্থলাভের তাগিদে। এমনকি গণিকাদের কামশাস্ত্রে পারদর্শিতা লাভ করতে হলে সবার আগে ৬৪ কলায় নিপুণতা লাভ করতে হবে। একটু জেনে নেওয়া যাক ৬৪ কলাগুলো কী কী–(১) কণ্ঠসংগীত। (২) যন্ত্রসঙ্গীতে পারদর্শিতা।(৩) নৃত্যকলা (৪) চিত্রাঙ্কন। (৫) কেশ সজ্জা।(৬) পুষ্পশয্যা নির্মাণ। (৭) নানাবিধ বর্ণে গৃহ সুসজ্জিতকরণ। (৮) নিজ পোশাক-পরিচ্ছদ, কেশ, নখ, দন্ত, প্রত্যক্ষ বর্ণের দ্বারা সুসজ্জিতকরণ। (৯) বর্ণাঢ্য প্রস্তর এবং ধাতব পদার্থে ঘর ও শয্যা সুশোভিত করা।(১০) ভিন্ন ভিন্ন উৎসবে বা আনন্দে শয্যা নানাভাবে আস্তরণ দেওয়া। (১১) সাঁতার ও জলকেলি। (১২) প্রিয় লোককে আকর্ষণ করার জন্য মন্ত্র-তন্ত্র অনুশীলন।(১৩) ফুল নিয়ে মালা গাঁথা ও অঙ্গাদি সুশোভিত করা। (১৪) ফুল নিয়ে মালার মুকুট ও বেষ্টন।(১৫) নিজের শোভন বেশভুষা করা—উৎসবে একপ্রকার, অন্য উৎসবে অন্য প্রকার। (১৬) চিত্তহারী প্রথায় কানের দুল পরিধান করা (১৭) সুগন্ধি দ্রব্য তৈরি করা। তৈজসপত্রাদি তৈরি সম্পর্কে শিক্ষা করা। (১৮) নতুন ভূষণ তৈরি বা পুরানো বিভিন্ন ধরনের অলংকার নতুন করে গড়া (১৯) অতিথিচর্যা (২০) পরিচ্ছদ রচনার সুচারুতা। (২১) হাতের কাজ।(২২) রন্ধনকলা। (২৩) পানীয় দ্রব্য, বিবিধ মিষ্টান্ন, আচার, চাটনি, ইত্যাদি তৈরিতে পারদর্শিতা। (২৪) সেলাই ও দেহের বস্ত্রাবরণ করতে সুদক্ষতা। (২৫) বস্ত্রখণ্ড ও সুতো দিয়ে পাখি, পাতা, ফুল ইত্যাদি তৈরি করা। (২৬) বীণা ও ডমরুর শব্দ অনুকরণ। (২৭) নানাবিধ হেঁয়ালিপূর্ণ আচরণ।(২৮) তাৎক্ষণিক কাব্যরচনা ও আবৃত্তি। (২৯) কঠিন অর্থপূর্ণ দুরূহ শব্দের অর্থ নিরূপণ করা। (৩০) সুমধুর কণ্ঠে শাস্ত্রীয় শ্লোক আবৃত্তি। (৩১) নাটক, অভিনয়, দর্শন ও নাটকের বিভিন্ন চরিত্রের প্রকৃত সমালোচনা। (৩২) কোনো কবিতার হারানো পঙক্তির পুনরুদ্ধার করা বা তা পুনরায় নতুন করে লেখা। (৩৩) বেত বা তৃণ থেকে নানাবিধ নতুন নতুন আসবাবপত্র রচনা বা বোনা। (৩৪) কাঠ থেকে কুঁদে ছবি বা দৃশ্য রচনা। (৩৫) কাঠমিস্ত্রির কাজ, এবং বাড়িঘর নির্মাণ। (৩৬) সোনা, রূপা ও দামি পাথর বসিয়ে নানা কাজ করা। (৩৭) রসায়ন বা ধাতব শাস্ত্র অধ্যয়ন। (৩৮) উজ্জ্বল পাথর ও দামি ধাতুর বস্তু রচনা। (৩৯) কানন রচনা ও পুষ্পবিন্যাস। (৪০) ভেড়া, মোরগ এবং পায়রাদের নিয়ে কৌতুকপূর্ণ খেলা করার উৎসাহ দান। (৪১) শুক, ময়না প্রভৃতি পাখিকে কথা শেখানো ও তাদের দিয়ে মজাদার কাজ করানো। (৪২) গাত্র মর্দন করতে শেখা, বেশভূষা রচনা করা, কাজের শিল্প শিক্ষা করা। (৪৩) সংবাদ প্রাপ্তির নমুনাস্বরূপ আঙ্গুলের দাগ বোঝা।(৪৪) গুপ্ত সংকেত শেখা ও ব্যবহার। (৪৫) বিভিন্ন দেশের লিখিত ভাষা ও কথাবার্তা বোঝ। (৪৬) ঘোড়া, হাতি ও যানবাহন সুসজ্জিত করা। (৪৭) সংকেত চিহ্ন বা গুপ্ত বার্তা বোঝা (৪৮) নানা ধরনের যন্ত্রে জ্ঞানলাভ করা। (৪৯) স্মৃতিশক্তি বা স্মরণশক্তি বৃদ্ধি করার অভ্যাস। (৫০) নানাবিধ পুস্তক পাঠ। (৫১) নানাবিধ পুস্তক রচনা। (৫২) অভিধান ও বিশ্বকোশ সংগ্রহ।(৫৩) ছন্দের নিয়ম এবং বক্তৃতা শিল্প শিক্ষা। (৫৪) লুকানোর শিল্প, তুলো রচিত দ্রব্যকে পশমরূপে রূপদান, সাধারণ দ্রব্যকে চিত্তাকর্ষক করে তোলা। নানা বস্ত্র পরিধান করা। (৫৫) দাবা খেলা ও পাশা খেলায় দক্ষতা (৫৬) বস্ত্র পরিচ্ছদ পরিধান করে নিজেকে অন্যের চোখে আকর্ষণীয় করে তোলা। (৫৭) শিশুদের মতো পুতুল ও গোলাকার সব বস্তু নিয়ে খেলা করা।(৫৮) নানা প্রকার শারীরিক ব্যায়াম ও কলাকৌশল শিক্ষা করা।(৫৯) রাজনীতি শিক্ষা করা।(৬০) সামরিক রীতিনীতি সম্পর্কে জ্ঞান (৬১) মুখ দেখে মানুষের চরিত্র আন্দাজকরণ।(৬২) কৃত্রিম পুষ্প তৈরি ৷(৬৩) কাদা বা নরম মাটি দিয়ে পুতুল, মূর্তি নির্মাণ (৬৪) গণিত বিষয়ে জ্ঞান লাভ।
বাৎস্যায়ন চৌষট্টি বা চতুঃষষ্টি কলায় সুশিক্ষিত গণিকাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন–“আভিরভূচ্ছিতা বেশ্যা শীলরূপগুণান্বিতা।/লভতে গণিকাশব্দং স্থানঞ্চ জনসংসদি৷৷” বাৎস্যায়নের সময় গণিকাদের বিয়ের মধ্যে এক অভিনব ব্যাপার ছিল। আর পাঁচটা সাধারণ মেয়েদের মতো তাঁরাও বিয়ে-থা, সন্তান জন্মদান, ঘর-সংসার করতে পারত। তবে কোনো গণিকাকেই বিয়ের পর পুরোনো গণিকাবৃত্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ করত না। অবশ্য বিয়ের পর প্রথম একটা বছর স্বামী ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে যৌনমিলন করা নিষিদ্ধ ছিল। বিয়ের এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর গণিকাবৃত্তিতে আর কোনো বাধা ছিল না। তবে সেক্ষেত্রে শর্ত একটাই–এক বছর পর স্বামী যে রাতে তাঁকে যৌনমিলনের তাগিদে বিছানায় আহ্বান করবে সেই মুহূর্তে শত খরিদ্দার ত্যাগ করেও সেই রাতে তাঁকে স্বামীর সঙ্গে যৌনমিলনে লিপ্ত হতে হবে (কামসূত্রম্ ৭/১/২২)। বাৎস্যায়ন শেষ করব গণিকাদের একটি বিপজ্জনক অপকর্ম দিয়ে। এইসব গণিকারা চতুরতার সাহায্যে মাঝমধ্যেই শাঁসালো ধনীর ছেলে খুঁজে তাঁর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করত। কীসের ক্ষতিপূরণ? গণিকারা তাঁর কোনো সখি বা দাসীর সাহায্যে তাঁর অক্ষতযোনি কন্যার যোনিদেশে সীসা-লৌহাদি নির্মিত কৃত্রিম লিঙ্গ প্রবেশ করিয়ে সতীচ্ছদ ছিন্ন করে ক্ষতের সৃষ্টি করত। এরপর ওই যযানি-বিধ্বস্ত মেয়েকে পাখি-পড়া পড়িয়ে মুখিয়ার দরবারে কিংবা বিচারালয়ে পূর্বে নির্দিষ্ট যুবকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করত এবং বেশ মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ আদায় করে নিত (কামসূত্রম্ ৭/১/২০)।
বাৎস্যায়নের সময়ে সমাজের বিদ্বান ব্যক্তিরা দলে দলে গণিকালয়ে আড্ডা জমাতেন। শুধু মুখে আচ্ছা নিশ্চয় হত না। নারী থাকবে, অথচ সুরা থাকবে না তা কি কখনো হয়! অতএব ঢালাও মদের ব্যবস্থাও ছিল সেই আড্ডায়। কত ধরনের মদের সমাবেশ ঘটানো হত, তার তালিকাও বাৎস্যায়ন উল্লেখ করেছেন। বাৎস্যায়ন এটাও প্রমাণ করে দিয়েছেন, অন্য বৃত্তিধারী বা পেশাদার মানুষরা যেমন বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে থাকে, ঠিক তেমনই গণিকারাও নিজের বৃত্তি বা পেশায় টিকে থাকার জন্য নানারকম কৌশল অবলম্বন করে থাকত। আর পাঁচটা বিক্রেতাদের খরিদ্দার ধরে রাখার মতো গণিকারাও পুরুষ ধরে রাখার চেষ্টা করতেন, ধরে রাখার বিদ্যাটাও অতি যত্নে আয়ত্ব করতে হত। বলতে দ্বিধা নেই, বাৎস্যায়ন তাঁর ‘কামশাস্ত্রম’ রচনা করেছিলেন মূলত গণিকাদের জন্যেই। গণিকারা যাতে উৎকৃষ্ট ও সুখদায়ক কামকলা প্রদর্শন করতে পারে সেই শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যেই কামসূত্র। গণিকাদের যৌনক্রিয়ার পারদর্শিনী করে তুলতেই এই আকর গ্রন্থ।
০৬. প্রাচীন সাহিত্যে গণিকা
আগেই বলেছি সংস্কৃত সাহিত্যের বিভিন্ন সমাজে দেবতা ও মানুষের সঙ্গে সঙ্গে গণিকাদের সঙ্গেও সহাবস্থানের প্রমাণ মেলে।এই সময়কালে গণিকারা সাধারণের চোখে মোটেই ঘৃণিত ছিলেন না, বরং মর্যাদার সঙ্গে তাঁরা জীবিকা নির্বাহ ও জীবনযাপন করতেন। প্রাচীন ভারতে ভারতের নাগরিক জীবনে গণিকারা বেশ গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছিল। মোটের উপর প্রাচীন ভারতের সামাজিক জীবনে যে গণিকাদের গৌরবময় ও মর্যাদাপূর্ণ স্থান ছিল তা তৎকালীন সাহিত্যই প্রমাণ দেয়। সেসময়ে গণিকাদের ডাক পড়ত উৎসব-অনুষ্ঠানেও। কারণ সেই সময়ের মানুষ মনে করত গণিকা-দর্শনে দিন ভালো যায়। এঁরা সৈন্যবাহিনীরও অনুচারিণী হত। ভিনদেশীয় কোনো রাজা এলে নগরের বাইরে গিয়ে গণিকারা তাঁদের অভ্যর্থনা করত। সংস্কৃত সাহিত্যের পাতায় পাতায় প্রচুর গণিকাদের বিবরণ পাওয়া গেলেও তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন প্রসিদ্ধ ও সমাদৃত ছিল। কয়েকজনের নাম উল্লেখ করতে পারি–বসন্তসেনা, বাসবদত্তা, শ্যামা, আম্রপালী প্রমুখ। প্রাচীন সাহিত্যের এইসব গণিকারা সুদীর্ঘকাল অতিক্রম করে একেবারে হাল আমলের সাহিত্যে জায়গা করে নিয়েছে। গণিকাদের বিচরণক্ষেত্র একালের মতো সেকালে শুধুমাত্র কামুক পুরুষদের জন্য ছিল না। বরং রাজ-সমীপে বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে বেঁচেবর্তে থাকত।
মহাকবি কালিদাসের মহাকাব্যগুলিতে গণিকাদের উল্লেখ আছে। মেঘদূতে আমরা গণিকাদের কথা জানতে পারি। বিক্রমোঝশীয়ম্ নাটকে মহাকবি যে উর্বশীকে নায়িকা করেছেন তিনি একজন বহুভোগ্যা গণিকারমণী। অবশ্যই উর্বশী ছিলেন তথাকথিত ‘স্বৰ্গবেশ্যা’। “নীচৈরাখ্যং গিরিমধিবসেস্তত্র বিশ্রামহেতোস্তৃৎসম্পকাৎ পুলকিতমিব প্রৌঢ় পুষ্পৈঃ কদম্বৈ/যঃ পণ্য স্ত্রী রতিপরিমলোদগারিভিৰ্মাগরানামুদ্দামানি প্ৰথয়তি শিলাবেশ্মভিযোবনানি (মেঘদূতম্, পূর্বমেঘ, ২৫)। শুধু কালিদাস কেন, বিশাখদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস গ্রন্থ থেকে জানা যায়–সেকালের গণিকাদের সঙ্গে রাজা ও সাধারণ মানুষের সম্পর্ক কাহিনি। সেকালের গণিকারা নানা বসনভূষণে অলংকৃত হয়ে রাজপথে কীভাবে শোভাবর্ধন করতেন, তারও উল্লেখ আছে। সপ্তম শতকের লেখক বাণভট্ট তাঁর কাদম্বরী গ্রন্থে লিখেছেন–সেকালে গণিকারা দেশের রাজাদের স্নান করাত। রাজাদের মাথায় আমলকী ঘষে দিত। স্নানের পর রাজাদের সারা শরীরে চন্দন, আতর, কুমকুম ইত্যাদি মাখিয়ে দিত। এমনকি রাজাদের পরনের যাবতীয় পোশাক গণিকারাই পরিয়ে দিতেন। নবম শতকে রচিত ‘কুট্টনীমত’ গ্রন্থে দামোদরগুপ্ত লিখেছেন–সেকালের বারাণসী নগরীতে মালতী নামে গণিকা বাস করত। সেই নারী গণিকা সংক্রান্ত নানা প্রয়োজনীয় উপদেশ নিতে বিকরবালা নামের এক বৃদ্ধা গণিকার কাছে যেতেন। কুট্টনীমত’ গ্রন্থটির উপজীব্যই হল সেই বৃদ্ধা গণিকার বিবৃত যৌনক্রিয়া সংক্রান্ত উপদেশাবলি। শ্রীধরদাস তাঁর ‘সদুক্তিৰ্ণামৃত’ গ্রন্থে তৎকালীন বঙ্গদেশের গণিকাদের বিবরণ দিয়েছেন। এখানে ‘তকালীন’ বলতে দ্বাদশ শতক বুঝতে হবে। শ্রীধরদাস বলেছেন–“বেশঃ কেষাং ন হরতি মনো বঙ্গ বারাঙ্গনানা”। ভবভূতির মালতীমাধব’ গ্রন্থে ব্রাহ্মণ মাধব সিংহলে বাণিজ্য করে প্রভূত সম্পদশালী হন। এরপর কুবলয়াবলি নামের এক সুন্দরী গণিকার প্রেমে পড়ে যান এবং যথারীতি যৌনমিলন কার্ব সম্পন্ন করেন। ব্রাহ্মণের মোহাবিষ্টতার সুযোগ নিয়ে সেই গণিকারমণী তাঁর সমস্ত সম্পত্তি হরণ করে চম্পট দেয়। পরে অবশ্য কুবলয়াবলিকে পাকড়াও করে এবং তাঁর নাক-কান কর্তন করে ছেড়ে দেন। এটাই মালতীমাধবের বিষয়। চারুদত্ত’ গ্রন্থে লেখক ভাসের কাহিনির উপজীব্য হল চারুদত্ত ও বসন্তসেনার প্রেম। বসন্তসেনা হলেন একজন গণিকা, যাঁর বিয়ে হয় চারুদত্ত নামের জনৈক ব্রাহ্মণ যুবকের সঙ্গে।এছাড়া শর্বিলক নামে এক ব্রাহ্মণের সঙ্গে মদনিকা নামে এক গণিকার বিয়ের কাহিনিও আছে।
জবালা এক বহুচারিণী বা গণিকার নাম। সামবেদীয় ছান্দোগ্য উপনিষদ থেকে জানতে পাই জবালা ও সত্যকামের কাহিনি। সত্যকাম জানতেন না তাঁর পিতৃপরিচয়। পিতৃপরিচয় নেই বলে সত্যকাম কোনো গুরুগৃহে বিদ্যাশিক্ষার জন্য যেতে পারতেন না। বহুচারিণী জবালাও খুব স্বাভাবিকভাবেই জানতেন সত্যকামের প্রকৃত পিতা কে। পরে অবশ্য সত্যকামের বিদ্যাশিক্ষার উপর আগ্রহ অনুভব করে গুরু গৌতম শিক্ষাদান করেছিলেন। বেদের যুগেও আমরা গণিকাদের পাচ্ছি। ঋকবেদে গণিকাদের বলা হত ‘জারিণী” “হপ্তাশ্চ বভ্রবো বাচমত এমদেং নিষ্কৃতং জারিণী” (অর্থাৎ ভ্ৰষ্টা নারী উপপতির নিকট গমন করে)। ঋকবেদে গণিকাদের ‘দিধিষু’ ও ‘সাধারণী’ বলা হয়েছে। অথর্ব বেদে বলা হয়েছে মহানগ্নী’, ‘পুংশ্চলী’। তবে একথা বলতেই হয়, তৎকালীন বৈদিক সাহিত্যে গণিকাদের বিষয়ে সরাসরি কোনো আলোচনা না-হলেও এটা অনুমান করা যায় যে, তৎকালীন সমাজে গণিকাদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য।
বেদের যুগে গণিকা ও গণিকাবৃত্তি মহত্বপূর্ণ হলেও মনুসংহিতার যুগে এসে নিন্দিত হয়েছে। স্মৃতিকারেরা প্রবঞ্চক, জুয়ারী, তস্করদের সঙ্গে গণিকাদের একাসনে বসিয়ে দিয়েছেন। মনু স্পষ্টভাবে বলেছেন–ব্রাহ্মণ কিংবা গৃহস্থ ব্যক্তির পক্ষে গণিকাদের কাছ থেকে কোনো দান অথবা ভক্ষদ্রব্য গ্রহণ করা দূষণীর। ব্রাহ্মণ কখনোই গণিকাগমন করবে না। যদি যায় তাহলে তাঁকে কৃচ্ছসাধন করে পবিত্র হতে হবে। মনু বলছেন–ষড়দোষে (অধিক মদ্যপান, অসৎ পুরুষ সংসর্গ, স্বামীবিচ্ছেদ, ইতস্তত ভ্রমণ, অসময়ে নিদ্রা এবং পরগৃহে বাস) দুষ্ট রমণী ব্যভিচারিণী হয়ে থাকে (“ষট স্ত্রিয়া ব্যভিচারায়া দোষ জনকানি তস্মাদেতেভ্য এতা রক্ষণীয়াঃ”), এ থেকেই বোঝা যায় সে যুগে ব্যভিচারিণী বা গণিকার উপস্থিতি ছিল। মনু গণিকাদের অশালীন আচরণ করার অপরাধে নানা রকম শাস্তির বিধান দিয়েও গেছেন। মনুর যুগে বিশেষ কোনো গণিকার নাম উল্লেখ না থাকলেও তৎকালীন সমাজে প্রচুর গণিকার উপস্থিতি প্রমাণিত হয় স্মৃতিশাস্ত্রের বিভিন্ন উক্তি থেকে। গণিকাদের মনে করা হত মানুষের চলার পথে কণ্টক স্বরূপ (“প্রকাশলোক বঞ্চকার চাবৈর্জনীয়াৎ”)। সেই কারণেই এঁদের ধরার জন্য রাজার চরেরা ঘুরে বেড়াত। যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতায় গণিকাদের কথা জানা যায়। যাজ্ঞবন্ধ্যে গণিকাদের ‘স্বৈরিণী’ বলা হয়েছে। স্বৈরিণী হল তাঁরাই, যাঁরা স্বীয় স্বামীকে পরিত্যাগ করে ইচ্ছাপূর্বক কোনো পরপুরুষের আশ্রয় করে। যাজ্ঞবল্ক্য গণিকাদের জন্য কিছু নিয়মনীতিও ঠিক করে দিয়েছিলেন। যেমন–(১) কোনো গণিকা যদি খরিদ্দারের কাছ থেকে শুল্ক গ্রহণ করে বা অগ্রিম অর্থ নিয়ে পরে যৌনমিলনে অনিচ্ছা প্রকাশ করলে গৃহীত অর্থের দ্বিগুণ খরিদ্দার পুরুষটিকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য থাকবে। অন্যথায় গণিকার দেহদানের সমান অর্থ পুরুষটাকে ফিরিয়ে দিতে হবে–“গৃহীত বেতনা বেশ্যা নেচ্চন্তী দ্বিগুণং বহেৎ।/অগৃহীতে সমং দাপ্যঃ পুমাণপ্যেসেব চ”। (২) কোনো পুরুষ যদি গণিকাকে দেহদানের নিমিত্ত অর্থ দিয়েও তাঁর সঙ্গে যৌনসংসর্গ না-করে, তাহলে তাঁর দেয় অর্থ সেই গণিকার কাছ থেকে কোনোমতেই ফেরত পেতে পারে না–“অযৌন গচ্ছতো যেধাং পুরুষং বাপি মোহতঃ।/চতুর্বিংশতিকো দণ্ডস্তথা প্রব্রজিতাগমো”। শুধুমাত্র মনুসংহিতা বা যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতাতেই নয়, পরাপরসংহিতা ও বিষ্ণুসংহিতাতেও গণিকাগমন নিন্দনীয় গণ্য করেছে। বলা হয়েছে, গণিকাগমন হস্তমৈথুনতুল্যের মতো অপরাধ। হিন্দুধর্মে হস্তমৈথুন বা স্বমেহনকে পাপকাজ বলে অভিহিত করা হয়েছে। গৌতমসংহিতায় সর্বসাধারণের ভোগ্যা নারীকে হত্যা করলে হত্যাকারীর কোনো শাস্তি হবে না বলেছে। গণিকার অনুগ্রহণও নিষিদ্ধ, বিশেষ করে ব্রাহ্মণদের।
তা সত্ত্বেও আমরা দেখতে পাই, প্রাচীন ভারতে জীবনের অপরিহার্য অঙ্গই ছিল গণিকারা। কোনো মহৎ উৎসব অনুষ্ঠান গণিকাদের উপস্থিতি ছাড়া হতই না। রামায়ণে আমরা দেখতে পাই গণিকার লোভ দেখিয়ে বিভাণ্ডক মুনির পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গ মুনিকে অযোধ্যার যজ্ঞে আনা হয়েছে। ঋষ্যশৃঙ্গ লোকালয়ের আসা একদম পছন্দ করতেন না। যত জরুরি কাজ থাক না-কেন কখনোই তিনি লোকালয়ে আসতেন না। অতএব রাজা দশরথকে তাঁর অমাত্য সুমন্ত পরামর্শ দিলেন–“মহারাজ, মানুষ সর্বদা যা কামনা করে এবং যাতে চিত্তচাঞ্চল্য ঘটে এমন ইন্দ্রিয়-ভোগ্য জিনিস জড়ো করে ঋষ্যশৃঙ্গকে আকৃষ্ট করে অযোধ্যায় আসা বাঞ্ছনীয়”–“ইন্দ্রিয়ার্থৈবাভমতৈৰ্ণরচিত্ত প্রমাতিথিঃ/পুরমানায়য়িষ্যামঃ ক্ষিপ্রং চাধ্যবসীবতা”। অমাত্য সুমন্ত সহাস্যে দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়েছিলেন–সেই ইন্দ্রিয়ভোগ্য জিনিস হল লাবণ্যময়ী যুবতী গণিকা। রাজা দশরথের নির্দেশে পুরোহিত ও মন্ত্রীরা অবিলম্বে সুন্দরী গণিকাদের ব্যবস্থা করলেন। আদেশানুসারে সেই সুন্দরী গণিকারা ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির আশ্রমের অভিমুখে যাত্রা করলেন। রামচন্দ্রের রাজ্যাভিষেককালেও প্রচুর গণিকাদের উপস্থিতির কথা জানতে পারি। অধিকৃত ব্যক্তিবর্গকে মুনি বশিষ্ঠ নির্দেশ দিয়েছিলেন–“মন্ত্রীগণ, সর্বত্র পতাকা উড্ডীন করে দাও। রাজপথে জলসিঞ্চন করো, যে পথে গণিকা সকল সুসজ্জিত হয়ে প্রাসাদের দ্বিতীয় কক্ষে অবস্থান করবে।” সুবৃহৎ সংস্কৃত মহাকাব্য মহাভারতেও গণিকাদের কদর ছিল। যৌন কেলেংকারীতে ভীমের হাতে মৃত্যু হয় বিরাটরাজের সেনাপতি কীচকের। সেনাপতির মৃত্যুর সুযোগ নিয়ে ত্রিগর্তের রাজা সুশর্মা কৌরবদের সাহায্য নিয়ে বিরাটরাজের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। বিরাটরাজও পাণ্ডবদের সহযোগিতায় ত্রিগর্তের রাজা সুশর্মাকে পরাজিত করেন। সেই যুদ্ধজয়ের আনন্দে বিরাটরাজ এক উৎসবের আয়োজন করেন। সেই রাজকীয় উৎসবের একেবারে পুরোধায় সুন্দরী গণিকাদের সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন বিরাটরাজ। গণিকাদেরই রণজয়ের ঘোষণা করতে আদেশ দিয়েছিলেন স্বয়ং বিরাটরাজ।
সে যুগে গণিকাদের সেনাবাহিনীর সঙ্গেও পাঠানো হত, সেনারা যাতে আমোদ-প্রমোদে সময় অতিবাহিত করতে পারে। রামচন্দ্রের স্বতন্ত্র সেনাবাহিনী, কৌরব ও পাণ্ডবদের সেনাবাহিনীতেও যথেষ্ঠ পরিমাণে গণিকা মজুত রাখা হয়েছিল। কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধকালীন সময়ে পাণ্ডব শিবিরে শত শত গণিকাদের দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল স্বয়ং ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের। এমনকি কৌরব-পাণ্ডবদের যুদ্ধের প্রাক্কালে কৃষ্ণ আসছেন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে দূতরূপে, এই সংবাদ পেয়ে ধৃতরাষ্ট্র দ্রুত নির্দেশ দিলেন–কৃষ্ণের অভ্যর্থনায় যেন কোনো ত্রুটি না হয়। অবিলম্বে হাজার হাজার গণিকাদের উত্তমোত্তর বেশভূষা পরিধান করে যেন কৃষ্ণকে আনতে যায়। অতএব স্বয়ং কৃষ্ণও গণিকাদের পেয়ে বিনোদিত হতেন। কাহিনি বিশ্লেষণে এটাই প্রমাণিত হয় যে, রামায়ণ ও মহাভারতের যুগে গণিকাবৃত্তি বিশেষ প্রসার লাভ করেছিল। মহাভারতের যুগে গণিকাদের রাজকীয় সম্মানে সম্মানিত করা হত। তাঁরা রাজাদের সবসময়ের সঙ্গী। সে সময়ে রাজারা মৃগয়ায় গেলে গণিকাদেরও যেতে হত বিনোদনের জন্যে। সেকালে গণিকাদের যে সম্মান ও মর্যাদা ছিল, সেই সম্মান ও মর্যাদা একেবারে তলানিতে।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে গণিকাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের বর্ণনা স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। আমরা এতক্ষণ যেসব গণিকাদের কথা জানলাম তাঁরা রাষ্ট্র-পৃষ্টপোষকতায় হলেও মোটামুটি স্বাধীন। কৌটিল্যের সময়ে এসে দেখতে পাচ্ছি গণিকারা কারোর অধীনে থেকে কাজ করছে। আমরা গণিকাধ্যক্ষের কথা জানতে পারছি, যাঁদের বর্তমান পরিচয় ‘মাসি’ বা ‘মক্ষীরানি’। কৌটিল্যের যুগেও বহু সংখ্যক গণিকা পিছু একজন করে। তত্ত্বাধায়ক বা গণিকাধ্যক্ষ থাকত। তাঁরাই গণিকা সংক্রান্ত নানাবিধ কাজ করত। কারা হতে পারত গণিকাধ্যক্ষ? না, এখনকার মতো বিগতযৌবনা গণিকাদের ‘মাসির মতো গণিকাধ্যক্ষ হতে পারত না। গণিকাধ্যক্ষ একটি রাজকীয় পদ। তাই গণিকাধ্যক্ষদের রীতিমতো রূপবতী, যৌবনবতী ও কলাসম্পন্না রমণী হতে হবে এবং অবশ্যই তাঁকে গণিকা বংশে উৎপন্না অথবা অগণিকা বংশেও হতে হবে। বেতন ছিল ১০০০ পণ। কৌটিল্য গণিকাদের গুণ-রূপ-কাজ অনুযায়ী ভাগও করেছেন। যেমন উত্তম শ্রেণির গণিকা, মধ্যম শ্রেণির গণিকা এবং কনিষ্ঠ শ্রেণির গণিকা। এঁরা সকলেই বেতনভুক্ত শ্রেণি। যেমন উত্তম শ্রেণির গণিকার বেতন ৩০০০ পণ, মধ্যম শ্রেণির গণিকার ২০০০ পণ এবং কনিষ্ঠ শ্রেণির গণিকার ১০০০ পণ। এই বেতন রাজা তথা রাষ্ট্র দিত।
এইসব রূপবতী গণিকাদের যৌবন হারালে কী হত? এখনকার মতোই, অন্যান্য গণিকাদের দেখভালের দায়িত্ব পালন করতেন সবেতন। বৃত্তিতে থাকতে থাকতে কোনো গণিকার মৃত্যু হলে সেই গণিকার কন্যা বা বোনের গণিকাবৃত্তির অধিকার ছিল। আর গণিকাদের গর্ভে যদি পুত্রসন্তান জন্মত, তাহলে সেই পুত্রসন্তানকে রাজার কাছে দাস হয়ে সারাজীবন কাটাতে হত। কৌটিল্যের যুগে গণিকা এবং খরিদ্দারদের জন্য শাস্তি বা দণ্ডের ব্যবস্থাও ছিল। যেমন–কোনো পুরুষ যদি কোনো গণিকার কুমারীকন্যাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনমিলন ঘটাত, সেই পুরুষের শাস্তির ব্যবস্থা ছিল। রাজ-আজ্ঞা সত্ত্বেও কোনো গণিকা যদি কোনো বিশেষ পুরুষের সঙ্গে যৌনমিলনে অনিচ্ছা প্রকাশ করত, তাহলে সেই গণিকার বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান ছিল। কোনো গণিকাকে অকারণে কোনো পুরুষ যদি হত্যা করে বা গণিকার ঘরে রাত কাটাতে গিয়ে তাঁর অলংকার চুরি করে, তখন সেই অভিযুক্ত পুরুষকে শাস্তির মুখোমুখি হতেই হত। কোনো পুরুষের কাছ থেকে আগাম পারিশ্রমিক নিয়েও যদি কোনো গণিকা যৌনমিলন না করত, সেক্ষেত্রেও বিশেষ শাস্তি ভোগ করতে হত গণিকাদের।
খ্রিস্ট্রীয় পঞ্চম শতকের মহাকবি কালিদাস তাঁর মেঘদূত কাব্যে দুই প্রকারের গণিকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে–একটি নগরনটী, অপরটি দেবদাসী। বিক্রমোর্বশীয়ম, নলোদয়, দ্বাবিংশপুত্তলিকা, ঋতুসংহারে কামুক পুরুষ ও গণিকাদের উল্লেখ আছে। দ্বাবিংশপুত্তলিকা কাব্যে মহাকবি কালিদাস মোট ৩২ জন গণিকার কথা বলেছেন। তাঁরা হলেন–মিশ্রকেশী, সুপ্রভা, ইন্দ্রসেনা, সুদতী, অনঙ্গনয়না, কুরঙ্গনয়না, লাবণ্যবতী, কমলিকা, চণ্ডিকা, বিদ্যাধরী, প্রজ্ঞাবতী, জনমোহিনী, বিদ্যাবতী, নিরুপমা, হরিমধ্যা, মদনসুন্দরী, বিলাসরসিকা, শৃঙ্গারকালিকা, মন্মথসঞ্জীবনী, রতিলীলা, মদনবতী, চিত্রলেখা, সুরতগহ্বরা, প্রিয়দর্শিনী, কামোন্মাদিনী, সুখসাগরা, শশিকলা, চন্দ্ররেখা, হংসগামিনী, কামরসিকা, উন্মাদিনী, প্রভাবতী ইত্যাদি। পাঠক, নামের ধরন দেখে বুঝে নিন এই নারীদের কাজ কী ছিল। মহাকবির লেখনীতে সরাসরি গণিকা না-বললেও নামের অর্থানুসারে অনুমান করাই যায় তাঁরা প্রত্যেকেই বারবিলাসিনী-কামনাময়ী। তবে গণিকাদের বর্ণনায় মহাকবি ছিলেন খুবই উদার। তিনি বর্ণনা দিয়েছেন–বিলাসিনীরা তাঁদের অর্থবান নাগরদের নানাভাবে গ্রীষ্মের তাপ নিবারণের আয়োজন করছে। এই সময় মেখলা শোভিত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বসনে তাঁদের নিতম্বের অংশবিশেষ দেখা যাচ্ছিল। প্রায় খোলাখুলিভাবে সুউচ্চ স্তনমণ্ডলে তাঁরা নাগরদের দেখিয়ে দেখিয়ে চন্দন মাখছিল এবং চুলে সুগন্ধি দিচ্ছিল (নিতম্ববিম্বৈঃ সদুকুলমেখলৈঃ স্তনৈঃ সহারাভরনৈ সচন্দনৈঃ।/শিরোরুহৈঃ স্নানকষায় বাসিতৈঃ স্ত্রিয়ো নিদাঘাংশময়ন্তি, কামিনা”)। কালিদাসের কাব্যে গণিকাদের গতিবিধি ছিল অবাধ। কথিত আছে, মহাকবি কালিদাস স্বয়ং ব্যক্তিগত জীবনে জনৈকা বিশিষ্ট গণিকার সঙ্গে দিনযাপন করতেন।
গুপ্তসাধনতন্ত্রে বলা হয়েছে গণিকারা শক্তিরূপে পরিগণিত হওয়ার যোগ্য। তান্ত্রিক সাধনায় এই শক্তির ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, তন্ত্রসাহিত্যের সৃষ্টি মূলত এক ধর্মীয় গোষ্ঠীকে কেন্দ্র করেই, সে ধর্মগোষ্ঠী সাধনায় সিদ্ধিলাভের জন্য মদ্য, মাংস, মৎস, মুদ্রা ও মৈথুন–এই পঞ্চ ম-কারে বিশেষ প্রাধান্য দিত। এই সাধনা চলত গণিকাদের উপর। আদিরস বা যৌনক্রিয়াকলাপ ছিল তাঁদের প্রধান উপজীব্য। গুপ্তসাধনতন্ত্রে গণিকাদের পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে—(১) রাজগণিকা বা নাগরী, এঁরা শহর বা নগরে বিচরণকারী গণিকা, (২) গুপ্তগণিকা, এঁরা সম্মানিত পরিবারে থেকে গোপনে গণিকাবৃত্তি করে। (৩) দেবগণিকা, এঁরা মন্দির বা দেবালয়ে গণিকাবৃত্তি করে। এঁদের প্রচলিত পরিচয় ‘দেবদাসী’। এঁদের বিষয়ে পরে অন্য অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। (৪) ব্ৰহ্মগণিকা, তীর্থস্থানে ঘুরে ঘুরে গণিকাবৃত্তি করেন।
ধর্মীয় সংস্কার-আচার-প্রথাও পবিত্র পতিতা’-র জন্ম দিয়েছে। লোকজীবনে দেহসাধনায় নামে যে অবাধ যৌনাচার চলে আসছে, তাতে ভণ্ড পির, কামুক সাধু কিংবা বৈরাগী-বৈষ্ণবী আখড়াও বাদ যায় না। নিরুত্তরতন্ত্রে আবার গণিকাদের ছয়ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন–(১) গুপ্তগণিকা—এঁরা সাধারণত তন্ত্রসাধক বা তান্ত্রিকদের বংশজাতা হয়। এঁরা স্বভাবে নির্লজ্জ এবং অত্যধিক কামাসক্ত হন। এঁরা পশুভাবাপন্ন পুরুষই পছন্দ করেন। (২) মহাগণিকা—এঁরা স্বেচ্ছায় শরীরের পোশাক ত্যাগ করে গোপন অঙ্গ প্রদর্শন পুরুষকে যৌনকর্মে আহ্বান করে (৩) কুলগণিকা–এঁরা স্বামীসন্তান নিয়ে সংসারধর্ম করেন এবং পাশাপাশি গণিকাবৃত্তিও করেন। (৪) রাজগণিকা—এঁরা স্বাধীনভাবে শহরের ভিতর পুরুষের সন্ধানে বিচরণ করে এবং রাজার মতোই আচরণ করে। (৫) ব্ৰহ্মগণিকা এবং (৬) মহোদয়া। এক্ষেত্রে বলা হয়েছে এইসব গণিকারা এক একটি তীর্থতুল্য। যেমন গুপ্তগণিকাদের বলা হয়েছে অযোধ্যা তীর্থতুল্য, মহাগণিকাদের বলা হয়েছে মথুরা তীর্থতুল্য, কুলগণিকাদের বলা হয়েছে মায়া তীর্থতুল্য, রাজগণিকারা দ্বারকা তীর্থতুল্য ও অবন্তী তীর্থতুল্য, ব্ৰহ্মগণিকারা দ্বারাবতী তীর্থতুল্য এবং মহোদয়া গণিকারা কালিকা তীর্থতুল্য।
নিরুত্তরতন্ত্রেই বলা বলা হয়েছে–“স্ত্রী পুংসো সঙ্গমে সৌখং জায়তে তং পরমং পদ”। অর্থাৎ, স্ত্রী ও পুরুষের যৌনমিলনে বা সঙ্গমে যে আনন্দ, তাই-ই পরমপদ বা ব্রহ্ম। সেই কারণেই তন্ত্রসাধনায় পঞ্চ ম-কারের এত আয়োজন। বলা হয়েছে–“বিনা পীত্বা সুরাং ভুক্কা মৎস্যমাংসং রজস্বলাং/যো জপে দক্ষিণাং কালীং তস্য দুঃখ পদে পদে”। অর্থাৎ, যে বিনা মদ্যপানে, বিনা মাছমাংসে, বিনা যুবতী সম্ভোগে যে দক্ষিণা কালীর আরাধনা করবে, তাঁর পদে পদে দুঃখ হবে।
ষষ্ঠ শতকের লেখক বিষ্ণুশর্মার পষ্ণতন্ত্রে বেশ কিছু কাহিনিতে তৎকালীন সময়ের গণিকাদের উল্লেখ পাওয়া যায়। আছে দেবদাসীদের কথাও। এই গ্রন্থ থেকে জানা যায় সে সময় গণিকারা প্রভূত ক্ষমতা ভোগ করত এবং প্রচুর সম্পদের অধিকারিণী ছিল। রবিচন্দ্রের অমরুশতকেও গণিকাদের কথা জানা যায়। অমরুশতকের কাহিনি ও চরিত্রের কাঠামো থেকেই অনুমিত হয় সে সময়ের গণিকাদের উপস্থিতি ছিল অবাধ। সপ্তম শতকে হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালে সভাকবি বাণভট্টের কাদম্বরী থেকে জানা যায় স্নানের পর রাজাদের গায়ে চন্দন, আতর, কুমকুম প্রভৃতি মাখিয়ে দিত গণিকারা। রাজাদের পোশাকও পরিয়ে দিতে হত। দ্বাদশ শতকের গ্রন্থ মৃন্ময়সুন্দরীকথাতে দেখি গণিকার আয়ের শতকরা পাঁচশো থেকে ত্রিশ ভাগ ছিল রাষ্ট্রের প্রাপ্য অর্থাৎ রাজস্ব। বৌদ্ধগ্রন্থে গণিকার ‘ভট্টি’ (সংস্কৃত ‘ভূতি’) অর্থাৎ বেতন এবং পরিব্বায়’ (সংস্কৃত পরিব্যয়ম) খরচের উল্লেখ পাই। মথুরার গণিকা বাসবদত্তার পারিশ্রমিকও অত্যন্ত উচ্চহারের ছিল। রাজগৃহের সালাবতী প্রতি রাত্রে একশো কার্যপণ উপার্জন করত।
শাস্ত্রের পাশাপাশি ইতিহাসের সাক্ষ্যও দুর্লভ নয়। বাংলার তাম্রশাসন আমলের লেখমালায় সংগীত ও নৃত্যপটিয়সী রাজনটী ওরফে রাজগণিকাদের পরিচয় মেলে। ধর্মীয় আচারের আড়ালেও আবার কখনো কখনো গণিকা ও গণিকাবৃত্তির জীবনযাপন করতে হয়েছে এবং হচ্ছে। এমন আধুনিক ধর্মগুরু রাম রহিম, রামপাল, স্বামী চিন্ময়ানন্দ, স্বামী নিত্যানন্দ, আশারামের নাম সবাই আজ জেনে গেছেন। কালীঘাটের পটচিত্রে গণিকাসম্ভোগের দৃশ্য আছে, অনেক মন্দিরগাত্রেও উৎকীর্ণ টেরাকোটাতেও এমন দৃশ্য বিরল নয়।
অনেকে মনে করতে পারেন, গণিকারা এমনই সহজলোভ্য পণ্য, যে অর্থ দিলেই হাতের মুঠোয়। এই চিন্তা একালের গণিকাদের প্রযোজ্য হলেও সেকালের গণিকাদের অর্থের হাতছানি করতলগত করা অতটা সহজ ছিল না। এমনই একজন গণিকার নাম হল বসন্তসেনা। হৃদয়বত্তা, ত্যাগ এবং একনিষ্ঠতার সন্ধান যদি করতে হয়, তবে বসন্তসেনাই তার ধারক ও বাহক। বোধহয় এমন মহিমময় গণিকা যুগে যুগে দ্বিতীয়টি সৃষ্টি সম্ভব নয়, যার মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠেছে একই সঙ্গে জায়া-জননী-প্রেয়সীর প্রতিরূপ। বসন্তসেনার নাম যখন উঠল, তখন। বৌদ্ধধর্মে উল্লেখিত গণিকাদের একটু খোঁজখবর নিতে পারি। বৌদ্ধধর্মের গ্রন্থগুলি থেকে আমি নয়জন গণিকার কথা জানতে পাচ্ছি–বসন্তসেনা, আম্রপালী, বাসবদত্তা, শলাবতী, অদ্ধকাশি বা অর্ধকাশি, কাশিসুন্দরী, শ্যামা, সুলসা ও কালি। আলোচনা করব। তবে তার আগে বলি রামায়ণ ও মহাভারতের রাজঃন্তপুরে গণিকাদের উপস্থিতি লক্ষ করি, ঠিক তেমনি বৌদ্ধকাহিনিতে উল্লেখিত রাজঃন্তপুরে গণিকাদের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। বৌদ্ধসাহিত্য বাত্তাক জাতক’ থেকে জানা যায়, গৌতম বুদ্ধের বিবাগি মনকে সংসারী করতে পিতা শুদ্ধোদন সুন্দরী গণিকাদের নিয়োগ করেছিল। এক কার্তিকের উৎসবে শুদ্ধোদন তাঁর পুত্রকে এক সুন্দরী গণিকার ঘরে পাঠিয়ে দেন। সেই গণিকা তাঁর হাজার ছলাকলা কলাকৌশলেও তাঁর ধ্যানভঙ্গ করতে ব্যর্থ হয় এবং তাঁকে পরিত্যাগ করে চলে যায়।
বসন্তসেনা : প্রমথ চৌধুরী তাঁর ‘বসন্তসেনা’ কবিতায় লিখছেন–“তুমি নও রত্নাবলী, কিম্বা মালবিকা, রাজোদ্যানে বৃন্তচ্যুত শুভ্র শেফালিকা।/ অনাঘ্রাত পুষ্প নও, আশ্রমবালিকা,/ বিলাসের পণ্য ছিলে, ফুলের মালিকা’রঙ্গালয় নয় তব পুষ্পের বাটিকা, অভিনয় কর নাই প্রণয়-নাটিকা।/ তব আলো ঘিরে ছিল পাপ কুঙ্কুটিকা, ধরণী জেনেছ তুমি মৃৎ-শকটিকা!/নিষ্কণ্টক ফুলশরে হওনি ব্যথিতা।/ বরেছিলে শরশয্যা, ধরায় পতিতা।/কলঙ্কিত দেহে তব সাবিত্রীর মন/সারানিশি জেগেছিল, করিয়ে প্রতীক্ষা/বিশ্বজয়ী প্রণয়ের, প্রাণ যার পণ।/ তারি বলে সহ তুমি অগ্নির পরীক্ষা!”
বসন্তসেনাকে আমরা পাই খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর নাট্যকার শূদ্রকে মৃচ্ছকটিকে। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে প্রদ্যোৎ সাম্রাজ্যের পতনকালে উজ্জয়িনী নামে একটি প্রাচীন ভারতীয় নগরের প্রেক্ষাপটে লেখা, যেখানকার রাজা ছিলেন পালক। চারুদত্ত নামের এক সম্ভ্রান্ত অথচ দরিদ্র ব্রাহ্মণ যুবককে কেন্দ্র করে, যিনি বসন্তসেনা নাম্নী এক গণিকা কর্তৃক প্রণয়াসক্ত হন। পারস্পরিক অনুরাগ সত্ত্বেও তাঁদের বাসস্থান ও ভালোবাসা দুই-ই পথে বসে সমস্থানিক নামে এক কামাতুর (বসন্তসেনার প্রতি) রাজসভাসদের চাতুর্যে। শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক নাটকে বসন্তসেনা একজন গণিকা। কিন্তু বসন্তসেনার শরীর ও মন দুইয়ের সমন্বয়ে এ নাটকে দেখানো হয়েছে। শ্ৰেষ্ঠী চারুদত্তকে ভালোবাসেন বসন্তসেনা। এই চারুদত্তের সংকটে বসন্তসেনা তাঁর সমস্ত গয়না সমর্পণ করেছেন। এটা শরীরের সম্পর্ক নয়, মনের সম্পর্ক।
আম্রপালী বা অম্বপালী : বৈশালীর রাজোদ্যান নামক স্থানে আমগাছের নিচে এক সদ্য জন্মানো মেয়ে শিশুর কান্নার আওয়াজ ওঠে। নগরের উদ্যান পালক শ্রীনাথ ও তাঁর পত্নী হরিবালা সেই শিশুকে উদ্ধার করে তাঁর ভরণপোষণের ভার গ্রহণ করেন। পালিভাষায় আমকে ‘অম্ব’ বলা হয়। আমগাছের নিচে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন বলে এই নামই রাখা হয়েছিল। আদান পালকের কন্যা বলেও তাঁর নাম হয় অম্বপালী বা আম্রপালী। পরিত্যক্ত কন্যাশিশুকে সেই দম্পতি নিজ সন্তানস্নেহে বড়ো করতে থাকেন। কিন্তু সেই বালিকা কৈশোরে পা দিতে না দিতেই নিদারুণ সমস্যায় পড়লেন বাবা ও মা। অসামান্যা সুন্দরী আম্রপালীকে নিয়ে বড় চিন্তায় পড়ে গেলেন তাঁর বাবা ও মা। আম্রপালীর রূপের আগুনে ঝাঁপ দিয়ে মরে যেতেও সুখ কামুক পুরুষরা। সবারই কাঙ্খিত নারী সে। গ্রামের মহাজন থেকে শুরু করে শহরের বণিক, জনপদের রাজা থেকে শুরু করে নগরের শ্রেষ্ঠী—কে নেই সেই তালিকায়! বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বীয় দেহের ক্রমবর্ধনশীল রূপ-যৌবনে টলটলে আম্রপালী নিয়ে যেন যুদ্ধ বেধে গেল।
বিশ্বের প্রাচীন গণতন্ত্রের মধ্যে বিখ্যাত বৈশালী। সেখানে রাজা নির্বাচিত হতেন নির্বাচনের মাধ্যমে। ছিল না পরিবারতন্ত্র, যোগ্য হলে তবেই নির্বাচিত হয়ে সিংহাসনে বসার সুযোগ মিলত। কথিত আছে, বৈশালীর এক রাজা মনুদেব হত্যা করেছিলেন আম্রপালীর বাল্যপ্রেমিক পুষ্পকুমারকে। সে রাতেই বিয়ে হওয়ার কথা ছিল আম্রপালী ও পুষ্পকুমারের। এরপর শুরু হয় তুমুল দ্বন্দ্ব, জনতার ইচ্ছার সভা বসে বৈশালী সংসদে। গণতন্ত্র বিধান দেয়, আম্রপালী কোনোদিনও বিয়ে করতে পারবেন না। কারণ এত রূপ-যৌবন নিয়ে তিনি কোনো একমাত্র পুরুষের ভোগ্যা হতে পারে না। আজব বিধান বইকি! গণতন্ত্রের শৃঙ্খলায় সেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হল। সুন্দরী হওয়ার অপরাধে আম্রপালী হয়ে গেলেন বৈশালীর গণিকা, বহু পুরুষের ভোগ্যা। আম্রপালী হলেন রাজ্যের সভানর্তকী। তিনি হলেন নৃত্যগীতে পারদর্শী, অভিজাত আদবকায়দায় রপ্ত এক সুন্দরী। সকল পুরুষ নয়, কেবলমাত্র উচ্চবংশের পুরুষই পেতে পারবে তাঁর কাছ থেকে যৌনসুখ। আম্রপালী নিজেই নিজের সঙ্গী নির্বাচন করতে পারবেন ভোগের জন্য। জেনে বিস্মৃত হবেন, গণিকা আম্রপালীকে দৃষ্টান্ত রেখে সেই আমলে বৈশালীতে নতুন একটা আইনও তৈরি হয়ে গেল। কী সেই আইন? কোনো অনিন্দ্য সুন্দরী নারী কখনো বিবাহ করতে পারবে না। তাঁকে বহু পুরুষের ভোগ্যা হয়ে যৌনানন্দ বিলিয়ে দেওয়ার জন্য উৎসর্গীকৃত হতেই হবে। তবে রাজগণিকা হওয়ার সুবাদে আম্রপালীর জন্য বরাদ্দ হয়েছিল সুবিশাল উদ্যান, মর্মর অট্টালিকা। ক্রমে আম্রপালী হয়ে উঠলেন প্রভুতা ক্ষমতার অধিকারিণী।
যাই হোক, মগধরাজ বিম্বিসার আম্রপালীর রূপের সংবাদ পেরে সেই রূপের আগুনে একটিবার ঝাঁপ দিতে চাইলেন। কিন্তু কী উপায়ে আম্রপালীকে অঙ্কশায়িনী করা সম্ভব? বৈশালী আর মগধ রাজ্যের মধ্যে তো ছিল পরস্পরের ঘোর শত্রুতা। শত্রুপক্ষের গণিকার কাছে তো আর কামাতুর হয়ে যাওয়া যায় না, আবার শত্রুরাজার কাছে নতজানুও হওয়াও যায় না। অতএব যুদ্ধ। রাজ্য ও রূপবতী গণিকা–দুইয়েরই দখল নেওয়া যাবে। মগধরাজ বিম্বিসার বৈশালী আক্রমণ করলেন ছদ্মবেশে আম্রপালীর প্রাসাদে সোজা ঢুকে গেলেন। ছদ্মবেশী সঙ্গীতজ্ঞ বিম্বিসারের গুণে আম্রপালী যেন ভেসে গেলেন। কিন্তু আম্রপালী যখন জানতে পারল এই ছদ্মবেশী বিম্বিসারই সাজানো বৈশালী তছনছ করে দিয়েছে, আম্রপালী দৃঢ়ভাবে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেন। শুধু প্রত্যাখ্যান নয়, সেইসঙ্গে বিম্বিসারকে শর্ত দিলেন তাঁকে অঙ্কশায়িনী করতে হলে বৈশালীকে মুক্ত করে দিতে হবে। আম্রপালীর অনমনীয়তায় বিম্বিসার অবশ্যই বৈশালীকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এই ব্যাপারটা বিম্বিসারের দুর্বলতা বলে ধরে নিয়েছিল শত্ৰুভূমি বৈশালীরাজ। ফলে দুই রাজ্যের দ্বন্দ্ব আটকানো সম্ভব হল না। বিম্বিসার আম্রপালীকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। কিন্তু সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন আম্রপালী। তবে বিয়ে না হলেও বিবাহ-বহির্ভূত তাঁদের এক সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। সেই সম্পর্কের জেরে তাঁদের এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। এরপর তিনি ফিরে যান নিজের রাজ্য মগধে।
বিম্বিসারের আর-এক পুত্র অজাতশত্রু পিতা বিম্বিসারকে তখন গৃহবন্দি করে সিংহাসন দখল করেন। অবশেষে গৃহবন্দি অবস্থায় বিম্বিসারের মৃত্যু ঘটে। এরপর অজাতশত্রু আক্রমণ করেছিলেন বৈশালী রাজ্য। উদ্দেশ্য দুটি–একটি হল ধন-সম্পদ লুঠ করা এবং আম্রপালীর দখল নেওয়া। অজাতশত্রু বৈশালী রাজ্যকে প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে দিলেন। এরপর আম্রপালীর প্রাসাদ দখল করে আম্রপালীকে বিয়ের প্রস্তাব। বাপের ভোগ করা নারী পুত্রেরও ভোগ্যা! না, অজাতশত্রু যখন জানতে পারলেন তাঁরই পিতার সঙ্গে আম্রপালীর সম্পর্ক ছিল এবং তাঁদের এক পুত্র সন্তান আছে, তখন রাগের বশে আম্রপালী ও তাঁর পুত্রকে গৃহবন্দি করে রাখলেন। এরপর তিনি শুরু করে দিলেন আরও লুঠতরাজ, আরও অত্যাচার। আম্রপালীর কারাগার বাদ দিয়ে গোটা বৈশালী পুড়িয়ে ছাই দিয়েছিলেন অজাতশত্রু।
অজাতশত্রু কর্তৃক বৈশালী ধ্বংস হয়ে গেলেও কিছুকাল পর বৈশালী রাজ্য পুনরায় মাথা তুলে দাঁড়ায়, পুনরায় সম্পদশালী রাজ্য হয়ে ওঠে। এই সময়ে বৈশালীতে গৌতম বুদ্ধ আসেন। সঙ্গে কয়েকশো শ্ৰমণ। আশ্রয় নেন এক নগরের উদ্যানে, নগরবাসীর গৃহে। সে সময় একদিন গৌতম বুদ্ধকে আমন্ত্রণ জানান আম্রপালী। গণিকা আম্রপালীর উদ্যানে অতিথি হয়ে তাঁর হাতে অনুগ্রহণ করেছিলেন গৌতম বুদ্ধ। এরপর একদিন আম্রপালী এক তরুণ সন্ন্যাসীকে দেখতে পেলেন। কিশোরীপ্রেম পুষ্পকুমারের পর ছদ্মবেশী বিম্বিসার, তারপর কারও রূপে মুগ্ধ হল আম্রপালী। ভাবলেন, একেই বশ করবেন। এই তরুণ সন্ন্যাসীও ছিলেন এক বৌদ্ধ শ্ৰমণ। ভিক্ষা ও আশ্রয়প্রার্থী। আম্রপালী নিজে তাঁকে ভিক্ষা দিলেন এবং তাঁর প্রাসাদে সময় অতিবাহিত করতে অনুরোধ করলেন। সন্ন্যাসী বললেন, তথাগতর আদেশ ছাড়া তিনি আশ্রয়গ্রহণ করতে পারবেন না। বুদ্ধদেবের কাছে গিয়ে অনুমতি চাইলেন তরুণ সন্ন্যাস। গৌতম বুদ্ধ অনুমতি দিলেন। এক গণিকার গৃহে থাকবেন বৌদ্ধ শ্রমণ? এই নিয়ে সঙ্ঘের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। গৌতম বুদ্ধও বিচলিত হলেন এহেন গুঞ্জনে। সমালোচকদের বললেন—ওই শ্রমণের চোখে তিনি কোনো কাম দেখেননি। অতএব শ্রমণ সময়মতোই নিষ্কলুষ হয়ে তাঁর কাছে ফিরবেন। কিছুদিন পর সময় অতিবাহিত হল। গণিকার গৃহে দীর্ঘ চারমাস কাটিয়ে সেই তরুণ সন্ন্যাসী ফিরলেন বুদ্ধের কাছে। নিষ্কলুষ শ্ৰমণ। তাঁর পিছন পিছন এলেন অসামান্য সুন্দরী আম্রপালী। আম্রপালী প্রণাম জানালেন গৌতম বুদ্ধকে। জানালেন–“তরুণ শ্রমণকে প্রলুব্ধ করতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখিনি, গণিকাবিদ্যার সব জ্ঞান প্রয়োগ করেও তাঁকে টলানো যায়নি। এই প্রথম কোনো পুরুষকে বশ করতে ব্যর্থ হয়েছি। উল্টে আমাকেই বশ করেছেন সর্বত্যাগী এই তরুণ শ্ৰমণ। আজ সর্বস্ব ত্যাগ করে তথাগত বুদ্ধর চরণে আশ্রয় চায় আম্রপালী।” কিন্তু সুন্দরী নারীর উপস্থিতিতে পাছে ভিক্ষু শ্ৰমণদের মনসংযোগ নষ্ট হয়, সেই আশঙ্কায় বুদ্ধ রাজি ছিলেন না। আম্রপালী তখন তাঁকে প্রশ্ন করেন–“বৌদ্ধ শ্ৰমণদের মনসংযোগ এতই ঠুনকো যে এক নারীর জন্য তা ভেঙে পড়বে?” একথা শুনে বুদ্ধ আম্রপালীকে সঙ্ঘে নিতে রাজি হন। আম্রপালী গৌতম বুদ্ধের ভিক্ষুণী রূপে সঘে যোগ দেন। আম্রপালী নিজের সব ধন-সম্পদ, সম্পত্তি, প্রাসাদ, উদ্যান বৌদ্ধসদ্যে দান করে দিয়েছিলেন। মোহমুক্ত হয়ে বাকি জীবন উৎসর্গ করেছিলেন বৌদ্ধসঙ্ঘে।
বাসবদত্তা : শ্ৰীমান উপগুপ্তের ব্যাবসার উন্নতি ও সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। তাঁর বিক্রয়লব্ধ দ্রব্যের গুণাগুণের কথা তথা সুসংত আচরণ, অমায়িক ও ভদ্র ব্যবহার, শীলগুণের কথাও ছড়িয়ে পড়ল। সেইসময় নগরীতে রূপের আলোয় আলোকিত করে অপেক্ষা করছিল বাসবদত্তা নামে এক যুবতী গণিকা।তিনি ছিলেন ধনী, প্রভাবশালী ও উচ্চবংশীয় পুরুষদের ভোগ্যা। গণিকা বাসবদত্তা তাঁর কলাকৌশলে, হাস্যে-লাস্যে, সুমধুর কণ্ঠস্বরে, নৃত্যের হিল্লোলে সকল পুরুষকে বিভোর করে রাখত।
মথুরার গণিকা বাসবদত্তা একদিন সুগন্ধী দ্রব্য কেনার জন্য তপতী নামের জনৈকা দাসীর কাছ থেকে জানতে পারলেন শ্রীমান উপগুপ্তের রূপ ও গুণের কথা। সে কথা শুনে বাসবদত্তা মুগ্ধ হল, উদ্বেলিত হল। মনে জাগল কামনার উদগ্র বাসনা। কামের প্রবল তাড়নায় শ্রীমান উপগুপ্তের প্রতি আকর্ষিত হতে থাকল। এ সময়ে মথুরা নগরে মদন উৎসব নামে একটি উৎসব হত। উৎসবের দিন কাছে এসে যাওয়ায় পথিকদের কর্মচাঞ্চল্যে নগর সর্বদা কোলাহল মুখর হয়ে আছে। উৎসবে যোগদান ও অংশগ্রহণ করতে প্রতি বছর উত্তরাপথের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে বহু বিদেশি (তখনকার সময়ে বিস্তীর্ণ ভারত উপমহাদেশের সব প্রদেশকে একে অপরের কাছে বিদেশি বা ভিনদেশি বলে পরিগণিত হত) মথুরার এসে সমবেত হত।
অভিজাতপল্লির এক সুউচ্চ অট্টালিকার অলিন্দ থেকে সেই জনপ্রবাহ প্রত্যক্ষ করছে বাসবদত্তা। জনতার স্রোতের ভিতর থেকে হঠাৎ এক রূপবান যুবককে দেখতে পেয়ে তিনি শিহরিত হল। প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে গেল বাসবদত্তা। সেই অভিজাত বংশজাত যুবকই হল শ্রীমান উপগুপ্ত। উত্তেজনায় থরথর বাসবদত্তা দাসী তপতীকে চিৎকায় করে ডাক দিল। তপতী হাজির হলে বাসবদত্তা বলল–“দেখেছ রাস্তা দিয়ে চলেছেন এক অসাধারণ রূপবান যুবক। নিশ্চয় ইনিই সেই যুবক যাঁর কথা তুমি বর্ণনা করেছিলে?” তপতী বলল–“তোমার রূপ বড়ই নিষ্ঠুর এই রূপ মুগ্ধ-পুরুষকে বিবশ করে দেয়। কত পুরুষই-না তোমার রূপের আগুনে দগ্ধ হওয়ার জন্য পতঙ্গের মতো ছুটে এসেছে। কত ধনকুবের তোমাকে লাভের আশায় তাঁদের ধনসম্পদ সর্বস্ব লুটিয়ে দিতে চেয়েছে। তুমি তাঁদের অনেককেই প্রত্যাখ্যান করেছ। সেই তুমি আজ কেন এই যুবকের প্রতি প্রলোভিত হচ্ছ? বলো আমায় কী করতে হবে?” বাসবদত্তা বলল–“তাঁকে জানাবে বাসবদত্তা আজ রাতের প্রথম প্রহরে প্রেমমুগ্ধ সতৃষ্ণ অন্তরে তাঁর জন্যে অপেক্ষা করে থাকবে। তিনি যেন এই নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। আরও বলবে বাসবদত্তা তাঁর প্রণয়াকাঙ্কিণী, তাঁর কাছ থেকে কোনোরূপ রজতমুদ্রার আশা করে না।”
শ্ৰীমান উপগুপ্তের কাছে এ বার্তা পৌঁছোলে তিনি মনে মনে ভাবলেন—এটা প্রলোভন। এই প্রলোভনে জড়িয়ে পড়া মানে আত্মাহুতি দেওয়া। এই আত্মাহুতি তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। বৈরীহীন নৈম্যের বিদ্যমানে শত্রুবহুল কামাসক্তিতে কী প্রয়োজন? বাসবদত্তার মতিভ্রম হয়েছে। বাসবদত্তা কামান্ধা। অতএব এহেন পরিস্থিতিতে তাঁকে উপায়-কুশলতা অবলম্বন করতে হবে। শ্রীমান উপগুপ্ত দূতী তপতীকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলেন–“এখন তাঁর সঙ্গে দেখা করার সময় নয়। উপযুক্ত সময় হলে আমি নিজেই তাঁর সঙ্গে দেখা করে নেব।” এই কথা শুনে তপতীকে বিফল মনোরথেই ফিরে যেতে হয়।
মনোবাঞ্ছা পূরণ হল না, এটা যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না বাসবদত্তা। মন অশান্ত হয়ে উঠল। রূপবান উপগুপ্তকে যে ভোলা যায় না! ধীরে ধীরে সময় অতিক্রান্ত হয়ে যায়। কিন্তু বাসবদত্তা যে একজন গণিকা। গণিকামাত্রেই দেহ-ব্যবসায়ী। দেহই তাঁর পুঁজি। উপগুপ্তকে লাভ করা গেল না তাতে কী হয়েছে! সবাই তাঁর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করবে কেন? বরং সকলে তাঁদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করবে তাঁর শরীর ভোগ করে। তাই বাসবদত্তার চাই নতুন পুরুষ। উপগুপ্তের জন্য আর অপেক্ষা না করে এক অশ্ব-ব্যবসায়ীর বাহুলগ্না হল। সেই অশ্ব-ব্যবসায়ী অগ্রিম ৫০০ স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে তাঁকে পেতে চাইল। বাসবদত্তা প্রলুব্ধ হয়ে সেই ব্যবসায়ীকে নিজগৃহে ডেকে পাঠায়। ব্যবসায়ী এলেন বটে। কিন্তু তাঁর মৃত্যু বাসবদত্তার হাতেই হল। ব্যবসায়ীর ধনরত্ন আত্মসাৎ করার লোভে তাঁকে হত্যা করে শৌচাগারে লুকিয়ে রাখে। এ খবর রাজার কানে পৌঁছে যায়। রাজা অপরাধের শাস্তিস্বরূপ বাসবদত্তার হাত-পা-নাক কেটে নগরের বাইরে শ্মশানে ফেলে আসার নির্দেশ দিলেন। মৃত্যুপথযাত্রিনী বাসবদত্তার সঙ্গে উপগুপ্তের শেষ দেখা হয়েছিল।
শলাবতী : বৌদ্ধসাহিত্যে ‘মহাবজ্ঞ’-এর এক জায়গায় শলাবতী নালী এক গণিকার কথা জানা যায়। সে রাজগৃহের প্রধানা গণিকা। যাঁর এক রাতের মূল্য ছিল ৫০০ কার্যপণ। সে একটা সময় গর্ভবতী হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় শলাবতী খরিদ্দারদের কাছে মিথ্যা কথা বললেন। বললেন–তাঁর শরীর খারাপ। কটাদিন তিনি বিশ্রাম চান। অবশেষে শলাবতীর সন্তান ভূমিষ্ঠ হল এবং সেই সন্তানকে আবর্জনার স্তূপে নিক্ষেপ করেন। সেই পতিত সন্তানকে আর-এক গণিকা আম্রপালীর পুর আভয় তাকে কুড়িয়ে নিয়ে লালনপালন করতে থাকে। পরে সেই পতিত সন্তান বড়ো হয়ে জীবক কুমারভৃত্য নাম ধারণ করে বিখ্যাত চিকিৎসক হিসাবে স্বীকৃত পেয়েছিল।
অদ্ধকাশি বা অর্ধকাশি : বৌদ্ধসাহিত্যে আর-এক গণিকা অদ্ধকাশিকেও পাচ্ছি। অদ্ধকাশি এতটাই রূপবতী ছিলেন যে সেই রূপের গর্বে তাঁর কাছে আসা পুরুষদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ দাবি করত। তাঁর গুণমুগ্ধ পুরুষের সংখ্যা প্রচুর থাকলে ক্রমশ সেই সংখ্যা কমতে থাকল অদ্ধকাশির মাত্রাতিরিক্ত দাবি মেটাতে না পেরে। আয়ও ক্রমশ কমতে কমতে অদ্ধকাশি কপর্দকহীন হয়ে পড়ল। অবশেষে শেষ আশ্রয় হিসাবে বুদ্ধের শরণাপন্ন হল।
কাশিসুন্দরী : বৌদ্ধসাহিত্য ব্ৰতীবদানমালা’-য় গণিকা কাশিসুন্দরীকে পাই। কাশিসুন্দরী প্রথম জীবনে মহারাজ অজাতশত্রুর মন্ত্রী প্রচণ্ডকে প্রত্যাখ্যান করে। প্রচণ্ডের পরিবর্তে তিনি সুবর্ণকে পছন্দ করেন। কিন্তু সুবর্ণ গণিকা কাশিসুন্দরীকে পছন্দ করে না। কাশিসুন্দরীও নাছোড়বান্দা। সুবর্ণ একথা জানতে পেরে কাশিসুন্দরীকে এমন মার মারে যে সে অজ্ঞান হয়ে যায়। অজ্ঞান কাশিসুন্দরীকে এক বিষধর সাপের কাছে ফেলে দেয়। সেই সাপের দংশনে কাশিসুন্দরীর মৃত্যু হয়। সুবর্ণর অবশ্য সেই অপরাধে রাজার আদেশে মৃত্যুদণ্ড হয়।
শ্যামা : বৌদ্ধসাহিত্যে ‘কানবের জাতক’ ও ‘মহাবস্তু অবদান’ গ্রন্থে শ্যামা নামে এক গণিকার কথা জানতে পারি। শ্যামা ছিল বারাণসীর শ্রেষ্ঠতম গণিকা। বসন্তসেনা ও বাসবদত্তাদের প্রচুর কাব্য-সাহিত্য-নাটক রচিত হলেও শ্যামা প্রায় উপেক্ষিতাই রয়ে গেছে। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গণিকা শ্যামাকে মনে রেখেছেন তাঁর রচিত নৃত্যনাট্য শ্যামা’ এবং কবিতা পরিশোধ’-এর মধ্য দিয়ে। তক্ষশীলার বজ্রসেন নামে এক ঘোড়া ব্যবসায়ী ঘোড়া বিক্রি করতে আসে বারাণসীতে। কিন্তু কপালমন্দে তাঁকে নগররক্ষীরা চোর সন্দেহে রাজার কাছে ধরে নিয়ে যায়। চুরি করার অভিযোগে রাজা বজ্রসেনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে বজ্রসেনকে বদ্ধভূমিতে নিয়ে যাওয়ার সময় গণিকা শ্যামার নজরে পড়ে যায়। রূপবান বজ্রসেনকে দর্শন করে শ্যামা মুগ্ধ হয়ে যায়। রূপবান বজ্রসেনকে যে শ্যামার চাই! মনে মনে তাঁকে যে প্রেমিক হিসাবে বরণ করে নিয়েছে। বজ্রসেনকে মুক্ত করতেই হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। নগররক্ষীদের প্রচুর ধনসম্পদ ঘুষ দিয়ে বজ্রসেনকে মুক্ত করে নিজগৃহের শয্যায় আহ্বান করে আনে। কিন্তু বজ্ৰসেন শ্যামার প্রেমের প্রতিদান দিতে পারেনি। সে যে প্রকৃতই তস্কর। শ্যামার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে প্রচুর মদ্যপান করিয়ে শ্যামার সমস্ত ধনসম্পদ লুঠ করে পালিয়ে যায়। বেহুস শ্যামাকে বারাণসীর ঘাটে ফেলে রেখে যায়। এত কিছুর পরেও বজ্রসেনের প্রতি শ্যামার প্রেমের ঘোর কাটল না। বজ্রসেনকে সে যেনতেনপ্রকারেণ কাছে পেতে চায়, উপভোগ করতে চায়। অতএব শ্যামার ঘনিষ্ঠ এক ভিক্ষুণীকে তক্ষশীলার পাঠিয়ে দেয় বজ্রসেনকে ফিরিয়ে আনতে।
সুলসা : সুলসাও বারাণসীর প্রসিদ্ধ গণিকা। গণিকা সুলসার কথা বৌদ্ধসাহিত্য ‘সুলতাজাতক’ গ্রন্থে পাওয়া যায়। সে ছিল অত্যন্ত ধনসম্পদশালিনী এবং ক্ষুরধার বুদ্ধিসম্পন্না। গণিকা সুলসা এক দস্যুর প্রেমে পড়ে যায়। কিন্তু সুলসার প্রেম-বিভোরতার সুযোগ নিয়ে সেই দস্যু তাঁকে এক পাহাড়ের উপর নিয়ে যায়। দস্যুটা ভেবেছিল সুলসাকে পাহাড়ের উপর থেকে ঠেলে ফেলে দেবে এবং তাঁর সমস্ত অলংকার হাতিয়ে নেবে। কিন্তু সুলসা টের পেয়ে যায় দস্যুর অভিপ্রায়। বাঁচার শেষ চেষ্টায় সুলতা দস্যুকে জানাল শেষবারের মতো তাঁর প্রেমিককে বুকে নিতে চায়। দস্যুও সুলসার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে রাজি হয়ে যায়। সুলসা আলিঙ্গনের ভান করে হাত বাড়িয়েই দস্যুকে ধাক্কা দিয়ে পাহাড় থেকে ফেলে দেয়।
কালি : ‘তরীয় জাতক’-এ আমরা গণিকা কালিকে পাচ্ছি। এ কাহিনি থেকে আমরা জানতে পারি তৎকালীন সমাজে গণিকাদের অন্য এক অবস্থানের কথা। এ সময়ে গণিকার প্রাপ্য যে অর্থ লাভ সে লাভ করবে তার অর্ধেকটা সে নিজে নেবে, বাকি অর্ধেকটা সে খরচ করবে রসসন্ধানী প্রেমিকদের জন্য গন্ধদ্রব্য, পোশাক, ফুলের মালা ইত্যাদির জন্য। সে পুরুষপ্রবর নিজের পোশাক খুলে গণিকার দেওয়া দ্রব্যাদি ব্যবহার করবে এবং অবশ্যই গৃহ ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় সেইসব পোশাকাদি খুলে রেখে পুনরায় নিজ পোশাকাদি পরে যেতে হবে। গণিকা কালি ধনসম্পদশালী ছিল কি না জানা না-গেলেও তাঁর ভাই তুণ্ডল্ল যে খুবই গরিব ছিল সেটা এক কাহিনি থেকে জানা যায়। তুণ্ডল্লর দারিদ্রতা ঘোচাতে গণিকা কালির দেওয়া মহার্ঘ পোশাকাদি নিয়ম ভেঙে তুণ্ডল্লকে দিয়ে দেয়। এতে গণিকা কালি যারপরনাই অপমানিত বোধ করে। কালি উচিত শিক্ষা দিতে চায় সেই প্রেমিক-পুরুষকে। প্রেমিক-পুরুষটি তুল্লকে পোশাকাদি দান করে এসে যখন নিজের পোশাক কালির কাছে কামনা করে, তখন গণিকা কালি প্রত্যাখ্যান করে এবং তাঁর ভৃত্যদের সাহায্যে সেই প্রেমিক-পুরুষকে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থাতেই ঘরের বাইরে বের করে দেয়।
আম্রপালী, বসন্তসেনা, শ্যামা, বাসবদত্তা প্রমুখ গণিকারা এমনই চারিত্রিক মহিমায় উদ্ভাসিত যে, তাঁরা একালের কবি-সাহিত্যিকের কাছে অনুপ্রেরণার বিষয়। এককথায়, প্রাচীন সাহিত্যের এই গণিকারা সুদীর্ঘকাল অতিক্রম করে একেবারে একালের আঙিনায় এসে ঠাঁই করে নিয়েছে এবং আগামী দিনেও হয়তো লেখকরা অনুপ্রাণিত হবেন নতুন সাহিত্য সৃষ্টিতে।
মোট কথা, প্রাচীন সাহিত্যে গণিকার উপস্থিতি নেই এমন কোনো সাহিত্যই নেই। যেমন ভোজদেব রচিত শৃঙ্গারমঞ্জরী কথা’, মহেন্দ্র সূরী রচিত ‘নিন্নয় সুন্দরী কথা’, সোমেশ্বর রচিত ‘মানোসসাল্লাস’, দামোদর গুপ্ত রচিত ‘কুট্টিনীমত’, কলহন মিশ্র রচিত ‘রাজতরঙ্গিনী’, দণ্ডি রচিত ‘দশকুমারচরিত’, গুণাঢ্য রচিত ‘বৃহকথা, বাসুদেব হিন্ডি রচিত শ্লোকসংগ্রহ’, কুমার ইলাঙ্গো আদিগল রচিত ‘শিলপ্লাদিকর’ প্রভৃতি গ্রন্থে ভিন্নধর্মী বহু গণিকার কীর্তিকলাপ সুগ্রথিত হয়েছে। এ সময় ব্যাবসা-বাণিজ্য, অর্থ-সম্পদ, বিলাস-ব্যসনে মনুষ্যজীবন সমৃদ্ধতর হয়ে উঠেছিল। আর কে না জানে জীবনে সার্বিক উন্নয়ন ঘটে গেলেই বিলাসিতার অঙ্গ হিসাবে গণিকা সঙ্গের প্রয়োজন হয়ে পড়ে! কায়ণ অর্থ-সম্পদ-শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের স্থূল কামনা-বাসনার তো জাগরণও ঘটতে থাকে। সে যুগে তো সর্বস্তরের মানুষের গণিকাপ্রীতি ছিল। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল শিল্প সাহিত্য-সংস্কৃতিতে। কে নেই, বৌদ্ধভিক্ষু থেকে শুরু করে নগররক্ষী, রাজা-মহারাজা থেকে শুরু করে ব্রাহ্মণ পণ্ডিত পর্যন্ত সকলেরই গণিকাপ্রীতি বিস্ময়ের উদ্রেগ করে, বিমূঢ় হয়ে যেতে হয়। সে সময় গণিকালয়গুলি এখনকার এঁদো-পুতিগন্ধময় ছিল না, গণিকালয় বা গণিকাগৃহগুলি ছিল সুরভিত, কুসুমাস্তীর্ণ, সুসজ্জিত এবং নান্দনিক–সবসময়। গণিকারাও সামাজিক মর্যাদার অধিকারিণী এবং ধনসম্পদশালী ছিল।
০৭. দেবদাসীর অন্য নাম গণিকা
দাসপ্রথারই একটা বিশেষ দিক এই দেবদাসী প্রথা। বিজয়ী জাতি বিজিত জাতিদের দাসে পরিণত করত। পুরুষ বন্দিরা দাস, নারীরা হত দাসী। দাসদের নিয়ে কী করা হত, সে বিষয়টি এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। তবে বিজিত বন্দি নারীরা হতেন ভোগের বস্তু। লালসা নিবৃত্তির যন্ত্র মাত্র। দাসত্বের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছেন নারী। অসম্মানিত হয়েছেন চরমভাবে। তাঁদের শরীর তাঁদের অধিকারে ছিল না। সেই অধিকার ছিল ভোগীদের। হাটে বিক্রি হত নারী। সেই হাটে নগ্ন করে দেখা হত নারী-শরীর। পছন্দ হলে ক্রেতারা ভোগের জন্য নিয়ে যেত। নারীদেহ চিরদিনই ভোগের সামগ্রী। বিংশ শতাব্দীর শেষপ্রান্তে এসেও এই পণ্য ব্যাবসায় ভাটা পড়েনি। এখান থেকেই শুরু হল দেবদাসীর চর্চা। এটি একটি ঘৃণিত প্রথা। ধর্মের মোড়কে বেশ্যাবৃত্তির মহান স্বীকৃতি। এরা নিতান্তই ভোগসুখের উপকরণ হিসাবে ব্যবহৃত হল মেয়েরা। রাজা, রাজপুরুষ মায় পুরোহিতদের যৌন-মনোরঞ্জন করাই হল এঁদের অবশ্য কর্তব্য। পুরোহিতদের পৌরোহিত্যেই এই পবিত্র’ প্রথা যুগ যুগ ধরে চলে এসেছে। আর এই যৌন-মনোরঞ্জনের আয়োজন হয় মন্দির বা দেবালয়ে। দেবতার নামে চলে নারীমাংসের উৎসব। শুধু ভারতেই নয়, এই প্রথা সারা বিশ্বজুড়ে চলে নানা মুখোশে, নানা রূপে। তবে ভারতে এই প্রথা ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল।
নারীপণ্যের একটা বিশাল বাজারই হল মন্দির। মন্দিরে হত বলেই দেবদাসী, মন্দির ছাড়া অন্য কোথাও হলে ‘গণিকা’। ভারতীয় নারীসমাজ বহুকাল যাবৎ এই প্রথার কারণে অসম্মানিত এবং অত্যাচারিত। এই প্রথা কেন বিস্তার লাভ করেছে, অতীত ও বর্তমানের অবস্থা বোঝা ও জানা প্রয়োজন।
মিশর পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্য দেশ বলে পরিচিত। এই দেশেই আমরা দেখতে পাই প্রথম দেবদাসী বৃত্তির কথা। আমন, আমনের স্ত্রী মুট এবং তাঁদের পুত্রসন্তান খোন সু–এই তিন দেবতার প্রতিষ্ঠা করেন মিশরের রাজারা। খ্রিস্টজন্মের প্রায় ১৪০০ বছর আগে রাজা তৃতীয় আমেস হোটেপ থিবস নগরীতে মহাসমারোহে মন্দির নির্মাণ করেন। মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে বিপুল পরিমাণে ধনসম্পদ লুঠ করে এই মন্দির নির্মাণ এবং দেবতার ভোগের উপকরণের জন্য ব্যয় করেন। এই মন্দিরে দাসদাসীও প্রচুর মজুত ছিল। এই সময়ের একটি দলিল থেকে জানা যায়, তৃতীয় রামেসিস আমন মন্দিরের জন্য ৮৬,৪৮৬ জন দাসদাসী উৎসর্গ করেছিলেন। ‘Great Harris Papyrus’ নামে এই দলিলটি সম্ভবত মন্দিরে দেবদাসী নিয়োগের প্রামাণ্য দলিল।
রামেসিস বংশের শেষ রাজার মৃত্যুর পর মিশরের শাসনভার যুগ্মভাবে তানিসের ফারাও ও থিবসের প্রধান পুরোহিতের উপর ন্যস্ত হয়। তানিসের রাজকন্যারা থিবসের মন্দিরে আমনদেবের স্ত্রী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকেন। সমাজের উচ্চকোটি নারী থেকে ক্রীতদাসী পর্যন্ত মন্দিরের দেবদাসী হিসাবে অংশগ্রহণ করত। আসিরীয় ও ব্যাবিলনীয় সভ্যতার ইতিহাসে দেবী ইশরাতের সঙ্গিনীরূপে নারীরা মন্দিরে দেবদাসী হিসাবে নিযুক্ত হত। এসময় ব্যাবিলনের দেবতারা হলেন–মারডুক, শামাশ, তাম্বুজ ও ইশতার। প্রাচীন ব্যাবিলনে প্রতিটি বিবাহযোগ্যা নারী দেবী ইশতারের মন্দিরে বসে থাকবেন। প্রথমেই যে পুরুষ অভীষ্ট নারীর কোলে একটি রৌপ্যমুদ্রা ফেলবেন, সেই পুরুষের সঙ্গেই নারীটি যৌনমিলনে প্রবৃত্ত হবেন। বিবাহ-পূর্ব বেশ্যাবৃত্তি এভাবেই শুরু হয়ে যেত। মন্দির-দাসীদের এই হল বেশ্যাবৃত্তির ইতিহাসের বাধ্যতামূলক সোপান।
আফ্রিকার উত্তর উপকূলে ফিনিশীয় মন্দিরগুলিতেও নর্তকী ও দেবদাসীর কথা জানা যায়। প্রাচীন গ্রিসের মন্দিরগুলোতেও দেবদাসী নিযুক্ত হত। Hierodule নামে এই দেবদাসীরা সূর্যদেবতা অ্যাপোলোর মন্দিরে সর্বত্রই দেবদাসী থাকত। শুধু অ্যাপোলোর মন্দিরেই নয়, গ্রিসের অন্যান্য মন্দিরেও দেবদাসী মজুত থাকত যথেষ্ট সংখ্যায়। এদের কাজ ছিল নৃত্যগীত প্রদর্শন এবং বাধ্যতামূলক গণিকাবৃত্তি। কেবলমাত্র পুরোহিত, রাজা ও ক্ষমতাশালীদের কাছেই এরা ভোগ্যা ছিল। আর্টেমিসের মদিরা দেব বাছুজের মন্দিরে দাসীরা বাধ্য হত এক বিচিত্র জীবনযাপনে। এই দাসীদের কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হত। যেমন–Maenad, Amazon ইত্যাদি। Maenad নারীদের শিশু বয়স থেকেই দেবদাসীর উপযুক্ত করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। Amazon নারীরা যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিনী। তাঁরা এতটাই উৎসর্গীকৃত ছিল যে, ডান কাঁধে তূণ রাখতে যাতে বাধা সৃষ্টি না-হয়, সেজন্য ডানদিকের স্তনটি কেটে ফেলতেন। বস্তুত একস্তনী হয়ে যেতেন বলেই এঁদের নাম A-mazon। এঁদের যে সন্তানসন্ততি হত, তাঁর মধ্যে কন্যাসন্তানটিকেই বাঁচিয়ে রাখা হত এবং পুরুষসন্তানদের হত্যা করা হত, নতুবা দেশ থেকে বিতাড়িত করা হত। কন্যাসন্তানদের বাঁচিয়ে রাখা হত মানে এই নয় যে, সন্তান খুব আদরনীয় ছিল। আদরনীয় ছিল, তবে তা ছিল ভোগ্যবস্তু বানানোর জন্য।
রোমান সভ্যতাতেও দেবদাসী প্রথার সন্ধান পাওয়া যায়। দাসনির্ভরশীল এই রোমান সভ্যতার জিউস, জুনো ও ভেনাসের মন্দির সহ অন্যান্য মন্দিরগুলিতে প্রচুর দেবদাসীও নিযুক্ত থাকত। পুরোহিতদের মনোরঞ্জন করাই ছিল মূল কাজ। তবে রাজা ও রাজপুরুষদেরও ভোগ্য ছিল। মনে করা হত, দেবতার ভোগ আর রাজাদের ভোগ সমপর্যায়ের। দেবদাসীদের পাশাপাশি রাজনটী ও নগরনটীদেরও আবির্ভাব হয়েছিল এ সময়। এদের Hataera বলা হত। তবে এঁদের সম্মান-মর্যাদা ছিল বেশ। এঁদের মতামতেরও মূল্য দিতেন জ্ঞানীগুণীরা।
Hataera-দের মতো জাপানের Geisha-দেরও যথেষ্ঠ মর্যাদা ছিল। সুন্দরী শিক্ষিতা এই নারীরা শুরুতে আলাপাচারণে শ্রোতাদের মোহাবিষ্ট করার কাজে নিয়োজিত হলেও পরে অবশ্য সরাসরি গণিকাবৃত্তিতে প্রবিষ্ট হতেন। তবে প্রাচীন জাপানে দেবদাসী ছিল কি না সে বিষয়ে কিছু জানা যায় না। ইনকা সভ্যতাতেও আমরা দেবদাসী প্রথার সন্ধান পাই। ইনকা সম্রাটদের সূর্যের সন্তান বলা হত। ইনকার সূর্যের মন্দিরের তত্ত্বাবধানের জন্য পুরোহিত ছিল। এই মন্দিরে নারীরা সূর্যকুমারী হিসাবে মন্দিরবাসিনী হত। মন্দিরবাসিনী এই নারীদের কাজ ছিল পুরোহিত ও রাজবংশীয়দের মনোরঞ্জন করা। দেবদাসী প্রথা ছিল আটজেক সভ্যতার ইতিহাসেও।
ভারতে দেবদাসী প্রথা নামে গণিকাবৃত্তি একেবারে জাঁকিয়ে প্রাচীন যুগে এবং মধ্যযুগে, যা বর্তমান যুগেও ফল্গুনদীর মতো বহমান। ভারতের দেবদাসী প্রথার সূচনার ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর এক গুহালিপি পাই। যে গুহালিপিতে সুতনুকা নামে এক দেবদাসীর কথা জানতে পারি। উল্লিখিত উত্তীর্ণ লিপিতে বলা হয়েছে–“সুতনুকা নাম দেবদাসিক্য তং কাময়িখ বালানশেয়ে দেবদিন্নে নাম লুপদকখে”। অর্থাৎ, সুতনুকা নামে দেবদাসী, তাঁকে কামনা করেছিল বারাণসীবাসী দেবদিন্ন (দেবদত্ত) নামে রূপদক্ষ। যোগীমায়া গুহা, সীতাবেন্দা ইত্যাদি নামে যে গুহার সন্ধান পাওয়া গেছে, লিপির সাহায্যে দ্বিধাহীনভাবে প্রমাণিত হয়েছে, এই গুহামঞ্চবাসীরা মূলত দেবদাসী শ্রেণির ছিল। পুরাণাদিতে আমরা যে স্বৰ্গবেশ্যা তথা অপ্সরাদের কথা জানতে পাই, তাঁরা ছিল আসলে হাই-প্রোফাইলের দেবদাসী।
ভরতের নাট্যশাস্ত্রে আমরা অপ্সরাদের পাচ্ছি নৃত্যগীতশিল্পী ও অভিনেত্রী হিসাবে, যাঁরা তথাকথিত দেবতাদের মনোরঞ্জনে ব্রতী হতেন। অপ্সরারা কোনো অলৌকিক বা কাল্পনিক অস্তিত্ব নয়, তাঁরা প্রকৃতপক্ষে রক্তমাংসের মানবী মাত্র। নাট্যশাস্ত্রের শুরুতেই এইসব নাট্যকুমারীদের কথা এবং অপ্সরাদের কথা বলা হয়েছে। এই নাট্যকুমারীরা একটি বিশেষ গোষ্ঠীভুক্ত ছিল, একথাও উল্লেখ আছে। এঁদের যে-কোনোভাবে সংগ্রহ করে অতি সহকারে নৃত্যগীতবাদ্য শিক্ষা দিয়ে রঙ্গমঞ্চে হাজির করা হত, তার বিশদ বর্ণনা আছে ভরতের নাট্যশাস্ত্রে। প্রসিদ্ধ তামিল নাটক ‘শিল্পপ্পাদিকর’-এর কয়েকটি অধ্যায়ে দক্ষিণ ভারতীয় প্রাচীন সংগীত ও নৃত্যের উল্লেখ আছে। এই নৃত্য অবশ্যই দেবদাসী নৃত্য। ধনবানদের বিলাসকলার অন্যতম প্রধান উপকরণ ছিল নারী। আর নারীরা ছিলেন সুশিক্ষিতা, সুবেশা এবং অবশ্যই কামশাস্ত্রনিপুণা।
বঙ্গদেশে দেবদাসী প্রথার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় অষ্টম শতকে কলহনের ‘রাজতরঙ্গিনী’ গ্রন্থে, নর্তকী কমলার প্রসঙ্গে। বঙ্গদেশে পালযুগেও দেবদাসী প্রথার অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়। গুপ্তযুগেও এইসব নর্তকীদের সম্বন্ধে বহু বর্ণনা পাওয়া যায়। বিজয়সেনের দেওপাড়া প্রশস্তিও এই প্রথার ব্যাপকতার ইঙ্গিত মেলে। দেওপাড়া প্রশস্তির কবি উমাপতি ধর লিখেছেন–বিষ্ণুমন্দিরে উৎসর্গীকৃত দেবদাসীরা যেন রূপ ও সৌন্দর্যের দ্বারা কামদেবতাকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন। ভট্ট ভবদেবের ভুবনেশ্বর প্রশস্তিও একই কথা বলেছে। দ্বাদশ শতাব্দীর সূচনায় কর্ণরাজের রত্নগিরি তাম্রশাসন থেকে জানা যায়, তাঁর রানি কর্পূরশ্রী সলোনপুরের বৌদ্ধমন্দিরের দেবদাসী ছিলেন। কর্পূরশ্রীর মা মাহুনদেবীও দেবদাসী ছিলেন। কর্ণাটকে দ্বাদশ শতাব্দীর সূচনায় চালুক্যরাজ বিক্রমাদিত্য ইত্তাগিতে চণ্ডালেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠা করে বিভিন্ন দেশ থেকে সুন্দরী নারীদের এনে সেখানে দেবদাসীরূপে নিয়োগ করেন। পহুবী লিপিগুলিতে দেবদাসীদের কথা উল্লেখ আছে। দেবদাসীদের নিয়ে আলাদা বর্ণনা পাওয়া যায় ‘মেঘদূত’ সহ বিভিন্ন কাব্যে।
সম্প্রতি “কর্ণাটক রাজ্যের দেবনগর জেলার উত্তরঙ্গমালা দুর্গা মন্দিরে রাতের বেলায় নারীদের দেবতার নামে উৎসর্গ করার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে”–এই মর্মে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের আবেদনের ভিত্তিতে সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন এক বেঞ্চ রাজ্যের মুখ্যসচিবকে ওই অনুষ্ঠান বন্ধ করার নির্দেশ দেন। এই কুপ্রথা কার্যত নারীদের যৌনশোষণ, যা ভারতে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ১৯৮৮ সালে। আশা ছিল এর ফলে দেবদাসীদের সামাজিক যৌনশোষণ বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু তা হয়নি। এখনও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে, মহারাষ্ট্রে, ওড়িশায় এবং দেবতাকে উৎসর্গ করার নামে দেবদাসীদের প্রধানত দেহভোগের কাজেই ব্যবহার করা হয়। দেবতা বা মন্দিরে উৎসর্গ করার পর তাঁদের পরিচয় হয় দেবদাসী। কোনো কোনো অঞ্চলে তাঁদের বলা হয় যোগিনী।
প্রায় হাজার বছরের প্রাচীন এই প্রথা ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এর পিছনের বড়ো কারণগুলি হল চরম দারিদ্রতা, বর্ণবৈষম্য ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। গরিব ঘরের মা-বাবা তাঁদের কুমারী মেয়েদের রজস্বলা হওয়ার আগেই নিয়ে আসত মন্দিরে। প্রথমে কুমারী মেয়েদের নিলাম করা হয়। তারপর মন্দিরের প্রধান পুরোহিত উৎসর্গ করার নামে বিগ্রহের সঙ্গে কুমারী তথাকথিত ‘বিয়ে’ দিয়ে দেন। এর ফলে সেই মেয়ের কোনো পুরুষই স্বামী হতে পারে না। নিরাকার দেবতাই তাঁর একমাত্র স্বামী। খাওয়া-পরার বিনিময়ে মন্দিরের বাসিন্দা হয়ে তাঁদের সারাজীবন কাটিয়ে দিতে হয়। কায়িক পরিশ্রমের সঙ্গে সঙ্গে মন্দিরের প্রধান পুরোহিত থেকে মন্দিরের অন্যান্য পুরুষদের সঙ্গে যৌনক্রিয়া করতে হত। এছাড়াও সমাজের উচ্চবর্গীয় ধনী কিংবা সামন্তপ্রভুদের রক্ষিতার ভূমিকা পালন করতে হয়। মন্দিরের পূজারী ব্রাহ্মণ এবং সামন্তপ্রভুদের যোগসাজসে কৃষক ও কারুশিল্পী বা কারিগরদের উপর ধর্মীয় প্রভাব খাঁটিয়ে দেবদাসীদের গণিকাবৃত্তিকে দেওয়া হয় ধর্মীয় সিলমোহর। উৎসর্গের পর দেবদাসীকে ভোগ করার প্রথম অধিকার মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের। আজব ব্যাপার, অন্য কোনো পুরুষকে নিজের স্বামী রূপে গ্রহণ করা যাবে না, কিন্তু যৌনমিলনে কোনো বাধা নেই! এই ধর্মীয় প্রথার উৎপত্তির ইতিহাস নিয়ে নানা কাহিনি, বিতর্ক এবং বিভিন্ন জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। দেবদাসীদের তথ্য ঐতিহাসিক বা পুরাতাত্ত্বিক বিভিন্ন মন্দিরের গাত্রে আজও উৎকীর্ণ আছে।
দক্ষিণের তিরুপতি মন্দিরে দেবদাসী সংগ্রহের প্রাচীন পদ্ধতি সম্পর্কে খ্রিস্টান মিশনারি অ্যাবে জে এ র্দুবা এক সমীক্ষায় লিখেছেন–“বছরের একটি বিশেষ দিনে এই মন্দিরের পুরোহিতেরা ভগবান বেঙ্কটেশ্বরের প্রতিমূর্তি নিয়ে শোভাযাত্রা বের করতেন এবং পথে যত সুন্দরী মেয়ে চোখে পড়ত তাঁদেরকে দেবদাসী করার দাবি জানাত। শুধু কুমারী মেয়েই নয়, সুন্দরী বিবাহিত মেয়েদেরও দাবি করত তাঁরা। এ থেকেই বোঝা যায়, দেবদাসী করার জন্য মেয়েদেরকে জোর করেই তুলে আনা হত।” দুবার এহেন মন্তব্য। গবেষক পণ্ডিত জি জি ফ্রজার পশ্চিম আফ্রিকায় দেবদাসী সংগ্রহের যে অভিনব উপায়ের উল্লেখ করেছেন, তা থেকে জানা যায়–মেয়েদের জোর করে তুলে এনে দেবদাসী থেকে গণিকা বানানো হত। ফ্রিজার লিখেছেন–“পুরোহিতরা একটা বিশেষ দিনে নগরের পথে পথে ঘুরে বেড়াত এবং সেদিন দুয়ারের বাইরে যত কুমারী মেয়ে পেত তাঁদের সবাইকে ধরে নিয় যেত মন্দিরে দেবদাসী করার জন্যে।”
রাজ্য জয় করে রাজারা যেমন গোরু-ছাগলের মেয়েদের মতো তুলে আনত, তেমনই সেইসব মেয়েদের ধরে ধরে দেবদাসী তথা গণিকায় পরিণত করত। আদতে এভাবেই দেবতাদের বউ বানানোর অছিলায় মেয়েদেরকে গণিকা বানিয়ে গণভোগ্যা বানিয়ে নিত সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। ১৮৬৭-৬৮ সালে জন শর্ট লন্ডনের অ্যানথ্রোপলজিক্যাল সোসাইটিতে ভারতের দেবদাসীদের প্রসঙ্গে একটি বিস্ফোরক রিপোর্ট পেশ করেন। রিপোর্টে বলা হয়েছে–মন্দিরে দেবদাসীদের কুমারীত্ব’ বহিরাগত ধনীদের কাছে চড়া দামে বিক্রি করা হত। তারপর তাঁরা গণিকাবৃত্তিতে নিয়োজিত হত।
এ প্রসঙ্গে বলা যায়, সব মেয়েকে যে জোর করে দেবদাসী বানিয়ে নেওয়া হত, তা কিন্তু নয়। দেবদাসী মাহাত্ম এমন পর্যায়ে প্রচার করা হয়েছিল যে, অনেকেই স্বেচ্ছায় দেবতার কাছে নিজেদের উৎসর্গ করে দিত। পুণ্যলাভের আশাতেও মা-বাবারা দেবতার সঙ্গে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিত। তবে এঁদেরকে মন্দিরে আত্মসমর্পণ করতে হত না, গণভোগ্যাও হতে হত না। অবশ্যই দেবতা বিয়ে করে দেবতার কাছে আত্মসমর্পণ করে সারাজীবন কাটিয়ে দিত। এমনই এক বিখ্যাত দেবদাসী মীরা তথা মীরাবাঈ। রাজস্থানের এক অভিজাতবংশীয় হিন্দু পরিবারের সন্তান। বাল্যকালে এক পরিব্রাজক সন্ন্যাসীর দ্বারা আরাধিত একটি কৃষ্ণমূর্তির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন এবং কৃষ্ণকে স্বামী হিসাবে গ্রহণ করেন। তাঁর মা তাঁর এই ভক্তিভাবের সমর্থক ছিলেন। শৈশবেই চিতোররাজ রানা সংগার জ্যেষ্ঠ পুত্র ভোজরাজের সঙ্গে মীরার বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন তিনি শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। স্বামী ভোজরাজকে বলেন, তিনি মীরার শরীর পাবেন, কিন্তু মন পাবেন না। কারণ মীরা তাঁর মনপ্রাণ সব কৃষ্ণের পায়ে নিবেদন করেছে।
ভবিষ্যপুরাণে আছে–“বেশ্যাকম্বকং যস্তু দদ্যাৎ সূর্যায় ভক্তিতঃ সগচ্ছেৎ পরমং স্থানং যত্র তিষ্ঠতি ভানুমান”। মহাকবি কালিদাস তাঁর মেঘদূতে উজ্জয়িনী মহাকাল মন্দিরে চামরহস্তা দেবদাসীদের ‘বেশ্যা’ বলে পরিচিত করিয়েছেন। দেবদাসী সৃষ্টির পিছনে ছিল মানুষের অশিক্ষা, কুশিক্ষা, ভুল ধারণা ও ধর্মান্ধতা। সাধারণ মানুষ মনে করত আত্মজাকে দেবদাসী করে দিতে পারলে শুধু দাতার নয় কন্যারও স্বর্গলাভের একটা পাকা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। যে ভাবনা থেকে নবমবর্ষীয় কন্যাকে কুলীন বৃদ্ধের কাছে গৌরীদান করত ভারতীয় হিন্দু পিতামাতারা। যেমনভাবে বোঝানো হত মৃত স্বামীর সঙ্গে চিতায় উঠে সহমরণে গেলে সরাসরি স্বর্গের জমি নিশ্চিত। সতী হিসাবেও পুজো পাবে সেই অভাগা নারী। আসলে এমনই বোঝানো হত। বোঝাত হিন্দু সমাজের পুরোহিতকুল।
কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে দেবদাসীদের আলোচনা করেছেন। তবে তিনি দেবদাসী শ্রেণির আইনকানুন লিপিবদ্ধ করেননি। তিনি এটা অবশ্যই বলেছেন যে, এসব ব্যাপারে আইনকানুনের দায়িত্ব পুরোহিত তথা পুরোহিততন্ত্রের। অর্থাৎ মধ্যযুগ থেকেই দেবদাসীদের উপর ওই পুরোহিতকুলের অধিকার ইতিহাস স্বীকৃত। যাঁরা দূরদর্শনে ‘অগ্নিজল’ ধারাবাহিকটি চাক্ষুষ করেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই এতদিনে জেনে গেছেন দেবদাসী নিয়ন্ত্রণে পুরোহিতদের কী দাপট! পুরোহিতদের আধিপত্য এতটাই যে দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাজাও ভয়ে সিঁটিয়ে থাকত। রাজাদের তরফ থেকে দেবদাসীদের বিষয়ে কোনো ভালো-মন্দ পরামর্শই পুরোহিতরা গ্রহণ করত না। পুরোহিতরা নিজেরা যেসব আইনকানুন বা বিধিনিষেধ আরোপ করত, তা অতি যত্নে গোপন রাখা হত। পুরোহিততন্ত্র নিজেদের স্বার্থেই দেবদাসীদের লোকচক্ষুর আড়ালে রাখত চাইত। যা কিছু আড়ালে-আবডালে তাতেই মানুষের মোহবৃদ্ধি। এটাই মনস্তাত্ত্বিক বিষয়।
দেবদাসীদের মোটামুটি ছয় ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন–(১) বিক্রিতা, (২) ভৃত্যা, (৩) ভক্তা, (৪) দত্তা, (৫) হৃতা এবং (৬) অলংকারা। এই বিভাজন কেন? এই ভাগ-বিভাগ কেন? আসুন একটু বিস্তারিত জেনে নিই।
(১) বিক্রেতা : এই মেয়েদের অর্থের বিনিময়ে কিনে নেওয়া হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এরা অত্যন্ত গরিব পরিবারের সুন্দরী মেয়ে। অধিক মেয়েদের পিতামাতারা অর্থের বিনিময়ে এরকম দু-একটি মেয়েকে তুলে দিত পুরোহিতদের মালিকানায়। দেবদাসীর গর্ভজাতা মেয়েও এই দলেই অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। এইসব মেয়েরা যৌবনপ্রাপ্তা হলে মন্দিরের পুরোহিত নিজে অথবা তাঁর প্রিয়পাত্রকে দিয়ে সেই মেয়ের কৌমার্য নষ্ট করে দেবদাসী হিসাবে নিয়োগ করতেন।
(২) ভৃত্যা : বিশেষণ পড়েই বুঝতে পারছেন এরা আসলে ভৃত্য বা চাকরানি শ্রেণির। তাই স্বাভাবিকভাবেই এরা পদমর্যাদায় ‘বিক্রেতা’ দেবদাসীর নিচে। যৌবনবতীদের কর্তব্য ছিল মন্দিরের অতিথিবর্গকে দেহদানের মাধ্যমে শরীরী-পরিসেবা দেওয়া।
(৩) ভক্তা : স্বেচ্ছায় কোনো মহিলা (কুমারী, সধবা, স্বামী পরিত্যক্তা যে কেউ) মন্দির কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করে যখন দেবদাসী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে, তাহলে সে ভক্তা। ভক্তিই এদের আধার। এরা অতি উচ্চ সম্মানের পদাধিকারী। তবে এদেরকে যৌনকর্মে লিপ্ত হতে হত না।
(৪) দত্তা : কোনো ধর্মান্ধ পুণ্যলোভী পিতা মনোবাসনা চরিতার্থ করার জন্য, মানত রাখার জন্য, স্বেচ্ছায় নিজের মেয়েকে মন্দিরে দান করলে সেই মেয়ে দত্তা হয়।
(৫) হৃতা : এই মেয়েদের মূলত চুরি করে আনা হত। নিরুদ্দিষ্টার সন্ধান পেত না সেই অঞ্চলের নগরকোটালও। সেই মেয়ে বহুদূর দেশে মন্দিরের অন্ধকূপে বন্দিনী হিসাবে থাকত।
(৬) অলংকারা : যে-কোনো শ্রেণির দেবদাসীই রূপ-গুণ নৃত্যগীত পারদর্শিতার বিচারে অলংকারা পদে উন্নীতা হতে পারে। ঐহিক বিচারে এই মেয়েরা শীর্ষস্থানীয় হলেও শ্রদ্ধা ও সম্মানের দিক থেকে ভক্তা শ্রেণির নিচে।
দেবদাসী প্রথা নির্মূল হয়ে গেছে বলে যাঁরা নিশ্চিন্তের ঢেঁকুর তোলেন। তাঁদের বলি, তুলবেন না সেঁকুর। খবর আছে। কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রের কিছু মন্দিরে এখনও বিগ্রহের কাছে মেয়েদের বিসর্জন দেওয়া হয়। আজকের দেবদাসীরা আর দেবতার দাস নয় অনেকক্ষেত্রেই। মূলত তাঁরা লোলুপ পুরুষের লালসার শিকার। আর এই লালসা তৃপ্ত করতে এগিয়ে এসেছে যেসব মন্দিরের রক্ষক, সেগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ কর্ণাটকের ইয়েলাম্মা মন্দির। যেহেতু মন্দিরকন্যাদের বিয়ে হয় না, তাই তাঁদের বিনা বাধায় সম্ভোগ করে সমাজের বিভিন্ন স্তরের পুরুষরা। যে পূজারী দেবদাসী অর্পণের কাজে লিপ্ত, তিনি মোটা অঙ্কের অর্থপ্রাপ্ত হন। যাঁরা এই প্রথাকে তাঁদের জাতিগত ঐতিহ্যের অংশ মনে করেন, তাঁরা বড়োই তৃপ্ত হন! তা ছাড়া ইয়েলাম্মা মন্দিরের মেয়েরা প্রকৃত অর্থে দেবদাসী নন। এঁরা না বোঝেন চৌষট্টি কলা, না কোনো ধনীব্যক্তির রক্ষিতা। একপ্রকার খোলাখুলিভাবেই দেহবিক্রিই তাঁদের কাজ।
মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকের প্রান্তিক জেলাগুলি থেকে প্রতি বছর প্রায় ৫০০০ হরিজন শ্রেণির মেয়েদেরকে ইয়ালাম্মার কাছে অর্পণ করা হয়। এই প্রথার পিছনে শুধু বহু যুগের বিশ্বাস এবং অজ্ঞতা আছে তা নয়–আছে আর্থিক কারণ, আছে পুরোহিতদের প্ররোচনা। প্রাচীন প্রথার এই দুঃসহ আধুনিকীকরণ সবচেয়ে বেশি প্রচলিত কর্ণাটকের বেলগাঁও, ধারওয়ার, বিজাপুর, গলবর্গা ও বেলারি জেলায়। অন্যদিকে মহারাষ্ট্রের সিতারা, কোলাপুর, শোলাপুর ও ওসমানাবাদ অঞ্চলে এবং তেলেঙ্গানাতে যথাক্রমে ১০,০০০ এবং ২৫,০০০ দেবদাসী আছে। বংশপরম্পরায় এই মেয়েরা পুরুষদের ভোগ্যা।
সর্বোপরি যেটা না বললে অন্যায় হবে, তা হল–দেবদাসীরা ভারত-সংস্কৃতিকে দিয়েছে অনেক সম্পদ। কথাকলি, ভারতনাট্যম, মোহিনী-আউম, কুচিপুড়ি–এ সবই দেবদাসী সংস্কৃতি। যুগে যুগে এঁর দেবদিন্নদের উদ্বুদ্ধ করেছে মন্দিগাত্র অলংকরণে–কোনারক, খাজুরাহো, বেলুড়, হালেবিড থেকে বাঁকুড়ার মন্দিরেই রয়ে গেছে শ্বাশত প্রমাণ। তাঁদের দান অক্ষয়, অমর।
দেবদাসী প্রথার বিরুদ্ধে বহুদিন ধরে সংগ্রাম চলছে। তা সত্ত্বেও জাতীয় বা আন্তর্জাতিক ভাবনায় বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। ১৯২৯ সালে ডাঃ মুথুলক্ষ্মী রেডিড নামে এক মনস্বিনী মহিলার নেতৃত্বে দেবদাসী প্রথা উচ্ছেদের যে সংগ্রাম শুরু হয়, তার ফলে দেবদাসী প্রথা বিলোপের জন্য মাদ্রাজ বিধানসভায় আইন প্রণয়ন করে এই প্রথা নিষিদ্ধ করা হয়। বোম্বাই বিধানসভায় ডাঃ হরি সিং গৌরও অনুরূপ চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৪৭ সালে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে দেবদাসী প্রথা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আক্ষেপ এই যে, ভারতে দেবদাসী প্রথা আজও বিলুপ্ত হল না। এখনও যেসব অঞ্চলে দেবদাসী বহাল তবিয়তে চলছে, সেগুলি হল–কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, গোয়া ও কেরলের একটা বড়ো অংশ। তাই দেবদাসী প্রথা বিলুপ্তির জন্য আন্দোলন থেমে যায়নি। ফলে আবার নতুন করে শুরু হয়েছে দেবদাসী-বিরোধী আন্দোলন। নেতৃত্ব দিচ্ছেন ‘দেবদাসী মুক্তি বাহিনী। নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও, আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কীভাবে দেবদাসী রমরম করে চলছে, সে ব্যাপারে স্থানীয়ভাবে কয়েকটি সমীক্ষা করা হয়েছে। সেই সমীক্ষায় উঠে এসেছে চমকপ্রদ তথ্য। জানা গেছে, এই দেবদাসী প্রথার মাধ্যমে মুম্বাই, বেঙ্গালুরু, দিল্লি, চেন্নাই পতিতালয়গুলি সমৃদ্ধ করা হচ্ছে। কারা এই প্রথাকে জিইয়ে রাখতে চাইছে কীভাবে রাখতে পারছে, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা প্রয়োজন।
০৮. প্রাক-আধুনিক ও আধুনিক সাহিত্যে গণিকা
প্রাক-আধুনিক যুগের সাহিত্যে এসে গণিকাদের প্রকটভাবে আর পাওয়া যায় না। প্রাক-আধুনিক যুগকে যদি চর্যাপদ ধরি, সেখানে গণিকাদের উপস্থিতি নেই। কেন নেই? হঠাৎ করে সমাজ বদলে যাওয়ার তো কোনো কারণ নেই। সে সময়কার মানুষের জীবনযাত্রা উল্লেখ করার মতো সংযত ছিল, এমন আভাস কোথায়! প্রকট না-হলেও প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত কিন্তু মেলে। কিন্তু ব্রাহ্মণ প্রভৃতি উচ্চবর্ণের নাগরিকেরা যে মাঝেমধ্যে গোপনে রমণীদের সঙ্গে সম্পর্ক করতেন, তার স্পষ্ট ইঙ্গিত মেলে এই পদগুলিতে–“টালত ঘর মোর নাহি পড়বেষী”, উঞ্চা উঞ্চা পাবত তহি বসহি সবরী বালী”, “নগর বাহিরি রে ডোম্বি তোহের কুড়িআ”। এইসব গণিকা-রমণীরা ছিল আর্থিক ও সামাজিকভাবে বিপর্যস্ত, অস্পৃশ্য ও অবহেলিত। ব্যভিচারিতা বলা যায় না, বরং বলা যায় এটা ছিল হতদরিদ্র নারীদের এটাই ছিল জীবিকার্জনের অন্যতম পথ। বলা যায় এসময় থেকেই গণিকাদের মর্যাদার পতন শুরু। ঘৃণ্য হতে শুরু করল।
ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলের দ্বিতীয় খণ্ড বিদ্যাসুন্দরে জনৈকা হীরামালিনী, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বড়ায়িরা দূতী হিসাবে পরিচিত হলেও সংস্কৃত সাহিত্যে এঁরা গণিকা রূপেই অঙ্কিত। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে গণিকাদের উপস্থিতি যেভাবে প্রকটিত হয়েছিল, মধ্যযুগ তথা প্রাক-আধুনিক যুগে এসে অনেকটাই প্রচ্ছন্ন হয়ে যায়। এহেন পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব হল? আসলে সেসময়টা ছিল নানবিধ উত্থান-পতনে জর্জরিত। গোটা মধ্যযুগ জুড়ে ছিল অস্থিরতা। শক, হুন, পাঠান, মোঘল, এমনকি বর্গি আর ঠগিদের দৌরাত্ম্যে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। চারিদিক যুদ্ধ, হানাহানি, হিংসা, আক্রমণ, প্রতি-আক্রমণের মানুষের মানবিক মূল্যবোধ প্রায় তলানিতে। এহেন অস্থির পরিমণ্ডলে কবি-লেখকদের লেখনী প্রায় স্তব্ধ হয়ে যায়। সম্ভব হয়ে উঠছিল না মননশীল সাহিত্য রচনা। সেইসঙ্গে ব্রাত্য ও অপাঙক্তেয় হল গণিকা। সম্ভবত এই কারণেই প্রাক-আধুনিক বাংলা সাহিত্যে তেমন একটা গণিকাঁচরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায় না। সমগ্র মধ্যযুগের ভরকেন্দ্র ছিল ধর্ম, বিশেষ করে বঙ্গদেশে। সেসময় যতটা-না সামাজিক সাহিত্য রচিত হয়েছে, তার চেয়ে কয়েকশো গুণ বেশি ধর্মাশ্রিত সাহিত্য রচিত হয়েছে। ফলে সে সময়ের অন্য সাহিত্যে গণিকাদের নিয়ে ভাবার অবকাশ লেখকেরা পাননি। তার মানে এই নয় যে, সেসময়ের সমাজে গণিকারা ছিল না। অবশ্যই ছিল, তবে ধর্মীয় অনুশাসনের বেড়াজালে নারীর জীবন প্রান্তিকায়িত হয়ে গেল।প্রাক্-আধুনিক যুগ ও তারও পরে গণিকাজীবন অবহেলিত থেকে গেল বাংলা সাহিত্যে।
প্রাক্-আধুনিক যুগ পেরিয়ে আধুনিক যুগে এসে সমাজ ও রাষ্ট্র (সেসময় রাষ্ট্র বলতে সমগ্র ভারত বোঝাত না) খানিকটা থিতু হয়ে এলে বাংলা সাহিত্যে পুনরায় জাঁকিয়ে প্রবেশ ঘটল গণিকাদের। প্রবেশ ঘটল বটে, তাঁদের হৃত সম্মান ফিরে এলো না। এ সময়ে গণিকারা ক্রমশ ঘৃণ্য ও প্রান্তিক হয়ে গেল। কী সমাজে, কী সাহিত্যে। তৎকালীন সমাজের গণিকাদের প্রতিচ্ছবিই সাহিত্যেও প্রতিফলন ঘটেছে। অথচ প্রাচীনকালে ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজ জুড়ে ছিল গণিকাদের মাথা উঁচু করে চলার অবাধ ও স্বাধীন বিচরণক্ষেত্র। এখনকার মতো গোপনীয় ও বিপন্নতা ছিল না গণিকাজীবন ও বৃত্তি। সম্মান ও মর্যাদা ছিল সমাজের অন্য পেশার মানুষদের মতো। বরং বলা যায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে অন্য পেশার মানুষদের চেয়েও বেশি সম্মান ছিল। গণিকাদের সমাজ ও জীবন ছিল বিশেষ মনোরম ও উপভোগ্য। এখনকার মতো মোটেই ক্লেদাক্ত জীবন ছিল। তবে প্রাচীন যুগে কখনো-সখনো নিয়মনিষ্ঠ শাস্ত্রকারেরা গণিকাদের সম্পর্কে কঠোর বাক্যবাণ প্রয়োগ করলেও বেদ, মহাকাব্য, পুরাণ সর্বত্রই গণিকাদের গৌরবোজ্জ্বল, রাজকীয়, দৃষ্টিনন্দন পদচারণা অনুভব করা
আধুনিক যুগে এসে গণিকার কথা জানতে পাচ্ছি এক গণিকা কলমে। মানদাদেবীর কলমে। লেখিকা মানদাদেবী নিজে একজন গণিকা। মানদাদেবীর গ্রন্থের প্রথম পর্বে বর্ণিত হল তাঁর জীবনের কৈশোর পেরিয়ে কীভাবে তিনি গণিকা হলেন। এরপর পাই একজন শিক্ষিতা গণিকায় মুখে তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা।এমন একটি নির্ভেজাল নির্মোহ গণিকার আত্মচরিত আগে কখনো পাওয়া যায়নি। সেই অর্থে বলা যায় এই দুর্লভ আত্মচরিত সেইসময়কার গণিকাদের জীবন সম্পর্কে আমাদের অনেকগুলো জানালা খুলে দিয়েছে।
আধুনিক যুগের লেখকদের লেখায় ফুটে উঠল গণিকাদের জীবনযাপন, তবে গণিকাদের প্রতি সমাজের ঘৃণ্য ও অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। অনেকক্ষেত্রেই সমাজ কলুষিত করছে এমন অভিযোগ গণিকাদের কাঠগোড়ায় দাঁড় করিয়েছে। গণিকারাও মানুষ, তাঁদেরও যে আর পাঁচটা মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন করার অধিকার আছে, স্বপ্ন আছে, সে বিষয়টি লেখকদের লেখায় প্রাধান্যই পায়নি। গণিকারা সমাজে অগ্রহণীয় হয়ে উঠল। গণিকাদের স্বাদ নেওয়া যায়, কিন্তু সমাজে গ্রহণ করা যায় না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা সংকলনে গণিকার চরিত্রায়ণ খুব একটা সুলভ নয়। যেটুকে এসেছে তাও সংস্কৃত ও পালি সাহিত্য চয়ন করা। তাঁর কাব্য ও নাট্যে শ্যামা, বাসবদত্তা নান্মী গণিকা চরিত্রগুলিরই পুনর্নির্মাণ লক্ষ করা যায়। তাঁর সমসাময়িক কোনো গণিকার কথা তাঁর সাহিত্যে উঠে আসেনি। রবীন্দ্র কথাসাহিত্যে গণিকাঁচরিত্রের স্বল্পতার কারণে তাঁর কাব্য-নাট্যে যে চরিত্রগুলি উঠে এসেছে তার আলোচনা প্রায় অনিবার্য হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যজীবনের যে বিশেষ পর্যায়টি অতীতের দিকে মোহমুগ্ধ দৃষ্টিতে ফিরে দেখায়, সেই সময়পর্বে লেখা কবিতাগুলির কথা উল্লেখ করতে পারি। যেমন–অভিসার, পতিতা, পূজারিনী, পরিশোধ, অপমানবর ইত্যাদি। প্রাচীন সাহিত্য, বৌদ্ধজাতক ও অবদান সাহিত্য এবং ভক্তমাল থেকে বিষয়বস্তু গ্রহণ করে তিনি এই কাব্যগুলিতে গণিকা চরিত্রগুলির পুনর্নির্মাণ করেছেন বলা যায়। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের আলোয় তিনি চিনতে চেয়েছেন দুঃখে-দ্বন্দ্বে-ক্রন্দনে সিক্ত গণিকাদের মনোজগৎটিকে। গণিকাদের তিনি শুধু নষ্ট মেয়ে হিসাবে দেখেননি, দেখতে চেয়েছেন আর পাঁচটা ঘাত-প্রতিঘাতে জর্জরিত সাধারণ নারী হিসাবে। প্রাচীন কাব্যে যে গণিকাদের পাওয়া যেত শাসকের হাতের পুতুল হিসাবে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে পড়ে সেই গণিকাদের মধ্যে প্রকাশ পেল তাঁদেরই অন্তর্দ্বন্দ্ব, অনুশোচনা ও আত্মশুদ্ধি এক ব্যক্তিত্বময় অভিব্যক্তি। তিনি কেন প্রাচীন সাহিত্য থেকে আবিষ্কৃত গণিকাদের অন্যভাবে প্রকাশ করলেন, তার জবাব কবি নিজেই দিয়েছেন–“রমণী পুষ্পতুল্য, তাহাকে ভোগে বা পূজায় তুল্যভাবে নিয়োগ করা যাইতে পারে। তাহাতে যে কদর্যতা বা পবিত্রতা প্রকাশ পায়, তাহা ফুলকে বা রমণীকে স্পর্শ করে না–ফুল বা রমণী চিরপবিত্র, চির অনাবিল।… যে সহজ-পূজ্য তাহাকে ভোগ্যের পদবিতে যে নামাইয়া আনে সেও একটা আনন্দ পায় বটে, কিন্তু সে আনন্দ অতি নিকৃষ্ট শ্রেণির। পতিতা হইলেও নারীর স্বাভাবিক পবিত্রতা তাহার ভিতর প্রচ্ছন্ন থাকে। … পাপের অন্যায়ে সে তাহার আত্মাকে কলুসিত করিয়াছে বটে, কিন্তু তাহার আত্মা একেবারে বিনষ্ট হইয়া যায় নাই–তাহার আত্মা বাষ্পচ্ছন্ন দর্পণের ন্যায় ক্ষণিকের জন্য তাহার সহজ স্বচ্ছতা ও শুচিতা হারাইয়াছে।”
রবীন্দ্রনাথের ‘বিচারক’ গল্পে একজন গণিকার কথা পাওয়া যায়। গণিকা ক্ষীরোদা। ক্ষীরোদাই এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র। ক্ষীরোদার যে জীবনবৃত্তান্ত এই গল্পের উপজীব্য তাতে গৃহস্থ ঘরের মেয়ে কেন গণিকাবৃত্তি গ্রহণ করে তার শেষ পরিণতি কী হয় সেই প্রসঙ্গই বিশ্লেষিত হয়েছে কবির কলমে। গল্পটির রচনাকাল উনিশ শতকের শেষ দশকে। উনিশ দশক জুড়ে গণিকা সম্পর্কে যে তাচ্ছিল্য ব্যঙ্গ ঘৃণা বর্ষিত হয়েছে, শেষ দশকে রচিত গণিকা ক্ষীরোদার চরিত্র তা থেকে আলাদা। আলাদা এই কারণে যে, পূর্ববর্তী লেখকেরা সমাজে গণিকাদের প্রবল উপস্থিতিকে স্বীকার করে নিলেও সাধারণভাবে তাঁদের প্রতি মোটেই সহানুভূতিশীল ছিল না। তাঁদের সামাজিক দৃষ্টিকোণ কিছুটা ভিক্টোরিয়ান শুচিতাবোধ, আবার কিছুটা গোঁড়া হিন্দু রক্ষণশীলতায় আচ্ছন্ন। রবীন্দ্রনাথ গণিকাদের দরদি হৃদয় দিয়ে বিশ্লেষণ করেন। এতদসত্ত্বেও রবীন্দ্র কথাসাহিত্যে গণিকা চরিত্র আর সৃজিত হয়নি। আশি বছরের দীর্ঘ জীবনের অর্ধাংশ রবীন্দ্রনাথ কাটিয়েছেন বিশ শতকের দ্রুত পরিবর্তিত আর্থ সামাজিক পরিবেশে। এমতাবস্থাতেও সময়ের প্রেক্ষাপটে গণিকা চরিত্র তাঁর কোনো গল্প-উপন্যাসে চিত্রিত হয়নি।
শরৎসাহিত্যে অবহেলিত, বঞ্চিত, দুর্ভাগা নারীরাই প্রধান উপজীব্য হয়ে উঠেছে। মানবিক রূপ নিয়ে এসেছে পতিতা তথা গণিকাদের কথাও। শরৎ চট্টোপাধ্যায়ের সময়ে পতিতা শব্দের অর্থও গেল বদলে। গণিকা বা পতিতা মানে কেবল দেহোপজীবিনীই নয়, দেহ ছাপিয়ে এই অপবাদ আরও বিস্তার করেছে নারীর জীবনে। শরৎসাহিত্যে গণিকারা হল ‘দেবদাস’-এর চন্দ্রমুখী, শ্রীকান্ত’-এর পিয়ারি বাইজি, ‘আঁধারে আলো’-র বিজলী।
শরবাবুর সময়ে ‘পতিতা’ শব্দটি সামাজিক অর্থে গৃহীত হয়ে গেছে। পতিতা হিন্দুসমাজের দৃষ্টিতে ‘সতী’ শব্দের বিপরীত অর্থবোধক। ভারতীয় নারীদের বিবাহমন্ত্রনির্দিষ্ট স্বামীই একমাত্র গ্রহণীয় পুরুষ। সুতরাং হিন্দুসমাজে নারী দেহ এবং মনে একজন মাত্র পুরুষকে সাধনা এবং কামনা করতে পারবে। অন্যথা সে পতিতা। সমাজের বিচারে স্বামী ছাড়া অন্য পুরুষকে মনে মনে কল্পনা করলেও সে নারী পতিতা। পতিব্রতা নারীর মর্যাদা নষ্ট হয়। নারী পতিতা হয়। হিন্দুশাস্ত্রে শুধুমাত্র মনে মনে কোনো পরপুরুষকে কামনা করলেও সেই নারী পতিত হয়। রেণুকার কাহিনি সংক্ষেপে দু-চার লাইনে স্মরণ করতে পারি। ব্রাহ্মণ জমদগ্নির স্ত্রী ক্ষত্রিয় রেণুকা। পরশুরাম হলেন তাঁদের পুত্রসন্তান। যিনি স্বাভাবিকভাবেই ব্ৰহ্মক্ষত্রিয়। অন্য চারপুত্ররা হলেন—বসু, বিশ্ববসু, বৃহদ্ভানু ও বৃহৎকশ্ব। যাই হোক, যেটা বলতে চাই সেটা হল–একবার চিত্ররথ নামক এক রাজাকে সস্ত্রীক জলবিহার করতে দেখে পরশুরামের মা রেণুকা কামার্তা হয়ে পড়েন। ধ্যানযোগে এ দৃশ্য দর্শন করে পরশুরামের পিতা জমদগ্নি তাঁর পুত্রদের মাতৃহত্যার আদেশ দেন। বসু, বিশ্ববসু, বৃহদ্ভানু ও বৃহৎকৰ্থ–এই চারপুত্র পিতার আদেশ অগ্রাহ্য করলেও পরশুরাম তাঁর কুঠার দিয়ে মায়ে মাথা-ধড় আলাদা করে দেন। বাকি কাহিনি এখানে বলার প্রয়োজন নেই।
শরৎসাহিত্যে প্রথম পরিচিত গণিকা বা পতিতা হল দেবদাস গ্রন্থের চন্দ্রমুখী। যেভাবে দেবদাসের সঙ্গে চন্দ্রমুখীর প্রথম পরিচয় পর্ব বর্ণিত হয়েছে, তাতে মনে হয় শৌণ্ডিকালয় বা শুড়িখানায় প্রথম পরিচয়ের দ্বিধা, সংকোচ, সংস্কারের আঘাত ও বিবেকের তাড়না যেন লেখকজীবনের বাস্তব ঘটনা। শুধুমাত্র মানসচক্ষে বিচারবুদ্ধি দিয়ে চন্দ্রমুখীর চরিত্রায়ণ এমন জীবন্তভাবে মোটেই সম্ভব নয়। চন্দ্রমুখী শুধুমাত্র শরীরী টানেই দেবদাসকে মুগ্ধ করেনি, ব্যক্তিগত আকর্ষণ দেবদাসের জীবনে কম প্রভাব বিস্তার করেনি। চন্দ্রমুখীর সহৃদয় ব্যবহার, সমাহিত আলাপ, দেবদাসকে সুপথে নিয়ে যাওয়ার আন্তরিক চেষ্টা করেছিল। স্নেহবুভুক্ষু দেবদাসের মনে সবচেয়ে বেশি মোহ বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। দেবদাস যেমন চন্দ্রমুখীর শরীরকে কেন্দ্র করে পিচ্ছিল পথে নেমেছিল, তেমনই প্রেমেও পড়েছিল। যে চন্দ্রমুখী একদিন শুধুমাত্র শরীরের আবেদনে রূপের পসরা সাজিয়ে সমাজের বাইরে দাঁড়িয়েছিল, সেই নারী একসময় দেবদাসকে কেন্দ্র করে একনিষ্ঠ প্রেমের সন্ধানে সমস্ত বিলাস, বিভ্রম ও ঐশ্বর্যকে পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছিল। হিন্দুঘরের বিবাহিতা নারী যেমন বিবাহের পর স্বামীর চরণে নিজেকে নিঃস্ব করে বিলিয়ে দেয়, ঠিক তেমনই চন্দ্রমুখীও দেবদাসকে দেবতার আসনে বসিয়ে নিজেকে নিঃস্ব করে দিয়েছিল। তবুও চন্দ্রমুখীর মলিনত্ব ঘুচল না। কারণ সমাজ তাঁর দুঃখাভিশপ্ত কপালে কলঙ্কতিলক পরিয়ে দিয়েছে। সে তো আর কেউ নয়–গণিকা, বারাঙ্গনা, পতিতা।
শ্রীকান্ত গ্রন্থে এক বাইজিকে পাই, যার নাম পিয়ারী। দেবদাসে চন্দ্রমুখীর ঘরে ঢোকার সময় লেখকের যে জড়তা দেখেছি, শ্রীকান্তে এসে সেই জড়তা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে সে। মজঃফরপুরে বন্ধু মহাদেবের ঘরে পিয়ারী বাইজির সামনে শ্রীকান্ত বেশ অপ্রকৃতস্থ। মাতলামি, মাতালের অর্থহীন প্রলাপ, লাম্পট্যের অভদ্র ইঙ্গিত এবং নর্তকীর বিলোল আভাস শ্রীকান্তকে আর বিভ্রান্ত করে না। পিয়ারি বাইজি সঙ্গে পরিচয়ও প্রগাঢ় হল। পিয়ারী বাইজি ওরফে রাজলক্ষ্মী ছিল শ্রীকান্তের বাল্যকালের খেলার সাথী, আজ সে যৌবনের অভিসারিকা। ব্রাহ্মণকন্যা ভদ্রঘরে জন্ম নিয়েও বিবাহিতা রাজলক্ষ্মী অবস্থার বিপর্যয়ে নর্তকী, গণিকা, দেহবিলাসিনী। পিয়ারী বাইজি আর রাজলক্ষ্মী এক দেহে পৃথক সত্তা। জীবিকার্জনে রাজলক্ষ্মীকে হতে হয়েছিল পিয়ারী বাইজি। দেহ ব্যাবসা নিজের দেহকে সে অপবিত্র করেছে। সমাজে চোখে সে হীনা, আত্মীয়স্বজনের কাছে রুদ্ধদ্বার। যদিও বারবিলাসিনী নর্তকীজীবনকে রাজলক্ষ্মী কখনো স্বচ্ছন্দ মনে গ্রহণ করেনি। তাই সমাজের বাইরে দাঁড়িয়েও রাজলক্ষ্মী কখনো সমাজবন্ধনকে পায়ে দলিত করতে চেষ্টা করেনি। শ্রীকান্ত নানাভাবে রাজলক্ষ্মীকে নিজের দিকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছিল বটে, কিন্তু রাজলক্ষ্মী তাঁর উচ্ছিষ্ট দেহ ধ্যানের দেবতাকে উৎসর্গ করতে পারেনি। নিজের অতীত জীবনের স্মৃতি প্রতিনিয়ত পীড়িত করত লজ্জা দিত রাজলক্ষ্মীকে।
‘আঁধারে আলো’ গ্রন্থে বিজলীও গণিকা। জমিদারপুত্র অনভিজ্ঞ সত্যেনকে বিজলী গঙ্গাতীরে প্রলুব্ধ করতে চেষ্টা করছিল। সুন্দর দেহ বিনিময়ে সে বহুপুরুষকে আকর্ষণ করেছে। দক্ষ মৎস্যশিকারির মতো পুরুষ তুলতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। একদিন ছল করে বিজলী সত্যেনকে তাঁর ঘরে আহ্বান করে। সত্যেন বিজলীর ঘরে ঢুকে জানতে পারল সে এক গণিকার ঘরে উপস্থিত হয়েছে। বিজলী মনে করেছিল সত্যেন আর পাঁচজন পুরুষের মতো দেহলোলুপ। কিন্তু অতর্কিতে বিজলী প্রথম দেখল তাঁর দেহসীমা অতিক্রম করে সত্যেন দাঁড়িয়ে আছে। বিজলীও চন্দ্রমুখীর মতো অমৃতস্পর্শে জেগে উঠেছিল। বিজলী বাইজী পারিজাত স্পর্শে মরেছে। চন্দ্রমুখীও একদিন দেবদাসের স্পর্শে মরেছিল। দানে রাজলক্ষ্মী অতুলনীয়া, চন্দ্রমুখী ত্যাগে গরীয়সী, বিজলী কিন্তু সত্যেনের কাছে কোনোরূপ প্রতিদান প্রার্থনা করেনি। সেই নিস্পৃহ প্রেমই বিজলীকে মহীয়সী করেছে। মোটের উপর শরৎবাবুর তিনজন গণিকার পিছনে ছিল নারীর প্রচ্ছন্ন সত্তা এবং প্রচ্ছন্ন সত্তার বিশ্লেষণ করে তিনি গণিকার নতুন রূপ দেখিয়ে দিয়েছেন।
সর্বোপরি শরৎবাবুর ‘পতিতা’ চরিত্রগুলি পতিতা হিসাবে ততটা পরিস্ফুট হয়নি, যতটা হয়েছে নারীচরিত্র। সেখানে কোনো নারী সামাজিক অর্থে পতিতা না অ-পতিতা, তা সাহিত্যিকের কাছে নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর বিষয়। জীবননাট্যলীলায় তাঁর ভূমিকাটি সাহিত্যিক সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়ে অঙ্কিত হয়েছে কি না, সেটাই সাহিত্যসমাজে বিবেচ্য বিষয়। শরত্যাবু অবিবাহিত বা বিবাহিত এই প্রশ্নের সমাধান না করেও বলা যায় যে, নারীর প্রতি তাঁর সহজ আকর্ষণ প্রবলতম। নারী-মন সন্ধানে শরত্যাবু নারীজগতের বহু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন। শরৎচন্দ্র ব্ৰহ্মপ্রবাসকালে ‘বেঙ্গল সোসিয়াল ক্লাব’-এ স্বরচিত ‘নারীর ইতিহাস’ পাঠ করেন এবং সাতশত পতিতা নারীর জীবনকাহিনি সংবলিত একটি পুস্তক প্রণয়ন করেছিলেন। ঘটনার বিপর্যয়ে শরৎচন্দ্র প্রথম যৌবনে সমাজচ্যুত হয়েছিলেন। সেই অবসরে নারীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় সাধারণত সমাজের বাইরে।
সেসময়ের সাহিত্যিকদের সাহিত্যে যেমন গণিকারা স্থান পেয়েছিল, ঠিক তেমনইভাবে সাহিত্যিকদের জীবনেও গণিকারা স্থান পেয়েছিল। সুরাপান, গণিকাসক্তি ও রক্ষিতা-পোষণ সেকালে এক ধরনের সামাজিক স্বীকৃতি লাভই করেছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তো গণিকাঁচর্চা গৌরব ও মর্যাদার প্রতীক হিসাবেও বিবেচিত হত। আঠারো-উনিশ শতকে কলকাতার নাগরিক জীবন এমনকি মফসসল শহরেও গণিকাঁচর্চা জীবনযাত্রার অনিবার্য প্রয়োজনীয় অনুসঙ্গ হয়ে ওঠে। ভারতপথিক রাজা রামমোহন রায় নিকির নাচ দেখেই সন্তুষ্ট ছিলেন না, বাঁধা রক্ষিতাও ছিল তাঁর। এই যবনী রক্ষিতার গর্ভে একটি পুত্রসন্তানও ‘উপহার’ দিয়েছিলেন। গণিকা সুকুমারী দত্তের প্রেমে মজেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। মরমি কবি হাসন রাজা তো হর হামেশাই গণিকা-দর্শনে গণিকালয়ে যেতেন। কবি নজরুল ইসলামও বাদ যাননি, তিনি গণিকা কাননবালার ঘরে নিয়মিতই যেতেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনে গণিকা ও বৈধতাও প্রশ্নহীন নয়। সাহিত্যিক জগদীশ গুপ্তও রক্ষিতা পুষতেন। রাজনারায়ণ বসু লিখছেন–“এক্ষণকার লো পানাসক্ত ও পূৰ্ব্বাপেক্ষা বেশ্যাসক্ত। যেমন–পানদোষ বৃদ্ধি পাইতেছে, তেমনি বেশ্যাগমনও বৃদ্ধি হইতেছে। সে কালে লোকে প্রকাশ্যরূপে বেশ্যা রাখিত। বেশ্যা রাখা বাবুগিরির অঙ্গ বলিয়া বিবেচিত হইত, এক্ষণে তাহা প্রচ্ছন্নভাবে ধারণ করিয়াছে, কিন্তু সেই প্রচ্ছন্নভাবে তাহা বিলক্ষণ বৃদ্ধি পাইতেছে। বেশ্যাগমন বৃদ্ধি পাইতেছে, তাহার প্রমাণ বেশ্যাসংখ্যার বৃদ্ধি। পূৰ্ব্বে গ্রামের প্রান্তে দুই এক ঘর দৃষ্ট হইত; এক্ষণে পল্লিগ্রাম বেশ্যার সংখ্যা বিলক্ষণ বৃদ্ধি পাইয়াছে। এমনকি স্কুলের বালকদিগের মধ্যেও এই পাপ প্রবলাকারে ধারণ করিয়াছে।”
০৯. বাবুবিলাসীদের গণিকাযাপন
‘বাবু কালচার’ নিয়ে আলোচনা হবে আর গণিকা আসবে না, তা কখনো সম্ভব? তা না-হলে যে সানি লিওনকে ‘ভার্জিন’ বলার সামিল হবে! বাবু, অথচ তিনি গণিকা সঙ্গ লাভ করেননি বা সঙ্গ লাভের জন্য উতলা হননি, এমন ‘বাবু’ বিরল। পরে আসছি সে কথায়। ‘নববাবুবিলাস’ ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত একটি ব্যঙ্গকৌতুক নকশা। প্রকাশকাল ১৮২৫। প্রমথনাথ শর্মন ছদ্মনামে প্রকাশিত। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও আশুতোষ ভট্টাচার্য এটিকে প্রথম বাংলা উপন্যাস’-এর মর্যাদা দিলেও অধিকাংশ সমালোচক এটির উল্লেখ করেছেন একটি কৌতুক নকশা হিসাবেই পরে নববিবিবিলাস’ নামে ভবানীচরণ এই গ্রন্থের একটি দ্বিতীয় পর্বও রচনা করেন। ‘নববাবুবিলাস’ গ্রন্থের মূল উপজীব্য বিষয় উনিশ শতকের প্রথমার্ধে কলকাতার উচ্চবিত্ত সমাজের বহুসমালোচিত বাবু’ সংস্কৃতির অন্ধকার দিক। বলা যায়, এটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রচিত প্রথম বাংলা কথাসাহিত্য। গ্রন্থটি চারটি খণ্ডে বিভক্ত–অঙ্কুর খণ্ড, পল্লব খণ্ড, কুসুম খণ্ড ও ফল খণ্ড। অঙ্কুর খণ্ড, অর্থাৎ বাবুরূপ বৃক্ষের অঙ্কুর অধ্যায়ে সেকালের উদ্ধৃঙ্খল যুবসমাজের ও ঔপনিবেশিক শিক্ষাপ্রণালীর প্রতি কৌতুক কটাক্ষ নিক্ষেপ করা হয়েছে। পল্লবখণ্ড, অর্থাৎ বাবুরূপ বৃক্ষের পল্লব অধ্যায়ে নব্যবাবুদের কুসঙ্গে পড়ার চিত্র বর্ণিত হয়েছে। কুসুমখণ্ড, এই খণ্ডে বাবুদের অধঃপতনের চরম পর্যায়। বাবুর ‘নব্যবাবু’ নামধারণ, গণিকাগমন ও বিলাসব্যসন এবং ফল খণ্ড অর্থাৎ বাবুরূপ বৃক্ষের ফল অধ্যায়ে বাবুপত্নীর বিরহ, খেদোক্তি ও অবশেষে করুণ পরিণতি বর্ণিত হয়েছে।
ডক্টর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে—‘বাবুর উপাখ্যান’ বা ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যঙ্গ আখ্যানগুলি অর্ধশিক্ষিত ধনী সন্তানদের কুৎসিত আমোদপ্রমোদের কথা সাধুভাষায় বলা হলেও উদ্দেশ্যটি তত সাধু ছিল না। বাইরের দিক থেকে এসব নকশায় রঙ্গকৌতুক, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও গল্পের আমেজ থাকলেও ভিতরে ছিল ‘পর্নো’ (porno), কেচ্ছা-কেলেংকারি। সমাজের কুরীতি দেখিয়ে সভ্যভব্য মানসিকতা সৃষ্টি, এই জন্যই ভবানীচরণ ও অন্যান্য নকশাকারেরা কলম ধরেছিলেন। কিন্তু রোগের চেয়ে ঔষধই হয়েছিল প্রাণঘাতী। যাই হোক, উনিশ শতকের কলকাতার বাবু কালচারের একটি উলঙ্গ রূপ চিত্রিত করে বাংলা সাহিত্য ও সামাজিক ইতিহাসে এই গ্রন্থটি এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে।
এখন প্রশ্ন হল এই বাবু সমাজের সৃষ্টি এবং বাবু কালচারের উত্থান হল কেন? বাবুরা আকাশ থেকে পড়ল নাকি! না, হিন্দু বাঙালির অধঃপতন হল দীর্ঘ আটশো বছরের মুসলিম শাসনে নয়, অধঃপতন হল খ্রিস্টান শাসনের শুরুতেই। ১৭৫৭ সালে সিরাজের বিরুদ্ধে পলাশির যুদ্ধে জয়লাভের মধ্য দিয়ে ইংরেজ ব্রিটিশরা বাংলার শাসন ক্ষমতা লাভ করে। খ্রিস্টান ইংরেজরা ক্ষমতা লাভ করেই তাঁদের প্রণীত শাসনব্যবস্থা ও ভূমিব্যবস্থা প্রবর্তন করে। এর ফলে বাংলার গ্রাম্যসমাজের প্রচলিত কাঠামোটা ভেঙে পড়ল। ব্রিটিশরা বাংলার ক্ষমতা লাভের পর ক্রমাগত করের চাপে, দুর্ভিক্ষে গ্রামের দরিদ্র মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে। অস্তিত্ব রক্ষায় তাঁরা একে একে গ্রাম ছেড়ে শহর কলকাতার আসতে শুরু করে দিল। কলকাতা শহর হয়ে উঠল এই সব ছিন্নমূল মানুষের নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল। খ্রিস্টান ইংরেজদের সৃষ্ট এইসব নিম্নবর্গের ছিন্নমূল এবং উচ্চবর্গের শোষকরা একসঙ্গে কলকাতা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাস করতে থাকল। সতেরো শতকের শেষদিকে ইংরেজদের দ্বারা কলকাতা নগরী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
সতেরো শতকের শেষার্ধে খ্রিস্টান (ইংরেজ) শাসন স্থাপিত হওয়ায় রাতারাতি কলকাতার গুরুত্ব রাজধানী মুর্শিদাবাদকে ছাড়িয়ে গেল। গ্রাম থেকে কলকাতার নতুন নতুন মানুষের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন রঙ্গও জমে উঠছিল। বিনয় ঘোষ লিখেছেন—কলকাতা শহরে প্রথমে যে ইংরেজরা এসেছিল, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশ ছিল অস্তগামী মধ্যযুগের উচ্ছিষ্টতুল্য প্রতিনিধি। নতুন শিক্ষা বা নতুন সভ্যতার অগ্রদূত তাঁরা ছিল না। তাঁরা দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হত, হিন্দুদের পুজোপার্বণে অংশগ্রহণ করত, তৎসহ হিন্দুদের মতোই তুকতাকে বিশ্বাস করত। উচ্ছিষ্টতুল্য প্রতিনিধিদের পিছন পিছন চুল পরিচর্যাকর, বাজিকর ইংরেজরাও এসেছিল। বাংলার জমিদারদের মতো খানাপিনা ও জীবনযাপন করাটাকেই তখন ইংরেজরা আভিজাত্য মনে করত।
বঙ্গদেশে খ্রিস্টান শাসন চালু হলে ছিন্নমূল মানুষের পাশাপাশি ইংরেজদের স্পর্শ পেয়ে প্রতাপশালী ‘বাবু’ নামে এক নতুন শ্রেণির উদ্ভব হল। প্রায় ২০০ বছর আগে থেকে শিক্ষিত, ধনী পুরুষদের নামের আগে ‘বাবু’ শব্দের ব্যবহার শুরু হয়। অবশ্য তখনও ‘বাবু’ শব্দের ব্যবহার মোটামুটি ধনী, শিক্ষিতদের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল। বাবু’ পদ পূর্বে নিজে থেকে কারও ব্যবহার করার অধিকার ছিল না। এটা ছিল মুসলিম নবাব প্রদত্ত উপাধি। সম্মানিত ধনাঢ্য ব্যক্তি ছাড়া নবাবেরা অন্য কাউকে এই উপাধি দিতেন না। কিন্তু ইংরেজ শাসনের অবসানের পর সকলেই যত্রতত্র ‘বাবু’ হয়ে গেলেন।
এ সময়ে পুরোনো ধনী সম্প্রদায় বিদায় নিলেন। আবির্ভাব হল এক নব্য ধনী সম্প্রদায়ের। এই নব্য ধনী সম্প্রদায়ই বাবু’। এঁরাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং কোম্পানির সাঙ্গোপাঙ্গদের আশীর্বাদে অল্পকালের মধ্যেই বেশ ধনী হয়ে ওঠেন। রাজা, মহারাজা উপাধি নিয়ে জুড়িগাড়ি, প্রাসাদোপম বাড়ি, মোসাহেব আর দাসদাসীদের নিয়ে কলকাতার জাঁকিয়ে বসেন। এর পাশাপাশি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ চালু হওয়ার পর বাংলায় নতুন জমিদার শ্রেণির উদ্ভব হয়। এঁদেরই একটি অংশ প্রজাদের যারপরনাই শোষণ করে নিঙড়ে নিয়ে প্রভূত বিত্তশালী হয়ে উঠছিলেন। হঠাৎ গজিয়ে ওঠা এই ধনিক এবং নতুন জমিদাররাই কলকাতার বসবাস করে ‘বাবু’ সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হয়ে ওঠেন। গণিকাবিলাস সহ বিভিন্ন কিসিমের আমোদপ্রমোদই এই বাবুকুলের একমাত্র আরাধ্য ছিল। নানারকম পুজো উপলক্ষে বা কোনোরকম উপলক্ষ ছাড়াই নাচ, গান, যাত্রা, থিয়েটার, বুলবুলির লড়াই, হাফ-আখড়াই, কবিগানের আয়োজনে এই বাবুরা থাকত সদাব্যস্ত। কার আয়োজন সব থেকে জমকালো হল, তা নিয়ে রীতিমতো অলিখিত প্রতিযোগিতা চলত। জলের মতো অর্থ ব্যয় হত। ইংরেজরা নিমন্ত্রিত হত। ইংরেজরা বাবুদের তারিফ করত। প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ধনী ও জমিদারদের উপাধি দিত। এই উপাধির লোভে নব্য ধনীরা উৎসবের আয়োজনে বহগুণ বৃদ্ধি করত। এ বলে আমায় দেখ, ও আমায় দেখ। বাবু’ নামের রম্যরচনায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন–“যিনি উৎসবার্থ দুর্গাপূজা করিবেন, গৃহিণীর অনুরোধে লক্ষ্মীপূজা করিবেন, উপগৃহিণীর অনুরোধে সরস্বতী পূজা করিবেন, এবং পাঁঠার লোভে গঙ্গাপূজা করিবেন, তিনিই বাবু।”
ইংরেজরা ক্ষমতায় এসে প্রথম নিজেরাই জমিদার হল। তারপর নতুন একশ্রেণির জমিদার-তালুকদার সৃষ্টি করল এবং নিজেদের লুণ্ঠনের বকযন্ত্র চালু রাখার জন্য দালাল, গোমস্তা, মুৎসুদ্দি, দেওয়ান নিয়ে একপ্রকার এদেশি ‘জেন্টু’ গড়ে তুলল। জমিদার ও জেন্টু উভয় শ্রেণির হাতে যথেষ্ট পয়সা জমল, কিন্তু পয়সার কোনো সদগতি হল না। স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকের মতো এই মজুত পয়সা শিল্পবাণিজ্যের ক্ষেত্রে অবাধে নিয়োগ করা গেল না। সুতরাং হক্কের ধন ফক্কে উড়তে লাগল। বাঁদরের বিয়েতে ও বাপের শ্রাদ্ধে লাখ লাখ টাকা খরচ করে, বাইজি নাচে, টপ্পা খেউড়ে, বুলবুলির আর মেড়ার লড়াইয়ে, ইংরেজ প্রভুদের উপঢৌকন দিয়ে, উৎসব-পার্বণে বিদেশি প্রভুদের ও দেশি দরিদ্র নারায়ণের সেবা করে।
নতুন জমিদারদের সম্পর্কে হুতোম প্যাঁচার নক্সায় কালীপ্রসন্ন সিংহ লিখছেন, ক্ষুদ্র নবাব, ক্ষুদ্র নবাব দিব্যি দেখতে দুধে আলতার মতো রং, আলবার্ট ফ্যাশানে চুল ফেরানো, চীনের শূয়রের মতো শরীরটি ঘাড়ে-গদ্দানে, হাতে লাল রুমাল ও পিচের ইস্টিক, সিমলের ফিনফিনে ধুতি মালকোঁচা করে পরা, হঠাৎ দেখলে বোধ হয়, রাজারাজড়ার পৌত্তর; কিন্তু পরিচয়ে বেরোবে ‘হৃদে জোলার নাতি!’ কোনো কোনো বাবু আবার নিজস্বতার কারণেও প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন–“গোবিন্দরামের ছড়ি/উমিচাঁদের দাড়ি/নকু ধরের কড়ি/মধু সেনের বাড়ি”। হুতোম প্যাঁচার নকশায় কালীপ্রসন্ন সিংহ লিখেছেন–“সহরে ইংরাজী কেতার বাবুরা দুটি দল হয়েছেন; প্রথম দল উঁচুকে সাহেবের গোবরের গস্ত, দ্বিতীয় ‘ফিরিঙ্গীর জঘন্য প্রতিরূপ’; প্রথম দলের সকলি ইংরাজি কেতা, টেবিল-চেয়ারের মজলিস, পেয়ালা করা চা, চুরোট, জগে করা জল, ডিকান্টরে ব্রান্ডি ও কাঁচের গ্লাসে সোলার ঢাকনি, সালুমোড়া; হরকরা ইংলিশম্যান ও ফিনিক্স সামনে থাকে, পলিটিক্স ও ‘বেস্ট নিউজ অব দি ডে’ নিয়েই সর্বদা আন্দোলন। টেবিলে খান, কমড়ে হাগেন এবং কাগজে পোঁদ পৌঁছেন। এঁরা সহৃদয়তা, দয়া, পরোপকার, নম্রতা প্রভৃতি বিবিধ সগুণে ভূষিত, কেবল সর্বদাই রোগ, মদ খেয়ে জুজু, স্ত্রীর দাস, উৎসাহ, একতা, উন্নতির ইচ্ছা একেবারে হৃদয় হতে নির্বাসিত হয়েছে; এঁরাই ওল্ড ক্লাস।” হুতোম প্যাঁচার নকশায় কালীবাবু বাবুদের চরিত্র নিয়ে একটা ছড়া লিখলেন। আপনিও পড়ন–“আজব শহর কলকেতা।/রাঁড়ি বাড়ি জুড়ি গাড়ি মিছে কথার কি কেতা।/হেতা খুঁটে পোড়ে গোবর হাসে বলিহারি ঐক্যতা;/যত বক বিড়ালে ব্ৰহ্মজ্ঞানী, বদমাইসির ফাঁদ পাতা/পুঁটে তেলির আশা ছড়ি, শুড়ি সোনার বেনের কড়ি,/খ্যামটা খানকির খাসা বাড়ি, ভদ্রভাগ্যে গোলপাতাহদ্দ হেরি হিন্দুয়ানি, ভিতরে ভাঙ্গা ভড়ং খানি,/পথে হেগে চোখ রাঙ্গানি, লুকোচুরির ফেঁরগাঁতা।/গিলটি কাজে পালিস করা, রাঙ্গা টাকায় তামা ভরা,/হুতোম দাসে স্বরূপ ভাসে, তফাৎ থাকাই সার কথা।” শিবনাথ শাস্ত্রীর কলম সাক্ষ্য দিচ্ছে–“রাত্রিকালে বারাঙ্গণাদিগের গৃহে গৃহে গীতবাদ্য ও আমোদপ্রমোদ করিয়া কাল কাটাইত এবং খড়দহের ও ঘোষপাড়ায় মেলা এবং মাহেশের স্নানযাত্রা প্রভৃতির সময়ে কলিকাতা হইতে বারাঙ্গণাদিগকে সঙ্গে লইয়া দলে দলে নৌকাযোগে আমোদ করিতে যাইতেন।”
‘বাবু’ সম্পর্কে চমৎকার সব কথা লিখেছেন কালীপ্রসন্ন সিংহ—বাবু মাত্রেই ধনী, কিন্তু ধনী হলেই বাবু হয় না। রামদুলাল সরকারের টাকা ছিল, কিন্তু বাবু হননি। তিনি অতি দরিদ্র থেকে বাংলার শ্রেষ্ঠ ধনী হয়েছিলেন। খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন। রামদুলাল দু-বেলা নিরামিষ খেতেন। দুপুর বেলা ভাত দুধ আর দু-একটি। মিঠাই আর রাতে আটার রুটি। খুব সাধারণ পোশাক পরতেন। নিজের ছেলের বিয়েতে তিনি শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কয়েকদিনের জন্য একজন সিপাহীকে নিয়োগ করেন। সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত রামদুলাল সাধারণ বেশে বিবাহ সংক্রান্ত কাজ দেখাশুনা করতে গিয়ে কাজ শেষে পুনরায় গৃহে প্রবেশ করতে চাইলে সিপাহী রামদুলালকে চিনতে না পেরে পথরোধ করে। কারণ ধনী লোকদের জীবনযাপন এত সাধারণ হতে পারে সিপাহীটি ভাবতেই পারেনি। সাদাসিধা জীবনযাত্রায় অভ্যেস্ত মানুষ ‘বাবু’ হতে পারে না। বাবু হতে গেলে কুকুরের বিয়েতে লাখ টাকা খরচ করা, চার ঘোড়ার গাড়ি চড়ে ভেঁপু বাজিয়ে স্নান করতে যাওয়া, দু-একটি রাঁড় রাখা, রক্ষিতাদের দালানকোঠা করে দেওয়া, পায়রা ওড়ানো, বিদ্যাসুন্দরের আসর বসানো, শনিবারের রাতে বাই-বেশ্যা নিয়ে আসর বসানো ইত্যাদি করতে হয়। বহু বাবু পাল্লা দিয়ে লোক দেখানো এসব করতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছিলেন। মোট কথা—বাবু শুধু ভোগ করতে চান না, খ্যাতি চান, সকলের সঙ্গে টাকা। ওড়ানোর প্রতিযোগিতা করে সবার উপরে থাকতে চান। কলকাতার বিখ্যাত আট বাবু ছিলেন এর মধ্যে অগ্রগণ্য। কলকাতার আট বাবুর মধ্যে ছিলেন নীলমণি হালদার, রামতনু দত্ত, গোকুলচন্দ্র মিত্র, রাজা রাজকৃষ্ণ, কালীপ্রসন্ন সিংহের পূর্বপুরুষ ছাতু সিংহ, দর্পনারায়ণ ঠাকুর, রাজা সুখময় রায় এবং চোরাবাগান মিত্র বংশের এক বাবু—এঁরাই ছিলেন আট বাবু। পরবর্তীকালে নামডাক সম্পন্ন আরও বাবু এসেছিলেন, কিন্তু উপরে উল্লিখিত আটবাবুই হলেন কলকাতার প্রথম বাবু।
সিরাজদৌলার বিরুদ্ধে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের সাহায্য করার পুরস্কার হিসেবে নবকৃষ্ণ দেব পান প্রভূত ধনসম্পত্তি, জমি ও মহারাজা উপাধি। তার স্বল্পকালের মধ্যেই উত্তর কলকাতার শোভাবাজারে প্রাসাদোপম ভদ্রাসন ও দুর্গাপুজোর উপযোগী বিশাল ঠাকুর দালান তৈরি করে দুর্গাপুজো আরম্ভ করে মহারাজ কৃষ্ণদেব। প্রধানত ক্লাইভ ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের আপ্যায়নের জন্যই নবকৃষ্ণের এই দুর্গাপুজোর আয়োজন। ইংরেজদের খেতাবধারী মহারাজা নবকৃষ্ণ তাঁর এক বন্ধুকে লিখেছিলেন—“এবার পূজার সময় লর্ড ক্লাইভ আমার বাটিতে অনুগ্রহপূর্বক প্রতিমা দর্শন করিতে আসিবেন। তাঁহার সহিত কোম্পানির বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত থাকিবেন।” নবকৃষ্ণের বাড়িতে ইংরেজ সাহেবরা দুর্গাপুজো দেখতে আসবে বলে সকাল থেকে চিৎপুরে রাস্তায় লোক চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিল পুলিশ। এসব দুর্গাপুজোর অধিকাংশেরই মূল উদ্দেশ্য ছিল বিত্ত ও প্রাচুর্য। প্রদর্শন এবং পুজো উপলক্ষে আমোদপ্রমোদের আয়োজন করে ইংরেজ রাজপুরুষদের তোষণ। শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপুজো শুরু হওয়ার সময়ে অথবা পরবর্তীকালে আঠারো শতকে কলকাতায় এই ধরনের যে দুর্গাপুজোগুলো আরম্ভ হয়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—জোড়াসাঁকোর দাঁ বাড়ি ও দর্জিপাড়ার জয়রাম মিত্রের বাড়ি, দক্ষিণ কলকাতার চক্ৰবাড়িয়া সড়কের মিত্র বাড়ি, উত্তর কলকাতার বিডন স্ট্রিটের ছাতুবাবু-লাটুবাবুর বাড়ি, খিদিরপুরের ভূ-কৈলাশ রাজবাড়ি, মধ্য কলকাতার রানি রাসমণির বাড়ি। দুর্গাপুজো ছিল বাবুদের সবচেয়ে জমকালো উৎসব। সাহেবরাও এই উৎসবে যোগদান করার জন্য সবসময়ই আমন্ত্রিত হতেন এবং উৎসবের কর্তারাও নানারকম ফলমূল দিয়ে তাদের অভ্যর্থনা করতেন। উৎসবকালে প্রতি সন্ধ্যায় নাচগানের ব্যবস্থা করা হত। আমন্ত্রণ করা হত নামকরা সব বাঈজি-বেশ্যাদের। ধণিক শ্রেণি ছাড়াও এই প্রসাদ পেত সাহেবরাও। হঠাৎ কোনো বাইজী বা গণিকার প্রসিদ্ধি ছড়িয়ে পড়লে তাঁকে ‘বাঁধা মেয়েমানুষ’ হিসাবে রাখার জন্যে বাবুদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেত। এই গণিকাঁচর্চাই ছিল বাবু কালচারের অঙ্গ। কালীপ্রসন্নের লেখা থেকে জানা যায়, রাজরাজড়ারা রাতে নিজ বিবাহিত স্ত্রীর মুখ দেখতেন না। বাড়ির প্রধান আমলা, দারওয়ান, মুৎসুদ্দিরা যেমন হুজুরের বিষয়কর্ম দেখেন, তেমনই রাজরাজড়ার স্ত্রীদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়দায়িত্বও তাঁদের উপর বর্তাত। সুতরাং তাঁরাই-বা ছাড়বেন কেন! এই ভয়ে কোনো কোনো বুদ্ধিমান স্ত্রীকে বাড়ির ভিতর ঘরে পুরে বাইরে দিয়ে তালা-চাবি মেরে সারারাত নিশ্চিন্তে রাঁড় নিয়ে বা বাইজী-গণিকাদের সঙ্গে ফুর্তি করে সকালে বাড়ি ফিরতেন ‘বাবু’। ভাবছেন বাবুদের এত মদন-দহন! সেকালের মদন-দহন কেমন ছিল? কয়েকটি পংক্তি পড়ে নিন–“মদন-আগুন জ্বলছে দ্বিগুণ, কি গুণ কল্প ঐ বিদেশী,ইচ্ছা করে উহার করে প্রাণ সঁপে দিই হইগো দাসী।/দারুণ কটাক্ষ-বানে, অস্থির করেছে প্রাণে,/মনে না ধৈরজ মানে, মন হয়েছে তাই উদাসী।”
তৎকালে বিদেশে স্ত্রী-পরিবার সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার প্রথা না-থাকায় প্রায় সকল আমলা-আইনজীবী ও মোক্তারদের এক একটি উপপত্নীর দরকার হত। অতএব এই ‘উপপত্নী’র সাপ্লাই যাতে নিরবচ্ছিন্ন হতে পারে, সেই কারণে তাঁদের বাসস্থানের সন্নিহিত স্থানে স্থানে গণিকালয় প্রতিষ্ঠা পেতে থাকল। সেজন্যই উত্তর কলকাতার প্রাচীন ও সম্ভ্রান্ত শহরবাসীদের বসতি কেন্দ্রের আশেপাশেই শহরের বিখ্যাত গণিকালয় প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা যায়। শহর কলকাতায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল এইসব গণিকালয়। বাবুদের মেয়েমানুষ নিয়ে আমোদ করার জন্য যেমন, তেমন সাধারণের জন্যও শহরে গড়ে উঠেছিল নতুন তীর্থক্ষেত্র, গণিকালয়। সুতরাং এমন পাড়া ছিল না যেখানে অন্তত দশঘর গণিকা নেই। শহরে তখন যত্রতত্র এদের বসবাস। গৃহস্থের বাড়ির পাশে, সদর রাস্তার উপর, যেখানে ইচ্ছা গণিকারা বাস করত। এমনকি জোড়াসাঁকোর মূল ব্রাহ্মসমাজটি গণিকালয়ের মাঝখানেই। হুতোম প্যাঁচার নকশার মন্তব্যে কলকাতা শহর তখন ‘বেশ্যাশহর’ হয়ে পড়েছে। প্রতিবছর গণিকার সংখ্যা বাড়ছে বই কমছে না। এমনকি একজন বড়ো মানুষের বাড়ির পাশে গৃহস্থের বৌ-ঝি নিয়ে বাস করবার জো পর্যন্ত ছিল না। গণিকারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি আর গালিগালাজ করত। সাধারণ পথিকরাও তাদের হাত থেকে নিস্তার পেত না। কখনো দেখা গেল এক গণিকা রসিক বাবুকে দেখে পানের পিক ফেলতে গিয়ে তা অফিস ফেরত এক কেরানির মাথায় পড়ল। কিন্তু কেরানিটি ভয়ে কিছু না-বলে মানসম্মান নিয়ে চলে গেল। দু-একজন কেরানি এসব ইতরামি সহ্য করতে না-পেরে প্রশাসনের ভয় দেখাত। গণিকারা তখন খিলখিল শব্দে হেসে উঠে বলত–“বেশ্যাবৃত্তি করি বটে, কিন্তু তোদের মতন সাতটা কেরানিকে পুষতে পারি। কলম পিষে তোর তিন পুরুষ যা না করতে পারবে আমরা একপুরুষে তাই করেছি।”
কলকাতায় গণিকাদের পসরা এতটাই বাড়বাড়ন্ত হয়ে উঠেছিল যে, কলকাতার এক বর্ণনায় দেখা যায়–“গৃহস্থের বাড়ির পাশে বেশ্যা, ছেলেদের পাঠশালার পাশে বেশ্যা, চিকিৎসক কবিরাজ বাসস্থানের পাশে বেশ্যা, এমনকি ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরের আষ্টেপৃষ্ঠে বেশ্যা।” ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ পত্রিকার খবরে জানা যায়–“গণিকারা প্রত্যহ সন্ধ্যা হতে রাত দশটা পর্যন্ত রাজপথে দাঁড়িয়ে থেকে নিজেদের মধ্যে যে-সব কুভাষা বা কদৰ্যালাপ করত, তাতে সাধারণ পথিকরা বিব্রত হতেন। স্বভাবতই পথিকদের দেখলে গণিকারা আমন্ত্রণ জানাত, পথিকদের নানাভাবে উৎপাত করত, এমনি পথিকদের উদ্দেশে নানারকম কুকথাও বলত।” কলকাতার পুলিশ ধনীদের আশ্রিত প্রমোদপল্লি এলাকায় হস্তক্ষেপ করতে সাহস পেত না। স্থানীয় বর্ধিষ্ণু সাধারণ মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকদের নীতিবোধ ও রুচিবোধ গণিকাদের এই প্রকাশ্য ইতরামিতে ক্ষুণ্ণ হত এবং তাঁরা কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন নিবেদন করত। কিন্তু তাতে ফল কিছুই পাওয়া যেত না। বিত্তবানদের আশ্রিত গণিকারা শহরের প্রকাশ্য রাজপথে নৃত্য করতেও ভয় পেত না। স্বয়ং দ্বারকানাথ ঠাকুর কলকাতার একটি এলাকাতেই ৪৩টি গণিকালয়ের মালিক ছিলেন। মানে বাড়িগুলোর ভাড়াটেদের পেশা ছিল গণিকাবৃত্তি। কলকাতায় তাঁর আরও এরকম অনেক বাড়ি ছিল। সেকালে গণিকাদের কাছে বাড়ি ভাড়া দিলে ভাড়াটা বেশি পাওয়া যেত।
বাবু কলকাতার সেই কদর্য বেলেল্লাপনার ছবি এখন আমরা কল্পনাতেও আনতে পারি না। শহরের যত্রতত্র গজিয়ে উঠেছে গণিকপল্লি। বিত্তশালী বাবুদের প্রশ্রয়েই এইসব গণিকাপল্লী গজিয়ে উঠেছিল। অতএব প্রশাসনের সাধ্য ছিল না এহেন কালচারের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার। এইসব বাবুদের আদর্শ ছিল মূলত ইংরেজ রাজকর্মচারীরা। শ্রীপান্থ তাঁর কলকাতা’ গ্রন্থে ‘রোটি আউর বেটি অংশে লিখেছেন—-“সতীদাহ কলকাতায় তখন প্রায় প্রতিদিনের ঘটনা। সারা ব্ল্যাক টাউন চিতার ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন, অন্ধকার। সেই অন্ধকারে চলছে বাবুবিলাস, গুরু-প্ৰসাদী কৌলীন্য রক্ষা। সতীর আর্তনাদে, বিধবার কান্না আর বারবনিতার কাতর আহ্বানে অষ্টাদশ শতকের কলকাতা প্রেতপুরী। পা যেন লজ্জায় জড়িয়ে আসে সেদিকে বাড়াতে।”
গণিকালয় যে শুধু সাহেব আর বাবুদের জন্য গড়ে উঠেছিল ব্যাপারটা এমন নয়। চোর-ডাকাত, বদমাস এবং ইতরজনরাও এসব গণিকাদের কাছে যৌনক্ষুধা মেটাতে যেত। তাই বলে সব গণিকালয় একরকম ছিল না। মানুষভেদে, শ্রেণিভেদে নানা ধরনের গণিকালয় গড়ে উঠেছিল সেসময়। সন্দেহ নেই এই গণিকালয়গুলো কলকাতা শহরের এক বৈচিত্র্য ছিল এবং বিভিন্ন গণিকালয়ে বিভিন্ন ধরনের রঙ্গ চলত। মধ্য রাতে শহরের রাস্তায় সজ্জিতভাবে বহু গণিকাকে খদ্দেরের হাত ধরে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত। ভদ্রলোক বাবুরা তখন নিজেদের ঘরের স্ত্রী-কন্যাদের পর্দানসীন করে ফেলেছিলেন, আর নিজেরা ইয়ার-বন্ধুদের নিয়ে বাগানবাড়িতে বসে সেরা গণিকাদের হাট বসাতেন। ঘরের স্ত্রী-কন্যাদের এসব জেনেও মুখ বন্ধ করে বসে থাকতে হত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা দ্বারকানাথ ঠাকুরের ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হয়নি। তিনি গোমাংস খেতেন, ইংরেজদের সঙ্গে একত্রে বসে মদ আর নারী নিয়ে হৈ হুল্লোড় করতেন। তাঁর বাগানবাড়িতে বাইজিদের নাচ-গানের আসর বসত প্রায় রাতেই।
সেসময়ের শনিবারের কলকাতা ছিল শহরজুড়ে সারারাত মদ, গাঁজা আর মেয়েমানুষ নিয়ে বেহদ্দ মজা করার দিন। বিশেষ করে রামবাগান, সোনাগাছি, মেছোবাজার, সিদ্ধেশ্বরীতলা, হাড়কাটা, চাঁপাতলা, ইমামবক্স, চিৎপুর মদের গন্ধে মম করত। একেবারে নরক গুলজার! বাবু কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় যখন খ্রিস্টান হল দ্বারকানাথ মন্তব্য করেছিলেন—এই ধর্মান্তরের কারণ ‘গোরুর মাংস ও মদ্যপান’-এর সুযোগ লাভ। মধুসূদন দত্ত, রাজনারায়ণ বসু, ভুদেবচন্দ্র মুখোপাধ্যায় যখন হিন্দু কলেজে পড়তেন তখন প্রকাশ্য স্থানে বসে নিকটস্থ মুসলিম দোকান থেকে গোরুর মাংসের কাবাব এনে খেতেন এবং মনে করতেন সেটাই পুরোনোকে বর্জন করার একটা বাহাদুরি। সঙ্গে মদ্যপান তো ছিলই। বাবুরা তখন তিন ‘ম’-তে বিশ্বাসী হয়ে পড়েছিলেন—মদ, মাংস ও মেয়েমানুষ। কিন্তু মধুসূদন, রাজনারায়ণ, ভুদেবের মতো ইয়ংবেঙ্গলরা মেয়েমানুষের ব্যাপারটাকে ঘৃণার চোখে দেখতেন। এই দোষটি তাঁদের ছিল না।
কলেজের ছাত্ররা সুরাদেবীর আরাধনা করতেন বটে, তবে গণিকাসক্ত ছিল না। তাঁদের একপুরুষ পূর্বে যুবকরা আবার গণিকাসক্ত ছিলেন, কিন্তু মদ্যপান করতেন না। গাঁজা, চরস বা আফিম খেতেন। ইংরেজি শিক্ষার ফলে পুরোনো নেশা চণ্ডু, গুলি, আফিম বা কালাচাঁদ, তড়িতানন্দ বা গাঁজা বিদায় নিল নতুন জাতে ওঠা অভিজাতদের কাছ থেকে। আগে নেশাখোর বোঝাতে ‘গুলিখোর’, ‘গাঁজাখোর’, ‘চণ্ডুখোর’, আফিমশোর’, প্রভৃতি শব্দ ব্যবহৃত হত। ইংরেজি শিক্ষিতদের কল্যাণে জন্ম হল নতুন শব্দ মদখোর’। ক্রমে এঁদের হাত ধরে মদের নেশা শুরু হল বাংলার ঘরে ঘরে। একদিন এমন হল যখন মদই নেশার জগতে একনম্বর স্থান পেল। তবে সবাই তো আর ভদ্রলোক হয়ে উঠতে পারেননি। নিম্নবর্গের যে মানুষ, এঁরাই ছিলেন সংখ্যায় বেশি। শুড়ির দোকানে বা চিকিৎসকের ডিসপেনসারিতে মদ বিক্রি হত এদের জন্য। অনেকেই সেখানে দাঁড়ভোগ’ খেয়ে টলতে বাড়ি ফিরতেন। এ দৃশ্য তখন কলকাতায় গা-সওয়া। মোদ্দা কথা, তখন হয় গণিকাবাড়ি, নয় রাস্তায় গড়াগড়ি। অথবা
পুরো গড়াগড়িটাই গণিকাবাড়িতে। বাঙালি শিক্ষিতদের কল্যাণে জন্ম হল আরও একটি নতুন শব্দ ‘মাগিখোর’ বা মাগিবাজ’।
১০. ভারতের বাইজি-সংস্কৃতি ও গণিকাবৃত্তি
বাবু কালচারের কথা আলোচনা করতে গিয়ে বাইজি প্রসঙ্গটা এসেছিল। তাই বাইজি নিয়ে একটু বিস্তারিত আলোচনা করতে মন চাইছে। আমাদের সমাজে গণিকাদের মতো বাঈজিরাও ঘৃণ্য, সমাজচ্যুত, প্রান্তিক। বাইজি আর গণিকা যেন সমার্থক। বাইজিদের নাচনেওয়ালি বা নর্তকীও বলা হয়। বাইজি’ হিন্দি শব্দ বাই-এর সঙ্গে ‘জি’ যুক্ত হয়ে বাইজি’ কথাটি প্রচলিত হয়েছে। অতীতে ভারতের উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র ও গুজরাট রাজ্যে বাই’ শব্দ দ্বারা ধ্রুপদী নৃত্য-গীতে পারদর্শী সম্ভ্রান্ত মহিলাদের বোঝানো হত। খুব ছোটো থাকতেই তাঁরা ওস্তাদদের কাছে তালিম নিয়ে নৃত্যগীত শিখতেন। শিক্ষা শেষে শাস্ত্রীয় নৃত্যগীতকে পেশা হিসাবে নিলে লোকে তাদের বাই’ শব্দটির সম্মানসূচক ‘জি’ শব্দটি জুড়ে দিত, তখন তাদের নামে শেষে ‘বাইজি’ শব্দটি শোভা পেত। বাইজি অর্থ পেশাদার নর্তকী ও গায়িকা। বাইজিদের নানা নামে পরিচয় আছে, যেমন–খেমটাওয়ালি, জান, তওয়াইফ, নাচনি, নাচওয়ালি, বাইওয়ালি ইত্যাদি। বইজিরা নিজগৃহে আসর বসিয়ে অথবা বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে, মহফিল দরবারে আমন্ত্রিত হয়ে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নৃত্যগীত পরিবেশন করেন। আগেকার দিনে নবাব, নৃপতি, রাজা, মহারাজা, জমিদার, আমলাবর্গের পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁদের ঘরোয়া অনুষ্ঠানে, আসরে, রংমহলে, বাগানবাড়িতে, প্রমোদবিহারে বাইজিরা নাচ-গান করতেন।
খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে বাংলায়, বিশেষ করে কলকাতায় বাইজিদের আগমন ঘটতে থাকে। অযোধ্যার বিতাড়িত নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের (১৮২২-১৮৯৭) কলকাতার মেটিয়াবুরুজ এলাকায় নির্বাসিত জীবনযাপনকালে সেখানে যে সঙ্গীত সভার পত্তন ঘটে, তাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থান থেকে অনেক বাঈজির আগমন ঘটে। বেশিরভাগ বাইজিই রাগসঙ্গীত ও শাস্ত্রীয় নৃত্য বিশেষত কখকে উচ্চশিক্ষা নিতেন। বাইজিদের নাচ-গানের আসরকে ‘মুজরো’ বলা হয়, আবার তাকে মেহফিল বা মাহফেলও বলা হয়ে থাকে। মেহফিলে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে অংশগ্রহণ ছাড়াও কোনো কোনো বাইজি রাজা-মহারাজা-নবাবদের দরবার থেকে নিয়মিত মাসিক বেতন পেতেন। বাইজিদের নাচ-গানে মোহগ্রস্ত হওয়ার কারণে কোনো কোনো নবাব-রাজা মহারাজা বা ধনাঢ্য ব্যক্তির পারিবারিক ও আর্থিক জীবনে বিপর্যয়েরও সৃষ্টি হয়েছে। বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত বাইজিদের জন্য পরিচিত ছিল লখনউ, এলাহাবাদ, বেনারস, কানপুর, পাটনা, আগ্রা, বরোদা, কলকাতা, দিল্লি প্রভৃতি স্থান। প্রাথমিক যুগের নামকরা বাইজিদের মধ্যে ছিলেন নিকি, আসরন, জিন্নাত, বেগমজান, হিলা, মির্জাজান, নান্নিজান, সুপনজান প্রমুখ। এদের মধ্যে নিকি বাইজি ১৮২৩ সালে রাজা রামমোহন রায়ের বাগানবাড়িতে নৃত্যগীত পরিবেশন করে দেশি-বিদেশি রসিকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে খ্যাতিলাভকারী বাঈজিদের মধ্যে শ্রীজান, মুশতারি, মাশকাজান, গহরজান, জদ্দনবাই, জানকী বা ছাপ্পান্ন ছুড়ি, জোরোবাই, আবদনবাই, নাছমিবাই, নীলম, রোশনারা, আসতারি, রসুলুন, কালীবাই, হীরাবাই, কেশরবাই, সরস্বতী, মুন্নি, কানিজান, আমিরজান, গাঙ্গু, বিদ্যাধরী, সিদ্ধেশ্বরী প্রমুখের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। হেকিম হাবিবুর রহমান তার লেখায় অনেক বাইজির নাম বলেছেন, যেমন—আবেদি বাই, আমু, গা, নোয়াবিন, পিয়ারী বেগম, আচ্ছিবাই, ওয়াসু, বাতানি, হীরা, লক্ষ্মী, জামুরাদ, রাজলক্ষ্মী। এ ছাড়া সত্যেন সেনের লেখা থেকে জানকীবাই ও মালেকাজানের নাম জানতে পারি।
নাচ গান ও রূপের নেশায় উচ্চমান অর্জন হলেও কোনো পুরুষ শিল্পী কিন্তু এই সব বাইজির সঙ্গে এক আসরে বসতে চাইতেন না। কলকাতার একটি আসরে মোস্তারিবাই পূরবী রাগে খেয়াল গেয়ে সুরের মদিরায় শ্রোতাদের এমন আচ্ছন্ন করেছিলেন যে, ওই আসরে পরবর্তী শিল্পী বিখ্যাত ফৈয়াজ খা, এনায়েত খা ও হাফেজ খাঁ মঞ্চে উঠতেই অস্বীকৃতি জানলেন। ইন্দোররাজ শিবাজী হোলকারের সভার বিখ্যাত বীনাকার স্বয়ং বন্দে আলি খাঁ। বীণা বাজিয়ে সুরের ইন্দ্রজালে মুগ্ধ করেন সব শ্রোতাদের, শিবাজীর খাস নর্তকী চুন্নাবাই কিন্তু ছিলেন সেদিন মুগ্ধ শ্রোতাদের আসরে। খুশি হয়ে রাজা ইনাম দিতে চেয়েছিলেন বীণাকারকে। সুরমুগ্ধ রাজাকে চমকে দিয়ে বন্দে আলি খাঁ ইনাম হিসাবে চেয়ে বসলেন বাইজি চুন্নাবাইকে।
“বাড়ি বাড়ি বা বাঈ ভেডুয়া নাচায় বাঈ
মনোগত রাগ সুর ধরে,
মৃদু তান ছেড়ে গান, বিবিজান নেচে যান।
বাবুদের লবেজান কোরে।”
ঈশ্বরগুপ্তের কলমে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগের কলকাতায় বাইবিলাসের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন এই কবিতাটিতে। সেকালের বাবুবিলাসের প্রধান উপকরণই ছিল বাইজি ও বাইনাচ। সেই বাবুরা সাহেবদের খুশি করার জন্যেও বাইজির আমদানি করত ভিন রাজ্য থেকে। সুদূর লখনউ থেকে বাইজি আনা হত আসরে। তবে আসর সেকালের কলকাতায় কিছু ব্যাপার নয়। অষ্টাদশ শতাব্দী থেকেই কলকাতা শহরে বাইচের নেশা জড়িয়ে গিয়েছিল। কোনো উৎসব লাগলেই হল, অমনি বাইজি এসে গেল নাচঘরে। মুজরোর খরচের বহর দেখিয়ে এবং রূপ-জৌলুসের বাহারে চোখ ধাঁধিয়ে এক বাবু আরেক বাবুকে টক্কর দিয়ে বড়োই আমোদ পেতেন। বাইজি নাচ ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গেল। তবে বাইজি নাচ ক্রমশ ভারতে সীমাবদ্ধ না থেকে ইউরোপীয় সমাজেও প্রচলন হয়ে গিয়েছিল। বাইজি নাচ সেসময় স্ট্যাটাস সিম্বল হিসাবে দেখা হত। কলকাতার সাংস্কৃতিক পরিবেশ লখনউ, বেনারসের বাইজিদের স্বপ্ন দেখিয়েছে। সেরা বাইজি বলতে যা বোঝায়, তাঁর অধিকাংশই ছিল অবাঙালি।
“তখন আমি দস্তুরমতো গানের চর্চা করি। কোথায় কে গাইয়ে-বাজিয়ে এলো সব খবর আসে আমার কাছে। কাশী থেকে এক বাইজি এসেছে, নাম সরস্বতী, চমৎকার গায়। শুনতে হবে। এক রাত্তিরে ছ’শো টাকা নেবে। শ্যামসুন্দরকে পাঠালুম, “যাও দেখো কত কমে রাজি করাতে পারো।’ শ্যামসুন্দর গিয়ে অনেক বলে করে তিনশো টাকায় রাজি করালে।”—‘জোড়াসাঁকোর ধারে’ নিবন্ধে সরস্বতী বাইজির গান শোনার স্মৃতিচারণ করছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাইজির গান শুনবেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুররা শুনতেন! মাত্র দুটি গানের জন্য এক রাতে ৩০০ টাকা দিয়ে! সে যুগে ৩০০ টাকার মূল্য নেহাত কম নয়। নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্রনাথও। এহেন সিদ্ধান্ত নিয়ে অসন্তোষ চেপে রাখেননি–“অবনদা, করেছ কী! তিনশো টাকা জলে দিলে?” এদিকে শ্যামসুন্দর এসে জানালেন, টাকার সঙ্গে দু-বোতল ব্র্যান্ডিও চাই সরস্বতীর। ব্র্যান্ডি না-খেলে তিনি নাকি গাইতেই পারেন না। অবনীন্দ্রনাথ তাতেও রাজি। গান তিনি শুনবেনই। সরস্বতী গাইতে শুরু করলেন রাত ১০টায়। একটা গানেই রাত ১১ টা বাজল। এ প্রসঙ্গে অবনীন্দ্রনাথ লিখছেন–“এক গানেই আসর মাত। গানের রেশে তখনও সবাই মগ্ন। সরস্বতীবাই বললেন, “আওর কুছ ফরমাইয়ে’।” তাঁকে এরপর একটা ভজন গাইতে বললেন অবন ঠাকুর। সরস্বতী গাইলেন ‘আও তো ব্রজচন্দলাল। মুগ্ধতার মীড়ে আরও একবার টান পড়ল। অবনীন্দ্রনাথ তাড়াতাড়ি করে ছবি এঁকে রাখলেন তাঁর। গান শেষ, বাই উঠে পড়লেন। অবনীন্দ্রনাথের মনে হল, দু-খানা গানের জন্য ৩০০ টাকা দেওয়া সার্থক।
নগেন্দ্রনাথ ঘোষ এক জায়গায় বলছেন, কলকাতায় বাইজি নাচের প্রবর্তক রাজা নবকৃষ্ণ দেব। তাঁর ইংরেজ আনুগত্য ছিল প্রশ্নাতীত। এই নবকৃষ্ণই ছিলেন কবিয়াল হরু ঠাকুর ও নিতাই দাসেরও পৃষ্ঠপোষক। তাঁর সভায় বাইচের আয়োজন হত ‘এলিট’ সাহেব-সুবো আর বাবুদের জন্য। কবিগানের দরজা সেখানে সাধারণের জন্যেও ভোলা। এমন ‘নষ্ট মেয়েমানুষ’ বাইজিদের নাচ-গানের পরে সেই কবিগানকে ঘোর অশ্লীল মনে হয়েছিল রেভারেন্ড ওয়ার্ডের। ১৮০৬ সালে শোভাবাজারের রাজা রাজকৃষ্ণ দেবের বাটিতে তিনি আমন্ত্রিত হয়েছিলেন বাই নাচ দেখতে। এই আয়োজন বাছাই করা মানুষদের জন্য। ভোররাতে বাই নাচের পরে শুরু হল হরু ঠাকুর আর নিতাই বৈরাগীর কবিগান। বন্ধ দরজা হাট করে খুলে দেওয়া হল সাধারণের জন্য। পিলপিল করে ঢুকল লোক। শুরু হল ‘অশ্লীল’ কবিগান। রেভারেন্ড ওয়ার্ডের মনে হল, বাই নাচের একদম বিপরীত মেজাজের অনুষ্ঠান এসব।
তবে নিন্দে-মন্দর বিপরীত স্রোতও ছিল সে সময়। সেখানে খেমটা নাচ আর বাইজি নাচের মধ্যে রুচি ও সংস্কৃতির পার্থক্যও খোঁজা চলছিল। দেখা গেল, বাইজি নাচ তুলনামূলক অনেক সভ্য, শালীন। বাইজি নাচকে ভুলবশত মহারাষ্ট্রের নৃত্য হিসাবে উল্লেখ করে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বঙ্গদর্শন’-এ লিখেছেন–“খেমটা তান্ত্রিক, মহারাষ্ট্র নৃত্য পৌরাণিক। পুরাণের ন্যায় এই নৃত্যের গাম্ভীর্য আছে।” খেমটা এই লেখার লেখকের চোখে ‘ছোটলোকের আমোদ’, ‘কুৎসিত নাচ’। সাধারণী’ পত্রিকাও খেমটাকে ‘নীচ ভাববাদ্দীপক জঘন্য’ নাচ বলে প্রশংসা করছে বাই। নাচের। অর্থাৎ বাই নাচের শ্রেণিচরিত্রগত একটি পার্থক্যও স্বীকৃত হচ্ছিল সমাজে। ভাবটা এমন যেন বাইরা ‘নষ্ট মেয়েমানুষ’ হতে পারে, কিন্তু তাঁদের শিল্পটি উচ্চাঙ্গের। তা উচ্চকোটির আস্বাদনের সামগ্রী।
বাইজি মানেই যেমন গণিকা নয়, তেমনি গণিকা মানেই বাইজি নয়। আবার বাইজিও গণিকা হতে পারে, গণিকাও বাইজি হতে পারে। তাই আমাদের সমাজে বাইজি আর গণিকা সমার্থক হয়ে আছে। ভবানীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ও বাইজি আর গণিকাকে একই মনে করতেন। তিনি তাঁর ‘নববাবুবিলাস’ গ্রন্থে লিখেছেন–“গাওনা বাজনা কিছু শিক্ষা করো যাহাতে সদা জিউ খুসি থকিবেক এবং যত প্রধানা নবীনা গলিতা যবনী বারাঙ্গনা আছে ইহাদিকের বাটীতে মধ্যে মধ্যে যাতায়াত করিয়া ঐ বারাঙ্গনাদিকের সর্বদা ধনাদি দ্বারা তুষ্ট রাখিবা, কিন্তু যবনী বারাঙ্গনাদিগের বাই বলিয়া থাকে, তাহা সম্ভোগ করিবা, কারণ পলাণ্ড অর্থাৎ পেঁয়াজ ও রশুন যাহারা আহার করিয়া থাকে তাহারদিগের সহিত সম্ভোগে যত মজা পাইবা এমন কো রাঁড়েই পাইবা না।”
বাইজি যেমন নাচ ও গান করত, তেমনই দেহসম্ভোগও করত। তা ছাড়া সেসময়ে নাচা-গানা একমাত্র বাইজি নারীরাই করত। দেবদাসী, গণিকারাও নাচত। সাধারণ নারীদের তা নিষিদ্ধ ছিল। সেই কারণেই নৃত্যশিল্পী বা নাচনেওয়ালি বা নর্তকীদের ঘৃণার চোখে দেখা হয়। সেসময় নাচ করা মেয়েদের বিয়ে দেওয়া মুশকিল ছিল। যেসব মেয়েরা শখ করে নাচ করত তাঁদের ‘বাইজি’ বা ‘নর্তকী’ বলে ঘৃণা করত সমাজ। আজও রক্ষণশীল পরিবারের বাবা-মায়েরা কখনোই নাচ করা মেয়ের সঙ্গে তাঁদের ছেলের বিয়ে দেন না।
বাইজির পেশার বাইরে মেয়েদের নাচ করার অভ্যেস শুরু হয়েছে, এই তো সেদিন। যাই হোক, গণিকাদের যেমন প্রকারভেদ ছিল, বাইজিদেরও প্রকারভেদ ছিল। বাইজিদেরকে চার শ্রেণিতে ভাগ করা হত। যেমন—(১) যাঁর নামের সঙ্গে ‘বাই’ শব্দটি থাকত, তিনি শুধুই গান করতেন। যেমন–মুন্নিবাই। (২) যাঁর নামের সঙ্গে ‘জান’ শব্দটি ব্যবহৃত হত, নাচ ও গান উভয়ই করতেন। যেমন–গহরজান। (৩) যিনি কেবলই অতিথিদের আদর-আপ্যায়ন করতেন, তাঁকে ‘কানিজ’ বলা হত। (৪) যিনি কেবলই গণিকাবৃত্তি করতেন, তাঁকে ‘খানাগি’ বলা হত। বাবুদের অবশ্য সবই চলত।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে কলকাতায় বাবুগিরির বড়োই টালমটাল অবস্থা হল। বাণিজ্যলক্ষ্মীর কৃপা থেকে বঞ্চিত হতে থাকল বাবুরা। কেউ উঠতির মুখে তো কেউ পড়তির মুখে। বাইজি নাচ ও খেমটা নাচ সেকালে ঢাকার মানুষদেরও জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কবি নবীনচন্দ্র সেন তাঁর ছেলের বিয়েতে ঢাকা থেকে বাইজি আনতে পেরে গর্ব অনুভব করেছিলেন। ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলে বাইজি বা গণিকাঁপাড়া ছিল। সে সময় বাইজিপাড়া হিসাবে গঙ্গাজলি ও সাঁচিবন্দর ছিল। ঢাকার ইসলাম পুর ও পাটুয়াটুলির মোড় থেকে যে পথটি ওয়াইজঘাট নামে বুড়িগঙ্গার দিকে চলে গেছে তার নাম ছিল গঙ্গাজলি। সন্ধ্যা নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে তবলার বোল, সেতারের ঝংকার আর নুপুরের নিক্কণ গঙ্গাজলির পরিবিশ মুখরিত হয়ে উঠত। বাবু আর সাহেবদের আলবোলার গুড়গুড় শব্দ পরিবেশের সঙ্গে ছিল সংগতিপূর্ণ।
নাট্যকার সাঈদ আহমেদ তাঁর একটি লেখায় বলেছেন—কাছেই ছিল মহেশ ভট্টাচার্যর বিশাল হোমিওপ্যাথিক ওষুধের দোকান, গঙ্গাজলির উল্টোদিকে ছিল কালীমন্দির। গঙ্গাজলি ছিল দোতালা প্রশস্ত বাড়ি। নীচতলায় বাইজিদের কাজের লোকেরা থাকত। বাইজিরা থাকতেন দোতালায়। বাঁকওয়ালা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হত। বারান্দায় পাতা থাকত ইজিচেয়ার। বাইজিদের খাসকামরা সাজানো থাকত শান-শওকতে। ফরাশ বিছানো ঘর।
গঙ্গাজলির অধিকাংশ বাঈজিরা প্রতিদিন সকালে গঙ্গাজলি থেকে স্নানের জন্য দল বেঁধে বুড়িগঙ্গায় যেতেন। স্নান সেরে বুকে গামছা জড়িয়ে কোমড়ে পিতলের কলসি নিয়ে সিক্ত ভূষণে বাইজিরা লাইন দিয়ে ফিরে আসতেন। এ দৃশ্য উপভোগ করতে কৈশোরে বন্ধুদের নিয়ে ওয়াইজ ঘাট এলাকায় যেতেন নাট্যকার সাঈদ আহমেদ। শিল্পী পরিতোষ সেনও কিন্তু ভুলে যাননি সিক্ত বসনে বাইজিদের ঘরে ফেরার দৃশ্যর বর্ণনা দিতে। তিনি লিখছেন—“আমাদের পাড়ায় বারবনিতারা প্রতিদিন সকালে স্নান করতে বুড়িগঙ্গা যায়। তাঁদের স্নানে যাওয়ার পথটি আমাদের বাসার সামনে দিয়ে। ফেরার পথে ভেজা কাপড়ে কালী মন্দিরে প্রণাম করে আমাদের গলির মুখে আবার দেখা হয়। সকালবেলার এই মনোরম দৃশ্যটি আমাদের পাড়ার পুরুষদের চোখকে বেশ তৃপ্তি দিত। তাঁদের মন মেজাজ খোশ রাখে। দিনটি ভালো কাটে।” সদ্যস্নাত তরুণীদের প্রথম সারির মাঝখানে ১৬ ১৭ বছরের একটি মেয়ের আকর্ষণীয় বর্ণনাও দিয়েছিলেন পরিতোষ সেন। সেই সরস বর্ণনা শামীম আমিনুর রহমানের একটি লেখায় পাচ্ছি—“মুখটি অবিকল লিচুর মতো গোল। থুতুনিটি ঈষৎ তীক্ষ্ণ, ঠোঁট দুটি যেন রসালো দুটি কমলার কোয়া। তাঁর নাকের ছোট্ট পাটা দুটি প্রতিটি নিঃশ্বাসের সাথে সাথে ফুলে ফুলে উঠছিল। গোটা শরীরটি যেন মুর্শিদাবাদী রেশম দিয়ে মোড়ানো। এমনই মসৃণ আর চকচকে তাঁর ত্বক। পাকা পাতিলেবুর গায়ে হাল্কা গোলাপি রঙের পোঁচে যে রঙের মিশ্রণ হয় ঠিক তেমনই তাঁর গায়ের রঙটি। তার নীল কালো চোখ। দুটি যেন স্তম্ভিত মেঘ মুখের অর্ধেকটাই জুড়ে আছে।” পরিতোষ সেন আরও বর্ণনা দিয়েছেন—“ভেজা কাপড়টি মেয়েটির গায়ে লেপটে থাকায় কারণে তাঁর শরীরের প্রতিটি অঙ্গ যেন একটি ফুলের বিভিন্ন পাপড়ির মতো আলাদা সত্ত্বা নিয়ে সরল বৃন্তটির উপর দাঁড়িয়ে আছে। এক একটি পাপড়ি যেন একেকটি ফুল। বাকি মেয়েকটির মতো তার কাঁধেও পেতলের কলসি ভরা বুড়িগঙ্গায় জল। এই কলসি আর নিতম্ব দুইই মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। দুইই টলোমলো। এমনই সুন্দর সাবলীল আর বেপরোয়া।”
সত্যেন সেন তার রচনায় ঢাকার জানকীবাইয়ের কথা বলেছেন। এলাহাবাদের মেয়ে ছিলেন। থাকতেন ঢাকায়। সে সময় তিনিই ঢাকার সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক প্রাপ্ত বাইজি ছিলেন। একদিনের মুজরোতে তাঁকে ১৫০০ টাকা দিতে হত তৎকালীন সময়ে। জানকী ছিলেন এক নবাবের রক্ষিতা। নবাব তাতে এতই মুগ্ধ ছিলেন যে, কেউ যেন তাঁর কাছ থেকে জানকীকে ছিনিয়ে নিতে না পারে সেই জন্য কিছুটা কুৎসিত করার নিমিত্তে জানকীকে ৫৬ টি ছুরির আঘাত করেছিলেন। সে কারণে জানকী ছাপান্ন ছুড়ি নামে পরিচিত ছিল। ঢাকার বাঈজিদের নিয়ে তথ্য পাওয়া যায় হেকিম হাবিবুর রহমানের লেখায়। এলাহিজান উত্তর ভারত থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। নওয়াব আবদুল গনির কাছ থেকে তিনি নিয়মিত মাসোহারা পেতেন। নবাব সাহেবের কাছ থেকে আরও অনেকে মাসোহারা পেতেন, যাঁদের কথাও হেকিম সাহেব তাঁর লেখায় উল্লেখ্য করেছেন। হেকিম হাবিবুর রহমানের লেখায় পাওয়া যায় আচ্ছিবাইকে। আচ্ছিবাইকে নবাব সাহেবের সব থেকে ‘পেয়ারী বাইজি’ বলে উল্লেখ্য করেন। লক্ষ্ণৌর এই বাইজি ছিলেন নৃত্যে সুনিপুণা। হেকিম সাহেবের মতে ঢাকায় এরপরে এত বড়ো মাপের আর কোনো নর্তকী আসেনি। হীরা বাইজি নাকি নাচে খুব দক্ষ ছিলেন, হীরা বাইজি যখন নাচতেন তখন তাঁর গায়ের কালো রং থেকে নাকি আলো ঠিকরে পড়ত। হীরা বাইজির মেয়ে পান্না কিন্তু গজল গেয়ে সুখ্যাতি অর্জন করেছিল।
সত্যেন সেনের লেখায় মালকাজান সম্বন্ধে জানা যায়। মালকাজান মুজরো করতে ঢাকা আসতেন। সে সময় তিনজন মালকাজান ছিলেন। আগ্রাওয়ালি মালকাজান, বেনারসের চুলবুলিয়া মালকাজান ও ভাগলপুরী মালকাজান। উপমহাদেশের বিখ্যাত বাইজি গওহরজান ছিলেন বেনারসের চুলবুলিয়া বা বড়ো মালকাজানের কন্যা। অসামান্য রূপসী মালকাজানের পূর্ব নাম ছিল লেডি এডেলাইন। আর্মেনিয়ান ইহুদি। স্বামী রবার্ট ইউয়ার্ডের সঙ্গে বিচ্ছেদ হলে পরে এডেলাইন বাইজিবৃত্তি গ্রহণ করে। এরপর ইসলাম ধর্মগ্রহণ করে নিজের নাম রাখেন মালকাজান। আর মেয়ে এঞ্জেলিনার নাম রাখেন গওহরজান। গওহরজান ছিলেন ভীষণ শৌখিন আর ফ্যাশন সচেতন। নিজেকে সবসময়ই সাজিয়ে গুছিয়ে উপস্থাপন করতেন। বস্তুত গওহরজানের হাত ধরেই কিন্তু শিল্পীদের ফ্যাশন সচেতনতা এ দেশে শুরু হয়। গওহরজানের মা মালকাজানের সৎ বোন ছিল জদ্দনবাই। জদ্দনের মা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং জীবিকার কারণে মেয়েকে বাই হিসাবে তৈরি করে। জদ্দনবাই বেশ কয়েক বার বিয়েও করেন। জদ্দনবাই ঢাকার বিভিন্ন মেহফিল মাতিয়ে রাখতেন। তিনি ঢাকার নবাবের ঘনিষ্ট সান্নিধ্য পেয়েছিলেন বলেও জানা যায়। জদ্দনের শেষ স্বামী উত্তম চাঁদমোহন জদ্দনের প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে মুসলমান হন, আর তাঁকে বিয়ে করেন। মোহন নিজের নাম রাখেন আবদুর রশিদ। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ এ বিয়েতে সাক্ষী হন।
১৮৭৩ সালে কলকাতার মেয়েরা যখন রঙ্গমঞ্চে আসার অনুমতি পেলেন, তখন সর্বপ্রথম গণিকাপল্লির সংগীতে পারদর্শীরাই কিন্তু মঞ্চে এসেছিলেন। তখন থেকে বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশক পর্যন্ত কিন্তু সমস্ত অভিনেত্রীরাই সুগায়িকা ছিলেন। এ প্রসঙ্গে বিনোদিনী, তিনকড়ি, তারাসুন্দরী থেকে বিংশ শতাব্দীর আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালা পর্যন্ত অনেকের কাছে নাম করা যায়। কাননদেবী এখনও অনেকেরই প্রিয়। কাননদেবী অভিনয়ও করতেন। ঢাকার প্রথম পূর্ণাঙ্গ নির্বাক চলচিত্র ছিল ‘দ্য লাস্ট কিস’-এর নায়িকা ছিল ললিতা। তাঁকে বাদামতলির গণিকাপল্লি থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল। তাঁর আসল নাম ছিল বুড়ি। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর। দ্যা লাস্ট কিসের সহ নায়িকা চারুবালাকে আনা হয় কুমারটুলির গণিকালয় থেকে। জিন্দাবাহার লেন থেকে আনা হয়েছিল দেববালাকে।
বাইজি বা গণিকা থেকে যেমন অভিনেত্রী ও গায়িকার ইতিহাস আছে, তেমনি বাইজি থেকে বেগম হওয়ার ইতিহাসও আছে। যেমন–মণি বা মুন্নিবাই। ইতিহাসের এক ধূলি-সময়ের কথা। মুন্নিবাই ছিল নবাব আলিবর্দি খাঁর জলসাঘরের এক বাইজি। অসম্ভব সুন্দর দেহবল্লরীর অধিকারিণী ছিলেন তিনি। তাঁর রূপ-মাধুরী আর নাচের নুপুরের নিক্কণে নবাব অন্দরমহলের অনেক যুবা পুরুষেরই অন্তরে কাঁপন ধরত। মিরজাফরেরও অন্তর কাঁপিয়েছিল এই নর্তকী। আলিবর্দি খাঁর প্রধান সেনাপতি থাকা অবস্থায় মিরজাফর প্রায়ই জলসাঘরে গিয়ে মুন্নিবাইয়ের সঙ্গে ফুর্তি করত। তখন থেকেই তাঁর স্বপ্ন ছিল মুন্নিবাইকে বিয়ে করার।কিন্তু রাজকীয় প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী জলসাঘরের কোনো নর্তকী অভিজাত মুসলমানের পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব ছিল না।মিরজাফর তাঁর লালিত স্বপ্ন পূরণ করেন পলাশি যুদ্ধের পর পুতুল নবাব হয়ে। তাঁর প্রথম স্ত্রী শাহ বেগমের আকস্মিক মৃত্যু হলে তাঁর স্বপ্নপূরণের সুযোগ এসে যায়। সমস্ত লোকলজ্জার মাথা খেয়ে তিনি এই নর্তকী মুন্নিবাইকে বিয়ে করে বেগমের মর্যাদা দেন।এইভাবেই শুরু হয়েছিল মুর্শিদাবাদে জেনানা মহলে বাইজি থেকে বেগম হওয়ার অধঃপতিত কাহিনি।
কথিত আছে, ‘দুশ্চরিত্রা’ এই মুন্নিবাইকে মিরজাফর আর-এক লম্পট লর্ড ক্লাইভের কাছে মনোরঞ্জনের জন্য পাঠাতেন। মুন্নিবাই তাঁর রূপ-মাধুরীতে বিমুগ্ধ করত ক্লাইভকে। সেইসঙ্গে তাঁদের নাবালক পুত্র নাজিমের জন্য বাংলার পরবর্তী নবাবের পদটিও নিশ্চিত করিয়ে নিয়েছিলেন। প্রায় সময়েই মিরজাফর অন্যান্য নারী ও নর্তকীদের সঙ্গে সুরাপানে মত্ত থাকত, আর এইসব নারীদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ করে দিত স্বয়ং মুন্নিবাই। এই সুযোগে মুন্নিবাইও রাজমহলের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতেন। বাংলার নবাবিও চালাত ইংরেজ লর্ডদের সঙ্গে যোগসাজস ও মনোরঞ্জন করে এই নাচনেওয়ালি। তাহলে দেখা যাচ্ছে মুন্নিবাই বাইজি থেকে বেগম হলেন বটে, কিন্তু বেগম থেকে যে-কোনো স্বার্থে গণিকা হতেও তাঁর আপত্তি ছিল না।
বাইজিদের জীবনে যেমন হাসি-আনন্দ আছে, তেমন আছে দুঃখ-বেদনারও ইতিহাস। গণিকা ও বাইজি নামোচ্চারণে ছিল সমাজের বাঁকা চোখের ভ্রুকুটি। সমাজ তাঁদের অপাঙক্তেয় করে রাখলেও সমাজের ব্যক্তিবর্গরা তাঁদের গুণপনাকে কাজে লাগাতে কসুর করেনি। কিন্তু তাঁদের ভিতর কিন্তু সুরেবেসুরে বেজে উঠত–“ছিঃ ছিঃ এত্তা জঞ্জাল”। গণিকাদের মতোই বাইজিদেরও দিনগত বৃত্তিক্রিয়া যেন জীবন-মৃত্যুর সহবাস। গানই ছিল তাঁদের পারাপারের কাণ্ডারী। গানেই তাঁদের মুক্তির আনন্দ, গানেই পরিস্ফুট বেদনার কান্না। বাইজিদের কিছু গান আমি এখানে উল্লেখ করব। যেসব গানে খুঁজে পাবেন বাইজদের সুখ-দুঃখ-যন্ত্রণার কাহিনি।
(১) লুম খাম্বাজ # কাওয়ালি
অনেক দিনের পরে দেখা, কেমন ছিলে বলো না।
দাসী বলে গুণমণি, মনে কি হে ছিল না।
আসি বলে চলে গেলে, সে আসা কি এই আসিলে
ভালোবাসি বলে কি রে, আসিতে ভালোবাসো না।
তোমা সনে প্রেম করে, জ্বালাতন যার পরে,
যত দুঃখ সই অন্তরে, জেনেও কি তা জানো না।
(২) খেমটা
অমন করিয়ে আঁখি আর ঠের নারে।
আর ঠের না আঁখি প্রাণে মেরো নারে।
তুমি যে চাওনি চাও, ও চাউনি কোথা পাও,
উড়ে যায় প্রাণপাখি মন তত বোঝে নারে।
(৩) কাওয়ালি
আগে আমার ছিল না সে জ্ঞান।
তুমি হইবে জাদু, পরেরই পরান।
তোমাতে আমারি আশ, তুমি হলে পরবশ,
অমৃত জানিয়ে বিষ, করিছিরে পান।
(৪) মিশ্র বেহাগ # খেমটা
আছে যার নয়ন।
রূপে যদি না ভোলে তার মন,
জানি নয়ন তার কেমন।
ধীরে ধীরে নয়নে পশে, রূপ হৃদয়ে বসে,
গুমোর যায় ভেসে, রূপে মন বসে,
জোর চলে না, বুঝ মানে না,
সাধে মন পায়ে বাঁধন।
নয় তো পরে কে করে যতন।
(৫) খাম্বাজ # একতাল
আজ তোমাকে দেখতে এলেম, অনেক দিনে পরে।
ভয় নাইকো সুখে থাকো, অধিকক্ষণ থাকব নাকো,
আসিয়াছি দু-দণ্ডেরি তরে।
দেখব শুধু মুখখানি, শুনব দুটি মধুর বাণী,
আড়াল থেকে হাসি দেখে, চলে যাব দেশান্তরে।
কোনো কোনো বাইজি সামাজিক কল্যাণমূলক কাজের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। সময়, চাহিদা ও মূল্যবোধের পরিবর্তন, নবাব-রাজা-মহারাজাদের পতন ইত্যাদি কারণে বাইজিদের অস্তিত্ব এখন লুপ্ত হয়েছে। তাঁদের নৃত্য সঙ্গীতে পারদর্শিতা, রূপলাবণ্য ও গুণের কথা কেবল বিধৃত হয়ে আছে বিভিন্ন লেখায়। আজও বউবাজার এলাকার বহু অট্টালিকা (বাইজিবাড়ি) ভগ্নপ্রায় অবস্থায় নির্জনে পড়ে আছে। আছে কিছু বাইজি পরিবার। কিন্তু সেখানে আর সুরের কলতান শোনা যায় না, বেলোয়ারি ঝাড়ে বাতি জ্বলে না, রসিকজনের যাতায়াতও আর নেই।
১১. ব্রিটিশ-ভারতে গণিকাদের সামাজিক অবস্থা
কলকাতায় প্রথম বিচারালয় স্থাপনের পর অ্যাটর্নি হয়ে এসেছিলেন উইলিয়াম হিকি। ১৭৭৭ সাল থেকে ১৮০৮ সাল পর্যন্ত হিকি সাহেব কলকাতায় ছিলেন। লন্ডনে ফেরার পর তাঁর স্মৃতিকথায় (১৭৪৯-১৮০৯) যা লিখেছিলেন সেটি শৈশবের কলকাতার সামাজিক ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল হিসাবে স্বীকৃত বলা যায়। হিকি মিস ডানডাস নামে মহানগরের এক ‘বহুজন পরিচিতা বারাঙ্গনা’র কথা তাঁর স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন। আধুনিক যুগে কলকাতা ও সন্নিহিত অঞ্চলে গণিকাবৃত্তির সূচনা যে ব্রিটিশ আমলেই হয়েছিল, তাতে কোনো সংশয় নেই। আধুনিক শহরের সমস্ত কদর্যতাকে সঙ্গে নিয়ে নগর কলকাতার ক্রমবিকাশ হয়েছে। আর এদেশে নবপর্যায়ে গণিকাবৃত্তির উদ্ভব বৃটিশদের হাত ধরেই। ১৭৯৫ সালে রুশ যুবক হেরাসিম লেবেদফ যখন কলকাতায় অস্থায়ী মঞ্চ বেঁধে প্রথম বাংলা থিয়েটারের সূচনা করলেন, তখন সেই নাটকে নারী চরিত্রে অভিনয়ের জন্য গণিকাপল্লির মেয়েদের এনেছিল। কারণ তখনকার সময়ে সাধারণ ভদ্রঘরের মেয়েদের যাত্রা নাটকে অভিনয় করা নিন্দনীয় ছিল। এমনকি যাত্রা-নাটক দেখাটাও ছিল নিন্দনীয়। বলা হত–যাত্রা দেখে ফাত্রা লোকে। সে যুগে ফাত্রা’ শব্দটি চরিত্রহীন মানুষদের বোঝাত।
যাই হোক, হিকি সাহেবের স্মৃতিকথা থেকেই জানা যাচ্ছে, ১৭৯৫ সালের অনেক আগে থেকেই গণিকাপল্লির অস্তিত্ব ছিল। শুধু কলকাতা নয়, বাংলার সমৃদ্ধ শহরগুলি, যেখানে ব্রিটিশরা কোর্ট-কাছারি ইত্যাদি খুলেছিল, সেখানেই সন্নিহিত অঞ্চলে গণিকাপল্লি গড়ে উঠেছিল। ব্রিটিশদের সহায়ক বাবু সমাজের পৃষ্ঠপোষকতায় গণিকাপল্লিগুলো ফুলে-ফেঁপে উঠতে থাকল গোটা উনিশ শতক জুড়ে। রক্ষিতা পোষণ, গণিকাগমন তখনকার সমাজ শুধু অনুমোদনই করত না, এইসব বেলেল্লাপনা ছিল তাঁদের মর্যাদা সূচক।
ইংরাজের নতুন ভুমিব্যবস্থা গ্রাম্য সমাজকে ভেঙে তছনছ করে দিল। ফলে বংশানুক্রমিক পেশা ও বৃত্তি থেকে উৎখাত হয়ে যেমন চোর ডাকাতের দল সৃষ্টি হয়ে শহরে আশ্রয় নিল, তেমনই দারিদ্রের তাড়নায় শহরের গণিকাপল্লিতে আশ্রয় নিল মেয়েরা। ১৮৭২ সালের সরকারি নথিপত্র থেকে জানা যায় যে, কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার গণিকারা অধিকাংশই তাঁতি, তেলি, জেলে, কৈবর্ত, ময়রা, চামার, কামার, কুমোর, যুগী, গোয়ালা, নাপিত, মালি, বেদে ইত্যাদি সম্প্রদায়ের। এই সময়ে কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে গণিকাদের সংখ্যা কীরকম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছিল, তা জানা যায় এই তথ্য থেকে। কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের ১৮৬৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বরের হিসাবমতো ৩০০০ মেয়ে গণিকাবৃত্তিতে এসেছিল। ১৮৮০ সালের এক হিসাবে শহরে গণিকাদের সংখ্যা ছিল ৭০০০, আর ১৮৯৩ সালে সেই সংখ্যাটা বেড়ে হয়েছিল ২০,১১৬। শুধু সমাজের নিম্নবর্গের মেয়েরাই নয়, কুলীন ঘরের বহু মেয়েও অবস্থার দুর্বিপাকে আশ্রয় নিত গণিকাপল্লিতে। সরকারি প্রতিবেদনে স্বীকার করা হয়েছিল যে, গণিকাদের সংখ্যা বৃদ্ধির একটা কারণ হিন্দু বিধবাদের গণিকাপল্লিতে আশ্রয়। বিধবাবিবাহ প্রথা চালু না-হওয়ায় লালসার শিকার বিধবা তরুণীদের শেষ আশ্রয় ছিল এই গণিকাপল্লি। সরকারি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল—“হিন্দুর বিবাহ-বিচ্ছেদ নেই, বিধবা হলে হয় পবিত্র হও, নচেৎ বেশ্যা হও।” সরকারি প্রতিবেদন অনুযায়ী হিন্দু বিধবারা প্রধানত হুগলি, বর্ধমান, হাওড়া, চব্বিশ পরগনা, মেদিনীপুর ও ওড়িশা থেকে আসত। তরুণী বিধবারা বাবুদের লালসার শিকার হতেন, কেউ কেউ গর্ভবতী হয়ে পড়তেন। শেষপর্যন্ত তাঁদের আশ্রয় হত গণিকালয়ে। দারিদ্র, দুর্ভিক্ষ, ইত্যাদি কারণে মা, মেয়ে উভয়কেই আশ্রয় নিতে হত গণিকাপল্লিতে। মুহূর্তের ভুলে (তখন তো কোনো গর্ভনিরোধক ব্যবস্থা ছিল না) গর্ভবতী নারী আত্মহত্যা না করে বাঁচার উপায় খুঁজেছেন গণিকালয়ে আশ্রয় নিয়ে। আবার বহুবিবাহের শিকার নারী প্রেমিকের হাত ধরে কুলত্যাগিনী হয়েছেন। অবশেষে এসে ভিড়তে হয়েছে গণিকাপল্লিতে।
সতেরো শতকে তৎকালীন ভারতের পর্তুগিজ উপনিবেশ গোয়া ছিল পর্তুগিজ দাস’ নামক সম্প্রদায় নিয়ে গঠিত পর্তুগিজদের একটি শক্তিশালী ঘাঁটি। এই পর্তুগিজ দাস’ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল অল্পবয়সি জাপানি মহিলারা, যাঁদের পর্তুগিজ বণিকেরা ধরে বেঁধে এনে যৌনদাসী হিসাবে ব্যবহার করত—এদের বলা হত “জাপানি দাস’ এবং এছাড়াও ছিল জাপান থেকে আগত বন্দি দক্ষিণ এশীয় খালাসি। অষ্টাদশ শতকের শেষে এবং ঊনবিংশ শতকের শুরুতে ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের আমলে, ব্রিটিশ সৈন্যরা তাঁদের কামনা চরিতার্থ করবার জন্য অল্পবয়সি মেয়েদের সেক্স-টুল হিসাবে ব্যবহার করে কিছু আরামপ্রদ স্থান তৈরি করেছিল। ব্রিটিশ সেনারা এই স্থানগুলি তাঁদের নিজেদের গণিকাবলয় হিসাবে ব্যবহার করত। বিবিসি’-র একটি নিবন্ধ জানাচ্ছে, ব্রিটিশ সৈন্যরা মুম্বাইয়ের মতো ভারতের বিভিন্ন শহর জুড়ে গণিকালয় তৈরি করতে সাহায্য করেছিল। ভারতীয় খালাসি সমুদ্র নাবিকরা, যাঁদের জোর করে যুক্তরাজ্যের ব্রিটিশ সেনাবিভাগে নিয়োগ করা হত, তাঁরা তাঁদের মালিকদের অনুকরণ করে অহরহ সেখানকার স্থানীয় ব্রিটিশ গণিকালয়ে গমন করত। ঊনবিংশ ও বিংশ শতকের শুরুতে উপমহাদেশীয় ইউরোপ এবং জাপান থেকে হাজার হাজার মেয়েদের ব্রিটিশ অধিকৃত ভারতবর্ষে পাচার করত; সেখানে তাঁরা গণিকা হিসাবে ব্রিটিশ সৈন্য ও ভারতীয় পুরুষদের সেবায় নিয়োজিত থাকত।
ভারতে ব্রিটিশ শাসনকালে গণিকাদের পৃষ্ঠপোষকতা, গণিকা বৃদ্ধি এবং গণিকাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিয়ে বিস্তারিত জানতে পারা যায় পাঁচখানি আকর গ্রন্থ থেকে। যেমন–(১) ‘বেশ্যানুরক্তি বিষমবিপত্তি’–এটি ১৮৬৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। উনিশ শতকে গণিকাদের যাঁরা বাড়বাড়ন্ত মনে করতেন তাঁদের দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা।(২) ‘বেশ্যা গাইড’–এটিও ১৮৬৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। যৌন সংক্রামক রোগ প্রতিরোধের জন্য ১৪ আইন জারি করেছিল। সেই আইনে বলা হয়েছিল গণিকারা কীভাবে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে পেশা চালিয়ে যেতে পারবে। (৩) “পাঁচালী কমলকলি’–বইটি ১৮৭২ সালে প্রকাশিত হয়। স্বাস্থ্য পরীক্ষার নামে গণিকাদের নিপীড়ন করা, অত্যাচার করা ইত্যাদি বিষয়। (৪) ‘বেশ্যাই সৰ্ব্বনাশের মূল’–বইটি প্রকাশিত হয় ১৮৭৩ সালে। বিষয় তিন নম্বর বইয়ের পরের অংশ। (৫) এলোকেশী বেশ্যা’–এটি প্রকাশিত হয় ১৮৭৬ সালে। অনাচার থেকে মুক্তির উপায় আছে খ্রিস্টধর্মে।
উপরোক্ত গ্রন্থগুলি থেকে যেটুকু জ্ঞান আরহণ করতে পেরেছি, তা সংক্ষেপে এখানে উল্লেখ করতে পারি। উনিশ শতক জুড়ে গণিকা, গণিকাবৃত্তি ও গণিকাবাপন এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, তাঁদের নিয়ন্ত্রণের জন্য নিজেদের স্বার্থেই বিভিন্ন আইন তৈরি করে ফেলেছিল ব্রিটিশরা। কারণ অনিয়ন্ত্রিত যৌনযাপনে সিফিলিস, গনোরিয়ার মতো মারাত্মক মারণ রোগ পড়েছিল সমাজে। পাছে গণিকারসিক ব্রিটিশদেরও আক্রমণ করে সেই ভীতিতেই গণিকাদের রোগমুক্ত রাখতে চেয়েছিল।এমতাবস্থায় সিভিল সোসাইটিও দু-ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। একপক্ষ যাঁরা গণিকাদের ‘সোস্যাল এভিলস’ ভাবত, অপরপক্ষ এই আইনের ফলে গণিকাদের মধ্যে যে সংকট এসেছিল, তাঁর বিরুদ্ধে। ব্রিটিশদের কাছে সৈন্যরা ছিল অমূল্য সম্পদ। কারণ এই সৈন্যদের দিয়েই ভারতীয় নেটিভ’-দের টাইট দেওয়া হত। তাই সৈন্যদের জন্য গণিকা সুলভ করে দেওয়া হয়েছিল। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছিল। অনিয়ন্ত্রিত যৌনসঙ্গমে যৌনরোগ মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল। সে সময়কার রিপোর্ট বলছে, ১৮২৭ সালে ইংরেজ-সৈন্যদের মধ্যে মারণ যৌনরোগ ২৯ % থেকে বৃদ্ধি পেয়ে মাত্র দুই বছরে অর্থাৎ ১৮২৯ সালে ৩১ % হয়ে দাঁড়ায়। ১৮৬০ সালে এসে সেটা এসে দাঁড়ায় ৭০ শতাংশে। এর ফলে একে একে সৈন্যদের বরখাস্ত করতে হচ্ছিল। সৈন্যসংখ্যা কমতে থাকায় সরকারের অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। উদ্ধার পেতে আইন জারি করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ তাঁরা খুঁজে পেলেন না বিকল্প হিসাবে দুটি পথ তো খোলা ছিলই। (১) গণিকাবৃত্তি আইন করে নিষিদ্ধ করে দেওয়া। গণিকাবৃত্তিতে যাঁরা জড়িত থাকবেন তাঁদের চরম শাস্তির বিধান তৈরি করা এবং (২) সৈন্যদের গণিকা নিষিদ্ধ করা। কোনো সৈন্য যদি গণিকাগমন করে, তাঁকে কঠোর শাস্তি প্রদান করা। ইংরেজরা বিকল্প হিসাবে এই কঠিন পথদুটি গ্রহণ করলেন না, গ্রহণ করলেন সহজ পথ। এতে বাঁশও ভাঙল না, বাঁশিও বাজল। গণিকারা থাকবে, সেনারা থাকবে এবং সেনাদের যৌন বিনোদনও থাকবে। অতএব সেনাদের পৃথক গণিকালয় তৈরি করা হল সেনাছাউনিগুলোতে। সাপ্লাই অ্যান্ড ডিমান্ডের ধারা অক্ষুণ্ণ রাখতে প্রণয়ন হল ‘ক্যান্টনমেন্ট অ্যাক্ট ১৮৬৪’ ও ‘চোদ্দো আইন’। এই ক্যান্টনমেন্ট অ্যাক্ট ১৮৬৪’ আইনের বলে যেসব গণিকারা রেজিস্ট্রিভুক্ত হবে এবং কার্ডহোল্ডার হবে, একমাত্র তাঁরাই গণিকাবৃত্তি চালিয়ে যেতে পারবে। বাকিরা নয়, সেনাদের জন্য তো নয়ই।
এতকিছু করেও সৈন্যদের মধ্যে মারণ যৌনরোগ নিশ্চিহ্ন করা যচ্ছিল না। যেহেতু সেনা তদারকির বাইরেও গণিকারা গণিকাবৃত্তি করত, সেনারা সেখানেও নিয়মিত যাতায়াত করত। এর ফলে সেনা ছাড়িয়ে সাধারণ মানুষদের মধ্যেও এই যৌনরোগ ছড়িয়ে পড়তে থাকল। ১৮৬৪ সালে কলকাতার হেলথ অফিসার ফেবর টনেয়রও জানিয়েছিলেন, সিফিলিসের মতো রোগ শুধু সেনাদের মধ্যেই নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। ১৮৬৭ সালে ‘Contagious Diseases Act, XIV of 1868’ নামে একটি খসড়া তৈরি করে তাতে fola fracal–“I beg to state that in addition to my ususal duties, I am willing to undertake the organization of the new office, to superintend the registration of the prostitution. As well as to take an active part in the sanitary inspection of the public women.” প্রণয়ন হল ‘Indian Contagious Disaases Act’ বা চোদ্দো আইন।
কেমন ছিল সেই চোদ্দো আইন? একটু দেখে নেওয়া যাক–(১) ১৮৬৯ সালের ১ এপ্রিলের পর থেকে কলকাতা ও শহরতলিতে কোনো নারী বা কোনো ব্যক্তি নিজ নিজ বাসস্থান যে থানার অধীন সেই থানায় রেজিস্ট্রি না করে গণিকাবৃত্তি ও গণিকালয় রক্ষকের কাজ করতে পারবে না। (২) প্রত্যেক থানায় ইন্সপেক্টর নিজ নিজ থানা এলাকায় যে যে সাধারণ গণিকা ও গণিকালয় রক্ষক বাস করে তাঁদের রেজিস্ট্রি করে নিতে হবে। (৩) কোনো সাধারণ নারী গণিকাবৃত্তি করতে ইচ্ছা করলে তাঁর নিজের নাম, বয়স, জাতি বা ধর্ম, জন্মস্থান, বাসস্থান এবং যে সময়ে গণিকাপেশায় যুক্ত হয়েছে এবং যদি কোনো গণিকালয়ে বর্তমানে বাস করে, তাহলে সেই বাড়ির কর্তারও রক্ষকের নাম এবং পরে লিখিত জেনারেল রেজিস্ট্রি বুকে তার নম্বর সহ সমস্ত তথ্য থানায় নিজে এসে লেখাতে হবে। (৪) থানার ইন্সপেক্টর সেইসব বিবরণ পাওয়ামাত্র থানায় যে রেজিস্ট্রি বুক (ফর্ম–এ) রাখা থাকবে তাতে লিখে ওই টিকিট কমিশনার সাহেবের স্বাক্ষরের জন্য তাঁর অফিসে পাঠিয়ে দিতে হবে। (৫) থানায় রেজিস্ট্রি বুকের মতো সমস্ত শহর ও শহরতলির জন্য পুলিশ অফিসে যে জেনারেল রেজিস্ট্রি বুক রাখা হবে, সেই রেজিস্ট্রি বুকে কমিশনার সাহেব ওই গণিকাকে রেজিস্ট্রি করবেন। জেনারেল রেজিস্ট্রি বুকে ওই গণিকার যে নম্বর হবে সেই নম্বর রেজিস্ট্রেশন টিকিটের প্রথম ঘরে লিখতে হবে। এটা লেখা হলে উক্ত টিকিট কমিশনার বা ডেপুটি কমিশনার সাহেবের দ্বারা স্বাক্ষরিত হয়ে থানার ইন্সপেক্টরের কাছে পাঠাতে হবে। ইন্সপেক্টর নিজের রেজিস্ট্রি বুকে উক্ত রেজিস্ট্রেশন টিকিটে লিখিত নম্বর লিখে নিয়ে যাঁর টিকিট তাঁকে দেবেন। (৬) প্রত্যেক গণিকালয় রক্ষক যে থানার এলাকায় নিজের পেশায় চালায় সেই থানায় তাঁকে রেজিস্ট্রি করতে হবে আর রেজিস্ট্রি করার সময় নিজের নাম, বাসস্থান এবং যে বাড়িতে কী ঘরে কী স্থানে যৌনক্রিয়ার মাধ্যমে রোজগার করে, তা লেখাতে হবে থানার ইন্সপেক্টর উক্ত বিবরণ থানায় যে রেজিস্ট্রি বুক (ফর্ম–সি) রাখা হবে সেই বইয়ে লিখিয়ে নেবেন। তারপর রেজিস্ট্রি টিকিট (ফর্ম–ডি) লিখে ওই টিকিট কমিশনার সাহেবের স্বাক্ষরের জন্য জন্য তাঁর অফিসে পাঠিয়ে দেবে।(৭) কমিশনার সাহেব তাঁর অফিসে এক রেজিস্টার বুকে প্রত্যেক গণিকালয় রক্ষকের নাম এবং অন্যান্য তথ্য লিখে রাখবেন। (৮) কমিশনার সাহেবের অফিসের জেনারেল রেজিস্ট্রি বুকে গণিকালয় রক্ষকদের রেজিস্ট্রেশনের যে নম্বর হবে টিকিটেও সেই নম্বর দেওয়া হবে। আর ওই টিকিট কমিশনার কিংবা ডেপুটি কমিশনার সাহেবের স্বাক্ষর হলে যে থানা এলাকায় ওই গণিকালয় রক্ষক নিজের পেশা চালিয়ে যেতে চায় সেই থানার ইন্সপেক্টরের কাছে পাঠানো হবে। (৯) কমিশন সাহেবের দ্বারা টিকিটে যে নম্বর দেওয়া হবে সেই নম্বর ইন্সপেক্টর রেজিস্ট্রি বুকে লিখে যাঁর টিকিট তাঁকে ফিরিয়ে দেবে। (১০) যদি কোনো মহিলা কিংবা কোনো ব্যক্তি পূর্বোক্ত মতে রেজিস্ট্রি না করে এবং পূর্বের মতে রেজিস্ট্রেশন না করে গণিকাবৃত্তি করে কিংবা গণিকালয় চালায় তাহলে তাঁকে এবং তাঁদেরকে সমন জারি না করেই (১৮৬৮ সালের ১৪ আইন মোতাবেক) গ্রেফতার হতে হবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে সোপর্দ করা হবে বিচারের জন্য। (১১) কোনো রেজিস্ট্রিকৃত গণিকার নিজের বাসস্থান পরিবর্তন করার ইচ্ছা হয়, তখন তাঁকে কমিশনার বা ডেপুটি কমিশনার সাহেবের কাছে নিজে গিয়ে অথবা ইংরেজিতে আবেদনপত্র লিখে যে গলিতে বা অঞ্চলে বসবাস করতে ইচ্ছুক, সেই অঞ্চলের বাড়ির নম্বর এবং রক্ষকের নাম জানাতে হবে। সেইসঙ্গে পূর্বের রেজিস্ট্রিকৃত টিকিট জমা দিতে হবে সশ্লিষ্ট অফিসে। যদি কোনো গণিকালয়ে কেউ বাস করতে সিদ্ধান্ত নেয়, তবে সেই নতুন ঠিকানার গণিকালয়ের রক্ষকের নাম ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর লিখিয়ে নিতে হবে।(১২) এমন আবেদনপত্র পেলে কমিশনার সাহেব রেজিস্ট্রেশন টিকিটে ও জেনারেল রেজিস্ট্রি বুকে প্রয়োজনমতো পরিবর্তন করতে নির্দেশ দেবেন এবং পূর্বোক্ত সেই গণিকাকে ফিরিয়ে দেবেন এবং পূর্বে ওই গণিকা যে থানায় রেজিস্ট্রি হয়েছে সেই থানা থেকে তাঁর নাম পরিবর্তন করে যে থানা এলাকায় সে বাস করতে চায় সেই থানায় তাঁকে পুনরায় রেজিস্ট্রি করতে আদেশ দেবেন। (১৩) কোনো গণিকা রেজিস্টার করে অন্য শহরে কিংবা শহরতলিতে গণিকাবৃত্তি ত্যাগ করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তাঁকে স্বয়ং এসে কিংবা ইংরেজি ভাষায় আবেদনপত্র লিখে কমিশনার সাহেবকে জানাতে হবে যে, তাঁর নাম যেন রেজিস্ট্রি বুক থেকে মুছে ফেলা হয় এবং ওই গণিকা যথার্থভাবে বৃত্তি বা পেশা ত্যাগ করেছে এমন প্রমাণ দিলে কমিশনার সাহেব তাঁর নাম জেনারেল রেজিস্টার ও থানার রেজিস্টার থেকে মুছে দিতে আদেশ করবেন এবং সেই গণিকার রেজিস্ট্রেশন ফিরিয়ে নেবেন। সেইসঙ্গে যে পর্যন্ত ওই আবেদনপত্রের চূড়ান্ত হুকুম না-হয়, সেই পর্যন্ত কমিশনার সাহেব যদি উচিত বিবেচনা করে তাহলে সেই গণিকাকে ‘মেডিকেল টেস্ট থেকে অব্যহতি দিতে পারেন। (১৪) যদি কোনো গণিকালয়ের রক্ষক নিজের বাসস্থান বা ব্যাবসার স্থান পরবর্তন করেন, তাহলে সে যে স্থানে চলে যাচ্ছেন সেই স্থানের নাম ও নম্বর দিয়ে কমিশনার সাহেবের কাছে ইংরেজি ভাষাতে আবেদন করবে এবং সেই আবেদনপত্রের সঙ্গে রেজিস্ট্রেশন টিকিট দাখিল করবে।
গণিকাদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা যেন অকথ্য অত্যাচারের সামিল ছিল। কেমন ছিল সেই স্বাস্থ্যপরীক্ষা, সেটা বর্ণনা করেছে ‘সংবাদ প্রভাকর’। ১৮৬৯ সালের ১৫ এপ্রিলের একটি সংখ্যায় লিখেছে–“বেশ্যাদিগের রেজিস্ট্রারি ও ব্যাধি পরীক্ষা সম্বন্ধে রাজধানী মধ্যে যে কতপ্রকার ভয়ংকর ভয়ংকর কথা শোনা যাইতেছে, তাহা প্রকাশ করিতে হইলে বিদ্রোহীর মধ্যে গণনীয় হওয়া অসম্ভাবিত হয় না। অধিকন্তু অশ্লীলতা ও জনপ্রিয়তার হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাওয়া দুর্ঘট হয়। কেহ বলিতেছে পুলিশের লোকেরা স্ত্রীলোকের প্রতি নির্দয় হইয়া রেজিস্ট্রারির জন্য গ্রেফতার করিতেছে। তাহাদের ক্রদনে ও আর্তনাদে পুলিশের আহ্লাদ বর্ধিত হইতেছে। কোনো-কোনো ডাক্তার অসম্ভব বল প্রকাশ করিয়া এ কাজ করিতেছেন। যাহাদের ব্যাধি নেই তাহারাও পরীক্ষার পর গৃহে আসিয়া উদর বেদনায় ৩/৪ দিন শয্যাগত থাকিতেছে। সেই ভয়ে শত শত বেশ্যা কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করাতে বেশ্যাপল্লী সকল অন্ধকারময় হইয়াছে। যাহারা কলিকাতায় বেশ্যাবৃত্তি করিতে না চাহিয়া স্থানান্তরে যাইতে চাহে, পুলিশের লোকেরা তাহাদিগকে পথিমধ্যে এমনকী নৌকা হইতেও ধরিয়া আনিতেছে।” ভয়ংকর দুর্বিসহ সেইসব পরীক্ষা-পদ্ধতি এবং অসহায় ব্যবহারের ফলে গণিকাদের নানা সংকট দেখা দিচ্ছিল সে সময়। একথা বলাই যায়, গণিকাবৃত্তি এবং সংক্রামক যৌনব্যাধি এত বাড়াবাড়ি স্তরে পৌঁছে গিয়েছিল যে ‘চোদ্দো আইন’ খুবই জরুরি ছিল। এখন যেমন এইডসের মতো মারণ রোগের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখতে কন্ডোমের ব্যবহার করা হয়েছে, তখন তো কন্ডোমের ব্যবহার ছিল না। তাই নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা ছাড়া বিকল্প কোথায়! গণিকাদের নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা এখনও হয়, তবে সেটা সেদিনকার মতো বিভীষিকাময় নয়। ১৮৭২ সালে ‘সোমপ্রকাশ’-এ লেখা হল–“এই আইনটি যখন হয় আমরা প্রাণপণে ইহার প্রতিবাদ করিয়াছিলাম। তখন আমাদিগের কথা রাজপুরুষদিগের ভালো লাগে নাই। কিন্তু এই আইনটি স্ত্রী সম্প্রদায়ের প্রতি অত্যাচারের কারণ হইয়া উঠিয়াছে।”
কেমন ছিল সেই স্বাস্থ্যপরীক্ষার নামে অত্যাচার? ‘সম্বাদ ভাস্কর’ লিখছে–“উক্ত আইনের কার্ব নিৰ্বাহ জন্য লালবাজারে যেসকল ডাক্তার নিযুক্ত হইয়াছেন তাঁহারা পরীক্ষার ছলে নারীদিগের বিশেষ কষ্ট দিতেছেন, দূষ্যাদিগের অপেক্ষা নির্দোষা বেশ্যাদিগের অধিক যন্ত্রণা হইতেছে। দূষ্যাদের মধ্যে অধিকাংশই পরীক্ষার পূর্বে রোগ স্বীকার করে, সুতরাং তাহাদের আর দেহপরীক্ষার প্রয়োজন হয় না। চিকিৎসার অধীনে থাকে, যাহাদের রোগ নাই, তাহারা ব্যাধির অনস্তিত্ত্ব ব্যক্ত করে, চিকিৎসক শোনামাত্রই কেন তাহা বিশ্বাস করিবেন, কার্যতই পরীক্ষার হয়–তাহা সামান্যাকারে দর্শনাদিরূপ পরীক্ষাতেই সমাধা হইতে পারে, কিন্তু আমাদের চিকিৎসকেরা সেরূপে সন্তুষ্ট হন না–তাঁহারা ওই পরীক্ষিত বেশ্যাগণকে প্রথমত টবে বসাইয়া দেন, তাহাতে জলের সহিত জ্বালাকর পদার্থ থাকে, ওই পরীক্ষার পর গর্ভ দর্শনীয় বিশাল যন্ত্রদ্বারা দর্শন হয়, পরে উগ্রতর পিচকারি দেওয়া হইয়া থাকে। জনরবকারিরা বলেন, এই পিচকারিতে অনেকের উদর ফুলিয়া জীবন সংশয় হইয়াছে। অতএব উহা যে স্ত্রীদেহের উপযোগী স্বাভাবিক পিচকারি নহে, ইহা অবাধেই অনিষ্ট সাব্যস্ত হইতেছে। এই পিচকারি দান বিষয়ে পাত্রপাত্র বিচার নাই। ডাক্তারেরা রজস্বলাক্ষেত্রেও উহার প্রয়োগ করিতেছেন। তাহাতে আবার অধিকতর অনিষ্ট হইতেছে, অপরিমিত রুধিরক্ষরণে দুই এক তরুণীর জীবনও গিয়াছে।”
এই বর্ণনায় স্পষ্ট হয় যে, অত্যাচার কতটা অবর্ণনীয় ছিল। এতটাই অবর্ণনীয় ছিল যে, তামাম গণিকারা দলে দলে কলকাতা ত্যাগ করে অন্যত্র পালিয়ে যেতে থাকল। কেউ কেউ কলকাতা ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে গণিকাবৃত্তিও ত্যাগ করতে থাকল। অনেকে আবার ফরাসি উপনিবেশ ফরাসডাঙায় গিয়ে দিন গুজরান করতে থাকল। ব্রিটিশ পুলিশদের আতঙ্কে এমন অবস্থা হল যে, লাল পাগড়ি পরা কোনো লোক দেখলেই পুলিশ আত্মগোপন করে ফেলত। আবার কেউ কেউ আত্মহত্যা করতে বাধ্য হত। রূপচাঁদ পক্ষী লিখলেন–
“কারে বলিব বনমালী! এ দুখের কথা।
হলো চৌদ্দ আইন বড়োই কঠিন বল যাই কোথা।
ভেবে ভেবে গুমড়ে মরি এ কি আইন হলো জারী,
দিগম্বরী করবে যত বারবণিতা।”
এহেন পরিস্থিতে সমাজের একটা বড়ো অংশ প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছিল। ব্রিটিশ সরকার এই প্রতিবাদ গোড়ার দিকে তেমন পাত্তা না দিলেও পরে বিষয়টা নিয়ে ভাবতে বাধ্য হল। বাধ্য হল কারণ, ফরাসি উপনিবেশ ফরাসডাঙায় গণিকারা দলে দলে কলকাতা ছেড়ে যাওয়াতে ইংরেজদের মুখ পুড়েছিল। সেই মুখ রক্ষা করতে এবং এ দেশীয় ভদ্রলোকদের তীব্র সমালোচনা মুখ বন্ধ করতে সচেষ্ট হল। ইংরেজরা বুঝতে পারল এই আইনটি সম্পূর্ণভাবেই আনপপুলার। যে উদ্দেশ্যে এই আইন প্রণয়ন করা সেই সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ। সেনারা যথারীতি যৌনরোগে আক্রান্ত হচ্ছিল। তা ছাড়া এই আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে জলের মতো রাজস্ব খরচ হয়ে যাচ্ছিল। পাক্কা কুড়ি বছর এই আইন সক্রিয় ছিল। অবশেষে ১৮৮৮ সালে এই আইনটি বিলুপ্ত করে দেওয়া হল।
ফিরে আসি গণিকাদের রেজিস্ট্রেশনের প্রসঙ্গে। কোনো প্রকার যৌনরোগ না-থাকলে তবেই একজন গণিকাপেশায় জন্য রেজিস্ট্রিভুক্ত হতে পারত এবং পেশায় যোগদান করতে পারত। যাঁরা রোগাক্রান্ত হত তাঁদের ‘লক হাসপাতাল’-এ পাঠানো হত। কী এই ‘লক হাসপাতাল’? ইংল্যান্ডে এ ধরনের হাসপাতাল ছিল, যেটা তৈরি করা হয়েছিল হিংস্র নেকড়েদের আটকে রাখার জন্য। এই হাসপাতাল লন্ডনে তৈরি করা হয়েছিল ১৭৪৬ সালে। এই লক হাসপাতাল যৌনরোগাক্রান্ত গণিকাদের রাখা হত। সরকারি নির্দেশে কলকাতার বিভিন্ন গণিকাপল্লিতে গিয়ে ব্রিটিশ পুলিশ তল্লাসি চালিয়ে মেয়েদের ডাক্তারি পরীক্ষা করতে যেত। সেইসব মেয়েদের প্রতি নৃশংসতা ক্রমশই মাত্রা ছাড়াচ্ছিল। এর ফলে কলকাতা থেকে অন্য কোনো শহরে বা অন্য কোনো গ্রামে গণিকারা পালিয়ে যেতে থাকল দলে দলে। যৌনরোগের কারণে যেসব হতভাগীদের চিকিৎসার জন্য লক হাসপাতালে যেতে হয়েছিল, তাঁদের ফিরে এসে আর পুরোনো ফিরে যেতে সাহস পেত না। রোগের ভয়ে খরিদ্দারদের আনাগোনাও ক্রমশ কমতে থাকল। সেই ভীতি আজও বহমান। তাহলে কি এটাই বুঝতে হয় ব্রিটিশ-ভারত সরকার প্রত্যক্ষভাবে নাহলেও পরোক্ষভাবে গণিকাবৃত্তিকে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল? বাঙালি ভদ্রলোক সমাজের চাপে কখনো-কখনো প্রশাসন শহরের মধ্যবিত্ত এলাকা গণিকালয় উচ্ছেদ করত। গণিকা ও গণিকাবৃত্তির বিরোধিতার কেন্দ্রে ছিলেন সেসময়ের বিশিষ্ট তরুণ বাঙালি বুদ্ধিজীবী, সমাজ-সংস্কারক পর্যন্ত। মহাভারতকার কালীপ্রসন্ন সিংহ পর্যন্ত গণিকাবৃত্তির বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করেছিলেন। ব্রিটিশ-ভারত সরকারকে এ ব্যাপারে ধারাবাহিকভাবে বোঝানো চেষ্টা করে গেছেন। নগরায়নের ফলে যে নতুন অর্থনীতির উদ্ভব ঘটেছিল, শিল্পকেন্দ্রিক সেই অর্থনীতি ও সামাজিক অবস্থায় গ্রাম্যসমাজ ও পরিবারচ্যুত মানুষ যে। বিনোদনের আশায় গণিকাদের কাছে যাবে, এটাই আধুনিকতার অবধারিত পরিণতি। সেটা বুঝতে পারেনি উনিশ শতকের বিদ্যোৎসমাজ। খেতে না-পাওয়া মেয়েদের এই বৃত্তিটা এবং গণিকালয়গুলি হয়ে গিয়েছিল নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম যেখানে প্রাণ খুলে যেমন খুশি খিস্তি দিতে পারে, তেমনি নিজের গতর-খাটানো রোজগার করা অর্থ নিজের মতো করে খরচ করতে পারে।
গোটা উনিশ শতক জুড়ে ভদ্রবাড়ির মেয়েরা চাকরি করতে বাইরে বেরচ্ছেন এমন চিত্র অতি বিরল ছিল। বলা যায়, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার হয়তো প্রথম চিত্র এই গণিকাদের রোজগারের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল। তা ছাড়া এ এমন এক পেশা, যে পেশায় যোগদান করলেই রোজগার নিশ্চিত। রোজগারও সীমাহীন হতে পরে। কাঁচা পয়সা যাকে বলে। এ পেশায় অনাচার, অত্যাচার, লাঞ্ছনা নিশ্চয় ছিল। সে তো গার্হস্থ্যজীবনেও কম ছিল না। সামাজিক শোষণ তো কম ছিল না মেয়েদের। সেই সামাজিক শোষণের সঙ্গে সম্পৃত্ত থাকে সমাজ, প্রশাসন ও রাষ্ট্রব্যবস্থা। গণিকাজীবনেও ছিল, আছে, থাকবে। সে সময় সর্বদাই গণিকাদের বিরুদ্ধে গৃহস্থরা মুখর ছিল। তাঁরা সর্বদা আদালতে চলে যেত গণিকাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে। আদালতও গণিকাদের বিরুদ্ধে। আদালত যারপরনাই গণিকাদের অপমানজনক কথা বলত, ভর্ৎসনা করত। এতে গণিকাদের কোনো হাত নেই। হাত আছে মূলত পুরুষতান্ত্রিক ভদ্রলোক সমাজের আধিপত্যবাদ। গণিকালয় সেই পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের পরিসর গড়ে তুলেছে। যাই হোক, তথাকথিত ভদ্রলোকদের উপর্যুপরি দাবিকে গুরুত্ব দিয়ে ১৮৬৮ সালে চোদ্দো আইন প্রণয়ন করে ব্রিটিশ সরকার এদেশীয় ভদ্রলোকদের রক্ষা করল। পাশাপাশি গণিকাদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা করিয়ে রেজিস্ট্রির মাধ্যমে পেশা চালানোর সুযোগ করে দিয়েছিল। বলা যায়, গণিকাদের সরকারি স্বীকৃতি দিয়েছিল।
সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস এসময়ে প্রবল হয়ে উঠছিল। গণিকা ও গণিকাবৃত্তির সমর্থন ও আপত্তিই যেন একমাত্র সত্য হয়ে উঠেছিল। সেসময়ে সাহিত্য-নাটক-যাত্রা-প্রহসনে গণিকা চরিত্র আবশ্যক অনুপ্রবেশ ঘটছিল। কেউ কেউ আবার গণিকাদের পরিত্রাণের উপায়ও বাতলে দিচ্ছিলেন। জনৈকা মিশ লেসলি লিখলেন, গণিকাদের পরিত্রাণ মিলবে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে জিশুকে স্মরণ করে। সংখ্যায় অতি অল্প হলেও কিছু গণিকা পাপস্খলনের জন্য খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।
শুধু ব্রিটিশ উপনিবেশেই নয়, ফরাসি পোর্তুগিজদের উপনিবেশের ফলেও ভারত উপমহাদেশে এক অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষিত হল। বিদেশিরা ভারতের বাসিন্দাদের দাসানুদাস কীটাণুকীট মনে করত। পুরুষদের সহজলভ্য শ্রমিক আর মেয়েদের সহজলোভ্য ভোগ্যা মনে করত। এর ফলে অবাধ, অসংযম এবং অবাঞ্ছিত যৌনজীবনে জড়িয়ে পড়ল তাঁদের এক অংশ। গণিকাবৃত্তির রমরমা হতে শুরু করল এই সময় থেকেই। গণিকাগৃহে যাওয়া যেন এক স্ট্যাটাস সিম্বল হয়ে দাঁড়াল। সংক্রমিত হতে থাকল কালান্তক যৌনব্যাধী। তাঁদের বেপরোয়া যৌন সম্ভোগ সিফিলিস এবং গনোরিয়ার মতো যৌনব্যাধী আতঙ্কের সৃষ্টি করল। যৌনব্যাধীর আতঙ্কে বাজারও খানিকটা স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল কিছুকালের জন্য। কন্ডোম বাধ্যতামূলক হওয়ার আগে পর্যন্ত এই ভীতি কাজ করত রসিকদের মনে। শোনা যায়, ফরাসিদের কাছ থেকেই সিফিলিস যৌনরোগটি আমদানি হয়েছিল। সিফিলিস রোগটি মূলত কুকুরদের অসুখ, কুকুরদের হত। কুকুরদের কাছ থেকে এই সিফিলিস রোগটি মানুষের শরীরে কীভাবে সংক্রমিত হল, সেটা অবশ্যই গবেষণার বিষয় হতে পারে। আতঙ্ক নিয়ে বেশ কয়েক যুগ কেটে গেল গণিকা ও গণিকাপ্রেমীদের। এরপর রসিক-রসকিনীদের চোখেমুখে ভরসার আলো দেখা গেল। সিফিলিস ও গনোরিয়া নিরাময়ের জন্য হাতে চলে এলো অব্যর্থ প্রতিষেধক মেচনিকফ মলম, পেনিসিলিন, সালফাথিয়াজোল ইত্যাদি। এইসব ওষুধের ব্যবহার বাড়তেই গণিকাদের যৌনজীবনে এক বিপ্লব ঘটে গেল। কিন্তু পূর্ব-সতর্কতা নেওয়া যায় না-বলে রোগটা থেকেই গেল। সেই অভাবটা পূরণ করে দিল কন্ডোম। এখন অবশ্য সিফিলিস, গনোরিয়ার কথা খুব একটা শোনা যায় না। বরং এখন নতুন আতঙ্ক এইডস। সেটাও প্রায় স্তিমিত। সচেতনতা ও বাধ্যতামূলক কন্ডোম ব্যবহারে যৌনরোগ এখন আর তেমন আতঙ্ক ছড়াতে পারছে না। কন্ডোম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব আলাদা একটি অধ্যায়ে।
১২. অন্য দেশ : প্রাচীন সভ্যতায় গণিকাবৃত্তি
ইহুদি ধর্ম গোত্রের ভিতরে সদস্য-সদস্যাদের কাউকেই গণিকাবৃত্তিতে উৎসাহিত করত না। বরং সেটা তাঁদের নৈতিক আইন অনুসারে জঘন্য অপরাধ বলে বিবেচিত হত। তবুও ইতিহাসে খুব অল্প সময়ের জন্যই তাঁরা রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছিল। তাই তাঁদের নিজস্ব গোত্রের মধ্যে গণিকাবৃত্তি দমন করতে পারলেও নগর থেকে গণিকাবৃত্তি নিষিদ্ধ করতে পারেনি। যত বড়ো নগর তত বেশি গণিকা, তত বেশি ব্যাভিচার। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ‘লিডিয়ান’ ও ‘সাইপ্রিয়ান’ জাতির মেয়েরা দূরবর্তী অঞ্চলে গিয়ে গণিকাবৃত্তি করে অর্থসংগ্রহ করে এনে বিয়ে করত। ভারতেও কয়েকটি প্রদেশে রাজাদের অধীনে ‘নাইক’ নামে একটি সম্প্রদায় ছিল। নাইক মেয়েরাও সংসারের ব্যয় নির্বাহের জন্য গণিকাবৃত্তিতে অংশ নিত। পুরোহিতেরাও কখনো-কখনো ধর্মের দোহাই দিয়ে মেয়েদেরকে গণিকাবৃত্তিতে নিযুক্ত করত। যেমন ব্যাবিলোনিয়ায় মেয়েদেরকে ইশতার মন্দিরে যেতে হত। মন্দিরের যে পুরুষ প্রথমে জিভ দিয়ে ওই মেয়েকে রুপোর মুদ্রা নিক্ষেপ করবে, সেই পুরুষ ওই শরীর ভোগের অধিকার পাবে। এ নিয়ম মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম আফ্রিকাতেও প্রচলন ছিল।
প্রাচীন গ্রিস, রোমে এ ধরনের গণিকাবৃত্তির প্রথম উৎপত্তি। গ্রিক সভ্যতাও একটা পর্যায়ে শুধুমাত্র গণিকাবৃত্তির জন্যই বিখ্যাত ছিল। তাঁদের নগরে যদিও গণিকাদের নাগরিক অধিকার ছিল সামান্য। তবে নগরের অধিকাংশ সম্পদের মালিক ছিল গণিকারা। তাঁরাই নগরের সম্ভ্রান্ত নাগরিকদের বিলাস ও ব্যাভিচারের অর্থ প্রদান করত। উচ্চাভিলাষী যে-কোনো নারী সে সময়ে স্ব-ইচ্ছায় গণিকাবৃত্তিতে অংশগ্রহণ করত এবং তাঁরা অর্থে-বিত্তে-সম্মানে কারোর থেকে কোনো অংশে পিছিয়ে ছিল না। বরং সামনের কাতারেই অবস্থান করত। প্রাচীন গ্রন্থাদি সূত্রে, যেমন ইতিহাসের জনক হিসাবে খ্যাত হেরোডেটাস (খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০/২০)-এর লেখায় এই পবিত্র’ গণিকাবৃত্তির বহু নমুনা পাওয়া যায়, যেটি প্রথম শুরু হয়েছিল ব্যাবিলনে। সেখানে প্রত্যেক নারীকে বছরে অন্তত একবার করে যৌনতা, উর্বরতা ও সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতির মন্দিরে যেতে হত এবং সেবাশুশ্রষার নমুনা হিসাবে একজন বিদেশির সঙ্গে নামমাত্র মূল্যে যৌনসঙ্গম করতে হত। একই ধরনের গণিকাবৃত্তির চর্চা হত সাইপ্রাস এবং করিন্থে। এটার বিস্তৃতি পেয়েছিল সার্দিনিয়া এবং কিছু ফিনিশীয় সংস্কৃতিতে, বিশেষ করে ইস্টার দেবতার সম্মানে। ফিনিশীয়দের মাধ্যমে ক্রমশ এটি ভূমধ্যসাগরের অন্যান্য বন্দর শহরগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে, যেমন–সিসিলি, ক্ৰটন, রোসানো ভাগলিও সিক্কা ভেনেরিয়া এবং অন্যান্য শহরে। এক্ষেত্রে অনুমান করা যায়, এশিয়া মাইনর, লাইদিয়া, সিরিয়া ও এট্রাকসনের নামও। ইসরায়েলে এটি একটি সাধারণ ব্যাপার ছিল। আগেই বলেছি, প্রাচীন গ্রিকের এথেইনাইয়ের কবি সোলোন (খ্রিস্টপূর্ব ৬৩ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৫৯০), যিনি তৎকালীন গ্রিকের সাতজন জ্ঞানী লোকের একজন হিসাবে গণ্য হতেন। খ্রিস্টপূর্ব ছয় শতকে এথেন্সে প্রথম গণিকালয় স্থাপন করেন। এই গণিকালয়ের উপার্জন দিয়ে আফ্রোদিতিকে নিবেদন করে একটি মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল। ইউস্তিয়ানের স্ত্রী রোমক সম্রাজ্ঞী থেওডেরো প্রথম জীবনে গণিকা ছিল। বোসপোরুসে তিনি ৫০০ গণিকার জন্য একটি নির্দিষ্ট গণিকালয় গড়ে তুলেছিলেন। প্রাচীন হেল্লাস বা গ্রিস দেশের আথেনাই বা এথেন্সে গণিকালয় ছিল। প্রাচীন গ্রিসের লোকেরা স্ত্রী ছাড়াও অন্য মহিলাদের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা করতে পারত এবং করত। প্রাচীন গ্রিক ইতিহাসবিদ, পরিব্রাজক ও কূটনীতিক মেগাস্থিনিস এক ধরনের পরিদর্শকের কথা বলেছেন, যাঁরা রাজ্যের সকল কার্যক্রমের উপর গণিকাদের সহায়তায় নজর রাখত এবং রাজার কাছে গোপনে রিপোর্ট করত।
রোমান আমলেই পৃথিবীতে প্রথম গণিকাবৃত্তির লাইসেন্স দেওয়া হয় ও কর ধার্য করা হয়। রোমানরা গণিকালয়কে ‘নুপানরিয়া’ (Lupanaria) বলত। তাঁরা ক্রীতদাসীদের সবসময় গণিকা হিসাবে কাজ করাত। যখন এঁদের সংখ্যা বাড়তে থাকল, তখন এইসব গণিকাদের আলাদা করে রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল। অনেক সময় গণিকাদের রূপে মুগ্ধ হয়ে রোমান যুবকরা বিয়ে করতে শুরু করল। সেসময় রক্তের পবিত্রতা ও বংশের ঐতিহ্য রক্ষার জন্য গণিকালয় তুলে দেওয়ার জন্য বিপ্লব দানা বেঁধে ওঠে। দানা বাঁধলেই হল! সেখানকার সম্রাট গণিকালয় থেকে প্রচুর খাজনা পেত। অতএব আর্থিক দিক দিয়ে চিন্তা করে গণিকালয় ও গণিকাবৃত্তি নিষিদ্ধ করা সম্ভব হল না।
চিনে তাও রাজবংশ একটি নির্দিষ্ট এলাকায় গণিকাবৃত্তি চালু করে। পরবর্তী সাঙ রাজবংশ (৯৬০ থেকে ১১২৬ সাল) ক্যাফেতে ও অন্যান্য প্রমোদস্থানে যেসব মহিলারা গণিকাবৃত্তি করত, তাঁদের হাংচৌ শহরে সীমাবদ্ধ করে দেয়। ওয়েবস্টার অভিধান মতে, সুমেরিয়ানদের মধ্যেই প্রথম ‘পবিত্র’ গণিকার দেখা মেলে।
সূর্যোদয়ের দেশ প্রাচ্যের সুপ্রাচীন সভ্যতার দেশ নিপ্পন তথা জাপানে ঠিক কবে কোন্ অঞ্চল থেকে গণিকাবৃত্তির উদ্ভব হয়েছিল, তা অবশ্যই গবেষণার বিষয় হতে পারে। তবে জাপানের গণিকাবৃত্তির ঐতিহ্য খুবই গভীরে প্রোথিত অনুমান করা যায়। প্রাচীন জাপানে জিশুখ্রিস্টের জন্মের আগের সময়ে জাপানের গণিকাবত্তি সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে কমপক্ষে হেইয়ান যুগ (৭৯৪-১১৮৫ খ্রিস্টাব্দ) থেকে কামাকুরা যুগ (১১৮৫-১৩৩৩ খ্রিস্টাব্দ) পর্যন্ত শরীর ভাড়া ও শরীর বিক্রির তথা যৌনতা বিক্রি পেশা হিসাবে গ্রহণ করার কথা জানা যায়। সে সময়ে ‘ইউজো’ বা ‘আসোবি মে’ নামে গণিকারা কেবল পেশাগতভাবে শরীরসর্বস্বই ছিল না, তাঁরা নাচ-গান-অভিনয় করেও অর্থ রোজগার করত। নারা যুগ (৭১০-৭৯৪ খ্রিস্টাব্দ) থেকে হেইয়ান যুগ পর্যন্ত ‘মিকো’ বা ‘ফুজো’ নামে মেয়েরা শিন্টোও ধর্মীয় ‘জিনজা’-তে সেবাদাসী হিসাবে কাজ করত। এঁরাই পরবর্তীকালে সেবাদাসীর কাজ ছেড়ে অনেকেই বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত সরাইখানা, মন্দির সংলগ্ন হাট-বাজার, নদী-বন্দর বেছে নিল যৌনকর্মে অংশ নিতে। কামাকুরা যুগ থেকে মুররামাচি যুগ (১৩৯২-১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দ) পর্যন্ত জাপানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ‘কোওশোকুকা’ (অশোভন), ‘কেইসেইইয়া’ (রাজকীয়) প্রভৃতি গণিকালয়গুলি ব্যক্তিগতভাবে গড়ে উঠছিল। সেইসময়ে ‘ৎসুজিকো’ নামে এক প্রভাবশালী গণিকা একটি বিশাল গণিকালয় প্রতিষ্ঠা করেছিল।
আদিম সমাজে গণিকাবৃত্তি আয়ের উৎস হিসাবে যথেষ্ট আদৃত ছিল। ধর্মের দিক থেকে, সমাজের দিক থেকে, পিতা-মাতা ও স্বামীর পক্ষ থেকেও কক্ষনো ঘৃণা করা হত না। তা ছাড়া মেয়ের উপর পিতা বা স্বামীর একচ্ছত্র অধিকার ছিল বলে দুর্দিনে তাঁরা আর্থিক উন্নতির জন্য তাঁদের কর্তৃত্বাধীন মেয়েদের যৌনপেশায় উৎসাহ দিত। ঈশ্বরের পরেই স্বামীর স্থান, তাই স্বামীকে সাহায্য করা মানেই ধর্মীয় কাজ হিসাবে বিবেচিত হত। প্রাচীন যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে গণিকাবৃত্তির প্রচলন ছিল। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’-এও গণিকাদের কথা জানা যায়।
১৩. যাত্রা-থিয়েটার-চলচ্চিত্রে গণিকা
যাত্রা-থিয়েটার-চলচ্চিত্রের একেবারে গোড়ার দিকে ছিল নারী-বর্জিত। সে সময়ে নারীরা এসব ক্ষেত্রে আসত না। ফলে বহু বছর পুরুষ অভিনেতারা নারীসজ্জায় সজ্জিত হয়ে নারীচরিত্রে অভিনয় করত। সে সময়ে নারীর অভিনয় করাটাকে মানুষ সুনজরে দেখত না। ১৯২৭-২৮ সালের দিকে ঢাকার নবাব পরিবারের কয়েকজন তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেন। তাঁরা ‘সুকুমারী’ নামে চার রিলের একটি নির্বাক ছবি বানান। ছবিটি পরিচালনা করেন বিশিষ্ট নাট্যকর্মী ও জগন্নাথ কলেজের শরীরশিক্ষার প্রশিক্ষক অম্বুজ প্রসন্ন গুপ্ত। এই চলচ্চিত্রে নারী চরিত্র থাকলেও কোনো নারী অভিনয় করেনি। পুরুষরাই নারী চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সৈয়দ আবদুস সোবহান। ঢাকাই চলচ্চিত্রে নবাব পরিবারের অবদান থেমে থাকেনি। নবাব পরিবারের উদ্যোগে ঢাকার ইস্টবেঙ্গল সিনেমাটোগ্রাফ কোম্পানি গঠিত হয়। এর প্রযোজনায় অম্বুজ প্রসন্ন গুপ্ত নির্মাণ করে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের নির্বাক চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটির নাম ‘দ্য লাস্ট কিস’। তবে এই চলচ্চিত্রে নারীচরিত্রে নারীরাই অভিনয় করেছিল। নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন লোলিটা বা বুড়ি নামের জনৈকা বাইজি। চারুবালা, দেববালা বা দেবী নামের আরও দুজন বাইজিও এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিল। এঁদের তিনজনকেই আনা হয়েছিল গণিকালয় থেকে। চলচ্চিত্রই বলুন, কিংবা যাত্রা-থিয়েটার, সর্বত্রই নারী চরিত্রে প্রথম অভিনয় করতে আসেন বাইজি বা গণিকা মেয়েরা। এঁদের এসব ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের কারণে মানুষের মনমন্দিরে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেল চলচ্চিত্র-যাত্রা-থিয়েটারে যেসব মেয়েরা অভিনয় করে তাঁরা ‘বেশ্যা’। আজও আমাদের সমাজে অভিনেত্রীদের সুনজরে দেখা হয় না।
গবেষক-অধ্যাপক বিজিতকুমার দত্ত সরকারি দস্তাবেজ উদ্ধার করে লিখেছেন—“সরকারি মহাফেজখানা থেকে যে রিপোর্ট পেয়েছি তা কৌতূহলোদ্দীপক। দেখা যায় দশ বছরের নিচে বেশ্যাদের বাড়িতে বেশ কিছু মেয়ে রয়েছে। সরকার এদের কথা মাঝে মাঝে ভেবেছে। কিন্তু তাদের সংখ্যা এত ব্যাপক যে সরকারের পক্ষে কিছু করে ওঠা কঠিন।” সেই পর্যবেক্ষণ অনুসারে গণিকাপল্লিতে গণিকা-গর্ভজাত কন্যাসন্তানের সংখ্যা ছিল ৪০৮ জন। এইসব গণিকা-কন্যাদের পুনর্বাসন বা সমাজের মূলস্রোতে নিয়ে আসার ব্যাপারে তখনকার সরকার যেমন কিছু করার চেষ্টামাত্র করেনি। তেমনই সমাজ-সংস্কারকদেরও উদাসীনতা ছিল। গণিকাদের মুক্তির পথ দেখাল থিয়েটার। সেই গণিকা-কন্যাদের মুক্তির জন্য থিয়েটারে অংশগ্রহণের পথ খুলে দিয়েছিলেন মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। সৌভাগ্যবশত উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি থিয়েটার সম্পর্কে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। ভালোভাবে থিয়েটার পরিচালনার জন্য বেঙ্গল থিয়েটার একটি উপদেষ্টা সমিতি গঠন করেছিল। উপদেষ্টামণ্ডলীতে যেমন ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, তেমনি ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, উমেশচন্দ্র দত্তের মতো ব্যক্তিত্বরা। থিয়েটারে অভিনেত্রী নিয়োগ সংক্রান্ত জরুরি সভায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিরোধিতা করলেন। বিদ্যাসাগরের মতো ব্যক্তিত্বের বিরোধিতাকে অগ্রাহ্য করে উমেশচন্দ্র দত্ত ও মধুসূদন দত্তের সমর্থনে বেঙ্গল থিয়েটার কর্তৃপক্ষ গণিকালয় থেকে চারজন মেয়েকে অভিনেত্রীকে হিসাবে আনলেন। মধুসূদনের ‘শর্মিষ্ঠা নাটক দিয়ে বেঙ্গল থিয়েটার যাত্রা শুরু করে। মেয়েদের জন্য থিয়েটারের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ায় অন্ধকার জগতের মেয়েরা মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার একটা অবলম্বন পেলেন। এই পথ ধরেই। থিয়েটারে এসেছিলেন গোলাপসুন্দরী, বিনোদিনী, তারাসুন্দরী, এলোকেশী, জগত্তারিণী, শ্যামা, কুসুমকুমারী, নীহারবালা, কৃষ্ণভামিনী, প্রভাদেবীর মতো গণিকারাও। পরবর্তী সত্তর-আশি বছর বাংলা থিয়েটারকে আলোকিত করেছেন এঁরা, সমৃদ্ধ করেছেন অন্ধকার জগৎ থেকে আসা এই মহিলারাই, যাঁদের পোশাকি পরিচয় গণিকা।
থিয়েটারের দরজা উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ক্লেদাক্ত অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার সংগ্রাম শুরু করলেন পিতৃপরিচয়হীনা গণিকা-কন্যারা। সেকালের সংবাদপত্র ও সমাজপতিদের লাগাতার বিরোধিতা ও নিন্দাবাদ সত্ত্বেও সমাজ তাঁদের সঙ্গে ছিল না, একথা বলা যায় না। সেইসব সমাজপতিদের উদ্দেশ্যে নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের প্রশ্ন ছিল—“এইসব মেয়েদের তো আমি অন্তত রাস্তায় দাঁড়িয়ে খরিদ্দার পাকড়াবার চেষ্টা থেকে সরিয়ে, মঞ্চে তুলে দিয়ে রোজগারের একটা পথ দেখিয়েছি, কিন্তু তোমরা এদের জন্য কী করেছ?” একথা অনস্বীকার্য যে, গণিকা-কন্যাদের অনেকেই আমাদের বিনোদন শিল্প তো বটেই, সাহিত্যে ও এবং সামাজিক ইতিহাসেও অপরিমেয় কীর্তি রেখে গেছেন। তাঁদেরকে বাদ দিয়ে চলচ্চিত্র-যাত্রা-থিয়েটারের ইতিহাস লেখা কখনো সম্পূর্ণ হবে না। আমাদের সমাজ এই সব নারীদের প্রাপ্য মর্যাদা দেয়নি, দিতে চায়নি।
এরকমই এক গণিকা-কন্যা বিনোদিনী দাসী। ঘটনাচক্রে বিনোদিনী রঙ্গালয়ে এসে পড়েন। তিনি চৈতন্যলীলায় নিমাইয়ের ভূমিকায় অভিনয় করে সাড়া জাগিয়েছিলেন। পরে শ্রীরামকৃষ্ণের স্পর্শে তাঁর ‘চৈতন্য’ হয় বলে জনশ্রুতি আছে। বর্তমানের ‘স্টার’ থিয়েটারের নামের সঙ্গে বিনোদিনীর নামও বিজড়িত হয়ে আছে। যদিও থিয়েটারের নাম বিনোদিনী দাসীর নামে ‘বিনোদিনী’ হওয়ার প্রস্তাব উঠেছিল, কিন্তু একটা গণিকার নামে থিয়েটারের নাম হবে! বিনোদিনীই এই থিয়েটারের নামকরণ করল ‘স্টার’। বিনোদিনী বোঝাতে সক্ষম হল–“আপনার ভাববেন স্টার মানে আমি, আর দর্শকরা ভাববে স্টার মানে আমরা সবাই।” বিনোদিনী তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার কথা’ গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন। বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা আত্মজীবনী লেখিকার মর্যাদা বিনোদিনী কিন্তু পায়নি। গণিকা বলে থিয়েটারের নাম ‘বিনোদিনী’ রাখা যেমন সম্ভব হয়নি, তেমনি তাকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা আত্মজীবনী লেখিকার মর্যাদাও দেওয়া যায়নি। বিনোদিনীর এক শিশুকন্যার জন্ম হয়। এক সম্ভ্রান্ত পুরুষ সেই শিশুকন্যা সহ বিনোদিনীকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছিল। কিন্তু গণিকা কন্যা বলে বিনোদিনী তাঁর কন্যা শকুন্তলাকে কোনো বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে পারেননি। মাত্র ১৩ বছর বয়সে শকুন্তলা মারা যায়। সমাজের লাঞ্ছনা-গঞ্জনা নিয়ে তাঁকে আর বেঁচে থাকতে হয়নি।
রঙ্গালয়ের আর-এক গণিকা অভিনেত্রী হলেন গোলাপসুন্দরী। বেঙ্গল থিয়েটারের নাট্যপরিচালক উপেন্দ্রনাথ দাসের ‘শরৎ-সরোজিনী’ নাটকে গোলাপসুন্দরী সুকুমারী চরিত্রে এমন প্রাণবন্ত অভিনয় করেছিলেন যে, তিনি গোলাপসুন্দরী থেকে সুকুমারী’ নামেই পরিচিত হয়ে গেলেন। ডিরেক্টর উপেন্দ্রনাথ দাস গোলাপের বিয়ে দিয়েছিলেন থিয়েটারেরই এক সুদর্শন অভিনেতা গোষ্ঠবিহারী দত্তের সঙ্গে। তাঁরা এক ভদ্রপল্লিতে বসবাস করতেন। তবে এক কন্যার জন্মের পর গোলাপসুন্দরী স্বামী পরিত্যক্তা হন।
চলচ্চিত্র-যাত্রা-থিয়েটারে গণিকাদের প্রথম পদচারণা শুধু ভারতেই নয়, সারা পৃথিবীতেই ছিল। এক্ষেত্রে একটা কথা বলা দরকার—গণিকারা যেমন অভিনেত্রী হয়েছেন, তেমনি অভিনেত্রী থেকে গণিকা হয়েছেন এমন উদাহরণও কম নয়। নাম মার্গারেট আলিবার্ত। প্যারিসের মার্গারেট আলিবার্তকে লোকে যাঁকে চেনে ম্যাগি মেলার’ হিসাবে। কিশোরী অবস্থায় সে সন্তানসম্ভবা। সেই সন্তানের পিতা কে সেই প্রশ্নের উত্তরও সে জানে না। এক দুর্ঘটনায় পুত্র-সন্তানের মৃত্যুর দায়ে তাঁর বাবা-মা ম্যাগিকে ত্যাগ করে। বাবা-মায়ের কাছ থেকে বিতারণের পর কিছু সন্ন্যাসিনীর আশ্রয়েই জীবন কাটছিল ম্যাগির। কুমারী ম্যাগী এক কন্যা-সন্তান প্রসব করল। এবার সন্ন্যাসিনীরাও তাঁকে ত্যাগ করল। মেয়েকে অন্যত্র রেখে মাত্র ষোলোবর্ষীয় সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত ম্যাগি প্যারিসের পথে পথে ঘুরতে থাকল। অবশেষে জীবিকার জন্য সে নিজের শরীরকেই পণ্য হিসাবেই উপস্থাপন করে নেয়। কিন্তু এত রূপ নিয়ে কি পথগণিকা হিসাবে মানায়? শিয়াল-কুকুরে ছিঁড়ে খাবে যে! সে নজরে পড়ে গেল ম্যাদাম ডেনার্টের।এই ডেনার্টের কাছেই সে সেরার সেরা গণিকা হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। পেতে শুরু করে সেরার সেরা শাঁসালো ক্লায়েন্ট। এই কায়েন্টরা শুধু প্যারসেই নয়, সুদূর আমেরিকা, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল।
শরীর যখন পণ্য, তখন শরীরটাকে ক্লায়েন্টদের পছন্দমতো করে গড়ে তুলতে হবে, এ আর নতুন কথা কী! তাই শরীরচর্চারও প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ম্যাগিকে একটা সুন্দর শরীরের মালকিন করে তুলল ম্যাদাম ডেনার্ট। ডেনার্টের দেহব্যাবসা ক্রমশ ম্যাগি তুরুপের তাস হয়ে উঠল। ইউরোপের শরীর-বাজারে ম্যাগি এতটাই জনপ্রিয় উঠেছিল যে, সেই মহাদেশের আনাচে-কানাচে কান পাতলেই ম্যাগির নাম শোনা যায়। ম্যাগির শরীরী-সান্নিধ্য এতটাই সুখকর ও তৃপ্তিদায়ক ছিল যে, তাঁর রূপ-লাবণ্য ছড়িয়ে পড়া রাত অতি তাড়াতাড়ি ভোর হয়ে যেত।
চল্লিশবর্ষীয় অ্যান্ড্রু নামে এক বিবাহিত যুবক সপ্তদশী ম্যাগিকে বিয়ে করে। ম্যাগিও মন দিয়ে ঘর-সংসার করতে থাকল। কিন্তু সুখ সবার সয় না! কয়েক বছরেই মধুচন্দ্রিমার সমাপ্তি ঘটে গেল। ম্যাগিকে ফেলে অ্যান্ড্রু পুনরায় নিজের পুরোনো সংসারে ফিরে গেল। ম্যাগিও আবার আগের জীবনে ফিরে গেল। পুনরায় যৌবনকে ব্যবহার করে উদ্দাম যৌনতার পসার সজিয়ে বসল। আবারও ম্যাগির কাছ থেকে যৌনসুখ কিনতে তৎকালীন ইউরোপের তাবড় তাবড় ব্যক্তিরা ভিড় জমাতে লাগল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ফ্রান্স ভরে গেছে ব্রিটিশ-সেনায়। সেই সেনার অন্যতম কর্তা প্রিন্স অফ ওয়ালেস অষ্টম প্রিন্স এডওয়ার্ড। যৌনসুখের তাগিদে তাঁর এক বন্ধুর সাহায্য নিয়ে একজন রক্ষিতা তথা গণিকাকে ভাড়া করল।কিন্তু সেই মহিলার যথার্থ যৌনজ্ঞান না-থাকায় এডওয়ার্ডকে তৃপ্ত করতে সক্ষম হয়নি। অতএব নতুন খাবারের সন্ধান দিল সেই বন্ধুই। বন্ধুই ম্যাগির সঙ্গে এডওয়ার্ডের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়।শরীরী সঙ্গ দিতে দিতে ম্যাগির সঙ্গে এডওয়ার্ডের প্রেম হয়ে যায়। কিন্তু সেই প্রেম টেকে মাত্র এক বছর।
ম্যাগি এতদিনে বিলক্ষণ বুঝে গেছে উপঢৌকন আর প্রচুর অর্থের আগমন তাঁর শরীরকে কেন্দ্র করেই। আর এই ভাবনা থেকেই ম্যাগির অর্থ-লালসা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। আরও অর্থ চাই, আরও, আরও অর্থ। এবার ম্যাগির জীবনে বসন্ত নিয়ে আসে চার্লস লরেন্ট নামের এক যুবক। বিয়ে করল এবং ছয় মাসের সংসারও হল। ডিভোর্স হয়ে গেল। আর ডিভোর্সের সেটেলমেন্টে লরেন্টের কাছ পেয়ে গেল প্রচুর অর্থ, বাড়ি, গাড়ি, ঘড়াশাল, চাকর-বাকর ইত্যাদি। গণিকা ম্যাগির আবার বিবাহযোগ। এবার একেবারে প্রাচ্যের এক রাজপরিবারের সঙ্গে সংসার পাতার সৌভাগ্যের দরজা খুলে গেল। স্বামী মিশরের রাজপুত্র আলি কামেল ফাহমি বে। এ বিয়ের মূল উদ্দেশ্য রাজপুত্রের অর্থ-প্রতিপত্তি। নাঃ, এ বিয়েও টিকল না। ফাহমির সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেল। ম্যাগি রীতিমতো ছক কষে লন্ডনের এক হোটেলে খুন করল ফাহমিকে। স্বামীকে খুন করে ম্যাগি গ্রেফতার হয়। কিন্তু আদালতে প্রমাণ হল তাঁর উপর স্বামীর উপর্যুপরি অত্যাচারের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার তাগিদেই ম্যাগি খুন করতে বাধ্য হয়েছিল। আদালত ম্যাগিকে মুক্তি দেয়। মুক্তি পেয়ে ম্যাগি প্যারিসে ফিরে আসে। ফিরে এসে ম্যাগি প্যারিস চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে শুরু করেন। বেশ কয়েক বছর সে অভিনয় করেছিল। তবে অভিনেত্রী হওয়ার পরও সে গণিকাবৃত্তি চালিয়ে গেছে মোটা অঙ্কের অর্থলোভে। তবে সে আর বিয়ে করেনি। যৌবন-শেষে বার্ধক্য কাটিয়েছে অন্তরালেই। শেষপর্যন্ত কেউ তাঁর কোনো খোঁজ পায়নি।
গণিকাবৃত্তি করতে করতে অভিনয় পেশা আসা মেয়েদের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়। সেকাল থেকে একাল সর্বত্র ছড়িয়ে আছে এঁরা। সম্প্রতি ভারতীয় চলচ্চিত্রে অংশগ্রহণ করেছে পর্ন-গণিকা ভারত বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান সানি লিওনি। টিনা নন্দী, জোয়া রাঠোর, কাজল গুপ্তা, সোনিয়া মহেশ্বরী, আলিশা, কবিতা রাধেশ্যামের মতো গণিকারা তো এখন ওয়েব সিরিজের নামে ক্যামেরার সামনেই গণিকাবৃত্তি করছেন। বাজারও রমরমা। এ তো গেল গণিকা থেকে অভিনেত্রী হওয়ার কথা। অভিনেত্রী থেকে গণিকাবৃত্তিতে আসার ঘটনাও কিছু কম নয়।
কাবুকি, জাপানের একটি বিশেষ নাট্যধারা। সাধারণের রঙ্গালয় হিসাবে এই নাট্যধারার সময়কাল সপ্তদশ শতাব্দী। এই নাট্যধারার স্রষ্টা একজন মহিলা হলেও মহিলা ও তরুণদের জন্য অভিনয় নিষিদ্ধ করেছিলেন। ১৬০৩ সালে ইজুমো নো ওকুমি শুখনো নদীখাতে বিশেষ এক জাতীয় নৃত্যনাট্যের সূচনা করেন। শুরু হল মহিলা কাবুকির যুগ। এই মহিলা কাবুকিদের বলা হত ‘অন্না-কাবুকি’। এই কাবুকি নাট্যধারা যতই জনপ্রিয়তার শিখরে উঠতে থাকল, ততই বিনোদনের পথে পা বাড়িয়ে দিল অধিক অর্থলোভে। কম পরিশ্রমে অধিক রোজগারের হাতছানিতে যৌনপেশায় যুক্ত হতে থাকল অভিনেত্রীরা। কাবুকি নাট্যধারা ক্রমশ গণিকাদের নৃত্যসংগীত হিসাবে পরিচিতি হয়ে গেল। জাপানের সামাজিক সংস্কৃতির সঙ্গে এই পরিবর্তিত কাবুকি সংস্কৃতি মিশে গিয়ে সামাজিক অবক্ষয়ের সূচনা হতেই জাপানের তৎকালীন শোগুন শাসন ‘অন্না-কাবুকি নিষিদ্ধ করে দেয়। সালটা ছিল ১৬২৯। তবে ‘অন্না-কাবুকি’-কে অনুসরণ করে একদল উৎসাহী তরুণ ‘ওয়াকাসু-কাবুকি’ নাট্যধারা শুরু করে। কিন্তু এর অভিনেত্রীরাও যৌনকর্মে যুক্ত হলে শোগুন শাসক ‘ওয়াকাসু-কাবুকি’ও নিষিদ্ধ করে দেয়।
সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে কাবুকি নাট্যধারা প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের হাতে গিয়ে পড়ে। পুরুষ-পরিচালিত এই কাবুকির ডাকনাম ‘ইয়াররা-কাবুকি’। ইয়ারো-কাবুকিদের মধ্যে যাঁরা মহিলা চরিত্রে যেসব পুরুষ অভিনয় করত, তাঁদের বলা হত ‘অন্নাগাতা’। নারী-বর্জিত এই নাট্যধারা বেশ কিছুদিন বেশ চলছিল। সমস্যাও শুরু হয়ে গেল কিছু সময় পর। “অন্নাগাতা’ অভিনেতারা (অভিনেত্রীই বলা উচিত) দীর্ঘদিন ধরে নারীচরিত্রে অভিনয় করতে করতে নিজেদের মধ্যে নারীসুলভ আচরণ লালন করত। এই নারীসুলভ পুরুষরাও যৌনপেশায় যুক্ত হয়ে পড়ে। এঁদের ক্লায়েন্ট নারী-পুরুষ উভয়ই। যথারীতি ইয়ারো-কাবুকি’-ও নিষিদ্ধ হল। পরে অবশ্য (১৬৫২ সালে) এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
জাপান ছেড়ে চলে আসুন ভারতে। ভারতেরও বেশকিছু অভিনেত্রী চলচ্চিত্র ও ধারাবাহিকে অভিনয় করার পাশাপাশি অধিক অর্থ-লালসায় যৌনপেশাও চালিয়ে যায়। গ্ল্যামার দুনিয়ার কত স্বনামধন্য মেয়েরা এসকর্ট গার্ল হিসাবে কাজ করে তার হিসাবে রাখা হয় না বোধহয়। কী টলিউড, কী বলিউড, কী কলিউড, কী হলিউড, কী মলিউড, কী ঢলিউড–সর্বত্র একই চিত্র। ধরা পড়ে গেলে জানতে পারি, না ধরা পড়লে বিন্দাস চলে যৌনকর্ম। প্রবচন হয়েছে–‘ধরা পড়লে ধনঞ্জয়, না পড়লে এনজয়’। কিছুদিন আগেই তো টলিউডের এক প্রথম সারির বিবাহিতা অভিনেত্রীর বিরুদ্ধে এক চিটফান্ড কোম্পানির কর্ণধারের কয়েক কোটি টাকার বিনিময়ে নিয়মিত শয্যাসঙ্গিনী হতেন। সেই সংবাদ ফলাও করে সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। নিশ্চয় সেই সংবাদ সবাই পড়েছে। এরা কেউ গরিব নন, আর্থিক অনটনে দিন গুজরান করে না। রাতারাতি আরও ধনী হওয়ার লোভ ও যথেচ্ছ যৌনতার হাতছানিতে অত্যন্ত গোপনে এঁরা গণিকাবৃত্তি অব্যাহত রাখে। মুম্বাইয়ের নামজাদা এক চলচ্চিত্র অভিনেত্রীর লিজ দেওয়া ফ্ল্যাটে যৌনকর্ম চলত। সংশ্লিষ্ট অভিনেত্রীই যৌনকর্ম পরিচালনা করত কি না, সেটা অবশ্য ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বছর কয়েক আগে হায়দরাবাদের বানজারা হিলসের একটি বিলাসবহুল হোটেলে গণিকাবৃত্তি করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গেল বলিউডের অভিনেত্রী শ্বেতা প্রসাদ বসু। যে রাতে সে ধরা পড়েছিল সেই রাতের তাঁর রেট ছিল পাঁচ লাখ টাকা। অগ্রিম হিসাবে এক লাখ টাকাও নিয়েছিল। সেলিব্রেটি হওয়ার সুবাদেই তাঁদের শরীর-মূল্যও অনেক চড়া হয়। ধনকুবেররাও শয্যাসঙ্গিনী হিসাবে সেলিব্রটিদেরই চায়। তাই সেলিব্রেটি অভিনেত্রীদের বাজার ও বাজার-দর আকাশছোঁয়া। গণিকাবৃত্তির সঙ্গে ঐশ আনসারি, ভুবনেশ্বরী, শ্রাবণী, যমুনা, দিব্যাশ্রী প্রমুখ অভিনেত্রীদের নামও উঠে এসেছে সংবাদ শিরোনামে। ২০০৯ সালে গণিকাবৃত্তির অপরাধে অভিনেত্রী ভুবনেশ্বরী গ্রেফতার হয়েছিল। ভুবনেশ্বরী নিজে গণিকাবৃত্তি করতেন, তা নয়। তিনি গ্ল্যামার জগতের তারকাদের নিজের ফ্ল্যাটে এনে যৌনকর্ম করাতেন বলে অভিযোগ ছিল। শোনা যায়, তিনি নীল ছবির অভিনেত্রীও ছিলেন। ২০১৩ সালে যোধপুরের এক হোটেলে যৌনকর্ম করতে গিয়ে অত্যন্ত আপত্তিকর অবস্থায় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে অভিনেত্রী ঐশী আনসারি। এ বছরেই আর এক তামিল অভিনেত্রী সায়রাবানু গ্রেফতার হন গণিকাবৃত্তির অভিযোগে। দক্ষিণী ছবির আরও দুজন অভিনেত্রী শ্রাবণী ও যমুনাকে মধুচক্র চালানোর অভিযোগে গ্রেফতার হয়। শ্রাবণীর ক্লায়েন্টদের মধ্যে বেশিরভাগই অন্ধ্রপ্রদেশের মন্ত্রী। সম্প্রতি মধুচক্রের খবর পেয়ে মুম্বাই পুলিশ হানা দেয় আন্ধেরি এক থ্রি-স্টার হোটেলে হানা দেয়। সেই মধুচক্রের ডেরা থেকে পুলিশের হাতে ধরা পড়ল বলিউডের অভিনেত্রী প্রিয়া শর্মা। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২৯ বর্ষীয়া এই অভিনেত্রীই ছিল এই মধুচক্রের মূল কাণ্ডারী। প্রিয়া শর্মা দূরদর্শনের জনপ্রিয় একটি ক্রাইম শোতে ইতোমধ্যেই অভিনয় করেছে। প্রিয়া শর্মা ছাড়াও মারাঠি সিরিয়াল ও চলচ্চিত্রের অভিনয় করা আর-এক অভিনেত্রী পুলিশের কাছে ধরা পড়ে। আর-এক নাবালিকা অভিনেত্রীকেও পাওয়া গিয়েছিল এখান থেকে। সে একটি ওয়েবসিরিজে অভিনয় করেছে।
এই অধ্যায় শেষ করব একটি অন্য ধরনের ঘটনার বিবরণ দিয়ে। তাঁর কথা, যে অভিনেত্রী হয়ে গণিকা নয় বা গণিকা থেকে অভিনেত্রী হওয়ার ঘটনা নয়। সে অভিনেত্রী হতে এসে গণিকা হয়ে গেছে। আসলে অভিনেত্রী হওয়া তাঁর হয়ে ওঠেনি। তাঁর নাম গাঙ্গুবাই কাঠিয়াবাই। মুম্বাইয়ের কামাথিপুরার একজন গণিকা। ভারতের গণিকা নারীদের অধিকার রক্ষা আন্দোলনের নেত্রী, যিনি গণিকালয় রক্ষা করতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সঙ্গেও দেখা করেছেন। গাঙ্গুবাই কাঠিয়াবাই মুম্বাইয়ের চলচ্চিত্র জগতের অভিনেত্রী স্বপ্ন দেখতেন। তখন তাঁর নাম ছিল হরজীবনদাস কাঠিয়াবাদি। গুজরাটের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে ছিলেন তিনি। সেই চল্লিশের দশকেও সমাজের কাছে একটা নিদর্শন হয়েছিল তাঁর পরিবার। সেই সময়েও সেই পরিবারের মেয়েরা সিনেমা দেখতেন। হিন্দি সিনেমা দেখেই শুরু হয় গঙ্গার স্বপ্নের জাল বোনা। মুম্বাই আসতে চায়। মুম্বাই তাঁর স্বপ্নের শহর। চোখে শুধু অভিনেত্রী হওয়ার স্বপ্ন। এমন সময়ে তাঁদের ফার্মে অ্যাকাউন্ট্যান্ট রামলাল নায়েক নামে এক যুবক নিযুক্ত হন। গঙ্গা জানতে পারল এই যুবক কিছুদিন মুম্বাইতে কাজ করেছে। শুরু হল তাঁর কাছে সেই স্বপ্নের শহরের গল্প শোনা। গল্প শুনতে শুনতে তাঁর প্রেমে পড়ে যাওয়া। অতঃপর দুজনে বিয়ে-থা করে মুম্বাই চলে আসে। কিন্তু মুম্বাই এসে গঙ্গার স্বপ্ন ভেঙে ছত্রখান হয়ে গেল। মুম্বাই এসে স্বামী রামলাল মাত্র ৫০০ টাকার বিনিময়ে কামাথিপুরার গণিকালয়ে গঙ্গাকে বিক্রি করে দেয়। গঙ্গাকে ৫০০ টাকায় কিনে নিল গণিকালয়ের সর্দারনি শীলা মাসি। গঙ্গা বহুবার সেখান থেকে পালানোর চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু সফল হয়নি। গঙ্গার নাম বদলে গেল, হল গাঙ্গুবাই। ক্রমে ক্রমে শিক্ষিত ও ব্যক্তিত্বপূর্ণ গঙ্গা ‘গাবাই’ গণিকালয়ের সর্বেসর্বা হয়ে উঠল।
ইতোমধ্যে কামাথিপুরা গণিকালয় পাঠান-মাফিয়াদের আস্তানা হয়ে ওঠে। গাঙ্গুবাই মাফিয়া সর্দারের হাতে রাখি পরিয়ে ভাই পাতিয়ে নেয়। এর ফলে গাঙ্গুবাইয়ের ক্ষমতা বৃদ্ধি হয়। কামাথিপুরার গণিকালয়ে গাঙ্গুবাইরাজ প্রতিষ্ঠা হল। বদলাতে থাকল কামাথিপুরা গণিকালয়ের অন্দরমহলের নিয়মকানুন। যেমন–(১) কোনো মেয়েকেই আর জোর করে গণিকালয়ে নিয়ে আসা যেত না। (২) কেউ যদি গোপনে কোনো মেয়েকে গণিকালয়ে বিক্রি করে দিয়ে যায়, যদি সেই মেয়েটি গণিকাবৃত্তি গ্রহণ করতে না চাইত, তাহলে সেই মেয়েকে গাঙ্গুবাই নিজ দায়িত্বে বাড়ি পৌঁছে দিত।
ভারত ব্রিটিশ মুক্ত হওয়ার পর ব্রিটিশদের মদতে পুষ্ট হয়ে যেসব গণিকালয় গড়ে উঠেছিল, সেগুলি বন্ধ করে দেওয়ার দাবি উঠল। সে সময় গাঙ্গুবাই কামাথিপুরা গণিকালয়ের প্রেসিডেন্ট। গাজুবাই হাজার হাজার গণিকাদের সঙ্গে নিয়ে রাজপথে নামল। গণিকালয় বাঁচাতে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহর নেহরুর সঙ্গে দেখা করে প্রসিডেন্ট গাঙ্গুবাই। গাঙ্গুবাইয়ের দাবি মেনে নিলেন নেহরু।
কামাথিপুরার গণিকালয়েই গাঙ্গুরামের মৃত্যু হয়। গাঙ্গুবাঈকে আর কেউ মনে রাখেনি। গাঙ্গবাইয়ের সংগ্রামী ইতিহাস চাপা পড়ে যায়। না, কেউ মনে রাখেনি একথা বললে নির্জলা মিথ্যা বলা হবে। গাঙ্গু সিনেমার অভিনেত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখলেও, অভিনেত্রী হতে না-পারলেও তাঁর জীবন যে সিনেমার মতই বর্ণময় ঘটনাবহুল! তাই হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস জেগে উঠল। গাঙ্গুর জীবন নিয়ে মুম্বাইতে তৈরি হল ‘গাঙ্গুবাই কাঠিয়াবাদি’ নামে সিনেমা। শুধু গাঙ্গুবাই নয়, গ্ল্যামারের টানে অভিনেত্রীর স্বপ্ন দেখতে এসে অসংখ্য মেয়েকে শেষপর্যন্ত গণিকা হয়ে যেতে হয়েছে। অভিনেত্রীর হওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে, এই টোপ খেয়ে ইন্ডাস্ট্রির বিভিন্ন মানুষদের সঙ্গে বিছানা শেয়ার করতে করতেই একসময় অনেক মেয়েকেই গণিকাবৃত্তির পথ বেছে নিতে হয়। নায়িকা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে গণিকা হতে হয় তাঁদেরই, যাঁদের অভিনয় দক্ষতা নেই। তাঁদের ইতিহাস হয়তো কোনোদিনও লেখা হবে না, তাঁদের জীবন-যন্ত্রণা সেলুলয়েড বন্দিও হবে না।
সিরিয়াল, সিনেমার অভিনেত্রী মানেই কি সে চরিত্রহীনা, গণিকা, পতিতা, বেশ্যা? এদেশের অভিনয় শিল্পে নায়িকাদের সম্পর্কে এক শ্রেণির মানুষ এমন চিন্তাভাবনাই পোষণ করে। অনেকে প্রকাশ্যেই সেই মনোভাব ব্যক্ত করে। সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, ইন্ডাস্ট্রির ভিতরের মানুষরাও এমন ধারণা ব্যক্ত করে।এই তো বছর কয়েক আগে টলিউডের প্রথম সারির অভিনেত্রী কোয়েল মল্লিক দড়াম্ করে এক বোমা ফাটিয়ে দিলেন। তিনি বললেন–“অভিনয়ের জন্য নগ্নতাকে সামনে আনতে কোনো অসুবিধা নেই। প্রতিদিনই আমাদের নগ্ন হতে হয়।” ইঙ্গিতপূর্ণ এহেন বিবৃতিতে টলিউড তোলপাড় হয়ে ওঠে। ভারতীয় অভিনেত্রী ঊষা যাদব বিবিসি কে এক সাক্ষাৎকারে বিস্ফোরক বিবৃতি দিলেন, বললেন–“সে ব্যক্তি যেখানেই চেয়েছে আমার শরীরে সেখানেই হাত দিয়েছে। সে যেখানেই চেয়েছে আমার শরীরের সেখানেই চুমু খেয়েছে। সে আমার জামার ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিয়েছিল। আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। আমি তাকে থামিয়ে দিয়েছিলাম। তখন সে বলল, তোমার মনোভাব যদি এরকম হয়, তাহলে তুমি এখানকার জন্য উপযুক্ত নও।” এহেন বিবৃতি অভিনেত্রীদের সামগ্রিক অবস্থা বিচার করতে খুব বেশি চিন্তা করার প্রয়োজন পড়ে না। উল্টোদিক থেকে যেসব অভিনেত্রী ‘এরকম’ না করে এখানকার মতো করে টিকে গেছে বা টিকে আছে, তাঁরা কি অভিনয়ের বিনিময়ে শরীর বিক্রি করে ফেলেছে? প্রশ্ন উঠছে। ঊষা যাদব এও বলেছেন, সিনেমার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তি তাকে সরাসরি যৌন সম্পর্কের প্রস্তাব দিয়েছিল। বলেছিল–“তুমি যদি এই রোল বা ভূমিকা পেতে চাও, তাহলে আমার সঙ্গে শুতে হবে। তাহলে কি এটা দাঁড়াল না যে, অভিনেত্রীদের সিনেমায় রোল পেতে হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে যৌনক্রিয়া করতে হয়? অর্থাৎ যতগুলো সিনেমায় রোল পেতে চাইবে ততগুলো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে যৌনক্রিয়া করতে হবে? এই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি’-রা কারা? সে কখনো নামজাদা নায়ক হতে পারে, আবার পরিচালক বা প্রযোজকও হতে পারে। নিট রেজাল্ট, অভিনেত্রী হওয়ার আগে তাঁকে গণিকা হতেই হবে। একথা সব অভিনেত্রীই স্বীকার করার সাহস পায় না। কারণ, ঊষা যাদবের ভাষায়–“অনেকেই ভয় পায়। কারণ এখানে কিছু ব্যক্তি এত ক্ষমতাধর যে তাঁদের সৃষ্টিকর্তার মতো মনে করা হয়।” এঁদের বিরুদ্ধে কেউই মুখ খোলেন না, তা ঠিক নয়। তবে কতিপয় যে কজন মুখ খুলেছে, তাঁদের প্রত্যেরই সিনেমা কেরিয়ার এক লহমায় খতম হয়ে গেছে।
কিছুদিন আগে ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত করে কাস্টিং কাউচের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেছিলেন তেলগু অভিনেত্রী শ্রী রেডি। একের পর এক নিজেদের সঙ্গে যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে এই তেলগু অভিনেত্রী। আর এক তেলগু অভিনেত্রী সন্ধ্যা নাইডু। তিনিও জানালেন–“বয়সের কারণে এখন তাঁর কাছে মা বা মাসির চরিত্রে অভিনয়েরই সিংহভাগ অফার আসে। সকালে শু্যটিংয়ের সময় তাঁকে বলা হয় ‘আম্মা’, আর রাত হলে বলা হয় “শুতে’। সন্ধ্যা নাইডু আরও বলেন–“একদিন একজন জিজ্ঞাসা করল, তিনি ভেতরে কী পরে আছেন? তা স্বচ্ছ কি না।” আমি নিশ্চিত, এই শ্ৰী রেড্ডি, সন্ধ্যা নাইডুরা ইন্ডাস্ট্রিতে থাকতে পারবে না। অভিনয় পেশা থেকে সরে আসতেই হবে। কেউ কাজ দেবে না। যেমনভাবে পপ সংগীতশিল্পী আলিশা চিনাই, তনুশ্রী দত্তদের ইন্ডাস্ট্রি থেকে সরে যেতে হয়েছে। অভিনেত্রী সুনীতা রেডিড নামে আর-এক অভিনেত্রীর কথায়–“জোর করে সকলের সামনে পোশাক পালটাতে বাধ্য করা হয় তাঁদের। অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে সকলের সামনে পোশাক পালটাতেই হয়। এমনকী ন্যাপকিন পালটানো, মলমূত্র ত্যাগের মতো প্রাকৃতিক কাজও মেটাতে হয় পাঁচজনের সামনেই।” মারাঠি সিনেমার অভিনেত্রী শ্রুতি মারাঠে ছবির প্রযোজককে মোক্ষম জবাব দিয়ে তাঁকে স্তম্ভিত ও হতচকিত করে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল। কেন? ‘হিউম্যানস অফ বম্বে’-এর একটি পোস্টে শ্রুতি মারাঠে তাঁর বক্তব্য শেয়ার করলেন। শ্রুতি লিখলেন–“আমাকে আমার রোলটি নিয়ে আলোচনা করার জন্য প্রযোজক ডেকে পাঠান। প্রথমে পেশাদার ভঙ্গিতেই কাজের কথা আলোচনা করছিলেন। একটু পরেই সুর বদলে যায়। তাঁর সঙ্গে আমাকে রাত কাটানোর অফার দেন।” প্রযোজকের প্রস্তাবের জবাবে শ্রুতি তাঁকে বলেন–“নায়িকার রোল পেতে হলে আমাকে আপনার সঙ্গে শুতে হবে? নায়ককে কার সঙ্গে শুতে বলেছেন?” এরপরেও যেসব অভিনেত্রীরা বলেন ‘অভিনয়ের জন্য, চিত্রনাট্যের চাহিদা মেটাতে আমরা পর্দায় নগ্ন হতে পারি, তাঁদের কিছু বলার নেই।
সিনেমা, টিভির অভিনেত্রীরা নিজেরা যে এসব যৌনবৃত্তির পুরোধা অথবা তাঁদের অনুসরণ করেই শেষপর্যন্ত বিস্তার ঘটে, সিনেমা শিল্পের গোড়া থেকেই মধ্যবিত্ত এমনকি উচ্চ মধ্যবিত্তেরা মন্তব্য করে এসেছিলেন। সাধারণ মানুষের মনে সর্বদাই সিনেমার অভিনেত্রী মানেই আসলে একজন গণিকা এবং সে কথা সংবাদপত্র পত্রপত্রিকায় ব্যক্ত হচ্ছে। মিডিয়াগুলো বলছে–গ্ল্যামার দুনিয়ার মেয়েরা অভিনেত্রী সাইনবোর্ড কাজে লাগিয়ে অধিক অর্থ কামানোর লালসায় অনৈতিক ব্যাবসায় জড়িয়ে পড়ছে। কারণ শরীরলোভী পুরুষরা সিনেমা অভিনেত্রী, মডেল তারকা, টিভি অভিনেত্রীদের বেশি পছন্দ করে। তার জন্য তাঁরা যথেষ্ট মূল্য দিতেও এক পায়ে রাজি থাকে। হাই-ফাই জীবনের স্বপ্ন দেখতে গিয়ে অনেকক্ষেত্রেই সবকিছু ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়। তাঁদের কোনো ভদ্র যুবক বিয়ে করে না। যদিও-বা কোনো ক্লায়েন্ট রূপের মোহে মুগ্ধ হয়ে বিয়ে করে দু-এক বছর সংসার করে চম্পট দেয়। তখন এদের শরীর ছাড়া আর কোনো পুঁজিই থাকে না।
এক সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের সিনেমানগরী ঢাকার অনেক অভিনেত্রী আছে, যাঁরা পুরোপুরি গণিকাবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত। এদের অনেকেই যৌবন হারিয়ে মাসির ভূমিকায় ব্যাবসা চালায়। সিনেমা জগতের গডফাদার থেকে শুরু করে বড়ো ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সরকারি আমলারা এঁদের ক্লায়েট। এইসব ক্লায়েন্টের মধ্যে অনেকে আবার ভাড়া করা কলগার্ল, নিজের বান্ধবী নিয়ে ওইসব গণিকালয়ে ফুর্তি করতে যায়। অনেক অভিনেত্রী আবার তাঁদের ক্লায়েন্টদের নিয়ে সেক্স ট্রিপে যায় এইসব গণিকালয়ে। বর্তমানে যেসব অভিনেত্রী নিজে এবং কয়েকজন মেয়ে নিয়ে দেহব্যাবসা চালাচ্ছে, তাঁদের মধ্যে অন্যতমা একা। পুরোনো ঢাকার বাসিন্দা একা চলচ্চিত্রের অভিনেত্রী হয়ে যতটুকু নামডাক অর্জন করেছিল, তার চেয়ে বেশি দুর্নাম কুড়িয়েছিল এই যৌনপেশায় এসে। অভিনেত্রীর খাতায় নাম লেখানোর পরপরই অভিনেত্রী একা দেহব্যাবসায় এসেছিলেন। শরীর বিক্রি করে প্রচুর অর্থ কামানোই ছিল তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য। একসময় যৌনবাজারে নিজের চাহিদা কমে যাওয়ায় বাড়িতে কয়েকজন মেয়েকে বোন পরিচয়ে রেখে যৌনব্যাবসা চালাতে লাগল। বর্তমানে ইস্কাটন এলাকায় একা সেক্স সেন্টার চালায়। দেহব্যাবসাকে পেশা হিসাবে নিয়েছিল ঢাকার আর-এক বিতর্কিত অভিনেত্রী কেয়া। শুধু কেয়া একা নয়, তাঁর অপর ছয় বোন বীথি, সাথী, লাকি, তানিয়া, যুঁথি আর ইতিকে নিয়ে এক জমজমাট যৌথ যৌনব্যাবসা চালায় তাঁর গর্ভধারিণী মা সুফিয়া বেগম। যশোরের বহুল আলোচিত মক্ষীরানি সুফিয়া বেগম গুলশান অঞ্চলের ‘শেলফোর্ড নামের বাড়িতে যৌনব্যাবসা পরিচালনা করে, যে বাড়িটির মাসিক ভাড়া বাংলাদেশী মুদ্রায় ৫৫,০০০ টাকা। বাংলাদেশের অভিনেত্রী সাদিয়া আফরিনকেও গণিকাবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়েছে। একটি বাংলাদেশী এসকর্ট সার্ভিস প্রোভাইডার সাইটে ছবি সহ প্রোফাইল দেখা গেছে ‘নিনা’ ছদ্মনামে। অভিনেত্রী সাদিয়া আফরিন বিনোদন বিচিত্রা সেরা ফোটোসুন্দরী প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ২০১১ সালে মিডিয়ায় পা রাখে। মডেলিংয়ের পাশাপাশি বেশ কিছু সিনেমান আইটেম গানে কাজ করেন। এছাড়া বেশ কিছু সিরিয়াল ও টেলিফ্লিমেও কাজ করেছেন। এই হল অবস্থা! সেই কারণেই বোধহয় জনপ্রিয় মালয়ালাম অভিনেতা-সাংসদ ইনোসেন্ট ভারিদ থেক্কেথালা অবলীলায় বলে ফেলতে পারেন–“ছবিতে চরিত্র পাওয়ার জন্য তাঁদের যৌন-শোষণের মুখোমুখি হতে হয় না। যদি মেয়েটি খারাপ হয়, তবেই সে বিছানায় যায়।”
১৪. স্বাধীনতা সংগ্রামে গণিকা
ভারতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে গণিকাদের অংশগ্রহণ স্মরণীয়। স্বাধীন ভারত তাঁদের কথা ভুলে গেলেও এ প্রবন্ধকার ভোলেনি। ১৯০৭ সালে অনুশীলন সমিতির বিপ্লবী যুবকদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল প্রচুর গণিকা নারী। ১৯০৭ সালের অক্টোবর মাসে অনুশীলন সমিতির যুবকেরা ঠিক করলেন সরকারি নির্দেশ উপেক্ষা করে বিডন স্কোয়ারে একটা সভা করবেন। সভা শুরু হল, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় জ্বালাময়ী ভাষণ দিলেন। আর তারপরেই শুরু হল পুলিশের লাঠিচার্জ। বিপ্লবী যুবকেরা ইট-পাথর ছুঁড়ে পাল্টা আক্রমণ চালাল। আর সেই সময় দেখা গেল চিৎপুরের বাড়ির ছাদ, বারান্দা, জানালা থেকে গণিকা নারীরা পুলিশের উপর ইট ছুঁড়ে তাঁদের তাড়িয়ে দিচ্ছে।
অসহযোগ আন্দোলনের সময় ১৯২১ সালে কলকাতার গণিকা নারীরা আন্দোলনের জন্য অর্থসংগ্রহের কাজে অংশগ্রহণ করে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস এবং জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলি সোনাগাছি অঞ্চলের গণিকাদের নিয়ে সভা করেন। এর পরের বছর বন্যার্তদের সাহায্যের জন্যেও পথে নেমেছিল গণিকারা। ত্রাণের জন্য যে রিলিফ কমিটির গঠিত হল ‘বেঙ্গল রিলিফ কমিটি’, যার সভাপতি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। সদস্যদের মধ্যে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চিত্তরঞ্জন দাস, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, ডাক্তার নীলরতন সরকার প্রমুখ। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই বেঙ্গল রিলিফ কমিটি ১ লাখ টাকার ও বেশি সংগ্রহ করতে পেরেছিল। মানদাদেবীর লেখা বই থেকে জানা যায় সেই সময় ‘পতিতা সমিতি গঠিত হয়েছিল। তাঁরা লালপাড় শাড়ি পরে কপালে সিঁদুরের ফোঁটা লাগিয়ে গান গেয়ে টাকা তুলেছিলেন বন্যার্তদের জন্য মাসিক বসুমতিতে এই নিয়ে একটি রচনা লেখা হয়। সংগৃহীত অর্থ তাঁরা আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের হাতে তুলে দিয়েছিল। পিতৃস্নেহে ‘এসো এসো মা লক্ষীরা’ বলে আচার্য তাঁদের আহ্বান করেন এবং তাঁরা এই অকৃত্রিম স্নেহ দেখে আপ্লুত হয়ে যান। বরিশালেও পতিতা সমিতি গড়ে ওঠে। তাঁর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন গান্ধীবাদী শরকুমার ঘোষ।
১৯২৪ সালে গণিকা নারীরা তারকেশ্বরে সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণ করেন নেতৃত্বে ছিলেন স্বয়ং চিত্তরঞ্জন দাস। বাংলার ভদ্র সমাজ এই নিয়ে আবার তীব্র প্রতিবাদও জানিয়েছিলেন। প্রবাসী’ পত্রিকা এই নিয়ে প্রতিবাদ করেন, কেন গণিকা নারীরা সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণ করছে। ১৯২৫ সালে চিত্তরঞ্জন দাস প্রয়াত হলে তাঁর মরদেহ নিয়ে যে বিরাট মিছিল হয়েছিল সেই মিছিলে পা মেলান গণিকারা। ১৯৩০ মেদিনীপুরে নন্দীগ্রামে সত্যবতী নামে একা গণিকা নারী লবণ সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণ করে পুলিশ দ্বারা নির্যাতিত হয়েছিলেন। তমলুকে ৪২-এর আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে আহত কয়েকজন বিপ্লবীর প্রাণ বাঁচিয়েছিল এক গণিকা নারী। এক সংগ্রামী মিটিংয়ে মেদিনীপুরের ম্যাজিস্ট্রেট পেডি সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী নিয়ে উপস্থিত হন। পেডি আদেশ দিলেন—“১৪৪ ধারা জারি আছে, মিটিং করা যাবে না”। বিপ্লবী জ্যোতির্ময়ী দেবী পুলিসের বাধা অগ্রাহ্য করে জনতাকে আহ্বান করে বললেন–“যারা বুকের রক্ত দিতে প্রস্তুত আছেন তারা এই সভায় এগিয়ে আসুন। যারা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবেন তাঁরা ফিরে যান।” এই আহ্বান শুনে সাবিত্রী নামে তমলুকের এক সালঙ্কারা পরমাসুন্দরী ষোড়শী গণিকা নারী এগিয়ে বললেন—“আমরা বুকের রক্ত দেব। কিন্তু পৃষ্ঠপ্রদর্শন করব না।”
বঙ্গদেশে তুমুল ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম শুরু হয়ে গেলেও তথাকথিত ভদ্রঘরের মেয়েরা সেই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেনি সে সময়। মূলত পুরুষদের মধ্যেই আন্দোলন সীমাবদ্ধ থাকলেও মেয়েরা যে আসেনি তা কিন্তু নয়। যৌনপল্লির মেয়েরাই সংগ্রামে অংশ নিয়েছিল। বিশেষ করে চিৎপুরের যৌনকর্মীরা ব্রিটিশ পুলিশের বিরুদ্ধে। রুখে দাঁড়িয়েছিল।
যৌনকর্মীদের স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের চমকে দিয়েছিল। মেয়েরা যে এভাবে এগিয়ে আসবেন তাঁরা কখনো স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। পুলিশের ধাওয়া খেয়ে বিপ্লবীরা যৌনপল্লিতে আত্মগোপন করত কোনো যৌনকর্মীর ঘরে। যৌনকর্মীরাও তাঁদের শেল্টার দিতে আপত্তি করত না। শুধু শেল্টার দিত তাই নয়, তাঁদের উপার্জিত অর্থ নিজেদের স্বর্ণালংকার বিপ্লবীদের হাতে তুলে দিত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য।
‘শিক্ষিতা পতিতার আত্মচরিত গ্রন্থ থেকে মানদা দেবীর বর্ণনায় জানা যায়–আন্দোলনে অংশ নিয়ে মিছিলে হাঁটা, ত্রাণের টাকা তোলা বারাঙ্গনা নারীরা করতেন। তাঁরা গান গেয়ে কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বিপ্লবী আন্দোলনে সামিল হতেন। প্রাণমন সঁপে দিয়ে করতেন। ১৯২৯ সালে অসহযোগ আন্দোলনেও গণিকাদের অংশগ্রহণ ছিল।
তবে ভদ্রসমাজের একটা অংশ গণিকাদের এই অংশগ্রহণ মেনে নিতে পারেনি। ব্রহ্মবাদীদের এমন আচরণ দেখা গেল যখন তারকেশ্বরে সত্যাগ্রহ আন্দোলনে গণিকারা অংশ নিয়েছিলেন। গণিকাদের এই অংশগ্রহণ নিয়ে সেই সময়কার পত্রপত্রিকায় বিস্তর লেখালেখিও হয়েছে। গণিকারা স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করাকে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় কটাক্ষ করলেন। তিনি লিখলেন–“খবরের কাগজে পড়িয়াছি তারকেশ্বরে যে সকল নারী সত্যাগ্রহ করিতেছেন পতিতা নারীরাও তাঁহাদের দলভুক্ত এবং তাহারা অবাধেই সকলের সঙ্গে মিশিতেছে। … সত্য হইলে ইহা বাঞ্ছনীয় নহে। কারণ ইহাতে সামাজিক পবিত্রতা সংরক্ষিত ও বর্ধিত না পাইয়া নষ্ট হইবার সম্ভাবনাই বেশি।” এমনকি মহাত্মা গান্ধিও গণিকাদের অংশগ্রহণ ভালো চোখে দেখেনি। সে সময় কমলকুমার মিত্র তাঁর সম্পাদিত ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকায় লিখলেন–“প্রকৃতপক্ষে কতকগুলি বেশ্যা, বাগদি, ডোম প্রভৃতি নিম্নশ্রেণির স্ত্রীলোক দ্বারা এই দল গঠিত। বেশ্যা ও অপর শ্রেণির স্ত্রীলোকদের ভলান্টিয়ার করা ভালো হয় নাই।” অবিনাশ নামে এক বিপ্লবী ভদ্রলোক যৌনপল্লিতে ঢুকেছিলেন যৌনকর্মীদের কাছ থেকে আন্দোলনের জন্য চাঁদা তুলতে। যৌনকর্মীরা একবাক্যে রাজি হয়ে যান চাঁদা দিতে। সেই বার্তা বিপ্লবী অশ্বিনী দত্ত ও প্রমথনাথ মিত্রকে জানানো হলে তাঁরা যৌনকর্মীদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়ায় আপত্তি তোলেন। এই রক্ষণশীলতার কারণে আর চাঁদা তোলা সম্ভব হয়নি।
সেই সময়কার বিমলা নামের গণিকার কথা জানা যায়, যিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ব্রিটিশদের চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। চিৎপুরের গণিকা ছিলেন বিমলা। সেই পেশা ত্যাগ করে দেশের কাজে পাকাপাকিভাবে ব্রতী হন। তিনি যেমন শিক্ষিতা ছিলেন, তেমনি ছিলেন রূপবতী। বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজি ভাষাতে কথা বলাতে যথেষ্ট সাবলীল ছিলেন। যে-কোনো ভাষাতেই অসাধারণ বক্তৃতা দিতে পারতেন।
মহিলাদের এক ব্রিটিশ বিরোধী জনসভা হচ্ছিল। সেই জনসভায় বিশাল পুলিশবাহিনী উপস্থিত জনতার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঘোড়া-পুলিশের দল জমায়েতের ভিতর ঘোড়া ছুটিয়ে তাণ্ডব শুরু করে দিল। সেসময় মঞ্চে ঝাঁঝালো বক্তৃতা দিচ্ছিলেন চিৎপুরের গণিকা বিমলা দেবী। বিমলা দেবী ছুটে গিয়ে এক পুলিশ সার্জেন্টের ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরেন এবং বলেন–“Are you not born of a woman? How do you beat your mothers and sisters?” সেদিন রণচণ্ডী বিমলার তেজ ও সাহসিকতার সামনে পুলিশ হঠে যেতে বাধ্য হয়। এ ঘটনার সংবাদ পৌঁছে গিয়েছিল কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছেও। তিনি বিমলা দেবীর মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন–“সাবাস। কে বলে তুই অবজ্ঞার পাত্রী! তোর মধ্যে আজ আদ্যাশক্তি মহিষাসুরমর্দিনীর বিভূতি দেখলুম।”
আন্দোলনের একটা সময়ে এসে বিপ্লবীরা নরমপন্থী ও চরমপন্থী হিসাবে দু-ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলে। আন্দোলনে অভিমুখ ক্রমশ বদলাতে থাকল। ভদ্রসমাজ গণিকা দেশপ্রেমীদের উপেক্ষা করতে থাকল। দেশের কাজ করতে গিয়ে বারবার বাধা পেতে থাকেন। অবশেষে বিমলাকে পুনরায় গণিকাজীবনে ফিরে আসতে হয়। ফিরে আসতে বাধ্য হয়। গণিকাজীবন শুরু করলেও দেশের কাজ থেকে তিনি কোনোদিন বিরত থাকতে পারেননি। শচীনন্দন চট্টোপাধ্যায় লিখছেন, বিমলা কীভাবে এক বেকার কংগ্রেসকর্মীকে স্নেহ দিয়ে অর্থের জোগান দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। এক বিপ্লবীর আত্মগোপন করে থাকার সময়ে সমস্ত খরচ জুগিয়েছিলেন বিমলা। শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ উপন্যাসে সুমিত্রা চরিত্রটি কী বিমলারই প্রতিচ্ছবি? অনেকে তেমনটাই মনে করেন।
১৯৩০ সালে মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর জালালাবাদের যুদ্ধ সংঘটিত হয় ব্রিটিশদের মধ্যে। এই যুদ্ধে শহিদ হন ৯ জন বাঙালি বিপ্লবী। এর মধ্যে একজন ছিলেন বিপ্লবী অর্ধেন্দু দস্তিদার। অর্ধেন্দু দস্তিদার ঘটনাস্থলে ভয়ানকভাবে জখম হন। সেই অবস্থায় তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। কোনোরূপ চিকিৎসা না করে তাঁকে জেরায় জেরায় জেরবার করে তোলা হয়। অবশেষ বিপ্লবী অর্ধেন্দু মারা যান। বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর মুক্তিসংগ্রামে অন্তঃপুরবাসিনী ও বারাঙ্গনাগণ’ নিবন্ধে পূর্ণেন্দু দস্তিদারের বয়ানে লিখলেন–“মৃতদেহ শ্মশানে রেখে তখন অর্ধেন্দুর ডাক্তারকাকা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যবস্থা করছেন। তখন তিনি দেখলেন শ্মশানের গেটে একটি ঘোড়ার গাড়ি থামল এবং তা থেকে নামল চারজন নারী। কাছে এগিয়ে এলে দেখা গেল তাঁরা শহরের বারাঙ্গনা। তিনি তাঁদের ওখানে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তাঁদের মধ্যে একজন বলল তাঁরা দেবতা দেখতে এসেছেন। তাঁদের শাড়ির মধ্যে লুকানো দুধের বোতলগুলি আর ফুলের তোড়া বের করে তাঁরা বলে–‘এই দুধ দিয়ে ওই দেবতার মৃতদেহ আমরা স্নান করাতে চাই। তারপর ফুলগুলি দিয়ে ফিরে যাব। শহিদ অর্ধেন্দু দস্তিদারের পিতৃব্য পূর্ণেন্দু দস্তিদার তাঁদের অনুমতি দিয়েছিলেন।
১৫. গণিকাবৃত্তি নানা রূপে
প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ এবং ব্রিটিশ-ভারতে গণিকাবৃত্তির ধরনধারণ তো আমরা কিছুটা ধারণা নিতে পারলাম। কিন্তু বর্তমান তথা আধুনিক যুগে গণিকাবৃত্তির ধরনধারণ কোন্ পথে, আমরা এবার সেটা জানার চেষ্টা করব। বর্তমান সময়ে গণিকাবৃত্তির ধরনে আমূল পরিবর্তন এসেছে। যৌনব্যাবসা এখন শুধু স্থানীয় নয়, আন্তর্জাতিক। প্রযুক্তিকে যথাযথ ব্যবহারে যৌনপেশা তরতর করে এগিয়ে চলেছে। কমেছে শরীর নিয়ে ছুঁৎমার্গ। সর্বস্তরের ক্লায়েন্টদের টানত যৌনপেশা ক্রমশ উন্নত থেকে উন্নত হচ্ছে। সেইসঙ্গে আসছে নতুন নতুন বিভাজন। আসুন, এবার বিভাজনগুলি দেখে নেওয়া যাক।
(১) stree Protitute : শব্দটার বাংলা পাইনি। তাই ইংরেজিতেই লিখলাম। এইভাবেই শব্দটি সবাই জানে। যাই হোক, এই গণিকারা ক্লায়েট (গণিকাজগতে এখন আর বাবু, খরিদ্দার বলে না। সবাই ক্লায়েট।) ধরার জন্য বিভিন্ন রাস্তার পাশে, রাজপথে, পার্ক বা অন্যান্য পাবলিক প্লেস, যানবাহনে বা সংকীর্ণ কোনো ঘুপচিতে কম পয়সার বিনিময়ে এঁরা যৌনক্রিয়া সম্পন্ন করে। এঁরা স্বাধীন গণিকা। রোজগারের জন্য এই পেশা নেয় তাঁরাই, যাঁদের অন্য কোনো কাজ করার স্কিলড নেই। শুধু পুলিশকে প্রাপ্য মিটিয়ে দিলেই হল। না মেটালে সারাদিন পুলিশের তাড়া খেয়ে বেড়াতে হবে।
(২) গণিকালয় : গণিকালয়, পতিতালয়, বেশ্যালয়, নিষিদ্ধপল্লি, ব্রোথেল (Brothel), Red light area বা কোঠি–এগুলি সমার্থক শব্দ। এখানে ঘর ভাড়া দিয়ে বা ঘর ভাড়া নিয়ে ঘোষিতভাবে যৌনকর্ম চালানো হয়। তবে খোলা রাস্তার থেকে অনেক বেশি নিরাপদ। রোজগার নিশ্চয়তা কিছুটা বেশি। এখানে ক্লায়েট খুঁজে বেড়াতে হয় না, ক্লায়েন্টই খুঁজে নেয় যৌনকর্মী নিজের পছন্দমতো।
তবে নিষিদ্ধপল্লি বা লালবাতি এলাকা বা Red light area শব্দটির অর্থ আরও বিস্তারে ভাবা হয়েছে।এই অঞ্চল বলতে বোঝায় যৌনশিল্প সংক্রান্ত বাণিজ্যের অস্তিত্ব, যেমন–সেক্স শপ, স্ট্রিপ ক্লাব বা অ্যাডাল্ট থিয়েটার। কোনো কোনো নিষিদ্ধপল্লিতে যৌনকর্মীরা বৈধভাবে ব্যাবসা চালায়, কিন্তু বেশ কিছু অঞ্চল তাঁদের বেআইনি কার্যকলাপের জন্য কুখ্যাত। ১৮৯৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মিলওয়াউঁকির সংবাদপত্র ‘দ্য সেন্টিনাল’ এ একটি নিবন্ধে ‘Red-light distric’ শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয়। ১৮৯০-র দশকে সমগ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বহু ক্ষেত্রে এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছিল। অনেক মনে করেন ‘রেড লাইট’ বা ‘লালবাতি’ কথাটির উৎস রেলওয়ে কর্মচারীদের লাল লণ্ঠন। এই লণ্ঠন তাঁরা গণিকালয়ে প্রবেশের আগে বাইরে রেখে যেত, যাতে ট্রেন চলাচল সংক্রান্ত যে-কোনো প্রয়োজনে তাঁদের সহজে খুঁজে পাওয়া যায়। অন্যমতে, প্রাচীন চিনে গণিকালয়ের বাইরে ঝুলিয়ে রাখা যৌনোদ্দীপক লাল রঙের কাগুঁজে লণ্ঠন থেকে এই শব্দের উৎপত্তি।
বাইবেলের একটি কাহিনিতে দেখা যায়, জেরিকো অঞ্চলে রাহাব নামে এক গণিকা জোশুয়ার গুপ্তচরদের মদত দিয়েছিল এবং নগর দখলের পর লুণ্ঠনের সময় তাঁরা যাতে সহজেই রাহাবের বাড়ি চিনতে পারে এবং সেই বাড়িটিকে রেহাই দেয় সেইজন্যে সে একটি লাল দড়ি দিয়ে তাঁর বাড়ি চিহ্নিত করে রাখত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বেলজিয়াম ও ফ্রান্সের বহু গণিকালয়ে নীল ও লাল রঙ দিয়ে যথাক্রমে অফিসারদের ও অন্যান্য পদের লোকেদের ব্যবহৃত গণিকালয় চিহ্নিত করা হত।
লালবাতি এলাকার জাপানি নাম ‘আকাসেন’, বাংলা তর্জমায় অর্থ হল–লাল রেখা। জাপান পুলিশ মানচিত্রে লাল রেখা দিয়ে দিয়ে নিষিদ্ধপল্লির সীমা নির্ধারণ করত। সেই থেকে এই নামের উৎপত্তি। তাঁরা ‘আওসেন’ বলেও একটি শব্দ ব্যবহার করত, যাঁর বাংলা ভাষায় অর্থ ‘নীল রেখা। নীল রেখা দিয়ে তাঁরা বেআইনি কার্যকলাপপ্রবণ অঞ্চলগুলি চিহ্নিত করত। যাই হোক, বিভিন্ন সংস্কৃতিতে লালবাতি অঞ্চলকে বিভিন্ন রূপে দেখা যায়, কিন্তু আদতে এগুলি গণিকালয়েরই বিভিন্ন রূপ।
(৩) সেক্সডল গণিকালয় : না, এখানে কোনো হিউম্যান বডি গণিকাবৃত্তি করে না। সেক্সডল কোনো রক্তমাংসের উষ্ণ শরীর নয়। সেক্সডল কৃত্রিম প্রযুক্তিতে তৈরি সিলিকনের নারীশরীর। পৃথিবীর বেশ কিছু উন্নত দেশে সেক্সডলের চাহিদা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। নিরাপদ যৌনকর্মী বা জীবনসঙ্গীর অভাব পূরণ করতেই সেক্সডলের আবির্ভাব। আমেরিকা, জার্মানি, চিন সহ বিশ্বের একাধিক দেশেই কথা বলতে পারে এমন সেক্সডলের চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি হচ্ছে। এই সেক্সডলগুলি রিমোর্ট কন্ট্রোলের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ভারতীয় মুদ্রায় এক একটি কথা বলতে পারা’ সেক্সডলের দাম আড়াই থেকে তিন লক্ষ টাকা। সবচেয়ে বেশি সেক্সডল প্রস্তুত হয় চিনেই। চিনের কারখানায় ভিন্ন ধরনের সেক্সডলের নির্মাণ হয়ে থাকে। এমনই এক কারখানার নাম WMDOLL। সেক্সডলের চাহিদায় এই সংস্থা প্রায় ৮০ শতাংশ সেক্সডল প্রস্তুত করে থাকে। এই সংস্থার ৫০ শতাংশ অংশীদারী আমেরিকার। বলে রাখি, এইসব কারখানায় শুধু যে নারীশরীরের সেক্সডল তৈরি হয় তা কিন্তু নয়, যথেষ্ট পরিমাণে চাহিদা অনুযায়ী পুরুষশরীরের সেক্সডলও তৈরি করা হয়।
সেক্সডলের সঙ্গে সেক্স করলে তাঁকে গণিকা বলা হবে কি না, সেক্সডল খাঁটিয়ে কেউ কোথাও যৌনব্যাবসা হলে সেটাকে গণিকালয় বলা হবে কি না, ঘরওয়ালিকে মক্ষীরানি’ বলা যাবে কি না, তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক হতে পারে। তবে সেক্সডল নিয়ে গণিকালয় তৈরির কথাও ভাবা হচ্ছে। সাধারণভাবে পুরুষরা যেমন বাড়তি যৌন মনোরঞ্জনের জন্য গণিকালয়ে গিয়ে থাকে বা বাগানবাড়িতে গণিকা নিয়ে এসে মনোরঞ্জন করে থাকে। তারপর সময়ের বিবর্তনে মানুষ যৌনতার একঘেঁয়েমি কাটানোর জন্য সেক্সরোবট ব্যবহারও করতে থাকে। থেমে থাকে না স্বপ্ন। আমেরিকার এক শহরে এমন এক গণিকালয় খোলার কথা ভেবেছিল, যেখানে অর্থের বিনিময়ে সার্ভিস দেবে সেক্সডল। সেক্সডল তো সেই অর্থ রোজগার করবে না, রোজগার করবে সেক্সডলের মালকিন। তবে সেই সেক্সডল গণিকালয়ের অনুমোদন মঞ্জুর হয়নি। অনুমোদন করা হয়নি এই কারণে যে, এই ধরনের গণিকালয় জনপ্রিয় হয়ে উঠলে হিউম্যান বডি গণিকালয়ের জনপ্রিয়তা হারাবে। ফলে বহু মেয়েরা যেমন জীবিকা হারাবে, পেশায় সঙ্গে জড়িত বহু মানুষ সংকটের মধ্যে পড়ে যাবে। অর্থনীতিও ভেঙে পড়বে। কানাডার এক প্রতিষ্ঠান Kinkysdolls সেক্সডল নিয়ে একটি গণিকালয় খোলার প্রস্তাব দিয়েছিল। এ বিষয়ে একটি অনলাইন মতামত নেওয়া হয়েছিল, যেখানে ১২,০০০ মানুষের সমর্থন পাওয়া গিয়েছিল। তবে অনেকেই মনে করেন, এমন গণিকালয় হলে মহিলারা শুধুই পণ্যভোগ্য সামগ্রীতে পরিণত হবে। কেউ কেউ মনে করেন এর ফলে সমাজে আসবে বৈষম্য, বাড়বে হিংসা। তবে টরেন্টো ও প্যারিসে এরকম সেক্সডল গণিকালয় অনেক আগে থেকেই ছিল। এছাড়া অস্ট্রিয়া, সাউথ কোরিয়া, চিন, ইউনাইটেড স্টেট ছাড়াও অন্যত্র এই ধরনের।
(৪) এসকর্ট (Esort) : এসকর্ট সার্ভিস সাধারণত বিজ্ঞাপনের মাধ্যমেই জানানো হয়। এই বিজ্ঞাপনে কোনো ঠিকানা থাকে না, থাকে ফোন নম্বর। গুগল সার্চ করলে এরকম অসংখ্য এসকর্টের খবর পাওয়া যাবে। এছাড়া শহরের বিভিন্ন জায়গায় পোস্টারও দেখতে পাওয়া যায়। বিভিন্ন ভাষায় পত্রপত্রিকাতে বিজ্ঞাপনও দেখতে পাওয়া যায়। ফোন নম্বরে ফোন করলে ওপাশ থেকে নারীকণ্ঠ অথবা পুরুষকণ্ঠে ভেসে আসবে–ওয়েলকাম স্যর।
–এখানে মেয়ে পাওয়া যাবে?
–পাওয়া যাবে স্যার। সুন্দরী সুন্দরী মেয়েদের পাওয়া যাবে।
–রেট কীরকম?
–আমাদের সেন্টারে এলে অবিবাহিতা কলেজ গার্ল প্রতি ঘণ্টায় ৩০০০ টাকা, বিবাহিতা ঘরোয়া মহিলা ২৫০০ টাকা, বিধবা বা ডিভোর্সি ২০০০ টাকা। এটা নন-এসির রেট, এসি নিলে অতিরিক্ত ৬০০ টাকা। আপনার নিজস্ব জায়গাতে নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত ৫০০ টাকা দিতে হবে। ট্রান্সপোর্টেশন খরচও আপনার।
–কোনো ঝুটঝামেলা নেই তো?
–একদম ঝুটঝামেলা নেই। ১০০ % নিরাপদ ও সুরক্ষিত। কবে আসবেন স্যার? আজই আসবেন?
–না, আজকেই যাচ্ছি না। সময় সুযোগ পেলে ফোন করে নেব।
–ঠিক আছে স্যার। এটা আপনার হোয়াটস অ্যাপ নম্বর? কিছু মেয়েদের ছবি পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনি পছন্দ করতে পারেন। আপনি যখন আসবেন আমাদের জানালে আপনাকে সম্পূর্ণ ঠিকানা আর পথনির্দেশ দিয়ে দেব।
‘এসকর্ট গার্ল’ বলতেই একঝাঁক স্মার্ট শিক্ষিত মেয়েদের ছবি ভেসে ওঠে। বাস্তবিকই। আপনি ঠিকানা পেয়ে গেলেন একটি নির্দিষ্ট এলাকার নির্দিষ্ট ফ্লাটে। দরজা বন্ধই থাকে। কলিং বেল টিপলেই দরজা খুলে যাবে। ভিতরটা শুনশান ফাঁকা। আপনাকে একটি ঘরে বসানো হবে। দুজন বা তিনজন ধোপদুরস্ত জিনস টি-শার্ট পরিহিতা স্মার্ট মেয়ে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আপনাকে বলবে–“আমরা তিনজন আছি। কাকে পছন্দ?” প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, এই তিনজনের মধ্যে থেকে একজনকেও যদি আপনার পছন্দ না হয়, তখন আপনাকে হোয়াটস অ্যাপ খুলে অন্য মেয়েদের ছবি দেখানো হবে। হোয়াটস অ্যাপের কোনো মেয়ে পছন্দ হলে সেই মেয়েকে সেদিন আপনি পাবেন না। আপনাকে বলা হবে, একটি নির্দিষ্ট দিনে আপনি পাবেন। তারিখ-সময় ফাইনাল হলে সেই মেয়েকে ডাকিয়ে আনা হবে আপনার জন্য।
উপরের সংলাপটি কাল্পনিক নয়, একটি ফাইন্ড ফ্যাক্ট। সার্ভিস পরিস্থিতি অনুযায়ী সংলাপ অন্যরকমও হতে পারে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, যেই মূহুর্তে আপনি সার্ভিস জোনে ঢুকে পড়লেন, আপনাকে নজরে রাখতে পারে কোনো গোপন ক্যামেরা। কিন্তু আপনার কাছে থাকা কোনো গোপন ক্যামেরার কার্যকারিতা থাকবে না।
কলেজ ছাত্রী থেকে গৃহবধূ, বিমানসেবিকা থেকে কলসেন্টার কর্মী, এমনকি মডেল গার্ল, টিভি বা সিনেমার অভিনেত্রীদের তালিকাও এই এসকর্ট সার্ভিসের সঙ্গে যুক্ত। উপযুক্ত টাকা খরচ করতে পারলেই যেমন বাঘের দুধ মেলে, তেমনি শয্যাসঙ্গিনীও মেলে। সবচেয়ে কম খরচ কলেজ পড়ুয়া বা ঘরোয়া গৃহবধূদের ক্ষেত্রে। সবচেয়ে বেশি খরচ হবে স্ট্রাগলিং অ্যাক্ট্রেস বা ভিআইপি মডেল গার্লদের ক্ষেত্রে। ঘণ্টায় এক লাখ টাকাও হতে পারে। গোটা রাতের জন্য হলে আরও বেশি। আবার এই টাকার অঙ্কের পরিমাণ নির্ভর করবে ওই সময়ের মধ্যে তাঁর সঙ্গে কতবার যৌনমিলন করবেন তার উপর। তবে কোথাও প্যাকেজ সিস্টেম চালু আছে। যেমন ধরুন এক ঘণ্টায় চুক্তিতে ২০০০ টাকার বিনিময়ে আপনি সর্বাধিক চারবার যৌনমিলন করতে পারবেন। আপনি চুক্তিবদ্ধ হলে আপনার সঙ্গে যে মেয়েটি যাবে সে তাঁর সঙ্গে চারটি কন্ডোম নিয়ে নেবে। মনে রাখবেন, কন্ডোম ছাড়া আপনি কোনো মেয়ের সঙ্গেই যৌনমিলন করতে পারবেন না। কোনো কোনো এসকর্ট সেন্টারে ক্লায়েন্টের কাছ থেকে যৌনমিলন করার আগে টাকা নেওয়া হয়, কোথাও-বা যৌনমিলন করার পর টাকা নেওয়া হয়।
এই সার্ভিসে কোনো দালাল বা মধ্যস্থতাকারী নেই। কোনো দালালের মাধ্যমে এসকর্ট সার্ভিস আপনি পাবেন না। এই সার্ভিস সম্পূর্ণভাবে অনলাইন-নির্ভর। এসকর্ট সার্ভিসগুলি ছড়িয়ে শহর বা শহরের বাইরে ছড়িয়ে আছে। সল্টলেক, লেক টাউন, রাজারহাট, মধ্যমগ্রাম, এয়ারপোর্ট এলাকা, পার্কস্ট্রিট, ধর্মতলা, বড়োবাজার, যাদবপুর, ভবানীপুর, বারাকপুর, নৈহাটি, দুর্গাপুর—কোথায় এই সার্ভিস পাওয়া যায় না! ওয়েবসাইটগুলি ঘাঁটলে আপনি কোনো কোনো সাইটে পেয়ে যেতে পারেন সংশ্লিষ্ট মেয়েটির ছবি সহ শারীরিক বিবরণ। যেমন–বয়স, চুলের রং, চোখের রং, গায়ের রং, উচ্চতা, ওজন, স্তনের সাইজ, কোমরের সাইজ, নিতম্বের সাইজ, মদ্যপান করে কি না, ধূমপান করে কি না ইত্যাদি সমস্ত তথ্য। আজকাল ফেসবুকেও এসকর্ট সার্ভিসের পেজ খোলা হচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সবার আগে এগিয়ে।
এসকর্ট হল ছকভাঙা যৌনযাপন। এখানকার মেয়েরা কেউ কেউ আর পাঁচটা পেশার মতো করে পেশাকে বেছে নিয়েছে। আর পাঁচজন অফিস-কর্মীর মতো সকালে নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেন ধরে চলে আসে সেন্টারে, আবার সন্ধ্যায়। বাড়ি ফিরে যায় আর পাঁচজন অফিস-কর্মীর মতোই। বাড়ির মা-বাবা-সন্তান-স্বামী জানেন তাঁদের মেয়ে-মা-স্ত্রী চাকরি করতে যাচ্ছেন, আর চাকরি করে বাড়ি ফিরছেন। এমন চাকরি, যাতে মাঝেমধ্যে নাইট ডিউটিও করতে হয়। এসকর্ট গার্লদের একটা অংশ শুধুমাত্র হোটেল-রিসোর্টে গিয়ে সার্ভিস দেয়। এক্ষেত্রে আপনি এঁদের সার্ভিস পেতে কোনো সাইট থেকে যোগাযোগ করলে এঁরা আপনার কাছ থেকে জানতে চাইবে আপনি কোন্ হোটেলে আছেন সেই হোটেলের নাম, ঠিকানা ও রুম নম্বর। আপনার এসব তথ্য নিয়ে ঠিক সময়মতো পৌঁছে যাবে রুমের কাছে, আপনার পছন্দের হার্টথ্রব গার্ল। এঁরা সাইটগুলিতে নিজেদের ছবি ও শরীরের বিস্তারিত বিবরণ সহ বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে।
তবে সাধু সাবধান! এতক্ষণ বিবরণ পড়ে আপনি যদি খুব উৎসাহিত হয়ে পড়েন, তাহলে এবার নিরাশ করব। আসলের পাশাপাশি প্রচুর ফেক সাইটও আছে। আসল বেছে নেওয়া সহজ কাজ নয়। না-বাছতে পারলে মারাত্মক বিপদে পড়ে যেতে পারেন। পুরুষদের বিপদের কথা পড়ে বলছি। তার আগে মেয়েদের বিপদের কথা বলে নিই। প্রচুর অর্থ রোজগায়ের আশায় যেসব মেয়েরা এসকর্টে যুক্ত হওয়ার কথা ভাবছেন, তাঁরাও সাবধান। চরম মূল্য দিতে হতে পারে। এই এসকর্ট সার্ভিস কতকগুলি ক্ষেত্রে কীরকম বিপজ্জনক হতে পারে, তা একটি এসকর্ট সাইটে গেলেই কিছুটা আভাস পাওয়া যেতে পারে। যাঁরা ভাবছেন এসকর্টে যুক্ত হয়ে শরীর বেচে উপার্জন করবেন, সাইটিতে ক্লিক করলে আমি নিশ্চিত আপনারও হাড় হিম হয়ে যাবে। মেয়েদের ছবি-সর্বস্ব এই সাইটটির একজন এসকর্ট মেয়েও বেঁচে নেই। কারণ সাইটটি আদতেই ফেক, জাল। এসকর্ট জীবনের কী চরম পরিণতি হতে পারে, তা প্রচার করতেই ফরাসি দাঁতব্য সংস্থা ‘মুভমে দ্যু নি’ নামে সাইটটি তৈরি করেছে। যৌনকর্মীদের সচেতনতা বাড়ানোর জন্যেই এই সাইটটি। এই এসকর্টরা তাঁদের ক্লায়েন্টের কাছ থেকে প্রতারিত হয়েছে এবং মুখ খুলে শেষপর্যন্ত খুন হয়েছে। ভুয়ো এই এসকর্ট সাইটটি ১০ ঘণ্টা লাইভ থাকে। মুভমে দ্যু নি’-র কর্মীরাই মৃত যৌনকর্মীদের হয়ে ক্লায়েন্টের সঙ্গে চ্যাট করে যায়। দিনে কমপক্ষে ৬০০ ক্লায়েন্টের সঙ্গে তাঁদের কথা হয়। চ্যাটের একটা সময় যখন ক্লায়েন্টরা সার্ভিস চায়, তখন জানিয়ে দেওয়া হয় এতক্ষণ যাঁর সঙ্গে কথা বলছিলেন সে মৃত। তাই সার্ভিস সম্ভব নয়। এঁরা প্রত্যেকেই ক্লায়েন্টের হাতে খুন হয়েছে।
এবার আসি পুরুষের বিপদ নিয়ে কথায়। পুরুষ যৌনকর্মীদের নিয়ে পরে বিস্তারিত আলোচনা করব। পুরুষদের ‘গণিকা’ বা ‘পতিতা’, ‘বেশ্যা’ বলা যায় না। এগুলি স্ত্রীবাচক শব্দ। পুরুষরা শরীর বিক্রি করে রোজগার করলেও পুংবাচক কোনো শব্দ এখনও তৈরি হয়নি। তাই ‘যৌনকর্মী’ শব্দেই আটকে থাকতে হচ্ছে। সারা পৃথিবীতেই পুরুষ-যৌনকর্মীদেরও ব্যাপক চাহিদা আছে। আর পাঁচটা পেশার মতো এই পেশাও পুরুষদের কছে কম আকর্ষণীয় নয়। রোজগার মেয়েদের মত না-হলেও নেহাৎ কম নয়। চাকরির বাজার যতই সংকুচিত হচ্ছে, ততই এই পেশায় আসার ঝোঁক বাড়ছে পুরুষদের। অটোমেশনের যুগে এখন প্রায় সব কাজ মেশিনই করে দিচ্ছে। ফলে হিউম্যান বডি আর তেমন প্রয়োজন হচ্ছে না। কম্পিউটার আর রোবট-মেশিন ১০০ জনের কাজ একাই করে দিতে সক্ষম। নিয়োগ বলতে গেলে একেবারেই বন্ধ। কিছু ক্ষেত্রে নিয়োগ হলেও সেখানে প্রতিযোগিতা তীব্র। ২০০ পদের শূন্যপদের জন্য ২ কোটি চাকুরিপ্রার্থীর লাইন। ২০০ জনের চাকরি না-হয় হল, বাকিরা কী করবে! হাতে রইল যৌনতার বাজার বা অন্য কিছু। পুরুষদের বাজার মেয়েদের বাজারের মতো ততটা বড়ো না-হলেও বাজার ক্রমশ বাড়ছে। অনেক পুরুষই এই পেশায় আসছে, কাজ করছে। অনেক আগ্রহী পুরুষই আগ্রহ প্রকাশ করেছে এই কাজ করার জন্য। সম্প্রতি সমীক্ষার জন্য ‘পুরুষ যৌনকর্মী চাই’ বলে ফেসবুকে একটি ফেক পেজ খুলেছিলাম। লিখলাম ‘Add me 30+ handsome male for income with real fun’। প্রতিদিন শোয়ে শোয়ে রিকোয়েস্ট আসতে থাকল। অনেককেই অ্যাকসেপ্ট করলাম। সবাই পাগলের মতো জানাতে থাকল এই কাজ করতে চায় বলে। জানতে চায় কীভাবে করতে হবে, কোথায় করতে হবে। অনেকেই আগাম নিজের ফোন নম্বর দিয়ে জানাল সে খুবই আগ্রহী, তাঁর সঙ্গে যেন যোগাযোগ করে নিই। যাঁদের রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করতে পারিনি বা করিনি, তাঁরাও আকুতি নিয়ে রিকোয়েস্ট মেসেঞ্জারে তাঁদের ফোন নম্বর রেখে গেল। পুরুষদের কতটা যৌনপেশায় আসতে আগ্রহী সেটা জানতেই এই ফেক পেজ খুলেছিলাম। কাজ মিটে যেতে যেতেই পেজটি ফেসবুক থেকে ডিঅ্যাক্টিভেট সহ ডিলিট করে দিই। যাই হোক, চিত্রটা খানিকটা হয়তো বোঝা গেল। বিপদ ও প্রতারণার সুযোগটা তো এখান থেকেই। একশ্রেণির মানুষ এই সুযোগটা নিতে শুরু দিল। ট্রেনে, বাসে, পথে-ঘাটে, সোসাল মিডিয়ায় বিজ্ঞাপিত হতে থাকল–“প্লেবয় চাই। দারুণ মজার কাজ। রথ দেখা কলা বেচা দুইই হবে। সক্ষম পুরুষরা যোগাযোগ করুন। স্মার্ট জব স্মার্ট মানি। সার্ভিস সপ্তাহে দু-দিন পাবেন। এই কাজ শুরু করতে কোনো রেজিস্ট্রেশন চার্জ লাগে না। শুধুমাত্র আপনার মেডিকেল করাতে ২০০০ টাকা লাগে।” সঙ্গে অবশ্যই ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য ফোন নম্বর। কী ভাবছেন? ভাববেন পড়ে। এখন শুনেনি এক যুবকের অভিজ্ঞতার কাহিনি। অনেক কষ্টে জোগাড় করেছি তাঁকে। এটা ওটা বলার পর সে জানাল তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। জানাল বলা ভুল হল, বরং বলা ভালো শোনাল। তাঁদের ফোনে কনভারসানের রেকর্ড আমাকে পাঠিয়ে দিল। যুবকটি এমনই এক ফোন নম্বরে কল করেছিল। কল রিসিভ করল একজন মেয়ে। যুবকটি তাঁর আগ্রহের কথা জানালে ওরা যা বলল, সেটার হুবহু অনুলিখন করলাম।
–নমস্কার স্যার। আপনার বয়সটা বলবেন স্যার?
–থার্টি ফাইভ।
–বাঃ, আপনি যৌন-সক্ষম তো?
–হ্যাঁ।
–আপনি কাজ করতে চান?
–হ্যাঁ। কীভাবে কাজ পাব? কাজ কোথায় হবে? রোজগার কেমন হবে?
–আপনাকে ডিটেইলস বলে দিচ্ছি। আমাদের কাছে প্রচুর মহিলাদের ফোন নম্বর ঠিকানা আছে, যাঁরা সেক্সের ক্ষেত্রে আনসাটিসফায়েড। আপনাকে তাঁদের সেক্স সাটিসফায়েড করতে হবে। সবাই হাই প্রোফাইলের মহিলা। ওরাই আপনার ক্লায়েন্ট। সপ্তাহে দু-দিন কাজ পাবেন। ক্লায়েন্ট পিছু দশ হাজার থেকে পনেরো হাজার পাবেন। আমরা আপনার রোজগার থেকে ক্লায়েন্ট পিছু ২০% নেব।
–আমাকে কী করতে হবে? মানে কীভাবে আমি ক্লায়েন্ট পেতে পারি?
–আপনাকে প্রথমে আপনার নাম রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। যে নম্বরে আপনি ফোন করেছেন সেই নম্বরে আপনার ডিটেইলসটা পাঠিয়ে দেবেন।
–ডিটেইলস বলতে আপনার নাম, আপনার বাবার নাম, আপনার সম্পূর্ণ ঠিকানা, আপনার ফোন নম্বর যে নম্বরে আপনাকে এসকর্ট করা হবে, আপনার ওজন, গায়ের রং, চোখের রং, অবশ্যই জানাতে হবে আপনার লিঙ্গের দৈর্ঘ্য ইঞ্চির মাপে কতটা, আপনি পেশায় নতুন না পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে ইত্যাদি। আমরা পিডিএফ ফর্ম পাঠিয়ে দেব। আপনাকে শুধু পূরণ করে পাঠাতে হবে।
–রেজিস্ট্রেশন কি আগে করতে হবে? নাকি বায়োডেটা পাঠানোর পরে করতে হবে?
–না, রেজিস্ট্রেশনটা আপনাকে আগে করতে হবে। রেজিস্ট্রেশন ফিজ ৩০০০ টাকা দিতে হবে। রেজিস্ট্রেশন কমপ্লিট হলে আপনার কাছ থেকে আপনার ডিটেইলস নেব এবং পরদিনই ক্লায়েন্টের ফোন নম্বর দেব। আপনি তাঁকে ফোন করে কাজ করার সময় জেনে নেবেন।
–টাকাটা কীভাবে পাঠাতে হবে?
–নেট ব্যাংকিং করে অথবা পেটিএমের মাধ্যমে পাঠাতে পারেন।
–আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনাদের ব্যাংক ডিটেইলসটা পাঠিয়ে দিন।
–ওকে। হোয়াটস অ্যাপে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
দু-দিন পর হোয়াটস অ্যাপে ওরা ব্যাংক ডিটেইলস পাঠিয়ে দিলে যুবকটি ৩০০০ টাকা ব্যাংক ট্রান্সফার করে দেয়। টাকাটা ট্রান্সফার হওয়ার পর একটা ফর্ম হোয়াটস অ্যাপে চলে আসে। সেটাকে ফিল-আপ করে সঙ্গে সঙ্গে যুবকটি পাঠিয়ে দেয়। পরের দিন সকাল ৯ টা নাগাদ ওখান থেকে একটা আসে।
–আপনি কি আজকে কাজ করতে পারবেন?
–কটার সময়?
–বেলা বারোটা নাগাদ।
–হ্যাঁ, পারব।
–ঠিক আছে। আপনাকে ক্লায়েন্টের ফোন নম্বর দিয়ে দিচ্ছি। আপনি তাঁকে ফোন করে জেনে নেবেন কখন সে সার্ভিস পেতে চায়। আপনার বিষয়ে সমস্ত বলা আছে ম্যাডামের কাছে। কোনো অসুবিধা হবে না। হ্যাপি জার্নি।
কিছুক্ষণ বাদে যুবকটির হোয়াটস অ্যাপে একটি ফোন নম্বর চলে আসে। ফোন নম্বরে কল করল যুবকটি। ও প্রান্তে নারী কণ্ঠ।
–আপনি কখন আসতে পারবেন?
–আপনি যখন বলবেন?
–ঠিক আছে। আপনি দুপুর নাগাদ চলে আসুন। আমি একা থাকব।
–ঠিক আছে। আপনার ঠিকানা দিন। কোথায় কীভাবে যাব একটু বলে দিন ম্যাডাম।
–অবশ্যই বলব। ঠিকানা না বললে আমাকে সার্ভিস দেবেন কীভাবে? তার আগে আমাকে একটা কাজ করে দেবেন প্লিজ?
–কী কাজ, বলুন?
–আমার ড্রাইভারটা বিহারে গিয়ে খুব বিপদে পড়ে গিয়েছে। ওকে ৫০০০ টাকা পাঠাতে হবে। আপনি একটু ওর অ্যাকাউন্টে আপনার কাছ থেকে দিয়ে ফেলে দেবেন? আপনি আমার কাছে এলে আপনার সার্ভিসের পনেরো হাজার টাকা উইথ পাঁচ হাজার মোট কুড়ি হাজার টাকা সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দেব। আমি আসলে ঘর থেকে বেরিয়ে ব্যাংকে যেতে পারছি না। একটু অসুবিধা আছে। তাই আপনাকে বলতে বাধ্য হচ্ছি। আপনি আসার সঙ্গে সঙ্গে পুরো টাকাটাই পেয়ে যাবেন।
–এমন কথা তো ছিল না। দেখছি কী করা যায়। ওদের সঙ্গে এবার একবার কথা বলেনি, যাঁরা আমাকে আপনার কাছে পাঠাচ্ছে।
–ঠিক আছে। আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছি।
যুবকটি কল সেন্টারে ফোন করে সব ঘটনা বিস্তারিত বলতেই ওরা হতবাক হয়ে গেল। বলল–
–সেকি! এমন তো হওয়ার কথা নয়। সে আপনার কাছ থেকে টাকা চাইবে কেন? বরং আপনি সার্ভিস দিলে আপনাকে তিনি টাকা দেবেন। আপনি তো টাকা দিতে যাবেন না, টাকা কামাতে যাবেন। আপনি একটু লাইনে থাকুন। কনফারেন্স কলে তাঁর সঙ্গে কথা বলে নিচ্ছি। আপনিও শুনবেন।
–হ্যালো, ম্যডাম বলছেন?
–হ্যাঁ, বলছি। বলুন।
–ম্যাডাম, আমরা যে ক্লায়েন্টকে আপনাকে সার্ভিস দিতে পাঠিয়েছি, আপনি তাঁর কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা চেয়েছেন। এটা তো ঠিক নয়। এর ফলে আপনাকে পরবর্তীতে সার্ভিস পাবেন কি না আমাদের ভাবতে হবে।
–প্লিজ, রাগ করবেন না। আমি বিপদে না পড়লে টাকাটা ওনার কাছে চাইতাম না। আমি বলেছি উনি এলেই ওনাকে পুরো টাকাটাই দিয়ে দেব। ভয় নেই।
–স্যার, শুনলেন তো ওনার কথা। আমিও যেটা বললাম সেটাও নিশ্চয় শুনেছেন?
–হ্যাঁ, শুনলাম।
–আপনি টাকাটা পাঠিয়ে দিন। উনি তো বললেন আপনি যাওয়ার পরই আপনাকে টাকাটা দিয়ে দেবে। ভয় নেই। কোনো অসুবিধা হলে আমরা তো আছি। উপযুক্ত ব্যবস্থাই নেব।
–বেশ। তাহলে আপনি একটা কাজ করুন। ওনাকে বলুন ওনার সম্পূর্ণ ঠিকানা আর ব্যাংক ডিটেইলসটা আমাকে দিতে। আমি ওই ঠিকানায় পৌঁছে টাকাটা আমার মোবাইল থেকেই ব্যাংক ট্রান্সফার করে দিচ্ছি।
–ওকে। বলে দিচ্ছি।
তারপর আর কোনোদিন ওখান থেকে ফোন আসেনি। যুবকটি বুঝলেন সে প্রতারিত হয়েছেন। তিন হাজার টাকার উপর দিয়ে গেছে। লোভ নিয়ন্ত্রণ করতে না-পারলে আরও পাঁচ হাজার গচ্ছা যেত। এরকম প্রতিদিন কত যুবক যে প্রতারিত হচ্ছে, তার ইয়ত্তা নেই। চারিদিকে জাল বিছিয়ে রেখেছে প্রতারকরা। সেই ফাঁদে ফেঁসে যাচ্ছে যুবকরা। পুলিশ-প্রশাসনকে জানালে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন ঠিকই। গ্রেফতারও করছে। কিন্তু প্রতারণা বন্ধ হচ্ছে না। নতুন নতুন নামে প্রতিষ্ঠান খুলে প্রতারণা করেই চলেছে। ফেসবুকে হাজার হাজার পেজ খুলে রেখেছে এই প্রতারকরা।
(৫) Private : এঁরা গণিকালয় বা কোনো সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত নয়। এঁরা ব্যক্তিগত উদ্যোগেই ক্লায়েন্ট খুঁজে নেয়। তবে যাকে-তাকে নয়, ঝাড়াইবাছাই পরীক্ষানিরীক্ষা করেই ক্লায়েন্ট ধরে। বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য ক্লায়েন্টই তাঁদের পছন্দ। অবশ্য শাঁসালো হতেই হবে ক্লায়েন্টকে। ক্লায়েন্টকে নিয়ে এঁরা কোনো বিলাসবহুল হোটেল বা রিসোর্টে সময় কাটায় মোটা টাকার বিনিময়ে। এছাড়া এঁরা ক্লায়েন্টের ভ্রমণসঙ্গীও হয়। সেইভাবে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপনও দেয়। ক্লায়েন্টের ঘাড় ভেঙে দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করে এবং মনের আশ মিটিয়ে কেনাকাটা করে নেয়। বিনিময়ে সে কয়েক রাতের শয্যাসঙ্গিনী হয়ে যায় ক্লায়েন্টের।
(৬) window or Doorway : জানালা বা প্রবেশপথের মাধ্যমে গণিকালয়ের গণিকারা সম্ভাব্য ক্লায়েন্টকে আহ্বান করে। উইন্ডো’ গণিকারা সাধারণত উষ্ণ জায়গা পছন্দ করে। অপরদিকে ‘ডোরওয়ে’ গণিকারা সাধারণত ঠান্ডা জায়গা পছন্দ করে। উইন্ডো গণিকাদের সাধারণত নেদারল্যান্ড, জার্মানি, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড দেশগুলিতে দেখা যায়। এইসব গণিকারা দিনের বা দিনের কিছুটা অংশ কাজের জন্য উইন্ডো ভাড়া দেয়। গণিকারা স্বাধীন ও নিজেদের পরিচিত ক্লায়েন্টদেরই প্রোভাইড করে এবং তাঁর সঙ্গে সার্ভিস বিষয়ক ও পারিশ্রমিকের বিষয়ে কথাবার্তা বলে নেয়। উইন্ডো গণিকাবৃত্তি মূলত একটি ডাচ ফর্ম (Dutch form)। এই ফর্ম পুরোনো গির্জার আশেপাশে আমস্টারডামের পুরোনো রেড-লাইট এরিয়ায় রাস্তার পাশে শুরু হয়েছিল। শুরুতে জানালাগুলিতে পর্দা লাগানো ছিল। পরে যৌন-নৈতিকতার (Sexual morality) কঠোরতা কম হওয়ায় জানালাগুলি থেকে পর্দা পুরোপুরিভাবে সরে যায়। তখন গণিকারা গণিকাদের পোশাক বা পোশাকের টুকরো ঝুলিয়ে রাখত। বর্তমানে গণিকারা তখনই জানালা বন্ধ রাখে যখন ঘরের ভিতরে ক্লায়েন্ট থাকে। নেদারল্যান্ডের গণিকারা প্রায় ১২০০ উইন্ডো ব্যবহার করে থাকে। নেদারল্যান্ডের ত্রিশ শতাংশ গণিকা উইন্ডোর পিছনে যৌনকর্ম করে। নেদারল্যান্ডের আল্কমার, আমস্টারডাম, হেগ, ডিভেনটার, ডোয়েটিচেম, এইনধোভেন, গ্রোনিনজেন, হারলিম, হিরেনভিন, লাউওয়াডেন, নিমেজেন, রটারডাম শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে উইন্ডো গণিকাবৃত্তি হয়। বেলজিয়ামের অন্টউইপ, ব্রাসেলস, ঘেন্ট, ওসটেন্ড, চারলিওরই, ডেইনজ, লিগ, সিন্ট টুইডেন শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে উইন্ডো গণিকাবৃত্তি হয় এবং জার্মানিতে অ্যাচেন, বোচাম, ব্রাউনচেউইগ, ডর্টমুনড়, ডুইসবার্গ, এসেন, ফ্রাংকফুর্ট, হামবার্গ, কার্লফ্রহে, কলোনি, মনহেইম, ওবারহাউসেন শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে উইন্ডো গণিকাবৃত্তি হয়।
(৭) club, Pub, Bar, Karaoke Bar, Dancehall : এইসব গণিকারা ক্লাব, পাব, বার, মদ ও অন্যান্য টুকিটাকি জিনিস খুচরো বিক্রির স্থানগুলিতে ক্লায়েন্টের কাছে যৌন-আবেদন রাখেন। ক্লায়েন্ট পটে গেলে সংশ্লিষ্ট গণিকার সঙ্গে নির্দিষ্ট ঘরে সময় কাটায়। এই ধরনের গণিকা থাইল্যান্ড, লাস ভেগাস, চিনের ক্যাসিনোগুলিতে দেখা যায়।
(৮) other all-male venues : এইসব গণিকারা যেখানে নিয়মিত পুরুষের জমায়েত থাকে, সেখানেই হাজির হয়ে ছুকছুকে পুরুষদের কাছে ঘেঁষে এসে যৌনমিলনের জন্য প্ররোচিত দেয়। সেনাছাউনি, বাজার-ঘাট, ব্যস্ত রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাস, খনি-ক্যাম্প ইত্যাদি জায়গায় এঁদের দেখা যায়।
(৯) Door knock or hotel : এই গণিকারা সাধারণত আবাসিক হোটেলে বসবাসরত পুরুষ বর্ডারদের যৌনকর্মে আহ্বান জানায়। হোটেলের দরজায় কড়া নাড়ায়। হোটেলের ম্যানেজারের মাধ্যমেও এঁরা হোটেলের রুমে পৌঁছে যায়। ক্লায়েন্ট রাজি হলে হোটেলের ম্যানেজারও কমিশন পায়।
(১০) Transport : এই গণিকারা সাধারণত চলমান বাস, চলমান ট্রেন, চলমান জাহাজে উঠে ভ্রমণরত যাত্রীদের যৌনকর্মে আহ্বান জানায়।
(১১) CB Radio : এই গণিকারা সম্ভাব্য ট্র্যাক ড্রাইভার ক্লায়েন্টদের সঙ্গে একচেঞ্জ বার্তা (অপভাষা) CB Redio ব্যবহার করে হাইওয়ে বরাবর ড্রাইভ করে ট্রাকস্টপ বা পার্কিং এলাকায় যৌন-পরিসেবা দেয়।
(১২) other methods of Solicitation : এইসব গণিকারা বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে–যেমন নোটিশ বোর্ড ও সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন, মোবাইল নম্বর সহ ‘যৌনকর্মীর ক্যাটালগ’, ইন্টারনেটকে ব্যবহার করে ভার্চুয়াল গণিকালয় এবং অন্যান্য অন্তরঙ্গ স্থানগুলিতে যৌন-পরিসেবা বিতরণ করে থাকে।
(১৩) Phone Sex : এটি একটি নতুন ধরনের ট্রেন্ড। এই ফোন সেক্সের দুটো শ্রেণি। একটি হল–“তুমি আমার ফোনে ২০০ টাকা রিচার্জ করে দাও, তাহলে তোমার সঙ্গে চ্যাটে সেক্স করব। তারপর তোমাকে ভালো লেগে গেলে রিয়েল সেক্সও করতে পারি।” এদের সাধারণত প্রতারক গণিকাও বলা যায়। শরীর ও সেক্সের লোভ দেখিয়ে নিজের ফোন রিচার্জ করিয়ে নেয়। তারপর গ্রাহকের ফোন নম্বরটি ব্ল্যাকলিস্টে পাঠিয়ে দেয়। একই সঙ্গে ফেসবুক থেকেও তাঁকে ব্লক করে দেওয়া। কারণ ফেসবুকে একটা আইডি খুলে এঁরা ফেসবুকেই এমন অফার দিয়ে থাকে। অন্যটি হল–এঁরা বলে “তুমি আমার ফোনে এত টাকা রিচার্জ করে দাও, তাহলে তোমাকে আমি আমার ন্যুড ছবি দেখাব, ভিডিও কল করে আমাকে ন্যুড দেখাব।” কতটা ন্যুড সে দেখাবে তা নির্ভর করবে আপনি কত টাকার রিচার্জ করে দিচ্ছেন তার উপর। এঁরাও প্রতারক গণিকা। আর শ্রেণির গণিকা আছেন যাঁরা সেক্স ভিডিও করবে বলে কোনো সাইটে বিজ্ঞাপন দেয়। সঙ্গে থাকে হোয়াটস অ্যাপ নম্বর। হোয়াটস অ্যাপ করলে মেয়েটি জানায় পেটিএমে ৫০০ টাকা পাঠালে ন্যাকেড হয়ে ভিডিও কল করব। যত বেশি টাকা পাঠাবে তত বেশিক্ষণ ভিডিওতে থাকব। ৫০০ টাকায় পাঁচ মিনিট। এঁদের কেউ কেউ প্রতারক হলেও সবাই প্রতারক নয়। তাঁরা ভিডিও কলের মাধ্যমে নিজের শরীর নগ্ন করে উপস্থাপন করে। প্রযুক্তির কল্যাণে সেইসব ভিডিও ‘ওয়েবক্যাম ভিডিও’ নামে বিভিন্ন পর্নো সাইটে পাওয়া যায়।
(১৪) Massage Parlour : ম্যাসাজ পার্লারের বাজার এই মুহূর্তে বেশ রমরমা। বিদেশে থাইল্যান্ড, লাস ভেগাস, চিন প্রভৃতি দেশের ক্যাসিনোগুলোতে বহু আগে থেকেই মেসেজ পার্লারগুলিতে যৌনতা বিক্রি হয়ে আসছে। ভারত তথা কলকাতাতেও এখন মেসেজ পার্লারগুলি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। মেসেজ পার্লারগুলি কিছুদিন আগে পর্যন্ত ধনীদের কুক্ষিগত ছিল। এখন মধ্যবিত্ত ও নিন্মবিত্তদের নাগালের মধ্যেও চলে এসেছে। বিভিন্ন ম্যাসাজ পার্লার, বিলাসহুল ফ্ল্যাট, নামী-দামি বিউটি পার্লারে ‘মেল টু মেল’, ‘ফিমেল টু ফিমেল’, ‘মেল টু ফিমেল’, ফিমেল টু মেল’ ম্যাসাজ করা হয়।
ম্যাসাজ শব্দটির বাংলা অর্থ করলে যা দাঁড়ায় তা হল শরীর মর্দন করা। বর্তমানে ম্যাসাজ পার্লার’ শব্দটি একটি গণিকালয় হিসাবে পরিগণিত হয়েছে। গোড়ার দিকে শুধুমাত্র শরীর ও মন ভালো রাখার জন্য একপ্রকার থেরাপি হিসাবে ব্যবহৃত হলেও ধীরে ধীরে এটা যৌনকর্মের আখড়া হয়ে উঠতে থাকল। সামনের গ্লোসাইন বোর্ডে ম্যাসাজ পার্লার লেখা থাকলেও পিছনে যৌনকর্ম চলে। এ ক্ষেত্রে ১৮৯৪ সালে প্রথম বিষয়টি মানুষের নজরে আসে, যা ম্যাসাজ কেলেংকারী’ নামে পরিচিত হয়েছিল। ১৮৯৪ সালে ব্রিটিশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ম্যাসেজ প্র্যাকটিশনারদের শিক্ষা ও অনুশীলনের অনুসন্ধান করতে গিয়ে তাঁরা দেখে অদক্ষ গণিকাদের আনাগোনা। প্রতিক্রিয়া হিসাবে তাঁরা বৈধ ম্যাসাজ কর্মীদের পৃথকভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে উচ্চতর একাডেমিক মানসম্পন্ন করে ম্যাসিউসেস সোসাইটি’ গঠন করে। সওনাস, স্পা বা অনুরূপ যা কিছু ম্যাসাজ পার্লারের ছদ্মবেশে গণিকাবৃত্তির প্রসার চলতে থাকল। নির্দিষ্ট ম্যাসেজ পার্লারে একটি শুভ সমাপ্তি (Happy Ending) থাকতে পারে, যেখানে ম্যাসাজ আসলে ক্লায়েন্টের সঙ্গে যৌনমুক্তি। যৌনতামূলক হ্যাপি এন্ডিং ছাড়াও ক্লায়েন্টের সঙ্গে যৌন-উত্তেজক ম্যাসাজও করা হয়। এমনকি স্ট্রিপেইজ সঞ্চালনের সময় ক্লায়েন্ট তাঁকে বা নিজেকে হস্তমৈথুন করাতে বা করতে পারে। ইটালি, মালয়েশিয়া, নেপাল, থাইল্যান্ড, আমেরিকা, ব্রিটেন হল এই ধরনের ম্যাসাজ পথপ্রদর্শক।
আমরা নানা ধরনের ম্যাসাজের নাম দেখতে বা শুনতে পাই। যেমন–সুইডিশ ম্যাসাজ, ডিপ টিস্যু ম্যাসাজ, হট-স্টোন ম্যাসাজ, স্পোর্টস ম্যাসাজ, সিয়াৎসু ম্যাসাজ, ট্রিগার পয়েন্ট, কাপলস ম্যাসাজ, প্রেরেন্টাল ম্যাসাজ, রিফ্লেক্সোলজি ম্যাসাজ, থাই ম্যাসাজ, ফুট ম্যাসাজ, অ্যারোমাথেরাপি, স্পা, চেয়ার ম্যাসাজ ইত্যাদি। এই ম্যাসাজ করলে নানা রকমের টেনশন থেকে মুক্তি, শরীরের নানারকম ব্যথা থেকে মুক্তি, ডিপ্রেসন, ইনসোমেনিয়া, হাড়ের জয়েন্ট বা পেশির আড়ষ্টতা কেটে যায় বলে দাবি করা হয়। তবে কোন্ প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের ম্যাসাজ হয়, আর কোন্ অন্য কিছু হয় সেটা যাচাই করে নেওয়া জরুরি। মাঝেমধ্যেই এই ধরনের ম্যাসাজ পার্লারগুলি থেকে যৌনকর্মরত মহিলা ও ক্লায়েন্টদের পুলিশ গ্রেফতার করে, সেই খবর আমরা পাই। তবে কোনো কোনো ম্যাসাজ পার্লার সাইটের মাধ্যমে ম্যাসাজের জন্য ক্লায়েন্টের আকর্ষিত করে। ইন্টারনেট ঘাঁটলে এরকম অসংখ্য সাইটে দেখা মিলবে, যেখানে সরাসরি যৌনকর্মের কথাই বলা হয়ে থকে। এঁদের ম্যাসাজের নামও একটু ভিন্ন। যেমন—স্যান্ডউইচ ম্যাসাজ। খুব জনপ্রিয় ম্যাসাজ। এই ম্যাসাজে দুজন নারী ও একজন পুরুষ। একজন নারী নীচে থেকে ক্রিয়া করবে, অন্য নারী উপর থেকে ক্রিয়া করবে। মাঝে থাকবে পুরুষটি। অথবা দুজন পুরুষ ও একজন নারী। অনুরূপ একজন পুরুষ নীচ থেকে ক্রিয়া করবে, অন্য পুরুষ উপর থেকে ক্রিয়া করবে। মাঝে থাকবে নারী। কোনো ঢাকাঢাক গুড়গুড় নেই। এঁরা স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বিজ্ঞাপিত করে–“We are provide full body massage with full satisfaction by hot expert beautiful female like body to body massage, sextual service, nude massage etc. Full body massage spa with full satisfaction enjoyment and unlimited short with two girls.”
উল্লেখ থাকে রেট, ফোন নম্বর ও ঠিকানা। রেটগুলি এরকম–
Body to body massage — 1500
Sandwich body massage with 2 girls — 2500
Sex massage — 1500
Full body massage — 2000
Erotic massage — 1500
Dry massage — 1500
4 hands massage with sex — 2500
Oil massage — 1500
Powder massage — 1500
(তথ্যসূত্র : Sonia Spa Center)
আজকাল কলকাতা, বড়ো শহর শহরতলিতে অনেকেই নিশ্চয় পোস্টার দেখতে পান, যেখানে মেয়েদের ছবি সহ ‘বডি ম্যাসাজ’ লেখা থাকে অনেকগুলো ফোন নম্বর সহ। এঁরা মূলত প্রতিষ্ঠিত গণিকাপল্লির আধুনিক সংস্করণ। আর-একটু মোডিফায়েড। এখানকার মেয়েরা কেউ গণিকাপল্লির স্থায়ী বাসিন্দা নয়। এঁরা প্রত্যেকেই বিভিন্ন শহর বা গ্রাম থেকে এসে ক্লায়েন্টের জন্য অপেক্ষা করে। কায়েন্ট সংগ্রহ হয় ফোনের মাধ্যমে। ক্লায়েন্ট কবে কখন আসবে সেইমতো ক্লায়েন্টকে একজন সাহায্য করতে এগিয়ে যাবে এবং ক্লায়েন্টকে সঙ্গে নিয়ে সোজা নিজেদের অফিসে চলে আসবে। একটি করে মেয়ে দেখাবে। সংশ্লিষ্ট অফিস থেকে মেয়ে পছন্দ হলে তো ভালোই, নাহলে অন্য অফিসগুলো থেকেও মেয়ে দেখানো হয়। যেহেতু বিজ্ঞাপনে বডি ম্যাসাজ লেখা থাকে, তাই নামকাওয়াস্তে মিনিট দশেক ম্যাসাজ করলেও আসল কাজ যৌনকর্ম চালু হয়ে যায়।
স্ব-ইচ্ছায় যাঁরা যৌনপেশায় আসে, তাঁদের কথায় পরে আসছি। অনিচ্ছাকৃতভাবে যাঁরা যৌনপেশায় আসতে বাধ্য হয়, তাঁদের কথা দিয়েই শুরু করি।
(১) প্রতারক কর্তৃক পাচারকৃত গণিকা : প্রায় গোটা পৃথিবী জুড়েই নারী পাচারের চক্র সক্রিয় আছে। তবে তৃতীয় বিশ্বের গরিব দেশগুলি থেকেই বেশি নারী পাচার হয়ে থাকে। ২০১৬ সালের এক পরিসংখ্যান জানা যাচ্ছে ভারতে ৩ কোটি ১০ লক্ষেরও বেশি মানুষ পাচার হয়ে যায়। এর মধ্যে ১০ লক্ষ ৮ হাজার জন নারী পাচার হয়ে যেতে হয়েছে বিভিন্ন গণিকাপল্লিতে। তবে পশ্চিমবঙ্গের তিনটি আন্তর্জাতিক সীমানা থাকায় পাচারকারীদের জন্য অনুকূল। প্রায় সব ক্ষেত্রে প্রতারকদের দ্বারাই পাচার সম্পন্ন হয়। প্রতারক যে কেউ হতে পারে। সৎ বাবা, সৎ মা হতে পারে, স্বামী হতে পারে, প্রেমিক হতে পারে, প্রতিবেশী হতে পারে, বান্ধবীও হতে পারে। এরা মানুষের দারিদ্রতার সুযোগ নিয়ে ছেলেদের সর্বস্বান্ত করে দেয়, তেমনি মেয়েদের যৌবনও বেচে খায়। কখনো কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে, কখনো বিয়ে করে গণিকালয়ে বিক্রি করে দিয়ে আসে। অত্যন্ত সংঘবদ্ধ এই নারীদেহ পাচারের ব্যাবসা। গুণ্ডা, দালাল থেকে শুরু করে বাড়িওয়ালা-বাড়িওয়ালি পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের মানুষ মিলে এই জাল বিস্তার করেছে।
পণ্যসর্বস্ব আগ্রাসী দুনিয়ায় সবচেয়ে লোভনীয় হল মানুষ, আর লোভনীয় মানুষের চেয়ে সবচেয়ে লোভনীয় হল মেয়েমানুষ। মেয়েমানুষের ব্যাবসা বিশ্বের সবচেয়ে লাভজনক ব্যাবসা। প্রায় বিনিয়োগবিহীন ব্যাবসা। তাই এই দেহব্যাবসার সঙ্গে জড়িয়ে আছে দরিদ্র থেকে ধনী, নেতা-মন্ত্রী পর্যন্ত। গণিকাপল্লির সমৃদ্ধ হবে কীভাবে? ক্লায়েন্ট যে নতুন নতুন চিড়িয়া’ চায়। সিল’ না-কাটা মেয়েদের যে কদর বেশি, রেটও বেশি। অতএব নারীপাচার জারি আছে এবং থাকবে। এই পাচারযজ্ঞ আজ এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, এখন মাতৃগর্ভে থাকা কন্যাভ্রণটিও পাচার হয়ে যেতে পারে।
বিগত কয়েক দশকে সমগ্র বিশ্বজুড়ে নারী ও শিশু পাচারের মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ নারী ও শিশু পাচারের একটি উৎস এবং ট্রানজিট রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত। প্রতিদিন এদেশ থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী ও শিশু বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত দিয়ে অথবা বিমান যোগে পাচার হয়ে যাচ্ছে। পাচারকৃত নারী ও শিশুদের নিয়োগ করা হচ্ছে পতিতালয়ে বা অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ পেশায়।
নারী ও শিশু পাচারের বিষয়টা আসলে কেমন? বিশ্বায়নের যুগে পুঁজি, পণ্য ও প্রযুক্তির মতো পৃথিবী জুড়ে শ্রমের চলাচলও সহজ হওয়ার কথা। কিন্তু জটিল ইমিগ্রেশন নীতির কারণে গত শতাব্দীগুলোর তুলনায় বর্তমান সময়ে বৈধ পথে শ্রম অভিবাসন অনেক কম ঘটেছে। তবে পৃথিবী জুড়ে মানুষের চলাচল থেমে থাকেনি। নানা অবৈধ উপায়ে মানুষ এক দেশ থেকে অন্য দেশে আসা-যাওয়া চলছে। নানা ধরনের চলাচলের মধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হল নারী ও শিশু পাচার। আন্তর্জাতিকভাবে নারী ও শিশু পাচারকে আধুনিক যুগের দাসপ্রথা হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। পাচার কাকে বলে? এ বিষয়ে বড়ো ধরনের বিভ্রান্তি আছে। অবশ্য পাচারের উদ্দেশ্য, প্রকৃতি, পদ্ধতি সবই আগের তুলনায় অনেক জটিল হয়ে গেছে। সাধারণত যে-কোনো ধরনের শোষণের উদ্দেশ্যে জোড় খাঁটিয়ে, ছল চাতুরি, ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে এবং চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে অথবা যাকে পাচার করতে চায় তার উপর কর্তৃত্ব আছে এমন ব্যক্তিকে আইন বহির্ভূত উপায়ে টাকা লেনদেন করার মাধ্যমে লোক সংগ্রহ, স্থানান্তর, আশ্রয়দান ও অর্থ-বিনিময়ে গ্রহণ ইত্যাদি যে-কোনো কর্মকাণ্ডই হল পাচার।
আইওএম, অর্থাৎ ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশনের ব্যাখ্য অনুযায়ী মানুষ পাচার তখনই ঘটে, যখন একজন অভিবাসী জাতীয় অথবা আন্তর্জাতিক সীমান্ত অতিক্রম করে অবৈধভাবে (যেমন—চাকুরি প্রাপ্তির নিমিত্তে, অপহৃত হয়ে, বিক্রিত হয়ে) কোনো কাজে নিযুক্ত হন। পাচারকারী এই কর্মকাণ্ডের যে-কোনো পর্যায়ে উক্ত অভিবাসীকে প্রতারণা, পীড়ন বা অন্য যে-কোনো শোষণের মাধ্যমে তাঁর মানবাধিকার লঙ্ঘন করে অথনৈতিক বা অন্য যে-কোনো প্রকার মুনাফা অর্জন করে।
যে সমস্ত পরিবারের অধিকাংশ দুঃস্থ, নিঃস্ব ও অসহায়, সেই পরিস্থিতির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে আন্তর্জাতিকভাবে সংঘবদ্ধ এক শ্রেণির প্রতারক। তাঁরা প্রলোভন দেখিয়ে অসহায় পিতামাতার মেয়েদের শহরে চাকরি বা যৌতুকবিহীন বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে পাচার করে দিচ্ছে অন্ধকার জগতে। পাচারকারীদের প্রলোভনের শিকার হচ্ছে দেশের ছিন্নমূল, ভবঘুরে নারী ও তাঁদের অভিভাবকরা এবং দারিদ্র্যের নিষ্পেষনে জর্জরিত অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, বিচ্ছেদপ্রাপ্ত ও বিধবা নারীরা। অসহায় নারীরা সুন্দরভাবে বাঁচার আশায় নতুন জীবনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে পাচারকারীদের পাতা জালে জড়িয়ে পড়ছে। পিতামাতারা অর্থ উপার্জনের আশায় বেশি বেতনের চাকরির প্রলোভনে পড়ে বা সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় না-জেনে শিশু-সন্তানদের তুলে দিচ্ছে। পাচারকারীদের হাতে। এভাবে শিশুরাও প্রতারণার শিকার হয়ে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এই পাচারের পিছনে প্রায় সবক্ষেত্রেই অন্যতম কারণ হিসেবে নিহিত রয়েছে দারিদ্র্য, বেকারত্ব, নারীর নিম্নমানের পেশা, চাকরির সুযোগের অভাব, মাথাপিছু নিম্ন আয়, সম্পদে নারীর অধিকার, চাকরির ক্ষেত্রে সমান সুযোগের অভাব ইত্যাদি। দারিদ্র্য ও বেকারত্বের চরম পরিস্থিতিতে দরিদ্র নারী এবং তাঁদের পরিবার বিয়ে ও চাকরির প্রস্তাবে প্রলুব্ধ হয়। এই পরিস্থিতিতে নগদ অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় এমন কারও কাছ থেকে পরিবারের নারী ও শিশুদের জন্য বিবাহ বা চাকরির প্রস্তাব পেলে এসব এলাকার পিতামাতারা তা গ্রহণ করতে দেরি করে না। অন্যদিকে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং ভোগ্যপণ্য পাওয়ার লোভে পাচারকারীরা নিজেদের নিপুণভাবে পরিচালনা করে থাকে।
ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় ১৯৪৭ সালে এবং পুনরায় ১৯৭১ সালে রাজনৈতিক বিভাজন এই এলাকায় পরিবারগুলোকে বিভক্ত করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। দেশবিভাগের কারণে এই বিভক্ত পরিবারগুলোর সদস্যরা একে অন্যকে সীমান্তের একপার হতে অন্য পারে আনা-নেওয়ার কাজে নিয়োজিত। সীমান্ত অতিক্রম করে এক পরিবারের সদস্যরা অন্য পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার বাসনা অনেক সময় নারী ও শিশু পাচারকে ত্বরান্বিত করে। এছাড়া নারী ও শিশু পাচারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক কারণ হলে পরিবারে নারীর অধস্তন অবস্থান, যা সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন মূল্যবোধ, আচার-আচরণ ও সামাজিক রীতি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। আমাদের সমাজে নারীর সামাজিক অবস্থান তাঁর বৈবাহিক অবস্থা দ্বারা নির্ধারিত। বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারের পিতামাতারা মেয়েদের জন্য আইন দ্বারা নির্ধারিত বিয়ের উপযুক্ত বয়স ১৮ বছরের কম হওয়া সত্ত্বেও মেয়েদের বিয়ে দেওয়া দায়িত্ব বলে মনে করে, যার দুটি খারাপ পরিণতি আছে। যেসব ছেলে বিয়েতে যৌতুক চায় না কন্যাদায়গ্রস্ত দরিদ্র পিতামাতারা তাঁদের সঙ্গে খোঁজখবর ছাড়াই কম বয়সি মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করে। অনেক পাচারকারী এই দুর্বলতার সুযোগ নেয়। তাঁরা অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বিয়ে করে নিয়ে গিয়ে বিদেশে পাচার করে দেয়। দ্বিতীয় পরিণতি হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে সহায়সম্বলহীন পিতামাতা বিয়ের সময় যৌতুকের দাবি মেনে নিয়ে বিয়ের ব্যবস্থা করে। কিন্তু পরবর্তীকালে আর শোধ করতে পারে না। তখন মেয়েটি তাঁর স্বামী ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নির্মম নির্যাতনের শিকারে পরিণত হয়। একদিকে মেয়েটি বাবার বাড়িতেও ফিরে যেতে পারে না, অন্যদিকে নির্যাতনের নির্মমতা সহ্যের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। এরকম অসহায় অবস্থার সুযোগ নেয় পাচারকারী চক্র। বিয়ের পর স্ত্রী রেখে পালিয়ে যাওয়া এবং বৈবাহিক সন্ত্রাস পাচারের কারণ হিসাবে কাজ করে। যুবতী, অবিবাহিত অথবা স্বামী পরিত্যক্তা এবং বিধবা নারী সমাজ ও পরিবারের কাছে বোঝাস্বরূপ। এই শ্রেণির নারীর কাছে বিকল্প কর্ম অথবা বিবাহের প্রস্তাব আকর্ষণীয় বলে মনে হয়। তাঁরা পাচারকারী চক্রের সদস্যদের বিবাহ বা লোভনীয় চাকুরির প্রস্তাবে সহজেই সাড়া দেয় আর শেষপর্যন্ত পাচারকারীদের ফাঁদা জালে আটকা পড়ে।
পাচারের উদ্দেশ্য কী আর একটু স্পষ্ট করে বলা যাক—(১) পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিত করা। (২) পর্নোগ্রাফি সিনেমায় ব্যবহার করা। (৩) মধ্যপ্রাচ্যে উটের জকি হিসাবে ব্যবহার করা। (৪) ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত করা। (৫) শরীরের রক্ত বিক্রি করা। (৬) অঙ্গ-প্রতঙ্গ কেটে ব্যাবসা। (৭) মাথার খুলি, কঙ্কাল রপ্তানি করা ইত্যাদি।
এশিয়ার মধ্যে নারী পাচারের প্রথম বৃহৎ দেশ হল নেপাল এবং দ্বিতীয় বৃহৎ দেশ হল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ৪,২২২ কিলোমিটার এবং মায়ানমারের সাথে ২৮৮ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকা আছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম এবং উত্তরবঙ্গ সীমানা দিয়েই পাচার বেশি হয়। বাংলাদেশের পাচারকারীরা ভারতের বিভিন্ন সীমান্ত ব্যবহার করে পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে নারীদের পাচার করে। দেশের উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, রংপুর, রাজশাহী ও চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলার সীমান্ত পথ দিয়ে পণ্য সামগ্রী পাচারের পাশাপাশি নারী ও শিশু পাচার হয়ে থাকে। এসব অঞ্চলের ১১টি রুট পাচারের উদ্দ্যেশে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়ার জন্য যশোরের বেনাপোল একটি অত্যন্ত সহজ ও সুপরিচিত রুট। এখান থেকে বাস ও ট্রেনের যোগাযোগ খুব ভালো হওয়ায় পাচারকারীরা খুব সহজেই কলকাতা পৌঁছে যেতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁ শহরটি বেনাপোল থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে, যেখানে গোটা বাংলাদেশ থেকে সংগ্রহ করা নারী ও শিশুদেরকে নিয়ে যাওয়া হয়। বৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমের মাধ্যমেই হোক আর অবৈধ অনুপ্রবেশের মাধ্যমেই হোক পাচারের উদ্দেশ্যে বড়ো ধরনের কোনো কেন্দ্রে পাঠানোর জন্য তাঁদেরকে বনগাঁয় নিয়ে আসা হয়। বেনাপোল ছাড়া যশোর থেকে পাচারকারীরা সাধারণত ভোমরা, কলারোয়া, দর্শনা, জীবননগর ও ঝাউডাঙ্গা সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে নারী ও শিশু পাচার করে থাকে। এছাড়াও কুষ্টিয়া ও সাতক্ষীরার বিভিন্ন বর্ডার এলাকা দিয়েও পাচার করা হয়। যশোর থেকে নাভারন চৌরাস্তা দিয়ে ভারতে যাওয়া খুবই সহজ। বৈধভাবে ভারতে যাওয়া বেশ ঝামেলাপূর্ণ হওয়ায় পাচারকারী চক্র বিডিআর প্রশাসনের উদাসীনতার সুযোগে এই পথে অবৈধভাবে ভারতে যায়। ভারতীয় পাচারকারী, হস্তান্তরিত নারী ও শিশুকে কলকাতা, দিল্লি ও মুম্বাইয়ের গণিকালয়ে বিক্রি করে কিংবা সেখান থেকে মধ্যপ্রাচ্যে পাচার করে। দীর্ঘকাল ধরে দেহব্যাবসা এবং নারী ও শিশু বিক্রয়ের জন্য কলকাতা নিরাপদ স্থান হিসাবে পরিচিত। আর মুম্বাই নগরীকে পাচারের ট্রানজিট পয়েন্ট হিসাবে ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন গবেষণা থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, যশোরের অধিকাংশ ট্রানজিট পয়েন্টের সঙ্গে ভারতের বিশেষ করে চব্বিশ পরগনার পয়েন্টগুলোর সূক্ষ্ম যোগাযোগ আছে।
কীভাবে পাচার হয় নারী ও শিশু? (১) মূল হোতা : যে ব্যক্তি পাচারের মূল ব্যাবসা পরিকল্পনা, পরিচালনা এবং নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, তাকে পাচারকারী চক্রের মূল হোতা হিসাবে আখ্যায়িত করা যায়। পাচার সংক্রান্ত অর্থের লেনদেন এবং পাচার প্রক্রিয়ার প্রশাসনিক কার্যাবলি এই ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে থাকে। মূল হোতা যে দেশের নাগরিক সে দেশে তাঁর কর্মক্ষেত্র বা দপ্তর থাকতে পারে। আবার তাঁর কর্মস্থল আন্তর্জাতিক ক্ষেত্র পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে অন্য দেশের পাচারকারী চক্রের সঙ্গে যোগাযোগের ভিত্তিতে সে পাচারকার্য সম্পন্ন করে থাকে। (২) দালাল : দালাল হল সেই মধ্যস্বত্বভোগী, যাঁর দেশের ভিতরে বিভিন্ন এলাকায় নেটওয়ার্ক আছে। এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নারী ও শিশু সংগ্রহ করে এবং পাচারকারী চক্রের প্রতিনিধি অথবা পাচারকৃতদের ব্যবহারকারী সংগঠনের হাতে তুলে দেয়। (৩) সংগ্রহকারী : দালালের নেটওয়ার্কের অভ্যন্তরে যেসব ব্যক্তি স্থানীয়ভাবে লোক সংগ্রহ করে দেয়, তাঁদেরকে বলা যেতে পারে সংগ্রহকারী। আরও ব্যাখ্যা করলে সংগ্রহকারী বলতে বোঝায় পাচারের কাজে নিয়োজিত সেইসব লোক, যাঁরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নারী ও শিশু সংগ্রহের কাজকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করেছে। সংগ্রহকারী সাধারণত নিজ গ্রাম থেকে নারী ও শিশু সংগ্রহ করে না, অন্যান্য গ্রাম থেকে তাঁদের সংগ্রহ করে থাকে। অপেক্ষাকৃত ছোটো দালাল আবার নিজেই সংগ্রহকারীর ভূমিকা পালন করতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে সংগ্রহকারী একেবারে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সক্রিয় থাকতে পারে। (৪) সহযোগী : পাচার একটি সংগঠিত চক্রের কাজ। কিন্তু সমাজের বিভিন্ন অংশ যেমন পরিবার, স্থানীয় নেতা, ব্যবসায়ী, পরিবহন শিল্পে কর্মরত লোক, স্থানীয় মস্তান—এরা বুঝে অথবা না বুঝে কিছু অর্থনৈতিক লাভের জন্য পাচারের কাজে সহায়তা করে। এই শ্রেণিকে নারী ও শিশু পাচারের সহযোগী বলা যায়। পাচারের উদ্দেশ্যে সংগ্রহ করা নারী ও শিশুর পরিবার থেকে শুরু করে সীমান্তরক্ষী বাহিনী পর্যন্ত এ ধরনের সহযোগী ব্যক্তিদের পাওয়া যায়। (৫) পরিবার : একজন দালাল যখন সংগ্রহের কাজ করে তখন পরিবারের সদস্যরা অনেক ক্ষেত্রে জেনেশুনেও নারী বা শিশুকে পাচারকারীদের হাতে তুলে দেয়। জামাইবাবু শালীকে অথবা মামা ভাগ্নিকে পাচারকারীদের হাতে তুলে দেওয়ার মত ঘটনাও ঘটে থাকে। (৬) পরিবহন চালক এবং মালিক : পাচারের উদ্দেশ্যে সংগৃহীত নারী ও শিশুদেরকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেওয়ার জন্য বিভিন্ন রকমের পরিবহন ব্যবহার করা হয়। যেমন—রিক্সা, ভ্যান, বাস, নৌকা, ট্রাক ইত্যাদি। এ সকল যানবাহনের চালকরা জেনে বা না-জেনে স্থানান্তরের কাজটি করে থাকেন। এরাও পাচারের সহযোগী। (৭) ঘাট মালিক : নারী ও শিশুদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করার পর সীমান্তবর্তী এলাকায় এনে জড়ো করা হয়। এই এলাকাগুলো ঘাট নামে পরিচিত। ঘাট একটি মাঠ হতে পারে, নদীর তীর হতে পারে, এমনকি একটি বাড়িও হতে পারে। স্থানীয় প্রভাবশালী লোকজন অবৈধ উপায়ে মানুষ পারাপারের লক্ষ্যে সহায়তা করার জন্য এই ঘাটগুলো ইজারা নেয়। নারী ও শিশু পাচারের জন্য এই ঘাটগুলো ব্যবহৃত হয়। এক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ঘাট মালিকরা পাচারের সহযোগী হিসাবে কাজ করে। (৮) সীমান্তরক্ষী বাহিনী : মানুষ পাচারের ক্ষেত্রে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সম্পৃক্ততার কথা সর্বজনবিদিত। তাঁদের সহযোগিতা ছাড়া পাচারকারীদের পক্ষে নিয়মিত এক দেশ থেকে অন্য দেশের সীমান্ত পারাপার করা সম্ভব নয়। অনেক ক্ষেত্রেই পাচারের কাজে সরাসরি যুক্ত না হলেও অর্থের বিনিময়ে তাঁরা সীমান্ত পারাপারে পাচারকারীদের সহযোগিতা করে থাকে।
বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ নারী পাচার হয়ে বিদেশে যাচ্ছে, তার সিংহভাগ অংশকে জোরপূর্বক গণিকাবৃত্তিতে নিয়োগ করা হয়। গণিকাবৃত্তিতে পাচারকৃত মেয়েদের নিয়োগ নির্ভর করে তাঁদের বয়স ও দৈহিক সৌন্দর্যের উপর। এক পরিসংখ্যানে পাওয়া যায় কলকাতার বিভিন্ন পতিতালয়ে বাংলাদেশী প্রায় ২০ হাজার মেয়ে আছে। বিপুল অংকের টাকার বিনিময়ে পাচারকারীরা একেকজন নারীকে গণিকালয়ে বিক্রি করে দেয়। এদের মধ্যে অনেক কিশোরীও থাকে। গণিকালয়ে প্রথম থেকেই নারীরা মানসিক ও দৈহিক উভয় প্রকার নির্যাতনের শিকার হতে থাকে। গণিকাবৃত্তিতে অস্বীকৃতি জানালে সর্দারনি বা গণিকালয়ের মালিকদের হাতে তাঁদের নির্যাতিত হতে হয়। তাঁদেরকে বদ্ধ ঘরে আটকে রাখা হয়। এমনকি অ্যাসিড দিয়ে শরীরের অংশ বিশেষ পুড়িয়ে দেওরার মতো ঘটনাও ঘটে। স্বাস্থ্যগত ও মানসিক দিক বিবেচনায় গণিকালয়ে বিক্রি হয়ে যাওয়া নারী অত্যন্ত বিপজ্জনক অবস্থায় থাকে। সঠিকভাবে নিরাপদ ব্যবস্থা গ্রহণ না-করার বিভিন্ন যৌনরোগে তাঁরা আক্রান্ত হয়। অনেক ক্ষেত্রে এইডসের মতো ভয়াবহ ব্যাধিরও সংক্রমণ ঘটে থাকে, যার অবধারিত ফল মৃত্যু। অনেকে অনাকাঙ্খিতভাবে গর্ভধারণ করে। আর এই অবস্থায় জোরপূর্বক তাঁদের গর্ভপাত ঘটানো হয়, যা তাঁদের স্বাস্থ্যহানি থেকে শুরু করে মৃত্যুরও কারণ হয়। গণিকালয়ে বিক্রি করা ছাড়াও অন্য ধরনের যৌন-ব্যাবসায়ও পাচারকৃত নারী ও মেয়ে শিশুদের কাজে লাগানো হয়। যৌন-পর্যটনের জন্য পাচারকৃত নারীকে হোটেল কর্তৃপক্ষের কাছে বিক্রয় করা হয়। পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্য এ সব নারী ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অনেক সময় ধনী ব্যক্তিরা রক্ষিতা বা সেবাদাসী হিসাবে ব্যবহারের জন্যেও পাচার হয়ে যাওয়া নারীদের কিনে নেয়। সেখানে তাঁদের মুক্তভাবে চলাচল, মত প্রকাশ বা নিজের ব্যপারে কথা বলারও কোনো অধিকার থাকে না। পকিস্তানে পাচার হয়ে যাওয়া বেশিরভাগ নারীই শিকার হয় বাধ্যতামূলক শ্রমের। বিশেষ করে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের লোকেরা তাঁদের কিনে নিয়ে যায় এবং বিয়ে করে। এইসব নারী তৃতীয়, চতুর্থ বা পঞ্চম স্ত্রী হিসাবে শস্য উৎপাদন ও অন্যান্য কাজে শ্রম দিতে বাধ্য হয়। মানুষের বসবাসের অনুপযোগী মরুভূমি অঞ্চলে প্রখর রোদে ভেড়া চড়ানো, জল টানা ইত্যাদি কষ্টদায়ক কাজ করতে বাধ্য হয়। ক্রয় করে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করা হয় বলে সামাজিকভাবেও এঁরা নিগৃহীত হয়। প্রয়োজনবোধে স্বামী আবারও তাঁকে বিক্রি করে দিতে পারে। বাংলাদেশ থেকে নারী প্রতারিত হয়ে সৌদি আরবে যৌনদাসীতে পরিণত হয়ে থাকে। রাজি না-হলে তাঁদের উপর অকথ্য অত্যাচার করা হয়।
নারী ও শিশু পাচারে পশ্চিমবঙ্গের স্থান সারা ভারতে প্রথম। এই হিসাব জাতীয় অপরাধ তথ্য-পরিসংখ্যান দপ্তরের, যা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সরকার ও এনজিওগুলো ভুল বলে দাবি করছে। কেন্দ্রীয় সরকারের নারী ও শিশুকল্যাণ দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী কৃষ্ণা রাজ সংসদে জানিয়েছেন, বাল্য বিবাহ এবং নারী ও শিশু পাচারে পশ্চিমবঙ্গ সারা দেশের সমস্ত রাজ্যের মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে। প্রতি বছরই নারী পাচারের সংখ্যাটা বাড়ছে। রাজ্যসভায় এক লিখিত প্রশ্নের জবাবে কৃষ্ণা রাজ জানান, ২০১৫-১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ নারী ও শিশু পাচারে পয়লা নম্বরে ছিল। ২০১৫ সালে ২০৬৪ জন নারী পাচার হয়েছে। পরের বছর সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫৫৯ জন। শিশু পাচার ২০১৫ সালে ছিল ১৭৯২ জন, ২০১৬ সালে সেটা প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১১৩ জনে। নারী ও শিশু কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী এই হিসাব দাখিল করেছেন ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য উদ্ধৃত করে। রাজ্য সচিবালয়ের দাবি, আগের সরকারের আমলে নারী ও শিশু পাচারের ঘটনা ঘটলেও তা পুলিসের খাতায় নথিভুক্ত হত না। রাজ্যের নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজা নিজে অবশ্য এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। তবে দলীয় সাংসদ কাকলী ঘোষ দস্তিদার দাবি করেছেন, কেন্দ্র সরকারের দেওয়া এই রিপোর্ট ভুল। রাজ্যে শিশু পাচারের দায়ে অভিযুক্ত খোদ বিজেপি নেতা-নেত্রীরা। তাই এখন ভুল পরিসংখ্যান দিয়ে অন্য দিকে নজর ঘোরানোর চেষ্টা চলছে।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর এই তথ্য-পরিসংখ্যানকে ভুল না-বললেও অন্য একটি অসংগতির দিকে নির্দেশ করেছেন দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির দায়িত্বে থাকা ডাঃ স্মরজিৎ জানা। সোনাগাছির গণিকাপল্লিতে বহু বছর ধরেই যৌনকর্মীদের অধিকার নিয়ে লড়ছে দুর্বার, যার মধ্যে এক বড়ো কাজ অনিচ্ছুক যৌনকর্মীদের উদ্ধার করা। অর্থাৎ জোর করে, ইচ্ছের বিরুদ্ধে, কিংবা ভুলিয়ে-ভালিয়ে যৌনপেশায় আনা হয়েছে যে মেয়েদের, যাঁরা পাচার হয়ে এসেছে, দুর্বার তাঁদের চিহ্নিত করে হয় বাড়িতে ফেরত পাঠায়, অথবা বিকল্প কর্মসংস্থান করে। ডঃ জানার বক্তব্য, যারা যৌনপেশায় আসছে প্রতি বছর, তাঁদের সবাইকেই পাচার হওয়া মেয়ে হিসাবে দেখানো হয় ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্যে। কিন্তু অনেক মেয়েই স্বেচ্ছায়, জীবিকার তাগিদে যৌনপেশায় আসে।
দুর্বারের নিজের কাছে এ সংক্রান্ত যা তথ্য আছে, তাতে দেখা যায় অর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা মেয়েরা সাধারণত তিন ধরনের কাজে মূলত শহরে আসে। গৃহ পরিচারিকার কাজ, নির্মাণ শ্রমিকের কাজ এবং যৌনপেশা। প্রথম দুটি কাজ যেহেতু পরিশ্রম-সাপেক্ষ এবং সেই তুলনায় মজুরি যথেষ্ট নয়, তাই সবাই ওই পরিশ্রমের কাজ করতে চায় না। এমতাবস্থায় নিজেরাই অপেক্ষাকৃত কম শারীরিক পরিশ্রমের, কিন্তু বেশি উপার্জনের পেশা যৌনপেশা বেছে নেন। ডাঃ স্মরজিৎ জানার বক্তব্য, এটা একটা বাস্তব প্রবণতা, যাকে উপেক্ষা করা যায় না। বরং অগ্রাহ্য করা যায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের সংসদে দেওয়া ওই তথ্যকে, যা সমস্যার পুরোটা দেখছে না।
একদা যেটা সম্রাট বা রাজা বা জমিদাররা নিজস্ব লেঠেল বাহিনীদের কাজে লাগিয়ে মেয়েদের তুলে আনত বাইজি বা গণিকা বা রক্ষিতা বানানোর জন্য। আজও মেয়েদের ফুসলিয়ে আনা হয় নানারকম প্রলোভন দেখিয়ে। ভারতে ব্রিটিশ আমলে খ্রিস্টান শাসকদের এবং সেনাদের মনোরঞ্জনের জন্য নতুন নতুন গণিকাপল্লি গড়ে ওঠে। সেই গণিকাপল্লি ফলেফুলে ভরিয়ে তুলতে খ্রিস্টান শাসকদের (ব্রিটিশ) পা-চাটা কতিপয় নারী ও পুরুষ উভয়েই প্রত্যন্ত গ্রামে ঢুকে পড়ত মেয়ে সংগ্রহ করতে। মেয়ে তুলে আনার বিনিময়ে প্রাপ্তি হত প্রচুর অর্থ ও উপঢৌকন। এমনকি অতি লোভে মন্দির থেকে দেবদাসীদের পর্যন্ত গণিকালয়ে তুলে আনা হত।
গণিকালয়গুলিতে ‘আড়কাঠি’ শব্দটি খুব শোনা যায়। আড়কাঠি হাল আমলের কোনো নতুন ব্যবস্থা নয়। প্রাচীন যুগেও আড়কাঠি ছিল, যাঁরা ‘বিট’ নামে পরিচিত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে রাজা শূদ্রক রচিত সংস্কৃত নাটক ‘মৃচ্ছকটিকম’ নাটকে বিট চরিত্রের উল্লেখ আছে। তবে আজকের আড়কাঠিদের সঙ্গে প্রাচীনযুগের বিটদের মূলগত পার্থক্য আছে। নাট্যশাস্ত্রে বিটের লক্ষণে বলা হয়েছে–বিট হবেন গণিকাগণের সঙ্গে ব্যবহারে বিশেষজ্ঞ, মধুরভাষী, পক্ষপাতহীন, কবিভাবাপন্ন, শাস্ত্রাৰ্থ ও গণিকা সম্বন্ধে জ্ঞানসম্পন্ন, ইতি ও নেতিবাচক যুক্তিসম্পন্ন বাগী ও চতুর। বিট ব্রাহ্মণ, শিক্ষিত, সংস্কৃতভাষী ও প্রাকৃতভাষী দুই-ই হতে পারে। মৃচ্ছকটিক প্রকরণে দুজন বিট চরিত্র পাওয়া যায়। একজন বসন্তসেনার, অপরজন শকারের। ইন্টারন্যাশনাল জাস্টিস মিশন (IJM) বহু বছর ধরে পাচারকৃত যৌনকর্মীদের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার কাজ করে চলেছে। আমাদের দেশে প্রতি বছর প্রায় ২০,০০০ হাজার মেয়ে কিডন্যাপিং হয়, যার বেশিরভাগরেই জায়গা হয় যৌনপল্লিতে।
(২) যুদ্ধ, সাম্প্রদায়িকতা ও দেশভাগের ফলে গণিকা : আদিমকাল থেকে যুদ্ধের ময়দানে পুরুষের বর্বরতার শিকার হয় নারী। এটা সর্বত্র সত্য, সব দেশেই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চার লক্ষ নারী ধর্ষিত হয়েছিল। ধর্ষক পাকিস্তানি সেনা ও পাকপন্থী রাজাকার। বিশ্বের ইতিহাসে যুগ যুগ ধরে দেখা যায় যে-কোনো জাতিকে দমন করার জন্য, নির্মূল করা জন্য দুটি অস্ত্র এক সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে। তার একটি গণহত্যা, অপরটি ধর্ষণ। মহান মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর একটি বড়ো ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ ছিল নারী ধর্ষণ। এই যুদ্ধকালীন সময়ে নারী ধর্ষণ ছিল পাকবাহিনীর একটি অস্ত্র। একাত্তরে বাংলাদেশের নারীদের উপর যৌন নির্যাতনের ব্যাপকতা, নৃশংসতা এ যাবৎকালে বিশ্বে সংগঠিত সকল যৌন-নির্যাতনের শীর্ষে এবং তা মানব ইতিহাসে বিরল। এটি ছিল পাকিস্থানের দীর্ঘ পরিকল্পনার অংশ, অত্যন্ত সুকৌশলে এ দেশের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে নিজেদের উত্তরসূরি’ রেখে যাওয়া, যাতে এরা ভবিষ্যতে মাথা উঁচু করে না দাঁড়াতে পারে। ১৯৭১ সালে পাকবাহিনী ও তাঁদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের সাহায্যে এ-কাজটি করে। তাঁদের আক্রোশ থেকে দেশের কোনো অঞ্চলই বাদ পড়েনি, তাঁরা সারা দেশে যত্রতত্র এই অত্যাচার চালায়। জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হত ক্যাম্পে। যাতে পালাতে না পারে, তাই বিবস্ত্র করে রাখা হত মেয়েদের। মাথায় চুল পেঁচিয়ে যাতে আত্মহত্যা করতে না-পারে, তাই তাঁদের মাথার চুল কেটে ফেলা হত। তাঁদের ধর্ষণ করা হত দিনের পর দিন। এর ফলশ্রুতিতে এই বিশাল সংখ্যক ধর্ষিতা নারীদের একটি বড় অংশ গর্ভবতী হয়ে পড়ে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ধর্ষণের ফলে অন্তঃসত্ত্বার সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০০০। সাক্ষাৎকারের বিভিন্ন অংশে ডঃ ডেভিস বলেন—“সবচেয়ে সুন্দরী ও বিত্তশালী পরিবারের মেয়েদেরকে অফিসারদের জন্য রেখে বাকিদের সৈন্যদের মাঝে ভাগ করে দেওয়া হত।”
“ওরা আমার বাবা-মাকে মেরে ফেলে, দুজনকেই বন্দুকের বাট দিয়ে পেটাতে পেটাতে মেরেছে। এরপর মেঝেতে আমাকে চিৎ করে শুইয়ে তিনজন মিলে ধর্ষণ করেছে।” এমনটা বলেছে বর্তমানে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত পেট্রাপোলের উদ্বাস্তু শিবিরের এক ষোড়শী। একই প্রতিবেদনের ভাষ্য, “ভিটেমাটি ছেড়ে প্রাণভয়ে পালাতে থাকা পরিবারগুলোর মেয়েদেরও হামলা চালিয়ে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং এরপর বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে পাকবাহিনীর কাছে। অবশ্য পরিবারগুলো মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ছুটিয়ে নিয়েছে অনেককে। যাঁরা পারেনি, তাঁদের ঠাঁই হয়েছে রাজাকারদের খোলা বেশ্যালয়ে। (টাইমস—২১ জুন ১৯৭১)
সরকারি তথ্য অনুযায়ী পাকিস্তানে ধরে নিয়ে যাওয়া কমফোর্ট’ নারীদের মধ্যে ২৫,০০০ নারী ফোর্সড প্রেগনেন্সির শিকার হয়। তবে ‘ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিংস কমিটির সভাপতি ডা. এম এ হাসান বলেন—সংখ্যাটা ৮৮,২০০ জন। ২০০৯ সালে ‘ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিংস কমিটি’ একটি জরিপে উল্লেখ করে–১৯৭১ সালে ২৫ মার্চের কালো রাতে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’-এর মাধ্যমে নিরপরাধ বাঙালি নারীদের উপর নির্যাতন শুরু হয়। ১৯৭১ সালের মার্চে ১৮,৫২৭ জন, এপ্রিলে ৩৫,০০০ জন, মে মাসে ৩২,০০০ জন, জুন মাসে ২৫,০০০ জন, জুলাই মাসে ২১,০০০ জন, আগস্ট মাসে ১২,০০০ জন, সেপ্টেম্বর মাসে ১৫,০০০ জন, অক্টোবর মাসে ১৯,০০০ জন, নভেম্বর মাসে ১৪,০০০ জন, ডিসেম্বর মাসে ১১,০০০ নারী ধর্ষণের শিকার হয়। ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর শেখ মুজিবর রহমান এইসব ধর্ষিতা নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধি দেন। কিন্তু ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধিটি সামাজিকভাবে নেতিবাচক হয়ে গেছে। এইসব নারীরা সম্মানের বদলে পেয়েছে কটুক্তি, বঞ্চনা ও গঞ্জনা। এ উপাধি যেন লজ্জার। বাংলাদেশের ইতিহাসে ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সিনেমাগুলিতে ‘বীরাঙ্গনা বিষয়টিকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে, বীরাঙ্গনার অর্থ দাঁড়িয়ে গেল ধর্ষিতা। ধর্ষিতা? অর্থাৎ বেশ্যা, কুলটা।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এইসব নারীদের নিয়ে বিপাকে পড়ে তাঁদের পরিবারগুলি। তাঁদের স্বাভাবিক জীবনে সবচেয়ে বড়ো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় সমাজব্যবস্থা এবং বিবাহিত নারীদের মধ্যে অনেককেই তাঁদের এমন কি অনেক মুক্তিযোদ্ধা স্বামীরাও গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। ঐ পরিস্থিতিতে অনেককেই বেছে নিতে বাধ্য করে আত্মহত্যার পথ। আবার অনেকেরই জায়গা হয় গণিকালয়ে।
যে দেশের স্বপ্ন চোখে নিয়ে নারীর সম্ভ্রম হারাল, যে মানুষদের জন্য যেসব নারীরা আত্মত্যাগ করল, সেইসব নারীদেরই পরিবার সমাজ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করল। সেইসব বীরাঙ্গনাদের ঠাঁই হল গণিকাপল্লিতে। দেশ স্বাধীন হয়, মর্যাদা পায় না ধর্ষিতা নারীরা। তাঁদের মনে রাখতে চায় না কেউ। সমাজ ‘বেশ্যা’ বলে ঘৃণা করে। অবশ্য পরবর্তী সময়ে বীরাঙ্গনা নারীদের মুক্তিযোদ্ধা এবং তাঁদের সন্তানদের মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হল। বর্তমানে এইসব ধর্ষিত বীরাঙ্গনাদের উদ্দেশ্যে ‘বেশ্যা’ বললে তা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হয়।
১৯৪৬ থেকে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের কারণে এক ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয় ভারত-পাকিস্তান উভয় দেশেই। লাখো লাখ মানুষ যেমন হত্যা হয়েছিল, তেমনি লাখো লাখো নারীকে ধর্ষিতা হতে হয়েছিল। একসময় শান্ত হল দুই যুযুধান সম্প্রদায়। কিন্তু সেই ধর্ষিতা নারীদের কেউ মনে রাখেনি। সমাজ প্রত্যাখ্যান করেছিল। অবশেষে ঠাঁই হল গণিকালয়ে। এটাই শেষ আশ্রয়। গণিকালয় ভরে উঠল। যুদ্ধ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশভাগের পরিণতিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মেয়েরা। প্রতিপক্ষ ছিঁড়েখুঁড়ে খায় নারীশরীর। মেয়েদের দিকেই নেমে আসে আক্রমণের প্রথম বুলডোজারটা। মেয়েরা পতিত হয়।
(৩) উপনিবেশের ফলে গণিকা : শুধু ভারতবর্ষেই নয়, গোটা বিশ্বে এমন কোনো দেশ খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে বিদেশি রাষ্ট্রের উপনিবেশ ঘটেনি। ভারতের কথাই যদি ধরি, তাহলে বলাই যায়, বিদেশি উপনিবেশ ব্যাপকভাবে হয়েছে। কারা উপনিবেশ করেনি–ফরাসি, পোর্তুগিজ, ডাচ, ব্রিটিশ ইত্যাদি। এঁরা নেটিভদের ঘৃণা করত। মেয়েদেরকে কেবলমাত্র ভোগের বস্তু মনে করত। ব্রিটিশ কর্তৃক ভারতীয় মেয়েরা কম ধর্ষিতা হয়নি। লুষ্ঠিত হয়েছে নারী। ব্রিটিশ উপনিবেশকালে ব্রিটিশদের পৃষ্ঠপোষকতায় হাজারে হাজার গণিকা আর গণিকালয় সৃষ্টি হয়েছে। সৃষ্টি করেছিল নিজেদের ও তাঁদের উপোসী সেনাদের কাম চরিতার্থ করার জন্য। এইভাবে বিদেশিদের দ্বারা স্বদেশি নারীরা বারবার লালসার শিকার হয়েছে। লালসা মেটার পর গণিকালয়ের আস্তাকুড়ে ঠেলে দিয়েছে।
(৪) পর্নোগ্রাফির গণিকা : পর্নো-গণিকাবৃত্তি ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছিল? চলমান ছবি আবিষ্কারের পরে পরেই যৌন উত্তেজক চলচ্চিত্রের উৎপাদন শুরু হয়। প্রথমদিকের দুই ফরাসি ইউজেন পিরো (Eugene Pirou) এবং আলবার্ট কারচনার (Albert Kirchner) ছিলেন যৌন উত্তেজক চলচ্চিত্রের অগ্রণী। আলবার্ট কারচেনার বন্ধু পিরোর জন্য প্রথম লাইভ যৌন উত্তেজক ফিল্ম পরিচালিত। তিনি ১৮৯৬ সালে ৭ মিনিটের Le Coucher de la Mariee’ শিরোনামে লুইস উইলি একটি বাথরুম স্ট্রিপটিজ চলচ্চিত্র সম্পাদন ও পরিচালনা করেছিলেন। অভিনয় করেছিলেন লুইস উইলি (Louise willy)। এছাড়াও ১৮৯৬ সালে ফাতিমার ‘Coochie Coochie Dance’ নামক এই ধরনের একটি বেলি ডান্সারের চলচ্চিত্র হিসাবে মুক্তি পায়। ১৯১০ সালে জার্মান ফিল্ম ‘আম অ্যাবেড’ (Am Abend) দশ মিনিট ফিল্ম, যা একজন মহিলা তাঁর শোবার ঘরে একা হস্তমৈথুন করা শুরু করে এবং Straight Sex ও পায়ুমৈথুনরত (Penetration) একজন ব্যক্তিকে সেই দৃশ্যে দেখা যায়। পর্নোগ্রাফিক সিনেমা ১৯২০ সালে নির্বাক চলচ্চিত্র যুগেও বিস্তৃত ছিল এবং প্রায়শই গণিকালয়গুলিতে প্রদর্শিত হত।
নারী ও শিশুদেহের বাণিজ্যিক ব্যবহারের আর-একটি ভয়াবহ দিক হল সেলুলয়েডে যৌনকর্ম করা, অর্থাৎ পর্নোপেশায় যুক্ত হওয়া। এর চর্চা আধুনিক প্রযুক্তির হাত ধরে গোটা পৃথিবীব্যাপী মহামারীর রূপ নিয়েছে। এই খাতটিরও অর্থনৈতিক বাজার বিশাল বড়ো। বিলিয়ান ট্রিলিয়ন ডলারের। তবে এক্ষেত্রে নীল চলচ্চিত্রে অংশগ্রহণকারী নারী ও পুরুষ উভয়কেই গণিকা বলতে হয়। এই পেশায় সবাইকেই যে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, তা কিন্তু বলা যায় না। বহু মেয়েরা স্বেচ্ছায় মোটা টাকা রোজগারের তাগিদে এ পেশায় আসে।
বিশ্বখ্যাত নারীবাদী নেত্রী ও আইনজীবী ক্যাথরিন ম্যাককিননের মতে, পর্নোগ্রাফি ইন্ডাস্ট্রি হিসাবে হলিউডের চেয়ে অনেক অনেক বিশাল। স্যাটেলাইট টিভি ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে যার দ্রুত বিস্তার ঘটেছে। উচ্চবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারের ঘরে ঘরে ইন্টারনেট কানেকশন এখন আর বিস্ময়ের কিছু না। চাইলেই তাঁরা যখন খুশি সেক্স সাইট ব্রাউজ করতে পারছে, ডাউনলোড করে নিতে পারছে যে-কোনো পরিমাণ পর্নো ফুটেজ। যাঁদের ঘরে সে সুবিধা নেই তাদের জন্য আছে অলিতে-গলিতে গজিয়ে ওঠা সাইবার ক্যাফে। এক ঘণ্টা ব্রাউজ করার জন্য ক্যাফেগুলোতে চার্জ নেওয়া হয় মাত্র ২০ থেকে ২৫ টাকা এবং বিনিময়ে একটিমাত্র ক্লিকেই পৌঁছে যাওয়া যায় ভার্চুয়াল যৌনমিলনের জগতে। গুগলের হিসাবে সবচেয়ে বেশি সার্চ হয় পর্নোর সাইটগুলিতে। যাঁরা গণিকালয়ে গিয়ে নারীভোগ করার বুকের পাটা নেই, তারাই সেলুলয়েডে যৌনমিলন দেখে কামপ্রবৃত্তি নিবৃত্তি করে। মানসদর্শনে যৌনমিলন করেন। পুরুষরা সেলুলয়েডের নারীকে ভার্চুয়াল সেক্স করে, নারীরা সেলুলয়েডের পুরুষের সঙ্গে ভার্চুয়াল সেক্স করে। ক্যামেরার সামনে কোটি কোটি যৌনউন্মাদদের কামপ্রবৃত্তি নিবৃত্ত করতে যাঁরা অর্থের বিনিময়ে যৌনকর্ম করে তাঁরা গণিকা না-হলে কারা গণিকা? এ ধরনের গণিকাবৃত্তি ভারত-বাংলাদেশে সহ প্রায় সব বিশ্বেই নির্মাণ হয়ে থাকে। কোথাও গোপনে, কোথাও ওপেনে। সারা বিশ্বে কত রেভিনিউ আদায় হয় এই সেক্স-অ্যাডভেঞ্চার থেকে?
Alex Helmy (founder and publisher of adult-entertainment trade publication) 501629, “পর্নোশিল্পের রাজস্ব অনুমান ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন যে শিল্প বছরেও ৬ বিলিয়ন ডলার উপার্জন করে, কেউ বলবে এটি ১০ বিলিয়ন ডলার, ১৫ বিলিয়ন ডলার বা এমনকি ৯৭ বিলিয়ন ডলার করে। কারণ বেশিরভাগ পর্নো সংস্থাগুলি ব্যক্তিগতভাবে সমস্ত তথ্য গোপন রাখে, তাই সম্পূর্ণরূপে সঠিক অনুমান পাওয়া অসম্ভব।” অন্য এক সূত্র থেকে জানা যায়, বিশ্বব্যাপী পর্নোগ্রাফি প্রায় 100 বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে, এটি একটি বড় স্কেল ব্যাবসা। ২০০৬ সালে চিন ২৭.৪০ বিলিয়ন ডলার, দক্ষিণ কোরিয়া ২৫.৭৩ বিলিয়ন ডলার, জাপান ১৯.৯৮ বিলিয়ন ডলার এবং মার্কিন ১৩.৩৩ বিলিয়ন ডলার আয় করে। এটা মাইক্রোসফট, গুগল, আমাজন, ইবে, ইয়াহু, অ্যাপল এবং নেটফ্লিক্সের তুলনায় বড়ো আয়। পরিসংখ্যানগুলি দেখায় যে, ইন্টারনেট পর্নোগ্রাফির সর্বাধিক দর্শকরা উচ্চ আয়ের সঙ্গে থাকে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নেট পর্নো ভিউয়ার থেকে ৩৫ শতাংশ, অর্থাৎ বছরে ৭৫,০০০ ডলার বা তার বেশি উপার্জন করে। পরের সর্বোচ্চ, ২৬ শতাংশ, অর্থাৎ যাঁরা বছরে ৫০,০০০ ডলার থেকে ৭৫,০০০ ডলার উপার্জন করে। পর্নো ইন্ডাস্ট্রি বিশ্ব অর্থনীতির একটি প্রধান উপাদান, বৃহদায়তন আয় এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। toptenreviews.com-র মতে, পর্নোগ্রাফিতে বিশ্বের প্রতি সেকেন্ডে ৩,০০০ ডলারেরও বেশি খরচ হয়।
চিন — $ ২৭.৪০
দক্ষিণ কোরিয়া — $ ২৫.৭৩
জাপান — $ ১৯.৯৮
আমেরিকা — $ ১৩.৩৩
অস্ট্রেলিয়া — $ ২.০০
ব্রিটেন — $ ১.৯৭
ইতালি — $ ১.৪০
কানাডা — $ ১.০০
ফিলিপিনস — $ ১.০০
তাইওয়ান — $ ১.০০
জার্মানি –- $ .৬৪
ফিনল্যান্ড — $ .৬০
চেক প্রজাতন্ত্র –-$ ৪৬
রাশিয়া — $ .২৫
নেদারল্যান্ড –- $ .২০
ব্রাজিল — $ ১০
মোটা টাকার হাতছানি এড়ানো যে খুব শক্ত কাজ, সেটা বিশ্বের পয়লা নম্বর পর্ন-গণিকা সানি লিওনি একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছে–তাঁর সেক্স করাটা প্যাশন। তিনি স্ব-ইচ্ছায় এই পেশা বেছে নিয়েছেন। স্টেইট, লেসবো – সব ধরনের সেক্স তিনি স্বচ্ছন্দ ছিলেন। আবার একটা সময় ইচ্ছা হল এই পেশা ছেড়ে দিয়ে বলিউডে পাড়ি জমালো ফ্লিমে অভিনয় করে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেওয়ার জন্য। তাই বলে নিজস্ব পর্নোফ্লিমের সাইট কিন্তু বন্ধ করে দেননি। সেই সাইটে শুধু তাঁরই করা পর্নোমুভি সঞ্চিত আছে। কারণ তাঁর সেলুলয়েড সেক্স বিক্রি করে নিয়মিত মোটা টাকার আমদানি হয়। পর্নো-বাজারে সানি লিওনি মুকুটহীন সম্রাজ্ঞী। কোটি ডলার তাঁর দাম। অভিনেত্রী হিসাবে এক-আধটা সিনেমায় কাজ পেলেও তিনি সুযোগ পেলেই দেহব্যাবসার ডাক লঘন করতে পারে না। বছর কয়েক আগে বলিউডের মূলস্রোতে আসার পরেও তিনি ৪৫ লক্ষ টাকার বিনিময়ে এক হিরে ব্যবসায়ীর পার্টিতে নগ্ননৃত্য ইত্যাদি করে এসেছেন। সেই নাচের ভিডিও দৃশ্য সোস্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয়েছে। ডাক্তার স্বামী ড্যানিয়েল ওয়েবর সঙ্গে নিয়ে সানি লিওনি প্রায় ৫৬ টি যৌনসঙ্গম ক্যামেরাবন্দি করেছে। ৫৯ টি পর্নোমুভি নিজে পরিচালনা করেছে। অনুরূপ আর-এক দামি পর্নো-গণিকা মিয়া খলিফাও স্বেচ্ছায় ক্যামেরার সামনে সেক্স করতে এসেছিলেন মোটা টাকা কামানোর জন্য। আবার তিনিও স্বেচ্ছায় এই পেশা ছেড়ে দিলেও পূর্বের করা পর্নো থেকে আসা রোজগার নিতে ছাড়েননি। এছাড়া প্রিয়া অঞ্জলি রাই, দেবিকা, রেশমা, শাকিলা, পিটা জেনসেন, লিজা আন, হিটোমি তানাকা, ক্রিস্টি ম্যাক, নাতাশা ডালাস, ক্রিস্টিনা রোজ, হোলি সুইট, অ্যালেক্সা লোরেন, অলিভিয়া লাভলি প্রমুখ পর্ন-গণিকারা মোটা টাকা রোজগারের জন্যেই ক্যামেরার সামনে যৌনকর্ম বেছে নিয়েছে। অন্তত এদের অকপট স্বীকারোক্তি সেটাই প্রমাণ করে।
গণিকাপল্লির মেয়েদের সঙ্গে মূলগত পার্থক্য হল পল্লির গণিকারা চার দেয়ালের ভিতরে গোপনীয়তা রক্ষা করে হাজার হাজার পুরুষের সঙ্গে যৌনমিলন করে ন্যায্য অর্থের বিনিময়ে। পর্নোস্টাররা ক্যামেরার সামনে অর্থের বিনিময়ে হাজার হাজার পুরুষের সঙ্গে যৌনমিলন করে এবং সেই ক্যামেরাবন্দি যৌনমিলন সারা পৃথিবীর কোটি কোটি দেখে। আর-একটি পার্থক্য হল পর্নো-গণিকাদের পরিচালকের নির্দেশে বিভিন্ন কায়দায় যৌনমিলন করতে হয় এবং সাধারণ গণিকারা কোনো তৃতীয় পক্ষের নির্দেশ ছাড়াই স্বাধীনভাবে যৌনমিলন করে। পার্থক্য যাই-ই থাক, উভয়ে গণিকাবৃত্তিই করে।
ধনী সাধারণ গণিকা যেমন আছে, তেমনি ধনী পর্নো-গণিকাও আছে। তবে পর্নো-গণিকাদের মতো উচ্চহারে উপার্জন বোধহয় সাধারণ গণিকাদের হয় না। সাধারণ গণিকাদের উপার্জনে যেমন বিভিন্নতা আছে, ঠিক তেমনি পর্নো-গণিকাদের উপার্জনেও রকমফের আছে। সকলেই চোখ কপালে তোলা উপার্জন করার সৌভাগ্য অর্জন না-করলেও মোটামুটি যে ১০ জন পর্নো-গণিকার উপার্জনের কথা উল্লেখ করব, তাতে চোখ কপালে উঠবেই। পর্নো-গণিকাদের প্রথম ১০ জনের সম্পত্তির পরিমাণে শীর্ষে জেনা জ্যাকসন।
সেরা ১০ জন পর্নো-গণিকার সম্পত্তির পরিমাণ–
কিন্তু ক্যামেরার সামনে যৌনপেশায় এইসব গণিকাদের রোজগারই তো শেষ কথা নয়। আছে আরও অনেকেই। আলো যেমন আছে, অন্ধকার আছে তেমন পাশাপাশি। অসংখ্য যে পর্নো-গণিকারা যে কাজ করেন, তাঁদের সকলের পারিশ্রমিক কিন্তু আশাব্যঞ্জক নয়। (১) নারী, যাঁরা কেবল বিভিন্ন পুরুষের সঙ্গে যৌনমিলন করবে। এঁদের গড় আয় ৩০০ থেকে ১৫০০ মার্কিন ডলার। (২) যে নারী একজন নারীর সঙ্গে যৌনমিলন করবে, সেই নারীদ্বয়ের পরিশ্রমিক ৭০০ থেকে ১২০০ মার্কিন ডলার। (৩) পুরুষ, যে পুরুষরা নারীর সঙ্গে যৌনমিলন করবে, তাঁর পারিশ্রমিক ৫০০ থেকে ১৫০০ মার্কিন ডলার। (৪) পরিচালকের গড় আয় ১০০০ থেকে ৩০০০ মার্কিন ডলার। (৫) ক্যামেরাম্যানের পারিশ্রমিক ৫০০ থেকে ৭০০ মার্কিন ডলার। (৬) সাউন্ড টেকনিশিয়ানদের পারিশ্রমিক ৩০০ থেকে ৪০০ মার্কিন ডলার। (৭) প্রোডাকশন অ্যাসিস্ট্যান্টের গড় আয় ১০০ থেকে ২৫০ মার্কিন ডলার। (৮) স্টিল ফোটোগ্রাফারের গড় পারিশ্রমিক ৫০০ মার্কিন ডলার। (৯) মেক আপ আর্টিস্টের পারিশ্রমিক ৫০০ মার্কিন ডলার।
যাঁরা নিয়মিত পর্নোমুভি বা তথাকথিত নীল ছবির দুনিয়ার সামান্যতম খোঁজখবর রাখেন, এক ডাকে থ্রি অলসনকে চিনে থাকবেন। কী বলছেন অলসন? তিনি বলছেন–“পর্নো করলে তুমি সমাজ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়বে। তোমার মানবাধিকার কেড়ে নিতে উদ্যত হবে।” থ্রি অলসন বলছেন–“পর্নো খারাপ, এ কথা আমি বলছি না। কিন্তু বাকিরা তোমার সঙ্গে কীভাবে আচরণ করছে, সেটাই তোমার জীবনের প্রধান বিষয়। যদি মনে করো, মেয়েদের কোনো আড্ডায় যোগদান করবে, তাহলে স্রেফ পেশার জন্যেই তুমি সেখানে ঠাঁই পাবে না। … একবার যখন পর্নো-গণিকার তকমা তোমার গায়ে লেগেছে, তখন তুমি বাড়িতেও সবসময় যৌনতার হাট খুলে বসেছে। অপরদিকে রক্ষণশীল দেশের জনপ্রিয় অভিনেত্রী রাখী সাওয়ান্ত সাংবাদিকদের ক্যামেরার সামনে সটান ঘোষণা দিতে পারেন–“আমি আপনাদের সকলকে আজ একটা ভালো খবর দিতে চাই। আমি একজন পর্নোস্টার হতে চাই।” এই ঘোষণা শুনে যাঁরা সেলুলয়েডে রাখী সাওয়ান্তের যৌনক্রিয়া দেখার জন্য উশখুশ করছিলেন, শেষপর্যন্ত তাঁদের ইচ্ছাপূরণ হয়েছে কি না আমার জানা নেই। হায়, গণিকা হওয়া কি এতই সুখের!
একটি ঘটনার উল্লেখ করি। ঘটনাটা ঘটেছে ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ভারতের বেঙ্গালুরুতে। পর্নো ছবি দেখে তো স্বামীর মাথায় হাত। ডেক্সটপের পর্দায় যে মহিলাটি যৌনসঙ্গম করছেন, তিনি আর কেউ নয়, তাঁর নিজের স্ত্রী। পর্নোগ্রাফি দেখতে দেখতে প্রায় হার্ট অ্যাটাক হওয়ার উপক্রম স্বামীর। পর্নোগ্রাফি দেখা শিকেয় উঠল তাঁর, বসে পড়লেন মাথায় হাত দিয়ে। ২০১৮ সালে বিয়ে হয় কলকাতার বাসিন্দা এক মহিলা ও উত্তরপ্রদেশের এক যুবকের। বিয়ের পর তাঁরা থিতু হন বেঙ্গালুরুতে! বিয়ের কিছুদিন পর স্ত্রী স্বামীকে জানিয়েছিলেন তাঁর প্রাক্তন প্রেমিকের বিষয়ে। এও বলেছিলেন, সেই ব্যাক্তির সঙ্গে বর্তমানে তাঁর আর কোনো যোগাযোগ নেই। স্ত্রীর সততায় বেশ খুশিই হয়েছিলেন স্বামী। স্বামী লক্ষ করলেন পর্নোগ্রাফির প্রতি স্ত্রীর চূড়ান্ত আসক্তিতে। একদিন স্ত্রী স্বামীকেও একটি পর্নোগ্রাফির ভিডিও দেখতে বললেন। সঙ্গেও এও দাবি রাখলেন, ছবির মতো করেই তাঁকে ‘আদর করতে হবে। স্ত্রীর আবদার মানতে পর্নোগ্রাফি দেখা শুরু করলেন স্বামী, এরপরই ঘটল বিপত্তি। স্ত্রীর মোবাইলে পর্নোমুভি দেখতে গিয়েই ভিরমি খেলেন। দেখলেন পর্নোমুভির নায়িকা খোদ তাঁর স্ত্রী। ধরা পড়ে গিয়ে মহিলা বলেন, ছবিতে তাঁর বিপরীত থাকা পুরুষটিই তাঁর প্রাক্তন প্রেমিক। বাধ্য হয়েই ভিডিওটি স্যুট করেছিলেন। এই ভিডিওটি দেখিয়ে রীতিমত তাঁকে ব্ল্যাকমেলও করত প্রাক্তন প্রেমিক। স্ত্রীর কথা বিশ্বাসও করে নেন স্বামী। কিন্তু দিনকয়েক বাদে ফের পর্নোসাইটে স্ত্রীর আরেকটি ভিডিও দেখতে পান স্বামী। সেখানে সঙ্গী আবার অন্য পুরুষ। অবশেষে হাতেনাতে ধরা পরতেই সত্যিটা স্বীকার করেন মহিলা। জানান, এক নয়, একাধিক পুরুষের সঙ্গে তিনি যৌন মিলন করেছেন এবং এটা ওর খুব ভালো লাগে। নতুন নতুন পুরুষসঙ্গে নতুন নতুন কায়দায় যৌনমিলনে সে সম্পূর্ণ তৃপ্ত, ব্যাংক ব্যালান্সও মন্দ হচ্ছে না।
(৫) রূপোলি পর্দায় গণিকা : মুভিমোগল শেখর কাপুর, রাজকাপুর প্রমুখ কতিপয় চলচ্চিত্র নির্মাতা খুব কায়দা করে সেলুলয়েডে নারী-শরীর বিক্রি করতেন মুনশিয়ানার সঙ্গে। এইসব নির্মাতারা বিলক্ষণ জানেন নারীর খোলা বুক, নগ্ন পা, খোলা পিঠ, স্বচ্ছ সাদা কাপড়ে জলে-ভেজা নগ্ন শরীর ভালো বিকোয়। তাই কোনো না কোনো ছুতোনাতায় নারী-শরীরের গোপন সেলুলয়েড বন্দি করে ফেলবে। কখনো-বা অভিনেত্রীর উপর প্রভাব খাঁটিয়ে, কখনো যথেষ্ট পারিশ্রমিক দিয়ে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একদম আনকোরা মেয়েদের ব্যবহার করা হয়। সেইসব মেয়েরাও ইন্ডাস্ট্রিতে কেরিয়ারের স্বপ্ন দেখে রাজিও হয়ে যায়। অভিনেত্রীদের বোঝাতে সক্ষম হয় যে তারা কত মহান কাজ করতে চলেছে, ইতিহাস রচনা করতে চলেছে। সত্যি কথা বলতে কি সেইসব অভিনেত্রীরা বেশিদূর আর এগোতে পারে না। সব হারিয়ে যায় অকালেই। কারণ দর্শকরাও সেই অভিনেত্রীর কাছ থেকে কেবলমাত্র নগ্নতাই প্রত্যাশা করে। অল্পস্বল্প নারী-অঙ্গ দেখাতে দেখাতে নির্মাতারা এতটাই সাহসী হয়ে ওঠে যে নগ্নতা তথা যৌনমিলনের দৃশ্যও টেক করতে শুরু করে দেয়। ভারতীয় চলচ্চিত্রে এইসব দৃশ্য সেন্সর বোর্ড আটকে দিলেও হলিউডের চলচ্চিত্রগুলিতে সেইসব নগ্নতা তথা যৌনমিলনের দৃশ্য প্রদর্শন করা হয়। চলচ্চিত্র উৎসবে সেইসব আন-সেন্সর্ড সিনেমা দেখার জন্য দর্শকরা পাগলের মতো ছুটে গিয়ে প্রেক্ষাগৃহ হাউসফুল করে দেয়। নারীর নগ্ন শরীর দেখিয়ে প্রযোজকরা ফুলেফেঁপে ওঠে। তবে ভারতীয় চলচ্চিত্রে খুল্লামখুল্লা দৃশ্যায়ন হলে সেন্সর পায় না বটে, কিন্তু এ ধরনের সিনেমা তৈরি তাতে থেমে থাকে না। প্রচুর রগরগে যৌনদৃশ্য তৈরি করা হয়। খুব কম পয়সা বিনিয়োগ করে প্রচুর মুনাফা অর্জনের লোভ ছাড়বে কে? কসমিক সেক্স, দি ডিভাইন সেক্স, গাণ্ডু, মাশরুম (ছত্রাক), রঙ রসিয়া, কামসূত্র, কামসূত্র থ্রিডি, সিদ্ধার্থ, মচালতা জওয়ানি, রেশমি কি জওয়ানি, গোলাবি রাতে, হর রাত নই খিলাড়ি ইত্যাদি মুভি নারী-শরীর নির্ভর করেই। এইসব চলচ্চিত্রের অভিনেত্রীদের ‘গণিকা’ বই অন্য কিছু বলে না মানুষ।
মেইন স্ট্রিমের এইসব মুভিতে যৌনদৃশ্য কেন সেলুলয়েডে বন্দি করা হয়? নির্মাতারা বলেন–“চিত্রনাট্যের ডিমান্ড”। চিত্রনাট্যের ডিমান্ড কীভাবে তৈরি হয়? ঈশ্বর-প্রেরিত পূর্বনির্ধারিত ব্যাপার নাকি? আসলে কোনো মুভিতে কোথায় কতটা নগ্ন যৌনতা রাখা হবে, তা পরিকল্পিতভাবেই করা হয়। এটাই ব্যাবসায়িক কৌশল। প্রোডিউসারদের নির্দেশ। ব্যাবসা ভালো হয়। সেভাবেই ছক কষা হয়। কারণ ওই রগরগে যৌনদৃশ্যই মুনাফা আনবে। চিত্রনাট্যের ডিমান্ড একটা ভাঁওতা। সংশ্লিষ্ট মুভি যৌনদৃশ্যগুলি বাদ দিয়ে দেখানো হলে আপনি বুঝতেই পারবেন না, সেখানে কোনো যৌনদৃশ্যের প্রয়োজন আছে। একটা উদাহরণ দিই। আপনারা নিশ্চয় ‘মাশরুম’ বা ‘ছত্রাক’ মুভির নাম শুনেছেন? এই মুভির কোনো একটি দৃশ্যে দেখানো হয়েছে অভিনেত্রী পাওলি দাম নীচে পা ঝুলিয়ে খাটের উপর সম্পূর্ণ উলঙ্গ চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। অভিনেতা অনুব্রত মণ্ডল পাওলির দু-পা ফাঁক করে উপরদিকে তুলে ধরে যৌনাঙ্গ চাটছে। পাওলির সংলাপ–“উফ উফ, চাট চাট”। এই দৃশ্য মুভি রিলিজের আগে ইন্টারনেটে লিক হয়ে মোবাইলে মোবাইলে ছড়িয়ে পড়ে। মাশরুম বা ছত্রাক মুভি কজন দেখেছেন সেটা বলা মুশকিল, পাওলি-অনুব্রতর যৌনদৃশ্যের ভিডিও ক্লিপিংটি দেখতে বোধহয় কেউ বাকি নেই। এখনও নেট সার্চ করলে এই ভিডিও ক্লিপিংটা পাওয়া যায়। যারা ‘মাশরুম’ বা ‘ছত্রাক’ মুভিটি দেখেছেন, তারা কি বলতে পারবেন মুভিতে ওই দৃশ্যটি কোথায় ছিল? বলতে পারবেন না। কারণ ওই দৃশ্যটি মুভিতে রাখাই যায়নি। এমনকি কান ও টরেন্টের চলচ্চিত্র উৎসবেও ওই দৃশ্যটি দেখানো যায়নি। যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে মুভি জগতের সঙ্গে জড়িত আছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানেন সেন্সর বোর্ড কী ছাড় দেবেন আর কী ছাড় দেবেন না। সেন্সর নির্দিষ্ট গাইড লাইন আছে। সেই গাইড লাইন কী নির্দেশ আছে সে বিষয়ে সকলেই অবগত। তা সত্ত্বে এই যৌনদৃশ্য বা যৌনমিলনের দৃশ্যগুলো সেলুলয়েডে বন্দি করা হয় কেন? উদ্দেশ্য দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার। শুধু ভারতেই নয়, পৃথিবীর সর্বত্রই এক শ্রেণির অভিনেতা-অভিনেত্রীরা সেলুলয়েডে যৌনমিলনের দৃশ্য সেলুলয়েড বন্দি করে। এক একটা মুভি এমন তৈরি করা হয়, সেগুলি পর্নোমুভি বলাই যায়। সেলুলয়েডে সেক্স করা অভিনেত্রী (‘গাণ্ডু’ ও ‘কসমিক সেক্স’ খ্যাত) ঋতুপর্ণা ওরফে ঋ এক সাক্ষাৎকারে কী বলছে, পড়ুন – “আমার শরীরের মালিকানা আমার। দোকান সাজিয়ে বসেছি। বেচতে লজ্জা কীসের! আমার বাবু আর আমার দালাল আমি নিজেই। যারা আমার শরীর দেখে লজ্জা পান, উত্তেজিত হয়ে পড়েন, তাঁরা হোন। কিন্তু এই যে প্রতিনিয়ত তাঁদের আদিম সত্তাকে ‘ট্রিগার’ করি, এটাই কানেকশন উইথ মাই অডিয়েন্স।” কী বুঝলেন? গণিকা!
২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে সারা বিশ্বে করোনা প্যানডেমিকের প্যানিকে লক ডাউন ঘোষণা হল। বলা হল মুখে মাস্ক এবং অবশ্যই সোস্যাল ডিসট্যান্সিং মেনে চলতে হবে। স্তব্ধ হয়ে রুজিরোজগার। কোটি কোটি মানুষ কাজ হারাল। সেই ভয়ংকর প্রভাব থেকে যৌনপল্লিও রেহাই পেল না। কোনো ক্লায়েন্ট আর যৌনকর্মীদের সংস্পর্শে আসতে চাইলেন করোনার ভয়ে। যৌনকর্মীরা ভাতে মারা গেল। রোজগার বন্ধ হয়ে গেল। মাসের পর মাস। লক ডাউন উঠে গেলেও যৌনবাজার স্বাভাবিক হল না। এমতাবস্থায় যৌনপল্লির যৌনকর্মীরা যেমন সংকটে পড়ে গেল, তেমনি যৌনপল্লির বাইরে স্বাধীন যৌনকর্মীরাও সংকটের মধ্যে পড়ে গেল। ঠিক এমন সময়ে এক শ্রেণির শর্টফ্লিম নির্মাতারা আসরে নেমে পড়ল। শর্টফ্লিমের নামে যৌনমিলনের মুভি তৈরি করতে থাকল। এইসব মুভিতে সুযোগ পেতে থাকল যৌনকর্মীরা। নতুন মেয়েরাও এই মুভিতে কাজ করতে শুরু করে দিল যাঁরা অনেকেই লক ডাউনে কাজ হারিয়েছে। এইসব মুভি বিশেষ কিছু অ্যাপ ইনস্টল করে দেখতে হয়। নির্ধারিত সাবস্ক্রিপশন দিয়ে। তেমনই কিছু অ্যাপের নাম Hothit, 11Up Movies, Unseen, Uncutmasala, Eightshots, Fliz Movies ইত্যাদি। শর্ট ফ্লিমের এই নব সংস্করণের বাজারি নাম ওয়েব সিরিজ। এই মুভিগুলি আসলে সেলুলয়েডে বন্দি অবাধ যৌনকর্ম। রমরমা বাজার। সেন্সর বোর্ডের নজরদারি নেই। এইসব মুভিতে বহু পরিচিত অংশগ্রহণকারী মুখগুলি হল–টিনা নন্দী, জোয়া রাঠোর, কাজল গুপ্তা, সোনিয়া মাহেশ্বরী, কবিতা রাধেশ্যাম, আলিশা, জারা, সীমা, সুচরিতা, দোলন, রিংকি চোপড়া, এলিজা প্রমুখ। এঁদের অভিনেত্রী বললে অভিনেত্রীদের অপমান করা হবে। এঁরা গণিকাই, যাঁরা অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন পুরুষের সঙ্গে যৌনকর্ম করে। পুরুষ যৌনকর্মীরাও এই ট্রেন্ডে কাজ করছে। বিশ্বকে দেখানোর যৌনকর্ম এবং মোটা অঙ্কের রোজগার।
মুভির অভিনেত্রীরা কেন গণিকা বা যৌনকর্মী নয়? এ প্রশ্ন আমার নয়, এ প্রশ্ন কলকাতার খোদ যৌনকর্মীদের পক্ষ থেকেই উঠেছে। ‘অল ইন্ডিয়া নেটওয়ার্ক অব সেক্স ওয়ার্কার্স’-এর পক্ষ থেকে যৌনকর্মীদের এমনই প্রশ্ন বিশ্বের কাছে। যৌনকর্মীদের স্পষ্ট প্রশ্ন সিনেমার নায়িকা হওয়ার জন্যেও তো বিক্রি করতে হয় শরীর। সেক্ষেত্রে যিনি শরীর বিক্রি করলেন, তাঁকে তো যৌনকর্মী বা গণিকা বলা হয় না। তাঁদের পরিচয় প্রদানেও কোনো অসম্মানজনক শব্দ বা রুচিহীন শব্দ ব্যবহার করা হয় না। তাহলে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য শরীরের বিনিময়ে উপার্জনের ক্ষেত্রে আমাদের কেন যৌনকর্মী পরিচয় পেতে হবে? শরীরের বিনিময়ে নায়িকা হওয়া বা নায়িকা হয়ে শরীর বিক্রি করার বিষয়টি খুব প্রচলন একটি গোপন সত্য হিসাবে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশেও প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। গুঞ্জন আছে, অধিকাংশ নায়িকাই শরীর উপটৌকন দিয়ে থাকেন পরিচালক কিংবা প্রযোজক কিংবা প্রভাবশালীদের কাছে। অনেক নায়িকাই বিদ্রোহ করে কাজ হারান, আবার অনেকেই আপোস করে টিকে থাকেন। শরীরকে বিনিয়োগ করে কেরিয়ারের সিঁড়ি হিসাবে ব্যবহার করতে পিছ-পা হন না অনেকেই। শরীরের বিনিময়ে তাঁরা সিনেমায়, নাটক ইত্যাদিতে কাজের সুযোগ পান। বাংলাদেশে এক ধরনের মুভি বা মিউজিক ভিডিও করা হয়, যেখানে নায়িকারা সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে সম্পূর্ণ জামাকাপড় পরিহিত নায়কের সঙ্গে চটুল বাংলা গান সহ নাচ করেন। অত্যন্ত জঘন্য সেই নৃত্যদৃশ্য। বুঝতে অসুবিধা হয় না এইসব নায়িকাদের একমাত্র মূলধন নগ্ন শরীর। নগ্ন শরীর প্রদর্শন করেই অর্থ রোজগার করেন। শরীর বিক্রিই তো করে এঁরা। গণিকা নয়? তাহলে সেক্ষেত্রে যৌনকর্মীদের প্রশ্নটিকে উড়িয়ে দেওয়া হবে কেন? ক্যামেরার সামনে শরীর দান করে, শরীর প্রদর্শন করে তামাম পুরুষদের ট্রিগার করে তাঁরা নায়িকা পরিচয় নিয়ে থাকবেন, আর শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য শরীর বিক্রি করে যাঁরা অর্থ রোজগার করে ক্যামেরা ছাড়া, তাঁরা যৌনকর্মী? তাই সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার তাগিদে শরীর বিক্রি করা যৌনকর্মীরা প্রশ্ন তুলেছে যৌনতার জন্য যেসব অভিনেত্রীরা শরীরকে অর্থ রোজগারের মাধ্যম করে, তাঁরা কেন যৌনকর্মী নয়?
বদল ঘটেছে যৌনতায়, সেটা সমাজের বিভিন্ন অংশের যৌনকর্মীদের বিভিন্ন মনোভাব ও কাজকর্মের ধরনেই প্রকাশ পায়। এআইএনএসডব্লিউ (AINSW)-এর নতুন কমিটি যুগ্ম সচিব তথা বিহারের পূর্ণিয়ার যৌনকর্মীদের সংগঠন ‘আম্রপালি কল্যাণ সমিতি’-র সচিব রেখা রানি বলেন–“ফিল্মের নায়িকা হওয়ার জন্যেও তো শরীর বিক্রি করতে হয়। যাঁরা শরীর বিক্রি করে নায়িকা হন, তাঁদের কেন সেক্স ওয়ার্কার বলা হবে না?” তিনি অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে বলেন–“যৌনকর্মীদের পরিচয় দেওয়ার জন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমন শব্দ ব্যবহার করা হয়, সেই শব্দ কেন ওই নায়িকাদের জন্য ব্যবহার হয় না?” রেখা রানি বলেন–“শরীরের বিনিময়ে নায়িকা হওয়া তো সেক্স ওয়ার্কারের মতো কাজ। আমরাও তো সেক্স করেই উপার্জন করি। দিই যৌনসুখ। তাহলে আমাদের ক্ষেত্রে কেন অন্য রকমের আচরণ করা হবে? ওদের নায়িকা হওয়ার জন্যে সেক্স করতে হয়, আর আমরাও রোজগারের জন্য সেক্স করি। নায়িকারা গ্ল্যামার সেইসঙ্গে রোজগারের জন্য সেক্স, আর আমাদের গ্ল্যামারহীন রোজগারের জন্য সেক্স করি–পার্থক্য শুধু এইটুকুই।” যৌনকর্মীদের সংগঠন দিশা মহিলা বহু-উদ্দেশীয় সংগঠনের সচিব তথা এআইএনডব্লিউ-র অপর যুগ্ম সচিব লতা কাপসের মতে, “শরীর বিক্রি করে নায়িকা হলেও সেক্ষেত্রে সেক্স ওয়ার্কার বলা হয় না। আর আমরা শরীরের বিনিময়ে বেঁচে থাকলেও আমাদের সেক্স ওয়ার্কার বলা হয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসন্মানিত করা হয়।”
(৬) ক্যানভাসে গণিকা : ‘রং রসিয়া’ নামে হিন্দি মুভিতে দেখানো হয়েছে চিত্রশিল্পী রবি ভার্মার চিত্রশিল্পের মডেলার সুগন্ধি, যিনি চিত্রশিল্পীর চিত্রশিল্পের জন্য নগ্ন হতেন এবং কখনো-সখনো সুযোগ-সুবিধা মতো। চিত্রশিল্পীর সঙ্গে যৌনমিলনও করতেন। সুগন্ধি বিলক্ষণ বুঝেছিলেন তিনি শিল্প এবং প্রেমের জন্য নগ্ন হলেও রবি ভার্মা, রক্ষণশীল সমাজ ও রাষ্ট্র তাঁকে ‘বেশ্যা’ হিসাবেই দেখত। স্বীকৃতিহীন এক নারী সুগন্ধির পরিণতি হল গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহনন। এটাই বাস্তব। প্রদীপের নীচে অন্ধকারকে আড়ালে রেখে চিত্রশিল্পীরা বিখ্যাত হয়ে যায়। মডেল নারীদের কেউ মনে রাখে না। যে সলতে হয়ে শিল্পীর শিল্পসত্তাকে জাগিয়ে তুলে পুড়ে মরল, তাঁদের খবর কেউ রাখি না। চিত্রশিল্পীরা চিত্র অঙ্কন করবেন, ভাস্কররা ভাস্কর্য নির্মাণ করবেন, সে তো ভালো কথা। শিল্প মনের বিকাশ ঘটায়, চেতনার মুক্তি দেয়। তার জন্য কেন নারীকে নগ্ন হতে হবে? কেন নারী-শরীরকে ব্যবহার করতে হবে? যে নারী শিল্পীর ক্যানভাসের নগ্ন হয়ে বসেন, সে কী সমাজে পরিবারে বলতে পারে, সে শিল্পীর সামনে শিল্পের জন্য নগ্ন হয়? না, বলতে পারে না। কারণ এই নগ্ন হওয়াটা সমাজ মহৎ হিসাবে দেখে না। গণিকারা যেভাবে বাড়িতে তাঁর কাজের ধরন লুকিয়ে রেখে গণিকাবৃত্তি চালিয়ে যায়, ঠিক তেমনিভাবেই মডেল নারীরা পরিবার ও সমাজকে তাঁর পেশা লুকিয়ে নগ্ন হতে আসে। সমাজ ও পরিবারে সেই নারী বলতে পারেন না যে, সে চিত্রশিল্পীর সামনে নগ্ন হয়ে রোজগার করেন। কারণ পেশাটি সমাজে নিষিদ্ধ। ন্যুড স্টাডির নামে নারীকে শুধু নগ্ন করা হয় তা তো নয়, অনেক ক্ষেত্রে শিল্পীর যৌনলালসার শিকার হন। কিন্তু এই মডেলরা কোনো স্বীকৃতি পায় না। আসলে ছলে-বলে-কৌশলে শিল্প মাধুর্যে নারীকে নগ্ন করে দেওয়াই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরোনো অভ্যাস। বলা হচ্ছে–The nude’ figure is mainly a tradition in Western art, and has been used to express ideals of male and female beauty and other human qualities. It was a central preoccupation of ancient Greek art, and after a semi-dormant period in the Middle Ages returned to a central position in Western art with the Renaissance. Athletes, dancers, and warriors are depicted to express human energy and life, and nudes in various poses may express basic or complex emotions such as pathos. In one sence, a nude is a nude is a work of fine are that has as its primary subject the unclothed human body, forming a subject genre of art, in the same way as landscapes and still life. Unclothed figures often also play a part in other types of art, portraiture, or the decorative art. While there is no single definition or fine art, there are certain generally accepted features of most definitions. In the fine arts, the subject is not merely copied from nature, but transformed by theb artist into an aesyhetic object, usually without significant utilitarian, commercial (advertision, illustration), or purely decorative purposes.
একটা গল্প বলি, গল্প নয় সত্য ঘটনা। আমার মেজো ভাইরা ভাই বিখ্যাত মডেল ফোটোগ্রাফার। তিনি তাঁর এক অভিজ্ঞতা আমার সঙ্গে শেয়ার করলেন। বললেন–“আমাকে একটা মডেল সেশনের জন্য মধ্যপ্রদেশ যেতে হয়েছিল কয়েকদিনের জন্য। খাজুরাহের মন্দিরকে বিষয় করে মডেল-নারীরা বিভিন্ন রকমের পোজ দেবেন। সেই ছবি তুলে ফোটোগ্রাফার হিসাবে আমাকে মডেল-নারীদের প্রোফাইল তৈরি করে দিতে হবে। সেই প্রোফাইলের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ভর করে ফোটোগ্রাফারদের উপর। সব মডেল-নারীই চাইবে তাঁর প্রোফাইলই শ্রেষ্ঠ হবে। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু চাইলেই তো শ্রেষ্ঠ হওয়া যায় না। তা নির্ভর করে একজন ফোটোগ্রাফার কতটা তাঁকে এক্সপোজ দেবে, কীভাবে দেখবে তার উপর। বিশেষ কোনো মডেল-নারীকে সে এক্সপোজ কেন দেবে? সেই প্রশ্নটাই বড়ো হয়ে দাঁড়ায়। অতএব ফোটোগ্রাফারকে বশে আনতে হবে। সেটা কীভাবে? মাঝরাতে হোটলে ফোটোগ্রাফারের ঘরের দরজায় কড়া নাড়তে হবে এবং শরীর নিবেদন করার সুযোগ নিতে হবে। সুযোগ নিতে পারলেই কেল্লা ফতে। এটাও মনে রাখতে হবে সব ফোটোগ্রাফারকে যেমন শরীর নিবেদন করে বশ করা যায় না, তেমনি সব মডেল-নারীও শ্রেষ্ঠ প্রোফাইলের জন্য শরীর বিক্রি করে না। তা সত্ত্বেও সমাজে মডেল-নারী ও মডেল-ফোটোগ্রাফারদের সুনজরে দেখা হয় না। ধরেই নেওয়া হয় মডেল-নারী ও মডেল ফোটোগ্রাফারের চরিত্রের ঠিক নেই। এঁরা এর সঙ্গে তাঁর সঙ্গে শোয়। মডেল ফোটোগ্রাফারের কাজ করি শুনলেই মেয়ের বাবারা তাঁদের মেয়ে দিতে চায় না এই কারণেই।”
নগ্ন আলোকচিত্রশিল্প বলতে নগ্ন বা অর্ধ-নগ্ন ব্যক্তির চিত্র ধারণকারী যে-কোনো ধরনের আলোকচিত্র বা নগ্নতার ইঙ্গিতপূর্ণ চিত্রসমূহ নির্দেশ করে। নগ্ন আলোকচিত্র বিভিন্ন উদ্দেশ্যে গ্রহণ করা হয়ে থাকে, যার মধ্যে শিক্ষাগত ব্যবহার, বাণিজ্যিক প্রয়োগ এবং শিল্পকর্মের উদ্দেশ্য নিহিত থাকে। সাধারণত ব্যক্তিগত ব্যবহার, নির্দিষ্ট বিষয় বা শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট সঙ্গীর উপভোগের উদ্দেশ্যেও নগ্ন আলোকচিত্র গ্রহণ করা হয়ে থাকে। প্রদর্শনী বা নগ্ন আলোকচিত্রের প্রকাশ বিভিন্ন সংস্কৃতি বা দেশে বিতর্কিত হতে পারে, বিশেষত যদি আলোকচিত্রের বিষয়টি অপ্রাপ্তবয়স্ক হয়ে থাকে। অধিকাংশ নগ্ন আলোকচিত্র সাধারণত নারী বিষয়ক বৈশিষ্ট্য সংবলিত হতে দেখা যায়।
নগ্ন আলোকচিত্র সাধারণত বৈজ্ঞানিক এবং শিক্ষাবিষয়ক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য গ্রহণ করা হয়ে থাকে, যেমন জাতিগত গবেষণা, মানবদেহতত্ত্ব বা যৌনশিক্ষা ইত্যাদি। এই প্রসঙ্গে আলোকচিত্র গ্রহণে এর বিষয় বা আলোকচিত্রটির সৌন্দর্য বা যৌনকামনা সৃষ্টির উপর জোর দেওয়া হয় না, বরং শিক্ষাগত বা প্রদর্শনমূলক উদ্দেশ্যে আলোকচিত্র তৈরি করা হয়।
Edouard-Henri Avril একজন ফরাসি চিত্রশিল্পী ছিলেন, যিনি তাঁর অঙ্কিত নগ্ন এবং যৌন উত্তেজক শিল্পকর্মের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি ‘পল আভ্রিল’ ছদ্মনামে ছবি প্রকাশ করতেন। তেওপিল গাউটিয়েরের (ফরাসি লেখক) লেখা উপন্যাস ‘ফরচুনিও’-তে ছবি আঁকতে গিয়ে তিনি সর্বপ্রথম ‘পল আভিল’ নাম গ্রহণ করেন। তাঁর আঁকা ছবি দেখে বহু লেখক তাদের গল্প বা উপন্যাসে নগ্ন ছবি আঁকার জন্য পলকে নিতেন। পল নগ্ন ছবি এঁকে রাতারাতি খ্যাতিমান হয়ে যান অল্প দিনের মধ্যেই। প্রায় প্রতিদিনই ফ্রান্সে তাঁর আঁকা ছবি সংবলিত বই বিক্রি হত এবং কমপক্ষে একশোটার নীচে বিক্রি হত না। তিনি নিজেও বহু ছবি এঁকে বেচেন এবং ভালো আয় করেন। শিল্পী নারীকে নগ্ন করেন সামান্য অর্থের বিনিময়ে। সেই চিত্র বিক্রি করে শিল্পী খ্যাতি লাভ করেন, প্রচুর অর্থ রাজগার করেন। আর যে নারী নগ্ন হয়ে শরীরী বিভঙ্গ বিক্রি করলেন, তাঁর প্রাপ্তি কতটুকু? সেই প্রশ্নটা থেকেই যায়।
নগ্ন শরীর প্রদর্শন করাও এক শ্রেণির নারীদের মধ্যে এক জনপ্রিয় পেশা। স্ট্রিপটিজ, অর্থাৎ পরনের কাপড় খোলা হচ্ছে মানুষের মধ্যে যৌন-উত্তেজনা জাগানোর জন্য এক প্রকারের আয়োজন, যেটাতে একজন সুন্দরী নারী একে একে তাঁর সব কাপড় খোলা শুরু করে ধীরে ধীরে এবং সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে যায় একটা সময়ে। এরূপ কর্মে নিয়োজিত নারীকে স্ট্রিপার বা ইক্সোটিক ড্যান্সার বলা হয়। এই ধরনের অনুষ্ঠান বা আয়োজন সাধারণত কোনো বিলাসবহুল পাঁচ তারকা হোটেল বা স্ট্রিপ ক্লাবে হয়। স্ট্রিপটিজের মূল উদ্দেশ্য মানুষের শরীর দেখিয়ে অন্য মানুষকে যৌন-উত্তেজনা দেওয়া, যৌনমিলন করতে দেওয়া নয়। অর্থাৎ যৌনমিলন না-করেও শরীর বিক্রির ব্যবসা। চিনে এক ধরনের সংগীত গোষ্ঠী আছে, সেই গোষ্ঠীর সব সদস্যরাই নারী। অর্থাৎ ভোকালিস্ট থেকে কনসার্ট শিল্পীরা। এঁরা তিনদিক ভোলা মঞ্চে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে হাজার হাজার দর্শকদের সামনে সংগীত পরিবেশন করে থাকে। শুধু চিন কেন, আমাদের ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে তিনদিক খোলা মঞ্চে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে হাজার হাজার দর্শকদের সামনে চটুল গানের সঙ্গে খ্যামটা নাচে। এমনকি খোলা মঞ্চে সব বয়সের হাজার হাজার দর্শকদের সামনে যৌনমিলনও করে থাকে। এই ধরনের যৌনব্যাবসা সবচেয়ে বেশি দেখতে পাওয়া দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে।
ঠিক কবে থেকে শিল্পীদের মধ্যে নারীকে নগ্ন করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল? ঠিকঠাক সাল-তারিখ জানা না গেলেও একথা বলাই যায় সমাজে পুরুষ আধিপত্য কায়েম হওয়ার পর থেকেই নারীকে নগ্ন করা শুরু হয়। প্রাচীন তৈলচিত্ৰতেও আমরা নগ্ন নারীদের দেখতে পাই। মুসলিম যুগেও নগ্ন নারীর তৈলচিত্র পাওয়া যায়। নারীকে নগ্ন করা হত তা নয়, নারীদের নগ্ন রাখা হত। ক্রীতদাসী ও হারেমে রক্ষিত নারীদের নগ্নভাবে থাকতে হত। তাঁদের যেমন খুশি ব্যবহার করা হত। নিজ শরীরের উপর নারীদের কোনো অধিকার ছিল না। ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দাপটে নিন্মবর্ণের নারীদের ঊধ্বাঙ্গ অনাবৃত রাখতে হত। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রে পুরুষরা নারীদের নগ্ন করতে নগ্ন দেখতে নানা অছিলায় লালায়িত। শরীরী বিভঙ্গের প্রশংসায় নারীও সজ্ঞানে-অজ্ঞানে পুরুষদের পাতা ফাঁদে নিজেদের পা গলিয়ে ফেলল। শরীরী-সৌন্দর্য প্রদর্শনে নারীরাও উদগ্রীব হয়ে উঠল।
সম্ভবত নগ্নচর্চা শুরু হয়েছে রাজাদের ইচ্ছাপূরণ ও মনোরঞ্জনের কারণে। অনুরূপ রাজাদের মনোরঞ্জনের শিল্পীরা চিত্র অঙ্কন করত, তেমনি নগ্ন তথা আদিরসাত্মক যৌনসাহিত্যও রচনা করত কবিরা। রাজারা নগ্নতা খুব পছন্দ করতেন। তাই রাজাদের খুশি করতে পারলে দামি উপটৌকন, সেইসঙ্গে সভাকবি বা রাজকবির পদ। চিত্রশিল্পীরাও পেতেন। সেকালে কবি-চিত্রশিল্পীরা রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি করতেন। হাতুড়ি-ছেনি-তুলিতে ফুটিয়ে তোলা হত নারীর নগ্নতা। অশ্লীলতার সমালোচনার ঝড় এড়াতে সুপরিকল্পিতভাবে শিল্পের নামে মাহাত্ম বা মহিমা জুড়ে দেওয়া হল। নগ্নতাই হয়ে উঠল ‘শিল্প’। নারীকে যত খুশি যেমন খুশি নগ্ন করো, সামনে বসাও, শোয়াও, দাঁড় করাও এবং সুযোগ পেলে ভোগ করো। বিনিময়ে সামান্য পারিশ্রমিক দাও। সামান্য রোজগারের আশায় মফঃস্বল থেকে নিন্মবিত্ত এমনকি মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে মেয়েরা আসছে নগ্ন হতে। বেশিরভাগ মেয়েরা দারিদ্রতার কারণে সংসারে অভাব মেটানোর তাগিদে গোপনে এই পেশা বেছে নিচ্ছে। নগ্ন নারীদের চিত্র-ভাস্কর্য খুব চড়া দামেই বিকোয়। শিল্পীরা ‘দ্যুড আর্ট’ যতই মাহাত্ম্য আরোপ করুক না কেন, সমাজে এইসব মেয়েরা কুলটা’ বলেই ঘৃণিত।
(৭) আকর্ষণীয় পেশা হিসাবে গণিকা : সব মেয়েরাই যে পাচারকৃত হয়ে বা প্রতারিত হয়ে গণিকা পেশায় নিযুক্ত হচ্ছেন এ কথা বলা যায় না। প্রচুর মেয়েরা এ পেশায় আসছেন স্ব-ইচ্ছায়, কায়িক পরিশ্রমহীন মোটা টাকা রোজগারের হাতছানিতে। অন্য রোজগার থাকা সত্ত্বেও অতিরিক্ত রোজগারের আশায় যেমন আসে, তেমনি অভাবি মেয়ে-বউরাও গণিকাপেশায় আসে। আর পাঁচটা স্বাভাবিক পেশার মতোই এই পেশাকেও গ্রহণ করে।
তবে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন এবং থাইল্যান্ড এই চারটি দেশে জরিপ তথ্য সাক্ষ্য দেয় যে, নিরক্ষর ও অদক্ষ মেয়েদের পক্ষে যেসব কাজ করা সম্ভব তার মধ্যে গণিকাবৃত্তিই সবচেয়ে বেশি অর্থাগম ঘটায়। উদাহরণস্বরূপ, মালয়েশিয়ার ম্যানুফাঁকচারিং কোম্পানিতে কাজ করে ১৯৯০ সালে একজন দক্ষ শ্রমিক বছরে উপার্জন করত ২৮৫২ মার্কিন ডলার এবং একজন অদক্ষ শ্রমিক উপার্জন করত ১৭১১ মার্কিন ডলার। বিপরীতে সেই সময়ের হিসাবে কোনো নিন্মমানের হোটেলে যৌন-পরিসেবা বা শরীর বিক্রি করে একজন মহিলা সপ্তাহে মাত্র একদিন বারো ঘণ্টা কাজ করে বছরে ২০৮০ মার্কিন ডলার উপার্জন করতে পারত। স্কুল কলেজের ছাত্রীরা এবং গৃহবধূরা আজকাল স্বেচ্ছায় এই পেশায় আসছেন প্রচুর পরিমাণে। বাড়তি চাহিদা মেটাতেও এই পেশায় আসছে কাঁচা পয়সার হাতছানিতে। এই ভারতে তথা এই বাংলায় খুব গোপনে প্রচুর অর্থ রোজগারের আশায় মেয়েরা আসছে। এখন যৌনমিলনে কন্ডোম বাধ্যতামূলক। কন্ডোম ছাড়া কোনো মেয়েই যৌনকর্ম করে না। এর ফলে যেমন মেয়েদের গর্ভবতী হওয়ার ভয় নেই, তেমনি যৌনরোগেরও ভয় নেই। ফলে উদ্যাম যৌনকর্মে কোনোরকম ভয় কাজ করছে না। কন্ডোমের ব্যবহারের ফলে যৌনরোগেরও ভয় থাকছে না। এইসব মেয়েরা অনেকেই শিক্ষিত। ফলে ক্লায়েন্টের কাছ থেকে ঘৃণা নয়, সমীহ আদায় করে নেয় অনেকক্ষেত্রেই। এঁরা ট্রিপিকাল গণিকাদের মতো সারাক্ষণ পান চিবোয় না। ক্লায়েন্টের অনুরোধ না-থাকলে পারতপক্ষে মদ্যপান করে না, ধূমপান করে না। এইসব ধোপদুরস্ত মেয়ে-বউদের কাছে যৌনকর্মে ক্লায়েন্টরা স্বস্তি পায়। যৌনরোগের আশঙ্কায় ভোগে না ক্লায়েন্টরাও। এই শ্রেণির গণিকাদের রেটও যথেষট চড়া। যৌনপল্লির মতো ঘুপচি সিঙ্গেল খাটে যৌনক্রিয়া নয়। রাতারাতি ধনী হওয়ার লোভেও অনেক মেয়ে-বউরা শাঁসালো পুরুষকে ক্লায়েন্ট হিসাবে বেছে নেয়। সমাজের আনাচে-কানাচে চলছে এহেন নিরন্তর যৌনকর্ম।
বছর কয়েক আগে সংবাদপত্রে একটি সংবাদ হয়তো সবাই পড়েছেন। যাঁরা পড়েননি, তাঁদের জন্য সংবাদটা উল্লেখ করলাম–ভারতের একটি শহর। থানায় এসে এক মহিলা সটান এসে বলল, “আমি বাজারের মেয়েছেলে নই। আমি যৌনকর্মী। এটাই আমার পেশা।” ডিউটি অফিসারের তো ভড়কে যাওয়ার দশা। মুম্বাইয়ের এক কলগার্ল উত্তরপ্রদেশের লখনউয়ে মহিলা থানায় অভিযোগ লেখাতে গিয়েছিলেন। শহরের কয়েকজন বিত্তবান ব্যক্তি এক পাঁচতারা হোটেলে এই মহিলার কাছ থেকে যৌন-পরিসেবা নিয়েছে। এরপর এই কলগার্লকে ন্যায্য পারিশ্রমিক তো দূরের কথা, উল্টে তাঁর কাছে থাকা প্রচুর পরিমাণে টাকাপয়সা ও অন্যান্য সামগ্রী যা ছিল, সব লুঠ করে ক্লায়েন্টরা পালিয়ে গেছে। মুখে তাঁর ইংরেজির ফুলঝুরি। মেয়েটিকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় পুলিশ আধিকারিকদের তো বিমূঢ় অবস্থা। নিজের পুরো কাহিনি শুনিয়ে বলল–“এই পেশা থেকে দুই কোটি টাকা আমাকে উপার্জন করতে হবে। সেই উপার্জনের অর্থে আমি একটা আধুনিক বিউটি পার্লার খুলব। এরপর এই পেশা ছেড়ে বিউটি পার্লার চালাব বাকি জীবন।” মেয়েটি পুলিশ আধিকারিককে জানায়, শরীরের জৌলুস ও বাঁধুনি ঠিক রাখতে একজন পেশাদার প্রশিক্ষকের কাছে তিনি যান। খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে তিনি খুব সচেতন। মাত্রাতিরিক্ত খাওয়ার ফলে শরীরে চর্বি জমে গেলে কদর থাকবে না। তাই সে ডায়াটিশিয়ানের পরামর্শ মেনে চলে। শুধু তাই নয়, তিনি প্রতি ছয় মাস অন্তর মেডিকেল চেক আপও করিয়ে নেয়।
গিয়েছিলাম বি কে পাল অ্যাভিনিউয়ের কাছাকাছি একটি ফ্ল্যাটে। আগে থেকেই কথা ছিল আমি যাব। ফোনেই সময়-দিন জানিয়েছিলাম। সে মোতাবেক একজন যুবক এসে আমাকে কোয়ার্টারের ভিতরে নিয়ে গেল। তিনতলায় গেলাম। আমাকে বলল, কেমন মেয়ে চান? বিবাহিত, না অবিবাহিত?
আমার পাঁচজন মেয়ে চাই একসঙ্গে–আমি বললাম।
–হয়ে যাবে। ডাকি মেয়েদের? পছন্দ করুন মেয়েদের।
–রেট বলুন।
–এক ঘণ্টার জন্য ২০০০ টাকা। নন-এসি। এসি হলে অতিরিক্ত ৬০০ টাকা। একবার শট। দু-ঘণ্টার জন্য নিলে ৩০০০ টাকা নন-এসি। এসি অতিরিক্ত ৬০০ টাকা। চারবার শট নিতে পারবেন। টাকা কাজ করার পর দেবেন।
–এক ঘণ্টা হলেই হবে। পছন্দ করার কিছু নেই। ডাকুন যে-কোনো পাঁচজন মেয়ে।
পাঁচজন নানা বয়সের মেয়ে এসে আমাকে একটি ঘরে নিয়ে গেল। ঘরে ঢুকিয়ে দরজায় ছিটকিনি তুলে একজন মেয়ে আমাকে বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করল–“মাত্র এক ঘণ্টার পাঁচজন মেয়ে দিয়ে কী করবেন?” মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলাম–কী নাম তোমার? নাম বলল–“কাজল”। আমি বললাম–“তোমরা সবাই খাটের উপর উপর গোল হয়ে বসো। আমিও বসছি।” খাটের উপর গোল হয়ে বসে প্রত্যেকে নিজের নিজের টি-শার্ট খোলার জন্য উদ্যত হতে দেখে আমি বললাম–“খোলার দরকার নেই। তোমাদের সঙ্গে গল্প করার জন্য এসেছি। অন্য কোনো কারণে নয়। গল্প করা যাবে?” একটি মেয়ে বলল–কত ঘণ্টার জন্য নিয়েছ আমাদের?
–এক ঘণ্টা।
এই এক ঘণ্টা তোমার। তোমার যা মনে হয় করতে পারো।
শুধু গল্প করব, সবার সঙ্গে। প্রথমে তোমাদের নামগুলো বলো।
আমি পায়েল।
–আমি রীতা।
–আমি তপতী
–আমি নূরজাহান।
–আর তুমি কাজল।—আমি বললাম।
–কী গল্প করবেন?
—ব্যক্তিগত। তোমাদের কাজকর্ম নিয়ে।
–বলুন, কী জানতে চান?
–তোমরা এই কাজে কীভাবে এলে? প্রতারণার শিকার হয়ে?
–না। মেয়েরা সমস্বরে বলল।
–তাই নাকি? তাহলে কীভাবে এই কাজ বেছে নিলে শুনি সেই গল্প।
–আমি এখানে আসার আগে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করতাম। বনগাঁ থেকে সল্টলেক আসতাম। করেছিলাম বেশ কয়েক বছর। একদিন কাজ শেষ হতে অনেকটা রাত হয়ে গেল। অফিস থেকে রাস্তায় বেরিয়েছি। হঠাৎ দেখি একটা গাড়ি এসে আমার সামনে দাঁড়াল। গাড়ির ভিতরে কোম্পানির মালিক। আমাকে উঠতে বলল। আমি বললাম–“প্রয়োজন নেই। আমি একাই যেতে পারব।” উনি নাছোড়। বাধ্য হয়েই গাড়িতে উঠে পড়তে হল। দশ মিনিটের রাস্তায় উনি বললেন–“চলো, একদিন দীঘা থেকে বেরিয়ে আসি তুমি আর আমি। খুব মজা হবে।” আমি বললাম–“তা কী করে হয়?” উনি বললেন–“কেন হবে না? তোমার কোনো খরচা নেই। সব খরচা আমার। এছাড়াও তোমাকে দশ হাজার টাকা দেব। ক্যাশ।” আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। উল্টোডাঙা স্টেশন এসে গেছে। আমি বললাম–“ব্যাস, এখানেই নামিয়ে দিন।” “কিছু বললে না”–উনি বললেন। আমি বললাম–“ভেবে দেখি। কাল জানিয়ে দেব।” না, কাল আর কাজে গেলাম না। আসলে কাজটাই ছেড়ে দিলাম। আর ভাবতে থাকলাম, উনি কেন আমাকে নিজের খরচে বেড়াতে নিয়ে যাবেন? কেনই-বা এমনি এমনি দশ হাজার টাকা দেবেন? নিশ্চয় এমনি এমনি নয়। আমাকে ভোগ করবে। দশ হাজার টাকায় আমাকে ভোগ করার মূল্য দিতে চায়। আমাকে ভোগ করতে দিলে কেউ দশ হাজার টাকা দেবে তাহলে? মন্দ নয় তো ব্যাপারটা! পাকাপাকিভাবেই তো এ কাজ করা যেতে পারে। রোজগার আর সেক্স দুটোই মিটবে। এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে আমি ডেলি প্যাসেঞ্জারি করতাম। তাঁকে বললাম–“এরকম একটা কাজ দেখে দাও না। খুব ইচ্ছা।” উনি বললেন–“আচ্ছা, ঠিক আছে।” কয়েকদিন বাদে উনি জানালেন, “কালকে চলে এসো, তোমাকে সেখানে নিয়ে গিয়ে আলাপ করিয়ে দেব।” আমি চলে এলাম এখানে। বাড়ির মালিক বলল–“তুমি নাবালিকা। তোমাকে কাজে নেওয়া যাবে না।” আমি বললাম–এই দেখুন আমার পেট। আমি দুই সন্তানের মা। আমার পেটে দাগ দেখুন। আমার বয়স তিরিশ।” মালিক বলল–“এসব কথা বোর্ডে বলবে। বোর্ডে বলতে পারবে তো? বোর্ডে পাশ করলে আমাদের কাজে নিতে কোনো অসুবিধা নেই।” বোর্ডে উঠলাম এবং পাশ করলাম। আজ প্রায় বছর খানেক হল এখানে কাজ করছি। সকাল সাতটার মধ্যে এখানে ঢুকি, আর রাত সাতটায় এখান থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফিরি। রোজ। তবে যেদিন হোল নাইট ক্লায়েন্ট আসে, সেদিন রাতে তো থাকতেই হয়।”–এ কাহিনি শোনাল কাজল।
–পায়েলের কথা বলল এবার। পায়েল, তোমারও কী এখানে আসার কাহিনি একরমই?
–একদম না।—ঘাড় ঝাঁকিয়ে পায়েল বলল।
–বলল, তোমার এখানে আসার গল্প।
–আমার স্বামী আছে। এক সন্তানও আছে। এই দেখুন ছেলের ছবি। ক্লাস সেভেনে পড়ে। ইংলিশ মিডিয়াম পড়ে। আমার স্বামীর যা রোজগার, তাতে আমার ছেলেকে ভালো স্কুলে পড়ানো সম্ভব নয়। আমাকেও কোনো কিছু করা দরকার। কিন্তু কী করব? কে কাজ দেবে? আমি তো কোনো কাজ জানি না। কাজ না-জানলে কায়িক পরিশ্রমের কাজ করতে হবে, যেখানে শরীরের শক্তি প্রয়োজন। রোজগারও তেমন হবে না। শরীরই যখন খাটাতে হবে, তবে শরীর খাঁটিয়ে অনেক বেশি রোজগার করা যায় তেমন পেশাই বাছতে হবে। চলে এলাম এখানে, শুরু করলাম কাজ। এ পেশায় টানা পাঁচ বছর। ডেলি কম করে ১০০০ টাকা রোজগার করা মোটেই কঠিন নয় এখানে। ধনী ক্লায়েন্টের কাছ থেকে বখশিস পাওয়া যায়। যদিও বকশিস ধনী-অধনী সবাই দেয় খুশি হয়ে।—এ হল পায়েলের এ পেশা বেছে নেওয়া কাহিনি।
–বেশ। রীতা, এবার তুমি বলো তোমার কথা।
–আমি ডিভোর্সি। এক বছর হল ডিভোর্স হয়েছে। স্বামী নপুংসক ছিল। ডিভোর্স তো হল, কিন্তু আমার বাকি জীবন চলবে কী করে? আবার বিয়ে করব? আবার বিয়ে মানে তো পুরুষ বদল। তিনি হবে দ্বিতীয় স্বামী। ডিভোর্সী মেয়ে মানে এঁটো মেয়ে। সে কী আমাকে ভালো চোখে দেখবে? মোহ ভেঙে দু-দিন বাদে সেও যদি আমাকে ছেড়ে দেয়? আমি কি তৃতীয় বিয়ে করব? তৃতীয়বার পুরুষ বদল? পুরুষ যদি বদল করতেই হয়, তবে এভাবে কেন? লাভ কী? বিগ জিরো। সিদ্ধান্ত নিলাম এ পেশায় আসব। এ পেশায় অর্থ যেমন আছে, তেমনি সক্ষম পুরুষের যৌনতা আছে, আছে প্রতিদিন নতুন নতুন পুরুষে সঙ্গ। চলে এলাম। কাজ শুরু দিলাম। বিন্দাস আছি। ব্যাংক ব্যালান্সও মন্দ নয়। অনেকেই আমাকে বিয়ের অফার দিয়েছে। আমি সেই প্রত্যাখ্যান করেছি। করার বিয়ের করার সঙ্গে সঙ্গে আমার আর্থিক স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলব। তা ছাড়া ওইসব পুরুষরা ভালোবেসে বিয়ের অফার দেয় না। অফার দেয় আমাদের ব্যাংক ব্যালান্স হাতানোর লোভে। আমাদের লাইনের বেশকিছু মেয়ে প্রতারিত হয়েছে সর্বস্ব খুঁইয়ে। আবার এখানেই ফিরে আসতে হয়েছে ‘সংসার’ হারিয়ে।
–না, তোমার ব্যাংক ব্যালান্স কত জানতে চাইব না। জানতে চাইব তপতীর কথা। তপতী কীভাবে এলেন?
–বিজ্ঞাপন দেখে। সাইট থেকে জানতে পারলাম যৌন-পরিসেবা দিয়ে প্রচুর রোজগার করা যায়। বিজ্ঞাপনে ফোন নম্বর দেখে যোগাযোগ করলাম। কাজ হয়ে গেল। আমি খুশি। রোজগারও বেশ ভালো। স্ব-ইচ্ছায় এসেছি, স্ব-ইচ্ছায় ছেড়ে চলে যাব।
–স্ব-ইচ্ছায় ছেড়ে যাওয়া যায়! আচ্ছা, এ ব্যাপারে পরে জানব। তার আগে নুরজাহান বলুক তাঁর কথা। কীভাবে এলে এই পেশায়?
–কোটিপতি না হলে কীসের বেঁচে থাকা! অনেক টাকায় মালিক হতে চেয়েছিলাম। এ পৃথিবীতে টাকাই সব। কলেজে পড়তে পড়তেই একদম স্বাধীনভাবে যৌনপেশা করতাম। তবে লুকিয়ে। একটা সাইট আছে এরকম। যাঁরা এ পেশায় আসতে চায় তাঁরা নিজেদের সম্বন্ধে বিস্তারিত জানিয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া যায়। সেই সঙ্গে প্রতি রাতে বা প্রতি ঘণ্টার কত পারিশ্রমিক নেব সেটাও জানাতে হয়। আমিও জানালাম। ক্লায়েন্ট পেতে থাকলাম। মোটা টাকা আসতে থাকল। কিন্তু ভয় পেয়ে বসল। নিজ দায়িত্বে কাজটি করতে হত। কোনো প্রোটেকশন নেই বিপদে পড়লে রক্ষা করার। কে কেমন জানতে পারি না। সন্দেহ নিয়ে কাজ করা মুশকিল। তখন ভাবলাম এখানে নাম লেখাই। নাম লেখালাম। মাথার উপর সবরকমের সার্পোট আছে। নিশ্চিন্তে কাজ করছি। রোজগারও বেশ ভালো। এ পেশায় কন্ডোম বাধ্যতামূলক। তাই যৌনরোগে আক্রান্ত হওয়ার ভয়টাও নেই।
–যদি কখনো মনে হয় এ কাজ আর করবে না, তখন ছেড়ে দিতে পারবে?
–ছাড়ব কেন? ছেড়ে রোজগার হারাব কেন? দু-হাতে টাকা ঘাটি এখন, পেশা ছেড়ে দিলে খুব খারাপ লাগবে। অতএব ছাড়ার কোনো প্রশ্নই নেই।—বলল কাজল।
–তর্কের খাতিরে যদি ভাবি পেশা ছেড়ে দেব, যখন খুশি ছেড়ে দিতে পারি। বাড়ির মালিককে বললে, সে একবারের জন্যেও যারণ করবে না। বাধা দেওয়ার কেউ নেই। আমরা স্বাধীন। কারও ক্রীতদাসী নই। মালিকের কাছে কিছু পাওনা বকেয়া থাকলে হিসাব বুঝে নিয়ে চলে যেতে পারি।—বলল নুরজাহান।
–রোজগার কীভাবে হয়? ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে যা পাও সব তোমাদের?
–তা কখনো হতে পারে? আমাদের সঙ্গে এই কাজের সঙ্গে আরও অনেকে যুক্ত নানাভাবে। তাঁরাও ওই টাকার অংশ পাবে। যে ছেলেটি তোমাকে উপরে নিয়ে এসেছে, সেও পায়। আমাদের রেট দু-ঘণ্টার ৩০০০ টাকা। ২০০ টাকা আমাদের। বাকিটা মালিকের কাছে থাকে। অন্যান্যদের পেমেন্ট করে। এই কোয়ার্টারে অসংখ্য মালিক আছে। সেই মালিকের অধীনে কারো দশজন, কারো পনেরজন, আবার কারো পঁচিশজন বা তারও বেশি আছে। মনে করো ক্লায়েন্ট এলো আমার মালিকের কাছে। মালিক তাঁর নিজের ঘরের মেয়েদের আগে দেখাবে। যদি মালিকের ঘর থেকে মেয়ে পছন্দ না-হয়, তখন অন্য মালিকের ঘর থেকে মেয়ে দেখানো হয়। অন্য মালিকের ঘরের মেয়ে যদি আমার মালিকের ক্লায়েন্ট পছন্দ করে, তখন মেয়েটি পাবে ২০০ টাকার পরিবর্তে ১০০ টাকা। বাকি ১০০ টাকা পাবে আমার মালিক। তবে ক্লায়েন্টের দেওয়া বকশিসের টাকায় মালিক ভাগ বসায় না।—রীতা বলল।
–তাহলে বলছ যে-কোনো মেয়ে চাইলে এই পেশায় আসতে পারে?
–ইন্ডিভিজুয়াল যে-কোনো মেয়েই এই পেশায় আসতে পারে। কিন্তু এখানে সবাই আসতে পারে না। মালিক সরাসরি কোনো মেয়েকে কাজে লাগাতে পারে না। কোনো মেয়ে যদি আসে তখন তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সংগঠনের কাছে। আমাদের সংগঠন দুর্বার কমিটি। সেখানে গেলে তাঁকে বোর্ডে বসতে হবে। সে কেন এ পেশায় আসতে চায়, কেউ বাধ্য করাচ্ছে কি না ইত্যাদি প্রশ্ন জানতে চায়। বয়সের প্রমাণপত্র চাওয়া হয়। প্রমাণপত্র না-থাকলে বা বয়স নিয়ে কমিটির সন্দেহ হলে বিশেষ পরীক্ষার মাধ্যমে সঠিক বয়স জেনে নেওয়া হয়। কোনো যৌনরোগ আছে কি না, সেটাও পরীক্ষা করে জেনে নেওয়া হয়। একটা সময়ান্তরে আমাদেরও নিয়ম করে মেডিকেল টেস্ট করতে হয়। সব পরীক্ষায় পাশ হলে তবেই কমিটি একজন মেয়েকে কাজ করার অনুমতি দেয়। কমিটিকে এড়িয়ে কোনো মালিক গোপনে কোনো মেয়েকে কাজ করাতে পারবে না।—বলল কাজল।
–খারাপ লাগে না এরকম পেশার যুক্ত থাকতে? লোকে বাঁকা চোখে দেখে, ভর্ৎসনা করে, ঘৃণাও করে। খারাপ লাগে না?
তপতী ঝাঁঝিয়ে জবাব দিল–“খারাপ লাগবে কেন? চুরি-ডাকাতি করছি কি? পরিশ্রম করি, রোজগার করি। শরীর আমাদের পুঁজি ঠিকই। শরীর খাঁটিয়ে আর পাঁচজনের মতো আমরাও রোজগার করি। এ পৃথিবীতে এমন কোনো পেশা আছে, যেখানে শরীরের প্রয়োজন হয় না। কেউ শরীরের হাত ব্যবহার করে রোজগার করে, কেউ শরীরের পা ব্যবহার করে রোজগার করে, কেউ শরীরের চোখ ব্যবহার করে রোজগার করে, কেউ শরীরের নাক ব্যবহার করে রোজগার করে, কেউ শরীরের জিভ ব্যবহার করে রোজগার করে, আর আমরা শরীরের যোনি ব্যবহার করে রোজগার করি। তফাৎ কোথায়? এইভাবে ভাবতে পারেন না কেন? আমরা সেভাবেই ভাবি। তাই খারাপ লাগে না। খারাপ লাগলে দিনের পর দিন এভাবে কাজ করতে পারতাম? পেশাকে তো জেনেই এসেছি। সবচেয়ে বড়ো কথা, আপনি যে পেশাতেই আসুন-না কেন স্বেচ্ছায় হোক বা বাধ্য হয়ে, সেই পেশাকে মন থেকে ভালোবাসতে না-পারলে আপনি কাজটি ঠিকঠাক করে উঠতে পারবেন না। শ্রমিক হিসাবেও আপনি ব্যর্থ।”
আর পাঁচটা ব্যবসার মতো শরীর বিক্রির ব্যবসারও এখন বেশ চাহিদা। শুধু শরীর কেন, অনেক মানুষকেই অনেক সময় অনেক অপছন্দের কাজ করতে হয়, বেঁচে-বর্তে থাকার জন্যে। এমএ পাশ বনগাঁর এক যুবককে জানি যিনি যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থান করতে না পেরে পাথরপ্রতিমায় গিয়ে রিক্সা চালাত। পাড়া-প্রতিবেশী কেউ সেটা জানত না। বাড়ি থেকে ভালো শু্যট-বুট পরে হাতে ব্যাগ নিয়ে বেরত। এরকম খুঁজলে প্রচুর যুবকদের পাওয়া যাবে। এমএ পাশ পিএইডি করা কোনো যুবক যদি ডোমের চাকরি পেয়ে যেত, সেটা কী কেউ জানতে পারত যে, সে ডোমের কাজ করে? আমার বাড়ির পাশে এক ভদ্রলোক রাইটার্স বিল্ডিংয়ে সুইপারের কাজ করত। কিন্তু সারাজীবন সে পেশা লুকিয়ে রেখেছে। লুকিয়ে রাখা পেশা অনেককেই করতে হয়। আজকাল ছেলেরাও গোপনে যৌনপেশার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। এদের পুরুষ যৌনকর্মী বা জিগোলো বলে। এ বিষয়ে পরে বিস্তারিত আলোচনা করব।
শরীর বিক্রির ব্যাবসা যে বিনাপুঁজির লাভজনক ব্যাবসা, সেটা এই ভোগবাদী রাষ্ট্রনাগরিকরা বিলক্ষণ বুঝে গেছে। দেহোপজীবিনীরাও বুঝে গেছে একাধারে সীমাহীন যৌনসুখ ও অর্থসুখ দুইই ভোগ করা সম্ভব এই গণিকাবৃত্তিতে। বস্তুত যেসব মেয়েরা গণিকাবৃত্তি গ্রহণ করেন, তাঁরা কোনো না-কোনো ভাবে এই বৃত্তিতে আসছে বাধ্য হয়, এ ধারণা সবক্ষেক্ষেই সত্য নয়। মেয়েরা যে বাধ্য হয়েই গণিকাবৃত্তিতে আসে, তা প্রমাণ হয় কীসে? এ পেশায় বাধ্য এসেছে এ বয়ান কার? যিনি গণিকা তাঁর। গণিকা যে সত্য বলছেন না মিথ্যা বলছেন, তা সহসা প্রমাণ করা যায় না। কারণ যিনি বাদী, তিনিই বিবাদী, তিনিই সাক্ষী। গোপনে যৌনকর্ম করতে গিয়ে কত ‘ভদ্রঘরের’ (‘ভদ্রঘরের মহিলা’ বলতে যাঁর পিঠে গণিকার স্ট্যাম্প পড়েনি) মহিলাদের বলতে শুনেছি ‘পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে এ লাইনে এসেছি’। যৌনকর্ম করতে গিয়ে ধরা পড়ার পর সব মেয়েদেরই এই একটাই গৎ—‘পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে এ লাইনে এসেছি’। এতে চরম সহানুভূতি মেলে। যৌনকর্ম আদিরস থেকে করুণ রসে ভেসে যেতে থাকে। পশ্চাৎপটে প্যাথোজ বাজতে থাকে। পেটের দায়’ ব্যাপারটা কেমন যেন অভাব অভাব দারিদ্র্য দারিদ্র্য ভাব। বস্তুত আমরা সকল কর্মজীবীরাই পেটে দায়ে কর্মযজ্ঞে আসি। পরের সেবা করি অর্থের বিনিময়ে। নিজেদের উৎকৃষ্ট পণ্য করে তোলার চেষ্টা করি। পেট আমাদের সকলের আছে। পেট আছে, তাই ক্ষুধাও আছে। পেট না থাকলে কেউ কোনো কর্ম করত না। তা সে যৌনকর্মই হোক কিংবা ক্ষৌরকর্ম। একটু ভাবুন, শরীর আমরা সবাই বেচি। সব পেশাতেই শরীর বেচতে হয়। যতক্ষণ শরীর, ততক্ষণ পেশা। অবশ্য রোজগারের জন্য কেউ কেউ বুদ্ধিও বেচে। অতএব বলা যায়, পেটের দায়’ কথাটা অত্যন্ত নিন্মমানের অজুহাত।
দারিদ্র্যতা থেকে অভাব, অভাব থেকেই যদি মেয়েরা গণিকাবৃত্তি বেছে নেয়, সেটা কতটা বাস্তবানুগ? চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, রাহাজানি সবই কি অভাবের তাড়নায়? খেটে খেতে চাইলে কি এ পৃথিবীতে কাজের অভাব? তাহলে গণিকাবৃত্তি বা যৌনপেশায় কেন? অভাব, না স্বভাব? প্রতিটি যৌন-সক্ষম সুস্থ মানুষ জিনগতভাবে বহুগামী। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। বহুগামিতা পুরুষের একচেটিয়া নয়। নারী-পুরুষ সমান আগ্রহী। সামাজিক কারণেই বেশিরভাগ মানুষ সেটা নিয়ন্ত্রণ করে, আবার পাপ বা অপরাধবোধ থেকেও ও-পথে পা বাড়াতে সাহস পায় না। সামাজিক জীবনযাপনের তোয়াক্কা না করে অনেকেই আবার ‘নিষিদ্ধ’ কাজে এসে পড়ে। এরা বেশ সাহসী মানসিকতার হয়। সমাজকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাতে হলে সাহসী তো হতেই হয়।
দারিদ্রতা বা অভাবই যদি মেয়েদের যৌনপেশায় আসার একমাত্র কারণ হত, ভারত তথা গোটা পৃথিবীতে যে বিপুল সংখ্যক দারীদ্রসীমার নীচে থাকা মেয়ে-বউ, তাঁরা সকলেই গণিকাবৃত্তিকেই বেছে নিত। বাস্তবিকই তা হয় না। তাহলে অসংখ্য দরিদ্র মহিলারা কলে-কারখানায়, মাঠে-ময়দানে, খনিতে-নদীতে সেলাই-ফোঁড়াই করে, ঠোঙা বেঁধে, বিড়ি বেঁধে সর্বত্র হাড়খাটুনি পরিশ্রম করে জীবনধারণ করত না। সীমাবদ্ধ রোজগারে জীবনধারণ করত না। এমনকি চরম দারিদ্রতায় আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়, তবুও যৌনপেশায় আসে না। কোটি কোটি মহিলা দারিদ্র্যের যন্ত্রণায় ছটফট করে মরলেও তাঁরা যৌনপেশায় আসে না। প্রচুর অর্থলোভ ও সীমাহীন যৌনতার আনন্দ নিতেই বহুবল্লভা হয় এক শ্রেণির মহিলা। উপ জনজাতিদের মধ্যে অর্থনৈতিক অবস্থা দারিদ্র্যসীমার একেবারেই নীচে। পিঁপড়ে ডিম, ঝলসানো ছুঁচো, গাছের কন্দ ইত্যাদি খেয়ে যাঁদের জীবনধারণ করতে হয়, সেই আদিবাসীরা কখনো যৌনপেশায় এসেছে বলে শুনিনি।
মানুন বা না-মানুন, বিভিন্ন স্তরের বিভিন্ন যৌনকর্মীদের পর্যবেক্ষণ করে, যে চিত্র উঠে আসে, তা হল চটজলদি মোটা অঙ্ক রোজগারের হাতছানিতে এই পেশা বেছে নেয়। লঙ আইল্যান্ড ও ওয়েস্টার থেকে গৃহবধূ হাতেগরম রোজগারের জন্য ১৯৭৩ সালে নিউইয়র্কে পেশাদার গণিকাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামে। এঁরা কারোরই আর্থিক অবস্থা খারাপ ছিল না। ভারতেও বহু মধ্যবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত মহিলাদের মধ্য থেকেও অনেকে যৌনপেশায় আসে। প্রোফাইল যেমন ‘হাই’ হবে, সেই মহিলাকে বিছানায় পেতেও তেমন ‘হাই’ মূল্য গুণতে হবে। সিরিয়াল করতে করতে, সিনেমা করতে করতেও অনেক অভিনেত্রী যৌনপেশা চালিয়ে যায়। ধনবান ক্লায়েন্টরা সিনেমা-সিরিয়ালের মহিলাদের ও মডেল-কন্যাদের সঙ্গ পেতে চড়া মূল্য পর্যন্ত দিতে রাজি থাকে। অনেক কম পরিশ্রমে, অনেক কম সময়ে এককালীন নগদ মোটা অঙ্কের রোজগারের হাতছানি এড়ানো অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। একটা সময়ে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অর্থনেশা ও যৌননেশা উভয়ই। ধনীর দুলালি থেকে শুরু করে ধনী গৃহবধূ, আইপিএস অফিসারের স্ত্রী থেকে কর্নেলের স্ত্রী, স্বামী পরিত্যক্তা ও স্বামীহারা বিধবা বা বিবাহবিচ্ছিন্না মহিলা সহ সমাজের উঁচুতলার মহিলাদেরও এই পেশায় দেখা যায়। এঁরা গণিকাপল্লিতে ঘর নিয়ে কারবার নিশ্চয় করে না। কলগার্ল হিসাবে কাজ করে লোকচক্ষুর আড়ালে। কলগার্লের ফোন নম্বর রাখা থাকে হোটেল বা রিসোর্ট বা অন্য কোনো মধ্যস্থতাকারীর কাছে। কাস্টমারের চাহিদা অনুযায়ী ফোন করলেই সময়মতো চলে আসে কলগার্লেরা। এঁরা বেশিরভাগ অবদমিত যৌনতাড়নায় আসে এবং অবশ্যই মোটা টাকারও দাবি করে। সানি লিওন যৌনপেশায় এসেছিল অভাবের তাড়নায় নয়, এসেছিল শখে। একথা সানি লিওন নিজেই বলেছে এক সাক্ষাৎকারে। দেশের আর্থিক উন্নতি যত হচ্ছে যৌনকর্মীর সংখ্যা তত বাড়ছে। তার কারণ ভোগবাদী সমাজ বিস্তার লাভ করছে। আগে নির্দিষ্ট এলাকায় যৌনকর্মীদের দেখা মিলত, আজকাল শহরে-গ্রামে লোক সমাগম হয় এমন জায়গাতেও যৌনকর্মীদের দেখতে পাবেন। সম্ভ্রান্ত এলাকায় সম্ভ্রান্ত মহিলাদেরও যৌন-পরিসেবা দিতে দেখা যাচ্ছে। যথাযথ পয়সা ফেললে ‘অ-গণিকা’ কলেজ পড়ুয়া থেকে ঘরোয়া বধূদের পেতে পারেন কয়েক ঘণ্টার জন্য শয্যাসঙ্গিনী হিসাবে।
এই আদি পেশাটি বর্তমান সময়ে কোনো পল্লিতে বা কোনো মহল্লায় বা কোনো রেড লাইট এলাকায় আটকে নেই। গণিকাঁচর্চা এখন ভুবনজুড়েই। ২৪ ঘণ্টাই। ৩৬৫ দিনই। প্রযুক্তি খুলে দিয়েছে নতুন নতুন জানালা ও দরজা। যে খুশি সেখানে আসতে পারে, যেতেও পারে। ক্লায়েন্ট হিসাবে আপনাকেও কোনো গণিকাপল্লিতে মুখ লুকিয়ে ঢুকতে হবে না। সেক্স অ্যাডভেঞ্চার পাওয়ার জন্য গুগলে গিয়ে সার্চ করলেই হল। যৌনসঙ্গী আর যৌনসঙ্গিনীর বিশাল বাজার খুলে যাবে আপনার চোখের সামনে। অসংখ্য সাইট আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছে ১০০% সুরক্ষা নিয়ে। আড়ালে-আবডালে অন্ধকারের অন্ধগলিতে এক চিলতে ঘরের দেড় হাত চওড়া সিঙ্গেল চৌকি নয়, ঝাঁ চকচকে বেডরুমে। যৌনবাজার এখন খোলা বাজার। এখান থেকেই পাওয়া যায় নিরাপদ কোনো নির্জন নিরাপদ ফ্ল্যাটের ঠিকানা।
আসুন, একটু অন্তর্জাল যৌনবাজার ঘুরে দেখে আসি। তার আগে কিছু প্রাসঙ্গিক কথা সেরে নেব। আমেরিকার যৌনকর্মীরা চিন্তিত অনলাইন গণিকাবৃত্তির অধিকার খর্ব করা নিয়ে একটি নতুন আইন। এই আইনবলে আমেরিকার অনলাইন দেহব্যাবসার সাইটগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এমতাবস্থায় নামজাদা গণিকা জনৈকা মলি স্মিথ তাঁর মতামত জানিয়ে বললেন –”শরীর নিয়ে ব্যাবসায়িক চুক্তি অনলাইনেই হলে গণিকাদের আর রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হয় না। তাতে তাঁদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় না, বিশেষ করে নতুনদের। তা ছাড়া গণিকারা প্রকাশ্যে এলে পুলিশ কর্তৃক ধরা পড়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। সরকার ভাত মারছেন আমাদের। যৌনপেশাকে ক্রিমিনালাইজ করলে তা কখনোই বন্ধ করা সম্ভব নয়। কোনো না-কোনোভাবে টিকে থাকবেই। অথচ তার খেসারত গুণতে থাকে এই পেশার সঙ্গে জড়িতরা।”
একেবারে শুরুর দিকে এই ধরনের ব্যাবসার সাইটগুলি কিছু দেশে বন্ধ করে দেওয়ার হিড়িক পড়লেও কিছু বাদে সাইটগুলি রমরমাভাবে চালু আছে সারা বিশ্বে। আইনগতভাবে আর বন্ধ করতে পারছে না। কারণ ওইসব দেহব্যাবসার সাইটগুলিতে দেহব্যাবসার নামগন্ধ পর্যন্ত থাকে না। সরাসরি দেহবিক্রির কোনোরূপ ঘোষণা থাকে না। মেসেজ পার্লারের পরিসেবা দেওয়ার ঘোষণা থাকে মাত্র। মেসেজ শরীর ও মন চর্চার অংশ। তাই মেসেজ পার্লার নিষিদ্ধ নয় কোনো দেশেই। এই মেসেজ পার্লারের বিজ্ঞাপন দেখে যাঁরা খাদ্য খোঁজার তাঁরা খুঁজে নেয়। নির্দিষ্ট সান্ধ্যভাষা, চিহ্ন, ছবি বা কিছু নমুনা দেখে ক্ষুধার্ত ক্লায়েন্ট বুঝে নেয়। অভিজ্ঞদের কোনোরূপ বেগ পেতে হয় না। তবে আজকাল অবশ্য সাইটের গণিকারা সরাসরিই উল্লেখ করে দেয় তাঁরা কোন্ ধরনের যৌন পরিসেবায় কত মূল্যে নেবেন।
শিকাগোর লোয়োলা ইউনিভার্সিটি এবং মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির মেরি ফিন, অ্যান্ট্রি হিনিয়ন প্রমুখ ক্রিমিনোলজিস্টরা এই ধরনের অনলাইন গণিকাবৃত্তির উপর একটি সমীক্ষা চালিয়ে হাতে যে তথ্য আসে, তা হল–মোট ৭১ জন গণিকা-মধ্যস্থতাকারী (Pimp) জানিয়েছেন তাঁরা নতুন টেকনোলজি অর্থাৎ অনলাইনেই বেশি আগ্রহী। অনলাইনের গণিকাদের রোজগার গড় ৭৫ হাজার ডলারের (বার্ষিক) কাছাকাছি। বর্তমানে আমেরিকার ৮০% যৌনপেশা অনলাইনের মাধ্যমেই হয়। কম-বেশি সব দেশেই এখন অনলাইন যৌনব্যাবসা বেছে নিয়েছে। শুধু অনলাইনে সাইটের মাধ্যমেই নয়, ফেসবুক, ইন্সট্রাগ্রাম ইত্যাদি সোস্যাল মিডিয়াকেও ব্যাপকভাবে যৌনপেশা প্রসারে ব্যবহার করা হচ্ছে। সমকামী থেকে বিষমকামী সকলেই সোস্যাল মিডিয়ায় ভিড় করছে। ফ্রান্সে তো যৌনব্যাবসার মূল মাধ্যমই টিল্ডার আর ফেসবুক। ইজরায়েলেও টিন্ডার নির্ভর যৌনব্যাবসা ফুলেফেঁপে উঠেছে। জাম্বিয়াতে আবার হোয়াটস অ্যাপ ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে, ফেসবুকও পিছিয়ে নেই। কলকাতায় বহুদিন হোয়াটস অ্যাপ যৌনব্যাবসা চালু আছে। নির্দিষ্ট নম্বরে হোয়াটস অ্যাপ নক করলেই একগুচ্ছ মেয়েদের ছবি চলে আসবে কাছে। তারপর নির্দিষ্ট ফ্ল্যাটে। চিন, জাপানের মতো দেশে যতই কড়া বিধিনিষেধ থাকুক না-কেন, বা জার্মানের মত উদারপন্থী দেশেও একই অবতার। সবসময়ই যে মধ্যস্থতাকারী যৌনকর্মীদের জন্য ক্লায়েন্ট সংগ্রহ করেন, তা কিন্তু নয়। অনেকক্ষেত্রেই গণিকারা মধ্যস্থতাকারীদের সযত্নে এড়িয়ে নিজেরাই ক্লায়েন্ট সংগ্রহ করে নিচ্ছে। যিনি যৌনতা বা শরীর বিক্রি করতে ইচ্ছুক, তিনি নিজেই সরাসরি বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বা নিষিদ্ধপল্লিতে অবস্থান করে যৌনবৃত্তি করার দিন শেষ হতে চলেছে। হাতের মুঠোয় অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল থাকলে হাতের মুঠোয় ক্লায়েন্ট পৌঁছে যাচ্ছে। এই ব্যবস্থায় মধ্যস্থতাকারীরা বা দালালরা অনুপস্থিত থাকায় ক্লায়েন্টদের থেকে প্রাপ্য পুরো পারিশ্রমিকটাই গণিকাদের। গণিকারা বাঁদরের ভাগ করা পিঠে খেতে চায় না। নিজের পিঠে নিজে বানাবে, নিজেই খাবে।
মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি অধ্যাপক মেরি ফিনের মতে–সব মেয়েদেরই যে বলপ্রয়োগ করে যৌনপেশায় আনা হয়, তা কিন্তু মোটেই নয়। যেসব মেয়েদের শিক্ষাগত বা কারিগরি দক্ষতা নেই অথচ সহজেই রোজগারের প্রয়োজন, তাঁদের ক্ষেত্রে যৌনপেশার বিকল্প নেই। অদক্ষ শ্রমিকদের জন্য তেমন রোজগার নেই। যদি থাকত, তাহলে হয়তো এই পেশায় অনেকেই আসত না।
আসুন, আমরা জেনে নিতে পারি অনলাইন এসকর্ট সার্ভিস সংস্থাগুলি কী বলছে সম্ভাব্য ক্লায়েন্টদের টানতে। কলকাতায় এক এসকর্টের কর্ণধার অঞ্জলি খান্না বলছে, তাঁদের প্রতিষ্ঠান বাঙালি কল গার্লস এবং হাই প্রোফাইল এসকর্ট অফার করে। তাঁদের সদর্প ঘোষণা–“কলকাতায় অনেক এসকর্ট এজেন্সি রয়েছে। কিন্তু যখন আসল এবং সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য প্রতিষ্ঠানে প্রশ্ন ওঠে, তখন কেউই আমাদের সঙ্গে কেউ টক্কর দিতে পারে না। আমরাই শীর্ষ মহিলা এসকর্ট, যাঁরা কলকাতায় বাঙালি কল গার্লদের পরিসেবা প্রদানকারী। আপনি যদি আমাদের মহিলা এসকর্ট পরিসেবাটি পছন্দ করেন, তবে অবশ্যই আপনার সিদ্ধান্তটি সঠিক। অঞ্জলি খান্না ২০১০ সাল থেকে কলকাতায় নিজস্ব এসকর্ট এজেন্সি চালাচ্ছেন এবং কল গার্ল পরিসেবা এবং ক্লায়েন্টদের জন্য এসকর্ট পরিসেবা সরবরাহ করেন। কলকাতায় এসকর্ট ভাড়া দেওয়ার জন্য আমাদের শর্টস অফ শর্টস কেবলমাত্র সমস্ত ভিআইপি হোটেল ইনকল বা আউটকল এসকর্ট পরিসেবা সরবরাহ করুন। আপনি যদি ইতিমধ্যে কলকাতায় যে-কোনো হোটেলে থাকেন এবং আউটকল পরিসেবা চান, তবে অবশ্যই আপনার হোটেল থেকে আলাদা হওয়া উচিত। তাঁদের বর্ডারদের কোনো মহিলা সাহচর্যে থাকার অনুমতি আছে কি না। আমাদের মহিলা এসকর্টগুলি আপনার জন্য ২৪/৭ লভ্য। আপনি যদি আমাদের কলকাতা কল গার্লদের ভাড়া করেন, তবে আপনার সর্বোচ্চ শারীরিক তৃপ্তির নিশ্চয়তা রয়েছে।
ক্লায়েন্টদের এসকর্ট পরিসেবাগুলি সরবরাহ করার জন্য আমাদের কলকাতায় বিভিন্ন ধরনের কল গার্ল আছে। আমরা বুঝতে পারি আমাদের ক্লায়েন্টদের কী দরকার। এসকর্ট ম্যানেজার এমন একটি মেয়েকে উপস্থাপন করে, যা আমাদের ক্লায়েন্টের প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে মেলে। আরও ভালো অভিজ্ঞতার জন্য আপনি আমাদের বাঙালি কল গার্লদের ব্যবহার করে দেখতে পারেন। কলকাতায় আমাদের ভিআইপি এসকর্ট কখনও এসকর্ট পরিসেবার মানের সঙ্গে কোনো আপস করেন না। কারণ আমরা আমাদের ক্লায়েন্টদের সঙ্গে দৃঢ় এবং দীর্ঘ সম্পর্ক স্থাপনে বিশ্বাস করি। একটি আকর্ষণীয় এবং আশ্চর্য প্যাকেজ বোনাস পেতে এখনই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করুন। আমাদের কলকাতায় কলেজ কল গার্লস, গৃহবধূ এসকর্টস, রাশিয়ান এসকর্টের মতো বিস্তৃত পরিসরে মেয়ে এবং মহিলা এসকর্ট আছে। আমাদের সমস্ত এসকর্ট মেয়েরা সুন্দর এবং সেক্সি। তাঁরা কীভাবে উদ্বেগ বজায় রাখতে, গোপনীয়তা রক্ষা করতে এবং পরিস্থিতি পরিচালনা করতে হয় জানে। আমরা আমাদের এসকর্ট পরিসেবার জন্য সম্পূর্ণ সুরক্ষা এবং সাবধানতা গ্রহণ করি এবং গর্ভাবস্থা এড়াতে উচ্চমানের কন্ডোম এবং গর্ভনিরোধক বড়ি সরবরাহ করি। আপনার নিজের পছন্দমতো আমাদের এসকর্ট মেয়েদের আসল ছবি পেতে আপনি এখনই কল করতে পারেন বা হোয়াটসঅ্যাপ করতে পারেন এবং আমরা আপনার জন্য সমস্ত কিছু ব্যবস্থা করব। যদি আনন্দ করতে চান, তবে অবশ্যই আপনাকে কলকাতায় হাই প্রোফাইল এসকর্টের সঙ্গে দেখা করতে হবে। কলকাতায় নির্দিষ্ট কিছু জায়গা রয়েছে যেখানে সমস্ত বিলাসবহুল হোটেল এবং রেস্তোঁরা রয়েছে। আপনি দক্ষিণ কলকাতা বা উত্তরে থাকতে পারেন। আনন্দের এই শহরে বেশ কয়েকটি নামী হোটেল আছে, আপনি যদি দুর্গাপুজো বা ব্যাবসায়িক উদ্দেশ্যে কলকাতায় বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন, তবে একা একা আসুন। একটি হোস্ট হিসাবে আমরা আপনাকে একটি বাঙালি মেয়ে উপহার দেব, তিনি আপনাকে কিছু অবিস্মরণীয় স্মৃতি সরবরাহ করবেন। সতেজ মনের জন্য আপনার অভ্যন্তরীণ বাসনা পূর্ণ করুন। আমাদের সঙ্গে বেশ কয়েকজন বাঙালি কল গার্ল কাজ করছে। বাঙালি মেয়েরা মিষ্টি এবং সেক্সি পাশাপাশি। তাঁরা সুশিক্ষিত এবং তাঁদের একটি ভালো রক্ষণাবেক্ষণযোগ্য ব্যক্তিত্ব আছে। তারা বাংলা হিন্দি বা ইংরেজির যে-কোনো ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে। সুতরাং, আপনি যদি ব্যবসায়ের মালিক হন এবং আপনার সংস্থার জন্য একটি মিষ্টি এবং সেক্সি মেয়ে খুঁজছেন, কেবল আমাদের এখনই কল করুন! আপনার হোটেলে স্বাধীন ও সুন্দরীর সঙ্গে উপভোগ করুন।
একবার যদি আপনি কলকাতায় বাঙালি কল গার্লস পরিসেবাগুলি বেছে নেন, তাহলে আপনি যার যার তাঁদের পছন্দ করবেন। কলকাতা তার খাবার এবং সংস্কৃতির জন্য বিখ্যাত। স্থানীয় মেয়েকে ভাড়া দেওয়ার আরেকটি সুবিধা হ’ল, তিনি আপনাকে কলকাতা শহরটি অনায়াসে আবিষ্কার করতে সহায়তা করবেন। আপনি প্রতি মুহূর্তে তার সাথে নিজেকে উপভোগ করবেন। একটি রেস্তোঁরা বা সুইমিং পুল বা কিছু অন্যে কিছু গুণমানের সময় ব্যয় করুন। আনন্দ সহ সুখী একজন এসকর্ট মেয়েদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক তৈরি করুন। আপনার জীবন থেকে সমস্ত যন্ত্রণা ভুলে যান এবং কিছু মুহূর্ত উপভোগ করুন। কিছু মুহূর্ত যা অবিস্মরণীয় এবং যা আপনি কখনোই ভুলে যাবেন না। সর্বদা মনে রাখবেন, আমরা সবাই অর্থের জন্য কাজ করছি। আপনার যদি টাকা না থাকে তবে আপনি কোনো কিছু উপভোগ করতে পারছেন না। কারণ অর্থ যে-কোনো কিছু কিনতে পারে! হ্যাঁ, এটা সত্য, আপনি যদি প্রতিশ্রুতি ছাড়াই কোনো সম্পর্ক উপভোগ করতে চান, তবে আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক করুন। আমরা আপনাকে বাঙালি কল গার্লস সরবরাহ করব, যাঁরা আপনাকে নিঃশর্ত ভালোবাসা এবং যত্ন দেবে, যা আপনি কোনো গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থেকেও পেতে পারেন না। কলকাতায় এখন সেরা এসকর্ট এজেন্সি ভাড়া। তিনি কখনো কোনো উপহারের দাবি করবে না এবং আপনার কাছ থেকে কখনো কোনো প্রত্যাশা করবেন না। এসকর্টগুলি উচ্চ প্রশিক্ষিত এবং তারা কীভাবে আপনাকে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করাবে, তা তারা জানে। তিনি আপনার পুরো অন্তঃকরণের কথা শুনবেন এবং আপনাকে আনন্দিত করবেন। আপনি যখনই যা বলেছেন সে শুনবে।”
এ তো গেল প্রতিষ্ঠানগুলির সোচ্চার ঘোষণা। এবার আসি ব্যক্তিগত (Individual) ঘোষণায়। পাঠকরা এতক্ষণে হয়তো উশখুশ করছেন যে, অনলাইনের গণিকাদের বিজ্ঞাপনগুলি ঠিক কেমন। কেমন সেই বিজ্ঞাপনের ভাষা ও বয়ান? আগ্রহী পাঠকদের জন্য কয়েকটি বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করেছি। তবে ফোন নম্বরগুলি বিকৃত করা হল সংগত কারণেই।
বিজ্ঞাপন—১
Pooja Jain Beautiful Independent Call Girl
Hello Guys, I am Pooja Jain, a beautiful air hostess. I’ve been dating several individuals on a regular basis and having endless pleasure with them. It simply makes me feel great. The dating experience that I get with the mature guys is simply astonishing. To enjoy some astonishing moments with the paid professionals, I get in touch with them. The reliable call girl services in Park Street that I provide are simply astonishing. I ensure to put a big smile on the face of my lovers and make them feel better than ever. Simply get in touch with me, if you want to get some astonishing experiences. I have maintained my curvy figure (36-26-34) by doing all types of workouts and eating a healthy diet. It simply makes me feel better than ever.
I feel like providing social services to my clients. If you think that I can serve you well, ensure to hire me once. I would be happy to assist you by doing all types of lovemaking positions in bed. I have expertise in dealing with men having diverse physical abilities. Being a beautiful Kolkata escort, I ensure to do all types of naughty activities to make my clients feel better than ever.
Personal Details :
Age: 22
Location: Kolkata
Fig: 34-26-32
Hair and Eye: Black
Height: 5’3”
Body Weight: 58 Kgs
Language: English, Hindi
Occupation: (Housewife)
Hobbies: Music and Dancing
বিজ্ঞাপন—২
Radhika Arora Young College Girl for Ultimate Romance
Thank for viewing my profile. I am grateful to see you here. I am a beautiful Radhika Arora, a college girl. I always want to have endless pleasure with hot and sensational females and cherish my mood with them. It simply gives me erotic experiences to cherish my love life. I have become a call girl because I have extreme sensuous needs. I want to have endless pleasure in my life and enjoy a lavish lifestyle. It gives me immense pleasure to serve as one of the demanding Kolkata escorts. My lovers just want to have endless pleasure with me. To fulfill the extreme physical needs of individuals, I ensure to do stunning activities with them. Dating hot and sensational females is something that could be erotic for you to cherish unique memories.
I just enjoy providing my call girl services. I maintain my figure in an appropriate manner and fulfill the sensuous desires of my clients. I feel like doing a great work by putting a smile on the face of tensed and depressed men. Lovemaking experiences that I get with different individuals have always given me confidence. I feel like a strong lady with high intention to have fun with different individuals.
Personal Details :
Age: 22
Location: Kolkata
Fig: 34-26-32
Hair and Eyes: Black
Height: 5’3”
Body Weight: 58 Kgs
Language: English, Hindi
Occupation: (Housewife)
Hobbies: Music and Dancing
বিজ্ঞাপন—৩
Sonalika Hot Charming Call Girl Perfect for Delightful Experience
Being an incredibly hot adult entertainer, I offer the stunning physical services to my lovers and make them feel delightful. The hotness of my body arouses the intimacy of men and I easily satisfy my clients by giving my best efforts. I can do all types of erotic positions in bed and make individuals feel delightful. As one of the gorgeous escortss in Kolkata, I spread jovial feelings around and make my lovers feel better than ever. The extreme pleasure that you can expect of getting from me would give you the immense happiness. I ensure to do the tremendous sexual moves and make my lovers feel better than ever. Hire me once and spend some quality experiences. I can do the erotic sexual positions in an incredible way and cherish the love life of individuals.
I ensure to do every adult activity in an erotic manner and fulfill the intimate desires of people. My clients are so many and they come back to me time and again. I never disappoint anyone and try to fulfill the extreme intimacy of different companions. I have dated so many dazzling females and enjoyed great memories with them. It has boosted my confidence and filled my love life with the immense sensual satisfaction. Building a close relationship with me can satisfy your intimate desires. Hire me once, if you really want to experience the heat of the sexual relationship. I assure you to satisfy your hot feelings and cherish your mood like never before.
Personal Details :
Age: 22
Location : Kolkata
Fig : 34-26-32
Hair and Eyes : Black
Height : 5’3”
Body Weight : 58 Kgs
Language : English, Hindi
Occupation : (Model)
Hobbies : Music and Dancing
বিজ্ঞাপন—৩
NO BROKER, IT’S MY PERSONAL SERVICE. PAID SEX. ARPITA SEN HERE..–21
Here is arpita frm your service.. I am 21 years. If you want girlfriend type experience in bed then contact me. No anal sex. People from kolkata only who want SEX service. No any online advance payment required for booking. Payment by cash only in hand after meet in room face to face.
**Do not contact me fake person for time pass or don’t tell me about sexual talking. I don’t do phone sex. I do sex in bed only..so why r u waiting?? Hurry up! Whatsapp me.. 824059**18
বিজ্ঞাপন—৪
I AM MS BHATTACHARIYA 22 YEAR COLLEGE GIRL–22
I Am Student Girl Study Purpose I Am In 1Bhk Flat Located ~ Baguihati Teghoria. My Personal Independent Relation 3 Hour 2 Shot–7000 Rs. If You Want To Spend A Good Time Then You Must Contact. I Am Available Today. Call And Final Your Time. Mob–987430**95 Shreya Bhattachariya.
বিজ্ঞাপন—৫
2 SHOT GET 3 HOUR TIME DURATION / SHREYA HERE–22
I m College Girl My Personal Service’ Single Liveing In Independent 1Bhk Flat’ LOCATED : VIP Road Baguohati, Teghoria. I CHARGE: 7000 RS FOR 3 HOUR 1 SHOT ALLOWED. If You Looking For Unprofessional Homely College Student Girl Then. You Must Contact : Mob–987430**95
বিজ্ঞাপন—৬
BENGALI GIRL I AM SHREYA–22
Shreya Here I Am College Girl My Personal Independent Relation. I Am Single Liveing In 2Bhk Flat. I Am Single Liveing Here. If You Want To Spend A Good Time Then You Must Contact : Shreya–987430**95. Call Me Directly.
বিজ্ঞাপন—৭
I DO PROVIDE SELF SERVICE SECRATELY–22
I Do Provide Personal Service I Am Single Liveing In Kolkata 2Bhk Rented Residencial
Flat.–Welcome In My Flat ~ I Charge Following Amount 1 Shot 1 Hour Duration–4000 Rs., 2 shot 3 Hour Duration–7000 Rs., One Night Stand 10,000 Rs. I Live In Baguihati, Teghoria. Come Direct In My Flat. Mob–987430**95. No Extra Charge / No Hidden Coast.
বিজ্ঞাপন—৮
SHREYA HERE BENGALI GIRL PERSONAL SERVICE–22
Not An Escort Not A Massage Centre, Personal Independent Service. I Am Shreya Live Single In 1Bhk Flat Location—Baguihati. I Am College Student. Provide Personal Service. No Broker. No Middlemen. No Agent. No Third Person. Contact Me : 987430**95. I Charge 7000 Rs For 2 Shot, 3 Hour Duration. Fixed Charge (Bargainer Are Stay Away).
বিজ্ঞাপন—৯
HI AM MOU–25
Hi I’m mou housewife. 26 years old. I give personal service at my place for satisfaction. no broker—direct contact. Call/WhatsApp no _704437**27. Dumdum metro.
1 hour—1 sot 2000
2 hour—2 sot 3000
2 hour–3 sot 4500
বিজ্ঞাপন–১০
MY HUSBAND IS ABROAD
I am Rupa, 29 years Independent Housewife. My husband is abroad. I stay here in south Kolkata alone. I am 5’4”, extremely fair, very good looking chubby and very sportive. Looking for som extra income and ready to share a great companionship. I am expecting a short time. Full night just call 799830**84.
বিজ্ঞাপন—১১
WHO CAN SATISFIED ME
My fugure is so good, but my husband can’t satisfied me. I need good looking man who can satisfied me. My real picture here. So, plz contact 86974**76. Only 1600 per shot.
বিজ্ঞাপন–১২
MY HUSBAND CAN’T SATISFIED ME
Hi, my self Shima Sen, 25 years old, I am married house wife. My figure is so good. But my husband can’t satisfied me. I need good looking man who can satisfied me. So please contact 799877**51. JODI AMAR HUSBAND PHONE RECEIVE KORE BOLBE AMAR FRIEND.
না, আর তালিকা লম্বা করব না। এই কয়েকটা নমুনাতেই পরিস্থিতির চিত্রটা বুঝে নিতে অসুবিধা হবে না। পাঠকদের। বিজ্ঞাপনগুলি সুস্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে, তা হল–মানুষ ক্রমশ সাবালক হয়ে উঠছে। ঘোমটার নীচে খেমটা নাচার দিন শেষ। খেমটাই এখন ঘোমটাকে পিষ্ট করে নিচ্ছে। ভাবের ঘরে চুরি করার দিন আর যৌনকর্মীরা চায় না। সেক্স এখন চড়া দামে বিক্রি হয়। তাই বাজারে পণ্যের অভাব নেই। বিজ্ঞাপিত হয় বিজ্ঞাপনের ভাষায়।
(৮) মধুচক্র : হাজার হাজার রিসর্ট, আবাসিক হোটেল, লজ, ফাঁকা ফ্ল্যাট, নির্জন বাড়ি সর্বত্র এখন যৌনমস্তির ক্ষেত্ৰভূমি। গোপনে চলছে মধুচক্র। আধ-আধটা প্রকাশ্যে এসে পড়লেও একটা বড়ো অংশই আড়ালে থেকে যায়। ধনী ক্লায়েন্টদের খুব পছন্দের জায়গা। কারণ ভালো বিছানা, সাফসুতরো পরিবেশ, অ্যাচাট বাথরুম, ঘরোয়া পরিবেশ, সহজগম্য, গায়ে চট করে কাদা লাগে না ইত্যাদি। অপরদিকে মেয়েদের গায়ে ‘বেশ্যা’ তকমা লাগে না এবং বেশ্যালয়ের গন্ধও নেই। তদুপরি গুপছুপ কাজটা সেরে নেওয়া যায়। মধুচক্রে দু-রকমভাবে চালানো হয়। এক, কোনো মালিক বা মালকিন মেয়ে মজুত রাখে। ক্লায়েন্ট মেয়ে পছন্দ করে মালিক বা মালকিনের নিজস্ব ঘর বা রিসর্টে যৌনমিলনের সাহায্য করে। দুই, মালিক বা মালকিনের ঘর বা ফ্ল্যাট কয়েক ঘণ্টার বাইরে কোনো কাপল এলে তাঁদের নির্দিষ্ট ভাড়ায় অন্তরঙ্গ সময় কাটাতে সাহায্য করে। এই কাপলরা সাধারণত সভ্রান্ত পরিবার থেকে আসে। এই ধরনের কাজ আজকাল গণিকাপল্লিগুলিতেও হচ্ছে। গণিকাপল্লিতে হলে অবশ্য মধুচক্র বলা হয় না। তবে এখানে সভ্রান্ত পরিবারের কাপলরা ঘেঁষে না।
কারা চালায় মধুচক্রের আসর? বরং প্রশ্ন করুন কারা থাকেন না? সমাজের উঁচুতলার মহিলা ও পুরুষরা এই আসর চালায়। কে নেই? রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী থেকে শিক্ষকের স্ত্রী, আইনজীবীর স্ত্রী কর্পোরেট কর্মীর স্ত্রী, ডাকসাইটের অভিনেত্রী থেকে বড়ো ব্যবসায়ী—সবাই। খুব গোপনে কাজ সম্পন্ন হলেও মাঝেমধ্যেই পুলিশের জালে ফেঁসে যায় এঁরা। ফেঁসে গেলেও লেনদেনের মাধ্যমে দু-দিন পর আবার রমরম করে কাজ শুরু হয়ে যায়। কয়েকটা ঘটনার উল্লেখ করি।
ঘটনা–১
তারিখ : ১৫ আগস্ট, ২০১৫
রোজগার বাড়াতে বাড়ি ভাড়া নিয়ে মধুচক্র চালাচ্ছিলেন এক তৃণমূল নেত্রী। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে গ্রেফতার করে ওই নেত্রীকে। গ্রেফতার করা হয়েছে তাঁর সঙ্গী এক যুবককেও। মালদহের ইংরেজবাজারের সিঙ্গাতলা এলাকায় একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে ললিতা মণ্ডল নামে এক মহিলা মধুচক্রটি চালাচ্ছিলেন বলে অভিযোগ। গাজোলের ললিতা ওই ব্লকেরই তৃণমূল নেত্রী। ইংরেজবাজার থানার অদূরেই সিঙ্গাতলা। সেখানেই একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে তিনি দিব্যি ব্যাবসা ফেঁদেছিলেন বলে অভিযোগ। সিঙ্গাতলার ওই বাড়িতে মালিক থাকতেন না। তিনি থাকতেন অন্যত্র। অভিযোগ, সেই সুযোগটাকেই কাজে লাগাচ্ছিলেন ললিতা। মোটা মাইনের লোভ দেখিয়ে নিয়ে আসা হত মহিলাদের। পরে নামানো হত দেহব্যাবসায়। বেশ কিছু দিন ধরে বাড়িটিতে অচেনা যুবক-যুবতীদের আনাগোনা দেখে সন্দেহ হয় স্থানীয়দের। খবর দেওয়া হয় পুলিশে। পুলিশ গিয়ে দুই তরুণী ও এক যুবককে আপত্তিকর অবস্থায় দেখতে পায়। ললিতা নিজেও সেই সময় বাড়িতে ছিলেন। সবাইকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে গ্রেফতার করা হয় ললিতা ও এক যুবককে। ঘটনায় বেজায় অস্বস্তিতে পড়েছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে চাননি তাঁরা। তৃণমূল নেতা সুশীল রায় বলেন, ললিতাকে মহিলা সংগঠনের নেত্রী বলেই জানি। এর বেশি কিছু বলতে পারব না।
স্থানীয় সূত্রের খবর, প্রথমে ললিতা গাজোলে একটি পার্লার চালাতেন। পরে মোটা টাকা রোজগারের লোভে মধুচক্রের ব্যাবসা ফাঁদেন। ইংরেজবাজারের বিভিন্ন জায়গায় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে পার্লার। এগুলির সিংহভাগেই অনৈতিক কাজ হয় বলে অভিযোগ। বেকার যুবক-যুবতীদের মোটা মাইনের চাকরির টোপ দিয়ে নিয়ে আসা হয় পার্লারে। পরে মগজ ধোলাই করে নামিয়ে দেওয়া হয় দেহব্যাবসায়। আর একবার ব্যাবসায় নেমে যাওয়ার পর আর ফিরতে পারেন না অধিকাংশ তরুণ-তরুণী। কারণ কম খাটুনিতে প্রচুর পয়সা রোজগার করা যায় এই পেশায়। তাতে বজায় থাকে ঠাঁট-বাট। স্থানীয়দের অভিযোগ, পুলিশ সক্রিয় না হওয়াতেই এসব ‘অনৈতিক কারবার চলছে রমরমিয়ে। জেলার প্রায় সর্বত্রই পার্লারের আড়ালে মধুচক্রের ব্যাবসা চলছে রমরমিয়ে। পুলিশ মাঝেমধ্যে হানাও দেয়। ধরাও পরে। তারপরেও দিব্যি চলতে থাকে মধুচক্র। মোটা টাকার বিনিময়ে বিকিয়ে যায় নারী শরীর। বিকায় পুলিশ-প্রশাসনও।
ঘটনা–২
তারিখ : ২১ ডিসেম্বর, ২০১৯
নৈহাটিতে কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ের ধারের একটি হোটেলে মধুচক্রের আসরে হানা দিয়ে সাত যুবককে গ্রেপ্তার করল পুলিশ। বৃহস্পতিবার রাতে গোপন সূত্রে খবর পেয়ে নৈহাটি থানার পুলিশ রাজেন্দ্রপুরের কাছে ওই হোটেলে হানা দেয়। হাতেনাতে ধরা হয় সাত জনকে। জনা কুড়ি যুবতীকেও ওই হোটেল থেকে পুলিশ উদ্ধার করেছে। নৈহাটি থানার পুলিশের কাছে গত কয়েকদিন ধরে খবর আসছিল কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ের ধারে থাকা ওই হোটেলে অবাধে চলছে মধুচক্র।
ঘটনা–৩
তারিখ : ৯ ডিসেম্বর, ২০১৯
স্পা ও কলসেন্টারের আড়ালে মধুচক্র। চার জায়গায় যৌথ অভিযান চালায় কলকাতা পুলিশের এসটিএফ, গোয়েন্দা বিভাগ ও গুদমন শাখা। শহরের ৪ জায়গা থেকে ধৃত ৬৫। শহরে মধুচক্রের হদিশ। কোথাও স্পায়ের আড়ালে কোথাও বা কলসেন্টারের আড়ালে চলছিল মধুচক্র। কলকাতা পুলিশের এসটিএফ, গোয়েন্দা বিভাগ ও গুন্ডাদমন শাখা অভিযান চালায় গড়িয়াহাটের রাসবিহারী অ্যাভিনিউ, ভবানীপুর, নিউ মার্কেট ও প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডে। গড়িয়াহাটের রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের এই বাড়ির তিনতলায় আগেও মধুচক্রের হদিশ মিলেছিল। এই বাড়িরই একতলায় ঘর ভাড়া নিয়ে স্পায়ের আড়লে মধুচক্র চালাত দেবব্রত বৈদ্য। ভবানীপুরের শ্রীপল্লি এলাকায় সুন্দর সাজানো গোছানো একটি স্পা সেন্টার। সাইনবোর্ডে ‘ফ্যামিলি স্যালোঁ’ লেখা থাকলেও আদপে এখানে মধুচক্রের আসর বসত। পুলিশি অভিযানে স্পায়ের দুই কর্মীসহ ৯ যুবককে গ্রেফতার করা হয়। যাদের মধ্যে দুজন ভিনরাজ্যের যুবকও ছিল। আটক করা হয় ৯ মহিলাকে। বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে বেশ কয়েকটি মোবাইল ও ৩টি বাইক। নিউমার্কেট ও প্রিন্স আনোয়ার শা রোডেও অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা। হয় ৪৪ জনকে।
ঘটনা–৪
তারিখ : ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮
বেসরকারি একটি লজে মধুচক্রের আসরে হানা দিয়ে ৭ মহিলা ও ১৩ পুরুষকে আটক করেছে পুলিশ। ভারতের ছত্তিশগড়ের মহাসমুন্ডের তোগভে এ ঘটনা ঘটেছে। ওই বেসরকারি লজে দীর্ঘদিন ধরে এই মধুচক্র নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করার পর পুলিশ অভিযান চালায়। পুলিশ জানান, ওই বেসরকারি লজ থেকে পুরুষ ও মহিলাসহ মোট ২০ জনকে আটক করা হয়েছে। এর আগেও মধুচক্র নিয়ে একাধিকবার আলোচনায় আসে ছত্তিশগড়ের নাম। অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া ছত্তিশগড়ের নগরজীবনে লাগাতার চলছে লড়াই। কখন শরীর বিক্রি করে, অথবা কখনও নাবালিকাকে হোটেলে পাঠিয়ে অর্থ উপার্জনের কাজ চলছে। জোর করে নাবালিকাদের আটকে রেখে প্রতি রাতে হোটেলে মধুচক্রের আসর বসানোর অভিযোগও আছে।
ঘটনা–৫
তারিখ : ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০
শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদের অন্তর্গত ফাঁসিদেওয়া ব্লকের বিধাননগরের একটি হোটেল। সেখানেই গোপনে চলছিল মধুচক্রের আসর। দীর্ঘদিন ধরেই ওই হোটেলের ঘর ভাড়া নিয়ে বিভিন্ন বয়েসি ছেলে-মেয়েরা নিজেদের যৌন-চাহিদা মেটাচ্ছিল। জানা গিয়েছে, ওই বার-কাম-রেস্টুরেন্টের উপর তলায় অবৈধভাবে কয়েকটি ঘর তৈরি করেই এই কাজ চলছিল। সেখানে ঘণ্টা হিসেবে রুম ভাড়া দেওয়া হত। গোপন সূত্রে খবর পেয়েই সেখানে হানা দেয় পুলিশ। হোটেলের বিভিন্ন ঘর থেকে হাতে নাতে ধরা হয় পাঁচ জোড়া স্কুল পড়য়াকে। এদের মধ্যে অনেকেই নাবালিকা বলে জানা গিয়েছে। প্রত্যেককেই আটক করে থানার নিয়ে যায় পুলিশ। পুলিশি অভিযানের খবর পেয়েই ওই হোটেলের সামনে জড়ো হয় এলাকাবাসী। তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই মহিলা, তাঁরা ওই স্কুল পড়ুয়াদের দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তাঁদের ঘিরে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। এলাকাবাসীর দাবি, বহুদিন ধরেই এই হোটেলে অল্প বয়সি ছেলেমেয়েদের যাতায়াত চোখে পড়ছে। অথচ পুলিশ এর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না-নেওয়ার ফলেই এখানে দেহ ব্যাবসার রমরমা বেড়ে গিয়েছিল।
ঘটনা–৫
তারিখ : ২৮ জানুয়ারি, ২০২০
খবরের কাগজে ‘বন্ধুত্ব করুন’-এর বিজ্ঞাপন। আর তার আড়ালে মধুচক্র চালানোর অভিযোগ। বারাসতে গ্রেফতার এক সাইবার কাফের মালিক প্রভাস হালদার। মধুচক্র চালানোর পাশাপাশি বারাসত ও নিউটাউন থানায় কয়েক কোটি টাকা প্রতারণার মামলা রয়েছে ধৃত প্রভাস হালদারের বিরুদ্ধে। কল্যাণী থানায় অভিযোগ দায়ের হয়েছিল প্রভাস হালদারের বিরুদ্ধে। সেই তদন্তে নেমেই এই কীর্তির পর্দাফাঁস পুলিশের। কয়েক সপ্তাহ আগে মধ্যমগ্রামের একটি বাড়িতে ভুয়ো অফিসের সন্ধান পায় পুলিশ। সেখান থেকেই অপারেশন চালাত প্রভাস হালদার। ‘পত্রমিতালি’ নাম দিয়ে বিজ্ঞাপন ছাপা হয় খবরের কাগজে। বন্ধুত্ব করুন’ সংস্থার আড়ালে রমরমিয়ে চলত মধুচক্র। এরপর বিভিন্ন অন্তরঙ্গ ভিডিও জোগাড় করে ক্রেতাদের ক্রমাগত ব্ল্যাকমেলিং করা হত। তাদের কাছ থেকে মোটা টাকার চেক নিয়ে রাখা হত বিভিন্ন বেনামি অ্যাকাউন্টে। সেই টাকাতেই মাইনে দেওয়া হত অফিসের কর্মচারীদের। বেনামি অ্যাকাউন্টগুলি বেশিরভাগই বিভিন্ন দুঃস্থ পড়ুয়াদের নামে। পরে সেখান থেকে চেক ভাঙিয়ে ক্যাশ তোলা হত।
কল্যাণী থানায় প্রতারিত এক ব্যক্তি অভিযোগ দায়ের করেন। তদন্তে নামে সিআইডি। সন্ধান পায় মধ্যমগ্রামের ভুয়ো অফিসের। জানা গিয়েছে, বাড়ির মালিককে মোটা ভাড়ার লোভ দেখিয়ে ভাড়া নেয় প্রধান অভিযুক্ত ঘনশ্যাম হালদার। তল্লাশিতে নেমে সেই বাড়ি থেকে ১৫ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। জেরায় নাম উঠে আসে ঘনশ্যামের। ফোনের মাধ্যমে আলাপ ও পরে কাজ না হলে হুমকি। এভাবেই অপারেশন চালাত অভিযুক্ত। বারাসত থানার পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে সোমবার রাতে তল্লাশি চালায় সিআইডি। বারাসতের অশ্বিনীপল্লি থেকে অভিযুক্তের দাদা প্রভাস হালদারকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
ঘটনা–৬
তারিখ : ২ জানুয়ারি, ২০১৯
শহরে দেহব্যাবসা এখন আর নির্দিষ্ট কয়েকটি জায়গায় সীমাবদ্ধ নেই। অভিজাত এলাকাতেও রমরমিয়ে মধুচক্রের কারবার চলছে বলে অভিযোগ। প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে অসৎ পথে পা বাড়াচ্ছেন তরুণীরা। কাজে লাগানো হচ্ছে নাবালিকাদেরও। সেক্টর টু-এর গ্রিন শেল্টার গেস্ট হাউসে মধুচক্রের সন্ধান পেলেন সিআইডি আধিকারিকরা। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে ওই গেস্ট হাউসে অভিযান চালান গোয়েন্দারা। হাতেনাতে ধরা পড়ে যান গেস্ট হাউসের ম্যানেজার, এক মহিলা নারী পাচারকারীসহ ছয় জন। উদ্ধার করা হয়েছে দুজন নাবালিকাসহ ছয় জনকে। গেস্ট হাউসের ম্যানেজার ও এক মহিলাসহ মোট ৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছেন রাজ্য গোয়েন্দা সংস্থার আধিকারিকরা। দিন কয়েক আগেই কলকাতা ও বাগুইআটির পাঁচটি ম্যাসাজ পার্লারে মধুচক্রের পর্দাফাঁস করেন লালবাজারে গোয়েন্দারা। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ ও স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের যৌথ অভিযানে ধরা পড়ে ৫৪ জন। ধৃতদের মধ্যে ৩৬ জন মহিলা। তাদের কেউ যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করত, কেউ আবার ছিল মধুচক্র বা ম্যাসাজ পার্লারের মালিক বা মালকিন। বিভিন্ন বয়সের এইসব যৌনকর্মীরা মূলত শহর ও শহরতলির বাসিন্দা। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, সল্টেলেকের গ্রিন শেল্টার গেস্ট হাউসের ম্যানেজার সন্দীপ মিশ্র। তাঁর বাড়ি পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরে। অপর দুই অভিযুক্ত রাজু দাস ও তুহিন বন্দ্যোপাধ্যায় বাঁকুড়ার বাসিন্দা। বাকি তিনজন উত্তর চব্বিশ পরগনার দমদম, বারাসত ও পূর্ব বর্ধমানের।
ঘটনা–৭
তারিখ : ১০ জানুয়ারি, ২০২০
মধুচক্র (Sex Racket) চালানোর অভিযোগে গ্রেফতার করা হল বিগ বস ১৩-র প্রাক্তন প্রতিযোগী আরহান খানের বান্ধবী অমৃতা ধানোয়াকে। গোরেগাঁওয়ের একটি পাঁচতারা হোটেল থেকে গ্রেফতার করা হয় অমৃতাকে। গোরেগাঁওয়ের একটি পাঁচতারা হোটেলে পার্টি চলাকালীন গ্রেফতার করা হয় আরহান খানের প্রাক্তন বান্ধবী অমৃতা ধানোয়াকে। মধুচক্র চালানোর অভিযোগেই গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। অমৃতার বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির বেশ কয়েকটি ধারায় অভিযোগ দায়ের করা হয়। অমৃতার পাশাপাশি রিচা সিং নামে আরও এক অভিনেত্রীকে গ্রেফতার করা হয়। রূপোলি জগতে খাতা খোলার চেষ্টায় ছিলেন রিচা সিং নামে ওই অভিনেত্রী। আচমকাই গোরেগাঁওয়ের ওই পাঁচতারা হোটেল থেকে অমৃতার সহযোগী হিসেবে গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। গোরেগাঁওয়ের ওই পাঁচতারা হোটেলে পুলিসের হানাদারি চলতে পারে। এই খবর শোনার পর সেখান থেকে পালানোর চেষ্টা করেন অমৃতা। কিন্তু সফল হননি। চম্পট দেওয়ার আগেই ওই পাঁচতারা হোটেলের পার্টি থেকে গ্রেফতার করা হয় আরহান খানের প্রাক্তন বান্ধবীকে।
ঘটনা–৮
তারিখ : ১৯ অক্টোবর, ২০১৯
দিনে দুপুর জনবহুল এলাকায় মধুচক্র চালানোর অভিযোগ এক গৃহবধুর বিরুদ্ধে। প্রতিবেশীরা হাতেনাতে মধুচক্র ধরে তুলে দিল পুলিশের হাতে। ঘটনাটি ঘটেছে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট শহরের সাহেব কাছারি এলাকায়। জানা গেছে সাহেব কাছারি এলাকায় বাসিন্দা পূরবী সরকারের স্বামী মারা যাওয়ার পর দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এর পর থেকেই তিনি দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে মিলে বাড়িতে মধুচক্রের আসর বসাতেন। এর আগেও একই অভিযোগে তাঁদের জেলও হয় বলে জানা গেছে। জেল থেকে ছাড়া পেয়েই তাঁরা আবার বালুরঘাট সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকার মহিলাদের নিয়ে মধুচক্রের আসর শুরু করেন। প্রতিবেশীরা বেশ কিছু দিন ওই বাড়িতে অপরিচিত নারী পুরুষের আনাগোনা লক্ষ করছিলেন এবং এই মধুচক্রের আসর হাতে নাতে ধরার লক্ষ্যে ছিলেন। আজ আবার কিছু অপরিচিত নারী পুরুষকে ওই বাড়িতে যেতে দেখলে তাঁরা হাতেনাতে তিনজন মহিলা ও দুই পুরুষকে ধরে ফেলে। এছাড়াও একজন পুরুষ পালিয়ে গেছে বলেও জানা গেছে। এরপর এলাকাবাসী পুলিশকে খবর দিলে পুলিশ এসে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে।
ঘটনা–৯
তারিখ : ৮ আগস্ট, ২০১৭
অভিযোগ আগেই ছিল। এবার একেবারে হাতেনাতে ধরা পড়ল। খোদ সিনেমা হলের ভিতরে দেহব্যাবসা চালানোর অভিযোগে ওই হলে ব্যাপক ভাঙচুর চালালেন স্থানীয় মানুষজন। ভরদুপুরে হঠাৎ ওই সিনেমা হলের দোতলার ঘর থেকে এক মহিলাকণ্ঠের আর্ত চিৎকারে আশপাশের বাসিন্দারা ছুটে যান। সেখানে গিয়ে ওই যুবতীর কাছ থেকেই তাঁরা মধুচক্রের কথা জানতে পারেন। ঘটনাস্থল থেকেই দুই যুবক ও এক যুবতীকে হাতেনাতে ধরে বেধড়ক মারধর করেন তাঁরা। এর পরই উত্তেজিত স্থানীয় মানুষ হামলা চালান ওই সিনেমা হলে। গুসকরা ফাঁড়ির পুলিস ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, গুসকরা ২ নম্বর ওয়ার্ডের নদীপটি এলাকায় ওই হলে দিনের পর দিন সিনেমা দেখানোর নামে রমরমিয়ে চলছে মধুচক্র। সিনেমা হলটির ভিতরে বেশ কয়েকটি ঘর আছে। সেগুলিকে দেহব্যাবসায় কাজে লাগিয়ে ঘণ্টা হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয়। ফলে এই সিনেমা হলে সকাল থেকেই গুসকরা শহর ও আশপাশের গ্রামগঞ্জের মানুষের ভিড় লক্ষ করা যায়। সিনেমা হলে ছবি দেখানোর নামে মধুচক্রের অভিযোগ নিয়ে দিনের পর দিন বিভিন্ন মহলে জানিয়েও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এদিন দুপুর নাগাদ সিনেমা হলের ভিতরে এক যুবক এক যুবতীকে মারধর করলে সেই যুবতী আর্ত চিৎকার করে ছুটতে ছুটতে বাইরের দিকে আসছিল। সেই সময় স্থানীয় মানুষ তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই সে দেহব্যাবসায় কথা জানায়। এর পরই সেখান থেকে দুই যুবককে টেনে বার করে মারধর দিয়ে স্থানীয়রা চড়াও হন সিনেমা হলে। এলাকাবাসীদের অভিযোগ, এই সিনেমা হলে অনৈতিক কাজকারবারের পিছনে অদৃশ্য হাত রয়েছে। তাই হলের ভিতরে ঘর ভাড়া দিয়ে চলছে মধুচক্র। এতে এলাকার সুনাম নষ্ট হচ্ছে। তাঁরা লজ্জায় তাঁদের পাড়ার নাম কাউকে বলতে পারেন না। বিষয়টি তাঁরা পুলিস থেকে শুরু করে স্থানীয় ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলরকেও বারবার জানিয়েছিলেন। কিন্তু কেউ কোনো ব্যবস্থা নেননি। এমনকি রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ শেষ শো ভাঙার পরেও সারা রাত অনেককেই এই সিনেমা হল থেকে বেরতে দেখা যায়।
ঘটনা–১০
তারিখ : ৪ জুন, ২০১৮
ব