- বইয়ের নামঃ গণিকা-দর্শন
- লেখকের নামঃ অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
০. মুখবন্ধ (গণিকা-দর্শন)
গণিকা-দর্শন (প্রাপ্তমনস্কদের জন্য) – অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
.
উৎসর্গ : কবি অলোক বিশ্বাসকে
এক শীতের সকালে যে আমাকে ভাবিয়েছিল, চাইলে আমিও লিখতে পারি
.
সূচিপত্র
- মুখবন্ধ
- বেশ্যানাং পুরুষাধিগমে রতির্বৃত্তিশ্চ সৰ্গাৎ
- গণিকা এবং চৌষট্টি কলার সমম্বয়
- স্বর্গের বেশ্যা যাঁহারা = স্বৰ্গবেশ্যা
- গণিকাবৃত্তির এক করুণ রূপ বিষকন্যা
- বাৎস্যায়নের চোখে গণিকা
- প্রাচীন সাহিত্যে গণিকা
- দেবদাসীর অন্য নাম গণিকা
- প্রাক-আধুনিক ও আধুনিক সাহিত্যে গণিকা
- বাবুবিলাসীদের গণিকাযাপন
- ভারতের বাঈজি-সংস্কৃতি ও গণিকাবৃত্তি
- ব্রিটিশ-ভারতে গণিকাদের সামাজিক অবস্থা
- অন্য দেশ : প্রাচীন সভ্যতায় গণিকাবৃত্তি
- যাত্রা-থিয়েটার-চলচ্চিত্রে গণিকা
- স্বাধীনতা সংগ্রামে গণিকা
- গণিকাবৃত্তি নানা রূপে
- দেশে দেশে গণিকাবৃত্তি
- পুরুষ যৌনকর্মীর বাজার
- গণিকাবৃত্তির বিশ্ব-অর্থনীতি
- গণিকালয়ের নাম সোনাগাছি
- উত্তরণ : বেশ্যা থেকে যৌনকর্মী
- পুরুষরা কেন যৌনকর্মীদের সাহচর্য চায়
- বেশ্যাদ্বারের মাটি : গূঢ়তত্ত্ব
- যৌনকর্মীরা কি বাধ্য হয়েই যৌনপেশায়?
- গণিকাবৃত্তির অধিকারের লড়াই, নিশ্চয়তা, নিরাপত্তায় স্বেচ্ছাসেবী
- গণিকাগমন এবং গনোরিয়া, সিফিলিস ও এইডস
.
মুখবন্ধ (গণিকা-দর্শন)
যৌনপেশা সাধারণত দুটো ভাগে ভাগ করে নেওয়া যায়–(১) রেড লাইট এরিয়া এবং (২) নন-রেড লাইট এরিয়া। রেড লাইট এরিয়ায় মূলত বিক্রি হয়ে, পাচার ও প্রতারিত হয়ে আসা মেয়েরা বাধ্য হয়ে যৌনপেশায় যুক্ত থাকে। এঁরা সমাজের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন। নন-রেড লাইট এরিয়ার গণিকারা স্বেচ্ছায় যৌনপেশা বেছে নেয়। অতিরিক্ত রোজগারে আশায় এ পেশায় আসে। এঁরা কেউ স্বাধীন, কেউ-বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাজ করে। এঁরা সমাজের মূলস্রোতে বুক ফুলিয়েই থাকে। চাকরির মতো সকালে সেজেগুজে বেরয়, রাতে বাড়ি ফেরে।
গণিকাবৃত্তি বা বেশ্যাবৃত্তি বা যৌনপেশা আমাদের মনুষ্য সমাজে দুটি নজরে বা দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয়। সর্বাপেক্ষা প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গিটি হল নোংরামি, অনৈতিক এবং দণ্ডনীয়। অর্থাৎ গণিকাবৃত্তিকে দেখা হয় পাপকর্ম বা পাপাচার হিসাবে। অপর দৃষ্টিভঙ্গিটি হল সেফটি ভালব, মানুষের যৌন অবদমন থেকে মুক্তিদাত্রী। নারীদের গণিকাবৃত্তিকে সেফটি ভালব হিসাবে দেখার কারণ বিবাহের সীমার মধ্যে যেসব পুরুষের অধরা যৌনবাসনা পূরণ না-হয়, তাঁদের সেই কামনা চরিতার্থ করতেই সমাজে গণিকাবৃত্তির প্রয়োজন। গণিকারা যেন নীলকণ্ঠ, সমাজের পুরুষ-বিষ ধারণ করবে সে–এরকম একটা ট্যাবু।
অন্দরমহলে নারীর মূলত প্রধান দুটি ভূমিকা–একটি স্ত্রী, অন্যটি মাতা। দুটি সম্পর্কেই যত দ্বন্দ্ব! দুটি ভূমিকাই প্রজন্মের প্রজনন কর্মের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। প্রজনন প্রশ্নে অবশ্যই আসবে যৌনতা। যৌনতা বলতে গোদা বাংলায় অবশ্যই যৌনক্রিয়া বা ইন্টারকোর্স বোঝায়। যেহেতু নারীর যৌনতাকে কেবলমাত্র বিবাহের মাধ্যমেই বৈধতা দেওয়া হয়েছে, তাই বিবাহের মধ্যেই যৌনতাকে সংগঠিত করা হয়। বৈবাহিক জীবনে নারীর যৌনতা একটি গৃহস্থালী দায়িত্ব ও কর্তব্যে পর্যবসিত হয়ে যায়। স্বামীর যৌনক্ষুধা নিবারণ ও সন্তান উৎপাদনের জন্য উৎসর্গীকৃত নারী। স্বামী-স্ত্রীর এই সম্পর্কে যদি স্ত্রীর কামনা-বাসনা কিছুটাও পরিতৃপ্ত হয়, তা সত্ত্বেও বিবাহ নামক এই প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি হয়েছে সন্তান উৎপাদন ও স্বামীর যৌনক্ষুধা নিবারণ করতে। নারীর যৌনক্ষুধার তৃপ্তি মিটুক বা না-মিটুক বংশরক্ষার কারণে নারীকে অবশ্যই যৌনকর্ম করতে হবে। পুরুষকেও কেবলমাত্র স্ত্রীর সঙ্গেই যৌনকর্ম করতে হবে। তবে পুরুষ স্ত্রীসঙ্গ ছাড়া অন্য নারীর সঙ্গও পেতে পারে। বিশাল বাজার তাঁর জন্য খোলা আছে। চাইলেই বহুগামী মনকে বিকশিত করতে পারে। অথবা যৌন অবদমন থেকে মুক্তি পেতে পারে। কিন্তু আর্থ-সামাজিক কারণে তেমন সুযোগ হয়তো কম। সেই কম সুযোগটাকেও অনেক সাহসী নারী কাজে লাগিয়ে থাকে। স্বামী বা স্ত্রী ব্যতীত অন্য নারী বা পুরুষের সঙ্গে যৌনাচার করতে সাহস তো লাগেই। তাই নারী যৌনকর্মীদের সঙ্গে সঙ্গে পুরুষ যৌনকর্মীদের বাজারও আছে। দেহ বিক্রির বাজার না-নারী না-পুরুষদের জন্যেও আছে, যাদের আমরা সমকামী ও রূপান্তরকামী বলে থাকি।
গণিকাবৃত্তির যদি কেবলই নেতিবাচক প্রভাব থাকত, তবে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি সমাজে বা রাষ্ট্রে এই পেশা বিদ্যমান থাকত না হাজার হাজার বছর ধরে। কবেই নির্মূল হয়ে যেত। আসলে সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে এর বহু ইতিবাচক প্রভাব আছে। পেশাগত দিক থেকেও লাভজনক। ইকোসিস্টেমে যেমন পৃথিবীর কোনো প্রাণীকেই অপ্রয়োজনীয় ভাবতে পারি না, তেমনি কোনো পেশাকেই অপ্রয়োজনীয় ভাবার কোনো অর্থ নেই। কেউ যদি স্বেচ্ছায় কোনো পেশা বেছে নিয়ে নিজের মতো করে, তাতে তো কারোর আপত্তি থাকার কথা নয়। সারা দেশে বেকারত্বের সংখ্যা উত্তোরত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি সর্বত্র কর্মসংস্থানের হাহাকার। উচ্চমেধাদের জন্য কিছু ব্যবস্থা থাকলেও মধ্যমেধা আর নিন্মমেধাদের জন্য আর কোনো কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। চতুর্দিকে যে হারে অটোমেশন ঢুকে পড়েছে, ভবিষ্যতে মধ্যমেধা আর নিন্মমেধারা ভয়ানকভাবে সংকটে পড়বে। এখনই পরিলক্ষিত হচ্ছে এমএ পাশ পিএইচডি করা ছেলেমেয়েরা চতুর্থ শ্রেণি বা ডোমের পেশার মতো জায়গায় আবেদন করছে। যাঁরা বিশেষ কোনো কাজে দক্ষ নয়, তাঁরা নির্বিবাদে বেছে নিচ্ছে অন্য পেশা। তার মধ্যে যৌনপেশাও আছে–নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। কী বললেন? যৌনপেশা সম্মানজনক পেশা নয়? সমাজ যৌনকর্মীদের ঘৃণা করে? একদম ঠিক বলেছেন। যৌনপেশা ছাড়া গোটা পৃথিবী সহ আমাদের দেশেও অসংখ্য মানুষ নিজের পেশা লুকিয়ে জীবন অতিবাহিত করে। কী পুরুষ, কী নারী। কারণ সেই পেশা সমাজে সম্মানজনক নয়। সমাজের এক শ্রেণির মানুষ সেই পেশাকে ‘ছোটো কাজ’ বলে ঘৃণা করে। তাঁর প্রতি সম্বোধনই বদলে যায়। তবুও মানুষকে সেই পেশাকেই বেছে নিতে ভরা পেটে বেঁচে থাকার জন্য। পাথরপ্রতিমায় আমার এক পরিচিতের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সে রিকশা চালাচ্ছিল। আমার ক্লাসমেট ছিল। ও বনগাঁ থেকে প্রতিদিন সকালে স্যুটেড বুটেড হয়ে হাতে অফিস ব্যাগ নিয়ে ট্রেন ধরত। সবাই জানত সে কোনো অফিসে কাজ করে। পাথরপ্রতিমায় এসে নিজের পোশাক খুলে রিকশার সিটের নীচে ঢুকিয়ে রেখে সস্তার পোশাক পরে নিত। তারপর রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়ত। এরকম অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়।
‘International Encyclopedia of Social’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে–সমাজ গণিকাবৃত্তিকে ঘৃণার চোখে দেখলেও এর বিলুপ্তির জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করেনি। কারণ কতগুলো সামাজিক কাজ এটি করে থাকে। ফলে সমাজে ধর্ষণ প্রবণতাও হ্রাস পায়। বিবাহ ছাড়া যৌনক্ষুধার মতো মৌলিক ও জৈবিক চাহিদা পূরণের সুযোগ শুধু গণিকারাই দিয়ে থাকে। এভাবে যৌনকর্মীরা নিজের জীবনজীবিকার সঙ্গে সঙ্গে পরোক্ষ উপকারও করছে সমাজের। আসলে গণিকাবৃত্তি ছাড়াও অসংখ্য ‘নিকৃষ্ট’ পেশা আমাদের সমাজে টিকে আছে মানুষেরই স্বার্থের জন্যে। এইসব ইতিবাচক প্রভাব এবং সমাজের পরোক্ষ উপকারের জন্যই সমাজের ঘৃণিত প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও বিলুপ্ত করা হয়নি, হবেও না। তাই গণিকাবৃত্তির অনুমোদনে সরাসরি কোনো আইনের অস্তিত্ব না-থাকলে পরোক্ষভাবে গণিকাবৃত্তির অস্তিত্ব মেনে নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের মতো বেশ কিছু দেশে আবার ১৮ বছরের উপরের যুবতীদের এফিডেভিটের মাধ্যমে স্বেচ্ছায় গণিকাবৃত্তি গ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। থাইল্যান্ডের সরকার পর্যটন পরিকল্পনার আওতায় গণিকাবৃত্তিকে ‘জাতীয় শিল্প হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার পর এমন হয়েছে যে, সেই দেশের সব মেয়েকেই মনে করা হয় যৌনকর্মী। ফলে রাস্তায় দাঁড়ানো যে-কোনো মেয়ের কাছে গিয়ে পর্যটকরা বলা আরম্ভ করল, তাঁর সঙ্গে মেয়েটি শোবে কি না!
নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, আর্জেন্টিনা, আর্মেনিয়া, অস্ট্রিয়া, বেলিজ, লাটভিয়া, বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকার কিছু অংশ আছে, যেখানে গণিকাবৃত্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত নীতিগুলি আরও উদার। সেসব দেশে বেশ কয়েকটি বৈধ গণিকালয়ও আছে। তবে উত্তর কোরিয়া, সুদান, ইরান এবং সৌদি আরবের মতো দেশও আছে, যেখানে গণিকাবৃত্তি একটি গুরুতর অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হয় এবং যদি দোষী সাব্যস্ত হয়—শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তাই বলে সেখানে গণিকাবৃত্তি সেখানে বন্ধ আছে? গণিকাবৃত্তি বৈধকরণ সম্পর্কিত ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে কোনো মিল নেই। অবৈধ হওয়া সত্ত্বেও গৃহযুদ্ধের কারণে সামাজিক ভাঙন এবং দারিদ্র্যের কারণে আফ্রিকার কয়েকটি দেশে গণিকাবৃত্তি পরিচালিত হয়। গণিকাবৃত্তি ভারত, নেপাল, ভুটান এবং পাকিস্তানে অবৈধ, তবে এখনও বিভিন্ন ছদ্মবেশে চলছে। এশীয় দেশগুলির মধ্যে থাইল্যান্ডে যৌন পর্যটন বেশ জনপ্রিয়।
বিশ্বের বহু দেশেই গণিকাবৃত্তি বৈধ এবং সেখানে যৌনকর্মীরা নিয়মিত আয়করও দেন। হল্যান্ডে পর্যটকদের মূল আকর্ষণই এই ‘গণিকাপল্লি’, পুরোপুরি বৈধ। ইউরোপের এই দেশটির গণিকাপল্লি সত্যিকার অর্থেই বিশ্ববিখ্যাত। ওই ‘রেডলাইট জোন’ দেখতে প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজারো পর্যটক আসে আমস্টারডামে। নেদারল্যান্ডসের মতো ইউরোপের আর-এক দেশ বেলজিয়ামেও দেহ-ব্যাবসা সম্পূর্ণ বৈধ। জার্মানি এবং ফ্রান্সে বৈধ হলেও কঠোর, সেক্ষেত্রে যৌনকর্মীদের মানতে হয় কঠোর আইন। জার্মানির কিছু শহরে যৌনকর্মীরা রাস্তায় নেমে ক্লায়েন্টদের ডাকতে পারে না। ফ্রান্সেও ২০১৪ সালে এমন একটা আইন হয়েছে, যা মেনে যথেচ্ছ দেহ-ব্যাবসা করা খুব কঠিন। সুইডেন আর নরওয়েতেও নিয়ন্ত্রিত গণিকাবৃত্তি। ফ্রান্সের ২০১৪ সালের আইনটি প্রথম চালু হয়েছিল, সুইডেনে ১৯৯৯ সালে। এই কারণে আইনটি ‘সুইডিশ মডেল হিসাবে পরিচিত। এ আইনে যৌনকর্মীদের অধিকার রক্ষা করে দালালদের নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সুইজারল্যান্ড ও অস্ট্রিয়ায় যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা বাধ্যতামূলক। তবে এই দুটি দেশে ১৯ বছর বয়স না-হলে কেউ দেহ-ব্যাবসায় আসতে পারেন না। যৌনকর্মীদের যাতে কোনো যৌনরোগ না-হয় কিংবা তাঁদের মাধ্যমে ক্লায়েন্টদের মধ্যে যাতে এইডস, সিফিলিস বা অন্য কোনো যৌনরোগ ছড়াতে না-পারে, তা নিশ্চিত করতে যৌনকর্মীদের নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা করাতে হয়। অবশ্য শুধু সুইজারল্যান্ড ও অস্ট্রিয়াতে নয়, জার্মানিতেও ওই একই নিয়ম। গ্রিস ও তুরস্কেও গণিকাবৃত্তি নিয়ন্ত্রিত। গ্রিস এবং তুরস্কেও গণিকাবৃত্তি পুরোপুরি বৈধ। তবে দেহ-ব্যাবসার আইন। খুব কঠিন। জার্মানির মতো এই দুটি দেশেও যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্যবিমা করা বাধ্যতামূলক। এছাড়া যৌনকর্মীরা নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা করায় কি না, তা সবসময় তদারক করা হয়। স্বাস্থ্যকার্ডেই লেখা থাকে স্বাস্থ্যপরীক্ষার সব তথ্য। দক্ষিণ আমেরিকায় অধিকাংশ দেশেই যৌন-ব্যাবসা বৈধ। তবে কিছু দেশে মাফিয়া এবং মানব পাচার বড়ো সমস্যা হয়ে ওঠায় এই ব্যাবসার উপর কড়া নজর এবং তদারকি বেড়েছে। দেহ-ব্যাবসাকে মাফিয়া চক্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখতে ব্রাজিল এবং মেক্সিকোতে আছে কঠোর আইন। তারপরও দেশ দুটিতে মাফিয়া চক্রের আধিপত্য থেকে গেছে। প্রতিবেশী হয়েও নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার আলাদা নিয়ম, নিউজিল্যান্ডে যৌন ব্যাবসা একেবারেই বৈধ। তবে প্রতিবেশী দেশ অস্ট্রেলিয়ার অনেক রাজ্যে এই ব্যাবসা এখনও অবৈধ। ২০০৩ সালে আইন করে সব প্রাপ্তবয়স্কের জন্য যৌন-ব্যাবসাকে বৈধ করে দেয় নিউজিল্যান্ড।
আমার এই ‘গণিকা-দর্শন’ গ্রন্থে বিশ্বদর্শনের যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি। সমাজের সব শ্রেণির যৌনকর্মীদের নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করেছি। তুলে আনার চেষ্টা করেছি গোটা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণিকাবৃত্তির ইতিহাস ও বর্তমান বহমানতা। যৌনপেশা কারা করে? কেন করে? কারা যায় যৌনকর্মীর কাছে? কেন যায়? যৌনকর্ম কি বৈধ করা উচিত? কেন উচিত নয়? কেন অনুচিত? সমস্ত দূরহ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছি এই গ্রন্থে। বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে গণিকাবৃত্তির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে। যৌনকর্মীদের অন্দরমহলের কথা উঠে এসেছে। উঠে এসেছে তাঁদের জীবন-যৌবন-অর্থের কথাও। চমকে যাওয়ার মতো অনেক তথ্য উঠেছে, যা আগে কখনো কেউ বলেনি। এই গ্রন্থ কেবলমাত্র তথ্যের ঘনঘটা নয়, এটি একট ওয়ার্কশপ। মাঠে নেমে সংশ্লিষ্ট মানুষের সঙ্গে কথা বলে তুলে এনেছি মানুষের কথাই। যৌনপল্লিতে ঘুরে ঘুরে শুধু অন্ধকার খুঁজিনি, খুঁজেছি আলোর রশ্মিও। যৌনপল্লিগুলির বাইরেও আছে দেহ বিক্রেতাদের বৃহৎ বাজার। সেখানেও পৌঁছে গেছি ছলে-বলে-কৌশলে। সহজ কাজ ছিল না। পৌঁছে যেতে পেরেছি পুরুষ। যৌনকর্মীদের কাছেও। সর্বোপরি এটা বলে রাখা প্রয়োজন, এই গ্রন্থটি শুধুমাত্র প্রাপ্তমনস্কদের জন্য পাঠযোগ্য বলেছি। তার কারণ এই গ্রন্থে এমন অনেক বর্ণনা আছে এমন অনেক বিষয় আলোচিত হয়েছে, যা কখনোই অপ্রাপ্তমনস্কদের পাঠ্য নয়।
গণিকা বা পতিতা বা বেশ্যা অথবা যৌনকর্মী যাই-ই বলি না-কেন–সম্মান বা মর্যাদায় কোনো আকাশপাতাল প্রভেদ দেখি না। যৌনকর্মী’ বলার মধ্যে একটা ‘কর্মী’ স্বীকৃতি পায় বটে, আসলে পেশার পরিচয়ে সব শব্দই সমান। তবে আমি ‘গণিকাপরিচয় দিয়েই লেখা এগিয়ে নিয়ে গেছি। তবে কোথাও কোথাও অবশ্য ‘যৌনকর্মী’ সম্বোধনও করেছি প্রয়োজনে।
যৌনকর্মী বা গণিকাদের বিষয় করে ইংরেজি ভাষায় প্রচুর বইপত্র বাজারে আছে। কিন্তু গণিকাদের নিয়ে বাংলা ভাষায় লেখা বইপত্র অতি বিরল। থাকলেও তা পূর্ণাঙ্গ নয়। সেই তাগিদ থেকেই ‘গণিকা-দর্শন’ বাংলা ভাষায় লেখা এমনই একটি বই। পাঠকের প্রাপ্তিও অনেক বেশি হবে। এটা পাঠকরা এই আশা করতেই পারেন। সেই আশা পূরণের চেষ্টা করেছি, যতটা সম্ভব। জ্ঞানপিপাসু এবং কৌতূহলী পাঠকদের কথা মাথায় রেখে প্রচুর তথ্য সংযোজন করা হয়েছে। বিভিন্ন সংযোজনের মাধ্যমে গ্রন্থের বিষয়কে আপ টু ডেট করা হয়েছে। আশা করি এ গ্রন্থটি সর্বস্তরে আগ্রহ ও গুরুত্ব সহকারে পঠিত হবে।
পরিশেষে বলি, দীর্ঘ ১৪ বছরের গবেষণার ফল এই গ্রন্থটি। গ্রন্থ হয়ে ওঠার পিছনে যে অসংখ্য মানুষের সাহায্যের হাত আমার হাত ছুঁয়েছে, যাঁরা আমার সুপ্ত স্বপ্নকে সাকার করেছে নানাভাবে তাঁদের ঋণ কখনোই শোধ যাবে না। কৃতজ্ঞতা রইল অফুরাণ। বিভিন্ন স্তরের সেইসব যৌনকর্মীদের কাছেও আমি ঋণী, যাঁরা তাঁদের মূল্যবান সময় থেকে আমাকে সময় দিয়েছেন। তাঁদের জন্য কৃতজ্ঞতা অফুরাণ। শেষ পর্যন্ত পাঠক পরিতৃপ্ত ও সমৃদ্ধ হলে আমার পরিশ্রম সার্থক হবে। আমার এ লেখা পাঠকের চিন্তনে সামান্য আঁচড়ও যদি কাটতে পারে, তবেই আমি নিজেকে সার্থক বলে মনে করব।
০১. বেশ্যানাং পুরুষাধিগমে রতির্বৃত্তিশ্চ সৰ্গাৎ
‘পবিত্র’ গণিকাবৃত্তি প্রাচীন প্রাচ্য দেশে বেশি মাত্রায় হত। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ানরা ধর্মীয় যৌনতার প্রতিটি সুযোগই কাজে লাগাত। গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডটাস বলেন—ব্যাবলীয়ানদের সবচেয়ে খারাপ রীতি ছিল জীবনে একবার হলেও প্রত্যেক মহিলাকে বাধ্য করা হত আফ্রিদিতি মন্দিরে যেতে, যেখানে তাঁকে একজন অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে যৌনকর্মে লিপ্ত হতে হত। যেসব মহিলারা ধনী ও বংশমর্যাদায় গর্বিত ছিলেন, তাঁরা মিলিত হতে চাইতেন না। তাঁদের তখন দড়ি দিয়ে বেঁধে আনা হত মন্দিরে। প্রচুর অনুগামী লোক ভিড় করত তখন। এভাবে বিপুল সংখ্যক মহিলাদের আনা হত। যৌনকর্মে লিপ্ত হওয়ার আগে মহিলারা কখনোই বাড়িতে ফিরে যেতে পারতেন না। অপরিচিত কোনো লোককে অবশ্যই টাকা দিতে হত বন্দিনী মহিলার আঁচলে এবং তাঁকে আহবান করতে হত মাইলিত্তা দেবীর নামে। তাঁদের মন্দিরের বাইরে মিলিত হতে হত। টাকার পরিমাণ যাই হোক না-কেন, তা নিতে অস্বীকার করা পাপ মনে করা হত। এইভাবে সুন্দরী মহিলারা মর্যাদা খুঁইয়ে মুক্তি পেত অল্প দিনে। অসুন্দরীদের থাকতে হত দুই থেকে তিন বছর পর্যন্ত কোনো লোকের সঙ্গে যৌনমিলন হওয়া পর্যন্ত। খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৪ বছর আগে গ্রিসে জেনোফন নামের একজন অলিম্পিক বিজয়ী দেবীর মন্দিরে ১০০ জনের মতো তরুণীকে উপহার হিসেবে দান করে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ। করিন্থ নামক ওই শহরে দেবী আফ্রিদিতির মন্দির ছিল। রোমান যুগে ওই মন্দিরে প্রায় হাজারের উপর দেবদাসী ছিল।
“বেশ্যানাং পুরুষাধিগমে রতির্বৃত্তিশ্চ সৰ্গাৎ”–বেশ্যাগণের পুরুষগ্রহণ প্রবৃত্তি বা পুরুষকে প্রলুব্ধ করা এবং অর্থাৰ্জন সেই সৃষ্টিকাল থেকে চলে আসছে। এহেন ব্যাখ্যাই বাৎস্যায়ন তাঁর ‘কামসূত্র’ গ্রন্থের চতুর্থ অধিকরণে অবহিত করেছেন। বাৎস্যায়ন তাঁর গ্রন্থের চতুর্থ অধিকরণটি বৈশিক বা বেশ্যাদের জন্যই বেশ গুরুত্ব সহকারে বরাদ্দ রেখেছেন। প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে ‘বেশ্যা’ বিশেষণের বেশ কিছু সমতুল প্রতিশব্দ পাওয়া যায় পেশার ধরন হিসাবে। যেমন–পতিতা, বারাঙ্গনা, দেহপসারিণী, দেহপোজীবিনী, রূপোপজীবিনী, রক্ষিতা, খানকি, ছিনাল, বারবনিতা, উপপত্নী, জারিণী, সাধারণী, মহানগ্নী, পুংলী, পুংশ্চল, অতীত্বরী, বিজর্জরা, অসোঙ, অতিষ্কদ্বয়ী, গণিকা, গণেরুকা, নটী, হট্টবিলাসিনী এবং হাল আমলের ‘যৌনকর্মী। আমি যেহেতু আমার গ্রন্থের নাম ‘গণিকা দর্শন’ রেখেছি, তাই গোটা গ্রন্থে যথাসম্ভব ‘গণিকা’ প্রতিশব্দটিই ব্যবহার করব। তবে ইংরেজিতে যেমন Domimonde, Public Women, Hatairai, Aspasia, Phrynes ইত্যাদি শব্দের মতো আদিম ও প্রাগৈতিহাসিক বিশেষণ আছে, ঠিক তেমনি আধুনিক বিশেষণগুলি হল–Prostitute, Call Girl, Escort Girl, Pornstar ইত্যাদি।
মোদ্দা কথা, অর্থ বা পার্থিব সম্পদের বিনিময়ে যে নারীরা একাধিক পুরুষের সঙ্গে যৌনমিলন বা যৌনসুখ শরীর উলঙ্গ করে প্রদর্শনকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করেছে, তাঁকেই গণিকা (Prostitute) বলে। বলা হয়, এটি পৃথিবীর আদিম পেশা। বিশেষ এই পেশা মেয়েদের যে বিশেষণে বিশেষিত করা হয়েছে, সেগুলির সবই পেশার রকমফেরের উপর ভিত্তি করে। সবকটি বিশেষণের ব্যাখ্যা দিয়ে কলেবর বৃদ্ধি করব না। তবে আমাদের কাছে ‘বেশ্যা’ বিশেষণ বা পরিচয়টি বেশি পরিচিত। ভিন্টারনিৎসের মতে, ঋগবেদের প্রথম মণ্ডলের ১২৬ তম সূক্তের অন্তর্গত পঞ্চম ঋকে যে ‘বিশ্যা’ শব্দটি আছে, তা থেকেই ‘বেশ্যা’ শব্দটির উৎপত্তি। ঋকটি এরকম–“সুবন্ধবো যে বিশ্যা ইব ব্রা অনস্বন্তঃ শ্রব ঐযন্ত পূজা”। ভিন্টারনিৎস ঠিক না বেঠিক, সে ব্যাপারে এই ভারতের কোনো বেদবেত্তা আপত্তি করেছেন বলে শুনিনি।
‘বেশ্যা’ বা ‘গণিকা’ শব্দটির সঙ্গে ‘বৃত্তি’ শব্দটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এটাকে ব্যবসাও বলে, যেমন–দেহ-ব্যাবসা। যিনি অর্থ বা অন্য কোনো সম্পদের বিনিময়ে যৌনক্রিয়া করে, সে বিক্রেতা। আর সেই নারীর কাছে গিয়ে যৌনক্রিয়ার মাধ্যমে যৌনসুখ পেতে যে বা যাঁরা অর্থ বা সম্পদ প্রদান করে, সে ক্রেতা। যিনি অর্থ বা সম্পদের বিনিময়ে ক্রেতার সঙ্গে যৌনকর্মে লিপ্ত হন, সে যৌনসুখ পেল কি পেল না তাতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু যিনি অর্থ বা সম্পদ প্রদানের মাধ্যমে কোনো নারীর সঙ্গে যৌনক্রিয়া করতে আসেন, তাঁর যৌনসুখ অবশ্যই চাই। যৌনসুখ ছাড়া সে অর্থ প্রদান করবে না। ক্রেতাকে চরম যৌনসুখ দেওয়াটাই বিক্রেতার একমাত্র কর্তব্য। বিক্রেতারা চাইবে ক্রেতাদের নেশাগ্রস্ত কামগ্রস্ত করে তুলতে, যাতে ক্রেতারা বারবার বিক্রেতাদের কাছে আসে। কারণ শরীরই যে তাঁর পণ্য। ভালো মোড়কে সুস্বাদু করে পরিবেশন করতে হবে তাঁকে। শরীর বাজারে বিক্রেতার অধিকার অর্থ (Money), আর ক্রেতার অধিকার নারী-শরীর, যৌনসুখ।
গণিকাবৃত্তির শুরুটা ঠিক কবে থেকে? গণিকাবৃত্তির প্রসঙ্গ উঠলেই সবাই বলে ‘আদিম পেশা। “আদিম’ মানে কী? “আদিম জাতি’ বলতে আমরা সেই সময়ের মানুষের কথা বুঝি, যে সময় মানুষ পোশাকের ব্যবহার জানত না, উলঙ্গ থাকত। তাহলে গণিকাবৃত্তির শুরু কি সেইসময় থেকেই? গণিকাবৃত্তি ঠিক তখন থেকেই সৃষ্টি হয়েছে বলে আমি মনে করি না। সম্ভবত গণিকাবৃত্তি শুরু হয়েছে মানুষের পোশাকের ব্যাবহার শেখার অনেক পরে। নাগরিক সভ্যতায় বিনিময় প্রথার প্রচলন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শরীর বিক্রির প্রথা চালু হতে পারে। ক্রয়-বিক্রয় ব্যবস্থা চালু হলে শরীর বিক্রিও চালু হয়। নাগরিক জীবন শুরু হল বহির্দেশীয় মানুষদের আগমনের মধ্য দিয়ে। এই বহির্দেশীয়রাই ভূমিকন্যাদের যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করত। ক্রীতদাসী হিসাবে কিনে নিত বা দখল করত এবং যথেষ্ট ভোগ করত। সমাজের ধনশালী, বলশালী এবং তথাকথিত উচ্চস্তরের মানুষগুলো ভূমিকন্যা বা অনার্যদের সঙ্গে শারীরিকভাবে লিপ্ত হলেও স্বীকৃতি দেয়নি। অনার্য-কন্যাদের শারীরিকভাবে ভোগ করা যায়, কিন্তু গ্রহণ করা যায় না। প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে আমরা আর্য-অনার্যদের সংঘর্ষের কাহিনি পাই। মনুসংহিতায় এইভাবেই পেয়ে যাই হাজারো জারজ সন্তানের সংবাদ। ধর্ষণ করলে অনার্যদের শাস্তির বিধান ছিল, কিন্তু আর্যদের নয়। আর্যদের তুলনায় অনার্যরা সমরাস্ত্রের দিক দিয়ে দুর্বল ছিল। তাঁরা আর্যদের মতো তির-ধনুক, বর্শা, ছোঁড়া, কুঠার ব্যবহার করলেও শিরস্ত্রাণের ব্যবহার জানত না। তাই অনার্যদের বারবার পরাজয় ঘটত। সেই পরাজয়ের ফলে পুরুষ অনার্যদের হয় মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে, নচেৎ দাসত্ব বা বশ্যতা মেনে নিতে হয়েছে। আর অনার্য নারীরা দখলীকৃত ভোগের বস্তুতে পরিণত হয়েছে। প্রাচীন ও মধ্যযুগ জুড়ে অঞ্চলে অঞ্চলে যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই থাকত ভূমিদখলের জন্য। যুদ্ধে যুদ্ধে বিধ্বস্ত পুরুষরা ক্রীতদাসে পরিণত হত, আর নারীরা যৌনদাসীতে পরিণত হত। এঁদেরই একটা বড়ো অংশ যৌনজীবিকার পথ বেছে নিয়েছিল। সেইসব নারীরা বুঝে নিয়েছিল, নারী-শরীরের প্রতি পুরুষদের তীব্র লালসা। তাঁদের এই লালসা মোচন কেন মাগনায় হবে? সমাজেরই ধণিক শ্রেণি সেইসব নারীদের মূল্য নির্ধারণ করে দিল। তৈরি করা হল সেইসব নারীদের নির্দিষ্ট আস্তানা। সেই সময় গণিকাগমনের অধিকার ছিল শুধুমাত্র ধনীদেরই। সমাজে যখন রাজতান্ত্রিকতার উন্মেষ ঘটেছিল, তখন এইসব নারীদের শরীরী-ছলনায় শত্রু নিধন এবং গুপ্তচর বৃত্তির কাজে লাগানো হত। আজও এই ব্যবস্থা চালু আছে। স্বার্থসিদ্ধির জন্য নারীকে ‘ভেট’ দেওয়ার রীতি প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। আজকাল তো শুনছি নির্বাচনে প্রার্থী হিসাবে টিকিট পেতেও ‘মেয়েমানুষ’ ভেট দিতে হয়! একথা অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই বিশিষ্ট অতিথি, অমাত্য এবং অপরাপর উচ্চধনীবর্গদের আবদার মেটাতে নারী-শরীর উপঢৌকন দেওয়ার রীতি আজও অব্যাহত আছে। ব্রিটিশ যুগেও এই বৃত্তি রাষ্ট্রের আনুকূল্যে ও পৃষ্ঠপোষকতায় পুষ্ট হত। কলামিস্ট তসলিমা নাসরিন এই পেশা সম্বন্ধে এক লেখায় বলেছেন–“এটাকে পৃথিবীর প্রাচীনতম পেশা বলে লোককে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা হয় বটে, আসলে কিন্তু প্রাচীনতম পেশা নয়, এটা বরং মেয়েদের বিরুদ্ধে পৃথিবীর প্রাচীনতম নির্যাতন।”
প্রচলিত অর্থে বেশ্যা বা পতিতা বা গণিকা বলতে আমরা যেমনটাই বুঝি না-কেন, প্রাচীন ভারতে এইসব রমণীরা কিন্তু তেমনটা ছিলেন না। দেশের (দেশ বলতে সমগ্র ভারত বুঝবেন না। সে সময় দেশ বলতে সংশ্লিষ্ট রাজার শাসিত এক টুকরো ভূখণ্ড বা অঞ্চলকে বোঝাত।) রাজা স্বয়ং গণিকাদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বার্ষিক ১০০০ পণ বেতন দিয়ে রাজা তাঁর প্রাসাদে গণিকাদের নিয়োগ করতেন। গণিকাদের আয়ের একটা অংশ কর হিসাবে রাজাদের কোষাগারে সংগৃহীত হত। প্রাচীন ভারতে গণিকারা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হিসাবে গণ্য হত। তদুপরি গণিকাদের ঘরে যেমন জ্ঞানী-গুণীদের আলোচনা সভা বসত, আবার এমন জ্ঞানী-গুণীদের এবং শিক্ষাব্রতীদের গণিকালয় ছিল প্রধান আখড়া। প্রাচীনকালে গণিকালয়ে যাতায়াত খুব একটা গোপনীয় বা লজ্জাকর বিষয় ছিল না। সে যুগের নাগরিকরা বসন-ভূষণে সজ্জিত হয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে দিনে-দুপুরেই গণিকালয়ে যাতায়াত করতে পারতেন।
আগেই বলেছি, প্রাচীনকালে বহুভোগ্যা নারীদের নানাবিধ নামে উল্লেখ করা হত গণিকাবৃত্তির চরিত্রানুসারে। কেন সেটা কিছুটা আন্দাজ করা যেতেই পারে। যদিও মোটিভেশন একই, সকলেরই পেশা শরীর বিক্রি করা। এখনকার মত প্রাচীনকালেও গণিকা বলতে বোঝাত বহুভোগ্যা নারীকেই।গণ বা দলবদ্ধ হয়ে যে নারী যাপন করে, তিনিই গণিকা। অনুরূপ বেশ্যা বলতে বোঝায় যে নারী বেশ বা সাজসজ্জা দ্বারা পুরুষদের প্রলুব্ধ করে, তিনিই বেশ্যা। যে নারীদের পণের বাজি রেখে সম্ভোগ করা হত, সেই নারীরা পণ্যাঙ্গনা। যে নারীরা যুগপৎ মন্দিরের সেবাদাসী বা রাজা বা অমাত্য মর্যাদার রাজকর্মচারীদের ভোগ্যা হতেন, সেসব নারী বারস্ত্রী। পরিচারিকা বা ক্রীতদাসী বা রক্ষিতারা ভূজিয়া বলে পরিচিত। যে নারীর চরিত্রের পতন হয়েছে, তিনি পতিতা। অনুমান করা হয়, প্রধানত ব্রাহ্মসমাজের প্রচারের দৌলতেই ‘পতিতা’ শব্দটি বেশ্যার সুভাষণরূপে গ্রহণীয় হয়ে ওঠে। ১৮৯৪ সালে লেখা ‘বিচারক’ গল্পে রবীন্দ্রনাথও দেখছি ‘পতিতা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। সাহিত্যিক সমর সেন অবশ্য গণিকা শব্দটিই ব্যবহার করতেন। প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় তাঁর পত্রিকায় বারবার ‘বেশ্যা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। সাম্প্রতিককালে গণিকা বা বেশ্যা শব্দের বিকল্পে ‘যৌনকর্মী শব্দটিও শোনা যাচ্ছে। যৌনকর্মী শব্দটি যেন একটু বেশি নগ্ন হয়ে ধরা পড়েছে। যৌনকর্মী শব্দটি যেন তাঁদের জীবিকার ধরনকে আরও প্রকট করে তুলেছে। যোনিক্ষেত্রকেই প্রকট করে এই ‘যৌনকর্মী’ সম্ভাষণ। এই সম্ভাষণ তাঁরা স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছেন। কারণ তাঁদের শ্লোগান–“গতর খাঁটিয়ে খাই, শ্রমিকের অধিকার চাই”, “যৌনকর্মীর অধিকার, নারী-আন্দোলনের হাতিয়ার”, “মে দিবসের অঙ্গিকার, যৌনপেশার পূর্ণ অধিকার”।
০২. গণিকা এবং চৌষট্টি কলার সমন্বয়
বর্তমানে ধাত্রীবিদ্যা, উদ্যানবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা ইত্যাদি যেমন নানাপ্রকারের বিশেষ শিক্ষা আছে, ঠিক তেমনই সেকালে গণিকাবিদ্যাও ছিল এমনই এক শিক্ষণীয় বিষয় এবং সেই শিক্ষা এক্কেবারেই নিন্দনীয় ছিল না। এই বিষয়ে পৃথক বিদ্যালয়ও ছিল। রীতিমতো পরিচর্যা, প্রশিক্ষণ এবং অনুশীলন দ্বারা আগামীদিনের হবু গণিকাদের এইসব বিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ হতে হত। নৃত্য-গীত-বাদ্য ছাড়াও চিত্রকলা, জ্যোতিষশাস্ত্র, অভিনয়, রন্ধনবিদ্যা, ভাষাশিক্ষা, লিখন, মার্জিত ভাষায় কথা বলা, মালা গাঁথা ইত্যাদি এরকম ৬৪ কলায় পারদর্শী করে তোলা হত। ৬৪ কলায় সুশিক্ষিতা, রূপবতী গণিকারাই জনসমাজে বা রাজদরবারে বিশেষ মর্যাদাপ্রাপ্ত হতেন, সমাদর পেতেন।
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার সংজ্ঞা বলছে–গণিকাবৃত্তি হল স্বামী বা বন্ধুকে ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে নগদ অর্থ বা অন্য কিছুর বিনিময়ে বাছবিচারহীন ভাবে যৌনকর্মে লিপ্ত হওয়া। এই পণ্য-দুনিয়ায় নারী-মানুষকে পণ্য করার বা পণ্য হওয়ার নেটওয়ার্কগুলির জোয়ার ক্রমবর্ধমান। আজকাল প্রকাশ্যে বিজ্ঞাপন দিয়েই যৌনকর্মী নিয়োগ ও কাস্টমারদের আহ্বান করা হচ্ছে। জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে নিরাপত্তা সহ অন্যান্য সুবিধাগুলি। যৌন বাণিজ্যে এখন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের মুনাফা।
বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্রম’ গ্রন্থের ‘বৈশিকাখ্যং’ অধ্যায়ে বলা হয়েছে–“রুচি হইতে যে পুরুষগ্রহণপ্রবৃত্তি, তা স্বাভাবিক আর ‘অর্থাৰ্জনার্থ’ যে প্রবৃত্তি তা কৃত্রিম।” বাৎস্যায়ন উল্লিখিত ‘অর্থাৰ্জনার্থ’ এই কৃত্রিম প্রবৃত্তিই নিন্দাহ। এই গণিকাবৃত্তিই বর্তমান বিশ্বে পয়লা নম্বরের বাণিজ্য-উপজীব্য। এই পেশার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নেতা, মন্ত্রী, পুঁজিপতি, সমাজের বিভিন্ন স্তরের নারী ও পুরুষ। অনেক দেশের রাজকোশ উপচে পড়ে গণিকাবৃত্তির রাজস্বতে। কৌটিল্য বিভিন্ন কারণে যৌন-ব্যাবসাকে স্বাভাবিক বলেই ধরে নিয়েছিলেন। অবৈধ নারীসংসর্গ বোঝাতে তিনি ‘বাহবিহার’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু এই ‘বাহবিহার’-এর পক্ষে বা বিপক্ষে স্পষ্ট করে কিছুই তিনি বলেননি। বাৎস্যায়ন বলেছেন–গণিকা অথবা বিধবাদের সঙ্গে দেহসম্ভোগ সমর্থন করা হয় না, আবার নিষিদ্ধও নয়।
সমাজবিদ লেকির মতে, গণিকাবৃত্তি হল সমাজের মাত্রাতিরিক্ত যৌনকামনা বেরিয়ে যাওয়ার একটি সেফটি ভালভ। লেকি মনে করেন, নিজে মূর্তিমতী পাপীষ্ঠা হলেও পরিণামে পুণ্যের অধিকারিণী এই মেয়েরা। এরা না থাকলে সংখ্যাহীন সুখী পরিবারের প্রশ্নাতীত পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যেত।” তাহলে কি গণিকারা যুগের পর যুগ সমাজের বিষ-ক্লেদ কণ্ঠে ধারণ করে নীলকণ্ঠী হয়ে থেকে যাবে? উঁহু, গণিকারা লেকির সঙ্গে একমত নয়। গণিকারা মনে করে না, তাঁরা সমাজের সেফটি-ভালভ। তাঁরা মনে করেন গণিকা ছাড়াও এই সমাজে প্রচুর নারী-পুরুষ আছেন, যাঁরা গোপনে যৌন-বিনোদন দিয়ে থাকেন। গণিকারা মনে করে না, সেই কারণে তাঁরা পুণ্যের অধিকারিণী। গণিকারা মনে করে না, তাঁরা না-থাকলে সংখ্যাহীন সুখী পরিবারের প্রশ্নাতীত পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যেত। গণিকালয়ে গিয়ে প্রচুর গণিকাদের সঙ্গে কথা বলে আমার অন্তত সেটাই মনে হয়েছে।
নারীবাদী কলামিস্ট তসলিমা নাসরিন একটি ব্লগে লিখেছেন–ক্রীতদাস প্রথার সঙ্গে পতিতাপ্রথার মূলত কোনো পার্থক্য নেই। ক্রীতদাসরা যখন তুলো ক্ষেতে চাষের কাজ করত, দাসমালিকরা প্রায়ই সশরীরে উপস্থিত হয়ে কিছু ক্রীতদাসীকে যৌনকর্মের জন্য তুলে নিয়ে যেত। ত্বক যাঁদের একটু কম কালো, সাধারণত তাঁদেরকেই পছন্দ করত। বাজারে নিয়ে যৌন-ব্যাবসার জন্য ভাড়া খাটাত, নয়তো সরাসরি পতিতালয়েই নগদ টাকায় ক্রীতদাসীদের বিক্রি করে দিত। আঠারো-উনিশ শতকে যে প্রথাটিকে বলা হত ক্রীতদাস প্রথা, বিংশ একবিংশ শতকে সেই প্রথাকে বলা হচ্ছে পতিতাপ্রথা।” লেখিকা অনেক পুরোনো ধারণা নিয়ে লিখেছেন বোঝাই যাচ্ছে তাঁর বক্তব্য পড়ে। সময় বদলে গেছে অনেক। সব গণিকাই ক্রীতদাস নয়। এখন বহু সাধারণ মহিলারা স্বেচ্ছায় এই গণিকাবৃত্তিকে জীবিকা হিসাবে বেছে নিচ্ছেন আর পাঁচটা জীবিকার মতোই এবং স্বাধীনভাবেই জীবিকা করেন। বর্তমানে কোনো মেয়ে বা মহিলাকে জোর করে কোনো গণিকালয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া এত কাজ নয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব পরবর্তী কোনো অধ্যায়ে।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে গণিকা ও গণিকাবৃত্তি সংক্রান্ত ভারতবর্ষীয় এক চিত্র পাওয়া যায়। কী বলছে অর্থশাস্ত্র? অর্থশাস্ত্র বলছে দেহ-ব্যাবসা একটি প্রতিষ্ঠিত ব্যাবসা। পুরোপুরি ঘৃণিত বা গোপনীয় নয়। কৌটিল্যের সময় দেহ-ব্যাবসা শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত হয় বলে জানা যায়, যে শিল্পের নাম ছিল বৈশিক কলা। বিশেষজ্ঞরা এই শিল্পের চর্চা করতেন এবং শিক্ষা দিতেন। অর্থশাস্ত্রের ২৭ অধ্যায়ে গণিকাধ্যক্ষেরও উল্লেখ আছে।এখানে মৌর্য সাম্রাজ্যের সময়কার বহু পুরুষগামী বারাঙ্গনা নারীদের হাল-হকিকৎ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছে। বলা হয়েছে, গণিকাধ্যক্ষের কাজ ছিল রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে গণিকাদের সংগঠিত করা ও দেখভাল করা। গণিকাধ্যক্ষদের নিযুক্ত করতেন দেশের রাজা। গণিকাধ্যক্ষের আর-একটা প্রধান কাজ ছিল গণিকাদের আয় ও ব্যয়ের হিসাবপত্র রাখা। কোন্ গণিকার দিনে কত খরিদ্দার আসছে, খরিদ্দার-পিছু পারিশ্রমিক কত, উপরি পাওনা বা বকসিস কী ও কত, তার ব্যয়ই-বা কত ইত্যাদি সবকিছুই সে জাবেদা খাতায় নথিভুক্ত করত। অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে, কোনো গণিকা যদি তাঁর বৃত্তি ছেড়ে চলে যায়, অথবা কোনো কারণে মারা যায়, তাহলে তাঁর মেয়ে বা বোন তাঁর বৃত্তি গ্রহণ করবে। এই কারণেই তাঁর ত্যাজ্য সম্পত্তিরও সে মালিক হবে। অথবা সেই মৃতা কিংবা বৃত্তিত্যাজ্যা গণিকার মা তাঁর শূন্যস্থানে অন্য কোনো যোগ্য মেয়ে দ্বারা পূরণ করতে পারবে। যদি সেই মৃতা কিংবা বৃত্তিত্যাজ্যা গণিকার মেয়ে বা বোন বা মাতৃনিযুক্ত প্রতিগণিকা না-থাকে সেক্ষেত্রে তাঁর ত্যাজ্য ধন রাজকোশে জমা পড়বে।
কৌটিল্যের সময় গণিকাদের তিনভাগে ভাগ করা হত। যেমন–কনিষ্ঠ, মধ্যম ও উত্তম। কোন গুণাবলি বিবেচনা করে এই বিভাজন? বিভাজন হত কোন্ গণিকার কীরকম রূপ, কীরকম শারীরিক গঠন, কীরকম বয়স–সব মিলিয়ে তাঁর পুরুষকে আকর্ষণ ও মনোরঞ্জনের ক্ষমতা কতখানি, এসব দেখে তাঁকে উত্তম বা মধ্যম বা কনিষ্ঠ শ্রেণির গণিকার স্বীকৃতি দেওয়া হত। এই স্বীকৃতি বা সার্টিফিকেট দেওয়ার ক্ষমতা ছিল একমাত্র গণিকাধ্যক্ষের। গণিকার শ্রেণিভেদে বেতন তথা পারিশ্রমিকও ছিল ভিন্ন। যেমন–কনিষ্ঠ শ্রেণির গণিকার বেতন ছিল ১০০০ পণ, মধ্যম শ্রেণির গণিকার ২০০০ পণ এবং উত্তম শ্রেণির গণিকার বেতন ছিল। ৩০০০ পণ। সেসময় কোনো রাজকুলে নিযুক্ত গণিকারা যদি রাজসেবা থেকে কোনো কারণে মুক্তি চাইত, তাহলে সেই গণিকাদের রাজার কোষাগারে ২৪,০০০ পণ মুক্তিমূল্য দিতে হত। এমনকি গণিকাদের সন্তানদের দাসত্ব (গণিকার সন্তানদের ‘দাস’ হিসাবে গণ্য করা হত) থেকে মুক্তি পেতে ১২,০০০ পণ নিষ্ক্রয় দিতে হত। গণিকাদের কাছ থেকে শুধুই নিঙড়ে নিত যাঁরা ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন, তাঁদের বলি–নিঙড়ে যেমন নিত, তেমনি নিরাপত্তার দিকটিও কঠোরভাবে দেখা হত। যেমন–কোনো কামনারহিত গণিকাকে কোনো পুরুষ (খরিদ্দার) তাঁর ঘরে আবদ্ধ করে রাখে, অথবা কোনো গোপন স্থানে লুকিয়ে রাখে এবং তাঁর শরীরে ক্ষতের সৃষ্টি করে, দাঁত দিয়ে তাঁর বিশেষ বিশেষ স্থানে আঘাত করে তাঁর রূপ নষ্ট করে–তাহলে সেই পুরুষপুঙ্গবটিকে ২৪,০০০ পণ এবং প্রয়োজনে ৪৮,০০০ পণ পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। এখানেই শেষ নয়, যে গণিকা রাজার ছত্র, ভৃঙ্গার (জল ছিটানোর ছিদ্রযুক্ত পাত্রবিশেষ) বহনের কাজে নিযুক্ত হয়েছে, তাঁকে কোনোরকম মারধর করলে সংশ্লিষ্ট অভিযুক্ত পুরুষটিকে ৭২,০০০ পণ অর্থদণ্ড করা হত।
শুধু খরিদ্দার-পুরুষদের জন্যেই শাস্তি বা অর্থদণ্ডের ব্যবস্থা ছিল, তা কিন্তু নয়। শাস্তি বা অর্থদণ্ডের ব্যবস্থা ছিল গণিকাদেরও। যেমন–(১) রাজার আজ্ঞা বা আদেশ সত্ত্বেও যদি কোনো গণিকা কোনো বিশেষ পুরুষের সঙ্গে যৌনক্রিয়ায় আপত্তি জানায়, তাহলে সেই সংশ্লিষ্ট গণিকাকে ১০০০ বার চাবুক মারা হবে। কখনো-কখনো ৫০০০ পণ পর্যন্ত গুণগারি দেওয়ার রীতি ছিল। (২) যদি কোনো গণিকা কোনো পুরুষের কাছ থেকে যৌনক্রিয়া করার শর্তে অগ্রিম অর্থ নিয়ে দুর্ব্যবহার করে, তাহলে সংশ্লিষ্ট গণিকা অগ্রিম অর্থের দ্বিগুণ পুরুষটিকে ফেরত দিতে হত। (৩) যদি কোনো গণিকা কোনো পুরুষের কাছ থেকে যৌনক্রিয়া করবে এই শর্তে রাত্রিযাপনের কোনোরূপ আগাম অর্থ নিয়েও যৌনমিলন না করে, তাহলে উক্ত পুরুষ গণিকাটিকে যে পরিমাণ অর্থ প্রদান করেছিল তার আট গুণ অর্থ ফেরত দিতে হত। (৪) কোনো গণিকা যদি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে কোনো পুরুষকে হত্যা করে, তাহলে সেই মৃত পুরুষের জ্বলন্ত চিতায় খুনী গণিকাকেও পুড়িয়ে মারার বিধান ছিল।
০৩. স্বর্গের বেশ্যা যাঁহারা = স্বৰ্গবেশ্যা
ভারতের প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে–বিশেষ করে পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতে প্রচুর গণিকার উল্লেখ আছে। এইসব গণিকাদের মধ্যে বেশ কিছু গণিকা ‘স্বৰ্গবেশ্যা’ হিসাবেই পরিচিতা। সংস্কৃত শব্দ অপ্ (বাংলা অর্থ জল) থেকে এঁদের উৎপত্তি, তাই ‘অপ্সরা’ বলা হয়। ঋগবেদে অপ্সরা হলেন গন্ধর্বের স্ত্রী। অপ্সরা আবার দুই ধরনের–লৌকিক ও বৈদিক। অপ্সরাদের সৌন্দর্য ও যৌন আবেদনের কথা সবসময়ে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, অপ্সরারা মায়ারূপিনী, তাঁরা শরীর বা দেহ পরিবর্তন করতে পারত, অর্থাৎ চূড়ান্ত ছলনাময়ী ছিলেন। অথর্ব বেদে উল্লেখ আছে, এঁরা পাশা খেলতে খুব ভালোবাসত। পারদর্শিতার সঙ্গে খেলত। দেবাসুরের সমুদ্রমন্থনকালে এঁরা সমুদ্র থেকে উত্থিত হয়েছিলেন। কথিত আছে, দেবতা ও অসুরের সমুদ্রস্নানের সময় গণিকারা সমুদ্রের ভিতর থেকে অসংখ্য নারীর সঙ্গে উঠে আসেন। কিন্তু এইসব গণিকাদের কী দেবকুল কী অসুরকুল, কেউই গ্রহণ করতে রাজি হলেন না। তাহলে সমুদ্র থেকে উত্থিত এই নারীদের ভবিষ্যৎ কী? অতএব গ্রহণ করা না-গেলেও পণ্য করে নিতে কোনো বাধা নেই। প্রভাবশালী মানুষদের যৌন-বিনোদনের জন্য বিতরণ করা যেতেই পারে। একই সঙ্গে শরীরী ফাঁদ পেতে ধনী ও প্রভাবশালী পুরুষদের বিভ্রান্ত করাই হবে এঁদের কাজ।
অধিকাংশ স্বৰ্গবেশ্যার স্বামী ছিলেন গন্ধর্বরা। তবে অপ বা জল থেকে উৎপন্ন হননি, এমন কিছু অতুলনীয় নারীকেও স্বৰ্গবেশ্যা হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এঁদের মধ্যে স্বর্গের কিছু স্বাধীনা স্বৰ্গবেশ্যাও আছেন। এঁদেরকে সপ্তম মনু সৃষ্টি করেছিলেন বলে জানা যায়। এদের সংখ্যা প্রায় ৬০,০০০। এই ৬০,০০০ স্বৰ্গবেশ্যাদের অধিপতি ছিলেন কামদেবতা। এঁরা নৃত্যকলায় পারদর্শী ছিলেন। অধিকাংশ সময় গন্ধর্বদের সঙ্গে এঁরা ইন্দ্রের সভায় নর্তকী হিসাবে নৃত্য প্রদর্শন করতেন।
ভরত মুনির নাট্যশাস্ত্রের প্রথম অধ্যায় ৪৫-৫০ শ্লোকে পাওয়া যায়, ব্রহ্মা ভরতকে কৌশিকীনৃত্তির জন্য শিবের নৃত্য থেকে শৃঙ্গাররসের উপযোগী কোমল অঙ্গহার, আত্মা রস, ভাব ও ক্রিয়া নামক উপাদান দেন। এ সকল উপাদান নারী ছাড়া পুরুষ এককভাবে প্রয়োগ করতে পারে না। তাই ব্রহ্মা কিছু নিপুণ অপ্সরা তৈরি করলেন। এই অপ্সরা ছিলেন মঞ্জুকেশী, সুকেশী, মিশ্রকেশী, সুলোচনা, সৌদামিনী, দেবদত্তা, দেবসেনা, মনোরমা, সুদতী, সুন্দরী, বিদগ্ধা, সুমালা, সন্ততি, সুনন্দা, সুমুখী, মাগধী, অর্জুনী, সরলা, কেরলা, ধৃতি, নন্দা, সুপুষ্কলা ও কলভা। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনিগুলোতে যে সমস্ত স্বৰ্গবেশ্যা বা অপ্সরার নাম পাওয়া যায়, তাঁরা হলেন—অদ্রিকা, অরুণা, অর্জুনী, অলম্বুষা, অসিতা, উর্বশী, কলভা কেরলা, ঘৃতাচী, জানপদী, তিলোতমা, দেবদত্তা, দেবসেনা, ধৃতি, নন্দা, নাগদত্তা, পুঞ্জিকাস্থলা, বিদগ্ধা, বিদ্যুৎপর্ণা, বিশ্বাচী, পঞ্চচূড়া, পূর্বচিত্তি, মঞ্জুকেশী, মনোরমা, মাগধী, মিশ্রকেশী, মেনকা, রম্ভা, রুচিরা, সরলা, সুকেশী, সুদতী, সুনন্দা, সন্ততি, সুন্দরী, সুপুষ্কলা, সুবাহু, সুমধ্যা, সুমালা, সুমুখী, সুলোচনা, সোমা, সৌদামিনী, হেমা প্রমুখ। এঁদের মধ্যে মেনকা, উর্বশী, রম্ভা ও তিলোত্তমা হলেন অন্যতম। পুরাণে নানা রকম নারী আছে। স্বৰ্গবেশ্যা নারী, সতী নারী, ছলনাময়ী নারী, রহস্যময়ী নারী। পুরাণ থেকে নারী সরিয়ে দিলেই তা আর পুরাণ থাকে না।
খুব সুন্দরী মেয়েদের ‘অপ্সরা সুন্দরী’ বলার সময় কি কাদের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে সুন্দরীদের ভাবা হয়? সে যাই হোক, এইসব অপ্সরারা যে অতীব সুন্দরী ছিলেন, এটা মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। তাঁরা শুধু অতীব সুন্দরী ছিলেন, তা নয়। তাঁরা নৃত্য ও সংগীতেও পারদর্শিনী ছিলেন। ইন্দ্রের সভায় এঁদের গায়িকা ও নর্তকী হিসাবে পাই। এঁদের উপস্থিতিতে ইন্দ্রের সভা সর্বদাই ঝলমলে থাকত। স্বর্গের গণিকাদের অধিপতি ছিলেন স্বয়ং কামদেব। তাই কামদেব এইসব গণিকাদের যৌনপ্রতিমা করে গড়ে তুলেছিলেন। মোদ্দা কথা, গণিকা মানেই সাক্ষাৎ যৌনপ্রতিমা। যৌনক্রিয়ায় ইচ্ছাপূরণ দেবী যেন। তথাকথিত দেবতারা আসন্ন বিপদের ঘ্রাণ পেলেই সেই বিপদ থেকে মুক্তি পেতে পরমা সুন্দরী গণিকাদের লেলিয়ে দিত। এই লেলিয়ে দেওয়ার কাজটি করতেন স্বয়ং ইন্দ্র। দেবরাজ ইন্দ্র প্রায়ই এঁদের পাঠিয়ে দিত মুনি-ঋষিদের প্ররোচিত ও প্রলোভিত করে ধ্যানভঙ্গ করার জন্য। কারণ তাঁদের ধ্যান সমাপ্ত হলে তাঁরা যদি প্রবল পরাক্রান্ত হয়ে ওঁর ইন্দ্ৰত্ব (ইন্দ্রত্ব’ বিষয়টি আর কিছু নয়। ইন্দ্রত্ব একটি পদমাত্র। ইন্দ্রের পদ এবং ঐশ্বর্য ) দাবি করে বসে! গণিকারা ছলা আর কলায় তাঁদের বিভোর করে কাজ হাসিল করে নিত। এইসব গণিকারা মুনি-ঋষিদের ধ্যান ভাঙাতেন। কেন ধ্যান ভাঙাতেন? উদ্দেশ্য কী? কারণ বৈদিক যুগে কঠোর তপস্যার বলে কখনো-কখনো দেবতাদের চেয়েও বেশি ক্ষমতাধর উঠতেন মুনি-ঋষিরা। যাতে তাঁরা দেবতাদের চেয়ে ক্ষমতাধর হয়ে না-পড়েন, সেই কারণেই গণিকাদের নিয়োগ করা হত। এমনকি অসুরদের কবজা করতেও এঁদের নিয়োগ করা হত।
পাঠকগণ, আলোচনায় দেবতা প্রসঙ্গে বিভ্রান্ত হবেন না। হিন্দুসমাজের দেবতা কোনো অশরীরী, অলৌকিক কোনো বিষয় নয়। কিছু নিছক কাল্পনিক হলেও বেশিরভাগই শরীরী, রক্তমাংসের অস্তিত্ব। দেবতাদের জন্ম আছে, পূর্বাপর-সম্বন্ধ আছে। এক দেবতা থেকে আর-এক দেবতার জন্ম আছে। প্রায় সব বিষয়েই মানুষের সঙ্গে দেবতাদের মিল দেখা যায়। তাই হিন্দুধর্মের দেবতাদের মধ্যে মানুষেরই প্রতিরূপ পাওয়া যায়। সেই কারণে পুরাণের বর্ণিত দেবতারা মানুষের মতো দোষেগুণে (ষড়রিপু = কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য) গড়ে উঠেছে। আবার অনেক দেবতা সাধারণ মানুষ থেকেও জন্মেছেন। তাই আহার-বিহার, যানবাহন, বসন-ভূষণ প্রভৃতি ব্যাপারে অনেক দেবতা মানুষের কাছাকাছি। ইতিহাস থেকে আমরা দুই ধরনের দেবতাদের পাই–(১) আর্য দেবতা এবং (২) অনার্য দেবতা। বস্তুত পুরাণ থেকে আমরা প্রচুর দেবতার কাহিনি পাই। বিভিন্ন অলৌকিক কাণ্ডকারখানার মধ্য দিয়ে এই দেবদেবীদের প্রকাশ। এত দেবদেবতার প্রাবল্য একমাত্র সনাতন ধর্মেই দেখা মেলে। তবে গ্রিস ও রোমেও দেবদেবতাদের আধিক্য দেখা যায় যাঁদের দেখতে অবিকল মানুষের মতোই। সনাতনী দেবতারাও মানুষের রূপধারী। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষই দেবতায় উন্নীত হয়েছে সনাতন ধর্মে। আজও মানুষ দেবতায় উন্নীত হয়–ভগবান রজনীশ, ভগবান চন্দ্রস্বামী, ভগবান সাঁইবাবা, ভগবান আশারাম, ভগবান সারথীবাবা ইত্যাদি!!! ভগবান মনু রাজাদেরও দেবতা বা দেবতারূপী বলেছেন। বস্তুত প্রাচীন যুগে রাজা বা শাসকরাই ছিলেন স্বঘোষিত ভগবান। এঁরা পুজো পান। ভক্তদের কাছে অমিতাভ বচ্চনও দেবতা। কলকাতাতেই অমিতাভ বচ্চনের মূর্তি গড়ে মন্দির বানিয়ে পুজো দেওয়া হয়। আবার গুজরাটে গান্ধি হত্যাকারী নাথুরাম গডসেকেও মূর্তি গড়ে মন্দির বানিয়ে পুজো দেওয়া হয়। আসুন, কতিপয় স্বৰ্গবেশ্যাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই।
মেনকা : মহাঋষি বিশ্বামিত্রের ধ্যান ভাঙার জন্য গণিকা মেনকাকে নিয়োগ করা হয়েছিল। মেনকা নগ্ন হয়ে কামনামদির নৃত্য প্রদর্শন করে কামশৃঙ্গারে বিশ্বামিত্রকে বিচলিত করেছিল। তারই ফলস্বরূপ বিশ্বামিত্র গণিকা মেনকার সঙ্গে যৌনকর্মে লিপ্ত হতে বাধ্য হন এবং শকুন্তলার জন্ম দেন। যেহেতু এই ধরনের সম্পর্ক এবং সম্পর্কের ফলে জন্মানো সন্তান সমাজ স্বীকৃত নয়, সেহেতু সেই সদ্যজাত শিশুকে মালিনী নদীর তীরে নিক্ষেপ করে মেনকা পালিয়ে যায়। পালাবেই না-কেন, মেনকা তো মা হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় জন্ম দেননি। তিনি আজ্ঞাবাহক মাত্র। ঋষির ধ্যান ভাঙতে সফল হয়েছেন, সেইসঙ্গে তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্যও শেষ হয়েছে।
হিন্দুধর্ম মতে, ব্রাহ্মণগণ কঠোর তপস্যার ফলে দেবতা পদে উন্নীত হতে পারতেন। বিশ্বামিত্র তেমনই একজন ব্রাহ্মণ, দোর্দণ্ডপ্রতাপ। দেবরাজ ইন্দ্র তাঁকে যেমন সমীহ করতেন, তেমনি ঈর্ষাও করতেন। ভয়ও করতেন। ইন্দ্র সর্বদাই এক আতঙ্কে ভুগতেন, এই বোধহয় কেউ এসে তাঁর সিংহাসন ও পদ দখল করে নিল। ইন্দ্র আশঙ্কায় থাকতেন, ইন্দ্রের রাজ্যে বিশ্বামিত্র হানা দিতে পারেন। বিশ্বামিত্র তপস্যায় মগ্ন হলে ইন্দ্র বিশ্বামিত্রের ধ্যান ভাঙার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। হাতিয়ার করলেন গণিকা মেনকাকে। বিশ্বামিত্রের ধ্যানভঙ্গের জন্য মেনকাকে নির্দেশ দিলেন। অবাক হওয়ার কিছু নেই। সেই ট্র্যাডিশন আজও সমানভাবে চলছে। আজও বিভিন্ন কার্যসিদ্ধির উদ্দেশ্যে নেতা-মন্ত্রী-ধনী-পুঁজিপতিরা গণিকাদের রূপ-যৌবনকে কাজে লাগায়। এমনকি সেনানায়কদেরও কুপোকাৎ করে গোপন নথি সরিয়ে ফেলা হয়। গণিকা নিয়োগের মাধ্যমে কত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে যাচ্ছে, তার হিসাব কে রেখেছে! খেলোয়াড়দের মনোযোগ নষ্ট করার জন্য নারীকে নগ্ন করিয়ে মাঠের মাঝখান দিয়ে দৌড় করানোর রেকর্ড তো আছেই। খেলোয়াড়দের নারীমাংসের আবেশে ভুলিয়ে রাখার জন্য কত গণিকা যে হোটেল পর্যন্ত হানা দেয়!
কালিকাপুরাণে আমরা মেনকাকে দক্ষকন্যা সতীর সখী হিসাবে পাই। মহাভারতেও মেনকাকে পাই গন্ধর্বরাজ বিশ্বাবসুর স্ত্রী হিসাবে। বিশ্বাবসু ও মেনকার মিলনে এক কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। সেই কন্যাকে মহর্ষি স্থূলকেশের আশ্রমের পাশে বয়ে চলা এক নদীতীরে চলে যান। মহর্ষি সেই পতিত কন্যা দেখতে পেয়ে তাঁকে আশ্রমে এনে লালনপালন করতে থাকেন। নাম দেন প্রমদ্বরা। প্রমদ্বরা মহাভারতে উল্লিখিত বিখ্যাত রাজা রুরুর স্ত্রী।
উর্বশী : উর্বশী নাকি নারায়ণের উরু থেকে জন্ম নিয়েছেন। সে যেখান থেকেই জন্ম নিক, ইনি একজন স্বনামখ্যাত স্বর্গের পরমা সুন্দরী গণিকা। শতপথব্রাহ্মণে উর্বশী ও পুরূরবার প্রেমকাহিনি আছে। এই কাহিনি ঋগবেদেও কিছুটা পাওয়া যায়। সেই কাহিনি এখানে উল্লেখ করার প্রাসঙ্গিকতা নেই। পদ্মপুরাণে আছে, বিষ্ণু ধর্মপুত্র হয়ে পর্বতে তপস্যা করছিলেন। তাঁর এই তপস্যায় ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন। অতএব বিষ্ণুর তপস্যায় বিঘ্ন ঘটাতে হবে। ভাবনার বাস্তবায়ন করতে ইন্দ্র কয়েকজন গণিকার সঙ্গে বসন্ত ও কামদেবকে চক্রান্তে নিয়োগ করলেন। তাঁদের পাঠিয়ে দিলেন বিষ্ণুর ধ্যানভঙ্গ করতে। বলা হয়েছে, সেই দল তপস্যা ভঙ্গে ব্যর্থ হলে স্বয়ং কামদেব অন্যান্য গণিকাদের উরু থেকে উর্বশীকে সৃষ্টি করলেন এবং বিষ্ণুর ধ্যানভঙ্গ করতে পাঠিয়ে দিলেন। এর কার্যসিদ্ধি হল। কার্যসিদ্ধি করলেন গণিকা উর্বশী ধ্যান ভাঙলে বিষ্ণু উর্বশীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। উর্বশী রাজি হয়ে যান। উর্বশীর পতন হল পরে। না, বিষ্ণুর কারণে নয়। উর্বশীর পতন হল মিত্র ও বরুণের অভিশাপে (পড়ুন নির্দেশে)। বিষ্ণুর কিছু পরে মিত্র ও বরুণ উর্বশীকে কাছে পেতে চাইলেন। উর্বশী তা প্রত্যাখ্যান করেন। সেই অপরাধে উর্বশীকে মনুষ্যভোগ্যা করে মর্ত্যলোকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কারোকে প্রত্যাখ্যানের অধিকার গণিকার নেই। তাই এই চরমতম শাস্তি।
রম্ভা : রম্ভা হলেন স্বর্গগণিকাদের মধ্যে অন্যতম। রম্ভা নামের মানে কলাগাছের মতো পুষ্ট যে নারীর উরু। রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে উল্লেখ আছে, লঙ্কেশ্বর রাবণ পথে রম্ভাকে একা পেয়ে জোরপূর্বক যৌনসঙ্গম করেন। রম্ভা কুবেরের পুত্র নলকুবেরের কাছে অভিসারে যাওয়ার সময় রম্ভাকে দেখে কামদগ্ধ হয়ে পড়ে রাবণ। লঙ্কেশ্বর রাবণ সংযম হারিয়ে খোলা আকাশের নীচেই রম্ভাকে ধর্ষণ করেন। এরপর রম্ভা নলকুবেরের কাছে পৌঁছে সমস্ত ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করেন। সেই অপরাধে নলকুবের রাবণকে অভিসম্পাত করেন–রাবণ যদি কখনো নারীকে বলপ্রয়োগ করে ধর্ষণ করবে, তখনই তাঁর মাথা সাত খণ্ডে বিভক্ত হয়ে যাবে।
স্কন্ধপুরাণে উল্লেখ আছে, বিশ্বামিত্রের তপস্যায় ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে দেবরাজ ইন্দ্র গণিকা রম্ভাকে নিয়োগ করেন। কিন্তু ইন্দ্র এই অপারেশন চরমভাবে ব্যর্থ হন, সেইসঙ্গে বিশ্বামিত্রের ক্রোধে বিশ্বামিত্রের আশ্রমে রম্ভা ১০০০ বছরের জন্য শিলায় পরিণত হন। বিশ্বামিত্রের আশ্রমে যেসময় রম্ভার শিলারূপে অবস্থান করছিলেন, সেসময় অঙ্গকার নামে রাক্ষুসী নানারকম উপদ্রব করছিলেন। সেসময় ওই আশ্রমে তপস্যারত শ্বেমুনি বায়ব্য অস্ত্রে ওই শিলারূপী রম্ভাকে দু-টুকরো করে রাক্ষুসীকে লক্ষ করে নিক্ষেপ করেন। রাক্ষুসীর মৃত্যু হয়। রম্ভা আবার নিজরূপ ফিরে পান। স্কন্ধপুরাণের অন্য এক কাহিনি বলছে, ইন্দ্রের সভায় নৃত্য পরিবেশনের সময় রম্ভার তালভঙ্গ হয়। ইন্দ্র ক্ষুব্ধ হন এবং রম্ভাকে স্পন্দনহীন বিকলাঙ্গ করে সভা থেকে বহিষ্কার করে ভূতলে নিক্ষেপ করেন। গণিকার ভুল হতে নেই যে। পরে অবশ্য ব্ৰহ্মর্ষি নারদের পরামর্শে শিবকে সন্তষ্ট করে ইন্দ্রলোকে ফিরে আসতে সক্ষম হন।
অন্য এক পুরাণে উল্লেখ আছে, জাবালি মুনির তপস্যা ভঙ্গ করতে ইন্দ্র গণিকা রম্ভাকে নিয়োগ করেন। রম্ভা ইন্দ্রের ষড়যন্ত্র সফল করেন। রম্ভার রূপ-যৌবনে কামমোহিত হয়ে জাবালি মুনির সঙ্গে যৌনকর্মে লিপ্ত হন। এর ফলে মুনির ঔরসে রম্ভা এক কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। জাবালি এই কন্যার প্রতিপালন করেন। কন্যার নাম দেন ফলবতী। জাবালি মুনি বিশ্বামিত্রের মতোই অসংযমী হলেও বিশ্বামিত্রের মতো নিজ সন্তানকে প্রত্যাখ্যান করেননি। তবে বিশ্বামিত্রের সময়ে মেনকা যে কাজটি করেছেন, রম্ভাও সেই কাজ করেছেন। নিজ সন্তানকে ত্যাগ করে চলে যান। সেটাই স্বাভাবিক। তাঁরা গণিকাধর্ম পালন করেছেন, সন্তানের মা হতে নয়।
তিলোত্তমা : কালিকাপুরাণে আমরা গণিকা তিলোমাকে পাই। অপরূপা গণিকাদের মধ্যে অন্যতম। দৈত্যরাজ নিকুম্ভের দুই পুত্র সুন্দ ও উপসুন্দকে রূপের জালে ফাঁসানোর জন্য তিলোত্তমাকে নিয়োগ করা হয়েছিল। সুন্দ ও উপসুন্দ দুই ভাই ত্রিলোক বিজয়ের জন্য কঠোর তপস্যার মাধ্যমে ব্রহ্মার কাছে অমরত্ব প্রার্থনা করেন। কিন্তু ব্রহ্মা এঁদেরকে অমরত্ব দানে মোটেই রাজি নন। শেষপর্যন্ত অমরত্ব দিতেই হল, তবে তা কৌশল করেই। বলা হল, স্থাবর-জঙ্গমের কোনো প্রাণীই তাঁদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। এ পর্যন্ত এটা একপ্রকার অমরত্ব বলেই ভ্রম হতে পারে। মৃত্যুহীন জীবনযাপন করতে পারবে তা কি হয়? অর্থাৎ এরপর সংযোজন করা হল–তাঁদের মৃত্যু তখনই হবে, যখন দুই ভাই পরস্পর পরস্পরের হাতে হত্যা করবে। সুন্দ ও উপসুন্দ দুই ভাইয়ের মধ্যে এত ভাব-ভালোবাসা ছিল যে, এঁরা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি এক ভাইয়ের দ্বারা অন্য ভাইয়ের ন্যূনতম ক্ষতি হতে পারে। তাই অমরত্বের দাপটে স্বর্গলোকে দাপিয়ে বেড়াতে লাগল। ওঁরা স্বপ্নে কখনো ভাবতে না পারলেও বরদাতা ব্রহ্মা সেই ব্যবস্থা করে নিলেন, যাতে দুই ভাইয়ের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। টোপ হিসাবে ব্যবহার করা হল যৌন-আবেদনময়ী লাস্যময়ী নারীকে। এতটাই যৌন-আবেদনময়ী নারীকে ব্যবহার করা হল, তেমন নারী গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডেও দেখা গেল না। তাই স্বয়ং ব্রহ্মা স্পেশাল নারী সৃষ্টি করলেন, যিনি স্বর্গীয় সুন্দরী তিলোত্তমা। যাঁকে দেখে পাথর পর্যন্ত গলে যাবে, আর সুন্দ ও উপসুন্দ তো রক্তমাংসের! ত্রিভুবনের সমস্ত উত্তম বস্তু তিল তিল করে সংগ্রহ করে ব্রহ্মা এই তিলোত্তমাকে সৃষ্টি করলেন। সুন্দ ও উপসুন্দকে নিকেশ করতে নিয়োগ করা হল তিলোত্তমাকে। পরমা সুন্দরী তিলোত্তমা দুই ভাইয়ের সামনে সম্পূর্ণ নগ্ন উপস্থিত হয়ে নৃত্য শুরু করে দিলেন। তিলোতমার ভুবনমোহিনী রূপ আর কামোদ্দীপক দেহবল্লরীর ঝাঁকুনিতে দুই ভাই বিমূঢ় হয়ে পড়লেন। দুজনেই তিলোত্তমাকে কাছে পেতে চাইলেন। কিন্তু একজন নারীকে দুইজন কীভাবে পেতে পারে! তার উপর এইসব গণিকারা যত জনের সঙ্গেই যৌনমিলন করুক না-কেন, এঁরা পুনরায় কুমারীত্ব ফিরে পায়। এরা সসময়ই কুমারী। এ স্বাদের তো ভাগও করা সম্ভব নয়। অতএব যুদ্ধ, এক নারীকে পাওয়ার জন্য দুই ভাইয়ের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। যুদ্ধে দুই ভাইয়েরই মৃত্যু হল একে অপরের শাণিত অস্ত্রে। বোধহয়, স্বয়ং ঈশ্বর গণিকা সৃষ্টি করলেন কামুক পুরুষদের ধ্বংসের জন্য।
ঘৃতাচী : স্বর্গের আরও একজন গণিকার কথা না বললেই নয়। তিনি ঘৃতাচী। ইন্দ্রের হুকুমে ইনিও নিজের নগ্ন রূপ দেখিয়ে প্রচুর মুনি-ঋষিদের তপস্যাকর্মে জল ঢেলে দিয়েছেন। ঘৃতাচী এতটাই যৌন-আবেদনময়ী ছিলেন যে, তাঁকে দেখামাত্রই পুরুষদের বীর্যপাত হয়ে যেত। যেমন-তেমন পুরুষ নয় এমন মুনি-ঋষিদেরও একই হাল হত। ঘৃতাচীকে দেখে ভরদ্বাজ ঋষিরও বীর্যপাত হয়ে যায়। এই পতিত বীর্যেই দ্রোণের জন্ম হয়। ইনিই মহাভারতের দ্রোণাচার। অপরদিকে চ্যবন ও সুকন্যার পুত্র প্রমতির সঙ্গে ঘৃতাচী যৌনমিলন হয় এবং রুরুর জন্ম হয়।
একবার ব্যাসদেব সুমেরু পর্বত থেকে নিজ আশ্রমে ফিরে হোমের আয়োজন করছিলেন। সেসময় সেই হোম অনুষ্ঠানে গণিকা ঘৃতাচী এসে উপস্থিত হন। ঘৃতাচীকে দেখামাত্রই ব্যাসদেব কামাতুর হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় অনিবার্য ধর্ষণের আশঙ্কায় ঘৃতাচী পড়িমরি করে অকুস্থল থেকে পালিয়ে যান শুকপাখির রূপ ধরে। কিন্তু চরম কামোত্তেজনায় ব্যাসদেবের বীর্যপাত হয়ে যায়। সেই বীর্য অরণির (অরণি হল একপ্রকার কাঠ, যে কাঠের ঘর্ষণে আগুন জ্বলে) উপর ছিটকে গিয়ে পতিত হয়। ব্যাসদেব সেই অরণি মন্থন করতে শুরু করে দিলেন। মন্থনের ফলে এক শিশুপুত্রের জন্ম হয়। ঘৃতাচীকে স্মরণ করে সেই শিশুপুত্রের নাম রাখেন শুক। স্বর্গের সব গণিকাদের নিয়ে আলোচনা করাই যেত। কিন্তু তাতে কলেবর বৃদ্ধি হয়, লাভ কিছু হয় না। কয়েকজন গণিকার বিষয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করলাম স্বর্গের গণিকাদের বিষয়ে কিঞ্চিত আভাস দেওয়ার জন্য। আর-একটু সংযোজন করি। এইসব অনন্তযৌবনা গণিকারা দেবরাজ ইন্দ্রের নির্দেশে গুপ্তচরবৃত্তি ও গুপ্তহত্যার কাজে নিযুক্ত হতেন। রামায়ণেও প্রচুর গণিকার উল্লেখ আছে, যাঁরা গুপ্তচর বৃত্তির কাজে নিয়োজিত ছিল। রামচন্দ্রের অভিষেকের সময় প্রচুর গণিকা অংশগ্রহণ করেছিলেন। রামায়ণের যুগে বিশিষ্ট অভ্যাগতদের অভ্যর্থনায় রাজপরিবারের মানুষদের মৃগয়ায় গণিকাদের নিয়োগপ্রথার প্রচলন ছিল। গণিকা কর্তৃক ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির প্রলোভনের আখ্যান রামায়ণে সুখ্যাত হয়ে আছে।
মহাভারতের যুগে এমন জনা পাঁচেক মুনি-ঋষির নাম পড়ে পড়ছে, যাঁরা গণিকাদের শরীরী ছলনায় বশীভূত হয়ে কামার্ত হয়ে যৌন-সংসর্গ করেছিলেন। এঁরা হলেন–বিশ্বামিত্র, শরদ্বান, ভরদ্বাজ, ব্যাস, বশিষ্ঠ, পরাশর, দীর্ঘতমা প্রমুখ। মহাভারতের যুগে অপরাপর সম্মানজনক বৃত্তিগুলির মধ্যে গণিকাবৃত্তি ছিল অন্যতম। রাজদরবারে ও বিবিধ রাজকীয় অনুষ্ঠানে গণিকাদের উপস্থিতি ছিল অপরিহার্য। এঁরা মনোহর রত্ন, সোনা ও মণিমুক্তাখচিত অলংকারাদি ও মহামূল্য পোশাকে আচ্ছাদিত হয়ে রাজপথে অবাধে বিচরণ করতেন। যে-কোনো অনুষ্ঠানে ও শোভাযাত্রায় আয়োজন হলে পুরোভাগে বস্ত্রালংকার শোভিত সুন্দরী গণিকারা থাকতেন।
শুধু সুরলোকেই নয়, অন্যত্র গণিকাদের প্রয়োজনীয়তা ছিল যথেষ্ট, উপস্থিতিও ছিল লক্ষ্যণীয়। মহাভারতে তৃষ্টা নামক এক ঋষির কথা জানা যায়। ত্বষ্টার পুত্র ছিলেন ত্রিশিরা। ত্রিশিরা ছিলেন মদ্যপ ও নিষ্ঠাবান ধার্মিক। তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল স্বর্গলোক জয়। যেহেতু স্বর্গলোকের চৌকিদার স্বয়ং ইন্দ্র, সেইহেতু ইন্দ্রের ভয়ের কারণ হল ত্রিশিরা। উপায় খুঁজতে রূপবতী গণিকাদের শরণাপন্ন হলেন পুরন্দর ইন্দ্র। ত্রিশিরার তপস্যা ভঙ্গ করতে সুন্দরী গণিকাদের কাজে লাগালেন দেবরাজ। এখনকার মতো মহাভারতের যুগেও সমরসম্ভারের সঙ্গে সৈন্যশিবিরে সুন্দরী গণিকাদের স্থান দেওয়া হত। সেনাদের একঘেয়েমি নিবারণ ও যৌনক্ষুধা মেটানোর জন্য এঁদের মজুত রাখা হত। যুযুধান দুইপক্ষ পাণ্ডব ও কৌরব সেনাশিবিরে অসংখ্য সৈন্যদের বিনোদন ও মনোরঞ্জনের জন্য শত সহস্র গণিকা নিয়োগ করা হয়েছিল। পাণ্ডব সেনাশিবিরে যেসব ‘বেশস্ত্রী’ অর্থাৎ বেশ্যা বা গণিকা নিয়োগ করা হয়েছিল। তাঁদের সুযোগসুবিধা যা কিছু দেখভালের দায়িত্ব সবই ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের উপর ন্যস্ত ছিল। রামায়ণে রামচন্দ্রের জন্য যে স্বতন্ত্র সৈন্যবাহিনী গঠন করা হয়েছিল, সেই বাহিনীতে বিবিধ সমরসম্ভারেও অজস্র যৌবনবতী গণিকা নিয়োগ করা হয়েছিল।
শুধু হিন্দুধর্মেই নয়, আমরা ইসলাম ধর্মেও স্বৰ্গবেশ্যাদের কথা জানতে পারি, যাদের হুরপরি বলা হয়। বেহেশতকামীদের লোভ দেখাতেই এই স্বৰ্গবেশ্যাদের উপস্থাপনা। যাদের সঙ্গে বেহেশতবাসী পুরুষরা অনন্তকাল সেক্স করতে পারবে। মাসের পর মাস তাঁরা সেক্স করবে, কিন্তু সেই সেক্স কোনোদিন শেষ হবে না। তাঁরা ক্লান্ত হবে না, সেই বেশ্যারাও ক্লান্ত হবে না। কেমন হবে সেই গণিকারা? কেমন বর্ণনা দেওয়া হয়েছে সব বেশ্যাদের? স্বৰ্গবেশ্যাদের শারীরিক বর্ণনা যা পাওয়া যায়, তা হচ্ছে অনেকটা এরকম–
প্রত্যেক বেহেশতবাসীকে দেওয়া হবে ৭২টি অনিন্দ্য সুন্দরী হুরপরি তাঁদের ভোগের জন্য। বেহেশতবাসীরা যে কোনো বয়সেই মারা যাক না-কেন, তাঁরা যখন বেহেশতে প্রবেশ করবে তখন তাঁদের বয়স হবে ৩০ বছরের যুবকের মতো এবং তাঁদের বয়সের আর কোনো পরিবর্তন হবে না; আর প্রত্যেক বেহেশতবাসীকে ১০০টি শক্তিশালী পুরুষের সমান যৌনশক্তি দান করা হবে (তিরমিজি, অধ্যায় ২, পৃষ্ঠা ১৩৮)। হজরত আলি বর্ণনা করেছেন, নবি বলেছেন যে বেহেশতে একটি মস্ত বড় খোলা বাজার থাকবে, যেখানে কোনো কেনাবেচা হবে না। সেখানে শুধুই থাকবে অতিসুন্দরী উন্নবক্ষা হুরপরিরা, যাঁরা ফলের দোকানের মতো সেজেগুজে বসে থাকবে বেহেশতবাসীদেরকে আকর্ষণ করার জন্য। বেহেশতবাসীদের পছন্দ হলেই তৎক্ষণাৎ তাঁরা সেই হুরির সঙ্গে যৌনকর্ম শুরু করে দেবে ঠিক সেখানেই (সহি হাদিস, অধ্যায় ৪, পৃষ্ঠা ১৭২, নং ৩৪)। হুরপরিরা এত বেশি সুন্দরী ও রূপসী হবে যে, তাঁরা যদি আকাশের জানালা দিয়ে পৃথিবীর দিকে তাকায়, তাহলে সমস্ত দুনিয়া আলোকিত হবে এবং সুঘ্রাণে ভরে যাবে আকাশ ও পৃথিবীর মাঝখানের সব জায়গা। একজন হুরির মুখমণ্ডল হবে আয়নার চেয়েও মসৃণ বা পরিষ্কার, যাতে নিজ চেহারা দেখতে পাবে এবং হুরির পায়ের মজ্জা দেখা যাবে খালি চোখে (মিসকাত অধ্যায় ৩, পৃষ্ঠা ৮৩-৯৭)। একজন হুরি অনিন্দ্যসুন্দরী যুবতী, যাঁর শরীর হবে আয়নার মত স্বচ্ছ বা মসৃণ। তাঁর পায়ের হাড়ের ভেতরের মজ্জা দেখতে পাওয়া যাবে যেন মণি-মুক্তোর ভিতরে রেখার মতো। তাঁকে মনে হবে একটি সাদা গ্লাসে রাখা লাল মদের মতো। সে হবে সাদা রঙের দুধে আলতা মিশানো এবং তাঁর কখনো হায়েজ (মাসিক), মলমুত্র ত্যাগ, গর্ভবতী হওয়া ইত্যাদি কিছুই হবে না। হুরি হবে অল্পবয়স্কা, যাঁর স্তনযুগল হবে বড়ো বড়ো ও গোলাকার, যা কখনোই ঝুলে পড়বে না; সবসময় তীরের মতো তীক্ষ্ণ থাকবে। এসব হুরিরা থাকবেন এক অতি উজ্জ্বল এবং জৌলুসপূর্ণ জায়গায় (তিরমিজি, অধ্যায় ২, পৃষ্ঠা ৩৫ ৪০)।
আবু ওমামা বলেছেন যে, আল্লাহর রসুল বলেছেন—“আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বেহেশতে স্থান দেবেন এবং প্রতিটি বেহেশতবাসীকে বিবাহ দেবেন ৭২ জন অনিন্দ্যসুন্দরী রমণীয় সঙ্গে; যাঁদের মধ্যে দুইজন হবে চিরকুমারী আয়তলোচনা এবং বড়ো বড়ো চোখওয়ালা হুরি এবং বাকি ৭০ জন হবে উত্তরাধিকার, যা সে লাভ করবে জাহান্নমবাসীদের গনিমতের মাল থেকে। প্রত্যেকটি সুন্দরী রমণীর থাকবে খুব সুখদায়ক যৌনাঙ্গ এবং বেহেশতি পুরুষের যৌনাঙ্গ সর্বদাই শক্ত ও খাড়া হয়ে থাকবে, কখনো বাঁকা হবে না যৌনতার সময়। অর্থাৎ মূলত পুরুষাঙ্গটি সবসময়ই হুরপরিদের যোনির ভিতরে প্রবিষ্ট থাকবে পালাক্রমে একের পর এক প্রায় ৭০ বছর ধরে (হাদিস নং ৪৩৩৭ ইবনে মাজাহ, ভলিউম ৫, পৃষ্ঠা ৫৪৭)। আবু উমামা কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসুল বলেছেন–“আল্লাহ যাঁদের জান্নাতে প্রেরণ করবেন, তাঁদের প্রত্যেককে ৭২ জন হুরির সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হবে; যাঁর দুটি হুরি এবং বাকি সত্তরখানা হবে জাহান্নামবাসীদের সম্পত্তির। তাঁদের সকলের থাকবে কামুক যৌনাঙ্গ এবং তাঁর লিঙ্গ থাকবে অনন্তকাল উত্থিত [সুনান ইবনে মাজা, যুহদ (Book of Abstinence) ৩৯]। দারাজ ইবনে আবি হাতিম কর্তৃক উল্লেখিত, আবু সাইদ আল-খুদরির কাছ থেকে প্রাপ্ত, আবু আল-হায়থাম আবদুল্লাহ ইবনে ওহাব কর্তৃক বর্ণিত, যিনি শুনেছেন, নবি বলেছেন–“জান্নাতের সবচেয়ে ছোটো পুরস্কার হবে একটি প্রাকৃতিক ঘর, যেখানে আট হাজার ভৃত্য এবং ৭২ জন হুরি থাকবে, যার গম্বুজ থাকবে মুক্তো, পান্না ও চুনি দ্বারা সজ্জিত, এবং যা প্রশ্বস্ত হবে আল-জাবিয়াহ থেকে সানার মধ্যকার দুরত্বের সমান (আল-তিরমিজি, ভল্যুম ৪, চ্যাপ্টার ২১, নাম্বার ২৬৮৭)। একজন হুরির সঙ্গে প্রতিবার শয্যাগ্রহণকালে আমরা তাঁকে কুমারী হিসেবে পাব। তাছাড়া জান্নাতিদের লিঙ্গ কখনো নমনীয় হবে না। এই লিঙ্গোত্থান হবে অনন্তকালের জন্য; প্রতিবার তোমরা যে আনন্দ উপভোগ করবে, তা হবে পরম তৃপ্তিদায়ক যা এই দুনিয়ার কেউ পায়নি, এবং তোমরা যদি সেই পুলক দুনিয়াতে থেকে লাভ করতে তাহলে অজ্ঞান হয়ে যেতে। নির্বাচিত প্রতিটি মুসলিম বান্দা তাঁদের পৃথিবীর স্ত্রীদের ছাড়া আরও ৭০ খানা হুরির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হইবে, এবং তাঁদের সকলের থাকবে অত্যন্ত কামুক যোনি। (আল-ইতকান ফি উলুম আল-কুরান, পৃষ্ঠা ৩৫১)
০৪. গণিকাবৃত্তির এক করুণ রূপ বিষকন্যা
মহাভারতের যুগে ‘বিষকন্যা’ নামক এক শ্রেণির সুন্দরী গণিকাদের কথা জানা যায়। এঁরা খুনে গুপ্তচর বাহিনীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন। তাঁদের কাজ ছিল যৌনসম্ভোগকালে ওষ্ঠ-চুম্বনে অথবা দন্তদংশনে এরা হত্যার জন্য প্রেরিত ব্যক্তির শরীরে বিষ ঢেলে দিত। সেই ব্যক্তি জ্ঞান হারালে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করত এবং তাঁর পুরুষাঙ্গটিও কেটে ফেলা হত। মহাভারতের চতুর্দশ অধ্যায়ের বিষয়ই বিষকন্যা পাঠিয়ে গুপ্তহত্যা। শ্রীসুখময় ভট্টাচার্য তাঁর ‘মহাভারতের সমাজ’ গ্রন্থে লিখেছেন–“অনেক সময় শত্রুপক্ষ সুন্দর যুবতীকে উপঢৌকন স্বরূপ পাঠাইয়া থাকেন। পরিমিত মাত্রায় বিষ হজম করাইয়া সেই সকল কন্যাকে এমনভাবে তৈয়ারি করা হয় যে, তাহাদের স্পর্শমাত্রই অপর প্রাণী মৃত্যুমুখে পতিত হইয়া থাকে। সেই সকল কন্যাকে ‘বিষকন্যা’ বলে। গুপ্তচরের মুখে সমস্ত বার্তা অবগত হইয়া অতিশয় সাবধানে বাস করিবে। এই সকল প্রলোভন হইতে নিজেকে রক্ষা করিতে না পারিলে বিনাশ সুনিশ্চিত।”
শৈশবকাল থেকেই সুন্দরী কন্যাসন্তানদের শরীরে অল্প অল্প করে বিষ প্রয়োগ করে তাঁদের শরীরকে বিষ সহনীয় করে তোলা হত। এই প্রক্রিয়াকালে অনেক কন্যাসন্তান বিষের প্রভাবে মারাও যেত। যাঁরা সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যেত, তাঁদের শরীর জুড়ে বিষের প্রবাহ। এইসব মেয়েরা পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে উঠলে শত্রু কবজা করতে পাঠিয়ে দেওয়া হত। এঁরা শরীরী-ছলনায় কামুক পুরুষদের দখল নিত। যে পুরুষ যৌনকামকে জয় করতে পারত, তাঁকে কবজা করা জটিল হয়ে পড়ত।যে জয় করতে পারত না, তাঁর মৃত্যু অনিবার্য।
মোট কথা, ক্ষমতাবান শত্রুকে ধ্বংস করার জন্য বিষকন্যা পাঠানোর রেওয়াজ ছিলই। মৌযযুগেও এমন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল বলে জানা যায়। নন্দরাজার এক মন্ত্রী চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কাছে বিষকন্যা পাঠিয়েছিল। চাণক্যের কুট-বিচক্ষণতায় সেই বিষকন্যাকে পর্বতক নামে এক ব্যক্তির কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পর্বতক বিষকন্যায় শরীরী ছলনায় আত্মসমর্পণ করলে তাঁর মৃত্যু হয়। ভারতবর্ষে ‘বিষকন্যা’ গণিকাদের বাড়বাড়ন্ত হয়েছিল মৌর্য সাম্রাজ্যের সময়েই। বিশাখদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটকের প্রথম ও দ্বিতীয়াংশে বিষকন্যাদের উল্লেখ আছে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও বিষকন্যার হদিস পাওয়া যায়। কল্কিপুরাণে সুলোচনা (সুলোচনা ছিলেন গন্ধর্ব চিত্রগ্রীবের স্ত্রী) নামে এক বিষকন্যার কথা জানা যায়। এইসব বিষকন্যার নজরে কোনো পুরুষ পড়লেই পুরুষটি মারা যায়।
তৎকালীন রাজারাও বিষকন্যাদের নিয়োগ করতেন শক্রনিধনের স্বার্থে। এহেন বিষকন্যারা একদিকে যেমন বহুপুরুষগামী, অপরদিকে হত্যাকারী। জিশুর জন্মের ৩২৭ বছর আগে আটাশ বর্ষীয় এক শক্তিশালী গ্রিক রাজার কথা জানতে পাই। তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল পশ্চিম ইউরোপ থেকে পারস্য পর্যন্ত। এই রাজা পারস্যরাজ দরায়ুসকে পরাজিত করে পৌঁছোলেন ভারত ভূখণ্ডে এবং ভারত জয় করে নিলেন। পুষ্কলাবতীর রাজা অষ্টক, অশ্বক জাতির রাজারা একে একে তাঁর কাছে পরাজিত হলেন। তক্ষশীলার রাজাও আত্মসমর্পণ করলেন। অর্ধেক পৃথিবীর ‘রাজা’ তৃতীয় আলেকজান্ডারের শিবিরে বহুমূল্যের উপঢৌকন পাঠালেন ভারতীয় রাজ্যের রাজা সিকান্দার। সঙ্গে পাঠালেন পাঁচ অপরূপ সুন্দরী লাস্যময়ী নারী। সেই ক্ষীণকটির রূপবৈভবে মুগ্ধ হয়ে গেলেন গ্রিক শিবির। নারীর প্রতি যে আলেকজান্ডারের আসক্তি ছিল, সে কথা ততদিনে ভারতে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই আসক্তিকেই সুচারুভাবে কাজে লাগালেন ভারতীয় রাজা। আলেকজান্ডারও ঘুণাক্ষরে টের পেলেন না ভারতীয় রাজার কৌশল। লুব্ধ দৃষ্টিতে মোহিত হয়ে লাস্যময়ী নারীর দিকে এগোতে থাকলেন আলেকজান্ডার। ভারতীয় রাজা এই সুযোগের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। আত্মসমর্পণের বদলা নিতেই রাজা লাস্যময়ীদের পাঠিয়েছিলেন। গ্রিকশিবিরের আলেকজান্ডারের সঙ্গে ছিলেন অ্যারিস্টটল। আলেকজান্ডারের গুরু। লাস্যময়ীর নৃত্যে আলেকজান্ডার মোহিত হয়ে গেলেও অ্যারিস্টটল সতর্ক ছিলেন। তিনি আলেকজান্ডারকে সতর্ক করে বললেন–“আর এগিয়ো না বৎস। এই লাস্যময়ী বিষকন্যা”। আলেকজান্ডার বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না গুরুকে।গুরু অ্যারাস্টটলের দিকে অবিশ্বাসের চোখে তাকাতেই গুরু বললেন–“অপেক্ষা করো বেটা। আমি প্রমাণ দিচ্ছি”। অ্যারিস্টটল ঈশারায় দুজন দাসকে কাছে ডাকলেন এবং আদেশ দিয়ে বললেন–“ওই নারীর ওষ্ঠে চুম্বন করো”।
চুম্বন করবে কী! তাঁরা সেই লাস্যময়ী নারী শরীর স্পর্শ করামাত্রই দুজন দাসই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। এখানেই শেষ নয় পরীক্ষার। তিনি সেই নারীকে আলেকজান্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ঘোড়াকে স্পর্শ করতে বললেন। নারীর স্পর্শে নিমেষে তেজি ঘোড়া নিস্তেজ হয়ে গেল। এবার আলেকজান্ডারের মোহ ভাঙল এবং তলোয়ার দিয়ে দ্বিখণ্ডিত করে দিল এই গুপ্তঘাতিনী লাস্যময়ী নারীকে। তারপর বিষকন্যাকে পুড়িয়ে দেওয়া হল। এ কাহিনি পাওয়া যায় কবি গুইলাম ডি চেরভেরা রচিত ‘রোমানিয়া গ্রন্থ থেকে। এ কাহিনি ছড়িয়ে পড়েছিল ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি পর্যন্ত। এছাড়া আলেকজান্ডারের যেসব উপদেশ অ্যারিস্টটল দিয়েছিলেন, তার একটা সংকলন প্রকাশিত হয়। সংকলনটির নাম ‘সিক্রেটা সিক্রেটোরাম’। সিক্রেট সিক্রেটোরামে অ্যারিস্টটল ভারতের বিষকন্যাদের থেকে শত হস্তে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন আলেকজান্ডারকে। অ্যারিস্টটল এটাও মনে করিয়ে দিয়েছেন, অতীতে বহু রাজা খতম হয়েছেন এই বিষকন্যাদের সংসর্গে। ভারতের মতোই আকর্ষণীয় ভারতের বিষকন্যাদের কাহিনি। এই বিষকন্যারা গণিকা হিসাবে পরিচিত হলেও তাঁর সঙ্গে যৌনসংসর্গ করে উঠত পারত না শিকার। কারণ তাঁদের সামান্য স্পর্শেই শিকারের মৃত্যু অনিবার্য। সেই কারণেই বিনা যুদ্ধে শত্রুবিনাশে এই অপ্সরা-সুন্দরীদের ব্যবহার করত রাজা, মহারাজা, সম্রাটরা।
যে পদ্ধতিতে বিষকন্যাদের বিষসহনে অভ্যস্ত করা হত তার নাম মিথ্রিডেটিজম। গ্রিসের পন্টাসের রাজা ষষ্ঠ মিথ্রিডেটস নিজের শক্তিশালী শত্রুদের দমন করার জন্য প্রথম বিষকন্যাদের বিষময় করে তোলার পদ্ধতি ব্যবহার করেন। তিনি ভীত ছিলেন এই ভেবে যে, তাঁর মা তাঁকে বিষ দিয়ে হত্যা করবে। সেই ভয়ে তিনি জঙ্গলে পালিয়ে যান। সেখানে গিয়ে বনচরদের কাছ থেকে শিখে নেন কীভাবে অল্প পরিমাণ বিষাক্ত পদার্থ শরীরে প্রবেশ করিয়ে বিষক্রিয়া প্রতিরোধ করা যায়। বিষকন্যারা তাঁদের রূপের জালে রাজা বা রাজপুরুষ বা বণিকদের ফাঁসিয়ে গুপ্তহত্যার চেষ্টা করত প্রতিপক্ষ। শক্তিশালী শত্রু প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মানবঘাতক বিষকন্যাদের ব্যবহার করার সবথেকে বড়ো সুবিধা হল, তাঁদের বিষকন্যা হিসাবে চেনা অত সহজ ছিল না। ভোগলালসা নারীসঙ্গে ডুবে থাকা রাজারা খুব সহজেই গণিকা বিষকন্যাদের সৌন্দর্য ও লাস্যের ফাঁদে পড়ে মৃত্যুর দেশে পৌঁছে যেত নিমেষের মধ্যেই। বিষকন্যাদের যে চেন যেত না, তা কিন্তু নয়। অভিজ্ঞরা অবশ্যই চিনতে পারতেন।
প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত তিন চিকিৎসক হলেন–চরক, সুশ্রুত ও ভাগবত। এঁরা তাঁদের রচিত গ্রন্থে বিষকন্যাদের কথা লিখে গেছেন। সেখানে বলা হয়েছে বিষকন্যাদের চেনার সহজ উপায়–(১) অকারণ হাসি, (২) চুলে আঙুল চালানো, (৩) সন্দেহজনক আচরণ, (৪) অতিরিক্ত কথা বলা, (৫) মাটি আঁচড়ানো, (৬) ঘনঘন পিছন ফিরে দরজা দেখা, (৭) কোনো প্রশ্ন করলে নীরব থাকা ইত্যাদি।
বিষকন্যার বিষের সঙ্গে কীভাবে রক্ষা পেতে হবে, সেই উপায়ও বাতলে দিয়েছেন চিকিৎসক সুশ্রুত। কীভাবে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে সে কথাও বলে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন মেয়েদের অন্ন, দাঁত মাজার সামগ্রী, চুলের তেল, জামাকাপড়, স্নানের জল, চোখের পথ্য, অলংকার, প্রসাধনী দ্রব্য ইত্যাদিতে বিষক্রিয়ার সম্ভাবনা থাকে। প্রাচীন যুগে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশেই বিষকন্যাদের ব্যবহার ছিল। বোহেমিয়ার রাজা দ্বিতীয় ওয়েনচেসলাউসের মৃত্যু হয় বিষকন্যাদের সংসর্গেই। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে উত্তর ভারতের রাজনীতিতে বিষকন্যাদের দাপট ছিল ব্যাপক। অঙ্গ, কোশল, কাঞ্চী, অবন্তী সহ একাধিক রাজাদের পরাজিত করে মগধের উত্থান হয়েছিল এই বিষকন্যাদের সংসর্গে। মুদ্রারাক্ষস, অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে সেইসব রোমহর্ষক কাহিনি পাওয়া যায়। নন্দবংশের শাসনামলে বিষকন্যা কর্তৃক রাজা ও রাজপুরুষদের গুপ্তহত্যা প্রবলভাবে বেড়ে যায়। মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা একবার মরতে মরতে বেঁচে যান চাণক্যের তীক্ষ্ণ বুদ্ধিতে। মৌর্যসম্রাট চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে মগধসম্রাট ধননন্দের সঙ্গে বিরোধ ছিল। দাম্ভিক, প্ৰজাবিদ্বেষী রাজা ধননন্দের ভয়ে চন্দ্রগুপ্ত জঙ্গলে আত্মগোপন আছেন। প্রজ্ঞা ও চতুর কৌশলে চাণক্য আভাস পাচ্ছিলেন চারপাশে চন্দ্রগুপ্তকে হত্যার চক্রান্ত চলছে, তার মধ্যে বিষকন্যা কর্তৃক বিষের আক্রমণের সম্ভাবনাই ছিল প্রবল। তাই চন্দ্রগুপ্তের খাবারে তিনি গোপনে প্রতিদিন বিষ মিশিয়ে দিতেন। বিষের স্পর্শ থেকে বাঁচাতে চাণক্য এইভাবেই চন্দ্রগুপ্তের শরীরকে তৈরি করতে থাকলেন। যুদ্ধে ধননন্দের মৃত্যু হলেও ধননন্দের রাক্ষস নামক মন্ত্রী চন্দ্রগুপ্তের কাছে এক লাস্যময়ী বিষকন্যাকে পাঠিয়ে দিলেন। মৌর্যসম্রাটের ছায়াসঙ্গী চাণক্য সেই বিষকন্যাকে দ্রুত চিনে ফেললেন। তিনি সেই বিষকন্যাকে চন্দ্রগুপ্তের ত্রিসীমানায় ঢুকতে দিলেন না। বিষকন্যাকে পাঠিয়ে দিলেন পর্বতকের কাছে। পর্বতক ধননন্দের পুত্র। পর্তক চন্দ্রগুপ্তের প্রতিদ্বন্দ্বী। চন্দ্রগুপ্তের পথের কাঁটা হয়ে তিনিও গোপনে ষড়যন্ত্র রচনা করছিলেন। চন্দ্রগুপ্তকে পাঠানো বিষকন্যার ছোবলেই পর্বতকের মৃত্যু হয়।
তবে এমন শোনা যায় যে, বিষকন্যারা একবার কারোর মৃত্যুর কারণ হলে তাঁর শরীর থেকে বিষ শেষ হয়ে যেত। তাই একই সঙ্গে দুজনের মৃত্যু ঘটানো সম্ভব হত না, যতক্ষণ-না নতুন করে তাঁদেরকে বিষের জোগান দেওয়া হত। বিষ হজম করে বড় হতে থাকা মেয়েদের উপর চলত বিশেষ প্রশিক্ষণ। রাজ্যের বিশিষ্ট গণিকা, নর্তকীদের তত্ত্বাবধানে চলত এঁদের শিক্ষাদীক্ষা। শরীরের প্রতিটি অঙ্গের ব্যবহার কীভাবে সুচারুভাবে করতে হয়, তার শিক্ষা নিতে হত। শিখতে হত মোহময় বাক্যজাল বিস্তার। পুরুষকে আকর্ষণ করার সমস্ত ছলাকলাই শিখতে হত। এর সঙ্গে শিখতে হত ছদ্মবেশ ধারণ করা ও কামকলা। তাঁদের চলনে, বলনে, শরীরী কটাক্ষে ঝরে পড়তে হবে উত্তেজক যৌনতা। সেই যৌনতায় খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে তাবড় রাজা-মহারাজা বীরপুরুষরা।
এইসব বিষকন্যাদের মতো হত্যাকারিণীদের কি কোনো শাস্তির বিধান ছিল? না, এমন কোনো বিধান বা নির্দেশ ছিল না। তবে কোনো মেয়েকে বিষকন্যা বলে টের পেলে তাঁর শরীর তলোয়ার দিয়ে টুকরো টুকরো কেটে ফেলা হত। তারপর মাটিতে পুঁতে দেওয়া কিংবা আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হত। আমি আগেই উল্লেখ করেছি আলেকজান্ডারও তলোয়ার দিয়ে দ্বিখণ্ডিত করেছিল গুপ্তঘাতিনী লাস্যময়ী বিষকন্যাকে। তারপর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। কেটে দু-টুকরো করে দেওয়াই হোক বা মাটিতে পুঁতে ফেলাই হোক, আগুনে পুড়িয়ে দেওয়াই হোক–কী যায় আসে! এই অভাগাদের জীবন কি জীবন! মৃত্যুতেই এই অভাগা নারীদের মুক্তি। সেই শৈশবকাল থেকেই তাঁদের নিয়মিত বিষপান করতে হত রাজাদের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায়। নিজের শরীরে বিষ প্রতিরোধ করার সক্ষমতা এলে মানুষ মারার উপযুক্ত হয়ে উঠলে সেই মেয়েদের পাঠানো হত বিভিন্ন রাজার দরবারে। সব মেয়েই বিষ প্রতিরোধ করতে পারত না। অনেকেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তেন। হত অকালমৃত্যু। ভাগ্যক্রমে বেঁচে থাকলে কোনো রাজার বিশ্বাসভাজন হয়ে থাকতে হত শরীরে বিষের জ্বালা নিয়ে। সেই রাজা যখন মনে করত প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিপক্ষ রাজাকে হত্যা করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, তখন এইসব মেয়েদের পাঠিয়ে দেওয়া হত সংশ্লিষ্ট রাজার বিলাসভবনে।এঁদের প্রথম কাজ ছিল রাজার খাবারে বিষ মিশিয়ে খাওয়ানো। তবে রাজাকে সন্দেহমুক্ত করার জন্য নিজেকেও সেই বিষ মেশানো খাবার খেতে হত। এরপর রাজা সেই বিষ-খাবার খেয়ে মারা যেত, কিন্তু বিষকন্যাদের কিছু হত না। রাজাদের সাম্রাজ্যগ্রাসের কুটিল রাজনীতিতে বিষই হয়ে উঠেছিল বিষকন্যাদের জীবনের একমাত্র পরিচয়, যাকে ইচ্ছামতো ব্যবহার করত সেকালের ধুরন্ধর রাষ্ট্রনেতা, সমরবিদরা।
পৃথিবী জুড়ে আজও এঁরা আছে। কেবল পদ্ধতি পালটে গেছে। অন্য রূপে। অন্য ভাবে। যেমন ধরুন হাতের কাছে হানি ট্র্যাপ। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয় বিমানবাহিনীর এক অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল হানি ট্র্যাপের কাছে ঘায়েল হওয়ার। এরা সেইসব নারী, যাঁদের আন্তরিক আহ্বান, সহজ-সরল চোখদুটিকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা খুব কম পুরুষেরই আছে। এঁরা পুরুষদের প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে গোপন তথ্য বের করে আনে। ১৯১০ সালে বার্লিন থেকে প্যারিস সারা ইউরোপ জুড়ে দাপিয়ে বেড়াত মাতা হারি নামে এক গণিকা গুপ্তচর। পামেলা বোর্দেও ছিল এমনই এক গণিকা গুপ্তচর। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের চর ডামিনি ম্যাকনট নামে এক লাস্যময়ী নারীর ফাঁদে পা দেন বিমান বাহিনীর ওই অফিসার। তিনি নাকি বাহিনীর রণকৌশল পাচার করেছিলেন। সিআইএ, মোসাদ, র, হামাস, কেজিবি, আইএসআই সব গোয়েন্দা সংস্থার তূণে আছে এই গণিকা গুপ্তচর। ‘হানি ট্র্যাপ’ মানেই যে ‘মধুর ফাঁদ’। এই মধুর ফাঁদে শত শত রাঘব বোয়াল ধরা দেবেন এ আর নতুন কথা কী।
০৫. বাৎস্যায়নের চোখে গণিকা
প্রাচীন যুগে গণিকাদের বিবরণ দিতে চাইব, অথচ বাৎস্যায়নের কামসূত্রম’ উল্লেখ করব না, তাই হয় নাকি? কামসূত্রম আলোচনা করার আগে গ্রন্থের রচয়িতা বাৎস্যায়নকে না-জানলে আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। মল্লনাগ বাৎস্যায়ন ছিলেন বেদজ্ঞ ভারতীয় দার্শনিক। ধারণা করা হয় তিনি গুপ্তযুগে চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতাব্দী ভারতে বর্তমান ছিলেন। কামসূত্রম ও গৌতমের ন্যায়সূত্র গ্রন্থের টীকা ‘ন্যায়সূত্ৰভাষ্য’-এর রচয়িতা রূপে তাঁর নাম পাওয়া যায়। তবে সম্ভবত, বাৎস্যায়ন নামক কোনো একক ব্যক্তি এই দুই গ্রন্থ রচনা করেননি। তাঁর সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা যায় না। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল মল্লিনাগ বা মৃল্লান। বাৎস্যায়ন ছিল তার বংশনাম বা পদবি। নিজ গ্রন্থের শেষে তিনি যে আত্মপরিচয় দান করেছেন তা এরকম–“বাভ্রব্য ও অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থকারদের রচনা পড়িয়া তদনুসারে এবং তাঁহাদিগের দ্বারা প্রদত্ত অর্থবিধান পর্যালোচনা করিবার পর পবিত্র আদেশানুসারে জগতের কল্যাণার্থে বারাণসীর চতুষ্পঠীর ছাত্র ও দেবসেবক বাৎস্যায়ন কর্তৃক এই সন্দৰ্ভটি রচিত হইয়াছে। ইহা আমাদিগের কামনাবাসনা চরিতার্থ করিবার পুস্তক নহে। যে ব্যক্তি এই বিজ্ঞান সম্পর্কে সম্যক অবহিত, যিনি নিজ ধর্ম, অর্থ ও কাম রক্ষা করিয়া এবং লোকাঁচার মানিয়া চলেন, কেবল তিনিই তাঁর ইন্দ্রিয় জয়ে সক্ষম। সংক্ষেপে বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী ব্যক্তি ধর্ম ও অর্থের অধিকারী হইলে কামেরও অধিকারী হইবেন। তজ্জন্য তাঁহাকে তাঁহার কামনা বাসনার ক্রীতদাসত্ব করিতে হইবে না। তিনি যাহাই করিবেন তাহাতেই সাফল্য পাইবেন।”
বাৎস্যায়নের জীবন বা রচনার সঠিক সময়কাল নির্ধারণ করা অসম্ভব। সম্ভবত খ্রিস্টীয় প্রথম থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যবর্তী কোনো একসময়ে তিনি বিদ্যমান ছিলেন। তাঁর রচনায় আছে, কুন্তলরাজ সাতকর্ণী সাতবাহন কামান্ধ হয়ে কর্তারি নামক অস্ত্রের সাহায্যে নিজ পত্নী মাল্যবতাঁকে হত্যা করেন। এই ঘটনা উল্লেখ করে বাৎস্যায়ন সর্বসাধারণকে সতর্ক করে দেখিয়ে দেন যে কামান্ধ হয়ে নারীকে আঘাত করার মতো প্রাচীন প্রথা কতটা বিপজ্জনক হতে পারে। এই কুন্তলরাজ খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে বিদ্যমান ছিলেন। অর্থাৎ, বাৎস্যায়নের সময়কাল প্রথম শতাব্দীর পরে। আবার বরাহমিহির রচিত ‘বৃহৎসংহিতা’ গ্রন্থের অষ্টাদশ অধ্যায়টিও কামকলা সংক্রান্ত। এর বিষয়বস্তু মূলত বাৎস্যায়নের গ্রন্থ থেকে গৃহীত। বরাহমিহিরের সময়কাল খ্রিস্ট্রীয় ষষ্ঠ শতাব্দী। অর্থাৎ, বাৎস্যায়ন যেহেতু বরাহমিহিরের পূর্বে তাঁর গ্রন্থ রচনা করেন, সেইহেতু তিনি প্রথম থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে বিদ্যমান ছিলেন।
বাৎস্যায়ন ছিলেন কোনো ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের সন্তান। কেউ কেউ মনে করেন তাঁর বাল্যকাল কেটেছিল এক গণিকালয়ে, যেখানে তাঁর প্রিয় মাসি কাজ করতেন। এখান থেকেই তিনি কামকলা সংক্রান্ত প্রথম জ্ঞান লাভ করেছিলেন। বাৎস্যায়নের কামসূত্রম পাঠ করলে বোঝা যায়, ওইরূপ কামবিলাসসম্পন্ন পুরুষ ও নারীদের যুগে তাঁর আবির্ভাব হয়েছিল। কোথায় এবং কোন্ দেশে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন তাঁর ঐতিহাসিক বৃত্তান্ত বিশেষ পাওয়া যায় না। তবে মনে হয়, তিনি গুপ্ত সম্রাটদের সময়েই আবির্ভূত হয়েছিলেন। এই গুপ্ত সম্রাটদের সময়েই মহাকবি কালিদাস, জ্যোতির্বিদ বরাহ মিহির ইত্যাদি মনীষা সম্পন্ন ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাৎস্যায়নের সাহিত্যের মতো তাঁদের সাহিত্যে ও অনেক অধুনা সমাজ বিরুদ্ধ ও তথা কথিত বর্তমান ‘অশ্লীল’ আখ্যা বিশিষ্ট কবিতা ও লেখা দেখতে পাওয়া যায়। নাট্যলেখক শূদ্রক রাজা ও ওই সময়ে তাঁর ‘মৃচ্ছকটিক’ নামে সংস্কৃত নাটক লেখেন। তবে অনেকে বলেন বাৎস্যায়ন খ্রিস্টপূর্ব যুগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কেউ কেউ বলেন খ্রিস্টজন্মের পরবর্তী যুগে তিনি জন্মগ্রহণ করেন দাক্ষিণাত্য দেশে। এ বিষয়ে অনেক মতানৈক্য আছে। তবে আমরা একথা অনেকটা বিশ্বাস করি যে, মহর্ষি বাৎস্যায়ন গুপ্তরাজাদের সময়কালেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বহুদেশ বিদেশ ঘুরে যৌনক্রিয়ার বিভিন্ন প্রচলন দেখে জ্ঞান লাভ করে কামসূত্রম’ নামে গ্রন্থটি রচনা করেন।
পুরাণ মতে, মহাদেবের অনুচর নন্দী হর-পার্বতীর কথোপকথন শুনে রচনা করেন রতিশাস্ত্র। মহর্ষি উদ্দালকের পুত্র শ্বেতকেতু তা থেকে একটি সুন্দর গ্রন্থ রচনা করেন। তারপর বাভ্রব্য নামে উত্তর ভারতের একজন ঋষি তাঁকে সুন্দর ভাবে ১৫০ টি পরিচ্ছেদে ভাগ করে তা বিশ্লেষণ করেন। বাব্যের এই পুস্তক সারা বিশ্বের পণ্ডিত ও লেখক সমাজে বিশেষ প্রশংসা লাভ করে। গ্রন্থটির বিভিন্ন অধ্যায়কে আরও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে ভারতের ঋষিরা বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেন—(১) চারায়ণ লেখেন সাধারণ কাম বিচার’। (২) সুবর্ণাভ লেখেন ‘যৌন কাম বিচার”। (৩) ঘোটক মুখ লেখেন যুবতী নারীর বিচার’। (৪) গোমার্দীয় লেখেন “স্বামী-স্ত্রীর সম্বন্ধের বিচার’। (৫) গণিকা পুত্র লেখেন ‘পরস্ত্রী গমন বিচার’! (৬) দত্তক লেখেন ‘পতিতাদের কাম বিচার’। (৭) কুচুমার লেখেন ‘দেহ সৌন্দর্য ও যৌনিক বৃদ্ধির উপায় বিচার’। কিন্তু এইসব গ্রন্থ প্রত্যেকটি উৎকৃষ্ট হলেও পরস্পর বিচ্ছিন্ন ছিল বলে মানুষের মনকে তা আকর্ষণ করতে পারেনি। তাই ঋষি বাৎস্যায়ন এই শাস্ত্র একত্রিত করে তার “কামসূত্রম’ নামক গ্রন্থটি রচনা করলেন। এই গ্রন্থে তিনি বিভিন্ন ভাগে সব রকম কাম উদ্রেকের তত্ত্ব বিষয়ে সুন্দর ভাষায় ও স্পষ্ট করে আলোচনা করেছেন।
বাৎস্যায়নের মতে কামের পথে প্রকৃতই অগ্রসর হতে হলে নারী বা পুরুষ উভয়ের কতকগুলি কলাবিদ্যা শিক্ষা করা উচিত। মোট চৌষট্টি কলা বাৎস্যায়ন দেখিয়ে গেছেন। এইসব কলায় একজন মানুষ হয়তো শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারে না, তবে কয়েকটি কলায় সে ব্যুৎপত্তি লাভ করতে পারে। আর কলা ছাড়া জীবন ও কাম কিছুই। মধুময় হতে পারে না।
কোনো কোনো ভারতীয় দার্শনিক ‘পুরুষার্থ’ নামক জীবনের চার উদ্দেশ্যের কথা বলেছেন—(১) ধর্ম : ধার্মিক জীবন, (২) অর্থ : আর্থিক সমৃদ্ধি, (৩) কাম : নান্দনিক ও যৌন আনন্দ লাভ ও (৪) মোক্ষ : আধ্যাত্মিক মুক্তি। ধর্ম, অর্থ ও কাম দৈনন্দিন জীবনের লক্ষ্য। কিন্তু মোক্ষ জন্ম ও পুনর্জন্মের চক্র থেকে মুক্তিলাভ। কামসূত্রম গ্রন্থে লিখেছেন–“ধর্ম অর্থ অপেক্ষা শ্রেয়, অর্থ কাম অপেক্ষা শ্রেয়। কিন্তু অর্থই রাজার জীবনে প্রথম উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। কারণ কেবল ইহা হতেই প্রজাগণ জীবনধারণ করিবেন। পুনরপি, কাম বেশ্যাদিগের উপার্জনপথ এবং তাঁহারা অন্য দুই অপেক্ষা ইহাকেই বাছিয়া লয়। ইহা সাধারণ নিয়মের ব্যতয়।” এই গ্রন্থের একটি অংশের উপজীব্য বিষয় হল যৌনতা সংক্রান্ত ব্যাবহারিক উপদেশ। গ্রন্থটি মূলত গদ্যে লিখিত। তবে অনুষ্টুপ ছন্দে রচিত অনেক পদ্যাংশ এতে সন্নিবেশিত হয়েছে। ‘কাম’ শব্দের অর্থ ইন্দ্রিয়সুখ বা যৌন আনন্দ। অপরদিকে ‘সূত্র’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ সুতো বা যা একাধিক বস্তুকে সূত্রবদ্ধ রাখে। কামসূত্র’ শব্দটির অর্থ তাই পুস্তকের আকারে এই জাতীয় উপদেশমালার গ্রন্থনা। এতে রমণীদের জন্য প্রযোজ্য চৌষট্টি কলা বিবৃত হয়েছে।
মল্লনাগ বাৎস্যায়ন রচিত কামসূত্র গ্রন্থে ৭ ভাগে বিভক্ত ৩৬টি অধ্যায়ে মোট ১২৫০টি শ্লোক রয়েছে—১. সাধারণম্ (ভূমিকা) শাস্ত্রসংগ্রহ (গ্রন্থের উপাদান সংক্রান্ত অধ্যায়সমূহ), ত্রিবর্গপ্রতিপত্তি (জীবনের তিন লক্ষ্য), বিদ্যাসমুদ্দেশ (জ্ঞান লাভ), নাগরকবৃত্তম (সুনাগরিকের আচরণ), নায়কসহায়দূতীকর্মবিমর্শ (নায়কের সহায়তায় দৌত্যকর্ম সংক্রান্ত অধ্যায়) ২. কন্যাসযুক্তকম (পত্নীলাভ) বর্ণসম্বিধানম সম্বন্ধনিশ্চয় চ (বিবাহের ধরন), কন্যাবিস্ৰম্ভণম (পত্নীকে শান্ত করণ), বালায়াম উপক্ৰমা ইঙ্গিতাকারসূচনম চ (পত্নীলাভ), একপুরুষাভিয়োগা (একক ব্যবস্থাপন), বিবাহ দ্বারা সম্মিলন ৩. ভার্যাধিকারিকম (পত্নী সম্পর্কে) একচারিণীবৃত্তম প্রবাসচার্য চ (এক পত্নী সংক্রান্ত), প্রধানা পত্নী ও অন্যান্য পত্নী সংক্রান্ত ৪. বৈশিকম (গণিকা) সহায়গম্যাগম্যচিন্তা গমনকারণং গম্যোপাবর্তনম (প্রণয়ী নির্বাচন সংক্রান্ত উপদেশ), কান্তানুবৃত্তম (স্থায়ী প্রণয়িনীর অনুসন্ধান), অর্থাগমোপায়া বিরক্তলিঙ্গানি বিরক্তপ্রতিপত্তির নিষ্কাসনক্রম (অর্থোপার্জন), বিশীর্ণপ্রতিসন্ধানম (পুরাতন প্রণয়ীর সহিত পুনরায় বন্ধুত্বকরণ), লাভবিশেষা (লাভ বিশেষ), অর্থানর্থবন্ধসংশয়বিচারা বেশ্যাবিশেষশ্চ (লাভ ও ক্ষতি) ৫. পারদারিকম (অন্যান্য পত্নী সংক্রান্ত) স্ত্রীপুরুষশীলবষ্ঠাপনম ব্যবৰ্তনকারণাণি স্ত্রী সিদ্ধা পুরুষা অযত্নসাধ্য যোষিত (স্ত্রী ও পুরুষের আচরণ), পরিচয়কারণায় অভিযোগ (পরিচিত হওয়া), ভাবপরীক্ষা (ভাবপরীক্ষা করণ), দূতীকর্মাণি (দৌত্য), ঈশ্বরকামিতম (রাজসুখ), অন্তঃপুরিকং দাররক্ষিতকম (অন্দরমহল) ৬. সংপ্রয়োগিকম (যৌন মিলন) প্রমাণকালভবেভয়ো রত অবস্থাপনম (কামনা উদ্দীপ্তকরণ), আলিঙ্গনবিকারা (আলিঙ্গন), চুম্বনবিকল্পাস (চুম্বন), আদর, দশনচ্ছেদ্যবিহায়ো (দংশন), সম্বেশনপ্রকারাশ্চিতররতানি (স্ত্রীপুরুষের দৈহিক মিলন), প্রহণনপ্রয়োগাস তক্তাশ শীৎকৃতক্রম (শীৎকারাদি), পুরুষোপসৃপতানি পুরুষায়িতম (নারীর পুরুষোচিত আচরণ), ঔপরিষ্ঠকম (মৌখিক যৌনাচার), রত অরম্ভ অবসানিকম রত বিশেষ প্রণয়কলহশ্চ (কামকেলির বিবরণী) (১০ অধ্যায়) ৭. ঔপনিষদিকম (বশীকরণ) সুভগংকারণম বশীকরণম বৃষ্যাশ্চ যোগা (শারীরিক আকর্ষণের উন্নতি করণ), নষ্টরাগপ্রত্যানয়নম বৃদ্ধিবিধায়শ্চরিতাশ্চ যোগা (হ্রাসপ্রাপ্ত যৌনক্ষমতা পুনরায় বৃদ্ধিকরণ)
কামসূত্ৰমের ‘বৈশিক’ নামে একটি বিস্তৃত অধিকরণে প্রাচীনকালে ভারতীয় গণিকাদের জীবনযাত্রার একটি সুস্পষ্ট এবং সম্পূর্ণ বিবরণ পাওয়া যায়। এই বিবরণ থেকেই সাধারণের মনে গণিকাদের সম্পর্কে যে অবজ্ঞা, ঘৃণা এবং অশ্রদ্ধার বিরূপ ধারণা আছে বাৎস্যায়নের উল্লিখিত গণিকাদের জীবনযাত্রার বর্ণনা হৃদয়ঙ্গম করলেই সেই বদ্ধমূল ধারণার বদল হতে পারে।
বাৎস্যায়ন গণিকাদের পরিচয় দিতে গিয়ে কামসূত্ৰমের চতুর্থ অধিকরণের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম শ্লোকে বলেছেন–“বেশ্যানাং পুরুষাধিগমে রতির্বৃত্তিশ্চ সৰ্গাৎ”। অর্থাৎ “গণিকাদের পুরুষ-ধরা বিদ্যা এবং অর্থ উপার্জন সেই সৃষ্টির আদিকাল থেকে চলে আসছে”। দ্বিতীয় শ্লোকে বলেছেন–“রতিতঃ প্রবর্তনং স্বাভাবিকং কৃত্রিমমর্থার্থম্”। অর্থাৎ রুচি হল রতির প্রতিশব্দ। রুচি থেকে যে পুরুষ গ্রহণে প্রবৃত্তি সেটা স্বাভাবিক, আর তা থেকে গণিকাদের যে অর্থোপার্জন প্রবৃত্তি সেটা কৃত্রিম”। এবার গণিকাদের উদ্দেশে তৃতীয় শ্লোকটি পড়ুন–“তদপি স্বাভাবিকবপরেৎ কামপরাসু হি পুংসাং বিশ্বাসযোগাৎ”। অর্থাৎ “তুমি যে পুরুষের কাছে ছল করছ, সেটা যেন বুঝতে না পারে। এমন ভাব দেখাবে যে তুমি তাকে ভালোবাসো, তাঁর অনুরাগিণী–এরকম হলে পুরুষ তোমার হাতের মুঠোয় এসে যাবে”। ষষ্ঠ শ্লোকে বলা হয়েছে–“ন চানুপায়েনার্থান সাধয়েদায়তিসংরক্ষণার্থ”। অর্থাৎ, “পুরুষের কাছে অর্থ উপার্জন করবে, কিন্তু খুব কৌশলে”।
এই পরামর্শই বুঝিয়ে দেয় গণিকাবৃত্তির বৈধতা ছিল, নিন্দনীয় নয়। বাৎস্যায়ন পইপই করে বলে দিয়েছেন কোন্ ধরনের পুরুষ একজন গণিকার কাছে চরম কাম্য হওয়া আবশ্যক। অর্থাৎ সাদা বাংলায় গণিকারা কোন্ ধরনের পুরুষদের সঙ্গ দিলে মোটা টাকা মিলবে। তৎকালীন সময়ে গণিকারা প্রভাবশালী ও ধনীদেরই শয্যাসঙ্গিনী হতেন। এখনও এমন এক গণিকাশ্রেণি আছেন, যাঁরা কেবলমাত্র প্রভাবশালী ও ধনীদের বিলাসবহুল কক্ষে শয্যাসঙ্গিনী হন মোটা অর্থের বিনিময়ে। তবে তা খুব সংগোপনে।
যাই হোক, দেখা যাক বাৎস্যায়ন গণিকাদের কেমন শয্যাসঙ্গী পছন্দ করতে বলেছেন। যেমন–(১) ধনী তো হতেই হবে, সেইসঙ্গে পুরুষটিকে স্বাধীন হতে হবে। অর্থাৎ পিছুটান নেই এমন পুরুষ। (২) যে ব্যক্তি প্রজাদের কাছ থেকে শুল্কাদি আদায় করে। (৩) ধনীক শ্রেণির যৌন-বিকৃত বৃদ্ধ। (৪) সংঘর্ষবন, অর্থাৎ এক গণিকাকে নিয়ে দুজন ধনীর প্রতিদ্বন্দ্বীর কে কত টাকা দিয়ে তাঁকে নিতে পারে। (৫) সবসময় যাদের হাতে টাকা আসে। যেমন–সুদখোর, কুসীদজীবী ইত্যাদি (৬) যে পুরুষ দেখতে কালো কুৎসিত, অথচ নিজেকে সে রূপবান এবং রমণীরঞ্জন মনে করে।(৭) আত্মশ্লাঘার বড়াই করে এমন ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা আদায় করা খুব সহজ। (৮) ধনী, অথচ ধ্বজভঙ্গ বা নপুংসক পুরুষ বিবেচ্য। (৯) বাপ-মায়ের অনাদরের ছেলেকে আদরে ভরিয়ে দিলে প্রচুর অর্থ সমাগমের সম্ভাবনা। (১০) সঙ্গদোষে দুষ্ট বখে যাওয়া যুবক। ইত্যাদি।
কোন পুরুষের সঙ্গে গণিকারা যৌনমিলন করবে না, সে বিষয়েও পরামর্শ দিতে ভোলেননি বাৎস্যায়ন।যেমন–(১) যক্ষ্মারোগ (টিউবারকুলাইসিস) হয়েছে এমন পুরুষ। (২) কুষ্ঠরোগাক্রান্ত (লেপ্রসি) পুরুষ। (৩) যে ব্যক্তির বীর্যের সঙ্গে ক্রিমি জাতীয় একপ্রকার ক্ষুদ্র কীট (বোঝাই যাচ্ছে এখানে বিশেষ কোনো যৌনরোগের কথাই বলা হয়েছে) থাকে, যা নারীর যোনির ভিতর দিয়ে জরায়ুতে পৌঁছে নারীকে জরাগ্রস্ত করবে। (৪) কঠোর ও কর্কশভাষী। (৫) কঞ্জুষ বা কিপটে। (৬) নির্মূণ। (৭) গুরুজনের পরিত্যক্ত পুরুষ। (৮) চোর। (৯) বিশ্বাসঘাতক। (১০) যে পুরুষের মুখে দুর্গন্ধ। (১১) যে পুরুষ বশীকরণ জানে। (১২) বঞ্চক ইত্যাদি।
সব ঠিক থাকলে তবেই একজন গণিকা “বর্তমানং নিষ্পীড়িতার্থমুৎস্যজন্তী বিশীর্ণেন সহ সন্ধ্যাৎ”–একজন পুরুষের অর্থ নিঃশেষ করে ছিবড়ে করে তারপর আর-একজন অর্থবান পুরুষকে পাকড়াও করবে। (কামসূত্রম্ ৪/৩/১) বাৎস্যায়ন মনে করেন, একজন গণিকাকে বিভিন্ন রুচির যুবক এবং প্রৌঢ় ব্যক্তির সঙ্গ দিতে হবে। যদি ধনবান হয়, প্রয়োজনে বৃদ্ধের সঙ্গেও শুতে হবে অর্থলাভের তাগিদে। এমনকি গণিকাদের কামশাস্ত্রে পারদর্শিতা লাভ করতে হলে সবার আগে ৬৪ কলায় নিপুণতা লাভ করতে হবে। একটু জেনে নেওয়া যাক ৬৪ কলাগুলো কী কী–(১) কণ্ঠসংগীত। (২) যন্ত্রসঙ্গীতে পারদর্শিতা।(৩) নৃত্যকলা (৪) চিত্রাঙ্কন। (৫) কেশ সজ্জা।(৬) পুষ্পশয্যা নির্মাণ। (৭) নানাবিধ বর্ণে গৃহ সুসজ্জিতকরণ। (৮) নিজ পোশাক-পরিচ্ছদ, কেশ, নখ, দন্ত, প্রত্যক্ষ বর্ণের দ্বারা সুসজ্জিতকরণ। (৯) বর্ণাঢ্য প্রস্তর এবং ধাতব পদার্থে ঘর ও শয্যা সুশোভিত করা।(১০) ভিন্ন ভিন্ন উৎসবে বা আনন্দে শয্যা নানাভাবে আস্তরণ দেওয়া। (১১) সাঁতার ও জলকেলি। (১২) প্রিয় লোককে আকর্ষণ করার জন্য মন্ত্র-তন্ত্র অনুশীলন।(১৩) ফুল নিয়ে মালা গাঁথা ও অঙ্গাদি সুশোভিত করা। (১৪) ফুল নিয়ে মালার মুকুট ও বেষ্টন।(১৫) নিজের শোভন বেশভুষা করা—উৎসবে একপ্রকার, অন্য উৎসবে অন্য প্রকার। (১৬) চিত্তহারী প্রথায় কানের দুল পরিধান করা (১৭) সুগন্ধি দ্রব্য তৈরি করা। তৈজসপত্রাদি তৈরি সম্পর্কে শিক্ষা করা। (১৮) নতুন ভূষণ তৈরি বা পুরানো বিভিন্ন ধরনের অলংকার নতুন করে গড়া (১৯) অতিথিচর্যা (২০) পরিচ্ছদ রচনার সুচারুতা। (২১) হাতের কাজ।(২২) রন্ধনকলা। (২৩) পানীয় দ্রব্য, বিবিধ মিষ্টান্ন, আচার, চাটনি, ইত্যাদি তৈরিতে পারদর্শিতা। (২৪) সেলাই ও দেহের বস্ত্রাবরণ করতে সুদক্ষতা। (২৫) বস্ত্রখণ্ড ও সুতো দিয়ে পাখি, পাতা, ফুল ইত্যাদি তৈরি করা। (২৬) বীণা ও ডমরুর শব্দ অনুকরণ। (২৭) নানাবিধ হেঁয়ালিপূর্ণ আচরণ।(২৮) তাৎক্ষণিক কাব্যরচনা ও আবৃত্তি। (২৯) কঠিন অর্থপূর্ণ দুরূহ শব্দের অর্থ নিরূপণ করা। (৩০) সুমধুর কণ্ঠে শাস্ত্রীয় শ্লোক আবৃত্তি। (৩১) নাটক, অভিনয়, দর্শন ও নাটকের বিভিন্ন চরিত্রের প্রকৃত সমালোচনা। (৩২) কোনো কবিতার হারানো পঙক্তির পুনরুদ্ধার করা বা তা পুনরায় নতুন করে লেখা। (৩৩) বেত বা তৃণ থেকে নানাবিধ নতুন নতুন আসবাবপত্র রচনা বা বোনা। (৩৪) কাঠ থেকে কুঁদে ছবি বা দৃশ্য রচনা। (৩৫) কাঠমিস্ত্রির কাজ, এবং বাড়িঘর নির্মাণ। (৩৬) সোনা, রূপা ও দামি পাথর বসিয়ে নানা কাজ করা। (৩৭) রসায়ন বা ধাতব শাস্ত্র অধ্যয়ন। (৩৮) উজ্জ্বল পাথর ও দামি ধাতুর বস্তু রচনা। (৩৯) কানন রচনা ও পুষ্পবিন্যাস। (৪০) ভেড়া, মোরগ এবং পায়রাদের নিয়ে কৌতুকপূর্ণ খেলা করার উৎসাহ দান। (৪১) শুক, ময়না প্রভৃতি পাখিকে কথা শেখানো ও তাদের দিয়ে মজাদার কাজ করানো। (৪২) গাত্র মর্দন করতে শেখা, বেশভূষা রচনা করা, কাজের শিল্প শিক্ষা করা। (৪৩) সংবাদ প্রাপ্তির নমুনাস্বরূপ আঙ্গুলের দাগ বোঝা।(৪৪) গুপ্ত সংকেত শেখা ও ব্যবহার। (৪৫) বিভিন্ন দেশের লিখিত ভাষা ও কথাবার্তা বোঝ। (৪৬) ঘোড়া, হাতি ও যানবাহন সুসজ্জিত করা। (৪৭) সংকেত চিহ্ন বা গুপ্ত বার্তা বোঝা (৪৮) নানা ধরনের যন্ত্রে জ্ঞানলাভ করা। (৪৯) স্মৃতিশক্তি বা স্মরণশক্তি বৃদ্ধি করার অভ্যাস। (৫০) নানাবিধ পুস্তক পাঠ। (৫১) নানাবিধ পুস্তক রচনা। (৫২) অভিধান ও বিশ্বকোশ সংগ্রহ।(৫৩) ছন্দের নিয়ম এবং বক্তৃতা শিল্প শিক্ষা। (৫৪) লুকানোর শিল্প, তুলো রচিত দ্রব্যকে পশমরূপে রূপদান, সাধারণ দ্রব্যকে চিত্তাকর্ষক করে তোলা। নানা বস্ত্র পরিধান করা। (৫৫) দাবা খেলা ও পাশা খেলায় দক্ষতা (৫৬) বস্ত্র পরিচ্ছদ পরিধান করে নিজেকে অন্যের চোখে আকর্ষণীয় করে তোলা। (৫৭) শিশুদের মতো পুতুল ও গোলাকার সব বস্তু নিয়ে খেলা করা।(৫৮) নানা প্রকার শারীরিক ব্যায়াম ও কলাকৌশল শিক্ষা করা।(৫৯) রাজনীতি শিক্ষা করা।(৬০) সামরিক রীতিনীতি সম্পর্কে জ্ঞান (৬১) মুখ দেখে মানুষের চরিত্র আন্দাজকরণ।(৬২) কৃত্রিম পুষ্প তৈরি ৷(৬৩) কাদা বা নরম মাটি দিয়ে পুতুল, মূর্তি নির্মাণ (৬৪) গণিত বিষয়ে জ্ঞান লাভ।
বাৎস্যায়ন চৌষট্টি বা চতুঃষষ্টি কলায় সুশিক্ষিত গণিকাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন–“আভিরভূচ্ছিতা বেশ্যা শীলরূপগুণান্বিতা।/লভতে গণিকাশব্দং স্থানঞ্চ জনসংসদি৷৷” বাৎস্যায়নের সময় গণিকাদের বিয়ের মধ্যে এক অভিনব ব্যাপার ছিল। আর পাঁচটা সাধারণ মেয়েদের মতো তাঁরাও বিয়ে-থা, সন্তান জন্মদান, ঘর-সংসার করতে পারত। তবে কোনো গণিকাকেই বিয়ের পর পুরোনো গণিকাবৃত্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ করত না। অবশ্য বিয়ের পর প্রথম একটা বছর স্বামী ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে যৌনমিলন করা নিষিদ্ধ ছিল। বিয়ের এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর গণিকাবৃত্তিতে আর কোনো বাধা ছিল না। তবে সেক্ষেত্রে শর্ত একটাই–এক বছর পর স্বামী যে রাতে তাঁকে যৌনমিলনের তাগিদে বিছানায় আহ্বান করবে সেই মুহূর্তে শত খরিদ্দার ত্যাগ করেও সেই রাতে তাঁকে স্বামীর সঙ্গে যৌনমিলনে লিপ্ত হতে হবে (কামসূত্রম্ ৭/১/২২)। বাৎস্যায়ন শেষ করব গণিকাদের একটি বিপজ্জনক অপকর্ম দিয়ে। এইসব গণিকারা চতুরতার সাহায্যে মাঝমধ্যেই শাঁসালো ধনীর ছেলে খুঁজে তাঁর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করত। কীসের ক্ষতিপূরণ? গণিকারা তাঁর কোনো সখি বা দাসীর সাহায্যে তাঁর অক্ষতযোনি কন্যার যোনিদেশে সীসা-লৌহাদি নির্মিত কৃত্রিম লিঙ্গ প্রবেশ করিয়ে সতীচ্ছদ ছিন্ন করে ক্ষতের সৃষ্টি করত। এরপর ওই যযানি-বিধ্বস্ত মেয়েকে পাখি-পড়া পড়িয়ে মুখিয়ার দরবারে কিংবা বিচারালয়ে পূর্বে নির্দিষ্ট যুবকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করত এবং বেশ মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ আদায় করে নিত (কামসূত্রম্ ৭/১/২০)।
বাৎস্যায়নের সময়ে সমাজের বিদ্বান ব্যক্তিরা দলে দলে গণিকালয়ে আড্ডা জমাতেন। শুধু মুখে আচ্ছা নিশ্চয় হত না। নারী থাকবে, অথচ সুরা থাকবে না তা কি কখনো হয়! অতএব ঢালাও মদের ব্যবস্থাও ছিল সেই আড্ডায়। কত ধরনের মদের সমাবেশ ঘটানো হত, তার তালিকাও বাৎস্যায়ন উল্লেখ করেছেন। বাৎস্যায়ন এটাও প্রমাণ করে দিয়েছেন, অন্য বৃত্তিধারী বা পেশাদার মানুষরা যেমন বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে থাকে, ঠিক তেমনই গণিকারাও নিজের বৃত্তি বা পেশায় টিকে থাকার জন্য নানারকম কৌশল অবলম্বন করে থাকত। আর পাঁচটা বিক্রেতাদের খরিদ্দার ধরে রাখার মতো গণিকারাও পুরুষ ধরে রাখার চেষ্টা করতেন, ধরে রাখার বিদ্যাটাও অতি যত্নে আয়ত্ব করতে হত। বলতে দ্বিধা নেই, বাৎস্যায়ন তাঁর ‘কামশাস্ত্রম’ রচনা করেছিলেন মূলত গণিকাদের জন্যেই। গণিকারা যাতে উৎকৃষ্ট ও সুখদায়ক কামকলা প্রদর্শন করতে পারে সেই শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যেই কামসূত্র। গণিকাদের যৌনক্রিয়ার পারদর্শিনী করে তুলতেই এই আকর গ্রন্থ।
০৬. প্রাচীন সাহিত্যে গণিকা
আগেই বলেছি সংস্কৃত সাহিত্যের বিভিন্ন সমাজে দেবতা ও মানুষের সঙ্গে সঙ্গে গণিকাদের সঙ্গেও সহাবস্থানের প্রমাণ মেলে।এই সময়কালে গণিকারা সাধারণের চোখে মোটেই ঘৃণিত ছিলেন না, বরং মর্যাদার সঙ্গে তাঁরা জীবিকা নির্বাহ ও জীবনযাপন করতেন। প্রাচীন ভারতে ভারতের নাগরিক জীবনে গণিকারা বেশ গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছিল। মোটের উপর প্রাচীন ভারতের সামাজিক জীবনে যে গণিকাদের গৌরবময় ও মর্যাদাপূর্ণ স্থান ছিল তা তৎকালীন সাহিত্যই প্রমাণ দেয়। সেসময়ে গণিকাদের ডাক পড়ত উৎসব-অনুষ্ঠানেও। কারণ সেই সময়ের মানুষ মনে করত গণিকা-দর্শনে দিন ভালো যায়। এঁরা সৈন্যবাহিনীরও অনুচারিণী হত। ভিনদেশীয় কোনো রাজা এলে নগরের বাইরে গিয়ে গণিকারা তাঁদের অভ্যর্থনা করত। সংস্কৃত সাহিত্যের পাতায় পাতায় প্রচুর গণিকাদের বিবরণ পাওয়া গেলেও তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন প্রসিদ্ধ ও সমাদৃত ছিল। কয়েকজনের নাম উল্লেখ করতে পারি–বসন্তসেনা, বাসবদত্তা, শ্যামা, আম্রপালী প্রমুখ। প্রাচীন সাহিত্যের এইসব গণিকারা সুদীর্ঘকাল অতিক্রম করে একেবারে হাল আমলের সাহিত্যে জায়গা করে নিয়েছে। গণিকাদের বিচরণক্ষেত্র একালের মতো সেকালে শুধুমাত্র কামুক পুরুষদের জন্য ছিল না। বরং রাজ-সমীপে বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে বেঁচেবর্তে থাকত।
মহাকবি কালিদাসের মহাকাব্যগুলিতে গণিকাদের উল্লেখ আছে। মেঘদূতে আমরা গণিকাদের কথা জানতে পারি। বিক্রমোঝশীয়ম্ নাটকে মহাকবি যে উর্বশীকে নায়িকা করেছেন তিনি একজন বহুভোগ্যা গণিকারমণী। অবশ্যই উর্বশী ছিলেন তথাকথিত ‘স্বৰ্গবেশ্যা’। “নীচৈরাখ্যং গিরিমধিবসেস্তত্র বিশ্রামহেতোস্তৃৎসম্পকাৎ পুলকিতমিব প্রৌঢ় পুষ্পৈঃ কদম্বৈ/যঃ পণ্য স্ত্রী রতিপরিমলোদগারিভিৰ্মাগরানামুদ্দামানি প্ৰথয়তি শিলাবেশ্মভিযোবনানি (মেঘদূতম্, পূর্বমেঘ, ২৫)। শুধু কালিদাস কেন, বিশাখদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস গ্রন্থ থেকে জানা যায়–সেকালের গণিকাদের সঙ্গে রাজা ও সাধারণ মানুষের সম্পর্ক কাহিনি। সেকালের গণিকারা নানা বসনভূষণে অলংকৃত হয়ে রাজপথে কীভাবে শোভাবর্ধন করতেন, তারও উল্লেখ আছে। সপ্তম শতকের লেখক বাণভট্ট তাঁর কাদম্বরী গ্রন্থে লিখেছেন–সেকালে গণিকারা দেশের রাজাদের স্নান করাত। রাজাদের মাথায় আমলকী ঘষে দিত। স্নানের পর রাজাদের সারা শরীরে চন্দন, আতর, কুমকুম ইত্যাদি মাখিয়ে দিত। এমনকি রাজাদের পরনের যাবতীয় পোশাক গণিকারাই পরিয়ে দিতেন। নবম শতকে রচিত ‘কুট্টনীমত’ গ্রন্থে দামোদরগুপ্ত লিখেছেন–সেকালের বারাণসী নগরীতে মালতী নামে গণিকা বাস করত। সেই নারী গণিকা সংক্রান্ত নানা প্রয়োজনীয় উপদেশ নিতে বিকরবালা নামের এক বৃদ্ধা গণিকার কাছে যেতেন। কুট্টনীমত’ গ্রন্থটির উপজীব্যই হল সেই বৃদ্ধা গণিকার বিবৃত যৌনক্রিয়া সংক্রান্ত উপদেশাবলি। শ্রীধরদাস তাঁর ‘সদুক্তিৰ্ণামৃত’ গ্রন্থে তৎকালীন বঙ্গদেশের গণিকাদের বিবরণ দিয়েছেন। এখানে ‘তকালীন’ বলতে দ্বাদশ শতক বুঝতে হবে। শ্রীধরদাস বলেছেন–“বেশঃ কেষাং ন হরতি মনো বঙ্গ বারাঙ্গনানা”। ভবভূতির মালতীমাধব’ গ্রন্থে ব্রাহ্মণ মাধব সিংহলে বাণিজ্য করে প্রভূত সম্পদশালী হন। এরপর কুবলয়াবলি নামের এক সুন্দরী গণিকার প্রেমে পড়ে যান এবং যথারীতি যৌনমিলন কার্ব সম্পন্ন করেন। ব্রাহ্মণের মোহাবিষ্টতার সুযোগ নিয়ে সেই গণিকারমণী তাঁর সমস্ত সম্পত্তি হরণ করে চম্পট দেয়। পরে অবশ্য কুবলয়াবলিকে পাকড়াও করে এবং তাঁর নাক-কান কর্তন করে ছেড়ে দেন। এটাই মালতীমাধবের বিষয়। চারুদত্ত’ গ্রন্থে লেখক ভাসের কাহিনির উপজীব্য হল চারুদত্ত ও বসন্তসেনার প্রেম। বসন্তসেনা হলেন একজন গণিকা, যাঁর বিয়ে হয় চারুদত্ত নামের জনৈক ব্রাহ্মণ যুবকের সঙ্গে।এছাড়া শর্বিলক নামে এক ব্রাহ্মণের সঙ্গে মদনিকা নামে এক গণিকার বিয়ের কাহিনিও আছে।
জবালা এক বহুচারিণী বা গণিকার নাম। সামবেদীয় ছান্দোগ্য উপনিষদ থেকে জানতে পাই জবালা ও সত্যকামের কাহিনি। সত্যকাম জানতেন না তাঁর পিতৃপরিচয়। পিতৃপরিচয় নেই বলে সত্যকাম কোনো গুরুগৃহে বিদ্যাশিক্ষার জন্য যেতে পারতেন না। বহুচারিণী জবালাও খুব স্বাভাবিকভাবেই জানতেন সত্যকামের প্রকৃত পিতা কে। পরে অবশ্য সত্যকামের বিদ্যাশিক্ষার উপর আগ্রহ অনুভব করে গুরু গৌতম শিক্ষাদান করেছিলেন। বেদের যুগেও আমরা গণিকাদের পাচ্ছি। ঋকবেদে গণিকাদের বলা হত ‘জারিণী” “হপ্তাশ্চ বভ্রবো বাচমত এমদেং নিষ্কৃতং জারিণী” (অর্থাৎ ভ্ৰষ্টা নারী উপপতির নিকট গমন করে)। ঋকবেদে গণিকাদের ‘দিধিষু’ ও ‘সাধারণী’ বলা হয়েছে। অথর্ব বেদে বলা হয়েছে মহানগ্নী’, ‘পুংশ্চলী’। তবে একথা বলতেই হয়, তৎকালীন বৈদিক সাহিত্যে গণিকাদের বিষয়ে সরাসরি কোনো আলোচনা না-হলেও এটা অনুমান করা যায় যে, তৎকালীন সমাজে গণিকাদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য।
বেদের যুগে গণিকা ও গণিকাবৃত্তি মহত্বপূর্ণ হলেও মনুসংহিতার যুগে এসে নিন্দিত হয়েছে। স্মৃতিকারেরা প্রবঞ্চক, জুয়ারী, তস্করদের সঙ্গে গণিকাদের একাসনে বসিয়ে দিয়েছেন। মনু স্পষ্টভাবে বলেছেন–ব্রাহ্মণ কিংবা গৃহস্থ ব্যক্তির পক্ষে গণিকাদের কাছ থেকে কোনো দান অথবা ভক্ষদ্রব্য গ্রহণ করা দূষণীর। ব্রাহ্মণ কখনোই গণিকাগমন করবে না। যদি যায় তাহলে তাঁকে কৃচ্ছসাধন করে পবিত্র হতে হবে। মনু বলছেন–ষড়দোষে (অধিক মদ্যপান, অসৎ পুরুষ সংসর্গ, স্বামীবিচ্ছেদ, ইতস্তত ভ্রমণ, অসময়ে নিদ্রা এবং পরগৃহে বাস) দুষ্ট রমণী ব্যভিচারিণী হয়ে থাকে (“ষট স্ত্রিয়া ব্যভিচারায়া দোষ জনকানি তস্মাদেতেভ্য এতা রক্ষণীয়াঃ”), এ থেকেই বোঝা যায় সে যুগে ব্যভিচারিণী বা গণিকার উপস্থিতি ছিল। মনু গণিকাদের অশালীন আচরণ করার অপরাধে নানা রকম শাস্তির বিধান দিয়েও গেছেন। মনুর যুগে বিশেষ কোনো গণিকার নাম উল্লেখ না থাকলেও তৎকালীন সমাজে প্রচুর গণিকার উপস্থিতি প্রমাণিত হয় স্মৃতিশাস্ত্রের বিভিন্ন উক্তি থেকে। গণিকাদের মনে করা হত মানুষের চলার পথে কণ্টক স্বরূপ (“প্রকাশলোক বঞ্চকার চাবৈর্জনীয়াৎ”)। সেই কারণেই এঁদের ধরার জন্য রাজার চরেরা ঘুরে বেড়াত। যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতায় গণিকাদের কথা জানা যায়। যাজ্ঞবন্ধ্যে গণিকাদের ‘স্বৈরিণী’ বলা হয়েছে। স্বৈরিণী হল তাঁরাই, যাঁরা স্বীয় স্বামীকে পরিত্যাগ করে ইচ্ছাপূর্বক কোনো পরপুরুষের আশ্রয় করে। যাজ্ঞবল্ক্য গণিকাদের জন্য কিছু নিয়মনীতিও ঠিক করে দিয়েছিলেন। যেমন–(১) কোনো গণিকা যদি খরিদ্দারের কাছ থেকে শুল্ক গ্রহণ করে বা অগ্রিম অর্থ নিয়ে পরে যৌনমিলনে অনিচ্ছা প্রকাশ করলে গৃহীত অর্থের দ্বিগুণ খরিদ্দার পুরুষটিকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য থাকবে। অন্যথায় গণিকার দেহদানের সমান অর্থ পুরুষটাকে ফিরিয়ে দিতে হবে–“গৃহীত বেতনা বেশ্যা নেচ্চন্তী দ্বিগুণং বহেৎ।/অগৃহীতে সমং দাপ্যঃ পুমাণপ্যেসেব চ”। (২) কোনো পুরুষ যদি গণিকাকে দেহদানের নিমিত্ত অর্থ দিয়েও তাঁর সঙ্গে যৌনসংসর্গ না-করে, তাহলে তাঁর দেয় অর্থ সেই গণিকার কাছ থেকে কোনোমতেই ফেরত পেতে পারে না–“অযৌন গচ্ছতো যেধাং পুরুষং বাপি মোহতঃ।/চতুর্বিংশতিকো দণ্ডস্তথা প্রব্রজিতাগমো”। শুধুমাত্র মনুসংহিতা বা যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতাতেই নয়, পরাপরসংহিতা ও বিষ্ণুসংহিতাতেও গণিকাগমন নিন্দনীয় গণ্য করেছে। বলা হয়েছে, গণিকাগমন হস্তমৈথুনতুল্যের মতো অপরাধ। হিন্দুধর্মে হস্তমৈথুন বা স্বমেহনকে পাপকাজ বলে অভিহিত করা হয়েছে। গৌতমসংহিতায় সর্বসাধারণের ভোগ্যা নারীকে হত্যা করলে হত্যাকারীর কোনো শাস্তি হবে না বলেছে। গণিকার অনুগ্রহণও নিষিদ্ধ, বিশেষ করে ব্রাহ্মণদের।
তা সত্ত্বেও আমরা দেখতে পাই, প্রাচীন ভারতে জীবনের অপরিহার্য অঙ্গই ছিল গণিকারা। কোনো মহৎ উৎসব অনুষ্ঠান গণিকাদের উপস্থিতি ছাড়া হতই না। রামায়ণে আমরা দেখতে পাই গণিকার লোভ দেখিয়ে বিভাণ্ডক মুনির পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গ মুনিকে অযোধ্যার যজ্ঞে আনা হয়েছে। ঋষ্যশৃঙ্গ লোকালয়ের আসা একদম পছন্দ করতেন না। যত জরুরি কাজ থাক না-কেন কখনোই তিনি লোকালয়ে আসতেন না। অতএব রাজা দশরথকে তাঁর অমাত্য সুমন্ত পরামর্শ দিলেন–“মহারাজ, মানুষ সর্বদা যা কামনা করে এবং যাতে চিত্তচাঞ্চল্য ঘটে এমন ইন্দ্রিয়-ভোগ্য জিনিস জড়ো করে ঋষ্যশৃঙ্গকে আকৃষ্ট করে অযোধ্যায় আসা বাঞ্ছনীয়”–“ইন্দ্রিয়ার্থৈবাভমতৈৰ্ণরচিত্ত প্রমাতিথিঃ/পুরমানায়য়িষ্যামঃ ক্ষিপ্রং চাধ্যবসীবতা”। অমাত্য সুমন্ত সহাস্যে দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়েছিলেন–সেই ইন্দ্রিয়ভোগ্য জিনিস হল লাবণ্যময়ী যুবতী গণিকা। রাজা দশরথের নির্দেশে পুরোহিত ও মন্ত্রীরা অবিলম্বে সুন্দরী গণিকাদের ব্যবস্থা করলেন। আদেশানুসারে সেই সুন্দরী গণিকারা ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির আশ্রমের অভিমুখে যাত্রা করলেন। রামচন্দ্রের রাজ্যাভিষেককালেও প্রচুর গণিকাদের উপস্থিতির কথা জানতে পারি। অধিকৃত ব্যক্তিবর্গকে মুনি বশিষ্ঠ নির্দেশ দিয়েছিলেন–“মন্ত্রীগণ, সর্বত্র পতাকা উড্ডীন করে দাও। রাজপথে জলসিঞ্চন করো, যে পথে গণিকা সকল সুসজ্জিত হয়ে প্রাসাদের দ্বিতীয় কক্ষে অবস্থান করবে।” সুবৃহৎ সংস্কৃত মহাকাব্য মহাভারতেও গণিকাদের কদর ছিল। যৌন কেলেংকারীতে ভীমের হাতে মৃত্যু হয় বিরাটরাজের সেনাপতি কীচকের। সেনাপতির মৃত্যুর সুযোগ নিয়ে ত্রিগর্তের রাজা সুশর্মা কৌরবদের সাহায্য নিয়ে বিরাটরাজের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। বিরাটরাজও পাণ্ডবদের সহযোগিতায় ত্রিগর্তের রাজা সুশর্মাকে পরাজিত করেন। সেই যুদ্ধজয়ের আনন্দে বিরাটরাজ এক উৎসবের আয়োজন করেন। সেই রাজকীয় উৎসবের একেবারে পুরোধায় সুন্দরী গণিকাদের সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন বিরাটরাজ। গণিকাদেরই রণজয়ের ঘোষণা করতে আদেশ দিয়েছিলেন স্বয়ং বিরাটরাজ।
সে যুগে গণিকাদের সেনাবাহিনীর সঙ্গেও পাঠানো হত, সেনারা যাতে আমোদ-প্রমোদে সময় অতিবাহিত করতে পারে। রামচন্দ্রের স্বতন্ত্র সেনাবাহিনী, কৌরব ও পাণ্ডবদের সেনাবাহিনীতেও যথেষ্ঠ পরিমাণে গণিকা মজুত রাখা হয়েছিল। কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধকালীন সময়ে পাণ্ডব শিবিরে শত শত গণিকাদের দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল স্বয়ং ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের। এমনকি কৌরব-পাণ্ডবদের যুদ্ধের প্রাক্কালে কৃষ্ণ আসছেন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে দূতরূপে, এই সংবাদ পেয়ে ধৃতরাষ্ট্র দ্রুত নির্দেশ দিলেন–কৃষ্ণের অভ্যর্থনায় যেন কোনো ত্রুটি না হয়। অবিলম্বে হাজার হাজার গণিকাদের উত্তমোত্তর বেশভূষা পরিধান করে যেন কৃষ্ণকে আনতে যায়। অতএব স্বয়ং কৃষ্ণও গণিকাদের পেয়ে বিনোদিত হতেন। কাহিনি বিশ্লেষণে এটাই প্রমাণিত হয় যে, রামায়ণ ও মহাভারতের যুগে গণিকাবৃত্তি বিশেষ প্রসার লাভ করেছিল। মহাভারতের যুগে গণিকাদের রাজকীয় সম্মানে সম্মানিত করা হত। তাঁরা রাজাদের সবসময়ের সঙ্গী। সে সময়ে রাজারা মৃগয়ায় গেলে গণিকাদেরও যেতে হত বিনোদনের জন্যে। সেকালে গণিকাদের যে সম্মান ও মর্যাদা ছিল, সেই সম্মান ও মর্যাদা একেবারে তলানিতে।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে গণিকাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের বর্ণনা স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। আমরা এতক্ষণ যেসব গণিকাদের কথা জানলাম তাঁরা রাষ্ট্র-পৃষ্টপোষকতায় হলেও মোটামুটি স্বাধীন। কৌটিল্যের সময়ে এসে দেখতে পাচ্ছি গণিকারা কারোর অধীনে থেকে কাজ করছে। আমরা গণিকাধ্যক্ষের কথা জানতে পারছি, যাঁদের বর্তমান পরিচয় ‘মাসি’ বা ‘মক্ষীরানি’। কৌটিল্যের যুগেও বহু সংখ্যক গণিকা পিছু একজন করে। তত্ত্বাধায়ক বা গণিকাধ্যক্ষ থাকত। তাঁরাই গণিকা সংক্রান্ত নানাবিধ কাজ করত। কারা হতে পারত গণিকাধ্যক্ষ? না, এখনকার মতো বিগতযৌবনা গণিকাদের ‘মাসির মতো গণিকাধ্যক্ষ হতে পারত না। গণিকাধ্যক্ষ একটি রাজকীয় পদ। তাই গণিকাধ্যক্ষদের রীতিমতো রূপবতী, যৌবনবতী ও কলাসম্পন্না রমণী হতে হবে এবং অবশ্যই তাঁকে গণিকা বংশে উৎপন্না অথবা অগণিকা বংশেও হতে হবে। বেতন ছিল ১০০০ পণ। কৌটিল্য গণিকাদের গুণ-রূপ-কাজ অনুযায়ী ভাগও করেছেন। যেমন উত্তম শ্রেণির গণিকা, মধ্যম শ্রেণির গণিকা এবং কনিষ্ঠ শ্রেণির গণিকা। এঁরা সকলেই বেতনভুক্ত শ্রেণি। যেমন উত্তম শ্রেণির গণিকার বেতন ৩০০০ পণ, মধ্যম শ্রেণির গণিকার ২০০০ পণ এবং কনিষ্ঠ শ্রেণির গণিকার ১০০০ পণ। এই বেতন রাজা তথা রাষ্ট্র দিত।
এইসব রূপবতী গণিকাদের যৌবন হারালে কী হত? এখনকার মতোই, অন্যান্য গণিকাদের দেখভালের দায়িত্ব পালন করতেন সবেতন। বৃত্তিতে থাকতে থাকতে কোনো গণিকার মৃত্যু হলে সেই গণিকার কন্যা বা বোনের গণিকাবৃত্তির অধিকার ছিল। আর গণিকাদের গর্ভে যদি পুত্রসন্তান জন্মত, তাহলে সেই পুত্রসন্তানকে রাজার কাছে দাস হয়ে সারাজীবন কাটাতে হত। কৌটিল্যের যুগে গণিকা এবং খরিদ্দারদের জন্য শাস্তি বা দণ্ডের ব্যবস্থাও ছিল। যেমন–কোনো পুরুষ যদি কোনো গণিকার কুমারীকন্যাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনমিলন ঘটাত, সেই পুরুষের শাস্তির ব্যবস্থা ছিল। রাজ-আজ্ঞা সত্ত্বেও কোনো গণিকা যদি কোনো বিশেষ পুরুষের সঙ্গে যৌনমিলনে অনিচ্ছা প্রকাশ করত, তাহলে সেই গণিকার বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান ছিল। কোনো গণিকাকে অকারণে কোনো পুরুষ যদি হত্যা করে বা গণিকার ঘরে রাত কাটাতে গিয়ে তাঁর অলংকার চুরি করে, তখন সেই অভিযুক্ত পুরুষকে শাস্তির মুখোমুখি হতেই হত। কোনো পুরুষের কাছ থেকে আগাম পারিশ্রমিক নিয়েও যদি কোনো গণিকা যৌনমিলন না করত, সেক্ষেত্রেও বিশেষ শাস্তি ভোগ করতে হত গণিকাদের।
খ্রিস্ট্রীয় পঞ্চম শতকের মহাকবি কালিদাস তাঁর মেঘদূত কাব্যে দুই প্রকারের গণিকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে–একটি নগরনটী, অপরটি দেবদাসী। বিক্রমোর্বশীয়ম, নলোদয়, দ্বাবিংশপুত্তলিকা, ঋতুসংহারে কামুক পুরুষ ও গণিকাদের উল্লেখ আছে। দ্বাবিংশপুত্তলিকা কাব্যে মহাকবি কালিদাস মোট ৩২ জন গণিকার কথা বলেছেন। তাঁরা হলেন–মিশ্রকেশী, সুপ্রভা, ইন্দ্রসেনা, সুদতী, অনঙ্গনয়না, কুরঙ্গনয়না, লাবণ্যবতী, কমলিকা, চণ্ডিকা, বিদ্যাধরী, প্রজ্ঞাবতী, জনমোহিনী, বিদ্যাবতী, নিরুপমা, হরিমধ্যা, মদনসুন্দরী, বিলাসরসিকা, শৃঙ্গারকালিকা, মন্মথসঞ্জীবনী, রতিলীলা, মদনবতী, চিত্রলেখা, সুরতগহ্বরা, প্রিয়দর্শিনী, কামোন্মাদিনী, সুখসাগরা, শশিকলা, চন্দ্ররেখা, হংসগামিনী, কামরসিকা, উন্মাদিনী, প্রভাবতী ইত্যাদি। পাঠক, নামের ধরন দেখে বুঝে নিন এই নারীদের কাজ কী ছিল। মহাকবির লেখনীতে সরাসরি গণিকা না-বললেও নামের অর্থানুসারে অনুমান করাই যায় তাঁরা প্রত্যেকেই বারবিলাসিনী-কামনাময়ী। তবে গণিকাদের বর্ণনায় মহাকবি ছিলেন খুবই উদার। তিনি বর্ণনা দিয়েছেন–বিলাসিনীরা তাঁদের অর্থবান নাগরদের নানাভাবে গ্রীষ্মের তাপ নিবারণের আয়োজন করছে। এই সময় মেখলা শোভিত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বসনে তাঁদের নিতম্বের অংশবিশেষ দেখা যাচ্ছিল। প্রায় খোলাখুলিভাবে সুউচ্চ স্তনমণ্ডলে তাঁরা নাগরদের দেখিয়ে দেখিয়ে চন্দন মাখছিল এবং চুলে সুগন্ধি দিচ্ছিল (নিতম্ববিম্বৈঃ সদুকুলমেখলৈঃ স্তনৈঃ সহারাভরনৈ সচন্দনৈঃ।/শিরোরুহৈঃ স্নানকষায় বাসিতৈঃ স্ত্রিয়ো নিদাঘাংশময়ন্তি, কামিনা”)। কালিদাসের কাব্যে গণিকাদের গতিবিধি ছিল অবাধ। কথিত আছে, মহাকবি কালিদাস স্বয়ং ব্যক্তিগত জীবনে জনৈকা বিশিষ্ট গণিকার সঙ্গে দিনযাপন করতেন।
গুপ্তসাধনতন্ত্রে বলা হয়েছে গণিকারা শক্তিরূপে পরিগণিত হওয়ার যোগ্য। তান্ত্রিক সাধনায় এই শক্তির ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, তন্ত্রসাহিত্যের সৃষ্টি মূলত এক ধর্মীয় গোষ্ঠীকে কেন্দ্র করেই, সে ধর্মগোষ্ঠী সাধনায় সিদ্ধিলাভের জন্য মদ্য, মাংস, মৎস, মুদ্রা ও মৈথুন–এই পঞ্চ ম-কারে বিশেষ প্রাধান্য দিত। এই সাধনা চলত গণিকাদের উপর। আদিরস বা যৌনক্রিয়াকলাপ ছিল তাঁদের প্রধান উপজীব্য। গুপ্তসাধনতন্ত্রে গণিকাদের পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে—(১) রাজগণিকা বা নাগরী, এঁরা শহর বা নগরে বিচরণকারী গণিকা, (২) গুপ্তগণিকা, এঁরা সম্মানিত পরিবারে থেকে গোপনে গণিকাবৃত্তি করে। (৩) দেবগণিকা, এঁরা মন্দির বা দেবালয়ে গণিকাবৃত্তি করে। এঁদের প্রচলিত পরিচয় ‘দেবদাসী’। এঁদের বিষয়ে পরে অন্য অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। (৪) ব্ৰহ্মগণিকা, তীর্থস্থানে ঘুরে ঘুরে গণিকাবৃত্তি করেন।
ধর্মীয় সংস্কার-আচার-প্রথাও পবিত্র পতিতা’-র জন্ম দিয়েছে। লোকজীবনে দেহসাধনায় নামে যে অবাধ যৌনাচার চলে আসছে, তাতে ভণ্ড পির, কামুক সাধু কিংবা বৈরাগী-বৈষ্ণবী আখড়াও বাদ যায় না। নিরুত্তরতন্ত্রে আবার গণিকাদের ছয়ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন–(১) গুপ্তগণিকা—এঁরা সাধারণত তন্ত্রসাধক বা তান্ত্রিকদের বংশজাতা হয়। এঁরা স্বভাবে নির্লজ্জ এবং অত্যধিক কামাসক্ত হন। এঁরা পশুভাবাপন্ন পুরুষই পছন্দ করেন। (২) মহাগণিকা—এঁরা স্বেচ্ছায় শরীরের পোশাক ত্যাগ করে গোপন অঙ্গ প্রদর্শন পুরুষকে যৌনকর্মে আহ্বান করে (৩) কুলগণিকা–এঁরা স্বামীসন্তান নিয়ে সংসারধর্ম করেন এবং পাশাপাশি গণিকাবৃত্তিও করেন। (৪) রাজগণিকা—এঁরা স্বাধীনভাবে শহরের ভিতর পুরুষের সন্ধানে বিচরণ করে এবং রাজার মতোই আচরণ করে। (৫) ব্ৰহ্মগণিকা এবং (৬) মহোদয়া। এক্ষেত্রে বলা হয়েছে এইসব গণিকারা এক একটি তীর্থতুল্য। যেমন গুপ্তগণিকাদের বলা হয়েছে অযোধ্যা তীর্থতুল্য, মহাগণিকাদের বলা হয়েছে মথুরা তীর্থতুল্য, কুলগণিকাদের বলা হয়েছে মায়া তীর্থতুল্য, রাজগণিকারা দ্বারকা তীর্থতুল্য ও অবন্তী তীর্থতুল্য, ব্ৰহ্মগণিকারা দ্বারাবতী তীর্থতুল্য এবং মহোদয়া গণিকারা কালিকা তীর্থতুল্য।
নিরুত্তরতন্ত্রেই বলা বলা হয়েছে–“স্ত্রী পুংসো সঙ্গমে সৌখং জায়তে তং পরমং পদ”। অর্থাৎ, স্ত্রী ও পুরুষের যৌনমিলনে বা সঙ্গমে যে আনন্দ, তাই-ই পরমপদ বা ব্রহ্ম। সেই কারণেই তন্ত্রসাধনায় পঞ্চ ম-কারের এত আয়োজন। বলা হয়েছে–“বিনা পীত্বা সুরাং ভুক্কা মৎস্যমাংসং রজস্বলাং/যো জপে দক্ষিণাং কালীং তস্য দুঃখ পদে পদে”। অর্থাৎ, যে বিনা মদ্যপানে, বিনা মাছমাংসে, বিনা যুবতী সম্ভোগে যে দক্ষিণা কালীর আরাধনা করবে, তাঁর পদে পদে দুঃখ হবে।
ষষ্ঠ শতকের লেখক বিষ্ণুশর্মার পষ্ণতন্ত্রে বেশ কিছু কাহিনিতে তৎকালীন সময়ের গণিকাদের উল্লেখ পাওয়া যায়। আছে দেবদাসীদের কথাও। এই গ্রন্থ থেকে জানা যায় সে সময় গণিকারা প্রভূত ক্ষমতা ভোগ করত এবং প্রচুর সম্পদের অধিকারিণী ছিল। রবিচন্দ্রের অমরুশতকেও গণিকাদের কথা জানা যায়। অমরুশতকের কাহিনি ও চরিত্রের কাঠামো থেকেই অনুমিত হয় সে সময়ের গণিকাদের উপস্থিতি ছিল অবাধ। সপ্তম শতকে হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালে সভাকবি বাণভট্টের কাদম্বরী থেকে জানা যায় স্নানের পর রাজাদের গায়ে চন্দন, আতর, কুমকুম প্রভৃতি মাখিয়ে দিত গণিকারা। রাজাদের পোশাকও পরিয়ে দিতে হত। দ্বাদশ শতকের গ্রন্থ মৃন্ময়সুন্দরীকথাতে দেখি গণিকার আয়ের শতকরা পাঁচশো থেকে ত্রিশ ভাগ ছিল রাষ্ট্রের প্রাপ্য অর্থাৎ রাজস্ব। বৌদ্ধগ্রন্থে গণিকার ‘ভট্টি’ (সংস্কৃত ‘ভূতি’) অর্থাৎ বেতন এবং পরিব্বায়’ (সংস্কৃত পরিব্যয়ম) খরচের উল্লেখ পাই। মথুরার গণিকা বাসবদত্তার পারিশ্রমিকও অত্যন্ত উচ্চহারের ছিল। রাজগৃহের সালাবতী প্রতি রাত্রে একশো কার্যপণ উপার্জন করত।
শাস্ত্রের পাশাপাশি ইতিহাসের সাক্ষ্যও দুর্লভ নয়। বাংলার তাম্রশাসন আমলের লেখমালায় সংগীত ও নৃত্যপটিয়সী রাজনটী ওরফে রাজগণিকাদের পরিচয় মেলে। ধর্মীয় আচারের আড়ালেও আবার কখনো কখনো গণিকা ও গণিকাবৃত্তির জীবনযাপন করতে হয়েছে এবং হচ্ছে। এমন আধুনিক ধর্মগুরু রাম রহিম, রামপাল, স্বামী চিন্ময়ানন্দ, স্বামী নিত্যানন্দ, আশারামের নাম সবাই আজ জেনে গেছেন। কালীঘাটের পটচিত্রে গণিকাসম্ভোগের দৃশ্য আছে, অনেক মন্দিরগাত্রেও উৎকীর্ণ টেরাকোটাতেও এমন দৃশ্য বিরল নয়।
অনেকে মনে করতে পারেন, গণিকারা এমনই সহজলোভ্য পণ্য, যে অর্থ দিলেই হাতের মুঠোয়। এই চিন্তা একালের গণিকাদের প্রযোজ্য হলেও সেকালের গণিকাদের অর্থের হাতছানি করতলগত করা অতটা সহজ ছিল না। এমনই একজন গণিকার নাম হল বসন্তসেনা। হৃদয়বত্তা, ত্যাগ এবং একনিষ্ঠতার সন্ধান যদি করতে হয়, তবে বসন্তসেনাই তার ধারক ও বাহক। বোধহয় এমন মহিমময় গণিকা যুগে যুগে দ্বিতীয়টি সৃষ্টি সম্ভব নয়, যার মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠেছে একই সঙ্গে জায়া-জননী-প্রেয়সীর প্রতিরূপ। বসন্তসেনার নাম যখন উঠল, তখন। বৌদ্ধধর্মে উল্লেখিত গণিকাদের একটু খোঁজখবর নিতে পারি। বৌদ্ধধর্মের গ্রন্থগুলি থেকে আমি নয়জন গণিকার কথা জানতে পাচ্ছি–বসন্তসেনা, আম্রপালী, বাসবদত্তা, শলাবতী, অদ্ধকাশি বা অর্ধকাশি, কাশিসুন্দরী, শ্যামা, সুলসা ও কালি। আলোচনা করব। তবে তার আগে বলি রামায়ণ ও মহাভারতের রাজঃন্তপুরে গণিকাদের উপস্থিতি লক্ষ করি, ঠিক তেমনি বৌদ্ধকাহিনিতে উল্লেখিত রাজঃন্তপুরে গণিকাদের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। বৌদ্ধসাহিত্য বাত্তাক জাতক’ থেকে জানা যায়, গৌতম বুদ্ধের বিবাগি মনকে সংসারী করতে পিতা শুদ্ধোদন সুন্দরী গণিকাদের নিয়োগ করেছিল। এক কার্তিকের উৎসবে শুদ্ধোদন তাঁর পুত্রকে এক সুন্দরী গণিকার ঘরে পাঠিয়ে দেন। সেই গণিকা তাঁর হাজার ছলাকলা কলাকৌশলেও তাঁর ধ্যানভঙ্গ করতে ব্যর্থ হয় এবং তাঁকে পরিত্যাগ করে চলে যায়।
বসন্তসেনা : প্রমথ চৌধুরী তাঁর ‘বসন্তসেনা’ কবিতায় লিখছেন–“তুমি নও রত্নাবলী, কিম্বা মালবিকা, রাজোদ্যানে বৃন্তচ্যুত শুভ্র শেফালিকা।/ অনাঘ্রাত পুষ্প নও, আশ্রমবালিকা,/ বিলাসের পণ্য ছিলে, ফুলের মালিকা’রঙ্গালয় নয় তব পুষ্পের বাটিকা, অভিনয় কর নাই প্রণয়-নাটিকা।/ তব আলো ঘিরে ছিল পাপ কুঙ্কুটিকা, ধরণী জেনেছ তুমি মৃৎ-শকটিকা!/নিষ্কণ্টক ফুলশরে হওনি ব্যথিতা।/ বরেছিলে শরশয্যা, ধরায় পতিতা।/কলঙ্কিত দেহে তব সাবিত্রীর মন/সারানিশি জেগেছিল, করিয়ে প্রতীক্ষা/বিশ্বজয়ী প্রণয়ের, প্রাণ যার পণ।/ তারি বলে সহ তুমি অগ্নির পরীক্ষা!”
বসন্তসেনাকে আমরা পাই খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর নাট্যকার শূদ্রকে মৃচ্ছকটিকে। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে প্রদ্যোৎ সাম্রাজ্যের পতনকালে উজ্জয়িনী নামে একটি প্রাচীন ভারতীয় নগরের প্রেক্ষাপটে লেখা, যেখানকার রাজা ছিলেন পালক। চারুদত্ত নামের এক সম্ভ্রান্ত অথচ দরিদ্র ব্রাহ্মণ যুবককে কেন্দ্র করে, যিনি বসন্তসেনা নাম্নী এক গণিকা কর্তৃক প্রণয়াসক্ত হন। পারস্পরিক অনুরাগ সত্ত্বেও তাঁদের বাসস্থান ও ভালোবাসা দুই-ই পথে বসে সমস্থানিক নামে এক কামাতুর (বসন্তসেনার প্রতি) রাজসভাসদের চাতুর্যে। শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক নাটকে বসন্তসেনা একজন গণিকা। কিন্তু বসন্তসেনার শরীর ও মন দুইয়ের সমন্বয়ে এ নাটকে দেখানো হয়েছে। শ্ৰেষ্ঠী চারুদত্তকে ভালোবাসেন বসন্তসেনা। এই চারুদত্তের সংকটে বসন্তসেনা তাঁর সমস্ত গয়না সমর্পণ করেছেন। এটা শরীরের সম্পর্ক নয়, মনের সম্পর্ক।
আম্রপালী বা অম্বপালী : বৈশালীর রাজোদ্যান নামক স্থানে আমগাছের নিচে এক সদ্য জন্মানো মেয়ে শিশুর কান্নার আওয়াজ ওঠে। নগরের উদ্যান পালক শ্রীনাথ ও তাঁর পত্নী হরিবালা সেই শিশুকে উদ্ধার করে তাঁর ভরণপোষণের ভার গ্রহণ করেন। পালিভাষায় আমকে ‘অম্ব’ বলা হয়। আমগাছের নিচে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন বলে এই নামই রাখা হয়েছিল। আদান পালকের কন্যা বলেও তাঁর নাম হয় অম্বপালী বা আম্রপালী। পরিত্যক্ত কন্যাশিশুকে সেই দম্পতি নিজ সন্তানস্নেহে বড়ো করতে থাকেন। কিন্তু সেই বালিকা কৈশোরে পা দিতে না দিতেই নিদারুণ সমস্যায় পড়লেন বাবা ও মা। অসামান্যা সুন্দরী আম্রপালীকে নিয়ে বড় চিন্তায় পড়ে গেলেন তাঁর বাবা ও মা। আম্রপালীর রূপের আগুনে ঝাঁপ দিয়ে মরে যেতেও সুখ কামুক পুরুষরা। সবারই কাঙ্খিত নারী সে। গ্রামের মহাজন থেকে শুরু করে শহরের বণিক, জনপদের রাজা থেকে শুরু করে নগরের শ্রেষ্ঠী—কে নেই সেই তালিকায়! বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বীয় দেহের ক্রমবর্ধনশীল রূপ-যৌবনে টলটলে আম্রপালী নিয়ে যেন যুদ্ধ বেধে গেল।
বিশ্বের প্রাচীন গণতন্ত্রের মধ্যে বিখ্যাত বৈশালী। সেখানে রাজা নির্বাচিত হতেন নির্বাচনের মাধ্যমে। ছিল না পরিবারতন্ত্র, যোগ্য হলে তবেই নির্বাচিত হয়ে সিংহাসনে বসার সুযোগ মিলত। কথিত আছে, বৈশালীর এক রাজা মনুদেব হত্যা করেছিলেন আম্রপালীর বাল্যপ্রেমিক পুষ্পকুমারকে। সে রাতেই বিয়ে হওয়ার কথা ছিল আম্রপালী ও পুষ্পকুমারের। এরপর শুরু হয় তুমুল দ্বন্দ্ব, জনতার ইচ্ছার সভা বসে বৈশালী সংসদে। গণতন্ত্র বিধান দেয়, আম্রপালী কোনোদিনও বিয়ে করতে পারবেন না। কারণ এত রূপ-যৌবন নিয়ে তিনি কোনো একমাত্র পুরুষের ভোগ্যা হতে পারে না। আজব বিধান বইকি! গণতন্ত্রের শৃঙ্খলায় সেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হল। সুন্দরী হওয়ার অপরাধে আম্রপালী হয়ে গেলেন বৈশালীর গণিকা, বহু পুরুষের ভোগ্যা। আম্রপালী হলেন রাজ্যের সভানর্তকী। তিনি হলেন নৃত্যগীতে পারদর্শী, অভিজাত আদবকায়দায় রপ্ত এক সুন্দরী। সকল পুরুষ নয়, কেবলমাত্র উচ্চবংশের পুরুষই পেতে পারবে তাঁর কাছ থেকে যৌনসুখ। আম্রপালী নিজেই নিজের সঙ্গী নির্বাচন করতে পারবেন ভোগের জন্য। জেনে বিস্মৃত হবেন, গণিকা আম্রপালীকে দৃষ্টান্ত রেখে সেই আমলে বৈশালীতে নতুন একটা আইনও তৈরি হয়ে গেল। কী সেই আইন? কোনো অনিন্দ্য সুন্দরী নারী কখনো বিবাহ করতে পারবে না। তাঁকে বহু পুরুষের ভোগ্যা হয়ে যৌনানন্দ বিলিয়ে দেওয়ার জন্য উৎসর্গীকৃত হতেই হবে। তবে রাজগণিকা হওয়ার সুবাদে আম্রপালীর জন্য বরাদ্দ হয়েছিল সুবিশাল উদ্যান, মর্মর অট্টালিকা। ক্রমে আম্রপালী হয়ে উঠলেন প্রভুতা ক্ষমতার অধিকারিণী।
যাই হোক, মগধরাজ বিম্বিসার আম্রপালীর রূপের সংবাদ পেরে সেই রূপের আগুনে একটিবার ঝাঁপ দিতে চাইলেন। কিন্তু কী উপায়ে আম্রপালীকে অঙ্কশায়িনী করা সম্ভব? বৈশালী আর মগধ রাজ্যের মধ্যে তো ছিল পরস্পরের ঘোর শত্রুতা। শত্রুপক্ষের গণিকার কাছে তো আর কামাতুর হয়ে যাওয়া যায় না, আবার শত্রুরাজার কাছে নতজানুও হওয়াও যায় না। অতএব যুদ্ধ। রাজ্য ও রূপবতী গণিকা–দুইয়েরই দখল নেওয়া যাবে। মগধরাজ বিম্বিসার বৈশালী আক্রমণ করলেন ছদ্মবেশে আম্রপালীর প্রাসাদে সোজা ঢুকে গেলেন। ছদ্মবেশী সঙ্গীতজ্ঞ বিম্বিসারের গুণে আম্রপালী যেন ভেসে গেলেন। কিন্তু আম্রপালী যখন জানতে পারল এই ছদ্মবেশী বিম্বিসারই সাজানো বৈশালী তছনছ করে দিয়েছে, আম্রপালী দৃঢ়ভাবে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেন। শুধু প্রত্যাখ্যান নয়, সেইসঙ্গে বিম্বিসারকে শর্ত দিলেন তাঁকে অঙ্কশায়িনী করতে হলে বৈশালীকে মুক্ত করে দিতে হবে। আম্রপালীর অনমনীয়তায় বিম্বিসার অবশ্যই বৈশালীকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এই ব্যাপারটা বিম্বিসারের দুর্বলতা বলে ধরে নিয়েছিল শত্ৰুভূমি বৈশালীরাজ। ফলে দুই রাজ্যের দ্বন্দ্ব আটকানো সম্ভব হল না। বিম্বিসার আম্রপালীকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। কিন্তু সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন আম্রপালী। তবে বিয়ে না হলেও বিবাহ-বহির্ভূত তাঁদের এক সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। সেই সম্পর্কের জেরে তাঁদের এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। এরপর তিনি ফিরে যান নিজের রাজ্য মগধে।
বিম্বিসারের আর-এক পুত্র অজাতশত্রু পিতা বিম্বিসারকে তখন গৃহবন্দি করে সিংহাসন দখল করেন। অবশেষে গৃহবন্দি অবস্থায় বিম্বিসারের মৃত্যু ঘটে। এরপর অজাতশত্রু আক্রমণ করেছিলেন বৈশালী রাজ্য। উদ্দেশ্য দুটি–একটি হল ধন-সম্পদ লুঠ করা এবং আম্রপালীর দখল নেওয়া। অজাতশত্রু বৈশালী রাজ্যকে প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে দিলেন। এরপর আম্রপালীর প্রাসাদ দখল করে আম্রপালীকে বিয়ের প্রস্তাব। বাপের ভোগ করা নারী পুত্রেরও ভোগ্যা! না, অজাতশত্রু যখন জানতে পারলেন তাঁরই পিতার সঙ্গে আম্রপালীর সম্পর্ক ছিল এবং তাঁদের এক পুত্র সন্তান আছে, তখন রাগের বশে আম্রপালী ও তাঁর পুত্রকে গৃহবন্দি করে রাখলেন। এরপর তিনি শুরু করে দিলেন আরও লুঠতরাজ, আরও অত্যাচার। আম্রপালীর কারাগার বাদ দিয়ে গোটা বৈশালী পুড়িয়ে ছাই দিয়েছিলেন অজাতশত্রু।
অজাতশত্রু কর্তৃক বৈশালী ধ্বংস হয়ে গেলেও কিছুকাল পর বৈশালী রাজ্য পুনরায় মাথা তুলে দাঁড়ায়, পুনরায় সম্পদশালী রাজ্য হয়ে ওঠে। এই সময়ে বৈশালীতে গৌতম বুদ্ধ আসেন। সঙ্গে কয়েকশো শ্ৰমণ। আশ্রয় নেন এক নগরের উদ্যানে, নগরবাসীর গৃহে। সে সময় একদিন গৌতম বুদ্ধকে আমন্ত্রণ জানান আম্রপালী। গণিকা আম্রপালীর উদ্যানে অতিথি হয়ে তাঁর হাতে অনুগ্রহণ করেছিলেন গৌতম বুদ্ধ। এরপর একদিন আম্রপালী এক তরুণ সন্ন্যাসীকে দেখতে পেলেন। কিশোরীপ্রেম পুষ্পকুমারের পর ছদ্মবেশী বিম্বিসার, তারপর কারও রূপে মুগ্ধ হল আম্রপালী। ভাবলেন, একেই বশ করবেন। এই তরুণ সন্ন্যাসীও ছিলেন এক বৌদ্ধ শ্ৰমণ। ভিক্ষা ও আশ্রয়প্রার্থী। আম্রপালী নিজে তাঁকে ভিক্ষা দিলেন এবং তাঁর প্রাসাদে সময় অতিবাহিত করতে অনুরোধ করলেন। সন্ন্যাসী বললেন, তথাগতর আদেশ ছাড়া তিনি আশ্রয়গ্রহণ করতে পারবেন না। বুদ্ধদেবের কাছে গিয়ে অনুমতি চাইলেন তরুণ সন্ন্যাস। গৌতম বুদ্ধ অনুমতি দিলেন। এক গণিকার গৃহে থাকবেন বৌদ্ধ শ্রমণ? এই নিয়ে সঙ্ঘের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। গৌতম বুদ্ধও বিচলিত হলেন এহেন গুঞ্জনে। সমালোচকদের বললেন—ওই শ্রমণের চোখে তিনি কোনো কাম দেখেননি। অতএব শ্রমণ সময়মতোই নিষ্কলুষ হয়ে তাঁর কাছে ফিরবেন। কিছুদিন পর সময় অতিবাহিত হল। গণিকার গৃহে দীর্ঘ চারমাস কাটিয়ে সেই তরুণ সন্ন্যাসী ফিরলেন বুদ্ধের কাছে। নিষ্কলুষ শ্ৰমণ। তাঁর পিছন পিছন এলেন অসামান্য সুন্দরী আম্রপালী। আম্রপালী প্রণাম জানালেন গৌতম বুদ্ধকে। জানালেন–“তরুণ শ্রমণকে প্রলুব্ধ করতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখিনি, গণিকাবিদ্যার সব জ্ঞান প্রয়োগ করেও তাঁকে টলানো যায়নি। এই প্রথম কোনো পুরুষকে বশ করতে ব্যর্থ হয়েছি। উল্টে আমাকেই বশ করেছেন সর্বত্যাগী এই তরুণ শ্ৰমণ। আজ সর্বস্ব ত্যাগ করে তথাগত বুদ্ধর চরণে আশ্রয় চায় আম্রপালী।” কিন্তু সুন্দরী নারীর উপস্থিতিতে পাছে ভিক্ষু শ্ৰমণদের মনসংযোগ নষ্ট হয়, সেই আশঙ্কায় বুদ্ধ রাজি ছিলেন না। আম্রপালী তখন তাঁকে প্রশ্ন করেন–“বৌদ্ধ শ্ৰমণদের মনসংযোগ এতই ঠুনকো যে এক নারীর জন্য তা ভেঙে পড়বে?” একথা শুনে বুদ্ধ আম্রপালীকে সঙ্ঘে নিতে রাজি হন। আম্রপালী গৌতম বুদ্ধের ভিক্ষুণী রূপে সঘে যোগ দেন। আম্রপালী নিজের সব ধন-সম্পদ, সম্পত্তি, প্রাসাদ, উদ্যান বৌদ্ধসদ্যে দান করে দিয়েছিলেন। মোহমুক্ত হয়ে বাকি জীবন উৎসর্গ করেছিলেন বৌদ্ধসঙ্ঘে।
বাসবদত্তা : শ্ৰীমান উপগুপ্তের ব্যাবসার উন্নতি ও সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। তাঁর বিক্রয়লব্ধ দ্রব্যের গুণাগুণের কথা তথা সুসংত আচরণ, অমায়িক ও ভদ্র ব্যবহার, শীলগুণের কথাও ছড়িয়ে পড়ল। সেইসময় নগরীতে রূপের আলোয় আলোকিত করে অপেক্ষা করছিল বাসবদত্তা নামে এক যুবতী গণিকা।তিনি ছিলেন ধনী, প্রভাবশালী ও উচ্চবংশীয় পুরুষদের ভোগ্যা। গণিকা বাসবদত্তা তাঁর কলাকৌশলে, হাস্যে-লাস্যে, সুমধুর কণ্ঠস্বরে, নৃত্যের হিল্লোলে সকল পুরুষকে বিভোর করে রাখত।
মথুরার গণিকা বাসবদত্তা একদিন সুগন্ধী দ্রব্য কেনার জন্য তপতী নামের জনৈকা দাসীর কাছ থেকে জানতে পারলেন শ্রীমান উপগুপ্তের রূপ ও গুণের কথা। সে কথা শুনে বাসবদত্তা মুগ্ধ হল, উদ্বেলিত হল। মনে জাগল কামনার উদগ্র বাসনা। কামের প্রবল তাড়নায় শ্রীমান উপগুপ্তের প্রতি আকর্ষিত হতে থাকল। এ সময়ে মথুরা নগরে মদন উৎসব নামে একটি উৎসব হত। উৎসবের দিন কাছে এসে যাওয়ায় পথিকদের কর্মচাঞ্চল্যে নগর সর্বদা কোলাহল মুখর হয়ে আছে। উৎসবে যোগদান ও অংশগ্রহণ করতে প্রতি বছর উত্তরাপথের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে বহু বিদেশি (তখনকার সময়ে বিস্তীর্ণ ভারত উপমহাদেশের সব প্রদেশকে একে অপরের কাছে বিদেশি বা ভিনদেশি বলে পরিগণিত হত) মথুরার এসে সমবেত হত।
অভিজাতপল্লির এক সুউচ্চ অট্টালিকার অলিন্দ থেকে সেই জনপ্রবাহ প্রত্যক্ষ করছে বাসবদত্তা। জনতার স্রোতের ভিতর থেকে হঠাৎ এক রূপবান যুবককে দেখতে পেয়ে তিনি শিহরিত হল। প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে গেল বাসবদত্তা। সেই অভিজাত বংশজাত যুবকই হল শ্রীমান উপগুপ্ত। উত্তেজনায় থরথর বাসবদত্তা দাসী তপতীকে চিৎকায় করে ডাক দিল। তপতী হাজির হলে বাসবদত্তা বলল–“দেখেছ রাস্তা দিয়ে চলেছেন এক অসাধারণ রূপবান যুবক। নিশ্চয় ইনিই সেই যুবক যাঁর কথা তুমি বর্ণনা করেছিলে?” তপতী বলল–“তোমার রূপ বড়ই নিষ্ঠুর এই রূপ মুগ্ধ-পুরুষকে বিবশ করে দেয়। কত পুরুষই-না তোমার রূপের আগুনে দগ্ধ হওয়ার জন্য পতঙ্গের মতো ছুটে এসেছে। কত ধনকুবের তোমাকে লাভের আশায় তাঁদের ধনসম্পদ সর্বস্ব লুটিয়ে দিতে চেয়েছে। তুমি তাঁদের অনেককেই প্রত্যাখ্যান করেছ। সেই তুমি আজ কেন এই যুবকের প্রতি প্রলোভিত হচ্ছ? বলো আমায় কী করতে হবে?” বাসবদত্তা বলল–“তাঁকে জানাবে বাসবদত্তা আজ রাতের প্রথম প্রহরে প্রেমমুগ্ধ সতৃষ্ণ অন্তরে তাঁর জন্যে অপেক্ষা করে থাকবে। তিনি যেন এই নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। আরও বলবে বাসবদত্তা তাঁর প্রণয়াকাঙ্কিণী, তাঁর কাছ থেকে কোনোরূপ রজতমুদ্রার আশা করে না।”
শ্ৰীমান উপগুপ্তের কাছে এ বার্তা পৌঁছোলে তিনি মনে মনে ভাবলেন—এটা প্রলোভন। এই প্রলোভনে জড়িয়ে পড়া মানে আত্মাহুতি দেওয়া। এই আত্মাহুতি তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। বৈরীহীন নৈম্যের বিদ্যমানে শত্রুবহুল কামাসক্তিতে কী প্রয়োজন? বাসবদত্তার মতিভ্রম হয়েছে। বাসবদত্তা কামান্ধা। অতএব এহেন পরিস্থিতিতে তাঁকে উপায়-কুশলতা অবলম্বন করতে হবে। শ্রীমান উপগুপ্ত দূতী তপতীকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলেন–“এখন তাঁর সঙ্গে দেখা করার সময় নয়। উপযুক্ত সময় হলে আমি নিজেই তাঁর সঙ্গে দেখা করে নেব।” এই কথা শুনে তপতীকে বিফল মনোরথেই ফিরে যেতে হয়।
মনোবাঞ্ছা পূরণ হল না, এটা যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না বাসবদত্তা। মন অশান্ত হয়ে উঠল। রূপবান উপগুপ্তকে যে ভোলা যায় না! ধীরে ধীরে সময় অতিক্রান্ত হয়ে যায়। কিন্তু বাসবদত্তা যে একজন গণিকা। গণিকামাত্রেই দেহ-ব্যবসায়ী। দেহই তাঁর পুঁজি। উপগুপ্তকে লাভ করা গেল না তাতে কী হয়েছে! সবাই তাঁর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করবে কেন? বরং সকলে তাঁদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করবে তাঁর শরীর ভোগ করে। তাই বাসবদত্তার চাই নতুন পুরুষ। উপগুপ্তের জন্য আর অপেক্ষা না করে এক অশ্ব-ব্যবসায়ীর বাহুলগ্না হল। সেই অশ্ব-ব্যবসায়ী অগ্রিম ৫০০ স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে তাঁকে পেতে চাইল। বাসবদত্তা প্রলুব্ধ হয়ে সেই ব্যবসায়ীকে নিজগৃহে ডেকে পাঠায়। ব্যবসায়ী এলেন বটে। কিন্তু তাঁর মৃত্যু বাসবদত্তার হাতেই হল। ব্যবসায়ীর ধনরত্ন আত্মসাৎ করার লোভে তাঁকে হত্যা করে শৌচাগারে লুকিয়ে রাখে। এ খবর রাজার কানে পৌঁছে যায়। রাজা অপরাধের শাস্তিস্বরূপ বাসবদত্তার হাত-পা-নাক কেটে নগরের বাইরে শ্মশানে ফেলে আসার নির্দেশ দিলেন। মৃত্যুপথযাত্রিনী বাসবদত্তার সঙ্গে উপগুপ্তের শেষ দেখা হয়েছিল।
শলাবতী : বৌদ্ধসাহিত্যে ‘মহাবজ্ঞ’-এর এক জায়গায় শলাবতী নালী এক গণিকার কথা জানা যায়। সে রাজগৃহের প্রধানা গণিকা। যাঁর এক রাতের মূল্য ছিল ৫০০ কার্যপণ। সে একটা সময় গর্ভবতী হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় শলাবতী খরিদ্দারদের কাছে মিথ্যা কথা বললেন। বললেন–তাঁর শরীর খারাপ। কটাদিন তিনি বিশ্রাম চান। অবশেষে শলাবতীর সন্তান ভূমিষ্ঠ হল এবং সেই সন্তানকে আবর্জনার স্তূপে নিক্ষেপ করেন। সেই পতিত সন্তানকে আর-এক গণিকা আম্রপালীর পুর আভয় তাকে কুড়িয়ে নিয়ে লালনপালন করতে থাকে। পরে সেই পতিত সন্তান বড়ো হয়ে জীবক কুমারভৃত্য নাম ধারণ করে বিখ্যাত চিকিৎসক হিসাবে স্বীকৃত পেয়েছিল।
অদ্ধকাশি বা অর্ধকাশি : বৌদ্ধসাহিত্যে আর-এক গণিকা অদ্ধকাশিকেও পাচ্ছি। অদ্ধকাশি এতটাই রূপবতী ছিলেন যে সেই রূপের গর্বে তাঁর কাছে আসা পুরুষদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ দাবি করত। তাঁর গুণমুগ্ধ পুরুষের সংখ্যা প্রচুর থাকলে ক্রমশ সেই সংখ্যা কমতে থাকল অদ্ধকাশির মাত্রাতিরিক্ত দাবি মেটাতে না পেরে। আয়ও ক্রমশ কমতে কমতে অদ্ধকাশি কপর্দকহীন হয়ে পড়ল। অবশেষে শেষ আশ্রয় হিসাবে বুদ্ধের শরণাপন্ন হল।
কাশিসুন্দরী : বৌদ্ধসাহিত্য ব্ৰতীবদানমালা’-য় গণিকা কাশিসুন্দরীকে পাই। কাশিসুন্দরী প্রথম জীবনে মহারাজ অজাতশত্রুর মন্ত্রী প্রচণ্ডকে প্রত্যাখ্যান করে। প্রচণ্ডের পরিবর্তে তিনি সুবর্ণকে পছন্দ করেন। কিন্তু সুবর্ণ গণিকা কাশিসুন্দরীকে পছন্দ করে না। কাশিসুন্দরীও নাছোড়বান্দা। সুবর্ণ একথা জানতে পেরে কাশিসুন্দরীকে এমন মার মারে যে সে অজ্ঞান হয়ে যায়। অজ্ঞান কাশিসুন্দরীকে এক বিষধর সাপের কাছে ফেলে দেয়। সেই সাপের দংশনে কাশিসুন্দরীর মৃত্যু হয়। সুবর্ণর অবশ্য সেই অপরাধে রাজার আদেশে মৃত্যুদণ্ড হয়।
শ্যামা : বৌদ্ধসাহিত্যে ‘কানবের জাতক’ ও ‘মহাবস্তু অবদান’ গ্রন্থে শ্যামা নামে এক গণিকার কথা জানতে পারি। শ্যামা ছিল বারাণসীর শ্রেষ্ঠতম গণিকা। বসন্তসেনা ও বাসবদত্তাদের প্রচুর কাব্য-সাহিত্য-নাটক রচিত হলেও শ্যামা প্রায় উপেক্ষিতাই রয়ে গেছে। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গণিকা শ্যামাকে মনে রেখেছেন তাঁর রচিত নৃত্যনাট্য শ্যামা’ এবং কবিতা পরিশোধ’-এর মধ্য দিয়ে। তক্ষশীলার বজ্রসেন নামে এক ঘোড়া ব্যবসায়ী ঘোড়া বিক্রি করতে আসে বারাণসীতে। কিন্তু কপালমন্দে তাঁকে নগররক্ষীরা চোর সন্দেহে রাজার কাছে ধরে নিয়ে যায়। চুরি করার অভিযোগে রাজা বজ্রসেনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে বজ্রসেনকে বদ্ধভূমিতে নিয়ে যাওয়ার সময় গণিকা শ্যামার নজরে পড়ে যায়। রূপবান বজ্রসেনকে দর্শন করে শ্যামা মুগ্ধ হয়ে যায়। রূপবান বজ্রসেনকে যে শ্যামার চাই! মনে মনে তাঁকে যে প্রেমিক হিসাবে বরণ করে নিয়েছে। বজ্রসেনকে মুক্ত করতেই হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। নগররক্ষীদের প্রচুর ধনসম্পদ ঘুষ দিয়ে বজ্রসেনকে মুক্ত করে নিজগৃহের শয্যায় আহ্বান করে আনে। কিন্তু বজ্ৰসেন শ্যামার প্রেমের প্রতিদান দিতে পারেনি। সে যে প্রকৃতই তস্কর। শ্যামার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে প্রচুর মদ্যপান করিয়ে শ্যামার সমস্ত ধনসম্পদ লুঠ করে পালিয়ে যায়। বেহুস শ্যামাকে বারাণসীর ঘাটে ফেলে রেখে যায়। এত কিছুর পরেও বজ্রসেনের প্রতি শ্যামার প্রেমের ঘোর কাটল না। বজ্রসেনকে সে যেনতেনপ্রকারেণ কাছে পেতে চায়, উপভোগ করতে চায়। অতএব শ্যামার ঘনিষ্ঠ এক ভিক্ষুণীকে তক্ষশীলার পাঠিয়ে দেয় বজ্রসেনকে ফিরিয়ে আনতে।
সুলসা : সুলসাও বারাণসীর প্রসিদ্ধ গণিকা। গণিকা সুলসার কথা বৌদ্ধসাহিত্য ‘সুলতাজাতক’ গ্রন্থে পাওয়া যায়। সে ছিল অত্যন্ত ধনসম্পদশালিনী এবং ক্ষুরধার বুদ্ধিসম্পন্না। গণিকা সুলসা এক দস্যুর প্রেমে পড়ে যায়। কিন্তু সুলসার প্রেম-বিভোরতার সুযোগ নিয়ে সেই দস্যু তাঁকে এক পাহাড়ের উপর নিয়ে যায়। দস্যুটা ভেবেছিল সুলসাকে পাহাড়ের উপর থেকে ঠেলে ফেলে দেবে এবং তাঁর সমস্ত অলংকার হাতিয়ে নেবে। কিন্তু সুলসা টের পেয়ে যায় দস্যুর অভিপ্রায়। বাঁচার শেষ চেষ্টায় সুলতা দস্যুকে জানাল শেষবারের মতো তাঁর প্রেমিককে বুকে নিতে চায়। দস্যুও সুলসার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে রাজি হয়ে যায়। সুলসা আলিঙ্গনের ভান করে হাত বাড়িয়েই দস্যুকে ধাক্কা দিয়ে পাহাড় থেকে ফেলে দেয়।
কালি : ‘তরীয় জাতক’-এ আমরা গণিকা কালিকে পাচ্ছি। এ কাহিনি থেকে আমরা জানতে পারি তৎকালীন সমাজে গণিকাদের অন্য এক অবস্থানের কথা। এ সময়ে গণিকার প্রাপ্য যে অর্থ লাভ সে লাভ করবে তার অর্ধেকটা সে নিজে নেবে, বাকি অর্ধেকটা সে খরচ করবে রসসন্ধানী প্রেমিকদের জন্য গন্ধদ্রব্য, পোশাক, ফুলের মালা ইত্যাদির জন্য। সে পুরুষপ্রবর নিজের পোশাক খুলে গণিকার দেওয়া দ্রব্যাদি ব্যবহার করবে এবং অবশ্যই গৃহ ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় সেইসব পোশাকাদি খুলে রেখে পুনরায় নিজ পোশাকাদি পরে যেতে হবে। গণিকা কালি ধনসম্পদশালী ছিল কি না জানা না-গেলেও তাঁর ভাই তুণ্ডল্ল যে খুবই গরিব ছিল সেটা এক কাহিনি থেকে জানা যায়। তুণ্ডল্লর দারিদ্রতা ঘোচাতে গণিকা কালির দেওয়া মহার্ঘ পোশাকাদি নিয়ম ভেঙে তুণ্ডল্লকে দিয়ে দেয়। এতে গণিকা কালি যারপরনাই অপমানিত বোধ করে। কালি উচিত শিক্ষা দিতে চায় সেই প্রেমিক-পুরুষকে। প্রেমিক-পুরুষটি তুল্লকে পোশাকাদি দান করে এসে যখন নিজের পোশাক কালির কাছে কামনা করে, তখন গণিকা কালি প্রত্যাখ্যান করে এবং তাঁর ভৃত্যদের সাহায্যে সেই প্রেমিক-পুরুষকে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থাতেই ঘরের বাইরে বের করে দেয়।
আম্রপালী, বসন্তসেনা, শ্যামা, বাসবদত্তা প্রমুখ গণিকারা এমনই চারিত্রিক মহিমায় উদ্ভাসিত যে, তাঁরা একালের কবি-সাহিত্যিকের কাছে অনুপ্রেরণার বিষয়। এককথায়, প্রাচীন সাহিত্যের এই গণিকারা সুদীর্ঘকাল অতিক্রম করে একেবারে একালের আঙিনায় এসে ঠাঁই করে নিয়েছে এবং আগামী দিনেও হয়তো লেখকরা অনুপ্রাণিত হবেন নতুন সাহিত্য সৃষ্টিতে।
মোট কথা, প্রাচীন সাহিত্যে গণিকার উপস্থিতি নেই এমন কোনো সাহিত্যই নেই। যেমন ভোজদেব রচিত শৃঙ্গারমঞ্জরী কথা’, মহেন্দ্র সূরী রচিত ‘নিন্নয় সুন্দরী কথা’, সোমেশ্বর রচিত ‘মানোসসাল্লাস’, দামোদর গুপ্ত রচিত ‘কুট্টিনীমত’, কলহন মিশ্র রচিত ‘রাজতরঙ্গিনী’, দণ্ডি রচিত ‘দশকুমারচরিত’, গুণাঢ্য রচিত ‘বৃহকথা, বাসুদেব হিন্ডি রচিত শ্লোকসংগ্রহ’, কুমার ইলাঙ্গো আদিগল রচিত ‘শিলপ্লাদিকর’ প্রভৃতি গ্রন্থে ভিন্নধর্মী বহু গণিকার কীর্তিকলাপ সুগ্রথিত হয়েছে। এ সময় ব্যাবসা-বাণিজ্য, অর্থ-সম্পদ, বিলাস-ব্যসনে মনুষ্যজীবন সমৃদ্ধতর হয়ে উঠেছিল। আর কে না জানে জীবনে সার্বিক উন্নয়ন ঘটে গেলেই বিলাসিতার অঙ্গ হিসাবে গণিকা সঙ্গের প্রয়োজন হয়ে পড়ে! কায়ণ অর্থ-সম্পদ-শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের স্থূল কামনা-বাসনার তো জাগরণও ঘটতে থাকে। সে যুগে তো সর্বস্তরের মানুষের গণিকাপ্রীতি ছিল। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল শিল্প সাহিত্য-সংস্কৃতিতে। কে নেই, বৌদ্ধভিক্ষু থেকে শুরু করে নগররক্ষী, রাজা-মহারাজা থেকে শুরু করে ব্রাহ্মণ পণ্ডিত পর্যন্ত সকলেরই গণিকাপ্রীতি বিস্ময়ের উদ্রেগ করে, বিমূঢ় হয়ে যেতে হয়। সে সময় গণিকালয়গুলি এখনকার এঁদো-পুতিগন্ধময় ছিল না, গণিকালয় বা গণিকাগৃহগুলি ছিল সুরভিত, কুসুমাস্তীর্ণ, সুসজ্জিত এবং নান্দনিক–সবসময়। গণিকারাও সামাজিক মর্যাদার অধিকারিণী এবং ধনসম্পদশালী ছিল।
০৭. দেবদাসীর অন্য নাম গণিকা
দাসপ্রথারই একটা বিশেষ দিক এই দেবদাসী প্রথা। বিজয়ী জাতি বিজিত জাতিদের দাসে পরিণত করত। পুরুষ বন্দিরা দাস, নারীরা হত দাসী। দাসদের নিয়ে কী করা হত, সে বিষয়টি এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। তবে বিজিত বন্দি নারীরা হতেন ভোগের বস্তু। লালসা নিবৃত্তির যন্ত্র মাত্র। দাসত্বের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছেন নারী। অসম্মানিত হয়েছেন চরমভাবে। তাঁদের শরীর তাঁদের অধিকারে ছিল না। সেই অধিকার ছিল ভোগীদের। হাটে বিক্রি হত নারী। সেই হাটে নগ্ন করে দেখা হত নারী-শরীর। পছন্দ হলে ক্রেতারা ভোগের জন্য নিয়ে যেত। নারীদেহ চিরদিনই ভোগের সামগ্রী। বিংশ শতাব্দীর শেষপ্রান্তে এসেও এই পণ্য ব্যাবসায় ভাটা পড়েনি। এখান থেকেই শুরু হল দেবদাসীর চর্চা। এটি একটি ঘৃণিত প্রথা। ধর্মের মোড়কে বেশ্যাবৃত্তির মহান স্বীকৃতি। এরা নিতান্তই ভোগসুখের উপকরণ হিসাবে ব্যবহৃত হল মেয়েরা। রাজা, রাজপুরুষ মায় পুরোহিতদের যৌন-মনোরঞ্জন করাই হল এঁদের অবশ্য কর্তব্য। পুরোহিতদের পৌরোহিত্যেই এই পবিত্র’ প্রথা যুগ যুগ ধরে চলে এসেছে। আর এই যৌন-মনোরঞ্জনের আয়োজন হয় মন্দির বা দেবালয়ে। দেবতার নামে চলে নারীমাংসের উৎসব। শুধু ভারতেই নয়, এই প্রথা সারা বিশ্বজুড়ে চলে নানা মুখোশে, নানা রূপে। তবে ভারতে এই প্রথা ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল।
নারীপণ্যের একটা বিশাল বাজারই হল মন্দির। মন্দিরে হত বলেই দেবদাসী, মন্দির ছাড়া অন্য কোথাও হলে ‘গণিকা’। ভারতীয় নারীসমাজ বহুকাল যাবৎ এই প্রথার কারণে অসম্মানিত এবং অত্যাচারিত। এই প্রথা কেন বিস্তার লাভ করেছে, অতীত ও বর্তমানের অবস্থা বোঝা ও জানা প্রয়োজন।
মিশর পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্য দেশ বলে পরিচিত। এই দেশেই আমরা দেখতে পাই প্রথম দেবদাসী বৃত্তির কথা। আমন, আমনের স্ত্রী মুট এবং তাঁদের পুত্রসন্তান খোন সু–এই তিন দেবতার প্রতিষ্ঠা করেন মিশরের রাজারা। খ্রিস্টজন্মের প্রায় ১৪০০ বছর আগে রাজা তৃতীয় আমেস হোটেপ থিবস নগরীতে মহাসমারোহে মন্দির নির্মাণ করেন। মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে বিপুল পরিমাণে ধনসম্পদ লুঠ করে এই মন্দির নির্মাণ এবং দেবতার ভোগের উপকরণের জন্য ব্যয় করেন। এই মন্দিরে দাসদাসীও প্রচুর মজুত ছিল। এই সময়ের একটি দলিল থেকে জানা যায়, তৃতীয় রামেসিস আমন মন্দিরের জন্য ৮৬,৪৮৬ জন দাসদাসী উৎসর্গ করেছিলেন। ‘Great Harris Papyrus’ নামে এই দলিলটি সম্ভবত মন্দিরে দেবদাসী নিয়োগের প্রামাণ্য দলিল।
রামেসিস বংশের শেষ রাজার মৃত্যুর পর মিশরের শাসনভার যুগ্মভাবে তানিসের ফারাও ও থিবসের প্রধান পুরোহিতের উপর ন্যস্ত হয়। তানিসের রাজকন্যারা থিবসের মন্দিরে আমনদেবের স্ত্রী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকেন। সমাজের উচ্চকোটি নারী থেকে ক্রীতদাসী পর্যন্ত মন্দিরের দেবদাসী হিসাবে অংশগ্রহণ করত। আসিরীয় ও ব্যাবিলনীয় সভ্যতার ইতিহাসে দেবী ইশরাতের সঙ্গিনীরূপে নারীরা মন্দিরে দেবদাসী হিসাবে নিযুক্ত হত। এসময় ব্যাবিলনের দেবতারা হলেন–মারডুক, শামাশ, তাম্বুজ ও ইশতার। প্রাচীন ব্যাবিলনে প্রতিটি বিবাহযোগ্যা নারী দেবী ইশতারের মন্দিরে বসে থাকবেন। প্রথমেই যে পুরুষ অভীষ্ট নারীর কোলে একটি রৌপ্যমুদ্রা ফেলবেন, সেই পুরুষের সঙ্গেই নারীটি যৌনমিলনে প্রবৃত্ত হবেন। বিবাহ-পূর্ব বেশ্যাবৃত্তি এভাবেই শুরু হয়ে যেত। মন্দির-দাসীদের এই হল বেশ্যাবৃত্তির ইতিহাসের বাধ্যতামূলক সোপান।
আফ্রিকার উত্তর উপকূলে ফিনিশীয় মন্দিরগুলিতেও নর্তকী ও দেবদাসীর কথা জানা যায়। প্রাচীন গ্রিসের মন্দিরগুলোতেও দেবদাসী নিযুক্ত হত। Hierodule নামে এই দেবদাসীরা সূর্যদেবতা অ্যাপোলোর মন্দিরে সর্বত্রই দেবদাসী থাকত। শুধু অ্যাপোলোর মন্দিরেই নয়, গ্রিসের অন্যান্য মন্দিরেও দেবদাসী মজুত থাকত যথেষ্ট সংখ্যায়। এদের কাজ ছিল নৃত্যগীত প্রদর্শন এবং বাধ্যতামূলক গণিকাবৃত্তি। কেবলমাত্র পুরোহিত, রাজা ও ক্ষমতাশালীদের কাছেই এরা ভোগ্যা ছিল। আর্টেমিসের মদিরা দেব বাছুজের মন্দিরে দাসীরা বাধ্য হত এক বিচিত্র জীবনযাপনে। এই দাসীদের কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হত। যেমন–Maenad, Amazon ইত্যাদি। Maenad নারীদের শিশু বয়স থেকেই দেবদাসীর উপযুক্ত করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। Amazon নারীরা যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিনী। তাঁরা এতটাই উৎসর্গীকৃত ছিল যে, ডান কাঁধে তূণ রাখতে যাতে বাধা সৃষ্টি না-হয়, সেজন্য ডানদিকের স্তনটি কেটে ফেলতেন। বস্তুত একস্তনী হয়ে যেতেন বলেই এঁদের নাম A-mazon। এঁদের যে সন্তানসন্ততি হত, তাঁর মধ্যে কন্যাসন্তানটিকেই বাঁচিয়ে রাখা হত এবং পুরুষসন্তানদের হত্যা করা হত, নতুবা দেশ থেকে বিতাড়িত করা হত। কন্যাসন্তানদের বাঁচিয়ে রাখা হত মানে এই নয় যে, সন্তান খুব আদরনীয় ছিল। আদরনীয় ছিল, তবে তা ছিল ভোগ্যবস্তু বানানোর জন্য।
রোমান সভ্যতাতেও দেবদাসী প্রথার সন্ধান পাওয়া যায়। দাসনির্ভরশীল এই রোমান সভ্যতার জিউস, জুনো ও ভেনাসের মন্দির সহ অন্যান্য মন্দিরগুলিতে প্রচুর দেবদাসীও নিযুক্ত থাকত। পুরোহিতদের মনোরঞ্জন করাই ছিল মূল কাজ। তবে রাজা ও রাজপুরুষদেরও ভোগ্য ছিল। মনে করা হত, দেবতার ভোগ আর রাজাদের ভোগ সমপর্যায়ের। দেবদাসীদের পাশাপাশি রাজনটী ও নগরনটীদেরও আবির্ভাব হয়েছিল এ সময়। এদের Hataera বলা হত। তবে এঁদের সম্মান-মর্যাদা ছিল বেশ। এঁদের মতামতেরও মূল্য দিতেন জ্ঞানীগুণীরা।
Hataera-দের মতো জাপানের Geisha-দেরও যথেষ্ঠ মর্যাদা ছিল। সুন্দরী শিক্ষিতা এই নারীরা শুরুতে আলাপাচারণে শ্রোতাদের মোহাবিষ্ট করার কাজে নিয়োজিত হলেও পরে অবশ্য সরাসরি গণিকাবৃত্তিতে প্রবিষ্ট হতেন। তবে প্রাচীন জাপানে দেবদাসী ছিল কি না সে বিষয়ে কিছু জানা যায় না। ইনকা সভ্যতাতেও আমরা দেবদাসী প্রথার সন্ধান পাই। ইনকা সম্রাটদের সূর্যের সন্তান বলা হত। ইনকার সূর্যের মন্দিরের তত্ত্বাবধানের জন্য পুরোহিত ছিল। এই মন্দিরে নারীরা সূর্যকুমারী হিসাবে মন্দিরবাসিনী হত। মন্দিরবাসিনী এই নারীদের কাজ ছিল পুরোহিত ও রাজবংশীয়দের মনোরঞ্জন করা। দেবদাসী প্রথা ছিল আটজেক সভ্যতার ইতিহাসেও।
ভারতে দেবদাসী প্রথা নামে গণিকাবৃত্তি একেবারে জাঁকিয়ে প্রাচীন যুগে এবং মধ্যযুগে, যা বর্তমান যুগেও ফল্গুনদীর মতো বহমান। ভারতের দেবদাসী প্রথার সূচনার ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর এক গুহালিপি পাই। যে গুহালিপিতে সুতনুকা নামে এক দেবদাসীর কথা জানতে পারি। উল্লিখিত উত্তীর্ণ লিপিতে বলা হয়েছে–“সুতনুকা নাম দেবদাসিক্য তং কাময়িখ বালানশেয়ে দেবদিন্নে নাম লুপদকখে”। অর্থাৎ, সুতনুকা নামে দেবদাসী, তাঁকে কামনা করেছিল বারাণসীবাসী দেবদিন্ন (দেবদত্ত) নামে রূপদক্ষ। যোগীমায়া গুহা, সীতাবেন্দা ইত্যাদি নামে যে গুহার সন্ধান পাওয়া গেছে, লিপির সাহায্যে দ্বিধাহীনভাবে প্রমাণিত হয়েছে, এই গুহামঞ্চবাসীরা মূলত দেবদাসী শ্রেণির ছিল। পুরাণাদিতে আমরা যে স্বৰ্গবেশ্যা তথা অপ্সরাদের কথা জানতে পাই, তাঁরা ছিল আসলে হাই-প্রোফাইলের দেবদাসী।
ভরতের নাট্যশাস্ত্রে আমরা অপ্সরাদের পাচ্ছি নৃত্যগীতশিল্পী ও অভিনেত্রী হিসাবে, যাঁরা তথাকথিত দেবতাদের মনোরঞ্জনে ব্রতী হতেন। অপ্সরারা কোনো অলৌকিক বা কাল্পনিক অস্তিত্ব নয়, তাঁরা প্রকৃতপক্ষে রক্তমাংসের মানবী মাত্র। নাট্যশাস্ত্রের শুরুতেই এইসব নাট্যকুমারীদের কথা এবং অপ্সরাদের কথা বলা হয়েছে। এই নাট্যকুমারীরা একটি বিশেষ গোষ্ঠীভুক্ত ছিল, একথাও উল্লেখ আছে। এঁদের যে-কোনোভাবে সংগ্রহ করে অতি সহকারে নৃত্যগীতবাদ্য শিক্ষা দিয়ে রঙ্গমঞ্চে হাজির করা হত, তার বিশদ বর্ণনা আছে ভরতের নাট্যশাস্ত্রে। প্রসিদ্ধ তামিল নাটক ‘শিল্পপ্পাদিকর’-এর কয়েকটি অধ্যায়ে দক্ষিণ ভারতীয় প্রাচীন সংগীত ও নৃত্যের উল্লেখ আছে। এই নৃত্য অবশ্যই দেবদাসী নৃত্য। ধনবানদের বিলাসকলার অন্যতম প্রধান উপকরণ ছিল নারী। আর নারীরা ছিলেন সুশিক্ষিতা, সুবেশা এবং অবশ্যই কামশাস্ত্রনিপুণা।
বঙ্গদেশে দেবদাসী প্রথার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় অষ্টম শতকে কলহনের ‘রাজতরঙ্গিনী’ গ্রন্থে, নর্তকী কমলার প্রসঙ্গে। বঙ্গদেশে পালযুগেও দেবদাসী প্রথার অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়। গুপ্তযুগেও এইসব নর্তকীদের সম্বন্ধে বহু বর্ণনা পাওয়া যায়। বিজয়সেনের দেওপাড়া প্রশস্তিও এই প্রথার ব্যাপকতার ইঙ্গিত মেলে। দেওপাড়া প্রশস্তির কবি উমাপতি ধর লিখেছেন–বিষ্ণুমন্দিরে উৎসর্গীকৃত দেবদাসীরা যেন রূপ ও সৌন্দর্যের দ্বারা কামদেবতাকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন। ভট্ট ভবদেবের ভুবনেশ্বর প্রশস্তিও একই কথা বলেছে। দ্বাদশ শতাব্দীর সূচনায় কর্ণরাজের রত্নগিরি তাম্রশাসন থেকে জানা যায়, তাঁর রানি কর্পূরশ্রী সলোনপুরের বৌদ্ধমন্দিরের দেবদাসী ছিলেন। কর্পূরশ্রীর মা মাহুনদেবীও দেবদাসী ছিলেন। কর্ণাটকে দ্বাদশ শতাব্দীর সূচনায় চালুক্যরাজ বিক্রমাদিত্য ইত্তাগিতে চণ্ডালেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠা করে বিভিন্ন দেশ থেকে সুন্দরী নারীদের এনে সেখানে দেবদাসীরূপে নিয়োগ করেন। পহুবী লিপিগুলিতে দেবদাসীদের কথা উল্লেখ আছে। দেবদাসীদের নিয়ে আলাদা বর্ণনা পাওয়া যায় ‘মেঘদূত’ সহ বিভিন্ন কাব্যে।
সম্প্রতি “কর্ণাটক রাজ্যের দেবনগর জেলার উত্তরঙ্গমালা দুর্গা মন্দিরে রাতের বেলায় নারীদের দেবতার নামে উৎসর্গ করার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে”–এই মর্মে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের আবেদনের ভিত্তিতে সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন এক বেঞ্চ রাজ্যের মুখ্যসচিবকে ওই অনুষ্ঠান বন্ধ করার নির্দেশ দেন। এই কুপ্রথা কার্যত নারীদের যৌনশোষণ, যা ভারতে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ১৯৮৮ সালে। আশা ছিল এর ফলে দেবদাসীদের সামাজিক যৌনশোষণ বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু তা হয়নি। এখনও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে, মহারাষ্ট্রে, ওড়িশায় এবং দেবতাকে উৎসর্গ করার নামে দেবদাসীদের প্রধানত দেহভোগের কাজেই ব্যবহার করা হয়। দেবতা বা মন্দিরে উৎসর্গ করার পর তাঁদের পরিচয় হয় দেবদাসী। কোনো কোনো অঞ্চলে তাঁদের বলা হয় যোগিনী।
প্রায় হাজার বছরের প্রাচীন এই প্রথা ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এর পিছনের বড়ো কারণগুলি হল চরম দারিদ্রতা, বর্ণবৈষম্য ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। গরিব ঘরের মা-বাবা তাঁদের কুমারী মেয়েদের রজস্বলা হওয়ার আগেই নিয়ে আসত মন্দিরে। প্রথমে কুমারী মেয়েদের নিলাম করা হয়। তারপর মন্দিরের প্রধান পুরোহিত উৎসর্গ করার নামে বিগ্রহের সঙ্গে কুমারী তথাকথিত ‘বিয়ে’ দিয়ে দেন। এর ফলে সেই মেয়ের কোনো পুরুষই স্বামী হতে পারে না। নিরাকার দেবতাই তাঁর একমাত্র স্বামী। খাওয়া-পরার বিনিময়ে মন্দিরের বাসিন্দা হয়ে তাঁদের সারাজীবন কাটিয়ে দিতে হয়। কায়িক পরিশ্রমের সঙ্গে সঙ্গে মন্দিরের প্রধান পুরোহিত থেকে মন্দিরের অন্যান্য পুরুষদের সঙ্গে যৌনক্রিয়া করতে হত। এছাড়াও সমাজের উচ্চবর্গীয় ধনী কিংবা সামন্তপ্রভুদের রক্ষিতার ভূমিকা পালন করতে হয়। মন্দিরের পূজারী ব্রাহ্মণ এবং সামন্তপ্রভুদের যোগসাজসে কৃষক ও কারুশিল্পী বা কারিগরদের উপর ধর্মীয় প্রভাব খাঁটিয়ে দেবদাসীদের গণিকাবৃত্তিকে দেওয়া হয় ধর্মীয় সিলমোহর। উৎসর্গের পর দেবদাসীকে ভোগ করার প্রথম অধিকার মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের। আজব ব্যাপার, অন্য কোনো পুরুষকে নিজের স্বামী রূপে গ্রহণ করা যাবে না, কিন্তু যৌনমিলনে কোনো বাধা নেই! এই ধর্মীয় প্রথার উৎপত্তির ইতিহাস নিয়ে নানা কাহিনি, বিতর্ক এবং বিভিন্ন জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। দেবদাসীদের তথ্য ঐতিহাসিক বা পুরাতাত্ত্বিক বিভিন্ন মন্দিরের গাত্রে আজও উৎকীর্ণ আছে।
দক্ষিণের তিরুপতি মন্দিরে দেবদাসী সংগ্রহের প্রাচীন পদ্ধতি সম্পর্কে খ্রিস্টান মিশনারি অ্যাবে জে এ র্দুবা এক সমীক্ষায় লিখেছেন–“বছরের একটি বিশেষ দিনে এই মন্দিরের পুরোহিতেরা ভগবান বেঙ্কটেশ্বরের প্রতিমূর্তি নিয়ে শোভাযাত্রা বের করতেন এবং পথে যত সুন্দরী মেয়ে চোখে পড়ত তাঁদেরকে দেবদাসী করার দাবি জানাত। শুধু কুমারী মেয়েই নয়, সুন্দরী বিবাহিত মেয়েদেরও দাবি করত তাঁরা। এ থেকেই বোঝা যায়, দেবদাসী করার জন্য মেয়েদেরকে জোর করেই তুলে আনা হত।” দুবার এহেন মন্তব্য। গবেষক পণ্ডিত জি জি ফ্রজার পশ্চিম আফ্রিকায় দেবদাসী সংগ্রহের যে অভিনব উপায়ের উল্লেখ করেছেন, তা থেকে জানা যায়–মেয়েদের জোর করে তুলে এনে দেবদাসী থেকে গণিকা বানানো হত। ফ্রিজার লিখেছেন–“পুরোহিতরা একটা বিশেষ দিনে নগরের পথে পথে ঘুরে বেড়াত এবং সেদিন দুয়ারের বাইরে যত কুমারী মেয়ে পেত তাঁদের সবাইকে ধরে নিয় যেত মন্দিরে দেবদাসী করার জন্যে।”
রাজ্য জয় করে রাজারা যেমন গোরু-ছাগলের মেয়েদের মতো তুলে আনত, তেমনই সেইসব মেয়েদের ধরে ধরে দেবদাসী তথা গণিকায় পরিণত করত। আদতে এভাবেই দেবতাদের বউ বানানোর অছিলায় মেয়েদেরকে গণিকা বানিয়ে গণভোগ্যা বানিয়ে নিত সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। ১৮৬৭-৬৮ সালে জন শর্ট লন্ডনের অ্যানথ্রোপলজিক্যাল সোসাইটিতে ভারতের দেবদাসীদের প্রসঙ্গে একটি বিস্ফোরক রিপোর্ট পেশ করেন। রিপোর্টে বলা হয়েছে–মন্দিরে দেবদাসীদের কুমারীত্ব’ বহিরাগত ধনীদের কাছে চড়া দামে বিক্রি করা হত। তারপর তাঁরা গণিকাবৃত্তিতে নিয়োজিত হত।
এ প্রসঙ্গে বলা যায়, সব মেয়েকে যে জোর করে দেবদাসী বানিয়ে নেওয়া হত, তা কিন্তু নয়। দেবদাসী মাহাত্ম এমন পর্যায়ে প্রচার করা হয়েছিল যে, অনেকেই স্বেচ্ছায় দেবতার কাছে নিজেদের উৎসর্গ করে দিত। পুণ্যলাভের আশাতেও মা-বাবারা দেবতার সঙ্গে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিত। তবে এঁদেরকে মন্দিরে আত্মসমর্পণ করতে হত না, গণভোগ্যাও হতে হত না। অবশ্যই দেবতা বিয়ে করে দেবতার কাছে আত্মসমর্পণ করে সারাজীবন কাটিয়ে দিত। এমনই এক বিখ্যাত দেবদাসী মীরা তথা মীরাবাঈ। রাজস্থানের এক অভিজাতবংশীয় হিন্দু পরিবারের সন্তান। বাল্যকালে এক পরিব্রাজক সন্ন্যাসীর দ্বারা আরাধিত একটি কৃষ্ণমূর্তির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন এবং কৃষ্ণকে স্বামী হিসাবে গ্রহণ করেন। তাঁর মা তাঁর এই ভক্তিভাবের সমর্থক ছিলেন। শৈশবেই চিতোররাজ রানা সংগার জ্যেষ্ঠ পুত্র ভোজরাজের সঙ্গে মীরার বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন তিনি শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। স্বামী ভোজরাজকে বলেন, তিনি মীরার শরীর পাবেন, কিন্তু মন পাবেন না। কারণ মীরা তাঁর মনপ্রাণ সব কৃষ্ণের পায়ে নিবেদন করেছে।
ভবিষ্যপুরাণে আছে–“বেশ্যাকম্বকং যস্তু দদ্যাৎ সূর্যায় ভক্তিতঃ সগচ্ছেৎ পরমং স্থানং যত্র তিষ্ঠতি ভানুমান”। মহাকবি কালিদাস তাঁর মেঘদূতে উজ্জয়িনী মহাকাল মন্দিরে চামরহস্তা দেবদাসীদের ‘বেশ্যা’ বলে পরিচিত করিয়েছেন। দেবদাসী সৃষ্টির পিছনে ছিল মানুষের অশিক্ষা, কুশিক্ষা, ভুল ধারণা ও ধর্মান্ধতা। সাধারণ মানুষ মনে করত আত্মজাকে দেবদাসী করে দিতে পারলে শুধু দাতার নয় কন্যারও স্বর্গলাভের একটা পাকা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। যে ভাবনা থেকে নবমবর্ষীয় কন্যাকে কুলীন বৃদ্ধের কাছে গৌরীদান করত ভারতীয় হিন্দু পিতামাতারা। যেমনভাবে বোঝানো হত মৃত স্বামীর সঙ্গে চিতায় উঠে সহমরণে গেলে সরাসরি স্বর্গের জমি নিশ্চিত। সতী হিসাবেও পুজো পাবে সেই অভাগা নারী। আসলে এমনই বোঝানো হত। বোঝাত হিন্দু সমাজের পুরোহিতকুল।
কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে দেবদাসীদের আলোচনা করেছেন। তবে তিনি দেবদাসী শ্রেণির আইনকানুন লিপিবদ্ধ করেননি। তিনি এটা অবশ্যই বলেছেন যে, এসব ব্যাপারে আইনকানুনের দায়িত্ব পুরোহিত তথা পুরোহিততন্ত্রের। অর্থাৎ মধ্যযুগ থেকেই দেবদাসীদের উপর ওই পুরোহিতকুলের অধিকার ইতিহাস স্বীকৃত। যাঁরা দূরদর্শনে ‘অগ্নিজল’ ধারাবাহিকটি চাক্ষুষ করেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই এতদিনে জেনে গেছেন দেবদাসী নিয়ন্ত্রণে পুরোহিতদের কী দাপট! পুরোহিতদের আধিপত্য এতটাই যে দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাজাও ভয়ে সিঁটিয়ে থাকত। রাজাদের তরফ থেকে দেবদাসীদের বিষয়ে কোনো ভালো-মন্দ পরামর্শই পুরোহিতরা গ্রহণ করত না। পুরোহিতরা নিজেরা যেসব আইনকানুন বা বিধিনিষেধ আরোপ করত, তা অতি যত্নে গোপন রাখা হত। পুরোহিততন্ত্র নিজেদের স্বার্থেই দেবদাসীদের লোকচক্ষুর আড়ালে রাখত চাইত। যা কিছু আড়ালে-আবডালে তাতেই মানুষের মোহবৃদ্ধি। এটাই মনস্তাত্ত্বিক বিষয়।
দেবদাসীদের মোটামুটি ছয় ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন–(১) বিক্রিতা, (২) ভৃত্যা, (৩) ভক্তা, (৪) দত্তা, (৫) হৃতা এবং (৬) অলংকারা। এই বিভাজন কেন? এই ভাগ-বিভাগ কেন? আসুন একটু বিস্তারিত জেনে নিই।
(১) বিক্রেতা : এই মেয়েদের অর্থের বিনিময়ে কিনে নেওয়া হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এরা অত্যন্ত গরিব পরিবারের সুন্দরী মেয়ে। অধিক মেয়েদের পিতামাতারা অর্থের বিনিময়ে এরকম দু-একটি মেয়েকে তুলে দিত পুরোহিতদের মালিকানায়। দেবদাসীর গর্ভজাতা মেয়েও এই দলেই অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। এইসব মেয়েরা যৌবনপ্রাপ্তা হলে মন্দিরের পুরোহিত নিজে অথবা তাঁর প্রিয়পাত্রকে দিয়ে সেই মেয়ের কৌমার্য নষ্ট করে দেবদাসী হিসাবে নিয়োগ করতেন।
(২) ভৃত্যা : বিশেষণ পড়েই বুঝতে পারছেন এরা আসলে ভৃত্য বা চাকরানি শ্রেণির। তাই স্বাভাবিকভাবেই এরা পদমর্যাদায় ‘বিক্রেতা’ দেবদাসীর নিচে। যৌবনবতীদের কর্তব্য ছিল মন্দিরের অতিথিবর্গকে দেহদানের মাধ্যমে শরীরী-পরিসেবা দেওয়া।
(৩) ভক্তা : স্বেচ্ছায় কোনো মহিলা (কুমারী, সধবা, স্বামী পরিত্যক্তা যে কেউ) মন্দির কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করে যখন দেবদাসী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে, তাহলে সে ভক্তা। ভক্তিই এদের আধার। এরা অতি উচ্চ সম্মানের পদাধিকারী। তবে এদেরকে যৌনকর্মে লিপ্ত হতে হত না।
(৪) দত্তা : কোনো ধর্মান্ধ পুণ্যলোভী পিতা মনোবাসনা চরিতার্থ করার জন্য, মানত রাখার জন্য, স্বেচ্ছায় নিজের মেয়েকে মন্দিরে দান করলে সেই মেয়ে দত্তা হয়।
(৫) হৃতা : এই মেয়েদের মূলত চুরি করে আনা হত। নিরুদ্দিষ্টার সন্ধান পেত না সেই অঞ্চলের নগরকোটালও। সেই মেয়ে বহুদূর দেশে মন্দিরের অন্ধকূপে বন্দিনী হিসাবে থাকত।
(৬) অলংকারা : যে-কোনো শ্রেণির দেবদাসীই রূপ-গুণ নৃত্যগীত পারদর্শিতার বিচারে অলংকারা পদে উন্নীতা হতে পারে। ঐহিক বিচারে এই মেয়েরা শীর্ষস্থানীয় হলেও শ্রদ্ধা ও সম্মানের দিক থেকে ভক্তা শ্রেণির নিচে।
দেবদাসী প্রথা নির্মূল হয়ে গেছে বলে যাঁরা নিশ্চিন্তের ঢেঁকুর তোলেন। তাঁদের বলি, তুলবেন না সেঁকুর। খবর আছে। কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রের কিছু মন্দিরে এখনও বিগ্রহের কাছে মেয়েদের বিসর্জন দেওয়া হয়। আজকের দেবদাসীরা আর দেবতার দাস নয় অনেকক্ষেত্রেই। মূলত তাঁরা লোলুপ পুরুষের লালসার শিকার। আর এই লালসা তৃপ্ত করতে এগিয়ে এসেছে যেসব মন্দিরের রক্ষক, সেগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ কর্ণাটকের ইয়েলাম্মা মন্দির। যেহেতু মন্দিরকন্যাদের বিয়ে হয় না, তাই তাঁদের বিনা বাধায় সম্ভোগ করে সমাজের বিভিন্ন স্তরের পুরুষরা। যে পূজারী দেবদাসী অর্পণের কাজে লিপ্ত, তিনি মোটা অঙ্কের অর্থপ্রাপ্ত হন। যাঁরা এই প্রথাকে তাঁদের জাতিগত ঐতিহ্যের অংশ মনে করেন, তাঁরা বড়োই তৃপ্ত হন! তা ছাড়া ইয়েলাম্মা মন্দিরের মেয়েরা প্রকৃত অর্থে দেবদাসী নন। এঁরা না বোঝেন চৌষট্টি কলা, না কোনো ধনীব্যক্তির রক্ষিতা। একপ্রকার খোলাখুলিভাবেই দেহবিক্রিই তাঁদের কাজ।
মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকের প্রান্তিক জেলাগুলি থেকে প্রতি বছর প্রায় ৫০০০ হরিজন শ্রেণির মেয়েদেরকে ইয়ালাম্মার কাছে অর্পণ করা হয়। এই প্রথার পিছনে শুধু বহু যুগের বিশ্বাস এবং অজ্ঞতা আছে তা নয়–আছে আর্থিক কারণ, আছে পুরোহিতদের প্ররোচনা। প্রাচীন প্রথার এই দুঃসহ আধুনিকীকরণ সবচেয়ে বেশি প্রচলিত কর্ণাটকের বেলগাঁও, ধারওয়ার, বিজাপুর, গলবর্গা ও বেলারি জেলায়। অন্যদিকে মহারাষ্ট্রের সিতারা, কোলাপুর, শোলাপুর ও ওসমানাবাদ অঞ্চলে এবং তেলেঙ্গানাতে যথাক্রমে ১০,০০০ এবং ২৫,০০০ দেবদাসী আছে। বংশপরম্পরায় এই মেয়েরা পুরুষদের ভোগ্যা।
সর্বোপরি যেটা না বললে অন্যায় হবে, তা হল–দেবদাসীরা ভারত-সংস্কৃতিকে দিয়েছে অনেক সম্পদ। কথাকলি, ভারতনাট্যম, মোহিনী-আউম, কুচিপুড়ি–এ সবই দেবদাসী সংস্কৃতি। যুগে যুগে এঁর দেবদিন্নদের উদ্বুদ্ধ করেছে মন্দিগাত্র অলংকরণে–কোনারক, খাজুরাহো, বেলুড়, হালেবিড থেকে বাঁকুড়ার মন্দিরেই রয়ে গেছে শ্বাশত প্রমাণ। তাঁদের দান অক্ষয়, অমর।
দেবদাসী প্রথার বিরুদ্ধে বহুদিন ধরে সংগ্রাম চলছে। তা সত্ত্বেও জাতীয় বা আন্তর্জাতিক ভাবনায় বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। ১৯২৯ সালে ডাঃ মুথুলক্ষ্মী রেডিড নামে এক মনস্বিনী মহিলার নেতৃত্বে দেবদাসী প্রথা উচ্ছেদের যে সংগ্রাম শুরু হয়, তার ফলে দেবদাসী প্রথা বিলোপের জন্য মাদ্রাজ বিধানসভায় আইন প্রণয়ন করে এই প্রথা নিষিদ্ধ করা হয়। বোম্বাই বিধানসভায় ডাঃ হরি সিং গৌরও অনুরূপ চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৪৭ সালে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে দেবদাসী প্রথা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আক্ষেপ এই যে, ভারতে দেবদাসী প্রথা আজও বিলুপ্ত হল না। এখনও যেসব অঞ্চলে দেবদাসী বহাল তবিয়তে চলছে, সেগুলি হল–কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, গোয়া ও কেরলের একটা বড়ো অংশ। তাই দেবদাসী প্রথা বিলুপ্তির জন্য আন্দোলন থেমে যায়নি। ফলে আবার নতুন করে শুরু হয়েছে দেবদাসী-বিরোধী আন্দোলন। নেতৃত্ব দিচ্ছেন ‘দেবদাসী মুক্তি বাহিনী। নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও, আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কীভাবে দেবদাসী রমরম করে চলছে, সে ব্যাপারে স্থানীয়ভাবে কয়েকটি সমীক্ষা করা হয়েছে। সেই সমীক্ষায় উঠে এসেছে চমকপ্রদ তথ্য। জানা গেছে, এই দেবদাসী প্রথার মাধ্যমে মুম্বাই, বেঙ্গালুরু, দিল্লি, চেন্নাই পতিতালয়গুলি সমৃদ্ধ করা হচ্ছে। কারা এই প্রথাকে জিইয়ে রাখতে চাইছে কীভাবে রাখতে পারছে, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা প্রয়োজন।
০৮. প্রাক-আধুনিক ও আধুনিক সাহিত্যে গণিকা
প্রাক-আধুনিক যুগের সাহিত্যে এসে গণিকাদের প্রকটভাবে আর পাওয়া যায় না। প্রাক-আধুনিক যুগকে যদি চর্যাপদ ধরি, সেখানে গণিকাদের উপস্থিতি নেই। কেন নেই? হঠাৎ করে সমাজ বদলে যাওয়ার তো কোনো কারণ নেই। সে সময়কার মানুষের জীবনযাত্রা উল্লেখ করার মতো সংযত ছিল, এমন আভাস কোথায়! প্রকট না-হলেও প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত কিন্তু মেলে। কিন্তু ব্রাহ্মণ প্রভৃতি উচ্চবর্ণের নাগরিকেরা যে মাঝেমধ্যে গোপনে রমণীদের সঙ্গে সম্পর্ক করতেন, তার স্পষ্ট ইঙ্গিত মেলে এই পদগুলিতে–“টালত ঘর মোর নাহি পড়বেষী”, উঞ্চা উঞ্চা পাবত তহি বসহি সবরী বালী”, “নগর বাহিরি রে ডোম্বি তোহের কুড়িআ”। এইসব গণিকা-রমণীরা ছিল আর্থিক ও সামাজিকভাবে বিপর্যস্ত, অস্পৃশ্য ও অবহেলিত। ব্যভিচারিতা বলা যায় না, বরং বলা যায় এটা ছিল হতদরিদ্র নারীদের এটাই ছিল জীবিকার্জনের অন্যতম পথ। বলা যায় এসময় থেকেই গণিকাদের মর্যাদার পতন শুরু। ঘৃণ্য হতে শুরু করল।
ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলের দ্বিতীয় খণ্ড বিদ্যাসুন্দরে জনৈকা হীরামালিনী, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বড়ায়িরা দূতী হিসাবে পরিচিত হলেও সংস্কৃত সাহিত্যে এঁরা গণিকা রূপেই অঙ্কিত। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে গণিকাদের উপস্থিতি যেভাবে প্রকটিত হয়েছিল, মধ্যযুগ তথা প্রাক-আধুনিক যুগে এসে অনেকটাই প্রচ্ছন্ন হয়ে যায়। এহেন পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব হল? আসলে সেসময়টা ছিল নানবিধ উত্থান-পতনে জর্জরিত। গোটা মধ্যযুগ জুড়ে ছিল অস্থিরতা। শক, হুন, পাঠান, মোঘল, এমনকি বর্গি আর ঠগিদের দৌরাত্ম্যে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। চারিদিক যুদ্ধ, হানাহানি, হিংসা, আক্রমণ, প্রতি-আক্রমণের মানুষের মানবিক মূল্যবোধ প্রায় তলানিতে। এহেন অস্থির পরিমণ্ডলে কবি-লেখকদের লেখনী প্রায় স্তব্ধ হয়ে যায়। সম্ভব হয়ে উঠছিল না মননশীল সাহিত্য রচনা। সেইসঙ্গে ব্রাত্য ও অপাঙক্তেয় হল গণিকা। সম্ভবত এই কারণেই প্রাক-আধুনিক বাংলা সাহিত্যে তেমন একটা গণিকাঁচরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায় না। সমগ্র মধ্যযুগের ভরকেন্দ্র ছিল ধর্ম, বিশেষ করে বঙ্গদেশে। সেসময় যতটা-না সামাজিক সাহিত্য রচিত হয়েছে, তার চেয়ে কয়েকশো গুণ বেশি ধর্মাশ্রিত সাহিত্য রচিত হয়েছে। ফলে সে সময়ের অন্য সাহিত্যে গণিকাদের নিয়ে ভাবার অবকাশ লেখকেরা পাননি। তার মানে এই নয় যে, সেসময়ের সমাজে গণিকারা ছিল না। অবশ্যই ছিল, তবে ধর্মীয় অনুশাসনের বেড়াজালে নারীর জীবন প্রান্তিকায়িত হয়ে গেল।প্রাক্-আধুনিক যুগ ও তারও পরে গণিকাজীবন অবহেলিত থেকে গেল বাংলা সাহিত্যে।
প্রাক্-আধুনিক যুগ পেরিয়ে আধুনিক যুগে এসে সমাজ ও রাষ্ট্র (সেসময় রাষ্ট্র বলতে সমগ্র ভারত বোঝাত না) খানিকটা থিতু হয়ে এলে বাংলা সাহিত্যে পুনরায় জাঁকিয়ে প্রবেশ ঘটল গণিকাদের। প্রবেশ ঘটল বটে, তাঁদের হৃত সম্মান ফিরে এলো না। এ সময়ে গণিকারা ক্রমশ ঘৃণ্য ও প্রান্তিক হয়ে গেল। কী সমাজে, কী সাহিত্যে। তৎকালীন সমাজের গণিকাদের প্রতিচ্ছবিই সাহিত্যেও প্রতিফলন ঘটেছে। অথচ প্রাচীনকালে ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজ জুড়ে ছিল গণিকাদের মাথা উঁচু করে চলার অবাধ ও স্বাধীন বিচরণক্ষেত্র। এখনকার মতো গোপনীয় ও বিপন্নতা ছিল না গণিকাজীবন ও বৃত্তি। সম্মান ও মর্যাদা ছিল সমাজের অন্য পেশার মানুষদের মতো। বরং বলা যায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে অন্য পেশার মানুষদের চেয়েও বেশি সম্মান ছিল। গণিকাদের সমাজ ও জীবন ছিল বিশেষ মনোরম ও উপভোগ্য। এখনকার মতো মোটেই ক্লেদাক্ত জীবন ছিল। তবে প্রাচীন যুগে কখনো-সখনো নিয়মনিষ্ঠ শাস্ত্রকারেরা গণিকাদের সম্পর্কে কঠোর বাক্যবাণ প্রয়োগ করলেও বেদ, মহাকাব্য, পুরাণ সর্বত্রই গণিকাদের গৌরবোজ্জ্বল, রাজকীয়, দৃষ্টিনন্দন পদচারণা অনুভব করা
আধুনিক যুগে এসে গণিকার কথা জানতে পাচ্ছি এক গণিকা কলমে। মানদাদেবীর কলমে। লেখিকা মানদাদেবী নিজে একজন গণিকা। মানদাদেবীর গ্রন্থের প্রথম পর্বে বর্ণিত হল তাঁর জীবনের কৈশোর পেরিয়ে কীভাবে তিনি গণিকা হলেন। এরপর পাই একজন শিক্ষিতা গণিকায় মুখে তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা।এমন একটি নির্ভেজাল নির্মোহ গণিকার আত্মচরিত আগে কখনো পাওয়া যায়নি। সেই অর্থে বলা যায় এই দুর্লভ আত্মচরিত সেইসময়কার গণিকাদের জীবন সম্পর্কে আমাদের অনেকগুলো জানালা খুলে দিয়েছে।
আধুনিক যুগের লেখকদের লেখায় ফুটে উঠল গণিকাদের জীবনযাপন, তবে গণিকাদের প্রতি সমাজের ঘৃণ্য ও অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। অনেকক্ষেত্রেই সমাজ কলুষিত করছে এমন অভিযোগ গণিকাদের কাঠগোড়ায় দাঁড় করিয়েছে। গণিকারাও মানুষ, তাঁদেরও যে আর পাঁচটা মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন করার অধিকার আছে, স্বপ্ন আছে, সে বিষয়টি লেখকদের লেখায় প্রাধান্যই পায়নি। গণিকারা সমাজে অগ্রহণীয় হয়ে উঠল। গণিকাদের স্বাদ নেওয়া যায়, কিন্তু সমাজে গ্রহণ করা যায় না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা সংকলনে গণিকার চরিত্রায়ণ খুব একটা সুলভ নয়। যেটুকে এসেছে তাও সংস্কৃত ও পালি সাহিত্য চয়ন করা। তাঁর কাব্য ও নাট্যে শ্যামা, বাসবদত্তা নান্মী গণিকা চরিত্রগুলিরই পুনর্নির্মাণ লক্ষ করা যায়। তাঁর সমসাময়িক কোনো গণিকার কথা তাঁর সাহিত্যে উঠে আসেনি। রবীন্দ্র কথাসাহিত্যে গণিকাঁচরিত্রের স্বল্পতার কারণে তাঁর কাব্য-নাট্যে যে চরিত্রগুলি উঠে এসেছে তার আলোচনা প্রায় অনিবার্য হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যজীবনের যে বিশেষ পর্যায়টি অতীতের দিকে মোহমুগ্ধ দৃষ্টিতে ফিরে দেখায়, সেই সময়পর্বে লেখা কবিতাগুলির কথা উল্লেখ করতে পারি। যেমন–অভিসার, পতিতা, পূজারিনী, পরিশোধ, অপমানবর ইত্যাদি। প্রাচীন সাহিত্য, বৌদ্ধজাতক ও অবদান সাহিত্য এবং ভক্তমাল থেকে বিষয়বস্তু গ্রহণ করে তিনি এই কাব্যগুলিতে গণিকা চরিত্রগুলির পুনর্নির্মাণ করেছেন বলা যায়। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের আলোয় তিনি চিনতে চেয়েছেন দুঃখে-দ্বন্দ্বে-ক্রন্দনে সিক্ত গণিকাদের মনোজগৎটিকে। গণিকাদের তিনি শুধু নষ্ট মেয়ে হিসাবে দেখেননি, দেখতে চেয়েছেন আর পাঁচটা ঘাত-প্রতিঘাতে জর্জরিত সাধারণ নারী হিসাবে। প্রাচীন কাব্যে যে গণিকাদের পাওয়া যেত শাসকের হাতের পুতুল হিসাবে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে পড়ে সেই গণিকাদের মধ্যে প্রকাশ পেল তাঁদেরই অন্তর্দ্বন্দ্ব, অনুশোচনা ও আত্মশুদ্ধি এক ব্যক্তিত্বময় অভিব্যক্তি। তিনি কেন প্রাচীন সাহিত্য থেকে আবিষ্কৃত গণিকাদের অন্যভাবে প্রকাশ করলেন, তার জবাব কবি নিজেই দিয়েছেন–“রমণী পুষ্পতুল্য, তাহাকে ভোগে বা পূজায় তুল্যভাবে নিয়োগ করা যাইতে পারে। তাহাতে যে কদর্যতা বা পবিত্রতা প্রকাশ পায়, তাহা ফুলকে বা রমণীকে স্পর্শ করে না–ফুল বা রমণী চিরপবিত্র, চির অনাবিল।… যে সহজ-পূজ্য তাহাকে ভোগ্যের পদবিতে যে নামাইয়া আনে সেও একটা আনন্দ পায় বটে, কিন্তু সে আনন্দ অতি নিকৃষ্ট শ্রেণির। পতিতা হইলেও নারীর স্বাভাবিক পবিত্রতা তাহার ভিতর প্রচ্ছন্ন থাকে। … পাপের অন্যায়ে সে তাহার আত্মাকে কলুসিত করিয়াছে বটে, কিন্তু তাহার আত্মা একেবারে বিনষ্ট হইয়া যায় নাই–তাহার আত্মা বাষ্পচ্ছন্ন দর্পণের ন্যায় ক্ষণিকের জন্য তাহার সহজ স্বচ্ছতা ও শুচিতা হারাইয়াছে।”
রবীন্দ্রনাথের ‘বিচারক’ গল্পে একজন গণিকার কথা পাওয়া যায়। গণিকা ক্ষীরোদা। ক্ষীরোদাই এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র। ক্ষীরোদার যে জীবনবৃত্তান্ত এই গল্পের উপজীব্য তাতে গৃহস্থ ঘরের মেয়ে কেন গণিকাবৃত্তি গ্রহণ করে তার শেষ পরিণতি কী হয় সেই প্রসঙ্গই বিশ্লেষিত হয়েছে কবির কলমে। গল্পটির রচনাকাল উনিশ শতকের শেষ দশকে। উনিশ দশক জুড়ে গণিকা সম্পর্কে যে তাচ্ছিল্য ব্যঙ্গ ঘৃণা বর্ষিত হয়েছে, শেষ দশকে রচিত গণিকা ক্ষীরোদার চরিত্র তা থেকে আলাদা। আলাদা এই কারণে যে, পূর্ববর্তী লেখকেরা সমাজে গণিকাদের প্রবল উপস্থিতিকে স্বীকার করে নিলেও সাধারণভাবে তাঁদের প্রতি মোটেই সহানুভূতিশীল ছিল না। তাঁদের সামাজিক দৃষ্টিকোণ কিছুটা ভিক্টোরিয়ান শুচিতাবোধ, আবার কিছুটা গোঁড়া হিন্দু রক্ষণশীলতায় আচ্ছন্ন। রবীন্দ্রনাথ গণিকাদের দরদি হৃদয় দিয়ে বিশ্লেষণ করেন। এতদসত্ত্বেও রবীন্দ্র কথাসাহিত্যে গণিকা চরিত্র আর সৃজিত হয়নি। আশি বছরের দীর্ঘ জীবনের অর্ধাংশ রবীন্দ্রনাথ কাটিয়েছেন বিশ শতকের দ্রুত পরিবর্তিত আর্থ সামাজিক পরিবেশে। এমতাবস্থাতেও সময়ের প্রেক্ষাপটে গণিকা চরিত্র তাঁর কোনো গল্প-উপন্যাসে চিত্রিত হয়নি।
শরৎসাহিত্যে অবহেলিত, বঞ্চিত, দুর্ভাগা নারীরাই প্রধান উপজীব্য হয়ে উঠেছে। মানবিক রূপ নিয়ে এসেছে পতিতা তথা গণিকাদের কথাও। শরৎ চট্টোপাধ্যায়ের সময়ে পতিতা শব্দের অর্থও গেল বদলে। গণিকা বা পতিতা মানে কেবল দেহোপজীবিনীই নয়, দেহ ছাপিয়ে এই অপবাদ আরও বিস্তার করেছে নারীর জীবনে। শরৎসাহিত্যে গণিকারা হল ‘দেবদাস’-এর চন্দ্রমুখী, শ্রীকান্ত’-এর পিয়ারি বাইজি, ‘আঁধারে আলো’-র বিজলী।
শরবাবুর সময়ে ‘পতিতা’ শব্দটি সামাজিক অর্থে গৃহীত হয়ে গেছে। পতিতা হিন্দুসমাজের দৃষ্টিতে ‘সতী’ শব্দের বিপরীত অর্থবোধক। ভারতীয় নারীদের বিবাহমন্ত্রনির্দিষ্ট স্বামীই একমাত্র গ্রহণীয় পুরুষ। সুতরাং হিন্দুসমাজে নারী দেহ এবং মনে একজন মাত্র পুরুষকে সাধনা এবং কামনা করতে পারবে। অন্যথা সে পতিতা। সমাজের বিচারে স্বামী ছাড়া অন্য পুরুষকে মনে মনে কল্পনা করলেও সে নারী পতিতা। পতিব্রতা নারীর মর্যাদা নষ্ট হয়। নারী পতিতা হয়। হিন্দুশাস্ত্রে শুধুমাত্র মনে মনে কোনো পরপুরুষকে কামনা করলেও সেই নারী পতিত হয়। রেণুকার কাহিনি সংক্ষেপে দু-চার লাইনে স্মরণ করতে পারি। ব্রাহ্মণ জমদগ্নির স্ত্রী ক্ষত্রিয় রেণুকা। পরশুরাম হলেন তাঁদের পুত্রসন্তান। যিনি স্বাভাবিকভাবেই ব্ৰহ্মক্ষত্রিয়। অন্য চারপুত্ররা হলেন—বসু, বিশ্ববসু, বৃহদ্ভানু ও বৃহৎকশ্ব। যাই হোক, যেটা বলতে চাই সেটা হল–একবার চিত্ররথ নামক এক রাজাকে সস্ত্রীক জলবিহার করতে দেখে পরশুরামের মা রেণুকা কামার্তা হয়ে পড়েন। ধ্যানযোগে এ দৃশ্য দর্শন করে পরশুরামের পিতা জমদগ্নি তাঁর পুত্রদের মাতৃহত্যার আদেশ দেন। বসু, বিশ্ববসু, বৃহদ্ভানু ও বৃহৎকৰ্থ–এই চারপুত্র পিতার আদেশ অগ্রাহ্য করলেও পরশুরাম তাঁর কুঠার দিয়ে মায়ে মাথা-ধড় আলাদা করে দেন। বাকি কাহিনি এখানে বলার প্রয়োজন নেই।
শরৎসাহিত্যে প্রথম পরিচিত গণিকা বা পতিতা হল দেবদাস গ্রন্থের চন্দ্রমুখী। যেভাবে দেবদাসের সঙ্গে চন্দ্রমুখীর প্রথম পরিচয় পর্ব বর্ণিত হয়েছে, তাতে মনে হয় শৌণ্ডিকালয় বা শুড়িখানায় প্রথম পরিচয়ের দ্বিধা, সংকোচ, সংস্কারের আঘাত ও বিবেকের তাড়না যেন লেখকজীবনের বাস্তব ঘটনা। শুধুমাত্র মানসচক্ষে বিচারবুদ্ধি দিয়ে চন্দ্রমুখীর চরিত্রায়ণ এমন জীবন্তভাবে মোটেই সম্ভব নয়। চন্দ্রমুখী শুধুমাত্র শরীরী টানেই দেবদাসকে মুগ্ধ করেনি, ব্যক্তিগত আকর্ষণ দেবদাসের জীবনে কম প্রভাব বিস্তার করেনি। চন্দ্রমুখীর সহৃদয় ব্যবহার, সমাহিত আলাপ, দেবদাসকে সুপথে নিয়ে যাওয়ার আন্তরিক চেষ্টা করেছিল। স্নেহবুভুক্ষু দেবদাসের মনে সবচেয়ে বেশি মোহ বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। দেবদাস যেমন চন্দ্রমুখীর শরীরকে কেন্দ্র করে পিচ্ছিল পথে নেমেছিল, তেমনই প্রেমেও পড়েছিল। যে চন্দ্রমুখী একদিন শুধুমাত্র শরীরের আবেদনে রূপের পসরা সাজিয়ে সমাজের বাইরে দাঁড়িয়েছিল, সেই নারী একসময় দেবদাসকে কেন্দ্র করে একনিষ্ঠ প্রেমের সন্ধানে সমস্ত বিলাস, বিভ্রম ও ঐশ্বর্যকে পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছিল। হিন্দুঘরের বিবাহিতা নারী যেমন বিবাহের পর স্বামীর চরণে নিজেকে নিঃস্ব করে বিলিয়ে দেয়, ঠিক তেমনই চন্দ্রমুখীও দেবদাসকে দেবতার আসনে বসিয়ে নিজেকে নিঃস্ব করে দিয়েছিল। তবুও চন্দ্রমুখীর মলিনত্ব ঘুচল না। কারণ সমাজ তাঁর দুঃখাভিশপ্ত কপালে কলঙ্কতিলক পরিয়ে দিয়েছে। সে তো আর কেউ নয়–গণিকা, বারাঙ্গনা, পতিতা।
শ্রীকান্ত গ্রন্থে এক বাইজিকে পাই, যার নাম পিয়ারী। দেবদাসে চন্দ্রমুখীর ঘরে ঢোকার সময় লেখকের যে জড়তা দেখেছি, শ্রীকান্তে এসে সেই জড়তা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে সে। মজঃফরপুরে বন্ধু মহাদেবের ঘরে পিয়ারী বাইজির সামনে শ্রীকান্ত বেশ অপ্রকৃতস্থ। মাতলামি, মাতালের অর্থহীন প্রলাপ, লাম্পট্যের অভদ্র ইঙ্গিত এবং নর্তকীর বিলোল আভাস শ্রীকান্তকে আর বিভ্রান্ত করে না। পিয়ারি বাইজি সঙ্গে পরিচয়ও প্রগাঢ় হল। পিয়ারী বাইজি ওরফে রাজলক্ষ্মী ছিল শ্রীকান্তের বাল্যকালের খেলার সাথী, আজ সে যৌবনের অভিসারিকা। ব্রাহ্মণকন্যা ভদ্রঘরে জন্ম নিয়েও বিবাহিতা রাজলক্ষ্মী অবস্থার বিপর্যয়ে নর্তকী, গণিকা, দেহবিলাসিনী। পিয়ারী বাইজি আর রাজলক্ষ্মী এক দেহে পৃথক সত্তা। জীবিকার্জনে রাজলক্ষ্মীকে হতে হয়েছিল পিয়ারী বাইজি। দেহ ব্যাবসা নিজের দেহকে সে অপবিত্র করেছে। সমাজে চোখে সে হীনা, আত্মীয়স্বজনের কাছে রুদ্ধদ্বার। যদিও বারবিলাসিনী নর্তকীজীবনকে রাজলক্ষ্মী কখনো স্বচ্ছন্দ মনে গ্রহণ করেনি। তাই সমাজের বাইরে দাঁড়িয়েও রাজলক্ষ্মী কখনো সমাজবন্ধনকে পায়ে দলিত করতে চেষ্টা করেনি। শ্রীকান্ত নানাভাবে রাজলক্ষ্মীকে নিজের দিকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছিল বটে, কিন্তু রাজলক্ষ্মী তাঁর উচ্ছিষ্ট দেহ ধ্যানের দেবতাকে উৎসর্গ করতে পারেনি। নিজের অতীত জীবনের স্মৃতি প্রতিনিয়ত পীড়িত করত লজ্জা দিত রাজলক্ষ্মীকে।
‘আঁধারে আলো’ গ্রন্থে বিজলীও গণিকা। জমিদারপুত্র অনভিজ্ঞ সত্যেনকে বিজলী গঙ্গাতীরে প্রলুব্ধ করতে চেষ্টা করছিল। সুন্দর দেহ বিনিময়ে সে বহুপুরুষকে আকর্ষণ করেছে। দক্ষ মৎস্যশিকারির মতো পুরুষ তুলতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। একদিন ছল করে বিজলী সত্যেনকে তাঁর ঘরে আহ্বান করে। সত্যেন বিজলীর ঘরে ঢুকে জানতে পারল সে এক গণিকার ঘরে উপস্থিত হয়েছে। বিজলী মনে করেছিল সত্যেন আর পাঁচজন পুরুষের মতো দেহলোলুপ। কিন্তু অতর্কিতে বিজলী প্রথম দেখল তাঁর দেহসীমা অতিক্রম করে সত্যেন দাঁড়িয়ে আছে। বিজলীও চন্দ্রমুখীর মতো অমৃতস্পর্শে জেগে উঠেছিল। বিজলী বাইজী পারিজাত স্পর্শে মরেছে। চন্দ্রমুখীও একদিন দেবদাসের স্পর্শে মরেছিল। দানে রাজলক্ষ্মী অতুলনীয়া, চন্দ্রমুখী ত্যাগে গরীয়সী, বিজলী কিন্তু সত্যেনের কাছে কোনোরূপ প্রতিদান প্রার্থনা করেনি। সেই নিস্পৃহ প্রেমই বিজলীকে মহীয়সী করেছে। মোটের উপর শরৎবাবুর তিনজন গণিকার পিছনে ছিল নারীর প্রচ্ছন্ন সত্তা এবং প্রচ্ছন্ন সত্তার বিশ্লেষণ করে তিনি গণিকার নতুন রূপ দেখিয়ে দিয়েছেন।
সর্বোপরি শরৎবাবুর ‘পতিতা’ চরিত্রগুলি পতিতা হিসাবে ততটা পরিস্ফুট হয়নি, যতটা হয়েছে নারীচরিত্র। সেখানে কোনো নারী সামাজিক অর্থে পতিতা না অ-পতিতা, তা সাহিত্যিকের কাছে নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর বিষয়। জীবননাট্যলীলায় তাঁর ভূমিকাটি সাহিত্যিক সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়ে অঙ্কিত হয়েছে কি না, সেটাই সাহিত্যসমাজে বিবেচ্য বিষয়। শরত্যাবু অবিবাহিত বা বিবাহিত এই প্রশ্নের সমাধান না করেও বলা যায় যে, নারীর প্রতি তাঁর সহজ আকর্ষণ প্রবলতম। নারী-মন সন্ধানে শরত্যাবু নারীজগতের বহু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন। শরৎচন্দ্র ব্ৰহ্মপ্রবাসকালে ‘বেঙ্গল সোসিয়াল ক্লাব’-এ স্বরচিত ‘নারীর ইতিহাস’ পাঠ করেন এবং সাতশত পতিতা নারীর জীবনকাহিনি সংবলিত একটি পুস্তক প্রণয়ন করেছিলেন। ঘটনার বিপর্যয়ে শরৎচন্দ্র প্রথম যৌবনে সমাজচ্যুত হয়েছিলেন। সেই অবসরে নারীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় সাধারণত সমাজের বাইরে।
সেসময়ের সাহিত্যিকদের সাহিত্যে যেমন গণিকারা স্থান পেয়েছিল, ঠিক তেমনইভাবে সাহিত্যিকদের জীবনেও গণিকারা স্থান পেয়েছিল। সুরাপান, গণিকাসক্তি ও রক্ষিতা-পোষণ সেকালে এক ধরনের সামাজিক স্বীকৃতি লাভই করেছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তো গণিকাঁচর্চা গৌরব ও মর্যাদার প্রতীক হিসাবেও বিবেচিত হত। আঠারো-উনিশ শতকে কলকাতার নাগরিক জীবন এমনকি মফসসল শহরেও গণিকাঁচর্চা জীবনযাত্রার অনিবার্য প্রয়োজনীয় অনুসঙ্গ হয়ে ওঠে। ভারতপথিক রাজা রামমোহন রায় নিকির নাচ দেখেই সন্তুষ্ট ছিলেন না, বাঁধা রক্ষিতাও ছিল তাঁর। এই যবনী রক্ষিতার গর্ভে একটি পুত্রসন্তানও ‘উপহার’ দিয়েছিলেন। গণিকা সুকুমারী দত্তের প্রেমে মজেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। মরমি কবি হাসন রাজা তো হর হামেশাই গণিকা-দর্শনে গণিকালয়ে যেতেন। কবি নজরুল ইসলামও বাদ যাননি, তিনি গণিকা কাননবালার ঘরে নিয়মিতই যেতেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনে গণিকা ও বৈধতাও প্রশ্নহীন নয়। সাহিত্যিক জগদীশ গুপ্তও রক্ষিতা পুষতেন। রাজনারায়ণ বসু লিখছেন–“এক্ষণকার লো পানাসক্ত ও পূৰ্ব্বাপেক্ষা বেশ্যাসক্ত। যেমন–পানদোষ বৃদ্ধি পাইতেছে, তেমনি বেশ্যাগমনও বৃদ্ধি হইতেছে। সে কালে লোকে প্রকাশ্যরূপে বেশ্যা রাখিত। বেশ্যা রাখা বাবুগিরির অঙ্গ বলিয়া বিবেচিত হইত, এক্ষণে তাহা প্রচ্ছন্নভাবে ধারণ করিয়াছে, কিন্তু সেই প্রচ্ছন্নভাবে তাহা বিলক্ষণ বৃদ্ধি পাইতেছে। বেশ্যাগমন বৃদ্ধি পাইতেছে, তাহার প্রমাণ বেশ্যাসংখ্যার বৃদ্ধি। পূৰ্ব্বে গ্রামের প্রান্তে দুই এক ঘর দৃষ্ট হইত; এক্ষণে পল্লিগ্রাম বেশ্যার সংখ্যা বিলক্ষণ বৃদ্ধি পাইয়াছে। এমনকি স্কুলের বালকদিগের মধ্যেও এই পাপ প্রবলাকারে ধারণ করিয়াছে।”
০৯. বাবুবিলাসীদের গণিকাযাপন
‘বাবু কালচার’ নিয়ে আলোচনা হবে আর গণিকা আসবে না, তা কখনো সম্ভব? তা না-হলে যে সানি লিওনকে ‘ভার্জিন’ বলার সামিল হবে! বাবু, অথচ তিনি গণিকা সঙ্গ লাভ করেননি বা সঙ্গ লাভের জন্য উতলা হননি, এমন ‘বাবু’ বিরল। পরে আসছি সে কথায়। ‘নববাবুবিলাস’ ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত একটি ব্যঙ্গকৌতুক নকশা। প্রকাশকাল ১৮২৫। প্রমথনাথ শর্মন ছদ্মনামে প্রকাশিত। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও আশুতোষ ভট্টাচার্য এটিকে প্রথম বাংলা উপন্যাস’-এর মর্যাদা দিলেও অধিকাংশ সমালোচক এটির উল্লেখ করেছেন একটি কৌতুক নকশা হিসাবেই পরে নববিবিবিলাস’ নামে ভবানীচরণ এই গ্রন্থের একটি দ্বিতীয় পর্বও রচনা করেন। ‘নববাবুবিলাস’ গ্রন্থের মূল উপজীব্য বিষয় উনিশ শতকের প্রথমার্ধে কলকাতার উচ্চবিত্ত সমাজের বহুসমালোচিত বাবু’ সংস্কৃতির অন্ধকার দিক। বলা যায়, এটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রচিত প্রথম বাংলা কথাসাহিত্য। গ্রন্থটি চারটি খণ্ডে বিভক্ত–অঙ্কুর খণ্ড, পল্লব খণ্ড, কুসুম খণ্ড ও ফল খণ্ড। অঙ্কুর খণ্ড, অর্থাৎ বাবুরূপ বৃক্ষের অঙ্কুর অধ্যায়ে সেকালের উদ্ধৃঙ্খল যুবসমাজের ও ঔপনিবেশিক শিক্ষাপ্রণালীর প্রতি কৌতুক কটাক্ষ নিক্ষেপ করা হয়েছে। পল্লবখণ্ড, অর্থাৎ বাবুরূপ বৃক্ষের পল্লব অধ্যায়ে নব্যবাবুদের কুসঙ্গে পড়ার চিত্র বর্ণিত হয়েছে। কুসুমখণ্ড, এই খণ্ডে বাবুদের অধঃপতনের চরম পর্যায়। বাবুর ‘নব্যবাবু’ নামধারণ, গণিকাগমন ও বিলাসব্যসন এবং ফল খণ্ড অর্থাৎ বাবুরূপ বৃক্ষের ফল অধ্যায়ে বাবুপত্নীর বিরহ, খেদোক্তি ও অবশেষে করুণ পরিণতি বর্ণিত হয়েছে।
ডক্টর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে—‘বাবুর উপাখ্যান’ বা ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যঙ্গ আখ্যানগুলি অর্ধশিক্ষিত ধনী সন্তানদের কুৎসিত আমোদপ্রমোদের কথা সাধুভাষায় বলা হলেও উদ্দেশ্যটি তত সাধু ছিল না। বাইরের দিক থেকে এসব নকশায় রঙ্গকৌতুক, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও গল্পের আমেজ থাকলেও ভিতরে ছিল ‘পর্নো’ (porno), কেচ্ছা-কেলেংকারি। সমাজের কুরীতি দেখিয়ে সভ্যভব্য মানসিকতা সৃষ্টি, এই জন্যই ভবানীচরণ ও অন্যান্য নকশাকারেরা কলম ধরেছিলেন। কিন্তু রোগের চেয়ে ঔষধই হয়েছিল প্রাণঘাতী। যাই হোক, উনিশ শতকের কলকাতার বাবু কালচারের একটি উলঙ্গ রূপ চিত্রিত করে বাংলা সাহিত্য ও সামাজিক ইতিহাসে এই গ্রন্থটি এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে।
এখন প্রশ্ন হল এই বাবু সমাজের সৃষ্টি এবং বাবু কালচারের উত্থান হল কেন? বাবুরা আকাশ থেকে পড়ল নাকি! না, হিন্দু বাঙালির অধঃপতন হল দীর্ঘ আটশো বছরের মুসলিম শাসনে নয়, অধঃপতন হল খ্রিস্টান শাসনের শুরুতেই। ১৭৫৭ সালে সিরাজের বিরুদ্ধে পলাশির যুদ্ধে জয়লাভের মধ্য দিয়ে ইংরেজ ব্রিটিশরা বাংলার শাসন ক্ষমতা লাভ করে। খ্রিস্টান ইংরেজরা ক্ষমতা লাভ করেই তাঁদের প্রণীত শাসনব্যবস্থা ও ভূমিব্যবস্থা প্রবর্তন করে। এর ফলে বাংলার গ্রাম্যসমাজের প্রচলিত কাঠামোটা ভেঙে পড়ল। ব্রিটিশরা বাংলার ক্ষমতা লাভের পর ক্রমাগত করের চাপে, দুর্ভিক্ষে গ্রামের দরিদ্র মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে। অস্তিত্ব রক্ষায় তাঁরা একে একে গ্রাম ছেড়ে শহর কলকাতার আসতে শুরু করে দিল। কলকাতা শহর হয়ে উঠল এই সব ছিন্নমূল মানুষের নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল। খ্রিস্টান ইংরেজদের সৃষ্ট এইসব নিম্নবর্গের ছিন্নমূল এবং উচ্চবর্গের শোষকরা একসঙ্গে কলকাতা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাস করতে থাকল। সতেরো শতকের শেষদিকে ইংরেজদের দ্বারা কলকাতা নগরী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
সতেরো শতকের শেষার্ধে খ্রিস্টান (ইংরেজ) শাসন স্থাপিত হওয়ায় রাতারাতি কলকাতার গুরুত্ব রাজধানী মুর্শিদাবাদকে ছাড়িয়ে গেল। গ্রাম থেকে কলকাতার নতুন নতুন মানুষের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন রঙ্গও জমে উঠছিল। বিনয় ঘোষ লিখেছেন—কলকাতা শহরে প্রথমে যে ইংরেজরা এসেছিল, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশ ছিল অস্তগামী মধ্যযুগের উচ্ছিষ্টতুল্য প্রতিনিধি। নতুন শিক্ষা বা নতুন সভ্যতার অগ্রদূত তাঁরা ছিল না। তাঁরা দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হত, হিন্দুদের পুজোপার্বণে অংশগ্রহণ করত, তৎসহ হিন্দুদের মতোই তুকতাকে বিশ্বাস করত। উচ্ছিষ্টতুল্য প্রতিনিধিদের পিছন পিছন চুল পরিচর্যাকর, বাজিকর ইংরেজরাও এসেছিল। বাংলার জমিদারদের মতো খানাপিনা ও জীবনযাপন করাটাকেই তখন ইংরেজরা আভিজাত্য মনে করত।
বঙ্গদেশে খ্রিস্টান শাসন চালু হলে ছিন্নমূল মানুষের পাশাপাশি ইংরেজদের স্পর্শ পেয়ে প্রতাপশালী ‘বাবু’ নামে এক নতুন শ্রেণির উদ্ভব হল। প্রায় ২০০ বছর আগে থেকে শিক্ষিত, ধনী পুরুষদের নামের আগে ‘বাবু’ শব্দের ব্যবহার শুরু হয়। অবশ্য তখনও ‘বাবু’ শব্দের ব্যবহার মোটামুটি ধনী, শিক্ষিতদের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল। বাবু’ পদ পূর্বে নিজে থেকে কারও ব্যবহার করার অধিকার ছিল না। এটা ছিল মুসলিম নবাব প্রদত্ত উপাধি। সম্মানিত ধনাঢ্য ব্যক্তি ছাড়া নবাবেরা অন্য কাউকে এই উপাধি দিতেন না। কিন্তু ইংরেজ শাসনের অবসানের পর সকলেই যত্রতত্র ‘বাবু’ হয়ে গেলেন।
এ সময়ে পুরোনো ধনী সম্প্রদায় বিদায় নিলেন। আবির্ভাব হল এক নব্য ধনী সম্প্রদায়ের। এই নব্য ধনী সম্প্রদায়ই বাবু’। এঁরাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং কোম্পানির সাঙ্গোপাঙ্গদের আশীর্বাদে অল্পকালের মধ্যেই বেশ ধনী হয়ে ওঠেন। রাজা, মহারাজা উপাধি নিয়ে জুড়িগাড়ি, প্রাসাদোপম বাড়ি, মোসাহেব আর দাসদাসীদের নিয়ে কলকাতার জাঁকিয়ে বসেন। এর পাশাপাশি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ চালু হওয়ার পর বাংলায় নতুন জমিদার শ্রেণির উদ্ভব হয়। এঁদেরই একটি অংশ প্রজাদের যারপরনাই শোষণ করে নিঙড়ে নিয়ে প্রভূত বিত্তশালী হয়ে উঠছিলেন। হঠাৎ গজিয়ে ওঠা এই ধনিক এবং নতুন জমিদাররাই কলকাতার বসবাস করে ‘বাবু’ সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হয়ে ওঠেন। গণিকাবিলাস সহ বিভিন্ন কিসিমের আমোদপ্রমোদই এই বাবুকুলের একমাত্র আরাধ্য ছিল। নানারকম পুজো উপলক্ষে বা কোনোরকম উপলক্ষ ছাড়াই নাচ, গান, যাত্রা, থিয়েটার, বুলবুলির লড়াই, হাফ-আখড়াই, কবিগানের আয়োজনে এই বাবুরা থাকত সদাব্যস্ত। কার আয়োজন সব থেকে জমকালো হল, তা নিয়ে রীতিমতো অলিখিত প্রতিযোগিতা চলত। জলের মতো অর্থ ব্যয় হত। ইংরেজরা নিমন্ত্রিত হত। ইংরেজরা বাবুদের তারিফ করত। প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ধনী ও জমিদারদের উপাধি দিত। এই উপাধির লোভে নব্য ধনীরা উৎসবের আয়োজনে বহগুণ বৃদ্ধি করত। এ বলে আমায় দেখ, ও আমায় দেখ। বাবু’ নামের রম্যরচনায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন–“যিনি উৎসবার্থ দুর্গাপূজা করিবেন, গৃহিণীর অনুরোধে লক্ষ্মীপূজা করিবেন, উপগৃহিণীর অনুরোধে সরস্বতী পূজা করিবেন, এবং পাঁঠার লোভে গঙ্গাপূজা করিবেন, তিনিই বাবু।”
ইংরেজরা ক্ষমতায় এসে প্রথম নিজেরাই জমিদার হল। তারপর নতুন একশ্রেণির জমিদার-তালুকদার সৃষ্টি করল এবং নিজেদের লুণ্ঠনের বকযন্ত্র চালু রাখার জন্য দালাল, গোমস্তা, মুৎসুদ্দি, দেওয়ান নিয়ে একপ্রকার এদেশি ‘জেন্টু’ গড়ে তুলল। জমিদার ও জেন্টু উভয় শ্রেণির হাতে যথেষ্ট পয়সা জমল, কিন্তু পয়সার কোনো সদগতি হল না। স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকের মতো এই মজুত পয়সা শিল্পবাণিজ্যের ক্ষেত্রে অবাধে নিয়োগ করা গেল না। সুতরাং হক্কের ধন ফক্কে উড়তে লাগল। বাঁদরের বিয়েতে ও বাপের শ্রাদ্ধে লাখ লাখ টাকা খরচ করে, বাইজি নাচে, টপ্পা খেউড়ে, বুলবুলির আর মেড়ার লড়াইয়ে, ইংরেজ প্রভুদের উপঢৌকন দিয়ে, উৎসব-পার্বণে বিদেশি প্রভুদের ও দেশি দরিদ্র নারায়ণের সেবা করে।
নতুন জমিদারদের সম্পর্কে হুতোম প্যাঁচার নক্সায় কালীপ্রসন্ন সিংহ লিখছেন, ক্ষুদ্র নবাব, ক্ষুদ্র নবাব দিব্যি দেখতে দুধে আলতার মতো রং, আলবার্ট ফ্যাশানে চুল ফেরানো, চীনের শূয়রের মতো শরীরটি ঘাড়ে-গদ্দানে, হাতে লাল রুমাল ও পিচের ইস্টিক, সিমলের ফিনফিনে ধুতি মালকোঁচা করে পরা, হঠাৎ দেখলে বোধ হয়, রাজারাজড়ার পৌত্তর; কিন্তু পরিচয়ে বেরোবে ‘হৃদে জোলার নাতি!’ কোনো কোনো বাবু আবার নিজস্বতার কারণেও প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন–“গোবিন্দরামের ছড়ি/উমিচাঁদের দাড়ি/নকু ধরের কড়ি/মধু সেনের বাড়ি”। হুতোম প্যাঁচার নকশায় কালীপ্রসন্ন সিংহ লিখেছেন–“সহরে ইংরাজী কেতার বাবুরা দুটি দল হয়েছেন; প্রথম দল উঁচুকে সাহেবের গোবরের গস্ত, দ্বিতীয় ‘ফিরিঙ্গীর জঘন্য প্রতিরূপ’; প্রথম দলের সকলি ইংরাজি কেতা, টেবিল-চেয়ারের মজলিস, পেয়ালা করা চা, চুরোট, জগে করা জল, ডিকান্টরে ব্রান্ডি ও কাঁচের গ্লাসে সোলার ঢাকনি, সালুমোড়া; হরকরা ইংলিশম্যান ও ফিনিক্স সামনে থাকে, পলিটিক্স ও ‘বেস্ট নিউজ অব দি ডে’ নিয়েই সর্বদা আন্দোলন। টেবিলে খান, কমড়ে হাগেন এবং কাগজে পোঁদ পৌঁছেন। এঁরা সহৃদয়তা, দয়া, পরোপকার, নম্রতা প্রভৃতি বিবিধ সগুণে ভূষিত, কেবল সর্বদাই রোগ, মদ খেয়ে জুজু, স্ত্রীর দাস, উৎসাহ, একতা, উন্নতির ইচ্ছা একেবারে হৃদয় হতে নির্বাসিত হয়েছে; এঁরাই ওল্ড ক্লাস।” হুতোম প্যাঁচার নকশায় কালীবাবু বাবুদের চরিত্র নিয়ে একটা ছড়া লিখলেন। আপনিও পড়ন–“আজব শহর কলকেতা।/রাঁড়ি বাড়ি জুড়ি গাড়ি মিছে কথার কি কেতা।/হেতা খুঁটে পোড়ে গোবর হাসে বলিহারি ঐক্যতা;/যত বক বিড়ালে ব্ৰহ্মজ্ঞানী, বদমাইসির ফাঁদ পাতা/পুঁটে তেলির আশা ছড়ি, শুড়ি সোনার বেনের কড়ি,/খ্যামটা খানকির খাসা বাড়ি, ভদ্রভাগ্যে গোলপাতাহদ্দ হেরি হিন্দুয়ানি, ভিতরে ভাঙ্গা ভড়ং খানি,/পথে হেগে চোখ রাঙ্গানি, লুকোচুরির ফেঁরগাঁতা।/গিলটি কাজে পালিস করা, রাঙ্গা টাকায় তামা ভরা,/হুতোম দাসে স্বরূপ ভাসে, তফাৎ থাকাই সার কথা।” শিবনাথ শাস্ত্রীর কলম সাক্ষ্য দিচ্ছে–“রাত্রিকালে বারাঙ্গণাদিগের গৃহে গৃহে গীতবাদ্য ও আমোদপ্রমোদ করিয়া কাল কাটাইত এবং খড়দহের ও ঘোষপাড়ায় মেলা এবং মাহেশের স্নানযাত্রা প্রভৃতির সময়ে কলিকাতা হইতে বারাঙ্গণাদিগকে সঙ্গে লইয়া দলে দলে নৌকাযোগে আমোদ করিতে যাইতেন।”
‘বাবু’ সম্পর্কে চমৎকার সব কথা লিখেছেন কালীপ্রসন্ন সিংহ—বাবু মাত্রেই ধনী, কিন্তু ধনী হলেই বাবু হয় না। রামদুলাল সরকারের টাকা ছিল, কিন্তু বাবু হননি। তিনি অতি দরিদ্র থেকে বাংলার শ্রেষ্ঠ ধনী হয়েছিলেন। খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন। রামদুলাল দু-বেলা নিরামিষ খেতেন। দুপুর বেলা ভাত দুধ আর দু-একটি। মিঠাই আর রাতে আটার রুটি। খুব সাধারণ পোশাক পরতেন। নিজের ছেলের বিয়েতে তিনি শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কয়েকদিনের জন্য একজন সিপাহীকে নিয়োগ করেন। সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত রামদুলাল সাধারণ বেশে বিবাহ সংক্রান্ত কাজ দেখাশুনা করতে গিয়ে কাজ শেষে পুনরায় গৃহে প্রবেশ করতে চাইলে সিপাহী রামদুলালকে চিনতে না পেরে পথরোধ করে। কারণ ধনী লোকদের জীবনযাপন এত সাধারণ হতে পারে সিপাহীটি ভাবতেই পারেনি। সাদাসিধা জীবনযাত্রায় অভ্যেস্ত মানুষ ‘বাবু’ হতে পারে না। বাবু হতে গেলে কুকুরের বিয়েতে লাখ টাকা খরচ করা, চার ঘোড়ার গাড়ি চড়ে ভেঁপু বাজিয়ে স্নান করতে যাওয়া, দু-একটি রাঁড় রাখা, রক্ষিতাদের দালানকোঠা করে দেওয়া, পায়রা ওড়ানো, বিদ্যাসুন্দরের আসর বসানো, শনিবারের রাতে বাই-বেশ্যা নিয়ে আসর বসানো ইত্যাদি করতে হয়। বহু বাবু পাল্লা দিয়ে লোক দেখানো এসব করতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছিলেন। মোট কথা—বাবু শুধু ভোগ করতে চান না, খ্যাতি চান, সকলের সঙ্গে টাকা। ওড়ানোর প্রতিযোগিতা করে সবার উপরে থাকতে চান। কলকাতার বিখ্যাত আট বাবু ছিলেন এর মধ্যে অগ্রগণ্য। কলকাতার আট বাবুর মধ্যে ছিলেন নীলমণি হালদার, রামতনু দত্ত, গোকুলচন্দ্র মিত্র, রাজা রাজকৃষ্ণ, কালীপ্রসন্ন সিংহের পূর্বপুরুষ ছাতু সিংহ, দর্পনারায়ণ ঠাকুর, রাজা সুখময় রায় এবং চোরাবাগান মিত্র বংশের এক বাবু—এঁরাই ছিলেন আট বাবু। পরবর্তীকালে নামডাক সম্পন্ন আরও বাবু এসেছিলেন, কিন্তু উপরে উল্লিখিত আটবাবুই হলেন কলকাতার প্রথম বাবু।
সিরাজদৌলার বিরুদ্ধে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের সাহায্য করার পুরস্কার হিসেবে নবকৃষ্ণ দেব পান প্রভূত ধনসম্পত্তি, জমি ও মহারাজা উপাধি। তার স্বল্পকালের মধ্যেই উত্তর কলকাতার শোভাবাজারে প্রাসাদোপম ভদ্রাসন ও দুর্গাপুজোর উপযোগী বিশাল ঠাকুর দালান তৈরি করে দুর্গাপুজো আরম্ভ করে মহারাজ কৃষ্ণদেব। প্রধানত ক্লাইভ ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের আপ্যায়নের জন্যই নবকৃষ্ণের এই দুর্গাপুজোর আয়োজন। ইংরেজদের খেতাবধারী মহারাজা নবকৃষ্ণ তাঁর এক বন্ধুকে লিখেছিলেন—“এবার পূজার সময় লর্ড ক্লাইভ আমার বাটিতে অনুগ্রহপূর্বক প্রতিমা দর্শন করিতে আসিবেন। তাঁহার সহিত কোম্পানির বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত থাকিবেন।” নবকৃষ্ণের বাড়িতে ইংরেজ সাহেবরা দুর্গাপুজো দেখতে আসবে বলে সকাল থেকে চিৎপুরে রাস্তায় লোক চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিল পুলিশ। এসব দুর্গাপুজোর অধিকাংশেরই মূল উদ্দেশ্য ছিল বিত্ত ও প্রাচুর্য। প্রদর্শন এবং পুজো উপলক্ষে আমোদপ্রমোদের আয়োজন করে ইংরেজ রাজপুরুষদের তোষণ। শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপুজো শুরু হওয়ার সময়ে অথবা পরবর্তীকালে আঠারো শতকে কলকাতায় এই ধরনের যে দুর্গাপুজোগুলো আরম্ভ হয়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—জোড়াসাঁকোর দাঁ বাড়ি ও দর্জিপাড়ার জয়রাম মিত্রের বাড়ি, দক্ষিণ কলকাতার চক্ৰবাড়িয়া সড়কের মিত্র বাড়ি, উত্তর কলকাতার বিডন স্ট্রিটের ছাতুবাবু-লাটুবাবুর বাড়ি, খিদিরপুরের ভূ-কৈলাশ রাজবাড়ি, মধ্য কলকাতার রানি রাসমণির বাড়ি। দুর্গাপুজো ছিল বাবুদের সবচেয়ে জমকালো উৎসব। সাহেবরাও এই উৎসবে যোগদান করার জন্য সবসময়ই আমন্ত্রিত হতেন এবং উৎসবের কর্তারাও নানারকম ফলমূল দিয়ে তাদের অভ্যর্থনা করতেন। উৎসবকালে প্রতি সন্ধ্যায় নাচগানের ব্যবস্থা করা হত। আমন্ত্রণ করা হত নামকরা সব বাঈজি-বেশ্যাদের। ধণিক শ্রেণি ছাড়াও এই প্রসাদ পেত সাহেবরাও। হঠাৎ কোনো বাইজী বা গণিকার প্রসিদ্ধি ছড়িয়ে পড়লে তাঁকে ‘বাঁধা মেয়েমানুষ’ হিসাবে রাখার জন্যে বাবুদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেত। এই গণিকাঁচর্চাই ছিল বাবু কালচারের অঙ্গ। কালীপ্রসন্নের লেখা থেকে জানা যায়, রাজরাজড়ারা রাতে নিজ বিবাহিত স্ত্রীর মুখ দেখতেন না। বাড়ির প্রধান আমলা, দারওয়ান, মুৎসুদ্দিরা যেমন হুজুরের বিষয়কর্ম দেখেন, তেমনই রাজরাজড়ার স্ত্রীদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়দায়িত্বও তাঁদের উপর বর্তাত। সুতরাং তাঁরাই-বা ছাড়বেন কেন! এই ভয়ে কোনো কোনো বুদ্ধিমান স্ত্রীকে বাড়ির ভিতর ঘরে পুরে বাইরে দিয়ে তালা-চাবি মেরে সারারাত নিশ্চিন্তে রাঁড় নিয়ে বা বাইজী-গণিকাদের সঙ্গে ফুর্তি করে সকালে বাড়ি ফিরতেন ‘বাবু’। ভাবছেন বাবুদের এত মদন-দহন! সেকালের মদন-দহন কেমন ছিল? কয়েকটি পংক্তি পড়ে নিন–“মদন-আগুন জ্বলছে দ্বিগুণ, কি গুণ কল্প ঐ বিদেশী,ইচ্ছা করে উহার করে প্রাণ সঁপে দিই হইগো দাসী।/দারুণ কটাক্ষ-বানে, অস্থির করেছে প্রাণে,/মনে না ধৈরজ মানে, মন হয়েছে তাই উদাসী।”
তৎকালে বিদেশে স্ত্রী-পরিবার সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার প্রথা না-থাকায় প্রায় সকল আমলা-আইনজীবী ও মোক্তারদের এক একটি উপপত্নীর দরকার হত। অতএব এই ‘উপপত্নী’র সাপ্লাই যাতে নিরবচ্ছিন্ন হতে পারে, সেই কারণে তাঁদের বাসস্থানের সন্নিহিত স্থানে স্থানে গণিকালয় প্রতিষ্ঠা পেতে থাকল। সেজন্যই উত্তর কলকাতার প্রাচীন ও সম্ভ্রান্ত শহরবাসীদের বসতি কেন্দ্রের আশেপাশেই শহরের বিখ্যাত গণিকালয় প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা যায়। শহর কলকাতায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল এইসব গণিকালয়। বাবুদের মেয়েমানুষ নিয়ে আমোদ করার জন্য যেমন, তেমন সাধারণের জন্যও শহরে গড়ে উঠেছিল নতুন তীর্থক্ষেত্র, গণিকালয়। সুতরাং এমন পাড়া ছিল না যেখানে অন্তত দশঘর গণিকা নেই। শহরে তখন যত্রতত্র এদের বসবাস। গৃহস্থের বাড়ির পাশে, সদর রাস্তার উপর, যেখানে ইচ্ছা গণিকারা বাস করত। এমনকি জোড়াসাঁকোর মূল ব্রাহ্মসমাজটি গণিকালয়ের মাঝখানেই। হুতোম প্যাঁচার নকশার মন্তব্যে কলকাতা শহর তখন ‘বেশ্যাশহর’ হয়ে পড়েছে। প্রতিবছর গণিকার সংখ্যা বাড়ছে বই কমছে না। এমনকি একজন বড়ো মানুষের বাড়ির পাশে গৃহস্থের বৌ-ঝি নিয়ে বাস করবার জো পর্যন্ত ছিল না। গণিকারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি আর গালিগালাজ করত। সাধারণ পথিকরাও তাদের হাত থেকে নিস্তার পেত না। কখনো দেখা গেল এক গণিকা রসিক বাবুকে দেখে পানের পিক ফেলতে গিয়ে তা অফিস ফেরত এক কেরানির মাথায় পড়ল। কিন্তু কেরানিটি ভয়ে কিছু না-বলে মানসম্মান নিয়ে চলে গেল। দু-একজন কেরানি এসব ইতরামি সহ্য করতে না-পেরে প্রশাসনের ভয় দেখাত। গণিকারা তখন খিলখিল শব্দে হেসে উঠে বলত–“বেশ্যাবৃত্তি করি বটে, কিন্তু তোদের মতন সাতটা কেরানিকে পুষতে পারি। কলম পিষে তোর তিন পুরুষ যা না করতে পারবে আমরা একপুরুষে তাই করেছি।”
কলকাতায় গণিকাদের পসরা এতটাই বাড়বাড়ন্ত হয়ে উঠেছিল যে, কলকাতার এক বর্ণনায় দেখা যায়–“গৃহস্থের বাড়ির পাশে বেশ্যা, ছেলেদের পাঠশালার পাশে বেশ্যা, চিকিৎসক কবিরাজ বাসস্থানের পাশে বেশ্যা, এমনকি ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরের আষ্টেপৃষ্ঠে বেশ্যা।” ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ পত্রিকার খবরে জানা যায়–“গণিকারা প্রত্যহ সন্ধ্যা হতে রাত দশটা পর্যন্ত রাজপথে দাঁড়িয়ে থেকে নিজেদের মধ্যে যে-সব কুভাষা বা কদৰ্যালাপ করত, তাতে সাধারণ পথিকরা বিব্রত হতেন। স্বভাবতই পথিকদের দেখলে গণিকারা আমন্ত্রণ জানাত, পথিকদের নানাভাবে উৎপাত করত, এমনি পথিকদের উদ্দেশে নানারকম কুকথাও বলত।” কলকাতার পুলিশ ধনীদের আশ্রিত প্রমোদপল্লি এলাকায় হস্তক্ষেপ করতে সাহস পেত না। স্থানীয় বর্ধিষ্ণু সাধারণ মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকদের নীতিবোধ ও রুচিবোধ গণিকাদের এই প্রকাশ্য ইতরামিতে ক্ষুণ্ণ হত এবং তাঁরা কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন নিবেদন করত। কিন্তু তাতে ফল কিছুই পাওয়া যেত না। বিত্তবানদের আশ্রিত গণিকারা শহরের প্রকাশ্য রাজপথে নৃত্য করতেও ভয় পেত না। স্বয়ং দ্বারকানাথ ঠাকুর কলকাতার একটি এলাকাতেই ৪৩টি গণিকালয়ের মালিক ছিলেন। মানে বাড়িগুলোর ভাড়াটেদের পেশা ছিল গণিকাবৃত্তি। কলকাতায় তাঁর আরও এরকম অনেক বাড়ি ছিল। সেকালে গণিকাদের কাছে বাড়ি ভাড়া দিলে ভাড়াটা বেশি পাওয়া যেত।
বাবু কলকাতার সেই কদর্য বেলেল্লাপনার ছবি এখন আমরা কল্পনাতেও আনতে পারি না। শহরের যত্রতত্র গজিয়ে উঠেছে গণিকপল্লি। বিত্তশালী বাবুদের প্রশ্রয়েই এইসব গণিকাপল্লী গজিয়ে উঠেছিল। অতএব প্রশাসনের সাধ্য ছিল না এহেন কালচারের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার। এইসব বাবুদের আদর্শ ছিল মূলত ইংরেজ রাজকর্মচারীরা। শ্রীপান্থ তাঁর কলকাতা’ গ্রন্থে ‘রোটি আউর বেটি অংশে লিখেছেন—-“সতীদাহ কলকাতায় তখন প্রায় প্রতিদিনের ঘটনা। সারা ব্ল্যাক টাউন চিতার ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন, অন্ধকার। সেই অন্ধকারে চলছে বাবুবিলাস, গুরু-প্ৰসাদী কৌলীন্য রক্ষা। সতীর আর্তনাদে, বিধবার কান্না আর বারবনিতার কাতর আহ্বানে অষ্টাদশ শতকের কলকাতা প্রেতপুরী। পা যেন লজ্জায় জড়িয়ে আসে সেদিকে বাড়াতে।”
গণিকালয় যে শুধু সাহেব আর বাবুদের জন্য গড়ে উঠেছিল ব্যাপারটা এমন নয়। চোর-ডাকাত, বদমাস এবং ইতরজনরাও এসব গণিকাদের কাছে যৌনক্ষুধা মেটাতে যেত। তাই বলে সব গণিকালয় একরকম ছিল না। মানুষভেদে, শ্রেণিভেদে নানা ধরনের গণিকালয় গড়ে উঠেছিল সেসময়। সন্দেহ নেই এই গণিকালয়গুলো কলকাতা শহরের এক বৈচিত্র্য ছিল এবং বিভিন্ন গণিকালয়ে বিভিন্ন ধরনের রঙ্গ চলত। মধ্য রাতে শহরের রাস্তায় সজ্জিতভাবে বহু গণিকাকে খদ্দেরের হাত ধরে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত। ভদ্রলোক বাবুরা তখন নিজেদের ঘরের স্ত্রী-কন্যাদের পর্দানসীন করে ফেলেছিলেন, আর নিজেরা ইয়ার-বন্ধুদের নিয়ে বাগানবাড়িতে বসে সেরা গণিকাদের হাট বসাতেন। ঘরের স্ত্রী-কন্যাদের এসব জেনেও মুখ বন্ধ করে বসে থাকতে হত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা দ্বারকানাথ ঠাকুরের ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হয়নি। তিনি গোমাংস খেতেন, ইংরেজদের সঙ্গে একত্রে বসে মদ আর নারী নিয়ে হৈ হুল্লোড় করতেন। তাঁর বাগানবাড়িতে বাইজিদের নাচ-গানের আসর বসত প্রায় রাতেই।
সেসময়ের শনিবারের কলকাতা ছিল শহরজুড়ে সারারাত মদ, গাঁজা আর মেয়েমানুষ নিয়ে বেহদ্দ মজা করার দিন। বিশেষ করে রামবাগান, সোনাগাছি, মেছোবাজার, সিদ্ধেশ্বরীতলা, হাড়কাটা, চাঁপাতলা, ইমামবক্স, চিৎপুর মদের গন্ধে মম করত। একেবারে নরক গুলজার! বাবু কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় যখন খ্রিস্টান হল দ্বারকানাথ মন্তব্য করেছিলেন—এই ধর্মান্তরের কারণ ‘গোরুর মাংস ও মদ্যপান’-এর সুযোগ লাভ। মধুসূদন দত্ত, রাজনারায়ণ বসু, ভুদেবচন্দ্র মুখোপাধ্যায় যখন হিন্দু কলেজে পড়তেন তখন প্রকাশ্য স্থানে বসে নিকটস্থ মুসলিম দোকান থেকে গোরুর মাংসের কাবাব এনে খেতেন এবং মনে করতেন সেটাই পুরোনোকে বর্জন করার একটা বাহাদুরি। সঙ্গে মদ্যপান তো ছিলই। বাবুরা তখন তিন ‘ম’-তে বিশ্বাসী হয়ে পড়েছিলেন—মদ, মাংস ও মেয়েমানুষ। কিন্তু মধুসূদন, রাজনারায়ণ, ভুদেবের মতো ইয়ংবেঙ্গলরা মেয়েমানুষের ব্যাপারটাকে ঘৃণার চোখে দেখতেন। এই দোষটি তাঁদের ছিল না।
কলেজের ছাত্ররা সুরাদেবীর আরাধনা করতেন বটে, তবে গণিকাসক্ত ছিল না। তাঁদের একপুরুষ পূর্বে যুবকরা আবার গণিকাসক্ত ছিলেন, কিন্তু মদ্যপান করতেন না। গাঁজা, চরস বা আফিম খেতেন। ইংরেজি শিক্ষার ফলে পুরোনো নেশা চণ্ডু, গুলি, আফিম বা কালাচাঁদ, তড়িতানন্দ বা গাঁজা বিদায় নিল নতুন জাতে ওঠা অভিজাতদের কাছ থেকে। আগে নেশাখোর বোঝাতে ‘গুলিখোর’, ‘গাঁজাখোর’, ‘চণ্ডুখোর’, আফিমশোর’, প্রভৃতি শব্দ ব্যবহৃত হত। ইংরেজি শিক্ষিতদের কল্যাণে জন্ম হল নতুন শব্দ মদখোর’। ক্রমে এঁদের হাত ধরে মদের নেশা শুরু হল বাংলার ঘরে ঘরে। একদিন এমন হল যখন মদই নেশার জগতে একনম্বর স্থান পেল। তবে সবাই তো আর ভদ্রলোক হয়ে উঠতে পারেননি। নিম্নবর্গের যে মানুষ, এঁরাই ছিলেন সংখ্যায় বেশি। শুড়ির দোকানে বা চিকিৎসকের ডিসপেনসারিতে মদ বিক্রি হত এদের জন্য। অনেকেই সেখানে দাঁড়ভোগ’ খেয়ে টলতে বাড়ি ফিরতেন। এ দৃশ্য তখন কলকাতায় গা-সওয়া। মোদ্দা কথা, তখন হয় গণিকাবাড়ি, নয় রাস্তায় গড়াগড়ি। অথবা
পুরো গড়াগড়িটাই গণিকাবাড়িতে। বাঙালি শিক্ষিতদের কল্যাণে জন্ম হল আরও একটি নতুন শব্দ ‘মাগিখোর’ বা মাগিবাজ’।
১০. ভারতের বাইজি-সংস্কৃতি ও গণিকাবৃত্তি
বাবু কালচারের কথা আলোচনা করতে গিয়ে বাইজি প্রসঙ্গটা এসেছিল। তাই বাইজি নিয়ে একটু বিস্তারিত আলোচনা করতে মন চাইছে। আমাদের সমাজে গণিকাদের মতো বাঈজিরাও ঘৃণ্য, সমাজচ্যুত, প্রান্তিক। বাইজি আর গণিকা যেন সমার্থক। বাইজিদের নাচনেওয়ালি বা নর্তকীও বলা হয়। বাইজি’ হিন্দি শব্দ বাই-এর সঙ্গে ‘জি’ যুক্ত হয়ে বাইজি’ কথাটি প্রচলিত হয়েছে। অতীতে ভারতের উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র ও গুজরাট রাজ্যে বাই’ শব্দ দ্বারা ধ্রুপদী নৃত্য-গীতে পারদর্শী সম্ভ্রান্ত মহিলাদের বোঝানো হত। খুব ছোটো থাকতেই তাঁরা ওস্তাদদের কাছে তালিম নিয়ে নৃত্যগীত শিখতেন। শিক্ষা শেষে শাস্ত্রীয় নৃত্যগীতকে পেশা হিসাবে নিলে লোকে তাদের বাই’ শব্দটির সম্মানসূচক ‘জি’ শব্দটি জুড়ে দিত, তখন তাদের নামে শেষে ‘বাইজি’ শব্দটি শোভা পেত। বাইজি অর্থ পেশাদার নর্তকী ও গায়িকা। বাইজিদের নানা নামে পরিচয় আছে, যেমন–খেমটাওয়ালি, জান, তওয়াইফ, নাচনি, নাচওয়ালি, বাইওয়ালি ইত্যাদি। বইজিরা নিজগৃহে আসর বসিয়ে অথবা বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে, মহফিল দরবারে আমন্ত্রিত হয়ে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নৃত্যগীত পরিবেশন করেন। আগেকার দিনে নবাব, নৃপতি, রাজা, মহারাজা, জমিদার, আমলাবর্গের পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁদের ঘরোয়া অনুষ্ঠানে, আসরে, রংমহলে, বাগানবাড়িতে, প্রমোদবিহারে বাইজিরা নাচ-গান করতেন।
খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে বাংলায়, বিশেষ করে কলকাতায় বাইজিদের আগমন ঘটতে থাকে। অযোধ্যার বিতাড়িত নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের (১৮২২-১৮৯৭) কলকাতার মেটিয়াবুরুজ এলাকায় নির্বাসিত জীবনযাপনকালে সেখানে যে সঙ্গীত সভার পত্তন ঘটে, তাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থান থেকে অনেক বাঈজির আগমন ঘটে। বেশিরভাগ বাইজিই রাগসঙ্গীত ও শাস্ত্রীয় নৃত্য বিশেষত কখকে উচ্চশিক্ষা নিতেন। বাইজিদের নাচ-গানের আসরকে ‘মুজরো’ বলা হয়, আবার তাকে মেহফিল বা মাহফেলও বলা হয়ে থাকে। মেহফিলে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে অংশগ্রহণ ছাড়াও কোনো কোনো বাইজি রাজা-মহারাজা-নবাবদের দরবার থেকে নিয়মিত মাসিক বেতন পেতেন। বাইজিদের নাচ-গানে মোহগ্রস্ত হওয়ার কারণে কোনো কোনো নবাব-রাজা মহারাজা বা ধনাঢ্য ব্যক্তির পারিবারিক ও আর্থিক জীবনে বিপর্যয়েরও সৃষ্টি হয়েছে। বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত বাইজিদের জন্য পরিচিত ছিল লখনউ, এলাহাবাদ, বেনারস, কানপুর, পাটনা, আগ্রা, বরোদা, কলকাতা, দিল্লি প্রভৃতি স্থান। প্রাথমিক যুগের নামকরা বাইজিদের মধ্যে ছিলেন নিকি, আসরন, জিন্নাত, বেগমজান, হিলা, মির্জাজান, নান্নিজান, সুপনজান প্রমুখ। এদের মধ্যে নিকি বাইজি ১৮২৩ সালে রাজা রামমোহন রায়ের বাগানবাড়িতে নৃত্যগীত পরিবেশন করে দেশি-বিদেশি রসিকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে খ্যাতিলাভকারী বাঈজিদের মধ্যে শ্রীজান, মুশতারি, মাশকাজান, গহরজান, জদ্দনবাই, জানকী বা ছাপ্পান্ন ছুড়ি, জোরোবাই, আবদনবাই, নাছমিবাই, নীলম, রোশনারা, আসতারি, রসুলুন, কালীবাই, হীরাবাই, কেশরবাই, সরস্বতী, মুন্নি, কানিজান, আমিরজান, গাঙ্গু, বিদ্যাধরী, সিদ্ধেশ্বরী প্রমুখের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। হেকিম হাবিবুর রহমান তার লেখায় অনেক বাইজির নাম বলেছেন, যেমন—আবেদি বাই, আমু, গা, নোয়াবিন, পিয়ারী বেগম, আচ্ছিবাই, ওয়াসু, বাতানি, হীরা, লক্ষ্মী, জামুরাদ, রাজলক্ষ্মী। এ ছাড়া সত্যেন সেনের লেখা থেকে জানকীবাই ও মালেকাজানের নাম জানতে পারি।
নাচ গান ও রূপের নেশায় উচ্চমান অর্জন হলেও কোনো পুরুষ শিল্পী কিন্তু এই সব বাইজির সঙ্গে এক আসরে বসতে চাইতেন না। কলকাতার একটি আসরে মোস্তারিবাই পূরবী রাগে খেয়াল গেয়ে সুরের মদিরায় শ্রোতাদের এমন আচ্ছন্ন করেছিলেন যে, ওই আসরে পরবর্তী শিল্পী বিখ্যাত ফৈয়াজ খা, এনায়েত খা ও হাফেজ খাঁ মঞ্চে উঠতেই অস্বীকৃতি জানলেন। ইন্দোররাজ শিবাজী হোলকারের সভার বিখ্যাত বীনাকার স্বয়ং বন্দে আলি খাঁ। বীণা বাজিয়ে সুরের ইন্দ্রজালে মুগ্ধ করেন সব শ্রোতাদের, শিবাজীর খাস নর্তকী চুন্নাবাই কিন্তু ছিলেন সেদিন মুগ্ধ শ্রোতাদের আসরে। খুশি হয়ে রাজা ইনাম দিতে চেয়েছিলেন বীণাকারকে। সুরমুগ্ধ রাজাকে চমকে দিয়ে বন্দে আলি খাঁ ইনাম হিসাবে চেয়ে বসলেন বাইজি চুন্নাবাইকে।
“বাড়ি বাড়ি বা বাঈ ভেডুয়া নাচায় বাঈ
মনোগত রাগ সুর ধরে,
মৃদু তান ছেড়ে গান, বিবিজান নেচে যান।
বাবুদের লবেজান কোরে।”
ঈশ্বরগুপ্তের কলমে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগের কলকাতায় বাইবিলাসের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন এই কবিতাটিতে। সেকালের বাবুবিলাসের প্রধান উপকরণই ছিল বাইজি ও বাইনাচ। সেই বাবুরা সাহেবদের খুশি করার জন্যেও বাইজির আমদানি করত ভিন রাজ্য থেকে। সুদূর লখনউ থেকে বাইজি আনা হত আসরে। তবে আসর সেকালের কলকাতায় কিছু ব্যাপার নয়। অষ্টাদশ শতাব্দী থেকেই কলকাতা শহরে বাইচের নেশা জড়িয়ে গিয়েছিল। কোনো উৎসব লাগলেই হল, অমনি বাইজি এসে গেল নাচঘরে। মুজরোর খরচের বহর দেখিয়ে এবং রূপ-জৌলুসের বাহারে চোখ ধাঁধিয়ে এক বাবু আরেক বাবুকে টক্কর দিয়ে বড়োই আমোদ পেতেন। বাইজি নাচ ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গেল। তবে বাইজি নাচ ক্রমশ ভারতে সীমাবদ্ধ না থেকে ইউরোপীয় সমাজেও প্রচলন হয়ে গিয়েছিল। বাইজি নাচ সেসময় স্ট্যাটাস সিম্বল হিসাবে দেখা হত। কলকাতার সাংস্কৃতিক পরিবেশ লখনউ, বেনারসের বাইজিদের স্বপ্ন দেখিয়েছে। সেরা বাইজি বলতে যা বোঝায়, তাঁর অধিকাংশই ছিল অবাঙালি।
“তখন আমি দস্তুরমতো গানের চর্চা করি। কোথায় কে গাইয়ে-বাজিয়ে এলো সব খবর আসে আমার কাছে। কাশী থেকে এক বাইজি এসেছে, নাম সরস্বতী, চমৎকার গায়। শুনতে হবে। এক রাত্তিরে ছ’শো টাকা নেবে। শ্যামসুন্দরকে পাঠালুম, “যাও দেখো কত কমে রাজি করাতে পারো।’ শ্যামসুন্দর গিয়ে অনেক বলে করে তিনশো টাকায় রাজি করালে।”—‘জোড়াসাঁকোর ধারে’ নিবন্ধে সরস্বতী বাইজির গান শোনার স্মৃতিচারণ করছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাইজির গান শুনবেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুররা শুনতেন! মাত্র দুটি গানের জন্য এক রাতে ৩০০ টাকা দিয়ে! সে যুগে ৩০০ টাকার মূল্য নেহাত কম নয়। নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্রনাথও। এহেন সিদ্ধান্ত নিয়ে অসন্তোষ চেপে রাখেননি–“অবনদা, করেছ কী! তিনশো টাকা জলে দিলে?” এদিকে শ্যামসুন্দর এসে জানালেন, টাকার সঙ্গে দু-বোতল ব্র্যান্ডিও চাই সরস্বতীর। ব্র্যান্ডি না-খেলে তিনি নাকি গাইতেই পারেন না। অবনীন্দ্রনাথ তাতেও রাজি। গান তিনি শুনবেনই। সরস্বতী গাইতে শুরু করলেন রাত ১০টায়। একটা গানেই রাত ১১ টা বাজল। এ প্রসঙ্গে অবনীন্দ্রনাথ লিখছেন–“এক গানেই আসর মাত। গানের রেশে তখনও সবাই মগ্ন। সরস্বতীবাই বললেন, “আওর কুছ ফরমাইয়ে’।” তাঁকে এরপর একটা ভজন গাইতে বললেন অবন ঠাকুর। সরস্বতী গাইলেন ‘আও তো ব্রজচন্দলাল। মুগ্ধতার মীড়ে আরও একবার টান পড়ল। অবনীন্দ্রনাথ তাড়াতাড়ি করে ছবি এঁকে রাখলেন তাঁর। গান শেষ, বাই উঠে পড়লেন। অবনীন্দ্রনাথের মনে হল, দু-খানা গানের জন্য ৩০০ টাকা দেওয়া সার্থক।
নগেন্দ্রনাথ ঘোষ এক জায়গায় বলছেন, কলকাতায় বাইজি নাচের প্রবর্তক রাজা নবকৃষ্ণ দেব। তাঁর ইংরেজ আনুগত্য ছিল প্রশ্নাতীত। এই নবকৃষ্ণই ছিলেন কবিয়াল হরু ঠাকুর ও নিতাই দাসেরও পৃষ্ঠপোষক। তাঁর সভায় বাইচের আয়োজন হত ‘এলিট’ সাহেব-সুবো আর বাবুদের জন্য। কবিগানের দরজা সেখানে সাধারণের জন্যেও ভোলা। এমন ‘নষ্ট মেয়েমানুষ’ বাইজিদের নাচ-গানের পরে সেই কবিগানকে ঘোর অশ্লীল মনে হয়েছিল রেভারেন্ড ওয়ার্ডের। ১৮০৬ সালে শোভাবাজারের রাজা রাজকৃষ্ণ দেবের বাটিতে তিনি আমন্ত্রিত হয়েছিলেন বাই নাচ দেখতে। এই আয়োজন বাছাই করা মানুষদের জন্য। ভোররাতে বাই নাচের পরে শুরু হল হরু ঠাকুর আর নিতাই বৈরাগীর কবিগান। বন্ধ দরজা হাট করে খুলে দেওয়া হল সাধারণের জন্য। পিলপিল করে ঢুকল লোক। শুরু হল ‘অশ্লীল’ কবিগান। রেভারেন্ড ওয়ার্ডের মনে হল, বাই নাচের একদম বিপরীত মেজাজের অনুষ্ঠান এসব।
তবে নিন্দে-মন্দর বিপরীত স্রোতও ছিল সে সময়। সেখানে খেমটা নাচ আর বাইজি নাচের মধ্যে রুচি ও সংস্কৃতির পার্থক্যও খোঁজা চলছিল। দেখা গেল, বাইজি নাচ তুলনামূলক অনেক সভ্য, শালীন। বাইজি নাচকে ভুলবশত মহারাষ্ট্রের নৃত্য হিসাবে উল্লেখ করে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বঙ্গদর্শন’-এ লিখেছেন–“খেমটা তান্ত্রিক, মহারাষ্ট্র নৃত্য পৌরাণিক। পুরাণের ন্যায় এই নৃত্যের গাম্ভীর্য আছে।” খেমটা এই লেখার লেখকের চোখে ‘ছোটলোকের আমোদ’, ‘কুৎসিত নাচ’। সাধারণী’ পত্রিকাও খেমটাকে ‘নীচ ভাববাদ্দীপক জঘন্য’ নাচ বলে প্রশংসা করছে বাই। নাচের। অর্থাৎ বাই নাচের শ্রেণিচরিত্রগত একটি পার্থক্যও স্বীকৃত হচ্ছিল সমাজে। ভাবটা এমন যেন বাইরা ‘নষ্ট মেয়েমানুষ’ হতে পারে, কিন্তু তাঁদের শিল্পটি উচ্চাঙ্গের। তা উচ্চকোটির আস্বাদনের সামগ্রী।
বাইজি মানেই যেমন গণিকা নয়, তেমনি গণিকা মানেই বাইজি নয়। আবার বাইজিও গণিকা হতে পারে, গণিকাও বাইজি হতে পারে। তাই আমাদের সমাজে বাইজি আর গণিকা সমার্থক হয়ে আছে। ভবানীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ও বাইজি আর গণিকাকে একই মনে করতেন। তিনি তাঁর ‘নববাবুবিলাস’ গ্রন্থে লিখেছেন–“গাওনা বাজনা কিছু শিক্ষা করো যাহাতে সদা জিউ খুসি থকিবেক এবং যত প্রধানা নবীনা গলিতা যবনী বারাঙ্গনা আছে ইহাদিকের বাটীতে মধ্যে মধ্যে যাতায়াত করিয়া ঐ বারাঙ্গনাদিকের সর্বদা ধনাদি দ্বারা তুষ্ট রাখিবা, কিন্তু যবনী বারাঙ্গনাদিগের বাই বলিয়া থাকে, তাহা সম্ভোগ করিবা, কারণ পলাণ্ড অর্থাৎ পেঁয়াজ ও রশুন যাহারা আহার করিয়া থাকে তাহারদিগের সহিত সম্ভোগে যত মজা পাইবা এমন কো রাঁড়েই পাইবা না।”
বাইজি যেমন নাচ ও গান করত, তেমনই দেহসম্ভোগও করত। তা ছাড়া সেসময়ে নাচা-গানা একমাত্র বাইজি নারীরাই করত। দেবদাসী, গণিকারাও নাচত। সাধারণ নারীদের তা নিষিদ্ধ ছিল। সেই কারণেই নৃত্যশিল্পী বা নাচনেওয়ালি বা নর্তকীদের ঘৃণার চোখে দেখা হয়। সেসময় নাচ করা মেয়েদের বিয়ে দেওয়া মুশকিল ছিল। যেসব মেয়েরা শখ করে নাচ করত তাঁদের ‘বাইজি’ বা ‘নর্তকী’ বলে ঘৃণা করত সমাজ। আজও রক্ষণশীল পরিবারের বাবা-মায়েরা কখনোই নাচ করা মেয়ের সঙ্গে তাঁদের ছেলের বিয়ে দেন না।
বাইজির পেশার বাইরে মেয়েদের নাচ করার অভ্যেস শুরু হয়েছে, এই তো সেদিন। যাই হোক, গণিকাদের যেমন প্রকারভেদ ছিল, বাইজিদেরও প্রকারভেদ ছিল। বাইজিদেরকে চার শ্রেণিতে ভাগ করা হত। যেমন—(১) যাঁর নামের সঙ্গে ‘বাই’ শব্দটি থাকত, তিনি শুধুই গান করতেন। যেমন–মুন্নিবাই। (২) যাঁর নামের সঙ্গে ‘জান’ শব্দটি ব্যবহৃত হত, নাচ ও গান উভয়ই করতেন। যেমন–গহরজান। (৩) যিনি কেবলই অতিথিদের আদর-আপ্যায়ন করতেন, তাঁকে ‘কানিজ’ বলা হত। (৪) যিনি কেবলই গণিকাবৃত্তি করতেন, তাঁকে ‘খানাগি’ বলা হত। বাবুদের অবশ্য সবই চলত।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে কলকাতায় বাবুগিরির বড়োই টালমটাল অবস্থা হল। বাণিজ্যলক্ষ্মীর কৃপা থেকে বঞ্চিত হতে থাকল বাবুরা। কেউ উঠতির মুখে তো কেউ পড়তির মুখে। বাইজি নাচ ও খেমটা নাচ সেকালে ঢাকার মানুষদেরও জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কবি নবীনচন্দ্র সেন তাঁর ছেলের বিয়েতে ঢাকা থেকে বাইজি আনতে পেরে গর্ব অনুভব করেছিলেন। ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলে বাইজি বা গণিকাঁপাড়া ছিল। সে সময় বাইজিপাড়া হিসাবে গঙ্গাজলি ও সাঁচিবন্দর ছিল। ঢাকার ইসলাম পুর ও পাটুয়াটুলির মোড় থেকে যে পথটি ওয়াইজঘাট নামে বুড়িগঙ্গার দিকে চলে গেছে তার নাম ছিল গঙ্গাজলি। সন্ধ্যা নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে তবলার বোল, সেতারের ঝংকার আর নুপুরের নিক্কণ গঙ্গাজলির পরিবিশ মুখরিত হয়ে উঠত। বাবু আর সাহেবদের আলবোলার গুড়গুড় শব্দ পরিবেশের সঙ্গে ছিল সংগতিপূর্ণ।
নাট্যকার সাঈদ আহমেদ তাঁর একটি লেখায় বলেছেন—কাছেই ছিল মহেশ ভট্টাচার্যর বিশাল হোমিওপ্যাথিক ওষুধের দোকান, গঙ্গাজলির উল্টোদিকে ছিল কালীমন্দির। গঙ্গাজলি ছিল দোতালা প্রশস্ত বাড়ি। নীচতলায় বাইজিদের কাজের লোকেরা থাকত। বাইজিরা থাকতেন দোতালায়। বাঁকওয়ালা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হত। বারান্দায় পাতা থাকত ইজিচেয়ার। বাইজিদের খাসকামরা সাজানো থাকত শান-শওকতে। ফরাশ বিছানো ঘর।
গঙ্গাজলির অধিকাংশ বাঈজিরা প্রতিদিন সকালে গঙ্গাজলি থেকে স্নানের জন্য দল বেঁধে বুড়িগঙ্গায় যেতেন। স্নান সেরে বুকে গামছা জড়িয়ে কোমড়ে পিতলের কলসি নিয়ে সিক্ত ভূষণে বাইজিরা লাইন দিয়ে ফিরে আসতেন। এ দৃশ্য উপভোগ করতে কৈশোরে বন্ধুদের নিয়ে ওয়াইজ ঘাট এলাকায় যেতেন নাট্যকার সাঈদ আহমেদ। শিল্পী পরিতোষ সেনও কিন্তু ভুলে যাননি সিক্ত বসনে বাইজিদের ঘরে ফেরার দৃশ্যর বর্ণনা দিতে। তিনি লিখছেন—“আমাদের পাড়ায় বারবনিতারা প্রতিদিন সকালে স্নান করতে বুড়িগঙ্গা যায়। তাঁদের স্নানে যাওয়ার পথটি আমাদের বাসার সামনে দিয়ে। ফেরার পথে ভেজা কাপড়ে কালী মন্দিরে প্রণাম করে আমাদের গলির মুখে আবার দেখা হয়। সকালবেলার এই মনোরম দৃশ্যটি আমাদের পাড়ার পুরুষদের চোখকে বেশ তৃপ্তি দিত। তাঁদের মন মেজাজ খোশ রাখে। দিনটি ভালো কাটে।” সদ্যস্নাত তরুণীদের প্রথম সারির মাঝখানে ১৬ ১৭ বছরের একটি মেয়ের আকর্ষণীয় বর্ণনাও দিয়েছিলেন পরিতোষ সেন। সেই সরস বর্ণনা শামীম আমিনুর রহমানের একটি লেখায় পাচ্ছি—“মুখটি অবিকল লিচুর মতো গোল। থুতুনিটি ঈষৎ তীক্ষ্ণ, ঠোঁট দুটি যেন রসালো দুটি কমলার কোয়া। তাঁর নাকের ছোট্ট পাটা দুটি প্রতিটি নিঃশ্বাসের সাথে সাথে ফুলে ফুলে উঠছিল। গোটা শরীরটি যেন মুর্শিদাবাদী রেশম দিয়ে মোড়ানো। এমনই মসৃণ আর চকচকে তাঁর ত্বক। পাকা পাতিলেবুর গায়ে হাল্কা গোলাপি রঙের পোঁচে যে রঙের মিশ্রণ হয় ঠিক তেমনই তাঁর গায়ের রঙটি। তার নীল কালো চোখ। দুটি যেন স্তম্ভিত মেঘ মুখের অর্ধেকটাই জুড়ে আছে।” পরিতোষ সেন আরও বর্ণনা দিয়েছেন—“ভেজা কাপড়টি মেয়েটির গায়ে লেপটে থাকায় কারণে তাঁর শরীরের প্রতিটি অঙ্গ যেন একটি ফুলের বিভিন্ন পাপড়ির মতো আলাদা সত্ত্বা নিয়ে সরল বৃন্তটির উপর দাঁড়িয়ে আছে। এক একটি পাপড়ি যেন একেকটি ফুল। বাকি মেয়েকটির মতো তার কাঁধেও পেতলের কলসি ভরা বুড়িগঙ্গায় জল। এই কলসি আর নিতম্ব দুইই মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। দুইই টলোমলো। এমনই সুন্দর সাবলীল আর বেপরোয়া।”
সত্যেন সেন তার রচনায় ঢাকার জানকীবাইয়ের কথা বলেছেন। এলাহাবাদের মেয়ে ছিলেন। থাকতেন ঢাকায়। সে সময় তিনিই ঢাকার সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক প্রাপ্ত বাইজি ছিলেন। একদিনের মুজরোতে তাঁকে ১৫০০ টাকা দিতে হত তৎকালীন সময়ে। জানকী ছিলেন এক নবাবের রক্ষিতা। নবাব তাতে এতই মুগ্ধ ছিলেন যে, কেউ যেন তাঁর কাছ থেকে জানকীকে ছিনিয়ে নিতে না পারে সেই জন্য কিছুটা কুৎসিত করার নিমিত্তে জানকীকে ৫৬ টি ছুরির আঘাত করেছিলেন। সে কারণে জানকী ছাপান্ন ছুড়ি নামে পরিচিত ছিল। ঢাকার বাঈজিদের নিয়ে তথ্য পাওয়া যায় হেকিম হাবিবুর রহমানের লেখায়। এলাহিজান উত্তর ভারত থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। নওয়াব আবদুল গনির কাছ থেকে তিনি নিয়মিত মাসোহারা পেতেন। নবাব সাহেবের কাছ থেকে আরও অনেকে মাসোহারা পেতেন, যাঁদের কথাও হেকিম সাহেব তাঁর লেখায় উল্লেখ্য করেছেন। হেকিম হাবিবুর রহমানের লেখায় পাওয়া যায় আচ্ছিবাইকে। আচ্ছিবাইকে নবাব সাহেবের সব থেকে ‘পেয়ারী বাইজি’ বলে উল্লেখ্য করেন। লক্ষ্ণৌর এই বাইজি ছিলেন নৃত্যে সুনিপুণা। হেকিম সাহেবের মতে ঢাকায় এরপরে এত বড়ো মাপের আর কোনো নর্তকী আসেনি। হীরা বাইজি নাকি নাচে খুব দক্ষ ছিলেন, হীরা বাইজি যখন নাচতেন তখন তাঁর গায়ের কালো রং থেকে নাকি আলো ঠিকরে পড়ত। হীরা বাইজির মেয়ে পান্না কিন্তু গজল গেয়ে সুখ্যাতি অর্জন করেছিল।
সত্যেন সেনের লেখায় মালকাজান সম্বন্ধে জানা যায়। মালকাজান মুজরো করতে ঢাকা আসতেন। সে সময় তিনজন মালকাজান ছিলেন। আগ্রাওয়ালি মালকাজান, বেনারসের চুলবুলিয়া মালকাজান ও ভাগলপুরী মালকাজান। উপমহাদেশের বিখ্যাত বাইজি গওহরজান ছিলেন বেনারসের চুলবুলিয়া বা বড়ো মালকাজানের কন্যা। অসামান্য রূপসী মালকাজানের পূর্ব নাম ছিল লেডি এডেলাইন। আর্মেনিয়ান ইহুদি। স্বামী রবার্ট ইউয়ার্ডের সঙ্গে বিচ্ছেদ হলে পরে এডেলাইন বাইজিবৃত্তি গ্রহণ করে। এরপর ইসলাম ধর্মগ্রহণ করে নিজের নাম রাখেন মালকাজান। আর মেয়ে এঞ্জেলিনার নাম রাখেন গওহরজান। গওহরজান ছিলেন ভীষণ শৌখিন আর ফ্যাশন সচেতন। নিজেকে সবসময়ই সাজিয়ে গুছিয়ে উপস্থাপন করতেন। বস্তুত গওহরজানের হাত ধরেই কিন্তু শিল্পীদের ফ্যাশন সচেতনতা এ দেশে শুরু হয়। গওহরজানের মা মালকাজানের সৎ বোন ছিল জদ্দনবাই। জদ্দনের মা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং জীবিকার কারণে মেয়েকে বাই হিসাবে তৈরি করে। জদ্দনবাই বেশ কয়েক বার বিয়েও করেন। জদ্দনবাই ঢাকার বিভিন্ন মেহফিল মাতিয়ে রাখতেন। তিনি ঢাকার নবাবের ঘনিষ্ট সান্নিধ্য পেয়েছিলেন বলেও জানা যায়। জদ্দনের শেষ স্বামী উত্তম চাঁদমোহন জদ্দনের প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে মুসলমান হন, আর তাঁকে বিয়ে করেন। মোহন নিজের নাম রাখেন আবদুর রশিদ। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ এ বিয়েতে সাক্ষী হন।
১৮৭৩ সালে কলকাতার মেয়েরা যখন রঙ্গমঞ্চে আসার অনুমতি পেলেন, তখন সর্বপ্রথম গণিকাপল্লির সংগীতে পারদর্শীরাই কিন্তু মঞ্চে এসেছিলেন। তখন থেকে বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশক পর্যন্ত কিন্তু সমস্ত অভিনেত্রীরাই সুগায়িকা ছিলেন। এ প্রসঙ্গে বিনোদিনী, তিনকড়ি, তারাসুন্দরী থেকে বিংশ শতাব্দীর আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালা পর্যন্ত অনেকের কাছে নাম করা যায়। কাননদেবী এখনও অনেকেরই প্রিয়। কাননদেবী অভিনয়ও করতেন। ঢাকার প্রথম পূর্ণাঙ্গ নির্বাক চলচিত্র ছিল ‘দ্য লাস্ট কিস’-এর নায়িকা ছিল ললিতা। তাঁকে বাদামতলির গণিকাপল্লি থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল। তাঁর আসল নাম ছিল বুড়ি। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর। দ্যা লাস্ট কিসের সহ নায়িকা চারুবালাকে আনা হয় কুমারটুলির গণিকালয় থেকে। জিন্দাবাহার লেন থেকে আনা হয়েছিল দেববালাকে।
বাইজি বা গণিকা থেকে যেমন অভিনেত্রী ও গায়িকার ইতিহাস আছে, তেমনি বাইজি থেকে বেগম হওয়ার ইতিহাসও আছে। যেমন–মণি বা মুন্নিবাই। ইতিহাসের এক ধূলি-সময়ের কথা। মুন্নিবাই ছিল নবাব আলিবর্দি খাঁর জলসাঘরের এক বাইজি। অসম্ভব সুন্দর দেহবল্লরীর অধিকারিণী ছিলেন তিনি। তাঁর রূপ-মাধুরী আর নাচের নুপুরের নিক্কণে নবাব অন্দরমহলের অনেক যুবা পুরুষেরই অন্তরে কাঁপন ধরত। মিরজাফরেরও অন্তর কাঁপিয়েছিল এই নর্তকী। আলিবর্দি খাঁর প্রধান সেনাপতি থাকা অবস্থায় মিরজাফর প্রায়ই জলসাঘরে গিয়ে মুন্নিবাইয়ের সঙ্গে ফুর্তি করত। তখন থেকেই তাঁর স্বপ্ন ছিল মুন্নিবাইকে বিয়ে করার।কিন্তু রাজকীয় প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী জলসাঘরের কোনো নর্তকী অভিজাত মুসলমানের পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব ছিল না।মিরজাফর তাঁর লালিত স্বপ্ন পূরণ করেন পলাশি যুদ্ধের পর পুতুল নবাব হয়ে। তাঁর প্রথম স্ত্রী শাহ বেগমের আকস্মিক মৃত্যু হলে তাঁর স্বপ্নপূরণের সুযোগ এসে যায়। সমস্ত লোকলজ্জার মাথা খেয়ে তিনি এই নর্তকী মুন্নিবাইকে বিয়ে করে বেগমের মর্যাদা দেন।এইভাবেই শুরু হয়েছিল মুর্শিদাবাদে জেনানা মহলে বাইজি থেকে বেগম হওয়ার অধঃপতিত কাহিনি।
কথিত আছে, ‘দুশ্চরিত্রা’ এই মুন্নিবাইকে মিরজাফর আর-এক লম্পট লর্ড ক্লাইভের কাছে মনোরঞ্জনের জন্য পাঠাতেন। মুন্নিবাই তাঁর রূপ-মাধুরীতে বিমুগ্ধ করত ক্লাইভকে। সেইসঙ্গে তাঁদের নাবালক পুত্র নাজিমের জন্য বাংলার পরবর্তী নবাবের পদটিও নিশ্চিত করিয়ে নিয়েছিলেন। প্রায় সময়েই মিরজাফর অন্যান্য নারী ও নর্তকীদের সঙ্গে সুরাপানে মত্ত থাকত, আর এইসব নারীদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ করে দিত স্বয়ং মুন্নিবাই। এই সুযোগে মুন্নিবাইও রাজমহলের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতেন। বাংলার নবাবিও চালাত ইংরেজ লর্ডদের সঙ্গে যোগসাজস ও মনোরঞ্জন করে এই নাচনেওয়ালি। তাহলে দেখা যাচ্ছে মুন্নিবাই বাইজি থেকে বেগম হলেন বটে, কিন্তু বেগম থেকে যে-কোনো স্বার্থে গণিকা হতেও তাঁর আপত্তি ছিল না।
বাইজিদের জীবনে যেমন হাসি-আনন্দ আছে, তেমন আছে দুঃখ-বেদনারও ইতিহাস। গণিকা ও বাইজি নামোচ্চারণে ছিল সমাজের বাঁকা চোখের ভ্রুকুটি। সমাজ তাঁদের অপাঙক্তেয় করে রাখলেও সমাজের ব্যক্তিবর্গরা তাঁদের গুণপনাকে কাজে লাগাতে কসুর করেনি। কিন্তু তাঁদের ভিতর কিন্তু সুরেবেসুরে বেজে উঠত–“ছিঃ ছিঃ এত্তা জঞ্জাল”। গণিকাদের মতোই বাইজিদেরও দিনগত বৃত্তিক্রিয়া যেন জীবন-মৃত্যুর সহবাস। গানই ছিল তাঁদের পারাপারের কাণ্ডারী। গানেই তাঁদের মুক্তির আনন্দ, গানেই পরিস্ফুট বেদনার কান্না। বাইজিদের কিছু গান আমি এখানে উল্লেখ করব। যেসব গানে খুঁজে পাবেন বাইজদের সুখ-দুঃখ-যন্ত্রণার কাহিনি।
(১) লুম খাম্বাজ # কাওয়ালি
অনেক দিনের পরে দেখা, কেমন ছিলে বলো না।
দাসী বলে গুণমণি, মনে কি হে ছিল না।
আসি বলে চলে গেলে, সে আসা কি এই আসিলে
ভালোবাসি বলে কি রে, আসিতে ভালোবাসো না।
তোমা সনে প্রেম করে, জ্বালাতন যার পরে,
যত দুঃখ সই অন্তরে, জেনেও কি তা জানো না।
(২) খেমটা
অমন করিয়ে আঁখি আর ঠের নারে।
আর ঠের না আঁখি প্রাণে মেরো নারে।
তুমি যে চাওনি চাও, ও চাউনি কোথা পাও,
উড়ে যায় প্রাণপাখি মন তত বোঝে নারে।
(৩) কাওয়ালি
আগে আমার ছিল না সে জ্ঞান।
তুমি হইবে জাদু, পরেরই পরান।
তোমাতে আমারি আশ, তুমি হলে পরবশ,
অমৃত জানিয়ে বিষ, করিছিরে পান।
(৪) মিশ্র বেহাগ # খেমটা
আছে যার নয়ন।
রূপে যদি না ভোলে তার মন,
জানি নয়ন তার কেমন।
ধীরে ধীরে নয়নে পশে, রূপ হৃদয়ে বসে,
গুমোর যায় ভেসে, রূপে মন বসে,
জোর চলে না, বুঝ মানে না,
সাধে মন পায়ে বাঁধন।
নয় তো পরে কে করে যতন।
(৫) খাম্বাজ # একতাল
আজ তোমাকে দেখতে এলেম, অনেক দিনে পরে।
ভয় নাইকো সুখে থাকো, অধিকক্ষণ থাকব নাকো,
আসিয়াছি দু-দণ্ডেরি তরে।
দেখব শুধু মুখখানি, শুনব দুটি মধুর বাণী,
আড়াল থেকে হাসি দেখে, চলে যাব দেশান্তরে।
কোনো কোনো বাইজি সামাজিক কল্যাণমূলক কাজের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। সময়, চাহিদা ও মূল্যবোধের পরিবর্তন, নবাব-রাজা-মহারাজাদের পতন ইত্যাদি কারণে বাইজিদের অস্তিত্ব এখন লুপ্ত হয়েছে। তাঁদের নৃত্য সঙ্গীতে পারদর্শিতা, রূপলাবণ্য ও গুণের কথা কেবল বিধৃত হয়ে আছে বিভিন্ন লেখায়। আজও বউবাজার এলাকার বহু অট্টালিকা (বাইজিবাড়ি) ভগ্নপ্রায় অবস্থায় নির্জনে পড়ে আছে। আছে কিছু বাইজি পরিবার। কিন্তু সেখানে আর সুরের কলতান শোনা যায় না, বেলোয়ারি ঝাড়ে বাতি জ্বলে না, রসিকজনের যাতায়াতও আর নেই।
১১. ব্রিটিশ-ভারতে গণিকাদের সামাজিক অবস্থা
কলকাতায় প্রথম বিচারালয় স্থাপনের পর অ্যাটর্নি হয়ে এসেছিলেন উইলিয়াম হিকি। ১৭৭৭ সাল থেকে ১৮০৮ সাল পর্যন্ত হিকি সাহেব কলকাতায় ছিলেন। লন্ডনে ফেরার পর তাঁর স্মৃতিকথায় (১৭৪৯-১৮০৯) যা লিখেছিলেন সেটি শৈশবের কলকাতার সামাজিক ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল হিসাবে স্বীকৃত বলা যায়। হিকি মিস ডানডাস নামে মহানগরের এক ‘বহুজন পরিচিতা বারাঙ্গনা’র কথা তাঁর স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন। আধুনিক যুগে কলকাতা ও সন্নিহিত অঞ্চলে গণিকাবৃত্তির সূচনা যে ব্রিটিশ আমলেই হয়েছিল, তাতে কোনো সংশয় নেই। আধুনিক শহরের সমস্ত কদর্যতাকে সঙ্গে নিয়ে নগর কলকাতার ক্রমবিকাশ হয়েছে। আর এদেশে নবপর্যায়ে গণিকাবৃত্তির উদ্ভব বৃটিশদের হাত ধরেই। ১৭৯৫ সালে রুশ যুবক হেরাসিম লেবেদফ যখন কলকাতায় অস্থায়ী মঞ্চ বেঁধে প্রথম বাংলা থিয়েটারের সূচনা করলেন, তখন সেই নাটকে নারী চরিত্রে অভিনয়ের জন্য গণিকাপল্লির মেয়েদের এনেছিল। কারণ তখনকার সময়ে সাধারণ ভদ্রঘরের মেয়েদের যাত্রা নাটকে অভিনয় করা নিন্দনীয় ছিল। এমনকি যাত্রা-নাটক দেখাটাও ছিল নিন্দনীয়। বলা হত–যাত্রা দেখে ফাত্রা লোকে। সে যুগে ফাত্রা’ শব্দটি চরিত্রহীন মানুষদের বোঝাত।
যাই হোক, হিকি সাহেবের স্মৃতিকথা থেকেই জানা যাচ্ছে, ১৭৯৫ সালের অনেক আগে থেকেই গণিকাপল্লির অস্তিত্ব ছিল। শুধু কলকাতা নয়, বাংলার সমৃদ্ধ শহরগুলি, যেখানে ব্রিটিশরা কোর্ট-কাছারি ইত্যাদি খুলেছিল, সেখানেই সন্নিহিত অঞ্চলে গণিকাপল্লি গড়ে উঠেছিল। ব্রিটিশদের সহায়ক বাবু সমাজের পৃষ্ঠপোষকতায় গণিকাপল্লিগুলো ফুলে-ফেঁপে উঠতে থাকল গোটা উনিশ শতক জুড়ে। রক্ষিতা পোষণ, গণিকাগমন তখনকার সমাজ শুধু অনুমোদনই করত না, এইসব বেলেল্লাপনা ছিল তাঁদের মর্যাদা সূচক।
ইংরাজের নতুন ভুমিব্যবস্থা গ্রাম্য সমাজকে ভেঙে তছনছ করে দিল। ফলে বংশানুক্রমিক পেশা ও বৃত্তি থেকে উৎখাত হয়ে যেমন চোর ডাকাতের দল সৃষ্টি হয়ে শহরে আশ্রয় নিল, তেমনই দারিদ্রের তাড়নায় শহরের গণিকাপল্লিতে আশ্রয় নিল মেয়েরা। ১৮৭২ সালের সরকারি নথিপত্র থেকে জানা যায় যে, কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার গণিকারা অধিকাংশই তাঁতি, তেলি, জেলে, কৈবর্ত, ময়রা, চামার, কামার, কুমোর, যুগী, গোয়ালা, নাপিত, মালি, বেদে ইত্যাদি সম্প্রদায়ের। এই সময়ে কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে গণিকাদের সংখ্যা কীরকম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছিল, তা জানা যায় এই তথ্য থেকে। কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের ১৮৬৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বরের হিসাবমতো ৩০০০ মেয়ে গণিকাবৃত্তিতে এসেছিল। ১৮৮০ সালের এক হিসাবে শহরে গণিকাদের সংখ্যা ছিল ৭০০০, আর ১৮৯৩ সালে সেই সংখ্যাটা বেড়ে হয়েছিল ২০,১১৬। শুধু সমাজের নিম্নবর্গের মেয়েরাই নয়, কুলীন ঘরের বহু মেয়েও অবস্থার দুর্বিপাকে আশ্রয় নিত গণিকাপল্লিতে। সরকারি প্রতিবেদনে স্বীকার করা হয়েছিল যে, গণিকাদের সংখ্যা বৃদ্ধির একটা কারণ হিন্দু বিধবাদের গণিকাপল্লিতে আশ্রয়। বিধবাবিবাহ প্রথা চালু না-হওয়ায় লালসার শিকার বিধবা তরুণীদের শেষ আশ্রয় ছিল এই গণিকাপল্লি। সরকারি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল—“হিন্দুর বিবাহ-বিচ্ছেদ নেই, বিধবা হলে হয় পবিত্র হও, নচেৎ বেশ্যা হও।” সরকারি প্রতিবেদন অনুযায়ী হিন্দু বিধবারা প্রধানত হুগলি, বর্ধমান, হাওড়া, চব্বিশ পরগনা, মেদিনীপুর ও ওড়িশা থেকে আসত। তরুণী বিধবারা বাবুদের লালসার শিকার হতেন, কেউ কেউ গর্ভবতী হয়ে পড়তেন। শেষপর্যন্ত তাঁদের আশ্রয় হত গণিকালয়ে। দারিদ্র, দুর্ভিক্ষ, ইত্যাদি কারণে মা, মেয়ে উভয়কেই আশ্রয় নিতে হত গণিকাপল্লিতে। মুহূর্তের ভুলে (তখন তো কোনো গর্ভনিরোধক ব্যবস্থা ছিল না) গর্ভবতী নারী আত্মহত্যা না করে বাঁচার উপায় খুঁজেছেন গণিকালয়ে আশ্রয় নিয়ে। আবার বহুবিবাহের শিকার নারী প্রেমিকের হাত ধরে কুলত্যাগিনী হয়েছেন। অবশেষে এসে ভিড়তে হয়েছে গণিকাপল্লিতে।
সতেরো শতকে তৎকালীন ভারতের পর্তুগিজ উপনিবেশ গোয়া ছিল পর্তুগিজ দাস’ নামক সম্প্রদায় নিয়ে গঠিত পর্তুগিজদের একটি শক্তিশালী ঘাঁটি। এই পর্তুগিজ দাস’ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল অল্পবয়সি জাপানি মহিলারা, যাঁদের পর্তুগিজ বণিকেরা ধরে বেঁধে এনে যৌনদাসী হিসাবে ব্যবহার করত—এদের বলা হত “জাপানি দাস’ এবং এছাড়াও ছিল জাপান থেকে আগত বন্দি দক্ষিণ এশীয় খালাসি। অষ্টাদশ শতকের শেষে এবং ঊনবিংশ শতকের শুরুতে ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের আমলে, ব্রিটিশ সৈন্যরা তাঁদের কামনা চরিতার্থ করবার জন্য অল্পবয়সি মেয়েদের সেক্স-টুল হিসাবে ব্যবহার করে কিছু আরামপ্রদ স্থান তৈরি করেছিল। ব্রিটিশ সেনারা এই স্থানগুলি তাঁদের নিজেদের গণিকাবলয় হিসাবে ব্যবহার করত। বিবিসি’-র একটি নিবন্ধ জানাচ্ছে, ব্রিটিশ সৈন্যরা মুম্বাইয়ের মতো ভারতের বিভিন্ন শহর জুড়ে গণিকালয় তৈরি করতে সাহায্য করেছিল। ভারতীয় খালাসি সমুদ্র নাবিকরা, যাঁদের জোর করে যুক্তরাজ্যের ব্রিটিশ সেনাবিভাগে নিয়োগ করা হত, তাঁরা তাঁদের মালিকদের অনুকরণ করে অহরহ সেখানকার স্থানীয় ব্রিটিশ গণিকালয়ে গমন করত। ঊনবিংশ ও বিংশ শতকের শুরুতে উপমহাদেশীয় ইউরোপ এবং জাপান থেকে হাজার হাজার মেয়েদের ব্রিটিশ অধিকৃত ভারতবর্ষে পাচার করত; সেখানে তাঁরা গণিকা হিসাবে ব্রিটিশ সৈন্য ও ভারতীয় পুরুষদের সেবায় নিয়োজিত থাকত।
ভারতে ব্রিটিশ শাসনকালে গণিকাদের পৃষ্ঠপোষকতা, গণিকা বৃদ্ধি এবং গণিকাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিয়ে বিস্তারিত জানতে পারা যায় পাঁচখানি আকর গ্রন্থ থেকে। যেমন–(১) ‘বেশ্যানুরক্তি বিষমবিপত্তি’–এটি ১৮৬৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। উনিশ শতকে গণিকাদের যাঁরা বাড়বাড়ন্ত মনে করতেন তাঁদের দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা।(২) ‘বেশ্যা গাইড’–এটিও ১৮৬৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। যৌন সংক্রামক রোগ প্রতিরোধের জন্য ১৪ আইন জারি করেছিল। সেই আইনে বলা হয়েছিল গণিকারা কীভাবে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে পেশা চালিয়ে যেতে পারবে। (৩) “পাঁচালী কমলকলি’–বইটি ১৮৭২ সালে প্রকাশিত হয়। স্বাস্থ্য পরীক্ষার নামে গণিকাদের নিপীড়ন করা, অত্যাচার করা ইত্যাদি বিষয়। (৪) ‘বেশ্যাই সৰ্ব্বনাশের মূল’–বইটি প্রকাশিত হয় ১৮৭৩ সালে। বিষয় তিন নম্বর বইয়ের পরের অংশ। (৫) এলোকেশী বেশ্যা’–এটি প্রকাশিত হয় ১৮৭৬ সালে। অনাচার থেকে মুক্তির উপায় আছে খ্রিস্টধর্মে।
উপরোক্ত গ্রন্থগুলি থেকে যেটুকু জ্ঞান আরহণ করতে পেরেছি, তা সংক্ষেপে এখানে উল্লেখ করতে পারি। উনিশ শতক জুড়ে গণিকা, গণিকাবৃত্তি ও গণিকাবাপন এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, তাঁদের নিয়ন্ত্রণের জন্য নিজেদের স্বার্থেই বিভিন্ন আইন তৈরি করে ফেলেছিল ব্রিটিশরা। কারণ অনিয়ন্ত্রিত যৌনযাপনে সিফিলিস, গনোরিয়ার মতো মারাত্মক মারণ রোগ পড়েছিল সমাজে। পাছে গণিকারসিক ব্রিটিশদেরও আক্রমণ করে সেই ভীতিতেই গণিকাদের রোগমুক্ত রাখতে চেয়েছিল।এমতাবস্থায় সিভিল সোসাইটিও দু-ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। একপক্ষ যাঁরা গণিকাদের ‘সোস্যাল এভিলস’ ভাবত, অপরপক্ষ এই আইনের ফলে গণিকাদের মধ্যে যে সংকট এসেছিল, তাঁর বিরুদ্ধে। ব্রিটিশদের কাছে সৈন্যরা ছিল অমূল্য সম্পদ। কারণ এই সৈন্যদের দিয়েই ভারতীয় নেটিভ’-দের টাইট দেওয়া হত। তাই সৈন্যদের জন্য গণিকা সুলভ করে দেওয়া হয়েছিল। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছিল। অনিয়ন্ত্রিত যৌনসঙ্গমে যৌনরোগ মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল। সে সময়কার রিপোর্ট বলছে, ১৮২৭ সালে ইংরেজ-সৈন্যদের মধ্যে মারণ যৌনরোগ ২৯ % থেকে বৃদ্ধি পেয়ে মাত্র দুই বছরে অর্থাৎ ১৮২৯ সালে ৩১ % হয়ে দাঁড়ায়। ১৮৬০ সালে এসে সেটা এসে দাঁড়ায় ৭০ শতাংশে। এর ফলে একে একে সৈন্যদের বরখাস্ত করতে হচ্ছিল। সৈন্যসংখ্যা কমতে থাকায় সরকারের অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। উদ্ধার পেতে আইন জারি করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ তাঁরা খুঁজে পেলেন না বিকল্প হিসাবে দুটি পথ তো খোলা ছিলই। (১) গণিকাবৃত্তি আইন করে নিষিদ্ধ করে দেওয়া। গণিকাবৃত্তিতে যাঁরা জড়িত থাকবেন তাঁদের চরম শাস্তির বিধান তৈরি করা এবং (২) সৈন্যদের গণিকা নিষিদ্ধ করা। কোনো সৈন্য যদি গণিকাগমন করে, তাঁকে কঠোর শাস্তি প্রদান করা। ইংরেজরা বিকল্প হিসাবে এই কঠিন পথদুটি গ্রহণ করলেন না, গ্রহণ করলেন সহজ পথ। এতে বাঁশও ভাঙল না, বাঁশিও বাজল। গণিকারা থাকবে, সেনারা থাকবে এবং সেনাদের যৌন বিনোদনও থাকবে। অতএব সেনাদের পৃথক গণিকালয় তৈরি করা হল সেনাছাউনিগুলোতে। সাপ্লাই অ্যান্ড ডিমান্ডের ধারা অক্ষুণ্ণ রাখতে প্রণয়ন হল ‘ক্যান্টনমেন্ট অ্যাক্ট ১৮৬৪’ ও ‘চোদ্দো আইন’। এই ক্যান্টনমেন্ট অ্যাক্ট ১৮৬৪’ আইনের বলে যেসব গণিকারা রেজিস্ট্রিভুক্ত হবে এবং কার্ডহোল্ডার হবে, একমাত্র তাঁরাই গণিকাবৃত্তি চালিয়ে যেতে পারবে। বাকিরা নয়, সেনাদের জন্য তো নয়ই।
এতকিছু করেও সৈন্যদের মধ্যে মারণ যৌনরোগ নিশ্চিহ্ন করা যচ্ছিল না। যেহেতু সেনা তদারকির বাইরেও গণিকারা গণিকাবৃত্তি করত, সেনারা সেখানেও নিয়মিত যাতায়াত করত। এর ফলে সেনা ছাড়িয়ে সাধারণ মানুষদের মধ্যেও এই যৌনরোগ ছড়িয়ে পড়তে থাকল। ১৮৬৪ সালে কলকাতার হেলথ অফিসার ফেবর টনেয়রও জানিয়েছিলেন, সিফিলিসের মতো রোগ শুধু সেনাদের মধ্যেই নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। ১৮৬৭ সালে ‘Contagious Diseases Act, XIV of 1868’ নামে একটি খসড়া তৈরি করে তাতে fola fracal–“I beg to state that in addition to my ususal duties, I am willing to undertake the organization of the new office, to superintend the registration of the prostitution. As well as to take an active part in the sanitary inspection of the public women.” প্রণয়ন হল ‘Indian Contagious Disaases Act’ বা চোদ্দো আইন।
কেমন ছিল সেই চোদ্দো আইন? একটু দেখে নেওয়া যাক–(১) ১৮৬৯ সালের ১ এপ্রিলের পর থেকে কলকাতা ও শহরতলিতে কোনো নারী বা কোনো ব্যক্তি নিজ নিজ বাসস্থান যে থানার অধীন সেই থানায় রেজিস্ট্রি না করে গণিকাবৃত্তি ও গণিকালয় রক্ষকের কাজ করতে পারবে না। (২) প্রত্যেক থানায় ইন্সপেক্টর নিজ নিজ থানা এলাকায় যে যে সাধারণ গণিকা ও গণিকালয় রক্ষক বাস করে তাঁদের রেজিস্ট্রি করে নিতে হবে। (৩) কোনো সাধারণ নারী গণিকাবৃত্তি করতে ইচ্ছা করলে তাঁর নিজের নাম, বয়স, জাতি বা ধর্ম, জন্মস্থান, বাসস্থান এবং যে সময়ে গণিকাপেশায় যুক্ত হয়েছে এবং যদি কোনো গণিকালয়ে বর্তমানে বাস করে, তাহলে সেই বাড়ির কর্তারও রক্ষকের নাম এবং পরে লিখিত জেনারেল রেজিস্ট্রি বুকে তার নম্বর সহ সমস্ত তথ্য থানায় নিজে এসে লেখাতে হবে। (৪) থানার ইন্সপেক্টর সেইসব বিবরণ পাওয়ামাত্র থানায় যে রেজিস্ট্রি বুক (ফর্ম–এ) রাখা থাকবে তাতে লিখে ওই টিকিট কমিশনার সাহেবের স্বাক্ষরের জন্য তাঁর অফিসে পাঠিয়ে দিতে হবে। (৫) থানায় রেজিস্ট্রি বুকের মতো সমস্ত শহর ও শহরতলির জন্য পুলিশ অফিসে যে জেনারেল রেজিস্ট্রি বুক রাখা হবে, সেই রেজিস্ট্রি বুকে কমিশনার সাহেব ওই গণিকাকে রেজিস্ট্রি করবেন। জেনারেল রেজিস্ট্রি বুকে ওই গণিকার যে নম্বর হবে সেই নম্বর রেজিস্ট্রেশন টিকিটের প্রথম ঘরে লিখতে হবে। এটা লেখা হলে উক্ত টিকিট কমিশনার বা ডেপুটি কমিশনার সাহেবের দ্বারা স্বাক্ষরিত হয়ে থানার ইন্সপেক্টরের কাছে পাঠাতে হবে। ইন্সপেক্টর নিজের রেজিস্ট্রি বুকে উক্ত রেজিস্ট্রেশন টিকিটে লিখিত নম্বর লিখে নিয়ে যাঁর টিকিট তাঁকে দেবেন। (৬) প্রত্যেক গণিকালয় রক্ষক যে থানার এলাকায় নিজের পেশায় চালায় সেই থানায় তাঁকে রেজিস্ট্রি করতে হবে আর রেজিস্ট্রি করার সময় নিজের নাম, বাসস্থান এবং যে বাড়িতে কী ঘরে কী স্থানে যৌনক্রিয়ার মাধ্যমে রোজগার করে, তা লেখাতে হবে থানার ইন্সপেক্টর উক্ত বিবরণ থানায় যে রেজিস্ট্রি বুক (ফর্ম–সি) রাখা হবে সেই বইয়ে লিখিয়ে নেবেন। তারপর রেজিস্ট্রি টিকিট (ফর্ম–ডি) লিখে ওই টিকিট কমিশনার সাহেবের স্বাক্ষরের জন্য জন্য তাঁর অফিসে পাঠিয়ে দেবে।(৭) কমিশনার সাহেব তাঁর অফিসে এক রেজিস্টার বুকে প্রত্যেক গণিকালয় রক্ষকের নাম এবং অন্যান্য তথ্য লিখে রাখবেন। (৮) কমিশনার সাহেবের অফিসের জেনারেল রেজিস্ট্রি বুকে গণিকালয় রক্ষকদের রেজিস্ট্রেশনের যে নম্বর হবে টিকিটেও সেই নম্বর দেওয়া হবে। আর ওই টিকিট কমিশনার কিংবা ডেপুটি কমিশনার সাহেবের স্বাক্ষর হলে যে থানা এলাকায় ওই গণিকালয় রক্ষক নিজের পেশা চালিয়ে যেতে চায় সেই থানার ইন্সপেক্টরের কাছে পাঠানো হবে। (৯) কমিশন সাহেবের দ্বারা টিকিটে যে নম্বর দেওয়া হবে সেই নম্বর ইন্সপেক্টর রেজিস্ট্রি বুকে লিখে যাঁর টিকিট তাঁকে ফিরিয়ে দেবে। (১০) যদি কোনো মহিলা কিংবা কোনো ব্যক্তি পূর্বোক্ত মতে রেজিস্ট্রি না করে এবং পূর্বের মতে রেজিস্ট্রেশন না করে গণিকাবৃত্তি করে কিংবা গণিকালয় চালায় তাহলে তাঁকে এবং তাঁদেরকে সমন জারি না করেই (১৮৬৮ সালের ১৪ আইন মোতাবেক) গ্রেফতার হতে হবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে সোপর্দ করা হবে বিচারের জন্য। (১১) কোনো রেজিস্ট্রিকৃত গণিকার নিজের বাসস্থান পরিবর্তন করার ইচ্ছা হয়, তখন তাঁকে কমিশনার বা ডেপুটি কমিশনার সাহেবের কাছে নিজে গিয়ে অথবা ইংরেজিতে আবেদনপত্র লিখে যে গলিতে বা অঞ্চলে বসবাস করতে ইচ্ছুক, সেই অঞ্চলের বাড়ির নম্বর এবং রক্ষকের নাম জানাতে হবে। সেইসঙ্গে পূর্বের রেজিস্ট্রিকৃত টিকিট জমা দিতে হবে সশ্লিষ্ট অফিসে। যদি কোনো গণিকালয়ে কেউ বাস করতে সিদ্ধান্ত নেয়, তবে সেই নতুন ঠিকানার গণিকালয়ের রক্ষকের নাম ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর লিখিয়ে নিতে হবে।(১২) এমন আবেদনপত্র পেলে কমিশনার সাহেব রেজিস্ট্রেশন টিকিটে ও জেনারেল রেজিস্ট্রি বুকে প্রয়োজনমতো পরিবর্তন করতে নির্দেশ দেবেন এবং পূর্বোক্ত সেই গণিকাকে ফিরিয়ে দেবেন এবং পূর্বে ওই গণিকা যে থানায় রেজিস্ট্রি হয়েছে সেই থানা থেকে তাঁর নাম পরিবর্তন করে যে থানা এলাকায় সে বাস করতে চায় সেই থানায় তাঁকে পুনরায় রেজিস্ট্রি করতে আদেশ দেবেন। (১৩) কোনো গণিকা রেজিস্টার করে অন্য শহরে কিংবা শহরতলিতে গণিকাবৃত্তি ত্যাগ করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তাঁকে স্বয়ং এসে কিংবা ইংরেজি ভাষায় আবেদনপত্র লিখে কমিশনার সাহেবকে জানাতে হবে যে, তাঁর নাম যেন রেজিস্ট্রি বুক থেকে মুছে ফেলা হয় এবং ওই গণিকা যথার্থভাবে বৃত্তি বা পেশা ত্যাগ করেছে এমন প্রমাণ দিলে কমিশনার সাহেব তাঁর নাম জেনারেল রেজিস্টার ও থানার রেজিস্টার থেকে মুছে দিতে আদেশ করবেন এবং সেই গণিকার রেজিস্ট্রেশন ফিরিয়ে নেবেন। সেইসঙ্গে যে পর্যন্ত ওই আবেদনপত্রের চূড়ান্ত হুকুম না-হয়, সেই পর্যন্ত কমিশনার সাহেব যদি উচিত বিবেচনা করে তাহলে সেই গণিকাকে ‘মেডিকেল টেস্ট থেকে অব্যহতি দিতে পারেন। (১৪) যদি কোনো গণিকালয়ের রক্ষক নিজের বাসস্থান বা ব্যাবসার স্থান পরবর্তন করেন, তাহলে সে যে স্থানে চলে যাচ্ছেন সেই স্থানের নাম ও নম্বর দিয়ে কমিশনার সাহেবের কাছে ইংরেজি ভাষাতে আবেদন করবে এবং সেই আবেদনপত্রের সঙ্গে রেজিস্ট্রেশন টিকিট দাখিল করবে।
গণিকাদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা যেন অকথ্য অত্যাচারের সামিল ছিল। কেমন ছিল সেই স্বাস্থ্যপরীক্ষা, সেটা বর্ণনা করেছে ‘সংবাদ প্রভাকর’। ১৮৬৯ সালের ১৫ এপ্রিলের একটি সংখ্যায় লিখেছে–“বেশ্যাদিগের রেজিস্ট্রারি ও ব্যাধি পরীক্ষা সম্বন্ধে রাজধানী মধ্যে যে কতপ্রকার ভয়ংকর ভয়ংকর কথা শোনা যাইতেছে, তাহা প্রকাশ করিতে হইলে বিদ্রোহীর মধ্যে গণনীয় হওয়া অসম্ভাবিত হয় না। অধিকন্তু অশ্লীলতা ও জনপ্রিয়তার হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাওয়া দুর্ঘট হয়। কেহ বলিতেছে পুলিশের লোকেরা স্ত্রীলোকের প্রতি নির্দয় হইয়া রেজিস্ট্রারির জন্য গ্রেফতার করিতেছে। তাহাদের ক্রদনে ও আর্তনাদে পুলিশের আহ্লাদ বর্ধিত হইতেছে। কোনো-কোনো ডাক্তার অসম্ভব বল প্রকাশ করিয়া এ কাজ করিতেছেন। যাহাদের ব্যাধি নেই তাহারাও পরীক্ষার পর গৃহে আসিয়া উদর বেদনায় ৩/৪ দিন শয্যাগত থাকিতেছে। সেই ভয়ে শত শত বেশ্যা কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করাতে বেশ্যাপল্লী সকল অন্ধকারময় হইয়াছে। যাহারা কলিকাতায় বেশ্যাবৃত্তি করিতে না চাহিয়া স্থানান্তরে যাইতে চাহে, পুলিশের লোকেরা তাহাদিগকে পথিমধ্যে এমনকী নৌকা হইতেও ধরিয়া আনিতেছে।” ভয়ংকর দুর্বিসহ সেইসব পরীক্ষা-পদ্ধতি এবং অসহায় ব্যবহারের ফলে গণিকাদের নানা সংকট দেখা দিচ্ছিল সে সময়। একথা বলাই যায়, গণিকাবৃত্তি এবং সংক্রামক যৌনব্যাধি এত বাড়াবাড়ি স্তরে পৌঁছে গিয়েছিল যে ‘চোদ্দো আইন’ খুবই জরুরি ছিল। এখন যেমন এইডসের মতো মারণ রোগের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখতে কন্ডোমের ব্যবহার করা হয়েছে, তখন তো কন্ডোমের ব্যবহার ছিল না। তাই নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা ছাড়া বিকল্প কোথায়! গণিকাদের নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা এখনও হয়, তবে সেটা সেদিনকার মতো বিভীষিকাময় নয়। ১৮৭২ সালে ‘সোমপ্রকাশ’-এ লেখা হল–“এই আইনটি যখন হয় আমরা প্রাণপণে ইহার প্রতিবাদ করিয়াছিলাম। তখন আমাদিগের কথা রাজপুরুষদিগের ভালো লাগে নাই। কিন্তু এই আইনটি স্ত্রী সম্প্রদায়ের প্রতি অত্যাচারের কারণ হইয়া উঠিয়াছে।”
কেমন ছিল সেই স্বাস্থ্যপরীক্ষার নামে অত্যাচার? ‘সম্বাদ ভাস্কর’ লিখছে–“উক্ত আইনের কার্ব নিৰ্বাহ জন্য লালবাজারে যেসকল ডাক্তার নিযুক্ত হইয়াছেন তাঁহারা পরীক্ষার ছলে নারীদিগের বিশেষ কষ্ট দিতেছেন, দূষ্যাদিগের অপেক্ষা নির্দোষা বেশ্যাদিগের অধিক যন্ত্রণা হইতেছে। দূষ্যাদের মধ্যে অধিকাংশই পরীক্ষার পূর্বে রোগ স্বীকার করে, সুতরাং তাহাদের আর দেহপরীক্ষার প্রয়োজন হয় না। চিকিৎসার অধীনে থাকে, যাহাদের রোগ নাই, তাহারা ব্যাধির অনস্তিত্ত্ব ব্যক্ত করে, চিকিৎসক শোনামাত্রই কেন তাহা বিশ্বাস করিবেন, কার্যতই পরীক্ষার হয়–তাহা সামান্যাকারে দর্শনাদিরূপ পরীক্ষাতেই সমাধা হইতে পারে, কিন্তু আমাদের চিকিৎসকেরা সেরূপে সন্তুষ্ট হন না–তাঁহারা ওই পরীক্ষিত বেশ্যাগণকে প্রথমত টবে বসাইয়া দেন, তাহাতে জলের সহিত জ্বালাকর পদার্থ থাকে, ওই পরীক্ষার পর গর্ভ দর্শনীয় বিশাল যন্ত্রদ্বারা দর্শন হয়, পরে উগ্রতর পিচকারি দেওয়া হইয়া থাকে। জনরবকারিরা বলেন, এই পিচকারিতে অনেকের উদর ফুলিয়া জীবন সংশয় হইয়াছে। অতএব উহা যে স্ত্রীদেহের উপযোগী স্বাভাবিক পিচকারি নহে, ইহা অবাধেই অনিষ্ট সাব্যস্ত হইতেছে। এই পিচকারি দান বিষয়ে পাত্রপাত্র বিচার নাই। ডাক্তারেরা রজস্বলাক্ষেত্রেও উহার প্রয়োগ করিতেছেন। তাহাতে আবার অধিকতর অনিষ্ট হইতেছে, অপরিমিত রুধিরক্ষরণে দুই এক তরুণীর জীবনও গিয়াছে।”
এই বর্ণনায় স্পষ্ট হয় যে, অত্যাচার কতটা অবর্ণনীয় ছিল। এতটাই অবর্ণনীয় ছিল যে, তামাম গণিকারা দলে দলে কলকাতা ত্যাগ করে অন্যত্র পালিয়ে যেতে থাকল। কেউ কেউ কলকাতা ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে গণিকাবৃত্তিও ত্যাগ করতে থাকল। অনেকে আবার ফরাসি উপনিবেশ ফরাসডাঙায় গিয়ে দিন গুজরান করতে থাকল। ব্রিটিশ পুলিশদের আতঙ্কে এমন অবস্থা হল যে, লাল পাগড়ি পরা কোনো লোক দেখলেই পুলিশ আত্মগোপন করে ফেলত। আবার কেউ কেউ আত্মহত্যা করতে বাধ্য হত। রূপচাঁদ পক্ষী লিখলেন–
“কারে বলিব বনমালী! এ দুখের কথা।
হলো চৌদ্দ আইন বড়োই কঠিন বল যাই কোথা।
ভেবে ভেবে গুমড়ে মরি এ কি আইন হলো জারী,
দিগম্বরী করবে যত বারবণিতা।”
এহেন পরিস্থিতে সমাজের একটা বড়ো অংশ প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছিল। ব্রিটিশ সরকার এই প্রতিবাদ গোড়ার দিকে তেমন পাত্তা না দিলেও পরে বিষয়টা নিয়ে ভাবতে বাধ্য হল। বাধ্য হল কারণ, ফরাসি উপনিবেশ ফরাসডাঙায় গণিকারা দলে দলে কলকাতা ছেড়ে যাওয়াতে ইংরেজদের মুখ পুড়েছিল। সেই মুখ রক্ষা করতে এবং এ দেশীয় ভদ্রলোকদের তীব্র সমালোচনা মুখ বন্ধ করতে সচেষ্ট হল। ইংরেজরা বুঝতে পারল এই আইনটি সম্পূর্ণভাবেই আনপপুলার। যে উদ্দেশ্যে এই আইন প্রণয়ন করা সেই সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ। সেনারা যথারীতি যৌনরোগে আক্রান্ত হচ্ছিল। তা ছাড়া এই আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে জলের মতো রাজস্ব খরচ হয়ে যাচ্ছিল। পাক্কা কুড়ি বছর এই আইন সক্রিয় ছিল। অবশেষে ১৮৮৮ সালে এই আইনটি বিলুপ্ত করে দেওয়া হল।
ফিরে আসি গণিকাদের রেজিস্ট্রেশনের প্রসঙ্গে। কোনো প্রকার যৌনরোগ না-থাকলে তবেই একজন গণিকাপেশায় জন্য রেজিস্ট্রিভুক্ত হতে পারত এবং পেশায় যোগদান করতে পারত। যাঁরা রোগাক্রান্ত হত তাঁদের ‘লক হাসপাতাল’-এ পাঠানো হত। কী এই ‘লক হাসপাতাল’? ইংল্যান্ডে এ ধরনের হাসপাতাল ছিল, যেটা তৈরি করা হয়েছিল হিংস্র নেকড়েদের আটকে রাখার জন্য। এই হাসপাতাল লন্ডনে তৈরি করা হয়েছিল ১৭৪৬ সালে। এই লক হাসপাতাল যৌনরোগাক্রান্ত গণিকাদের রাখা হত। সরকারি নির্দেশে কলকাতার বিভিন্ন গণিকাপল্লিতে গিয়ে ব্রিটিশ পুলিশ তল্লাসি চালিয়ে মেয়েদের ডাক্তারি পরীক্ষা করতে যেত। সেইসব মেয়েদের প্রতি নৃশংসতা ক্রমশই মাত্রা ছাড়াচ্ছিল। এর ফলে কলকাতা থেকে অন্য কোনো শহরে বা অন্য কোনো গ্রামে গণিকারা পালিয়ে যেতে থাকল দলে দলে। যৌনরোগের কারণে যেসব হতভাগীদের চিকিৎসার জন্য লক হাসপাতালে যেতে হয়েছিল, তাঁদের ফিরে এসে আর পুরোনো ফিরে যেতে সাহস পেত না। রোগের ভয়ে খরিদ্দারদের আনাগোনাও ক্রমশ কমতে থাকল। সেই ভীতি আজও বহমান। তাহলে কি এটাই বুঝতে হয় ব্রিটিশ-ভারত সরকার প্রত্যক্ষভাবে নাহলেও পরোক্ষভাবে গণিকাবৃত্তিকে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল? বাঙালি ভদ্রলোক সমাজের চাপে কখনো-কখনো প্রশাসন শহরের মধ্যবিত্ত এলাকা গণিকালয় উচ্ছেদ করত। গণিকা ও গণিকাবৃত্তির বিরোধিতার কেন্দ্রে ছিলেন সেসময়ের বিশিষ্ট তরুণ বাঙালি বুদ্ধিজীবী, সমাজ-সংস্কারক পর্যন্ত। মহাভারতকার কালীপ্রসন্ন সিংহ পর্যন্ত গণিকাবৃত্তির বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করেছিলেন। ব্রিটিশ-ভারত সরকারকে এ ব্যাপারে ধারাবাহিকভাবে বোঝানো চেষ্টা করে গেছেন। নগরায়নের ফলে যে নতুন অর্থনীতির উদ্ভব ঘটেছিল, শিল্পকেন্দ্রিক সেই অর্থনীতি ও সামাজিক অবস্থায় গ্রাম্যসমাজ ও পরিবারচ্যুত মানুষ যে। বিনোদনের আশায় গণিকাদের কাছে যাবে, এটাই আধুনিকতার অবধারিত পরিণতি। সেটা বুঝতে পারেনি উনিশ শতকের বিদ্যোৎসমাজ। খেতে না-পাওয়া মেয়েদের এই বৃত্তিটা এবং গণিকালয়গুলি হয়ে গিয়েছিল নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম যেখানে প্রাণ খুলে যেমন খুশি খিস্তি দিতে পারে, তেমনি নিজের গতর-খাটানো রোজগার করা অর্থ নিজের মতো করে খরচ করতে পারে।
গোটা উনিশ শতক জুড়ে ভদ্রবাড়ির মেয়েরা চাকরি করতে বাইরে বেরচ্ছেন এমন চিত্র অতি বিরল ছিল। বলা যায়, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার হয়তো প্রথম চিত্র এই গণিকাদের রোজগারের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল। তা ছাড়া এ এমন এক পেশা, যে পেশায় যোগদান করলেই রোজগার নিশ্চিত। রোজগারও সীমাহীন হতে পরে। কাঁচা পয়সা যাকে বলে। এ পেশায় অনাচার, অত্যাচার, লাঞ্ছনা নিশ্চয় ছিল। সে তো গার্হস্থ্যজীবনেও কম ছিল না। সামাজিক শোষণ তো কম ছিল না মেয়েদের। সেই সামাজিক শোষণের সঙ্গে সম্পৃত্ত থাকে সমাজ, প্রশাসন ও রাষ্ট্রব্যবস্থা। গণিকাজীবনেও ছিল, আছে, থাকবে। সে সময় সর্বদাই গণিকাদের বিরুদ্ধে গৃহস্থরা মুখর ছিল। তাঁরা সর্বদা আদালতে চলে যেত গণিকাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে। আদালতও গণিকাদের বিরুদ্ধে। আদালত যারপরনাই গণিকাদের অপমানজনক কথা বলত, ভর্ৎসনা করত। এতে গণিকাদের কোনো হাত নেই। হাত আছে মূলত পুরুষতান্ত্রিক ভদ্রলোক সমাজের আধিপত্যবাদ। গণিকালয় সেই পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের পরিসর গড়ে তুলেছে। যাই হোক, তথাকথিত ভদ্রলোকদের উপর্যুপরি দাবিকে গুরুত্ব দিয়ে ১৮৬৮ সালে চোদ্দো আইন প্রণয়ন করে ব্রিটিশ সরকার এদেশীয় ভদ্রলোকদের রক্ষা করল। পাশাপাশি গণিকাদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা করিয়ে রেজিস্ট্রির মাধ্যমে পেশা চালানোর সুযোগ করে দিয়েছিল। বলা যায়, গণিকাদের সরকারি স্বীকৃতি দিয়েছিল।
সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস এসময়ে প্রবল হয়ে উঠছিল। গণিকা ও গণিকাবৃত্তির সমর্থন ও আপত্তিই যেন একমাত্র সত্য হয়ে উঠেছিল। সেসময়ে সাহিত্য-নাটক-যাত্রা-প্রহসনে গণিকা চরিত্র আবশ্যক অনুপ্রবেশ ঘটছিল। কেউ কেউ আবার গণিকাদের পরিত্রাণের উপায়ও বাতলে দিচ্ছিলেন। জনৈকা মিশ লেসলি লিখলেন, গণিকাদের পরিত্রাণ মিলবে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে জিশুকে স্মরণ করে। সংখ্যায় অতি অল্প হলেও কিছু গণিকা পাপস্খলনের জন্য খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।
শুধু ব্রিটিশ উপনিবেশেই নয়, ফরাসি পোর্তুগিজদের উপনিবেশের ফলেও ভারত উপমহাদেশে এক অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষিত হল। বিদেশিরা ভারতের বাসিন্দাদের দাসানুদাস কীটাণুকীট মনে করত। পুরুষদের সহজলভ্য শ্রমিক আর মেয়েদের সহজলোভ্য ভোগ্যা মনে করত। এর ফলে অবাধ, অসংযম এবং অবাঞ্ছিত যৌনজীবনে জড়িয়ে পড়ল তাঁদের এক অংশ। গণিকাবৃত্তির রমরমা হতে শুরু করল এই সময় থেকেই। গণিকাগৃহে যাওয়া যেন এক স্ট্যাটাস সিম্বল হয়ে দাঁড়াল। সংক্রমিত হতে থাকল কালান্তক যৌনব্যাধী। তাঁদের বেপরোয়া যৌন সম্ভোগ সিফিলিস এবং গনোরিয়ার মতো যৌনব্যাধী আতঙ্কের সৃষ্টি করল। যৌনব্যাধীর আতঙ্কে বাজারও খানিকটা স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল কিছুকালের জন্য। কন্ডোম বাধ্যতামূলক হওয়ার আগে পর্যন্ত এই ভীতি কাজ করত রসিকদের মনে। শোনা যায়, ফরাসিদের কাছ থেকেই সিফিলিস যৌনরোগটি আমদানি হয়েছিল। সিফিলিস রোগটি মূলত কুকুরদের অসুখ, কুকুরদের হত। কুকুরদের কাছ থেকে এই সিফিলিস রোগটি মানুষের শরীরে কীভাবে সংক্রমিত হল, সেটা অবশ্যই গবেষণার বিষয় হতে পারে। আতঙ্ক নিয়ে বেশ কয়েক যুগ কেটে গেল গণিকা ও গণিকাপ্রেমীদের। এরপর রসিক-রসকিনীদের চোখেমুখে ভরসার আলো দেখা গেল। সিফিলিস ও গনোরিয়া নিরাময়ের জন্য হাতে চলে এলো অব্যর্থ প্রতিষেধক মেচনিকফ মলম, পেনিসিলিন, সালফাথিয়াজোল ইত্যাদি। এইসব ওষুধের ব্যবহার বাড়তেই গণিকাদের যৌনজীবনে এক বিপ্লব ঘটে গেল। কিন্তু পূর্ব-সতর্কতা নেওয়া যায় না-বলে রোগটা থেকেই গেল। সেই অভাবটা পূরণ করে দিল কন্ডোম। এখন অবশ্য সিফিলিস, গনোরিয়ার কথা খুব একটা শোনা যায় না। বরং এখন নতুন আতঙ্ক এইডস। সেটাও প্রায় স্তিমিত। সচেতনতা ও বাধ্যতামূলক কন্ডোম ব্যবহারে যৌনরোগ এখন আর তেমন আতঙ্ক ছড়াতে পারছে না। কন্ডোম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব আলাদা একটি অধ্যায়ে।
১২. অন্য দেশ : প্রাচীন সভ্যতায় গণিকাবৃত্তি
ইহুদি ধর্ম গোত্রের ভিতরে সদস্য-সদস্যাদের কাউকেই গণিকাবৃত্তিতে উৎসাহিত করত না। বরং সেটা তাঁদের নৈতিক আইন অনুসারে জঘন্য অপরাধ বলে বিবেচিত হত। তবুও ইতিহাসে খুব অল্প সময়ের জন্যই তাঁরা রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছিল। তাই তাঁদের নিজস্ব গোত্রের মধ্যে গণিকাবৃত্তি দমন করতে পারলেও নগর থেকে গণিকাবৃত্তি নিষিদ্ধ করতে পারেনি। যত বড়ো নগর তত বেশি গণিকা, তত বেশি ব্যাভিচার। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ‘লিডিয়ান’ ও ‘সাইপ্রিয়ান’ জাতির মেয়েরা দূরবর্তী অঞ্চলে গিয়ে গণিকাবৃত্তি করে অর্থসংগ্রহ করে এনে বিয়ে করত। ভারতেও কয়েকটি প্রদেশে রাজাদের অধীনে ‘নাইক’ নামে একটি সম্প্রদায় ছিল। নাইক মেয়েরাও সংসারের ব্যয় নির্বাহের জন্য গণিকাবৃত্তিতে অংশ নিত। পুরোহিতেরাও কখনো-কখনো ধর্মের দোহাই দিয়ে মেয়েদেরকে গণিকাবৃত্তিতে নিযুক্ত করত। যেমন ব্যাবিলোনিয়ায় মেয়েদেরকে ইশতার মন্দিরে যেতে হত। মন্দিরের যে পুরুষ প্রথমে জিভ দিয়ে ওই মেয়েকে রুপোর মুদ্রা নিক্ষেপ করবে, সেই পুরুষ ওই শরীর ভোগের অধিকার পাবে। এ নিয়ম মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম আফ্রিকাতেও প্রচলন ছিল।
প্রাচীন গ্রিস, রোমে এ ধরনের গণিকাবৃত্তির প্রথম উৎপত্তি। গ্রিক সভ্যতাও একটা পর্যায়ে শুধুমাত্র গণিকাবৃত্তির জন্যই বিখ্যাত ছিল। তাঁদের নগরে যদিও গণিকাদের নাগরিক অধিকার ছিল সামান্য। তবে নগরের অধিকাংশ সম্পদের মালিক ছিল গণিকারা। তাঁরাই নগরের সম্ভ্রান্ত নাগরিকদের বিলাস ও ব্যাভিচারের অর্থ প্রদান করত। উচ্চাভিলাষী যে-কোনো নারী সে সময়ে স্ব-ইচ্ছায় গণিকাবৃত্তিতে অংশগ্রহণ করত এবং তাঁরা অর্থে-বিত্তে-সম্মানে কারোর থেকে কোনো অংশে পিছিয়ে ছিল না। বরং সামনের কাতারেই অবস্থান করত। প্রাচীন গ্রন্থাদি সূত্রে, যেমন ইতিহাসের জনক হিসাবে খ্যাত হেরোডেটাস (খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০/২০)-এর লেখায় এই পবিত্র’ গণিকাবৃত্তির বহু নমুনা পাওয়া যায়, যেটি প্রথম শুরু হয়েছিল ব্যাবিলনে। সেখানে প্রত্যেক নারীকে বছরে অন্তত একবার করে যৌনতা, উর্বরতা ও সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতির মন্দিরে যেতে হত এবং সেবাশুশ্রষার নমুনা হিসাবে একজন বিদেশির সঙ্গে নামমাত্র মূল্যে যৌনসঙ্গম করতে হত। একই ধরনের গণিকাবৃত্তির চর্চা হত সাইপ্রাস এবং করিন্থে। এটার বিস্তৃতি পেয়েছিল সার্দিনিয়া এবং কিছু ফিনিশীয় সংস্কৃতিতে, বিশেষ করে ইস্টার দেবতার সম্মানে। ফিনিশীয়দের মাধ্যমে ক্রমশ এটি ভূমধ্যসাগরের অন্যান্য বন্দর শহরগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে, যেমন–সিসিলি, ক্ৰটন, রোসানো ভাগলিও সিক্কা ভেনেরিয়া এবং অন্যান্য শহরে। এক্ষেত্রে অনুমান করা যায়, এশিয়া মাইনর, লাইদিয়া, সিরিয়া ও এট্রাকসনের নামও। ইসরায়েলে এটি একটি সাধারণ ব্যাপার ছিল। আগেই বলেছি, প্রাচীন গ্রিকের এথেইনাইয়ের কবি সোলোন (খ্রিস্টপূর্ব ৬৩ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৫৯০), যিনি তৎকালীন গ্রিকের সাতজন জ্ঞানী লোকের একজন হিসাবে গণ্য হতেন। খ্রিস্টপূর্ব ছয় শতকে এথেন্সে প্রথম গণিকালয় স্থাপন করেন। এই গণিকালয়ের উপার্জন দিয়ে আফ্রোদিতিকে নিবেদন করে একটি মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল। ইউস্তিয়ানের স্ত্রী রোমক সম্রাজ্ঞী থেওডেরো প্রথম জীবনে গণিকা ছিল। বোসপোরুসে তিনি ৫০০ গণিকার জন্য একটি নির্দিষ্ট গণিকালয় গড়ে তুলেছিলেন। প্রাচীন হেল্লাস বা গ্রিস দেশের আথেনাই বা এথেন্সে গণিকালয় ছিল। প্রাচীন গ্রিসের লোকেরা স্ত্রী ছাড়াও অন্য মহিলাদের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা করতে পারত এবং করত। প্রাচীন গ্রিক ইতিহাসবিদ, পরিব্রাজক ও কূটনীতিক মেগাস্থিনিস এক ধরনের পরিদর্শকের কথা বলেছেন, যাঁরা রাজ্যের সকল কার্যক্রমের উপর গণিকাদের সহায়তায় নজর রাখত এবং রাজার কাছে গোপনে রিপোর্ট করত।
রোমান আমলেই পৃথিবীতে প্রথম গণিকাবৃত্তির লাইসেন্স দেওয়া হয় ও কর ধার্য করা হয়। রোমানরা গণিকালয়কে ‘নুপানরিয়া’ (Lupanaria) বলত। তাঁরা ক্রীতদাসীদের সবসময় গণিকা হিসাবে কাজ করাত। যখন এঁদের সংখ্যা বাড়তে থাকল, তখন এইসব গণিকাদের আলাদা করে রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল। অনেক সময় গণিকাদের রূপে মুগ্ধ হয়ে রোমান যুবকরা বিয়ে করতে শুরু করল। সেসময় রক্তের পবিত্রতা ও বংশের ঐতিহ্য রক্ষার জন্য গণিকালয় তুলে দেওয়ার জন্য বিপ্লব দানা বেঁধে ওঠে। দানা বাঁধলেই হল! সেখানকার সম্রাট গণিকালয় থেকে প্রচুর খাজনা পেত। অতএব আর্থিক দিক দিয়ে চিন্তা করে গণিকালয় ও গণিকাবৃত্তি নিষিদ্ধ করা সম্ভব হল না।
চিনে তাও রাজবংশ একটি নির্দিষ্ট এলাকায় গণিকাবৃত্তি চালু করে। পরবর্তী সাঙ রাজবংশ (৯৬০ থেকে ১১২৬ সাল) ক্যাফেতে ও অন্যান্য প্রমোদস্থানে যেসব মহিলারা গণিকাবৃত্তি করত, তাঁদের হাংচৌ শহরে সীমাবদ্ধ করে দেয়। ওয়েবস্টার অভিধান মতে, সুমেরিয়ানদের মধ্যেই প্রথম ‘পবিত্র’ গণিকার দেখা মেলে।
সূর্যোদয়ের দেশ প্রাচ্যের সুপ্রাচীন সভ্যতার দেশ নিপ্পন তথা জাপানে ঠিক কবে কোন্ অঞ্চল থেকে গণিকাবৃত্তির উদ্ভব হয়েছিল, তা অবশ্যই গবেষণার বিষয় হতে পারে। তবে জাপানের গণিকাবৃত্তির ঐতিহ্য খুবই গভীরে প্রোথিত অনুমান করা যায়। প্রাচীন জাপানে জিশুখ্রিস্টের জন্মের আগের সময়ে জাপানের গণিকাবত্তি সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে কমপক্ষে হেইয়ান যুগ (৭৯৪-১১৮৫ খ্রিস্টাব্দ) থেকে কামাকুরা যুগ (১১৮৫-১৩৩৩ খ্রিস্টাব্দ) পর্যন্ত শরীর ভাড়া ও শরীর বিক্রির তথা যৌনতা বিক্রি পেশা হিসাবে গ্রহণ করার কথা জানা যায়। সে সময়ে ‘ইউজো’ বা ‘আসোবি মে’ নামে গণিকারা কেবল পেশাগতভাবে শরীরসর্বস্বই ছিল না, তাঁরা নাচ-গান-অভিনয় করেও অর্থ রোজগার করত। নারা যুগ (৭১০-৭৯৪ খ্রিস্টাব্দ) থেকে হেইয়ান যুগ পর্যন্ত ‘মিকো’ বা ‘ফুজো’ নামে মেয়েরা শিন্টোও ধর্মীয় ‘জিনজা’-তে সেবাদাসী হিসাবে কাজ করত। এঁরাই পরবর্তীকালে সেবাদাসীর কাজ ছেড়ে অনেকেই বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত সরাইখানা, মন্দির সংলগ্ন হাট-বাজার, নদী-বন্দর বেছে নিল যৌনকর্মে অংশ নিতে। কামাকুরা যুগ থেকে মুররামাচি যুগ (১৩৯২-১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দ) পর্যন্ত জাপানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ‘কোওশোকুকা’ (অশোভন), ‘কেইসেইইয়া’ (রাজকীয়) প্রভৃতি গণিকালয়গুলি ব্যক্তিগতভাবে গড়ে উঠছিল। সেইসময়ে ‘ৎসুজিকো’ নামে এক প্রভাবশালী গণিকা একটি বিশাল গণিকালয় প্রতিষ্ঠা করেছিল।
আদিম সমাজে গণিকাবৃত্তি আয়ের উৎস হিসাবে যথেষ্ট আদৃত ছিল। ধর্মের দিক থেকে, সমাজের দিক থেকে, পিতা-মাতা ও স্বামীর পক্ষ থেকেও কক্ষনো ঘৃণা করা হত না। তা ছাড়া মেয়ের উপর পিতা বা স্বামীর একচ্ছত্র অধিকার ছিল বলে দুর্দিনে তাঁরা আর্থিক উন্নতির জন্য তাঁদের কর্তৃত্বাধীন মেয়েদের যৌনপেশায় উৎসাহ দিত। ঈশ্বরের পরেই স্বামীর স্থান, তাই স্বামীকে সাহায্য করা মানেই ধর্মীয় কাজ হিসাবে বিবেচিত হত। প্রাচীন যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে গণিকাবৃত্তির প্রচলন ছিল। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’-এও গণিকাদের কথা জানা যায়।
১৩. যাত্রা-থিয়েটার-চলচ্চিত্রে গণিকা
যাত্রা-থিয়েটার-চলচ্চিত্রের একেবারে গোড়ার দিকে ছিল নারী-বর্জিত। সে সময়ে নারীরা এসব ক্ষেত্রে আসত না। ফলে বহু বছর পুরুষ অভিনেতারা নারীসজ্জায় সজ্জিত হয়ে নারীচরিত্রে অভিনয় করত। সে সময়ে নারীর অভিনয় করাটাকে মানুষ সুনজরে দেখত না। ১৯২৭-২৮ সালের দিকে ঢাকার নবাব পরিবারের কয়েকজন তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেন। তাঁরা ‘সুকুমারী’ নামে চার রিলের একটি নির্বাক ছবি বানান। ছবিটি পরিচালনা করেন বিশিষ্ট নাট্যকর্মী ও জগন্নাথ কলেজের শরীরশিক্ষার প্রশিক্ষক অম্বুজ প্রসন্ন গুপ্ত। এই চলচ্চিত্রে নারী চরিত্র থাকলেও কোনো নারী অভিনয় করেনি। পুরুষরাই নারী চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সৈয়দ আবদুস সোবহান। ঢাকাই চলচ্চিত্রে নবাব পরিবারের অবদান থেমে থাকেনি। নবাব পরিবারের উদ্যোগে ঢাকার ইস্টবেঙ্গল সিনেমাটোগ্রাফ কোম্পানি গঠিত হয়। এর প্রযোজনায় অম্বুজ প্রসন্ন গুপ্ত নির্মাণ করে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের নির্বাক চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটির নাম ‘দ্য লাস্ট কিস’। তবে এই চলচ্চিত্রে নারীচরিত্রে নারীরাই অভিনয় করেছিল। নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন লোলিটা বা বুড়ি নামের জনৈকা বাইজি। চারুবালা, দেববালা বা দেবী নামের আরও দুজন বাইজিও এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিল। এঁদের তিনজনকেই আনা হয়েছিল গণিকালয় থেকে। চলচ্চিত্রই বলুন, কিংবা যাত্রা-থিয়েটার, সর্বত্রই নারী চরিত্রে প্রথম অভিনয় করতে আসেন বাইজি বা গণিকা মেয়েরা। এঁদের এসব ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের কারণে মানুষের মনমন্দিরে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেল চলচ্চিত্র-যাত্রা-থিয়েটারে যেসব মেয়েরা অভিনয় করে তাঁরা ‘বেশ্যা’। আজও আমাদের সমাজে অভিনেত্রীদের সুনজরে দেখা হয় না।
গবেষক-অধ্যাপক বিজিতকুমার দত্ত সরকারি দস্তাবেজ উদ্ধার করে লিখেছেন—“সরকারি মহাফেজখানা থেকে যে রিপোর্ট পেয়েছি তা কৌতূহলোদ্দীপক। দেখা যায় দশ বছরের নিচে বেশ্যাদের বাড়িতে বেশ কিছু মেয়ে রয়েছে। সরকার এদের কথা মাঝে মাঝে ভেবেছে। কিন্তু তাদের সংখ্যা এত ব্যাপক যে সরকারের পক্ষে কিছু করে ওঠা কঠিন।” সেই পর্যবেক্ষণ অনুসারে গণিকাপল্লিতে গণিকা-গর্ভজাত কন্যাসন্তানের সংখ্যা ছিল ৪০৮ জন। এইসব গণিকা-কন্যাদের পুনর্বাসন বা সমাজের মূলস্রোতে নিয়ে আসার ব্যাপারে তখনকার সরকার যেমন কিছু করার চেষ্টামাত্র করেনি। তেমনই সমাজ-সংস্কারকদেরও উদাসীনতা ছিল। গণিকাদের মুক্তির পথ দেখাল থিয়েটার। সেই গণিকা-কন্যাদের মুক্তির জন্য থিয়েটারে অংশগ্রহণের পথ খুলে দিয়েছিলেন মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। সৌভাগ্যবশত উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি থিয়েটার সম্পর্কে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। ভালোভাবে থিয়েটার পরিচালনার জন্য বেঙ্গল থিয়েটার একটি উপদেষ্টা সমিতি গঠন করেছিল। উপদেষ্টামণ্ডলীতে যেমন ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, তেমনি ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, উমেশচন্দ্র দত্তের মতো ব্যক্তিত্বরা। থিয়েটারে অভিনেত্রী নিয়োগ সংক্রান্ত জরুরি সভায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিরোধিতা করলেন। বিদ্যাসাগরের মতো ব্যক্তিত্বের বিরোধিতাকে অগ্রাহ্য করে উমেশচন্দ্র দত্ত ও মধুসূদন দত্তের সমর্থনে বেঙ্গল থিয়েটার কর্তৃপক্ষ গণিকালয় থেকে চারজন মেয়েকে অভিনেত্রীকে হিসাবে আনলেন। মধুসূদনের ‘শর্মিষ্ঠা নাটক দিয়ে বেঙ্গল থিয়েটার যাত্রা শুরু করে। মেয়েদের জন্য থিয়েটারের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ায় অন্ধকার জগতের মেয়েরা মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার একটা অবলম্বন পেলেন। এই পথ ধরেই। থিয়েটারে এসেছিলেন গোলাপসুন্দরী, বিনোদিনী, তারাসুন্দরী, এলোকেশী, জগত্তারিণী, শ্যামা, কুসুমকুমারী, নীহারবালা, কৃষ্ণভামিনী, প্রভাদেবীর মতো গণিকারাও। পরবর্তী সত্তর-আশি বছর বাংলা থিয়েটারকে আলোকিত করেছেন এঁরা, সমৃদ্ধ করেছেন অন্ধকার জগৎ থেকে আসা এই মহিলারাই, যাঁদের পোশাকি পরিচয় গণিকা।
থিয়েটারের দরজা উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ক্লেদাক্ত অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার সংগ্রাম শুরু করলেন পিতৃপরিচয়হীনা গণিকা-কন্যারা। সেকালের সংবাদপত্র ও সমাজপতিদের লাগাতার বিরোধিতা ও নিন্দাবাদ সত্ত্বেও সমাজ তাঁদের সঙ্গে ছিল না, একথা বলা যায় না। সেইসব সমাজপতিদের উদ্দেশ্যে নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের প্রশ্ন ছিল—“এইসব মেয়েদের তো আমি অন্তত রাস্তায় দাঁড়িয়ে খরিদ্দার পাকড়াবার চেষ্টা থেকে সরিয়ে, মঞ্চে তুলে দিয়ে রোজগারের একটা পথ দেখিয়েছি, কিন্তু তোমরা এদের জন্য কী করেছ?” একথা অনস্বীকার্য যে, গণিকা-কন্যাদের অনেকেই আমাদের বিনোদন শিল্প তো বটেই, সাহিত্যে ও এবং সামাজিক ইতিহাসেও অপরিমেয় কীর্তি রেখে গেছেন। তাঁদেরকে বাদ দিয়ে চলচ্চিত্র-যাত্রা-থিয়েটারের ইতিহাস লেখা কখনো সম্পূর্ণ হবে না। আমাদের সমাজ এই সব নারীদের প্রাপ্য মর্যাদা দেয়নি, দিতে চায়নি।
এরকমই এক গণিকা-কন্যা বিনোদিনী দাসী। ঘটনাচক্রে বিনোদিনী রঙ্গালয়ে এসে পড়েন। তিনি চৈতন্যলীলায় নিমাইয়ের ভূমিকায় অভিনয় করে সাড়া জাগিয়েছিলেন। পরে শ্রীরামকৃষ্ণের স্পর্শে তাঁর ‘চৈতন্য’ হয় বলে জনশ্রুতি আছে। বর্তমানের ‘স্টার’ থিয়েটারের নামের সঙ্গে বিনোদিনীর নামও বিজড়িত হয়ে আছে। যদিও থিয়েটারের নাম বিনোদিনী দাসীর নামে ‘বিনোদিনী’ হওয়ার প্রস্তাব উঠেছিল, কিন্তু একটা গণিকার নামে থিয়েটারের নাম হবে! বিনোদিনীই এই থিয়েটারের নামকরণ করল ‘স্টার’। বিনোদিনী বোঝাতে সক্ষম হল–“আপনার ভাববেন স্টার মানে আমি, আর দর্শকরা ভাববে স্টার মানে আমরা সবাই।” বিনোদিনী তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার কথা’ গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন। বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা আত্মজীবনী লেখিকার মর্যাদা বিনোদিনী কিন্তু পায়নি। গণিকা বলে থিয়েটারের নাম ‘বিনোদিনী’ রাখা যেমন সম্ভব হয়নি, তেমনি তাকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা আত্মজীবনী লেখিকার মর্যাদাও দেওয়া যায়নি। বিনোদিনীর এক শিশুকন্যার জন্ম হয়। এক সম্ভ্রান্ত পুরুষ সেই শিশুকন্যা সহ বিনোদিনীকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছিল। কিন্তু গণিকা কন্যা বলে বিনোদিনী তাঁর কন্যা শকুন্তলাকে কোনো বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে পারেননি। মাত্র ১৩ বছর বয়সে শকুন্তলা মারা যায়। সমাজের লাঞ্ছনা-গঞ্জনা নিয়ে তাঁকে আর বেঁচে থাকতে হয়নি।
রঙ্গালয়ের আর-এক গণিকা অভিনেত্রী হলেন গোলাপসুন্দরী। বেঙ্গল থিয়েটারের নাট্যপরিচালক উপেন্দ্রনাথ দাসের ‘শরৎ-সরোজিনী’ নাটকে গোলাপসুন্দরী সুকুমারী চরিত্রে এমন প্রাণবন্ত অভিনয় করেছিলেন যে, তিনি গোলাপসুন্দরী থেকে সুকুমারী’ নামেই পরিচিত হয়ে গেলেন। ডিরেক্টর উপেন্দ্রনাথ দাস গোলাপের বিয়ে দিয়েছিলেন থিয়েটারেরই এক সুদর্শন অভিনেতা গোষ্ঠবিহারী দত্তের সঙ্গে। তাঁরা এক ভদ্রপল্লিতে বসবাস করতেন। তবে এক কন্যার জন্মের পর গোলাপসুন্দরী স্বামী পরিত্যক্তা হন।
চলচ্চিত্র-যাত্রা-থিয়েটারে গণিকাদের প্রথম পদচারণা শুধু ভারতেই নয়, সারা পৃথিবীতেই ছিল। এক্ষেত্রে একটা কথা বলা দরকার—গণিকারা যেমন অভিনেত্রী হয়েছেন, তেমনি অভিনেত্রী থেকে গণিকা হয়েছেন এমন উদাহরণও কম নয়। নাম মার্গারেট আলিবার্ত। প্যারিসের মার্গারেট আলিবার্তকে লোকে যাঁকে চেনে ম্যাগি মেলার’ হিসাবে। কিশোরী অবস্থায় সে সন্তানসম্ভবা। সেই সন্তানের পিতা কে সেই প্রশ্নের উত্তরও সে জানে না। এক দুর্ঘটনায় পুত্র-সন্তানের মৃত্যুর দায়ে তাঁর বাবা-মা ম্যাগিকে ত্যাগ করে। বাবা-মায়ের কাছ থেকে বিতারণের পর কিছু সন্ন্যাসিনীর আশ্রয়েই জীবন কাটছিল ম্যাগির। কুমারী ম্যাগী এক কন্যা-সন্তান প্রসব করল। এবার সন্ন্যাসিনীরাও তাঁকে ত্যাগ করল। মেয়েকে অন্যত্র রেখে মাত্র ষোলোবর্ষীয় সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত ম্যাগি প্যারিসের পথে পথে ঘুরতে থাকল। অবশেষে জীবিকার জন্য সে নিজের শরীরকেই পণ্য হিসাবেই উপস্থাপন করে নেয়। কিন্তু এত রূপ নিয়ে কি পথগণিকা হিসাবে মানায়? শিয়াল-কুকুরে ছিঁড়ে খাবে যে! সে নজরে পড়ে গেল ম্যাদাম ডেনার্টের।এই ডেনার্টের কাছেই সে সেরার সেরা গণিকা হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। পেতে শুরু করে সেরার সেরা শাঁসালো ক্লায়েন্ট। এই কায়েন্টরা শুধু প্যারসেই নয়, সুদূর আমেরিকা, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল।
শরীর যখন পণ্য, তখন শরীরটাকে ক্লায়েন্টদের পছন্দমতো করে গড়ে তুলতে হবে, এ আর নতুন কথা কী! তাই শরীরচর্চারও প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ম্যাগিকে একটা সুন্দর শরীরের মালকিন করে তুলল ম্যাদাম ডেনার্ট। ডেনার্টের দেহব্যাবসা ক্রমশ ম্যাগি তুরুপের তাস হয়ে উঠল। ইউরোপের শরীর-বাজারে ম্যাগি এতটাই জনপ্রিয় উঠেছিল যে, সেই মহাদেশের আনাচে-কানাচে কান পাতলেই ম্যাগির নাম শোনা যায়। ম্যাগির শরীরী-সান্নিধ্য এতটাই সুখকর ও তৃপ্তিদায়ক ছিল যে, তাঁর রূপ-লাবণ্য ছড়িয়ে পড়া রাত অতি তাড়াতাড়ি ভোর হয়ে যেত।
চল্লিশবর্ষীয় অ্যান্ড্রু নামে এক বিবাহিত যুবক সপ্তদশী ম্যাগিকে বিয়ে করে। ম্যাগিও মন দিয়ে ঘর-সংসার করতে থাকল। কিন্তু সুখ সবার সয় না! কয়েক বছরেই মধুচন্দ্রিমার সমাপ্তি ঘটে গেল। ম্যাগিকে ফেলে অ্যান্ড্রু পুনরায় নিজের পুরোনো সংসারে ফিরে গেল। ম্যাগিও আবার আগের জীবনে ফিরে গেল। পুনরায় যৌবনকে ব্যবহার করে উদ্দাম যৌনতার পসার সজিয়ে বসল। আবারও ম্যাগির কাছ থেকে যৌনসুখ কিনতে তৎকালীন ইউরোপের তাবড় তাবড় ব্যক্তিরা ভিড় জমাতে লাগল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ফ্রান্স ভরে গেছে ব্রিটিশ-সেনায়। সেই সেনার অন্যতম কর্তা প্রিন্স অফ ওয়ালেস অষ্টম প্রিন্স এডওয়ার্ড। যৌনসুখের তাগিদে তাঁর এক বন্ধুর সাহায্য নিয়ে একজন রক্ষিতা তথা গণিকাকে ভাড়া করল।কিন্তু সেই মহিলার যথার্থ যৌনজ্ঞান না-থাকায় এডওয়ার্ডকে তৃপ্ত করতে সক্ষম হয়নি। অতএব নতুন খাবারের সন্ধান দিল সেই বন্ধুই। বন্ধুই ম্যাগির সঙ্গে এডওয়ার্ডের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়।শরীরী সঙ্গ দিতে দিতে ম্যাগির সঙ্গে এডওয়ার্ডের প্রেম হয়ে যায়। কিন্তু সেই প্রেম টেকে মাত্র এক বছর।
ম্যাগি এতদিনে বিলক্ষণ বুঝে গেছে উপঢৌকন আর প্রচুর অর্থের আগমন তাঁর শরীরকে কেন্দ্র করেই। আর এই ভাবনা থেকেই ম্যাগির অর্থ-লালসা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। আরও অর্থ চাই, আরও, আরও অর্থ। এবার ম্যাগির জীবনে বসন্ত নিয়ে আসে চার্লস লরেন্ট নামের এক যুবক। বিয়ে করল এবং ছয় মাসের সংসারও হল। ডিভোর্স হয়ে গেল। আর ডিভোর্সের সেটেলমেন্টে লরেন্টের কাছ পেয়ে গেল প্রচুর অর্থ, বাড়ি, গাড়ি, ঘড়াশাল, চাকর-বাকর ইত্যাদি। গণিকা ম্যাগির আবার বিবাহযোগ। এবার একেবারে প্রাচ্যের এক রাজপরিবারের সঙ্গে সংসার পাতার সৌভাগ্যের দরজা খুলে গেল। স্বামী মিশরের রাজপুত্র আলি কামেল ফাহমি বে। এ বিয়ের মূল উদ্দেশ্য রাজপুত্রের অর্থ-প্রতিপত্তি। নাঃ, এ বিয়েও টিকল না। ফাহমির সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেল। ম্যাগি রীতিমতো ছক কষে লন্ডনের এক হোটেলে খুন করল ফাহমিকে। স্বামীকে খুন করে ম্যাগি গ্রেফতার হয়। কিন্তু আদালতে প্রমাণ হল তাঁর উপর স্বামীর উপর্যুপরি অত্যাচারের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার তাগিদেই ম্যাগি খুন করতে বাধ্য হয়েছিল। আদালত ম্যাগিকে মুক্তি দেয়। মুক্তি পেয়ে ম্যাগি প্যারিসে ফিরে আসে। ফিরে এসে ম্যাগি প্যারিস চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে শুরু করেন। বেশ কয়েক বছর সে অভিনয় করেছিল। তবে অভিনেত্রী হওয়ার পরও সে গণিকাবৃত্তি চালিয়ে গেছে মোটা অঙ্কের অর্থলোভে। তবে সে আর বিয়ে করেনি। যৌবন-শেষে বার্ধক্য কাটিয়েছে অন্তরালেই। শেষপর্যন্ত কেউ তাঁর কোনো খোঁজ পায়নি।
গণিকাবৃত্তি করতে করতে অভিনয় পেশা আসা মেয়েদের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়। সেকাল থেকে একাল সর্বত্র ছড়িয়ে আছে এঁরা। সম্প্রতি ভারতীয় চলচ্চিত্রে অংশগ্রহণ করেছে পর্ন-গণিকা ভারত বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান সানি লিওনি। টিনা নন্দী, জোয়া রাঠোর, কাজল গুপ্তা, সোনিয়া মহেশ্বরী, আলিশা, কবিতা রাধেশ্যামের মতো গণিকারা তো এখন ওয়েব সিরিজের নামে ক্যামেরার সামনেই গণিকাবৃত্তি করছেন। বাজারও রমরমা। এ তো গেল গণিকা থেকে অভিনেত্রী হওয়ার কথা। অভিনেত্রী থেকে গণিকাবৃত্তিতে আসার ঘটনাও কিছু কম নয়।
কাবুকি, জাপানের একটি বিশেষ নাট্যধারা। সাধারণের রঙ্গালয় হিসাবে এই নাট্যধারার সময়কাল সপ্তদশ শতাব্দী। এই নাট্যধারার স্রষ্টা একজন মহিলা হলেও মহিলা ও তরুণদের জন্য অভিনয় নিষিদ্ধ করেছিলেন। ১৬০৩ সালে ইজুমো নো ওকুমি শুখনো নদীখাতে বিশেষ এক জাতীয় নৃত্যনাট্যের সূচনা করেন। শুরু হল মহিলা কাবুকির যুগ। এই মহিলা কাবুকিদের বলা হত ‘অন্না-কাবুকি’। এই কাবুকি নাট্যধারা যতই জনপ্রিয়তার শিখরে উঠতে থাকল, ততই বিনোদনের পথে পা বাড়িয়ে দিল অধিক অর্থলোভে। কম পরিশ্রমে অধিক রোজগারের হাতছানিতে যৌনপেশায় যুক্ত হতে থাকল অভিনেত্রীরা। কাবুকি নাট্যধারা ক্রমশ গণিকাদের নৃত্যসংগীত হিসাবে পরিচিতি হয়ে গেল। জাপানের সামাজিক সংস্কৃতির সঙ্গে এই পরিবর্তিত কাবুকি সংস্কৃতি মিশে গিয়ে সামাজিক অবক্ষয়ের সূচনা হতেই জাপানের তৎকালীন শোগুন শাসন ‘অন্না-কাবুকি নিষিদ্ধ করে দেয়। সালটা ছিল ১৬২৯। তবে ‘অন্না-কাবুকি’-কে অনুসরণ করে একদল উৎসাহী তরুণ ‘ওয়াকাসু-কাবুকি’ নাট্যধারা শুরু করে। কিন্তু এর অভিনেত্রীরাও যৌনকর্মে যুক্ত হলে শোগুন শাসক ‘ওয়াকাসু-কাবুকি’ও নিষিদ্ধ করে দেয়।
সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে কাবুকি নাট্যধারা প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের হাতে গিয়ে পড়ে। পুরুষ-পরিচালিত এই কাবুকির ডাকনাম ‘ইয়াররা-কাবুকি’। ইয়ারো-কাবুকিদের মধ্যে যাঁরা মহিলা চরিত্রে যেসব পুরুষ অভিনয় করত, তাঁদের বলা হত ‘অন্নাগাতা’। নারী-বর্জিত এই নাট্যধারা বেশ কিছুদিন বেশ চলছিল। সমস্যাও শুরু হয়ে গেল কিছু সময় পর। “অন্নাগাতা’ অভিনেতারা (অভিনেত্রীই বলা উচিত) দীর্ঘদিন ধরে নারীচরিত্রে অভিনয় করতে করতে নিজেদের মধ্যে নারীসুলভ আচরণ লালন করত। এই নারীসুলভ পুরুষরাও যৌনপেশায় যুক্ত হয়ে পড়ে। এঁদের ক্লায়েন্ট নারী-পুরুষ উভয়ই। যথারীতি ইয়ারো-কাবুকি’-ও নিষিদ্ধ হল। পরে অবশ্য (১৬৫২ সালে) এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
জাপান ছেড়ে চলে আসুন ভারতে। ভারতেরও বেশকিছু অভিনেত্রী চলচ্চিত্র ও ধারাবাহিকে অভিনয় করার পাশাপাশি অধিক অর্থ-লালসায় যৌনপেশাও চালিয়ে যায়। গ্ল্যামার দুনিয়ার কত স্বনামধন্য মেয়েরা এসকর্ট গার্ল হিসাবে কাজ করে তার হিসাবে রাখা হয় না বোধহয়। কী টলিউড, কী বলিউড, কী কলিউড, কী হলিউড, কী মলিউড, কী ঢলিউড–সর্বত্র একই চিত্র। ধরা পড়ে গেলে জানতে পারি, না ধরা পড়লে বিন্দাস চলে যৌনকর্ম। প্রবচন হয়েছে–‘ধরা পড়লে ধনঞ্জয়, না পড়লে এনজয়’। কিছুদিন আগেই তো টলিউডের এক প্রথম সারির বিবাহিতা অভিনেত্রীর বিরুদ্ধে এক চিটফান্ড কোম্পানির কর্ণধারের কয়েক কোটি টাকার বিনিময়ে নিয়মিত শয্যাসঙ্গিনী হতেন। সেই সংবাদ ফলাও করে সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। নিশ্চয় সেই সংবাদ সবাই পড়েছে। এরা কেউ গরিব নন, আর্থিক অনটনে দিন গুজরান করে না। রাতারাতি আরও ধনী হওয়ার লোভ ও যথেচ্ছ যৌনতার হাতছানিতে অত্যন্ত গোপনে এঁরা গণিকাবৃত্তি অব্যাহত রাখে। মুম্বাইয়ের নামজাদা এক চলচ্চিত্র অভিনেত্রীর লিজ দেওয়া ফ্ল্যাটে যৌনকর্ম চলত। সংশ্লিষ্ট অভিনেত্রীই যৌনকর্ম পরিচালনা করত কি না, সেটা অবশ্য ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বছর কয়েক আগে হায়দরাবাদের বানজারা হিলসের একটি বিলাসবহুল হোটেলে গণিকাবৃত্তি করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গেল বলিউডের অভিনেত্রী শ্বেতা প্রসাদ বসু। যে রাতে সে ধরা পড়েছিল সেই রাতের তাঁর রেট ছিল পাঁচ লাখ টাকা। অগ্রিম হিসাবে এক লাখ টাকাও নিয়েছিল। সেলিব্রেটি হওয়ার সুবাদেই তাঁদের শরীর-মূল্যও অনেক চড়া হয়। ধনকুবেররাও শয্যাসঙ্গিনী হিসাবে সেলিব্রটিদেরই চায়। তাই সেলিব্রেটি অভিনেত্রীদের বাজার ও বাজার-দর আকাশছোঁয়া। গণিকাবৃত্তির সঙ্গে ঐশ আনসারি, ভুবনেশ্বরী, শ্রাবণী, যমুনা, দিব্যাশ্রী প্রমুখ অভিনেত্রীদের নামও উঠে এসেছে সংবাদ শিরোনামে। ২০০৯ সালে গণিকাবৃত্তির অপরাধে অভিনেত্রী ভুবনেশ্বরী গ্রেফতার হয়েছিল। ভুবনেশ্বরী নিজে গণিকাবৃত্তি করতেন, তা নয়। তিনি গ্ল্যামার জগতের তারকাদের নিজের ফ্ল্যাটে এনে যৌনকর্ম করাতেন বলে অভিযোগ ছিল। শোনা যায়, তিনি নীল ছবির অভিনেত্রীও ছিলেন। ২০১৩ সালে যোধপুরের এক হোটেলে যৌনকর্ম করতে গিয়ে অত্যন্ত আপত্তিকর অবস্থায় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে অভিনেত্রী ঐশী আনসারি। এ বছরেই আর এক তামিল অভিনেত্রী সায়রাবানু গ্রেফতার হন গণিকাবৃত্তির অভিযোগে। দক্ষিণী ছবির আরও দুজন অভিনেত্রী শ্রাবণী ও যমুনাকে মধুচক্র চালানোর অভিযোগে গ্রেফতার হয়। শ্রাবণীর ক্লায়েন্টদের মধ্যে বেশিরভাগই অন্ধ্রপ্রদেশের মন্ত্রী। সম্প্রতি মধুচক্রের খবর পেয়ে মুম্বাই পুলিশ হানা দেয় আন্ধেরি এক থ্রি-স্টার হোটেলে হানা দেয়। সেই মধুচক্রের ডেরা থেকে পুলিশের হাতে ধরা পড়ল বলিউডের অভিনেত্রী প্রিয়া শর্মা। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২৯ বর্ষীয়া এই অভিনেত্রীই ছিল এই মধুচক্রের মূল কাণ্ডারী। প্রিয়া শর্মা দূরদর্শনের জনপ্রিয় একটি ক্রাইম শোতে ইতোমধ্যেই অভিনয় করেছে। প্রিয়া শর্মা ছাড়াও মারাঠি সিরিয়াল ও চলচ্চিত্রের অভিনয় করা আর-এক অভিনেত্রী পুলিশের কাছে ধরা পড়ে। আর-এক নাবালিকা অভিনেত্রীকেও পাওয়া গিয়েছিল এখান থেকে। সে একটি ওয়েবসিরিজে অভিনয় করেছে।
এই অধ্যায় শেষ করব একটি অন্য ধরনের ঘটনার বিবরণ দিয়ে। তাঁর কথা, যে অভিনেত্রী হয়ে গণিকা নয় বা গণিকা থেকে অভিনেত্রী হওয়ার ঘটনা নয়। সে অভিনেত্রী হতে এসে গণিকা হয়ে গেছে। আসলে অভিনেত্রী হওয়া তাঁর হয়ে ওঠেনি। তাঁর নাম গাঙ্গুবাই কাঠিয়াবাই। মুম্বাইয়ের কামাথিপুরার একজন গণিকা। ভারতের গণিকা নারীদের অধিকার রক্ষা আন্দোলনের নেত্রী, যিনি গণিকালয় রক্ষা করতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সঙ্গেও দেখা করেছেন। গাঙ্গুবাই কাঠিয়াবাই মুম্বাইয়ের চলচ্চিত্র জগতের অভিনেত্রী স্বপ্ন দেখতেন। তখন তাঁর নাম ছিল হরজীবনদাস কাঠিয়াবাদি। গুজরাটের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে ছিলেন তিনি। সেই চল্লিশের দশকেও সমাজের কাছে একটা নিদর্শন হয়েছিল তাঁর পরিবার। সেই সময়েও সেই পরিবারের মেয়েরা সিনেমা দেখতেন। হিন্দি সিনেমা দেখেই শুরু হয় গঙ্গার স্বপ্নের জাল বোনা। মুম্বাই আসতে চায়। মুম্বাই তাঁর স্বপ্নের শহর। চোখে শুধু অভিনেত্রী হওয়ার স্বপ্ন। এমন সময়ে তাঁদের ফার্মে অ্যাকাউন্ট্যান্ট রামলাল নায়েক নামে এক যুবক নিযুক্ত হন। গঙ্গা জানতে পারল এই যুবক কিছুদিন মুম্বাইতে কাজ করেছে। শুরু হল তাঁর কাছে সেই স্বপ্নের শহরের গল্প শোনা। গল্প শুনতে শুনতে তাঁর প্রেমে পড়ে যাওয়া। অতঃপর দুজনে বিয়ে-থা করে মুম্বাই চলে আসে। কিন্তু মুম্বাই এসে গঙ্গার স্বপ্ন ভেঙে ছত্রখান হয়ে গেল। মুম্বাই এসে স্বামী রামলাল মাত্র ৫০০ টাকার বিনিময়ে কামাথিপুরার গণিকালয়ে গঙ্গাকে বিক্রি করে দেয়। গঙ্গাকে ৫০০ টাকায় কিনে নিল গণিকালয়ের সর্দারনি শীলা মাসি। গঙ্গা বহুবার সেখান থেকে পালানোর চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু সফল হয়নি। গঙ্গার নাম বদলে গেল, হল গাঙ্গুবাই। ক্রমে ক্রমে শিক্ষিত ও ব্যক্তিত্বপূর্ণ গঙ্গা ‘গাবাই’ গণিকালয়ের সর্বেসর্বা হয়ে উঠল।
ইতোমধ্যে কামাথিপুরা গণিকালয় পাঠান-মাফিয়াদের আস্তানা হয়ে ওঠে। গাঙ্গুবাই মাফিয়া সর্দারের হাতে রাখি পরিয়ে ভাই পাতিয়ে নেয়। এর ফলে গাঙ্গুবাইয়ের ক্ষমতা বৃদ্ধি হয়। কামাথিপুরার গণিকালয়ে গাঙ্গুবাইরাজ প্রতিষ্ঠা হল। বদলাতে থাকল কামাথিপুরা গণিকালয়ের অন্দরমহলের নিয়মকানুন। যেমন–(১) কোনো মেয়েকেই আর জোর করে গণিকালয়ে নিয়ে আসা যেত না। (২) কেউ যদি গোপনে কোনো মেয়েকে গণিকালয়ে বিক্রি করে দিয়ে যায়, যদি সেই মেয়েটি গণিকাবৃত্তি গ্রহণ করতে না চাইত, তাহলে সেই মেয়েকে গাঙ্গুবাই নিজ দায়িত্বে বাড়ি পৌঁছে দিত।
ভারত ব্রিটিশ মুক্ত হওয়ার পর ব্রিটিশদের মদতে পুষ্ট হয়ে যেসব গণিকালয় গড়ে উঠেছিল, সেগুলি বন্ধ করে দেওয়ার দাবি উঠল। সে সময় গাঙ্গুবাই কামাথিপুরা গণিকালয়ের প্রেসিডেন্ট। গাজুবাই হাজার হাজার গণিকাদের সঙ্গে নিয়ে রাজপথে নামল। গণিকালয় বাঁচাতে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহর নেহরুর সঙ্গে দেখা করে প্রসিডেন্ট গাঙ্গুবাই। গাঙ্গুবাইয়ের দাবি মেনে নিলেন নেহরু।
কামাথিপুরার গণিকালয়েই গাঙ্গুরামের মৃত্যু হয়। গাঙ্গুবাঈকে আর কেউ মনে রাখেনি। গাঙ্গবাইয়ের সংগ্রামী ইতিহাস চাপা পড়ে যায়। না, কেউ মনে রাখেনি একথা বললে নির্জলা মিথ্যা বলা হবে। গাঙ্গু সিনেমার অভিনেত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখলেও, অভিনেত্রী হতে না-পারলেও তাঁর জীবন যে সিনেমার মতই বর্ণময় ঘটনাবহুল! তাই হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস জেগে উঠল। গাঙ্গুর জীবন নিয়ে মুম্বাইতে তৈরি হল ‘গাঙ্গুবাই কাঠিয়াবাদি’ নামে সিনেমা। শুধু গাঙ্গুবাই নয়, গ্ল্যামারের টানে অভিনেত্রীর স্বপ্ন দেখতে এসে অসংখ্য মেয়েকে শেষপর্যন্ত গণিকা হয়ে যেতে হয়েছে। অভিনেত্রীর হওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে, এই টোপ খেয়ে ইন্ডাস্ট্রির বিভিন্ন মানুষদের সঙ্গে বিছানা শেয়ার করতে করতেই একসময় অনেক মেয়েকেই গণিকাবৃত্তির পথ বেছে নিতে হয়। নায়িকা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে গণিকা হতে হয় তাঁদেরই, যাঁদের অভিনয় দক্ষতা নেই। তাঁদের ইতিহাস হয়তো কোনোদিনও লেখা হবে না, তাঁদের জীবন-যন্ত্রণা সেলুলয়েড বন্দিও হবে না।
সিরিয়াল, সিনেমার অভিনেত্রী মানেই কি সে চরিত্রহীনা, গণিকা, পতিতা, বেশ্যা? এদেশের অভিনয় শিল্পে নায়িকাদের সম্পর্কে এক শ্রেণির মানুষ এমন চিন্তাভাবনাই পোষণ করে। অনেকে প্রকাশ্যেই সেই মনোভাব ব্যক্ত করে। সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, ইন্ডাস্ট্রির ভিতরের মানুষরাও এমন ধারণা ব্যক্ত করে।এই তো বছর কয়েক আগে টলিউডের প্রথম সারির অভিনেত্রী কোয়েল মল্লিক দড়াম্ করে এক বোমা ফাটিয়ে দিলেন। তিনি বললেন–“অভিনয়ের জন্য নগ্নতাকে সামনে আনতে কোনো অসুবিধা নেই। প্রতিদিনই আমাদের নগ্ন হতে হয়।” ইঙ্গিতপূর্ণ এহেন বিবৃতিতে টলিউড তোলপাড় হয়ে ওঠে। ভারতীয় অভিনেত্রী ঊষা যাদব বিবিসি কে এক সাক্ষাৎকারে বিস্ফোরক বিবৃতি দিলেন, বললেন–“সে ব্যক্তি যেখানেই চেয়েছে আমার শরীরে সেখানেই হাত দিয়েছে। সে যেখানেই চেয়েছে আমার শরীরের সেখানেই চুমু খেয়েছে। সে আমার জামার ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিয়েছিল। আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। আমি তাকে থামিয়ে দিয়েছিলাম। তখন সে বলল, তোমার মনোভাব যদি এরকম হয়, তাহলে তুমি এখানকার জন্য উপযুক্ত নও।” এহেন বিবৃতি অভিনেত্রীদের সামগ্রিক অবস্থা বিচার করতে খুব বেশি চিন্তা করার প্রয়োজন পড়ে না। উল্টোদিক থেকে যেসব অভিনেত্রী ‘এরকম’ না করে এখানকার মতো করে টিকে গেছে বা টিকে আছে, তাঁরা কি অভিনয়ের বিনিময়ে শরীর বিক্রি করে ফেলেছে? প্রশ্ন উঠছে। ঊষা যাদব এও বলেছেন, সিনেমার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তি তাকে সরাসরি যৌন সম্পর্কের প্রস্তাব দিয়েছিল। বলেছিল–“তুমি যদি এই রোল বা ভূমিকা পেতে চাও, তাহলে আমার সঙ্গে শুতে হবে। তাহলে কি এটা দাঁড়াল না যে, অভিনেত্রীদের সিনেমায় রোল পেতে হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে যৌনক্রিয়া করতে হয়? অর্থাৎ যতগুলো সিনেমায় রোল পেতে চাইবে ততগুলো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে যৌনক্রিয়া করতে হবে? এই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি’-রা কারা? সে কখনো নামজাদা নায়ক হতে পারে, আবার পরিচালক বা প্রযোজকও হতে পারে। নিট রেজাল্ট, অভিনেত্রী হওয়ার আগে তাঁকে গণিকা হতেই হবে। একথা সব অভিনেত্রীই স্বীকার করার সাহস পায় না। কারণ, ঊষা যাদবের ভাষায়–“অনেকেই ভয় পায়। কারণ এখানে কিছু ব্যক্তি এত ক্ষমতাধর যে তাঁদের সৃষ্টিকর্তার মতো মনে করা হয়।” এঁদের বিরুদ্ধে কেউই মুখ খোলেন না, তা ঠিক নয়। তবে কতিপয় যে কজন মুখ খুলেছে, তাঁদের প্রত্যেরই সিনেমা কেরিয়ার এক লহমায় খতম হয়ে গেছে।
কিছুদিন আগে ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত করে কাস্টিং কাউচের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেছিলেন তেলগু অভিনেত্রী শ্রী রেডি। একের পর এক নিজেদের সঙ্গে যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে এই তেলগু অভিনেত্রী। আর এক তেলগু অভিনেত্রী সন্ধ্যা নাইডু। তিনিও জানালেন–“বয়সের কারণে এখন তাঁর কাছে মা বা মাসির চরিত্রে অভিনয়েরই সিংহভাগ অফার আসে। সকালে শু্যটিংয়ের সময় তাঁকে বলা হয় ‘আম্মা’, আর রাত হলে বলা হয় “শুতে’। সন্ধ্যা নাইডু আরও বলেন–“একদিন একজন জিজ্ঞাসা করল, তিনি ভেতরে কী পরে আছেন? তা স্বচ্ছ কি না।” আমি নিশ্চিত, এই শ্ৰী রেড্ডি, সন্ধ্যা নাইডুরা ইন্ডাস্ট্রিতে থাকতে পারবে না। অভিনয় পেশা থেকে সরে আসতেই হবে। কেউ কাজ দেবে না। যেমনভাবে পপ সংগীতশিল্পী আলিশা চিনাই, তনুশ্রী দত্তদের ইন্ডাস্ট্রি থেকে সরে যেতে হয়েছে। অভিনেত্রী সুনীতা রেডিড নামে আর-এক অভিনেত্রীর কথায়–“জোর করে সকলের সামনে পোশাক পালটাতে বাধ্য করা হয় তাঁদের। অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে সকলের সামনে পোশাক পালটাতেই হয়। এমনকী ন্যাপকিন পালটানো, মলমূত্র ত্যাগের মতো প্রাকৃতিক কাজও মেটাতে হয় পাঁচজনের সামনেই।” মারাঠি সিনেমার অভিনেত্রী শ্রুতি মারাঠে ছবির প্রযোজককে মোক্ষম জবাব দিয়ে তাঁকে স্তম্ভিত ও হতচকিত করে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল। কেন? ‘হিউম্যানস অফ বম্বে’-এর একটি পোস্টে শ্রুতি মারাঠে তাঁর বক্তব্য শেয়ার করলেন। শ্রুতি লিখলেন–“আমাকে আমার রোলটি নিয়ে আলোচনা করার জন্য প্রযোজক ডেকে পাঠান। প্রথমে পেশাদার ভঙ্গিতেই কাজের কথা আলোচনা করছিলেন। একটু পরেই সুর বদলে যায়। তাঁর সঙ্গে আমাকে রাত কাটানোর অফার দেন।” প্রযোজকের প্রস্তাবের জবাবে শ্রুতি তাঁকে বলেন–“নায়িকার রোল পেতে হলে আমাকে আপনার সঙ্গে শুতে হবে? নায়ককে কার সঙ্গে শুতে বলেছেন?” এরপরেও যেসব অভিনেত্রীরা বলেন ‘অভিনয়ের জন্য, চিত্রনাট্যের চাহিদা মেটাতে আমরা পর্দায় নগ্ন হতে পারি, তাঁদের কিছু বলার নেই।
সিনেমা, টিভির অভিনেত্রীরা নিজেরা যে এসব যৌনবৃত্তির পুরোধা অথবা তাঁদের অনুসরণ করেই শেষপর্যন্ত বিস্তার ঘটে, সিনেমা শিল্পের গোড়া থেকেই মধ্যবিত্ত এমনকি উচ্চ মধ্যবিত্তেরা মন্তব্য করে এসেছিলেন। সাধারণ মানুষের মনে সর্বদাই সিনেমার অভিনেত্রী মানেই আসলে একজন গণিকা এবং সে কথা সংবাদপত্র পত্রপত্রিকায় ব্যক্ত হচ্ছে। মিডিয়াগুলো বলছে–গ্ল্যামার দুনিয়ার মেয়েরা অভিনেত্রী সাইনবোর্ড কাজে লাগিয়ে অধিক অর্থ কামানোর লালসায় অনৈতিক ব্যাবসায় জড়িয়ে পড়ছে। কারণ শরীরলোভী পুরুষরা সিনেমা অভিনেত্রী, মডেল তারকা, টিভি অভিনেত্রীদের বেশি পছন্দ করে। তার জন্য তাঁরা যথেষ্ট মূল্য দিতেও এক পায়ে রাজি থাকে। হাই-ফাই জীবনের স্বপ্ন দেখতে গিয়ে অনেকক্ষেত্রেই সবকিছু ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়। তাঁদের কোনো ভদ্র যুবক বিয়ে করে না। যদিও-বা কোনো ক্লায়েন্ট রূপের মোহে মুগ্ধ হয়ে বিয়ে করে দু-এক বছর সংসার করে চম্পট দেয়। তখন এদের শরীর ছাড়া আর কোনো পুঁজিই থাকে না।
এক সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের সিনেমানগরী ঢাকার অনেক অভিনেত্রী আছে, যাঁরা পুরোপুরি গণিকাবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত। এদের অনেকেই যৌবন হারিয়ে মাসির ভূমিকায় ব্যাবসা চালায়। সিনেমা জগতের গডফাদার থেকে শুরু করে বড়ো ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সরকারি আমলারা এঁদের ক্লায়েট। এইসব ক্লায়েন্টের মধ্যে অনেকে আবার ভাড়া করা কলগার্ল, নিজের বান্ধবী নিয়ে ওইসব গণিকালয়ে ফুর্তি করতে যায়। অনেক অভিনেত্রী আবার তাঁদের ক্লায়েন্টদের নিয়ে সেক্স ট্রিপে যায় এইসব গণিকালয়ে। বর্তমানে যেসব অভিনেত্রী নিজে এবং কয়েকজন মেয়ে নিয়ে দেহব্যাবসা চালাচ্ছে, তাঁদের মধ্যে অন্যতমা একা। পুরোনো ঢাকার বাসিন্দা একা চলচ্চিত্রের অভিনেত্রী হয়ে যতটুকু নামডাক অর্জন করেছিল, তার চেয়ে বেশি দুর্নাম কুড়িয়েছিল এই যৌনপেশায় এসে। অভিনেত্রীর খাতায় নাম লেখানোর পরপরই অভিনেত্রী একা দেহব্যাবসায় এসেছিলেন। শরীর বিক্রি করে প্রচুর অর্থ কামানোই ছিল তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য। একসময় যৌনবাজারে নিজের চাহিদা কমে যাওয়ায় বাড়িতে কয়েকজন মেয়েকে বোন পরিচয়ে রেখে যৌনব্যাবসা চালাতে লাগল। বর্তমানে ইস্কাটন এলাকায় একা সেক্স সেন্টার চালায়। দেহব্যাবসাকে পেশা হিসাবে নিয়েছিল ঢাকার আর-এক বিতর্কিত অভিনেত্রী কেয়া। শুধু কেয়া একা নয়, তাঁর অপর ছয় বোন বীথি, সাথী, লাকি, তানিয়া, যুঁথি আর ইতিকে নিয়ে এক জমজমাট যৌথ যৌনব্যাবসা চালায় তাঁর গর্ভধারিণী মা সুফিয়া বেগম। যশোরের বহুল আলোচিত মক্ষীরানি সুফিয়া বেগম গুলশান অঞ্চলের ‘শেলফোর্ড নামের বাড়িতে যৌনব্যাবসা পরিচালনা করে, যে বাড়িটির মাসিক ভাড়া বাংলাদেশী মুদ্রায় ৫৫,০০০ টাকা। বাংলাদেশের অভিনেত্রী সাদিয়া আফরিনকেও গণিকাবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়েছে। একটি বাংলাদেশী এসকর্ট সার্ভিস প্রোভাইডার সাইটে ছবি সহ প্রোফাইল দেখা গেছে ‘নিনা’ ছদ্মনামে। অভিনেত্রী সাদিয়া আফরিন বিনোদন বিচিত্রা সেরা ফোটোসুন্দরী প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ২০১১ সালে মিডিয়ায় পা রাখে। মডেলিংয়ের পাশাপাশি বেশ কিছু সিনেমান আইটেম গানে কাজ করেন। এছাড়া বেশ কিছু সিরিয়াল ও টেলিফ্লিমেও কাজ করেছেন। এই হল অবস্থা! সেই কারণেই বোধহয় জনপ্রিয় মালয়ালাম অভিনেতা-সাংসদ ইনোসেন্ট ভারিদ থেক্কেথালা অবলীলায় বলে ফেলতে পারেন–“ছবিতে চরিত্র পাওয়ার জন্য তাঁদের যৌন-শোষণের মুখোমুখি হতে হয় না। যদি মেয়েটি খারাপ হয়, তবেই সে বিছানায় যায়।”
১৪. স্বাধীনতা সংগ্রামে গণিকা
ভারতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে গণিকাদের অংশগ্রহণ স্মরণীয়। স্বাধীন ভারত তাঁদের কথা ভুলে গেলেও এ প্রবন্ধকার ভোলেনি। ১৯০৭ সালে অনুশীলন সমিতির বিপ্লবী যুবকদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল প্রচুর গণিকা নারী। ১৯০৭ সালের অক্টোবর মাসে অনুশীলন সমিতির যুবকেরা ঠিক করলেন সরকারি নির্দেশ উপেক্ষা করে বিডন স্কোয়ারে একটা সভা করবেন। সভা শুরু হল, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় জ্বালাময়ী ভাষণ দিলেন। আর তারপরেই শুরু হল পুলিশের লাঠিচার্জ। বিপ্লবী যুবকেরা ইট-পাথর ছুঁড়ে পাল্টা আক্রমণ চালাল। আর সেই সময় দেখা গেল চিৎপুরের বাড়ির ছাদ, বারান্দা, জানালা থেকে গণিকা নারীরা পুলিশের উপর ইট ছুঁড়ে তাঁদের তাড়িয়ে দিচ্ছে।
অসহযোগ আন্দোলনের সময় ১৯২১ সালে কলকাতার গণিকা নারীরা আন্দোলনের জন্য অর্থসংগ্রহের কাজে অংশগ্রহণ করে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস এবং জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলি সোনাগাছি অঞ্চলের গণিকাদের নিয়ে সভা করেন। এর পরের বছর বন্যার্তদের সাহায্যের জন্যেও পথে নেমেছিল গণিকারা। ত্রাণের জন্য যে রিলিফ কমিটির গঠিত হল ‘বেঙ্গল রিলিফ কমিটি’, যার সভাপতি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। সদস্যদের মধ্যে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চিত্তরঞ্জন দাস, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, ডাক্তার নীলরতন সরকার প্রমুখ। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই বেঙ্গল রিলিফ কমিটি ১ লাখ টাকার ও বেশি সংগ্রহ করতে পেরেছিল। মানদাদেবীর লেখা বই থেকে জানা যায় সেই সময় ‘পতিতা সমিতি গঠিত হয়েছিল। তাঁরা লালপাড় শাড়ি পরে কপালে সিঁদুরের ফোঁটা লাগিয়ে গান গেয়ে টাকা তুলেছিলেন বন্যার্তদের জন্য মাসিক বসুমতিতে এই নিয়ে একটি রচনা লেখা হয়। সংগৃহীত অর্থ তাঁরা আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের হাতে তুলে দিয়েছিল। পিতৃস্নেহে ‘এসো এসো মা লক্ষীরা’ বলে আচার্য তাঁদের আহ্বান করেন এবং তাঁরা এই অকৃত্রিম স্নেহ দেখে আপ্লুত হয়ে যান। বরিশালেও পতিতা সমিতি গড়ে ওঠে। তাঁর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন গান্ধীবাদী শরকুমার ঘোষ।
১৯২৪ সালে গণিকা নারীরা তারকেশ্বরে সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণ করেন নেতৃত্বে ছিলেন স্বয়ং চিত্তরঞ্জন দাস। বাংলার ভদ্র সমাজ এই নিয়ে আবার তীব্র প্রতিবাদও জানিয়েছিলেন। প্রবাসী’ পত্রিকা এই নিয়ে প্রতিবাদ করেন, কেন গণিকা নারীরা সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণ করছে। ১৯২৫ সালে চিত্তরঞ্জন দাস প্রয়াত হলে তাঁর মরদেহ নিয়ে যে বিরাট মিছিল হয়েছিল সেই মিছিলে পা মেলান গণিকারা। ১৯৩০ মেদিনীপুরে নন্দীগ্রামে সত্যবতী নামে একা গণিকা নারী লবণ সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণ করে পুলিশ দ্বারা নির্যাতিত হয়েছিলেন। তমলুকে ৪২-এর আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে আহত কয়েকজন বিপ্লবীর প্রাণ বাঁচিয়েছিল এক গণিকা নারী। এক সংগ্রামী মিটিংয়ে মেদিনীপুরের ম্যাজিস্ট্রেট পেডি সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী নিয়ে উপস্থিত হন। পেডি আদেশ দিলেন—“১৪৪ ধারা জারি আছে, মিটিং করা যাবে না”। বিপ্লবী জ্যোতির্ময়ী দেবী পুলিসের বাধা অগ্রাহ্য করে জনতাকে আহ্বান করে বললেন–“যারা বুকের রক্ত দিতে প্রস্তুত আছেন তারা এই সভায় এগিয়ে আসুন। যারা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবেন তাঁরা ফিরে যান।” এই আহ্বান শুনে সাবিত্রী নামে তমলুকের এক সালঙ্কারা পরমাসুন্দরী ষোড়শী গণিকা নারী এগিয়ে বললেন—“আমরা বুকের রক্ত দেব। কিন্তু পৃষ্ঠপ্রদর্শন করব না।”
বঙ্গদেশে তুমুল ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম শুরু হয়ে গেলেও তথাকথিত ভদ্রঘরের মেয়েরা সেই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেনি সে সময়। মূলত পুরুষদের মধ্যেই আন্দোলন সীমাবদ্ধ থাকলেও মেয়েরা যে আসেনি তা কিন্তু নয়। যৌনপল্লির মেয়েরাই সংগ্রামে অংশ নিয়েছিল। বিশেষ করে চিৎপুরের যৌনকর্মীরা ব্রিটিশ পুলিশের বিরুদ্ধে। রুখে দাঁড়িয়েছিল।
যৌনকর্মীদের স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের চমকে দিয়েছিল। মেয়েরা যে এভাবে এগিয়ে আসবেন তাঁরা কখনো স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। পুলিশের ধাওয়া খেয়ে বিপ্লবীরা যৌনপল্লিতে আত্মগোপন করত কোনো যৌনকর্মীর ঘরে। যৌনকর্মীরাও তাঁদের শেল্টার দিতে আপত্তি করত না। শুধু শেল্টার দিত তাই নয়, তাঁদের উপার্জিত অর্থ নিজেদের স্বর্ণালংকার বিপ্লবীদের হাতে তুলে দিত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য।
‘শিক্ষিতা পতিতার আত্মচরিত গ্রন্থ থেকে মানদা দেবীর বর্ণনায় জানা যায়–আন্দোলনে অংশ নিয়ে মিছিলে হাঁটা, ত্রাণের টাকা তোলা বারাঙ্গনা নারীরা করতেন। তাঁরা গান গেয়ে কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বিপ্লবী আন্দোলনে সামিল হতেন। প্রাণমন সঁপে দিয়ে করতেন। ১৯২৯ সালে অসহযোগ আন্দোলনেও গণিকাদের অংশগ্রহণ ছিল।
তবে ভদ্রসমাজের একটা অংশ গণিকাদের এই অংশগ্রহণ মেনে নিতে পারেনি। ব্রহ্মবাদীদের এমন আচরণ দেখা গেল যখন তারকেশ্বরে সত্যাগ্রহ আন্দোলনে গণিকারা অংশ নিয়েছিলেন। গণিকাদের এই অংশগ্রহণ নিয়ে সেই সময়কার পত্রপত্রিকায় বিস্তর লেখালেখিও হয়েছে। গণিকারা স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করাকে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় কটাক্ষ করলেন। তিনি লিখলেন–“খবরের কাগজে পড়িয়াছি তারকেশ্বরে যে সকল নারী সত্যাগ্রহ করিতেছেন পতিতা নারীরাও তাঁহাদের দলভুক্ত এবং তাহারা অবাধেই সকলের সঙ্গে মিশিতেছে। … সত্য হইলে ইহা বাঞ্ছনীয় নহে। কারণ ইহাতে সামাজিক পবিত্রতা সংরক্ষিত ও বর্ধিত না পাইয়া নষ্ট হইবার সম্ভাবনাই বেশি।” এমনকি মহাত্মা গান্ধিও গণিকাদের অংশগ্রহণ ভালো চোখে দেখেনি। সে সময় কমলকুমার মিত্র তাঁর সম্পাদিত ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকায় লিখলেন–“প্রকৃতপক্ষে কতকগুলি বেশ্যা, বাগদি, ডোম প্রভৃতি নিম্নশ্রেণির স্ত্রীলোক দ্বারা এই দল গঠিত। বেশ্যা ও অপর শ্রেণির স্ত্রীলোকদের ভলান্টিয়ার করা ভালো হয় নাই।” অবিনাশ নামে এক বিপ্লবী ভদ্রলোক যৌনপল্লিতে ঢুকেছিলেন যৌনকর্মীদের কাছ থেকে আন্দোলনের জন্য চাঁদা তুলতে। যৌনকর্মীরা একবাক্যে রাজি হয়ে যান চাঁদা দিতে। সেই বার্তা বিপ্লবী অশ্বিনী দত্ত ও প্রমথনাথ মিত্রকে জানানো হলে তাঁরা যৌনকর্মীদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়ায় আপত্তি তোলেন। এই রক্ষণশীলতার কারণে আর চাঁদা তোলা সম্ভব হয়নি।
সেই সময়কার বিমলা নামের গণিকার কথা জানা যায়, যিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ব্রিটিশদের চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। চিৎপুরের গণিকা ছিলেন বিমলা। সেই পেশা ত্যাগ করে দেশের কাজে পাকাপাকিভাবে ব্রতী হন। তিনি যেমন শিক্ষিতা ছিলেন, তেমনি ছিলেন রূপবতী। বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজি ভাষাতে কথা বলাতে যথেষ্ট সাবলীল ছিলেন। যে-কোনো ভাষাতেই অসাধারণ বক্তৃতা দিতে পারতেন।
মহিলাদের এক ব্রিটিশ বিরোধী জনসভা হচ্ছিল। সেই জনসভায় বিশাল পুলিশবাহিনী উপস্থিত জনতার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঘোড়া-পুলিশের দল জমায়েতের ভিতর ঘোড়া ছুটিয়ে তাণ্ডব শুরু করে দিল। সেসময় মঞ্চে ঝাঁঝালো বক্তৃতা দিচ্ছিলেন চিৎপুরের গণিকা বিমলা দেবী। বিমলা দেবী ছুটে গিয়ে এক পুলিশ সার্জেন্টের ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরেন এবং বলেন–“Are you not born of a woman? How do you beat your mothers and sisters?” সেদিন রণচণ্ডী বিমলার তেজ ও সাহসিকতার সামনে পুলিশ হঠে যেতে বাধ্য হয়। এ ঘটনার সংবাদ পৌঁছে গিয়েছিল কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছেও। তিনি বিমলা দেবীর মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন–“সাবাস। কে বলে তুই অবজ্ঞার পাত্রী! তোর মধ্যে আজ আদ্যাশক্তি মহিষাসুরমর্দিনীর বিভূতি দেখলুম।”
আন্দোলনের একটা সময়ে এসে বিপ্লবীরা নরমপন্থী ও চরমপন্থী হিসাবে দু-ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলে। আন্দোলনে অভিমুখ ক্রমশ বদলাতে থাকল। ভদ্রসমাজ গণিকা দেশপ্রেমীদের উপেক্ষা করতে থাকল। দেশের কাজ করতে গিয়ে বারবার বাধা পেতে থাকেন। অবশেষে বিমলাকে পুনরায় গণিকাজীবনে ফিরে আসতে হয়। ফিরে আসতে বাধ্য হয়। গণিকাজীবন শুরু করলেও দেশের কাজ থেকে তিনি কোনোদিন বিরত থাকতে পারেননি। শচীনন্দন চট্টোপাধ্যায় লিখছেন, বিমলা কীভাবে এক বেকার কংগ্রেসকর্মীকে স্নেহ দিয়ে অর্থের জোগান দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। এক বিপ্লবীর আত্মগোপন করে থাকার সময়ে সমস্ত খরচ জুগিয়েছিলেন বিমলা। শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ উপন্যাসে সুমিত্রা চরিত্রটি কী বিমলারই প্রতিচ্ছবি? অনেকে তেমনটাই মনে করেন।
১৯৩০ সালে মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর জালালাবাদের যুদ্ধ সংঘটিত হয় ব্রিটিশদের মধ্যে। এই যুদ্ধে শহিদ হন ৯ জন বাঙালি বিপ্লবী। এর মধ্যে একজন ছিলেন বিপ্লবী অর্ধেন্দু দস্তিদার। অর্ধেন্দু দস্তিদার ঘটনাস্থলে ভয়ানকভাবে জখম হন। সেই অবস্থায় তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। কোনোরূপ চিকিৎসা না করে তাঁকে জেরায় জেরায় জেরবার করে তোলা হয়। অবশেষ বিপ্লবী অর্ধেন্দু মারা যান। বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর মুক্তিসংগ্রামে অন্তঃপুরবাসিনী ও বারাঙ্গনাগণ’ নিবন্ধে পূর্ণেন্দু দস্তিদারের বয়ানে লিখলেন–“মৃতদেহ শ্মশানে রেখে তখন অর্ধেন্দুর ডাক্তারকাকা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যবস্থা করছেন। তখন তিনি দেখলেন শ্মশানের গেটে একটি ঘোড়ার গাড়ি থামল এবং তা থেকে নামল চারজন নারী। কাছে এগিয়ে এলে দেখা গেল তাঁরা শহরের বারাঙ্গনা। তিনি তাঁদের ওখানে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তাঁদের মধ্যে একজন বলল তাঁরা দেবতা দেখতে এসেছেন। তাঁদের শাড়ির মধ্যে লুকানো দুধের বোতলগুলি আর ফুলের তোড়া বের করে তাঁরা বলে–‘এই দুধ দিয়ে ওই দেবতার মৃতদেহ আমরা স্নান করাতে চাই। তারপর ফুলগুলি দিয়ে ফিরে যাব। শহিদ অর্ধেন্দু দস্তিদারের পিতৃব্য পূর্ণেন্দু দস্তিদার তাঁদের অনুমতি দিয়েছিলেন।
১৫. গণিকাবৃত্তি নানা রূপে
প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ এবং ব্রিটিশ-ভারতে গণিকাবৃত্তির ধরনধারণ তো আমরা কিছুটা ধারণা নিতে পারলাম। কিন্তু বর্তমান তথা আধুনিক যুগে গণিকাবৃত্তির ধরনধারণ কোন্ পথে, আমরা এবার সেটা জানার চেষ্টা করব। বর্তমান সময়ে গণিকাবৃত্তির ধরনে আমূল পরিবর্তন এসেছে। যৌনব্যাবসা এখন শুধু স্থানীয় নয়, আন্তর্জাতিক। প্রযুক্তিকে যথাযথ ব্যবহারে যৌনপেশা তরতর করে এগিয়ে চলেছে। কমেছে শরীর নিয়ে ছুঁৎমার্গ। সর্বস্তরের ক্লায়েন্টদের টানত যৌনপেশা ক্রমশ উন্নত থেকে উন্নত হচ্ছে। সেইসঙ্গে আসছে নতুন নতুন বিভাজন। আসুন, এবার বিভাজনগুলি দেখে নেওয়া যাক।
(১) stree Protitute : শব্দটার বাংলা পাইনি। তাই ইংরেজিতেই লিখলাম। এইভাবেই শব্দটি সবাই জানে। যাই হোক, এই গণিকারা ক্লায়েট (গণিকাজগতে এখন আর বাবু, খরিদ্দার বলে না। সবাই ক্লায়েট।) ধরার জন্য বিভিন্ন রাস্তার পাশে, রাজপথে, পার্ক বা অন্যান্য পাবলিক প্লেস, যানবাহনে বা সংকীর্ণ কোনো ঘুপচিতে কম পয়সার বিনিময়ে এঁরা যৌনক্রিয়া সম্পন্ন করে। এঁরা স্বাধীন গণিকা। রোজগারের জন্য এই পেশা নেয় তাঁরাই, যাঁদের অন্য কোনো কাজ করার স্কিলড নেই। শুধু পুলিশকে প্রাপ্য মিটিয়ে দিলেই হল। না মেটালে সারাদিন পুলিশের তাড়া খেয়ে বেড়াতে হবে।
(২) গণিকালয় : গণিকালয়, পতিতালয়, বেশ্যালয়, নিষিদ্ধপল্লি, ব্রোথেল (Brothel), Red light area বা কোঠি–এগুলি সমার্থক শব্দ। এখানে ঘর ভাড়া দিয়ে বা ঘর ভাড়া নিয়ে ঘোষিতভাবে যৌনকর্ম চালানো হয়। তবে খোলা রাস্তার থেকে অনেক বেশি নিরাপদ। রোজগার নিশ্চয়তা কিছুটা বেশি। এখানে ক্লায়েট খুঁজে বেড়াতে হয় না, ক্লায়েন্টই খুঁজে নেয় যৌনকর্মী নিজের পছন্দমতো।
তবে নিষিদ্ধপল্লি বা লালবাতি এলাকা বা Red light area শব্দটির অর্থ আরও বিস্তারে ভাবা হয়েছে।এই অঞ্চল বলতে বোঝায় যৌনশিল্প সংক্রান্ত বাণিজ্যের অস্তিত্ব, যেমন–সেক্স শপ, স্ট্রিপ ক্লাব বা অ্যাডাল্ট থিয়েটার। কোনো কোনো নিষিদ্ধপল্লিতে যৌনকর্মীরা বৈধভাবে ব্যাবসা চালায়, কিন্তু বেশ কিছু অঞ্চল তাঁদের বেআইনি কার্যকলাপের জন্য কুখ্যাত। ১৮৯৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মিলওয়াউঁকির সংবাদপত্র ‘দ্য সেন্টিনাল’ এ একটি নিবন্ধে ‘Red-light distric’ শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয়। ১৮৯০-র দশকে সমগ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বহু ক্ষেত্রে এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছিল। অনেক মনে করেন ‘রেড লাইট’ বা ‘লালবাতি’ কথাটির উৎস রেলওয়ে কর্মচারীদের লাল লণ্ঠন। এই লণ্ঠন তাঁরা গণিকালয়ে প্রবেশের আগে বাইরে রেখে যেত, যাতে ট্রেন চলাচল সংক্রান্ত যে-কোনো প্রয়োজনে তাঁদের সহজে খুঁজে পাওয়া যায়। অন্যমতে, প্রাচীন চিনে গণিকালয়ের বাইরে ঝুলিয়ে রাখা যৌনোদ্দীপক লাল রঙের কাগুঁজে লণ্ঠন থেকে এই শব্দের উৎপত্তি।
বাইবেলের একটি কাহিনিতে দেখা যায়, জেরিকো অঞ্চলে রাহাব নামে এক গণিকা জোশুয়ার গুপ্তচরদের মদত দিয়েছিল এবং নগর দখলের পর লুণ্ঠনের সময় তাঁরা যাতে সহজেই রাহাবের বাড়ি চিনতে পারে এবং সেই বাড়িটিকে রেহাই দেয় সেইজন্যে সে একটি লাল দড়ি দিয়ে তাঁর বাড়ি চিহ্নিত করে রাখত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বেলজিয়াম ও ফ্রান্সের বহু গণিকালয়ে নীল ও লাল রঙ দিয়ে যথাক্রমে অফিসারদের ও অন্যান্য পদের লোকেদের ব্যবহৃত গণিকালয় চিহ্নিত করা হত।
লালবাতি এলাকার জাপানি নাম ‘আকাসেন’, বাংলা তর্জমায় অর্থ হল–লাল রেখা। জাপান পুলিশ মানচিত্রে লাল রেখা দিয়ে দিয়ে নিষিদ্ধপল্লির সীমা নির্ধারণ করত। সেই থেকে এই নামের উৎপত্তি। তাঁরা ‘আওসেন’ বলেও একটি শব্দ ব্যবহার করত, যাঁর বাংলা ভাষায় অর্থ ‘নীল রেখা। নীল রেখা দিয়ে তাঁরা বেআইনি কার্যকলাপপ্রবণ অঞ্চলগুলি চিহ্নিত করত। যাই হোক, বিভিন্ন সংস্কৃতিতে লালবাতি অঞ্চলকে বিভিন্ন রূপে দেখা যায়, কিন্তু আদতে এগুলি গণিকালয়েরই বিভিন্ন রূপ।
(৩) সেক্সডল গণিকালয় : না, এখানে কোনো হিউম্যান বডি গণিকাবৃত্তি করে না। সেক্সডল কোনো রক্তমাংসের উষ্ণ শরীর নয়। সেক্সডল কৃত্রিম প্রযুক্তিতে তৈরি সিলিকনের নারীশরীর। পৃথিবীর বেশ কিছু উন্নত দেশে সেক্সডলের চাহিদা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। নিরাপদ যৌনকর্মী বা জীবনসঙ্গীর অভাব পূরণ করতেই সেক্সডলের আবির্ভাব। আমেরিকা, জার্মানি, চিন সহ বিশ্বের একাধিক দেশেই কথা বলতে পারে এমন সেক্সডলের চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি হচ্ছে। এই সেক্সডলগুলি রিমোর্ট কন্ট্রোলের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ভারতীয় মুদ্রায় এক একটি কথা বলতে পারা’ সেক্সডলের দাম আড়াই থেকে তিন লক্ষ টাকা। সবচেয়ে বেশি সেক্সডল প্রস্তুত হয় চিনেই। চিনের কারখানায় ভিন্ন ধরনের সেক্সডলের নির্মাণ হয়ে থাকে। এমনই এক কারখানার নাম WMDOLL। সেক্সডলের চাহিদায় এই সংস্থা প্রায় ৮০ শতাংশ সেক্সডল প্রস্তুত করে থাকে। এই সংস্থার ৫০ শতাংশ অংশীদারী আমেরিকার। বলে রাখি, এইসব কারখানায় শুধু যে নারীশরীরের সেক্সডল তৈরি হয় তা কিন্তু নয়, যথেষ্ট পরিমাণে চাহিদা অনুযায়ী পুরুষশরীরের সেক্সডলও তৈরি করা হয়।
সেক্সডলের সঙ্গে সেক্স করলে তাঁকে গণিকা বলা হবে কি না, সেক্সডল খাঁটিয়ে কেউ কোথাও যৌনব্যাবসা হলে সেটাকে গণিকালয় বলা হবে কি না, ঘরওয়ালিকে মক্ষীরানি’ বলা যাবে কি না, তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক হতে পারে। তবে সেক্সডল নিয়ে গণিকালয় তৈরির কথাও ভাবা হচ্ছে। সাধারণভাবে পুরুষরা যেমন বাড়তি যৌন মনোরঞ্জনের জন্য গণিকালয়ে গিয়ে থাকে বা বাগানবাড়িতে গণিকা নিয়ে এসে মনোরঞ্জন করে থাকে। তারপর সময়ের বিবর্তনে মানুষ যৌনতার একঘেঁয়েমি কাটানোর জন্য সেক্সরোবট ব্যবহারও করতে থাকে। থেমে থাকে না স্বপ্ন। আমেরিকার এক শহরে এমন এক গণিকালয় খোলার কথা ভেবেছিল, যেখানে অর্থের বিনিময়ে সার্ভিস দেবে সেক্সডল। সেক্সডল তো সেই অর্থ রোজগার করবে না, রোজগার করবে সেক্সডলের মালকিন। তবে সেই সেক্সডল গণিকালয়ের অনুমোদন মঞ্জুর হয়নি। অনুমোদন করা হয়নি এই কারণে যে, এই ধরনের গণিকালয় জনপ্রিয় হয়ে উঠলে হিউম্যান বডি গণিকালয়ের জনপ্রিয়তা হারাবে। ফলে বহু মেয়েরা যেমন জীবিকা হারাবে, পেশায় সঙ্গে জড়িত বহু মানুষ সংকটের মধ্যে পড়ে যাবে। অর্থনীতিও ভেঙে পড়বে। কানাডার এক প্রতিষ্ঠান Kinkysdolls সেক্সডল নিয়ে একটি গণিকালয় খোলার প্রস্তাব দিয়েছিল। এ বিষয়ে একটি অনলাইন মতামত নেওয়া হয়েছিল, যেখানে ১২,০০০ মানুষের সমর্থন পাওয়া গিয়েছিল। তবে অনেকেই মনে করেন, এমন গণিকালয় হলে মহিলারা শুধুই পণ্যভোগ্য সামগ্রীতে পরিণত হবে। কেউ কেউ মনে করেন এর ফলে সমাজে আসবে বৈষম্য, বাড়বে হিংসা। তবে টরেন্টো ও প্যারিসে এরকম সেক্সডল গণিকালয় অনেক আগে থেকেই ছিল। এছাড়া অস্ট্রিয়া, সাউথ কোরিয়া, চিন, ইউনাইটেড স্টেট ছাড়াও অন্যত্র এই ধরনের।
(৪) এসকর্ট (Esort) : এসকর্ট সার্ভিস সাধারণত বিজ্ঞাপনের মাধ্যমেই জানানো হয়। এই বিজ্ঞাপনে কোনো ঠিকানা থাকে না, থাকে ফোন নম্বর। গুগল সার্চ করলে এরকম অসংখ্য এসকর্টের খবর পাওয়া যাবে। এছাড়া শহরের বিভিন্ন জায়গায় পোস্টারও দেখতে পাওয়া যায়। বিভিন্ন ভাষায় পত্রপত্রিকাতে বিজ্ঞাপনও দেখতে পাওয়া যায়। ফোন নম্বরে ফোন করলে ওপাশ থেকে নারীকণ্ঠ অথবা পুরুষকণ্ঠে ভেসে আসবে–ওয়েলকাম স্যর।
–এখানে মেয়ে পাওয়া যাবে?
–পাওয়া যাবে স্যার। সুন্দরী সুন্দরী মেয়েদের পাওয়া যাবে।
–রেট কীরকম?
–আমাদের সেন্টারে এলে অবিবাহিতা কলেজ গার্ল প্রতি ঘণ্টায় ৩০০০ টাকা, বিবাহিতা ঘরোয়া মহিলা ২৫০০ টাকা, বিধবা বা ডিভোর্সি ২০০০ টাকা। এটা নন-এসির রেট, এসি নিলে অতিরিক্ত ৬০০ টাকা। আপনার নিজস্ব জায়গাতে নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত ৫০০ টাকা দিতে হবে। ট্রান্সপোর্টেশন খরচও আপনার।
–কোনো ঝুটঝামেলা নেই তো?
–একদম ঝুটঝামেলা নেই। ১০০ % নিরাপদ ও সুরক্ষিত। কবে আসবেন স্যার? আজই আসবেন?
–না, আজকেই যাচ্ছি না। সময় সুযোগ পেলে ফোন করে নেব।
–ঠিক আছে স্যার। এটা আপনার হোয়াটস অ্যাপ নম্বর? কিছু মেয়েদের ছবি পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনি পছন্দ করতে পারেন। আপনি যখন আসবেন আমাদের জানালে আপনাকে সম্পূর্ণ ঠিকানা আর পথনির্দেশ দিয়ে দেব।
‘এসকর্ট গার্ল’ বলতেই একঝাঁক স্মার্ট শিক্ষিত মেয়েদের ছবি ভেসে ওঠে। বাস্তবিকই। আপনি ঠিকানা পেয়ে গেলেন একটি নির্দিষ্ট এলাকার নির্দিষ্ট ফ্লাটে। দরজা বন্ধই থাকে। কলিং বেল টিপলেই দরজা খুলে যাবে। ভিতরটা শুনশান ফাঁকা। আপনাকে একটি ঘরে বসানো হবে। দুজন বা তিনজন ধোপদুরস্ত জিনস টি-শার্ট পরিহিতা স্মার্ট মেয়ে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আপনাকে বলবে–“আমরা তিনজন আছি। কাকে পছন্দ?” প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, এই তিনজনের মধ্যে থেকে একজনকেও যদি আপনার পছন্দ না হয়, তখন আপনাকে হোয়াটস অ্যাপ খুলে অন্য মেয়েদের ছবি দেখানো হবে। হোয়াটস অ্যাপের কোনো মেয়ে পছন্দ হলে সেই মেয়েকে সেদিন আপনি পাবেন না। আপনাকে বলা হবে, একটি নির্দিষ্ট দিনে আপনি পাবেন। তারিখ-সময় ফাইনাল হলে সেই মেয়েকে ডাকিয়ে আনা হবে আপনার জন্য।
উপরের সংলাপটি কাল্পনিক নয়, একটি ফাইন্ড ফ্যাক্ট। সার্ভিস পরিস্থিতি অনুযায়ী সংলাপ অন্যরকমও হতে পারে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, যেই মূহুর্তে আপনি সার্ভিস জোনে ঢুকে পড়লেন, আপনাকে নজরে রাখতে পারে কোনো গোপন ক্যামেরা। কিন্তু আপনার কাছে থাকা কোনো গোপন ক্যামেরার কার্যকারিতা থাকবে না।
কলেজ ছাত্রী থেকে গৃহবধূ, বিমানসেবিকা থেকে কলসেন্টার কর্মী, এমনকি মডেল গার্ল, টিভি বা সিনেমার অভিনেত্রীদের তালিকাও এই এসকর্ট সার্ভিসের সঙ্গে যুক্ত। উপযুক্ত টাকা খরচ করতে পারলেই যেমন বাঘের দুধ মেলে, তেমনি শয্যাসঙ্গিনীও মেলে। সবচেয়ে কম খরচ কলেজ পড়ুয়া বা ঘরোয়া গৃহবধূদের ক্ষেত্রে। সবচেয়ে বেশি খরচ হবে স্ট্রাগলিং অ্যাক্ট্রেস বা ভিআইপি মডেল গার্লদের ক্ষেত্রে। ঘণ্টায় এক লাখ টাকাও হতে পারে। গোটা রাতের জন্য হলে আরও বেশি। আবার এই টাকার অঙ্কের পরিমাণ নির্ভর করবে ওই সময়ের মধ্যে তাঁর সঙ্গে কতবার যৌনমিলন করবেন তার উপর। তবে কোথাও প্যাকেজ সিস্টেম চালু আছে। যেমন ধরুন এক ঘণ্টায় চুক্তিতে ২০০০ টাকার বিনিময়ে আপনি সর্বাধিক চারবার যৌনমিলন করতে পারবেন। আপনি চুক্তিবদ্ধ হলে আপনার সঙ্গে যে মেয়েটি যাবে সে তাঁর সঙ্গে চারটি কন্ডোম নিয়ে নেবে। মনে রাখবেন, কন্ডোম ছাড়া আপনি কোনো মেয়ের সঙ্গেই যৌনমিলন করতে পারবেন না। কোনো কোনো এসকর্ট সেন্টারে ক্লায়েন্টের কাছ থেকে যৌনমিলন করার আগে টাকা নেওয়া হয়, কোথাও-বা যৌনমিলন করার পর টাকা নেওয়া হয়।
এই সার্ভিসে কোনো দালাল বা মধ্যস্থতাকারী নেই। কোনো দালালের মাধ্যমে এসকর্ট সার্ভিস আপনি পাবেন না। এই সার্ভিস সম্পূর্ণভাবে অনলাইন-নির্ভর। এসকর্ট সার্ভিসগুলি ছড়িয়ে শহর বা শহরের বাইরে ছড়িয়ে আছে। সল্টলেক, লেক টাউন, রাজারহাট, মধ্যমগ্রাম, এয়ারপোর্ট এলাকা, পার্কস্ট্রিট, ধর্মতলা, বড়োবাজার, যাদবপুর, ভবানীপুর, বারাকপুর, নৈহাটি, দুর্গাপুর—কোথায় এই সার্ভিস পাওয়া যায় না! ওয়েবসাইটগুলি ঘাঁটলে আপনি কোনো কোনো সাইটে পেয়ে যেতে পারেন সংশ্লিষ্ট মেয়েটির ছবি সহ শারীরিক বিবরণ। যেমন–বয়স, চুলের রং, চোখের রং, গায়ের রং, উচ্চতা, ওজন, স্তনের সাইজ, কোমরের সাইজ, নিতম্বের সাইজ, মদ্যপান করে কি না, ধূমপান করে কি না ইত্যাদি সমস্ত তথ্য। আজকাল ফেসবুকেও এসকর্ট সার্ভিসের পেজ খোলা হচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সবার আগে এগিয়ে।
এসকর্ট হল ছকভাঙা যৌনযাপন। এখানকার মেয়েরা কেউ কেউ আর পাঁচটা পেশার মতো করে পেশাকে বেছে নিয়েছে। আর পাঁচজন অফিস-কর্মীর মতো সকালে নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেন ধরে চলে আসে সেন্টারে, আবার সন্ধ্যায়। বাড়ি ফিরে যায় আর পাঁচজন অফিস-কর্মীর মতোই। বাড়ির মা-বাবা-সন্তান-স্বামী জানেন তাঁদের মেয়ে-মা-স্ত্রী চাকরি করতে যাচ্ছেন, আর চাকরি করে বাড়ি ফিরছেন। এমন চাকরি, যাতে মাঝেমধ্যে নাইট ডিউটিও করতে হয়। এসকর্ট গার্লদের একটা অংশ শুধুমাত্র হোটেল-রিসোর্টে গিয়ে সার্ভিস দেয়। এক্ষেত্রে আপনি এঁদের সার্ভিস পেতে কোনো সাইট থেকে যোগাযোগ করলে এঁরা আপনার কাছ থেকে জানতে চাইবে আপনি কোন্ হোটেলে আছেন সেই হোটেলের নাম, ঠিকানা ও রুম নম্বর। আপনার এসব তথ্য নিয়ে ঠিক সময়মতো পৌঁছে যাবে রুমের কাছে, আপনার পছন্দের হার্টথ্রব গার্ল। এঁরা সাইটগুলিতে নিজেদের ছবি ও শরীরের বিস্তারিত বিবরণ সহ বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে।
তবে সাধু সাবধান! এতক্ষণ বিবরণ পড়ে আপনি যদি খুব উৎসাহিত হয়ে পড়েন, তাহলে এবার নিরাশ করব। আসলের পাশাপাশি প্রচুর ফেক সাইটও আছে। আসল বেছে নেওয়া সহজ কাজ নয়। না-বাছতে পারলে মারাত্মক বিপদে পড়ে যেতে পারেন। পুরুষদের বিপদের কথা পড়ে বলছি। তার আগে মেয়েদের বিপদের কথা বলে নিই। প্রচুর অর্থ রোজগায়ের আশায় যেসব মেয়েরা এসকর্টে যুক্ত হওয়ার কথা ভাবছেন, তাঁরাও সাবধান। চরম মূল্য দিতে হতে পারে। এই এসকর্ট সার্ভিস কতকগুলি ক্ষেত্রে কীরকম বিপজ্জনক হতে পারে, তা একটি এসকর্ট সাইটে গেলেই কিছুটা আভাস পাওয়া যেতে পারে। যাঁরা ভাবছেন এসকর্টে যুক্ত হয়ে শরীর বেচে উপার্জন করবেন, সাইটিতে ক্লিক করলে আমি নিশ্চিত আপনারও হাড় হিম হয়ে যাবে। মেয়েদের ছবি-সর্বস্ব এই সাইটটির একজন এসকর্ট মেয়েও বেঁচে নেই। কারণ সাইটটি আদতেই ফেক, জাল। এসকর্ট জীবনের কী চরম পরিণতি হতে পারে, তা প্রচার করতেই ফরাসি দাঁতব্য সংস্থা ‘মুভমে দ্যু নি’ নামে সাইটটি তৈরি করেছে। যৌনকর্মীদের সচেতনতা বাড়ানোর জন্যেই এই সাইটটি। এই এসকর্টরা তাঁদের ক্লায়েন্টের কাছ থেকে প্রতারিত হয়েছে এবং মুখ খুলে শেষপর্যন্ত খুন হয়েছে। ভুয়ো এই এসকর্ট সাইটটি ১০ ঘণ্টা লাইভ থাকে। মুভমে দ্যু নি’-র কর্মীরাই মৃত যৌনকর্মীদের হয়ে ক্লায়েন্টের সঙ্গে চ্যাট করে যায়। দিনে কমপক্ষে ৬০০ ক্লায়েন্টের সঙ্গে তাঁদের কথা হয়। চ্যাটের একটা সময় যখন ক্লায়েন্টরা সার্ভিস চায়, তখন জানিয়ে দেওয়া হয় এতক্ষণ যাঁর সঙ্গে কথা বলছিলেন সে মৃত। তাই সার্ভিস সম্ভব নয়। এঁরা প্রত্যেকেই ক্লায়েন্টের হাতে খুন হয়েছে।
এবার আসি পুরুষের বিপদ নিয়ে কথায়। পুরুষ যৌনকর্মীদের নিয়ে পরে বিস্তারিত আলোচনা করব। পুরুষদের ‘গণিকা’ বা ‘পতিতা’, ‘বেশ্যা’ বলা যায় না। এগুলি স্ত্রীবাচক শব্দ। পুরুষরা শরীর বিক্রি করে রোজগার করলেও পুংবাচক কোনো শব্দ এখনও তৈরি হয়নি। তাই ‘যৌনকর্মী’ শব্দেই আটকে থাকতে হচ্ছে। সারা পৃথিবীতেই পুরুষ-যৌনকর্মীদেরও ব্যাপক চাহিদা আছে। আর পাঁচটা পেশার মতো এই পেশাও পুরুষদের কছে কম আকর্ষণীয় নয়। রোজগার মেয়েদের মত না-হলেও নেহাৎ কম নয়। চাকরির বাজার যতই সংকুচিত হচ্ছে, ততই এই পেশায় আসার ঝোঁক বাড়ছে পুরুষদের। অটোমেশনের যুগে এখন প্রায় সব কাজ মেশিনই করে দিচ্ছে। ফলে হিউম্যান বডি আর তেমন প্রয়োজন হচ্ছে না। কম্পিউটার আর রোবট-মেশিন ১০০ জনের কাজ একাই করে দিতে সক্ষম। নিয়োগ বলতে গেলে একেবারেই বন্ধ। কিছু ক্ষেত্রে নিয়োগ হলেও সেখানে প্রতিযোগিতা তীব্র। ২০০ পদের শূন্যপদের জন্য ২ কোটি চাকুরিপ্রার্থীর লাইন। ২০০ জনের চাকরি না-হয় হল, বাকিরা কী করবে! হাতে রইল যৌনতার বাজার বা অন্য কিছু। পুরুষদের বাজার মেয়েদের বাজারের মতো ততটা বড়ো না-হলেও বাজার ক্রমশ বাড়ছে। অনেক পুরুষই এই পেশায় আসছে, কাজ করছে। অনেক আগ্রহী পুরুষই আগ্রহ প্রকাশ করেছে এই কাজ করার জন্য। সম্প্রতি সমীক্ষার জন্য ‘পুরুষ যৌনকর্মী চাই’ বলে ফেসবুকে একটি ফেক পেজ খুলেছিলাম। লিখলাম ‘Add me 30+ handsome male for income with real fun’। প্রতিদিন শোয়ে শোয়ে রিকোয়েস্ট আসতে থাকল। অনেককেই অ্যাকসেপ্ট করলাম। সবাই পাগলের মতো জানাতে থাকল এই কাজ করতে চায় বলে। জানতে চায় কীভাবে করতে হবে, কোথায় করতে হবে। অনেকেই আগাম নিজের ফোন নম্বর দিয়ে জানাল সে খুবই আগ্রহী, তাঁর সঙ্গে যেন যোগাযোগ করে নিই। যাঁদের রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করতে পারিনি বা করিনি, তাঁরাও আকুতি নিয়ে রিকোয়েস্ট মেসেঞ্জারে তাঁদের ফোন নম্বর রেখে গেল। পুরুষদের কতটা যৌনপেশায় আসতে আগ্রহী সেটা জানতেই এই ফেক পেজ খুলেছিলাম। কাজ মিটে যেতে যেতেই পেজটি ফেসবুক থেকে ডিঅ্যাক্টিভেট সহ ডিলিট করে দিই। যাই হোক, চিত্রটা খানিকটা হয়তো বোঝা গেল। বিপদ ও প্রতারণার সুযোগটা তো এখান থেকেই। একশ্রেণির মানুষ এই সুযোগটা নিতে শুরু দিল। ট্রেনে, বাসে, পথে-ঘাটে, সোসাল মিডিয়ায় বিজ্ঞাপিত হতে থাকল–“প্লেবয় চাই। দারুণ মজার কাজ। রথ দেখা কলা বেচা দুইই হবে। সক্ষম পুরুষরা যোগাযোগ করুন। স্মার্ট জব স্মার্ট মানি। সার্ভিস সপ্তাহে দু-দিন পাবেন। এই কাজ শুরু করতে কোনো রেজিস্ট্রেশন চার্জ লাগে না। শুধুমাত্র আপনার মেডিকেল করাতে ২০০০ টাকা লাগে।” সঙ্গে অবশ্যই ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য ফোন নম্বর। কী ভাবছেন? ভাববেন পড়ে। এখন শুনেনি এক যুবকের অভিজ্ঞতার কাহিনি। অনেক কষ্টে জোগাড় করেছি তাঁকে। এটা ওটা বলার পর সে জানাল তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। জানাল বলা ভুল হল, বরং বলা ভালো শোনাল। তাঁদের ফোনে কনভারসানের রেকর্ড আমাকে পাঠিয়ে দিল। যুবকটি এমনই এক ফোন নম্বরে কল করেছিল। কল রিসিভ করল একজন মেয়ে। যুবকটি তাঁর আগ্রহের কথা জানালে ওরা যা বলল, সেটার হুবহু অনুলিখন করলাম।
–নমস্কার স্যার। আপনার বয়সটা বলবেন স্যার?
–থার্টি ফাইভ।
–বাঃ, আপনি যৌন-সক্ষম তো?
–হ্যাঁ।
–আপনি কাজ করতে চান?
–হ্যাঁ। কীভাবে কাজ পাব? কাজ কোথায় হবে? রোজগার কেমন হবে?
–আপনাকে ডিটেইলস বলে দিচ্ছি। আমাদের কাছে প্রচুর মহিলাদের ফোন নম্বর ঠিকানা আছে, যাঁরা সেক্সের ক্ষেত্রে আনসাটিসফায়েড। আপনাকে তাঁদের সেক্স সাটিসফায়েড করতে হবে। সবাই হাই প্রোফাইলের মহিলা। ওরাই আপনার ক্লায়েন্ট। সপ্তাহে দু-দিন কাজ পাবেন। ক্লায়েন্ট পিছু দশ হাজার থেকে পনেরো হাজার পাবেন। আমরা আপনার রোজগার থেকে ক্লায়েন্ট পিছু ২০% নেব।
–আমাকে কী করতে হবে? মানে কীভাবে আমি ক্লায়েন্ট পেতে পারি?
–আপনাকে প্রথমে আপনার নাম রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। যে নম্বরে আপনি ফোন করেছেন সেই নম্বরে আপনার ডিটেইলসটা পাঠিয়ে দেবেন।
–ডিটেইলস বলতে আপনার নাম, আপনার বাবার নাম, আপনার সম্পূর্ণ ঠিকানা, আপনার ফোন নম্বর যে নম্বরে আপনাকে এসকর্ট করা হবে, আপনার ওজন, গায়ের রং, চোখের রং, অবশ্যই জানাতে হবে আপনার লিঙ্গের দৈর্ঘ্য ইঞ্চির মাপে কতটা, আপনি পেশায় নতুন না পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে ইত্যাদি। আমরা পিডিএফ ফর্ম পাঠিয়ে দেব। আপনাকে শুধু পূরণ করে পাঠাতে হবে।
–রেজিস্ট্রেশন কি আগে করতে হবে? নাকি বায়োডেটা পাঠানোর পরে করতে হবে?
–না, রেজিস্ট্রেশনটা আপনাকে আগে করতে হবে। রেজিস্ট্রেশন ফিজ ৩০০০ টাকা দিতে হবে। রেজিস্ট্রেশন কমপ্লিট হলে আপনার কাছ থেকে আপনার ডিটেইলস নেব এবং পরদিনই ক্লায়েন্টের ফোন নম্বর দেব। আপনি তাঁকে ফোন করে কাজ করার সময় জেনে নেবেন।
–টাকাটা কীভাবে পাঠাতে হবে?
–নেট ব্যাংকিং করে অথবা পেটিএমের মাধ্যমে পাঠাতে পারেন।
–আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনাদের ব্যাংক ডিটেইলসটা পাঠিয়ে দিন।
–ওকে। হোয়াটস অ্যাপে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
দু-দিন পর হোয়াটস অ্যাপে ওরা ব্যাংক ডিটেইলস পাঠিয়ে দিলে যুবকটি ৩০০০ টাকা ব্যাংক ট্রান্সফার করে দেয়। টাকাটা ট্রান্সফার হওয়ার পর একটা ফর্ম হোয়াটস অ্যাপে চলে আসে। সেটাকে ফিল-আপ করে সঙ্গে সঙ্গে যুবকটি পাঠিয়ে দেয়। পরের দিন সকাল ৯ টা নাগাদ ওখান থেকে একটা আসে।
–আপনি কি আজকে কাজ করতে পারবেন?
–কটার সময়?
–বেলা বারোটা নাগাদ।
–হ্যাঁ, পারব।
–ঠিক আছে। আপনাকে ক্লায়েন্টের ফোন নম্বর দিয়ে দিচ্ছি। আপনি তাঁকে ফোন করে জেনে নেবেন কখন সে সার্ভিস পেতে চায়। আপনার বিষয়ে সমস্ত বলা আছে ম্যাডামের কাছে। কোনো অসুবিধা হবে না। হ্যাপি জার্নি।
কিছুক্ষণ বাদে যুবকটির হোয়াটস অ্যাপে একটি ফোন নম্বর চলে আসে। ফোন নম্বরে কল করল যুবকটি। ও প্রান্তে নারী কণ্ঠ।
–আপনি কখন আসতে পারবেন?
–আপনি যখন বলবেন?
–ঠিক আছে। আপনি দুপুর নাগাদ চলে আসুন। আমি একা থাকব।
–ঠিক আছে। আপনার ঠিকানা দিন। কোথায় কীভাবে যাব একটু বলে দিন ম্যাডাম।
–অবশ্যই বলব। ঠিকানা না বললে আমাকে সার্ভিস দেবেন কীভাবে? তার আগে আমাকে একটা কাজ করে দেবেন প্লিজ?
–কী কাজ, বলুন?
–আমার ড্রাইভারটা বিহারে গিয়ে খুব বিপদে পড়ে গিয়েছে। ওকে ৫০০০ টাকা পাঠাতে হবে। আপনি একটু ওর অ্যাকাউন্টে আপনার কাছ থেকে দিয়ে ফেলে দেবেন? আপনি আমার কাছে এলে আপনার সার্ভিসের পনেরো হাজার টাকা উইথ পাঁচ হাজার মোট কুড়ি হাজার টাকা সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দেব। আমি আসলে ঘর থেকে বেরিয়ে ব্যাংকে যেতে পারছি না। একটু অসুবিধা আছে। তাই আপনাকে বলতে বাধ্য হচ্ছি। আপনি আসার সঙ্গে সঙ্গে পুরো টাকাটাই পেয়ে যাবেন।
–এমন কথা তো ছিল না। দেখছি কী করা যায়। ওদের সঙ্গে এবার একবার কথা বলেনি, যাঁরা আমাকে আপনার কাছে পাঠাচ্ছে।
–ঠিক আছে। আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছি।
যুবকটি কল সেন্টারে ফোন করে সব ঘটনা বিস্তারিত বলতেই ওরা হতবাক হয়ে গেল। বলল–
–সেকি! এমন তো হওয়ার কথা নয়। সে আপনার কাছ থেকে টাকা চাইবে কেন? বরং আপনি সার্ভিস দিলে আপনাকে তিনি টাকা দেবেন। আপনি তো টাকা দিতে যাবেন না, টাকা কামাতে যাবেন। আপনি একটু লাইনে থাকুন। কনফারেন্স কলে তাঁর সঙ্গে কথা বলে নিচ্ছি। আপনিও শুনবেন।
–হ্যালো, ম্যডাম বলছেন?
–হ্যাঁ, বলছি। বলুন।
–ম্যাডাম, আমরা যে ক্লায়েন্টকে আপনাকে সার্ভিস দিতে পাঠিয়েছি, আপনি তাঁর কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা চেয়েছেন। এটা তো ঠিক নয়। এর ফলে আপনাকে পরবর্তীতে সার্ভিস পাবেন কি না আমাদের ভাবতে হবে।
–প্লিজ, রাগ করবেন না। আমি বিপদে না পড়লে টাকাটা ওনার কাছে চাইতাম না। আমি বলেছি উনি এলেই ওনাকে পুরো টাকাটাই দিয়ে দেব। ভয় নেই।
–স্যার, শুনলেন তো ওনার কথা। আমিও যেটা বললাম সেটাও নিশ্চয় শুনেছেন?
–হ্যাঁ, শুনলাম।
–আপনি টাকাটা পাঠিয়ে দিন। উনি তো বললেন আপনি যাওয়ার পরই আপনাকে টাকাটা দিয়ে দেবে। ভয় নেই। কোনো অসুবিধা হলে আমরা তো আছি। উপযুক্ত ব্যবস্থাই নেব।
–বেশ। তাহলে আপনি একটা কাজ করুন। ওনাকে বলুন ওনার সম্পূর্ণ ঠিকানা আর ব্যাংক ডিটেইলসটা আমাকে দিতে। আমি ওই ঠিকানায় পৌঁছে টাকাটা আমার মোবাইল থেকেই ব্যাংক ট্রান্সফার করে দিচ্ছি।
–ওকে। বলে দিচ্ছি।
তারপর আর কোনোদিন ওখান থেকে ফোন আসেনি। যুবকটি বুঝলেন সে প্রতারিত হয়েছেন। তিন হাজার টাকার উপর দিয়ে গেছে। লোভ নিয়ন্ত্রণ করতে না-পারলে আরও পাঁচ হাজার গচ্ছা যেত। এরকম প্রতিদিন কত যুবক যে প্রতারিত হচ্ছে, তার ইয়ত্তা নেই। চারিদিকে জাল বিছিয়ে রেখেছে প্রতারকরা। সেই ফাঁদে ফেঁসে যাচ্ছে যুবকরা। পুলিশ-প্রশাসনকে জানালে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন ঠিকই। গ্রেফতারও করছে। কিন্তু প্রতারণা বন্ধ হচ্ছে না। নতুন নতুন নামে প্রতিষ্ঠান খুলে প্রতারণা করেই চলেছে। ফেসবুকে হাজার হাজার পেজ খুলে রেখেছে এই প্রতারকরা।
(৫) Private : এঁরা গণিকালয় বা কোনো সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত নয়। এঁরা ব্যক্তিগত উদ্যোগেই ক্লায়েন্ট খুঁজে নেয়। তবে যাকে-তাকে নয়, ঝাড়াইবাছাই পরীক্ষানিরীক্ষা করেই ক্লায়েন্ট ধরে। বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য ক্লায়েন্টই তাঁদের পছন্দ। অবশ্য শাঁসালো হতেই হবে ক্লায়েন্টকে। ক্লায়েন্টকে নিয়ে এঁরা কোনো বিলাসবহুল হোটেল বা রিসোর্টে সময় কাটায় মোটা টাকার বিনিময়ে। এছাড়া এঁরা ক্লায়েন্টের ভ্রমণসঙ্গীও হয়। সেইভাবে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপনও দেয়। ক্লায়েন্টের ঘাড় ভেঙে দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করে এবং মনের আশ মিটিয়ে কেনাকাটা করে নেয়। বিনিময়ে সে কয়েক রাতের শয্যাসঙ্গিনী হয়ে যায় ক্লায়েন্টের।
(৬) window or Doorway : জানালা বা প্রবেশপথের মাধ্যমে গণিকালয়ের গণিকারা সম্ভাব্য ক্লায়েন্টকে আহ্বান করে। উইন্ডো’ গণিকারা সাধারণত উষ্ণ জায়গা পছন্দ করে। অপরদিকে ‘ডোরওয়ে’ গণিকারা সাধারণত ঠান্ডা জায়গা পছন্দ করে। উইন্ডো গণিকাদের সাধারণত নেদারল্যান্ড, জার্মানি, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড দেশগুলিতে দেখা যায়। এইসব গণিকারা দিনের বা দিনের কিছুটা অংশ কাজের জন্য উইন্ডো ভাড়া দেয়। গণিকারা স্বাধীন ও নিজেদের পরিচিত ক্লায়েন্টদেরই প্রোভাইড করে এবং তাঁর সঙ্গে সার্ভিস বিষয়ক ও পারিশ্রমিকের বিষয়ে কথাবার্তা বলে নেয়। উইন্ডো গণিকাবৃত্তি মূলত একটি ডাচ ফর্ম (Dutch form)। এই ফর্ম পুরোনো গির্জার আশেপাশে আমস্টারডামের পুরোনো রেড-লাইট এরিয়ায় রাস্তার পাশে শুরু হয়েছিল। শুরুতে জানালাগুলিতে পর্দা লাগানো ছিল। পরে যৌন-নৈতিকতার (Sexual morality) কঠোরতা কম হওয়ায় জানালাগুলি থেকে পর্দা পুরোপুরিভাবে সরে যায়। তখন গণিকারা গণিকাদের পোশাক বা পোশাকের টুকরো ঝুলিয়ে রাখত। বর্তমানে গণিকারা তখনই জানালা বন্ধ রাখে যখন ঘরের ভিতরে ক্লায়েন্ট থাকে। নেদারল্যান্ডের গণিকারা প্রায় ১২০০ উইন্ডো ব্যবহার করে থাকে। নেদারল্যান্ডের ত্রিশ শতাংশ গণিকা উইন্ডোর পিছনে যৌনকর্ম করে। নেদারল্যান্ডের আল্কমার, আমস্টারডাম, হেগ, ডিভেনটার, ডোয়েটিচেম, এইনধোভেন, গ্রোনিনজেন, হারলিম, হিরেনভিন, লাউওয়াডেন, নিমেজেন, রটারডাম শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে উইন্ডো গণিকাবৃত্তি হয়। বেলজিয়ামের অন্টউইপ, ব্রাসেলস, ঘেন্ট, ওসটেন্ড, চারলিওরই, ডেইনজ, লিগ, সিন্ট টুইডেন শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে উইন্ডো গণিকাবৃত্তি হয় এবং জার্মানিতে অ্যাচেন, বোচাম, ব্রাউনচেউইগ, ডর্টমুনড়, ডুইসবার্গ, এসেন, ফ্রাংকফুর্ট, হামবার্গ, কার্লফ্রহে, কলোনি, মনহেইম, ওবারহাউসেন শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে উইন্ডো গণিকাবৃত্তি হয়।
(৭) club, Pub, Bar, Karaoke Bar, Dancehall : এইসব গণিকারা ক্লাব, পাব, বার, মদ ও অন্যান্য টুকিটাকি জিনিস খুচরো বিক্রির স্থানগুলিতে ক্লায়েন্টের কাছে যৌন-আবেদন রাখেন। ক্লায়েন্ট পটে গেলে সংশ্লিষ্ট গণিকার সঙ্গে নির্দিষ্ট ঘরে সময় কাটায়। এই ধরনের গণিকা থাইল্যান্ড, লাস ভেগাস, চিনের ক্যাসিনোগুলিতে দেখা যায়।
(৮) other all-male venues : এইসব গণিকারা যেখানে নিয়মিত পুরুষের জমায়েত থাকে, সেখানেই হাজির হয়ে ছুকছুকে পুরুষদের কাছে ঘেঁষে এসে যৌনমিলনের জন্য প্ররোচিত দেয়। সেনাছাউনি, বাজার-ঘাট, ব্যস্ত রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাস, খনি-ক্যাম্প ইত্যাদি জায়গায় এঁদের দেখা যায়।
(৯) Door knock or hotel : এই গণিকারা সাধারণত আবাসিক হোটেলে বসবাসরত পুরুষ বর্ডারদের যৌনকর্মে আহ্বান জানায়। হোটেলের দরজায় কড়া নাড়ায়। হোটেলের ম্যানেজারের মাধ্যমেও এঁরা হোটেলের রুমে পৌঁছে যায়। ক্লায়েন্ট রাজি হলে হোটেলের ম্যানেজারও কমিশন পায়।
(১০) Transport : এই গণিকারা সাধারণত চলমান বাস, চলমান ট্রেন, চলমান জাহাজে উঠে ভ্রমণরত যাত্রীদের যৌনকর্মে আহ্বান জানায়।
(১১) CB Radio : এই গণিকারা সম্ভাব্য ট্র্যাক ড্রাইভার ক্লায়েন্টদের সঙ্গে একচেঞ্জ বার্তা (অপভাষা) CB Redio ব্যবহার করে হাইওয়ে বরাবর ড্রাইভ করে ট্রাকস্টপ বা পার্কিং এলাকায় যৌন-পরিসেবা দেয়।
(১২) other methods of Solicitation : এইসব গণিকারা বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে–যেমন নোটিশ বোর্ড ও সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন, মোবাইল নম্বর সহ ‘যৌনকর্মীর ক্যাটালগ’, ইন্টারনেটকে ব্যবহার করে ভার্চুয়াল গণিকালয় এবং অন্যান্য অন্তরঙ্গ স্থানগুলিতে যৌন-পরিসেবা বিতরণ করে থাকে।
(১৩) Phone Sex : এটি একটি নতুন ধরনের ট্রেন্ড। এই ফোন সেক্সের দুটো শ্রেণি। একটি হল–“তুমি আমার ফোনে ২০০ টাকা রিচার্জ করে দাও, তাহলে তোমার সঙ্গে চ্যাটে সেক্স করব। তারপর তোমাকে ভালো লেগে গেলে রিয়েল সেক্সও করতে পারি।” এদের সাধারণত প্রতারক গণিকাও বলা যায়। শরীর ও সেক্সের লোভ দেখিয়ে নিজের ফোন রিচার্জ করিয়ে নেয়। তারপর গ্রাহকের ফোন নম্বরটি ব্ল্যাকলিস্টে পাঠিয়ে দেয়। একই সঙ্গে ফেসবুক থেকেও তাঁকে ব্লক করে দেওয়া। কারণ ফেসবুকে একটা আইডি খুলে এঁরা ফেসবুকেই এমন অফার দিয়ে থাকে। অন্যটি হল–এঁরা বলে “তুমি আমার ফোনে এত টাকা রিচার্জ করে দাও, তাহলে তোমাকে আমি আমার ন্যুড ছবি দেখাব, ভিডিও কল করে আমাকে ন্যুড দেখাব।” কতটা ন্যুড সে দেখাবে তা নির্ভর করবে আপনি কত টাকার রিচার্জ করে দিচ্ছেন তার উপর। এঁরাও প্রতারক গণিকা। আর শ্রেণির গণিকা আছেন যাঁরা সেক্স ভিডিও করবে বলে কোনো সাইটে বিজ্ঞাপন দেয়। সঙ্গে থাকে হোয়াটস অ্যাপ নম্বর। হোয়াটস অ্যাপ করলে মেয়েটি জানায় পেটিএমে ৫০০ টাকা পাঠালে ন্যাকেড হয়ে ভিডিও কল করব। যত বেশি টাকা পাঠাবে তত বেশিক্ষণ ভিডিওতে থাকব। ৫০০ টাকায় পাঁচ মিনিট। এঁদের কেউ কেউ প্রতারক হলেও সবাই প্রতারক নয়। তাঁরা ভিডিও কলের মাধ্যমে নিজের শরীর নগ্ন করে উপস্থাপন করে। প্রযুক্তির কল্যাণে সেইসব ভিডিও ‘ওয়েবক্যাম ভিডিও’ নামে বিভিন্ন পর্নো সাইটে পাওয়া যায়।
(১৪) Massage Parlour : ম্যাসাজ পার্লারের বাজার এই মুহূর্তে বেশ রমরমা। বিদেশে থাইল্যান্ড, লাস ভেগাস, চিন প্রভৃতি দেশের ক্যাসিনোগুলোতে বহু আগে থেকেই মেসেজ পার্লারগুলিতে যৌনতা বিক্রি হয়ে আসছে। ভারত তথা কলকাতাতেও এখন মেসেজ পার্লারগুলি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। মেসেজ পার্লারগুলি কিছুদিন আগে পর্যন্ত ধনীদের কুক্ষিগত ছিল। এখন মধ্যবিত্ত ও নিন্মবিত্তদের নাগালের মধ্যেও চলে এসেছে। বিভিন্ন ম্যাসাজ পার্লার, বিলাসহুল ফ্ল্যাট, নামী-দামি বিউটি পার্লারে ‘মেল টু মেল’, ‘ফিমেল টু ফিমেল’, ‘মেল টু ফিমেল’, ফিমেল টু মেল’ ম্যাসাজ করা হয়।
ম্যাসাজ শব্দটির বাংলা অর্থ করলে যা দাঁড়ায় তা হল শরীর মর্দন করা। বর্তমানে ম্যাসাজ পার্লার’ শব্দটি একটি গণিকালয় হিসাবে পরিগণিত হয়েছে। গোড়ার দিকে শুধুমাত্র শরীর ও মন ভালো রাখার জন্য একপ্রকার থেরাপি হিসাবে ব্যবহৃত হলেও ধীরে ধীরে এটা যৌনকর্মের আখড়া হয়ে উঠতে থাকল। সামনের গ্লোসাইন বোর্ডে ম্যাসাজ পার্লার লেখা থাকলেও পিছনে যৌনকর্ম চলে। এ ক্ষেত্রে ১৮৯৪ সালে প্রথম বিষয়টি মানুষের নজরে আসে, যা ম্যাসাজ কেলেংকারী’ নামে পরিচিত হয়েছিল। ১৮৯৪ সালে ব্রিটিশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ম্যাসেজ প্র্যাকটিশনারদের শিক্ষা ও অনুশীলনের অনুসন্ধান করতে গিয়ে তাঁরা দেখে অদক্ষ গণিকাদের আনাগোনা। প্রতিক্রিয়া হিসাবে তাঁরা বৈধ ম্যাসাজ কর্মীদের পৃথকভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে উচ্চতর একাডেমিক মানসম্পন্ন করে ম্যাসিউসেস সোসাইটি’ গঠন করে। সওনাস, স্পা বা অনুরূপ যা কিছু ম্যাসাজ পার্লারের ছদ্মবেশে গণিকাবৃত্তির প্রসার চলতে থাকল। নির্দিষ্ট ম্যাসেজ পার্লারে একটি শুভ সমাপ্তি (Happy Ending) থাকতে পারে, যেখানে ম্যাসাজ আসলে ক্লায়েন্টের সঙ্গে যৌনমুক্তি। যৌনতামূলক হ্যাপি এন্ডিং ছাড়াও ক্লায়েন্টের সঙ্গে যৌন-উত্তেজক ম্যাসাজও করা হয়। এমনকি স্ট্রিপেইজ সঞ্চালনের সময় ক্লায়েন্ট তাঁকে বা নিজেকে হস্তমৈথুন করাতে বা করতে পারে। ইটালি, মালয়েশিয়া, নেপাল, থাইল্যান্ড, আমেরিকা, ব্রিটেন হল এই ধরনের ম্যাসাজ পথপ্রদর্শক।
আমরা নানা ধরনের ম্যাসাজের নাম দেখতে বা শুনতে পাই। যেমন–সুইডিশ ম্যাসাজ, ডিপ টিস্যু ম্যাসাজ, হট-স্টোন ম্যাসাজ, স্পোর্টস ম্যাসাজ, সিয়াৎসু ম্যাসাজ, ট্রিগার পয়েন্ট, কাপলস ম্যাসাজ, প্রেরেন্টাল ম্যাসাজ, রিফ্লেক্সোলজি ম্যাসাজ, থাই ম্যাসাজ, ফুট ম্যাসাজ, অ্যারোমাথেরাপি, স্পা, চেয়ার ম্যাসাজ ইত্যাদি। এই ম্যাসাজ করলে নানা রকমের টেনশন থেকে মুক্তি, শরীরের নানারকম ব্যথা থেকে মুক্তি, ডিপ্রেসন, ইনসোমেনিয়া, হাড়ের জয়েন্ট বা পেশির আড়ষ্টতা কেটে যায় বলে দাবি করা হয়। তবে কোন্ প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের ম্যাসাজ হয়, আর কোন্ অন্য কিছু হয় সেটা যাচাই করে নেওয়া জরুরি। মাঝেমধ্যেই এই ধরনের ম্যাসাজ পার্লারগুলি থেকে যৌনকর্মরত মহিলা ও ক্লায়েন্টদের পুলিশ গ্রেফতার করে, সেই খবর আমরা পাই। তবে কোনো কোনো ম্যাসাজ পার্লার সাইটের মাধ্যমে ম্যাসাজের জন্য ক্লায়েন্টের আকর্ষিত করে। ইন্টারনেট ঘাঁটলে এরকম অসংখ্য সাইটে দেখা মিলবে, যেখানে সরাসরি যৌনকর্মের কথাই বলা হয়ে থকে। এঁদের ম্যাসাজের নামও একটু ভিন্ন। যেমন—স্যান্ডউইচ ম্যাসাজ। খুব জনপ্রিয় ম্যাসাজ। এই ম্যাসাজে দুজন নারী ও একজন পুরুষ। একজন নারী নীচে থেকে ক্রিয়া করবে, অন্য নারী উপর থেকে ক্রিয়া করবে। মাঝে থাকবে পুরুষটি। অথবা দুজন পুরুষ ও একজন নারী। অনুরূপ একজন পুরুষ নীচ থেকে ক্রিয়া করবে, অন্য পুরুষ উপর থেকে ক্রিয়া করবে। মাঝে থাকবে নারী। কোনো ঢাকাঢাক গুড়গুড় নেই। এঁরা স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বিজ্ঞাপিত করে–“We are provide full body massage with full satisfaction by hot expert beautiful female like body to body massage, sextual service, nude massage etc. Full body massage spa with full satisfaction enjoyment and unlimited short with two girls.”
উল্লেখ থাকে রেট, ফোন নম্বর ও ঠিকানা। রেটগুলি এরকম–
Body to body massage — 1500
Sandwich body massage with 2 girls — 2500
Sex massage — 1500
Full body massage — 2000
Erotic massage — 1500
Dry massage — 1500
4 hands massage with sex — 2500
Oil massage — 1500
Powder massage — 1500
(তথ্যসূত্র : Sonia Spa Center)
আজকাল কলকাতা, বড়ো শহর শহরতলিতে অনেকেই নিশ্চয় পোস্টার দেখতে পান, যেখানে মেয়েদের ছবি সহ ‘বডি ম্যাসাজ’ লেখা থাকে অনেকগুলো ফোন নম্বর সহ। এঁরা মূলত প্রতিষ্ঠিত গণিকাপল্লির আধুনিক সংস্করণ। আর-একটু মোডিফায়েড। এখানকার মেয়েরা কেউ গণিকাপল্লির স্থায়ী বাসিন্দা নয়। এঁরা প্রত্যেকেই বিভিন্ন শহর বা গ্রাম থেকে এসে ক্লায়েন্টের জন্য অপেক্ষা করে। কায়েন্ট সংগ্রহ হয় ফোনের মাধ্যমে। ক্লায়েন্ট কবে কখন আসবে সেইমতো ক্লায়েন্টকে একজন সাহায্য করতে এগিয়ে যাবে এবং ক্লায়েন্টকে সঙ্গে নিয়ে সোজা নিজেদের অফিসে চলে আসবে। একটি করে মেয়ে দেখাবে। সংশ্লিষ্ট অফিস থেকে মেয়ে পছন্দ হলে তো ভালোই, নাহলে অন্য অফিসগুলো থেকেও মেয়ে দেখানো হয়। যেহেতু বিজ্ঞাপনে বডি ম্যাসাজ লেখা থাকে, তাই নামকাওয়াস্তে মিনিট দশেক ম্যাসাজ করলেও আসল কাজ যৌনকর্ম চালু হয়ে যায়।
স্ব-ইচ্ছায় যাঁরা যৌনপেশায় আসে, তাঁদের কথায় পরে আসছি। অনিচ্ছাকৃতভাবে যাঁরা যৌনপেশায় আসতে বাধ্য হয়, তাঁদের কথা দিয়েই শুরু করি।
(১) প্রতারক কর্তৃক পাচারকৃত গণিকা : প্রায় গোটা পৃথিবী জুড়েই নারী পাচারের চক্র সক্রিয় আছে। তবে তৃতীয় বিশ্বের গরিব দেশগুলি থেকেই বেশি নারী পাচার হয়ে থাকে। ২০১৬ সালের এক পরিসংখ্যান জানা যাচ্ছে ভারতে ৩ কোটি ১০ লক্ষেরও বেশি মানুষ পাচার হয়ে যায়। এর মধ্যে ১০ লক্ষ ৮ হাজার জন নারী পাচার হয়ে যেতে হয়েছে বিভিন্ন গণিকাপল্লিতে। তবে পশ্চিমবঙ্গের তিনটি আন্তর্জাতিক সীমানা থাকায় পাচারকারীদের জন্য অনুকূল। প্রায় সব ক্ষেত্রে প্রতারকদের দ্বারাই পাচার সম্পন্ন হয়। প্রতারক যে কেউ হতে পারে। সৎ বাবা, সৎ মা হতে পারে, স্বামী হতে পারে, প্রেমিক হতে পারে, প্রতিবেশী হতে পারে, বান্ধবীও হতে পারে। এরা মানুষের দারিদ্রতার সুযোগ নিয়ে ছেলেদের সর্বস্বান্ত করে দেয়, তেমনি মেয়েদের যৌবনও বেচে খায়। কখনো কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে, কখনো বিয়ে করে গণিকালয়ে বিক্রি করে দিয়ে আসে। অত্যন্ত সংঘবদ্ধ এই নারীদেহ পাচারের ব্যাবসা। গুণ্ডা, দালাল থেকে শুরু করে বাড়িওয়ালা-বাড়িওয়ালি পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের মানুষ মিলে এই জাল বিস্তার করেছে।
পণ্যসর্বস্ব আগ্রাসী দুনিয়ায় সবচেয়ে লোভনীয় হল মানুষ, আর লোভনীয় মানুষের চেয়ে সবচেয়ে লোভনীয় হল মেয়েমানুষ। মেয়েমানুষের ব্যাবসা বিশ্বের সবচেয়ে লাভজনক ব্যাবসা। প্রায় বিনিয়োগবিহীন ব্যাবসা। তাই এই দেহব্যাবসার সঙ্গে জড়িয়ে আছে দরিদ্র থেকে ধনী, নেতা-মন্ত্রী পর্যন্ত। গণিকাপল্লির সমৃদ্ধ হবে কীভাবে? ক্লায়েন্ট যে নতুন নতুন চিড়িয়া’ চায়। সিল’ না-কাটা মেয়েদের যে কদর বেশি, রেটও বেশি। অতএব নারীপাচার জারি আছে এবং থাকবে। এই পাচারযজ্ঞ আজ এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, এখন মাতৃগর্ভে থাকা কন্যাভ্রণটিও পাচার হয়ে যেতে পারে।
বিগত কয়েক দশকে সমগ্র বিশ্বজুড়ে নারী ও শিশু পাচারের মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ নারী ও শিশু পাচারের একটি উৎস এবং ট্রানজিট রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত। প্রতিদিন এদেশ থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী ও শিশু বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত দিয়ে অথবা বিমান যোগে পাচার হয়ে যাচ্ছে। পাচারকৃত নারী ও শিশুদের নিয়োগ করা হচ্ছে পতিতালয়ে বা অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ পেশায়।
নারী ও শিশু পাচারের বিষয়টা আসলে কেমন? বিশ্বায়নের যুগে পুঁজি, পণ্য ও প্রযুক্তির মতো পৃথিবী জুড়ে শ্রমের চলাচলও সহজ হওয়ার কথা। কিন্তু জটিল ইমিগ্রেশন নীতির কারণে গত শতাব্দীগুলোর তুলনায় বর্তমান সময়ে বৈধ পথে শ্রম অভিবাসন অনেক কম ঘটেছে। তবে পৃথিবী জুড়ে মানুষের চলাচল থেমে থাকেনি। নানা অবৈধ উপায়ে মানুষ এক দেশ থেকে অন্য দেশে আসা-যাওয়া চলছে। নানা ধরনের চলাচলের মধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হল নারী ও শিশু পাচার। আন্তর্জাতিকভাবে নারী ও শিশু পাচারকে আধুনিক যুগের দাসপ্রথা হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। পাচার কাকে বলে? এ বিষয়ে বড়ো ধরনের বিভ্রান্তি আছে। অবশ্য পাচারের উদ্দেশ্য, প্রকৃতি, পদ্ধতি সবই আগের তুলনায় অনেক জটিল হয়ে গেছে। সাধারণত যে-কোনো ধরনের শোষণের উদ্দেশ্যে জোড় খাঁটিয়ে, ছল চাতুরি, ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে এবং চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে অথবা যাকে পাচার করতে চায় তার উপর কর্তৃত্ব আছে এমন ব্যক্তিকে আইন বহির্ভূত উপায়ে টাকা লেনদেন করার মাধ্যমে লোক সংগ্রহ, স্থানান্তর, আশ্রয়দান ও অর্থ-বিনিময়ে গ্রহণ ইত্যাদি যে-কোনো কর্মকাণ্ডই হল পাচার।
আইওএম, অর্থাৎ ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশনের ব্যাখ্য অনুযায়ী মানুষ পাচার তখনই ঘটে, যখন একজন অভিবাসী জাতীয় অথবা আন্তর্জাতিক সীমান্ত অতিক্রম করে অবৈধভাবে (যেমন—চাকুরি প্রাপ্তির নিমিত্তে, অপহৃত হয়ে, বিক্রিত হয়ে) কোনো কাজে নিযুক্ত হন। পাচারকারী এই কর্মকাণ্ডের যে-কোনো পর্যায়ে উক্ত অভিবাসীকে প্রতারণা, পীড়ন বা অন্য যে-কোনো শোষণের মাধ্যমে তাঁর মানবাধিকার লঙ্ঘন করে অথনৈতিক বা অন্য যে-কোনো প্রকার মুনাফা অর্জন করে।
যে সমস্ত পরিবারের অধিকাংশ দুঃস্থ, নিঃস্ব ও অসহায়, সেই পরিস্থিতির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে আন্তর্জাতিকভাবে সংঘবদ্ধ এক শ্রেণির প্রতারক। তাঁরা প্রলোভন দেখিয়ে অসহায় পিতামাতার মেয়েদের শহরে চাকরি বা যৌতুকবিহীন বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে পাচার করে দিচ্ছে অন্ধকার জগতে। পাচারকারীদের প্রলোভনের শিকার হচ্ছে দেশের ছিন্নমূল, ভবঘুরে নারী ও তাঁদের অভিভাবকরা এবং দারিদ্র্যের নিষ্পেষনে জর্জরিত অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, বিচ্ছেদপ্রাপ্ত ও বিধবা নারীরা। অসহায় নারীরা সুন্দরভাবে বাঁচার আশায় নতুন জীবনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে পাচারকারীদের পাতা জালে জড়িয়ে পড়ছে। পিতামাতারা অর্থ উপার্জনের আশায় বেশি বেতনের চাকরির প্রলোভনে পড়ে বা সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় না-জেনে শিশু-সন্তানদের তুলে দিচ্ছে। পাচারকারীদের হাতে। এভাবে শিশুরাও প্রতারণার শিকার হয়ে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এই পাচারের পিছনে প্রায় সবক্ষেত্রেই অন্যতম কারণ হিসেবে নিহিত রয়েছে দারিদ্র্য, বেকারত্ব, নারীর নিম্নমানের পেশা, চাকরির সুযোগের অভাব, মাথাপিছু নিম্ন আয়, সম্পদে নারীর অধিকার, চাকরির ক্ষেত্রে সমান সুযোগের অভাব ইত্যাদি। দারিদ্র্য ও বেকারত্বের চরম পরিস্থিতিতে দরিদ্র নারী এবং তাঁদের পরিবার বিয়ে ও চাকরির প্রস্তাবে প্রলুব্ধ হয়। এই পরিস্থিতিতে নগদ অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় এমন কারও কাছ থেকে পরিবারের নারী ও শিশুদের জন্য বিবাহ বা চাকরির প্রস্তাব পেলে এসব এলাকার পিতামাতারা তা গ্রহণ করতে দেরি করে না। অন্যদিকে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং ভোগ্যপণ্য পাওয়ার লোভে পাচারকারীরা নিজেদের নিপুণভাবে পরিচালনা করে থাকে।
ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় ১৯৪৭ সালে এবং পুনরায় ১৯৭১ সালে রাজনৈতিক বিভাজন এই এলাকায় পরিবারগুলোকে বিভক্ত করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। দেশবিভাগের কারণে এই বিভক্ত পরিবারগুলোর সদস্যরা একে অন্যকে সীমান্তের একপার হতে অন্য পারে আনা-নেওয়ার কাজে নিয়োজিত। সীমান্ত অতিক্রম করে এক পরিবারের সদস্যরা অন্য পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার বাসনা অনেক সময় নারী ও শিশু পাচারকে ত্বরান্বিত করে। এছাড়া নারী ও শিশু পাচারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক কারণ হলে পরিবারে নারীর অধস্তন অবস্থান, যা সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন মূল্যবোধ, আচার-আচরণ ও সামাজিক রীতি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। আমাদের সমাজে নারীর সামাজিক অবস্থান তাঁর বৈবাহিক অবস্থা দ্বারা নির্ধারিত। বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারের পিতামাতারা মেয়েদের জন্য আইন দ্বারা নির্ধারিত বিয়ের উপযুক্ত বয়স ১৮ বছরের কম হওয়া সত্ত্বেও মেয়েদের বিয়ে দেওয়া দায়িত্ব বলে মনে করে, যার দুটি খারাপ পরিণতি আছে। যেসব ছেলে বিয়েতে যৌতুক চায় না কন্যাদায়গ্রস্ত দরিদ্র পিতামাতারা তাঁদের সঙ্গে খোঁজখবর ছাড়াই কম বয়সি মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করে। অনেক পাচারকারী এই দুর্বলতার সুযোগ নেয়। তাঁরা অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বিয়ে করে নিয়ে গিয়ে বিদেশে পাচার করে দেয়। দ্বিতীয় পরিণতি হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে সহায়সম্বলহীন পিতামাতা বিয়ের সময় যৌতুকের দাবি মেনে নিয়ে বিয়ের ব্যবস্থা করে। কিন্তু পরবর্তীকালে আর শোধ করতে পারে না। তখন মেয়েটি তাঁর স্বামী ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নির্মম নির্যাতনের শিকারে পরিণত হয়। একদিকে মেয়েটি বাবার বাড়িতেও ফিরে যেতে পারে না, অন্যদিকে নির্যাতনের নির্মমতা সহ্যের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। এরকম অসহায় অবস্থার সুযোগ নেয় পাচারকারী চক্র। বিয়ের পর স্ত্রী রেখে পালিয়ে যাওয়া এবং বৈবাহিক সন্ত্রাস পাচারের কারণ হিসাবে কাজ করে। যুবতী, অবিবাহিত অথবা স্বামী পরিত্যক্তা এবং বিধবা নারী সমাজ ও পরিবারের কাছে বোঝাস্বরূপ। এই শ্রেণির নারীর কাছে বিকল্প কর্ম অথবা বিবাহের প্রস্তাব আকর্ষণীয় বলে মনে হয়। তাঁরা পাচারকারী চক্রের সদস্যদের বিবাহ বা লোভনীয় চাকুরির প্রস্তাবে সহজেই সাড়া দেয় আর শেষপর্যন্ত পাচারকারীদের ফাঁদা জালে আটকা পড়ে।
পাচারের উদ্দেশ্য কী আর একটু স্পষ্ট করে বলা যাক—(১) পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিত করা। (২) পর্নোগ্রাফি সিনেমায় ব্যবহার করা। (৩) মধ্যপ্রাচ্যে উটের জকি হিসাবে ব্যবহার করা। (৪) ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত করা। (৫) শরীরের রক্ত বিক্রি করা। (৬) অঙ্গ-প্রতঙ্গ কেটে ব্যাবসা। (৭) মাথার খুলি, কঙ্কাল রপ্তানি করা ইত্যাদি।
এশিয়ার মধ্যে নারী পাচারের প্রথম বৃহৎ দেশ হল নেপাল এবং দ্বিতীয় বৃহৎ দেশ হল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ৪,২২২ কিলোমিটার এবং মায়ানমারের সাথে ২৮৮ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকা আছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম এবং উত্তরবঙ্গ সীমানা দিয়েই পাচার বেশি হয়। বাংলাদেশের পাচারকারীরা ভারতের বিভিন্ন সীমান্ত ব্যবহার করে পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে নারীদের পাচার করে। দেশের উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, রংপুর, রাজশাহী ও চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলার সীমান্ত পথ দিয়ে পণ্য সামগ্রী পাচারের পাশাপাশি নারী ও শিশু পাচার হয়ে থাকে। এসব অঞ্চলের ১১টি রুট পাচারের উদ্দ্যেশে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়ার জন্য যশোরের বেনাপোল একটি অত্যন্ত সহজ ও সুপরিচিত রুট। এখান থেকে বাস ও ট্রেনের যোগাযোগ খুব ভালো হওয়ায় পাচারকারীরা খুব সহজেই কলকাতা পৌঁছে যেতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁ শহরটি বেনাপোল থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে, যেখানে গোটা বাংলাদেশ থেকে সংগ্রহ করা নারী ও শিশুদেরকে নিয়ে যাওয়া হয়। বৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমের মাধ্যমেই হোক আর অবৈধ অনুপ্রবেশের মাধ্যমেই হোক পাচারের উদ্দেশ্যে বড়ো ধরনের কোনো কেন্দ্রে পাঠানোর জন্য তাঁদেরকে বনগাঁয় নিয়ে আসা হয়। বেনাপোল ছাড়া যশোর থেকে পাচারকারীরা সাধারণত ভোমরা, কলারোয়া, দর্শনা, জীবননগর ও ঝাউডাঙ্গা সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে নারী ও শিশু পাচার করে থাকে। এছাড়াও কুষ্টিয়া ও সাতক্ষীরার বিভিন্ন বর্ডার এলাকা দিয়েও পাচার করা হয়। যশোর থেকে নাভারন চৌরাস্তা দিয়ে ভারতে যাওয়া খুবই সহজ। বৈধভাবে ভারতে যাওয়া বেশ ঝামেলাপূর্ণ হওয়ায় পাচারকারী চক্র বিডিআর প্রশাসনের উদাসীনতার সুযোগে এই পথে অবৈধভাবে ভারতে যায়। ভারতীয় পাচারকারী, হস্তান্তরিত নারী ও শিশুকে কলকাতা, দিল্লি ও মুম্বাইয়ের গণিকালয়ে বিক্রি করে কিংবা সেখান থেকে মধ্যপ্রাচ্যে পাচার করে। দীর্ঘকাল ধরে দেহব্যাবসা এবং নারী ও শিশু বিক্রয়ের জন্য কলকাতা নিরাপদ স্থান হিসাবে পরিচিত। আর মুম্বাই নগরীকে পাচারের ট্রানজিট পয়েন্ট হিসাবে ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন গবেষণা থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, যশোরের অধিকাংশ ট্রানজিট পয়েন্টের সঙ্গে ভারতের বিশেষ করে চব্বিশ পরগনার পয়েন্টগুলোর সূক্ষ্ম যোগাযোগ আছে।
কীভাবে পাচার হয় নারী ও শিশু? (১) মূল হোতা : যে ব্যক্তি পাচারের মূল ব্যাবসা পরিকল্পনা, পরিচালনা এবং নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, তাকে পাচারকারী চক্রের মূল হোতা হিসাবে আখ্যায়িত করা যায়। পাচার সংক্রান্ত অর্থের লেনদেন এবং পাচার প্রক্রিয়ার প্রশাসনিক কার্যাবলি এই ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে থাকে। মূল হোতা যে দেশের নাগরিক সে দেশে তাঁর কর্মক্ষেত্র বা দপ্তর থাকতে পারে। আবার তাঁর কর্মস্থল আন্তর্জাতিক ক্ষেত্র পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে অন্য দেশের পাচারকারী চক্রের সঙ্গে যোগাযোগের ভিত্তিতে সে পাচারকার্য সম্পন্ন করে থাকে। (২) দালাল : দালাল হল সেই মধ্যস্বত্বভোগী, যাঁর দেশের ভিতরে বিভিন্ন এলাকায় নেটওয়ার্ক আছে। এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নারী ও শিশু সংগ্রহ করে এবং পাচারকারী চক্রের প্রতিনিধি অথবা পাচারকৃতদের ব্যবহারকারী সংগঠনের হাতে তুলে দেয়। (৩) সংগ্রহকারী : দালালের নেটওয়ার্কের অভ্যন্তরে যেসব ব্যক্তি স্থানীয়ভাবে লোক সংগ্রহ করে দেয়, তাঁদেরকে বলা যেতে পারে সংগ্রহকারী। আরও ব্যাখ্যা করলে সংগ্রহকারী বলতে বোঝায় পাচারের কাজে নিয়োজিত সেইসব লোক, যাঁরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নারী ও শিশু সংগ্রহের কাজকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করেছে। সংগ্রহকারী সাধারণত নিজ গ্রাম থেকে নারী ও শিশু সংগ্রহ করে না, অন্যান্য গ্রাম থেকে তাঁদের সংগ্রহ করে থাকে। অপেক্ষাকৃত ছোটো দালাল আবার নিজেই সংগ্রহকারীর ভূমিকা পালন করতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে সংগ্রহকারী একেবারে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সক্রিয় থাকতে পারে। (৪) সহযোগী : পাচার একটি সংগঠিত চক্রের কাজ। কিন্তু সমাজের বিভিন্ন অংশ যেমন পরিবার, স্থানীয় নেতা, ব্যবসায়ী, পরিবহন শিল্পে কর্মরত লোক, স্থানীয় মস্তান—এরা বুঝে অথবা না বুঝে কিছু অর্থনৈতিক লাভের জন্য পাচারের কাজে সহায়তা করে। এই শ্রেণিকে নারী ও শিশু পাচারের সহযোগী বলা যায়। পাচারের উদ্দেশ্যে সংগ্রহ করা নারী ও শিশুর পরিবার থেকে শুরু করে সীমান্তরক্ষী বাহিনী পর্যন্ত এ ধরনের সহযোগী ব্যক্তিদের পাওয়া যায়। (৫) পরিবার : একজন দালাল যখন সংগ্রহের কাজ করে তখন পরিবারের সদস্যরা অনেক ক্ষেত্রে জেনেশুনেও নারী বা শিশুকে পাচারকারীদের হাতে তুলে দেয়। জামাইবাবু শালীকে অথবা মামা ভাগ্নিকে পাচারকারীদের হাতে তুলে দেওয়ার মত ঘটনাও ঘটে থাকে। (৬) পরিবহন চালক এবং মালিক : পাচারের উদ্দেশ্যে সংগৃহীত নারী ও শিশুদেরকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেওয়ার জন্য বিভিন্ন রকমের পরিবহন ব্যবহার করা হয়। যেমন—রিক্সা, ভ্যান, বাস, নৌকা, ট্রাক ইত্যাদি। এ সকল যানবাহনের চালকরা জেনে বা না-জেনে স্থানান্তরের কাজটি করে থাকেন। এরাও পাচারের সহযোগী। (৭) ঘাট মালিক : নারী ও শিশুদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করার পর সীমান্তবর্তী এলাকায় এনে জড়ো করা হয়। এই এলাকাগুলো ঘাট নামে পরিচিত। ঘাট একটি মাঠ হতে পারে, নদীর তীর হতে পারে, এমনকি একটি বাড়িও হতে পারে। স্থানীয় প্রভাবশালী লোকজন অবৈধ উপায়ে মানুষ পারাপারের লক্ষ্যে সহায়তা করার জন্য এই ঘাটগুলো ইজারা নেয়। নারী ও শিশু পাচারের জন্য এই ঘাটগুলো ব্যবহৃত হয়। এক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ঘাট মালিকরা পাচারের সহযোগী হিসাবে কাজ করে। (৮) সীমান্তরক্ষী বাহিনী : মানুষ পাচারের ক্ষেত্রে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সম্পৃক্ততার কথা সর্বজনবিদিত। তাঁদের সহযোগিতা ছাড়া পাচারকারীদের পক্ষে নিয়মিত এক দেশ থেকে অন্য দেশের সীমান্ত পারাপার করা সম্ভব নয়। অনেক ক্ষেত্রেই পাচারের কাজে সরাসরি যুক্ত না হলেও অর্থের বিনিময়ে তাঁরা সীমান্ত পারাপারে পাচারকারীদের সহযোগিতা করে থাকে।
বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ নারী পাচার হয়ে বিদেশে যাচ্ছে, তার সিংহভাগ অংশকে জোরপূর্বক গণিকাবৃত্তিতে নিয়োগ করা হয়। গণিকাবৃত্তিতে পাচারকৃত মেয়েদের নিয়োগ নির্ভর করে তাঁদের বয়স ও দৈহিক সৌন্দর্যের উপর। এক পরিসংখ্যানে পাওয়া যায় কলকাতার বিভিন্ন পতিতালয়ে বাংলাদেশী প্রায় ২০ হাজার মেয়ে আছে। বিপুল অংকের টাকার বিনিময়ে পাচারকারীরা একেকজন নারীকে গণিকালয়ে বিক্রি করে দেয়। এদের মধ্যে অনেক কিশোরীও থাকে। গণিকালয়ে প্রথম থেকেই নারীরা মানসিক ও দৈহিক উভয় প্রকার নির্যাতনের শিকার হতে থাকে। গণিকাবৃত্তিতে অস্বীকৃতি জানালে সর্দারনি বা গণিকালয়ের মালিকদের হাতে তাঁদের নির্যাতিত হতে হয়। তাঁদেরকে বদ্ধ ঘরে আটকে রাখা হয়। এমনকি অ্যাসিড দিয়ে শরীরের অংশ বিশেষ পুড়িয়ে দেওরার মতো ঘটনাও ঘটে। স্বাস্থ্যগত ও মানসিক দিক বিবেচনায় গণিকালয়ে বিক্রি হয়ে যাওয়া নারী অত্যন্ত বিপজ্জনক অবস্থায় থাকে। সঠিকভাবে নিরাপদ ব্যবস্থা গ্রহণ না-করার বিভিন্ন যৌনরোগে তাঁরা আক্রান্ত হয়। অনেক ক্ষেত্রে এইডসের মতো ভয়াবহ ব্যাধিরও সংক্রমণ ঘটে থাকে, যার অবধারিত ফল মৃত্যু। অনেকে অনাকাঙ্খিতভাবে গর্ভধারণ করে। আর এই অবস্থায় জোরপূর্বক তাঁদের গর্ভপাত ঘটানো হয়, যা তাঁদের স্বাস্থ্যহানি থেকে শুরু করে মৃত্যুরও কারণ হয়। গণিকালয়ে বিক্রি করা ছাড়াও অন্য ধরনের যৌন-ব্যাবসায়ও পাচারকৃত নারী ও মেয়ে শিশুদের কাজে লাগানো হয়। যৌন-পর্যটনের জন্য পাচারকৃত নারীকে হোটেল কর্তৃপক্ষের কাছে বিক্রয় করা হয়। পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্য এ সব নারী ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অনেক সময় ধনী ব্যক্তিরা রক্ষিতা বা সেবাদাসী হিসাবে ব্যবহারের জন্যেও পাচার হয়ে যাওয়া নারীদের কিনে নেয়। সেখানে তাঁদের মুক্তভাবে চলাচল, মত প্রকাশ বা নিজের ব্যপারে কথা বলারও কোনো অধিকার থাকে না। পকিস্তানে পাচার হয়ে যাওয়া বেশিরভাগ নারীই শিকার হয় বাধ্যতামূলক শ্রমের। বিশেষ করে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের লোকেরা তাঁদের কিনে নিয়ে যায় এবং বিয়ে করে। এইসব নারী তৃতীয়, চতুর্থ বা পঞ্চম স্ত্রী হিসাবে শস্য উৎপাদন ও অন্যান্য কাজে শ্রম দিতে বাধ্য হয়। মানুষের বসবাসের অনুপযোগী মরুভূমি অঞ্চলে প্রখর রোদে ভেড়া চড়ানো, জল টানা ইত্যাদি কষ্টদায়ক কাজ করতে বাধ্য হয়। ক্রয় করে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করা হয় বলে সামাজিকভাবেও এঁরা নিগৃহীত হয়। প্রয়োজনবোধে স্বামী আবারও তাঁকে বিক্রি করে দিতে পারে। বাংলাদেশ থেকে নারী প্রতারিত হয়ে সৌদি আরবে যৌনদাসীতে পরিণত হয়ে থাকে। রাজি না-হলে তাঁদের উপর অকথ্য অত্যাচার করা হয়।
নারী ও শিশু পাচারে পশ্চিমবঙ্গের স্থান সারা ভারতে প্রথম। এই হিসাব জাতীয় অপরাধ তথ্য-পরিসংখ্যান দপ্তরের, যা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সরকার ও এনজিওগুলো ভুল বলে দাবি করছে। কেন্দ্রীয় সরকারের নারী ও শিশুকল্যাণ দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী কৃষ্ণা রাজ সংসদে জানিয়েছেন, বাল্য বিবাহ এবং নারী ও শিশু পাচারে পশ্চিমবঙ্গ সারা দেশের সমস্ত রাজ্যের মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে। প্রতি বছরই নারী পাচারের সংখ্যাটা বাড়ছে। রাজ্যসভায় এক লিখিত প্রশ্নের জবাবে কৃষ্ণা রাজ জানান, ২০১৫-১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ নারী ও শিশু পাচারে পয়লা নম্বরে ছিল। ২০১৫ সালে ২০৬৪ জন নারী পাচার হয়েছে। পরের বছর সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫৫৯ জন। শিশু পাচার ২০১৫ সালে ছিল ১৭৯২ জন, ২০১৬ সালে সেটা প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১১৩ জনে। নারী ও শিশু কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী এই হিসাব দাখিল করেছেন ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য উদ্ধৃত করে। রাজ্য সচিবালয়ের দাবি, আগের সরকারের আমলে নারী ও শিশু পাচারের ঘটনা ঘটলেও তা পুলিসের খাতায় নথিভুক্ত হত না। রাজ্যের নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজা নিজে অবশ্য এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। তবে দলীয় সাংসদ কাকলী ঘোষ দস্তিদার দাবি করেছেন, কেন্দ্র সরকারের দেওয়া এই রিপোর্ট ভুল। রাজ্যে শিশু পাচারের দায়ে অভিযুক্ত খোদ বিজেপি নেতা-নেত্রীরা। তাই এখন ভুল পরিসংখ্যান দিয়ে অন্য দিকে নজর ঘোরানোর চেষ্টা চলছে।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর এই তথ্য-পরিসংখ্যানকে ভুল না-বললেও অন্য একটি অসংগতির দিকে নির্দেশ করেছেন দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির দায়িত্বে থাকা ডাঃ স্মরজিৎ জানা। সোনাগাছির গণিকাপল্লিতে বহু বছর ধরেই যৌনকর্মীদের অধিকার নিয়ে লড়ছে দুর্বার, যার মধ্যে এক বড়ো কাজ অনিচ্ছুক যৌনকর্মীদের উদ্ধার করা। অর্থাৎ জোর করে, ইচ্ছের বিরুদ্ধে, কিংবা ভুলিয়ে-ভালিয়ে যৌনপেশায় আনা হয়েছে যে মেয়েদের, যাঁরা পাচার হয়ে এসেছে, দুর্বার তাঁদের চিহ্নিত করে হয় বাড়িতে ফেরত পাঠায়, অথবা বিকল্প কর্মসংস্থান করে। ডঃ জানার বক্তব্য, যারা যৌনপেশায় আসছে প্রতি বছর, তাঁদের সবাইকেই পাচার হওয়া মেয়ে হিসাবে দেখানো হয় ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্যে। কিন্তু অনেক মেয়েই স্বেচ্ছায়, জীবিকার তাগিদে যৌনপেশায় আসে।
দুর্বারের নিজের কাছে এ সংক্রান্ত যা তথ্য আছে, তাতে দেখা যায় অর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা মেয়েরা সাধারণত তিন ধরনের কাজে মূলত শহরে আসে। গৃহ পরিচারিকার কাজ, নির্মাণ শ্রমিকের কাজ এবং যৌনপেশা। প্রথম দুটি কাজ যেহেতু পরিশ্রম-সাপেক্ষ এবং সেই তুলনায় মজুরি যথেষ্ট নয়, তাই সবাই ওই পরিশ্রমের কাজ করতে চায় না। এমতাবস্থায় নিজেরাই অপেক্ষাকৃত কম শারীরিক পরিশ্রমের, কিন্তু বেশি উপার্জনের পেশা যৌনপেশা বেছে নেন। ডাঃ স্মরজিৎ জানার বক্তব্য, এটা একটা বাস্তব প্রবণতা, যাকে উপেক্ষা করা যায় না। বরং অগ্রাহ্য করা যায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের সংসদে দেওয়া ওই তথ্যকে, যা সমস্যার পুরোটা দেখছে না।
একদা যেটা সম্রাট বা রাজা বা জমিদাররা নিজস্ব লেঠেল বাহিনীদের কাজে লাগিয়ে মেয়েদের তুলে আনত বাইজি বা গণিকা বা রক্ষিতা বানানোর জন্য। আজও মেয়েদের ফুসলিয়ে আনা হয় নানারকম প্রলোভন দেখিয়ে। ভারতে ব্রিটিশ আমলে খ্রিস্টান শাসকদের এবং সেনাদের মনোরঞ্জনের জন্য নতুন নতুন গণিকাপল্লি গড়ে ওঠে। সেই গণিকাপল্লি ফলেফুলে ভরিয়ে তুলতে খ্রিস্টান শাসকদের (ব্রিটিশ) পা-চাটা কতিপয় নারী ও পুরুষ উভয়েই প্রত্যন্ত গ্রামে ঢুকে পড়ত মেয়ে সংগ্রহ করতে। মেয়ে তুলে আনার বিনিময়ে প্রাপ্তি হত প্রচুর অর্থ ও উপঢৌকন। এমনকি অতি লোভে মন্দির থেকে দেবদাসীদের পর্যন্ত গণিকালয়ে তুলে আনা হত।
গণিকালয়গুলিতে ‘আড়কাঠি’ শব্দটি খুব শোনা যায়। আড়কাঠি হাল আমলের কোনো নতুন ব্যবস্থা নয়। প্রাচীন যুগেও আড়কাঠি ছিল, যাঁরা ‘বিট’ নামে পরিচিত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে রাজা শূদ্রক রচিত সংস্কৃত নাটক ‘মৃচ্ছকটিকম’ নাটকে বিট চরিত্রের উল্লেখ আছে। তবে আজকের আড়কাঠিদের সঙ্গে প্রাচীনযুগের বিটদের মূলগত পার্থক্য আছে। নাট্যশাস্ত্রে বিটের লক্ষণে বলা হয়েছে–বিট হবেন গণিকাগণের সঙ্গে ব্যবহারে বিশেষজ্ঞ, মধুরভাষী, পক্ষপাতহীন, কবিভাবাপন্ন, শাস্ত্রাৰ্থ ও গণিকা সম্বন্ধে জ্ঞানসম্পন্ন, ইতি ও নেতিবাচক যুক্তিসম্পন্ন বাগী ও চতুর। বিট ব্রাহ্মণ, শিক্ষিত, সংস্কৃতভাষী ও প্রাকৃতভাষী দুই-ই হতে পারে। মৃচ্ছকটিক প্রকরণে দুজন বিট চরিত্র পাওয়া যায়। একজন বসন্তসেনার, অপরজন শকারের। ইন্টারন্যাশনাল জাস্টিস মিশন (IJM) বহু বছর ধরে পাচারকৃত যৌনকর্মীদের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার কাজ করে চলেছে। আমাদের দেশে প্রতি বছর প্রায় ২০,০০০ হাজার মেয়ে কিডন্যাপিং হয়, যার বেশিরভাগরেই জায়গা হয় যৌনপল্লিতে।
(২) যুদ্ধ, সাম্প্রদায়িকতা ও দেশভাগের ফলে গণিকা : আদিমকাল থেকে যুদ্ধের ময়দানে পুরুষের বর্বরতার শিকার হয় নারী। এটা সর্বত্র সত্য, সব দেশেই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চার লক্ষ নারী ধর্ষিত হয়েছিল। ধর্ষক পাকিস্তানি সেনা ও পাকপন্থী রাজাকার। বিশ্বের ইতিহাসে যুগ যুগ ধরে দেখা যায় যে-কোনো জাতিকে দমন করার জন্য, নির্মূল করা জন্য দুটি অস্ত্র এক সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে। তার একটি গণহত্যা, অপরটি ধর্ষণ। মহান মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর একটি বড়ো ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ ছিল নারী ধর্ষণ। এই যুদ্ধকালীন সময়ে নারী ধর্ষণ ছিল পাকবাহিনীর একটি অস্ত্র। একাত্তরে বাংলাদেশের নারীদের উপর যৌন নির্যাতনের ব্যাপকতা, নৃশংসতা এ যাবৎকালে বিশ্বে সংগঠিত সকল যৌন-নির্যাতনের শীর্ষে এবং তা মানব ইতিহাসে বিরল। এটি ছিল পাকিস্থানের দীর্ঘ পরিকল্পনার অংশ, অত্যন্ত সুকৌশলে এ দেশের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে নিজেদের উত্তরসূরি’ রেখে যাওয়া, যাতে এরা ভবিষ্যতে মাথা উঁচু করে না দাঁড়াতে পারে। ১৯৭১ সালে পাকবাহিনী ও তাঁদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের সাহায্যে এ-কাজটি করে। তাঁদের আক্রোশ থেকে দেশের কোনো অঞ্চলই বাদ পড়েনি, তাঁরা সারা দেশে যত্রতত্র এই অত্যাচার চালায়। জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হত ক্যাম্পে। যাতে পালাতে না পারে, তাই বিবস্ত্র করে রাখা হত মেয়েদের। মাথায় চুল পেঁচিয়ে যাতে আত্মহত্যা করতে না-পারে, তাই তাঁদের মাথার চুল কেটে ফেলা হত। তাঁদের ধর্ষণ করা হত দিনের পর দিন। এর ফলশ্রুতিতে এই বিশাল সংখ্যক ধর্ষিতা নারীদের একটি বড় অংশ গর্ভবতী হয়ে পড়ে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ধর্ষণের ফলে অন্তঃসত্ত্বার সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০০০। সাক্ষাৎকারের বিভিন্ন অংশে ডঃ ডেভিস বলেন—“সবচেয়ে সুন্দরী ও বিত্তশালী পরিবারের মেয়েদেরকে অফিসারদের জন্য রেখে বাকিদের সৈন্যদের মাঝে ভাগ করে দেওয়া হত।”
“ওরা আমার বাবা-মাকে মেরে ফেলে, দুজনকেই বন্দুকের বাট দিয়ে পেটাতে পেটাতে মেরেছে। এরপর মেঝেতে আমাকে চিৎ করে শুইয়ে তিনজন মিলে ধর্ষণ করেছে।” এমনটা বলেছে বর্তমানে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত পেট্রাপোলের উদ্বাস্তু শিবিরের এক ষোড়শী। একই প্রতিবেদনের ভাষ্য, “ভিটেমাটি ছেড়ে প্রাণভয়ে পালাতে থাকা পরিবারগুলোর মেয়েদেরও হামলা চালিয়ে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং এরপর বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে পাকবাহিনীর কাছে। অবশ্য পরিবারগুলো মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ছুটিয়ে নিয়েছে অনেককে। যাঁরা পারেনি, তাঁদের ঠাঁই হয়েছে রাজাকারদের খোলা বেশ্যালয়ে। (টাইমস—২১ জুন ১৯৭১)
সরকারি তথ্য অনুযায়ী পাকিস্তানে ধরে নিয়ে যাওয়া কমফোর্ট’ নারীদের মধ্যে ২৫,০০০ নারী ফোর্সড প্রেগনেন্সির শিকার হয়। তবে ‘ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিংস কমিটির সভাপতি ডা. এম এ হাসান বলেন—সংখ্যাটা ৮৮,২০০ জন। ২০০৯ সালে ‘ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিংস কমিটি’ একটি জরিপে উল্লেখ করে–১৯৭১ সালে ২৫ মার্চের কালো রাতে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’-এর মাধ্যমে নিরপরাধ বাঙালি নারীদের উপর নির্যাতন শুরু হয়। ১৯৭১ সালের মার্চে ১৮,৫২৭ জন, এপ্রিলে ৩৫,০০০ জন, মে মাসে ৩২,০০০ জন, জুন মাসে ২৫,০০০ জন, জুলাই মাসে ২১,০০০ জন, আগস্ট মাসে ১২,০০০ জন, সেপ্টেম্বর মাসে ১৫,০০০ জন, অক্টোবর মাসে ১৯,০০০ জন, নভেম্বর মাসে ১৪,০০০ জন, ডিসেম্বর মাসে ১১,০০০ নারী ধর্ষণের শিকার হয়। ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর শেখ মুজিবর রহমান এইসব ধর্ষিতা নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধি দেন। কিন্তু ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধিটি সামাজিকভাবে নেতিবাচক হয়ে গেছে। এইসব নারীরা সম্মানের বদলে পেয়েছে কটুক্তি, বঞ্চনা ও গঞ্জনা। এ উপাধি যেন লজ্জার। বাংলাদেশের ইতিহাসে ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সিনেমাগুলিতে ‘বীরাঙ্গনা বিষয়টিকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে, বীরাঙ্গনার অর্থ দাঁড়িয়ে গেল ধর্ষিতা। ধর্ষিতা? অর্থাৎ বেশ্যা, কুলটা।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এইসব নারীদের নিয়ে বিপাকে পড়ে তাঁদের পরিবারগুলি। তাঁদের স্বাভাবিক জীবনে সবচেয়ে বড়ো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় সমাজব্যবস্থা এবং বিবাহিত নারীদের মধ্যে অনেককেই তাঁদের এমন কি অনেক মুক্তিযোদ্ধা স্বামীরাও গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। ঐ পরিস্থিতিতে অনেককেই বেছে নিতে বাধ্য করে আত্মহত্যার পথ। আবার অনেকেরই জায়গা হয় গণিকালয়ে।
যে দেশের স্বপ্ন চোখে নিয়ে নারীর সম্ভ্রম হারাল, যে মানুষদের জন্য যেসব নারীরা আত্মত্যাগ করল, সেইসব নারীদেরই পরিবার সমাজ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করল। সেইসব বীরাঙ্গনাদের ঠাঁই হল গণিকাপল্লিতে। দেশ স্বাধীন হয়, মর্যাদা পায় না ধর্ষিতা নারীরা। তাঁদের মনে রাখতে চায় না কেউ। সমাজ ‘বেশ্যা’ বলে ঘৃণা করে। অবশ্য পরবর্তী সময়ে বীরাঙ্গনা নারীদের মুক্তিযোদ্ধা এবং তাঁদের সন্তানদের মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হল। বর্তমানে এইসব ধর্ষিত বীরাঙ্গনাদের উদ্দেশ্যে ‘বেশ্যা’ বললে তা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হয়।
১৯৪৬ থেকে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের কারণে এক ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয় ভারত-পাকিস্তান উভয় দেশেই। লাখো লাখ মানুষ যেমন হত্যা হয়েছিল, তেমনি লাখো লাখো নারীকে ধর্ষিতা হতে হয়েছিল। একসময় শান্ত হল দুই যুযুধান সম্প্রদায়। কিন্তু সেই ধর্ষিতা নারীদের কেউ মনে রাখেনি। সমাজ প্রত্যাখ্যান করেছিল। অবশেষে ঠাঁই হল গণিকালয়ে। এটাই শেষ আশ্রয়। গণিকালয় ভরে উঠল। যুদ্ধ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশভাগের পরিণতিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মেয়েরা। প্রতিপক্ষ ছিঁড়েখুঁড়ে খায় নারীশরীর। মেয়েদের দিকেই নেমে আসে আক্রমণের প্রথম বুলডোজারটা। মেয়েরা পতিত হয়।
(৩) উপনিবেশের ফলে গণিকা : শুধু ভারতবর্ষেই নয়, গোটা বিশ্বে এমন কোনো দেশ খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে বিদেশি রাষ্ট্রের উপনিবেশ ঘটেনি। ভারতের কথাই যদি ধরি, তাহলে বলাই যায়, বিদেশি উপনিবেশ ব্যাপকভাবে হয়েছে। কারা উপনিবেশ করেনি–ফরাসি, পোর্তুগিজ, ডাচ, ব্রিটিশ ইত্যাদি। এঁরা নেটিভদের ঘৃণা করত। মেয়েদেরকে কেবলমাত্র ভোগের বস্তু মনে করত। ব্রিটিশ কর্তৃক ভারতীয় মেয়েরা কম ধর্ষিতা হয়নি। লুষ্ঠিত হয়েছে নারী। ব্রিটিশ উপনিবেশকালে ব্রিটিশদের পৃষ্ঠপোষকতায় হাজারে হাজার গণিকা আর গণিকালয় সৃষ্টি হয়েছে। সৃষ্টি করেছিল নিজেদের ও তাঁদের উপোসী সেনাদের কাম চরিতার্থ করার জন্য। এইভাবে বিদেশিদের দ্বারা স্বদেশি নারীরা বারবার লালসার শিকার হয়েছে। লালসা মেটার পর গণিকালয়ের আস্তাকুড়ে ঠেলে দিয়েছে।
(৪) পর্নোগ্রাফির গণিকা : পর্নো-গণিকাবৃত্তি ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছিল? চলমান ছবি আবিষ্কারের পরে পরেই যৌন উত্তেজক চলচ্চিত্রের উৎপাদন শুরু হয়। প্রথমদিকের দুই ফরাসি ইউজেন পিরো (Eugene Pirou) এবং আলবার্ট কারচনার (Albert Kirchner) ছিলেন যৌন উত্তেজক চলচ্চিত্রের অগ্রণী। আলবার্ট কারচেনার বন্ধু পিরোর জন্য প্রথম লাইভ যৌন উত্তেজক ফিল্ম পরিচালিত। তিনি ১৮৯৬ সালে ৭ মিনিটের Le Coucher de la Mariee’ শিরোনামে লুইস উইলি একটি বাথরুম স্ট্রিপটিজ চলচ্চিত্র সম্পাদন ও পরিচালনা করেছিলেন। অভিনয় করেছিলেন লুইস উইলি (Louise willy)। এছাড়াও ১৮৯৬ সালে ফাতিমার ‘Coochie Coochie Dance’ নামক এই ধরনের একটি বেলি ডান্সারের চলচ্চিত্র হিসাবে মুক্তি পায়। ১৯১০ সালে জার্মান ফিল্ম ‘আম অ্যাবেড’ (Am Abend) দশ মিনিট ফিল্ম, যা একজন মহিলা তাঁর শোবার ঘরে একা হস্তমৈথুন করা শুরু করে এবং Straight Sex ও পায়ুমৈথুনরত (Penetration) একজন ব্যক্তিকে সেই দৃশ্যে দেখা যায়। পর্নোগ্রাফিক সিনেমা ১৯২০ সালে নির্বাক চলচ্চিত্র যুগেও বিস্তৃত ছিল এবং প্রায়শই গণিকালয়গুলিতে প্রদর্শিত হত।
নারী ও শিশুদেহের বাণিজ্যিক ব্যবহারের আর-একটি ভয়াবহ দিক হল সেলুলয়েডে যৌনকর্ম করা, অর্থাৎ পর্নোপেশায় যুক্ত হওয়া। এর চর্চা আধুনিক প্রযুক্তির হাত ধরে গোটা পৃথিবীব্যাপী মহামারীর রূপ নিয়েছে। এই খাতটিরও অর্থনৈতিক বাজার বিশাল বড়ো। বিলিয়ান ট্রিলিয়ন ডলারের। তবে এক্ষেত্রে নীল চলচ্চিত্রে অংশগ্রহণকারী নারী ও পুরুষ উভয়কেই গণিকা বলতে হয়। এই পেশায় সবাইকেই যে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, তা কিন্তু বলা যায় না। বহু মেয়েরা স্বেচ্ছায় মোটা টাকা রোজগারের তাগিদে এ পেশায় আসে।
বিশ্বখ্যাত নারীবাদী নেত্রী ও আইনজীবী ক্যাথরিন ম্যাককিননের মতে, পর্নোগ্রাফি ইন্ডাস্ট্রি হিসাবে হলিউডের চেয়ে অনেক অনেক বিশাল। স্যাটেলাইট টিভি ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে যার দ্রুত বিস্তার ঘটেছে। উচ্চবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারের ঘরে ঘরে ইন্টারনেট কানেকশন এখন আর বিস্ময়ের কিছু না। চাইলেই তাঁরা যখন খুশি সেক্স সাইট ব্রাউজ করতে পারছে, ডাউনলোড করে নিতে পারছে যে-কোনো পরিমাণ পর্নো ফুটেজ। যাঁদের ঘরে সে সুবিধা নেই তাদের জন্য আছে অলিতে-গলিতে গজিয়ে ওঠা সাইবার ক্যাফে। এক ঘণ্টা ব্রাউজ করার জন্য ক্যাফেগুলোতে চার্জ নেওয়া হয় মাত্র ২০ থেকে ২৫ টাকা এবং বিনিময়ে একটিমাত্র ক্লিকেই পৌঁছে যাওয়া যায় ভার্চুয়াল যৌনমিলনের জগতে। গুগলের হিসাবে সবচেয়ে বেশি সার্চ হয় পর্নোর সাইটগুলিতে। যাঁরা গণিকালয়ে গিয়ে নারীভোগ করার বুকের পাটা নেই, তারাই সেলুলয়েডে যৌনমিলন দেখে কামপ্রবৃত্তি নিবৃত্তি করে। মানসদর্শনে যৌনমিলন করেন। পুরুষরা সেলুলয়েডের নারীকে ভার্চুয়াল সেক্স করে, নারীরা সেলুলয়েডের পুরুষের সঙ্গে ভার্চুয়াল সেক্স করে। ক্যামেরার সামনে কোটি কোটি যৌনউন্মাদদের কামপ্রবৃত্তি নিবৃত্ত করতে যাঁরা অর্থের বিনিময়ে যৌনকর্ম করে তাঁরা গণিকা না-হলে কারা গণিকা? এ ধরনের গণিকাবৃত্তি ভারত-বাংলাদেশে সহ প্রায় সব বিশ্বেই নির্মাণ হয়ে থাকে। কোথাও গোপনে, কোথাও ওপেনে। সারা বিশ্বে কত রেভিনিউ আদায় হয় এই সেক্স-অ্যাডভেঞ্চার থেকে?
Alex Helmy (founder and publisher of adult-entertainment trade publication) 501629, “পর্নোশিল্পের রাজস্ব অনুমান ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন যে শিল্প বছরেও ৬ বিলিয়ন ডলার উপার্জন করে, কেউ বলবে এটি ১০ বিলিয়ন ডলার, ১৫ বিলিয়ন ডলার বা এমনকি ৯৭ বিলিয়ন ডলার করে। কারণ বেশিরভাগ পর্নো সংস্থাগুলি ব্যক্তিগতভাবে সমস্ত তথ্য গোপন রাখে, তাই সম্পূর্ণরূপে সঠিক অনুমান পাওয়া অসম্ভব।” অন্য এক সূত্র থেকে জানা যায়, বিশ্বব্যাপী পর্নোগ্রাফি প্রায় 100 বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে, এটি একটি বড় স্কেল ব্যাবসা। ২০০৬ সালে চিন ২৭.৪০ বিলিয়ন ডলার, দক্ষিণ কোরিয়া ২৫.৭৩ বিলিয়ন ডলার, জাপান ১৯.৯৮ বিলিয়ন ডলার এবং মার্কিন ১৩.৩৩ বিলিয়ন ডলার আয় করে। এটা মাইক্রোসফট, গুগল, আমাজন, ইবে, ইয়াহু, অ্যাপল এবং নেটফ্লিক্সের তুলনায় বড়ো আয়। পরিসংখ্যানগুলি দেখায় যে, ইন্টারনেট পর্নোগ্রাফির সর্বাধিক দর্শকরা উচ্চ আয়ের সঙ্গে থাকে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নেট পর্নো ভিউয়ার থেকে ৩৫ শতাংশ, অর্থাৎ বছরে ৭৫,০০০ ডলার বা তার বেশি উপার্জন করে। পরের সর্বোচ্চ, ২৬ শতাংশ, অর্থাৎ যাঁরা বছরে ৫০,০০০ ডলার থেকে ৭৫,০০০ ডলার উপার্জন করে। পর্নো ইন্ডাস্ট্রি বিশ্ব অর্থনীতির একটি প্রধান উপাদান, বৃহদায়তন আয় এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। toptenreviews.com-র মতে, পর্নোগ্রাফিতে বিশ্বের প্রতি সেকেন্ডে ৩,০০০ ডলারেরও বেশি খরচ হয়।
চিন — $ ২৭.৪০
দক্ষিণ কোরিয়া — $ ২৫.৭৩
জাপান — $ ১৯.৯৮
আমেরিকা — $ ১৩.৩৩
অস্ট্রেলিয়া — $ ২.০০
ব্রিটেন — $ ১.৯৭
ইতালি — $ ১.৪০
কানাডা — $ ১.০০
ফিলিপিনস — $ ১.০০
তাইওয়ান — $ ১.০০
জার্মানি –- $ .৬৪
ফিনল্যান্ড — $ .৬০
চেক প্রজাতন্ত্র –-$ ৪৬
রাশিয়া — $ .২৫
নেদারল্যান্ড –- $ .২০
ব্রাজিল — $ ১০
মোটা টাকার হাতছানি এড়ানো যে খুব শক্ত কাজ, সেটা বিশ্বের পয়লা নম্বর পর্ন-গণিকা সানি লিওনি একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছে–তাঁর সেক্স করাটা প্যাশন। তিনি স্ব-ইচ্ছায় এই পেশা বেছে নিয়েছেন। স্টেইট, লেসবো – সব ধরনের সেক্স তিনি স্বচ্ছন্দ ছিলেন। আবার একটা সময় ইচ্ছা হল এই পেশা ছেড়ে দিয়ে বলিউডে পাড়ি জমালো ফ্লিমে অভিনয় করে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেওয়ার জন্য। তাই বলে নিজস্ব পর্নোফ্লিমের সাইট কিন্তু বন্ধ করে দেননি। সেই সাইটে শুধু তাঁরই করা পর্নোমুভি সঞ্চিত আছে। কারণ তাঁর সেলুলয়েড সেক্স বিক্রি করে নিয়মিত মোটা টাকার আমদানি হয়। পর্নো-বাজারে সানি লিওনি মুকুটহীন সম্রাজ্ঞী। কোটি ডলার তাঁর দাম। অভিনেত্রী হিসাবে এক-আধটা সিনেমায় কাজ পেলেও তিনি সুযোগ পেলেই দেহব্যাবসার ডাক লঘন করতে পারে না। বছর কয়েক আগে বলিউডের মূলস্রোতে আসার পরেও তিনি ৪৫ লক্ষ টাকার বিনিময়ে এক হিরে ব্যবসায়ীর পার্টিতে নগ্ননৃত্য ইত্যাদি করে এসেছেন। সেই নাচের ভিডিও দৃশ্য সোস্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয়েছে। ডাক্তার স্বামী ড্যানিয়েল ওয়েবর সঙ্গে নিয়ে সানি লিওনি প্রায় ৫৬ টি যৌনসঙ্গম ক্যামেরাবন্দি করেছে। ৫৯ টি পর্নোমুভি নিজে পরিচালনা করেছে। অনুরূপ আর-এক দামি পর্নো-গণিকা মিয়া খলিফাও স্বেচ্ছায় ক্যামেরার সামনে সেক্স করতে এসেছিলেন মোটা টাকা কামানোর জন্য। আবার তিনিও স্বেচ্ছায় এই পেশা ছেড়ে দিলেও পূর্বের করা পর্নো থেকে আসা রোজগার নিতে ছাড়েননি। এছাড়া প্রিয়া অঞ্জলি রাই, দেবিকা, রেশমা, শাকিলা, পিটা জেনসেন, লিজা আন, হিটোমি তানাকা, ক্রিস্টি ম্যাক, নাতাশা ডালাস, ক্রিস্টিনা রোজ, হোলি সুইট, অ্যালেক্সা লোরেন, অলিভিয়া লাভলি প্রমুখ পর্ন-গণিকারা মোটা টাকা রোজগারের জন্যেই ক্যামেরার সামনে যৌনকর্ম বেছে নিয়েছে। অন্তত এদের অকপট স্বীকারোক্তি সেটাই প্রমাণ করে।
গণিকাপল্লির মেয়েদের সঙ্গে মূলগত পার্থক্য হল পল্লির গণিকারা চার দেয়ালের ভিতরে গোপনীয়তা রক্ষা করে হাজার হাজার পুরুষের সঙ্গে যৌনমিলন করে ন্যায্য অর্থের বিনিময়ে। পর্নোস্টাররা ক্যামেরার সামনে অর্থের বিনিময়ে হাজার হাজার পুরুষের সঙ্গে যৌনমিলন করে এবং সেই ক্যামেরাবন্দি যৌনমিলন সারা পৃথিবীর কোটি কোটি দেখে। আর-একটি পার্থক্য হল পর্নো-গণিকাদের পরিচালকের নির্দেশে বিভিন্ন কায়দায় যৌনমিলন করতে হয় এবং সাধারণ গণিকারা কোনো তৃতীয় পক্ষের নির্দেশ ছাড়াই স্বাধীনভাবে যৌনমিলন করে। পার্থক্য যাই-ই থাক, উভয়ে গণিকাবৃত্তিই করে।
ধনী সাধারণ গণিকা যেমন আছে, তেমনি ধনী পর্নো-গণিকাও আছে। তবে পর্নো-গণিকাদের মতো উচ্চহারে উপার্জন বোধহয় সাধারণ গণিকাদের হয় না। সাধারণ গণিকাদের উপার্জনে যেমন বিভিন্নতা আছে, ঠিক তেমনি পর্নো-গণিকাদের উপার্জনেও রকমফের আছে। সকলেই চোখ কপালে তোলা উপার্জন করার সৌভাগ্য অর্জন না-করলেও মোটামুটি যে ১০ জন পর্নো-গণিকার উপার্জনের কথা উল্লেখ করব, তাতে চোখ কপালে উঠবেই। পর্নো-গণিকাদের প্রথম ১০ জনের সম্পত্তির পরিমাণে শীর্ষে জেনা জ্যাকসন।
সেরা ১০ জন পর্নো-গণিকার সম্পত্তির পরিমাণ–
কিন্তু ক্যামেরার সামনে যৌনপেশায় এইসব গণিকাদের রোজগারই তো শেষ কথা নয়। আছে আরও অনেকেই। আলো যেমন আছে, অন্ধকার আছে তেমন পাশাপাশি। অসংখ্য যে পর্নো-গণিকারা যে কাজ করেন, তাঁদের সকলের পারিশ্রমিক কিন্তু আশাব্যঞ্জক নয়। (১) নারী, যাঁরা কেবল বিভিন্ন পুরুষের সঙ্গে যৌনমিলন করবে। এঁদের গড় আয় ৩০০ থেকে ১৫০০ মার্কিন ডলার। (২) যে নারী একজন নারীর সঙ্গে যৌনমিলন করবে, সেই নারীদ্বয়ের পরিশ্রমিক ৭০০ থেকে ১২০০ মার্কিন ডলার। (৩) পুরুষ, যে পুরুষরা নারীর সঙ্গে যৌনমিলন করবে, তাঁর পারিশ্রমিক ৫০০ থেকে ১৫০০ মার্কিন ডলার। (৪) পরিচালকের গড় আয় ১০০০ থেকে ৩০০০ মার্কিন ডলার। (৫) ক্যামেরাম্যানের পারিশ্রমিক ৫০০ থেকে ৭০০ মার্কিন ডলার। (৬) সাউন্ড টেকনিশিয়ানদের পারিশ্রমিক ৩০০ থেকে ৪০০ মার্কিন ডলার। (৭) প্রোডাকশন অ্যাসিস্ট্যান্টের গড় আয় ১০০ থেকে ২৫০ মার্কিন ডলার। (৮) স্টিল ফোটোগ্রাফারের গড় পারিশ্রমিক ৫০০ মার্কিন ডলার। (৯) মেক আপ আর্টিস্টের পারিশ্রমিক ৫০০ মার্কিন ডলার।
যাঁরা নিয়মিত পর্নোমুভি বা তথাকথিত নীল ছবির দুনিয়ার সামান্যতম খোঁজখবর রাখেন, এক ডাকে থ্রি অলসনকে চিনে থাকবেন। কী বলছেন অলসন? তিনি বলছেন–“পর্নো করলে তুমি সমাজ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়বে। তোমার মানবাধিকার কেড়ে নিতে উদ্যত হবে।” থ্রি অলসন বলছেন–“পর্নো খারাপ, এ কথা আমি বলছি না। কিন্তু বাকিরা তোমার সঙ্গে কীভাবে আচরণ করছে, সেটাই তোমার জীবনের প্রধান বিষয়। যদি মনে করো, মেয়েদের কোনো আড্ডায় যোগদান করবে, তাহলে স্রেফ পেশার জন্যেই তুমি সেখানে ঠাঁই পাবে না। … একবার যখন পর্নো-গণিকার তকমা তোমার গায়ে লেগেছে, তখন তুমি বাড়িতেও সবসময় যৌনতার হাট খুলে বসেছে। অপরদিকে রক্ষণশীল দেশের জনপ্রিয় অভিনেত্রী রাখী সাওয়ান্ত সাংবাদিকদের ক্যামেরার সামনে সটান ঘোষণা দিতে পারেন–“আমি আপনাদের সকলকে আজ একটা ভালো খবর দিতে চাই। আমি একজন পর্নোস্টার হতে চাই।” এই ঘোষণা শুনে যাঁরা সেলুলয়েডে রাখী সাওয়ান্তের যৌনক্রিয়া দেখার জন্য উশখুশ করছিলেন, শেষপর্যন্ত তাঁদের ইচ্ছাপূরণ হয়েছে কি না আমার জানা নেই। হায়, গণিকা হওয়া কি এতই সুখের!
একটি ঘটনার উল্লেখ করি। ঘটনাটা ঘটেছে ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ভারতের বেঙ্গালুরুতে। পর্নো ছবি দেখে তো স্বামীর মাথায় হাত। ডেক্সটপের পর্দায় যে মহিলাটি যৌনসঙ্গম করছেন, তিনি আর কেউ নয়, তাঁর নিজের স্ত্রী। পর্নোগ্রাফি দেখতে দেখতে প্রায় হার্ট অ্যাটাক হওয়ার উপক্রম স্বামীর। পর্নোগ্রাফি দেখা শিকেয় উঠল তাঁর, বসে পড়লেন মাথায় হাত দিয়ে। ২০১৮ সালে বিয়ে হয় কলকাতার বাসিন্দা এক মহিলা ও উত্তরপ্রদেশের এক যুবকের। বিয়ের পর তাঁরা থিতু হন বেঙ্গালুরুতে! বিয়ের কিছুদিন পর স্ত্রী স্বামীকে জানিয়েছিলেন তাঁর প্রাক্তন প্রেমিকের বিষয়ে। এও বলেছিলেন, সেই ব্যাক্তির সঙ্গে বর্তমানে তাঁর আর কোনো যোগাযোগ নেই। স্ত্রীর সততায় বেশ খুশিই হয়েছিলেন স্বামী। স্বামী লক্ষ করলেন পর্নোগ্রাফির প্রতি স্ত্রীর চূড়ান্ত আসক্তিতে। একদিন স্ত্রী স্বামীকেও একটি পর্নোগ্রাফির ভিডিও দেখতে বললেন। সঙ্গেও এও দাবি রাখলেন, ছবির মতো করেই তাঁকে ‘আদর করতে হবে। স্ত্রীর আবদার মানতে পর্নোগ্রাফি দেখা শুরু করলেন স্বামী, এরপরই ঘটল বিপত্তি। স্ত্রীর মোবাইলে পর্নোমুভি দেখতে গিয়েই ভিরমি খেলেন। দেখলেন পর্নোমুভির নায়িকা খোদ তাঁর স্ত্রী। ধরা পড়ে গিয়ে মহিলা বলেন, ছবিতে তাঁর বিপরীত থাকা পুরুষটিই তাঁর প্রাক্তন প্রেমিক। বাধ্য হয়েই ভিডিওটি স্যুট করেছিলেন। এই ভিডিওটি দেখিয়ে রীতিমত তাঁকে ব্ল্যাকমেলও করত প্রাক্তন প্রেমিক। স্ত্রীর কথা বিশ্বাসও করে নেন স্বামী। কিন্তু দিনকয়েক বাদে ফের পর্নোসাইটে স্ত্রীর আরেকটি ভিডিও দেখতে পান স্বামী। সেখানে সঙ্গী আবার অন্য পুরুষ। অবশেষে হাতেনাতে ধরা পরতেই সত্যিটা স্বীকার করেন মহিলা। জানান, এক নয়, একাধিক পুরুষের সঙ্গে তিনি যৌন মিলন করেছেন এবং এটা ওর খুব ভালো লাগে। নতুন নতুন পুরুষসঙ্গে নতুন নতুন কায়দায় যৌনমিলনে সে সম্পূর্ণ তৃপ্ত, ব্যাংক ব্যালান্সও মন্দ হচ্ছে না।
(৫) রূপোলি পর্দায় গণিকা : মুভিমোগল শেখর কাপুর, রাজকাপুর প্রমুখ কতিপয় চলচ্চিত্র নির্মাতা খুব কায়দা করে সেলুলয়েডে নারী-শরীর বিক্রি করতেন মুনশিয়ানার সঙ্গে। এইসব নির্মাতারা বিলক্ষণ জানেন নারীর খোলা বুক, নগ্ন পা, খোলা পিঠ, স্বচ্ছ সাদা কাপড়ে জলে-ভেজা নগ্ন শরীর ভালো বিকোয়। তাই কোনো না কোনো ছুতোনাতায় নারী-শরীরের গোপন সেলুলয়েড বন্দি করে ফেলবে। কখনো-বা অভিনেত্রীর উপর প্রভাব খাঁটিয়ে, কখনো যথেষ্ট পারিশ্রমিক দিয়ে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একদম আনকোরা মেয়েদের ব্যবহার করা হয়। সেইসব মেয়েরাও ইন্ডাস্ট্রিতে কেরিয়ারের স্বপ্ন দেখে রাজিও হয়ে যায়। অভিনেত্রীদের বোঝাতে সক্ষম হয় যে তারা কত মহান কাজ করতে চলেছে, ইতিহাস রচনা করতে চলেছে। সত্যি কথা বলতে কি সেইসব অভিনেত্রীরা বেশিদূর আর এগোতে পারে না। সব হারিয়ে যায় অকালেই। কারণ দর্শকরাও সেই অভিনেত্রীর কাছ থেকে কেবলমাত্র নগ্নতাই প্রত্যাশা করে। অল্পস্বল্প নারী-অঙ্গ দেখাতে দেখাতে নির্মাতারা এতটাই সাহসী হয়ে ওঠে যে নগ্নতা তথা যৌনমিলনের দৃশ্যও টেক করতে শুরু করে দেয়। ভারতীয় চলচ্চিত্রে এইসব দৃশ্য সেন্সর বোর্ড আটকে দিলেও হলিউডের চলচ্চিত্রগুলিতে সেইসব নগ্নতা তথা যৌনমিলনের দৃশ্য প্রদর্শন করা হয়। চলচ্চিত্র উৎসবে সেইসব আন-সেন্সর্ড সিনেমা দেখার জন্য দর্শকরা পাগলের মতো ছুটে গিয়ে প্রেক্ষাগৃহ হাউসফুল করে দেয়। নারীর নগ্ন শরীর দেখিয়ে প্রযোজকরা ফুলেফেঁপে ওঠে। তবে ভারতীয় চলচ্চিত্রে খুল্লামখুল্লা দৃশ্যায়ন হলে সেন্সর পায় না বটে, কিন্তু এ ধরনের সিনেমা তৈরি তাতে থেমে থাকে না। প্রচুর রগরগে যৌনদৃশ্য তৈরি করা হয়। খুব কম পয়সা বিনিয়োগ করে প্রচুর মুনাফা অর্জনের লোভ ছাড়বে কে? কসমিক সেক্স, দি ডিভাইন সেক্স, গাণ্ডু, মাশরুম (ছত্রাক), রঙ রসিয়া, কামসূত্র, কামসূত্র থ্রিডি, সিদ্ধার্থ, মচালতা জওয়ানি, রেশমি কি জওয়ানি, গোলাবি রাতে, হর রাত নই খিলাড়ি ইত্যাদি মুভি নারী-শরীর নির্ভর করেই। এইসব চলচ্চিত্রের অভিনেত্রীদের ‘গণিকা’ বই অন্য কিছু বলে না মানুষ।
মেইন স্ট্রিমের এইসব মুভিতে যৌনদৃশ্য কেন সেলুলয়েডে বন্দি করা হয়? নির্মাতারা বলেন–“চিত্রনাট্যের ডিমান্ড”। চিত্রনাট্যের ডিমান্ড কীভাবে তৈরি হয়? ঈশ্বর-প্রেরিত পূর্বনির্ধারিত ব্যাপার নাকি? আসলে কোনো মুভিতে কোথায় কতটা নগ্ন যৌনতা রাখা হবে, তা পরিকল্পিতভাবেই করা হয়। এটাই ব্যাবসায়িক কৌশল। প্রোডিউসারদের নির্দেশ। ব্যাবসা ভালো হয়। সেভাবেই ছক কষা হয়। কারণ ওই রগরগে যৌনদৃশ্যই মুনাফা আনবে। চিত্রনাট্যের ডিমান্ড একটা ভাঁওতা। সংশ্লিষ্ট মুভি যৌনদৃশ্যগুলি বাদ দিয়ে দেখানো হলে আপনি বুঝতেই পারবেন না, সেখানে কোনো যৌনদৃশ্যের প্রয়োজন আছে। একটা উদাহরণ দিই। আপনারা নিশ্চয় ‘মাশরুম’ বা ‘ছত্রাক’ মুভির নাম শুনেছেন? এই মুভির কোনো একটি দৃশ্যে দেখানো হয়েছে অভিনেত্রী পাওলি দাম নীচে পা ঝুলিয়ে খাটের উপর সম্পূর্ণ উলঙ্গ চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। অভিনেতা অনুব্রত মণ্ডল পাওলির দু-পা ফাঁক করে উপরদিকে তুলে ধরে যৌনাঙ্গ চাটছে। পাওলির সংলাপ–“উফ উফ, চাট চাট”। এই দৃশ্য মুভি রিলিজের আগে ইন্টারনেটে লিক হয়ে মোবাইলে মোবাইলে ছড়িয়ে পড়ে। মাশরুম বা ছত্রাক মুভি কজন দেখেছেন সেটা বলা মুশকিল, পাওলি-অনুব্রতর যৌনদৃশ্যের ভিডিও ক্লিপিংটি দেখতে বোধহয় কেউ বাকি নেই। এখনও নেট সার্চ করলে এই ভিডিও ক্লিপিংটা পাওয়া যায়। যারা ‘মাশরুম’ বা ‘ছত্রাক’ মুভিটি দেখেছেন, তারা কি বলতে পারবেন মুভিতে ওই দৃশ্যটি কোথায় ছিল? বলতে পারবেন না। কারণ ওই দৃশ্যটি মুভিতে রাখাই যায়নি। এমনকি কান ও টরেন্টের চলচ্চিত্র উৎসবেও ওই দৃশ্যটি দেখানো যায়নি। যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে মুভি জগতের সঙ্গে জড়িত আছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানেন সেন্সর বোর্ড কী ছাড় দেবেন আর কী ছাড় দেবেন না। সেন্সর নির্দিষ্ট গাইড লাইন আছে। সেই গাইড লাইন কী নির্দেশ আছে সে বিষয়ে সকলেই অবগত। তা সত্ত্বে এই যৌনদৃশ্য বা যৌনমিলনের দৃশ্যগুলো সেলুলয়েডে বন্দি করা হয় কেন? উদ্দেশ্য দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার। শুধু ভারতেই নয়, পৃথিবীর সর্বত্রই এক শ্রেণির অভিনেতা-অভিনেত্রীরা সেলুলয়েডে যৌনমিলনের দৃশ্য সেলুলয়েড বন্দি করে। এক একটা মুভি এমন তৈরি করা হয়, সেগুলি পর্নোমুভি বলাই যায়। সেলুলয়েডে সেক্স করা অভিনেত্রী (‘গাণ্ডু’ ও ‘কসমিক সেক্স’ খ্যাত) ঋতুপর্ণা ওরফে ঋ এক সাক্ষাৎকারে কী বলছে, পড়ুন – “আমার শরীরের মালিকানা আমার। দোকান সাজিয়ে বসেছি। বেচতে লজ্জা কীসের! আমার বাবু আর আমার দালাল আমি নিজেই। যারা আমার শরীর দেখে লজ্জা পান, উত্তেজিত হয়ে পড়েন, তাঁরা হোন। কিন্তু এই যে প্রতিনিয়ত তাঁদের আদিম সত্তাকে ‘ট্রিগার’ করি, এটাই কানেকশন উইথ মাই অডিয়েন্স।” কী বুঝলেন? গণিকা!
২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে সারা বিশ্বে করোনা প্যানডেমিকের প্যানিকে লক ডাউন ঘোষণা হল। বলা হল মুখে মাস্ক এবং অবশ্যই সোস্যাল ডিসট্যান্সিং মেনে চলতে হবে। স্তব্ধ হয়ে রুজিরোজগার। কোটি কোটি মানুষ কাজ হারাল। সেই ভয়ংকর প্রভাব থেকে যৌনপল্লিও রেহাই পেল না। কোনো ক্লায়েন্ট আর যৌনকর্মীদের সংস্পর্শে আসতে চাইলেন করোনার ভয়ে। যৌনকর্মীরা ভাতে মারা গেল। রোজগার বন্ধ হয়ে গেল। মাসের পর মাস। লক ডাউন উঠে গেলেও যৌনবাজার স্বাভাবিক হল না। এমতাবস্থায় যৌনপল্লির যৌনকর্মীরা যেমন সংকটে পড়ে গেল, তেমনি যৌনপল্লির বাইরে স্বাধীন যৌনকর্মীরাও সংকটের মধ্যে পড়ে গেল। ঠিক এমন সময়ে এক শ্রেণির শর্টফ্লিম নির্মাতারা আসরে নেমে পড়ল। শর্টফ্লিমের নামে যৌনমিলনের মুভি তৈরি করতে থাকল। এইসব মুভিতে সুযোগ পেতে থাকল যৌনকর্মীরা। নতুন মেয়েরাও এই মুভিতে কাজ করতে শুরু করে দিল যাঁরা অনেকেই লক ডাউনে কাজ হারিয়েছে। এইসব মুভি বিশেষ কিছু অ্যাপ ইনস্টল করে দেখতে হয়। নির্ধারিত সাবস্ক্রিপশন দিয়ে। তেমনই কিছু অ্যাপের নাম Hothit, 11Up Movies, Unseen, Uncutmasala, Eightshots, Fliz Movies ইত্যাদি। শর্ট ফ্লিমের এই নব সংস্করণের বাজারি নাম ওয়েব সিরিজ। এই মুভিগুলি আসলে সেলুলয়েডে বন্দি অবাধ যৌনকর্ম। রমরমা বাজার। সেন্সর বোর্ডের নজরদারি নেই। এইসব মুভিতে বহু পরিচিত অংশগ্রহণকারী মুখগুলি হল–টিনা নন্দী, জোয়া রাঠোর, কাজল গুপ্তা, সোনিয়া মাহেশ্বরী, কবিতা রাধেশ্যাম, আলিশা, জারা, সীমা, সুচরিতা, দোলন, রিংকি চোপড়া, এলিজা প্রমুখ। এঁদের অভিনেত্রী বললে অভিনেত্রীদের অপমান করা হবে। এঁরা গণিকাই, যাঁরা অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন পুরুষের সঙ্গে যৌনকর্ম করে। পুরুষ যৌনকর্মীরাও এই ট্রেন্ডে কাজ করছে। বিশ্বকে দেখানোর যৌনকর্ম এবং মোটা অঙ্কের রোজগার।
মুভির অভিনেত্রীরা কেন গণিকা বা যৌনকর্মী নয়? এ প্রশ্ন আমার নয়, এ প্রশ্ন কলকাতার খোদ যৌনকর্মীদের পক্ষ থেকেই উঠেছে। ‘অল ইন্ডিয়া নেটওয়ার্ক অব সেক্স ওয়ার্কার্স’-এর পক্ষ থেকে যৌনকর্মীদের এমনই প্রশ্ন বিশ্বের কাছে। যৌনকর্মীদের স্পষ্ট প্রশ্ন সিনেমার নায়িকা হওয়ার জন্যেও তো বিক্রি করতে হয় শরীর। সেক্ষেত্রে যিনি শরীর বিক্রি করলেন, তাঁকে তো যৌনকর্মী বা গণিকা বলা হয় না। তাঁদের পরিচয় প্রদানেও কোনো অসম্মানজনক শব্দ বা রুচিহীন শব্দ ব্যবহার করা হয় না। তাহলে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য শরীরের বিনিময়ে উপার্জনের ক্ষেত্রে আমাদের কেন যৌনকর্মী পরিচয় পেতে হবে? শরীরের বিনিময়ে নায়িকা হওয়া বা নায়িকা হয়ে শরীর বিক্রি করার বিষয়টি খুব প্রচলন একটি গোপন সত্য হিসাবে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশেও প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। গুঞ্জন আছে, অধিকাংশ নায়িকাই শরীর উপটৌকন দিয়ে থাকেন পরিচালক কিংবা প্রযোজক কিংবা প্রভাবশালীদের কাছে। অনেক নায়িকাই বিদ্রোহ করে কাজ হারান, আবার অনেকেই আপোস করে টিকে থাকেন। শরীরকে বিনিয়োগ করে কেরিয়ারের সিঁড়ি হিসাবে ব্যবহার করতে পিছ-পা হন না অনেকেই। শরীরের বিনিময়ে তাঁরা সিনেমায়, নাটক ইত্যাদিতে কাজের সুযোগ পান। বাংলাদেশে এক ধরনের মুভি বা মিউজিক ভিডিও করা হয়, যেখানে নায়িকারা সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে সম্পূর্ণ জামাকাপড় পরিহিত নায়কের সঙ্গে চটুল বাংলা গান সহ নাচ করেন। অত্যন্ত জঘন্য সেই নৃত্যদৃশ্য। বুঝতে অসুবিধা হয় না এইসব নায়িকাদের একমাত্র মূলধন নগ্ন শরীর। নগ্ন শরীর প্রদর্শন করেই অর্থ রোজগার করেন। শরীর বিক্রিই তো করে এঁরা। গণিকা নয়? তাহলে সেক্ষেত্রে যৌনকর্মীদের প্রশ্নটিকে উড়িয়ে দেওয়া হবে কেন? ক্যামেরার সামনে শরীর দান করে, শরীর প্রদর্শন করে তামাম পুরুষদের ট্রিগার করে তাঁরা নায়িকা পরিচয় নিয়ে থাকবেন, আর শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য শরীর বিক্রি করে যাঁরা অর্থ রোজগার করে ক্যামেরা ছাড়া, তাঁরা যৌনকর্মী? তাই সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার তাগিদে শরীর বিক্রি করা যৌনকর্মীরা প্রশ্ন তুলেছে যৌনতার জন্য যেসব অভিনেত্রীরা শরীরকে অর্থ রোজগারের মাধ্যম করে, তাঁরা কেন যৌনকর্মী নয়?
বদল ঘটেছে যৌনতায়, সেটা সমাজের বিভিন্ন অংশের যৌনকর্মীদের বিভিন্ন মনোভাব ও কাজকর্মের ধরনেই প্রকাশ পায়। এআইএনএসডব্লিউ (AINSW)-এর নতুন কমিটি যুগ্ম সচিব তথা বিহারের পূর্ণিয়ার যৌনকর্মীদের সংগঠন ‘আম্রপালি কল্যাণ সমিতি’-র সচিব রেখা রানি বলেন–“ফিল্মের নায়িকা হওয়ার জন্যেও তো শরীর বিক্রি করতে হয়। যাঁরা শরীর বিক্রি করে নায়িকা হন, তাঁদের কেন সেক্স ওয়ার্কার বলা হবে না?” তিনি অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে বলেন–“যৌনকর্মীদের পরিচয় দেওয়ার জন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমন শব্দ ব্যবহার করা হয়, সেই শব্দ কেন ওই নায়িকাদের জন্য ব্যবহার হয় না?” রেখা রানি বলেন–“শরীরের বিনিময়ে নায়িকা হওয়া তো সেক্স ওয়ার্কারের মতো কাজ। আমরাও তো সেক্স করেই উপার্জন করি। দিই যৌনসুখ। তাহলে আমাদের ক্ষেত্রে কেন অন্য রকমের আচরণ করা হবে? ওদের নায়িকা হওয়ার জন্যে সেক্স করতে হয়, আর আমরাও রোজগারের জন্য সেক্স করি। নায়িকারা গ্ল্যামার সেইসঙ্গে রোজগারের জন্য সেক্স, আর আমাদের গ্ল্যামারহীন রোজগারের জন্য সেক্স করি–পার্থক্য শুধু এইটুকুই।” যৌনকর্মীদের সংগঠন দিশা মহিলা বহু-উদ্দেশীয় সংগঠনের সচিব তথা এআইএনডব্লিউ-র অপর যুগ্ম সচিব লতা কাপসের মতে, “শরীর বিক্রি করে নায়িকা হলেও সেক্ষেত্রে সেক্স ওয়ার্কার বলা হয় না। আর আমরা শরীরের বিনিময়ে বেঁচে থাকলেও আমাদের সেক্স ওয়ার্কার বলা হয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসন্মানিত করা হয়।”
(৬) ক্যানভাসে গণিকা : ‘রং রসিয়া’ নামে হিন্দি মুভিতে দেখানো হয়েছে চিত্রশিল্পী রবি ভার্মার চিত্রশিল্পের মডেলার সুগন্ধি, যিনি চিত্রশিল্পীর চিত্রশিল্পের জন্য নগ্ন হতেন এবং কখনো-সখনো সুযোগ-সুবিধা মতো। চিত্রশিল্পীর সঙ্গে যৌনমিলনও করতেন। সুগন্ধি বিলক্ষণ বুঝেছিলেন তিনি শিল্প এবং প্রেমের জন্য নগ্ন হলেও রবি ভার্মা, রক্ষণশীল সমাজ ও রাষ্ট্র তাঁকে ‘বেশ্যা’ হিসাবেই দেখত। স্বীকৃতিহীন এক নারী সুগন্ধির পরিণতি হল গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহনন। এটাই বাস্তব। প্রদীপের নীচে অন্ধকারকে আড়ালে রেখে চিত্রশিল্পীরা বিখ্যাত হয়ে যায়। মডেল নারীদের কেউ মনে রাখে না। যে সলতে হয়ে শিল্পীর শিল্পসত্তাকে জাগিয়ে তুলে পুড়ে মরল, তাঁদের খবর কেউ রাখি না। চিত্রশিল্পীরা চিত্র অঙ্কন করবেন, ভাস্কররা ভাস্কর্য নির্মাণ করবেন, সে তো ভালো কথা। শিল্প মনের বিকাশ ঘটায়, চেতনার মুক্তি দেয়। তার জন্য কেন নারীকে নগ্ন হতে হবে? কেন নারী-শরীরকে ব্যবহার করতে হবে? যে নারী শিল্পীর ক্যানভাসের নগ্ন হয়ে বসেন, সে কী সমাজে পরিবারে বলতে পারে, সে শিল্পীর সামনে শিল্পের জন্য নগ্ন হয়? না, বলতে পারে না। কারণ এই নগ্ন হওয়াটা সমাজ মহৎ হিসাবে দেখে না। গণিকারা যেভাবে বাড়িতে তাঁর কাজের ধরন লুকিয়ে রেখে গণিকাবৃত্তি চালিয়ে যায়, ঠিক তেমনিভাবেই মডেল নারীরা পরিবার ও সমাজকে তাঁর পেশা লুকিয়ে নগ্ন হতে আসে। সমাজ ও পরিবারে সেই নারী বলতে পারেন না যে, সে চিত্রশিল্পীর সামনে নগ্ন হয়ে রোজগার করেন। কারণ পেশাটি সমাজে নিষিদ্ধ। ন্যুড স্টাডির নামে নারীকে শুধু নগ্ন করা হয় তা তো নয়, অনেক ক্ষেত্রে শিল্পীর যৌনলালসার শিকার হন। কিন্তু এই মডেলরা কোনো স্বীকৃতি পায় না। আসলে ছলে-বলে-কৌশলে শিল্প মাধুর্যে নারীকে নগ্ন করে দেওয়াই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরোনো অভ্যাস। বলা হচ্ছে–The nude’ figure is mainly a tradition in Western art, and has been used to express ideals of male and female beauty and other human qualities. It was a central preoccupation of ancient Greek art, and after a semi-dormant period in the Middle Ages returned to a central position in Western art with the Renaissance. Athletes, dancers, and warriors are depicted to express human energy and life, and nudes in various poses may express basic or complex emotions such as pathos. In one sence, a nude is a nude is a work of fine are that has as its primary subject the unclothed human body, forming a subject genre of art, in the same way as landscapes and still life. Unclothed figures often also play a part in other types of art, portraiture, or the decorative art. While there is no single definition or fine art, there are certain generally accepted features of most definitions. In the fine arts, the subject is not merely copied from nature, but transformed by theb artist into an aesyhetic object, usually without significant utilitarian, commercial (advertision, illustration), or purely decorative purposes.
একটা গল্প বলি, গল্প নয় সত্য ঘটনা। আমার মেজো ভাইরা ভাই বিখ্যাত মডেল ফোটোগ্রাফার। তিনি তাঁর এক অভিজ্ঞতা আমার সঙ্গে শেয়ার করলেন। বললেন–“আমাকে একটা মডেল সেশনের জন্য মধ্যপ্রদেশ যেতে হয়েছিল কয়েকদিনের জন্য। খাজুরাহের মন্দিরকে বিষয় করে মডেল-নারীরা বিভিন্ন রকমের পোজ দেবেন। সেই ছবি তুলে ফোটোগ্রাফার হিসাবে আমাকে মডেল-নারীদের প্রোফাইল তৈরি করে দিতে হবে। সেই প্রোফাইলের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ভর করে ফোটোগ্রাফারদের উপর। সব মডেল-নারীই চাইবে তাঁর প্রোফাইলই শ্রেষ্ঠ হবে। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু চাইলেই তো শ্রেষ্ঠ হওয়া যায় না। তা নির্ভর করে একজন ফোটোগ্রাফার কতটা তাঁকে এক্সপোজ দেবে, কীভাবে দেখবে তার উপর। বিশেষ কোনো মডেল-নারীকে সে এক্সপোজ কেন দেবে? সেই প্রশ্নটাই বড়ো হয়ে দাঁড়ায়। অতএব ফোটোগ্রাফারকে বশে আনতে হবে। সেটা কীভাবে? মাঝরাতে হোটলে ফোটোগ্রাফারের ঘরের দরজায় কড়া নাড়তে হবে এবং শরীর নিবেদন করার সুযোগ নিতে হবে। সুযোগ নিতে পারলেই কেল্লা ফতে। এটাও মনে রাখতে হবে সব ফোটোগ্রাফারকে যেমন শরীর নিবেদন করে বশ করা যায় না, তেমনি সব মডেল-নারীও শ্রেষ্ঠ প্রোফাইলের জন্য শরীর বিক্রি করে না। তা সত্ত্বেও সমাজে মডেল-নারী ও মডেল-ফোটোগ্রাফারদের সুনজরে দেখা হয় না। ধরেই নেওয়া হয় মডেল-নারী ও মডেল ফোটোগ্রাফারের চরিত্রের ঠিক নেই। এঁরা এর সঙ্গে তাঁর সঙ্গে শোয়। মডেল ফোটোগ্রাফারের কাজ করি শুনলেই মেয়ের বাবারা তাঁদের মেয়ে দিতে চায় না এই কারণেই।”
নগ্ন আলোকচিত্রশিল্প বলতে নগ্ন বা অর্ধ-নগ্ন ব্যক্তির চিত্র ধারণকারী যে-কোনো ধরনের আলোকচিত্র বা নগ্নতার ইঙ্গিতপূর্ণ চিত্রসমূহ নির্দেশ করে। নগ্ন আলোকচিত্র বিভিন্ন উদ্দেশ্যে গ্রহণ করা হয়ে থাকে, যার মধ্যে শিক্ষাগত ব্যবহার, বাণিজ্যিক প্রয়োগ এবং শিল্পকর্মের উদ্দেশ্য নিহিত থাকে। সাধারণত ব্যক্তিগত ব্যবহার, নির্দিষ্ট বিষয় বা শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট সঙ্গীর উপভোগের উদ্দেশ্যেও নগ্ন আলোকচিত্র গ্রহণ করা হয়ে থাকে। প্রদর্শনী বা নগ্ন আলোকচিত্রের প্রকাশ বিভিন্ন সংস্কৃতি বা দেশে বিতর্কিত হতে পারে, বিশেষত যদি আলোকচিত্রের বিষয়টি অপ্রাপ্তবয়স্ক হয়ে থাকে। অধিকাংশ নগ্ন আলোকচিত্র সাধারণত নারী বিষয়ক বৈশিষ্ট্য সংবলিত হতে দেখা যায়।
নগ্ন আলোকচিত্র সাধারণত বৈজ্ঞানিক এবং শিক্ষাবিষয়ক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য গ্রহণ করা হয়ে থাকে, যেমন জাতিগত গবেষণা, মানবদেহতত্ত্ব বা যৌনশিক্ষা ইত্যাদি। এই প্রসঙ্গে আলোকচিত্র গ্রহণে এর বিষয় বা আলোকচিত্রটির সৌন্দর্য বা যৌনকামনা সৃষ্টির উপর জোর দেওয়া হয় না, বরং শিক্ষাগত বা প্রদর্শনমূলক উদ্দেশ্যে আলোকচিত্র তৈরি করা হয়।
Edouard-Henri Avril একজন ফরাসি চিত্রশিল্পী ছিলেন, যিনি তাঁর অঙ্কিত নগ্ন এবং যৌন উত্তেজক শিল্পকর্মের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি ‘পল আভ্রিল’ ছদ্মনামে ছবি প্রকাশ করতেন। তেওপিল গাউটিয়েরের (ফরাসি লেখক) লেখা উপন্যাস ‘ফরচুনিও’-তে ছবি আঁকতে গিয়ে তিনি সর্বপ্রথম ‘পল আভিল’ নাম গ্রহণ করেন। তাঁর আঁকা ছবি দেখে বহু লেখক তাদের গল্প বা উপন্যাসে নগ্ন ছবি আঁকার জন্য পলকে নিতেন। পল নগ্ন ছবি এঁকে রাতারাতি খ্যাতিমান হয়ে যান অল্প দিনের মধ্যেই। প্রায় প্রতিদিনই ফ্রান্সে তাঁর আঁকা ছবি সংবলিত বই বিক্রি হত এবং কমপক্ষে একশোটার নীচে বিক্রি হত না। তিনি নিজেও বহু ছবি এঁকে বেচেন এবং ভালো আয় করেন। শিল্পী নারীকে নগ্ন করেন সামান্য অর্থের বিনিময়ে। সেই চিত্র বিক্রি করে শিল্পী খ্যাতি লাভ করেন, প্রচুর অর্থ রাজগার করেন। আর যে নারী নগ্ন হয়ে শরীরী বিভঙ্গ বিক্রি করলেন, তাঁর প্রাপ্তি কতটুকু? সেই প্রশ্নটা থেকেই যায়।
নগ্ন শরীর প্রদর্শন করাও এক শ্রেণির নারীদের মধ্যে এক জনপ্রিয় পেশা। স্ট্রিপটিজ, অর্থাৎ পরনের কাপড় খোলা হচ্ছে মানুষের মধ্যে যৌন-উত্তেজনা জাগানোর জন্য এক প্রকারের আয়োজন, যেটাতে একজন সুন্দরী নারী একে একে তাঁর সব কাপড় খোলা শুরু করে ধীরে ধীরে এবং সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে যায় একটা সময়ে। এরূপ কর্মে নিয়োজিত নারীকে স্ট্রিপার বা ইক্সোটিক ড্যান্সার বলা হয়। এই ধরনের অনুষ্ঠান বা আয়োজন সাধারণত কোনো বিলাসবহুল পাঁচ তারকা হোটেল বা স্ট্রিপ ক্লাবে হয়। স্ট্রিপটিজের মূল উদ্দেশ্য মানুষের শরীর দেখিয়ে অন্য মানুষকে যৌন-উত্তেজনা দেওয়া, যৌনমিলন করতে দেওয়া নয়। অর্থাৎ যৌনমিলন না-করেও শরীর বিক্রির ব্যবসা। চিনে এক ধরনের সংগীত গোষ্ঠী আছে, সেই গোষ্ঠীর সব সদস্যরাই নারী। অর্থাৎ ভোকালিস্ট থেকে কনসার্ট শিল্পীরা। এঁরা তিনদিক ভোলা মঞ্চে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে হাজার হাজার দর্শকদের সামনে সংগীত পরিবেশন করে থাকে। শুধু চিন কেন, আমাদের ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে তিনদিক খোলা মঞ্চে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে হাজার হাজার দর্শকদের সামনে চটুল গানের সঙ্গে খ্যামটা নাচে। এমনকি খোলা মঞ্চে সব বয়সের হাজার হাজার দর্শকদের সামনে যৌনমিলনও করে থাকে। এই ধরনের যৌনব্যাবসা সবচেয়ে বেশি দেখতে পাওয়া দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে।
ঠিক কবে থেকে শিল্পীদের মধ্যে নারীকে নগ্ন করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল? ঠিকঠাক সাল-তারিখ জানা না গেলেও একথা বলাই যায় সমাজে পুরুষ আধিপত্য কায়েম হওয়ার পর থেকেই নারীকে নগ্ন করা শুরু হয়। প্রাচীন তৈলচিত্ৰতেও আমরা নগ্ন নারীদের দেখতে পাই। মুসলিম যুগেও নগ্ন নারীর তৈলচিত্র পাওয়া যায়। নারীকে নগ্ন করা হত তা নয়, নারীদের নগ্ন রাখা হত। ক্রীতদাসী ও হারেমে রক্ষিত নারীদের নগ্নভাবে থাকতে হত। তাঁদের যেমন খুশি ব্যবহার করা হত। নিজ শরীরের উপর নারীদের কোনো অধিকার ছিল না। ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দাপটে নিন্মবর্ণের নারীদের ঊধ্বাঙ্গ অনাবৃত রাখতে হত। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রে পুরুষরা নারীদের নগ্ন করতে নগ্ন দেখতে নানা অছিলায় লালায়িত। শরীরী বিভঙ্গের প্রশংসায় নারীও সজ্ঞানে-অজ্ঞানে পুরুষদের পাতা ফাঁদে নিজেদের পা গলিয়ে ফেলল। শরীরী-সৌন্দর্য প্রদর্শনে নারীরাও উদগ্রীব হয়ে উঠল।
সম্ভবত নগ্নচর্চা শুরু হয়েছে রাজাদের ইচ্ছাপূরণ ও মনোরঞ্জনের কারণে। অনুরূপ রাজাদের মনোরঞ্জনের শিল্পীরা চিত্র অঙ্কন করত, তেমনি নগ্ন তথা আদিরসাত্মক যৌনসাহিত্যও রচনা করত কবিরা। রাজারা নগ্নতা খুব পছন্দ করতেন। তাই রাজাদের খুশি করতে পারলে দামি উপটৌকন, সেইসঙ্গে সভাকবি বা রাজকবির পদ। চিত্রশিল্পীরাও পেতেন। সেকালে কবি-চিত্রশিল্পীরা রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি করতেন। হাতুড়ি-ছেনি-তুলিতে ফুটিয়ে তোলা হত নারীর নগ্নতা। অশ্লীলতার সমালোচনার ঝড় এড়াতে সুপরিকল্পিতভাবে শিল্পের নামে মাহাত্ম বা মহিমা জুড়ে দেওয়া হল। নগ্নতাই হয়ে উঠল ‘শিল্প’। নারীকে যত খুশি যেমন খুশি নগ্ন করো, সামনে বসাও, শোয়াও, দাঁড় করাও এবং সুযোগ পেলে ভোগ করো। বিনিময়ে সামান্য পারিশ্রমিক দাও। সামান্য রোজগারের আশায় মফঃস্বল থেকে নিন্মবিত্ত এমনকি মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে মেয়েরা আসছে নগ্ন হতে। বেশিরভাগ মেয়েরা দারিদ্রতার কারণে সংসারে অভাব মেটানোর তাগিদে গোপনে এই পেশা বেছে নিচ্ছে। নগ্ন নারীদের চিত্র-ভাস্কর্য খুব চড়া দামেই বিকোয়। শিল্পীরা ‘দ্যুড আর্ট’ যতই মাহাত্ম্য আরোপ করুক না কেন, সমাজে এইসব মেয়েরা কুলটা’ বলেই ঘৃণিত।
(৭) আকর্ষণীয় পেশা হিসাবে গণিকা : সব মেয়েরাই যে পাচারকৃত হয়ে বা প্রতারিত হয়ে গণিকা পেশায় নিযুক্ত হচ্ছেন এ কথা বলা যায় না। প্রচুর মেয়েরা এ পেশায় আসছেন স্ব-ইচ্ছায়, কায়িক পরিশ্রমহীন মোটা টাকা রোজগারের হাতছানিতে। অন্য রোজগার থাকা সত্ত্বেও অতিরিক্ত রোজগারের আশায় যেমন আসে, তেমনি অভাবি মেয়ে-বউরাও গণিকাপেশায় আসে। আর পাঁচটা স্বাভাবিক পেশার মতোই এই পেশাকেও গ্রহণ করে।
তবে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন এবং থাইল্যান্ড এই চারটি দেশে জরিপ তথ্য সাক্ষ্য দেয় যে, নিরক্ষর ও অদক্ষ মেয়েদের পক্ষে যেসব কাজ করা সম্ভব তার মধ্যে গণিকাবৃত্তিই সবচেয়ে বেশি অর্থাগম ঘটায়। উদাহরণস্বরূপ, মালয়েশিয়ার ম্যানুফাঁকচারিং কোম্পানিতে কাজ করে ১৯৯০ সালে একজন দক্ষ শ্রমিক বছরে উপার্জন করত ২৮৫২ মার্কিন ডলার এবং একজন অদক্ষ শ্রমিক উপার্জন করত ১৭১১ মার্কিন ডলার। বিপরীতে সেই সময়ের হিসাবে কোনো নিন্মমানের হোটেলে যৌন-পরিসেবা বা শরীর বিক্রি করে একজন মহিলা সপ্তাহে মাত্র একদিন বারো ঘণ্টা কাজ করে বছরে ২০৮০ মার্কিন ডলার উপার্জন করতে পারত। স্কুল কলেজের ছাত্রীরা এবং গৃহবধূরা আজকাল স্বেচ্ছায় এই পেশায় আসছেন প্রচুর পরিমাণে। বাড়তি চাহিদা মেটাতেও এই পেশায় আসছে কাঁচা পয়সার হাতছানিতে। এই ভারতে তথা এই বাংলায় খুব গোপনে প্রচুর অর্থ রোজগারের আশায় মেয়েরা আসছে। এখন যৌনমিলনে কন্ডোম বাধ্যতামূলক। কন্ডোম ছাড়া কোনো মেয়েই যৌনকর্ম করে না। এর ফলে যেমন মেয়েদের গর্ভবতী হওয়ার ভয় নেই, তেমনি যৌনরোগেরও ভয় নেই। ফলে উদ্যাম যৌনকর্মে কোনোরকম ভয় কাজ করছে না। কন্ডোমের ব্যবহারের ফলে যৌনরোগেরও ভয় থাকছে না। এইসব মেয়েরা অনেকেই শিক্ষিত। ফলে ক্লায়েন্টের কাছ থেকে ঘৃণা নয়, সমীহ আদায় করে নেয় অনেকক্ষেত্রেই। এঁরা ট্রিপিকাল গণিকাদের মতো সারাক্ষণ পান চিবোয় না। ক্লায়েন্টের অনুরোধ না-থাকলে পারতপক্ষে মদ্যপান করে না, ধূমপান করে না। এইসব ধোপদুরস্ত মেয়ে-বউদের কাছে যৌনকর্মে ক্লায়েন্টরা স্বস্তি পায়। যৌনরোগের আশঙ্কায় ভোগে না ক্লায়েন্টরাও। এই শ্রেণির গণিকাদের রেটও যথেষট চড়া। যৌনপল্লির মতো ঘুপচি সিঙ্গেল খাটে যৌনক্রিয়া নয়। রাতারাতি ধনী হওয়ার লোভেও অনেক মেয়ে-বউরা শাঁসালো পুরুষকে ক্লায়েন্ট হিসাবে বেছে নেয়। সমাজের আনাচে-কানাচে চলছে এহেন নিরন্তর যৌনকর্ম।
বছর কয়েক আগে সংবাদপত্রে একটি সংবাদ হয়তো সবাই পড়েছেন। যাঁরা পড়েননি, তাঁদের জন্য সংবাদটা উল্লেখ করলাম–ভারতের একটি শহর। থানায় এসে এক মহিলা সটান এসে বলল, “আমি বাজারের মেয়েছেলে নই। আমি যৌনকর্মী। এটাই আমার পেশা।” ডিউটি অফিসারের তো ভড়কে যাওয়ার দশা। মুম্বাইয়ের এক কলগার্ল উত্তরপ্রদেশের লখনউয়ে মহিলা থানায় অভিযোগ লেখাতে গিয়েছিলেন। শহরের কয়েকজন বিত্তবান ব্যক্তি এক পাঁচতারা হোটেলে এই মহিলার কাছ থেকে যৌন-পরিসেবা নিয়েছে। এরপর এই কলগার্লকে ন্যায্য পারিশ্রমিক তো দূরের কথা, উল্টে তাঁর কাছে থাকা প্রচুর পরিমাণে টাকাপয়সা ও অন্যান্য সামগ্রী যা ছিল, সব লুঠ করে ক্লায়েন্টরা পালিয়ে গেছে। মুখে তাঁর ইংরেজির ফুলঝুরি। মেয়েটিকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় পুলিশ আধিকারিকদের তো বিমূঢ় অবস্থা। নিজের পুরো কাহিনি শুনিয়ে বলল–“এই পেশা থেকে দুই কোটি টাকা আমাকে উপার্জন করতে হবে। সেই উপার্জনের অর্থে আমি একটা আধুনিক বিউটি পার্লার খুলব। এরপর এই পেশা ছেড়ে বিউটি পার্লার চালাব বাকি জীবন।” মেয়েটি পুলিশ আধিকারিককে জানায়, শরীরের জৌলুস ও বাঁধুনি ঠিক রাখতে একজন পেশাদার প্রশিক্ষকের কাছে তিনি যান। খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে তিনি খুব সচেতন। মাত্রাতিরিক্ত খাওয়ার ফলে শরীরে চর্বি জমে গেলে কদর থাকবে না। তাই সে ডায়াটিশিয়ানের পরামর্শ মেনে চলে। শুধু তাই নয়, তিনি প্রতি ছয় মাস অন্তর মেডিকেল চেক আপও করিয়ে নেয়।
গিয়েছিলাম বি কে পাল অ্যাভিনিউয়ের কাছাকাছি একটি ফ্ল্যাটে। আগে থেকেই কথা ছিল আমি যাব। ফোনেই সময়-দিন জানিয়েছিলাম। সে মোতাবেক একজন যুবক এসে আমাকে কোয়ার্টারের ভিতরে নিয়ে গেল। তিনতলায় গেলাম। আমাকে বলল, কেমন মেয়ে চান? বিবাহিত, না অবিবাহিত?
আমার পাঁচজন মেয়ে চাই একসঙ্গে–আমি বললাম।
–হয়ে যাবে। ডাকি মেয়েদের? পছন্দ করুন মেয়েদের।
–রেট বলুন।
–এক ঘণ্টার জন্য ২০০০ টাকা। নন-এসি। এসি হলে অতিরিক্ত ৬০০ টাকা। একবার শট। দু-ঘণ্টার জন্য নিলে ৩০০০ টাকা নন-এসি। এসি অতিরিক্ত ৬০০ টাকা। চারবার শট নিতে পারবেন। টাকা কাজ করার পর দেবেন।
–এক ঘণ্টা হলেই হবে। পছন্দ করার কিছু নেই। ডাকুন যে-কোনো পাঁচজন মেয়ে।
পাঁচজন নানা বয়সের মেয়ে এসে আমাকে একটি ঘরে নিয়ে গেল। ঘরে ঢুকিয়ে দরজায় ছিটকিনি তুলে একজন মেয়ে আমাকে বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করল–“মাত্র এক ঘণ্টার পাঁচজন মেয়ে দিয়ে কী করবেন?” মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলাম–কী নাম তোমার? নাম বলল–“কাজল”। আমি বললাম–“তোমরা সবাই খাটের উপর উপর গোল হয়ে বসো। আমিও বসছি।” খাটের উপর গোল হয়ে বসে প্রত্যেকে নিজের নিজের টি-শার্ট খোলার জন্য উদ্যত হতে দেখে আমি বললাম–“খোলার দরকার নেই। তোমাদের সঙ্গে গল্প করার জন্য এসেছি। অন্য কোনো কারণে নয়। গল্প করা যাবে?” একটি মেয়ে বলল–কত ঘণ্টার জন্য নিয়েছ আমাদের?
–এক ঘণ্টা।
এই এক ঘণ্টা তোমার। তোমার যা মনে হয় করতে পারো।
শুধু গল্প করব, সবার সঙ্গে। প্রথমে তোমাদের নামগুলো বলো।
আমি পায়েল।
–আমি রীতা।
–আমি তপতী
–আমি নূরজাহান।
–আর তুমি কাজল।—আমি বললাম।
–কী গল্প করবেন?
—ব্যক্তিগত। তোমাদের কাজকর্ম নিয়ে।
–বলুন, কী জানতে চান?
–তোমরা এই কাজে কীভাবে এলে? প্রতারণার শিকার হয়ে?
–না। মেয়েরা সমস্বরে বলল।
–তাই নাকি? তাহলে কীভাবে এই কাজ বেছে নিলে শুনি সেই গল্প।
–আমি এখানে আসার আগে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করতাম। বনগাঁ থেকে সল্টলেক আসতাম। করেছিলাম বেশ কয়েক বছর। একদিন কাজ শেষ হতে অনেকটা রাত হয়ে গেল। অফিস থেকে রাস্তায় বেরিয়েছি। হঠাৎ দেখি একটা গাড়ি এসে আমার সামনে দাঁড়াল। গাড়ির ভিতরে কোম্পানির মালিক। আমাকে উঠতে বলল। আমি বললাম–“প্রয়োজন নেই। আমি একাই যেতে পারব।” উনি নাছোড়। বাধ্য হয়েই গাড়িতে উঠে পড়তে হল। দশ মিনিটের রাস্তায় উনি বললেন–“চলো, একদিন দীঘা থেকে বেরিয়ে আসি তুমি আর আমি। খুব মজা হবে।” আমি বললাম–“তা কী করে হয়?” উনি বললেন–“কেন হবে না? তোমার কোনো খরচা নেই। সব খরচা আমার। এছাড়াও তোমাকে দশ হাজার টাকা দেব। ক্যাশ।” আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। উল্টোডাঙা স্টেশন এসে গেছে। আমি বললাম–“ব্যাস, এখানেই নামিয়ে দিন।” “কিছু বললে না”–উনি বললেন। আমি বললাম–“ভেবে দেখি। কাল জানিয়ে দেব।” না, কাল আর কাজে গেলাম না। আসলে কাজটাই ছেড়ে দিলাম। আর ভাবতে থাকলাম, উনি কেন আমাকে নিজের খরচে বেড়াতে নিয়ে যাবেন? কেনই-বা এমনি এমনি দশ হাজার টাকা দেবেন? নিশ্চয় এমনি এমনি নয়। আমাকে ভোগ করবে। দশ হাজার টাকায় আমাকে ভোগ করার মূল্য দিতে চায়। আমাকে ভোগ করতে দিলে কেউ দশ হাজার টাকা দেবে তাহলে? মন্দ নয় তো ব্যাপারটা! পাকাপাকিভাবেই তো এ কাজ করা যেতে পারে। রোজগার আর সেক্স দুটোই মিটবে। এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে আমি ডেলি প্যাসেঞ্জারি করতাম। তাঁকে বললাম–“এরকম একটা কাজ দেখে দাও না। খুব ইচ্ছা।” উনি বললেন–“আচ্ছা, ঠিক আছে।” কয়েকদিন বাদে উনি জানালেন, “কালকে চলে এসো, তোমাকে সেখানে নিয়ে গিয়ে আলাপ করিয়ে দেব।” আমি চলে এলাম এখানে। বাড়ির মালিক বলল–“তুমি নাবালিকা। তোমাকে কাজে নেওয়া যাবে না।” আমি বললাম–এই দেখুন আমার পেট। আমি দুই সন্তানের মা। আমার পেটে দাগ দেখুন। আমার বয়স তিরিশ।” মালিক বলল–“এসব কথা বোর্ডে বলবে। বোর্ডে বলতে পারবে তো? বোর্ডে পাশ করলে আমাদের কাজে নিতে কোনো অসুবিধা নেই।” বোর্ডে উঠলাম এবং পাশ করলাম। আজ প্রায় বছর খানেক হল এখানে কাজ করছি। সকাল সাতটার মধ্যে এখানে ঢুকি, আর রাত সাতটায় এখান থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফিরি। রোজ। তবে যেদিন হোল নাইট ক্লায়েন্ট আসে, সেদিন রাতে তো থাকতেই হয়।”–এ কাহিনি শোনাল কাজল।
–পায়েলের কথা বলল এবার। পায়েল, তোমারও কী এখানে আসার কাহিনি একরমই?
–একদম না।—ঘাড় ঝাঁকিয়ে পায়েল বলল।
–বলল, তোমার এখানে আসার গল্প।
–আমার স্বামী আছে। এক সন্তানও আছে। এই দেখুন ছেলের ছবি। ক্লাস সেভেনে পড়ে। ইংলিশ মিডিয়াম পড়ে। আমার স্বামীর যা রোজগার, তাতে আমার ছেলেকে ভালো স্কুলে পড়ানো সম্ভব নয়। আমাকেও কোনো কিছু করা দরকার। কিন্তু কী করব? কে কাজ দেবে? আমি তো কোনো কাজ জানি না। কাজ না-জানলে কায়িক পরিশ্রমের কাজ করতে হবে, যেখানে শরীরের শক্তি প্রয়োজন। রোজগারও তেমন হবে না। শরীরই যখন খাটাতে হবে, তবে শরীর খাঁটিয়ে অনেক বেশি রোজগার করা যায় তেমন পেশাই বাছতে হবে। চলে এলাম এখানে, শুরু করলাম কাজ। এ পেশায় টানা পাঁচ বছর। ডেলি কম করে ১০০০ টাকা রোজগার করা মোটেই কঠিন নয় এখানে। ধনী ক্লায়েন্টের কাছ থেকে বখশিস পাওয়া যায়। যদিও বকশিস ধনী-অধনী সবাই দেয় খুশি হয়ে।—এ হল পায়েলের এ পেশা বেছে নেওয়া কাহিনি।
–বেশ। রীতা, এবার তুমি বলো তোমার কথা।
–আমি ডিভোর্সি। এক বছর হল ডিভোর্স হয়েছে। স্বামী নপুংসক ছিল। ডিভোর্স তো হল, কিন্তু আমার বাকি জীবন চলবে কী করে? আবার বিয়ে করব? আবার বিয়ে মানে তো পুরুষ বদল। তিনি হবে দ্বিতীয় স্বামী। ডিভোর্সী মেয়ে মানে এঁটো মেয়ে। সে কী আমাকে ভালো চোখে দেখবে? মোহ ভেঙে দু-দিন বাদে সেও যদি আমাকে ছেড়ে দেয়? আমি কি তৃতীয় বিয়ে করব? তৃতীয়বার পুরুষ বদল? পুরুষ যদি বদল করতেই হয়, তবে এভাবে কেন? লাভ কী? বিগ জিরো। সিদ্ধান্ত নিলাম এ পেশায় আসব। এ পেশায় অর্থ যেমন আছে, তেমনি সক্ষম পুরুষের যৌনতা আছে, আছে প্রতিদিন নতুন নতুন পুরুষে সঙ্গ। চলে এলাম। কাজ শুরু দিলাম। বিন্দাস আছি। ব্যাংক ব্যালান্সও মন্দ নয়। অনেকেই আমাকে বিয়ের অফার দিয়েছে। আমি সেই প্রত্যাখ্যান করেছি। করার বিয়ের করার সঙ্গে সঙ্গে আমার আর্থিক স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলব। তা ছাড়া ওইসব পুরুষরা ভালোবেসে বিয়ের অফার দেয় না। অফার দেয় আমাদের ব্যাংক ব্যালান্স হাতানোর লোভে। আমাদের লাইনের বেশকিছু মেয়ে প্রতারিত হয়েছে সর্বস্ব খুঁইয়ে। আবার এখানেই ফিরে আসতে হয়েছে ‘সংসার’ হারিয়ে।
–না, তোমার ব্যাংক ব্যালান্স কত জানতে চাইব না। জানতে চাইব তপতীর কথা। তপতী কীভাবে এলেন?
–বিজ্ঞাপন দেখে। সাইট থেকে জানতে পারলাম যৌন-পরিসেবা দিয়ে প্রচুর রোজগার করা যায়। বিজ্ঞাপনে ফোন নম্বর দেখে যোগাযোগ করলাম। কাজ হয়ে গেল। আমি খুশি। রোজগারও বেশ ভালো। স্ব-ইচ্ছায় এসেছি, স্ব-ইচ্ছায় ছেড়ে চলে যাব।
–স্ব-ইচ্ছায় ছেড়ে যাওয়া যায়! আচ্ছা, এ ব্যাপারে পরে জানব। তার আগে নুরজাহান বলুক তাঁর কথা। কীভাবে এলে এই পেশায়?
–কোটিপতি না হলে কীসের বেঁচে থাকা! অনেক টাকায় মালিক হতে চেয়েছিলাম। এ পৃথিবীতে টাকাই সব। কলেজে পড়তে পড়তেই একদম স্বাধীনভাবে যৌনপেশা করতাম। তবে লুকিয়ে। একটা সাইট আছে এরকম। যাঁরা এ পেশায় আসতে চায় তাঁরা নিজেদের সম্বন্ধে বিস্তারিত জানিয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া যায়। সেই সঙ্গে প্রতি রাতে বা প্রতি ঘণ্টার কত পারিশ্রমিক নেব সেটাও জানাতে হয়। আমিও জানালাম। ক্লায়েন্ট পেতে থাকলাম। মোটা টাকা আসতে থাকল। কিন্তু ভয় পেয়ে বসল। নিজ দায়িত্বে কাজটি করতে হত। কোনো প্রোটেকশন নেই বিপদে পড়লে রক্ষা করার। কে কেমন জানতে পারি না। সন্দেহ নিয়ে কাজ করা মুশকিল। তখন ভাবলাম এখানে নাম লেখাই। নাম লেখালাম। মাথার উপর সবরকমের সার্পোট আছে। নিশ্চিন্তে কাজ করছি। রোজগারও বেশ ভালো। এ পেশায় কন্ডোম বাধ্যতামূলক। তাই যৌনরোগে আক্রান্ত হওয়ার ভয়টাও নেই।
–যদি কখনো মনে হয় এ কাজ আর করবে না, তখন ছেড়ে দিতে পারবে?
–ছাড়ব কেন? ছেড়ে রোজগার হারাব কেন? দু-হাতে টাকা ঘাটি এখন, পেশা ছেড়ে দিলে খুব খারাপ লাগবে। অতএব ছাড়ার কোনো প্রশ্নই নেই।—বলল কাজল।
–তর্কের খাতিরে যদি ভাবি পেশা ছেড়ে দেব, যখন খুশি ছেড়ে দিতে পারি। বাড়ির মালিককে বললে, সে একবারের জন্যেও যারণ করবে না। বাধা দেওয়ার কেউ নেই। আমরা স্বাধীন। কারও ক্রীতদাসী নই। মালিকের কাছে কিছু পাওনা বকেয়া থাকলে হিসাব বুঝে নিয়ে চলে যেতে পারি।—বলল নুরজাহান।
–রোজগার কীভাবে হয়? ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে যা পাও সব তোমাদের?
–তা কখনো হতে পারে? আমাদের সঙ্গে এই কাজের সঙ্গে আরও অনেকে যুক্ত নানাভাবে। তাঁরাও ওই টাকার অংশ পাবে। যে ছেলেটি তোমাকে উপরে নিয়ে এসেছে, সেও পায়। আমাদের রেট দু-ঘণ্টার ৩০০০ টাকা। ২০০ টাকা আমাদের। বাকিটা মালিকের কাছে থাকে। অন্যান্যদের পেমেন্ট করে। এই কোয়ার্টারে অসংখ্য মালিক আছে। সেই মালিকের অধীনে কারো দশজন, কারো পনেরজন, আবার কারো পঁচিশজন বা তারও বেশি আছে। মনে করো ক্লায়েন্ট এলো আমার মালিকের কাছে। মালিক তাঁর নিজের ঘরের মেয়েদের আগে দেখাবে। যদি মালিকের ঘর থেকে মেয়ে পছন্দ না-হয়, তখন অন্য মালিকের ঘর থেকে মেয়ে দেখানো হয়। অন্য মালিকের ঘরের মেয়ে যদি আমার মালিকের ক্লায়েন্ট পছন্দ করে, তখন মেয়েটি পাবে ২০০ টাকার পরিবর্তে ১০০ টাকা। বাকি ১০০ টাকা পাবে আমার মালিক। তবে ক্লায়েন্টের দেওয়া বকশিসের টাকায় মালিক ভাগ বসায় না।—রীতা বলল।
–তাহলে বলছ যে-কোনো মেয়ে চাইলে এই পেশায় আসতে পারে?
–ইন্ডিভিজুয়াল যে-কোনো মেয়েই এই পেশায় আসতে পারে। কিন্তু এখানে সবাই আসতে পারে না। মালিক সরাসরি কোনো মেয়েকে কাজে লাগাতে পারে না। কোনো মেয়ে যদি আসে তখন তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সংগঠনের কাছে। আমাদের সংগঠন দুর্বার কমিটি। সেখানে গেলে তাঁকে বোর্ডে বসতে হবে। সে কেন এ পেশায় আসতে চায়, কেউ বাধ্য করাচ্ছে কি না ইত্যাদি প্রশ্ন জানতে চায়। বয়সের প্রমাণপত্র চাওয়া হয়। প্রমাণপত্র না-থাকলে বা বয়স নিয়ে কমিটির সন্দেহ হলে বিশেষ পরীক্ষার মাধ্যমে সঠিক বয়স জেনে নেওয়া হয়। কোনো যৌনরোগ আছে কি না, সেটাও পরীক্ষা করে জেনে নেওয়া হয়। একটা সময়ান্তরে আমাদেরও নিয়ম করে মেডিকেল টেস্ট করতে হয়। সব পরীক্ষায় পাশ হলে তবেই কমিটি একজন মেয়েকে কাজ করার অনুমতি দেয়। কমিটিকে এড়িয়ে কোনো মালিক গোপনে কোনো মেয়েকে কাজ করাতে পারবে না।—বলল কাজল।
–খারাপ লাগে না এরকম পেশার যুক্ত থাকতে? লোকে বাঁকা চোখে দেখে, ভর্ৎসনা করে, ঘৃণাও করে। খারাপ লাগে না?
তপতী ঝাঁঝিয়ে জবাব দিল–“খারাপ লাগবে কেন? চুরি-ডাকাতি করছি কি? পরিশ্রম করি, রোজগার করি। শরীর আমাদের পুঁজি ঠিকই। শরীর খাঁটিয়ে আর পাঁচজনের মতো আমরাও রোজগার করি। এ পৃথিবীতে এমন কোনো পেশা আছে, যেখানে শরীরের প্রয়োজন হয় না। কেউ শরীরের হাত ব্যবহার করে রোজগার করে, কেউ শরীরের পা ব্যবহার করে রোজগার করে, কেউ শরীরের চোখ ব্যবহার করে রোজগার করে, কেউ শরীরের নাক ব্যবহার করে রোজগার করে, কেউ শরীরের জিভ ব্যবহার করে রোজগার করে, আর আমরা শরীরের যোনি ব্যবহার করে রোজগার করি। তফাৎ কোথায়? এইভাবে ভাবতে পারেন না কেন? আমরা সেভাবেই ভাবি। তাই খারাপ লাগে না। খারাপ লাগলে দিনের পর দিন এভাবে কাজ করতে পারতাম? পেশাকে তো জেনেই এসেছি। সবচেয়ে বড়ো কথা, আপনি যে পেশাতেই আসুন-না কেন স্বেচ্ছায় হোক বা বাধ্য হয়ে, সেই পেশাকে মন থেকে ভালোবাসতে না-পারলে আপনি কাজটি ঠিকঠাক করে উঠতে পারবেন না। শ্রমিক হিসাবেও আপনি ব্যর্থ।”
আর পাঁচটা ব্যবসার মতো শরীর বিক্রির ব্যবসারও এখন বেশ চাহিদা। শুধু শরীর কেন, অনেক মানুষকেই অনেক সময় অনেক অপছন্দের কাজ করতে হয়, বেঁচে-বর্তে থাকার জন্যে। এমএ পাশ বনগাঁর এক যুবককে জানি যিনি যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থান করতে না পেরে পাথরপ্রতিমায় গিয়ে রিক্সা চালাত। পাড়া-প্রতিবেশী কেউ সেটা জানত না। বাড়ি থেকে ভালো শু্যট-বুট পরে হাতে ব্যাগ নিয়ে বেরত। এরকম খুঁজলে প্রচুর যুবকদের পাওয়া যাবে। এমএ পাশ পিএইডি করা কোনো যুবক যদি ডোমের চাকরি পেয়ে যেত, সেটা কী কেউ জানতে পারত যে, সে ডোমের কাজ করে? আমার বাড়ির পাশে এক ভদ্রলোক রাইটার্স বিল্ডিংয়ে সুইপারের কাজ করত। কিন্তু সারাজীবন সে পেশা লুকিয়ে রেখেছে। লুকিয়ে রাখা পেশা অনেককেই করতে হয়। আজকাল ছেলেরাও গোপনে যৌনপেশার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। এদের পুরুষ যৌনকর্মী বা জিগোলো বলে। এ বিষয়ে পরে বিস্তারিত আলোচনা করব।
শরীর বিক্রির ব্যাবসা যে বিনাপুঁজির লাভজনক ব্যাবসা, সেটা এই ভোগবাদী রাষ্ট্রনাগরিকরা বিলক্ষণ বুঝে গেছে। দেহোপজীবিনীরাও বুঝে গেছে একাধারে সীমাহীন যৌনসুখ ও অর্থসুখ দুইই ভোগ করা সম্ভব এই গণিকাবৃত্তিতে। বস্তুত যেসব মেয়েরা গণিকাবৃত্তি গ্রহণ করেন, তাঁরা কোনো না-কোনো ভাবে এই বৃত্তিতে আসছে বাধ্য হয়, এ ধারণা সবক্ষেক্ষেই সত্য নয়। মেয়েরা যে বাধ্য হয়েই গণিকাবৃত্তিতে আসে, তা প্রমাণ হয় কীসে? এ পেশায় বাধ্য এসেছে এ বয়ান কার? যিনি গণিকা তাঁর। গণিকা যে সত্য বলছেন না মিথ্যা বলছেন, তা সহসা প্রমাণ করা যায় না। কারণ যিনি বাদী, তিনিই বিবাদী, তিনিই সাক্ষী। গোপনে যৌনকর্ম করতে গিয়ে কত ‘ভদ্রঘরের’ (‘ভদ্রঘরের মহিলা’ বলতে যাঁর পিঠে গণিকার স্ট্যাম্প পড়েনি) মহিলাদের বলতে শুনেছি ‘পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে এ লাইনে এসেছি’। যৌনকর্ম করতে গিয়ে ধরা পড়ার পর সব মেয়েদেরই এই একটাই গৎ—‘পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে এ লাইনে এসেছি’। এতে চরম সহানুভূতি মেলে। যৌনকর্ম আদিরস থেকে করুণ রসে ভেসে যেতে থাকে। পশ্চাৎপটে প্যাথোজ বাজতে থাকে। পেটের দায়’ ব্যাপারটা কেমন যেন অভাব অভাব দারিদ্র্য দারিদ্র্য ভাব। বস্তুত আমরা সকল কর্মজীবীরাই পেটে দায়ে কর্মযজ্ঞে আসি। পরের সেবা করি অর্থের বিনিময়ে। নিজেদের উৎকৃষ্ট পণ্য করে তোলার চেষ্টা করি। পেট আমাদের সকলের আছে। পেট আছে, তাই ক্ষুধাও আছে। পেট না থাকলে কেউ কোনো কর্ম করত না। তা সে যৌনকর্মই হোক কিংবা ক্ষৌরকর্ম। একটু ভাবুন, শরীর আমরা সবাই বেচি। সব পেশাতেই শরীর বেচতে হয়। যতক্ষণ শরীর, ততক্ষণ পেশা। অবশ্য রোজগারের জন্য কেউ কেউ বুদ্ধিও বেচে। অতএব বলা যায়, পেটের দায়’ কথাটা অত্যন্ত নিন্মমানের অজুহাত।
দারিদ্র্যতা থেকে অভাব, অভাব থেকেই যদি মেয়েরা গণিকাবৃত্তি বেছে নেয়, সেটা কতটা বাস্তবানুগ? চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, রাহাজানি সবই কি অভাবের তাড়নায়? খেটে খেতে চাইলে কি এ পৃথিবীতে কাজের অভাব? তাহলে গণিকাবৃত্তি বা যৌনপেশায় কেন? অভাব, না স্বভাব? প্রতিটি যৌন-সক্ষম সুস্থ মানুষ জিনগতভাবে বহুগামী। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। বহুগামিতা পুরুষের একচেটিয়া নয়। নারী-পুরুষ সমান আগ্রহী। সামাজিক কারণেই বেশিরভাগ মানুষ সেটা নিয়ন্ত্রণ করে, আবার পাপ বা অপরাধবোধ থেকেও ও-পথে পা বাড়াতে সাহস পায় না। সামাজিক জীবনযাপনের তোয়াক্কা না করে অনেকেই আবার ‘নিষিদ্ধ’ কাজে এসে পড়ে। এরা বেশ সাহসী মানসিকতার হয়। সমাজকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাতে হলে সাহসী তো হতেই হয়।
দারিদ্রতা বা অভাবই যদি মেয়েদের যৌনপেশায় আসার একমাত্র কারণ হত, ভারত তথা গোটা পৃথিবীতে যে বিপুল সংখ্যক দারীদ্রসীমার নীচে থাকা মেয়ে-বউ, তাঁরা সকলেই গণিকাবৃত্তিকেই বেছে নিত। বাস্তবিকই তা হয় না। তাহলে অসংখ্য দরিদ্র মহিলারা কলে-কারখানায়, মাঠে-ময়দানে, খনিতে-নদীতে সেলাই-ফোঁড়াই করে, ঠোঙা বেঁধে, বিড়ি বেঁধে সর্বত্র হাড়খাটুনি পরিশ্রম করে জীবনধারণ করত না। সীমাবদ্ধ রোজগারে জীবনধারণ করত না। এমনকি চরম দারিদ্রতায় আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়, তবুও যৌনপেশায় আসে না। কোটি কোটি মহিলা দারিদ্র্যের যন্ত্রণায় ছটফট করে মরলেও তাঁরা যৌনপেশায় আসে না। প্রচুর অর্থলোভ ও সীমাহীন যৌনতার আনন্দ নিতেই বহুবল্লভা হয় এক শ্রেণির মহিলা। উপ জনজাতিদের মধ্যে অর্থনৈতিক অবস্থা দারিদ্র্যসীমার একেবারেই নীচে। পিঁপড়ে ডিম, ঝলসানো ছুঁচো, গাছের কন্দ ইত্যাদি খেয়ে যাঁদের জীবনধারণ করতে হয়, সেই আদিবাসীরা কখনো যৌনপেশায় এসেছে বলে শুনিনি।
মানুন বা না-মানুন, বিভিন্ন স্তরের বিভিন্ন যৌনকর্মীদের পর্যবেক্ষণ করে, যে চিত্র উঠে আসে, তা হল চটজলদি মোটা অঙ্ক রোজগারের হাতছানিতে এই পেশা বেছে নেয়। লঙ আইল্যান্ড ও ওয়েস্টার থেকে গৃহবধূ হাতেগরম রোজগারের জন্য ১৯৭৩ সালে নিউইয়র্কে পেশাদার গণিকাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামে। এঁরা কারোরই আর্থিক অবস্থা খারাপ ছিল না। ভারতেও বহু মধ্যবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত মহিলাদের মধ্য থেকেও অনেকে যৌনপেশায় আসে। প্রোফাইল যেমন ‘হাই’ হবে, সেই মহিলাকে বিছানায় পেতেও তেমন ‘হাই’ মূল্য গুণতে হবে। সিরিয়াল করতে করতে, সিনেমা করতে করতেও অনেক অভিনেত্রী যৌনপেশা চালিয়ে যায়। ধনবান ক্লায়েন্টরা সিনেমা-সিরিয়ালের মহিলাদের ও মডেল-কন্যাদের সঙ্গ পেতে চড়া মূল্য পর্যন্ত দিতে রাজি থাকে। অনেক কম পরিশ্রমে, অনেক কম সময়ে এককালীন নগদ মোটা অঙ্কের রোজগারের হাতছানি এড়ানো অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। একটা সময়ে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অর্থনেশা ও যৌননেশা উভয়ই। ধনীর দুলালি থেকে শুরু করে ধনী গৃহবধূ, আইপিএস অফিসারের স্ত্রী থেকে কর্নেলের স্ত্রী, স্বামী পরিত্যক্তা ও স্বামীহারা বিধবা বা বিবাহবিচ্ছিন্না মহিলা সহ সমাজের উঁচুতলার মহিলাদেরও এই পেশায় দেখা যায়। এঁরা গণিকাপল্লিতে ঘর নিয়ে কারবার নিশ্চয় করে না। কলগার্ল হিসাবে কাজ করে লোকচক্ষুর আড়ালে। কলগার্লের ফোন নম্বর রাখা থাকে হোটেল বা রিসোর্ট বা অন্য কোনো মধ্যস্থতাকারীর কাছে। কাস্টমারের চাহিদা অনুযায়ী ফোন করলেই সময়মতো চলে আসে কলগার্লেরা। এঁরা বেশিরভাগ অবদমিত যৌনতাড়নায় আসে এবং অবশ্যই মোটা টাকারও দাবি করে। সানি লিওন যৌনপেশায় এসেছিল অভাবের তাড়নায় নয়, এসেছিল শখে। একথা সানি লিওন নিজেই বলেছে এক সাক্ষাৎকারে। দেশের আর্থিক উন্নতি যত হচ্ছে যৌনকর্মীর সংখ্যা তত বাড়ছে। তার কারণ ভোগবাদী সমাজ বিস্তার লাভ করছে। আগে নির্দিষ্ট এলাকায় যৌনকর্মীদের দেখা মিলত, আজকাল শহরে-গ্রামে লোক সমাগম হয় এমন জায়গাতেও যৌনকর্মীদের দেখতে পাবেন। সম্ভ্রান্ত এলাকায় সম্ভ্রান্ত মহিলাদেরও যৌন-পরিসেবা দিতে দেখা যাচ্ছে। যথাযথ পয়সা ফেললে ‘অ-গণিকা’ কলেজ পড়ুয়া থেকে ঘরোয়া বধূদের পেতে পারেন কয়েক ঘণ্টার জন্য শয্যাসঙ্গিনী হিসাবে।
এই আদি পেশাটি বর্তমান সময়ে কোনো পল্লিতে বা কোনো মহল্লায় বা কোনো রেড লাইট এলাকায় আটকে নেই। গণিকাঁচর্চা এখন ভুবনজুড়েই। ২৪ ঘণ্টাই। ৩৬৫ দিনই। প্রযুক্তি খুলে দিয়েছে নতুন নতুন জানালা ও দরজা। যে খুশি সেখানে আসতে পারে, যেতেও পারে। ক্লায়েন্ট হিসাবে আপনাকেও কোনো গণিকাপল্লিতে মুখ লুকিয়ে ঢুকতে হবে না। সেক্স অ্যাডভেঞ্চার পাওয়ার জন্য গুগলে গিয়ে সার্চ করলেই হল। যৌনসঙ্গী আর যৌনসঙ্গিনীর বিশাল বাজার খুলে যাবে আপনার চোখের সামনে। অসংখ্য সাইট আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছে ১০০% সুরক্ষা নিয়ে। আড়ালে-আবডালে অন্ধকারের অন্ধগলিতে এক চিলতে ঘরের দেড় হাত চওড়া সিঙ্গেল চৌকি নয়, ঝাঁ চকচকে বেডরুমে। যৌনবাজার এখন খোলা বাজার। এখান থেকেই পাওয়া যায় নিরাপদ কোনো নির্জন নিরাপদ ফ্ল্যাটের ঠিকানা।
আসুন, একটু অন্তর্জাল যৌনবাজার ঘুরে দেখে আসি। তার আগে কিছু প্রাসঙ্গিক কথা সেরে নেব। আমেরিকার যৌনকর্মীরা চিন্তিত অনলাইন গণিকাবৃত্তির অধিকার খর্ব করা নিয়ে একটি নতুন আইন। এই আইনবলে আমেরিকার অনলাইন দেহব্যাবসার সাইটগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এমতাবস্থায় নামজাদা গণিকা জনৈকা মলি স্মিথ তাঁর মতামত জানিয়ে বললেন –”শরীর নিয়ে ব্যাবসায়িক চুক্তি অনলাইনেই হলে গণিকাদের আর রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হয় না। তাতে তাঁদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় না, বিশেষ করে নতুনদের। তা ছাড়া গণিকারা প্রকাশ্যে এলে পুলিশ কর্তৃক ধরা পড়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। সরকার ভাত মারছেন আমাদের। যৌনপেশাকে ক্রিমিনালাইজ করলে তা কখনোই বন্ধ করা সম্ভব নয়। কোনো না-কোনোভাবে টিকে থাকবেই। অথচ তার খেসারত গুণতে থাকে এই পেশার সঙ্গে জড়িতরা।”
একেবারে শুরুর দিকে এই ধরনের ব্যাবসার সাইটগুলি কিছু দেশে বন্ধ করে দেওয়ার হিড়িক পড়লেও কিছু বাদে সাইটগুলি রমরমাভাবে চালু আছে সারা বিশ্বে। আইনগতভাবে আর বন্ধ করতে পারছে না। কারণ ওইসব দেহব্যাবসার সাইটগুলিতে দেহব্যাবসার নামগন্ধ পর্যন্ত থাকে না। সরাসরি দেহবিক্রির কোনোরূপ ঘোষণা থাকে না। মেসেজ পার্লারের পরিসেবা দেওয়ার ঘোষণা থাকে মাত্র। মেসেজ শরীর ও মন চর্চার অংশ। তাই মেসেজ পার্লার নিষিদ্ধ নয় কোনো দেশেই। এই মেসেজ পার্লারের বিজ্ঞাপন দেখে যাঁরা খাদ্য খোঁজার তাঁরা খুঁজে নেয়। নির্দিষ্ট সান্ধ্যভাষা, চিহ্ন, ছবি বা কিছু নমুনা দেখে ক্ষুধার্ত ক্লায়েন্ট বুঝে নেয়। অভিজ্ঞদের কোনোরূপ বেগ পেতে হয় না। তবে আজকাল অবশ্য সাইটের গণিকারা সরাসরিই উল্লেখ করে দেয় তাঁরা কোন্ ধরনের যৌন পরিসেবায় কত মূল্যে নেবেন।
শিকাগোর লোয়োলা ইউনিভার্সিটি এবং মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির মেরি ফিন, অ্যান্ট্রি হিনিয়ন প্রমুখ ক্রিমিনোলজিস্টরা এই ধরনের অনলাইন গণিকাবৃত্তির উপর একটি সমীক্ষা চালিয়ে হাতে যে তথ্য আসে, তা হল–মোট ৭১ জন গণিকা-মধ্যস্থতাকারী (Pimp) জানিয়েছেন তাঁরা নতুন টেকনোলজি অর্থাৎ অনলাইনেই বেশি আগ্রহী। অনলাইনের গণিকাদের রোজগার গড় ৭৫ হাজার ডলারের (বার্ষিক) কাছাকাছি। বর্তমানে আমেরিকার ৮০% যৌনপেশা অনলাইনের মাধ্যমেই হয়। কম-বেশি সব দেশেই এখন অনলাইন যৌনব্যাবসা বেছে নিয়েছে। শুধু অনলাইনে সাইটের মাধ্যমেই নয়, ফেসবুক, ইন্সট্রাগ্রাম ইত্যাদি সোস্যাল মিডিয়াকেও ব্যাপকভাবে যৌনপেশা প্রসারে ব্যবহার করা হচ্ছে। সমকামী থেকে বিষমকামী সকলেই সোস্যাল মিডিয়ায় ভিড় করছে। ফ্রান্সে তো যৌনব্যাবসার মূল মাধ্যমই টিল্ডার আর ফেসবুক। ইজরায়েলেও টিন্ডার নির্ভর যৌনব্যাবসা ফুলেফেঁপে উঠেছে। জাম্বিয়াতে আবার হোয়াটস অ্যাপ ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে, ফেসবুকও পিছিয়ে নেই। কলকাতায় বহুদিন হোয়াটস অ্যাপ যৌনব্যাবসা চালু আছে। নির্দিষ্ট নম্বরে হোয়াটস অ্যাপ নক করলেই একগুচ্ছ মেয়েদের ছবি চলে আসবে কাছে। তারপর নির্দিষ্ট ফ্ল্যাটে। চিন, জাপানের মতো দেশে যতই কড়া বিধিনিষেধ থাকুক না-কেন, বা জার্মানের মত উদারপন্থী দেশেও একই অবতার। সবসময়ই যে মধ্যস্থতাকারী যৌনকর্মীদের জন্য ক্লায়েন্ট সংগ্রহ করেন, তা কিন্তু নয়। অনেকক্ষেত্রেই গণিকারা মধ্যস্থতাকারীদের সযত্নে এড়িয়ে নিজেরাই ক্লায়েন্ট সংগ্রহ করে নিচ্ছে। যিনি যৌনতা বা শরীর বিক্রি করতে ইচ্ছুক, তিনি নিজেই সরাসরি বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বা নিষিদ্ধপল্লিতে অবস্থান করে যৌনবৃত্তি করার দিন শেষ হতে চলেছে। হাতের মুঠোয় অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল থাকলে হাতের মুঠোয় ক্লায়েন্ট পৌঁছে যাচ্ছে। এই ব্যবস্থায় মধ্যস্থতাকারীরা বা দালালরা অনুপস্থিত থাকায় ক্লায়েন্টদের থেকে প্রাপ্য পুরো পারিশ্রমিকটাই গণিকাদের। গণিকারা বাঁদরের ভাগ করা পিঠে খেতে চায় না। নিজের পিঠে নিজে বানাবে, নিজেই খাবে।
মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি অধ্যাপক মেরি ফিনের মতে–সব মেয়েদেরই যে বলপ্রয়োগ করে যৌনপেশায় আনা হয়, তা কিন্তু মোটেই নয়। যেসব মেয়েদের শিক্ষাগত বা কারিগরি দক্ষতা নেই অথচ সহজেই রোজগারের প্রয়োজন, তাঁদের ক্ষেত্রে যৌনপেশার বিকল্প নেই। অদক্ষ শ্রমিকদের জন্য তেমন রোজগার নেই। যদি থাকত, তাহলে হয়তো এই পেশায় অনেকেই আসত না।
আসুন, আমরা জেনে নিতে পারি অনলাইন এসকর্ট সার্ভিস সংস্থাগুলি কী বলছে সম্ভাব্য ক্লায়েন্টদের টানতে। কলকাতায় এক এসকর্টের কর্ণধার অঞ্জলি খান্না বলছে, তাঁদের প্রতিষ্ঠান বাঙালি কল গার্লস এবং হাই প্রোফাইল এসকর্ট অফার করে। তাঁদের সদর্প ঘোষণা–“কলকাতায় অনেক এসকর্ট এজেন্সি রয়েছে। কিন্তু যখন আসল এবং সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য প্রতিষ্ঠানে প্রশ্ন ওঠে, তখন কেউই আমাদের সঙ্গে কেউ টক্কর দিতে পারে না। আমরাই শীর্ষ মহিলা এসকর্ট, যাঁরা কলকাতায় বাঙালি কল গার্লদের পরিসেবা প্রদানকারী। আপনি যদি আমাদের মহিলা এসকর্ট পরিসেবাটি পছন্দ করেন, তবে অবশ্যই আপনার সিদ্ধান্তটি সঠিক। অঞ্জলি খান্না ২০১০ সাল থেকে কলকাতায় নিজস্ব এসকর্ট এজেন্সি চালাচ্ছেন এবং কল গার্ল পরিসেবা এবং ক্লায়েন্টদের জন্য এসকর্ট পরিসেবা সরবরাহ করেন। কলকাতায় এসকর্ট ভাড়া দেওয়ার জন্য আমাদের শর্টস অফ শর্টস কেবলমাত্র সমস্ত ভিআইপি হোটেল ইনকল বা আউটকল এসকর্ট পরিসেবা সরবরাহ করুন। আপনি যদি ইতিমধ্যে কলকাতায় যে-কোনো হোটেলে থাকেন এবং আউটকল পরিসেবা চান, তবে অবশ্যই আপনার হোটেল থেকে আলাদা হওয়া উচিত। তাঁদের বর্ডারদের কোনো মহিলা সাহচর্যে থাকার অনুমতি আছে কি না। আমাদের মহিলা এসকর্টগুলি আপনার জন্য ২৪/৭ লভ্য। আপনি যদি আমাদের কলকাতা কল গার্লদের ভাড়া করেন, তবে আপনার সর্বোচ্চ শারীরিক তৃপ্তির নিশ্চয়তা রয়েছে।
ক্লায়েন্টদের এসকর্ট পরিসেবাগুলি সরবরাহ করার জন্য আমাদের কলকাতায় বিভিন্ন ধরনের কল গার্ল আছে। আমরা বুঝতে পারি আমাদের ক্লায়েন্টদের কী দরকার। এসকর্ট ম্যানেজার এমন একটি মেয়েকে উপস্থাপন করে, যা আমাদের ক্লায়েন্টের প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে মেলে। আরও ভালো অভিজ্ঞতার জন্য আপনি আমাদের বাঙালি কল গার্লদের ব্যবহার করে দেখতে পারেন। কলকাতায় আমাদের ভিআইপি এসকর্ট কখনও এসকর্ট পরিসেবার মানের সঙ্গে কোনো আপস করেন না। কারণ আমরা আমাদের ক্লায়েন্টদের সঙ্গে দৃঢ় এবং দীর্ঘ সম্পর্ক স্থাপনে বিশ্বাস করি। একটি আকর্ষণীয় এবং আশ্চর্য প্যাকেজ বোনাস পেতে এখনই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করুন। আমাদের কলকাতায় কলেজ কল গার্লস, গৃহবধূ এসকর্টস, রাশিয়ান এসকর্টের মতো বিস্তৃত পরিসরে মেয়ে এবং মহিলা এসকর্ট আছে। আমাদের সমস্ত এসকর্ট মেয়েরা সুন্দর এবং সেক্সি। তাঁরা কীভাবে উদ্বেগ বজায় রাখতে, গোপনীয়তা রক্ষা করতে এবং পরিস্থিতি পরিচালনা করতে হয় জানে। আমরা আমাদের এসকর্ট পরিসেবার জন্য সম্পূর্ণ সুরক্ষা এবং সাবধানতা গ্রহণ করি এবং গর্ভাবস্থা এড়াতে উচ্চমানের কন্ডোম এবং গর্ভনিরোধক বড়ি সরবরাহ করি। আপনার নিজের পছন্দমতো আমাদের এসকর্ট মেয়েদের আসল ছবি পেতে আপনি এখনই কল করতে পারেন বা হোয়াটসঅ্যাপ করতে পারেন এবং আমরা আপনার জন্য সমস্ত কিছু ব্যবস্থা করব। যদি আনন্দ করতে চান, তবে অবশ্যই আপনাকে কলকাতায় হাই প্রোফাইল এসকর্টের সঙ্গে দেখা করতে হবে। কলকাতায় নির্দিষ্ট কিছু জায়গা রয়েছে যেখানে সমস্ত বিলাসবহুল হোটেল এবং রেস্তোঁরা রয়েছে। আপনি দক্ষিণ কলকাতা বা উত্তরে থাকতে পারেন। আনন্দের এই শহরে বেশ কয়েকটি নামী হোটেল আছে, আপনি যদি দুর্গাপুজো বা ব্যাবসায়িক উদ্দেশ্যে কলকাতায় বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন, তবে একা একা আসুন। একটি হোস্ট হিসাবে আমরা আপনাকে একটি বাঙালি মেয়ে উপহার দেব, তিনি আপনাকে কিছু অবিস্মরণীয় স্মৃতি সরবরাহ করবেন। সতেজ মনের জন্য আপনার অভ্যন্তরীণ বাসনা পূর্ণ করুন। আমাদের সঙ্গে বেশ কয়েকজন বাঙালি কল গার্ল কাজ করছে। বাঙালি মেয়েরা মিষ্টি এবং সেক্সি পাশাপাশি। তাঁরা সুশিক্ষিত এবং তাঁদের একটি ভালো রক্ষণাবেক্ষণযোগ্য ব্যক্তিত্ব আছে। তারা বাংলা হিন্দি বা ইংরেজির যে-কোনো ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে। সুতরাং, আপনি যদি ব্যবসায়ের মালিক হন এবং আপনার সংস্থার জন্য একটি মিষ্টি এবং সেক্সি মেয়ে খুঁজছেন, কেবল আমাদের এখনই কল করুন! আপনার হোটেলে স্বাধীন ও সুন্দরীর সঙ্গে উপভোগ করুন।
একবার যদি আপনি কলকাতায় বাঙালি কল গার্লস পরিসেবাগুলি বেছে নেন, তাহলে আপনি যার যার তাঁদের পছন্দ করবেন। কলকাতা তার খাবার এবং সংস্কৃতির জন্য বিখ্যাত। স্থানীয় মেয়েকে ভাড়া দেওয়ার আরেকটি সুবিধা হ’ল, তিনি আপনাকে কলকাতা শহরটি অনায়াসে আবিষ্কার করতে সহায়তা করবেন। আপনি প্রতি মুহূর্তে তার সাথে নিজেকে উপভোগ করবেন। একটি রেস্তোঁরা বা সুইমিং পুল বা কিছু অন্যে কিছু গুণমানের সময় ব্যয় করুন। আনন্দ সহ সুখী একজন এসকর্ট মেয়েদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক তৈরি করুন। আপনার জীবন থেকে সমস্ত যন্ত্রণা ভুলে যান এবং কিছু মুহূর্ত উপভোগ করুন। কিছু মুহূর্ত যা অবিস্মরণীয় এবং যা আপনি কখনোই ভুলে যাবেন না। সর্বদা মনে রাখবেন, আমরা সবাই অর্থের জন্য কাজ করছি। আপনার যদি টাকা না থাকে তবে আপনি কোনো কিছু উপভোগ করতে পারছেন না। কারণ অর্থ যে-কোনো কিছু কিনতে পারে! হ্যাঁ, এটা সত্য, আপনি যদি প্রতিশ্রুতি ছাড়াই কোনো সম্পর্ক উপভোগ করতে চান, তবে আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক করুন। আমরা আপনাকে বাঙালি কল গার্লস সরবরাহ করব, যাঁরা আপনাকে নিঃশর্ত ভালোবাসা এবং যত্ন দেবে, যা আপনি কোনো গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থেকেও পেতে পারেন না। কলকাতায় এখন সেরা এসকর্ট এজেন্সি ভাড়া। তিনি কখনো কোনো উপহারের দাবি করবে না এবং আপনার কাছ থেকে কখনো কোনো প্রত্যাশা করবেন না। এসকর্টগুলি উচ্চ প্রশিক্ষিত এবং তারা কীভাবে আপনাকে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করাবে, তা তারা জানে। তিনি আপনার পুরো অন্তঃকরণের কথা শুনবেন এবং আপনাকে আনন্দিত করবেন। আপনি যখনই যা বলেছেন সে শুনবে।”
এ তো গেল প্রতিষ্ঠানগুলির সোচ্চার ঘোষণা। এবার আসি ব্যক্তিগত (Individual) ঘোষণায়। পাঠকরা এতক্ষণে হয়তো উশখুশ করছেন যে, অনলাইনের গণিকাদের বিজ্ঞাপনগুলি ঠিক কেমন। কেমন সেই বিজ্ঞাপনের ভাষা ও বয়ান? আগ্রহী পাঠকদের জন্য কয়েকটি বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করেছি। তবে ফোন নম্বরগুলি বিকৃত করা হল সংগত কারণেই।
বিজ্ঞাপন—১
Pooja Jain Beautiful Independent Call Girl
Hello Guys, I am Pooja Jain, a beautiful air hostess. I’ve been dating several individuals on a regular basis and having endless pleasure with them. It simply makes me feel great. The dating experience that I get with the mature guys is simply astonishing. To enjoy some astonishing moments with the paid professionals, I get in touch with them. The reliable call girl services in Park Street that I provide are simply astonishing. I ensure to put a big smile on the face of my lovers and make them feel better than ever. Simply get in touch with me, if you want to get some astonishing experiences. I have maintained my curvy figure (36-26-34) by doing all types of workouts and eating a healthy diet. It simply makes me feel better than ever.
I feel like providing social services to my clients. If you think that I can serve you well, ensure to hire me once. I would be happy to assist you by doing all types of lovemaking positions in bed. I have expertise in dealing with men having diverse physical abilities. Being a beautiful Kolkata escort, I ensure to do all types of naughty activities to make my clients feel better than ever.
Personal Details :
Age: 22
Location: Kolkata
Fig: 34-26-32
Hair and Eye: Black
Height: 5’3”
Body Weight: 58 Kgs
Language: English, Hindi
Occupation: (Housewife)
Hobbies: Music and Dancing
বিজ্ঞাপন—২
Radhika Arora Young College Girl for Ultimate Romance
Thank for viewing my profile. I am grateful to see you here. I am a beautiful Radhika Arora, a college girl. I always want to have endless pleasure with hot and sensational females and cherish my mood with them. It simply gives me erotic experiences to cherish my love life. I have become a call girl because I have extreme sensuous needs. I want to have endless pleasure in my life and enjoy a lavish lifestyle. It gives me immense pleasure to serve as one of the demanding Kolkata escorts. My lovers just want to have endless pleasure with me. To fulfill the extreme physical needs of individuals, I ensure to do stunning activities with them. Dating hot and sensational females is something that could be erotic for you to cherish unique memories.
I just enjoy providing my call girl services. I maintain my figure in an appropriate manner and fulfill the sensuous desires of my clients. I feel like doing a great work by putting a smile on the face of tensed and depressed men. Lovemaking experiences that I get with different individuals have always given me confidence. I feel like a strong lady with high intention to have fun with different individuals.
Personal Details :
Age: 22
Location: Kolkata
Fig: 34-26-32
Hair and Eyes: Black
Height: 5’3”
Body Weight: 58 Kgs
Language: English, Hindi
Occupation: (Housewife)
Hobbies: Music and Dancing
বিজ্ঞাপন—৩
Sonalika Hot Charming Call Girl Perfect for Delightful Experience
Being an incredibly hot adult entertainer, I offer the stunning physical services to my lovers and make them feel delightful. The hotness of my body arouses the intimacy of men and I easily satisfy my clients by giving my best efforts. I can do all types of erotic positions in bed and make individuals feel delightful. As one of the gorgeous escortss in Kolkata, I spread jovial feelings around and make my lovers feel better than ever. The extreme pleasure that you can expect of getting from me would give you the immense happiness. I ensure to do the tremendous sexual moves and make my lovers feel better than ever. Hire me once and spend some quality experiences. I can do the erotic sexual positions in an incredible way and cherish the love life of individuals.
I ensure to do every adult activity in an erotic manner and fulfill the intimate desires of people. My clients are so many and they come back to me time and again. I never disappoint anyone and try to fulfill the extreme intimacy of different companions. I have dated so many dazzling females and enjoyed great memories with them. It has boosted my confidence and filled my love life with the immense sensual satisfaction. Building a close relationship with me can satisfy your intimate desires. Hire me once, if you really want to experience the heat of the sexual relationship. I assure you to satisfy your hot feelings and cherish your mood like never before.
Personal Details :
Age: 22
Location : Kolkata
Fig : 34-26-32
Hair and Eyes : Black
Height : 5’3”
Body Weight : 58 Kgs
Language : English, Hindi
Occupation : (Model)
Hobbies : Music and Dancing
বিজ্ঞাপন—৩
NO BROKER, IT’S MY PERSONAL SERVICE. PAID SEX. ARPITA SEN HERE..–21
Here is arpita frm your service.. I am 21 years. If you want girlfriend type experience in bed then contact me. No anal sex. People from kolkata only who want SEX service. No any online advance payment required for booking. Payment by cash only in hand after meet in room face to face.
**Do not contact me fake person for time pass or don’t tell me about sexual talking. I don’t do phone sex. I do sex in bed only..so why r u waiting?? Hurry up! Whatsapp me.. 824059**18
বিজ্ঞাপন—৪
I AM MS BHATTACHARIYA 22 YEAR COLLEGE GIRL–22
I Am Student Girl Study Purpose I Am In 1Bhk Flat Located ~ Baguihati Teghoria. My Personal Independent Relation 3 Hour 2 Shot–7000 Rs. If You Want To Spend A Good Time Then You Must Contact. I Am Available Today. Call And Final Your Time. Mob–987430**95 Shreya Bhattachariya.
বিজ্ঞাপন—৫
2 SHOT GET 3 HOUR TIME DURATION / SHREYA HERE–22
I m College Girl My Personal Service’ Single Liveing In Independent 1Bhk Flat’ LOCATED : VIP Road Baguohati, Teghoria. I CHARGE: 7000 RS FOR 3 HOUR 1 SHOT ALLOWED. If You Looking For Unprofessional Homely College Student Girl Then. You Must Contact : Mob–987430**95
বিজ্ঞাপন—৬
BENGALI GIRL I AM SHREYA–22
Shreya Here I Am College Girl My Personal Independent Relation. I Am Single Liveing In 2Bhk Flat. I Am Single Liveing Here. If You Want To Spend A Good Time Then You Must Contact : Shreya–987430**95. Call Me Directly.
বিজ্ঞাপন—৭
I DO PROVIDE SELF SERVICE SECRATELY–22
I Do Provide Personal Service I Am Single Liveing In Kolkata 2Bhk Rented Residencial
Flat.–Welcome In My Flat ~ I Charge Following Amount 1 Shot 1 Hour Duration–4000 Rs., 2 shot 3 Hour Duration–7000 Rs., One Night Stand 10,000 Rs. I Live In Baguihati, Teghoria. Come Direct In My Flat. Mob–987430**95. No Extra Charge / No Hidden Coast.
বিজ্ঞাপন—৮
SHREYA HERE BENGALI GIRL PERSONAL SERVICE–22
Not An Escort Not A Massage Centre, Personal Independent Service. I Am Shreya Live Single In 1Bhk Flat Location—Baguihati. I Am College Student. Provide Personal Service. No Broker. No Middlemen. No Agent. No Third Person. Contact Me : 987430**95. I Charge 7000 Rs For 2 Shot, 3 Hour Duration. Fixed Charge (Bargainer Are Stay Away).
বিজ্ঞাপন—৯
HI AM MOU–25
Hi I’m mou housewife. 26 years old. I give personal service at my place for satisfaction. no broker—direct contact. Call/WhatsApp no _704437**27. Dumdum metro.
1 hour—1 sot 2000
2 hour—2 sot 3000
2 hour–3 sot 4500
বিজ্ঞাপন–১০
MY HUSBAND IS ABROAD
I am Rupa, 29 years Independent Housewife. My husband is abroad. I stay here in south Kolkata alone. I am 5’4”, extremely fair, very good looking chubby and very sportive. Looking for som extra income and ready to share a great companionship. I am expecting a short time. Full night just call 799830**84.
বিজ্ঞাপন—১১
WHO CAN SATISFIED ME
My fugure is so good, but my husband can’t satisfied me. I need good looking man who can satisfied me. My real picture here. So, plz contact 86974**76. Only 1600 per shot.
বিজ্ঞাপন–১২
MY HUSBAND CAN’T SATISFIED ME
Hi, my self Shima Sen, 25 years old, I am married house wife. My figure is so good. But my husband can’t satisfied me. I need good looking man who can satisfied me. So please contact 799877**51. JODI AMAR HUSBAND PHONE RECEIVE KORE BOLBE AMAR FRIEND.
না, আর তালিকা লম্বা করব না। এই কয়েকটা নমুনাতেই পরিস্থিতির চিত্রটা বুঝে নিতে অসুবিধা হবে না। পাঠকদের। বিজ্ঞাপনগুলি সুস্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে, তা হল–মানুষ ক্রমশ সাবালক হয়ে উঠছে। ঘোমটার নীচে খেমটা নাচার দিন শেষ। খেমটাই এখন ঘোমটাকে পিষ্ট করে নিচ্ছে। ভাবের ঘরে চুরি করার দিন আর যৌনকর্মীরা চায় না। সেক্স এখন চড়া দামে বিক্রি হয়। তাই বাজারে পণ্যের অভাব নেই। বিজ্ঞাপিত হয় বিজ্ঞাপনের ভাষায়।
(৮) মধুচক্র : হাজার হাজার রিসর্ট, আবাসিক হোটেল, লজ, ফাঁকা ফ্ল্যাট, নির্জন বাড়ি সর্বত্র এখন যৌনমস্তির ক্ষেত্ৰভূমি। গোপনে চলছে মধুচক্র। আধ-আধটা প্রকাশ্যে এসে পড়লেও একটা বড়ো অংশই আড়ালে থেকে যায়। ধনী ক্লায়েন্টদের খুব পছন্দের জায়গা। কারণ ভালো বিছানা, সাফসুতরো পরিবেশ, অ্যাচাট বাথরুম, ঘরোয়া পরিবেশ, সহজগম্য, গায়ে চট করে কাদা লাগে না ইত্যাদি। অপরদিকে মেয়েদের গায়ে ‘বেশ্যা’ তকমা লাগে না এবং বেশ্যালয়ের গন্ধও নেই। তদুপরি গুপছুপ কাজটা সেরে নেওয়া যায়। মধুচক্রে দু-রকমভাবে চালানো হয়। এক, কোনো মালিক বা মালকিন মেয়ে মজুত রাখে। ক্লায়েন্ট মেয়ে পছন্দ করে মালিক বা মালকিনের নিজস্ব ঘর বা রিসর্টে যৌনমিলনের সাহায্য করে। দুই, মালিক বা মালকিনের ঘর বা ফ্ল্যাট কয়েক ঘণ্টার বাইরে কোনো কাপল এলে তাঁদের নির্দিষ্ট ভাড়ায় অন্তরঙ্গ সময় কাটাতে সাহায্য করে। এই কাপলরা সাধারণত সভ্রান্ত পরিবার থেকে আসে। এই ধরনের কাজ আজকাল গণিকাপল্লিগুলিতেও হচ্ছে। গণিকাপল্লিতে হলে অবশ্য মধুচক্র বলা হয় না। তবে এখানে সভ্রান্ত পরিবারের কাপলরা ঘেঁষে না।
কারা চালায় মধুচক্রের আসর? বরং প্রশ্ন করুন কারা থাকেন না? সমাজের উঁচুতলার মহিলা ও পুরুষরা এই আসর চালায়। কে নেই? রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী থেকে শিক্ষকের স্ত্রী, আইনজীবীর স্ত্রী কর্পোরেট কর্মীর স্ত্রী, ডাকসাইটের অভিনেত্রী থেকে বড়ো ব্যবসায়ী—সবাই। খুব গোপনে কাজ সম্পন্ন হলেও মাঝেমধ্যেই পুলিশের জালে ফেঁসে যায় এঁরা। ফেঁসে গেলেও লেনদেনের মাধ্যমে দু-দিন পর আবার রমরম করে কাজ শুরু হয়ে যায়। কয়েকটা ঘটনার উল্লেখ করি।
ঘটনা–১
তারিখ : ১৫ আগস্ট, ২০১৫
রোজগার বাড়াতে বাড়ি ভাড়া নিয়ে মধুচক্র চালাচ্ছিলেন এক তৃণমূল নেত্রী। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে গ্রেফতার করে ওই নেত্রীকে। গ্রেফতার করা হয়েছে তাঁর সঙ্গী এক যুবককেও। মালদহের ইংরেজবাজারের সিঙ্গাতলা এলাকায় একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে ললিতা মণ্ডল নামে এক মহিলা মধুচক্রটি চালাচ্ছিলেন বলে অভিযোগ। গাজোলের ললিতা ওই ব্লকেরই তৃণমূল নেত্রী। ইংরেজবাজার থানার অদূরেই সিঙ্গাতলা। সেখানেই একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে তিনি দিব্যি ব্যাবসা ফেঁদেছিলেন বলে অভিযোগ। সিঙ্গাতলার ওই বাড়িতে মালিক থাকতেন না। তিনি থাকতেন অন্যত্র। অভিযোগ, সেই সুযোগটাকেই কাজে লাগাচ্ছিলেন ললিতা। মোটা মাইনের লোভ দেখিয়ে নিয়ে আসা হত মহিলাদের। পরে নামানো হত দেহব্যাবসায়। বেশ কিছু দিন ধরে বাড়িটিতে অচেনা যুবক-যুবতীদের আনাগোনা দেখে সন্দেহ হয় স্থানীয়দের। খবর দেওয়া হয় পুলিশে। পুলিশ গিয়ে দুই তরুণী ও এক যুবককে আপত্তিকর অবস্থায় দেখতে পায়। ললিতা নিজেও সেই সময় বাড়িতে ছিলেন। সবাইকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে গ্রেফতার করা হয় ললিতা ও এক যুবককে। ঘটনায় বেজায় অস্বস্তিতে পড়েছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে চাননি তাঁরা। তৃণমূল নেতা সুশীল রায় বলেন, ললিতাকে মহিলা সংগঠনের নেত্রী বলেই জানি। এর বেশি কিছু বলতে পারব না।
স্থানীয় সূত্রের খবর, প্রথমে ললিতা গাজোলে একটি পার্লার চালাতেন। পরে মোটা টাকা রোজগারের লোভে মধুচক্রের ব্যাবসা ফাঁদেন। ইংরেজবাজারের বিভিন্ন জায়গায় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে পার্লার। এগুলির সিংহভাগেই অনৈতিক কাজ হয় বলে অভিযোগ। বেকার যুবক-যুবতীদের মোটা মাইনের চাকরির টোপ দিয়ে নিয়ে আসা হয় পার্লারে। পরে মগজ ধোলাই করে নামিয়ে দেওয়া হয় দেহব্যাবসায়। আর একবার ব্যাবসায় নেমে যাওয়ার পর আর ফিরতে পারেন না অধিকাংশ তরুণ-তরুণী। কারণ কম খাটুনিতে প্রচুর পয়সা রোজগার করা যায় এই পেশায়। তাতে বজায় থাকে ঠাঁট-বাট। স্থানীয়দের অভিযোগ, পুলিশ সক্রিয় না হওয়াতেই এসব ‘অনৈতিক কারবার চলছে রমরমিয়ে। জেলার প্রায় সর্বত্রই পার্লারের আড়ালে মধুচক্রের ব্যাবসা চলছে রমরমিয়ে। পুলিশ মাঝেমধ্যে হানাও দেয়। ধরাও পরে। তারপরেও দিব্যি চলতে থাকে মধুচক্র। মোটা টাকার বিনিময়ে বিকিয়ে যায় নারী শরীর। বিকায় পুলিশ-প্রশাসনও।
ঘটনা–২
তারিখ : ২১ ডিসেম্বর, ২০১৯
নৈহাটিতে কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ের ধারের একটি হোটেলে মধুচক্রের আসরে হানা দিয়ে সাত যুবককে গ্রেপ্তার করল পুলিশ। বৃহস্পতিবার রাতে গোপন সূত্রে খবর পেয়ে নৈহাটি থানার পুলিশ রাজেন্দ্রপুরের কাছে ওই হোটেলে হানা দেয়। হাতেনাতে ধরা হয় সাত জনকে। জনা কুড়ি যুবতীকেও ওই হোটেল থেকে পুলিশ উদ্ধার করেছে। নৈহাটি থানার পুলিশের কাছে গত কয়েকদিন ধরে খবর আসছিল কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ের ধারে থাকা ওই হোটেলে অবাধে চলছে মধুচক্র।
ঘটনা–৩
তারিখ : ৯ ডিসেম্বর, ২০১৯
স্পা ও কলসেন্টারের আড়ালে মধুচক্র। চার জায়গায় যৌথ অভিযান চালায় কলকাতা পুলিশের এসটিএফ, গোয়েন্দা বিভাগ ও গুদমন শাখা। শহরের ৪ জায়গা থেকে ধৃত ৬৫। শহরে মধুচক্রের হদিশ। কোথাও স্পায়ের আড়ালে কোথাও বা কলসেন্টারের আড়ালে চলছিল মধুচক্র। কলকাতা পুলিশের এসটিএফ, গোয়েন্দা বিভাগ ও গুন্ডাদমন শাখা অভিযান চালায় গড়িয়াহাটের রাসবিহারী অ্যাভিনিউ, ভবানীপুর, নিউ মার্কেট ও প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডে। গড়িয়াহাটের রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের এই বাড়ির তিনতলায় আগেও মধুচক্রের হদিশ মিলেছিল। এই বাড়িরই একতলায় ঘর ভাড়া নিয়ে স্পায়ের আড়লে মধুচক্র চালাত দেবব্রত বৈদ্য। ভবানীপুরের শ্রীপল্লি এলাকায় সুন্দর সাজানো গোছানো একটি স্পা সেন্টার। সাইনবোর্ডে ‘ফ্যামিলি স্যালোঁ’ লেখা থাকলেও আদপে এখানে মধুচক্রের আসর বসত। পুলিশি অভিযানে স্পায়ের দুই কর্মীসহ ৯ যুবককে গ্রেফতার করা হয়। যাদের মধ্যে দুজন ভিনরাজ্যের যুবকও ছিল। আটক করা হয় ৯ মহিলাকে। বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে বেশ কয়েকটি মোবাইল ও ৩টি বাইক। নিউমার্কেট ও প্রিন্স আনোয়ার শা রোডেও অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা। হয় ৪৪ জনকে।
ঘটনা–৪
তারিখ : ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮
বেসরকারি একটি লজে মধুচক্রের আসরে হানা দিয়ে ৭ মহিলা ও ১৩ পুরুষকে আটক করেছে পুলিশ। ভারতের ছত্তিশগড়ের মহাসমুন্ডের তোগভে এ ঘটনা ঘটেছে। ওই বেসরকারি লজে দীর্ঘদিন ধরে এই মধুচক্র নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করার পর পুলিশ অভিযান চালায়। পুলিশ জানান, ওই বেসরকারি লজ থেকে পুরুষ ও মহিলাসহ মোট ২০ জনকে আটক করা হয়েছে। এর আগেও মধুচক্র নিয়ে একাধিকবার আলোচনায় আসে ছত্তিশগড়ের নাম। অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া ছত্তিশগড়ের নগরজীবনে লাগাতার চলছে লড়াই। কখন শরীর বিক্রি করে, অথবা কখনও নাবালিকাকে হোটেলে পাঠিয়ে অর্থ উপার্জনের কাজ চলছে। জোর করে নাবালিকাদের আটকে রেখে প্রতি রাতে হোটেলে মধুচক্রের আসর বসানোর অভিযোগও আছে।
ঘটনা–৫
তারিখ : ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০
শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদের অন্তর্গত ফাঁসিদেওয়া ব্লকের বিধাননগরের একটি হোটেল। সেখানেই গোপনে চলছিল মধুচক্রের আসর। দীর্ঘদিন ধরেই ওই হোটেলের ঘর ভাড়া নিয়ে বিভিন্ন বয়েসি ছেলে-মেয়েরা নিজেদের যৌন-চাহিদা মেটাচ্ছিল। জানা গিয়েছে, ওই বার-কাম-রেস্টুরেন্টের উপর তলায় অবৈধভাবে কয়েকটি ঘর তৈরি করেই এই কাজ চলছিল। সেখানে ঘণ্টা হিসেবে রুম ভাড়া দেওয়া হত। গোপন সূত্রে খবর পেয়েই সেখানে হানা দেয় পুলিশ। হোটেলের বিভিন্ন ঘর থেকে হাতে নাতে ধরা হয় পাঁচ জোড়া স্কুল পড়য়াকে। এদের মধ্যে অনেকেই নাবালিকা বলে জানা গিয়েছে। প্রত্যেককেই আটক করে থানার নিয়ে যায় পুলিশ। পুলিশি অভিযানের খবর পেয়েই ওই হোটেলের সামনে জড়ো হয় এলাকাবাসী। তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই মহিলা, তাঁরা ওই স্কুল পড়ুয়াদের দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তাঁদের ঘিরে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। এলাকাবাসীর দাবি, বহুদিন ধরেই এই হোটেলে অল্প বয়সি ছেলেমেয়েদের যাতায়াত চোখে পড়ছে। অথচ পুলিশ এর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না-নেওয়ার ফলেই এখানে দেহ ব্যাবসার রমরমা বেড়ে গিয়েছিল।
ঘটনা–৫
তারিখ : ২৮ জানুয়ারি, ২০২০
খবরের কাগজে ‘বন্ধুত্ব করুন’-এর বিজ্ঞাপন। আর তার আড়ালে মধুচক্র চালানোর অভিযোগ। বারাসতে গ্রেফতার এক সাইবার কাফের মালিক প্রভাস হালদার। মধুচক্র চালানোর পাশাপাশি বারাসত ও নিউটাউন থানায় কয়েক কোটি টাকা প্রতারণার মামলা রয়েছে ধৃত প্রভাস হালদারের বিরুদ্ধে। কল্যাণী থানায় অভিযোগ দায়ের হয়েছিল প্রভাস হালদারের বিরুদ্ধে। সেই তদন্তে নেমেই এই কীর্তির পর্দাফাঁস পুলিশের। কয়েক সপ্তাহ আগে মধ্যমগ্রামের একটি বাড়িতে ভুয়ো অফিসের সন্ধান পায় পুলিশ। সেখান থেকেই অপারেশন চালাত প্রভাস হালদার। ‘পত্রমিতালি’ নাম দিয়ে বিজ্ঞাপন ছাপা হয় খবরের কাগজে। বন্ধুত্ব করুন’ সংস্থার আড়ালে রমরমিয়ে চলত মধুচক্র। এরপর বিভিন্ন অন্তরঙ্গ ভিডিও জোগাড় করে ক্রেতাদের ক্রমাগত ব্ল্যাকমেলিং করা হত। তাদের কাছ থেকে মোটা টাকার চেক নিয়ে রাখা হত বিভিন্ন বেনামি অ্যাকাউন্টে। সেই টাকাতেই মাইনে দেওয়া হত অফিসের কর্মচারীদের। বেনামি অ্যাকাউন্টগুলি বেশিরভাগই বিভিন্ন দুঃস্থ পড়ুয়াদের নামে। পরে সেখান থেকে চেক ভাঙিয়ে ক্যাশ তোলা হত।
কল্যাণী থানায় প্রতারিত এক ব্যক্তি অভিযোগ দায়ের করেন। তদন্তে নামে সিআইডি। সন্ধান পায় মধ্যমগ্রামের ভুয়ো অফিসের। জানা গিয়েছে, বাড়ির মালিককে মোটা ভাড়ার লোভ দেখিয়ে ভাড়া নেয় প্রধান অভিযুক্ত ঘনশ্যাম হালদার। তল্লাশিতে নেমে সেই বাড়ি থেকে ১৫ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। জেরায় নাম উঠে আসে ঘনশ্যামের। ফোনের মাধ্যমে আলাপ ও পরে কাজ না হলে হুমকি। এভাবেই অপারেশন চালাত অভিযুক্ত। বারাসত থানার পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে সোমবার রাতে তল্লাশি চালায় সিআইডি। বারাসতের অশ্বিনীপল্লি থেকে অভিযুক্তের দাদা প্রভাস হালদারকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
ঘটনা–৬
তারিখ : ২ জানুয়ারি, ২০১৯
শহরে দেহব্যাবসা এখন আর নির্দিষ্ট কয়েকটি জায়গায় সীমাবদ্ধ নেই। অভিজাত এলাকাতেও রমরমিয়ে মধুচক্রের কারবার চলছে বলে অভিযোগ। প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে অসৎ পথে পা বাড়াচ্ছেন তরুণীরা। কাজে লাগানো হচ্ছে নাবালিকাদেরও। সেক্টর টু-এর গ্রিন শেল্টার গেস্ট হাউসে মধুচক্রের সন্ধান পেলেন সিআইডি আধিকারিকরা। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে ওই গেস্ট হাউসে অভিযান চালান গোয়েন্দারা। হাতেনাতে ধরা পড়ে যান গেস্ট হাউসের ম্যানেজার, এক মহিলা নারী পাচারকারীসহ ছয় জন। উদ্ধার করা হয়েছে দুজন নাবালিকাসহ ছয় জনকে। গেস্ট হাউসের ম্যানেজার ও এক মহিলাসহ মোট ৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছেন রাজ্য গোয়েন্দা সংস্থার আধিকারিকরা। দিন কয়েক আগেই কলকাতা ও বাগুইআটির পাঁচটি ম্যাসাজ পার্লারে মধুচক্রের পর্দাফাঁস করেন লালবাজারে গোয়েন্দারা। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ ও স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের যৌথ অভিযানে ধরা পড়ে ৫৪ জন। ধৃতদের মধ্যে ৩৬ জন মহিলা। তাদের কেউ যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করত, কেউ আবার ছিল মধুচক্র বা ম্যাসাজ পার্লারের মালিক বা মালকিন। বিভিন্ন বয়সের এইসব যৌনকর্মীরা মূলত শহর ও শহরতলির বাসিন্দা। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, সল্টেলেকের গ্রিন শেল্টার গেস্ট হাউসের ম্যানেজার সন্দীপ মিশ্র। তাঁর বাড়ি পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরে। অপর দুই অভিযুক্ত রাজু দাস ও তুহিন বন্দ্যোপাধ্যায় বাঁকুড়ার বাসিন্দা। বাকি তিনজন উত্তর চব্বিশ পরগনার দমদম, বারাসত ও পূর্ব বর্ধমানের।
ঘটনা–৭
তারিখ : ১০ জানুয়ারি, ২০২০
মধুচক্র (Sex Racket) চালানোর অভিযোগে গ্রেফতার করা হল বিগ বস ১৩-র প্রাক্তন প্রতিযোগী আরহান খানের বান্ধবী অমৃতা ধানোয়াকে। গোরেগাঁওয়ের একটি পাঁচতারা হোটেল থেকে গ্রেফতার করা হয় অমৃতাকে। গোরেগাঁওয়ের একটি পাঁচতারা হোটেলে পার্টি চলাকালীন গ্রেফতার করা হয় আরহান খানের প্রাক্তন বান্ধবী অমৃতা ধানোয়াকে। মধুচক্র চালানোর অভিযোগেই গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। অমৃতার বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির বেশ কয়েকটি ধারায় অভিযোগ দায়ের করা হয়। অমৃতার পাশাপাশি রিচা সিং নামে আরও এক অভিনেত্রীকে গ্রেফতার করা হয়। রূপোলি জগতে খাতা খোলার চেষ্টায় ছিলেন রিচা সিং নামে ওই অভিনেত্রী। আচমকাই গোরেগাঁওয়ের ওই পাঁচতারা হোটেল থেকে অমৃতার সহযোগী হিসেবে গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। গোরেগাঁওয়ের ওই পাঁচতারা হোটেলে পুলিসের হানাদারি চলতে পারে। এই খবর শোনার পর সেখান থেকে পালানোর চেষ্টা করেন অমৃতা। কিন্তু সফল হননি। চম্পট দেওয়ার আগেই ওই পাঁচতারা হোটেলের পার্টি থেকে গ্রেফতার করা হয় আরহান খানের প্রাক্তন বান্ধবীকে।
ঘটনা–৮
তারিখ : ১৯ অক্টোবর, ২০১৯
দিনে দুপুর জনবহুল এলাকায় মধুচক্র চালানোর অভিযোগ এক গৃহবধুর বিরুদ্ধে। প্রতিবেশীরা হাতেনাতে মধুচক্র ধরে তুলে দিল পুলিশের হাতে। ঘটনাটি ঘটেছে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট শহরের সাহেব কাছারি এলাকায়। জানা গেছে সাহেব কাছারি এলাকায় বাসিন্দা পূরবী সরকারের স্বামী মারা যাওয়ার পর দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এর পর থেকেই তিনি দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে মিলে বাড়িতে মধুচক্রের আসর বসাতেন। এর আগেও একই অভিযোগে তাঁদের জেলও হয় বলে জানা গেছে। জেল থেকে ছাড়া পেয়েই তাঁরা আবার বালুরঘাট সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকার মহিলাদের নিয়ে মধুচক্রের আসর শুরু করেন। প্রতিবেশীরা বেশ কিছু দিন ওই বাড়িতে অপরিচিত নারী পুরুষের আনাগোনা লক্ষ করছিলেন এবং এই মধুচক্রের আসর হাতে নাতে ধরার লক্ষ্যে ছিলেন। আজ আবার কিছু অপরিচিত নারী পুরুষকে ওই বাড়িতে যেতে দেখলে তাঁরা হাতেনাতে তিনজন মহিলা ও দুই পুরুষকে ধরে ফেলে। এছাড়াও একজন পুরুষ পালিয়ে গেছে বলেও জানা গেছে। এরপর এলাকাবাসী পুলিশকে খবর দিলে পুলিশ এসে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে।
ঘটনা–৯
তারিখ : ৮ আগস্ট, ২০১৭
অভিযোগ আগেই ছিল। এবার একেবারে হাতেনাতে ধরা পড়ল। খোদ সিনেমা হলের ভিতরে দেহব্যাবসা চালানোর অভিযোগে ওই হলে ব্যাপক ভাঙচুর চালালেন স্থানীয় মানুষজন। ভরদুপুরে হঠাৎ ওই সিনেমা হলের দোতলার ঘর থেকে এক মহিলাকণ্ঠের আর্ত চিৎকারে আশপাশের বাসিন্দারা ছুটে যান। সেখানে গিয়ে ওই যুবতীর কাছ থেকেই তাঁরা মধুচক্রের কথা জানতে পারেন। ঘটনাস্থল থেকেই দুই যুবক ও এক যুবতীকে হাতেনাতে ধরে বেধড়ক মারধর করেন তাঁরা। এর পরই উত্তেজিত স্থানীয় মানুষ হামলা চালান ওই সিনেমা হলে। গুসকরা ফাঁড়ির পুলিস ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, গুসকরা ২ নম্বর ওয়ার্ডের নদীপটি এলাকায় ওই হলে দিনের পর দিন সিনেমা দেখানোর নামে রমরমিয়ে চলছে মধুচক্র। সিনেমা হলটির ভিতরে বেশ কয়েকটি ঘর আছে। সেগুলিকে দেহব্যাবসায় কাজে লাগিয়ে ঘণ্টা হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয়। ফলে এই সিনেমা হলে সকাল থেকেই গুসকরা শহর ও আশপাশের গ্রামগঞ্জের মানুষের ভিড় লক্ষ করা যায়। সিনেমা হলে ছবি দেখানোর নামে মধুচক্রের অভিযোগ নিয়ে দিনের পর দিন বিভিন্ন মহলে জানিয়েও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এদিন দুপুর নাগাদ সিনেমা হলের ভিতরে এক যুবক এক যুবতীকে মারধর করলে সেই যুবতী আর্ত চিৎকার করে ছুটতে ছুটতে বাইরের দিকে আসছিল। সেই সময় স্থানীয় মানুষ তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই সে দেহব্যাবসায় কথা জানায়। এর পরই সেখান থেকে দুই যুবককে টেনে বার করে মারধর দিয়ে স্থানীয়রা চড়াও হন সিনেমা হলে। এলাকাবাসীদের অভিযোগ, এই সিনেমা হলে অনৈতিক কাজকারবারের পিছনে অদৃশ্য হাত রয়েছে। তাই হলের ভিতরে ঘর ভাড়া দিয়ে চলছে মধুচক্র। এতে এলাকার সুনাম নষ্ট হচ্ছে। তাঁরা লজ্জায় তাঁদের পাড়ার নাম কাউকে বলতে পারেন না। বিষয়টি তাঁরা পুলিস থেকে শুরু করে স্থানীয় ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলরকেও বারবার জানিয়েছিলেন। কিন্তু কেউ কোনো ব্যবস্থা নেননি। এমনকি রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ শেষ শো ভাঙার পরেও সারা রাত অনেককেই এই সিনেমা হল থেকে বেরতে দেখা যায়।
ঘটনা–১০
তারিখ : ৪ জুন, ২০১৮
বিভিন্ন রাজ্যের মেয়েদের নিয়ে এসে চেন্নাইতে মধুচক্র চালানোর অভিযোগে গ্রেফতার করা হল জনপ্রিয় তামিল অভিনেত্রী সঙ্গীতা বালানকে। অভিযোগ, সিনেমা বা টিভিতে সুযোগ করে দেওয়ার টোপ দিয়ে অভিনয়কে পেশা হিসাবে গ্রহণ করতে ইচ্ছুক তরুণীদের চেন্নাই ডেকে আনত সঙ্গীতা ও তাঁর সহযোগী সতীশ। একরাশ স্বপ্ন নিয়ে চেন্নাই হাজির হওয়া সেসব তরুণীদের অবশেষে স্থান হত সঙ্গীতার রমরমা মধুচক্রে। তাঁদের গণিকাবৃত্তি করতে বাধ্য করা হত বলে অভিযোগ। পুলিশ সঙ্গীতা বালানকে গ্রেফতার করার পাশাপাশি তার সাগরেদ সতীশকেও গ্রেফতার করেছে। মধুচক্র থেকে তরুণীদের উদ্ধার করে তাঁদের চিকিৎসার জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। ১৯৯৬ সালে তামিল ছবি ‘কারুঞ্জু রোজা’-য় অভিনয় দিয়ে তামিল চলচ্চিত্র জগতে পা দেয় সঙ্গীতা বালান। তারপরও অনেক জনপ্রিয় সিনেমা ও টিভি সিরিয়ালে অভিনয় করেছে সে।
স্কুল-কলেজ থেকে গৃহবধূ–অবাধ যৌনতার জন্য এবং মোটা অর্থ রোজগারের মধুচক্রই বেশি পছন্দ। গোপনীয়তা রক্ষার প্রতিশ্রুতি থাকে এখানে। এখানকার ক্রেতা ও বিক্রেতারা উভয়পক্ষই মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবার থেকেই আসে। এখানকার শরীর-বিক্রেতারা আসেন মূলত অতৃপ্ত যৌনবাসনা মেটাতে। কেউ আসে শুধুই যৌনবাসনা মেটাতে, কেউ আসে অধিক অর্থ-লালসায়। শুধুই যৌনবাসনা মেটাতে আসে, তাঁরা পছন্দের পুরুষ বা নারীর সঙ্গে বা অনেকের সঙ্গে গ্রুপ সেক্স করে। অনেকে আসেন বিবাহ-বহির্ভূত বা পরকীয় যৌন সম্পর্ক করতে। এছাড়া এক শ্রেণির মানুষ আসেন, যাঁরা নিজেদের স্বামী ও স্ত্রী বদল (Swap) করে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হয়। এইসব মধুচক্রে তাঁরাই আসে যাঁদের জীবনসঙ্গিনীর বা সঙ্গীদের সঙ্গে শরীরী সম্পর্ক করার আড়াল বা নিরাপদ জায়গা নেই। এঁরা অবশ্য নিজেদের অর্থ লেনদেন করে শরীরের বিনিময়ে। শুধু হোটেল বা রিসর্টের ভাড়া মিটিয়ে দিলেই হল। প্রতিবেশীদের কাছ থেকে থানায় কোনো অভিযোগ না-করলে বা খুনের মতো কোনো ঘটনা না-ঘটলে নির্বিঘ্নেই কাজ চলে। যেহেতু মধুচক্রের স্পট, স্পটের কর্তা ও স্পটের ব্যক্তিরা উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং হোমড়াচোমড়া দুনিয়ার হয়, তাই কেউ সাহস করে কাঠি দিতে যায় না। মাসোহারা পায় বলে পুলিশ নিষ্ক্রিয়। মাসোহারা বন্ধ হলে হঠাৎ করে জেগে উঠলেও বকেয়া মিটিয়ে দিলেই সব সমস্যার সমাধান। তাই কোথায় কী হয় দুনিয়ার সবাই জানলেও শুধু পুলিশই কিছু জানে না।
(৯) যৌন পর্যটন বা সেক্স ট্যুরিজম : বিশ্বায়নের ছোঁয়া লাগার সঙ্গে সঙ্গে যৌন-বাণিজ্যের আরও নানা রূপ, নানা চরিত্রে, নানা চেহারায় প্রসার ঘটছে। তার বড়ো ক্ষেত্র হল সেক্স ট্যুরিজম। যৌন ক্রিয়াকলাপের জন্য বিশেষত গণিকাদের সঙ্গে যৌন পর্যটন হল বিভিন্ন পাবলিক প্লেস বা লোকালয়ে ভ্রমণ। হ্যাঁ, পর্যটন খাতের অভ্যন্তরে নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে বাণিজ্যিক যৌন-সম্পর্ক কার্যকর করাই হল প্রাথমিক উদ্দেশ্য। যৌন পর্যটন হল বহু বিলিয়ন ডলারের শিল্প। এয়ারলাইনস, ট্যাক্সি, রেস্টুরেন্ট, হোটেলে সুবিধা প্রদান করে এই যৌন পর্যটন। এই শিল্প বিদেশে অর্থনীতিকে বৃদ্ধি করে। যৌন পর্যটন শুধু সেক্সের জন্য অর্থ নয়। যৌন পর্যটনের মূল কারণ হল গণিকা খোঁজা আর গণিকার জন্য জীবিকা তৈরি করাই মূল লক্ষ্য। যৌন পর্যটন হল আইনি বহিরাগত। নেভেদা ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাস্তব সম্মত নয়। ২০০৩ সালে নিউজিল্যান্ড আইনের আওতায় গণিকাবৃত্তি যুক্ত হয়েছে। এখানে সংযুক্ত হয়েছে অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া, বাংলাদেশ, বেলজিয়াম, ব্রাজিল, কানাডা, কলোমরিয়া, ডেনমার্ক, ইকিয়েড, ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রিস, ইন্দোনেশিয়া, নেদারল্যান্ডস।
প্রতিদিনই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় অপরিণত ও পরিণত বয়সি নারী পাচার হয়ে আন্তর্জাতিক এইসব যৌন-বাণিজ্যের কবলে পড়ছে। পাচারকারী ও যৌন-বাণিজ্যের সবচেয়ে বড়ো বড়ো মাথাওয়ালা হর্তাকর্তা শ্রেণির ব্যক্তিদের নেটওয়ার্ক এতটাই বিস্তৃত ও শক্তিশালী যে, তাঁদের শক্তিমত্তার সঙ্গে পেরে ওঠার চেষ্টা বেশিরভাগ রাষ্ট্রগুলি করে না। না-করার বড় কারণ হল রাজস্ব। অনেক রাষ্ট্রের মোটা অঙ্কের আয়ই নির্ভর করে এই ধরনের পেশার উপর। বিশেষ করে, সেক্স ট্যুরিজম বা যৌন পর্যটন যেসব রাষ্ট্রের আয়ের প্রধান উৎস, সেসব রাষ্ট্র যৌন পর্যটন ব্যাপারটা প্রশ্রয়ই দেয়।
জাতি সঙ্ঘের বিশেষ এজেন্সি বিশ্ব পর্যটন সংস্থা’-র মতে, পর্যটন ট্রিপ কর্তৃক আয়োজিত অথবা ট্রিপের বাইরের কারও আয়োজনে পর্যটন ট্রিপের কাঠামো ও নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে গন্তব্যস্থানের বসবাস স্থলে পর্যটক কর্তৃক বাণিজ্যিকভাবে যৌন-সম্পর্ক স্থাপনকেই যৌন পর্যটন বলে। জাতি সঙ্ঘ যৌন পর্যটন সমর্থন করে না এই কারণে যে, এর মাধ্যমে পর্যটকের নিজের দেশ ও গন্তব্য দেশ উভয়েই স্বাস্থ্যগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে পর্যটকের নিজের দেশের চেয়ে গন্তব্যদেশের আর্থ সামাজিক অবস্থা এবং পর্যটকের নিজের সঙ্গে ওখানকার মানুষের লৈঙ্গিক-বায়সিক অবস্থায় বৈচিত্র্যই এর জন্য দায়ী। যৌন পর্যটকদের জন্য কখনো-কখনো গন্তব্যদেশে স্বল্পমূল্যে যৌন-পরিসেবা পাওয়ার আকর্ষণ থাকে। এমনকি সেসব দেশের থাকে যৌন-সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়ে আইনগত শৈথিল্য এবং শিশু যৌনকর্মী পাওয়ার আকর্ষণও।
যৌন পর্যটনের জন্য পর্যটকদের প্রথম পছন্দের দেশগুলি হল থাইল্যান্ড, ব্রাজিল, ডমিনিকান রিপাবলিক, কোস্টারিকা, কিউবা, জার্মানি, মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, নেদারল্যান্ডস এবং কম্বোডিয়া। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পর রাশিয়া, হাঙ্গেরি, ইউক্রেন, পোল্যান্ড এবং চেক রিপাবলিকের নামও ওই তালিকায় সংযুক্ত এবং যৌন-পরিসেবা দিয়ে থাকে। ওসব দেশের মোট যৌনকর্মীর সিংহভাগই স্থানীয় পুরুষকুলের চাহিদা মেটায়। নির্দিষ্ট কোনো দেশের কেবল এক বা একাধিক নির্দিষ্ট স্থানই কেবল যৌন পর্যটকদের গন্তব্য হয়। যেমন নেদারল্যান্ডের আমস্টারডাম; থাইল্যান্ডের ব্যাংকক, পাট্টায়া ও পুকেট; আমেরিকায় নেভাদা ইত্যাদি। ভারতেও বিদেশি পর্যটকরা যৌন পর্যটন উপভোগ করেন। নির্দিষ্ট সাইটে কল করলেই যৌনকর্মী চলে আসবে সংশ্লিষ্ট হোটেলে। এইসব যৌনকর্মীরা হোটেলে বসবাসকারী পর্যটক ছাড়া শরীরসঙ্গ দেন না। যদিও এটা আইনসম্মত নয়।
এছাড়াও অন্যান্য কিছু শহরে স্থানীয় পর্যটকরা বিশেষ আইনগত অনুমোদন নিয়ে যৌন পর্যটনে বেরয়। এসব পর্যটকদের অধিকাংশেরই তীব্র ঝোঁক থাকে শিশু যৌনকর্মীর প্রতি, যদিও অধিকাংশ দেশেই শিশুদের যৌনকর্মে ব্যবহার আইনসম্মত নয়, দণ্ডনীয় অপরাধ বলে বিবেচিত। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা যৌন পর্যটন ও শিশু যৌন পর্যটনকে আলাদা করে দেখে। সংস্থার মতে, যেসব পর্যটক শিশুদেরকে যৌনকাজে ব্যবহার করে তাঁরা ‘কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব দ্য চাইল্ড’ এবং ‘অপশনাল প্রটোকল অন দ্য সেল দ্য চিলড্রেন’, এবং চাইল্ড প্রস্টটিউশন অ্যান্ড চাইল্ড পর্নোগ্রাফি আইন লঙ্ঘন করে। অনেক দেশই ‘ওরস্ট ফর্ম অব চাইল্ড লেবর কনভেনশন, ১৯৯৯’-এ স্বাক্ষর করেছে এবং নিজেদের দেশে সেটা বাস্তবায়ন করেছে। সিঙ্গাপুরের এরকম কোনো আইন নেই বলে তাঁরা ইতোমধ্যে অনেক নিন্দা করেছে। ইন্দোনেশিয়ার বাটামও এইরকম একটি গন্তব্য (Destination), যেখানে প্রচুর কমবয়সি শিশুকে যৌনকাজে ব্যবহারের জন্য পাওয়া যায়।
‘ওয়ার্ল্ড অব ওয়ার্ক’-এর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, ১৯৯৮ ইস্যুতে মুদ্রিত একটি প্রবন্ধে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন এবং থাইল্যান্ডের যৌন-বাণিজ্যে কী পরিমাণে অর্থাগম ঘটে তার কিছু পরিসংখ্যান পাওয়া যায়। ওই প্রবন্ধে স্বীকার করা হয় যে, সেক্স ট্রিপ বা যৌনখাতকে একটি অর্থনৈতিক খাত হিসাবে অফিসিয়াল পরিসংখ্যান উন্নয়ন পরিকল্পনা বা সরকারের বাজেটে এখনও স্বীকৃত নয়। কিন্তু এ খাতে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থের লেনদেন ঘটে। বলা হয়, যৌনখাতে এই চারটি দেশে প্রকৃতপক্ষে কী পরিমাণ নারী যুক্ত আছেন, তা পেশাটি অনৈতিক ও গোপন হওয়ার কারণে বলা একেবারেই মুশকিল। তবে ধরে নেওয়া যায় দেশগুলির মোট নারী জনগোষ্ঠীর ০.২৫ থেকে ১.৫ শতাংশ এ পেশায় যুক্ত। ১৯৯৩-১৯৯৪ সালে তৈরি একটি হিসাব অনুযায়ী ইন্দোনেশিয়ায় যৌনকর্মীর সংখ্যা দেখানো হয় ১,৪০,০০০ থেকে ২,৩০,০০০ জন। মালয়েশিয়ায় এই সংখ্যা ৪৩,০০০ থেকে ১,৪২,০০০ জন। তবে আইএলও-র মতে সংখ্যাটা আরও কয়েক গুণ বেশি। ফিলিপাইনে যৌনকর্মীর সংখ্যা জানানো হয় ১,০০,০০০ থেকে ৬,০০,০০০ জন। তবে ৫,০০,০০০ হওয়ার ব্যাপারে অনেকেই একমত বলে জানানো হয়েছে। থাইল্যান্ডের জনস্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ১৯৯৭ সালে হিসাব করা জরিপ অনুযায়ী যৌনকর্মীর সংখ্যা দেখানো হয়েছে ৬৫,০০০ জন। কিন্তু আন-অফিসিয়াল সূত্র দাবি করে এই সংখ্যা হবে ২,০০,০০০ থেকে ৩,০০,০০০ জন। এর বাইরে থাই এবং ফিলিপিনো আরও ১০,০০০ নারী, শিশু এবং হিজড়া যৌনকর্মী বিদেশে কর্মরত আছে।
বলা হয়, যৌনতাভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলি, সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিনোদনমূলক প্রতিষ্ঠান এবং যৌন পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত মালিক, ব্যবস্থাপক, দালাল, সহযোগী, ক্যাশিয়ার, নিরাপত্তা রক্ষী এবং অন্যান্য কর্মকর্তা, কর্মচারী ইত্যাদি মিলে আরও কয়েক মিলিয়ন শ্রমজীবী মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই ধরনের পেশার মাধ্যমে জীবনধারণ করে। প্রতিবেদনটি বলছে, এই চারটি দেশের জিডিপি-র ২ শতাংশ থেকে ১৪ শতাংশই আসে সেক্সস্ট্রিপ থেকে। সরকারি কর্তৃপক্ষ বৈধ ও অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণে করও আদায় করে থাকে। থাইল্যান্ডের শহরে গণিকাবৃত্তিতে নিবিষ্ট গ্রামীণ নারীরা বছরে তাঁদের উপার্জন থেকে ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার গ্রামে তাঁদের পরিবারের কাছে পাঠান। ১৯৯৩-১৯৯৪ সময়কালে দেশগুলি গণিকাবৃত্তি থেকে বছরে ২২.৫ বিলিয়ন থেকে ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার উপার্জন করে। ইউনিসেফের (UNICEF) তত্ত্বাবধানে হওয়া সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় আফ্রিকার দরিদ্র দেশ কেনিয়ায় শিশু গণিকাবৃত্তির এক ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে জানা যায়, দেশটির উপকূলীয় এলাকায় যৌন পর্যটন চালু থাকায় সেখানকার অজস্র শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। প্রায় ১০,০০০ থেকে ১৫,০০০ মেয়েশিশু দেশটির মালিন্দি, মোম্বাসা, কালিফি এবং দিয়ানি উপকূলীয় এলাকায় বাস করে, যাঁরা মাঝেমধ্যেই অর্থেই বিনিময়ে যৌনকর্ম করে। এছাড়াও ২০০০ থেকে ৩০০০ শিশু ছেলেমেয়ে অর্থের বিনিময়ে সার্বক্ষণিক যৌন-পরিসেবা দিয়ে থাকে। উপকূলীয় যৌনপেশায় কর্মরতদের ৪৫ শতাংশই আসে দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে, যাঁরা পূর্বেই এ কাজে হাতেখড়ি নিয়ে নেয়। অধিকাংশই আগে নিজেদের এলাকার বাইরে এ কাজে অভিজ্ঞতা অর্জন করে ও প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড়, সাজগোজ করার কসমেটিক গার্মেন্টস ও চুলের স্টাইল আধুনিককরণ করার জন্য অর্থ উপার্জন করে, তারপর পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্য আসে। এখানে শিশুদের মধ্যে যৌনকর্মের প্রাদুর্ভাব এতটাই বেড়ে গেছে যে, প্রতি দশজন শিশুর একজন এ কাজে যুক্ত হয়, যাঁদের বয়স বারোতে পৌঁছোয়নি। চরম দারিদ্র্যের কারণে কেনিয়ায় এখন এটি সামাজিকভাবেও অনেকাংশে স্বীকৃতি পাচ্ছে। শিশুদের একটা অংশ সাধারণত সেসব পরিবার থেকে আসে যেসব পরিবারে উপার্জনক্ষম কেউ নেই, অথবা কম উপার্জন করে, কিংবা সেসব শিশু যাঁদের মা-বাবা উভয়েই মারা গেছে। তবে আগতদের ৫০ শতাংশের মা-বাবাই কর্মজীবী এবং তাঁদের সন্তানরা স্কুলেও যায়। তবে তাঁরা চায় হাতখরচের জন্য বাড়তি কিছু টাকা। অবশ্য এঁরা সতর্ক থাকে যাতে সমাজের বেশি বয়সি কেউ যেন বিষয়টি টের না-পেয়ে যায়। সূত্র জানায়, কেনিয়ার সৈকতে শিশু যৌন পর্যটনে আগতদের ১৮ শতাংশ সুইস। এরপয়েই আসে উগান্ডান, তাঞ্জানিয়ান, ব্রিটিশ এবং সৌদি আরবীয়রা। তবে দেশের ভিতরেও এই শিশুদের ক্লায়েন্ট প্রচুর। পর্যটকদের আগমন যে সময়ে কম হয় বা একেবারেই হয় না, তখনও এই শিশুরা একেবারে কর্মহীন থাকে না।
যৌন পর্যটনে শুধু যে পুরুষরা পর্যটকরাই যৌনকর্মীদের আকর্ষণে যায়, তা নয়। মহিলা পর্যটকরাও পুরুষ যৌনকর্মীদের আকর্ষণে যায়। মহিলা যৌন ভ্রমণের জন্য জনপ্রিয় দেশগুলির মধ্যে আছে দক্ষিণ ইউরোপ (মূলত গ্রিস, ইতালি, সাইপ্রাস, স্পেন এবং পর্তুগাল); ক্যারিবিয়ান (জামাইকা, বার্বাডোস এবং ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রের নেতৃত্বে); ব্রাজিল, মিশর, তুরস্ক এবং থাইল্যান্ডের ফুকেট) এবং আফ্রিকার গাম্বিয়া, সেনেগাল এবং কেনিয়া। অন্যান্য জনপ্রিয় Destinations বা গন্তব্যগুলির মধ্যে আছে বুলগেরিয়া, তিউনিসিয়া, লেবানন, মরোক্কো, জর্ডান, আজারবাইজান, ফিজি, কলম্বিয়া এবং কোস্টারিকা। সেক্স ট্যুরিজম সবচেয়ে সাধারণ ধরনের পুরুষদের মধ্যে মহিলাদের সন্ধান করা seeking কম, সাধারণ ফর্মগুলির মধ্যে মহিলা যৌন পর্যটন (পুরুষদের সন্ধানকারী মহিলা), পুরুষদের খোঁজ পুরুষ এবং শিশু প্রাপ্তবয়স্কদের অন্তর্ভুক্ত আছে। যৌন পর্যটকরা সাধারণত ইউরোপের পাশাপাশি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের উন্নত দেশ থেকে আসে। এশীয় দেশগুলি, বিশেষত থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, কম্বোডিয়া এবং নেপাল যৌন পর্যটকদের পাশাপাশি মধ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকায় দেশগুলির সাধারণ গন্তব্য।
প্রোকন দ্বারা পরিচালিত একটি গবেষণা (একটি অলাভজনক, নিরপেক্ষ জনসাধারণের স্বেচ্ছাসেবক, যা বিতর্কিত ইস্যুতে বিভিন্ন মতামত দেয়) তাঁদের জীবনে কমপক্ষে একবার যৌন-সম্পর্কের জন্য পুরুষদের শতকরা হার অনুমান করে এবং কম্বোডিয়ায় সর্বোচ্চ হার খুঁজে পেয়েছে (৫৯ শতাংশ এবং ৮০ শতাংশের মধ্যে), পুরুষদের মধ্যে কমপক্ষে একবার যৌনতার জন্য অর্থ প্রদান করেছিলেন। থাইল্যান্ড (আনুমানিক ৭৫ শতাংশ), ইতালি (১৬.৭ থেকে ৪৫ শতাংশ), স্পেন (২৭ থেকে ৩৯ শতাংশ), জাপান (৩৭ শতাংশ), নেদারল্যান্ডস (১৩.৫ থেকে ২১.৬ শতাংশ) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (১৫.০ থেকে ২০.০শতাংশ) পরিসংখ্যানগুলি ইঙ্গিত দেয় যে, যুক্তরাষ্ট্রে বাণিজ্যিক যৌন-সম্পর্কে জড়িত পুরুষদের শতাংশ সাম্প্রতিক দশকগুলিতে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। কম্বোডিয়া এবং থাইল্যান্ডের মতো কয়েকটি দেশে গণিকাদের সঙ্গে যৌনমিলনকে সাধারণ বিষয় হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং যে পুরুষরা বাণিজ্যিক যৌনতায় লিপ্ত হন না, তাঁরা তাঁদের সহকর্মীদের তরফ থেকে অস্বাভাবিক হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
মহিলা যৌন পর্যটন সম্পর্কিত পরিভাষা নিয়ে চলছে তর্ক-বিতর্ক। প্রুয়েট (Pruitt) এবং লাফন্ট (Lafont) যুক্তি দিয়েছিলেন যে, মহিলা যৌন পর্যটন’ শব্দটি স্থানীয় পুরুষদের সঙ্গে মহিলা পর্যটকদের সম্পর্কের প্রতিনিধিত্ব করে না। তাঁদের যুক্তি ছিল যে, মহিলা যৌন পর্যটন এই মহিলাদের উদ্দেশ্যকে আরও প্রশস্ত করে এবং ‘রোম্যান্স ট্যুরিজম’ এই মহিলারা রোম্যান্স ট্যুরের সঙ্গে জড়িত থাকাকালীন কীভাবে নিজেকে নিযুক্ত করছে, তার জটিল প্রকৃতির ব্যাখ্যা দেয়। ক্লাউস ডি আলবার্কের্কের (Klaus de Alburquerque) মতো বিদ্বানরা মনে করেন যে, রোম্যান্স ট্যুরিজম’ শব্দটি যৌন ভ্রমণকারীদের উদ্দেশ্য কী বোঝায় না। ডি আলবুকার্ক বলেছিলেন যে ‘রোম্যান্স ট্যুরিজম’-এর মতো ধারণাগুলি কেবল জ্যামাইকা এবং এর সাংস্কৃতিক বিশ্বাসের মতো ছোটো ছোটো কুলুঙ্গিগুলির প্রতিনিধিত্ব করে। তাঁর গবেষণার মাধ্যমে তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, বেশিরভাগ মহিলা যৌন পর্যটক কেবলমাত্র শারীরিক লড়াইয়ের (Physical Encounters) জন্য পর্যটন করেন, রোম্যান্সের জন্য নয়।
গবেষক জ্যাকলিন সানচেজ-টেলর (Jacqueline Sanchez-Taylor) যুক্তি দিয়েছিলেন যে, মহিলা যৌন পর্যটন এবং এমনকি ‘রোম্যান্স ট্যুরিজম’ শব্দটি আসলে যে পরিস্থিতিতে ঘটছে, তা হীন করে তোলে। তিনি মহিলা এবং পুরুষ যৌন পর্যটনকে তুলনা করে দেখান যে, প্রতিটি সম্পর্ক কীভাবে যৌন-অর্থনৈতিক সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। তিনি নারী যৌন পর্যটন বা রোম্যান্সের ভিত্তিতে মনে করেন এবং যদি উভয়পক্ষের মধ্যে একরকম যৌন-অর্থনৈতিক সম্পর্ক দেখা দেয়, তবে অনুসন্ধান করে আরও যোগ করেছেন—-“পুরুষ ও মহিলা যৌন পর্যটনের মধ্যে যে সমান্তরালতা রয়েছে তা ব্যাপকভাবে উপেক্ষা করা হয় এবং লিঙ্গ ক্ষমতার (Gender Power) বিদ্যমান তাত্ত্বিক ও সাধারণ ধারণা বোঝার ক্ষেত্রে দুর্বলতাগুলি প্রতিফলিত করে এবং পুনরুৎপাদন করে যৌন পর্যটন।”
দক্ষিণ ইউরোপ (প্রধানত গ্রিস, ইতালি, স্পেন এবং ক্রোয়েশিয়াতে) সহ বেশ কয়েকটি দেশ মহিলা যৌন পর্যটনের ডেস্টিনেশনে পরিণত হয়েছে। ক্যারিবিয়ান (বার্বাডোস, ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র, কিউবা এবং জামাইকা); ইকুয়েডর, কোস্টারিকা, মরক্কো, তুরস্ক, নেপাল, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও ফিজি; এবং আফ্রিকার গাম্বিয়া এবং কেনিয়া ছাড়াও অন্যান্য গন্তব্য সহ বুলগেরিয়া, আলবেনিয়া, পর্তুগাল এবং হাইতি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার বালির এমন একটি ডেস্টিনেশন, যেখানে পশ্চিম ইউরোপ, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা মহিলারা স্থানীয় পুরুষদের সঙ্গে যৌন পর্যটনে লিপ্ত হন। ২০০৯ সালে আফ্রিকার সেক্স ট্যুরিজম বইয়ে ওয়াঞ্জোহি কিবিচো (Wanjohi Kibicho) দ্বারা পরিচালিত কেনিয়ায় মালিন্দিতে একটি জরিপে করে বলেছেন—কেনিয়ার বুমিং ইন্ডাস্ট্রিতে দেখা গেছে যে, জরিপ করা যৌন পর্যটকদের মধ্যে ৬১ শতাংশ ছিলেন ৪৬ থেকে ৫০ এবং ৩১ এবং ৩৫ (তিন শতাংশ) বয়সের মধ্যে কনিষ্ঠ বয়সিরা নিবন্ধিত হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে নারীদের মধ্যে ২২ শতাংশ জার্মানি, ১৯ শতাংশ ইতালি এবং ১৫ শতাংশ নেদারল্যান্ডের ছিল। যৌন পর্যটনের যুক্তি উপস্থাপন করতে গিয়ে কিবিচো সংক্ষেপে জানিয়েছিলেন যে, যে মহিলারা “বেশি ওজন এবং বয়স্ক” (overweight and older) বলে উন্নত দেশগুলির পুরুষদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত বোধ করেন, তাঁরাই কেনিয়ায় এসে হঠাৎ বিপরীত (Reversed) হয়ে পড়েছেন। সেখানে তাঁরা পুরুষদের দ্বারা ‘রোম্যান্সড’ (Romanced) এবং ‘প্রিয়’ (Loved) হয়ে উঠছেন।
পুরুষ যৌন পর্যটন ও মহিলা যৌন পর্যটনের পাশাপাশি গে বা সমকামীদের যৌন পর্যটনেরও ব্যবস্থা আছে। গে সেক্স ট্যুরিজম এমন এক যৌন পর্যটন শিল্প, যা সমকামী, উভকামী এবং দ্বি-দলীয় পর্যটকদের জন্য একটি সমৃদ্ধ উপ-বাজার সরবরাহ করে। বিদ্যমান পরিসংখ্যানগুলি থেকে বোঝা যায় যে, সমকামী যৌন ভ্রমণে সমকামীদের অ-সমকামী সেক্স ট্যুরিজমের মতোই অনুপ্রেরণা রয়েছে, যার সঙ্গে যুক্ত করা যায় যে কারও সমকামী যৌন পরিচয়ের সঙ্গে সংযোগ রাখতে সক্ষম হওয়াও যুক্ত আছে। সমকামী-বন্ধুত্বপূর্ণ অন্যান্য ভ্রমণ। গন্তব্য যেমন হতে পারে, তাই তাঁদের সঙ্গে তাঁদের পরিচয় অন্বেষণ করার জন্য অন্যান্য সমকামী সনাক্তকারীদের সুযোগ দেয়। গ্রান ক্যানেরিয়া, ইবিজা, সার্ডিনিয়া, সিসিলি এবং ফায়ার আইল্যান্ডের জনপ্রিয় সমকামী যৌন পর্যটন বাজারগুলি সমকামী যৌন ক্রিয়াকলাপ ব্যাপকভাবে সম্ভব হয়েছে। ঠিক ভিন্ন ভিন্ন যৌন পর্যটন বাজারের মতো কিছু ব্যবস্থা আর্থিক হতে পারে এবং কিছু নাও হতে পারে। বিভিন্ন জায়গায় এই ধরনের ব্যবস্থায় তাদের আগ্রহ চিহ্নিত করার বিভিন্ন উপায় আছে। উদাহরণস্বরূপ, ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে, সমকামী যৌন পর্যটন জাতিগতভাবে বৈচিত্র্যময় বাজারের হোস্টিং একটি জনপ্রিয় কুলুঙ্গিতে পরিণত হয়েছে। সেখানকার যৌন-শ্রমিকদের ‘মিশিগস’ বলা হয় এবং উজ্জ্বল নীল রঙের তোয়ালে পরে তাঁরা দাঁড়িয়ে থাকে এবং প্রায়শ সোনাস (Bath House) এ কাজ করেন। ধর্মীয় এবং সমকামী বিরোধী গোষ্ঠীগুলির দ্বারা বিক্ষোভের মাধ্যমে সমকামী সেক্স ট্যুরিজম বহুবার আক্রান্ত হয়েছে।
মহিলা সেক্স ট্যুরিজম হল যৌন পর্যটন, যা মহিলারা এক বা একাধিক স্থানীয়, সাধারণত পুরুষ যৌনকর্মীর সঙ্গে যৌনক্রিয়ায় জড়িত হওয়ার উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করে। মহিলা যৌন পর্যটকরা যৌন সম্পর্কের এমন দিকগুলি খুঁজতে পান, যা সাধারণত পুরুষ যৌন পর্যটকদের দ্বারা ভাগ করা হয় না, যেমন—অনুভূত রোম্যান্স এবং ঘনিষ্ঠতা। যে মহিলারা এই প্রোফাইলটি প্রস্তুত করে, বিশেষত ধনী, একক, বয়স্ক শ্বেতাঙ্গ মহিলারা, তাঁদের ছুটির পরিকল্পনা করে এমন কোনো সঙ্গীর সঙ্গে রোম্যান্স এবং যৌনমিলনের জন্য, যা তাদের কীভাবে বিশেষ উপলব্ধি করতে এবং তাদের মনোযোগ দিতে জানে। তবে মহিলা সেক্স ট্যুরিজমের প্রচলন পুরুষ সেক্স ট্যুরিজমের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। মহিলা যৌন পর্যটন বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘটে। মহিলা সেক্স ট্যুরিজমের জনসংখ্যার পরিসংখ্যান গন্তব্য অনুসারে পরিবর্তিত হয়, তবে সাধারণত মহিলা যৌন পর্যটকদের সাধারণত উন্নত দেশের মহিলাদের শ্রেণিবদ্ধ করা হয়, যারা রোম্যান্স বা যৌন আউটলেটের সন্ধানে স্বল্প উন্নত দেশে ভ্রমণ করে। সেক্স ট্যুরিজমের সঙ্গে জড়িত মহিলারা তাঁদের বেশিরভাগই সুরক্ষিত যৌনসঙ্গী পুরুষদের সঙ্গে যৌনমিলনের সময় গর্ভনিরোধক ব্যবহার করে না।
যৌন পর্যটন প্রসারিত যে সমস্ত জায়গাগুলি সর্বাধিক জনপ্রিয়, তেমন ১৩ টি স্থান একটু দেখে নিতে পারি। যেমন—
(১) ডোমেনিকান রিপাবলিক : যৌন পর্যটনের প্রথম নাম ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র। যদিও গণিকাবৃত্তি বৈধ, যদিও অর্থ বন্ধ করা যায় না, তবে তাঁরা কেবল নিজেদের জন্য উপার্জন করতে সক্ষম হয়। সেক্স ট্যুরিজম সাইটগুলিতে ডোমেনিকানরা হায়াতিয়ানদের ঘৃণা পোষণ করে। যাঁরা রাস্তায় কাজ করতে বাধ্য হয় তাঁদের প্রতি ঘৃণাই বর্তমান।
(২) থাইল্যান্ড : থাইল্যান্ডের পাট্যায়া শহর, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ যৌন রাজধানী। এটা নাকি যৌনকর্মের ‘জান্নাত হিসাবে পরিচিত।
(৩) কোস্টা রিকা : কোস্টা রিকা যৌন পর্যটনে উচ্চতায় পৌঁছেছে। ১০ শতাংশ পর্যটক সেক্সের জন্য কোস্টা রিকায় আসেন। কিন্তু কোস্টা রিকা এত স্পেশাল কী করে? কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গণিকাবৃত্তি অবৈধ। কোস্টা রিকার ৮০ শতাংশ যৌনকর্মী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী।
(৪) কেনিয়া : কেনিয়ায় গণিকাবৃত্তি আইনি। কিন্তু পার্থক্য হল যে, নারীরা নারীদের জন্য এই গন্তব্যস্থলে আসার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয়দের মানুষদের থেকে পেতে ইচ্ছুক। এটি একটি আকর্ষণীয় টার্ম সেখানে একটি নামও আছে, মিজু। যে মহিলারা স্থানীয়দের সঙ্গে যৌন-সম্পর্কের জন্য আসে।
(৫) জাপান : জাপান বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় মানুষের জন্য শীর্ষ পর্যটকদের মধ্যে একটি। যাই হোক, জাপানে বিদেশি পুরুষরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বাগত জানায় না। কারণ নারীরা অনাকাক্ষিত হয়। বিদেশিদের মধ্যে আছে ভিন্ন গন্ধ, আর ভাষার প্রতিবন্ধকতাকে নারীরা ভয় পায়।
(৬) আমস্টারডাম : আমস্টারডাম কুখ্যাত হয়েছে যৌনবৃত্তির মরুদ্যানের জন্যে। অ্যামস্টারডাম সম্ভবত গণিকাবৃত্তি আইনি সম্পর্কে মনে করার সময় মানুষের মনে সবচেয়ে সাধারণ জায়গা। কেবলমাত্র আইনি ও নিরাপদ পছন্দ নয়, তবে পার্টির পরে দেখা করার জন্য একটি যৌনমিলনেরও ব্যবস্থা থাকে।
(৭) কম্বোডিয়া : কম্বোডিয়ার ফনম পেন (Phnom Penh) নারী যৌনকর্মীদের জন্য নির্দিষ্ট। নানাবিধ কারণের মধ্যে দারিদ্যতাই প্রধান কারণ। উদ্বাস্তুদের অনেকেই দারিদ্রতার কারণে গণিকাবৃত্তি গ্রহণ করে থাকে।
(৮) ফিলিপাইন : এই পেশা এখানে অবৈধ। তবে এটি এখনও ম্যাসেজ পার্লারসের আড়ালে গণিকাবৃত্তিতে এবং আরও অনেক কিছু ঘটে। চাহিদা আছে, আছে সরবরাহ। লোকেরা যৌনতা বিক্রি করার উপায় খুঁজে বের করে। কারণ তাঁরা জানে যে, এটি চড়া দরে বিক্রি হয়। এটি দুর্ভাগ্যজনক যৌন পর্যটন ভাবে। ফিলিপাইনে আসার জন্য মানুষকে প্রধান আকর্ষণ করা হল যৌন পর্যটন প্রচারণা এবং যৌনকর্মীদের সঙ্গে আনন্দের একটি জগৎ।
(৯) ইন্দোনেশিয়া : ইন্দোনেশিয়ায় গণিকাবৃত্তি অবৈধ হলেও পতিতাবৃত্তির সব পথই খোলা থাকে। তবে ইন্দোনেশিয়া অনলাইন যৌন ফোরাম এবং গণিকাবৃত্তি রিংগুলির জন্যও বেশি খ্যাত। কেউ যৌন সফর করার সিদ্ধান্ত নিলে এটাও মেনে নিতে হবে চরম মুহূর্ত পর্যন্ত নাও পৌঁছোতে পারে। অতএব সবসময় সতর্ক থাকতে হয়।
(১০) স্পেন : স্পেন কেবলমাত্র সেরা মদ আর ষাঁড়ের লড়াইয়ের জন্য প্রসিদ্ধ নয়, এই দেশ সেরা গণিকাবৃত্তির জন্যেও প্রসিদ্ধ। এ বিষয়ে পরে বিস্তারিত আলোচনা করব। স্পেনের রেড লাইট এরিয়াগুলিতে খুব উচ্চগ্রামের ও উৎসবের মেজাজে নারী-পুরুষ উভয়ই যৌনঘটিত ঘটনাগুলি ঘটাতে পারেন। লাল আলো জেলার একটি খুব উঁচু এবং উৎসাহী অংশ যেখানে অনেক পুরুষ এবং মহিলারা অবশ্যই মূল্যের জন্য যৌন-উদ্দীপক জিনিসগুলি করতে পারেন।
(১১) ব্রাজিল : ব্রাজিলে ফুটবলের জন্য অবশ্যই যাবেন। কিন্তু সেক্স করার জন্যেও অবশ্যই যাবেন। ব্রাজিলে গণিকাবৃত্তি বৈধ। ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই যৌন পরিসেবা নিতে ও দিতে পারে স্বচ্ছন্দে। এখানে উঁচুতলার মহিলারাও স্বচ্ছন্দে যৌনকর্ম করে থাকে। রিও ডি জেনিরো ও ফোর্টালেজা শহর দুটি রেড লাইট এরিয়ার জন্য প্রসিদ্ধ।
(১২) জ্যামাইকা : কেনিয়ার নারীদের মতোই পুরুষ যৌনকর্মীও সম্মানিত হয়। তবে এখানে গুজবের গুরুত্ব খুব বেশি।
(১৩) হাইতি : হাইতি হল দরিদ্রদের দেশ। এখানে যৌনকর্মীরা যথেষ্ট মজুরি পায়। দারিদ্রতাই নারীকে গণিকাবৃত্তিতে নামায়।
১৬. দেশে দেশে গণিকাবৃত্তি
এই ভারত উপমহাদেশ সেই প্রাচীন যুগ থেকেই বহিরাগতদের অনুপ্রবেশের কারণে ভারতীয় আদি সংস্কৃতি হারিয়ে গিয়ে এক মিশ্র সংস্কৃতির নাম ভারতীয় সংস্কৃতি। তথাকথিত সনাতন ধর্ম (বৈদিক ধর্ম বা পৌরাণিক ধর্ম বা হিন্দু ধর্ম), বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম, শিখ ধর্ম, ইসলাম ধর্ম, খ্রিস্টান ধর্ম সব মিলিয়ে ভারতীয় সংস্কৃতি ঘেঁটে ঘ। হয়ে গেছে। ফলে প্রাচীন যুগে যে পেশা ছিল বৈধ, রাষ্ট্র দ্বারা স্বীকৃত, সম্মানীয়–সেই একই পেশা আজ না ঘরকা না-ঘাটকা, না-বৈধ না-অবৈধ, ন যযৌ ন তস্থৌ ভাব। তাই গণিকাবৃত্তির প্রসার আছে ঠিকই, ভবিষ্যতেও আরও প্রসার ঘটবে। সেইসঙ্গে থাকবে নিরাপত্তাহীনতা, থাকবে পুলিশি অনুপ্রবেশ, থাকবে মস্তানদের দৌরাত্মও।
ঝেড়ে কাশেননি অনেক দেশের আইনপ্রণেতারা। অনেক আইনপ্রণেতাই সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না গণিকাবৃত্তি বৈধ না অবৈধ। অবৈধ করে দিলে সমাজের উঁচুতলার সাহেবসুবোরা নারী-রসদ থেকে বঞ্চিত হবেন। আবার বৈধ করলে যথেষ্টভাবে গণিকাবৃত্তিতে চলে আসবে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। চাহিদার থেকে জোগান বেশি হলে শরীর সস্তায় বিকোতে পারে। সমাজের ভারসাম্যও নষ্ট হতে পারে। বৈধ হোক বা অবৈধ হোক, পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ নেই যে দেশে গণিকাবৃত্তি হয় না। আছে গণিকা, আছে গণিকাবৃত্তি, আছে গণিকালয়। বরং বলা ভালো পরিধি ক্রমশই বাড়ছে। বর্তমানে এমন অনেক দেশ আছে, যেখানে গণিকাবৃত্তি আইনত বৈধ। বৈধতা সত্ত্বেও সেখানে যেমন সকল নারী-পুরুষ যেমন গণিকাবৃত্তিতে আসেনি, ঠিক তেমনি যেসব দেশে গণিকাবৃত্তি অবৈধ, সেখানেও গণিকাবৃত্তি নিশ্চিহ্ন করা যায়নি। অবশ্য নিশ্চিহ্ন করার ব্যাপারে কেউ গুরুতর প্রয়াস করেছে আমার জানা নেই। যাই হোক, আমরা জেনে নেব গণিকাবৃত্তি ১০০ টি দেশের মধ্যে ৫০ টি দেশে বৈধ, ৩৯ টি অবৈধ এবং ১১ টি দেশে সীমাবদ্ধ বৈধ।
৫০ টি বৈধ দেশগুলি হল–(১) আর্জেন্টিনা, (২) আমেরিকা, (৩) অস্ট্রিয়া, (৪) বেলজিয়াম, (৫) বেলিজ, (৬) বলিভিয়া, (৭) ব্রাজিল, (৮) কানাডা, (৯) চিলি, (১০) কলম্বিয়া, (১১) কোস্টা রিকা, (১২) সাইপ্রাস, (১৩) চেক রিপাবলিক, (১৪) ডেনমার্ক, (১৫) ডোমেনিকান রিপাবলিকান, (১৬) ইকুয়াডর, (১৭) এল সালভাদর, (১৮) ইস্টোনিয়া, (১৯) ইথিয়োপিয়া, (২০) ফিনল্যান্ড, (২১) ফ্রান্স, (২২) জার্মানি, (২৩) গ্রিস, (২৪) গুয়াতেমালা, (২৫) হন্ডুরাশ, (২৬) হাঙ্গেরি, (২৭) ইন্দোনেশিয়া, (২৮) আয়ারল্যান্ড, (২৯) ইজরায়েল, (৩০) ইটালি, (৩১) কিরগিজস্তান, (৩২) লাটভিয়া, (৩৩) লুক্সেমবার্গ, ৩৪) মেক্সিকো, (৩৫) নেদারল্যান্ডস, (৩৬) নিউজিল্যান্ড, (৩৭) নিকায়াগুয়া, (৩৮) পানামা, (৩৯) পারাগুয়া, (৪০) পেরু, (৪১) পোল্যান্ড, (৪২) পোর্তুগাল, (৪৩) সেনেগল, (৪৪) সিঙ্গাপুর, (৪৫) স্লোভাকিয়া, (৪৬) সুইজারল্যান্ড, (৪৭) তুরস্ক, (৪৮) ইউনাইটেড কিংডম (স্কটল্যান্ড সহ), (৪৯) উরুগুয়ে, (৫০) ভেনেজুয়েলা।
৩৯ টি অবৈধ দেশগুলি হল–(১) আফগানিস্তান, (২) আলবানিয়া, (৩) অ্যাঙ্গোলা, (৪) অ্যান্টিগা ও বারবুদা, (৫) বাহামা, (৬) বারবাডোজ, (৭) কাম্বোডিয়া, (৮) চিন (তাইওয়ান সহ), (৯) ক্রোয়েশিয়া, (১০) কিউবা, (১১) ডোমিনিকা, (১২) ইজিপ্ট, (১৩) গ্রেনাডা, (১৪) গুয়ানা, (১৫) হাইতি, (১৬) ইরান, (১৭) ইরাক, (১৮) জ্যামাইকা, (১৯) জর্ডন, (২০) কেনিয়া, (২১) উত্তর কোরিয়া, (২২) দক্ষিণ কোরিয়া, (২৩) লাইবেরিয়া, (২৪) লিথুয়ানিয়া, (২৫) মাল্টা, (২৬) ফিলিপিনস, (২৭) রোমানিয়া, (২৮) রুয়ান্ডা, (২৯) সেন্ট কিটস ও নেভিস, (৩০) সেন্ট লুসিয়া, (৩১) সেন্ট ভিনসেন্ট ও গ্রেনাডাইনস, (৩২) সৌদি আরব, (৩৩) সালভেনিয়া, (৩৪) দক্ষিণ আফ্রিকা, (৩৫) সুরিনাম, (৩৬) থাইল্যান্ড, (৩৭) ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, (৩৮) উগান্ডা, (৩৯) সংযুক্ত আমির শাহি।
১১ টি সীমাবদ্ধ বৈধ দেশগুলি হল–(১) অস্ট্রেলিয়া, (২) বাংলাদেশ, (৩) বুলগেরিয়া, (৪) আইসল্যান্ড, (৫)। ভারত, (৬) জাপান, (৭) মালয়েশিয়া, (৮) নরওয়ে, (৯) স্পেন, (১০) সুইডেন, (১১) ইউনাইটেড স্টেট।
এক গণিকালয়ের গণিকার স্বীকারোক্তি প্রকাশ করে যে, এটা আমেরিকার সর্বোচ্চ উপার্জন’। গণিকাবৃত্তি, যা আইনিভাবে স্বীকৃত, যেখানে বলে দেয় এই গণিকাবৃত্তির কাজে আসলে কী হয়! এখানে এই পেশায় গণিকাবৃত্তির সঙ্গে জড়িত কোনো নারী বা পুরুষ লজ্জা বোধ করেন না, বরং শরীরের সঙ্গে এমন আতিথেয়তায় তাঁরা খুবই সুখী। পরিসংখ্যানে তাঁরা হিসাব দেয় যে, কন্ডোম আর তৈলাক্ততায় (লুব্রিকেটিং) তাঁরা ১,৭৫০ পাউন্ড ব্যয় করে। শুধু তাই নয়, ৭,১১,০০০ পাউন্ডের বিনিময়ে তাঁদের নিজেদেরকে সেইভাবে সাজাতে হয়। সেরা সুন্দরীদের কাঁধে কাঁধ মেলাতে তাঁরা দৈনিক সময়ের সাথে ১২ ঘণ্টা থেকে ১৪ ঘণ্টা ব্যয় করে। এক একজনকে সেক্সপার্ট তাঁদের আঁকড়ে রেখেছেন। অনেকে তো নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছেন। ক্লায়েন্টরা যেমন কেউ ডিভোর্সি, কেউ কুমারী, কেউ কেউ বিধবাদের সঙ্গে সময় কাটাতে পছন্দ করে। অনেকেই অকপট স্বীকারোক্তি দিয়েছেন যে, তাঁরা আন্তরিকভাবে মনে করেন, এই যৌনমিলন স্বাস্থ্য আর সুস্থতার জন্য তাঁদের প্রয়োজন। এখানে দ্বিমত নেই যে, সবটুকুই স্বয়ংকৃত এবং মান্য। তাঁরা মনে করেন শারীরিক, মানসিকভাবে চরমভাবে প্রভাবিত—তাই অকপটেই বিনিময়।
এখানে ২০ বছর বয়স থেকে অনেকেই স্বাধীনভাবে ঠিকাদার যৌনকর্মী হিসাবে কাজ করেন। সেখানে প্রতিদিনকার রোজনামচা বলে, তাঁরা সকাল ৭ টায় ঘুম থেকে ওঠে। তাঁরা হাঁটতে বেরোয়। শুধু তাই নয়, তারপর তাঁরা মনোবিজ্ঞান শিক্ষায় প্রযুক্তিবিদ্যার সাহায্য নেয়। পড়াশোনা কখনোই বন্ধ থাকে না। মনোবিজ্ঞান, যৌনতা, সমাজবিজ্ঞান তাঁদের উপজীব্য বিষয়। অনলাইন ভিডিওগুলির সাহায্যে তাঁরা জনগণকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে পারে। আয়ারল্যান্ড এই বিষয়ে একটু পিছিয়ে থাকলেও যৌনকর্মীরা মনে করে তাঁদের বৈধতা আবশ্যক। তবে এটাও আশ্চর্যের বিষয় যে, এদের পরিবার এটাকে কেবল এক পেশা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। পরিবাররাও উন্মুক্ত সমর্থন দিয়েছেন এবং তাঁদের প্রতি যত্নশীল। সত্যিই সময় অনেক এগিয়ে গেছে, এখানে প্রযুক্তির সাহায্য নিজের কুমারিত্বকে নিলামে বৃহত্তর অংশ বলতে তাঁদের দ্বিধাবোধ হয় না। এখানে কোনো নির্দিষ্ট সম্প্রদায় নয়, ধর্ম নয়—বরং উন্মুক্ততা এসেছে মনে। তাই স্বীকৃতি গণিকাবৃত্তির।
তাঁরা মনে করে এই ধরনের কর্মজীবন সংক্ষিপ্ত, কিন্তু অবশ্যই লাভজনক। একরাতে তাঁরা ১০,০০০ ডলার উপার্জন করতে পারে, যা ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৭,০৩,৮৫০ রুপি। তাঁদের মতে, বেডরুমের দরজা আর আত্মসমান সহ প্রত্যাশায় উন্মুক্ত। হালকা গোলাপি ম্যানিকিউর, অ্যান্ডারওয়্যার তাঁদের পেশায় ভালোই অনুরণন তোলে। এঁদের মধ্যে অনেকেই প্রথম জীবনে পর্নোগ্রাফিতে অভ্যস্ত। পরে তাঁরা স্ট্রিপ ক্লাবে কাজ করেন, আর তারপরই তাঁরা শরীর তথা যৌনতা বিক্রি করতে নেমে পড়েন। কারণ এখানে ক্ষমতাই হৃদয়ের খবরদারি করে, আর তা পর্যাপ্ত না-হলেই সম্পর্কের বাঁধন ক্ষুণ্ণ হয়।
পরিসংখ্যান বলছে, উদাহরণস্বরূপ ব্লগিং কলগার্ল বেল্লে ডে জোর ( Belle de jour), উল্লেখযোগ্য। এরা ব্লগকে মাধ্যম করে, পিএইচডির সময় এই পেশায় আসে, আর যৌন-সম্পর্ক স্থাপনে সাফল্য লাভ করে পায়। শুধুমাত্র তাঁর উপার্জন একরাতে ১০,০০০ ডলার ছাপিরে ৪০,০০০ হাজার ডলার হয়ে যায়। কলগার্ল’ বেল্লে ডে জোর ১৯৬৭ সালে ক্যাথেরিন ডিনিউভের সঙ্গে একটি ছবিতে অভিনয়ও করেন। কান চলচ্চিত্র উৎসবে তিনি বিশ্বের সেরা হোটেলে ছিলেন। এমনকি প্রভাবশালী পুরুষদের হৃদয়ের আভিজাত্যের যৌনক্ষুধা মেটাতেন তিনি। যথার্থ রুচিপূর্ণ মানুষের সঙ্গিনী এঁরা। স্বীকারোক্তি বলে যে, ২০১২ সালে লিবিয়ার একনায়কতন্ত্রের ছেলের সঙ্গী হিসাবে যে অপরাধমূলক অভিযোগ ওঠে, সেখানে একরাতে এই পেশায় আয় ৪০,০০০ ডলার। স্বীকারোক্তিতে আরও অভিযোগ করে যে, সেন্ট ট্রোপজের মধ্যে এক নৌকাঁচালক আছেন। এই নৌকা তরতাজা মেয়েদেরকে বিনিয়োগে নামায়। তাঁরা মাদ্রাসায় নিয়োগ হয়, তবে সবই ধান্দার বাজারে বিকিয়ে যায়। বিকিয়ে যায় সিনেমার পরিচিত মুখ, টাকায় মুখে ঢাকা পড়ে অভিনয়। যৌনতার বয়স অর্থের কাছে তরুণ রক্তের উদ্দীপনা চায়। উল্লেখ্য, একজন সৌদি প্রিন্স এক মডেলের সঙ্গে রাত কাটালে, সেই মডেল এক রাতে ১০,০০০ ডলার লাভ করে, আবার তার থেকে বেশি অর্থ দিয়ে কেবল সেক্সর জন্য প্রায় ৯ থেকে ৯০ ভাগ সময় তাঁদের পুষতে পারে।
প্যরিস তো আবার এককাঠি উপরে। সেখানে যৌনকর্মীদের যৌনতার পাঠ দেওয়া হয় যৌনবিদ্যালয়ে। কী থাকে সিলেবাসে? আসুন, জেনে নিই—(১) এখানে যৌনতা করার সময় দৈহিক অবস্থান দেখানো হয়। (২) যৌনতা করার সময় মৌখিক (Oral Sex) সেরা যৌন সঞ্চালন দেখানো হয়। গলার দিকে শিথিল পেশির চলন, আর অন্যান্য পুরুষের অন্তর্ভুক্ত যা কিছু তা সম্যকভাবে শেখানো হয়। (৩) প্রতিনিধিত্ব এবং দাসত্ব—দুই ধরনের শরীরী খেলায় তার প্রভাব শেখানো হয়। (৪) আধিপত্যের ক্ষেত্রে কোর পেশি, জাং পেশি ভারসাম্য বিকাশে কীভাবে ক্রিয়া করে, তার গুরুত্ব বোঝানো হয়। (৫) কখন কীভাবে আঙ্গুল আর জিভের ব্যবহার করতে হবে, তা শেখানো হয়। (৬) গ্রুমিং ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা একান্ত প্রয়োজন। কারণ বিকিনির লাইনে কোনো চুল আছে কি না, আর কোনো অস্পষ্ট ক্ষত আছে কি না নিশ্চিত করার জন্য এই গ্রুমিংয়ের ব্যবস্থা। (৭) চোখে চোখ, প্রচণ্ড উত্তেজনায় চেহারায় উপভোগ, আর সঙ্গি বা সঙ্গিনীর সঙ্গে উত্তেজনায় উভয়পক্ষের ভোগ সম্পর্কে জানা। (৮) শরীরের কম্পন কীভাবে, কখন ব্যবহার করতে হবে, তা শেখানো। (৯) পরিতৃপ্তি সর্বাধিক করার জন্য একসঙ্গে কাজ করার পদ্ধতি শিক্ষা দেওয়া হয়। (১০) অবশেষে শেখানো হয়, পরিতৃপ্তি হলেই কাস্টমার টিকে থাকবে। এই পদ্ধতি হল বাণিজ্যিক। আর এর দ্বারাই নিয়মমাফিক নিত্য স্বাভাবিক চলনের সার্থকতা। অর্থাৎ টিকিয়ে রাখার প্রক্রিয়াকরণ যথার্থ করতেই এই শিক্ষা।
“Prostitution: Prices and Statistics of the Global Sex Trade” থেকে বিশ্বব্যাপী পতিতাবৃত্তি সম্পর্কে কিছু পরিসংখ্যান এবং তথ্য পাওয়া যায়। সারা বিশ্বে গণিকার সংখ্যা প্রায় ১৩,৮২৮,৭০০ টি। এটা সারা বিশ্বে কত গণিকা আছে তার আনুমানিক চিত্র। দেশগুলির গণিকার সংখ্যা বিপুল পরিমাণে পাবলিক উৎস থেকে সংগৃহীত হয়েছিল। উৎসগুলির মধ্যে রয়েছে—নিরাপত্তা পরিসেবা অনুমান, জনস্বাস্থ্য কর্মসূচির প্রতিবেদন এবং বিশ্বব্যাপী ফৌজদারি বিচার কার্যক্রম থেকে অন্যান্য পর্যবেক্ষণের তথ্য। এবার দেখে নিতে পারি, কোন্ দেশে কতজন গণিকা গণিকাবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত–(১) চিন ৫,০০,০০০ জন (২) ভারত ৩,০০,০০০ জন (৩) আমেরিকা ১,০০,০০০ জন (৪) ফিলিপিনস ৮,০০,০০০ জন (৫) মেক্সিকো ৫,০০,০০০ জন (৬) জার্মানি ৪,০০,০০০ জন (৭) ব্রাজিল ২,৫০,০০০ জন (৮) থাইল্যান্ড ২,৫০,০০০ জন (৯) বাংলাদেশ ২,০০,০০০ জন (১০) দক্ষিণ কোরিয়া ১,৪৭,০০০ জন (১১) তুরস্ক ১,১৮,০০০ জন (১২) তাইওয়ান ১,০০,০০০ জন (১৩) কাম্বোডিয়া ৭০,০০০ জন (১৪) ইউক্রেন ৬৭,৫০০ জন (১৫) ব্রিটেন ৫৮,০০০ জন (১৬) কেনিয়া ৫০,০০০ জন (১৭) ভিয়েতনাম ৩৩,০০০ জন (১৮) দক্ষিণ আফ্রিকা ৩০,০০০ জন (১৯) সংযুক্ত আরব শাহি ৩০,০০০ জন (২০) ফ্রান্স ২০,০০০ জন (২১) সুইজারল্যান্ড ২০,০০০ জন (২২) পোল্যান্ড ১৯,০০০ জন (২৩) মঙ্গোলিয়া ১৯,০০০ জন (২৪) ইসরায়েল ১৭,৫০০ জন (২৫) কোস্টা রিকা ১৫,০০০ জন (২৬) নেদারল্যান্ড (হল্যান্ড) ৭,০০০ জন (২৭) নিউজিল্যান্ড ৩,৫০০ জন (২৮) ডেনমার্ক ৩,২০০ জন (২৯) আয়ারল্যান্ড ১,০০০ জন।
সারা বিশ্বের যে দেশগুলি গণিকাবৃত্তিতে রাজস্ব আদায়ের নিরিখে প্রথম দশে আছে, সেই দশটি দেশের বেশ্যাবৃত্তির ইতিহাস, ভূগোল, অর্থনীতি বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করতে পারি। প্রথম দশের দেশগুলি হল যথাক্রমে–(১) চিন, (২) স্পেন, (৩) জাপান, (৪) জার্মান, (৫) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, (৬) দক্ষিণ কোরিয়া, (৭) ভারত, (৮) থাইল্যান্ড, (৯) ফিলিপাইন, (১০) তুরস্ক।
(১) চিন : উত্তর কোরিয়া নাম বললেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার আর চরম শাস্তির কথা মনে পড়ে। প্রায় ১০,০০০ উত্তর কোরিয়ার নারী ও মেয়েশিশু অবৈধভাবে শিকার। ২০০৫ সালের উৎস বলছে, গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ উত্তরদাতাদের মধ্যে নারী ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষ মানব পাচারের শিকার। এটা চিনে ‘ট্রাফিকিং’ নামে খ্যাত। ট্রাফিকেরা একপ্রকার লুট, ড্রাগ আটক বা অপহরণ করে। তারপর নারীরা ইন্টারনেট সেক্সের সাইটগুলির মাধ্যমে গণিকাবৃত্তিতে বাধ্য হয়, আর স্থান হয় নাইটক্লাবগুলিতে। উত্তর কোরিয়ার শ্রম উপনিবেশগুলিতে এই ধরনের পুনর্বাসন ব্যবস্থা রাখে। এখানে সবচেয়ে ভয়াবহতা হল যে, কেবলমাত্র চিনের জনগোষ্ঠীকে ‘উত্তর কোরিয়ার বিশুদ্ধ রক্ত রক্ষার জন্য’ নামে গর্ভপাত জোরদার করে। এমনকি ‘কোরীয় তরঙ্গ’-এর জনপ্রিয়তার কারণে দক্ষিণ কোরিয়া কলেজের মেয়েরা দালালদের দ্বারা চিন, হংকং, তাইওয়ান এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় গণিকাবৃত্তিতে সংযুক্তির জন্য প্রেরণা পায়। ২০১১ সালে ম্যাকাওতে চিনের মানুষের সেবা করার জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার পত্নীদের একটি বিশাল আংটি উন্মোচিত হয়েছিল। ম্যাকাওতে গণিকাবৃত্তি হিসাবে কাজ করার সময় কিছু কোরিয়ার নারী কিমিনস পরেন। ম্যাকাওতে অনেক জাপানি ‘অশ্লীল’ অভিনেত্রী গণিকা হিসাবে কাজ করে এবং তাঁদের গ্রাহকেরা সমৃদ্ধ হলেন চিনা পুরুষ। মঙ্গোলিয়ার নারী বেইজিংয়ে বার্লিতে গণিকাবৃত্তি হিসাবে কাজ করে।
উনিশ শতকে অথবা তার সমসাময়িক সময়ে পোর্তুগিজ গণিকারা ম্যাকুতে পরিচালিত হত। কিছু চৈনিক ব্যাবসায়ী ম্যাকু থেকে এসে পোর্তুগিজ গণিকাদের বিয়ে করত। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৩০ সালে সংহাইতে ৮০০০ হোয়াইট রাশিয়ান গণিকা ছিল। চিনা শহরগুলিতে অনেক ইউরোপীয় নারী নিজেদেরকে এসকর্ট হিসাবে বাজারে আকৃষ্ট করে। তাঁরা স্বাধীনভাবে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিজ্ঞাপনের কাজ করে। সাংহাইতে অনেক রাশিয়ান নারী গণিকা হিসাবে কাজ করে। এটা বলাই যায় যে, হার্বিনে রাশিয়ান গণিকা এবং আফ্রিকান ছাত্রদের পৃষ্ঠপোষকতাও প্রকট। অনেক ভিয়েতনামী নারী চিনের পুরুষদের যৌনতা প্রদান করে। গুয়াংজি সীমান্তে বিভিন্ন উপায়ে ভিয়েতনাম থেকে চিনের পাচারকারী হিসাবে ভিয়েতনামীরা নারী পাচারের শিকার। ভিয়েতনামের সঙ্গে চিন সীমান্তে ‘ভিয়েতনামী নারী মার্কেট তৈরি করা হয়। এটা কেবলমাত্র যৌনতা প্রদানের কেন্দ্র। এমনকি প্রতি বছর কেনিয়া, রুয়ান্ডা বা উগান্ডা থেকে হাজার হাজার নারী চিন, ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ার গণিকাদের মধ্যে যুক্ত হয়।
প্যালেস্টাইন সমাজে মহিলাদের যৌনতা, সেইসঙ্গে ফিলিস্তিনি-ইসরায়েলি দ্বন্দ্বের অবস্থা বিবেচনা করে সামাজিক-সাংস্কৃতিক দিকগুলি পরীক্ষা করা হয়। ওআইসিটাইপটি প্যালেস্টাইনী যৌথ পরিচয়কে শক্তিশালী করে উভয়ই এবং একই সময়ে একটি পিতৃতান্ত্রিক সমাজের মধ্যে তাঁদের যৌনতা কীভাবে পরিচালনা করা যায় সে বিষয়ে অল্পবয়সি নারীদের বার্তা প্রেরণ করে। হংকং গণিকাবৃত্তিতে বৈধতা অবাধ। চিনের চেয়েও এই স্থান গণিকাবৃত্তি উচ্চবৃত্তিতে বিশেষ আকার নিয়েছে। বাণিজ্যের কাজে অংশ নেওয়ার জন্য চিনের মহিলারা মূল ভূখণ্ড থেকে হংকং ও মাকাওয়ে ভ্রমণ করে। এই অভিযানে নারী পাচারের অভিযোগও আছে। এখন প্রশ্ন পাচারকারীর নারীরা কোথা থেকে এসেছে? পরিসংখ্যান বলছে, নারীরা মূল ভূখণ্ড চিন, মঙ্গোলিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ইউরোপ ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসে।
এলিজাবেথ হুইলার এন্ডরু ( ১৮৪৫- ১৯২৭) এবং ক্যাথারিন ক্যারোলিন বুশেলেল (১৮৫৬- ১৯৪৬), যাঁরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নারীদের অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে লিখেছিলেন। তাঁর কলমের উপাদান ছিল—হংকং তংকা বাসিন্দা, গণিকাবৃত্তি শিল্প এবং বিদেশি নাবিকদের জন্যে সরবরাহকারী। তংকারা চিনাদের সঙ্গে বিয়ে করে না। কিন্তু সেটা জলপথের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাঁরাই ব্রিটিশদের এই কাজে সহায়তা করে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল চিনা গণিকা পশ্চিমাদের সেবা করতে ভয় পায়। হংকংয়ের নিম্ন শ্রেণি ইউরোপীয়রা সহজেই তাতার গণিকাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। কান্টার প্রদেশে বেশিরভাগ চিনা নাগরিকের মধ্যে তংকা মহিলারা গণিকাবৃত্তিতে সীমাবদ্ধ ছিল। রিপাবলিকান যুগে গুমের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতেই গণিকাদের সংখ্যাও বেড়ে ওঠে।
মাঞ্চু ভ্রমণকারী কিয়াই-শি ১৭৭৭ সালে শিনজিয়াংয়ের করসাহরের এলাকায় তোরঘুত ও খোশোত নারীদের মধ্যে গণিকাবৃত্তির কথা বলেন। তিনি কাশগারে গণিকাবৃত্তির প্রসার সম্পর্কেও লিখেছেন যে, শিনজিয়াংয়ের কয়েকজন মাঞ্চু সৈন্য ও কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরে লন্ডন-তুর্কি পত্নীর সঙ্গে আঞ্চলিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। ১৯০০ সালে কাশগারের রাশিয়ার কর্মকর্তাদের দ্বারা গঠিত একটি পার্টিতে স্থানীয় তুর্কি (উইঘুর) নারীর উপস্থিতি রাশিয়ান রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষোভের সম্মুখীন হয়। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে স্কটিশ ধর্মপ্রচারক জর্জ ডব্লিউ হান্টার উল্লেখ করেছেন যে, তুর্কি মুসলমানদের দারিদ্র (উইঘুর) তাঁদের মেয়েদের বিক্রি করে দিত এবং এই প্রথাটি শিনজিয়াংকে তুলে ধরেছিল, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তুর্কি গণিকা ছিল। বিপরীতে, তিনি তুগান মুসলমানদের (হিউইউ) সম্প্রদায়ের মধ্যে খুব কম গণিকাবৃত্তি দেখেন। একই সময়ে ফিনল্যান্ডের সামরিক কর্মকর্তা কার্ল ম্যানেনহিম জানান যে, হোটেনের বিভিন্ন রাস্তাগুলি উইঘুর গণিকাদের দ্বারা বিনিময় করেছিল, যাঁরা ভ্রমণকারীদের সঙ্গে তাঁদের পরিসেবা বিক্রি করার জন্য বিশেষ অভিজ্ঞ ছিল। তুর্ন থেকে রেকর্ডগুলি ইঙ্গিত দেয় যে, শিনজিয়াংয়ের তুর্কি গণিকাদের গ্রাহকরা চিনের ব্যবসায়ীদের যথোপযুক্ত ছিল।
(২) স্পেন : স্পেনকে বলা হয় গণিকাবৃত্তিতে বিশ্বের রাজধানী। গণিকাবৃত্তি স্পেনে এত জনপ্রিয় (এবং সামাজিকভাবেও গ্রহণযোগ্য) যে, জাতিসংঘের গবেষণায় দেখা গেছে যে, স্পেনীয় পুরুষদের ৩৯ শতাংশই অন্তত একবার গণিকা সেবা গ্রহণ করেছে। ২০০৯ সালে স্প্যানিশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক জরিপে দেখা গেছে, একবার গণিকা ব্যবহারকারীদের হার ৩২ শতাংশ। জাতিসংঘের সংখ্যা কম, সম্ভবত ১৪ শতাংশের চেয়েও বেশি, উদারমনস্ক হল্যান্ড বা ব্রিটেনের তুলনায় অনেক বেশি। ৫ এবং ১০ শতাংশ মধ্যে ‘Oscillate’ রিপোর্ট করা হয় এবং শুধু পুরুষরা এটা স্বীকার করতে ইচ্ছুক ছিল। এই বিশাল চাহিদা পূরণের জন্য স্পেনের প্রায় ৩,০০,০০০ গণিকা স্পেনে কাজ করছে। অন্ধকার নামতেই শহরের কেন্দ্রস্থলগুলিতে, যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট, রাস্তার পাশে একচেটিয়া বার, শ্যাম্পেনের পকেটগুলো বা নমনীয় নারীদের শেপিং লক্ষণ দ্বারা সর্বশেষে স্বীকৃত। সম্প্রতি ১৮০ জন যৌনকর্মী সহ ফরাসি সীমান্তে ক্লাব প্যারাডাইজ খোলা হয়েছিল, এটি ইউরোপের বৃহত্তম গণিকালয় হিসাবে গড়ে উঠল। ক্লাব বড়ো হলেও কম বয়সি ক্লায়েন্টদের প্রত্যাশা পূরণ করে।
‘Spanish Association for the Social Reintegration of Female Prostitutes’ দ্বারা পরিচালিত গবেষণা বলছে, ১৯৯৮ সালে সাধারণ ক্লায়েন্টের মধ্যে ৪০ বছর বয়সি পুরুষদের প্রাধান্য ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ২০০৭ সালে সেই বয়সের ক্রম অনেক কমে গেছে। এখন প্রশ্ন হল, কমবয়সিরা কেন গণিকালয়ে যাচ্ছে? উত্তর হল, তাঁরা এই ক্ষেত্রে সবকিছু খুব দ্রুত পেয়ে যাচ্ছে, যেটা তাঁদের ইচ্ছার সঙ্গে সহমত আর চাহিদার সঙ্গে জোগান সহজলভ্য। যেখানে শরীর কেনাবেচাতে টাকা দেওয়ার অর্থ হল অধিকার বোধ জন্মানো। অধিকারের সঙ্গে ক্ষমতা মানে ইচ্ছার অপমৃত্যু, বর্বরতার জয়। তবে এটা খুব নির্মম, এটা কিন্তু বলা যায় না। কারণ সহজলভ্য উষ্ণতা যদি প্রয়োজনে দেহকামনার সঙ্গে এক হয়ে কেবল অর্থকে ভিত্তি করে ব্যাবসার নামে পরিসেবার রূপ নেয়, তাহলে হয়তো সেটা অধিক প্রয়োজনে, নিমর্মতা মোটেই নয়।
এখন প্রশ্ন হল, তবে কি দেহজ কারণই একমাত্র কারণ? না, কেবলমাত্র দেহজ নয়। বরং স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যক্তি স্বাধীনতা বোধকে প্রতিষ্ঠা করতেই এই গণিকাবৃত্তির রমরমা। ফ্রাঙ্কো যুগে সংকীর্ণতাভিত্তিক পরিবারের চাপ একসময় গণিকালয়গুলি নিষিদ্ধ করে দেয়। ১৯৩৫ সালে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রেও গণিকাবৃত্তি নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৩৯ সালে ‘ডিকটেটরশিপ’ (একনায়কতন্ত্র) প্রতিষ্ঠা হয়। সে সময় যৌনকর্মের ক্ষেত্রে যৌনপল্লিগুলি প্রায় একঘরে হয়ে যায়। এটা ছিল সেই সময়ের একনায়কতন্ত্রের প্রভাব। যেহেতু সময় কখনও থেমে থাকে না, যেহেতু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়, এক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটল। তবে ১৯৪১ সালে এই আইন বাতিল হয়। ১৯৬২ সালে ১৮ জুন স্পেনে প্রাচীনপন্থী স্পেনীয়ভাব বিলুপ্ত হয়। গোপন ইচ্ছার অগোচর সমৃদ্ধি একনায়কের ইন্দ্রপতনে মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। অর্থাৎ কেবলমাত্র স্পৃহা নয়, সংকীর্ণ চাপের ঊর্ধ্বে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করাই মূল কারণ। তবে ধীরে ধীরে গণিকাবৃত্তি বর্তমানে ইয়োলো পেজে স্থান পেয়েছে। স্প্যানিশ প্রদেশে ১৯৮০-এর দশকে একজন যদি গণিকালয়ে রাত কাটাতেন, তবে সেটা কুমারীত্ব হারানোর বিষয়ের মধ্যে গণ্য হত না। এবার তাহলে বুঝতেই হয় যে, যৌনবৃত্তি ক্ষুগ্নিবৃত্তির মতোই নিবৃত্তি ভোজনের সাধারণ অনুসঙ্গ ছাড়া আর কিছুই নয়।
১৯৯০ সালে ম্যাগাজিন, ইন্টারভিউ এবং অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিকেরা Spanish Lover Guide’ প্রকাশ করে নিজেরা কৃতিত্ব অর্জন করতেন। বর্তমানেও যে ক্লায়েন্ট’ কথাটার গুরুত্ব হারায়নি, তা কিন্তু কথার মূলে শব্দপ্রয়োগ থেকেই বোধগম্য হয়। যদি ফ্রাঙ্কো যুগের সংকীর্ণতাভিত্তিক পরিবারের চাপ বর্তমানে গণিকাবৃত্তি সমর্থনের মূল কারণ হয়, তবে বর্তমানে দামি সংবাদপত্রগুলিতে যৌনকর্মীর জন্য বিজ্ঞাপন ‘যৌনবিপ্লব’ নামে অভিহিত হয়। কারণ পুরানো ভিত্তি নয়, বরং স্বৈরাচারের পতন আর স্বাভাবিক সাবলীলতার জয়ই হল ‘যৌনবিপ্লব’ শব্দের পরিচায়ক। উল্লেখ্য, এখনও একটি প্রধান ‘জাতীয় দৈনিক মাদ্রিদ’-এ ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ বিজ্ঞাপন গণিকাদের জন্য, আর তাদের কাছ থেকে সমস্ত রকম পরিসেবার জন্য বিবিধ মূল্য নির্দিষ্ট বিজ্ঞাপনে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়। এখন প্রশ্ন হল বিজ্ঞাপনগুলি দূর করা কি সম্ভব নয়? আসলে স্পেনের মুদ্রণের মাধ্যমে অনিশ্চিত অর্থনৈতিক রাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে এবং এটি ন্যায়সংগত।
যাই হোক, স্পেনে এই পেশা বাণিজ্যিক ধারার স্বীকৃত হলেও বাস্তবে পেশা বলতে যা বোঝায়, তার কোনো স্বীকৃতি নেই। ২০০৯ সালে শুধুমাত্র স্বরাষ্ট্রমন্ত্রালয় ১৭ টি আন্তর্জাতিক অপরাধের মূলে যৌনকর্মকে দায়ী করেছে। ১৯১৯ সালেই জানুয়ারি আর এপ্রিল মাসে ‘El Pais’ পত্রিকার মতে, কর্তৃপক্ষ যৌনদাসত্বে ক্রীত মহিলাদের ৪৯৩ টি মামলা দায়ের করে। মাদ্রিদভিত্তিক এনজিও ‘প্রোকেক্টো এসপেরা’-র মুখপাত্র মার্টা গঞ্জালেজ মত প্রকাশ করেন যে, নারী বিক্রির জন্য সম্পূর্ণ অসচেতনতাই দায়ী। এখানে ক্লায়েন্টরা বেশিরভাগ সময়েই বুঝতে পারেন না যে, এটি তাঁদের পরিবারের জন্য একটি মৃত্যু হুমকিস্বরূপ, তাই সচেতনতা একান্ত আবশ্যক।
স্পেনের গণিকাবৃত্তি কোনো নির্দিষ্ট আইনের দ্বারা সংযত নয়, তবে কিছু ক্ষেত্রে অবৈধ। জাতিসংঘের হিসাব অনুসারে স্পেনে ৭০,২৬৮ গণিকালয় আছে। গণিকাবৃত্তি সরাসরি স্পেনের ফৌজদারি কোডে অন্তর্ভুক্ত নয়, তবে পিং পিং হিসাবে অবৈধ। সেক্ষেত্রে ১৮৮ ধারা একমাত্র নিষিদ্ধ ধারা, বিশেষ করে পিং পিং দের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এই ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ ভীতি প্রদর্শন, শঠতা বা প্রয়োজনের শিকার হয়, তবে ১২ থেকে ২৪ মাসের জেল হতে পারে।
তবে কি স্পেন গণিকাবৃত্তি স্বীকার করেনি কোনোদিন? মধ্যযুগে কিন্তু স্পেনে গণিকাবৃত্তিকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। সতেরো শতকে চতুর্থ ফিলিপের ফরমানে এটি বন্ধ হয়। উনিশ শতকের পর ইসাবেল দ্বিতীয় রাজত্বকালে এই প্রথা আবার শহরে চালু হয়, রমরমিয়ে এই ব্যাবসা বাড়াবাড়ির চূড়ান্ত পর্যায়ে যায়। ১৯৩৫ সালে আবার এই গণিকাবৃত্তি নিষিদ্ধ হয়, শুরু হয় একনায়কতন্ত্র, বাতিল হয়ে যায় এই আইন। ১৯৭৫ সালে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। পায়। ১৯৯৯ আরও সংশোধন করা হয় এবং এই যৌন-ব্যভিচারের শিকারদের আশ্রয় প্রদান করা হয়।
২০০৯ সালের TAMPEP গবেষণার মতে, শতকরা ৯৫ শতাংশ যৌনকর্মী অভিবাসী। প্রায় শতকরা ৮০ শতাংশ লাতিন আমেরিকান (প্রধানত ইকুয়েডর, কলম্বিয়া এবং ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র থেকে)। তবে পূর্ব। ইউরোপীয় অভিবাসী (প্রধানত রোমানিয়া ও বুলগেরিয়া) আগমনের কারণে পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে।
ইমিগ্রেশন প্রসঙ্গে স্পেন উল্লেখযোগ্য। ২০০৮ সালে স্প্যানিশ সরকার পাচার করা নারীদের সাহায্য করার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিল। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১২ থেকে সেপ্টেম্বর ২০১৩ পর্যন্ত বার্সেলোনার এশিয়ান ১৩৮ টি পরিদর্শনে ৫৪৪ গণিকা সনাক্ত করা হয়েছিল। ৩০ নভেম্বর ২০১২ সালে প্যারাগুয়ে থেকে ৩৪ বছর বয়সি একজন মহিলা কুয়েনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, তখন তিনি তাঁর মেয়ের সঙ্গে একটি গণিকা করছিলেন।
স্পেনের যৌনকর্মীদের সঙ্গে কাজ করার সংস্থাগুলির মধ্যে আছে এপিআরএএমপিপি (অ্যাসোসিয়েশন প্যারা লা প্রেভেনসিওন, রেইন্সরসিওন ইয় এটেনসিওন দে লা মুজার প্রোফ্লুইটিডাডা) যৌনকর্মীদের অধিকার সংগঠন হিটাইরা (মাদ্রিদ), সেইসঙ্গে আঞ্চলিক সংগঠন যেমন এসআইসিএর অস্টুরিয়াস, এএমটিটিসিএসইএ (অ্যাসোসিয়েশন দে মুজিরেস), ট্রানসুকেসেলস ইয়ে ট্রাভিস্টিস কমো ট্র্যাজেজাদাসাস স্পেসিস এ এস স্পনা, মালাগা) এবং সিএটিএস (কমেট দে অ্যাপোও লাস ট্র্যাজাজাদাসার ডেল সেক্সো, মুরসিয়া)। স্প্যানিশ যৌনকর্মীরা তাঁদের সুরক্ষার অভাব সম্পর্কে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করে। একটি যোগাযোগ মাধ্যম যৌনকর্মীদের অভিযোগগুলি নির্ধারণের জন্য প্রকাশ করে। স্প্যানিশ সংস্কৃতি যৌনকেন্দ্র হল গোয়া। স্পেন যৌন-পাচারের শিকার নারী এবং শিশুদের জন্য ট্রানজিট দেশ। স্পেনের পাচারকারীরা লিবিয়া থেকে মরোক্কো পর্যন্ত পৌঁছে যায় এবং এখানে সাগরের দক্ষিণে স্পেনে স্থানান্তরিত হয়।
কিছু ইন্টারনেট সূত্র সত্ত্বেও স্পেনের গণিকাবৃত্তি আইনি বলে দাবি করে, সত্য হল যৌনকর্মীরা আইনি ভ্যাকুয়ামেই আছে। যৌন শ্রমিকদের দণ্ডিত করা হয় না, বরং এর পরিবর্তে ক্রয়কারীরা আইন দ্বারা শাস্তি পায়। স্পেনের ৯০ শতাংশ যৌনকর্মী মানব পাচারের শিকার বলে মনে করা হয়, যা আইনতভাবে জটিল মনে হতে পারে। ১৯৫৬ সাল থেকে গণিকালয়গুলি স্পেনে অবৈধ ছিল। কিন্তু আজকাল তাদের বেশিরভাগই ‘হেসেস্টারিয়া’ বা ‘ক্লাব’ হিসাবে ছদ্মবেশী এবং স্বাভাবিক হিসাবে কাজ করার জন্য আছে। স্পেনের কিছু অংশে বার্সেলোনা সহ যৌনকর্মী ও তার ক্লায়েন্ট উভয়ের বিরুদ্ধে মামলা করা যেতে পারে। সত্যিকার অর্থে, স্পেনের গণিকাবৃত্তি অন্যান্য দেশের মতো কলঙ্কিত নয়। সাধারণ মানুষ বার্সেলোনার গ্রান ভিয়া এবং বার্সেলোনায় লাস রাযাম্বলাসের মতো খোলা জায়গাগুলিতে যৌনকর্মীদের কাছে আসতে পারেন, যা অনেকগুলি স্প্যানিশ শহরের একটি সম্পূর্ণ সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গির মতো মনে হয়। স্পেনের গণিকাবৃত্তি নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্যকর ব্যাপার নয়, এটি নেদারল্যান্ডস বলে। হিউম্যান ট্র্যাফিকিং বা মানব পাচার হল গুরুতর বিশ্বব্যাপী সমস্যা এবং শোষিত যৌনকর্মীদের নিয়োগের জন্য কিছুটা অসন্তুষ্ট ক্রিয়াকলাপ, যা সরাসরি অর্থোপার্জনে সহায়ক।
(৩) জাপান : জাপানে গণিকাবৃত্তির প্রাচীন ইতিহাসের উৎস সহজলভ্য নয়। কারণ হয়তো এই বৃত্তি রুচিসম্মত নয় বলেই ইতিহাসের প্রাচীনকাল কেউ রচনা করার প্রয়োজন বোধ করেনি। জাপানে ঠিক কবে ঠিক কোন্ অঞ্চলে প্রথম যৌনপেশার অভ্যুদয় হয়েছিল, সেটা জানতে হলে ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন। তবে কিছু তথ্য দেওয়া যেতেই পারে। প্রাচীনকালে জাপানের গণিকাবৃত্তি জাপানি সমাজে একটি বুনকা’ (সংস্কৃতি) হিসাবে দেখা হত। জাপানি ভাষায় যৌনকর্মীদের নানা শব্দবন্ধে বলা হয়েছে, যেমন–ইউজো, আসোবি মে, তাইউ, ওইরান, শোওবাই ওননা, কুগুৎসুমে, শিরাবিয়োশি, জোরোও, ইউকুন, শোওগি, গেই, গেইজুৎসু, গেইশাবুনকা, ইউনা, অদোরিকো, হাকুজিন, জোকাবুকি ইত্যাদি।
জাপানের গণিকাবৃত্তিকে কয়েকটা যুগে ভাগ করা যায়। ৭১০ সাল থেকে ৭৯৪ সাল পর্যন্তকে বলা হয় নারা যুগ’, ৭৯৪ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্তকে বলা হয় হেইয়ান যুগ’, ১১৮৫ সাল থেকে ১৩৩৩ সাল পর্যন্ত সময়কে বলা হয় “কামাকুরা যুগ’, ১৩৩৩ সাল থেকে ১৫৭৩ ‘মুরোমাচি যুগ’, ১৪৬৭ সাল থেকে ১৫৭৩ সাল পর্যন্ত ‘গৃহযুদ্ধের যুগ’ বা ‘ছেনগোকু জিদাই’-ও বলা হয়, ১৬০৩ সাল থেকে ১৬৬৮ সাল পর্যন্ত এদো যুগ। এই সময়কালে জাপানিদের শরীর বিক্রি বা যৌনপেশার কথা জানা যায়। এই সময়কালে আমরা ‘ইউজো’ বা আসোবি মে’ শব্দবন্ধের গণিকানারীদের কথা জানতে পারে। এঁরা যেমন শরীর বিক্রি করে অর্থ রোজগার করতেন, তেমনি নাচ-গান-অভিনয় করেও অর্থ রোজগার করত। মানয়োওশুউ’ (সহস্র পাতার বই) নামে এক প্রাচীন কবিতা-সংকলনে এইসব নারীদের ‘উকারে মে’ বা ‘ইউকোওজোফু’ বলা হয়েছে। নারা যুগ থেকে হেইয়ান যুগ পর্যন্ত ‘মিকো’ বা ‘ফুজো’ শব্দবন্ধের যুবতী নারীরা শিন্তো জিনজা মন্দিরে সেবাদাসী হিসাবে কাজ করত। এইসব সেবাদাসী বা দেবদাসীদের কেউ কেউ বিভিন্ন সরাইখানা, হাটবাজার, নদীবন্দর প্রভৃতি জায়গাগুলিতে গিয়ে বিনোদন যেমন দিত তেমন যৌনসেবাতেও লিপ্ত হতেন। জাপানি সমাজে এঁদের জন্য শব্দবন্ধ বরাদ্দ হয়েছে ইউজো’ বা ‘আসোবি মে’। মুরোমাচি যুগে জাপানের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে ‘কোওশোকুকা’ অর্থাৎ ‘অশোভন এবং ‘কেইসেইইয়া’ অর্থাৎ ‘রাজকীয় গণিকালয়’ নামে গণিকালয় গড়ে উঠেছিল ব্যক্তিগত উদ্যোগে। জানা যায় সে সময়ে সুজিকো নামে এক ধনী গণিকা একটি বড়ো গণিকালয় প্রতিষ্ঠা করেছিল। এদো যুগের প্রথম দিকে জাপানের কিয়োতো নগরে ইজুমো-নো-ওকুনি নামে এক প্রভাবশালী ও লাস্যময়ী নারীর কথা জানা যায়, যিনি পক্ষান্তরে গণিকা ছিল। তিনি হাজার হাজার গণিকাদের পরিচালনা করতেন। এমন অবস্থা হয় যে, কিয়োতো নগরের চারিদিক ভাসমান গণিকা ছড়িয়ে পড়ে যেনবিপর্যস্ত অবস্থা। এই বিপর্যস্ততা থেকে রেহাই পেতে বা সমাজকে রক্ষা করতে ভাসমান গণিকাদের একত্রিত করে জাপানের প্রথম গণিকালয়টি স্থাপন হয়। এরপর ওসাকা ও এদো শহরেও গণিকালয় স্থাপিত হয়। তবে জাপানের সামুরাই শাসক তোয়োতোমি হিদেয়োশির রাজত্বকালে শাসক অনুমোদিত প্রথম গণিকালয়টি স্থাপিত হয়। সেই গণিকালয়ের মালিকের নাম ছিল সাবুরোজোয়েমোন হারা।
জাপানের এদো শহর। ১৫০০ সালে যে শহরের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ১০০০ জন। ১৬০০ সালে জনসংখ্যা এসে দাঁড়ায় ১,৫০,০০ জনে। ১৭০০ সালে সেই সংখ্যা এসে পৌঁছোয় ১ কোটিতে। মানুষের জৈবিক চাহিদা মেটাতে এ শহরে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে স্থাপিত হল স্বর্গীয় প্রমোদপুরী, যার নাম দেওয়া হল জাপানি ভাষায় ‘য়োশিওয়ারা, বাংলা অর্থ দাঁড়ায় গণিকালয়। এদো বাকুফুর কেন্দ্রীয় প্রশাসনের প্রচুর সৈন্যসামন্ত, সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সাধারণ কর্মচারী ছিল। বিশাল সেনাবাহিনীর অধিকাংশই ছিলেন অবিবাহিত যুবক। এমনিতেই এদো যুগে মেয়েদের চেয়ে পুরুষের সংখ্যা ছিল অস্বাভাবিক বেশি। একজন নারীপ্রতি আটজন পুরুষ। ফলে সকলের পক্ষে বিয়ে করে যৌনজীবন ভোগ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। অতএব যৌনচাহিদা মেটাতে শহরের প্রায় সর্বত্র গণিকালয় গড়ে উঠেছিল গোপনে। শুধু এদো শহরেই নয়, দেশের অন্যান্য শহরেও গণিকালয় গড়ে উঠেছিল। ১৬১২ সালে জিনয়েমোন শোউজি নামে এক ব্যক্তি গণিকাদের জন্য একটি সংরক্ষিত পরিবেষ্টন তৈরির আবেদন করেন সরকারের কাছে। অনুমোদন মিলল না। জিনয়েমোন দমে না-গিয়ে পুনঃপুনঃ চেষ্টা করতে লাগলেন অনুমোদন পাওয়ার জন্য। অবশেষে ১৬১৭ সালে অনুমোদন মিলে গেল। স্থাপিত হল গণিকালয়। অনুমোদনের সঙ্গে সঙ্গে সরকার কিছু নিয়মকানুনও বেঁধে দিল। যেমন–(১) গণিকালয়ে তালিকাভুক্ত গণিকাদের পরিবেষ্টনের ভিতরেই থাকতে হবে। পরিবেষ্টনের বাইরে কোথাও গিয়ে তাঁরা যৌনব্যাবসা করতে পারবে না। কোনো ক্লায়েন্টের সঙ্গে বাইরে কোথাও যেতে পারবে না। (২) গণিকারা জমকালো পোশাক দামি অলংকারে সাজতে পারবে না। (৩) কোনো ক্লায়েন্ট ২৪ ঘণ্টার মধ্যে একবার এসে নির্দিষ্ট সময়ের বেশি থাকতে পারবে না। (৪) পরিবেষ্টিত এলাকার অভ্যন্তরে উঁচু বাড়িঘর নির্মাণ করতে পারবে না ইত্যাদি।
য়োশিওয়ারা পুরুষদের জন্য যৌন-উপভোগের আনন্দ-অমরাবতী হলেও মেয়েদের জন্য ছিল দাসত্ব। কারণ এখানে ঢোকার পর বেরোবার আর কোনো উপায় ছিল না। ৯-১০ বছর বয়সি মেয়েদের গরিব বাবা-মায়েরা যোশিওয়ারাতে বিক্রি করে দিতেন। সেইসব শিশুকন্যাদের বড়ো হওয়া পর্যন্ত যোশিওয়ারা কর্তৃপক্ষ প্রচুর টাকা খরচ করত। ভোগযোগ্য হয়ে উঠলে তবেই গণিকাপেশায় নিযুক্ত করত। গণিকাদের কেশসজ্জার কাজ করতেন অভিজ্ঞ নর-নারী। ক্লায়েন্টের কাছে আরও আবেদনময়ী করার জন্য গণিকাদের যৌনকেশ চর্চা করতে হত। যৌনাঙ্গের উপরিভাগে ‘ইরেজুমি’ (উল্কি) আঁকাতে হত। তাঁদের বিক্রয়কল্পে যে টাকা বাবা-মাকে দিতে হত, সেই টাকা মেয়েদেরই শোধ করতে হত। এককালীন শোধ করা ছিল প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। তাই সেখান থেকে মুক্তি মৃত্যুর আগে মিলত না। এইসব মেয়েরা বাকি জীবনে মাত্র তিনবার ছুটি পেত। বাবা ও মায়ের মৃত্যুর পর এবং হানামি নামে একটি উৎসবে। এই বন্দিদশা থেকে উদ্ধারের একমাত্র পথ ছিল টাকা শোধ করা। যদিও সেই বিপুল পরিমাণের টাকা নিজের থেকে শোধ করা যেত। কিন্তু তা তো হওয়ার জো নেই। কারণ তাঁরা গণিকালয়ে যৌনকর্মী হিসাবে চাকরি করত মাত্র। পারিশ্রমিক হিসাবে যা পেত, তা দিয়ে নিজের চলাই কঠিন হয়ে যেত। তা থেকে অর্থ সঞ্চয় করে শোধ দেওয়া তো আকাশকুসুম।
জাপানে গণিকাবৃত্তি সে দেশের ইতিহাস থেকে পাওয়া যায়। জাপানে গোটা দেশ জুড়ে হাজার হাজার ‘ওনছেন’ রিসর্ট হোটেল থাকে, যেখানে ‘কলগার্ল’ ও ‘কম্পেনিয়ন’ বলে পরিচিত, যাঁদের নিয়ে রাত্রিযাপন করা হয়। প্রাচীন ও মধ্যযুগ থেকে তো বটেই, আধুনিক যুগেও মেয়েরা গণিকাবৃত্তির সঙ্গে আছে। পণ্যপ্রস্তুতকারী সংস্থা ও চলচ্চিত্র বিষয়ক পোস্টারে নগ্নপ্রায় নারী না-থাকলে সেগুলি কোনো পোস্টারই নয়। জাপানিরা যৌনতা বিষয়ে খুবই সচেতন। গণিকাদের প্রকাশ্যে ফুওজোকু’ বা ‘বাইশুন’ বলা যায় না, বলতে হয় ‘সেক্স ওয়ার্কার’। জাপানি ‘বুনকা’ শব্দটির বাংলা অর্থ সংস্কৃতি। ফুওজোকু বুনকা’, ‘বাইশুন বুনকা’ শব্দগুলির বাংলা অর্থ দাঁড়ায় গণিকা সংস্কৃতি। এই বুনকার পিছনে প্রতিদিন কোটি কোটি ইয়েন-ডলার বিনিয়োগ হয়ে চলেছে। ৮০ ও ৯০ দশকে উপচে পড়া বাব অর্থনীতির রমরমা অবস্থার প্রভাবে জাপানি পুরুষরা দল বেঁধে ফিলিপিন্স ও থাইল্যান্ডের গণিকালয়ের তরুণীদের সঙ্গে যৌন-উপভোগ করার জন্য যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল।
জাপানের আধুনিক সমাজব্যবস্থায় গণিকা সংস্কৃতি ধরে না-রাখলে বড়ো বড়ো লেনদেন, আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ ব্যাবসা-বাণিজ্য এবং দেশ-জাতির কলুষতা রক্ষা করা কঠিন।
আধুনিক যুগে ১৯৫৬ সালের ‘গণিকাবৃত্তি বিরোধী আইন অনুসারে কোনো ব্যক্তি গণিকাবৃত্তি করতে পারে না বা তাঁর গ্রাহক হয়ে উঠতে পারে না।” উদার ব্যাখ্যা এবং আইন শূন্য প্রয়োগে যৌনশিল্পকে উন্নতি করতে প্রতি বছর আনুমানিক ২.৩ ট্রিলিয়ন ইয়েন আয়কে ২৪ বিলিয়ন ডলার করে দেওয়া হয়েছে। জাপানের ‘যৌনশিল্প’ কিন্তু গণিকাবৃত্তির সমার্থক নয়। যেহেতু জাপানি আইন গণিকাবৃত্তিকে ‘অর্থের বিনিময়ে অনির্দিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে যৌন-সম্পর্ক হিসাবে সংজ্ঞায়িত করে, তাই বেশিরভাগ ফুজুকু কেবল কথোপকথন, নৃত্য বা স্নানের মতো আইন-কানুন পরিসেবাগুলি অফার করে আইনিবলেই। তবুও এমআইডাব্লিউ এবং জাপানের ন্যাশনাল উইমেনস এডুকেশন সেন্টারের জরিপে দেখা গেছে যে, শতকরা ২০ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত জাপানি পুরুষ যৌনতার জন্য অর্থ প্রদান করেছে।
পঞ্চদশতম শতাব্দী থেকে চিনা, কোরিয়াব এবং অন্যান্য পূর্ব এশিয়ায় দর্শকরা জাপানে গণিকাবৃত্তি ঘটিয়েছিল। পরে এই অনুশীলনটি ‘পশ্চিমাঞ্চলীয় অঞ্চল থেকে আসা দর্শকদের মধ্যে অব্যাহত থাকে। পোর্তুগিজ দর্শনার্থীরা এবং তাঁদের দক্ষিণ এশীয় ও আফ্রিকান ক্রু সদস্যরা প্রায়ই জাপান দাসত্বের সঙ্গে জড়িত ছিল। তাঁরা জাপানি নারী ও মেয়েদের ক্রীত হিসাবে ধরে নিয়েছিল। তাঁদের জাহাজে যৌন ক্রীতদাস হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল, অথবা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আমেরিকা ও ভারত, ম্যাকাও এবং অন্যান্য পোর্তুগিজ উপনিবেশগুলিতেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দ্রুত জাপানের অধিনায়ক এবং সৈন্যদের সেবা করার জন্য নারুহিকো হিগাশিকুনি সরকারের গণিকাবৃত্তি সংগঠিত করার জন্য বিনোদন ও বিনোদন সমিতি গঠিত হয়। ১৯৪৫ সালের ১৯ আগস্ট, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জাপানি জাতিটির ‘বিশুদ্ধতা রক্ষা করার জন্য সহযোগী সৈন্যদের জন্য গণিকাবৃত্তি সেবা প্রতিষ্ঠার জন্য স্থানীয় সরকারি কার্যালয়কে আদেশ দেয়। এই গণিকাবৃত্তি ব্যবস্থাটি সান্ত্বনা ব্যবস্থার অনুরূপ ছিল। কারণ জাপানি পুলিশ বাহিনী এই কেন্দ্রগুলিতে নারীদের গণিকাবৃত্তি জোরদার করার জন্য সচেষ্ট ছিল। একইভাবে প্যাসিফিক যুদ্ধের সময় জাপানি সেনাবাহিনী নারীদের জোরপূর্বক গণিকাদের ভোগ করেছে। পুলিশ বাহিনী এই ক্যাম্পগুলিতে সেবা করার জন্য লাইসেন্সপ্রাপ্ত এবং লাইসেন্সহীন উভয় গণিকাদেরই জোরপূর্বক ভোগ করেছে। সরকারি ঘোষণায় বলা হয়েছে, “শোয়া যুগের হাজার হাজার ‘ওকিচিস’ উৎসর্গের মাধ্যমে, আমরা দখলি সৈন্যদের পাগলামো উন্মত্ততা ধরে রাখতে এবং ভবিষ্যতে দীর্ঘদিন ধরে আমাদের জাতিটির বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে এবং সংরক্ষণ করতে পারি।” এই ধরনের ক্লাব মন্ত্রিপরিষদ কাউন্সিলর ইয়োশিও কোডমা এবং রয়াইচি সাসাকাওয়া দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
১৯৪৬ সালে SCAP (Security Content Automation Protocal) লাইসেন্সপ্রাপ্ত গণিকাবৃত্তি ব্যবস্থাকে বাতিল করে দেয়। যার ফলে তথাকথিত আকসেন (লাল লাইন) সিস্টেম, যার অধীনে লাইসেন্সকৃত নাইট লাইফ প্রতিষ্ঠানগুলি একটি সাধারণ ক্লাব বা ক্যাফে হিসাবে বিবেচনার ভিত্তিতে যৌন পরিসেবা দিতে শুরু করে। মানচিত্রের উপর ‘লাল লাইন’ অঙ্কন করে স্থানীয় পুলিশ কর্তৃপক্ষ ঐতিহ্যগতভাবে এই ধরনের স্থাপনার অবস্থান নিয়ন্ত্রণ করে। অন্য এলাকায়, তথাকথিত ‘নীল লাইন প্রতিষ্ঠানগুলি রেস্টুরেন্ট, বার বা অন্যান্য ক্ষেত্রে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত স্থাপনাগুলির বিকাশের অধীনে যৌন-পরিসেবাগুলি সরবরাহ করেছিল। টোকিওতে সুপরিচিত ‘লাল লাইন’ জেলাগুলিতে যশিওয়ারা ও শিনজুকু ২-চোম ছিল, যেখানে সুপরিচিত ‘নীল লাইন’ জেলা ছিল কাবুকি-চ। ১৯৪৭ সালে সাম্রাজ্য অধ্যাদেশ (৯ নং) নারীকে গণিকা হিসাবে কাজ করার জন্য প্ররোচিত করে। যদিও গণিকাবৃত্তি আইনি ছিল। বেশিরভাগ বিল গণিকাবৃত্তি করার জন্য আরও আইনি জরিমানা জোগানোর জন্য নিয়ন্ত্রণগুলি প্রবর্তিত হয়েছিল। কিন্তু শাস্তিযোগ্য পর্যায়ে বিরোধের কারণে পাস করা হয়নি। ১৯৫৬ সালের ২৪ মে জাপানের ডায়েট এন্টি-গণিকাবৃত্তি আইন পাস করে, যা ১৯৫৮ সালের এপ্রিল মাসে কার্যকর হয়েছিল। এন্টি-গণিকাবৃত্তির আইন প্রকৃত বা প্রতিশ্রুত ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে যৌনমিলনের কাজকে অপরাধী করে। এটি ‘লাল লাইন’ এবং ‘নীল লাইন’ সিস্টেমগুলি নির্মূল করে এবং যৌন বিনোদন’ প্রবিধানগুলি, যেমন, ‘সোয়াপল্যান্ডস’ এবং ফ্যাশন স্বাস্থ্য পার্লারগুলির অধীনে চলতে দেওয়া বেশ কয়েকটি প্রদত্ত যৌন পরিসেবাগুলিকে অনুমোদন দেয়। ২০১৩ সালে জাপান রিস্টোরেশন পার্টির সহসভাপতি তোরু হাশিমতো প্রস্তাব করেছিলেন, “জাপানে আইনিভাবে তাঁদের যৌনশক্তি প্রকাশ করতে পারে এমন স্থান আছে” এবং তাঁদের এই সুবিধাগুলির ব্যবহার না-করা পর্যন্ত, যৌন প্রবৃত্তিগুলি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে।”
২০০৩ সালে রিপোর্ট করা হয়েছিল যে, জাপানে গণিকাবৃত্তিতে প্রায় ১৫০,০০০ জন জাপানি নারী জড়িত ছিল। ন্যাশনাল পুলিশ এজেন্সি রেকর্ড অনুযায়ী ২০১৩ সালে গণিকাবৃত্তির অপরাধে গ্রেফতারকৃত ৫০ জন জাপানি নাগরিকের মধ্যে ৩১ (৬২%) মূল ভূখণ্ড চিনা, ১৩ (২৬%) কোরিয়াব এবং ৪ (৪%) থাই গণিকা ছিল। ১৯৫৬ সালের এন্টি-গণিকাবৃত্তি আইনের নিবন্ধ ৩ দ্বারা আধুনিক জাপানে গণিকাবৃত্তি অবৈধ হলেও, গণিকাবৃত্তির সংজ্ঞা কঠোরভাবে কোটা হিসাবে সীমিত। এর মানে হল মুখমৈথুন, পায়ুমৈথুন, পশুমৈথুন এবং অন্যান্য নন কোয়েল্ট যৌনকর্মগুলো আইনি। ১৯৪৮ সালের পাবলিক মরালস রেগুলেশন আইন প্রভাবিত ব্যবসাগুলি ১৯৮৫ ও ১৯৯৯ সালে সংশোধিত ‘অ্যাডাল্ট বিনোদন ব্যবসার নিয়ন্ত্রন আইন’ নামেও পরিচিত, যা এই ব্যবসাগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে।
‘হেলথ’ যৌন-পরিসেবা একটি পরিচিত শব্দ। বৈষম্য হচ্ছে যে, গণিকাবৃত্তির নিজস্ব কোনো আস্তানা নেই এবং এটি অবশ্যই একটি মেয়ে বা ‘এসকর্ট পরিসেবা’, যা নারীদের তাঁদের গ্রাহকদের ঘরে বা হোটেলগুলিতে পাঠানো হয়। আউটডোর কলগার্ল ব্যাবসাগুলি হোম ও অ্যাপার্টমেন্ট মেলবক্সে, টেলিফোন বুথ, রেস্টরুম এবং জাপানের বড় শহরগুলির মতো বিজ্ঞাপন হ্যান্ডবিল বিতরণ করে। এই ব্যাবসা বা অন্যান্য অনুরূপ ব্যাবসা খুঁজে পেতে অনেক ওয়েবসাইট আছে। ফ্যাশন-হেলথ ক্লাব জাপানের সমস্ত বড় শহরগুলিতে পাওয়া যায় এবং তাঁদের উজ্জ্বল ঝলকানি আলো এবং নারীসুলভ সজ্জা কারণে স্পট করা সহজ। প্রায়শই হেলথ ক্লাব হিসাবে বিজ্ঞাপন, অভ্যন্তরীণ ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে অপরিচিত বিদেশিদের বিভ্রান্ত করতে পারে। এই ক্লাবগুলি সাধারণত প্রবেশদ্বারের কাছাকাছি তাঁদের তথাকথিত ম্যাসেজের ছবি পোস্ট করে। যাই হোক, কখনো-কখনো মুখ এবং পিক্সেলেশন কালো রেখাচিত্র দিয়ে সেন্সর করা হয়।
ইমেজ ক্লাবগুলিতে তাৎক্ষণিক ফোটোগ্রাফ গ্রহণ, একটি মহিলার অন্তর্বাস অপসারণ বা বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট পরিসেবাদির জন্য আইটেমযুক্ত মূল্য প্রদান করতে পারে। ইমেজ ক্লাবগুলিতে কাজ করে এমন নারীদের প্রতিদিন ৩০,০০০ থেকে ৩৫,০০০ ইয়েন প্রদান করে এবং তা থেকে প্রতি মাসে একজন নারী ১ মিলিয়ন ইয়েন আয় করতে পারে। পিংক স্যালন’, জাপান দেশে এটি এক ধরনের গণিকাবৃত্তি, যা ‘ওরাল যৌন-বিশেষজ্ঞ হিসাবে পরিচিত। পিংক ফ্ল্যাশগুলি গণিকাবৃত্তির জন্য খাদ্য সরবরাহ করে, ব্যক্তিগত কক্ষ ছাড়া অপারেটিং এবং সীমাবদ্ধতার জন্য প্রদত্ত পরিসেবাদিকে সীমাবদ্ধ করে। তাঁরা জাপান জুড়ে এবং তাঁদের মধ্যে কাজ করা নারীরা প্রতি শিফটে এক ডজন বা আরও বেশি পুরুষদের সেবা করতে পারে। সোপল্যান্ড, বা সোপু, একটি জাপাপলিশ শব্দ, যা দুটি ইংরেজী শব্দ ‘সোপ’ এবং ‘ল্যান্ড থেকে সৃষ্ট এবং এটি জাপানের রাতের বিনোদন বিনোদন শিল্পের অংশ, যা ‘মিজু শোবাই’ নামেও পরিচিত।
যেহেতু অর্থের জন্য যৌন-সঙ্গত আনুষ্ঠানিকভাবে জাপানে নিষিদ্ধ, তবুও জাপানে বিভিন্ন ধরনের গণিকাবৃত্তি বিকাশ লাভ করেছে। যদিও সোপগুলির জন্য প্রধান ক্লায়েন্ট পুরুষ হয়, বিশেষত মহিলা ক্লায়েন্টদের জন্যেও কয়েকটি সোপল্যান্ড আছে। বিভিন্ন ধরনের সোপল্যান্ড আছে এবং তাঁরা সাধারণত বিভিন্ন সোয়াপল্যান্ডের কমপ্লেক্সে অবস্থিত। সুপরিচিত কমপ্লেক্স সপোরো, সুসুকিনো, টোকিওর জোশিয়ার ও কাবুকিচো, গিফুতে কাওয়াসাকেন, গিফুতে কানজুয়েন, শিগায় ওগোটো, কোবেতে ফুকুহারা, ওডওয়ারারে সাগামামুনুমাটা এবং ফুকুওকাতে নকাকুতে অবস্থিত। তবে অন্যান্য অনেকগুলি এলাকাও আছে।
১৯৫৮ সালে জাপানে স্পষ্টভাবে গণিকাবৃত্তি অবৈধ হয়ে যাওয়ার সময় সোয়াপল্যান্ড শুরু হয়, যেখানে স্নান দ্বারা নারীর শরীর ধুয়ে এক সাধারণ ফর্ম হিসাবে কাজ করে। তাঁরা মূলত তুর্কি-বুরো নামে পরিচিত ছিল, যার অর্থ তুর্কি স্নান। তুর্কি পণ্ডিত স্রেট সানকাক্লি ১৯৮৪ সালের প্রচারণার পর গণিকাবৃত্তির জন্য এই নামটির ব্যবহারকে অস্বীকার করে নতুন নাম ‘সোপল্যান্ড’ তাঁদের নামকরণের জন্য দেশব্যাপী প্রতিযোগিতার বিজয়ী হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়। সুমাটা’ (কখনো-কখনো ‘পশ্চাদপসরণ’ হিসাবে পশ্চিমে পরিচিত) জাপানি গণিকাবৃত্তিতে জনপ্রিয় একটি অ-তীব্র যৌন কার্যকলাপের জাপানি শব্দ। বলা যায় এটি একটি পুরুষ ক্লায়েন্টের উপর মহিলা যৌনকর্মী দ্বারা সঞ্চালিত ফ্রন্টেজের একটি ফর্ম। যৌনকর্মী তার আন্তঃসম্পর্কীয় যৌনতায় এবং ল্যাবিয়া মেয়ের সঙ্গে ক্লায়েন্টের সেক্সকে চাঙা করে এবং এখানে penile-vaginal প্রবেশ ছাড়া উল্লাস উদ্দীপনা করা হয়। এই কার্যকলাপটি ১৯৫৬ সালের এন্টি-গণিকাবৃত্তি আইনকে কঠোর করে তোলে, যা অর্থের জন্য যৌনসঙ্গিনীকে নিষিদ্ধ করে।
মূলত জাপান হল যৌন-পাচারে পুরুষ, নারী এবং শিশুদের জন্য ট্রানজিট দেশ। উত্তর-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা এবং আফ্রিকা থেকে পুরুষ, নারী এবং শিশুরা চাকরি বা জালিয়াতি বিয়ের জন্য জাপানে বেড়াতে আসে এবং যৌন হয়রানির শিকার হয়। পাচারকারীরা বার, ক্লাব, গণিকালয় এবং ম্যাসেজ পার্লারগুলিতে জোরপূর্বক গণিকাবৃত্তি করার জন্য জাপানে নারীর প্রবেশাধিকার সহজতর করার জন্য বিদেশি নারী ও জাপানি পুরুষদের মধ্যে জালিয়াতি বিয়ে করে থাকে। পাচারকারীরা বাধ্যতামূলক গণিকাবৃত্তিতে ঋণের দাসত্ব, সহিংসতার হুমকি, নির্বাসন, ব্ল্যাকমেইল এবং অন্যান্য মানসিকভাবে বাধ্যতামূলক পদ্ধতি ব্যবহার করে। গণিকালয় পরিচালকরা কখনো-কখনো ইচ্ছাকৃতভাবে অসৎ আচরণের দ্বারা শিকারদের উপর জরিমানা চাপিয়ে দেয়। পূর্ব এশিয়া ও উত্তর আমেরিকা সহ পশ্চিমাঞ্চলীয় গন্তব্যগুলিতে শোষিত হওয়ার আগে পাচারকারীরা জাপানকে ট্রানজিট করে। জাপানি নাগরিক, বিশেষত পালিয়ে যাওয়া কিশোরী মেয়েরাও যৌন পাচারের শিকার। অত্যন্ত সংগঠিত গণিকাবৃত্তি নেটওয়ার্কগুলি ঝুঁকিপূর্ণভাবে জাপানি নারী ও মেয়েশিশুদের লক্ষ করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট অফ স্টেট’ অফিসে মনিটরিং ও ট্র্যাফিকিংয়ে ব্যক্তিদের জাপানকে ‘টায়ার ১’ দেশ হিসাবে স্থান করে নিয়েছে।
(৪) জার্মান : আইন অনুসারে জার্মানে গণিকাবৃত্তির আয় থেকে গণিকাদের ট্যাক্স প্রদান করতে হয়। জার্মানের আমস্টারডাম ‘গণিকাবৃত্তির রাজধানী হিসাবে পরিচিত। জার্মানে অন্য শিল্প বছরে ১৫ বিলিয়ন ইউরোর বেশি আয় করে এবং ৪,০০,০০০ গণিকা প্রতিদিন ১.২ মিলিয়ন পুরুষকে সেবা করে।
জার্মানের ইতিহাস জুড়ে সরকার সাধারণত শিল্পে জড়িতদের নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ করতে পছন্দ করে। এটি মূলত ২০০২ সালে গণিকাবৃত্তির আইন দ্বারা বর্ধিত অধিকারগুলির সঙ্গে ১৯২৭ সালে (ভেরিয়াল ডিজিজের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আইন) নিষ্পত্তি করা হয়েছিল। এই আইনটি গণিকাদের কাজের চুক্তিতে জড়িত থাকার (এবং প্রয়োগ করার অনুমতি দেওয়ার মাধ্যমে সামাজিক কল্যাণ ও গণিকাদের আইনি অধিকার উন্নত করতে চাওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা দিতে এবং স্বাস্থ্যবিমা ব্যবহার করে।
ফলে জার্মানে যৌন হয়রানি থেকে গণিকাবৃত্তিজনিত অপরাধ বেড়েছে। বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপে থেকে নারীদের শোষণ একটি প্রধান সমস্যা। এটা বিশ্বাস করা হয় যে, দেশের প্রায় শতকরা ৭০ শতাংশ নারী বিদেশে কাজ করে। ২০০২ সালে তৈরি করা আইনটি ব্যাপকভাবে ব্যর্থ বলে মনে করা হয়। অনেক গণিকা অল্প সময়ের জন্যই দেশে থাকে। গণিকারা উচ্চ করের অর্থ প্রদান করে এবং রাষ্ট্রের আয় বৃদ্ধি করে। তবে নারীকে রক্ষা করার জন্য বেশিরভাগই সামান্য কাজ করে।
বন শহরের গণিকালয়গুলিতে পার্কিং মিটারগুলির মতো ভেন্ডিং মেশিনগুলির মাধ্যমে Immenburgstrasse-এ কাজ করার জন্য একটি রাতের যৌন কাজ কর প্রদান করে। মিউনিখের পুরো শহর কেন্দ্রটি ‘সেরপারেজিরক’। হামবুর্গের কুখ্যাত ‘রিপারবার্ন’ (রেড লাইট এরিয়া) সবচেয়ে সুপরিচিত এলাকা। উল্লেখ্য যে, কয়েকটি রাজ্যে ৩৫,০০০-এরও কম অধিবাসীদের শহরগুলিতে গণিকাবৃত্তি নিষিদ্ধ করে। অন্যদিকে, বার্লিনের গণিকাবৃত্তিকে সর্বত্র অনুমতি দেওয়া হয়।
ফ্রাঙ্কফুর্টের সমৃদ্ধ ব্যাংকিং শিল্প এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রায়ই সফল যৌনবাজারের সঙ্গে যুক্ত হয়। এটি সমৃদ্ধ রেড লাইট এরিয়ার আশেপাশে হুপবানহফে ‘বাহনফসভিয়ের্টেল’ (Bahnhofsviertel) নামে পরিচিত এবং পেশাদার যৌনশিল্প হিসাবেও পরিচিত। ইরোস সেন্টারে (ম্যাডাম বা মালকিন বা মক্ষীরানি ছাড়া সস্তা লাইসেন্সপ্রাপ্ত গণিকালয়) জার্মানিতে সবচেয়ে বড়ো গণিকালয়গুলির মধ্যে এই সুবিধা আছে। কলোনি জিস্টেমান্ডার স্ট্রাব (Geestemunder Strabe) রাস্তার গণিকাবৃত্তি করার অনুমতি দেয়, কিন্তু মজার বিষয়, মাদক বিক্রেতা এবং পাম্পগুলি অনুমোদিত নয়। উপরন্তু মেগা গণিকালয় ‘পাসচা’ (Pauscha) ১২ তল এবং ১০০ টিরও বেশি কক্ষ আছে।
একটি জার্মান চলচ্চিত্র এবং বিনোদন সংস্থা হোস্ট এবং চলচ্চিত্রগুলি বিভিন্ন থিমগুলির সঙ্গে গ্যাং ব্যাং (gang bang) দল, যা তাঁরা জনসাধারণের কাছে পর্নোগ্রাফি হিসাবে বিক্রি করে। প্রতি অংশগ্রহণকারী ৩৫ ইউরো প্রদান করে, যা পানীয় এবং খাদ্যের অন্তর্ভুক্ত। ‘বিনোদন’ হিসাবে প্রদত্ত মহিলারা সকলেই গণিকা নারী। কন্ডোম ব্যবহারে স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ, যদিও বাণিজ্যিক যৌন-ক্রেতা বা ক্লায়েন্টরা পরিচয় গোপন করার জন্য মাউথ-মাস্ক সরবরাহ করা হয়, যাতে কেউ চিনতে না পারে। পুরুষদের অবশ্যই একটি সাম্প্রতিক এইচআইভি রিপোর্ট (দুই সপ্তাহের পুরোনো নয়) আনতে হবে, অথবা গণিকালয়ে এসে অতি দ্রুত পরীক্ষা করাতে হবে। জার্মানিতে পর্নোগ্রাফি, গণিকালয় এবং গণিকাবৃত্তি প্রচারের জন্য বেশ কয়েকটি টিভি শো আছে। সেইসব জার্মান চ্যানেলগুলি রিয়ালিটি শোতে গণিকাবৃত্তি সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করে। গণিকা নারীরা কেমন পরিসেবা প্রদান করে এবং তা কতটা উত্তেজনাপূর্ণ এবং ভালোবাসাপূর্ণ সে সম্পর্কে কথা বলে। ২০১০ সালে এই চ্যানেলটি এমন একটি গণিকালয় সম্পর্কে একটি অনুষ্ঠান প্রচার করেছে, যা যৌনকল্পনাকে (Sex fantasy) যৌন-সম্পর্ক স্থাপন করতে সহায়তা করেছে। YouTube-এ একটি ভিডিও এই গণিকাবৃত্তির পঞ্চম বার্ষিকী প্রদর্শন করে, যেখানে অনেক জার্মান সেলিব্রিটিদের উপস্থিত থাকতে দেখা যায়।
২০১১ সালে ‘দ্য উইলসহেইমস’ (Wollersheims) নামে একটি রিয়ালিটি শোয়ে গণিকালয়ের মালিক বার্ট উইলসহেইম এবং জার্মানির সবচেয়ে প্রতারক গণিকার বসের নতুন প্রেম’ শিরোনামে একটি অনুষ্ঠান করে। ৯০-এর দশকে ওয়ালারশিম (wollersheim) মানব পাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত হন। তাঁরই নির্দেশে একজন গণিকা নারীকে অপহরণ করা হয়েছিল। কারণ সেই মহিলা গণিকাবৃত্তি করতে চাননি এবং তাঁর নতুন প্রেমিক (বা পাম্প) স্থানান্তর ফি দিতে ইচ্ছুক ছিল না।
বিখ্যাত ‘প্যারাডাইজ ব্রথেল’ চেইনটির ম্যানেজার মাইকেল বিয়ারেটিন (Michael Beretin) জার্মানির গণিকাবৃত্তি সংবলিত দুটি রিয়ালিটি টিভি প্রোগ্রামে জড়িত ছিলেন। আর-একটি শোতে ‘বার্ডেল এসওএস’ গোষ্ঠী আরও নগদ টাকা আনায় সহায়তা করার জন্য গণিকাকেই ‘জ্যাজ’ করে। ২০১৫ সালে বিয়ারেটিনকে (Beretin) মানব পাচার, জোরপূর্বক গণিকাবৃত্তি এবং জালিয়াতির সন্দেহে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও জার্মান টেলিভিশন চ্যানেলগুলি অনুষ্ঠানের আয়োজন চালিয়ে গেছে।
যৌনসম্পর্কের জন্য অর্থ প্রদানের সঙ্গে মানুষদের মধ্যে পার্থক্য কী? ব্যাপারটি আসলে পর্নো এবং গণিকাবৃত্তির মধ্যে স্পষ্টভাবে কোনো পার্থক্য নেই। বাস্তবিকই পর্নো এবং গণিকাবৃত্তির মধ্যে যোগসূত্র অবিচ্ছেদ্য। গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে, সাধারণ জনসংখ্যার তুলনায় বিগত বছরগুলিতে গণিকাবৃত্তিতে যাওয়া ব্যক্তিরা দ্বিগুণ পর্নোগ্রাফি দেখেছেন। এটিও বিস্ময়কর নয় যে, এই গ্রাহকরা যখন দেখেন, তখন তাঁরা যে পর্নো কাজগুলি করতে চায় সেগুলি শোনার জন্য অনেকগুলি পর্নো ছবির সঙ্গে প্রস্তুত থাকে। জার্মানিতে গণিকাবৃত্তি, পর্নোগ্রাফি ব্যাপকভাবে উদযাপন করে এবং সমাজের অগ্রগতি হিসাবে স্বাগত জানায়।
মানব পাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জার্মানি গণিকাবৃত্তির নতুন আইন পাস করেছে। এটি আরও নিয়ন্ত্রণ, আরও প্রণিধানযোগ্য এবং আরও জরিমানা করার জন্য ভাবা হচ্ছে। এর ফলে জার্মানিতে যৌনকর্মী হিসাবে অর্থ উপার্জন করা আরও কঠিন হয়ে উঠবে। গণিকাবৃত্তি শিল্পের নিয়ন্ত্রণ এবং যৌনকর্মীদের সুরক্ষা, যা আইন হিসাবে কার্যকর হয়। গণিকাবৃত্তি এখন নতুন আইনের অধীনে ঘনিষ্ঠভাবে নজরদারির অধীনে থাকবে। জার্মানির প্রাক্তন পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী ম্যানুয়েল শোশেগ (Manuela Schwesig) যখন এক বছর আগে জার্মান বুন্ডস্ট্যাগে খসড়া আইন পেশ করেছিলেন, তখন তিনি বলেন, “এই দেশে গণিকাবৃত্তির চেয়ে স্ন্যাকবার খোলা কঠিন”। এখানকার যৌনকর্মীরা প্রায়শই অপমানজনক কাজের পরিবেশের মুখোমুখি হন। নতুন আইনের মতে, যৌনকর্মীদের স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিবন্ধন করতে হবে এবং একটি জনস্বাস্থ্য পরিসেবা থেকে চিকিৎসা পরামর্শ চাইতে হবে। ভবিষ্যতে যৌনসেবা প্রস্তাবকারী গণিকাকে একটি পারমিটের জন্য আবেদন করতে হবে, যা শুধুমাত্র স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্যবিধি এবং শয্যাঘরের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করে দেওয়া হবে। নতুন আইনটি ফ্ল্যাট-রেট (flat-rate) গণিকাবৃত্তি এবং গ্যাং ব্যাং গোষ্ঠীগুলিকে নিষিদ্ধ করে, যার মধ্যে একজন গণিকা বা যৌনকর্মী একযোগে বেশ কয়েকজন পুরুষকে সেবা করতে হবে। এছাড়া কন্ডোম ছাড়া যৌনকর্ম নিষিদ্ধ করা হয়। জার্মানিতে বিলিয়ন ইউরো গণিকাবৃত্তি বাজার, যা ২,০০,০০০ থেকে ৫,০০,০০০ নারী ও পুরুষদের মধ্যে কোথাও না কোথাও কাজ করে।
(৫) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র : ফেডারেশন আইনের পরিবর্তে রাষ্ট্র আইনের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গণিকাবৃত্তি অবৈধ। তবে নেভাদা রাজ্যের কিছু গ্রামীণ কাউন্টিতে গণিকাবৃত্তি বৈধ। এই নেভাদা রাজ্যেই লাস ভেগাস (Las Vegas) একটি বিখ্যাত শহর, যে শহরটিকে একটি প্রমোদনগরী হিসাবে সারাবিশ্বে বিখ্যাত। এ শহর যেমন জুয়া খেলার বিখ্যাত, তেমনি গণিকাবৃত্তির জন্যও বিখ্যাত। জুয়া আর গণিকাভোগের টানেই প্রতি বছর কয়েক কোটি মানুষ এ শহরে বেড়াতে আসে। লাস ভেগাস নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে আলো ঝলমলে একটা ছবি। উদ্দাম আনন্দ, উৎসব। কিন্তু তার পিছনেই আছে অন্ধকার। সেই অন্ধকার সবাই দেখতে পায় না, জানতে পারে না, অনুভব করতে পারে না।
লাস ভেগাসেই আছে আমেরিকার সবচেয়ে দামি হোটেলগুলি। এই হোটেলগুলি গণিকাবৃত্তির প্রসোদকানন। এখানে যৌনতা এতটাই উদ্দাম ও উদোম যে, হোটেলে নিজের ঘরে যৌনক্রিয়া করে সেটা একরকম, কিন্তু উদ্দাম যৌনতায় নরনারী মেতে ওঠে হলঘরেও। তবে হলঘরের যৌনমিলন সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে হয় না, যতটা সম্ভব পোশাক শরীরে রাখা থাকে। এমনকি হোটেলের সুইমিং পুলেও নর-নারী যৌনমিলন করে। প্রতিদিন এত এত ব্যবহৃত কন্ডোম, মদের বোতল, যৌনরসে সিক্ত নোংরা পোশাক, সিরিঞ্জ আর বমি পরিষ্কার করতে করতেই সাফাইকর্মীরা ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
আমেরিকায় সর্বত্র নিষিদ্ধ হলেও গণিকাবৃত্তি সারা দেশেই ঘটে। দেশের গণিকাবৃত্তির নিয়ন্ত্রণ ফেডারেল সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষমতাগুলির এক্তিয়ার নয়। তাই এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের দশম সংশোধনীর অধীনে বাণিজ্যিকভাবে সেক্সকে অনুমোদন, নিষিদ্ধকরণ বা অন্যথায় বাণিজ্যিকভাবে নিয়ন্ত্রিত করার জন্য রাজ্যগুলির ডোমেন ব্যতীত ম্যানগ্র আইনের অধীনে অন্তর্বর্তী বাণিজ্য অংশ হিসাবে কংগ্রেস এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। বেশিরভাগ রাজ্যে গণিকাবৃত্তিকে জনসাধারণের ক্রম-অপরাধের অপরাধে বিভ্রান্তিকর বলে মনে করা হয়, যা কমিউনিটির আদেশকে বাধা দেয়। গণিকাবৃত্তি একটি সময় পর্যন্ত ভয়ানক অপরাধ বলে মনে করা হত।
বর্তমানে নেভাদা বৈধ গণিকাবৃত্তি-নিয়ন্ত্রিত। নেভাদা সংশোধিত সংবিধিগুলির মধ্যে নির্ধারিত শর্তগুলির অনুমতি দেওয়ার একমাত্র মার্কিন অধিকারী। শুধুমাত্র আটটি কাউন্টিতে বর্তমানে সক্রিয় গণিকাবৃত্তি আছে। ক্লার্ক কাউন্টি (যা লাস ভেগাস-প্যারাডাইজ মেট্রোপলিটন এলাকায় আছে), গণিকা কাউন্টি (যার মধ্যে রেইনও আছে), কারসন সিটি, ডগলাস কাউন্টি এবং লিঙ্কন কাউন্টিতে সমস্ত ধরনের গণিকাবৃত্তি অবৈধ। অন্য কাউন্টিগুলি তাত্ত্বিকভাবে গণিকাবৃত্তিকে অনুমোদন দেয়। তবে কিছু কাউন্টিতে বর্তমানে কোনো সক্রিয় গণিকাবৃত্তি নেই। রাস্তার গণিকাবৃত্তির আয় থেকে জীবনযাপন করা নেভাদা আইনের অধীনে অবৈধ। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ জাস্টিসের মতে, ২০০৪ সালে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, দেশে প্রায় ১৫-২০ শতাংশ পুরুষই গণিকার সঙ্গে যৌনসম্পর্ক করেছে। অন্য দেশগুলির মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গণিকাবৃত্তিটি তিনটি বিস্তৃত বিভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে—রাস্তায় গণিকাবৃত্তি, গণিকালয়ে গণিকাবৃত্তি এবং এসকর্ট গণিকাবৃত্তি।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে আমেরিকান বিপ্লবের কয়েকজন নারী যাঁরা মহাদেশীয় সেনাবাহিনীর অনুসারী ছিলেন, তাঁদের মধ্যে সেনা ও কর্মকর্তারা যৌন অংশীদার হিসাবে পরিসেবা নিয়েছিল। বিশেষত ভেনেরিয়াল রোগের (venereal diseases) সম্ভাব্য বিস্তারের কারণে গণিকাসঙ্গে সেনাবাহিনী নেতৃত্বের জন্য একটি উদ্বেগজনক উপস্থিত হয়েছিল। তবে সেনাবাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তা সৈন্যদের মনোবল বজায় রাখতে গৃহযুদ্ধের সময় গণিকাদের উপস্থিতিকে উৎসাহিত করেন। ১৮৬৩ সালে ২০ আগস্ট মার্কিন সেনা কমান্ডার ব্রিগেড, জেনারেল রবার্ট এস এবং গ্র্যাঞ্জার ইউনিয়ন সৈন্যদের মধ্যে ভেনেরিয়াল রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য ন্যাশভিল, টেনেসিতে গণিকাবৃত্তি বৈধ করেছিলেন। এই পদক্ষেপ সফল ছিল এবং কঠোর সুস্থতা প্রোগ্রামের কারণে ভেনেরিয়াল রোগের হার মাত্র চার শতাংশে নেমে গিয়েছিল। যার জন্য সমস্ত গণিকাবৃত্তি নিবন্ধন করতে এবং একটি বোর্ড প্রত্যয়িত চিকিৎসকের প্রতি দুই সপ্তাহের জন্য পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল, যার জন্য তাঁদের পাঁচ ডলারের নিবন্ধন ফি এবং প্রতি পরীক্ষায় ৫০ সেন্ট চার্জ করা হয়েছিল।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে পার্লার হাউস গণিকালয়গুলি উচ্চশ্রেণির ক্লায়েন্টদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। কনসার্ট স্যালুনে পুরুষরা খেতে পারে, গান শুনতে পারে, যৌনতার জন্য নারীসঙ্গ নিতে পারে। লোয়ার ম্যানহাটানের ২০০ টিরও বেশি গণিকালয় বিদ্যমান। গণিকাবৃত্তি আইনানুগ আইনের অধীনে অবৈধ ছিল বটে। কিন্তু পুলিশ ও শহরের কর্মকর্তাদের উদাসীনতায় এটি কখনোই কার্যকর ছিল না। কারণ তাঁরা গণিকালয়ের মালিক ও মালকিন দ্বারা প্রভাবিত ছিল। বিংশ শতাব্দীতে, অর্থাৎ ১৯০৮ সালে ‘ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (বিওআই) প্রতিষ্ঠা করা হয়, যাতে তাঁরা অপহরণ করা হয়েছে কি না তা খুঁজে বের করা সম্ভব হয়। গণিকালয় কর্মচারীদের সাক্ষাতে ‘সাদা দাসত্ব’ (white slavery) তদন্তের জন্যেও এই প্রতিষ্ঠান সক্রিয় ছিল। এক শহরে ১১০৬ জন গণিকার সাক্ষাৎকারে ৬ জন বলেছে তাঁরা সাদা দাসত্বের শিকার। ১৯১০ সালের ‘হোয়াইট স্লেভ ট্রাফিক আইন’ তথাকথিত ‘সাদা দাসত্ব’ নিষিদ্ধ করেছিল। এটি অনৈতিক উদ্দেশ্যে (Immoral Purposes)। মহিলাদের অন্তর্নিহিত পরিবহন নিষিদ্ধ করে। পরে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ‘অনৈতিক উদ্দেশ্য’-এর অধীনে সম্মিলিত বিদ্রোহে (debauchery), ব্যভিচার এবং বহুগামিতাও অন্তর্ভুক্ত হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে গণিকালয় বা গণিকাবৃত্তি আইনে অপরাধমূলক কিছু আইন ছিল। ১৯১৮ সালে চেম্বারলাইন-কাহন আইন (Chamberlain-Kahn Act) সরকারকে যৌন সংক্রামিত রোগ (এসটিডি) হওয়ার সন্দেহে যে-কোনো মহিলাকে সংহত করার ক্ষমতা দিয়েছে। একটি মেডিকেল পরীক্ষায় প্রয়োজন হত এবং একটি এসটিডি প্রকাশ করা হত। এই আবিষ্কার গণিকাবৃত্তি প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারে। এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল মূলত মার্কিন সৈন্যদের মধ্যে ভেনেরিয়াল রোগের বিস্তার প্রতিরোধ করা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নিকটস্থ সেনাবাহিনী এবং নৌবাহিনীর ক্যাম্পগুলিতে ভেনেরিয়াল রোগের সংক্রমণ প্রতিরোধে স্টোরিভিল (Storyville) বন্ধ হয়ে যায়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ঔপনিবেশিক ফিলিপাইনে মার্কিন সশস্ত্র বাহিনী ‘আমেরিকান পরিকল্পনা’ নামে একটি গণিকাবৃত্তি ব্যবস্থাপনা প্রোগ্রাম গড়ে তোলে, যা সেনা ও সেনানিবাসের পাঁচ মাইলের মধ্যে কোনো গণিকাকে গ্রেফতার করতে সামরিক সক্ষম করে। সংক্রামিত হলে সুস্থ না-হওয়া পর্যন্ত একজন গণিকাকে হাসপাতালে বা ফার্ম উপনিবেশে (Farm Colony) দণ্ডিত করা যেতে পারে। ন্যাশনাল ভেনেরিয়াল ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যাক্ট’, যা ১ জুলাই, ১৯৩৮ কার্যকর হয়েছিল, ভেনেরিয়াল রোগগুলির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করার জন্য ফেডারেল তহবিলের অনুমোদন করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে প্রবেশের পর এই আইনের অধীনে অনুমোদন দ্বিগুণ হয়। মে আইন ৩ (May Act,3) রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর দ্বারা কার্যকর হয়ে যায়। ১১ জুলাই, ১৯৪১ যুক্তরাষ্ট্রীয় সামরিক ক্যাম্প এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর আশেপাশে বাণিজ্যিক ভাইসকে (commercialized vice) দমন করার ক্ষমতা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারকে সশস্ত্র করে।
মে আইন, যা ১৯৪১ সালের জুন মাসে প্রণয়ন হয়েছিল। করেছিল সামরিক ঘাঁটির চারপাশে সীমিত অঞ্চলগুলিতে গণিকাবৃত্তি প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে। এটি যুদ্ধকালীন সময় প্রধানত কার্যকর করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও মার্কিন মিলিটারিদের মধ্যে যৌনশিক্ষা চালু ছিল। ১৯৪৪ সালে মন্টেন্সেন (Mortensen) বনাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের উদ্দেশ্য গণিকাবৃত্তি না-হওয়ার কারণে গণিকারা রাষ্ট্রীয় সীমান্ত জুড়ে ভ্রমণ করতে পারে বলে রায় দেয়। ১৯৬৭ সালে নিউইয়র্ক সিটি ম্যাসেজ পার্লারের জন্য লাইসেন্সের প্রয়োজনীয়তা বাতিল করে। কারণ প্রচুর ম্যাসেজ পার্লার সাক্ষাৎ গণিকালয় হয়ে ওঠেছিল। ১৯৭০ সালে নেভাদা গণিকালয় নিয়ন্ত্রণ শুরু করে। ১৯৭১ সালে মসতং রাঞ্চ (Mustang Ranch) নেভাদায় প্রথম লাইসেন্স প্রাপ্ত গণিকালয় হয়ে ওঠে। অবশেষে রাষ্ট্রের মধ্যে ১৭টি গণিকালয় বৈধকরণ পরিচালিত হতে থাকে। পরবর্তী সময়ে, মসতং রাঞ্চ (Mustang Ranch) নেভাদা সবচেয়ে বড় গণিকালয় হিসাবে জেগে ওঠে, অন্যান্য বৈধ নেভাদা গণিকালয়ের তুলনায় রাজস্ব সহ আরও উজ্জীবিত হয়ে ওঠে।
১৯১৭ সালে নিউ অর্লিঙ্গ সরকার গণিকাবৃত্তি বন্ধ করে দিয়েছিল। ১৯১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি সানফ্রান্সিসকোতে একটি গণিকাবৃত্তিমূলক প্রচারণা জনসাধারণের সভাগুলোতে বিশাল জনতাকে আকর্ষণ করেছিল। এক সভায় ৭০০০ জন উপস্থিত ছিলেন, ২০,০০০ জনকে রুমের অভাবের জন্য বাইরে রাখা হয়েছিল। রেভেরেন্ড পল স্মিথ একটি কনফারেন্সে গণিকালয়ের মুখোমুখি হন। ৩০০ গণিকালয় সহনশীলতার জন্য একটি আবেদন করেছিলেন এবং ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন যে, তাঁরা দারিদ্র্যের কারণে গণিকাবৃত্তিতে বাধ্য হয়েছিলেন। স্মিথ যখন বললেন, তাঁরা সপ্তাহে ৮ থেকে ১০ ডলারে অন্য কাজ করবে। তখন মহিলারা হতাশার সঙ্গে হেসে উঠল, যা তাদের জনসাধারণের প্রতি সহানুভূতি হারিয়েছিল। এর পরপরই পুলিশ গণিকালয়ের প্রায় ২০০ টি বাড়ি বন্ধ করে দেয়।
১৯৯০-এর দশকের শেষদিকে হেইডি ফ্লিস (Heidi Fleiss) আমেরিকার সেরা পরিচিত মালকিনদের (গণিকালয়ের) একজন হয়ে ওঠে। ২০ শতকের প্রথম দিকে ফোনের ব্যাপক ব্যবহারে কলগার্লদের উদ্ভব হয়। তাঁরা সম্ভাব্য গ্রাহকদের কাছে তাঁদের কার্ডে লেখা ফোন নম্বর দেয়। গণিকাবৃত্তির নতুন ট্রেন্ড ‘কলগার্ল’ হিসাবে ক্রমবর্ধমান ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ চর্চা হয়ে গেছে। ১৯৬০-এর দশকে যৌন-বাণিজ্য শ্রমিকদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। ১৯৬০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গর্ভনিরোধক ব্যবহারের জন্য প্রথম Oral Contraceptive Pill অনুমোদিত হয়। একটা সময় পর্যন্ত গর্ভাবস্থা প্রতিরোধে ‘পিল’ গণিকাবৃত্তিতে ব্যাপক সাহায্য করেছিল। ১৯৭১ সালে বিখ্যাত নিউ ইয়র্ক মালকিন জাভিয়ের হোল্যান্ডার (Xaviera Hollander) লিখেছেন “The Happy Hooker : My Own Story’ নামে একটি বই, যে বইটি তাঁর সতোর জন্য উল্লেখযোগ্য ছিল এবং যৌন সম্পর্কে ইতিবাচক লেখার প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল। জাভিয়ের হোল্যান্ডারের প্রথম দিকের অগ্রদূত (১৯২০-৩০) গণিকালয়ের একাধারে মালকিন ও লেখক পোলি অ্যাডলার (Polly Adler) ছিলেন, যিনি ঘরে বসে বইটি A House is not a Home’ ছিল। পরে A House is not a Home’ নামে একটি চলচ্চিত্রও তৈরি হয়েছিল। ১৯৭৮ সালে ‘Sex worker’ শব্দটি “Scarlot Harlot’ হিসাবে পরিচিত হল।
(৬) দক্ষিণ কোরিয়া : দক্ষিণ কোরিয়ার গণিকাবৃত্তি অবৈধ। কিন্তু কোরিয়ার ‘Women’s Development Institute’ মতে, ২০০৭ সালে কোরিয়াতে ১৪ ট্রিলিয়ন দক্ষিণ কোরিয়ান যৌন-বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জন করেছে ১৩ বিলিয়ন ডলার (আনুমানিক), যা দেশটির মোট দেশীয় উৎপাদনের মোট ১.৬%। কোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল কলেজ পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২৩.১% পুরুষ এবং ২.৬% নারীর গণিকাবৃত্তির মধ্য দিয়ে তাঁদের প্রথম যৌন অভিজ্ঞতা হয়েছে। একই সময়ের মধ্যে জনসংখ্যার গণিকাদের সংখ্যা ১৮%। অর্থাৎ ২,৬৯,০০০ ছাড়িয়ে গেছে। ২০০৭ সালে যৌন-ব্যাবসার লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৯৪ মিলিয়ন ডলার, যা ২০০২ সালে ১৭০ মিলিয়ন ডলার থেকেও কম। আইনি নিষেধাজ্ঞা ও পুলিশ কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া সত্ত্বেও গণিকাবৃত্তি চলতে থাকে দক্ষিণ কোরিয়াতে, যখন যৌনকর্মীরা সক্রিয়ভাবে রাষ্ট্রের কার্যক্রমকে প্রতিরোধ করছে।
দক্ষিণ কোরিয়াতে মেয়েদের কুমারীত্ব হারানোর অভ্যাস ব্যাপক। কোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল কলেজে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, পুরুষরা প্রথমত গণিকাবৃত্তির অভিজ্ঞতার জন্য যথাক্রমে ২৩.১%, এবং মহিলাদের ১৩.৪% গড়ের জন্য ২.৩% শতাংশের কম প্রকাশ করেছে। কোরিয়ার আধুনিকীকরণের আগে কোনো গণিকা ছিল না। কিন্তু অভিজাত জমিদার শ্রেণিদের জন্য নারীদের একটি জাতি যৌনশ্রম পালন করত। আধুনিকীকরণে কোরিয়ান জাতিব্যবস্থা পুরোপুরি নির্মূল হয়ে যায়। ১৮৭৬ সালে কূটনৈতিক চুক্তির মাধ্যমে দেশটি প্রথমে তাঁদের বন্দরটি খুলতে শুরু করে। কোরিয়াতে প্রথম গণিকাদের জন্য গণিকালয় শুরু হয়। ১৯৬০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত মার্কিন ক্যাম্প শহরে গণিকাবৃত্তি মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলির বাইরে (উদাহরণস্বরূপ ক্যাম্প ক্যাসি এবং ক্যাম্প স্ট্যানলি) লক্ষ করা যায়। কোরীয় সরকার ও মার্কিন সামরিক বাহিনীর মধ্যে আলোচনার ফলে এটি মার্কিন সেনা মোতায়েনের ক্যাম্প শহরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যদের মধ্যে গণিকালয় জড়িত ছিল। Western Princess’ নামে পরিচিত এক গণিকা সরকার নিবন্ধিত হয় এবং সমস্ত গণিকাকেই মেডিকেল সার্টিফিকেট বহন প্রয়োজনয়ীতার কথা জানান। মার্কিন সামরিক পুলিশ এই মার্কিন ক্যাম্প শহরে গণিকালয় অঞ্চলের নিরাপত্তা প্রদান করে এবং যৌন-সম্পর্কিত রোগের মহামারি প্রতিরোধে অসুস্থ বলে বিবেচিত গণিকাদের আটক করতে থাকে। এই সরকারের অতীত প্রেরণা ছিল আমেরিকায সামরিক, উত্তর কোরিয়া থেকে দক্ষিণ কোরিয়া রক্ষা—যা ছেড়ে চলে যেতে হবে। যদিও মার্কিন কর্মকর্তারা জনসাধারণের গণিকাবৃত্তিকে নিন্দা প্রকাশ করেছিলেন, তবে তাঁরা এটিকে প্রতিরোধ করার জন্য সামান্য পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে মনে করে। কিছু স্থানীয় নাগরিক পরামর্শ দেয় যে, মার্কিন সেনা কর্তৃপক্ষ সৈনিকদের বাণিজ্যিক যৌন পরিসেবাগুলি পছন্দ করে।
২০০৩ সালে কোরিয়ান মন্ত্রণালয়ের জেন্ডার ইকুইলিটি ঘোষণা করে যে, ২,৬০,০০০ নারী গণিকাবৃত্তির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। অর্থাৎ ২৫ জন কোরিয়ান মহিলাদের মধ্যে ১ জন যৌনপেশায় জড়িত। ‘Korea Women’s Development Institute’ প্রস্তাব করেছে যে, গণিকাবৃত্তি শিল্পে ৫,১৪,০০০ থেকে ১.২ মিলিয়ন কোরিয়ান নারী অংশগ্রহণ করে। উপরন্তু ‘Korean Institute of Criminology’-এর রিপোর্টে দেখা গেছে যে, ২০% পুরুষ প্রতি মাসে কমপক্ষে ৪ বার যৌনসঙ্গমের জন্য অর্থ প্রদান করে এবং দৈনিক ৩,৫৮,০০০ জন কোরিয়ান নারী গণিকাবৃত্তি করে।
২০০৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার ‘Special Law on Sex Trade 2004’ নামে একটি বিশেষ গণিকাবৃত্তি বিরোধী আইন প্রণয়ন করে শরীর কেনাবেচা তথআ গণিকাবৃত্তি নিষিদ্ধ করে দেয়। এরপর দ্রুত আইন বাতিলের দাবিতে ২,৫০০ জনেরও বেশি যৌনকর্মীরা রাস্তার বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। কারণ তাঁরা বিশ্বাস করেছিল যে, এই আইন তাঁদের জীবিকা হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। ২০০৬ সালে জেন্ডার ইকুলিটি মন্ত্রণালয় গণিকাবৃত্তির চাহিদা মেটাতে একটি প্রচেষ্টা শুরু করে দেয়। অফিসাররা পরে যৌনকর্মীদের বেতন দেওয়ার অঙ্গীকার করে। এই নীতির সপক্ষে ব্যক্তিরা দাবি করে যে, তাঁরা সংস্কৃতির অবসান করতে চায়, যাতে লোকজন মাতাল হয় এবং যৌনতা কিনতে যায়। ২০০৭ সালে সরকার ঘোষণা করেছিল যে, কোরিয়ানরা যৌনতা অবৈধভাবে বিক্রি করবে, সেইসঙ্গে কোরিয়ান মহিলারা যৌনতা বিক্রি করতে বিদেশেও যাবেন। আদালতগুলি ৩৫,০০০ ক্লায়েন্টের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। ২০০৩ সালে যাঁরা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিল, তাঁদের তুলনায় ২.৫ গুণ বেশি।
২০০৪ সালে বিশেষ আইন প্রণয়ন করার পর রেড লাইট এরিয়াতে একটি কঠোর ব্যবস্থা (Crackdown) ছিল। যদিও ওই এলাকার বেশিরভাগ গণিকালয়গুলি বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল। তেমনি কঠোর ব্যবস্থাটি যত তাড়াতাড়ি ঘটেছিল, ততই গণিকাবৃত্তি আরও আন্ডারগ্রাউন্ড হয়ে ওঠেছিল এবং কম দাম এবং অতিরিক্ত পরিসেবাদি নিয়ে আরও বেশি প্রতিযোগিতামূলক ব্যাবসা হয়ে ওঠেছিল। দক্ষিণ কোরিয়াতে রেড লাইট এরিয়াগুলিকে অ্যামস্টারডাম ও জার্মানির সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়ার চারটি প্রধান গণিকাপল্লি হল—চেওনিঙ্গানি ৫৮৮ (Cheongnyangni 588), ইয়ংসান স্টেশন (Yongsan Station), সিওলের মিয়া-রাই (Mia-ri in Seoul) এবং ডাইগুয়ের জগালমাদং (Jagalmadang in Daegu)।
জেন্ডার ইকুইলিটি ও পরিবার মন্ত্রণালয় ২০১২ সালের একটি সমীক্ষা অনুসারে, ৩৫% পালিয়ে যাওয়া যুবকদের গণিকাবৃত্তির কাছে উন্মুক্ত করা হয়েছে ক্রেতা অথবা গণিকা হিসাবে। ইন্টারনেট চ্যাটের মাধ্যমে যৌনতা বিক্রি করে এমন সম্ভ্রান্ত মহিলাদের ক্ষেত্রে রিপোর্ট করা হয়েছে। গণিকাবৃত্তির নির্মূলকরণের জন্য ‘United Voice’ অনুসারে, কম বয়সিদের গণিকাবৃত্তিকে ধর্ষণের মতো অপরাধ এবং সিফিলিসের মতো রোগের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে বলে মনে হয়। ‘United Voice’ দ্বারা সার্ভেতে জানা যায়, অর্ধেকের বেশি মেয়েরা প্রায়শই পূর্ববর্তী স্বামী, সমাজ বা পরিবার থেকে বিতাড়িত এবং দালাল দ্বারা ব্ল্যাকমেইল কারণে যৌন বাণিজ্যে আসে এবং বাকি অর্ধেক রাতারাতি ধনী হওয়ার লালসা নিয়ে স্বেচ্ছায় আসে।
যদিও ২০০৪ সালের হিসাবে সরকার মানব পাচার নিষিদ্ধ করেছিল এবং গণিকাবৃত্তির জন্য জরিমানা বৃদ্ধি করেছিল। যৌন-বাণিজ্য ও তাঁর ক্ষতিগ্রস্তদের সুরক্ষা রোধে ২০০৪ সালের আইন পাস করা হয়েছে। পাচারকারীদের দমন করার মতো শাস্তি, ক্ষতিগ্রস্তদের নির্বাসনের অবসান এবং ভিকটিমদের জন্য আশ্রয়স্থল প্রতিষ্ঠা করাই ছিল উদ্দেশ্য। ২০০৫ সাল নাগাদ মানব পাচারের জন্য ১৪৪ জন মানুষ জেলে ছিলেন। ২০০৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন অভিবাসন কর্মকর্তা স্বীকার করেছিলেন যে, “কোরিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নিয়োগকারী, দালাল, মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে একটি অত্যন্ত সংগঠিত যুক্তিসংগত নেটওয়ার্ক আছে।” লস এঞ্জেলেস পুলিশের একজন মুখপাত্র জানান, গণিকাবৃত্তির জন্য মাসে যে ৭০ থেকে ৮০ জন গ্রেফতার হয়, তার প্রায় ৯০ শতাংশই কোরিয়ান নারী। লস এঞ্জেলেস পুলিশ অনুমান করে যে, ৮০০০ কোরিয়ান গণিকা ওই শহর ও উপকূলে কাজ করছে। ২০১২ সালেও দেখা যাচ্ছে সরকার যৌন পাচারের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগকারী প্রচেষ্টাকে অব্যাহত রেখেছে। বহুবিধ পাচারমূলক সচেতনতা প্রচারণা পরিচালনা করেছে।
দক্ষিণ কোরিয়া হল মানব পাচারের জন্য একটি উৎস এবং গন্তব্য দেশ (destination country)। অল্প বয়সি মেয়েদের কোরিয়ার যাওয়ার জন্য সংস্থাগুলি উচ্চহারে বেতন দিয়ে থাকে এবং তাঁরা সেখানে পৌঁছানোর পর তাঁদেরকে যৌনদাসী হিসাবে কাজ করার জন্য বাধ্য করা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কোরিয়ার রেড লাইট এরিয়ায় নব্য রাশিয়ান মেয়েদের দেখা যায়। তাঁরা গ্রাহকদের বিনোদনের জন্য বার, স্ট্রিপ ক্লাব এবং কফি শপে অপেক্ষা করে। ২০০০ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ ২০০১ সালের মধ্যে প্রায় ৬,০০০ রাশিয়ান নারী বুশান বন্দর এবং জিম্পের মাধ্যমে কোরিয়াতে প্রবেশ করেছিল। ২০০০ সালে ৩,০৬৪ রাশিয়ান নারী গণিকাবৃত্তির জন্যে দক্ষিণ কোরিয়াতে প্রবেশ করেছিল।
(৭) ভারত ভারতের গণিকাবৃত্তি নিয়ে আগের অধ্যায়গুলিতে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। তাই এই অধ্যায়ে পুনরাবৃত্তি করব না। এখানে সেইসব বিষয়ই আলোচনা করব যা আগের অধ্যায়গুলিতে আলোচিত হয়নি। গণিকাবৃত্তি মূলত অর্থের বিনিময়ে যৌনসেবা) ভারতে আংশিক বৈধ। তবে পাবলিক প্লেসে গণিকাবৃত্তি, গণিকালয়ে গণিকাবৃত্তি, হোটেলে গণিকাবৃত্তি, শিশু গণিকাবৃত্তি, দালাল এবং পাচার অবৈধ। মুম্বাই, দিল্লি এবং কলকাতা সহ বেশ কয়েকটি গণিকালয় অবৈধভাবে ভারতীয় শহরগুলিতে পরিচালনা করে। UNAIDS অনুমান করে দেশে ৬,৫৭,৮২৯ গণিকা আছে। জরিপ প্রদর্শন করেছে যে, গণিকাবৃত্তিতে আনুমানিক ১.২ মিলিয়ন শিশুও জড়িত আছে।
বৈধ গণিকাবৃত্তি নিজেই অস্পষ্ট। যৌনকর্মীদের পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রাথমিক আইন হল ১৯৫৬ আইনটি, যা অনৈতিক ট্রাফিক (দমন) আইন (SITA) নামে পরিচিত। এই আইনের মতে, গণিকারা ব্যক্তিগতভাবে তাঁদের ব্যাবসা অনুশীলন করতে পারে, কিন্তু আইনিভাবে গ্রাহকদের কাছে অনুরোধ করতে পারে না। তবে বিবিসি একটি নিবন্ধে উল্লেখ করে যে, ভারতে গণিকাবৃত্তি অবৈধ। ভারতীয় আইনটি ‘গণিকাবৃত্তি’ হিসাবে নিজের যৌনসেবা বিক্রি করার অভ্যাসকে বোঝায় না। ক্লায়েন্টদের প্রকাশ্যে যৌন কার্যকলাপ (sexual activity) জন্য শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। সংগঠিত গণিকাবৃত্তি অবৈধ। যতক্ষণ পর্যন্ত এটি স্বতন্ত্রভাবে এবং স্বেচ্ছায় করা হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত একজন নারী (ভারতীয় গণিকাবৃত্তি আইনের ধারা ৩৭৭-এর অধীনে পুরুষের গণিকাবৃত্তি ভারতের কোনো আইনের ক্ষেত্রে স্বীকৃত নয়, এমনকি সম্মিলিতভাবে মলদ্বারে যৌন হয়রানিও অবৈধ) তাঁর শারীরিক বেনিফিটের বিনিময়ে তাঁর শরীর ব্যবহার করতে পারে। এমনকি পাবলিক প্লেসের ২০০ গজের মধ্যে তাঁর পেশা বহন করতে নিষিদ্ধ করা হয়।
ইন্ডিয়ান পেনাল কোড (আইপিসি), যা SITA-কে পূর্বাভাস দেয়, তা প্রায়ই ‘জনসাধারণের অসদাচরণ’ (Public Indecency) বা জনসাধারণের বিরক্তিকর’ (Public Nuisance) হিসাবে যৌন অপরাধীদের চার্জ করার জন্য ব্যবহৃত হয়। ১৯৮৬ সালে পুরোনো আইনটি অনৈতিক ট্রাফিক (প্রতিরোধ) আইন বা আইটিপিএ হিসাবে সংশোধন করা হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক ক্লায়েন্টদের অপরাধী করার জন্য এটি সংশোধন করার প্রচেষ্টার বিরোধিতা করা হয়েছে। কলকাতায় নারী যৌনকর্মীদের জীবনযাত্রার উন্নতিতে ইতিবাচক বিকাশে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিমা সংস্থা ২৫০ ব্যক্তিকে জীবনবিমা সরবরাহ করেছে। গত কয়েক বছরে ভারতে যৌনকর্মীদের এবং তাঁদের সন্তানদের মধ্যস্থতাকারীদের দ্বারা এবং এইচআইভি / এইডসের হুমকি বেড়ে যাওয়ার কারণে গণিকাবৃত্তি বৈধকরণের লক্ষ্যে ভারতে ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি দেখা গেছে। অনৈতিক ট্রাফিক (প্রতিরোধ) আইন বা আইটিপিএ ১৯৮৬ সালে জাতিসংঘের ঘোষিত চুক্তির ফলে ১৯৫৬ সালে নিউইয়র্কে পাচার দমনের দায়ে স্বাক্ষরিত হওয়ার এক আইন সংশোধনের ১৯৮৬ সালের সংশোধনী। অল ইন্ডিয়া সাপ্রেশন অব অনৈতিক ট্রাফিক অ্যাক্ট (All India Suppression of Immoral Traffic Act ) নামে এই আইনটি বর্তমান আইন সংশোধন করা হয়। এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল যৌনকর্মের বিভিন্ন দিকগুলি ধীরে ধীরে ফৌজদারি করে ভারতে গণিকাবৃত্তি সীমিত করার এবং অবশেষে গণিকাবৃত্তির অবসান। নিম্নরূপ PITA এর প্রধান পয়েন্টগুলি হল—গণিকার গণিকাবৃত্তির বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। একইভাবে কলগার্লরা পাবলিকলি ফোন নম্বর প্রকাশ করতে পারবেন না (জরিমানা ৬ মাস পর্যন্ত)। কোনো যৌনকর্মীকে কোনো পাবলিক জায়গায় গণিকাবৃত্তির জন্য শাস্তিপ্রদান করা হয়। (জরিমানা ৩ মাসের কারাদণ্ড)
২০০ গজের মধ্যে একটি যৌনকর্মীর সঙ্গে যৌনকর্ম জড়ালে চার্জ করা যেতে পারে (৩ মাসের কারাদণ্ড )। যৌনকর্মী ১৮ বছর বয়সের নীচে হলে ক্লায়েন্টকে শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে শাস্তি ৭ থেকে ১০ বছরের কারাদণ্ড। বাবু বা দালাল বা পোষ্য প্রেমিক, যাঁরা গণিকাবৃত্তির মাধ্যমে উপার্জন করে, তা দণ্ডনীয় অপরাধ। কোন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ যদি গণিকার সঙ্গে বসবাস করে এবং তা প্রমাণিত হয়, তবে তাকেও দোষী মনে করা হয়। শাস্তি জরিমানা সহ ২ বছরের কারাদণ্ড। বড়িওয়ালি এবং গণিকালয়-রক্ষীদের বিরুদ্ধে মামলা করা যেতে পারে। ভারতে গণিকালয় চালানো অবৈধ। প্রথম অপরাধের জন্য জরিমানা সহ ১ থেকে ৩ বছর কারাদণ্ড। কেউ যদি যৌন-শোষণের উদ্দেশ্যে আটক করে, তাহলে মামলা দায়ের করতে পারে। শাস্তি ৭ বছরের বেশি সময় কারাবাস। হোটেলে গণিকাবৃত্তি চালানোও একটি ফৌজদারি অপরাধ।
২০০৯ সালে সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে, আইন সংশোধন বিবেচনা করার জন্য গণিকাবৃত্তি আইনি করা উচিত এবং একটি প্যানেল গঠন করা উচিত। ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টের মতে, মর্যাদা সহকারে বসবাসের অধিকার’ একটি সাংবিধানিক অধিকার এবং শ্রমকর্মীদের মর্যাদা সহকারে কাজ করার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির শর্ত সম্পর্কিত একটি আদেশ জারি করে। আদালতে কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে পুনর্বাসনের জন্য আগ্রহী দেশে যৌনকর্মীদের সংখ্যা নির্ধারণের জন্য একটি জরিপ পরিচালনা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে ২০১২ সালে কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রিম কোর্টের কাছে একটি আপিল করেছিল যে যৌনকর্মীদের সাংবিধানিক মর্যাদা সহকারে বসবাসের অধিকার’ অনুযায়ী তাদের ব্যাবসা চালানোর অনুমতি দেওয়া উচিত নয়। সরকারি পরামর্শে বলা হয়েছে যে, আদালত কর্তৃক এ ধরনের কোনো অনুমোদন আইটিপিএর অত্যাবশ্যক হবে, যা সম্পূর্ণরূপে গণিকাবৃত্তিকে নিষিদ্ধ করে। বিরোধিতাকারী আইনজীবী এই আইনটি শুধুমাত্র গণিকাবৃত্তি কার্যক্রম এবং পিম্পসের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিষিদ্ধ করেছিল। সুপ্রিম কোর্টের এই আবেদনটি পর্যবেক্ষণ করার জন্য রাজি হয়েছে।
একনজরে ভারতীয় গণিকাবৃত্তির বিরুদ্ধে আইন :
যৌনকর্মী : কোনো গণিকা যদি প্রলুব্ধ করে বা আহ্বান জানায় তবে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হবে। একইভাবে, কলগার্লরাও তাঁদের ফোন নম্বর জনসমক্ষে প্রকাশ করতে পারবে না। (জরিমানাসহ ৬ মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড, ৮ নং পয়েন্ট)।
প্রকাশ্য স্থান অথবা ‘বিজ্ঞাপিত স্থানের’ কাছাকাছি গণিকাবৃত্তির জন্যও যৌনকর্মীদের শাস্তি হবে (জরিমানাসহ তিনমাস পর্যন্ত কারাদণ্ড, পয়েন্ট ৭),
ক্লায়েন্ট : গণিকাদের সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হওয়ার জন্য একজন ক্লায়েন্ট অপরাধী হিসাবে গণ্য হবে এবং সে যদি কোনো প্রকাশ্য স্থানের কিংবা বিজ্ঞাপিত স্থানের’ ২০০ গজের মধ্যে কোনো যৌনকর্মীর সঙ্গে যৌনসংসর্গে লিপ্ত থাকে তবে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হবে। (তিনমাস পর্যন্ত কারাদণ্ড, ৭ নং পয়েন্ট)। যৌনকর্মী যদি ১৮ বছরের নীচে হয় তাহলেও ক্লায়েন্টদের শাস্তি দেওয়া হবে (৭ থেকে ১০ পর্যন্ত কারাদণ্ড, যদি গণিকা শিশু অথবা নাবালিকা হয়ে থাকে)।
কুটনি বা বাবু : গণিকাদের আয়ের অর্থে জীবনযাপন করা কুটনি বা বাবু বা লিভ-ইন প্রেমিকেরাও অপরাধী। গণিকাদের সঙ্গে বসবাস করা যে-কোনো প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকেই অপরাধী হিসাবে ধরে নেওয়া হবে, যদি না সে নিজেকে দোষমুক্ত হিসাবে দেখাতে না পারে। (জরিমানাসহ ২ বছরের জেল, ৪ নং পয়েন্ট)।
গণিকালয় : গণিকালয়ের মালিক এবং এর রক্ষকের দণ্ডাজ্ঞা হতে পারে; গণিকালয় চালানো অপরাধ। (প্রথম অপরাধের জন্য জরিমানাসহ ১ থেকে ৩ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে)। যৌন শোষণ করার জন্য কাউকে গণিকালয়ে আটক করে রাখলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। (৭ বছরের অধিক কারাদণ্ড, পয়েন্ট ৬)। হোটেলে গণিকাবৃত্তিও একটি আইনত অপরাধ।
জোগান দেওয়া এবং পাচার করা : কোনো ব্যক্তি যদি কুটনিগিরি করে অথবা করার চেষ্টা করে তবে উক্ত ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। এছাড়াও কোনো ব্যক্তি যদি কাউকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যায় (মানব পাচার) তবে তাঁরও একই শাস্তি হবে। (প্রথম অপরাধের জন্য জরিমানাসহ ৭ বছরের কারাদণ্ড এবং পরবর্তী ক্ষেত্রে আজীবন কারাদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে; পয়েন্ট ৫বি)।
উদ্ধারকৃত মহিলা : সাহায্যপ্রার্থী যে-কোনো যৌনকর্মীকে উদ্ধার করতে এবং নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে তাকে পুনর্বাসন করাতে সরকার আইনত বাধ্য থাকবে। (পয়েন্ট ২১)।
এই আইন মোতাবেক প্রকাশ্য স্থানগুলি হল–সর্বসাধারণের ধর্মীয় পূজাঅর্চনার স্থান, শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান, ছাত্রাবাস/হস্টেল, হাসপাতাল ইত্যাদি। PITA আইন মোতাবেক রাজ্য সরকার যেসব স্থানগুলিকে গণিকাবৃত্তি মুক্ত ঘোষণা করেছে সেগুলিকে বলা হবে ‘বিজ্ঞাপিত স্থান। এই আইন অনুসারে গণিকালয় হল এমনই একটি স্থান, যেখানে দুই অথবা ততোধিক যৌনকর্মী রয়েছে (২)। গণিকাবৃত্তি এমনিতে কোনো অপরাধ নয়, কিন্তু সলিসিটিং, গণিকালয়, কুটনি ইত্যাদি হল বেআইনি।
উন্নয়ন সংস্থা ‘সংলাপ’-এর বেশিরভাগ গবেষণা ইঙ্গিত করে যে, ভারতে বেশিরভাগ যৌনকর্মী নিজেদের বা তাঁদের সন্তানদের ভরণপোষণ করার জন্য গণিকা হিসাবে কাজ করেন। বেশিরভাগই মেয়েরা এই পেশাটি পছন্দ করেন না। কিন্তু বিবাহ বহির্ভূত, বিবাহবিচ্ছেদ এবং তাঁদের পরিবারের দ্বারা তাঁদের বাড়ি থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর এই পেশায় চলে আসে। যৌনকর্মীদের সন্তানরাও এই ধরনের কাজেও জড়িত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অল বেঙ্গল উইমেন ইউনিয়নের ১৯৮৮ সালে একটি সার্ভে রিপোর্ট বলছে, কলকাতায় ১৬০ জন যৌনকর্মীদের মধ্যে একটি উপযুপরি নমুনা (random sample) সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, তাতে দেখা গেছে—তাদের মধ্যে ২৩ জন দাবি করেছেন যে, তাঁরা তাঁদের এ পেশা নিজেরাই পছন্দ করে নিয়েছেন, বাকি ১৩৭ জন নারী যৌন-বাণিজ্য এজেন্টের মাধ্যমে এসেছে।
১৯৯৬ সালে মুম্বাইয়ের এক গণিকালয়ে বিশাল চিরুনি তল্লাসি করে ৪৮৪ জন গণিকার মধ্যে ৪০% নারীকে উদ্ধার করা হয়েছিল, যাঁদের নেপাল থেকে আনা হয়েছিল। ১৯৯০ সালে ভারতে এক গণনা দেখা গেছে যে, গণিকালয়গুলিতে ২,০০,০০০ নেপালি মেয়ে ছিল, যাঁদের বয়স ১৪ বছরের নীচে।
ভারত একটি উৎস, গন্তব্য, এবং যৌন পাচারের শিকার নারী এবং শিশুদের জন্য সংযোগ দেশ। ভারতের বেশিরভাগ পাচারের সমস্যা অভ্যন্তরীণ এবং সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত সামাজিক স্তরের—নিম্নতম বর্ণবাদী দলিত, উপজাতি সম্প্রদায়, ধর্মীয় সংখ্যালঘু নারী ও মেয়েশিশুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবণতা। হাজার হাজার অননুমোদিত কাজ প্রদানকারী সংস্থাগুলি (Placement Agencies) মিথ্যা প্রতিশ্রুতির দিয়ে প্রাপ্তবয়স্কদের এবং শিশুদের পাচার করে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, লক্ষ লক্ষ নারী ও শিশু ভারতে যৌন হয়রানির শিকার হয়। প্রথাগত রেড লাইট এরিয়ার পাশাপাশি, ছোটো হোটেল, যানবাহন এবং ব্যক্তিগত বাসস্থানগুলিতে নারী ও শিশুদের পাচার করা হয়।
ভারতে ৭ টি স্থান, যেখানে গণিকালয়গুলি একটি ঐতিহ্য। নারী তাঁদের জীবিকার জন্য এই পেশাকে সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে। এটি খুব স্পষ্ট যে, কেন গণিকাবৃত্তি (অর্থের জন্য যৌনসেবা বিনিময়) বিশ্বের প্রাচীনতম পেশা বলে মনে করা হয়? প্রথম দিকের সময়ে, সৌজন্যে সাম্রাজ্যগুলিতে রাজকীয় অবস্থা উপভোগ করত, যা আজকে ভারতে একটি খুব দুর্বল অবস্থা থেকে নেমে এসেছে। ভারতে গণিকাবৃত্তি অবৈধ হলেও, আপনি কি জানেন যে দেশে এমন জায়গা রয়েছে যেখানে আজও নারী তাঁদের জীবিকার জন্য এটির উপর নির্ভরশীল? ভারতের কয়েকটি বিখ্যাত গণিকালয়–
আমাদের দেশে একাধিক জায়গা আছে যেখানে এই কাজ এবং সেই সমস্ত জায়গাকেই রেড লাইট এরিয়া বা রেড লাইট স্ট্রিট বা রেড লাইট ডিস্ট্রিক্ট বলা হয়। এরকমই কুখ্যাত দশটি নিষিদ্ধ এলাকার কথা বলব যেগুলি আমাদের দেশের বিভিন্ন বড়ো শহরে আছে।
(১) মীরাগঞ্জ, উত্তরপ্রদেশ : উত্তরপ্রদেশের এলাহাবাদে আছে এই রেড লাইট এলাকা মীরাগঞ্জ। যৌন আনন্দের জন্য এখানে অত্যন্ত সুন্দরী গণিকা পাওয়া যায়। কিন্তু এই মীরাগঞ্জ জোরপূর্বক গণিকাবৃত্তি এবং অবৈধ পাচারের জন্য বিখ্যাত। এখানে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খণ্ড এবং নেপাল ও বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশী দেশ থেকেও গণিকা আছে।
(২) চতুর্ভুজস্থান, মুজাফফরপুর : এটি একটি মোগলীয় ধরনের রেড লাইট এরিয়া। এলাকাটি মোগলদের দ্বারা শুরু হয় এবং এটি ২৫০০ জন যৌনকর্মীর একটি বাসস্থান। এখানকার প্রতিটি গণিকালয়ে একজন ম্যাডাম বা মাসি থাকে, যে ওই নির্দিষ্ট গণিকালয়ের সর্বময় কত্রী।
(৩) শিবদাসপুর, উত্তরপ্রদেশ : বারাণসী স্টেশন থেকে দশ মিনিটের পথ শিবদাসপুর। এটা একটা যথেষ্ট ঘন। জনবসতিপূর্ণ এলাকা। এটিও একটি মোগল আমলের নিষিদ্ধ এলাকা। অনেক আগে এটি শুরু হয়েছিল। এখানে খুব বড়ো আকারের কোনো গণিকালয় নেই, কিন্তু ছোটো বড়ো অনেক ঘর আছে যেখানে চলে গণিকাবৃত্তির কাজ। প্রাচীনকাল থেকেই বারাণসী গণিকাবৃত্তির জন্য বিখ্যাত এবং মার্জিত ড্যানুসাস, যা আমরা এটিকে ‘তাওয়াইফ সংস্কৃতি’ বলে অভিহিত করি। কিছু বলিউড চলচ্চিত্রও এই সংস্কৃতির গভীর দিক দেখিয়েছে। কিন্তু একইরকম পরিস্থিতি এখনও অব্যাহত রয়েছে এবং যা আরও বেশি ক্ষতিকর।
(৪) ইটওয়ারি, মহারাষ্ট্র : নাগপুরের গঙ্গা-যমুনার সংযোগস্থলে অবস্থিত ইটওয়ারি। এখানে অনেক যুবতী মেয়ে গণিকাবৃত্তির কাজ করে থাকে। এখানে শুধুমাত্র অবৈধ গণিকাবৃত্তিই চলে না, সঙ্গে আরও অন্যান্য দুষ্কর্ম চলে এবং স্মাগলিংয়ের ব্যাবসাও চলে।
(৫) বুধওয়ার পেঠ, মহারাষ্ট্র : পাঁচ হাজারের বেশি যৌনকর্মী আছে বুধওয়ার পেঠে এবং একাধিক গণিকালয় আছে। অনেক লোক এখানে যান এখানকার আকর্ষণে। এছাড়াও এই এলাকাটি ইলেকট্রনিক্স দ্রব্যাদির বাজার এবং অজস্র বইয়ের দোকানের জন্য বিখ্যাত।
(৬) কামাথিপুরা, মহারাষ্ট্র : মুম্বাইয়ের কামাথিপুরা জায়গাটি তার নামের জন্য এখন বেশি পরিচিত হয়। এখানকার প্রধান আকর্ষণ হল, এখানকার গণিকালয়গুলি এবং এই জায়গাটিকে এখন মুম্বাইয়ের রেড স্ট্রিট বলা হয়। এটি এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম রেড লাইট এরিয়া। এই এলাকাটি আর্থিক রাজধানীতে সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গাগুলির মধ্যে একটি, যেখানে অপরাধের হার কখনও নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
(৭) জিবি বোড়, দিল্লি : জিবি, রোড বা গারস্টিন বাস্তিয়ন রোড দিল্লির একটি অত্যন্ত জনবহুল জায়গা এবং এখানে আছে একাধিক দোকান। এখানে রাস্তার দু-পাশে অনেক পুরনো উঁচু উঁচু বিল্ডিং দেখতে পাওয়া যায়। এটি রাজধানীর আর-একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র, যেখানে পুরোনো মাল্টি-স্টোরেড বিল্ডিং দেখতে পাওয়া যায়, যেখানে নীচের তলায় নিয়মিত দোকান হিসাবে কাজ করে এবং বাকি ফ্লোরগুলি গণিকালয় হিসাবে কাজ করে। এখানে গোটা দেশের মেয়েদের এনে বিক্রি করা অন্যতম বড় ব্যাবসা। আপনি যদি দিল্লিতে থাকেন, তবে আপনার যৌনকর্ম ব্যতীত এই স্থান সম্পর্কে সচেতন হওয়ার কথা নয়। এই এলাকাটি যেখানে সমগ্র দেশ থেকে মেয়েশিশুদের এবং অপ্রাপ্তবয়স্কদের বিক্রি করা হয়।
(৮) মুভাত্তুপুলা, কেরালা : ভারতের অন্যতম আধুনিক গণিকালয়। এখানে ক্লায়েন্টরা অনলাইনে বুকিং করেও আসতে পারেন আনন্দ করার জন্য। তাছাড়াও এখানে ফোনে বুকিংয়ের সুবিধাও আছে বিভিন্ন এজেন্ট মারফত। এই এলাকায় যৌনকর্মীরা প্রধানত কেরলের মেয়ে এবং শ্রীলঙ্কারও কিছু মেয়ে আছে এখানে।
(৯) রেড লাইট জেলা, জম্মু : জম্মুতে আছে রেড লাইট অঞ্চল। যদিও জম্মু বিখ্যাত এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য। কিন্তু অনেক পুতুলের মতো সুন্দরী মেয়েরা আছে এখানে, যাঁরা যৌনকর্মীর কাজ করে। এখানকার বেশিরভাগ মেয়েকেই জোর করে করানো হয় এই কাজ।
(১০) ওয়াডিয়া, গুজরাট : প্রাচীনকালে থেকেই এই এলাকায় নারী পতিতাবৃত্তির মাধ্যমে তাঁদের পরিবারকে সমর্থন করার জন্য জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে,। যদিও পুরুষরা আসলে মহিলাদের জন্য গ্রাহকদের সন্ধান করে। সঠিক ভাষায়, এই শহরে পুরুষরা পিম্পস এবং শতাব্দী প্রাচীন সংস্কৃতি বর্তমান। যার কারণে এটি শেষ করা কঠিন। শিক্ষা ড্রাইভ এবং গণ বিবাহের একটি ছোটো প্রভাব ফেলেছে বটে, কিন্তু বড়ো অনুশীলন অবৈধভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে।
(১১) উত্তরপুর, মধ্যপ্রদেশ : উত্তরপ্রদেশের একটি ছোট্ট গ্রাম নেক্র, এখন ৪০০ বছর ধরে নেক্রর গণিকাবৃত্তি একটি ঐতিহ্য আছে। রাজধানীর লখনউ শহর থেকে আনুমানিক দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। এই গ্রামের প্রায় ৫,০০০ নারী তাঁদের উপার্জনের জন্য এই গণিকাবৃত্তি উপর মূলত নির্ভর করে। এই গ্রামের বাচ্চারা, সাধারণত তাঁদের মায়েদের সঙ্গে বসবাস করে তাঁদের পিতা কে কেউ জানে না।
(১০) সোনাগাছি, পশ্চিমবঙ্গ : এশিয়ার সবচেয়ে বড়ো গণিকালয় কলকাতার সোনাগাছি। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, এখানকার গণিকালয় নির্মাণ করেন ব্রিটিশরা, তাঁদের সেনাবাহিনীর জন্য। কারণ তাঁদের স্ত্রীরা তখন ইংল্যান্ডে থাকত। বর্তমানে প্রায় ১১ হাজারের বেশি যৌনকর্মী আছে এখানে। বলা হয় যে, ইংরেজরা জোরপূর্বক বিধবা মহিলাদের নিয়ে আসত এখানে। এখানে একাধিক ছোটো বড়ো বিল্ডিং রয়েছে যেখানে চলে এই কাজ। না, এই ঐতিহ্যবাহী সোনাগাছি নিয়ে আলোচনা এতটুকুতেই শেষ করা যায় না। আলাদা একটি অধ্যায়ে বিস্তারিত লেখার সুযোগ আছে এবং লিখব।
একটা ঘটনার উল্লেখ করে ভারতের গণিকাবৃত্তির আলোচনা শেষ করব। এমন একটা সম্প্রদায়ের মেয়েদের কথা বলব যেখানে এক সম্প্রদায়ের সদস্যরা তাদের পরিবারে জন্ম নেওয়া সবচেয়ে বড়ড়া মেয়েকে গণিকাবৃত্তির দিকে ঠেলে দেয়। যেখানে দেশের বেশিরভাগ পরিবারের বাবা-মায়েরা মেয়ে সন্তানের চাইতে ছেলে সন্তানদের বেশি পছন্দ করে। সেখানে হিনা জন্মগ্রহণ করলে তাঁর বাবা-মা রীতিমত উৎসব উদযাপন করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত এই উদযাপনের পিছনে ছিল বিচিত্র একটি উদ্দেশ্য। হিনা ভারতের পশ্চাৎপদ সম্প্রদায়ের একজন সদস্য। এই সম্প্রদায়ে শত শত বছর ধরে এখন পর্যন্ত একটি প্রথা প্রচলিত আছে। যেখানে সম্প্রদায়ের সদস্যরা তাঁদের পরিবারে জন্ম নেওয়া সবচেয়ে বড়ো মেয়েকে গণিকাবৃত্তির দিকে ঠেলে দেয়। আর এই গণিকাবৃত্তি শুরু হয় মেয়ের মাত্র ১০ থেকে ১২ বছর বয়সেই। পরিবারের পুরুষ সদস্য থেকে শুরু করে বাকি সবার জীবন ওইটুকু মেয়ের আয়ের উপরই নির্ভর করে। কোনো-কোনো ক্ষেত্রে মেয়েটির নিজের বাবা অথবা ভাই দালাল হিসাবে কাজ করে। যখন এই মেয়েটির বয়স হয়ে যায়, তখন তাঁর জায়গা দখল করে নেয় তাঁরই ছোটো বোন।
এভাবেই এই প্রথা সম্প্রদায়ের সবার গ্রহণযোগ্যতার উপর নির্ভর করে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পালন হয়ে আসছে। এই সম্প্রদায়ে বিয়েটাও হয় ভিন্নভাবে। এখানে বিয়ে দেওয়ার সময় কনের পরিবার বরের পরিবারের কাছ থেকে বড়ো অংকের অর্থ দাবি করে। যেটাকে অনেকেই উল্টো যৌতুক হিসাবে আখ্যা দেন। হিনাকে জন্মের পর থেকে এই ধরনের জীবনের জন্য প্রস্তুত করা হয় এবং তারপরে খুব অল্প বয়সেই তাঁকে এই কাজে জোরপূর্বক ঠেলে দেওয়া হয়। বিবিসি হিন্দিকে তিনি বলেন, “আমাকে যখন এই পেশায় ঠেলে দেওয়া হয়। তখন আমার বয়স মাত্র ১৫ বছর। পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে আমাকে আমার মা ও দিদিমার দেখানো পথেই। চলতে হয়েছে। ১৮ বছর বয়সে আমি প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমার সঙ্গে কত অন্যায় হয়েছে এবং ভীষণ রাগও হয়েছিল তখন। কিন্তু এ ছাড়া আমার আর কিই-বা করার ছিল? যদি আমি এভাবে উপার্জন না করতাম তাহলে আমার পরিবার কীভাবে বাঁচত?” প্রতিদিন তাঁর কাছে গ্রামীণ ধনী থেকে শুরু করে ট্রাক চালক পর্যন্ত একাধিক ক্লায়েন্ট আসত।
ভারতের বাচ্ছা সম্প্রদায়ের মানুষেরা সাধারণত ভীষণ দারিদ্রপীড়িত। পরিবারের জন্য উপার্জন এবং আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে তাঁরা নারী সদস্যদের উপর নির্ভর করে। পেশায় আসা এক-তৃতীয়াংশের বেশি মেয়ে বয়সে অনেক ছোটো। বাচ্ছা সম্প্রদায় একসময় যাযাবর উপজাতি গোষ্ঠী ছিল। পরে তাঁরা মধ্যপ্রদেশের তিনটি জেলায় ছড়িয়ে যায়। এই সম্প্রদায়ের মানুষেরা বেশিরভাগ গ্রামীণ এলাকা বা মহাসড়কের পাশে থাকে, যেখানে ট্রাক ড্রাইভাররা বিরতি নিয়ে থাকে। অল্প বয়সি মেয়েরা, যাঁরা কিনা স্থানীয়ভাবে খেলোয়াড় হিসাবে পরিচিত। তাঁরা দলবেঁধে, না-হলে একা একাই ক্লায়েন্টদের অনুরোধ করার জন্য অপেক্ষা করে। এছাড়া পথের দু-পাশে প্রায়শই ছোটো দোকানের মতো বুথ থাকে, সেখানে মেয়েটির দালাল হিসাবে তার ভাই না-হলে বাবা, ক্লায়েন্টকে আহ্বান জানায়। তাঁরা চালকদের সঙ্গে একটি চুক্তি করে, যা সাধারণত ক্লায়েন্ট প্রতি ভারতীয় মুদ্রায় ১০০ থেকে ২০০ হয়ে থাকে। স্থানীয়দের মতে, একটি কুমারী মেয়ের জন্য সর্বোচ্চ দাম পাওয়া যায়। ক্লায়েন্ট প্রতি সেটা ৫০০০ রুপি বা ৭২ ডলার পর্যন্ত হয়ে থাকে। বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হিনা বলেন, “প্রতিদিন দিনের বেলা প্রায় চার থেকে পাঁচজন পুরুষ আসে। রাতের বেলা আমরা হোটেল বা কাছাকাছি অন্য কোথাও যাই। সবসময় সংক্রমিত রোগে ভোগার ঝুঁকি ছিল।” ‘দ্য হিন্দু পত্রিকা ২০০০ সালে এই ধরনের চিকিৎসার অবহেলার বিষয়টি তুলে ধরে প্রতিবেদন করে। তাঁরা জানিয়েছে যে, এই সম্প্রদায়ের ৫৫০০ সদস্যকে পাওয়া গেছে যারা এইচআইভি পজিটিভ। শতাংশের হিসাবে এই আক্রান্তের হার সম্প্রদায়ের মোট জনসংখ্যার ১৫%। এসব খেলোয়াড়দের অনেক মেয়েরা গর্ভবতী হয়ে পড়ে। এই পেশায় আসায় কয়েক বছরের মাথায় হিনা একটি কন্যাশিশুর জন্ম দেয়। মা হওয়ার পরও তাঁকে আরও বেশি বেশি পরিশ্রম করার জন্য চাপ দেওয়া হত। অনেক মেয়েরা এক পর্যায়ে গর্ভবতী হয়ে পড়লেও তাঁদের এই কাজ চালিয়ে যেতে হয়। সন্তানদের যত্ন নেওয়ার জন্য আরও অর্থ উপার্জন করতে চাপ দেওয়া হয় তাঁদের। একজন যৌনকর্মী হওয়ার অর্থ হল যে, সে তাঁর সম্প্রদায়ের মধ্যে কারোকে বিয়ে করার জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যায়। অবশেষে হিনা স্থানীয় এনজিও-র সহায়তায় এই প্রথা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন।
সামাজিকভাবে অনুমোদিত এই প্রথার উৎস নিয়ে অনেক তত্ত্ব আছে। তাঁদের মধ্যে একজন জানায়, কীভাবে নরমেডিক উপজাতিদের বাহিরাগত হিসাবে অর্থ উপার্জন করতে গিয়ে সংগ্রাম করতে হয়েছিল। পরে তাঁরা এই যৌনপেশাকে দারিদ্রতা কাটিয়ে ওঠার উপায় বলে মনে করতে থাকে। এই সম্প্রদায়ের প্রায় ৩৩,০০০ সদস্য আছে, যাঁর মধ্যে অন্তত ৬৫% নারী। বেশি সংখ্যক নারী হওয়ার একটি কারণ হল এই অঞ্চলে অল্প বয়সি মেয়েদের অবৈধভাবে পাচার করা হয়। মধ্যপ্রদেশের যেখানে এই সম্প্রদায় বসবাস করে, সম্প্রতি একটি আইন পাস করে, সেখানে ১২ বছরের কম বয়সি শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়া প্রাপ্তবয়স্ক কেউ ১৮ বছরের কম বয়সি মেয়ের সঙ্গে যৌন-সম্পর্ক করলে তাঁদের কারাদণ্ডও বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এই ধরনের পদক্ষেপ পরিস্থিতি পরিবর্তন আনতে পারেনি।
বাচ্ছা সম্প্রদায়ের এই গণিকাবৃত্তির প্রথা পরিহারের উদ্দেশ্যে ১৯৯৩ সালে একটি প্রকল্প চালু করা হয়। কিন্তু এটি এখনও সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করা হয়নি। নারী ও শিশু কল্যাণ বিভাগের কর্মকর্তা রাজেন্দ্র মহাজন বলেন, “প্রতি বছর আমরা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার জন্য অলাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্দেশ্যে প্রতিবছর বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকি, কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ আমাদের মানদণ্ডগুলো পূরণ করতে পারেনি।”
(৮) থাইল্যান্ড : শতাব্দী ব্যাপী থাইল্যান্ডের গণিকাবৃত্তি আধুনিক থাইল্যান্ড। Ayutthaya রাজত্বের (১৩৫১ ১৭৬৭) সময়, গণিকা বৈধ এবং রাজস্বও নেওয়া হয়। ১৯৬০ সাল থেকে থাইল্যান্ডে গণিকাবৃত্তি অবৈধ হল। যাই হোক, এটি জাতীয় জিডিপির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হিসাবে (২০১৫) বছরে আনুমানিক ৬.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের রাজস্ব অর্জন করেছিল।
থাইল্যান্ডে সব গণিকারা কি নারী? না, তা হতে পারে না। কারণ প্রতি দশজনের একজন পুরুষ যৌনকর্মী। এখানকার ক্লায়েন্ট বেশিরভাগই বিদেশি। এদের পোশাকে আর ব্যাবসায় নিজেদের সংস্কৃতি বজায় রাখার এক বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা আছে। তবে এই গণিকাবৃত্তি শিল্প এক নির্দিষ্ট স্থান, অর্থাৎ ব্যাংককের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। এই শহরে রেস্তোরাঁগুলি যৌনপেশার জন্যে উর্বর জায়গা। এখানকার শ্রমিকেরাও যৌনতা বিক্রি করে।
পরিসংখ্যান বলছে, থাইল্যান্ড ৬০ লাখ (আনুমানিক) মানুষ বসবাসকারী একটি দেশ। দেশটি প্রধানত বৌদ্ধ (৯৫%) অধ্যুষিত দেশ। অন্যান্য ধর্মের মধ্যে রয়েছে মুসলিম (৩.৮%), খ্রিস্টান (০.৫%), হিন্দুধর্ম (০.১%) এবং অন্যান্য (০.৬%)। থাইল্যান্ডের তিন-চতুর্থাংশ আদিবাসী ১৪% চিনা এবং ১১% বিভিন্ন জাতি। যদিও কৃষি হল দেশটির নেতৃস্থানীয় পেশা (৫৪%), পরিসেবা শিল্প, যা যৌন-ব্যাবসা সংক্রান্ত সমস্ত ব্যাবসাগুলির ৩১% এবং শিল্প ১৫% অনুসরণ করে। (সিআইএ ওয়েবসাইট : থাইল্যান্ড)
বলতে দ্বিধা নেই যে, থাইল্যান্ড যৌন-ব্যাবসার শ্রেষ্ট কেন্দ্র। ১৯৬০ সালে এই ব্যাবসা এখানে অবৈধ ছিল। তা সত্ত্বেও এই ব্যাবসা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে। এই গণিকাবৃত্তিতে প্রতি বছর ২,০০,০০০ মানুষকে নিযুক্ত করা হয়েছে। এই পেশায় নারীরা সর্বাধিক যুক্ত। যদিও-বা শিশু ও পুরুষ আছে। বেশিরভাগ চাকরির টোপে পড়ে নিজেদের আত্মীয়দের সাহচর্যে এই পেশায় যুক্ত হয়েছে। কেউ আবার সামাজিক অপমান ভুলতে এবং সেখান থেকে অব্যাহতি পেতে এখানে এসেছেন। এছাড়া হোটেল, রেস্টুরেন্ট, নাচ ক্লাব ছেড়ে বর্তমানে এই উন্মুক্ত পথে, এমনকি যৌন পর্যটনে এর বহুল প্রভাব চোখে পড়ে। এখানে যৌন-ব্যাবসা জাপান, জার্মানি, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মতোই সাবলীল হয়ে উঠেছে। ভিয়েতনামের যুদ্ধের পর যৌন-ব্যাবসা মার্কিনি সামরিক বাহিনীদের জন্যই ভোলা হয়। ব্যাংককের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক বাজার এই যৌন পর্যটনের জন্যে আজও টিকে আছে। আজ এখানে বিজ্ঞাপনে মার্কিনিদের জন্য যৌন প্যাকেজ ট্যুর দেওয়া হয়। হোটেলগুলিতে থাকা, খাওয়ার সঙ্গে দীর্ঘ সময়ের নারী অতিথিও ভাড়া দেওয়া হয়। আখেরে হোটেলগুলি যৌনক্রীড়ার কর্মক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
থাইল্যান্ডে প্রজনন আইন ও প্রতিরোধের আইন, বিই ২৫৩৯ (১৯৯৬) আর্টিকেলে সরাসরি গণিকাবৃত্তি আইনত নিষিদ্ধ। এই আইনের অধীনে, গণিকাবৃত্তির সংজ্ঞা হল—“যৌন-সংযম বা অন্য কোনো কাজ, অথবা অন্য কোনো ব্যক্তির কমিশন অর্থের বিনিময়ে অন্য কোনো ব্যক্তির যৌন-বাসনা বা অন্য কোনো উপকারে ফিরে আসার জন্য, যে ব্যক্তিটি পরিসেবা গ্রহণ করে এবং যে ব্যক্তি কাজ সম্পাদন করে, সেটি একই লিঙ্গের বা হোক না-কেন।”, তা অপরাধ। গণিকাবৃত্তির উদ্দেশ্যে অন্য ব্যক্তির সঙ্গে গণিকাবৃত্তির প্রতিষ্ঠানে জড়িত ব্যক্তিরাও কারাগারের মেয়াদ বা জরিমানা বা উভয়ের মুখোমুখি হয়। শিশু গণিকাবৃত্তির ক্ষেত্রে গুরুতর জরিমানা (যার মধ্যে গণিকা ১৫ বছরের কম বয়সি হলে ৬ বছর পর্যন্ত কারাবাস) হয়। অন্যথায় আইন। সাধারণত ব্যক্তিগত জায়গায় গণিকাবৃত্তির বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হয় না। এই আইনটি গণিকাবৃত্তি ব্যাবসা ও প্রতিষ্ঠানের মালিকদের বিরুদ্ধে বড় অংকের জরিমানা ধার্য করে। এছাড়াও ফৌজদারি কোড গণিকবৃত্তি থেকে অর্জিত অর্থ সংগ্রহ বা ব্যবহার করার জন্য জরিমানা নির্ধারণ করা হয়েছে।
গণিকাবৃত্তির আইন প্রতিরোধ ও নির্যাতন শিশু গণিকাবৃত্তি ও পাচারের উপর বিশেষ মনোযোগ নিবেশ করেছে থাইল্যান্ড সরকার। ধারা ৮ বলছে, ১৫ বছরের কম বয়সি যৌনকর্মীদের যৌন-সম্পর্ক স্থাপন করলে ২ থেকে ৬ বছরের কারাদণ্ড এবং ১,২০,০০০ টাকা জরিমানা করে ক্লায়েন্টদের শাস্তি দেয়। ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সের যৌনকর্মীদের ক্ষেত্রে কারাগারের মেয়াদ ১ থেকে ৩ বছর, এবং জরিমানা ৬০,০০০ টাকা পর্যন্ত ধার্য করা যায়। পাচারের বিষয়ে ধারা ৯-এর বিধান অনুসারে, যে ব্যক্তি বা কোনো ব্যক্তি যিনি তাঁর বা তাঁর সম্মতি মোতাবেক, এমনকি সেই ব্যক্তির গণিকাবৃত্তির জন্য কোনো ব্যক্তিকে কিনে নেয়, উচ্ছেদ করে এবং কোনো অপরাধ সংঘটিত বিভিন্ন কাজ কি না তা নির্বিশেষে, রাজ্যের অভ্যন্তরে বা বাইরে যা করা হয়, তাহলে ১ থেকে ১০ বছর মেয়াদে কারাগারবাস এবং ২৫ হাজার থেকে ২ হাজার বাহাত জরিমানা করা হবে। উপরন্তু ধারা ৯ এর অধীনে যে-কোনো অপরাধ প্রতারণা, হুমকি, সহিংসতা, অযৌক্তিক প্রভাব বা জোরপূর্বক অনুশীলনের মাধ্যমে যদি সংঘটিত হয়, তার ফলে এক-তৃতীয়াংশ গুরুতর শাস্তি হয়।
দণ্ডবিধির সংশোধনী আইন (নং ১৪), বিই ২৫৪০ (১৯৯৭) আর্টিকেলে স্পষ্টভাবে বলেনি যে, থাইল্যান্ডে গণিকাবৃত্তি অবৈধ। কিন্তু দণ্ডবিধির ২৮৬ ধারা অনুসারে—যে ব্যক্তি ১৬ বছর বয়সি একজন গণিকাবৃত্তির উপার্জনের উপর নির্ভর করে, এমনকি যদি তাঁর আয়ের কিছু অংশের উপর নির্ভর করে, তবে তাঁকে ৭ থেকে ২০ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হবে এবং ৪ হাজার থেকে ১৪ হাজার বাহাত জরিমানা করা হবে বা যাবজ্জীবন দণ্ডিত করা হবে। জরিমানা নির্দিষ্ট করা না হলেও, আইনের ধারায় একই কোনো ব্যক্তি যিনি (i) কোনো গণিকার সঙ্গে বসবাস করেন বা বাস্তবসম্মতভাবে সংযুক্ত হন, তাঁকে শাস্তি দেন (i) কোনো গণিকা দ্বারা পরিচালিত বোর্ডিং, অর্থ বা অন্যান্য সুবিধা পান অথবা (iii) কোনো গ্রাহকের সঙ্গে ঝগড়া করতে সহায়তা করে। আইনটি শিশু গণিকাবৃত্তি মোকাবিলার জন্যও লিখিত ছিল। কিন্তু সম্পূর্ণ স্বচ্ছতার অভাব ছিল, কারণ এটি একটি পর্নো কাজ’ কি না তা সংজ্ঞায়িত করে না।
১৯৬৬ সালের বিনোদন স্থান আইনটি (Entertainment Places Act of 1966) বিনোদনের চৌহদ্দিতে গণিকাবৃত্তি ঘটালে নির্দিষ্ট ধরনের বিনোদন প্রতিষ্ঠানের মালিকের উপর অপরাধ সাব্যস্ত হয়ে থাকে। যার ফলে তাঁরা অপরাধমূলকভাবে দায়বদ্ধ হয়ে পড়ে। গণিকালয় পরিচালনা করা, অনুরোধ এবং অন্যদের গণিকাবৃত্তি থেকে লাভজনক সম্পর্কিত কার্যক্রম অবৈধ। থাই আইন অনুযায়ী গণিকাবৃত্তি নিষিদ্ধ। তবে কারাওকে বার (Karaoke bars) এবং ম্যাসেজ পার্লারগুলিকে স্বাভাবিক, বৈধ ব্যবসা হিসাবে নথিভুক্ত করা যেতে পারে। যৌনকর্মীদের গ্রেফতার করা হয় তখনই, যখন এই ধরনের কাজ চৌহদ্দির মধ্যে সংঘটিত হবে। তখন পুলিশ সাধারণত যৌনকর্মী এবং ক্লায়েন্টের মধ্যে বিনিময় হিসাবে গণিকাবৃত্তির আচরণকে বিনিময় হিসাবে মেনে নেয়।
সোয়া ম্যাসেজ ইনস্টিটিউটস, জাপানি সোপল্যান্ডগুলির মতো, সাধারণত ওয়েল ম্যাসেজ, নগ্ন শরীরের ম্যাসেজ বা স্নান চিকিৎসা যা যৌন পরিসেবাগুলিও অন্তর্ভুক্ত করে। এই ধরনের প্রতিষ্ঠানে পুরুষ ক্লায়েন্ট নারী গণিকাদের সঙ্গে যৌন কার্যকলাপে ব্যস্ত হতে পারে। ব্যাংককের কিছু প্রতিষ্ঠানে প্রচুর পরিমাণে সোপ ম্যাসেজ ব্যাবসার জড়িত আছে।
থাইল্যান্ডের থাই-ম্যাসেজের জন্য পরিচিত হলেও এটি ‘নুয়েট ফেন বোয়ার’ নামে পরিচিত ম্যাসেজের যৌনতাহীনতা (Non-sexual), ঐতিহ্যগত কায়দায় ম্যাসেজের চালু আছে। কিছু ম্যাসেজ পার্লারে হাত দিয়ে লিঙ্গমৈথুন (handjobs), ওরাল সেক্স এবং যৌনসঙ্গম (Sexual Intercourse) সহ অতিরিক্ত খরচ করলেই পাওয়া যায়। ২০১৬ সালে ‘Federation of Thai Spa Associations’ (FTSPA) কর্তৃপক্ষ কিছু ম্যাসেজ পার্লারে দেওয়া যৌন-পরিসেবাদি বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। FTSPA বজায় রাখে যে, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ‘চমৎকার স্বাস’ (pretty spas) বা ম্যাসেজ পার্লারগুলি থেকে পর্যটকরা যৌন-পরিসেবাদি কিনতে পারে।
১৯০৫ সালে যখন রামা ভি দাসত্ব (slavery) নিশ্চিহ্ন করেন। তখন মহিলারা নিজেদের ছাড়া কিছু খুঁজে পেলেন না। তাই তাঁরা বেঁচে থাকার জন্য তাঁদের শরীর বিক্রি করতে শুরু করে। সেই সময় প্রায় লক্ষ লক্ষ চিনা পুরুষ নির্মাণ কাজ (Construction Work) করতে এসেছিল, যাঁরা যৌন-সম্পর্কের দাবি করেছিল। ১৯০৮ সালে তৎকালীন রাজা গণিকাবৃত্তি বৈধকরণ এবং যৌনকর্মীদের চিকিৎসা সেবা পেতে আইন পাস করেন। থাইল্যান্ডের প্রাচীন গ্রন্থগুলির একটি প্রাচীন, ধারাবাহিক ঐতিহ্য, যা সাধারণত ধম্মসাৎ (Dhammasattha) সাহিত্যের শিরোনামে বর্ণনা করা হয়েছে, যেখানে গণিকাবৃত্তি বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত এবং সর্বজনীনভাবে নিষিদ্ধ করে। বিংশ শতাব্দীতে যৌনশিল্প (Sex Industry) সম্পর্কিত বিভিন্ন আইন পাস করা হয়, যার মধ্যে ১৯০৮ সালের সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ আইন এবং বিনোদন স্থান আইন, ১৯৬৬ (Entertainment Places Act of 1966) অন্তর্ভুক্ত। ১৯৫০-এর দশকে থাই প্রধানমন্ত্রী ফিল্ড মার্শাল সরিত থানতারাত (Sarit Thanarat) নৈতিকতা নিয়ে প্রচারণা শুরু করেন, যার মধ্যে আছে জরিমানা ও কারাদণ্ড আরোপের মাধ্যমে গণিকাবৃত্তিকে অপরাধে পরিণত করা। থাইল্যান্ডের যৌনকর্মীরা যৌনবৃত্তি করেন আর্থিক চাপের জন্য নয়, প্রমাণ রয়েছে যে বেশিরভাগ মেয়েরা গণিকাবৃত্তি পছন্দ করেন।
(৯) ফিলিপাইন : ফিলিপাইনের গণিকাবৃত্তি অবৈধ, যদিও যৌনকর্মীদের ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারীরা খুব কমই বিরল। পাচারের ক্ষেত্রে জড়িত ব্যক্তিদের জন্য জরিমানা করা হয় বটে, যা ২০০৩ সালের ‘Anti-Trafficking in Persons Act of 2003’ দ্বারা সুরক্ষিত। গণিকাবৃত্তি প্রায়শই বার, কারওকে বার (কেটিভি হিসাবেও পরিচিত), ম্যাসেজ পার্লারস, ব্রথেলস (এটি কাসা নামে পরিচিত), রাস্তায় চলমান গণিকাবৃত্তি এবং এসকর্ট সেবা দিতে দেখা যায়। ফিলিপাইনের ‘Population Institute and Demographic Research and Development Foundation’ কর্তৃক ২০০২ সালে ‘তরুণ প্রাপ্তবয়স্ক উর্বরতা ও যৌনতা চর্চা’ পরিচালিত হয়েছিল যে, ১৯% তরুণ পুরুষ যৌনতার জন্য অর্থ প্রদান করেছিল এবং ১১% যৌন অনুগ্রহের জন্য অর্থ প্রদান পেয়েছিল। ২০১৩ সালে আনুমানিক ৯৭.৫ মিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে ফিলিপাইনে ৫,০০,০০০ গণিকাবৃত্তির সঙ্গে জড়িত ছিল। ২০০৫ সালের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, সিনেটর পিয়া এস (Pia S. Cayetano) তার অ্যান্টি-গণিকাবৃত্তি আইন’ (সেনেট বিল নং ২৩৪১, ২০১০)-এ বলেছিলেন যে, ফিলিপাইনে গণিকাবৃত্তিতে শোষিত মানুষের সংখ্যা ৮,০০,০০০ এর চেয়ে বেশি হতে পারে।
ফিলিপাইনে গণিকারা স্থানীয় গ্রাহকদের এবং বিদেশিদের যৌন-পরিসেবা দিয়ে থাকে। এখানকার গণিকাবৃত্তি এক উচ্চতর ঘটনা। অলিঙ্গাপো সিটি, এঞ্জেলস সিটি, আলবেয়ের লিগাজিপ সিটি, পাসে সিটি এবং জাম্বলেস শহরগুলির সাধারণত পূর্ব এশীয় ও পশ্চিমা দেশগুলির বিদেশি ব্যবসায়ীদের মধ্যে গণিকাবৃত্তি চলে। অলিঙ্গাপো সিটি এবং এঞ্জেলস সিটিতে গণিকাবৃত্তি যথাক্রমে সাবিক বে ন্যাভাল বেস এবং ক্লার্ক এয়ারবেসে মার্কিন সামরিক বাহিনীর সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। ১৯৯১ সালে যখন পিনাতুবো পর্বতমালার একটি আগ্নেয়গিরি অগ্ন্যুৎগার হয়, এটি ক্লার্ক এয়ারবেসের বেশিরভাগ অংশই ধ্বংস হয়ে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৯২ সালে বেসটি বন্ধ করে দেয়। এর সঙ্গে যুক্ত কিছু গণিকাবৃত্তি বাণিজ্যও বন্ধ করে দেয়। কিন্তু ম্যানিলার মেয়র আলফ্রেডো লিম যখন ১৯৯২ সালে শুরু হওয়া ম্যানিলার আর্মি এলাকার যৌনশিল্প এলাকাগুলি বন্ধ করে দেন, তখন বেশিরভাগ গণিকারা নতুন গ্রাহক খুঁজতে এঞ্জেলসে চলে যায়। যৌন পর্যটকদের এটা যেন তীর্থক্ষেত্র। সিবুর মতো অন্যান্য পর্যটন এলাকাগুলিও একটি উচ্চ-প্রোফাইল গণিকাবৃত্তি শিল্পের বিকাশ হয়েছে। অনলাইন ডেটিং সাইট এই প্রবণতা উৎসাহিত করতে একটি বড় ভূমিকা নিয়েছে।
ফিলিপাইনের একক অবাঞ্ছিত মা হওয়ার পরে কিছু নারীও গণিকাবৃত্তি শিল্পে যোগ দেয়। গণিকাবৃত্তি গ্রহণের বিভিন্ন কারণের মধ্যে রয়েছে ফিলিপাইনের কৃত্রিম গর্ভনিরোধের অসম্পূর্ণতা, অপর্যাপ্ত যৌনশিক্ষা, জন্ম নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে বিলম্ব এবং বহু ফিলিপিনো পুরুষের মধ্যে একটি টেকিক্যাল মনোভাব। ফিলিপাইনে প্রতি বছর জন্মগ্রহণকারী শিশুদের অর্ধেকেরও বেশি অবৈধ এবং অবৈধ শিশু বছরে প্রায় ২ শতাংশ হারে বেড়েছে।
মেসেজেস হিসাবে কাজ করা মহিলাদের জরিপের মাধ্যমে জানা যায়, ৩৪ শতাংশ তাঁদের দরিদ্র বাবা-মাকে সাহায্য সমর্থন করার জন্য তাঁদের এই কাজ পছন্দ, ভাইবোনদের সাহায্য করার জন্য ৪ শতাংশ এবং স্বামী বা ছেলেবন্ধুদের সহায়তায় ২৪ শতাংশ। ২০ শতাংশের বেশি কাজটি স্রেফ ভালো লাগে বলেই করেন। কিন্তু মাত্র ২ শতাংশ বলেছিলেন এটি সহজ কাজ এবং মাত্র ২ শতাংশ কাজটি উপভোগ করার দাবি করেছে। এক তৃতীয়াংশেরও বেশি রিপোর্ট করেছে যে, তাঁরা হিংস্রতা বা হয়রানির শিকার হয়েছে, বিশেষ করে পুলিশের কাছ থেকে।
International Labour Organization’ কর্তৃক পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, ফিলিপাইনের ম্যাসেজ পার্লারের ৫০ শতাংশ নারী “with a heavy heart” নিয়ে তাঁদের কাজ করেছে এবং ২০ শতাংশ বলেছে যে, তাঁরা ‘Conscience-stricken’। কারণ তাঁরা এখনও গ্রাহকদের সঙ্গে যৌন-সম্পর্ক করেন। ফিলিপাইনের বারগার্লদের সাক্ষাৎকারে দেখা গেছে যে, তাঁদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি গ্রাহক যখন ক্লায়েন্টের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক লিপ্ত হয়, তখন ‘কিছুই’ অনুভব করেননি এবং বাকিরা বলেছিলেন যে এই পেশায় লেনদেনগুলি তাঁদের দুঃখ দেয়।
ফিলিপিন্স একটি উৎস দেশ এবং অল্প পরিমাণে, নারী ও শিশুদের যৌন পাচারের শিকার একটি ডেসটিনেশন এবং যোগাযোগের দেশ। আনুমানিক ১০ মিলিয়ন ফিলিপিনো বিদেশে বসবাস করে বা বিদেশে কাজ করে এবং ফিলিপিনস প্রতি বছর বিদেশে কাজ করার জন্য সরকার প্রায় ২.৩ মিলিয়ন নতুন বা পুনর্নবীকরণ চুক্তি প্রক্রিয়া করে। এই অভিবাসী কর্মীদের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যা যৌন পাচারের শিকার, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলেও।
গনসাল (Gonzales) বলেন, “এমন সময় ছিল যখন তাদের খাবার কিনতে কোনো টাকা ছিল না। যখন আপনার সন্তানদের খাওয়ানোর কোনো কিছুই না থাকে, তখন দ্রুত অর্থের জন্য গণিকাবৃত্তিতে পরিণত হওয়ার জন্য প্রলুব্ধ করে, সেই হাতছানি কিছুতেই এড়ানো যায় না।” গনসাল যৌনকর্মীদের আহ্বান করে। গনসাল বলেন–“আমরা তাঁদের ‘গণিকা নারী’ বলে ডাকি, কারণ গণিকাবৃত্তি কোনো চাকরি নয় বরং মানবাধিকার লঙ্ঘন।” গনসাল বলেন, তবে তাঁর গ্রুপ নারীকে তাঁদের ব্যাবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য করে না।”
(১০) তুরস্ক : তুরস্কে গণিকাবৃত্তি বৈধ এবং অবশ্যই নিয়ন্ত্রিত। তুর্কি সমাজের ধর্মনিরপেক্ষতা গণিকাবৃত্তিকে ২১ শতকের প্রথম দিকে আইনি অবস্থা অর্জনের অনুমতি দেয়। দেশে সাধারণ ঘর’ (General Houses) হিসাবে পরিচিত, গণিকালয় পরিচালনার জন্য অবশ্যই সরকার থেকে সম্মতি গ্রহণ করতে হয়। এর ফলে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলি যৌনকর্মীদের কাছে পরিচয়পত্র প্রদান করে, যার মাধ্যমে তাঁদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা এবং অন্যান্য সামাজিক পরিসেবাদির অধিকার দেয়। যাই হোক, অনেক স্থানীয় সরকারে এখন নতুন নথিভুক্ত না করার নীতিও আছে। সেই কারণে কিছু শহর যেমন আঙ্কারা (Ankara) ও বিরসা (Bursa) আদালতের আদেশে গণিকালয়গুলি বিধ্বস্ত করা হয়েছিল।
তুরস্কের গণিকালয়গুলিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ২২৭ নম্বর আর্টিকেল (Turkish Penal Code,Law No. 5237) প্রয়োগ করা হয়। তবে এই আইনের প্রয়োগ বেশ বিতর্কিত আছে। গণিকালয়গুলি প্রমোট করলে ২ মাস থেকে ৪ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। তবে অবৈধ গণিকালয় লাইসেন্স দেওয়া ছাড়াই একটি গণিকাবৃত্তির কাজ হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ করা, স্বাস্থ্য পরীক্ষা না-করে গণিকা হওয়া, লাইসেন্স ছাড়াই গণিকা হওয়া, অথবা নথিভুক্ত হওয়া ছাড়া গণিকালয় পরিচালনা করলে তা শাস্তিযোগ্য, সর্বোচ্চ ১ বছরের কারাদণ্ড।
স্ট্রিপ ক্লাব (Strip Clubs) বর্তমান তুরস্কেও উপস্থিত। তবে স্ট্রিপ ক্লাবগুলিকেও লাইসেন্সপ্রাপ্ত হতে হয় এবং স্ট্রিপগুলিকে অবশ্যই নথিভুক্ত হতে হবে এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। স্ট্রিপ ক্লাবগুলিতে প্রবেশকারী সকল ব্যক্তিকে অন্তত কঠোরভাবে ১৮ বছরের উপর হতে হবে।
২০০৪ সালে, তুরস্কের সমাজসেবী ও যৌনকর্মীরা ঘোষণা করেছিল, তাঁরা তুরস্কের প্রথম যৌনকর্মী ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার প্রকল্পে কাজ করেছে। আঙ্কার চেম্বার অফ কমার্স বলছে, তুরস্কে গণিকালয়ের সংখ্যা প্রায় ১,০০,০০০। ৫৬ টি গণিকাপল্লি দ্বারা নথিভুক্ত গণিকার সংখ্যা ৩,০০০। পুলিশের কাছে নথিভুক্ত গণিকার সংখ্যা ১৫,০০০। এছাড়া ৩০,০০০ মহিলা লাইসেন্স পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে আছে। গণিকাদের বয়স ১৮ এবং ৪০-এর মধ্যে। বার্ষিক টার্নওভার ৩ থেকে ৪ বিলিয়ন ডলার।
ইউএনডোকির (UNDOC) একটি প্রতিবেদন অনুসারে, তুরস্ক যৌন-বাণিজ্য সম্পর্কিত মানুষের পাচারের শিকার হওয়া শীর্ষস্থানীয় ডেসটিনেশন। ২০০৪ সালে পাচারকর্মে চিহ্নিত শিকারদের জন্য উৎস দেশগুলি হল তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, আর্মেনিয়া, মোলদাভিয়া, কিরগিজস্তান, রাশিয়া, জর্জিয়া, ইউক্রেন, আজারবাইজান, রোমানিয়া, কাজাখস্তান, বেলারুশ, বুলগেরিয়া, ইন্দোনেশিয়া। উল্লেখযোগ্যভাবে রাশিয়ান সংগঠন অপরাধ সিন্ডিকেটগুলি গণিকাবৃত্তির জন্য মহিলাদের পাচারের কাজে জড়িত এবং তুরস্ক সহ বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশগুলিতে রাশিয়ান ও ইউক্রেনীয় নারীরা গণিকায় পরিণত হয়। ২০০৬ সালে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে, সোভিয়েত রাষ্ট্রের যৌন-ক্রীতদাসদের জন্য দ্রুততম এবং বৃহত্তম বাজারে পরিণত হচ্ছে। মোলদাভিয়া এবং ইউক্রেন থেকে প্রায় অর্ধেকেরও বেশি নারী তুরস্ক জুড়ে যৌনদাস হিসাবে কাজ করছে বলে মনে করা হয়। তুরস্কের আঙ্কার বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ প্রফেসর আইসিগুল আকবের (Aysegul Akbay) মতে, প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের বার্ষিক বাজার মূল্য নিয়ে তুরস্কের গণিকালয়ের সংখ্যা ১,০০,০০০-এরও বেশি।
নথিভুক্ত গণিকাদের জন্য যৌন-সংক্রামিত রোগের জন্য নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা পরিচালনা করা বাধ্যতামূলক এবং কন্ডোম ব্যবহারও বাধ্যতামূলক। তুরস্কের পুলিশ সঠিকভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে কি না তা যাচাই করার জন্য এবং নথিভুক্ত গণিকালয়ের সত্যতা যাচাই করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে এবং তাঁরা যদি তা না করে তবে তারা স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করে। তবে পুরুষ গণিকারা এই নিয়মের অধীনে নিবন্ধিত করতে পারবেন না। তবে বেশিরভাগ গণিকাই নিবন্ধিত নয়। কারণ স্থানীয় সরকারগুলি নতুন নিবন্ধন না-করে নীতিটি তৈরি করেছে।
ব্যবহারকারীদের তথ্য অনুযায়ী তুরস্কে ভিআইপিদের যৌনসেবা লাভ করার জন্য খরচ করতে হয় প্রতি ঘণ্টায় ৩০ মার্কিন ডলার এবং সারা রাতের জন্য ১০০ মার্কিন ডলার। আঙ্কার, ইজমির এবং ইস্তানবুলের মতো বৃহত্তর মহানগর এলাকার গণিকাদের যৌন পরিসেবার হার আরও বেশি হয়। এইসব এলাকার যৌনকর্মীরা সারা রাতে ৫০০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত রোজগার করতে পারে। গণিকামহলের এক মহিলা মালিক ছিলেন তুরস্কের বৃহত্তম করদাতা। বস্তুত লাইসেন্স প্রাপ্ত যৌনকর্মীরাই কর প্রদান করে। ফলে তুরস্কের মুসলিম সরকার তাঁদের সামাজিক সুরক্ষা এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষাগুলি প্রদান করে। লাইসেন্স ছাড়াই যাঁরা অবৈধভাবে কাজ করে, তাঁদের উপর তুরস্ক পুলিশ অত্যাচার এবং জরিমানা এবং তোলাবাজি চালায়। গত দশকে ক্ষমতাসীন ইসলামবাদী বিচার ও উন্নয়ন দল (একক) নিঃশব্দে কয়েক ডজন গণিকালয় বন্ধ করে দিয়েছে। এর ফলে শত শত নারী গৃহহীন এবং বেকার হয়ে পড়েছিল। পুলিশী অভিযান সত্ত্বেও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে (এবং তুরস্কের আইএমএফ চালিত অর্থনৈতিক সংস্কার) জোর করে বেঁচে থাকার জন্য আরও বেশি নারীকে যৌনকর্ম করতে বাধ্য করছে। কিন্তু সরকার এখন লাইসেন্স প্রদান বন্ধ করে দিয়েছে। রাস্তায় গণিকাদের রেখেছে, যেখানে তাঁরা হয়রানির শিকার, পুলিশের অত্যাচার ও জরিমানা জারি থাকছে। ইস্তানবুলের হৃদয় টাক্সিম স্কোয়ারে হেয়েরেটিন বুলান (Hayrettin Bulan) পুরুষ গণিকাবৃত্তির জন্য ঘোষণা করেছেন। এই ঘোষণাটি দারিদ্র-বিরোধী (Anti-poverty) গ্রুপ সেকাট ডের’ (Sefkat Der) দ্বারা তৈরি করা হয়েছে। গ্রুপটি রাষ্ট্র পরিচালিত গণিকাবৃত্তির জন্য শেষ যুদ্ধ করছে। বুলান বলেছে, নারীদের জন্য গণিকাবৃত্তির আহ্বান জানাতে তাঁদের এই মৌলবাদী পদক্ষেপ হতাশা থেকে বেরিয়ে এসেছে। বুলান বলছেন, “সরকার মূলত যৌন-দাসত্বকে রক্ষা করার জন্য আইনি ভিত্তি ব্যবহার করছে। তাঁরা বলে যে, পুরুষদের যৌনতা দরকার এবং তাঁদের জন্যে গণিকালয়ের প্রয়োজন হবে। কিন্তু অন্যদিকে তাঁরা ‘লিঙ্গ-সমতা’ (Gender Equality) নীতিগুলি গ্রহণ করে না। বুলান এবং তাঁর সহকর্মীরা যুক্তি দেন যে, “যদি আপনি অনুমান করেন যে, নারীদের যৌনতা দরকার এবং তাঁদের জন্য একইরকমের গণিকালয় দাবি করেন, তাহলে এই চাহিদা মেটাতে পুরুষ গণিকালয়ও খোলা উচিত।
অটোম্যান সাম্রাজ্যে গণিকাবৃত্তি : গণিকালয়গুলি দাবি করে, এ পেশা বিশ্বের প্রাচীনতম পেশা। কিন্তু যখন এই পেশা অটোমান যুগে ছিল, তখন খুব কমই পরিচিত। এটি কেবলমাত্র অল্প গবেষণায় ঘটেনি। বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, দাসত্ব এবং ব্যভিচার অটোমান প্রথাগত আইন এবং মুসলিম আইন ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। শরিয়ায় গণিকাবৃত্তি হয় না। তা ছাড়া, গবেষকরা অভিযোগ করেছেন যে, অটোমান রেকর্ডগুলিতে উল্লিখিত যে ঘটনাগুলি ‘অনৈতিকতা’ (Immorality) আসলে গণিকাবৃত্তি জড়িত কি না তা নির্ধারণ করার জন্য যথেষ্ট নির্দিষ্ট নয়।
প্রথমবারের মতো আমরা গণিকাবৃত্তি সম্পর্কে জানতে পারি সুলতান সুলায়মানের শেষ বছরগুলিতে মহৎ শাসনের (১৫২২-১৫৬৬) সময়। ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে রেফিক আহমেট সেভেনগিলের ‘ইস্তানবুল নাসিল ইগ্লেনিয়ঙু (Istanbul Nasil Egleniyordu) নামে ঘটনাটি ঘটে। সুলতানির নামে একটি জেলার স্থানীয় লোকজন একসঙ্গে মিলিত হয়ে স্থানীয় কাদি (বিচারক) গিয়েছিল এবং এই এলাকার বাসিন্দা পাঁচজন নারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিল। সেই নারীদের নাম ছিল আরাপ ফাতি, নারিন, গরিটিলি নেফাইস, কামার। অভিযোগ ছিল যে, এই মহিলারা খোলাখুলিভাবে গণিকাবৃত্তিতে জড়িত ছিল। পাঁচজন নারীর মধ্যে শুধুমাত্র আরাপ ফাতিকে যখন ডাকা হয়েছিল তখন বিচারকের সামনে উপস্থিত হতে অস্বীকার করেন। সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল যে, এই নারীর বাড়ি বিক্রি হবে এবং মহিলাকে শহর থেকে বের করে দেওয়া হবে।
যখন ইমাম আরাফ ফাতির বাড়িতে এসেছিলেন, তখন তিনি ইমাম, কাদি ও শরিয়া আইনকে অভিশাপ দিয়েছিলেন এবং এটি নির্ধারণ করা হয়েছিল যে, তিনি তাঁর বাড়িতে অপরিচিতদের (তাঁরা পুরুষ ছিলেন, যাঁরা তাঁর পিতা বা স্বামী বা ভাই কেউ নয়) অনুমতি দিয়েছিলেন। ইস্তানবুলের একটি ভিন্ন এলাকার তারও অনুরূপ অবস্থা হয়েছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না, তাঁর বাড়ি বিক্রি হয় এবং তাঁর স্বামী ফিরে না-আসা পর্যন্ত তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়।
গণিকালয় এই সময়ে এক জায়গায় সীমাবদ্ধ ছিল না, গোটা ইস্তানবুল জুড়ে দেখা যায়। সুলতান দ্বিতীয় সেলিম (১৫৬৬-১৫৭৪) শহরটিতে গণিকালয় এবং অনৈতিকতার তদন্তের জন্য আহ্বান জানায় এবং সংশ্লিষ্ট সকলের এবং তাঁদের শাস্তি নিবন্ধনের জন্য ডিক্রি জারি করে। গণিকারা কারাগারে ছিল। স্পষ্টতই গণিকাবৃত্তি বন্ধের ডাক দেওয়া খুব সফল ছিল না। কারণ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অন্য উপায় সন্ধানে ঘুষ দেওয়া খুব সহজ ছিল।
“Prostitution in Ottoman Istanbul, Late Sixteenth–Early Eighteenth Century” are মারিনস সারিয়ানিস মন্তব্য করেছেন যে, ১৬ শতকের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী আইনটি অস্পষ্ট ছিল বলে মনে করা হয়। তবে আইনটি অপরাধ ছিল। অটোমানরা ব্যভিচার সম্পাদনকারী নারীদের কাছ থেকে জরিমানা করতে পছন্দ করে এবং এটিও সেই গণিকাবৃত্তিকে উপযুক্ত বলে মনে করে। কারণ তাঁরা তাঁর সেবাগুলির জন্য অর্থ প্রদানের দাবিতে কাদিতে যাওয়ার ব্যাপারে দ্বিধা বোধ করে না। বিদেশিদের জন্য নির্দিষ্ট এলাকার গণিকাদের বাড়ি থেকে বের করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। অথচ মুসলিম নারীদের গণিকাবৃত্তি করার ক্ষেত্রে টেকনিক্যালি নিষিদ্ধ ছিল।
(১১) নেপাল : নেপালে পতিতাবৃত্তি অবৈধ। Human Trafficking and Transportation (Control) Act’, ২০৬৪, ২০৬৪ সালের আইনের নং ৫ নম্বর (২০০৮), গণিকাবৃত্তি এবং মানব পাচারের সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করে গণিকাবৃত্তির উপার্জনের জীবনজীবিকাকে অপরাধী করে তোলে। UNAIDS (United Nations Programme on HIV/AIDS)-এর অনুমান, দেশে ৬৭,৩০০ গণিকা আছে।
যদিও নেপালে যৌনকর্মকে বিশেষভাবে অপরাধমূলক করার মতো কোনও আইন নেই, তবে ১৯৮০-এর দশক জুড়ে এমন কিছু আইন প্রণীত হয়েছিল, যা নেপালের অভ্যন্তরে এবং বাইরের পাচারকে অপরাধমূলক যৌনকর্মের দিকে ব্যবহার করতে হয়। এই আইনগুলির অনেকগুলি মাঝে মাঝে যৌনকর্মীদেরও দোষারোপ করার জন্য ব্যাখ্যা করা হয়, যা প্রত্যক্ষ যৌন পাচারের এবং যৌনকর্মের মধ্যে পার্থক্য জ্ঞানের অভাব (Lack of Knowledge) থেকে আসে। যৌনকর্ম’ এমন একটি শব্দ যা বিশ্বজুড়ে বৈধ এবং অবৈধ যৌনশিল্পের সমস্ত দিককে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। শরীরী এবং মৌখিক (Oral) সহ যৌনকর্মের বিভিন্ন ধরন আছে। এই পার্থক্যটি এমন, যা সত্য কি না বোঝা যায় না। সুতরাং পাচারের বিরুদ্ধে নেপালের মধ্যে প্রণীত অনেক নীতি ও আইন–অনেকের যুক্তি যৌনকর্মের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা উচিত নয়। দাসত্ব, পাচার বন্ধ করার চেষ্টাকারী কর্তৃপক্ষ এবং আইন যৌনকর্মী, ক্লায়েন্ট এবং যৌনশিল্পের সঙ্গে জড়িত অন্যদের বিরুদ্ধে ভুলভাবে প্রয়োগ করা হয়।
১৯৮৬ সালে, নেপালে ট্র্যাফিক ইন হিউম্যানস (কন্ট্রোল) আইনটি পাস হয়েছিল এবং গণিকাবৃত্তি ধরনের পাচার বন্ধ করার লক্ষ্যে ছিল। তবে এই আইনটি অন্যান্য অনেকের মতোই অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছিল। মূলত এই কারণে যে, এই আইনটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাচারের ঘটনা রোধ না করে গণিকাবৃত্তিকে অপরাধী করে তোলা হয়েছিল। ২০০৮ সালে ‘Human Trafficking and Transportation (Control) Act গণিকাবৃত্তি ও মানব পাচারের সংজ্ঞা অন্তর্ভুক্ত করে গণিকাবৃত্তির উপার্জনের জীবনযাপনকে অপরাধী করে তোলে।
অনেকের কাছেই যৌনশিল্পে প্রবেশের একমাত্র উপায় হল যে, তাঁরা নেপালে অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকতে সাহায্য করে। তবে শ্রমের শিল্প বা পরিসেবা প্রকল্পের মধ্যে যৌনকর্ম আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত নয়। নেপালে যৌন পাচারের একটি বড় ঘটনা আছে বটে। তবে সাধারণভাবে অনেকেই স্বেচ্ছায় যৌনকর্মে বিশ্বাস রাখে।
আজ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে উন্নয়নশীল দরিদ্র দেশগুলির মধ্যে নেপাল সর্বাধিক দারিদ্র্যপীড়িত। গবেষণা থেকে দেখা যায় যে, নেপালি জনসংখ্যার প্রায় ৩৮ শতাংশ প্রতিদিন ১ মার্কিন ডলারে জীবন নির্বাহ করে এবং ৮২ শতাংশ প্রতিদিন ২ মার্কিন ডলারে জীবন নির্বাহ করছে। দারিদ্র্যের এই উচ্চ হারের কারণে, গ্রামীণ দরিদ্র নেপালি লোকেরা সাধারণত বড়ো পরিবার, ভূমিহীন বা খুব কম জমির মালিক, নিরক্ষরতার উচ্চ হার এবং নির্দিষ্ট জাতি, বর্ণ এবং সংখ্যালঘু গোষ্ঠীতে মনোনিবেশিত হয়। দারিদ্র্যের এই বিষয়গুলি নেপালের যৌনশিল্পে সিজেন্ডার (Cisgender) এবং হিজড়া পুরুষ এবং মহিলা উভয়ই যৌনকর্মে অংশ নেয়। তাঁদের বিশাল পরিবারগুলির কারণে এই যৌনকর্মীদের পরিবারের মধ্যে সহায়তা করার একটি উপায় খুঁজে নেওয়া। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায় যে, মহিলা যৌনকর্মীরা এবং সাধারণভাবে মহিলাদের পক্ষে ঘরোয়া পরিবেশ এবং কর্তব্যগুলি ভেঙে ফেলার খুব বেশি সুযোগ নেই, যা তাদের দারিদ্র্যে মধ্যে ফেলে রেখেছে। সুতরাং তাদের জন্য একমাত্র বিকল্পটি হল যৌনকর্মে চলে আসা।
অন্যান্য দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলির মতো নেপালেও মহিলাদের জন্য সীমিত পরিমাণে সংস্থান রয়েছে। সম্প্রতি নেপাল সরকার পারিবারিক সম্পৃক্ততা, শারীরিক অখণ্ডতা, মালিকানা অধিকার এবং সামগ্রিক নাগরিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে নারীদের আরও বেশি অধিকার স্বীকৃতি দিয়েছে। যাই হোক, এর ফলে এই সত্যটি পরিবর্তন করে না যে, নেপালি সমাজে এখনও নারীদের উচ্চাসনে উপবিষ্ট করা হচ্ছে এবং পুরুষদের মতো সমান অধিকার নেই।
নেপালে বেশিরভাগ মহিলারাই এই যৌনকর্মীদের দ্বারা পরিচালিত হয়। কারণ অন্যথায় তাঁদের খুব কমই কোনো সুযোগ থাকে। এই মহিলারা যে কাজটি করে তা নারীর ক্ষমতায়ন বোধ করে। এই অর্থে যে, তাঁরা তাঁদের পরিবারকে আরও ভালোভাবে সাহায্য করতে পারে এবং সমাজ নারীদের সঙ্গে যেরূপ আচরণ করে তা ছাড়া অন্য কোনও কিছুর জন্যেও করতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে যৌনশিল্পে মেয়েরা নেপালের বাইরে বা শহরে আরও কেন্দ্রীভূত হয় তাঁদের পরিবারকে আরও ভালোভাবে সাহায্য করার জন্য কার্পেট কারখানায় নিযুক্ত করতে বাধ্য হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁদের প্রত্যক্ষ পাচারে অপহরণ করে বা যোগদান করতে বাধ্য করা হয়। দারিদ্র্যের বিষয়টি নেপালের অনেক পরিবারকে হতাশায় ফেলেছে, ঘরে ঘরে সাহায্যে জন্য অর্থ উপার্জনের জন্য তাঁদের মেয়েদের রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছে।
নেপালে মানব পাচার, আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে যৌন পাচার স্বেচ্ছায় যৌন কাজের একটি সাধারণ পূর্বসূরী। অর্থাৎ যৌন পাচারের জগৎ থেকে পালানোর পরে নেপালে ফিরে আসার সময় মহিলারা স্বেচ্ছায় যৌনকর্মেই ফিরে আসে। কারণ শুধুমাত্র এই কাজটিই তাঁরা ঠিকঠাক জানে। নেপালের এই যৌনপেশাই প্রতিদিন এই হাজার হাজার মহিলাদের দারিদ্র্য ও সংগ্রামের (স্বল্পমেয়াদি হলেও) স্বস্তি দিয়ে থাকে। দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব যৌনপেশার ক্ষেত্রে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসে এবং অবশ্যই এটা যৌনকর্মের বিরুদ্ধে বড়ো যুক্তি।
নেপালের মেয়েরা পরিবার এবং নিজের জন্য আরও ভালো সুযোগের প্রত্যাশায় অনেকেই যৌনপেশায় প্রবেশ করেন। নেপালে এটি বিশেষভাবে সত্য, যেটি বিশ্বের সর্বনিম্ন মানব বিকাশের সূচকযুক্ত দেশগুলির মধ্যে একটি। জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন (United Nations Human Development) সূচকে ১৪৩ তম স্থান পেয়েছে। যেহেতু যৌনকর্মীরা সাধারণত নেপালের অভ্যন্তরে জাতিব্যবস্থায় নিম্নবর্ণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকে (ইউএন নেপাল পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, যৌনকর্মীদের বেশিরভাগই তামাং ও দলিত ছিলেন)। ভারত এবং অন্যান্য দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলিতে তাঁরা মনে করেন যৌনপেশা হল একমাত্র সুযোগ, যা তাদের সত্যিকারের জীবন এবং তাঁদের পরিবারের উন্নতি করতে পারে। সাধারণত নেপালি বর্ণবাদ ব্যবস্থা যে-কোনো নিম্নশ্রেণির লোকদের উচ্চতর শ্রেণিতে উঠতে খুব কঠিন করে তোলে। এমন বিরল উদাহরণ আছে যেখানে নির্দিষ্ট শ্রেণির সদস্যদের উত্থান ঘটেছিল এবং এমনকি এই ক্ষেত্রে সদস্যরা কেবল তাঁদের নিজ বর্ণের মধ্যেই উঠে আসে। এই সামাজিক বন্ধনের (Trap) কারণে যৌনশিল্পকে সামাজিক ব্যবস্থা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার উপায় হিসাবে দেখা হয়। যৌনকর্মের ফলে নিম্নবর্ণের ব্যক্তিরা তাঁদের পরিবারকে বিভিন্ন উপায়ে সাহায্য করতে পারে। স্বল্পমেয়াদে যৌনশিল্পে যাওয়া একটি যৌক্তিক সমাধানের মতো, যেহেতু এই যৌনকর্মীদের বেশিরভাগ অর্থ তাঁদের পরিবারের উন্নতির জন্য ব্যবহৃত হয়। দীর্ঘমেয়াদি যৌনকর্মের পরিণতি যৌনকর্মীরা বিভিন্ন ধরনের গুরুতর ঝুঁকির মুখোমুখি হন, যার মধ্যে রয়েছে যৌন সংক্রমণজনিত রোগ, সুরক্ষা হ্রাস এবং মানবাধিকার হ্রাস।
নেপালে বেশিরভাগ জনসংখ্যাপূর্ণ এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ, (MARPs) যেমন—যৌনকর্মীদের, যাঁরা শরীরে মাদক ইনজেক্ট করে (IDUs), যেসব পুরুষরা (MSM) পুরুষদের সঙ্গে যৌনমিলন করে এবং অভিবাসীদের মধ্যে এইচআইভির (HIV) প্রকোপ বাড়ছে। ১৯৮৮ সাল থেকে যখন নেপালে এইচআইভি/এইডসের প্রথম ঘটনাটি প্রকাশিত হয়েছিল, তখন এইডসের ১,৭৫০ টিরও বেশি এবং এইচআইভি সংক্রমণের ১১,০০০-এরও বেশি মামলা আনুষ্ঠানিকভাবে রিপোর্ট করা হয়েছিল। যেহেতু নেপাল তার জনস্বাস্থ্য নজরদারি সিস্টেমের (Public Health Surveillance) ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ, তাই সারা দেশে সংক্রমণের প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি বলে জানা যায়। ইউএনএইডস (UNAIDS) অনুমান করেছে যে, ২০১৮ সালে প্রায় ৩০,০০০ এইচআইভি নিয়ে বাস করছিল। যৌনকর্মীদের মধ্যে এইচআইভি প্রবণতা ধরা পড়েছিল ৪.২ শতাংশ, সাধারণ জনগণের জন্য এটি ০.১ শতাংশ ছিল।
যৌনকর্মে মহিলাদের প্রবেশ কখনো-কখনো একটি অপ্রত্যাশিত মোড় নিতে পারে। যদিও কিছু মহিলা স্বেচ্ছায় যৌনপেশায় প্রবেশ করে, তবে তাঁদের একটা বড়ো অংশ ভারত এবং আশেপাশের অঞ্চলে বৃহত্তর যৌন পাচারের শিকার হয়। ভারতে মেয়ে পাচার একটি বড়ো সমস্যা, যা আন্তর্জাতিক সংবাদে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর প্রায় ৭,০০০ নেপালি মেয়েকে ভারতে পাচার করা হয়, যেখানে তাঁদের যৌনকর্মে বাধ্য করা হয়। নেপালি মহিলা এবং মেয়েদের (বিশেষত কুমারী), ভারতের যৌনবাজারে খুবই চাহিদা। কারণ তাঁদের ফর্সা চামড়া এবং তরুণ চেহারার (Young Look) কারণে তাঁদের সর্বদাই কমবয়সি মনে হয়। চিন ও নেপালের মধ্যে উন্মুক্ত সীমানার কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বিপুল সংখ্যক নেপালি মহিলা গণিকাবৃত্তিতে অথবা চিনা পুরুষদের কাছে নববধূ হিসাবে বিক্রি হয়েছে।
যৌনশিল্পে জীবনযাপন করার সময় অনেকেই যুক্তি দিয়েছিলেন যে, এ পেশা মানবাধিকার হারানোর মতো সাধারণ ঝুঁকি। অনেক সময়, বিশেষত নেপালে, যৌনশিল্প সংক্রান্ত অপরাধ সংগঠিত হয়। নেপালের মতো দেশগুলিতে যৌনশিল্পে মোট দেশজ উৎপাদনের ২ শতাংশ থেকে ১৪ শতাংশের মধ্যে অবদান রাখে। এই কারণে কর্মকর্তা এবং পুলিশরা এসব দুর্নীতির জন্য সক্রিয় থাকে। এটি যৌনকর্মীদেরকে দুর্বল অবস্থানে ফেলেছে। কারণ প্রতিষ্ঠানটি তাঁদের সুরক্ষার জন্য বাধ্য হয় এবং তাঁদের সমস্যাগুলিকে উপেক্ষা করে এবং নির্যাতনে অংশ নেয়। যৌনকর্মীরা যদি এইসব কর্মকর্তাদের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাত, তাহলে তাঁদের নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ দাবি করতে পারত। নেপালে নেপালি ক্লায়েন্টদের জন্য কিছু চিনা যৌনকর্মীও আছে। নেপালের পুলিশ নেপালি পুরুষদের জন্য চিনা যৌনকর্মীদের গ্রেপ্তার করেছে। নেপাল দেশটি হল নারী ও শিশু পাচারের উৎস, ট্রানজিট এবং গন্তব্য দেশ। নেপালি মেয়েরা ভারত, মধ্য প্রাচ্য, এশিয়া এবং উপ-সাহারা আফ্রিকাতে যৌন পাচারের শিকার হয়। বিপুল সংখ্যক নেপালি যাঁরা ভারতে ভ্রমণ করেন বা অনিবন্ধিত (Unregistered) এজেন্টদের উপর নির্ভর করে এবং অভিবাসীরা বিশেষত যৌন পাচারের ঝুঁকির মধ্যেই থাকে। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং সম্ভবত অন্যান্য দেশ থেকে কিছু অভিবাসী নেপালকে মধ্য প্রাচ্যের কর্মসংস্থানের পরিবহন পথ করে। সম্ভাব্যভাবে নকল নেপালি ভ্রমণের নথি ব্যবহার করে এবং মানব পাচারের বিষয় হয়। কিছু সরকারি কর্মকর্তা নেপালি নকল পরিচয়পত্র এবং ভুয়া তথ্য অন্তর্ভুক্ত করতে বা সম্ভাব্য শ্রম অভিবাসীদের প্রতারণামূলক নথি সরবরাহের জন্য ঘুষ গ্রহণ করে বলে অভিযোগ করা আছে। ২০১৫ সালের ভূমিকম্পের ফলে বাচ্চা সহ অনেক নেপালি যাঁদের বাড়ি বা জীবিকা ধ্বংস হয়েছে, তারা পাচারের শিকার হয়েছে।
কাঠমান্ডুকে বলা হয় যৌন-শহর। নেপালে ম্যাসেজ পার্লারগুলি আপনাকে কেবল চনমনে হওয়ার ম্যাসেজ পরিসেবা দেয় না, সেইসঙ্গে দুটি পরিসেবাও অফার করে। একটি প্রকৃত দীর্ঘমেয়াদি বডি ম্যাসাজ, স্বল্পমেয়াদি ম্যাসাজ যাতে যৌনসঙ্গম থাকে। গণিকাবৃত্তি নেপালে অবৈধ, যার কারণে গণিকালয় মালিকরা ম্যাসেজ পার্লার, কেবিন রেস্তোঁরা এবং নৃত্য বারের মাধ্যমে যৌনবৃত্তি করে। নেপালের বেশিরভাগ যৌনকর্মী রাস্তায় না-গিয়ে ম্যাসাজ পার্লার এবং ডান্সবারে চাকরি পছন্দ করেন। কারণ তাঁরা পুলিশের অভিযান থেকে নিরাপদ থাকতে পারে এবং আরও ভালো উপার্জন করে তাঁদের সামাজিক অবস্থানও বজায় রাখতে পারে। নেপালের বেশিরভাগ যৌনকর্মী অশিক্ষিত, যৌনকর্মী হওয়ার নীতি এবং সচেতনতা সম্পর্কে অবগত নয়। যৌনকর্মীরা অবশ্যই দারিদ্র্য থেকে স্বল্পমেয়াদি স্বস্তি পান, তবে দীর্ঘ সময় ধরে তাঁরা এইচআইভি/এইডস-এর মতো সামাজিক ট্রমা এবং যৌন সংক্রমণে ভুগতে পারেন।
ধারণা করা হয় যে, ২,০০,০০০ নেপালি মহিলাকে ভারতে গণিকাবৃত্তির জন্য বিক্রি করা হয়েছিল। কিছু মেয়েদের ১১ বছর বয়সে তাঁদের পরিবার দ্বারা বিক্রি করা হয়েছিল। যেহেতু নেপালি মহিলারা বেশ সুন্দরী হিসাবে বিবেচিত হয় এবং খুব অল্প বয়সি বলে মনে হয়, তাই চাহিদাও তুঙ্গে। ক্লায়েন্টরা মনে করে নেপালি মেয়েরা কুমারী এবং এইচআইভি এবং অন্যান্য যৌন সংক্রমণজনিত রোগ (এসটিডি) থেকে মুক্ত, তাই মেয়েদের বেশি দাম দিতে পিছ-পা হয় না। যদিও বোম্বের একটি সার্ভে রিপোর্ট ইঙ্গিত দিয়েছে যে ৫০ শতাংশ গণিকা এইচআইভিতে আক্রান্ত। বর্ণবাদী নেপালের নিম্নবর্ণের যৌনকর্মী, যাঁদের উপার্জন পুরো সম্প্রদায় সমর্থন করে। মেয়েরা কোনো সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ভোগ করেন না এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে ফিরে যান। খুব কম বিবাহিত, কারণ বর্ণের বাইরের পুরুষরা যৌনকর্মীদের সঙ্গে বিয়ে করে না এবং বর্ণের ভিতরে পুরুষরা কেবলমাত্র কমপক্ষে ৩ কন্যা পরিবারের সঙ্গে মেয়েদের বিয়ে করে, যাতে সমাজে আয় রক্ষা করতে পারে। ভাদি সম্প্রদায়ের গণিকারা ৭০ শতাংশই এসটিডি সংক্রামিত। ভারতীয় গণিকালয় থেকে ফিরে আসা নেপালি গণিকা এবং সিজনাল অভিবাসী কর্মীরা যাঁরা তাঁদের পরিসেবা ব্যবহার করেন, তাঁদের মাধ্যমেই নেপালের বিস্তৃত সম্প্রদায়ের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমিত হয়। প্রচলিত প্রতিরোধ কর্মসূচি যেগুলি গণিকাদের কন্ডোম ব্যবহার করতে এবং এটি কীভাবে ব্যবহার করতে হয় তা শেখানোর উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। পাচার বন্ধে নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টা সফল হয়নি। পরিশেষে, মহিলাদের অবস্থা অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে, যাতে তাঁরা স্বায়ত্তশাসিত ব্যক্তি হিসাবে বিবেচিত হয়, যাঁরা নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারে।
একুশ বর্ষীয়া মায়া নামে একজন নেপালি যৌনকর্মীর গল্প বলি। নেপালের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় খানারে যেখান থেকে তিনি প্রায় ৫ কিলোমিটার (৩.১০ মাইল) শহর ইটাহাড়িতে এক ক্লায়েন্টের সঙ্গে দেখা করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ইটাহাড়ি, এটি নেপাল এবং ভারতকে সংযোগকারী একটি হাইওয়ে, যা একটি উন্মুক্ত সীমান্ত ভাগ, এটি যৌন-ব্যাবসার জন্য একটি যথার্থ শহর। শহরটি ভারতীয় ব্যবসায়ীদের কাছে একটি জনপ্রিয় গন্তব্য, যাঁরা যৌনকর্মী ভাড়া নিতে চায়।
মায়া জানায় যে, ১৪ বছর বয়স থেকে তিনি এই শহরের যৌনশিল্পে কাজ করছে। ২০১৩ সালে, তিনি যে হোটেলটিতে কাজ করেছিলেন সেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল এমন একজনকে বিয়ে করেছিলেন। তখন তিনি যৌনপেশা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। লোকটি তাঁর বা অন্য কোনও যৌনকর্মীর ক্লায়েন্ট ছিল না। তবে তাঁর মেয়ে স্বস্তিকার যখন তিন মাস বয়স তখন স্বামী মায়াকে ত্যাগ করল। মায়া তখন যৌনশিল্পে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। তিনি দিনের বেলা ক্লায়েন্টদের সঙ্গে দেখা করেন, যখন কোনও প্রতিবেশী স্বস্তিকার দেখাশোনা করে। কারণ সে রাতে বাচ্চার জন্য সময় দেয়। সে এক সপ্তাহে ২,০০০ রুপি (১৮.৭১ ডলার) থেকে ৫০০০ টাকা (৪৬.৭৭ ডলার)-এর মধ্যে আয় করেন। এটি কোনো বাড়িতে বা হোটেল ক্লিনারের উপার্জনের চেয়ে অনেক বেশি। মাত্র অষ্টম শ্রেণির পড়াশোনা নিয়ে মায়া, যিনি তাঁর মেয়ের সঙ্গে ভাড়া ঘরে থাকে। সে বলে। তাঁর কাছে অন্য কিছু উপায় নেই। মায়া বলে, “এই পেশা আমার পছন্দ হওয়ার কারণে নয়, তবে আমি এই কাজটি করতে বাধ্য হই।” কাঠমান্ডু আসার দু-বছর পরে এক বন্ধু তাঁকে বলেছিল একটি কারখানায় কাজ করলে সে বেশি অর্থ উপার্জন করতে পারবে। মায়া যখন এই পরিকল্পনার সঙ্গে একমত হয়ে গেল, বন্ধুটি তাঁকে কোনো কারখানায় নয়, ইটাহারির এক হোটেলে নিয়ে গেল এবং তাঁকে সেখানে রেখে গেল। এমতাবস্থায় মায়া খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। জায়গাটি নতুন ছিল এবং কাউকে চিনত না। এখানে তাঁকে কী করতে কী তাঁর কাজ সে কিছুই জানত না। এদিকে হোটেল মালিক তো মায়াকে কী করতে পারে তার অপশন দিল। (১) হোটেলটি ছেড়ে দিতে হবে, (২) হোটেলে থেকে ফাইফরমাস খাটতে হবে এবং (৩) যৌনকর্মী হিসাবে কাজ করতে হবে। মোদ্দা কথা বসে খাওয়া চলবে না। দুই সপ্তাহ পর মায়া যৌনকর্মী হিসাবে কাজ করতে রাজি হয়ে যায়। তিনটি অপশনের মধ্যে যে গণিকাবৃত্তিতেই ফায়দা বেশি, সেটা ১৪ বর্ষীয় মায়ার বুঝে নিতে বিলম্ব হয়নি। তরুণ কিশোর ক্লায়েন্টদের কাছে সে খুব জনপ্রিয় ছিল। অনেক পুরুষ তাঁর সঙ্গ পাওয়ার আশায় তালিকাবদ্ধ হয়ে অপেক্ষা করত। ওই হোটেলটিতে আরও ৫ জন যৌনকর্মী ছিলেন। তবে তাঁদের সকলেরই বয়স ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। হোটেল কোনো গণিকালয় নয়–এটি সাময়িকভাবে থাকার জন্য একটি আদর্শ জায়গা। তবে যে ঘরে ঘুমানো এবং খাওয়ার জন্য খাবার আছে, সেখানকার সাধারণ পরিসেবাগুলি ছাড়াও হোটেলটি যৌনকর্মীও সরবরাহ করত।
যৌন পাচার ও জোরপূর্বক গণিকাবৃত্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্য বিশ্বব্যাপী যৌন-বাণিজ্যকে নিন্দা করা হয়েছে। তবে নেপালের একটি বড়ো যৌন পরিবহন কেন্দ্র ইটাহারিতে। এই বাণিজ্যটি বাড়ছে, কারণ অল্প শিক্ষায় শিক্ষিত অল্পবয়সি মেয়েরা এই পেশা বেছে নিয়েছে। নেপালে যৌন-বাণিজ্য আইন নয়, তাই এটি অবৈধ বা আইনিও নয়। তবুও এই পেশা সমৃদ্ধ হচ্ছে, বিশেষ করে কাঠমান্ডু, পোখারা, সুনসারি এবং কৈলালিতে। নারায়ণ প্রসাদ কাফলে বলেছেন, নেপালে যৌন-বাণিজ্যের বিষয়ে কোনো জাতীয় সমীক্ষা হয়নি, তবে জাতীয় এইডস ও এসটিডি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের ২০১১ সালের এক অনুমান অনুযায়ী দেশে মহিলা যৌনকর্মীর সংখ্যা ২৬,৫০০-এরও বেশি হয়ে গেছে। ২০১০ সালে সুইস ত্রাণ সংস্থা টেরে ডেস হোমস দ্বারা পরিচালিত আরেক জরিপে অনুমান করা হয়েছে যে ১১,০০০ থেকে ১৩,০০০-এর মধ্যে কিশোরী ও যুবতীরা কাঠমান্ডু উপত্যকায় বিনোদন শিল্পে কাজ করছিল। যৌন-বাণিজ্য সাধারণত ভালো অর্থ প্রদান করে। অনেকের ধারণা যৌনকর্মীর সংখ্যা আরও। বাড়তে থাকবে। কাঠমান্ডুতে অবস্থিত যৌনকর্মী ফেডারেশনের জাগৃতি মহিলা মহাসংঘের সভাপতি বিজয়া কালাকাল মায়ার মতো বাণিজ্যের অনেক মেয়ে এবং যুবতী মহিলারা সমস্যাগ্রস্ত ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসে। মায়া বলেছেন যে, তাঁর বাবা-মা আলাদা হয়ে যাওয়ার পরে তিনি ১২ বছর বয়সে পশ্চিম নেপালের ডাঙ জেলায় নিজের বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিলেন। তিনি নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে গিয়েছিলেন, সেখানে তিনি এক হোটেলে ডিশ ওয়াশার হিসাবে কাজ পেয়েছিলেন এবং মাসে মাসে প্রায় ৩০০ রুপি (২.৮১ ডলার) আয় করেছিলেন। ইটাহারি সংগঠন মহিলা সহযোগী সামুহের সভাপতি বিমল মল্লা ঠাকুরি বলেছেন—মেয়েরা ১২ বছরেরও কম বয়সি। বস্তুত নেপালি মেয়েরা ভারতীয় ক্লায়েন্টদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। কিছু ক্লায়েন্ট এক রাতের জন্য ২০,০০০ টাকা (১৮৭.০৭ ডলার) পর্যন্ত নেপালি গণিকাদের দিয়ে থাকে।
(১২) গ্রিস : প্রাচীন গ্রিসের একটি সাধারণ দিক ছিল গণিকাবৃত্তি। গ্রিসের গুরুত্বপূর্ণ শহর এবং বিশেষত বহু বন্দরগুলিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গণিকা যৌনপেশায় নিযুক্ত ছিল এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে উপস্থাপন করত। এ পেশায় কোনো গোপনীয়তার ব্যাপার ছিল না। শহরগুলি গণিকালরের নিন্দা করত না বা ঘৃণার চোখে দেখত না। উপরন্তু তাঁরা যাতে ঠিকঠাকভাবে পেশাটি চালিয়ে যেতে পারে তার জন্য রাষ্ট্র কিছু প্রয়োজনীয় নিয়মকানুন প্রতিষ্ঠা করেছিল। গ্রিসের গণিকাবৃত্তিতে নারী-পুরুষ উভয় আলাদাভাবে জড়িত। প্রধানত পুরুষ ক্লায়েন্টেদের জন্য সকল বয়সের মহিলারা এবং যুবকেরা গণিকা ছিল। একই সঙ্গে অবশ্য মুক্ত মহিলাদের সঙ্গে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কগুলি কঠোরভাবে মোকাবিলা করা হয়েছিল। ব্যভিচারের ক্ষেত্রে ধরা পড়লে অপরাধীকে হত্যা করার আইনি অধিকার ছিল। ধর্ষণের শাস্তিও একইরকম ছিল। পুরুষের জন্য বিবাহের গড় বয়স ছিল ৩০ বছর বয়স, অল্প বয়সি এথেনিয়ান দাস বা গণিকাদের কাছে না-গিয়ে যৌন-সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইলে তার কোনো বিকল্প ছিল না।
প্রাচীন গ্রিসের ধ্রুপদী যুগে পর্নাই (Pornai) ছিল দাস ও বর্বরদের উৎস। হেলেনিস্টিক (Hellenistic) যুগে যুবতী মেয়েদের নাগরিক পিতাদের বাতিল বা পরিত্যক্ত করার বিষয়টি দাসত্ব করা যেতে পারে। অন্যথায় প্রমাণিত না-হওয়া পর্যন্ত এগুলি দাস হিসাবে বিবেচিত হত। পর্নাই সাধারণত পিরিয়াস (অ্যাথেন্সের বন্দর) বা এথেন্সের কেরামাইকোসের মতো ‘রেডলাইট’ এলাকার অবস্থিত গণিকালয়গুলিতে যুক্ত ছিল।
অ্যাথেন্সে কিংবদন্তি আইনপ্রণেতা সলনকে (Solon) নিয়ন্ত্রিত দাম দিয়ে রাষ্ট্রীয় গণিকালয় তৈরি করার কৃতিত্ব দেওয়া হয়। ব্যভিচার রোধ করার জন্য তিনি জনস্বাস্থ্যের পরিমাপ হিসাবে এটি করেছিলেন। এথেন্স যুবক যুবতীদের দ্বারা পরিপূর্ণ এবং সহজাত বাধ্যবাধকতা এবং অনুপযুক্ত দিকের দিকে বিপথগামী হওয়ার অভ্যাস উভয়ই দেখে তাঁরা মহিলাদের ক্রয় করত এবং বিভিন্ন জায়গায় তাঁদের প্রতিষ্ঠা করত, সজ্জিত করত সাধারণ সবার কাছে। গ্রিক কবি ফিলেমন বলছেন—মহিলাদের উলঙ্গ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেও আপনি প্রতারিত হবে না। সব কিছু দেখুন। হয়তো আপনি অস্বস্তি বোধ করতে পারেন। আপনার সামান্য বেদনা বোধও হতে পারে। দরজাটি খোলা, একটি ওবোল (গ্রিক মুদ্রা) খরচ করুন। আশা করি সেখানে কোনো ছদ্মবেশ নেই, স্ন্যাং কথাবার্তা নেই বা কোনো গণিকারা আপনাকে টেনে নিয়ে যাবে না। সরাসরি আপনার ইচ্ছামতো আপনি যেভাবেই চান আপনি বেরিয়ে আসুন, তাঁকে জাহান্নামে বলতে পারেন। কারণ তিনি আপনার কাছে অপরিচিত।
ফিলেমন বিশেষভাবে বলেছেন, সলোনিয়ান গণিকালয়গুলি রোজগার নির্বিশেষে সকলের জন্য গ্রহণযোগ্য একটি পরিসেবা দিত। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সোলন আফ্রোডাইট পান্ডেমোস মন্দির তৈরি করার জন্য গণিকালয়গুলি থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব ব্যবহার করেছিল। এমনকি যদি এই ঘটনার ঐতিহাসিক যথার্থতা নিয়ে সন্দেহ থাকে, তবে এটি স্পষ্ট করে যে, ধ্রুপদী এথেন্স গণিকাবৃত্তিকে গণতন্ত্রের অঙ্গ হিসাবে বিবেচনা করত। গণিকাদের পারিশ্রমিকের ক্ষেত্রে বেশ সস্তাই ছিল। মৌলিক কাজগুলির ক্ষেত্রে কোনো সন্দেহ নেই। এটি সত্যিকারের দাম (Actual Price) ছিল বা ভালো চুক্তি (Good Deal) হিসাবে চিহ্নিত প্রবাদ ছিল কি না তা নির্ধারণ করা কঠিন।
রাস্তায় কাজ করা স্বাধীন গণিকারা পরের স্তরে ছিল। সম্ভাব্য ক্লায়েন্টদের কাছে সরাসরি তাঁদের কমনীয়তা প্রচারের পাশাপাশি তাঁদের প্রচারের প্রশ্রয় ছিল। এই গণিকাদের বিভিন্ন উৎস ছিল–মেটিক (একটি শহর) মহিলারা, যাঁরা অন্য কাজ খুঁজে পেতেন না বা দরিদ্র বিধবা বা বয়স্ক পর্নাই যাঁরা তাঁদের স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার যৌনপেশায় সফল হয়েছিলেন। এথেন্সে নিবন্ধিত হয়ে রাজস্বও দিতে হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ পেশার উপর নির্ভর করে সৌভাগ্যবান হয়েছিল। প্রথম শতাব্দীতে রোমান মিশরের কিষ্টে (Qift)। গণিকাদের প্রবেশের জন্য ১০৮ ড্রাচমা (Drachma) দিয়েছিল।
গণিকাদের শুল্ক মূল্যায়ন করা খুব কঠিন ছিল। পঞ্চম এবং চতুর্থ শতাব্দীতে গণিকারা গড় চার্জ তিন ওবোল থেকে শুরু করে এক ড্রাচমা পর্যন্ত চার্জ করতে পারত। প্যালাটিন নৃতাত্ত্বিক তথ্য উদ্ধৃত করেছে। এক ডজন দর্শনের জন্য পাঁচ ড্রাচমা গ্রাহকের ব্যবস্থা উল্লেখ করেছে। দ্বিতীয় শতাব্দীতে হিটেরার সংলাপে লুসিয়ান গণিকা অ্যাম্পেলিস পরিদর্শনকালে পাঁচটি ড্রাচমা একটি মাঝারি মূল্য (৮, ৩) হিসাবে বিবেচনা করেছেন। একইভাবে একটি অল্প বয়স্ক কুমারী মিনা (গ্রিক মুদ্রা) দাবি করতে পারে, এটি ১০০ ড্রাচমা (৭, ৩), বা গ্রাহককে কাছ থেকে দুই মিনাও দাবি করতে পারে। একজন যুবতী এবং সুন্দরী গণিকা তাঁর সহকর্মীর চেয়েও বেশি দাম নিতে পারে। বয়স্ক গণিকাদের জন্য একটি নির্দিষ্ট বাজারও ছিল। ক্লায়েন্ট এক্সকুসিভিটি দাবি করলে পারিশ্রমিকও পরিবর্তন হত। একদল বন্ধুও এক্সক্লসিভিটি কিনতে পারে।
অনেক ব্যয়বহুল এবং একচেটিয়া গণিকারা ‘হিটেইরা’ (Hetaera) নামে পরিচিত ছিল, যার অর্থ সহচর। হিটেইরা (Hetairai) ছিলেন সুন্দরী, মার্জিত, সুশিক্ষিত, এঁরা প্রায়শই দক্ষ যৌনকর্মী হয়ে থাকে এবং মুক্ত হিটেইরা তাঁদের নিজস্ব আর্থিক নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছিল। হিটেইরাই সাধারণত উচ্চবিত্ত পুরুষদের সঙ্গী ছিল। কখনো-কখনো তাঁরা বয়স্ক পুরুষদের সঙ্গে তাঁদের স্ত্রীদের চেয়ে বেশিবার মদ্যপান অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাঁরা কম বয়সিদের কাছে যৌনশিল্পে ‘শিক্ষক হিসাবে কাজ করতেন। হিটেইরা, পর্নাইয়ের গণিকারা পৃথক বা একক ক্লায়েন্টদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক করত এবং যৌনতার পাশাপাশি সাহচর্যও সরবরাহ করত। পর্নাই, হিটেইরাইকে প্রতিটি পৃথক যৌন ক্রিয়াকলাপের পরিবর্তে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের সংস্থার জন্য অর্থ প্রদান করা হয়েছে বলে মনে করা হয়।
খ্রিস্টপূর্ব ২ বছর আগে স্ট্রাবো (Strabo) করিন্থ শহরের ভৌগলিক/ঐতিহাসিক বিবরণে করিন্থের অ্যাফ্রোডাইট মন্দিরে মহিলা মন্দির কর্মচারীদের বিষয়ে কিছু মন্তব্য লিখেছিলেন, যা সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ৭০০-৪০০ সময়কালের কাছাকাছি। লিখেছেন—“এফ্রোডাইটের (Aphrodite) মন্দিরটি এত সমৃদ্ধ ছিল যে, এটি এক হাজারেরও বেশি হিটেইরাকে কাজে লাগিয়েছিল, যা পুরুষ ও মহিলা উভয়ই দেবীকে দিয়েছিলেন। অনেক লোক তাদের কারণে এই শহরটি পরিদর্শন করত এবং এইভাবে এই হিটাইরা শহরের ধন-সম্পদে অবদান রেখেছিল। কারণ জাহাজের ক্যাপ্টেনরা খুব দৃঢ়ভাবে সেখানে তাঁদের অর্থ ব্যয় করত। একাধিক উপায়ে সেই মহিলাদের যৌন-ব্যবসার দিকে ইঙ্গিত করে। এই মন্দির সম্পর্কে স্ট্রাবো সরাসরিই বলেছেন–“মহিলারা এখানে তাঁদের দেহ দিয়ে অর্থ উপার্জন করতেন।”
খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৪ সালে, অলিম্পিক গেমসে করিন্থের (Corinth) নাগরিক যিনি পেন্টাথলনের প্রশংসিত রানার এবং বিজয়ী ছিলেন, সেই জেনোফোন (Xenophon) নামে এক ব্যক্তি ১০০ জন যুবতী মেয়েকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য দেবীর মন্দিরে উৎসর্গ করেছিলেন। এটি আমরা একটি স্তোত্রের কারণে জানি, যা পিন্ডারকে লিখিত আদেশ দেওয়া হয়েছিল, “এই অতিথি মেয়েদের পেরোথো এবং বিলাসবহুল করিন্থের দাস” হিসাবে স্বাগতম জানায়। ড্যানিয়েল আরনাড (Daniel Arnaud), জুলিয়া অ্যাসান্তে (Julia Assante) এবং স্টেফানি। বুডিন (Stephanie Budin)-এর মতো লিঙ্গ-গবেষকদের কাজ পণ্ডিতদের পুরো ঐতিহ্যকেই সন্দেহযুক্ত করে তুলেছে, যা মন্দিরের ‘পবিত্র’ গণিকাবৃত্তির ধারণাটিকে সন্দেহ হিসাবে চিহ্নিত করেছিল। বুডিন (Budin) পবিত্র গণিকাবৃত্তির ধারণাটিকে একটি মিথ হিসাবে বর্ণনা করেছেন এবং রাজস্বের ভিত্তিতে যুক্তি দিয়েছিলেন যে, উৎসগুলিতে বর্ণিত রীতিগুলি পারিশ্রমিকহীন আধ্যাত্মিক যৌনতা বা অ-যৌন ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি ছিল, সম্ভবত সাংস্কৃতিক অপবাদও ছিল। যদিও আধুনিক যুগে জনপ্রিয়, যদিও এই মতামতটি তাঁর পদ্ধতিগত সমালোচনা না করে চলে যায়নি, এটি একটি আদর্শিক এজেন্ডা বলে অভিযোগ আনা হয়েছে।
প্রত্নতাত্ত্বিক এবং ধ্রুপদী স্পার্টা (Sparta), প্লুটার্ক (Plutarch) দাবি করেছেন যে, মূল্যবান ধাতু, অর্থের অভাব এবং লাইকুরগাসের (Lycurgus) দ্বারা প্রবর্তিত কঠোর নৈতিক ব্যবস্থা থাকার কারণে কোনো গণিকা ছিল না। প্লুটার্কের বিরোধিতা হিসাবে ব্যাখ্যা করা যেতেই পারে। তবে সারাহ পোমেরো (Sarah Pomeroy) যুক্তি দেখান যে, চিত্রিত করা জমকালো ব্যাঙ্কোয়েট ধর্মনিরপেক্ষ নয় এবং চিত্রিত মহিলাটি তাই গণিকা নয়। স্পার্টান (Spartan) নাগরিকদের জন্য মূল্যবান ধাতু ক্রমশ সুলভ হয়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গে গণিকাবৃত্তিতে প্রবেশ করা আরও সহজ হয়ে উঠেছিল। ৩৯৭ সালে আউলনের পেরিওসিক গ্রামে এক গণিকার বিরুদ্ধে স্পার্টান পুরুষদের দুর্নীতি করার অভিযোগ করা হয়েছিল। এমনকি হেলেনিস্টিক (Hellenistic) যুগে, স্পার্টায় নামকরা ভাস্কর্যগুলি কোটিনা (Cottina) নামে হিটেইরা দ্বারা উৎসর্গীকৃত ছিল। কোটিনা নামে একটি গণিকালয়ও স্পার্টায় বিদ্যমান বলে মনে হয়েছিল। সে সময়ের গণিকাদের সামাজিক অবস্থার মূল্যায়ন করা কঠিন। তবে অনেকে মনে করেন মহিলা হিসাবে তাঁরা গ্রিক সমাজে প্রান্তিক ছিল। তবে তাদের জীবন বা গণিকালয়ে যে তারা কাজ করেছে তার প্রত্যক্ষ প্রমাণের কথা জানা যায় না। সম্ভবত গ্রিক গণিকালয়গুলি রোমের মতো ছিল। তবে অসংখ্য লেখক এ বিষয়ে বর্ণনা করেছিলেন এবং পম্পেই শহরে তা সংরক্ষণ করে রেখেছেন। গণিকারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপবাদজনক শব্দের মধ্যে একটি ছিল ‘খামতিপিস’ (Khamaitypes)। প্রাচীন গ্রিকদের কাব্যিক চিন্তাভাবনার এই শব্দটির দ্বারা ‘নীচু’ কিছু বলে মনে হয়েছিল।
লেখক লুসিয়ান (Lucian) গণিকাদের সম্পর্কে বলছেন—এখানকার গণিকারা হয় স্বাধীন। এখানকার উৎসগুলি লাভের উৎস হিসাবে বিবেচনা করা ছাড়া দাস-গণিকারা পরিস্থিতি নিয়ে নিজেকে উদ্বিগ্ন বোধ করে না। প্রাচীন গ্রিক পুরুষরা গণিকা সম্পর্কে কী ধারণা করেছিল তা পুরোপুরি স্পষ্ট। মূলত তাঁদের ক্রিয়াকলাপের বাণিজ্যিক প্রকৃতির জন্য নিন্দিত হয়। গণিকাবৃত্তির দক্ষতা গ্রিক কমেডির চলমান থিম। গণিকা একমাত্র এথেনিয়ান মহিলাই ছিল, যাঁরা অর্থ পরিচালনার কাজ করেছিল। তাদের আচরণের একটি ব্যাখ্যা হল গণিকার পেশা সংক্ষিপ্ত হতে থাকে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের আয়ও হ্রাস পেতে থাকে। ব্যাবসার সমস্ত স্তরেই কম বয়সি এবং সুন্দরী গণিকারা সম্ভবত বয়স্ক, কম আকর্ষণীয় সহকর্মীর চেয়ে বেশি অর্থ উপার্জন করতে পারে। তাঁদের সীমিত সময়ে যথাসম্ভব পরিমাণ অর্থ অর্জন করতে হয়েছিল। এই ড্রাইভটি অবশ্যই সকল পেশার পক্ষে স্বাভাবিক, যেহেতু প্রত্যেকেই কোনো না-কোনো সময়ের বিপর্যয়ের মুখোমুখি।
চিকিৎসা গণিকাদের দৈনন্দিন জীবনের নামকেওয়াস্তে, খুব আংশিক এবং অসম্পূর্ণ সাহায্য করে। উপার্জন চালিয়ে যাওয়ার জন্য দাস-গণিকাদের যে-কোনো মূল্যে গর্ভাবস্থা এড়াতে হত। গ্রিকরা গর্ভনিরোধকের কৌশলগুলি সম্বন্ধে রোমানদের মতো ততটা পরিচিত নয়। গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটিস (Hippocrates) একটি গ্রন্থে লিখেছেন–দাস-গণিকারা যে-কোনো মূল্যে গর্ভাবস্থা এড়াতে চাইত। গর্ভাবস্থা থেকে মুক্ত হতে তাঁরা লাফাত এবং নিচু হত, গোড়ালি দিয়ে পাছা স্পর্শ করত। শুক্রাণুকে দূরে রাখতে এবং ঝুঁকি এড়াতে এটাই একমাত্র পথ ছিল। এটাও সম্ভবত মনে হয় যে, পর্নাইয়ের গর্ভপাত বা শিশু হত্যাও একটা পথ ছিল। স্বাধীন গণিকাদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতিটা তেমন স্পষ্ট নয়। সর্বোপরি মেয়েরা এই ‘চাকরিতে প্রশিক্ষিত হত, তাঁদের মায়েদের উত্তরসূরি হতে এবং মায়েরা বৃদ্ধ হলে তাঁদের সাহায্য করত।
গ্রিক মৃৎশিল্পীরাও গণিকাদের প্রতিদিনের জীবন সম্পর্কে অন্তদৃষ্টি তুলে ধরে। তাঁদের প্রতিনিধিত্ব সাধারণত চারটি ভাগে ভাগ করে—বনভোজন দৃশ্য, যৌন ক্রিয়াকলাপ, টয়লেট দৃশ্য এবং তাদের অপব্যবহার চিত্রিত দৃশ্য। টয়লেট দৃশ্যে গণিকাদের শারীরিক আদর্শের চিত্র হিসাবে উপস্থাপিত হয় না; স্তন্যপানরত স্তন, মাংসের রোলস ইত্যাদি। সেখানে একটি কাইলিক্স (এক ধরনের ধাতব পাত্র) আছে, যা একটি গণিকাকে একটি কক্ষে সেই পাত্রে প্রস্রাব করতে হবে। যৌন ক্রিয়াকলাপের উপস্থাপনে গণিকার উপস্থিতির বিষয়টি প্রায়শই একটি পার্সের উপস্থিতি দ্বারা চিহ্নিত করা হত, যা অফার করে যে শরীরী সম্পর্ক হবে তার মধ্যে একটি আর্থিক উপাদান আছে। যা প্রদর্শন করে লিপফ্রোগ (Leapfrog) বা সোডোমি (Sodomy)—এই দুটি অবস্থানই বেশ জটিল এবং দৃশ্যত পৃথক। লিপফ্রোগে মহিলাটি মাটির উপর দুই হাত ভাঁজ করে থাকত। সোডমিকে একজন প্রাপ্তবয়স্কের জন্য অবনমিত বলে মনে করা হত এবং মনে হয় লিপফ্রোগের অবস্থান (মিশনারি আসনের বিপরীতে) মহিলার পক্ষে কম তৃপ্তিযুক্ত বলে বিবেচিত হত। পরিশেষে, বেশ কয়েকটি ফুলের তোড়া দৃশ্যের প্রতিনিধিত্ব করত, যেখানে গণিকাকে লাঠি বা স্যান্ডেল দেখিয়ে হুমকি দেওয়া হত। গ্রিকরা তাকে অবজ্ঞাপূর্ণ বলে গণ্য করতে বাধ্য করেছিল। যেমন ফেলিটিও, সোডোমি বা একাধিক অংশীদারদের সঙ্গে যৌনমিলন করতে বাধ্য করত। যদিও হিটেইরা গণিকারা নিঃসন্দেহে গ্রিসের সর্বাধিক মুক্ত মহিলা ছিল, তাঁদের মধ্যেও অনেকের ‘সম্মানজনক’ হওয়ার এবং স্বামী বা স্থায়ী সহযোগী খুঁজে পাওয়ার ইচ্ছা ছিল। এথেনিয়াস মন্তব্য করেছেন যে “যখন এই জাতীয় মহিলারা স্বচ্ছল জীবনে পরিবর্তিত হন এবং তাঁরা যে নারীদের সম্মানের প্রতি গর্বিত হন তাঁদের থেকে আরও ভালো হয়। তবে নাগরিক শ্রেণির কোনো মহিলাদের স্বেচ্ছায় হিটেইরা হওয়ার কোনো নজির নেই। এটি অবাক হওয়ার মতো বিষয় নয়, যেহেতু নাগরিক শ্রেণির মহিলাদের কোনো কাজ করার জন্য কোনো উৎসাহই ছিল না।
গণিকাবৃত্তি ছিল প্রাচীন এবং আধুনিক বিশ্বের প্রায় সমস্ত সংস্কৃতির অংশ। গণিকাবৃত্তির ইতিহাস অত্যন্ত জটিল এবং এটি শুধুমাত্র সহজ জীবনধারণের পছন্দ বা দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির ফল হিসাবেই সহজ এবং বোঝা কঠিন। গণিকাবৃত্তির প্রথম দিকের তথ্যগুলি প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় সুমেরীয় সংস্কৃতির দিনগুলির সঙ্গে সম্পর্কিত, যেখানে ব্যাবসা এবং নাবিকদের আকর্ষণ করে এমন বাজার-এলাকা বিকাশের পাশাপাশি গণিকাপেশাও সমৃদ্ধ হয়েছিল।
সুমেরীয় দেবী ইন্নানা, যিনি ‘ইশতার’ নামে সুপরিচিত। তিনি মধ্য প্রাচ্য জুড়ে অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উপাসনা ছিলেন। অন্যান্য বিষয়গুলির মধ্যে গণিকা এবং সরকারি কাজের পৃষ্ঠপোেষক ছিলেন। গণিকাবৃত্তি প্রাচীন গ্রিক সমাজের অংশ ছিল, যেখানে এটি যুক্তিসংগতভাবে গৃহীত হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ এবং পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যবর্তীকালে অ্যাথেন্সে গণিকাবৃত্তি আইনি ছিল এবং অন্য যে-কোনো পেশার মতোই। যৌনপেশার সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেককেই তাঁদের আয়ের উপর রাজস্ব দিতে হত। এখানে দুই ধরনের গণিকা বা যৌনকর্মী ছিল—পাই এবং হিটেইরা। পর্নাই শব্দটি ‘ক্রয়যোগ্য হিসাবেও অনুবাদ করা যায় এবং এটি আধুনিক ইংরেজি ভাষায় ‘পর্নোগ্রাফি’ শব্দের উৎসও।
গ্রিসের বেশিরভাগ গণিকাদের মুক্তাঙ্গন ছিল এই পর্নাই শহর, এই পর্নাইরা ছিল রাস্তায় কাজ করা সাধারণ গণিকা। তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল ক্রীতদাস বা সীমিত অধিকার সহ বিদেশি হিসাবে বিবেচিত হত। সকলেরই যৌন-পরিসেবা দিয়ে অর্থোপার্জনের সুযোগ ছিল। পর্নাই গণিকারা কেবল একটি কৌশল আয়ত্ত করেছিল, সেটা হল চরম যৌন আনন্দ দেওয়া। রাস্তায় যারা কাজ করত তাঁরা নতুন ক্লায়েন্টকে শহরের নির্দিষ্ট জায়গায় প্রলুব্ধ করার জন্য অত্যন্ত উদ্ভাবনী বিপণনের কৌশল অবলম্বন করত, বিশেষ স্যান্ডেল পরত, ‘আমাকে অনুসরণ করুন’ বার্তাটি রাখত। কথিত আছে যে, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে এথেনিয়ার একজন রাষ্ট্রপতি ও আইনবিদ সোলন (Solon) পর্নাইয়ে গিজগিজ করা গণিকালয়গুলিকে বিশাল অঙ্কের তহবিল দিয়েছিলেন। পেশাটি ‘গণতান্ত্রিক’ হওয়ায় দাস-গণিকারা তাঁদের স্বাধীনতাকে কিনতে পারত। বেশিরভাগ উচ্চাভিলাষীরাই তাঁদের নিজস্ব গণিকালয় খুলত।
প্রাচীন গ্রিসে কোনো পুরুষের ৩০ বছর বয়সি হওয়ার পরেই তাঁরা বিয়ে করা আশা করত। কিন্তু যৌনকামনা নিবৃত্তির জন্য তাঁরা প্রায়শই গণিকাদের সঙ্গ উপভোগ করত। কখনো-কখনো পুরুষরা দীর্ঘ সময় ধরে একজন রক্ষিতা বা উপপত্নী কাছে রাখত। সেই রক্ষিতার সঙ্গে কেমিস্ট্রি জমে উঠলে কখনো-কখনো তাঁরা বিয়েও করে নিত। যাই হোক, যদি এইরকম একটি বিয়ে যেখানে শিশুর জন্ম দেয়, সেইসব সদ্যজাত শিশুদের নাগরিক হিসাবে স্বীকৃত ছিল না। সুতরাং দুর্ভাগ্যক্রমে সেইসব শিশুদের মেরে ফেলা হত। এরকম হত্যাকাণ্ড একটি সাধারণ অভ্যাস ছিল।
হিটেইরা গণিকারা যৌনশিল্পে যাত্রীদের এথেন্সে বেশিদিন থাকার জন্য প্ররোচিত করত। কিন্তু এর ফলে শহরটি কুখ্যাত হয়ে উঠেছিল। স্থানীয় এবং বিদেশি উভয়ই যৌন-পরিসেবা, পাশাপাশি বিবাহিত পুরুষদেরও উপভোগ করত তাঁরা। গ্রিসের বিবাহিত মহিলাদের তেমন স্বাধীনতা ছিল না এবং তাঁরা তাঁদের স্বামীদের অন্যায় সম্পর্কে খুব বেশি কিছু করতেও পারেনি। একটি মামলার প্রমাণ আছে, যেখানে অ্যাথেন্সের এক মহিলা বিবাহবিচ্ছেদের জন্য একটি মামলা দায়ের করেছিলেন। কারণ হিসাবে উল্লেখ করা ছিল–তাঁর স্বামী গণিকার সঙ্গে জড়িত। যেখানে গণিকাবৃত্তির ব্যাবসার সঙ্গে জড়িত মহিলারা বেশি স্বাধীনতা ভোগ করত এবং তাঁদের নিজের জীবনের উপর নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ছিল এবং তাঁরা অর্থ উপার্জন করতে পারত এবং নিজস্ব ব্যাবসা শুরু করতে পারত এবং তাঁরা কী করতে চায় তা স্থির করতে পারত, সেখানে বিবাহিত মহিলারা ছিল ঠুটো জগন্নাথ।
থিসপিয়ায় (বুয়েটিয়া) অ্যাপিকেলের মেয়ে ছিলেন ফ্রেইন (Phryne)। তবে তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি এথেন্সে কাটিয়েছিলেন। যদিও আমরা তাঁর জন্ম ও মৃত্যুর সঠিক তারিখগুলি জানি না, বিভিন্ন ঐতিহাসিকরা অনুমান করেন যে, তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৩৭১ সালে। থিবেস লেপ্যাক্টার যুদ্ধের অনেকটা সময় পরে থিপসিয়াকে ধ্বংস করেছিলেন এবং সেখানকার অধিবাসীদের বহিষ্কার করেছিলেন। তাঁর অসাধারণ সৌন্দর্যের জন্য তিনি বিভিন্ন চিত্রশিল্পী এবং ভাস্করদের কাছে দুর্দান্ত মডেল হয়ে ওঠেন, দুর্দান্ত প্রক্সিটেলস (যিনি তাঁর ক্লায়েন্টদের একজনও ছিলেন) সহ। ফ্রেইনের সৌন্দর্য অনেক প্রাচীন গ্রীক পণ্ডিতদেরও ভাবনার বিষয় হয়ে উঠেছিল, যাঁরা তাঁর সুন্দর চেহারার প্রশংসা করেছিলেন, অ্যাথেনিয়াস ফ্রিইনের জীবনের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছিলেন—“ফ্রেইন সত্যই সুন্দরী মহিলা ছিলেন। এমনকি ব্যক্তির সেই অংশগুলিতেও, যা সাধারণত দেখা যায় না, কোনোভাবেই তাকে উলঙ্গ দেখা সহজ ছিল না। কারণ তিনি এমন একটি পোশাক পরতেন, যা তাঁর পুরো শরীরকে ঢেকে রাখত এবং সে কখনও প্রকাশ্যে স্নান (সে সময়ে প্রকাশ্যে স্নান করার রীতি ছিল) করত না। কিন্তু ইলেউসিনিয়ার উৎসব এবং পোসেইডোনিয়ার উৎসব উপলক্ষে, তখন তিনি একত্রিত সমস্ত গ্রিকদের সামনে নিজের পোশাকটি খুলে রাখতেন এবং চুল সরিয়ে তিনি সাগরে স্নান করতে যেতেন। আর এঁর থেকেই অ্যাপেলস তাঁর নগ্ন ছবি এফ্রোডাইট আনাদ্যোমিনে তুলেছিলেন এবং প্র্যাক্সাইটেলস ভাস্কর। যিনি তাঁর প্রেমিক ছিলেন, তাঁর দেহ থেকে স্নিডাসের অ্যাফ্রোডাইটকে মডেল করেছিলেন। থিয়েটারের মঞ্চের নীচে অবস্থিত তাঁর ইরোসের মূর্তির পাদদেশে তিনি এই শিলালিপিটি লিখেছিলেন—
“Praxiteles has devoted earnest care
To representing all the love he felt,
Drawing his model from his inmost heart:
I gave myself to Phryne for her wages,
And now I no more charms employ, nor arrows,
Save those of earnest glances at my love.”
অ্যাথেনিয়াস আরও রেকর্ড করেছিলেন যে, ফ্রেইন সম্ভবত তাঁর সময়ের স্বনির্মিত ধনী মহিলা। তিনি তাঁর জীবনের এক পর্যায়ে এত বেশি ধনী হয়েছিলেন যে, তিনি থিবসের দেয়ালগুলির পুনর্নির্মাণের জন্য অর্থের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, যা আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট ৩৩৬ খ্রিস্টপূর্বে ধ্বংস করেছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন যে, ‘আলেকজান্ডার দ্বারা ধ্বংস, ফ্রেইন দ্য সিটেনিয়ান পুনরুদ্ধার করা লাইনটি দেওয়ালে লিপিবদ্ধ করা হবে। একজন মহিলা—এই বিষয়টির জন্য কেবল কোনও মহিলাই নয়, একজন গণিকা—এই বিষয়টি দেখে ভয় পেয়েছিলেন যে, গ্রেট আলেকজান্ডার ধ্বংস করেছিলেন, ফিরিনের এই প্রস্তাবটি শহরের পৌরপতিরা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং দেয়ালগুলি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল।
ফ্রেইনের ‘ঐশ্বরিক’ চেহারা, অবিশ্বাস্য সম্পদ এবং বিখ্যাত প্রেমীদের সত্ত্বেও ইতিহাসের বইগুলিতে ফ্রেইনকে যেভাবে অমর করে তুলেছিল তা তাঁর বিখ্যাত নির্মাতা হলেন এথেনিয়াস। এথেনিয়াস লিখেছেন যে, তাঁর বিরুদ্ধে একটি আর্থিক অভিযোগের জন্য মামলা করা হয়েছিল এবং হাইপ্রেইডস, যিনি তাঁর অন্যতম প্রেমিক ছিলেন তাঁর পক্ষ থেকে তাঁকে রক্ষা করেছিলেন। তিনি অভিযোগের প্রকৃতি নির্দিষ্ট করেননি, যদিও কিছু যাচাই না-করা ঐতিহাসিক উৎস হিসাবে (সিউডো-প্লুটার্ক) উল্লেখ করেছেন যে, তিনি অশ্লীলতার অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন।
যদিও সেদিন আদালতে সত্যই কী ঘটেছিল, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিরাট বিরোধ আছে। তবে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য এক সূত্র (এথেনিয়াসের) একথা বলেছে যে, বিচারকরা তাঁর সুন্দর স্তনদুটি দেখার জন্য হাইপ্রেইডস আদালতের কক্ষে মাঝে ফ্রেইনের পোশাক টেনে ছিঁড়ে ফেলেছিল। তাঁর যুক্তি ছিল যে, কেবল ঈশ্বরই কোনো দেহকে এত নিখুঁতভাবে তৈরি করতে পারেন এবং তাঁকে হত্যা করা বা কারাবন্দি করাটাকে নিন্দানীয় ও অসম্মানীয় হিসাবে দেখা হয়েছে। ঈশ্বর অসন্তুষ্ট হবেন। অ্যাথেনিয়াস উল্লেখ করেছেন, “এখন ফ্রেইন থিপ্পিয়ার বাসিন্দা এবং ইউটিয়াসের বিরুদ্ধে আর্থিক অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হলেও পরে তিনি খালাস পেয়েছিলেন। যার কারণে ইউথিয়াস এতটাই রেগে গিয়েছিলেন যে, হার্মিপ্লাস আমাদের যেমন বলেছেন, তিনি কখনও কোনো মামলা পরিচালনা করেননি। কিন্তু হাইপ্রেইডস যখন ফ্রেইনের পক্ষে যুক্তি শোনালেন, তিনি মোটেই সফল হননি। তবে এটি স্পষ্ট ছিল যে, বিচারকরা তাঁকে নিন্দা করতে চেয়েছিলেন, তাঁকে আদালতের মাঝামাঝি সময়ে নিয়ে এসেছিলেন এবং ফ্রেইনের গায়ের পোশাকটি টেনে ছিঁড়ে ফেলেছিলেন এবং তার নগ্ন স্তন প্রদর্শন করিয়েছিলেন। বিচারকদের একটি কুসংস্কারজনক ভয় জাগিয়ে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, যাতে তাঁরা অনুকম্পার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় এবং যখন তিনি খালাস পেয়েছিলেন, নিম্নলিখিত আদেশে একটি আদেশ জারি করা হয়েছিল—“এরপরে কোনো বক্তা কারও পক্ষ থেকে দয়া অনুভব করার চেষ্টা করবেন না এবং যে-কোনো পুরুষ বা মহিলা অভিযুক্ত হওয়ার পরে তাঁর মামলার সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয় উপস্থিত থাকাকালীন”। যা ফ্রেইনের কাছে হারানো কেস হিসাবে মনে হয়েছিল, হাইপ্রেইডসের অনুপ্রেরণামূলক অভিনয়ের পরে তাঁর পক্ষে দ্রুত একটি জয়ে রূপান্তরিত হয়েছিল। ফ্রেইন আদালতকে বিজয়ী করে তুলেছিলেন। চিত্রকর্ম সহ বিভিন্ন শিল্পকর্মের অনুপ্রেরণা জাগিয়ে তোলে ফ্রেইন। ফরাসি ভাস্কর আলেকজান্দ্রে ফালগুইয়ার লিখেছেন ভাস্কর্যটি ফ্রেইনির। বিখ্যাত হিটেরাইকে আজ কিছু পণ্ডিত দমনবিরোধী স্বাধীনতার প্রতীক হিসাবে ধর্মভ্রষ্টতার ছদ্মবেশ হিসাবে দেখেন, যদিও আমাদের বেশিরভাগই একমত হবেন, তাঁর জীবনের কিছু পছন্দ কোনো মহিলার পক্ষে সবচেয়ে আদর্শ বা নৈতিক ছিল না।
আধুনিক গ্রিসের হালহকিকৎ কেমন? আধুনিক গ্রিসে আর্থিক পঙ্গুতার কারণে এক টুকরো স্যান্ডউইচের মূল্য সংগ্রহের জন্য যৌন-বিক্রয়কারী কিশোরীরা গণিকাদের দাম সর্বকালের সর্বনিম্ন স্থানে ফেলে দিয়েছে। গ্রিসের পঙ্গু আর্থিক সংকটের অর্থ হল ইউরোপীয় দেশগুলিতে আরও বেশি মহিলারা স্যান্ডউইচের ব্যয়ের চেয়ে কম দামে শরীর বিক্রয় করছে। হ্যাঁ, গ্রিসের কিছু মহিলা স্যান্ডউইচের দামের জন্য শরীর বিক্রয় করছেন। কিছু ক্ষেত্রে যৌন-সেশনের দাম ৫০ ইউরো থেকে কমে মাত্র ২ ডলারে নেমেছে। গণিকাবৃত্তি বৈধ, তবে ৫২৫ গ্রিক গণিকালয়ের মধ্যে ১০ জনেরই লাইসেন্স আছে। একটি নতুন প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে যে, পূর্ব ইউরোপীয় মহিলাদের তুলনায় আরও বেশি গ্রিক মহিলারা কঠিন সময়গুলোতে অনুসরণ করে গ্রিসে গণিকা হিসাবে কাজ করছেন। এথেন্সের প্যান্টিন ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক গ্রেগরি লাজোস (Lazos) এই প্রতিবেদনের লেখককে দাবি করেছেন, “কিছু মহিলা কেবল একটি পনির পাই বা স্যান্ডউইচের জন্য তাঁদের খাওয়ার প্রয়োজনে তাঁরা যৌন-ক্ষুধার্ত হয়। অধ্যাপক লাজোস বলেছিলেন যে, গ্রিসে ১৮,৫০০ জন যৌনকর্মীর নাম লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
গ্রিসে গণিকাবৃত্তি বৈধ এবং মজুরি হ্রাস এবং বর্ধমান বেকারত্বের কারণে এই শিল্পটি দ্রুত বাড়ছে। মিঃ লাজোস বলেছিলেন, ‘মেয়েদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যার ইন্ডাস্ট্রি যা তাদের প্রয়োজনের উপর নির্ভর করে ব্যাবসার বাইরে আসা এবং বাইরে চলে যায়, এবং মহিলা গণিকাদের মোট সংখ্যা চমকপ্রদ হয়ে ওঠে। গ্রিক একাডেমিক এক অনুসন্ধানে দেখেছে যে, যৌন-বাণিজ্য শিল্পের ৮০ শতাংশই এখন গ্রিক মহিলারাই প্রাধান্য পাচ্ছে, যা ১০০ মিলিয়ন ডলারের ব্যাবসায় পরিণত হয়েছে। ২০০৪ সালের অলিম্পিক গেমসের আগে গণিকাবৃত্তির আইনে পরিবর্তন আনার প্রস্তাবের প্রতিবাদে গ্রিসের দেড় শতাধিক গণিকা একটি গণিকালয়ের বাইরে আন্দোলন-বিক্ষোভ করেছিলেন। গ্রিক সরকার বেশ কয়েকটি গণিকালয় স্কুল ও গির্জার কাছাকাছি অবস্থিত জানতে পেরে সেগুলি বন্ধ করার চেষ্টা করেছিল।
‘National Center for Social Research’ ঘোষণা করেছে যে, অর্থনৈতিক সংকট শুরুর পর থেকে গ্রিসে গণিকাবৃত্তির হার ১৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে। এর অর্থ হল যে মহিলারা সাধারণত যৌনকর্মী হিসাবে কর্মসংস্থান খুঁজছেন না, তাঁরাও এখন সাহায্য করছে এবং উপায় হিসাবে এই পেশার দিকে ঝুঁকছে। ইকেকে (EKKE) পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বর্তমান গ্রিসে ২০,০০০ পতিতাদের মধ্যে মাত্র ১০০০ জনেরও কম মহিলা আইনিভাবে নিবন্ধিত। রাস্তার গণিকাবৃত্তি গ্রিসে অবৈধ, কারণ এঁরা নিরাপদ নয়। আইনি বৈধ গণিকালয়গুলিকে নিরাপদ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। কারণ তাঁদের অঞ্চলের নিরাপত্তার পাশাপাশি স্বাস্থ্য স্ক্রিনিং দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এই অঞ্চলগুলিতে কর্মরত মহিলাদের একটি নিবন্ধ এবং মেডিকেল কার্ড বহন করা দরকার হয়। অধিকন্তু, দেশে একটি বিশাল নির্ধারিত সংখ্যক পকেট খোলা হয়েছে, যেখান অবৈধ গণিকালয়গুলির সেরা আবরণ। বাইরে থেকে পার্লার বা স্টুডিও মনে হলেও সেগুলি আসলেই মুখোশের আড়ালে গণিকালয়। গ্রিসের গণিকারা ও গণিকালয়গুলি ১৯৯৯ সালে আপডেট হওয়া আইন অনুসারে কাজ করে।
গ্রিসে ১৮ বছর বয়সি হলেই তাঁর জন্য গণিকাবৃত্তি আইনিভাবে বৈধ এবং এটি নিয়ন্ত্রিত। অনুমান করা হয় যে, এক হাজারেরও কম মহিলাই বৈধভাবে গণিকা হিসাবে নিযুক্ত হয়েছেন। প্রায় ২০,০০০ জন নারী, যাঁদের মধ্যে অর্ধেক বিদেশি নারী এবং অন্য অর্ধেক গ্রিক অবৈধ গণিকাবৃত্তিতে লিপ্ত রয়েছেন। অর্থনৈতিক সংকটে আক্রান্ত বহু মহিলা গণিকাতে পরিণত হয়েছেন। নারী-শরীর বিক্রির বাজার আছে, সেই বাজারে বিক্রিও বেশি। বাজার ছোটো হলেও পুরুষ-শরীরও বিক্রি হচ্ছে সেখানে। আকাশচুম্বী বেকারত্বের মোকাবিলা করতে যৌনপেশাই। এখন একটা বিকল্প পথ অবশ্যই।
গণিকাবৃত্তিতে জড়িত ব্যক্তিরা কেবলমাত্র রাষ্ট্র পরিচালিত গণিকালয়গুলিতে (স্টুডিও’ নামেও পরিচিত) কাজ করতে পারেন। সেক্ষেত্রে মহিলাদের অবশ্যই ১৮ বছরের বেশি হতে হবে, অবিবাহিত হতে হবে, গ্রিসে বাস করার এবং কাজ করার নাগরিক অধিকার থাকতে হবে, এসটিআই থেকে মুক্ত থাকতে হবে। মানসিক অসুস্থতা থাকলে নয়, মাদকাসক্তি থাকলে নয় এবং হত্যা, পিম্পিং, শিশুপর্নো, পাচার, ডাকাতি বা ব্ল্যাকমেইলের জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়নি এমন মহিলা গণিকাবৃত্তিতে আসতে পারবে। এছাড়া তাঁদের অবশ্যই স্থানীয় প্রদেশে নিবন্ধন করতে হবে এবং প্রতি দুটি সপ্তাহে আপডেট হওয়া একটি মেডিকেল কার্ড বহন করতে হবে। গ্রিক কর্তৃপক্ষ ১৯৯৯ সালের আইন বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যার অধীনে বলা হয়েছে যে, সমস্ত গণিকালয়কে অবশ্যই অনুমতি দেওয়া উচিত। অনুমতি সাধারণত রাজ্যের প্রবীণ মহিলাদের দ্বারা দেওয়া হয়। এই প্রবীণ মহিলাগুলির মধ্যে বেশিরভাগই প্রাক্তন গণিকা। গণিকালয়গুলি সর্বজনীন ভবন থেকে কমপক্ষে ২০০ মিটার দূরে থাকতে হবে। ২০০৪ সালের অ্যাথেন্স অলিম্পিকের আগে এটি কমিয়ে ১০০ মিটার করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু গ্রিক সরকার এই প্রস্তাবটি কার্যকর করেনি। ২০১১ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে গ্রিসে এইচআইভি সংক্রমণ ২০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। এইচআইভির হার এক বছরে এতটা বৃদ্ধির ফলে অ্যাথেন্সের কর্তৃপক্ষ অনেক মাদকসেবী এবং গণিকাদের গ্রেপ্তার করেছিল এবং এই ব্যক্তিদের উপর। এইচআইভি জন্য বাধ্যতামূলকভাবে পরীক্ষা পরিচালনা করেছিল। মিডিয়া পাচারে জড়িত ছিল এবং যাঁরা এইচআইভি পজিটিভ ছিল তাঁদের নাম এবং ছবি প্রকাশ করেছিল। এই পদক্ষেপটি গণিকাদের যদি ইতিবাচক পরীক্ষার জন্য তাদের নাম প্রকাশিত হয়, তবে তাঁদের পরীক্ষা করা থেকে সতর্ক করে তুলেছিল। গ্রিসে এইচআইভি সংক্রমণ ২০০ শতাংশ বৃদ্ধির মূল কারণ যৌনকর্মী এবং ক্লায়েন্টদের মধ্যে কন্ডোমের ব্যবহার। খুবই বিরল (ইউএনএআইডিএস দ্বারা অনুমান করা হয় ৮.৭ শতাংশ)। এটি এইচআইভি এবং অন্যান্য এসটিআই সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
গ্রিস একটি যৌনকর্মীদের ডেসটিনেশন, ট্রানজিট এবং খুব সীমিত পরিমাণে হলেও নারী ও শিশুদের যৌন পাচারের শিকার হওয়ার উৎস দেশ। পূর্ব ও দক্ষিণ ইউরোপ, দক্ষিণ এশিয়া, পশ্চিম আফ্রিকা এবং পূর্ব এশিয়ার কিছু মহিলা এবং শিশুরা রাস্তায়, স্ট্রিপ ক্লাব, ম্যাসেজ সেলুন এবং হোটেলগুলিতে লাইসেন্সবিহীন গণিকালয়গুলির জন্য যৌন পাচারের শিকার হয়েছে। গ্রিসে অবিসংবাদিত শিশু অভিবাসী বৃদ্ধির ফলে শোষণের শিকার শিশুদের সংখ্যা বেড়েছে। কিছু পাবলিক কর্মকর্তাকেও মানব পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি ২৩৩/২০০৩ যৌন পাচার এবং জোরপূর্বক যৌনশ্রম উভয়ই নিষিদ্ধ এবং ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের শাস্তি নির্ধারণ করে। ২০১৫ সালে পুলিশ ১৮ টি যৌন পাচারের ঘটনা তদন্ত করেছিল। সরকার ২০১৬ সালে যৌন পাচারের জন্য ২৫ জন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। পুলিশ ২০১৫ সালে ৩৪ জনের মধ্যে পাঁচ শিশু সহ ২৬ জন যৌন পাচারের শিকারকে সনাক্ত করেছে।
(১৩) বাংলাদেশ : বাংলাদেশে গণিকাবৃত্তি আইন অনুযায়ী বৈধ, তবে তা নিয়ন্ত্রিত। গণিকা হিসাবে কাজ করতে হলে তাঁকে অবশ্যই রেজিস্ট্রি করতে হবে এবং আদালতে উপস্থিত হয়ে একটি হলফনামা জমা দিতে হবে এই মর্মে যে, তাঁরা তাঁদের নিজস্ব পছন্দ ও জোরজবরদস্তি ছাড়াই গণিকাবৃত্তিকে পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছে এবং তাঁরা অন্য কোনো পেশা খুঁজে পেতে অসমর্থ। তবে বাংলাদেশের সংবিধান বলছে যে, “রাষ্ট্র জুয়া ও গণিকাবৃত্তি প্রতিরোধ করবে।” তবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শিশু গণিকাবৃত্তি, জোরপূর্বক গণিকাবৃত্তি, অবৈধ গণিকালয় ইত্যাদির বিরুদ্ধে আইন বলবৎ আছে। বিভিন্ন আইন কখনো-কখনো গণিকাবৃত্তির বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। ২০০০ সালে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত রায় দেয় যে, দেশে ১০০ জন গণিকা গ্রেফতার অভিযান ছিল বেআইনি। যদিও এ দেশে গণিকাবৃত্তি একটি বৈধ পেশা। তবে প্রায়ই পুলিশ বাহিনী বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ করে হোটেলে বেআইনি গণিকাবৃত্তির বিরুদ্ধে অভিযান করে এবং গণিকা ও তাঁদের গ্রাহক উভয়কে গ্রেপ্তার করে আদালতে চালান করে দেয়। বাংলাদেশের দণ্ডবিধির ৩৭২, ৩৭৩, ৩৬৪ (ক) ও ৩৬৬ (খ) ধারায় গণিকাবৃত্তির উদ্দেশ্যে অপ্রাপ্তবয়স্কদের ক্রয়-বিক্রয়ের শাস্তির বিধান বর্ণনা করা হয়েছে।
এক সময় গণিকাবৃত্তি কেবল গণিকালয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ফলে সে সময় গণিকাদের সংখ্যা নিরূপণ করা সহজ ছিল। বর্তমানে অনিবন্ধিত বা পার্টটাইম দেহব্যবসায়ীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে। শুধুমাত্র গণিকালয়ে জরিপ চালিয়ে পরিসংখ্যান তৈরি করা সম্ভব নয় কত সংখ্যক মহিলা যৌনপেশায় জড়িত। স্থানীয় কিছু এনজিওর হিসাবে ২০০৮ সালে মহিলা গণিকার সংখ্যা ছিল আনুমানিক ১,০০,০০০ লাখ। ২০১৬ সালে ইউএনএইডসের হিসাবে এই সংখ্যাটি দাঁড়ায় ১,৪০,০০০।
বাংলাদেশে ১৪ টি বৈধ গণিকালয় আছে। অর্থাৎ এই গণিকালয়গুলি বাংলাদেশে সরকার দ্বারা অনুমোদিত। এগুলি হল টাঙ্গাইল শহরের বেবিস্ট্যান্ড কান্দাপাড়া গণিকালয়, রাজবাড়ি জেলার দৌলতদিয়া গণিকালয়, খুলনার সুন্দরবন সংলগ্ন বাণীশান্তা গণিকালয়, যশোরের বাবুবাজার গণিকালয়, মাড়োয়ারি মন্দির গণিকালয়, ঝালাইপট্টি গণিকালয়, ফরিদপুর শহরের রথখোলা গণিকালয়, ময়মনসিংহ গাঙ্গিনাপাড় গণিকালয়, জামালপুরের রানিগঞ্জ গণিকালয় ইত্যাদি। এসব গণিকালয়ে সরকার অনুমোদিত লাইসেন্সধারী গণিকা আছে। মজার বিষয় হচ্ছে, এইসব লাইসেন্সধারী গণিকাদের একটি বড়ো অংশই হল ১৮ বছরের নিচে। এঁরা নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে লাইসেন্স নিয়ে কাজ করছে। “The Global March Against child Labour’-এর হিসাব মতে বাংলাদেশে ১৮ বছরের নিচে গণিকার সংখ্যা প্রায় ২০,০০০। ২০০৫ সালে মার্কিন সরকারের মানবাধিকার রিপোর্ট অনুসারে অবশ্য ১৮ বছরের নিচে গণিকার সংখ্যা ছিল ২৯ হাজারের বেশি। এসব শিশু গণিকারা শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গ্রোথ বাড়ানোর জন্য গোরুর জন্য ব্যবহৃত মোটা-তাজাকরণ ট্যাবলেট সেবন করে এবং দৈনিক ১৫-২০ জন পুরুষের সঙ্গে মিলিত হয়। গত ২০১৬ সালে ব্রিটেনের ‘ইন্ডিপেনডেন্ট’ পত্রিকা বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার কান্দাপাড়া গণিকালয় নিয়ে একটি রিপোর্ট পেশ করে। রিপোর্টে জানানো হয়, এই গণিকালয়ে একটি নারী প্রবেশ করে ১২-১৪ বছর বয়সে। গত বছর বিদেশি কয়েকটি মিডিয়ায় বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার কান্দাপাড়া গণিকালয় গণিকাদের ছবিসহ নাম প্রকাশ পায়। সেখানে খদ্দেরকে আলিঙ্গনরত অবস্থায় ১৪ বছর বয়সি আসমা, ১৭ বছর বয়সি কাজল, ১৫ বছর বয়সি পাখি, ১৭ বছর বয়সি সুমাইয়াকে দেখা যায়। বাংলাদেশ মানব পাচারের জন্য একটি উৎস, ট্রানজিট ও গন্তব্য দেশের মধ্যে অগ্রগণ্য। এখানে নারী ও শিশুদের পাচারের শিকার হতে হয়। এখানকার মেয়েদের পাচার করে ভারত, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাচার করা হয়, যাঁদের অধিকাংশই যৌনপেশায় জড়িয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে যে-কটি গণিকালয় আছে, তার মধ্যে দৌলতদিয়া গণিকালয় দেশের মধ্যে বৃহত্তম। এটি পৃথিবীর বড়ো কয়েকটি গণিকালয়ের মধ্যেও একটি। এখানে আমি দৌলতদিয়া গণিকালয় ছাড়াও বেশ কয়েকটি প্রথম সারিতে থাকা গণিকালয়ের কথা উল্লেখ করব। দৌলতদিয়া গণিকালয় দিয়ে শুরু করি।
দৌলতদিয়া গণিকালয় : দৌলতদিয়া গণিকালয় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো গণিকালয়। এটি এশিয়ার সবচেয়ে বড়ো গণিকালয়গুলোর একটি। এখানে প্রায় ৪,০০০ যৌনকর্মী যৌনপেশার সঙ্গে যুক্ত। দৌলতদিয়া গণিকালয়টি বাংলাদেশের রাজবাড়ি জেলার অন্তর্গত গোয়ালন্দ উপজেলায় অবস্থিত। গোয়ালন্দ উপজেলার একটি ইউনিয়ন হল দৌলতদিয়া। দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে গণিকালয়টি অবস্থিত। ১৯৮৮ সালের দিকে এটি প্রতিষ্ঠিত বলা হলেও সংশ্লিষ্ট স্থানে বহুকাল আগে থেকেই গণিকাবৃত্তির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা বাস করতেন এবং অননুমোদিত ও অবৈধ গণিকালয় হিসাবে কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিল। বর্তমানে এখানে সরকারি হিসাবে প্রায় ১,৫০০ যৌনকর্মী থাকে। প্রতিদিন প্রায় ২০০০ থেকে ৩০০০ জন ব্যক্তি এখানে যৌন পরিসেবা নিতে আসেন। শরীরে জৌলুস। বাড়াতে বা অক্ষুণ্ণ রাখতে কাউ প্রোটিন albumin সেবন করে থাকে। ২০ টি ট্যাবলেটের দাম ১০ টাকা।
দৌলতদিয়া গণিকালয়টি সরকারি অনুমোদিত হলেও বিভিন্ন সময় এখানে আইন বহির্ভুত কাজকর্ম চলছে। যেমন, বেআইনিভাবে জোরপূর্বক কোনো মহিলাকে যৌনপেশায় বাধ্য করা বা নারী পাচারের মতো অভিযোগ রয়েছে। গণিকালয়ের অভ্যন্তরে নানা রকম মাদকদ্রব্য বিক্রি ছাড়াও ঝুঁকিপূর্ণ ওষুধ সেবন, অপ্রাপ্তবয়স্ক যৌনকর্মী নিয়োগ, তাঁদের উপর শারীরিক নির্যাতনসহ অনেক অমানবিক ও বেআইনি কার্যকর্ম সংগঠিত হওয়ার অভিযোগ আছে। বিভিন্ন এনজিও এবং সামাজিক সংগঠনরা মনে করেন যৌনকর্মীরা এখানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করে এবং অনেক সময় বিভিন্নভাবে তাঁদের নির্যাতনের শিকার হতে হয়। দৌলতদিয়া গণিকাপল্লির গণিকাদের পারিশ্রমিক প্রতি ঘণ্টায় ১০০ টাকা থেকে শুরু। দরকষাকষিও চলে।
দীর্ঘ ৪৭ বছর পর গোয়ালন্দের দৌলতদিয়া বর্তমানে নতুন নামে পরিচিত হচ্ছে সরকারিভাবে। দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে হাসিনা সরকার নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে একটি গেজেট প্রকাশ করেছে। নাম পরিবর্তনের কারণ গণিকালয় তকমা থাকায় এই অঞ্চলের বসবাসকারী গণিকাদের ছেলেমেয়েদের কোনো স্কুলে ভর্তি নিত না। ফলে তারা পড়াশোনার কোনো সুযোগ পেত না। উক্ত গেজেটবলে ‘দৌলতদিয়া গণিকালয়’ পরিবর্তে ‘দৌলতদিয়া বাজার পূর্বপাড়া’ বলে পরিচিত হয়েছে। বর্তমানে এই গণিকাপল্লির সন্তানেরা পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে। স্থানীয় স্কুলগুলোও খুশি।
কান্দাপাড়া গণিকালয় : কান্দাপাড়া গণিকালয় বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন গণিকালয়। প্রায় ২০০ বছর আগে এই গণিকালয়ের গোড়াপত্তন হয়, দেশভাগের আগে অবিভক্ত ভারতে অবস্থিত ছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে গণিকালয়টি জোরপূর্বক উচ্ছেদ করে দেওয়া হয়। উচ্ছেদের আগে পর্যন্ত এই গণিকালয় বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম গণিকালয় হিসাবে বিখ্যাত ছিল। কান্দাপাড়া গণিকালয়টি বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলায় অবস্থিত। কান্দাপাড়া গণিকালয়ে মোট ঘর আছে প্রায় ৮০০টি। এখানে প্রায় ৯০০ জন যৌনকর্মী বসবাস করেন। এই গণিকালয়কে ব্যবহার করে কোনো মহিলাকে বসবাস ও যৌনপেশা হিসেবে গ্রহণ করতে হলে সেই মহিলাকে আদালতে উপস্থিত হয়ে একটি হলফনামা জমা দিতে হয়। এই মর্মে যে, তাঁরা তাঁদের নিজস্ব পছন্দ ও জোরজবরদস্তি ছাড়াই যৌনপেশাকে বেছে নিয়েছে এবং একই সঙ্গে এটাও উল্লেখ করতে হবে যে, তাঁরা অন্য কোনো পেশা গ্রহণ করতে বা খুঁজে পেতে অসমর্থ। কান্দাপাড়া গণিকালয়ে বৈধ যৌনকর্মীর সংখ্যা ৯০০ জন বলা হলেও বাস্তবে এই সংখ্যা অনেকগুণ বেশি। ২০১৪ সালের শেষের দিকে ‘Bangladesh National Women Lawyers Association’ যৌনকর্মীদের উচ্ছেদকে অবৈধ কর্মকাণ্ড বলে বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে এক মামলা দায়ের করে। আদালত তাঁদের আবেদনের পক্ষে রায় দেন। ফলে কান্দাপাড়ার যৌনকর্মীরা তাঁদের পুরোনো আবাস ও পেশা ফিরে পায়। বর্তমানে কান্দাপাড়া গণিকালয়টি ২ মিটার দেয়াল। দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। এই পাঁচিল পরিবৃত্তের ভিতরে মূল গণিকালয়টি অবস্থিত। মূল গণিকালয়ের ভিতরে সরু সরু রাস্তা আছে, আর রাস্তার পাশ দিয়ে বিভিন্ন দোকানপত্র আছে। জার্মান আলোকচিত্রশিল্পী সান্দ্রা হোইন কান্দাপাড়া গণিকালয়ে আসেন এবং এখানকার জীবনমান ও গণিকালয়ের অবস্থা নিয়ে ছবি তোলেন। ছবিগুলো প্রকাশের পর আন্তর্জাতিক মহলের কাছে কান্দাপাড়া গণিকালয়ের দুরবস্থার চিত্র প্রকাশিত হয়ে পড়ে। এখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ যৌন পরিসেবা নিতে এলেও ধর্মীয় ও সামাজিক কারণে কান্দাপাড়া গণিকালয়কে বিভিন্ন সময় হামলা ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়। বাংলাদেশে সামাজিক ভাবে গণিকা ঘৃণ্য চোখে দেখা হয়।
টানবাজার গণিকালয় : টানবাজার গণিকালয় বাংলাদেশের আর-একটি গণিকালয়। ধারণা করা হয় যে, প্রায় ৪০০ বছর আগে অর্থাৎ অবিভক্ত ভারত-ভূখণ্ডে এই গণিকালয়ের যাত্রা শুরু হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৯৯ সালে গণিকালয়টি উচ্ছেদ করে দেওয়ার আগে এটি ছিল দেশের সবচেয়ে বৃহত্তম এবং পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো গণিকালয়গুলির মধ্যে একটি। টানবাজার গণিকালয় নারায়ণগঞ্জ জেলার টানবাজার পার্কের পাশে কুটিপাড়ায় অবস্থিত ছিল। টানবাজার মূলত রং, সুতো ও কেমিক্যাল পণ্যের ব্যাবসার জন্য বিখ্যাত। এই গণিকালয়ে যাওয়ার জন্য দুটি রাস্তা ছিল। একটি ‘আশা’ ও ‘মাশা’ নামের সিনেমা হলের পাশ দিয়ে এবং অন্যটি টানবাজার মসজিদের পাশ দিয়ে। প্রায় ৩ একর জায়গা জুড়ে গড়ে উঠেছিল এই গণিকালয়টি। টানবাজার গণিকালয় বর্তমানে মোহাম্মদ কমপ্লেক্স’-এ এসেছে। তবে পুরোনো গণিকালয়ের ৪/৫ তলা কিছু ভবন এখনও আছে। এখান থেকে যৌনকর্মীরা গোটা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
টানবাজার গণিকালয়ে প্রায় ২০০০টি ঘরে ৩৫০০ জনের বেশি যৌনকর্মী যৌনপেশার সঙ্গে জড়িত ছিল। যাঁদের অনেকেই বংশানুক্রমে সেখানে বসবাস করত। প্রায় ৪০০ বছর ধরে সেখানে যৌনপেশাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ড়া গণিকালয়টি গড়ে উঠেছিল। ১৯৯৯ সালে সাধারণ একশ্রেণির জনগণ ও পুলিশ একযোগে আচমকা মধ্যরাতে যৌনকর্মীদের উপর হামলা করে এবং তাঁদের সেখান থেকে বের করে দেয়। যৌনকর্মীদের আচার-অনুষ্ঠান পালনের জন্য যে মন্দির ছিল, সেই ‘মা ফাতিমা মন্দির’ও ভেঙে ফেলা হয়। কোনোরকম পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ছাড়াই তাঁদের উচ্ছেদ করা হয়। এর প্রতিবাদে গোটা বাংলাদেশে বিভিন্ন সংগঠন আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। গণিকালয় রক্ষা আন্দোলনে সেই সময় যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম সর্দারনি ছিলেন রিতা খানম।
বাংলাদেশের জনৈক সাংসদ শামীম ওসমান বলেন, “এই গণিকাপল্লিতে ১১,০০০ মেয়ে ছিল, যাঁদের বয়স ৯ থেকে ১১ বছরের মধ্যে। বাংলাদেশের অনেক বড়ড়া বড়ো লোক, যাঁরা আজকে টিভি টকশোতে কথা বলেন বা বড়ো বড়ো পত্রিকার সঙ্গে জড়িত সুশীল সমাজ। এখান থেকে প্রতি মাসে ৩০০ করে মেয়ে নিয়ে পুনর্বাসন দেখাত। পুনর্বাসন দেখিয়ে মাথাপিছু ৫০,০০০ টাকা নিত। সাংসদ দাবি করেছেন, টানবাজার গণিকাপল্লি থেকে থানা পেত প্রতিদিন ৪৫ লাখ টাকা। ৪৫ লাখ!
গাঙ্গিনাপাড় পতিতালয় : গাঙ্গিনাপাড় গণিকালয় ময়মনসিংহ রেলস্টেশন থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরে। ভবনের উপরে বিশাল সাইনবোর্ডে লেখা—“আসুন, এইডস থেকে বাঁচুন”। নাজমা বোডিং’ নামে একটা গণিকালয়। সরকার অনুমোদিত গণিকালয়গুলির একটি হল গাঙ্গিনাপাড়। ৪০,০০০ টাকায় মিলে যায় রেজিস্ট্রেশন। দুই পুলিশ কর্মকর্তার গ্রিন সিগন্যাল আর টাকা দিলেই মেলে যৌনপেশার রেজিস্ট্রেশন নম্বর। এখানে আনুমানিক ৪০ জন সর্দারনির অধীনে ৪০০ থেকে ৫০০ মেয়ে যৌনপেশায় যুক্ত আছে। যৌনকর্মীদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন ভবনে ছোটো ছোটো নিজস্ব ঘর। এক একটা ঘরের ভাড়া ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা। ঘরগুলি এক-একজনের নামে পরিচিতি। ঘোট ঘোট এসব রুম সর্দারনিরা দৈনিক ভিত্তিক ভাড়া নিয়ে থাকেন। ঘরের মূল মালিককে দেওয়া হয় ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। বেশির ভাগ সর্দারনী আবার ভাড়া দেন নিয়ন্ত্রণে থাকা গণিকাদের কাছে। তাদের কাছ থেকে আদায় করা হয় দৈনিক ১,০০০ থেকে ১,৫০০ টাকা। কোনো-কোনো ঘরে টাঙানো রয়েছে গণিকার বাঁধাই করা বড়ো ছবি। ময়মনসিংহের এই গণিকালয়ে কিশোর-যুবকদের ক্লায়েন্টদের ক্রমাগত বৃদ্ধি লক্ষণীয়। প্রতিদিন পাঁচ শতাধিক ক্লায়েন্ট এই কিশোর-যুবকরাই। এখানে কিশোরী গণিকাদের প্রচুর চাহিদা। ক্লায়েন্টদের পছন্দের তালিকায় এইসব কিশোরীরাই। রাত ১১টা পর্যন্ত আসা-যাওয়া চলে। তারপর বন্ধ হয়ে যায় গণিকালয়ের প্রধান ফটক। ভিতরে চলে যৌনপ্রমোদ। সেখানে পাহারায় থাকে বেতনভোগী দারোয়ান। শহরের প্রাণকেন্দ্র রমেশ সেন এলাকায় প্রতিষ্ঠিত এই গণিকালয়ের বয়স প্রায় ১৫০ বছর।
২০০১ সাল থেকে গণিকালয় নিয়ন্ত্রণে ‘শুকতারা কল্যাণ সংস্থা’ নামে একটি সংগঠন আছে। এই সংগঠনে আছে ১১ সদস্যের নির্বাচিত কমিটি। ২ বছর পরপর যৌনকর্মীদের সরাসরি ভোটে এ কমিটি নির্বাচন করা হয়। এই সংগঠনের সভাপতি লাভলি প্রায় ৩০ বছর ধরে এই পল্লিতে পেশাগত কারণে বসবাস করে। সাধারণ সম্পাদক রুমানা আক্তার। কমিটির কার্যক্রম সম্পর্কে লাভলি বলেন—গণিকালয়ের যৌনকর্মীদের অধিকার আদায়ে তাঁরা কঠোর ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেন। কাউকে ধরে নিলে কিংবা নতুন মেয়ে আনলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা তাঁরাই গ্রহণ করেন। অভিযোগ রয়েছে, মূলত নেত্রীদের দ্বারাই সাধারণ যৌনকর্মীরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হচ্ছে। অপরদিকে নেত্রীরা টাকার কুমির বনে গেছে। তিনি বলেন, আগে কোনো সংস্থা বা কমিটি না-থাকায় যৌনকর্মীরা ছিলেন অসহায়। এখন সময় পাল্টেছে। নিজেদের পেশাকে করেছি নিরাপদ। এদিকে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে একাধিকবার গণিকালয়ের কাজকর্ম বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শেষপর্যন্ত তা কার্যকর করতে পারেনি প্রশাসন। সভাপতি লাভলি বলেন, আমরা সেক্স করে জীবিকা নির্বাহ করছি। যতদিন ভালো লাগবে এ পেশায় থাকব। এ সকল প্রভাবশালী সর্দারনিদের এই শহরে একাধিক ভাড়া বাড়ি আছে। এঁরা আবার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। তারপরও এ ব্যাবসাকে পুঁজি করে রেখেছেন।
সন্ধ্যাবাজার গণিকালয় : সিলেটের ধোপাদিঘীর পাড় এলাকায় সন্ধ্যাবাজার গণিকালয়, যা স্থানীয়ভাবে ‘পৌরবিপণি’ নামে পরিচিত। এখানেই একটি আবাসিক হোটেলের মধ্যেই আছে একটি মিনি গণিকালয়। নিচে মসজিদ, উপরে গণিকালয় হওয়ার কারণে জায়গাটি বিশেষভাবে আলোচিত। এই কারণেই গণিকালয়টি নজরে আসার উচ্ছেদও করে দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে এঁরা জায়গাটির আশেপাশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়।
এ তো গেল কিছু রেজিস্টার্ড গণিকালয়গুলির কথা। এছাড়াও বাংলাদেশে প্রায় হাজারখানেক গণিকালয় আছে। রাস্তার পাশে যে আবাসিক হোটেলটি দেখতে পাচ্ছেন, সেটিও গণিকালয় হতে পারে। পেতে পারেন মাত্র ৩০০/৪০০ টাকা পারিশ্রমিকের গণিকাও।
মাড়োয়ারি মন্দির গণিকালয় : মাড়োয়ারি মন্দির এলাকার নিষিদ্ধ তিনটি গণিকালয়। মাড়োয়ারি মন্দির এলাকার এক নম্বর গলির মালিক ডাঃ ইয়াকুব তাঁর ২৪টি ঘর থেকে ভাড়া বাবদ দিন ১০০ টাকা হারে মাসে ৭২ হাজার টাকা আয় করে। দুই নম্বর গলির মালিক দুই সহোদরা কণা ও কাজল তাদের ১৬টি ঘর থেকে মাসে ভাড়া বাবদ আদায় করে ৪৮ হাজার টাকা। তিন নম্বর গলির মালিক একসময়ের যৌনকর্মী মেরি তাঁর দ্বিতল বাড়ির ২৭টি ঘর থেকে দিন ৪০ টাকা হারে মাসে ৩২ হাজার টাকা ভাড়া বাবদ আয় করে। ঘরওয়ালিদের ঘরের পজিশন বাবদ এককালীন বাড়িওয়ালাকে দিতে হয় ৪০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। এই গণিকালয়ের ঘরওয়ালিদের আছে আর-এক নাম সর্দারনি’। শারীরিক আবেদন হারানোর কারণে এঁরা এখন আর নিজ দেহ বিক্রি করতে পারে না। ফলে জীবিকার জন্য ভাড়াটিয়া রাখে ২/৩ বা তারও অধিক যৌনকর্মীকে। এই যৌনকর্মীরা ৩ বেলা খাবার ও ঘরের জন্য ভাড়া দেয় দিন প্রতি ১০০ টাকা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কিছু কিছু সর্দারনির অধীনে আছে ১২/১৩ বছরের অল্প বয়সি মেয়ে, এখানে যাঁরা ছুকড়ি’ হিসাবে চিহ্নিত হয়। এরা যে অর্থ আয় করে তার পুরোটাই নিয়ে নেয় সর্দারনি। বিনিময়ে তাদের আশ্রয়, খাবার, পরিধান ও চিকিৎসাসহ যাবতীয় দায়িত্ব নেয়। প্রতিদিন এই যৌনকর্মীদের মাথা প্রতি নাইটগার্ডকে দিতে হয় ১০ টাকা, ভিতরে নিয়মিত পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য দিতে হয় চাঁদা। দিনভর কঠিন যন্ত্রণার পরও রাতে একটু শান্তিতে ঘুমোনোর কোন সুযোগ নেই তাঁদের। ছোট্ট ঘরে একটি খাটে সর্দারিনীসহ ৩/৪ জনকে ঘুমাতে হয় কোনোরকমে। সকালে ল্যাট্রিনের জন্য লাইন, স্নানের জন্য অপেক্ষা, দিনভর নানা পুরুষের মনোরঞ্জন, বিকৃত রুচিসমপন্ন মানুষের বিচিত্র উৎপাত সব কিছুকেই এদের আলিঙ্গন করতে হয় হাসিমুখে। কারণ, এই হাসিই তাদের বিজ্ঞাপন। পুঁজি শরীর।
রাজনীতিক, সাংবাদিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিশেষ বাহিনী, পুলিশসহ সমাজের কথিত অভিজাত থেকে নিচুতলার সব শ্রেণির মানুষই এখানকার নিত্য অতিথি। এক প্রশ্নের জবাবে তারা জানায়, গত বছরখানিক ধরে তেমন কোনো উৎপাত নেই। কিন্তু তার আগে ২/৩ বছরে অত্যাচারের ঝড় বয়ে গেছে তাঁদের উপর দিয়ে। এমনও দিন গেছে তাঁদের যে, থালা-বাসন পর্যন্ত কেড়ে নিয়ে গেছে মাস্তানরা। যশোরের সব থেকে পুরাতন একটি দৈনিকের সম্পাদকের মেজো ছেলের উৎপাতের কথা বলতে গিয়ে তারা জানায়, এক সময় সে টাকা তত দিতই না, বরং মারার হুমকি দিত। অনুরূপ অভিযোগ আনে এই শহরের একটি আক্রমণাত্মক দৈনিকের একজন ক্রাইম রিপোর্টারের বিরুদ্ধে, পরে দৈনিকটির সম্পাদকের কান পর্যন্ত বিষয়টি পৌঁছোলে তিনি নাকি তাদের পাওনা ৫০ টাকা দিয়েছেন। এছাড়াও প্রায়ই সাংবাদিক পরিচয়ে প্রতারকরা এখানে ভিড় করে। এই। সংবাদ সংগ্রহকালে প্রতিবেদক দেখতে পান কতিপয় সাংবাদিককে এই নিষিদ্ধ গলিতে আহ্বান করতে। শহর। ও শহরতলির অনেক মানুষের স্ত্রী হয়ে আছে এই গণিকারা। কথিত ওই স্বামীর উদ্দেশ্য একটাই—স্ত্রীর উপার্জিত অর্থ ভোগ করা। এ ধরনের স্বামীর মধ্যে প্রভাবশালী একটি রাজনৈতিক দলের প্রথম শ্রেণির নেতার ছেলের নামও শোনা যায়। বর্তমানে মাড়োয়ারি মন্দিরের সামনে স্যালভেশন আর্মির (নেদারল্যান্ডের একটি স্বেচ্ছাসেবক প্রতিষ্ঠান) একটি পরামর্শ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ডাক্তাররা নিয়মিত তাঁদের রক্তসহ আনুষঙ্গিক পরীক্ষা করে।
ব্রিটিশ যুগেরও আগে মোগল আমলে এই মাড়োয়ারি মন্দির এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শুধুমাত্র এখানেই না, শহরের গাড়িখানা রোডের পুরোনো পুলিশ ফাঁড়ির পিছনে ঝালাইপট্টি এলাকায়ও সেই সময়ে গড়ে ওঠে। গণিকালয়। তিন নম্বর গলির অতীত উল্লেখ করে তিনি জানান, এই বাড়ির মালিক মেরি এই পল্লির গণিকা ছিল, বয়স এখন তার ৬০, প্যারালাইসিস হয়ে বর্তমানে তিনি শয্যাশায়ী। এই মেরি বাড়ি কিনেছেন বুলি নামক আর-এক গণিকার কাছ থেকে, বৃদ্ধা বয়সে তিনি (বুলি) এই বাড়ি বিক্রি করে ভারতে চলে যান। শোনা যায় বুলি মারা গেছেন বেশ কিছুকাল আগে।
ঝালাইপট্টি ও বাবুবাজার গণিকালয় : যশোরের আরও দুটি গণিকালয়—ঝালাইপট্টি ও বাবুবাজার। ঝালাইপট্টি ও বাবুবাজারের দুটি করে চারটি গলি বা বাড়িতে মোট ৬৭টি ঘরে যৌনকর্মীর সংখ্যা রয়েছে ১৩৭ জন। ঘরওয়ালি আছে ৬৭ জন, চৌকিদার গার্ড আছে প্রায় ১৫ জন, এছাড়াও আছে অনেকের ২/১ জন করে ছেলে-মেয়ে, রয়েছে রাঁধুনি (মাসি)। গড়ে প্রায় ৩০০টি মুখের সরাসরি নির্ভরতা রয়েছে এই পেশার আয়ের উপর। পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল আছে অসংখ্য পরিবার। গণিকাদের অনেকের বাবা মার সংসারসহ এই ব্যাবসাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে নানা পেশার মানুষের জীবন। সরেজমিনে দেখা গেছে, মাড়োয়ারি মন্দির গণিকালয়ের তুলনায় এই দুটি গণিকালয় অতিমাত্রায় নিম্নমানের। ক্লায়েন্ট আকৃষ্ট করার যোগ্যতার ভিত্তিতে এই সমস্ত গণিকালয়গুলি বিভাজিত হয় বিভিন্ন শ্রেণিতে। এই বিভাজনে মাড়োয়ারি মন্দির গণিকালয় চিহ্নিত হয় অভিজাত শ্রেণির গণিকালয় হিসাবে, আর ঝালাইপট্টি ও বাবুবাজার গণিকালয় চিহ্নিত হয় নিম্নশ্রেণির হিসাবে। মাড়োয়ারি মন্দির বাসিন্দাদের জন্য আছে একতালা দুইতলা পাকা ভবন, কয়েকটিতে আছে টালির ছাউনি, ভিতরে হার্ডবোর্ডের সিলিং। এসব ঘরগুলোর মধ্যে জৌলুস কম নয়। আছে রঙিন টেলিভিশন, ফ্রিজ, ফ্যান, পালঙ্ক, সোফা। বেশভূষায় পড়েছে স্যাটালাইটের প্রভাব, পরিধানে রয়েছে স্কার্ট, চোখে গগস, শরীরে দামি অর্নামেন্টস। অপরদিকে ঝালাইপট্টি ও বাবুবাজার গণিকালয়ের চিত্র করুণ। সারিবদ্ধ নিচু নিচু খুপড়ি ঘর, গোলপাতার ছাউনি, ভাঙাচোরা, চাটাইয়ের বেড়া, অনেক ঘরের দরজায় চটের আড়াল বা আচ্ছাদান। ভিতরে নেই কোনো আধুনিকতার বালাই। দিনেরবেলাতেও ঘরে সূর্যের আলো প্রবেশ করে না। এরই মাঝে টিমটিমে বিজলি বাতির স্বল্প আলোয় ঘরে বিরাজ করে এক ভৌতিক অবস্থা।
প্রবীণ পৌর কর্মকর্তা (অবঃ) চুড়িপট্টি নিবাসী দেওয়ান মোস্তফা আমান বলেন মোগল সম্রাট আকবরের শাসনামল থেকেই যশোর শহরে চলে আসছে গণিকাবৃত্তি। ব্রিটিশ যুগে শহরের তিনটি স্থানে বর্তমান ইডেন মার্কেট ও শিল্প ভাণ্ডারের পিছনে গড়ে ওঠে প্রথম শ্রেণির গণিকালয়। কাঁঠালতলা গণিকালয়, হোটেল মিড টাউন ও মাড়োয়ারি মন্দিরের মাঝে মাড়োয়ারি বাবুদের প্রয়োজনে গড়ে ওঠে দ্বিতীয় শ্রেণির এবং ঝালাইপট্টির পুরোনো ছাগলহাটার দক্ষিণে গড়ে ওঠে তৃতীয় শ্রেণির গণিকালয়। শহরের অভিজাত শ্রেণির মানুষরা যেত কাঁঠালতলা গণিকালয়ে। ইতিহাস আছে বর্তমান জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপারের বাংলো ছিল তৎকালীন জমিদারদের বাইজিখানা। এই বাইজিখানায় সপ্তাহে দু-দিন কলকাতা থেকে ৮ ঘোড়ার ফিটন গাড়িতে চড়ে আসতেন জমিদার ব্যারিস্টার মন্মথনাথ রায় ও তাঁর সঙ্গীরা। শনিবার আধা বেলা এবং রবিবার সারাদিন ফুর্তি করে তিনি পুনরায় কলকাতায় চলে যেতেন। সে সময়ে ওই বাইজিখানায় মেয়ে সাপ্লাই দেওয়া হত চাঁচড়া রায়পাড়ার ব্রাহ্মণ পরিবার থেকে। জানা যায় কখনও টাকা দিয়ে কখনও জোরপূর্বক ওই মেয়েদের নিয়ে যাওয়া হত বাইজিখানায়। যে পরিবারের এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই।
জনশ্রুতি আছে যে, আজকের দড়াটানা জামে মসজিদ যে স্থানে অবস্থিত, অতীতে সেখানে ছিল গণিকালয় ও বাইজিখানা। কাপুড়িয়া পট্টি এলাকায় ছিল নামজাদা সব বাইজিদের বসতবাড়ি। এই বিশেষ আকর্ষণে একদা ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে জমিদার, মহাজন, মাড়োয়ারি বাবুরা ছুটে আসতেন এই প্রাচীন যশোর পৌরশহর জনপদে। বাবুবাজার, বাবুঘাট, মাড়োয়ারি মন্দির এই স্থানিক নামবাচক শব্দ আজও বহন করে চলেছে সেই প্রাচীন গণিকাবৃত্তির ইতিহাস। প্রাচীন এই গণিকাবৃত্তির ইতিহাস-ঐতিহ্য আর শিল্পের সঙ্গে কোনো মিল নেই আজকের গণিকাবৃত্তির। হয়তো-বা পরিবর্তনশীল এই সমাজের গণিকাবৃত্তির আধুনিক রূপান্তরের ফলেই শিল্প হারিয়েছে পুরোনো ধাঁচের এই সব গণিকালয়গুলি। হয়তো-বা পণ্যের সস্তা মূল্যই এই গণিকালয়গুলিকে আরও বেশি অস্বাস্থ্যকর করে তুলেছে। তবুও ব্যাবসার সচেতনতা এবং সেই সঙ্গে ন্যূনতম আর্থিক সংগতি থাকার কারণে মাড়োয়ারি মন্দির গণিকালয়ের বাসিন্দারা স্ব-উদ্যোগে নিয়মিত পয়ঃনিষ্কাশন ও আনুষাঙ্গিকের ব্যবস্থা করলেও নিম্নশ্রেণির এই দুটি গণিকালয়ের (ঝালাইপট্টি ও বাবুবাজার)-তে নিয়মিত পয়ঃনিষ্কাশন স্বাস্থ্যকর রাখার কোনো ব্যবস্থাই তাঁরা নিতে পারে না। ডাক্তারী পরীক্ষাসহ কোনো ধরনের স্বাস্থ্যবিধি এখানে মানা হয় না। মুখে তাঁরা যাই বলুক না-কেন, ডাক্তার হয়তো-বা কদাচিৎ যায়ও কিন্তু সবকিছুই ‘ওকে’ হয়ে যায় সামান্য টাকায়। ফলে বছরের পর বছর ধরে এই গণিকালয়গুলি যে সমাজে মারাত্মক সব রোগের বীজ ছড়াচ্ছে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
কেমন আছে বাংলাদেশের যৌনকর্মীরা? বাংলাদেশে ‘গণিকাবৃত্তি’ বৈধ হলেও নানা কারণে উচ্ছেদ হয়েছে বেশ কিছু গণিকালয়। গণিকাপেশা নির্মূলের সদিচ্ছার জন্য নয়, অনেকক্ষেত্রেই উচ্ছেদের আসল কারণ জমি দখল। বাংলাদেশে যেমন বৈধ যৌনকর্মী আছেন প্রায় ১ লাখ, তেমনি অবৈধভাবে আছেন আরও তিন-চার লাখ। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরের মধ্যে মাদরীপুর, খুলনার ফুলতলা এবং টাঙ্গাইল মিলিয়ে মোট তিনটি গণিকালয় উচ্ছেদ করা হয়েছে। এর মধ্যে টাঙ্গাইল ছাড়া আরও দুটি এখন বহুতল মার্কেট। টাঙ্গাইলের রেজিস্টার্ড গণিকালয়ের যৌনকর্মী হাসি ডয়চে ভেলেক জানান, “আমাদের নির্মম নির্যাতন আর অত্যাচার করে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। আমাদের অনেকের নিজেদের জমি ও ঘর থাকার পরও আমরা সেখানে থাকতে পারিনি। পরে আদালতের রায়ে আমরা ফিরে আসতে পারলেও সবাই আসেনি। তাঁরা এখন দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। জানি না তাদের সন্তানরা কেমন আছে, কেমনভাবে চলছে তাদের জীবন।” হাসি বলেন, “আমরা ফিরে এলেও এখন আমাদের উপর পুলিশের নতুন নির্যাতন শুরু হয়েছে। পুলিশ হামলা চালায়, খদ্দের ধরার নামে চাঁদা নেয়। ওদিকে বাড়িওয়ালারাও ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে। ছোট্ট একটা রুমের একদিনের ভাড়া ৬০০ টাকা। তার উপর মাস্তানদের চাঁদা তো আছেই। তাই যৌনকর্মীদের অনেকেরই এখন পেটে ভাত নেই। কেউ কেউ ধার দেনা ও ঋণ করে চলছে।” টাঙ্গাইলের গণিকালয়কে আবার আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে যাঁরা আন্দোলন করেছেন, তাঁদের মধ্যে সবার আগে আসে মাহমুদা শেলির নাম। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আমার মনে হচ্ছে, পুলিশ প্রশাসন এখন কৌশলে এই গণিকালয়টি উচ্ছেদ করতে চায়। তাই ক্লায়েন্টরা যাতে আসতে না পারে, সেজন্য তাঁরা নানাভাবে হয়রানি করে। ক্লায়েন্ট না-এলে যৌনকর্মীরা তাঁদের কাজ টিকিয়ে রাখতে পারবে না। তিনি জানান, “এই যৌনপল্লিটি উচ্ছেদের পিছনে প্রভাবশালী মহলের হাত ছিল। তাঁদের টার্গেট ছিল এখানকার জমি দখল করা। তাই তাঁরা দু-ঘণ্টার মধ্যে যৌনপল্লিটি উচ্ছেদ করেছিল।”
নারায়নগঞ্জের টানবাজার এবং ঢাকার ইংলিশ রোডের গণিকালয়ও এক রাতের মধ্যে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। এই দুটি গণিকালয়ের যৌনকর্মীদেরও মারপিট ও নির্যাতন করে উচ্ছেদ করা হয়। প্রভাবশালীরা প্রশাসনের সহায়তায় এ কাজ করে। যৌনকর্মীদের আটক করে প্রিজন ভ্যানে ভবঘুরে কেন্দ্রে পাঠানো হলেও, তাঁরা শেষপর্যন্ত সেখানে থাকেননি। পুলিশও এঁদের উপর অত্যাচার করে, ভয় দেখিয়ে ওঁদের ভোগ করে, ধর্ষণ। করে। সেখান থেকে পালিয়ে তাঁদের অনেকেই এখন ভাসমান যৌনকর্মী।
জয়া শিকদার যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করা ‘অ্যাক্টিভিস্ট মুভমেন্ট’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রধান নির্বাহী। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, “যৌনকর্মীদের উচ্ছেদ করা হলে তাঁদের ভাসমান না-হয়ে উপায় থাকে। তাঁদের বিকল্প পেশা নেই। ফলে দিন দিন ভাসমান যৌনকর্মীদের সংখ্যা বাড়ছে। তা ছাড়া ভাসমান যৌনকর্মীরা স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন সুবিধা পর্যন্ত পায় না। ফলে তাঁরা নানা রোগে আক্রান্ত হয়। তাঁদের সন্তানরাও দুর্বিষহ জীবনযাপন করে।”
বাংলাদেশে ‘গণিকাবৃত্তি’ অবৈধ নয়। প্রাপ্তবয়স্ক নারী, যাঁদের বয়স ১৮ বছর বা তার বেশি, তাঁরা স্বেচ্ছায় ঘোষণা দিয়ে এই পেশা বেছে নিতে পারেন। তবে রাষ্ট্র গণিকাবৃত্তি বন্ধে ব্যবস্থা নেবে। এখানে জোর করে কাউকে এই পেশায় নিয়োজিত করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তা ছাড়া ১৮ বছরের নীচে কোনো নারী এই পেশা বেছে নিতে পারবেন না। তবে এই পেশা স্বেচ্ছায় বেছে নিতেও পুলিশকে ঘুস দিতে হয়। ২০ থেকে ৪০ হাজার টাকার কমে অনুমতি মেলে না। সেক্স ওয়ার্কার্স নেটওয়ার্ক’-এর আরিফুর রহমান সবুজ ডয়চে ভেলেকে জানান, “আমাদের হিসাবে সারা দেশে ২৫,০০০ ভাসমান এবং যৌনপল্লিগুলোতে ৭০,০০০ বৈধ যৌনকর্মী আছেন।” তবে জয়া শিকদার মনে করেন, “বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে এই সংখ্যা পাঁচ লাখের কম হবে না।”
বাংলাদেশে অনেকক্ষেত্রে প্রতারণার শিকার হয়ে গণিকালয়গুলিতে হাজির হন মেয়েরা। প্রত্যন্ত অঞ্চলের হতদরিদ্র পরিবারের সদস্যরা কখনো-কখনো অর্থের লোভে মেয়েদের বিক্রি করে দেন বলে জানিয়েছে একাধিক আন্তর্জাতিক বার্তাসংস্থা। এছাড়া ভালোবাসার ফাঁদে ফেলে কিংবা বিদেশ যাওয়ার লোভ দেখিয়েও মেয়েদের গণিকালয়ে আনা হয়। অভিযোগ রয়েছে, গণিকালয়ের মালিক নতুন আসা যৌনকর্মীদের শরীর ভোগ্যপণ্য করে তুলতে স্টেরয়েড ট্যাবলেট সেবনে বাধ্য করে, যা সাধারণত গোরুকে খাওয়ানো হয়। গোরুর স্বাস্থ্য বাড়াতে ব্যবহার করা এই ট্যাবলেট মানুষের দেহের জন্য ক্ষতিকর। কম বয়সি নাবালিকা মেয়েরা পূর্ণ যুবতী হয়ে ওঠে স্টেরয়েডের প্রভাবে। বাংলাদেশের এক গণিকালয়ের মালিক রোকেয়া জানান, স্টেরয়েড ওষুধ প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে ভালো কাজে দেয়। কিন্তু অপ্রাপ্তবয়স্ক, বিশেষ করে ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সি মেয়েদের ক্ষেত্রে এটি কার্যকর নয়। তা সত্ত্বেও অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের স্বাস্থ্য ভালো করতে এই বিশেষ ধরনের ইনজেকশন ব্যবহার করা হয়। স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে গিয়ে একসময় বেশিরভাগ গণিকা স্টেরয়েডে আসক্ত হয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশন এইড ইউকে এক সমীক্ষার ভিত্তিতে ২০১০ সালে জানায় যে, বাংলাদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ যৌনকর্মী ওরাডেক্সন বা অন্যান্য স্টেরয়েড ট্যাবলেট নিয়মিত গ্রহণ করে। তাঁদের গড় বয়স ১৫-৩৫ বছর। স্টেরয়েড ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে প্রচারণা চালাচ্ছে অ্যাকশন এইড। সংস্থাটির বাংলাদেশ অংশের কর্মকর্তা লুৎফুন নাহার জানিয়েছেন, “ওরাডেক্সন গ্রহণ করার পর শুরুতে মেয়েদের শরীরে চর্বির পরিমাণ বাড়তে থাকে। কিন্তু এটি নিয়মিত সেবন করলে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, চামড়ায় ক্ষতসহ বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়।”
বাংলাদেশের বেশ কয়েক নারীকে মধ্যপ্রাচ্যে যৌনদাসী হিসাবে ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। তাঁদের পাচার করে সিরিয়ায় নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে একাধিক বার্তাসংস্থা। এসব নারীকে ফিরিয়ে আনতে সরকারি উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে। তবে শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিভিন্ন গণিকালয়েও বাংলাদেশি নারীদের জোরপূর্বক গণিকাবৃত্তিতে নিয়োগ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। কাজ দেওয়ার নাম করে বাংলাদেশের মেয়েদের মধ্যপ্রাচ্যে নিয়ে যায় একশ্রেণির দালাল। বহু বছর থেকেই তাঁরা অতি সক্রিয়। বাংলাদেশী এইসব মেয়েরা সৌদিতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়।
বিদেশিদের খুশি করতে বাংলাদেশের আশ্রিত রোহিঙ্গা নারীদেরও যৌনকাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অল্পবয়সি মেয়েরা বিদেশিদের যৌনকর্মে ব্যবহারের টার্গেট হয়ে উঠছে। কক্সবাজার থেকে যৌন-ব্যাবসার জন্য রোহিঙ্গা মেয়ে ও শিশুদের পাচার করা হচ্ছে বলে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। বিবিসি নিউজের একটি দল এবং অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ফাউন্ডেশন সেন্টিনেল ওই অনুসন্ধানে নামে। তাঁরা কক্সবাজারের ছটো হোটেল ও সৈকতের রিসোর্ট থেকে মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই দালালদের টেলিফোন নম্বর যোগাড় করে। এই হোটেল ও রিসোর্টে যৌন-কর্মকাণ্ডের জন্য রুম ভাড়া পাওয়া যায়। পুলিশকে বিষয়টি জানিয়েই বিবিসি নিউজের দলটি এসব নম্বরে ফোন করে দালালদের কাছে জানতে চায় বিদেশিদের জন্য অল্পবয়সি রোহিঙ্গা মেয়ে পাওয়া যাবে কি না। এর উত্তরে টেলিফোনের ওপার থেকে এক দালাল জানায়–“অল্পবয়সি মেয়ে আছে, কিন্তু রোহিঙ্গা মেয়ে কেন খোঁজা হচ্ছে? ওরা তো খুব নোংরা”। আরও গভীরে গিয়ে দেখা গেল রোহিঙ্গা মেয়েদের সেখানে সবচাইতে সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে। গণিকাবৃত্তির ক্ষেত্রেও তাঁরা সেখানে সবচাইতে নিচের সারিতে রয়েছে। বিবিসির দলটি দালালকে জানালো যত দ্রুত সম্ভব তাঁরা এসব মেয়েদের সঙ্গে রাত কাটাতে চায়। খুব দ্রুতই বিভিন্ন দালালদের কাছ থেকে রোহিঙ্গা মেয়েদের ছবি আসতে শুরু করল। যাদের বয়স ১৩ থেকে ১৭ বছর। বলা হল ছবির মেয়েদের পছন্দ না-হলে আরও মেয়ে দেখানো সম্ভব। চাইলেই পাওয়া যাবে। এভাবে এত রোহিঙ্গা মেয়ে পাওয়া গেল, যা খুবই ভয়াবহ। দালালদের সঙ্গে কথাবার্তার রেকর্ডিং ও ভিডিও স্থানীয় পুলিশকেও দেওয়া হয়েছে। অভিযানের অংশ হিসেবে দলটি কক্সবাজারের ওই দালালকে ফোন করে। ছবিতে দেখা দুটো মেয়েকে রাত আটটায় শহরের একটি নামি হোটেলে পাঠাতে বলা হয়। ফাউন্ডেশন সেন্টিনেলের এক কর্মী ‘অনুবাদক হিসাবে হোটেলের বাইরে অপেক্ষা করছিল। হোটেলের কার পার্কে অপেক্ষা করছিল পুলিশ। রাত আটটার দিকে বেশ কিছু ফোন কলের পর একটি গাড়িতে করে ড্রাইভারের সঙ্গে ছবিতে দেখা মেয়ে দুটিকে পাঠানো হয়। বিদেশি ক্লায়েন্ট সেজে থাকা ব্যক্তিটি জানতে চায় আজ রাতের পরে আরও মেয়ে পাওয়া যাবে কি না। গাড়ির চালক সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে। টাকা হস্তান্তরের পরই পুলিশ গাড়ির চালককে গ্রেপ্তার করে। মেয়ে দুটিকে উদ্ধার করে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। দারিদ্র আর গণিকাবৃত্তির জালে যেন এই মেয়ে দুটি আটকে গেছে। তাঁরা জানায় গণিকাবৃত্তি ছাড়া জীবন চালানো তাঁদের জন্য খুব কঠিন।
আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় পর্যায়ে নারী ও শিশু পাচারে খুব শক্তিশালী নেটওয়ার্ক দরকার হয়। এ ক্ষেত্রে ইন্টারনেট এখন যোগাযোগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। রোহিঙ্গা মেয়েদের ঢাকা, নেপালের কাঠমান্ডু ও ভারতের কোলকাতায় নিয়ে আসা হয় বলে তথ্য পাওয়া গেছে। কলকাতায় ব্যস্ত যৌন-ব্যাবসায় এরকম অনেক নারীদের পরিচয়পত্রের ব্যবস্থা করে দেওয়া হচ্ছে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিলেমিশে যাচ্ছে তাঁরা। এরপর তাঁদের আজ খোঁজ মিলছে না। এমন ওয়েবসাইটও পাওয়া গেল যেখানে কীভাবে রোহিঙ্গা মেয়েদের ব্যবহার করা যায়, সে নিয়ে ধাপে ধাপে তথ্য দেওয়া হয়েছে। কীভাবে ধরা পরার হাত থেকে বাঁচা যায়, কোন্ এলাকায় সবচাইতে বেশি শিশু পাওয়া যায়, এমন সব তথ্য দিয়েছে এক ব্যক্তি। যদিও এই ওয়েবসাইটটি পুলিশ সরিয়ে ফেলেছে। তবে তার আগে সেটি যাচাই করে জানা গেছে কীভাবে শিশুকামী ও পাচারকারীদের টার্গেট হয়ে উঠছে রোহিঙ্গা শিশু ও নারীরা। বাংলাদেশে নতুন সেক্স ইন্ডাস্ট্রি গড়ে না-উঠলেও যৌনকর্মী হিসাবে কাজের জন্য মেয়ে সরবরাহ বেড়ে গেছে। আর সেটির অন্যতম শিকার রোহিঙ্গা মেয়েরা। বাংলাদেশের কক্সবাজারে ক্যাম্পগুলোতে নারীদের যৌন নির্যাতন ও যৌনপেশায় জড়িয়ে পড়ার এমন অনেক ঘটনার বর্ণনা পাওয়া গেছে। অল্প বয়সি নারী ও শিশুরা এর মূল টার্গেট। বিপদগ্রস্ত এই নারী ও শিশুদের মূলত কাজের লোভ দেখিয়ে ক্যাম্প থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ক্যাম্পে রোহিঙ্গা শিশু ও তাঁদের অভিভাবকরা বলছেন দেশের বাইরে কাজ, রাজধানী ঢাকায় বাড়িঘরে গৃহকর্মীর কাজ বা হোটেলে কাজের অনেক প্রস্তাব আসছে তাঁদের কাছে। মারাত্মক ঘনবসতিপূর্ণ ক্যাম্পে বিশৃঙ্খল পরিবেশ পাচারকারীদের সুযোগ যেন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। মাসুদা নামের আর-এক কিশোরী তাঁর কাহিনি বর্ণনা করতে গিয়ে বলছেন, “আমি জানতাম আমার কপালে কী আছে। যে মহিলা আমাকে কাজ দেওয়ার কথা বলেছিল সেও একজন রোহিঙ্গা। অনেকদিন আগে এখানে এসেছে। সবাই জানে যে, সে লোকজনকে যৌনকাজে সহায়তা করে। আমার কোনো উপায় ছিল না, কারণ এখনও আমার জন্য কিছুই নেই।”
‘Research Evaluation Associates for Development (RED)’ সমীক্ষায় বলছে বাংলাদেশের গণিকাপল্লির যৌনকর্মীদের অবস্থা খুবই করুণ। নারায়ণগঞ্জের টানবাজার, মাসদাইর, রূপালি গেট, হাজিগঞ্জ; ঢাকায় তেজগাঁও, কমলাপুর; ময়মনসিংহের স্বদেশিবাজার, নিমতলি, কান্দুপট্টি, রাজবাড়ির দৌলতদিয়া ঘাট; টাঙ্গাইলের কান্দাপাড়ার যৌনকর্মীরা খুবই বিপন্ন। পুলিশ, মস্তান সবাই গিলে খাচ্ছে, নিঙড়ে নিচ্ছে দেহরস। পাশবিক অত্যাচার করে ভবঘুরে কেন্দ্রে চালান করে দিচ্ছে যৌনকর্মীদের। সেখানে পুলিশদের দ্বারা যৌনকর্মীরা ব্যবহৃত হচ্ছে, চলছে যৌন-সন্ত্রাস। বিভীষিকাময় পরিস্থিতি।
গণিকাদের উচ্ছেদ করে গাজিপুরের কাশিমপুর এবং পুবাইল ভবঘুরে কেন্দ্রে আশ্রয় দেওয়া হয়। পুলিশ মাঝেমধ্যেই গণিকাপল্লিগুলিতে অতর্কিতে হানা দিয়ে মেয়েদের আটক করে ভবঘুরে চালান করে দেয়। মধ্যরাতে পুলিশের অতর্কিত হামলায় গণিকাপল্লিরা মেয়েরা আতঙ্কিত হয়ে বাথরুমের পিছনের পাইপ, দেয়াল, পায়খানাপূর্ণ ড্রেন দিয়ে পালানোর সময় মলমূত্রে মাখামাখি হয়ে যায়। যেহেতু মধ্যরাতে পুলিশি হামলা শুরু হয়, যেহেতু এই সময়ে যৌনকর্মীরা যৌনকর্মে ব্যস্ত থাকেন–অতএব বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যৌনকর্মী মেয়েদের সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে অথবা খোলা বুকে ঘর ছেড়ে পালাতে হয়। ধরা পড়লে পুলিশ নৃশংসভাবে এঁদের উপর অত্যাচার করে, শারীরিক নির্যাতন করে। তাঁদের চুলের মুঠি ধরে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হয়। মেয়েদের তলপেটে ভারী বুটের লাথি নেমে আসে। পুলিশ-ভ্যানে তুলে এঁদেরকে পাটতনের উপর ফেলে কয়েকজন পুলিশ মিলে ধর্ষণ পর্যন্ত করে থাকে।
বাংলাদেশের গবেষক-লেখক শাহিন পারভিনের কয়েকটি কেস স্টাডি রিপোর্ট গণিকাবৃত্তি প্রসঙ্গে এক সমীক্ষায় মাধ্যমে যে কজন তথ্যদাতার সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, তাঁরা সকলেই একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই গণিকাবৃত্তিতে এসেছেন। জানাচ্ছে এঁরা কেউই স্বেচ্ছায় এই পেশায় আসেননি। তাঁদের জীবনের অভিজ্ঞতা, দুঃখ-কষ্ট ও কোন্ প্রক্রিয়ায় তাঁরা এই পেশায় এসেছেন সেই চিত্র স্পষ্ট হয় পাঁচজনের এই কেস স্টাডি থেকে। পনেরো জন পতিতার সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল।
কেস স্টাডি–এক : নাম স্বপ্ন। পেশা ভাসমান গণিকা। বয়স ২৬। কাজের জায়গা সোহরাওয়ার্দি উদ্যান ও রমনা পার্ক। রাতে ফুটপাতে বা পার্কে ঘুমিয়ে থাকেন। স্বপ্ন ১২ বছর বয়সে তাঁর দুর সম্পর্কীয় এক মামার সঙ্গে ঢাকায় আসেন। তাঁর মামা তাঁকে একটি বাড়িতে কাজের জন্য দেয়। সেখানে কিছুদিন কাজ করার পর সে নতুন আর-এক বাড়িতে কাজ ধরে। সেই বাড়ির ছেলের সঙ্গে তাঁর প্রেম ও শারীরিক সম্পর্ক হয়। গোপনে তাঁরা বিয়েও করে নেয়। কিন্তু এসব জানাজানি হলে গৃহকর্তা তা মেনে নিতে চায় না। এর মধ্যে স্বপ্নার এটি সন্তানও হয়। সন্তান হওয়ার পর স্বপ্নার শ্বশুর তাঁর স্বামীকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয় এবং তাঁকে ঘর থেকে বের করে দেয়। তাঁর স্বামীও তাঁর আর কোনো খোঁজখবর নেয়নি। স্বপ্নকে বাড়ি থেকে বের করে দিলে সে কোলের সন্তানকে গ্রামে তাঁর বোনের কাছে রেখে আসে এবং সে গার্মেন্টসে ৩০০ টাকার একটি কাজ জোগাড় করে। সেখানে কিছুদিন কাজ করার পর গার্মেন্টসের এক দারোয়ান তাঁকে ধর্ষণ করে। এর ফলে এ কাজটিও হারায় স্বপ্না। এক মহিলা ৯০০ টাকায় বাসায় কাজ ঠিক করে দেবে বলে নিয়ে যায় একটি বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে তিনজন পুরুষ স্বপ্নকে উপর্যুপরি ধর্ষণ করে। ধর্ষণ করার পর ওই মহিলা স্বপ্নকে ৫০ টাকা দেয় এবং সেখান থেকে বের করে দেয়। এই মহিলার সাহায্যেই এক হোটেলে কিছুদিন কাজ করে। হোটেলের এক কাস্টমার তাঁকে টানবাজারে নিয়ে যায়। এখানে সে পাঁচ বছর কাজ করে। কিছু টাকাপয়সাও তাঁর জমে। কিন্তু কিছুদিন পর উচ্ছেদ হলে সে সেইসব টাকাপয়সা আনতে পারেনি। উচ্ছেদের পর সে কাসিমপুরে বন্দি ছিল। সেখান থেকে পালানোর চেষ্টা করলে পুলিশের হাতে ধৃত হয় এবং প্রচণ্ড মার খান। এরপর তাঁর পরিচিত একজন স্বামীর পরিচয় দিয়ে তাঁকে সেখান থেকে ছাড়িয়ে আনে। ছেড়ে দেওয়ার সময় স্বপ্নাকে একটা সেলাই মেসিন আর ৭০০০ টাকা দেওয়া হয়। এসব নিয়ে কিছুদূর আসতে না-আসতেই কিছু দুষ্কৃতি তাঁর সেলাই মেসিন কেড়ে নেয়। ছাড়িয়ে আনার জন্য সেই পরিচিত লোকটিকে ৫০০ টাকা দিয়েছিল। বাকি টাকা গ্রামের বোনকে দিয়ে সে ঢাকায় এসে সোহরাওয়ার্দিতে ভাসমান গণিকা হিসাবে কাজ শুরু দেয়।
কেস স্টাডি–দুই : নাম জাহানারা। বয়স ৩০। সন্তান দুটি। বাপের বাড়ি ময়মনসিংহ। বিয়ের পর তাঁর স্বামী তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসে। স্বামী হোটেলে কাজ করত। বিয়ের পর প্রথম ৪/৫ বছর স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক ভালোই ছিল। ওইসময় তাঁর একটা সন্তান হয়। সন্তান জন্মের পর তাঁর স্বামীর অন্য এক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক হয় ও নেশায় আসক্ত হয় এবং জাহানারাকে খুব শারীরিক নির্যাতন শুরু করে। তাঁর স্বামীর সঙ্গে বাড়িতে মাঝেমধ্যে একটা পুলিশ এসেও নেশা করত। একদিন তাঁর স্বামী পুলিশকে বাড়িতে রেখে সরে পড়ে। পুলিশটি জাহানারাকে ধর্ষণ করে। এরপর থেকে প্রায়ই তাঁর স্বামী পুলিশের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সরে পড়ত। আর প্রতিদিন জাহানারা ওই পুলিশের দ্বারা যৌন-লালসার শিকার হত। স্বামী কিন্তু সংসারের খরচ দিত না। ফলে বাচ্চা ও নিজের খাবার জোটানোর জন্য সে বাসা-বাড়িতে কাজ করতে শুরু করে। কিন্তু বাচ্চার কারণে কেউ তাঁকে বেশিদিন কাজে রাখত না। এরপরে সে ওই পুলিশের সাহায্যে পুলিশের ইনফর্মার হিসাবে কাজ শুরু করে। কিন্তু বেশিদিন ওই কাজ করতে পারে না। কারণ তাঁর এক দেবর জেলে ছিল। সে জেল থেকে বের হয়ে জাহানারাকে ওই কাজ ছেড়ে দেওয়ার জন্য হুমকি দিলে ওই কাজ ছেড়ে দেয়। জাহানারার পেটে যখন দ্বিতীয় সন্তান তখন তাঁর স্বামী তাঁকে ছেড়ে চলে যায়। এরপর সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে এসে দেহ-ব্যাবসা শুরু করে। প্রায় দুই বছর সে এই কাজ করেছে। কাজ ছাড়ার পাঁচ মাস আগে জাহানারার টাইফয়েড হয়। টাইফেয়েডের ফলে তাঁর এক হাত ও এক পা দিয়ে কোনো কাজই করতে পারে না। উদ্যানে সে সারাদিন একটা পলিথিন বিছিয়ে ৫ বছরের ছেলে ও ১ বছরের মেয়েকে নিয়ে শুয়ে থাকে। খিদে পেলে ৫ টাকার বিনিময়ে খাবার কিনে খেত। জাহানারা সাধারণত রাতে খদ্দেরদের সঙ্গে দেহ-ব্যাবসা করত।
কেস স্টাডি–তিন : নাম কালী। বয়স ২৮। আজিমপুর বস্তির বাসিন্দা কালীর দুটি সন্তান। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর প্রায় ১০ বছর দেহ-ব্যাবসার পেশায় আছে। কালী যখন ছোটো ছিল তখন তাঁর বাবার মৃত্যু হয়। বাবার মৃত্যুর পর তাঁদের সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকত। কেউ তাঁকে দেখতে পেত না। সারাক্ষণ গালিগালাজ করত। এ সময় কালীর মাসি তাঁকে এক বাড়িতে কাজ দেওয়ার জন্য ঢাকায় নিয়ে আসে। কালী ওই বাড়িতে কিছুদিন থাকার পর থেকে ওই বাড়ির ছেলের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হতে থাকে। হয়রানি এড়াতে একদিন সে সেই বাড়ি থেকে পালিয়ে এক মহিলার কাছে আশ্রয় পায়। এই মহিলাই কালীকে দেহ ব্যাবসায় নিয়ে আসে। এই পেশায় থাকতে থাকতে এক ছেলের সঙ্গে কালীর প্রেম হয় এবং একে অপরকে বিয়ে করে। বিয়ের পর কালী দেহ-ব্যাবসা ছেড়ে দেয়। কিন্তু বিয়ের পর কালী জানতে পারে তাঁর স্বামীর আরও একটি স্ত্রী আছে এবং স্বামীর নেশাও করে। বিয়ের আগে তাঁর স্বামী তাঁর সঙ্গে বেশ ভালো ব্যবহারই করত। কিন্তু বিয়ের পরই কালীর উপর শারীরিক নির্যাতন করতে থাকে। এরই মাঝে তাঁর একটি সন্তান হয়। তাঁর স্বামী সন্তান ও তাঁর খরচ তত দিতই না, উলটে দেহ-ব্যাবসা করে অর্থ উপার্জনের জন্য চাপ দিত। কালীর পেটে দ্বিতীয় সন্তান, তখন তাঁর স্বামী তাঁকে ছেড়ে চলে যায়। এই বিপদে কেউ তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। কালী সন্তান পেটে নিয়ে দেহ-ব্যাবসায় চলে আসে তাঁর সন্তান আর নিজের খাবার জোগাড় করেছে। মাঝে এই পেশায় বিরতি দিয়েছিল দ্বিতীয় সন্তান প্রসবের কারণে। এরপর পুনরায় পেশায় ফিরে আসে। কাজে আসার সময় তাঁর বাচ্চাদের এক পিসির কাছে রেখে আসে। প্রতিবেশীরা জানত কালী গার্মেন্টসে কাজ করে।
কেস স্টাডি–চার : নাম হামিদা। বয়স ৩৫। এক সন্তানের মা। ১৫ বর্ষীয় সেই সন্তান হামিদার মায়ের সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে থাকে। হামিদা বিধবা। স্বামী পুলিশের চাকরি করত। নয় বছর আগে তিনি মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পরে হামিদার উপর খুব নির্যাতন করত শ্বশুরবাড়ির লোকজনেরা। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে হামিদা তাঁর বাপের বাড়িতে চলে আসে সন্তানকে নিয়ে। তাঁর ও তাঁর সন্তানের দায়িত্ব ভাইয়েরা নেয়নি। এমতাবস্থায় হামিদা ধারকর্জ করে দিন গুজরান করতে থাকে। কিন্তু হামিদা কোনো ধারই শোধ দিতে পারেনি। ফলে একটা সময় কেউই আর ধার দিতে চায় না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হামিদা মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে চলে আসে ঢাকার মাসির বাড়ি। সেখান থেকে এক বাড়িতে গৃহকর্মী হিসাবে কাজ নেয়। সেখানে হামিদা প্রায়ই গৃহকর্তা ভাইয়ের দ্বারা যৌনলালসার শিকার হতে থাকে। এ ঘটনা জানাজানি হয়ে গেলে গৃহকত্রী হামিদাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেয়। মাসির বাড়ি ফিরে এলে এক মাস সেখানে থাকার পর সেই মাসি সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে গণিকাবৃত্তিতে ঢুকিয়ে দেয়। হামিদার পরিচিত-পরিজনেরা জানত সে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কাজ করে। থাকত আজিমপুর বস্তিতে। সে দুপুর ২/৩ টায় উদ্যানে আসত রাত পর্যন্ত কাজ করত এবং সকাল ৭/৮ টা নাগাদ বাড়ি ফিরত।
কেস স্টাডি–পাঁচ; নাম নাজমা। বয়স ২৯। পরিবারে তাঁর স্বামী ও দুই সন্তান। থাকেন আজিমপুর বস্তিতে। স্বামী অসুস্থ বলে কোনো কাজকর্ম করতে পারে না। স্বামী অসুস্থ হওয়ার পর নাজমা সংসারের সব দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নেয়। কাপড়ের ব্যাবসা শুরু দেয়। কিন্তু কাপড়ের ঠিকমতো না জানায় কাগজ কুড়োনোর কাজ নেয়। এতসব করেও অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসার খরচ আর সংসার চালানো একবারেই সম্ভব হচ্ছিল না। এরপর বাধ্য হয়েই গণিকাবৃত্তিতে যোগ দেয়। টানা তিন বছর সে এই কাজ করেছে। গণিকাবৃত্তি করে স্বামীর চিকিৎসা, সংসার চালানো, শ্বশুর-শাশুড়ির দেখাশোনা এবং ননদকে ১০ হাজার টাকা যৌতুক দিয়ে বিয়েও দিয়েছে সে। নাজমার এই পেশার কথা শুধুমাত্র স্বামীই জানত। বাকিরা জানত সে গার্মেন্টসে কাজ করত। তবে এ কাজ নাজমার মোটেই ভালো লাগত না। ভালো না লাগার কারণ, এ পেশাকে গোপন রাখতে তাঁকে সবসময় অনর্থক মিথ্যা কথা বলতে হত। ভয়ে ভয়ে তাঁর দিন কাটত।
এ চিত্র শুধু বাংলাদেশের নয়। এ চিত্র ভারত সহ বিভিন্ন দেশে প্রায় একই। গণিকা হওয়া ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের বিষয় নয়। খুব কম গণিকাই মানসিকভাবে এ পেশাকে বেছে নেয়।
গণিকালয়ের বাইরেও বহু নারী দেহব্যাবসায়ে জড়িত। বিভিন্ন শহরে-নগরে বাড়ি ভাড়া করেও এঁরা গণিকাবৃত্তি চালায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থেকে শুরু করে গৃহবধুরাও অতিরিক্ত আয়ের জন্য এই কাজ করে থাকে। আবাসিক হোটেলে ঘর ভাড়া নিয়ে দেহব্যাবসায় করা একটি প্রতিষ্ঠিত কর্ম। এক শ্রেণির দালালের মাধ্যমে সাধারণ নারীরা খদ্দের জোগাড় করে।
বাংলাদেশে তো গণিকাদের হোম সার্ভিসও চালু আছে। বাংলাদেশের জনৈক দালাল অকপটে জানিয়েছেন–“ঢাকায় হোটেলে পুলিশের হয়রানি। ফ্ল্যাট বাড়িতে স্থানীয় হোমরাচোমরা ও মস্তানদের উৎপাত। তাঁদের বখরা না-দিয়ে নিস্তার মেলে না। তাই বাধ্য হয়েই হোম সার্ভিসে জড়িয়ে গেছি। খদ্দেরের কল পেলে বাসায় যাই।” রাজধানীর এক যৌনকর্মীর আবাসিক হোটেলে নিয়মিত যাতায়াত ছিল তাঁর। কিন্তু সেখানে কমিশন দিয়েও রেহাই ছিল না, তাঁদের অন্যান্য চাহিদায় সাড়া দিতে হত। এ অবস্থায় বাধ্য হয়েই তাঁকে বেছে নিতে হয়েছে হোম সার্ভিস। এভাবে অসংখ্য যৌনকর্মী নানাভাবে তাঁদের পেশাকে বিস্তৃত করেছে এখন। হোটেল আর রাজপথ পেরিয়ে তাঁরা যুক্ত হয়েছে হোম সার্ভিসে। তাদের এ পেশার নেপথ্যে রয়েছে শক্তিশালী দালাল চক্র। এঁরা প্রকাশ্যে চলার পথে হাত বাড়িয়ে পথিকদের হাতে ধরিয়ে দেয় তাদের ভিজিটিং কার্ড। রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেট, বাসস্ট্যান্ড, বাজার, অলিগলি ও অফিস-আদালতের সামনে দালালরা এসব কার্ড বিলি করে। যে-কোনো প্রয়োজনে ফোন দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে মুহূর্তেই জনতার ভিড়ে অদৃশ্য হয়ে যায় তাঁরা। যৌনকর্মীরা জানায়, আবাসিক হোটেলের ম্যানেজার ও বয়-বেয়ারা নির্দিষ্ট কমিশনের ভিত্তিতে খদ্দের যোগাড় করে দেয় তাঁদের। অনেক পেশাদার যৌনকর্মী অবশ্য নিজেরাই কার্ড বিলি করে। এসব কার্ডে সাধারণত মধ্যস্থতাকারীর মোবাইল নম্বর থাকে। পার্ক, ওভারব্রিজ এলাকায় তাদের তৎপরতা বেশি। আরেক কৌশল হল হারবাল চিকিৎসার নামে ভিজিটিং কার্ড বিতরণ। ফার্মগেট, শাহবাগ, কাকরাইল, মালিবাগ, মতিঝিল, সায়েদাবাদ, গাবতলি এলাকায় এ তৎপরতা বেশি। ব্যস্ততম গাড়িতে ছুঁড়ে দেওয়া হয় যৌন-চিকিৎসার নামের হ্যান্ড বিল। ওইসব চিকিৎসার আড়ালে চলে যৌন-ব্যাবসা। রাজধানীর আবাসিক হোটেলের সামনে প্রতিদিন অবস্থান করে দালাল চক্র। টার্গেট করা পথচারীকে তাঁরা ডাকে মামা বলে। কাছে এলেই ধরিয়ে দেয় ভিজিটিং কার্ড। বলে, মামা যেমন বয়সের দরকার সব ব্যবস্থা আছে। জায়গার সমস্যা হলে বলবেন। তবে রেটটা বাড়িয়ে দিতে হবে। যৌনকর্মীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের পরিচিত মানুষের মাধ্যমে বাড়িতে খদ্দের পেয়ে থাকে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ফ্ল্যাট বাড়িতে ভিআইপি যৌন-ব্যাবসা নতুন কিছু নয়। বিশেষ করে মহাখালী ডিওএইচএস, গুলশান, বনানী লালমাটিয়া, দিলু রোড, ইস্কাটন রোড, সেন্ট্রাল রোড, মোহম্মদপুর, রামপুরা, শান্তিনগর, উত্তরা, কাকলী, কালাচাঁদপুর এলাকায় এ ব্যাবসা চলছে বলে জানায় এক যৌনকর্মী। তবে ভিআইপি এলাকায় যৌন-ব্যবসা পরিচালিত হয় বিশেষ গোপনীয়তায়। সেখানে যাতায়াত করে বিশেষ ধরনের খদ্দের। মালিবাগের এক ভ্রাম্যমাণ যৌনকর্মী জানায়, ঢাকা শহরের দু-একটা স্থান ছাড়া সব জায়গাতেই এ ব্যাবসা চলছে। মোবাইল ফোন ও ভিজিটিং কার্ডের মাধ্যমে এ ব্যাবসার গতি বৃদ্ধি পেয়েছে। পেটের দায়ে যে যৌনকর্মীরা রাস্তায় নেমেছে পুলিশের হাতে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হতে হয় তাঁদের। কিন্তু ভিআইপি এলাকায় পুলিশকে সালাম দিয়েই ঢুকে যায় তাঁরা। পথচারী আলাল মিয়া জানান, তার হাতে একটি কার্ড পড়েছিল। কল করলে একজন পুরুষ রিসিভ করে। বিনয়ের সঙ্গে জানায়, আপনার ফোনের অপেক্ষায় আছেন ঢাকার বিভিন্ন কলেজ, ইউনিভারসিটির ছাত্রী ও মধ্য বয়সের মহিলা যৌনকর্মী। বলুন কী সেবা করতে পারি স্যার? তাঁর মতে, আজকাল সংসারে অশান্তি, স্বামী বিদেশে বা স্বামীর কর্মস্থল ঢাকার বাইরে এ ধরনের অনেক মহিলা হোম সার্ভিসে যোগ দিয়েছেন। ভিজিটিং কার্ডের নম্বরধারীরা সাধারণত চারটি ভাগে রাজধানীতে যৌনকর্মী সরবরাহ করে। প্রথমত, যৌনকর্মীকে ভিজিটরের বাড়ির ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া। দ্বিতীয়ত, যৌনকর্মী ও ফ্ল্যাট ভিজিটরকে নিরাপদে নিয়ে আসা। তৃতীয়ত, হোটেল ঘরে যৌনমিলনে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা এবং চতুর্থত, প্রাইভেট পরিবহন ও পার্ক।
তবে বিশেষ শ্রেণির যৌনকর্মীরা নিজের ফ্ল্যাট বাসা-বাড়িতে খদ্দেরকে আপ্যায়ন করে। একটি সূত্র জানায়, সংখ্যায় কম হলেও কেবল টাকার জন্য নয়, নিজেদের যৌনবাসনা পূরণ ও মনোরঞ্জনের জন্যও অনেক মহিলা এ কাজে নেমেছে। এমনও যৌনকর্মী আছে যাদের সন্তান বড়ো স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। সূত্র মতে, আবাসিক হোটেলের প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ ভিজিটিং কার্ডধারী যুবক এখন যৌনকর্মীদের মধ্যস্থতাকারীর কাজে লিপ্ত। ভিজিটিং কার্ডের আয় থেকে চলছে তাঁদের সংসার। কাওরান বাজারের এক হোটেল বয় জানায়, আজকাল ভদ্রঘরের মেয়েরাও যৌন-ব্যাবসার প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা নেমেছে এ পেশায়। তাঁরা বড়ো বড়ো হোটেলে যায়। তাঁদের কন্টাক্ট নম্বর কেবল হোটেলে পাওয়া যায়। ডিওএইচএস-এর এক যৌনকর্মী সম্পর্কে সে জানায়, দূরের জেলায় ব্যাবসা করে। নিঃসন্তান। প্রতি শুক্রবার স্বামী ঢাকায় ফেরে। ওই মহিলা সপ্তাহে তিন দিন আমাদের মাধ্যমে নিজের বাড়িতে খদ্দের নেয়। ভিজিটের অর্ধেক টাকা দিয়ে দেয়। বনানীর এক যৌনকর্মীর স্বামী সরকারি কর্মকর্তা। সে এক সন্তানের মা। তবুও অতিরিক্ত টাকার রোজগারের নেশায় এ পেশায় এসেছে। সূত্র খুব বিরক্তি প্রকাশ করে বলে, সে একেবারে হাড়কিপটে। জিজ্ঞেস করা হয়, মহিলার আয় কত? সপ্তাহে ২৫ হাজার টাকা। আর সে কমিশন পায় ৫ হাজার টাকা। জানতে চাওয়া হয় কতদিন ধরে মহিলা এ কাজে লিপ্ত? উত্তরে জানায়, ৪ মাস। আরেক সূত্র জানায়, হোটেলে শুধু গণিকা মেয়েরা আসে না। কেউ আসে গণিকা সেজে। খদ্দের দেখে পছন্দ হলে বাসায় নিয়ে যায়। বিনিময়ে আমাদের কিছু টাকা ধরিয়ে দেয়। তাঁর মতে এরা গণিকা নয়। স্বামীর অসংগতি, সংসারে ঝামেলা ও বিভিন্ন মানসিক কষ্টের কারণে এ কাজে তাঁরা ঝুঁকে পড়েছে। জানতে চাওয়া হয়, এই ধরনের মহিলাদের সংখ্যা? সে বলে, তার হাতে আছে ২৩ জন। প্রতিদিন পালাক্রমে তাঁদের খদ্দের পাঠাতে হয়। এঁরা ‘ভাবী’ নামে পরিচিত। এই ‘ভাবী’দের ভিজিট কেমন? ঘণ্টা প্রতি ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। তবে সুদর্শন পুরুষ তাঁদের বেশি পছন্দের। তাঁদের জন্য ডিসকাউন্ট আছে। এ সূত্রটির মাসিক আয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। এক যৌনকর্মী জানায়, সে ঢাকায় এসেছে স্বামীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে। প্রতিবেশী ভাবীর সঙ্গে পরিচয়ের পর তাঁর উৎসাহে এ পেশায় এসেছে। অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর শতাধিক খদ্দের জুটে গেছে। এক ডাকে সবাই তাঁকে চেনে। পুলিশ তাঁর জন্য কোনো সমস্যা নয় বলে জানায়।
বাংলাদেশের গণিকাবৃত্তিতে নারীদের পাশাপাশি পুরুষদেরও পাওয়া যায়। নারীদের গণিকাবৃত্তিতে সাহায্য করতে স্বামী পরিচয়ে পুরুষ ভাড়াও পাওয়া যায়। ঢাকার বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে যৌনকর্মীদের আনাগোনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ওইসব যৌনকর্মীরা এখন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ফ্ল্যাট বাড়ি ভাড়া নিয়ে দেহ-ব্যাবসা শুরু করেছে। বাড়ি ভাড়া নিতে গেলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্বামী ছাড়া বাড়ির মালিক বাড়ি ভাড়া দিতে চান না। বাড়ি ভাড়া নেওয়ার ওই প্রতিবন্ধকতার কথা চিন্তা করে যৌনকর্মীরা তাঁদের পূর্বপরিচিত কোনো পুরুষকে স্বামী হিসাবে ভাড়া করেন। বাড়ি ভাড়া করার সময় সঙ্গে থাকেন ভাড়াটে স্বামী। দেখা গেছে, বাড়ি ভাড়া নেওয়ার সময় বাড়ির মালিককে বলা হয় স্বামী নিয়মিত ঢাকায় থাকে না, বাইরের কোনো জেলায় চাকরি বা ব্যাবসা করে। একই সঙ্গে বলা হয়, বাসায় নিয়মিত থাকবে তাঁর স্ত্রী ও দুই বা তিন বোন। ওই বোনদের থাকার কথা বলে বৈধ করে নেওয়া হয় আরও দুই-তিনজন যৌনকর্মীকেও। এভাবেই ঢাকা শহর জুড়ে ফ্ল্যাট বাড়িগুলোতে চলছে যৌন-বাণিজ্য।
শনির আখড়ার সোহান (ছদ্মনাম) বরিশাল থেকে অভাবের তাড়নায় ঢাকায় আসেন। এসএসসি পাস নয়, তাই কোনো চাকরি দিতে চাইছে না কেউ। এরই মধ্যে দেখা মিলে ছিনতাইকারী কাজলের সঙ্গে। নিরূপায় হয়ে তাঁর সঙ্গে যোগ দেয় সংসদ ভবন এলাকায় ছিনতাইয়ের কাজে। পরিবর্তন করে ফেলে নিজের বংশ-পরিচয়ও। এরই মধ্যে পরিচয় হয় স্বামী পরিত্যক্তা রূপার (ছদ্মনাম) সঙ্গে। তখন তিনি একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে। চাকরির পাশাপাশি যৌন-ব্যবসায় লিপ্ত ছিলেন।
সিদ্ধান্ত হয় স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে দুজন রাজধানীর শনির আখড়ায় বসবাস করবেন। এরপরই বিউটি পার্লার ব্যাবসার আড়ালে রুপা শুরু করে জোরালো যৌন-ব্যাবসা। বিধি বাম, এলাকার দুষ্ট বেরসিক ছেলেরা জেনে যায় সোহান-রূপা আসলে স্বামী-স্ত্রী নয়। দুজনের এই অবাধ বসবাসে বাদ সাধে তাঁরা। দুজনকেই বাধ্য করে সত্যিকারের বিয়েতে। এছাড়াও সোহান রাজধানীর শান্তিনগর, বাড্ডা, ফার্মগেট এলাকাসহ ৮/৯টি জায়গায় যৌনকর্মীদের স্বামী পরিচয়ে বাসা ভাড়া নিয়ে নিজে রোজগার করছেন মোটা অঙ্কের টাকা। আর মাঝে মধ্যে খদ্দের জোগাড় করে দিলে তাঁর কমিশন তো আছেই।
রাজধানীতে তিন ধরনের কাজের জন্য মহিলাদের স্বামী পরিচয়ে পুরুষ ভাড়া করার ক্ষেত্র চিহ্নিত করা গেছে। বিশেষ করে যৌন-ব্যাবসার সঙ্গে জড়িত নারীরা বাড়ি ভাড়া নেওয়ার সময় স্বামী হিসেবে লোক ভাড়া করে বাড়ির মালিককে দেখিয়ে থাকেন। এনজিওসহ বেশকিছু মাল্টিপারপাস কোম্পানি থেকে ক্ষুদ্রঋণ নেওয়ার শর্ত হিসাবে স্বামীর পরিচয় ও তাঁর ছবি ব্যবহার করতে স্বামী ভাড়া করেন। এছাড়া, সাম্প্রতিককালে পাসপোর্ট অফিসে কোনো মহিলা স্বামী ছাড়া একা গেলে তাঁকে স্বামীর উপস্থিতি দেখানোর প্রয়োজনে স্বামী ভাড়া করে আবার স্বামী নিয়ে আসার ঝামেলা থেকে মুক্ত হতে হয়।
১৯৯৭ সালে স্থানীয় কমিশনার এক সময়ের কান্দুপট্টির অধিপতি হোসেন মোল্লার নেতৃত্বে তথাকথিত পঞ্চায়েত কমিটি নামে একটি সংঘবদ্ধ চক্র সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্র ইংলিশ রোডে কান্দুপট্টির গণিকাদের উপর অতর্কিতে হামলা চালিয়ে গণিকালয়ে অবস্থানরত নারী ও শিশুদের উচ্ছেদ করেছিল। তাঁদের উপর নির্মম নির্যাতন চালায় এবং গণিকাদের সারাজীবনের সঞ্চিত সম্পদ লুটপাট নিয়ে যায়। উচ্ছেদকৃত মমতাজ বেগম নামে জনৈক গণিকা উচ্ছেদকৃত যৌনকর্মীদের একত্রিত করে ‘পতিতা সংগ্রাম পরিষদ’ নামে একটি কমিটি গঠন করে প্রেসক্লাবে অবস্থান শুরু করে। এই সংগ্রাম পরিষদকে সামনে রেখে নারীপক্ষ এবং বেশ কিছু মানবাধিকার সংগঠন মিলে সংহতি প্রকাশ করে এই আন্দোলনের সঙ্গে যোগ দেয়। ১০ টি নারী ও মানবাধিকার সংগঠন মিলিতভাবে কান্দুপট্টি নারী ও শিশু সংহতি পরিষদ’ নামেও একটি কমিটি গঠন করে। নারীপক্ষের উদ্যোগে কালুপট্টি থেকে উচ্ছেদকৃত যৌনকর্মীদের নিয়ে আরও একটি সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা হয় এবং বাংলাদেশে প্রথম ‘উল্কা নারী সংঘ’ বিভিন্ন কাজ করে আসছে। অন্যদিকে ‘কেয়ার’ এইচআইভি/এইডসের কাজ করতে গিয়ে ঢাকায় ভাসমান যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করছে। নারী মৈত্রী এবং বিডাব্লিউএইচসি যৌনকর্মীদের সঙ্গে অনুরূপ প্রকল্প চালাচ্ছিল।
দুর্জয় নারী সংঘ, উল্কা নারী সংঘ, মুক্তি নারী সংঘ, টানবাজার ও নিমতলী যৌনকর্মীদের বাংলাদেশ সরকারের কাছে যে দাবিগুলি জানিয়েছে, তা হল–(১) পুনর্বাসনের নামে উচ্ছেদ বন্ধ করতে হবে, (২) যৌনকর্মীদের বর্তমান বাসস্থানে রেখে উন্নয়ন কর্মসূচি নিতে হবে, যেমন–শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি, (৩) সরকারকে যৌনকর্মীদের উন্নয়ন কর্মসূচি পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে যৌনকর্মী ও মনবাধিকার ও নরী আন্দোলনের কর্মীসহ সকলকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, (৪) যে কারণে এবং প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একজন নারী যৌনকর্মী হয়, সরকারকে সকল কারণগুলি চিহ্নিত করে প্রতিরোধক ব্যবস্থা নিতে হবে, (৫) যেসব দালাল, পাচারকারী সহ জড়িত সকল লোকজন, যাঁরা গোটা প্রক্রিয়ার জড়িত তাঁদের চিহ্নিত করতে হবে এবং আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে, (৬) যেসব যৌনকর্মীকে পুনর্বাসনের নামে তাঁদের বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে বা হচ্ছে তাঁদের বাসস্থান ও জীবিকার ব্যবস্থা করতে হবে, এবং (৭) পুনর্বাসনের নামে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা বন্ধ করতে হবে।
মূলত উচ্ছেদের পর যৌনকর্মীদের জোরপূর্বক ভবঘুরে কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু গণিকারা তো কেউ ভবঘুরে নয়! তাঁদের ভবঘুরে কেন্দ্রে নেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট আইন আছে? গণিকাদের ভবঘুরে কেন্দ্রে নেওয়ার ব্যাপারটি সম্পূর্ণভাবে বেআইনি। ১৯৯৯ সালে ৩১ জুলাই পুনর্বাসনে অনাগ্রহী গাজিপুরের কাশিমপুর ভবঘুরে কেন্দ্রে স্থানান্তরিত যৌনকর্মীরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ২২৭ জন যৌনকর্মী বন্দিদশা থেকে মুক্তির জন্য দুপুরে খাবার গ্রহণ না করে বিক্ষোভে অংশ নেন। এমনকি মুক্তি না-দিলে যৌনকর্মীরা আত্মহত্যার পথ বেছে নেবে বলে হুমকি দেয়। যৌনকর্মীদের নেত্রী সাথী বলেন, “মুক্তি না-দিলে তাঁরা কেন্দ্রের ভিতর আগুন জ্বালিয়ে দেবে। গাছ থেকে লফিয়ে বা গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেবে। ওইদিন কেন্দ্রে এলেই আপনারা লাশ দেখবেন।”
বাংলাদেশে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। এখানে প্রায়শই যৌনকর্মীদের অমানুষিক পুলিসি নির্যাতন নেমে আসে। মাঝেমাঝেই পুলিশের সঙ্গে যৌনকর্মীদের খণ্ডযুদ্ধ বেধে যায়। চলে গুলি, কাঁদানে গ্যাস, লাঠিচার্জ। চলে গণিকাদের শ্লীলতাহানি, ধর্ষণও। রাতের অন্ধকারে যৌনকর্মীদের কোলপাঁজা করে বাসে তোলা হয়। টানাহ্যাঁচড়ায় যৌনকর্মীদের শরীর থেকে কাপড় খুলে পড়ে। সঙ্গমকালীন পুলিশের রেইড হওয়ার কারণে। পতিতারা নগ্ন হয়েই রাতভর দৌড়াদৌড়ি করে ছুটে পালায়। নারী সংগঠনের জনৈক নেত্রী সুফিয়া কামাল স্পষ্টত ক্ষোভ উগড়ে জানান–সমাজে অনেক ধনীঘরের মেয়েবউরাও গণিকাবৃত্তি করে। প্লেনে করে নামে, প্লেনে করে চলে যায়। তাঁদের নিয়ে তো কেউ মাথা ঘামাতে সাহস পায় না? এই গরিব মেয়েগুলোর উপর। কেন এত অত্যাচার করা হবে? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোক পুলিশ, সেই পুলিশই এঁদের পেটায় বেশি।”
১৭. পুরুষ যৌনকর্মীর বাজার
নারী-শরীর বিক্রির বাজার আছে, সেই বাজারে বিক্রিও বেশি। নারী যৌনতার জন্য শরীর বিক্রি ভাবলেই তাঁর বাজার সর্বদাই মজুত। বাজার ছোটো হলেও পুরুষ-শরীরও বিক্রি হয়। আকাশচুম্বী বেকারত্বের মোকাবিলা করতে যৌনপেশাই এখন একটা পথ অবশ্যই। বাজারে বেশিরভাগ অর্থ পুরুষদের হাতে। তাই নারী-শরীর কেন, সেই পুরুষ পৃথিবীর সবকিছুই কিনে নিতে পারে যে-কোনো মূল্যে। যেহেতু অর্থবান নারীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অত্যন্ত কম, সেইহেতু পুরুষ-শরীরের বাজার তেমন রমরমিয়ে উঠতে পারেনি। তবে নারী যত বেশি বেশি করে আর্থিক বাজারের সঙ্গে যুক্ত (স্বাধীনভাবে বা পরাধীনভাবে, যেভাবেই হোক) হবে, ততই পুরুষ-যৌনকর্মীদের বাজার চাঙা হবে। তবে বর্তমানে ধনীঘরের এক শ্রেণির মহিলারা স্বামীর অর্থে পুরুষ যৌনকর্মীর কাছে যৌনসুখ কিনছে।
আসুন, এবার পুরুষ যৌনকর্মীদের হালহকিকৎ জানার চেষ্টা করি। পুরুষ যৌনকর্মীদের ‘গণিকা’ বা ‘বেশ্যা’ বা ‘পতিতা’ বলা যাচ্ছে না। কারণ এই বিশেষণগুলির সবকটাই স্ত্রীলিঙ্গ। বর্তমানে একটি নতুন বিশেষণ চালু হয়েছে, সেটি হল ‘যৌনকর্মী’ (Sex Worker)। এটি একটি ইউনিসেক্স পরিচয়। এই পরিচয়ে মহিলা, পুরুষ, সমকামী সকলেই অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। ব্যাপারটা আর লিঙ্গভিত্তিক থাকল না।
প্রত্যেকদিন সাহসী হচ্ছে বিশ্ব। আসলে নতুন কিছুই নয়–নগ্ন হয়ে জীবনযাপন করা থেকে শুরু করে বিবাহ বহির্ভূত যৌনতা এবং যৌনপেশা। সবই ছিল, সবই আছে এবং সবই থাকবে। ভণ্ডামির মধ্যেও থাকবে। যৌনতার ক্ষেত্রে তো অবশ্যই। আর এক্ষেত্রে মহিলাদের পাশাপাশি পুরষরাও আসছে যৌনপেশায়। গণিকাবৃত্তি মহিলাদের জন্য আর একচেটিয়ে থাকছে না। মহিলাদেরও প্রয়োজন হচ্ছে পুরুষ যৌনকর্মীদের সঙ্গ। অতৃপ্ত দাম্পত্য অথবা অতি দেরিতে বিয়ে করার বা হওয়ার কারণেই এই প্রয়োজনীয়তা। বিশেষত বিশ্বের প্রথম দেশগুলিতে তো বটেই। তৃতীয় বিশ্বের মহিলারাও যৌনতার সুখ খুঁজতে পুরুষ যৌনকর্মী ভাড়া করে জীবন উপভোগ করা শুরু করেছে। Women who pay for Sex’ শিরোনামে বিবিসি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এমনটাই বলা হয়েছে। সাংবাদিক হান্নাহ বারনেসের লেখা ফিচারধর্মী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্রিটেনে এমন অনেক মহিলা আছেন যারা বার কিংবা নাইট ক্লাবে গিয়ে পুরুষ সঙ্গী খোঁজা পছন্দ করেন না। যৌনতা উপভোগের জন্য তাঁরা ‘এসকর্ট এজেন্সির সাহায্য নেন। এসব এজেন্সির কাছে ফোনে এসকর্ট চাইলেই তাঁরা মহিলা ক্লায়েন্টদের শোওয়ার ঘরে পুরুষ ‘এসকর্ট’ পৌঁছে দেয়। এইসব মহিলা সাধারণ নিজের বয়সে চেয়ে অনেকটা কম বয়সি যুবকদের সঙ্গী হিসাবে পছন্দ করে। এতে বেশ একটা অজাচার (Incest) ফিলিংসও আসে।
ইংল্যান্ডের ওয়েস্ট মিডল্যান্ডের একটি বিলাসবহুল এসকর্ট এজেন্সির মালিক নিকোল। মহিলাদের জন্য তিনি একটি বিলাসবহুল এবং বড় আকারের বাংলো তৈরি করে রেখেছেন। যেটি শহর থেকে প্রায় অনেকটাই দূরে! এই বাড়ির ভিতরে কী চলছে সেটা বাইরে থেকে কোনোভাবেই বোঝার উপায় নেই। নিকোল জানান, “মহিলা ক্লায়েন্টরা নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতে চান। এটা তাঁদের নিজস্ব পৃথিবী, এই গোপনীয়তা তাঁদের জীবনেরই অংশ।” পুরুষ যৌনকর্মীরা জানেন তাঁদের কাছে আসা মহিলারা অবিবাহিত বা একাকী নন। এমনই একজন পুরুষ যৌনকর্মী জানাচ্ছেন, “কিছু মহিলা মনে করেন যৌনতার জন্য অর্থ ব্যয় কোনো অপরাধ নয়। এটি প্রেম বা অন্যান্য সম্পর্কের মতোই স্বাভাবিক ব্যাপার।” যেসব মহিলার বয়ফ্রেন্ড বা স্বামী আছে, তাঁদের জন্য বারে কিংবা অন্য কোনো প্রকাশ্য জায়গায় অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গ খুবই বিপদজ্জনক। নিকোলের মতে, ‘তাঁদের জন্য এমন জায়গা দরকার যেখানে প্রতিবেশী বা পরিচিত কেউ তাদের দেখে ফেলবে না। সেজন্যে তাঁর তৈরি বাড়ি ইতিমধ্যে বেশ জনপ্রিয়। অনেক মহিলাই আসেন, যাঁরা যৌনসুখ খোঁজেন। সেরা যৌনসুখটির খোঁজে তাঁরা যথেচ্ছ অর্থ ব্যয় করে, চলে অবাধ যৌনতা। সেরা যৌনসুখের অনেক ভাগ্যবতী মহিলাদের অর্থও ব্যয় করতে হয় না। কোনো পছন্দের পুরুষকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে সেই পুরুষটির সঙ্গে স্বেচ্ছায় অবাধ যৌনসঙ্গম করে নেয়। বিনিময়ে প্রেমের আকুতি, ভালো-মন্দ উপহার, প্রয়োজনে কিছু আর্থিক সাহায্য, একে অপরের সুখ-দুঃখ শেয়ার করা ইত্যাদি। এক্ষেত্রে একটু বেশি বয়সের মহিলারাই নতুন এক আইডেন্টিটি খুঁজে পায়। এই ভেবে আত্মশ্লাঘা বোধ করে যে, সে এখনও নিঃশেষ হয়ে যায়নি। এইভাবে এসকর্ট সার্ভিসে না জানিয়ে একজন বিশ্বস্ত ও বিশ্বাসী পুরুষের সঙ্গে নিজের যৌন চাহিদা মিটিয়ে নেয়। তবে এই শ্রেণির মহিলারা যেমন বেশি বয়সের হয়, তেমনি সম-বয়সের পুরুষ-সঙ্গীও খুঁজে নেয়।
মধ্য চল্লিশের নিঃসঙ্গ মহিলা হন কিংবা যৌনসুখে আসক্ত যুবতী–যে কেউ হতে পারে পুরুষ যৌনকর্মীর ক্লায়েন্ট। এইসব মহিলারা নিভৃতে ও গোপনে যৌনসুখ পেতে পুরুষ যৌনকর্মীদের ‘কল’ করে। সময়-দিন চূড়ান্ত করে পুরুষ যৌনকর্মী নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলে চলে আসে। কোনো কোনো পুরুষ যৌনকর্মীর এটাই একমাত্র পেশা, কেউ কেউ আবার অন্য পেশায় যুক্ত থাকলেও বাড়তি রোজগারের জন্যেও আসে। কেউ অবিবাহিত, কারোর-বা স্ত্রী-সন্তানও আছে। মোটা অঙ্কের রোজগারের জন্য অথবা স্রেফ স্ফুর্তির জন্য অথবা উভয়রেই জন্য এ পেশায় আসার সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে। এখন যেন নেশায় পরিণত হয়েছে। জিগোলো বা কলবয়ের পেশায় আসছে স্কুল-কলেজের ছাত্ররাও। আগেই বলেছি মধ্যবয়সি মহিলাদের কাছে কম বয়সি পুরুষদের চাহিদা বেশি। অজাচারের সুপ্ত ইচ্ছাটাও পূরণ হয় এতে। এক্ষেত্রে পুরুষ যৌনকর্মীদের কাছে ক্লায়েন্টের বয়স যত বেশি হয় রেটও তত বেশি হয়। অবাক হবেন না, পুরুষ যৌনকর্মীদের মুখ থেকেই শোনা যায়, ১৭ থেকে ৭০ সব বয়সি মহিলারা ক্লায়েন্ট হয় তাঁদের। এমনকি মায়ের বয়সি প্রৌঢ়া মহিলাদের সঙ্গেও যৌন-সম্পর্ক করতে হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনৈক পুরুষ যৌনকর্মীর অভিজ্ঞতা বলছে–“একবার কিছুদিনের জন্য এক মহিলার স্বামীর ভূমিকায় থাকতে হয়েছিল। আবার আলিপুরের এক মহিলার স্বামী আমাকে ভাড়া করে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরই স্ত্রীর জন্য। ভদ্রলোক অসম্ভব পয়সাওয়ালা, কিন্তু যৌনতায় অক্ষম। তাই স্বামী-স্ত্রীর সমঝোতায় এই ব্যবস্থায় এসেছিলেন। ভদ্রলোকের একটাই শর্ত ছিল–তাঁর সামনেই তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে কাজ করতে হবে। আর একটি ক্লায়েন্টের কথা বলি। এখানেও স্বামীর সামনে স্ত্রীর সঙ্গে কাজ করতে হয়েছিল। এক্ষেত্রে ক্লায়েন্ট ছিল সরাসরি মহিলাটিই। প্রৌঢ়া মহিলা, তবে বেশ সুন্দরী এবং আকর্ষণীয়। মহিলাটিই আমাকে কল করেছিলেন। যেদিন কাজ করতে গিয়েছিলাম সেদিন দেখলাম ওনার স্বামী বেডরুমে উপস্থিত ছিল। এই সময়ে ওই মহিলাটি কাজ শুরু করতে বলে। ঘরে অন্য এক তৃতীয় ব্যক্তির (যে কিনা ওনার স্বামী) উপস্থিতিতে বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল আমার। স্বামীটিই আমার অস্বস্তি কাটিয়ে দিয়ে আমার ডান হাতটা ওর স্ত্রীর একটি স্তনের উপর চেপে ধরল। আমি বুঝলাম ওনার সামনেই কাজটা করতে হবে। একটা সময় ওই ভদ্রলোক আমার প্যান্ট খুলে উলঙ্গ করে দিলেন এবং আমার পেনিসটি মুখে নিয়ে ওরাল করতে থাকল। তারপর একটা সময় উনিই বললেন এবার দিয়ে দাও। আমি নির্দেশ পালন করলাম। পরে আরও কয়েকবার যেতে হয়েছিল, ওই মহিলার সঙ্গে কাজ করতে হয়েছিল। তবে এই ভদ্রলোক যৌনতায় অক্ষম ছিল কি না কোনোদিন জানা হয়নি। একবার বেশ বড়োলোক বাঙালি বাড়ির ২৪-২৫ বছরের ছেলে তাঁর মধ্যবয়সি মায়ের জন্য আমাকে ভাড়া করেছিল। অবশ্যই মায়ের সম্মতিতেই। অত্যন্ত সুন্দরী ছিলেন সেই ভদ্রমহিলা। এক বয়স্ক মহিলা আমার ক্লায়েন্ট ছিল, তিনি তাঁর বিধবা মেয়ের জন্য আমাকে ভাড়া করতেন।
“শুধু সিঙ্গল বেড পার্টনার নয়, পুরুষ যৌনকর্মীদের ডাক পড়ে গ্রুপ সেক্স বা কাপল সেক্সের জন্যেও। গ্রুপ সেক্স মানে একটি সিটিংয়ে তিন-চার বা তারও বেশি বিভিন্ন বয়সি বা সমবয়সি মহিলাদের সঙ্গে কাজ করতে হবে। এক্ষেতে পারিশ্রমিকও বেশ ভালো পাওয়া যায়। তবে এক্ষেত্রে বলতে গেলে আমাকে কিছুই করতে হয় না। যা করার ওরাই সমবেতভাবে করে। এরা পরস্পর পরস্পরের পরিচিত হয়ে থাকেন। নিজেদের মধ্যে বোঝাবুঝিও খুব মসৃণ। কাপল সেক্সটা হল স্বামী-স্ত্রী যৌথভাবে কোনো একজন পুরুষ যৌনকর্মীকে ভাড়া করেন। সেক্ষেত্রে একজন কলগার্লকেও নিয়ে যেতে হয় ওই পুরুষ যৌনকর্মীকে। হবে পার্টনার সোয়াপিং। পুরুষ যৌনকর্মীটি মহিলার (স্ত্রী) সঙ্গে এবং মহিলা যৌনকর্মীটি পুরুষের (স্বামী) সঙ্গে। অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী উভয়ই যৌনকর্মীর সঙ্গে যৌনসঙ্গম করবে। হাই প্রোফাইল মহিলারা চাকরি বা ব্যাবসায় সূত্রে আসেন নামীদামি হোটেল-রিসর্টে। এই মহিলাদের কেউ ডমিনেটিং, কেউ প্রচণ্ড কামার্তা, কেউ বিকৃতকামী।” অভিজ্ঞতার কথাগুলো বললেন নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক জনৈক পুরুষ যৌনকর্মী।
পুরুষ যৌনকর্মীরা বিবিসি-কে জানার, মহিলারা নানা কারণেই যৌনতার জন্য অর্থ ব্যয় করতে চান। যৌনতায় আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়া, নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা ইত্যাদি। এছাড়াও কর্পোরেট মহিলারা সময়ের অভাবে তাঁদের স্বামীর সঙ্গে মিলিত হতে পারে না। ফলে তাঁরাও এই বাড়িতে আসেন কিংবা ডেকে নেন তাঁদের নিরাপদ স্থানে। ইতিমধ্যে ব্রিটেনে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে এই পরিসেবা। পুরুষরাও আসছেন এই পেশায়। নিকোল জানাচ্ছে, “ইংল্যান্ডে বেকারত্ব সমস্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন ঘণ্টাপ্রতি ৬০ পাউন্ডেও পুরুষ যৌনকর্মী ভাড়া পাওয়া যায়। যা কিনা ভারতীয় মুদ্রায় মাত্র সাড়ে ৫ হাজারের মতো। গড়পড়তায় ঘণ্টায় সর্বনিম্ন ১০০ থেকে ১৫০ পাউন্ড খরচ করলেই মিলবে কাঙ্খিত যৌনসুখ।”
পুরুষদের এসকর্ট সার্ভিস এখন সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে পড়েছে। ভারত, বাংলাদেশ কোনো দেশই বাদ নেই। আছে এই কলকাতাতেও। তবে প্রকৃত এসকর্ট সার্ভিসে চেয়ে প্রতারক এসকর্ট সার্ভিসই বেশি গজিয়ে ওঠেছে। প্রতারক এসকর্ট সার্ভিসগুলি থেকেই জানা যায় আগ্রহী পুরুষ যৌনকর্মীর সংখ্যা যথেষ্ট বাড়ছে। সেসব আগ্রহী পুরুষরা অনেকক্ষেত্রেই ভুয়ো এসকর্টের খপ্পরে পড়ে অর্থদণ্ড দেয়। পুরুষ এসকর্ট সার্ভিস থেকে কীভাবে পুরুষ। যৌনকর্মী আহ্বান করা হয়? একটা নমুনা দিলাম। বিধিবদ্ধসতর্কীকরণ : উল্লেখিত বিজ্ঞাপন থেকে কেউ যোগাযোগের চেষ্টা করবেন না। যদি করেন, তা নিজ দায়িত্বে। লেখক কোনো দায় নেবে না। কারণ এই বিজ্ঞাপন যাচাই করা হয়নি। দেখুন–WELCOME TO GIGOLO CLUB (ALL OVER INDIA)
INFO:
Become a Gigolo!! We require looking, young boys for satisfying our female clients . It is a good income source with enjoyment. You can earn up to 25,000/- per meeting.
Enjoy your time with women, satisfy them, and what’s more, get paid for it!! We are so excited to launching this club and look forward to the positive effects it will have on so many peoples lives.
Why Gigolo Club is Best for you :–
1) low membership fee
2) only one time membership
3) privacy is assured
4) 100% safe
5) no need of your real name
6) you can use nick name
7) no need of photos
Membership plans:
1) SILVER PLAN—
-Rs 1000/- lifetime .
–4 clients in month
–only short time service
2) GOLDEN PLAN :-
-Rs 3000/- only lifetime-
-unlimited clients
( daily service available)
–short time and full night service available
Membership fee is for that to see only serious guys will join otherwise all beggars will join freely.
JOINING PROCEDURE :
1) choose membership plan.
2) pay membership fee.
3) then send screen shot or transaction id
3) send your city and nick name.
4)after 2 hours you will start your work.
PAYMENT OPTIONS :
- Paytm
880046**39
- Account Transfer
A/C NO: 918010087578961
IFSC CODE: UTIB0000589
3)google pay 730366**18
4) Phone pay 730366**18
Send transaction slip after payment.
NOTES :
1) If you are agree to above terms and condition, then ask more questions. Otherwise stay away.
2) without membership we can’t give you work.
3) without membership we cant meet anywhere.
4) due to privacy, we dont have a office .
5) don’t ask for deduction of membership free from your earnings, because clients will directly pays you money.
6) no photo sharing without membership
Thanks and Regards
Thanks.
এতক্ষণে আপনি নিশ্চয় ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন যে, পুরুষদের যৌনপেশায় আসাটা হাল-আমলের, একটা নতুন ট্রেন্ড। না, নতুন ট্রেন্ড বা হাল-আমলের মোটেই নয়। গোপনে হলেও বহু প্রাচীনকাল থেকেই পুরুষরা যৌনপেশার সঙ্গে যুক্ত ছিল। বর্তমানে যেটা ছড়িয়ে পড়েছে। প্রথম পুরুষ যৌনকর্মী মোটামুটি দুই ধরনের–এক ধরনের পুরুষ যৌনকর্মী, তাঁরা মহিলা ক্লায়েন্টদের সঙ্গে অর্থের বিনিময়ে যৌনসঙ্গম করে। এবং আর-এক ধরনের পুরুষ যৌনকর্মীরা হল তাঁরা কেবলমাত্র পুরুষদের সঙ্গে অর্থের বিনিময়ে যৌনসঙ্গম করে, এঁদের সাধারণত ‘টপ’ (Top) বলে। অর্থাৎ যেসব পুরুষ যৌনবৃত্তি করে, তাঁদের ইংরেজিতে বলা হয় জিগোলো (GIGOLO)। জিগোলো শব্দটির অর্থ, কোনো মহিলাকে পুরুষের সামাজিক সঙ্গ দেওয়া। তবে কেবলমাত্র আক্ষরিক অর্থে সীমাবদ্ধ নয় জিগোলো। যেসব পুরুষ সমকামী নয়, কিন্তু সমকামী পুরুষদের জন্য কাজ করে, তাদেরকে জিপি (গে ফর পে) নামে ডাকা হয়। সাধারণত এই পেশায় জড়িত সকল পুরুষদেরই পেশাদারি নাম ‘পুরুষ বেশ্যা’ বা ‘পুরুষ পতিতা’।
পুরুষ যেখানে শাসক, সেখানে তাঁদের যৌনসম্ভোগ মেটায় যে কর্মীরা, তাঁদের নারীই হতে হবে। সেই তো স্বাভাবিক গতানুগতিক শুধু নারী-পুরুষে যৌন-সম্ভোগীদের জন্যে। কিন্তু সেই নগরবধূদের জায়গায় যদি রাতে নেমে আসে লিঙ্গধারী সদস্যরা! কী নামে ডাকবেন তাদেরকে? নগরবধূর বিপরীতে নগরস্বামী? ইংরেজি ভাষায় বেশ কিছু ডাকনাম আছে, যার বেশিরভাগ অকথ্য। যেমন—জন (John), এসকর্ট (Escort), রেন্ট বয় (Rent Boy), মডেল (Model), ম্যাসার (Masseur, হাসল (Hustler), ট্রিক (Trick), টার্নিং ট্রিক (Turning Trick), জিগোলো (Gigolo) প্রভৃতি। কিন্তু প্রমিত বাংলা ভাষায় ‘পুরুষ বেশ্যা’ শব্দ ছাড়া কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। তবে ভাষায় লিঙ্গের প্রভেদ সংকুচিত করার উপায়ান্তরে এবং পেশাগত দিক বিবেচনায় যারা প্রত্যক্ষ যৌনশিল্পে জড়িত, তাঁদেরকে বলা হয় যৌনকর্মী।
ছুটির দিনে এদের অনেকেই মোটা অর্থে অনেক নারীর সঙ্গী হয়, তাই তাঁরা ‘Escort’। সহযাত্রী, রক্ষী, অনেকে এদেরকে ডাকে ‘রেন্ট বয়’ বা ‘কলবয়’ নামে, নারীর ক্ষেত্রে যেমন বলা হয় ‘কলগার্ল’। এঁদের অনেকের নিজস্ব পছন্দ আছে, আগে থেকেই জানিয়ে দেয় নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দগুলো। যেমন—ভালো গাড়ি চড়াতে হবে, ভালো হোটেল বা কটেজে রাখতে হবে, এইসব বিভিন্ন পেশাদারি আবদার। যেসব পুরুষ যৌনকর্মীরা পথের। উপর অপেক্ষা করে, তাঁদেরকে বলা হয় জন(John), ট্রিক বা টার্নিং ট্রিক। মডেল, ম্যাসার এবং হাসলার—এই ত্রয়শব্দ কখনো-কখনো নজর কাড়ে। কিন্তু সরাসরি এই শব্দগুলো পুরুষ যৌনকর্মীদের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যায় না। কেউ কেউ মডেলিং এবং ম্যাসাজের পাশাপাশি যৌন-ব্যাবসায় লিপ্ত হয়, কিন্তু তাই বলে সবাইকে এর অন্তর্ভুক্ত করাটা যুক্তিসংগত নয়। সমাজের অনেকেই একসঙ্গে দু-ধরনের পেশায় সংলিপ্ত থাকে, কোনো ডাক্তার যদি গায়ক হন, তাহলে তার দুই কর্মক্ষেত্রকে সমাজ এক কাতারে ফেলে না। অন্যদিকে একজনকে কেন্দ্র করে যেমন সব ডাক্তারকেই গায়ক মনে করা হয় না, তেমন করেই সব মডেল, ম্যাসার নিশ্চয় যৌনকর্মী নন। এধরনের ‘পদ সম্বোধন’ সমাজে ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে কিছু বিরূপ সংস্কার তৈরি করে। হাসল’ শব্দটা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য ব্যবহৃত হয়। ফরাসি শব্দ ‘জিগোলো’, অনেক দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে, যা কিনা শুধুমাত্র নারী গ্রাহকদের জন্য প্রযোজ্য। যেসব পুরুষ সমকামী নয়, কিন্তু সমকামী পুরুষদের জন্য কাজ করে তাঁদের বলা হয় গে ফর পে (Gay for pay)। ট্রেড (trade) অর্থের মাপকাঠিতে সমাজ যেখানে মূল্যবোধগুলোকে পথে টেনে বাণিজ্য করছে, সেখানে যৌনকর্মীর গায়ে ট্রেডমার্ক নামের লেবেল এঁটে দেওয়া হয়েছে। এই যে এত লেবেলর কথা বললাম, এই লেবেল দেওয়ার অধিকার কাদের? এই লেবেল দেওয়ার অধিকার তাঁদের গ্রাহকদেরই।
বিশ্বের ইতিহাস একটি বিস্মৃতবাদী সমাজের (Misogynist Society) মধ্যে নির্মিত হয়েছিল। সুতরাং বিস্ময়ের অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই যে, মহিলারা অতীতকালীন যুক্তিবাদী চিন্তাভাবনা, কলা এবং বিজ্ঞানকে আশ্রয় করে এমন সমস্ত মহান পুরুষদের বিপরীতে গৌণ ও নিম্নমানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। সেন্ট অগাস্টিন থেকে শোপেনহাউয়ার এবং ডারউইন পর্যন্ত ইতিহাস পুরুষদের কৃতিত্বের দিকে বর্ণনা করেছে। মহিলাদের সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত কিছু বোকা হুল্লাবলুদের (Foolish hulabaloos) উৎসাহিত করেছিল। অন্ধকার যুগের সময় অনুসন্ধানের শাস্তি বা মহিলা বিশৃঙ্খলা প্রবণতা ব্যাখ্যা করার জন্য এবং প্রমাণ করার জন্য মহিলা যৌন উগ্রতার উত্থান হয়। দুষ্টের প্রতিমূর্তি হিসাবে মহিলাদের ধারণার ফলে নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক অংশ বাদ দেওয়া হয়েছিল, যেখানে পুরুষ লিঙ্গ ঠিক তেমন শক্তিশালী বা তত উন্নত দেখা যায় না। এই অনুচ্ছেদের একটি হল প্রাচীন গ্রিস এবং রোমের পুরুষ যৌনকর্মীদের কাহিনি।
প্রাচীন গ্রিসে লিঙ্গভিত্তিক যৌন দৃষ্টিভঙ্গির একটি গৌণ ভূমিকা ছিল। তাঁদের যৌন পছন্দগুলির দ্বারা কারও সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি এবং সামাজিক নিয়মাবলি যৌনতাকে একটি প্রাকৃতিক অনুশীলন হিসাবে দেখেছিল, যার। কোনও পোলিসের সঙ্গে সম্পর্কিত বা অন্যের কাছ থেকে গ্রহণযোগ্যতার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না। গ্রিসে পুরুষ যৌনবৃত্তি নারী যৌনবৃত্তির মতোই সাধারণ ব্যাপার ছিল। তবে পুরুষত্ব যৌনতার সময় একটি ‘শ্রেষ্ঠত্বের নীতি’ প্রকাশ করেছিল। লিঙ্গের ক্ষেত্রে সক্রিয়-নিষ্ক্রিয় (Active-Passive) দ্বিপদী এক অপরিসীম তাৎপর্য অর্জন করে। যেহেতু যৌনক্রিয়া চলাকালীন একজন ব্যক্তির ভূমিকা তাঁদের সামাজিক অবস্থান প্রকাশের একটি খাঁটি উপায় হয়ে উঠেছে। অনুপ্রবেশকারী’ (Penetrator) সাধারণত সামাজিক বা সামরিক খেতাব সহ উচ্চমানের ব্যক্তি ছিলেন।
পুরুষ যৌনকর্মীদের থেকে মহিলা যৌনকর্মীরা কিছুটা পৃথক। কারণ পুরুষরা তাঁদের শরীর মহিলাদের কাছে যেমন উপস্থাপন করতে পারত, তেমনই একই লিঙ্গের অন্যান্য ব্যক্তিদের উপভোগ এবং আনন্দ দিতে পারত। পুরুষ যৌনবৃত্তির অনুশীলনের দুটি ভিন্ন উপায় ছিল, যা বিভিন্ন স্তরে অবনমিত ছিল। ট্রামোস বা পর্নোইকে নিকৃষ্ট বা অবাঞ্ছিত হিসাবে বিবেচনা করা হত। কারণ তারা বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট পরিমাণে উপার্জনের জন্য তাঁদের দেহ বিক্রি করেছিল, কিন্তু তাঁদের কেউই গ্রিসের নাগরিক ছিল না। যেহেতু তাঁরা যুদ্ধবন্দি ছিল, তাই হেলেনিক সমাজের নিম্ন স্তরের চেয়েও নিকৃষ্ট বলে বিবেচিত হয়েছিল। তাঁদের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা কঠোরভাবে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল, যাঁদের পরিসেবা প্রয়োজন। রোমান সমাজ একই নীতি গ্রহণ করেছিল, এটি বেশ কয়েকটি আইন দ্বারা প্রয়োগ করা হয়েছিল, যা নিশ্চিত করেছিল যে উচ্চপদস্থ ব্যক্তিটি প্রবেশকারী (Penetrator) হিসাবে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করবে। অন্যথায় তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করা এবং মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি পেতে হবে।
দ্বিতীয় ধরনের পুরুষ যৌনকর্মীকে হেঁটেরিকোস (Hetairikos) বলা হত। তাঁদের মর্যাদা হিটেইরাস নামক এক উচ্চপদস্থ মহিলা যৌনকর্মীদের সমান ছিল। তাঁদের ভূমিকা আজকের এসকর্টের মতো ছিল। এই পুরুষরা সাময়িকভাবে একই পদমর্যাদার নাগরিকদের দ্বারা গৃহীত (Adopted) হত। যতক্ষণ না তাঁরা প্রকাশ্যে অন্তত তাঁদের সম্পর্কের সক্রিয়-নিষ্ক্রিয় নীতিটিকে সম্মান করে, তাঁরা তাঁদের মাস্টার’-দের প্রতি যৌন অনুগ্রহ প্রদান করেছিল।
পুরুষের যৌনপেশা বা পুরুষ যৌনবৃত্তি বিষয়টি নতুন মনে হলেও এটি সভ্যতার নতুন কোনো বিষয় নয়। রোমান এবং গ্রিক পুরাণেও এমন অনেক চরিত্র পাওয়া যায়, যা প্রমাণ করে সেই সময়েও পুরুষ দেহব্যাবসা প্রচলিত ছিল এবং পুরুষদেরকে বাধ্য করা হত এই পেশা বেছে নিতে। ইতিহাসেও পাওয়া যায় এমন ঘটনা! প্লেটোর রচনা ‘ইলিসের ফিডো’ এমনই একটা সত্যকাহিনি, যাতে পুরুষ যৌনকর্মীদের বর্ণনা আছে। হিব্রু বাইবেলেও পুরুষের যৌনপেশার কাহিনির উল্লেখ আছে। অতীতে অনেক যুদ্ধ ফেরত সৈনিক এই পেশা গ্রহণ করেছিল। কিন্তু সেইসময় পুরুষের যৌনবৃত্তি নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন মনে করত না কেউ। কারণ সেটা কতিপয় জনগোষ্ঠীর মধ্যেই যেমন সীমাবদ্ধ ছিল। তেমনি এই বিষয়ে তৎকালীন সমাজে সাধারণ মানুষের ধারণাও ছিল সামান্য। কাজেই বলা যেতে পারে, পুরুষের যৌনপেশা কোনো নতুন বিষয় নয়, বরঞ্চ এই ঘটনাটি নারীদের পাশাপাশি চলে আসছে বহুকাল ধরেই।
সোস্যাল মিডিয়ায় পুরুষ যৌনকর্মীদের দেখা মেলে প্রচুর পরিমাণে। একজন পুরুষ যৌনকর্মীকে পেশিবহুল, মার্জিত, অতি সুসজ্জিত এবং আকর্ষণীয় ছবিসহ সেইসব পেইজের দেয়াল ভরে আছে। তা ছাড়া ওই নির্দিষ্ট রেন্টবয়ের কাছে সে কী কী সুযোগসুবিধা, সেবা এবং পরিচর্যা গ্রাহক পেতে পারে, সে বিবরণ আকর্ষণীয়ভাবেই তুলে ধরা হয়, কিছু দাবি-দাওয়াও আছে সেখানে। যেমন—ক্লায়েন্টের কী কী ব্র্যান্ডের গাড়ি থাকতে হবে, কটেজে না বাড়িতে থাকবে, কী খাবার খাওয়াতে হবে, এইসব আবদার পেশাদারি দাবি। আরও কিছু তথ্য জানা গেল এমন কিছু পেইজ ঘাঁটাঘাঁটি করে। খুব স্পষ্ট করে জানানো আছে এইসব পেইজে। যেমন—কে শুধুমাত্র সমলিঙ্গের সঙ্গ দিতে চায়, কে শুধুমাত্র নারীর সঙ্গী হতে চায় এবং কারা উভয়ের সঙ্গ দিতে আগ্রহী ইত্যাদি। যাই হোক, অর্থ আর আয়ের বিষয় এইক্ষেত্রে খুবই আনুসঙ্গিক। কারণ এই পেশাও একটা বাণিজ্য। এই পেশায় যদি পুরুষের আয় নারীর চেয়ে বেশি হয় তাহলে এটাও ভুললে চলবে না, পুরুষ যৌনকর্মীদের ক্লায়েন্ট শুধুমাত্র নারীই নয়, ধনী, উচ্চবিত্ত এবং অনেক প্রভাবশালী পুরুষও। অর্থের বাড়তি অঙ্কটার আমদানি সেই পাল্লাতেই ভারী। যে কারণে ব্যক্তিগতভাবে সমকামী না-হলেও এই পেশায় অনেক কর্মী সমকামী পুরুষদেরও সঙ্গী হয়।
পুরুষ যৌনকর্মীদের বিষয়ে নারীবাদীরা কী মনে করেন একটু দেখা যাক। নারীবাদীরা পুরুষের যৌনপেশায় আসা নিয়ে সোচ্চারভাবে কিছু না-বললেও যে একেবারেই বলেননি তা কিন্তু নয়। কট্টর নারীবাদীরা গণিকাবৃত্তির বিরোধিতা করছে চিরকাল, সেটা নারী কিংবা পুরুষ হোক। তাঁরা অস্তিত্ববাদী বা উদারপন্থী নারীবাদীদের মতো যৌনকর্মকে সমাজের বুকে মেনে নিয়ে আইনসম্মত করাটা মানবতার বিরোধিতা মনে করে। যেমন করে সমাজে পুরুষরা নারীকে শোষণ করে যৌনপেশায় কাজ করায়, তেমনি পুরুষরাই কিছু পুরুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এই পেশায় নিয়োগ করে শোষণ করছে, অর্থবলে-ক্ষমতাবলে। এটা ঠিক যে, অনেক পুরুষ স্বেচ্ছায় এই পেশায় আসছে। কিন্তু অন্যদিকে অস্বীকার্য যে অনেক কম বয়সি পুরুষ বাধ্য হয়। সমকামী পুরুষের মনোরঞ্জনে যৌন চাহিদা মেটানো। এমন কি বয়োঃসন্ধিকালে অনেক অল্প বয়সি পুরুষ এই পেশায় নিয়োজিত হয়, সমকামী না-হয়েও। অবশেষে অর্থাভাবে অনেকেই এই পথকেই বেছে নেয় পেশা হিসাবে। তা ছাড়া, অপ্রাপ্ত বয়স থেকে এই পেশায় থাকার কারণে মানসিকভাবে অন্য পথটাও তাঁদের চেনা ওঠে হয়ে না।
পুরুষ হওয়ার কারণে এঁরা নির্যাতিত হয় না, সেটা সঠিক তথ্য নয়। নারী যৌনকর্মীদের মতোই পুরুষরাও ধর্ষিত হয়, শারীরিকভাবে অত্যাচারিত হয়, আর্থিকভাবে প্রতারিত হয়। সেইজন্য পাশ্চাত্যে পুরুষদের ‘রেপ ক্রাইসিস সেলটার’-গুলোতে এতো পুরুষ যৌনকর্মীদের ভিড়। সমকামী পুরুষ এবং যৌনকর্মীরাই সেখানে বেশি। যৌনকর্মী, হোক সে নারী কিংবা পুরুষ, যৌন হয়রানির শিকারের আধিক্য তাঁদের উপরই বেশি। তাঁদেরকে যেমনভাবে ইচ্ছা ব্যবহার করা যায়, কারণ তাঁরা অর্থের বিনিময়ে ভোগ্য মানুষ। অর্থশালী নারী-পুরুষ উভয়েই তাঁদেরকে ব্যবহার করে ইচ্ছানুযায়ী। প্রথমে আর্থিকভাবে ঠকানো, তারপর শারীরিক নির্যাতন। পুলিশও ওদের পক্ষে থাকে না, থাকলেও পুলিশরেই উপর্যুপরি প্রশ্নে জর্জরিত হতে হয় ওদেরকে। তা ছাড়া বেশিরভাগ দেশেই তো ওরা বেআইনি, পুলিশের সাহায্য আশা করতে পারে না। অত্যাচারী গ্রাহকেরা সে ব্যাপারে অবগত বলেই অত্যাচার করতে দ্বিধাবোধ করে না। অনেকসময় ওরা নির্যাতন সয়ে নিয়ে ক্রাইসিস লাইনে ফোন করে কথা বলে অবস্থার প্রতিকার চায়। সেইজন্যই অস্তিত্ববাদীরা এবং উদারপন্থীরা মনে করে যে, যৌনকর্মীদের জন্য বিশেষ আইন থাকা প্রয়োজন। কর্মী বা ক্লায়েন্ট কেউই যেন কোনো অনাচারের শিকার না হয়, সঙ্গে সঙ্গে যৌনকর্মীরা বয়সকালে রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত না-হয় সেইজন্য তাঁরা উপযোগী আইন গঠনের পক্ষে।
এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে পুরুষের বেশ্যাবৃত্তি কি আইনসম্মত? অনেক দেশেই এই পেশা বিধিসম্মত, কিছু দেশে আংশিক আইনি, আবার কোনো-কোনো দেশে সম্পূর্ণ বেআইনি। যৌন-ব্যাবসায় নারী-পুরুষের আইন প্রকৃতপক্ষে একই। কিন্তু কোনো কোনো দেশে ভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ অঞ্চলেই পুরুষের যৌন-ব্যাবসা বে-আইনি নেভাডা অঞ্চল ছাড় দিয়ে। কিন্তু পুরুষ যৌনকর্মীদের সঙ্গে বসবাস নিষিদ্ধ। ২০০৯ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে শুধুমাত্র রোড আইল্যান্ডে গণিকাবৃত্তি বিধানসম্মত ছিল। কানাডায় পুরুষের যৌনবৃত্তি আইনসিদ্ধ। কিন্তু রাস্তায় দাঁড়িয়ে দরদাম বা কারবারি নিষিদ্ধ। ভারতে পুরুষের যৌন-ব্যাবসা বেআইনি নয়। তবে অপ্রাপ্তবয়স্ক কোনো পুরুষকে জবরদস্তি করে এই ব্যাবসায় নামানো বা প্রলুব্ধ করাটা বে-আইনি। বাংলাদেশে নারীর যৌন ব্যাবসা আংশিক আইনি, কিন্তু পুরুষের যৌন-ব্যাবসা বেআইনি।
একজন পুরুষ যৌনকর্মীদের কাছ থেকে নারী আসলে কী চায়? আসুন, উত্তর জেনে নিই একজন পুরুষ যৌনকর্মীর কাছ থেকে। পুরুষ যৌনকর্মী হিসাবে দীর্ঘদিন থেকে কাজ করছেন অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দা রায়ান জেমস। নারীদের সঙ্গে যৌনসঙ্গমে দীর্ঘদিনের প্রচুর অভিজ্ঞতা তাঁর। বিবাহিত, অবিবাহিত, কুমারিসহ নানা বয়সের নারী তাঁকে ভাড়া করে ভোগ করেছে। আর সময় দেওয়ার বিনিময়ে ৪০০ ডলার থেকে শুরু করে ৬০০০ ডলার পর্যন্ত পারিশ্রমিক পেয়েছেন রায়ান জেমস। তাঁর মতে, নারীরা কেবল যৌনমিলকেই প্রাধান্য দেন না, তাঁদের চাহিদা অন্যরকম। সম্প্রতি ইংল্যান্ডের ডেইলি মেইলের অস্ট্রেলিয়া ভার্সনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি নারীর বিভিন্ন চাওয়া পাওয়ার কথা বলেন। তিনি জানান, বিছানায় নারী শুধু যৌনতাই চান না। একে অপরের কথা বলা, এখানে-ওখানে ঘুরতে যাওয়াও নারীর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজন পুরুষের কাছে নারী প্রেমিকের মতো আচরণ চায়, যন্ত্রের মতো নয়। তিনি জানান, তাঁকে শুধু নারীর সঙ্গে যৌনমিলন করার জন্যই ভাড়া করা হয় না। একসঙ্গে ঘুরে বেড়ানোসহ আরও অন্যান্য কাজের জন্যেও তাকে পারিশ্রমিক প্রদান করা হয়। তিনি তাঁর পেশাদারিত্বের খাতিরে ৪০০ ডলার থেকে শুরু করে ৬০০০ ডলার পর্যন্ত পারিশ্রমিক নিয়ে থাকে। তার মধ্যেই যৌনমিলন ও হোটেলে অবস্থান সংযুক্ত থাকে।
রায়ন বলেন, পুরুষরা বেশিরভাগ সময় যৌনমিলনকেই প্রাধান্য দেয়। বিশেষ করে কোনো পুরুষ ক্লায়েন্ট যখন মহিলা যৌনকর্মীর কাছে যায়। শুধু যৌনকর্মই সব কিছু নয়। অনেক নারী আছেন যাঁরা যৌনতা নির্ভর খুনসুটি করতেও ভালোবাসেন। তাই পুরুষদের উচিত শুধু যৌনমিলনের উপর গুরুত্ব না দিয়ে, অন্যান্য বিষয়ের উপরেও গুরুত্ব দেওয়া। রায়ান আরও বলেন, “অনেক নারী আছেন যাঁরা বারে গিয়ে যে-কোনো পুরুষ যৌনকর্মীকে নিয়ে আনন্দ ফুর্তি করেন, কিন্তু যৌনমিলন করেন না। বেশিরভাগ নারী তাঁর যৌনকর্মীর সঙ্গে কী করবেন, তা আগে থেকে ঠিক করেন না। ভাড়া করার পর যা করতে ভালো লাগে তাই করতে শুরু করেন। আবার অনেক নারী আছেন, যাঁদের পছন্দের বিষয় তাঁরা জানান। তাঁরা মিলিত হয়ে সেভাবেই কাজ করতে বলেন। আবার কিছু নারী আছেন, যাঁরা শুধু যৌনমিলনের জন্যই টাকা পরিশোধ করেন। তাঁরা নিজেদের শারীরিক চাহিদা মিটিয়েই চলে যান। তাঁদের নিজের কোনো পছন্দের কথা বলেন না। আমি যা করি তাঁরা তাতেই খুশি থাকেন।” নিজের অভিজ্ঞতা কথা বলতে গিয়ে রায়ান আরও বলেন, “পুরুষের উচিত নারীর মনের কথা জানা। তা না-হলে নারীকে সন্তুষ্ট করা সম্ভব নয়। আর এ বিষয়টি একজন পুরুষ যৌনকর্মীর খুব ভালো করেই জানতে হয়।”
আসলে মহিলাদের যৌনাঙ্গ পুরুষদের যৌনাঙ্গের তুলনায় অনেক বেশি জটিল, ফলে অর্গাজমে পৌঁছোতে মহিলাদের সময় অনেক বেশি লাগে। এছাড়া আরও অনেকগুলো ব্যাপার এখানে কাজ করে, কিছু মহিলা তাঁদের ‘জি-স্পট’-এ স্পর্শ করলেই উত্তেজিত হয়ে যান। মহিলাদের ৯ রকমের অর্গাজম হতে পারে। একদিনেই হতে পারে, আবার বিভিন্ন দিনেও হতে পারে। তবে সব মহিলার যে এরকম যৌন অভিজ্ঞতা হতেই হবে, তা কিন্তু নয়। আপনি হয়তো ‘জি-স্পট’-এর কথা শুনেছেন, বেশিরভাগ মহিলার ঘাড়ের কাছে অথবা পিঠের দিকে এই স্পট থাকে, যেখানে পুরুষের স্পর্শ হলে মহিলারা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। কিন্তু জি-স্পট’ ছাড়াও ‘সি-স্পট’, ‘ও-স্পট’, ‘এ-স্পট’-ও থাকে একজন মহিলার। তা ছাড়া একজন মহিলার ক্লিটোরাল অর্গাজম, ভ্যাজাইনাল অর্গাজমও হতে পারে। মহিলাদের অর্গাজম পুরুষদের তুলনায় দেরিতে হলেও তার রেশ কিন্তু বেশ অনেকক্ষণ থাকে। সাধারণত অর্গাজমের অনুভূতি পুরুষদের মধ্যে সাত সেকেন্ড পর্যন্ত থাকে, সেখানেই মহিলাদের এই সুখানুভূতি ২৭ সেকেন্ডের বেশি সময় পর্যন্ত বজায় থাকে। আর মহিলাদের তো একবার না, বারবার অর্গাজম হতে পারে। অনেকেই ইজাকুলেশন এবং অর্গাজমের মধ্যে তফাত বুঝতে পারেন না। অর্গাজম হলেই যে ইজাকুলেশন হবে তার কোনো মানে নেই। কিন্তু পুরুষদের ক্ষেত্রে তাঁরা অর্গাজমে পৌঁছেলে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেন না, তাঁদের ইজাকুলেশন হবেই। অনেক পুরুষ আবার একবার মাত্র ইজাকুলেট করেই ক্লান্ত হয়ে পড়েন এবং ঘুমিয়েও পড়েন! স্কোয়ারটিং? সে আবার কী? খায় না মাথায় দেয়! এসব প্রশ্ন যদি আপনার মাথায় ঘোরে এই মুহূর্তে তা হলে বলে রাখি, স্কোয়ারটিং হল সেই অনুভূতি, যা আপনাকে অর্গাজমে পৌঁছোতে সাহায্য করে। অনেকেই আবার স্কোয়ারটিংকে অর্গাজম বলে ভুল করে ফেলেন। তবে সব মহিলার কিন্তু স্কোয়ারটিং হয় না। স্কোয়ারটিংয়ের জন্য আপনার সঙ্গীকে ঠিক পয়েন্টে আপনাকে ছুঁতে হবে এবং আপনি সম্পূর্ণভাবে তৃপ্ত হলে তবেই আপনার স্কোয়ারটিং হবে! তবে হ্যাঁ, মনে রাখবেন স্কোয়ারটিং, অর্গাজম এবং ইজাকুলেশন কিন্তু এক ব্যাপার নয়! অতএব মনে রাখতে হবে পুরুষদের যৌনকর্মে সীমাবদ্ধতা আছে, যে সীমাবদ্ধতা নারীদের ক্ষেত্রে প্রায় নেই-ই। একজন নারী যৌনকর্মী প্রতিদিন যত সংখ্যক পুরুষকে যৌনসুখ দিতে পারে, একজন পুরুষ যৌনকর্মীর পক্ষে তত সংখ্যক নারীকে যৌনসুখ দিতে মোটেই সক্ষম নয়। তা ছাড়া নারীর অর্গাজম হোক বা না-হোক, একাধিক পুরুষের অর্গাজম দিতে সক্ষম। পুরুষের বীর্যস্থলনের সঙ্গে সঙ্গে বহুক্ষণ সময় লাগে অপর নারীর সঙ্গে যৌনসঙ্গে লিপ্ত হতে। এছাড়া একজন পুরুষের শারীরিক মিলনের সময়ে অর্গাজমে পৌঁছোতে যতটা সময় লাগে তার চেয়ে বেশ অনেকক্ষণ পর একজন মহিলা সেই চরমসীমায় পৌঁছেন। সেই কারণেই মহিলা যৌনকর্মীদের তুলনায় পুরুষ যৌনকর্মীদের রেট কিছু কিছু ক্ষেত্রে কিছুটা বেশি।
ভারতেও বাড়ছে পুরুষ যৌনকর্মীর সংখ্যা। সম্প্রতি যৌনকর্মীদের উপর সমীক্ষা চালাতে গিয়ে মাথায় হাত কেরালা স্টেট এইডস কন্ট্রোল সোসাইটির। সম্প্রতি তাঁদের চালানো এক সমীক্ষাতে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। কেরালা স্টেট এইডস কন্ট্রোল সোসাইটি (KSACS)-র রিপোর্ট বলছে, গোটা কেরল জুড়ে শুধু ১৩,৩৩১ জন পুরুষ যৌনকর্মী আছে। আর সেখানে মহিলা যৌনকর্মীর সংখ্যা তার অর্ধেক। তথ্য বলছে গোটা রাজ্যে মাত্র মহিলা যৌনকর্মীর সংখ্যা ১৭,০০০। স্টেট এইডস কন্ট্রোল সোসাইটির চালানো সমীক্ষা বলছে, অভিবাসী যৌনকর্মীর সংখ্যাও ক্রমশ বাড়ছে। শুধু তাই নয়, সমীক্ষাতে উঠে এসেছে আরও কিছু তথ্য। সমীক্ষা বলছে, কেরালার বহু পুরুষ যৌনকর্মী পেশার তাগিদে বাইরে রাজ্যে যান। আবার অন্য রাজ্য থেকে কেরালায় আসা অভিবাসী পুরুষ যৌনকর্মীর সংখ্যাও কম নয়। রিপোর্ট অনুযায়ী, অভিবাসী পুরুষ যৌনকর্মী কেরালায় উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। সমীক্ষাতে উঠে আসা আরও তথ্য বলছে, গ্রাম থেকে বহু যৌনকর্মী তাঁরা আসছেন শহরে। যাদের বয়স ৩৬ থেকে ৪৬ বছরের মধ্যে। কেরলের বিভিন্ন হোটেল, ফ্ল্যাট ভাড়া করে রমরমিয়ে তারা যৌন-ব্যাবসা চালাচ্ছেন। এমনকি কেরলে বেশি বয়সের বিভিন্ন মহিলা এবং পুরুষরা আছেন, তাঁরাও দালালির কাজ শুরু করে দিয়েছেন। স্থানীয় মানুষ ছাড়াও এদের মূলত টার্গেট বিদেশি এবং দেশি পর্যটকরা।
সমীক্ষাতে উঠে আসা তথ্য বলছে বাংলা থেকেও বহু পুরুষ যৌনকর্মী কেরলে গিয়ে যৌন-ব্যাবসায় নাম লেখাচ্ছেন। এছাড়াও বিহার এবং ওড়িশা থেকেও বহু লোকজন সেখানে যাচ্ছে বলে জানাচ্ছে সমীক্ষা। দেখা গিয়েছে, ওই যৌনকর্মীদের একটা অংশ কেরালায় কাজ করতে আসা ভিনরাজ্যের শ্রমিকদের সম্পর্কে আত্মীয়। অভিবাসী যৌনকর্মীর হার সবচেয়ে বেশি কেরালার পেরুম্বাবুরে। এই যৌনকর্মীদের অধিকাংশই আবার বাঙালি। বিভিন্ন এজেন্টের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাঁরা এসেছেন। আবার পুরুষ যৌনকর্মীদের মধ্যে অধিকাংশই কোঝিকোড় জেলার। এই পুরুষ যৌনকর্মীদের মধ্যে ১০ হাজার আবার মাদকাসক্ত। যৌনকর্মীদের মধ্যে সবমিলিয়ে ১৫ জনের রক্তপরীক্ষায় এইচআইভি পজিটিভ ধরা পড়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে ৪ জন মহিলা যৌনকর্মী, ১১ জন পুরুষ যৌনকর্মী।
বাদ নেই ভারতের পাশের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশও। পশ্চিমা বিশ্বসহ পৃথিবীর অনেক দেশে এ ধরনের বাণিজ্য চালু থাকলেও বাংলাদেশে কিছুদিন আগেও অনলাইনে এ ব্যাবসার কথা শোনা যায়নি। অনলাইনে এসব গ্রুপে নারী ও পুরুষ যৌনকর্মী সরবরাহের নিশ্চয়তা দেওয়া হচ্ছে। অনলাইনভিত্তিক এই গ্রুপগুলো বাড়িতে বা ফ্ল্যাটে যৌনকর্মী সরবরাহ করার কথা বলছে। এমনকি শতভাগ সততা ও গোপনীয়তার সঙ্গে কাজ করার নিশ্চয়তাও দেওয়া হচ্ছে।
গ্লোবালটিভি অনলাইনের অনুসন্ধানে এ ধরনের প্রায় অর্ধশত পেজের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে একটি হল ‘বিডি কল গার্ল লিমিটেড’। ফেসবুক পেজে প্রতিষ্ঠানটির দেওয়া বিজ্ঞাপনে প্রকারভেদে যৌনকর্মের মূল্য তালিকাও দেওয়া আছে। তালিকা অনুযায়ী রিয়েল সেক্স ২০০০, ফুল নাইট ৫০০০, ভিডিও সেক্স ১৫০০, ফোন সেক্স ৩০০ এবং চ্যাট (মেসেজ) সেক্স ২০০ টাকা। তবে মোবাইল নম্বর ছাড়া ওয়েব সাইটে সুনির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা নেই। এর ফলে এই পেজ ও ওয়েবসাইটটি কে বা কারা পরিচালনা করছে, সে বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা যায় না। তবে পরিচয় গোপন করে ওয়েবসাইটে দেওয়া একটি মোবাইল নম্বরে ফোন করলে তামান্না নামে এক তরুণী কলটি রিসিভ করেন। নিজস্ব স্থান না-থাকার অজুহাত দেখিয়ে সেবা নিতে তাঁদের নির্ধারিত কোনো জায়গা দিতে পারবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তামান্না জানায়, আমরা সাপ্লাই দেই, ঘর ভাড়া দেই না। কীভাবে সাপ্লাই পাওয়া যাবে এমন প্রশ্নের জবাবে ওই তরুণী জানায়, ‘আগে পেজ মেম্বার হতে বিকাশের মাধ্যমে ২০০০ টাকা পাঠাতে হবে। আরও দুয়েকটি প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করতেই অপর প্রান্ত থেকে ফোনের লাইন কেটে দেওয়া হয়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অনলাইনে বিভিন্ন সাইট ঘেঁটে এ ধরনের যে গ্রুপগুলো পাওয়া গেছে তার মধ্যে ‘বিডি কল গার্ল লিমিটেড’ ছাড়াও ‘বিডি কলগার্ল সার্ভিস’, ‘সেক্স পার্টি’, ‘অ্যাটেনশন প্লিজ’, ‘কর্ল গার্লস ঢাকা, ‘ঢাকা ফ্রেন্ডশিপ ক্লাব’, ‘কল বয় ঢাকা’, ‘ঢাকা গার্লস সেকিং বয়েজ ফর ফ্রেন্ডশিপ’, ‘কল বয় বাংলাদেশ’, ‘প্লে বয় সার্ভিস ইন বাংলাদেশ ছাড়াও অন্তত ১৫টি এসকর্ট (Escort) এজেন্সির সন্ধান পাওয়া গেছে। যৌন-চাহিদা মেটানোর জন্য এসকর্ট এজেন্সির নামে যে গ্রুপগুলো অনলাইনে সক্রিয় আছে তার মধ্যে এসকর্ট সার্ভিস’, ‘এসকর্ট ঢাকা’, ‘এসকর্ট মোহাম্মদপুর’, ‘এসকর্ট ধানমন্ডি’, ‘বিডি এসকর্ট সার্ভিস’, ‘ঢাকা কল বয় এজেন্সি’, ‘মেইল গুলশান’, ‘বালক গুলশান লিমিটেড। সাইটগুলো ঘেঁটে দেখা গেছে এসকর্ট গ্রুপের প্রতিটি পোস্টে অশ্লীল ভঙ্গির ছবিসহ কিছু মেয়ে কিম্বা ছেলের নাম ও বর্ণনা দেওয়া আছে। ঢাকা ছাড়াও দেশের কোথায় কোথায় সার্ভিসের জন্য যেতে পারবে এবং সেজন্য ঘণ্টা কিংবা দিনপ্রতি ডলার ও টাকার হিসেবে দেওয়া আছে। শুধুমাত্র মহিলা যৌনকর্মী পাওয়া যাবে যেসব এসকর্ট এজেন্সি থেকে—‘ডিয়ার লেডিস’, ‘আর ইউ লোনলি’ ‘হাউজ ওয়াইফ’, ‘ডিভোর্সেড লেডি’, ‘সিঙ্গেল গার্ল’, ‘ফরেনার লেডি’ ‘লুকিং ফর ফুল বডি ম্যাসেজ’, ‘ট্রাভেল’, ‘ফান সার্ভিস’ ইত্যাদি।
সবশেষে প্রতিটি পোস্টে দেওয়া রয়েছে, ওই এসকর্টের নিজস্ব কিছু শর্ত। এই শর্তের অন্যতম হল, যে নারী খদ্দের এসকর্ট সার্ভিস নিতে ইচ্ছুক, তাঁর নিজের উদ্যোগেই বাড়ি বা ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করতে হবে। তবে এসব বিজ্ঞাপনে তাঁদের কোনো যোগাযোগের নম্বর বা ঠিকানা দেওয়া থাকে না। সাইটগুলোতে শুধু ইনবক্সে যোগাযোগ করতে বলা হয়। ইনবক্সে ‘হাই বা হ্যালো’ বললে স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি ফিরতি বার্তা আসে। আর উত্তর দিলেই শুরু হয় দরদাম। আর সব কিছুই চলে মেসেজ (ইনবক্স বার্তা)-এর মাধ্যমে।
ঢাকার বাসিন্দা আবদুল হাকিম এসকর্ট ব্যাবসার জন্য ছদ্মনামে ফেসবুকে এডমিন হিসেবে পাঁচটি পেইজ পরিচালনা করত। নারী ক্লায়েন্টদের আকৃষ্ট করতে এ সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন প্রমোট করত। এমনকি নারীদের ফেসবুকের ইনবক্সেও পাঠানো হত এ সংক্রান্ত ক্ষুদে বার্তা। ক্ষুদে বার্তা বিজ্ঞাপনের সূত্র ধরেই হাকিমের ডাক পড়ত অভিজাত এলাকার নারীদের বাড়িতে বা ফ্লাটে। পরবর্তী যোগাযোগ হত হোয়াটসঅ্যাপে। নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট স্থানে সুন্দর পোশাকে সেজেগুজে অপেক্ষা করত হাকিম। অতঃপর দেখা হয় নির্দিষ্ট নারীর সঙ্গে। তাঁদের সঙ্গে রাতযাপন করে ফিরতেন ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে। এসব নারীরা মূলত উচ্চবিত্তশালী। কেউ কেউ ভিনদেশি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এডমিন হিসাবে অন্তত পাঁচটি অ্যাডাল্ট পেইজ পরিচালনা করত আবদুল হাকিম। এসব পেইজে জাহিদ হাসান, সায়মা হক ও তানভির আহমেদ নামেও এডমিন আছে। অনৈতিক এই পেশায় জড়ানো প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদে হাকিম জানিয়েছে, অর্থের নেশাই তাঁকে এপথে এনেছে। এইচএসসি পাস যুবক আবদুল হাকিম অল্পতেই বিপুল অর্থের মালিক হতে হাঁটতে থাকে ভিন্নপথে। ইংরেজি লেখায়-বলায় ও কম্পিউটারে পারদর্শী হাকিম কয়েক বছর আগে কাজ নেয় রাজধানীর পল্টনের একটি দোকানে। কম্পিউটারের ওই দোকানে মূলত অনুবাদের কাজ করত হাকিম। বেশিরভাগ সময় কাটাত কম্পিউটারে ইন্টারনেটে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচয় হয় চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী, চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের সদস্য মাহতাব রফিকের সঙ্গে। ব্যবসায়ী রফিকের কাছে কাজ খুঁজছিল হাকিম। মাহতাব রফিক তাকে ফিমেইল এসকর্ট প্রোভাইডার হিসাবে কাজ করতে পরামর্শ দেয়। এতে বসে বসেই প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা আয় করা সম্ভব বলে জানায় মাহতাব রফিক। ব্যস, সেই পথেই হাঁটতে থাকে হাকিম। বিভিন্ন মাধ্যমে ফিমেল এসকর্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ফিমেল এসকর্টদের মুখ-ঢাকা ছবি-বিজ্ঞাপন প্রচার করে মাহতাব রফিকের এসকর্ট সংক্রান্ত ওয়েবসাইট। ক্লায়েন্ট যোগাযোগ করে। এভাবেই জড়িয়ে যায় যৌনপেশায়। ভিনদেশি নারী ও দেশের মধ্যে নারীদের কথা চিন্তা করেই ফিমেল এসকর্টের পাশাপাশি শুরু করে মেইল এসকর্টের কাজও। নিজের যৌবন ও শরীরকে কাজে লাগিয়ে রাতারাতি এক শ্রেণির নারীদের কাছেও প্রিয় হয়ে উঠে হাকিম। হাকিমের বাড়ি গোড়ানে। স্ত্রী ও এক সন্তান নিয়ে তাঁর পরিবার। সিরাজগঞ্জের এক কৃষক পরিবারের সন্তান হাকিম। তিন ভাইয়ের মধ্যে ছোটো। এক ভাই চাকরি করে বিশেষ একটি বাহিনীতে, আর এক ভাই পুলিশে এএসআই পদে কর্মরত।
বাংলাদেশের জনৈক সাংবাদিক এক গল্প শোনালেন—মগবাজার মোড় থেকে কিছুটা সামনে রাস্তাটা বাঁক নিয়ে সিদ্ধেশ্বরীর দিকে গেছে। একটি স্মার্ট ছেলেকে এমন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়, যেন সে কারও অপেক্ষায় আছে। কিছুটা দুরে গিয়ে দাঁড়ালাম এবং লক্ষ করতে থাকলাম। ছেলেটির পরনে নেভি ব্লু প্যান্ট, সাদা গেঞ্জি, কাঁধে একটি ব্যাগ। তাঁর শরীর থেকে ভেসে আসছিল উগ্র পারফিউমের ঘ্রাণ। বারকয়েক কথা বলল মোবাইল ফোনে। সময় তখন রাত ৯ টা প্রায়। দেখেই মনে হয়েছিল নির্ধারিত কারও জন্য অপেক্ষা করছিল সে। কিছুক্ষণ পরেই একটি ব্লু কালারের গাড়ি এসে দাঁড়াল। গাড়ির গ্লাস নামিয়ে এক মধ্য বয়সি মহিলা যুবকটিকে হাতের ঈশারায় ডাকলেন। মুচকি হেসে ছেলেটি এগিয়ে যায়। তারপর আস্তে আস্তে কথা হয় তাঁদের। স্পষ্ট বোঝা যায় যে, দরকষাকষি চলছে কিছু নিয়ে। অতঃপর যুবকটি গাড়িতে উঠতেই গাড়িটি সামনের দিকে যায়। তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকায় এরকম অনেক পুরুষ যৌনকর্মী আছে। তাদের মধ্যে একজন হয়তো এই ছেলেটি। অপর একজন জানালেন লেখাপড়ার পাশপাশি বিদেশিদের গাইড হিসাবে কাজ করত সে।
সে পুরুষ যৌনবৃত্তির এই ধারণা পেয়েছিল এক বিদেশিনীর মাধ্যমে। ঢাকায় বেড়াতে এসেছিলেন সেই নারী। গুলশানের একটি হোটেলে ছিলেন। ওই নারীর গাইড হিসাবে কাজ করার দ্বিতীয় দিনই তাঁকে বিছানায় সঙ্গ দিতে প্রস্তাব দেন। বিনিময়ে তাঁকে পে করা হবে বলে জানায় মহিলাটি। তখন আমেরিকান ওই নারীর প্রস্তাবে রাজি হয়ে বেশ কিছু বাড়তি টাকা আয় করেছিল ছেলেটি। শারীরিকভাবে ভীষণ তৃপ্ত হয়ে সেই নারী তাকে পরামর্শ দেন মেইল এস্কর্ট হিসাবে কাজ করলে ভালো উপার্জন করবে সে। সেই থেকেই এই পথে যাত্রা শুরু তার। বাংলাদেশে একটা শ্রেণি আছে যাঁদের লাইফ স্টাইল বিদেশিদের মতোই। জানা যায়, ওই শ্রেণির কাছে ওয়েবসাইট তৈরি করে নিজেদের প্রচার করতে শুরু করে এই ছেলেরা। পরবর্তীকালে খোঁজ পান মেসেঞ্জার পাবলিক ডটকমের। সেখানে অনেক মেল এসকর্ট আছে। অ্যাকাউন্ট ওপেন করেন সেখানে। ওই সাইটে গিয়ে দেখা গেছে এতে তাঁর বিস্তারিত তথ্য আছ। যা দেখলে সহজে তাঁর সম্পর্কে অনুমান করা যায়। তাঁদের উচ্চতা, বয়স, কী কী ভাষায় দক্ষ সব তথ্য দেওয়া থাকে। সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়, অভিজ্ঞতা অনুসারে গোপনীয়তা, নিরাপদ সম্পর্ক, প্রকৃত তৃপ্তি দেওয়ার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়। শুধু প্রকৃত ক্লায়েন্টকে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করে ফোন নম্বর ও মেলের ঠিকানা দেওয়া থাকে সেখানে। জানা যায়, এই পুরুষ যৌকর্মীদের ক্লায়েন্ট মূলত অভিজাত শ্রেণির ও বিদেশিনী কিছু নারী। দেশি অভিজাত নারীদের অনেকের স্বামী নেই। ডিভোর্সি অথবা বিধবা। নিঃসঙ্গ বোধ করেন এমন কোনো মহিলা। তাঁরা পুরুষ যৌনকর্মী খোঁজেন। গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরা ও ধানমন্ডি এলাকার এরকম অনেক ক্লায়েন্ট আছে বলে জানা যায়। অনেক নারী শুধু শরীর ম্যাসেজ করার জন্যেও এঁদের ডাকেন। এসব কাজে ঘণ্টা হিসাবে টাকা নেওয়া হয়। প্রতি ঘন্টায় ২০ থেকে ৪০ ডলার বা ২০০০ থেকে ৪০০০ টাকা নেওয়া হয়।
নারীরা সাধারণত সুঠামদেহী, শ্যামলা, ২৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সি ছেলেদের বেশি পছন্দ করেন। এজন্য পুরুষ যৌনকর্মীরা নিয়মিত ব্যায়াম করে নিজেকে প্রস্তুত রাখে। সুস্থ ও শক্তিশালী থাকার জন্য প্রয়োজনীয় খাবার খায়। জেন্টস পার্লারে যায় নিয়মিত। তবে পুরুষ যৌনকর্মীদের অনেকেই প্রতারণা করেন নারীদের সঙ্গে। তাঁদের একজনকে গ্রেপ্তার করেছিল আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। তার নাম ফুয়াদ বিন সুলতান। তাঁকে উত্তরার একটি বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। র্যাব জানিয়েছে, ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সে পর্নোগ্রাফির ব্যাবসা শুরু করে। তাঁর সঙ্গে অন্তত দেড় শতাধিক নারীর অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও পাওয়া গেছে। নিজেকে ‘সুলতান অব সেক্স’ দাবি করে, নারীরা তাঁর কাছে স্বেচ্ছায় আসতেন। তবে র্যাব দাবি করেছে, শারীরিক সম্পর্কের ভিডিও ধারণ করে নারীদের ব্ল্যাকমেইল করত সুলতান। ফুয়াদ বিন সুলতান আবার। প্রাক্তন এক উচ্চ পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার সন্তান।
মহিলা যৌনকর্মীদের মতো পুরুষ যৌনকর্মীদের যৌনপল্লি আছে কি না জানতে পারিনি। তবে জার্মান মনোবিজ্ঞানী ম্যাগনাস যেসব যৌনপল্লিগুলি ঘুরে দেখেছেন সে সবই মহিলাদের যৌনপল্লির অনুরূপ পুরুষ যৌনপল্লি। খুবই সংগঠিত ও পরিকল্পিতভাবে এই যৌনপেশা চলে। সমুদ্রোপকূলের করাচি শহরের যৌনপেশার ইতিহাস সুপ্রাচীন। এখানে অনেক পুরুষ যৌনপল্লি ছিল। ১৮৫২ সালে উত্তর-পূর্ব ভারতের মণিপুর রাজ্যের একদল নারীবেশী পুরুষ যৌনকর্মীদের দেহ-ব্যাবসার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। এ থেকেই বোঝা যায় এ অঞ্চলের পুরুষ যৌনপেশার প্রচলন ছিল। আমরা এতক্ষণ পুরুষ যৌনকর্মী ‘জিগোলো’ দের কথা আলোচনা করেছি। এবার আসি সেই যৌনকর্মীদের কথায়, যাঁরা নারীবেশী পুরুষ যৌনকর্মীদের কথায়। এঁদের ডাকনাম ‘শিমেল’ (Shemale) বা লেডিবয়’ (Ladyboy)।
এঁরা মূলত সমকামী ও রূপান্তরকামী পুরুষ। সমকামী পুরুষ যৌনপেশায় ঠিক কবে এসেছে তার কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। সুপ্রাচীনকাল থেকেই যে সমলিঙ্গের মধ্যে যৌন-সখ্যতা গড়ে উঠেছে তার অনেক দৃষ্টান্ত বিভিন্ন দেশের সাহিত্য, ইতিহাস, ধর্মশাস্ত্রে পাওয়া যায়। শিমেল বা লেডিবয়দের আমরা দুই ভাগে দেখি। একটা ভাগে তাঁরা, যাঁরা বাইরের পুরুষ অঙ্গ, হৃদয়টি নারীময়–এঁরা সমকামী। আর-একটা ভাগে দেখব বাহ্যিক ভাবে দুটো সত্তার প্রকাশ, এরা রূপান্তরকামী। এঁদের কোমরের নীচে পুরুষ, আর কোমরের উপরের অংশ নারীর। অর্থাৎ এঁদের পুরুষদের মতো একটি পুরুষ্ট এবং সক্রিয় লিঙ্গ থাকে, তেমনই বুকে দুটো প্রমাণ সাইজের সুডৌল স্তন থাকে।
একটু বিস্তারিত আলোচনা করা যাক যাঁরা বাইরের পুরুষ অঙ্গ, হৃদয়টি নারীময় তাঁদের নিয়ে। এই নারী চেতনার পুরুষরা মেয়েলি’ ভাবের পুরুষ। এঁরা সাধারণত মেয়েদের সঙ্গে তৃপ্ত হতে পারে না, তাই পুরুষরাই এঁদের যৌনসঙ্গী। পরিবারের চাপে পড়ে কেউ কেউ মেয়েদের সঙ্গে দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করলেও সংসার সুখের হয় না। দু-চারদিন যেতে না-যেতেই মনের মতো পুরুষসঙ্গী পেরে গেলে তার সঙ্গেই মিলিত হয়। এঁরা অনেকেই যৌনপেশার সঙ্গে যুক্ত। এঁরা পুরুষ-শরীরে নারীর প্রসাধন-পরিধানে সজ্জিত হয়ে পুরুষ শিকার করে। এঁরা পুরুষ ক্লায়েন্টদের সঙ্গে যৌনমিলনের জন্য নারীর যৌনাঙ্গের বিকল্প হিসাবে পায়ুপথ ব্যবহার করে। পায়ুকামীদের কাছে এঁদের খুব চাহিদা।
প্রসঙ্গত জানাই, গ্রিক পুরাণে জিউস ও গানাইমেডির বৃত্তান্ত সমলিঙ্গের প্রেম-ভালোবাসার কথা জানা যায়। রোম সম্রাট নিরো ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠুর এবং খামখেয়ালি। তিনি একবার এক তরুণকে বিয়ে করার কথা ভাবেন এবং বিয়েও করে ফেলেন। অবশ্য বিয়ের পরে সেই তরুণ সম্রাটের নির্দেশে স্ত্রীবেশ ধারণ করেছিল। জুলিয়াস সিজারেরও সমলিঙ্গের প্রতি ঝোঁক ছিল। হায়দরাবাদের নবাব টিপু সুলতানও পুরুষদের সঙ্গে যৌনমিলনে লিপ্ত হতেন। পাঞ্জাবের মহারাজা রঞ্জিৎ সিংহ মাঝেমধ্যেই বালকদের সঙ্গে যৌনক্রীড়া করতেন। শরিয়তি নির্দেশকে উপেক্ষা করেই মুসলিম শাসনাধীন রাষ্ট্রে শেখরা অন্য পুরুষদের সঙ্গে যৌন-সম্পর্ক বজায় রাখতেন। খ্রিস্ট্রীয় নবম শতাব্দীতে ইরানীয় এক প্রশাসকের মুখ্য সহকারী ছিলেন মুতাজিলি ইসলাম সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি। তিনি আমজনতার কাছে ঘোষণা রাখেন–মুতাজিলি হল শ্রেষ্ঠ ধর্ম এবং পুরুষ সম্ভোগই যৌন-আনন্দের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম।
অবশেষে নিত্যনৈমিত্তিক বহুগামী যৌন-অভ্যাসের মধ্যেই একসময় অর্থের অনুপ্রবেশ ঘটে। অর্থের বিনিময়ে যৌন-আনন্দ পেতে কেউই পিছ-পা হন না। পুরুষ-যৌনতাকে নিয়ে শুরু হয় ব্যাবসা। এই ব্যাবসার একটি বিশেষ রূপ হল সমকামী যৌন-ব্যাবসা। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে প্রাচীন গ্রিসেই খুব বিক্ষিপ্তভাবে পুরুষ যৌনকর্মীদের ব্যাবসা শুরু হয়। এ বিষয়ে পূর্বে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
যদিও এ পথ মসৃণ নয়, দোষী হিসাবে পুরুষ যৌনকর্মীদের উপর কঠিন শাস্তি নেমে আসে। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, জার্মানি প্রভৃতি দেশে পুরুষ যৌনকর্মীদের উপর রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। শুরু হয় গ্রেফতার। পুরুষ যৌনকর্মীদের এই সময় অত্যন্ত ভয়াবহ অবস্থা হয়। পুরুষ যৌনকর্মীদের ফাঁসিও দেওয়া হয়েছে।
১৮. গণিকাবৃত্তির বিশ্ব-অর্থনীতি
গণিকাবৃত্তির বাজারে নারী নিজেকে পণ্য করে ফেলেছে সজ্ঞানে-অজ্ঞানে। মূল কারণ রাতারাতি ধনী হওয়ার লোভ আর যৌনলালসায়। তাই যৌনবাজার রমরমা। চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জোগানের কোনো ঘাটতি নেই। স্কুল-কলেজের ছাত্রী, গৃহবধূ, উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত–সব শ্রেণি থেকে এখন নতুন পেশায় মেতেছে। শরীরটাকে উত্তরণের সিঁড়ি বানিয়ে নারী ক্রমশ আধুনিকতার দিকে এগিয়ে চলেছে, ফল্গু নদীর মতো অন্তঃসলিলা হয়ে।
সরাসরি দেহব্যাবসার মাধ্যমে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আর্থিক লেনদেন হয়। Havocscope সূত্রে জানা যায়, সারা বিশ্বে শুধু শরীর বিক্রিতেই রেভিনিউ আদায় হয় ১৮৬ বিলিয়ন ডলার। এই হিসাব শুধুমাত্র নথিভুক্ত যৌনপেশায় যুক্তদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অর্থাৎ, সারা বিশ্বের ১৩,২৬৫,৯০০ জন দেহব্যবসায়ীদের হিসাবে। নথিভুক্ত যৌনজীবীদের হিসাব আরও কয়েকশো গুণ। বিশ্বের অনেক দেশে যাঁদের প্রধান আয় আসে যৌন পর্যটন থেকে। সেসব দেশে এখনও সরকারি তত্ত্বাবধানেই দেহব্যাবসা পরিচালিত হয়। এমনকি বাংলাদেশও এখন এ প্রথা অনুমোদন করেছে। গণিকাবৃত্তিতে আগ্রহী যে-কোনো ১৮ বছর বয়সোত্তীর্ণ নারীকে দেহ-ব্যাবসা চালানোর জন্য লাইসেন্স দিয়ে, সারা দেশে ১৪ টি গণিকালয় পরিচালনা করে এবং সেখান থেকে রেভিনিউ গ্রহণ করে।
পৃথিবীতে পতিতাবৃত্তি কিন্তু কোনো বিশেষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। কারণ যখনই অস্থির ও বিপজ্জনক কোনো কিছুর সঙ্গে মোকাবিলা করার প্রয়োজন পড়েছে, তখনই কাজে লাগানো হয়েছে। আবার তাকে নানা কারণে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কখনও আইন, কখনও পরিণতি প্রতিবন্ধকতা দেখিয়ে রোধ করার চেষ্টা করা হয়েছে। উত্তর আয়ারল্যান্ডে যৌনপেশাকে তাই আইনি আওতায় নেওয়া কথা বলা হয়েছে। আবার মার্কিনিরা এই বিষয়ে বেশ সাবলীল। কারণ এখানে যৌনপেশা আইনগতভাবে সিদ্ধ, এখানে আয়ারল্যান্ডের মতো অনুরোধ করাটা বরং আইন সিদ্ধ নয়। বিবিসি রিপোর্ট অনুসারে সুইডেনের স্টকহোমে গণিকাবৃত্তি এলাকার নারীদের সংখ্যা ৭০০ থেকে ৮০০। পরে আইনি আওতাভুক্ত হওয়ায় উৎসাহী পরিসংখ্যান কমিয়ে দেওয়া হয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই যৌনতাকে সংহতির জন্য কাজেও লাগানো হয়। এই সংহতি, শারীরিক ও মানসিক ঘনিষ্ঠতা ভাগ করে নেওয়ার জন্য একজন যৌনসঙ্গী হিসাবে রোগীদেরকে যৌন সমস্যার সমাধান করতে সহায়তা করে। সেই থেরাপিতে যৌন সংসর্গ নাও থাকতে পারে। তবে ঘন ঘন কাউন্সেলিং, মনোবিজ্ঞান ও থেরাপির সাহায্যে যৌনতার ফিল্ডগুলো কাজ করে। এখানে বেশির ভাগই ‘surrogate’ মহিলা এবং অধিকাংশ ক্লায়েন্ট পুরুষ হয়, যদিও ব্যতিক্রম আছে। তবে এই ‘surrogates’ লড়াইয়ে শীর্ষস্থানে যৌনকর্মীরা আছেন।
বিশ্বের প্রায় ৪০ মিলিয়ন মানুষ (নারী ও পুরুষ) গণিকাবৃত্তিতে যুক্ত আছেন। পরিসংখ্যান বলছে ২.৫ মিলিয়ান নারী পাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ যেন এক চরম বাণিজ্যিক ফসল। ঝুঁকিপূর্ণ এই ব্যবসায় বলা হয়েছে, ২ মিলিয়ান শিশু পাচারের শিকার হয়। সমীক্ষকরা এক জায়গায় পাচারের শোষণের কথা বলতে গিয়ে মর্মান্তিক ঘটনার উল্লেখ করেছে। পতিতাদের নাকি রোজ ৫০ জন গ্রাহকের সঙ্গে ঘুমাতে যৌনক্রীড়া করতে হয় এবং উপার্জনের সব টাকা দিয়ে দিতে হয়। সব টাকা না দিলে কাপড় ছিঁড়ে, লাঠি দিয়ে আঘাত করে, আর ইলেকট্রিক শক দিয়ে দুর্বল করে দেওয়া হয়।
গণিকাবৃত্তিতে বয়সের গড় ১৩। কারণ এই বয়স যৌবনের আর সৌন্দর্যময় জীবনের সূত্রপাত। সময় পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু প্রতি ১০ জনের মধ্যে একজন এই পেশা সঙ্গে যুক্ত। তাঁর কারণ বর্তমানে প্রযুক্তির সহজলভ্যতা। এখন অনলাইনেই যৌনতা গোপনে কেনাবেচা করা যায়। অর্থ যেন শরীরসর্বস্ব হয়ে যায় এঁদের জীবনে। কিন্তু গড়ে ৮০ শতাংশ পুরুষ মহিলা ধর্ষণের শিকার হয়। এখানে গণিকাবৃত্তির অভিজ্ঞতা ধর্ষণ। ইতিহাস বলছে ধর্ষিত শ্রেণির মধ্যে সর্বাধিক শিকার হল নারী।
পাশ্চাত্য দেশগুলিতে বড়ো অঙ্কের টাকার হিসাব বলতে পুরুষদের সমানাধিকার স্বীকৃত। এটি তাদের ক্ষেত্রে এক দ্রুততম শিল্প। হাফিংটন পোস্টের রিপোর্ট অনুসারে পাঁচমাসে পাঁচ থেকে পঞ্চাশ হাজার ডলার তাদের উপার্জন করা সম্ভব। কলগার্লরা এক ঘণ্টায় ৫,৫০০ ডলার (প্রায় ৩৮৫৪৭৭ ভারতীয় রুপি) এক ঘণ্টায় উপার্জন করে। সংবেদনশীল প্রত্যাশাগুলি প্রশ্ন করে যে, সত্যিই কি ঘন্টায় এত রোজগার সম্ভব? সেখানে উত্তর আসে যে, এখানে দক্ষতা প্রয়োজন হয়। পরিসংখ্যান বলছে, পেশাভিত্তিক জীবনে এই পরিসেবার বাজার অন্যতম। পরিসংখ্যান আরও বলছে, উচ্চমানের পতিতারা ৪০,০০০ ডলারের (প্রায় ২৮০৬৩৮০ ভারতীয় রুপি) বেশি আয় করে। এমনকি একজন কলগার্ল একজন চাকরিরত পুরুষকে অবাঞ্ছিত বলে মনে করে। এক জায়গায় বলা হয়েছে যে, যৌনকর্মীরা কখনও বাড়ির বউ হবে না। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, বিয়ের বাজারে উপার্জনের সুযোগে খরচ মেটানোর জন্য গণিকাবৃত্তি এক অন্যতম পেশা। তবে এই পেশার নারীরা কেবল সৌন্দর্যময়ই নয়, বরং বুদ্ধিমত্তা আর পরিশ্রমের প্রতীক। অনেকসময় এই অর্থ প্রাপ্তির জন্য মেয়েরা স্টাইলিস হয়। চুল কাটা, নিজেদের পরিচ্ছন্ন রাখা, এমনকি প্ল্যাস্টিক অস্ত্রোপচারে তাঁরা অনেক অর্থ ব্যয় করে। কিন্তু এ সত্ত্বেও অনেকে নির্যাতনের শিকার। অর্থ থেকে এই শারীরিক ব্যাবসা পণ্যের বাজারে শিল্প হিসাবে ধরা দেয়। তবে ২০১৪ সালের হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণিকাবৃত্তির গড়মূল্য ঘণ্টায় ২০০ ডলার (প্রায় ১৪০৩১ ভারতীয় রুপি)। ইউরোপীয় ইউনিয়নের গড় মূল্য ঘণ্টায় ২৫০ ডলার।
থাইল্যান্ডের শহরে গণিকাবৃত্তিতে নিবিষ্ট গ্রামীণ নারীরা বছরে তাঁদের উপার্জন থেকে ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার গ্রামে তাঁদের পরিবারের কাছে পাঠান। ১৯৯৩-১৯৯৪ সময়কালে দেশগুলি গণিকাবৃত্তি থেকে বছরে ২২.৫ বিলিয়ন থেকে ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার উপার্জন করে।
গণিকাবৃত্তি থেকে কত রাজস্ব সংগ্রহ হয় সারা বিশ্বে? এই গণিকাবৃত্তি ফলে বিশ্বব্যাপী রাজস্ব (Revenue) সংগ্রহ হয় প্রায় ১৮৬ বিলিয়ন ডলার। গণিকাবৃত্তি রাজস্ব যেখানে দেশগুলির কাছ থেকে আনুমানিক বাজার মূল্য যুক্ত করে ‘Havocscope’ বিশ্বের গণিকাবৃত্তির আয় হিসাব করে। রাজস্বের অনুমানগুলি জনস্বাস্থ্য কর্মসূচি, আইন প্রয়োগকারী উদ্যোগ এবং অন্যান্য ফৌজদারি বিচার প্রোগ্রামগুলির পাশাপাশি মিডিয়া রিপোর্টগুলির একটি বিস্তৃত উৎস থেকে আসে। আমরা এখন দেখব কোন্ দেশ কত পরিমাণ রাজস্ব সংগ্রহ করে–(১) চিন ৭৩ বিলিয়ন ডলার, (২) স্পেন ২৬.৫ বিলিয়ন ডলার, (৩) জাপান ২৪ বিলিয়ন ডলার, (৪) জার্মানি ১৮ বিলিয়ন ডলার, (৫) আমেরিকা ১৪.৬ বিলিয়ন ডলার, (৬) দক্ষিণ কোরিয়া ১২ বিলিয়ন ডলার, (৭) ভারত ৮.৪ বিলিয়ন ডলার, (৮) থাইল্যান্ড ৬.৪ বিলিয়ন ডলার, (৯) ফিলিপিনস ৬ বিলিয়ন ডলার, (১০) তুরস্ক ৪ বিলিয়ন ডলার, (১১) সুইজারল্যান্ড ৩.৫ বিলিয়ন ডলার, (১২) ইন্দোনেশিয়া ২.২৫ বিলিয়ন ডলার, (১৩) তাইওয়ান ১.৮৪ বিলিয়ন ডলার, (১৪) ইউক্রেন ১.৫ বিলিয়ন ডলার, (১৫) বুলগেরিয়া ১.৩ বিলিয়ন ডলার, (১৬) ব্রিটেন ১ বিলিয়ন ডলার, (১৭) নেদারল্যান্ড ৮০০ মিলিয়ন ডলার, (১৮) ইতালি ৬০০ মিলিয়ন ডলার, (১৯) কাম্বোডিয়া ৫১১ মিলিয়ন ডলার, (২০) ইসরায়েল ৫০০ মিলিয়ন ডলার, (২১) আয়ারল্যান্ড ৩২৬ মিলিয়ন ডলার, চেক প্রজাতন্ত্র ২০০ মিলিয়ন ডলার, (২২) জামাইকা ৫৪ মিলিয়ন ডলার, (২৩) অস্ট্রেলিয়া ২৭ মিলিয়ন Golf (Source : Prostitution: Prices and Statistics of the Global Sex Trade)
২০০৭ সালে কোরিয়াতে ১৪ ট্রিলিয়ন দক্ষিণ কোরিয়ান যৌন-বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জন করেছে ১৩ বিলিয়ন ডলার (আনুমানিক), যা দেশটির মোট দেশীয় উৎপাদনের মোট ১.৬%। কোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল কলেজ পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২৩.১% পুরুষ এবং ২.৬% নারীর যৌনপেশার মধ্য দিয়ে তাঁদের প্রথম যৌন অভিজ্ঞতা হয়েছে। একই সময়ের মধ্যে জনসংখ্যার যৌনকর্মীদের সংখ্যা ১৮%। অর্থাৎ ২,৬৯,০০০ ছাড়িয়ে গেছে। ২০০৭ সালে যৌন-ব্যাবসার লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৯৪ মিলিয়ন ডলার, যা ২০০২ সালে ১৭০ মিলিয়ন ডলার থেকেও কম।
এবার একনজরে দেখে নিতে পারি পৃথিবীর দেশগুলিতে যৌনকর্মীদের গড়মূল্য কত?–(১) আলবেনিয়া : $ ৫০ (এক ঘণ্টায় জন্য), (২) আর্জেন্টিনা : $ ৩০, (৩) অস্ট্রেলিয়া : $ ১৫০ প্রতি ঘণ্টা (এশিয়ান মহিলা জন্য); $ ৩০০ (ককেশীয় মহিলার জন্য), (৪) অস্ট্রিয়া : $ ৭৫ (গণিকাগৃহে দ্রুত সেক্সের জন্য), (৫) বাংলাদেশ : $ ০.৬০ থেকে $ ৩, (৬) ব্রাজিল : যুবতী মেয়েদের জন্য ৫.৫০ ডলার, (৭) ব্রাজিল–ব্রোথেল (রিও): সেন্ট্রালার এ $ ৬০ এন্ট্রি ফি, (৮) ব্রাজিল (ভিলা মিমোসা, রিও) : $ ২০, (৯) বেলারুশিয়ান : $ ৭০ এক ঘণ্টা (গণিকালয়ে), (১০) বেলজিয়াম : রেড লাইট এরিয়াতে $ ৩৫ থেকে $ ৭০, (১১) বেলিজ : $ ২০ (পতিতালয়ে), (১২) ব্রাজিল : $ ১০, (১৩) বুলগেরিয়া : একটি জিপসি সড়ক হুইয়ারের জন্য $ ২৫, (১৪)। কম্বোডিয়া : প্রায় $ ১৫ থেকে ২৫ ডলার (আরডিএল গ্রহণের সময়ে) $ ৫০ (‘স্বল্প সময়ের জন্য’ অথবা সারা রাতে) পর্যন্ত, (১৫) কানাডা : $ ৫০ সড়ক গণিকাবৃত্তি (অধিকাংশ আদিবাসী), $ ২৫০ থেকে $ ৩৫০ এক ঘন্টায়, (১৬) চিন (বেইজিং) : $ ১০০ থেকে $ ৪০০ (এসকোর্ট সংস্থার জন্য), (১৭) চিন : হোটেল স্পা $ ১৩০, (১৮) চিন (সাংহাই) : $ ৬৫০ থেকে $ ১,৬০০, (১৯) চিলি : $ ২৫ (ম্যাসেজ পার্লার ), (২০) কলম্বিয়া : $ ২০০ (ভার্জিন গার্ল সঙ্গে), (২১) কোস্টা রিকা : $ ৩০ (ইয়াং স্ট্রিট হুঁকার), (২২) ক্রোয়েশিয়া : $ ৮০ (বেসরকারি অ্যাপার্টমেন্টে এসকর্ট), (২৩) কিউবা : দ্রুততম জন্য $ ২০ থেকে ৪০ এবং সারা রাত $ ৫০ থেকে $ ১৫০ (২৪) সাইপ্রাস : $ ৭০ থেকে $ ৮০ (সাইপ্রাসের উত্তর দিকের পতিতালয়ে), (২৫) ডেনমার্ক : $ ১৫০ থেকে $ ২০০ প্রতি ঘণ্টায়, (২৬) দুবাই : $ ৮০ থেকে $ ১৫০ (স্টুডিও ফ্লাটে), (২৭) মিশর : $ ২০০ থেকে $ ৪০০ (পর্যটকদের জন্য) এবং $ ২০-এর নীচে (স্থানীয়দের জন্য), (২৮) এস্টোনিয়া : $ ৩০ থেকে $ ৪০ (রাস্তার হুয়াইকার) এবং $ ৮০ থেকে $ ১০০ এক ঘন্টার (প্রাইভেট অ্যাপার্টটেন্ট), (২৯) ফিনল্যান্ড : $ ২৫০ থেকে $ ৩৫০ এক ঘণ্টায় জন্য, (৩০) ফ্রান্স (কান) : $ ৪০,০০০ পর্যন্ত (রাতের জন্য) (৩১) জার্মানিঃ $ ৪০ থেক $ ৬৫ (রেড লাইট জেলাগুলিতে), (৩২) গ্রিস : $ ১৫ থেকে $ ২০ (৩৩) হংকং : $ ২৩২ ডলারে $ ৪০ (হোস্টেস্ট বারে এক-রুমের ব্রোশেল থেকে), (৩৪) হাঙ্গেরি : রাস্তায় $ 30-40, (৩৫) ভারত : $ ১০০০ (কুমারী জন্য), $ ১ থেকে $ ৪ (বয়স্কদের জন্য), (৩৬) ভারত–কলকাতা, কলকাতা গণিকাবৃত্তি আয় : প্রতিদিন $ ২ (৩৬) ভারত–(অনলাইন) : দুই ঘণ্টার জন্য $ ৫০০ পর্যন্ত, (৩৭)। ইন্দোনেশিয়া : $ ৭৮৪ থেকে $ ১,১২০ প্রতি মাসে, (৩৮) ইরান: $ ২০ থেকে $ ৪০ (এলাকার উপর নির্ভর করে। ইরানের সেক্স মূল্য অনেকটা পরিবর্তিত হয়), (৩৯) ইরাক : প্রতি সেশন $ ১০০ থেকে $ ২০০ প্রতি রাতের জন্য, (৪০) আয়ারল্যান্ড : $ ৪৫ থেকে $ ১৩০ (পুরুষ যৌনকর্মী দ্বারা), (৪১) আয়ারল্যান্ড (লিমেরিক) : $ ১০৭ থেকে $ ১৩৩ (অনলাইন), $ ৪০ থেকে $ ৬৬ (রাস্তার মূল্য)। (৪২) ইতালি–$ ৩০ দ্রুতগতির জন্য (হাইওয়ে রাস্তার পাশে জিপসি স্ট্রিট হুয়াইকার) (৪৩) জাপান : এক ঘণ্টার জন্য $ ১২৫ (দক্ষিণ কোরীয় গণিকা দিয়ে), ছোটো মেয়েদের সঙ্গে যৌনকর্মের জন্য $ ১০০, (৪৪) জর্দান: $ ১০০০ পর্যন্ত (ফিলিপিনো নারীদের জন্য), (৪৫) কেনিয়া : $ ৫ থেকে $ ২৫ (তরুণী উগান্ডা মেয়ে সঙ্গে সেক্সের জন্য), (৪৬) কুর্দিস্তান : $ ১৫০ (ইরাকে, তবে কুর্দিশ অঞ্চলের অন্যান্য এলাকায় আরও সস্তা), (৪৭) কুয়েত: $ ৫০০ থেকে $ ৭০০ প্রতি ঘণ্টার জন্য, (৪৮) লাতভিয়া : $ ৫০ (ইন কল), (৪৯) রাশিয়া : $ ৩০ থেকে $ ৫০, (৫০) মাদাগাস্কার : $ ১৫ (এক সেশনের জন্য), (৫১) মালদ্বীপ : $ ১০ (তরুণী মেয়ে), (৫২) মালি : $ ২ থেকে $ ৪ (তরুণ হুইয়ার জন্য), (৫৩) মালয়েশিয়ায় : $ ১০০ (যুবতী মেয়েদের সঙ্গে যৌনকর্ম করার জন্য), (৫৪) মেক্সিকো : $ ৩০, (৫৫) মোন্দাভিয়া : $ ৩০ (রাস্তায়), (৫৬) মোনাকো : $ ৬০০০ থেকে ১২০০০ (রাতের বিলাসিতা এসকর্টদের জন্য), (৫৭) মরোক্কো : $ ২৫ থেকে শুরু, (৫৮) নেপাল : প্রায় $ ২০ থেকে $ ২৫ (রাস্তার), (৫৯) নেদারল্যান্ডস (আমস্টারডাম) : $ ৪৫ থেকে $ ৭০ (১৫ মিনিটের জন্য, (৬০) নেপাল : নেপালি যুবকের সঙ্গে যৌনকর্মের জন্য), (৬১) ইতালি : $ ১৩ (নাইজেরিয়ান নারী প্রতি লেনদেনের জন্য) (৬৩) আইভরি কোস্ট : $ ২ (নাইজেরিয়ান নারীদের প্রতি কাজে) (৬৪) নরওয়ে : $ ১০ থেকে $ ৫০ (আফ্রিকান রাস্তার মেয়েরা); $ ২৫০ (অনলাইন ইনকল বেশিরভাগ পূর্ব ইউরোপীয়); $ ৪০০ (নেটিভ নরওয়েজিয়ান মেয়েরা) (৬৫) ওমান : $ ২৫ থেকে $ ৩৫ (অল্প সময়ের জন্য) এবং $ ১৫০ (চিনা যৌনকর্মীদের সঙ্গে দীর্ঘ সময়ের জন্য) (৬৬) পাকিস্তান: $ ৬ (স্থানীয়দের জন্য, পর্যটক আরও বেশি অর্থ প্রদান করে), (৬৭) পানামা : $ ২০০ থেকে $ ৩০০ (স্ট্রিপ ক্লাবের জন্য), (৬৮) পেরু : $ ৫০ (গণিকালয়ে প্রতি ঘণ্টায়), (৬৯) ফিলিপিন্স (উপকণ্ঠে) $ ৬ থেকে $ ১৫ (রাস্তার হুইয়ার); $ ৪০ (নাইট ক্লাবের ফ্রিল্যান্সার মেয়েরা), (৭০) পোল্যান্ড : $ ৪০ (একটি গণিকাগৃহে মধ্যে একবার যৌনসঙ্গমের জন্য), (৭১) পর্তুগাল : $ ৩৫, (৭২) কাতার : $ ৫৫ থেকে $ ৮০ (বারের মেয়ে), (৭৩) ম্যাসেডোনিয়া প্রজাতন্ত্র : $ ২০, (৭৪) রোমানিয়া: $ ২৫ থেকে $ ৩০ (রাস্তায় গণিকা), (৭৫) রাশিয়া : $ ৬০ থেকে $ ১০০ (গণিকালয়ে এক ঘণ্টার জন্য) (৭৬) স্কটল্যান্ড : $ ৪৮, (৭৭) সিঙ্গাপুর : $ ২৫০০০ ( তিনদিনের সফরের জন্য); $ ৪৭ থেকে $ ৫৫ (তরুণীদের জন্য), (৭৮) সিঙ্গাপুর : $ ১১১ থেকে $ ১১৯ (অনলাইনে ৯০ মিনিটের জন্য), (৭৯) দক্ষিণ কোরিয়া (দক্ষিণ সিউল) : $ ১১৭, (৮০) দক্ষিণ কোরিয়া : $ ২৭৫ (অল্পবয়স্ক মেয়ে), (৮১) স্পেন (মাদ্রিদ) : $ ৩৫, (৮২) সুরিনাম : এক গ্রাম স্বর্ণ, (৮৩) সুইজারল্যান্ড : $ ১০০, (৮৪) সিরিয়ার নারী : $ ৭ (শরণার্থী শিবিরে), (৮৫) তাইওয়ান : $ ৩৪৪ (দক্ষিণ কোরীয় প্রবাল্টি জন্য), (৮৬) থাইল্যান্ড : $ ৩০ থেকে $ ৬০ (বারগার্ল), (৮৭) তুরস্ক : $ ৫০০ (ভিআইপি সেবার জন্য) এবং $ ২০ (রেড লাইট এরিয়া), (৮৮) তিউনিশিয়া : $ ১৫ থেকে $ ২৫, (৮৯) ইউক্রেইন্ : $ ১২৪ থেকে $ ২৪৮ (বিদেশি ভাষাভাষী যৌনকর্মীর জন্য), (৯০) ইউনাইটেড কিংডম : $ ৩০, (৯১) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র : $ ৪০ থেকে $ ১০০ (রাস্তায় গণিকাবৃত্তি জন্য); প্রতি ঘণ্টায় $ ৫০০ (ইন্ডিয়ানাপোলিসে হাই-এন্ড এসকোর্ট); $ ১০,০০০ এক রাতের জন্যে (NYC মধ্যে সর্বোচ্চ এসকর্ট); $ ২০০ থেকে $ ৬০০ (নেভাদা মধ্যে বৈধ ব্রোথেল); $ ১৫০ থেকে $ ৩০০ (ম্যাসেজ পার্লার : ওরাল সেক্স এবং ইন্টারকোর্স সম্পর্কের জন্য); $ ৮,০০০ থেকে $ ১০,০০০ (ম্যাসেজ পার্লারের ওয়ার্কার); $ ৪০ (মিনেসোটার তরুণ মেয়েদের সঙ্গে ওরাল সেক্সের জন্য); $ ৪০ থেকে $ ৮০ (হাউস্টন, টেক্সাসের রাস্তায় যৌনকর্মীর সঙ্গে)।
পরিসংখ্যান বলছে, শিকাগো শহরে সেক্স ব্যাবসায় উপর আলোকপাত করে। এখানে গণিকাবৃত্তি বাজার কেবলমাত্র ব্যাবসার কাজ করে। বাজার সবসময় ক্রেতা আর বিক্রেতা দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে। এখানে লেনদেন একসঙ্গে পারস্পরিকভাবে চলে। এখানে চার্জ নির্ধারিত হয় আলোচনা, কন্ডোম সবকিছুর উপর নির্ভর করে। তবে গণিকারা তাঁদের নিজেদের জন্য ক্রেতাদের খুঁজে নেয়। সম্প্রতি এক গবেষণায় শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টিভেন ডি লেভিত এবং সুধীর আল্লাদি ভেঙ্কটেশ্বর শিকাগোর পুলিশ বিভাগ থেকে সর্বজনীনভাবে নির্ভরযোগ্য তথ্য বলছে, ১৬০ জন গণিকা দ্বারা পরিচালিত ২০০ টি গণিকাগৃহ বর্তমান। এঁরা ট্র্যাডিশনাল মার্কেটিং চানেলে সহজলভ্য নয়। তবে শপিংমলের দোকানে এরা যথেষ্ট পরিচিত। গণিকাবৃত্তিতে অপরিচিত ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলেও মাদক বিক্রয়ে এরা সম্পৃক্ত নয়। রোজল্যান্ডের গণিকারা বাইরের কাজ করে না, যদিও পুলেমানের সমস্ত রাস্তার গণিকারা কাজ করে।
১৯. গণিকালয়ের নাম সোনাগাছি
গণিকা ও গণিকালয় নিয়ে লেখালেখি হবে, অথচ সোনাগাছি নিয়ে আলোচনা হবে না! সোনাগাছি নিয়ে আলোচনা করার জন্য তাই আলাদা একটি অধ্যায় রাখা হল। সোনাগাছি’, এই শব্দটি ফিসফিস করে উচ্চারণ করতে হয় ভদ্রসমাজকে। অনেকে অবশ্য সোনাগাছি না-বলে গণিকাপল্লি বোঝাতে ‘বি কে পাল অ্যাভিনিউ’ বা ‘চিৎপুর’ বা ‘যাত্রাপাড়া’ও বলে থাকে। সোনাগাছি, এই শব্দটির সঙ্গে গণিকাপল্লির ৪০০ বছরের ইতিহাস আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। সুনামেই হোক বা দুর্নামেই হোক–গণিকালয় হিসাবে সোনাগাছি অদ্বিতীয়তম্। ‘সোনাগাছি’ আর ‘গণিকালয়’ আজ একটি সমার্থক শব্দ। বাংলা সাহিত্যে-সিনেমায় কখনোই উপেক্ষিতা হয়নি। বাংলা সাহিত্যে-সিনেমার আনাচে-কানাচে সোনাগাছির অন্ধকার উঠে এসেছে।
বস্তুত ব্রিটিশ-ভারত সরকারের আমলেই সোনাগাছি বৃহৎ আকার ধারণ করে। এলাকা বৃদ্ধি আজও অব্যাহত। শুধু ঊনবিংশ শতাব্দীই নয়, বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সোনাগাছির সীমানা ছিল উত্তরে কর্নওয়ালিস স্ট্রিট (বর্তমানে বিধান সরণি), দক্ষিণে চিৎপুর রোড (বর্তমানে রবীন্দ্র সরণি), পূর্বদিকে শোভাবাজার বি কে পাল অ্যাভিনিউ এবং পশ্চিমে জোড়াসাঁকো ঠকুরবাড়ির প্রায় সংলগ্ন অঞ্চল। পরে সোনাগাছির মাঝখান দিয়ে একটা রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। উত্তর থেকে দক্ষিণে, অর্থাৎ বাগবাজার থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত। শুরুতে চিত্তরঞ্জন, পরে ভূপেন্দ্র বসু অ্যাভিনিউ। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের পূর্বদিকের অঞ্চলটায় ক্রমশই নির্বাসিত হল গণিকারা। সোনাগাছির উল্টোদিকের দর্জিপাড়া অঞ্চলটি ক্রমশই গৃহস্থদের দখলে চলে যাচ্ছে। অথচ এই দর্জিপাড়াই একসময় গণিকাপল্লির সমার্থক ছিল। এখন সেখান থেকে গণিকাদের পাততাড়ি গোটাতে হয়েছে। নবনির্মিত গৃহস্থ পাড়ায় গণিকাদের জায়গা দিতে নারাজ ভদ্র বাবুবিবিরা। এইভাবেই দর্জিপাড়া হাতছাড়া হয়ে গেল গণিকাদের। এলাকা ছোটো হোক বা বড়ো, এখন পুরো অঞ্চলটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘রেড লাইট এরিয়া হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। অনেকে বলেন এশিয়ার সর্ববৃহৎ নিষিদ্ধপল্লি। ভারতের তো বটেই, পশ্চিমবঙ্গেরও।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই সোনাগাছির জন্ম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঠাকুর্দা দ্বারকানাথ ঠাকুর ইংরেজদের হাতে তামুক খেতে খেতে ‘প্রিন্স’ উপাধিও পেয়ে গেছেন। আর এটা পেয়েছেন ইংরেজদের ভেট দিয়ে। ভেটের মধ্যে অন্যতম ছিল নারীশরীর। দ্বারকানাথ নিজেও ছিলেন প্রচণ্ড নারীবিলাসী। স্বদেশ-বিদেশ যেখানের তিনি থাকুন না-কেন নারীই তাঁর নিত্যসঙ্গী। তিনি জাহাজের ব্যাবসা, নীলের ব্যাবসা, সিল্কের ব্যাবসা সবেতই দখল নিয়েছিলেন ইংরেজদের আনুকূল্যে। ইংরেজদের আনুকূল্যে পেয়েছিলেন বিশাল জমিদারি। জোড়াসাঁকো থেকে শোভাবাজারের জমি। এই অংশেই ছিল সোনাগাছি অঞ্চল। আসলে এই অঞ্চলটির আদি নাম সোনাগাজির চত্বর। এই সোনাগাজিই লোকের মুখ-ফেরতা হয়ে হয়ে এখন সোনাগাছি। কেউ বলেন, স্বর্ণ নামে এক বাইজি ওই এলাকায় বাস করত। তাঁর নাম থেকেই সোনাগাছি। আবার কেউ বলেন, সোনাগাজি বা মুসলিম পির সনা উল্লাহ গাজি নামে এক পির বসবাস করত। তাঁর নামে একটি মসজিদও আছে এই এলাকায়। ৩০০ বছরের পুরোনো সেই মসজিদ। সেই সোনাগাজি থেকেই নাকি সোনাগাছি।
বিভিন্ন সময়ে কলকাতা শহরে আরও অনেক নিষিদ্ধপল্লি গড়ে উঠেছিল। যেমন মধ্য কলকাতার বউবাজার এলাকার হারকাটা গলি, দক্ষিণ কলকাতার কালীঘাট অঞ্চল, খিদিরপুর সহ আরও বহু জায়গায় তৈরি হয় গণিকাপল্লি। একসময় হুতোম কলকাতাকে ‘বেশ্যাশহর’ আখ্যা দিয়েছেন। বুলবুলির লড়াইয়ে কলকাতা শহরে হুতোমি ডিকশনে ‘বেশ্যাবাজী’ ছিল বড়ো মানুষের এলবাত। শুধু সোনাগাছি অঞ্চলেই আছে ১০,০০০ যৌনকর্মী। আছে কয়েকশো বহুতল বাড়ি। সোনাগাছি অঞ্চলে যৌনকর্মীরা আসে সাধারণত নেপাল, বাংলাদেশ থেকে এবং ভারতের অন্য রাজ্য থেকেও। আছে নানা ভাষাভাষীর মানুষ। গোটা ভারতবর্ষই ঢুকে পড়েছে সোনাগাছির অন্দরমহলে। এখানকার কোনো বাড়ি ৫ কামরার তো কোনো বাড়িতে ২৫ কামরা। এমন কয়েকশো বাড়িতে যৌন পরিসেবা দিয়ে চলেছে যৌনকর্মীর মেয়েরা। আবার দেখা গেছে একই ঘরে একাধিক পার্টিশন দিয়ে যৌনকর্ম চলে। সেই পার্টিশনগুলি এতটাই সংকীর্ণ যে, কোনোমতে দুটো শরীরই আটতে পারে।
সোনাগাছির বর্তমান অবস্থান উত্তর কলকাতার মার্বেল প্যালেসের উত্তরে চত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, শোভাবাজার ও বিডন স্ট্রিটের সংযোগস্থলের কাছে। নানা ক্যাটাগরির যৌনকর্মী অপেক্ষা করে থাকেন রসিক ক্লায়েন্টদের জন্য। শরীর-মূল্য প্রতি ঘণ্টায় ১০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকা বা তারও বেশি। এই সমস্ত পল্লি এলাকায় ঢুকলেই। চোখে পড়বে গলির দু-ধারে এবং আশেপাশে বিভিন্ন বয়সের মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে। এঁরা মুখে সস্তার রং মেখে উৎকট প্রসাধনে সেজে বিশেষ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে। এঁরা নিজের নিজের ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে, গলির মুখে দাঁড়ায়, দরজায় চৌকাঠে। এঁদের শরীর-মূল্য খুবই কম। উচ্চমূল্যে, অতি উচ্চমূল্যে শরীর বিক্রি করেন এমন যৌনকর্মীও আছে এই পল্লিতে। তাঁদের খুঁজে নিতে হয়। যাঁর যেমন সামর্থ্য সে তেমন মূল্যের যৌনকর্মীর যৌন পরিসেবা নেন। তবে যিনি যে মূল্যেই যৌন-পরিসেবা নিক না-কেন কন্ডোম বাধ্যতামূলক। শুধু সোনাগাছিই নয়, কন্ডোম ছাড়া কোনো এলাকার কোনো যৌনকর্মীই যৌন-পরিসেবা দেয় না।
সোনাগাছিতে বেশকিছু বিলাসবহুল বাড়ি আছে, যেখানে উচ্চমূল্যের যৌনকর্মীরা থাকে। বাড়িগুলি বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন–প্রেমবন্ধন, নাইট লাভার্স, ১২ নম্বর, কাঞ্চন প্যালেস, গঙ্গা-যমুনা, নীলকমল ইত্যাদি। এঁদের বেশিরভাগই ভিনরাজ্যের। আগ্রা, দিল্লি, পাঞ্জাব ইত্যাদি প্রদেশ থেকে আসা মেয়েরা। এঁরা শীততাপনিয়ন্ত্রিত ফানিশড সুগন্ধযুক্ত ঘরেই যৌন পরিসেবা দিয়ে থাকে। যদিও এইসব বাড়িগুলি ছাড়াও অন্য বাড়িতেও যৌনকর্মীরা ফার্নিশড ঘর না-হলেও শীততাপনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা রেখেছে। তবে তার জন্য অতিরিক্ত ৬০০ টাকা গুণতে হয় ক্লায়েন্টকে। নামাঙ্কিত বাড়িগুলির মাসিক ভাড়া ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। তাহলে বুঝতেই পারছেন এইসব বাড়ির যৌনকর্মীদের শরীর-মূল্য কত হতে পারে! যেমন গুড় তেমন মিষ্টি আর কী! এইসব যৌনকর্মীর শুধু যৌন-পরিসেবাই দেয় না, সঙ্গে নাচ-গানও চলে। শুধু নাচ-গানও শুনতে বা দেখতেও কেউ কেউ আসে এখানে। নাচ বলতে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে নাচ। যৌনমিলন ছাড়া এই ধরনের কাজের রেটও আলাদা। ৩২০০ টাকা থেকে শুরু। যৌনকর্মে আলাদা রেট। আজকাল সোনাগাছির কিছু কিছু বাড়িতে ম্যাসাজ সেন্টারের নামেও এক ধরনের যৌনপেশা চালু হয়েছে। বলা হয়, ১৫ মিনিটের ‘ফুল বডি ম্যাসাজের রেট ৫০০ টাকা, ‘অন্য কিছু চাইলে প্রতি ঘণ্টায় ১৫০০ টাকা। পারিশ্রমিকের এত বৈচিত্র্য ভারতের আর কোনো গণিকালয়ে পাওয়া যায় না। যেমন সোনাগাছির ‘আগ্রাওয়ালিদের কোঠি’ বলে পরিচিত এই বাড়ির যৌনকর্মীদের কাছ থেকে যৌন পরিসেবা নিতে হলে বেশ চড়া মূল্য গুণতে হয়। যে-কোনো যৌনপল্লিতে প্রবেশ করলেই দুটি শব্দ আপনার কানে আসবে। একটি হল—‘বসবে’? এখানে বসবে’ মানে আমার সঙ্গে শোবে’? দ্বিতীয় শব্দটি হল–‘শট’। শট শব্দের মানে যোনিমূলে লিঙ্গের প্রবেশ (Penetration)। অর্থাৎ ক্লায়েন্ট কতবার যৌনমিলন করবেন। প্রতি যৌনমিলনে রেট নির্ধারিত হয়। এক একটি ইনিংস কমপক্ষে এক ঘণ্টার হয়ে থাকে। তবে। ক্লায়েন্টের বীর্যস্থলনের সঙ্গে সঙ্গে একটি শট শেষ হয়ে যায়।
সোনাগাছিতে তিন শ্রেণির গণিকাদের পাওয়া যায়—(১) যাঁরা এই অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দা। এঁরা হয় বিক্রি হয়ে আসা, নয় পাচারকৃত হয়ে আসা, নয় প্রতারণার শিকার হয়ে আসা। (২) যাঁরা স্থায়ী বাসিন্দা নয়, সকালে এসে কাজ করে সন্ধ্যায় নিজের বাড়ি ফিরে যায়। প্রয়োজন হলেই ফুল নাইট’ কাজ করে। ফুল নাইট কাজ তখনই করে, যখন কোনো একজন ক্লায়েন্ট তাঁকে সারা রাতের জন্য চায়। এঁদের বয়স মোটামুটি তিরিশের নিচে। এঁরা স্বেচ্ছায় এই পেশা বেছে নিয়েছে। এবং (৩) এঁরা স্থায়ী বসিন্দা যেমন নয়, তেমন বাড়ি থেকে এসেও এখানে ঢোকে না। এঁরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা এসে কাছাকাছি বিভিন্ন মানুষের যাতায়াতের জায়গায় দাঁড়ায়। যেমন–উল্টাডাঙা বা শিয়ালদহ স্টেশন সংলগ্ন এলাকা, বুকিং কাউন্টারের সামনে, ভিআইপি ফুটব্রিজের উপরে, আশেপাশে ক্লায়েন্টের জন্য অপেক্ষা করে। এছাড়া ছবিঘর, প্রাচী, মেট্রো, পূরবী সিনেমা হলের সামনে শো টাইমে দাঁড়ায়। ক্লায়েন্ট জুটে গেলে তাঁকে নিয়ে সোজা সোনাগাছির কোনো ঘরে নিয়ে এসে যৌন পরিসেবা দেয়। কেউ কেউ কাছাকাছি হোটেলেও পরিসেবা দেয়। এইসব যৌনকর্মীরা সাধারণত মধ্যবয়স্কা ও পড়ন্ত যৌবনা। এঁরাও স্বেচ্ছায় এই পেশা বেছে নিয়েছে। সবাই যে শুধুমাত্র পেটের জন্য আসে, তা নয়। কথা বলে জানা গেছে, অনেক মেয়েরা বহুগামিতা চেতনা থেকেও এই পেশায় আসে। তাঁদের বহু পুরুষের সঙ্গ না পেলে ভালো লাগে না। তাঁদের কাছে যৌনতা একটা প্যাশন। জনৈক শরীর-ব্যাবসায়ী স্পষ্টত জানালেন–“আমি আমার ক্লায়েন্টদের ক্লায়েন্ট’ ভাবি না। বন্ধু ভাবি এবং ভাবাই। আর্থিক লেনদেন থাকলেও ক্লায়েন্টদের বন্ধু হই এবং বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করি। ক্লায়েন্টদেরও বোঝাতে সক্ষম হই যে, আমি তোমার কিছু মুহূর্তের জন্য যৌনসঙ্গী হলেও, বন্ধুও। বিভিন্ন পুরুষের সঙ্গে সেক্স করতে আমার ভালো লাগে। বিচিত্র যৌন অভিজ্ঞতা হয় আমার, যা খুবই মজাদার। পূর্ণ স্বাধীনতায় আমি আমার কাজ করি। ইচ্ছে হল করি, ইচ্ছে না হলে করি না। বাড়িতে রেস্ট নিই। আমি সোনাগাছি অঞ্চলে কাজ করি বটে। কিন্তু থাকি না। ঘড়ি ধরে বাড়ি থেকে বেরোই, আবার ঘড়ি ধরে বাড়িতে ঢুকে যাই। বেরোনোর সময় কোনো ক্লায়েন্ট এলেও ছেড়ে দিই। বাড়ির সবাই জানে আমি চাকরি করি। এটা আমার কাছে এখন আর পেশা নয়, নেশা। অর্থ ও যৌনসুখ দুই-ই পাই।”
অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর বখে যাওয়া বাঙালি বাবু’ সম্প্রদায় এই অঞ্চলে নিজ নিজ উপপত্নীদের প্রতিপালন করতেন। এই অঞ্চলের বেশ কিছু বাড়ি নির্মিত হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। প্যারিসের যৌনকর্মীরাও এই সোনালি অঞ্চলের (Golden District) খ্যাতি সম্পর্কে অবহিত ছিল। সেই বাবু সম্প্রদায় আজ নিশ্চয় নেই। তবে অন্য এক বাবুরা তো আছেন যাঁরা লুকিয়ে গণিকাদের সঙ্গ নেন। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে সমাজের মান্যগণ্য অনেক ব্যক্তিবাবুরাই গণিকালয়ে পদধূলি দেন। সোনাগাছিতে আর-এক ধরনের ‘বাবু’-র সন্ধান পাওয়া যায়। আসুন, সেইসব বাবুদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই।
সোনাগাছির অন্দরমহলে ‘বাবু’ কাকে বলে? নিষিদ্ধপল্লিতে ‘বাবু’, ‘বসা’, ‘বাড়ি’ ইত্যাদি শব্দগুলির চালু আছে। শুধু বাবুদের কথাই বলি, সাধারণ ক্লায়েন্ট বা খরিদ্দারদের আর বাবুদের মধ্যে তফাতটা বুঝে নিই। বাবু তাঁরাই, যাঁরা যৌনকর্মীদের খরিদ্দার। সাধারণ খরিদ্দাররা শুধুমাত্র যৌন উত্তেজনা প্রশমণ করতে যৌনকর্মীদের সঙ্গ নেয় কিছু সময়ের জন্য। এঁদের অন্য কোনো দায় নেই। পয়সা ফেলবে, তার বিনিময়ে যৌনসুখ নেবে। ফেলো কড়ি মাখো তেল। কিন্তু বাবুদের দায় আছ। দায় থাকে। বাবু হল বাঁধা কাস্টমার, যাঁর সঙ্গে একজন যৌনকর্মীর সম্পর্ক প্রায় স্বামী-স্ত্রীর মতো। সেই সম্পর্কে ভালোলাগা থাকে, ভালোবাসা থাকে, আবার একটু আশ্রয়ের জন্যেও হতে পারে। এই যৌনকর্মীরা মূলত সোনাগাছি এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা। বাঁধা খরিদ্দারের দায়িত্ব অনেক বেশি। এঁরা বসন্তের পাখি নয়। এঁদের কেউ কেউ উপাসনালয়ে গিয়ে শাখাসিঁদুর পরিয়ে বিয়েও করে নেয়। কাঁধে তুলে নেয় আজীবনের দায়িত্বভার। এঁরা গণিকাপল্লিতে ‘বাবু’ হিসাবেই পরিচিত।
সমাজের যে-কোনো স্তরের খরিদ্দাররাই বাবু হতে পারে। কোনো বাছবিচার নেই। অফিসের পিওন থেকে শুরু করে কোনো উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী, ডাক্তার, আইনজীবী, মাফিয়া ডন, পুরোহিত, কুলি-কামিন, ঠ্যালাওয়ালা–কে নয়! তবে সব মাছ যেমন ইলিশ নয়, তেমন সব পুরুষই জাত-বাবু নয়। বাবুদেরও প্রকারভেদ আছে। বাবুদের দায়বদ্ধতাকে কেন্দ্র করেই প্রকারভেদ।
(১) টাইমের বাবু : ইনি সেই পুরুষ, যিনি কাম্য নারীর কাছে টাইমে আসেন, টাইমেই যান। মধু খেতে আসেন, খাওয়া হলেই ফুড়ৎ। ইনি বসন্তের পাখি। দায়িত্ব তো নেই-ই, উলটে বিপদ বুঝলেই ধা। তবে নীতিগতভাবেই এই পুরুষটি অন্য মেয়ের ঘরে যান না। তাই ইনি বাঁধা বাবুর মর্যাদা পান।
(২) সাহসী বাবু : ইনি সেই পুরুষ, যিনি ভালোবাসার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। যৌনকর্মীটিকে বিয়েও করেছেন। বিয়ে করে নিজের বাড়িতেও নিয়ে যান মর্যাদার সঙ্গে নিজের বাড়ি না-থাকলে ঘর ভাড়া করেও অন্যত্র থাকেন।
(৩) অভিজাত বাবু : ইনি সেই পুরুষ, যিনি ভালোবাসার বিবিকে সাহস করে নিজের বাড়ি বা অন্য কোথাও নিয়ে যেতে পারে না। তবে বিবিটির সারাজীবনের দায়িত্ব নেন। অন্য কোনো বাবুর সঙ্গে সেই বিবি সহবাস করতে পারবে না। তবে বাবুটি মেয়েটির ‘যৌনকর্মী’ হিসাবে বিশ্বস্ত থাকবেন, এমন কোনো গ্যারান্টি নেই। বাবুটি অন্য একাধিক যৌনকর্মীর সঙ্গে শোবেন, শুতে পারেন।
(৪) খাওয়া-মোছা বাবু : এই বাবু অবশ্য কাঠ-বেকার পুরুষ। কোনো যৌনকর্মীর অন্নে প্রতিপালিত হয়। বিনিময়ে ঘর মুছে দেওয়া, রান্না করে দেওয়া, বাজার করে দেওয়া, বিভিন্ন ফাইফরমাস খাটা ইত্যাদি।
পড়ন্ত বয়সে যৌনকর্মীদের পরিণতি কী? এই প্রশ্নটার উত্তর তো খুঁজতে হবে। দুটি পরিণতি দেখতে পাওয়া যায়–(১) গেরস্ত হওয়া এবং (২) হাফ-গেরস্ত হওয়া। গেরস্ত হওয়া মানে যদি কোনো বাঁধা বাবু’, সে মজুর দালাল পাতি চাকুরে বা ব্যাবসায়ী যেই হোক তাকে ধরে কপালে সিঁদুর নিয়ে কোথাও সংসার পাতা যায়। অপরদিকে হাফ-গেরস্ত মানে অন্তত কোনো বাঁধা বাবু’ পাওয়া, যে তাঁকে বিপদে-আপদে দেখবে, হয়তো দু চার পয়সা মূলধন দিয়ে সাহায্য করবে, যাতে কিনা সে কালেকালে বাড়িওয়ালি’ হয়ে উঠতে পারে। এইভাবেই তাঁর পেশার উত্তরণ হয়। এই দুয়ের মধ্যে কিছুই না-হলে ক্ৰমে ওই পল্লিতেই ঝি-গিরি করে পেট চালাতে হয়। নয়তো পথে পথে ভিক্ষে করে বেড়াতে হয়। যদি দেশ-গাঁঘর-আত্মীয় বলে কিছু খুঁজে পাওয়া যায়, তবে। সেখানেই বেঁচে থাকার অন্তিম ঠাঁই মেলে।
যে সমস্ত পুরুষরা ওই পাড়ায় থাকে তাঁরা অধিকাংই নেশাগ্রস্ত, বেকার, গণিকাদের উপার্জনের নির্লজ্জ পরজীবী। ওইসব নিষ্কর্মা গুলিশোর পুরুষরাই ওদের (গণিকাদের) প্রহার করে, অত্যাচার করে। সংগঠনের সদস্য অলংকৃত করে, মতামত প্রদান করে। এইসব পুরুষপুঙ্গবদের হাত থেকে, দালালদের হাত থেকে, মাসিদের হাত থেকে অত্যাচারিত মেয়েদের রক্ষা করতে পারবে কারা? সংগঠন? সংগঠনের কর্মকাণ্ডে মিশে গেছে অত্যাচারী যাঁরা, তাঁরাও। গণিকাপল্লির স্থায়ী বাসিন্দা দুর্ভাগা গণিকাদের কথা বলবে কারা? সংগঠন? ওদের কণ্ঠ কারা? সংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবীরা, যাঁরা মৌচাকে রানি-মৌমাছি হয়ে বসে আছে পিরামিডের চূড়ায়। সংগঠনের অফিস আছে, অফিসে মোটা বেতনের চাকুরে আছে, সংগঠনের প্রেস আছে, সভা-সমিতি আছে। সংগঠনের রাজনীতি আছে। পাড়া কোন রাজনৈতিক দলের কুক্ষিগত থাকবে, তা নিয়ে নিত্য লড়াই-সংঘর্ষ আছে।
যৌনপল্লির মেয়েদের যৌনজীবন ঠিক কেমন? গড়পড়তা একজন যৌনকর্মীকে প্রতিদিন কমপক্ষে চারবার যৌন-সম্পর্ক করতেই হয়। দিনের বা রাতের খরিদ্দারটির জন্য যখন সে ‘বসছে’, তখন সে অবসন্ন, ক্লান্ত। সপ্তাহে সাতদিন, মাসে তিরিশ দিনে, বছরে তিনশো পঁয়ছট্টি দিন নিরন্তর যৌবন বিক্রি করতে হয় যৌনকর্মীদের। ইচ্ছা হলে কাজ করব, না-ইচ্ছা হলে কাজ করব না–এমন চিন্তা মাথাতেই আনতে পারবে না। যৌনপল্লির এইসব স্থায়ী বাসিন্দারা। এঁদের একপ্রকার যৌনদাসীই বলা যায়। এঁরা শ্রমিক, যেমন কলকারখানায় কায়িক শ্রমের বিনিময়ে অর্থোপার্জন করে। ভালো না-লাগলেও একঘেয়ে লাগলেও শ্রম দিয়ে যেতে হয়। কারণ এই শ্রমটা না-দিলে সেই যৌনকর্মীর মুখে ভাত উঠবে না। বসিয়ে বসিয়ে কে কাকে খাওয়ায় এ পৃথিবীতে!
বিচ্ছিন্ন প্রবাসী শ্রমিকদের বস্তির মধ্যে গণিকাপল্লি এখনও জাঁকিয়ে বসতে পারেনি, যেখানে কলকাতার মেয়েরা ওভারটাইম খাটে। গণিকাদের কাজ হল যথাযথ অর্থের বিনিময়ে পুরুষদের যৌনসুখ দিতে হয়। শুধুই কি যৌনসুখ? একজন পুরুষ যখন মূল্য দিয়ে একতাল নারীমাংস ভাড়ায় নেয়, তখন সে মনে করে সব কিনে নিয়েছে। তখন যৌনসুখ যৌনকর্মীদের মাথায় উঠে যায়। ক্রেতাপুরুষটি মনে করে মূল্য যখন সে দিয়েছে, তখন সে যা খুশি করতে পারে। সে যেমন সঙ্গম করতে পারে, তেমনি যৌন-বিকৃতি চরিতার্থ করতে পারে, যৌনকর্মীকে প্রহার করতে পারে, ধর্ষকাম মেটাতে পারে, যৌনকর্মীর যৌনাঙ্গে জ্বলন্ত সিগারেট ঠুসে দিতে পারে।
শুধু কলকাতার সোনাগাছিই নয়। সোনাগাছি ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি প্রসিদ্ধ যৌনপল্লি আছে কলকাতাতে। যেমন হাড়কাটা গলি, বউবাজার, খিদিরপুর আরও অনেক। কলকাতা ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলাতে অসংখ্য গণিকাপল্লি আছে। জেলার হোটেল ও রিসোর্টগুলিতেও যৌনকর্মীদের রমরমা ব্যাবসা চলে।
২০. উত্তরণ: বেশ্যা থেকে যৌনকর্মী
গণিকাপল্লির স্থায়ী বাসিন্দা গণিকাদের ‘যৌনকর্মী’ বা ‘বেশ্যা’ যাই বলা হোক না-কেন, তাঁদের ‘যৌন-ক্রীতদাসী’ বলাটাই সবচেয়ে যুক্তিসংগত। সিটি কলেজের অধ্যাপক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য এক সাক্ষাৎকারে স্পষ্টভাবে বলেছেন–”যাঁদের দেহ বেঁচে খেতে হয়, তাঁদের ‘যৌনকর্মী’ বলে এই কুপ্রথাটিকে এক ধরনের অনুমোদন (স্যাংশান) দেওয়ায় আমার প্রবল আপত্তি আছে। পদ্মলোচন নাম দিলে অন্ধের দৃষ্টি ফেরে না। দেহব্যাবসা শ্রেণিসমাজের বহু কলঙ্কের একটি শ্রেণিপূর্ব সমাজে এমন কোনো কুৎসিত পেশা ছিল না। জীবনধারণের কোনো উপায় না থাকলে তবেই মেয়েদের এই পথ বেছে নিতে হয়–তার কারণ বেছে নেওয়ার মতো আর কোনো বিকল্প তাঁদের থাকে না। এই পেশা বন্ধ করাই হবে শ্রেণিহীন সমাজের দিকে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কাজ। ‘যৌনকর্মী’ নাম দিয়ে, ট্রেড লাইসেন্স চালু করে যাঁরা এই পেশাটাকে টিকিয়ে রাখতে চায়, তাঁরা আসলে শ্রেণিসমাজেরই পক্ষে : আরও বহুরকম শোষণের মতো এই শোষণেও তাঁদের কোনো আপত্তি নেই।” (টপ কোয়ার্ক, ডিসেম্বর, ২০০৪, ৬৯ পৃষ্ঠা)।
রামকৃষ্ণবাবুর সঙ্গে আমি একমত নই। কারণ ট্রেড লাইসেন্স ছাড়াই হাজার হাজার বছর ধরে যৌনপেশা চলে আসছে। ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষণা করেও নিশ্চিহ্ন করা যায়নি। ‘অবৈধ’ পেশা দেগে দিয়েও হাজার হাজার বছর ধরে যৌনপেশা চলে আসছে। সারাবিশ্বে রমরমিয়ে যৌনপেশা চলছে নানা বৈচিত্র্যে। পৃথিবীতে এমন কোনো পেশা নেই, যা রাষ্ট্রের কঠোর হস্তক্ষেপে বিলুপ্ত হয়েছে। বিলুপ্ত করতে পারেনি। কারণ চাহিদা থাকলে জোগান থাকবেই। চাহিদা নির্মূল করা কি সম্ভব? আগে চাহিদা নিমূল করুন, তখন দেখবেন স্বাভাবিক নিয়মেই জোগান বন্ধ হয়ে যাবে। যদিও এটা একটা অবাস্তব চিন্তা। যৌন-চাহিদা এমন এক চাহিদা, যা একটি মৌলিক চাহিদা। আমরা নানাভাবে সেই চাহিদা মেটাই। কেউ বিয়ে করে মেটায়, কেউ যৌনকর্মীর কাছে গিয়ে মেটায়, কেউ পরকীয়ায় মেটায় দুপুর ঠাকুরপো’ হয়ে, কেউ হস্তমৈথুনে মেটায়। আর যে এসব কিছুই করে উঠতে পারে না, সে যৌন-অবদমনে ডুকরে মরে।
শরীর বিক্রির পেশাকে ‘যৌনকর্ম বা পেশায় যুক্ত মেয়েদের যৌনকর্মী’ হিসাবে চিহ্নিত করা বড়ড়াই বিভ্রান্তিকর। কারণ যৌনকর্ম বলার মধ্যে দিয়ে গণিকাবৃত্তিকে কর্ম বা পেশার অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়। মূলত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে এ ধরনের যৌনাচারের সিস্টেমকে বিশাল পুঁজি বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে যৌনশিল্প বা সেক্স ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত করেছে। পৃথিবীর এই সেক্স ইন্ডাস্ট্রিগুলি নারীমাংসের বেচাকেনা করে বিলিয়ান বিলিয়ন ডলার ঘরে তোলে। অর্থগৃধু আর লালসায় নারীও স্বয়ং এবং স্বেচ্ছায় শরীর-ব্যাবসায় নেমে পড়েছে চড়া দর হাঁকিয়ে। সব মিলিয়ে কেবল নারীত্বের আবমাননাই নয়, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় স্বয়ং নারী এবং নারীর চারপাশ তাঁকে ‘পণ্য’ বা ‘মাল’ হিসাবে চিত্রিত করেছেন। তবে আমার মনে হয় যাঁরা যৌনকর্মী শব্দটি জীবিকা হিসাবে বর্ণনা করতে চাইছেন, তাঁরা হয়তো এটাই উদ্ভাবন করতে চাইছেন যে, এই শব্দটি দ্বারা যৌনপেশার সঙ্গে যুক্ত নারীদের নামের সুপ্ত কলঙ্ক খণ্ডন করা যাবে, তাঁদের কর্মী বা শ্রমিক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে। যৌনপেশার যুক্ত নর-নারীদের কর্মী বা শ্রমিক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়তো করা যাবে একদিন–আজ, না হয় কাল। তাই বলে কলঙ্ক ঘোচানো যাবে কখনো? কখনোই নয়। নামবদলে কলঙ্ক ঘুচবে এটার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
তবে ‘যৌনকর্মী’ শব্দটি ইউনিসেক্স। কারণ শুধু নারীরাই যৌনকর্ম করে না, পুরুষরাও করছে। পুরুষদের গণিকা, পতিতা, বেশ্যা বলা যায় না। কারণ এই শব্দগুলো স্ত্রীবাচক বিশেষণ। অতএব ‘যৌনকর্মী একটি যথার্থ বিশেষণ। সমস্ত ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয়। এই মুহূর্তে যাঁদের যৌনকর্মী বলা হচ্ছে, তাঁদের আজও বলা হয়, বেশ্যা, পতিতা, গণিকা, বারাঙ্গনা ইত্যাদি। এই শব্দগুলির সবকটাই স্ত্রীলিঙ্গবাচক। কেবল নারীরাই এই পেশা করে, এটাই বোঝাত। কিন্তু এখন সময় বলেছে। এখন কেবল নারীরাই এই পেশার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে না। যুক্ত হচ্ছে। পুরুষরাও। পুরুষ যৌনকর্মীদের জন্য কোনো শব্দ সৃষ্টি হয়নি। সেক্ষেত্রে যৌনকর্মী’ শব্দটি নারী ও পুরুষ উভয় শ্রেণির যৌনপেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের বোঝায়। সম্বিত একজন বেশ্যা বা পতিতা, ব্যাকরণগতভাবে ভুল। সম্বিত একজন যৌনকর্মী, ব্যাকরণগতভাবে সঠিক। তেমনি সুপ্রিয়া একজন যৌনকর্মী, এ কথা বললে একজন নারীই যৌনকর্মী বলে চিহ্নিত করা হয় না। যৌনকর্মী নারী ও পুরুষ উভয়ই। কোনো লিঙ্গের সমস্যা নেই। তবে সাইড এফেক্ট হিসাবে যেটা পাওয়া গেল, তা হল ‘যৌন’। অর্থাৎ পেশায় কর্ম কী, যোনি বা যৌনাঙ্গের ব্যবহার। অর্থাৎ যিনি যৌনাঙ্গের ব্যবহার করে, তিনিই যৌনকর্মী। নামচিহ্নে প্রকট হয়ে উঠল পেশার ধরন। দেহ নয়, কেবলই যৌনাঙ্গ। শরীর নয়, শরীরের একটা অংশ। কিন্তু বাস্তবিক পুরোপুরি তো তা নয়। একজন যৌনকর্মীর কাছে সকলেই যৌনকর্ম (Intercourse) করতে আসে না। সময় কাটাতেও অনেকে আসেন। বহু এমন কর্মী আছে যাঁরা পুরুষদের কাছ থেকে অর্থ নেয় শুধু শরীর মর্দন করেই। আবার অনেক মহিলা আছেন পুরুষ যৌনকর্মীদের অর্থ দেয় শুধুমাত্র শরীর মর্দন করিয়ে, অন্যান্য সঙ্গদানের বিনিময়ে। সবসময়ই যে যৌনকর্মের বিনিময়ে অর্থ আদানপ্রদান হয়, তা তো নয়।
এখন প্রশ্ন হল, যৌনকর্ম কি কোনো কর্ম? আমি বলি অবশ্যই কর্ম। আমরা সবাই শরীরের কোনো না-কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ব্যবহার করে কাজ করি। কেউ হাত, কেউ পা, কেউ চোখ, কেউ মুখ, কেউ কান দিয়ে কাজ করি। যৌনকর্মীরা যৌনাঙ্গ সহ গোটা শরীরকে লাগিয়ে কাজ করে। কাজটা ‘সেক্স করা’ বলে সেটা কর্ম নয়? এ কেমন কথা! সেক্স একটি স্বাভাবিক কর্ম। যৌনকর্মীরাও তো সেক্সই করে। পার্থক্য একটাই, বিবাহ বহির্ভূত সেক্স। যৌনকর্মীদের যৌনকর্ম উচ্ছেদ করলেই কি বিবাহ বহির্ভূত যৌনকর্ম বিলুপ্ত হয়ে যাবে? কখনোই নয়। এরপর যৌনকর্ম করে অর্থোপার্জনের প্রসঙ্গ। বিবাহ সম্পর্কিত যৌনকর্ম বিনা খরচায় হয়? হয় না। অনেকে মনে করেন, গণিকাবৃত্তিকে ‘কর্ম’ বললে তা আসলে গণিকাবৃত্তিকেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়। হ্যাঁ, হয়। অবশ্যই হয়। তাতে আপত্তি কীসের? হাজার হাজার বছর ধরে সারাবিশ্বে কর্মের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি বলে কি যৌনপেশা বিলুপ্ত হয়ে গেছে! হয়নি, উল্টে বৃদ্ধি পেয়েছে, পাচ্ছে। এই পেশাকে বৈধতা দিন বা অবৈধ বলুন, পেশা কিন্তু চলবেই। বরং আরও আধুনিকীকরণ হবে এবং হচ্ছে।
যৌনকর্মীরা কি শ্রমিক? এমন প্রশ্নে উচ্চ আদালতের আইনজীবী অশোক কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এক বিবৃতিতে বলেছেন–“চরম দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে যে সমস্ত মেয়েগুলোকে ধরে এনে দেহব্যাবসা করানো হচ্ছে, তাঁদের পুনর্বাসন না-করে ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে আরও জাঁকিয়ে ব্যাবসা করার দাবি জানানো হচ্ছে। এর থেকে দুর্ভাগ্যজনক আর কী হতে পারে? যৌনকর্মীরা চাইছে ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার, ভাবা যায়! আরে বাবা, ব্যাবসা হল সাধারণত দু-রকম। এক, সুস্থ ও আইনি ব্যাবসা। দুই, অসুস্থ ও বেআইনি ব্যাবসা। এখন যে ব্যাবসাটা আপদমস্তক অসুস্থ ও বেআইনি, তার আবার ট্রেড ইউনিয়ন কীসের, আমার মাথায় তো কিস্যু ঢুকছে না। আর এই দাবির পিছনে যুক্তিটা কী, না আইনের অধিকার পেলে যৌনকর্মীদের ব্যাবসা করতে আরও সুবিধা হবে। কিন্তু কথা হচ্ছে, এই ব্যাবসা চালাতে আজও কি আইন তাঁদের স্বীকৃতি দিয়েছে? দেয়নি। সুতরাং যে পেশা বা ব্যাবসার কোনো আইনি ভিত্তিই নেই, সে ব্যাবসার আবার পরবর্তী সুযোগসুবিধা নিয়ে ভেবে লাভ কী? আজ যৌনকর্মীরা তাঁদের শ্রমিক বলে দাবি করছে। তাঁদের গতর খাটানোর সঙ্গে শ্রমিকের গতর খাটানোর তুলনা করছে। খুব নিষ্ঠুর অর্থে তাঁদের এবং শ্রমিকের গতর খাটানোর এই তুলনাটা মেনে নিলেও জানতে ইচ্ছে করে একজন যৌনকর্মীর পক্ষে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কি একজন শ্রমিকের মতো উৎপাদন করা সম্ভব? সম্ভব নয়। শুধু তাই নয়, সমাজের প্রতি একজন শ্রমিকের দায়বদ্ধতা, একজন যৌনকর্মীরও কি সেই সমান দায়বদ্ধতা আছে! নিশ্চয় নয়। যদিও তাঁদের বক্তব্য, যৌনকর্মী না-থাকলে আজ ঘরে ঘরে এই ব্যাবসা হত, যে ব্যাবসা বন্ধ করেই নাকি সোনাগাছি, প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিট, কালীঘাটের মতো যৌনপল্লির প্রয়োজন। এটা একেবারেই অযৌক্তিক কথা। যেমন অযৌক্তিক তাঁদের দাবি। আরে বাবা, আইনের স্বীকৃতি পেলেই কি মানুষের মানসিকতা, সমাজব্যবস্থা সম্পূর্ণ পালটে যাবে?” (টপ কোয়ার্ক, ডিসেম্বর ২০০৪, ৭০ পৃষ্ঠা)
অশোকবাবুর জন্য আমার একটাই প্রশ্ন–অন্ধ হয়ে থাকলে কি প্রলয় থাকে? আইনজীবী অশোকবাবুর সঙ্গে আমার কয়েকটা পয়েন্টে দ্বিমত আছে। অশোকবাবু প্রশ্ন করেছেন—(১) একজন যৌনকর্মীর পক্ষে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কি একজন শ্রমিকের মতো উৎপাদন করা সম্ভব? অশোকবাবু, শ্রমিক মাত্রই কি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত? তাহলে যাঁরা উৎপাদন করে না তাঁরা শ্রমিক নন? যাঁরা পরিসেবা দেন তাঁরা শ্রমিক নন? শ্রম দান করেন যিনি তিনিই তো শ্রমিক। তাই না? শ্রম দান করে যে রোজগার করে, তাঁর রোজগারকেই তো পারিশ্রমিক বলে। সেই শ্রমদান শুয়ে শুয়ে, বসে বসে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, দৌড়ে দৌড়ে যে-কোনোভাবেই হতে পারে। বড়ো মুখ করে আজ যাঁদের শ্রমিক বলি, তাঁদেরও একদা শ্রমিক ও শ্রমের মর্যাদা দিতে চায়নি রাষ্ট্রগুলো। তখনও আপনাদের মতো মানুষেরাই শ্রমিকের দাবির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। অনেক রক্তের বিনিময়ে আজ তাঁরা শ্রমিকের মর্যাদা পেয়েছেন। সেও তো প্রায় ১৩৫ বছর হয়ে গেল। এককথায় বলতে গেলে যিনি শ্রম দেন তিনিই শ্রমিক, তবে আইনের ভাষায় হওয়া উচিৎ—যিনি মজুরি বা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে শ্রম দেন তিনিই শ্রমিক। শ্রমিকের সংজ্ঞা হবে–শ্রমের বিনিময়ে যিনি মজুরি গ্রহণ করেন তিনিই শ্রমিক অথবা মজুরির বিনিময়ে যিনি শ্রম দেন তিনিই শ্রমিক। মধ্যযুগে ইংল্যান্ডে কৃষকরা তাঁদের মজুরি বৃদ্ধি এবং কাজের উপযুক্ত পরিবেশ পাওয়ার জন্য বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। এই বিদ্রোহের অন্যতম নেতা জন বল তার এক বিখ্যাত বক্তৃতায় বলেন, “জন্মের সময় সব মানুষই সমান। যখন আদম ও হাওয়া পৃথিবীতে এসেছিল, তখন কি তারা ভদ্রলোক ছিল?” শ্রমিকরা প্রায়ই তাঁদের পূর্বতন অধিকারের জন্য আপিল করত। উদাহরণস্বরূপ, ইংরেজ কৃষকরা যখন আন্দোলন শুরু করে, তখন তাঁদের বেশিরভাগ আন্দোলনই ছিল ঐতিহ্যগতভাবে পাওয়া সাম্প্রদায়িক জমিগুলো নিয়ে। ইংল্যান্ডে ১৮৩৩ সালে একটি আইন পাস করেছিল। যেখানে বলা ছিল যে, ৯ বছরের কম বয়সি কোনো শিশু কাজ করতে পারবে না, শিশুদের বয়স ৯-১৩ এর মধ্যে হলে দৈনিক মাত্র ৮ ঘণ্টা এবং বয়স ১৪-১৮ এর মধ্যে হলে দৈনিক মাত্র ১২ ঘণ্টা কাজ করতে পারবে।
১৯১৯ সালে শ্রমিক অধিকার রক্ষার জন্য সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা গঠন করা হয়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা পরবর্তীতে জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্ত হয়ে ওঠে। জাতিসংঘ নিজেই তাঁদের মানবাধিকার সনদের ২টি আর্টিকেলে শ্রমিকদের অধিকারের ব্যাপারে সমর্থন দিয়েছে। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার (নিবন্ধ ৬-৮) চুক্তিতে বলা হয়েছে–(১) প্রত্যেকেরই কাজ করার, স্বাধীনভাবে কর্মসংস্থান পদ্ধতি বাছাই করে নেওয়ার, পছন্দের কাজের ক্ষেত্রে ন্যায্য ও অনুকূল শর্ত এবং বেকারত্ব থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার অধিকার আছে। (২) প্রত্যেকেরই কোনোরূপ বৈষম্য ছাড়া সমান কাজের জন্য সমান বেতন পাওয়ার অধিকার রয়েছে। (৩) যারা কাজ করে তাদের প্রত্যেকেরই ন্যায্য ও অনুকূল পারিশ্রমিক পাবার এবং তাদের পরিবারের সকল সদস্যদের সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার এবং অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। (৪) সবারই তাঁদের নিজস্ব স্বার্থ রক্ষার জন্য ট্রেড ইউনিয়নে যোগদানের অধিকার আছে।
শ্রমের অধিকার ও শ্রমিকের মর্যাদা আদায়ের লড়াই নতুন কিছু নয়। শ্রমিকদের প্রতি শোষণ ও বঞ্চনা তো অনস্বীকার্য। শ্রমিকদের দিয়ে উদয়াস্ত খাঁটিয়ে নেওয়ার অভ্যাস ছিল মালিকদের। শ্রমিকরা ছিল পশুর মতো। যথাযথ পারিশ্রমিক পর্যন্ত দেওয়া হত না। শ্রমিক যেন ক্রীতদাস। শ্রমিকরা বিদ্রোহ ঘোষণা করল। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে দৈনিক আটঘন্টার কাজের দাবিতে শ্রমিকরা জমায়েত হয়েছিল। তাঁদেরকে ঘিরে থাকা পুলিশের প্রতি এক অজ্ঞাতনামার বোমা নিক্ষেপের পর পুলিশ শ্রমিকদের উপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। ফলে প্রায় ১০-১২ জন শ্রমিক ও পুলিশ নিহত হয়। এরপর ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে মে দিবসের দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। পরে, ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে আমস্টারডাম শহরে অনুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এই উপলক্ষ্যে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবে দৈনিক আটঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণের দাবি আদায়ের জন্য এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বজুড়ে পয়লা মে তারিখে মিছিল ও শোভাযাত্রা আয়োজন করতে সকল সমাজবাদী গণতান্ত্রিক দল এবং শ্রমিক সংঘের (ট্রেড ইউনিয়ন) প্রতি আহ্বান জানানো হয়। সেই সম্মেলনে “শ্রমিকদের হতাহতের সম্ভাবনা না-খাকলে বিশ্বজুড়ে সকল শ্রমিক সংগঠন মে মাসের ১ তারিখে ‘বাধ্যতামূলকভাবে কাজ না-করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। হে মার্কেটের হত্যাকাণ্ডের পর আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড মনে করেছিলেন পয়লা মে তারিখে যে-কোনো আয়োজন হানাহানিতে পর্যবসিত হতে পারে। সে জন্য ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দেই তিনি নাইটের সমর্থিত শ্রম দিবস পালনের প্রতি ঝুঁকে পড়েন।
অতএব শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকারের লড়াই সেদিনও করতে হয়েছিল, আজও করতে হয়। আজ না হয় কাল, গণিকারা শ্রমিকের মর্যাদা পাবেই। কোনো জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতাই এটা আটকাতে পারবে না। শ্রমদান কে শুয়ে করবে কে বসে করবে, সেটা বিবেচ্য নয়। বিবেচ্য সেটাই হবে কোনো ব্যক্তি সত্যিই শ্রমদান করছে কি না। অনেকের মনে হতে পারে, সেক্স করাটা একটা আরামের বিষয়, সুখের বিষয়। শ্ৰম কীসের? এটা সাধারণ যৌন-সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও পেশাদার যৌনকর্মীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। প্রতিদিন অসংখ্য ক্লায়েন্টের সঙ্গে যৌনসঙ্গম নিশ্চয় আরামের হতে পারে না। কোনো ছুটি নেই। কোনো ডিউটি আওয়ারস নেই। ২৪ X ৭ X ৩৬৫ দিন একটানা যৌনসঙ্গমে কতটা যৌনসুখ পাওয়া যায়? শরীরটা তখন শরীরের সেই বিরল সুখ দিতে পারে না, যন্ত্র হয়ে যাওয়া শরীর তখন যন্ত্রের যন্ত্রণা দেয় এবং তা হাসিমুখে হজম করতে হয়।
যৌনপল্লিতে কোনো পুরুষই পয়সা খরচা করে কোনো যৌনকর্মীকেই যৌনসুখ দিতে আসে না, যৌনসুখ বুঝে নিতে আসে। তাই যৌনকর্মীদেরও সর্বদা শরীর-মন সুস্থ-সবল-চাঙা রাখতে হয়। ইচ্ছা-অনিচ্ছার স্বাধীনতা সব যৌনকর্মীর থাকে না, বিশেষ করে যখন বাড়িওয়ালি কিনে কোনো মেয়েকে যৌনপেশায় নিযুক্ত করেছে। সে সব মেয়েরা একপ্রকার ক্রীতদাসীই। এইসব মেয়েদেরকে দিনে প্রচুর খরিদ্দারদের সঙ্গে শুতে হয় রোজগার বাড়ানোর জন্যে। তা না-হলে বাড়িওয়ালির ভাগের পয়সা মেটানো যাবে না। ফলে খরিদ্দারের সঙ্গে দ্রুত কাজ সেরে, পরের খরিদ্দারের সঙ্গে শোওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে হয়। এইভাবে প্রতিদিন চলে। এঁদের শরীর বলতে একটি ফুটো’ ছাড়া আর কিছু নয়। শীঘ্রপতনের খরিদ্দার পেয়ে গেলে একটু রেহাই পায় বইকি। অনেক খরিদ্দার মনে করেন দীর্ঘক্ষণ সঙ্গম করলে বোধহয় পৌরুষত্ব দেখানো যায়। সেক্ষেত্রে এইসব যৌনকর্মীরা সময় হয়ে গেলে ঘর থেকে ঘাড় ধরে বের করে দেয় কাস্টমারকে। তবে অবসন্ন ও দুর্বল শরীর দিক বা না দিক, বাবু’ এলে ‘বসতেই হবে। একটু দরিদ্র শীর্ণকায় যৌনকর্মীদের কখনো-সখনো শরীরের জেল্লা বাড়াতে গর্ভধারণও করতে হয়। গর্ভধারণ করলে বুক-দুটো ভারী হয়ে ওঠে, শরীরটাও গোলপানা হয়। পোয়াতি মেয়ের ভরা বুক ভরা শরীর অনেক খরিদ্দারকে তাতিয়ে দিতে সক্ষম হয়। কিন্তু সন্তান যতক্ষণ ধারণ করা সম্ভব ততক্ষণ ধারণ করে। তারপর গর্ভপাত। পেট খসাতে’ হাতুড়ে ডাকতে হয়। অনেকক্ষেত্রে ব্যাপারটা খুব বিপজ্জনক হয়ে যায়। জীবন সংকটে পড়ে যায়।
(২) সমাজের প্রতি একজন শ্রমিকের দায়বদ্ধতা, একজন যৌনকর্মীরও কি সেই সমান দায়বদ্ধতা আছে? শ্রমিকের সামাজিক দায়বদ্ধতা? একজন শ্রমিক কি সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে শ্রম দান করে নাকি? মোটেই না। একজন শ্রমিক তাঁর, তাঁর পরিবার এবং নিয়োগকর্তার কাছে দায়বদ্ধ। তা ছাড়া সে আর কারোর কাছে তাঁরা দায়বদ্ধ নয়। একজন যৌনকর্মীও কোনোরূপ সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকতে পারে না। একজন যৌনকর্মী আর পাঁচজন শ্রমিকের মতো তাঁর ও পরিবারের কাছে দায়বদ্ধ। অতিরিক্ত যে কাজটি একজন যৌনকর্মী তাঁর অজান্তেই করে ফেলে, তা হল মানুষের যৌন অবদমন থেকে সমাজকে মুক্তি দেয়। এটা সামাজিক দায় বইকি। প্রতি সুস্থ মানুষের যৌন তাড়না (লিবিডো) থাকবেই। সেই যৌন তাড়না থেকে মুক্তির পথ খুঁজে নেবে প্রতিটি সুস্থ মানুষ। এটা তাঁর মৌলিক চাহিদা ও অধিকার। আর যদি মুক্তির পথ খুঁজে না-পায়, তখন তা জোর করে অবদমন করতে হয়। এই যৌন অবদমনের ফলে মানুষ বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে। মস্তিষ্ক বিকাশে বাধাপ্রাপ্ত হয়। যে ব্যক্তি সারাজীবন যৌনতার সুযোগ পায় না, সে অপরিণতমনস্ক হয়। অকারণে ক্রোধী হয়। জীবনে অবসাদ নেমে আসে। সেই অবসাদ থেকে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ে। যৌন অবদমন মানুষকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে।
যৌন তাড়না বা যৌন প্রবৃত্তি হল এমন চাহিদা যা সবাই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। যৌন তাড়না কোনো ব্যক্তির সার্বিক যৌন প্রবৃত্তি বা যৌনকামনা। যৌন প্রবৃত্তি জৈবিক, মানসিক ও সামাজিক বিষয় কর্তৃক প্রভাবিত হয়। জৈবিকভাবে, যৌন হরমোনসমূহ ও সহযোগী নিউরোট্রান্সমিটারসমূহ যেগুলো নিউক্লিয়াস অ্যাকিউম্বেন্সের উপর ক্রিয়া করে (প্রাথমিকভাবে টেস্টোস্টেরন ও ডোপামিন), এগুলো মানবদেহে যৌন প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করে। কাজ ও পরিবারের মতো সামাজিক বিষয় এবং ব্যক্তিত্ব ও মনোদৈহিক চাপের মতো অভ্যন্তরীণ মনস্তাত্ত্বিক উপাদান বা বিষয়গুলোও যৌন প্রবৃত্তিকে প্রভাবিত করতে পারে। পাশাপাশি শারীরিক অবস্থা, ওষুধপত্র, জীবনযাপন-প্রণালী, সম্পর্কের বিষয়াবলি ও বয়স (যেমন বয়ঃসন্ধি) দ্বারাও যৌন প্রবৃত্তি প্রভাবিত হতে পারে। কোনো ব্যক্তির যদি চরমভাবে বারংবার বা হঠাৎ করে যৌন তাড়না বৃদ্ধি পাওয়ার প্রবণতা থাকে তবে তাঁর হাইপারসেক্সয়ালিটি হয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে, আর এর বিপরীত অবস্থাকে বলা হয় হাইপোসেজুয়ালিটি।
কোনো ব্যক্তির হয়তো যৌন আকাঙ্ক্ষা আছে, কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণের কোনো সুযোগ নেই, অথবা ব্যক্তিগত, নৈতিক বা ধর্মীয় কারণে সে উক্ত চাহিদা অনুযায়ী আচরণ করা থেকে বিরত থাকে। মনস্তাত্ত্বিকভাবে, কোনো ব্যক্তির চাহিদাকে অবদমন সসম্মানে গ্রহণ করা হতে পারে। অপরদিকে, কোনো প্রকৃত বাসনা ছাড়াও কোনো একজন ব্যক্তি যৌনাচরণে অংশ নিতে পারে। বিভিন্ন উপাদান মানব যৌন প্রবৃত্তিকে প্রভাবিত করতে পারে, যেমন শারীরিক ও মানসিক চাপ, অসুস্থতা ইত্যাদি। মানব সমাজে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক তৈরিতে ও তা বজায় রাখতে যৌন আকাঙ্ক্ষাসমূহ প্রায়শই একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে কাজ করে। যৌন আকাঙ্ক্ষার অভাব বা শূন্যতা উক্ত সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। কোনো যৌন-সম্পর্কে যে কোনো সঙ্গীর যৌন আকাঙ্ক্ষার পরিবর্তন যদি বহাল থাকে বা সমাধান না-করা হয়, তবে তা সম্পর্কে সমস্যা তৈরি করতে পারে। কোনো সঙ্গীর অবিশ্বস্ততা এই ইঙ্গিতের আভাস বহন করতে পারে যে, কোনো সঙ্গীর পরিবর্তনশীল/পরিবর্তিত যৌন আকাঙ্ক্ষাবর্তমান সম্পর্কের মাধ্যমে আর তৃপ্ত হতে পারবে না। সঙ্গীদের মধ্যে যৌন আকাঙ্ক্ষার অসমতা বা যৌন আকাঙ্ক্ষাসম্পন্ন ও যৌনতাপ্রিয় সঙ্গীদের মাঝে নগণ্য যোগাযোগের ফলে সমস্যার উত্থান হতে পারে।
যৌন অবদমন থেকে যৌন বিকৃতি চরম মাত্রা পায়। মূলত যৌনতার মতো মানুষের শক্তিশালী জৈবিক প্রবৃত্তির মাত্রাতিরিক্ত দমনের ফলে তা বিকৃত যৌনাচারের দিকে যায়। ধর্ষণের মতো সামাজিক অপরাধ ঘটার এবং উত্তরোত্তর এর বিপজ্জনক প্রাদুর্ভাবের পিছনে বিভিন্ন কারণ কাজ করে। লৈঙ্গিক বৈষম্য, ক্ষমতা, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিচারহীনতা, নারীর দুর্বল সামাজিক অবস্থান, নৈতিক অবক্ষয়, প্রজন্মের পর্নাসক্তি ইত্যাদি। কিন্তু এইসব কারণগুলোকে নেতৃত্ব দেয় অস্বাভাবিক যৌন অবদমন। মাত্রাতিরিক্ত যৌন অবদমন মানুষের অবচেতনে স্তরে স্তরে জমা হয়ে এক ধরনের বিকৃত মনস্তত্ব তৈরি করে। মানুষের মাঝে যৌন হিংসা এবং ধর্ষকামী মনোভাব আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যায়। স্বাভাবিক যৌনতা থেকে বঞ্চিত হয়ে সমাজের সদস্যরা অবচেতনে ধর্ষকামী মনোভাব লালন করে থাকে। এমন না যে, প্রত্যেক অসচেতন ধর্ষকামীই পরবর্তীতে ধর্ষণ করে। বরং এর একটা বড়ো অংশ স্বাভাবিক সামাজিক জীবনযাপন করে যায় তাঁর ধর্ষকামী মনোভাবকে মনের অবচেতনে জমা রেখেও। মনের মধ্য ধর্ষকাম পোষণ করা মানুষেরাই পরবর্তীতে নৈতিক পুলিশের ভূমিকা পালন করে। সমাজের কোনো সদস্যের যে-কোনো রকমের চরিত্র বিচ্যুতির ঘটনায় এঁরা উৎফুল্ল হয়ে উক্ত ঘটনার রসালো আলাপ বাজারে চালু রাখে এবং এভাবেই তাঁদের ধর্ষকামকে তাঁরা প্রশমিত করতে চায়।
ফ্রয়েডের মতে, মানুষের মন প্রচণ্ডভাবে গতিশীল এবং এই মন’ নামক মানবিক উপাদানটি সহজাত প্রবৃত্তি, তাড়না, বিরোধ, গূঢ়ৈষা, অবদমন ইত্যাদির মতো কিছু ইচ্ছামূলক ক্রিয়া দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আমরা আমাদের সমাজব্যবস্থায় অবস্থান করি বিভিন্ন বিরোধ আর বাধাকে গ্রাহ্য করে এবং এর ফলে আমরা কখনোই সম্পূর্ণ। স্বাধীন নই। আমাদের চিন্তারও নেই কোনো স্বতঃস্ফূর্ত প্রবাহ। যে কামনা, বাসনা আর যৌন তাড়না একটি মানুষ বিভিন্ন সামাজিক নিয়মকানুনের জন্য তৃপ্ত করতে পারে না, সেই অতৃপ্তি-জাত ইচ্ছেগুলোকেই অবদমিত হয়ে স্থান করে নেয় মানুষের মনের অচেতন স্তরে। এই অচেতন স্তরেই অবদমনকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয় এক ধরনের বিপরীতমুখী বিরোধ ও বাধার, যা লজ্জা, ভয়, দুঃখ ইত্যাদিসহ বিভিন্ন মানসিক বা মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে থাকে। মানুষের যে ইচ্ছে পূর্ণ হয়নি, যার জন্য সে অতৃপ্ত, সেই অবদমিত অতৃপ্তি ও ইচ্ছাগুলোই অচেতন স্তর থেকে স্বপ্ন হয়ে বেরিয়ে আসে বা বাস্তবে তার প্রয়োগ ঘটাতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়ে যায়। ফ্রয়েডের তত্ত্ব অনুযায়ী মনের চেতনও অবচেতন স্তরের সমন্বয়ে তৈরি হয় একজন ব্যক্তিমানুষের অহং। সামাজিক অহং সবসময় বাস্তবতায় নিয়মকানুন মেনে চলে এবং অচেতনে বন্দি কামজ ইচ্ছা বা বাসনাকে সমাজ-বাস্তবতায় আসতে দেয় না। ফ্রয়েডের সংশোধিত মতবাদে অহং আংশিক চেতন ও আংশিক অচেতন রূপকে গ্রাহ্য করা হয়েছে।
ফ্রয়েড কথিত আংশিক চেতন অহংকে আমরা শুধু অহং হিসাবেই চিহ্নিত করব এবং অচেতন অহংকে বলব অদ। অদ সবসময় সুখসূত্র মেনে চলে—জৈবিক সুখ, কামনা, বাসনা ইত্যাদির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন চায় অদ। অদের জৈবিক কামনা, বাসনা ও তাড়না যেহেতু সবসময় সমাজের নিয়মকানুন মানে না, সেহেতু অহং, অদের সব ইচ্ছে পূরণ হতে দেয় না বাস্তবতার সূত্র গ্রাহ্য করে। অদের যে কামনা, বাসনা বা ইচ্ছা সমাজের নৈতিক আদর্শের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়, তা অপূর্ণ থেকেই অবদমিত হয়ে অচেতন মনে জমা হতে থাকে। যে অহং বাস্তবতার সূত্র মানে, তাকে ফ্রয়েড অতি-অহং বা অধিসত্তা হিসাবেও চিহ্নিত করেছেন।
ফ্রয়েড তাঁর মনঃসমীক্ষণ তত্ত্বে মানুষের যৌন-আকাক্ষা, অবদমন এবং শৈশবকালীন যৌনতার বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে, মানুষের আত্মরক্ষামূলক কাজ হল অহং প্রবৃত্তি। কামপ্রবৃত্তির উপাদান হিসাবে আমরা সব ধরনের প্রেম, ভালোবাসা, বন্ধুপ্রীতি, আদর, সোহাগ ইত্যাদিকে চিহ্নিত করতে পারি। কামপ্রবৃত্তির উপস্থিতি হল একজন মানুষের জৈবিক সংগঠনের মৌলিক উপাদান এবং এর ফলে একটি শিশুর জন্ম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আত্মকামী সত্তা হিসাবে যৌন অনুভূতিকেন্দ্রিক কামপ্রবৃত্তির দিকে এগিয়ে যায়। একটি শিশু জন্মের পর নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে স্বাধীন সত্তা হিসাবে গ্রাহ্য করে না, এ অবস্থায় সে হয়ে ওঠে এক আত্মকামী ‘নার্সিসাস’। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি কিশোর যখন তার সমবয়স্ক অন্য কোনো কিশোরের ভালবাসা কামনা করে, তখন মনস্তাত্ত্বিক কারণেই এক ধরনের কামপ্রবৃত্তির সৃষ্টি হয়, যাকে আমরা বলি সমকাম (এরকম যৌনচতনা যদি প্রাপ্তবয়স্ক স্তর পর্যন্ত চেতনায় থাকে তবে তা সমকামী বিষয় হিসাবে গণ্য হয়)। একটি শিশুর সমলিঙ্গ প্রেম সাধারণত বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চলে যায় এবং একসময় তা নারী-পুরুষকেন্দ্রিক যৌন কামনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। কামপ্রবৃত্তির উপাদান হিসাবে আরও কিছু বিষয় নিয়ে তাত্ত্বিক ধারণা দিয়েছেন ফ্রয়েড, যার মাঝে ইদিপাস এষণা, ইলেক্ট্রা এষণা, মর্ষকাম, ধর্ষকাম, জীবনবৃত্তি এবং মরণপ্রবৃত্তি উল্লেখযোগ্য। একটি পুরুষ শিশু তার আত্মকামকে গ্রাহ্য করে বিপরীত লিঙ্গের মায়ের প্রতি যে যৌন-আকর্ষণ অনুভব করে এবং একই সঙ্গে সমলিঙ্গের পিতাকে ভালোবাসার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে চিহ্নিত করে যে ঈর্ষা ও ঘৃণা দেখায়, তাকে ফ্রয়েড ইদিপাস এষণা হিসাবে চিহ্নিত করেন। ইদিপাস এষণার বিপরীত মনস্তাত্ত্বিক উপাদান হল স্ত্রী-শিশুর পিতার প্রতি যৌন-আকর্ষণ এবং মাকে ঘৃণা ঈর্ষা করা, যাকে ফ্রয়েড বলেন, ইলেক্ট্রা এষণা, মর্ষকাম হচ্ছে ভালোবাসার পাত্র বা পাত্রী দ্বারা নিগৃহীত হয়ে যৌনসুখ নেওয়া, আর ধর্ষকাম হল ভালোবাসার মানুষকে নিপীড়ন করে যৌনতৃপ্তি পাওয়া। ফ্রয়েডের তত্ত্বের একটা বড়ো অংশজুড়ে রয়েছে যৌনতা বা অবদমিত কামনা। ফ্রয়েডের তত্ত্বে যেভাবে অবদমিত কামনা বা লিবিডোের ধারণা এসেছে ঘুরেফিরে, তাতে করে অনেকেই কানে তুলো খুঁজেছিলেন তঙ্কালীন সময়ে। কানাঘুসো করছিলেন–ছিঃ, আমরা কামসর্বস্ব! ফ্রয়েড কিন্তু বলছেন—ঠিক তাই, আর এটাই হল নিদারুণ বাস্তব। এমনকি মানবশিশুর বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়াকে ধাপেধাপে ভেঙে তিনি দেখিয়েছেন, সেখানেও কেমনভাবে যৌনতার ভূমিকা আছে।
বিশ্বের যে-কোনো সাহিত্যে আমরা যৌন অবদমনের প্রসঙ্গ পেয়েছি। দুনিয়া কাঁপানো লেখা লিখছেন সাদাত হোসেন মান্টোর মতো লেখকরা। এমনকি বাংলা সাহিত্যেও পেয়েছি। শুরু হয়েছে রবীন্দ্র-পরবর্তী প্রথা-ভাঙা সাহিত্যচর্চা। সাহিত্যে তখন উত্তাল কল্লোল যুগ। বুদ্ধদেব বসুর কলমে তখন বজ্রনিঘোষ। সময়ের ডাকে বাংলা সাহিত্যে হু-হু ঢুকে পড়ছে যৌনতা। আর ঠিক এই সময়ে দেখা যাচ্ছে, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোয়েন্দাসাহিত্যেও ফ্রয়েডের ‘অবদমিত কামনা’ চলে আসছে। অবদমিত যৌনতা সাহিত্যেও এড়ানো যায়নি। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছুরি’ বলে একটা গল্পের বিষয় হল—এক যুবক একটি বন্ধকি কারবারের দোকান চালায়। যুদ্ধের বাজারে গোরা সৈনিকরা জিনিসপত্র বাঁধা দিয়ে টাকা ধার নেয় সেখান থেকে। এমনই একজন লোক একদিন একটা ছুরি বাঁধা দিতে আসে সেই যুবকের দোকানে। ছুরিটা খুব সামলে রাখতে বলা হল। এদিকে বাড়িতে তাঁর রুগ্ন বিগতযৌবনা স্ত্রী। তাই সে অর্থে যুবকের যৌনজীবন বলে কিছুই নেই। সবচেয়ে বড়ো কথা, তার জন্য আক্ষেপও নেই তাঁর সচেতন মনে। কিন্তু ছুরিটা হাতে পাওয়ার পর থেকেই সব যেন কেমন ওলটপালট হয়ে গেল। ওই ছুরি যেন যুবকের অবদমিত কামনার প্রতীক হয়ে দাঁড়াল। সে প্রথমে ওই ছুরিটা তাঁর দোকানের নরম গদির উপর বিধিয়ে দিল। সে কী অপার্থিব অনুভূতি! তারপর একদিন মাঝরাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তার এক কুকুরকে ওই ছুরি চালিয়ে মারল। তারপর সেদিন এসে গেল, ওই ছুরিটা চালিয়ে দিল তাঁর স্ত্রীর শরীরে। শরীর এ-ফোঁড় ওফোঁড় করে দিল যুবকটি। একবার নয়, বারবার বিধিয়ে দিয়ে যেন এক অপার্থিব সুখ পেল। বলাই বাহুল্য, বন্ধকি কারবারি ওই যুবক যে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে যৌনভাবে অতৃপ্ত ছিল, তা কিন্তু সরাসরি কোথাও বলা হয়নি গল্পে। শুধু তাঁর হালকা আভাস দিয়েছিলেন লেখক। ওই ছুরিটা হল যুবকের অবদমিত যৌনতার প্রতীকমাত্র। ওটা হাতে পেয়েই যুবকের অবদমিত কামনা জেগে উঠেছিল। আর ওই ছুরি সে নরম গদি থেকে শুরু নরম শরীরে বিধিয়ে বিঁধিয়ে নিজের সাপ্রেসড সেক্সকে পরিপূর্ণ করল। ছুরি যেন লিঙ্গের প্রতীক হয়ে গেল।
হ্যাঁ, যৌনকর্মীদের যতই হেলাফেলা করি না-কেন, যতই অবজ্ঞার চোখে দেখি না কেন, তাঁরা অজান্তেই সমাজের সেফটি ভালভ, যাঁরা যৌন অবদমনের ভয়ংকরতা থেকে সমাজকে মুক্তি দেয়। এটা নিদারুণভাবে উপলব্ধি করতে পারব সেদিন, যেদিন ‘অলৌকিকভাবে গোটা পৃথিবী থেকে যৌনকর্মীরা উধাও হয়ে যাবে। অতএব চোখ বন্ধ করে রাখলে প্রলয় থামানো যাবে না।
আইনজীবীকে অনেকে রক্ষণশীল বলতেই পারেন। তাঁর সঙ্গে কেউ একমত হতেও পারেন, আবার না-ও হতে পারেন। তবে আমি বলব–প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সারা পৃথিবীতে যে বিপুল পরিমাণ নারী বা পুরুষ এই পেশার যুক্ত হয়েছেন বা হতে বাধ্য হচ্ছেন, তাঁরা যেভাবেই হোেক তাঁদের শ্রমই বিক্রি করছেন। একদিনের বা এক মাসের নোটিসে এদের এই পেশা থেকে সরিয়ে আনা সম্ভব নয়। একটি বড়ো শহরের সবকটি বড়ো বড়ো শিল্পপ্রতিষ্ঠান হঠাৎ করে বন্ধ করে দিলে শহরে যেরকম দুর্যোগ বাড়বে, শ্রমিকদের যে করুণ পরিণতি হবে, এটিকেও সেভাবেই দেখতে হবে।
১৮৫৩ সালে তৈরি এক পুলিশ রিপোর্ট কলকাতার তৎকালীন চিফ ম্যাজিস্ট্রেট এলিয়ট গোটা কলকাতা শহরে ৪০৪৯ টি গণিকাদের ঘর আছে বলে স্বীকার করেন, যাতে বাস করত মোট ১২,৪১৯ জন গণিকা বা যৌনকর্মী। অর্থাৎ ঘরপ্রতি যৌনকর্মীর সংখ্যা ছিল ৩ জনেরও বেশি। ১৮৬৭ সালে কলকাতার হেস্থ অফিসার ফেভার টোনার যৌনকর্মীর সংখ্যা ৩০,০০০ জন সনাক্ত করেন। ১৯১১ সালের আদমসুমারিতে উল্লিখিত এ সংখ্যা ১৪,২৭১ জন। ১৯২১ এবং ১৯৩১ সালে আদমসুমারিতে সংখ্যাটি কমে দাঁড়ায় যথাক্রমে ১০,৮১৪ এবং ৭,৯৭০ জনে। কিন্তু ১৯৩২ সালে বেঙ্গল উইমেনস ইউনিয়নের সভানেত্রী দাবি করেন যে, পুলিশের হিসাবে কলকাতার যৌনকর্মীর সংখ্যা ২০,০০০ জন। ১৯৩২ সালের পর অনেক জল গড়িয়ে গেছে গঙ্গা দিয়ে। এর মধ্যে গোটা ভারত উপমহাদেশে সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিকের পটভূমি ব্যাপক উলটপালট হয়ে গেছে। গোটা বিশ্বজুড়ে বিশ্বযুদ্ধ সমস্ত মূল্যবোধের খলনলচে বদলে গেছে। এই বাংলায় একের পর এক মন্বন্তর। সবচেয়ে ভয়ানক ছিল পঞ্চাশের (ইংরেজি ১৯৪৩) মন্বন্তর। এই বাংলাতেই না খেতে পেয়ে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েছিল ৩০ লক্ষ মানুষ। যাঁরা মরেননি, তাঁরাও আর্থিকভাবে ব্যাপক প্রভাবিত হয়েছিল। অভাবের করাল থাবায় এবং বিশ্বায়নের কুফল হিসাবে দিকে দিকে দরিদ্রতা হু হু করে বেড়েছে, তার তালে তালে বেড়েছে নারী পাচার। অসংখ্য মেয়েরা পেটের জ্বালা নিরসনে যৌনপেশা বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে। কলকাতা সহ গোটা রাজ্যে হু হু করে বেড়েছে যৌনকর্মীর সংখ্যা, গজিয়ে উঠছিল অসংখ্য যৌনপল্লি।
দেবাশিস বসুর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ১৯৯৩ সালে ‘অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অফ হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেঙ্খ’ বিভাগের মহামারিতত্ত্ব বিভাগ যে জরিপ চালায়, তাতে কলকাতা ও হাওড়া শহরে মোট ১৯টি যৌনপল্লি চিহ্নিত হয়। প্রতিটি পল্লিতে যদি গড়ে ২০০ করেও ঘর ধরা হয়, তাহলে মোট ঘরের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৮০০টি এবং ঘরপ্রতি ৩ জন ধরলে যৌনকর্মীর সংখ্যা হয় ১১,৪০০ জন। ভাসমান যৌনকর্মীর সংখ্যা যদি ৮,৬০০ জন ধরা হয়, তবে এই সংখ্যাটি হবে ২০,০০০ জন। দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির হিসাবটা ঠিক এরকমই। তাঁদের মতে, কলকাতার মোট যৌনকর্মীর মধ্যে পাড়া-নির্ভর ১২,০০০ জন এবং ভাসমান ৮,০০০ জন। কিন্তু লক্ষণীয় যে, এই সংখ্যায় আবাসিক হোটেল, সাধারণ গৃহকোণ এবং ফ্ল্যাটবাড়িভিত্তিক যৌন পরিসেবাকারীদের চিত্রটি নেই। নেই তাঁদের কথাও, যাঁরা গোপনে আড়ালে-আবডালে যৌনপেশার সঙ্গে যুক্ত, অথচ নিজেকে ‘যৌনকর্মী পরিচয় দেয় না। সে হতে পারে স্কুল-কলেজের ছাত্রী বা সাধারণ গৃহবধূ। এই ভাগে আরও ২০,০০০ জন থাকাও বিচিত্র নয়। এটি ধরা হলে কলকাতা শহরে মোট যৌন পরিসেবাকারীদের সংখ্যা দাঁড়াবে ৪০,০০০ জন।
তথাকথিত ‘নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিনও গণিকাবৃত্তিকে বৈধতা দেওয়ার বিরুদ্ধে। তিনি এক লেখায় বলছেন–“পতিতাপ্রথাকে বৈধ করা মানে নারী নির্যাতনকে বৈধ করা। যে রাষ্ট্রে পতিতাপ্রথা বৈধ সেই রাষ্ট্র সত্যিকার কোনো সভ্যতা বা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। গণতন্ত্র মানবাধিকার নিশ্চিত করে, নারী-পুরুষের সমানাধিকার নিশ্চিত করে। কোনো গণতন্ত্র মানুষের উপর নির্যাতনকে ছল-ছুতোয় মেনে নেওয়ার চেষ্টা করে না। করতে পারে না। যদি করে, সেই গণতন্ত্রের নাম নিতান্তই পুরুষতন্ত্র, আর সেই সভ্যতার নাম বর্বরতা ছাড়া অন্য কিছু নয়।” তসলিমা নাসরিন একটু মোটা দাগের নারীবাদী। মোটা দাগের বিবৃতি দিতেই বেশি পছন্দ করেন। তাই উনিই বলতে পারেন, “পুরুষরা যেমন খালি গায়ে ঘুরে বেড়ায় নারীরাও তেমনি খালি গায়ে ঘুরে বেড়বে।” যাই হোক তসলিমার বিবৃতি প্রসঙ্গে বলব, প্রতিটি দেশের সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির পেশা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দিয়েছে। কে কোন্ পেশা স্বাধীনভাবে বেছে নেবে সেটাই গণতন্ত্র। গণতন্ত্রই নিজের পেশা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দেয়। কারোকে কোনো পেশায় বাধ্য করানো যায় না। বাধ্য করানোটাই অগণতান্ত্রিক।
তা ছাড়া পৃথিবীতে এমন হাজার হাজার পেশা আছে, যেগুলো মানুষের ইচ্ছা না-থাকলেও করতে বাধ্য হয়। সবার ভাগ্যে পছন্দের পেশাটি করে উঠতে পারে না। আমরা বেশিরভাগই অমলকান্তির মতো, যে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল। অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে উল্লেখ করে আর-একটু বলতে চাই–“আমাদের মধ্যে যে এখন মাস্টারি করে,/অনায়াসে সে ডাক্তার হতে পারত,/যে ডাক্তার হতে চেয়েছিল, উকিল হলে তার এমন কিছু ক্ষতি হত না।/অথচ, সকলেরই ইচ্ছেপূরণ হল, এক অমলকান্তি ছাড়া।/অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।” কারণ অমলকান্তি অন্ধকার ছাপাখানায় কাজ করে। এরকম অনেককেই এমন পেশা বেছে নিতে হয়, যা তাঁর পছন্দের নয়, ভালোবাসার নয়, ভালোলাগার নয়। তবুও করতে হয় সারাজীবন। সবার ক্ষেত্রেই যে এমনটা হয়, তেমনটাও নিশ্চয়ই নয়। আবার বিকল্প পেলে পেশা পরিবর্তনও করতে পারে। যৌনপেশাও ঠিক তেমনি।
শুধু মেয়েরা নয়, পুরুষরাও এই পেশায় আসছে। বিকল্প নেই বলেই আসছে। কারণ সকলের জন্য বিকল্প থাকে না। স্কিল্ড বা দক্ষ হতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যথেষ্ট পুঁজিও লাগে। দক্ষতা ও পুঁজি সবার থাকে না। অগত্যা যৌনপেশা বেছে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে নারী-পুরুষের মধ্যে। এই পেশাকে অবৈধ করে রেখে নির্মূল করার চিন্তা বাতুলতা মাত্র। বরং আমি মনে করি যৌনপেশাকে কেউ যদি স্বেচ্ছায় বেছে নেয়, তাহলে সেক্ষেত্রে এই পেশাকে ঘিরে অপরাধ প্রবণতা কমবে। একই সঙ্গে আমি এটাও বলব, এক্ষেত্রে কেউ যদি কোনো নারী বা পুরষকে যৌনপেশা করতে বাধ্য করে সেক্ষেত্রে কঠোরতম শাস্তির ব্যবস্থা করুক রাষ্ট্র। যেমন পাচার, বিক্রি, জোর করে যৌনপেশায় বাধ্য করানো ইত্যাদি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কঠোর নজরদারি থাক। এমনকি যাঁরা নারী বা পুরুষের যৌনপেশার পয়সায় (পরিবার ছাড়া) জীবনধারণ করে বা সেক্স ইন্ডাস্ট্রি পরিচালনা করে বা যৌনকর্মের জন্য বাড়ি ভাড়া দেয় তাঁদের কঠোরতম শাস্তি দিক রাষ্ট্র। যৌনকর্মীদের জন্য ন্যূনতম শাস্তি থাকা উচিত নয়। উল্টে যৌনকর্মীরা যাতে নির্বিবাদে তাঁর পেশা চালিয়ে যেতে পারে, তারজন্য সুরক্ষাকবচ দেওয়া উচিত। একই সঙ্গে যেহেতু যথেচ্ছ যৌনসঙ্গম ভয়ংকর যৌনরোগের কারণ, সেহেতু যৌনকর্মে কন্ডোমের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। কোনো অজুহাতেই যৌনকর্মীরা কন্ডোম ছাড়া যৌনমিলন করতে পারবে না। করলেই মোটা অঙ্কের জরিমানা বা জেল বা উভয়ই ধার্য হোক। তাহলেই মানুষের প্রতি সুবিচার হয়। তার মানে এই যে, যৌনপেশাকে বৈধ করে দিলে সকলেই দলে দলে গণিকাবৃত্তিতে নাম লেখাবে, এটা ভাবা অমূলক—কষ্টকল্পনা। পৃথিবী এমন কোনো পেশা নেই যেখানে মানুষ দলে দলে নাম লিখিয়েছে। এই পেশাকে বৈধতা দিতে তাঁদেরই আপত্তি, যাঁদের কাছে এই পেশা অবৈধ থাকলেই সুবিধা বেশি বলে মনে করে।
‘Sex Worker’ (যৌনকর্মী) শব্দটি নতুন। এই শব্দটি নির্বাচনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক দুনিয়া কর্মের বৈধতা দিল। অর্থাৎ যৌনপেশার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁরা নিজেদেরকে কর্মী’ ভাববে। অর্থাৎ গণিকারাও কর্মীর স্বীকৃতি পেল। গণিকারাও এখন নিজেদেরকে ‘যৌনকর্মী’ বলতেই পছন্দ করে। পতিতা বা গণিকা শব্দের ব্যবহার অল্পবেশি ব্যবহার থাকলেও ‘বেশ্যা’ শব্দটিই আমাদের সমাজে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। আমাদের সমাজে ‘বেশ্যা’ শব্দটি যেমন যৌনকর্মীদের বিশেষিত হলেও সাধারণ মহিলাদের মধ্যেও ‘বেশ্যা’ সম্বোধন করে অপমান করা হয়। অর্থাৎ ‘বেশ্যা’ শব্দটি অপমানসূচক হিসাবেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বেশ্যা’ ও ‘বেশ্যাবৃত্তি’ শব্দের সঙ্গে সামাজিক ঘৃণা যুক্ত হয়েছে। অতএব ‘বেশ্যা’ শব্দটি কোনোভাবেই ব্যবহার করা যাবে না। যদিও অনেকে বলছেন যৌনকর্মীর বিশেষণের মধ্যে সামাজিক মর্যাদা বা পেশাকে সম্মান দেওয়ার অভিব্যক্তি প্রকাশ পাচ্ছে। আমি অবশ্য তা মনে করি না। এটাও যথেষ্ট অসম্মানজনক বিশেষণ। কারণ বেশ্যা ও যৌনকর্মী শব্দটির মধ্যে মর্যাদাগতভাবে কোনো পার্থক্য নেই। দীর্ঘদিন ধরে ‘বেশ্যা’ শব্দটি ব্যবহারে যেমন অশ্লীল হয়ে গেছে, তেমনি ‘যৌনকর্মী’ শব্দটিও অশ্লীল হবে। দুটো শব্দই সমান ঘৃণার। অবশ্য পৃথিবীতে এরকম অনেক পেশা আছে। যেগুলো ঘৃণার চোখেই দেখা হয় এবং সেই পেশার সঙ্গে জড়িত মানুষদেরও ঘৃণার চোখেই দেখা হয়। এটা আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ। নাম পালটে তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধি করা যাবে না। যাহাই লাউ তাহাই কদু।
তসলিমার সুরে সুর মিলিয়ে বলাই যায়–“নিজেদের যতই শ্রমিক বলে দাবি করুক, সমাজ জানে এঁরা বেশ্যার কাজই করছে। তকমা বদলালেই কি জীবন বদলাবে? মেথরের কাজকে জাতিভেদাশ্রিত সমাজ শ্রদ্ধার চোখে না-দেখলেও সেটা শ্রমিকের কাজ। কিন্তু বেশ্যাবৃত্তির কখনও এরকম ব্যাখ্যা হতে পারে না।” আসলে একটা শ্রেণির নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যেই ‘যৌনকর্মী’ শব্দটির উদ্ভব। সেটি হল কর্মের অধিকারে আইনি স্বীকৃতি। অর্থাৎ পেশার বৈধতা। বিপন্ন’ যৌনকর্মীদের সুরক্ষিত রাখতেই আইনি বৈধতার প্রয়োজন আছে বইকি। আইনি স্বীকৃতি দিলেই যে সব মহিলারা দলে দলে এই পেশায় অংশগ্রহণ করবেন, এটা যেমন ঠিক ভাবনা নয়–ঠিক তেমনি এই পেশার সঙ্গে যুক্ত মহিলারা বুক চিতিয়ে ‘গতর খাঁটিয়ে খাই, শ্রমিকের অধিকার চাই’ বলবে এটাও অনেকে মেনে নিতে পারছে না। যৌনপেশাকে যাঁরা শ্রমের মর্যাদা দিতে নারাজ, তাঁদের বক্তব্য–যে পথেই হোক, যৌনপেশাকে নিয়ে কখনোই আহ্লাদিত হওয়ার নয়। কারণ কোনো অপরাধই আইনগ্রাহ্য হতে পারে না। তাঁরা আরও বলছেন–“খাইতে পারিলে কে চুরি করে বললে কারোর চুরি করার অধিকার জন্মায় না। চৌর্যবৃত্তিও বৈধতা পায় না। তাহলে তো কোনো অপরাধীকেই শাস্তি দেওয়া উচিত নয়। মানুষ তো পেটের জ্বালা মেটাতেই চুরি ডাকাতি রাহাজানি করে। শখ করে তো কেউ চুরি ডাকাতি রাহাজানি করে না।” চুরি ডাকাতি রাহাজানি আর যৌনপেশা কি এক জিনিস? চুরি ডাকাতি রাহাজানি কবে থেকে পেশা হল? চুরি ডাকাতি রাহাজানি অন্যের কষ্টার্জিত সম্পদ হরণ করে। অন্যের সম্পদ হরণ করা নিশ্চয় বৈধ হতে পারে না। সাধারণত অন্যের ক্ষতি করে এমন কোনো কাজই অপরাধ, বেআইনি। যৌনপেশায় যৌনকর্মীরা তো কারোর কোনো সম্পদ হরণ করে না, কারোর কোনো ক্ষতিসাধনও করে না। যাঁদের ইচ্ছে হবে তাঁদের কাছে যাবে, যাঁদের ইচ্ছে হবে না তাঁরা তাঁদের কাছে যাবে না। যৌনকর্মীরা তো কারোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে না। বরং আমি সমর্থন করি–এই। পেশার সঙ্গে জড়িত আড়কাঠি, দালাল, মেয়ে পাচারকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক। এঁদের বিরুদ্ধে এমন আইন তৈরি হোক যে আইনে কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তি দেওয়া সম্ভব।
বিশ্বজুড়ে বহু যুগ (বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে) ধরে যে বিতর্ক চলছে, তা হল–গণিকাবৃত্তিকে কি আইনি বৈধতা দেওয়া উচিত? সেমিনারের পর সেমিনার হচ্ছে। নারীবাদীদের সঙ্গে সমাজতাত্ত্বিকরাও নেমেছেন আসরে। কিন্তু বিতর্কের কোনো অবসান হচ্ছে না। আইনি বৈধতা নয়, এর সপক্ষে মোটামুটি দশটি যুক্তি পাওয়া যায়। যেমন–(১) গণিকাবৃত্তির আইনি স্বীকৃতি আসলে আড়কাঠি, দালাল, শরীর-ব্যবসায়ী বাড়িওয়ালিদের কাছে এক উপহারস্বরূপ। এই ছাড়পত্রের সুবাদে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠবে গণিকালয়, সেক্স ক্লাব, ম্যাসাজ পার্লার, মধুচক্র, যৌনঠেক ইত্যাদি। (২) গণিকাবৃত্তির বৈধতাদান বা নিরপরাধীকরণের অর্থ নারী পাঁচরকে উৎসাহিত করা। (৩) যৌনপেশার আইনি বৈধতা বা নিরপরাধীকরণ গণিকাবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে না, বরং তাকে বাড়িয়ে দেয়। (৪) গণিকাবৃত্তি আইনি বৈধতা পেলে গোপনকর্ম আর গোপনে থাকবে না। প্রকাশ্যেই শরীর কেনাবেচার হাট বসে যেতে পারে। (৫) গণিকাবৃত্তির স্বীকৃতিদান ও নিরপরাধীকরণ যৌনপেশায় নাবালিকাদের অংশগ্রহণ বাড়িয়ে দেবে। (৬) গণিকাবৃত্তির আইনি স্বীকৃতি সাধারণ নারীদের নিরাপত্তা দিতে পারবে না। (৭) যৌনব্যাবসা চাহিদা আরও বাড়িয়ে দেবে। আইনি প্রশ্রয় পেয়ে পুরুষকে নারীদেহের প্রতি আরও আকৃষ্ট করবে। (৮) আইনি বৈধতার যৌনপেশায় যুক্ত মেয়েদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা দেয় না। (৯) বৈধতা বলবৎ হলেও যৌনপেশায় যুক্ত মেয়েদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্য বৃদ্ধি পাবে না। (১০) তদুপরি যৌনপল্লির স্থায়ী বাসিন্দারাই চায় না বৈধতা।
গণিকাবৃত্তিকে অবৈধ করলে গণিকারা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে যা তাদের প্রতি সহিংসতা, দারিদ্রতা, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও সামাজিক নিরাপত্তার মতো বিষয়ে দুর্বল অবস্থানে দাঁড় করায়। একজন সাধারণ নারীর তুলনায় একজন গণিকার ধর্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা তুলনামুলকভাবে অনেক বেশি। এমনকি গণিকাদের খুন হওয়ার সম্ভাবনাও সাধারণ নারীর তুলনায় বেশি। ২০১৫ সালের ৩০ জুন, বিবিসির একটি লেখায় ব্রেন্ডা মায়েরস পাওয়েল (Brenda Myers-Powell) নামের প্রাক্তন এক গণিকার ২৫ বছর উপস্থাপিত হয়েছে। তার ভাষায়–“I’ve been shot five times, stabbed 13 times–I don’t know why those men attacked me, all I know is that society made it comfortable for them to do so.” (আমাকে পাঁচবার গুলি করা হয়েছে, ছুরির আঘাত করা হয়েছে ১৩ বার। এসব মানুষগুলো আমাকে আক্রমণ করেছিল কেন তা আমি জানি না। আমি শুধু জানি, সমাজ তাঁদেরকে এসব কাজের জন্য একটি তৃপ্তিদায়ক অনুভুতি দেয়।)।
গণিকাবৃত্তি বৈধ হলে গণিকাদের উপর অমানবিক আচরণ এবং সহিংসতার জন্য তাঁদের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার দারস্থ হওয়ার পথ খোলা থাকে, যা কিছুটা হলেও এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সহায়ক হবে। ব্রেন্ডা মায়েরস পাওয়েলের একজন প্রাক্তন গণিকা, যে কিশোরী মেয়েদের তাঁর মতো পথ থেকে দুরে রাখতে কাজ করছে। তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই তাঁকে একাজে উদ্বুদ্ধ করেছে। অনেক প্রামাণিক লেখা থেকে জানা যায়, যেখানে গণিকারাই দাবি করছে গণিকাবৃত্তি তাঁদেরকে সক্ষমতার দিকে এগিয়ে দিয়েছে। নারীকে আর্থিক সক্ষমতার শক্তিশালী করে তুলেছে। অনেকক্ষেত্রে যৌন স্বাধীনতা না-থাকলেও অন্যান্য স্বাধীনতাগুলি ভোগ করার সুযোগ এনে দিয়েছে। গণিকাদের অনেক লেখা ও সাক্ষাৎকার থেকে জানা গেছে, গণিকাবৃত্তিকে নিজেদের মুক্তির কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ২০১৬ সালে ‘Quartz’ নামের অনলাইল সাইট তাঁদের ফেসবুক পেজে যৌনকর্মীদের লেনদেন নিয়ে এই ভিডিও প্রকাশ করে, যেখানে একজন গণিকা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবার কারণ হিসেবে গণিকাবৃত্তিকে সামনে নিয়ে আসে। স্বয়ং গণিকাদের এমন সাবলীল স্বীকারোক্তি গণিকাবৃত্তিকে অবৈধ করার রাখার পিছনে যুক্তি কি, আবার খতিয়ে দেখতে উৎসাহিত বস্তুত অবৈধ গণিকাবৃত্তি জোরপূর্বক শিশু গণিকাবৃত্তি, মানব পাচারের মত অপরাধগুলো বাড়িয়ে তোলে। অবৈধ গণিকালয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নজরদারি না-থাকার কারণে গণিকাবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে এর পারিপার্শ্বিক অপরাধগুলোও সংগঠিত হতে থাকে, যা ধীরে ধীরে শুধুমাত্র ওই দেশ বা সমাজ না, পার্শ্ববর্তী দেশ, এমনকি পৃথিবীর অন্য প্রান্তেও সম্পৃক্ত অপরাধ বাড়িয়ে তুলতে পারে। গণিকাবৃত্তির বৈধতা গণিকালয় সম্পর্কিত অপরাধের উপর নজরদারি নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা তৈরি করে।
প্রকৃতপক্ষে গণিকাবৃত্তি যৌন-সম্পর্ক পরস্পরের প্রতি অন্তরঙ্গতা প্রকাশের এক অদ্বিতীয় উপায়, গণিকাবৃত্তি একে চুক্তিভিত্তিক লেনদেনের পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে আসে। এই সেবাগ্রহীতার অনেকের কাছেই যৌন-সম্পর্ক তখন শুধুমাত্র অর্থ প্রদানের মাধ্যমে উদ্দেশ্যসাধনের উপায় হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। এরকম মনোভাব মানুষকে গণিকাদের দিয়ে এমন যৌনাচারের হাতিয়ার হিসাবে সামনে আনতে পারে যা সাধারণ নারী যাতে অনিচ্ছুক এবং এই প্রেক্ষাপটও মূল সমস্যার খুবই ক্ষুদ্র অংশকে উপস্থাপন করে। ২০১০ সালের ১৫ জানুয়ারিতে গার্ডিয়ানে প্রকাশিত ৭০০ জন যৌন পরিসেবা গ্রহণকারীদের উপর গবেষণার উপর একটি প্রতিবেদন অ্যালেক্স নামের এক ভদ্রলোক যৌনতা ক্রয় সম্পর্কে তার মনোভাব তুলে ধরেছেন এভাবে–“গণিকারা তাঁকে পছন্দ করুক সে তাই চায়, আবার একই সঙ্গে সে এই বিভ্রমে থাকতে চায় না যে তাঁরা প্রকৃতপক্ষেই একটি সম্পর্কের মধ্যে আছে।” গণিকাদের প্রতি এরকম মানসিকতা একেবারেই সাধারণ ঘটনা।
গণিকাবৃত্তি বৈধতা পেলে কিছু মানুষ তা নিয়ে বৈধ উপায়ে উপার্জনের পথ দেখাবে। কিছু মানুষ গণিকাদের নিয়ে ব্যাবসা খুলে বসবে। গণিকালয়গুলো চলে যাবে ক্ষমতাবান এবং বিত্তশালী কিছু মানুষের হাতে, যাঁরা আসলে মূল ব্যাবসাটা করবে যেখানে পুঁজি থাকবে গণিকারাই। পশ্চিমে গণিকালয়ে যারা ইম্প (যাঁরা যৌন সম্পর্কের জন্য গণিকা সরবরাহ করে থাকে) এবং এখানে মাসি বা পিসি নামে পরিচিত, তাঁরাই মূল ব্যাবসার সুযোগ পাবে। গণিকারা তাঁদের হাতের অদৃশ্য সুতোয় বন্দি থাকবে। বর্তমানে রাজমিস্ত্রী, কাঠমিস্ত্রী প্রভৃতি শ্রমিকরাও এরকম সিন্ডিকেটতন্ত্রে আবদ্ধ হয়ে গেছে। কোনো শ্রমিক পেতে হলে সেই সিন্ডিকেটের সুপারভাইজারের সঙ্গে কথা বলতে হয়। শ্রমিকদের পারিশ্রমিকের একটা অংশ সুপারভাইজাররাই ভোগ করে। এটা কি আমরা আটকাতে পেয়েছি? না আটকানোর কোনো চেষ্টা করেছি? গণিকাদের ক্ষেত্রে এমন হলে আটকাবো কেন?
বৈধতা প্রদানের ভালো কিছু উদাহরণও আমাদের সামনে আছে। ১৯৮০ সালের জানুয়ারিতে নেদারল্যান্ড গণিকাবৃত্তিকে বৈধ পেশার স্বীকৃতি দেয়। এমনকি এই পেশায় উপার্জনের উপর করও আরোপিত হয়। গণিকাবৃত্তি দু-ভাবেই চর্চা হয়—ইচ্ছাকৃত এবং জোরপূর্বকভাবে। ১৯৮০ সালের পর এই দুই চর্চার মাঝে সীমারেখা টানা এবং তা নজরদারি সহজ হয়েছে। ১৯৯৬ সালের দিকে সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় এবং ১৯৯৯ থেকে উপার্জনের উপর কর আরোপিত হয়, যা ধীরে ধীরে সমাজের চোখে একটি সাধারণ পেশা হিসাবে গণিকাবৃত্তিকে প্রতষ্ঠিত করতে সাহায্য করে। ভারতের যৌনকর্মীদের সংগঠন জাল নোট সনাক্ত করতে গণিকাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে, যা তাঁদেরকে অর্থনৈতিক ঝুঁকি থেকে কিছুটা হলেও সুরক্ষা দেয়। অবৈধতা এরকম সুরক্ষার ক্ষেত্র প্রস্তত করত বলে আমার মনে হয় না।
২০০০ সালে বাংলাদেশে গণিকাবৃত্তি বৈধতা পায় উচ্চ আদালতের রায়ে। যদিও বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী- “State shall endeavor to prevent gambling and prostitution”। ২০০০ সালে গণিকালয় থেকে আটককৃত শতাধিক গণিকার আটকাদেশ নিয়ে উচ্চ আদালতের রায় ছিল এটি। ভারতেও গণিকাবৃত্তি বৈধ, তবে একটু অন্যভাবে। কারণ ভারতে গণিকাবৃত্তি বৈধ, কিন্তু গণিকালয় নয়। বিবাহ, বধু এবং প্রেমিকার মতো গণিকাও এক বাস্তবতা। অবৈধ করে এটিকে থামানো সম্ভব না। ইউএসএ-এর নেভাদার অবৈধ গণিকাবৃত্তির আকার অন্য প্রদেশের বৈধ গণিকাবৃত্তির চার গুণেরও বেশি বড়ো। বৈধতা এবং অবৈধতা দুটি ধারার সমস্যা নিয়ে আমাদের সামনে আসে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি বৈধতা দিয়ে যথাযথ নজরদারির মাধ্যমে এই সম্পৰ্কত অপরাধ নিয়ন্ত্রণের রাখা সম্ভব এবং এটাই যৌক্তিক উপায়।
জুয়াও বেআইনি। জুয়া খেলতে খেলতে মানুষ সর্বস্বান্ত হয়, আত্মহত্যাও করে থাকে। সে জুয়া যখন সরকারের স্বীকৃতি পায় সেটা তখন আইনি। তেমনই এক জুয়ার নাম লটারি। এই লটারির টিকিট কেনা ও বেচা কোনোটাই অপরাধ নয়। আছে মোটা অঙ্কের প্রাইজ মানি। এই প্রাইজ মানির লোভে কত মানুষ সর্বস্বান্ত হয় তার কোনো খবর কেউ রাখে না। কিন্তু কেউ এর বাইরে অন্য কোনো জুয়া খেললে তা গ্রেফতারযোগ্য ও দণ্ডনীয় অপরাধ। যেমন সাট্টা ইত্যাদি। পাড়ায় বসে তাস খেলছেন? সেই খেলায় টাকা লেনদেন করছেন? তাহলে তা অবশ্যই গ্রেফতারযোগ্য ও দণ্ডনীয় অপরাধ। ক্রিকেট বা কোনো খেলায় বেটিং করছেন? তাহলে সেটাও গ্রেফতারযোগ্য ও দণ্ডনীয় অপরাধ। আপনি চোলাই মদ বানাচ্ছেন বা বিক্রি করছেন? এটাও গ্রেফতারযোগ্য ও দণ্ডনীয় অপরাধ। তার কারণ আপনি এসব করেন সরকারকে রাজস্ব না দিয়ে। সীমান্তে ‘চোরা কারবার’ গ্রেফতারযোগ্য অপরাধ এবং দণ্ডনীয়। কেন? তাঁরা কি চোরাই পণ্য এ-দেশ ও-দেশ করে? মোটেই না। তাঁরা গাঁটের কড়ি খরচা করে পণ্য কিনে অন্য দেশে বিক্রি করে। তাঁদের অপরাধ হল তাঁরা সরকারকে রফতানি শুল্ক দেয় না, ফাঁকি দেয়। অর্থাৎ যে পেশায় রাজস্ব দেওয়া হয় না, সেই পেশাই অবৈধ। যদি যৌনকর্মীরাও সরকারকে রাজস্ব প্রদান করে, তাহলে যৌনপেশাও বৈধ হয়ে যাবে। যৌনকর্মীদের ট্রেড লাইলেন্স ও রোজগারের বার্ষিক রিটার্ন জমা দিলে পেশাটি বৈধতা পাবে। অর্থাৎ এই পেশায় যাঁরা আসবে তাঁদের সরকার দ্বারা রেজিস্টার্ড হতে হবে। এটা আর পাঁচটা পরিসেবা বা পেশার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিসেবা। আপনার প্রাত্যহিক প্রয়োজনে অর্থের বিনিময়ে বাজার থেকে চাল ডাল কিনে খেতে যদি আপত্তি না থাকে, তাহলে অর্থের বিনিময়ে যৌনতা কেনাবেচার আপত্তি থাকবে কেন? তাহলে কি বিনামূল্যে শরীর ও যৌনসুখ পেলে সব অপরাধ ঘুচে যাবে? পৃথিবী থেকে বাজারের ধারণা যেদিন বিলুপ্ত হবে সেদিন থেকে আর পাঁচটা পেশার মতো যৌনপেশাও বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বাজার থাকলেই পণ্য থাকবে, পণ্য থাকলে বাজারও সৃষ্টি হবে।
২১. পুরুষরা কেন যৌনকর্মীদের সাহচর্য চায়
মেয়েরা কেন একাধিক পুরুষসঙ্গ বা পুরুষ যৌনকর্মী কামনা করে, সে বিষয়ে আগের অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এই অধ্যায়ে আলোচনা করব পুরুষরা অধিক নারী সাহচর্য বা যৌনকর্মীদের কেন কাছে যায়। একাধিক নারীসঙ্গ বা একাধিক পুরুষসঙ্গ যাঁরা চায়, তাঁদের বহুগামী বহুগামিনী বলে। তার আগে আমরা জেনে নেব বহুগামিতার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ। বহুগামিতা হল মূলত বিবাহ বহির্ভূত যৌন-সম্পর্ক, যা একজন অবিবাহিত ও বিবাহিত উভয়ের পক্ষেই প্রযোজ্য। বিস্তারিতভাবে বললে বহুগামিতা হল পরস্পর সম্মতিক্রমে একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে একই জীবনে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক করার অভ্যাস কিংবা আকাঙ্ক্ষা। বহুগামিতাকে “সম্মতিসূচক, নৈতিক ও দায়বদ্ধ অ-একগামিতা” হিসাবেও বর্ণনা করা হয়। নিজেকে বহুগামী বলে পরিচয়দাতারা বিশ্বাস করে এমন এক মুক্ত সম্পর্কে যেখানে একগামিতার হিংসাপরায়ণতা নেই, আধিপত্যবাদ নেই। তাদের মতে, দীর্ঘমেয়াদি কোনো ভালোবাসার সম্পর্কের জন্য যৌন এবং প্রেমঘটিত স্বতন্ত্রতার প্রয়োজন নেই। বহু-অংশীদার সম্পর্ক, অ-একগামিতা, অস্বতন্ত্র যৌন এবং প্রেমঘটিত সম্পর্ক বোঝাতে বহুগামিতা শব্দটি ব্যবহৃত হয়। শব্দটি জড়িত ব্যক্তিদের পছন্দ এবং দর্শন ও নৈতিক মূল্যবোধের উপর। যেমন–ভালোবাসা, ঘনিষ্ঠতা, সততা, নিষ্ঠা, সমতা, পরস্পর যোগাযোগ এবং প্রতিশ্রুতি সহ নানাবিধ বিষয় প্রতিফলিত করে। একজন পুরুষ যখন একাধিক নারীকে বিয়ে বা যৌন-সম্পর্ক করে, তা বোঝাতে সমাজবিজ্ঞানীরা ‘Polygyny’ শব্দটি ব্যবহার করেন। একজন মহিলা যখন একাধিক পুরুষকে বিয়ে বা যৌন-সম্পর্ক করে, তা বোঝাতে সমাজবিজ্ঞানীগণ ‘Polyandry’ শব্দটি ব্যবহার করেন। কিন্তু বাংলায় দুটো শব্দের জন্য আলাদা প্রতিশব্দ না থাকায় ঢালাওভাবে বহুবিবাহ বা বহুগামী বলে। একদা ভারত সহ সব দেশেই সব ধর্মের মধ্যেই বহুবিবাহ করার রীতি বা অভ্যাস ছিল। বহু বছর হল আইন করে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। বহুবিবাহ নিষিদ্ধ হলেও বহুগামিতা তো রয়েই গেছে। তাকে তো আইন করে দমন করা সম্ভব নয়।
এখন আর একাধিক বিয়ে করার কোনো সুযোগ নেই, সামর্থ্যও নেই। তা সত্ত্বেও বহুবিবাহের প্রচলন ছিল, তখনও মানুষ বহুগামী ছিল এবং একাধিক মহিলার সঙ্গে যৌন-সম্পর্কে লিপ্ত হওয়ার সুযোগ ছিল। বহুগামিতার একটি পরিচিত রূপ হল বহুপত্নীকতা। বহুপত্নীক বিবাহবন্ধন সাধারণত একজন স্বামী ও একাধিক স্ত্রীর সমন্বয়ে গড়ে উঠে। অধিকাংশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এবং উল্লেখযোগ্য মুসলিম জনসংখ্যা বিশিষ্ট রাষ্ট্র ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে বহুবিবাহের বৈধতা দেয়। কিছু ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রও এর বৈধতা দিয়েছে। কিন্তু চারটির বেশি কখনোই নয়, তাও শর্তসাপেক্ষে। অতএব চারটি বিয়ে করে ফেলা মোটেই কাজ নয়। মুসলিম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মের মানুষদের একের অধিক বিয়ে করার অধিকার বর্তমানে নেই। অন্যান্য মহাদেশের তুলনায় আফ্রিকা মহাদেশে বিশেষত পশ্চিম আফ্রিকা অঞ্চলে এর বিস্তৃতি ব্যাপক। এর কারণ হিসাবে পণ্ডিতগণ আফ্রিকায় নারী-পুরুষের সাংখ্যিক অনুপাত এবং দাসপ্রথাকেই দায়ী হিসাবে উল্লেখ করছেন। নৃতত্ত্ববিদ জ্যাক গুঁড়ি অ্যাথনোগ্রাফিক এটালাস ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী বিবাহের তুলনামূলক গবেষণায় উপ-সাহারান আফ্রিকান সমাজগুলির ক্ষেত্রে ব্যাপক খামার বাগান এবং বহুগামিতার মধ্যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক প্রদর্শন করেন।
মানুষ কি জিনগতভাবেই বহুগামী? সেক্স থেরাপিস্ট গের্টরুড ভোলফ অবশ্য এ ব্যাপারে তাঁর অবস্থান এককথায় জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “মানুষ জিনগতভাবেই একগামী নয়।” ভোলফের এক-তৃতীয়াংশ ক্লায়েন্টই তাঁর কাছে আসেন প্রতারণার অভিযোগ নিয়ে। একটি দম্পতি বা যুগলের যে-কোনো একজন অন্য জনের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন, এমন অভিযোগই বেশি। আর অনেক যুগলের কাছেই, যৌনজীবনে সৎ থাকা মানে একগামিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এই বিষয়ে তিনি বলেন, “আমি প্রায়ই এমন মানুষের মুখোমুখি হই, যাঁরা বলেন যে তাঁরা কোনোদিনই প্রতারণা করবেন না। এবং তাঁদের সঙ্গী বা সঙ্গিনী যদি প্রতারণা করেন, তাহলে তাঁকে ক্ষমা করবেন না।” তিনি বলেন, “অনেক সময় দেখা যায়, তাঁদের অনেকে আবার আমার সামনে এসে বসেন, কেন-না, তাঁরা আসলে যৌনজীবনে সঙ্গী বা সঙ্গিনীর সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।”
অনেক মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম, একগামিতার বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্ত। একটা সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কি না, সেটা নিয়ে সন্দিহান তাঁরা। আর কারও কারও মতে, একগামিতা আসলে সেকেলে ধারণা, যা শীঘ্রই সমাজ থেকে পুরোপুরি হারিয়ে যাবে। ভোলফ মনে করেন, একগামিতা হচ্ছে পুরুষের আবিষ্কৃত এক ধারণা, যাকে সাংস্কৃতিক অর্জন বলা যেতে পারে। আর এটা এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারও। ভোলফ তাঁর বই ‘Construction of Adult’-এ মানুষের যৌনাকাঙ্ক্ষার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। সেখানে তিনি দুই ধরনের সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছেন। একটি ধরন হচ্ছে, যেটি পুরোপুরি শারীরিক চাহিদা থেকে সৃষ্ট। এখানে ঘনিষ্ঠতার কোনো ব্যাপার নেই, বরং পুরোটাই শারীরিক চাহিদা। এই সম্পর্ক সাময়িক।
সেটা ছিল পড়ন্ত বিকেল, মদের নেশাটাও বাড়ছিল, মোটের উপর সঙ্গিনীও ছিল আকর্ষণীয়। ফলে হাসিঠাট্টা এক পর্যায়ে চুমুতে রূপ নেয়, যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে বিছানায়। ম্যাক্স মাঝেমাঝেই এভাবে বিভিন্ন নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান। আর এটা কোনো সমস্যা হত না, যদি-না তিনি বিবাহিত হতেন। ম্যাক্স মনে করেন, তাঁর এই যৌনাকাঙ্ক্ষা স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও এমনটা করা ঠিক নয়। বর্তমানে ৩০ বছর বয়সি এই নারী বয়স ২০ পেরুনোর পর নানাভাবে যৌনতার স্বাদ নিয়েছেন। কখনো সুইঙ্গার ক্লাব মানে তাৎক্ষণিক সঙ্গী বদলের ক্লাবে গিয়েছেন, কখনো এমন সব স্থানে সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছেন, যা স্বাভাবিকভাবে ভাবা যায় না। তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল যতটা সম্ভব আনন্দ, উত্তেজনা উপভোগ করা।
আর দ্বিতীয় ধরনের সম্পর্ক হচ্ছে, যেখানে যৌনতার মাধ্যমে সৃষ্টি হওয়া ঘনিষ্ঠতা, যা মানসিকও হতে পারে। ভোল্ফের ভাষায় যাকে বলে, “সংস্কৃতির আদলে যৌনতা।” তাঁর মতে, এ ধরনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একগামিতা বিশেষ ভূমিকা পালন করে, কেন-না, দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ যৌনসম্পর্কের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যকার সম্পর্ককে মজবুত করে তোলেন। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় কিটি পার্টির আয়োজন হচ্ছে সর্বত্র। যে পার্টিতে সঙ্গী বা সঙ্গিনীর অদলবদল করে যৌনসঙ্গী করে নিচ্ছে সাময়িক সময়ের জন্য। একঘেঁয়েমি যৌনজীবন থেকে মুক্তি পেতেই এই ধরনের পার্টির গ্রহণযোগ্যতা বাড়াচ্ছে।
গের্টরুড ভোল্ফের কাছে আরও এক ধরনের ক্লায়েন্ট আসেন, যাঁদের যৌনচাহিদা তাঁদের সঙ্গী বা সঙ্গিনী পূরণ করেন না। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়, দুজনের চাহিদা ভিন্ন কিংবা একজনের চাহিদা অন্যজনের পছন্দ নয়। সেসব যুগলের ক্ষেত্রে সম্পর্কটা একসময় এমন এক পর্যায়ে চলে যায় যে, তাঁদের কেউ কেউ নিজের চাহিদা পূরণে অন্য কারও সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান। এবং প্রতারণা তাঁদের কাছে অস্বাভাবিক কিছু মনে হয় না। ভোল্ফ মনে করেন, যৌনতা নিয়ে এমন কোনো একক সমাধান নেই, যা সব যুগলের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে। কিছু যুগল এই সমস্যার সমাধানে তাঁদের সম্পর্কটা উন্মুক্ত করে দেন, অর্থাৎ যৌনজীবনে একগামী থাকার ব্যাপারটি বাদ দিয়ে দেন।
ক্যাথরিনা এবং তাঁর ছেলেবন্ধু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, নিজেদের সম্পর্কের বাইরে সাময়িক যৌন সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে তাঁরা একে অপরকে বাধা দেবেন না। ক্যাথরিন অবশ্য জানেন, এভাবে যে পরীক্ষা তাঁরা করেন, সেটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং এটা কোনো মজার ব্যাপার নয়। তিনি বলেন, “আমার কাছে এই উন্মুক্ত সম্পর্কের অর্থ এই নয় যে, আমি যা খুশি তা-ই করতে পারব।’’ যেহেতু তাঁদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আর কোনো সীমান্ত নেই, তাই তাঁকে নিজের কৃতকর্মের জন্য দায় নিতে হয়। ফলে তিনি এমন কিছু করতে পারেন না, যা তাঁর নিজের এবং তাঁদের সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। অনেকক্ষেত্রে পরকীয়াও একটি সম্পর্ককে উন্মুক্ত করে দেয়। তবে সেক্ষেত্রে যে এভাবে প্রতারণা করছেন, তাঁর সঙ্গী বা সঙ্গিনী বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নিতে চান না। “পরকীয়া বা উন্মুক্ত সম্পর্ক যা-ই হোক না কেন, যুগলের মধ্যে সেটা সংকট তৈরি করতে পারে। আবার এই সংকটের কারণে একটি সম্পর্ক বৃদ্ধিও পেতে পারে।”—বলেন ভোঙ্ক।
সেক্স থেরাপিস্টের কথা হচ্ছে, “একগামিতাই যেমন সম্পর্কের একমাত্র অর্থবহ ধারণা নয়, আবার একগামিতার ধারণা ব্যর্থও হয়নি। ফলে একটি যুগল কোন্ ধরনের সম্পর্ক গড়বেন, সেটা দিনের শেষে। তাঁদেরই নির্ধারণ করতে হবে, অন্য কেউ সেটা ঠিক করে দিতে পারবে না। কেননা, যৌনতা অবশ্যই একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার।” বলেন ভোলফ।
স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে মাত্র ৩ % প্রাণী সামাজিকভাবে একগামী। ১০০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে তিন প্রজাতির প্রাণী মাত্র ১ জন সঙ্গী নিয়ে কাটিয়ে দিতে পারে। মানুষ যথারীতি সেই ৩ শতাংশের মধ্যে পড়ে না। পৃথিবীতে এই মুহূর্তে নারী-পুরুষের সেক্স রেশিও ১ : ১। অর্থাৎ প্রতি ১ জন নারীর বিপরীতে ১ জন পুরুষ। ঠিক এই মুহূর্তে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যায় হিসাব করলে ১০১ জন পুরুষের বিপরীতে নারী আছে ১০০ জন।
বহুগামিতা অনেক রকমের আছে, কোনটা স্রেফ মানসিক এবং কোনটা আবার দুয়ারে এসে কড়া নাড়ে বাস্তব জীবনে। মানসিক বহুগামিতায় পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ আক্রান্ত। এমন কোনো মানুষ খুঁজলে পাওয়া যাবে না, যিনি নিজের সঙ্গী ব্যতীত অন্য নারী বা পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কের কথা বা যৌনতার কথা ভাবেননি, যদি সে যৌনক্ষমতারহিত না হন। বাস্তব জীবনের চারপাশে থাকা মানুষ তো বটেই, এমনকি নায়ক-নায়িকাদের নিয়েও কাজ করে বেডরুম-ফ্যান্টাসি। হ্যাঁ, বিবাহিত মানুষদের মাঝেই বরং এই প্রবণতা বেশি দেখা যায়। অন্যদিকে বাস্তবের বহুগামিতা থেকেই জন্ম নেয় সম্পর্কের প্রতারণা, বিবাহে পরকীয়া, মন আর সংসারের ভাঙন। কেউ কেউ এই বহুগামিতায় ধরা পড়েন, কেউ পড়েন না। তবে এমন কাজ করার মতো মানুষ সমাজে ভুরি ভুরি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পৃথিবীতে কেন প্রায় প্রতিটি মানুষই বহুগামী কিংবা বহুগামিতার কথা ভাবেন? জবাব লুকিয়ে আছে হয়তো আমাদের জীবনেই–(১) বহুগামিতার প্রথম ও প্রধান কারণটিই হচ্ছে যৌন আকর্ষণ। ভিন্ন ভিন্ন যৌনসঙ্গী পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা বা ইচ্ছা থেকেই মানুষ বহুগামিতায় লিপ্ত হন। অনেকেই আছেন যাঁরা বাস্তবজীবনে লিপ্ত হতে না-পারলেও মানসিকভাবে লিপ্ত হন। পৃথিবীতে পর্নোগ্রাফির বাজার সুলভ হওয়ায় এটাও একটা কারণ। (২) জীবনের পরিস্থিতিও একটা বড়ো কারণ বহুগামিতার পিছনে। অনেক কিছুই ঘটে আমাদের জীবনে, যার ফলে একাধিক সম্পর্কে জড়িত হতে বাধ্য হয়ে যায় মানুষ। প্রেম হোক বা দাম্পত্য, একটি সম্পর্ক চিরকাল নাই-ই টিকতে পারে, আর সেটাই বেশি স্বাভাবিক। যারা সমস্ত বাঁধা পেরিয়ে সম্পর্ক ধরে রাখতে পারেন, তাঁরা আসলে সৌভাগ্যবান। (৩) বহুগামিতার আর-একটা বড়ো কারণ হচ্ছে লিঙ্গ পার্থক্য। স্বভাবতই নারী ও পুরুষ উভয়কে প্রকৃতি বা জিনগতভাবে পৃথকভাবে তৈরি করেছে। পুরুষ যেখানে সর্বদা চায় উন্মুক্ত, দায়িত্বহীন জীবন। তেমনি বেশিরভাগ নারী ঠিক তার বিপরীতে চায় সংসার, সন্তান ও নিরাপত্তা। এই ভিন্ন ভিন্ন চাহিদার কারণে নারী-পুরুষের বনিবনা না-হওয়ার বিষয়টিও চিরন্তন। ফলে বহুগামিতায় ঝুঁকে পড়ে। (৪) সম্পর্ক একঘেঁয়ে হয়ে যাওয়ার বিষয়টিও বহুগামিতার দিকে মানুষকে ঠেলে দেয়। একই সম্পর্কে দীর্ঘদিন চলার পর স্বভাবতই হারিয়ে ফেলে নতুনত্ব। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুরোনো সম্পর্কে নতুনত্ব ধরে রাখার বিষয়ে যত্নশীল হন না জুটিরা। এর ফলেও সম্পর্কে বহুগামিতার ফাঁদ খুলে যায়। (৫) এছাড়াও আরও কিছু কারণ আছে। যেমন স্বামী বা স্ত্রীর যৌনতার অনীহা, অন্যের সঙ্গে তুলনা, ঈর্ষা, ঝগড়াটে স্বভাব বা কাউকে নিজের জন্য যোগ্য মনে না করা ইত্যাদি। তবে দিনশেষে কঠিন সত্য এটাই যে প্রাণী হিসাবে মানুষ বহুগামী, তা সে মানসিকভাবেই হোক কিংবা বাস্তব জীবনে। খুব মানুষই আছেন এই ব্যাপারটির বাইরে। (One Love? Don’t Think So: 4 Gaping Flaws With The Concept Of Monogamy’—Mia Bates)
কাতারের দোহা কলেজের মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান মার্টিন স্টুয়ার্ট এক গবেষণায় ৫০০ পুরুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। এঁদের মধ্যে তিনি ২৭ ধরনের পুরুষের খোঁজ পেয়েছেন। তাঁর ধারণা হয়েছে, বিবর্তনের ধারাই আসলে পুরুষকে প্রতারক করে তুলেছে। সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৪৫ শতাংশ বলেছেন, জীবনে কখনো-না-কখনো তাঁরা স্ত্রী বা সঙ্গিনীর সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। ২৭ শতাংশ উত্তরদাতা এ কাজটি করেছেন তাঁদের বর্তমান সঙ্গিনীর সঙ্গেই। আর তাঁদের সবাই এমন আচরণের পেছনে কোনো না-কোনো যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন। প্রশ্নটি তখনই ওঠে যখন কোনো নারী হঠাৎই আবিষ্কার করেন যে, তাঁর স্বামী বা প্রেমিক অন্য কোনো নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছেন এবং ক্রমাগত মিথ্যে বলে যাচ্ছেন। “আমরা আজ যে আচরণ করছি–অনেক ক্ষেত্রে তার শেকড় প্রোথিত সুদূর অতীতে–আমাদের আদি পুরুষের মধ্যে। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়–আদি পুরুষেরা কেন বহুগামী হতেন? বিবর্তনবাদ অনুযায়ী, এর একটি উত্তর হতে পারে প্রজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার তাগিদ।”
স্টুয়ার্টের মতে, বিবর্তনের ধারার পুরুষের মস্তিষ্ক এমনভাবে তৈরি হয়েছে যে, শারীরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অধিকাংশ পুরুষের মধ্যেই কম-বেশি অবিশ্বস্ত হওয়ার প্রবণতা রয়ে গেছে। গবেষণা থেকে জানা যায়, ওই ২৭ ধরনের পুরুষের মধ্যে কোনো কোনো ধরনের পুরুষের অবিশ্বস্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি। সুতরাং সম্পর্কে জড়ানোর আগে নারীদের ভাবতে হবে–কোন্ ধরনের পুরুষের সঙ্গে তিনি যাচ্ছেন। স্টুয়ার্টের এই ২৭ ধরনের পুরুষের মধ্যে একটি হল সুযোগসন্ধানী। অর্থাৎ, কারও সঙ্গে শরীরী প্রেমের কোনো সুযোগই এঁরা ছাড়তে চান না। পরিণতি কী হবে–সেটাও তাঁরা ভেবে দেখেন না। আর-এক জাতের পুরুষ আছে, যাঁরা দুর্বলতার সুযোগ নেন। এঁরা সবসময় পরিস্থিতিকে নিজের পক্ষে নিতে চান এবং নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য পরিবারের সদস্য, বন্ধু, স্ত্রী বা সঙ্গিনীর কাছ থেকে দুর্বলতাকে ব্যবহার করে সুবিধা আদায় করেন। স্টুয়ার্ট অবশ্য বলেছেন, সমীক্ষায় তিনি বহু পুরুষ দেখেছেন, যাঁরা এখনও সঙ্গিনীর প্রতি সৎ, বিশ্বস্ত, পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল এবং মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা রাখেন।
আমাদের ধনতান্ত্রিক ভোগবাদী দুনিয়ার প্রেক্ষিতে আমরা ক্রমেই পেতেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। তাই প্রাপ্তির কোটা পুরোপুরি পুরণ না-হলেই মনের মধ্যে জমে ওঠা ক্ষোভের বিক্ষুব্ধ বাষ্প অসহিষ্ণু করে তোলে আমাদের। সেই অসহিষ্ণুতার অস্থিরতায় খেয়ালই থাকে না যে, আমার দেওয়ার কোটায় আর একজনের অপ্রাপ্তির ব্যথা বেদনা রয়ে গেল কি না।
বহুগামিতা পুরুষজাতির একচেটিয়া অধিকার নয়। বহুগামিতা নারী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই সমান আবেদন। নারীর প্রকাশ কম, কারণ সামাজিক ও ধর্মীয় নিগড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। পুরুষের ক্ষেত্রেও সামাজিক ও ধর্মীয় নিগড় থাকলেও পুরুষ সেটা অনেক ক্ষেত্রে জয় করতে পেরেছে। জয় করেছে ঠিকই, তাই সবাইকে বলে বেড়ানোর সাহস পুরুষের নেই। কারণ বহুগামী নারীদের যেমন সমাজ ঘৃণা করে, তেমনি বহুগামী পুরুষকেও সমাজ ঘৃণা করে।
যাই হোক, আমরা এখন দেখব পুরুষরা কেন যৌনকর্মীর কাছে যায়। নারী গবেষক জুলি বিনডেল ২০১০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত পুরুষদেরদের যৌনকর্মীর কাছে যাওয়া কারণ নিয়ে একটি প্রবন্ধ লেখেন। ‘The Guardian’ প্রকাশিত “Why men use prostitutes” প্রবন্ধে লিখেছেন—(১) শৈশবের নিঃসঙ্গতা এবং আত্মীয়স্বজন বিশেষ করে মহিলাদের সঙ্গে সেভাবে মিশতে পারার কৌশল না-জানার কারণেও ভিতরে ভিতরে বহুদিনের জিইয়ে রাখা কষ্ট থেকে অনেকেই যৌনকর্মীদের কাছে যায়। এ ব্যাপারে লেখক বলেন–“একজন আমাকে তাঁর শৈশবের নির্মমতা, অবহেলা এবং অন্যদের সঙ্গে বিশেষ করে মহিলাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করার ব্যাপায়ে অক্ষমতার অভিজ্ঞতার কথা বলেন। তিনি সাক্ষাৎকারে অংশগ্রহণ করা অ্যালেক্সের কথা উল্লেখ করে বলেন, তিনি একজন যৌনকর্মীর সঙ্গে সহবাস করে তেমন কিছুই পান না তাঁর শুধু শূন্যতায় অনুভুত হয়। কিন্তু তিনি জানেন কীভাবে একজন মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে হয় তাঁর সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলতে হয়। (২) গণিকাবৃত্তি রোধে তেমন আইন না থাকা বা থাকলেও তাঁর সঠিক বাস্তবায়ন না থাকা টাকার বিনিময়ে সেক্সকর্ম করা অনেক দেশেই আইনের চোখে দোষনীয়। এটাকে খারাপ। চোখে দেখা হয় বিভিন্ন দেশে। গবেষণার মাধ্যমে জানা যায় যে মাত্র ৬ % পুরুষ টাকার বিনিময়ে যৌনকর্মী ব্যবহারের কারণে গ্রেপ্তার হয়। এই কাজ না করার ব্যাপারে সে ধরনের আইন এবং আইন থাকলেও তা বাস্তবায়নের সুষ্ঠু পদক্ষেপ না-থাকার কারণেই অধিকাংশ পুরুষ এসব কাজ করছে বলে গবেষণার মাধ্যমে জানা যায়। এই গবেষণা চলাকালে সাক্ষাৎকার দেওয়া একজন বলেন—“যদি কোনো নেগেটিভ কিছু ঘটত, তাহলে আপনাকে পুনরায় বিবেচনা করতে শেখাত। আইনটি এখন বাস্তবায়ন হয়নি। এর ফলাফল হিসাবে যদি নেগেটিভ কিছু ঘটতে থাকে তাহলে তা অবশ্যই আমাকে এ কাজ থেকে বিরত রাখবে।” গবেষণায় সাক্ষাৎকার দেওয়া অন্য আর-একজন বলেন—“যদি এই কাজ করার জন্য আমাকে কোনো ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হত তাহলে আমি কখনোই এ কাজ করতাম না। এই দেশে পুলিশরা পুরুষদের সঙ্গে সুন্দর আচরণই করে যৌনকর্মীদের সঙ্গে মিলিত হবার পরও।” (৩) স্ত্রী বা গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে বোঝাঁপড়ার অভাব থেকে অনেক পুরুষই মহিলাদের সঙ্গে একটি সত্যিকারের সম্পর্ক তৈরি করতে চায় এবং ব্যর্থ হয়ে প্রায় সময়ই হতাশ হয়ে পড়ে। আর সে সম্পর্কের বিকাশ সাধন করতে পারে না। এ ব্যাপারে গবেষণায় সাক্ষাৎকার দেওয়া একজন বলেন—“এটা শুধুমাত্র একটা যৌনকর্ম, কোনো আবেগ-প্রেম নয়। এটা গ্রহণ করতে হয় প্রস্তুত থাকতে হবে, নয়তো একেবারে না-যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাঁরা স্ত্রী বা গার্লফ্রেন্ডের মতো নয়।” এই গবেষণায় বব নামক একজন আরও পরিষ্কারভাবে বলেন যে, তাঁরা টাকার বিনিময়ে যৌনকর্মীর সঙ্গে সহবাস করে, যাতে তাঁরা নিজেকে এনকাউন্টার থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। বব বলেন—“দেখুন, পুরুষরা নারীকে (যৌনকর্মী) টাকা দিয়ে তাঁর সঙ্গে সহবাস করে, কারণ এক্ষেত্রে সে যা খুশি তাই করতে পারে বা যাকে খুশি ব্যবহার করতে পারে। অধিকাংশ পুরুষই যৌনকর্মীদের কাছে এজন্য যায় যে, তারা তাদের সাথে এমন আচরণও করতে পারে বা পেতে পারে যা সত্যিকারের ভালো মহিলারা পছন্দ বা সহ্য করতে পারবে না।” (৪) অন্য নারীদের ধর্ষিতা হওয়া থেকে বাঁচাতে গবেষক জুলি বিনডেল বলেন, এই গবেষণার পর একটা আশ্চর্যজনক ফলাফল পাই যে, অধিকাংশ পুরুষই মনে করেন যে তাঁরা যদি টাকার বিনিময়ে যৌনকর্মীর কাছে না-যেত, তাহলে তাদের যৌন তাড়না মেটাতে প্রয়োজনে তাঁদেরকে অন্য নারীদের ধর্ষণ করতে হত। এমনকি একজন আমাকে বলেই ফেললেন যে—“কখনও তুমি কাউকে ধর্ষণ করতে পারো, কাজেই তাঁর পরিবর্তে যৌনকর্মীর কাছে যাওয়া ভালো।” গবেষক জুলি বিনডেল তাঁর আর্টিকেলে এই বিষয় নিয়ে লিখতে গিয়ে বলেন—“সেক্সের জন্য মরিয়া হয়ে উঠা একজন পুরুষ যে এই খারাপভাবেও যৌনকর্ম সাধন করতে চায়, তাঁর যৌনকর্ম করার ব্যবস্থা থাকা উচিত, তা–হলে সে কাউকে ধর্ষণ করতে পারে।” জুলি বিনডেল বলেছেন, “অভিজ্ঞতা থেকে আমার একটা বিষয় মনে হয়েছে যে, প্রত্যেক পুরুষই একজন পটেনশিয়াল ধর্ষক।” (৫) আর-এক শ্রেণির পুরুষ আছে, তাঁরাও যৌনপল্লিতে যান। তাঁরা হলেন ইমপোটেন্ট পুরুষ, যৌন অক্ষম পুরুষ। কেন-না যৌনপল্লিতে পৌঁছে গিয়ে যৌনকর্মীকে ন্যায্য মূল্য চুকিয়ে দিলেই একটা নারীর নগ্ন শরীর পেয়ে যায় সে। শরীর না উঠলে কী হয়, মন তো নারী-শরীর চায়। যৌনপল্লির নারীকে যৌনসুখ দেওয়ার কোনো দায় থাকে না কোনো পুরুষেরই। এক্ষেত্রেও অন্যথা হয় না। যৌনকর্মীদের টাকা দিলেই হল। টাকা পেলে যৌনকর্মীদেরও কোনো দাবি নেই, দাবি থাকেও না। ভালোবাসার নারীকে যৌনসুখ দিতেই হয়। ধর্মপত্নীকে যৌনসুখ দিতেই হয়। তাঁরা মানবে কেন? কিন্তু ইমপোটেন্ট পুরুষের তো সেটা দিতে অপারগ। ইমপোটেন্ট যুবকরা যেমন যৌনপল্লিতে যায়, তেমনি লোল-চামড়ার দাঁত ফোকলা যৌন-অক্ষম বৃদ্ধরাও যৌনপল্লিতে যায়। চতুর বৃদ্ধরা অবশ্য যৌনবর্ধক ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল সেবন করে যায়, যাতে দণ্ড সোজা করে যৌনকর্মটা করে বাহবা দেখাতে পারে।
বাংলাদেশী বিশিষ্ট গবেষক এবং লেখক আখতার হামিদ খান একটি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত যৌনকর্মীদের গণিকালয়ে আসার কারণ নিয়ে লেখা “কেন এরা এ পথে আসে” শিরোনামের একটি প্রবন্ধে বাংলাদেশী পুরুষদের যৌনকর্মীদের কাছে যাওয়ার তিনটি কারণ উল্লেখ করেন। কারণ তিনটি হচ্ছে—(১) ব্লু-ফিল্ম, পর্নোসাহিত্য ও অশ্লীল ম্যাগাজিন পুরুষদের যৌন উত্তেজনার অন্যতম কারণ। ব্লু-ফিল্ম, অশ্লীল ম্যাগাজিন ও তথাকথিত যৌন উত্তেজক গল্প-উপন্যাস এবং বিদেশি যৌন উত্তেজক ছায়াছবির ব্যাপক ছড়াছড়ি যুবকদের দেহমনে কামনার আগুন জ্বালিয়ে দেয়। তখনোই তাঁরা অবৈধ নারী সংসর্গ কামনায় পাগলপারা হয়ে ওঠে। যে কোনো উপায়ে নারী ধর্ষণের চেষ্টা করে, না-পারলে ছোটে যৌনকর্মীর সন্ধানে। প্রশ্ন উঠতে পায়ে, বহু আগে যখন ব্লু-ফিল্ম আবিষ্কার হয়নি, তখনও তো যৌনপল্লি ছিল। প্রথমত তখন ব্লু-ফিল্ম না-থাকলেও পর্নোসাহিত্য, যৌন উত্তেজক পেইটিং ও চারুশিল্পের অস্তিত্ব ছিল। শত শত বছর আগের উলঙ্গ ভাস্কর্য, নগ্ন নারী চিত্র ও নারী-পুরুষের যৌন মিলনের বহু চিত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। দ্বিতীয়, পর্নোছবি ছাড়াও তখন যৌন উত্তেজক অন্যান্য কারণগুলো তখনও ছিল। কেননা জৈবিক তাড়না তো প্রকৃতিগত। (২) দেরিতে বিয়ে করা বা হওয়াও একটি কারণ। যৌবনের তাড়না স্বাভাবিকভাবেই প্রকৃতিগত। এ জন্যই বিয়ের ব্যবস্থা। কিন্তু যে-কোনো কারণে হোক বিয়ে করতে দেরি হলে বয়সের দাবি তো তার অধিকার ছাড়বে না। তাই যৌবনের স্বাভাবিক তাড়নায় যুবকরা বাধ্য হয় যৌনকর্মীর সন্ধান করতে করতে যৌনপল্লিতে পৌঁছে যাওয়া ছাত্র, যুবক ও স্ত্রীসঙ্গহীন পুরুষরাই অধিকহারে গণিকাগমন করে থাকে। (৩) যে কারণই থাক, যত কারণই থাক ধর্মহীনতা ও নৈতিকতার অবক্ষয় সকল অপকর্মের মূল কারণ। তা যেমন যৌন অপরাধের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, অন্যান্য ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। মজার ব্যাপার হল, অনেকে আছেন, যারা গণিকাবৃত্তির বিরুদ্ধে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে বেড়ান, আবার তাঁরাই রাতের আঁধারে খদ্দের হয়ে ভেজা বেড়ালের মতো মাথা গুঁজে ঢোকেন যৌনপল্লিতে অথবা হোটেলে বা অন্য কোনোখানে।
২২. বেশ্যাদ্বারের মাটি : গূঢ়তত্ত্ব
বাঙালির দুর্গাপুজোয় গণিকাঘরের মাটির (বেশ্যাদ্বারের মাটি) প্রয়োজন হয়। গণিকা ও গণিকালয় নির্মূল করে দিলে এ মাটি আসবে কোথা থেকে? ‘বেশ্যাবাড়ির মাটি ছাড়া কি দুর্গাপুজো হবে? দুর্গাপুজো হবে কি হবে না, সেই ভিত্তিতে গণিকাবৃত্তিকে সমর্থন করব কি করব না সেটা নির্ভর করে না। একসময় নীলকণ্ঠ পাখি না ওড়ালে জমিদাররা দেবী বিসর্জন স্বপ্নেও ভাবতে পারত না। এখন ভাবতে পারে। একসময় পশুবলি ছাড়া দুর্গাপুজো করার কথা ভাবতেই পারত না। এখন কিন্তু পশুবলি ছাড়াই পুজোপার্বণ হচ্ছে। অতএব চাইলে ‘বেশ্যাবাড়ির মাটি ছাড়াও দুর্গাপুজো হতে পারে। সে কথা এখানে আলোচ্য বিষয় নয়। আমাকে অনেকেই জিজ্ঞাসা করেছেন সত্যিই কি দুর্গাপুজোয় ‘বেশ্যাবাড়ির মাটি’ লাগে? ব্যাপারটা কীভাবে সম্পন্ন হয়? তার আগে জেনে নেব দুর্গাপুজোয় যে ‘বেশ্যাবাড়ির মাটি’ লাগে, তা কতটা শাস্ত্রসম্মত?
কী বলছে শাস্ত্র? হিন্দুশাস্ত্র লিঙ্গপুরাণে দুর্গাপুজোকে ‘চতুষ্কর্মময়ী’ বলা হয়েছে। চতুষ্কর্ম বলতে–(১) মহাস্নান, (২) ষোড়শোপচার পুজো, (৩) বলিদান এবং (৪) হোম। দুর্গাদেবীর স্নান একটি অত্যাবশ্যকীয় পূজাঙ্গ। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী তিথিতে দেবীকে বহুবিধ উপাচার সহযোগে স্নান করানো হয়। উপাচারগুলি কী আমরা এবার জেনে নিতে পারি। এই উপাচারগুলির মধ্যে ১২ টি মাটির উল্লেখ পাওয়া যায়–(১) রাজবাড়ির দুয়ারের মাটি, (২) চার মাথার মোড়ের মাটি, (৩) গঙ্গার মাটি, (৪) ষাঁড়ের শৃঙ্গ মাটি, (৫) নদীর দুই কূলের মাটি, (৬) সর্বতীর্থের মাটি, (৭) উইঢিবির মাটি, (৮) সাগরের মাটি, (৯) বুনো শুয়োরের দন্তলগ্ন মাটি, (১০) গোষ্ঠের মাটি, (১১) দেবদুয়ারের মাটি এবং (১২) বেশ্যাদ্বারের মাটি।
দুর্গাপুজোয় বেশ্যাদ্বারের মাটির ব্যবহার প্রায় সর্বত্র প্রচলিত। তবে এই ব্যবহার শাস্ত্রসম্মত নয়। কারণ ‘বেশ্যা’ শব্দটি সাহিত্যে ব্যবহৃত হয়েছে ‘পতিতা’ অর্থে। কিন্তু বিভিন্ন শাস্ত্রে ‘বেশ্যা’ একটি ভিন্নার্থক পারিভাষিক শব্দ। আমরা লোকপ্রচলিত অর্থকে শাস্ত্র ব্যাখ্যার সময় গ্রহণ করার বেশ্যাদ্বার মৃত্তিকার অর্থ গণিকালয়ের মাটি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য এর সপক্ষে কোনো কোনো পণ্ডিত বলেছেন যে, বেশ্যাদ্বার পুণ্যশোষী। যে পুরুষ বেশ্যালয়ে প্রবেশ করে তাঁর সমস্ত পুণ্যবল ওই বেশদ্বার শোষণ করে নেয়। বেশ্যাগামী পুরুষ পুণ্যরিক্ত হয়ে পাপগৃহে প্রবেশ করে। যেহেতু বেশ্যাদ্বার সমস্ত পুরুষের পুণ্য শোষণ করে নেয়, তাই ওই ‘দ্বার’ সংলগ্ন মাটি পবিত্র। এবং অবশ্যই মহামায়ার স্নানের উপযোগী। খুবই বোকা বোকা ব্যাখ্যা! ব্যাখ্যাটি ‘তৃপ্তিদায়ক’ হলেও মোটেই শাস্ত্রসম্মত নয়। কেননা পুণ্যবান ব্যক্তির পুণ্যফল কোনো তরল পদার্থ নয় যে, বেশ্যাদ্বারে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়বে। পাপ ও পুণ্য মানুষের জন্মজন্মার্জিত কর্মফল বাহিত সূক্ষ্ম ধারণা বা সংস্কার। বাস্তবিকই সেটিকে কোনো কিছুর দ্বারাই শোষণ করা সম্ভব নয়। বেশ্যাদ্বারে কোনো ব্লটিং পেপার থাকে না, যা শোষণ করার ক্ষমতা রাখে। অর্থাৎ ভাবনাটা অযৌক্তিক। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
‘বেশ্যা’ শব্দটির বর্ণভিত্তিক অর্থ ব্যাখ্যা করলে এই তত্ত্ব খানিকটা পরিষ্কার হবে। বেশ্যা’ শব্দটির বর্ণ বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায়–ব + ঋ + এ + ঋ + শ + ঋ + য + ঋ + আ। শ্রীপঞ্চানন শাস্ত্রী সম্পাদিত ‘তন্ত্রাভিধান’ গ্রন্থের ‘বর্ণাভিধান’ অধ্যায়ে আমরা ‘বেশ্যা’ শব্দটির বর্ণগত বিশ্লেষণ করব। শাস্ত্রে ‘ব’ বর্ণটি বাল বা নব (নতুন) অর্থে বোঝায়। এ-কারে ‘এ’ অর্থে শক্তি। শ’ অর্থে হয় বৃষগ্ন। শাস্ত্রে বৃষ বা ষাঁড়কে ধর্মস্বরূপ জ্ঞান করা হয়। তাহলে ‘বৃষ’ অর্থ দাঁড়াল ধর্মহানি। য-ফলার ‘য’ অর্থে কালী এবং আ-কারের ‘আ’ অর্থে প্রতিষ্ঠা। তাহলে ‘বেশ্যা’ শব্দের অর্থ দাঁড়াল–বালশক্তি বা নবজাতক সাধনশক্তি সহায়ে ধর্মহানি (দূর করে) কালীতত্ত্বে প্রতিষ্ঠাতা সাধিকা, এটাই হল বেশ্যা।
‘বেশ্যা’ শব্দের আর-একরকম ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। অন্য ব্যাখ্যায় ‘ব’ অর্থ মাতা। ‘এ’ অর্থে ভগবতী। শ’ অর্থে বৃষ বা ধর্মবাধা। ‘য’ অর্থে সর্বেশ্বরী এবং ‘আ’ অর্থে প্রতিষ্ঠা। এখানে শব্দগুলি জুড়ে দাঁড়াল—মাতা ভগবতীর ইচ্ছায় ধর্মবাধা জয় করে সর্বেশ্বরীত্বে প্রতিষ্ঠাতা সাধিকা, অর্থাৎ এটাই বেশ্যা।
বৈষ্ণবাচার্য শ্রীমন্ মধ্ব বিরচিত একটি মাতৃকা-নির্ঘণ্ট আছে। এবার এই মাতৃকা-নির্ঘণ্ট অবলম্বনে ‘বেশ্যা’ শব্দের অর্থোদ্ধার করতে পারি। শ্ৰীমন্ মধ্বের মতে ‘ব’ অর্থে পুরুষোত্তম। ‘এ’ অর্থে দামোদর’ ‘শ’ অর্থে লক্ষ্মীশ।‘ য’ অর্থে বাগীশ’ ‘আ’ অর্থে বাসুদেব। অর্থাৎ, শ্ৰীমন্ মধ্বের মতে বেশ্যা শব্দের অর্থ দাঁড়াল–ভগবান মহিমময় পুরুষোত্তম রূপে, দর্পহারী দামোদর রূপে, ধনৈশ্বৰ্য্যদায়ী লক্ষ্মীশ রূপে, জ্ঞানৈশ্বৰ্য্যদায়ী বাগীশ রূপে এবং পরম প্রেমময় বাসুদেব রূপে যাঁর হৃদয়কন্দরে সতত বিরাজমান, তিনিই বেশ্যা। (শ্রীমৎ স্বামী পরমাত্মানন্দনাথ ভৈরব গিরি)।
সংস্কৃত শব্দের অর্থ না-জানার ফলে বিভ্রান্তিতে পড়ছে অনেকে। “অভিষিক্তা ভবেৎ বেশ্যা ন বেশ্যা কুলটা প্রিয়ে”–মহানির্বাণ তন্ত্র। “পূর্ণাভিষেকো দেবেশি দশ বিদ্যাবিধোস্মৃত”—দশ মহাবিদ্যার উপাসকগণই পূর্ণাভিষেকে অধিকারি অন্যে নহে।–কুলার্ণব তন্ত্র। দীক্ষা পুরশ্চরণঃ পূর্ণাভিষেক মন্ত্রচৈতন্য হওয়ার ফলে যিনি দেবত্বে উন্নিত হয়েছেন, এরকম অভিষিক্তাকে বেশ্যা বলা হয়েছে। আর উনারা যেখানে বাস করেন সেই দ্বারের মাটিকে বলা হয়েছে। বর্তমান সমাজের কুলটা’ বারবনিতা’ পতিতালয়ের মাটি বলা হয়নি। এই ঘৃণিত মহাপাপকে শাস্ত্র কখনও প্রশ্রয় দেয়নি, বরং প্রায়শ্চিত্ত করতে বলেছে। বৈদিক যুগে এই আদ্যা ব্রহ্মশক্তির কথা আবার কোনো উপনিষদেও উমা-হৈমবতীরূপে আমরা জেনেছি। সেখানে তিনি জ্যোতিঃস্বরূপ সচ্চিদানন্দ ব্রহ্মকে দেবতাদের বুঝিয়েছেন। করুণাময়ী জননী মূর্তিতে ইন্দ্রাদি দেবতাদের অহংকার নাশ করে তাঁদের ব্রহ্মজ্ঞান তত্ত্ব উপলব্ধিতে সাহায্য করেছেন। অহংকারই জীবের অজ্ঞানের কারণ। এই অহং নাশ হলে তবেই তত্ত্বোপলব্ধি হয়। আর আদি জননীর কৃপাতেই দেবসন্তানদের সেই অহং নাশ হয়ে ব্রহ্ম সম্পর্কে ধারণা জন্মায়। ঋকবেদের রাত্রিসূক্তের পরিশিষ্টের দ্বাদশ ঋকে একটি মন্ত্র আছে, সেটি হল–“তামগ্নিবর্ণা তপসাজ্বলন্তীং বৈরোচনী কর্মফলেষু জুষ্টা। দুর্গাং দেবিং শরণমহম্ প্রপদ্যে সুতরসি তরসে নমঃ।” দেবীর স্বরূপ বলা হচ্ছে যিনি অগ্নিবর্ণা ও স্বকীয় তপঃশক্তিতে উজ্জ্বল, চতুর্বর্গ ফলদাত্রী, পরিত্রাণকারিণী। সংসার সাগর পার হওয়ার জন্য সেই দুর্গাদেবীর আমি শরণ নিচ্ছি। তৈত্তিরীয় আরণ্যকে নবম অনুবাকে দুর্গা-গায়ত্রী আছে–“কাত্যায়নায় বিদ্মহে কন্যা কুমারিং ধীমহি তন্নোদুর্গি-প্রচোদ্দয়াৎ।” এই মন্ত্র দ্বারা স্বর্ণবর্ণা, শিরে চন্দ্রকলাশোভিতা বেদপ্ৰসিদ্ধা দেবী ভগবতীর কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে। যিনি কাত্যায়ন ঋষির আশ্রমে প্রকাশিতা সেই আদি কুমারী দুর্গা দেবীর কাছে জ্ঞান লাভের জন্য প্রার্থনা করা হচ্ছে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে শাস্ত্রের কোনো অংশে বেশ্যা মানে ‘পতিত’ নারীর কথা বোঝাচ্ছে না, যাঁরা যৌনপেশার মাধ্যমে অর্থ রোজগার করে এবং জীবনধারণ করে। তাহলে শাস্ত্র বহির্ভূত হয়ে কবে থেকে ‘বেশ্যা’ অর্থে পতিতালয়ের মাটি বা ‘বেশ্যাদ্বারের মাটি হয়ে উঠল? না, সাল-তারিখ-উদ্দেশ্য কিছুই জানা যায় না। তবে মনে হয় গণিকালয় যে একটি পবিত্র জায়গা, এটা সাব্যস্ত করতেই তৎকালীন সমাজপতিদের এহেন অপব্যাখ্যা। এর ফলে গণিকাগমন কোনো অপরাধ হয় না। পাপ কাজ বা কোনো ঘৃণ্য কাজ রূপে পরিগণিত হয় না। সেকালে এখনকার মত গণিকাবৃত্তি ও গণিকাগমন মোটেই ঘৃণ্য ছিল না। আর একটা কারণও হতে পারে। এমনটাও অনেকে মনে করে—একটা পুরুষ যখন গণিকার বাড়ি গিয়ে অবৈধ যৌনাচার করে তখন ওই পুরুষের জীবনের সমস্ত পুণ্য গণিকার বাড়ির মাটিতে পতিত হয় বা পুণ্য তাঁকে ত্যাগ করে, বিনিময়ে ওই পুরুষ গণিকার ঘর থেকে নিয়ে আসে সমস্ত পাপ। এরূপ বহু পুরুষের অর্জিত সমস্ত পুণ্য ত্যাগে গণিকাদের ঘরের মাটি পূণ্যময় হয় বলে মনে করা হয়, তাই গণিকার ঘরের মাটি প্রয়োজন হয়। এ থেকে শিক্ষা লাভ করা যায় যে, গণিকার ঘরে গিয়ে অবৈধ যৌনাচার করে নিজের জীবনের সমস্ত পুণ্য বিসর্জন দিও না। নারী কখনো অপবিত্র হয় না। নারীকে গণিকা বানায় পুরুষরাই। তাই ওই পুরুষরাও অপবিত্র। মায়ের প্রতিমা তৈরিতে গণিকালয়ের মাটি দিতে হয়। এর মাধ্যমে এটাই বোঝানো হয়েছে যে, তাঁরা পরিস্থিতির শিকার, তাঁদের সন্মান করতে হবে। নারী কখনও অপবিত্র হতে পারে না (নিজের ইচ্ছেতে যে নারী নিজেকে বিকিয়ে দেন তাঁরা ছাড়া), যেসব পুরুষ ওই নারীদের গণিকা হতে বাধ্য করেছে, সেই সব পুরুষরাই অপবিত্র। শরৎকালে হয় দেবীর অকালবোধন। এই সময় মহামায়া ৯টি রূপে (এই নবকন্যা হলেন (১) নর্তকী, অভিনেত্রী, (২) কাঁপালিক, (৩) ধোপানি, (৪) নাপিতানি, (৫) ব্রাহ্মণী, (৬) শূদ্রাণী, (৭) গোয়ালিনী, (৮) মালিনী ও (৯) গণিকা) পূজিত হন। এই নবম রূপটিই আসলে গণিকালয়ের প্রতিনিধি। মনে করা হয়, সে কারণেও এই রীতির জন্ম হয়েছে। দেবী দুর্গা যেহেতু সমগ্র নারীশক্তিরই প্রতীক, তাই গণিকাকেও এখানে সমগ্র নারীজাতিরই এক অঙ্গ হিসাবে দেখা হয়। তাই দুর্গাপুজোয় অষ্টকন্যার ঘরের মাটি নেওয়ার পর নবম কন্যা হিসাবে গণিকালয়ের মাটি মূর্তি তৈরির সময় ব্যবহার করা হয়। আর দুর্গাপুজোয় মূল উদ্দেশ্য যেহেতু সমস্ত নারীজাতিকেই সম্মান দেখানো, তাই গণিকাকেও এখানে সম্মান দেখানোর রীতি চলে আসছে।
এছাড়া প্রচলিত বিশ্বাস আছে যে, মানুষের কামনা, বাসনা, লালসা, লোভ, কদর্যতাকে গণিকারা নিজের মধ্যে ধারণ করে নিজেকে অশুদ্ধ, অপবিত্র করে সমাজকে পবিত্র, পরিশুদ্ধ রাখে, সমাজের নৈতিকতাকে তাঁরা একভাবে ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। তাই দেবী পুজোর মূর্তি তৈরিতে গণিকাপল্লির (সমাজের) মাটি গ্রহণ করা আদতে তাঁদেরই খানিক সম্মান দেখানো! তা ছাড়া হিন্দুপুরাণে বিশ্বাস করা হয়ে থাকে যে, গণিকাদের ক্ষমতা নাকি দেবতাদের থেকেও বেশি। কারণ ঋষি বিশ্বামিত্র যখন ইন্দ্রত্ব লাভের জন্য কঠোর তপস্যায় ব্রতী হয়েছিলেন, তখন তাঁর ধ্যানভঙ্গ করার জন্য দেবরাজ ইন্দ্র স্বর্গগণিকা মেনকাকে পাঠান। মেনকার নৃত্যের ফলে বিশ্বামিত্রের ধ্যান ভঙ্গ হয়। ফলে দেবরাজ ইন্দ্র সর্বশক্তিমান হয়েও যা পারলেন না, মেনকা সামান্য নারী হয়ে তা হেলায় করে ফেললেন।
২৩. যৌনকর্মীরা কি বাধ্য হয়েই যৌনপেশায়?
মেয়েরা পেটের জ্বালায়, চরম দারিদ্র্যতায় যৌনপেশায় আসে। সাধ করে আসে না, বাধ্য হয়েই আসে। যৌনকর্মীদের সিনেমা-সাহিত্য-প্রবন্ধে-নিবন্ধে সর্বত্র একই দুঃখভরা কাহিনি শোনা যায়। আসলে দুঃখ ও দারিদ্রতা ভালো দামে বিক্রি হয়। দরিদ্রতায় সহানুভূতি আদায় করে কাজকে জাস্টিফাই করা হয়। যে মেয়েটি ক্লায়েন্টের কাছ প্রতি রাতে পাঁচ লক্ষ টাকা আর করে তাঁরও পেটের দায়! যাঁরা বলেন পেটের দায়ে মেয়েরা যৌনপেশায় আসে, তাঁদের বলি, আমরা সকলেই কিন্তু পেটের দায়েই বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হই। সবসময়ই সেই পেশা ভলো লাগে, তা তো নয়। তবুও করতে হয়। তা ছাড়া দীর্ঘদিন একই কাজ করতে একঘেঁয়েমিও আসে। তবু করতে বাধ্য হয় মানুষ। দারিদ্র্যতা থাকলেও করতে হয়, সচ্ছলতা থাকলেও করতে হয়। হ্যাঁ, বাধ্য হয়েই করতে হয়।
যৌনপেশা বৈধ হোক বা অবৈধ হোক, সেটা দরিদ্রতা, অভাব, পেটের দায় অজুহাত দিয়ে জাস্টিফাই করতে হবে! যাঁরা পাচার হয়ে, প্রতারিত হয়ে, বিক্রি হয়ে এ পেশায় আসে, তাঁদের নিশ্চয়ই বাধ্য হয়েই এ পেশাটা চালিয়ে যেতে হয়। তবে এঁদের অনেকেই যৌবন থাকাকালীন অন্য পেশায় টেনে আনা যায় না। বর্তমান রাজ্য সরকার চেষ্টা করেছিল এঁদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার, চেষ্টা করেছিল নতুন পেশায় নিযুক্ত করতে। কিন্তু বিশেষ ফল পাওয়া যায়নি। তাঁরা নতুন পেশায় আগ্রহ বোধ করেনি। কারণ তাঁদের যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী নতুন পেশায় প্রচুর রোজগার পাইয়ে দেওয়া তো সম্ভব নয়। যৌনপেশায় অল্প পরিশ্রমে যে কাঁচা পয়সা রোজগার করা যায়, সেটা তো অন্য পেশায় করা যায় না। পুনর্বাসন চাই, পুনর্বাসন চাই’ বলে যাঁরা চিৎকার করে, তাঁদের বেশিরভাগ পড়ন্ত যৌবনা, বাজারদর প্রায় ফুরিয়ে আসা মহিলারা। উত্তুঙ্গু বাজার থেকে তুলে আনা খুবই কঠিন কাজ। তবে কেউ কেউ কোনো ক্লায়েন্টের প্রেমে পড়ে পল্লি ছেড়ে বেরিয়ে আসে বটে। সেগুলি অবশ্যই বিরল ঘটনা। কোটিতে গুটি। একবার যে অর্থের স্বাদ একবার পেয়েছে তাঁর হাত থেকে অর্থ কেড়ে নিয়ে অন্যের অধীন করানো অত সহজ কাজ নয়। আজকাল বহু মেয়ে-বউরাও স্বেচ্ছায় এ পেশা বেছে নিচ্ছে অতিরিক্ত রোজগারের জন্য। সেই রোজগার করে গাড়ি-বাড়ি করে ফেলছে। ব্যাংক ব্যালান্স করছে। এ লাইনে নতুন এসেছি’ বলে এঁরা সবসময়ই বাজারদর উঁচুতে রাখতে সক্ষম হয়।
যৌনকর্ম করতে গিয়ে কোনো হোটেল থেকে কোনো যৌনকর্মী যদি পুলিশের খপ্পরে পড়ে যায়, তখন সকলেই একটা বুলি–“অভাবের তাড়নায় এ পেশা বেছে নিতে বাধ্য হয়েছি।” সহানুভূতি উপচে পড়ে মানুষের। অমনি সেলিব্রেটিরা সেই মেয়েটির পক্ষে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করে দেয়–“যে পুরুষরা ওদের কাছে আসে তাঁদের কেন ‘বেশ্যা’ বলা হবে না?” দোকান খুলবেন আপনি, দোকান খুলে পণ্য বেচবেন আপনি, খরিদ্দার গেলেই দোষী? আপনি দোকান খুললে আপনি বেচছেন এটাই তো আহ্বান। আপনি কমার্শিয়াল পারপাসের গাড়ি বের করলে যাত্রী সেই গাড়িতে উঠবেই এবং সেই যাত্রীকে গন্তব্য স্থলে পৌঁছে দিতে আপনি বাধ্য, যদি যাত্রী ন্যায্য ভাড়া দেয়। কোনো খরিদ্দার জোর করে আপনাকে ভোগ করছে না, করে না। আপনি ড্রিল করেছেন, তবেই আপনার কাছে কোনো পুরুষ গিয়েছে। আপনি আহ্বান করেছেন।
আর অভাবের তাড়নায় কথা যদি বলেন, তাহলে বলব, ভারতের ৮০ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, যাঁদের ২ টাকা কেজি করে চাল খাওয়ায় ভারত সরকার। যদি অভাবের তাড়নায় যৌনপেশায় আসার অন্যতম কারণ হয়, গোটা ভারতে যৌনকর্মীর সংখ্যা আকাশছোঁয়া হত। গোটা দেশই গণিকালয়ে পরিণত হয়ে যেত। তাহলে চাহিদার চেয়ে জোগান বৃদ্ধি হয়ে যৌনকর্মীদের রেটও তলানিতে এসে ঠেকত। তা হয়নি। যা হয়, তা হল কত মানুষ অভাবের তাড়নায় আত্মহত্যা পর্যন্ত করে, কিন্তু যৌনপেশায় কখনোই আসে না। কত মহিলা স্বামীকে সাহায্য করতে কায়িক পরিশ্রম করছে, ভারী ভারী মাল টানছে, ইটভাটায় কাজ করছে, রাজমিস্ত্রীর সহযোগী হচ্ছে, নানারকম কঠোর পরিশ্রম করে–তা সত্ত্বেও তাঁরা যৌনপেশায় আসে না। বরং পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি বহু অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে-বউরাও এ পেশায় আসছেন অতিরিক্ত রোজগারের জন্য। মডেল, চলচ্চিত্র, সিরিয়ালের সেলিব্রেটিরাও আসছে। উঁচুতলার যৌনকর্মীরা উঁচুতলার মানুষদের মনোরঞ্জন করে। সচিব, মন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতা, আমলা প্রমুখদের তো আর যৌনপল্লিতে গিয়ে যৌন-বিনোদন সম্ভব নয়। তাই ধোপদূরস্ত নামী-দামি যৌনকর্মীরাই পৌঁছে যায় তাঁদের ঘরে।
নারী দুর্বল, নারী অবলা–এই তকমাগুলো পুরুষতান্ত্রিক সমাজেরই তৈরি করা। নারীকে দুর্বল থেকে আরও দুর্বলতর করে রাখার জন্যেই এই তকমা। সেই পুরুষতান্ত্রিক তকমাগুলো বেশিরভাগ নারী তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগও পছন্দ করে। এতে অনেক সুবিধা আছে। অনেক দায়িত্ব থেকে গা বাঁচিয়ে ফেলা যায়। কিছু দিন আগে গোটা দেশে লক ডাউন হল। আমাদের রাজ্যেও হল। এমতাবস্থায় এক মহিলা রাস্তায় ওলায় চেপে বেরোলে কলকাতা পুলিশ বাধা দেয়। মহিলাটি গাড়ি থেমে নেমে ছুটি এসে এক পুলিস অফিসারের পেটে কামড় বসিয়ে দেয় এবং সাদা জামায় লাল লিপস্টিক লাগিয়ে দেয়। মহিলাটি কেন এটা করতে সাহস পেল? কারণ মহিলাটি জানে উলটোদিক থেকে কোনো প্রতিরোধ আসবে না। কারণ সেখানে কোনো মহিলা পুলিস ছিল না। এটা কিন্তু কোনো পুরুষ করতে সাহস পেত না। কারণ পুরুষটি জানে এটা করলে তাঁর হাড়গোড় ভেঙে পুলিশ হাসপাতালে পাঠিয়ে দিত সেই মুহূর্তেই। আর-একটি ঘটনা বলি। মধ্যরাতে এক দম্পতি নিজের গাড়ি থেকে নেমে বহুক্ষণ ধরে কলকাতার রাজপথে বেলাল্লাপনা করছিল। পুরুষসঙ্গীটি গাড়িতেই ছিল, মহিলাটি রাস্তায় নেমে বাওয়াল করছিল। রাত-পাহারায় পুলিশ রাস্তাতেই ছিল। এক বয়স্ক পুলিশ মহিলাটিকে বাড়ি চলে যেতে বললে মহিলাটি ওই পুলিশকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেতে থাকে। পুলিশ অসহায়। এই দৃশ্যের ভিডিও সোস্যাল মিডিয়া ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। এই কাজটা যদি কোনো পুরুষ কোনো মহিলা পুলিশকে করতে পারত? তখন পুরুষ পুলিশরা এসে তাঁকে মেরে হাড়গোড় ভেঙে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিত সেই মুহূর্তেই। কারণ ওই বেহেড মাতাল মহিলাটি জানে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো প্রত্যাঘাত আসবে না। এরকম ঘটনা বলে শেষ করা যাবে না। নিজেরা দুর্বল এটা ভাবিয়ে যেতে পছন্দ করে অনেকে। আস্তে লেডিজ’ বলে যখন বাস-কন্ডাক্টার যখন বাস দাঁড় করার তখন কোনো নারীবাদী মহিলাকেও প্রতিবাদ করতে দেখিনি। অতএব যেমন চলছে, চলুক। অসুবিধা তো নেই, বরং সুবিধাই বেশি। কোনো মহিলা পকেটমার ট্রেনের জেনারেল কম্পার্টমেন্ট থেকে ধরা পড়ে সামান্য তিরস্কার করে পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারে যাত্রীরা। কিন্তু মেরে চামড়া গুটিয়ে দেবে না। আর মেয়েটা যদি কোনোক্রমে বলে ফেলতে পারে ঘরে তাঁর অসুস্থ স্বামী তিনটে ছোটো বাচ্চার সংসারে বাধ্য হয়ে এই পথ বাধ্য হয়েছি। তাহলে তো আর দেখতে হবে না। চোখের জলে ভাসতে থাকবে উপস্থিত মানুষরা। সেই পথেই যৌনবৃত্তি করতে গিয়ে ধরা পড়লে সে তাঁর অসহায়ত্বের কথা শোনায়। সেইসঙ্গে পুরুষদেরও কাঠগোড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়। আত্মরক্ষার অতি সহজ পথ।
সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি সেই মধ্যযুগেই পড়ে আছে। পৃথিবীর সব বদলে যাচ্ছে, কিছু নারী ‘অবলা’ থেকে ‘সবলা’ হয়ে উঠতে চাইছে না। নারী তখনই সবলা হয় যখন নারী কারোর প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে। বছর কয়েক আগে এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে নিয়ে সোস্যাল মিডিয়ায় যাচ্ছেতাই কাণ্ড করেছিল। সেই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে এক মহিলার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। টাকাপয়সার গণ্ডগোলে সেই মেয়েটি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের কিছু সেক্সচুয়াল অ্যাক্টিভিটির ভিডিও সোস্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দেয়। উদ্দেশ্য, সেই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের রাজনৈতিক কেরিয়ার ধ্বংস করে দেওয়া। নারী যেহেতু অবলা, তাই সোস্যাল মিডিয়ায় সেই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধেই ঢি ঢি পড়ে যায়। দল তাঁকে বহিষ্কার করে। নারী অবলা, তাই নারী স্বামী ও স্বামীর আত্মীয়স্বজনদের বিরুদ্ধে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মামলা এনে জেলের ঘানি টানাতে পারে। অথচ কত কত যে পুরুষ ‘অবলা’ দ্বারা শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত, সেই খবর কেউ রাখে না। কারণ পুরুষ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্তই ‘সবল’। নারী যত ভয়ংকর অপরাধই করুক না-কেন, আপনি তাঁকে একটা চড় কষিয়ে দিতে পারবেন না। তা করলেই আপনি অপরাধী। আপনার বিরুদ্ধে সবাই দাঁড়িয়ে পড়বে। কিন্তু কোনো অপরাধ না-করলেও কোনো মহিলা এসে আপনার গালে সপাটে চড় মারতে পারে, তখনও মহিলাটির বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বলবে না। কারণ ততক্ষণে মহিলাটি বলে ফেলতে পেরেছে আপনি মহিলাটির সঙ্গে ‘অসভ্যতামি’ করেছেন।
মহিলাদের নিয়ে এত কথা বললাম কেন? এই ‘অবলা’, ‘অসহায়’ শব্দগুলি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে চাপিয়ে দিয়েছে, যা ‘অপরাধপ্রবণ’ মহিলারা অস্ত্র হিসাবে কাজে লাগায়। আজ যদি কোনো রাষ্ট্র যৌনপেশাকে বৈধতা দিয়ে দেয়, তখন কিন্তু কেউ বলবে না ‘পেটের দায়ে’ ‘অভাবের তাড়নায়’ এ পেশায় এসেছি। তখন পুরুষদেরও কাঠগোড়ায় তোলার কথা ভাববে না। যতদিন এই পেশায় রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সমর্থন থাকবে না, ততদিন ৩৫ বর্ষীয়া যৌনকর্মীও ‘অবলা’ ও নাবালিকার মতো বলবে ‘চাপে পড়ে এ পেশায় এসেছি।
যৌনপেশায় তাঁরা যদি সত্যিই ‘চাপে পড়ে’ আসত, তাহলে যৌনকর্মী হিসাবে প্রকৃত না-খেতে পাওয়া দরিদ্র আদিবাসীদের মধ্যেই দেখা যেত। কারণ এঁরা দারিদ্র্যসীমার অত্যন্ত নীচে অতি কষ্টে জীবনধারণ করে বেঁচে থাকে। প্রকৃত আদিবাসীদের মধ্যে যৌনকর্মী নেই বললেই চলে। এটা আমি নই, এটা নৃতত্ত্ব ও মনোবিজ্ঞানীদের বক্তব্য। পাচারকৃত বা বিক্রি হওয়া নারীরা সত্যিই খুব অসহায়। কিন্তু তাঁরা কখনো যৌনকর্ম করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে না। কারণ তাঁরা নির্দিষ্ট এলাকায় (গণিকাপল্লি) বসবাস করে যৌনকর্ম চালায়। পুলিশও সেখানে ঢোকে না। তাঁদের বলতেও হয় না অভাবের তাড়নায়’ এ পেশায় এসেছি। বলার সেই সুযোগও নেই। কারা বলার সুযোগ পায়? তাঁরাই এসব সুযোগ পায়, যাঁরা হোটেল, রিসোর্ট, ফ্ল্যাট বা কারোর বাড়িতে যৌনকর্ম করতে গিয়ে ধরা খায়। এঁরা বেশিরভাগই সচ্ছল পরিবারের মহিলা। এমনকি তাঁরা সমাজের উঁচুতলারও হতে পারে। হতে পারে তাঁরা সমাজের প্রতিষ্ঠিত পুরুষদের স্ত্রী বা কন্যা। এইসব গণিকাদের সঙ্গে কথা বলে যেটা জানতে পেরেছি, সেটা হল বেশিরভাগ যৌনকর্মীরাই শহুরে বা শহরতলির। গ্রাম থেকে আসা মেয়েদের সংখ্যা অতি নগণ্য। গোরাচাঁদ কুণ্ডুর লেখা একটা আর্টিকেলের অংশ প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি, অংশটা এখানে উল্লেখ করি–“গণিকা পেশা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং কামজ পরিস্থিতির চরম পরিণতি নয়। নারী প্রকৃতির দুর্বোধ্য কিছু কারণেই অনেক নারী পরোক্ষ পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করে। মাতা’ এবং তার বিপরীত ‘পতিতা’–দুটিরই প্রত্যাশিত ফল পাওয়ার সম্ভাবনা সমস্ত নারীর মধ্যেই থাকে। মাতা এবং তদস্থানীয় নারীর মার্জিত শিক্ষা, দীক্ষা, নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি যদি শৈশবকাল থেকেই শিশুকন্যার মধ্যে মাতা প্রতিরূপকে (মাদার ইমেজকে) শক্তিশালী করতে সাহায্য করে, তাহলে শত দুর্বিপাকেও নারী পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করে না। জোরজুলুম করেও তাঁকে পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করানো যায় না। পতিতাদের আত্মহত্যার ঘটনার কারণও অধিকাংশ ক্ষেত্রে জুলুমের কাছে নতি স্বীকার না করার দৃঢ় মানসিকতা। সমাজের দায় অবশ্য এঁদেরই রক্ষা করা। এবং বাঁচার অধিকারে প্রতিষ্ঠা করা। পক্ষান্তরে, পতিতা-প্রবণ মানসিকতার নারীদের মধ্যে থাকে সুপ্ত সেক্স পলিটিক্সের প্রবণতা, এই প্রবণতাই উগ্র হয়ে কখনো-বা পরিণত হয় বৃত্তিতে।” বেশ কয়েক বছর আগে এক ভদ্রলোকের একটা লেখা পড়েছিলাম, তাতে লেখা ছিল–“সেই দিন আসন্ন, যেদিন পুরুষগণ সেক্সের জন্য মেয়েদের পিছন পিছন ভাদ্র মাসের কুকুরের মতো ছুটবে।” আসলে এটাই সেক্স পলিটিক্স। আপনার সামনে মেয়েরা সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে বডি পেইন্ট করাবে। বহু দেশে শুরু হয়ে গেছে। ভারতেও এখন হামাগুড়ি প্র্যাকটিস চলছে, যাকে বলে নেট প্র্যাকটিস শুরু হয়ে গেছে।
২৪. গণিকাবৃত্তির অধিকারের লড়াই, নিশ্চয়তা, নিরাপত্তায় স্বেচ্ছাসেবী
বিশ্বজুড়ে যৌনকর্মীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন চলছে। গোটা ভারতে চলছে। কলকাতাও বাদ নেই। দুর্বার মহিলা সমন্বয় সমিতি পশ্চিমবঙ্গের ৬৫ হাজার যৌনকর্মীর সমষ্টিগত দল। ১৯৯২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কলকাতার সবচেয়ে বড়ো নিষিদ্ধপল্লি সোনাগাছিতে প্রতিষ্ঠিত দুর্বার, ভারতের লক্ষ লক্ষ যৌনকর্মীর সঙ্গে নারী অধিকার, যৌনকর্মীদের অধিকার সমর্থন, মানব পাচার বিরোধী এবং এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করছে। ফোর্ড ফাউন্ডেশন এবং ন্যাশনাল এডস কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন (এনএসিও), ইত্যাদি সংস্থাগুলির সাহায্যে পশ্চিমবঙ্গে যৌনকর্মীদের জন্য ৫১টি বিনামূল্যের ক্লিনিক চালানো হয়, যারা নেটওয়ার্কিং, অধিকার সুরক্ষা এবং যৌনকর্মীদের জন্য বিকল্প জীবিকা তৈরির মতো উদ্যোগেও সহায়তা করে। গণিকাবৃত্তিকে বৈধ পেশা এবং যৌনকর্মীদের কর্মী হিসাবে স্বীকৃতির লড়াইয়ের জন্য এবং যৌনকর্মীদের তথা তাঁদের সন্তানদের জন্য নিরাপদ সামাজিক অস্তিত্বের জন্য দলটির লক্ষ্যমাত্রায় স্পষ্টত রাজনৈতিক। তাঁরা গণিকাবৃত্তি বৈধকরণের জন্য কাজ করে এবং আইন সংস্কারের চেষ্টা করে, যা যৌন মানবাধিকারকে সীমাবদ্ধ করে।
১৯৯২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কলকাতার অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স এন্ড পাবলিক হেস্থের একজন জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানী ডঃ স্মরজিৎ জানা এইচআইভি সম্পর্কিত গবেষণার জন্য সোনাগাছির নিষিদ্ধপল্লি এলাকা পরিদর্শন করেন। একটি সমগোত্রীয় শিক্ষা দল যৌনকর্মীদের মধ্যে থেকে গঠিত হয় এবং তাঁদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। অল্প কিছুদিন পরে গবেষণায় যৌনকর্মীদের মধ্যে যৌন বিষয়ক অধিকার, তাঁদের সন্তানদের শিক্ষা, আর্থিক পরিসেবাগুলির সুবিধা এবং পুলিশ এবং স্থানীয় গুণ্ডাদের দ্বারা হয়রানির শিকার হওয়ার সমস্যাগুলি উঠে আসে, সঙ্গে নিরাপদ যৌনসঙ্গমের স্বার্থে কন্ডোম ব্যবহারের প্রসার ঘটানো হয়। এভাবে ১৯৯৫ সালে তিনি ১২ জন যৌনকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে দুর্বার মহিলা সমিতি কমিটি’ (ডিএমএসসি) গঠন করেন। ২০১২ সালের মধ্যে ডিএমএসসি পশ্চিমবঙ্গের ৪৮টি শাখার মধ্য থেকে ৬৫ হাজার সদস্যের সদস্যপদ লাভ করে এবং যেগুলি যৌনকর্মীদের দ্বারা পরিচালিত হয়, তাঁদের সন্তান এবং সরকারি কর্মকর্তারা তাঁদের বোর্ড সদস্য হিসাবে থাকেন। কেবল নারীই যৌনকর্মীই নয়, বরং পুরুষ এবং ট্রান্সজেন্ডার যৌনকর্মীরাও এতে সদস্য হন। গণিকাপেশায় আসতে ইচ্ছুক এমন কোনো মেয়েই এই বোর্ডকে এড়িয়ে তাঁর পেশা শুরু করতে পারবে না। এই বোর্ডেই যাচাই করা হয় বয়স (নাবালিকা কি না। সেক্ষেত্রে ১৮ উপরে বয়স হতে হব। বয়সের প্রমাণপত্র না-থাকলে ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে বয়স জেনে নেওয়া হয়), এই পেশায় আসতে কেউ বাধ্য করেছে কি না জানতে চাওয়া হয়, পাচারকৃত কি না জানা হয় ইত্যাদি।
দুর্বার এসটিডি/এইচআইভির ইন্টারভেন্সন প্রোগ্রাম (সাধারণত সোনাগাছি প্রকল্প নামে পরিচিত) ১৯৯৯ সাল থেকে চালু হয়। সোনাগাছি প্রকল্পের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা All India Institute of Hygiene and Public Health’, যেটি কলকাতার অবস্থিত একটি কেন্দ্রীয় সরকারি ‘Public Health Training and Research Institute’, যাঁরা ১৯৯২ সালে এই প্রোগ্রামটি শুরু করে তাঁদের থেকে ডিএমএসসি কর্তৃক গৃহীত হয়। ১৯৯৯ সালে এসটিডি/এইচআইভি ইন্টারভেনশন প্রোগ্রাম নিয়ন্ত্রণ লাভের পর ডিএমএসসি পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য নিষিদ্ধ এলাকায় সোনাগাছি মডেলের অনুসরণ করা শুরু করেন।
‘শ্রমিকের অধিকার চাই’—আন্তর্জাতিক শ্রমদিবসে সোনাগাছিতে এই শ্লোগান তুলে পদযাত্রা করেন কয়েক হাজার যৌনকর্মী। ওই মিছিলে তাঁদের সন্তান ও অন্যান্য সংঠনের সদস্যরাও হাজির থাকেন। প্রতি বছর ১ মে সোনাগাছিতে নিজেদের কাজও বন্ধ রাখেন যৌনকর্মীরা। এই দাবি নিয়েই গত কয়েকবছর ধরে লাগাতার আন্দোলন করে চলেছেন সোনাগাছি সহ রাজ্যের অসংখ্য যৌনপল্লির কর্মীরা। শরিতা দশ বছর ধরে থাকেন মহানগরের এই যৌনপল্লিতে। সোনাগাছির বহু ঘটনার সাক্ষী শরিতা। তিনি অভিযোগ করেন—“এখনও সমাজে নানা ধরনের অত্যাচার আমাদের সহ্য করতে হয়। কখনও চাঁদার জুলুম তো কখনও মাস্তানের চোখরাঙানি। তা ছাড়া পুলিশের বিভিন্ন ধরনের অত্যাচারও আছে। এসব জ্বালাতন সঙ্গে করেই আমাদের চলতে হয়। কিছু ঘটনা অন্তরালেই থেকে যায়। অনেকে পাশে থাকার কথা বললেও লড়াইটা অনেক ক্ষেত্রে আমাদের নিজেদেরকেই করতে হয়। এত কিছু সত্ত্বেও এখনও আমরা শ্রমের স্বীকৃতি পেলাম না। আমাদের দাবি সরকারি শ্রমদপ্তরে ‘যৌনকর্মী হিসাবে আমাদের নথিভুক্ত করতে হবে। এটা আমাদের অন্যতম মূল দাবি। জানি না কবে মিলবে আমাদের অধিকার”।
আন্দোলনের কিছু ফল যে মেলেনি তা নয়। সোনাগাছি সহ রাজ্যের বিভিন্ন যৌনপল্লির যৌনকর্মীরা সরকারি নানা সুবিধা পাচ্ছেন। আধার কার্ড, রেশন কার্ড, ‘স্বাস্থ্য সাথী’, ‘কন্যাশ্রী’, ‘রূপশ্রী’, ‘সমব্যথী’ ‘সবুজ সাথী’, ‘খাদ্য সাথী’, ‘শিক্ষাশ্রী” সহ অনেক প্রকল্পেরও অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন অনেকেই। কিন্তু এখনও শ্রমিকের অধিকার পাননি তাঁরা। এটাই এখন কুরে কুরে খায় যৌনকর্মীদের। এটাই এখন মূল লড়াই তাবৎ যৌনকর্মীদের। তা ছাড়া ইমমরাল ট্রাফিকিং’ আইনের ফাঁদে পড়েও তাঁদের হয়রানির শিকার হতে হয়। যৌনপল্লিগুলির মহল্লায় মহল্লায় যৌনকর্মীদের এই অভিযোগ। তাঁদের বক্তব্য—“এটা আমাদের পেশা। তবু কেন পুলিশ হয়রান করবে? আর কবে এসব বন্ধ হবে?” ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস উদ্যাপন হয়। যৌনকর্মীরা কিন্তু এখনও তাঁরা সরকারিভাবে কর্মী হিসাবে নথিভুক্ত নন। বছরের পর বছর শ্রমিকের মর্যাদা চাই’ বলে দাবি করে আসছেন। মর্যাদা পাননি বলে কিন্তু যৌনকর্মীরা ঘরে বসে নেই। লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে শুধু দাবি বা পদযাত্রা নয়, শ্রম দিবসে তাঁরা কাজও বন্ধ রাখেন। সারা বিশ্বে অন্যান্য কর্মক্ষেত্রে যখন স্বাভাবিক ছুটি যাপন করেন কর্মীরা, তখন যৌনকর্মীরা শ্রমিকের মর্যাদার দাবিতে কাজ বন্ধ রাখেন। এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষে কাজল বসু বলেন, “আমরা ২৫ বছর ধরে সরকারি শ্রমদপ্তরের তালিকায় যৌনকর্মীদের কর্মী হিসাবে নথিভুক্ত করার দাবি জানিয়ে আসছি। তা ছাড়া ইমমরাল ট্রাফিকিং অ্যাক্টের বিভিন্ন ধারা বাতিল করতে হবে।”
ভারতে আনুমানিক ২৫ থেকে ৩০ লক্ষ ঘোষিত যৌনকর্মীদের মোটামুটি এই কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়—(১) লালবাতি এলাকার ভিতরে বা বাইরে যৌনপল্লিতে বসবাসকারী যৌনকর্মী, (২) পথচারী বা ভাসমান যৌনকর্মী, (৩) ছোটোবেলায় পারিবারিক দারিদ্রের জন্য দেবদাসী হিসাবে উৎসর্গীকৃত মেয়েরা, যাঁদের বেশিরভাগকেই পরে যৌনকর্মী হতে বাধ্য হয়, (৪) যাযাবর শ্রেণির মেয়েরা, যাঁদের ছোটোবেলা থেকেই যৌনকর্মী হওয়ার তালিম দেওয়া হয় এবং পরে পারিবারিক অভাব মেটানোর জন্য যৌনকর্মে নিযুক্ত করা হয়, (৫) যেসব মেয়েদের পূর্বপুরুষরা প্রথাগতভাবে পারিবারিক ভরণপোষণের জন্য মেয়েদের নাচগান পরিবেশনের উপর নির্ভর করতেন, তাঁদের অনেকে আজকাল বাইজি, নাচনি ইত্যাদি নামে যৌনকর্মে নিযুক্ত থাকেন, (৬) কলগার্ল বা শৌখিন যৌনকর্মী, যাঁদের অনেকেই মধ্যবিত্ত শ্রেণিভুক্ত। যাঁরা নিজেদের জীবনযাত্রার মান বাড়ানোর জন্য আংশিক বা পুরোভাবে যৌনকার্যে নিযুক্ত থাকেন, (৭) পুরুষ এবং হিজড়ে যৌনকর্মী, যাঁরা টাকার বিনিময়ে প্রধানত মহিলা, সমকামী বা উভয়কামী পুরুষদের যৌনক্ষুধা মেটান এবং (৮) শিশু যৌনকর্মী, যাঁরা কলগার্ল ছাড়া উপরের সব শ্রেণিরই অন্তর্ভুক্ত এবং যাঁদের বেশির ভাগই ট্র্যাফিকিংয়ের মর্মান্তিক শিকার। বস্তুত বেশিরভাগ যৌনকর্মীকেই ছলে-বলে-কৌশলে যৌনকার্যে নিযুক্ত করা হয়েছে। কেউ কেউ নানা দৈব-দুর্বিপাকে এমন এমন পেশায় মুখে পড়েছেন যে, নিছক বেঁচে থাকার তাগিদে যৌনপেশায় যোগ দিতে বাধ্য হয়েছেন। যৌনকর্মীদের প্রতি সামাজিক বিরূপতা বা ঘৃণা এত গভীর ও ব্যাপক যে, যাঁর উপর একবার যৌনকর্মীর ছাপ পড়ে যায় তাঁর পক্ষে সমাজের মূলস্রোতে ফিরে আসার কোনো উপায় থাকে না। ন্যূনতম মানবিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হয়ে চরম দারিদ্র্যে, জঘন্য পরিবেশে নানাভাবে নিপীড়িত হয়ে তাঁদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হয়।
উপরি প্রাপ্তি হিসাবে ভারতের বেশির ভাগ যৌনকর্মী কোনো না-কোনো যৌনরোগে প্রায়ই ভুগতেন। আজকাল তাঁদের অনেককেই অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খেতে হয়। কিন্তু যৌন-সংসর্গের মাধ্যমে এইচআইভি নামক ভাইরাস শরীরে সংক্রামিত হলে যে মারণরাগ এইডসের উৎপত্তি হয়, তার কোনো প্রতিষেধক টিকা ওষুধ এখনও বেরোয়নি। যৌনকর্মীরাই এইডসের সবচেয়ে বড়ো শিকার। সেই অসুখ ছড়িয়ে পড়ে খদ্দেরদের মধ্যে। কারণ নিছক জীবিকার জন্য তাঁদের অনেক খদ্দেরকে যৌনতৃপ্তি দিতে হয় এবং বেশিরভাগ খদ্দের কণ্ডোম ব্যবহার করতে চান না। কিন্তু সময় বদলেছে। এখন আর কেউ কন্ডোম ছাড়া যৌনকর্ম করতে পারবে না। ফলে যৌনরোগের প্রাদূর্ভাব অনেকটই কমেছে।
এইডস নিবারণ প্রকল্পের সহায়তায় যেসব যৌনকর্মীরা কন্ডোম ব্যবহারের অপরিহার্যতা সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন হয়েছেন। তবে দরিদ্র যৌনকর্মীদের মধ্যে দারিদ্রতার কারণে কন্ডোম ব্যবহার করতে অনিচ্ছুক খদ্দেরকে প্রত্যাখ্যান করতে পারেন না। সেজন্য ভারতের কিছু শহরের লালবাতি এলাকায় যৌনকর্মীদের মধ্যে এইচ আই-ভি/এডসের প্রসার ভয়ংকরভাবে বেড়ে গেছে এবং তার ফলে তাঁদের খদ্দেরদের মধ্যেও বাড়ছে। এইচআইভি আক্রান্ত খদ্দেরদের মাধ্যমে তাঁদের স্ত্রীদের শরীরেও এই ভাইরাস সংক্রামিত হচ্ছে। আবার স্ত্রীদের মাধ্যমে তাঁদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সন্তান এই ভাইরাসের শিকার হচ্ছে।
১৯৯০ দশকের প্রথম থেকে ভারতের কিছু শহরের লালবাতি এলাকায় যৌনকর্মীদের মধ্যে এইচআইভি/এইডস নিবারক প্রকল্প কার্যকারী হয়। কলকাতার সোনাগাছি এলাকায় যৌনকর্মীদের মধ্যে শুরু হয় ১৯৯২ সাল থেকে। এই প্রকল্পের একটি অঙ্গ হিসাবে ওই এলাকার কিছু বাছাই করা যৌনকর্মীকে এইচআইভি/এইডস পরীক্ষা, কন্ডোম ব্যবহার ইত্যাদি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিয়ে পিয়ার এডুকেটর হিসাবে নিযুক্ত করা হয়। রোজ কিছু সময় অন্যান্য যৌনকর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাঁদের এইচআইভি/এইডস সম্বন্ধে সচেতন করা ও কন্ডোম ব্যবহারের পদ্ধতি ইত্যাদি শিখিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে একটি মাসোহারা বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই পিয়ার এডুকেটররা বুঝতে পারলেন যে, যৌনকর্মীরা তাঁদের খদ্দেরদের সঙ্গে যৌন সংসর্গের সময়ে কন্ডোম ব্যবহার করতে যথেষ্ট আগ্রহী হলেও, খদ্দেররা সাধারণভাবে তা করতে একেবারেই অনিচ্ছুক। এটাও বুঝতে পারলেন যে, কোনো যৌনকর্মী তাঁর কন্ডোম ব্যবহার করতে অনিচ্ছুক খদ্দেরকে প্রত্যাখ্যান করলে, সেই খদ্দেরের পক্ষে একটু বেশি টাকা খরচ করলে কন্ডোম ব্যবহার না-করেই যৌনকর্মে রাজি এরকম যৌনকর্মীকে আশেপাশেই পাওয়া শক্ত হয় না। ফলে কন্ডোমের ব্যবহারের অনুপাত প্রায় কিছুই বাড়ছিল না। যদিও এই মুহূর্তে যে-কোনো যৌনপল্লিতেই কন্ডোম ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক। কন্ডোম ছাড়া কোনো যৌনকর্মীই যৌনকর্ম করেন না। ফলে এইডসের প্রাদুর্ভাব এখন অনেকটাই নির্মূল হয়েছে। যৌনপল্লির মেয়েরা এটা বুঝেছে, কন্ডোম শুধু যৌনরোগ থেকেই মুক্তি দেয় না, মুক্তি দেয় অবাঞ্ছিত গর্ভধারণ থেকে, মুক্তি দেয় ঘনঘন অ্যাবরশন থেকে, মুক্তি দেয় নিয়মিত গর্ভনিরোধক পিল খাওয়া থেকে। এমনকি তাঁদের যৌনাঙ্গের ভিতর-বাইরে পুরুষের বীর্যে মাখামাখি ও ধৌতকরণ থেকেও মুক্তি মিলল।
ডা. স্মরজিৎ জানা, যিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটিকে। কিছু সাফল্য অবশ্যই এসেছে। যেমন সোনাগাছির যৌনকর্মীদের যে সমবায় তহবিল, সেই ‘উষা কোঅপারেটিভ ক্রেডিট লিমিটেড’-এ নিবন্ধিকরণ করা গেছে যৌনকর্মীদের নামেই। এটা একটা বিরাট বড়ো সাফল্য, যেহেতু যৌনপেশা এখনও পূর্ণ বৈধ বৃত্তি বলে স্বীকৃত নয় ভারতের আইনে। কিন্তু ওই মূল জায়গাটায় সমস্যা থেকে গেছে। বহু উদ্যোগ সত্ত্বেও যৌনবৃত্তিকে বৈধ পেশায় স্বীকৃতি দেওয়া যায়নি। এ নিয়ে আইন সংশোধনের কিছু সুপারিশও করা হয়েছে। যেমন যৌনকর্মীর সন্তানদের জন্য বারুইপুরে একটি হোস্টেল চালু হয়েছে, যেখানে থেকে সাধারণ স্কুলে, আর পাঁচটা সাধারণ বাচ্চার সঙ্গে পড়াশোনা করতে পারবে তারা। আলাদা পরিবেশে থেকে। কিন্তু সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি তো এখনও বদলায়নি। ফলে কোনো শিক্ষকই হয়তো ঘুরিয়ে এমন কোনো একটা খোঁচা দিয়ে দিলেন যে, বাচ্চাটির খারাপ লাগল। যে কারণে স্কুল থেকে ‘ড্রপ আউট’-এর সংখ্যাও খুব বেশি।
পিতৃপরিচয় ছাড়া শিশুদের স্কুলে নেওয়া হত না। যৌনকর্মীদের সন্তানদের কোনো পিতৃপরিচয় নেই। একমাত্র মা তাঁদের অভিভাবক। তাহলে কি যৌনকর্মীর সন্তানদের পড়াশোনার অধিকার থাকবে না? পড়াশোনা করে নিজের পছন্দের পেশায় নিযুক্ত হওয়ার অধিকার থাকবে না? সকলের জন্য শিক্ষা’—এই শ্লোগানের মাহাত্ম্য কী? যৌনকর্মীদের সন্তানদের অপরাধ কি কেবল তাঁর মা যৌনকর্মী বলে? পল্লিগুলি বাস করা একজন যৌনকর্মীর তো স্বামী থাকে না। তা ছাড়া সেই সন্তানের প্রকৃত পিতা কে তাও জানা সম্ভব নয়। আর জানা গেলেও সেই পুরুষ পিতৃত্ব স্বীকার করতে বাধ্যও নয়। অবশ্য যাঁরা নিজের বাড়ি থেকে বিশেষত বিবাহিতরা (নিজ সংসার সামলে) যৌনপল্লিতে বা অন্যত্র যৌনকর্ম করেন, তাঁদের পিতৃপরিচয়ের সমস্যা হয় না। কারণ তাঁদের কারোর স্বামী আছে, অথবা বিধবা, অথবা ডিভোের্স। সমস্যা হয় যৌনপল্লিতে স্থায়ীভাবে বাস করা যৌনকর্মীদের।
চালু এই ব্যবস্থার জন্য চড়া মাসুল মাশুল দিচ্ছেন যৌনকর্মীদের সন্তানরা। কারণ চালু এই ব্যবস্থার জেরেও সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন তারা। অথচ এখনও পর্যন্ত তাঁরা সমস্যারই সমাধান করতে পেরেছেন। সেই তুলনায় আবার অনেকে পিছিয়ে রয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের বাইরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের যৌনকর্মীদের সন্তানরা। তাই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের যৌনকর্মীদের সন্তানরাও যাতে সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন, এ বার সেই প্রচেষ্টাই জারি রাখতে চলেছেন পশ্চিমবঙ্গের যৌনকর্মীদের সন্তানরা। কোন্ পথে, কীভাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের যৌনকর্মীদের সন্তানদের একজোট করা সম্ভব হতে পারে? কীভাবেই-বা সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত করানোর জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য সহ সাংস্কৃতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের সামিল করানো সম্ভব হতে পারে সেই ভাবনা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের যৌনকর্মীদের অন্যতম সংগঠন দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি। এই সংগঠনের অধীনেই আছে পশ্চিমবাংলা যৌনকর্মীদের সন্তানদের সংগঠন ‘আমরা পদাতিক’। তাঁরা লড়াই জারি রেখেছে। তবে এখনও অনেক পথ চলার বাকি থেকে গিয়েছে। যে কারণে একদিকে যেমন আরও পথ চলার জন্য অঙ্গীকার আছে। তেমনই অন্যদিকে আবার পশ্চিমবঙ্গের বাইরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের যৌনকর্মীদের সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে পথ চলার স্বপ্ন এবং লড়াইও রয়েছে।
শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গ নয়। সমাজের প্রান্তিক অংশের বাসিন্দা হিসাবে অন্যান্য রাজ্যের যৌনকর্মীদের সন্তানদেরও যদি সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত করানোর জন্য প্রচেষ্টা জারি রাখা না-হয়, তাহলে সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন দেশের প্রান্তিক অংশের বাসিন্দারাই। দেশের অন্য রাজ্যগুলির যৌনকর্মীদের সন্তানরাও যাতে পদাতিকের মতো কোনো সংগঠনের অধীনে থেকে সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার প্রয়াস জারি রাখতে পারে, সেই জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে পদাতিক। এখনও অনেক সমস্যা আছে। ওই সব সমস্যার মধ্যে অন্যতম হল সমাজের চালু ব্যবস্থা। এই সংস্কৃতির কারণে সন্তানের পরিচয় হিসাবে প্রথমেই পিতার নাম জানতে চাওয়া হয়। যৌনকর্মীদের সন্তানদের অনেকেই জানেন না তাঁদের পিতার নাম। যে কারণে সমাজের চালু এই ব্যবস্থার জন্য বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে যৌনকর্মীদের সন্তানদের। সেইজন্য স্কুল-কলেজ সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কখনও অপমানিত, কখনও আবার হয়রানির শিকার হচ্ছেন যৌনকর্মীদের সন্তানরা। যে কারণে সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে পিতৃপরিচয়ও সমস্যা হিসাবে দেখা দিচ্ছে। সন্তানের পরিচয় হিসাবে পিতা এবং মাতা দুজনের নামই নেওয়া যায়। কিন্তু সমাজের চালু ব্যবস্থার জন্য আগে পিতার নাম জানতে চাওয়া হয়। এই বিষয়টি মোকাবিলার জন্য আইনের বদল প্রয়োজন। আইন বদল করে প্রতিটি ক্ষেত্রে সন্তানের পরিচয় হিসাবে প্রথমে মায়ের নাম নেওয়ার বিষয়টি চালু হওয়া প্রয়োজন। অথবা পিতা বা মাতা যে-কোনো একজনের নামেই চলুক। বিশেষ করে আমাদের দেশ সহ বিশ্বের বহু দেশে সিঙ্গেল মাদার আছেন, তাঁদের সন্তানদেরও মাতার নামই সম্বল। আছে ধর্ষিতার সন্তানেরা, তাঁরা কেন পিতৃপরিচয় দিতে যাবেন? যদি পিতা বা মাতা যে কোনো একজনের নাম উল্লেখ করে সন্তানদের পরিচয় সম্পূর্ণ করতে পারে, তাহলে সার্বিকভাবে সমাজেরই মঙ্গল হবে। কলকাতার বিভিন্ন যৌনপল্লিতে যেভাবে যৌনকর্মীদের সন্তানরা আছেন, সেই তুলনায় আবার বেশি সমস্যায় আছেন কলকাতার বাইরে এ রাজ্যের বিভিন্ন যৌনপল্লির যৌনকর্মীদের সন্তানরা। কারণ ওইসব যৌনপল্লির অধিকাংশ স্থানেই সমাজবিরোধী তথা দুষ্কৃতীদের দৌরাত্মে যৌনকর্মী এবং তাঁদের সন্তানদেরও বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যে কারণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাড়িতেই সন্তানদের রেখে আসেন ওই সব স্থানের যৌনকর্মীরা।
তবে শুধুমাত্র যে আইন বদলের মাধ্যমে সন্তানের পরিচয় হিসাবে প্রথমে মায়ের নাম নেওয়ার দাবিই জানানো হচ্ছে, তা নয়। কারণ সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে যৌনকর্মীদের সন্তানদের যুক্ত করানোর সঙ্গে নীতি-নির্ধারণের বিষয়টিও জড়িত আছে। ডাক্তার স্মরজিৎ জানা বলেন, “বাল্যবিবাহ রোধ এবং শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি সহ বিভিন্ন অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে সরকারি নীতি-নির্ধারক কমিটিগুলিতে যৌনকর্মীদের সন্তানদের প্রতিনিধি রাখার জন্য আমাদের দাবি আছে। কারণ নীতি-নির্ধারণের ক্ষেত্রে যদি যৌনকর্মীদের সন্তানদের তরফে প্রতিনিধি রাখা না-হয়, তাহলে যথাযথ নীতি-নির্ধারণের ক্ষেত্রেও সমস্যা বাড়ে বই কমে না।” একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, “আমরা পদাতিক’ শুধুমাত্র যৌনকর্মীদের সন্তানদের স্বার্থরক্ষার কথা বলে না। বরং সার্বিকভাবে শিশুদের অধিকার রক্ষার জন্যই লড়াই জারি রেখেছে এই সংগঠন। বাল্যবিবাহ রোধ সহ বিভিন্ন ধরনের মাদক দ্রব্যের ব্যবহার, শিশুদের উপর হিংসাত্মক ঘটনার বিরুদ্ধে এবং শিশুদের অধিকার রক্ষার বিশ্বজুড়ে আন্দোলনের শরিক ‘আমরা পদাতিক’।
পশ্চিমবঙ্গে যৌনকর্মীদের সন্তানদের আত্মসম্মান রক্ষার লড়াইয়ের জেরে প্রতি বছর এখন মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক মিলিয়ে ৩০ জনের বেশি সফল হচ্ছেন। যৌনকর্মীদের সন্তানরাও এখন চাকরি করছেন। তেমনই শুধুমাত্র শিক্ষা নয়, তার সঙ্গে ফুটবল সহ বিভিন্ন ধরনের খেলা এবং নাচ-গান-ছবি আঁকা সহ বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও পদাতিকের মাধ্যমে যুক্ত আছেন যৌনকর্মীদের সন্তানরা। ডাক্তার স্মরজিৎ জানার কথায়, “আমরা পদাতিকের মতো যৌনকর্মীদের সন্তানদের এত বড়ো মাপের সংগঠন আর কোথাও নেই। তবে সমাজের বিভিন্ন অংশে এখনও বিভিন্ন ধরনের হুঁত্সর্গ রয়েছে। যৌনকর্মীদের সন্তানরাও বিভিন্ন ধরনের হুঁৎমার্গ থেকে মুক্ত নয়। সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে যৌনকর্মীদের সন্তানদের যুক্ত হওয়ার বিষয়টি সার্বিকভাবে তখনই সফল হবে, যখন বিভিন্ন ধরনের হুঁৎমার্গ থেকে তাঁরা মুক্ত থাকতে পারবেন।” সাধারণ মানুষের মানসিকতা উন্নত না-হলে, কীভাবে বিভিন্ন ধরনের ছুঁৎমার্গ থেকে মুক্ত হবে সমাজ?
তবে যৌনকর্মীদের সন্তানদের পড়াশোনা শেখানো থেকে শুরু করে বিভিন্ন বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, যাতে তারা অন্য পেশায় যেতে পারে, স্বাবলম্বী হয়। যৌনকর্মীর সন্তানেরা যাতে কোনোভাবে সমাজে নিজেদের অচ্ছুৎ বা অপাংক্তেয় না মনে করতে পারে, সেজন্য খুব জরুরি ছিল এই উদ্যোগ। এখন যৌনকর্মীর সন্তানেরাও মূল ধারার স্কুলে ভর্তি হচ্ছে। তাদের নিজস্ব একটা ফুটবল দল হয়েছে, যে দল গত বছর তৃতীয় ডিভিশনে খেলার পর দ্বিতীয় ডিভিশনে খেলার যোগ্যতামান পার করেছে।
শিশুর বড়ো হয়ে ওঠার সঙ্গে অনেকগুলো জিনিস গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। শিক্ষা তেমন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তেমনই দরকার সঠিক পরিবেশটাও। সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশ বা সমাজের সঙ্গে যোগ না-থাকলে শিশুদের বড় হওয়ার সঙ্গে খারাপ সঙ্গ বা ভুল পথে চলে যাওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা থাকে বলে মনে করেন চাইল্ড সাইকোলজিস্টরা। যৌনকর্মীদের সন্তানদের ভুল পথে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা সব থেকে বেশি থাকে। অনেকেই এমন আছে যারা জানেই তার বাবা কে! কিন্তু মা আছে। পেটের টানে তিনি এমন জায়গায় এসে পড়েছেন যে সেখান থেকে আর বেরোবার জায়গা নেই। দুই কুঠুরির ঘরে ভালো করে বসার জায়গাও থাকে না যৌনকর্মীদের। এর মধ্যেই অহোরাত্র কাস্টমারদের যাতায়াত লেগেই আছে। এর মধ্যে পড়াশোনা শিখে আলোর পথ দেখার সম্ভাবনা কম। এমনটাই জানাচ্ছে দুর্বার সমন্বয় সমিতির প্রধান ডঃ স্মরজিৎ জানা। তার চেষ্টাতেই দুর্বারের বারুইপুর হোমে আরও বড় ঘরে থাকার সুযোগ পাচ্ছে যৌনকর্মীর সন্তানরা। শিশু দিবসে এটাই হতে চলেছে ওদের গিফট। যেমন রফিক মণ্ডল জানাল, “আমাদের পড়াশোনার জায়গা ছিল না, এই হোম পাওয়ার পর আমাদের খুব সুবিধা হয়েছে।” আগে যে জায়গা ছিল সেখানে মাত্র ৩০ জনের থাকার। জায়গা। বারুইপুরের বাড়িতে আরও ৭০ জন যৌনকর্মী সন্তানের থাকার সুযোগ হবে। ওই সব ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের মায়েরা মীনা সর্দার, সুনীতা অধিকারী, আলোরানি বিশ্বাসরাও খুবই খুশি এই সুবিধা পেয়ে।
যৌনকর্মীদের পল্লিতেও স্কুল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হল। যৌনকর্মীদের পল্লি এলাকায় শিশু ও বয়স্কদের স্কুল খোলায় উদ্যোগী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের সমাজ নগরে প্রায় ৫০ জন যৌনকর্মী রয়েছেন। পড়ুয়ার সংখ্যা প্রায় ৩০-৩৫ জন। তাদের জনা পনেরো স্কুল যায় না। তার কারণ যৌনকর্মীর সন্তান হওয়ায় স্কুলে গেলে সহপাঠীদের কাছ থেকে নানা কটুক্তি শুনতে হয়। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটির তরফে ২০০৫ সালে বিদ্যাসাগর সর্ব শিক্ষা বিদ্যালয় চালু করা হয়েছিল। কিন্তু অর্থের অভাবে তা এখন বন্ধ। উদ্যোক্তারা এলাকায় স্কুলের প্রয়োজন আছে। শিশু ও বয়স্করা যাতে পড়াশোনা করতে পারে, সে চেষ্টা করা হবে। সঙ্গে মিড-ডে মিলের ব্যবস্থা রাখা হবে। সে জন্য এলাকায় একটি ঘরের দরকার। তিনি বলেন, “আমার চেষ্টা শুরু করেছি। আশা করছি শীঘ্রই স্কুল চালু করা যাবে।” অভিভাবক মঞ্চের সম্পাদক ল্যারি বসু জানান, “২০০৫ সালে একটি স্কুল শুরু করেছিলেন তাঁরা। অর্থাভাবে তা পরে বন্ধ হয়ে যায়। পরে স্কুল চালু করার প্রতিশ্রুতি দেন।” এলাকার বাসিন্দা তথা দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির সদস্য শিপ্রা সিংহ জানান, এই পল্লির অধিকাংশ বাচ্চা বাইরের স্কুলে পড়তে চায় না। তিনি বলেন, “এলাকায় স্কুল হবে শুনে ভালো লাগছে।” নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যৌনকর্মীরা জানান, “আমাদের সন্তানদের সমাজ ভালো ভাবে নেয় না। হাসি ঠাট্টা করে। এলাকায় স্কুল হলে তারা পড়াশোনা করতে পারবে।”
যৌনকর্মীদের উপর নির্যাতনের শেষ নেই, যা বলে শেষ করার নয়। এমনকি যৌনদস্যুদের অত্যাচারেও গণিকারা অতিষ্ট হয়ে উঠেছে। বছর ঘুরে আন্তর্জাতিক নারী দিবস আসে যায়। কিন্তু যৌনকর্মীদের জীবনে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের কোনো প্রভাব পড়ে না। দিনদিন যৌনদস্যুদের লাগাতার অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে উঠেছে বিভিন্ন যৌনপল্লির যৌনকর্মীরা। যৌনকর্মীদের সুত্রে জানা যায়, পেট বাঁচাতেই তাঁরা এ পেশায় এসেছে। ভ্রাম্যমান যৌনকর্ম করে কোনোমতে তাঁরা দিন যাপন করে। একদল যৌনদস্যু তাঁদেরকে বারবার ঠকিয়ে মানবেতর জীবনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তাঁরা জানান ওই সমস্ত যৌনদস্যু খদ্দের সেজে তাঁদের সঙ্গে চুক্তি করে খদ্দেরদের পছন্দমতো স্থানে নিয়ে যায়। সেখানে যাওয়ার পরেই ঘটে বিপত্তি। যৌনকর্মীরা জানান, চুক্তি অনুযায়ী যতজন খদ্দের সেখানে থাকার কথা থাকে তার চেয়ে অনেক বেশি। ভুয়ো খদ্দের সেজে যৌনদস্যুরা তাঁদেরকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে মনমতো ভোগ করার পর কখনো নামমাত্র কিছু টাকা দেয়, কখনো-বা খালি হাতে মারপিট করে ফিরিয়ে দিচ্ছে। যৌনকর্মীরা তাঁদের ন্যায্য মূল্য চাইলে তাঁদেরকে এলাকা থেকে উচ্ছেদসহ নানাপ্রকার হুমকি প্রদান করে থাকে। সামাজিকভাবে তাঁদের অবস্থান ক্ষীণ হওয়ায় তাঁরা কারও কাছে বিচার চাইতে গেলে উলটো তাঁদেরকে এলাকা ছাড়তে বলা হয়। এলাকায় ভুয়ো খদ্দের নামক যৌনদস্যুদের সংখ্যা এত বেড়ে গেছে যে কে খদ্দের আর কে যৌনদস্যু তা বুঝতে পারছে না যৌনকর্মীরা। একেক বার একেক জন তাঁদের সঙ্গে চুক্তি করলেও ঘটনাস্থলে পরিচিত বেশ কিছু যৌনদস্যুর কবলে তাঁরা বারবার পড়ছে বলে। দেশের বিভিন্ন শহরে যৌনকর্মীদের জীবন মানোন্নয়নে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কাজ করলেও মফস্বল এলাকাগুলির যৌনপল্লিতে কেউ বা কোনো প্রতিষ্ঠান কাজ করে না। যৌনকর্মীদের দাবি এলাকার মানুষ যৌনবৃত্তিকে পাপ আর যৌনকর্মীদেরকে পাপী হিসাবে দেখে, ঘৃণা করে। কিন্তু যেসব যৌনদস্যু প্রতারণার মাধ্যমে বিনামুল্যে তাঁদের পাপী শরীরগুলোকে ভোগ করছে সমাজপতিরা তাঁদের দিকে একবারও নজর দিচ্ছে না, বরং এটাকে ভালো কাজ হিসাবেই দেখছে।
যৌনকর্মীদের নিয়ে বাংলাদেশেও অনেক কাজ হচ্ছে। যৌনকর্মীদের নিরাপত্তা, জীবন ও জীবিকার অধিকার বিষয়ে এক গণশুনানিতে যৌনকর্মীদের জীবন ও জীবিকার অধিকার প্রশ্নে রাষ্ট্রকে সংযত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান। তাঁদের প্রতি প্রতিক্রিয়াশীল’ না হয়ে সংবেদনশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনসহ চারটি সংগঠন এই গণ-শুনানির আয়োজন করে। আয়োজক হিসাবে ছিল মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন সংহতি, সেক্স ওয়ার্কার্স নেটওয়ার্ক ও সোয়াসা। রাষ্ট্রকে তার সামাজিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার দায়ে অভিযুক্ত করে মোট ১০টি সিদ্ধান্ত ও দুটি সুপারিশ করা হয়েছে গণশুনানিতে।
মিজানুর রহমান বলেছেন–“যে-কোনো ধরনের অধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে কমিশনে অভিযোগ দায়ের করুন। প্রয়োজনে কমিশন আইনি লড়াইয়ে আপনাদের থাকবে।” সাতজন যৌনকর্মীর অভিজ্ঞতা শোনার পর তিনি বলেছেন–“এ ধরনের অনুষ্ঠানে বিচারকের ভূমিকায় এসে আমি মর্মাহত, লজ্জিত। এনাফ ইজ এনাফ। রাষ্ট্র তুমি সংযত হও।” সারা দেশ থেকে আসা যৌনকর্মী ও যৌনকর্মীদের নিয়ে কর্মরত সংগঠনগুলোর উপস্থিতিতে এই গণশুনানিতে পুনর্বাসন সমস্যা, পুলিশি হামলা আর পাড়া-মহল্লার সন্ত্রাসীদের নির্যাতন ও হয়রানি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন যৌনকর্মীরা। তাঁরা বলেছিলেন–“পুলিশ ও সন্ত্রাসীদের যৌথ হামলার শিকার হয় তাঁরা। কোথাও বিচার চাইতেও যেতে পারে না। উলটে তাঁদেরকেই চুরি, ছিনতাই, পাচার সহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত করে কারাগারে পাঠানো হয়। ভোটের অধিকার যখন আছে, তখন রাষ্ট্র আমাদের মৌলিক অধিকার পূরণে বাধ্য।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বিচারক হিসাবে যে সিদ্ধান্তগুলো পড়ে শোনান, তা হল–পুনর্বাসন না-করা পর্যন্ত পেশা হিসাবে যৌনকর্মকে স্বীকৃতি দিতে হবে, পুলিশি হয়রানি বন্ধ ও দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে, যৌনপল্লির পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, আদালত ও বিচারকদের আরও সংবেদনশীল হতে হবে। যাঁরা নির্বাচনে দাঁড়ান তাঁরা প্রতিনিধি হিসাবে যেন যৌনকর্মীদের অধিকার সুরক্ষায় মনোযোগী হন। পাশাপাশি যৌনকর্মীদের আইনি সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন। করতে হবে।”
যৌনপেশায় কিছু দিককে আইনি বৈধতা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’। আর এমন প্রস্তাবের পক্ষে-বিপক্ষে সরব হয়ে উঠেছে সোশ্যাল মিডিয়াতে। ইরান চুক্তি থেকে শুরু করে অনেক চলমান ইস্যুর ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায়, নীতি নির্ধারক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ মূল বিষয়টি সম্পর্কে অবগত না-হয়েই অন্যের প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে নিজের প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’ নিজস্ব টুইটার অ্যাকাউন্টে তাই এই সংক্রান্ত প্রস্তাবিত নীতির প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। অ্যামনেস্টি মনে করে–শরীর বিক্রির পেশায় যেসব মেয়েরা যুক্ত তাঁদের অধিকার রক্ষা রাষ্ট্র সব ধরনের দায়িত্ব নিক। এঁদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনোভাবে ‘অপরাধী’ বলে চিহ্নিত করা বন্ধ করুক।
তবে পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত শোনা যাচ্ছে। কেউ অ্যামনেস্টির এই অবস্থানকে স্বাগত জানিয়ে যৌনকর্মীদের অবস্থার উন্নতির আশা করছেন। কেউ এই নীতির চরম বিরোধিতা করছেন। সেইসঙ্গে আছেন সনিয়া ডলিনসেকের মতো কিছু মানুষ, যাঁরা মনে করেন, অ্যামনেস্টি যৌনকর্মীদের সম্পর্কে নির্দিষ্ট অবস্থান নিয়ে অত্যন্ত ভালো কাজ করেছে। যৌনকর্মীদের কাজ সম্পর্কে অ্যামনেস্টির নীতির পক্ষে অনেকেই সমর্থন জানিয়েছেন। কারমেন অ্যামিসিটিয়ে মনে করেন, যৌনকর্মীদের জন্য এটা ভালো দিন। কিউটক্যাট্রিয়য়ানা নামের আড়ালে এক টুইটার ব্যবহারকারী মনে করেন, বিরোধীরা এই প্রস্তাবের মর্ম বুঝতে পারছেন না। এর সাহায্যে নিপীড়ন, হিংসা, মানবপাচার প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। এইলিন স্মার্ট অভিযোগ করেছেন, অনেকেই ইচ্ছাকৃতভাবে অ্যামনেস্টির নীতির ভুল মূল্যায়ন ছড়িয়ে দিচ্ছে। তাঁর মতে, অবিলম্বে তা বন্ধ করা উচিত। ডনিয়া ক্রিস্টিন আবেগে আপ্লুত হয়ে অ্যামনেস্টির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।
বিরোধীরাও যথেষ্ট সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। রেচেল মোরান নামের এক প্রাক্তন যৌনকর্মী, লেখক ও ব্লগার নিজস্ব টুইটার অ্যাকাউন্টে এই ভয়াবহ জগত সম্পর্কে নিজের সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতার কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন। একটি টুইটে তিনি লিখেছেন, অ্যামনেস্টি তাঁদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতি সমর্থন জানানোর ফলে যৌন ব্যাবসা ও মানব পাচারের কবল থেকে উদ্ধার পাওয়া অসংখ্য মানুষ তাঁর কাছে অশ্রুপাত করছেন। নারীবাদী সংগঠন ‘ফেমেন’-এর সুইডেন শাখা অ্যামনেস্টির প্রস্তাবের বিরোধিতা করে লিখেছেন—“যেসব মানুষদের টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে, এখন তাঁদের অধিকার যৌনপেশার দালালদের চেয়েও কমে গেল। অ্যামনেস্টি যৌন ক্রেতা ও দালালদের ‘অ্যামনেস্টি’ ক্ষমা করে দিল। প্রায় একই সুরে অভিযোগ করেছেন আন্দ্রেয়াস পেটারসন। লার্স ওলি আবেগের সঙ্গে লিখেছেন—“বিদায় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশানাল। নারী অধিকারের জন্য লড়াইয়ের ক্ষেত্রে তোমাদের সংগঠনের উপর আর আস্থা রইল না।”
যৌনপেশা ও যৌনকর্মীদের বিরোধীরা মনে করে অ্যামনেস্টি যৌনকর্মী ও দালালদের বৈধ করতে চায়। বলা হচ্ছে বেশ্যালয়ের মালিকানাকে বৈধ করার সপক্ষে মতপ্রকাশ করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। যৌনপেশাকে পুরোপুরি ‘ডিক্রিমিনালাইজ’ করা, অর্থাৎ অপরাধ হিসেবে গণ্য না-করার সপক্ষে অ্যামনেস্টি। ডাবলিনের ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিলের এক সভায় ৭০টি দেশ থেকে আগত ৪০০ প্রতিনিধির এক সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ দৃশ্যত প্রস্তাবটি সমর্থন করেন, যদিও ভোটাভুটির কোনো খুঁটিনাটি তথ্য দেওয়া হয়নি।
অ্যামনেস্টি বিভিন্ন যৌনকর্মী সংগঠন ও গোষ্ঠী, এইচআইভি/এইডস ত্রাণকর্মী এবং মানুষ পাচার বিরোধী গোষ্ঠীর সঙ্গে দু-বছর ধরে কথাবার্তা বলার পর এই সিদ্ধান্তে আসে যে, যৌনকর্মীদের মানবাধিকার রক্ষার শ্রেষ্ঠ পন্থা হল দালালি ও গণিকালয়ের মালিকানা সহ সব ধরনের যৌন-পরিসেবাকে বৈধ ঘোষণা করা। এর ফলে যৌনকর্মীদের মারধোর, যৌন নির্যাতন, অকারণে গ্রেপ্তার, ব্ল্যাকমেল, নারী পাচার ও জোর করে এইডস পরীক্ষার ঘটনা কমবে, বলে অ্যামনেস্টির ধারণা। কাজেই অ্যামনেস্টির মহাসচিব সলিল শেট্টি একটি ‘ঐতিহাসিক দিনের কথা বলেন।
তবে ডাবলিনের এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার আগে থেকেই অ্যামনেস্টির অভিপ্রায় জ্ঞাত ছিল এবং অপরাপর বহু নারী অধিকার গোষ্ঠী সমালেচনায় মুখর হয়ে উঠেছিল। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘Coalition Against Trafficking in Women’ বা নারী পাচার বিরোধী জোটের কার্যনির্বাহী পরিচালক তাইনা বিয়্যাঁ এইমের মতে, যৌনকর্ম সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যকলাপ অপরাধের তালিকা থেকে অপসারণ করার অর্থ দালালদের Business-man’-এ পরিণত করা, যাতে তাঁরা নির্বিচারে অসহায়দের ‘বেচতে পারে। ডাবলিনের ভোটের আগেই নারী পাচার বিরোধী জোট একটি খোলাচিঠিতে সাবধান করে দিয়েছিল যে, এর ফলে অ্যামনেস্টির ভাবমূর্তি ‘বিশেষভাবে মলিন’ হবে। সিএটিডাব্লিউ-এর অনলাইন পিটিশনে ইতিমধ্যেই হাজার হাজার স্বাক্ষর পড়েছে। যাঁরা স্বাক্ষর করেছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন মেরিল স্ট্রিপ, কেট উইন্সলেট এবং এমা থমসনের মতো হলিউড তারকারাও আছেন।
নারী অধিকার গোষ্ঠী ‘Equality Now’-এর নারী পাচার বিরোধী কর্মসূচির পরিচালক এশোহে আঘাটিসে বলেছেন—“বাণিজ্যিক যৌনসম্ভোগের চাহিদা বাড়ার ফলেই নারী পাচার বাড়ে। তখন হঠাৎ নীতি বদলে বলতে পারে না যে, যাঁরা সেই চাহিদা বাড়াচ্ছে, চলো তাদেরই সুরক্ষা দেওয়া যাক।” তাই বিয়্যাঁ এইমও বলেছিলেন—শোষিতদের রক্ষা করার জন্য শোষণকারীদের সুরক্ষা দেওয়ার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। অপরদিকে অ্যামনেস্টি বলছে—‘Forced Labour’ বা বেগার খাটানো কিংবা যৌন শোষণের জন্য নারী পাচার ইত্যাদি ব্যাপারে তাঁদের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।
বিষয়টি এমনই বিতর্কিত যে, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন আইনকানুন চালু আছে। আইসল্যান্ড, সুইডেন এবং নরওয়েতে যৌনকর্মীদের পরিবর্তে তাঁদের গ্রাহকদেরই অপরাধী হিসাবে দেখা হয়। সম্প্রতি ফ্রান্সও যে পন্থা অবলম্বন করার চেষ্টা করছে। ইউরোপের বহু দেশে গণিকাবৃত্তি নিষিদ্ধ। অপরদিকে অস্ট্রিয়া, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড এবং আরও কয়েকটি দেশে তা সরকারিভাবে নিয়ন্ত্রিত।
কলকাতার সোনাগাছিতে ‘ঊষা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। সোনাগাছির যৌনকর্মীদের জন্য এই সংস্থাটিও অভূতপূর্ব কাজ করছে। ঊষা কো-অপারেটিভ সম্পর্কে আরও একটু জেনে রাখা প্রয়োজন আমাদের। এই প্রতিষ্ঠানের একটা ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাস জানতে আমাদের একটু পিছন দিকে যেতে হবে। উষা কো-অপারেটিভের যাত্রা শুরু ১৯৯৫ সালের ২১ জুন। শুধু পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতাই নয়, সারা ভারত মায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রথম যৌনকর্মীদের কো অপরেটিভের বিস্তার। যৌনকর্মী সদস্যদের আর্থিক কল্যাণের উদ্দেশ্য মাথায় রেখেই এ পথ চলা। তার পরের ইতিহাস দীর্ঘ ২৩ বছরের এক উত্থানের ইতিহাস রচিত হয়ে গেল। ১৯৯৫-৯৬ সালে যে সদস্যসংখ্যা ছিল মাত্র ৯৪ জন, সেই সংখ্যা ২০১২-১৩ সালে এসে দাঁড়াল ১৯ হাজার ৭২২ জন। এই সংখ্যাটা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
১৯৯২ সালে ‘All India Institute of Hygiene and Public Health’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) সহায়তায় সোনাগাছি অঞ্চলে যৌনস্বাস্থ্য প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। উদ্দেশ্য, যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্যসচেতন করে তোলা। যৌনকর্মীদের ঘরে ঘরে গিয়ে এইডস সহ বিভিন্ন যৌনরোগ এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে তাঁরা বোঝাতে শুরু করেন। এর সঙ্গে সঙ্গে ভাবতে শিখল শুধু স্বাস্থ্যসচেতন হলেই চলবে না, প্রয়োজন অর্থনৈতিক সুরক্ষা।
একসময় অভাব-অনটনের সময় কিস্তিওয়ালা সুদখোরদের কাছ থেকে ঋণ নিতে হত এবং সেই ঋণ শোধ করতে দম বেরিয়ে যেত। পথে বসার উপক্রম হত। এহেন এক পরিস্থিতিতে দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির সদস্যদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে ‘উষা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি। উষা কো-অপারেটিভ প্রথমদিকে কলকাতা সহ হাওয়ার পৌর এলাকায় কাজ করার অধিকার পেলেও পরে ২০০৯ সালে উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, নদিয়া ও মুর্শিদাবাদ এই চারটি জেলাতেও কাজ করার অধিকার পায়। অবশ্য ২০০১ সাল থেকেই পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত যৌনকর্মীরাই চাইছিলেন উষার ছায়াতলে ঠাঁই পেতে। নানা আবেদন নিবেদনের পর পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সমবায় মন্ত্রী রবীন্দ্র ঘোষ যৌনপল্লি এলাকায় যৌনকর্মীদের কো-অপরেটিভ গড়ে তোলার অনুমোদন দেন। উষা কো-অপারেটিভ ব্যাংক আজ যৌনকর্মীদের নিজস্ব ব্যাংক। ভুলে গেলে চলবে না, এই কো-অপারেটিভ গড়ে ওঠার আগে কোনো ব্যাংকই যৌনকর্মীদের টাকা জমা রাখত না। পেশা আর ঠিকানাই যৌনকর্মীদের কষ্টার্জিত অর্থ থেকে কিছুটা সঞ্চয় করে রাখার অধিকার দিত না। এখনও সেই অধিকার পাওয়া যায়নি। ফলে প্রয়োজন মিটিয়ে উদ্বৃত্ত অর্থ নিজেদের কাছেই রাখতে হত এবং সেটা খরচও হয়ে যেত। প্রয়োজনের সময় ঋণ করা ছাড়া কোনো উপায়ই থাকত না। উষা কো-অপারেটিভ ব্যাংক যৌনকর্মীদের সেই সমস্যার সুরাহা এনে দেয়। শুধু সঞ্চয়ই নয়, প্রয়োজনের সময় সহজ শর্তে ঋণও পেতে পারে যৌনকর্মীরা। সেভিংস ডিপোজিট (বার্ষিক সুদের হার ৫ শতাংশ), খ্রিফট ফান্ড (বার্ষিক সুদের হার ৭ শতাংশ), রেকারিং ডিপোজিট (বার্ষিক সুদের হার ৯.০৬ শতাংশ), মাসিক আয় প্রকল্প (বার্ষিক সুদের হার ৮ শতাংশ), স্থায়ী জমা প্রকল্পে (৮ বছর ৫ মাসে ডাবল)। ১৯৯৫-৯৬ সালে আমানত জমা পড়েছিল মাত্র ৩ লাখ টাকা। ২০১২-১৩ সালে এসে আমানত বৃদ্ধি হয়ে দাঁড়াল ১৬২৫ লাখে।
উষা কো-অপারেটিভ এখানেই থেমে থাকেনি। উষা বোঝে আরও অনেক কাজ করতে হবে। যৌনরোগ এড়াতে কন্ডোমের কোনো বিকল্প নেই। বাইরে থেকে কন্ডোম কিনলে খরচ অনেক বেশি পড়ে যায়। তাই যাতে সুলভে ও সঠিক মানের কন্ডোম তাঁরা যাতে পেতে পারে, সেই উদ্দেশ্য নিয়ে কন্ডোমের সামাজিক বিপণনের ব্যবস্থা শুরু করে। সারা পশ্চিমবঙ্গের যৌনকর্মীরা এই কন্ডোম ব্যবহার করে। যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করেন এমন। বহু সংস্থাকেও উষা কো-অপারেটিভ কন্ডোম বিক্রি করছে। এছাড়াও স্টেশনারি ব্যাবসা, ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলসের ব্যবসা, প্রসাধনী ব্যাবসা, কৃষি উৎপাদন ও বিপণন, পশুপালন ও মৎস্য চাষ এবং সেইসঙ্গে ন্যাপকিনের ব্যাবসাও করছে। যৌনকর্মী ও যৌনকর্মীদের সন্তানদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পথ প্রশস্ত করতেই প্রকল্পের উদ্দেশ্য।
চিটফান্ডের কবলে পড়ে উষা কো-অপারেটিভের আমানত লক্ষণীয়ভাবে কমতে শুরু করে দিয়েছিল। বহু যৌনকর্মী বেশি সুদের লোভে উষায় টাকা না-রেখে চিটফান্ডগুলিতে টাকা রাখতে শুরু করে দিয়েছিল। ঘটনায় দেখা গেছে লোভের বশে সোনাগাছি এলাকায় শুধু যৌনকর্মীরাই নয়–যৌনকর্মীর বাবু দালাল, বাড়ির কাজের লোক সবাই এইসব ভুয়ো সংস্থায় অর্থ লগ্নি করেছিলেন। মোট বিনিয়োগ কোটি টাকা ছাপিয়ে যাবে। উষা কো অপরেটিভ নিদারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ক্রমশ সঞ্চয়ী হয়ে উঠছেন এই রাজ্যের যৌনপল্লিগুলির মেয়েরা। পেশায় থাকাকালীন একটি পয়সাও সঞ্চয় না করায় এই রাজ্যের যৌনকর্মীদের ভিতর অনেকেই একটা বয়সের পর ফুটপাথে বসে ভিক্ষা করেছেন অথবা শেষ বয়সে চরম দুর্গতির শিকার হয়েছেন। জীবনের নির্মমতা ক্রমাগত যন্ত্রণা দিয়েছে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শরীর অশক্ত হয়েছে, আকর্ষণ হারাচ্ছে। একে তো সারাটা জীবন সমাজে প্রান্তিক মানুষ হিসাবে জীবন কাটানো। তার ওপর এই সমাজেরও ওঁদের প্রতি সহানুভূতি দেখানোর মানসিকতা ছিটেফোঁটাও ছিল না। ফলে পেশা থেকে সরে যাওয়ার পরের দিনগুলিতে যৌনকর্মীদের একাংশের চরম দুর্গতি অনেক যৌনকর্মীর চোখ খুলে দিয়েছে। ফলে তাঁদের ভাবনা চিন্তায় বৈপ্লবিক বদল ঘটেছে। যৌনকর্মীদের ভিতর সঞ্চয়ের প্রবণতা বেড়েছে। তাঁদের একটা বড়ো অংশ নিয়মিতভাবে সঞ্চয় করছেন। রোজগারের উত্তুঙ্গ সময়ে সঞ্চয় করার অভ্যাসটি যে-কোনো মানুষেরই সুঅভ্যাসের মতো করে অনুশীলন করা উচিত। সারা বাংলার যৌনকর্মীদের ভিতর গরিষ্ঠ সংখ্যকই এখন এমনটি মনে করেন। কিন্তু কলকাতা সহ এই রাজ্যের বিভিন্ন যৌনপল্লিগুলিতে নিয়মিত কিছু কিছু করে টাকা সঞ্চয় সম্পর্কে সচেতনতা জাগানোর কাজটি করতে সময় লেগেছে প্রায় দুটি দশক। এখন তাঁর সুফল ভোগ করছেন অধিকাংশ যৌনকর্মী। এর কৃতিত্ব প্রাপ্য ঊষা মাল্টিপারপাস কো অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের। এটি যৌনকর্মীদের জন্যে তৈরি প্রথম সমবায়। জানা গিয়েছে, সমবায়ের টার্ন ওভার এখন বার্ষিক ২৯ কোটি টাকা।
কলকাতা শহরের সোনাগাছি যৌনপল্লিটি মহানগরীর সবচেয়ে প্রাচীন ও বৃহত্তম যৌনপল্লি। এছাড়াও, মহানগরীর পরিচিত যৌনপল্লিগুলির ভিতর রয়েছে রামবাগান, বৌবাজার, ওয়াটগঞ্জ, খিদিরপুর, কালীঘাট এলাকার যৌনপল্লিগুলি। এছাড়াও দক্ষিণবঙ্গ ও উত্তরবঙ্গ জুড়ে বিভিন্ন যৌনপল্লিগুলিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন যৌনপেশার সঙ্গে যুক্তরা। এঁদের ভিতর একটা বড়ো অংশই ওই যৌনপল্লিগুলিতে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। কেবলমাত্র সোনাগাছিতেই যৌনকর্মীর সংখ্যা অন্ততপক্ষে ৯ হাজার। ১৯ থেকে ৪৫ বছর বয়স্ক মেয়েরা এখানে যৌনপেশায় যুক্ত। মাথা পিছু দৈনিক রোজগার অবশ্য একেক রকম। জানা গিয়েছে, বয়স্ক মহিলাদের চেয়ে তরুণীদের রোজগার তুলনায় অনেকটাই বেশি। সোনাগাছির বাসিন্দা একজন তরুণী যৌনকর্মী দিনে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত রোজগার করে থাকেন। এখানকার বাসিন্দা যৌনকর্মীদের ন্যূনতম দৈনিক আয় গড়ে ৫০০ টাকা। তবে বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আয়ের পরিমাণও কমতে শুরু করে।
শেষ করব এমন কয়েকটি কয়েকটি সংগঠনের কথা বলে যাঁরা বহু বছর ধরে যৌনকর্মীদের নিরাপত্তা, অধিকার ও স্বাস্থ্য নিয়ে আন্দোলন ও লড়াই করছেন। গণস্বাস্থ্য কর্মসূচি বর্তমানে বেশ কয়েকটি এনজিও এবং সরকারি সংস্থা এইডস সহ যৌনরোগ প্রতিরোধমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। এনজিও প্রতিষ্ঠান ‘সংলাপ’-এর প্রতিষ্ঠাতাদের দ্বারা রচিত এই ‘গিলটি উইথআউট ট্রায়াল’ যৌনপল্লির শরীর-ব্যাবসার বহু তথ্য জ্ঞাপন করে। ২০০৫ সাল থেকে সোনাগাছি প্রকল্প যৌনকর্মীদের সমবায়। সমবায়টি এই অঞ্চলের যৌনকর্মীদের মধ্যে কাজ করে তাঁদের মধ্যে কন্ডোম ব্যবহার ও মানুষ পাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর বিষয়ে সচেতনতার কথা প্রচার করে। ১৯৯২ সালে জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানী স্মরজিৎ জানা এই সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করেন। তবে যৌনকর্মীরাই এই প্রতিষ্ঠানকে সচল রাখেন। এই সংস্থায় কৃতিত্ব যৌনকর্মীদের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণের হার ৫ শতাংশ কমিয়ে এনেছে, যা ভারতের অন্যান্য নিষিদ্ধপল্লির তুলনায় বেশ কম। সেইজন্য রাষ্ট্রসংঘের এইডস কর্মসূচিতে এটি ‘বেস্ট প্র্যাকটিস মডেল’ বলে বন্দিত হয়েছে। দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি সোনাগাছি প্রকল্প সহ পশ্চিমবঙ্গের ৬৫,০০০ যৌনকর্মী ও তাঁদের সন্তানদের নিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প পরিচালনা করে থাকে। এঁরা যৌনকর্মীদের অধিকার, স্বীকৃতি ও যৌন-ব্যাবসার বৈধকরণের দাবি জানার। এছাড়াও তাঁরা বিভিন্ন শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের কর্মসূচি পালন করে।
১৯৯৭ সালের ১৪ নভেম্বর কলকাতায় আয়োজিত এই সম্মেলনের শিরোনাম ছিল–Sex Work is Real Work : We Demand Workers Rights’। ২০০৫ সালে ‘Born into Brothels’ নামে তথ্যচিত্রটি তৈরি করে শ্রেষ্ঠ তথ্যচিত্র বিভাগে অস্কার ছিনিয়ে আনে। এই তথ্যচিত্রে সোনাগাছির যৌনকর্মীদের সন্তানদের জীবনযাত্রা চিত্রিত হয়েছে। এতদিন যৌনপেশার পরিধি সীমাবদ্ধ ছিল মূলত দুর্গাচরণ মিত্র স্ট্রিট এবং গৌরীশংকর লেনের মধ্যেই। এখন সোনাগাছির এলাকা ক্রমেই বাড়ছে, চারপাশ দিয়ে বাড়ছে। যৌনকর্মীরাও ছড়িয়ে পড়ছেন আশেপাশের অঞ্চলে।
দুর্বারের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতের অন্যান্য কিছু এলাকায় যৌনকর্মীরাও তাঁদের নিজস্ব সংস্থা গড়ে তুলেছে। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল–পঞ্চম (বিহার), সাভেরা (দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ ও বিহার), সেক্স ওয়ার্কার্স ফোরাম (কেরল), বেশ্যা এইডস মোকাবিলা পরিষদ (মহারাষ্ট্র), উইমেন্স ইনিশিয়েটিভ (তিরুপতি)। এছাড়াও সারা বিশ্বে হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে নিরন্তর। বাংলাদেশের দুর্জয় নারী সংঘ, উল্কা নারী সংঘ, অক্ষয় নারী সংঘ ইত্যাদি।
ভারতের লক্ষ লক্ষ যৌনকর্মীদের পক্ষে সংঘবদ্ধ হয়ে নিজেদের নানাবিধ অধিকারের দাবি করা এবং ইতোমধ্যে অতি অল্প হলেও তার কিছুটা আদায় করা তাঁদের নিজেদের কাছে বা অন্যদের কাছেও ১৫ বছর আগে প্রায় স্বপ্নেরও অতীত ছিল। অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপের কিছু দেশে যৌনকর্মীরা বেশ কয়েক বছর হল তাঁদের নিজেদের কিছু দাবি-দাওয়া আদায় করতে পেরেছে। কিন্তু এইসব যৌনকর্মীরা ভারতের ও অন্যান্য অনুন্নত দেশের যৌনকর্মীদের মতো এত দরিদ্র, এত নির্যাতিত ও এত অসহায় কখনোই ছিল না। ভারতের যৌনকর্মীদের ক্ষমতায়নের যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে তা আরও জোরালো হবে এবং অন্যান্য অনুন্নত দেশের যৌনকর্মীদের পক্ষে পথ-প্রদর্শক হিসাবে গণ্য হবে।
বস্তুত মানুষ হিসাবে আমরা সবাই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পুঁজিবাদের বদ্ধভূমিতে বন্দি হয়ে পড়ছি ক্রমশ। ক্ষমতার লড়াই চলছে সর্বত্র। নারীও পিছিয়ে নেই, সেই লড়াইয়ে নারীও সামগ্ৰীক অংশীদার। সবাই জানে ক্ষমতায়নের প্রধান রসদ অর্থ। সেই অর্থ নিজের ঘরে মজুত করার জন্য ‘ভালো’ বা ‘মন্দ’ কোনোকিছুতেই দ্বিধা নেই, সংকোচ নেই। তাঁরা সেই সারসত্য মেনে নিয়েছে–লজ্জা ঘৃণা ভয়, তিন থাকতে নয়। তাই এ কাজে পাপবোধ হয় না?” এমন প্রশ্নে জনৈক যৌনকর্মী সপ্রতিভ উত্তর দিলেন–“আরে ধুস। শরীরে যৌনাঙ্গ আছেই তো যৌনকর্ম করার জন্যে। শরীরটাও আমার। যৌনাঙ্গটাও আমার। সেই যৌনাঙ্গ দিয়ে কার সঙ্গে কতজনের সঙ্গে কীভাবে যৌনকর্ম করব, সবটাই আমি ঠিক করি। পাপবোধ হবে কেন? পাপবোধ তাঁদেরই হয়, যেসব মেয়েরা তাঁর শরীরের উপর পুরুষের একক মালিকানায় বিশ্বাসী।”
তাই বিশ্বায়নের নিত্যনতুন কৌশল মানুষের মগজ আর মননে জমা হচ্ছে পরতে পরতে। মৌলবাদ ও পুঁজিবাদ দুটোই মানুষের অস্তিত্বের জন্য চরম সংকটের। এ সংকট রাতারাতি মুক্ত হয়ে যাবে, এ আশাও আমি করি না। পুঁজিবাদী মূল্যবোধে ঠাসা মগজের কারফিউ কোনোদিন ভাঙবে কি না তাও জানি না।
২৫. গণিকাগমন এবং গনোরিয়া, সিফিলিস ও এইডস
আগের অধ্যায়ে আলোচনা করেছি ব্রিটিশ-ভারতে অনিয়ন্ত্রিত যৌনজীবনে কীভাবে মানুষের মধ্যে যৌনরোগ ছড়িয়ে পড়েছিল। সে সময় যৌনরোগের এতটাই প্রাদুর্ভাব হয়েছিল যে, সকলেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। এই ধারা অব্যাহত ছিল ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। ব্রিটিশ আমলের পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যাবে কি অবস্থা ছিল ওই সময়। দেবাশিস বসুর ‘কলকাতার যৌনপল্লী’ থেকে জানা যায়—১৮৫৩ সালে কলকাতা শহরে ৪০৪৯ টি গণিকালয় ছিল, যাতে বাস করছিলেন ১২,৪১৯ জন যৌনকর্মী। ১৮৬৭ সালে ছিল ৩০,০০০ জন। ১৯১১ সালের আদশুমারি অনুযায়ী ১৪২৭১ জন। ১৯২১ সালের আদমশুমারিতে অনুযায়ী ১০,৮১৪ জন যৌনকর্মী ছিল কলকাতায়। প্রকৃত সংখ্যা হয়তো আরও বেশি হবে। বিনয় ঘোষ তাঁর কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত’-এ লিখেছেন—কলকাতায় খুবই রমরমা ছিল গণিকাদের জগৎ। গৃহস্থের বাড়ির পাশে গণিকা, ছেলেদের পাঠশালার পাশে গণিকা, চিকিৎসালয়ের পাশে গণিকা, মন্দিরের পাশে গণিকা। বিশেষ করে রামবাগান, সোনাগাছি, মেছোবাজার, সিদ্ধেশ্বরীতলা, হাড়কাটা, চাঁপাতলা, ইমামবক্স এগুলো ছিল গণিকাদের আখড়া। এমনকি কিছু গণিকা শহরে প্রকাশ্য রাজপথে নৃত্য পর্যন্ত করত। সাধারণ মানুষ পুলিশের কাছে আবেদন করা সত্ত্বেও এর কোনো প্রতিকার হয়নি। কারণ কলকাতায় পুলিশ ধনীদের তৈরি গণিকালয়গুলোতে হস্তক্ষেপ করতে সাহস পেত না। শুধুমাত্র দ্বারকানাথ ঠাকুর কলকাতায় একটি এলাকাতেই ৪৩টি গণিকালয়ের মালিক ছিলেন।
অবাঞ্ছিত, অনিয়ন্ত্রিত যৌনজীবন অতিবাহিত করার ফলে যে যে যৌনরোগ ছড়িয়ে পড়ছিল, সেগুলি হল–গনোরিয়া, সিফিলিস, জেনিটাল হার্পিস, এইডস, ক্লেমিডিয়া, শ্যানক্রয়েড, জিকা ভাইরাস ইত্যাদি।
গনোরিয়া : গনোরিয়া আছে এমন কারোর সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হলে গনোরিয়া হতে পারে। এই রোগে আক্রান্ত মা থেকে নবজাতকের শরীরে এই জীবাণু প্রবেশ করতে পারে। পুরুষ ও নারী, বিশেষ করে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সিরা গনোরিয়ায় আক্রান্ত হয় বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও নিবারণ কেন্দ্র (সিডিসি)। গনোরিয়া হলে মূত্রত্যাগের সময় জ্বালাপোড়া ও যৌনাঙ্গ দিয়ে সাদা, হলুদ ও সবুজ স্রাব বের হতে পারে।
সিফিলিস : গনোরিয়ায় মতো সিফিলিসের জীবাণুও মা থেকে নবজাতকের দেহে ঢুকতে পারে। চিকিৎসা না করালে সিফিলিস থেকে দীর্ঘমেয়াদে জটিল সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছে সিডিসি। সিফিলিসের লক্ষণ প্রাথমিক পর্যায়ে যন্ত্রণা ও চুলকানিবিহীন ক্ষত হতে পারে, দ্বিতীয় পর্যায়ে মুখ, যোনি কিংবা মলদ্বারে ব্যাশ বা ক্ষত হতে পারে। শেষ পর্যায়ে প্যারালিসিস থেকে অন্ধত্ব, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।
জেনিটাল হার্পিস : যৌনকাজে সক্রিয় যে কেউ এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। আক্রান্তদের অনেকের শরীরে এই রোগের লক্ষণ দেখা যায় না। অর্থাৎ কারও শরীরে এই রোগের লক্ষণ না-থাকলেও তিনি সঙ্গীর দেহে এটি ছড়িয়ে দিতে পারেন। লক্ষণগুলো হল–যৌনাঙ্গ, মলদ্বার ও মুখে একটি বা দুটি ফোস্কা পড়তে পারে। সেগুলো ভেঙে গিয়ে ব্যথা হতে পারে। সেই ব্যথা সারতে কয়েক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে।
এইচআইভি/এইডস : যাঁদের সিফিলিস, গনোরিয়া ও হার্পিস আছে তাঁদের ভবিষ্যতে এইচআইভি আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। কারণ রোগগুলো একইরকম যৌন আচরণের জন্য হয়ে থাকে। এইচআইভিতে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম দুটি কারণ হল কন্ডোম ছাড়া যৌনমিলন এবং একাধিক ও অপরিচিত কারও সঙ্গে মিলন। তবে এইচআইভিতে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তি বা কোনো এইডস রোগীর রক্ত আপনার শরীরে ঢুকলেও এই রোগ হয়। এইডস (Acquired Immuno Deficiency Syndrome) বা অর্জিত প্রতিরক্ষার অভাবজনিত রোগলক্ষণসমষ্টি হচ্ছে এইচ.আই.ভি. (Human Immunodeficiency Virus) তথা মানব প্রতিরক্ষা অভাবসৃষ্টিকারী ভাইরাস’ নামক ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট একটি রোগলক্ষণসমষ্টি, যা মানুষের দেহে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বা প্রতিরক্ষা তথা অনাক্রম্যতা হ্রাস করে। এর ফলে একজন এইডস রোগী খুব সহজেই যে কোনো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হতে পারেন, যা শেষপর্যন্ত তাঁর মৃত্যু ঘটাতে পারে।
এইচ.আই.ভি. সংক্রমণের সঙ্গে সঙ্গেই সর্বদা এইডস হয় না। শুরুতে ক্ষেত্রবিশেষে ইনফ্লুয়েঞ্জা জাতীয় উপসর্গ দেখা যেতে পারে। এরপর বহুদিন কোনো উপসর্গ দেখা যায় না। এইচ.আই.ভি. ভাইরাসের আক্রমণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেহের প্রতিরক্ষাতন্ত্র বা অনাক্রম্যতন্ত্র দুর্বল হতে থাকে এবং আক্রান্ত ব্যক্তি সাধারণ সংক্রামক ব্যাধি যেমন যক্ষ্মায় যেমন আক্রান্ত হতে পারেন, তেমনই সুযোগসন্ধানী সংক্রামক ব্যাধি এবং অবুদ বা টিউমারের শিকার হতে পারেন, যেগুলি কেবলমাত্র সেসব লোকেরই হয়, যাঁদের দেহের অনাক্রম্যতন্ত্র (বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা) কাজ করে না। এইচ.আই.ভি. সংক্রমণের এই পর্যায়টিকেই এইডস বলা হয়। এই পর্যায়ে প্রায়শই রোগীর অনিচ্ছাকৃতভাবে ও অত্যধিক পরিমাণে ওজন হ্রাস পায়।
যেহেতু একবার সংক্রামক এইচ.আই.ভি. শরীরে ঢুকলে তাকে পুরোপুরি দূর করা এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি, তাই এইচ.আই.ভি. সংক্রমণ হলে এইডস প্রায় অনিবার্য। তবে বিনা চিকিৎসায় এইডস পর্যায়ে পৌঁছোতে যদি লাগে গড়ে দশ বছর, তবে চিকিৎসার দ্বারা তাকে আরও কিছু বছর পিছিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু ‘HAART নামে এইডসের যে সমন্বিত ওষুধ দ্বারা চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে, তা অত্যন্ত খরচ সাপেক্ষ। ২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বে প্রায় ৩ কোটি ৬৭ লক্ষ লোক এইচ.আই.ভি দ্বারা আক্রান্ত ছিল এবং ওই বছর এইডসের কারণে ১০ লক্ষ লোকের মৃত্যু হয়। তবে ২০১৬ সালে ২০১৫ সালের তুলনায় নতুন এইচআইভি সংক্রমণের সংখ্যা ৩ লক্ষ কম ছিল। বেশির ভাগ এইডস আক্রান্ত রোগীই সাহারা-নিম্ন আফ্রিকাতে বাস করে ১৯৮০-র দশকের শুরুতে রোগটি চিহ্নিত করার পর থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সারা বিশ্বব্যাপী এইডস রোগে মোট আনুমানিক ৩ কোটি ৫০ লক্ষ লোক মারা গেছে। এইডসকে বর্তমানে একটি মহামারী ব্যাধি হিসেবে গণ্য করা হয়, যা বিশ্বের বিশাল এক আয়তন জুড়ে বিদ্যমান এবং যা সক্রিয়ভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। এইচআইভি ভাইরাসটি সম্ভবত ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে বা বিংশ শতকের শুরুর দিকে পশ্চিম-মধ্য আফ্রিকাতে উৎপত্তিলাভ করে। ১৯৮১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র সিডিসি সর্বপ্রথম রোগটি শনাক্ত করে এবং তার পরে ১৯৮০-র দশকের শুরুর দিকে এই রোগের কারণ হিসেবে এইচআইভি ভাইরাসকে শনাক্ত করা হয়। সিডিসির (রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র, যুক্তরাষ্ট্র সরকার) ২০১৭ সালের জরিপ অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে এইচ.আই.ভি. আক্রান্তের ৭০ শতাংশই সমকামী এবং উভকামী পুরুষ।
ক্লেমিডিয়া : পুরুষ ও নারীর উভয়েরই এটি হতে পারে। নারীর গর্ভধারণ ক্ষমতায় স্থায়ী সমস্যা তৈরি করতে পারে ক্লেমিডিয়া। এই রোগের একবার চিকিৎসা হলেও পরবর্তীতে আবারও এটি হতে পারে। এমনটি হল নারীদের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক অথবা অনিয়মিত ঋতুস্রাব, মূত্রত্যাগের সময় জ্বলাপোড়া হতে পারে। পুরুষের বেলাতেও প্রায় একই ধরনের লক্ষণ দেখা দেয়।
শ্যানক্রয়েড : শ্যানক্রয়েডের ফলে যৌনাঙ্গে যন্ত্রণাদায়ক ঘা দেখা দেয়। যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায়। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এটি বেশি দেখা যায়। এর সঙ্গে যৌনকর্মীদের একটি সম্পর্ক রয়েছে, কারণ দেখা গেছে যাদের শ্যানক্রয়েড হয়েছে তাঁরা কোকেন ব্যবহার করেছেন কিংবা গণিকালয়ে গেছেন। উপযুক্ত চিকিৎসা না-হলে রোগাক্রান্তদের পুরুষাঙ্গের ছিদ্র সরু হয়ে প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
জিকা ভাইরাস : সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত এই রোগের জন্য সাধারণত মশা দায়ী। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সিডিসি বলছে, যৌন মিলনের মাধ্যমেও এই ভাইরাস ছড়াতে পারে।
নাম ছিল বুলাদি। পদবির বালাই ছিল না মাঝবয়সি মহিলার। ১০৯৭ নম্বরে ফোন করলে কথা বলতেন তিনি। এক দশক আগে টিভি থেকে শুরু করে খবরের কাগজ কিংবা রেডিয়ো অথবা হোর্ডিং—সব ধরনের গণমাধ্যমে দেখা যেত বুলাদিকে। সরকারি এই অ্যানিমেটেড চরিত্রটি এইচআইভি আর এইডস সংক্রমণ নিয়ে অবিরাম সচেতনতার বার্তা বিলিয়ে চলতেন ১৯৯৮ সাল থেকে। গণিকালয়ে পৌঁছে যদি দেখত সঙ্গে কন্ডোম নেই, তাহলে যৌনকর্মীর কাছে না-গিয়ে বলা হচ্ছিল–“চলো, এক দান লুডো খেলি”। কিন্তু গত আট বছরে আর দেখা যায়নি তাঁকে। ২০০৮ থেকে আচমকাই গায়েব হয়ে গিয়েছেন ‘পাশের বাড়ির মেয়ে’-র মোড়কে পেশ করা রাজ্য এইডস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সমিতির (স্যাক্স) ওই দূতকে।
ন্যাকো (ন্যাশনাল এইডস কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন)-র এক কর্তার বক্তব্য, সরকারি হিসাব অনুযায়ী এ রাজ্যে ১.২৫ লক্ষ (দেশে ২১ লক্ষ) এইচআইভি পজিটিভ রোগী থাকার কথা। কিন্তু সরকারি খতিয়ান বলছে, এ যাবৎ মাত্র ৬২ হাজার রোগী চিহ্নিত হয়েছেন এবং তাঁদের মধ্যে ৫৬ হাজারকে আনা গিয়েছে সরকারি চিকিৎসার (অ্যান্টি-রেট্রোভাইরাল থেরাপি বা এআরটি) আওতায়। বাদ বাকি রোগীদের চিহ্নিত করে এআরটি-র আওতায় আনাই এখন প্রধান লক্ষ্য সরকারের। ওই কর্তার কথায়—নানা ফাঁকফোকরের কারণেই সব রোগীর নাগাল এখনও পাওয়া যায়নি। সেই ফাঁকগুলো মেরামত করে রোগী চিহ্নিত করার প্রক্রিয়াগুলো আরও জোরদার করতে চায় সরকার। হয়তো সেই কাজেই লাগানো হবে বুলাদিকে। স্যাক্সের প্রকল্প অধিকর্তা পৃথা জানান, ২০৩০-এর মধ্যে দুনিয়াকে এইচআইভি মুক্ত করার যে লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, সেইমতো সরকারের প্রাথমিক লক্ষ্য হল মা-বাবার শরীর থেকে সন্তানের রক্তে এইচআইভি সংক্রমণ ঠেকানোনা। কিন্তু নিজেরাই এইচআইভি সংক্রামিত, সেই তথ্যই যদি মা-বাবা নিজেরা না–জানেন, তা হলে সন্তানের শরীরে সংক্রমণ ঠেকানো মুশকিল। তাই যাঁদের এ রোগ হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে, তাঁরা যাতে আইসিটিসি-তে (ইন্টিগ্রেটেড টেস্টিং অ্যান্ড কাউন্সেলিং সেন্টার) নিজে থেকে গিয়েই রক্তপরীক্ষা করান, তার প্রচারে জোর দেওয়া হচ্ছে। অবশেষে কন্ডোমের প্রবেশ মানুষের যৌনজীবনে এনে দিল উদ্দাম বিলব। কন্ডোম (Condom) প্রধানত যৌনসঙ্গমকালে ব্যবহৃত এক প্রকার জন্মনিরোধক বস্তু। এটি মূলত গর্ভধারণ ও গনোরিয়া, সিফিলিস ও এইচআইভির মতো যৌনরোগের প্রতিরোধক হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এটি পুরুষদের উত্থিত পুরুষাঙ্গে পরানো হয়। রেতঃস্থলনের পর কন্ডোম যৌনসঙ্গীর শরীরে বীর্য প্রবেশে বাধা দেয়। এর ফলে সরাসরি যোনি ও লিঙ্গের চামড়ার সংস্পর্শ হয় না। কন্ডোমের উপাদান দুই শরীরের মাঝে সূক্ষ দেয়াল তুলে ধরে।
আধুনিক যুগে কন্ডোম মূলত তরুক্ষীর থেকে প্রস্তুত করা হয়। তবে কনডম তৈরি ক্ষেত্রে অনেক সময় পলিআরথিন, পলিইসোথ্রিন বা ল্যাম্ব ইনসেসটাইনও ব্যবহৃত হয়। জন্ম নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি হিসাবেই কন্ডোম আবিষ্কারের প্রধান উদ্দেশ্য। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এসে যা ভয়ংকর যৌনরোগ প্রতিরোধের জন্য আবশ্যিক হয়ে পড়েছে। কন্ডোম অত্যন্ত সুলভ, সহজে ব্যবহার্য, কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াযুক্ত ও যৌনব্যাধি প্রতিরোধে সর্বাধিক কার্যকর।
কন্ডোম প্রায় ৪০০ বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই কন্ডোম ব্যবহার সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় জন্মনিরোধ পদ্ধতি। আধুনিক সমাজে কন্ডোমের ব্যবহার ব্যাপক মান্যতা লাভ করেছে। প্রাচীন সভ্যতাগুলিতে কন্ডোমের ব্যবহার প্রচলিত ছিল কি না তা নিয়ে পুরাতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ যথেষ্ট। প্রাচীন মিশর, গ্রিস ও রোমে গর্ভাধান রোধ নারীর দায়িত্ব হিসাবে পরিগণিত হত। এই সব দেশ থেকে সে সমস্ত সুলিখিত প্রাচীন জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির বিবরণীগুলি পাওয়া গেছে, সেগুলিতে মূলত নারী-নিয়ন্ত্রিত গর্ভনিরোধ বস্তুগুলিরই উল্লেখ রয়েছে। পঞ্চদশ শতাব্দীর আগে কিছু শিশ্নাগ্র কনডমের ব্যবহারের কথা জানা যায়। এগুলি প্রধানত পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগকে ঢেকে রাখত। কন্ডোমের প্রচলন মূলত সমাজের উচ্চশ্রেণির মানুষের মধ্যেই পরিলক্ষিত হত। চিনে শিশ্নাগ্র কন্ডোম তৈরি হত তৈলনিষিক্ত রেশমি কাগজ বা ভেড়ার অন্ত্র দিয়ে। জাপানে কন্ডোম তৈরি হত কচ্ছপের খোল বা জন্তুর শিং দিয়ে।
ষোড়শ শতাব্দীর ইতালিতে গ্যাব্রিয়েলে ফ্যালোপিও সিফিলিস রোগের উপর একখানি গবেষণাগ্রন্থ রচনা করেন। সেই সময়কার লিখিত ইতিহাস থেকে জানা যায় যে ১৪৯০-এর দশকে সিফিলিস একটি ভয়ানক রোগের আকারে প্রকট হয়েছিল। রোগাক্রান্ত হওয়ার মাস কয়েকের মধ্যেই রোগীর মৃত্যু ঘটত। ফ্যালোপিওর গবেষণা গ্রন্থটি কন্ডোম ব্যবহারের প্রাচীনতম অবিতর্কিত বিবরণ। এই বর্ণনা অনুযায়ী, একটি ক্ষৌমবস্তুনির্মিত খাপকে একটি রাসায়নিক দ্রবণে ডুবিয়ে রাখা হত এবং ব্যবহারের পূর্বে সেটি শুকিয়ে নেওয়া হত। বর্ণনা অনুযায়ী এক কাপড়টি কেবলমাত্র শিশ্নাগ্রভাগকেই ঢেকে রাখত এবং একটি রিবন দিয়ে এটিকে বেঁধে রাখা হত। ফ্যালোপিও দাবি করেন, ক্ষৌমবস্ত্রাকার খাপের একটি পরীক্ষামূলক ব্যবহার ঘটিয়ে দেখেছেন যে এর মাধ্যমে সিফিলিস প্রতিরোধ করা সম্ভব।
এর পর থেকে সমগ্র ইউরোপে বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত নানা রকম পুরুষাঙ্গ-আচ্ছাদনী রোগ প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। ১৬০৫ সালে রচিত ‘De iustitia et iure’ (বিচার ও আইন প্রসঙ্গে) নামে একটি ধর্মীয় গ্রন্থের বক্তব্য থেকে জানা যায়, এই জাতীয় বস্তুগুলি রোগ প্রতিরোধের বদলে জন্মনিয়ন্ত্রক হিসাবেই বেশি ব্যবহৃত হত। এই গ্রন্থের লেখক ক্যাথলিক ধর্মতত্ত্ববিদ লেওনার্দাস লেসিয়াস এগুলিকে অনৈতিক বলে বর্ণনা করেছেন। ১৬৬৬ সালে ব্রিটিশ বার্থ রেট কমিশনের বক্তব্য থেকে জানা যায় যে এই সময় কন্ডোম ব্যবহারের ফলে জন্মহার হ্রাস পেয়েছে। ক্ষৌমবস্ত্রের পাশাপাশি রেনেসাঁর যুগে অন্ত্র ও মুত্রাশয় নির্মিত কনডমের ব্যবহারও প্রচলন লাভ করে। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে ওলন্দাজ বনিকেরা ভালো চামড়া’ নির্মিত কন্ডোম নিয়ে যায় জাপানে। এই অঞ্চলে পূর্বে ব্যবহৃত শিং-নির্মিত কন্ডোম শুধুমাত্র শিশ্নাগ্রভাগকেই ঢাকত। কিন্তু এই সমস্ত চামড়ার কন্ডোমে সমগ্র পুরুষাঙ্গকে ঢাকার সুবিধা পাওয়া যেত।
অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে আইনজ্ঞ, ধর্মতত্ত্ববিদ ও চিকিৎসকদের একটি অংশ কন্ডোম ব্যবহারের বিরোধিতা করতে থাকেন। সেসময় তাঁরা যে আপত্তিগুলি তোলেন, সেগুলির অনেকগুলি এসময় আজও তোলা হয়ে থাকে। যেমন—কন্ডোম গর্ভাধান সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়, যাকে কেউ কেউ জাতির পক্ষে অনৈতিক ও অবাঞ্ছিত মনে করেন। এগুলি যৌনরোগ থেকে সম্পূর্ণ রক্ষা করতে অক্ষম, অথচ এদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতায় বিশ্বাস রেখে মানুষ তাঁদের যৌন কার্যকলাপ বৃদ্ধি করে থাকে। তা ছাড়া অনেকেই নানা ব্যবহায় সংক্রান্ত সমস্যা, চড়া দাম ও ব্যবহারের ফলে কামোদ্দীপনা কমে যাওয়ার জন্য কন্ডোম ব্যবহার এড়িয়ে চলেন। কিন্তু কোনো কোনো মহলের বিরোধিতা সত্ত্বেও কন্ডোমের বিক্রি বাড়তে থাকে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিভিন্ন মান ও আকারের কন্ডোম কিনতে পাওয়া যেত। এর মধ্যে যেমন রাসায়নিক মাখানো ক্ষৌমবস্ত্র নির্মিত কনডম ছিল, তেমনই ছিল ‘ত্বক’ ও (সালফার ও লাই মিশ্রিত নরম করা মুত্রাশয় বা তন্ত্র)। সমগ্র ইউরোপে ও রাশিয়ায় পাব, নাপিতের দোকান, ঔষধের দোকান, খোলাবাজার এবং নাট্যশালায় কন্ডোম বিক্রি হত। পরে এগুলি আমেরিকাতেও বিক্রি হতে শুরু করে। তবে সর্বত্রই চড়া দাম, সচেতনতা ও সঠিক যৌনশিক্ষার অভাবে কেবলমাত্র উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির একাংশের মধ্যেই কন্ডোমের প্রচলন সীমাবদ্ধ থাকল
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে জন্মনিরোধক পদ্ধতিগুলির সঙ্গে সমাজের দরিদ্র শ্রেণি পরিচিত হয়। এই সময়কার জন্মনিরোধক সম্পর্কিত লেখকেরা জন্মনিয়ন্ত্রণের অন্যান্য পদ্ধতিগুলিকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। এযুগের নারীবাদীরা বলতেন জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি একান্তভাবেই নারীর হাতে থাকা উচিত। তাঁরা কন্ডোম জাতীয় সকল পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত জন্মনিরোধকের বিরোধী ছিলেন। অন্যান্য লেখকেরা লিখেছেন কন্ডোম ছিল দামী ও নির্ভরযোগ্যতাশূন্য। অভিযোগ ছিল এগুলি ছিদ্র হয়ে যেত, শরীরে বাইরে খুলে আসত বা ফেটে যেত)। তবে তাঁরা কতকগুলি ক্ষেত্রে কন্ডোমকে ভালো বিকল্প বলেছেন। যেমন রোগপ্রতিরোধের ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যবহার্য ছিল কনডম। অনেকে আবার অবাঞ্ছিত সন্তান ও যৌনরোগের ভয়ে যৌনসঙ্গম পরিত্যাগ করার পথ বেছে নিতেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন সামরিক বাহিনীয় কন্ডোম ব্যবহারকে সমর্থন করেনি; বরং এই জাতীয় পোস্টারের মাধ্যমে সবাইকে ব্রহ্মচর্য পালনকে উৎসাহিত করত।
অনেক দেশে কনডম উৎপাদন বা গর্ভনিরোধ ব্যবস্থার প্রসার রোধ করার জন্য আইন পাস করা হয়। কিন্তু এত বাধা সত্ত্বেও ভ্রাম্যমাণ ভাষণ ও সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনের কন্ডোমের কথা প্রচারিত হতে থাকে। যে সমস্ত অঞ্চলে এই জাতীয় বিজ্ঞাপন আইনত নিষিদ্ধ ছিল সেখানে শালীনভাবে কন্ডোমের কথা প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ঘরে কি করে কন্ডোম তৈরি করা হয় তার নির্দেশিকা বিলি করা হত। সামাজিক ও আইনি প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে কন্ডোমই হয়ে ওঠে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি।
ঊনবিংশ শতাব্দীর পরার্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যৌনরোগীর সংখ্যা অকস্মাৎ অত্যন্ত বৃদ্ধি পায়। ঐতিহাসিকরা এর জন্য আমেরিকার গৃহযুদ্ধের প্রভাব ও কমস্টক আইন কর্তৃক প্রচারিত প্রতিরোধ ব্যবস্থাগুলির প্রতি অজ্ঞতাকে দায়ী করেন। এই ক্রমবর্ধমান মহামারির সঙ্গে যুঝতে সরকারি বিদ্যালয়গুলিতে প্রথম যৌনশিক্ষা পাঠক্রম চালু করা হয়। এই পাঠক্রমের মাধ্যমে বিভিন্ন যৌনব্যাধি ও কেমন করে তা সংক্রমিত হয়, সেই সম্পর্কে পাঠদান দেওয়া হত। তবে যৌনব্যাধি নিয়ন্ত্রণে কন্ডোমের ব্যবহারকে উৎসাহিত করা হত না। কারণ সেযুগের চিকিৎসক মহল ও নৈতিকতার ধ্বজাধারীরা মনে করতেন, যৌনরোগ আসলে যৌন অসদাচারের শাস্তি। যৌনরোগে আক্রান্তদের প্রতি বিদ্বেষ এতটাই ছড়িয়ে পড়ে যে, অনেক হাসপাতাল সিফিলিস রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসা করতে অস্বীকার করে।
এদিকে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে জার্মান সামরিক বাহিনীতে সেনা জওয়ানদের মধ্যে কন্ডোম ব্যবহারকে উৎসাহ দেওয়া হতে থাকে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে মার্কিন সামরিক বাহিনী কর্তৃপক্ষ একটি পরীক্ষা চালিয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে কন্ডোম ব্যবহারের ফলে সেনা জওয়ানদের যৌনরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও (কেবলমাত্র যুদ্ধের সূচনাভাগে) ব্রিটেন যুদ্ধের সেনা জওয়ানদের মধ্যে কন্ডোম সরবরাহ বা কন্ডোম ব্যবহার উৎসাহিত করেনি, যুদ্ধের অংশগ্রহণকারী অন্যান্য সকল রাষ্ট্রই করেছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরও কয়েক দশক সমগ্র ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কন্ডোম ব্যবহারে সামাজিক ও আইনগত বাধা থেকেই যায়। মনস্তত্ত্ব চর্চার প্রবর্তক সিগমুন্ড ফ্রয়েড এই মর্মে সমস্ত প্রকার জন্মনিয়ন্ত্রক পদ্ধতির বিরোধিতা করেছেন যে, সেগুলির ব্যর্থতার হার ছিল সুউচ্চ। ফ্রয়েড বিশেষভাবে কন্ডোম ব্যবহারের বিরোধিতা করেন। কারণ তিনি মনে করতেন কন্ডোম যৌন উত্তেজনা প্রশমিত করে দেয়। কোনো কোনো নারীবাদীও কন্ডোম সহ সব রকমের পুরুষনিয়ন্ত্রিত জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বিরোধিতা করতে থাকেন। ১৯২০ সালে চার্চ অফ ইংল্যান্ডের ল্যামবেথ কনফারেন্সে সকল প্রকার ‘Unnatural means of conception avoidance’-এর বিরোধিতা করা হয়। লন্ডনের বিশপ আর্থার উইনিংটন-ইনগ্রাম অভিযোগ করেন যে, গলি ও উদ্যানগুলিতে বিশেষ করে সপ্তাহান্ত ও ছুটির দিনগুলিতে ব্যবহৃত কন্ডোম ছড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
যদিও ইউরোপীয় সামরিক বাহিনীগুলি রোগ প্রতিরোধকল্পে নিজ সদস্যদের কন্ডোম সরবরাহ করত। এমনকি যেসব দেশে সাধারণের মধ্য কন্ডোমের ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল, সেইসব দেশেও সেনাবাহিনীতে কন্ডোম ব্যবহার করা যেত। ১৯২০-এর দশকে আকর্ষক নাম ও চকচকে মোড়ক ব্যবহার কন্ডোম ও সিগারেটের মতো পণ্য বিক্রির এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাবসায়িক কৌশল হয়ে ওঠে। মানপরীক্ষাও প্রচলন লাভ করে। চাপহীনতা পরীক্ষা করার জন্য অন্যান্য সব পদ্ধতির সঙ্গে কন্ডোমে হাওয়া ভরেও পরীক্ষা করা হত। ১৯২০-এর দশকে বিশ্বব্যাপী কন্ডোমের বিক্রি দ্বিগুণ হয়ে যায়।
১৯৩০ সালে অ্যাংলিকান চার্চের ল্যামবেথ কনফারেন্সে বিবাহিত দম্পতির ক্ষেত্রে জন্মনিরোধক ব্যবহারে অনুমোদন জানানো হয়। ১৯৩১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশানাল কাউন্সিল অফ চার্চেস একটি অনুরূপ বক্তব্য জানায়। রোমান ক্যাথলিক চার্চ এর প্রতিক্রিয়ায় ‘Casti Connubii’ নামে একটি এনসাইক্লিকাল (সমগ্র বিশ্বে রোমান ক্যাথলিক বিশপদের প্রেরিত পোপের চিঠি) জারি করে সকল প্রকার জন্মনিরোধ ব্যবহারের বিরুদ্ধে রোমান ক্যাথলিক চার্চের কড়া অবস্থানের কথা জানিয়ে দেওয়া হয়। এই চার্চ অদ্যাবধি এই অবস্থান থেকে সরে আসেনি। ১৯৩০-এর দশক থেকেই কন্ডোমের উপর থেকে আইনি বিধিনিষেধ শিথিল করা হতে থাকে। তবে ফ্যাসিবাদী ইতালি ও নাৎসি জার্মানিতে কন্ডোমের উপর বিধিনিষেধ বৃদ্ধি করা হয় (যদিও রোগ প্রতিরোধে কন্ডোমের ব্যবহার তখনও অনুমোদিত ছিল)। মহামন্দার সময় সৃক্সিডের কন্ডোম জনপ্রিয়তা অর্জন করে। স্ ডি সিমেন্ট-ডিপিং পদ্ধতিতে কন্ডোম প্রস্তুত করত। তরুক্ষীর কন্ডোমের তুলনায় এই জাতীয় কন্ডোমে দুটি অধিক সুবিধা পাওয়া যেত। প্রথমত, সিমেন্ট-ডিপড কন্ডোমের সঙ্গে তৈলমিশ্রিত লুব্রিকেন্ট ব্যবহার করা যেত এবং দ্বিতীয়ত পুরোনো রবারের কন্ডোম পুনর্ব্যবহারযোগ্য ছিল, যা সেই মন্দার বাজারে অনেকের ক্ষেত্রে আর্থিকভাবে সুবিধাজনক প্রতিপন্ন হয়। ১৯৩০-এর দশকে মানের দিকটিতেও গুরুত্ব দেওয়া শুরু হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সেদেশে বিক্রিত কন্ডোমের মান নিয়মিত করতে শুরু করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন কন্ডোম শুধুমাত্র মার্কিন সামরিক বাহিনীর সেনা জওয়ানদের মধ্যে বিতরণই করা হয় না, বরং চলচ্চিত্র, পোস্টার ও লেকচারের মাধ্যমে কন্ডোমের ব্যবহারকে উৎসাহিত করা হতে থাকে। ইউরোপীয় ও এশীয় সকল পক্ষের সামরিক বাহিনীগুলি যুদ্ধ চলাকালীন আগাগোড়াই সেনাবাহিনীতে কন্ডোমের সরবরাহ অব্যাহত রেখেছিল। এমনকি জার্মানিতে ১৯৪১ সালে সকল নাগরিকের কন্ডোম ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়ে গেলেও সেনা জওয়ানদের কন্ডোম ব্যবহারে ছাড় দেওয়া হয়। অন্যদিকে কন্ডোম সহজলভ্য ছিল বলে সেনারা যৌনসঙ্গম ছাড়াও অন্যান্য কাজে কন্ডোম ব্যবহার করতে শুরু করে। এই রকম কিছু ব্যবহার অদ্যাবধি প্রচলিত রয়েছে।
যুদ্ধের পরেও কন্ডোমের বিক্রি বাড়তে থাকে। ১৯৫৫-১৯৬৫ সময়কালের মধ্যে আমেরিকার প্রজননশীল জনসংখ্যার ৪২ শতাংশই জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য কন্ডোমের উপর নির্ভর করতেন। ১৯৫০-১৯৬০ সময়কালের মধ্যে ব্রিটেনে ৬০ শতাংশ বিবাহিত দম্পতি কন্ডোম ব্যবহার করতেন। ১৯৬০ সালে বাজারে আসার সঙ্গে সঙ্গে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি জন্মনিয়ন্ত্রণের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় পন্থায় পরিণত হয়। কিন্তু কন্ডোম শক্তিশালী দ্বিতীয় বিকল্প হয়ে থেকেই যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশানাল ডেভেলপমেন্ট উন্নয়নশীল দেশগুলিকে ‘বিশ্ব জনসংখ্যা বৃদ্ধি সমস্যা সমাধানার্থে কন্ডোম ব্যবহারের দিকে ঠেলে দিতে থাকে। ১৯৭০ সালের মধ্যে ভারতে লক্ষাধিক কন্ডোম প্রতি বছর ব্যবহৃত হতে থাকে। (সাম্প্রতিক দশকগুলিতে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে: ২০০৪ সালে ভারত সরকার পরিবার পরিকল্পনা ক্লিনিকে বিতরণার্থে ১.৯ বিলিয়ন কন্ডোম ক্রয় করে।)
১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে মানের ব্যাপারে কড়াকড়ি করা হয়। কন্ডোম ব্যবহারের ক্ষেত্রে আইনি বাধাগুলিও বহুলাংশে অপসারিত হয় এই সময়। ১৯৭৮ সালে আয়ারল্যান্ডে প্রথম আইনসম্মত কন্ডোম বিক্রি হয়। অবশ্য কন্ডোমের বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে আইনি বাধা কিছু থেকেই যায়। ১৯৫০-এর দশকের শেষভাগে আমেরিকার ন্যাশানাল অ্যাসোসিয়েশন অফ ব্রডকাস্টার্স জাতীয় টেলিভিশনে কন্ডোমের বিজ্ঞাপনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এই নীতি ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত বজায় ছিল।
১৯৮০-এর দশকে জানা যায় যে, এইডস একটি যৌনব্যাধিও হতে পারে। এরপর থেকেই এইচআইভি প্রতিরোধকল্পে কন্ডোমের ব্যবহারকে উৎসাহিত করা হতে থাকে। কিছু রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অন্যান্য ব্যক্তিত্বের বিরোধিতা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে জাতীয়স্তরে কন্ডোম ব্যবহারকে উৎসাহ দিতে প্রচারাভিযান চালানো হতে থাকে। এই সমস্ত প্রচারাভিযানের ফলে কন্ডোমের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। এই মুহূর্তে কন্ডোমের বাজার তুঙ্গে। আর এটা সম্ভব হয়েছে এইডস প্যানিককে সর্বোচ্চ মাত্রায় প্রোপাগান্ডার ফলেই, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে।
ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও বৃহত্তর সামাজিক স্বীকৃতির ফলে বিভিন্ন ধরনের পাইকারে দোকানে কন্ডোম বিক্রি শুরু হয়ে যায়। এই সব দোকানের মধ্যে সুপারমার্কেট ও ওয়াল-মার্টের মতো ডিসকাউন্ট ডিপার্টমেন্ট স্টোর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত কন্ডোমের ব্যবহার বাড়তে থাকে। এরপরই গণমাধ্যমগুলি এইডস রোগাক্রান্তের সংখ্যাহ্রাসের দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এরপরই রোগ প্রতিরোধক হিসাবে কন্ডোমের ব্যবহার আকস্মিকভাবে হ্রাস পায়। এই ঘটনাকে কন্ডোম অবসাদ’ বলে উল্লেখ করা হয়। পর্যবেক্ষকরা ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা উভয় অঞ্চলেই এই কন্ডোম অবসাদের ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেছেন। এরপর থেকেই কন্ডোম উৎপাদকরা তাঁদের বিজ্ঞাপনের সুর বদলে ভয়াল বিজ্ঞাপনের বদলে মজার বিজ্ঞাপন প্রচার করতে থাকে। এরপর কন্ডোমের বাজারে বেশ কিছুটা নতুন উন্নতির ঘটনা ঘটে। ১৯৯০-এর দশকে ডুরেক্স কন্ডোমের উৎপাদক সংস্থা অবন্তী নামের ব্র্যান্ডে প্রথম পলিআরথিন কন্ডোম বাজারে ছাড়ে। ২০০৩ সালে দেফিট নামে প্রথম কাস্টম সাইজ-টু-ফিট কন্ডোম বাজারে আসে। মনে করা হচ্ছে সারা বিশ্ব কন্ডোমের ব্যবহার বাড়তেই থাকবে। একটি সমীক্ষার মতে ২০১৫ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলির ১৮.৬ বিলিয়ন কন্ডোম প্রয়োজন হবে। বর্তমানে কন্ডোম আধুনিক সমাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে।
২০১০ সালের মার্চ মাসে সুইজারল্যান্ড সরকার ঘোষণা করেছে যে, তারা ১২-১৪ বছরের পুরুষের জন্য ছোটো আকারের কন্ডোম প্রস্তুত করবে। এই কন্ডোমের নাম রাখা হয়েছে হটশট। সেদেশের সরকারি গবেষণা থেকে দেখা গেছে, বারো থেকে চোদ্দো বছর বয়সি ছেলেরা যৌনসঙ্গমের সময় যথেষ্ট পরিমাণে প্রতিরোধক ব্যবহারের সুযোগ পায় না। একটি প্রমাণ আকারের কন্ডোমের ব্যাস ২ ইঞ্চি (৫.২ সেন্টিমিটার); কিন্তু হটশটের ব্যাস ১.৭ ইঞ্চি (৪.৫ সেন্টিমিটার)। তবে উভয় প্রকার কন্ডোমের দৈর্ঘ্য একই থাকবে–৭.৪ ইঞ্চি (১৯ সেন্টিমিটার)। একটি জার্মান সমীক্ষায় দেখা গেছে ১২,৯৭০ জন ১৩ থেকে ২০ বছর বয়সিদের দলে এক-চতুর্থাংশেরই বক্তব্য প্রমাণ আকারের কন্ডোম বেশ বড়ো। অন্যদিকে সুইজারল্যান্ডের সরকারি গবেষণা ও বাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট পারসোন্যালিটি সাইকোলজির গবেষণাপত্রের ভিত্তিতে পরিবার পরিকল্পনা গোষ্ঠীগুলি এবং সুইস এইডস ফেডারেশন হটশট উৎপাদনের সপক্ষে প্রচার চালায়। কন্ডোম উপাদানের বিবর্তন—রবার ১৮৫৫, ল্যাটেক্স ১৯২০, পলিআরথিন ১৯৯৪, পলিআইসোপ্রিন ২০০৮। কন্ডোম বিজ্ঞানের একটা বড়ো এবং গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার, যা গনোরিয়া, সিফিলিস ও এইডসের মতো ভয়ংকর ধরনের যৌনরোগ থেকে মুক্ত পৃথিবী উপহার দিতে সক্ষম হয়েছে। বাধ্যতামূলকভাবে কন্ডোমের ফলে দুটি কারণে যৌনকর্মীদের বাজার এখন নিরাপদ ও রমরমা। (১) বাধ্যতামূলক কন্ডোমের ব্যবহারে ভয়ংকর যৌনরোগের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এবং (২) গর্ভবতী হয়ে পড়ার সম্ভাবনাও নেই। (সূত্র : উইকিপিডিয়া)
———–
তথ্যসূত্র–(১) কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত—বিনয় ঘোষ, (২) সংবাদপত্রে সেকালের কথা—ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, (৩) রঙ্গালয়ে বঙ্গনটী—অমিত মৈত্র, (৪) সুকুমারী দত্তর অপূর্ব সতী’ নাটকের ভুমিকা—ড. বিজিতকুমার দত্ত (নাট্য আকাদেমি পত্রিকা, জানুয়ারি ১৯৯২, (৫) অন্য কলকাতা—বিশ্বনাথ জোয়ারদার, (৬) কলকাতা—শ্রীপান্থ। (৭) প্রসঙ্গ দেবদাসী—আরতি গঙ্গোপাধ্যায়, (৮) Prostitution and Its Impact on Society : A Criminological Perspective–Haveripeth Prakash, (৯) New Directions in Research on Prostitution–R. Weitzer, (১০) What makes a ‘Prostitute’ a Prostitute? Mordern Definitions and Ancient Meanings–Julia Assante, (১১) Painted Love : Prostitution French Art of the Impressionist Era–Hollis Clayson, (১২) The Sociology of Prostitution : Kingsley Davis, (১৩) Sexual Exploitation and Prostitution and its impact on Gender Equality–Erika Schulza, (১৪) Prostitution, Community and Civic Regulation in Early Modern Bologna–Vanessa Gillian McCarthy, (১৫) Trafficking in Women and Prostitution in the Baltic States : Social and Legal Aspects–International Organization for Migration, (১৬) Prostitution Online–Donna M. Hughes, (১৭) Race, Class, Gender and Deviancy : The Criminalization of Prostitution–Ann M. Lucas, (১৮) Reframing Prostitution : from discourse to description, from moralization to normalization?–Gert Vermeulen, (১৯) Decades of Reform : Prostitution, Feminists, and the War on White Slavery–Jodie Masotta, (২০) The History of Prostitution–William W. Sanger (২১) জাপানে গণিকা সংস্কৃতি–প্রবীর বিকাশ সরকার, (২২) গণিকা সম্বাদ ইতিহাস ও বহমানতা–সম্পাদনা অর্ক দেব, (২৩) উৎস মানুষ, আগস্ট ২০০৫, (২৪) টপ কোয়ার্ক, ডিসেম্বর ‘০৪–আগস্ট ‘০৫, (২৫) আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ এপ্রিল, ২০০৬, (২৬) বিকেলের প্রতিদিন, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০০৬, (২৭) সংবাদ এখন, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, (২৮) আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৩ নভেম্বর, ২০১৪, (২৯) যৌনতা ও সংস্কৃতি—সুধীর চক্রবর্তী, (৩০) বেশ্যাসংগীত বাইজিসংগীত–দেবজিত বন্দ্যোপাধ্যায়, (৩১) খারাপ মেয়ের কথা–দুর্গাপদ চট্টোপাধ্যায়, (৩২) বেশ্যাপাড়ার পাঁচটি দুর্লভ গ্রন্থ–মৌ ভট্টাচার্য সম্পাদিত, (৩৩) সেকাল আর একাল–রাজনারায়ণ বসু, (৩৪) রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন সমাজ–শিবনাথ শাস্ত্রী, (৩৫) হুতোম প্যাঁচার নকশা–কালীপ্রসন্ন সিংহ (৩৬) বিকিয়ে যাই–মালা দত্তরায়, (৩৭) স্নায়ুরোগ–সিগমুন্ড ফ্রয়েড, (৩৮) ফিরে দেখা–ফিরদৌস আজিম, মাহবুবা মাহমুদ, সেলিনা শেলী সম্পাদিত।