পত্র পড়ি চন্দ্রাবতী চক্ষের জলে ভাসে।
শিশুকালের স্বপ্নের কথা মনের মধ্যে আসে।।
এক বার দুই বার তিন বার করি।
পত্র পড়ে চন্দ্রাবতী নিজ নাম স্মরি।।
নয়নের জলে কন্যার অক্ষর মুছিল।
এক বার দুই বার পত্র যে পড়িল।।
“শুন শুন বাপ আগো শুন মোর কথা।
তুমি সে বুঝিবে আমি দুঃখিনীর ব্যথা।।
জয়ানন্দ লেখে পত্র আমার গোচরে।
তিলেকের লাগ্যা চায় দেখিতে আমারে।।”
“শুন গো প্রাণের কন্যা আমার কথা ধর।
একমনে পূজ তুমি দেও বিশ্বেশ্বর।।
অন্য কথা স্থান কন্যা নাহি দিও মনে।
জীবন মরণ হইল যাহার কারণে।।
নষ্ট হইল পুজার ফুল ছুঁইল যবনে।
না লাগে উচ্ছিষ্ট ফল দেবের কারণে।।
আছিল গঙ্গার জল অপবিত্র হইল।
বিধাতা সাধিছে বাদ সব নষ্ট হইল।।
তুমি যা লইছ মাগো সেই কাজ কর।
অন্য চিন্তা মনে স্থান নাহি দিও আর।।
পত্র লিখি চন্দ্রাবতী জয়ের গোচরে।
পুষ্পদূর্ব্বা লইয়া কন্যা পশিল মন্দিরে।
যোগাসনে বসে কন্যা নয়ন মুদিয়া।
একমনে করে পূজা ফুলবিল্ব দিয়া।।
শুকাইল আঁখির জল সর্ব্ব চিন্তা দূরে।
একমনে পূজে কন্যা অনাদি শঙ্করে।।
কিসের সংসার কিসের বাস কেবা পিতামাতা।
পূজিতে তুলিল কন্যা শৈশবের কথা।
জয়ানন্দ চুলি কন্যা পূজয়ে শঙ্করে।
একমনে ভাবে কন্যা হর বিশ্বেশ্বরে।
শান্তিতে আছয়ে কন্যা একনিষ্ঠ হইয়া।
আসিল পাগল জয়া শিকল ছাড়িয়া।।
“দ্বার খোল চন্দ্রাবতী তোমারে শুধাই।
জীবনের শেষ তোমায় একবার দেখ্যা যাই।।
আর না দেখিব তোমায় নয়ন চাহিয়া।
দোষ ক্ষমা কর কন্যা শেষ বিদায় দিয়া।।”
কপাটে আঘাত করে শিরে দিয়া হাত।
বজ্রের সমান করে বুকেতে নির্ঘাত।।
যোগাসনে আছে কন্যা সমাধিশয়নে।
বাহিরের কথা কিছু নাহি পশে কানে।।
পাগল হইয়া নাগর কোন কাম করে।
চারিদিকে চাহিয়া দেখে নাহি দেখে কারে।।
না খোলে মন্দিরের কপাট নাহি কয় কথা।
মনেতে লাগিল যেমন শক্তিশেলের ব্যথা।।
পাগল হইল জয়ানন্দ ডাকে উচ্চৈস্বরে।
“দ্বার খোল চন্দ্রাবতী দেখা দেও আমারে।।
না ছুঁইব না ধরিব দূরে থাক্যা খাড়া।
ইহজন্মের মতন কন্যা দেও মোরে সাড়া।।
দেবপূজার ফুল তুমি গঙ্গার পানি।
আমি যদি ছুই কন্যা হইবা পাতকিনী।।
নয়ন ভরে দেখ্যা যাই জন্মশোধ দেখা।
শৈশবের নয়ান দেখি নয়ানভঙ্গি বাঁকা।।”
না খোলে মন্দিরের দ্বার মুখে নাহি বাণী।
ভিতরে আছরে কন্যা যৈবনে যগিনী।।
চারি দিকে চাইয়া নাগর কিছু নাহি পায়।
ফুট্যাছে মালতীফুল সামনে দেখতে পায়।।
পুষ্প না তুলিয়া নাগর কোন কাম করে।
লিখিল বিদায়পত্র কপাট উপরে।
“শৈশবকালের সঙ্গী তুমি যৈবনকালের সাথী।
অপরাধ ক্ষমা কর তুমি চন্দ্রাবতী।।
পাপিষ্ঠ জানিয়া মোরে না হইলা সম্মত।
বিদায় মাগি চন্দ্রাবতী জনমের মত।।”
ধ্যান ভাঙ্গি চন্দ্রাবতী চারিদিকে চায়।
নির্জন অঙ্গন নাহি কারে দেখতে পায়।।
খুলিয়া মন্দিরের দ্বার হইল বাহির।
কপাটে আছিল লেখা পড়ে চন্দ্রাবতী।
(এই লাইনটি নেই)
অপবিত্র হইল মন্দির হইল অধোগতি।
কলসী লইয়া জলের ঘাটে করিল গমন।
করিতে নদীর জলে স্নানাদি তর্পণ।।
জলে গেল চন্দ্রাবতী চক্ষে বহে পানি।
হেনকালে দেখে নদী ধরিছে উজানি।। **
একেলা জলের ঘাটে সঙ্গে নাহি কেহ।
জলের উপরে ভাসে জয়ানন্দের দেহ।।
দেখিতে সুন্দর নাগর চান্দের সমান।
ঢেউয়ের উপর ভাসে পুন্নুমাসীর চান।।
আঁখিতে পলক নাহি মুখে নাই সে বাণী।
পারেতে খাড়াইয়া দেখে উমেদা কামিনী।। ***
স্বপ্নের হাসি স্বপ্নের কান্দর নয়ান চান্দে গায়।
নিজের অন্তরের দুষ্কু পরকে বুঝান দায়।।
* জন্মথ : আজন্ম আইবড়
** ধরিছে উজানি : উজান বয়ে চলছে
*** উমেদা : উন্মত্ত
দস্যু কেনারামের পালা (রচয়িতা – চন্দ্রাবতী)
কেনারামের জন্ম ও নানা কষ্ট
তার পরে যশোধরা শুন দিয়া মন |
মাসেকের মধ্যে হৈল গর্ভের লক্ষণ ||
সুগোল সুন্দর তনুগো লাবণি জড়িত |
সর্ব্ব অঙ্গ দিনে দিনে হইল পূরিত ||
অজীর্ণ অরুচি আর মাথাঘোরা আদি|
আলস্য জড়তা হৈল আছে যত ব্যাধি।।
সর্ব্ব অঙ্গে জ্বলে মাথা তুলিতে না পারে।
আহার করিয়া মাত্র ফেলে বমি করে।।
রুচী হৈল চূকা আর ছিকর মাটিতে |
বিছানা ছাড়িয়া শুয়ে কেবল ভূমিতে ||
এহি মতে দশ মাস দশ দিন গেল |
পরেত গর্ভেত এক ছাওয়াল জন্মিল।।
চন্দ্রাবতী কয় শুনগো অপুত্রার ঘরে।
সুন্দর ছাওয়াল হৈল মনসার বরে।।
মায়ের অঞ্চলের নিধিগো মায়ের পরাণী।
দিন দিন বাড়ে যেমন চাঁদের লাবণী।।
ছয় না মাসের শিশুগো হইল যখন।
মহা আয়োজনে করে অন্ন পরশন।।
বাছিয়া রাখিল মায়ে গো শুন কিবা নাম।
দেবীর পূজার কিনা তাই “কেনারাম”।।
হায়রে দারুণ বিধি কি লিখিয়া ভালে |
মরিলা জননী হায়রে সাত মাসের কালে ||
কোলেতে লইয়া পুত্র কান্দে খেলারাম |
“কি হেতু হৈলা মর প্রতি বাম ||
মাও ভিন্ন কে বা জানেরে পুত্রের বেদন |
যাহার স্তনেতে হয় শরীর পালন ||
সেই মায়ের নিলা কারি কিসের কারণে |
কি মতে বাঁচাইয়া পুত্র রাখিব জীবনে ||
অপুত্রা ছিলামগো মোরা সেই ছিল ভাল |
ভুলাইয়া মায়ায় পরে কেন দেও শেল ||”
কান্দিয়া কান্দিয়া তবে যায় খেলারাম |
পুত্র কোলে উপনিত দেবপুর গ্রাম ||
সোহিত গ্রামেতে হয় মাতুল আলয় |
মামার বাড়ীতে কেনা কিছুদিন রয় ||